আলো
ডেটাশিটগুলো সরিয়ে রেখে পিয়া যখন কেবিন থেকে বেরিয়ে এল, ততক্ষণে আলো বেশ কমে এসেছে। বোটের সামনের দিকে যাওয়ার পথে কানাইয়ের কেবিনের সামনে এসে একটু দাঁড়াল ও, বোঝার চেষ্টা করল ভেতর থেকে কোনও আওয়াজ আসছে কিনা। ওর দেওয়া ওষুধটা খেয়ে সারা দুপুর ঘুমিয়েছে কানাই, কিন্তু এখন মনে হল ঘুমটা ভেঙে গেছে। কেবিনের ভেতরে নড়াচড়ার শব্দ কানে এল পিয়ার। দরজায় টোকা মারার জন্যে ও একবার হাতটা তুলল, কিন্তু কী মনে হতে টোকাটা আর দিল না। আস্তে আস্তে ডেক পার হয়ে লঞ্চের সামনের দিকটায় গিয়ে দাঁড়াল।
সূর্য ডুবতে চলেছে। জোয়ারের জলে প্রায় তলিয়ে গেছে গর্জনতলা। অন্ধকার হয়ে আসা আকাশের গায়ে দ্বীপটাকে এখন ঝাপসা একটা দাগের মতো দেখতে লাগছে। সন্ধের মরা আলোয় মনে হচ্ছে দিনের শেষে পরম শান্তির ঘুমে আস্তে আস্তে তলিয়ে যাচ্ছে গর্জনতলা। কিন্তু হঠাৎ সবে মাত্র পিয়া গলুইটার কাছে উঠে দাঁড়াতে গেছে–ঝাপসা দ্বীপটার ওপর মিটমিট করে উঠল খুদে খুদে আলোর টিপ; মাত্র এক পলকের জন্যে। তারপরেই আবার অন্ধকার। পরমুহূর্তেই আবার জ্বলে উঠল আলোর বিন্দুগুলো, একসঙ্গে হাজার হাজার, হয়তো বা লক্ষ লক্ষ ছুঁচের ডগার মতো বিন্দু বিন্দু আলো। এত মৃদু, যে বোটের ওপর থেকে কোনওরকমে শুধু বোঝা যায়। জ্বলা-নেভার ছন্দে দৃষ্টি একটু অভ্যস্ত হয়ে আসতেই শেকড় আর ডালপালার আবছায়া একটা আদল ধরা পড়ল পিয়ার চোখে, গুঁড়ি গুঁড়ি আলোর দানায় ঢাকা।
তাড়াতাড়ি উলটোদিকে ফিরে পিয়া ছুটল কানাইয়ের কেবিনের দিকে। দরজায় ধাক্কা দিয়ে ডাকল, “জেগে আছেন? একটা জিনিস দেখে যান একবার। তাড়াতাড়ি আসুন।”
দরজাটা খুলতেই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে একটু পিছিয়ে গেল পিয়া। যাকে দেখতে পাবে আশা করছিল, ওর সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা যেন সে নয়, অন্য কেউ। মুখ আর শরীর থেকে ঘষে সাফ করা হয়ে গেছে সমস্ত ময়লা, পরনে হরেনের কাছ থেকে ধার করা একটা গেঞ্জি আর লুঙ্গি। কানাইয়ের চেহারার মধ্যে সবসময়ে যে একটা স্পষ্ট আত্মবিশ্বাসের ছাপ থাকে, সেটার কোনও চিহ্নও দেখা যাচ্ছে না। সব মিলিয়ে মানুষটাকে যেন চিনতেই অসুবিধা হচ্ছিল পিয়ার।
“কানাই, কী হয়েছে আপনার? আপনি ঠিক আছেন তো?”
“হ্যাঁ। ভালই আছি। একটু শুধু ক্লান্ত।”
“তা হলে আসুন আমার সঙ্গে। একটা জিনিস দেখাব।”
কানাইকে সঙ্গে করে বোটের সামনের দিকটায় নিয়ে গেল পিয়া। গর্জনতলার দিকে। ইশারা করে বলল, “ওই দেখুন।”
“কী দেখব?”
“অপেক্ষা করুন একটু।”
বলতে বলতেই হঠাৎ মিটমিট করে জ্বলে উঠল আলোর বিন্দুগুলো। “মাই গড!” বলে উঠল কানাই। “ওগুলো কী?”
“এমনি জোনাকি পোকা। একসঙ্গে তালে তালে জ্বলছে আর নিভছে,” জবাব দিল পিয়া। “এই ব্যাপারটার কথা আমি কোথায় যেন পড়েছি। সাধারণত নাকি ম্যানগ্রোভ জঙ্গলেই এটা দেখা যায়।”
“জীবনে কখনও এরকম দেখিনি আমি।”
“আমিও না,” পিয়া বলল।
মুগ্ধ হয়ে আলোর নাচ দেখতে লাগল পিয়া আর কানাই। বিন্দুগুলো আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠতে লাগল অন্ধকার ঘন হওয়ার সাথে সাথে। হঠাৎ কানাইয়ের চাপা গলা-খাঁকারির আওয়াজ কানে এল পিয়ার; মনে হল কিছু একটা বলার চেষ্টা করছে ও। খানিক পরে শেষ পর্যন্ত যখন বলল কথাটা, আশ্চর্য হয়ে গেল পিয়া। “শুনুন পিয়া,” কোনও ভূমিকা ছাড়াই শুরু করল কানাই, “একটা কথা আপনাকে বলতে চাইছিলাম–আমি ভাবছি কাল সকালেই ফিরে যাব।”
“ফিরে যাবেন? কোথায়?”
“লুসিবাড়ি, তারপর সেখান থেকে দিল্লি।”
“আচ্ছা!” পিয়া বিস্ময়ের ভান করল। এখন ও বুঝতে পারছিল, কানাই কী বলতে যাচ্ছে সেটা প্রথম থেকেই মনে মনে জানত ও। “এত তাড়াতাড়ি ফিরে যাবেন?”
“হ্যাঁ, কানাই বলল। “আমার আসলে অফিসে ফিরে যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। কালকের দিনটা গেলে এখানে আমার ন’ দিন হয়ে যাবে। ওদিকে সবাইকে আমি বলে এসেছি যে দিন দশেকের মধ্যেই ফিরব। দেরি হলে আবার অফিসের লোকজন সব চিন্তা করতে শুরু করবে। কালকে যদি ভোর ভোর রওয়ানা হয়ে যাই তা হলে পরশুই পৌঁছে যাব দিল্লি।”
কানাইয়ের গলা শুনে পিয়া বুঝতে পারছিল একটা কিছু কথা ও চেপে যাচ্ছে। “সেটাই আপনার ফেরত যাওয়ার একমাত্র কারণ? শুধু অফিসের জন্যে?”
“না,” শুকনো গলায় জবাব দিল কানাই। “আরেকটা কারণ হল, এখানে আমার থাকার আর কোনও প্রয়োজন নেই। মেসোর নোটবইটাও পড়া শেষ হয়ে গেছে। আর আপনারও যে খুব একটা কিছু কাজে আমি লাগছি এমনও নয়–আমার মনে হয় ট্রান্সলেটর ছাড়াও আপনি দিব্যি চালিয়ে নিতে পারবেন।”
“হ্যাঁ, আমার জন্যে আপনার থাকার সত্যিই কোনও প্রয়োজন নেই,” পিয়া বলল। “কিন্তু কিছু যদি না মনে করেন তা হলে একটা কথা জিজ্ঞেস করব? আজকে ওই দ্বীপে যা ঘটেছে তার সঙ্গে কি আপনার এই সিদ্ধান্তের কোনও সম্পর্ক আছে?”
জবাব দিতে খানিকক্ষণ সময় নিল কানাই। তারপর কিছুটা যেন অনিচ্ছার সঙ্গে বলল, “এসব আমার ঠিক পোষাবে না পিয়া। আজকে ওখানে যা হয়েছে তাতে আমি বুঝে গেছি। যে এ আমার জায়গা নয়।”
“ওখানে হয়েছিলটা কী আমাকে বলুন তো ঠিক করে। আপনি দ্বীপটাতে গিয়ে পৌঁছলেন কী করে?”
“ফকিরই বলেছিল একবার গিয়ে ঘুরে আসা যাক দ্বীপটা থেকে। আর আমিও ভাবলাম দেখেই আসি একবার। না যাওয়ার কী আছে? এই হল ব্যাপার।”
বিষয়টা নিয়ে যে কানাইয়ের কথা বলার খুব একটা ইচ্ছে নেই সেটা বোঝা গেলেও আবার প্রশ্ন করল পিয়া, “দোষটা কি তা হলে ফকিরের? ও কি ইচ্ছে করে আপনাকে ওখানে রেখে চলে এসেছিল?”
“না,” স্পষ্ট গলায় বলল কানাই। “আমিই আসলে কাদায় পড়ে গিয়ে মেজাজ হারিয়ে ফেলেছিলাম। ও আমাকে সাহায্যই করতে চেয়েছিল–কিন্তু আমিই ওকে গালাগাল করে বলেছিলাম চলে যেতে। ওকে দোষ দেওয়াটা ঠিক না।” কথাটা শেষ করেই ঠোঁটটা একটু ফাঁক করল কানাই, যেন পিয়াকে বলতে চায় এই নিয়ে আর কোনও আলোচনা করতে রাজি নয় ও।
“আপনি তো মনে হচ্ছে মন ঠিকই করে ফেলেছেন,” পিয়া বলল। “তা হলে আর আটকানোর চেষ্টা করব না আমি। ক’টা নাগাদ রওয়ানা হওয়ার প্ল্যান করছেন?”
“ভোরবেলা,” কানাই বলল। “হরেনের সঙ্গে কথা বলে নেব। ঠিক সময়ে যদি বেরিয়ে যেতে পারি তা হলে আমাকে লুসিবাড়িতে নামিয়ে দিয়ে ও সন্ধে নাগাদ ফিরে আসতে পারবে এখানে। আপনি তো বোধহয় এমনিতেই সারাটা দিন ফকিরের নৌকোতে ঘুরে ঘুরে কাটাবেন।”
“সেরকমই ইচ্ছে,” বলল পিয়া।
“তা হলে তো দিনের বেলা বোটটা আপনার কোনও কাজে লাগবে না, কী বলেন? কিছু অসুবিধা নিশ্চয়ই হবে না।”
কানাইয়ের সঙ্গে এই ক’দিন যেটুকু সময় কাটিয়েছে সে কথা মনে পড়তে একটু খারাপ লাগল পিয়ার। “না। অসুবিধা হবে না,” বলল ও। “তবে আপনার সঙ্গে আড্ডাটা মিস করব। এই ক’দিন সময়টা বেশ ভাল কেটেছে আমার। খুব এনজয় করেছি।”
“আমারও আপনার সঙ্গে সময়টা ভাল কেটেছে, পিয়া।” কথাটা বলে নিজেকে খানিকটা গুছিয়ে নেওয়ার জন্যে যেন একটু চুপ করে গেল কানাই। “আসলে, আমি আশা করেছিলাম–”
“কী?”
“আমি ভেবেছিলাম আপনিও চলে আসবেন… মানে, দিল্লিতে।”
“দিল্লিতে?” কথাটা পিয়ার এত অদ্ভুত লাগল যে একটা হাসির দমক গুরগুরিয়ে উঠে এল পেটের ভেতর থেকে।
“কথাটা হাস্যকর মনে হচ্ছে আপনার?” জিজ্ঞেস করল কানাই।
“সরি কানাই,” তাড়াতাড়ি বলল পিয়া। “আসলে এরকম কিছু একটা আপনি বলবেন আমি আশাই করতে পারিনি। এখান থেকে কত দূরে দিল্লি আর আমার তো এখানে এখন অনেক কাজ।”
“সে আমি জানি,” বলল কানাই। “আমি তো আর আপনাকে এক্ষুনি যেতে বলছিলাম না। ভেবেছিলাম আপনার সার্ভে-টার্ভে শেষ হয়ে গেলে তারপর যদি আসেন।”
কানাইয়ের কথার সুরটা শুনে একটু অস্বস্তি লাগল পিয়ার। মনে পড়ল, প্রথম যখন দেখা হয়েছিল ওর সঙ্গে, ট্রেনে–কী আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে প্রত্যেকটা কথা বলছিল, চলাফেরায় কেমন একটা কর্তৃত্বের ভাব ছিল। সেই স্মৃতির সঙ্গে ওর সামনে দাঁড়িয়ে থাকা আমতা আমতা করে কথা বলা, দ্বিধাগ্রস্ত এই মানুষটাকে কিছুতেই মেলানো যাচ্ছিল না। ফিরে দাঁড়িয়ে গর্জনতলার দিকে তাকাল পিয়া। দেখল দিগন্ত থেকে সেখানে আস্তে আস্তে উঠে আসছে চাঁদ।
“আপনি ঠিক কী চাইছেন একটু পরিষ্কার করে বলুন তো, কানাইকে জিজ্ঞেস করল পিয়া। “আমাকে দিল্লিতে কেন যেতে বলছেন?”
দু’ চোখের মাঝখানে নাকের হাড়টাকে দু’আঙুলে চেপে ধরল কানাই। যেন ঠিক ঠিক
শব্দগুলো খুঁজে পেতে সুবিধে হবে তাতে। “আমি আপনাকে মিথ্যে কথা বলব না পিয়া ঠিক কী যে বলতে চাইছি সেটা আমি নিজেই জানি না। এইটুকু শুধু বলতে পারি, যে আমি আবার আপনাকে দেখতে চাই। আর আপনি আমাকে আমার নিজের জায়গায় দেখেন, যেখানে’আমি থাকি সেখানে দেখেন, সেটাও চাই।”
দিল্লিতে কানাইয়ের জীবনের একটা ছবি মনে মনে ভাবার চেষ্টা করল পিয়া। কল্পনায় দেখতে পেল বিশাল একটা বাড়ি, নানারকম কাজের লোক সেখানে একজন রান্নার লোক, একজন ড্রাইভার, একজন ফাইফরমাশ খাটার লোক। মনে হল নিজের জীবন থেকে বহু দূরের কোনও ছবি দেখছে, টিভির বা সিনেমার কোনও দৃশ্যের মতো। কল্পনার সেই ছবিকে সিরিয়াসলি নেওয়াটা ওর পক্ষে অসম্ভব। আর এটাও পিয়া জানে, যে মনের এই ভাব লুকোনোটাও ওর পক্ষে সম্ভব নয়।
হাত বাড়িয়ে কানাইয়ের একটা হাত ছুঁল পিয়া। বলল, “শুনুন কানাই, আপনার কথা শুনলাম আমি। খুব ভাল লাগল, বিশ্বাস করুন। যা যা আপনি করেছেন আমার জন্যে, তাতে ভীষণ খুশি হয়েছি। আমি মন থেকে চাই আপনি ভাল থাকুন, আপনার ভাল থোক। দেখবেন, একদিন ঠিক আপনার মনের মতো কোনও মেয়েকে খুঁজে পাবেন আপনি। কিন্তু আমি সে মেয়ে নই।”
হাল ছেড়ে দেওয়ার ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল কানাই। বোঝা গেল জবাবটা অপ্রত্যাশিত ছিল, না ওর কাছে। বলল, “কত কী যে আপনাকে বলতে চাই পিয়া। মনে হয় এত কিছু না চাইলে হয়তো বলাটা অনেক সহজ হত। ময়না যেরকম বলে।”
কানাই নামটা উচ্চারণ করতেই যেন একটা ধাক্কা খেল পিয়া। “কী বলে?”
“বলে যে, কথা হল হাওয়ার মতো, শুধু জলের ওপরটায় ঢেউ তোলে, আসল নদীটা বয়ে যায় নীচে তাকে দেখাও যায় না, শোনাও যায় না।”
“তার মানে কী?”
“ফকিরের ব্যাপারে কথা বলতে বলতেই বলেছিল ময়না এটা,” কানাই বলল।
“মানে?”
“ফকির ওর সব, বুঝলেন–মানে, আপনার যদিও সেরকম মনে নাও হতে পারে, কিন্তু ও যেন কীরকম একটা আতঙ্কের মধ্যে রয়েছে, ভাবছে ফকির ওকে ছেড়ে চলে যাবে।”
“কিন্তু ফকির সেরকম করবে কেন?”
গলা নিচু করল কানাই, “হয়তো আপনার জন্যে।”
“অদ্ভুত কথা বলছেন আপনি কানাই,” প্রতিবাদ করল পিয়া। “এরকম মনে হওয়ার তো কোনও কারণ নেই। ময়নারও না, অন্য কারওরই না।”
“কোনও কারণই কি নেই?”
পিয়া বুঝতে পারছিল আস্তে আস্তে মেজাজটা খারাপ হতে শুরু করেছে ওর। গলার স্বর যতটা সম্ভব শান্ত রেখে বলল, “ঠিক কী বলতে চাইছেন আপনি, কানাই?”
“ময়না কী মনে করে সেটাই বলছি,”নরম সুরে জবাব দিল কানাই। “ওর বিশ্বাস, আপনি ফকিরের প্রেমে পড়েছেন।”
“আর আপনি?” তীক্ষ্ণ গলায় জিজ্ঞেস করল পিয়া। “আপনারও কি একই ধারণা?”
“তা হলে বলেই ফেলি, প্রেমে পড়েছেন নাকি?”
ধারালো, প্রায় কর্কশ গলায় পিয়া বলল, “কথাটা কি আপনি ওর হয়ে জানতে চাইছেন কানাই, না আপনার নিজের প্রয়োজনে জিজ্ঞেস করছেন?”
“কিছু কি এসে যায় তাতে?”
“সে আমি জানি না, কানাই। আপনাকে কী যে বলব আমি জানি না। ওকেও বা কী বলব। তাও বুঝতে পারছি না। আপনার কোনও প্রশ্নেরই উত্তর আমার জানা নেই।” হাত দিয়ে দুই কান চেপে ধরল পিয়া, যেন বাইরে সরিয়ে রাখতে চায় কানাইয়ের গলার আওয়াজ। “শুনুন, আমি দুঃখিত, এই নিয়ে আর একটা কথাও বলতে চাই না আমি।”
চাঁদ উঠে এসেছে গর্জনতলার ঠিক ওপরে। ফটফটে জ্যোৎস্নায় স্নান দেখাচ্ছে আলোর বিন্দুগুলো–আর চোখেই পড়ে না প্রায়। আবছা হয়ে আসা সেই আলোর টিপের দিকে চেয়েছিল পিয়া, মনে করতে চেষ্টা করছিল, মাত্র কয়েক মিনিট আগেও কেমন মোহময় মনে হচ্ছিল সেগুলোকে। “কী সুন্দর লাগছিল, তাই না?”
জবাবটা যখন এল, কানাইয়ের গলাও তখন পিয়ার মতোই আড়ষ্ট। “আমার মেসো থাকলে হয়তো বলত এ হল ভাটির দেশের জাদু।”
.
খোঁজ
ভোরবেলা কেবিন থেকে বেরিয়ে পিয়া দেখল ঘন কুয়াশা যেন মুড়ে রেখেছে মেঘাকে। কেবিনের সামনে থেকে বোটের দুই প্রান্ত দেখা যাচ্ছে না। ডেকের সামনের দিকে এগোতে গিয়ে আরেকটু হলেই কানাইয়ের গায়ের ওপর হুড়মুড়িয়ে পড়ে যাচ্ছিল ও। একটা চেয়ার নিয়ে বসেছিল কানাই, হাঁটুর ওপরে নোটবই, আর পাশে একটা লণ্ঠন।
“উঠে পড়েছেন এর মধ্যেই?”
“হ্যাঁ।” ক্লান্তভাবে হাসল কানাই। “ঘণ্টা কয়েক আগেই উঠে পড়েছি।”
“সে কী? কেন?”
“আসলে একটা কাজ করছিলাম,” বলল কানাই।
“এত ভোরবেলা?” বিস্ময় গোপন করতে পারল না পিয়া। “এই ভোর রাত্তিরে বিছানা ছেড়ে এসে কাজ করছেন–নিশ্চয়ই খুব ইম্পর্ট্যান্ট কিছু?”
“ইম্পর্ট্যান্ট,” জবাব দিল কানাই। “কাজটা আসলে আপনারই জন্যে। একটা উপহার। চলে যাওয়ার আগে এটা শেষ করে আপনাকে দিয়ে যেতে চাইছিলাম।”
“আমার জন্যে? কী উপহার?” জিজ্ঞেস করল পিয়া।
মাথা নেড়ে হাসল কানাই। মুখটা একটু বাঁকিয়ে বলল, “শেষ হলেই দেখতে পাবেন।”
“শেষ হয়নি এখনও?”
“না। তবে আমি যাওয়ার আগে শেষ হয়ে যাবে,” বলল কানাই।
“ঠিক আছে। পরে কথা হবে তা হলে।” জামাকাপড় ছাড়ার জন্যে কেবিনের দিকে এগোল পিয়া। তারপর দাঁত-টাত মেজে কলা আর ওভালটিন দিয়ে হালকা ব্রেকফাস্ট সেরে যখন আবার বেরিয়ে এল, ততক্ষণে হরেন উঠে পড়ে সারেং-এর ঘরে গিয়ে বসেছে। ফকিরও চলে গেছে ওর ডিঙিতে, নোঙর তোলার তোড়জোড় করছে। হাত বাড়িয়ে ফকিরকে পিঠব্যাগটা দিয়ে দিল পিয়া। ব্যাগের মধ্যে রয়েছে ওর যন্ত্রপাতি, দুটো জলের বোতল আর কয়েকটা নিউট্রিশন বার। তারপর একবার গেল সামনের ডেকে। কানাই তখনও বসে রয়েছে সেই চেয়ারে।
“হয়েছে শেষ?” জিজ্ঞেস করল পিয়া।
“হ্যাঁ।” উঠে দাঁড়িয়ে মোটা ব্রাউনপেপারের একটা বড় এনভেলপ পিয়ার হাতে দিল কানাই। “এই নিন।”
খামটা কানাইয়ের হাত থেকে নিয়ে উলটে পালটে দেখল পিয়া। “এখনও বলবেন না এটার মধ্যে কী আছে?”
“সেটা একটা সারপ্রাইজ,” চোখ নামিয়ে ডেকের দিকে তাকাল কানাই। পা ঘষল তক্তায়। “আর এটার ব্যাপারে আপনার মতামত যদি আমাকে জানাতে চান–খামের। পেছনে আমার ঠিকানা লেখা আছে। আশাকরি লিখবেন।”
“নিশ্চয়ই লিখব কানাই,” বলল পিয়া। “আমরা তো বন্ধু, তাই না?”
“আশা করি।”
পেছন থেকে হরেনের চোখ ওর পিঠটা প্রায় ফুটো করে দিচ্ছে, বুঝতে পারছিল পিয়া। তা না হলে কানাইয়ের গালে আলতো করে একটা চুমু খেতে ইচ্ছে করছিল ওর। বলল, “ভাল থাকুন।”
“আপনিও ভাল থাকুন পিয়া। গুড লাক।”
.
ঘন কুয়াশার ভারী চাদর ঝুলে আছে জলের ওপর। স্রোতের গতি যেন ধীর হয়ে গেছে তার ওজনে। ফকির জলে বৈঠা ডোবাতেই তরতর করে এগিয়ে গেল ডিঙি, গলুইয়ের সামনে কুয়াশা যেন ফেনিয়ে উঠল উথলানো দুধের মতো। পঁাড়ের কয়েকটা টানেই দৃষ্টির আড়ালে • চলে গেল মেঘা, কয়েক মিনিটের মধ্যেই মিলিয়ে গেল কুয়াশার ভেতর।
ডিঙি এগোতে লাগল ভাটির দিকে। কানাইয়ের দেওয়া খামটার দিকে একবার তাকিয়ে দেখল পিয়া। মাপ দেখেই বোঝা যাচ্ছে বেশ কয়েক পাতা কাগজ রয়েছে ভেতরে। পিয়া ঠিক করল এক্ষুনি খুলবে না খামটা। পিঠব্যাগটা নিয়ে ওটাকে তার মধ্যে রেখে পজিশনিং মনিটরটা বের করল। ডিঙিটা ঠিক কোন জায়গায় রয়েছে সেটা বুঝে নিয়ে তারপর কুয়াশাজড়ানো স্বপ্নিল শান্তির মধ্যে গা ভাসিয়ে দিল।
গত কয়েকদিন ধরেই ভটভটির কাপুনি আর ডিজেল ইঞ্জিনের ধকধক শব্দে কেমন অভ্যস্ত হয়ে গেছে শরীর–সে তুলনায় এই শব্দহীন নৌকোযাত্রা অনেক আরামের। নিজের জায়গায় বসে ভাল করে ডিঙিটার দিকে চেয়ে দেখল পিয়া। খসখসে কাঠ আর ছাই-রঙা ছইয়ের দিকে তাকিয়ে মনে হল যেন এই প্রথম ও মন দিয়ে দেখছে ওগুলোকে। খোলের ওপরে পাতা প্লাইউডের তক্তায় আঙুল বোলাল। কাঠের ওপর ছাপা ঝাপসা হয়ে আসা লেখাগুলো পড়ার চেষ্টা করল; মার্কিনি ডাকবিভাগের থলি কেটে তৈরি বুটিওয়ালা প্লাস্টিক শিটটার দিকে তাকিয়ে দেখল–মনে পড়ল প্লাস্টিকটা দেখে প্রথম যখন চিনতে পেরেছিল, কী ভীষণ অবাক লেগেছিল তখন। জলে ডুবতে ডুবতে বেঁচে যাওয়ার পর যখন এই ডিঙির তক্তার ওপর শুয়েছিল পিয়া, এই সাধারণ ছোটখাটো জিনিসগুলিকে কেমন অদ্ভুত মায়াময় বলে মনে হয়েছিল, কোনও জাদুকরের ভোজবাজির মতো। বাতিলের দল থেকে তুলে আনা এইসব টুকিটাকিগুলোকে সেদিনকার চোখে দেখতে দেখতে পিয়ার মনে হল, এই নৌকোটা নয়, আসলে ওর নিজের চোখই সেদিন জাদুকরি মায়ার সোনার কাঠি ছুঁইয়ে দিয়েছিল এদের গায়ে। এখন কিন্তু জিনিসগুলোকে ওরকম মায়াময় লাগছে না আর, মনে হচ্ছে খুবই সাধারণ সব টুকিটাকি, বহু পরিচিত ঘরোয়া আসবাবের মতো, স্বস্তিকর।
মন থেকে দিবাস্বপ্নের ভাবটা দূর করার জন্য মাথাটাকে একবার ঝাঁকিয়ে নিল পিয়া। উবু হয়ে উঠে বসে ইশারায় একজোড়া বৈঠা চেয়ে নিল ফকিরের কাছ থেকে। ডিঙিটাকে ফকির কোথায় নিয়ে যাচ্ছে ঠিক বুঝতে পারছিল না, তবে আন্দাজ করল ডলফিনরা যেদিক দিয়ে খাবারের খোঁজে যায় সেইরকমই একটা পথের দিকে ওরা চলেছে এখন। জোয়ার পুরো হয়েছে প্রায় ঘণ্টাখানেক হল, ডলফিনগুলো গর্জনতলার দহে এখনও আসেনি। ঠিক কোন জায়গায় ওদের দেখা যাবে ফকির মনে হল সেটা জানে।
নৌকো এখন স্রোতের অনুকুলে চলেছে। দু’জোড়া বৈঠায় জল কেটে তরতর করে এগোচ্ছে সামনে। খানিকক্ষণ পরেই ফকির ইশারায় পিয়াকে জানাল যে গন্তব্যে পৌঁছে গেছে ওরা। দাঁড় তুলে নিয়ে মিনিট কয়েক ডিঙিটাকে বয়ে যেতে দিল ফকির, তারপর একপাশে ঝুঁকে নোঙরটা ছুঁড়ে ফেলল নদীতে। দড়িটাকে হাত দিয়ে আস্তে আস্তে ছেড়ে দিল জলের মধ্যে।
কুয়াশা পাতলা হয়ে এসেছে। পিয়া লক্ষ করল ডিঙিটাকে ফকির এমন একটা জায়গায় এনে পঁড় করিয়েছে যেখান থেকে একটা বড় খাড়ির পুরো মুখটা চোখে পড়ে। বেশ কয়েকবার সেদিকে ইশারা করল ফকির, যেন বোঝাতে চাইল শিগগিরই ওই পথ দিয়ে ঢুকে আসবে ডলফিনগুলো। দূরবিন চোখে লাগানোর আগে জিপিএস-এ আরেকবার জায়গাটার অবস্থান দেখে নিল পিয়া। দেখল গর্জনতলার কাছে দাঁড় করানো মেঘার থেকে প্রায় আট কিলোমিটার দূরে চলে এসেছে ওরা।
শুরুতে ফকির যেন খানিকটা গা-ছাড়া ভাবে তাকিয়েছিল খাড়িটার দিকে, প্রায় হেলাফেলার ভাব নিয়ে যেন ও নিশ্চিত জানে ওইদিক থেকেই আসবে ডলফিনগুলো। কিন্তু প্রায় দু’ঘণ্টা পেরিয়ে যাওয়ার পরও যখন একটা পাখনাও চোখে পড়ল না, একটু যেন দ্বিধায় পড়ে গেল ও। আস্তে আস্তে পালটাতে শুরু করল ওর হাবভাব, আত্মবিশ্বাস যেন চিড় খেয়ে গেল একটু, মুখেচোখে কেমন একটা ভ্যাবাচ্যাকা ভাব।
আরও ঘণ্টা দুয়েক ওই একই জায়গায় অপেক্ষা করল ওরা। দিন পরিষ্কার, বহুদূর পর্যন্ত চোখে পড়ছে, কিন্তু ডলফিনের কোনও চিহ্নই দেখা যাচ্ছে না। এর মধ্যে ভাটাও পড়ে গেছে, সূর্য উঠতে শুরু করেছে মাঝ আকাশের দিকে, চড়চড় করে বেড়ে উঠছে রোদ। পিয়ার জামাটা ঘামে একেবারে চুপচুপে হয়ে গেছে। পিয়া খেয়াল করে দেখল ও এখানে আসার পর একদিনও এত সকাল সকাল এতটা গরম পড়েনি।
দুপুরের একটু পরে, জল তখন অনেকটা নেমে গেছে, ফকির নোঙর তুলে ফেলল। যেন বোঝাতে চাইছে এবার এ জায়গা থেকে যেতে হবে। প্রথমটায় পিয়ার মনে হল হাল ছেড়ে দিয়ে আবার গর্জনতলার দিকেই ফিরে যেতে চাইছে ও। কিন্তু পিয়া যখন বৈঠার জন্য হাত বাড়াল, মাথা নাড়ল ফকির। খাঁড়ির যে মুখটার দিকে ওরা সারা সকাল ধরে নজর রেখেছে, সেইদিকে ইঙ্গিত করে দেখাল। দূরবিন নিয়ে পিয়াকে সজাগ থাকতে বলল ইশারায়। ডিঙি ঘুরিয়ে নিয়ে এবার খাড়িটার ভেতর ঢুকে পড়ল ফকির। কয়েকশো মিটার যাওয়ার পর আবার নৌকোর মুখ ঘুরিয়ে ঢুকল একটা সুতিখালের মধ্যে।
প্রায় ঘন্টাখানেক এভাবে এই খাল ওই খাল ধরে চলার পর একটা জায়গায় এসে ডিঙি থামাল ফকির। সামনে জলের ওপর চোখ বুলিয়ে নিল একবার–ডলফিনের কোনও চিহ্নই নেই। অধৈর্য হয়ে টাকরায় একটা শব্দ তুলে আবার বৈঠা হাতে নিল ফকির, অন্য আরেকদিকে ঘুরিয়ে নিল নৌকোটাকে।
ডিঙি চলতে চলতে পিয়া আর একবার ওর জিপিএস মনিটরটা বের করে রিডিং নিল, দেখল গর্জনতলা থেকে ক্রমশ আরও দূরে সরে যাচ্ছে ওরা। সকাল থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত পনেরো কিলোমিটারেরও বেশি চলে এসেছে, যদিও সোজা রাস্তায় আদৌ নয়: যে পথ বরাবর ওরা এসেছে, সেটাকে পুরনো মাফলার থেকে খুলে নেওয়া উলের সুতোর মতো দেখাচ্ছে মনিটরের পর্দায়।
বাতাস একেবারে স্থির, যেন ভারী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে; নদীর জল কাঁচের মতো মসৃণ, হাওয়ার এতটুকু দাগ নেই তার ওপর। ঘামে একেবারে নেয়ে গেছে ফকির। সেই ভ্যাবাচ্যাকা-খাওয়া ভাবটার জায়গায় এখন একটা উদ্বেগের ছাপ ওর মুখে। সাত ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে ঘোরাঘুরির পরও কিছুই চোখে পড়েনি এখনও। পিয়া ইশারা করে ফকিরকে বলল একটু থেমে খানিকটা বিশ্রাম নিয়ে নিতে, কিন্তু কথাটাকে ও কোনও পাত্তাই দিল না। প্রাণপণে যেন নদী-খাঁড়ির গোলকধাঁধার আরও গভীরে ঢুকে যাওয়ার জন্য চেষ্টা করে যেতে লাগল।
* * *
লুসিবাড়িতে ফেরার সময় প্রথমটায় বেশ খানিকক্ষণ যে পথ দিয়ে ওদের যেতে হল সেদিকটায় মানুষের যাতায়াত বিশেষ নেই। গর্জনতলা ছাড়ার পর কয়েক ঘণ্টা পর্যন্ত তাই ছোট বড় কোনও নৌকোই চোখে পড়েনি। কিন্তু তারপরে ভটভটিটা একটা সাগরমুখো নদীর কাছাকাছি এসে পড়তেই দৃশ্যটা একেবারে পালটে গেল। নদীর নাম জাহাজফোড়ন। তার ওপর থিকথিক করছে নানা মাপের নৌকো, ভটভটি আর লঞ্চ। নদীর প্রস্থটা মেঘার মুখের সঙ্গে সমকোণে থাকায় বেশ অনেকটা দূর থেকেও অগুন্তি নৌকো চোখে পড়ছিল জলের ওপর। দৃশ্যটার মধ্যে এমনিতে অস্বাভাবিক কিছু নেই, শুধু একটা ব্যাপার ছাড়া–সবগুলি নৌকোই চলেছে একই পথে–সাগর থেকে দূরে, মূল স্থলভূমির দিকে।
রাত্তিরটা পুরোটাই প্রায় জেগে কেটেছে, তাই গর্জনতলা ছেড়ে আসার খানিকক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়েছিল কানাই। ঘুমটা ভেঙে গেল হরেনের গলার আওয়াজে। নীচের ডেক থেকে চেঁচিয়ে নাতিকে ডাকছে হরেন।
বাঙ্কের ওপর উঠে বসল কানাই। জামাকাপড় বিছানার চাদর সব একেবারে ভিজে গেছে। ঘামে। ভোরবেলা যখন শিরশিরে একটা বাতাস বইছিল তখন কেবিনের দরজাটা বন্ধ করে দিয়েছিল ও। দুপুর হতে এখনও কয়েক ঘণ্টা দেরি আছে, কিন্তু এর মধ্যেই কেবিনের দেয়াল-টেয়াল সব তেতে উঠেছে। বেরিয়ে এসে কানাই দেখল বোটের মাথার কাছে দাঁড়িয়ে সামনের চওড়া নদীর দিকে চেয়ে আছে হরেন, আর ওপরে সারেং-এর ঘরে চাকা ধরে বসে আছে নগেন।
“কী ব্যাপার হরেনদা?” ডেকের সামনেটায় এগিয়ে গেল কানাই। “কী দেখছেন?”
“দেখুন ওই দিকে,” হাত দিয়ে সামনে ইশারা করে বলল হরেন।
চোখের ওপর হাত আড়াল করে সামনে তাকাল কানাই। জলের দেশের রাহান-সাহানে অনভ্যস্ত ওর চোখেও নৌকোগুলোর চলনটা যেন কেমন বেখাপ্পা মনে হল। কিন্তু খটকাটা কোথায় লাগছে সেটা ও ঠিক বুঝে উঠতে পারল না। “ওদিকে তো অনেকগুলো নৌকো দেখতে পাচ্ছি শুধু।”
“সবগুলো একইদিকে যাচ্ছে সেটা দেখতে পাচ্ছেন না?” একটু রুক্ষ শোনাল হরেনের গলা। “যে যার গাঁয়ে ফিরে যাচ্ছে সবাই।”
ঘড়ির দিকে একপলক তাকিয়ে কানাই দেখল সবেমাত্র দশটা বেজেছে। হঠাৎ ওর খেয়াল হল এত সকাল সকাল তো জেলেদের মাছ নিয়ে ঘরে ফেরার কথা নয়। “এত তাড়াতাড়ি কেন ফিরে আসছে ওরা?” জিজ্ঞেস করল কানাই। “এখনও কি ফেরার সময় হয়েছে?”
“না,” হরেন বলল। “সন্ধে নামার আগে জেলেরা এভাবে ফেরে না।”
“তা হলে?”
“তা হলে একটাই কারণ হতে পারে বছরের এই সময়টায়।”
“কী কারণ?”
ঠোঁট বাঁকাল হরেন। ওর বয়স্ক মুখের জটিল ভাজের আড়ালে যেন হারিয়ে গেল চোখদুটো। “দেখতে পাবেন শিগগিরই।” মুখ ঘুরিয়ে সারেং-এর ঘরের দিকে স্টিয়ারিং ধরতে চলে গেল হরেন।
নদীটা পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছতে আরও মিনিট দশেক লাগল। খানিকটা যাওয়ার পর একটা বাঁক ঘুরে রায়মঙ্গলে এসে ইঞ্জিনটা প্রায় বন্ধ করে দিল হরেন। আস্তে আস্তে নিশ্চল হয়ে এল মেঘা। তারপর নগেনের হাতে স্টিয়ারিং দিয়ে হরেন চলে গেল বোটের পেছন দিকটায়। একটা মাছ-ধরা নৌকো কাছাকাছি আসার জন্যে অপেক্ষা করতে লাগল।
খানিক বাদেই একঝক ডিঙি এসে জড়ো হল বোটটার পাশে। কানে এল চিৎকার করে মাঝিদের সঙ্গে কথাবার্তা বলছে হরেন। তারপর দ্রুতপায়ে ও ফিরে গেল সারেং-এর ঘরে। মুখটা গম্ভীর, ভুরু দুটো কুঁচকে রয়েছে। বিড়বিড় করে নগেনকে কী যেন বলতেই একদৌড়ে নীচে নেমে গিয়ে ইঞ্জিন চালু করে দিল নগেন। হরেন স্টিয়ারিং ধরে বসল।
হরেনের মুখে ছায়া নেমে আসতে দেখে কানাইয়ের মনের মধ্যে কেমন একটা অজানা আশঙ্কার কাটা খচখচ করতে লাগল। জিজ্ঞেস করল, “ব্যাপারটা কী হরেনা? কিছু জানা গেল?”
“যা ভেবেছিলাম তাই। তা ছাড়া আর হবেটাই বা কী এই সময়ে?” একটু রূঢ় শোনাল হরেনের গলাটা।
ঝড় আসছে, জানাল হরেন। দিল্লির হাওয়া অফিস থেকে নাকি আগেরদিনই সতর্কবার্তা দিয়েছে। এমনকী সাইক্লোন পর্যন্ত হতে পারে। ভোর থেকে কোস্টগার্ডের বোট সাগরে ঘুরে ঘুরে সমস্ত মাছ-ধরা নৌকোগুলোকে ফেরত পাঠিয়ে দিচ্ছে। সেইজন্যেই সব ফিরে আসছে একসঙ্গে।
“কিন্তু তাহলে–” কানাইয়ের মাথায় প্রথমেই যে চিন্তাটা এল সেটা হল ফকির আর পিয়ার এখন কী হবে? ওরা তো গর্জনতলায় রয়ে গেছে।
প্রশ্নটার মাঝখানেই ওকে থামিয়ে দিল হরেন। “চিন্তার কিছু নেই। ঝড় কাল দুপুরের আগে আসছে না। মাঝে অনেকটা সময় আছে। আমরা গর্জনতলায় গিয়ে ওদের জন্যে অপেক্ষা করব। এমনকী ওরা যদি সন্ধে পর্যন্তও না ফেরে তাতেও ভয়ের কিছু নেই। কাল খুব ভোরবেলা যদি ওখান থেকে রওয়ানা হয়ে যেতে পারি তা হলেও ঝড় আসার আগে আমরা লুসিবাড়িতে পৌঁছে যাব।”
ধকধক আওয়াজ উঠল ইঞ্জিনে। দু’ কাঁধের পেশি ফুলিয়ে স্টিয়ারিং ঘোরাল হরেন। চুলের কাটার মতো একটা বাঁক নিল মেঘা। কয়েক মিনিটের মধ্যেই ওরা ফের গর্জনতলার দিকে এগোতে লাগল। সকালে যে পথ ধরে এসেছিল সেই পথ দিয়েই ফিরতে লাগল আবার।
গর্জনতলায় গিয়ে যখন ওরা পৌঁছল তখন দুপুর প্রায় একটা বাজে। সেখানে কাউকেই দেখা গেল না। তাতে অবশ্য হরেন বা কানাই কেউই বিশেষ চিন্তিত হল না, কারণ সকালে ফকিরের ডিঙি ছাড়ার পর এতক্ষণে মাত্র সাতঘণ্টা মতো পেরিয়েছে। ওরা জানে যে লুসিবাড়ি ঘুরে মেঘার ফেরার সময়টা হিসেব করে নিশ্চয়ই আরও বেশ খানিকটা পরেই ফেরার প্ল্যান করেছে পিয়া আর ফকির। ফলে ওদের আসতে আসতে প্রায় সন্ধে হয়ে যাবে।
তবে একটা জিনিস কানাইয়ের বেশ অদ্ভুত লাগল। ভটভটিটা যেখানে নোঙর করেছে হরেন, সেখান থেকে গর্জনতলার দহটা পরিষ্কার দেখা যায়, তবুও, ভাটা পড়ে যাওয়া সত্ত্বেও সেখানে একটা ডলফিনেরও চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না। কানাইয়ের মনে পড়ল ভাটার সময় ডলফিনের দলটা এখানে এসে জড়ো হয়, আর ভাটা যে পড়ে গেছে অনভ্যস্ত চোখেও সেটা দিব্যি বুঝতে পারছিল ও। নিঃসন্দিগ্ধ হওয়ার জন্য তবুও একবার হরেনকে গিয়ে জিজ্ঞেস করল কানাই। হরেন বলল, “হ্যাঁ ভাটাই চলছে এখন। জোয়ার আসতে আরও দু-তিন ঘণ্টা অন্তত লাগবে।”
“কিন্তু হরেনদা, একটা জিনিস দেখুন,” গর্জনতলার দিকে হাত দিয়ে ইশারা করল কানাই। “এতক্ষণ হল ভাটা পড়ে গেছে, কিন্তু জল তো তবুও খালি। কেন বলুন তো?”
প্রশ্নটা শুনতে শুনতে ভুরু কোঁচকাল হরেন। অবশেষে জবাব দিল, “কী করে বলব বলুন? দুনিয়া তো আর ঘড়ির কাটা ধরে চলে না। সবকিছুই একেবারে ঠিক ঠিক সময় মেনে হবে এরকম তাই সবসময় হয় না।”
এই যুক্তির জবাবে আর বলার কিছু থাকে না। তবুও কানাইয়ের পেটের ভেতরে কী যেন গুড়গুঁড়িয়ে উঠল, মনে হল কোথাও যেন কিছু একটা গড়বড় হয়েছে। হরেনকে বলল, “আচ্ছা হরেনদা, এখানে বসে না থেকে আমরা একটু এগিয়ে গিয়ে খুঁজে দেখি না, ফকিরের নৌকোটাকে দেখা যায় কিনা?”
হরেন যেন মজা পেল কথাটা শুনে। গলা দিয়ে ঘোঁত করে একটা আওয়াজ করে বলল, “এখানে একটা ডিঙি খুঁজে বের করা আর খড়ের গাদা থেকে একটা উঁচ খুঁজে বের করা একই ব্যাপার, বুঝলেন কানাইবাবু?”
“কিন্তু ক্ষতি তো কিছু নেই,” কানাই নাছোড়বান্দা। “যদি আমরা সন্ধের মধ্যেই এখানে ফিরে আসি তবে আর অসুবিধা কী আছে? সব যদি ঠিকঠাক থাকে তা হলে তো এমনিতেই ওরা সন্ধেবেলা ফিরে চলে আসবেই এখানে।”
“কোনও লাভ নেই,” গম্ভীর গলায় বলল হরেন। “শত শত খাল থাকে এইসব দ্বীপের মধ্যে। বেশিরভাগই এত অগভীর যে এ ভটভটি নিয়ে ঢোকাই যাবে না সেগুলোর মধ্যে।”
কানাই বুঝতে পারছিল আস্তে আস্তে নরম হয়ে আসছে হরেন। হালকা গলায় বলল, “আমরা তো এমনিতে কিছুই করছি না–একটু ঘুরে দেখেই এলাম না হয়।”
“ঠিক আছে তা হলে।” রেলিংয়ের পাশ দিয়ে ঝুঁকে পড়ে চেঁচিয়ে নগেনকে ইঞ্জিন স্টার্ট করতে বলল হুরেন। তারপর নোঙর তুলল।
সারেং-এর ঘরটার গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছিল কানাই। গর্জনতলা ছাড়িয়ে ভটভটি আস্তে আস্তে এগোতে শুরু করল ভাটির দিকে। আকাশে কোথাও একটুকরো মেঘের চিহ্ন নেই। দুপুরের ঝিম-ধরানো রোদে কেমন চুপচাপ, শান্ত দেখাচ্ছে চারদিক। আবহাওয়া যে শিগগিরই খারাপ হওয়ার সম্ভাবনা আছে সেটা কল্পনা করাটাও এখন কঠিন।
.
হতাহত
স্রোত তখন ঘুরতে শুরু করেছে, এমন সময় অবশেষে জলের ওপর উঠে থাকা একটা তেকোনা পাখনা চোখে পড়ল পিয়ার। ডিঙি থেকে প্রায় কিলোমিটারখানেক সামনে, পাড়ের কাছ ঘেঁষে। যন্ত্রে ডলফিনটার অবস্থান মেপে দেখা গেল গর্জনতলা থেকে দক্ষিণ-পুবে প্রায় বিশ কিলোমিটার দূরে রয়েছে ওটা। দূরবিনটা ফের চোখে লাগিয়ে পিয়া আবিষ্কার করল ডলফিনটা একা নয়। আরও বেশ কয়েকটাকে আশেপাশে ঘোরাঘুরি করতে দেখা যাচ্ছে। নির্দিষ্ট একটা জায়গার মধ্যেই পাক খেয়ে যাচ্ছে প্রাণীগুলো–গর্জনতলার দহটাতে যেমন করে, সেরকম।
এখনও মোটামুটি মাঝামাঝি জায়গায় রয়েছে জলের স্তর। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে পিয়া দেখল বিকেল তিনটে। বুকের ভেতর একটা ধুকপুকুনি টের পাচ্ছিল ও। প্রথম যেদিন ফকির ওকে গর্জনতলায় ডলফিনের দলটাকে দেখাতে নিয়ে গিয়েছিল সেদিনও ঠিক এরকমই অনুভূতি হয়েছিল পিয়ার। এই জায়গাটাতেও যদি ভাটার সময় শুশুকগুলো এসে জড়ো হয়, তার মানে এখানেও ওরকম আরেকটা দহ আছে। তা হলে এটা নিশ্চয়ই নতুন আরেকটা দল। এর থেকে ভাল খবর আর কিছু হতে পারে না। কিন্তু ফকিরের দিক থেকে তো উৎসাহের কোনও লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। কেমন একটা খটকা লাগল পিয়ার ওর মুখের দিকে তাকিয়ে। কীরকম যেন একটা সতর্ক দৃষ্টি ওর চোখে, যেন কোথাও কিছু একটা গণ্ডগোল হয়েছে। পিয়ার একটু অস্বস্তি লাগল।
ডলফিনগুলো যখন নৌকো থেকে আর কয়েকশো মিটার মাত্র দূরে, এমন সময় কাদার ওপরে স্থির হয়ে পড়ে থাকা ইস্পাত-ধূসর একটা আকৃতি চোখে পড়ল। মুহূর্তে চোখ বন্ধ করে ফেলল পিয়া। জিনিসটা কী সেটা ও জানে। মনে মনে তবুও আশা করছিল যে হয়তো ভুল হলেও হতে পারে। চোখ যখন খুলল, ওটা তখনও পড়ে আছে একই জায়গায়। এবং ও যে ভয় করেছিল বস্তুটা তাই একটা ইরাবড়ি ডলফিন। মরা।
কাছ থেকে ভাল করে দেখতে গিয়ে আরও একটা ধাক্কা লাগল পিয়ার। প্রাণীটার শরীর অন্যদের তুলনায় মাপে একটু ছোট। দেখা মাত্র পিয়ার মনে হল এটা নিশ্চয়ই ওর চেনা সেই বাচ্চা ডলফিনটা, গত কয়েকদিন ধরে যেটাকে জুড়ি বেঁধে ঘুরতে দেখেছিল মায়ের সঙ্গে। ছোট্ট শরীরটা মনে হল কয়েক ঘণ্টা আগেই এসে ঠেকেছে ডাঙায়, জল নেমে যাওয়ায় পড়ে রয়ে গেছে কাদার ওপর। প্রাণহীন দেহটাকে এখন প্রায় ছুঁইছুঁই করছে জোয়ারের জল, মাঝে মাঝে কেঁপে কেঁপে উঠছে সেটা স্রোতের ধাক্কায়।
পিয়ার ষষ্ঠেন্দ্রিয় যেন ওকে বলে দিল ভাটার সময় ডলফিনদের যে দলটা গর্জনতলায় এসে জড়ো হয় এটা সেই একই দল। মরা শুশুকটা দেখে ওদের স্বাভাবিক চলনের পরিবর্তনের কারণটাও খানিকটা আন্দাজ করল ও চোখের সামনে মৃত সঙ্গীকে এভাবে ফেলে রেখে গর্জনতলার দহে ওরা ফিরে যেতে চাইছে না। পিয়ার মনে হল জোয়ারের জলে ডলফিনটা আবার ভেসে উঠবে, দলটা যেন সেই অপেক্ষাতেই আছে।
ফকিরও বোঝা গেল দেখতে পেয়েছে মরা ডলফিনটাকে। পিয়া লক্ষ করল নৌকোর মুখ আস্তে আস্তে ঘুরে যাচ্ছে পাড়ের দিকে। ডাঙার কাছাকাছি আসতেই ভক করে একটা দুর্গন্ধের ঝলক পিয়ার গলার ভেতর এসে লাগল। দুপুরের চড়চড়ে রোদ এসে পড়েছে মরা প্রাণীটার গায়ে; ফলে এত জোরালো গন্ধ বেরোচ্ছে যে পাড়ে নামার আগে দু’ ফেরতা কাপড় মুখের চারিদিকে জড়িয়ে নিতে হল পিয়াকে।
কাছে গিয়ে পিয়া দেখল ডলফিনটার নাকের ঠিক পেছন থেকে বিশাল একটা ক্ষত। একটুকরো মাংস আর চর্বি কে যেন খুবলে বের করে নিয়েছে। ক্ষতটার আকার দেখে মনে হল প্রাণীটা কোনও দ্রুতগতির মোটরবোটের প্রপেলারে ধাক্কা খেয়েছিল। ব্যাপারটা লক্ষ করে একটু অবাকই হল পিয়া: এ অঞ্চলে সেরকম কোনও মোটরবোট চলাচল করতে তো ও এ যাবৎ দেখেনি। ফকিরই অবশেষে সমস্যাটার সমাধান করল। হাত দিয়ে কাদার ওপর একটা টুপির ছবি আঁকল ও। পিয়া বুঝতে পারল উর্দিপরা সরকারি লোকেরা যে ধরনের বোট ব্যবহার করে সেইরকম কোনও বোটের কথা বোঝাতে চাইছে ফকির–কোস্টগার্ডের বা আর্মির বোট। ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টেরও হতে পারে। সকালের দিকে হয়তো এরকম কোনও মোটরবোট এদিক দিয়ে গেছে, আর অনভিজ্ঞ ছানাটা নিশ্চয়ই ঠিক সময় মতো পথ থেকে সরে যেতে পারেনি।
পিঠব্যাগ থেকে একটা ফিতে বের করে নরিস প্রোটোকল অনুযায়ী ভাল করে ডলফিনটার মাপ নিল পিয়া। তারপর ছোট একটা ছুরি নিয়ে চামড়া, চর্বি আর কয়েকটা প্রত্যঙ্গের কিছু স্যাম্পল কেটে নিল। রাংতায় মুড়ে নিয়ে জিপলক ব্যাগের মধ্যে যত্ন করে রাখল সেগুলোকে। এর মধ্যেই দলে দলে কাঁকড়া আর নানা পোকামাকড় ঘেঁকে ধরেছে ছোট্ট শরীরটাকে, ক্ষতস্থানটা থেকে কুরে কুরে খেতে শুরু করেছে মাংস আর চর্বি।
পিয়ার মনে পড়ল প্রথমবার মায়ের পাশে পাশে সাঁতার কাটা ছানাটাকে দেখে ও কেমন খুশি হয়ে উঠেছিল। সেই প্রাণীটার মরা শরীরের পাশে বেশিক্ষণ আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না ও। ফকিরকে ইশারা করল ওটার লেজের দিকটা তুলে ধরতে, নিজে মুঠো করে ধরল পাখনাদুটো। তারপর দুজনে মিলে নিষ্প্রাণ শরীরটাকে শূন্যে কয়েকবার দুলিয়ে নিয়ে ছুঁড়ে দিল নদীর মধ্যে। পিয়া ভেবেছিল জলের ওপরে ওটা ভেসে উঠবে আবার, কিন্তু ওকে অবাক করে দিয়ে দেহটা দ্রুত তলিয়ে গেল নদীর গভীরে।
বেশিক্ষণ আর জায়গাটাতে থাকতে চাইছিল না পিয়া। ডিঙির কাছে গিয়ে যন্ত্রপাতিগুলো ছুঁড়ে দিল ভেতরে, তারপর ফকিরের সঙ্গে হাত লাগিয়ে নৌকোটাকে ঠেলে দিল জলের ভেতর।
স্রোতের টানে আস্তে আস্তে ভেসে যাচ্ছিল ডিঙি। হঠাৎ ফকির তার ওপর দাঁড়িয়ে উঠল। তারপর উজান আর ভাটির দিকে, পুবে আর পশ্চিমে হাত দিয়ে ইশারা করে দেখাতে লাগল। আস্তে আস্তে সেই ইশারার অর্থ স্পষ্ট হল পিয়ার কাছে। মনে হল ফকির বলতে চাইছে যে এখানে ওরা যা দেখেছে এই অঞ্চলে সেরকম দৃশ্য প্রায়শই দেখা যায়। ফকির নিজেই তিনটে ডলফিনের মৃতদেহ দেখেছে বিভিন্ন জায়গায় জায়গাগুলোর একটা এখান থেকে খুবই কাছে, ভাটির দিকে। সেখানেও একটা মরা ডলফিন এরকম স্রোতের টানে পাড়ে গিয়ে ঠেকেছিল। সেটা মনে ছিল বলেই ফকির ওকে এইদিকে নিয়ে এসেছে।
ওরা যখন মাঝনদীতে গিয়ে পৌঁছল ততক্ষণে শুশুকগুলো আস্তে আস্তে সরে যেতে শুরু করেছে জায়গাটা থেকে। শুধু একটা ছাড়া। দহটা ছেড়ে সেটা যেন নড়তেই চাইছে না। পিয়া আন্দাজ করল ডুবে যাওয়া মৃতদেহটা স্রোতের টানে গড়িয়ে যাচ্ছে নদীর তলায়, আর সেটারই চারপাশে ঘুরপাক খাচ্ছে ডলফিনটা। এটাই কি ওই ছানাটার মা? কোনও উপায় নেই সে প্রশ্নের জবাব পাওয়ার।
হঠাৎই কীসের যেন সংকেত পেয়ে এক সঙ্গে সমস্ত ডলফিনগুলো উধাও হয়ে গেল। ওদের পেছন পেছন যাওয়ার ইচ্ছে ছিল পিয়ার, কিন্তু সেটা এখন আর সম্ভব নয়। বিকেল চারটে বেজে গেছে। আর হুড়মুড় করে নদীতে ঢুকে আসছে জোয়ারের জল। সকালে যে জলের স্রোত ওদের সহায় হয়েছিল, এখন তা প্রতিকূলে। দুজনে মিলে দাঁড় বাইলেও খুব একটা বেশি এগোনো যাবে না।
.
প্রায় তিনঘণ্টা ধরে নিষ্ফল ঘোরাঘুরির পর অবশেষে হরেন বলল, “যথেষ্ট খোঁজা হয়েছে, এবার ফিরতে হবে আমাদের।” ওর রুক্ষ গলায় যেন একটা জয়ের সুর।
খাঁড়ি আর সুতিখালগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখ ব্যথা হয়ে গেছে কানাইয়ের। সূর্য পশ্চিমের দিকে ঢলে পড়েছে, বিকেলের রোদটা সোজা চোখে এসে লাগছে। ফলে ভাল করে দেখাটা আরও কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু মনের ভেতর থেকে অস্বস্তিটা কিছুতেই যাচ্ছে না। ওদের পক্ষে আর কিছুই করার নেই সেটা ঠিক যেন বিশ্বাসই করে উঠতে পারছিল না কানাই। “এক্ষুনি ফিরে যেতে হবে?” ও জিজ্ঞেস করল হরেনকে।
মাথা নাড়ল হরেন। “অনেকটা তেল খরচ করে ফেলেছি আমরা। আরও বাড়তি ঘোরাঘুরি করলে কালকে লুসিবাড়ি পর্যন্ত পৌঁছতেই পারব না। তা ছাড়া ওরা মনে হয় এতক্ষণে পৌঁছে গেছে গর্জনতলায়।”
“আর যদি না পৌঁছে থাকে?” তীক্ষ্ণ গলায় প্রশ্ন করল কানাই। “ওদের ফেলে রেখে চলে যাব নাকি আমরা?”
চোখদুটো সরু করে ভুরু কুঁচকে কানাইয়ের দিকে তাকাল হরেন। বলল, “দেখুন, ফকির আমার ছেলের মতো। আর কিছু করা যদি আমার পক্ষে সম্ভব হত, সেটা আমি ঠিকই করতাম।”
হরেনের বকুনিটা যুক্তিযুক্ত, মেনে নিল কানাই। মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ, হ্যাঁ, তা তো ঠিকই।” ফকির আর পিয়াকে খুঁজে বের করার ব্যাপারে হরেনের আগ্রহকে সন্দেহ করেছিল বলে মনে মনে একটু লজ্জাও লাগল ওর। বোটের মুখ ঘোরার পরে খানিকটা আপোশের সুরে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা হরেনদা, আপনার তো এসব ব্যাপারে অনেক অভিজ্ঞতা। সাইক্লোন যদি আসে তা হলে এসব জায়গায় কী অবস্থা হতে পারে একটু বলুন না আমাকে।”
গম্ভীরভাবে চারদিকে একবার চেয়ে দেখল হরেন। “একেবারে পালটে যাবে এ জায়গার চেহারা। কোনও মিলই পাবেন না। রাত আর দিনের যেমন তফাত, সেইরকম তফাত হয়ে যাবে।”
“আপনি তো একবার সাইক্লোনের মুখে পড়েছিলেন, তাই না।”
“হ্যাঁ, ধীর, সংক্ষিপ্ত জবাব হরেনের। “যে বছর আপনি এসেছিলেন, সেই বছরে, ১৯৭০।”
বর্ষা কেটে যাওয়ার বেশ কিছুদিন পরে ঘটেছিল ঘটনাটা। বলাইকাকার নৌকোয় সাগরে গিয়েছিল হরেন। সবসুদ্ধ মোটে তিনজন ছিল নৌকোটাতে: হরেন, বলাইকাকা, আর একজন কে যেন–তাকে আগে দেখেনি হরেন। সাগরের ভেতরে খুব বেশিদূরে ওরা যায়নি, রায়মঙ্গল নদীর মুখটা থেকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার এগিয়েছিল। সেখান থেকে ডাঙা পরিষ্কার চোখে পড়ছিল। সে সময়ে তো আর এরকম আগাম সতর্কবার্তা-টার্তা ছিল না, তাই ঝড় এসে একেবারে ঘাড়ের ওপর পড়ার আগে কিছুই আন্দাজ করতে পারেনি ওরা। চারদিকে ঝকঝকে রোদ্দুর, একটু জোরালো বাতাস দিচ্ছিল শুধু। আধঘণ্টার মধ্যে হঠাৎ দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে হুড়মুড় করে এসে পড়ল ঝড়টা। দেখতে-না-দেখতে চারপাশ একেবারে অন্ধকার হয়ে এল। দিশা ঠিক করাই দায়। সঙ্গে কম্পাস-টম্পাস কিছু নেই; কোন পথে যেতে হবে বোঝার জন্য চোখই একমাত্র ভরসা। এমনিতে ডাঙার থেকে খুব বেশি দূরে সাধারণত ওরা যেত না। তবে যন্ত্রপাতি কিছু সঙ্গে থাকলেও লাভ বিশেষ কিছু হত না। সে ঝড়ে ইচ্ছেমতো দিক ঠিক করে নৌকো চালানোর সুযোগই ছিল না কোনও। বাতাসের বেগ এত প্রচণ্ড যে কোনও বাধাই তার সামনে বাধা নয়। ওরা হাওয়ার মুখে কুটোর মতো ভেসে চলল, উত্তর-পুবে। শক্ত করে ডিঙির কাঠ আঁকড়ে ঝুলে থাকা ছাড়া ঘণ্টা কয়েক কিছুই করার কোনও ক্ষমতা ছিল না ওদের। তারপর হঠাৎই দেখা গেল নৌকোটা তিরবেগে এগিয়ে চলেছে জলে ভেসে যাওয়া একটা গ্রামের দিকে। কয়েকটা গাছের মাথা আর কিছু ঘরবাড়ির চাল চোখে পড়ল–বেশিরভাগই ছোট ছোট কুঁড়েঘর। ঝড়ের এমনই দাপট যে জলের ধারের গ্রামগুলো সব একেবারে ডুবে গিয়েছিল। জল এতটা উঠেছিল যে একটা গাছের গায়ে সটান গিয়ে ধাক্কা খাওয়ার আগে ওরা বুঝতেই পারেনি যে ডিঙিটা ডাঙাজমির ওপর গিয়ে পৌঁছেছে অবশেষে। ধাক্কাটা খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে গেল ডিঙি, কিন্তু হরেন আর ওর কাকা গাছটাকে আঁকড়ে ধরে প্রাণে বেঁচে গেল কোনওরকমে। দলের তিন নম্বর লোকটাও একটা ডাল হাতে ধরতে পেরেছিল, কিন্তু ওর ওজনে মট করে ভেঙে গেল সেটা। আর কখনও দেখা যায়নি লোকটাকে।
হরেনের তখন বছর কুড়ি মাত্র বয়েস, শরীরে মোষের মতো জোর। ফুঁসতে থাকা জলের ভেতর থেকে কাকাকে টেনে তুলে নিয়ে গাছের উঁচু একটা ডালে গিয়ে উঠল। দুজনে মিলে তারপর গামছা আর লুঙ্গি খুলে নিয়ে নিজেদের কষে বেঁধে নিল গাছটার সঙ্গে। শোঁ শোঁ করে বয়ে যাচ্ছে ঝড়, আর হরেন ওর কাকার দু হাত শক্ত করে ধরে বসে আছে গাছের ওপর। মাঝে মাঝে এত জোরে হাওয়া দিচ্ছিল যে অতবড় গাছটা একটা বঁটার মতো দুলছিল এদিক ওদিক। কোনওরকমে সেটাকে আঁকড়ে ধরে বসে রইল হরেন আর বলাই।
ঝড়ের দাপট একটু কমলে দেখা গেল জলের তোড়ে এটা-ওটা নানা জিনিস এসে গাছের ডালপালার মধ্যে আটকে রয়েছে। আশেপাশের ঘরবাড়ি থেকে ভেসে আসা কিছু বাসন-কোসনও রয়েছে তার মধ্যে। সেখান থেকে একটা আস্ত মাটির হাঁড়ি খুঁজে বের করে নিয়ে তাতে খানিকটা বৃষ্টির জল ধরে রাখল হরেন। ভাগ্যিস বুদ্ধিটা মাথায় এসেছিল, তা না হলে পরের দিন তেষ্টার চোটেই গাছ থেকে নেমে পড়তে হত ওদের।
রাত কেটে অবশেষে সকাল হল। আকাশে আর মেঘের এতটুকু চিহ্ন নেই, চারিদিকে ঝকঝক করছে রোদ্দুর। পায়ের নীচে কিন্তু তোড়ে বয়ে চলেছে জলের স্রোত: ওদের গাছটার অর্ধেকের বেশি তখনও ডুবে আছে বানের জলে। আশেপাশে তাকিয়ে হরেন আর বলাই দেখল ওরা একা নয়, আরও বহু লোক ওদের মতো এভাবে গাছে উঠে প্রাণ বাঁচিয়েছে নিজেদের। ছেলেবুড়ো সুদ্ধ একেকটা গোটা পরিবার উঠে বসে আছে গাছের ডালে। এ গাছ থেকে ও গাছে চেঁচিয়ে কুশল জিজ্ঞাসার পর ওরা জানতে পারল ঝড়টা যখন উঠেছিল তখন ওরা যেখানে ছিল তার থেকে প্রায় পঞ্চাশ কিলোমিটার মতো পুবে চলে এসেছে। বর্ডার-টর্ডার পেরিয়ে পৌঁছে গেছে গলাচিপার কাছে, একেবারে আগুনমুখা নদীর মুখে।
“সে জায়গাটা এখন বাংলাদেশে পড়ছে,” বলল হরেন। “বোধহয় খুলনা জেলা।”
দু’দুটো দিন সেই গাছের ওপর কাটিয়ে দিল ওরা। খাওয়া নেই, দাওয়া নেই, হাঁড়িতে ধরে রাখা সেই বৃষ্টির জলটুকু শুধু সম্বল। জল নামতে অবশেষে গাছ থেকে নেমে কাছাকাছি কোনও শহরের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করল হরেন আর বলাই। তবে বেশিদূর যেতে পারল না, খানিকটা এগোতেই মনে হল ওরা যেন একটা যুদ্ধক্ষেত্রের মধ্যে এসে পড়েছে। চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে আছে মানুষের লাশ; মরা মাছ আর গোরু-ছাগলে একেবারে ঢেকে গেছে চারিদিক। পরে জানা গেল প্রায় লাখ তিনেক লোকের প্রাণ গিয়েছিল সেই ঝড়ে।
“এ তো একেবারে হিরোশিমার মতো,” প্রায় ফিসফিস করে বলল কানাই।
ভাগ্যক্রমে একদল জেলের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল হরেন আর বলাইয়ের। তাদের ডিঙিটা মোটামুটি আস্তই ছিল। সেই ডিঙিতে করে এই খাল সেই খাল হয়ে কোনওরকমে বর্ডার পেরিয়ে অবশেষে ইন্ডিয়াতে এসে পৌঁছল ওরা।
এই হল হরেনের সাইক্লোন দেখার অভিজ্ঞতা। একটা জীবনে সে অভিজ্ঞতা ভোলা যায় না। আর কখনও এরকম ঝড়ের মুখে পড়তে চায় না হরেন।
গল্পটা যখন শেষ হল ততক্ষণে প্রায় গর্জনতলার কাছাকাছি পৌঁছে গেছে ওরা।
লালচে আলোর একটা গালিচা যেন পাতা রয়েছে জলে ভেজা দ্বীপটার সামনে। দহটাকে ঢেকে দিয়ে সে গালিচা চলে গেছে দুর মোহনার শেষ প্রান্ত পর্যন্ত। সূর্য অস্ত যাচ্ছে সেখানে এখন। তেরছা হয়ে আলো যেভাবে এসে পড়েছে তাতে একটা কোনও নৌকো নদীতে থাকলেও জলের ওপর লম্বা ছায়া পড়বে তার, ছোট্ট একটা ডিঙি হলেও পরিষ্কার তা চোখে পড়বে। কিন্তু আশেপাশে একটা নৌকোরও কোনও চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না। পিয়া আর ফকির এখনও ফেরেনি।
.
উপহার
সন্ধে নামার সময় জিপিএস-এ ডিঙির অবস্থান মেপে পিয়া দেখল গর্জনতলা তখনও প্রায় বারো কিলোমিটার দূরে। বোঝাই যাচ্ছিল রাতের মধ্যে ওখানে গিয়ে আর পৌঁছনো যাবে না। কিন্তু পিয়ার মনে হল তাতে ভাবনার কিছু নেই। হরেন মনে হয় না খুব একটা দুশ্চিন্তা করবে। ও নিশ্চয়ই বুঝতে পারবে যে ফিল্ডে কাজ করতে করতে অনেকটা দূরে চলে গেছে পিয়ারা, রাতের মধ্যে তাই ফেরা সম্ভব হচ্ছে না।
ফকিরও মনে হল একই কথা ভাবছে। কারণ, খানিক বাদেই দেখা গেল রাতের জন্যে নোঙর ফেলার মতো একটা জায়গা খুঁজছে ও। দিনের শেষ আলোটা মিলিয়ে যাওয়ার ঠিক আগে অবশেষে মোটামুটি উপযুক্ত একটা জায়গা পাওয়া গেল–সরু একটা সুতিখাল প্রায় সমকোণে এসে একটা বড় খালে পড়েছে, ঠিক তার বাঁকে। শেষবেলার ভরা জোয়ারে ছোট নালাটাকেও একটা প্রমাণ মাপের নদী বলে মনে হচ্ছে, কিন্তু পিয়া জানে যে জল একবার নেমে গেলেই ছোট্ট শান্ত পুঁতিখাল তার নিজের চেহারায় ফিরে আসবে। চারদিকে ডাঙা যেটুকু দেখা যাচ্ছে সবই ঘন জঙ্গলে ঢাকা। সন্ধের আবছা আলোয় নিরেট একটা সবুজ দেয়ালের চেহারা নিয়েছে সে জঙ্গল।
নালাটা ঠিক যেখানে বড় খালে এসে পড়েছে জল সে জায়গাটায় একটু শান্ত। সেইখানটাতেই এসে নোঙর ফেলল ফকির। নোঙরটা নামানোর আগে হাত দিয়ে চারিদিকে একবার ইশারা করে জায়গার নামটা বলল পিয়াকে: গেরাফিতলা।
ডিঙিটা থেমে যাওয়ার পর পিয়া লক্ষ করল থালার মতো বড় একটা চাঁদ উঠেছে আকাশে। প্রায় নিটোল গোল, একটা ধার শুধু যেন আলতো করে কেউ চেঁছে নিয়েছে। হালকা তামাটে রঙের একটা আভা ছড়িয়ে আছে চাঁদের চারদিকে। পিয়ার মনে হল এই বাদাবনের স্থির, ভেজা ভেজা হাওয়ায় যেন আতসকাঁচের গুণ আছে। এত বড় আর এত স্পষ্ট চাঁদ এর আগে ও কখনও দেখেনি।
মুগ্ধ হয়ে দেখছিল পিয়া, এমন সময় ডিঙির ছইয়ের ভেতর থেকে হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে ফকির এসে পাশে বসল। গাঢ় বেগুনি রং ধরেছে আকাশে, প্রতি মুহূর্তে তা গাঢ়তর হচ্ছে। একটা আঙুল তুলে সেই লালচে-বেগনি আকাশের গায়ে ধনুকের মতো একটা দাগ কাটল ফকির। কিন্তু সেদিকে তাকিয়ে কিছুই দেখা গেল না। মাথা নেড়ে পিয়া বোঝাল ওর চোখে বিশেষ কিছু পড়ছে না। তখন আর একবার ভাল করে তাকিয়ে দেখতে ইশারা করল ফকির। চাঁদের ওপর দিয়ে গোল করে ধনুকের মতো দাগ টানল আঙুলে। রুপোলি আলোয় ৩২৮
চোখ খানিকটা সয়ে আসতে হঠাৎ রঙিন আলোর আবছায়া একটা পট্টি নজরে এল পিয়ার। এক মুহূর্তের জন্যে যেন শূন্যে ভেসে রইল আলোটা, তারপরেই মিলিয়ে গেল আবার। ফকিরও আলোটা দেখতে পেয়েছে কি না বোঝার জন্যে ওর দিকে একবার তাকাল পিয়া, সেটা দেখে মাথা ঝাঁকাল ফকির। তারপর আঙুল দিয়ে আবার একটা ধনুকের মতো আঁক কাটল শুন্যে, এবার অনেক বড় মাপে–আকাশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত। হঠাৎ পিয়ার মনে হল ও বোধহয় রামধনু জাতীয় কিছু একটা জিনিসের কথা বোঝানোর চেষ্টা করছে। সেটাই কি ওকে দেখাল ফকির এক্ষুনি–চাঁদের আলোয় রামধনু? সোৎসাহে মাথা ঝকাল ফকির, পিয়াও ঘাড় নাড়ল–ব্যাপারটা তো নিজের চোখে দেখেছে ও, মুহূর্তের জন্যে হলেও দেখেছে। জীবনে এরকম কিছুর কথা কখনও শোনেনি পিয়া, কিন্তু কীই বা এসে গেল তাতে?
চাঁদ আর বনের ছায়ার থেকে চোখ সরিয়ে স্রোতের আঁকিবুকির দিকে তাকাল পিয়া। মনে হল জলের গভীর থেকে একটা হাত এসে যেন নদীর বুকে চিঠি লিখে যাচ্ছে ওর জন্যে–ঢেউ আর ঘূর্ণির আঁকাবাঁকা অক্ষরে। একটা টুকরো কথা হঠাৎ ভেসে এল মনে, কানাই বলেছিল, ময়নার বিষয়ে না দেখা জলের স্রোত আর চোখে-পড়া হাওয়ার কারিকুরি নিয়ে কী যেন একটা কথা। আচ্ছা, ফকির কি বোঝে যে ও এমন একজন মানুষ, যার প্রেরণা থেকে এত কিছু যন্ত্রণা আর অসুবিধা সত্ত্বেও উঠে আসতে পারে এরকম অবিচল আনুগত্য? যে সম্পদ ফকিরের আছে তার এক ভগ্নাংশের সমান মূল্যেরও কি কিছু ওকে কোনওদিন দিতে পারবে পিয়া নিজে?
নিশ্চল বসে রইল ওরা পরস্পরের অস্তিত্বের তীব্রতায় অবশ হয়ে থাকা দুটো বন্য প্রাণীর মতো। যখন চোখাচোখি হল, পিয়ার মনে হল ও এতক্ষণ ধরে যা ভাবছিল এক নজর তাকিয়েই তা যেন বুঝতে পেরে গেছে ফকির। ওর একটা হাত নিয়ে ফকির নিজের দুহাতে ধরল একবার, তারপর মুখ ফিরিয়ে নিল অন্যদিকে। পিয়ার দিকে আর না তাকিয়ে ডিঙির পেছনে চলে গিয়ে উনুন ধরাতে বসল।
রান্নাবান্না শেষ হওয়ার পর একটা থালায় করে খানিকটা খাবার পিয়ার জন্যে নিয়ে এল ফকির ভাত আর আলুর তরকারি। কিছুতেই ফেরাতে পারল না পিয়া। মনে হল খাবারের থালাটা যেন ওকে উৎসর্গ করছে ফকির, বিদায়ী প্রতাঁকের মতো। একসঙ্গে দেখা ওই জ্যোৎস্নার রামধনু যেন দু’জনের মধ্যেকার একটা আড়াল ভেঙে দিয়েছে, একটা কিছু যেন শেষ হয়ে গেছে, পড়ে রয়েছে শুধু তার বেদনার ছায়াটুকু। সে বেদনার রূপ বোঝা যায় না, কেননা কোনও নাম নেই তার। খানিক পরে, উনুন আর বাসনপত্র গুছিয়ে তুলে রাখা হয়ে গেলে ফকিরের একটা কথা মুড়ি দিয়ে ডিঙির সামনে নিজের জায়গাটায় এসে বসল পিয়া। ফকির গিয়ে ঢুকল ছইয়ের নীচে।
কানাইয়ের দেওয়া চিঠিটার কথা মনে পড়ল পিয়ার। সেটা বের করে নিল পিঠব্যাগ থেকে। মনটা একটু অন্যদিকে ঘোরাতে পারলে ভাল হয়, অন্য কিছু একটা চিন্তা করা দরকার এখন। চাঁদের আলোয় খামের ওপরের লেখাটা চোখ কুঁচকে পড়ার চেষ্টা করছে দেখে ফকির এসে একটা দেশলাই আর মোমবাতি দিয়ে গেল। সলতেটা জ্বালিয়ে দু’-এক ফোঁটা গলন্ত মোম ডিঙির আগার কাঠটার ওপর ফেলল পিয়া। তারপর বাতিটা চেপে বসিয়ে দিল তার ওপর। নিঝুম হয়ে আছে রাত্রি, বাতাস একেবারে স্থির, একটুও নড়ছে না মোমবাতির শিখা। আড়ালের কোনও দরকার নেই।
খাম ছিঁড়ে লেখাটা বের করে পড়তে শুরু করল পিয়া।
.
“ডিয়ার পিয়া,
“একজন পুরুষ যখন কোনও নারীকে কিছু দিতে চায়–যার দাম টাকায় মাপা যায় না, যে উপহারের মূল্য বুঝবে কেবল সেই নারী, সে ছাড়া আর কেউ নয়–তার মানেটা কী হতে পারে বলুন তো?
“আমাদের চিরকালের চেনা সেই একঘেয়ে পুরনো প্রশ্ন এ নয়। সত্যি বলছি, এক্কেবারে বোকা বনে গিয়েছি আমি–এই রকম আবেগ জীবনে কখনও অনুভব করিনি এর আগে। আমার মতো একজন লোক, যে সারা জীবন একেবারে খাঁটি বর্তমানটুকুকে নিয়ে কারবার করে এসেছে আর, স্বীকার করা ভাল, যে নিজের দিকে ছাড়া অন্য কোনওদিকে বিশেষ চেয়ে দেখেনি তার পক্ষে এ একেবারে নতুন অভিজ্ঞতা, পুরোপুরি অচেনা একটা ক্ষেত্র। যে আবেগ থেকে অজানা এই অনুভূতির উৎসার, তা একেবারে ভিত পর্যন্ত নাড়িয়ে দিয়েছে আমাকে। তাই বলে এর আগে কি প্রেমে পড়িনি কখনও? জগৎ এবং জীবন সম্পর্কে নিজের অভিজ্ঞতার গভীরতা আর বিস্তার নিয়ে সব সময় গর্ব করে এসেছি আমি: বুক ফুলিয়ে বলেছি, ছয়-ছয়টা ভাষায় প্রেম করেছি আমি। সেসব আজকে মনে হচ্ছে, যেন কত যুগ আগেকার কথা: গর্জনতলায় গিয়ে চোখ খুলে গেছে আমার। বুঝতে পেরেছি কত কম আমি চিনি এই জগৎটাকে। নিজেকেও।
“সুতরাং বলাই বাহুল্য, নিজে কষ্ট স্বীকার করেও অন্য আরেকটা মানুষকে খুশি করতে চাওয়ার যে কী অর্থ সে ধারণা আগে আমার কখনও ছিল না।
“কাল আমি উপলব্ধি করলাম যে আপনাকে এমন কিছু দেওয়ার ক্ষমতা আমার রয়েছে, যা আমি ছাড়া আর কেউ দিতে পারবে না। মনে আছে, আপনি কালকে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন ফকির কী গান গাইছে, আর আমি বলেছিলাম ওই জিনিস অনুবাদ করা আমার কর্ম নয়: খুবই কঠিন কাজ ওটা? ভুল বলিনি কিন্তু। কারণ ও যেটা গাইছিল সে গানের প্রতিটা কথার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে ইতিহাস, সে শুধু ফকিরের নিজের জীবনের ইতিহাস নয়, এই গোটা জায়গাটার ইতিহাস, এই ভাটির দেশের ইতিহাস। আপনাকে একদিন বলেছিলাম না, কিছু মানুষ থাকে যারা কবিতার দুনিয়াতে বাস করে? আমার মেসো ছিল সেইরকম একজন লোক। নিজে তো স্বপ্ন দেখতই, আর নিজের মতো মানুষদেরও ঠিক ঠিক চিনে নিতে পারত। যে নোটবইটা আমি পড়েছিলাম তাতে এক জায়গায় একটা ঘটনার কথা লিখেছে মেসো, যেখানে পাঁচ বছর বয়সের ফকির এই ভাটির দেশের একটা গাথা থেকে মুখস্থ বলে যাচ্ছে একটার পর একটা শ্লোক। বাদাবনের রক্ষয়িত্রী বনবিবির কাহিনি নিয়ে তৈরি সেই গাথা। সে কাহিনির ঠিক কোন অংশটা ফকির আবৃত্তি করছিল সেটাও লিখে গেছে মেসো যেখানে একটা মূল চরিত্র, দুখে বলে একটি গরিব ছেলেকে বাঘের দেবতা দক্ষিণ রায়ের মুখে ফেলে দিয়ে চলে গেছে ধনা নামের এক নৌকোর মালিক, সেই জায়গাটা।
‘ফকিরের ক্ষমতা দেখে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল মেসো। কারণ, ও তো এখন যেরকম, তখনও তেমনই লিখতে পড়তে কিছু জানত না। সঙ্গে সঙ্গে মেসো এটাও বুঝতে পেরেছিল যে, যে শব্দগুলো গড়গড় করে বলে যাচ্ছে ওই বাচ্চা ছেলেটা, ওর কাছে সেগুলো শুধু একটা উপকথার অংশ মাত্র নয়, ওই কাহিনিই ওর চোখে জীবন্ত করে তুলেছে এই ভাটির দেশটাকে। সেই গানটাই কালকে ফকিরের গলায় শুনেছিলেন আপনিঃ ওর মজ্জার মধ্যে মিশে আছে ওই গান, আর, সম্ভবত এখনও ওর সত্তাটাকে তৈরি করে যাচ্ছে তিল তিল করে। আর এই উপহারই আপনাকে দিয়ে যাব আমি আজকে এই কাহিনি, যা আসলে একটা গান, এই কথাগুলো, যেগুলো ফকিরের সত্তার একটা অংশ। এই গল্প আপনাকে শোনাতে গিয়ে যদি ভুল কোথাও করি, তার জন্যে বিন্দুমাত্র আফশোস নেই আমার, কারণ আমার সেই ভুলগুলোই আপনাকে ভুলতে দেবে না আমার কথা, উঁচুদরের অনুবাদকদের মতো আড়ালে সরে যেতে দেবে না আমাকে। আর তা যদি হয়, তা হলে অন্তত এই একবারের মতো নিজেকে ভুলতে না-দেওয়া ভুল করতে পেরে ভাল লাগবে আমার।
“আবদুর রহিম প্রণীত ভাটির দেশের মহাকাব্য: বোন বিবির কেরামতি অর্থাৎ বোন বিবি জহুরানামা।
বোন-বিবি দুখেকে উদ্ধার করিবার বয়ান
দাড়ি মাঝিগণে ধোনা কহে ফজরেতে ॥ কেঁদোখালি যাব ডিঙা ছাড় সেতাবিতে * হুকুম পাইয়া দাড়ি মাঝি যত ছিল ॥ কেঁদোখালি তরফেতে রওয়ানা হইল * সাত ডিঙা বাহিয়া চলিল লোক জনে ॥ দেখিয়া দক্ষিণা দেও বলে মনে মনে * ধোনা মৌলে আসিতেছে সহদ লইতে ॥ বনে আমি যাই হাট মধু বসাইতে * কেঁদোখালি বিচে দেও আসিয়া পৌঁছিল ॥ যত মৌমাছি তরে হুকুম করিল * লক্ষ লক্ষ মৌমাছি হুকুমে দেওয়ের ॥ বসাইল হাট মধু ভিতরে বনের * থরেথরে খোনদাকে কোটরে ডালে পাতে ॥ বেশুমার মধু চাক লাগিল গড়িতে * খোসালিত হয়ে ধোনা তরণী লইয়া ॥ কয় রোজে কেঁদোখালি পৌঁছিল আসিয়া * মাঝিদিগে বলে কিস্তি বান্ধহ এইখানে ॥ চল মধু দেখিবারে যাই সবে বনে * ইহা বলে নৌকা বেন্ধে বাদা বনে যায় ॥ দেখিল মধুর চাক যেথায় সেথায় * ধোনা মৌলে দেখে ফিরে আইল খুসি হইয়া ॥ নায়ে এসে খেয়ে পিয়ে রহিল শুইয়া * দু প্রহর রাতে ধোনা স্বপন দেখিল ॥ আসিয়া দক্ষিণা দেও কহিতে লাগিল * চাক ভাঙ্গিবারে যবে যাইবে বনেতে । মেরা নাম লিবে ভাঙ্গিবার প্রথমেতে * তাহা বাদে দিবে হাত মধুর ভাণ্ডারে ॥ মৌমাছি উড়িয়া ভাগিয়া যাইবে দূরে * আর এক বাত আছে কহি তুঝে এবে ॥ একজনে সাথে লিয়া বনেতে যাইবে * নাহি দিব মোম মধু তোমাকে ভাঙ্গিতে ॥ তামাসা দেখিবে ঘুরেফিরে জঙ্গলেতে * আমার লস্কর দিয়া মধু ভাঙ্গাইব ॥ বেসেরবে তোমার ডিঙাতে পৌঁছাইব * কিন্তু সেই কথা মেরা ইয়াদ রাখিবে ॥ যাইবার সময় দুখেকে দিয়া যাবে * ওজর তাহার না করিবে খবরদার ॥ জান লিয়া টানাটানি হইবে তোমার * এ কথা বলিয়া দেও গায়েব হইল ॥ ফজরেতে ধোনা তবে জাগিয়া উঠিল * সবাকারে হুকুম করিল ফজরেতে ॥ দুখেকে বসায়ে চল সবে জঙ্গলেতে * যায় মধু ভাঙ্গিবার হুকুমে ধোনার ॥ দুখে বলে চাচাজি গো কি কহিব আর * কান্দিয়া কান্দিয়া ফের কহিতে লাগিল ৷ তোমার মোকছেদ চাচা হাছেল হইল * দেওয়ের সহিত তেরা হয়েছে কারার ॥ আমারে দিয়া যে ঘরে যাবে আপনার * এ কথা শুনিয়া ধোনা হাসিয়া উঠিল ৷ যত সব বাজে কথা তোরে কে শুনাল * এতেক বলিয়া ধোনা চলিল বেবাক ৷ যাইয়া মধুর চাক দেখিয়া অবাক * যত লোক গিয়াছিল ধোনায়ের সাথ ॥ লইয়া দেওয়ের নাম চাকে দিল হাত * মাক্ষি সব তাড়া পেয়ে ভাগিল উড়িয়া ॥ রাক্ষস দক্ষিণা দেও জানিতে পারিয়া * ভূত প্রেত দেওয়ান লইয়া সঙ্গেতে ॥ আসিয়া পৌঁছিল ধোনা ছিল যে বনেতে * দেও বলে দেখ ধোনা তামাসা আমার ॥ পৌঁছইয়া দিব মধু নায়েতে তোমার * এই কথা বলিয়া দেও দান সবাকায় ॥ মোম মধু ভাংগিতে হুকুম দিল ঠায় * দক্ষিণা দেওয়ের বাতে দান ছিল যত ॥ ভূত প্রেত ডাকিনী ধাইল শত শত * ভাংগিয়া তামাম মধু মহজার বিচেতে ॥ সাত ডিঙা বোঝাই করিল সহদেতে * ধোনাকে দক্ষিণা দেও কহে এ প্রকার ॥ দেখ আর জাগা নাই কিস্তিতে তোমার * ধাওয়াধাই ধোনা এসে নায়েতে পৌঁছিল ৷ বাকি নাহি আছে জাগা বোঝাই হইল * তখন আবার দেও কহে এ রূপেতে ৷ দেহ সাত ডিঙা মধু ফেলিয়া পানিতে * মোম দিব সাত ডিঙা বোঝাই করিয়া ॥ তাহাতে কিম্মত বেশি পাইবে বেচিয়া * মোম হৈতে খুব কম মধুর কিম্মত ॥ গাঙেতে ফেলিয়া দিল সহদ তারত * যে গাঙে ধোনাই মধু ফেলিল তামাম ॥ সেই হইতে সে গাঙের মধুখালি নাম * যে পানির মাঝে মধু ধোনাই ফেলিল ॥ চারিদিকে নোনা বিচখানে মিঠা হইল * আজ তক সেই গাঙে আছে মিঠা পানি। ৷ তাহা বাদে সাত ডিঙা মোম দেওমনি * ধোনার নায়েতে দিল বোঝাই করিয়া ॥ তা বাদে কহিল দেও শোন দেল দিয়া * তোমাকে দিলাম মোম বহুত কিম্মতি ॥ বেচিয়া পাইবে ধন করিবে রাজত্যি * যে কারণে দিনু মোম শোনো তার বেনা ৷ দুখেকে দিতে খবরদার ভুলিবে না * যদি হেলা ছাজি কর সাজা পাবে তার ॥ গাঙেতে তামাম নাও ডুবাব তোমার * বিদায় হইল এই ধোনাকে বলিয়া ॥ পাকাইতে ছিল দুখে নায়েতে বসিয়া * ভিজা কাট নাহি জ্বলে পাকাতে না পারে ॥ রন্ধন না হৈল তাই কান্দে জারে জারে * রশুই না হইলে গোশ্ব হইবে ধোনায় ॥ ভাবিয়া তাহার দিশা কিছু নাহি পায় * বন বিবির নাম শেষে ইয়াদ করিল ॥ ভুরকুণ্ডায় ছিল বিবি মালুম পাইল * পলক মারিতে দের না হইল আর ॥ দুখের নিকটে এসে কহে এ প্রকার * কেন ডাকিয়াছ কহে আসিয়া নিকটে ॥ দুখে কহে মা জননী পড়িনু সঙ্কটে * ধোনা চাচা বলে গেছে রশুই করিতে ॥ শুখা কাষ্ঠ অভাবে না পারি পাকাইতে *বন বিবি বলে বাছা না ভাবিও তুমি ॥ খোদার শুকুমে পাকাইয়া দিব আমি * বন বিবি তাহাকে যে ভরসা দিল । সকল হাড়ির পরে হাত ফেরাইল * কামালের ধনী বিবি বরকতের হাত ৷ বুজরগীতে পাকাইল ছালুন ও ভাত * বেগর আগুনে খানা হল তৈয়ার ॥ বিবি কহে সকলেতে খাও এইবার * আরজ করিয়া দুখে কহিল তখন ॥ শুন মা জননী আমার বিপদের বর্ণন * কাল বুঝি ধোনা চাচা যাবে ডিঙা লিয়া ॥ দক্ষিণা দেওয়ের তরে যাবে মোরে দিয়া * জগত জননী মাতা আসিয়া তরাবে ৷ বন বিবি বলে বাছা মনে না ভাবিবে * খাইতে তোমারে নাহি রায়ের ক্ষমতা ॥ আশা মেরে শা জঙলি উড়াইবে মাথা * বন বিবি ইহা বলে বিদায় হইল ৷ মহল থাকিয়া ধোনা আসিয়া পৌঁছিল * দুখেকে কহিল কোন ডিঙার উপর ॥ পাকাইয়া রাখিয়াছ কহ সে খবর * দুখে বলে চাচাজিগো এই ডিঙা পরে ॥ রান্ধিয়া রেখেছি আমি তোমাদের তরে * ধোনা যদি শোনে এয়ছা গিয়া সেই নায় ॥ সকলে একস্তরে বসে খানা খায় * সেরূপ অমৃত খানা কভু না খাইল ॥ সকলেতে কানাকানি করিতে লাগিল * সকলে মিলিয়া কহে ধোনার খাতের ॥ কভু এই খানা নহে দুখের হাতের * সকলেতে ঠারাঠারি কহিতে লাগিল ৷ দুখের উপরে সদয় বন বিবি হইল * ধোনা কহে হেগে বেটা পানি নাহি লয় ॥ দুখের উপর বন বিবি হইবে সদয় * এইরূপে বলা কওয়া করিতে লাগিল ৷ দিন গুজারিয়া রাত আসিয়া পৌঁছিল * যার যে ডিঙাতে গিয়া করিলা আরাম ॥ সারা রাত হৈল দুখের আরাম হারাম * ভাবিতে লাগিল এয়ছা কান্দিয়া কান্দিয়া ॥ ধোনা চাচা যাবে দেশে কাল ডিঙা লিয়া * দক্ষিণা দেওয়ের তরে আমারে দে যাবে ॥ বাঘ হয়ে আমাকে সে ধরিয়া খাইবে * মা বলিতে আমা বই কেহ আর নাই ৷ আমার ভাগ্যেতে আল্লা লিখি এয়ছাই ৷ এই কথা ভেবে দুখে দেলে আপনার ॥ আল্লাকে ইয়াদ করে কান্দে জারেজার * এক জারা চক্ষে তার নিন্দ না আইল ॥ কান্দিয়া কান্দিয়া সেই রাত পোহাইল * খানা পিনা খেয়ে সবে শুইয়া রহিল ৷ যেই রাত পোহাইয়া ফজর হইল * দাড়ি মাঝি সবাকারে কহিল ধোনাই ॥ খোলহ নায়ের কাছি আর দেরি নাই * ছয় ডিঙা খুলে দিল হুকুমে ধোনার ॥ নাহি খোলে এক ডিঙা ভেদ ছিল তার * কহে ধোনা দের করিতেছ কি কারণ ॥ মাঝি বলে কিসে হবে নায়েতে রন্ধন * নায়ের পরেতে কাঠ নাহি একখানা ॥ নায়ে এত লোক কিসে পাকাইবে খানা * মাঝির মুখেতে ধোনা শুনে এ বয়ান ॥ বলে বাবা দুখে থোড়া কাষ্ঠ কেটে আন * দুখে কহে মাফ কর চাচাজি আমায় ॥ দোছরাকে ভেজে দেহ না যাব চড়ায় * এত লোক আছে কর তাদের হুকুম ॥ আমার উপরে কর খামকা জুলুম * ধোনা মৌলে বলে বেটা নায়ে বসে খাবে । আদান ফরমাস করিলাম নাহি যাবে * ছঙিন জবাব দিলে মুখের উপরে ॥ চড়াতে না যাব আমি কাষ্ঠ আনিবারে * কাটিয়া জবান দেব কুকুরে আমার ॥ দুখে বলে চাচাজিগো হেকমত তোমার * চেতনে আথিনু দেও কহিল তোমায় ॥ কেঁদোখালি চরে তুমি দে যাবে আমায় * বাঘ হৈয়া দেও এসে পরে খাবে মোরে ॥ মাল লিয়া বড়লোক হবে গিয়া ঘরে * দুখের মায়েরে কবে দেশেতে যাইয়া ॥ ছেলেকে খাইল বাঘে দিবে শোনাইয়া । কি বলে আনিয়া মোরে ছিলে ঘর হইতে ৷ মা আমাকে সুপে দিয়া ছিল তেরা হাতে * তাহার সরত শুধু আদায় করিয়া ॥ কেঁদোখালির চরে মোরে বাঘে খাওয়াইয়া * শুনিয়া আমার মাতা কান্দিয়া কান্দিয়া ॥ আর কেহ নাহি শোকে যাইবে মরিয়া * ধোনা বলে পাজি বেটা ওস্তাদ ঠেটার ॥ একটা ফরমাস যদি শুনিলে আমার * ভালাই চাহ তো জলদি কাঠ আন গিয়া ॥ নাও হইতে কান ধরে দিব নামাইয়া * এই কাজের তরে মোরে নায়ে এনেছিলে ॥ দুখের জান গেল আর তুমি ধনী হইলে * আর কেন ফজিহত কর বার বার ॥ আমারে খাইলে বাঘে পরওয়া কি তোমার * দুখে বলে চাচাজিগো ছালাম চরণে ॥ বল কাঠ ভাঙিবারে যাব কোন বনে * এশারা করিয়া ধোনা বন দেখাইল ॥ দুঃখ মনে দুখে নাও হইতে নামিল ॥ গেল দুখে কেঁদোখালি চর পার হইয়া ॥ ধোনা ডিংগা খুলে গেল দুখেকে রাখিয়া * কহিতে লাগিল ধোনা মুখে আপনার ॥ দুখেকে দিলাম তোরে রাক্ষস এইবার * মেরা দোষ ঘাট মাফ কর দেওমণি ॥ রাখ মার যাহা ইচ্ছা আমি নাহি জানি ॥ কাঠ লিয়া আসে দুখে জংগল হইতে ॥ আসিয়া পৌঁছিল কেঁদোখালির চরেতে * দেখিল যে ধোনা মৌলে গেছে নাও লিয়া ॥ চরেতে বসিয়া কান্দে কাতর হইয়া * খাড়ি হতে দৈত্য তবে দেখিতে পাইল ॥ দুখেকে দিয়াছে ধোনা মালুম করিল * খাইতে রাক্ষস তবে এরাদা করিয়া ॥ আপনাকে বাঘের ছুরত বানাইয়া * মানুষের গোস্ত খাব বহুদিন বাদে ॥ দুখেকে খাইতে যায় মনের আনন্দে * চরে থেকে দুখে হেথা পাইল দেখিতে ॥ বাঘ হইয়া আসে দেও আমাকে খাইতে * প্রকাণ্ড শরীর আর দুম ঊর্ধ্বে তুলে ॥ হাওয়া ভরে আসে সেই বাঘ গাল মেলে * দেখিয়া দুখের গেল পরাণ উড়িয়া ৷ বলে বন বিবি মাগো লেহ উদ্ধারিয়া * এত বলে তরাসে গিরিয়া গেল ভূমে ॥ তামাম অজুদ তরতর হইল ঘামে * বলে মাগো বন বিবি কোথা আছে ছেড়ে ॥ এ সময় আইস মাগো দুখে মারা পড়ে * তরাবে বাঘের হাতে দিয়াছ কারার ॥ না তরাবে কলঙ্ক মা হইবে তোমার * এতেক বলিয়া তবে জ্ঞান হারাইল ॥ ভুরকুণ্ডে থাকিয়া বিবি জানিতে পারিল * সাজংলিকে কহে ভাই জলদি আইস সাথে ॥ বুঝি মারা গেল বাছা রাক্ষসের হাতে * চল জলদি গিয়া করি উহারে উদ্ধার ॥ আস্পর্ধা হয়েছে বড় রাক্ষস বেটার * খেয়ে যদি ফেলে তবে হবে মহা দায় ॥ পলকেতে ভাই বহিন পৌঁছিল সেথায় * দেখে দুখে পড়ে আছে হুস হারাইয়া ॥ দুখেকে লইল বিবি কোলে উঠাইয়া * ধুলা মুছ্যা কোলে নিল জগতের মাতা ॥ বাছা বাছা বলে ডাকে নাহি কহে কথা * বেহুস বেলাল ছিল না পায় শুনিতে ॥ জংগলিকে বলে ভাই দেখ কি চক্ষেতে * সা জংগলি কথা শুনে আসিয়া ত্বরায় ॥ এছম আজম পড়ে ফুক দিল গায় * পানি মুখে দিতে তবে হুস যে হৈল ॥ দেও দুরে বাঘ রূপে খাড়া হয়ে ছিল * সা জংগলিকে দেবি কহে গোশ্ব ভরে ॥ কিছু শিক্ষা দাও এই রাক্ষস বেটারে * ছের উড়াইয়া দেহ থাপ্পড় মারিয়া ॥ শুনিয়া সা জংগলি দৌড়ে আশা হাতে লিয়া * সা জংগলি হুকুম পেয়ে জানের গোশ্বায় ॥ খুব জোরে চড়া মারে বাঘের মাথায় * নামাকুল চড় খেয়ে ফাফড় হইল ৷৷ জান লিয়া দক্ষিণা দেও দক্ষিণে চলিল ॥”
.
চিঠি পড়া শেষ হতে ডিঙির মাঝখানটায় গিয়ে বসল পিয়া। খানিক বাদে ফকিরও এসে বসল পাশে। পিয়ার অবশ্য কেমন যেন মনেই হচ্ছিল যে ও আসবে। ডিঙির ধারের কাঠের ওপর ভর দিয়ে বসেছিল ফকির। ওর কবজির ওপর একটা হাত রেখে পিয়া বলল, “সিং। বনবিবি–দুখে–দক্ষিণ রায়। সিং।” খানিক দ্বিধার পর শেষে রাজি হল ফকির। মাথাটা একটু পেছনে হেলিয়ে সুর করে গাইতে শুরু করল আস্তে আস্তে। হঠাৎ পিয়ার চারিদিকে যেন নদীর মতো বয়ে যেতে লাগল সে গানের সুর আর কথা। তার কোনও অংশ এতটুকু দুর্বোধ্য নয়; প্রতিটা শব্দ পরিষ্কার বুঝতে পারছিল পিয়া। যদিও যে গলাটা কানে শুনতে পাচ্ছে সেটা ফকিরের গলা, আর গানের মানেটা যে বুঝতে পারছে সেটা কানাইয়ের কল্যাণে, এবং অন্তরের গভীরে পিয়া জানে যে ওর মনের ভেতরে এই দু’জনকে নিয়ে টানা-পোড়েন কখনও শেষ হবে না।
কানাইয়ের চিঠির শেষ পাতাটা ওলটাল পিয়া। পেছনে ছোট্ট কয়েক লাইন লেখা। “এই লেখার মূল্য কী তা যদি সত্যিই কখনও জানতে চান, রিলকের এই কথাগুলো মনে করবেন:
‘শোনো: আমরা যে প্রেম করি, ফুলেদের মতো নয়, নয় এক বৎসরের
জন্য শুধু প্রেমরত আমাদের বাহুতে উচ্ছিত হয় প্রাণরস
অনন্ত স্মরণাতীত কাল থেকে। হায়, কন্যা,
এ-ই তবে! অভ্যন্তরে আমরা বেসেছি ভাল–কোনো অনাগতা
অনন্যাকে নয়,
কিন্তু সব কিজাত অগণ্য উচ্ছ্বাস: শুধু নয় একটি শিশুকে,
কিন্তু পিতৃপুরুষেও, যাঁরা ভগ্ন পর্বতের মতো আমাদেরই
গভীরে আছেন পড়ে; আর লুপ্ত মাতাদের শুষ্ক নদীগর্ভ–
তাও; আর সেই শব্দহীন ভূদৃশ্যের সমগ্র বিস্তার, যার
নিয়তি কখনও মেঘে আচ্ছন্ন, আর কখনও নির্মল;–
কন্যা, এরা তোমার অগ্রিম।’
.
মিঠে জল, নোনা জল
রাতে এত গরম পড়েছিল যে মাঝখানে একবার উঠে গিয়ে কেবিনের দরজাটা খুলে দিল কানাই–যদি হাওয়া ঢোকে খানিকটা। তারপর দরজা খোলা রেখেই আবার গিয়ে শুল বাঙ্কের ওপর। পাল্লার ফাঁক দিয়ে বাইরের একটা ফালি চোখে পড়ছে। নরম জ্যোৎস্নায় গর্জনতলার গাছপালার হালকা ছায়া পড়েছে নদীর বুকে। রুপোলি জলের ওপর কালচে ছোপের মতো দেখাচ্ছে সেগুলোকে। কেবিনের ভেতরেও এসে পড়েছে এক চিলতে আলো। আগের দিন ছেড়ে রাখা কাদামাখা জামাকাপড়ের স্তূপটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে সে আলোতে।
ঘুম আসতে দেরি হচ্ছিল কানাইয়ের। আধো তন্দ্রায় চোখদুটো মাঝে মাঝে জড়িয়ে এলেও একটানা গভীর ঘুম কিছুতেই হল না। স্বপ্নের মধ্যে চমক লেগে বারবার তন্দ্রা ভেঙে যাচ্ছিল। ভোর চারটে পর্যন্ত এইভাবে চেষ্টা করে অবশেষে হাল ছেড়ে দিল কানাই। উঠে পড়ল বিছানা ছেড়ে। লুঙ্গির কষিটা শক্ত করে বেঁধে নিয়ে বেরিয়ে এল ডেকের ওপর। আশ্চর্য হয়ে দেখল হরেনও উঠে পড়েছে ঘুম থেকে। পাশাপাশি রাখা দুটো আরাম-চেয়ারের একটায় বসে আছে। জড়ো করা দু’হাতের ওপর থুতনির ভর রেখে এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছে নদীর দিকে। কানাইয়ের পায়ের আওয়াজে মাথা তুলল হরেন। ঘাড় ফিরিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনারও ঘুম হল না?”
“নাঃ,” জবাব দিল কানাই। “আপনি কখন উঠলেন?”
“এই ঘণ্টাখানেক হবে।”
“ওদের নৌকোটা ফিরে আসছে কিনা তাই দেখছিলেন?”
গলার ভেতরে ঘড়ঘড়ে একটা আওয়াজ করল হরেন। “হতেও পারে।”
“কিন্তু এখনও তো আলো ফোটেনি,” কানাই বলল। “এই রাতের বেলায় কি রাস্তা চিনে আসতে পারবে ওরা?”
“চাঁদটা দেখেছেন তো?” জিজ্ঞেস করল হরেন। “একেবারে জ্বলজ্বল করছে আজকে। আর এ জায়গার নদীনালা ফকির ওর হাতের তেলোর মতো চেনে। ফিরতে চাইলে ফিরতে ঠিকই পারত।”
হরেনের কথার ইঙ্গিতটা ঠিক ধরতে পারল না কানাই। “তার মানে?”
“হয়তো ও ফিরতে চায় না আজকে রাতে।” পূর্ণ দৃষ্টিতে কানাইয়ের চোখের দিকে তাকাল হরেন। ধীরে ধীরে হালকা একটা হাসি ছড়িয়ে গেল ওর মুখে। বলল, “কানাইবাবু, আপনি তো অনেক জায়গা ঘুরেছেন, অনেক কিছু দেখেছেন। ভালবাসায় পড়লে মানুষের যে কী হয় সে কি আপনি জানেন না?”
বুকের ওপর জোরালো একটা ঘুষির মতো তীব্রতায় কানাইকে ধাক্কা দিল প্রশ্নটা–তক্ষুনি কোনও জবাব খুঁজে পেল না বলে শুধু নয়, এই রকম একটা কথা হরেনের স্বভাবের সঙ্গে কিছুতেই যেন মিল খায় না, তাই কেমন যেন অদ্ভুত লাগল কানাইয়ের।
জিজ্ঞেস করল, “সত্যি সত্যি এরকম কিছু হয়েছে বলে মনে হয় আপনার?”
হরেন হাসল। “আপনি কি জেনেশুনে অন্ধ সাজার চেষ্টা করছেন কানাইবাবু? নাকি ফকিরের মতো একটা অশিক্ষিত মানুষও যে প্রেমে পড়তে পারে সেটা বিশ্বাস করে উঠতে পারছেন না?”
বিরক্ত হল কানাই। “এ কথা কেন বলছেন হরেনদা? আর এরকম কিছু আমি ভাবতেই বা যাব কেন?”
“ভাবলে আশ্চর্য হব না,” শান্ত গলায় বলল হরেন। “এরকম চিন্তা লোকের মনে আসতে আমি আগেও দেখেছি। সত্যি কথা বলতে কী, আপনার মেসোকেই দেখেছি।”
“মেসো? মানে নির্মল সারের কথা বলছেন আপনি?”
“আজ্ঞে। সেই যে রাতের বেলায় আমার নৌকোয় উনি আর আমি মরিচঝাঁপিতে গিয়ে উঠেছিলাম, সে কথা জানেন তো? আপনি কি ভেবেছেন শুধু ঝড়ের টানেই ওখানে গিয়ে ঠেকেছিলাম আমরা? তা নয়।”
“তার মানে?”
“কুসুম আর আমি যে একই গাঁয়ের লোক সে কথা তো আপনি জানেন কানাইবাবু। আমার থেকে প্রায় বছর ছয় সাতের ছোট ছিল কুসুম। যখন আমার বিয়ে হয়, ও তখন একেবারে ছেলেমানুষ। আমার বয়স তখন ছিল চোদ্দো। আমাদের বিয়ে-শাদির সব কিছু তো বাড়ির বড়রাই ঠিক করে, আর এ ব্যাপারে আমার নিজের কোনও মতামতও ছিল না। তো, কুসুমের বাবাকে আমি ছোটবেলা থেকেই চিনতাম। মাঝে মধ্যেই ওদের ডিঙিতে টুকটাক কাজ করতে যেতাম। যেবার ওর বাবাকে বাঘে ধরল তখনও আমি ছিলাম ওখানে। কুসুমের সঙ্গে বাঁধের ওপর দাঁড়িয়ে চোখের সামনে দেখেছিলাম পুরো ঘটনাটা। সেই থেকেই কেমন যেন মনে হত ওর আর ওর মায়ের দেখাশোনা করাটা আমারই দায়িত্ব। অবশ্য খুব বিশেষ কিছু যে করতে পারতাম তাও নয়। আমার তখন কতই বা বয়েস? মেরেকেটে কুড়ি। নিজের একটা সংসার আছে, বৌ বাচ্চা আছে। এদিকে কুসুমের মা তখন দিলীপের কাছে কাজের খোঁজ করছে। আমাকে বলেছিল সে কথা। আমি তো শুনেই বুঝেছি ব্যাপার সুবিধের নয়। নানাভাবে সাবধান করার চেষ্টা করলাম। কী কাজ দিলীপ দিতে পারে সেটাও বোঝানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু আমার কথা শুনলে তো। কতটুকুই বা খবর রাখত বেচারি এই দুনিয়াটার? এইসব ব্যাপার-স্যাপার ওর কল্পনারও বাইরে ছিল। তারপর চলে যখন গেল শেষ পর্যন্ত, আমার তখন আরও বেশি করে মনে হত লাগল কুসুমের দেখাশোনা আমাকেই করতে হবে। সেজন্যেই ওকে লুসিবাড়িতে নিয়ে এসেছিলাম আমি–আপনার মাসির কাছে। সেখানেও যখন দেখলাম দিলীপের নাগাল পৌঁছেছে, তখন আমি ওকে লুসিবাড়ি থেকে বের করে নিয়ে গেলাম। একেবারে ভাটির দেশের বাইরে যাতে চলে যেতে পারে সে ব্যবস্থা করে দিলাম। তবে আমি তো আমার মতো করে ভেবেছিলাম ভেবেছিলাম কুসুমকে আমি আড়াল করে রাখছি, দূরে সরিয়ে রাখছি সব বিপদ আপদ থেকে; আসলে কিন্তু কুসুমের মনের জোর ছিল আমার থেকে অনেক বেশি। আমার কেন, কারওর পাহারাদারিরই কোনও দরকার ছিল না ওর। মাকে খুঁজতে যাওয়ার জন্য যেদিন ওকে ক্যানিং স্টেশনে নিয়ে গেলাম সেই দিনই আমি বুঝতে পেরেছিলাম সেটা। ট্রেনে তুলে দেওয়ার আগে হঠাৎ আমার মনে হল আর হয়তো জীবনে কোনওদিন ওর সঙ্গে দেখা হবে না। ওকে যেতে বারণ করলাম আমি। বার বার করে বললাম ফিরে আসতে আমার সঙ্গে। সত্যি কথা বলব–আমার কেমন ভয় করছিল। একা একটা মেয়ে অজানা অচেনা জায়গায় কোথায় ঘুরে ঘুরে বেড়াবে, কখন কী বিপদ হবে কে বলতে পারে। অনেক করে মানা করলাম। এমনকী বললাম আমার বউ-বাচ্চাকে ছেড়ে দেব, ওকে বিয়ে করে একসঙ্গে থাকব। কিন্তু কে শোনে কার কথা। ওর মন যা চেয়েছে সে ও করবেই, কেউ আটকাতে পারবে না। করলও তাই শেষ পর্যন্ত। এখনও ওকে ট্রেনে তুলে দেওয়ার সময়কার ছবিটা আমার চোখে ভাসে। ফ্রক পরা, চুলগুলো তখনও ছোট ছোট বড় মেয়েমানুষ নয়, একটা বাচ্চার মতো চেহারা। ট্রেনটা চলে গেল, কিন্তু সে ছবিটা রয়ে গেল আমার মনের মধ্যে।
“তার প্রায় বছর আষ্টেক কেটে যাওয়ার পর ঘটল মরিচঝাঁপির ঘটনা। নানারকম গুজব কানে আসত তখন। শুনতে পেলাম রিফিউজিরা এসে উঠেছে ওখানে। দখল করে বসেছে দ্বীপটা। কানাঘুষোয় শুনলাম আমাদের কুসুমও নাকি আছে ওই রিফিউজিদের সঙ্গে। বিধবা হয়ে ফিরে এসেছে আবার ভাটির দেশে। সঙ্গে একটা বাচ্চা। ও কোথায় আছে সেটা খুঁজে বের করলাম আমি। ডিঙিতে করে ওর ঘরের পাশ দিয়ে কয়েকবার যাতায়াত করলাম, কিন্তু কিছুতেই সাহস করে গিয়ে দেখা করে উঠতে পারলাম না। যেদিন আপনার মেসোকে নিয়ে কুমিরমারি গেলাম, সেদিন ওর কথাই আমি ভাবছিলাম সর্বক্ষণ। কত কাছ থেকে এসে ঘুরে যাচ্ছি, বার বার সে কথাই মনে হচ্ছিল আমার। তারপর ফেরার পথে সেই ঝড় উঠল, বনবিবির আশীর্বাদের মতো।
“সেইদিন থেকে আমি ঘুরে ফিরে বারবার যেতে লাগলাম মরিচঝাঁপিতে। আপনার মেসোকে ওখানে নিয়ে যাওয়ার অছিলায় চলে যেতাম, উনিও যেতেন বারবার, আমার অছিলায়। একটা জিনিস খেয়াল করলাম–আমি যেমন সবসময় কুসুমের কথা ভাবতাম, উনিও সেরকম ওর কথা না ভেবে থাকতে পারতেন না। আমার মতো ওনারও যেন রক্তের মধ্যে ঢুকে গিয়েছিল কুসুম। ওর নাম শুনলেই চঞ্চল হয়ে উঠতেন উনি, হাঁটাচলা বদলে যেত, মুখে যেন কথার খই ফুটত। খুব কথা বলতে ভালবাসতেন আপনার মেসো। আর আমার আবার মুখে বেশি কথা আসত না। আমি বুঝতে পারতাম এটা-ওটা নানারকমের গল্প-কাহিনি বলে ওকে বশ করার চেষ্টা করছেন উনি। আমার সেদিক থেকে দেওয়ার কিছুই ছিল না–শুধু চোখের দেখাটুকু ছাড়া। শেষ পর্যন্ত কিন্তু দু’জনের মধ্যে থেকে আমাকেই বেছে নিল কুসুম।
“হামলার আগের রাত্তিরে, বুঝলেন কানাইবাবু, আপনার মেসো যখন ওনার শেষ কথাগুলো লিখছিলেন ওই খাতাটায়, কুসুম আমাকে বলল, সারকে আরেকটু সময় দাও; চলো আমরা বাইরে যাই। ও আমাকে নিয়ে গেল আমার নৌকোয়। সেখানেই প্রমাণ দিল ওর ভালবাসার একটা পুরুষ মানুষ যা চাইতে পারে, সব চাহিদা পূরণ করে দিল ও। নদীতে ভরা জোয়ার তখন। ঢেউয়ের মুখে অল্প দোল খাচ্ছিল’ বাদাবনের আড়ালে লুকিয়ে রাখা আমার ডিঙি। আমরা গিয়ে উঠলাম তার ওপর, আমার গামছা দিয়ে ওর গোড়ালি থেকে মুছিয়ে দিলাম কাদা। আমার পা দুটো কুসুম ওর দু’হাতের মধ্যে নিয়ে ভাল করে ধুয়ে পরিষ্কার করে দিল। তারপর যেন একটা বাঁধ ভেঙে গেল। জলের মতো গলে গিয়ে মিশে গেল আমাদের শরীরদুটো–নদী যেমন সাগরে গিয়ে মেশে, সেরকম। মুখ ফুটে কেউ কাউকেই বলিনি কিছুই, বলার কিছু ছিলও না। সব কথাই ঢাকা পড়ে গিয়েছিল আমাদের শরীরের ওমে। কথা কিছু ছিল না, শুধু মিশে যাওয়া ছিল–মিঠে জল আর লোনা জলের মতো। আর ছিল জোয়ার-ভাটার ঢেউয়ের মতো ওঠাপড়া। আর কিচ্ছু না।”
.
দিগন্তে
ভোরবেলা ঘুম ভাঙতে পিয়া দেখল মুখ মাথা ভিজে চুপচুপে হয়ে গেছে রাতের শিশিরে। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, সকালের দিকটায় জলের ওপর রোজ যেমন কুয়াশা থাকে আজকে তার চিহ্নমাত্র দেখা যাচ্ছে না। আগের রাতে এত গরম ছিল, তার জন্যেই নিশ্চয়ই এরকম হয়েছে। এখন অবশ্য বেশ ভালই হাওয়া চলছে, এমনকী নদীতে ঢেউও উঠছে অল্প অল্প। মনে হচ্ছে কালকের অসহ্য গরমটা আজকে আর ভোগ করতে হবে না।
ফকির এখনও অঘোর ঘুমে। তাই চুপচাপ নিজের জায়গায় শুয়ে শুয়ে ভোরের শব্দ শুনতে লাগল পিয়া: দুরে কোথায় একটা পাখি ডাকছে, ঝরঝর করে হাওয়া বইছে জঙ্গলের ডালপাতার মধ্যে দিয়ে, ছলাৎ ছলাৎ ঢেউ উঠছে জোয়ারের জলে। চারপাশের বিভিন্ন আওয়াজে কান খানিকটা অভ্যস্ত হয়ে আসার পর অন্যরকম একটা শব্দ শুনতে পেল পিয়া, যে সমস্ত আওয়াজগুলো এতক্ষণ ধরে কানে আসছিল সেগুলোর সঙ্গে এটা যেন ঠিক খাপ খায় না। ফোঁস করে হাঁফ ছাড়ার মতো ছোট্ট একটা শব্দ, অনেকটা যেন কেউ দীর্ঘশ্বাস ছাড়ছে থেমে থেমে। কিন্তু ইরাবড়ি ডলফিনের আওয়াজের সঙ্গে কোনও মিল নেই এ শব্দের। চট করে উপুড় হয়ে গিয়ে দুরবিনটার দিকে হাত বাড়াল পিয়া। মাথার ভেতর থেকে কেউ যেন বলে উঠল আওয়াজটা গ্যাঞ্জেটিক ডলফিনের প্ল্যাটানিস্টা গ্যাঞ্জেটিকা। কয়েক সেকেন্ড পরেই জলের মধ্যে ডিগবাজি খাওয়া পাখনাবিহীন একটা মসৃণ পিঠ চোখে পড়ল পিয়ার নৌকো থেকে প্রায় দুশো মিটার সামনে। মিলে গেছে! এত তাড়াতাড়ি ধারণাটা সত্যি প্রমাণিত হতে উত্তেজিত হয়ে উঠল পিয়া। একটা নয়, অন্তত গোটা তিনেক ডলফিন চক্কর কেটে বেড়াচ্ছে ডিঙিটার আশেপাশে।
উত্তেজনায় উঠে বসল পিয়া। এই ক’দিনের মধ্যে গ্যাঞ্জেটিক ডলফিন চোখেই পড়েনি, মনটা তাই একটু খুঁতখুঁত করছিল ওর–আর আজকে এই সক্কাল সক্কাল, এ তো একেবারে মেঘ না চাইতেই জল। তাড়াতাড়ি জিপিএস-এ একটা রিডিং নিয়ে ডেটাশিট বের করার জন্যে পিয়া পিঠব্যাগটার দিকে হাত বাড়াল।
ডেটাশিটে কয়েকটা এন্ট্রি করার পর হঠাৎ কেমন যেন একটা ধন্দ লাগল পিয়ার; মনে হল কোথায় যেন গড়বড় হচ্ছে একটা। হিসেব করে দেখল অস্বাভাবিক রকম কম সময়ের ব্যবধানে ডলফিনগুলো ভেসে উঠছে জলের ওপর। খুব বেশি হলে দু’এক মিনিট পর পরই ভুস করে উঠে শ্বাস ছাড়ছে, আবার ডিগবাজি খেয়ে তলিয়ে যাচ্ছে নদীর মধ্যে। আর একাধিকবার, শ্বসের আওয়াজের সঙ্গে সঙ্গে একটা কুঁইকুই শব্দও কানে এল পিয়ার।
নাঃ, একটা কিছু গন্ডগোল নিশ্চয়ই আছে। এমনিতে তো এই প্রাণী কখনও এরকম ব্যবহার করে না। ডেটাশিটটা পাশে সরিয়ে দূরবিনে চোখ রাখল পিয়া।
ডলফিনগুলোর অস্বাভাবিক ব্যবহারের কথা ভাবতে ভাবতে হঠাৎ কয়েক বছর আগে পড়া একটা প্রবন্ধের কথা মনে পড়ে গেল ওর। প্রফেসর জি পিলেরি নামের এক সুইস সিটোলজিস্টের লেখা। মিষ্টি জলের শুশুকদের বিষয়ে গবেষণায় অগ্রগণ্য সুইজারল্যান্ডের এই অধ্যাপক; অন্যতম পথিকৃৎ-ও বলা যায়। যতদূর মনে পড়ল সত্তরের দশকের কোনও এক সময়ে প্রকাশিত হয়েছিল প্রবন্ধটা। পাকিস্তানের সিন্ধু নদে তার গবেণার কাজ করছিলেন পিলেরি। ওখানকার কয়েকজন জেলেকে কিছু টাকাপয়সা দিয়ে রাজি করিয়েছিলেন একজোড়া প্ল্যাটানিস্টা ধরে দেওয়ার জন্য একটা ছেলে শুশুক আর একটা মেয়ে শুশুক। ডলফিন ধরার সেই কাহিনি বিস্তারিতভাবে লিখেছিলেন অধ্যাপক তার ওই প্রবন্ধে। খুব একটা সহজ ছিল না কাজটা। কারণ গ্যাঞ্জেটিক ডলফিনদের শরীরের ধ্বনি-প্রতিক্ষেপক রাডার এতই নির্ভুল যে নদীতে জাল নামানো মাত্র ওরা সেটা টের পেয়ে যায়। শেষে অনেক মাথা খাঁটিয়ে জেলেরা শুশুকগুলোকে লোভ দেখিয়ে এমন একটা জায়গায় নিয়ে গেল যেখানে ওপর থেকে জাল ফেলে ওদের ধরা যায়।
জোড়া ডলফিন ধরা তো পড়ল৷ পিলেরির পরবর্তী কাজ হল পাকিস্তান থেকে তাদের সুইজারল্যান্ডে নিজের গবেষণাগারে নিয়ে যাওয়া। সে প্রক্রিয়া এতই জটিল আর অদ্ভুত, যে পড়তে পড়তে হো হো করে হেসে উঠেছিল পিয়া। প্রথমে তো প্রাণীগুলোকে ভেজা কাপড় দিয়ে জড়ানো হল। তারপর মোটরবোটে করে নিয়ে যাওয়া হল এক গাড়ি-চলা পথের কাছে। সেখান থেকে একটা ট্রাক ভাড়া করে প্রথমে একটা রেলস্টেশনে যাওয়া হল, তারপর ট্রেনে করে করাচি। আর এই পুরো সময়টা ধরে কিছুক্ষণ পর পরই সিন্ধু নদের জল দিয়ে ভিজিয়ে দেওয়া হচ্ছিল শুশুকগুলোর সারা গা। করাচি স্টেশনে ওদের জন্য অপেক্ষা করছিল একটা ল্যান্ড-রোভার। তাতে করে প্রাণীগুলোকে নিয়ে যাওয়া হল একটা হোটেলে। সেখানে বিশেষভাবে তৈরি করা একটা সুইমিং পুলে রাখা হল ওদের। তারপর কয়েকদিনের বিশ্রাম। বিশ্রাম শেষে আবার ল্যান্ড-রোভারে চড়িয়ে ডলফিনযুগলকে নিয়ে যাওয়া হল করাচি এয়ারপোর্টে। সোজা টারম্যাক পর্যন্ত গাড়িতে করে নিয়ে গিয়ে একটা সুইসএয়ার প্লেনে উঠিয়ে দেওয়া হল ওদের। দুই শুশুককে নিয়ে সেই প্লেন পাকিস্তান থেকে সরাসরি বরফ-জমা সুইজারল্যান্ডে না গিয়ে মাঝপথে আথেন্সে থামল কিছুক্ষণ। সেখান থেকে অবশেষে জুরিখ। এয়ারপোর্ট থেকে হটওয়াটার বটল আর কম্বল চাপা দিয়ে গরম অ্যাম্বুলেন্সে করে ডলফিনদুটোকে নিয়ে যাওয়া হল বার্নের এক প্রাণিগবেষণাকেন্দ্রে। সেখানে বিশাল একটা চৌবাচ্চা আগে থেকে বিশেষ ভাবে প্রস্তুত রাখা হয়েছিল ওদের জন্যে। এমন ব্যবস্থা করা ছিল যাতে সে চৌবাচ্চায় জলের উষ্ণতা মোটামুটি সিন্ধু নদের জলের তাপমাত্রার সমান থাকে সব সময়।
আল্পস পাহাড়ের এই সিন্ধু নদে গবেষণার সময়ই প্ল্যাটানিস্টাদের স্বভাবের একটা অদ্ভুত দিক লক্ষ করেন পিলেরি। যে অভ্যাসের কথা তার আগে কেউ জানত না। দেখা গেল এ জাতের ডলফিনরা আবহাওয়ার পরিবর্তনের প্রতি খুবই সংবেদনশীল। বায়ুর চাপের রদবদলের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যায় ওদের ব্যবহার। বার্ন এবং আশেপাশের অঞ্চলে ঝড় বাদলা হলেই কেমন অস্বাভাবিক হয়ে যায় ওদের আচরণ।
বহুদিন আগে পড়া প্রবন্ধ থেকে প্ল্যাটানিস্টাদের স্বভাবের এই খুঁটিনাটিগুলো মনে করার চেষ্টা করছিল পিয়া। হঠাৎ, দূরবিনটা একটু সরতেই নদী থেকে ওর নজর গিয়ে পড়ল দিগন্তের দিকে, দক্ষিণ-পুর্ব কোণে। অন্য কোথাও মেঘের কোনও চিহ্ন নেই, কিন্তু ঠিক ওই কোণ বরাবর গিয়ে রং পালটে গেছে আকাশের, অদ্ভুত ইস্পাত-ধূসর চেহারা নিয়েছে সেখানটায়।
চোখ থেকে দূরবিন নামিয়ে নিল পিয়া। আকাশ থেকে চোখ ফিরিয়ে ডলফিনগুলোর দিকে তাকাল, তারপর ফের দেখল আকাশের দিকে। হঠাৎ পুরো বিষয়টা জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গেল ওর চোখের সামনে। কিছুনা ভেবেই চিৎকার করতে শুরু করল ও, “ঝড় আসছে, ফকির, ঝড় আসছে! এক্ষুনি মেঘার কাছে ফিরে যেতে হবে আমাদের।”
.
হরেনের আঙুল বরাবর দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে তাকাল কানাই। সেখানে দিগন্তের কাছে স্পষ্ট চোখে পড়ছে একটা কালচে ছোপ, ধেবড়ে যাওয়া কাজলের মতো। “যা ভেবেছিলাম তার চেয়ে অনেক তাড়াতাড়িই এসে গেল,” কবজি উলটে ঘড়ি দেখল হরেন। “সাড়ে পাঁচটা বাজে এখন। খুব বেশি হলে আর ঠিক আধঘণ্টা অপেক্ষা করতে পারব আমরা। তার চেয়ে দেরি করলে লুসিবাড়িতে আর ফেরা হবে না।”
মানতে চাইল না কানাই। “এভাবে ওদের ঝড়ের মুখে ফেলে রেখে আমরা নিরাপদে ফিরে চলে যাব? তা কী করে হয় হরেনদা?”
“কিছু করার নেই কানাইবাবু,” জবাব দিল হরেন। “হয় আধঘণ্টার মধ্যে ফিরে যেতে হবে, নয়তো এই ভটভটিসুদ্ধ এখানেই ডুবে মরতে হবে সবাই মিলে। শুধু আমার কি আপনার কথা আমি ভাবছিনা, আমার বাচ্চা নাতিটাও তো সঙ্গে আছে। আর নিরাপদে ফেরার কথা বলছেন? আমরাও যে ঝড় সামলে ঠিকমতো ফিরতে পারব কোনও গ্যারান্টি নেই তার।”
“কিন্তু এখানে কাছাকাছি কোনও আড়াল-টাড়াল নেই? যেখানে ঝড় থামা পর্যন্ত অপেক্ষা করা যেতে পারে?”
দিগন্তের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত আঁক কেটে গেল হরেনের তর্জনী। “কানাইবাবু, তাকিয়ে দেখুন চারদিকে। কোথাও কোনও আড়াল চোখে পড়ছে আপনার? এই সব ছোট ছোট দ্বীপগুলো দেখছেন তো আশেপাশে? ঝড় এলে প্রত্যেক ক’টা কয়েক ফুট জলের তলায় চলে যাবে। যদি এখানে থাকি, হয় মাঝনদীতে ডুববে আমাদের ভটভটি, নয়তো গিয়ে আছড়ে পড়বে পাড়ের ওপর। একেবারে কোনও আশা থাকবে না বাঁচার। কাজেই, ফিরতে আমাদের হবেই।”
“আর ওদের কী হবে?” জিজ্ঞেস করল কানাই। “ওরা বাঁচবে কী করে?”
কানাইয়ের কাঁধে হাত রাখল হরেন। বলল, “শুনুন। খুব একটা সহজ হবে না ব্যাপারটা, কিন্তু এরকম সময় কী করতে হয় ফকির সেটা খুব ভাল করে জানে। এই ঝড়ের মুখ থেকে বেঁচে কেউ যদি ফিরতে পারে, তা হলে ও-ই পারবে। ওর দাদুও একবার গর্জনতলায় এরকম সাইক্লোনের মধ্যে থেকে বেঁচে এসেছিল। এ ছাড়া আর কী বলব বলুন? এখন সবটাই আমাদের হাতের বাইরে।”
.
ক্ষয়ক্ষতি
খাঁড়ির মুখ থেকে ফকির যখন ডিঙিটাকে ঠেলে বের করল, তখন সবে মাত্র সাড়ে পাঁচটা বেজেছে। বাতাসের বেগ বেড়েছে, কিন্তু আকাশের বেশিরভাগটাই পরিষ্কার দেখে একটু ভরসা পেল পিয়া। এমনকী শুরুর দিকে একটু সুবিধাই হল ওদের, যেদিকে ওরা যেতে চাইছিল ঢেউ আর হাওয়ার টানে সেই দিকেই তরতর করে এগোতে লাগল নৌকো। ফলে, মনে হচ্ছিল যেন একজোড়া বাড়তি দাঁড় কেউ জুড়ে দিয়েছে ডিঙিটার সঙ্গে।
নৌকোর মুখের দিকে পিঠ করে বসেছিল পিয়া, তাই প্রথম দিকটায়, হাওয়া যখন ঠেলে নিয়ে যাচ্ছিল ওদের, তখন পেছন থেকে আসা ঢেউগুলোকে ও দেখতে পাচ্ছিল। তখনও পর্যন্ত জলের ওপর উঁচু-নিচু ভাঁজের মতো মনে হচ্ছিল সেগুলোকে, ওপরে কোনও ফেনা টেনাও ছিল না। একটার পর একটা ঢেউ নিঃশব্দে গড়িয়ে এসে তুলে ধরছিল ডিঙির পেছনটা, তারপর আবার নামিয়ে দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল সামনে।
আধঘণ্টাখানেক পর জিপিএস মনিটরে নিজেদের অবস্থানটা একবার দেখে নিল পিয়া। মনে হল দুশ্চিন্তার কিছু নেই। হিসেব করে দেখল এই গতিতে যদি এগোনো যায় তাহলে ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই গর্জনতলায় পৌঁছে যাবে সম্ভবত ঝড় আসার আগেই।
কিন্তু এক একটা মিনিট যেতে লাগল আর সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে লাগল হাওয়ার বেগ। আকাশের কোণের কালো দাগটাও দ্রুত ছড়িয়ে যেতে লাগল চারদিকে। এদিকে ওরা যেখানে আছে সেখান থেকে একটানা সোজা পথে গর্জনতলায় যাওয়া যাবে না। এ খড়ি সে খুঁড়ি হয়ে এঁকেবেঁকে চলতে হচ্ছে ওদের। আর প্রত্যেকটা বাঁক নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বদলে যাচ্ছে হাওয়ার দিক। একেক সময় এমনভাবে ঝাঁপটা এসে লাগছে যে একপাশে একেবারে কাত হয়ে যাচ্ছে ডিঙিটা। বাতাসের বেগ বাড়ার সাথে সাথে ঢেউগুলোও উঁচু হতে শুরু করেছে। মাথায় এখন তাদের সাদা ফেনার ঝুঁটি। বৃষ্টি নামেনি, কিন্তু হাওয়ার তোড়ে গুঁড়ি গুঁড়ি জলের ছিটে এসে লাগছে সারা গায়ে। ভিজে চুপ্পুড় হয়ে গেছে পিয়ার জামাকাপড়। একটু পরে পরেই জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিতে হচ্ছে, না হলে খড়খড়ে নুনের পরত জমে যাচ্ছে ঠোঁটের ওপর।
প্রথম মোহনাটাতে গিয়ে পৌঁছতেই বিশাল বিশাল সব ঢেউয়ের মুখে গিয়ে পড়ল ওদের ডিঙি। এতক্ষণ যেসব ঢেউয়ের মোকাবিলা করে এসেছে সেগুলো এদের তুলনায় একেবারে শিশু। একেকটা ঢেউ ফণা তুলে এগিয়ে আসছে, আর দাঁড় টেনে ডিঙিটাকে তার ওপর দিয়ে নিয়ে যেতে দম বেরিয়ে যাচ্ছে ওদের। অর্ধেক রাস্তা পেরোতে এখন যেন দ্বিগুণ পরিশ্রম করতে হচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন সমতলের সোজা একটা রাস্তাকে তুলে নিয়ে কেউ উঁচুনিচু পাহাড় আর উপত্যকার ওপর দিয়ে পেতে দিয়েছে।
মোহনাটা পেরোনোর পর জিপিএস-এ আরেকবার রিডিং নিল পিয়া। কাজটা করতে খুব বেশি সময় লাগেনি, কিন্তু তাতেই এত পরিশ্রম হল যে দম ফিরে পেতে ওর প্রায় মিনিটখানেক সময় লেগে গেল। হিসেব করে যা পাওয়া গেল সেটাও খুব একটা উৎসাহিত হওয়ার মতো কিছু না। গতি যে কমেছে সেটাই বোঝা গেল আরেকবার, দেখা গেল প্রায় শামুকের মতো বেগে এখন এগোচ্ছে ওদের নৌকো।
মনিটরটা জায়গায় রেখে সবে দাঁড়ের দিকে হাত বাড়িয়েছে পিয়া, এমন সময় কী যেন একটা জিনিস ওর গাল ঘেঁষে কোলের ওপর উড়ে এসে পড়ল। চোখ ফিরিয়ে দেখল জঙ্গলের গাছের একটা পাতা। বাঁদিক থেকে এসেছে পাতাটা। সেদিকে এক পলক তাকাল পিয়া। দেখল বিশাল একটা নদীর একেবারে মধ্যিখানে রয়েছে ওদের ডিঙি। মানে, পাড় থেকে নৌকো পর্যন্ত প্রায় দু’কিলোমিটার পথ পাতাটাকে উড়িয়ে নিয়ে এসেছে হাওয়ায়।
খানিক এগিয়ে আরও একটা বাঁক নিতে হল নৌকোটাকে। হাওয়ার দিকে পেছন ফিরে এখন দাঁড় টানতে হচ্ছে পিয়াকে। যেদিক থেকে ঢেউ আসছে সেদিকটা চোখে পড়ছে না বলে কেমন অদ্ভুত অস্বস্তিকর লাগছে ব্যাপারটা। কোনোক্রমে ঢেউয়ের মাথায় পৌঁছনোর পর জলের গিরিশিরার ওপর টালমাটাল একটা গা-গোলানো মুহূর্ত, তারপরেই আবার টলমল করতে করতে প্রায় চিত হয়ে নেমে আসা–ব্যালান্স রাখতে পিয়াকে দুহাতে নৌকোর কাঠ আঁকড়ে থাকতে হচ্ছে। নীচের দিকে নামতে থাকা ডিঙির মুখের দিক থেকে হুড়হুড় করে উথলে আসছে জল, মনে হচ্ছে যেন ঝপাস করে বালতিভর্তি জল কেউ ঢেলে দিচ্ছে পিঠের ওপর।
ঢেউয়ের ওপর দিয়ে ক্রমাগত এই ওঠানামার ধাক্কায় আস্তে আস্তে আলগা হতে শুরু করেছে ফকিরের ডিঙির প্লাইউডের পাটাতন। মচমচ খটখট আওয়াজ উঠছে সেগুলো থেকে। হঠাৎ বাতাসের একটা ঝাঁপটায় একটুকরো প্লাইউডকে যেন ছিঁড়ে নিয়ে চলে গেল নৌকোর গা থেকে। মুহূর্তের মধ্যে দৃষ্টির বাইরে চলে গেল সেটা। কয়েক মিনিট পরে আরও একটা টুকরো পাক খেতে খেতে উড়ে চলে গেল, তারপরে আরও একটা। ডিঙির খোলের মধ্যেটা এখন পরিষ্কার চোখে পড়ছে। ফকির যেখানে ওর কাঁকড়াগুলো জড়ো করে রেখেছে সে জায়গাটাও এখন দেখতে পাচ্ছে পিয়া।
আরও একটা মোেড়। এবার পাশ থেকে আসছে হাওয়ার ঝাঁপট। নৌকোটা একেবারে কেতরে যাচ্ছে একদিকে। পিয়ার ডানহাতের দড়টা প্রায় ফুটখানেক ওপরে উঠে গেছে অন্যটার থেকে। ডিঙির পাশ দিয়ে ঝুঁকে পড়ে জলের নাগাল পেতে হচ্ছে সেদিকটায়। নৌকো কাত হয়ে যাওয়ায় ছইয়ের নীচে গড়াগড়ি খাচ্ছে ওর পিঠব্যাগ। পিয়া ভেবেছিল ছইয়ের আড়ালে শুকনো থাকবে ওটা, কিন্তু এখন আর কিছুই যায় আসে না। সব দিক থেকে এমনভাবে জলের ছিটে আসছে যে ডিঙির ওপর সবকিছুই ভিজে জবজবে হয়ে গেছে। ঢেউয়ের মাথায় নৌকো আরেকবার লাফিয়ে উঠতেই শূন্যে ছিটকে উঠল পিঠব্যাগটা। ছই না থাকলে এতক্ষণে তলিয়েই যেত নদীতে। হাত থেকে দাঁড়দুটো নামিয়ে রাখল পিয়া। কোনোক্রমে হামাগুড়ি দিয়ে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল ব্যাগটার ওপর। দূরবিন, ডেথ-সাউণ্ডার থেকে শুরু করে ওর সমস্ত যন্ত্রপাতি রয়েছে এর ভেতরে। শুধু জিপিএস মনিটরটা ছাড়া। সেটা ও আগেই প্যান্টের বেল্টের সঙ্গে লাগিয়ে নিয়েছিল। তা ছাড়াও ওর সমস্ত ডেটাশিটগুলোও রয়েছে ওই ব্যাগের মধ্যে। সেগুলোকে প্লাস্টিকে মুড়ে একটা ক্লিপবোর্ডের সঙ্গে লাগিয়ে রেখেছে পিয়া। ওগুলো গেলে গত নদিন ধরে নোট করা ওর সমস্ত তথ্য জলে যাবে।
ব্যাগটাকে কী করে বাঁচানো যায় তার একটা উপায় খুঁজছিল পিয়া, এমন সময় দাঁড় টানা থামিয়ে ফকির একটা দড়ি ছুঁড়ে দিল ওর দিকে। কৃতজ্ঞতায় ভরে গেল পিয়ার মন। হাত বাড়িয়ে দড়িটা নিয়ে ব্যাগের স্ট্র্যাপের মধ্যে দিয়ে গলিয়ে শক্ত করে বেঁধে দিল ছইয়ের বাঁশের সঙ্গে। যন্ত্রপাতিগুলো সব ঠিকঠাক আছে কিনা দেখে নেওয়ার জন্যে একটুখানি ফাঁক করল ব্যাগের মুখটা। মজবুত ওয়াটারপ্রুফ কাপড়ে তৈরি বলে ব্যাগের ভেতরের জিনিসপত্র মোটামুটি শুকনোই আছে দেখা গেল। নিশ্চিন্ত হয়ে ফ্ল্যাপটা বন্ধ করতে গিয়ে হঠাৎ ভেতরের একটা পকেটের দিকে নজর পড়ল পিয়ার। ওর সেলফোনটা রাখা আছে সেখানে। ইন্ডিয়ায় এসে ওটা ব্যবহার করার কথা ভাবেইনি ও, ফলে একবারও অন করাই হয়নি যন্ত্রটা। চার্জও দেওয়া হয়নি কখনও। এখন এই টালমাটাল ডিঙির ওপর বসে হঠাৎ কেমন একটা কৌতূহল পেয়ে বসল পিয়াকে। সুইচ টিপে অন করে দিল ফোনটা। চেনা সবজে আলোটা পর্দায় ফুটে উঠতেই উৎসাহিত হয়ে উঠল ও। কিন্তু এক মুহূর্ত পরেই মিইয়ে গেল সমস্ত উৎসাহ। স্ক্রিনের ওপর ভেসে ওঠা লেখায় দেখা গেল কাভারেজ এরিয়ার বাইরে রয়েছে ফোনটা এখন। যন্ত্রটা ব্যাগের পকেটে রেখে দিয়ে ফ্ল্যাপটা বন্ধ করে দিল পিয়া। তারপর আবার নিজের জায়গায় ফিরে গিয়ে দাঁড় তুলে নিল হাতে।
হাওয়ার জোর আরও বেড়ে গেছে। নৌকোটা আরও একটু কাত হয়ে পড়েছে একপাশে। আবার প্রাণপণে দাঁড় টানতে লাগল পিয়া। কিন্তু তার মধ্যেও মোবাইল ফোনটার কথাই ঘুরে ফিরে আসতে লাগল ওর মাথায়। মনে পড়ল, বইয়ে কি খবরের কাগজে কত লোকের কথা পড়েছে নানা সময়, যারা উলটে যাওয়া ট্রেনের তলা থেকে, ভূমিকম্পে ভেঙে পড়া বাড়ির নীচ থেকে, জ্বলন্ত ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের ভেতর থেকে মোবাইল ফোনে। আত্মীয় পরিজনদের জানিয়েছে তাদের বিপদের কথা।
আচ্ছা, মোবাইলটা যদি চালু থাকত তাহলে কাকে ফোন করত ও এখন? ওয়েস্ট কোস্টের বন্ধুদের? নাঃ। ওরা বুঝতেই পারত না ও কোথায় রয়েছে এখন। জায়গাটা বুঝিয়ে বলতেই অনৈকটা সময় লেগে যেত। তাহলে কানাইকে? পিয়ার মনে পড়ল, সেই ‘উপহারের’ খামটার পেছনে ঠিকানা ছাড়াও কতগুলো ফোন নাম্বার লিখে দিয়েছিল কানাই। একটা মোবাইল নাম্বারও ছিল তার মধ্যে। এতক্ষণে নিশ্চয়ই দিল্লি ফেরার প্লেনে উঠে পড়েছে কানাই। হয়তো বা অফিসে পৌঁছেও গেছে। এখন ওকে ফোন করলে অদ্ভুত হত ব্যাপারটা। হয়তো এমন কিছু একটা ও বলত যে হাসিই পেয়ে যেত পিয়ার। ভাবনাটা মাথায় আসতেই ঠোঁট কামড়াল পিয়া। একটু হাসতে পারলে এখন মন্দ হত না। উথাল পাথাল ঢেউয়ের ওপর মোচার খোলার মতো দুলছে নৌকোটা। কাঠের জোড়গুলো থেকে কেমন একটা গোঙানির মতো শব্দ আসছে, যে-কোনও মুহূর্তে টুকরো টুকরো হয়ে ভেসে যেতে পারে তক্তাগুলো।
শক্ত করে চোখদুটো বন্ধ করল পিয়া, ছেলেবেলায় যেমন করত। প্রার্থনা করার মতো বিড়বিড় করে বলল, জলের মধ্যে নয়, প্লিজ। কিছু হলে শক্ত মাটির ওপরে হোক, জলে নয়; জলের মধ্যে যেন কিছু না হয়।
আরেকটা বাঁকের মুখে এসে পড়ল ওদের ডিঙি। বাঁকটা ঘুরতেই উবু হয়ে উঠে বসল ফকির। আঙুল তুলে দূরের এক চিলতে ডাঙার দিকে ইশারা করল : গর্জনতলা।
“মেঘা? হরেন?” জিজ্ঞেস করল পিয়া। ফকির মাথা নাড়ল। আরেকটু ভাল করে দেখার জন্যে পিয়া উঠে দাঁড়াল। কিন্তু এক নজরেই বোঝা গেল ফকির ভুল বলেনি–হরেনের লঞ্চটা ওখানে নেই। দ্বীপের চারপাশে ধু ধু করছে জল; ফুঁসে ওঠা ঢেউ আর তাদের মাথায় সাদা ফেনা ছাড়া আর কিচ্ছু চোখে পড়ছে না কোথাও।
ব্যাপারটা তখনও হজম করার চেষ্টা করছে পিয়া, এমন সময় ডিঙির ছইয়ের নীচে লাগানো পলিথিনটা হঠাৎ পটপট করে উঠল হাওয়ার টানে-সেই ছাই রঙের পলিথিনটা, মার্কিন মেলব্যাগের থেকে কেটে নেওয়া, প্রথম দিন ডিঙিতে পা দিয়েই যেটা চোখে পড়েছিল পিয়ার। ছইয়ের বাতার নীচ থেকে হঠাৎই খুলে বেরিয়ে এল প্লাস্টিকটা, হাওয়ার টানে ফুলে উঠল পালের মতো। সঙ্গে সঙ্গে মচমচ করে উঠল নৌকোর কাঠগুলো। দাঁত নখওয়ালা হিংস্র একটা জন্তুর মতো ঝড়টা যেন ছিন্নভিন্ন করে ফেলতে চাইছে নৌকোটাকে।
হাওয়ার তোড়ে ফুলে ওঠা প্লাস্টিকের টুকরোটার বাঁধনে টান পড়তেই ডিঙির পেছনদিকটা উঁচু হয়ে উঠল। সামনের দিকটা নিচু হয়ে প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়ল জলের ওপর। দাঁড়-টাড় ফেলে এক লাফ দিয়ে ফকির এগিয়ে গেল বাঁধন খুলে প্লাস্টিকটাকে আলগা করে দেওয়ার জন্যে। কিন্তু দড়ি কাটতে কাটতেই হঠাৎ মড়মড় করে প্রচণ্ড একটা শব্দ শোনা গেল এক ঝটকায় ডিঙির গা থেকে ভেঙে বেরিয়ে গেল ছইটা, হাওয়ার তোড়ে উড়ে গেল শূন্যে। পেছন পেছন ঘুড়ির লেজের মতো উড়ে চলে গেল দড়িদড়ায় জড়ানো পিয়ার পিঠব্যাগ। দেখতে দেখতে কয়েক মিনিটের মধ্যেই প্লাস্টিকের টুকরো, নৌকোর ছই, যন্ত্রপাতি ডেটাশিট আর কানাইয়ের উপহার সমেত পিয়ার ব্যাগ-ট্যাগ সমস্ত নিয়ে জবড়জং জিনিসটা এত দূরে চলে গেল যে কালো আকাশের গায়ে ছোট্ট একটা বিন্দুর মতো দেখাতে লাগল সেটাকে।
.
রায়মঙ্গলের মোহনা থেকে মেঘা যখন লুসিবাড়ির দিকে মোড় নিল, ঘড়ির কাঁটা তখন প্রায় এগারোটার ঘর ছুঁয়েছে। জল থইথই করছে চারদিকে–অদ্ভুত অর্ধস্বচ্ছ জল। সিসার মতো কালো আকাশের নীচে সেই বাদামি জল থেকে যেন নিয়নের মতো আভা বেরোচ্ছে, মনে হচ্ছে নদী যেন ভেতর থেকে জ্বলছে।
যে ক’টা মোহনা ওরা এখনও পর্যন্ত পার হয়ে এসেছে, তাদের সবার থেকে বেশি এই মোহনার বিস্তার; এত বড় বড় ঢেউও আগে দেখা যায়নি। সে ঢেউয়ের মুখে পড়তেই ভটভটির ইঞ্জিনের ছন্দ বদলে গেল–একটানা ঘ্যানঘ্যানে একটা আওয়াজ তুলে ফুলে ওঠা জল কেটে এগোতে লাগল মেঘা। লঞ্চের মুখে ফেটে যাওয়া ঢেউ সমানে লাফিয়ে উঠতে লাগল শূন্যে, উড়ে আসা জলের কণায় ধুয়ে যেতে লাগল সারেঙের কেবিনের কাঁচের জানালা।
কানাই প্রায় সমস্ত সময়টাই সারেঙের কেবিনে হরেনের পাশের সিটটাতে বসেছিল। হাওয়ার জোর বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কথা কমে আসছিল হরেনের, ক্রমশ আরও গম্ভীর হয়ে উঠছিল মুখটা। রায়মঙ্গলের বড় মোহনায় পড়ার পর কানাইয়ের দিকে তাকিয়ে ও বলল, “প্রচুর জল ঢুকছে লঞ্চে। ইঞ্জিনে একবার যদি ঢুকে যায় তাহলে কিন্তু আর কোনো আশা নেই। আপনি বরং একবার নীচে গিয়ে দেখুন কিছু করতে পারেন কিনা।”
ঘাড় নেড়ে উঠে দাঁড়াল কানাই। একটু কুঁজো হয়ে দাঁড়াতে হচ্ছিল, যাতে নিচু ছাদে মাথা না ঠুকে যায়। দরজা খোলার আগে লুঙ্গির খুঁটটা কোমরে গুঁজে নিল ও।
“সাবধান,” পেছন থেকে বলল হরেন। “ডেকটা কিন্তু ভীষণ পিছল হয়ে আছে।” হাতল ঘোরাতেই হাওয়ার তোড়ে হাত থেকে যেন ছিনিয়ে নিয়ে গেল পাল্লাটাকে; দড়াম করে খুলে গিয়ে সেটা ধাক্কা মারল কেবিনের দেওয়ালে। লাথি মেরে পা থেকে চটিগুলোকে সারেঙের ঘরের ভেতর ছুঁড়ে দিয়ে দরজাটার মোকাবিলা করার জন্যে তৈরি হল কানাই। পাশ থেকে ঘুরে গিয়ে কাঁধ দিয়ে ঠেলা মারতে হল হাওয়ার উলটোদিকে সেটাকে বন্ধ করার জন্যে। রেলিং-এ পিঠ ঠেকিয়ে এক পা এক পা করে তারপর নীচে নামার মইটার দিকে এগোতে লাগল ও। মইটা একেবারে খোলা হাওয়ার মুখোমুখি। তার প্রথম ধাপটায় পা রাখতেই কানাইয়ের ওপর যেন আছড়ে পড়ল ঝড়ের তাড়স। চটিদুটো না রেখে এলে নির্ঘাত পা থেকে খুলে নিয়ে চলে যেত হাওয়ায়। বাতাসের এমনি টান যে কানাইয়ের মনে হল মুহূর্তের জন্যে হাত আলগা হলেই হাওয়ায় মইয়ের থেকে উড়িয়ে নিয়ে গিয়ে নীচের উথাল পাথাল জলের মধ্যে ফেলে দেবে ওকে। শেষ ধাপটা থেকে নেমে গুহার মতো খোলটার ভেতরে ঢুকতেই প্রায় তিন সেন্টিমিটার জলের মধ্যে ডুবে গেল কানাইয়ের পায়ের পাতা। অন্ধকার হয়ে আছে ভেতরটা। খোলের প্রায় শেষ বরাবর, যে খোপের মধ্যে ডিজেল ইঞ্জিনটা বসানো আছে, তার পাশে নগেনকে দেখতে পেল কানাই। একটা প্লাস্টিকের বালতি দিয়ে নগেন প্রাণপণে খোলের ভেতর থেকে জল তুলছে আর বাইরে ফেলছে।
গোড়ালি-ডোবা জলের মধ্যে দিয়ে কানাই আস্তে আস্তে এগোল সেদিকে। “আরেকটা বালতি আছে?”
জবাবে আঙুল তুলে একটা টিনের দিকে দেখাল নগেন। তেলতেলে জলের ওপরে ভাসছে টিনটা। সেটার হাতলটা ধরে জলে ডোবাতে যেতেই ভটভটিটা হঠাৎ একপাশে কাত হয়ে গেল। উলটে পড়ে যেতে যেতে কোনওরকমে সামলে নিল কানাই। কোনও রকমে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ও দেখল টিনে করে জল তোলাটা যতটা সোজা হবে মনে করেছিল তত সহজ নয় ব্যাপারটা। মেঘার দুলুনিতে খোলের ভেতরে জমা জল এমনভাবে নড়ছে যে মনে হচ্ছে যেন ওদের সঙ্গে খেলা করছে জলটা। ওরা দুজনে মিলে সমানে এদিক ওদিক লাফ ঝপ করে যাচ্ছে, কিন্তু যতটা কসরত করছে বালতি ততটা ভরতে পারছে না। খানিক বাদে জল তোলা থামিয়ে পাড়ের দিকে ইশারা করল নগেন। বলল, “লুসিবাড়ির কাছাকাছি এসে গেছি আমরা। ওখানেই যাবেন তো আপনি?”
“হ্যাঁ। কিন্তু তোমরা যাবে না?”
“না। আমরা এর পরের দ্বীপটাতে নামব। এই এলাকায় ঝড়ের সময় ওখানেই একমাত্র নিশ্চিন্তে গিয়ে ওঠা যায়। আপনি বরং ওপরে গিয়ে একবার দাদুকে জিগ্যেস করুন কী করে লুসিবাড়িতে আপনাকে নামানো হবে। এই হাওয়ার মধ্যে ওখানে গিয়ে নামা কঠিন হবে।”
“ঠিক আছে।” এঁচোড়-পাচোড় করে মই বেয়ে আস্তে আস্তে আবার ওপরে গিয়ে উঠল কানাই৷ পিছল ডেকের ওপর দিয়ে পা টিপে টিপে ফিরে গেল সারেঙের ঘরে।
“কী অবস্থা নীচে?” জিগ্যেস করল হরেন।
“মোহনার মাঝখানটায় যখন ছিলাম তখন বেশ খারাপই ছিল। এখন খানিকটা ভাল।”
বুড়ো আঙুল দিয়ে জানালার কাছে টোকা মারল হরেন। “ওই দেখুন, সামনে লুসিবাড়ি দেখা যাচ্ছে। আপনি কি ওখানেই নামবেন, না আমাদের সঙ্গে যাবেন?”
জবাবটা আগের থেকেই ভেবে রেখেছিল কানাই। “আমি লুসিবাড়িতেই নামব। মাসিমা একা আছেন। ওনার কাছে যাওয়া উচিত আমার।”
“ঠিক আছে। পাড়ের যতটা কাছাকাছি যাওয়া সম্ভব আমি নিয়ে যাব ভটভটিটাকে। বাকিটা কিন্তু আপনাকে জলের মধ্যে দিয়ে হেঁটে গিয়ে উঠতে হবে।”
“আর আমার সুটকেসটার কী হবে?”
“ওটা আপনি রেখেই যান। আমি পরে গিয়ে পৌঁছে দিয়ে আসব।”
সুটকেসের মধ্যে একটা জিনিসের জন্যেই সবচেয়ে বেশি মায়া কানাইয়ের। বলল, “ঠিক আছে। ওই নোটবইটা ছাড়া বাকি আর যা আছে সব রেখে যাচ্ছি। কিন্তু নোটবইটা সঙ্গে নিয়ে যাব। প্লাস্টিক দিয়ে মুড়ে নেব, যাতে ভিজে না যায়। ওটা আমি নিয়ে যেতে চাই।”
“এই যে, এটা নিন।” স্টিয়ারিং-এর নিচ থেকে পলিথিনের একটা ব্যাগ বের করে কানাইয়ের হাতে দিল হরেন। “কিন্তু এবার তাড়াতাড়ি করুন। প্রায় পৌঁছে গেছি আমরা।”
সারেঙের ঘর থেকে ডেকের ওপর বেরিয়ে এল হরেন। দু-এক পা এগিয়েই কেবিন। কোনোরকমে গলে যাওয়ার মতো দরজাটা ফাঁক করে চট করে ভেতরে ঢুকে পড়ল কানাই। আধো অন্ধকারের মধ্যে সুটকেসটা খুলল, নির্মলের নোটবইটা বের করল, তারপর যত্ন করে সেটাকে মুড়ে নিল পলিথিনে। প্যাকেটটা সঙ্গে নিয়ে কেবিন থেকে বেরোতে যাবে, ঠিক সেই মুহূর্তে বন্ধ হয়ে গেল ভটভটির ইঞ্জিনটা।
ডেকের ওপরে হরেন অপেক্ষা করছিল ওর জন্যে। “খুব বেশিদূর যেতে হবে না আপনাকে,” মিটার তিরিশেক দূরে লুসিবাড়ির বাঁধের দিকে ইশারা করে বলল হরেন। বাঁধের গোড়ার দিকে ঠিক যেখানটায় মোহনার ঢেউগুলো এসে আছড়ে পড়ছে দ্বীপের ওপর, একটানা একটা সাদা ফেনার রেখা দেখা যাচ্ছে। “জল খুব একটা বেশি নয়,” হরেন বলল। “কিন্তু খুব সাবধানে যাবেন।” তারপর কী মনে হতে বলল, “আর ময়নার সঙ্গে যদি আপনার দেখা হয় ওকে বলবেন ঝড়টা একটু কমলেই আমি গিয়ে ফকিরকে নিয়ে আসব।”
“আমিও তখন যাব আপনার সঙ্গে,” বলল কানাই। “মনে করে লুসিবাড়ি হয়ে যাবেন কিন্তু।”
“ঠিক সময় মতো এসে আপনাকে তুলে নেব আমি,”হাত তুলে কানাইকে বিদায় জানাল হরেন। “আর ময়নাকে কথাটা বলতে ভুলবেন না যেন।”
“ভুলব না।”
লঞ্চের পেছনের দিকে আস্তে আস্তে এগিয়ে গেল কানাই। আগে থেকেই নগেন সেখানে একটা তক্তা লাগিয়ে রেখেছে। “পেছন ফিরে পা রাখুন তক্তাটার ওপরে,” কানাইকে সাবধান করে দিল নগেন। “মই বেয়ে নামার মতো দু’হাতে কাঠটাকে ধরে ধরে নামুন। নইলে কিন্তু হাওয়ার টানে উলটে পড়ে যাবেন।”
“ঠিক আছে।” পলিথিনে মোড়া নোটবইটাকে লুঙ্গির কষিতে বেঁধে নামার জন্যে প্রস্তুত হল কানাই। তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে নিচু হয়ে দু’হাতে তক্তার দুটো ধার চেপে ধরল শক্ত করে। সঙ্গে সঙ্গেই বুঝতে পারল নগেনের পরামর্শ না নিলে সত্যি সত্যিই হাওয়ার টানে জলের মধ্যে গিয়ে পড়ত ও। নামার সময় হাতদুটো ব্যবহার না করলে এ হাওয়ার ঝাঁপট সামলানো অসম্ভব। পেছন ফিরে চার হাতপায়ে হামাগুড়ি দিয়ে নামতে লাগল কানাই।
সোজা হয়ে দাঁড়াল একেবারে তক্তা থেকে নামার পর। জলে নামার পর নীচের নরম কাদায় আস্তে আস্তে ডুবে যেতে লাগল পায়ের পাতা। মুহূর্তের জন্য তক্তাটাকে আঁকড়ে ধরে টাল সামলাল কানাই। কোমরের একটু নীচ পর্যন্ত জল এখানটায়। প্রচণ্ড স্রোতের টানে সোজা হয়ে দাঁড়ানোই কঠিন। নোটবইটা প্রায় বুকের কাছে তুলে নিল কানাই। তারপর সামনের বাঁধের দিকে দৃষ্টি স্থির রেখে খালি পায়ে খুব সাবধানে এক পা এক পা করে এগোতে লাগল জল ঠেলে। জল যখন হাঁটুর কাছাকাছি নেমে এল তখন অবশেষে একটু স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল–প্রায় চলে এসেছে এখন, বাকি জলটুকু পেরিয়ে পাড়ে গিয়ে ওঠা যাবে শেষ পর্যন্ত। পেছনে ভটভটির ইঞ্জিন চালু হল আবার। শব্দটা কানে আসতে ঘুরে তাকাল কানাই।
ঠিক এই অসতর্ক মুহূর্তটুকুর জন্যেই যেন অপেক্ষা করছিল হাওয়াটা। একপাক ঘুরিয়ে কাত করে কানাইকে ফেলে দিল জলের মধ্যে। হাবুডুবু খেতে খেতে দুটো হাত কাদার মধ্যে ঠেসে ধরল ও। তারপর টলমল করে কোনওরকমে দাঁড়িয়ে উঠেই দেখতে পেল মিটার দশেক দূরে স্রোতের টানে দুলতে দুলতে ভেসে যাচ্ছে নোটবইটা। কয়েক মিনিট ভেসে থাকার পর আস্তে আস্তে সেটা তলিয়ে গেল দৃষ্টির আড়ালে।
.
তরী থেকে তীরে
নৌকো যখন গর্জনতলায় পৌঁছল, এমনিতে তখন ভাটার সময়। কিন্তু ঝড়ের টানে এমন ফুলে উঠেছে নদী যে ভরা জোয়ারেও অতটা জল উঠতে কখনও দেখেনি পিয়া। হাওয়ার তোড়ে নদীটা যেন খানিকটা হেলে পড়েছে একদিকে। জলটাকে যেন ক্রমশ ঢালু হয়ে আসা একটা ঢিপির মতো করে এক জায়গায় জড়ো করে রেখেছে কেউ। সে ঢিপির মাথাটা দ্বীপের পাড়ের চেয়েও বেশ খানিকটা উঁচু।
জটপাকানো শেকড়-বাকড়ের ফাঁক দিয়ে ডিঙিটাকে কতগুলো ঘন হয়ে দাঁড়ানো গাছের একেবারে মাঝখানে নিয়ে চলে এল ফকির। পিয়া লক্ষ করল, অন্যান্যবার গর্জনতলায় এসে ফকির যেখানে ডিঙি রাখে এবার কিন্তু সেদিকটায় ও গেল না। তার বদলে জলের মধ্যে থেকে বেরিয়ে থাকা দ্বীপের সবচেয়ে উঁচু জায়গাটার দিকে নিয়ে গেল নৌকোটাকে।
ডিঙির মাথাটা যখন গাছগুলোর একদম কাছাকাছি এসে গেছে, পাশ দিয়ে এক লাফ মেরে ফকির নেমে গেল জলের মধ্যে। তারপর নৌকোটাকে টেনে নিয়ে যেতে লাগল দ্বীপের আরও ভেতরে। গলুইয়ের একদম সামনে থেকে টানছিল ফকির, যাতে সহজে নৌকোর দিক বদলানো যায় দরকার মতো। আর পিয়া চলে গেল একেবারে পেছনে, যেখান থেকে সর্বশক্তিতে ঠেলা মারা যায়। ঠেলতে ঠেলতে নৌকোটাকে কতগুলো গুঁড়ির ফাঁকে ঢুকিয়ে দিল দু’জনে। তারপর এক লাফ মেরে ফকির উঠে পড়ল তার ওপর। আস্তে আস্তে নৌকোর পেছন দিকে গিয়ে খুলে ফেলল খোলের পাটাতনটা। পিয়াও উঠে এসেছে ততক্ষণে। ফকিরের কাঁধের ওপর দিয়ে উঁকি মেরে আশ্চর্য হয়ে দেখল এত ঝড়-ঝাঁপটা সত্ত্বেও নৌকোর খোলটা আর তার ভেতরের জিনিসপত্র কিন্তু মোটামুটি ঠিকঠাকই আছে। ফকিরের উনুন আর বাসনপত্রের সঙ্গে কয়েকটা নিউট্রিশন বারও দেখা যাচ্ছে সেখানে। তার মধ্যে গড়াগড়ি যাচ্ছে গোটা দুই জলের বোতল। নিউট্রিশন বারগুলোকে জিনসের পকেটে পুরে নিল পিয়া, আর এক বোতল জল নিয়ে ফকিরের হাতে দিল। তেষ্টায় গলা শুকিয়ে এলেও খুব সাবধানে সামান্য একটু জল নিজের গলায় ঢালল। এই দু’ বোতল দিয়েই কতক্ষণ যে চালাতে হবে কে জানে।
খোলের মধ্যে থেকে ফকির তারপর পুরনো একটা শাড়ি বের করে আনল। পিয়ার মনে পড়ল কদিন আগেই ওটাকে একদিন মাথার বালিশ করে শুয়েছিল ও। কাপড়টাকে শরীর দিয়ে আড়াল করে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে একটা দড়ি বানিয়ে ফেলল ফকির; ইশারায় পিয়াকে বলল সেটাকে কোমরে বেঁধে নিতে। কারণটা বুঝতে না-পারলেও ফকিরের কথামতো দড়িটা কোমরে জড়িয়ে নিল পিয়া। ফকির ততক্ষণে আবার খোলের ভেতর হাত ঢুকিয়ে গোল করে গুটিয়ে রাখা কাঁকড়া ধরার সুতোটা বের করে এনেছে। নাইলন সুতোর বান্ডিলটা পিয়ার হাতে দিয়ে দিল ও। ইশারায় বলল সাবধানে ধরতে। একটু অসতর্ক হলেই সুতোয় বাঁধা খোলামকুচি কি মাছের কাটায় কেটেকুটে যেতে পারে হাত-পা। এরপর ডিঙি থেকে নেমে এসে পিয়াকে দেখিয়ে দিল কী করে বান্ডিলটাকে বুক দিয়ে হাওয়া থেকে আড়াল করে সুতো ছাড়তে হয়। নৌকোটাকে উলটে দিয়ে তার তক্তার ফঁকফোকরের মধ্যে দিয়ে সুতো গলিয়ে সুতোর বাকি অংশটা চারপাশের গাছগুলোর চারদিকে জড়িয়ে দিতে লাগল ফকির তারপর। পিয়া বুঝতে পারল ওর কাজ হচ্ছে সুতোটার দিকে নজর রাখা, যাতে সেটা টানটান থেকে সব জায়গায়। কারণ কোথাও একটু আলগা হলেই হাওয়ার টানে উড়ে যাবে সুতো, তাতে বাঁধা কঁকড়ার চার আর খোলামকুচি গুলিগোলার মতো এসে লাগবে গায়ে।
কয়েক মিনিটের মধ্যেই ঘন মাকড়শার জালের মতো নাইলনের সেই সুতোর বুনোনে চারপাশের গাছগুলোর সঙ্গে বাঁধা হয়ে গেল ডিঙিটা। কিন্তু যতটা সম্ভব সতর্ক থাকা সত্ত্বেও সুতোয় বাঁধা শক্ত জিনিসগুলোর থেকে পুরোপুরি গা বাঁচাতে পারেনি ফকির। কাজ শেষ হওয়ার পর দেখা গেল ছোট ছোট কাটা-ছড়ার দাগে ভর্তি হয়ে গেছে ওর সারাটা মুখ আর বুক।
তারপর পিয়ার হাত ধরে দ্বীপের আরও গভীরে এগিয়ে চলল ফকির। হাওয়ার উলটোদিকে চলার জন্যে নিচু হয়ে প্রায় গুঁড়ি মেরে এগোতে হচ্ছিল ওদের। চলতে চলতে একসময় লম্বা একটা গাছের কাছে এসে পৌঁছল দু’জন। গাছটা সাধারণ বাদাবনের গাছের তুলনায় অস্বাভাবিকরকম উঁচু, গুঁড়িটাও অনেকটা মোটা। ইশারায় ফকির সেই গাছের ওপরে উঠে পড়তে বলল পিয়াকে। তারপর নিজেও উঠতে লাগল পেছন পেছন। মাটি থেকে মিটার তিনেক ওপরে ওঠার পর একটা মোটা ডাল বেছে নিয়ে তার ওপরে বসতে বলল পিয়াকে। ইশারায় দেখিয়ে দিল কীভাবে গুঁড়ির দিকে মুখ করে দু’পা দু’দিকে ঝুলিয়ে বসতে হবে। তারপর মোটর সাইকেলের পেছনের সিটে যেভাবে বসে, সেইভাবে পিয়ার পেছনে বসে পড়ল নিজে। ঠিকমতো বসার পর হাতের ইশারায় পিয়ার কোমরে বাঁধা পেঁচানো শাড়িটা চাইল ফকির। এতক্ষণে পিয়া বুঝতে পারল ফকির কেন ওটা সঙ্গে নিয়ে এসেছে–গাছের গুঁড়ির সঙ্গে শাড়িটা দিয়ে নিজেদের বাঁধতে চাইছে ও। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে পেঁচানো কাপড়টার একটা প্রান্ত ফকিরের হাতে দিল পিয়া। গাছের চারদিকে সেটাকে বেড় দিয়ে আনতে হাত লাগাল নিজেও। শাড়িটা দিয়ে দু’বার বেড় দেওয়া গেল গাছটাকে। তারপর তার দুটো প্রান্ত একসঙ্গে এনে কষে একটা গিট বেঁধে ফেলল ফকির।
এক মুহূর্তের জন্যেও বিরাম নেই ঝড়ের, উলটে বরং সমানে বেড়েই চলেছে হাওয়ার তেজ। ঝড়ের শব্দ একটা সময় এত জোরালো হয়ে উঠল যে পিয়ার কানে একেবারে অন্যরকম শোনাতে লাগল সেটা। যেন তা বাতাসের আওয়াজ নয়, অন্য কোনও নৈসর্গিক শক্তির গর্জন। শোঁ শোঁ সড়সড় খসখস আওয়াজের জায়গা নিল বুক কাঁপানো একটা গম্ভীর গুমগুম শব্দ–মনে হল যেন নড়েচড়ে উঠছে গোটা পৃথিবীটা। তীব্র হাওয়ার সঙ্গে ঘন কুয়াশার মতো উঠে আসছে ধুলো, জলের কণা, কাঠকুটো, গাছের ঘেঁড়া পাতা, ডালপালা। ফলে কিছুই প্রায় দেখা যাচ্ছে না কোনওদিকে। এমনিতেও অন্ধকার হয়ে এসেছে চারদিক; ঘড়ির কাটায় সবেমাত্র দুপুর একটা, কিন্তু আলো এত কমে গেছে যে মনে হচ্ছে যেন রাত নেমে এসেছে প্রায়। বাতাসের তেজ যে এর থেকেও বেশি হতে পারে, আরও ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে ঝড়ের তাণ্ডব, এই মুহূর্তে সেটা কল্পনা করাও কঠিন। কিন্তু পিয়া মনে মনে পরিষ্কার বুঝতে পারছিল যে এ ঝড় আরও বাড়বে বই কমবে না।
.
সারা শরীর, গায়ের জামাকাপড় সব মাখামাখি হয়ে গেছে কাদায়। খালি পায়ে প্রায় হামাগুড়ি দিতে দিতে উঁচু পাড়িটা পেরিয়ে এল কানাই, হাওয়ার ঝাঁপটা থেকে বাঁচার জন্য গুটিসুটি মেরে বসে রইল বাঁধের গোড়ায়। ভিজে সপসপ করছে মাথার চুল থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত, তার ওপরে ঝড়ের তেজ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঠান্ডা হয়ে আসছে বাতাস। দু’হাতে নিজেকে জড়িয়ে ধরে হি হি করে কাঁপতে কাঁপতে কানাই আকাশের দিকে তাকাল।
নীলের কোনও চিহ্ন নেই আকাশে, কিন্তু কালো রংটাও টানা একরকম নয় সব জায়গায়। কোথাও গাঢ়, কোথাও হালকা–নানারকম শেডের কালো মেঘে ছেয়ে আছে সমস্ত আকাশ। কোথাও সে মেঘ ছাইয়ের মতো ধূসর, কোথাও সিসার মতো নীলচে কালো। গোটা আকাশ জুড়ে নানা স্তরে যেন ছড়িয়ে রয়েছে নানারকম মেঘ। তাদের প্রত্যেকের রং আলাদা, গতি আলাদা। কানাইয়ের মনে হল আকাশটা যেন কালো কাঁচের একটা আয়না, ভাটির দেশের জলের ছায়া পড়েছে তাতে। সে জলের নানারকম স্রোত, ছোট বড় ঘূর্ণি–সবকিছু দেখা যাচ্ছে ওই আয়নায়। রঙের তফাত সামান্য হলেও আয়নার গায়ে নদী নালা ঘূর্ণিগুলোকে চিনে নিতে অসুবিধা হচ্ছে না একটুও।
বাঁধ বরাবর টানা সারি দেওয়া ঝাউগাছগুলো হাওয়ার দাপটে নুয়ে প্রায় দু’ ভাঁজ হয়ে গেছে। আশেপাশে নারকেলগাছ যে ক’টা আছে তাদের পাতাগুলো সব মুচড়ে পাকিয়ে গিয়ে আগুনের শিখার মতো চেহারা নিয়েছে। ফলে এমনিতে বাঁধের কাছ থেকে দ্বীপের ভেতরে যতটা দেখা যায় তার থেকে অনেক বেশিদূর পর্যন্ত চোখ চলে যাচ্ছে এখন। লুসিবাড়ির সবচেয়ে উঁচু বাড়িগুলির একটা হল হাসপাতালটা, সেটা খুব সহজেই চোখে পড়ছে এখান থেকে।
হাসপাতালের দিকে দৌড়তে শুরু করল কানাই, কিন্তু কয়েক পা গিয়েই গতি কমাতে হল। পিছল হয়ে আছে ভেজা রাস্তা, কাদার মধ্যে বারবার হড়কে যাচ্ছে খালি পা। বেশ খানিকটা এগোনোর পরও কোনও লোকজন চোখে পড়ল না পথে–বেশিরভাগই বোধহয় পালিয়েছে ঘরবাড়ি ছেড়ে। যারা রয়ে গেছে, তারাও মনে হল শক্ত করে খিল এঁটে বসে রয়েছে নিজের নিজের নিরাপদ আশ্রয়ে। কিন্তু হাসপাতাল চত্বরের গেটটা যখন চোখে পড়ল, কানাই দেখল দলে দলে মানুষ সার বেঁধে এগিয়ে চলেছে সেদিকে–সবাই হাসপাতাল বাড়িতে গিয়ে উঠতে চায়। কারণটা বোঝা খুব একটা কঠিন নয়। বেশ শক্তপোক্ত গড়ন বাড়িটার, দেখলেই বেশ ভরসা পাওয়া যায় মনে। বেশিরভাগ মানুষই আসছে পায়ে হেঁটে। কেউ কেউ আবার রিকশা ভ্যানে চড়ে বসেছে– বিশেষ করে বুড়োবুড়ি আর কচি বাচ্চারা। কানাইও পায়ে পায়ে এগোল ভিড়ের সঙ্গে। দালানে পা দিয়েই দেখল পুরোদস্তুর উদ্বাসনের কাজ শুরু হয়ে গেছে সেখানে। দলে দলে নার্স আর ভলান্টিয়াররা ব্যস্ত হয়ে ছোটাছুটি করছে, করিডোর ধরে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে পেশেন্টদের, সিঁড়ি দিয়ে ধরে ধরে নিয়ে গিয়ে তুলছে ওপরের সাইক্লোন শেল্টারে।
একতলার লম্বা বারান্দার একপ্রান্তে দাঁড়িয়েছিল ছোট্টখাট্ট চেহারার একটা বাচ্চা ছেলে। ভিড় কাটিয়ে তার দিকে এগিয়ে গেল কানাই–”টুটুল?”
ছেলেটা চিনতে পারল না ওকে। জবাবও দিল না কোনও। কানাই উবু হয়ে ওর সামনে বসে আবার জিজ্ঞেস করল, “টুটুল, তোমার মা কোথায়?”
মাথা নেড়ে সামনের একটা ওয়ার্ডের দিকে ইশারা করল টুটুল। সেদিকে যাবে বলে কানাই যেই উঠে দাঁড়াতে গেছে, ঝড়ের মতো সেখান থেকে বেরিয়ে এল ময়না–তার পরনে নার্সের সাদা ইউনিফর্ম। কানাইয়ের ভেজা লুঙ্গি আর কাদামাখা জামার দিকে তাকাল একবার; চিনতে পারল না।
“ময়না, আমি কানাই।”
বিস্ময়ে মুখে হাত চাপা দিল ময়না। “কানাইবাবু! এ কী অবস্থা হয়েছে আপনার?”
“সে কথা পরে হবে,” বলল কানাই। “শোনো, একটা জরুরি কথা বলার আছে। তোমাকে–”
কথার মাঝখানেতে ওকে থামিয়ে দিল ময়না। “ওরা কোথায়? আমার বর আর ওই আমেরিকান মেয়েটা?”
“সেটাই বলতে যাচ্ছি তোমাকে, ময়না,” জবাব দিল কানাই। “ওরা গর্জনতলায় রয়ে গেছে। ওদের ওখানে রেখেই চলে আসতে হয়েছে আমাদের।”
“ওদের ফেলে রেখে চলে এলেন আপনি?” ঘৃণা আর ক্রোধ ঝরে পড়ছে ময়নার দু’চোখে। “এই প্রচণ্ড সাইক্লোন আসছে–তার মধ্যে জঙ্গলে ফেলে রেখে চলে এলেন ওদের?”
“আমার নিজের ইচ্ছায় আসিনি ময়না। ফিরে আসার ব্যাপারটা হরেনই ঠিক করেছিল। ও-ই বলল ফিরতে হবে, তা ছাড়া আর কোনও উপায় নেই।”
“আচ্ছা?” হরেনের নামটা শুনে একটু যেন ঠান্ডা হল ময়না। কিন্তু ওরা এখন কী করবে? ওই জঙ্গলের মধ্যে–একটুও আড়াল নেই কোথাও…”
“কিছু হবে না, ময়না,” বলল কানাই। “ফকির সব জানে, কীভাবে কী করতে হয় এরকম অবস্থায়। তোমার কোনও চিন্তা নেই। আগেও তো ওই দ্বীপে কত লোক ঝড়ের মুখ থেকে ফিরে এসেছে। ফকিরের দাদুই তো একবার ঝড়ে পড়েছিলেন ওখানে, তাই না?”
খানিকটা যেন হাল ছেড়ে দিয়ে মাথা নাড়ল ময়না। “এখন তো আর কিছুই করার নেই, শুধু ভগবানকে ডাকা ছাড়া।”
“হরেন তোমাকে বলতে বলে দিয়েছে যে ঝড়টা থামলেই ও ফিরে যাবে ওখানে। আমিও যাব বলেছি। যাওয়ার পথে হরেন তুলে নিয়ে যাবে আমাকে।”
“বলবেন আমিও যাব,” এক হাতে টুটুলের হাত ধরে বলল ময়না। “মনে করে বলবেন কিন্তু।”
“নিশ্চয়ই বলব,” গেস্ট হাউসটার দিকে এক নজর তাকিয়ে জবাব দিল কানাই। “আমি বরং একবার গিয়ে দেখি মাসিমা কোথায় আছেন?”
“মাসিমাকে নিয়ে গেস্ট হাউসের দোতলায় উঠে যান,” ময়না বলল। “আমি জানালাগুলো সব বন্ধ করে দিয়ে এসেছি। কোনও অসুবিধা হবে না।”
.
ঢেউ
একটা একটা করে মিনিট যাচ্ছে আর ক্রমশ বড় হচ্ছে উড়ে আসা জঞ্জালের মাপ। শুরুতে শুধু ছোট ছোট ডালপালা আর কাঠকুটো উড়ে আসছিল হাওয়ার মুখে, তাদের জায়গায় এখন পাক খেতে খেতে ধেয়ে আসছে গোটা গোটা নারকেল গাছ আর আস্ত সব গাছের গুঁড়ি। ঝড়ের তেজ বাড়তে বাড়তে এমন একটা জায়গায় গিয়ে পৌঁছেছে, যে এক সময় পিয়া দেখল গোটা একটা দ্বীপ যেন উড়ে যাচ্ছে মাথার ওপর দিয়ে। বস্তুটা আসলে আর কিছুই না, জঙ্গলের একগোছা গাছ, জটপাকানো শেকড়-বাকড়ে একসঙ্গে জড়ানো। হঠাৎ ফকিরের হাত শক্ত হয়ে চেপে বসল ওর কাঁধের ওপর। এক নজর তাকিয়ে পিয়া দেখল মাথার ওপর বনবন করে পাক খাচ্ছে একটা চালাঘর। চালাটাকে দেখেই চিনতে পারল পিয়া। গর্জনতলার জঙ্গলের ভেতরে যে মন্দিরের কাছে ফকির একবার ওকে নিয়ে গিয়েছিল, ওটা সেই মন্দিরটা। ওদের চোখের সামনে টুকরো টুকরো হয়ে গেল বাঁশের কাঠামোটা, মূর্তিগুলো ছিটকে উড়ে গেল হাওয়ার সঙ্গে।
ঝড়ের তাণ্ডব বাড়ার সাথে সাথে সামনের গাছ আর পেছনে ফকিরের মাঝখানে আস্তে আস্তে অভ্যস্ত হয়ে যেতে থাকল পিয়ার শরীর। যে ডালের ওপর ওরা বসেছিল সেটা গাছের গুঁড়ির আড়াল করা দিকটায়, হাওয়া যেদিক থেকে আসছে তার উলটোদিকে। মানে, ডালের ওপর দু’দিকে দুই পা ছড়িয়ে হাওয়ার দিকে মুখ করে বসেছিল পিয়া আর ফকির গুঁড়ির ছায়ার’ আড়ালে। এভাবে না বসলে এতক্ষণে ঝড়ের সাথে উড়ে আসা আবর্জনার ধাক্কায় থেঁতলে যেত ওরা দু’জন। যতবার একটা করে ডাল ভাঙছে অথবা উড়ন্ত কোনও কাঠকুটো এসে ধাক্কা খাচ্ছে গাছের গায়ে, সারাটা শরীর ঝনঝন করে উঠছে পিয়ার। মাঝে মাঝে একেকটা ধাক্কায় মড়মড় করে কেঁপে উঠছে গাছটা, আর কোমরে বাঁধা পাকানো শাড়িটা চামড়ার মধ্যে যেন কেটে বসে যাচ্ছে। কাপড়টা না থাকলে অনেক আগেই হাওয়ায় ওদের উড়িয়ে ফেলে দিত গাছের ডাল থেকে।
পিয়ার পেটের কাছটায় দু’হাতে ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রেখেছে ফকির। মুখটা রেখেছে ওর ঘাড়ের ওপর। ঘাড়ের কাছে ফকিরের দাড়ির ঘষা টের পাচ্ছে পিয়া। খানিক বাদে পিয়ার শ্বাস-প্রশ্বাসের ছন্দ মিলে গেল ওর বুকের ছন্দের সঙ্গে, ফকিরের পেটের ওঠা-নামার চাপের সাথে সাথে উঠতে নামতে লাগল পিয়ার পিঠের নীচের দিকের গড়ানে জায়গাটা। দু’জনের গায়ের খোলা অংশ যেখানে যেখানে পরস্পরকে ছুঁয়েছে, দুটো শরীরকে সেখানে জুড়ে রেখেছে পাতলা একটা ঘামের পর্দা।
হঠাৎ যেন আরও বেড়ে গেল ঝড়ের আওয়াজ; তার ঠিক পরেই বাতাসের গোঁ গোঁ শব্দকে ছাপিয়ে কানে এল অন্য একটা গর্জন–খানিকটা জলপ্রপাতের গর্জনের মতো। আঙুলের ফাঁক দিয়ে এক ঝলক তাকিয়ে পিয়া দেখল নদীর ভাটির দিক থেকে বিশাল দেওয়ালের মতো কী যেন একটা প্রচণ্ড বেগে ধেয়ে আসছে ওদের দিকে। ঠিক যেন শহরের একটা ব্লক হঠাৎ নড়েচড়ে উঠে চলতে শুরু করে দিয়েছে-নদীটা যেন তার পায়ের কাছে শুয়ে থাকা ফুটপাথ, আর তার মাথাটা জঙ্গলের সবচেয়ে বড় গাছগুলোকেও ছাড়িয়ে উঠে গেছে অনেক উঁচুতে। জলোচ্ছ্বাস! জলোচ্ছ্বাস আসছে সমুদ্র থেকে, ভয়ানক গর্জন করতে করতে সামনের সমস্ত কিছুকে আড়াল করে ধেয়ে আসছে ওদের দিকে। চোখের সামনে অবিশ্বাস্য ঘটনাটা দেখতে দেখতে হঠাৎ এক ঝলকে ব্যাপারটা যেই বুঝতে পারল পিয়া, সঙ্গে সঙ্গে মাথার ভেতরটা যেন খালি হয়ে হয়ে গেল। এতক্ষণ পর্যন্ত ভয় পাওয়ারই কোনও সময় পায়নি ও, কোনওরকমে প্রাণটা বাঁচিয়ে রাখার জন্যই এত ব্যস্ত ছিল যে ঝড়ের বাস্তবতাটাকে উপলব্ধি পর্যন্ত করে উঠতে পারেনি, কিন্তু এবার যেন মৃত্যু স্পষ্ট ঘোষণা করে দিল তার আগমনবার্তা, সে অমোঘ পরিণতির জন্য শুধু অপেক্ষা করে থাকা ছাড়া আর কিছুই করার নেই এখন। ভয়ে অসাড় হয়ে গেল পিয়ার আঙুলগুলো। ফকির ওর হাতদুটো নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে গাছের গায়ে শক্ত করে চেপে না ধরলে গুঁড়িটা ও হয়তো ধরেই থাকতে পারত না। পিয়া টের পেল ফকিরের বুকটা ফুলে উঠছে–লম্বা একটা শ্বাস টেনে নিচ্ছে ফকির। দেখাদেখি পিয়াও যতটা পারে বাতাস টেনে নিল বুকের মধ্যে।
তারপর একটা বাঁধ যেন ভেঙে পড়ল ওদের মাথার ওপর। তীব্র গতিতে নেমে আসা জলের চাপে বেঁকে প্রায় দু’ভঁজ হয়ে গেল গাছের গুঁড়িটা। ফকিরের দু’হাতের বেষ্টনীতে আটকা অবস্থায় পিয়া টের পেল ওদের দু’জনকে সুদ্ধ নুয়ে পড়ছে গাছটা; বাঁকতে বাঁকতে মাটি ছুঁয়ে ফেলল গাছের মাথা ওরা দু’জনে পা ওপরে মাথা নীচে অবস্থায় কোনওরকমে লেগে রইল তার গায়ে। ভয়ংকর ঘূর্ণি তুলে প্রচণ্ড গতিতে জল বয়ে চলেছে শরীরের চারপাশ দিয়ে; এমন তার টান, মনে হচ্ছে যেন টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলতে চাইছে ওদের। একেকবার মড়মড় করে উঠছে গাছটার শেকড়, মনে হচ্ছে উথাল পাথাল ঢেউয়ের টানে যে-কোনও সময় উপড়ে চলে যাবে মাটি থেকে।
বুকের ওপর যে চাপ পড়ছিল তার থেকে পিয়া আন্দাজ করল অন্তত মিটার তিনেক জলের নীচে রয়েছে ওরা। যে শাড়ির বাঁধনকে একটু আগে ভগবানের আশীর্বাদের মতো মনে হচ্ছিল, সেটাই এখন যেন নোঙরের মতো নদীর তলায় আটকে রেখেছে ওদের। বাঁধন থেকে আলগা হয়ে জলের ওপরে উঠে একটু দম নেওয়ার জন্যে ফকিরের বজ্রমুষ্টি থেকে হাত ছাড়িয়ে নিল পিয়া, কাপড়ের গিটটা খোলার জন্যে চেষ্টা করতে লাগল প্রাণপণে। কিন্তু ওকে সাহায্য করার বদলে টান মেরে বাঁধন থেকে ওর হাতদুটো সরিয়ে দিল ফকির। ফকিরের সমস্ত শরীরের ওজন এখন পিয়ার ওপর, পিয়া যেখানে আছে সেখানেই ওকে আটকে রাখার জন্য সর্বশক্তি দিয়ে যেন ও লড়ে যাচ্ছে। কিন্তু পিয়াও হাল ছেড়ে দিতে পারছে না কিছুতেই বুকের মধ্যে হাওয়া ফুরিয়ে এলে কারও পক্ষে স্থির হয়ে থাকা সম্ভব নয়।
তারপরেই হঠাৎ, ফকিরের হাতের বাঁধনের মধ্যে হাঁকুপাকু করতে করতেই, পিয়া টের পেল আস্তে আস্তে হালকা হয়ে আসছে জলের চাপ। ঢেউয়ের চূড়াটা পেরিয়ে গেছে ওদের, গাছটাও সোজা হতে শুরু করেছে। চোখ খুলে পিয়া দেখল ওপরে আলো দেখা যাচ্ছে, আবছা হলেও বোঝা যাচ্ছে। কাছে, আরও কাছে ক্রমশ এগিয়ে আসতে লাগল আলোটা, তারপর হঠাৎ, যখন পিয়ার মনে হচ্ছে বুকটা প্রায় ফেটে যাবে এবার, এক ঝটকায় সোজা হয়ে গেল গাছটা। সঙ্গে সঙ্গে ফকির আর পিয়ার মাথা উঠে এল জলের ওপরে। ঢেউয়ের মাথাটা ওদের পেরিয়ে যাওয়ার পর হাওয়ার চাপে জল খানিকটা নেমেছে, যদিও আগের জায়গায় পৌঁছয়নি এখনও। ওদের পায়ের সামান্য নীচ দিয়ে এখন বয়ে যাচ্ছে স্রোত।
.
বৃষ্টির ধারা তিরের মতো নেমে আসছে আকাশ থেকে। হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এসে গেস্ট হাউসের দিকে ছুটতে শুরু করল কানাই। জলের ফোঁটাগুলো যেন ছিটেগুলির মতো এসে লাগছে, গলন্ত ধাতুর মতো আছড়ে পড়ছে গায়ের ওপর। একেকটা ফোঁটা যেখানে মাটিতে এসে পড়ছে, ছোট্ট গর্ত হয়ে যাচ্ছে সে জায়গাটায়।
নীলিমার জানালায় কোনও আলো দেখা যাচ্ছে না। তাতে অবশ্য খুব একটা আশ্চর্য হল । কানাই; কারণ ট্রাস্টের জেনারেটরটা চালানো হয়নি সারাদিন, আর এই ঝড়ের হাওয়ায় লণ্ঠন জ্বালানো খুব একটা সোজা কাজ নয়।
দরজায় ধাক্কা দিল কানাই–”মাসিমা! ঘরে আছ নাকি?”
মিনিটখানেক কেটে গেল, কারও সাড়া নেই।
দুম দুম করে আবার দরজায় ঘা দিল কানাই–”মাসিমা! আমি এসেছি গো, আমি কানাই।” দরজার ওপারে হাতড়ে হাতড়ে নীলিমা ছিটকিনি খোলার চেষ্টা করছে, শুনতে পেল কানাই। চেঁচিয়ে বলল, “সাবধানে, খুব সাবধানে খুলবে কিন্তু।”
খুব একটা লাভ হল না কানাইয়ের সাবধানবাণীতে। ছিটকিনি ভোলা মাত্রই হাওয়ার টানে ছিটকে খুলে গেল পাল্লাটা, দড়াম করে গিয়ে ধাক্কা মারল দেওয়ালে। একগাদা ফাইল হুড়মুড় করে পড়ে গেল তাকের ওপর থেকে, আর একরাশ কাগজপত্র পাক খেয়ে উড়তে লাগল ঘরের মধ্যে। একটু টাল খেয়ে পিছিয়ে গিয়ে মচকে যাওয়া হাতটা ঝাড়তে লাগল নীলিমা। কানাই তাড়াতাড়ি দরজাটা বন্ধ করে নীলিমাকে জড়িয়ে ধরে নিয়ে বিছানায় বসাল।
“খুব জোরে লেগেছে? ব্যথা করছে খুব?”
“তেমন কিছু না রে। ঠিক হয়ে যাবে এক্ষুনি,” কোলের ওপর হাতদুটো জড়ো করে বসল নীলিমা। “তোকে দেখে আমার কী যে শান্তি হল না রে কানাই… ভীষণ চিন্তা হচ্ছিল তোর জন্যে ।”
“কিন্তু তুমি এখনও এখানে বসে রয়েছ কেন?” কানাইয়ের গলায় উদ্বেগের সুর। “এক্ষুনি গেস্ট হাউসের দোতলায় উঠে যাওয়া উচিত তোমার।”
“কেন রে?”
“নদী একেবারে টাপুস-টুপুস ভরে রয়েছে। যে-কোনও সময়ে সব ভাসিয়ে দেবে,” কানাই বলল। “তখন তো আটকে যাবে তুমি এখানে। জল সেরকম বাড়লে তো এখানেও এসে উঠবে, তাই না?” চারপাশে তাকিয়ে ঘরের জিনিসপত্রগুলি একবার ভাল করে দেখে নিল কানাই। “তোমার সবচেয়ে জরুরি জিনিসপত্র এখানে কী কী আছে বলো দেখি, সব জড়ো করি এক জায়গায়। কিছু আমরা ওপরে নিয়ে চলে যাব, আর বাকি যা থাকবে খাটের ওপরে রেখে দেব। খাটটা উঁচুই আছে, এতদূর জল উঠবে বলে মনে হয় না।”
গোটা দুই সুটকেস টেনে বের করল নীলিমা। দুজনে মিলে হাত লাগিয়ে ফাইল-টাইল আর কাগজপত্রগুলো একটার মধ্যে ভরে ফেলল। আর অন্যটার মধ্যে নিল কয়েকটা জামাকাপড় আর কিছু চাল, ডাল, চিনি, তেল আর চা।
“এবার তোয়ালে-টোয়ালেগুলো ভাল করে গায়ে মাথায় মুড়ে নাও দেখি,”কানাই বলল। “প্রচণ্ড বৃষ্টি পড়ছে। দরজা থেকে বেরিয়ে ওপাশের সিঁড়ি পর্যন্ত যেতে যেতেই পুরো ভিজে যাব আমরা।”
তৈরি-টৈরি হয়ে সুটকেস দুটো প্রথমে বের করে দিল নীলিমা, তারপর নিজে বেরিয়ে এল। আরও কালো হয়ে গেছে আকাশটা, প্রচণ্ড বৃষ্টির তোড়ে কাদা কাদা হয়ে গেছে মাটি। দরজাটা টেনে বন্ধ করে তালা লাগিয়ে দিল কানাই। সুটকেস দুটো তুলে নিল দু’হাতে। এক হাতে ওর কনুইটা ধরে আস্তে আস্তে নীলিমা এগোতে লাগল সিঁড়ির দিকে।
সিঁড়িঘর পর্যন্ত পৌঁছতে পৌঁছতেই কাকভেজা হয়ে গেল দুজনে। তবে তোয়ালে জড়ানো থাকায় নীলিমার গা-মাথা পর্যন্ত পৌঁছতে পারেনি বৃষ্টির জল। তোয়ালেগুলো গা থেকে খুলে ভাল করে নিংড়ে নিয়ে তারপর সিঁড়িতে পা দিল নীলিমা। গেস্ট হাউসে গিয়ে ঢুকতেই মনে হল হঠাৎ করে যেন কমে গেছে ঝড়টা। জানালা-টানালাগুলো শক্ত করে বন্ধ থাকায় ঝড়ের আওয়াজ কানে আসছে, কিন্তু বাতাসের ঝাঁপটাটা আর টের পাওয়া যাচ্ছে না। শক্তপোক্ত চার দেওয়ালের আড়াল থেকে সে আওয়াজ শুনতে কিন্তু মন্দ লাগছে না খুব একটা।
সুটকেসগুলো মেঝেতে রেখে নীলিমার কাছ থেকে একটা নিংড়ানো তোয়ালে নিয়ে নিল কানাই। মাথাটা ভাল করে মুছে নিয়ে গা থেকে টেনে খুলে ফেলল কাদামাখা শার্টটা। তোয়ালেটা জড়িয়ে নিল খালি গায়ের ওপর।
নীলিমা এর মধ্যে ডাইনিং টেবিলের একটা চেয়ারে গিয়ে বসে পড়েছে। জিজ্ঞেস করল, “বাকিরা সব কোথায় গেল রে কানাই? পিয়া, ফকির ওরা সব?”
গম্ভীর হয়ে গেল কানাই। বলল, “পিয়া আর ফকিরকে আমরা খুঁজে পাইনি মাসি। ওদের ছেড়েই চলে আসতে হয়েছে আমাদের। যতক্ষণ পারা যায় আমরা অপেক্ষা করেছিলাম, কিন্তু তারপর হরেন বলল এবার রওয়ানা হতেই হবে। কালকে আবার ফিরে গিয়ে ওদের খোঁজ করব।”
“তার মানে ওরা বাইরেই রয়ে গেছে এখনও?” নীলিমা জিজ্ঞেস করল। “এই ঝড়ের মধ্যে?”
মাথা নাড়ল কানাই। “হ্যাঁ। কিছুই করা গেল না।”
“আশা করি–” কথাটা আর শেষ করল না নীলিমা। মাঝখান থেকে কানাই বলল, “আরও একটা খারাপ খবর তোমাকে দেওয়ার আছে।”
“কী খবর?”
“নোটবইটা।”
“মানে? কী হয়েছে নোটবইটার?” অজানা আশঙ্কায় নীলিমা সোজা হয়ে বসল।
টেবিলটা ঘুরে মাসির পাশে গিয়ে বসল কানাই। বলল, “আজকে সকালে পর্যন্ত ওটা সঙ্গে ছিল আমার। ভাল করে প্লাস্টিক দিয়ে মুড়ে এখানে নিয়ে আসছিলাম। কিন্তু জলের মধ্যে পিছলে পড়ে গেলাম একবার, আর আমার হাত ফসকে ভেসে চলে গেল ওটা।”
হাঁ করে রইল নীলিমা। মুখ দিয়ে কথা সরল না।
“আমার যে কী খারাপ লাগছে তোমাকে বলে বোঝাতে পারব না মাসি,” বলল কানাই। “যদি পারতাম কিছুতেই ওটাকে ভেসে যেতে দিতাম না, বিশ্বাস করো।”
মাথা নাড়ল নীলিমা। সংযত করে নিল নিজেকে। শান্ত গলায় বলল, “জানি। এর জন্য দোষ দিস না নিজেকে। কিন্তু নোটবইটা কি পড়া হয়ে গিয়েছিল তোর?”
“হ্যাঁ।” মাথা নাড়ল কানাই।
ওর দিকে চেয়ে রইল নীলিমা। বলল, “কী লেখা ছিল রে?”
“নানা বিষয়ে অনেকরকম কথা,” জবাব দিল কানাই। “ইতিহাস, কবিতা, জিওলজি–বিভিন্ন বিষয়। তবে প্রধানত ছিল মরিচঝাঁপির কথা। গোটা নোটবইটা একটানা দেড়দিনে লিখেছিল মেসো–গোটা একটা দিন আর একটা রাতের অর্ধেকের বেশি সময় ধরে। মনে হয় হামলা শুরু হওয়ার জাস্ট ঘণ্টা কয়েক আগে শেষ করেছিল লেখাটা।”
“হামলার কথা তার মানে কিছু ছিল না?”
“না,” বলল কানাই। “ততক্ষণে ওটা হরেনকে দিয়ে দিয়েছিল মেসো। হরেন তার পরে পরেই ফকিরকে নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিল মরিচঝাঁপি ছেড়ে। ভাগ্যিস চলে এসেছিল ওরা; নোটবইটাও বেঁচে গিয়েছিল তাই।”
“কিন্তু একটা কথা আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না, জানিস? ওর স্টাডিতে ওটা এল কী করে?”
“সে আরেক অদ্ভুত গল্প,” কানাই বলল। “হরেন নাকি আমাকে পাঠাবে বলে ভাল করে প্লাস্টিকে মুড়ে যত্ন করে রেখেছিল নোটবইটা। কিন্তু একদিন হঠাৎ কী করে ওটা হারিয়ে গেল। তারপর এই কদিন আগে নাকি আবার পাওয়া গিয়েছিল। হরেন প্যাকেটটা ময়নার হাতে দিয়ে দিয়েছিল, আর ময়না নাকি চুপিচুপি গিয়ে রেখে এসেছিল স্টাডিতে।”
চুপ করে গেল নীলিমা। ভাবতে লাগল। খানিক পরে বলল, “একটা কথা আমাকে বল তো কানাই, নোটবইটা আমাকে কেন দেয়নি সে বিষয়ে কিছু লিখেছিল নির্মল?”
“সেরকম স্পষ্ট করে কিছু লেখেনি। তবে আমার মনে হয়, মেসো ভেবেছিল এ ব্যাপারে তোমার সহানুভূতি বিশেষ পাবে না,” জবাব দিল কানাই।
“সহানুভূতি?’ রেগেমেগে চেয়ার ছেড়ে উঠে ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে শুরু করল নীলিমা। “কানাই, সহানুভূতি ছিল না ব্যাপারটা তা ঠিক নয়। ঘটনা হল আমার সহানুভূতির লক্ষ্যটা ছিল অনেকটা ছোট। আমি জানি, সারা পৃথিবীর সমস্ত দুঃখ-দুর্দশা মোচনের ক্ষমতা আমার নেই। একটা ছোট জায়গার ছোট ছোট কিছু সমস্যার সমাধান যদি করতে পারি সেই আমার কাছে অনেক। আমার জন্য সেই ছোট জায়গাটা হল লুসিবাড়ি। আমার পক্ষে যতটা দেওয়া সম্ভব আমি এই লুসিবাড়িকে দিয়েছি, আর এতগুলি বছর পরে তার কিছু ফল তো ফলেছে কিছুটা তো সাহায্য হয়েছে মানুষের; সামান্য কয়েকটা হলেও, কিছু পরিবারের একটু ভাল তো করা গেছে। কিন্তু নির্মলের কাছে সেটা যথেষ্ট ছিল না। ওর কথা ছিল হয় পুরোটা পালটাতে হবে, নয়তো কিছুই না। শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়াল নিজে–সেই ‘কিছুই না’-তেই।”
“সে তুমি যদি নোটবইটার কথা বাদ দাও তা হলে,” মাসিকে সংশোধন করে দিল কানাই। “এই একটা কাজের কাজ তো করে যেতে পেরেছিল মেলো৷”
“সেটাও তো রইল না আর,” বলল নীলিমা।
“না,” বলল কানাই। “পুরোটা রইল না। তবে বেশ খানিকটাই থেকে গেছে আমার মাথার মধ্যে। যতটা পারি সেটাকে গুছিয়ে লিখে ফেলার চেষ্টা করব আমি।”
কানাইয়ের চেয়ারের পেছনে হাত রেখে ওর চোখের দিকে তাকাল নীলিমা। আস্তে আস্তে বলল, “এই লেখাটা লেখার সময় আমার কথাগুলোও তাতে রাখবি তো কানাই?”
মানেটা বুঝে উঠতে পারল না কানাই। বলল, “বুঝতে পারলাম না ঠিক।”
“কানাই, স্বপ্ন যারা দেখে তাদের হয়ে কথা বলার জন্যে লোকের অভাব হয় না,” নীলিমা বলল। “কিন্তু যারা ধৈর্য ধরতে জানে, যারা মনকে শক্ত করে কাজ করতে পারে, যারা কোনও একটা জিনিস গড়ে তোলার চেষ্টা করে–তাদের কাজের মধ্যে কি আর কাব্য কবিতা খুঁজে পাওয়া যায়, কী বল?”
কেমন নরম হয়ে এল কানাইয়ের মনটা নীলিমার এই সরাসরি অনুরোধ শুনে। বলল, “আমি পাই মাসি। তোমার মধ্যে আমি…” ডাইনিং টেবিলটা হঠাৎ খটখট করে নড়ে উঠতে কথাটা শেষ না করেই থেমে গেল কানাই। ঝড়ের শব্দকে ছাপিয়ে দূরে কোথাও থেকে শো শো করে একটা আওয়াজ ভেসে এল সঙ্গে সঙ্গে।
জানালার কাছে গিয়ে খড়খড়ির ফাঁক দিয়ে বাইরে তাকাল কানাই। “জলোচ্ছ্বাস! নদীর খাত ধরে এইদিকেই আসছে সোজা।”
জলের একটা দেওয়াল প্রচণ্ড বেগে ধেয়ে আসছে ওদের দিকে। বাঁধের সঙ্গে ধাক্কা লেগে সে দেওয়ালের পাশ বরাবর জলকণার একটা বিশাল মেঘ ছিটকে উঠছে শূন্যে। গোটা দ্বীপটা কাত হয়ে যাওয়া প্লেটের মতো আস্তে আস্তে জলে ভরে উঠছে, চোখের সামনে বিশাল ঢেউটা ক্রমশ ঘিরে ফেলেছে লুসিবাড়িকে। আতঙ্ক বিস্ফারিত চোখে কানাই আর নীলিমা দেখতে লাগল জল বাড়ছে, বেড়েই চলেছে সমানে–একটা একটা করে ডুবে যাচ্ছে নীলিমার ঘরে ওঠার সিঁড়ির ধাপগুলো। অবশেষে ঘরের দরজার ঠিক নীচে পৌঁছনোর পর বন্ধ হল জল বাড়া।
“এই জল জমি থেকে হেঁচে বের করতে তো অনেকদিন লেগে যাবে, তাইনা?” জিজ্ঞেস করল কানাই।
“তা যাবে, কিন্তু তার থেকেও জরুরি হল মানুষের প্রাণ।” ঘাড় কাত করে হসপিটালটা দেখার চেষ্টা করল নীলিমা। বানের জল দেখার জন্যে ঝড় উপেক্ষা করে লোকে সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তিনতলার বারান্দায়।
“সাইক্লোন শেল্টারটার জন্যে কত লোক প্রাণে বেঁচে গেল বল তো?” নীলিমা বলল। “নির্মল প্রায় জোর করে আমাদের দিয়ে বানিয়েছিল ওটা। জিওলজি আর আবহাওয়ার ব্যাপারে অদ্ভুত একটা ইন্টারেস্ট ছিল তো ওর; নির্মল না-বললে ওটা বানানোর কথা মাথায়ই আসত না আমাদের।”
“সত্যি?”
“হ্যাঁ,” বলল নীলিমা। “সারা জীবনে ও যা যা করেছে, তার মধ্যে সবচেয়ে ইম্পর্ট্যান্ট হল এই কাজটা আমাদের দিয়ে এই সাইক্লোন শেল্টারটা বানানো। তার প্রমাণ তো চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছিস এখন। কিন্তু এই কথাটা যদি নির্মলকে বলা হত, হেসেই উড়িয়ে দিত ও। বলত এ তো এমনি সমাজসেবা, বিপ্লব তো আর নয়।”
.
ঝড়ের কেন্দ্রটা যে মাথার ওপর এসে পড়েছে তার প্রথম সংকেত পাওয়া গেল যখন বাতাসের আওয়াজটা কমে গেল হঠাৎ করে। শব্দটা কিন্তু থেমে যায়নি একেবারে, একটু পিছিয়ে গেছে মাত্র। আর তার সঙ্গে সঙ্গে কমে গেছে হাওয়ার তেজ। একটা সময় মনে হল পুরোপুরি স্থির হয়ে গেছে বাতাস। চোখ মেলল পিয়া। যা দেখল তাতে একেবারে অভিভূত হয়ে গেল। পাক খেয়ে আকাশে উঠে যাওয়া কুয়োর মতো একটা ঘূর্ণায়মান সুড়ঙ্গের ঠিক ওপরে ঝকঝক করছে থালার মতো গোল চাঁদ। ঘুরন্ত সেই পাইপের ভেতরের দিকটা চকচক করছে চাঁদের আলো পড়ে, জ্যোৎস্নায় ধুয়ে যাচ্ছে উথাল পাথাল ঝড়ের স্থির কেন্দ্রবিন্দু।
চারপাশে যতদূর চোখ যায়, পুরু হয়ে বিছিয়ে আছে ঝরা পাতার গালিচা, তার নীচে নদী প্রায় চোখেই পড়ে না। জলের ঢেউ, ঘূর্ণি, স্রোত–সবকিছু ঢাকা পড়ে গেছে সেই সবুজ আস্তরণে। পুরো দ্বীপটাই প্রায় তলিয়ে গেছে জলের নীচে; কিছু গাছের সবচেয়ে উঁচু যে কয়েকটা ডালপালা জলের ওপরে জেগে আছে, তাই দেখে কোনওরকমে আন্দাজ করা যাচ্ছে দ্বীপের সীমানা। গাছগুলোকেও কেমন যেন কঙ্কালের মতো দেখাচ্ছে, বেশিরভাগেরই শাখা-প্রশাখা আর কিছু অবশিষ্ট নেই। ডালের সঙ্গে লেগে থাকা পাতা তো চোখেই পড়ে না প্রায়। বহু গাছ আধখানা হয়ে ভেঙে গেছে; মুচড়ে যাওয়া খোঁটার মতো দেখাচ্ছে তাদের।
একখানা সাদা মেঘ ভাসতে ভাসতে এসে জলের ওপর জেগে থাকা ডালপালাগুলির ওপরে নামল। মেঘটা আসলে এক ঝাক সাদা পাখি–এত ক্লান্ত, যে পিয়া আর ফকিরকে দেখে ভয় পাওয়ার শক্তিটুকু পর্যন্ত চলে গেছে ওদের। শাড়ির বাঁধনটা আলগা করে দু’হাতে গুঁড়িটার গায়ে চাপ দিয়ে হাত-পা ছাড়িয়ে নিল পিয়া। তারপর সামনে বসে-থাকা একটা পাখিকে ধরে ফেলল হাত বাড়িয়ে। থরথর করে কাঁপছিল পাখিটা, ছোট্ট বুকের ধুকপুকটুকু হাতে টের পাচ্ছিল পিয়া। বোঝা যাচ্ছে পাখিগুলো ঝড়ের চোখটার মধ্যেই থাকতে চাইছে। কত দূর থেকে উড়ে এসেছে ওরা? কল্পনাও করতে পারল না পিয়া। পাখিটাকে ছেড়ে দিয়ে গাছের গায়ে হেলান দিয়ে বসল ও।
ফকির দেখা গেল এর মধ্যে ডালটার ওপর ব্যালান্স করে দাঁড়িয়ে পড়েছে, সোজা হয়ে খিল ছাড়াচ্ছে পায়ের। কেমন যেন একটু ব্যস্ত ভাব ওর চোখেমুখে, মনে হচ্ছে যেন অন্য কোনও ডালে গিয়ে ওঠা যায় নাকি চারদিকে তাকিয়ে সেটা দেখার চেষ্টা করছে। কিন্তু সেরকম ডাল কোথায়? এখন যেটার ওপর ওরা রয়েছে সেটা ছাড়া এ গাছের একটা ডালও আস্ত নেই আর।
হঠাৎ উবু হয়ে বসে পড়ল ফকির। পিয়ার হাঁটু ছুঁয়ে, প্রায় বোঝাই যায় না এরকম ছোট্ট একটা ইশারা করল। ওর আঙুল বরাবর তাকিয়ে পিয়া দেখল দ্বীপের অন্যদিকে, দূরে আরেকটা ঝোঁপড়ার কাছে, একটা বাঘ হেঁচড়ে হেঁচড়ে জল থেকে উঠে গাছে চড়ার চেষ্টা করছে। বাঘটাও মনে হল পাখিগুলোর মতোই ঝড়ের চোখটার সঙ্গে সঙ্গে চলছে, আর যখনই সুযোগ পাচ্ছে বিশ্রাম নিয়ে নিচ্ছে একটু। ফকির আর পিয়া যখন বাঘটাকে দেখল, ঠিক সেই মুহূর্তেই ও-ও নজর করল ওদের। কয়েকশো মিটার দূর থেকেও বোঝা যাচ্ছিল জানোয়ারটা কী বিশাল; গাছটা যে ওর ভারে ভেঙে পড়ে যাচ্ছে না সেটাই আশ্চর্যের। একবারও চোখের পলক না ফেলে মিনিট কয়েক ওদের দিকে তাকিয়ে রইল বাঘটা–সমস্ত শরীর স্থির, শুধু লেজের ডগাটা একটু একটু নড়ছে। পিয়ার মনে হল লোমশ শরীরটার ওপর যদি হাত রাখা যেত, তা হলে বাঘটার বুকের ধকধকও নিশ্চয়ই হাতে টের পেত ও।
ঝড়টা আবার ফিরে আসছে কি? বাঘটা মনে হল সেরকমই কিছু একটা আন্দাজ করেছে। কারণ একবার ঘাড় ঘুরিয়ে পেছন দিকে তাকিয়েই ও গাছ থেকে আবার নেমে পড়ল জলে। হাঁড়ির মতো মাথাটা কয়েক মিনিট জলের ওপর ভাসতে ভাসতে চলল, আর তারপরেই আস্তে আস্তে কমে এল চাঁদের আলো, সঙ্গে সঙ্গে বাতাসের গর্জনে সব আওয়াজ ঢাকা পড়ে গেল আবার।
তাড়াতাড়ি ঘুরে গিয়ে ডালের দু’দিকে পা ঝুলিয়ে আবার আগের জায়গায় ফিরে গেল পিয়া। গুঁড়ির দিকে মুখ করে বসার পর দু’জনে মিলে পাকানো শাড়িটা দিয়ে আবার বেড় দিল গাছটাকে। তারপর শাড়ির দু’ মুখ এক জায়গায় এনে শক্ত করে গিট বাঁধল ফকির। কোনওরকমে গুছিয়ে বসতে না বসতেই ঝড়টা ফের এসে পড়ল ওদের ওপর। হঠাৎই আবার ছিটকে আসা ডালপালা আর কাঠকুটোয় ভরে উঠল চারদিক।
কিন্তু কিছু একটা মনে হচ্ছে পালটে গেছে। পরিবর্তনটা কী সেটা ধরতে কয়েক মিনিট সময় লাগল পিয়ার। হাওয়ার দিক বদলে গেছে। এবারে উলটো দিক থেকে আসছে ঝড়। আগেরবার যেখানে গাছের গুঁড়িটা পিয়াকে আড়াল করে রেখেছিল, এবার তার জায়গায় আড়াল বলতে শুধু ফকিরের শরীরটা। এইজন্যেই কি ফকির অন্য কোনও গাছে অন্য ডাল খুঁজছিল তখন? ও কি তা হলে বুঝতে পেরেছিল যে ঝড়ের চোখটা পেরিয়ে গেলে এই ডালের ওপর ওর শরীর দিয়েই আড়াল করতে হবে পিয়াকে? ফকিরের আলিঙ্গন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে ওকে টেনে নিজের সামনের দিকে নিয়ে আসার চেষ্টা করল পিয়া, যাতে এবার ঝড়ের মুখ থেকে ও-ই আড়াল করতে পারে ফকিরকে। কিন্তু এতটুকু নড়ানো গেল না ওকে। ফকিরের নিজের শক্তি ছাড়াও এখন হাওয়ার চাপটাও আছে পেছন থেকে, ফলে ওর হাত থেকে পিয়া ছাড়াতেই পারল না নিজেকে। এত কাছাকাছি, প্রায় একসঙ্গে মিশে আছে ওদের শরীরদুটো যে ফকিরের গায়ে প্রত্যেকটা আঘাতের ধাক্কা নিজের শরীরে টের পাচ্ছে পিয়া–ধুপধাপ করে ফকিরের পিঠে এসে লাগা প্রতিটা চোট বুঝতে পারছে ও। ফকিরের গালের হাড়গুলোর ছোঁয়া স্পষ্ট অনুভব করা যাচ্ছে, মনে হচ্ছে কেউ যেন সুপারইম্পোজ করে সেগুলো লাগিয়ে দিয়েছে পিয়ার নিজের গালের ওপর। জীবন যা দিতে পারেনি, সেটাই যেন ওদের দিয়ে গেল এই ঝড়–একসঙ্গে দু’জনকে মিলিয়ে দিয়ে এক করে দিল ওদের।
.
পরদিন
খুবই ধীর গতিতে চলছিল মেঘা। গর্জনতলার দিকে দু’ভাগ পথ এগোনোর পর দূরে একটা ডিঙি চোখে পড়ল–গত কয়েক ঘণ্টায় এই প্রথম।
ঝকঝকে পরিষ্কার দিন; একটু ঠান্ডা আছে, তবে হাওয়া নেই। ঝড় কেটে যাওয়ার পর জল আস্তে আস্তে নামতে শুরু করেছে, কিন্তু জঙ্গলের বেশিরভাগটাই ডুবে রয়েছে এখনও। যতদূর চোখ চলে একটানা একটা সবুজ গালিচায় ঢেকে রয়েছে নদীর বুক, আর জঙ্গলের যে কয়টা গাছ জলের ওপর জেগে রয়েছে একটা পাতাও লেগে নেই তাদের গায়ে–উলঙ্গ গুঁড়িগুলো শুধু দাঁড়িয়ে আছে ভিড় করে। পুরো জায়গাটা ডুবে যাওয়ায় নদীর পাড়গুলো আর দেখা যাচ্ছে না, ফলে দিক ঠিক করে বোট চালানো দ্বিগুণ কঠিন হয়ে গেছে। তাই ভোরবেলা লুসিবাড়ি ছেড়ে বেরোনোর পর থেকেই প্রায় শামুকের গতিতে এগোচ্ছে মেঘা।
দিগন্তের কাছে ভেসে থাকা নৌকোটাকে হরেনই চিনতে পারল প্রথম। ছইটা উড়ে যাওয়ার ফলে নৌকোর চেহারাটা এতই পালটে গেছে যে কানাই বা ময়না কেউই ওটাকে ফকিরের ডিঙি বলে বুঝতেই পারেনি। কিন্তু এই ডিঙি হরেনের নিজের হাতে বানানো, ফকিরকে দিয়ে দেওয়ার আগে নিজে বহু বছর চালিয়েছে হরেন; এক নজর দেখেই নৌকোটাকে চিনতে ওর কোনও অসুবিধা হয়নি তাই। “ওটা ফকিরের নৌকো,” হরেন বলল। “আমি পরিষ্কার চিনতে পারছি। ঝড়ে ছইটা উড়িয়ে নিয়েছে, কিন্তু ওইটাই ফকিরের নৌকোটা।”
“কে আছে নৌকোর মধ্যে?” কানাই জিজ্ঞেস করল। কোনও জবাব এল না হরেনের কাছ থেকে।
লঞ্চের একেবারে গলুইটার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল কানাই আর ময়না। ইঞ্চি ইঞ্চি করে ডিঙি আর বোট এগোচ্ছে পরস্পরের দিকে; মনে হচ্ছে যেন জমাট বেঁধে গেছে মাঝখানের জলটুকু। খানিকক্ষণ যাওয়ার পর কানাই বুঝতে পারল একটাই মানুষ বসে রয়েছে নৌকোর ওপর, সে পুরুষ কি মহিলা বোঝার কোনও উপায় নেই, কারণ পা থেকে মাথা পর্যন্ত তার পুরো শরীরটাই ঢেকে রয়েছে কাদায়।
বোটের রেলিং-এর গায়ে শক্ত করে এঁটে বসে আছে ময়নার হাত। কানাইয়েরও তাই। ময়নার হাতের গাঁটগুলোও ওর নিজের হাতের গাঁটগুলোর মতো ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে, লক্ষ করল কানাই। পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে ওরা, কিন্তু মনে হচ্ছে যেন একটা গভীর ফাটল দু’জনকে দু’জনের থেকে আলাদা করে রেখেছে। তীক্ষ্ণ চোখে সামনের দিকে তাকিয়ে দু’জনেই বোঝার চেষ্টা করছে কে আছে ডিঙির ওপরে।
“ওই মেয়েটা,” অবশেষে বলল ময়না। ফিসফিস করে বলতে শুরু করা কথাগুলো চিৎকার হয়ে ছড়িয়ে গেল তারপর–”আমি দেখতে পেয়েছি–ফকির নেই নৌকোতে।” দু’হাত মুঠো করে শাখাগুলো কপালে আছড়ে আছড়ে ভাঙতে লাগল ময়না। ভাঙা শাখার টুকরোয় কেটে গিয়ে একফোঁটা রক্ত গড়িয়ে পড়ল কপাল বেয়ে।
আরও আঘাত থেকে বাঁচাতে ওর হাত দুটোকে শক্ত করে টেনে ধরল কানাই। বলল, “ময়না, দাঁড়াও! একটু অপেক্ষা করে দেখো…”
স্থির হয়ে গেল ময়না। ভূতগ্রস্তের মতো চেয়ে রইল সামনের দিকে। এগিয়ে আসা নৌকোটা যেন মায়াবলে বেঁধে রেখেছে ওকে।
“ও নৌকোতে নেই! ও নেই… ও আর নেই.” হঠাৎ দুমড়ে গেল ময়নার পা দুটো, ডেকের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল ও। একটা হুলুস্থুলু পড়ে গেল লঞ্চে, চেঁচিয়ে নগেনকে ইঞ্জিন বন্ধ করতে বলে সারেঙ-এর ঘর থেকে দৌড়ে নেমে এল হরেন। কানাই আর হরেন দু’জনে ধরাধরি করে ময়নাকে একটা কেবিনে নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দিল বাঙ্কের ওপর।
কেবিন থেকে ডেকে বেরিয়ে এসে কানাই দেখল ডিঙিটাকে মেঘার পাশে নিয়ে চলে এসেছে পিয়া। টলমলে ডিঙিটার ওপর কোনওরকমে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ও, হাতে জিপিএস মনিটরটা, যেটা দেখে দেখে দিক ঠিক রেখে এতটা এসে পৌঁছেছে। বোটের পেছনদিকটায় গিয়ে ওর দিকে হাত বাড়িয়ে দিল কানাই। দুজনের কেউই কোনও কথা বলল না, কিন্তু বোটে পা রাখতে রাখতেই দুমড়ে মুচড়ে গেল পিয়ার মুখটা, মনে হল ও যেন পড়ে যাবে এক্ষুনি। ধরার জন্য কানাই দু’হাত বাড়াতেই হুমড়ি খেয়ে এসে পড়ল পিয়া, মাথাটা রাখল কানাইয়ের বুকের ওপর। আস্তে আস্তে নরম গলায় কানাই জিজ্ঞেস করল, “ফকির?”
একেবারে যেন শোনাই গেল না পিয়ার গলা: “পারল না, ও পারল না…”
ঝড় প্রায় শেষ হওয়ার সময় ঘটল ঘটনাটা, পিয়া জানাল। প্রচণ্ড ভারী, বিরাট একটা গাছের গুঁড়ি উড়ে এসে লেগেছিল ফকিরের গায়ে। এত জোরে আঘাতটা এসেছিল যে পিয়ার মনে হচ্ছিল ও-ও যেন চেপটে যাচ্ছে গাছের গায়ে। শাড়ির বাঁধনটা থাকায় মারা যাওয়ার সময়ও ডাল থেকে পড়ে যায়নি ফকির। ফকিরের মুখটা প্রায় লেগে ছিল পিয়ার কানের সঙ্গে, তাই ওর শেষ কথা ক’টা শুনতে পেয়েছিল পিয়া। নিশ্বাস ফুরিয়ে যাওয়ার আগে শুধু একবার ময়না আর টুটুলের নাম করেছিল ফকির। জন্তু জানোয়ারদের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য ওর শরীরটাকে ময়নার শাড়িটা দিয়ে বেঁধে গাছের ওপরেই রেখে এসেছে পিয়া। বাঁধন কেটে নামানোর জন্যে আবার গর্জনতলায় ফিরে যেতে হবে ওদের।
* * *
ফকিরের প্রাণহীন শরীরটা বোটে করে লুসিবাড়িতে নিয়ে এল ওরা। সেই সন্ধ্যাতেই সারা হয়ে গেল দাহকার্য।
ঝড়ে লুসিবাড়ির মানুষদের ক্ষয়ক্ষতি খুব বেশি হয়নি। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি যাদের হতে পারত, আগাম সতর্কবার্তা পাওয়ার দরুন আগেভাগেই তারা হাসপাতালে এসে আশ্রয় নিতে পেরেছিল। ফলে খানিকক্ষণের মধ্যেই গোটা দ্বীপ জেনে গেল খবরটা। অনেক লোক এসেছিল ফকিরের শেষ কাজে।
দাহকার্যের সময় এবং তারপরেও সারাদিন ময়নার সঙ্গে ওর ঘরেই ছিল পিয়া; চেনাশোনা আত্মীয়-পড়শিরা অনেকে ভিড় করেছিল সেখানে। মেয়েদের মধ্যে একজন জল এনে দিল পিয়াকে, গা-হাত পা ধুয়ে পরিষ্কার হয়ে নেওয়ার জন্যে। আরেকজন একটা শাড়ি নিয়ে এল ওর জন্যে, সাহায্য করল সেটা পরে নিতে। সকলের বসার জন্যে মাদুর পেতে দেওয়া হল ঘরের মেঝেতে। পিয়া গিয়ে তাতে বসতেই কোত্থেকে টুটুল এসে হাজির হল পাশে। ওর কোলের ওপর দুটো কলা রেখে চুপ করে পাশটিতে এসে বসল, মুখে কোনও কথা নেই। টুটুলকে জড়িয়ে ধরে বুকের কাছে টেনে নিল পিয়া, এত কাছে যে ওর বুকের ধুকপুকটুকুও টের পাচ্ছিল নিজের পাঁজরের পাশে। পিয়ার মনে পড়ল উড়ে আসা গাছের গুঁড়িটা কী প্রচণ্ড জোরে ধাক্কা মেরেছিল ফকিরের খোলা পিঠের ওপর, মনে পড়ল কাঁধের ওপর ফকিরের থুতনির ভার, ফকিরের ঠোঁটদুটো ওর কানের কত কাছে ছিল সে কথা মনে পড়ল–এত কাছে যে যতটা না কথার শব্দ, তার চেয়ে বেশি ঠোঁটের নড়াচড়া থেকেই ও বুঝতে পেরেছিল যে নিশ্বাসের সঙ্গে বিড়বিড় করে বউ আর ছেলের নাম করছে ফকির।
পিয়ার মনে পড়ল নিজের বুকের নিস্তব্ধতায় মনে মনে কী কথা দিয়েছিল ও ফকিরকে, কেমন করে ওই প্রচণ্ড ঝড় বাদলের মধ্যে মুখের কাছে জলের বোতলটা শুধু এগিয়ে ধরতে পেরেছিল ও, তা ছাড়া শেষ মুহূর্তটাতে আর কিছুই করতে পারেনি ফকিরের জন্যে। মনে পড়ল গভীর ভালবাসার কথা ক’টা মনে করিয়ে দেবে বলে মনে মনে কেমন হাতড়াচ্ছিল ও এবং আগেও বহুবার যেমন হয়েছে তেমনই, মুখে কিছু বলা হলেও, কেমন করে যেন ফকির জেনে গেছে পিয়া কী বলতে চেয়েছিল ওকে।
.
বাড়ি : একটি উপসংহার
মাসখানেক কেটে গেছে ঝড়ের পর। একদিন দুপুরে নিজের ডেস্কে বসে কাজ করছে নীলিমা, এমন সময় হাসপাতাল থেকে একজন নার্স ছুটতে ছুটতে এসে খবর দিল বাসন্তীর লঞ্চ থেকে ‘পিয়াদিদিকে’ নামতে দেখেছে ও, এই ট্রাস্টের অফিসের দিকেই এখন আসছে ‘পিয়াদিদি’।
বিস্ময় গোপন করতে পারল না নীলিমা। জিজ্ঞেস করল, “পিয়া? মানে সায়েন্টিস্ট পিয়া? তুই ঠিক দেখেছিস?”
“হ্যাঁ গো মাসিমা, পিয়াদিদিই। ভুল দেখিনি আমি।”
চেয়ারে গা এলিয়ে দিল নীলিমা, মনে মনে খবরটা হজম করার চেষ্টা করতে লাগল। প্রায় হপ্তাদুয়েক হয়ে গেল এখান থেকে চলে গেছে পিয়া। সত্যি বলতে কী ওকে বিদায় জানানোর সময় নীলিমা ভাবেইনি আবার কখনও দেখা হবে ওর সঙ্গে। ঝড়ের পর কয়েকদিন লুসিবাড়িতেই থেকে গিয়েছিল মেয়েটা। গেস্ট হাউসে ওর উপস্থিতিটা কেমন যেন অস্বস্তিকর হয়ে উঠেছিল তখন যেন একটা ছায়া পড়েছিল ওর ওপর, ভূতের মতো থাকত সারাদিন নিজের মনে, মুখখানা সব সময় গোমড়া, কথাবার্তাও বিশেষ বলত না কারও সঙ্গে। একা নীলিমার পক্ষে ওকে সামলানো তখন হয়তো কঠিন হত, কিন্তু ভাগ্যক্রমে সেই সময়টায় ময়নার সঙ্গে অদ্ভুত একটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক হয়ে গিয়েছিল পিয়ার। বেশ কয়েকবার ওদের একসঙ্গে দেখেছে নীলিমা, গেস্ট হাউসের ভেতরে কিংবা আশেপাশে, চুপ করে পাশাপাশি বসে আছে দু’জন। এমনকী মাঝে মাঝে পিয়াকে ময়না বা ময়নাকে পিয়া ভেবে ভুলও করেছে নীলিমা। নিজের জামাকাপড় সব নষ্ট হয়ে যাওয়ায় বাধ্য হয়েই তখন শাড়ি পরতে হচ্ছিল পিয়াকে উজ্জ্বল লাল, হলুদ, সবুজ রং-এর সব শাড়ি। ময়না যে কাপড়গুলো আর কোনওদিন পরবে না, সেগুলো দিয়ে দিয়েছিল পিয়াকে। বৈধব্যের রীতি মেনে নিজের চুলগুলো কেটে ফেলেছিল ময়না, পিয়ার চুলের মতো ছোট ছোট করে। তাতে আরও এক রকম লাগত দু’জনকে। মিল বলতে অবশ্য শুধু এইটুকুই। স্বভাবে আর মনের ভাব প্রকাশের ভঙ্গিতে কিন্তু দু’জনে একেবারেই দু’রকম। ময়নার শোক চোখে দেখে বোঝা যেত, সব সময় লাল হয়ে ফুলে থাকত ওর চোখদুটো; পিয়ার মুখ কিন্তু পাথরের মতো, ভাবলেশহীন, দেখে মনে হত যেন নিজের ভেতরে গুটিয়ে গেছে মেয়েটা।
“পিয়া আসলে একটা ঘোরের মধ্যে রয়েছে,” দিল্লি ফিরে যাওয়ার আগে নীলিমাকে একদিন বলেছিল কানাই। “সেটা অবশ্য স্বাভাবিক। কল্পনা করতে পারো, ঝড়ের শেষটায় ওই গাছের ওপর বসে থাকার সময় কী মনের অবস্থাটা হয়েছিল ওর? ফকিরের মরা শরীরটা যখন ঝড় থেকে আড়াল করে রেখেছে ওকে? সেই ভয়ংকর স্মৃতির কথা যদি বাদও দাও, তাহলেও ওর অপরাধবোধ আর দায়ভারের কথাটা একবার ভাব।”
“সেসব আমি বুঝতে পেরেছি রে কানাই,” নীলিমা জবাব দিয়েছিল। “সেইজন্যেই আরও আমার মনে হয় এখান থেকে ফিরে গিয়ে নিজের চেনা কোনও জায়গায় থাকলেই আঘাতটা কাটিয়ে ওঠা সহজ হবে ওর পক্ষে। তুই কী বলিস, আমেরিকাতেই ফিরে গেলে ভাল হয় না ওর এখন? না হলে অন্তত নিজের আত্মীয়স্বজনদের কাছে কলকাতাতেও গিয়ে থাকতে পারে।”
“সে কথা আমি ওকে বলেছিলাম মাসি, কানাই বলেছিল। “এমনকী ওর আমেরিকা যাওয়ার টিকিটের ব্যবস্থাও করে দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু মনে হল ও যেন শুনতেই পেল
আমার কথাগুলো, সত্যি বলছি। আমার ধারণা ময়না আর টুটুলের কী হবে সেটাই সব সময় ভেবে যাচ্ছে ও। একটা অপরাধবোধও হয়তো কাজ করছে মনের মধ্যে। আসলে, নিজেকে সামলানোর জন্যে একটু সময় দিতে হবে ওকে, কিছুদিন একটু নিজের মতো থাকতে দিতে হবে।”
“তার মানে ওকে এখানে এইভাবে রেখেই তুই চলে যাবি? আমার ঘাড়ে ফেলে দিয়ে?” আশঙ্কার সুর নীলিমার গলায়।
“তোমার কোনও অসুবিধা ও করবে বলে মনে হয় না আমার”, জবাব দিয়েছিল কানাই। “ওকে নিয়ে কোনও ঝামেলাই হবে না তোমার, দেখো। ওর আসলে একটু সময় লাগবে নিজেকে গুছিয়ে নেওয়ার জন্যে। আমি এখানে থাকলে তার কোনও সুবিধা হবে বলে মনে হয় না, বরং উলটোটাই হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।”
আর আপত্তি করেনি নীলিমা। কানাইকে আটকাতেও চেষ্টা করেনি আর। “জানি রে কানাই, তোরও তো কাজকর্ম সব পড়ে আছে…”
মাসিকে এক হাতে জড়িয়ে ধরেছিল কানাই। বলেছিল, “কিছু চিন্তা কোরো না গো মাসি। দেখো সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি আবার আসব কিছুদিন পরে।”
কানাইয়ের শেষ কথাটাকে খুব একটা গুরুত্ব দেয়নি নীলিমা। মাথা নেড়ে বলেছিল, “সে আসিস। তোর জন্যে তো এখানকার দরজা সব সময়ই খোলা…”
পরের দিনই দিল্লি ফিরে গিয়েছিল কানাই–ঝড়ের ঠিক এক সপ্তাহ পর। তার দিন কয়েক পরেই পিয়া একদিন এসে নীলিমাকে বলল ও-ও চলে যাবে।
“হ্যাঁ বাছা, যাবে তো নিশ্চয়ই। কী আর বলব।” মনের স্বস্তিটুকু যাতে ধরা না পড়ে যায়, তার জন্যে খানিকটা জোর করেই নিরুত্তাপ ভাব আনতে হল গলায়। গত কয়েকদিন ধরেই একটা কথা নীলিমার মনের মধ্যে খোঁচা দিচ্ছিল : পিয়া লুসিবাড়িতে আছে বলে সরকারি লোকেরা কোনও ঝামেলা করবে না তো? ভিসা-টিসা কি আছে ওর? ঠিকঠাক পারমিট নিয়ে এসেছে কি? জানে না নীলিমা। জিজ্ঞেসও করতে চায় না। “এই ক’দিন যা গেছে তোমার ওপর দিয়ে…” নীলিমার গলায় স্নেহের সুর। “ঝড়টা কাটিয়ে ওঠার জন্যে নিজেকে একটু সময় দাও এবার।”
“কিছুদিন পরেই আবার ফিরে আসব আমি,” পিয়া বলেছিল। অকৃত্রিম স্নেহে নীলিমা জবাব দিয়েছিল, “হ্যাঁ মা, নিশ্চয়ই আসবে।”
এই ধরনের কথাগুলি নীলিমার খুব চেনা। অনেক সহৃদয় বিদেশির মুখে হুবহু এই শব্দগুলোই এর আগে বহুবার শুনেছে ও। তাদের একজনও আর ফিরে আসেনি কখনও। যোগাযোগও করেনি। পিয়ার বেলাতেও তাই তার অন্যথা হবে বলে আশা করেনি নীলিমা। কিন্তু সে ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়ে গেল এখন। সত্যি সত্যিই কথা রেখেছে পিয়া।
.
ভাল করে গুছিয়ে বসার আগেই টক টক আওয়াজ শোনা গেল দরজায়। কী বলবে ভেবে উঠতে না পেরে শেষে নীলিমা বলল, “আরে পিয়া! তুমি ফিরে এসেছ!”
“হ্যাঁ,” শুকনো গলায় জবাব দিল পিয়া। “আপনি কি ভেবেছিলেন আর আসব না?”
সত্যি কথা বলতে কী, মনে মনে সেইরকমই ভেবেছিল নীলিমা। তাড়াতাড়ি কথা ঘুরিয়ে তাই বলল, “তারপর? এখান থেকে যাওয়ার পর কোথায় কোথায় ঘুরলে?” এর মধ্যে নতুন জামাকাপড় কিনে নিয়েছে মেয়েটা, লক্ষ করল নীলিমা। আগের মতোই সেই সাদা শার্ট আর সুতির প্যান্ট পরেছে।
“কলকাতায় গিয়েছিলাম,” বলল পিয়া। “ওখানে আমার মাসির কাছে ছিলাম কয়েকদিন। বেশিরভাগ সময়টাই ইন্টারনেট দেখে কাটিয়েছি। যা রেসপন্স পেয়েছি না–জানলে খুব খুশি হবেন আপনি।”
“রেসপন্স? কীসের?”
“ঝড়ের সময় কী কী হয়েছিল আর ফকির কীভাবে মারা গেল সেসব বিস্তারিতভাবে লিখে বিভিন্ন জায়গায় কয়েকটা চিঠি পাঠিয়েছিলাম আমি। সেই চিঠিগুলোকে আবার আমার কয়েকজন বন্ধু আর সহকর্মী সারা পৃথিবীর বহু মানুষকে পাঠিয়েছে; পরিচিত লোকেদের কাছে সাহায্য চেয়েছি ময়না আর টুটুলের জন্যে। আমরা যতটা আশা করেছিলাম তার থেকে অনেক অনেক বেশি রেসপন্স এসেছে মাসিমা। অবশ্য টাকা যতটা হলে ভাল হত ততটা ওঠেনি, তবে খানিকটা উঠেছে। যা জোগাড় হয়েছে তাতে মাথার ওপরে একটা ছাদের ব্যবস্থা হয়ে যাবে ওদের, আর কলেজ পর্যন্ত টুটুলের পড়াশোনার খরচও হয়তো চলে যাবে।”
“আচ্ছা!” সোজা হয়ে উঠে বসল নীলিমা। “খুব খুশি হয়েছি আমি, খুব খুশি হয়েছি। ময়নাও নিশ্চয়ই খুশি হবে খুব।”
“তা ছাড়াও আরও আছে–”
“সত্যি? ভুরুদুটো ওপরে তুলে বলল নীলিমা। “আর কী কী করেছ তুমি শুনি?”
“একটা রিপোর্ট লিখেছি,” জবাব দিল পিয়া। “এখানে ডলফিনদের ওপর যতটুকু স্টাডি করতে পেরেছি তার ওপর। খুবই ভাসা ভাসা হয়েছে রিপোর্টটা, কারণ ডেটা যা জোগাড় করতে পেরেছিলাম সবই তো নষ্ট হয়ে গেছে। কিন্তু ওইটুকু দেখেই খুব উৎসাহিত হয়েছেন অনেকে। বেশ কয়েকটা সংরক্ষণ সংস্থা এবং পরিবেশ নিয়ে যারা কাজকর্ম করে এরকম কয়েকটা অর্গানাইজেশন এই বিষয়ে গবেষণা করার জন্য খরচ অফার করেছে আমাকে। কিন্তু আপনার সঙ্গে আগে কথা না বলে ওদের কিছু জানাতে চাইনি আমি।”
“আমার সঙ্গে?” বিস্ময় ধরে রাখতে পারল না নীলিমা। “আমি এসবের কী জানি?”
“আপনি এখানকার মানুষদের সম্পর্কে অনেক কিছু জানেন মাসিমা,” পিয়া বলল। “আর আমার দিক থেকে আমি এইটুকু বলতে পারি যে পরিবেশ সংরক্ষণের ভার মাথায় চাপিয়ে দিয়ে সাধারণ গরিব-গুর্বো মানুষকে নাজেহাল করার মতো কোনও কাজ আমি করতে চাই না। যদি কোনও প্রজেক্ট আমি এখানে করি, সেটা আমি করতে চাই বাদাবন ট্রাস্টের সাহায্য নিয়ে, যাতে যে সমস্ত জেলেরা এখানে মাছ-কাঁকড়া ধরে খায়, তাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলে এগোনো যায়। ট্রাস্টেরও তাতে উপকার হবে। ফান্ড যা আসবে তা আমরা ভাগ করে নেব।”
ফান্ডের কথা উঠতেই সচেতন হয়ে উঠল নীলিমার বাস্তববাদী মন। ঠোঁট কামড়ে বলল, “বেশ। নিশ্চয়ই ভাবা যেতে পারে ব্যাপারটা। কিন্তু পিয়া, এর মধ্যে প্র্যাকটিকাল সমস্যা যা যা হতে পারে সেগুলো কি ভাল করে ভেবে দেখেছ তুমি? যেমন ধরো, তুমি নিজে কোথায় থাকবে?”
মাথা নাড়ল পিয়া। বলল, “সেটাও ভেবেছি। আইডিয়াটা আপনার পছন্দ হয় কিনা দেখুন।”
“বলো।”
“আমি ভাবছিলাম, আপনার যদি আপত্তি না থাকে, তাহলে এ বাড়ির দোতলাটা, মানে গেস্ট হাউসটা, আমি ভাড়া নিয়ে নিতে পারি। ওখানে থেকেই দিব্যি চালিয়ে নিতে পারব। ছোট একটা অফিস করব, আর একটা ডেটাব্যাঙ্ক। অফিস একটা দরকার হবেই, কারণ খুঁটিনাটি প্রত্যেকটা খরচ-খরচার সব হিসেব দেখাতে হবে।”
প্রশ্রয়ের হাসি হাসল নীলিমা। যে কাজ হাতে নিতে যাচ্ছে তার ঝামেলা যে কত সে ব্যাপারে কোনও ধারণাই নেই মেয়েটার। ফাইলপত্র ঘাঁটাঘাঁটির কাজ তো খুব কম দিন করছে না নীলিমা। নরম গলায় আস্তে আস্তে তাই পিয়াকে বলল, “শোনো মেয়ে, এত বড় মাপের একটা কাজ করতে গেলে একা হাতে তো তুমি পুরোটা সামলাতে পারবে না। তোমাকে নোক রাখতে হবে।”
“জানি মাসিমা, জবাব দিল পিয়া। “সেটাও আমি ভেবে রেখেছি। আমার মনে হয় ওই হিসেব কেতাবের ব্যাপারগুলো ময়নাই সামলে দিতে পারবে। তার জন্যে ওকে পুরো সময় কাজ করতেও হবে না; হাসপাতালের কাজ সেরে হাতে যেটুকু সময় থাকবে তাতেই হয়ে যাবে। এতে কিছু বাড়তি রোজগারও হবে ওর। আমার মনে হয় না ময়নার খুব একটা অসুবিধা হবে। আর আমার তো খুবই সুবিধা হবে। ও খানিকটা বাংলাও শিখিয়ে দিতে পারবে আমাকে; তার বদলে ওকে আমি ইংরেজি শেখাব।”
নিজের ডান হাতের চেটোটা বাঁ হাতের মধ্যে নিয়ে মোচড়াতে লাগল নীলিমা। ভুরু কুঁচকে ভাবতে লাগল পিয়া এখানে থেকে কাজ করতে গেলে কোন কোন দিক থেকে সমস্যা আসতে পারে। অবশেষে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা, একটা কথা বলো, তোমার ভিসা আর পারমিট-টারমিট সব কিছু আছে? তুমি কিন্তু বিদেশি, সেটা ভুলে যেয়ো না। লম্বা সময়ের জন্যে তোমার এখানে থাকাটা বে-আইনি হবে কিনা আমি জানি না।”
এই সমস্যাটাও সমাধানের ব্যবস্থা করে ফেলেছে পিয়া। বলল, “আমি আমার কাকার সঙ্গে কথা বলেছি এই নিয়ে। কাকা বলেছেন কী একটা কার্ড আমি নাকি পেতে পারি যাতে যতদিন ইচ্ছা থাকা যেতে পারে এখানে। আমার বাবা-মা ইন্ডিয়ান ছিলেন বলেই নাকি এই সুবিধাটা পেতে পারি আমি। আর পারমিটের ব্যাপারে কাকা বললেন বাদাবন ট্রাস্ট যদি আমার রিসার্চের কাজ স্পনসর করতে রাজি হয় তাহলে বাকিটুকু উনি সামলে দিতে পারবেন। পরিবেশ সংরক্ষণ নিয়ে কাজ করে দিল্লির এরকম কিছু অর্গানাইজেশনের লোকজনদের কাকা চেনেন, তাদের বললে তারাই সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করে সব ব্যবস্থা করে দিতে পারবে।”
“বাপরে বাপ! তুমি তো দেখছি একেবারে সব আটঘাট বেঁধেই এসেছ,” হোহো করে হেসে উঠল নীলিমা। “তোমার প্রোজেক্টের একটা নামও নিশ্চয়ই ঠিক করে ফেলেছ, তাই না?” ঠাট্টা করে বলা কথাটা শুনে একটু গম্ভীর হয়ে গেল পিয়া। নীলিমা বুঝতে পারল এই মেয়ের কাছে এটা কোনও রসিকতার বিষয় নয়। “সত্যি সত্যিই নাম ঠিক করা হয়ে গেছে? এর মধ্যেই?”
“ফাইনাল কিছু করিনি, তবে মোটামুটি একটা ভাবছিলাম,” পিয়া বলল। “ফকিরের নামে নাম দেওয়া যেতে পারে। ওর দেওয়া ডেটাগুলোর তো একটা বড় ভূমিকা থাকবে এই প্রোজেক্টে।”
“ফকিরের দেওয়া ডেটা?” চোখ প্রায় কপালে উঠে গেল নীলিমার। “ কিন্তু তুমি যে বললে ডেটাগুলো সব ঝড়ে হারিয়ে গেছে?”
হঠাৎ চকচক করে উঠল পিয়ার চোখ। বলল, “সবটা হারায়নি মাসিমা। এই জিনিসটা রয়ে গেছে আমার সঙ্গে।” পকেট থেকে জিপিএস মনিটরটা বের করে নীলিমাকে দেখাল পিয়া। “এই দেখুন, গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেমে থাকা স্যাটেলাইটগুলোর সঙ্গে সব সময় যোগাযোগ থাকে এই যন্ত্রের। ঝড়ের দিন এটা আমার পকেটে ছিল। ফলে যন্ত্রপাতির মধ্যে এটাই একমাত্র বেঁচে গেছে।” পিয়া একটা বোতাম টিপতেই জ্বলে উঠল স্ক্রিনের আলো। তারপর যন্ত্রের মেমরিতে পৌঁছনোর জন্য অন্য আর একটা বোম টিপল কয়েকবার। “যে যে পথ দিয়ে ফকির আমাকে নিয়ে গিয়েছিল সেগুলো সব স্টোর করা আছে এতে। দেখুন।” পর্দার ওপর ফুটে ওঠা একটা আঁকাবাঁকা রেখার দিকে ইশারা করল পিয়া। “ঝড়ের আগের দিন এই পথটা দিয়ে গিয়েছিলাম আমরা। সরু সরু সুঁতিখাল, খাঁড়ি–যেখানে যেখানে ডলফিন ওর চোখে পড়েছে তার প্রত্যেকটা জায়গায় সেদিন ডিঙি নিয়ে গিয়েছিল ফকির। বহু বছর ধরে সঞ্চয় করা জ্ঞানের ভাণ্ডার লুকিয়ে আছে এই একখানা ম্যাপের মধ্যে। এটার ওপর ভিত্তি করেই দাঁড় করাতে হবে আমার প্রোজেক্টকে। আর সেই জন্যেই আমার মনে হয় ফকিরের নামেই হওয়া উচিত এই প্রোজেক্টের নাম।”
“আরিব্বাস!” বলে উঠল নীলিমা। সামনের জানালার ফাঁক দিয়ে নজরে আসা এক চিলতে আকাশের দিকে চোখ চলে গেল ওর। “তার মানে তুমি বলছ এই সব কিছু ওইখানে ধরা রয়ে গেছে?”
“ঠিক তাই।”
চুপ করে গেল নীলিমা। মনে মনে ভাবতে লাগল ফকিরের কথা, ওর ডিঙিটার কথা, যে রহস্যময় পথে একদিন যাত্রা করেছিল ফকির কেমন দূর আকাশের তারার ভাষাতে লেখা হয়ে রয়ে গেছে সেই পথের ঠিকানা, সেই কথা। পিয়ার ডান হাতখানা নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে আলতো করে চাপ দিল ও। বলল, “ঠিক বলেছ। ফকিরের একটা স্মৃতিচিহ্ন থাকুক। এই পৃথিবীতেও থাকুক, ওই আকাশেও থাকুক। কিন্তু কাজে হাত দেওয়ার আগে পুরো ব্যাপারটা একবার ভাল করে ভেবে নেওয়ার জন্য একটু সময় দিতে হবে আমাকে।” লম্বা একটা শ্বাস ফেলে চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ল নীলিমা। “তবে তারও আগে সবচেয়ে জরুরি কাজটা কী জান? গরম গরম এক কাপ চা খাওয়া। কী বলো?”
“নিশ্চয় খাব মাসিমা। থ্যাঙ্ক ইউ।”
রান্নাঘরে গিয়ে ফিল্টার থেকে কেটলিতে জল ভরল নীলিমা। তারপর কেরোসিন স্টোভটা যখন পাম্প করছে, সেই সময় দরজা দিয়ে মাথা বাড়াল পিয়া।
“আচ্ছা মাসিমা, কানাইয়ের কী খবর?” ও জিজ্ঞেস করল। “এর মধ্যে আর যোগাযোগ করেছে?”
একটা দেশলাই কাঠি জ্বেলে স্টোভটা ধরাল নীলিমা। লোহার জালিটা বসাল তার ওপর। বলল, “হ্যাঁ করেছে। এই তো কালকেই একটা চিঠি পেয়েছি ওর কাছ থেকে।”
“কেমন আছে?” জিজ্ঞেস করল পিয়া। কেটলিটা স্টোভের ওপর বসাতে বসাতে একগাল হাসল নীলিমা। “কী বলব রে মা, ওরও তো তোমারই মতো অবস্থা। ভয়ানক ব্যস্ত সব সময়।”
“তাই নাকি? কী করছে ও এখন?”
“বলছি দাঁড়াও,” টিপটটার দিকে হাত বাড়াতে বাড়াতে বলল নীলিমা। “কোত্থেকে শুরু করি বলো তো? সবচেয়ে ভাল কাজ যেটা করেছে কানাই, সেটা হল নিজের কোম্পানিটাকে একেবারে ঢেলে সাজিয়েছে। ফলে এখন দরকার মতো একটু ছুটি নিতে পারে মাঝে মাঝে। কিছুদিন কলকাতাতেও এসে থাকার ইচ্ছে আছে ওর।”
“সত্যি?” পিয়ার চোখে বিস্ময়। “কী করবে ও কলকাতায়?”
“সেটা ঠিক বলতে পরব না,” অনেক দিন ধরে জমিয়ে রাখা দার্জিলিং চায়ের পাতা চামচে করে টিপটের মধ্যে ঢালল নীলিমা। “তবে আমাকে ও একদিন বলেছিল যে নির্মলের নোটবইয়ের কাহিনিটা ও গুছিয়ে লিখতে চায়: কী করে নোটবইটা ওর হাতে এল, কী ছিল ওর মধ্যে, কী করে আবার ওটা হারিয়ে গেল–এই সব। কিন্তু এই কাজটা ঠিক কীভাবে ও করতে চায় সেটা বরং তুমিই জিজ্ঞেস করে নিয়ে ওকে। দু-এক দিনের মধ্যেই ও আসবে এখানে।”
“দু-এক দিনের মধ্যে?”
মাথা নাড়ল নীলিমা। টক টক করে আওয়াজ উঠছে কেটলির ঢাকনায়; স্টোভ থেকে কেটলিটাকে নামিয়ে নিল ও। ফুটন্ত জলটা টিপটে ঢেলে দিয়ে বলল, “কানাই যখন আসবে তখন যদি কয়েকদিন ও ওপরের গেস্ট হাউসটাতে থাকে, তাতে তোমার কোনও আপত্তি নেই তো?”
হাসল পিয়া। “না। কোনওই আপত্তি নেই। সত্যি কথা বলতে কী, ও বাড়িতে থাকলে আমার ভালই লাগবে।”
পিয়ার শব্দ ব্যবহারে এত আশ্চর্য হয়ে গেল নীলিমা যে ঠং করে চায়ের চামচটা পড়ে গেল হাত থেকে। অবাক চোখে ওর দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি ঠিক শুনলাম তো? ‘বাড়িতে’ বললে কি তুমি?”
নিজের অজান্তেই কথাটা বেরিয়ে এসেছিল পিয়ার মুখ দিয়ে। এখন খেয়াল হতে কপালে ভাঁজ পড়ল ওর।
অবশেষে বলল, “জানেন মাসিমা, এই ওর্কায়েলা ডলফিনগুলো যেখানে থাকে সেটাই আমার বাড়ি। তাহলে এই জায়গাটাই বা হবে না কেন?” চোখদুটো বড় বড় হয়ে উঠল নীলিমার। তারপর হো হো করে হাসিতে ফেটে পড়ে বলল, “দেখো পিয়া, এইখানে তোমার আর আমার মধ্যে একটা তফাত আছে। আমি ‘বাড়ি’ বলতে কী বুঝি জানো? যেখানে শান্তিতে এক কাপ চা বানিয়ে খেতে পারি সেটাই আমার বাড়ি।”