২.৪
দিল্লিতে চিত্তরঞ্জন পার্কে একটা গেস্ট হাউজে উঠেছেন কবির খান। এ শহরে তাঁর প্রচুর বন্ধুবান্ধব আছে, কিন্তু কারুকেই খবর দেননি। এবারে তাঁর কাজটা অনেকটাই গোপন। যদিও পুলিশেরই কাজ কিন্তু ঠিক সবরকম আইন-নিয়ম মেনে চলা হচ্ছে না। বেশি জানাজানি না হওয়াই ভালো।
কবির এখানে পৌঁছেছেন রাত আটটার একটু পরে। এপ্রিল মাসে দিল্লির আবহাওয়া অতি চমৎকার। অনেকেই এ সময় বাইরে বেরিয়ে পড়ে।
দুর্লভ সিং আসবে নটার সময়। এর মধ্যে বেজে উঠল কবিরের মোবাইল ফোন।
তাঁর বন্ধু বিনায়ক।
বিনায়ক জিগ্যেস করলেন, হুমায়ুন, তুমি কোথায়? তোমার বাড়িতে ফোন করলাম, কেউ ধরল না। তুমি কলকাতায় নেই?
কবির বললেন, না, আমি দিল্লিতে এসেছি।
বিনায়ক বললেন, এক্সসেলেন্ট! আমি কোথায় বলো তো?
কবির বললেন, তুমিও দিল্লিতে নাকি?
বিনায়ক বললেন, ঠিক প্রপার দিল্লি নয়। গুরগাঁও-তে একটা চমৎকার হোটেলে। তুমি চলে এসো। অনেকদিন বাদে ভালো করে আড্ডা দেওয়া যাবে।
এখন তো যাওয়ার উপায় নেই। আমি দিল্লি এসেছি একটা জরুরি কাজ নিয়ে। সেই ব্যাপারেই…
রাত আটটার পরেও কাজ? চলে এসো, চলে এসো! আমার কাছে একটা ভালো হুইস্কি আছে।
এখন সত্যিই যেতে পারছি না। এখানকার পুলিশের একজন আসবে একটু পরে।
হুমায়ুন, তুমি দেখছি প্রমোশন পাবেই পাবে। এত কাজ!
বিনায়ক, তুমি কদিন থাকচ্ছ? তুমি কাল সকালে চলে এসো বরং। তোমাকে আমি একটা গল্প শোনাতে পারব। সে গল্পের অর্ধেকটা তুমি জানো–
তার মানে? কোন গল্প?
লক্ষ্মীমণি নামে একটি মেয়ের কথা তোমার মনে আছে? তোমার স্ত্রী যাকে চাকরি দিয়েছেন তাঁর স্কুলে?
হ্যাঁ, মনে থাকবে না কেন? বিশাখার কাছ থেকে আমি মাঝে-মাঝে রিপোর্ট পাই। সে তো ভালোই কাজ করছে। বাচ্চাদের খুব ভালোবাসে, যত্ন করে। শি ইজ নাও সেটেল ইন লাইফ।
সে সবই তো ঠিক ছিল। এখন দিল্লি পুলিশ তাকে আবার চাইছে। লক্ষ্মীমণি যা স্টেটমেন্ট দিয়েছিল, তাতে গণ্ডগোল ছিল কিছু কিছু। একটা মার্ডারের ব্যাপারে তাকে অ্যাকসেসরি হিসেবে সন্দেহ করা হচ্ছে।
তাকে দিল্লিতে ধরে এনেছ? তার মানে, তার চাকরি যাবে। সে আর ফিরতে পারবে না। তরে জীবনটা শেষ পর্যন্ত নষ্টই হবে। ছি ছি ছি, তোমাদের পুলিশদের কি মানবিকতা বোধ বলে কিছু থাকতে নেই?
দাঁড়াও, দাঁড়াও, অত উত্তেজিত হচ্ছ কেন? না, তাকে দিল্লি আনা হয়নি। ডেফিনিট প্রমাণ না পেলে যাতে তাকে অ্যারেস্ট করা না হয়, সেই চেষ্টাই এখনও করে যাচ্ছি। তাকে বাঁচাবার চেষ্টা করবার জন্যই আমাকে দিল্লিতে আসতে হয়েছে।
এখানকার বাঙালিরা আমাকে একটা সম্বর্ধনা দেওয়ার জন্য ডেকে এনেছে। কাল আমি সময় পাব না। পরশুদিন ফিরে যাওয়ার কথা। আজ সন্ধেটাই ফাঁকা ছিলাম। এরপর আর তোমার সঙ্গে দেখা করার সময় পাব কি না বলতে পারছি না।
ঠিক আছে, আমি তোমায় ফোন করব।
কবিরের সঙ্গেও একটা স্কচের বোতল আছে। হাত-মুখ ধুয়ে নিয়ে তিনি একটা গেলাশ নিয়ে বসলেন। টিভি খুলতেই দেখা গেল জবর খবর। দিল্লির খান মার্কেটে বিকেলবেলা দু বার বম্ব ব্লাস্ট হয়েছে। মৃত্যু হয়েছে এগারোজনের।
কবিরের মুখটা কুঁকড়ে গেল। এইরকম যখন-তখন বোমার আক্রমণ এখন অনেকটা জল ভাত হয়ে গেছে। অথচ বারবার নিরীহ মানুষই তো মরে। আজকের নিহতদের মধ্যে রয়েছে দুটি কিশোর-কিশোরী, মা-বাবার সঙ্গে তারাও বাজারে এসেছিল।
টিভিতে বলছে, এর পেছনে রয়েছে ইসলামি জেহাদি একটি দল। কিন্তু এরকম অকারণ নরহত্যার সমর্থন ইসলামে কোথাও নাই। এরকম ঘটনার কথা জানলে শুধু দুঃখ নয়, রাগেও কবিরে শরীর জ্বলতে থাকে।
দুর্লভ এল ঠিক কাঁটায়-কাঁটায় নটার সময়।
প্রথমে অবধারিত ভাবে আজকের বোমা বিস্ফোরণের কথা এসেই পড়ে। দুর্লভের কাছ থেকে কবির ঘটনার পুরো বিবরণ শুনলেন। দুটো বোমা ফেটেছে, আরও দুটো বোমা রাখা ছিল কাছাকাছি। পুলিশ যথাসময়ে সে দুটি অকেজো করে দিয়েছে। সে দুটোও ফাটলে আরও অনেকের মৃত্যু হত।
কথার মাঝখানে কবির হঠাৎ বলে উঠলেন, দুর্লভ, তোমাকে একটা কথা জিগ্যেস করব? তুমি সত্যি উত্তর দেবে? আমি একজন মুসলমান। আজকের ঘটনাটাও কিছু-মুসলমানই ঘটিয়েছে। তাই আমার ওপরে ভেতরে-ভেতরে রাগ কিংবা ঘৃণা হচ্ছে না?
দুর্লভ খানিকটা অবাকচোখে চেয়ে থেকে বলল, স্যার, আপনি মুসলমান? আপনি একজন পুলিশ অফিসার, আমিও তাই। আমরা দুজনে একইরকম সার্ভিস রুল মানি, আমাদের তো আলাদা কোন জাত বা ধর্ম থাকে না!
কবির বললেন, তবু
তাকে বাধা দিয়ে দুর্লভ আবার বললন, যারা আজ বোমা ফাটিয়েছে, তারা শুধু মুসলমান নয়, তারা মৌলবাদী, উগ্রপন্থী। এরকম মৌলবাদী কোন ধর্মে নেই? ইহুদিদের মধ্যে নেই, হিন্দুদের মধ্যে নেই। এরা সবাই এক ধরনের অন্ধ দানব। আমার তো মনে হয়, মানুষের সভ্যতাই ধ্বংসের পথে চলেছে আর এই মৌলবাদীরা সেই ধ্বংসকেই এগিয়ে আনছে।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কবির বললেন, নাঃ, এরা শেষ পর্যন্ত সভ্যতাকে ধ্বংস করতে পারবে না।
গেলাশে একটা চুমুক দিয়ে তিনি বললেন, তুমি একটা নেবে? তুমি খাও কি?
দুর্লভ বলল, রেগুলার খাই না, মাঝে-মাঝে। কিন্তু হুইস্কি আমার সহ্য হয় না। কখনও পার্টি-ফার্টিতে রেড ওয়াইন খাই।
কবির বললেন, তা আমার কাছে নেই। ঠিক আছে, কাজের কথা হোক।
দুর্লভ বলল, আমাদের প্রধান কাজ দুটো। প্রথম হচ্ছে, শিউলাল ঝাঁকে খুঁজে বার করা। এই শিউলাল থানায় গিয়ে রিপোর্ট করেছিল। কিন্তু তার ঠিকানা কিংবা কাজের জায়গা সম্পর্কে কিছু জানায়নি। সে এখনও বেঁচে আছে কি না, তাও আমরা জানি না। আর সেকেন্ডলি, গীতা চাওলাকে জেরা করে জানতে হবে, আসল ঘটনাটা কী ঘটেছিল।
কবির জিগ্যেস করলেন, আমার একটা খটকা লাগছে। খুন হয়েছিল একটা, না দুটো? দুই বন্ধু এক বাইজির বাড়ি গিয়ে মদ্যপান করতে করতে নিজেদের মধ্যে ঝগড়া বাধিয়ে ফেলল। তারপর একজন গুলি করল আর একজনকে। ঘরে পড়ে রইল একজন, রিভলভার হাতে বেরিয়ে এলো আততায়ী, তার নাম সহদেব, ধুতি পরা, হাতে বালা। রাইট? গুলি করতে করতে সে সিঁড়ি দিয়ে নেমে পালাল। তখন কিছু জানাজানি হয়নি। ছমাস বাদে সেই বাড়ি ভেঙে ফেলার সময় ভিত খুঁড়ে পাওয়া গেল একটা ডেডবডি। সেটা শিউলালের নয়, তোমরা আইডেন্টিফাই করেছ। সেটা ওই সহদেবের। সে খুন হল কখন, কোথায়? ও বাড়িতে তো শিউলালের খুন হওয়ার কথা আমরা জেনেছি।
না, স্যার। ঘটনার কয়েকদিন পর শিউলাল নিজে এসে থানায় খবর দিয়েছিল। সে তো খুন হয়নি?
ঘটনাটা যে মিলছে না। থানায় এসে যে খবর দিল, সে কি সত্যিই শিউলাল? নাকি অন্য কেউ শিউলাল বলে নিজের পরিচয় দিয়েছিল। তোমরাই তো বলছ, শিউলালের আর কোনও ট্রেস নেই।
অন্য কেউ এসে নিজেকে শিউলাল বলেছিল?
লজিক্যালি তাই তো মনে হয়।
তা হলে শিউলালের ডেডবডি গেল কোথায়?
বাড়ি ভাঙার সময় একটু ডেডবডি পাওয়া গেছে, এবার ভালো করে খুঁজে দেখো, আর একটা ডেডবডিও পাওয়া যায় কি না!
সে বাড়ি পুরোটাই ভাঙা হয়ে গেছে, সেখানে আর কিছু পাওয়া যায়নি, দ্যাট ইজ ফর শিওর!
কলকাতার মেয়ে লক্ষ্মীমণি, সে শুধু প্রথম খুনটাই দেখেছিল। সহদেবকে সে জ্যান্ত অবস্থায় পালাতে দেখেছে। এখন শিউলালের ডেডবডি যদি পাওয়া না যায়, তাহলে ও কেসটা এখন তোলা যায় না। লক্ষ্মীমণিকেও সাক্ষী হিসেবে ডেকে আনার দরকার নেই।
সেটা স্যার নির্ভর করছে, গীতা চাওলা শেষ পর্যন্ত কী বলে? সে যদি মুখ খুলতে না চায়, তা হলে সবাইকেই কোর্টে প্রোডিউস করতে হবে। লক্ষ্মমণিকেও বাদ দেওয়া যাবে না।
দুর্লভ, চতুর্দিকে অকারণে মানুষ মরছে। আর আমরা একটা অসহায় মেয়েকে বাঁচাবার চেষ্টা করছি। যদি কোনও কারণে–
স্যার, আইন আমাদের হাতে নেই। আমরা চেপে গেলেও আদালতে জজই বলবেন, সে বাড়িতে আর কে কে ছিল। অন্য সাক্ষী কোথায় গেল?
উঠে দাঁড়িয়ে সে বলল, আজ আমার একটু ব্যস্ততা আছে। গীতা চাওলার সঙ্গে আমি কাল সকালে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট করেছি। সাড়ে দশটায়। আপনাকে আমি ঠিক পৌনে দশটার সময় এসে তুলে নিয়ে যাব। রেডি থাকবেন।
কলকাতার তুলনায় দিল্লিতে ভোর হয় একটু দেরিতে। এই সময়টায় বেশ কুয়াশা থাকে। কবির বুঝতেই পারেননি কত বেলা হয়ে গেছে। সব জানলার পরদা টানা। ঘুম ভাঙার পরেও একটুক্ষণ আলস্য করলেন কবির। তারপর বালিশের পাশে রাখা হাতঘড়িটা তুলে নিয়ে দেখেই ধড়মড় করে উঠে বসলেন।
আটটা চল্লিশ! প্রাতঃকৃত্য সারতে কবিরের অনেকটা সময় লাগে। টেলিফোনে চায়ের অর্ডার দিয়ে তিনি ছুটলেন বাথরুমে।
দিল্লিতে সকালের দিকে নানা রাস্তায় ট্রাফিক জ্যাম হয়, তবু দুর্লভ সিং একেবারে ঠিক সময়ে এসে উপস্থিত। কবিরও তখন টাইয়ের গিট বাঁধছেন।
গীতা চাওলার অ্যাপার্টমেন্ট বসন্তবিহারে একটা বাড়ির তিনতলায়। বেশ সুন্দরভাবে সাজানো। প্রশস্ত বসবার ঘর, তার মধ্যে আট-দশটা টবের গাছ। দু-দিকের দেওয়ালে পরপর কয়েকটি পাখির ছবি। আঁকা নয়, ফটোগ্রাফ।
গীতা চাওলার বয়েস ঠিক বোঝা যায় না। তিরিশ থেকে চল্লিশের মধ্যে। পাতলা, ছিপছিপে চেহারা, বেশ রূপসী, মুখে বুদ্ধি আর কিছুটা শিক্ষারও ছাপ আছে। রং ফরসা, ঠোঁটে গাঢ় লাল লিপস্টিক লাগানো। তার শালোয়ার-কামিজের রংও লাল।
পরিস্কার ইংরিজিতে সে বলল, প্লিজ কাম ইন। বসুন। আগেই জিগ্যেস করে নিচ্ছি, আপনারা চা না কফি খাবেন? আমি নিজে মাছের চপ বানিয়েছি, তাও খেতে হবে।
কবির বললেন, আমি ব্রেকফাস্ট খাওয়ার সময় পাইনি। মাছের চপ খেতে রাজি আছি, সঙ্গে চা খাব।
গীতা ওদের মুখোমুখি একটা সোফায় বসার পর দুর্লভ বলল, কলকাতা থেকে আমাদের একজন অফিসার এসেছেন। তিনি আগে আপনাকে কিছু প্রশ্ন করতে চান। আপনার আপত্তি নেই তো?
গীতা বলল, না, আপত্তি থাকবে কেন?
কবির বললেন, নমস্কার আমি প্রথমেই জানতে চাই, রাজেন্দ্রনগরের একটা বাড়িতে আপনি একসময় ছিলেন, তখন আপনার নাম কী ছিল? গীতা চাওলা?
না, তখন আমার নাম ছিল দিলরুবা।
দিলরুবা? আমি যে শুনেছি, আপনার নাম ছিল জানেমন বিবি?
তা হতেও পারে। আমি এক-এক সময় এক একটা নাম দিই। সারা জীবন ধরে একটাই নাম আমার মোটেই পছন্দ হয় না। এখন যে আমি গীতা চাওলা, এই নামটাও আমার আসল নাম নয়।
বাঃ! নতুন-নতুন নাম, এটা বেশ ভালো ব্যাপার। রাজেন্দ্রনগরের সেই বাড়িটায় একটা খুন হয়েছিল? একটা কিংবা দুটো। আপনি বলেছেন, আপনি সে সময় ও বাড়িতে ছিলেন না, আগেই ছেড়ে চলে গেছেন। এটা সত্যি?
দেখুন সাহেব, আমারা মা ছিলেন প্রফেশনাল বাইজি। লাখনউতে থাকতেন। আমিও তাই। লাখনউয়ের বদলে দিল্লিতেই এখন টাকা বেশি। নাম বদলের মতন, ঘনঘন বাড়ি বদল করাও আমার শখ। রাজেন্দ্রনগরের ওই বাড়ি ছেড়ে আমি অনেক আগেই এখানে চলে এসেছি, তার অকাট্য প্রমাণ আছে। আমি যে দেড় বছর ধরে এই ফ্ল্যাটে থাকি, অনেক লোক তার সাক্ষী দেবে।
আমি যদি বলি, ওই খুনের সময় আপনি রাজেন্দ্রনগরেই ছিলেন, আর আপনার নাম তখন ছিল জানেমন বিবি?
আপনি বললেই তো হবে না।
যদি বলি, আমার কাছে তার প্রমাণ আছে?
কী প্রমাণ?
কবির কোটের পকেট থেকে একটা ফটোগ্রাফ বার করলেন। সেটা গীতার মুখের সামনে তুলে ধরে জিগ্যেস করলেন, আপনি একে চেনেন?
দু-এক পলক তাকিয়েই গীতা ঠোঁট উলটে বলল, না। কখনও দেখিনি।
ফটোগ্রাফটি আবার তুলে ধরে কবির বললেন, এর নাম লক্ষ্মীমণি। পশ্চিম বাংলার মেয়ে। কেউ কেউ একে সরিফন বিবি বলেও ভুল করেছে। এ মেয়েটি আপনার মেইড সারভেন্ট ছিল। এই মেয়েটি আর আপনি, দুজনেই খুনের সময়…ও বলেছে..
ঠোঁটে বিদ্রুপের হাসি ফুটিয়ে গীতা বলল, মেইড সারভেন্টদের মুখ আমি মনে রাখি না। এ পর্যন্ত কত মেয়েই তো আমার কাছে কাজ করেছে, তাদের কথা মনে রাখতে হবে নাকি! আপনাদের বাংলার কোনও মেয়ে আমার সম্পর্কে কী বলেছে না বলেছে, তাতে কিছু প্রমাণ হয় নাকি? আপনি একজন দায়িত্বশীল অফিসার হয়ে এ কী কথা বলছেন?
দুর্লভ এবার বললেন, মিস চাওলা, একটা খুনের ব্যাপারে আমরা এসেছি। আপনি সেই খুনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, এমন অভিযোগ আমরা করিনি। সত্যিই সেরকম ভাবিনি। আমরা শুধু আপনার কাছে সাহায্য চাইতে এসেছি, যাতে খুনের রহস্যটা সম্ভ করা যায়। আপনি যা দেখেছেন, সাক্ষী দেওয়ার সময় সেই কথা বলবেন।
মুখের হাসি মুছে ফেলে গীতা এবার জ্বলন্ত চোখে বলল, আমি কোর্টে গিয়ে সাক্ষী। দেব? সারা দুনিয়া জানবে যে আমি একটা বাইজি? আমার ঘরে মানুষ খুন হয়? নো! আমি যা বলেছি, তাতেই স্টিক করে থাকছি। আপনারা আমার নামে অ্যারেস্টের ওয়ারেন্ট আনতে পারবেন? আই চ্যালেঞ্জ ইউ!
বাকি দুজন একটুক্ষণ নীরব।
গীতা নিজেকে একটু সামলে নিয়ে বলল, নিন, চা খান। ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।
এই সময় দরজায় কলিং বেল বাজল।
গীতা বাড়িতে এ সময় কোনও কাজের লোক রাখেনি। নিজেই উঠে গিয়ে খুলে দিল দরজা।
হাতে একগুচ্ছ গোলাপ নিয়ে ঢুকল শৌখিন চেহারার এক যুবক। পুরোদস্তুর ধূসর রঙের সুট পরা। মাথায় অনেক চুল। চোখে সানগ্লাস।
গীতা পুলিশ অফিসার দুজনের দিকে ফিরে বলল, ইনি আমার বিশেষ বন্ধু।
দুর্লভ একটু অস্বস্তির সঙ্গে বলল, আমরা একটা বিশেষ ব্যাপার নিয়ে আলোচনা করছি। সেটা গোপন রাখতে চাই। আপনার বন্ধুকে একটু পরে আসতে বলবেন? কিংবা অন্য কোনও ঘরে যদি বসান।
যুবকটি বলল, তার চেয়ে আমার এখানে বসাই ভালো। আমি হয়তো আপনাদের অনেকটা সাহায্য করতে পারব।
গীতার পাশে বসে পড়ে সে প্রথমে গোলাপগুচ্ছ তার হাতে তুলে দিল। তারপর সানগ্লাসটা খুলে ফেলে অন্য দুজনের দিকে তাকিয়ে বলল, নমস্কার। আমার নাম শিউলাল ঝা।
ঘরের মধ্যে যেন একটা বোমা পড়ল।
কবির আর দুর্লভ স্তম্ভিতের মতন তাকালেন পরস্পরের দিকে।
দুর্লভ অস্ফুট স্বরে বলল, শিউলাল ঝা। আপনি..আপনি…এতদিন কোথায় ছিলেন?
শিউলাল হেসে বলল, কিছুদিন ছিলাম আগ্রায়, কিছুদিন চেন্নাই, এখন বহাল তবিয়তেই দিল্লিতে আছি।
দুর্লভ বলল, পুলিশ অনেক খুঁজেও আপনাকে পায়নি।
শিউলাল অবাক হয়ে বলল, পুলিশ আমাকে খুঁজবে কেন? আমি কি কোনও অপরাধ করেছি? না তো!
আপনার বন্ধু সহদেব আচারিয়া?
জি হ্যাঁ।
সে রাজেন্দ্রনগরের একটা বাড়িতে খুন হয়েছে। আপনি–
আমি তো তাকে খুন করিনি। আমিই থানায় গিয়ে তার খুনের কথা রিপোর্ট করেছিলাম। আপনারা তার ডেডবডি খুঁজে পেয়েছেন?
হ্যাঁ, পেয়েছি।
এতদিন পর? আমি আমার ডিউটি ঠিকই করেছিলাম। কোনও খুনের ঘটনা জানলে পুলিশকে জানাতে হয়, তাই না? আর তো আমার কোনও দায়িত্ব নেই?
সেই খুনের সময়, এই মেয়েটি, গীতা চাওলা, তখন ওর অন্য নাম ছিল, ওখানে উপস্থিত ছিল?
ছিল।
অ্যাঁ? ছিল? ও যে অনবরত বলছে, ওখানে ছিল না, খুনের ঘটনা কিছুই জানে না?
সে কথা বলেছিল, কারণ, ও চাইছিল, আপনারা যেন বারবার ওকে এই নিয়ে বিরক্ত না করেন। কাল রাত্তির থেকে আমি ওকে বোঝাচ্ছি, পুলিশের কাছে সবকথা খুলে না বললে পুলিশ পিছু ছাড়বে না। বারবার ফিরে-ফিরে আসবে। সেইজন্যই তো আজ আমি এই সময় চলে এলাম।
থ্যাঙ্ক ইউ। তা হলে আপনার কাছে আরও কিছু প্রশ্নের উত্তর পেতে পারি?
অবশ্যই পারেন। কিন্তু তার আগে আমি একটা কথা বলে নিই। সহদেবের খুনের ব্যাপারে আমি আর গীতা কোনওক্রমেই জড়িত নই। তবু পুলিশ যদি আমাদের জড়াবার চেষ্টা করে, সেজন্য আমরা আটঘাট সব বেঁধে রেখেছি। পুলিশ ইচ্ছে করলে যে-কোনও একটা কেস জড়িয়ে দিতে পারে। না, না, আপত্তি করবেন না। এরকম হয়, বিনা দোষে মানুষের ফাঁসিও হয়। তাই আমরা ব্যবস্থা করে রেখেছি, প্রমাণ করে দেব সেই সময় গীতা ও বাড়িতে ছিল না, আমিও ছিলাম না। আমার আসল নাম বসন্তকুমার, আমার স্কুল সার্টিফিকেটেও এই নাম আছে, শিউলাল আমার ডাক নাম। বসন্তকুমার সেই সময় আগ্রায় দেশের বাড়িতে ছিল, তাও প্রমাণ করে দেব!
দুর্লভ বলল, আপনারা ইনভলভড না থাকলে পুলিশ আপনাদের টাচ করবে না, এ বিষয়ে আমি কথা দিচ্ছি। ওয়ার্ড অফ অনার।
বেশ। তা হলে কী জিগ্যেস করবেন, করুন।
দুর্লভ এবার কবিরের দিকে ফিরে বলল, সার, নাও ইট ইজ ইয়োর টার্ন।
কবির বললেন, আপনি আর সহদেব, দুই বন্ধু, খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন?
জি হাঁ, ক্লোজ ফ্রেন্ড।
সমান সমান বন্ধুত্ব? নাকি একজন বস আর অন্যজন তার তাঁবেদার? কে বেশি পয়সা খরচ করত?
আপনি ঠিক ধরেছেন, সেই দিক দিয়ে সমান সমান বন্ধুত্ব নয়। সহদেব খুব বড়লোকের। ছেলে, হাতে প্রচুর পয়সা। সেদিক থেকে তখনও আমি কমজোরি ছিলাম। আমার বাবার মৃত্যু হয়েছিল কিন্তু আমি সম্পত্তির ভাগ পাইনি। মামলা চলছিল। এখন মিটে গেছে। এখন ভাগ পেয়েছি। যাই হোক, সহদেবের পাল্লায় পড়ে আমিও প্রচুর মদ খেতাম, মেয়েমানুষের বাড়ি যেতাম। সহদেবই খরচ করত বেশি।
সহদেব কীরকম মানুষ ছিল? বুদ্ধিমান না মাথা মোটা? গোঁয়ার? গানবাজনা বুঝত?
সহদেব এমনিতে ভালো মানুষ ছিল। খুব একটা বুদ্ধি ছিল না। তবে বেশি মেদ খেলে একেবারে পাগল হয়ে যেত। কিছুতেই নিজেকে সামলাতে পারত না। লোকের সঙ্গেও খুব খারাপ ব্যবহার করত। যেন অন্য মানুষ। যেভাবে ও চলছিল, তাতে খুন না হলেও যে কোনওদিন ও অ্যাকসিডেন্টে মারা যেতে পারত। সেরকম অবস্থায় দু-একবার আমি ওকে বাঁচিয়েছি।
ওকে খুন করল কে?
গীতা খুন করেনি, আমি তার সাক্ষী। আমি খুন করিনি, গীতা তার সাক্ষী। এবং এটা হ্যাঁন্ড্রেড পারসেন্ট সত্যি।
আমি এখনও একটা ধাঁধার উত্তর পাচ্ছি না। ও বাড়িতে একজন মেইড সারভেন্ট ছিল, সে জানিয়েছে যে এই গীতার ঘরে সহদেব তার এক বন্ধুকে গুলি করে মেরে ফেলে। তারপর নিজে রিভলভার হাতে নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে থাকে। তা হলে সেদিন কি আপনার বদলে অন্য কোনও বন্ধু ছিল ওর সঙ্গে?
না। আমিই ছিলাম। একজন মেড সারভেন্ট বলেছে এ কথা? গুড! গুড, গুড, গুড! তার মানে তো প্রমাণ হয়েই গেল, সহদেব জ্যান্ত অবস্থায় সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেছে। ওর খুনের ব্যাপারে আমার কোনও হাত থাকতে পারে না। সহদেব আমাকেই গুলি করেছিল। কিন্তু আমি মরিনি। আহত হয়েছিলাম, তাও খুব বেশি না।
আপনাকে গুলি করল কেন?
বলব? সেটা খুব নোংরা ব্যাপার। অবশ্য আপনারা ভেটারান পুলিশ, আপনাদের নিশ্চয়ই। এসব শোনা বা দেখার অভ্যেস আছে।
গীতার দিকে তাকিয়ে সে জিগ্যেস করল, কী বলব?
গীতা একটুখানি কাঁধ ঝাঁকিয়ে উত্তর দিল, আমার কিছু আসে যায় না।
শিউলাল বা বসন্তকুমার বলল, সংক্ষেপে জানাচ্ছি। সেদিন বেশি মদ খেতে-খেতে সহদেব পাগল হয়ে গেল। গীতার এক মেইড সারভেন্ট, সে বোধহয় বাংগালি ছিল, মাঝে-মাঝে ঘরে এসে আমাদের নাস্তা, পানি, কাবাব-টাবাব সার্ভ করে যাচ্ছিল। রোজই করে। তাকে দেখতে এমন কিছু ভালো নয়, তবে ফিগারটা বেশ টাইট। সহদেবের মাথায় হঠাৎ ভূত চাপল। সে ওই মেয়েটিকে বলল, তুই আজ শাড়ি-টাড়ি সব খুলে ফেলে সার্ভ কর। সে তো কিছুতেই রাজি নয়। বাংগালি মেয়েদের লজ্জা বেশি হয়, সে এতখানি জিভ বার করে বলতে লাগল, ও মা, ছি ছি, না, সে আমি পারব না। সহদেব বলল, কেন পারবি না? এই নে টাকা, কত টাকা চাস। পকেট থেকে সে মুঠো মুঠো টাকা বার করে ছুঁড়ে দিতে লাগল। মেয়েটা কিছুতেই রাজি নয়। সে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে লাগল, আর সহদেব জোর করে তাকে ধরে আনতে লাগল। মেয়েটা নিজের শাড়ি চেপে ধরে কান্না শুরু করে দিল। আমি তখন বিরক্ত হয়ে সহদেবকে বললাম, আর ছোড় না ইয়ার। ও মেয়েটাকে জোর করছিস কেন? ও চলে যাক, গীতা না হয় পোশাক-টোশাক সব খুলে বসবে। গীতার অত লজ্জা-টজ্জা নেই। তখন সহদেব আবার বলল, না, ও মেয়েটা যাবে না। গীতা আর ও দুজনেই সবকিছু খুলে বসবে। গীতা আবার তাতে রাজি নয়। মেড সারভেন্টের সামনে সে কাপড় উল্লাবে কেন? যে-যাই কাজ করুক, সবারই তো একটা ডিগনিটি আছে। টাকা দিয়ে সবকিছু কেনা যায় না। সহদেব দুজনেরই কাপড় ধরে টানাটানি করছে আর চিৎকার করছে ষাঁড়ের মতন, আমার আর সহ্য হল না। আমি খুব জোরে একটা থাপ্পড় কষালাম সহদেবকে। সেই থাপ্পড় খেয়ে সহদেব কাজের মেয়েটাকে ছেড়ে দিল, সে দৌড়ে পালাল। আমার দিকে চেয়ে হিংস্রভাবে দাঁত বার করে সহদেব বলল, তুই আমার গায়ে হাত তুললি? তোর এত সাহস, কুত্তার বাচ্চা…। আমি বললাম, সহদেব মাথা ঠান্ডা কর। একটু চুপ করে বোস। সহদেব যে সঙ্গে রিভলভার নিয়ে এসেছে, আমি জানতাম না। অন্যদিন আনে না। হঠাৎ ফস করে একটা রিভলভার বার করে গুলি চালিয়ে দিল আমার দিকে।
দুর্লভ বলল, তখন কেউ ওর মাথায় একটা কাচের বোতল নিয়ে মারল?
শিউলাল বলল, নো! কেউ মারেনি।
কবির বললেন, তারপরও তো সহদেব সিঁড়ি দিয়ে নেমেছে, তখন ওর মাথায় তো কোনও ক্ষত ছিল না। গুলিটা আপনার কোথায় লেগেছিল?
কাঁধে! একেবারে গলা ঘেঁষে। আর ডান দিকে লাগলেই আমার গলাটা ফুটো হয়ে যেত। লাগেনি, বিশেষ কিছু হয়নি। পরে কয়েকদিন আমি গলায় একটা মাফলার জড়িয়ে ঘুরেছি। সেদিন গুলিটা লাগার পরেই আমি মাটিতে হুমড়ি খেয়ে মড়ার মতো পড়ে রইলাম। নড়াচড়া করলেই ও আবার গুলি করত। আমার কাঁধ দিয়ে গলগল করে রক্ত বেরুচ্ছে আর গীতা ভয়ে চাঁচাচ্ছে। সহদেব খানিকটা ভয় পেয়ে দৌড়ে বেরিয়ে গেল। দেয়ার এন্ডস মাই স্টোরি।
দুর্লভ বলল, তা হলে সহদেবকে খুন করল কে? তাকে অন্য কোথাও খুন করে ওই বাড়িতে এনে পুঁতে দেওয়া হয়েছিল?
উহুঃ!
বাকিটা যে মিস্ট্রি রয়ে গেল?
সহদেব সেই রাতেই খুন হয়েছিল। কে খুন করেছে, তাও আমরা জানি। কিন্তু অন্য কারুকে ধরিয়ে দেওয়া আমাদের উচিত নয়। এবার আপনারা খুঁজে দেখুন। মোট কথা, গীতা কিংবা আমি কিংবা ওই বাংগালি মেইড সারভেন্ট, আমরা কেউই ওকে খুন করিনি।
এইবার গীতা বলল, পুলিশ শত চেষ্টা করলেও আসল খুনিকে ধরতে পারবে না। সুতরাং, এখন বাকি গল্পটা বলে দেওয়া যেতে পারে।
দুর্লভ বলল, পুলিশ কিন্তু শেষ পর্যন্ত অনেক কিছুই পারে।
গীতা বলল, দেখুন চেষ্টা করে। আমরা নাম বলে দিচ্ছি।
শিউলাল বলল, সে রাত্তিরেই আমি আর গীতা ওবাড়ি থেকে হাওয়া হয়ে যাই। অন্যান্য ঘরের মেয়েরাও ভেঙ্গে পড়ে। খুনের ব্যাপারটা আমরা চোখে দেখিনি, কিন্তু জানি। খুন না। বলে এটাকেই ন্যায় বিচার বলা উচিত। ও বাড়িতে নেপালি দারোয়ান ছিল। তাদের একজনের নাম বাহাদুর। পুরো নাম জানি না। খুব বড়সড় চেহারা, তেমনি গায়ের জোর। অসম্ভব বিশ্বাসী। এমনিতে মানুষটা শান্ত, কিন্তু বদরাগী। একবার রাগ হলে হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। সরিফন বলে একজন মেইড সারভেন্টের সঙ্গে ওর ঘনিষ্ঠতা ছিল। সহদেব সিঁড়ি দিয়ে নেমে এসে বাইরে। বেরুবার গেট খুঁজে পায়নি। বদ্ধ মাতাল তো। হাতে রিভলভার, এলোমেলো গুলি চালাচ্ছে। নীচের সবাই আড়ালে লুকিয়ে পড়েছে। তবু একটা গুলি লাগে সরিফনের পায়ে। তখন একটা বাঘের মতন বাহাদুর আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে একটা বোতল দিয়ে মারে সহদেবের মাথায়। সহদেব তাকে মারার জন্যও রিভলভার তুলেছিল, আর সুযোগ পায়নি। বাহাদুরের বোতলের আঘাতটা একটু জোরেই হয়ে গিয়েছিল। সেই এক আঘাতেই সহদেব খতম। আপনারাই বলুন, বাহাদুর কি কিছু অন্যায় করেছে?
দুর্লভ ব্যাজার মুখে বলল, সে বিচারের ভার আমাদের ওপর নয়।
শিউলাল বলল, সহদেবের ডেডবডির ব্যবস্থা বাহাদুর একাই করেছে। পুলিশ যাতে সঙ্গে সঙ্গে খুঁজে না পায়, তার জন্য মেঝেতে গর্ত করে তার মধ্যে লাশটাকে কবর দিয়ে তার ওপর। খাঁটিয়া পেতে সরিফনকে শুইয়ে রেখেছিল। তারপর সরিফনকে নিয়ে সে কোথায় চলে গেছে, জানি না। সত্যিই জানি না। খুব সম্ভবত নেপালে চলে গেছে। নেপাল থেকে তাকে খুঁজে বার করতে পারেন তো দেখুন।
কবিরের দিকে তাকিয়ে দুর্লভ বলল, এবার সম্ভবত কেসটা ড্রপ করতেই হবে।
কবির বললেন, আমরা চেষ্টার কোনও ত্রুটি করিনি। কিন্তু এই কেসে কারুকে শাস্তি দেওয়া আর বোধহয় সম্ভব নয়। আমি এটা ভুলে যেতেই চাই।