আর্থিক উন্নতির শর্ত
আর্থিক উন্নতির মূল শর্তগুলি সরল। শিক্ষা ও বিজ্ঞানচর্চার প্রসার এবং কৃষি ও শিল্পে, অথবা ধনোৎপাদনের ক্ষেত্রে, বিজ্ঞানের প্রয়োগের সাহায্যে মানুষের উৎপাদিকা শক্তির বৃদ্ধিই আর্থিক উন্নতির মূল কথা। শিল্পোন্নত দেশগুলির ভিতর অন্যান্য নানা পার্থক্য দেখা। যায়, যেমন বিভিন্ন দেশে রাজনীতিক ব্যবস্থা এক নয়। কিন্তু শিক্ষা ও বিজ্ঞানের প্রসার ও বিজ্ঞানের ব্যাপক প্রয়োগ ভিন্ন কোনো দেশেই আর্থিক উন্নতি সম্ভব নয়। সেই সঙ্গে প্রয়োজন নিয়মিত কঠিন পরিশ্রমের অভ্যাস এবং শ্রমের প্রতি একটা শ্রদ্ধাবোধ। কথাটা। বিখ্যাত সমাজতান্ত্রিক এরিক ফ্রমের ভাষায় বলা যাক। ফ্রম লিখেছেন “The drive for relentless work was one of the fundamental productive forces, no less important for the development of our industrial system than steam and electricity.” (The Fear of Freedom) বাষ্পীয় শকট ও বৈদ্যুতিক শক্তির আবিষ্কার ছাড়া যেমন শিল্পবিল্পব হত না, শ্রমে একান্ত অনুরাগও তেমনই শিল্পোন্নতির জন্য ছিল অত্যাবশ্যক।
আধুনিক যুগের গোড়ায় পাশ্চাত্ত্য সমাজে ধার্মিক ও নাস্তিক বহু চিন্তাশীল মানুষ শ্রমের প্রতি নিষ্ঠা সৃষ্টি করতে সাহায্য করেছেন। উদাহরণত খ্রীষ্টান পিউরিটান আন্দোলনের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। প্রকৃতির বিবিধ সম্পদ মানুষকে দান করেছেন ভগবান। পার্থিব সম্পদ নানাভাবে বাড়িয়ে তুললে ঈশ্বরের এই দানের প্রতি সম্মান দেখান হবে এবং ভগবান তাতে তুষ্ট হবেন। এই জাতীয় একটা চিন্তা যোড়শ শতকের শেষ ভাগ থেকে ক্রমশ পশ্চিম ইয়োরোপের উঠতি দেশগুলির ভিতর ছড়িয়ে পড়ে। জাপানে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন সবাইকে শিখিয়েছে কঠিন পরিশ্রমকে কর্তব্য হিসাবে গ্রহণ করতে। বিজ্ঞান ও এম আর্থিক উন্নতির এই যুগ্ম ভিত্তি। যে-দেশ বিজ্ঞান চচায় উৎসাহী ও ধনোৎপাদনের জন্য কঠিন পরিশ্রমে অভ্যস্ত তারই উন্নতি অনিবার্য।
ব্যক্তিবিশেষ চৌর্যের সাহায্যে বড়লোক হতে পারে। কিন্তু কোনো বৃহৎ সমাজ অথবা দেশের আর্থিক উন্নতি শুধু লুঠতরাজ ও প্রবঞ্চনার উপর স্থায়িভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। আমাদের ভিতর অনেকের বিশ্বাস যে পাশ্চাত্ত্য দেশগুলির আর্থিক উন্নতির মূলে আছে ঔপনিবেশিক শোষণ। এ ধারণা বহুব্যাপ্ত হলেও অভ্রান্ত নয়। শুধু পরস্বাপরহরণের পুরস্কারস্বরূপ ইতিহাস কোনো দেশকে আর্থিক উন্নতির বরমাল্য দান করেনি। এজন্য। অন্য গুণের প্রয়োজন। বিজ্ঞান ও শ্রমে অনুরাগই স্থায়ী সমৃদ্ধির মূল শর্ত। এই শর্ত যে-দেশে পূর্ণ হয়নি ঔপনিবেশিক শোষণের সুযোগ পেয়েও সে বেশী দূর এগোতে পারেনি। ষোড়শ শতক থেকে ইংল্যাণ্ড ও স্পেন উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকায় এবং পরবর্তীকালে পৃথিবীর অন্য কয়েকটি অংশে উপনিবেশ স্থাপন করেছে। লুঠতরাজে সে যুগে স্পেনের জুড়ি মেলা ভার। অথচ আর্থিক দিক থেকে স্পেন ইয়োরাপের একটি পশ্চাদপদ দেশ হয়েই রইল। অপর পক্ষে যে-সব দেশে আর্থিক উন্নতির মূল শর্ত পূর্ণ হয়েছে উপনিবেশের উপর নির্ভর না করেও তারা এগিয়ে যেতে পেরেছে। ইয়োরোপে আজ জীবনযাত্রার মান সবচেয়ে উঁচু সুইডেনে। উপনিবেশের সাহায্য ছাড়াই সুইডেনের উন্নতি সম্ভব হয়েছে। সুইজারল্যাণ্ড, চেকোস্লোভাকিয়া, ডেনমার্ক, নরওয়ে প্রভৃতি দেশ সম্বন্ধেও একথা বলা চলে। জার্মানী, জাপান, ফ্রান্স, হল্যান্ড প্রভৃতি দেশ উপনিবেশ হারাবার পর আরও দ্রুত এগিয়ে চলেছে। ঔপনিবেশিক ব্যবস্থার মূলে নেই ততটা সুচিন্তিত স্বার্থবুদ্ধি যতটা আছে যুক্তির চেয়েও আদিম জঙ্গী মনোবৃত্তি। এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বরং একথাটাই বলা উচিত যে, কোনো দেশেরই আর্থিক উন্নতির জন্য উপনিবেশ অপরিহার্য নয়; এমন কি অবস্থাবিশেষে এর অস্তিত্ব শোষক ও শোষিত উভয় দেশেরই উন্নতির পথে বাধা। আঠার শতকের শেষভাগে সেকালের শ্রেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ অ্যাডাম স্মিথ ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক ব্যবস্থার বিরোধিতা করে অনুরূপ কথাই বলেছিলেন। মার্কিন দেশ ইংল্যাণ্ডের হাত ছাড়া হওয়াতে উভয় দেশই আখেরে উপকৃত হয়েছে। শিল্পোন্নত ধনতান্ত্রিক দেশগুলির উন্নতির প্রধান কারণ ঔপনিবেশিক শোষণ নয়, বরং বিজ্ঞান ও শ্রমনিষ্ঠা। এ বিষয়ে আমাদের ভুল ধারণার সংশোধন প্রয়োজন। কারণ এরই ফলে। আমরা আজও বিদেশী সাম্রাজ্যবাদের সমালোচনায় যতটা উৎসাহী দেশীয় অন্ধতার বিরোধিতায় ততটা নই। সাম্রাজ্যবাদের সমালোচনা ভালো, কিন্তু সেটাই যথেষ্ট নয়।
আগেই বলেছি যে, বিজ্ঞানচর্চা ছাড়া আর্থিক উন্নতির স্থায়ী ভিত্তি নেই। এখানে খানিকটা ব্যাখ্যা প্রয়োজন। তা নইলে ভুল বোঝার সম্ভাবনা থেকে যায়। আঠার শতাকের শেষভাগে ইংল্যাণ্ডে শিল্পবিল্পব শুরু হয়; ফরাসী দেশে তখনও শুরু হয়নি। অথচ বিজ্ঞানচচায় ফ্রান্স সেদিন পিছিয়ে ছিল বলা চলে না উনিশ শতকের রুশ দেশেও বিশ্ববিখ্যাত বৈজ্ঞানিক ছিলেন বেশ কয়েকজন। এদের ভিতর মেণ্ডেলে সর্বজনবিদিত; কিন্তু লমনসভ থেকে শুরু করে আরও কয়েকজনের নাম বিশেষ উল্লেখযোগ্য। বিজ্ঞানের চচায় উপরতলায় গুণীজ্ঞানীদের কথা ধরলে উনিশ শতকে রুশদেশ মার্কিন দেশের চেয়ে খাটো ছিল না। অথচ আর্থিক উন্নতিতে মার্কিন দেশই সেদিন এগিয়ে গেল। এসব তথ্য থেকে একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায়। অভিজাত বংশীয় কয়েকজন গুণী ব্যক্তি বিজ্ঞানচর্চায় ডুবে থাকলেই উন্নতি ঘটে না। বিজ্ঞানকে উদ্ভাবনী শক্তি দ্বারা কৃষি ও শিল্পের সঙ্গে যুক্ত করাও প্রয়োজন। ক্ষেতে ও কারখানায় বিজ্ঞানকে টেনে আনা আবশ্যক। একাজ যে দেশে সুসম্পন্ন হয় সে দেশ আর্থিক উন্নতির পথে এগিয়ে যায়। আঠার শতকের ফরাসী দেশের তুলনায় ইংল্যাণ্ডের, উনিশ শতকের রুশ দেশের চেয়ে আমেরিকার, শ্রেষ্ঠত্ব এখানেই।
আমাদের দেশের দিকে তাকালেও একথাটাই স্পষ্টভাবে বোঝা যায়। এদেশে বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক একেবারে জন্মাননি এমন নয়। তবু জাপান এগিয়ে গেছে আর আমরা পিছিয়ে আছি। এদেশের শিক্ষিত মানুষ তেমনভাবে কৃষি ও শিল্পে বিজ্ঞানেরপ ব্যবহারে এগিয়ে যাননি যেমনভাবে ওঁরা গেছেন জাপানে। কৃষির ক্ষেত্রে এই দৈন্য বিশেষভাবে চোখে পড়ে। উনিশ শতকের শেষভাগে বিজ্ঞানের প্রয়োগে জাপানে কৃষির উন্নতি শুরু হয়ে গেছে। আর এদেশে ওপরতলায় কৃষিবিজ্ঞান নিয়ে কিছু গবেষণা সত্ত্বেও নীচের তলায় তেমন কিছু ঘটেনি। শিল্পের ক্ষেত্রেও এদেশে বিজ্ঞানের সঙ্গে ব্যবহারের সুষ্ঠু সংযোগ স্থাপিত হয়নি। এদেশের শিল্পপতিরাও প্রায়ই গবেষণায় অর্থ ব্যয় করতে নারাজ। অথচ শুধু সরকারী গবেষণাগারে বিজ্ঞানচচাই আমাদের শিল্পের উন্নতির পক্ষে যথেষ্ট নয়।
আগেই বলেছি যে, দ্রুত আর্থিক উন্নতির জন্য চাই বিজ্ঞানচর্চার সঙ্গে শ্রমনিষ্ঠার সংযোগ। নিয়মিত শ্রমের অভ্যাস গড়ে তুলতে হলে একদিকে যেমন প্রয়োজন শ্রমের মূল্য সম্বন্ধে সমাজের চেতনাকে জাগ্রত করা অন্যদিকে তেমনই চাই শ্রমের সঙ্গে পারিশ্রমিকের যোগসাধন ও শ্রমে অবহেলার জন্য দণ্ডবিধান। প্রাচীন সমাজে যৌথ পরিবার ব্যবস্থায় শ্রমের সঙ্গে পারিশ্রমিকের সম্পর্ক ছিল শিথিল। শিল্পোন্নত দেশগুলিতে এ দুয়ের যোগ ঘনিষ্ঠ। ধনতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক উভয় ব্যবস্থাতেই এটা লক্ষ্য করা যায়। সমালোচকেরা কখনও বলে থাকেন যে, ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শ্রমিকের কাজে। উৎসাহ থাকা সম্ভব নয়, কারণ শ্রমের সম্পূর্ণ ফল শ্রমিক লাভ করেন না। কিন্তু সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠিত না হলে শ্রমিকের মনে কাজে আগ্রহ আসে না এই ধারণার সঙ্গে তথ্যের সামঞ্জস্য নেই। পশ্চিম জার্মানীর তুলনায় পূর্ব জার্মানীতে, ইংল্যাণ্ডের তুলনায় পোল্যাণ্ডে, অথবা জাপানের তুলনায় সোভিয়েত দেশে শ্রমিকের কাজে উৎসাহ বেশী একথা বলা চলে না। আসলে সোভিয়েত ও প্রাগ্রসর ধনতান্ত্রিক দেশগুলির ভিতর মজুরী ব্যবস্থার সাদৃশ্যও উল্লেখযোগ্য। শিল্পোন্নত দেশে শিক্ষা, স্বাস্থ ইত্যাদি ব্যাপারে সর্বসাধারণের কতগুলি ন্যূনতম প্রয়োজন মেটাবার চেষ্টা আছে। কিন্তু শ্রমের সঙ্গে দণ্ড ও পুরস্কারের ঘনিষ্ঠ। সম্পর্ক স্থাপন ভিন্ন নিয়মিত পরিশ্রমের অভ্যাস তৈরী করা কঠিন একথাটা সোভিয়েত ও ধনতান্ত্রিক দেশগুলি সমভাবে বহুদিন আগে মেনে নিয়েছে।
কৃষির ক্ষেত্রে নানা বিকল্প ব্যবস্থা সম্ভব। যেমন কৃষক যদি তাঁর জমির মালিক হন তাহলে সরকারকে কর দেবার পর তাঁর শ্রমের ফল তিনি নিজেই লাভ করেন। কাজেই যে কৃষক জমির মালিক তাঁর কাজে উৎসাহ বাড়বার সম্ভাবনা বেশী। অবশ্য যে-দেশে অধিকাংশ মানুষ দরিদ্র ও অশিক্ষিত সেখানে দেশময় ছোট ছোট স্বাধীন চাষী সৃষ্টি করলেই যে চাষের উন্নতি হবে এমন বলা যায় না। কৃষিক্ষেত্রে বিজ্ঞানের ব্যবহার কি উপায়ে দ্রুত চালু করা যায় সেটাই প্রধান প্রশ্ন। জমির উৎপাদিকা শক্তি বাড়াবার জন্য চাই জল, সার, ভালো বীজ ইত্যাদির প্রয়োগ এবং নানাধরনের পরীক্ষানিরীক্ষার ভিতর দিয়ে কৃষিপদ্ধতির ক্রমাগত উন্নতিসাধন। এই ধরনের পরীক্ষানিরীক্ষায় অপেক্ষাকৃত বড় চাষী অনেক সময়ে অগ্রণী হন। তিনি পথ দেখালে অপেক্ষাকৃত ছোট চাষীও নতুন পথ গ্রহণ করেন। চাষের উন্নতি নানা পথেই সম্ভব; কিন্তু এখানেও মূল শর্ত ঐ একই, বিজ্ঞান ও শ্রমের সমন্বয়।
অর্থনীতিজ্ঞেরা এককালে আর্থিক উন্নতির মূল শর্ত হিসাবে একটি বিষয়ের উপরই বিশেষভাবে জোর দিতেন, সেটি হল মূলধন গঠন। মূলধন গঠন প্রয়োজন সন্দেহ নেই। কিন্তু বিজ্ঞানের সহায়তায় যে-দেশে উৎপাদনপদ্ধতির ক্রমাগত উন্নতিসাধন না হচ্ছে সেখানে মূলধনের ব্যবহারে খুব বেশী ফললাভ হয় না। মূলধন গঠন করাও সেদেশে কঠিন! অর্থনীতির ছাত্ৰমাত্রেই জানেন যে, কৃষিপদ্ধতি অপরিবর্তিত থাকলে শুধু বাড়তি শ্রম অথবা মূলধন নিয়োগ করে ফসল সমান হারে বাড়িয়ে যাওয়া যায় না। বরং ফসলবৃদ্ধির হার এ অবস্থায় ক্রমেই কমে আসে। বিজ্ঞানের নিত্য নতুন প্রয়োগের দ্বারাই উৎপাদন ক্রমাগত বাড়িয়ে চলা সম্ভব। বিজ্ঞানের সঙ্গে যুক্ত হয়েই মূলধন সমাজের পক্ষে ফলপ্রসূ হয়।
অবশ্য বিজ্ঞানের ব্যাপক প্রয়োগের জন্যও মূলধন প্রয়োজন। কাজেই উন্নতিশীল সকল দেশকেই শিক্ষা ও বিজ্ঞান চর্চার সঙ্গে সঙ্গে মূলধন গঠনের প্রতি দৃষ্টি দিতে হয়। এই অর্থে একেও আর্থিক উন্নতির অন্যতম শর্ত হিসাবে স্বীকার করে নেওয়া যায়।
.
২
বিভিন্ন দেশে মূলধন গঠনের প্রয়াস বিভিন্ন রূপ ধারণ করেছে। জাপানে “জাইবাৎসু গোষ্ঠী দীর্ঘকাল যাবৎ শিল্প ও ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে বহু বড় বড় প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছেন। ব্যবসায় থেকে একদিকে যেমন তাঁরা অনেক লাভ করেন অন্যদিকে তেমনই এই লাভের একটা বড় অংশ মূলধন হিসাবে বিনিয়োগ করেন। সোভিয়েত দেশে ভিন্ন ব্যবস্থা। বৃহৎ শিল্প ও ব্যবসায়ের কর্তৃত্ব সেখানে রাষ্ট্রের হাতে। দীর্ঘদিন যাবৎ সোভিয়েত সরকার ভোগ্যবস্তু যে-খরচে তৈরী হয় তার চেয়ে অনেকটা বেশী দামে বিক্রী করে এ দু’য়ের পার্থক্যটা একটা কর হিসাবে গ্রহণ করেছেন। অর্থাৎ, ক্রেতার দাম ও বিক্রেতার খরচের ভিতর পার্থক্যটা ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় পুঁজিপতির হাতে যাচ্ছে লভ্যাংশ হিসাবে, আর সমাজতান্ত্রিক দেশে সরকারের হাতে যাচ্ছে বাড়তি রাজস্ব হিসাবে। এই টাকারই অংশবিশেষ পরে মূলধন হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে শিল্পের প্রসারের জন্য। জাপানী সরকার ভূমিকরের সাহায্যে কৃষকের আয়ের একাংশ নিজে গ্রহণ করেন। জাপানে আর্থিক উন্নতির প্রথম পর্যায়ে এটাই ছিল সরকারী রাজস্বের প্রধান উৎস। সোভিয়েত দেশে ব্যবস্থা ছিল ভিন্ন। যৌথচাষ প্রথায় চাষীকে ফসলের একটা অংশ সরকারের হাতে তুলে দিতে হত নামমাত্র দরে; বাজারদরের চেয়ে সেটা অনেক কম। সরকারের অর্থলাভের এটা ছিল একটা উল্লেখযোগ্য উপায়।
অর্থাৎ, বিভিন্ন দেশে ব্যবস্থা বিভিন্ন; কিন্তু সব কিছুর ভিতর একটা বড় মিলও আছে। সব দেশেই চাষী ও মজুর অথবা সাধারণ ক্রেতার হাত থেকে জাতীয় আয়ের একটা অংশ প্রথমে সরিয়ে নেওয়া হয়, তারপর সেটা নিয়োগ করা হয় মূলধন হিসাবে আর্থিক সম্প্রসারণের জন্য। উৎপাদিত ধনের একটা অংশমাত্র সরাসরিভাবে মজুরী হিসাবে শ্রমিকের হস্তগত হয়। উদ্বৃত্ত অর্থ ব্যয় হয় অংশত মূলধন হিসাবে; তা ছাড়া প্রতিরক্ষা ও শাসনযন্ত্র চালাবার খরচ আছে, পরিচালক গোষ্ঠীর ব্যয়ভারও আছে। ধনতান্ত্রিক সমাজের বিশ্লেষণ করতে গিয়ে মার্ক্স এই ব্যাপারটাকে নাম দিয়েছিলেন “শোষণ”। কিন্তু মনে রাখতে হবে যে, ধনতান্ত্রিক সমাজতান্ত্রিক কোনো সমাজেই উৎপাদিত ধনের সমস্তটা শ্রমিকের হাতে পৌঁছয় না।
সাম্যবাদী এখানে একটা আপত্তি তুলতে পারেন। তিনি বলবেন যে, সমাজতান্ত্রিক দেশে ধনের একটা অংশ শ্রমিকের হাত থেকে সরকার সরিয়ে রাখেন বটে, কিন্তু সেটা নিযুক্ত হয় দেশের আর্থিক উন্নতির জন্য, এই আর্থিক উন্নতির ফলও শ্রমিকই অবশেষে ভোগ করেন। আর ধনতান্ত্রিক দেশে পুঁজিপতি অর্থ বিনিয়োগ করেন নিজের স্বার্থে। এতে কিন্তু সবটা বলা হল না। মার্ক্স বলেছিলেন যে, আমাদের ব্যক্তিগত ইচ্ছার দ্বারা ইতিহাস নিয়ন্ত্রিত হয় না। পুঁজিপতির ব্যক্তিগত ইচ্ছা দিয়েও শ্রমিকশ্রেণীর ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হয় না। মার্ক্স দেখেছিলেন যে, ধনিকশ্রেণী তার ইচ্ছার বিরুদ্ধেই ব্যবসায়ে মন্দা ও সংকট ডেকে আনে। কিন্তু আর একটি ব্যাপার তিনি তেমন গভীরভাবে লক্ষ করেননি। ধনতন্ত্রের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে শ্রমিকশ্রেণীরও অবস্থার উন্নতি হয়েছে। আজকের জাপানী, জার্মান বা ইংরেজ শ্রমিক যে বিশ অথবা পঞ্চাশ বৎসর আগের তুলনায় অনেকটা সচ্ছল অবস্থায় আছেন এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। “সাম্যবাদী” পূর্ব জামানীতে শ্রমিকের অবস্থার যে-উন্নতি হয়েছে “ধনতান্ত্রিক পশ্চিম জার্মানীতে উন্নতি তার চেয়ে কম হয়নি। পুঁজিপতি হয় তো পুঁজি বিনিয়োগ করেন নিজের স্বার্থের কথা চিন্তা করেই, যদিও জাতিকে শক্তিশালী করবার কথা তিনি যে কখনও ভাবেন না এমন কথাও জোর করে বলা যায় না। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে তিনি যাই চিন্তা করুন না কেন পুঁজি বিনিয়োগের ফলে উৎপাদন পদ্ধতিরও উন্নতি ঘটে। অবশ্য মূলধনের অপচয় ও অপব্যবহারও আছে এবং তা থেকে কোনো দেশই মুক্ত নয়। তবু ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিতে দেখলে মূলধন গঠনের সঙ্গে উৎপাদন পদ্ধতির যোগ স্পষ্ট। বিশেষত যে-সব দেশ বিজ্ঞানে অগ্রসর তাদের সম্বন্ধে কথাটা খুবই সত্য। উৎপাদনপদ্ধতির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে শ্রমিকশ্রেণী ক্রমশ দক্ষ ও শিক্ষিত হয়ে ওঠে, শ্রমের উৎপাদিকা শক্তি বৃদ্ধি পায়। দক্ষ, শিক্ষিত ও সুসংবদ্ধ শ্রমিকশ্রেণীর জীবনযাত্রার মান অনিবার্যভাবে ক্রমশ উন্নত হয়ে ওঠে। ধনতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক উভয় দেশেরই বর্তমানকালের ইতিহাসের এটা একটা প্রধান ঘটনা। সকল দেশেই পুঁজি গঠনের গোড়ার কথা হল ধনের একটা অংশ শ্রমিকের হাত থেকে সরিয়ে রাখা, আর তার শেষ ফল হচ্ছে শ্রমিকের উৎপাদিকা শক্তি ও জীবনযাত্রার মানের উন্নয়ন। এই উন্নতি কোনো দেশেই সহসা ঘটেনি এবং বিনা কষ্টেও সম্ভব হয়নি। এ কথাটা তবু স্বীকার্য যে, যাকে “শোষণ” বলা হয় এবং যা ছাড়া মূলধন গঠন সম্ভব নয়, তাই আবার বিজ্ঞানের সঙ্গে যুক্ত হয়ে শ্রমিকের জীবনের মানের উন্নতিরও কারণ।
কোনো সামাজিক ব্যবস্থাই অন্যায় থেকে মুক্ত নয়, ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থা তো নয়ই। ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় মূলধনের উপর কর্তৃত্ব প্রধানত অল্পসংখ্যক লোকের হাতে সাম্যবাদী সমালোচক এই ব্যবস্থার পরিবর্তন চান। এ ব্যাপারে সাম্যবাদী আদর্শের একটা যৌক্তিকতা আছে। ধনতান্ত্রিক দেশে মূলধনের যাঁরা মালিক তাঁরা অনেক সময় শিল্পের পরিচালক নন। তাঁদের অনেকেই শিল্পের “ঘুমন্ত” বা কহীন অংশীদার। এই ব্যবস্থাতে আমাদের ন্যায়বোধ পীড়িত হয়। যাঁদের ভূমিকা ছাড়াই শিল্পকর্ম চলতে পারে তাঁদের আয় ন্যায্য বলে মেনে নেওয়া কঠিন। আদর্শের দিক থেকে বৃহৎ শিল্পে যাঁরা কর্মে অংশীদার তাঁদেরই কর্তৃত্ব বাঞ্ছনীয়।
কিন্তু এই আদর্শকে অবিলম্বে রূপদান করা কঠিন। শান্তিপূর্ণ পথে অগ্রসর হলে সহসা কোনো বৃহৎ পরিবর্তন আনা সম্ভব নয়। আবার হিংসাত্মক উপায়ে উদ্দেশ্যসাধন করতে চাইলে তার ফল অনেক সময়েই আদর্শের বিপরীত হয়। হিংসার অস্ত্র হিসাবে যে-দল। গঠিত হয়, অত্যাচারের যন্ত্রে তা অবশেষে পরিণতি লাভ করে। পুঁজিপতির অন্যায়ের চেয়ে এই দলীয় অত্যাচার কম পীড়াদায়ক নয়। তা ছাড়া গৃহযুদ্ধের ফলে শান্তি ও শৃঙ্খলা ভেঙ্গে পড়লে তাতে আর্থিক দিক থেকেও দেশ পিছিয়ে যেতে পারে।
শিল্পোন্নয়নের প্রথম যুগে সামাজিক ভাঙ্গাগড়ার মাঝখানে বিপ্লব ডেকে আনা অপেক্ষাকৃত সহজ। কিন্তু অনুন্নত দেশে “সমাজতন্ত্র” নামধারী কোনো ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হলেও সেই ব্যবস্থা বিকৃত সমাজতন্ত্র ছাড়া আর কিছুই হয় না। পুঁজিপতি শ্রেণীর অস্তিত্বে সমাজে অসাম্য বৃদ্ধি পায় বটে; কিন্তু মনে রাখা ভালো যে, আর্থিক উন্নতির প্রথম যুগে বিনা কষ্টে মূলধন গঠন কোনো ব্যবস্থাতেই সম্ভব নয়। মূলধন গঠনে সহায়তা করাই পুঁজিপতি শ্রেণীর ঐতিহাসিক ভূমিকা। এই শ্রেণীর উচ্ছেদের পর মূলধন গঠনের কাজ গিয়ে পড়ে রাষ্ট্রের হাতে, অর্থাৎ রাজনীতিক দলবিশেষ ও আমলাতন্ত্রের হাতে। অনুন্নত দেশে মূলধন গঠন ইতিহাসের এক “নোংরা কাজ। হিংসাত্মক বিল্পবের পর এই কাজের ভার গিয়ে যখন পড়ে ভ্রাতৃহন্তা এক সমাজে পারস্পরিক সন্দেহে কলুষিত একদল মানুষের হাতে তখন সেই শাসক দলের অধঃপতন রোধ করা যায় না। এরই ফলে ঘটে সমাজতন্ত্রের বিকৃতি। শোষণমুক্ত সমাজের নামে হিংসাত্মক বিল্পবের প্রচণ্ড আঘাত দেশকে ভেঙ্গে তচনচ করলেই আদর্শসমাজের দ্বার উন্মুক্ত হয় না।
ধনতন্ত্রের বহু গলদ আছে। তার বিরুদ্ধে সজাগ ও সচেষ্ট হওয়া নিঃসন্দেহে প্রয়োজন। দুয়েকটি উদাহরণই যথেষ্ট। শিল্পোন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে, বিশেষত গোড়ার যুগে, দেশের একাংশে শ্রীবৃদ্ধি ও অন্যাংশে দারিদ্র ও অভাব বৃদ্ধি ঘটতে দেখা গেছে। শুধু শ্রেণীগত অসাম্য নয় আঞ্চলিক বৈষম্যও সামাজিক ব্যাধির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সমৃদ্ধ সমাজেও সম্প্রদায়বিশেষের ভিতর অস্বাভাবিক দারিদ্র্যের উদাহরণ আছে; যুক্তরাষ্ট্রে নিগ্রোদের কথা প্রথমেই মনে পড়ে। এ জাতীয় বৈষম্যের প্রতিকারের জন্য ব্যক্তিগত শিল্পোদ্যোগ যথেষ্ট নয়; রাষ্ট্রেরও একটি সক্রিয় ভূমিকা প্রয়োজন। ধনতন্ত্রের আর একটি সমস্যা “শোষণকে কেন্দ্র করে। একটি তুলনার সাহায্যে বিষয়টি ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। কৃষক যখন বীজধান সরিয়ে রাখেন তখন তিনি জানেন যে, তাঁর নিজেরই ভবিষ্যতের জন্য এটা প্রয়োজন। পুঁজিপতি যখন উৎপাদিত ধনের একটা অংশ শ্রমিকের হাত থেকে সরিয়ে নেন, তখন কিন্তু সমাজের ভবিষ্যতের সঙ্গে এই “শোষণ” ও পুঁজিগঠনের যোগটা মোটেই প্রত্যক্ষ নয়। এই জটিলতার উপর যোগ হয়েছে শ্রমিকের সঙ্গে মালিক ও পরিচালকের সামাজিক দূরত্ব ও মনান্তর। সব সমাজব্যবস্থার মতো ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। এই পরিবর্তনের ভিতর যদি কোনো দিগবোধ রক্ষা করতে হয় তবে উন্নততর সহযোগিতাই আমাদের লক্ষ হওয়া উচিত। একথা শিল্প প্রতিষ্ঠান সম্বন্ধে যেমন সত্য বৃহত্তর সমাজজীবন সম্বন্ধেও তেমনই। সমাজে উন্নততর সহযোগিতা তাকেই বলি যাতে একই সঙ্গে শ্রমের উৎপাদিকা শক্তি বাড়ে, মানুষে মানুষে অসাম্য লাঘব হয় ও ব্যক্তিস্বাধীনতার বিস্তৃতি ঘটে।
উন্নতির এই বিভিন্ন উপাদানের ভিতর সামঞ্জস্য বিধান সহজ নয়। আমরা আগেই দেখেছি যে, বৈপ্লবিক উল্লম্বনে হঠাৎ সাম্য, স্বাধীনতা ও উৎপাদিকা শক্তির মহান শিখরে আরোহণ করা যায় না। অসাধ্যসাধনে মত্ত হলে অকারণে দুর্দশা বাড়ে। পরীক্ষানিরীক্ষার ভিতর দিয়ে সাধ্যের সীমানা ক্রমশ বিস্তৃত করেই মানুষকে এগোতে হয়। এ পথে কিছু ফল লাভ যে সম্ভব, এ শতাব্দীর ইতিহাসে তার উদাহরণের অভাব নেই। মার্ক্সবাদী বিচারে ধনতন্ত্রের বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে শ্রেণী সংগ্রাম ক্রমশ তীব্র হয়ে ওঠে; ধনতন্ত্রের সংকট বৃদ্ধি পায়; আন্তজাতিক ক্ষেত্রে এই সংকট প্রতিফলিত হয় ঘোরতর দ্বন্দ্বে ও যুদ্ধে। এই তাত্ত্বিক সিদ্ধান্তের সঙ্গে কিন্তু এ যুগের ইতিহাসের গতির গুরুতর অমিল আছে। শিল্পোন্নত ধনতান্ত্রিক দেশগুলিতে বিপ্লবের আকর্ষণ কমে এসেছে; দারিদ্র্যের উপশমের সঙ্গে সঙ্গে জীবনধারণের সংগ্রামের মতো শ্রেণীসংগ্রামও এসব দেশে অপেক্ষাকৃত সংযত আকার ধারণ করেছে। শিক্ষা ও সংগঠন-শক্তির ফলে শ্রমিকের প্রতি অন্যায়ের প্রতিরোধ ক্রমে সহজ হয়েছে; যে-অন্যায় একদিন ছিল অতি সাধারণ, আজ তা। ব্যতিক্রম। উনিশ শ ত্রিশের দশকের গোড়ায় ধনতন্ত্রের সংকট যতটা তীব্র ছিল আজ ততটা নেই। ব্যবসায়ের উত্থান পতন আছে বটে, কিন্তু উন্নত ধনতান্ত্রিক দেশগুলিতে এখন পরিকল্পনার সাহায্যে আর্থিক সংকট নিয়ন্ত্রণের শক্তি বেশী। ঔপনিবেশিক ব্যবস্থা আজ দ্রুত অবক্ষয়ের পথে। আর উপনিবেশ হারিয়েও শিল্পোন্নত দেশগুলি আগের চেয়ে সংকটমুক্ত ও আরও দ্রুত এগিয়ে চলেছে। ধনতন্ত্রের গলদ আছে; কিন্তু বৈষয়িক অর্থে তার সাফল্যও অস্বীকার করা যায় না।
.
৪
তবু এসব কিছুকে খর্ব করে যে-সমস্যা আজও অটল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তার চরিত্র ভিন্ন। আন্তর্জাতিক দ্বন্দ্ব আজকের পৃথিবীতে তীব্র ও নিষ্ঠুর। এই দ্বন্দ্বকে ধনতন্ত্রের সংকটের প্রতিফলন বলা ভুল। ধনতান্ত্রিক দেশ যেমন ধনতান্ত্রিক দেশের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে সাম্যবাদী দেশও তেমনই আজ সাম্যবাদী দেশের শত্রু হয়েছে। এর মূলে আছে, জাতিতে জাতিতে অবিশ্বাস ও ক্ষমতার নেশা। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার যুদ্ধ মূলত। বাজার নিয়ে দ্বন্দ্ব নয়। ইন্দোনেশিয়া হাত ছাড়া হওয়াতে হল্যাণ্ডের অর্থনীতি ভেঙ্গে পড়েনি; ভিয়েতনাম হাত ছাড়া হলেও মার্কিন অর্থনীতি ভেঙ্গে পড়বে না। বিজ্ঞানকে যদি বলি উন্নতির পরম বন্ধু, যুদ্ধকে যদি বলি শত্রু, তবে একথাও স্বীকার করতে হয় যে, এ যুগের যা-কিছু শ্রেষ্ঠ কীর্তি ও যা-কিছু চূড়ান্ত কলঙ্ক তার কোনোটারই ব্যাখ্যা চলে না শুধু শ্রেণী সংগ্রামের সূত্র ধরে। ধনতন্ত্র অথবা সমাজতন্ত্রকে আমরা যে বাস্তবের চেয়েও ভয়ঙ্কর অথবা রমণীয় করে আঁকি এরও মূলে আছে হয় তো যুক্তির চেয়েও আদিম প্রবৃত্তি, আদর্শের ছদ্মবেশে যুযুৎসা। মানুষের সব উন্নতির পথে আজ বড় বাধা যুদ্ধ। যুদ্ধ ও যুদ্ধের প্রস্তুতিই এ যুগে বিজ্ঞানের অপপ্রয়োগের সবচেয়ে ভয়াবহ উদাহরণ। বিভিন্ন সমাজ ব্যবস্থার কলহ ছাপিয়েও আজ তীব্র হয়ে উঠেছে জাতিতে জাতিতে ক্ষমতার লড়াই। সারা পৃথিবীতে অচিরে ধনতন্ত্র অথবা সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠিত হবে এমন সম্ভাবনা নেই। কিন্তু শান্তি আমাদের চাই। এ যুগের প্রধান প্রয়োজন বিজ্ঞান ও শান্তি।
মানুষের ইতিহাসে বিজ্ঞানের প্রাধান্য সাম্প্রতিক ঘটনা। এই অল্পকালের ভিতর বিজ্ঞান আমাদের জীবনের বহিরঙ্গে এনেছে বিরাট পরিবর্তন। কিন্তু মানুষের মনের গভীরে পরিবর্তনের গতি মন্থর, সেখানে আজও প্রাগৈতিহাসিক শক্তিরই প্রাধান্য। প্রকৃতি একদিন মানুষের কাছে ছিল বুদ্ধির অগম্য ভয়ংকর শক্তির লীলাক্ষেত্র, প্রাচীন আফ্রিকার অরণ্যের মতো অন্ধকার ও বিপদসংকুল। মানুষের জীবন ছিল সেদিন অজ্ঞাত শত্রুর আক্রমণে। প্রতিক্ষণ বিপন্ন। অগণিত শতাব্দী জুড়ে মানুষ বেঁচেছে প্রতি মুহূর্তে অতি ভয়ে। যেখানে প্রতিক্ষণ প্রাণ বিপন্ন সেখানে প্রাণী যেমন ভীত তেমনই হিংস্র। সেই অন্ধ, ক্ষমাহীন প্রাগৈতিহাসের কবল থেকে মানুষের মন আজও মুক্তি পায়নি। বিশ শতকের বিজ্ঞান। মানুষের মনের সেই স্তরের অন্ধকার এখনও দূর করতে পারেনি। ব্যক্তিগতভাবে যদি-বা
আমরা ভদ্র এবং কিছু পরিমাণে দায়িত্বজ্ঞানও রাখি, সমষ্টিগতভাবে আমরা প্রায়ই দায়িত্বজ্ঞানহীন ও হিংসার অধীন। আমদের মনের ওপরের দিকটায় যেহেতু আমরা যুক্তি ও গণনায় অভ্যস্ত অতএব সব কিছুর একটা আর্থিক ব্যাখ্যা আমরা সহজে গ্রহণ করি; কিন্তু আজকের যুগের বহু সমস্যার মূলেই আছে যুক্তির চেয়ে প্রাচীন যৌথ আতঙ্ক ও হিংসা। মার্কিন দেশে নিগ্রো সমস্যার মূলে শেতাঙ্গদের আর্থিক লাভক্ষতির গণনার চেয়েও অযৌক্তিক বর্ণবিদ্বেষ প্রধান। আরব-ইজরায়েল অথবা ভারত-পাকিস্তান বৈরিতার গোড়ায় আছে ধর্মবিদ্বেষ। গণতন্ত্র, শ্রেণীসংগ্রাম, সমাজতন্ত্র কিছুই আজ সামষ্টিক বিদ্বেষের প্রভাব থেকে মুক্ত নয়। রবীন্দ্রনাথ ছোট-আমি ও বড়-আমির ভিতর পার্থক্য করেছিলেন। কিন্তু সবচেয়ে ভয়াবহ কপট বড়-আমি। ছোট-আমি যখন নিজের ক্ষুদ্র ভয়কে লুকোতে চায় কোনো অতিকায় উত্তেজনার আড়ালে তখনই বিপত্তির সম্ভাবনা অত্যন্ত বেশী। প্রকৃত বড়-আমি হিংসার অধীন নয় সে চলে শান্ত বুদ্ধিতে। তারই হাতে বিজ্ঞানের শক্তিও নিরাপদ।
মানুষের গড়বার ও ভাঙ্গবার শক্তি একদিন ছিল ছোট সীমায় বাঁধা। তার সমস্ত আস্ফালন সত্ত্বেও সে পৃথিবীর কোনো একটি কোণে মায়ের কোলে দামাল শিশুর মতো সামান্য আলোড়ন সৃষ্টি করতে পারতো মাত্র। আজ পৃথিবী ধ্বংস করবার ক্ষমতা তার হাতে। এই প্রচণ্ড শক্তি নিয়ে যদি তাকে বাঁচতে হয় তো সেই সঙ্গে চাই বিজ্ঞানকে গড়বার কাজে প্রয়োগ করবার যোগ্য ভয়বিদ্বেষমুক্ত বুদ্ধি। এ যদি না হয় তো প্রকৃতিকে পরাভূত করেও মানুষ মানুষকে বাঁচাতে পারবে না। উন্নতির শর্ত সরল তবু কঠিনসাধ্য। সমাজ ও ইতিহাস (১৯৭০)