গাড়ি চলেছে। দুই লম্বা বেঞ্চি ও দুটো বাংওয়ালা ছোট্ট সরু কামরা। ধারে একটা পায়খানা, তা থেকে তীব্র গন্ধ ছুটছে–গাড়ি ছুটলে একটু কম থাকে, কিন্তু থামলে আর টেকা যায় না। পরিতোষ একটা বেঞ্চে পা থেকে মাথা অবধি র্যাপার মুড়ি দিয়ে পড়ে আছে, তার পায়ের কাছে বড়কর্তার সেই দুটো অনুচর পাশাপাশি বসে আছে। আমি সামনের বেঞ্চিটায় বাইরের দিকের জানলার ধারে বসে। পকেটে দুখানা হাওড়ার টিকিট–সংসারে সেই মাত্র সম্বল। মনের মধ্যে বর্তমান ছাড়া আর চিন্তা নেই। গাড়ি চলেছে।
গাড়ি চলেছে–গরুর গাড়ির চালে। প্যাসেঞ্জার গাড়ি, দশ-পনেরো মিনিট অন্তর একটা করে স্টেশনে থামে। থায়ে তো থেমেই যায়–মেরে না তাড়ালে এগুতে চায় না এমন অবস্থা। ঘণ্টা দেড় কি দুই বাদে বড়কর্তার একজন অনুচর আমাকে জিজ্ঞাসা করলে, তোমাদের বাড়ি কি খাস কলকাতায়?
বললুম, হ্যাঁ, খাস কলকাতায়।
কলকাতার কোন জায়গায়?
মেছুয়াবাজারে।
লোকটা আর কোনো কথা না বলে চুপ করে রইল। কিছুক্ষণ চুপচাপ কাটবার পর আমি জিজ্ঞাসা করলাম, এ গাড়ি কখন গিয়ে কলকাতায় পৌঁছবে?
সে বললে, আজ সারাদিন যাবে, সারারাত যাবে, কাল বিকেলে পৌঁছবে, পাসিঞ্জার গাড়ি কিনা, কিছু ঢিমা চলে।
আমি আবার প্রশ্ন করলুম, তোমরা কলকাতায় যাবে নাকি?
লোকটা আমার প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়ে সলজ্জভাবে এক রহস্যময় মুচকি হাসি হেসে মুখখানা ফিরিয়ে নিলে। হনুমানের মতন সেই মুখে ওই হাসি দেখে ইচ্ছে হতে লাগল চোয়ালে একটি ‘নক্ আউট’ ঝেড়ে বদনটি একেবারে বিগড়ে দিই। কিন্তু হায়! মানুষ অবস্থার দাস। চুপ করে বসে থেকে সেই নীরব অভিনয় সহ্য করতে লাগলুম। বেশ বুঝতে পারলুম, বড়কর্তা পাহারাস্বরূপ এদের পাঠিয়েছে আমাদের সঙ্গে। মনে মনে হিসাব করতে লাগলুম, কলকাতায় নিয়ে গিয়ে একবার যদি লোক-দুটোকে আমাদের আস্তানায় জিম্মে করতে পারি, তা হলে আমাদের ওপরে এই অত্যাচারের শোধ তুলব।
লোকটাকে খুব মিষ্টি করে বললুম, কলকাতায় আমাদের বাড়িতে গিয়ে থাকবে চল। কিছুদিন থেকে মৌজ করে আবার চলে আসবে, কোনো খরচ লাগবে না তোমাদের।
লোকটা আমার কথা শুনে সেইরকম রহস্যময় হাসি হেসে জানলার দিকে মুখ ফিরিয়ে নিলে। গাড়ি ছুটতে লাগল।
আরও কয়েকটা স্টেশন পার হয়ে যাবার পর আমিও পরিতোষের মতন আপাদমস্তক র্যাপার মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লুম, গাড়ির দোলানিতে কখন ঘুমিয়ে পড়লুম টেরও পাইনি।
কতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলুম জানি না। ঘুম ভেঙে দেখি, বেলা অনেকখানি গড়িয়ে গিয়েছে। উঠে দেখলুম, আমাদের প্রহরী দুজন কোথায় নেমে গিয়েছে, কামরার দুই বেঞ্চিতে আমরা দুজন শব্দ ও গতির তরঙ্গে আন্দোলিত হচ্ছি।
পরিতোষ তখনও সেইভাবে শুয়ে। বাইরের রোদের ঝাঁজ একেবারে কমে গিয়েছে। বসে থাকতে থাকতে বেশ শীত করতে লাগল, মনে হল, যেন একটু জ্বরও এসেছে, বেঞ্চির ওপরে পা-দুটো গুটিয়ে বেশ করে র্যাপার মুড়ি দিয়ে বসলুম।
ঘুমিয়ে বেশ নিশ্চিন্তে ছিলুম। জাগা-মাত্র আমার চিন্তা শুরু হয়ে গেল। মনে হতে লাগল, এমন ঘটনাবহুল, এমন বিচিত্র দিন আমার জীবনে আর আসেনি। এত অল্প সময়ের মধ্যে এতখানি ভাগ্য-পরিবর্তন পৃথিবীর ক’জনের হয়েছে তা জানি না। সেই ভোর থেকে আরম্ভ করে একে একে সমস্ত ঘটনা মনের মধ্যে এসে উদয় হতে লাগল। বয়স অল্প ছিল বটে, কিন্তু সেই বয়সেই অভিজ্ঞতার অশ্রুধারায় আমার জীবনপাত্র কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে উঠেছিল।
অভিমান নেই; কার ওপর অভিমান করব, কতবার অভিমান করব! মনে মনে শুধু বলতে লাগলুম, হে আমার ভাগ্যবিধাতা! এই যদি তোমার মনে ছিল তবে এমন রামধনু কেন রচেছিলে আমার ভাগ্যাকাশে?
রেলগাড়ি চলেছে। প্যাসেঞ্জার গাড়ি হলেও স্থিরভাবে টেনে নিয়ে চলেছে আমাকে সেই ফেলে আসা জীবন-আবর্তের পানে।
বাইরের দিকে চেয়ে বসে রইলুম। বেহারের রুক্ষ জমি, ঘাস কিংবা শস্য নেই। কোনো স্টেশনের কাছাকাছি এলে দেখতে পাওয়া যায়, পল্লীবালারা সারে সারে মাথায় জলভরা গাগরি নিয়ে দল বেঁধে চলেছে, সুন্দর সে দৃশ্য। কোথাও-বা নীচু কুয়ো থেকে বলদের সাহায্যে ওপরে জল তোলা হচ্ছে, কলকাতাবাসীর কাছে সে-দৃশ্য অভিনব।
সূর্য ক্রমেই পশ্চিমের গভীরে ঢলে পড়তে লাগল, স্টেশনগুলো ক্রমেই হয়ে উঠতে লাগল জনবিরল। কোনো কোনো স্টেশনে একেবারেই লোক নেই; শুধু একটানা করুণ সুর মাঝে মাঝে শুনতে পাওয়া যাচ্ছে, রোটি গো-স্ত্।
খিদেয় পেটের মধ্যে পাক দিচ্ছে, কিন্তু একটি পয়সাও কাছে নেই, যে কিছু খাই। কাশীতে আসার টিকিট করবার সময় কিছু খুচরো পাওয়া গিয়েছিল, আনা কয়েক হবে। সেগুলো পরিতোষের কাছে আছে, না ওরা কেড়ে নিয়েছে, তা কিছুই মনে নেই। প্রহারের চোটে লোকে বাপের নামই ভুলে যায়, পয়সার হিসেব তো দূরের কথা!
আরও কয়েকটা স্টেশন পার হবার পর পরিতোষ ধড়মড় করে উঠে বসে বিহ্বলদৃষ্টিতে আমার মুখের দিকে স্থিরভাবে চেয়ে রইল। দেখলুম, তার মুখখানা এমন ফুলেছে যে, তাকে আর চিনতে পারা যায় না। চোখ-দুটো, এমন-কি তার অস্বাভাবিক লম্বা নাকটা পর্যন্ত কোথায় ভেতরে ঢুকে গিয়েছে। কিছুক্ষণ সেইরকম বিহ্বলদৃষ্টিতে আমার মুখের দিকে কুতকুত করে চেয়ে থেকে সে কাঁদতে আরম্ভ করে দিলে। বললুম, কাঁদছিস কেন ভাই, খুব যন্ত্রণা হচ্ছে?
সে একবার-দু’বার ঘাড় নেড়ে বললে, তোর কি হয়েছে?
কি হয়েছে রে?
নাকটা যে ভেঙে গেছে।
অ্যাঁ!–বলে নাকে হাত দিয়ে দেখি, নাক অদৃশ্য। দুই গাল আর নাক, একেবারে সমভূমি হয়ে গেছে। সকাল থেকেই নাকের কাছে একটা ভার ও অস্বস্তিকর বেদনা অনুভব করছিলুম বটে, কিন্তু তিনি যে এই অবস্থায় দাঁড়িয়েছেন তা কল্পনাও করতে পারিনি। ভাগ্যে কাছে আয়না ছিল না!
পরিতোষকে আর তার মুখের অবস্থার কথা বললুম না। পকেট থেকে একটা ভাঙা বিড়ি বার করে ধরিয়ে তাকে দিতেই সে আমার নাকের শোক ভুলে গেল।
আবার পরামর্শ শুরু হল। অনেক চিন্তা ও গবেষণার পর স্থির করা গেল যে, ভাগ্যের কাছে এত সহজে হার মানা হবে না। তার ওপরে কাল এই হাঁড়িমুখ নিয়ে বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হলে তারাই বা বলবে কি? ঠিক করা গেল, একটা স্টেশনে নেমে পড়ে আবার একবার ভাগ্য পরীক্ষা করা যাক।
পরিতোষ জিজ্ঞাসা করলে, আংটিটা আছে তো?
এতক্ষণ আংটির কথা একেবারেই মনে ছিল না। তাড়াতাড়ি কাছা খুলে দেখলুম, সেটা তখনও বিশ্বাসঘাতকতা করেনি।
পরিতোষ বললে, বড্ড খিদে পেয়েছে।
বললুম, তোর কাছে খুচরো কিছু আছে না?
হ্যাঁ, হ্যাঁ।–বলেই সে পকেট হাতড়ে একটা আধুলি, তিনটে পয়সা ও একটা সিকি বার করলে।
ঠিক হল, আনা-চারেকের রোটি-গো কিনলে দুজনের পেট ভরে যাবে।
বাইরে রোদ পড়ে গেল। শীতের ম্লান গোধূলি আমাদের আশা-প্রদীপ-শিখার চতুর্দিকে ধীরে ধীরে জমাট হয়ে উঠতে আরম্ভ করলে। শোন নদীর লম্বা পোল পার হয়ে আরও কয়েকটা ছোটখাটো স্টেশন পেরিয়ে আমাদের ট্রেন একটা বড়গোছের প্ল্যাটফর্মে এসে দাঁড়ালো। বড় প্ল্যাটফর্ম মানে–লম্বা-চওড়ায় বড়, বাঁধানোও নয়, ঢাকাও নয়। প্ল্যাটফর্মের ওপরেই কয়েকটা বড় গাছ, বোধ হয় শিরীষফুলের গাছ হবে। স্টেশন প্রায় জনশূন্য, গাছগুলোতে রাজ্যের পাখির কিচির-মিচির ধ্বনিতে জায়গাটা আরও গম্ভীর হয়ে উঠেছে, দিবালোকও প্রায় নিবে এসেছে। এইখানে আমরা নেবে পড়লুম।
প্ল্যাটফর্ম থেকে বেরিয়ে প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে লাগা যাত্রীদের ঘরে এসে এক জায়গায় বসলুম। পরিতোষ তখন শীতে ঠকঠক করে কাঁপছে।
বেশ গুছিয়ে-গাছিয়ে র্যাপারটি আপাদমস্তক মুড়ি দিয়ে পরিতোষ বললে, যা, রোটি-গোস্ত্ কিনে নিয়ে আয়।
তার গায়ে হাত গিয়ে দেখলুম, জ্বরে একেবারে দেহ পুড়ে যাচ্ছে। বললুম, রোটি-গোস্ত্ আজ আর খেয়ে কাজ নেই ভাই, এত জ্বরে ওসব খাওয়া ঠিক হবে না।
পরিতোষ প্রায় কেঁদে ফেলে বললে, কি খাব, খিদেয় যে মরে গেলুম রে!
বললুম, তুই শুয়ে পড়, আমি দেখছি, কোথাও থেকে যদি একটু দুধ জোগাড় করতে পারি।
কোঁচা দিয়ে পাথরের মেঝের ধুলো ঝেড়ে দিতেই সে একেবারে লাঠির মতন পড়ে গেল।
পরিতোষের দেখাদেখি কিনা জানি না, আমারও জ্বর একটু একটু বাড়তে লাগল ও সেইসঙ্গে ঠক্ঠক্ করে কাঁপতে আরম্ভ করলুম। কোনোরকমে মনের জোরে বন্ধুর পাশে কুঁকড়ে-সুঁকড়ে দেওয়ালে ঠেসান দিয়ে গাড়ু হয়ে বসে রইলুম বটে, কিন্তু জ্বরের কাঁপুনিকে ঠেকাতে পারবার মতন মনের জোর কোথায় পাব? বোধ হয় মিনিট পনেরো অত্যন্ত কষ্টে কাটিয়ে একটু সামলে উঠতেই ঘরের মাঝখানে একটা বড় আলো জ্বলে উঠল।
ঘরের এক কোণে অনেকখানি জায়গা জুড়ে একটা চায়ের দোকান। দোকানের সর্বাঙ্গে অ্যানডু ইউল কোম্পানির পৃথিবী-মার্কা চায়ের বিজ্ঞাপন ঝুলছে। বড় বড় কাঁচের চ্যাপ্টা বোতলের মধ্যে লেড়ো বিস্কুট ও অন্যান্য বিস্কুট ও কেক সাজানো রয়েছে, সেখানে কয়েকজন লোক বসে চা খাচ্ছে ও গুলতানি করছে। দোকানটার দিকে দেখতে দেখতে মনে হল, হয়তো এইখানে চেষ্টা করলে একটু দুধ পাওয়া যেতে পারে। কাঁপতে কাঁপতে উঠে গিয়ে চা-ওয়ালাকে বললুম, বাপু হে, আমাকে একটু দুধ দিতে পার? আমার বন্ধুটির জ্বর হয়েছে, একটু দুধ পেলে বড় ভালো হত।
লোকটি আমার দিকে কিছু সময় চেয়ে থেকে বললে, আপনি কি বাংগালী?
হ্যাঁ।
আপনার বন্ধু কোথায়?
আঙুল দিয়ে পরিতোষকে দেখিয়ে দিলুম। একবার তার দিকে চেয়ে সে জিজ্ঞাসা করলে, আপনারা কোথায় যাবেন?
বললুম, এইখানে, তোমাদের দেশে নেমে পড়েছি, এখন ভগবান কোথায় নিয়ে যান দেখি!
একটা আধবুড়ো লোক সেখানে বসে চা খাচ্ছিল, আমার কথা শুনে চা-ওয়ালাকে আমাদেরই উদ্দেশে বললে, দিওয়ানা হ্যায়।
চা-ওয়ালা বললে, তোমরা আজ রাতে এইখানেই থাকবে তো? বললুম, হ্যাঁ।
তা হলে ঘণ্টাখানেক সবুর কর, টাকা দুধ আসবে, তাই থেকে দেব। আমার কাছে দুধ আছে, কিন্তু সে সেই সকালবেলাকার দুধ, অসুস্থ লোককে তা খাওয়ানো ঠিক হবে না। ততক্ষণে ওকে এক কাপ চা খাইয়ে দাও।
প্রস্তাবটা শুনে ভালোই লাগল। বললুম, আচ্ছা, আমাকে এক কাপ চা দাও তো।
আগুন-গরম এক কাপ চা খেয়ে আমার শীত তো চলেই গেল, পরন্তু বেশ ভালোই লাগতে লাগল। আর এক কাপ চা নিয়ে পরিতোষকে তুলে খাইয়ে দিলুম। চা খেয়ে সে বললে, অনেক ভালো লাগছে।
চা-ওয়ালার প্রাপ্য দুটো পয়সা চুকিয়ে দিতে সে জিজ্ঞাসা করলে, কতখানি দুধ চাই তোমাদের?
জিজ্ঞাসা করলুম কত করে সের?
দু-আনা সের
তা হলে এক সের দুধ গরম করে দিও।
চা খেয়ে পরিতোষ অনেকটা চাঙ্গা হয়ে উঠল। একটু পরেই কিন্তু আবার রোটি-গোস্ত্ খাবার জন্যে বায়না শুরু করলে, কিন্তু আমি কিছুতেই রাজী না হওয়ায় সে হাল ছেড়ে দিয়ে বললে, আচ্ছা, এক বান্ডিল বিড়ি কিনে নিয়ে আয়।
আবার এক কাপ চা খেয়ে বিড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে ভবিষ্যতের চিন্তায় মনোনিবেশ করা গেল। ঠিক করা হল, এবার যদি কোথাও আশ্রয় মেলে তা নেহাত অন্নদাস হয়ে আর থাকব না। বাড়ির ছোট ছেলে-মেয়ে পড়াব কিংবা চাকরের কাজ করব তাও স্বীকার, কিন্তু একান্ত আশ্রয়দাতার ওপরে নির্ভর করে আর কোথাও থাকব না। যদি কোথাও চাকরি না জোটে তো এবারকার মতন বাড়ি ফিরে যাব। অন্তত ছ’মাস খেয়ে পরে কাটাবার মতন টাকার ব্যবস্থা করতে না পারলে আর ভাগব না। সঙ্গে সঙ্গে এও ঠিক করা গেল যে, কালই যেমন করেই হোক দিদিমণিকে একখানা চিঠি লিখে সমস্ত কথা জানিয়ে দিতে হবে। কারণ সে মনে করতে পারে, তার একশো টাকা নিয়ে আমরা চম্পট দিয়েছি। আমাদের গোটা পঁচিশেক টাকা দিদিমণির কাছে জমা রেখেছিলুম, একটা ঠিকানার ব্যবস্থা হলে পাঠিয়ে দিতে লেখা যাবে। ছেঁড়া ধুতি-জামা যা সেখানে পড়ে রইল তা রয়েই গেল। ওই সঙ্গে বিশুদাকেও একখানা চিঠি লিখব, তাদের দয়ার কথা জীবনে কখনও ভুলব না।
চারিদিক নির্জন নিস্তব্ধ। প্ল্যাটফর্ম অন্ধকার, শুধু চায়ের দোকানে মাঝে মাঝে দু-একজন লোক এসে বসছে, খেয়ে-দেয়ে চলে যাচ্ছে। এইরকম প্রায় ঘণ্টাখানেক কেটে যাবার পর হঠাৎ আবহাওয়াটা চঞ্চল হয়ে উঠল। রেলের কুলিরা ব্যস্ত হয়ে ছুটোছুটি আরম্ভ করে দিলে, অন্ধকার প্ল্যাটফর্মের বাতিগুলো জ্বলে উঠল। টিকিট-ঘরের ঘুলঘুলির সামনে ছোট একটা ভিড় জমে গেল, টিকিট-ঘর খুলে গেল। দেখতে দেখতে চায়ের দোকানে খদ্দেরের ভিড় লেগে গেল। বাইরে এক্কা ও টাঙ্গাওয়ালাদের চিৎকারে জায়গাটা সরগরম হয়ে উঠল।
আমাদের শরীর তখন বেশ একটু চাঙ্গা হয়ে উঠেছিল। নিজেদের জায়গা ছেড়ে বাইরে গিয়ে দাঁড়ালুম। দেখলুম, সামনেই একটা চওড়া রাস্তা সোজা চলে গিয়ে অন্ধকারে মিশে গিয়েছে। দূর অন্ধকারের মধ্যে দৃষ্টি প্রসারিত করে ভাবতে লাগলুম, কাল সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে এই রাস্তা ধরে এগিয়ে চলব–কোথায় কোন গৃহে কতদিনের মতন আমাদের অন্ন-সংস্থান হয়ে আছে কে জানে!
কিছুক্ষণ চারিদিক ঘুরে-ফিরে ওরই মধ্যে যতটা সম্ভব দেখে শুনে আবার ঘরের মধ্যে নিজেদের জায়গায় গিয়ে বসলুম।
দেখতে দেখতে বিকট আওয়াজ করতে করতে একটা ট্রেন এসে প্ল্যাটফর্মে ঢুকল যাত্রী, কুলি ও ফেরিওয়ালাদের চিৎকারে জায়গাটা যেন একেবারে বিষিয়ে উঠল। মিনিট দশেক বাদে ট্রেনটা চলে। যেতেই আবার সব চুপচাপ। দেখলুম, প্ল্যাটফর্মের বাতিগুলো কিন্তু জ্বালাই রইল। চা-ওয়ালাকে জিজ্ঞাসা করে জানলুম যে, আধঘণ্টার মধ্যেই কলকাতা যাবার এক্সপ্রেস গাড়ি আসবে।
আবার ধীরে ধীরে জনতা ও গোলমাল বাড়তে আরম্ভ করল। পাছে আমাদের জায়গাটুকু মারা যায়, সেই ভয়ে গ্যাঁট হয়ে নিজেদের জায়গায় বসে রইলুম। বাইরে টাঙ্গাচক্র ও টাঙ্গাওয়ালাদের মুখরতা ক্রমেই গগনভেদী হয়ে উঠতে লাগল, এমন সময় একটি বাঙালি ভদ্রলোক, সম্মুখে মুটের মাথায় একটা বড় ট্রাঙ্ক ও তার ওপরে বিছানা, নিজের হাতে একটা বড় বালতি ও পশ্চাতে আপাদমস্তক টকটকে-লাল- র্যাপার-মণ্ডিত একটি মহিলা নিয়ে এসে আমাদের কাছেই জিনিসপত্র নামিয়ে রেখে চিৎকার করে কুলিদের বললেন, গাড়িতে তুলে দেবার পর বখশিশ মিলবে।
তার পরে ট্রাঙ্কটার ওপর থেকে বিছানার মোট নামিয়ে রেখে সেইরকম উচ্চৈঃস্বরে মহিলাটিকে বললেন, তুমি একটু বস, আমি মাস্টারমশায়ের সঙ্গে দেখা করে এখুনি আসছি। টিকিট-ঘর খুলতে এখনও দেরি আছে। আজ গাড়িতে বেশি ভিড় হবে না বলেই তো মনে হচ্ছে।
ভদ্রলোক প্ল্যাটফর্মের দিকে চলে গেলেন, আর ভদ্রমহিলা সেই ট্রাঙ্কের ওপরে বেশ জাঁকিয়ে বসলেন। বাঙালির মেয়ে, রঙ হয়তো উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ ছিল, কিন্তু শীতের চোটে নির্জলা শ্যামবর্ণে দাঁড়িয়েছে। সুন্দর ঢলঢলে মুখ, টিকটিকে নাকে ঝকঝক করছে একটি নাকছাবি, জুলজুল করে আমাদের দিকে কৌতূহলী চোখে চাইতে লাগলেন।
আমাদের চোরের মন! খালি মনে হয়, ধরা না পড়ে যাই! ভদ্রমহিলাকে ওইরকম ভাবে বারে বারে আমাদের দিকে চাইতে দেখে দস্তুরমতন অস্বস্তি শুরু হয়ে গেল। পরিতোষ একবার আমার কানে কানে বললে, কি রে বাবা! চেনাশোনা না হয়ে পড়ে!
কিছুক্ষণ বাদে ভদ্রলোক হৈ-হৈ করতে করতে ফিরে চিৎকার করে মহিলাটিকে বললেন, জান রাণু, মাস্টার বললে–ট্রেন আজ অন্তত আধ ঘণ্টা লেট হবে।
বুঝতে পারা গেল, আমাদের সামনে শয়নগৃহের নামে অভিহিত হয়ে ভদ্রমহিলা কিঞ্চিৎ চঞ্চল ও বিব্রত হয়ে মুখ ফিরিয়ে স্বামীকে কি বললেন। স্বামীটি কিন্তু সে ইঙ্গিত ধরতে না পেরে সেইরকম উচ্চৈঃস্বরেই জিজ্ঞাসা করলেন, কি? কে? কোথায়?
এবার ভদ্রমহিলা নিজের জায়গা ছেড়ে উঠে একটু দূরে গিয়ে দাঁড়ালেন। লোকটি কিঞ্চিৎ বিস্ময়াপন্ন হয়ে একবার চারদিকে চেয়ে স্ত্রীর কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই তিনি কি বললেন। লোকটি আমাদের দিকে একবার চেয়ে একটু হেসে স্ত্রীকে কি বলে আমাদের দিকে এগিয়ে এসে ট্রাঙ্কটার ওপর বসে জিজ্ঞাসা করলেন, দাদারা কি কলকাতায় যাচ্ছ?
গিন্নি আর সেদিকে এগুলেনই না। তিনি দূরে দাঁড়িয়ে দার্শনিকের দৃষ্টিতে চায়ের দোকানের প্ল্যাকার্ডগুলো পড়তে আরম্ভ করে দিলেন।
আমি বললুম কলকাতায় যাচ্ছিলুম, কিন্তু একটা বিশেষ দরকারে এখানে নেমে পড়েছি।
কোথা থেকে আসা হচ্ছে?
কাশী থেকে।
তা টিকিট কি এই অবধি করা হয়েছিল, না, হাওড়া অবধি?
হাওড়া অবধি।
তা হাওড়া তো আর যাওয়া হচ্ছে না?
না।
এবার ভদ্রলোক ট্রাঙ্ক ছেড়ে উঠে একেবারে আমাদের কাছে এসে উঁচু হয়ে বসে বললেন, তা দাদা, টিকিট-দুটো আমাকে বেচেই দাও না। আমারও সস্তায় কিস্তি হয়, আর তোমাদেরও কিছু এসে যায়।
আমি বললুম, তাতে আমাদের আপত্তি নেই, এ তো ভালোই হল।
আমার কাছ থেকে টিকিট দু-খানা নিয়ে তারিখ ইত্যাদি ভালো করে দেখে তিনি বললেন, ঠিক আছে। তবু ভাই, একবার মাস্টারমশায়কে দেখিয়ে আনি–কি জানি, কোম্পানির কারবার তো সাবধানের মার নেই, কি বল?
ভদ্রলোক টিকিট-দুখানা নিয়ে প্ল্যাটফর্মে ঢুকে গেলেন। দেখলুম, ভদ্রমহিলা তেমনই দূরে দাঁড়িয়ে রইলেন, একবার আমার চোখে চোখ পড়তেই সেখান থেকে আরও একটু দূরে সরে গেলেন।
কিছুক্ষণ কেটে যাবার পর পরিতোষ বললে, কি রে, রাজা-রানী দু-জনই যে সরে পড়ল!
বললুম, সরবে কোথায়? ট্রাঙ্ক রয়েছে যে এখানে। দেখতে দেখতে ঘরের মধ্যে ভিড় বাড়তে আরম্ভ করলে, চায়ের দোকানের তিনদিকের বেঞ্চি খদ্দেরে ভরে গেল। সবই বেহারী স্ত্রী-পুরুষ। কুলিদের হাল্লায় কানে তালা লাগবার উপক্রম, কিন্তু তখনও পর্যন্ত ট্রেনের কোনো চিহ্নই নেই। টিকিট-ঘরের ঘুলঘুলি বন্ধ।
আমরা দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসে বসে দেখতে লাগলুম, ভদ্রমহিলা ওখানে দাঁড়িয়ে অত্যন্ত অস্বস্তি ভোগ করছেন, কিন্তু তবুও এসে ট্রাঙ্কের ওপরে বসছেন না। দেখলুম, একটা কুলি মোটঘাট নিয়ে প্রায় তাঁর ঘাড়ের ওপরে পড়তে পড়তে সামলে গেল।
ব্যাপার দেখে আমি উঠে সোজা গিয়ে তাঁকে বললুম, এখানে দাঁড়িয়ে রইলেন কেন মা? এ লোকগুলোর তো হসি-দীঘি জ্ঞান নেই, কখন মোটঘাট নিয়ে হয়তো ঘাড়ের ওপরেই পড়ে যাবে।
হঠাৎ এইভাবে সম্ভাষিত হয়ে তিনি চমকে উঠলেন। কিন্তু হাজার হোক বাঙালির মেয়ে, তার ওপরে ‘মা’-ডাক কানে গেছে, মুহূর্তের মধ্যেই সেই সচকিত ভাব সামলে নিয়ে হাস্যোজ্জ্বল চোখে আমার দিকে ফিরে বললেন, দেখ তো বাবা! একটু হলেই ওই গন্ধমাদন ঘাড়ে ফেলে দিয়েছিল আর কি!
বললুম, চলুন, ওখানে গিয়ে বসবেন।
আর কোনো কথা না বলে তিনি ফিরে এসে নিজের ট্রাঙ্কটির ওপরে জমিয়ে বসে বালতিটা ঘ্যাড় করে কাছে টেনে নিয়ে তার মধ্যে কি খুঁজতে লাগলেন, বোধ হয় দেখে নিলেন, বালতির জিনিসপত্রগুলোর মধ্যে কোনোটি স্থানচ্যুত হয়েছে কি না। তারপর মুখ তুলে আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার নাম কি বাবা?
নাম বললুম। পরিতোষটা অন্য দিকে মুখ করে বসে ছিল। তার উদ্দেশে বলতে লাগলেন, হ্যাঁ গো ছেলে–ও ছেলে-
পরিতোষকে একটা কনুই দিয়ে খোঁচা মারতেই সে এদিকে মুখ ফেরালে। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার নাম কি বাবা?
পরিতোষ নাম বললে।
জিজ্ঞাসা করলেন, তোমাদের বাড়ি কোথায়?
কলকাতায়।
ঠিক বুঝেছি। কলকাতার লোক না হলে আর এমন হয়! আমিও বাবা কলকাতার মেয়ে হোগোলকুঁড়োয় আমাদের বাড়ি। আমরা তিন বোন, তা তিন-জনেরই বিয়ে হয়েছে পশ্চিমে। বাবা মেয়ে ছেড়ে থাকতে পারেন না, তাই তিন বোনে পালা করে বছরে চার মাস করে এক-একজন বাবার কাছে থাকে। আমি গেলে দিদি চলে যাবে তার শ্বশুরবাড়ি মজঃফরপুরে। বাবার আমার বড় কষ্ট।
তার পরে অত্যন্ত যেন একটা গোপনীয় কথা বলছেন, এমন ভঙ্গিতে ঘাড়টা লম্বা করে মুখখানা প্রায় আমাদের কানের কাছে নিয়ে এসে চুপিচুপি বললেন, মা নেই কিনা!
বাপের কথা বলতে বলতে ভদ্রমহিলার গলা প্রায় ধরে এল, তিনি অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। কিন্তু এক মুহূর্তের মধ্যেই সামলে নিয়ে আমাদের দিকে ফিরে বললেন, পোড়ারমুখো ট্রেন আসতে আজ বড্ড দেরি হবে মনে হচ্ছে।
পরিতোষ বললে, ট্রেনের সময় এখনও পেরিয়ে যায়নি।
ভদ্রমহিলা এবার জিজ্ঞাসা করলেন, তোমরা এই ট্রেনেই যাবে তো?
বললুম না, আজ আমরা কলকাতায় যাব না, এইখানেই একটু কাজ আছে।
এখানে! এই পাণ্ডববর্জিত দেশে আবার কি কাজ বাবা?
আছে একটু কাজ।
ভদ্রমহিলা বলেই চললেন, কলকাতা গিয়েই আমার সঙ্গে দেখা করবে, মাকে ভুলো না যেন। অমুক জায়গায় অমুক নম্বরের বাড়িতে গিয়ে বলবে, রাণুমা’র সঙ্গে দেখা করব। যখন খুশি যাবে, ভুলো না যেন। আমার স্বামীর নাম এই দেখ প্যাটরাটার গায়ে লেখা রয়েছে–মনে থাকবে তো?
বললুম, নিশ্চয় থাকবে।
ওদিকে আমাদের চারদিকে ভিড় ও সেইসঙ্গে কোলাহল বাড়তে আরম্ভ করলে। সেই তালে ভদ্রমহিলাও চঞ্চল হয়ে উঠতে লাগলেন। শেষকালে আর থাকতে না পেরে আমার নাম ধরে ডেকে বললেন, দেখ তো বাবা, উনি গেলেন কোথায়? বোধ হয় এই ইস্টিশান-মাস্টারের ঘরে বসে আড্ডা দিচ্ছেন। আড্ডা পেলে আর কিছু মনে থাকে না। এই মানুষকে ফেলে গিয়ে কি করে আমার দিন কাটে তা ভগবানই জানেন। ওদিকে বাবার যে কি কষ্ট! তোমরা যে মেয়েমানুষ হয়ে জন্মাওনি–বেঁচে গেছ। মেয়েমানুষের মনের কষ্ট মেয়েমানুষ ছাড়া আর কেউ বুঝতে পারে না।
যা হোক, মেয়েমানুষের কষ্ট বোঝবার আর অধিক চেষ্টা না করে আমি উঠে প্ল্যাটফর্মে ঢুকে স্টেশন-মাস্টারের ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালুম। দেখলুম, ঘরের মধ্যে একটা গোল টেবিল ঘিরে রেল-কোম্পানির কালো কোট ও গোলটুপি পরা জনা-তিনেক লোক বসে আছে, আর আমাদের ইনি দাঁড়িয়ে চিৎকার করে হিন্দি ভাষায় তাদের কি-সব বলছেন, আর তারা থেকে থেকে হাসিতে ফেটে পড়ছে।
দরজার কাছে আমি দাঁড়িয়েই আছি, ভদ্রলোক একবার ফিরেও দেখলেন না। হঠাৎ একবার চোখে চোখ পড়তেই তিনি ভেতর থেকে চিৎকার করে উঠলেন, এই যে ভায়া!
তার পর ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বললেন, তুমি বোধ হয় মনে করলে, শালা টিকিট-দুখানা নিয়ে সরেই পড়ল। আরে, সরব কোথায়, আমার সর্বস্ব যে তোমাদের কাছে জিম্মে করে এসেছি। পালাবার আর কি পথ আছে!
বলেই হো-হো করে হেসে উঠলেন।
বললুম, না না, তা নয়। আমি সেজন্য আসিনি, মানে, আপনার স্ত্রী ডাকছেন আপনাকে।
ও! ডাকছেন বুঝি আমাকে? বলো-গে, এক্ষুনি আসছি আমি, কোনো ভয় নেই, ট্রেন খুব লেট।
আমি চলে আসছি, এমন সময় ভদ্রলোক আমাকে ডেকে বললেন, ভায়া শোন।
কাছে যেতেই বললেন, স্টেশন-মাস্টারকে টিকিট-দুখানা দেখালুম, সে বললে, ঠিক আছে। হাওড়ার টিকিটের দাম হয় ছ’টাকা ক’আনা। আমি তোমাকে পাঁচটি টাকা দিচ্ছি ব্রাদার।
ব্যাগ থেকে পাঁচটি টাকা বের করে আমার হাতে দিয়ে বললেন, কেমন খুশি তো? এতে তোমাদেরও কিছু হয়ে গেল, আমারও কিছু লাভ হল। ভাই, বিদেশে ডাকঘরের কেরানিগিরি করি. এই করেই চালিয়ে নিতে হয়। রাগ করলে না তো?
বললুম, না না, রাগ করব কেন? আপনি আমাদের উপকারই করলেন।
ফিরে আসছিলুম, আমাকে ডেকে বললেন, ভায়া, আমার স্ত্রীকে এসব কথা বলো না যেন।
না, না, কি দরকার!–বলে টাকা ‘কটি ট্যাকে গুঁজতে গুঁজতে ফিরে এলুম। অপ্রত্যাশিতভাবে টাকা পাঁচটি পেয়ে বুক যেন দশহাত হয়ে গেল। প্রহার ও অনাহারজনিত শারীরিক গ্লানি কোথায় যে, উবে গেল কি বলব! অর্থ এমনই সালসা!
লম্বা-লম্বা পা ফেলে ঘরের মধ্যে গিয়ে দেখি, পরিতোষের বাঁ-হাতের তেলোয় পর্বতপ্রমাণ লুচির দিস্তে, তার ওপরে চুড়োর মতন খানিকটা তরকারি। তার চোয়াল-দুটো ঢেঁকির মতন উঠছে আর পড়ছে।
আমি কাছে আসতেই রাণুমা বললেন, তুমি তো বড় দুষ্টু ছেলে বাছা! সারাদিন খাওয়া হয়নি–এ-কথা মাকে বলতে হয়। কিরকম ছেলে তুমি আমার?
দস্তুরমতন মিলিটারি সুরে আমায় হুকুম করলেন, বস এখানে।
পরিতোষের পাশে বসে পড়লুম। রাণুমা একটা বড় গোল পেতলের কৌটো-গোছের বাক্স খুলে তার ভেতর থেকে একতাড়া লুচি ও খানিকটা আলু-প্যাজের চচ্চড়ি তার ওপরে চাপিয়ে আমাকে দিয়ে বললেন, খাও।
সারাদিন অনাহারের পর সে-খাবার যে কি ভালো লাগল, তা কি করে বোঝাব। প্রতি গ্রাসে মনে হতে লাগল, যেন ছ’মাসের পর পথ্যি পাচ্ছি।
রাণুমা বকবক করে বকে যেতে লাগলেন। জানি না, এরই মধ্যে পরিতোষ তাঁকে কি বলেছিল! তিনি বলতে লাগলেন, শখ করে এ-কষ্ট ভোগ করা কেন? ভালো ঘরের ছেলে তোমরা, এত কষ্ট কি সহ্য হবে? আমি যদি এখানে থাকতুম, তা হলে নিশ্চয় ধরে নিয়ে যেতুম তোমাদের, ইত্যাদি।
ইতিমধ্যে বাইরে প্ল্যাটফর্মে ঢং-ঢং করে ঘণ্টা বেজে উঠল। ওদিকে ঘরের ঘুলঘুলি গেল খুলে, আর সেখানে শুরু হল গুঁতোগুঁতি আর হুড়োহুড়ি।
মিনিট পাঁচ-সাত বাদে রাণুমার স্বামী অর্থাৎ সম্পর্কে আমাদের রাজাবাবা হন্তদন্ত হয়ে এসে ব্যাপার দেখে স্ত্রীকে বললেন, কি লাগিয়েছ?
রাণুমা নির্বিকারভাবে বললেন, ছেলেগুলোকে খাওয়াচ্ছি। সারাদিন না খেয়ে আছে, তা বাছারা কি আমায় আগে বলেছে! কথায় কথায় বার করে নিলুম।
ভদ্রলোক মুখে একটা ঔদাস্যের ভাব এনে ফরাসি কায়দায় হাতের তেলো-দুটোকে চিতিয়ে এক ভঙ্গি করে মুটেদের দিকে ফিরে বললেন, এইজন্যেই শাস্ত্রে বলেছে–মেয়েদের নিয়ে পথে বেরুতে নেই।
ভদ্রমহিলা স্বামীর দিকে মুখ তুলে বললেন, তা নিয়ে বেরুলে কেন? একলা পাঠিয়ে দিলেই হত।
ভদ্রলোক স্ত্রীর কথার কোনো জবাব না দিয়ে সশব্দে একটা নিশ্বাস ফেলে মুটেকে বললেন, ওরে, এই বিছানাটা তুলে নে।
মুটের পেছু পেছু তিনিও প্ল্যাটফর্মে ঢুকে গেলেন।
পরিতোষের খাওয়া প্রায় শেষ হয়ে এসেছিল। আমি তাড়াতাড়ি করে গিলতে আরম্ভ করেছি দেখে রাণুমা বললেন, তাড়াতাড়ি কোরো না বাবা, ধীরে সুস্থে খাও।
মিনিট দু-তিন যেতে-না-যেতে আমাদের রাজাবাবা লাফাতে লাফাতে এসে বললেন, ওগো, উঠে পড়, সিগ্ন্যাল পড়ে গেছে।
রাণুমা ঝঙ্কার দিয়ে উঠলেন, পড়ুক-গে, পোড়ারমুখোরা এতক্ষণ করছিল কি! ছেলেগুলোকে খেতে দিয়েছি, এখন যত রাজ্যের সিংগেল পড়বার তাড়া লেগে গেল!
আমি এতক্ষণে বাকি দু-তিনখানা লুচি ও তরকারিটুকু ঠেলে মুখগহ্বরে পুরে দিয়ে সেগুলিকে গন্তব্যস্থানে পৌঁছে দিবার চেষ্টা করতে লাগলুম।
রানুমা কিন্তু স্বামীর তাগাদায় ভ্রূক্ষেপ না করে আবার বালতিটা টেনে এনে তার ভেতর থেকে আর-একটা কাপড়ে-মোড়া কৌটো বার করে ন্যাকড়ার গাঁট খোলবার চেষ্টা করতে লাগলেন। ওদিকের ব্যাপার দেখে রাজাবাবা পাছা চাপড়ে একরকম নৃত্য করতে করতে গলা দিয়ে একটা অস্বাভাবিক সরু ও করুণ সুর বের করে গান শুরু করে দিলেন। গানের ভাষা হচ্ছে–হ্যায় হায়! আজ নেঘাত ট্রেন ফেল করালে দেখছি–
রানুমা নির্বিকার। স্বামীর নৃত্যগীতে ভ্রূক্ষেপ না করে ধীরে সুস্থে ন্যাকড়ার গাঁট খুলে বড় কৌটোর ভেতর থেকে আর-একটা ছোট কৌটো বের করে সেটার ঢাকনা খুলে দুটো প্যাড়া বের করে আমাদের দুজনের হাতে দিয়ে আবার কৌটো বাঁধতে লাগলেন।
রাজাবাবা আর সহ্য করতে না পেরে হেঁট হয়ে পরিতোষের একখানা হাত ধরে বললেন, চল ভায়া, প্ল্যাটফর্মের জলে তোমাদের জল খাইয়ে আনি।
আমরা দাঁড়িয়ে উঠলুম। ভদ্রলোক তাড়া দিয়ে মুটের মাথায় সেই বিরাট ট্রাঙ্ক তুলে দিয়ে বালতিটা টপ করে হাতে নিয়ে প্ল্যাটফর্মের দিকে দৌড় দিলেন।
প্ল্যাটফর্মে পৌঁছবার পূর্বেই বিরাট গর্জন করতে করতে ট্রেন এসে উপস্থিত হল। জল খাওয়া তখনকার মতন বন্ধ করে ছুটোছুটি করে খালি কামরার খোঁজ করতে লাগলুম। ট্রেনে বেশি ভিড় ছিল না। একটা দু-বেঞ্চিওয়ালা সরু কামরা খালি আছে দেখে সেইটেতে তুলে দিয়ে আমরা দরজার কাছে দাঁড়ালুম। গাড়ি বেশিক্ষণ দাঁড়াবে না, জল পরে খেলেও চলবে।
রাজাবাবা মুটে বিদেয় করতে করতে রাণুমা জিনিসপত্র গুছিয়ে জানলার ধারে এসে বসলেন।
আবার ঢং-ঢং করে কতকগুলো ঘণ্টা পড়ল। রাজাবাবা আমাদের বললেন, ভাগ্যে ভায়ারা ছিলে, তাই তাড়াতাড়ি উঠতে পারলুম।
রাণুমা স্বামীকে দমক দিয়ে বললেন, ভায়া আবার কি! ওরা আমার ছেলে যে।
ওঃ, ছেলে নাকি? তা আগে বলতে হয়! জানো বাবা, তোমাদের এই মা একটু রাগী মানুষ বটে, কিন্তু মনটা বড় ভালো–
তুমি থাম।–বলে রাণুমা আমার নাম ধরে বললেন, কলকাতায় গিয়েই দেখা করবে, ওই পরিতোষ ছেলের কাছে ঠিকানা-পত্র সব লিখে দিয়েছি, রাণুমাকে ভুলো না যেন-
বলতে বলতে ট্রেন ছেড়ে দিলে।
রাণুমাকে ভুলিনি, নিশ্চয় ভুলিনি। তবে তাঁর সঙ্গে দেখা-করাটা আর হয়ে ওঠেনি মাসকয়েক বাদে কলকাতায় ফিরে এসেছিলুম বটে, কিন্তু পরিতোষের বাবার তখন খুবই অসুখ। বোধ হয় সপ্তাহখানেক বাদেই তারা চলে গেল পশ্চিমের এক শহরে হাওয়া বদলাতে। আমি যাই-যাই করতে করতে দিন পনেরোর মধ্যেই শয্যাশায়ী হয়ে পড়লুম একজ্বরে। অনভ্যাস-অত্যাচারের শোধ প্রকৃতি সুদে-আসলে তুলে ছাড়লেন। রোগশয্যা ত্যাগ করার কিছুদিনের মধ্যে আবার আমাকে বেরুতে হল পথের আহ্বানে।
রাজুমা’র সঙ্গে জীবনে আর দেখা হয়নি বটে, কিন্তু রাণুমাকে ভুলিনি। অতীত দুর্দিনের পটভূমিতে মেঘাচ্ছন্ন আকাশে অকস্মাৎ সূর্যোদয়ের মতন প্রসন্নময়ী সেই মাতৃমুখ মনের মধ্যে ফুটে উঠেছে আর শ্রদ্ধায় মাথা নুয়ে পড়েছে। দূর অতীতের সেই এক সন্ধ্যায় প্রহারজর্জর, ক্ষুৎপিপাসাকাতর এই দুটি বালকের মুখে অযাচিত অন্ন দিয়ে যে রক্ষা করেছিল, তাকে কি কখনও ভুলতে পারি! জীবনের সেই দারুণ দুঃসময়ে হঠাৎ পথে-কুড়িয়ে-পাওয়া মাকে আজ আমি প্রণাম জানাচ্ছি। বন্ধু পরিতোষ আজ কাছে নেই, তার হয়েও আমি হৃদয়ের কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। জানি, আমাদের নিবেদন ব্যর্থ হবে না।
ট্রেন প্ল্যাটফর্ম থেকে বেরিয়ে যেতে-না-যেতে টপ টপ করে আলোগুলো সব নিবিয়ে দেওয়া হল। প্ল্যাটফর্মের কলে আকণ্ঠ জল পান করে আবার আমরা যাত্রীগৃহে ফিরে এলুম। বোধ হয় মিনিট পনেরোর মধ্যেই চারিদিক একেবারে নিশুতি হয়ে পড়ায় আমরা দুটো বেঞ্চি দখল করে ঘুমের সাধনায় মন দিলুম।
ঘুম জিনিসটা প্রাণীজগতে ঈশ্বরের এক অদ্ভুত দান। সন্ধ্যায় যে মাতা উপযুক্ত পুত্র হারিয়েছে, কাঁদতে কাঁদতে শেষরাত্রে অন্তত কিছুক্ষণের জন্যও সে ঘুমের কোলে ঢলে পড়ে–আমরা তো কোন ছার! সারারাত্রি কখনও ঘুম কখনও জাগরণ, এই করতে করতে রাত্রি ভোর হয়ে গেল। সকালবেলা দু-তিন কাপ চা খেয়ে ধাতস্থ হয়ে প্ল্যাটফর্মের কলে স্নান করে র্যাপার পরে ধুতি শুকিয়ে নিয়ে ঘণ্টাখানেক বাদে চায়ের দোকান থেকে দুজনে আধ সের করে দুধ মেরে বেরিয়ে পড়া গেল অনির্দিষ্ট যাত্রায়। ট্যাকে টিকিট-বিক্রয়-লব্ধ পাঁচটি টাকা, কাছায় বাঁধা একটি আংটি আর পরিতোষের পকেটে কয়েক আনা–এই মাত্র সম্বল।
স্টেশনের সামনে যে রাস্তাটার খানিকটা রাত্রে দেখা যাচ্ছিল, সেটা বেশি লম্বা নয়। একটু দূরে গিয়ে অপেক্ষাকৃত সরু কিন্তু বেশ ভালো একটা উত্তর-দক্ষিণমুখো সড়কে পড়ে আমরা উত্তরমুখো চলতে আরম্ভ করে দিলুম।
ছোট্ট শহর। আমরা যে রাস্তা ধরে অগ্রসর হতে লাগলুম, তার দু-দিকে কোনো কোনো জায়গায় ঘন খোলার চালের বসতি। কদাচিৎ দু-একখানা ইটের একতলা কি দোতলা বাড়ি চোখে পড়ল। মধ্যে মধ্যে রাস্তার দু-পাশেই চষা মাঠ, মাঝে মাঝে কোনো ক্ষেতে ফসল দেখা যাচ্ছে। চলতে চলতে ছোট্ট বাজার অর্থাৎ খান-তিন-চার-দোকানওয়ালা একটা জায়গায় এসে একজন মুরুব্বিগোছের লোককে জিজ্ঞাসা করলুম, এ রাস্তা কোথায় গিয়েছে?
লোকটা গম্ভীরভাবে বললে, গয়াজী।
পরিতোষকে বললুম, ভালোই হল, চল, গয়াতেই যাওয়া যাক।
আরও কয়েক মাইল গিয়ে আর-একজনকে জিজ্ঞাসা করলুম, হ্যাঁ বাবা, এ রাস্তা কতদূর গিয়েছে?
লোকটি বললে, বিহারশরীফ তক্।
কথাটা শুনে একটু দমে গেলুম। কারণ বিহারশরীফ মানুষের নাম, না, জায়গার নাম, তা অনেক গবেষণা করেও ঠিক করতে পারলুম না। বিশুদার ওখানে যতটুকু উর্দুজ্ঞান হয়েছিল, তাতে শরীফ কথাটি মানুষের মেজাজের প্রতি প্রযোজ্য, সেটি যে জায়গার পেছনেও ব্যবহৃত হয়ে থাকে সে-জ্ঞান আমাদের হয়নি, এইজন্যেই বলে–অল্পবিদ্যা ভয়ঙ্করী!
আরও কতদূর অগ্রসর হয়ে এক ব্যক্তিকে ওই প্রশ্ন করায় সে বললে, পাটনাশরীফ তক্। এতক্ষণে শরীফ-মাহাত্ম্য হৃদয়ঙ্গম করে জিজ্ঞাসা করলুম, এখান থেকে পাটনাশরীফ কতদূর হবে?
লোকটি মনে মনে কি হিসাব করে বললে, তা ষাট-সত্তর মিল হবে।
যা হোক, হিসাব করে ঠিক করা গেল যে, এই রাস্তা হয় বিহারশরীফ, আর না-হয় পাটনা, আর না-হয় গয়া অবধি পৌঁছেছে, রাস্তা শেষ হতে এখনও ষাট-সত্তর মাইল বাকি আছে।
চলতে চলতে শহর গ্রাম পেরিয়ে গেলুম। দু-পাশে শস্যক্ষেত্র, তারই মাঝখান দিয়ে সোজা রাস্তা বেয়ে আমরা এগিয়ে চলেছি মন্থরগতিতে, পথের শেষ কোথায় কে জানে!
ক্রমে মধ্যাহ্ন-সূর্য পশ্চিমে ঢলে পড়ল। বোধ হয় সকাল থেকে দশ-বারো মাইল পথ অতিক্রম করেছি। জুতোর অবস্থা আগে থাকতেই ছিল খারাপ, এতখানি পথ চলার ফলে তারা মুখব্যাদান করে চিৎকার করতে আরম্ভ করলে, ছেড়ে দে বাবা, কেঁদে বাঁচি। তাদের প্রতি মায়াপরবশ হয়ে জুতো হাতে করে চলতে শুরু করলুম। সেইদিন প্রথম বুঝতে পারলুম যে, খালি-পায়ে হাঁটাও অভ্যেস করতে হয়।
সারাদিন পথশ্রমে দেহও বিশ্রাম চাইছিল। সকালবেলা ইস্টিশানের সেই আধ সের দুধ কখন হজম হয়ে গিয়েছে, ক্ষিধের চোটে মনে হতে লাগল, পেটের মধ্যে যেন দধি-মন্থন চলেছে।
সম্মুখেই রাত্রি, কিন্তু আশ্রয় কোথায়? পথের দু-দিকে মাঠের প্রান্তে, সেই একেবারে দিগন্তে বললেই হয়, সেখানে বোধ হয় গ্রাম আছে; কিন্তু সেই দিগন্ত-বিস্তৃত মাঠ পার হবার সাহস নেই। দেখলুম রাস্তা দিয়ে দু-তিন দল রাখাল পাল-পাল গরু নিয়ে চিৎকার করে বেসুরো গান গাইতে গাইতে গেল–কোথায় গেল কে জানে! চলেছি তো চলেইছি, কিন্তু আর যে পা চলে না!
সূর্য তখন প্রায় ডুবে গেছে, এমন সময় আমরা একটা গ্রামের মতন জায়গায় এসে পৌঁছলুম, অর্থাৎ দু-একটা লোক পথে দেখা গেল, একটা বলদের গাড়িও যেতে দেখলুম।
রাস্তার ধারেই বেশ একটু উঁচু জায়গায় একটা ছোট পুকুর, বাংলাদেশের বড় ডোবার মতন হবে, তার চারিদিকে ঘন তালগাছের সারি। একটা গাছ থেকে আর-একটার ব্যবধান বোধ হয় দশ হাতও হবে না, কোথাও-বা জোড়া জোড়া গাছ একসঙ্গে উঠেছে। আমরা পথ ছেড়ে এই উঁচু জায়গাটাতে উঠে একজোড়া তালগাছের তলায় বসে বিশ্রাম করতে লাগলুম
পুকুরটাতে জল নেই বললেই হয়। তবুও মুখ ধোবার জন্যে পাড় বেয়ে জলের ধারে গিয়ে দেখলুম, অত্যন্ত নোংরা জল। মুখ না ধুয়েই উঠে এসে আবার সেইখানে বসলুম। জীবনে এতখানি পথ কখনও হাঁটিনি। অঙ্গের বেদনায় তালগাছের গুঁড়িতে দেহ এলিয়ে দেওয়া গেল।
বসে বসে দেখতে লাগলুম, মাথার ওপর দিয়ে দু-তিন-ফ্ল বক উড়ে গেল। একটু দূরেই রাস্তার দু-ধারে দুটো বড় গাছ, তার মধ্যে পাখিদের কচকচিতে সেই নিস্তব্ধ জায়গাটা যেন ভরে উঠল, কিন্তু তা অতি অল্পক্ষণেরই জন্য, তার পরেই সব স্তব্ধ। দূরে পশ্চিমে সূর্য ডুবে গেল। গোধূলির শেষরশ্মিতে দেখলুম, পরিতোষের চোখ-দুটো প্রায় বন্ধ হয়ে এসেছে। অন্ধকার একেবারে ঘনিয়ে ওঠবার আগেই বৃক্ষমূলে সে দেহ বিছিয়ে দিলে।
চারিদিক অন্ধকার হয়ে গেল। পরিতোষ ঘুমিয়ে পড়েছে, বসে বসে আমার ভয় করতে লাগল, এই অন্ধকারে কি সারারাত্রি কাটাতে হবে। মুখ ধুতে যাবার সময় পুকুর পাড়ে গোটাকয়েক শুকনো তালের পাতা দেখেছিলুম, মনে হল, সেগুলো টেনে নিয়ে এসে আগুন ধরালে মন্দ হয় না, কিন্তু কি জানি, সেখানে নামতে সাহস হল না। পরিতোষকে ধাক্কা দিয়ে তোলবার চেষ্টা করলুম, কিন্তু অদ্ভুত তার ঘুম! কি কতকগুলো বিড়বিড় করে বকে সেই ধূলিশয্যায় পাশ ফিরে শুল।
অন্ধকারে উৎকর্ণ হয়ে বসে আছি, মধ্যে মধ্যে কাছে দূরে কড়কড় সড়সড় আওয়াজ হতে লাগল। দেশলাই জ্বালিয়ে যতটুকু আলো পাওয়া যায়, তাই দিয়ে দেখে নিশ্চিন্ত হবার চেষ্টা করতে লাগলুম–তারপরে শান্তিময়ী নিদ্রা এসে কখন কোলে তুলে নিলে জানতেও পারিনি।
ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখতে লাগলুম–দিদিমণির সঙ্গে তার শ্বশুরবাড়ির দেশে গিয়েছি–রাজপুতানার পাহাড়ের কোলে স্বর্গের মতন সেই সুন্দর দেশে। পাহাড়ে হচ্ছে তুষার-বর্ষণ ও সেইসঙ্গে পড়ছে বড় বড় বাঁশের লাঠির মতন মোটা ও লম্বা মালাইয়ের কুলপি দু-হাতে করে সেই কুপি-বরফ খাচ্ছি, কিন্তু পেট ভরছে না কিছুতেই। দিদিমণি ঘরের ভেতর থেকে চ্যাচাচ্ছে–খাবার তৈরি হয়েছে, এবার খেতে এস। কিন্তু খেতে যাওয়াটা যে, কেন হচ্ছে না, তা কিছুতেই বুঝতে পারছি না।
হঠাৎ কিসের একটা শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। দেখি, পরিতোষের মতন আমিও ধূলিশয্যায় লম্বা হয়ে পড়ে আছি। কোন দূরে যেন কারা গান গাইছে! তাড়াতাড়ি উঠে বসে আবার পরিতোষকে ধাক্কা দিয়ে তোলবার চেষ্টা করলুম, কিন্তু সে কোনো সাড়াই দিলে না।
দেখলুম, মাথার ওপরে একটুখানি চাঁদ উঠেছে, রাস্তায় খানিকটা আলো ও খানিকটা অন্ধকার। বড় গাছ-দুটোর লম্বা ডালপালার ছায়া পড়ছে রাস্তার ওপরে।
রাস্তার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে আছি। মধ্যে মধ্যে একটা দমকা হাওয়া গাছগুলোর ঝুঁটি ধরে নাড়া দিয়ে যাচ্ছে, আর সঙ্গে সঙ্গে রাস্তার সেই ঘুমন্ত ছায়ানটীদের মধ্যে সাড়া জাগছে। থেকে থেকে ওপর দিয়ে নাম-না-জানা রাতপাখির দল চিৎকার করতে করতে উড়ে যাচ্ছে–নিস্তব্ধ নৈশ প্রকৃতির বুকে করাত চালিয়ে দিয়ে। মনের মধ্যে একটার পর একটা চিন্তার ঢেউ উঠছে। রাজকুমারী, চাটুজ্জে, দিদিমণি, বদ্যিনাথ, বাঙাল-মা, বড়কর্তা, বিশুদা, গিরিধারীর মুখ তালগোল পাকাতে পাকাতে আবার ঘুমিয়ে পড়লুম।
এবার অনেকক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলুম। কিসের একটা বিশ্রী উগ্র গন্ধে ঘুম ভেঙে যেতেই চোখ খুলে দেখি, প্রায় আমার নাকের ডগায় একটা জানোয়ারের মুখ! তার চোখ-দুটো পড়ন্ত চাঁদের আলোয় জ্বলজ্বল করছে।
বাপ রে!–বলে ধড়মড় করে উঠে বসতেই জন্তুটা ভড়কে চার-পাঁচ হাত পেছনে হটে গিয়ে আবার জ্বলজ্বল চোখ দিয়ে আমায় নিরীক্ষণ করতে লাগল।
শীতের রাত্রিশেষ। সারারাত রাস্তায় শুয়ে স্রেফ কাঁপুনির চোটে মুহূর্মুহূ ঘুম ছুটে যাচ্ছিল, হঠাৎ এই নতুন আপদের সম্মুখীন হয়ে দরদর করে কালঘাম ছুটতে আরম্ভ হল। জানোয়ারটা তখনও আমার দিকে তেমনই ভাবে চেয়ে। ভয়ে আমার কথা বন্ধ হয়ে গেলেও চক্ষু সজাগ ছিল। দেখলুম, শেয়ালের মতন চেহারা হলেও সেটা শেয়াল নয়, শেয়ালের চাইতে অনেক বড়। ঘাড়ের চারিদিকে ঘন কেশর, মাথার দিকটা উঁচু অর্থাৎ সামনের পা দুখানা অপেক্ষাকৃত বড় আর ল্যাজের দিকটা নীচু। মিনিটখানেক তার দিকে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে আছি, হঠাৎ উঠে মারব দৌড়–এইরকম একটা সঙ্কল্প আঁটছি মনে মনে, এমন সময় খসখস শব্দ হতে পাশের দিকে চেয়ে দেখি, আরও চার-পাঁচটা জানোয়ার নিকটে ও দূরে ঘোরাফেরা করছে। অতগুলোকে একসঙ্গে দেখে আমার মনে হল, নিশ্চয় এ নেকড়ের পাল, কারণ নেকড়েরা যে দলবদ্ধ হয়ে শিকার খুঁজতে বেরোয়, সে-কথা ছেলেবেলা থেকে বইয়ে পড়ে এসেছি। যাঁহাতক সেই কথা মনে হওয়া অমনই সেই উঁচু জায়গা থেকে গড়িয়ে নীচে পড়েই চিৎকার করতে আরম্ভ করে দিলুম, পরিতোষ, উঠে পড়, আমাদের নেকড়ে বাঘে অ্যাটক্ করেছে। পরিতোষ, বাঁচতে চাস তো এখনও ওঠ। পরিতোষ, আমি পালাচ্ছি।
আমার ওইরকম চিৎকার শুনে জানোয়ারগুলো একটি করে লাফ মেরে মারলে দৌড় ওদিককার মাঠে, ক্ষীণ চাঁদের আলোতে দেখতে পেলুম, রামদৌড় দৌড়ে তারা অদৃশ্য হয়ে গেল।
এমন একটা সাংঘাতিক ফ্যাসাদ থেকে যে এত সহজে উদ্ধার পাব, তা কল্পনাও করতে পারিনি। জানোয়ারগুলোর পলায়নের ধরন দেখে তৃতীয় পক্ষ হয়তো বুঝতেই পারত না, ভয়টা বেশি পেয়েছিল কে! আমি, না তারা?
যা হোক, একেবারে নিশ্চিত্ত হয়ে আবার উঠে পরিতোষের কাছে গেলুম। এতক্ষণে দেখি, সে মুখের কাপড়টা সরিয়ে শুয়ে শুয়েই জুলজুল করে চাইছে। আমাকে দেখে সে ধীরে-সুস্থে উঠে ধরা-ধরা গলায় জিজ্ঞাসা করলে, কি রে, ষাঁড়ের মতন চ্যাঁচাচ্ছিলি কেন?
তার সেই নিশ্চিন্ত বেপরোয়া ভাব দেখে রাগে আমার গা জ্বলে উঠল। বললুম, কুম্ভকর্ণের মতন ঘুমোও, এখুনি যে নেকড়ের পাল এসেছিল তার খোঁজ রাখ?
পরিতোষ সেইরকম ভাঙা গলায় বললে, এঃ, হেঁটে-হেঁটে তোর মাথাটা একদম গরমে গিয়েছে দেখছি। স্বপ্ন দেখছিলি বুঝি?
দেখলুম, তখনও তার চোখ থেকে ঘুমের ঘোর একেবারে কাটেনি। আমি রেগে সেখান থেকে সরে একটু দূরে গিয়ে বসে রইলুম।
আকাশে চাঁদ ক্রমেই নিষ্প্রভ হতে থাকল। পূর্বদিগন্তে একটু ক্ষীণ আলোর রেখা দেখা দিল। দূর থেকে দেখতে লাগলুম, পরিতোষ আবার শুয়ে পড়ল। আরও কিছুক্ষণ এপাশ-ওপাশ করে উঠে ধীরে ধীরে এসে আমার পাশে বসে বললে, কি রে, রাগ করলি?
বললুম, না, রাগ করব কেন? সারারাত কুম্ভকর্ণের মতন ঘুমোবে, তোমার এই ঘুমের জন্যে কোনদিন নেকড়ের পেটে চলে যাব, তবুও তোমার ঘুম ভাঙবে না।
পরিতোষ আর কথা না বাড়িয়ে চুপ করে বসে রইল। কিছুক্ষণ চুপচাপ কাটবার পর সে বলে, এর আগে নেকড়ে বাঘ কখনও দেখেছিলি?
বললুম, কেন, আলিপুরের চিড়িয়াখানায় নেকড়ের পাল আছে।
পরিতোষ চুপ করে রইল। ব্যাপারটার ওপরে আরও খানিকটা গুরুত্ব চাপাবার জন্যে বললুম, শুনেছি, এইসব জায়গায় নেকড়ে বাঘের ভারি উপদ্রব।
এতক্ষণে ব্যাপারটি অনুধাবন করে পরিতোষবাবুর মুখ শুকিয়ে গেল। সে জিজ্ঞাসা করলে, কতগুলো এসেছিল রে?
সত্যি কথা বলতে কি, কতগুলো যে এসেছিল তা দেখবার মতন মানসিক অবস্থা সে-সময় ‘আমার ছিল না। যতদূর মনে পড়ে, পাঁচ-ছ’টা জানোয়ার দেখেছিলুম। তবুও অবস্থার গাম্ভীর্য বাড়াবার জন্যে বললুম, সে-সময় কি আর গুনে দেখবার মতন মনের অবস্থা ছিল? তবুও দেখে মনে হল, পঞ্চাশ-ষাটটা হবে।
পঞ্চাশ-ষাটটা নেকড়ে বাঘের কথা শুনে পরিতোষ এবার দস্তুর মতন দমে গেল।
প্রায় ঘণ্টাখানেক চুপ করে বসে ও তারই মধ্যে বেশ এক পক্কড় ঘুম মেরে চাঙ্গা হয়ে পরিতোষ বললে, চল্, ওঠা যাক।
তখন বেশ রোদ উঠে গিয়েছে। রাস্তা দিয়ে দু-চারজন লোক ও একটা গরুর গাড়িও চলে যেতে দেখা গেল। আমরা পথে নেমে আবার চলতে শুরু করলুম। পথের শেষ কোথায়!
আধ ঘণ্টা অতীত হতে-না-হতে বেশ টের পেতে লাগলুম, কালকের মতন মনের উৎসাহ বা শরীরের শক্তি আজ আর নেই। খানিকটা পথ এগিয়ে যাই, আবার রাস্তার ধারে কিছুক্ষণ করে বিশ্রাম করি–এইভাবে চলতে চলতে প্রায় মাইল-আষ্টেক পথ অতিক্রম করে আমরা গ্রাম অথবা সেইরকম একটা কোনো জায়গায় এসে পৌঁছলুম। কিছুদূর এগিয়েই একটা বাজার দেখা গেল। দু-তিনখানা একতলা ইটের আর বাকি সব খোলার বাড়ি। গোটা-দুয়েক মুদির দোকান, একটি মাত্র ময়রার দোকান–খাদ্যের মধ্যে দেখলুম, একতাল গুড়ের জিলিপি পড়ে রয়েছে একটা তেলচিটে ময়লা বারকোশের ওপর। জিলিপিগুলোতে বোলতা ও রাজ্যের শ্যামাপোকা লেপটে রয়েছে অর্থাৎ সেগুলো নিরামিষ কি আমিষ তা বিচার করবার প্রয়োজন হয়। দোকানের প্রায় সামনেই কতকগুলো বলদ বসে রোমন্থন করে চলেছে, তারই কিছু দূরে খানকয়েক গরুর গাড়ি। চারদিকে এমন অনেকরকমের তরকারি ও শাক বিক্রি হচ্ছে, যা এর আগে কখনও দেখিনি।
ক্ষিধের চোটে তখন আমাদের প্রায় অজ্ঞান হয়ে পড়বার মতন অবস্থা। মোদকের দোকানে ঢুকে খাবার-দাবারের অবস্থা বিচার করে দু-পয়সার চিঁড়ে ও চার পয়সার দই কিনে কাঁচা শালপাতায় তো মাখা গেল। কিন্তু সে দই কি টক্ রে বাবা! আবার পয়সা দুয়েকের একেবারে ধুলো-রঙের চিনি কিনে তাতে মাখলুম; কিন্তু তাতে মিষ্টি কিছুই হল না, টকের তীব্রতা একটু কম পড়ল মাত্র।
যা হোক, সেই খাদ্য উদরস্থ করে মোদকের কাছ থেকে জল চেয়ে নিয়ে খেয়ে সেইখানেই রাতটা কাটানো যেতে পারে কি না তারই জল্পনা করতে লাগলুম।
মোদককে বললুম, দেখ, আমরা পরদেশী লোক, আশ্রয়হীন। তোমার এখানে রাতটা কাটাতে পারি কি? সেজন্যে ভাড়া যা লাগবে আমরা দেব।
আমাদের প্রস্তাবটা শোনামাত্রই মোদক বললে, না বাপু। আমার এখানে পরদেশী লোক রাখি না, তোমরা অন্যত্র ব্যবস্থা কর।
মোদক এতক্ষণ আমাদের সঙ্গে হেসে কথা বলছিল, কিন্তু থাকতে দেবার প্রস্তাব শুনেই সে গম্ভীর হয়ে পড়ল। ভাবলুম, আজও বোধ হয় আমাদের জন্যে পথের ধারেই শোবার ব্যবস্থা হয়েছে। শরীর এমন ভেঙে পড়েছিল যে, মনে হতে লাগল, আজ রাতে বাইরে শুলে ঠান্ডায় মরে যাব, তার ওপরে নেকড়ের পাল কি আজও মুখের শিকার ফেলে পালিয়ে যাবে?
পরিতোষ জিজ্ঞাসা করলে, এখান থেকে রেলের ইস্টিশান কত দূরে?
মোদক হিসেব করে তিনটে স্টেশনের নাম করলে। তার প্রত্যেকটির দূরত্ব সেখান থেকে আট-দশ মাইলের কম নয়। একটু চিন্তা করে সে আবার বললে, এখান থেকে সকালবেলা রওনা হলে বিকেল নাগাদ সেখানে পৌঁছানো যায়।
তখন বোধ হয় বেলা তিনটে হবে, কোনো স্টেশনের দিকে রওনা হওয়া সুবিবেচনার কাজ নয়। তার ওপরে দু-দিন ধরে অতখানি করে হেঁটে দেহ ও মনের শক্তি প্রায় নিঃশেষিত হয়ে এসেছিল। কি করব, কোথায় যাব, সেই চিন্তায় অভিভূত হয়ে পড়লুম। আবার মোদককে জিজ্ঞাসা করা গেল, আচ্ছা, রাতের মতন এখানে কোথাও আশ্রয় পাওয়া যেতে পারে কি?
মোদক কিছুক্ষণ গুম হয়ে থেকে বললে, এই দেহাতে কোন গৃহস্থ অজানা পরদেশীকে ঘরে থাকতে দেবে বল? এ কি শহর?
একজন আধাবয়সি লোক সে-সময় দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে সেই শ্যামাপোকার তবক-চড়ানো জিলিপি কিনছিল ও আমাদের দিকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকাচ্ছিল। মোদকের কথা শুনে জিজ্ঞাসা করলে, কি হয়েছে?
মোদক তাকে বললে, এরা পরদেশী, রাত্রে এখানে থাকতে চায়। তা এখানে থাকবার জায়গা কোথায়? অজানা লোককে আশ্রয় দিয়ে কি শেষে ফ্যাসাদে পড়ব?
লোকটি জিলিপির ঠোঙা হাতে আমাদের কাছে এসে জিজ্ঞাসা করলে, তোমরা আজ রাতে এখানে থাকতে চাও?
বললুম, আমরা পথশ্রমে অত্যন্ত ক্লান্ত, দু-তিন দিন অনবরত হেঁটেছি, আজ আর নড়বার শক্তি নেই। যদি আজকের রাত্রের জন্য কোথাও একটু আশ্রয় পাই তো বেঁচে যাই।
লোকটি আমাদের কথা শুনে বেশ আগ্রহের সঙ্গে বললে, এর জন্যে কি হয়েছে! তোমরা পরদেশী, আমাদের গ্রামে এসে কি পথে পড়ে থাকবে?
তারপর মোদককে দেখিয়ে দিয়ে বললে, এ-ব্যাটা বেনিয়ার বাচ্চা, দাঁও না দেখলে কি ও জায়গা দেবে! এখানে আমাদের জমিদারির কাছারি আছে, সেখানে গিয়ে শুয়ে থাক, কেউ কিছু বলবে না।
কোথায় তোমাদের জমিদারের কাছারি বাবা?
উঠে এস, আমি তোমাদের সেখানে নিয়ে যাচ্ছি।
এতবড় আশ্বাস পেয়ে তখুনি তড়াক করে উঠে পড়া গেল। লোকটি আমাদের নিয়ে চলল এ-গলি সে-গলি দিয়ে। চলতে চলতে সে বলতে লাগল, আমাদের মালিক অর্থাৎ জমিদার, সে একেবারে দেবতা। হুকুম আছে যে, তাঁর এলাকার মধ্যে কোনো লোক আশ্রয়হীন বা অনাহারে না থাকে। তাঁর রাজ্যে কোনো পরদেশী আশ্রয়হীন হয়ে পথে পড়ে আছে শুনলে সে-দেশের সবাইকে তার ফল ভোগ করতে হবে। ও-ব্যাটা বেনের বাচ্চা তোমাদের ভড়কি দিয়ে সরিয়ে দেবার চেষ্টা করছিল। মেহমানের ইজ্জৎ ও কি করে বুঝবে?
জিজ্ঞাসা করলুম, তোমাদের জমিদার কে?
লোকটি ভক্তিভরে দেড়গজী লম্বা কি-একটা নাম বললে, গোড়ায় নবাব ও শেষে বাহাদুর ছিল, এইটুকু মনে আছে।
যা হোক, আমরা বড় একটা ইটের গোলাবাড়ির সামনে এসে পৌঁছলুম। বাড়ির সামনে ঘাসবিহীন মাঠে একজায়গায় বিস্তর গরুর গাড়ি পাশাপাশি সাজানো। বোধ হয় পঞ্চাশ-ষাটটা ধলদকে একদিকে খেতে দেওয়া হচ্ছে, মাটির ছোট ছোট উঁচু ঢিপি পাশাপাশি লাইন-বাঁধা, ঢিপির প্রত্যেকটাতে একটা করে মাটির গামলা বসানো। এই গামলাগুলোতে বলদদের খাবার দেওয়া হচ্ছে, আর তারা মিলিটারি কায়দায় পাশাপাশি দাঁড়িয়ে সশব্দে খেয়ে চলেছে।
লোকটি আমাদের নিয়ে বাড়ির মধ্যে ঢুকল। গেট পেরিয়ে প্রকাণ্ড উঠোন, লম্বা-চওড়ায় প্রায় দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ির উঠোনের সমান হবে, তবে বাঁধানো নয়। সেখানে বোধ হয় সারাদিন শস্য ঝাড়া হয়েছে। সে সময়ে পনেরো-ষোলোটি স্ত্রীলোক মিলে শুকনো তালপাতার গোছা দিয়ে সেই বিরাট উঠোন পরিষ্কার করবার চেষ্টা করছিল। আমরা নাকে কাপড় দিয়ে কোনোরকমে সেই মাঠ পার হয়ে একটা সরু গলিপথ দিয়ে অপেক্ষাকৃত একটা ছোট উঠোনে এসে পড়লুম। এ জায়গাটা বেশ পরিষ্কার। উঠোনের তিন দিকে সারি সারি ঘর, কোনো কোনো ঘরে লোকজন বসে কাজ করছে, দেখলেই বোঝা যায় জমিদারি সেরেস্তা।
এইরকম গোটাকয়েক ঘর পেরিয়ে এসে আমাদের অনুগ্রাহক একটা ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে গেল। এই ঘরের ভেতর ফরাশের বদলে চেয়ার টেবিল দেখা গেল বটে, কিন্তু সে-আসবাবের বয়স নির্ণয় করতে হলে প্রত্নতাত্ত্বিকের প্রয়োজন হয়। লোকটি বাইরেই দাঁড়িয়ে ভেতর দিকে উঁকি দিয়ে যেন কাকে খুঁজতে লাগল। বারান্দা দিয়ে একটা চাকর-গোছের লোক যাচ্ছিল, তাকে ডেকে সে জিজ্ঞাসা করলে, পাঁড়েজী কোথায়?
লোকটা চিৎকার করে উত্তর দিলে, ওই যে ভেতরে রয়েছে, যাও না চলে।
চাকর চলে যেতেই লোকটি ইঙ্গিতে তাকে অনুসরণ করতে বলে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ল। তারপর চেয়ার-টেবিলের গলি-ঘুঁজি ও দু-পাঁচটি লিখনরত কর্মচারীকে পেরিয়ে আমরা সেই নায়েব-নাজিমের সম্মুখীন হলুম।
দেখলুম, এক বৃদ্ধ, মাথা ন্যাড়া, সেই শীতে আদুড়-গায়ে চোখে ডাল-ভাঙা চশমা লাগিয়ে একটা প্রকাণ্ড খাতার মধ্যে মুখ জুবড়ে অত্যন্ত মনোযোগের সঙ্গে কি দেখছে। লোকটির সেই ন্যাড়া মাথা থেকে আরম্ভ করে কোমর অবধি ও দুই হাতের আঙুলের ডগা অবধি চন্দনের ছাপে রামরাম লেখা। সেই দৃশ্য দেখে পরিতোষ আমার কানে কানে বললে, এ যে চিতাবাঘের খপ্পরে এনে ফেললে!
পরিতোষের একখানা হাত জোরে টিপে তাকে চুপ করতে ইঙ্গিত করলুম। আমাদের সঙ্গের লোকটি কিছুক্ষণ সেইদিকে অবাক হয়ে চেয়ে থেকে হঠাৎ যেন ডুকরে উঠল, গোড় লাগে পাঁড়েজী! কথাটা কানে যাওয়া-মাত্র পাঁড়েজী খাতা থেকে মুখ না তুলেই চেঁচিয়ে উঠলেন, বেঁচে থাক বাবা, রামজী তোমার কল্যাণ করুন।
আরও খানিকটা বিড়বিড় করে কি বললেন, সেগুলো অভিশাপ না আশীর্বাদ, তা ঠিক বোঝা গেল না। তার পরে ধীরে-সুস্থে সেই বিরাট খাতা বন্ধ করে চশমা খুলতে খুলতে জিজ্ঞাসা করলেন, কে তুমি?
আমি শিউরতন। এই দুটি ভদ্রলোককে নিয়ে এসেছি আপনার কাছে।
বৃদ্ধ আমাদের দিকে চাইতেই আমরা ঘাড় নীচু করে অতি বিনীতভাবে নমস্কার করলুম। আবার তুবড়ির মতন খানিকটা আশীর্বাদ বর্ষণ করে হাসি-হাসিমুখে মুখে আমাদের দেখতে লাগলেন। শিউরতন বললে, অমুক বেনের দোকানে এরা রাত্রিটুকুর মতন আশ্রয় চাইছিল, তা আমি এখানে নিয়ে এসেছি।
বৃদ্ধ আমাদের জিজ্ঞাসা করলেন, কোথায় দেশ?
কলকাতায়।
কলকাতায় শুনে বৃদ্ধ কিছুক্ষণ অবাক হয়ে আমাদের নিরীক্ষণ করে আবার জিজ্ঞাসা করলেন, খাস কলকাতায়?
আজ্ঞে খাস কলকাতায়।
তা বিছানাপত্তর সঙ্গে আছে তো?
এ-কথার আর কি জবাব দেব, চুপ করে রইলুম। বহুদর্শী লোক, আমাদের অবস্থা বুঝতে বিশেষ দেরি হল না। সঙ্গের লোকটিকে বললেন, আচ্ছা, তা হলে ওঁদের মুসাফিরখানায় নিয়ে যাও।
শিউরতন আবার তাঁকে ভক্তিভরে নমস্কার করে আমাদের বললে, আসুন। আবার সেই চেয়ার-টেবিল পেরিয়ে বাইরে এসে সামনের উঠোন পেরিয়ে এ-পারের দরদালানে এসে একটা ঘরের ভেজানো দরজা ধাক্কা দিয়ে খুলে শিউরতন আমাদের বললে, এই হচ্ছে মুসাফিরখানা। এই সারের পাশাপাশি যতগুলো ঘর দেখছ, সবই মুসাফিরদের জন্যে। এই ঘরটাই সবচেয়ে ভালো ঘর, তোমরা এই ঘরে আজকের রাতটা কাটিয়ে দাও।
ঘরের মধ্যে দুটো তক্তপোশ পড়ে আছে। তক্তপোশের তক্তাগুলির মধ্যে ব্যবধান অন্তত এক বিঘাৎ করে হবে। অসাবধানে শুলে হাত-পা গলে নীচে পড়ে যাওয়া অসম্ভব নয়। কিন্তু খাটে শোয়া আরামদায়ক হবে কি না, সে-কথা বিচার করার মতন অবস্থা আমাদের ছিল না। ঈশ্বরের ইচ্ছায় মাথার ওপর আচ্ছাদন পেয়েই খুশি হয়ে উঠলুম।
একটু বসেই শিউরতন উঠে বললে, অচ্ছা ভাই, আমি এখন চলি। কাল তোমরা কখন বেরুবে? বললুম, আমাদের বেরুতে বেরুতে অন্তত দশটা বেজে যাবে।
আচ্ছা, তোমরা যাবার আগে আমিই আসব’খন।
শিউরততন চলে গেল। আমরা দুজনে দুখানা তক্তপোশে গিয়ে বসলুম। ঘরখানা বেশ বড়। মেঝে মাটির, কিন্তু দেওয়াল ও ছাত পাকা। ঘরের এক কোণে একরাশ, প্রায় ছাত অবধি তাড়া করা কাঁচা কাঠ চেলা করে রাখা হয়েছে, তা থেকে তীব্র একটা মদির গন্ধ বেরুচ্ছে। সেই গন্ধের আকর্ষণে রাজ্যের চকোলেট ও হলদে রঙের বড় বড় ভীমরুলের আমদানি হয়েছে। ভীমরুলের অবিচ্ছিন্ন গুঞ্জনে ঘরের মধ্যে একটা অতিপ্রাকৃত অবস্থার উদ্ভব হয়েছে। ঘরের আর একদিকে একটা আলমারির মতন বড় কুলুঙ্গি, সেই কুলুঙ্গির মধ্যে ফুট-দুয়েক উঁচু চারটে লোহার পা-ওয়ালা চৌকো কাঁচের দীপাধার ও তার ভেতরে গেলাসের মধ্যে জল ও রেড়ির তেলের দীপ রয়েছে। ঘরের আর-এক দিকে একটা বিরাট ঢেঁকি বংশপরম্পরা ধরে উইয়ের দল খেয়ে চলেছে, কিন্তু তখনও সেটার আধখানাও তারা শেষ করতে পারেনি।
আমরা খাটের ওপর বসে থাকতে-থাকতেই ঘরের মধ্যে অন্ধকার নিবিড় হয়ে এল। দেশলাই দিয়ে সেই বাতি জ্বালিয়ে শোবার ব্যবস্থা করছি, এমন সময় বৃদ্ধ পাঁড়েজী খড়ম পায়ে খটখট করে আমাদের ঘরে এসে উপস্থিত হলেন। দেখলুম, বৃদ্ধের সেই রামনাম-অঙ্কিত ‘দেহ একটা মোটা গাঢ়ার চাদরে আবৃত হয়েছে। ভদ্রলোক কিছুক্ষণ প্রশ্নাদি করে বললেন, তাই তো, তোমাদের সঙ্গে বিছানাপত্র নেই, শীতে তো বড় কষ্ট হবে!
গতকাল যে আমরা রাস্তায় কাটিয়েছি, সে-কথা আর তাঁকে বললুম না। তিনি কিছুক্ষণ এদিক-ওদিক চেয়ে উপরি-উপরি দু-চারটে হাঁক ছাড়লেন। একটা চাকর দরজার কাছে এসে দাঁড়াতেই ভদ্রলোক হুকুম দিলেন, মেহমানদের জন্যে দুটো কম্বল এনে খাটে বিছিয়ে দাও
চাকর চলে গেল। পাঁড়েজী জিজ্ঞাসা করলেন, আহার করবেন তো?
বিকালবেলা বাজারে সেই যে ধুলো দিয়ে চিঁড়ে-দই মেখে খেয়েছিলুম, তাঁরা ততক্ষণে পেট থেকে বেরিয়ে পড়বার জন্যে মহা হাঙ্গামা শুরু করে দিয়েছিলেন। ক্ষুধা তো দূরের কথা, বিবমিষায় দেহ অত্যন্ত কাতর হয়ে পড়েছিল। পাঁড়েজীকে বললুম, বাজারে চিঁড়ে-দই খেয়েছিলুম, এখন আর খাওয়ার কোনো আকাঙ্ক্ষা নেই।
পাঁড়েজী বললেন, আচ্ছা, দুধ খানিকটা পাঠিয়ে দিচ্ছি, রাত্রে যদি ক্ষুধার উদ্রেক হয় তো খেয়ো। আমাদের মালিকের হুকুম আছে, মেহমানদের যেন কোনো অসুবিধা না হয়। তা ছাড়া এখানে মহিষের দুধ অপর্যাপ্ত পাওয়া যায়, তোমাদের কোনো সঙ্কোচ করবার কারণ নেই।
ইতিমধ্যে একজন চাকর দুটো কালো ‘ঘোড়ার কম্বল’ নিয়ে উপস্থিত হল। পাঁড়েজী বললেন, খাট-দুখানায় পেতে দাও।
চাকর কম্বল পেতে দিয়ে চলে যেতেই পাঁড়েজী বলতে লাগলেন, এই যে কম্বল দেখছ, এ অতি অদ্ভুত জিনিস। কোনো জানোয়ার, তা বিচ্ছুই বলো আর সাপ কি বিষখোপ্রাই বলো, এই কম্বলের ওপর কিছুতেই উঠতে পারবে না। দিনের বেলা হলে পিঁপড়ে ছেড়ে দেখিয়ে দিতুম, তারা এর ওপর দিয়ে চলতেই পারবে না, পা আটকে যাবে। এই জন্যে সন্ন্যাসী উদাসীরা এই কম্বল সঙ্গে রাখে। রাত-বিরেতে জঙ্গলে পাহাড়ে পথে ঘাটে তাদের ঘুরতে হয়, এই কম্বল পেতে শুয়ে পড়ে, কিছুতেই কিছু করতে পারে না।
আমার ছেলেবেলা থেকে বাঘ ভাল্লুক সিংহ নেকড়ে কাঁকড়াবিছে প্রভৃতি ‘সাংঘাতিক চতুষ্পদ ও সরীসৃপের কথা শুনেছি এবং বইতেও পড়েছি, কিন্তু বিষখোপ্রা মালটির কথা কখনও শুনিনি।
পাঁড়েজীকে জিজ্ঞাসা করলুম, বিষখোঁপা কি?
ভদ্রলোক একটু বৈদান্তিক হাসি হেসে বললেন, সে ভগবানের তৈরি এক জানোয়ার, সাপের মতনই দেখতে, তবে তার পা আছে।
ভয়ের চোটে জিজ্ঞাসা করতেই ভুলে গেলুম, ক’টা পা আছে?
একটু চুপ করে থেকে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, তোমরা মহাভারত পড়নি বুঝি?
বললুম, নিশ্চয় পড়েছি।
পাঁড়েজি বললেন,আশ্চর্য! তা হলে বিষখোপ্রার কথা পড় নি? আরে, ওই বিষখোঁপাই তো পরীক্ষিতরাজকে ভেঁশেছিলেন। বিষখোঁপা ডাঁশলে লোকে একবার মাত্র চেঁচিয়ে ওঠে–আ-ই মুঝে বিষখোপ্রা নে ডাঁশা। ব্যস্, তারপরই শেষ হয়ে যায়।
অদূর-ভবিষ্যতেই নিজের ঘুম সম্বন্ধে সন্দিহান হয়ে পরিতোষ চকিতে প্রশ্ন করলে, এই ঘরে বিষখোঁপা আছে নাকি?
পাঁড়েজী অত্যন্ত উদাসীনভাবে বললেন, এ-ঘরে আছে কি না জানি না, তবে মাঝে মাঝে তাঁর ডাক শুনতে পাই এদিকটায়।
পাঁড়েজী আমাদের ভরসা দিতে লাগলেন, কোনো ভয় নেই, রামজীর নাম করতে করতে শুয়ে পড়। ব্রহ্মশাপ না হলে বিষখোঁপা কখনও কামড়ায় না।
ভদ্রলোক যাবার সময় আবার বললেন, আমি এক লোটা দুধ পাঠিয়ে দিচ্ছি, তাই খেয়ে রামনাম করে শুয়ে পড়।
পাঁড়েজী খট খট করে বেরিয়ে চলে গেলেন। আমরা সামনা-সামনি সেই খাট-দুটোতে দুজনে উবু হয়ে মুখোমুখি বসে রইলুম। নতুন বিপদে পড়ে বাবা বিশ্বনাথের নাম জপতে জপতে হঠাৎ পাঁড়েজীর উপদেশ মনে পড়ে গেল। মনে মনে বিশ্বনাথের কাছে ক্ষমা চেয়ে বললুম, বাবা বিশ্বনাথ! কিছু মনে করো না বাবা। তুমি গোখরো কেউটে নিয়ে ঘর কর, বিষখোপ্রা সামলাতে পারবে না। এই রাত্রিটুকুর মতন দায়ে পড়ে ইষ্টনাম একটু অদলবদল করে নিতে হচ্ছে।
মিনিটে সত্তরটা হিসাবে রামনাম জপ করতে শুরু করে দিলুম।
উবু হয়ে বসে আছি। থেবড়ে বসতে ভয় হচ্ছে, পাছে কোথা দিয়ে বিষখোপ্রা এসে ভেঁশে দিয়ে যাবে, তারপর একবার ‘আ-ই মুঝে বিষখোপ্পা নে ডাঁশা’ বলেই কেতরে পড়ব।
একটু পরেই পরিতোষ একটা ‘উঃ’ আওয়াজ করে বললে, কি বরাত দেখেছিস আমাদের! ডাইনির কবল থেকে খুনের কবলে, খুনের কবল থেকে আধমরা হয়ে বেঁচে নেকড়ের কবলে, নেকড়ের হাত থেকে যদি-বা বাঁচা গেল তো বিষখোপ্রা–’
বাকিটুকু ভয়ে আর তার মুখ দিয়ে বেরুলেই না।
ভাবতে লাগলুম, এর চেয়ে যে রাস্তায় নেকড়ের পালের মধ্যেও পড়ে থাকা ভালো ছিল বাবা! নেকড়েদের মতন ইনিও যদি একটু শুঁকেই ছেড়ে দেন, তবে এ-যাত্রা রক্ষা পাই,–জয় রাম, জয় রাম, জয় রাম-
দুজনে মুখোমুখি বসে আছি। ঘরের দরজাটা খোলা, বাইরে একেবারে অন্ধকার হয়ে যাওয়ায় ঘরের আলোটা বেশ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। ঘরের কোণের কাঁচা কাঠের মধুপিয়াসী ভীমরুলদলের সেই অবিশ্রান্ত গুঞ্জন স্তব্ধ হয়েছে। বসে বসে ভাবছি,–সে আকাশ-পাতাল ভাবনার কী সীমা আছে? মাঝে মাঝে পরিতোষের মুখের দিকে চাইছি, তার চোখ-দুটোর সমস্ত স্পষ্ট দেখতে না পেলেও যতখানি দেখা যায়, তাতেই মনে হচ্ছে, অত্যন্ত অস্বস্তিকর চিন্তায় সে কাতর হয়ে পড়েছে।
নিস্তব্ধতাটা ক্রমেই যেন পীড়াদায়ক হয়ে উঠছিল, এমন সময় পরিতোষ হঠাৎ ‘বাপ রে’ বলেই- সেই উবু-হওয়া অবস্থা থেকেই কিরকম করে লাফ মেরে ব্যাঙের মতন মেঝেতে পড়ে গোঁ-গোঁ করতে আরম্ভ করে দিলে।
কি রে! কি হল?–বলে খাট থেকে নেমে তাকে ধরলুম। সে সেই গোঁ-গোঁ অবস্থাতেই বললে, কিসে যেন পশ্চাদ্দেশে ভেঁশে দিলে!
বলিস কি রে!
নিশ্বাস বন্ধ করে তার শরীরে বিষের ক্রিয়ার প্রতীক্ষা করতে লাগলুম। রামনামের গীত অজ্ঞাতসারেই দ্বিগুণ হয়ে গেল।
অনেকক্ষণ পরে পরিতোষ দাঁড়িয়ে উঠে কাতরভাবে বললে, জায়গাটা ফুলে উঠেছে বলে মনে হচ্ছে।
তাড়াতাড়ি দুজনে মিলে সেই গন্ধমাদন প্রদীপ উঠিয়ে নিয়ে এসে পরিতোষের খাটের ওপরে রেখে দংশন-কর্তা অথবা কর্ত্রীর সন্ধান করতে লাগলুম, কিন্তু কিছুই দেখতে পেলুম না। পরিতোষ বললে, আলোটা এই দুই খাটের মধ্যিখানে একটা উঁচু জায়গায় রাখতে পারলে ভালো হত। আলো থাকলে শুনেছি তারা আসতে পারে না।
একটু উঁচু টুলের মতন কিছু পাওয়া গেলে ভালো হত। কিন্তু ঘরের চারদিক খুঁজে-পেতে সেরকম কিছুই দেখতে পাওয়া গেল না। শেষকালে পরিতোষ প্রস্তাব করলে, একরাশ ওই চেলাকাঠ খাট-দুটোর মধ্যিখানে রেখে তার ওপরে আলোটা রাখতে পারলে কতকটা নিশ্চিন্ত হতে পারা যেত।
প্রস্তাবটা সমীচীন মনে হওয়ায় ঘরের কোণের সেই চেলাকাঠের পাহাড় থেকে যেমন একখানা কাঠ টানা, অমনই রাজ্যের ভীমরুল বোঁ-ওঁ-ওঁ-ওঁ করে উড়তে আরম্ভ করে দিলে। আমরা ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বারান্দায় দাঁড়িয়ে হাঁপাতে লাগলুম। আমার তো সেই শীতে একেবারে ঘাম ছুটতে লাগল, কারণ ইতিপূর্বে ভীমরুল-দংশনের অভিজ্ঞতা হয়ে গিয়েছিল কিনা!
ভয়াল সেই অভিজ্ঞতার কথা মনে করে আজ একাধারে হাসি পাচ্ছে আর পরিতোষের কথা মনে পড়ছে।
যা হোক, বেশ কিছুক্ষণ বাইরে দাঁড়িয়ে থেকে একবার দরজা দিয়ে মাথা গলিয়ে উৎকর্ণ হয়ে ভীমরুলের গুঞ্জন শোনবার চেষ্টা করলুম, কিন্তু কিছুই শুনতে পেলুম না। কতকটা নিশ্চিন্ত হয়ে আবার খাটের ওপরে সেইরকম উবু হয়ে বসা গেল।
একটু বাদেই একজন একটা মাঝারি-গোছের এক-লোটা দুধ ও একটা কাঁসার গেলাস নিয়ে এসে মেঝেতে রেখে বললে, দুধ রেখে গেলুম, যখন ইচ্ছা হয় খেয়ো।
দরজার দিকে একটু এগিয়ে আবার ফিরে সে বললে, দরজা বন্ধ করে শুয়ো নইলে কুকুর ঢুকে বিরক্ত করবে।
লোকটা বেরিয়ে যেতেই দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে খাটে এসে বসলুম। বিষখোঁপার চিন্তা তখনও মনের মধ্যে উদ্যত হয়ে রয়েছে। স্মৃতির গভীরে ডুব মেরে হাতড়াচ্ছি, ব্রহ্মশাপ কখনও হয়েছে কি না! মনে হতে লাগল, ভাগ্যে আমি জন্মাবার আগেই বাবা ব্রাহ্মণ্যের ‘ণ’কারটি লুপ্ত করে দিয়েছিলেন! নইলে ব্রাহ্মণদের মধ্যেই তো আমাকে মানুষ হতে হত, আমি যা ছেলে, কখন কোন ব্রাহ্মণ কি শাপ ঝেড়ে দিত, কে জানে!
একবার পরিতোষের দিকে চোখ পড়তে সে বললে, আচ্ছা, কাশী স্টেশনে কোনো পাণ্ডা আমাদের শাপ-টাপ দিয়েছিল রে?
অনেক ভেবে-চিন্তে বললুম, কই ভাই, কিছু মনে তো পড়ছে না।
আরও কিছুক্ষণ চিন্তা করে পরিতোষ বললে, পূর্বজন্মের ব্রহ্মশাপও এ-জন্মে ফলে যেতে পারে। রোহিতাশ্ব বেচারিকে যে সাপে কামড়েছিল, সে তো পূর্বজন্মের ব্রহ্মশাপের ফলে।
তার পরে সে ঘটি থেকে গেলাসে দুধ ঢালতে ঢালতে গম্ভীরভাবে বললে, নিয়তি যদি থাকে তো কেউ বাঁচাতে পারবে না।
এক গেলাস সেই আগুন-গরম দুধ চোঁ-চোঁ করে মেরে দিয়ে গেলাসটা ঘটির ওপর রেখে পরিতোষ বললে, বেড়ে দুধ রে, খেয়ে ফেল।
ভয় ও উৎকণ্ঠা রূপ দুই সড়কির তাড়নায় বিকেলবেলার সেই সাংঘাতিক চিঁড়ে-দইয়ের বিপ্লবাত্মক আর্তনাদ স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। কিছু ক্ষুধারও উদ্রেক হচ্ছিল। গেলাসে খানিকটা দুধ ঢেলে নিয়ে ফুঁ দিয়ে-দিয়ে চুমুক দিতে লাগলুম। ও-দিকে পরিতোষ কম্বলের ওপর লম্বা হয়ে পড়ল। গেলাসটা শেষ হবার আগেই সে ঘুমের অভয় অঙ্কে ঢলে পড়ল।
খাটের ওপরে সেইরকম উবু হয়ে বসে আছি চক্ষুকর্ণ সজাগ করে। পরিতোষের দিকে মধ্যে মধ্যে চোখ পড়ছে। তখন সন্ধ্যারাত্রি, বোধ হয় ন’টাও বাজেনি, ওরই মধ্যে দেহ তার ধনুকে পরিণত হয়েছে। বাইরে মাঝে মাঝে লোকজনদের কথাবার্তা শুনতে পাওয়া যাচ্ছিল, ক্রমে তাও বন্ধ হয়ে গেল। মাথার মধ্যে পাঁচ-সাত-দশজন থেকে থেকে ডুকরে উঠছে, আই মুঝে বিষখোপ্রা নে ডাঁশা। পরিতোষের নিশ্চিন্ত নিদ্রা দেখে ঈর্ষা হচ্ছে।
ক্রমে চারিদিক একেবারে নিশুতি হয়ে গেল, ঘরে-বাইরে ঝিল্লির ঝঙ্কার শুরু হয়ে গেল–ঝম্ ঝম্ ঝম্।
লোটা থেকে বাকি দুধটা গেলাসে ঢেলে নিয়ে এক চুমুকে মেরে দিয়ে শোবার জোগাড় করতে লাগলুম। ভয়ানক জলতেষ্টা পেতে লাগল, কিন্তু জল কোথায়!
বিছানার ওপর গা ঢেলে দেওয়ার বোধ হয় মিনিটখানেকের মধ্যে তিড়বিড়িয়ে লাফিয়ে উঠলুম। বাপ রে, এ যে কণ্টকশয্যা! সত্যই, অদ্ভুত সেই কম্বল! সাপ বিছে বিষখোপ্রা তো দূরের কথা, বাঘ ভাল্লুক পর্যন্ত তাতে পা দিতে পারে না। আমার গেঞ্জি শার্ট ধুতি ফুঁড়ে তার শোঁয়াগুলো ছুঁচের মতন দেহে বিঁধতে লাগল। একবার উঠে বসি, আবার শুয়ে পড়ি–এই করতে-করতে সেই কণ্টক-শয্যাতেই ঘুমিয়ে পড়লুম। সারারাত স্বপ্নের ঘোরে বিষখোঁপা, পরীক্ষিৎ ও রোহিতাশ্বের সঙ্গে তর্ক করতে করতে কেটে গেল।
ঘুম থেকে উঠে দেখি, পরিতোষবাবুর তখনও নিদ্রাভঙ্গ তো দূরের কথা, তিনি একেবারে বেনের পুঁটুলি মেরে গেছেন, সেই পুঁটুলির গেরো খুলতে খুলতে আমার দম বেরিয়ে গেল।
যা হোক, অনেক বায়নাক্কার পর তিনি গাত্রোত্থান করে জিজ্ঞাসা করলেন, কত বেলা হয়েছে রে?
দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে দেখি, প্রকৃতির ঘুম তখনও ঘন কুয়াশার অবগুণ্ঠনে আচ্ছন্ন, অথচ কাজকর্ম শুরু হয়ে গিয়েছে, দু-একজন লোকও চলাফেরা করছে। যা হোক, মুখ ধুয়ে তাজা হয়ে আবার রওনা হবার জন্যে প্রস্তুত হলুম। যাবার আগে পাঁড়েজীর কাছে বিদায় নেবার জন্যে সেই ঘরে গিয়ে উপস্থিত হওয়া গেল। দেখলুম, সেই ভোরেই পাঁড়েজী স্নান সেরে সর্বাঙ্গে রামনাম দেগে খালি-গায়ে বসে সেই বিরাট খাতায় মুখ জুবড়ে হিসাবপত্রের মধ্যে ডুব দিয়েছেন। অন্যান্য কর্মচারীরাও সেই ভোরে এসে নিজের নিজের জায়গায় বসে গিয়েছে। আমরা পাঁড়েজীর সামনে গিয়ে দাঁড়ালুম; কিন্তু তিনি হিসাবপত্রে এমনই তন্ময় যে, তা বুঝতেও পারলেন না। দু-এক মিনিট অপেক্ষা করে বলে ফেললুম, গোড় লাগে পাঁড়েজী।
সেই অবস্থাতেই পাঁড়েজী তুবড়ির মতন বড়বড় করে আশীর্বাদ বর্ষণ করতে-করতে মুখ তুলে চশমা খুলে বললেন, কি, রাত্রে ভালো ঘুম হয়েছিল তো?
আজ্ঞে হ্যাঁ, আপনার আশীর্বাদে ভালোই ঘুমিয়েছি। এবার আমরা যাই, আপনার কাছে বিদায় নিতে এসেছি। এই শীতের রাতে আশ্রয় দিয়ে আপনি যে উপকার করলেন–এ-জীবনে তা ভুলব না।
আমাদের কথা শুনে পাঁড়েজী দুহাতে দু-কান চেপে ধরে বললেন, আরে, না না। আশ্রয় দিয়েছেন আমাদের মালিক, যাঁর আশ্রয়ে আমি আছি। আমাদের জমিদার, তিনি গরিব ও নিরাশ্রয়ের মা-বাপ। একবার যদি তাঁর কাছে গিয়ে তোমাদের দুঃখ জানাতে পার তো সারাজীবনের হিল্লে হয়ে যাবে।
কি একটু চিন্তা করে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, তোমরা কোথায় যাবে?
পাটনা।
পাটনায় কি কোনো খাস কাজ আছে?
বললুম, না, পাটনায় খাস কাজ কিছু নেই। আমরা দুঃখী লোক, চাকরির উমেদার, যেখানে দু-মুঠো খাবার ব্যবস্থা হবে, সেখানেই পড়ে থাকব। আমাদের উম্মিদও এমন কিছু বেশি নয়। আমরা একেবারে মূর্খও নই, কিছু ইংরেজি লেখাপড়াও জানা আছে।
আমাদের কথা শুনে বোধ হয় পাঁড়েজীর মনে একটু দয়া হল। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, তোমাদের আপনার জন কে আছে?
বললুম, কেউ নেই হুজুর, আমরা একেবারে অনাথ।
পাঁড়েজী জিজ্ঞাসা করলেন, তোমরা দুজনে কি ভাই হও?
আজ্ঞে হ্যাঁ, মাসতুতো ভাই।
আমার কথা শুনে পরিতোষ ফিক করে হেসে ফেললে। কিন্তু তখুনি গম্ভীর হয়ে পাশের সেই পাহাড়-প্রমাণ উঁচু খাতাপত্রের দিকে চেয়ে রইল।
পাঁড়েজী কিছুক্ষণ আমাদের দিকে চেয়ে থেকে বললে, দেখ, আমি তোমাদের একটা পরামর্শ দিচ্ছি, বৃদ্ধের পরামর্শ বিপদকালে সর্বদা গ্রহণীয়। তোমরা সোজা চলে যাও আমাদের মালিকের কাছে। কোনোরকমে তাঁর কাছে গিয়ে নিজেদের দুঃখ জানাতে পার তো একটা হিল্লে তোমাদের হয়েই যাবে। সেখানে যদি বিফল-মনোরথ হও তো আমার কাছে ফিরে এসো, কোনোরকমে খেয়ে পরে বেঁচে থাকবার মতন ব্যবস্থা হয়েই যাবে। মাথার ওপর রামজী আছেন, তাঁর নাম করতে করতে চলে যাও।
যা হোক, রামজী আমাদের মনোমতো দেবতা না হলেও আপদ্ধর্ম হিসাবে রামজীর নামই স্মরণ করে বেরিয়ে পড়া গেল। বাজারে কিছু খেয়ে নিয়ে রওনা হব ঠিক করে সেদিকে কিছুদূর অগ্রসর হতেই কালকের সেই শিউরতনের সঙ্গে দেখা। শিউরতন বললে, আমি তোমাদের কাছে যাচ্ছিলুম। একেবারেই ভুলে গিয়েছিলুম যে, তোমরা আজ সকালে চলে যাবে।
তার সঙ্গে কথা বলতে বলতে আমরা সেই মোদকের দোকানে এসে উপস্থিত হলুম। দেখলুম, প্রায় দশ-বারোজন লোক দোকানের ভেতরে বসে খাচ্ছে। কেউ-বা চাল-ছোলা-ভাজা, কেউ-বা ভুট্টার খই দিয়ে জলপান করছে। অপেক্ষাকৃত বিলাসী যারা, তারা চিঁড়ে-দই খাচ্ছে। শিউরতনের মুখে শুনলুম, এরা প্রায় সকলেই অবস্থাপন্ন গৃহস্থ। তা না হলে ময়রার দোকানে এসে সকালবেলা জলখাবার সাধ্য এখানকার অল্প লোকেরই আছে।
দোকানে ঢুকে এক কোণে বসতেই সকলে জিজ্ঞাসু ও কৌতূহলী দৃষ্টিতে আমাদের দিকে চাইতে লাগল। শিউরতন সাধারণভাবে আমাদের পরিচয় দিলে, এরা বাংগাল দেশের লোক। ঘরে কেউ নেই, ভাগ্য টেনে এনেছে এখানে। নিরাশ্রয়, পথে পথে ঘুরে বেড়াচ্ছিল, আমি কাল কাছারিতে নিয়ে গিয়ে শোবার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলুম।
এতখানি বলে শিউরতন একবার সগর্বে চারিদিক চেয়ে নিয়ে আবার আরম্ভ করলে, পাঁড়েজী এদের বলেছে মালিকের সঙ্গে দেখা করতে, আমিও তাই বলেছি।
একটা লোক, ভুট্টার খইয়ে তার মুখ ভরতি, পাছে তার আগেই কেউ কোনো মন্তব্য প্রকাশ করে ফেলে, সেজন্য তৎপরতার সঙ্গে ‘মরি কি বাঁচি’ করে অর্ধচর্বিত খাদ্যের তাল গিলতে গিলতে আমাদের বলে ফেললে, আমাদের মালিক মানুষরূপী দেবতা, তাঁর কাছে একবার যদি পৌঁছতে পার তো সব দুঃখ দূর হয়ে যাবে।
বলতে বলতে সেখানে যতগুলি লোক বসেছিল, তারা সকলেই গদগদ হয়ে মালিকের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠল।
যা হোক, আবার সেই ধুলোরূপী চিনি দিয়ে সামান্য কিছু চিঁড়ে-দই গলাধঃকরণ করে শিউরতনের কাছ থেকে মালিক-গৃহের পথ-নির্দেশ নিয়ে রামনাম স্মরণ করে যাত্রা করা গেল
পথ চলতে চলতে কানের মধ্যে বাজতে লাগল, ‘কোশল-নৃপতির তুলনা নাই, জগৎ জুড়ি যশোগাথা, দীনের তিনি সদা শরণ-ঠাঁই, ক্ষীণের তিনি পিতা-মাতা। “
চলেছি পথ বেয়ে। দীর্ঘ পথ সর্পিল গতিতে এঁকে-বেঁকে চলে গিয়েছে মাঠের মধ্য দিয়ে। চোখের ওপর দিয়ে সেই পুরাতন ছবি একটার পর একটা ভেসে যাচ্ছে, মনের মধ্যে কিন্তু তোলপাড় চলেছে। অদৃষ্টের হালচাল দেখে মনে হচ্ছে, অতি ধীরে হলেও নিশ্চিতরূপে সে আমাকে টেনে নিয়ে চলেছে সেই পুরাতন আবর্তের পানে। সে-সম্বন্ধে মাঝে মাঝে পরিতোষের সঙ্গে আলোচনাও হচ্ছে। একবার তাকে জিজ্ঞাসা করলুম, কলকাতায় যদি ফিরে যেতে হয়, আবার ইস্কুলে ঢুকবি তো?
অত্যন্ত অবজ্ঞাভরে সে বললে, নাঃ আবার ইস্কুল!
বললুম, তোর বাবা কিছু বলবেন না?
সে বললে, না।
মনে হতে লাগল, ইস্কুল-যাওয়া সম্বন্ধে যদি তারই মতন বলতে পারতুম ‘নাঃ’!
সঙ্গে সঙ্গে একটা ছবি চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগল, একদিন সকালবেলা কি-একটা কথা নিয়ে তক্কাতক্কি হতে হতে দাদা বাবাকে বলে ফেললে, লেখাপড়া আমার আর হবে না। ওসব ছেড়ে দিয়ে চাকরি-বাকরি করে সংসারে সাহায্য করবার দিকে মন দেব।
এই কথা শুনে বাবার মাথায় সেদিন কিরকম খুন চেপে গেল। তিনি সারাদিন ধরে অমানুষিকভাবে দাদাকে পিটতে আরম্ভ করলেন। একতলা-দোতলা রক্তে রক্তারক্তি হয়ে গেল। পাড়ার মুরুব্বিরা এসে বাবাকে থামাতে না পেরে চলে গেলেন। আশেপাশের বাড়ির গিন্নিরা চেঁচিয়ে মাকে ডেকে বাবার উদ্দেশে বলতে লাগলেন, ছেলেটাকে মেরে ফেললে যে!
মা নির্বিকার হয়ে দু-হাতে বারান্দার রেলিঙের ওপর ভর দিয়ে সেই বীভৎস কাণ্ড দেখতে লাগলেন।
প্রহারের যন্ত্রণায় দাদা চিৎকার করতে লাগল, কে আছ, আমায় বাঁচাও–আজ আমাকে যে বাঁচাবে, আমি চিরকাল তার কেনা হয়ে থাকব।
কিন্তু কেউ এল না। বাবার মুখে এক কথা, আজ তোমাকে মেরেই ফেলব।
এইরকম চলেছে। নির্জিত ও নির্যাতনকারী উভয়েই ক্লান্ত, তবুও মার চলেছে। শেষকালে কেউ যখন বাঁচাতে এল না, তখন দাদা নিজেকে সাহায্য করবার গুরুভার নিজের কাঁধেই তুলে নিলে।
এক হেঁচকায় বাবার হাত থেকে ছিটকে পড়ে প্রায় গড়াতে গড়াতে ছুটে দাদা একটা ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ল। বাবাও তার পেছনে-পেছনে ছুটলেন। কিন্তু তাঁকে ঘরের মধ্যে আর ঢুকতে হল না। দরজার কাছে পৌঁছবার আগেই দাদা দরজার খিলটা এক হেঁচকায় উপড়ে ফেলে বাবার সম্মুখীন হয়ে বললে, আর একটা আঘাত যদি আমায় কর তো একঘায়ে তোমায় শেষ করে দেব।
দাদার সেই মূর্তি দেখে বাবা স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। দেখলুম, তাঁর প্রহরোদ্যত হাতখানা শিথিল হয়ে কাঁপতে কাঁপতে নীচে পড়ে গেল। দাদা চিৎকার করতে লাগল, আপনার অনেক অত্যাচার আমি শৈশব থেকে সহ্য করে আসছি, আজ তার শেষ হয়ে যাক।
বাবা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাদার সামনেই চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন।
আমি আর অস্থির এতক্ষণ কাঁদতে কাঁদতে তাঁর কাছে-কাছেই ওপর-নীচ করছিলুম। দাদার আর্তনাদের তালে তালে আমাদের কান্নার আওয়াজও উঠছিল পড়ছিল। হঠাৎ তাকে বৈষ্ণবভাব থেকে শাক্তভাবে পরিণত হতে দেখে আমরাও স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলুম।
বোধ হয় ব্যাপারটা বিশেষ গোলমেলে হয়ে দাঁড়াচ্ছে দেখে মা এসে পড়লেন তাঁদের দুজনের মাঝখানে, তাঁর মুখখানা ঘিরে একটা অস্বাভাবিক কাঠিন্য কিন্তু দুই চোখে অশ্রু টলটল করছে।
মা বাবাকে সেখান থেকে চলে যেতে বলামাত্র তিনি চলে গেলেন। দাদাকে দেখলুম, তার চোখ-দুটো লাল, মুখখানা একেবারে থেঁতো হয়ে গেছে, ধুতি শতচ্ছিন্ন, সেইভাবে হুড়কোখানা তখনও তুলে থরথর করে কাঁপছে।
দাদার সেই অবস্থা দেখে মা ছুটে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরলেন। সেও মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁপতে কাঁপতে অজ্ঞান হয়ে মেঝেয় লুটিয়ে পড়ল।
দাদা মরে গেল মনে করে আমি আর অস্থির চিৎকার করে উঠলুম। মা বললেন, জল নিয়ে আয়।
তখুনি বালতি করে জল নিয়ে এসে দাদার মাথায় দিতে লাগলুম। মা’র চিৎকার শুনে প্রতিবেশিনীরা, যাঁরা অন্তরঙ্গ হয়ে গিয়েছিলেন, তাঁরা ছুটে এলেন। চেঁচামেচি শুনে বাবা সেখানে এসে ব্যাপার দেখে ছুটলেন ডাক্তারের সন্ধানে। মিনিট দশেকের মধ্যেই বাবা পাড়ার একজন ডাক্তারকে নিয়ে এলেন। ডাক্তার নানারকম পরীক্ষা করে দাদার মাথা থেকে পা পর্যন্ত নানা স্থানে ব্যান্ডেজ ও তাপ্পি মেরে, দুটো-তিনটে ওষুধের প্রেসক্রিপশন লিখলেন। বাবা ছুটলেন ওষুধ আনতে দাদা তখনও অজ্ঞান।
বোধ হয় ঘণ্টাখানেক বাদে দাদার জ্ঞান হল। সে আচ্ছন্নের মতন আমাদের দেখতে দেখতে সেই অবস্থায় শুয়ে-শুয়েই মাকে জড়িয়ে ধরলে, মা পাশেই বসে ছিলেন।
আমরা তিন ভাইয়ে একটা বড় বিছানায় শুতুম। দাদার জন্যে তখন আলাদা বিছানা করে দেওয়া হল। মা তাকে নিয়ে রইলেন।
সেদিন আর আমাদের খাওয়া-দাওয়া নেই। বাবা একটা ঘরে শুয়ে আছেন, আমাদের ঘরে মা দাদাকে নিয়ে আছেন। তিনি কখনও তার পাশে শুয়ে পড়ছেন, কখনও-বা উঠে বসছেন। ঘরের সামনেই একটা চওড়া ঢাকা বারান্দায় টেবিল চেয়ার বেঞ্চি পাতা, সেখানে বসে আমরা পড়াশোনা করতুম–আমি আর অস্থির সেখানে বসে। বাড়িতে আরও দু-তিনটি মেয়ে থাকতেন, তাঁরাই ছোট ভাইবোনদের দেখাশোনা করতে লাগলেন।
সন্ধের সময় মা দাদাকে ছেড়ে উঠে সারাদিন বাদে আমাদের খাইয়ে ওপরে পাঠিয়ে দিলেন। দাদার বিছানার অনতিদূরে বিছানা পেতে সেই সন্ধে-রাতেই আমরা শুয়ে পড়লুম। মা-বাবা খেলেন কি না জানি না। আমরা শুয়ে পড়বার বোধ হয় ঘণ্টাখানেকের মধ্যে মা এসে দাদার মাথার কাছে বসলেন, দাদা তখন, ঘুমে কি না জানি না, একেবারে অচেতন।
অনেক রাত্রে দাদার কণ্ঠস্বরে ঘুম ভেঙে গেল। শুনলুম দাদা বলছে–তুমি আমায় মাসে পনেরোটা করে টাকা দিও, তা হলেই আমার হবে।
সকালবেলা উঠে দাদা বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল আর ফিরল রাত্রি প্রায় সাড়ে ন’টায়। জিজ্ঞাসা করলুম, সারাদিন কোথায় ছিলে দাদা?
দাদা কম্পিতকণ্ঠে বললে, এক বন্ধুর বাড়িতে।
একটু চুপ করে থেকে সে বললে, এবার এখান থেকে সম্পর্ক উঠল রে! আমি চলে যাচ্ছি বেলগেছের ভুেটারিনারি কলেজে পড়তে। সেখান থেকে পাস করে বেরিয়ে চাকরি নিয়ে চলে যাব বিদেশে। এ-বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক চুকে গেল।
অভিমানে তার কণ্ঠরোধ হয়ে গেল। দাদার কথা শুনে আমি ও অস্থির কাঁদতে লাগলুম। অনেকক্ষণ পরে সেইরকম ধরা-ধরা গলায় দাদা বললে, মা রইল, দেখিস।
এর পরের অংশটুকুর সঙ্গে যদিও বর্তমান কাহিনির সম্পর্ক কম, তবুও সেটুকু এইখানেই শেষ করে রাখি।
দাদা প্রতিদিনই বাবা ঘুম থেকে ওঠবার আগেই বেরিয়ে যায় আর ফেরে রাত্রে। বাবাও তার কোনো খোঁজ করেন না, শুধু মা আসেন তার সঙ্গে কথা বলতে। মায়ে-ছেলেয় ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে বারান্দায় বসে কি-সব কথাবার্তা হয় তা বুঝতে পারি না, দাদা ঘরে ফেরবার আগেই ঘুমিয়ে পড়ি। এই কয়েকদিনের মধ্যে সে যেন আমাদের কাছ থেকে অনেক দূরে চলে গেল। মনের মধ্যে নিয়তই একটা খোঁচা বাজতে লাগল, দাদা চলে যাবে, দাদা পর হয়ে যাবে, সে আমাদের ভুলে যাবে।
এইরকম দিনকয়েক চলবার পর একদিন বাবা আপিসে বেরিয়ে যাবার কিছু পরেই দাদা বাড়িতে এসে স্নান করে খেয়ে একটা বাক্সতে নিজের জামাকাপড় গুছিয়ে নিয়ে মাকে প্রণাম করে ভাড়াটে গাড়ি চড়ে চলে গেল।
তারপর তিন বছরের মধ্যে তিন মাস সে বাড়ি থাকেনি। ওখান থেকে পাস করে সে চলে গেল বিদেশে চাকরি নিয়ে। সেখানে, না খেয়ে, একটি একটি করে পয়সা জমিয়ে সে বিলেত চলে গেল। অবিশ্যি বিলেত যাওয়া সম্বন্ধে বাবাই ছিলেন তার প্রধান সহায়। যা হোক, ইংল্যান্ডে বিশেষ সুবিধা করতে না পেরে আমেরিকায় গিয়ে অত্যন্ত কৃচ্ছ্রসাধন করে পড়াশোনা করে মানুষের ডাক্তার হয়ে আজ সমারোহে সেখানে সে বাস করছে। সেই থেকে বাড়ির সঙ্গে তার সমস্ত সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল, আজও সে বাড়ি ফেরেনি।
বাবা মনে করেছিলেন, ছেলেকে নিজের মতন করে তৈরি করবেন, অবিশ্যি বাবার পক্ষে সে-কথা ভাবা অত্যন্ত স্বাভাবিক। কিন্তু বাবার পেছনে আর একজন বড় বাবা অদৃশ্যে বসে সকল বাবারই যে জীবন নিয়ন্ত্রণ করছেন, শাসন করবার সময় অনেক বাবারই সে-কথা স্মরণ থাকে না। তার ফলে বাবা হারালেন সন্তান; আর আমরা যা হারালুম, তা প্রকাশের নয়।
পথ চলতে চলতে বেলা যত পড়ে আসতে লাগল, মনের মধ্যে কেন জানি না, সেদিনকার সেই ছবিগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠতে লাগল।
চলেছি পথ বেয়ে। রাত্রিটুকু ছাড়া এই তিন দিন নিরন্তর পথ বেয়ে চলেছি। সেই সকাল থেকে এতক্ষণ বোধ হয় দশ বারো মাইল পথ অতিক্রম করেছি। জুতো-জোড়ায় এমন অবস্থা হয়েছিল যে, সকালবেলাতেই পথের পাশে ছুঁড়ে ফেলে দিতে হল। পায়ের তলা জ্বলে যাচ্ছে, তবুও চলেছি কোথায় সেই দীনের পালক, নিরাশ্রয়ের আশ্রয়দাতা, তাঁরই উদ্দেশে।
পথে লোক দেখলেই জিজ্ঞাসা করি, কোথায় তাঁর বাড়ি, আর কতদূর?
সকলেই তাঁকে জানে; বলে, আরও কয়েক মাইল। আশায় নতুন করে বুক বেঁধে আবার চলেছি। মাঝে মাঝে হাঁটু মুড়ে আসে, পথের ধারে বসে একটু জিরিয়ে নিয়ে আবার চলেছি। ক্ষুধায় নাড়ীতে পাক দিচ্ছে, জীবদ্দশাতেই বায়ু-ভোজী হতে হয়েছে। শীতের দিনেও তৃষ্ণায় কণ্ঠরোধ হয়ে আসছে। সূর্য পশ্চিমে ঢলে পড়ল বলে, তবুও চলেছি।
চলতে চলতে আমরা একটা শহরের মতন জায়গায় এসে পড়লুম। পথের ধার দিয়েই রেললাইন চলে গিয়েছে। দু-একখানা বাড়ির গাড়িও দেখলাম আমাদের পেরিয়ে চলে গেল। এক জায়গায় মাঠে একদল ছেলেকে ক্রিকেট খেলতে দেখলুম। আরও কিছুদূর অগ্রসর হবার পর দু-চারখানা ইটের বড় বাড়িও চোখে পড়ল। লোকজনের চলন-ফেরন ও সাজ-পোশাকের মধ্যে একটু নাগরিক ভাবও লক্ষ করতে লাগলুম।
ক্রমেই রাস্তা জনবহুল হয়ে উঠতে লাগল। বেশ বুঝতে পারলুম, আমরা একটা ছোট শহরের মধ্যে অথবা কোনো বড় শহরের প্রান্তে এসে উপস্থিত হয়েছি। অজানা অপরিচিত হলেও শহরের মুখ দেখে আমাদের নাগরিক মন একটু খুশির দোলায় নেচে উঠল। ভাবলুম, আজ রাতে যদি একান্ত কোথাও আশ্রয় না-ই মেলে, তা হলে অন্তত ইস্টিশানে পড়ে থাকতে পারব।
পথের লোকদের জিজ্ঞাসা করতে করতে চলেছি, নবাবসাহেবের বাড়ি কোথায়?
সকলেই প্রথমে অবাক হয়ে মুখের দিকে চায়। তারপর বলে, এই সোজা চলে গিয়ে বাঁ-দিকে ফিরতে হবে, তার পরে ডাইনে-
সোজা গিয়ে বাঁয়ে ঘুরে আবার ডাইনে চলেছি। বোধ হয় আধ মাইল যাবার পর আমরা একটা বাজারের মতন রাস্তায় এসে পৌঁছলুম, তার দু-দিকে সারি সারি দোকান-ঘর। দু-দিকের দুই সারি গিয়ে মিলেছে এক প্রকাণ্ড প্রাসাদের সিংহদ্বারে।
সিংহদ্বারের ওপরেই একটা খোলা ছাত, দূর থেকে মনে হল, যেন সেই ছাতের ওপরে কারা বসে রয়েছে। তাদের পাশেই একটা উঁচু জায়গায় সোনালি রঙের কি-একটা ছোট্ট জিনিস ঝকঝক করছে, অস্তরাগরঞ্জিত মন্দির-চূড়ার কনককুম্ভের মতন।
সিংহদুয়ারের কাছে এসে দেখলুম, সেখানে দু-তিন জন জঙ্গী-উর্দি-পরা বন্দুকধারী সিপাহী গটমট করে ঘুরে ঘুরে পাহারা দিচ্ছে, সামনেই একটা ভাঙা কামান সযত্নে সাজানো রয়েছে।
ভাবতে লাগলুম, এই প্রাসাদের মধ্যে কোথায় নবাবসাহেব আছেন, সেখানে আমাদের মতন অকিঞ্চন পৌঁছবে কি করে! কাকেই বা তাঁর কথা জিজ্ঞাসা করি! সেপাইদের সাজ-পোশাক ও ঘোরন-ফেরন দেখলে তো বুকের রক্ত জল হয়ে যায়!
অনেক চিন্তা ও পরামর্শের পর বুক ঠুকে ‘জয় বাবা বিশ্বনাথ’ বলে এগিয়ে গিয়ে এক সিপাহীকে জিজ্ঞাসা করলুম, এটা কি অমুক নবাবসাহেবের দৌলতখানা?
ভেবেছিলুম, সিপাহীসুলভ ধমক ও তাড়া দিয়ে সে আমাদের দূর করে দেবে; কিন্তু আমাদের অনুমান ব্যর্থ করে অতি মিষ্টি সুরে সে বললে, মালিকের সঙ্গে দেখা করতে চাও? কোথায় তোমাদের বাড়ি?
বাংলাদেশ।
সিপাহী বললে, ওই সিঁড়ি দিয়ে ওপরে চলে যাও, সেই ছাতে মালিক আর সৈয়দসাহেব বসে আছেন।
জিজ্ঞাসা করলুম, সৈয়দসাহেব কে?
তিনি মালিকের হ কিম। কোনো ভয় নেই, নির্ভয়ে উঠে যাও, কেউ কিছু বলবে না।
নির্ভয়ে সিঁড়ির দিকে অগ্রসর হওয়া গেল।
ওপরে উঠে দেখি, ভারতীয় চিত্রের আদর্শে একখানা উঁচু-নীচু ছাত, এখান থেকে সিঁড়ি উঠে গেছে একটা ছাতে, ওখান থেকে সিঁড়ি নেমে গিয়েছে অন্য ছাতে, ছাতের তিন দিক, অর্থাৎ সামনে রাস্তার দিক ছাড়া, মানুষের চেয়ে উঁচু দেওয়াল দিয়ে ঘেরা। আর সেই দেওয়ালের মাঝে মাঝে চমৎকার সব বাহারে কুলুঙ্গি। খোলা ছাতের দেওয়ালে এমন-সব সুদৃশ্য কুলুঙ্গি রাখবার মানে বুঝতে পারলুম না। বোধ হয় সমতল দেওয়াল খারাপ দেখায় বলে বাহার করবার জন্যে সেগুলি করা হয়েছে।
সেখান থেকে কয়েক ধাপ উপরে উঠে আর-একটা ছাতে গিয়ে পৌঁছলুম। সামনেই দেখা গেল, একজন সঙ্গিনধারী পাহারাদার দাঁড়িয়ে আছে, ছবির মতন স্থির। অনতিদূরেই, ছাতের প্রায় সীমানায় রাস্তার দিকে মুখ করে পাশাপাশি দুটো গদি-মোড়া চেয়ারে দুজন বৃদ্ধ বসে আছেন। অর্থাৎ আমরা মাত্র তাঁদের পিঠের দিকটাই দেখতে পেলুম। একপাশে ঘড়াঞ্চের মতন উঁচু একটা কাঠের টেবিলের মতন জায়গায় একটা জরির টুপি। বুঝতে পারলুম, এই টুপিটাই দূর থেকে মন্দিরচূড়ার সুবর্ণকলসের মতন দেখাচ্ছিল, সূর্যাস্তের আভায় তখনও সেটা ঝকঝক করছিল।
আমাদের দেখে পাহারাদার জিজ্ঞাসা করলে, কি চাই তোমাদের?
বললুম, মালিকের সঙ্গে দেখা করতে চাই।
ওই তো মালিক সামনেই বসে আছেন।
পা টিপে-টিপে এগিয়ে গেলুম। দেখলুম, দুই বৃদ্ধ পাশাপাশি চোখ বুজে বসে আছেন। দুজনেরই মাথায় ধবধবে সাদা বাবরি চুল ও মুখে লম্বা সাদা দাড়ি। আন্দাজ করবার মতন বয়স তাঁদের পেরিয়ে গিয়েছে, তাই সেটা ঠিক অনুমান করতে পারলুম না। আমরা দুটো লোক যে তাঁদের পাশে গিয়ে দাঁড়ালুম–পাশে কেন, প্রায় সামনে বললেও চলে, তা কেউ একবার ফিরেও দেখলেন না।
দুজনে একরকম নিশ্বাস বন্ধ করে সেই ধ্যানী মূর্তিযুগলের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। তাঁরা পশ্চিম দিকে মুখ করে বসেছিলেন, দেখতে দেখতে তাঁদের মুখের ওপর ছায়া ঘনিয়ে আসতে লাগল, জরির শিরস্ত্রাণ ক্রমেই নিস্প্রভ হয়ে পড়ল। একবার পাহারাদারের দিকে তাকালুম, দেখলুম সেও নিস্পন্দ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, শুধু তার করধৃত বন্দুকের মাথায় কিরিচের ডগাটুকু চকচক করছে।
মনের মধ্যে কে যেন খোঁচা দিয়ে ধমকে উঠল, ক’দিনের এই দুরন্ত পরিশ্রমের পর মন্দিরের দরজার কাছে এসে ফিরে যাবি? এখনি ধরণী আঁধার হয়ে যাবে, তার পরে আবার সেই অন্ধকার পথের ধারে শোওয়া–
অথচ এঁদের মধ্যে কে যে মালিক তা বুঝতে পারছি না, কাকে সম্বোধন করব! দুজনেই চোখ বুজে ধ্যানস্থ হয়ে আছেন।
আর দেরি নয়। এক কদম এগিয়ে গিয়ে ঘাড় নীচু করে কুর্নিশ করে বেশ চেঁচিয়েই বলে ফেলা গেল, আদাব আজ্ মালিক!
দুই বৃদ্ধ একেবারে চমকে উঠে চোখ খুললেন। তাঁদের মধ্যে যাঁকে অপেক্ষাকৃত অল্পবয়সি মনে হয়েছিল, তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, কে তোমরা? কি চাও?
বললুম, মালিক, আমরা মুসাফির, বহু দূর দেশ থেকে আপনার নাম শুনে হাঁটতে হাঁটতে এইমাত্র এখানে এসে পৌঁছেছি, আমরা সারাদিন অভুক্ত ও পথশ্রমে অত্যন্ত ক্লান্ত, চারদিন অনবরত হেঁটেছি, আমরা দাঁড়াতে আর পারছি না এমন অবস্থা।
বৃদ্ধ অতি ক্ষীণস্বরে হাঁক দিলেন, এই–
অদূরেই যে শাস্ত্রী দাঁড়িয়ে ছিল, ডাক শুনে একরকম ছুটে এসে সে কুর্নিশ করে সামনে দাঁড়াতেই তিনি তাকে বিড়বিড় করে কি যে বললেন, ধরতে পারলুম না।
কথাটা শুনেই লোকটা আবার সেইরকম দ্রুতপদক্ষেপে নীচে নেমে গেল। দু-তিন মিনিটের মধ্যে শাস্ত্রীর পেছনে একটা লোক দুটো মোড়া নিয়ে উপস্থিত হল। বৃদ্ধ তাকে হুকুম করতেই সে মোড়া-দুটো তাঁদের সামনে পাশাপাশি রেখে চলে গেল। তিনি আমাদের বললেন, বস এখানে।
আমরা দুজনে বসতেই তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, তোমাদের বাড়ি কোথায়?
কলকাতায়।
তা, এই বয়সে তোমরা বাড়ি থেকে বেরিয়েছ কেন? তোমাদের কি আপনার লোক কেউ নেই? একবার মনে হল, বলে ফেলি, হুজুর দুনিয়ায় আপনার বলতে আমাদের কেউ নেই। কিন্তু কি জানি কেন, একেবারে নির্জলা মিথ্যাকথাটা বলতে বাধ-বাধ ঠেকতে লাগল। বললুম, মালিক, আমাদের সবই আছে, কিন্তু আল্লা যার ভাগ্যে যা লিখেছেন তা তো ভোগ করতেই হবে।
বলা বাহুল্য, এইরকম সব বুক্নি বিশুদার আড্ডায় হামেশাই লোকের মুখে শুনতুম, কিন্তু এত শিগিরই যে সেগুলো কাজে লাগবে তা তখন মনেই করতে পারিনি।
এবারে বৃদ্ধ আমাদের আর কিছু না বলে পাশে উপবিষ্ট অতিবৃদ্ধকে কি-সব বলতে লাগলেন। যে ভাষায় তিনি কথা বলতে লাগলেন, তা উর্দু নয়, নিশ্চয় ফারসি হবে। তবে কথার মধ্যে দু-তিনবার বাংগালী শব্দটির উল্লেখ করলেন।
তাঁর কথা শুনে অপর বৃদ্ধ উর্দুতে বললেন, ওদের মুসাফিরখানায় পাঠিয়ে দাও, ওরা খাবার ব্যবস্থা নিজে করে নেবে’খন।
এতক্ষণে বুঝতে পারলাম, আমরা যাঁর সঙ্গে কথা বলছিলুম, তিনি আসল মালিক নন। যা হোক, মালিকের কথা শুনে তিনি বললেন, দেখ, আমাদের মালিকের মুসাফিরখানা আছে, সেখানে গিয়ে থাক। থাকবার কোনো অসুবিধা হবে না। তবে তোমরা হিন্দু, আমাদের তৈরি খাবার তো তোমাদের চলবে না। আমাদের হিন্দু বাবুর্চিও নেই, সেইজন্যে আহারের ব্যবস্থা তোমাদের নিজে করে নিতে হবে।
কথাটা শুনে দমে গেলেও মনের মধ্যে সঙ্গে সঙ্গে আশাও উঁকি দিতে লাগল, যা হোক, থাকবার একটা জায়গা তো ভগবান ঠিক করে দিয়েছেন, হয়তো আরও কিছু প্যাঁচ না কষে তিনি আহারের ব্যবস্থাটা করবেন না।
পরিতোষের দিকে চেয়ে দেখলুম, তার মুখখানা ঘিরে একটা অপ্রসন্ন ভাব ফুটে উঠেছে। তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে হকিমসাহেবকে, অর্থাৎ যিনি আমাদের সঙ্গে কথা বলছিলেন তাঁকে, কি-একটা বলতে যাচ্ছি, এমন সময় পরিতোষের আওয়াজ কানে এল। পরিতোষ চোস্ত উর্দুতে বললে, মালিক, একটা কথা আপনার চরণে নিবেদন করতে চাই।
আসল মালিক, যিনি এতক্ষণ চেয়ারে হেলান দিয়ে নির্জীবের মতন বসে ছিলেন, পরিতোষের কথা শুনে ধড়মড় করে যতদূর সম্ভব সিধে হয়ে বললেন, বল বেটা, কি তোমার বক্তব্য শুনি!
পরিতোষ বললে, মালিক, আমরা যে-ঘরের ছেলে সে-ঘরে আমাদের বয়সি ছেলেকে একলা রাস্তায় বেরুতে দেওয়া হয় না, গাড়ি-চাপা পড়বার ভয়ে। কিন্তু আমরা খোদার ভরসা করে গৃহত্যাগ করেছি জীবনে উন্নতি করব বলে। খোদার কৃপায় অনেক স্থানে আশ্রয়ও পেয়েছি, কিন্তু সব জায়গা থেকেই বিনাদোষে অপমানিত ও প্রহৃত হয়ে তাড়িত হয়েছি। আমরা প্রতিজ্ঞা করেছি, কোথাও অন্নদাস হয়ে আর থাকব না। আপনি মালিক, বিশ্বসুদ্ধ লোক আপনার দয়ার গাথা গায়, সেই কথা শুনে তীর্থযাত্রীর মতন আপনার পায়ে কাছে এসে পৌঁছেছি। আপনার বিশাল রাজত্ব, এই রাজত্বের মধ্যে কোথাও যদি কোনো কাজ দয়া করে দেন, তবেই আমরা থাকব, নইলে খোদার যা মরজি তাই হবে।
পরিতোষের কথা শুনে দুই বৃদ্ধ একেবারে চনমনিয়ে উঠলেন। হকিমসাহেব কিছুক্ষণ ধরে গড়গড় করে ফারসিতে নবাবসাহেবকে কি সব বললেন, তার একটি বর্ণও বোধগম্য হল না। তাঁর কথা শেষ হতে নবাবসাহেব আমাদের বললেন, কিন্তু তোমরা তো ছেলেমানুষ, এখনও খেলে বেড়ানোর বয়স পেরোয়নি, তোমাদের ওপরে কি কাজের ভার দেওয়া যেতে পারে?
এবার আমি বললুম, হুজুর আপনার বাড়িতে ছোট ছেলেপুলে যদি থাকে তো তাদের পড়বার ভার আমাদের ওপর দিতে পারেন। ইংরেজি, বাংলা, সংস্কৃত, ইতিহাস, ভূগোল, অঙ্কশাস্ত্রে আমরা এক-একটা দিগ্গজ। আমাদের বয়স দেখে আমাদের বিদ্যার মাপ করবেন না।
আমার কথা শুনে দুই বৃদ্ধ একেবারে অবাক। বোধ হয় পাছে নিজের বিদ্যা ধরা পড়ে যায়, সেইজন্যে হকিমসাহেব এবার ফারসি ছেড়ে উর্দু ভাষাতেই নবাবসাহেবকে বললেন, বাংগালীর ছেলেরা খুবই তালিম-ইয়াফ্তা হয়। আমি কলকাতায় অনেকদিন বাস করেছি, আমি জানি
দুই বৃদ্ধে পরামর্শ চলতে লাগল–কখনও ফারসিতে, কখনও উর্দুতে। ওদিকে সূর্য প্রায় ডুবে গেলেন, সামান্য একটু আলোতে তাঁদের মুখ দেখা যেতে লাগল।
কিছুক্ষণ তাঁদের মধ্যে কথাবার্তা চলবার পর নবাবসাহেব আমাকে লক্ষ্য করে বললেন, হ্যাঁ, আছে, বাড়িতে ছোট বাচ্চা আছে, আমার নাতি আছে। সে আমাদের লেখাপড়া কিছু কিছু জানে, কোরানশরীফ পড়তে পারে। তোমরা যদি তাকে বাংগালী, ইংরেজি, সংস্কৃত, তারিখ ও আর যা যা বললে, শেখাতে পার, তা হলে তোমাদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ থাকবই, তা ছাড়া তোমাদের আখেরে ভালো হবে।
মালিকের সহস্র বৎসর পরমায়ু হোক। আমাদের যতখানি সাধ্য তার চেষ্টার ত্রুটি করব না, আপনি আমাদের আশীর্বাদ করুন।
আমাদের কথা শুনে কম্পিত করুণ কণ্ঠে বৃদ্ধ চিৎকার করে উঠলেন, আল্লাহ্!
আর্তনাদের মতন অস্বাভাবিক সেই কণ্ঠস্বর শুনে আমার বুকের ভেতরটা গুরগুর করে উঠল। চেয়ে দেখলুম, তাঁর দুই চক্ষু মুদিত, ধ্যানস্থ যোগীর মতন। শীর্ণ শিথিল দক্ষিণ হস্ত আকাশের দিকে উত্তোলিত–বার্ধক্যজনিত দুর্বলতায় কম্পমান। নিবন্ত সূর্যের শেষ রশ্মিটুকুতে সেই অলৌকিক ছবিখানা ঝক্ঝক্ করতে লাগল, তার পরে সব অন্ধকার।
কিছুক্ষণ ঐ ভাবে ধ্যানস্থ থেকে হাতখানা নামিয়ে নিয়ে নবাবসাহেব আমাদের বললেন, আল্লার কাছে আশীৰ্বাদ ভিক্ষা কর বেটা, আমি কে? আমি তাঁর একজন অধম বান্দা মাত্র।
অন্ধকার বেশ ঘনিয়ে উঠতে দুজন লোক একটা তোলা-চেয়ার ও একজন একটা বড় আলো নিয়ে উপস্থিত হল। নবাবসাহেব আসন ছেড়ে সেই জরির টুপিখানা মাথায় দিয়ে তোলা-চেয়ারে বসতে বসতে বললেন, চল আমার ঘরে। স্থবির হয়ে পড়েছি, ঠান্ডা লেগে গেলে আবার সবাই বিরক্ত হবেন। সেইখানে বসে ধীরেসুস্থে তোমাদের কথা শোনা যাবে। চলুন সৈয়দসাহেব
আমরা সকলে একতলার একটা ঘরে এসে ঢুকলুম। চমৎকার ঘর, এর আগে এমন সুন্দর ঘর কখনও দেখিনি। ঘরখানা নীচু মাঝখানে একটা বড় ঝাড় ঝুলছে। আমরা এতদিন সাদা ঝাড়-ই দেখেছি, এটা কিন্তু রঙিন ঝাড়, বোধ হয় কুড়ি-পঁচিশ রঙ-বেরঙের গেলাসে মোমবাতি জ্বলছে। সিলিঙে কড়ি-বরগা কিছু নেই। সেখানে চমৎকার নক্শার মধ্যে লাল নীল হলদে সবুজ সোনালি চকচকে কাঁচ বসানো, তারই মধ্যে মধ্যে গোল চৌকো, ছ’কোনা আটকোনা, লম্বা আয়না বসানো। আগে কলকাতায় সব শৌখিন পানওয়ালার দোকানের সামনে যেমন নানা রঙের ফাঁপা কাঁচের বল ঝোলানো থাকত, সেইরকম নানা রঙের অসংখ্য ছোট-বড় গোলক সিলিং থেকে শিকল দিয়ে ঝোলানো রয়েছে। মাঝে মাঝে এক-একটা রঙিন কাপড় মোড়া সুদৃশ্য পাখির খাঁচা ঝুলছে। ঘরের চারিদিকের দেওয়ালেও সেইরকম সব রঙিন কাঁচ ও আয়না বসানো। মেঝেতে সুন্দর নরম কার্পেট পাতা, মনে হয় যেন এইমাত্র কিনে এনে পাতা হয়েছে। এক কোণে একটা নেয়ারের খাটে সুন্দর বিছানা। খাটের এমন সুন্দর পায়া কখনও দেখিনি, যেন চারটে বেঁটে মুগুর ও তাতে লাট্টুর মাথার মতন চকচকে-রঙ করা। দেখে মনে হতে লাগল, আমরা যেন আরব্য উপন্যাসের একখানা ঘরের মধ্যে এসে পড়েছি।
ঘরের মেঝের পাতা সেই কার্পেটের ওপরেই সকলে বসলুম। একটু পরেই একজন চাকর এসে একটা লাঠির মাথায় বাঁকানো লোহা দিয়ে টপটপ করে ঝাড়ের অর্ধেক বাতি নিবিয়ে দিয়ে চলে গেল।
এই ক’দিনের অত্যাচারে শরীর ও মন এমন অবসন্ন হয়ে পড়েছিল, সেই ঠান্ডা আলো ও শান্ত পরিবেশের মধ্যে বসে থাকতে থাকতে কেমন যেন একটা নেশায় দেহমন ভরে আসতে লাগল। নবাবসাহেব আমাদের নামধাম জিজ্ঞাসা করলেন। বাড়িতে কে আছে, কেন বাড়ি থেকে বেরিয়েছি–সেই সনাতন প্রশ্ন। তারপরে সব চুপচাপ।
কিছুক্ষণ চোখ বুজে থেকে হকিমসাহেব একবার হাই তুলে চোখ চেয়েই আমাদের বললেন, তোমাদের খুবই ক্লান্ত বলে মনে হচ্ছে, অসুখ-বিসুখ কিছু করেনি তো?
বললুম, আমাদের শরীর ও মনের ওপর দিয়ে এ-কদিন অমানুষিক অত্যাচার গিয়েছে, আমরা সত্যিই বড় ক্লান্ত।
হকিমসাহেব অনেকক্ষণ ধরে আমাদের দুজনের নাড়ী পরীক্ষা করে মৃদুস্বরে নবাবসাহেবকে কি বলতেই তিনি চমকে উঠে আমাদের জিজ্ঞাসা করলেন, তোমরা তো হিন্দু, আমাদের ঘরে খেলে তোমাদের কি জাত মারা যাবে। আজ না-হয় বাজারের কোনো হিন্দুর দোকান থেকে খাবার আনবার ব্যবস্থা করা যাচ্ছে, কিন্তু রোজ বাজারের পুরি-মিঠাই খেলে তো অসুস্থ হয়ে পড়বে!
পরিতোষ এতক্ষণ দেওয়ালে হেলান দিয়ে একেবারে নিঝুম হয়ে বসেছিল, আহারের প্রসঙ্গ শুরু হতেই সে গা-ঝাড়া দিয়ে বললে, মালিক! যে-হিন্দুর জাত মারা যায়, আমরা সে-হিন্দু নই। আমরা আপনার এখানেই খাব, তবে আমাদের দেশের হিন্দুরা গরু-শুয়োর খায় না, সেগুলো আর আমাদের দেবেন না।
পরিতোষের কথা শুনে হকিমসাহেব, ‘তোবা তোবা’ বলে কানে হাত দিয়ে বিড়বিড় করে কি-সব বলতে আরম্ভ করলেন। ইতিমধ্যে নবাবসাহেব অতি মিষ্টিসুরে পরিতোষকে বললেন, বেটা, তোমরা আমার ঘরে খাবে–এ আমার সৌভাগ্য। নিশ্চিন্ত থাক, মোটা গোত্ আমাদের বাড়িতে ঢোকে না; আর ওই যে জিনিসটির নাম করলে, ও-জিনিসটি পৃথিবীর কোনো মুসলমানের ঘরেই স্থান পায় না, ও আমাদের হারাম।
এতক্ষণে হকিমসাহেব চোখ খুলে আমাদের দিকে চেয়ে মুখভঙ্গি করলেন, অর্থাৎ কেমন, হল তো?
সেখানে খেতে রাজি হওয়ায় দেখলুম, নবাবসাহেব আমাদের ওপর বেশ খুশিই হয়ে উঠলেন। তিনি বলতে লাগলেন, তোমরা আমার বাচ্চার শিক্ষক হলে, তোমরা এ-বাড়ির মাননীয় ব্যক্তি। আমি আর কদিন আছি! তোমরা ছাত্রকে সৎপরামর্শ দিও, আল্লা তোমাদের ভালো করবেন।
কিছুক্ষণ বিড়বিড় করে ভগবানের নাম উচ্চারণ করে আবার বললেন, লেখাপড়া শেখা ও শেখানো–দুই কঠিন কাজ, সকলের ভাগ্যে হয় না। পড়ার জন্যে ছাত্রকে কখনও মারধর করো না বেটা, এইটুকুই আমার অনুরোধ তোমাদের কাছে।
আমি বললুম, মালিক, এই মারধরের জন্যেই আমার লেখাপড়া অগ্রসর হতে পারেনি। আপনি অনুরোধ করলেও ছাত্রকে মারা আমাদের দ্বারা সম্ভব হবে না।
কিছুক্ষণ আলাপচারীর পর হকিমসাহেব বিদায় নিলেন। তিনি চলে যাবার একটু পরেই নবাবসাহেব বললেন, তোমরা নিশ্চয়ই খুব ক্ষুধার্ত হয়েছ? যদিও আমি রাত্রি ন’টার আগে খাই না, তবুও আজ তোমাদের খাতিরে এখুনি খাবার দিতে বলি, কি বল?
পরিতোষ বললে, মালিকের যথা অভিরুচি।
নবাবসাহেব অতি মৃদুস্বরে ডাক দিলেন, এই!
চাকর বোধ হয় উৎকর্ণ হয়ে দরজার ধারেই দাঁড়িয়ে ছিল। আওয়াজ হওয়ামাত্র সে ঘরের মধ্যে এসে বললে, হুজুর!
নবাবসাহেব তার দিকে না চেয়েই বললেন, দস্তরখান বিছাও।
লোকটি ‘যো হুকুম’ বলে বেরিয়ে গেল। তখনই দু-তিনজন লোক এসে সেই কার্পেটের একধারে একটা শতরঞ্জি ও তার ওপরে ধবধবে সাদা চাদর পেতে দিলে। ইতিমধ্যে আর এক ব্যাক্ত একরাশ রঙিন চিনেমাটির ছোট-বড় প্লেট ও বাটি এনে চাদরের এক কোণে রেখে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। নবাবসাহেব বললেন, খাবার সময় তোমাদের বাচ্চা অর্থাৎ ছাত্রকে ডেকে পাঠাই, একসঙ্গে খাওয়া যাক, কি বল? তোমাদের আপত্তি নেই তো?
বললুম, না না, আপত্তি কিসের! ডাকুন তাকে, এখুনি আলাপ-পরিচয় হয়ে যাক।
নবাবসাহেব আবার মৃদুস্বরে ডাক দিলেন, এই!
হুজুর!–বলে তখুনি এক ব্যক্তি হাজির।
নবাবসাহেব অন্যদিকে তাকিয়ে মৃদুস্বরে বললেন, পেয়ারেসাহেবকে খবর দাও, তার যদি অসুবিধা না হয় তা হলে এখন আমার সঙ্গেই খানা নৌশ ফরমাবে।
চাকর ‘যো হুকুম’বলে বেরিয়ে গেল। নবাবসাহেব আমাদের জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করলেন, কতদিন হল বাড়ি থেকে বেরিয়েছ? এতদিন কোথায় কাটিয়েছ? কোন ইস্টিশান থেকে হাঁটতে হাঁটতে আসছ? আহা, বড় তলিফ হয়েছে তোমাদের, ইত্যাদি।
এতক্ষণে আমরা কিছু প্রকৃতিস্থ হয়েছিলুম। নবাবসাহেবকে প্রথম দেখেই মনের মধ্যে সত্যভাষণের যে আবেগ এসেছিল, তা অনেকখানি মন্দা পড়েছিল, তবুও ওরই মধ্যে যতদূর সম্ভব ভদ্রতা ও ইজ্জৎ বাঁচিয়ে তাঁর কথার জবাব দিতে লাগলুম। ওদিকে এক-একজন লোক চিনেমাটির বাসনে ঢাকা সব খাদ্যদ্রব্য এনে সামনে রেখে চলে যেতে লাগল। ইতিমধ্যে এক ব্যক্তি এসে খবর দিলে, সাহেবজাদা গোসল ফরমাচ্ছেন।
সঙ্গে সঙ্গে নবাবসাহেব বলে উঠলেন, মাশে আল্লা, খোদা তার তন্ দুরস্ত্, রাখুন।
আবার প্রশ্ন শুরু হল। রাত্রে একদিন নেকড়ে আক্রমণ করেছিল শুনে নবাবসাহেব একেবারে চমকে উঠলেন। তারপর সব বৃত্তান্ত শুনে বললেন, ওগুলো নেকড়ে নয়, ওগুলো হচ্ছে হুঁড়ার, মানুষ দেখলে ভাগে, ছোট ছোট অসহায় জানোয়ার ধরে খায়।
নেকড়ে-পালের কবল থেকে বেঁচে আসার দম্ভে আঘাত লাগায় কিঞ্চিৎ ক্ষুণ্ণই হলুম।
ইতিমধ্যে আর-এক ব্যক্তি এসে আদালতের নকিবের মতন গড়গড় করে বলে গেল–হুঁকুম শোনামাত্র সরকারের আদেশ তামিল করতে না পারার অনিচ্ছাকৃত অপরাধের জন্য সাহেবজাদা ক্ষমা প্রার্থনা করছেন, তিনি অনতিবিলম্বেই আপনার সম্মুখে এসে উপস্থিত হবেন।
যা হোক, আরও কিছুক্ষণ এইরকম গৌরচন্দ্রিকার পর ঘরের মধ্যে একজন এসে উপস্থিত হলেন। যিনি এলেন, মানুষের চেহারার মাপকাঠির হিসাবে তাঁকে সু-উচ্চ বলা চলতে পারে। অর্থাৎ নীচে বসে তাঁর মুখ দেখতে আমাদের মাথার পেছনদিকটা প্রায় পিঠে ঠেকবার উপক্রম হ’ল। উচ্চতার অনুপাতে প্রস্থের দিকও বেশ মানানসই। চাপদাড়ির গোড়া ছুঁচলো করে বেশ পরিপাটিরূপে ছাঁটা, গোঁফও ছোট করে ছাঁটা। গায়ের রঙ লালচে গৌর, চমৎকার টানা-টানা চোখ, দেখলেই মনে হয় যেন হাসছে, বয়স ত্রিশের কাছাকাছি বলেই মনে হল।
এই ব্যক্তি হলেন আমাদের ছাত্র এবং একেই প্রহার না দেবার জন্য নবাবসাহেব এতক্ষণ ধরে আমাদের মিনতি জানাচ্ছিলেন।
শিক্ষকের মূর্তি দেখে ছাত্রের পিলে চমকানো ব্যাপারটাই ন্যায়শাস্ত্রসম্মত, কিন্তু আমাদের কর্মফলজনিত অদৃষ্টলিপির বিধানে বরাবর উলটো ব্যবস্থাই দেখে আসছি। ছাত্রের মূর্তি দেখে তো পেটের মধ্যে কিরকম অস্বাভাবিক গুরগুরুনি শুরু হল, অবিশ্যি সেটা ক্ষিধের চোটেও হতে পারে, ঠিক বলতে পারছি না। ক্ষিধের চোটে বাঘের ঘাস খাওয়ার কথাটা কাল্পনিক হলেও স্রেফ ক্ষিধের জ্বালায় আমরা সেই পালোয়ান যুবককে সেদিন ছাত্র বলে মেনে নিয়েছিলুম।
বৃদ্ধ আমাদের সঙ্গে ছাত্রের পরিচয় করিয়ে দিলেন। কি-একটা দেড়গজী নাম বললেন, তা তখুনি ভুলে গেলুম, তবে বাড়িসুদ্ধ সকলে তাকে ‘পিয়ারাসাহেব’ বলে সম্বোধন করে।
কথাবার্তা শুরু হল। পিয়ারাসাহেব বললে, আমার অত্যন্ত সৌভাগ্য যে, আপনাদের মতন সজ্জন ও পণ্ডিতের শিষ্য হবার সৌভাগ্য মিলল।
বাঙালি জাতি ও তাদের নানা গুণের এত প্রশংসা সে করতে আরম্ভ করলে যে, তার পনেরো-আনা বুঝতে না পেরেও আমাদের লজ্জা করতে লাগল। মোট কথা, দেখলুম যে, বিনয়, সৌজন্য ও আপ্যায়নে পিয়ারাসাহেব তার ঠাকুরদাদার চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। ছাত্রের চেহারা দেখে ভড়কে গিয়েছিলুম বটে, কিন্তু তার চালচলন ও কথাবার্তা শুনে তাকে ভালো লাগতে লাগল। এও বুঝতে দেরি হল না যে, তার সেই বৃহৎ চেহারার মধ্যে একটি শিশু লুকিয়ে আছে।
তারপরে আহারের পালা। আহা! আহা! কেমন করে কোন ভাষায় সেই ‘ব্রহ্মানন্দ সহোদরা’র বর্ণনা করব! কি রূপ তার, আর কি তার গন্ধ ও আস্বাদন! ভোজনবিলাসী সেই বুভুক্ষু বাঙালি বালকের মুখগহ্বরে সে-খাদ্য সেদিন যে রসোল্লাস সৃষ্টি করেছিল, সে-কথা স্মরণ হলে আজও রোমাঞ্চ উপস্থিত হয়।
সেই রাত্রেই মনে হয়েছিল যে, মুসলমানেরা রন্ধনকার্যে পটীয়ান। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে এ-বিশ্বাস বেড়েই চলেছে, এবং বাংলাদেশে দেখ দেখ করে মুসলমানের সংখ্যা এত বেড়ে গেল কি করে তারও একটা হদিশ লাগছে।
যা হোক, আহারপর্ব শেষ হবার সঙ্গে-সঙ্গেই পিয়ারাসাহেব আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিলেন। চাকরেরা উদ্বৃত্ত খাদ্য, বাসনপত্র ও চাদর শতরঞ্চি সরিয়ে ফেলে সেইখানেই আমাদের বিছানা পেতে দিলে। চমৎকার বিছানা, পাতলা বালাপোশের মতন লেপ, বিছানা পেতে চাকর আমাদের জিজ্ঞাসা করলে, একখানা করে লেপেই হবে, না, আর লাগবে?
একখানা করে লেপেই আমাদের হবে শুনে তারা নবাবসাহেবের খাটের কাছে যেতেই তিনি হুকুম করলেন, আমার বিছানা জমিতেই করে দাও।
চাকরেরা পরস্পর মুখ চাওয়াচাওয়ি করে বিনাবাক্যব্যয়ে খাট থেকে বিছানা তুলে কার্পেটের ওপর পেতে দিয়ে চলে গেল।
নবাবসাহেব তাঁর বিছানায় গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে বললেন, এবার তোমরা আরাম কর। তাঁর মুখ দিয়ে কথাগুলো বেরুনো মাত্র পরিতোষ লম্বা হল, সঙ্গে সঙ্গে ঘুম।
একটু পরে নবাবসাহেব গলা থেকে গোল-গোল, হলদে পাথরের একটা লম্বা মালা বের করে জপতে আরম্ভ করলেন। বোধ হয় আধ ঘণ্টা পরে একজন চাকর এসে গোটাদুয়েক বাতি ছাড়া ঝাড়ের বাকি মোমবাতিগুলো নিবিয়ে দিয়ে চলে গেল।
কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলুম, টের পাইনি। ঘুমও হয়েছিল বেশ গাঢ়। হঠাৎ শুনতে পেলুম, দূরে যেন কোথায় পেটা-ঘণ্টায় তিনটে বাজল। চোখ চেয়েই মনে হল, এ আমি কোথায় শুয়ে আছি! ওপরে লাল নীল সবুজ সাদা রঙের আয়না দিয়ে বিচিত্র নক্শা-করা সিলিং, তা থেকে নানা রঙের কাপড়ে মোড়া সুন্দর সুন্দর খাঁচা ঝুলছে। এ-পাশে ফিরে দেখি, নবাবসাহেব পশ্চিম দিকে মুখ করে হাঁটু গেড়ে চোখ বুজে বসে সেইভাবে মালা জপ করে চলেছেন, সবার ওপরে স্তিমিত আলোর স্নিগ্ধ বিভা। আমার মনে হতে লাগল, আমি যেন একটা মুঘল চিত্রের মধ্যে ঢুকে পড়েছি, ছবিখানা মধ্যে আমিও যেন আঁকা হয়ে বিছানায় পড়ে আছি। বাকি রাতটুকু কখনও ঘুম কখনও-বা ঘুমঘোরে কাটতে লাগল, শুধু মধ্যে মধ্যে দূরে কে যেন ঘণ্টা পিটে চলতে লাগল, চারটে–পাঁচটা–
রূপের নেশায় একেবারে ভোম হয়ে গিয়েছিলুম, হঠাৎ ওপরের সেই পাখিগুলো একসঙ্গে বিচিত্র সুরে ভোরের গান শুরু করে দিলে। বনে-জঙ্গলে স্বাধীন পাখির প্রাণখোলা গান শোনার অভিজ্ঞতা আমার জীবনে অনেকবার হয়ে গিয়েছে, কিন্তু সেই ব্রাহ্মমুহূর্তে নবাবসাহেবের ঘরে পিঞ্জরাবদ্ধ পরাধীন পাখিরা আমাকে যে গান শুনিয়েছিল তা আজও ভুলিনি, তা ভোলবার নয়।
পাখির ডাক কিছুক্ষণ চলবার পর নবাবসাহেবের ধ্যানভঙ্গ হল।–তিনি মালাগাছা গলায় ঝুলিয়ে রেখে আসনপিঁড়ি হয়ে বসে পড়লেন। আমি উঠে বসতেই তিনি আমাকে সম্ভাষণ করে যা বললেন, তার অর্থ–রাত্রিটা তোমার সুস্বপ্নে কেটেছে তো?
আমি বললুম, কিন্তু আপনাকে দেখলুম, সারারাত্রিই তো ঘুমোন না।
নবাবসাহেব বললেন, সারাজীবন তো ঘুমিয়েই কাটালুম।
নবাবসাহেব তাঁর সেই সুন্দর ভাষায় ঈশ্বরের মহিমা কীর্তন করতে আরম্ভ করলেন, আর আমি মধ্যে মধ্যে ‘হাঁ, হুঁ, না, তা বইকি’ করে যেতে লাগলুম।
কিছুক্ষণ আলোচনা চলবার পর গত সন্ধ্যার সেই হকিমসাহেব এসে উপস্থিত হলেন। পরস্পর অভিবাদনান্তে হকিমসাহেব নবাবসাহেবের নাড়ী দেখতে আরম্ভ করলেন।
ওঃ, সে নাড়ী দেখা বটে, নবাবী নাড়ী কিনা!
হকিমসাহেব নাড়ী দেখতে শুরু করলেন, ইতিমধ্যে একজন লোক এসে বাতিগুলো নিবিয়ে দিয়ে গেল। পাখিগুলোর সেই মধুর কাকলি তীব্রতম ও ক্রমে কর্কশ শোনাতে লাগল। একজন চাকর এসে আমাদের হাত-মুখ ধুতে ডেকে নিয়ে গেল। ফিরে এসে দেখি, হকিমসাহেব তখনও নবাবসাহেবের ডান হাতের কব্জিতে টিপ কষছেন।
ইতিমধ্যে আর-একদল চাকর এসে ওপরকার সমস্ত খাঁচা নাবিয়ে পাখিদের হাওয়া খাওয়াতে নিয়ে গেল, তখনও তিনি নবাবসাহেবের কব্জি টিপে চোখ বুজে বসে।
আমাদের জন্যে জলখাবার এসে হাজির হল। আমরা খেতে খেতে দেখতে লাগলুম, হকিমসাহেব নবাবসাহেবকে চিত করে ফেলে অদ্ভুত তৎপরতার সঙ্গে তাঁর মাথার কাছে গিয়ে বসলেন, তারপর আবার ডান হাতে কব্জি টিপে ধরলেন। তারপর কভু এ-পাশ, কভু ও-পাশ, কভু চিত কভু উপুড় করতে করতে শেষকালে তাঁকে বসিয়ে দিয়ে হকিমসাহেব হাসিমুখে ঘোষণা করলেন, তবিয়ৎ খুব অস্ত্র।
যাক, স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বাঁচা গেল।
কিছুক্ষণ পরে, বোধ হয় নাড়ী দেখানোর পরিশ্রমের পর একটু দম নিয়ে নবাবসাহেব উঠে টুকটুক্ করে ঘরের বাইরে বেরিয়ে গেলেন, আর হকিমসাহেব আমাদের সঙ্গে গল্প জুড়ে দিলেন।
ইতিমধ্যে একজন লোক এসে আমাদের বললে, আপনাদের যদি অসুবিধা না হয়, তা হলে পিয়ারাসাহেব সাক্ষাৎ চাইছেন।
তক্ষুনি উঠে চললুম তার সঙ্গে। কিছুদূর অগ্রসর হয়ে লোকটিকে জিজ্ঞাসা করলুম, পিয়ারাসাহেব আছেন কোথায়?
কবুতরখানায়।
কথাটা কানে যেতেই পরিতোষ বললে, কি বাবা, পায়রা ওড়াতে হবে নাকি?
বললুম, দেখাই যাক না কি হয়!
পরিতোষ বললে, কি জানি বাবা! এক-এক জায়গায় তো দেখছি এক-এক রকমের রেওয়াজ। হয়তো এখানকার লোকে সকালবেলা মাস্টারদের ধরে পায়রা উড়িয়ে নেয়।
কথাবার্তা হতে হতে আমরা একটা সুদৃশ্য বাড়ির সামনে এসে উপস্থিত হলুম। চারিদিকে খুব উঁচু দেওয়াল-ঘেরা একটা বাড়ি, ওপরে থাকে থাকে চারতলা ছাত, অনেকটা ফতেপুরসিক্রির পঞ্চ-মহলের মতন দেখতে।
কিন্তু বাড়ি এমন সুন্দর দেখতে হলে হবে কি! বাপ রে বাপ, কি গন্ধ সেখানে! পায়রা ও পায়রা-বিষ্ঠার দুর্গন্ধে সে-বাড়ির বিশ রশির মধ্যে এগোয় কার সাধ্য!
যা হোক, নাকে কাপড় ঠেসে তো বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়া গেল। দেশ ও বিদেশ থেকে আহৃত হাজার হাজার পায়রা সেখানে বংশানুক্রমে পালিত হয়ে আসছে, সে বোধ হয় দু’শো বিভিন্ন জাতের।
পায়রা দেখতে দেখতে আমরা সেই লোকটির সঙ্গে তিনতলার ছাতে গিয়ে উঠলুম, সেখানে পিয়ারাসাহেব ও আরও অনেকগুলি লোক বসেছিলেন। পিয়ারাসাহেব আমাদের দেখে উঠে অভিবাদন করে আসরে নিয়ে গিয়ে বসিয়ে সবার সঙ্গে পরিচয় করে দিলেন। পিয়ারাসাহেব বললেন, আপনাদের অপেক্ষায় এতক্ষণ কবুতর ওড়ানো হয়নি। অনুমতি করেন তো আমরা আরম্ভ করি।
বললুম, হ্যাঁ হ্যাঁ, নিশ্চয়।
আসরে একজন দাড়িওয়ালা বৃদ্ধ ছিলেন, এঁরা বংশপরম্পরা ধরে কপোত-কুলগুরুর কাজ করে আসছেন। নবাবসাহেবের বাড়িতেও তাঁদের দু-তিন পুরুষ হয়ে গেছে। এই আসরে পিয়ারাসাহেবের পরেই তাঁর ইজ্জৎ।
আমার কথা শুনে পিয়ারাসাহেব বৃদ্ধকে বললেন, বড়েমিয়া, শুরু কিজিয়ে।
আমাদের ছেলেবেলায় অধিকাংশ অভিভাবকই ছেলেদের পায়রা-পোষাটা পছন্দ করতেন না। এর কারণ হচ্ছে, পায়রার পেছনে দিনরাত এত লেগে থাকতে হয় যে, ছেলেরা লেখাপড়া করবার অবকাশই পায় না। প্রথমত সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে পায়রাদের ওড়াবার পালা, তারপরে সারাদিন ধরে তাদের খেতে দেওয়া, স্নান ও পানীয় জলের বন্দোবস্ত করা, সন্ধে হতে-না-হতে প্রত্যেকটি পায়রা খোপস্থ হয়েছে কি না তার তদারক করা, ঠিক নিজের নিজের জোড়া নিজের ঘরে ঢুকেছে কি না তার তদন্ত করা। শুনেছি, মানুষ যেখানে বস্তিতে বাস করে পায়রার খোপের মতন ঘেঁষাঘেঁষি ঘর হওয়ার জন্যে সে-স্থানে ব্যভিচারের মাত্রা খুবই বেশি। আসল পায়রা সমাজের মধ্যে কিন্তু এ-নিয়মের বিশেষ ব্যতিক্রম দেখতে পাওয়া যায়। পাশাপাশি ঘরে বাস করলেও সন্ধের ঝোঁকে এর লোক ওঁর ঘরে ঢুকে পড়লে সে-লোকের দুর্ভোগের আর অন্ত থাকে না। বাড়ির গিন্নি সারারাত তাকে চঞ্চু ও পক্ষ-তাড়নায় একেবারে নাজেহাল করে ছাড়ে–এ বিষয়ে বিশেষ মনোযোগ ও দৃষ্টি রাখা। তা ছাড়া বেড়াল, ভাম ইত্যাদি যাতে পায়রা ধরে না খেয়ে ফেলে, সে-বিষয়ে সতর্ক থাকা। তা ছাড়া আজ এর পায়রা ও ধরে নিয়েছে, এ নিয়ে ঝগড়া মারামারি খুনোখুনি। ওদিকে বহূণ্ডপ্রসূ কপোতবধূর কল্যাগে একজোড়া পায়রা দেখ দেখ করে পাঁচ জোড়ায় পরিণত হতে বেশি দেরি লাগে না। ছেলেরা তখন জোড়া-জোড়া পায়রা কেউ-বা কোঁচায় ঢেকে, আর যাদের বাড়িতে পুরুষ অভিভাবকের বালাই নেই অথবা থেকেও ছেলেরা শাসনমুক্ত, তারা অভিভাবকদের সামনে দিয়েই খাঁচায় ভরে পায়রা নিয়ে যেত সপ্তাহে দু’বার করে বৈঠকখানার হাটে বিক্রি করতে। এইভাবে দিনরাত পায়রা-চর্চা করতে করতে তারা পাড়ার ও অন্যান্য ছেলেদের সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ত। আমাদের সময়ে ‘পায়রা-পোষা’ ছেলেদের হালচালই ছিল এক রকমের।
পায়রা-পোষার অভ্যেস না থাকলেও সকালবেলা ছাতে ওঠবার অবকাশ ঘটলেই দেখতুম, আকাশে ছোট-বড় ঝাঁকের পায়রা গোল হয়ে উড়ছে এখানে-সেখানে, মধ্যে মধ্যে এক-একটা পায়রা দল ছেড়ে বেরিয়ে এসে মনের সাধে শূন্যে উপরি-উপরি গোটাকয়েক ডিগবাজি কিংবা উল্টোবাজি খেয়ে আবার নিজের দলে ঢুকে পড়ে উড়তে আরম্ভ করছে। দৃশ্যটা ভালোই লাগত। কিন্তু কলকাতায় যাই দেখে থাকি না কেন, এখানে এদের পায়রা ওড়ানো দেখে জীবনে সত্যিই একটা অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলুম, যা অন্তত, কলকাতার লোকের কাছে দুর্লভ।
পিয়ারাসাহেবের হুকুম পাওয়ামাত্র বড়ে-মিয়া দাঁড়িয়ে উঠে সেলাম করে মুখের মধ্যে একটা আঙুল পুরে দিয়ে লম্বা শিস দিলেন। বলা বাহুল্য, ওড়বার পায়রাগুলো যে কোথায় আছে, তা আমরা দেখতে পাইনি।
বড়ে-মিয়ার শিস শেষ হবার বোধ হয় মিনিটখানেক পরে মাথার ওপরে পায়রা ওড়ার ফড়ফড় শব্দ শুনতে পাওয়া গেল। তার একটু পরেই দেখা গেল, বিরাট একঝাঁক ঝকঝকে সাদা পায়রা ছাতার মতন গোল হয়ে আকাশে উড়তে আরম্ভ করেছে, বুঝলুম, মাথার ওপরকার ছাতেই পায়রার দল বসে আছে ইঙ্গিতের অপেক্ষায়।
কিছুক্ষণ দেখবার পর লক্ষ্য করলুম, ঝাঁকের ঠিক মাঝখানে টিপের মতো চকচকে কালো একটা পায়রা উড়ছে। একটু পরেই বড়ে-মিয়া উপরি-উপরি দুটো টানা শিস কাটলেন, আর উড়ল একঝাঁক কুচকুচে কালো পায়রা, তার মধ্যিখানে ধবধবে সাদা একটা। তার পরে বড়েমিয়ার এক নতুন রকমের শিসে একঝাঁক সাদা পায়রা উড়ল, যাদের ল্যাজ লাল-রঙ-করা। আর একরকম শিসে আর এক দল সাদা পায়রা উড়ল যাদের ল্যাজগুলো কালো রঙ করা। চার দল পায়রা আকাশ জুড়ে গোল হয়ে কখনও ওপরে কখনও নীচে উড়তে লাগল।
এর পর শুরু হল আসল খেলা। সে-এক অদ্ভুত ব্যাপার। হঠাৎ বড়ে-মিয়া কিরকম উত্তেজিত হয়ে মুখের মধ্যে দুই হাতের আঙুল ঠেসে একরকমের শিস দিলেন, আর দেখতে দেখতে চারঝাঁক পায়রা, যারা এতক্ষণ আলাদা আলাদা উড়ছিল, তারা মিলে গিয়ে একসঙ্গে উড়তে লাগল। তার পরে আর এক ধরনের শিস, আবার যার যার দল আলাদা হয়ে গেল।
বড়ে-মিয়ার শিসের বিরাম নেই। আর এক শিসে সাদা পায়রার দল ভেঙে লাইনবন্দী হয়ে একটার পর একটা লম্বা হয়ে উড়ে ক্রমে লাইনের দুই মুখ জুড়ে বিরাট একটা পদ্মের মালার মতন হয়ে গেল, দেখতে দেখতে সেই মালার মাঝখানের শূন্য জায়গায় এসে ঢুকল কালো পায়রার দল, মনে হতে লাগল, যেন সাদা ফ্রেমে বাঁধানো কালো পায়রার ছবি দেখছি। দু-দল বিপরীত মুখে উড়তে থাকায় চোখে কিরকম ধাঁধা লেগে যায়, বেশিক্ষণ সেদিকে চেয়ে থাকা যায় না।
এইরকম প্রায় দেড় কি দু-ঘণ্টা কসরত দেখানোর পর বড়ে-মিয়ার এক শিসে পায়রাদের ব্যায়াম বন্ধ হল, তারা ছাতের ওপরে এসে বসল। ধন্য পায়রার দল, আর ধন্য বড়ে-মিয়ার শিক্ষা ও তার শিস দেবার কায়দা! আমাদের মনে হল, হ্যাঁ, দেখলুম বটে একটা জিনিস।
আমরা যখন অবাক হয়ে পায়রা ওড়ানো দেখছিলুম, তারই মধ্যে মধ্যে পিয়ারাসাহেব আমাদের জিজ্ঞাসা করতে লাগল, আচ্ছা, কবুতরকে ইংরিজিতে কি বলে, বাংলায় কি বলে? এইভাবে চোখ, চঞ্চু, ডানা ইত্যাদি কথার ইংরিজি ও বাংলা শিখে নিতে লাগল। এই অভিনব উপায়ে উভয় পক্ষেরই শিক্ষা শুরু হল আমাদের নতুন কর্মক্ষেত্রে।
দ্বিপ্রহরে আহারের সময় আর পিয়ারাসাহেবের দেখা পেলুম না। খেতে খেতে নবাবসাহেব জিজ্ঞাসা করলেন, এ-ঘরে থাকতে তোমাদের যদি অসুবিধা হয় তো বল, অন্য ঘরের ব্যবস্থা করে দিই।
বললুম, এ-ঘরে থাকতে আমাদের কোনো অসুবিধাই নেই, তবে আপনার যদি কিছু অসুবিধা হয়, তা হলে যা অভিরুচি তাই করুন।
আমরা নবাবসাহেবের ঘরেই থেকে গেলুম।
সেদিন বিকেলবেলা, তখনও রোদ বেশ চড়চড়ে আছে, পিয়ারাসাহেব আমাদের ডেকে পাঠালেন। চাকরের সঙ্গে আমরা প্রাসাদের হুদ্দোর মধ্যেই একটা বড় উঁচু-নীচু ছাতে গিয়ে হাজির হলুম। সেখানে দেখি, আট-দশটা লোক ছাতের হেথা-হোথা বসে দাঁড়িয়ে ইয়া-ইয়া বোম-লাটাইয়ে ঘুড়ি উড়োচ্ছে, আকাশে রঙের বাহার লেগে গেছে।
আমাদের দুজনেরই ঘুড়ি ওড়াবার শখ ছিল। ওই প্রকাণ্ড ছাত আর সেখানে ঘুড়ি উড়ছে দেখে মনটা ভারি প্রফুল্ল হয়ে উঠল। পিয়ারাসাহেব আমাকে ডেকে তার লাটাইটা এগিয়ে দিলে, ইয়া বোমা-লাটাই, আর সে কি ভারী রে বাবা! একটু নাড়াচাড়া করেই আবার যার গদা তার হাতে ফিরিয়ে দিলুম।
যা হোক, সকালবেলার মতন না হলেও এ-বেলাতেও আশ্চর্য কিছু কম হইনি। ঘুড়ি-ওড়ানোর মধ্যেও এত কারিগরি আছে, এর আগে তো দেখা তো দূরের কথা, শুনিইনি। সেখানে একজন লোক ছিল, যাকে একসঙ্গে দশজন মিলে আক্রমণ করলেও–অবিশ্যি ঘুড়ি-সুতো দিয়ে, সে অন্য কারুর ঘুড়ির সুতোয় নিজের ঘুড়ির সুতো না ঠেকিয়ে নিরাপদে বার করে নিয়ে আসতে পারত। আর আক্রমণ করবারই সে কত রকমের কায়দা–কখনও বা একসঙ্গে, কখনও বা এখানে একটা, ওখানে একটা, সেখানে একটা, প্রত্যেকেই নিরপেক্ষ উদাসীন ভাবে যেন উড়তে-হয়-তাই- উড়ছি গোছের–এমন সময় হঠাৎ একটা ঘুড়ি ছুটে তাকে আক্রমণ করতে গেল, তাকে কাটিয়ে বেরুনো মাত্র ঠিক আর দুটোর সামনে, কিন্তু আক্রমণের সমস্ত কায়দা ব্যর্থ করে প্রতিবারই সে-ব্যক্তি নিজের ঘুড়িকে বাঁচিয়ে নিয়ে আসতে লাগল।
আর একটা লোক ওইখানেই আর একরকমের ঘুড়ির খেলা দেখিয়েছিল, সে-ছবিটা মনে পড়লে আজও হাসি পায়। পূর্বোক্ত ব্যক্তি যেমন পলায়নের ওস্তাদ ছিল, এ ছিল তেমনই প্যাঁচ ভণ্ডুল করে দেবার ওস্তাদ! এর সঙ্গে প্যাঁচ খেলতে গেলেই সে অপর ব্যক্তির সুতোয় নিজের সুতো দিয়ে এমন একটা ফাঁস লাগিয়ে দিত যে, কারুর ঘুড়িই কাটত না, অবশেষে টানামানি হওয়া ছিল অনিবার্য, টানামানির দৃশ্যটা ছিল ভারী কৌতুকপ্রদ, এবং প্রতিবারেই সে অন্য পক্ষের ঘুড়ি ছিঁড়ে আনতে পারত।
সাধারণের কাছে এই পায়রা ঘুড়ি প্রভৃতি ওড়ার প্রসঙ্গ তেমন ভালো লাগবে না জানি; কিন্তু এটুকু হচ্ছে তাঁদেরই জন্যে, যাঁরা একদা উড়েছেন, যাঁরা এখনও উড়ছেন এবং একদা যাঁরা উড়বেন। এইখানে এই ছাতে আমাদের মাস্টারি জীবনের প্রথম দিনের আর একটি মজার অভিজ্ঞতার কথা মনে পড়ে। ঘুড়ি-ওড়ার সঙ্গে ছাত্রের তালিমও চলেছে। হঠাৎ পিয়ারাসাহেব জিজ্ঞাসা করলে, আচ্ছা, পতঙ্গকে ইংরেজি বাংলায় কি বলে?
প্রশ্ন শুনে বেশ বিব্রত হয়ে পড়লুম–পতঙ্গের ইংরেজি কি? মনে হতে লাগল, Insect মানে তো কীট। কিন্তু কীট ও পতঙ্গে যে অনেক তফাৎ! কি বলব ভাবছি, বেশ একটু দেরি হচ্ছে, এমন সময় ছাত্রই বাঁচিয়ে দিলে। সে বললে, আচ্ছা, নীল পতঙ্গকে ইংরিজিতে কি বলবে?
আর ভাবতে হল না। বুঝতে পারা গেল, পতঙ্গ মানে ঘুড়ি।
.