চতুর্থ পরিচ্ছেদ
১.
আজ হতে চল্লিশ বছর আগে কেউ যদি ঘুরতে ঘুরতে সালপেত্রিয়ের পার হয়ে বুলভার্দ দ্য হপিতালে আসত এবং সেখানে থেকে ব্যারিয়ের দ্য ইতালির পথে এগিয়ে যেত তা হলে তার মনে হত এটা হচ্ছে এমনই এক অঞ্চল সেখান থেকে প্যারিস শহরটা কোথায় যেন উধাও হয়ে গেছে। সে বেশ বুঝতে পারত এটা কোনও অরণ্য নয়, কারণ সেখানে মানুষ বাস করে। এটা কোনও গ্রাম বা গ্রামাঞ্চল নয়, কারণ যেখানে বড় বড় চওড়া রাস্তা এবং বড় বড় পাকা বাড়ি আছে, যা সাধারণত গাঁয়ে নেই। আবার ঠিক খাঁটি শহরও বলা যায় না, কারণ সেখানকার রাস্তাগুলো কাঁচা এবং তাতে ঘাস গজিয়ে উঠেছে। তবে জায়গাটা কী? এটা প্যারিসেরই এক রাস্তা, যে রাস্তা রাত্রিবেলায় অরণ্যের থেকেও ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে আর দিনেরবেলায় সমাধিভূমির থেকেও নির্জন আর বিষাদাচ্ছন্ন হয়ে থাকে। এ অঞ্চলটা আগে ছিল ঘোড়ার হাট যার নাম ছিল মার্শে-অ-শেভভা।
বাজারের ভাঙা দেয়ালগুলোর বাইরে র্যু দা পেতিত ব্যাংকিয়েরের ওধারে দেয়ালঘেরা একটা জায়গা আছে। কেউ যদি সেদিকে এগিয়ে যায় তা হলে দু দিকে দুটো বাগানবাড়ির মাঝখানে একটা কারখানার কাছে পুরনো আমলের একটা কটেজ ধরনের বাড়ি দেখতে পাবে। বাড়িটা কটেজ ধরনের দেখতে একতলা হলেও সামনে থেকে যতটা ছোট মনে হয় আসলে তা নয়। আসলে বাড়িটা এক বড় গির্জার মতোই বড়। সামনে থেকে শুধু বাড়িটার একটা মাত্র জানালা দেখা যায়। জায়গাটার নাম ভিগনে সেন্ট মাইকেল।
বাড়িটা দেখার সঙ্গে সঙ্গে যে কারণে আশ্চর্য লাগে সেটা হল এই যে বাড়িটার দরজাগুলো কটেজ ধরনের বাড়িটার সঙ্গে খাপ খেয়ে গেলেও তার জানালাগুলো অট্টালিকা ধরনের এক বাড়ির উপযুক্ত। তাছাড়া দরজাগুলো কেনা ছিল না; এখান-সেখান থেকে কাঠ জোগাড় করে তৈরি করা হয়। সামনের দরজাটা খুললেই সামনেই চওড়া সিঁড়ি পাওয়া যায়। বাইরে থেকে মনে হয় একটা যেন বড় মই অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেছে। দরজার মাথার উপর একটা তিনকোনা ঘুলঘুলি আছে যাতে দরজা বন্ধ থাকলে তার মধ্য দিয়ে আলো-বাতাস ঢুকতে পারে। দরজার ভেতরে কপাটের উপর ৫২ আর কপাটের উপর ৫০ লেখা আছে। একটা ময়লা কম্বল পর্দার মতো ঘুলঘুলির ফাঁকটা ঢেকে আছে। অতীতে এখানে এক হত্যাকাণ্ড ঘটে যার রহস্য আজও উদঘাটিত হয়নি। এই হত্যাকাণ্ড ফতেনব্লো হত্যাকাণ্ড নামে পরিচিত। এর কিছুদূর আগে ক্রোলগর্বে নামে একটা জায়গা আছে যেখানে উলবাক নামে একটা লোক এক ছাগলওয়ালীকে কোনও এক ঝড়ের রাতে হত্যা করে। কতকগুলি এলমগাছ জটলা পাকিয়ে হত্যাকাণ্ডের জায়গাটাকে লোকচক্ষু থেকে আড়াল করে আছে।
সঁইত্রিশ বছর আগে ৫০-৫২ নম্বর এই বাড়িটা এই অঞ্চলের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ জায়গা ছিল। ভালো ও ভদ্র বাসিন্দাদের বাড়িগুলো তৈরি হতে শুরু হয় তার পঁচিশ বছর পরে। বধ্যভূমি ছাড়াও এ জায়গায় মেয়েদের একটা পাগলাগারদও ছিল। এ অঞ্চলে এলে পর যে দিকেই দৃষ্টি যাবে দেখা যাবে শুধু কসাইখানার মতো বাড়িগুলো এক একটি হত্যাকাণ্ডের ভয়ঙ্কর সাক্ষীরূপে দাঁড়িয়ে আছে। কোনও জায়গা দেখে যদি ভয়ঙ্কর এক নারকীয় যন্ত্রণার কথা, হত্যা আর মারাত্মক পীড়নের কথা মনে পড়ে যায় তা হলে বুলভার্দ দ্য হপিতাল হল তাদের মধ্যে সবচেয়ে বড়।
কিন্তু বিশেষ করে শীতকাল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যখন সব আলো নিভে যায়, যখন সারাদিন ধরে এলমগাছের পাতাগুলো ঝরবার কাজ করে হিমেল বাতাসে স্তব্ধ হয়ে যায়, যখন কুয়াশাচ্ছন্ন আকাশে কোনও তারা দেখা যায় না, যখন বাতাসের সাহায্যে মেঘের এক একটা অংশ কিছুটা কাটিয়ে দিয়ে চাঁদের আলো বেরিয়ে আসে তখন ওই বুলভার্দ অঞ্চলটা হয়ে ওঠে আরও ভয়ঙ্কর। এ অঞ্চলের সীমারেখাগুলো অন্তহীন এক ঘন কালো ছায়ার মধ্যে ডুবে যায়। এক ভয়াবহ নির্জনতার মধ্যে ডুবে গিয়ে বহু হত্যাকাণ্ডের আধারভূমি এই জায়গাটা পথচারীর মনে কত অশুভ দুঃস্বপ্নের সৃষ্টি করে। ঝোঁপঝাড় আর গাছগুলোর মাঝে মাঝে ফাঁকা জায়গাগুলোকে এক একটা মৃত্যুর ফাঁদ বলে সন্দেহ হয়। ছায়াঘন প্রতিটি জায়গাকেই মৃত্যুকুটিল এক একটা সমাধিগহ্বর বলে সন্দেহ হয়। দিনের বেলায় জায়গাটা কুৎসিত দেখায়, সন্ধ্যার সময় বিষণ্ণ দেখায়, আর রাত্রিবেলায় ভয়ঙ্কর দেখায়।
গ্রীষ্মকালের সন্ধ্যায় গাছগুলোর তলায় অনেক বৃদ্ধা বৃষ্টির জলে-ভেজা আধপচা কাঠের রেকে বসে থাকে ভিক্ষাপাত্র হাতে।
এছাড়া বুলভার্দের বাকি অঞ্চলটায় দিনে দিনে কত পরিবর্তন ঘটেছে। ফবুর্গের পাশ দিয়ে প্যারিস থেকে অর্লিয়ান্সের পথে যে রেলপথ চলে গেছে সেই রেলপথের দৌলতেই এ অঞ্চলের যত কিছু উন্নতি। এই অঞ্চলেই বিপ্লবের ঢেউটা বেশি জোরে আছাড় খেয়ে পড়ে, গণ-অভ্যুত্থান তীব্রতর হয়ে ওঠে। মনে হয় সভ্যতার বেগবান ঘোড়াটা কয়লা আর আগুনের শিখা গ্রাস করতে করতে এগিয়ে যায়, কলুষিত পৃথিবীর মাটি মানুষের মতো সব প্রাচীন আবাসগুলোকে যেন খেয়ে ফেলে আর সেই সব জায়গায় গড়ে ওঠে নতুন আবাস। প্যারিস-অর্লিয়ান্স লাইনের প্রান্তভাগে সালপেত্রিয়ের অঞ্চলের সরু রাস্তাটার দু পাশের পুরনো বাড়িগুলো যানবাহনের ক্রমবর্ধমান চাপে বিলুপ্ত হয়ে যায় একে একে। এইভাবে ধীরে ধীরে এক নতুন শহর গড়ে ওঠে। এক নতুন জীবনের স্পন্দন দেখা দেয় সমস্ত অঞ্চলজুড়ে। যত যব নিরবচ্ছিন্ন নীরবতা আর অখণ্ড নিস্তব্ধতা ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় যানবাহন আর লোকজনের চাপে। অবশেষে ১৮৪৫ সালের জুলাই মাসের কোনও এক সকালে সভ্যতার ছুটন্ত ঘোড়াটা র্যু লোসিনে পর্যন্ত এগিয়ে আসে আর প্যারিস শহরটা নিজেকে প্রসারিত করে ফবুর্গ সেন্ট মার্কোর দিকে চলে আসে।
.
২.
গোর্বোতে একটা বাড়ির সামনে এসে থেমে যায় জাঁ ভলজাঁ। কোনও শিকারি পাখির মতো বাসা বাঁধার জন্য দূরতম কোনও নির্জন প্রদেশের খোঁজ করছিল সে। কসেত্তেকে তখনও সে বয়ে বেড়াচ্ছিল পিঠের উপর। তার কোটের পকেটে যে চাবিটা ছিল সেটা বার করে একটা ঘরের দরজা খুলে তার মধ্যে ঢুকে পড়েই দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে সিঁড়ির উপর দিয়ে উঠে গেল উপরে।
দোতলার বারান্দায় উঠে আর একটা চাবি বার করে আর একটা ঘরের দরজা খুলল সে। সে ঘরের মধ্যে ঢুকেও দরজাটা বন্ধ করে দিল। রাস্তার ধারে যে একটা ল্যাম্প পোস্ট ছিল তার আলোয় ঘরের ভেতরের অনেকখানি দেখা যাচ্ছিল। ঘরখানার আয়তনটা ছিল মাঝারি ধরনের! মেঝের উপর একটা তোষক পাতা ছিল। একটা টেবিল আর কয়েকটা চেয়ার ছিল এক জায়গায়। ঘরের এক কোণে একটা স্টোভ জ্বলছিল। ঘরের পেছন দিকে তার গায়ে আর একটা ছোটা ঘর ছিল। সে ঘরে একটা ছোট বিছানা পাতা ছিল। জাঁ ভলজাঁ সেখানে গিয়ে কসেত্তেকে সেই ছোট বিছানাটায় শুইয়ে দিল। তাকে জাগাল না।
টেবিলে একটা বাতি প্রস্তুত হয়ে ছিল। কাছেই চকমকি আর লোহা ছিল। ভলজাঁ চকমকির সাহায্যে আগুন জ্বেলে বাতিটা জ্বালাল। যে নিবিড় মমতা মানুষের আত্মাকে এক সমুন্নতির স্তরে নিয়ে যায় সেই মমতার সঙ্গে গতকালকের মতো কসেত্তে’র মুখপানে তাকিয়ে রইল জাঁ ভলজাঁ। যে পরিপূর্ণ বিশ্বাস মানুষের মনে দারুণ জোর নিয়ে আসে অথবা সে মনকে একটা স্বেচ্ছাকৃত দুর্বলতার স্রোতে ভাসিয়ে দেয় সেই বিশ্বাসকে আঁকড়ে ধরে সে কোথায় কার কাছে আছে তা জেনেই নিশ্চিন্ত ঘুমিয়ে পড়েছে। নত হয়ে কসেত্তের একটা হাত টেনে নিয়ে চুম্বন করল সে। আজ হতে নয় মাস আগে তার মা-ও এমনি করে ঘুমিয়ে পড়লে তার হাত চুম্বন করে সে। সেদিনকার মতোই আজও এক ধর্মীয় অনুভূতি অপরিসীম বেদনা আর অপার করুণায় বিগলিত হয়ে তার মর্মকে ভেদ করল। নতজানু হয়ে সেদিনকার মতো প্রার্থনা করতে লাগল সে।
পরদিন সকালবেলা দেখা গেল কসেত্তে তখনও ঘুমোচ্ছে। খোলা জানালা দিয়ে শীতের ম্লান রোদ এসে ঘরের কড়িকাঠগুলো ধরে যেন ঝুলছিল। কম্পিত আলোছায়ার খেলা চলছিল ঘরখানার মধ্যে। হঠাৎ রাস্তার উপর একটা বড় মালবোঝাই গাড়ির চাকার ঘর্ঘর আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল। সঙ্গে সঙ্গে উঠে পড়ে ঘুমের ঘোরেই বলে উঠল, যাচ্ছি মাদাম। আমার ঝাটাটা কোথায়?
এই বলে ঘরে থেকে বেরিয়ে যাবার জন্য দরজা খুঁজতে লাগল সে। এমন সময় জাঁ ভলজাঁ’র হাসিমাখা মুখখানা দেখেই বলল, সুপ্রভাত মঁসিয়ে। তা হলে দেখছি সব সত্যি।
আনন্দ আর উল্লাস যেন বাচ্চাদের এক সহজাত অনুভূতি, তাদের মনের এক স্বাভাবিক অঙ্গ। তাই যে কোনও অবস্থাতেই তারা অতি সহজেই আনন্দে মেতে উঠতে পারে, এক সরল সুখানুভূতিতে গাঁ ঢেলে দিতে পারে। বিছানার তলার দিকে ক্যাথারিন নামে তার পুতুলটাকে পড়ে থাকতে দেখে সেটাকে তুলে নিয়ে আদর করতে লাগল। তার পর জাঁ ভলজাঁকে নানারকম প্রশ্ন করতে লাগল, আমরা এখন কোথায় আছি? প্যারিস কি খুব একটা বিরাট শহর? মাদাম থেনার্দিয়ের কি অনেক দূরে আছে! সে কি তাদের কাছে আসবে?
সহসা বলে উঠল, জায়গাটা কত সুন্দর!
তাদের ঘরটা ছিল ছাদের ঘর। কসেত্তে নিজেকে মুক্ত এবং নিরাপদ ভাবল।
কসেত্তে আবার জিজ্ঞাসা করল ভলজাঁকে, তুমি আমাকে দিয়ে ঘর ঝাঁট দেয়াবে না তো?
জাঁ ভলজাঁ বলল, না, তুমি শুধু আনন্দ করে বেড়াবে।
এইভাবে দিনটা কেটে গেল। কী ঘটেছে না ঘটেছে, কী কারণে সে এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় এল তা জানতে চাইল না সে। শুধু তার ত্রাণকর্তা আর পুতুলটাকে নিয়ে এক অনির্বচনীয় সুখের অনুভূতিতে আত্মহারা হয়ে রইল।
.
৩.
পরদিনও সকাল হতেই কসেত্তে’র বিছানার পাশে গিয়ে দাঁড়াল জাঁ ভলজাঁ। সে জেগে না ওঠা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে লাগল নীরবে।
সম্পূর্ণ নতুন একটা ভাব যেন ধীরে ধীরে মাথা তুলে উঠছিল তার অন্তরের মধ্যে।
জীবনে সে কখনও কাউকে ভালোবাসেনি। পঁচিশ বছর ধরে সে পৃথিবীতে সম্পূর্ণ নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করে এসেছে। কারও সঙ্গে তার কোনও আত্মীয় সম্পর্ক নেই, সে কারও পিতা নয়, কারও প্রেমিক নয়, স্বামী নয়, বন্ধু নয়। জেলখানায় সে সব সময় নিরানন্দ, বিষণ্ণ ও মনে মনে হিংস্র হয়ে থাকত। সেখানে কোনও কিছুই এই কয়েদির অন্তরকে স্পর্শ করতে পারত না। তার বোন ও বোনের ছেলেমেয়েদের জন্য তার মনে যে চিন্তা ছিল তা ক্রমে দূরে সরে যেতে যেতে বিলীন হয়ে যায় অবশেষে। সে তাদের খুঁজে বার করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করে। কিন্তু না পেয়ে ব্যর্থ হয়ে মন থেকে তাদের চিন্তা ঝেড়ে ফেলে দেয়। মানবমনের এই হল ধর্ম। তার যৌবনের অন্যান্য স্মৃতিগুলোও কোথায় হারিয়ে গেল একে একে।
কিন্তু কসেত্তেকে দেখা এবং তাকে তার দাসত্ব থেকে মুক্ত করে আনার পর থেকে এক অনুভূতির অবতারণা হয় তার মধ্যে। ভালোবাসার সব অনুভূতিগুলো এক সঙ্গে সজাগ হয়ে উঠে কসেত্তে’র পানে একটি মাত্র ধারায় পরিণত হয়ে প্রবাহিত হতে থাকে। কসেত্তে’র শয্যাপার্শ্বে দাঁড়িয়ে ঘুমন্ত অবস্থায় তার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা মানে এক রোমাঞ্চকর আনন্দের আবেগে বিকশিত হওয়া। মাতৃসুলভ এক বেদনার্ত মমতার অনুভূতি জাগল তার মধ্যে, কিন্তু সে অনুভূতির স্বরূপটাকে সে বুঝে উঠতে পারল না। অকস্মাৎ এক নবজাগ্রত ভালোবাসার আবেগে অভিভূত অন্তরের মতো গভীরতর ও মধুরতম আর কিছু হতে পারে না। সে আবেগের স্পর্শে বিষণ্ণ বয়োপ্রবীণ অন্তরও নতুন হয়ে ওঠে সহসা।
যেহেতু জাঁ ভলজাঁর বয়স তখন পঞ্চান্ন এবং কসেত্তে’র বয়স আট, ভলজাঁ’র সমস্ত ভালোবাসার ঐশ্বর্য শুধু স্নেহে ঘনীভূত হয়ে উঠল। বিশপ ভলজাঁকে একদিন গুণশীলতার কথা শেখান। আজ কসেত্তে তাকে ভালোবাসা কী জিনিস তা শেখাল। প্রথম দু-একটা দিন এই সব চিন্তাভাবনার মধ্য দিয়ে কেটে গেল।
কসেত্তে’র মধ্যেও একটা পরিবর্তন দেখা দিল। অথচ সে তা বুঝতে পারল না। তার মা যখন তাকে হোটেলে রেখে চলে যায় তখন সে এত ছোট যে সে কথা তার মনে নেই। সকল অনাথ শিশুই আঙুরগাছের লতার মতো একটা শক্ত জিনিসকে অবলম্বন করে বেড়ে উঠতে চায়। এই অবলম্বনের জন্য ভালোবাসার এক সুদৃঢ় বনস্পতিকে খুঁজে পেতে চায়। কিন্তু তা পায়নি সে। ভালোবাসার পরিবর্তে পেয়েছে শুধু ঘৃণা। থেনার্দিয়ের আর তাদের ছেলেমেয়েরা তাকে বরাবর ঘৃণা করে এসেছে। সে যেন তাদের বাড়িতে কুকুরের মতো ছিল। পৃথিবীতে কেউ তাকে চায়নি কোনওদিন। কেউ তাকে ভালোবাসেনি। তার ফলে মাত্র আট বছর বয়সেই তার শিশু-অন্তর ভালোবাসার অভাবে নীরস হয়ে ওঠে, ভালোবাসার সব ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। তার পর জাঁ ভলকে কাছে পাওয়ার পর থেকে ভলজাঁই তার সকল চিন্তা ও অনুভূতির বিষয়বস্তু হয়ে ওঠে। আত্মোঘাটনের যে রহস্য আগে কখনও কোনওদিন অনুভব করেনি সে, সে রহস্য আজ প্রথম অনুভব করল।
ভলজাঁকে গরিব বা বৃদ্ধ বলে মনে হল না কসেত্তে’র। বরং সে দেখতে সুন্দর বলেই মনে হল। ঘৃণার মাঝে ভালোবাসা, দুঃখের মাঝে সুখের স্পর্শ পেয়ে নতুন জায়গায় এসে নতুন জীবন শুরু করে মনটা যেন একেবারে নতুন হয়ে ওঠে কসেত্তে’র।
জাঁ ভলজাঁ আর কসেত্তে’র মধ্যে পঞ্চাশ বছরের যে প্রকৃতিদত্ত ব্যবধান ছিল, নতুন পরিস্থিতি এক সেতুবন্ধের দ্বারা সে ব্যবধান ঘুচিয়ে দিল। নিয়তির অপ্রাকৃত শক্তি বয়সের ব্যবধানে বিচ্ছিন্ন দুটি প্রাণসত্তাকে এক অবিচ্ছিন্ন ঐক্যসূত্রে বেঁধে দিল। পরস্পরের সাহচর্য পরস্পরের নিঃসঙ্গতার সব বেদনাকে দূরীভূত করে দেয়। পিতার প্রতি এক সহজাত অভাববোধ ছিল কসেত্তে’র আর সন্তানের জন্য এক সহজাত অভাববোধ ছিল জাঁ ভলজাঁর। তাদের দুজনের দেখা হওয়ার পর থেকে দু জনের প্রয়োজনের পরিব্যাপ্তি ঘটতে থাকে। একজন অন্যজনকে দেখেই তার অভাব ও প্রয়োজনীয়তার কথা জানতে পারে এবং সে অভাব পূরণ করতে থাকে। বিপত্নীক-এর মতো এক নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করত জাঁ ভলজাঁ আর কসেত্তে ছিল পিতামাতাহীন এক অনাথ শিশু। অনাথা কসেত্তে’র পিতা হয়ে উঠল ভলজাঁ। সেদিন রাত্রিকালে বনভূমিতে ভলজাঁ’র ওপর যে আস্থা স্থাপন করে কসেত্তে, সে আস্থা মিথ্যা হয়নি। তার জীবনে ভলজাঁ’র আবির্ভাব যেন স্বয়ং ঈশ্বরের আবির্ভাব।
তার আশ্রয় নির্বাচনের ব্যাপারে প্রচুর সতর্কতা অবলম্বন করে ভলজাঁ। যে বাসা ভাড়া করে সে বাসার মধ্যে সে নিরাপদ বোধ করতে থাকে। তারা ছাদের উপর যে দুটো ঘর নিয়ে থাকত সেই ঘর দুটোর মধ্যে একটা মাত্র জানালা ছিল আর সে জানালা ছিল বাজারের দিকে। সেদিকে কোনও বাড়ি ছিল না। ফলে আশপাশের বাড়ির কোনও লোক তাদের জীবনযাত্রার কোনও কিছু দেখতে পেত না।
বাড়িটার নম্বর হল ৫০-৫২। এর নিচের তলাটা বাজারের লোকেরা ভাড়া নিয়ে ঘরগুলোতে তাদের পণ্যদ্রব্যগুলো মজুদ করে রাখত। নিচের তলায় কোনও লোক বাস করত না। উপরতলাতেও অনেকগুলো ঘর ছিল। সেইসব ঘরের একটাতে এক গরিব বুড়ি বাস করত। সেই বুড়িই জাঁ ভলজাঁর ঘরের সব কাজকর্ম করত। উপরতলার বাকি ঘরগুলো পড়ে থাকত।
এই বৃদ্ধাই বাড়িটার দেখাশোনা করত। লোকে তাকে অবশ্য প্রধান ভাড়াটে বলে জানত। এই বছরেই খ্রিস্টের জন্মদিনে এই বৃদ্ধাই ঘরভাড়া দেয় জাঁ ভলজাঁকে। ভলজাঁ তাকে বলে সে কোথাও চাকরি করে না, তার সঞ্চিত টাকা থেকে তার খরচ চলে। একবার এক স্পেনদেশীয় লোককে টাকা ধার দিয়ে সর্বস্বান্ত হয়। আরও বলে সে তার নাতনিকে নিয়ে এখানে বাস করবে। সে একসঙ্গে প্রথমেই দু মাসের ভাড়া অগ্রিম দিয়ে দেয়। ভলজাঁ ঘরভাড়া করেই বাইরে চলে যায়। যাবার সময় বৃদ্ধাকে বলে যায় সে যেন ঘরগুলো পরিষ্কার করে স্টোভটা জ্বালিয়ে রাখে। বৃদ্ধা তাদের আসার আগেই সব ঠিক করে রেখেছিল।
এইভাবে কয়েক সপ্তাহ কেটে গেল। দু জনে সেই বাসাটার মধ্যেই বাস করতে লাগল। সকাল হলেই পাখির মতো শিশুরাও গান করে। কসেত্তে মনের সুখে সারাদিন হাসত, কথা বলত, গান করত। জাঁ ভলজাঁ মাঝে মাঝে তার ছোট লাল একটা হাত টেনে নিয়ে স্নেহভরে চুম্বন করত। যে কসেত্তে বরাবর মার খেয়ে এসেছে সে ভলজাঁ’র এই চুম্বনের অর্থ বুঝতে পারত না, কেমন যেন বিব্রত বোধ করত। এক-এক সময় সে তার কালো পোশাকটার কথা ভাবত। এখন তাকে আর ছেঁড়া পোশাক পরতে হয় না, কিন্তু শোকসূচক এই পোশাকের অর্থ সে বুঝতে পারল না।
ভলজাঁ কসেত্তেকে পড়তে-লিখতে শেখাল। সে জেলে থাকাকালে যতটুকু লেখাপড়া শেখে, কসেত্তেকে তাই শেখাতে থাকে। অর্জিত জ্ঞানবিদ্যা কসেত্তেকে দান করতে পারার সুযোগ পেয়ে খুশি হয় সে। কসেত্তেকে লেখাপড়া শিখিয়ে তাকে জীবনে সুখী করে তোলাই জীবনের একমাত্র ব্রত হয়ে ওঠে তার। তাকে পড়াতে পড়াতে মুখে হাসি ফুটে উঠত তার। তার মনে হত সে যেন এক অদৃশ্য মহান শক্তির ইচ্ছা পালন করছে। জীবনের এক মহান কর্তব্য সে করে যাচ্ছে। এক-এক সময় কসেত্তেকে তার মার কথা বলত ভলজাঁ। তার মা’র প্রার্থনার কথাগুলো তাকে বলতে শেখাত। কসেত্তে ভলজাঁকে বাবা বলে ডাকত।
কসেত্তেকে দেখে, তার কথা শুনে ও তার পুতুল খেলা দেখে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিতে পারত ভলজাঁ। কসেত্তে যখন তার পুতুলটাকে পোশাক পরাত ও সাজাত তখন একদৃষ্টিতে দেখত সে। বাঁচার এক নতুন আগ্রহ খুঁজে পেল ভলজাঁ। জীবন হয়ে উঠল অর্থময়, জগক্টাকে ভালো মনে হতে লাগল, যা আগে কখনও মনে হয়নি। কারও প্রতি তার আর কোনও ক্ষোভ নেই, কোনও অভিযোগ নেই। এখন কসেত্তে তাকে। ভালোবাসে। শ্রদ্ধা করে। এখন তাকে দীর্ঘদিন বাঁচতে হবে। কসেত্তে’র সুমধুর সাহচর্যে আলোকিত এক ভবিষ্যতের ছবি ফুটে উঠত তার চোখের সামনে।
এটা আমাদের ব্যক্তিগত মত হলেও একথা বলতে আমাদের কোনও দ্বিধা নেই যে জাঁ ভলজাঁ কসেত্তেকে ভালোবাসতে শুরু করলেও সে যে সারাজীবন নীতি ও ধর্মের পথ ধরে চলবে, সে বিষয়ে কোনও নিশ্চয়তা নেই। এজন্য এক নৈতিক অবলম্বন দরকার। মন্ত্রিউল-সুর-মেরে নতুন জীবন শুরু করার পরও মানুষের হিংসা-দ্বেষ ও সমাজের নিষ্ঠুরতার দিকগুলোর সম্মুখীন হয়েছে সে। সত্যের শুধু একটা দিক দেখেছে। ফাঁতিনের মধ্যে সে দেখেছে নারীজাতির চরম দুর্ভাগ্য আর বিড়ম্বনা, জেভার্তের মধ্যে দেখেছে শাসন কর্তৃপক্ষের নির্মম প্রভুত্ব। দ্বিতীয়বার সে জেলে যায়, এবার কিন্তু এক মহৎ কারণেই স্বেচ্ছায় কারাদণ্ড তুলে নেয় নিজের মাথায়। কিন্তু আগের বারের মতো এবারেও শ্রমজনিত এক নিবিড় ক্লান্তি, দুর্বিষহ অবসাদ, আর সমাজের প্রতি অদম্য ঘৃণা, বিতৃষ্ণা আর তিক্ততা তার মনটাকে এমন প্রবলভাবে আচ্ছন্ন করে ফেলে যে বিশপের পবিত্র স্মৃতিটাও মাঝে মাঝে মুছে যায় মন থেকে। পরে অবশ্য সে স্মৃতি গ্রহণমুক্ত চাঁদের মতো। উজ্জ্বল হয়ে বেরিয়ে এলেও তার উজ্জ্বলতা অনেক কমে যায় আগের থেকে। ভলজাঁ যে হতাশ ও হতোদ্যম হয়ে তার নৈতিক সংগ্রাম ত্যাগ করেনি একথা জোর করে কে বলতে পারে? জীবনে একজনকে ভালোবাসতে পেরে সে অবশ্য মনের মধ্যে শক্তি খুঁজে পায়। তবু কিন্তু মনের দিক থেকে কসেত্তে’র থেকে কম দুর্বল ছিল না। কসেত্তেকে সবদিক দিয়ে রক্ষা করে চলত আর কসেত্তে মা’র মতো তার প্রাণশক্তিটাকে লালন করে চলত। তার জন্যই কসেত্তে জীবনে এগিয়ে যেতে পারত। ভলজাঁ ছিল কসেত্তে’র একমাত্র অবলম্বন আর কসেত্তে ছিল তার একমাত্র আশ্রয়স্থল। নিয়তির এক মহান ভারসাম্য দুটি জীবনকে ধরে রেখেছিল।
.
৪.
সদাসতর্ক হয়ে থাকত জাঁ ভলজাঁ। সতর্কতা হিসেবে সে দিনের বেলায় বাসা ছেড়ে কোথাও যেত না। প্রতিদিন সন্ধায় সে দু-এক ঘণ্টার জন্য বেড়াতে যেত বাইরে। কোনওদিন একা একা, আর কোনওদিন বা কসেত্তেকে সঙ্গে নিয়ে শহরের নির্জন রাস্তা দিয়ে কিছুক্ষণ বেড়িয়ে আসত। রাত্রির অন্ধকার ঘন হয়ে উঠলে কোনও কোনওদিন চার্চে যেত। সবচেয়ে কাছে ছিল সেন্ট মেদার্দ নামে একটা চার্চ। ভলজাঁ সেখানেই যেত।
কসেত্তে যেদিন ভলজাঁর সঙ্গে যেত না সেদিন সে বাসাতে বৃদ্ধার কাছে থাকত। তাকেই সবাই বাড়িওয়ালি বলত। তবে বাসায় সেই বুড়ির কাছে থাকার থেকে ভলজাঁ’র সঙ্গে বেড়াতে গিয়েই সবচেয়ে আনন্দ পেত কসেত্তে। তারা বাইরে বেড়াতে গিয়ে দু জনে হাতধরাধরি করে পথ হাঁটত, দু জনে কথা বলত। কসেত্তে’র আনন্দোচ্ছল ভাব দেখে মুগ্ধ হয়ে যেত ভলজাঁ।
বুড়ি তাদের বাসার ঘর পরিষ্কার করত, রান্না করে দিত, তাদের দোকান-বাজার করত। তারা খুব হিসাব করে চলত, গরিব লোকদের মতো যথাসম্ভব কম টাকায় সংসার চালাত। ভলজাঁ ঘর সাজাবার জন্য কোনও আসবাবপত্রই কেনেনি। শুধু কসেত্তে’র ছোট ঘরটার কাঁচের দরজাটা পাল্টে একটা কাঠের দরজা লাগিয়ে দেয়।
সেই হলুদ কোটটা তখনও পরত ভলজাঁ। তাতে কয়েকটা ফুটো ছিল। তার মাথার টুপিটা মোচড়ানো ছিল। পাড়ার লোকেরা তাকে গরিব ভাবত এবং মাঝে মাঝে কোনও কোনও বাড়ির কোনও দয়াবতী গৃহিণী তাকে দু-একটা স্যু দিত। জাঁ ভলজাঁ তা নিত। পরে আবার কোনও ভিখারি তার কাছে পয়সা চাইলে সে তাকে তা দিয়ে দিত। কখনও কখনও ভিখারিকে এক-আধটা রুপোর মুদ্রাও দিত। এজন্য পাড়ার লোকেরা তার সম্বন্ধে বলাবলি করত সে এমনই ভিখারি যে সে অন্য ভিখারিকে ভিক্ষা দেয়।
বাড়িওয়ালি বুড়ির একটা ঈর্ষান্বিত কৌতূহল ছিল তার প্রতিবেশীদের প্রতি। জাঁ ভলজাঁ’র প্রতি এক বিরাট অদম্য কৌতূহল ও আগ্রহ ছিল তার। কিন্তু তার এই আগ্রহের কথাটা ভলজাঁকে বুঝতে দিত না সে। সে কানে কম শুনত। উপরে ও নিচে তার মাত্র দুটি দাঁত ছিল। সে খুব বেশি কথা বলত এবং কসেত্তেকে একা পেলেই নানারকমের অজস্র প্রশ্ন করত। কসেত্তে বলত সে কিছু জানে না, সে শুধু এইটুকু জানে যে তারা মঁতফারমেল থেকে এসেছে।
একদিন বুড়ি দেখল বারান্দার ধারে যেসব খালি ঘরগুলো আছে তার একটাতে হঠাৎ ভলজাঁ ঢুকে পড়ল। বুড়ির সন্দেহ হওয়ায় সে আড়াল থেকে দেখতে লাগল। ভলজাঁ কী করে তা দেখতে চায় সে। সতর্কতার জন্য দরজার দিকে পেছন ফিরে ছিল ভলজাঁ। বিড়ালের মতো গুঁড়ি মেরে এক জায়গায় একটা ফাঁক দিয়ে দেখতে লাগল বুড়িটা। সে দেখল ভলজাঁ পকেট থেকে কাঁচি বার করে তার কোটের ভেতরের দিকের এক জায়গায়। কাঁচি দিয়ে সেলাই কেটে ভেতর থেকে ভাঁজ করা একটা হলুদ কাগজ বার করল। তার। ভাঁজটা খুললে বুড়ি আশ্চর্য হয়ে দেখল, সেটা এক হাজার ফ্লার একটা নোট। এই নিয়ে হাজার ফ্রা’র নোট জীবনে মাত্র দু-তিনবার দেখল সে।
কিছুক্ষণ পর ভলজাঁ বাইরে এসে বুড়িকে নোটটা ভাঙিয়ে আনতে বলল। সে বলল, গতকাল সে তার তিন মাসের আয়স্বরূপ টাকাটা তুলে এনেছে ব্যাংক থেকে। কিন্তু কোথা থেকে আনল সে? বুড়ি ভেবে দেখল গতকাল সে সন্ধে ছ’টার আগে সারা দিনের মধ্যে কোথাও যায়নি বাসা থেকে। তা হলে ব্যাংক থেকে কী করে তুলঁল টাকাটা? ভাবতে ভাবতে আশ্চর্য হয়ে গেল বুড়িটা। সে নোটটা নিয়ে ভাঙাতে চলে গিয়ে পাড়ার সবাইকে বলে দিল। কোটের মধ্যে সেলাই করা হাজার টাকার নোট। র্যু দ্য ভিগনে সেন্ট মার্শেলের অনেক বাড়ির গিন্নিরা উত্তেজিতভাবে আলোচনা করতে লাগল কথাটা।
দিনকতক পরে একদিন ভলজাঁ বারান্দায় আগুনের জন্য কাঠ চেরাই করছিল বসে। বসে। কসেত্তেও তার কাছে বসে ছিল। বুড়িটা ঘর পরিষ্কার করছিল। ঘরেতে সে একা ছিল। ভলজাঁ’র হলুদ কোটটা দেয়ালের একটা পেরেকে টাঙানো ছিল। বুড়ি কোটটা নেড়ে-চেড়ে পরীক্ষা করে দেখতে লাগল। সে দেখল যেখান থেকে সেদিন হাজার ফ্রা’র নোটটা বার করেছিল সে জায়গাটা আবার সেলাই করে দিয়েছে ভালো করে। সে হাত দিয়ে টিপে বুঝল আরও ভাজকরা কাগজ আছে তার মধ্যে। তার মনে হল আরও অনেক হাজার ফ্রা’র নোট আছে। এ ছাড়া সে দেখল কোটের বিভিন্ন পকেটে কাঁচি, সুচ, সুতো, ছুরি প্রভৃতি বিভিন্ন জিনিস রয়েছে। তাছাড়া আছে চামড়ার একটা মোটা প্যাকেট আর হাতলওয়ালা একটা বড় ছোরা। প্রতিটি পকেটে কিছু না কিছু দরকারি একটা জিনিস আছে।
তখন শীত শেষ হয়ে আসছিল।
.
৫.
সেন্ট মেদার্দ চার্চের কাছে একটা পুরনো সরকারি কূপের ধারে একটা ভিখারি বসত। ভলজাঁ তাকে প্রায়ই ভিক্ষা দিত। তার পাশ দিয়ে যাবার সময় কয়েকটা স্যু তার হাতে না দিয়ে সে যেত না। মাঝে মাঝে ভিখারিটার সঙ্গে কথা বলত সে। স্থানীয় অনেক লোক বলত ভিখারিটা পুলিশের লোক, সংবাদদাতার কাজ করে। অতীতে একসময় সে গানের দলে থেকে সমবেত কণ্ঠে গাইত, প্রার্থনার স্তোত্রগুলোতে সুর দিত। তার বয়স হয়েছিল পঁচাত্তর।
একদিন সন্ধেবেলায় ভলজাঁ একা সেই পথ দিয়ে যাচ্ছিল। ভিখারিটা পথের ধারে সেই একই জায়গায় বসে ছিল। সে তার দেহটাকে সামনে বাঁকিয়ে ঝুঁকে প্রার্থনা করছিল। ভলজাঁ তাকে অন্য দিনকার মতো পয়সা দিল। কিন্তু আজ ভিখারি মুখ তুলে ভলজাঁ’র মুখপানে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। সে যেন কার খোঁজ করছে। কিছুক্ষণ এইভাবে দেখার পর মাথাটা নামিয়ে নিল। রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের আলোয় ভিখারির মুখের কিছুটা ভলজাঁও দেখতে পেল। ভলজাঁ দেখল, সে মুখ কোনও ভক্তিভাবে অবনত কোনও ভিখারির মুখ নয়, তার চোখের দৃষ্টি কোনও ভবঘুরের শূন্য দৃষ্টি নয়। সে মুখ তার যেন অতি পরিচিত এক মুখ। অন্ধকারে যেন ক্ষুধিত বাঘের একজোড়া জ্বলন্ত চোখ দেখতে পেল ভলজাঁ। ভয়ে রক্ত হিম হয়ে উঠল তার। সে কয়েক পা পিছিয়ে এল। সে এখানে দাঁড়িয়ে থাকবে, না ছুটে পালাবে তা বুঝতে পারল না। কিছু বলবে, না চুপ করে থাকবে তা-ও বুঝতে পারল না।
সে দেখল ভিখারিটাও মাথা নত করে কী ভাবছে। সে যেন তার অস্তিত্বটা ভুলেই গেছে। ছেঁড়া কম্বল জড়িয়ে ভিখারিটা সেইখানে বসে রইল যেখানে সে বসে ছিল।
ভলজাঁ একবার ভাবল, আমি ভুল করছি, আমি পাগল। আসলে ও একটা ভিখারি। তবু আত্মরক্ষার তাগিদে সহজাত এক প্রবৃত্তির তাড়নায় সে কোনও কথা না বলে ভালোই করল। সে রাতে মনে এক দারুণ অশান্তি নিয়ে বাসায় ফিরল। সে যেন নিজের মনের কাছেও একথা স্বীকার করতে পারল না যে ভিখারির মধ্যে সে জেভার্তের মুখ দেখতে পেয়েছে।
তবু এ কথাটা বিশ্বাস করতে পারল না কিছুতেই। ভাবল, গতকাল কোনও কথা না বলে চলে এসে ভুল করেছে। ভিখারিকে তার মুখটা নামিয়ে নিয়ে বসে থাকার সময় তার মুখটা তোলার জন্য তাকে বলা উচিত ছিল।
পরদিন সন্ধ্যার সময় সাহসে ভর করে আবার গেল ভিখারির কাছে। আবার সে পয়সা দিল, ভিখারি তাকে ধন্যবাদ দিল। ভলজাঁ নতুন করে আশ্বস্ত হল। নিজেকে নিজে উপহাস করতে লাগল। সে তাকে জেভাৰ্ত মনে করে ভুল করেছে। সে আর এ নিয়ে কিছু ভাবল না।
কয়েকদিন পর একদিন সন্ধে আটটার সময় ভলজাঁ কসেত্তেকে পড়াচ্ছিল। সে শুনতে পেল রাস্তার দিকের সদর দরজাটা হঠাৎ কে খুলে আবার বন্ধ করল। এটা অস্বাভাবিক। এ সময় কেউ বাড়ি থেকে যায় না বা কেউ বাইরে থেকে আসে না। এ বাড়ির আর একমাত্র বাসিন্দা সেই বুড়িটা বাতিখরচের ভয়ে সন্ধে হতেই শুয়ে পড়ে। জাঁ ভলজাঁ ইশারায় কসেত্তেকে তার ঘরে পাঠিয়ে দিল। তার ঘরের দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল ভলজাঁ। সিঁড়ি বেয়ে নিশ্চয় কেউ উপরে আসছে। মনে হল ভারী জুতো পরে কোনও পুরুষমানুষ আসছে। এ পদশব্দ নিশ্চয় কোনও মেয়েমানুষের নয়, জ্বলন্ত বাতিটা নিবিয়ে দিল ভলজাঁ।
কসেত্তেকে চুম্বন করে পাঠিয়ে দিয়ে বিছানা থেকে উঠে স্থির হয়ে স্তব্ধ হয়ে একটা চেয়ারে বসে রইল শ্বাসরুদ্ধ হৃদয়ে। কিছুক্ষণ পর সে নিঃশব্দে উঠে দরজার একটা ফাঁক দিয়ে উঁকি মেরে দেখল, বাতি হাতে কে একজন লোক বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে।
কয়েক মিনিট পরে ভলজাঁ দেখল বাতির আলোকটা বারান্দায় দেখা যাচ্ছে না। আর জুতোর শব্দও হচ্ছে না। সে বুঝতে পারল লোকটা জুতো খুলে নিঃশব্দে দরজার কাছে। কান পেতে তাদের কথাবার্তা শোনার চেষ্টা করছে।
ভলজাঁ পোশাক পরেই শুয়ে পড়ল বিছানায়। সারা রাত্রি একবারও চোখে-পাতায় করতে পারল না। ভোরের দিকে ঘুমিয়ে পড়ল। হঠাৎ বাইরে সদর দরজা খোলার শব্দে ঘুম ভেঙে গেল ভলজাঁ’র। সিঁড়িতে আবার কাদের পদশব্দ শুনতে পেল। তার মনে হল গতকাল রাতে যারা সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠেছিল তারাই আবার উঠছে। ভলজাঁ বদ্ধ। দরজার স্বল্প ফাঁক দিয়ে দেখল একটা লোক সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে ভলজাঁ’র সামনে
থেমে বারান্দা দিয়ে চলে গেল। ভালো করে গোটা লোকটাকে দেখল ভলজাঁ পেছন থেকে। টেলকোট পরা লম্বা চেহারার একজন লোক বগলে একটা ছোট লাঠি নিয়ে ভারী জুতো পরে বারান্দার একপ্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তে হেঁটে যাচ্ছে। সে পেছনটা দেখে স্পষ্ট বুঝতে পারল লোকটা জেভাৰ্ত।
ভলজাঁ বুঝতে পারল কারও কাছ থেকে নিশ্চয় চাবি নিয়ে এ বাড়িতে ঢুকেছে জেভাৰ্ত। নিশ্চয় সে কারও কাছ থেকে সন্ধান পেয়ে তার খোঁজে এসেছে। কিন্তু কে তাকে চাবিটা দিয়েছে? কে তাকে তার খবরাখবর দিয়েছে? ভলজাঁ কিছুই বুঝতে পারল না।
জেভার্ত বাড়ি থেকে বেরিয়ে বাজারের দিকে চলে গেলে সেদিকের জানালাটা খুলে তাকে ভালো করে দেখার ইচ্ছা হল ভুলজার। কিন্তু ভয়ে জানালাটা খুলতে পারল না সে।
সকাল সাতটার সময় বুড়ি তার কাজে এল। ভলজাঁ তার পানে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল। তার মনে সন্দেহ দানা বেঁধে উঠল। কিন্তু কোনও কথা বা প্রশ্ন করল না তাকে। বুড়িটার হাবভাব ঠিক আগের মতোই আছে। সে ঘর ঝাট দিতে দিতে জিজ্ঞাসা করল, গতরাতে কারও আসার শব্দ শুনতে পেয়েছিলেন মঁসিয়ে?
সে বোঝাতে চাইল তার মতো বয়সের বৃদ্ধার কাছে রাত্রি আটটা দুপুর রাতের সমান।
ভলজাঁ বলল, হ্যাঁ, শুনেছিলাম। কিন্তু কে এসেছিল?
বুড়ি বলল, নতুন ভাড়াটে। ঘর ভাড়া নিয়েছে।
তার নাম কী?
ঠিক মনে করতে পারছি না। হয় মঁসিয়ে দুমত অথবা দমত। ওই ধরনের একটা কিছু হবে।
কী কাজ করেন মঁসিয়ে দুমত?
খেঁকশেয়ালের মতো ধূর্ত চোখদুটো তুলে বুড়ি বলল, আপনার মতোই টাকা ধার দিয়ে বেড়ায়।
ভলজাঁ’র মনে হল বুড়ির এ কথার একটা মানে আছে।
বুড়ি চলে গেলে ড্রয়ার থেকে একশো ফ্রা’র মুদ্রাগুলো ধীরে ধীরে পকেটের মধ্যে ভরে নিল। যাতে কোনও শব্দ না হয় সেদিকে নজর রেখে সাবধানে সে মুদ্রাগুলো তুলে নিলেও একটা পাঁচ ফ্রাঁ মুদ্রা মেঝের উপর সশব্দে পড়ে গেল।
সন্ধ্যা হতে সে একবার নিচে রাস্তায় নেমে গিয়ে চারদিকে সাবধানে তাকাতে লাগল। সে দেখল রাস্তাটা তখন নির্জন। তবে গাছের আড়ালে কেউ লুকিয়ে আছে কি না, তা বুঝতে পারল না।
ভলজাঁ উপরতলায় উঠে গিয়ে কসেত্তেকে বলল, চলে এস।
কসেত্তে’র হাত ধরে বাড়ি ছেড়ে চলে গেল সে।