বিষকামড়
সেপ্টেম্বর, ৮২৯ খ্রীস্টাব্দের কোনো এক রাত।
আমীর আবদুর রহমান হেরেমে শায়িত। সঙ্গীতের সুর মূর্ঘনায় তিনি বিমোহিত। এটা যিরাবের কারিশমা। জীবন বীণার সূক্ষ্মতারে তিনি ঝংকার তুলছেন। তিনি স্থান কাল পাত্র বুঝে সংগীতের বোতাম টিপতে পারতেন। আবদুর রহমানের আবেগ ও স্পর্শকাতর দিকটা তার জানা ছিল।
সুলতানা তার পাশে বসা। যেন সে আঃ রহমানকে কোলে করে নেয়া। আমীর চুলু ঢুলু চোখে আবদুর রহমানের দিকে তাকান। সুলতানার মুখে খেলে যায় উচ্ছ্বসিত হাসি। সুলতানার রূপলাবণ্য কমার পরিবর্তে দিন দিন যেন বেড়েই চলছিল।
এ সময় সবাইকে হতবাক করে দিয়ে দরজার কপাট খুলে যায়। বিরক্ত দৃষ্টিতে সেদিকে তাকায় সুলতানা। সে দেখল, দরজায় দারোয়ান দণ্ডায়মান। উঠে দরজার কাছে গেল সুলতানা। আবদুর রহমান জিজ্ঞেস করলেন-দরজায় কে?
দারোয়ানা সুলতানা বলল- টলেডো থেকে এসেছে। জরুরী কোন পয়গাম নিয়ে এসেছে।
সঙ্গীতের রাগ থেমে গেছে। কামরায় রাজ্যের নিস্তব্ধতা। আমীর আবদুর রহমান অঙ্গ মোচড়ান।
আমীরে স্পেন! যিরাব বলল, দূত সকালেও আসতে পারে। পয়গাম অতি জরুরী হলে এক দুদণ্ড পরেও আসা যেতে পারে। আমীরে স্পেন কারো বন্দী নয়তো।
সকালে আসতে বলল। চোখ ঢুলুঢুল অবস্থায় আবদুর রহমান বললেন।
দূতকে বলো সকালে দেখা করতে যিরাব বলল।
দারোয়ান চড়ে গেল। যিরাব ও সুলতানা মুখ চাওয়া-চাউয়ি করল। উভয়ের ওপ্রান্তে ভেসে উঠল অর্থপূর্ণ হাসি। হেরেমে আবার গুঞ্জরিত হলো পিয়ানোর সুর।
খানিকবাদে আবারো দরজা খুলে গেল। উঠে গেল সেই সাথে পর্দাও। আমীরে স্পন, যিরাব ও সুলতানা সকলে চমকে উঠলেন। এবারে সুলতানা ও যিরাবের চেহারার প্রতিক্রিয়া অন্যরকম। কেননা এবারে পূর্বানুমতি ছাড়া যিনি দরজা ঠেলে পর্দা উঁচিয়ে ভেতরে আসছেন তিনি আবদুর রহমানের ২০ বছর বয়স্ক পুত্ৰ উমাইয়া। উপ-সেনাপতি। ফৌজে তার পদমর্যাদা। একরাশ ঘৃণাসুলভ কণ্ঠে সে বললো,
আপনাকে পিতা নাকি আমীরে স্পেন বলব?
কি হলো তোমার উমাইয়া! তোমাকে এতটা অগ্নিমূর্তি দেখাচ্ছে কেন? আবদুর রহমান উঠে বসে বললেন।
টলেডোর বিদ্রোহীদের কি এ খবর দেব যে, তারা যেন কাল সকালে অভ্যুত্থান করে। কেননা, আমীরে স্পেন এক্ষণে সংগীত মোহে আচ্ছন্ন? টলেডোর দূতকে কে বলেছে সকালে দেখা করতে?
আরব দেশে কোন মা এমন সন্তান জন্ম দিয়েছে বলে আমার জানা নেই। তুমি কি আদর-লেহাজ ভুলে গেছো?
এ সময় আপনি আদর-লেহাজের যোগ্য নন। আদব-লেহাজ পাওয়ার যোগ্য তখন আপনি যখন দুশমনের সামনে পিঠটান করে দাঁড়ান। রণাঙ্গনের আদব। আলীজাহ! এতে তোমার কোনো আফসোস নাই যে, আমি বাবার সাথে ঔদ্ধত্যপূর্ণচিত্তে কথা বলছি। কিন্তু ইতিহাস ও স্বাধীনতার চেতনায় ঔদ্ধত্য প্রদর্শন করলেই কেবল আমার অনুশোচনা। আপনার মৃত্যুর পর জাতি বলবে, এ সেই লোকের সন্তান যিনি স্পেনের জাতিসত্তার শেকড় দুর্বল করে দিয়েছিলেন।
কি বলতে চাও তুমি?
জোয়ান বেটা বেরিয়ে গেল। নিয়ে এলো ছেঁড়াকাটা জামাধারী এক লোককে। তার মাথা ঘুরছে। মনে হচ্ছে টানা সফরের ক্লান্তিতে সে নেতিয়ে গেছে। উমাইয়া যিরাব ও সুলতানাকে কামরা থেকে বেরিয়ে যেতে নির্দেশ দিলেন।
বাবা! এ দূত টলেডোর। বড্ড পেরেশান অবস্থায় আমার কাছে এসেছেন। তিনি আপনার সাথে জরুরী আলাপ করতে চান। এত দ্রুত ছিল তার সফর যে, রাতেও সামান্য বিশ্রাম নেয়ার ফুরসৎ মেলেনি। পথিমধ্যে তার একটা ঘোড়া টানা সফরের ধকল সইতে না পেরে মারা গেছে। জনৈক মুসাফির থেকে ঘোড়া হাওলাত করে কোনক্রমে আপনার বালাখানায় পৌঁছেছেন।
টলেডোয় খ্রীস্টানরা বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে। দূত বললেন, প্রথমদিকে তারা আমাদের সেনাক্যাম্পের ওপর গেরিলা হামলা চালায়। ফৌজি রসদ বহরের ওপরও তারা বারকয়েক হামলা চালিয়েছে। ওদের সন্ধানে বাহিনী পাঠিয়ে কোন ফল হয়নি। কবরস্থানে ভেল্কিবাজি করে নগরবাসীকে বিদ্রোহে নামানো হয়েছে। বিদ্রোহীদের অস্ত্র চালনা দ্বারা বোঝা যাচ্ছে, তাদের কমান্ডার টেনিং-প্রাপ্ত বিদেশী কেউ। তবে মাদ্রিদের মত গণ বিদ্রোহ হয়নি।
যতদূর জানা গেছে, হাশেম কর্মকার এই বিদ্রোহের শিরোমণি, কিন্তু কোন খোঁজ নেই। জানা গেছে, ফ্লোরা নাম্নী এক মেয়ে যাকে সকলে দ্বিতীয় মরিয়ম সাব্যস্ত করেছে এই বিদ্রোহে সে ঘৃতাহুতি দিয়েছে। শহরবাসী রীতিমত সৈনিক সেজেছে। সুযোগ পেলেই তারা হামলা করে বসে।
বিদ্রোহীরা সরকারী কোষাগার লুণ্ঠনের চেষ্টা করছে কি? প্রশ্ন আঃ রহমানের।
আমীরে স্পেন, দূত বললেন।
ওরা কি সৈনিকদের মত সুশৃঙ্খল?
না। ওদের ভাবখানা ডাকাত ও ছিনতাইকারীদের মত। আবদুর রহমান দূতকে আরো কিছু প্রশ্ন করার পর বিদায় করলেন। শাহী প্রহরীকে ডেকে সেনাপতি ও মন্ত্রীকে দেখা করতে বললেন।
***
টলেডোর দুর্গম পাহাড়ী অঞ্চল।
ঘন ঝোঁপ ঝাড়ে স্থানটি ভরা।
এ এলাকা জনশূন্য। পাহাড়ের গায়ে বিশাল বিশাল গর্ত। এসব গর্তে একটা আলো জ্বলছে। এ গুহাই হাশেম কর্মকারের ঘাঁটি। একলোক ওখানে প্রবেশ করল। তাকে দেখে চতুর্দিকের লোক একত্রিত হল। তন্মধ্যে আছে সুন্দরী এক তরুণী। ফ্লোরা যার নাম।
বিদ্রোহীদের মনোবল তুঙ্গে তো? ফ্লোরা জিজ্ঞেস করল, কি সংবাদ এনেছ?
সংবাদ আমাকে শুনতে দাও! তুমি এখনও অপরপি। বিদ্রোহ ও যুদ্ধে আবেগ কাজে আসে না বলে এক লোক আগন্তুককে বললো, হ্যাঁ। বলল খবর কি?
সব কাজই ঠিকঠাকমত চলছে। আগন্তুক বললো, আপনার নির্দেশনা ঘরে ঘরে পৌঁছে দেয়া হয়েছে। তাজা খবর হচ্ছে, জনৈক মুসলিম দূতের কর্ডোভা যাত্রা। ওখান থেকে ফৌজ আসবে। টলেডোর সরকারী বাহিনীকে আমরা অতি দ্রুত শেষ করতে পারব। কিন্তু কর্ডোভা বাহিনী এসে পড়লে পরিস্থিতির মোকাবিলা মুশকিল হয়ে পঁড়াবে।
আমাদেরকে সেনা শৃঙ্খল হতে হবে। সকলকে বাড়ী বাড়ী অস্ত্র রাখতে বলেছি। নির্দেশ পেয়েই যেন সকলে সশস্ত্র নেমে পড়ে। হাশেম বলল।
হাশেম তার আশে পাশের লোকদের বলল, আমাদের কিছু লোক টলেডোর বাইরে থাকবে, তারা যেন কর্ডোভা বাহিনীকে পথিমধ্যেই আটকে দিতে পারে।
কিছুদিনের মধ্যে টলেডোর বাইরে এক বাহিনী গড়ে তোলা হলো। টলেডোর গভর্নর ছিলেন মোহাম্মদ ইবনে ওয়াসিম। তার বাহিনী ছিল খুবই নগণ্য। শহরের শান্তি, নিরাপত্তা ছিল এদের হাতে ন্যস্ত। এই বাহিনী গেরিলা বিদ্রোহীদের সন্ধানে থাকত। মোহাম্মদ ইবনে ওয়াসিমের হেড কোয়ার্টার টলেডোর বাইরে একটি সুন্দর শ্যামলিমাময় স্থানে। তার কাছে খবর আসে, টলেডোর দুতিন মাইল দূরে শক্ত বাহিনী গড়ে তোলা হচ্ছে। খুব সম্ভব এরা টলেডোর ওপর হামলা চালাবে। এমনটা হলে এ শহর খীস্ট রাজ্যে রূপান্তরিত হবে।
মোহাম্মদ ইবনে ওয়াসিম দ্রত একদল বাহিনীকে প্রস্তুতি নিতে বললেন। বাহিনী প্রস্তুত হলো। এদের নেতৃত্বভার নিজেই নিলেন।
ইবনে ওয়াসিমের আত্মতৃপ্তি ছিল এই ভেবে যে, তিনি অপেশাদার লোকদের বিরুদ্ধে সৈন্য মার্চ করতে যাচ্ছেন। কিন্তু বিদ্রোহীদের মুখোমুখি হলে দেখলেন ওরা সংখ্যায় বেশী। তিনি হুকুম দিলেন ওদের একটাও যেন জীবন্ত ছাড়া না পায়। বিদ্রোহীরা দীর্ঘক্ষণ ধরে লড়াই করে পিছু হটে যায়। আচমকা মুসলমানদেরকে তিনদিকে থেকে একদল সুদক্ষ ফৌজ হামলা করে বসে। মোহাম্মদ ইবনে ওয়াসিম অবস্থা বেগতিক দেখে সেনাদের পিছু হটতে বললেন।
তিনি বাহিনীকে ফেরৎ এনে দেখলেন অর্ধেক ফৌজ তার খোয়া গেছে। তিনি সংবাদ পেয়েছিলেন বিদ্রোহীরা ছোট ছোট দলে আক্রমণ করবে কিন্তু এখানকার পরিস্থিতি তাকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে তার ভুল ভেঙ্গে দেয়।
***
পলায়নকালে দুমুসলিম সেপাইকে চার বিদ্রোহী পশ্চাদ্ধাবন করছিল। এলাকাটি ঘন পাহাড়ী ঝোপে ঠাসা। তারা ওই ঝোপে আশ্রয় নিল। বিদ্রোহীরা ঘোড়পৃষ্ঠে এদের ওপর এলোপাতাড়ি তীর মেরে যাচ্ছিল, কিন্তু সমস্ত তীর নিশানচ্যুত হলো। মুসলিম সেপাই পাহাড়ের ঝোপে আশ্রয় নিল বটে, কিন্তু তাদের ধারণা এখান থেকে বেরোনো খুব। একটা সহজ নয়। তারাও ঘোড়া ছেড়ে পারলে ছুটতে লাগল। জঙ্গল খুবই ঘন। বিদ্রোহীদের অনুসন্ধানী আওয়াজ তাদের কানে ভেসে আসছে। তারা বেশ ওপরে উঠে গেছে যেখান থেকে অবলীলায় নীচে দেখা যায়।
কিছুক্ষণের মধ্যে বিদ্রোহীরা নীচে এসে গেল। থমকে থমকে চলছিল তারা। তাদের একজনে বলল, ওদের তালাশ করে মারা দরকার। আমাদের মূল ঘাঁটিতে বেটারা যেন পৌঁছে না যায়।
দেখ দেখ! আরেকজনে বলল, ওরা বেশ সামনে অগ্রসর হয়েছে। ঘাঁটি দেখে ফেললে আমাদের অবস্থা শোচনীয় হবে বৈকি।
মুসলিম সেপাহীদ্বয় জীবন বাঁচানোর তাগিদে হন্যে হয়ে ঘুরে ফিরছে। তাদের কানেও বিদ্রোহীদের উপরোক্ত কথা যায়। বলে, খুব সম্ভব ওরা সে জায়গার কথা বলছে যেখানে ওদের নেতারা থাকে এবং যাবতীয় দিক নির্দেশনা দিয়ে থাকে।
শুনেছি যে কুমারী মরিয়মের আর্বিভাব ঘটেছিল কবরস্থানে, সেও এখানে আছে। অপরজনে বলল।
আমাদের কমান্ডার বলেছিল বিদ্রোহী নেতা হাশেম কর্মকার। সে তার সাথে এক তন্বীতরুণীকে রেখেছে। ওই তরুণীকে তারা পবিত্র মনে করে।
আল্লাহর নাম নাও দোন্ত। অপরজনে বললো, ওই স্থান তালাশ করো! মরতে হলে কিছু করেই তবে মরব। ধর্মের নামে ওরা ধোকা দিলে সেই ধোকাকে আমরা ইসলামের নামে খতম করব। ওপরে অবস্থান নেয়া বিদ্রোহীরা বলেছে, আমরা না আবার আগে বেড়ে যাই।
এদের উপরে যারা ছিল তারা আগে বেড়ে গেল। মুসলিম সেপাহীরা পালানোর পথ পেয়ে গিয়েছিল। মুসলমানরা আত্মরক্ষার স্থলে এ মুহূর্তে গেরিলা হামলার চিন্তা করল। কেননা ওই চার বিদ্রোহী সওয়ারদের তারা দেখতে পাচ্ছে। সেপাহীরা চাচ্ছে বিদ্রোহী ছড়িয়ে পড়ুক-তাহলে যুতসই হামলা চালানো সম্ভব।
বাস্তবেও তাই হলো, ওরা আলাদা আলাদা চলতে লাগল। মুসলিম সিপাহীরা যেখানটায় আত্মগোপন করেছিল সেখানটা পাহাড়ের প্রান্ত। তাদের নীচে নামার কথা। বিদ্রোহীরা কেটে পড়ার পর উভয়ে বিদ্রোহীদের অবস্থান নেয়া ওপরের প্রান্তর।
এখান থেকে তারা একটি আলোকোজ্জ্বল গুহা দেখতে পায়। বিদ্রোহীরা ওই গুহার সামনে এসে দাঁড়াল। এ সময় গুহার মুখে এক নজরকাড়া সুন্দরীকে দেখা গেল।
এ সেই মেয়ে বোধ হয়! জঙ্গলে ওই মেয়ে ছাড়া আর কার থাকার কথা? বলল মুসলিম সেপাইয়ের একজন।
***
টলেডোর গভর্নর হাউজ।
বিক্ষিপ্ত পায়চারী করছেন মোহাম্মদ ইবনে ওয়াসিম। গোয় হাতের মুঠোয় মুঠো পুরে তিনি বলছেন,
কর্ডোভা থেকে এখনো কমান্ডো আসছে না কেন? দূত এখনো ফিরে আসেনি, বিলাসী আবদুর রহমান বোধ হয় যিরাবের সংগীতে ডুবে আছে, বগলদাবা করে আছে সুলতানকে।
কর্ডোভা থেকে ফৌজ আসার আগে বিদ্রোহী বাহিনীর সাথে আলাপ করলে কেমন হয়। তাদের থেকে জানুন না তাদের দাবী কি? বলল জনৈক ফৌজি কমান্ডার।
ওরা টলেডো লেখে দিতে বললে এই প্রস্তাবনা তুমি মেনে নেবে কি? মনে করছ পরাজিত হবার পর দুশমনের কাছে আমি করুণা ভিক্ষা চাইব? কোরআন বর্ণিত বিধানের বাইরে যাব? জানো কোরআনে পাকের বিধান কি? কোরআনের ভাষণ হচ্ছে, সন্ত্রাসের শেষ ছিটেফোঁটা থাকা পর্যন্ত জেহাদ চালিয়ে যাও। কুফরের ফেত্নাকে আমার আঙ্গিনায় প্রবেশানুমতি দিতে পারি না।
আমার উদ্দেশ্য সেটা নয়। বিদ্রোহীদের সাথে আমি কোন প্রকার সমঝোতার কথা বলছি না। চাচ্ছি আলোচনা চালিয়ে কালক্ষেপণ করতে। কমান্ডো আসতেই আমাদের এমন কোনো প্ল্যান নিতে হবে যাতে ওদের পিলা বিদীর্ণ হয়ে যায়।
সন্ধি-সমঝোতাকে যদিও আমরা একটি চাল হিসেবে নেই তথাপিও আমাদের আবদুর রহমান একে একটা মৌলনীতি হিসেবে গ্রহণ করবেন। বিলাসিতার সাথে দেশ চালানোর সহজ পন্থা হচ্ছে দুশমনকে দোস্ত করে জাতিকে ধাঁধার মধ্যে রাখা এবং আত্মপ্রবঞ্চিত হওয়া। এমন একটা সময় আসবে যখন আমাদের জাতি দুশমনের হুমকিতে ভীত হয়ে জাতির বাদশাহদের বীরত্বপূর্ণ কাহিনীগুলোকে মিথ্যে ঠাওরাবে। এ সময় শাহী প্রহরী এসে বলল, জনৈক কমান্ডার আপনার সাক্ষাপ্রার্থী।
এতে অনুমতির কি দরকার? কাউকে আসতে বাধা দিও না। সবার জন্য আমার দরজা উন্মুক্ত। আমি বাদশাহ কিংবা স্পেনের আমীর নই।
কমান্ডার ভেতরে এলেন। তাজা খুনে তার জামা লালে লাল।
তুমি কি যখমী? প্রশ্ন ইবনে ওয়াসিমের।
আমি আমার যখম দেখতে আসিনি। একশ সৈন্য নিয়ে আমি চৌকি প্রহরায় যাচ্ছিলাম। পথিমধ্যে বিদ্রোহী গেরিলা বাহিনী আমাদের ওপর চড়াও হয়। সংখ্যায় ওরা দুশ এর কম হবে না। আমার বাহিনী যতটা ক্ষিপ্র, চৌকস ও সুদক্ষ ততটা ওরাও। আমি আমার অধীনদের বীরত্বের উপাখ্যানও শোনাতে আসিনি। বলতে এসেছি, আমার একশ-এর ৬১ জনই শাহাদতের শিরীন শরাব পান করেছে। তবে তারাও দুশমনের একশ জনকে জাহান্নামের পথ দেখিয়েছে।
ওই চৌকি বাঁচানো সম্ভব হয়েছে কি?
না। চৌকি প্রহরী সামান্য ছিল। বিদ্রোহীরা ওটি দখল করে নিয়ে গেছে। আমি বলতে এসেছি বিদ্রোহীদের সংখ্যা এত বেশী যে, তাদের মোকাবেলা করার মত সেপাই আমাদের নেই। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হচ্ছে এই যে, দূরের ঘন ঝোঁপ-ঝাড়ে কিছু একটা আছে। বিদ্রোহীদের মদদ ও নির্দেশনা ওখান থেকেই আসছে বোধ হয়। হাশেম কর্মকার ও ফ্লোরা ওদের কাছে সর্বাপেক্ষা প্রিয় নেতাগোছের-এমর্মেও তথ্য আমার কাছে। আমার ধারণা ওরা গভীর ওই অরণ্যের কোথাও ঘাঁটি গেড়ে আছে। কাজেই এ মুহূর্তে আমার পরামর্শ জানবার্য একটা টিম গঠন করে ওদের কলিজায় আঘাত করার ব্যবস্থা করা হোক।
আমি দুর্গম ওই পাহাড়ী অবস্থান সম্পর্কে সর্বশেষ অবহিত। ওখানে কাউকে খুঁজে বের করা চাট্টিখানি কথা নয়। প্রথমত দুএকজন অনুসন্ধানী লোক পাঠানো লাগবে। তারা যুতসই রিপোর্ট দিলেই কেবল জানবার্য টিম পাঠানো যেতে পারে। ইবনে ওয়াসিম বললেন।
আমার গোস্তাকির জন্য আগাম মাফ চেয়ে নিচ্ছি। আপনি সম্ভব-অসম্ভবের দোলাচলের কথা বলছেন। অসম্ভবকে এই মুহূর্তে আমাদের সম্ভব করে দেখাতে হবে। কর্ডোভার কমান্ডো আগমন পর্যন্ত আমরা অপেক্ষা করতে পারব না। উদ্দীপনা ও স্পৃহাকে এ মুহূর্তে কাজে লাগাতে হবে। বিদ্রোহীদের উৎসগিরি খতম না হওয়া পর্যন্ত বিদ্রোহ দমন হবে না। আমাদের কোরবানী দিতে হবে প্রচুর। আমরা জানবাযি রাখতে প্রস্তুত। আমরা বেশী অপেক্ষা……………., কমান্ডার আর কিছু না বলে মূৰ্ছা খেয়ে জমিনে লুটিয়ে পড়ল। মোহাম্মদ ইবনে ওয়াসিম ও উপস্থিত উপ-সেনাধ্যক্ষরা তাকে ঘিরে ধরল। তার পেটে কাজ কাপড় মোড়ানো। অধিক রক্তক্ষরণের ফলে তিনি শাহাদত বরণ করলেন। কোনো মোজেযাবলেই এতক্ষণে তিনি কথা বলেছেন। কাপড় সরিয়ে দেখা গেল তার পেট ফাড়া।
এই জানবায যখন এখানে এসেছিল তখন সে জীবিত ছিল না। তার রুহ-ই। এতক্ষণ আমাদের সাথে কথা বলেছে। উহধ্বনি দিয়ে তিনি বলছেন, কওমের কোরবানী ও উদ্দীপনা শাসকদলের দহলিয়ে গিয়ে অর্থহীন ও নিশ্চল হয়ে ফেরে। কর্ডোভার দূত এখনও আসেনি। আমাদের আমীর বোধ হয় টলেডো পরিস্থিতি এখনও ঠাওর করতে পারেন নি। তিনি ঠাওর করতে না পারলেও আমরা পারছি। তিনি রাজত্ব ও ক্ষমতার পূজারী। আমরা স্বাধীনতার অমীয় চেতনায় বিশ্বাসী। স্পেন কারো বাপ-দাদার সম্পত্তি নয়। যতক্ষণ জিন্দা আছি ততক্ষণ আমরা একে বুকের তাজা খুনে রক্ষা করে যাব। মরলেও যার যার দায়িত্ব আদায় করেই তবে মরব। কিন্তু হাশেম কর্মকারের তথ্য কে দেবে আমায়?
মোহাম্মদ ইবনে ওয়াসিম দুহাত উঁচিয়ে আসমানের দিকে তাকিয়ে হাউমাউ করে ওঠেন। তোমার নামে…………তোমার সাহায্যে……..আমাদের ভুলে যেও না খোদা……..।
***
খোদাতায়ালা সিংহশাবকদের ভুলতে পারেন না। কর্ডোভাবাসী ভুলে গিয়েছিল যে, মোয়াল্লেদীন আন্দোলন কি। তারা বিশাল চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে মুসলিম জাতির সামনে। এ সেই আবদুর রহমান যিনি ফ্রান্সের ওপর হামলার ছক এঁকেছিলেন, সেই তিনি বিদ্রোহকে খুব আমলে আনছিলেন না। সঙ্গীতজ্ঞ যিরাব ও ছলনাময়ীর কোপানল থেকে বাবাকে ছড়িয়ে আনলেও আবদুর রহমানের ভুল ধারণা ভাঙ্গাতে পারেননি আমীর পুত্ৰ উমাইয়া। আবদুর রহমান সেনাপতিকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু তাদেরকে বলার সুযোগ দেননি তেমন একটা তিনি। সেনাপতি বলেছিলেন।
আমি মোহাম্মদ ইবনে ওয়াসিমকে চিনি। সামান্য ঘটনায় লোকটা ঘাবড়ে যায়। টলেডোর খ্রীস্টানরা এতটা দুঃসাহসিক নয় যে, তারা বড় মাপের বিদ্রোহ করবে। আমার মন বলছে, ডাকাতরা দুএকটা কাফেলা লুণ্ঠন করেছে। আপনারা কি আমাকে টলেডোয় বিশাল এক বাহিনী পাঠানোর পরামর্শ দেন? আপনারা দেখছেন, কর্ডোভা পরিস্থিতি ক্রমশঃ আমাদের বিরুদ্ধে চলে যাচ্ছে।
ডাকাতদের খপ্পরে পড়লে তার ঘাবড়ানো উচিত নয়। তথাপিও আমাদের কোনো খুঁকি নেয়া ঠিক হবে না। এখানকার পরিস্থিতি জানতে লোক পাঠানো যেতে পারে। সেনাপতি বললেন।
মোহাম্মদ ইবনে ওয়াসিমের কক্ষ থেকে কমান্ডারের লাশ উঠানো হলো। তিনি তার সামান্য বাহিনীকে ব্যবহারের প্ল্যান আঁকছিলেন মনে মনে। ইতোমধ্যে তিন-চারটি রিপোর্ট দ্বারা তিনি অবগত হলেন টলেডো নগরী কার্যত বিদ্রোহীদের দখলে। অবস্থা এমন হলে বিদ্রোহীদের দমন তার একার পক্ষে সম্ভব না। তিনি বড় দুশ্চিন্তগ্রস্ত অবস্থায় কামরায় পায়চারী করছিলেন। অপেক্ষা করছিলেন কর্ডোভা দূতের।
ইতিহাস লিখছে, আবদুর রহমান দূতের কাছে পত্র মারফত এই ফরমান লিখেছিলেন, কি হলো তোমার! বিশাল সৈন্যবহর নিয়েও তুমি সামান্য কিছু ডাকাত ও ছিনতাইরীদের রুখতে পারছ না। সামান্য কিছু লোক যদি বিদ্রোহ করেও থাকে তাহলে কেমন কাপুরুষ ও অকর্মা সেপাইদেরকে তাদের দমন করতে প্রেরণ করেছে যারা পা চালিয়ে লড়তে পারে না? খোদ নিজেই ময়দানে নেমে আইন-শৃঙ্খলা ভঙ্গকারীদের কচুকাটা করো।
মোহাম্মদ ইবনে ওয়াসিমের শিরায় খুন উত্তপ্ত হয়ে উঠল। বিদ্রোহীদের সামনে হাতিয়ার সমর্পণ করলেও ছিল আরেক কথা। আবদুর রহমানের পুত্র তার কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিটা দিয়েছিল মাত্র। তিনি চূড়ান্ত লড়াইয়ে আমার প্রস্তুতি নিলেন।
যখন তিনি নয়া ফায়সালা করার চিন্তা করছিলেন তখন সেই দুই সেপাই তার কাছে এলো যারা পাহাড়ে সত্যগোপন করে ফ্লোরার ঘাটি দেখেছিল। তিনি তাদের বললেন; কি সংবাদ এনেছে তোমরা? আমাদের আর কত চৌকি ধ্বংস হয়েছে? বিদ্রোহীদের আর কি কি বিজয় সাধিত হয়েছে?
আমাদের কাছে নতুন কোন সংবাদ নেই। ওদিন আমরা দুজন লড়াই থেকে পলায়নকালে চার বিদ্রোহী আমাদের ঘিরে ফেলে। আমরা পাহাড়ী এলাকায় আপাতত গোপন রইলাম। পশ্চাদ্ধাবনকারীরা আমাদেরকে দেখতে পায়নি। তারা খুঁজতে খুঁজতে নীচে নামছিল। ওদের কথা আমরা শুনেছি। বুঝেছি পাহাড়ে বিশেষ কোনো ঘাঁটি আছে। ওরা এক সময় আমাদের না পেয়ে আগে বাড়ে। আমরা তখন ফিরে আসার প্ল্যান করছিলাম, কিন্তু কেন যেন ওদের ঘাঁটি আবিষ্কারের অদম্য স্পৃহা মনকে উতলা করে তুলল। ওখানেই বসে ওদের সে ঘাঁটি আমাদের দৃষ্টি খুঁজে ফিরল। সত্যিই আমরা সে ঘাঁটি অবলীলায় পেয়ে বসলাম।
কি পেলে তোমরা?
ওখানে একটি গুহা থেকে কিছু মানুষকে বের হতে দেখলাম। দেখলাম ভুবন মোহিনী এক সুন্দরীকেও।
এ তাহলে সে-ই। তোমরা জানো না কি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য এটি। ওই মেয়ে-ই বিদ্রোহীদের প্রাণকেন্দ্র। আমি ওর বুকে খঞ্জর ফুলা ঢুকিয়েই তবে ক্লান্ত হব। শেষের দিকের কথা বলতে গিয়ে মোহাম্মদ ইবনে ওয়াসিমের চোয়াল দুটো শক্ত হয়ে উঠল।
তিনি তখনই তার কমান্ডারদের ডেকে পাঠালেন। বললেন, স্রেফ ১৫ জন সেপাই। যাদের স্পৃহা-উদ্দীপনা অজেয়, ইসলামের জন্য নিবেদিতপ্রাণ, তীক্ষ্ণ মেধা, প্রত্যুৎপন্নমতি।
কিছুক্ষণের মধ্যে ইসলামের নামে আত্মোৎসর্গী ১৫ জন জানবার্য তৈরী হয়ে গেল। তিনি সকলকে বলে দিলেন, এরা দুজন তোমাদের পথ প্রদর্শক। রাতের বেলা ওই গুহায় অগ্নিবাণ নিক্ষেপ করতে হবে। দেখো কেউ যেন পলায়ন করতে না পারে। মেয়েটাকে জীবন্ত গ্রেফতার করো। আমরা খ্রীস্টানদের দেখাতে চাই এ-ই তোমাদের তথাকথিত কুমারী মরিয়ম যার ভেলকি তোমরা কবরস্থানে দেখেছ।
গভর্নর অপর এক হুকুমে বললেন, বাদবাকী ফৌজ এখানে জমায়েত কর। এতে উপকার হবে দুটি– টলেডো বাসী ভাববে, ফৌজ পরাজিত হয়ে পলায়ন করছে। এবং সেক্ষেত্রে বিদ্রোহীরা প্রচণ্ড হামলা চালানোর সাহস পাবে। এতে বিজয়ের দিনে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হবে তারা।
গভীর রাতে ১৫ জন জানবা সেপাই দুর্গম টিলায় এসে দাঁড়াল। সাথে দু পথ প্রদর্শক। টিলাটিকে প্রশস্ত এক কেল্লাই বলতে হবে। এরা একসাথে যাচ্ছিল না, যাচ্ছিল দূরত্ব বজায় রেখে।
আচমকা ঘন ঝোঁপ থেকে আওয়াজ এলো– কে? জলদি এসো!
সামনের জানবায সেপাই থমকে দাঁড়াল। আহ্বানকারী তার সামনে এসে দাঁড়াল। আচমকা পেছন থেকে এক মুজাহিদ ওই বিদ্রোহী পাহারাদারের পিঠে খঞ্জর ফলা আমূল ঢুকিয়ে দিল। মুজাহিদরা তাকে সুগভীর ঢালে নিক্ষেপ করল। পরে আবার শুরু হলো দূরত্ব বজায় রেখে তাদের পথচলা। একটি গিরিপথ থেকে চলতে গিয়ে তারা আবার আরেক আওয়াজ পেল। সকলেই পথ ছেড়ে পাশের ঝোপে আত্মগোপন করল। স্রেফ দুমুজাহিদ মূলপথে অগ্রসর হলো।
তোমরা কে গো ভাই! জনৈক সিপাহী জিজ্ঞেস করল, আমি যখমী, আমি পানি তালাশ করে ফিরছি। আহ্বানকারী একেবারে কাছাকাছি এসে দাঁড়াল। এক বিদ্রোহী এ সময় দূরে আত্মগোপন করে এ দৃশ্য অবলোকন করছিল। অবস্থা বেগতিক দেখে এক লাফে অগ্রসর হলে দুমুজাহিদ তার বুকে খঞ্জর ঢুকিয়ে দিল।
মুসলিম কমান্ডার বললেন, ঘাটির পথে ওদের পাহারা খুবই নিচ্ছিদ্র মনে হচ্ছে।
আরেকটু অগ্রসর হয়ে আমাদের মূলপথ থেকে হটে যেতে হবে। পাড়ি দিতে হবে দুর্গম পথ। মুখে তালা দিতে হবে সকলের।
স্থানটি দুর্গম কেল্লা থেকে কোনো অংশে কম নয়। আরো উঁচু টিলায় চেপে তারা আলোর সন্ধান পেল। দুবিদ্রোহী পাহাড়ের মোড়ে আগুন জ্বেলেছিল। শাঁ করে দুতীর এসে এদের ঘায়েল করল।
প্রাথমিক এই বিজয়ের পর ওই পাহাড় থেকে নেমে আরেকটি পাহাড়ে চড়ল তারা। পনের জন জানবাযের দুজন মূল ঘাটির মূলে এসে দাঁড়াল। আড়ি পেতে তারা গুহার খবরাখবর নিয়ে এলো। এদের দ্বারা জানা গেল, ফ্লোরা এখানে নেই। সন্ধ্যার পূর্বে সে পলায়ন করেছে। ভেতরে আলো জ্বলছে টিমটিম। গুহার অভ্যন্তর বেশ চওড়া।
গুহার ভেতরে অবস্থান করে বিদ্রোহীরা মদের ড্রাম সামনে নিয়ে নেশা করছে। বলে চলেছে বিদ্রোহের আগামী দিনের নানা পরিকল্পনা। শাঁ করে তিনটি তীর তিন বিদ্রোহীর সীনা এফোঁড় ওফোড় করে দিল। ভেতরে এদের সংখ্যা জনাত্রিশেক হবে মাত্র। গুহাটি মসৃণ নয় তবে প্রশস্ত। প্রকাণ্ড পাথরে ঠাসা। এক একটি পাথরের পেছনে এক একজন একে আড়াল করে দাঁড়াতে পারে।
বিদ্রোহীরা হুঁশিয়ার হয়ে গেল। সকলেই ওসব পাথরের আড়ালে গিয়ে তীর নিক্ষেপ শুরু করল। বিদ্রোহীরা এতই দিশেহারা হলো যে, মশল ও প্রদীপ নেভানোর হুঁশটুকু তারা হারিয়ে ফেলল। বেশ খানিকক্ষণ তীর বিনিময় চলল। চার জানবায মুজাহিদ বুকডন করে ভেতরে গেল। তারা ঐ প্রকাণ্ড পাথরের আড়ালে আত্মগোপন করে সরাসরি তীর নিক্ষেপ প্রক্রিয়া চালিয়ে যেতে লাগল। এদের দেখাদেখি আরো চার মুজাহিদ সাহস করে ভেতরে এলো। তলোয়ার ও বর্শা যুদ্ধ শুরু হলো এবার। স্বল্প সময়ের ব্যবধানে এই যুদ্ধ খতম হয়ে গেল। ভেতরের সকল বিদ্রোহীকে জাহান্নামে পৌঁছে দেয়া হলো।
মুজাহিদদের মাত্র তিনজন শহীদ ও দুজন যখমী হলো। মুজাহিদ কমান্ডার যখমী বিদ্রোহীদের জিজ্ঞেস করলেন, হাশেম কর্মকার কৈ। সে এক যখমীর দিকে ইশারা
করলে। দেখা গেল বেটা অক্কা পেয়েছে। তার দেহে দুটি তীর বিদ্ধ। তার লাশ টেনেহিঁচড়ে বাইরে নিয়ে আসা হলো।
শেষ রাত।
ফ্লোরার কোন সন্ধান পাওয়া গেল না।
মোহাম্মদ ইবনে ওয়াসিম দুশ্চিন্তা গ্রস্ত। তার চিন্তার ললাটে বেশ কটা ভাজ। বিক্ষিপ্ত পায়চারী করছেন ও দিগন্তে চোখ ফেলছেন। পাশে জনাতিনেক কমান্ডার।
এক সময় অপেক্ষার পালা শেষ। খবর এলো, মুজাহিদবৃন্দ এসে পড়েছে। তিনি দৌড়ে বের হলেন। গেরিলা মুজাহিদ ও ওই দুপথ প্রদর্শক দণ্ডায়মান। সামনে তিন শহীদের তিন লাশ মোবারক ও দুখমী। এ ছাড়া পৃথক একটি লাশও দেখা গেল।
এই কি হাশেম কর্মকার? প্রশ্ন মোহাম্মদ ইবনে ওয়াসিমের।
হ্যাঁ! এ লোকই।
এই লাশ শহরের চৌরাস্তায় লটকে দাও। মোহাম্মদ ইবনে ওয়াসিম হুকুম দিলেন, ওকে গোটা খ্রীস্টান সম্প্রদায় ও মোয়াল্লেদীন আন্দোলন কর্মীরা দেখুক। ভোরের আলো ফোঁটার পূর্বেই এ লাশ লটকাও। এরপর দেখা যাবে ফ্লোরা কোথায়।
ফওরান এক লোককে ডেকে তার ঘোড়ার পিঠে হাশেম কর্মকারের লাশ চাপানো হলো। যিনি এই লাশ নিয়ে গেলেন তিনি নামীদামী এক গোয়েন্দা। ছিলেন খ্রীস্টান ছদ্মবেশে। এই বেশে তিনি খ্রীস্টানদের বহু তথ্য উদঘাটন করেছেন। তাকে বলা হলো, শহরে ঘোষণা করা হোক, এ সেই হাশেম যে তোমাদেরকে বিদ্রোহে মদদ করেছে। কর্ডোভা থেকে পিপীলিকার মত বাহিনী আসছে। কারো রক্ষা নেই। বিদ্রোহীদের এমন শাস্তি দেয়া হবে ইতিহাসের কলম যা লিখতে কেঁপে ওঠবে। কর্ডোভা বাহিনী কোথাও তবু গেড়ে আছে, যে কোন সময় টর্নেডো গতিতে এসে পড়বে।
***
বিদ্রোহীরা যে বাহিনী গড়ে তুলেছিল তাদের অর্ধেকটা বাইরে তাঁবু গেড়ে ছিল, বাদ বাকীটা শহরের ভেতরে। এক খবরে জানা গেল, বিদ্রোহীদের নেতৃত্ব দেয়ার জন্য ফ্রান্সের কমান্ডার এসেছে। এ দ্বারাই মোহাম্মদ ইবনে ওয়াসিম বাহিনীর পরাজয়ের কারণ অবলীলায় বুঝে আসে। এ বাহিনীর মনোবল তুঙ্গে কেননা ছোটখাট বিজয় তারা অর্জন করে যাচ্ছিলেন। মুসলিম ফৌজ তাদের মোকাবেলায় নগণ্য।
***
পরদিন।
বিদ্রোহী সেনা ছাউনিতে খবর ছড়িয়ে পড়ল যে, তাদের আধ্যাত্ম গুরু ও প্রধান নেতা হাশেম কর্মকারের লাশ শহরের প্রবেশ ফটকের সামনে ঝুলছে। লাশ যারা ঝুলিয়েছিল তারা শহরের প্রধান ফটকে বিদ্রোহীদের প্রহরা দেখেছিল। কাজেই তারা ভেতরে ঢুকতে পারেনি। ফ্লোরার ব্যাপারে রটেছিল, সেও মারা গেছে। ফ্লোরাকে কিডন্যাপ করা হয়েছিল। অবৈধ প্রেমের দরুন তার প্রেমিক ক্ষুব্ধ হয়ে এ কাজ করেছে। আরো ছড়ানো হলো, ফ্লোরা ছিল একটি রহস্য। সে বিবাহ বহির্ভূত এক লোকের সাথে একই ছাদের নীচে শুয়েছে। তার সাবেক প্রেমিকই তাকে হত্যা করেছে।
মোহাম্মদ ইবনে ওয়াসিম খ্রীস্টানদের বেশে আজো ছদ্মবেশী গোয়েন্দা ছড়িয়ে দেন। তারা এসে সংবাদ দেয়, মিশন সফল। শহরের বাইরে ছাউনি ফেলা বিদ্রোহী প্রধান ফটকে ভীড় জমায়। হাশেম কর্মকারের শেষ পরিণতি দেখার জন্য হুলুস্থুল বেঁধে যায়।
মোহাম্মদ ইবনে ওয়াসিম তার নগণ্য বাহিনী পূর্ব হতেই সতর্ক অবস্থায় রেখেছিলেন। রাতের বেলা তিনি সৈনিকদের উদ্দেশে এক জ্বালাময়ী ভাষণ রেখেছিলেন।
ভোমরা আল্লাহর সৈনিক। দুশমনদের সংখ্যাধিক্যে ঘাবড়ে যেও না। আল্লাহর রাসূল কোনদিনও কাফেরদের সংখ্যাধিক্যের প্রতি ভুক্ষেপ করেননি। তাঁর জীবদ্দশায় প্রতিটি যুদ্ধেই বলতে গেলে কাফেরদের দল ভারী ছিল। কিন্তু বিজয়ের সোনার হরিণ মুসলমানদের পদচুম্বন করছে। আজরাসূলের পবিত্ৰাত্মার চেতনা আমাদের জেহাদী বক্ষে জাগরুক করে তোল। খ্রীস্টানরা তোমাদের ওপর বিজয় লাভ করেছে মনে করো না বরং খ্রীস্ট-ই ইসলামের ওপর বিজয় লাভ করতে চেষ্টা করে যাচ্ছে। কর্ডোভার বিলাসী আমীরের উদাসীনতা তোমাদের যেন ভাবিয়ে না তোলে। ওরা দুনিয়াদারে। এ জীবনই ওদের কাছে সবকিছু, কিন্তু তোমাদের আসল জীবন মরণের পরে। তোমরা খোদার সৈনিক, খোদার প্রিয় মুজাহিদ। আর কোন মুজাহিদের কাছে জাগতিক জৌলুস প্রাধান্য পেতে পারে না। বিদ্রোহীরা একবার আমাদের পরাভূত করেছে। ঐ পরাজয়ে হতোদ্যম হয়ে একেই আগামী দিনের বিজয়ের মাইল ফলক মনে করে এগিয়ে যাও। টলেডো কাফেরদের কজায়। যে হিংস্রতার শিকারক্ষেত্র বানাতে আদা নুন খেয়ে নেমেছে ওরা– তোমাদের নয় তা, তোমরা কি এই বেইজ্জতির প্রতিশোধ নিতে চাও না?
ফৌজ নারাধ্বনি করে। হ্যাঁ, হা! আমরা প্রতিশোধ নিতে চাই। শহীদের রক্ত বৃথা যেতে পারে না। কর্ডোভার তখতে তাউস উল্টে আমরা সেখানে বোদার রাজ কায়েম করব। শহীদের ফোঁটা ফোঁটা খুনের বদলা আমরা এক একটা বিলাসীকে হত্যার মাধ্যমে নেব ইনশাআল্লাহ।
এরপর মোহাম্মদ ইবনে ওয়াসিমকে আর বলতে হলো না। তার কাছে হাশেম কর্মকারের নিহত হবার খবর আসা মাত্রই বিদ্রোহীদের তাঁবু গুটানো শুরু হয়ে যায়। তারা সেনা ছাউনি ছেড়ে পালাতে থাকে।
সেনা ছাউনি ওখান থেকে মাইল দুয়েক দূরে। তিনি সুযোগমত তার বাহিনী ছড়িয়ে দিলেন। এবার ফৌজ এক মাইল লম্বা কাতার ধরে কোচ করতে লাগল। মুসলিম ফৌজের চলার পথে বিধস্ত। কিছু তবু দেখা গেল। কমাণ্ডারদের নির্দেশে তাবু ও ডেকচিসহ খড়ের কুটোয় আগুন লাগিয়ে দেয়া হলো। বিদ্রোহী বাহিনী শহরের প্রবেশদ্বারে ভীড় করে দাঁড়ানো ছিল। সেই ভীড় থেকে আর্তনাদ ভেসে এলো, ফৌজ এসে গেছে, কর্ডোভার ফৌজ।
মোহাম্মদ ইবনে ওয়াসিম বিপুল বিক্রমে আক্রমণ করতে বললেন। বিক্ষিপ্ত আকারে চারদিক থেকে তার ফৌজ বিদ্রোহীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। কিন্তু পলায়ন করার সুযোগ নেই তাদের। পালাবে কোথায়। পলায়নের তামাম পথ রুদ্ধ। ক্রীড়া ও মহড়ার ময়দানে এটি। যাদের হাতে অস্ত্র ছিল তারা মুসলিম সিপাহীদের মোকাবেলায় নামল। বাদবাকীরা ফটকের ভেতরে চলে গেল। যারা লড়াইতে নেমেছিল তাদের সাথেই মারা পড়ল। ভেতর থেকে বিদ্রোহীরা প্রবেশ দরজা রুদ্ধ করে দিল। ওদিকে মুসলিম বাহিনী দেয়ালের ওপর থেকে তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করছিল।
মোহাম্মদ ইবনে ওয়াসিমের টর্নেডো বাহিনী যে গতিতে এসেছিল সে গতিতেই আবার পিছপা হলো। বিদ্রোহীদের অর্ধেকটা ইতোমধ্যেই শেষ। তাই শহর রক্ষা তাদের জন্য মুশকিল হয়ে দাঁড়াল।
মোহাম্মদ ইবনে ওয়াসিম আসমানের দিক দুহাত উঁচিয়ে ফরিয়াদ করলেন। আশু বিজয় কামনায় তার দুচোখ বেয়ে নামল অশ্রর ফোয়ারা। ইতিহাস তার এ বিজয় গাঁথাকে মোজেযা হিসেবেই উল্লেখ করেছে। আল্লাহ তার ফরিয়াদ শুনলেন। পরের দিন খবর এলো, আবদুর রহমানের পুত্র উমাইয়ার নেতৃত্বে কমান্ডো আসছে কর্ডোভা থেকে। মোহাম্মদ ইবনে ওয়াসিম ঘোড়ায় চেপে তাকে সংবর্ধনা জানাতে ছুটে গেলেন।
উমাইয়া আবদুর রহমানের কোন স্ত্রীর গর্ভজাত ইতিহাস সে ব্যাপারে খামেশ। মোদাচ্ছেরা তখন যুবতী স্ত্রী। তার গর্ভে ২১/২২ বছরের যুবক পুত্র অসম্ভব।
উমাইয়া বলেন, আমি আব্বজনকে বাধ্য করেছি টলেডোয় একদল ফৌজ পাঠাতে। ইবনে ওয়াসিম তাকে টলেডো পরিস্থিতি জ্ঞাত করলেন। ওই রাতেই টলেডো অবরোধ করা হলো। দরজার ওপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালানো হয়। কিন্তু বিদ্রোহীরা এতে এতটুকু প্রভাবিত হয়নি।
অবরোধ দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হলো। কোনো ফল না পেয়ে উমাইয়া অবরোধ তুলে নিতে বললেন। বিদ্রোহীরা তো অবাক। কর্ডোভা বাহিনীর অবরোধ উঠিয়ে নেয়ার কথা নয়। বিদ্রোহীদের কমান্ডার বললো, একজন মুসলিম সেনাও যেন জিন্দা ফিরে যেতে না পারে। তোমরা পশ্চাদ্ধাবন করো, ফরান দরজা খুলে দাও। শহর থেকে হাজার হাজার বিদ্রোহী বেরিয়ে এল। বাধ ভাঙ্গা প্লাবন সে কোন ছার।
ওই সময় কর্ডোভা বাহিনী কালতারাডা পাহাড়ের পাদদেশে উপনীত হয়েছিল। খ্রীস্টবাহিনীর পশ্চাদ্বাবন দেখে উমাইয়া সকলকে আত্মগোপন করতে বললেন। এ দেখে খ্রীস্টানদের হিম্মত বহুগুণে বেড়ে গেল। দ্রুতগতিতে তাদের ঘোড়া পাহাড়ী এলাকায় প্রবেশ করল। সমগ্র বাহিনী পাহাড়ী এলাকায় প্রবেশ করলে মুষলধারে তীর বৃষ্টি শুরু হলো। এ কৌশল উমাইয়ার। উমাইয়া প্ল্যান করেছিলেন, অবরোধ উঠিয়ে নিলে বিদ্রোহীরা একে আমাদের দুর্বল ভাববে। সে সুযোগে তারা আমাদের পশ্চাদ্ধাবন করবে। আমরা পাহাড়ী এলাকায় প্রবেশের আগে ওদের ওপর আক্রমণ চালাবে। না। ওরা সত্যিই বুদ্ধিমান হলে ফটক ছেড়ে বের হবে না। বের হলে কেল্লা ফতেহ।
মৌলবাদী খ্রীস্টানরা বিজয় শেষে বোকামি করল এবং উমাইয়ার পাতা ফাঁদে ফেঁসে গেল। শাঁ শাঁ করে তীর আসতে লাগল। অনিঃশেষ সে ভীর, অব্যর্থ সে টার্গেট। খ্রীস্টানরা টলেডোমুখী হতে গিয়ে দেখল, পেছনে সীসাঢালা প্রাচীরের ন্যায় দাঁড়িয়ে উমাইয়ার পশ্চাৎ বাহিনী।
কালতারাদা পাহাড় খ্রীস্ট মৌলবাদীদের রক্তে ভেসে গেল। আটকে গেল ঘোড়ার পা। একেই বলে গণহত্যা। প্রাণ নিয়ে পালাতে পারে নি একজনও। জনৈক নও মুসলিম কমান্ডার উমাইয়ার সাথে এসেছিলেন। তিনি দক্ষ কমান্ডার হওয়া সত্ত্বেও খ্রীস্টালাশের পাহাড় ও রক্তকন্যা দেখে বেঁহুশ হয়ে পড়লেন। সেই বেহুঁশী দেখে আর হুশ ফিরে পাননি।
এদিকে মোহাম্মদ ইবনে ওয়াসিম তার সাধের টলোডোয় প্রবেশ করেন বিজয়ীর বেশে যেখানে তখন বাধা দেয়ার কেউ নেই।