২.৪ টানা হেঁটেছে মিচনার

অধ্যায় ৩১

১৮২০ খৃস্টাব্দ

টানা হেঁটেছে মিচনার। হয়তো বছরের পর বছর। সে নিজেও জানে না। জনমানুষ, সভ্যতা তাকে কাছে টানেনি। মোজাম্বিক উপকূল থেকে হেঁটে ইথিওপিয়া, ইরিত্রিয়া, তারপর লোহিত সাগরের বুকে ছোট জনমানুষহীন, নামহীন এই দ্বীপ। এখানেই কেটে গেছে অনেক বছর। কালে ভদ্রে এখানে কেউ আসে। ঘন জঙ্গল আর উঁচু নীচু জমি আশপাশের অধিবাসিদের আকর্ষন করতে পারেনি। মাঝে মাঝে কিছু জেলে চলে আসে ছোট ছোট নৌকা নিয়ে। মানুষজন কম, তাই এখানকার সাগরের পানিতে মাছও বেশি। গত কয়েকবছর জেলের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছিল ক্রমে। মাঝে মাঝে দ্বীপে এসে বিশ্রামও নিতো ওরা। তারপর আবার আসতো, আরো লোকজন নিয়ে। বোঝা যাচ্ছিল দ্বীপটা সবার দৃষ্টি কেড়ে নিচ্ছিল। ফলে নিষ্ঠুর হতে হয়েছিল মিচনারকে।

একা কোন জেলেকে পেলে গলা কেটে মেরে ফেলতো মিচনার। তারপর কিছু টুকরো ভাসিয়ে দিতে সাগরে, কিছু রেখে দিতে সৈকতে। বাকিদের দেখানোর জন্য। কালো মানুষেরা এমনিতেই কুসংস্কারাছন্ন। মাঝে মাঝে ওদের দেখা দিতো মিচনার। তার সাদা চকচকে প্রায় উদোম দেহ, চুলদাড়িতে ঢাকা মুখ দেখে কালোদের মধ্যে ফিসফিসানি শুরু হয়ে গিয়েছিল। সাদা মানুষদের এরকম রুপে দেখে অভ্যস্ত নয় ওরা। মিচনারকে ওরা জঙ্গলের দানব হিসেবে ধরে নিয়েছিল। কিন্তু তারপরও ওদের আসা কমেনি। ফলে একবার পাঁচজনের ছোট একটা দলকে একসাথে শেষ করে ফেলল মিচনার। লাশগুলো ফেলে রাখল নৌকায়। দৈত্য-দানবের কাজ মনে করে তারপর আর কেউ আসে না।

এরপর থেকে সুন্দর দিন কেটে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে পানিতে নিজের চেহারা দেখে মিচনার। কথা বলতে ভুলেই গেছে এতোদিনে, গলা দিয়ে গো গো শব্দ হয় শুধু। পুরানো স্মৃতি আর তেমন কিছু মনে নেই। নিজেকে এখন জংলী জানোয়ার ছাড়া আর কিছু মনে হয় না। দ্বীপটায় অনেক শুয়োর, হরিন আছে। খিদে লাগলে শিকার করে মিচনার। আগুনের প্রয়োজন নেই তার এখন। কাঁচাই মাংস খায়। মাঝে মাঝে দ্বীপে চারপাশে সাঁতার কাটে, গাছের মগডালে বসে চারদিক দেখে। যে দিকে তাকায় শুধু সাগর আর সাগর। পুরো দ্বীপটার মালিক সে। বলার কেউ নেই।

নিজের মাঝে অদ্ভুত এক নৃশংসতা অনুভব করে মিচনার। রক্ত দেখতে ভালো লাগে। তাই একের পর এক খুন করেও অনুশোচনা হয় না। বরং ইদানিং লোকজন কেউ আসে না বলে কিছুটা আফসোস হয়। এই নিষ্ঠুরতার উৎস কি জানে না সে। তার গায়ে এখন আসুরিক শক্তি, এই শক্তির উৎসও অজানা। চাইলে এই দ্বীপ থেকে বেরিয়ে আবার সভ্য জগতে ফিরে যেতে পারে। কিন্তু কি লাভ এই অভিশপ্ত জীবন নিয়ে যুগ যুগ বেঁচে থাকার। আগে মানুষ ছিল, এখন নিতান্ত পশু ছাড়া আর কিছুই না সে। তবে এখানে আর খুব বেশি দিন হয়তো থাকা হবে না। মাথার ভেতর কেমন ভোতা শব্দ হয়। কেউ যেন তাকে কিছু করতে বলে। আরো পুবে যেতে বলে। সেই জায়গাটা কোথায় জানে না মিচনার। পুবে আসতে আসতে এতোদূর চলে এসেছে সে। আর কতো পুবে যেতে হবে? কি আছে সেখানে? কে আছে?

সন্ধ্যার পর দ্বীপের সুন্দর সৈকতে শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে মিচনার। অর্থহীন সবকিছু। হাতের কাছে বেশ কিছু কলা আর ডাব আছে, যেন ক্ষুধা পেলে খাওয়া যায়। কিন্তু ক্ষুধা যেন হারিয়ে গেছে। আসলে কোন কিছু করার উৎসাহ দিন দিন কমে যাচ্ছে। শুধু রক্ত দেখতে ইচ্ছে করে। অদ্ভুত এক নেশার মতো হয়ে গেছে। জঙ্গলের শিকার বেড়ে গেছে। ঐ সব জম্ভজানোয়ার অনেক শিকার করা হয়েছে। এখন আবার মানুষ শিকার করা দরকার। তার মনের একাংশ এখনো জানে কাজটা ঠিক নয়, বে-আইনি। অন্য অংশটা এখন বুনো, হিংস্র এক মানুষের দখলে। যে শুধু রক্ত দেখতে চায়। রক্ত।

***

সকালে ঝরঝরে মাইক্রোবাসে করে রওনা দিয়েছিল রাশেদ, লরেন্স আর এঞ্জেলের সাথে। সকাল না বলে কাক ডাকা ভোর বলা ঠিক হবে। এতো ভোরে শেষ কবে ঘুম ভেঙেছিল মনে করতে পারেনি রাশেদ। সেই শৈশবে দাদা ঘুম ভাঙাতো, খুব ভোরে, দুজনে হাঁটতে বের হতো গ্রামের পথ ধরে। কতদিন আগের কথা!

সঙ্গি দুজনেই ছিল প্রস্তুত। তাই কোনমতে কাপড় পাল্টে তৈরি হয়ে নিয়েছিল রাশেদ। নাস্তা করার সময়ও দেয়নি ওরা। ভেবেছিল ভোরের এই সুন্দর দৃশ্য দেখতে দেখতে যাওয়া যাবে, কিন্তু লরেন্স তা হতে দেয়নি। কালো একটা রুমাল দিয়ে চোখ বেঁধে রেখেছে তার, যাতে কোথায় যাচ্ছে, কোন পথ দিয়ে যাচ্ছে জানতে না পারে। বাঁধা দেয়নি সে। লাভও হতো না। রাজুর কথা চিন্তা করে যেকোন ঝুঁকি নিতে রাজি।

ঘন্টা দেড়েক পর মনে হলো গাড়িটা একটানা উঠছেই, বাঁক ঘুরছে বারবার। দক্ষ চালক ছাড়া বান্দরবানের এই পাহাড়ি এলাকায় গাড়ি চালানো খুব কঠিন। এঞ্জেল মনে হচ্ছে খুব অভিজ্ঞ। একবারও এদিক-সেদিক হচ্ছে না। অবশ্য একটু বেচাল হলেই পাশের খাদে পড়ে যেতে হবে, সেক্ষেত্রে মৃত্যু অনিবার্য। বান্দরবানের পাহাড়িগুলো একটু বেশি উঁচু। তাজিনডং, কেওক্রারাডং আর মাওডক মুয়ালের অবস্থান এই বান্দরবানে। গতবার এসে নীলগিরির দিকে যাওয়া হয়েছিল, ইচ্ছে ছিল বিশাল কোন পাহাড়ে উঠার। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হয়ে উঠেনি।

ক্ষুধা পেয়েছে, সকালে নাস্তা খাওয়া হয়নি। হঠাৎ ব্রেক কষেছে এঞ্জেল, কি যেন বলল লরেন্সকে। বুঝতে পারছে রাশেদ, এবার যাত্রা বিরতি হবে। চোখ থেকে কালো কাপড় খুলবে কি না বুঝতে পারছে না। এই পাহাড়ি এলাকাগুলো সব প্রায় একইরকম। দেড় ঘন্টা একটানা চলেছে মাইক্রোবাস। যতোটুকু বুঝতে পেরেছে দক্ষিনে এসেছে ওরা। সম্ভবত থানচির দিকে। থানচির একপাশে মায়ানমার। এককালের আরাকান। এখনো রোহিঙ্গারা এখানকার সীমানা পার হয়ে বাংলাদেশে ঢুকে পড়ে। একসময় এই পার্বত্য অঞ্চলে ছিল আরাকানরাজের দখলে।

লরেন্স এসে চোখের উপর থেকে কালো কাপড় সরিয়ে দিল। হঠাৎ চোখে আলোর ঝলকানিতে চোখ পিটপিট করে তাকাল রাশেদ। আস্তে আস্তে সয়ে এলো আলো। তাকাল চারদিকে। ছোট একটা বাজার আছে সামনে। সম্ভবত কোন কিছু কেনার জন্য এখানে মাইক্রোবাস থামিয়েছে এঞ্জেল।

‘তুমি কিছু খাবে?’ জিজ্ঞেস করল লরেন্স।

‘খাবো না মানে? সকাল থেকে পেটে কিছু পরেনি,’ বেশ ঝাঁজের সাথে বলল রাশেদ। বেরিয়ে এলো মাইক্রোবাস থেকে।

একটানা বসে থেকে হাতে-পায়ে খিল ধরে গিয়েছিল। একটু নাড়াচাড়া করে নিলো। এঞ্জেল গেছে বাজারে। লরেন্স মোবাইলের নেটওয়ার্ক ধরার চেষ্টা করছে। পকেট থেকে মোবাইল ফোনটা বের করল রাশেদ। নেটওয়ার্ক নেই। পুরো পার্বত্য চট্টগ্রামে মোবাইল নেটওয়ার্ক বিস্তৃত হলেও কিছু কিছু জায়গায় এখনো নেটওয়ার্ক পাওয়া যায় না।

চারপাশে তাকাল রাশেদ। উঁচু উঁচু পাহাড় ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ছে না। স্থানীয় অধিবাসি দেখা যাচ্ছে কিছু, বাঙালী নেই বললেই চলে। সম্ভবত একবারে প্রত্যন্ত অঞ্চলে এসে পড়েছে ওরা। এতো ভেতরে বাঙালীদের বসবাস কম। পরস্পরের মধ্যে বোঝাঁপড়ার অভাবই হয়তো এর কারন, ভাবল রাশেদ।

‘কলা আর পাউরুটি ছাড়া আর কিছু পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না,’ বিড়বিড় করে বলল লরেন্স।

‘আপাতত সেটাই যথে’, রাশেদ বলল।

‘আজ রাতে আমরা কাছাকাছি একটা জায়গায় থাকবো, কাল যাবো আরো ভেতরে।’

‘আমাকে এসব বলে লাভ কি? আমার তো চোখ বেঁধে রাখবেন।‘

‘এখন থেকে আর চোখ বাঁধবো না,’ হাসল লরেন্স, বুদ্ধিমান হলে পালাবার চো করবে না, প্যান্টের পকেট থেকে ছোট রিভলবারটা বের করে দেখাল।

ভয় পেয়েছে এমনভাব করলো রাশেদ, যদিও একেবারে ভয় পায়নি এটা বলাও ভুল হবে। লরেন্স নিজে হয়তো সন্ত্রাসী, তাই আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে ঘোরে। লরেন্সের শত্রু সঞ্জয়ই নিশ্চয়ই একই প্রকৃতির হবে।

‘রাজু কোথায়?’

‘খুঁজে বের করবো। তার আগে এই চামড়ার পার্চমেন্টে কি লেখা আছে সেটা উদ্ধার করতে হবে।’

‘ঠিক আছে,’ বলল রাশেদ। চুপচাপ চারদিক দেখতে থাকল। বান্দরবানকে প্রকৃতিকন্যা বলা হয়, কথাটা খুব একটা ভুল নয়। চারপাশ সবুজ আর সবুজ। চোখের সামনে দিয়ে এক ঝাঁক টিয়ে উড়ে চলে গেল। টিয়ে পাখি রাস্তার ধারে ভাগ্যগনকের কাছে দেখেই অভ্যস্ত রাশেদ, এরকম স্বাধীন টিয়ে পাখির ঝাঁক আগে কখনো চোখে পড়েনি। এই মুহূর্তে নিজেকে সেই বন্দি টিয়ে পাখির মতোই মনে হচ্ছে তার কাছে। লরেন্সের ইচ্ছের দাসে পরিণত হচ্ছে সে ধীরে ধীরে, যা মোটেও সহ্য হচ্ছে না। কিন্তু দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করতে হবে সবকিছু।

কিছুক্ষনের মধ্যেই এঞ্জেল চলে এলো। হাতে দুই প্যাকেট পাউরুটি, কলা আর পানির বোতল। এই প্রত্যন্ত অঞ্চলেও পানির বোতলের উপস্থিতি অবাক করলো রাশেদকে।

স্থানীয় কিছু লোকজনকে দেখা যাচ্ছে, মারমা হবে হয়তো, ভাবল রাশেদ। পার্বত্য চট্টগ্রামের এই অঞ্চল বোমাং সার্কেলের অন্তর্গত। এখানে মারমাদের সংখ্যাই বেশি। জায়গাটা সম্ভবত সীমান্ত অঞ্চলের কাছাকাছি, এরকম মনে হওয়ার কোন কারন নেই। তবু মনে হচ্ছে মায়ানমারের সীমানার কাছাকাছি চলে এসেছে।

পাউরুটি দেখে খুব একটা ভরসা পেল না রাশেদ, দুটো কলা খেয়ে নিলো। এই অঞ্চলের কলায় নিশ্চয়ই কোন রাসায়নিক মেশানো নেই। এঞ্জেলও শুধু পানি খেয়ে নিলো। লরেন্সের কোন কিছুতেই আপত্তি দেখা গেল না। একটা পাউরুটির প্যাকেট একাই শেষ করে দিল। বাকিটা রেখে দিলো পরে খাবে বলে। খাওয়া-দাওয়া সেরে সিগারেট ধরিয়েছে লরেন্স। হাত বাড়াতে রাশেদকে একটা দিল। বেশ তরতাজা অনুভব করছে রাশেদ এখন। সিগারেটের কারনে নয়, পেটে কিছু পড়াতে শারীরিক শক্তি কিছুটা হলেও যেন ফিরে এসেছে।

‘রাশেদ, তোমাকে আরেকটা কথা বলা দরকার,’ পাশে দাঁড়িয়ে নীচু স্বরে বলল লরেন্স।

‘বলুন।’

‘একটা শর্তেই তোমার বন্ধুকে উদ্ধার করবো আমি।’

‘কি শর্ত?’

‘সেটা হচ্ছে, এখানকার কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমাকে ছেড়ে যেতে পারবে না তুমি।

‘রাজু চলে যাবে আর আমি থেকে যাবো?’

‘হ্যাঁ। ঠিক তাই।‘

কিছুক্ষন চিন্তা করল রাশেদ। রাজুকে উদ্ধার না করা পর্যন্ত লরেন্সের সাথে কোন বিবাদে যাওয়া যাবে না।

‘ঠিক আছে, আমি রাজি।’

‘চলো তাহলে রওনা দেয়া যাক।‘

মাইক্রোবাসের ড্রাইভিং সীটে এবার লরেন্স বসল। পাশের সিটটাতে রাশেদকে ইশারা করল বসতে।

উঠে বসল রাশেদ। এঞ্জেলকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। অথচ একটু আগেও ছিল।

স্টার্ট দিয়েছে লরেন্স।

‘এঞ্জেল যাবেন না?’

‘না, সে এখানে থাকবে। অপেক্ষা করবে।‘

আর কিছু বলল না রাশেদ। চলতে শুরু করেছে মাইক্রোবাসটা। পাহাড়ি পথে ভালো চালাতে জানে লরেন্স, সেটা বোঝা যাচ্ছে। এই পথঘাট যেন হাতের তালুর মতো চেনে। পুরানো দিনের বাংলা গানের একটা ক্যাসেট ছেড়ে দিয়েছে এরমধ্যে। চোখ বন্ধ করল রাশেদ। এবার একটু ঘুমিয়ে নেয়া যায়। সামনে হয়তো অনেক ঝামেলা পড়ে আছে।

***

‘এখানে কি করছেন? আপনাকে কতোক্ষন ধরে খুঁজছি?’ যজ্ঞেশ্বর তার স্বাভাবিক বেশে দাঁড়িয়ে আছে পেছনে। গায়ে শুধু একটা চাদর জড়ানো।’

‘না, এমনি। একটু ঘুরতে বের হয়েছিলাম,’ বললেন তিনি। তাকালেন দূরে দাঁড়ানো অনুসরনকারির দিকে। লোকটার দিকে নজর রাখা দরকার ছিল। কিন্তু যজ্ঞেশ্বর এসে পড়াতে ঝামেলা হয়ে গেল।

‘চলুন রুমে ফিরে যাই, বাইরে অনেক ঠান্ডা,’ যজ্ঞেশ্বর বলল।

‘চলুন।‘

সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। দোকান-পাটে বৈদ্যুতিক বাতি জ্বলে উঠেছে। রাস্তার লোকজনও কমে আসবে কিছুক্ষনের মধ্যে। রুমে ফিরে কিছু করার নেই। যজ্ঞেশ্বরের গুরুর সাথে দেখা করার ব্যবস্থা করতে হবে। সেটা আজকেই হবে কি না বোঝা যাচ্ছে না। এখানে আসার পর যজ্ঞেশ্বর একবারও তার গুরুর সাথে দেখা করার কথা উল্লেখ করেনি। একবার শুধু বলেছিল সময় হলে গুরুই তাকে ডাকবে। সেই সময় কখন হবে কে জানে। ততোদিন চুপচাপ বসে থাকতে হবে হোটেল রুমে।

পাশাপাশি হাঁটছেন দুজন। যজ্ঞেশ্বরকে দেখে বোঝা যাচ্ছে সে খুব উপভোগ করছে। সবকিছু। এই অঞ্চলে আগে আসেনি। সবকিছুই তার কাছে নতুন। এক ভারতবর্ষেই কতো ধরনের জায়গা আছে সেটা না ঘুরলে বোঝা যাবে না।

অন্যকিছু ভাবছেন তিনি। যজ্ঞেশ্বরকে রুমে পাঠিয়ে দিয়ে ঐ লোকটার কার্যকলাপের উপর নজর রাখা দরকার। কিংবা বাংলাদেশি ভদ্রলোকের এখানে আসার উদ্দেশ্য কি সেটা জানারও চেষ্টা করা যেতে পারে।

‘আপনি রুমে ফিরে যান, আমি একটু পরে আসছি,’ বললেন তিনি।’

‘বিশ্রাম নেয়া দরকার আপনার।’

‘আমি একটু ঘুরবো,’ বললেন তিনি, এবার একটু জোর গলায়।

যজ্ঞেশ্বরকে দেখে মনে হলো আহত হয়েছে, কিন্তু কিছু করার নেই। এই সময় রুমে গিয়ে বসে থাকা ছাড়া আর কিইবা করার আছে। তারচেয়ে যদি কোন তথ্য পাওয়া যায় তাহলে অনেক কাজে লাগবে।

যজ্ঞেশ্বর চলে যাচ্ছে। আটকালেন না তিনি। এখন কাজ করার সময়। তার উদ্দেশ্য কিংবা কাজের ধরন সম্পর্কে যজ্ঞেশ্বরের কোন ধারনাই নেই। এসবের সাথে ওকে যুক্ত করার কোন প্রয়োজন নেই এখন।

যজ্ঞেশ্বর চলে যাওয়ার পর রাস্তায় কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থাকলেন তিনি। সেই লোকটাকে দেখা যাচ্ছে না। এরমধ্যে চলে গেছে কোথাও। হাঁটতে হাঁটতে কিছুদূর এগিয়ে লোকটাকে পেলেন তিনি। কথা বলছে কারো সাথে। লম্বা কোট আর মাথায় ক্যাপ পড়া থাকায় দুজনের কারো চেহারা পরিস্কার দেখা যাচ্ছে না। তবে দ্বিতীয় লোকটা সম্ভবত বাংলাদেশি ভদ্রলোকের সঙ্গে ছিল। বেশ কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে দুজনের কাৰ্যকলাপ বোঝার চেষ্টা করলেন তিনি। সম্ভবত কোন বিষয়ে মতের মিল হচ্ছে না দুজনের। টাকা বিনিময় হলো পরিস্কার দেখতে পেলেন তিনি। টাকার জন্য কাজ করছে। দ্বিতীয় লোকটা! হয়তো কোন তথ্য দিচ্ছে অনুসরনকারিকে। কিংবা অন্য কিছু।

কথাবার্তা শেষ হলে দুজন দুদিকে চলে গেল। আরো অনেকক্ষন চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে অনুসরনকারির পিছু নিলেন তিনি। লোকটা কোথায় যায় দেখা দরকার। হেঁটে রাস্তার পাশের ছোট একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকেছে লোকটা। নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে তিনিও ঢুকলেন। চারপাশে কফির গন্ধ, মৃদু গানের শব্দ ভেসে আসছে। টুরিস্টে গিজগিজ করছে রেস্টুরেন্টটা। কোনার একটা টেবিল ফাঁকা, চেয়ার টেনে বসলেন তিনি। এখান থেকে পুরো রেস্টুরেন্টটা পরিস্কার দেখা যায়। কিন্তু লোকটাকে দেখা যাচ্ছে না কোথাও। সরাসরি বাথরুমে চলে গেছে হয়তো। কিংবা অনুসরন করা হচ্ছে বুঝতে পেরে কোথাও ঘাপটি মেরে আছে।

কফির অর্ডার দিলেন।

‘আপনি কি আমাকে অনুসরন করছেন?’ পরিস্কার ইংরেজিতে বলল একজন।

ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেন তিনি। হ্যাঁ, যাকে খুঁজছিলেন সেই এসে দাঁড়িয়েছে পাশে।

‘না। এমনটা মনে হবার কারন? নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন তিনি।’

‘বসতে পারি?’

মাথা ঝাঁকালেন তিনি। লোকটা সুদর্শন। কাঁচাপাকা চুল, তবে বয়স চল্লিশ ছাড়িয়েছে কি না সন্দেহ। খাড়া নাক আর বুদ্ধিদীপ্ত চোখ। কেন জানি লোকটাকে পছন্দ হলো।

‘আমার নাম বিনোদ, বিনোদ চোপড়া, আপনি?’

‘আমি লখানিয়া সিং।’

‘আসল নাম নয় নিশ্চয়ই!’

হাসলেন তিনি। কি উত্তর দেবেন বুঝতে পারছেন না। বিনোদ চোপড়ার কথাবার্তা খুব সরাসরি। গায়ে লাগার মতো।

‘আসল নাম নয় কি করে বুঝলেন?’

‘এমনি বললাম। আরেকটা কথা মনে হচ্ছে আপনাকে দেখে। এই অঞ্চলে এবারই প্রথম এলেন?’

‘হ্যাঁ, কেন?’

‘এমনি। মনে হলো কেন জানি। কফি খাবেন না অন্য কিছু?’

‘কফি।‘

বেয়ারাকে ডেকে ব্ল্যাক কফির অর্ডার দিল বিনোদ। তারপর তাকাল তার দিকে, যেন খুব মনোযোগ দিয়ে চেহারাটা দেখছে।

‘আমি কোথাও যেন আপনাকে দেখেছি, ঠিক সেই চেহারা, যেরকম শুনেছি,’ বিস্ময়মাখা কণ্ঠে বলছে ডবনোদ।

‘কোথায় দেখেছেন? মেঘালয়ের বাইরে এবারই প্রথম এলাম।‘

‘মেঘালয় নয়। এমনকি এই ভারতেই নয়। অন্য কোথাও,’ চিন্তায় পড়ে গেছে বিনোদ।

এবার একটু অস্বস্তিবোধ করছেন তিনি। বিনোদ কিসের কথা বলছে? কোথাও তার কোন ছবি নেই। ইউরোপ ছেড়েছেন এক শতাব্দির বেশি সময় আগে।

‘যাক, বাদ দিন,’ বিনোদ বলল এবার। আমার পেছনে লেগেছেন কেন? আপনি কি পুলিশের লোক?

‘কেন? কোন পুলিশি ঝামেলা আছে আপনার?’

‘তা নেই,’ আমতা আমরা করে বলল বিনোদ। তবে দেশে খারাপ লোকেরও তো অভাব নেই। হয়তো আমাকে টার্গেট করেছেন। মেরে সব ছিনিয়ে নিয়ে যাবার প্ল্যান আছে আপনার।

‘এতোদূর ভাবার দরকার নেই,’ বললেন তিনি। ‘আসলে অহেতুক ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম তো। আপনার তাই এমন ভুল ধারনা হয়েছে।‘

কফি নিয়ে বেয়ারা হাজির হলো এই সময়। চিনি ছাড়া শুধু দুধ দিয়ে কফি ঢেলে নিলেন তিনি। বিনোদ বেশ যত্ন করে কাপে কফি ঢালছে, চিনির কিউব দিলো দুটো।

‘খুব সাবধান মি. লখানিয়া,’ শান্ত স্বরে বলল বিনোদ, ‘এরপর যদি আমার পেছনে দেখি তখন আর কিছু জিজ্ঞেস করবো না।‘

‘কি করবেন?’

লম্বা কোটের পকেট থেকে ছোট, কালো একটা ধাতব জিনিস বের করে দেখাল বিনোদ, শুধু এক ঝলক।

‘দেখেছেন তো জিনিসটা? ব্যবহার করতে এক সেকেন্ড দেরি হবে না আমার,’ বলল বিনোদ চোপড়া।

হাসলেন তিনি। এই ধরনের ভয় দেখিয়ে যে তাকে কাবু করা যাবে না বুঝতে পারেনি লোকটা। আস্তে করে আকাশের বাম হাতটা টেনে নিলেন। কব্জিটা ধরলেন আলতো করে।

‘এই ধরনের ভয় দেখানো ঠিক নয় মি. বিনোদ,’ এবার ঠান্ডা গলায় বললেন তিনি।

আকাশের কব্জিতে চাপ বাড়িয়েছেন একটু। চেহারা প্রায় নীল হয়ে গেছে আকাশের। হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করছে প্রানপন। কিন্তু কাজ হচ্ছে না। বাম হাত ধরেছেন তিনি, সর্বশক্তি লাগিয়ে দিয়েছে বিনোদ। ঘেমে গেছে, চোখ লাল হয়ে গেছে। বিনোদ চোপড়ার। কিন্তু এক বিন্দু চাপ কমাতে পারেনি কব্জির উপর থেকে। মনে হচ্ছে যে কোন সময় ভেঙে যাবে হাতটা। সহ্যের শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে বিনোদ। যে কোন সময় চিৎকার করে উঠবে। এই সময় হাত ছেড়ে দিলেন তিনি। লম্বা কোটের পকেট থেকে ছোট পিস্তলটা বের করে নিলেন অন্যহাতে। তারপর নিজের পকেটে ভরে নিলেন।

‘চাইলে আপনার এই অস্ত্রটা এখানেই গুড়ো করে ফেলতে পারি আমি,’ বললেন তিনি, ‘যেমন আপনার কব্জিটা গুড়ো করতে পারতাম।‘

নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছে বিনোদ চোপড়া। অন্য হাত দিয়ে কব্জিটা ধরে আছে, বোঝাই যাচ্ছে যথেষ্ট কষ্ট পাচ্ছে ব্যথায়।

টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। আকাশের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললেন, ‘ঐ লোকগুলোর পেছনে যদি ঘোরাঘুরি করতে দেখি তাহলে কি হবে চিন্তাও করতে পারবেন না মি. বিনোদ। আশা করি বুঝতে পারছেন কোন লোকগুলোর কথা বলছি।‘

ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে বিনোদ, চেহারায় বিস্ময়। লখানিয়া সিং নামধারী লোকটা বেরিয়ে গেল রেস্টুরেন্ট থেকে। যাওয়ার আগে কফির জন্য ধন্যবাদ জানাতে ভুলল না।

*

অধ্যায় ৩২

টানা তিনদিন অচেতন থাকার পর ঘুম ভাঙল ত্রিস্তানের। সারা শরীরে ব্যথা। কোনমতে চোখ মেলে তাকাল। কোথায় আছে, কিভাবে এসেছে এখানে কিছুই মনে পড়ছে না তার। ছোট একটা কুঁড়ে ঘরে শুয়ে আছে সে। একপাশের খোলা জানালা দিয়ে বাইরে থেকে রোদ ঢুকছে। উঠে বসতে গিয়ে বুঝতে পারল শরীর নাড়ানোই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে তার জন্য।

বৃদ্ধ লোকটাকে ঘরে ঢুকতে দেখল এই সময়। চিন্তিত চেহারায়, পেছনে অল্প বয়স্ক মেয়েটাও ঢুকল। হাতে একটা মাটির গামলা, সেখানে ধোঁয়া উঠা সাদা ভাত দেখা যাচ্ছে।

কুঁড়ে ঘরটার চারদিকে তাকাল ত্রিস্তান। অভাবের ছাপ স্পষ্ট চারদিকে। তেমন কোন আসবাব নেই, ছোট এই ঘরে একটাই বিছানা। দেয়ালে ছোট একটা খোপে হিন্দু দেবী মূর্তি।

বৃদ্ধকে দেখে হাত নাড়াল ত্রিস্তান। উত্তরে মুখটা আরো গম্ভীর হয়ে উঠল বৃদ্ধের।

‘তোমার নাম কি?’ গম্ভীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল বৃদ্ধ। শিয়রে এসে দাঁড়িয়েছে।

‘জিস্তান…’ আমতা আমতা করতে থাকল লিস্তান, ‘নামের বাকি অংশ মনে পড়ছে না।‘

‘তোমরা আমাদের সব জ্বালিয়ে দিয়েছিলে, রাগান্বিত কণ্ঠে বলল বৃদ্ধ, কিন্তু অসুস্থ মানুষকে মেরে ফেলার শিক্ষা পাইনি আমরা।‘

‘আমরা কি করেছি?’ ভাঙা ভাঙা বাংলায় বলল ত্রিস্তান। কিছুক্ষন আগেও মনে হচ্ছিল সব কিছু স্বাভাবিক, এখন মনে হচ্ছে ধারনাটা ভুল। অনেক কিছুই তার মনে পড়ছে না।’

‘কি করেছো মনে নেই?’ তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলো বৃদ্ধ। মারতে যাচ্ছিল আরেকটু হলেই, অল্প বয়েসি মেয়েটা থামাল কোনমতে।

হাসার চেষ্টা করল ত্রিস্তান। হাসি ফুটল না। আসলে কিছু মনে পড়ছে না এখন। কখন, কিভাবে এখানে এলো, এরা কারা কিছুই মাথায় ঢুকছে না।

‘দাদু, উনি বিশ্রাম নিক,’ মেয়েটা বলল। ‘তুমি এখন যাও।‘

গরগর করতে করতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল বৃদ্ধ। বিছানার একপাশে মাটির গামলা রেখে ত্রিস্তানের মাথার নীচে বালিশ গুঁজে দিল মেয়েটা, যেন ভাত খাওয়াতে সুবিধা হয়।

আগে খেয়াল করে দেখেনি, এখন মেয়েটার চেহারা খুব পরিচিত মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছিল অনেক আগের কেউ একজন ফিরে এসেছে নতুন করে। হারিয়ে যাওয়া সেই মেয়েটার নাম কিছুতেই মনে পড়ছে না। মেয়েটা যত্ন করে ভাত তুলে দিচ্ছে তার মুখে। এতো আন্তরিক সেবা এর আগে কবে পেয়েছিল মনে করতে পারছে না লিস্তান। হয়তো মা থাকলে এমন সেবা পাওয়া যেতো। কিন্তু তার চেহারাও এখন অস্পষ্ট ত্রিস্তানের কাছে। শুধু ভাত আর সাথে কিছু শাক। সম্ভবত কচু শাক। বোঝাই যাচ্ছে এরা খুবই দরিদ্র। ভালো কিছু রান্না করে খাওয়ানোর সামর্থ্য ওদের নেই। পেটে খিদে। শুধু ভাত আর এই শাকই অপূর্ব লাগছিল তার মুখে। মনে হচ্ছিল অনেক দিন পর পেটে কিছু একটা পড়ল। শেষ কখন খাওয়া হয়েছিল কিছুই মনে পড়ছে না।

ভাত খাওয়া হয়ে গেলে শাড়ীর আঁচল দিয়ে মুখ মুছিয়ে দিল মেয়েটা। তারপর চলে গেল ঘর থেকে। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল ত্রিস্তান। এতোক্ষন তার সাথে একটা কথা বলার চো করেনি মেয়েটা।

চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকল লিস্তান। মনে করার চেষ্টা করছে কি ঘটেছিল, এই অচেনা মানুষদের মাঝে সে কিভাবে এলো। গতরাতে মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিল এতোটুকুই মনে পড়ছে। এর বাইরে যা মনে পড়ছে সব ঝাপসা। যেন স্বপ্নে দেখা কিছু। নিজেকে খুব অসহায় মনে হচ্ছে, নাম-পরিচয়হীন একজন মানুষ এখন সে। ভিনদেশি। এখানে থাকাটা খুব একটা নিরাপদ হবে না তা ঐ বুড়োর সাথে কথা বলে বোঝা গেছে। দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস ফেলে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল ত্রিস্তান। বিকেল হয়ে এসেছে।

***

ড. কারসনের রুমে জমায়েত হয়েছে সবাই। প্রফেসর সুব্রামানিয়াম গম্ভীর মুখে তাকিয়ে আছেন, সন্দীপ চিন্তিত ভঙ্গিতে বসে আছে, ড.. আরেফিন চুপচাপ তাকিয়ে আছেন ড. কারসনের দিকে। এখন কাজ শুরু করার সময় হয়েছে। এই ব্যাপারে আলাপ করার জন্য সবাইকে ডেকেছেন তিনি। রাতের খাবার খেয়ে নিয়েছে সবাই। রামহরিকে দরজার বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখেছেন প্রফেসর। যাতে আচমকা কেউ ঢুকতে না পারে, এছাড়া তাদের খালি রুমে যাতে কেউ ঢুকে না যায় সে কাজটাও হবে একসাথে। সুরেশ ঝুনঝুনওয়ালা হোটেলে নেই। পরিচিত কারো সাথে দেখা করতে গেছে।

বসে ছিলেন, দাঁড়ালেন ড. কারসন।

‘আজ অনেক পুরানো একটা জিনিস আপনাদের দেখাবো,’ বললেন ড. কারসন। হাতের হলুদ খামটা দেখালেন সবাইকে। এই খামটা জোগাড় করতে যথেষ্ট কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে আমাকে।

অবাক চোখে তাকালেন ড. আরেফিন। এই খামটা তিবতিয়ান আর্কাইভস থেকে নিয়ে আসতে পনেরো মিনিটের বেশি সময় লাগেনি ড. কারসনের। ব্যাপারটা চোখ এড়ালো না বক্তার।

‘আপনি যা ভাবছেন তা নয়, গত প্রায় একবছর ধরে জিনিসটা চাইছিলাম আমি, ভারতে নামার পরও নিশ্চিত ছিলাম না জিনিসটা আমাকে দেবে কি না। হাজার হোক, আমি একজন বহিরাগত অন্তত তিব্বতিদের চোখে। তারা নিজেদের প্রাচীন সংস্কৃতি অন্য কারো হাতে দিতে চায় না। জিনিসটা অনেক পুরানো, হাজার বছরের কম হবে না। এটা আসলে একটা কোড। এখানে প্রাচীন তিব্বতি হরফে বিশেষ একটা জায়গার ইঙ্গিত দেয়া আছে, অন্তত এখানকার প্রধান তাই মনে করেন। সব কোড ভাঙতে এই কোডটা সবার চোখের আড়ালে রেখেছিলেন তিনি।‘ একটু থামলেন ড. কারসন।

‘আমার ধারনা কোডটা সাম্ভালার সাথে সম্পর্কিত। যদিও এখানকার প্রধান বলছেন সাম্ভালা একটা কল্পনা মাত্র, এর খোঁজ কেউ পায়নি,কেউ পাবেও না। কিন্তু এই কোড এবং বাকি যেসব তথ্য আমাদের কাছে আছে তা এই তত্ত্ব সাপোর্ট করে না। আমাদের মধ্যে সন্দীপ হচ্ছে কোড বিশেষজ্ঞ। এই কোড ভাঙার দায়িত্ব তাই তাকেই দিচ্ছি,’ বললেন ড. কারসন। হলুদ রঙের খামটা এগিয়ে দিলেন সন্দীপের দিকে।

অনিচ্ছাসত্ত্বেও খামটা হাতে নিলো সন্দীপ। শুঁকে দেখল। তারপর খুলল আস্তে আস্তে। হাজার বছর পুরানো একটা কাগজ বেরিয়ে এলো। ঠিক কাগজ বলাও ঠিক হবে না। কাগজের চেয়ে জিনিসটা একসময় অনেক পুরু ছিল সেটা দেখেই বোঝা যায়। সেখানে কালো কালিতে নানা-ধরনের আঁকিবুকি, বেশিরভাগই ডট আর যতি চিহ্ন। নির্দিষ্ট কোন প্যাটার্ন নেই। যেন কোন অস্থিরমতি শিশু ইচ্ছে মতো কলম চালিয়েছিল। যদিও সন্দীপের চেহারা তা বলছেনা। তার চেহারা আরো গম্ভীর হয়ে উঠেছে। প্রফেসর সুব্রামানিয়াম অন্যদিকে তাকিয়ে আছেন।’

‘এরকম কোডের কথা শুনেছিলাম, দেখলাম প্রথম,’ অবশেষে মুখ খুলল সন্দীপ। ‘জানি না এই কোড ভাঙতে পারবো কি না। তবে চেষ্টা করবো অবশ্যই।‘

‘চেষ্টায় সফল হতেই হবে, ড. কারসন বললেন। সন্দীপ চেষ্টা করতে থাকুক। আমরা কাল সকালে বের হবো।’

‘কোথায়?’ জিজ্ঞেস করলেন ড. আরেফিন।

‘এখানে ছোট একটা উপত্যকা আছে। সুরেশ নিয়ে যাবে আমাদের। উপত্যকার মাঝে ছোট একটা বৌদ্ধ মন্দিরে যাবো।‘

‘তারপর?’

‘সেখান থেকে আবার ফিরবো হোটেলে। এরমধ্যে আশা করি সন্দীপ তার কাজ করে ফেলতে পারবে। যদি না পারে, তাহলে আগের প্ল্যান অনুযায়ী এগুবো।‘

‘আগের প্ল্যান?’ প্রফেসর সুব্রামানিয়াম বললেন, অবাক হয়ে, ‘আগে কি প্ল্যান ছিল?’

‘আপনাদের বলিনি? ওহ, খুব ভুলে যাই ইদানিং। এরপর তিব্বতের সীমানার দিকে যাবো। সেখানেই সীমান্ত অঞ্চলে খোঁড়াখুঁড়ি শুরু করবো। পারমিশন নেয়া আছে আমাদের।’

‘কিন্তু আমি কিন্তু খোঁড়াখুঁড়ি করতে পারবো না, রামহরি যাবে সাথে।’

‘না। রামহরিকে নেয়া যাবে না। ও হোটেলেই থাকবে।’

‘আচ্ছা। ঠিক আছে। আপনি যা ঠিক মনে করেন,’ বলে উঠে দাঁড়ালেন প্রফেসর সুব্রামানিয়াম, ড. আরেফিনের দিকে তাকিয়ে চোখ টিপলেন যদিও ড. আরেফিন কারনটা বুঝতে পেরেছেন বলে মনে হলো না।

‘আমরা কিসের উপর ভিত্তি করে খুঁড়বো?’

‘তথ্য আছে আমার কাছে। যথাসময়ে পাবেন,’ বললেন ড. কারসন। একটা সিগারেট ধরালেন।

‘আমার মনে হয় সবকিছু পরিস্কার করে জানার অধিকার আছে আমাদের, সন্দীপ বলল। খামটা সাইড টেবিলে রাখল আলতো করে।’

‘এই খামটা নিয়ে যান আপনি, সন্দীপের উদ্দেশ্যে বললেন ড. কারসন, এই পুরোটা সময় আমাদের অনুসরন করা হয়েছে, জানেন আপনি? সেই লন্ডন থেকে কেউ একজন পিছু নিয়েছে আমার, এইটুকু বোঝার মতো বুদ্ধি আছে। তাই কোনকিছু আগে ভাগে বলতে চাচ্ছি না। হয়তো বড় কোন ঝামেলায় পড়ে যেতে পারেন আপনারা।

‘সে যাই হোক, সন্দীপ বলল, ‘সেই দিল্লি থেকে ম্যাকলডগঞ্জ চলে এলাম, অথচ কি করতে হবে, কিভাবে করতে হবে, কিছুই তেমন জানি না।

‘সময়মতো সব জানবেন মি. সন্দীপ, গম্ভীর কণ্ঠে বললেন ড. কারসন, ‘আপাতত একটু ধৈর্য্য ধরুন।

‘আচ্ছা, আমি যাই তাহলে। মিটিং তো শেষ, তাই না?’ বলল সন্দীপ।

‘হ্যাঁ, আজকের মিটিং এখানেই শেষ। আপনারা যার যার রুমে যেতে পারেন।‘

সবাই বের হয়ে যাওয়ার পর বের হলেন ড. আরেফিন। সবকিছু কেমন ধোঁয়াশা লাগছে। কাল সকালে বের হতে হবে তাড়াতাড়ি। এরমধ্যে সন্দীপ যদি কোড ভেঙে কিছু বের করতে পারে তাহলে তো কথাই নেই। পরিশ্রান্ত লাগছিল। ধীর পায়ে হেঁটে রুমে ফিরে এলেন তিনি। ঢাকায় কল করা হয়নি গত দু’একদিন, আজ খবর নিতে হবে।

***

আচমকা ঝাঁকিতে ঘুম ভাঙল রাশেদের। চারপাশে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেল। ঘুটঘুঁটে অন্ধকার। শুধু পাশের সীটে বসা লরেন্সের চেহারাটা আবছা দেখা যাচ্ছে। শুধু ড্যাশবোর্ডের আলোয় অপার্থিব দেখাচ্ছে চেহারাটা, ফ্যাকাশে, অভিব্যক্তিহীন মৃত লাশের মতো। কিন্তু লাশ কখনো হাসে না, মানুষ হাসে। লরেন্সের মুখটা হাসিহাসি।

‘এতো ঝাঁকির মধ্যে কিভাবে ঘুমাও?’ হেসে জিজ্ঞেস করল লরেন্স।

‘জানি না।’

হেডলাইটের আলোয় সামনের এবড়োখেবড়ো রাস্তাটা দেখা যাচ্ছে। একটু পর পর বাঁক। দক্ষ হাতে গাড়ির গতি সামলাচ্ছে লরেন্স। একটু এদিক-সেদিক হলেই পাশের খাদে পড়ে যেতে হবে।

‘কোথাও কি থামবো না আমরা?’ বিরক্তির সাথে জিজ্ঞেস করল রাশেদ।

‘থামবো, আর আধ-ঘন্টার মধ্যে, লরেন্স বলল। তোমার সীটের পাশে খবরের কাগজের প্যাকেটটা খোল।‘

সীটের একপাশে রাখা খবরের কাগজের প্যাকেটটা আগে চোখে পড়েনি রাশেদের। প্যাকেটটা হাতে নিলো, বেশ ভারি মনে হচ্ছে।

‘কি আছে এখানে?’

‘খুলেই দেখো,’ লরেন্স বলল।

প্যাকেটটা খুলল রাশেদ। কালো চকচকে একটা রিভলবার দেখা যাচ্ছে। একপাশে দুটো ম্যাগাজিন।

‘ম্যাগাজিন কিভাবে লোড করতে হয় জানো?’ জিজ্ঞেস করল লরেন্স।

‘এগুলো নিয়ে খুব বেশি নাড়াচাড়া করার সুযোগ হয়নি জীবনে, রাশেদ বলল, ‘আর নাড়াচাড়া করতেও চাই না।’

‘নিজের বাপত্তার জন্যই তোমার জিনিসটা দরকার, লরেন্স বলল, ‘কিভাবে কি করতে হয় শিখিয়ে দেবো তোমাকে।

‘ঠিক আছে,’ বলল রাশেদ, প্যাকেট থেকে রিভলবারটা বের করে হাতে নিলো। বেশ ভারি জিনিস, ম্যাগাজিন দু’টো থেকে একটা বের করে অনায়াসে লোড করে নিলো।

‘আরে, এতো দারুন ব্যাপার, লরেন্স বলল, ‘কে শিখিয়েছে?

উত্তর দিলো না রাশেদ। ম্যাগাজিন লোড করা খুব কঠিন কিছু মনে হয়নি তার কাছে। ইংরেজি অনেক সিনেমায় দেখেছে কিভাবে ম্যাগাজিন লোড করে।

‘শোন রাশেদ, এখন তুমি আমার সঙ্গি, লরেন্স বলল। আমি যা বলবো তাই করবে। বেশি কিছু বা নিজে থেকে কিছু করার চেষ্টা করবে না। রিভলবারটা যেখানে ছিল সেখানেই রেখে দাও। প্রয়োজন হলে বলবো।‘

‘ঠিক আছে,’ মৃদু স্বরে বলল রাশেদ। খবরের কাগজে মুড়িয়ে রিভলবারটা সীটের পাশে রেখে দিলো।

‘আজ রাতটা এক বন্ধুর ওখানে কাটাবো, লরেন্স বলল। সেখানে আমার ইশারা ছাড়া কোন কথা বলবে না।

‘জি।’

খুব ধীরে চলছে গাড়িটা। গভীর অন্ধকারে হেডলাইটের আলো বেশিদূর যেতে পারছে না। কেমন ভুতুড়ে লাগছে সবকিছু, গা ছমছম করে উঠলো রাশেদের। মোবাইল ফোনটা পকেট থেকে বের করে নেটওয়ার্ক দেখে নিলো। একদম সিগন্যাল নেই।

দূরে আবছা কিছু একটা দেখা যাচ্ছে। ছোটখাট একটা কাঠামো। ভালো করে তাকাল রাশেদ। গাড়ির গতি আরো কমে আসছে। সম্ভবত আজ রাতের জন্য এটাই তাদের আশ্রয়স্থল।

*

অধ্যায় ৩৩

মেয়েটার সাথে একজনের চেহারার খুব মিল। এমনকি মাঝে মাঝে মনে হয় রেবেকাই চলে এসেছে চোখের সামনে। সে একই দাঁড়ানোর ভঙ্গি, চাহনি। অনেক কিছু মনে না পড়লেও রেবেকার মুখটা ভোলেনি সে। অল্প বয়েসি মেয়েটার মনও খুব নরম। গত কিছুদিন অক্লান্ত পরিশ্রমে সারিয়ে তুলেছে তাকে। ভাগ্যকে সেজন্য ধন্যবাদ দেয় ত্রিস্তান। তার মতো একজন অচেনা মানুষ এতো সেবা, আতিথেয়তা পাবে তা অকল্পনীয়।

নিজের জীবনের অনেক কিছুই এখন ঝাপসা তার কাছে। রেবেকার মতো কিছু কিছু মুখ মনে পড়ে যায়। তিবাও, আন্তোনিওসহ অন্যান্য বন্ধুরা এখন শুধু স্মৃতি। মেঘনার তীরবর্তী এই অঞ্চল থেকে সরে যেতে হবে তাকে। এখানকার মানুষরা ঘনার চোখে দেখে তাকে। বৃদ্ধের আচরনেই ব্যাপারটা পরিস্কার হয়ে গেছে। ব্যতিক্রম শুধু অল্পবয়েসি মেয়েটা। ইদানিং মনে হয় মেয়েটা হয়তো ভালোবাসে তাকে। মুখে বলেনি কখনো, কিন্তু আচার-আচরনে মাঝে মাঝেই বুঝতে পারে ত্রিস্তান।

বাংলাটা মোটামুটি বুঝতে পারে, বলতেও পারে টুকটাক। শুনে হাসে মেয়েটা। ওর নামটা মালতী রানি, উচ্চারন করতে গিয়ে ‘মালোটি’ বলে ত্রিস্তান। বৃদ্ধও হাসি আটকাতে পারে না তখন। গত কিছুদিন হলো উঠে বসতে পারে ত্ৰিস্তান। মাঝে মাঝে বাইরে যায় হাঁটতে, গায়ের জোর এখনো ফিরে আসেনি। পুরো গ্রামটা হেঁটে আসে, দুপুরে খেয়ে নিয়ে ঘুমায় একটু। তারপর সন্ধ্যার পর উঠোনে বসে থাকে। ঝাপসা ঝাপসা নানা ছবি উঁকি দেয়, কোথাও যুদ্ধ করছে, কখনো সাঁতার কাটছে বন্ধুদের সাথে। অনেক দূরে নিজের দেশের কিছু ছবিও মাঝে মাঝে দেখতে পায়। সবই রেবেকার ঝাপসা মুখ। আর কোনদিন দেখা হবে না।

সন্ধ্যায় উঠোনে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে ত্রিস্তান। বৃদ্ধ বাইরে কোথাও গিয়েছিল, ফিরেছে একটু আগে। মালতী তাকে শুকনো মুড়ি আর গুড় দিয়েছে। তা নিয়ে গজগজ করছে বদ্ধ। শুনেও না শোনার ভান করে বসে আছে ত্রিস্তান। তাদের এই অবস্থার জন্য তাকেই দায়ী করে বৃদ্ধ সবসময়। হয়তো সে দায়ী, কিংবা তার জাতভাইরা। কিন্তু এখন কিছুই মনে পড়ে না। তাই চুপচাপ বসে বৃদ্ধের গালমন্দ শোনে, বৃদ্ধ একসময় শান্ত হয়ে চলে যায় ঘরে। ছোট একটা একচালা ঘর আছে একপাশে। সেখানে নানা-রকম মূর্তি সাজানো। সেখানে বসে পূজা করে। দেখে অবাক হয় ত্রিস্তান। কিন্তু কিছু বলে না।

আজ সন্ধ্যায় বৃদ্ধ ফিরে এসেছে একটু আগে। মূর্তির সামনে না গিয়ে সোজা ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। তার মানে আজ আর উঠবে না। হয়তো শরীর খারাপ। মালতী এসে দাঁড়িয়েছে পাশে। বাটিতে মুড়ি আর গুড় নিয়ে।

‘মালতী,’ হেসে জিজ্ঞেস করল ত্রিস্তান। ‘উনার কি শরীর খারাপ?’

হাত বাড়িয়ে বাটিটা নিলো ত্রিস্তান।

‘আমি কি খুবই খারাপ মালতী?’

‘জানি না।’ মালতী চলে যেতে চাচ্ছিল, হাত চেপে ধরল ত্রিস্তান।

‘তোমাকে আমার ভালো লাগে মালতী, ত্রিস্তান বলল। আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই।’

কিছুক্ষন চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল মালতী। কি উত্তর দেবে হয়তো বুঝতে পারছিল।

‘দাদুর সাথে কথা বলেন,’ ধীর কণ্ঠে বলল মালতী।

‘ঠিক আছে,’ ক্ৰিস্তান বলল। মালতীর হাত ছেড়ে দিল।

বৃদ্ধের সাথে কথা বলে লাভ হবে না এটা ভালোই জানা আছে। কিন্তু তারপরও চো করতে হবে এবং সেটা এখনি। উঠে দাঁড়াল ত্রিস্তান। বদ্ধের ঘরের দরজা খোলাই থাকে। ভিতরে হ্যারিকেন জ্বলছে। সোজা হয়ে শুয়ে আছে বৃদ্ধ। ওর নামটা কখনো জানা হয়নি ত্রিস্তানের। আজ জেনে নিতে হবে।

মালতী পূজার ঘরে চলে গেছে, এক ফাঁকে দেখে নিলো ত্রিস্তান। তারপর উঠোন পেরিয়ে বৃদ্ধের ঘরে ঢুকল।

বিছানায় সোজা হয়ে শুয়ে আছে বৃদ্ধ। চোখ খোলা। সেখানে প্রান আছে কি নেই বোঝা যাচ্ছে না। তাড়াতাড়ি পাশে গিয়ে দাঁড়াল ত্রিস্তান।

‘আপনি ঠিক আছেন?’ ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল ত্রিস্তান।

‘এখনো ঠিক আছি,’ মৃদু স্বরে বলল বৃদ্ধ। ঠোঁট জোড়া কাঁপছে থরথর করে। ‘পানি খাবো।’

চেঁচিয়ে মালতাঁকে ডাকল লিস্তান। তার ডাকার মধ্যেই এমন কিছু ছিল দৌড়ে ঘরে চলে এলো মালতী। হাতে পিতলের গ্লাসে পানি। বৃদ্ধের পাশে বসে মাথাটা তুলে পানি খাইয়ে দিল।

‘মালতী, তোকে সৎ পাত্রে দিয়ে যেতে পারলাম না, হাপাতে হাপাতে বলল বদ্ধ।

‘কথা বলো না, ঘুমাও।’

‘এখন আর ঘুমানোর সময় নেই, এই বিদেশির সাথে চলে যা এই গ্রাম ছেড়ে।’

‘কি বলছো এসব?’

‘আজ রাতটা টিকবো না আমি, বদ্ধ বলল। এই গ্রাম এখন পতিত হয়েছে। এই এলাকা ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যা। যেখানে কেউ এই বিদেশিকে চিনবে না।’

‘দাদু, এভাবে বলো না। তোমার কিছু হবে না।’

‘আমার সবকিছু আমি তোর জন্য রেখে যাচ্ছি,’ বৃদ্ধ বলল, হাত ইশারায় ঘরের কোনার দিকে একটা বড় সিন্দুক দেখাল। ঐ সিন্দুকে সব সোনা আছে, আমার সারা জীবনের সঞ্চয়। ঐ দিয়ে তারা নতুন জীবন শুরু করতে পারবি।‘

‘দাদু, আমি তোমাকে ছেড়ে যাবো না, এই গ্রাম ছেড়ে যাবো না,’ কাঁদতে কাঁদতে বলল মালতী।

‘এই, তুমি একটু বাইরে যাও, ত্রিস্তানকে বলল বৃদ্ধ। ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল ত্রিস্তান। ঐ বিদেশির কাছে একটা নক্সা ছিল, হয়তো কোন গুপ্তধনের। ওটাও আমি সিন্দুকে লুকিয়ে রেখেছি। বেচারা জিনিসটার কথা ভুলে গেছে। তুই নক্সাটা ওর হাতে পরতে দিবি না। তাহলে সর্বনাশ হবে। একবার ঐসব গুপ্তধনের খোঁজে বের হলে ওকে আর ফিরে পাবি না।’

‘ঠিক আছে, ওটা লুকিয়ে রাখবো আমি, মালতী বলল ফোঁপাতে ফোঁপাতে।’

‘যা, আমার জন্য আরেক গ্লাস পানি নিয়ে আয়,’ বলল বৃদ্ধ।

দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো মালতী। বাইরে দরজার একপাশে দাঁড়িয়ে ছিল ত্রিস্তান। ভেতরে ঢুকল। বৃদ্ধ আগের মতোই শুয়ে আছে। কিন্তু কোথাও যেন একধরনের অস্বাভাবিকতা আছে মনে হচ্ছে। বৃদ্ধের পাশে গিয়ে দাঁড়াল লিস্তান। হ্যারিকেনের আলোয় বৃদ্ধের চোখ দুটো শুন্য মনে হচ্ছে। কোন প্রান নেই। হাত দিয়ে নাড়ি দেখল ত্রিস্তান। ঝুঁকে বুকের উপর হাত রাখল। একদম নিন। শ্বাস-প্রশ্বাস চলছে না।

দৌড়ে ঘরে ঢুকেছে মালতী। হাতের গ্লাসের বেশিরভাগ পানিই পড়ে গেছে বাইরে। বৃদ্ধের মাথাটা তুলে পানি খাওয়াতে গিয়ে বুঝল দেরি হয়ে গেছে।

উঠোনে এসে দাঁড়িয়েছে ত্রিস্তান। ঘরে পাগলের মতো কাঁদছে মালতী। পৃথিবীতে হয়তো এই বদ্ধই তার একমাত্র আপনজন ছিল। তাকে হারানোর শোক তো হবেই।

কিন্তু ত্ৰিস্তানের মাথায় ঘুরছিল অন্য কথা। মালতাঁকে এখান থেকে নিয়ে যেতে হবে, অনেক দূরের কোন দেশে। যেখানে কেউ তাকে চিনবে না, পূর্বপরিচয় জানতে চাইবে না। সেখানে সে মালতীর সব দুঃখ ভুলিয়ে দেবে। কিন্তু মালতাঁকে একান্তে ডেকে বৃদ্ধ কি বলেছিল সেটা আর কখনোই জানা হবে না ত্রিস্তানের।

.

১৮৭০ খৃস্টাব্দ

দূরে ছোট একটা নৌকা দেখা যাচ্ছে। সম্ভবত মাছ ধরা নৌকা। যাত্রী তিনজন। এখানকার পানিতে অনেকদিন মাছ ধরতে আসে না কেউ। সাগরের দানোর কথা এখানকার জনপদে একটা মিথে পরিণত হয়েছে। ভয়ে কেউ আসে না এদিকটায়। ফলে মাছের অভয়ারন্যে পরিণত হয়েছে জায়গাটা। মাছ কিলবিল করে। বাঁশ দিয়ে লম্বা একটা বর্শা বানিয়ে নিয়েছে মিচনার। তার নিজেরও একটা নৌকা আছে, নৌকা না বলে ভেলা বলাই ভালো হবে। সেটা নিয়ে মাঝে মাঝে মাছ শিকারে যায় মিচনার। বর্শা দিয়ে ইচ্ছে মতো কিছু মাছ গেঁথে ফেলে। তারপর সেই মরা মাছগুলো আবার ফেলে দেয় পানিতে। এটা একধরনের খেলা তার কাছে। কিন্তু একই খেলা খেলতে আর কতো ভালো লাগে। মানুষ এসেছে অনেকদিন পর। এদের শিকার করতে পারার মধ্যেই আছে আসল আনন্দ। বড় বট গাছটা থেকে নেমে এলো মিচনার। তারপর গাছের আড়ালে লুকিয়ে দেখল নৌকাটার কার্যক্রম। এরা যদি মাছ ধরে নিয়ে ফিরে যেতে পারে তাহলেই সমস্যা। অন্যান্য জেলেদের তাহলে ভয় কেটে যাবে। দলে দলে আসতে থাকবে ওরা।

ছোট ভেলাটা দিনের আলো যায় না এমন এক জায়গায় লুকিয়ে রাখল মিচনার। কোমরে ছুরি খুঁজে ভেলাটায় চেপে বসল সে। আজ ঐ তিনটাকে এখান থেকে জ্যান্ত যেতে দেওয়া যাবে না।

স্রোত একেবারে কম এখানে। নিঃশব্দে এগিয়ে যাচ্ছে ভেলাটা। জেলেদের নৌকাটা একেবারে কাছেই। ওরা এখনো দেখতে পায়নি আগুন্তককে। লোকগুলোকে পরিস্কার দেখতে পাচ্ছে মিচনার এখন। পরনের পোশাক ইউরোপীয় ধাঁচের, গায়ের রঙ ফর্সা। অনেকটা তার মতোই। গত পঞ্চাশ বছরে এই অঞ্চলে সাদা চামড়ার মানুষের দেখা পায়নি। এই লোকগুলো কোথা থেকে এলো, ভাবছিল মিচনার।

চিন্তা করার মতো সময় হাতে নেই। এই লোকগুলোকে খতম না করলে তার নিজের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। এতো আরাম আয়েশে লোকচক্ষুর অন্তরালে আর কোথাও থাকা যাবে না।

ভেলা থেকে আস্তে করে শীতল পানিতে নেমে পড়ল মিচনার। একহাতে বর্শাটা রাখতে ভুলল না। ভেলায় করে ওদের কাছে যাওয়ার আগেই ওরা দেখে ফেলবে। তাই এই সাবধানতা। পানির নীচে ইচ্ছে মতো দম বন্ধ রাখার ক্ষমতা আছে তার। কাজেই ডুব সাঁতার দিয়ে নৌকাটার কাছে চলে গেল মিচনার। ওরা জাল ফেলেনি। ছিপ দিয়ে মাছ ধরতে এসেছে। নৌকাটার ঠিক নীচে গিয়ে স্থির হয়ে দাঁড়াল মিচনার। তারপর শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে ধাক্কা দিল নৌকার তলায়। উপরের তিনজন এই আকস্মিক ধাক্কা সামলাতে পারলো না। একজন পড়ে গেল সাথে সাথেই। তাকে বর্শা দিয়ে গেঁথে ফেলল মিচনার। চারপাশ লাল হয়ে গেছে রক্তে। নৌকার উপরের দুজন সমানে চেঁচাচ্ছে। ওদের চিৎকার শোনার মতো কেউ নেই আশপাশে। আবারও নৌকার তলায় ধাক্কা দিল মিচনার। দুজনের কেউ পড়লো না। নৌকার কিনার ধরে বসে পড়েছে। এবার কোমর থেকে ছুরি বের করল মিচনার। কাঠের তৈরি নৌকা, জায়গায় জায়গায় জোড়া দেয়া। ঠিক জায়গা দেখে ছুরিটা বসিয়ে দিল মিচনার নৌকার তলায়। ক্রমাগত খুঁচিয়ে যাচ্ছে ছুরির ধারাল আগা দিয়ে। কিছুক্ষনের মধ্যে ফুটো হয়ে গেল নৌকার তলাটা। উপায় না দেখে ঝাঁপ দিল আরেকজন। হয়তো সাঁতরে তীরে যাওয়ার ইচ্ছায়। কিন্তু মিচনার এখন অপ্রতিরোধ্য। রক্ত তার মধ্যে দারুন চাঞ্চল্য এনে দিয়েছে। বর্শাটা সর্বশক্তিতে ছুঁড়ে দিল মিচনার, পানির নীচে একেবেকে ছুরিটা এফোঁড়ওফোঁড় করে ফেলল লোকটাকে। রক্ত বেরিয়ে আসছে পিচকারির মতো। চারদিক অন্ধকার হয়ে এসেছে। এবার আরেকজন বাকি।

অপেক্ষা করার সময় নেই। রক্তের গন্ধ আরেকজনেরও খুব পছন্দ। রকহেড। একটা হাঙর, নামটা মিচনারের দেয়া। হয়তো কাছাকাছিই আছে, রক্তের গন্ধে যেকোন সময় ছুটে আসবে। ওর সাথে যুদ্ধ করার কোন ইচ্ছেই মিনারের নেই। তাই ডুব সাঁতারে ভেলাটার উপর ফিরে এলো মিচনার।

নৌকাটা ডুবছে। অসহায়ের মতো পানি সেঁচার চেষ্টা করছে জীবিত লোকটা। কিন্তু পানি ঢুকছে, নৌকাটার অর্ধেকের বেশি ডুবে গেছে। মাঝে মাঝে দূরে মিচনারের দিকে তাকাচ্ছে। দৃষ্টিতে অবিশ্বাস। একটা মানুষ পানির নীচ থেকে এভাবে আক্রমন করেছে এটা বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে লোকটার, বুঝতে পারল মিচনার। রকহেডের আসার সময় হয়েছে। একটু দূরে পানিতে আলোড়ন দেখা গেল। এই লোকটাকে নিজের হাতে মারতে না পারার আফসোস থাকবে।

কিছুক্ষনের মধ্যে সৈকতে ফিরে এলো মিচনার। শুয়ে পড়ল বালির উপর। অনেকদিন পর দারুন উত্তেজনাকর কিছু মুহূর্ত কেটেছে তার।

*

অধ্যায় ৩৪

যজ্ঞেশ্বরের শুরুর সাথে দেখা হয়েছে, এতোদূর আসাটা অনেকটাই সার্থক হয়েছে বলা যায়। মানুষটাকে দেখেই ভক্তি আসবে যে কারো। ফর্সা একহারা চেহারা, খাড়া নাক, প্রশস্ত কপাল আর বড় বড় দুটো চোখ। এই চোখগুলো অনেক কিছু দেখেছে। মুখভর্তি সাদা দাড়ি, লম্বা জটা চুলে অদ্ভুত রহস্যময় দেখাচ্ছিল লোকটাকে।

এই লোকের সামনে যজ্ঞেশ্বর যেন নিতান্তই এক শিশু, হাত জোড় করে পায়ের সামনে বসে ছিল যজ্ঞেশ্বর। গুরুজী পরম স্নেহে হাত রেখেছিল শিষ্যের মাথায়, তাতেই যেন জীবন ধন্য হয়ে গেছে যজ্ঞেশ্বরের। তাকিয়ে তাকিয়ে সব দেখছিলেন তিনি।

ম্যাকলডগঞ্জের বাইরে ছোট একটা পাহাড়ের পাদদেশে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। একটু আগেই উপর থেকে নামলেন। যজ্ঞেশ্বরের গুরুর সাথে দেখা করে। পাহাড়ের মাথা অনেকটাই সমতল, সেখানে বড় একটা গাছের তলায় ধ্যানমগ্ন অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল গুরুকে। অনেক কথা হলো, যদিও অনেক কিছুই এড়িয়ে গেছেন ভদ্রলোক, তবু যা জানার জেনে নিয়েছেন তিনি। ভারতীয় জ্ঞানগঞ্জ আর তিব্বতি সাম্ভালা যে একই বিষয় এটাই ছিল গুরুর প্রধান ভাষ্য। ব্যাপারটা ঠিক মতো বুঝতে পারেননি তিনি। জ্ঞানগঞ্জে নাকি অনেকেরই যাওয়া-আসা আছে। তবে সেটা তিব্বতের কাছাকাছি কোন জায়গা কি না তা পরিস্কার করে বলেননি গুরু। তার নিজের যেটুকু ধারনা তাতে জায়গাটা কৈলাস পর্বত এবং মানস সরোবরের কাছাকাছি কোন জায়গা হবে, আর অঞ্চলটা তিব্বতেরই অন্তর্গত।

দীর্ঘসময় ধরে কথা হয়েছে গুরুর সাথে। এক প্ৰসংগ থেকে নানা প্রসংগে চলে গেছেন। সম্রাট অশোকের সেই রহস্যময় নয় মানবের কথাও বাদ থাকেনি। গুরুর ধারনা নয় রহস্যময় মানব এখনো জীবিত এবং তাঁরা এখন সাম্ভালায় অবস্থান করছেন। মানবজাতির প্রয়োজনের সময় নাকি আবার চলে আসবেন। এঁদের একজনের সাথে নাকি গুরুজীর দেখাও হয়েছে। বিস্মিত হলেও বুঝতে দেননি তিনি। চুপচাপ বাধ্য শ্রোতার মতো শুনে গেছেন। প্রশ্ন করেননি কোন। তিনি নিজেই এক বিস্ময়ের নাম। নয় রহস্যময় মানব হয়তো সত্যি সত্যি আছে। হয়তো সাম্ভালায় কখনো যেতে পারলে। তাদের দেখা মিলবে।

নিজের পরিচয় দিয়েছিলেন লখানিয়া সিং বলে। চলে আসার সময়কার দৃশ্যটা চোখে ভাসছে এখনো। যজ্ঞেশ্বরকে অবাক করে তাকে জড়িয়ে ধরেছিলেন গুরুজী। কানে কানে বলেছিলেন, আমার কাছে পরিচয় গোপন করে লাভ নেই। আপনিই সেই বিশেষ একজন যার প্রতীক্ষায় ছিলাম আমি। তবে একটা ব্যাপারে সাবধান করে দিতে চাই। আপনার প্রতিদ্বন্দ্বী আসছে। ঝড়ের গতিতে। সাবধানে থাকবেন।

উত্তর দেননি তিনি। প্রতিদ্বন্দ্বী আবার কে? অভয় দেয়ার ভঙ্গিতে হেসেছিলেন। তারপর চলে এসেছেন।

যজ্ঞেশ্বর রয়ে গেছে গুরুর সেবায়। দু’একদিন পরে আসবে কিংবা নাও আসতে পারে। বেচারাকে জোর দেননি তিনি। সন্ন্যাসী মানুষ, প্রাত্যহিক জীবনে তাল মেলাতে চায় না।

অনেকক্ষন ধরেই এখানে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। আগের রাতে ঐ লোকটাকে প্রচ্ছন্ন হুমকি দিয়ে ভালোই করেছেন। লোকটাকে অবশ্য তেমন ভয়ংকর কিছু মনে হয়নি। বিশেষ কোন স্বার্থে বাংলাদেশি মানুষটার পেছনে লেগেছে। স্বার্থটা কি জানতে পারলে খুব ভালো হতো।

দূরে তাকিয়ে পরিচিত মানুষটাকে দেখতে পেলেন। বাংলাদেশি সেই ভদ্রলোক আসছেন, সাথে আরো দুজন। একজন ইউরোপীয়, বয়স্ক। অপরজন ভারতীয়, স্বাস্থ্যবান মানুষ। হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে দূর থেকেই বোঝা যাচ্ছে। এদের সাথে গাইড লোকটাও আছে। সবার হাতে ছোটখাট ব্যাগ। বিশেষ কোন উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে তারা, বুঝতে পারছেন তিনি। নিজেকে একটু আড়ালে নিয়ে গেলেন। গতরাতের অনুসরনকারি পেছনে আছে কি না বুঝতে চেষ্টা করছেন। সম্ভবত নেই। যে হুমকি দিয়েছিলেন তাতে হয়তো ভয় পেয়েছে।

কিন্তু ধারনা ভুল। বিপরীত দিকে ছোট একটা টিলার উপর একজনকে দেখা যাচ্ছে। মাথায় টুপি, শীতের ভারি পোশাক পরনে। তারপরও চিনতে ভুল হলো না তার। গতরাতের লোকটাই। হাতে বাইনোকুলার। কাছাকাছি না এসে দূর থেকে নজর রাখছে।

একচিলতে হাসি খেলে গেল তার মুখে। হুমকি দেয়ার পরও যেহেতু জানের ভয় পায়নি তাহলে এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। তবে এখন না, পরিস্থিতি যদি কখনো নিয়ন্ত্রনের বাইরে যাওয়ার মতো অবস্থা হয় তখন।

আস্তে আস্তে ছোট দলটাকে অনুসরন করছেন তিনি। এরা কি উদ্দেশ্যে এসেছে না জানা পর্যন্ত ভালো লাগছে না। মনে হচ্ছে সামনে বড় কোন বিপদ ওৎ পেতে আছে। ভয়কে জয় করেছেন অনেক আগেই। তবে গুরুজীর কথা একেবারে ফেলা দেয়াও হয়তো ঠিক হবে না। হয়তো এমন কেউ সত্যিই আছে যে তাকে নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করে। এই জীবনে কারো সাথে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করা হয়নি,মরনশীল মানুষের সাথে কোন কিছু করেই মজা নেই। সত্যিই যদি সেরকম কেউ আসে, তাহলে খারাপ হবে না।

নিজের মধ্যে অদ্ভুত উত্তেজনা টের পাচ্ছেন তিনি। তাকে চ্যালেঞ্জ করার মতো কেউ আসলে সত্যিই ভালো লাগবে।

শীতল হাওয়া বইছে। এই আবহাওয়ায় একসময় অভ্যস্ত ছিলেন তিনি। কিন্তু এখন গায়ে কাটা দিয়ে উঠছে। হাঁটতে হাঁটতেই পুরানো কিছু স্মৃতি মনে পড়ে গেল।

৩৮২

কন্সট্যান্টিপোলের আকাশ সেদিন অন্ধকার হয়ে এসেছিল। দিনরাত যুদ্ধের দামামা বাজছে। রোম সাম্রাজ্যের শেষ চিহ্ন এই কন্সট্যান্টিপোলও এখন ধ্বংসের মুখে। দৃঢ় চিত্ত সম্রাট কন্সট্যান্টিন চিন্তিত মুখে দাঁড়িয়ে আছেন প্রাসাদের বারান্দায়। এখান থেকে পুরো শহরটা ছবির মতো দেখা যায়। কন্সট্যান্টিপোলের তিন দিকে জল, একদিকে স্থল। দক্ষিণে গোল্ডেন হর্ণ, উত্তরে মারমারা উপসাগর আর পশ্চিমে বসফরাস প্রণালী। ভৌগলিক অবস্থানের কারনে বিশ্বের সুরক্ষিত নগরীগুলোর মধ্যে অন্যতম এই শহর। এর প্রতিরক্ষাব্যবস্থাও অত্যন্ত শক্তিশালী। গোটা নগরীর চারপাশে একাধিক দুর্ভেদ্য প্রাচীর ও সার্বক্ষণিক সশস্ত্র প্রহরা। এসব কারণে কন্সট্যান্টিপোল এক অজেয় দুর্গ। সেই অজেয় দূর্গে গত প্রায় উনপঞ্চাশ দিন ধরেই একটানা আক্রমন করে যাচ্ছে হানাদাররা। |||||||||| মুখে চিন্তার ছাপ নিয়ে চারপাশ খুটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিলেন সমাট কন্সট্যান্টিন। প্রথম এবং দ্বিতীয় স্ত্রী মারা গেছে। কোন সন্তান ছাড়াই। বংশধরের জন্য বিয়ের প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে জার্মানী আর স্কটল্যান্ডে। এখনো কোন উত্তর আসেনি। হয়তো আসবেও না। কন্সট্যান্টিপোলকে রক্ষা করতে না পারলে কে বিয়ে দেবে মেয়েকে তাঁর সাথে? এই যুদ্ধের মধ্যেও বিয়ের কথা মাথায় আসায় বিরক্ত হলেন সম্রাট। শহরের চারপাশ ঘিরে যে প্রাচীর বানানো হয়েছিল, তা এক কথায় দুর্ভেদ্য। এই শহর দখল করতে হলে সুলতান মুহাম্মদকে অনেক বুদ্ধি করে এগুতে হবে। এককালে এই তরুণ সুলতানের বাবার ইচ্ছেতেই বাইজানটাইন সাম্রাজ্যের সিংহাসনে বসতে পেরেছিলেন তিনি। কিন্তু মুরাদের অকাল মৃত্যুতেই সমস্যার শুরু। অটোমান সাম্রাজ্যের সিংহাসনে বসল তরুণ সুলতান মুহাম্মদ, মাত্র একুশ বছর বয়সে। তারপরই দুজনের মধ্যে বিরোধের শুরু। সেই বিরোধ যে যুদ্ধে রুপ নেবে তা বুঝতে পেরেছিলেন যখন সুলতান বসফরাসের দুই প্রান্তে দুটো দূর্গ নির্মাণ করেন। এই দূর্গগুলো নির্মানের ফলে বসফরাস প্রনালী পুরোপুরি সুলতানের নিয়ন্ত্রনে চলে যায়।

যুদ্ধের বার্তা পেয়েই সম্রাট কন্সট্যান্টিন খৃস্টান জাতিগুলোর উদ্দেশ্য সাহায্যের আহবান জানান, নিজের ভাইয়ের কাছেও বার্তাবাহক পাঠান। কিন্তু অটোমান আক্রমন প্রতিরোধে যে পরিমান সাহায্য আসার কথা তার সিকি পরিমান সাহায্যও তিনি পাননি। তাই শহরবাসী আর অল্প সৈনিক নিয়েই কন্সট্যান্টিপোল রক্ষায় নেমে যেতে হয় তাকে।

এরমধ্যে যতোটুকু শুনেছেন সুলতানের সৈন্য সংখ্যা প্রায় দুই লাখের কাছাকাছি, সমুদ্রে রনতরীর সংখ্যা তিনশোর উপরে। তবু মনোবল হারাননি তিনি। এর পেছনে তাঁর ব্যক্তিগত উপদেষ্টা লুকাসের অবদান স্বীকার করতেই হবে। দিনরাত ছায়ার মতো আছে তাঁর সাথে। গ্রিক এই লোকটা গত পাঁচ বছর ধরে আছে তাঁর সাথে, সিংহাসনে আরোহনের আগ থেকেই। যেন জানতো বাইজেনটাইন সাম্রাজ্যের প্রধান হতে যাচ্ছেন তিনি। প্রজাহিতকর নানা কাজে যেমন উৎসাহ দিয়েছে, তেমনি ব্যবসা-বানিজ্য বা

প্রতিরক্ষা বিষয়ক নানা কাজে তাকে পরামর্শ দিয়েছে। কন্সট্যান্টিপোল শুরু থেকেই প্রায় অপরাজেয়। প্রথম কন্সট্যান্টিন এভাবেই শহরটা তৈরি করেছিলেন যখন পশ্চিমে রোম সাম্রাজ্যের পতন হয়। এবার হয়তো আরেক কন্সট্যান্টিনের সাথেই এর পতন ঘটবে।

লুকাস একটু পেছনে দাঁড়িয়ে আছে, চুপচাপ, বিষণ্ণ ভঙ্গিতে। বয়স পয়তাল্লিশের কাছাকাছি। ঋজু দেহ, গভীর চোখ। সম্রাট কিছুক্ষন একা থাকতে চায় এটুকু বোঝে সে। বার্তাবাহক এসেছে একজন। তাকে দূরে দাঁড় করিয়ে রেখেছে লুকাস। সম্রাট এখন ভাবুক অবস্থায় আছেন, এখন তাকে বিরক্ত করা যাবে না। বার্তাবাহক যে বার্তা নিয়ে এসেছে তা জানে লুকাস। সুলতানের বার্তা। হয়তো এটাই শেষ বার্তা। শেষ সাবধানবানী। আত্মসমর্পন করার আহবান। সম্রাট কি রাজি হবেন? বুঝতে পারছে না লুকাস। রাজি হওয়ার সম্ভাবনা কম।

রেলিং-এ হেলান দিয়ে লুকাসকে কাছে ডাকলেন সম্রাট।

ধীর পায়ে এগিয়ে গেলেন লুকাস।

‘তোমার কি ধারনা লুকাস? এই যুদ্ধে আর কতোদিন টিকতে পারবো আমরা?’

‘মহামান্য সম্রাট, সুলতান বেপোরোয়া, কন্সট্যান্টিপোল তিনি দখল করবেনই। খুব বেশি আশার আলো আমি দেখতে পাচ্ছি না।’

‘একজন সম্রাটকে এভাবে ভয় দেখালে লুকাস! আসলে তোমার সাহস দেখে আমি মাঝে মাঝে অবাক হই,’ মৃদু হাসলেন সম্রাট কন্সট্যান্টিন। ‘হয়তো এজন্যই তোমাকে আমার বেশি ভালো লাগে।’

এবার সোজা হয়ে দাঁড়ালেন সম্রাট। বিকেলের শেষ আলোয় তাঁর চেহারায় এক ধরনের অদ্ভুত সুন্দর দেখাচ্ছিল।

‘ইটালী থেকে সাহায্য আসছে, আমার ভাইও সাহায্য পাঠাবে,’ বললেন সম্রাট, ‘সুলতানের লক্ষ সেনার একজনও এই শহরে ঢুকতে পারবে না।’

চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল লুকাস। উত্তর দিল না, সম্মতিসূচক মাথা নাড়ল শুধু। বার্তাবাহকের চিঠিটা সম্রাটের হাতে দিল। রাজোকীয় ফরমান। ধীরে ধীরে পড়লেন সম্রাট কন্সট্যান্টিন।

‘এই নিয়ে তিনবার পাঠালো, তাই না লুকাস?’

‘জি, মহামান্য সম্রাট।‘

‘খাঁটি মুসলমানের মতো কাজ করেছে সুলতান। আত্মসমর্পন করতে বলেছে, তাও পরপর তিনবার। এবার গ্রহন না করলে চরম আক্রমন করবে, তখন আর কাউকে ছাড় দেয়া হবে না।’

‘জি, মহামান্য সম্রাট।’

‘আমি কি করবো জানো?’

উত্তরের আশায় লুকাসের মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন সম্রাট। কিন্তু কি উত্তর দেবে বুঝতে পারছে না লুকাস। জীবন বাঁচাতে চাইলে আত্মসমর্পন করা ভালো, কিন্তু সম্রাট কন্সট্যান্টিন মৃত্যুকেই শ্রেয় মনে করবেন এটা নিশ্চিত।

‘জানো না। আমি বলছি, আত্মসমর্পন করবো না আমরা। আমার বীর সৈনিকরা এই অটোমান তুর্কিদের থামাতে পারবে।’

‘জি, মহামান্য সম্রাট।

‘বার্তাবাহককে পাঠিয়ে দাও। বলে দাও, যতদিন আমি বেঁচে আছি আত্মসমর্পনের প্রশ্নই উঠে না।’

‘জি, মহামান্য সম্রাট।‘

কিছুক্ষন পর বার্তাবাহককে পাঠিয়ে দিল লুকাস। তার মন বেদনায় ভারাক্রান্ত। কন্সট্যান্টিপোলের পতন অনিবার্য। সম্রাট তা বুঝতে চাইছেন না। এই মুহূর্তে সম্রাটের পাশে থাকাটা খুব জরুরি। কিন্তু এখানে থাকা আর নিরাপদ হবে না। সম্রাটকে বারান্দায় রেখে নীচে নেমে এলো লুকাস। হয়তো কাজটা কাপুরষতা হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু ধ্বংসসালুখ একটা শহরে সত্যিকার কোন কাজ নেই তার। সুলতান মুহাম্মদ বুদ্ধিমান, তরুণ এবং অসম্ভবকে সম্ভব করার সাহস রাখেন। যে বিশাল সৈন্যবাহিনী তিনি জড়ো করেছেন, সেই সাথে হাঙ্গেরীয় অস্ত্রবিদ ওরবানকে দিয়ে যে সব অস্ত্রশস্ত্র বানিয়েছেন কন্সট্যান্টিপোল দখল তিনি করবেনই তাতে কোন সন্দেহ নেই। সেই দখলের পর এখানে থাকাটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। তার আগেই চলে যেতে হবে এখান থেকে। দূরে কোথাও। সম্ভব হলে ব্রিটানিয়া অথবা অন্য কোথাও।

শহরের প্রধান গীর্জায় কিছুক্ষন সময় কাটিয়ে সন্ধ্যার পর পর বেরিয়ে পড়ল লুকাস। চারপাশ ঘিরে রেখেছে অটোমান তুর্কিরা। এরমধ্য দিয়ে বের হয়ে যাওয়াটা খুব ঝুঁকির কাজ হয়ে যেতে পারে। বাইজেনটাইন অথবা তুর্কি যে কারো দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু ঝুঁকি নেয়া ছাড়া আর কোন পথ নেই। শহরের বাইরে যাওয়ার এবং ঢোকার সবগুলো প্রবেশপথে বাইজেনটাইন সৈন্যরা পাহারা দিচ্ছে। তারপরও এমন একটা পথ চেনেন তিনি তা কেউ ব্যবহার করেনি কখনো।

ঠিক বারোটার পর বাইজেনটাইন এবং অটোমান সৈন্যদের ফাঁকি দিয়ে কন্সট্যান্টিপোলের বাইরে চলে এলো লুকাস। ছোট একটা পাহাড়ের উপর দাঁড়িয়ে আছে এখন সে। এতো রাতে বসফরাসের পশ্চিম তীরে মশালের লাফালাফি চোখে পড়ল। অন্ধকারের কারনে কিছু বোঝা যাচ্ছিল না, তবু নিশ্চয়ই বড় কোন কাজে নেমেছেন সুলতান। হয়তো অদ্ভুত কোন ফন্দি করেছেন। এখান থেকে তা বোঝার উপায় নেই। গোল্ডেন হর্ণে লাগানো শেকলের কারনে যুদ্ধজাহাজগুলো ঠিকমতো ব্যবহার করতে পারছেন না সুলতান। হয়তো তারই কোন সমাধানে নেমেছেন। আগামীকাল সকালেই হয়তো সব বোঝা যাবে। কিন্তু ততক্ষনে এই শহরের সীমা ছাড়িয়ে ইউরোপের দিকে পাড়ি জমাবে লুকাস। পেছনে পড়ে থাকবে বাইজেনটাইন সাম্রাজ্যের শেষ রাজধানী এবং শেষ সম্রাট। সেদিন ছিল মে মাসের সাতাশ তারিখ, ১৪৫৩ সাল, এর দুই দিন পরই বাইজেনটাইন সাম্রাজ্যের পরিসমাপ্তি ঘটে যা একসময় রোমান সাম্রাজ্যের শেষ চিহ্ন হিসেবে টিকে ছিল এশিয়ায়।

হাঁটতে হাঁটতে অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলেন তিনি। কন্সট্যান্টিপোলের নাম এখন ইস্তানবুল। সম্রাট কন্সট্যান্টিন আত্মসমর্পন করেননি,বীরের মতো প্রান দিয়েছেন যুদ্ধে। সমাহিত করার জন্য তাঁর লাশ পাওয়া যায়নি,সাধারন সৈনিকদের সাথে এককাতারে যুদ্ধ করেছিলেন সম্রাট, নিজের রাজকীয় পোশাক ছুঁড়ে ফেলে। সুলতান মুহাম্মদ ছিলেন অসাধারন সম্রাট, শহর দখল করেই তিনি জনগনকে মেরে ফেলেননি। মুসলমান সাম্রাজ্য কায়েম করেছিলেন। কন্সট্যান্টিপোল জয় করার জন্য এমন সব কৌশল আবিষ্কার করেছিলেন সুলতান যা তাকে ইতিহাসের সেরা সমরবিদের তালিকায় স্থান এনে দেবে। আশিটি রনতরী একরাতের মধ্যে ডাঙ্গায় তুলে কাঠের পাটাতনে তেল দিয়ে অপর পাশের গোল্ডেন হর্নে ছেড়েছিলেন যাতে ইউরোপের সাহায্য কন্সট্যান্টিপোলে না পৌঁছতে পারে। তাতেও কাজ না হওয়ায় কন্সট্যান্টিপোলের প্রাচীরের সমান উঁচু চলমান টাওয়ার বানিয়েছিলেন যাতে করে সৈন্যরা শহরে ঢুকতে পারে। সুলতানের সেই উদ্দেশ্য সফল হয়েছিল। কন্সট্যান্টিপোল জয়ের পর সুলতানের নামের সাথে যোগ হয়েছিল ফতেহ। এইসব ইতিহাস জানা হয়েছিল পরবর্তীতে।

সামনে তাকালেন, দূরে বিন্দুর মতো চারজনকে দেখা যাচ্ছে। মাঝে মাঝে পুরানো এসব স্মৃতি তাকে দারুন আন্দোলিত করে। সেইসব সাহসী লোক এখন হয়তো শুধু ইতিহাসের পাতায় পাওয়া যায়। অবশ্য আগের মতো যুদ্ধবিগ্রহও হয় না। তবে ধর্মীয় একটা বিভেদ রয়েই গেছে সেটা হয়তো সহজে দূর হবার নয়। ইহুদি, মুসলমান, হিন্দু, খৃস্টান সবার মধ্যেই পারস্পরিক সমঝোতার পথটা এখনো অনেক দূরে। তবে দূরে হলেও আশা হারাননি তিনি, একদিন হয়তো পুরো পৃথিবীতেই সাম্ভালার মতো শান্তি বিরাজ করবে, মানুষ জাগতিক চাওয়া-পাওয়া থেকে মুক্তি পাবে। সাম্ভালার খোঁজ পাওয়াটা তাই খুব জরুরি।

***

লোকগুলো পাহাড়ি, শক্তসমর্থ, বয়স বোঝা যায় না, তবে চল্লিশের নীচেই বয়স হবে সবার। পাঁচজনের একটা দল। ছোট কাঠের বাড়িটায় পাশাপাশি দুটো কামরা। একটায় বসে নিজেদের মধ্যে কথা বলছিল ওরা, চাকমা অথবা মারমা ভাষায়, কিছুই বুঝতে পারছিল না রাশেদ। পাশের ঘরে বসে ঘামছিল সে। এখানে বিদ্যুতের আলো এসে পৌঁছেনি এখনো। ছোট একটা হ্যারিকেন জ্বলছে এক কোনায়। তার আলোয় পুরো ঘরটা আলোকিত হয়নি। লরেন্স বসতে বলে গেছে অনেকক্ষন আগে। এখনো আসার নাম নেই। একটু ভয় ভয় লাগছিল রাশেদের। এই লোকগুলো হয়তো খারাপ না, অন্তত খুন-খারাপির সাথে জড়িত বলে মনে হয় না। চেহারায় শিশুসুলভ সারল্য আছে। এরা হয়তো খেটে খাওয়া মানুষ, এদের দিয়ে পরিশ্রমের কোন কাজ করাবে বলে হয়তো ঠিক করেছে লরেন্স।

ছোট একটা চৌকির উপর বসে আছে রাশেদ। পাশের জানালা খোলা। সেখানে তাকালে বাইরের ঘুটঘুঁটে অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই দেখা যায় না। বাইরে নানা ধরনের শব্দ। ঝিঁঝি পোকা থেকে শুরু করে তক্ষক, ব্যাঙ আরো অনেক কিছুই ডাকছে। অদ্ভুত এক ভয় পেয়ে বসেছে রাশেদকে। পাশের কামরায় লোকজন আছে, কিন্তু মনে হচ্ছে পৃথিবীতে সে একা একজন মানুষ। আর কেউ নেই। সবাই কোন নিউক্লিয়ার বিস্ফোরনে মারা গেছে। এখান থেকে বের হলেই দেখবে পাশের রুমে কেউ নেই। সবকিছু খাঁ খাঁ করছে। এই ধরনের অদ্ভুত চিন্তা তার মাথায় যখন তখন আসে। সাইক্রিয়াটিস্টের কাছে যাওয়া উচিত আরো বেশি খারাপ কিছু হওয়ার আগে।

দরজায় টোকা পড়াতে কিছুটা আঁতকে উঠলো রাশেদ। লরেন্স ঢুকেছে। ঘামছে দরদর করে।

‘আজ অনেক গরম,’ নিজের মনেই বলল লরেন্স। রাশেদের পাশে বসল। ‘তুমি কিছু খেয়েছো রাশেদ?’

উত্তর দিলো না রাশেদ। যাওয়ার সময় রুটি আর কলা রেখে গিয়েছিল লরেন্স, সেগুলো খাওয়া হয়েছে আরো অনেকক্ষন আগেই। মনে হচ্ছে সামনের কয়েকটা দিন রুটি আর কলা দিয়েই চালিয়ে দিতে হবে।

‘পাশের রুমে হৈ চৈ শুরু হয়েছে। হাসল লরেন্স।’

‘এখন ওরা পাহাড়ি খাচ্ছে, তুমি খাবে নাকি?’

‘আমি খাই না ওসব,’ বিরক্তির সাথে বলল রাশেদ।

‘শোন, কাল খুব ভোরে রওনা দেবো, লরেন্স বলল।’

‘তুমি ঘুমিয়ে পড়ো। আমি একটু ওদের সাথে সঙ্গ দেবো।’

রুম থেকে বেরিয়ে গেল লরেন্স। এই গরমে কিভাবে ঘুম আসবে বুঝতে পারছে না রাশেদ। জানালা দিয়ে এই সময় সুন্দর একটা বাতাস এলো। বাতাসটা শীতল। ছোট একটা বালিশ নিয়ে শুয়ে পড়ল রাশেদ। সকালে উঠতে হবে বলেছে লরেন্স। সেটা কতো সকাল, কে জানে?

সকালে ঘুম ভাঙল রাশেদের। ঘড়ি নেই হাতে। প্যান্টের পকেট থেকে মোবাইল ফোনটা বের করে সময় দেখল। ভোর ছটা বাজে। আসলে জানালা দিয়ে সূয্যের আলো সরাসরি মুখের উপর পড়াতে ঘুম ভেঙে গেছে। বিছানা ছেড়ে উঠে বাইরে এলো রাশেদ। পাশের রুমে লোকগুলো মেঝেতে শুয়ে আছে, এলোমেলো হয়ে। কার উপর কার পা কিংবা মাথা উঠে পড়েছে সে খেয়ালও নেই ওদের। লরেন্স নেই সেখানে। সম্ভবত মাইক্রোবাসে ঘুমাতে গেছে।

পুরো এলাকা আলোয় ঝলমল করছে। ছোট কাঠের বাড়িটা থেকে সামনের দিকে একটু এগিয়ে গেলেই পাহাড়ের চূড়া। সেখানে দাঁড়িয়ে সূর্যোদয় দেখতে পারলে ভালো হতো। একটা ঝোঁপের পাশে গিয়ে সকালের ভারমুক্ত হলো রাশেদ। ক্ষুধা পেয়েছে খুব। রুমে বেশ কয়েকটা পাকা কলা আছে। কিন্তু এখন আবার রুমে ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে না।

ঘুরে দাঁড়াতে গিয়ে অদ্ভুত একটা অনুভূতি হলো। মনে হলো আড়াল থেকে কেউ দেখছে তাকে। চারপাশে তাকাল রাশেদ। কেউ নেই। একটু দূরেই ঘন জঙ্গল। সেখানে কেউ লুকিয়ে থাকলে বোঝার কোন উপায় নেই। কিন্তু এই সাতসকালে সেখানে কারো থাকার কথা না।

হেঁটে নীচের দিকে নামতে থাকল রাশেদ। সমতল একটা জায়গার উপর মাইক্রোবাসটা রেখে উপরে উঠেছিল ওরা। লরেন্স নিশ্চয়ই সেখানে আছে। চারপাশে তাকাতে তাকাতে নীচে নামছে রাশেদ। অস্বস্তি লাগছে, মনে হচ্ছে কোথাও কোন ঝামেলা হয়েছে।

ঝামেলাটা কি এবার কিছুটা বুঝতে পারছে রাশেদ। মাইক্রোবাস যেখানে থাকার কথা সেখানে নেই। এমনকি আশপাশে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। শুকনো মাটিতে শুধু টায়ারের ছাপ। লরেন্স কি তাকে একা রেখে চলে গেল? নাকি আবার ফিরে আসবে? কিন্তু এভাবে না বলে লরেন্সের চলে যাবার কথা নয়। ব্যাপারটা আশ্চর্য্যজনক। এবার

সত্যিই মনে হচ্ছে পৃথিবীতে সে একা। উপর থেকে অনেকটা পথ নেমে এসেছে। রাশেদ। আরেকটু সামনে গেলেই রাস্তা। রাস্তাটা কোথায় গেছে সে সম্পর্কে কোন ধারনাই নেই। এই জায়গাটার নাম কি তাও জানার চেষ্টা করেনি সে লরেন্সের কাছ থেকে। এতোটা বিশ্বাস করা ঠিক হয়নি লরেন্সকে।

উপরে কাঠের বাড়িটার দিকে তাকাল। পাহাড়ি লোকগুলো ঘুম থেকে উঠেছে মনে হচ্ছে। কথাবার্তার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। লোকগুলো একেবারেই অচেনা, এদের সেভাবে বিশ্বাস করা যায় না। এখানে থাকাটা নিরাপদ হবে না, মনে মনে ভাবল রাশেদ। কিন্তু কোথায় যাবে? পুরো এলাকাটাই অপরিচিত। মনে মনে লরেন্সকে গালাগালি করছিল। এখন মাথা ঠান্ডা রেখে কাজ করতে হবে। হঠাৎ চোখে পড়ল পাহাড়ি লোকগুলোর মধ্যে দুই জন ঢাল বেয়ে নীচে নেমে আসছে। উদ্দেশ্য বোঝা যাচ্ছে না।

চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকার সিদ্ধান্ত নিলো রাশেদ। এই সময় মাইক্রোবাসের হর্ণের শব্দে ঘুরে তাকাল। দূরে মাইক্রোবাসটা দেখা যাচ্ছে। লরেন্স আছে সীটে। দেখে স্বস্তি লাগছে, মনে হচ্ছে বুকের উপর থেকে বড় একটা বোঝা নেমে গেছে।

পাহাড়ি লোক দু’জন নেমে এসেছে ইতিমধ্যে। এদের একজনের হাতে কলা, অন্যজনের হাতে পাউরুটি! হাসল রাশেদ। ওরাও হাসছে, না বুঝেই।

***

তেমন কিছুই সাথে আনতে পারেনি মালতী। যা পেরেছে নিয়েছে ছোট নৌকাটায়। এখানে আর থাকা যাবে না। পুরো গ্রামটা এখন খালি, কিন্তু লোকজন আবার ফিরে আসবে। হার্মাদদের পরাজয়ের কথা এখন আর গোপন নেই। আস্তে আস্তে লোকজন ফিরে আসলে তার সাথে শত্রুদের একজনকে দেখলে তাকে আস্ত রাখবে না গ্রামের লোক। বলা যায় ত্রিস্তানের জীবন বাঁচাতেই জন্মভূমি ছাড়তে হচ্ছে তাকে। এছাড়া ব্রাক্ষন পরিবারের মেয়ে হয়ে বিদেশি একজনকে বিয়ে করলে তাতে এমনিতেই সমাজচ্যুত করা হবে। তারচেয়ে ভিনদেশে গিয়ে অপরিচত মানুষের মতো থাকা অনেক ভালো।

এই কিছুদিনে ত্রিস্তানকে তার ভালো লেগে গেছে। এরকম একটা মানুষ একসময় ভয়ংকর একটা দলের সদস্য ছিল, হয়তো এর হাতেও অনেক সাধারন মানুষের রক্ত লেগে আছে। কিন্তু এখন লিস্তান ভিন্ন একজন মানুষ। অতীত জীবনের অনেক কথাই মনে করতে পারে না। শুরুতে ব্যাপারটা অস্বাভাবিক মনে হলেও পরে সত্যি মনে হয়েছে মালতীর কাছে। কেননা লোকটার হাতে যে জিনিসটা ছিল জ্ঞান ফিরে পাওয়ার পর তার কথা একবারও জিজ্ঞেস করেনি তার কাছে। একেবারে ভুলে গেছে।

ত্ৰিস্তান তাই নতুন একটা মানুষ মালতীর কাছে। একেবারে নিষ্পাপ, নিষ্কলঙ্ক, অতীতে যাই করে থাকুক না সেসবের কিছুই তাদের ভবিষ্যতকে নষ্ট করতে পারবে না। ত্রিস্তানের সাথে জীবনটা জড়িয়ে নিয়ে হয়তো কিছুটা ঝুঁকি নেয়া হয়ে গেছে, কিন্তু এছাড়া কিছু করার নেই মালতীর। রক্ত সম্পর্কে একমাত্র দাদা ছিল, যিনি মারা গেছেন গতকাল রাতে। মারা যাওয়ার আগে মালতাঁকে দিয়ে গেছেন তার সব সম্পদ। অনেকগুলো স্বর্ন আর রুপার মুদ্রা। কোথা থেকে পেয়েছে জিজ্ঞেস করার সময় পায়নি। তার দাদা বিভূতিভুষন চট্টোপাধ্যায় এখন মৃত। এই স্বর্ন আর রুপার মুদ্রা দিয়ে যে তাদের দুজনের অনেকদিন চলে যাবে এটা নিশ্চিত মালতী। নতুন জায়গায় নতুন করে জীবন শুরু করবে দুজনে।

ত্রিস্তানের কাছ থেকে পাওয়া চামড়ার খোপটা লুকিয়ে রেখেছে মালতী। এই চামড়ার খোপের ভেতর এমন কিছু আছে যা হয়তো ত্রিস্তানের জন্য ভালো হবে না। যে করেই হোক এটা ত্রিস্তানের হাতে পরতে দেবে না সে।

ঘোট নৌকাটা ধীর গতিতে এগিয়ে চলেছে। মাঝি বয়স্ক মানুষ, চুপচাপ দাঁড় বাইছে। বিষণ্ণ দৃষ্টিতে দিগন্তের পানে তাকিয়ে আছে ত্ৰিস্তান। দেখে মায়া লাগল মালতীর। এই বিষণ্ণতা সাময়িক, সামনে অবারিত নতুন এক জীবনের ডাক শুনতে পেয়েছে সে। যে জীবনের ডাকে সে এগিয়ে যাচ্ছে, সাথে থাকছে নীল চোখের আত্মবিস্মৃত এক ভিনদেশি যুবক, ত্ৰিস্তান।

*

ধ্যায় ৩৫

অনেকদিন এতোটা পথ একটানা হাঁটা হয়নি ড. আরেফিনের। হাঁপিয়ে গেছেন। এই শীতেও কপালে ঘাম জমেছে। সেই ভোরে উঠেছিলেন, তারপর এতোদূর এসেছেন হেঁটে। সঙ্গিদের অবস্থাও এক। ড. কারসনের চেহারা লাল হয়ে গেছে। প্রফেসর সুব্রামানিয়ামের অবস্থাও শোচনীয়। একমাত্র সুরেশ কিছুটা ভালো অবস্থায় আছে। বয়স কম, এছাড়া অভিজ্ঞতাও একটা বড় ব্যাপার।

ছোট যে বৌদ্ধ মন্দিরের কথা সুরেশ বলেছিল সেখানে চলে এসেছে দলটা। মন্দিরটা আসলেই ছোট। তবে অনেক পুরানো। সুরেশের কথামতো এই মন্দিরের বয়স একহাজার বছরের কম হবে না। কিন্তু এতোটা পুরানো মনে হয়নি ড. আরেফিনের কাছে।

মন্দিরের সিঁড়িতে বসে আছে সবাই। মন্দিরে উঠতে হলে জুতো খুলে ঢুকতে হবে। তাই ঢোকার আগে একটু বিশ্রাম নিয়ে নিচ্ছিল ড. কারসনের দলটা। সুরেশ একটু দূরে দাঁড়িয়ে মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক খোঁজার চেষ্টা করছিল।

চারপাশে শুধু বরফ, মাঝখানে ছোট এই মন্দিরটা। সাদার মাঝখানে কালো একটা ফুলকির মতো। মন্দির থেকে কিছুটা দূরে ঝাউ আর তারপর দেবদারুর সারি। বছরের এই সময়টায় বরফে ঢেকে থাকলেও গ্রীষ্মকালে পাহাড়ের চূড়া ছাড়া আর কোথাও বরফের চিহ্ন দেখা যায় না, তথ্যটা জেনে নিয়েছিলেন ড. আরেফিন।

নিজেদের মধ্যে টুকিটাকি কথা হচ্ছিল। ড. কারসন কিছুটা গম্ভীর সকাল থেকেই। প্রফেসর সুব্রামানিয়াম বিরক্ত, রামহরিকে সাথে আনার অনুমতি না দেয়ার জন্য। ড. আরেফিন স্বাভাবিক আছেন, যদিও সব কিছু কেমন যেন খাপছাড়া লাগছিল তার কাছে। ড. কারসন যেন নিজেকে আড়াল করে রেখেছেন দলটার কাছ থেকে। একটা প্রত্নতাত্ত্বিক দলের যেভাবে কাজ করা উচিত সেভাবে কিছুই এগুচ্ছে না। কায়িক পরিশ্রম মানে খোঁড়াখুঁড়ির জন্য ছোটখাট একটা দল নিয়ে আসা উচিত ছিল তাদের। যদি সত্যিই তিনি এখানে কোন খোঁড়াখুঁড়ি করতে চান। কিন্তু সেরকম কোন লক্ষন দেখা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে পুরো ব্যাপারটা এখনো তথ্য সংগ্রহের মধ্যেই সীমাবদ্ধ আছে।

প্রফেসর সুব্রামানিয়াম কফি ঢেলে দিচ্ছেন সবাইকে। রামহরি সকালে বানিয়ে একটা হটপটে দিয়ে দিয়েছিল। কফি খেয়ে কিছুটা চাঙ্গা বোধ করছেন ড. আরেফিন। ড. কারসনকেও কিছুটা স্বাভাবিক মনে হচ্ছে এখন।

মন্দিরের পুরোহিতকে দেখা গেল এই সময়। অতিথিদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন বৃদ্ধ। পরনে গেড়ুয়া, বয়স কমপক্ষে সত্ত্বর, আন্দাজ করলেন ড. আরেফিন।

‘স্বাগতম, নিঃখুত ইংরেজিতে বললেন পুরোহিত।’

‘ধন্যবাদ,’ বললেন ড. কারসন। ‘দুঃখিত, আপনাকে অসময়ে বিরক্ত করার জন্য।‘

‘ঠিক আছে,’ বললেন পুরোহিত। আসুন, ভেতরে আসুন।

জুতো খুলে মন্দির প্রবেশ করলেন তিনজন। চমৎকারভাবে সাজানো মন্দিরটা, মাঝখানে বেদী, সেখানে একটা বৌদ্ধমূর্তি শোভা পাচ্ছে।

পুরোহিত মেঝেতে বসে পড়েছেন। এক এক করে তিনজন বসলেন পাশাপাশি।

‘বলুন কিভাবে আপনার সহায়তা করতে পারি?’ হাসিমুখে বললেন পুরোহিত, ড. কারসনকে লক্ষ্য করে।

‘আসলে আমরা এসেছি একটা প্রত্নতাত্ত্বিক কাজে। এদিকে যাচ্ছিলাম তাই ভাবলাম একটু বিশ্রাম নিয়ে যাই,’ বললেন ড. কারসন, সহকর্মীদের দিকে তাকালেন।

‘ভালো করেছেন, এখানে তেমন কেউ আসে না, আমি একাই থাকি, গৌতম বুদ্ধের সেবা করি।’

‘আপনার কাছে একটা বিষয়ে জানার ছিল, একটু ইতস্তত করে বললেন ড. কারসন, ‘আপনি কি সাম্ভালা সম্পর্কে কিছু জানেন?’

‘সাম্ভালা সম্পর্কে আমরা সবাই জানি’, বললেন পুরোহিত, ‘গোপন, সুপ্ত একটা শহর। একমাত্র নির্বাণ পেলেই সেখানে যাওয়া সম্ভব।‘

‘কিন্তু আমি যতদূর জানি অনেকেই সেখানে গিয়েছেন আবার ফিরেও এসেছেন,’ বললেন ড. কারসন।

হতে পারে,’ বললেন পুরোহিত, ‘আমার জানা নেই।’

‘এই মন্দিরের সাথে সাম্ভালার কোন সম্পর্ক আছে?’ জিজ্ঞেস করলেন ড. কারসন।

‘আমি জানি না,’ বললেন পুরোহিত, উঠে দাঁড়ালেন। বোঝা যাচ্ছে বেশ অসন্তুষ্ট হয়েছেন। তার দেখাদেখি সবাই উঠে দাঁড়াল।

‘আপনি কি আমার কথায় আঘাত পেয়েছেন?’ বিব্রত স্বরে বললেন ড. কারসন, তাকে সত্যিই বিব্রত দেখাচ্ছে।

‘এখানে আঘাত পাওয়ার কিছু নেই, যা আমি জানি না সে সম্পর্কে কিছু বলতে পারবো না।‘

‘ঠিক আছে, আমরা তাহলে আসি।’

উত্তর দিলেন না পুরোহিত। মন্দিরের সিঁড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন অতিথিদের। তারপর আবার ভেতরে ঢুকে গেলেন।

মন্দিরের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে যে যার মতো জুতো পরে নিলেন। ড. কারসনকে বেশ হতাশ দেখাচ্ছে। প্রফেসরকেও। ড. আরেফিন চিন্তিত মুখে তাকিয়ে আছেন বাইরে খোলা প্রান্তরের দিকে, যেখানে শুধু বরফ আর বরফ।

‘চলুন, ফেরা যাক,’ বললেন প্রফেসর।

কাঁধে ব্যাগ চাপিয়ে ড. আরেফিনের দিকে তাকালেন ড. কারসন।

‘আপনি কিছু বলতে চান ড. আরেফিন?’ জিজ্ঞেস করলেন ড. কারসন।

‘আমার কেন যেন সন্দেহ হচ্ছে, লোকটা কিছু লুকোচ্ছে আমাদের কাছ থেকে,’ বললেন ড. আরেফিন।

‘এখানে সময় নষ্ট করার কোন মানে নেই,’ তাড়াহুরো করে বললেন প্রফেসর।

‘কি লুকাচ্ছে বলে মনে হয় আপনার কাছে?’ ড. কারসন জিজ্ঞেস করলেন।

‘সে কিছু না কিছু জানে। সেটা স্বীকার করতে চাইছে না আমাদের কাছে,’ বললেন ড. আরেফিন।’

‘সেক্ষেত্রে আমাদের কি করার আছে? প্রফেসর তাকিয়ে আছেন দুজনের দিকে, ‘আমরা তো উনার গলা টিপে ধরতে পারবো না।’

‘তা ঠিক,’ বললেন ড. কারসন। কিন্তু এভাবে হাল ছেড়ে দেয়াটা ঠিক হচ্ছে না, আমরা প্রয়োজনে আরেকবার আসবো।

‘আমারও মনে হয় সেটাই ভালো হবে,’ ড. আরেফিন বললেন, ‘এরমধ্যে সন্দীপ কিছু বের করতে পেরেছে কি না সেটাও দেখা দরকার।’

‘সন্দীপ? সে কি করবে?’ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন প্রফেসর।

‘কোড ভাঙতে দিয়েছি আমরা গতরাতে,’ ড. কারসন বললেন, আপনি এতো তাড়াতাড়ি ভুলে গেলেন!

‘স্যরি।’

হাঁটতে থাকলেন তিনজন। সুরেশ এসে যোগ দিল। সে এখনো মোবাইলে নেটওয়ার্ক খুঁজছে। বিরক্তির দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকালেন ড. কারসন।

‘সুরেশ, কাল আমার সাথে পাঁচজন লোক দেবেন, শ্রমিক। পারবেন না?’

দাঁত বের করে হাসল সুরেশ। ‘যা খুঁজছেন পেয়ে গেছেন তাহলে?’

‘সেটা জেনে আপনার কি দরকার। যা বললাম করবেন।‘

‘ঠিক আছে,’ বলে হাঁটতে থাকল সুরেশ। বুঝতে পারছে বেশি উৎসাহ দেখিয়ে ফেলেছে সে, যা ড. কারসনের পছন্দ হয়নি।

‘আপনার প্ল্যান কি ড. কারসন? এখনি শ্রমিক দিয়ে আমরা কি করবো?’ জিজ্ঞেস করলেন ড. আরেফিন।

‘একটা ধারনা পেয়ে গেছি। এখন সন্দীপের কাছ থেকে একটু তথ্য পেলেই কাজ শুরু করতে পারবো।‘

হাঁটতে থাকল ছোট দলটা। দূরে দেবদারু গাছের আড়াল থেকে কেউ একজন তাকিয়ে ছিল দলটার দিকে। দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে গেলে আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো লোকটা।

.

১৮৭০ খৃস্টাব্দ

খুব সকালে ঘুম ভেঙেছিল মিচনারের। এতোগুলো মানুষের হৈ চৈ চিৎকারে ঘুম ভাঙাটাই স্বাভাবিক। বড় একটা গাছের উপরের ডালে নিজের আস্তানায় বসে বিপদের গন্ধ টের পাচ্ছিল মিচনার। মাঝে মাঝে গুলির শব্দ ভেসে আসছিল। বোঝাই যাচ্ছিল উদ্দেশ্যহীন গুলি। নিজেকে আরো আড়াল করার জন্য আরো উপরের ডালে চলে গেল সে। এতো উপর থেকে নিচের কাউকে পরিস্কার দেখতে না পেলেও বুঝতে পারছিল আজ এই লোকগুলো সাধারন কোন কাজে আসেনি। এসেছে শিকার করতে। মানুষ শিকার। যদিও নিজেকে এখন মানুষ বলে পরিচয় দিতে ইচ্ছে হয় না মিচনারের।

কুকুরের ঘেউ ঘেউ শব্দ শুনে কিছুটা চিন্তায় পড়ে গেল মিচনার। কিছুদিন আগে যে সাদা চামড়ার লোকগুলোকে মেরেছিল এরা হয়তো তাদেরই সঙ্গিসাথি। হয়তো প্রতিশোধ নিতে এসেছে। ছোট এই দ্বীপটা ঘিরে এতোদিন যে অদ্ভুত উপকথা চালু হয়েছিল আশপাশের মানব বসতিতে সেখান থেকে খবর পেয়ে এসেছে এরা। খাকি পোশাক, মাথায় হ্যাট আর কাঁধে বন্দুক হাতে সাদা মানুষগুলোকে ইউরোপীয় মনে হচ্ছে, সম্ভবত ইতালিয়। আফ্রিকার কিছু অঞ্চল বিশেষ করে এই দ্বীপ সংলগ্ন ইরিত্রিয়া, ইথিওপিয়া এখন ইতালির দখলে। বাইরের পৃথিবী সম্পর্কে কোন খবর না রাখলেও নিজের আশপাশের এলাকার এই পরিবর্তনটুকুর খবর রেখেছে মিচনার। অনেকটা নিজের স্বার্থেই।

এই দ্বীপে তার সুখের দিন শেষ হয়েছে। এদের হাতে ধরা পড়লে রক্ষা নেই। চরম প্রতিশোধের নেশায় আজ কমপক্ষে পঞ্চাশ জন লোক এসেছে এখানে। দেখা মাত্র গুলিতে ঝাঁঝরা করে দেবে তাতে কোন সন্দেহ নেই।

দ্বীপের উল্টোদিকে যে এলাকা সেখানে কখনো যায়নি মিচনার। মাঝে মাঝে কিছু লোকের দেখা পেয়েছে। তবে ওরা আফ্রিকানদের মতো কালো নয়। বরং ওদের গায়ের রঙ কিছু কিছু ক্ষেত্রে ইউরোপীয়দের চেয়েও ফর্সা। সম্ভবত ওরা আরবীয়। ওদের কথা জাহাজে থাকতে শুনেছে মিচনার। খৃস্টানদের শত্রু এই আরব জাত। একসময় নাকি স্পেনও দখল করে নিয়েছিল।

নীচে তাকিয়ে লোকগুলোর অবস্থান দেখে নিল মিচনার। দু’একজন এখনো এলোপাথাড়ি গুলি ছুঁড়ছে। যে লোকগুলো মরেছে তারা সম্ভবত কেউকেটা ছিল, নইলে এতোগুলো লোক এভাবে ছুটে আসতো না। শুধু দু’একজন লোককে মারার জন্য সাধের এই জায়গা ছেড়ে সরে যেতে হবে ভেবে আফসোস হচ্ছিল মিচনারের। কিন্তু কিছু করার নেই। এখন কিভাবে পালানো যায় সে চিন্তা করতে হবে তাকে।

লোকগুলো সামনের দিকে যাচ্ছে, দেখল মিচনার। তারপর তরতর করে নেমে এলো গাছের গা বেয়ে। ভাগ্যভালো বাতাস উল্টোদিকে বইছে না, নইলে কুকুরগুলো এতোক্ষনে টের পেয়ে যেত। ছোটখাট একটা টিলার উপর দাঁড়িয়ে আছে মিচনার এখন, সামনে দিগন্ত বিস্তৃত সাগর। নীচে সাগরের ঢেউ টিলার গায়ে আছড়ে পড়ছে সবশক্তিতে। অল্পক্ষনের জন্য ফেনায় ঢেকে যাচ্ছে সব। তার ছোট ভেলাটা দ্বীপের অপর প্রান্তে। এই মুহূর্তে সেখানে যাওয়া প্রায় অসম্ভব। তবু যাবে কি না চিন্তা করতে করতেই শাঁ শাঁ শব্দে কানে তালা লেগে যাওয়ার উপায় হলো। অনুসন্ধানকারিরা তাকে দেখতে পেয়েছে এবং কেউ একজন গুলিও করেছে। ভেলার কাছে যাওয়ার চিন্তা বাদ দিয়ে সামনের দিকে তাকাল মিচনার। অন্তত ষাট ফুট নীচে সমুদ্রের পানি আছাড়ে পড়ছে টিলার পাথুরে দেয়ালটায়। সেখানে পড়লে হাড়গোড় কিছুই আস্ত থাকার কথা না। কিন্তু ওদের হাতে ধরা পড়লে চলবে না, তারচেয়ে ঝুঁকি নেয়া ভালো।

দম বন্ধ করে শরীর বাঁকা করে দাঁড়াল মিচনার। পুরো দ্বীপটার দিকে তাকাল একবার, এই দ্বীপটাতে অনেক শান্তিতে কেটে যাচ্ছিল দিনগুলো। কিন্তু এবার যাবার সময় এসেছে। ঝাঁপ দিলো মিচনার। দূর থেকে অনুসন্ধানকারিরা অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখল।

***

সামনে পাহাড়ি দুজন যাচ্ছে, মাঝখানে লরেন্স আর রাশেদ, পেছনে বাকি তিনজন পাহাড়ি। এই তিনজনের কাছে বেশ কিছু মালপত্র। ছোট একটা তাঁবু, সুটকেস আর রান্না করার সরঞ্জাম। দুপুর একটার মতো বাজে, ধারনা করলো রাশেদ। চারপাশে ঘন বন আর লম্বা লম্বা গাছের কারনে খুব বেশি রোদ ঢোকেনি বনে। ধীরে ধীরে উপরের দিকে যাচ্ছে ওরা। হাত লম্বা একটা বেত নিয়েছে রাশেদ, লরেন্স দিয়েছে। এই এলাকা নাকি সাপের অভয়ারন্য। সাপে খুব ভয় রাশেদের, দেখে শুনে পা ফেলছে।

হাঁটছে অনেকক্ষন হলো। টানা দুই ঘন্টা হেঁটে পা ব্যথা করছিল রাশেদের। এবার বিশ্রাম নেয়া দরকার। কিন্তু লরেন্সকে বলতে ইচ্ছে করছে না। গম্ভীর চেহারায় ক্রমাগত হেঁটে চলেছে লরেন্স। বোঝাই যাচ্ছে না এই লোকটাকে হোটেল রুমে অসুস্থ অবস্থায় পেয়েছিল সে আর রাজু। অদ্ভুত প্রানশক্তি লরেন্সের। নাকি গুপ্তধনের লোভ লোকটাকে এরকম বেপরোয়া করে তুলেছে?

ছোট সেই বাক্সটা এখন লরেন্সের কাছে। এরমধ্যে একবারও খুলে দেখেনি জিনিসটা লরেন্স। হয়তো খুলে দেখেছে যখন রাশেদ আশপাশে ছিল না। তা না হলে এতো নিশ্চিত হয়ে হাঁটতে পারতো না। মনে হচ্ছে ঠিক গন্তব্যের দিকেই এগুচ্ছে ওরা।

সামনে বন আরো ঘন হচ্ছে। ঘেমে গেছে রাশেদ। লরেন্সের দিকে তাকাল। চিন্তিত মুখে তাকিয়ে আছে সামনের দিকে। রাশেদের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলো এবার বিশ্রাম নেয়া দরকার। সামনের দুজনকে থামতে বলল লরেন্স।

মনে মনে লরেন্সকে ধন্যবাদ দিল রাশেদ। অনেক ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। পা দুটো আর চলতে চাচ্ছে না।

সামনের অল্প একটু জায়গা পরিস্কার করে নিয়ে বসে পড়েছে লরেন্স। রাশেদ গিয়ে বসল পাশে। পাহাড়ি লোকগুলোকে ইশারায় একটু দূরে গিয়ে দাঁড়াতে বলল লরেন্স।

‘আমরা কি কাছাকাছি চলে এসেছি? নীরবতা ভেঙে জিজ্ঞেস করল রাশেদ।’

‘এতো ব্যস্ত হচ্ছো কেন তুমি?’ কিছুটা বিরক্তির সাথে বলল লরেন্স।

‘দেখুন আপনার গুপ্তধনের অভিযানে কোন আগ্রহ নেই আমার, শুধু রাজুর জন্য এতোটা পথ এসেছি।‘

‘রাজুকে পাবে,’ লরেন্স বলল। তবে তার আগে একটু ধৈর্য ধরতেই হবে তোমাকে।’

‘ঠিক আছে,’ বলে চুপচাপ একটা সিগারেট ধরাল রাশেদ। ক্ষুধাও পেয়েছে যথেষ্ট। লরেন্স খাবার দাবার সাথে নিয়ে এসেছে কি না জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছে না।

‘তুমি কি আমার উপর রাগ করলে?’ লরেন্স জিজ্ঞস করল, গলার স্বর এখন কিছুটা নরম।

উত্তর না দিয়ে উঠে দাঁড়াল রাশেদ। চারপাশে তাকাল। চারপাশে শুধু গাছ আর গাছ, বাতাস বয়ে যাওয়ার মৃদু শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ নেই চারপাশে।

আবার বসে পড়ল রাশেদ।

‘আপনি ঐ বাক্সটা বের করুন,’ বলল রাশেদ, আপনি কি সত্যিই বিশ্বাস করেন গুপ্তধন আছে?

‘বিশ্বাস করি বলেই তো এতোদূর এসেছি,’ হাসল লরেন্স।

‘তাহলে আমাকে বিশ্বাস করান, আমার কাছে আজগুবি লাগে,’ রাশেদ বলল।

‘আমরা এখন বার্মার সীমানার কাছে, আরেকটু গেলেই বিশ্বাস হবে তোমার গুপ্তধন আছে কি না,’ লরেন্স বলল, উঠে দাঁড়িয়ে ইশারায় পাহাড়ি লোকগুলোকে তৈরি হতে বলল।

‘এক্ষুনি রওনা দেবো আমরা!’ বিস্মিত কণ্ঠে বলল রাশেদ।

‘হ্যাঁ, এক্ষুনি। সঞ্জয়ের চেলারা আশপাশে থাকতে পারে,’ চাপা গলায় বলল লরেন্স।

আর কথা বাড়াল রাশেদ। হাঁটতে থাকল। সামনে রাস্তা আরো কঠিন হয়ে আসছে। গাছগুলো যেন জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে আছে, কাউকে পথ দিতে চাইছে না।

এতোক্ষন আশপাশে কোন শব্দ ছিল না। হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেল লরেন্স, পাহাড়ি লোকগুলোও, যেন কোন শব্দ শুনতে পেয়েছে। রাশেদকে ইশারায় নীচু হতে বলল লরেন্স। রাশেদ যদিও কোন শব্দ শুনতে পায়নি,কিন্তু মনে হচ্ছে আশপাশে কেউ আছে।

নীচু হয়েই দূরে কয়েকটা ছায়া দেখতে পেল রাশেদ। অদ্ভুত পোশাক পড়া, এতো চমৎকার ক্যামোফ্লাজ পোশাক হতে পারে কল্পনাই করতে পারেনি। গাছের রঙের সাথে একদম মিলে যায়। সংখ্যায় আট-দশজনের কম হবে না। চারপাশ ঘিরে রেখেছে। ওদের।

সঞ্জয় নামে সত্যিই কেউ আছে কি না কেমন যেন সন্দেহ ছিল রাশেদের, কিন্তু ধীর পায়ে লরেন্সের সামনে যে লোকটা এসে দাঁড়িয়েছে সে লোকটাই যে সঞ্জয় তাতে কোন সন্দেহ নেই। বুকের উপর নেমপ্লেট লাগানো। কর্নেল সঞ্জয়! কোন আর্মির কর্নেল এই লোক!

*

অধ্যায় ৩৬

দুপুরের মধ্যে হোটেলে ফিরে এলো সবাই। ক্লান্ত সবাই, চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছিল। ড. কারসন বলে দিয়েছেন সন্ধ্যার পর তার রুমে যেতে। মাঝখানের সময়টা যে যার মতো কাটাতে পারে। হোটেল রুমের উতা ছাড়া আর কিছুই ঢুকছিল না ড. আরেফিনের মাথায়। প্রফেসর সুব্রামানিয়ামেরও একই অবস্থা। সুরেশের অবশ্য কোন সমস্যা নেই। সে আবার বাইরে চলে গেল তার কোন বন্ধুর সাথে দেখা করতে।

রুমে ফিরে হীটার চালু করে দিলেন ড. আরেফিন। সারাদিন পরিশ্রমে ঘাম হয়নি,কিন্তু মনে হচ্ছিল গোসল না করলে চলবে না। তাই কাপড়-চোপড় পাল্টে গরম শাওয়ার নিতে বাথরুমে ঢুকে পড়লেন। যখন বেরিয়ে এলেন দেখলেন সন্দীপ দাঁড়িয়ে

আছে রুমে। উত্তেজিত চেহারা। হাতে হলদে রঙের খামটা ধরে আছে।

‘স্যরি ড. আরেফিন, দরজা খোলা ছিল, নক না করেই ঢুকে পড়েছি,’ বলল সন্দীপ।

ইশারায় চেয়ারে বসতে বললেন ড. আরেফিন। পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করছেন। দরজা খোলা রেখে যাওয়ার মানুষ তিনি না। তবে ভুল হতেই পারে।

‘খুব উত্তেজিত দেখাচ্ছে আপনাকে মি. সন্দীপ,’ টাওয়ালে চুল মুছতে মুছতে বললেন ড. আরেফিন। নিজেকে শান্ত রেখেছেন। সন্দীপ কি বলতে এসেছে বুঝতে পারছেন না। তবে ব্যাপারটা ঐ হলদে খামের সাথে সম্পর্কিত।

‘এই খামের ভেতরের কাগজে যা আছে, তা হচ্ছে কোড। খুব সাধারন বাইনারি কোড। যদিও খুব সাধারন বাইনারি কোড, কিন্তু যে কেউ এটা ধরতে পারবে না,’ বলল সন্দীপ, ‘হলদে খামটা থেকে কাগজের মতো জিনিসটা বের করে টেবিলে বিছিয়ে দিল সাবধানে, দেখুন, এই খানে দেখুন–‘

‘আমার কথা শুনুন মি. সন্দীপ, কোড বিষয়ে আমার কোন ধারনাই নেই। আপনি ড. কারসনকে দেখান, কথার মাঝখানে থামিয়ে দিলেন ড. আরেফিন।

‘এখানেই আমার সমস্যা, কাগজটা খামে ঢুকিয়ে রাখল সন্দীপ সযত্নে। বিষয়টা ড. কারসনকে জানাতে চাচ্ছি না আমি।’

‘কেন? এই অভিযানের উনিই নেতা। এছাড়া এটা সংগ্রহও করেছেন তিনি। যা আমাদের সাম্ভালার দিকে নিয়ে যাবে।’

‘সে যাই হোক। এটা আমি উনার হাতে পরতে দেবো না।’

চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলেন ড. আরেফিন। কিভাবে সন্দীপকে বোঝাবেন চিন্তা করছেন। ড. কারসনকে নিয়ে এ ধরনের চিন্তাভাবনা সন্দীপের মাথায় কি করে এলো? সে কি ড. কারসনকে বিশ্বাস করছে না কোন কারনে? রাখেন, রামপ্রাসাদকে সঙ্গে নিয়ে। তারপর ভাষাটা চর্চা করার আর সুযোগ পাওয়া যায়নি। আজ অনেকদিন পর তিব্বতি ভাষায় কারো সাথে কথা বলার সুযোগ পেয়ে হাতছাড়া করা ঠিক হবে না বলে মনে হলো তাঁর। বাংলাদেশি লোকটা তাঁর দলবল নিয়ে চলে যাবার পর মন্দিরে প্রবেশ করেন তিনি।

পুরোহিত খুবই অবাক হয়েছে তাকে দেখে। এই সময় সাধারনত দর্শনার্থীর সংখ্যা থাকে একেবারে কম, তারমধ্যে একই দিনে বেশ কিছু মানুষ আসবে মন্দিরে এটা মোটামুটি অস্বাভাবিক ঘটনা তাঁর কাছে। অবাক হলেও অতিথিকে স্বাগত জানিয়েছেন পুরোহিত এবং অবাক হয়েছেন অতিথির মুখে অনেক আগেকার তিব্বতি ভাষা শুনে। ভাষা যুগে যুগে পরিবর্তনশীল। অতিথি যেভাবে কথা বলছে তাতে মনে হয় অনেককাল পুরানো তিব্বতি ভাষার চর্চা করেছে লোকটা। এই বিষয়টাই পুরোহিতকে আকর্ষন করেছে সবচেয়ে বেশি। দ্বিতীয় ব্যাপার হচ্ছে অতিথির চোখ, যেন অনেক কিছু দেখেছে, অনেক কিছু জানে। বহুদিন এই ধরনের মানুষ চোখে পড়ে না। তাই আনন্দিত হয়েই অতিথিকে মন্দিরের ভেতরে নিয়ে এসেছেন পুরোহিত।

খালি পায়ে পুরো মন্দিরটা হেঁটে দেখলেন তিনি। সাধারন একটা বৌদ্ধ মন্দিরের মতোই, তবে বিশেষত্ব হচ্ছে মন্দিরটা খুবই প্রাচীন। মন্দিরের মতো পুরোহিতও প্রাচীন একজন মানুষ। যদিও তাঁর তুলনায় কিছুই না।

মেঝেতে বসেছেন তিনি। সামনে পুরোহিত। গম্ভীর দৃহিতে তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে।

কোটের পকেট থেকে শেবারনের দেয়া চামড়ার খোপটা বের করলেন তিনি। লম্বাকৃতির খোপটা একদিক দিয়ে বের করে আনলেন জিনিসটা, চামড়ার তৈরি কিন্তু দেখতে অনেকটা কাগজের মতো। খুব সাবধানে বের করে আনলেন চামড়ার খোপের ভেতর থেকে। আস্তে করে ভাঁজ খুলে বিছিয়ে রাখলেন সামনে।

চোখ মুখ শক্ত হয়ে গেছে পুরোহিতের। অদ্ভুত কিছু দেখতে পেয়েছে যেন। বোঝাই যাচ্ছে বিশ্বাস হচ্ছে না বয়স্ক মানুষটার। কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলেন তিনি। লোকটার চেহারার আকস্মিক পরিবর্তন তার দৃষ্টি এড়ায়নি।

‘আপনি এটা কোথায় পেলেন?’ গম্ভীর কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন পুরোহিত।

‘এটা আমার কাছে আছে অনেক দিন ধরে, বললেন তিনি। আস্তে আস্তে পুরো কাগজটা ভাঁজ করে খোপে ঢুকিয়ে রাখলেন। খুব সাবধানে। একটু এদিক-সেদিন হলেই জিনিসটা না হয়ে যেতে পারে। তাহলে এতো পরিশ্রম সব মাটি হবে।

‘জানতে চাইছি জিনিসটা কোথায় পেলেন? চুরি করেছেন?’ চোয়াল চেপে প্রশ্ন করলেন পুরোহিত। বোঝা যাচ্ছে উত্তেজিত হয়ে উঠেছে লোকটা, কোনমতে নিয়ন্ত্রন করছে নিজেকে।

‘এ সম্পর্কে আপনি কি জানেন?’ উত্তর না দিয়ে পালটা প্রশ্ন করলেন তিনি।

‘আমি কিছু জানি না। শুধু এটুকু জানি, খুব গোপন কিছু লেখা আছে এতে। যার অর্থ বের করার সামর্থ্য আমার নেই। অন্য কারো আছে কি না তাও বলতে পারবো না। তবে এর কথা আমি শুনেছি, যদিও তখন অন্যান্য গল্পের মতোই মনে হতো।‘

‘অন্যান্য গল্প?’

‘আমাদের দেশ নিয়ে নানারকম গুজব, গল্পগাথা, মিথ ছড়িয়ে আছে। এই লেখার কথা আমি শুনেছি। আমার গুরুর কাছে, তিনি শুনেছেন তার পূর্বসুরির কাছে। এভাবে হয়তো আমাদের পরের প্রজন্মের পুরোহিতরাও একই গল্প শুনবে। শুনেছি এরকম একটা কাগজেই সাম্ভালার খোঁজ লেখা আছে। সেটা ছাড়া সাম্ভালার খোঁজ পাওয়া সম্ভব না। সেই কাগজটা আছে খে-লান ভাতৃ সম্প্রদায়ের সদস্যের কাছে, যাকে পেহ লিং বা সাদা লামা নামে ডাকা হতো। সেই জিনিস আপনার হাতে কি করে এলো? আপনি কি চুরি করেছেন? কিভাবে আপনার হাতে এলো এই গোপন সম্পদ?’

চুপচাপ কথাগুলো শুনছিলেন তিনি। কি উত্তর দেবেন বুঝতে পারছেন না। খে-লান ভাতৃসম্প্রদায় এখনো চালু আছে? জিজ্ঞেস করবেন কি না ভাবছেন তার আগেই উত্তর পেয়ে গেলেন।

‘তিব্বতিদের স্বর্নযুগ এখন আর নেই। নিজ দেশেই এখন আমরা পরবাসী। খে লান ভাতৃসম্প্রদায়ের কারো কথাও আমাদের জানা নেই। শুধু এটুকু জানি সাম্ভালার খোঁজ আছে সাদা লামা’র কাছে। শুনেছি লোকটা নামি অমর,’ বলতে বলতে মৃদু হাসলেন পুরোহিত।

‘আপনি কি অমরত্বে বিশ্বাস করেন না?’

‘করি। অবশ্যই করি। যেমন গৌতম বুদ্ধ এখনো বেঁচে আছেন আমাদের মাঝে। আমরা এমন অমরত্বই আশা করি। জাগতিক দেহ যুগ যুগ বয়ে বেড়ানোর কোন মানে নেই।’

‘হয়তো আপনার কথাই ঠিক, উঠে দাঁড়ালেন তিনি। কিন্তু পুরোহিত এখনো বসে আছেন। ইশারায় তাকে বসতে বললেন পুরোহিত। তিনি বসলেন।

‘আমাকে এই কাগজটা দেখানোর কারন কি জানতে পারি?’ পুরোহিত বললেন।

‘এখানে যা লেখা আছে তার অর্থ উদঘাটন করা আমার পক্ষে প্রায় অসম্ভব একটা কাজ। ভেবেছিলাম আপনার কাছে কোন সাহায্য পাওয়া যাবে কি না।

‘জানি না আপনাকে কিভাবে সাহায্য করবে। এই বিষয়ে মুখ খোলাও খুব কঠিন কাজ হয়ে যাবে। কেউ জানলে আপনার কাছ থেকে জিনিসটা ছিনিয়ে নিতে একবিন্দু দ্বিধা করবে না।‘

‘আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়াটা খুব সহজ হবে এটুকু বলতে পারি।’

‘আপনি আগামীকাল সকালে আসুন। আমি দেখি আজ চিন্তা করে কিছু করা যায় কি না।’

‘ঠিক আছে। এবার আমি আসতে পারি, হেসে বললেন তিনি।’

‘আসুন। তার আগে একটা কথা বলে যান, আপনি কি সেই পেহ লিং?’

‘ড. আরেফিন, সাম্ভালা কিংবা জ্ঞানগঞ্জ নিয়ে গবেষনা করতে তিনি আসেননি। তিনি এসেছেন ভিনগ্রহের প্রানীদের নিয়ে কাজ করতে।’

এবার হাসি চাপতে পারলেন না ড. আরেফিন।

‘আপনার কি মাথা খারাপ হয়েছে মি. সন্দীপ?’ হাসতে হাসতেই বললেন তিনি।

‘তিনি কখনো ভিনগ্রহের প্রানীদের নিয়ে গবেষনা করতে আসেননি। এটা নিশ্চিত করে বলতে পারি।’

‘কিভাবে এতোটা নিশ্চিত হলেন? আপনিও ঐ দলের লোক?’

‘কোন দল!’ অবাক হলেন ড. আরেফিন।

‘ড. কারসনের দল। তিনি আগে থেকেই আপনাকে আর প্রফেসরকে নিয়ে দল করেছেন, তাই আমাকে আজ সাথে নেননি।‘

‘আপনি মাথা ঠান্ডা করুন,’ ড. আরেফিন বললেন। ‘ঐ কাগজে কি পেয়েছেন?’

এই কোড হাজার বছর আগের কোন সাধারন মানুষের কাজ না। এটা ভিনগ্রহের প্রানীদের কাজ। ওরা এখানে একটা সিগন্যাল পাঠিয়েছে। যদিও সিগন্যালটা কি তাই ধরতে পারছি না আমি।

‘সাধারন কিছু আঁকাঝোকা হতে পারে,’ ড. আরেফিন বললেন, ‘ঐ সময়ের মানুষ অন্তত বাইনারি কোড ব্যবহার করতো না এটা আমি নিশ্চিত। অন্তত তিব্বত অঞ্চলে তো নয়ই।

‘আমার কি মনে হয় জানেন?’ ফিসফিস করে বলল সন্দীপ। চারপাশে তাকাল। কেউ নেই দেখে কিছুটা আশ্বস্ত হলো।

‘কি?’

‘সাম্ভালা আসলে ভিনগ্রহের প্রানীদের একটা শহর। সেখানে বসবাসকারীরা মানুষ। ওরা ভিনগ্রহের লোক।‘

‘অদ্ভুত! তেমন কোন প্রমান ছাড়া কিভাবে এমন ধারনা মাথায় আসে আপনার?’ এবার বিরক্ত না হয়ে পারলেন না ড. আরেফিন।

‘আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না এখন। কিন্তু বিশ্বাস করবেন একসময়,’ বলল সন্দীপ।

‘দেখা যাক, ড. আরেফিন বললেন, এ ব্যাপারে কারো সাথে আলোচনা করার দরকার নেই। এই রকম আজগুবি জিনিস শুনলে ড. কারসন এখনই সন্দীপকে কলকাতায় পাঠিয়ে দেবেন সন্দেহ নেই।

দরজায় নক পড়লো এই সময়। ড. আরেফিনের দিকে তাকাল সন্দীপ, তারপর এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলে দিল।

প্রফেসর দাঁড়িয়ে আছেন। সন্দীপকে দেখে থমকে গেছেন মনে হলো। উঠে গিয়ে প্রফেসরকে সম্ভাষন জানালেন ড. আরেফিন।

‘ভেতরে আসুন, প্রফেসর।‘

ইতস্তত করেও রুমে ঢুকলেন প্রফেসর। পেছনে তার সঙ্গি রামহরি।

‘আপনার সাথে একান্তে কিছু কথা ছিল ড. আরেফিন,’ যথাসম্ভব আস্তে বলার চেষ্টা করলেন প্রফেসর। যদিও কথাটা সন্দীপের কানে গেল, কিছু না বলে রুম থেকে বেরিয়ে গেল সে।

দুজনের এই বিরোধে বিরক্তি থাকলেও এখন মেজাজ খারাপ হয়ে গেল ড. আরেফিনের। ব্যক্তিগত রেষারেষিটাকেই দুজন বড় করে দেখছে।

‘বলুন, সন্দীপ চলে গেছেন,’ কিছুটা বিরক্তির সাথে বললেন ড. আরেফিন।

চেয়ারে আরাম করে বসলেন প্রফেসর। বোঝা যাচ্ছে সকালের হাঁটাহাঁটিতে ভালো পরিশ্রম হয়েছে ভদ্রলোকের।

‘আমার কেন জানি ভালো লাগছে না, শান্ত স্বরে বললেন প্রফেসর, কোথায় যেন খুব বেশি গোপনীয়তা আছে। আমরা সবকিছু ঠিকমতো জানি না। ড. কারসন আসলে কি করতে চাইছেন তা আমার কাছে পরিস্কার না।‘

‘এ ব্যাপারে আমিও আপনার সাথে একমত,’ বললেন ড. আরেফিন।

‘সন্দীপ কি বলতে এসেছিল? উৎসুকের মতো জানতে চাইলেন প্রফেসর।’

‘তেমন কিছু না।’

‘কোড ভাঙতে পেরেছে?’

‘কথা হয়নি,’ চেপে গেলেন ড. আরেফিন। সন্দীপ এতোক্ষন কি বলছিল তা প্রফেসরকে বলা ঠিক হবে না।

‘আমি জানতাম ও পারবে না। ওকে দিয়ে হবে না,’ ঝাঁঝের সাথে বললেন প্রফেসর।

‘ওর সাথে আপনার কোন সমস্যা আছে? মানে আগে কিছু ঘটেছিল।’

‘সে ব্যাপারে কথা না বলাই ভালো।’

‘ঠিক আছে, বলতে না চাইলে অসুবিধা নেই।’

‘তাহলে কি করতে চাইছেন?’ জিজ্ঞেস করলেন প্রফেসর।

‘আজ সন্ধ্যায় ড. কারসন আমাদের ডাকবেন, ড. আরেফিন বললেন, ‘তখনি সব পরিস্কার হয়ে যাবে।

‘ঠিক আছে। আমি যাই তাহলে। একটু ঘুমান দরকার।’

উঠে পড়লেন প্রফেসর, বেরিয়ে গেলেন রামহরিকে সাথে নিয়ে।

দরজা লক করে বিছানায় শুয়ে পড়লেন ড. আরেফিন। সন্দীপের বলে যাওয়া কথাগুলো মনে পড়ছিল, সাম্ভালা ভিনগ্রহের প্রাণীদের শহর! আজব!

***

অনেক আগে তিব্বতি ভাষা শেখার সুযোগ হয়েছিল, প্রথমবার যখন তিব্বতে পা

‘আমাকে দেখে কি তাই মনে হচ্ছে?’ বললেন তিনি। এখন তিনি অনেক তরুণ। এই চেহারার সাথে সেই পেহ লিঙের চেহারার যে বর্ননা এরা শুনেছে তার কোন মিল নেই।

‘আসলে আমি খুব দ্বিধায় পড়ে গেছি, সত্যি যদি আপনি পেহ লিং হোন তাহলে আপনাকে যথোপযুক্ত সম্মান আমি দেইনি।‘

‘সময়ে সব জানতে পারবেন এটুকু ভরসা দিতে পারি,’ বললেন তিনি। উঠে দাঁড়ালেন। আমার নাম লখানিয়া সিং। আপাতত এটুকু জানাই আপনার জন্য যথেষ্ট।

বয়স্ক পুরোহিত উঠে দাঁড়িয়েছেন। চেহারায় সেই গাম্ভীর্য এখন আর নেই। সেখানে এখন শ্রদ্ধা দেখতে পাচ্ছেন তিনি।

মন্দিরের বাইরে এসে তাকালেন চারদিকে। কাউকে দেখা যাচ্ছে না।

হাঁটতে হাঁটতে জ্যাকেটের ভেতরে সাবধানে ঢুকিয়ে রাখলেন চামড়ার খোপটা। কাল সকালে আবার আসতে হবে পুরোহিতের সাথে দেখা করার জন্য।

.

১৯১০ খৃস্টাব্দ

মৃত সাগর, কামরান, জর্দান।

অনেকগুলো দিন পার হয়ে গেছে সেই পাহাড়ের চূড়া থেকে ঝাঁপ দেবার পর। উত্তাল সমুদ্র পাড়ি দিয়ে কিছুদিন ইয়েমেনে কাটিয়েছে। এরপরের বেশিরভাগ সময় কেটেছে এখান থেকে সেখানে, লোকচক্ষুর আড়ালে থাকার জন্য সম্ভব সব চেষ্টা করেছে সে, তারপর ঠাই মিলেছে আরবীয় মরু ভূমিতে, মৃত সাগরের পাশে কিছু আদিম গুহাতে, যেখানে হাজার বছরে কারো পা পড়েনি।

উষর মরুতে দীর্ঘ একেকটা দিন কেটে যায়। জনপ্রানীর দেখা মেলে না একেবারেই। ছোট একটা গুহাকে নিজের থাকার উপযোগী করে নিয়েছে মিচনার। দিনে তীব্র গরম হলেও রাতে ঠিক একইভাবে শীতল হয়ে পড়ে জায়গাটা। তাই উতার প্রয়োজনে আগুনের ব্যবস্থাও করেছে গুহার এক কোনে। মরুভূমিতে লোকজন প্রায় আসে না বললেই চলে। মাঝে মাঝে দূর থেকে কাফেলা দেখা যায়। দীর্ঘ উটের পাল, পিঠে সাওয়ারি নিয়ে মরুভূমির বুক চিরে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে চলে যায়। মাঝে মাঝে খুব জানতে ইচ্ছে করে কি আছে এই মরুভূমির পর। এই ধুসর মরুভূমির মাঝে অদ্ভুত এক হ্রদ। সেখানে নেই কোন মাছ, পানি লবনের চাইতেও তিক্ত। গুহা থেকে মাঝে মাঝে বাইরে যায় মিচনার। হেঁটে আসে হ্রদের পাড় ঘেষে। প্রানের কোন চিহ্ন চোখে পড়ে না। তাই কোন কোন সময় শিকারের আশায় আরো দূরে চলে যায়। সেখানে মাঝে মাঝে মানুষের দেখা মেলে। শ্বেতকায় মানুষ, অদ্ভুত ভাষায় কথা বলে, কাছে যাওয়ার ইচ্ছে হয় কিন্তু কৌতূহলকে বাড়তে দেয় না মিচনার। গুহাতে অনেক শান্তিতে আছে সে। মানবসভ্যতা থেকে অনেক দূরে।।

মাঝে মাঝে বুকের ভেতর থেকে কে যেন ডাকে তাকে। বলে আরো দূরে কোথাও যেতে। কিন্তু ইচ্ছে করে না মিচনারের। কোথায় যাবে সে? এই কত বছরে পৃথিবী আরো অনেক বদলে গেছে। সেই পৃথিবীতে সে অচল। এছাড়া নিজেকে ইদানিং মানুষ ভাবতেও ভয় হয় তার। শরীর ঢাকার জন্য নুন্যতম যে পোশাক দরকার এখন তারও প্রয়োজনবোধ করে না সে। ক্ষুধা, তৃষ্ণা আর জৈবিক কিছু চাহিদার তাড়নায় বেঁচে আছে সে। কিন্তু এইভাবে বেঁচে থাকা কি অর্থহীন নয়? মাঝে মাঝেই নিজেকে প্রশ্নটা করে। এক অদ্ভুত অভিশাপ যেন তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে তাকে।

বিকেলেই গুহায় ফিরে এসেছে মিচনার। বাইরে আবহাওয়ার অবস্থা ভালো না। যে কোন সময় ধুলোঝড়ে সব ঢেকে যাবে। তাই আগেভাগেই গুহায় ফিরে এসেছে।

সন্ধ্যার পরপর ধুলোঝড় শুরু হলো। গুহার মুখে হেলান দিয়ে বসে দেখছিল মিচনার। উপভোগ করছিল বলা যায়। কারন গুহার মুখটা এমনভাবে বানানো বাইরে ঝড়-তুফান যাই হোক না কেন ভেতরে তার আঁচ পর্যন্ত আসে না। এই ধরনের গুহা এখানে অনেকগুলো আছে। ছোট ছোট গুহা, মনে হয় যেন মানুষের হাতে বানানো। প্রাকৃতিকভাবে এতো চমৎকারভাবে গুহা তৈরি হয় বলে বিশ্বাস হয় না তার। কিন্তু এই মৃত এলাকায় এসে গুহা বানিয়ে যাবে এমন দায় পড়েছে কার!

দূরে ছোটখাট একটা কাফেলা চোখে পড়ল এই সময়। চার-পাঁচটা উট দাঁড়িয়ে আছে বালিয়াড়ির মাথায়। সওয়ারি আছে কি না বোঝা যাচ্ছে না। থাকলেও হয়তো ঝড়ের কবলে পড়ে ছিটকে পড়েছে। উটের মাংস খেতে খারাপ লাগবে না বলে মনে হলো। এছাড়া আগুনে পুড়ে খেতে পারলে তো আরো মজা, ভাবছিল মিচনার। ছোট একটা পাথরের টুকরো ঘষে ছুরি বানিয়ে নিয়েছিল। জিনিসটা তার অনেক কাজে লাগে। আজো কাজে লাগবে। তবে ঝড় থামার পর কাজে নামতে হবে।

ঝড় থামার জন্য অপেক্ষা করতে করতে একসময় ক্লান্ত হয়ে পড়ল মিচনার। ঘুমিয়ে পড়ল।

*

অধ্যায় ৩৭

গভীর জঙ্গলের মাঝে ছোটখাট একটা এলাকা নিজের মতো করে সাজিয়ে নিয়েছে শয়তানটা। জায়গাটা বাংলাদেশ আর বার্মার সীমান্তের কাছাকাছি। চাইলে যেকোন সময় দুই দেশের যেকোনটাতে যাওয়া যায়। চারপাশের গাছপালার মাঝখানে কিছুটা জায়গা পরিস্কার করে কাটা, সেখানে সারি করে ছোট ছোট মাটির কিছু ঘর। বিদ্যুতের ব্যবস্থা নেই তাই ব্যাটারী দিয়ে আলোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। ছোট ঘরগুলোতে সঞ্জয়ের সাঙ্গপাঙ্গরা থাকে। বেশিরভাগই অবাঙ্গালী, সম্ভবত বার্মিজ রোহিঙ্গা।

মাঝখানের ঘরটা বড়। সঞ্জয় এখানেই থাকে। তার রুমে অত্যাধুনিক সব সরঞ্জাম। রেডিও, টেলিভিশন থেকে শুরু করে স্যাটেলাইট ফোন সবই আছে। এক কোনায় চেয়ারের সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে রাশেদ আর লরেন্সকে। সঙ্গি পাহাড়ি লোকগুলো হয়তো অন্য জায়গায়, ধারনা করলো রাশেদ। সন্ধ্যা হয়ে গেছে অনেকক্ষন আগে। এতোক্ষন পেটে কিছু পড়েনি,পেট তাই মোচড় দিয়ে উঠছে। জীবন নিয়ে এখান থেকে ফিরে যেতে পারবে কি না এ ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। রাজুকেও এরা আটকে রেখেছে। সম্ভবত অন্য কোন ঘরে।

সঞ্জয় ঘরে নেই। বাইরে কোথাও গেছে। ঘরের দরজায় আধুনিক অটোমেটিক মেশিনগান নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দু’জন প্রহরী। কড়া দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে যেন একটু এদিক-সেদিক হলেই গুলি করবে। এমনভাবে বেঁধেছে ঘাড় ঘুরিয়ে লরেন্সের দিকে তাকাবে এমন অবস্থা নেই। মুখের উপর একধরনের টেপ মেরেছে। কোনমতে নিঃশ্বাস নিতে পারছে রাশেদ।

ঘুম চলে আসছিল, কোনমতে চোখ খোলা রেখেছে রাশেদ। যেকোন সময় সঞ্জয় আসতে পারে। এই লোকটার ব্যাপারে তেমন কিছু জানা হয়নি লরেন্সের কাছ থেকে। তবে লোকটা যে হিংস্র তা পরিস্কার বোঝা যায় চেহারা দেখেই। কালো কুচকুচে গায়ের রঙ, কুতকুতে চোখ। ঘাড়ের উপর মাথাটা ছোট, চুল ছোট করে ছাটা। লম্বায় ছ’ফিট চার ইঞ্চির মতো হবে। মাংসল শরীর, বোঝা যায় শরীরের যথেষ্ট যত্ন করে। এই শরীরে রাশেদের মতো একজনকে অনায়াসে পিষে মারতে পারবে সঞ্জয়। যদিও এখনই কারো চাপে পিষে মরার মতো ইচ্ছে নেই রাশেদের।

সঞ্জয় আর তার চেপেলা অস্ত্র-মাদকের ব্যবসা করে তা বোঝাই যায়। এখানে আসার পথ এর কিছু নমুনা চোখে পড়েছে। এমন একটা এলাকা বেছে নিয়েছ যেখান থেকে বার্মা, বাংলাদেশ আর ভারতে নিশ্চিন্তে অস্ত্র, মাদক চোরাচালান করা যাবে। তবে লোকটা কেন কর্নেল সঞ্জয় নামের নেমপ্লেট পড়ে থাকে তা বুঝতে পারেনি রাশেদ।

কিছুক্ষনের মধ্যেই সঞ্জয় ঢুকলো। পেছনে দুজন দেহরক্ষী। মাঝখানে সুন্দর এক সেট সোফা পাতা। সেখানে গিয়ে বসল সঞ্জয়। তাকিয়ে আছে রাশেদের দিকে। দেহরক্ষীদের একজনকে ইশারা করলো। সে এসে রাশেদের মুখ থেকে টেপ টেনে তুলে নিল। ব্যথায় প্রায় চেঁচিয়ে উঠছিল রাশেদ, নিজেকে কোনমতে সামলে নিলো।

‘অ্যাই, তুই ঐ শালার সাথে কতোদিন আছিস?’ দাঁতে দাঁত চেপে জিজ্ঞেস করল সঞ্জয়।

কি উত্তর দেবে বুঝতে পারছে না রাশেদ।’

‘কি রে কথা কানে যায় না?’ আবারও খেঁকিয়ে উঠল সঞ্জয়।’

‘বেশিদিন না।’

‘আমাকে চিনিস তুই?’

‘না।’

‘আমার হাতে মরতে চলেছিস, যমকে না চিনলে হবে?

চুপ করে তাকিয়ে রইল রাশেদ। মরতে চলেছে সে? এতো তাড়াতাড়ি? বিশ্বাস হচ্ছে না। আবার অবিশ্বাস করারও কিছু নেই। মানুষ মেরে সঞ্জয়ের অভ্যাস হয়ে গেছে। হয়তো। হাত একটুও কাঁপবে না।

‘কি রে উত্তর দিচ্ছিস না কেন?’

নিরুত্তর রাশেদ।

উঠে দাঁড়িয়েছে সঞ্জয়, কোমরে গোঁজা পিস্তলটা বের করে হাতে নিয়েছে। আস্তে আস্তে এগুচ্ছে রাশেদের দিকে। চোখ বন্ধ করে বসে আছে রাশেদ। বুঝতে পারছে যে কোন সময় আঘাত হানবে সঞ্জয়। মাথা কেমন ঝিমঝিম করছে। হাত ঘেমে যাচ্ছে। এই সময় কপালে পিস্তলের শীতল নলটা অনুভব করলো রাশেদ।

***

ঠিক ছ’টায় ঘুম ভাঙল ড. আরেফিনের। উঠেই তৈরি হয়ে নিলেন। সাড়ে ছ’টায় ড. কারসনের রুমে যাওয়ার কথা। মাথাটা ভারভার লাগছিল। যাওয়ার আগে এক কাপ কফি খেয়ে নিলে মন্দ হতো না। চাইলে রুম সার্ভিসকে বললে হয় কিন্তু ইচ্ছে করছে না এখন। নীচে হোটেলের ক্যাফেটেরিয়াতে ভালো কফি বানায়। সেখানে বসে খেয়ে নেয়া যাবে, সাথে একটু হাঁটাও হবে। রুম লক করে বেরিয়ে এলেন ড. আরেফিন।

ক্যাফেটেরিয়ার লোকজন খুব কম। খুব বেশি বাতি জ্বলছে না। ড. আরেফিন যেখানে বসেছেন সেদিকটা প্রায় ফাঁকাই। তাই সেই শধারী তার নজর এড়াল না। ক্যাফেতে ঢোকার মুখেই একটা টেবিলে বসে আছে। দামী জ্যাকেট পরনে, মাথায় মাংকি ক্যাপ। এই লোকটাকে এর আগেও দেখেছেন ড. আরেফিন। মনে হচ্ছে সেই দিল্লি থেকে এই লোকটাই অনুসরন করে আসছে।

কফির অর্ডার দিয়ে চুপচাপ বসে আছেন ড. আরেফিন। কাউকে নিয়ে আসতে পারলে ভালো লাগতো। কিন্তু প্রফেসর সুব্রামানিয়াম কিংবা সন্দীপ কাউকেই ডাকতে ইচ্ছে করলো না।

শশ্রুধারী লোকটা একদৃষ্টিতে তার দিকেই তাকিয়ে আছে বুঝতে পারছেন ড. আরেফিন। কফির অর্ডার দেয়া হয়ে গেছে, এখন উঠে গেলে খারাপ দেখাবে। তাই কফি শেষ না করা পর্যন্ত চুপচাপ বসে থাকার সিদ্ধান্ত নিলেন।

ক্যাফেতে হাল্কা একটা সুর বাজছে। মন দিয়ে শোনার চেষ্টা করছেন ড. আরেফিন, কিন্তু মন বসছে না। বারবার আড়চোখে তাকাচ্ছেন ঐ লোকটার দিকে, অনেকটা নিজের অজান্তেই। তারপর চোখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। কি উদ্দেশ্য পিছু নিয়েছে বুঝতে পারলে ভালো হতো। হয়তো ড. কারসন জানেন। ব্যাপারটাকে তেমন একটা গুরুত্ব দেননি ভদ্রলোক।

হাতে মোবাইল ফোনটা নিয়ে নাড়াচড়া করছিলেন, হঠাৎ সুরেশকে ঢুকতে দেখলেন ক্যাফেতে। শধারী লোকটার সাথে ইশারায় কিছু একটা বুঝিয়ে ড. আরেফিনের দিকে এলো লোকটা।

‘কি ব্যাপার স্যার, একা একা বসে আছেন?’ সুরেশ বলল সামনে এসে।

‘এমনিই, আপনি বসুন।’

‘না, বসবো না। কফি খেতে ভালো লাগে না।’

‘আচ্ছা।’

‘বাকি সবাই কোথায়?’

‘বলতে পারছি না। তবে রুমেই তো থাকার কথা।’

‘সন্দীপ মশাইকে বাইরে যেতে দেখলাম। খুব তাড়াহুড়া করছিলেন।’

‘তাই? কখন?’

‘এই তো, একটু আগে।

হাত ঘড়িতে সময় দেখে নিলেন ড. আরেফিন। সোয়া ছ’টা বাজে। আর পনেরো মিনিট পর ড. কারসনের রুমে মিটিং। এই সময় সন্দীপ কোথায় যাবে?

‘কিছু মনে করবেন না স্যার। উনার গতিবিধি আমার কাছে সন্দেহজনক মনে হয়েছে,’ হাত কচলাতে কচলাতে বলল সুরেশ।

তোমার গতিবিধিও সন্দেহজনক, মনে মনে বললেন ড. আরেফিন। সন্দীপের মোবাইল ফোনে কল করলেন। বন্ধ।

কফি দিতে এতো সময় লাগাবে বুঝতে পারলে কখনোই আসতেন না। মেজাজ খারাপ হয়ে গেছে ড. আরেফিনের।

‘আপনি বাইরে গিয়ে দেখুন কোথায় গেছে? আশপাশে থাকতে পারে।’

‘ঠিক আছে, আমি আসি,’ বলে চলে গেল সুরেশ।

সুরেশ যাওয়ার একটু পর শশ্রুধারীও বের হতে যাচ্ছিল, টেবিলে বসে লক্ষ্য করছিলেন ড. আরেফিন। কিন্তু যেতে পারলো না। গেট দিয়ে একজন ঢুকেছে। বেশ লম্বা, সুদর্শন এক তরুণ। হাত ধরে আটকেছে শধারীকে। যেখানে বসেছিল সেখানে বসার ইশারা দিতে শশ্রুধারী বসে পড়ল। অবাক হয়ে দেখছিলেন ড. আরেফিন। এই তরুণকে এতো ভয় পাচ্ছে কেন শত্রুধারী লোকটা? ওর বস নাকি? নাকি অন্য কোন ব্যাপার?

কফি দিয়ে গেল এই সময়। ব্ল্যাক কফি। বেশ গরম, ধোয়া উঠছে। কফিতে চুমুক দিয়ে দুজনের দিকে তাকিয়ে আছেন তিনি। ওরা কথা বলছে। তবে খুবই নীচু গলায়। তরুণ যে শধারীকে শাসাচ্ছে এটা দূর থেকেই বোঝা যাচ্ছে।

এখানে আর সময় নষ্ট করা ঠিক হবে না। মিটিং-এ যেতে হবে। আজকে ড. কারসনের সাথে সব পরিস্কার করে নিতে হবে। উনি কি করতে চান, কিভাবে করতে চান, সব জানতে হবে।

ক্যাফে থেকে বেরিয়ে এলেন তিনি। তরুণ ছেলেটার দিকে তাকালেন একঝলক। মুখটা খুব চেনা চেনা মনে হলো। রাশেদের সাথে চেহারার আদল অনেকটা মিলে যায়। মৃদু হাসিটাও ঠিক রাশেদের মতো। অনেকদিন ছেলেটার খবর নেয়া হয় না। এবার দেশে গিয়ে খবর নিতে হবে, মনে মনে ঠিক করে রাখলেন ড. আরেফিন।

***

সঞ্জয় লোকটা চামারের মতো। নিজের লাভ ছাড়া কিছুই বোঝে না। যে দলটার নেতৃত্ব একসময় ছিল লরেন্সের হাতে আস্তে আস্তে তা নিজের হাতে নিয়ে নেয়। তার ক্রুরতা, নিষ্ঠুরতার কাছে লরেন্স কিছুই না। তাই একসময় যাকে আশ্রয় দিয়েছিল সেই সঞ্জয়ের কাছেই এখন বন্দী লরেন্স। বিএসএফ এর কর্নেল ছিল সঞ্জয়, কিন্তু চোরাচালানী আর মাদক ব্যবসায়ীদের সঙ্গ দেয়ার কারনে তাকে কোর্ট মার্শালে পাঠানোর কথা ছিল। সেই সময় লরেন্স উদ্ধার করে এনেছিল তাকে। বান্দরবানের পাহাড়ি এলাকায় আশ্রয় দিয়েছিল, নিজের ব্যবসায় সঙ্গি করে নিয়েছিল। কিন্তু সঞ্জয়ের মতো লোককে বিশ্বাস করা ঠিক হয়নি এটা হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছে এখন। সঞ্জয় নিজের দলকে আরো দূর্ধষ করে তুলেছে এরমধ্যে। লরেন্স এখন শুধু গলার কাটা, যেটা সরিয়ে দিতে পারলে স্বস্তিবোধ করবে সঞ্জয়। তাই করা হতো, কিন্তু যখনই কানে এসেছে লরেন্সের পূর্বপুরুষের লুকানো সম্পদের কথা তখন এই সরিয়ে দেয়ার ব্যাপারটা কিছুটা পিছিয়ে দিয়েছে সঞ্জয়।

রাশেদ দাঁড়িয়ে আছে, বিস্ময় এখনো কাটেনি তার। কিছুক্ষন আগেই তার কপালে পিস্তল ঠেকিয়েছিল সঞ্জয়। সেটা যে শুধু ভয় দেখানোর জন্য বুঝতে পারেনি রাশেদ। লরেন্সের কাছ থেকে ছোট বাক্সটা কেড়ে নিয়েছে সঞ্জয়। সেটা এখন রাশেদের হাতে। তাকে এভাবে মুক্তি দেয়ার কারন বুঝতে পারছে রাশেদ। এই পার্চমেন্টে কি লেখা আছে তা কোনভাবেই বের করতে পারবে না সঞ্জয়। তার সাহায্য দরকার। সেই সাহায্য একমাত্র হয়তো রাশেদই করতে পারবে।

রুম থেকে সবাইকে চলে যাওয়ার জন্য ইশারা করল সঞ্জয়। সোফায় আরাম করে বসে চুরুট ধরালো। কাঠের বাক্সটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রাশেদ। ইশারায় উল্টোদিকের সোফায় বসতে বলল সঞ্জয়।

‘তোকে কেন রেহাই দিয়েছি বুঝতে পারছিস?’ জিজ্ঞেস করল সঞ্জয়, চুরুটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে।

‘বুঝতে পেরেছি,’ রাশেদ বলল। ‘কিন্তু আমার একটা শর্ত আছে?’

চারদিক কাঁপিয়ে হেসে উঠল সঞ্জয়, যেন খুব মজা পেয়েছে রাশেদের কথায়।

‘তোর জান এখন আমার হাতে। আর আমাকেই তুই শর্ত দিচ্ছিস?

‘জানের পরোয়া করি না। কিন্তু আপনার কাজ করতে হলে আমার শর্ত মানতে হবে।

‘যদি না মানি?’

না মানলে কিছু করার নেই,’ একগুয়ের মতো বলল রাশেদ।’

‘আচ্ছা, তোর শর্ত বল।’

‘রাজুকে ছেড়ে দিতে হবে?’

‘ছেড়ে দেবো?’

‘হ্যাঁ, সরাসরি ঢাকা পাঠানোর ব্যবস্থা করে দিতে হবে।‘

কিছুক্ষন চিন্তা করল সঞ্জয়।

‘রাজুকে ছাড়বো। তবে ঢাকায় পাঠাবো না। তোর সাথেই থাকবে, তুই কাজ উদ্ধার করে দিবি, দুজনকে একসাথে ছেড়ে দেব।’

‘আপনি যে কথা রাখবেন তার নিশ্চয়তা কি?’

‘আমি কর্নেল সঞ্জয় সিং। কথা দিলে কথা রাখি, নিশ্চয়তা আর কি চাই তোর?’

‘লরেন্সের কি হবে?’ জিজ্ঞেস করল রাশেদ।

‘চোপ শালা!’ চেঁচিয়ে উঠলো সঞ্জয়। ঐ শালাকে নিয়ে কি করবো সেটা আমার ব্যাপার। তুই মাথা গলালে মাথাটাই কেটে ফেলবো।

চুপচাপ চারপাশে তাকাল রাশেদ। একটু দূরেই বসে আছে লরেন্স। চেয়ারের সাথে হাত-পা বাঁধা অবস্থায়। মুখে টেপ লাগানো, বেশ অসহায় দেখাচ্ছে। এই লোকটাই কিছুদিন আগে রাশেদ আর রাজুকে উদ্ধার করেছিল। কিন্তু সঞ্জয়ের রাগ দেখে বোঝা যাচ্ছে এখান থেকে লরেন্সকে জীবিত বের করা কঠিন হবে।

‘ঠিক আছে, বাদ দিলাম। তাহলে কাল থেকেই কাজে নেমে পড়ছি,’ রাশেদ বলল।

‘আরেকটা কথা,’ চুরুট নেভাল সঞ্জয়, রাশেদের দিকে তাকাল, ‘আমাকে বোকা বানানোর কোন চো করলে ফল ভালো হবে না।‘

‘ঠিক আছে, মনে থাকবে।’

সঞ্জয়ের ইশারায় দুজন দেহরক্ষী এসে দাঁড়াল রাশেদের দু’পাশে। সম্ভবত অন্য কোন রুমে নিয়ে যাবে তাকে। দেহরক্ষীদের সাথে বাইরে বেরিয়ে এলো রাশেদ। জোছনা রাত বনের মধ্যে অদ্ভুত এক মায়াবি পরিবেশের সৃষ্টি করেছে। মাঝখানের ছোট একটা মাটির ঘরে ঢোকানো হলো রাশেদকে। চমৎকার রুমটা। একপাশে পরিপাটি বিছানা, মশারি টানানো। সরাসরি বিছানায় চলে গেল রাশেদ। ছোট কাঠের বাক্সটা বিছানার একপাশে রাখল। রুমে বাতি জ্বলছে। আজ ঘুমানো চলবে না। পার্চমেন্টে কি লেখা আছে তা বের করতে হবে। তা না হলে সঞ্জয় কাউকে ফিরে যেতে দেবে না এখন থেকে।

*

অধ্যায় ৩৮

আজকের মিটিংটা অন্যরকম। সবাইকে কেমন বিষণ্ণ দেখাচ্ছে। ড. কারসন সবসময় ভালো মুডে থাকার চেষ্টা করেন, যদিও আজ সেই চেষ্টাটা সফল হচ্ছে না। মাঝখানে বসে আছেন তিনি। দুইপাশে ড. আরেফিন এবং প্রফেসর সুব্রামানিয়াম। একটু দূরে বসে আছে সন্দীপ। তাকে উদাসীন দেখাচ্ছে। যেন এই মিটিংটা তার কাছে খুবই অপ্রয়োজনীয়। দরজার বাইরে রাখা হয়েছে রামহরিকে। আচমকা কেউ যেন রুমে ঢুকতে না পারে। ভালো হোটেলগুলোতে এমনিতেই বেয়ারারা দরজায় নক না করে ঢোকে না। কিন্তু সাবধানতা হিসেবে রামহরিকে বাইরে রেখেছেন প্রফেসর সুব্রামানিয়াম।

সন্ধ্যা হয়ে গেছে অনেকক্ষন হলো। ড. আরেফিন কফি খেয়ে এসেছেন। বাকিরাও হয়তো যে যার মতো নাস্তা সেরে নিয়েছে। ড. কারসনের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে এখন সবাই। তাদের এই অভিযান আসলে কোন দিকে এগুচ্ছে, সত্যিই কোন দিকে এগুচ্ছে কি না, এটাই জানতে চাচ্ছেন ড. আরেফিন। প্রফেসর সুব্রামানিয়ামেরও একই মত। সন্দীপের ভাবসাব বুঝতে পারছেন না ড. আরেফিন। লোকটা অদ্ভুত চিন্তা করছে। এমনও হতে পারে শেষে হয়তো সন্দীপের ধারনাই ঠিক প্রমানিত হবে। কিন্তু এই ধরনের চিন্তাকে আপাতত প্রশ্রয় দেয়ার কোন যুক্তি দেখছেন না তিনি।

গলা খাঁকারি দিয়ে সবার দিকে তাকালেন ড. কারসন। তিনি এখন কথা শুরু করবেন। সন্দীপের মনোযোগ আকর্ষনের জন্য তাকালেন, যদিও সন্দীপ তাকিয়ে আছে জানালার দিকে।

‘সন্দীপ, আপনি কি কিছু নিয়ে চিন্তিত?’ জিজ্ঞেস করলেন ড. কারসন।

‘না, চিন্তিত নই, নিরস গলায় উত্তর দিল সন্দীপ।’

‘ভালো, তাহলে আমি যা বলছি মনোযোগ দিয়ে শুনবেন।‘

মাথা নাড়াল সন্দীপ।

‘আমরা হয়তো সাম্ভালার খুব কাছাকাছি চলে এসেছি, অথবা এখনো সাম্ভালা আমাদের কাছ থেকে অনেক দূরে। সত্যিই জায়গাটার অস্তিত্ব আছে কি না তা নিয়ে সন্দেহ থাকলেও মন্দিরের ঐ পুরোহিত আর সন্দীপের কাছে দেয়া তিব্বতি কোড থেকে মনে হচ্ছে সাম্ভালা আছে,’ ড. কারসন বলছেন। কথা বলতে বলতে তাকাচ্ছেন সবার দিকে, সবার মনোভাব বুঝতে চাইছেন।

‘সাম্ভালা অভিযানের খুবই প্রাথমিক পর্যায়ে আছি আমরা। মাত্র তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ চলছে। এতে শিগগিরি এই অভিযানের ফলাফল আশা করা ঠিক হবে না, এই বিষয়ে আপনার মতামত শুনতে চাই প্রফেসর?’ প্রফেসরের দিকে তাকিয়ে বললেন ড. কারসন।  

একটু নড়ে বসলেন প্রফেসর সুব্রামানিয়াম। অপ্রস্তুত অবস্থাটা কাটিয়ে নিলেন অল্পক্ষনেই।

‘আমার মতামত খুবই পরিস্কার। আমরা অনেকদূর এসেছি, সেই দিল্লি থেকে ধর্মশালা, কিন্তু কেন জানি মনে হচ্ছে, আমাদের কাজকর্মে খুব বেশি পরিকল্পনার ছাপ দেখা যাচ্ছে না। এলোমেলোভাবে কাজ করছি মনে হচ্ছে,’ শেষের কথাগুলো বলে ড. আরেফিনের দিকে তাকালেন প্রফেসর, অনেকটা সমর্থনের আশায়।

‘ঠিক আছে, আপনার কোন পরামর্শ থাকলে বলুন?’

‘আসলে ঠিক কিভাবে এগুলে সফল হবে তার একটা পরিকল্পনা করতে হবে আমাদের। আমরা শুধু আপনাকে অনুসরন করছি, জানি না ঠিক কিভাবে আপনি এগুতে চাচ্ছেন।’

‘ধন্যবাদ প্রফেসর। ড. আরেফিন কিছু বলবেন এ বিষয়ে?’

‘আমারও একই মত। অনেক কিছুই আমাদের কাছে পরিস্কার না। আমরা শুধু আপনাকে ফলো করছি। যেমন সেই মন্দির থেকে কোডের পার্চমেন্টটা নিয়ে এলেন, অথচ এ বিষয়ে আগে থেকে কিছু জানতাম না আমরা। সকালে এক মন্দিরে গেলাম, সে বিষয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত আমাদের কিছু জানানো হয়নি। আগামীকাল আমাদের প্ল্যান কি তাও পরিস্কার না।‘

‘আচ্ছা, এবার সন্দীপ, আপনি বলুন?’

‘সাম্ভালা আছে। তিব্বতের আশপাশেই আছে। তবে তা খোঁজার জন্য যে চোখ লাগবে, তা আপনার নেই ড. কারসন,’ বেশ কৌতুকের সাথে বলল সন্দীপ।

‘বুঝলাম না।’

‘দেখুন, সাম্ভালার অবস্থান শুরু থেকেই আমরা জানি তিব্বতে, কৈলাস এবং মানস সরোবরের আশপাশের কোন এলাকায়। অথচ আমরা এসে বসে আছি ধর্মশালায়। এখানে কি আছে? পালিয়ে আসা তিব্বতিদের এই রাজধানীতে আছে কিছু মন্দির, লাইব্রেরি আর কিছু বুড়ো পুরোহিত।‘

‘এক বুড়ো পুরোহিতই কিন্তু আমাকে ঐ কোডের কাগজটা দিয়েছেন।’

‘তা দিয়েছেন, কিন্তু…’

‘কিন্তু কোডটা উনারা ভাঙতে পারেননি,’ কথাটা শেষ করে দিলেন ড. কারসন।

‘এই কোড ভাঙা কঠিন, অন্তত মন্দিরের এইসব বুড়োদের কাজ নয় সেটা। আমি কোডের অর্থ অনেকটা বের করতে পেরেছি বলা যায়। আপনি হয়তো অবিশ্বাস করবেন, যেমন করেছেন ড. আরেফিন। আমার বিশ্বাস সাম্ভালা একটা স্পেসশিপ। ভিনগ্রহের প্রানীদের। যারা এই স্পেসশিপে পৃথিবীতে এসেছিল তারপর আর ফিরে যায়নি। হিমালয়ের কোলে কোন এক এলাকায় লুকিয়ে আছে। পৃথিবীর যারা সেই স্পেসশিপে গেছে তারা আর ফিরে আসেনি। সেখানে অদ্ভুত এক পরিবেশ তৈরির মাধ্যমে মানুষগুলো অমরত্ব পেয়েছে, জীবনের মানে খুঁজে পেয়েছে। সেই ভিনগ্রহের প্রানীরা আমাদের মধ্যেই থাকে। যাদের উপযুক্ত মনে করে তাদের সন্ধান দেয় সাম্ভালার।‘

‘আপনি এসব কি বলছেন?’ বললেন ড. কারসন। উঠে দাঁড়ালেন।’

‘কিসের উপর ভিত্তি করে বলছেন এসব?

‘যে কোডটা আপনি আমাকে দিয়েছেন সেই কোড দেখে বলছি।’

‘আমাকে ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দিতে হবে, কোড ব্রেকিং-এ আমার দক্ষতা শুন্যের কোঠায়, আমি শুধু সাধারন কিছু জিনিস জানি, বেশি কিছু না।

‘রুমে যেতে হবে আমাকে, আপনারা বসুন,’ বলে উঠে দাঁড়াল সন্দীপ, তারপর বেরিয়ে গেল রুম থেকে।

ড. কারসন তাকালেন বাকি দুজনের দিকে। রুমে নীরবতা নেমে এসেছে। সন্দীপ কি দেখাতে চায় তার জন্য অপেক্ষা করছে সবাই।

***

বিনোদকে সাথে নিয়ে বাইরে চলে এসেছেন তিনি। হোটেলের বাইরে এখন ভিড় কম। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। চাইলে ক্যাফেতে বসেই শায়েস্তা করতে পারতেন বিনোদকে। কিন্তু লোকজনের দৃষ্টি আকর্ষনের কোন ইচ্ছে তার নেই। বিনোদ ভেবেছিল নকল চুল আর দাড়ি লাগালেই হয়তো কেউ তাকে চিনতে পারবে না। ধারনা যে একবারে ভুল তা হাতে নাতে প্রমান পেয়েছে বেচারা।

রাস্তায় হাঁটছেন তিনি, একহাত দিয়ে বিনোদের একটা হাত ধরে রেখেছেন। দু’একবার চেষ্টা করেছে বিনোদ হাত ছোটাতে, পারেনি। উলটো আরো শক্ত হয়েছে হাতের বাঁধন। দূর থেকে কেউ দেখলে ভাববে অন্তরঙ্গ দুজন মানুষ হাত ধরাধরি করে হাঁটছে।

‘মি. বিনোদ, আপনার উদ্দেশ্য কি? ওদের পিছু নিয়েছেন কেন? প্রশ্ন করলেন তিনি হাঁটতে হাঁটতে।

‘একই প্রশ্ন আপনাকে করতে পারি আমি। আপনিই বা কেন ওদের রক্ষাকর্তার ভূমিকা নিচ্ছেন?’ চাপা গলায় বলল বিনোদ চোপড়া। বোঝা যাচ্ছে নিজেকে অনেক কষ্টে সংযত রেখেছে সে।’

‘প্রশ্নের উত্তরে প্রশ্ন করা ঠিক নয়, মি. বিনোদ,’ বললেন তিনি, ‘চলুন, আমার রুমে চলুন।

উত্তর দিলো না বিনোদ। বুঝতে পারছে এই লোকটার হাত থেকে খুব সহজে তার মুক্তি নেই।

.

১৯৩০ খৃস্টাব্দ

হিন্দুকুশ পর্বতমালা, আফগানিস্তান সীমান্ত।

গত কয়েকবছরে অনেকবার স্থান পরিবর্তন করতে হয়েছে তাকে। কোথাও একনাগাড়ে বেশিদিন থাকার মতো পরিস্থিতি নেই। পৃথিবীতে লোকসংখ্যা বাড়ছে। একেবারে গহীন অরন্য বা ধু ধু মরুভূমি ছাড়া প্রতিটি জায়গায় মানুষ বসতি গড়ে তুলেছে। মানুষের উপস্থিতি ভালো লাগে না মিচনারের কাছে। কেমন এক আদিম হিংস্রতা নিজের ভেতর অনুভব করে সে। আসলে নিজেকে এখন মনে হয় হিংস্র এক পশু অথবা মানবরুপী এক দানব।

সেই জাহাজ ডুবির সালটা তার মনে আছে। তারপর কতো বছর পার হয়েছে সে সম্পর্কে কোন ধারনাই নেই। তবে বিজ্ঞানের নিত্যনতুন আবিষ্কার তার চোখ এড়ায়নি। আকাশে একধরনের যন্ত্রকে উড়তে দেখে প্রথমে ভয় পেলেও পরে বুঝতে পেরেছে এটা মানুষেরই আবিষ্কার, সমুদ্রে চোখে পড়েছে পালতোলা জাহাজের বদলে বিশালকায় সব জাহাজ, যেখানে বড় বড় চিমনী দিয়ে গলগল করে ধোঁয়া বের হয়। মানুষের জীবনযাত্রায় হয়তো এমন অনেক পরিবর্তন এসেছে। যদিও এই সমাজ থেকে অনেক দূরে থাকার কারনে এই পরিবর্তনগুলো তার চোখে পড়েনি।

গত কয়েক বছর আগে এই এলাকায় এসে আস্তানা গড়েছে মিচনার। চারপাশে শুধু পাহাড় আর পাহাড়। এই পাহাড়গুলোর চূড়োয় বরফের টুপি। দেখতে খুবই ভালো লাগে। পাহাড়ের ঢালজুড়ে একটানা দেবদারু আর পাইন গাছের সারি। নিজের থাকার জন্য পাহাড়ের ঢাল কেটে ছোট একটা গুহা বানিয়ে নিয়েছে মিচনার। খুব কাছে না এলে এর অস্তিত্ব বোঝা অসম্ভব। পাহাড়ি ভালুকগুলো মাঝে মাঝে গুহার কাছাকাছি চলে আসে। কিছুদিন আগে বড় এক ভালুকের সাথে একেবারে হাতাহাতি অবস্থা। বোকা প্রানীটা হয়তো বুঝতেও পারেনি খালি হাতে একটা মানুষ তাকে মেরে ফেলতে পারবে। সামান্য এসব ঝামেলা ছাড়া জীবন এখানে অনেক আনন্দময়। সারাদিন বনে-জঙ্গলে পাহাড়ে পাহাড়ে ঘোরে মিচনার, তারপর সন্ধ্যায় ফিরে আসে গুহায়। সে সময় তার হাতে থাকে মেরে আনা খরগোশ অথবা হরিন। আগুন জ্বেলে মাংস পুড়িয়ে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে মিচনার। মাঝে মাঝে কোন এক পাহাড় চূড়ায় দাঁড়িয়ে পুরো এলাকাটা দেখে নেয়। দূরে মানুষের আনাগোনা চোখে পড়ে। পাহাড়ের গা কেটে সরু পথ একেবেকে চলে গেছে অনেক দূরে। যতোদূর দেখা যায় এই পথ চোখে পড়ে। সেখানে মাঝে মাঝে দেখা যায় সারি বেঁধে চলছে মানুষ। গাঁধা-ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে, সাথে আরো নানা সরঞ্জাম। এতোটুকু বুঝতে পারে মিচনার এরা ব্যবসায়ী। দেশ থেকে দেশে ব্যবসা করার উদ্দেশ্যে এই দুর্গম পথ দিয়ে যায় ওরা। এই এলাকা ছেড়ে অন্য কোথাও যেতে হলে এই পথ ছাড়া কোন উপায় নেই।

বিকেলের দিকে পুরো এলাকাটা শীতল হয়ে আসে। গুহায় ফেরার তাড়া অনুভব করে মিচনার। যেকোন সময় তুষার ঝড় শুরু হতে পারে। কিন্তু এখন যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখান থেকে গুহা অনেক দূর। এর মধ্যেই ঠান্ডা হাওয়া বইতে শুরু করেছে। খুব বেশি চিন্তা করার সময় নেই। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল মিচনার। আবার সময় হয়েছে অন্য কোথাও যাবার।

একটু দূরে পাহাড়ের ঢালে তাঁবু খাঁটিয়েছে ব্যবসায়ীর দল। আজ রাতে ওরা এখানেই থাকবে। দলটা ছোটখাট। বয়স্ক চারজন, বাকিরা অল্পবয়েসি তরুণ, চেহারায় ভারতীয় ছাপ আছে।

সন্ধ্যার পর নীচে নেমে এলো মিচনার। ঝোঁপের আড়ালে লুকিয়ে তাকিয়ে আছে। তাঁবুগুলোর দিকে। লোকগুলো আগুন জ্বালিয়েছে, তাঁবুতে ঢোকার আগে খেয়ে নিচ্ছে। বাতাসের বেগ বেড়েছে এরমধ্যে। আগুন জ্বালিয়ে রাখতে বেগ পেতে হচ্ছে লোকগুলোকে।

ঝোপের আড়ালে পরিস্কার একটা জায়গা দেখে নিয়ে একটা গাছের গোড়ায় হেলান দিয়ে বসল মিচনার। ঝড়ো বাতাস মাথার উপর দিয়ে চলে যাচ্ছে। একটু দূরের ব্যবসায়ী মানুষগুলোকে শীতে কাঁপতে দেখল সে। তার নিজের খালি গা, প্রচন্ড শীতেও তার মাঝে কোন প্রভাব পড়ে না। তাকে এই অবস্থায় দেখলে লোকগুলো দারুন অবাক হবে।

সকালে এরা যখন বের হবে তখন এদের পিছু নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে মিচনার। ঝড়ের প্রকোপ বাড়েনি বরং আস্তে আস্তে স্তিমিত হচ্ছে। আরামের একটা ঘুম হবে আজ।

*

অধ্যায় ৩৯

ঘুম আসছিল না রাশেদের। পার্চমেন্ট কাগজটা সামনে নিয়ে বসে আছে সে, মশারির নীচে। বড় বড় মশা ভনভন করছে, বের হলেই যেন সব রক্ত শুষে নেবে। বারোটার দিকে মনে হলো শুধু শুধু সময় নষ্ট হচ্ছে। পার্চমেন্টে লেখা হিজিবিজি লেখাগুলোর মানে বের করতে তার দরকার লাইব্রেরী অথবা ইন্টারনেট সংযোগসহ একটা ল্যাপটপ। লাইব্রেরী এখানে অসম্ভব ব্যাপার হলেও ল্যাপটপ হয়তো পাওয়া যাবে।

মশারি থেকে বেরিয়ে এলো রাশেদ। ঘরটার সামনে দুজন পাহারাদার দাঁড়িয়ে আছে, ওদেরকে পাঠাতে হবে সঞ্জয়ের কাছে। ঘরের দরজায় নক করলো রাশেদ, দরজাটা বাইরে থেকে আটকানো।

একটু পর দরজা খুলল একজন, হাতে অটোমেটিক রাইফেল তাক করা, যে কোন মূহূর্তে গুলি করার জন্য তৈরি।

‘আমার একটা ল্যাপটপ দরকার, সাথে ইন্টারনেট কানেকশন,’ বলল রাশেদ।

‘এতো রাতে ল্যাপটপ কোথায় পাবো?’ বিরক্তির সাথে বলল লোকটা।

‘সঞ্জয়কে বললেই হবে, ল্যাপটপ আর ইন্টারনেট না হলে কাজ এগুবে না।’

‘ঠিক আছে, দেখছি,’ বলে দরজা বন্ধ করে চলে গেল পাহারাদার।

বিছানার ভেতরে চলে এলো রাশেদ। কিছু একটা ব্যবস্থা হবে নিশ্চয়ই। ল্যাপটপ আর ইন্টারনেট সংযোগ পেলেই যে সব বের করা যাবে তা নিশ্চিত না। কিন্তু চেষ্টা অন্তত করা যাবে।

বসে থাকতে থাকতে বিরক্ত লাগছিল রাশেদের। এখানেই কোথাও রাজু আছে। সকালে জানতে হবে। এতোদিনে বাঁচিয়ে রেখেছে কি না কে জানে।

বেশিক্ষন অপেক্ষা করতে হলো না রাশেদকে। দরজা খুলে গেল, পাহারাদার লোকটাকে দেখা গেল একহাতে ল্যাপটপ আর অন্য হাতে অটোমেটিক রাইফেল নিয়ে। ল্যাপটপ নিয়ে বিছানায় চলে এলো রাশেদ, পেনড্রাইভ আকৃতির ছোট একটা মডেমও আছে সাথে। এই পাহাড়ি এলাকায় ইন্টারনেট সংযোগ পেয়ে কিছুটা অবাক লাগছে।

পার্চমেন্টটা ছড়িয়ে বসে কাজ শুরু করলো রাশেদ। এই কাজের উপর নির্ভর করছে মুক্তি।

***

একটু আগে রুমে যে প্রেজেন্টেশন দিলো সন্দীপ তাতে রীতিমতো চিন্তিত ড. আরেফিন। এভাবে ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তা করা যায় তা ভাবেননি তিনি। এর আগে লোকটার কথা হেসেই উড়িয়ে দিয়েছিলেন, এখন মনে হচ্ছে সেখানে কিছু সত্যতা থাকলেও থাকতে পারে। প্রফেসর সুব্রামানিয়ামের দিকে তাকালেন তিনি। ভু কুঁচকে বসে আছেন ভদ্রলোক। সন্দীপের কোন কিছুই তার পছন্দ না, কিন্তু একটু আগে যেসব যুক্তি সন্দীপ দিয়েছে তা এখন হয়তো একেবারে ফেলে দিতে পারছেন না। সবাই তাকিয়ে আছে ড. কারসনের দিকে, এমনকি সন্দীপও। পুরো সময়টা তিনি নীরব ছিলেন, এখন তার কথার উপর নির্ভর করছে অনেক কিছু।

‘ড. কারসন, আপনার মন্তব্য শুনতে চাচ্ছি?’ মৃদু গলায় বললেন ড. আরেফিন।

উঠে দাঁড়ালেন ড. কারসন, কথা শুরু করার আগে কিভাবে বলবেন তাই হয়তো ঠিক করে নিচ্ছেন। বিজয়ীর ভঙ্গিতে এককোনায় গিয়ে বসেছে সন্দীপ, যেন আর কিছু শোনার প্রয়োজন নেই তার, যা বলার বলে দিয়েছে সে।

‘তাহলে এবার আমার পালা,’ বললেন ড. কারসন, পুরো পৃথিবীতে ভিনগ্রহের প্রানী বা এলিয়েন নিয়ে হাজাররকম কথা শোনা যায়, নানা রকম মিথও তৈরি হয়েছে। বিভিন্ন অঞ্চলে, সাম্ভালাও কি তেমন একটা মিথ, যেখানে একটা বড় ভূমিকা রয়েছে ভিনগ্রহবাসীর?

সবার উদ্দেশ্যে প্রশ্নটা করলেন ড. কারসন, কিন্তু উত্তরের অপেক্ষা করলেন না, বলে চলেছেন তিনি, ‘আমাদের বিজ্ঞ সহকারী বেশ কিছু ডট আর তীর চিহ্নকে ভিনগ্রহবাসীদের কোড বলে প্রমান করেছেন, প্রমান করেছেন সাম্ভালা এলিয়েনদের শহর। তাহলে আমার প্রশ্ন হলো, এই ভিনগ্রহের প্রানীরা কেন সাম্ভালাতেই নিজেদের আটকে রেখেছে? কেন তারা বাইরে আসে না? এর উত্তর কি দেবেন মি. সন্দীপ আমি জানি। তিনি বলবেন, বাইরে আসার প্রয়োজন নেই তাদের। লুকিয়ে থাকতেই তারা বেশি স্বছন্দ্যবোধ করে, ইত্যাদি ইত্যাদি, একটু দম নিলেন ড. কারসন। মি. সন্দীপের সাথে আমি কোন তর্কে যেতে চাই না। আমি জানি সাম্ভালা আছে এবং সেটা ভিনগ্রহবাসীদের তৈরি নয়, সেখানে কোন ভিনগ্রহবাসী থাকেও না। যে কাগজটা দেয়া হয়েছে সন্দীপের কাছে সেটা এখানকার এক পুরোহিতের কাছে পেয়েছি আমি। আপনাদের অনেকেরই জানা নেই, তিব্বতে জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা হয়ে আসছে। অনেককাল আগে থেকেই। স্থাপত্য বিদ্যা এবং কোডিং-এ তারা মিশরীয়দের চেয়ে কোন অংশে পিছিয়ে ছিল না। সাম্ভালা তৈরির পর তার হদিস রয়ে গেছে শুধু মাত্র কয়েকটি নথিতে। তার মধ্যে উল্লেখ্যযোগ নথিটা আমি হাতে পাইনি এখনো। আমাদের হাতে যে কোডসমৃদ্ধ পার্চমেন্টটা আছে সেখানে সাম্ভালার অবস্থান দেখানো হয়েছে। সন্দীপ চক্রবর্তী পুরো কোডটাকেই উলটো করে ভেঙেছেন। সাম্ভালা আকাশে ভাসমান অবস্থায় নেই, সাম্ভালার অবস্থান মাটিতেই, হয়তো কোন পাহাড়ের আড়ালে পড়ে আছে, যেখানে এখনো মানুষের পা পড়েনি,এমনও হতে পারে এর অবস্থান মাটির তলায়। বিশেষ একটা সুড়ঙ্গ পথে যেতে হয় সেখানে।

এক গ্লাস পানি টেনে নিলেন ড. কারসন। এবার আসল কথায় আসি, আমি এখানে এসেছিলাম শুধু কিছু তথ্য যোগাড়ের আশায়। সেই তথ্য যোগাড় হয়েছে। কিছুটা। সন্দীপের কোড ভাঙাকে অন্যভাবে সাজাতে হবে আমাদের। প্রজেক্টরটা চালু করুন প্লিজ।

উঠে গিয়ে প্রজেক্টরটা চালু করল সন্দীপ, তাকে কিছুটা বিষণ্ণ মনে হচ্ছে।

‘সন্দীপের দেখানো সূত্র ধরেই যদি আমরা এগুই তাহলে দেখা যাবে ‘shamvala’ শব্দটার বাইনারি রুপ হবে অনেকটা এরকম…’

বড় একটা সাদা কাগজে লিখলেন ড. কারসন : ০১১১০০১১০১১০১০০০০১১০০০০১০১১০১১০১০১১১০১১০০১১০০০০ ১০১১০১১০০০১১০০০০১

‘বাইনারি কোড সম্পর্কে আপনাদের আমি জ্ঞান দিতে যাবো না, এ সম্পর্কে আপনারা সবাই মোটামুটি জানেন এবং শুধু বলে রাখি এর উৎপত্তি এই ভারত উপমহাদেশে, কাজেই সেই সময় কোন তিব্বতি যদি এই কোড প্রয়োগ করে থাকে। তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। এটা যে ভিনগ্রহবাসিদেরই কাজ তা নিশ্চিত করে বলা যাবে না। তবে এখানে উল্লেখকরার মতো ব্যাপার হচ্ছে তারা শুন্য আর এক এর বদলে অন্য আরো কিছু চিহ্ন ব্যবহার করেছে যা অনেকটা বাইনারি কোডের মতোই মনে হচ্ছে। কিন্তু সত্যিকারের বাইনারি কোড এটা নয়। কারন এক আর শুন্য ছাড়াও পার্চমেন্টে আরো কিছু চিহ্ন আছে যা মি. সন্দীপ হয় এড়িয়ে গেছেন অথবা মানে বুঝতে পারেননি।‘

আবার থামলেন ড. কারসন, হেঁটে জানালার দিকে গেলেন, কিছু একটা ভাবছেন মনোযোগ দিয়ে, তারপর আবার ফিরে এলেন আগের জায়গায়, কিন্তু সন্দীপ যে চিহ্নগুলোকে বাইনারি কোডে ভেঙেছে সেখানে আরো বেশি মনোযোগ দিতে হবে। কারন যে সময়ে এই কোডটাকে সাজানো হয়েছে তখনকার পরিস্থিতির সাথে এখনকার অবস্থার আকাশ-পাতাল পার্থক্য।

কথা বলতে বলতে হাঁটছেন ড. কারসন, এছাড়া সবচেয়ে বড় যে ব্যাপার আমাদের চোখ এড়িয়ে গেছে তা হচ্ছে এই পার্চমেন্ট কাগজের বয়স। ঠিক কতো বছর আগে এটা লেখা হয়েছিল তা জানতে পারলে অনেক কাজই সহজ হয়ে যাবে। অথচ ঠিক এই বিষয়গুলো এড়িয়ে সন্দীপসাহেব শুধুমাত্র ভিনগ্রহবাসীদের সব কৃতিত্ব দিয়ে দিচ্ছিলেন। আপনার কিছু বলার আছে মি. সন্দীপ?

সবাই ঘুরে তাকিয়েছে সন্দীপের দিকে। কিছুটা দ্বিধায় ভুগছে সন্দীপ, মনে হচ্ছে ড. কারসনের কথায় সে পুরোপুরি সন্তুষ্ট না আবার নিজের মতের পক্ষেও তেমন জোরালো কিছু খুঁজে পাচ্ছে না।

‘দেখা যাচ্ছে মি. সন্দীপের আর বলার কিছু নেই। এখানকার কাজ শেষ হয়েছে আমাদের। এবার যেতে হবে তিব্বতে। আপনাদের সবার ভিসা নেয়া আছে, সুরেশ কাজ সেরে রেখেছে। আগামীকাল খুব ভোরে উঠে রওনা দিতে হবে। সুরেশ আমাদের সাথে সীমান্ত পর্যন্ত যাবে, তারপর বাকিটা আমাদের নিজেদের ব্যবস্থা করে নিতে হবে। আশা করি কোন সমস্যা হবে না, সেখানে একজন তিব্বতি গাইড তৈরি থাকবে আমাদের জন্য। কারো কোন প্রশ্ন?’

ড. আরেফিনের দিকে তাকালেন কারসন, এরপর প্রফেসর সুব্রামানিয়াম এবং সন্দীপের দিকে। কেউ কিছু বলল না দেখে, নীরবতাকে সম্মতি বলে ধরে নিলেন তিনি।

‘ঠিক আছে, ডিনারের খুব বেশি দেরি নেই, মিটিং আজকের মতো এখানেই সমাপ্ত,’ বললেন ড. কারসন, প্রজেক্টর মেশিনটা বন্ধ করে দিলেন। সন্দীপ উঠে গিয়ে নিজের ল্যাপটপটা গুছিয়ে নিলো।

মনের মধ্যে কি একটা প্রশ্ন খচখচ করছিল, মনে করতে পারলেন না ড. আরেফিন। বের হয়ে এলেন রুম থেকে। ডিনারে যাবার সময় হয়ে গেছে, কিন্তু আজ ক্ষুধা পায়নি। রুমে ফিরে ঘুমিয়ে পড়বেন বলে ঠিক করলেন।

***

যজ্ঞেশ্বরের সাথে বিনোদ চোপড়াকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। এই শীতেও যজ্ঞেশ্বরের পরনে পাতলা একটা চাদর, বিনোদকে রীতিমতো অতিথির মতো বসিয়েছে রুমে। ওদের রুমে রেখে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছেন তিনি। ভাবছেন তিনি, বিনোদ চোপড়াকে রুমে বেশিদিন আটকে রাখা যাবে না। সেটা ঠিকও হবে না। লোকটার উদ্দেশ্য কি সেটাই জানা যায়নি। আগে ওর পেট থেকে কথা বের করতে হবে তারপর কোন একটা ব্যবস্থা নেয়া যাবে।

সন্ধ্যার পরপর রাস্তায় লোকজন কম থাকলেও এখন অনেক পর্যটক বের হয়েছে হাঁটতে। ছোট ছোট দলে হাঁটছে সবাই। এর মাঝে নিজেকে বড় একা মনে হলো। এই পুরো পৃথিবীতেই সে একা। কিংবা তার মতো অন্য কেউ হয়তো আছে যা কেউ জানে না।

যজ্ঞেশ্বর রীতিমতো গল্প শুরু করেছে বিনোদ চোপড়ার সাথে। বারান্দায় দাঁড়িয়েও কিছু কিছু কথা কানে আসছে। বিনোদ চোপড়া তেমন কিছু বলছে না, চুপচাপ যজ্ঞেশ্বরের কথা শুনছে। এই লোকটা ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে যে কোন সময়। অন্তত বিনোদ চোপড়ার চোখ দুটো দেখে তাই মনে হয়েছে।

রুমে ঢুকলেন তিনি। যজ্ঞেশ্বরকে ইশারায় চুপ করতে বললেন। তারপর বিনোদের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন।

একটা চেয়ারে হেলান দিয়ে চুপচাপ বসে আছে বিনোদ চোপড়া। তাকে বন্দী করা হয়নি,ইচ্ছে করলেই সে হয়তো চলে যেতে পারতো। কিন্তু এটুকু বুঝতে পারছে সামনের লোকটার ইচ্ছে না হলে এখান থেকে চলে যাওয়া অসম্ভব।

‘‘বিনোদ চোপড়া, আশা করি যজ্ঞেশ্বরের সাথে আপনার পরিচয়পর্ব শেষ হয়েছে, এবার কাজের কথায় আসি,’ একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বিনোদ চোপড়ার মুখোমুখি বসলেন তিনি।

‘আপনার স্থায়ী নিবাস কোথায়?’ প্রশ্ন করলেন তিনি।’

‘প্যারিস।‘

শহরের নামটা শুনে কিছুটা আনমনা হয়ে গেলেন তিনি। তার খুব প্রিয় একটা শহর।

‘আপনার পেশা?’

‘অ্যান্টিক কালেক্টর।’

‘এটা আবার কি জিনিস?’ পাশ থেকে বলে উঠলো যজ্ঞেশ্বর।

‘আপনি বুঝবেন না,’ যজ্ঞেশ্বরের উদ্দেশ্যে বললেন তিনি, তারপর আবার তাকালেন বিনোদ চোপড়ার দিকে। ‘এখানেও নিশ্চয়ই অ্যান্টিকের খোঁজে এসেছেন?’

‘বলতে পারেন।‘

‘ঠিক আছে। এবার বলুন ঐ লোকগুলোর পিছু নিয়েছেন কেন? ওরা কি অ্যান্টিক বেচাকেনা করে?’

বাকিদের কথা জানি না, তবে ড. কারসন হয়তো অ্যান্টিকের খবর রাখেন। প্যারিসের ল্যুভর মিউজিয়ামে তার সংগ্রহের বিশেষ একজোড়া জুতো আমি দেখেছি।

‘কি রকম জুতো?’

‘হীরে বসানো। বিশেষ একজন মানুষের পায়ে একসময় শোভা দিত সেই জুতো জোড়া।‘

‘আপনার কি ধারনা এরকম আরো অনেক জুতোর খোঁজ রয়েছে ড. কারসনের কাছে?’

‘জানি না। তবে তিনি যেহেতু প্রত্নতত্ত্ববিদ হয়তো তেমন কিছুর সন্ধানে এখানে এসেছেন। আমিও তাই পিছু নিয়েছি।’

‘কারনটা খুব সাধারন হয়ে গেল। আমার মনে হয় আরো বড় কোন কারন রয়েছে।’

চুপ করে রইল বিনোদ চোপড়া।

‘চুপ করে থাকলে চলবে না মি. বিনোদ। আমি জানি আরো কিছু জানেন আপনি যা বলতে চাচ্ছেন না।‘

এবার অন্যদিকে মুখ ফেরাল বিনোদ। ‘আমার যা বলার আমি বলেছি।‘

‘এতোক্ষন আমার ভালো রুপ দেখেছেন আপনি,’ বলে আকাশের একটা হাত ধরলেন তিনি। কব্জিতে চাপ বাড়ালেন। ব্যথায় কুকড়ে যাচ্ছে আকাশের চেহারা, তবু নিজেকে সংযত রাখার চেী চালিয়ে যাচ্ছে।

যজ্ঞেশ্বর সন্ন্যাসী মানুষ, কাউকে শারীরিকভাবে যন্ত্রনা দেয়ার দৃশ্য তার ভালো লাগার কথা না, তাই ইশারায় তাকে রুম থেকে চলে যেতে বললেন তিনি।

‘আমি কিন্তু একটা একটা করে হাত-পা সব ভাঙবো,’ ঠান্ডা গলায় বললেন তিনি, নিজের মাঝে অমানুষিক এক ক্রোধ অনুভব করছেন। কথা না বললে কি করে কথা বের করতে হয় তা তার জানা আছে।

‘বলছি, প্লিজ,’ আকুতি ঝরে পড়ল আকাশের কণ্ঠে।

হাতের বাঁধন শিথিল করে দিলেন তিনি।

‘বলুন এবার।‘

‘এসেছিলাম ড. কারসনের পেছন পেছন, জানতাম তিনি কোন প্রত্নতাত্ত্বিক অভিযানে যাচ্ছেন, কিন্তু কিসের খোঁজে যাচ্ছেন তা জানতাম না। তাই উনার দলের একজনের ল্যাপটপ চুরি করি আমি। সেখানেই সব তথ্য পাই, ধীরে ধীরে বলল বিনোদ চোপড়া।

‘কি তথ্য?’

‘তিনি সাম্ভালার খোঁজে এসেছেন।’

‘সাম্ভালা’ শব্দটা শুনে চমকে গিয়েছেন তিনি। কিন্তু বুঝতে দিলেন না।

‘সাম্ভালা আবার কি?’

‘অদ্ভুত এক জায়গা, যেখানে মানুষ অমর। দুঃখ, জরা, ব্যাধি সেখানকার মানুষকে ছুঁতে পারে না। তিব্বতের আশপাশে কোথাও এর অবস্থান।

হো হো করে হেসে উঠলেন তিনি। ‘সত্যি সত্যি এরকম কিছু আছে নাকি?’

‘আমি জানি না। আমাকে ছেড়ে দিন।‘

‘ছেড়ে দেবো? সেটা বোধহয় সম্ভব হবে না, চারপাশে তাকালেন তিনি। যদিও রুমে এখন কেউ নেই।‘

‘আমাকে ছেড়ে দিন। আমি প্যারিসে চলে যাবো।‘

‘আমার তা মনে হয় না। অ্যান্টিক শিকারী হলেও একজন প্রত্নতত্ত্ববিদের চেয়ে কম জানেন না আপনি। সাম্ভালা সত্যি আছে কি না তা দেখার জন্য হলেও ওদের পিছু ছাড়বেন না আপনি, আমি জানি।’

‘কথা দিচ্ছি, ছেড়ে দেবো। সোজা দিল্লি হয়ে প্যারিস চলে যাবো।’

‘আমি যদি আপনাকে যেতে না দিই?’

‘আমাকে আটকে রেখে আপনার লাভ কি?’

‘আমার লাভ নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না,’ বললেন তিনি। উঠে দাঁড়িয়ে পায়চারি করছেন, বিনোদ চোপড়াকে অনন্তকাল আটকে রাখা যাবে না, এর চেয়ে লোকটাকে সাথে রাখা ভালো হবে।

‘আমি খুনি, ডাকাত নই, একজন অ্যান্টিক কালেক্টর, বিনোদ চোপড়া বলল।’

‘আমাকে ছেড়ে দিন, চলে যাবো।

‘ছেড়ে দেয়া যাবে না, অন্তত আপনার মতো লোককে,’ বললেন তিনি, ‘আগামী কিছুদিন আমার সাথে থাকবেন আপনি। তারপর দেখা যাক কি করা যায়।’

‘আপনার সাথে থাকা তো অসম্ভব একটা কাজ, সময়ে অসময়ে কব্জি চেপে ধরবেন, কিছুটা ব্যঙ্গ করে বলল ডবনোদ।’

‘বাড়াবাড়ি না করলে ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা নেই, বিনা কারনে কাউকে আঘাত করি না আমি,’ বললেন তিনি।

‘ক্ষুধা পেয়েছে। রুম সার্ভিসকে খাবার পাঠাতে বলুন,’ বিনোদ চোপড়া বলল, অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে এসেছে সে।

‘হমম, যজ্ঞেশ্বর ব্যবস্থা করবে,’ বলে রুম লক করে বেরিয়ে এলেন তিনি। যজ্ঞেশ্বরের রুমটা পাশেই, কিন্তু রুমে নেই যজ্ঞেশ্বর। এই হোটেলের খাবারের চেয়ে বাইরে থেকে কিছু কিনে আনা ভালো হবে।

হোটেলের বাইরে চলে এলেন তিনি। একটা রেস্টুরেন্টের সামনে দাঁড়ালেন। ড. কারসনের গাইডকে দেখতে পেলেন দূরে দাঁড়িয়ে মোবাইল ফোনে কথা বলছে। এই লোকটার গতিবিধির দিকেও নজর রাখতে হবে। লোকটার আচরন সন্দেহজনক। রুতে এর সাথে বিনোদ চোপড়ার সম্পর্ক আছে মনে হলেও এখন মনে হচ্ছে এরা দুজন কেউ কাউকে চেনে না।

কিছু খাবার কিনে হাঁটতে হাঁটতে গাইডের পেছনে গিয়ে দাঁড়ালেন তিনি। কিন্তু খুবই সতর্ক লোকটা। তাকে আসতে দেখে মোবাইল ফোন পকেটে পুরে হাঁটতে থাকল। এখন পিছু নেয়া ঠিক হবে না, সন্দেহ করতে পারে, তাই হোটেলে ফিরে এলেন তিনি। রাত হয়ে গেছে অনেক, খাওয়া-দাওয়া করে ঘুমাতে হবে। বিনোদ চোপড়ার থাকার একটা ব্যবস্থাও করতে হবে। ওকে চোখে চোখে রাখতে হবে, যে কোন সময় পালিয়ে যেতে পারে।

*

অধ্যায় ৪০

সারারাত জেগে তেমন লাভ হয়নি,এখন ঘুম পাচ্ছে। পার্চমেন্টের লেখা অনেকটাই অস্পষ্ট, তবে সারারাত জেগে থাকা একেবারে বৃথা যায়নি। কিছু কিছু লেখা এখনো পরিস্কার, তা থেকে এটুকু বুঝতে সমস্যা হয়নি তিবাও যথেষ্ট ধন-সম্পদ জড় করেছিল। এখনকার হিসেবে সেটা কতো কোটি টাকায় ঠেকবে আন্দাজ করা কঠিন। আরাকান থেকে পূর্ব বাংলা পর্যন্ত লুট করা সমস্ত সম্পদ লুকিয়ে রেখেছিল সে। সবার ধারনা সনদ্বীপের কোথাও হয়তো ধনসম্পদ লুকিয়ে রেখেছে তিবাও। কিন্তু এই পার্চমেন্ট দেখলে সেই ধারনা ভুল বলে প্রমানিত হয়। সবাইকে বোকা বানিয়ে সনদ্বীপের বদলে পার্বত্য এলাকাকে নিজের সম্পদ লুকানোর আসল জায়গা হিসেবে বেছে নিয়েছিল তিবাও। ছোট একটা ম্যাপও আছে পার্চমেন্টে। সেখানে কয়েকটা পাহাড়ের অবস্থান দেখানো হয়েছে। এই পাহাড়গুলো সব বান্দরবানে এবং এগুলোর অবস্থান বার্মা-বাংলাদেশ সীমানার কাছাকাছি কোন এক জায়গায় আর জায়গাটা এখান থেকে খুব বেশি দূরে নয়।

সারি সারি করে সাজানো ঘরগুলো থেকে কিছুটা দূরে টয়লেট, প্রাতকৃত্য সেরে রুমে এসে বসেছে রাশেদ। পাহারাদার দু’জন সবসময় পেছনে আছে, এরা সারারাত পাহারা দিয়েছে, রাতের পর রাত হয়তো না ঘুমিয়ে থেকে এদের অভ্যাস হয়ে গেছে, ভাবল রাশেদ।

সকালের নাস্তার জন্য অপেক্ষা করছে এখন, আদৌ এখানে নাস্তার ব্যবস্থা আছে। কি না কে জানে। তবে বেশিক্ষন অপেক্ষা করতে হলো না, পরোটা আর গরম ডাল নিয়ে একজন ঢুকল।

নাস্তা করতে করতে রাজুর কথা ভাবছে রাশেদ। এখানেই থাকার কথা রাজুর। হয়তো পাশের কোন রুমে রয়েছে। পাহারাদারদের জিজ্ঞেস করলে ওরা কখনোই বলবে না। সঞ্জয়ের সাথে কথা বলতে হবে এ বিষয়ে।

হাত ঘড়িতে সময় দেখে নিলো রাশেদ। সকাল নয়টা বাজে। যে কোন সময় সঞ্জয়ের কাছ থেকে তলব আসবে। কিভাবে কি করবে মনে মনে একটা প্ল্যান করে নিলো রাশেদ। প্ল্যানে কাজ হবে কতোটা সেটা সময়ই বলে দেবে।

.

১৯৫০ সাল, রাজস্থান,
ভারত-পাকিস্তান সীমান্তের কাছাকাছি এলাকা

দীর্ঘ ধূসর মরুভূমিতে আবার নিজের জায়গা করে নিয়েছে মিচনার। বোবা-কালা হিসেবে আশ্রয় পেয়েছে স্থানীয় একটি আদিবাসি পরিবারে। খুবই সাধারন নিস্তরঙ্গ জীবন চলছে কিছু ভেড়া আর ছাগল চড়িয়ে। আগেকার দিনের মতো লোকচক্ষুর আড়ালে টিকে থাকা এখন অনেক কঠিন। তাই ঝামেলা এড়ানোর জন্যই প্রত্যন্ত অঞ্চলের এই পরিবারটিকে বেছে নিয়েছে মিচনার। ছোট ছোট কিছু ছনের ঘর নিয়ে ছোট একটা গ্রাম। অল্প কিছু মানুষের বসবাস। সবাই অশিক্ষিত, বাইরের দুনিয়ার সাথে কোন রকম যোগাযোগ নেই। এই জায়গাটাই নিরাপদ। অন্তত এতোদিন তাই মনে হয়েছিল।

যে পরিবারটিতে আশ্রয় নিয়েছে মিচনার সেই পরিবারের কর্তা বুড়ো, সত্তরের কম হবে না বয়স, চোখে দেখে না, কানেও কম শোনে। তার দুই ছেলে সংসার চালায়। ছেলের বউ আছে, নাতি-নাতনি আছে। বড় ছেলে আনওয়ারের চোখে পড়েছিল মিচনার। এই আনওয়ারই তাকে এই পরিবারে নিয়ে আসে। ভেড়া আর ছাগল চড়ানোর দায়িত্ব দেয়, খুশিমনেই সেই দায়িত্ব পালন করছে মিচনার। মাঝে মাঝেই প্রশ্ন করে ব্যতিব্যস্ত করে তোলে এরা। কিন্তু বোবা-কালা ভূমিকায় ভালোই অভিনয় করছে মিচনার। ফলে কোন সমস্যা হচ্ছে না। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে আবাদি জমি নিয়ে, এমনিতেই মরু এলাকায় আবাদি জমির পরিমান খুব কম। তার অল্প কিছু অংশে আনওয়ার আর তার ভাই করিম চাষাবাদ করে সংসার চালায়। স্থানীয় জমিদারের নজর পড়েছে এই জমির উপর। দুই ভাইকে এরমধ্যে জমি ছেড়ে দিতে বলেছে জমিদার। সময় বেঁধে দিয়েছে দুই সপ্তাহ। সেই দুই সপ্তাহ শেষ হতে আর দুই দিন বাকি আছে।

আনওয়ার আর করিম দুই ভাইই জেদি। বাপ-দাদার সম্পত্তি তারা জমিদারের দখলে যেতে দেবে না। প্রয়োজনে লড়াই করবে। পুরো গ্রামবাসি আছে তাদের সাথে। ছোট এই গ্রামটার অধিবাসিদের চেয়ে জমিদারের লাঠিয়াল বাহিনীর সদস্য সংখ্যা বেশি। এটাই হয়তো দৃষ্টি এড়িয়ে গেছিল আনওয়ার আর করিমের। কাজেই জমিদারের পোষা বাহিনী যেদিন আক্রমন করলো সেদিন গ্রামবাসিদের কাউকে আর পাওয়া গেল না পাশে।

মিচনার দাঁড়িয়ে ছিল আনওয়ারের পাশে। তার শরীর এখন আরো শক্তপোক্ত, এক সাথে অনেককে সামাল দেয়া তার জন্য কোন সমস্যা না। সকালে যখন জমিদারের লাঠিয়াল বাহিনী চুপিসারে আনওয়ারের বাড়িতে আক্রমন করলো, তখন বাড়ির সবাই ঘুমাচ্ছিল। মিচনার সবে বের হচ্ছিল তার ছাগল আর ভেড়ার পাল নিয়ে। বিন্দুমাত্র দেরি করেনি সে পালটা আক্রমন করতে। কিন্তু শুরুতেই করিম মারা গেল কিছু বুঝে উঠার আগেই। আনওয়ারের দুই ছেলে আর বউও মারা গেল। বৃদ্ধ বাবাকে আড়াল রেখে উঠানে দাঁড়িয়ে হুংকার দিচ্ছিল আনওয়ার, গ্রামবাসিকে এগিয়ে আসতে বলছিল। কিন্তু কেউ এগিয়ে আসেনি। মিচনার এসে দাঁড়িয়েছিল আনওয়ারের পাশে। হাতে বড় একটা লাঠি নিয়ে। তাদের চারপাশ ঘিরে তখন লাঠিয়াল বাহিনীর অন্তত বিশজন দাঁড়িয়ে, চক্রাকারে ঘুরছে। ওদের কারো হাতে লাঠি, কারো হাতে ছুরি, তলোয়ার। একজন একজন করে লাঠিয়াল বাহিনীর সদস্যদের ঘায়েল করছিল মিচনার। অনেক দিন পর রক্ত দর্শন তার মধ্যে এক উন্মাদনা সৃষ্টি করেছিল। নিজেকে নিয়ন্ত্রন করতে পারছিল না মিচনার। সারা শরীরে অদ্ভুত চাঞ্চল্য খেলা করছিল। লাঠিয়ালদের ঠেকাতে সে একাই লড়ছিল। আনওয়ার লড়াই ছেড়ে বৃদ্ধ বাবার সামনে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল মিচনারের প্রতি আক্রমন। তার দৃষ্টিতে ছিল অবিশ্বাস।

অন্তত সাতজনকে এরমধ্যে পরপারে পাঠিয়ে দিয়েছে মিচনার। বাকিরা এখন অনেক সাবধানী। সহজে কাছে ঘেষতে চাচ্ছে না। দূর থেকে আক্রমন করার চেী করছে। কানের পাশ দিয়ে সাঁই করে ছুরি চলে গেল একটা। একটু এদিক-সেদিক হলেই মাথা এফোঁড়ওফোঁড় হয়ে যেত মিচনারের।

একটা লাশের পাশে পড়ে থাকা একটা তলোয়ার তুলে নিলো মিচনার। হাতের লাঠিটা ফেলে দিল। হাতের জিনিসটা সকালের নতুন আলোয় চকচক করে উঠেছে। হুংকার দিয়ে সামনে এগুলো মিচনার। ওরা কাপুরুষ হতে পারে, কিন্তু ভয় বলে কোন কিছুর সাথে পরিচিত নয় মিচনার। ওরাও এগিয়ে এলো একসাথে চার-পাঁচজন। মাথা নীচু করে প্রথম হামলাটা এড়িয়ে গেল মিচনার, ভারসাম্য হারিয়ে পড়ে গেল লোকটা, মিচনারের পায়ের কাছে। তলোয়ার দিয়ে লোকটাকে গেঁথে ফেলল মিচনার। বাকি কয়জন ভয় পেলেও পালালো না। এক এক করে চারজনকে কচুকাটা করলো মিচনার। বাকিরা এখনো চারপাশ ঘিরে আছে, এগুচ্ছে না। তলোয়ারটা হাত বদল করছে মিচনার বারবার।

আনওয়ার আর তার বৃদ্ধ বাবাকে পেছনে রেখে অনেক সামনে চলে এসেছে মিচনার। ব্যাপারটা আগে চোখে পড়েনি। আক্রমনকারিরাও লক্ষ্য করেনি। এবার ওরাও লক্ষ্য করলো। ফলে মিচনারকে ফেলে সবাই দৌড়ে গেল আনওয়ারের দিকে। দুতিনজনকে ঠেকাতে পারলো আনওয়ার, কিন্তু একসাথে এতোজনকে সামলাতে পারলো না। মিচনার কিছু করার আগেই আনওয়ারের বুক চিরে দিল আক্রমনকারিদের তলোয়ার। ভীষন হুংকার দিয়ে এগিয়ে এসেছিল মিচনার। কিন্তু যা হবার হয়ে গেছে। আনওয়ারের বৃদ্ধ বাবা এর মধ্যেই মারা গেছে, কেউ একজন মাথায় আঘাত করেছে। আনওয়ারও মারা যাচ্ছে, মুখ দিয়ে রক্ত আসছে। আক্রমনকারিরা পালাচ্ছে এক এক করে। তাদের দায়িত্ব পালন করেছে তারা। আনওয়ার আর তার পরিবারকে মারার জন্যই এসেছিল তারা। সেই কাজ শেষ করেছে, এখন আর কারো মুখোমুখি হয়ে জান দেয়ার প্রয়োজন নেই তাদের।

আনওয়ার মারা গেল মিচনারের হাতেই। গুঙিয়ে উঠলো মিচনার। এই পরিবারটিকে খুব আপন মনে হয়েছিল। এখন আর কেউ বেঁচে নেই। তলোয়ার হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়াল মিচনার। যে কয়জন বেঁচে পালাচ্ছে ওদের একটাকেও বাঁচতে দেয়া যাবে না।

দৌড়ে উঠোনের বাইরে এসে দাঁড়াল মিচনার। গ্রামবাসির দল আস্তে আস্তে জড় হচ্ছে। মিনারের দিকে তাকিয়ে আছে সবাই ভয়ার্ত দৃষ্টিতে। কিন্তু সেদিকে লক্ষ্য নেই মিচনারের। রক্তমাখা খোলা তলোয়ার হাতে নিয়ে দৌড় দিলো সে। সামনে ধু ধু মরুভূমি। ওরা নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছানোর আগেই ওদের ধরতে হবে। তারপর যা হবার হবে।

গ্রামবাসিরা এরপর তাকে আর ফিরে আসতে দেখেনি।

***

লখানিয়া সিং নামটা অদ্ভুত, মেঘালয়ের সামান্য শহর থেকে উঠে আসা একটা মানুষ এই লখানিয়া সিং। গুরুর কাছে যেমন বর্ননা শুনেছিলেন তার সাথে এই লোকটার ধরন অনেকটাই মিলে যায়। যদিও গত কিছুদিনে মনে হয়েছিল লোকটার বিশেষত্ব কিছু নেই। মনে হয়েছিল গুরুর ধারনা ভুল, এই ধরনের মানুষের অবস্থান কেবল কল্পনাতেই। কিন্তু এখন অন্য রকম কিছু একটা গন্ধ পাচ্ছেন। লোকটার আচার-আচরন সাধারন মানুষের মতো না। সেই মেঘালয় থেকে তার সাথে আছে, উদ্দেশ্য জ্ঞানগঞ্জ বা সাম্ভালা খুঁজে বের করা। তিনিও এর সাথে তাল দিয়ে আছেন, সন্ন্যাসী জীবন বেছে নেয়ার পর এই ধরনের অনেক কল্পকথা তার কানে এসেছে। কিন্তু এসব নিয়ে কখনো মাথা ঘামাননি। এখন মনে হচ্ছে মাথা ঘামানো দরকার ছিল। দেখা যাচ্ছে শুধু লখানিয়া সিং না, আরো অনেকেই হয়তো এই সাম্ভালার পেছনে লেগেছে। এতোদিন একজায়গায় পড়ে থাকা তার মতো সন্ন্যাসীর জন্য বেমানান, কিন্তু অনুসন্ধিৎসু মন তারও আছে। চিরতারুন্য আর চিরসুখের দেশ সত্যিই যদি থেকে থাকে তাহলে এর শেষ দেখে না যাওয়া ঠিক হবে।

বাইরে অনেক শীত। পাতলা একটা চাদর পরে হাঁটছেন যজ্ঞেশ্বর। অনেক কিছু মাথায় আসছে, ছবির মতো। এই ধরনের কল্পকথা নিয়ে যা যা শুনেছিলেন সব মনে করার চেষ্টা করছেন। সব স্মৃতি ছাড়া ছাড়া। সব স্মৃতিকে একসাথে জোড়া লাগাতে পারলে হয়তো সমাধান একটা পাওয়া যেতো। এখন বয়স হয়েছে, এই সময়ে স্মৃতি অনেকটাই প্রতারকের ভূমিকা পালন করে।

লখানিয়া সিং, এই অদ্ভুত নাম বেছে নেয়ার কি কারন থাকতে পারে কে জানে। হাঁটতে হাঁটতে হোটেলের সামনে চলে এলেন যজ্ঞেশ্বর। রুমের জানালায় লখানিয়া সিং কে দেখা যাচ্ছে। দূরে তাকিয়ে আছে। কি দেখছে এতো তন্ময় হয়ে?

.

আবহাওয়া অফিস, কক্সবাজার

রুটিন মতো কাজ চলছে। প্রতিদিনের স্যাটেলাইট রিপোর্ট ঘেটে দেখছেন প্রধান আবহাওয়াবিদ সারওয়ার আলম। বেশ কয়েকদিন ধরে চমৎকার আবহাওয়া গোটা অঞ্চলে। জোয়ার-ভাটাও চলছে স্বাভাবিকভাবে। কিন্তু আজকের রিপোর্টটা দেখে মাথায় চিন্তার ভাঁজ পড়লো সারওয়ার আলমের। বঙ্গোপসাগরের অনেক পশ্চিমে বাতাসের চাপে বেশ উঠানামা দেখা যাচ্ছে। খুবই সাধারন মানের একটা নিম্নচাপের লক্ষন এটা। এই সাধারন নিম্নচাপ থেকে মদু কিংবা বিশাল আকারের ঘূর্নিঝড়ের আশংকা থাকে। বাংলাদেশের জন্য হয়তো চিন্তার কিছু হবে না। মায়ানমারের সীমার মধ্যেই থাকার কথা, কিন্তু বাতাসের বেগ বোঝা খুব কঠিন। তাকে নিয়ন্ত্রন করার কেউ নেই, ইচ্ছেমতো দিক পরিবর্তন করতে পারে।

ঢাকা হেড অফিসের সাথে যোগাযোগ করলেন সারওয়ার আলম। সেখান থেকে বলা হলো বেশি চিন্তা না করতে, অতিরিক্ত চিন্তা নাকি স্বাস্থ্যের জন্য খারাপ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *