২.৪ বংশধারা রক্ষা

–মা!

সমস্ত বাড়িময় যে যেখানে পেরেছে শুয়ে পড়েছে। অনেকের একটা চাটাই কিংবা বালিশও জোটেনি। কোঁচার খুঁটটা গায়ে দিয়ে একটা ছাদের তলা খুঁজে নিয়ে গড়িয়ে পড়েছে। কাজ শেষ হতে রাত প্রায় একটা বেজে গিয়েছিল। মাছের কাঁটা আর মাংসের এঁটো হাড়ের লোভে কিছু বেওয়ারিশ কুকুর পুকুরপাড়ে এসে অনেকক্ষণ কাড়াকাড়ি করে তখন পেট শান্ত করে ঘুমিয়ে পড়েছিল। বলতে গেলে কেউ আর তখন জেগে ছিল না। চৌধুরী মশাইও ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। বড় খাটুনি গিয়েছিল তাঁর। যখন সদানন্দ ফুলশয্যার ঘরে শুতে গেল তখনই শুধু একটা নিশ্চিন্তের দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়েছিলেন তিনি। যাক, বাঁচা গেল। চৌধুরী-পরিবারের বংশধারা রক্ষা পেল। আর কোনও দিন কোনও কালীগঞ্জের বউ এসে তাঁর কোনও ক্ষতিসাধন করতে পারবে না। এই বংশ শাখাপ্রশাখা মেলে যাবচ্চন্দ্রদিবাকরৌ বিস্তারলাভ করবে। ওই সদারও আবার একদিন সন্তান হবে। সেই সন্তানের আবার একদিন গায়ে-হলুদ হবে, একদিন বিয়ে হবে, একদিন ফুলশয্যাও হবে।

আর তারপর? তারপরের কথা ভাবতে গিয়েই চৌধুরী মশাই-এর দু’চোখ কখন ঘুমে জড়িয়ে এসেছিল।

–মা!

চৌধুরী মশাই চমকে উঠলেন। কে যেন কাকে ডাকছে! মেয়েলি গলা! তাড়াতাড়ি বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লেন তিনি। পাশেই বিছানার ওপর গৃহিণী ঘুমোচ্ছিল। বড় অঘোর ঘুম তার। আহা, ঘুমোক। অনেক দিন ধরে অনেক পরিশ্রম করে আজ সবে একটু বিশ্রাম করবার সুযোগ পেয়েছে। কিন্তু কে-ই বা ডাকছে তাকে! এত রাত্রে তাকে কেনই বা ডাকছে!

তিনি গৃহিণীর গায়ে ঠেলা দিলেন। বললেন–ওগো, ওগো, শুনছো–

ধড়মড় করে উঠে পড়লো প্রীতি। বললে–কী হলো?

চৌধুরী মশাই বললেন–দেখ দিকিনি, কে যেন ডাকছে তোমাকে–

–আমাকে? ডাকছে? কে ডাকছে।

–কী জানি! একজন মেয়েমানুষের গলা মনে হলো—

মেয়েমানুষের গলা! এত রাত্তিরে কে মেয়েমানুষ তাকে ডাকবে! এই তো সবাইকে খাইয়ে-দাইয়ে ভাঁড়ারের চাবি আঁচলে বেঁধে তিনি ঘরে এসে শুয়ে পড়েছেন।

জিজ্ঞেস করলেন–রাত কটা হলো গো?

চৌধুরী মশাই ঘড়িটার দিকে চেয়ে বললেন–রাত তিনটে—

রাত তিনটে মানে ভোর হয়ে এল। এত রাত পর্যন্ত ঘুম হয়েছে। তবে তো অনেকক্ষণ ঘুম হয়েছে। কিছুই টের পায়নি সে।

আবার বাইরে থেকে ডাক এল—মা–

প্রীতি তাড়াতাড়ি কাপড়টা গুছিয়ে নিতে নিতে ঘরের খিল খুলে বাইরে এলো। চারদিকে অন্ধকার। সামনের বারান্দায় যে-যেখানে যেমন ভাবে পেরেছে গড়া-গড়া শুয়ে পড়েছে। তাদের মধ্যে যেন মনে হলো কে একজন অন্ধকারে তার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

প্রীতি তাড়াতাড়ি সামনের দিকে এগিয়ে গেল। জিজ্ঞেস করলে কে? কে ওখানে দাঁড়িয়ে?

মূর্তিটা বললে—আমি–

–আমি? আমি কে?

প্রীতি একেবারে মূর্তিটার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো, মূর্তিটার মুখের কাছে মুখ নিয়ে যেতেই চমকে উঠেছে। বউমা? তুমি? তুমি হঠাৎ এত রাত্তিরে ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছ কেন? কী হয়েছে তোমার?

নয়নতারা তখন থরথর করে কাঁপছিল। বললে–আমার ভয় পাচ্ছে–

–কেন? ভয় পাচ্ছে কেন? খোকা কোথায়?

নয়নতারা এ-কথার কোনও জবাব দিলে না।

শাশুড়ী বললে–কী হলো, জবাব দিচ্ছ না কেন? খোকা কোথায় গেল? খোকা ঘরে নেই?

এবারও নয়নতারা কোন কথার উত্তর দিলে না।

কেমন যেন একটা সন্দেহ হলো শাশুড়ীর মনে। বললে–চলো, চলো, তোমার ঘরে চলো, কিছু ভয় নেই। চলো–

নয়নতারাকে হাতে ধরে নিয়ে প্রীতি তার শোবার ঘরের দিকে গেল। নয়নতারার শোবার ঘরের দরজা তখন হাট করে খোলা পড়ে ছিল। ভেতরে একরাশ ফুলের গন্ধ। দেয়ালের গায়ে টিমটিম করে তখনও দেয়ালগিরিটা জ্বলছে। বিছানা যেমন ছিল তেমনিই রয়েছে। চাদরে বালিশে এতটুকু ভাঁজও পড়েনি কোথাও। বিছানায় যে কেউ শুয়েছিল তার সামান্যতম চিহ্নও কোথাও নেই। বিছানাটা যেন ব্যবহারও করা হয়নি এক মূহূর্তের জন্যে।

চারিদিকে চেয়ে প্রীতি খানিকক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে রইল। যেন সমস্ত অবস্থাটা বোঝবার চেষ্টা করলে। তারপর নয়নতারার দিকে মুখ ফিরিয়ে বললে–খোকা কোথায় গেল?

নয়নতারা কথা বলতে গিয়েও কথা বলতে পারলে না। শাশুড়ীর চোখের দৃষ্টি এড়াবার জন্যে মুখটা নিচু করে নিলে।

–বলো, খোকা কোথায় গেল? বলো?

নয়নতারা চুপ। তার চোখ দিয়ে তখন টপ টপ করে জল গড়িয়ে পড়ছে।

–খোকা ঘরে শোয়নি?

এবার প্রীতি আর পারলে না। নয়নতারার চিবুকটা ধরে উঁচু করে নিজের মুখোমুখি ধরলে। নয়নতারা শাশুড়ীর সে দৃষ্টি সহ্য করত না পেরে চোখ দুটো বুঁজিয়ে ফেলল। বোঁজা চোখ দুটো দিয়ে তখন জলের ধারা আর বাধা মানছে না। দরদর করে গালে বেয়ে শাশুড়ীর হাতের পাতার ওপর পড়তে লাগলো।

–বলো বউমা, আমি তোমার শাশুড়ী হই, আমার কাছে লজ্জা করো না, খোকা তোমার বিছানায় শোয়নি?

নয়নতারার মুখে তখন যেন জবাব দেবার মত কোনও ক্ষমতাই আর নেই।

–বলো, জবাব দাও, খোকা শোয়নি?

এতক্ষণে নয়নতারার ঠোঁট দিয়ে একটা ছোট কথা বেরোল—না–

–শোয়নি? তা হলে কোথায় গেল সে?

নয়নতারা বললে–তা জানি না।

–কিন্তু তাকে তো আমরা তোমার ঘরে ঢুকিয়ে দিলুম। সে দরজায় খিল দিলে, তাও জানি। তারপর কী হলো? তারপর কখন সে বেরিয়ে গেল?

নয়নতারা এবার ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো।

প্রীতি বললে–বলল বউমা, আমার কথার জবাব দাও, তারপর কখন সে বেরিয়ে গেল? তোমার সঙ্গে কী কথা হলো? তুমি কি কিছু বলেছিলে তাকে? কী বলেছিলে?

নয়নতারা কাঁদতে কাঁদতেই বললে–কিছু বলিনি–

–কিছু বলোনি?

–না।

–সে তোমাকে কিছু বলেছিল?

–না।

প্রীতি একটু ভেবে নিলে। তারপর বললে–তোমাদের দু’জনের মধ্যে কোন কিছুই কথা হয়নি?

নয়নতারা বললে–না–

–তোমার গায়ে হাত দিয়েছিল সে?

নয়নতারা হঠাৎ এ-কথার জবাব দিতে পারলে না।

প্রীতি বললে–বলো বউমা, আমি তোমাকে বলছি, আমি তোমার শাশুড়ী হই, আমি তোমার মায়ের মত। এখানে তোমার মা থাকলে যেমন তাকে সব কথা বলতে, তেমনি আমাকেও তুমি বলো। মনে করে নাও এবাড়িতে আমিই তোমার মা আমাকে কোন কিছু বলতে তুমি লজ্জা করো না। বলল, তোমার গায়ে হাত দিয়েছিল সে?

নয়নতারা এবার শাশুড়ীর বুকের মধ্যে ভেঙে পড়লো। শাশুড়ী বউকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরে পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। বললে–কেঁদো না বউমা, চুপ করো, কেঁদো না। আমাকে সব খুলে বলো তুমি। তোমার কিছু ভয় নেই। আমি তো রয়েছি, তোমার কী ভয়? মার কাছে কি কেউ কিছু বলতে লজ্জা করে? বলো তো লক্ষ্মী মেয়ে, সদা বুঝি তোমার গায়ে হাত দিয়েছিল, আর তুমি বুঝি আপত্তি করেছিলে?

নয়নতারা শাশুড়ীর বুকের মধ্যেই মাথা নেড়ে বললে–না–

–তবে? তবে কেন খোকা চলে গেল?

এর উত্তর কী দেবে নয়নতারা? নয়নতারা কি নিজেই এর উত্তর জানতো! সে কি কল্পনা করতে পেরেছিল এমন করে তার ফুলশয্যা রাত্রের সমস্ত স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে? কত দিন কত মেয়ের কাছে তাদের ফুলশয্যা রাত্রের মুখরোচক গল্প শুনেছে সে। তারাও তার সঙ্গে এক স্কুলে এক ক্লাসে পড়েছে। তাদের বিয়ে হবার পরে তারাই গল্প করেছে সে-সব ঘটনার। বিয়ের আগে নয়নতারাও নিজের ফুলশয্যার রাত্রের অনেক স্বপ্ন তিলে তিলে মনের ভেতরে পুষে রেখেছিল। ভেবেছিল তার ফুলশয্যার রাত্রের ঘটনা তাদের বলবে। অন্তত বলবার মত একটা কিছু ঘটনা ঘটবে। কিন্তু এ কী হলো? কারো বাড়িতে কি বউভাতের রাত্রে পুলিস আসে! এমন ঘটনা তো তার কোনও বন্ধুর বিয়েতে ঘটেনি। পুলিসই বা কেন হঠাৎ আসতে গেল, আর খুনই বা হলো কে? সব কিছু মিশিয়ে যেন এক রহস্যজনক বিপর্যয় ঘটে গেল তার জীবনে। কান্না কি মানুষের চোখে সহজে আসে! আজ যদি মা এখানে থাকতো তো নয়নতারা তাকে জিজ্ঞেস করতো–মা, তুমি এমন জায়গায় আমার বিয়ে দিলে কেন? একটু খোঁজখবরও নিতে পারলে না ভালো করে?

প্রীতি কী করবে তখন বুঝতে পারছিল না। বললে–কেঁদো না বউমা, আমার সঙ্গে কথা বলো, আমি যে কথা বলছি তার জবাব দাও–

বলে নয়নতারাকে বুক থেকে সরিয়ে নিজের মুখোমুখি দাঁড় করালো। নিজের শাড়ির আঁচল দিয়ে বউমার চোখ মুখ মুছিয়ে দিয়ে বললে–এবার বলো তো বউমা, সত্যিই কী হয়েছিল? সব সত্যি করে বলবে, কিছু লুকোবে না–বলো–

নয়নতারা বললে–কিছু হয়নি মা—

শাশুড়ী বললে–কিছু হয়নি তো শুধু শুধু খোকা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল? ফুলশয্যার রাত্তিরে বর কখনও মিছিমিছি বউকে ছেড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়? এমন কথা কখনও কেউ শুনেছে? নিশ্চয় কিছু হয়েছে? তুমি আমার কাছে লুকোচ্ছ। বলল সত্যিই কী হয়েছিল?

নয়নতারা বললে–সত্যি বলছি মা, কিছু হয়নি–

–কিছু না হলে খোকা এমনিই বেরিয়ে গেল? আমার ছেলে তো পাগল নয়। পাগল হলে না-হয় বুঝতাম, তবু তার একটা মানে ছিল। শুধু শুধু সে বেরিয়ে গেল কেন? তুমি নিশ্চয়ই তাকে কিছু বলেছিলে!

–বিশ্বাস করুন মা, আমি কিছু বলিনি!

–তুমি বললেই আমি বিশ্বাস করবো? যখন তুমি দেখলে যে সে ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে যাচ্ছে তখন তুমি তাকে জিজ্ঞেস করলে না কেন যে সে বেরিয়ে যাচ্ছে কেন, কোথায় যাচ্ছে?

নয়নতারা অপরাধীর মত বললে–আমি জিজ্ঞেস করিনি—

কেন জিজ্ঞেস করোনি?

–আমার ভয় করেছিল!

–ভয়? কীসের ভয়?

কীসের যে ভয় তা নয়নতারা নিজেই জানে না তো শাশুড়ীকে বোঝাবে কেমন করে? বললে–আমি জানি না কীসের ভয়!

প্রীতি এবার যেন একটু অসন্তুষ্ট হলো। বলে উঠলো–তা তুমি যখন দেখলে সে ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে তখন তাকে ধরে রাখলে না কেন? তাহলে কীসের জন্যে ভগবান এত রূপ দিয়েছিল তোমাকে? তাহলে অন্য এত মেয়ে থাকতে কেন তোমাকেই বা এ বাড়ির বউ করে নিয়ে এলুম? আর এইটুকুই যদি তুমি না করতে পারবে তো এত রূপ নিয়ে কি আমি ধুয়ে খাবো? আমি রূপসী বউ চেয়েছিলুম কি আমার নিজের জন্যে?

কিন্তু কথাগুলো বলেই প্রীতি বুঝলো ঠিক এই সময়ে এ কথাগুলো বলা যেন তার উচিত হচ্ছে না।

নয়নতারা তখনও শাশুড়ীর বুকের মধ্যে মুখ লুকিয়ে কাঁদছিল। প্রীতি বললে–আর কেঁদো না বউমা, আমি বুঝতে পেরেছি তোমার কিছু দোষ নেই। আর সত্যিই তো, তুমিই বা কী করবে! তুমি তো নতুন এ বাড়িতে! এক কাজ করি, এখনও কিছুক্ষণ রাত আছে, আমি এসে তোমার কাছে শুচ্ছি। সারারাত জাগলে তোমার শরীর খারাপ হবে–তুমি একটু থাকো এখানে, আমি আসছি–

বলে নয়নতারাকে বিছানার ওপর বসিয়ে আবার নিজের ঘরে চলে এলো।

চৌধুরী মশাই তখন নিজের ঘরের ভেতর ছটফট করে পায়চারি করছিলেন। ঠিক বুঝতে পারছিলেন না, কোথায় কী গোলমাল বেধেছে। এখন যদি সমস্ত বাড়িময় জিনিসটা জানাজানি হয়ে যায়, তাহলে সর্বনাশ হয়ে যাবে একেবারে। সমস্ত নবাবগঞ্জময় লোক জেনে যাবে যে, তাঁর ছেলে ফুলশয্যার রাত্রে বাড়ি থেকে পালিয়েছে! কথাটা হয়ত শেষ পর্যন্ত কেষ্টনগরে বেয়াইবাড়িতেও গিয়ে পৌঁছোবে! তখন?

হঠাৎ গৃহিণী এসে ঘরে ঢুকল।

চৌধুরী মশাই সঙ্গে সঙ্গে গৃহিণীর দিকে এগিয়ে গেলেন কী হলো? বউমা কী বললে?

–যা ভেবেছিলাম তাই-ই হয়েছে, খোকা ঘরে নেই।

–ঘরে নেই?

গৃহিনী বললে–হ্যাঁ, বউমার একলা থাকতে ভয় করছিল, তাই আমাকে ডাকতে এসেছিল। আমি যাই বউমার কাছে। তোমাকে তাই বলতে এলুম–

–কিন্তু খোকা গেল কোথায়?

গৃহিণী বললে–তা কী করে ও জানবে? বউমার সঙ্গে খোকার কোনও কথাও হয়নি, ঘরে ঢুকেছে আর সঙ্গে সঙ্গে পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছে–

–খোকা বেরিয়ে গেল আর বউমা আটকাতে পারলে না?

গৃহিণী বললে–কী যে তুমি বলো! নতুন বউ, এখনও খোকার সঙ্গে একটা কথাও হয়নি, আর খোকাকে আটকাবে? নতুন বউ-এর অত সাহস থাকে? অচেনা জায়গা, অচেনা মানুষ, একেবারে বলতে গেলে প্রথম রাত, এর আগে কোনও দিন একটা কথাও হয়নি, তাকে কী বলে বাধা দেবে? তোমার এত বয়েস হলো আর তুমি এই কথা বলছো? আমার ফুলশয্যার রাতে যদি তুমি অমনি করতে তো আমি তোমাকে বাধা দিতে পারতুম? তা কি কোনও মেয়ে পারে? কী যে তোমার বুদ্ধি

চৌধুরী মশাই বললেন–তাহলে কী হবে?

গৃহিণী বললে–এখন কী হবে তাই-ই ভাবছি। বউমা একেবারে ভেঙে পড়েছে। বেচারী এই রাত তিনটে পর্যন্ত একলা কী করবে ভেবে পায়নি, শুধু ভয়ে কেঁপেছে, শেষকালে আর কোনও উপায় না পেয়ে লজ্জা সরম সব ঠেলে ফেলে আমাকে ডাকতে এসেছে

–তা তুমি কী বলে এলে বউমাকে?

–কী আর বলবো! আর আমারই কি ছাই মাথার ঠিক আছে এখন! প্রথমে খুব বকলুম, কিন্তু শেষে বুঝলুম বউমারই বা কী দোষ! খুব কাঁদছিল, আমি তার মাথায়-পিঠে হাত বুলিয়ে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে বসিয়ে রেখে দিয়ে এলুম। এখন যাই, যে রাতটুকু আছে, পাশে গিয়ে শুই, চেষ্টা করে দেখি যদি একটু ঘুম পাড়াতে পারি, তারপর সকাল হলে যা-হয় ঠিক করা যাবে–

চৌধুরী মশাই বললেন–ঠিক আর কী করবে তুমি! খোকা কি আর ফিরে আসবে?

–সে-সব এখন আর ভাবতে পারছি না আমি। আমারও মাথায় সব গোলমাল হয়ে গেছে। আমিও আর দাঁড়াতে পারছি না–

বলে গৃহিণী চলে যাচ্ছিল।

চৌধুরী মশাই পেছন থেকে ডাকলেন। বললেন–আর একটা কথা শোন—

গৃহিনী ফিরলো। বললে–কী?

–দেখ, বউমাকে বলে দিও যেন এ-সব কথা কাউকে না বলে। বাইরের লোক এ-কথা শুনলে নানান কেলেঙ্কারি রটবে। কেষ্টনগরের বেয়াই-বেয়ানের কানেও যেন কথাটা না ওঠে।

গৃহিণী বললে–বউমাকে না হয় বারণ করবো, কিন্তু তোমার ছেলে? তোমার ছেলেই যদি দশজনকে বলে বেড়ায়। আর যদি না–ও বলে তো এ-সব কথা তুমি কদ্দিন চেপে রাখতে পারবে?

চৌধুরী মশাই বললেন–সে পরের কথা পরে ভেবে দেখা যাবে। এখন আজকের কাণ্ডটা যেন দুকান না হয়। তোমার বাবা রয়েছে এখানে, আত্মীয়-কুটুম্ব সবাই এসেছে, এই অবস্থায় বাইরে জানাজানি হওয়া ভালো নয়, তারপর বাবার কানেও যেন না যায় কথাটা, তুমি একটু বউমাকে ভালো করে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে বলে দিও–

গৃহিণী বুঝলো কি বুঝলো না তা বোঝা গেল না। তাড়াতাড়ি ঘরের বাইরে চলে গেল। চৌধুরী মশাই তখন ঘরের মধ্যে ছটফট করতে করতে পায়চারি করতে লাগলেন।

নয়নতারা তখনও পাথরের মত ঠাণ্ডা শরীরে বিছানার ওপর কাঠ হয়ে বসে ছিল। শাশুড়ী ঘরে ঢুকেই বললে–ওমা, তুমি এখনও শোওনি? এসো, এসো, শুয়ে পড়ো–বলে নয়নতারাকে পাশে নিয়ে শুইয়ে দিলে। তারপর পায়ের দিকে পাট করে রাখা চাদরটা তার গায়ে ঢাকা দিয়ে নিজেও তার পাশে শুয়ে পড়লো।

বললে–কিছু ভয় নেই বউমা, খোকাকে তুমি ভুল বুঝো না, ও ওইরকম। একটু খেয়ালী ছেলে। আজকে ওইরকম ব্যবহার করলে বটে, কিন্তু দু’এক দিন পরে সব ঠিক হয়ে যাবে–তখন দেখবে ওরকম স্বামী হয় না। আমি ওর মা, তবু আমার সঙ্গে ওই রকম করে। তুমি কিছু ভেবো না বউমা, লক্ষ্মীটি।

বলে প্রীতি নয়নতারার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো।

তারপর আস্তে আস্তে বললে–একটা কথা বউমা, তুমি এসব কথা কাউকে বোল না যেন, আমি সব ঠিক করে দেব। এখনও তো তোমাদের ভালো করে জানাশোনা হয়নি, তাই একটু লজ্জা হয়েছে আমার খোকার। বড় লাজুক ছেলে কিনা আমার সদা-দু’দিন ঘর করলেই বুঝতে পারবে সব। তুমি যেন তোমার বাবা-মাকে এসব কথা কিছু বোল না, বুঝলে–

নয়নতারা বুঝলে না তা ঠিক বোঝা গেল না। বালিশে মুখ গুঁজে পড়ে রইল। শাশুড়ী তখনও নয়নতারার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। রাত তখন শেষ হয়ে আসছে। সমস্ত বিয়েবাড়ি নিস্তব্ধ। বিকেল থেকে রাত বারোটা পর্যন্ত যে কোলাহল চলছিল-তার চিহ্নমাত্র নেই আর কোথাও। সবাই ক্লান্তিতে আচ্ছন্ন। দূরে কোন্ পাড়ায় কাদের মুর্গী ডেকে উঠলো। এইবার ভোর হবে। এইবার একে একে আবার সবাই ঘুম ভেঙে উঠবে। আবার ডাক পড়বে প্রীতির। তার আঁচলে বড়-ভাঁড়ারের চাবি। এতগুলো লোক জলখাবার খাবে, কারো দুধ, কারো লুচি, কারো চা, কারো বা চিড়ে-মুড়ি। সকলের সব ফরমাস তামিল করতে হবে একা তাকেই। যেন কেউ না বলতে পারে চৌধুরী মশাই-এর ছেলের বিয়েতে নেমন্তন্ন খেতে এসে পেটই ভরেনি আমাদের।

না, আর দেরি করা নয়। এরপর যদি একটু তন্দ্রা এসে যায় তখন বেলা গড়িয়ে যাবে। তখন জানাজানি হয়ে যাবে যে চৌধুরী মশাই-এর ছেলের ফুলশয্যা হয়নি। ছেলের বদলে শাশুড়ী এসে নতুন বউএর পাশে শুয়ে রাত কাটিয়েছে। আস্তে আস্তে প্রীতি উঠলো। একবার নিচু হয়ে দেখবার চেষ্টা করলে বউমা ঘুমিয়ে পড়েছে কি না। কিন্তু কিছু বোঝা গেল না। বউমা তখনও ঠিক সেই ভাবে বালিশে মুখ গুঁজে স্থির হয়ে শুয়ে আছে।

প্রীতি আর শব্দ না করে টিপি টিপি পায়ে ঘরের বাইরে বেরিয়ে এল। তারপর আস্তে আস্তে দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে আবার নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ালো। বারান্দার ওপর তখনও মানুষ-জন গড়া গড়া শুয়ে আছে। তখনও যেন তাদের কাছে গভীর রাত।

কিন্তু সকলের আগে উঠেছে প্রকাশ মামা। প্রকাশ মামার ঘুম থেকে উঠেই চা খাওয়ার রোগ আছে। ঘুম থেকে উঠে সেইটেই তার প্রধান কাজ। বৃষ্টি হোক, ঝড় হোক, বন্যা, অগ্নিকাণ্ড, ভূমিকম্প, যা কিছু হোক, ওটি তার প্রথমেই চাই।

আগের রাতে শেষ নিমন্ত্রিত ব্যক্তিটি চলে না-যাওয়া পর্যন্ত প্রকাশ মামার শান্তি ছিল। সকলকে নিজে দাঁড়িয়ে খাইয়েছে প্রকাশ মামা। জোর-জবরদস্তি করে পেট ভরে সকলকে খাইয়েছে। যে দশখানা লুচির বেশি খেতে পারবে না, তাকে জোর-দবরদস্তি করে তিরিশ-চল্লিশখানা লুচি খাইয়েছে। মনে মনে সবাই বাহবা দিয়েছে শালাবাবুকে। হ্যাঁ, কেউ বলতে পারবে না যে সদানন্দর বিয়েতে ভালো করে খাতির-যত্ন হয়নি, পেট ভরে খেতে পায়নি। গাঁ-গঞ্জে এই-ই নিয়ম। বিয়ে বাড়ির এমন খাওয়া বছরে ক্বচিৎ কদাচিৎ কপালে জোটে। চাষাভুষোদের বিয়েবাড়িতে সাধারণত চিড়ের ফলারের বন্দোবস্ত।

প্রকাশ মামা কোথায় ছিল কেউ জানে না। চোখ মেলেই চেঁচিয়ে উঠলো–কই রে, চা হয়েছে?

কিন্তু কথাটা বলেই বুঝলো আজকে শালাবাবুর হুকুম তামিল করবার কেউ নেই আশেপাশে। আজকে সবাই ঘুমোচ্ছে। কালকের খাটুনির পর সকলেরই গায়ে-গতরে ব্যথা হয়ে বিছানায় গড়াচ্ছে। কিন্তু তা বললে তো নেশা শুনবে না। নেশার রসদ যোগাতেই হবে।

আস্তে আস্তে আড়ামোড়া খেয়ে প্রকাশ মামা উঠলো। উঠে একবার রান্নাবাড়ির দিকে গেল। কিন্তু সেদিকে সব ভোঁ-ভোঁ। কারোর টিকির পাত্তা নেই। একেবার পুকুরপাড়ের দিকে গেল। সেখানেই কালকে ভিয়েন চড়েছিল। মোটা-মোটা কাঠগুলো পুড়ে কাঠকয়লা হয়ে রয়েছে। কিন্তু ঠাকুর-চাকরদের কারো দেখা নেই। ঘুমোতে যেতে সেই রাত একটা বেজে গিয়েছিল কাল।

হঠাৎ একটা চেনা লোকের মুখ দেখেই খুশীতে লাফিতে উঠলো। লোকটা মাঠের দিক থেকে আসছিল।

প্রকাশ মামা তাকেই ধরলো–এই যে হে, উঠেছ? কী নাম যেন তোমার?

–আজ্ঞে বিন্দাবন?

–বৃন্দাবন! বেশ বেশ! বেশ নাম তোমার! চা খেয়েছো তুমি?

–আজ্ঞে চা আমি খাইনে।

প্রকাশ মামা যেন একটু হতাশ হলো কথাটা শুনে। বললে–চা খাও না? তা না-ই বা খেলে, চা তৈরি করতে পারো তো?

–আজ্ঞে, তা পারি।

–ভেরি গুড। চা এক বাটি তৈরি করো দিকিনি।

লোকটা জানতো শালাবাবুর হাতেই সব ক্ষমতা। মজুরি নেবার সময় এই শালাবাবুকেই ধরতে হবে। তখন চায়ের কথাটা মনে থাকবে। প্রকাশ মামা বললে–বেশ কড়া করে বানাবে, বুঝলে? দুধ-ফুদ যদি না পাও তো ক্ষতি নেই, রংটা যেন লঙ্কার মত লাল হয়। এই চায়ের জন্যে মাঠে যেতে পারছি না, সব আটকে গেছে, পেট-টেট সব বোম্ মেরে আছে–

লোকটা অদ্ভুত করিতকর্মা বটে! কোথা থেকে কাকে ধরে চা, দুধ, চিনি যোগাড় করে নিয়ে এল। তারপর কাঠকয়লার আগুন ধরিয়ে তার ওপর জল চড়িয়ে দিলে।

প্রকাশ মামা বললে–দুবাটির মত জল দাও, আমি খাবো, আর আমার পিসেমশাই খাবে। পিসেমশাইকে চেনো তো? ওই যে বরের দাদামশাই, ওঁকেও এক বাটি দেব। কুটুম মানুষ, লজ্জায় চায়ের কথা মুখ ফুটে বলতে পারবেন না। তবে আমার ও-সব লজ্জা-ফজ্জা নেই ভাই, আমি দিল-খোলা মানুষ। খাওয়ার ব্যাপারে লজ্জা-সরম করি নে; পেট হচ্ছে সকলের চেয়ে বড়, জানো বৃন্দাবন। পেটের জন্যেই দুনিয়া চলছে। আরো বড় একটা জিনিস আছে অবিশ্যি, কিন্তু পেট তার চেয়েও বড়। সেটা না হলেও চলে, কিন্তু পেট তো না হলে চলে না–

বৃন্দাবন জল গরম করছে আর প্রকাশ মামা উনুনের সামনে তাই দেখছে। হঠাৎ সদরের দিকে চেয়ে অবাক হয়ে গেল। আরে সদা না! এত ভোরে কোথায় গিয়েছিল!

আর বসা হলো না প্রকাশ মামার। উঠে দাঁড়ালো। সদানন্দ ভেতরের দিকেই ঢুকছিল। প্রকাশ মামাও তার দিকে যেতে লাগলো।

একেবারে কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলে কী রে, তুই? আজ এত সকালে উঠে পড়েছিস যে?

সদানন্দর মুখের ভাব দেখে প্রকাশ মামার কেমন সন্দেহ হলো।

বললে–তোর চেহারা ওরকম হলো কেন রে? কী হয়েছে বল তো?

সদানন্দ বললেন, কিছু হয়নি–

প্রকাশ মামা বললে–কিছু না হলেই ভালো। কাল তুই যা ভাবিয়ে তুলেছিলি সকলকে! আমি তো ভেবেছিলাম তুই একটা কিছু কাণ্ড করে বসবি। নতুন বউ বাড়িতে এসেছে। এই সময়ে কিছু করলে কেলেঙ্কারি হয়ে যেত মাইরি। তা যাক শেষ পর্যন্ত তোকে শোবার ঘরে ঢুকিয়ে তবে আমি খেইছি, জানিস! তোর দাদুও তোর জন্যে খুব ভাবনায় পড়েছিল। আমি যখন গিয়ে বললুম যে সদা ঘরে ঢুকে দরজায় খিল দিয়ে দিয়েছে, তখন বুড়ো নিশ্চিন্ত হলো–

তারপর একটু থেমে বললে–তা যাক সে-সব বাজে কথা, রাতটা কেমন কাটালি বল্–কে প্রথম কথা বললে? তুই, না তোর বউ?–

সদানন্দ কোনও জবাব দিলে না।

প্রকাশ মামা তবু পীড়াপীড়ি করতে লাগলো–কী রে? কথার জবাব দিচ্ছিস নে যে? বল না, বল্! আমাকে বলতে তোর লজ্জা কীসের? মাইরি বলছি আমি কাউকে বলবো না। আমাকে বলতে তোর দোষ কীসের? আমি না তোর বিয়ে দিয়ে নিয়ে এলাম, আজ আমার সঙ্গেই তুই বেইমানি করছিস!

সদানন্দ বললে–বলছি তো কিছু বলবার নেই–

–বলবার নেই মানে? তুই কি সারারাত নাক ডাকিয়ে ঘুমিয়ে কাটিয়েছি নাকি? অ্যাঁ? ছিঃ ছিঃ, তুই দেখছি একটা আস্ত হাঁদারাম! মেয়েটা কী ভাবলে বল্ দিকিনি? বেচারা কতদিন ধরে এই রাতটার দিকে চেয়ে বসে ছিল, আর তুই কিনা সারারাত নাক ডাকিয়ে ঘুমোলি?

সদানন্দ বললে–এখন ও-সব কথা ভাল লাগছে না প্রকাশ মামা, পরে সব বলবো–

বলে অন্যদিকে চলে যাচ্ছিল, কিন্তু প্রকাশ মামা ছাড়লে না। বললে–ওরে শয়তান, আজ আমি পর হয়ে গেলুম, না? অথচ আমিই এত কাঠ-খড় পুড়িয়ে তোর বিয়ে দিয়ে নিয়ে এলুম, আর আজ আমি কেউ নয়! বেইমান তুই, জাত বেইমান–

কিন্তু কথার মধ্যেখানে বাধা পড়লো। ওদিক থেকে চৌধুরী মশাই যাচ্ছিলেন। হঠাৎ সদানন্দকে দেখে এগিয়ে এলেন।

বললেন–খোকা, তুমি একবার ভেতরে আমার সঙ্গে দেখা করো তো—

বলে আর দাঁড়ালেন না। সোজা যেদিকে যাচ্ছিলেন সেই দিকেই চলতে লাগলেন।

সদানন্দও তাঁর পেছনে-পেছনে সেই দিকে চলতে লাগলো।

.

মনে আছে সেদিন সদানন্দ বাবার সামনে দাঁড়িয়ে প্রথমে একটু আড়ষ্ট হয়ে গিয়েছিল। চৌধুরী মশাই সোজা গিয়ে উঠলেন তাঁর চন্ডীমন্ডপে। আসলে কর্তাবাবু যেদিন পঙ্গু হয়ে পড়েছিলেন সেইদিন থেকেই তিনি নিজের আসন করে নিয়েছিলেন ওইখানে। ওইখানে বসেই তিনি ক্ষেতের কাজকর্ম পরিচালনা করতেন। সেই যে সকালবেলা গিয়ে সেখানে বসতেন, তখন থেকে বেলা একটা দুটো পর্যন্ত তাঁর ওই চণ্ডীমণ্ডপে কাটতো। এক-এক করে সবাই আসতো নানান কাজে। তিনি চাইতেন তাঁর সঙ্গে খোকাও ওখানে বসুক, তাঁর কাজ কর্ম আস্তে আস্তে দেখেশুনে নিক। তিনি থাকতে থাকতে ছেলে তাঁর কাছে সব কিছু কাজ-কর্ম শিখে নিক।

কিন্তু ছেলের মতিগতি তাঁর ভালো লাগতো না কোনও দিনই। বাপের কথা ছেলে অমান্য করত না বটে, কিন্তু তেমন মান্যও ঠিক করতো না যেন। যেন কাজকর্ম না করতে হলেই সে বেঁচে যেত।

কীর্তিপদবাবু জামাইকে বলতেন–এখন থেকে তোমার ছেলেকে সব কিছু বুঝিয়ে টুঝিয়ে দিচ্ছ তো বাবাজী?

জামাই বলতো–আমি তো বুঝিয়েই দিতে চাই, কিন্তু তার তো এসব দিকে একেবারেই মন নেই–

শ্বশুর বলতেন–এ-বয়সে মন তো থাকবেই না, আমারও ছিল না। আমার বাবা আমাকে কত বুঝিয়েছেন, তখন ওসব ভালো লাগতো না, কিন্তু পরে তাই নিয়েই তো মেতে আছি। এখন ও ছাড়া আর কিছু বুঝিই না–

কিন্তু আজ মনে হলো এবার আর দেরি নয়। যে ছেলে বিয়ের দিনে এই কাণ্ড করতে পারে সে বড় সাধারণ ছেলে নয়। তাকে বুঝিয়ে দেওয়া দরকার যে জীবন ছেলেখেলার জিনিস নয়। শুধু লেখাপড়া আর আড্ডা দিয়ে বেড়ালে আর যাই চলুক সংসার চলে না। সংসার মানে দায়িত্ব কাঁধে নেওয়া।

চণ্ডীমণ্ডপের মধ্যে একটা তক্তপোশ পাতা ছিল। তার ওপরে মাদুর পাতা। মাদুরের ওপর সামনের দিকে একটা কাঠের ক্যাশবাক্স। চৌধুরী মশাই সেই ক্যাশবাক্সের পেছনে গিয়ে বসলেন। তারপর ছেলের দিকে চেয়ে বললেন–বোস–

সদানন্দ বসলো না। তেমনি আড়ষ্ট হয়েই দাঁড়িয়ে রইলো।

–কই, বসলে না যে! বোস! তোমার কানে কি কথা যাচ্ছে না?

সদানন্দ এবার তক্তাপোশের ওপরেই পা ঝুলিয়ে বসলো।

কাল রাত্রেই চৌধুরী মশাই কথাগুলো ভেবে রেখেছিলেন। সেই রাত তিনটের সময়। গৃহিণী যখন বউমার ঘরে চলে গিয়েছিল। অনেক ভেবে-চিন্তে ছেলের বিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। অবশ্য বিয়ে তিনিও একদিন করেছিলেন। জীবনে বিয়ে করার কী মর্ম তা তিনি জানেন। মর্মও যেমন জানেন তেমনি তার সঙ্গে দায়িত্বের কথাটাও তিনি কখনও হালকা করে দেখেননি। কর্তাবাবুর মত তিনিও একদিন বুড়ো হয়ে যাবেন। তখন হয়ত ঠিক তাঁরই মত পঙ্গু হয়ে শয্যাশায়ী হয়ে পড়ে থাকবেন। তখন এই খোকাই এসে এই চণ্ডীমণ্ডপে বসে দৈনন্দিন কাজ চালিয়ে যাবে। কিন্তু যে ফুলশয্যার রাতে এইরকম কাণ্ড করতে পারে তার ওপর কতটা নির্ভর করা যায়।

হঠাৎ তাঁর মুখ দিয়ে আসল প্রশ্নটা বেরোল। বললেন–কোথায় ছিলে সমস্ত রাত?

সদানন্দও জবাব দিতে দেরি করলে না। বললে–বাইরে—

চৌধুরী মশাই থমকে রইলেন। জিজ্ঞেস করলেন–বাইরে মানে?

সদানন্দ বললে–বাইরে-মানে বাইরে। আমি বাড়িতে ছিলুম না সারারাত–

আরো অবাক হয়ে গেলেন চৌধুরী মশাই। তাঁর মুখের সামনে এমন করে তো কখনও আগে কথা বলেনি খোকা! হঠাৎ এত সাহস পেলে সে কোথা থেকে?

বললেন–তুমি জানো যে বাড়ির বাইরে থাকা এবাড়ির নিয়ম নয়! আর শুধু এবাড়ি কেন, কোন বাড়িতেই নিয়ম নেই বাড়ির ছেলে রাত্রে বাইরে রাত কাটাবে। কাটালে নিন্দে হয়, দশজনে দশ কথা বলে–

সদানন্দ উঠে দাঁড়ালো। বললে–আপনি কি আমাকে এই কথা বলতেই এখানে ডেকে এনেছেন?

সদানন্দর হাব-ভাব দেখে চৌধুরী মশাই তাজ্জব হয়ে চেয়ে রইলেন ছেলের দিকে। খানিক পরে বললেন–কেন, তোমাকে এখানে ডেকে এনে এই কথা বলা কি আমার অন্যায় হয়েছে?

সদানন্দ বললে–ন্যায়-অন্যায়ের কথা আপনারা তুলবেন না। কাকে ন্যায় বলে আর কাকে অন্যায় বলে তা আমি ভালো করেই জানি। আমি কি এখন যেতে পারি?

চৌধুরী মশাই বললেন–তুমি উঠে দাঁড়ালে কেন, বোস না–

সদানন্দ বললে, আমি এখানে বসব না। যা শোনবার আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই শুনতে পারবো

চৌধুরী মশাই বললেন–তাহলে বলো তুমি কেন এরকম করলে? বউমা তোমার কাছে কী অপরাধ করেছে? আর আমি আর তোমার মা, আমরাই বা তোমার কাছে কী অপরাধ করলুম যে দশের কাছে তুমি আমাদের বে-ইজ্জত করতে চাও! আমাদের বংশমর্যাদা, কোনও কিছুর কথাই কি তুমি ভাববে না?

সদানন্দ কথা না বলে চুপ করে রইল।

–কথা বলছো না যে, একটা কিছু জবাব দাও—

তবু সদানন্দ কিছু কথা বললে না। তেমনি চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো।

এবার চৌধুরী মশাই উঠলেন। উঠে সদানন্দর কাছে এলেন। তারপর বললেন–চলো, ভেতর বাড়িতে তোমার মার কাছে চলো, তোমার সঙ্গে কথা আছে–

বলে সদানন্দকে হাতে ধরে চণ্ডীমণ্ডপের বাইরে নিয়ে এলেন। বাইরে তখন বেশ স্পষ্ট সকাল হয়েছে। বিয়েবাড়ির লোকজন তখন এক-এক করে জেগে উঠেছে। তাদের সকলের দৃষ্টির সামনে দিয়ে একবারে সোজা তাকে ভেতর বাড়িতে নিয়ে এলেন। সেখানে মেয়েদের আনাগোনা। তখন তারাও উঠেছে ঘুম থেকে। চারদিক অগোছালো। চৌধুরী মশাই-এর পেছন-পেছন সদানন্দ যাচ্ছিল। অনেকেই ছোটবাবুকে দেখে ঘোমটা টেনে সামনে থেকে সরে গেল।

রাত্রে ভাল করে ঘুম হয়নি, তাই প্রীতি ভোরবেলাতেই তৈরি হয়ে নিয়েছিল। রাত তিনটের সময় সবেমাত্র একটু দু’চোখ জুড়ে এসেছিল এমন সময় ওই দুর্যোগ। মনটাও বিষিয়ে ছিল তার পর থেকে। নতুনবউ এর কাছে মুখ দেখাতেও যেন লজ্জা হচ্ছিল তার। ছেলে ফুলশয্যার রাতে বউ-এর সঙ্গে একঘরে শোয়নি, এ লজ্জা যেন ছেলেরও নয় বউ এরও নয়, এ লজ্জা যেন শাশুড়ীরই নিজের। অথচ এমন এক ঘটনা যা বাইরের লোককে বলাও যাবে না। যা বলে কারোর কাছ থেকে সহানুভূতিও পাওয়া যাবে না। নিজের মনে মনে জিনিসটাকে পুষে রেখে তুষের আগুনে জ্বলতে হবে।

হঠাৎ কর্তাকে সেই অসময়ে ঘরে আসতে দেখে প্রীতি অবাক হয়ে গেল। বললে–কী হলো, খোকার খোঁজ পেয়েছ?

কিন্তু তার কথা শেষ হওয়ার আগেই দেখলে, পেছনে খোকাও রয়েছে।

চৌধুরী মশাই সদানন্দকে ঘরে ঢুকিয়ে নিয়ে দরজার পাল্লা দুটো ভেজিয়ে দিলেন।

বললেন–এই তো খোকাকে সঙ্গে করে নিয়ে এলুম তোমার কাছে—

সদানন্দ তখন অপরাধীর মত মা’র সামনে দাঁড়িয়ে ছিল।

চৌধুরী মশাই বললেন–আমি ওকে অনেক কথা জিজ্ঞেস করেছি, তবু কোনও কথার জবাব দিচ্ছে না, দেখ, তুমি যদি কিছু কথা আদায় করতে পারো–

প্রীতি ছেলের মুখের দিকে সোজাসুজি চোখ রেখে বললে–হ্যাঁ রে খোকা, কোথায় ছিলি তুই সারারাত?

চৌধুরী মশাই বললেন–আমি ওকে সেই কথাই জিজ্ঞেস করেছি। সমস্ত রাত বাইরে বাইরে কাটালো, অথচ নতুন বউমা, সে বেচারি নতুন জায়গায় ভয়ে কেঁপে অস্থির–সে কী দোষ করলে?

প্রীতি ছেলের কাঁধে হাত দিয়ে সান্ত্বনা দিতে চাইলে। বললে–কী হয়েছিল তোর বল্ তো বাবা? বউমাকে পছন্দ হয়নি? আমাকে সত্যি করে মন খুলে বল, কী হয়েছিল তোর, বল কী হয়েছিল তোর? আমি কাউকে কিছু বলবো না। আমাদের কাছে বলতে তোর কীসের আপত্তি? আমাকে তো তুই আগে সব বলতিস, এখন তোর কী হলো যে আমাকে একবারও কিছু বললি না–না আমি তোর পর? তুই কি আমাদের পর মনে করিস?

সদানন্দ তখনও চুপ।

চৌধুরী মশাই বলতে লাগলেন–গায়ে-হলুদের সময় তুই বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেলি, ভাবলুম বিয়ের পর সব মিটে-টিটে যাবে। তারপর থানা-পুলিস কত কী হলো। তাও তো একরকম করে সব মিটলো, এখন পরের মেয়ে এ বাড়িতে এসেছে, সে বেচারি কী ভাবছে বল্ দিকিনি

মা ছেলের দিকে চেয়ে বললে–কী রে, কথা বলছিস নে যে? বাড়িত এখন এত লোকজন এসেছে, এদের কানে যদি কথাটা যায় তো তারাই বা কী ভাববে বল্ দিকিনি।

এতক্ষণে সদানন্দর মুখ দিয়ে কথা বেরোল।

বললে–মা…

কিন্তু কথা বলতে গিয়েও যেন সব কথা তার মুখের মধ্যে আটকে গেল।

মা বললে–কী রে, কী বলছিলি বল্, থামলি কেন?

সদানন্দ এবার মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল।

হঠাৎ বাইরে থেকে কৈলাস গোমস্তার গলা শোনা গেল—ছোটবাবু—

গৃহিণী বললে–ওই, গোমস্তা মশাই তোমাকে ডাকছে, যাও—

কিন্তু এই অবস্থায় চৌধুরী মশাই-এর ঘর থেকে চলে যাবার ইচ্ছে ছিল না।

চৌধুরী মশাই দরজা খুলে বাইরে আসতেই গোমস্তা মশাই বললে–রেলবাজার থেকে প্রাণকৃষ্ণ সা মশাই এসেছেন–

প্রাণকৃষ্ণ সা! প্রাণকৃষ্ণ সা রেলবাজারের আড়তদার মানুষ। মহাজনও বটে। টাকার দরকার হলে চৌধুরী মশাইকে ওই প্রাণকৃষ্ণ সা’র কাছেই হাত পাততে হয়।

জিজ্ঞেস করলেন–তা তিনি এই অসময়ে কেন?

কৈলাস বললে– কাল সন্ধেবেলা বউভাতে আসতে পারেননি, এখন এসেছে, বউমার মুখ দেখবেন।

চৌধুরী মশাই বিরক্ত হলেন মনে মনে। ঘরের ভেতর ঢুকে গৃহিণীকে বললেন–দেখেছ আক্কেলখানা! এই অসময়ে প্রাণকেষ্ট সা এসে হাজির, নতুন বউ-এর মুখ দেখবে! মুখ দেখবার আর সময় পেলে না! এখন কী করি বলো দিকিনি!

গৃহিণী বললেন–তা এসেছেন যখন তখন তো আর ফিরিয়ে দিতে পারবে না। কিন্তু একটু বসতে বলো গে। বউমা এখন ঘুমোচ্ছে, বউমা উঠবে, উঠে মুখ হাত ধোবে, তারপর সাজিয়ে-গুছিয়ে তবে বউ দেখাবো–তার আগে নয়–

চৌধুরী মশাই বিরক্ত হলেন। নিজের মনেই বললেন–আড়তদার মানুষ তো, তাই আক্কেলের মাথা খেয়ে বসে আছে একেবারে। সাত-সকালে বউ দেখতে চাইলেই অমনি দেখানো যায়! এখনও কারো বাসি কাপড় ছাড়া হয়নি–

আবার বাইরে এসে কৈলাসকে বললেন–সা মশাইকে বসিয়েছো তো!

–আজ্ঞে, তিনি তো কর্তাবাবুর কাছে বসে আছেন। কর্তাবাবুই আপনাকে ডাকতে পাঠালেন।

চৌধুরী মশাই বললেন–আচ্ছা ঠিক আছে, আমি যাচ্ছি–তুমি যাও–

সেখানেও কিছু লোকজন বসে আছে। তারা প্রাত্যহিক প্রয়োজনে আসে। হুকুম নেয় ছোটবাবুর কাছে। কোথায় কোন্ জমিতে লাঙল দিতে হবে, কোন্ জমির সর্ষে কাটতে হবে; কোন্ ক্ষেতের বেড়া বাঁধতে হবে–সব নির্দেশ ছোটবাবু সকালবেলাই দিয়ে দেন। তারপর আছে মজুরি দেওয়ার কাজ। রোজকার মজুরিটা ছোটবাবু রোজই দিয়ে দেন। ওটা পড়ে থাকে না। তার ওপর আছে উকিল-মুহুরি-মোক্তারের আনাগোনা।

ওপরে কর্তাবাবুর ঘরে তখন প্রাণকৃষ্ণ সা মশাই বেশ আসর জাঁকিয়ে বসেছে। নাতির বিয়েটা দিয়ে দিয়েছেন বলে খুব বাহবা দিচ্ছে কর্তাবাবুকে। বলছে–খুব ভাল কাজ করলেন কর্তাবাবু, একটা কাজের মত কাজ করে গেলেন–

কর্তাবাবু বললেন–আমার তো এই একটা কাজই বাকি ছিল, এবার রাস্তা ক্লিয়ার হয়ে গেল, এখন যেতে পারলেই হয়–

প্রাণকৃষ্ণ সা বললে–ওকথা বলবেন না কর্তাবাবু, নাতির তো এই সবে বিয়ে হলো, এখন তার ছেলে হোক, অন্নপ্রাশন হোক, আমরা পাত পেড়ে ভোজ খাই, তবে তো…

প্রাণকৃষ্ণ সা’র সঙ্গে কর্তাবাবুর পুরোন সম্পর্ক! সম্পর্কটা লেনদেনের হলেও কালক্রমে সেটা বন্ধুত্বের বন্ধনে নিবিড় হয়েছে। তাকে চৌধুরী বংশ সহজে অস্বীকার করতে পারে না। তাই তার অত্যাচার সহ্য করতে হয় এদের মুখ বুঁজে।

ততক্ষণে চৌধুরী মশাই এসে গেলেন।

বললেন–আপনি কাল আসেননি, তাই খুব ভাবছিলুম—

প্রাণকৃষ্ণ সা বললে–তা শুভ কাজ নির্বিঘ্নে মিটে গেছে তো, তাহলেই হলো বাবাজী…

কর্তাবাবুও তাই বললেন। বললেন–হ্যাঁ, আমার বড় উদ্বেগ ছিল সা মশাই। আমার নাতি যেমন বেয়াড়া, ভেবেছিলুম একটা কাণ্ড না আবার বাধিয়ে বসে। আজকালকার ছেলে ছোকরা তো আর আমাদের মত নয়, এরা সব অন্য রকম!

চৌধুরী মশাই কথার মাঝখানে বললেন–আপনাকে একটু অপেক্ষা করতে হবে কিন্তু, বউমা আমার সবে ঘুম থেকে উঠেছে তো, একটু মুখ-হাত-পা ধুয়ে তৈরি হয়ে নেবেন–

প্রাণকৃষ্ণ সা মশাই বললে–না, না, তার জন্যে ব্যস্ত হতে হবে না, আমার তাড়া নেই, আমি ততক্ষণ গল্প করছি–

কিন্তু ওদিকে সদানন্দ তখনও মার সামনে কাঠের পুতুলের মত দাঁড়িয়ে আছে।

মা বললে–কই, বল কী হয়েছে তোর, বল–

সদানন্দ এতক্ষণে আবার কথা বলে উঠলো। বললে–কেন তুমি বারবার এক কথা জিজ্ঞেস করছো, বলো তো?

মা বললে–তা তুই কেন বউমার কাছে শুবি নে তা বলবি তো?

সদানন্দ বললে–আমি তো বলেছি

–কী বলেছিস?

–আমি তো বলেছি তুমি বার বার ওকথা জিজ্ঞেস কোরনা আমাকে। আমি বলবো না।

মা বললে–তা আমাকে না বলিস, তুই বউমাকে বল্! বউমার সঙ্গে তুই একবার কথা বল্ গিয়ে। সে বেচারি কাল রাত তিনটের সময় ভয় পেয়ে আমাকে ডাকতে এসেছে, আমি গিয়ে তখন তার পাশে শুই, তবে বেচারি একটু ঘুমোতে পারে। জানিস আমাকে জড়িয়ে ধরে কী কাঁদাটা সে কেঁদেছে! তাকে আমি কী বোঝাই বল তো? বল, তাকে আমি কী বলে বোঝাব?

–তুমি কী বোঝাবে তা আমি কী করে জানবো?

–তুই যদি তা না জানবি তো ঘর থেকে পালিয়ে গেলি কেন? বউমা তোর কাছে কী দোষ করলো?

সদানন্দ বললে–তা আমি তো তোমাদের আগেই বলেছিলুম আমি বিয়ে করবো না!

মা বলে উঠলো–তা বিয়ে করবিই বা না কেন? বিয়ে কে না করে শুনি?

সদানন্দ বললে–তুমি সব কথা জানো না মা। তুমি যা জানো না তা নিয়ে কথা বলতে এসো না।

মা এবার ছেলের মুখের দিকে অনেকক্ষণ সোজাসুজি চেয়ে রইল। যেন কী একটা আতঙ্ক জেগে উঠলো মনে। বললে–তুই তাহলে কি কোনও দিনই বউমার কাছে শুবি নে নাকি?

সদানন্দ বললে–না–

–তাহলে পরের মেয়েকে বাড়িতে এনে তুই এত কষ্ট দিবি?

–তা সেজন্যে তো আমি দায়ী নই।

–কিন্তু সে বেচারি তাহলে এখানে কী করবে? সে এমন কী পাপ করলে যে তাকে তুই এমন শাস্তি দিবি? তোর ধর্ম বলেও কি কিছু নেই? দয়া মায়া ভগবান–কিছুই তুই মানবি নে? তুই তার দিকটা একটু ভেবে দেখবি নে? তার কথা না ভাবলেও আমাদের কথাও কি তুই একবার ভাববি নে? আমরাই বা লোকের কাছে কুটুমদের কাছে মুখ দেখাবো কী করে? চিরকাল তো আর এ-কথা চাপা থাকবে না, একদিন না একদিন তো এ দশ কান হবেই, তখন?

সদানন্দ বলে উঠলো–তা এসব কথা তোমরা আগে ভাবোনি কেন? যখন কালীগঞ্জের বউকে দাদু টাকা দিলে না, তখন এসব কথা কেন একবার ভাবলে না? যখন দাদু তাকে খুন করে মারলে তখনও তো কেউ একটা কথা পর্যন্ত বললে না তোমরা!

মা ছেলেকে চুপ করিয়ে দিলে। বললে–তুই আস্তে কথা বল বাবা, একটু আস্তে, বাইরের সবাই শুনতে পাবে

সদানন্দ আরো চেঁচিয়ে উঠলো–কেন, চুপ করে থাকলেই কি চিরকাল সব চাপা থাকবে তুমি বলতে চাও?

মা বললে–তোর দেখছি মাথা খারাপ হয়ে গেছে। চল, আমার সঙ্গে চল্, বউমার কাছে গিয়ে তুই এই কথাগুলো বলবি চ!

সদানন্দ বললে–কেন, বউমার কাছে আমি যাবো কেন? তোমরা তাকে বউ করে নিয়ে এসেছ, তোমরাই তার সঙ্গে ঘর করো, আমাকে ছেড়ে দাও, আমাকে ওর মধ্যে টেনো না

–পাগলামি করিস নে, আয় আমার সঙ্গে আয়—

বলে ছেলেকে হাত ধরে টানতে লাগলো প্রীতি।

সদানন্দ জোর করে হাত ছাড়িয়ে নিলে। বললে–তুমি কি আমাকে এতদিনেও চিনলে না? ভেবেছ তুমি হাত ধরে টানলেই আমি যাবো? আমি ছেলেমানুষ?

–তা তুই না যাস আমি বরং বউমাকে ডেকে তোর কাছে নিয়ে আসছি, তার কাছেই সব কথা পরিষ্কার হয়ে যাক।

সদানন্দ ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার চেষ্টা করতেই মা খপ করে তার হাতখানা ধরে ফেললে। বললে–কোথায় যাচ্ছিস?

সদানন্দ বললে–কোথায় যাচ্ছি তার কৈফিয়ৎ আমি তোমাকে দিতে বাধ্য নই–

মা বললে–তা আমাকে যদি না-ই বলিস তো বউমাকে বলে যা! বউমাকে বলে যা কেন তুই তার ঘরে থাকবি না! আমার দায়িত্বটা অন্তত কাটুক। আমি অন্তত মুক্তি পাই। তোরা দু’জনে নিজেদের মধ্যে যা ইচ্ছে বোঝাপড়া করে নে, আমি কেন মাঝখানে থেকে পাপের ভাগী হই?

সদানন্দ এ কথার কোনও উত্তর দিলে না।

মা এবার ছেলের আরো কাছে সরে এলো। বললে–কে কী দোষ করলো, তার জন্যে হেনস্তা হবে আমার আর ওই এক ফোঁটা দুধের মেয়ের? এই-ই কি তোর বিধান?

সদানন্দ বললে–তুমি বড় বড় কথা বোল না মা, ও-সব বড় বড় কথায় আমি ভুলবো না, তা জেনে রেখো। আমি যা করবো তা আমি ঠিক করেই রেখেছি–

–কী ঠিক করে রেখেছিস?

–কী ঠিক করেছি তা তুমি দেখতেই পাবে। আমাকে আর জিজ্ঞেস কোর না।

মা বললে–তাহলে তুই কোনও দিনই বউমার ঘরে শুবি নে?

সদানন্দ চুপ করে রইল।

মা আবার জোর দিয়ে জিজ্ঞেস করলে কী রে, উত্তর দিচ্ছিস নে যে? কথা বল, জবাব দে–

সদানন্দর চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছিল। তাড়াতাড়ি ডান হাত দিয়ে সেটা মুছে নিতে যাচ্ছিল, মা সঙ্গে সঙ্গে হাতটা ধরে ফেলেছে।

বললে–তুই আমার কাছে লুকোচ্ছিস? ভেবেছিস আমার কাছে মনের কথা লুকিয়ে তুই পার পাবি? তাহলে কেন আমি তোর মা হয়েছিলুম? কেন আমি তোকে দশমাস দশ দিন পেটে ধরেছিলুম? তোর জেদটাই বড় হবে রে, আর আমি কেউ নই? আমার কথার কোনও দাম নেই তোর কাছে? এই-ই তোর বিচার?

সদানন্দ মার কথা শুনতে শুনতে আর থাকতে পারলে না। দেখলে মার চোখ দিয়েও জল পড়ছে। সদানন্দ মার দিকে চেয়ে বললে–মা….

মা বলে উঠলো–না, আমি তোর মা নই। আজ থেকে আমি তোর কেউ নই, আমাকে তুই এখন থেকে আর মা বলে ডাকিস নে—যা–

বলে প্রীতি এক-পা পিছিয়ে গেল। সদানন্দ মার দিকে এগিয়ে গেল। বললে–মা–

প্রীতি বললেন, আমাকে তুই মা বলে আর ডাকিস নে, আমার ঘর থেকে তুই বেরিয়ে যা। আমি আর তোর মুখ দেখতে চাই নে–যা, বেরিয়ে যা–

সদানন্দ তবু মার দিকে এগিয়ে গেল। বললে–মা, তুমি আমার ওপর রাগ কোর না, আমার কথা শোন–

–তোর কোনও কথা শুনতে চাই নে, তুই আমার ঘর থেকে বেরিয়ে যা—

এবার সদানন্দ মা’র সামনে গিয়ে মাকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরলে। বললে–মা, তুমি আমার কথা শোন মা, আমার কথাগুলো শোন

মা ছেলের হাত দুটো ধরে নিজেকে ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করতে লাগলো। বললে–না, তুই চলে যা আমার সামনে থেকে, চলে যা–আমি তোর মুখ দেখতে চাই নে–

সদানন্দ বললে–না না, তুমি আমার ওপর রাগ কোর না, তুমি আমার দিকটা মোটে ভেবে দেখছ না। শুধু তোমাদের দিকটাই দেখছে। কিন্তু আমি কী করবো বলো তো, আমি কী করবো তুমি বলে দাও, আমি যে আর পারছি না–

মা বললে–কেন, কী হয়েছে তোর?

সদানন্দ বললে–কী হয়নি আমার, তাই আমাকে জিজ্ঞেস করো! আমি তোমাদের এই পাপের সংসারে কী করে থাকবো! কী করে তোমাদের সঙ্গে আমি মানিয়ে চলবো তাই শুধু আমি ভাবছি। আমার যে বুক ফেটে যাচ্ছে মা, সেটা তুমি দেখতে পাচ্ছো না?

–কেন? কীসের জন্যে তোর বুক ফেটে যাচ্ছে?

সদানন্দ বললে–তুমি তো বাড়ির ভেতরে থাকো, তুমি সেসব কথা জানবে কী করে? কপিল পায়রাপোড়াকে জানো? মানিক ঘোষকে জানো? ফটিক প্রামাণিক? কত লোকের নাম জানো তুমি? তারপরে এই কালীগঞ্জের বউ? মা, তুমি কেবল আমার নামেই দোষ দিতে পারো, আর কই, এতকাল ধরে যে এ বাড়িতে এত অন্যায় চলে আসছে, তার বিরুদ্ধে তো তোমরা কিছুই বলোনি?

মা বললে–তা ওসব কথা নিয়ে তুই অত মাথা ঘামাস কেন? ওসব নিয়ে তোর ভাববার দরকারই বা কী? ওসব ব্যাপারে তুই কানে তুলো দিয়ে রাখলেই পারিস–

সদানন্দ বললে–তা আমি যদি মাথা না ঘামাই তো ওরা কি এমনি করেই মরে যাবে? কেউ ওদের দেখবে না?

বাইরে থেকে ডাক এল হঠাৎ–ও বউদি, বউদি–

মা বললে–ওই তোর গৌরী পিসী ডাকছে। আমি যাই, কাজের বাড়ি, তোর সঙ্গে এতক্ষণ ধরে আমার কথা বলবার কি সময় আছে! যাই, আমি বাইরে যাই–

বলে একটু থেমে ছেলের দিকে চেয়ে বললে–তাহলে এবার থেকে আমার কথা শুনবি তো?

কিন্তু বাইরে থেকে আবার দরজা ঠেলার শব্দ–ও বউদি, বউদি–

প্রীতি দরজা খুলে দিতেই গৌরী পিসী বললে–কী করছিলে বউদি ঘরের ভেতর? তারপর সদানন্দকে দেখে আর কিছু বললে না। সদানন্দ খোলা দরজা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেল। সদানন্দ চলে যেতেই গৌরী বললে–খবর শুনেছ?

–কী খবর?

গৌরী গলা নিচু করে বললে–বউমার বাপের বাড়ি থেকে লোক এসেছে–

–কেন? এই তো কাল বিকেলেই ফুলশয্যের তত্ত্ব নিয়ে লোক এসেছিল। এই সাত সকালে আবার কী হলো?

গৌরী বললে–সব্বনাশ হয়েছে বউদি, খারাপ খবর নিয়ে এসেছে কেষ্টনগরের লোক–

–কী খারাপ খবর?

–বউমার মা’র নাকি খুব অসুখ।

–অসুখ? বউমাকে নিতে এসেছে নাকি? দেখ দিকিনি, কী কাণ্ড! তুই ওঘরে গিয়ে দেখেছিলি? বউমা কী করছে?

গৌরী বললে–আমি এ খবর দিতে পারবো না বাপু বউমাকে। তুমি দাও গে—

প্রীতি বললে–তা ছোট মশাই কোথায়? ছোট মশাই জানে?

–ছোট মশাই-এর কাছে তো বউমার বাপের বাড়ির লোক চিঠি নিয়ে দিয়েছে। বউমার বাপ নাকি চিঠিতে সব কথা লিখেছে–

প্রীতির মাথায় যেন বাজ ভেঙে পড়লো। সারারাত এত কাণ্ডের পর প্রাণকৃষ্ণ সা’ মশাই এসে হাজির হয়েছে বউ দেখবে বলে। তাঁকে বসিয়ে রাখা হয়েছে এতক্ষণ। এরপর বউমাকে মুখ-হাত পা ধুইয়ে সাজিয়ে গুজিয়ে সা’ মশাইকে দেখাতে হবে। এরই মধ্যে আবার বেয়ানের কিনা অসুখ! অসুখের কি সময় অসময় নেই গো? আর অসুখই যদি হলো তো এখনি সে খবর পাঠাতে হয়। একদিন পরে খবর পাঠালে কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যেত? এই সবে ফুলশয্যের রাত কাটলো, এখনও বাসি মুখে জল পড়েনি, এর মধ্যে খবরটাই বা বউমাকে দেওয়া যায় কী করে? হয়ত কেঁদে-কেটে একসা করবে।

–আচ্ছা তুই যা, আমি দেখছি—

বলে সোজা বউমার ঘরে গেল। বাইরে থেকে যেমন দরজা ভেজিয়ে রেখে দিয়েছিল, তখনও ঠিক তেমনি ভেজানোই রয়েছে।

প্রীতি আস্তে আস্তে নিঃশব্দে দরজার ফাঁক দিয়ে ঘরের ভেতরে উঁকি দিলে। উঁকি দিয়ে দেখলে বউ বিছানার ওপর শুয়ে বালিশের ওপর মুখ গুঁজে পড়ে রয়েছে। মনে হলো বোধ হয় জেগেই আছে।

আস্তে আস্তে প্রীতি ভেতরে ঢুকলো। তারপর বিছানার কাছে গিয়ে বোঝবার চেষ্টা করলে বউমা সত্যিই জেগে আছে না ঘুমোচ্ছে।

বোধ হয় প্রীতির পায়ের আওয়াজ নয়নতারার কানে গিয়েছিল। নয়নতারা মাথা তুলে দেখতেই প্রীতি বললে–তুমি জেগে আছ বউমা?

শাশুড়ীর কথার উত্তরে নয়নতারা ধড়মড় করে উঠে বসলো। বললে—হ্যাঁ–

–একটুও ঘুম হয়নি? তোমাকে ঘুম পাড়িয়েই তো গেলাম। একটু ঘুমোতে চেষ্টা করলে না কেন?

নয়নতারা কোনও উত্তর দিলে না।

প্রীতি বললে–ঠিক আছে বউমা, তুমি একটু বোস, কিছু ভেবো না। আমি এখুনি আসছি। তোমার চা খাওয়া অভ্যেস আছে তো? তুমি চা খাও?

নয়নতারা বললে—হ্যাঁ–

তাহলে আমি চা তৈরি করে নিয়ে আসছি। তারপর একজন ভদ্রলোক এসেছেন। তিনি কালকে আসতে পারেননি, আজকে ভোর থেকে এসে বসে আছেন। তোমার মুখ দেখে আশীর্বাদ করেই চলে যাবেন। তার আগে তোমাকে মুখ-হাত-পা ধুয়ে তৈরি হয়ে নিতে হবে–

তারপর একটু থেমে বললে–তুমি একটু অপেক্ষা করো বউমা আমি এখুনি আসছি, আমি যাবো আর আসবো–

বলে প্রীতি বাইরে চলে গেল। যাবার আগে দরজার পাল্লা দু’টো ভেজিয়ে দিয়ে গেল।

বাইরে গিয়ে নিজের ঘরের দিকে যাওয়ার পথে আবার চৌধুরী মশাই-এর সঙ্গে দেখা। চৌধুরী মশাই হনহন করে আসছিলেন। গৃহিণীকে দেখেই বললেন–ওগো শুনছো, কোথায় ছিলে তুমি?

গৃহিণী বললে–বউমার কাছে, কেন?

–বউমা কেমন আছেন এখন?

–থাকা-থাকি আর কী! সারারাতই ঘুমোয়নি। না-ঘুমিয়ে চোখ দুটো জবাফুলের মত লাল হয়ে রয়েছে। বউমার জন্যে চা তৈরি করতে আসছি। তা শুনছি নাকি বউমার মায়ের খুব অসুখ? বউমার বাপের বাড়ি থেকে নাকি লোক এসেছে-বেয়াই মশাই-এর চিঠি নিয়ে? বেয়ানের নাকি অসুখ?

–তোমায় কে বললে?

–গৌরী। তা অসুখের খবরটা কি আজকেই না-পাঠালে হতো না?

চৌধুরী মশাই হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেলেন। গলাটা নিচু করে বললেন–তোমাকে চুপি চুপি বলি। কাউকে যেন এখন বোল না। এই দেখ, বেয়াই মশাই এই চিঠি দিয়েছেন। খুবই দুঃখের খবর। বউমার মায়ের অসুখ নয়, ওটা আমি গৌরীকে ঘুরিয়ে বলেছি। আসলে বউমার মা কাল মারা গেছেন

–অ্যাঁ?

প্রীতির মাথায় যেন বাজ ভেঙে পড়লো। বললে–বলছো কী তুমি? কখন মারা গেলেন? কী হয়েছিল? কালও তো কিছু বলেনি ওদের লোকেরা!

এ বাড়ির যে গৃহিণী তারই যেন সব দায়, নতুন বউ বাড়িতে এলে গৃহিণীর দায়িত্ব কোথায় কমবে, তা নয়। যেন আরো বেড়ে গেল। একে ক’দিন থেকেই ঝঞ্ঝাট চলেছে, তার ওপর আছে ছেলের বেয়াড়াপনা। এখন বউকে সামলাবে, না ছেলেকে সামলাবে, সেই ভাবনাতেই অস্থির। তার ওপর আবার এই নতুন ঝঞ্ঝাট। মাথা ঠিক রাখাই দায় হয়ে পড়েছিল প্রীতির।

প্রীতি বললে–এখন কী করি তাহলে আমি? বউমাকে কথাটা বলি কী করে? খবরটা শুনে তো বউমা একেবারে কেঁদে ভাসাবে। তখন আমি সামলাবো কী করে?

চৌধুরী মশাই বললেন–আমিও তো তাই ভাবছি। কী যে করি আর কার সঙ্গেই বা পরামর্শ করি তাও বুঝতে পারছি না–

–তা বেয়াই বাড়ির লোক কী বলছে?

–ওরা আর কী বলবে? ওরা তো আমাদের খবর দিতে এসেছে। বেয়াই মশাই নিজেও কিছু ঠিক করতে পারেন নি, ওদিকে লোকজন সবাই শ্মশানে গেছে, আর এদেরও পাঠিয়ে দিয়েছেন এখানে। এখন যা করার হয় আমরা করবো।

বলে চৌধুরী মশাই কিছু সমাধান বার করতে না পেরে দু’হাতে মাথার চুলগুলোকে নিয়ে নাড়াচাড়া করতে লাগলেন। যেন মাথার চুলগুলোই সমস্যা সমাধানের বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

কিন্তু অত কথা শোনবার বা ভাববারও সময় তখন কারো ছিল না। না প্রীতির না চৌধুরী মশাইয়ের। চৌধুরী মশাই বললেন–ওদিকে আবার প্রাণকৃষ্ণ সা’ মশাই বসে আছে, বউমা তৈরি আছে তো?

প্রীতি রেগে গেল কী করে তৈরি থাকবে? যখন-তখন ওমনি বউ দেখতে এলেই হলো? মানুষের শরীর-গতিক বলে একটা জিনিস নেই?

চৌধুরী মশাই বললেন–না, আমি তা বলছি না। তাঁকে তো আমি বসিয়েই রেখেছি।

প্রীতি বললে–হ্যাঁ, তিনি বসে থাকুন। যখন বউমা তৈরি হবে তখন দেখাবো, তার আগে নয়। আর আমারও তো শরীর-গতিক আছে! সারারাত তো আমিও ঘুমোতে পারিনি। আমার মাথা টলছে, আমিও আর কিছু ভাবতে পারছি না–

বলে গৃহিণী তার নিজের কাজে চলে গেল।

চৌধুরী মশাই খানিকক্ষণ সেখানে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন। তারপর তিনিও বারবাড়ির দিকে এক-পা এক-পা করে এগোতে লাগলেন।

.

এ এক অদ্ভূত পরিস্থিতি সেদিন সমস্ত বাড়িটার মধ্যে সৃষ্টি হলো। কেউ জানলো না কোথায় সংসারের কোন্ কোণে একট ফাটল ধরেছে। সবাই উৎসবের আনন্দে উন্মত্ত। যারা নেমন্তন্ন খেয়ে গেছে তারা খাওয়ার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। যারা বউ-এর মুখ দেখে গেছে তারাও বউ এর রূপের প্রশংসায় মুখর। ঐশ্বর্যের প্রাচুর্যের আর বিলাসের জাঁকজমকের ঝলমলানিই তারা দেখলে। তার অন্তরের দুর্যোগের দুর্দশাটির চেহারা তারা উপলব্ধি করতে পারলে না। ওটা চাপা থাক, ওটাকে পুলটিশ দিয়ে ঢেকে রাখো। তোমার বাইরের ঐশ্বর্যটাই তাদের কাছে সত্যি হোক, কেউ যেন তার দারিদ্রটা না দেখতে পায়। ওটা দেখতে পেলে তোমার সম্মান সমৃদ্ধি আর সম্পদের সৌধটা ভেঙে গুঁড়িয়ে চুরমার হয়ে যাবে। তাহলে কেউ আর তোমায় সেলাম করবে না, কেউ তোমাকে হিংসেও করবে না। অথচ সংসারে তোমাকে কেউ হিংসে না করলে তোমার মাথাই বা উঁচু থাকবে কী করে? তুমি যে তাহলে সাধারণ হয়ে যাবে। একেবারে সাধারণ। আর সাধারণ হয়ে বেঁচে থাকা মানেই তো নিচু হওয়া। অর্থাৎ অন্য সবাইয়ের সমান হওয়া, সকলের সঙ্গে একাকার হওয়া।

যখন উৎসবের বাড়িতে আবার সবাই আগেকার বউভাতের জের টেনে সকালবেলা থেকেই খুশির হাওয়ায় গা ভাসিয়ে দিয়েছে, যখন সবাই বাসি লুচি-বেগুনভাজার ভোজে। বেসামাল, বাড়ির গিন্নির তখন মেজাজ সপ্তমে চড়ে উঠেছে। অথচ কাল রাত্রেও এমন ছিল না। বাড়ির গৃহিণী তখন শান্তিপুরের চওড়া জরির পাড়ওয়ালা শাড়ি পরে সবাইকে অভ্যর্থনা করছে। কিন্তু আজ তারই আবার তখন অন্য চেহারা, অন্য মেজাজ। গৌরী পিসী কী একটা আর্জি জানাতে এসে বকুনি খেয়ে ফিরে গেল।

প্রীতি বলে উঠলো–আমার একটা তো মাথা, আমি কোন দিক সামলাবো শুনি! না খেল তো বয়ে গেল! দরকার নেই কারো খেয়ে। আমার নতুন বউয়ের মুখে এখনও জল পড়েনি, আগে আমি তাই ভাববো না তোদের কথা ভাববো!

গৌরী পিসী বললে–আমি তো সে কথা বলিনি বউদি। বলছি রাঁধুনী বামুনরা জিজ্ঞেস করছে কত ময়দা মাখব–

প্রীতি ঝাঁঝিয়ে উঠলো–কত ময়দা মাখবে তা আমি এত আগে থেকে কী করে বলবো, আমি কি গুনতে জানি যে আগে গুনে বলবো আমার এতজন বাড়িতে খাবে…

এর পরে আর কথা চলে না। কিন্তু শুধু এই-ই শেষ নয়, সামান্য-সামান্য ব্যাপারেই সকাল থেকে বাড়ির গিন্নীর মেজাজটা সকলের নজরে পড়লো।

প্রকাশ মামা এসেই বললে–দিদি, শুনলুম বউমাকে নাকি বাপের বাড়ি পাঠানো হচ্ছে?

দিদি বললে–কেন, কে তোকে বললে?

–তুমি কথাটা সত্যি কি না তাই বলো না! কথা নেই বার্তা নেই ওমনি বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিলেই হলো? এখনও তো আট দিনও কাটলো না!

প্রীতি বললে–কিন্তু এ-সব কথা কে বললে তোকে?

–কে আবার বলবে, বলেছে জামাইবাবু!

–তা যে বলেছে তাকেই জিজ্ঞেস করগে কেন বউমাকে পাঠানো হচ্ছে।

প্রকাশ মামা বললে–তা হলে যা শুনছি তা সত্যি!

প্রীতি বললে–সত্যি-মিথ্যে আমি জানি নে। আমার অত জানবার সময় নেই বাপু

বলে আবার তার নিজের কাজে চলে গেল। কিন্তু প্রকাশ মামা ব্যাপারটা নিয়ে চুপ করে বসে থাকতে পারলে না। আসলে চুপ করে বসে থাকা তার স্বভাবেই নেই। আবার দৌড়ে গেল চৌধুরী মশাইয়ের কাছে। বললে–-জামাইবাবু, দিদি তো কই কিছু বললে না–

চৌধুরী মশাই তখন নিজের ঝঞ্ঝাট নিয়েই ব্যস্ত। প্রকাশের কথাটা বুঝতে পারলেন না। বললেন–কীসের কী?

–ওই যে আপনি বললেন বউমাকে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হবে!

চৌধুরী মশাই চটে গেলেন। বললেন–তা বউমা একবার বাপের বাড়িও যাবে না? বিয়ে হয়েছে বলে কি একেবারে চিরকাল শ্বশুরবাড়িতেই বাঁধা হয়ে থাকবে? বাপ-মার জন্যে একটু মন-কেমন করে না? ছেলেমানুষ বউ, বেশি তো বয়েস নয়–

–কিন্তু এখানে কিছুদিন তো অন্তত থাকবে। একটা হপ্তা থাকুক, আপনি এত তাড়াতাড়ি কেন ফেরত পাঠাচ্ছেন?

চৌধুরী মশাইয়ের কেমন যেন সন্দেহ হলো। বললেন–তা বউমার জন্যে তোমার এত মাথাব্যথা কেন হে? বউমা কিছু বলেছে তোমাকে?

–বউমা? বউমা কেন বলতে যাবে। আপনি কী যে বলেন!

–তা হলে? তা হলে কে তার হয়ে তোমাকে ওকালতি করতে বললে? বলো, কে বললে?

প্রকাশ মামা আর কী বলবে! হঠাৎ বলে ফেললে–সদা! সদা বলছিল—

চৌধুরী মশাই অবাক। বললেন–সদা? সদা তোমাকে বলেছে?

প্রকাশ মামা বললে–হ্যাঁ–

–কী বলেছে সদা?

–বলছিল এরই মধ্যে কেন বাবা বউকে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছে, সেই কথা জিজ্ঞেস করছিল।

–জিজ্ঞেস করেছে তোমাকে?

প্রকাশ মামা বললে–তা জিজ্ঞেস করবে না। সবে কাল ফুলশয্যে হয়েছে। এখনও ভালো করে ভাব-ভালবাসা হয়নি, এরই মধ্যে কিনা আপনি বউমাকে কেষ্টনগরে পাঠিয়ে দিচ্ছেন!

–সদা কোথায়? তাকে একবার ডেকে নিয়ে এসো তো আমার কাছে!

প্রকাশ মামা সদাকে আনতে চলে গেল। আসলে খবরটা কেউই বলেনি প্রকাশ মামাকে। ঘুম থেকে উঠে ঠাকুরদের বলে চা তৈরি করিয়ে নিয়ে খেয়েছিল। পিসে মশাইকেও গিয়ে এক কাপ খাইয়ে এসেছিল। বিরাট বাড়ি। বারবাড়ি, ভেতর বাড়ি। বার বাড়ির উঠোন, ভেতর-বাড়ির উঠোন। কাল বউভাতের রাত্রে সমস্ত বাড়িটা লোকজনে ভরে গিয়েছিল। তারপর কখন কে খেলে, কে না খেলে, সব তদারক করেছে সে। সঙ্গে সঙ্গে পাহারা দিয়েছে সদাকে। যেন কোথাও পালিয়ে না যায় সে। তারপর যখন সব শেষ হলো তার আগেই শোবার ঘরে সদাকে ঢুকিয়ে তবে নিশ্চিন্ত হয়েছে। কিন্তু তখন আর শরীর বইছে না তার। সবাই-ই ক্লান্ত। শেষকালে একটা জায়গা বেছে নিয়ে দু-চোখ বুজতেই ঘুমিয়ে পড়েছে অঘোরে তারপর সকালবেলাই দীনুর সঙ্গে দেখা। তখন বেশ বেলা হয়েছে। চা খেয়ে চাঙ্গা হয়েছে শরীর।

প্রকাশ মামা দীনুকে জিজ্ঞেস করলে কী খবর দীনু? কাল রাত্তিরে কেমন খেলে? দীনুর তখন কথা বলবার সময় ছিল না। বললে–ভালো–

বলেই চলে যাচ্ছিল। কিন্তু প্রকাশ মামা বললে–কী গো, অত সাতাড়াতাড়ি যাচ্ছো কোথায়? কর্তাবাবু উঠেছে নাকি?

দীনু যেতে যেতে বললে–না, কুটুমবাড়ির লোক এসেছে, তাদের খাওয়ার বন্দোবস্ত করতে হবে।

–কুটুমবাড়ির লোক! কেষ্টনগর থেকে এসেছে? কালই তো ফুলশয্যের তত্ত্ব নিয়ে এসে খেয়ে-দেয়ে চলে গেল! আবার আজ সকালেই এসেছে? হঠাৎ এল কেন?

দীনু বললে–বউমাকে নিয়ে যেতে–

–সে কী? বউমাকে নিয়ে যাবে মানে?

আসলে দীনুও ভালো করে কিছুই জানতো না। কুটুমবাড়ির লোক যখন এসেছে তখন বউমাকে নিয়ে যাবার জন্যেই এসেছে। তা ছাড়া আর কী হতে পারে?

–কোথায় তারা? কোথায় কুটুমবাড়ির লোক?

দীনু বললে–এই চণ্ডীমণ্ডপে বসে রয়েছে–

কিন্তু প্রকাশ মামা যখন চণ্ডীমণ্ডপে গেল তখন তারা চলে গেছে।

চৌধুরী মশাই প্রকাশকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন–কী দেখছো?

–আজ্ঞে শুনলুম কুটুমবাড়ির লোক এসেছে বউমাকে নিয়ে যেতে। দীনু বলছিল। কোথায় গেল তারা?

চৌধুরী মশাই বললেন–তারা চলে গেছে–কেন, তোমার কী দরকার?

–তা বউমাকে নিয়ে যাবার কথা আছে নাকি শুনলুম?

চৌধুরী মশাই নিজের মনেই তখনও ভাবছিলেন। কিছুই সিদ্ধান্ত করতে পারেন নি। এত বড় বিপর্যয়টা গেল, কেমন করে সমস্ত দিক সামলাবেন বুঝতে পারছিলেন না। সমস্ত জিনিসটাই যেন জটিল হয়ে আসছিল। এমনই ব্যাপার যে কাউকে বলাও যাবে না কিছু। ছেলে ফুলশয্যার রাত্রে বউয়ের ঘরে রাত কাটায়নি এও যেমন কাউকে বলার নয় তেমনি বউমার মায়ের মৃত্যুর খবরটাও এখন কাউকে বলা যাবে না। বউমার কানে যদি কোনও রকমে কথাটা ওঠে তো সে এক মর্মান্তিক কাণ্ড ঘটে যাবে তখনই।

প্রকাশ মামা তখনও জিজ্ঞেস করলে–তা বউমাকে আপনি সত্যি-সত্যিই পাঠিয়ে দেবেন নাকি?

চৌধুরী মশাই অন্যমনস্ক ভাবেই বলে ফেললেন–হ্যাঁ, তুমি এখন যাও, আমার কাজ আছে–

তখন থেকেই ছটফট করতে লাগলো প্রকাশ মামা। সদাকে খুঁজতে লাগলো। কোথাও নেই সে। ভেতরবাড়িতে দিদির কাছে গিয়েও কোনও সুরাহা হলো না। যাকে দেখে তাকেই জিজ্ঞেস করে–হ্যাঁ রে, সদাকে দেখেছিস? সদা কোথায় গেল?

কেউই দেখেনি সদাকে। যাকে ঘিরে এত কাণ্ড সে এই সময়ে কোথায় পালালো! পিসেমশাই-এর ঘরে গিয়ে দেখলে তিনি তামাক ধরিয়েছেন। প্রকাশ মামা তাকে গিয়েও জিজ্ঞেস করলে–সদাকে দেখেছেন নাকি পিসেমশাই?

কীর্তিপদবাবু অবাক হয়ে গেলেন–সদা? খোকার কথা বলছো? তা সে আবার কোথায় যাবে? আবার পালালো নাকি?

–না, তাকে আমার দরকার।

কীর্তিপদবাবু বললেন–তা দেখ গিয়ে সে হয়ত এখন নতুন নাতবউ-এর কাছে ঘুর ঘুর করছে–সে কি আর আজকে বুড়ো মানুষের সঙ্গে ঘোরাঘুরি করবে!

তা বটে। প্রকাশ মামা আবার ভেতর বাড়িতে ঢুকলো। দিদি তখন ভাড়ার নিয়ে ব্যস্ত। একেবারে সোজা গিয়ে সদার শোবার ঘরের ভেতর দিকে চেয়ে দেখলে। নতুন বউ চুপ করে বসে ছিল। পাশে গৌরী পিসী তাকে পাথরের বাটিতে মিষ্টি খাওয়াচ্ছে।

–হ্যাঁ গো গৌরী, আমাদের সদা কোথায় গেল? সদা এখানে আছে?

নয়নতারা মামাশ্বশুরকে দেখেই মাথার ঘোমটাটা একটু টেনে দিলে। গৌরী পিসী বললে–খোকা এখেনে থাকতে যাবে কেন গো, বারবাড়িতে গিয়ে দেখ–দিনের বেলা বর মানুষ কখনও বউ-এর কাছে থাকে?

প্রকাশ মামা সদাকে না পেয়ে আবার অন্য দিকে চলে গেল।

কর্তাবাবুর কাছে খবর গেল প্রাণকৃষ্ণ সা’ মশাই এবার বউ-এর মুখ দেখতে আসতে পারেন। আড়তদার লোক। অনেক টাকা নিয়ে নাড়াচাড়া করা মানুষ। টাকাও যেমন তিনি দেখেছেন, মানুষও দেখেছেন তেমনি অনেক। নতুন বউ খাটের ওপর বসে ছিল; আবার তাকে বেনারসী পরানো হয়েছে। আবার সারা গায়ে গয়না উঠেছে।

গৌরী পিসী বললে–বউমা, তুমি ওই কার্পেটের আসনের ওপর বোস–সা’ মশাই এলে তাকে প্রণাম করবে–

ওদিকে প্রাণকৃষ্ণ সা’ মশাইকে নিয়ে চৌধুরী মশাই ভেতর বাড়িতে এসে পড়েছেন। তাদের কথাবার্তা কানে আসছে। গণ্যমান্য লোক, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করলে বৈষয়িক ব্যাপারে ক্ষতি হবে এবাড়ির। যেন আদর-আপ্যায়নের কোন ত্রুটি না হয় কোথাও।

বাইরে এসে চৌধুরী মশাই গলা বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন–গৌরী, বউমা তৈরী? আমরা যাবো?

ভেতরে গৌরী পিসী নয়নতারাকে নিয়ে আসনের ওপর বসিয়ে দিতে দিতে বললে– হ্যাঁ, আসুন–

কিন্তু বসতে গিয়েই একটা কাণ্ড ঘটে গেল। পাথরের জলখাবারের গেলাসটা নয়নতারার পায়ে লেগে উল্টে গেল। আর সঙ্গে সঙ্গে গেলাসটা ভেঙে টুকরো-টুকরো হয়ে গেল। গিয়ে ঘরের মেঝেয় সেই টুকরোগুলো চারদিকে ছড়িয়ে গেল। গেলাসের জলটুকুও ছড়িয়ে ছিটিয়ে চারদিকে জলে জলময় হয়ে গেল।

চৌধুরী মশাইএর সঙ্গে প্রাণকৃষ্ণ সা’ মশাই তখন ঘরে ঢুকে ওই দৃশ্যের সামনে দাঁড়িয়ে হতবুদ্ধি হয়ে গেছেন।

কারোর মুখেই তখন কোনও কথা নেই।না  নয়নতারার, না গৌরী পিসীর। দুজনেরই মনে হলো যেন চরম সর্বনাশ ঘটে গেল তাদের চোখের সামনে। যেন আজকের সমস্ত অনুষ্ঠানের কেন্দ্র চরিত্র নয়নতারারও অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ সমস্ত কিছু ভেঙেচুর ছত্রখান হয়ে গেল হঠাৎ।

বাইরে প্রীতির কানে গেল শব্দটা। প্রীতি বুঝতে পারলে ঘরের ভেতর যেন কী একটা ভারি জিনিস হাত থেকে পড়ে গিয়ে ভেঙে গেল।

–কী যেন ভাঙলো না?

বেহারী পালের বউ সকালবেলাই এসেছিল। সেও বললে–ওমা, কী ভাঙলো ঘরের ভেতরে?

প্রাণকৃষ্ণ সা’ মশাই ওই পরিস্থিতির মধ্যে আর দাঁড়ালো না। যা সঙ্গে করে এনেছিল সেটা তাড়াতাড়ি নতুন বউএর হাতে তুলে দিয়েই বিদায় নিতে পারলে যেন বাঁচে। যেন তার অপরাধেই দুর্ঘটনাটা ঘটলো।

মাঝখানে ভাঙা পাথরের টুকরোগুলো, আর জল। আর একপাশে নতুন বউ দাঁড়িয়ে, আর একপাশে প্রাণকৃষ্ণ সা’ মশাই। নতুন বউ দু’হাত পেতে উপহারটা নিয়ে সা’ মশাইকে নমস্কার করতে যাচ্ছিল। কিন্তু সা’ মশাই বলে উঠলো–থাক, থাক, আমি চলি–

সত্যিই, তার অপরাধ-বোধ তাকে আর সেখানে এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থাকতে দিলে না। পেছনে দাঁড়িয়ে ছিলেন চৌধুরী মশাই। তিনিও ঘটনার আকস্মিকতায় তখন স্তব্ধ হতচকিত।

–চলো বাবাজী, চলো—

দুজনেই তাড়াতাড়ি ঘটনাস্থল থেকে বাইরে বার বাড়ির দিকে চলে গেলেন। তাঁরা চলে যেতেই প্রীতি ঘরে ঢুকলো। চোখের সামনে যে দৃশ্য তার নজরে পড়লো তা দেখে তার মুখ দিয়ে তখন আর কোনও কথা বেরোল না।

নতুন বউ তখনও তার কার্পেটের আসনটার ওপর দাঁড়িয়ে ছিল। তার সমস্ত শরীর তখন থরথর করে কাঁপছে। ভাঙা পাথরের গেলাসের টুকরোগুলো যেন তখনও তার বুকে গিয়ে ফুটছে। তার যন্ত্রনাতেই যেন সে ছটফট করতে আরম্ভ করেছে।

বেহারী পালের বউও পেছনে এসে দাঁড়িয়েছিল।

বললে–ওমা, এ কী, পাথরের গেলাসটা ভেঙে গেল নাকি?

কিন্তু কে আর তখন তার কথার উত্তর দেবে! সকলেই ঘটনার আকস্মিকতায় যেন মুহ্যমান।

প্রীতি চাইলে গৌরীর দিকে। বললে–হ্যাঁরে, গেলাসটা ভাঙলি?

গৌরী বললে–বউমার পায়ে লেগে ভেঙে গেল বৌদি–

ঝাঁঝিয়ে উঠলা প্রীতি। বললে–বউমার পায়ে লেগে ভেঙে গেল, তো তুই কোথায় ছিলি? তুই দেখতে পাসনি? তুই কি চোখের মাথা খেয়েছিলি? তুই গেলাসটা একপাশে সরিয়ে রাখতে পারিসনি?

গৌরী বললে–সা’ মশাই আসছিল তাই আমি তাড়াতাড়ি বৌমাকে আসনের ওপর বসাতে গেলুম…

–তা যখন দেখলি পায়ের সামনে গেলাসটা রয়েছে তখন ওটা সরাতে পারলি নে? দিন দিন তোর কী হচ্ছে কী? আজকের এই দিনে পাথরের জিনিস কি ভাঙা ভালো হলো?

বেহারী পালের বউও পেছনে দাঁড়িয়ে সব শুনছিল। বললে–-বেস্পতিবারের বারবেলায় ব্যাপারটা ভালো হলো না বউ।

কথাটা সকলেরই মনে গিয়ে লাগলো। এমনিতেই পাথরের জিনিস। তার ওপর বৃহস্পতিবার। একটা অজ্ঞাত আতঙ্কে সকলের বুকই ধকধক করে উঠলো। এ যে কত বড় অমঙ্গল সে-কথাটা যেন কারো হৃদয়ঙ্গম হতে আর বাকি রইলো না। সকলেরই মনে হলো এত বড় দুর্ঘটনা যেন ভাবী কোনও অমঙ্গলের সূচক। অথচ এর কী প্রতিবিধান তাও সেই মুহূর্তে কারো যেন মাথায় এলো না।

বাইরে এসে বেহারী পালের বউ বললে–কাজটা ভালো হলো না বউ, নতুনবউ বাড়িতে এসেই পা দিয়ে পাথরের গেলাসটা ভেঙে ফেললে এটা কিন্তু ভালো না।

প্রীতির তখন চোখ দুটো ছলছল করে উঠেছে। বললে–আমি কত দিক সামলাই বলো তো মাসীমা? আমার কি একটা জ্বালা? আর মানুষদেরও আক্কেল কী রকম দেখ, কালকে বউভাত গেল, কাল আসতে পারেনি বলে আজ এই অসময়ে আসতে হয়? আসবার আর সময় পেলে না কেউ? বউ তো পালিয়ে যাচ্ছে না বাড়ি থেকে! আর একটু বেলা করে এলে কী এমন ক্ষেতি হতো?

বেহারী পালের বউ বললে–তা কী আর করবে বলল, মঙ্গলচণ্ডীতলায় গিয়ে পূজো দিয়ে আসতে হবে।

–পূজো?

বেহারী পালের বউ বললে–ওমা, তা পূজো দেবে না? অন্য কেউ হলে তত কিছু না করলেও চলতো, কিন্তু নতুন বউ বলে কথা! তোমার নতুন বউকেও নিয়ে যেতে হবে।

–কিন্তু মাসীমা, ওদিকে আর এক বিপদ হয়ে গেছে আমার।

বলতে বলতে প্রীতির গলাটা যেন বন্ধ হয়ে এল। বললে–কাউকে যেন বোল না মাসীমা। তোমার দুটি পায়ে পড়ি এখন কাউকে বোল না। বউমার কানে গেলে আবার কেঁদেকেটে একসা করেবে

বেহারী পালের বউ গোপন কথার ইঙ্গিত পেয়ে আরো কৌতূহলী হয়ে উঠলো।

বললে–আমার কাউকে বলতে বয়ে গেছে, কথাটা কী শুনি না?

–তোমাকে আমার ঘরের লোক মনে করি বলেই বলছি, এখনও কেউ জানে না..

–আরে কথাটা কী তা-ই বলো না?

–বউমার মা মারা গেছে।

–ওমা, সে কী? কবে? কখন? কোত্থেকে খবর এল?

প্রীতি বললে–এই সকালবেলা বেয়াই মশাই খবর পাঠিয়েছেন। এখন আমি যে কী করি, কার সঙ্গে পরামর্শ করি তাই ভাবছি। বউমা জানে না কথাটা। পুরুতমশাইকে ডেকে পাঠানো হয়েছে, কর্তারা সে-সব করছেন। এখন বাড়ির মধ্যে আমি কী করবো তা বুঝতে পারছি নে!

বেহারী পালের বউ বললে–বলেছ ভালোই করেছ বউমা। তাহলে এক কাজ করো। আজকে আর মাছ-টাছ কিছু খেতে দিও না বউমাকে। নিরিমিষ খাক, তারপর চতুর্থী করার ব্যবস্থা করতে হবে

–কিন্তু ওরা তো বৌমাকে নিয়ে যেতে এসেছিল। তা বাপের বাড়িতে তো মা ছাড়া আর দ্বিতীয় মেয়েমানুষ কেউ নেই। বেয়াইমশাই খুবই ভেঙে পড়েছেন। আমি ভাবছি বউমাকে কেষ্টনগরে পাঠিয়ে দিই।

বেহারী পালের বউ ভেবে-চিন্তে বললে–তা তাই-ই দাও বরং–

তারপর যেন কী ভাবলে! বললে–একে মা মারা যাওয়ার খবর এলো, তার ওপর বেস্পতিবারে পা দিয়ে পাথরের জিনিস ভাঙলে, এসব তো ভালো লক্ষণ নয় বউমা, এতে কারোর ভালো হবে না, তোমার ছেলের পক্ষেও ভালো নয়। অবিশ্যি তোমার ছেলের একটু কষ্ট হবে বটে। কদিন বউকে ছেড়ে খোকা থাকতে পারবে তো?

প্রীতি বললে–আমার ছেলের কথা ছেড়ে দাও

–তা ছেলে যদি তোমার রাগ না করে তো বউমা সেখানেই থাক। তারপর শ্রাদ্ধ শান্তি হয়ে গেলে, তখন না হয় ফিরবে। এই সময়ে বাপের কাছে থাকলে বাপও মনে একটু শান্তি পাবে–আর না-হয় ছেলেকেও বউ-এর সঙ্গে সেখানে পাঠিয়ে দাও। ছেলে যদি বউকে ছেড়ে থাকতে না পারে তো তাই-ই না হয় করো–

প্রীতি কিছু ভাঙলে না। মুখে বললে–দেখি, কী করি কিন্তু বউমাকে খবরটা আমি কী করে দেব তাই ভাবছি মাসীমা–বউমা তো এখনও কিছু জানে না–

তা আমি গিয়ে খবরটা দেব?

প্রীতি বললে–না মাসীমা, আমি বলি এখন থাক। কর্তাও বলছিলেন খবরটা এখন বউমাকে দিয়ে দরকার নেই। শেষকালে কান্নাকাটি করলে আমি আর বউমাকে সামলাতে পারবো না–

–তা তোমার ছেলে কী বলছে? সদা?

–ছেলের কথা তুমি ছেড়ে দাও মাসীমা। সে শুধু বিয়ে করেই খালাস। সে কারো সাতেও নেই পাঁচেও নেই। ভোরবেলা থেকে কোথায় যে সে ঘুরছে কেউ তার মুখও দেখেনি। খবরটা যে তাকে বলবো, তা তার দেখা পেলে তবে তো?

বেহারী পালের বউ বললে–তাহলে কর্তা যেমন বলেন সেই রকমই করো তুমি বউমা। ছেলের কানে গেলে যদি আবার সে বউমাকে বাপের বাড়ি যেতে না দেয়!

হঠাৎ চৌধুরী মশাই ভেতর বাড়িতে এলেন। প্রীতি কাছে এগিয়ে গেল। গলা নিচু করে জিজ্ঞেস করলে, কী খবর ওদিকের?

চৌধুরী মশাই বললেন–সা’ মশাইকে বিদেয় করে দিয়ে এলুম। লোকের আক্কেল দেখে অবাক। আর সময় পেলে না, এই অসময়ে এসে হাজির! পাথরের গেলাসটা ভেঙে গেল মাঝখান থেকে! দেখ দিকিন কী অমঙ্গলের ব্যাপার

–সে আর ভেবে কী হবে! কিন্তু পুরুত মশাই কী বললেন? বউমা আজ নিরিমিষ খাবে তো?

–তা সব জেনে-শুনে আর আঁশ খেতে দেওয়া যায় কী করে বলো!

–কিন্তু কেষ্টনগরে যাওয়া?

চৌধুরী মশাই বললেন–পুরুত মশাই তো বলছেন সেখানে পাঠিয়ে দিতে! দুদিন পরে তো পাঠাতেই হতো সেখানে। না হয় একদিন আগেই গেল! আমি ভাবছি সেইটেই ভালো হবে। খোকা যে কাণ্ড করছে, আজকেও যদি খোকা বউমার ঘরে না শোয় তো তাতেও বউমার মনে সন্দেহ হবে। তার চেয়ে বরং বউমাকে সেখানে পাঠিয়ে দেওয়াই ভালো হবে–

–সঙ্গে কে যাবে?

চৌধুরী মশাই বললেন–খোকা গেলেই ভালো হতো। কিন্তু কোথায় সে?

–থাকলেই কি সে সেখানে যেত? খোকা যদি না যায় তো প্রকাশ আর গৌরী সঙ্গে যাক। এখানকার আমাদের তরফের কেউ গেলেই ভালো হতো।

–কিন্তু সঙ্গে খোকা গেলেই সব চেয়ে ভালো হয়। তাহলে আর কারো যাবার দরকার হয় না।

প্রীতি বললে–তা দেখ না তাকে খুঁজে। যদি রাজি করাতে পারো–

চৌধুরী মশাই বললেন–সে না-হয় আমি দেখছি। কিন্তু তুমি ততক্ষণে বউমাকে তৈরি করিয়ে রাখো। খাইয়ে-দাইয়ে সাজিয়ে-গুজিয়ে রেখে দাও। বেরোলে এখুনি বেরোতে হবে। রজব আলীকে বলেছি গাড়ী তৈরি করতে। বেলাবেলির ট্রেনে পাঠানোই ভালো, প্রকাশ আর গৌরীকেও আমি তৈরি হতে বলেছি

বলে তিনি যেমন এসেছিলেন আবার তেমনি বারবাড়ির দিকে চলে গেলেন।

.

হায় রে কপাল! তখনও নয়নতারা জানতো না যে যে বাড়ি থেকে তাকে একদিন চিরকালের মত চলে যেতে হবে এই-ই বুঝি তার সূত্রপাত। এই ফুলশয্যার রাতই বুঝি তার জীবনের এক অমোঘ সূচনা। নইলে অমন করে পাথরের গেলাসটা পায়ে লেগে ভেঙে গেলই বা কেন? অথচ এসব কথা যখন মা বলেছে তখন বিশ্বাসই করে নি সে। ভেবেছে মা’র যত সব মনের কুসংস্কার। কোথায় কত দূরে রইল তার মা, আর কোথায় চিরকালের মত বিচ্ছিন্ন হয়ে সে চলে এল নবাবগঞ্জে। আর এই নবাবগঞ্জেই হয়ত তাকে সারাজীবন কাটাতে হবে।

সারাজীবন এখানে কাটাবার কথাটা মনে হতেই কেমন যেন আতঙ্কে শিউরে উঠলো সে। কাল রাত থেকেই সে ভয়ে কাঁপছে। কীসের ভয়? তার তো এখানে ভয় পাবার কোনও কারণ নেই! তার শাশুড়ী মানুষটা তো ভালো। শ্বশুরও তো ভালো। আর…

আর সেই তার স্বামীর কথাটা ভাবতে গিয়েই যেন সব কিছু তার কাছে অস্পষ্ট হয়ে গেল! কে সে? কী রকম মানুষ! কী রকম স্বভাবচরিত্র সে মানুষটার! শুধু বিয়ের সময় হাতে তার হাতের ছোঁয়া লেগেছিল কিছুক্ষণ। কেষ্টনগরের সবাই-ই বলেছিল–ওরকম বর নাকি সাধারণত দেখা যায় না।

আসবার সময় নয়নতারা যখন খুব কাঁদছিল তখন মা নিজের আঁচল দিয়ে চোখ মুছিয়ে দিয়ে বলেছিল–কাঁদিস নে মা, তোর কীসের দুঃখু, তুই যেমন স্বামী পেয়েছিস অমন স্বামী ক’জনের আছে বল তো! কাঁদিস নে–

তা সত্যি, বিয়ের দিন বাপের বাড়িতে একে একে সবাই তাকে এই কথাই বলে গেছে। যাদের বিয়ে হয় নি, কিম্বা যাদের বিয়ে হয়েছে সবাই তার বরের রূপ দেখে হিংসে করেছে।

হঠাৎ গৌরী পিসী ভাতের থালা নিয়ে ঘরে ঢুকলো। বললো–এই নাও বউমা ভাত খেয়ে নাও

নয়নতারা অবাক হয়ে গেল। জিজ্ঞেস করলে–এত সকাল-সকাল যে ভাত দিচ্ছ পিসীমা? কটা বাজলো এখন?

গৌরী পিসী বললে–সকাল-সকাল খেয়ে নাও, তুমি আবার কেষ্টনগরে যাবে যে আজ

–কেষ্টনগরে? আজকে? কেন?

গৌরী পিসী বললে–তোমার শ্বশুরের ইচ্ছে যে তোমার বাবা-মার সঙ্গে তুমি একবার দেখা করে আসবে। তুমি নাকি আসবার সময় সেদিন খুব কেঁদেছিলে, তাই। মাকে দেখতে তোমার খুব ইচ্ছে করছে না?

নয়নতারা বললে–হ্যাঁ, খুব ইচ্ছে করছে পিসীমা। মা’র জন্যে খুব মন-কেমন করছে আমার। কিন্তু তোমরা কী করে তা জানতে পারলে? আমি তো তোমাদের কিছু বলি নি!

গৌরী পিসী বললে–আহা, মন কেমন করবে না? মা কি যেমন-তেমন জিনিস বউমা?

নয়নতারা বললে–জানো পিসীমা, আমি কালকে রাত্তিরে মাকে স্বপ্ন দেখেছি। মা যেন আমার বউভাতের দিনে এই নবাবগঞ্জে এসেছে, এসে আমাকে মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করছে। আমি জিজ্ঞেস করলুম-মা, তুমি যে খবর দিয়েছিলে আসবে না! তবে এলে কেন? শুনে মা কী বললে জানো? মা বললে–তোর বউভাতের দিনে আমি না এসে কি থাকতে পারি রে? তারপর হঠাৎ ঘুমটা ভেঙে গেল। চেয়ে দেখি আমি বিছানায় শুয়ে আছি, আমার চোখ দুটো জলে ভেসে গেছে। কখন কেঁদেছি মনেও নেই

গৌরী পিসী বললে–তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও বউমা, দেরি হয়ে যাবে আবার। আজকে কিন্তু মাছ নেই, খেতে পারবে তো?

–মাছ নেই কেন পিসীমা?

গৌরী পিসী বললে–আজকে তোমার মাছ খেতে নেই–

–কেন পিসীমা, আজকে কী?

গৌরী পিসী সেকথার উত্তর না দিয়ে বললে–তোমার জন্যে আর একটু দুধ এনে দিই বউমা–

খেতে খেতে নয়নতারা কেবল মার কথাই বলতে লাগলো। মা কেমন চমৎকার রান্না করে, মা কেমন সেলাই করে, মা কেমন কথা বলে। মার কথা বলবার লোক পেয়ে নয়নতারা যেন বেঁচে গেল।

গৌরী পিসী বললে–তোমার শাশুড়ীও খুব ভালো বউমা, তোমার শাশুড়ীর মত মানুষও হয় না–

নয়নতারা বললে–মাও আমাকে তাই বলেছে। বলেছে–এখন থেকে শাশুড়ীকেই মায়ের মত ভক্তি করবি–

গৌরী পিসী বললে–ও কটা ভাত দুধ দিয়ে খেয়ে নাও বউমা, আমি একটা সন্দেশ আনছি।

গৌরী পিসী বাইরে চলে গেল। কেষ্টনগরে যাওয়ার কথা ভাবতেই নয়নতারার সব দুঃখ যেন কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেল। আবার যেন নতুন করে বেঁচে উঠলো সে। আবার যেন সে নিজের সত্তা ফিরে পেলে। বেঁচে থেকে যে এত সুখ তা যেন সে এতদিন এমন করে আর কখনও উপলব্ধি করতে পারে নি। পাখিদের মত যদি পাখা থাকতো তার তাহলে বেশ উড়ে যাওয়া যেত। কেষ্টনগরে যেতে তাহলে আর তার এত দেরি হতো না।

হঠাৎ যেন বাইরে তার সেই মামাশ্বশুরের গলা শোনা গেল।

–হ্যাঁ গো গৌরী, বউমা হঠাৎ বাপের বাড়ি যাচ্ছে কেন গো? কী হয়েছে?

গৌরী পিসীর গলা শোনা গেল তারপর। গৌরী পিসী বললে–অত জোরে কথা বোল মামাবাবু, একটু আস্তে, বউমার কানে যাবে। বউমার কানে গেলে অনত্থ বাধবে–

–কেন, কী হয়েছে? বউমার কানে গেলে ক্ষতি কী?

গৌরী পিসী বললে–বউমার মা যে মারা গেছে–

–অ্যাঁ? মা মারা গেছে? সদার শাশুড়ী? কীসে মারা গেল? কখন খবর এল? আমি তো কিছুই টের পাই নি, আমাকে তো কেউ কিছু বলে নি–

গৌরী পিসী বিরক্ত হয়ে বলে উঠলো–আঃ, বলছি আস্তে! বউমা ঘরের ভেতরে রয়েছে, শুনতে পাবে যে–

কিন্তু ততক্ষণে যা হবার তা হয়ে গেছে। গৌরী পিসী ঘরে ঢুকতেই দেখলে বউমার চোখ দুটো কেমন বিহ্বল হয়ে শূন্যের দিকে চেয়ে রয়েছে। হয়ত এখুনি ঢলে পড়ে যাবে।

গৌরী পিসী তাড়াতাড়ি পাশে গিয়ে তাকে ধরে ফেললে। বললে–কী হলো বউমা, তোমার শরীর খারাপ হলো নাকি!

নয়নতারার মুখে যেন তখন কথা বলবারও শক্তি নেই। কোনও রকমে বলে উঠলো– আমার মা মারা গেছে? তোমরা তো আমাকে কিছু বলো নি পিসীমা…

বলতে বলতে নয়নতারা সেইখানে বসেই ভেঙে পড়লো।

.

সংসারে যার জীবনের যাত্রাপথের সূচনাটাই মৃত্যু দিয়ে অভিষিক্ত হলো তার শেষ পরিণতি যে কোথায় কেমন করে কোন্ চোরাবালিতে গিয়ে পূর্ণচ্ছেদ টানবে তা যেমন তার সৃষ্টিকর্তাও বলতে পারে না, তেমনি কোনও ইতিহাস-লেখকও বলতে পারে না। তবু তো সৃষ্টির কাজ ব্যাহত হয় না সৃষ্টিকর্তার, আর লেখককেও তাই লিখে যেতে হয়। কারণ বিন্দু বিন্দু রক্ত দিয়ে যেমন একজন মানুষ, তেমনি এক একটি মানুষ নিয়েই সমাজ দেশ ভূগোল আর ইতিহাস। যাকে সেই ইতিহাস সৃষ্টি করতে হয় তাকে কখনও বা মধুর আবার কখনও বা নিষ্ঠুর হতে হয়। কারো মনোরঞ্জন করার দায় তার নেই, আবার কারো মুখ চাওয়ার দায়িত্ব নিলেও তার চলে না। সে যে নিষ্ঠুর, নিরাসক্ত, নির্বিকার!

অন্তত নয়নতারার সেদিন সেই কথাই মনে হয়েছিল। কার বিরুদ্ধে অভিযোগ করবে সে? কার কাছে সে প্রতিকার প্রার্থনা করবে? মাকে সে দুদিন আগেও দেখেছে। দুদিন আগেও মা তাকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দিয়েছে। মা বলেছে–দেখিস মা, আসছে বেস্পতিবারেই আবার তোকে নিয়ে আসবো, বেয়াই মশাইকে উনি বলে দিয়েছেন–

বৃহস্পতিবার মার কাছে যাবার প্রতীক্ষাতেই সে ছিল। ভেবেছিল এটা এই শ্বশুরবাড়িটা তার সাময়িক আশ্রয়, কেষ্টনগরের বাড়িটার আশ্রয়ই তার শাশ্বত। সেখানে সে আবার ফিরে যাবে। আবার তার বাবা-মাকে ঘিরে তার জীবনের পরিক্রমা আগের মতই সুচারুভাবে চলবে।

কিন্তু হঠাৎ অদৃশ্য দেবতার কোন অমোঘ নির্দেশে তার সব কিছু এমন হঠাৎ বানচাল হয়ে গেল।

নয়নতারা মনে মনে ভাবতে চাইলে হয়ত সে যা শুনেছে তা ভুল। ভাবতে ভালো লাগলো যে আসলে তার মা আছে। হে ভগবান, তার ভাবনাটাই যেন সত্যি হয়। যেন সে কেষ্টনগরে গিয়ে মাকে দেখতে পায়। তাহলে মাকে গিয়ে সে বলবে–মা, আমি আর নবাবগঞ্জে যাবো না, আমি এবার এই কেষ্টনগরে তোমার কাছেই থাকবো–

মা তাকে হয়ত বলবে–না মা, ও কথা বলতে নেই, এখন তোমার বিয়ে হয়েছে, এখন থেকে স্বামীর ঘরই তোমার ঘর, স্বামীই তোমার আপন, স্বামীই তোমার সব–

আশ্চর্য! কে জানতো এই স্বামীই তার কাছে একদিন সব চেয়ে পর হয়ে যাবে, সব চেয়ে দূর হয়ে যাবে। একদিন যার হাতে নয়নতারাকে তুলে দিয়ে তার মা সব চেয়ে নিশ্চিত বোধ করেছিল সেই সদানন্দই তাকে এমন করে দূরে ঠেলে দেবে–এ কথা কি তারা-ই কোনও দিন কল্পনা করতে পেরেছিল!

কালীকান্ত ভট্টাচার্য মশাই জীবন আরম্ভ করেছিলেন বড় মহৎ আদর্শ নিয়ে। তাঁর আদর্শ ছিল ছেলে মানুষ করবার। শুধু একজন ছেলে নয়, হাজার হাজার ছেলে। আর শুধু ছেলেই নয়, ভেবেছিলেন ছেলে মেয়ে সবাইকে তিনি মানুষ করে যাবেন নিজের আদর্শের মত করে। তিনি বলতেন–জীবনে পাওয়াটাই বড় কথা নয় নিখিলেশ, পেয়ে যেমন অনেকের হারিয়ে যায়, তেমনি হারিয়েও আবার অনেকে অনেক কিছু পায়। তথাগত বুদ্ধদেব রাজার ঐশ্বর্য হারিয়ে সম্রাটের ঐশ্বর্য পেয়েছিলেন। তাকেই বলে সত্যিকারের পাওয়া। কিন্তু আমরা সবাই পেয়ে হারাই নিখিলেশ। আমরাই হলুম আসল লক্ষ্মীছাড়া। আমরা যা পাই তাও ধরে রাখতে পারি না, আবার যা পাই না তার জন্যেও আমাদের আক্ষেপ নেই। এই আমার জীবনটাই দেখ না–

বলে নিজের দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন। বলেন–আমি কিছুই হারাতে পারলুম না বলে জীবনে কিছুই পেলুম না–

শুধু নিখিলেশ নয়, মাস্টার মশাই-এর কথাগুলো আরো অনেক ছাত্র শুনতো। ছুটির দিন সবাই ভট্টাচার্যি মশাই-এর বাড়ি আসতো। কথা বলতে বলতে যদি অনেক বেলা হয়ে যেত তাঁর নয়নতারা হঠাৎ ঘরে এসে বলতো–বাবা, তুমি আজ চান করবে না, খাবে না?

ভট্টাচর্যি মশাই-এর এতক্ষণে যেন হুঁশ হতো। বলতেন–এই দেখ, আমাদের বেশ কথা হচ্ছিল, বেশ বিদ্যার জগতে বিচরণ করছিলুম, হঠাৎ অবিদ্যা এসে সব ভেস্তে দিল–

নয়নতারা অভিমান করে বলতো–বা রে, আমি বুঝি তোমার অবিদ্যা?

ভট্টাচার্যি মশাই নিজের ভুল বুঝে নয়নতারাকে জড়িয়ে ধরে আদর করতেন–এই দেখ, আমার মেয়ে ওমনি আবার রাগ করে বসলো–

মেয়েকে আদর করতে করতে বলতেন–তুমি অবিদ্যা হতে যাবে কেন মা, তুমি হলে মা আমার সরস্বতী। মা-সরস্বতী তুমি আমার! আমি বলছিলাম কল্পনা আর বাস্তবের কথা। আমরা সবাই বেশ বড় বড় বিষয় নিয়ে আলোচনা করছিলাম, হঠাৎ তুমি আমাদের বাস্তব জগতে ফিরিয়ে নিয়ে এলে

নয়নতারা বলতো–বা রে, আমি কী করবো, মা যে তোমাকে ডাকতে বললে–

ভট্টাচার্যি মশাই বলতেন—না না, তোমার মা ঠিকই করেছে মা, বাস্তবকে বাদ দিয়ে তো কল্পনা হয় না। কল্পনার শেকড় থাকে বাস্তবের মাটিতে। তা না থাকলে সে কল্পনারও কোনও দাম নেই, সে কল্পনা হলো ফানুস, ফানুস ফেটে গেলে সে-ফানুসের তাই আর কোনও দাম থাকে না

নয়নতারা কিন্তু বাবার সে-সব কথায় কান দিত না। সে বাবার ছাত্রদের দিকে চেয়ে বলতো–তোমরা হাঁ করে দাঁড়িয়ে দেখছো কী? তোমরা বাড়ি যাবে না? তোমাদের বাড়ি ঘর দোর নেই?

ছাত্রদের মধ্যে নিখিলেশ ছিল একটু স্পষ্টবক্তা।

নিখিলেশ বলতো–তা আজকে তুমিই আমদের খেতে দাও না–আমরা এখানেই দুটি খাই–

নয়নতারা বলতো–ইস, খাবে! তাহলে রান্না করবে কে? মা’র যে শরীর খারাপ, মা’র বুঝি রাঁধতে কষ্ট হয় না?

নিখিলেশ বলতো–কেন? তুমি রাঁধবে! তুমি আমাদের জন্যে একটু কষ্ট করতে পারো না?

নয়নতারাও কম যেত না। সে বলতো–তোমাদের জন্যে কেন আমি কষ্ট করতে যাবো বলো তো? তোমরা আমার কে?

ভট্টাচার্যি মশাই বলতেন–ছিঃ, ও কথা বলতে নেই, পৃথিবীতে কেউ কারো পর নয়, জানো মা। পৃথিবীর সব মানুষকে আপন করে নিতে হবে। যে তা পারে সে-ই সত্যিকারের মানুষ। হিন্দু, মুসলমান, খৃষ্টান, বৌদ্ধ, সবাইকে নিজের লোক মনে করবে মা–

নয়নতারা বলতো–বা রে বা, তুমি তো আমার বাবা, কিন্তু ওরা আমার কে?

ভট্টাচার্যি মশাই একটু ভেবে নিয়ে বলতেন–ওরা? ওরা তোমার ভাই-এর মত। আমি কি শুধু তোমার একলার বাবা? আমি যে সকলের। আমি যেমন তোমার কথা ভাবি, তেমনি ওদের কথাও তো আমাকে ভাবতে হয়। আমি যে ওদেরও মঙ্গল চাই–

বাড়ির ভেতরে মা বলতো–আমার কথা কে ভাবে তার ঠিক নেই, আমি যাচ্ছি পরের কথা ভাবতে! পরের কথা ভাবতে আমার বয়ে গেছে–

নয়নতারাকে নিজের পাশে শুইয়ে মা বলতো–ওঁর কথা ছেড়ে দে তুই, এ-সব বড় বড় কথা শুনতে ভালো, বলতে ভালো, কিন্তু ওতে তো আমার পেট ভরবে না!

যখন বাবা ছাত্রদের নিয়ে লেখাপড়ার চর্চা করতো মা নিজের সংসার সামলাতেই হিমসিম্ খেয়ে যেত। আর সেই সময় সব সময়ের সঙ্গী থাকতো নয়নতারা। নয়নতারা মার কাছে কাছে ঘুরতো সারাদিন।

মা বলতো–ও মা নয়ন, এই চাল ক’টা একটু বেছে দে তো—

মা’র কথায় একটা কুলো নিয়ে নয়নতারা চাল বাছতে বসতো। কিন্তু চাল বাছা শেষ হতে না হতেই মা আর একটা কাজের হুকুম করতো। বলতো–ওরে নয়ন, কোথায় গেলি, বড়িগুলো একটু রোদদুরে দিয়ে দে তো মা–

যতবার নয়নতারা বই নিয়ে পড়তে বসতো ততবার মা’র ফরমাস। একটানা-একটা ফরমাস লেগেই থাকতো মা’র। মার সঙ্গে নয়নতারার লেখাপড়ার যেন আড়ি ছিল। নয়নতারাকে পড়তে বসতে দেখলেই মা যত বাজে কাজ আবিষ্কার করে বসতো।

শেষকালে বিরক্ত হয়ে যেত নয়নতারা বলতো–আমি পারবো না তোমার কাজ করতে, আমাকে দেখলেই বুঝি তোমার কাজ পায়?

মা বলতো–এক হাতে কত কাজ করছি তা তুই দেখতে পাচ্ছিস না? আমি খেটে খেটে মরে যাই তা-ই তোরা সবাই চাস্?

নয়নতারা বলতো তা একটা ঝি রাখলেই পারো, ওই তো কল্যাণীদের বাড়িতে কেমন দিন-রাতের ঝি আছে, সে-ই সব কাজ করে–

মা বলতো–আমি তোর ভালোর জন্যেই বলছি রে। এখন যদি এ-সব কাজ না করিস তাহলে কোথায় কার বাড়িতে যাবি, সেখানে গিয়ে যে শাশুড়ীর কাছে তোকে বকুনি খেয়ে মরতে হবে। তখন শাশুড়ী আবার তোকে খোঁটা দেবে। বলবে–বাপের বাড়িতে মা কিছুই শেখায়নি মেয়েকে, একেবারে ঠুঁটো জগন্নাথ করে রেখে দিয়েছে।

তারপর মা নিজের মনেই বলতো–আমি যা বলি তোর ভালোর জন্যেই বলি রে! আমি মরে গেলে তখন বুঝবি, মা তোর ভালোর জন্যেই এত কথা বলতো–

তা শেষকালে যখন নবাবগঞ্জের সম্বন্ধটা এল তখন একেবারে দৌড়তে দৌড়তে মা তার ঘরে এসেছে। বললে–ওরে, তুই এবার জমিদারের বউ হবি, জানিস–

জমিদারের ছেলের বউ হওয়া যে কী জিনিস তা যদি মা তখন জানতো! কিন্তু শুধু মা কেন, নয়নতারা কি নিজেই সে কথা জানতো! বোধ হয় ভূ-ভারতে কেউই জানতো না। নইলে কোনও মেয়ের ফুলশয্যার দিনে এমন দুর্ঘটনা ঘটে? কারো পা লেগে শ্বেত পাথরের গেলাস এমন করে ভেঙে টুকরো-টুকরো হয়ে যায়?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *