২.৪৯ The time, which steals our years away

The time, which steals our years away
Shall steal our pleasures too;
The memory of the past will stay
And half our joys renew.

হরিশঙ্কর আর সেই বাসযাত্রীর দ্বন্দ্ব আরও কতদূর এগোত কে জানে? হয়তো হাতাহাতির পর্যায়ে চলে যেত। ভদ্রলোক একবার মাত্র ছোটদাদুর চোখে চোখ রেখে স্থির হয়ে গেলেন। কী ছিল সেই চোখে? আমি তো বসে আছি পেছনে, প্রস্তুত হয়ে। তেমন কিছু হলেই ঝাঁপিয়ে পড়ব।

ছোটদাদু বললেন, ছি ছি! যাচ্ছেন জামাইবাড়ি! নাতিকে কী শিক্ষা দেবেন? পিচিক পিচিক থুতু ফেলা! ভদ্রলোক কেমন যেন চঞ্চল হয়ে উঠলেন। ছোটদাদু বললেন, শ্বশুরবাড়িতে মেয়ে এত অশান্তিতে রয়েছে, বনিবনা হচ্ছে না, মেয়ে কি আপনার স্বভাবই পেয়েছে? এইরকম উদ্ধত, অসভ্য! মেয়ের মা তো মাটির মানুষ ছিলেন! সেইজন্যই বুঝি তাকে ধামসে শেষ করে দিলেন! আপনি তো মশাই মহাবদ! কাছারির চাকরিটা খোয়ালেন কী করে? এদিকে তো পাইলসের যন্ত্রণায় ছটফট করেন।

উলঙ্গ মানুষ যেভাবে নিজেকে ঢাকবার চেষ্টা করে, ভদ্রলোক সেইভাবে জড়োসড়ো হয়ে গেলেন। মুখে অদ্ভুত একটা ভয়ের ভাব। পারলে কান ধরে জিভ বের করেন, এইরকম একটা অবস্থা। ছোটদাদুর এই কাণ্ডটা আমি খুব উপভোগ করি। ভীষণ একটা শ্রেষ্ঠত্বের ভাব আসে আমার মনে। এমন একজন মানুষ আমার দাদু, যিনি সমস্ত তামসিকতা এক ফুৎকারে স্তব্ধ করে দিতে পারেন। পাজা তুলোর মতো উড়িয়ে দিতে পারেন মানুষের যত নীচ অহংকার। লোকটি কেঁচোর মতো গুটিয়ে গেলেন। আর বাসের কনডাক্টর, এতক্ষণ যিনি পুরো পর্যায়ের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন, তিনি এগিয়ে এসে বললেন, মহাপুরুষের চরণে প্রণাম।

ছোটদাদু একঝলক তাকিয়েই বললেন, শীঘ্র তোমার এই কর্ম ঘুচে যাবে। তোমার শ্বশুরমশাইয়ের এখন-তখন অবস্থা। সাত দিনের মধ্যে তাঁর মৃত্যু হবে। তাঁর সমস্ত সম্পত্তির মালিক হবে তুমি, কারণ তার ছেলেটি উন্মাদ। লোকজন সরিয়ে কনডাক্টর ছোটদাদুর পায়ের পাশে বসে পড়লেন। মুখে কথা সরছে না। কেবল বলছেন, বাবা, বাবা। ছোটদাদু তার মাথায় হাত রেখে। বললেন, তোমার ত্রিতাপ জ্বালা জুড়িয়ে যাবে। তুমি শুদ্ধ প্রাণ। জননীর সেবা যেভাবে করছ, সেইভাবে করে যাও। ইষ্টদর্শন হবে। পারলে তারাপীঠে এসে আমার খোঁজ কোরো। বোলো, অথরবাবার আশ্রমে যাব।

বাসের প্রায় সমস্ত যাত্রী পাগলের মতো হয়ে উঠেছে। যেন স্বয়ং যিশুখ্রিস্ট এই বাসের যাত্রী। কৃপা চাই, একটু কৃপা। বাসচালক একধারে নিয়ে গিয়ে বাস থামিয়ে দিয়েছেন। চিৎকার করছেন, সকলের হবে, আমার কিছু হবে না!

হরিশঙ্কর বলছেন, নাও, এইবার বোঝে ঠ্যালা, কাঙালদের দেখিয়েছ শাকের খেত।

ছোটদাদু বাসচালককে বললেন, তুমিই তো আমাদের চালাচ্ছ! তোমার না হয়ে যায়! বর্ধমান চলো, সেখানে তোমার ব্যবস্থা হবে।

সহজে কেউ শান্ত হয়! মানুষ নয় তো, সবাই এক একটি ভোলা উনুন। অশান্তির কালো কয়লা জীবনের আঁচে জ্বলছে। ছোটদাদু হঠাৎ দু’হাত তুলে বললে, আচ্ছা, তা হলে আজ এই হোক, যাঁরা আমার সহযাত্রী তাদের সকলেরই মঙ্গল হোক। যেখানে যার যা বাধা আছে সব সরে যাক। মোটা ভাত কাপড় আর শান্তির অভাব যেন না হয় কারও। সবাই একটু মিষ্টি খাও। মিষ্টি মুখ করো। মিষ্টি মুখ। যার যা ইচ্ছে।

জীবনে আমার এমন অভিজ্ঞতা কখনও হয়নি। দেওঘরে বাবা বৈদ্যনাথ ধামের পাশে যে-পেঁড়ার দোকান থেকে স্বামী বিবেকানন্দ পেঁড়া খেয়েছিলেন, মিষ্টির কথায় আমি সেই দোকানের পেঁড়ার কথা ভেবেছিলুম। আমার মুখ সেই স্বাদে ভরে গেল। আমার মতোই অভিজ্ঞতা হল সকলের। বাসের সমস্ত যাত্রী কুঁদ হয়ে গেছেন। বাস আবার যাত্রা শুরু করল। সেই একই বাস, একই যাত্রী। পরিবেশ ভিন্ন। যেন চলমান একটা ধ্যানঘর। সবাই মৌনী।

মহাভারতের বনপর্বের উপাখ্যান মনে পড়ছে। দুর্যোধন, কর্ণ ও দুঃশাসনের দুষ্ট পরামর্শে তপস্বী দুর্বাসা তার অযুত শিষ্য নিয়ে কাম্যকবনে উপস্থিত হলেন। অতিক্রান্ত মধ্যাহ্নে। পঞ্চপাণ্ডবের আহারাদি সমাপ্ত। দ্রৌপদী সবার শেষে আহার করে সবে সামান্য বিশ্রামের আয়োজন করছেন। যুধিষ্ঠির দুর্বাসার সশিষ্য আগমন সংবাদ জানালেন। যুধিষ্ঠির যথাবিধি পুজো করে বলেছেন, ভগবন, আপনি আহ্নিক করে শীঘ্র আসুন, আপনার সেবা আমরা প্রস্তুত করছি। দ্রৌপদী মহাচিন্তায় পড়লেন। সশিষ্য দুর্বাসা মানে গেছেন। স্নান আর আহ্নিক এইটুকুমাত্র সময়। এর মধ্যে অন্নের আয়োজন কীভাবে হবে! অগতির গতি শ্রীকৃষ্ণ। দ্রৌপদী আকুল প্রার্থনা শুরু করলেন, হে কৃষ্ণ করুণাসিন্ধো, হে দুঃখনাশন, একটা কিছু উপায় করো ঠাকুর। দূতসভায় দুঃশাসনের হাত থেকে রক্ষা করেছিলে, আজ এই সংকট থেকে ত্রাণ করো প্রভু।

কৃষ্ণ ঠিক শুনতে পেলেন প্রিয়জনের প্রার্থনা। রুক্মিণীকে ছেড়ে চলে এলেন দ্রৌপদীর কাছে। দুর্বাসার আগমনের কথা শুনে তিনি বললেন, কৃষ্ণা, আমি অত্যন্ত ক্ষুধার্ত, শীঘ্র আমাকে খাওয়াও, তারপর তোমার অন্য কাজ। শীঘ্রং ভোজয় মা কৃষ্ণে পশ্চাৎ সর্বং করিষ্যসি। দ্রৌপদী লজ্জিত হলেন। যতক্ষণ না আনি নিজে আহার করি ততক্ষণ পর্যন্তই সূর্যদত্ত অনুপাত্রে অন্ন থাকে। আমার আহার যে হয়ে গেছে প্রভু। আর যে কিছু নেই। ভুক্তবত্যম্মাহং দেব তস্মাদন্নং ন বিদ্যতে। ভগবান। বললেন, কৃষ্ণা, এখন পরিহাসের সময় নয়, শীঘ্র যাও, ওই হাঁড়িটি এনে আমাকে দেখাও। দ্রৌপদী নিয়ে এলেন সেই অনুপাত্র। কৃষ্ণ দেখলেন, তার কানায় একটু শাকান্ন লেগে আছে। স্থাল্যাঃ কণ্ঠেহথ। সংলগ্নং শাকান্নং বীক্ষ্য কেশবঃ। সেই শাকান্নটুকু মুখে দিয়ে কেশব বললেন, বিশ্বাত্মা প্রীয়তাং দেবস্তুশ্চাত্ত্বিতি যজ্ঞভুক। বিশ্বাত্মা যজ্ঞভোজী দেব তৃপ্তিলাভ করুন, তুষ্ট হোন।

দুর্বাসা ও তার শিষ্য মুনিগণ তখন নদীতে স্নানের জন্য নেমে অঘমর্ষণ মন্ত্র জপ করছিলেন। সহসা তারা উদগার তুলতে শুরু করলেন। যেন কতই খাওয়া হয়েছে। উদগারে আহারের গন্ধ। তারা তৃপ্ত হয়ে জল থেকে উঠে এলেন। পরস্পরের দিকে তাকাচ্ছেন। মুনিরা দুর্বাসাকে বললেন, ব্ৰহ্মর্ষি, আমরা যেন আকণ্ঠ ভোজন করে তৃপ্ত হয়েছি, এখন আবার কী করে ভোজন করব! দুর্বাসা বললেন, বটেই তো! ওদিকে রাজর্ষি যুধিষ্ঠিরকে বৃথাই অন্নপাক করতে বলে মহা অপরাধে অপরাধী হলুম। হরিচরণাশ্রিত পাণ্ডবদের আমিও ভয় করি। ক্রুদ্ধ দৃষ্টিপাতে আমাদের দগ্ধ না করেন। চলো, আমরা পালাই।

কেশবের আদেশে তাদের ডাকতে নদীতীরে এসে সহদেব দেখলেন, কেউ কোথাও নেই।

ছোটদাদু যা করলেন, অনেকটা এইরকম। এ যে অদ্ভুত এক যোগশক্তি! সেই শক্তির অনুভব আমার মধ্যেও হল। কেমন করে অবিশ্বাস করি! নিপুণ শিল্পীর মতো ছোটদাদু ছোটখাটো নানা বিভূতি দেখিয়ে চলেছেন। বিজ্ঞান দিয়ে ব্যাখ্যা করার ক্ষমতা নেই আমার। হরিশঙ্করের ঠোঁটে একফালি হাসি লেগে আছে। তিনি মগ্ন হয়ে আছেন তাঁর সেই বিখ্যাত নোট খাতায়।

অলৌকিক সেই যাত্রার শেষ মিলল বর্ধমানে এসে। এতটা পথ ড্রাইভার ও কনডাক্টর কোনও যাত্রী তোলেননি, শুধু নামিয়ে গেছেন। ছোটদাদুর সম্মানে বাসটা স্পেশ্যাল বাস হয়ে গেছে। টার্মিনাসে বাস লাগল। কোনও আরোহী আগে নামলেন না। ছোটদাদু ও আমরা নামার পর সবাই নামলেন একে একে। বাসের চালক ছুটে এলেন। ফরসা সুন্দর চেহারার এক যুবক। একমাথা কালো কোকড়া কোকড়া চুল। প্রণাম করে বললেন, আপনি বলেছিলেন বর্ধমানে বলবেন।

ছোটদাদু তাকে টেনে নিয়ে গেলেন একপাশে। বেশ কিছুক্ষণ কথা হল দু’জনে অন্তরঙ্গ ভাবে।

রাজসমারোহে আমরা ট্রেনে চাপলুম। এইবার ছোটদাদু আমার পাশে। উলটোদিকে হরিশঙ্কর। হরিশঙ্করকে আমরা এমনভাবে ঘিরে রেখেছি যাতে আর কোনও গোলযোগ না হয়। ট্রেন অবশ্য খুবই ফাঁকা।

ছোটদাদু বললেন, ভীষণ মনখারাপ হয়ে গেল।

কেন? মনখারাপ কেন?

অত সুন্দর ছেলে, কিন্তু বাঁচবে না বেশিদিন।

কে? ওই ড্রাইভার?

হ্যাঁ। খুব সামান্য আয়ু হাতে নিয়ে এসেছে।

আপনি পারেন না বাড়াতে?

ওই একটা জায়গায় কেরামতি চলে না পিন্টু।

বিধ্বস্ত সৈন্যবাহিনীর মতো আমরা একটা দল পাড়ায় ঢুকলুম। আমাদের বিশ্বস্ত দুই অভিভাবক, দুটো কুকুর মোহর আর পন্টু, মাঝরাস্তাতেই ধরে ফেলল আমাদের। তাদের সে কী নর্তন কুর্দন! হরিশঙ্কর ছোটদাদু দু’জনেই এদের ভক্ত। সকাল বিকেল দুপুর ভোজনের অন্ত নেই। তন্ত্রের সঙ্গে কুকুরের গভীর যোগ। হরিশঙ্কর জীবজন্তুপ্রেমী। গাড়ি চাপায় মোহরের ঠ্যাং ভেঙেছিল, হরিশঙ্কর প্ল্যাস্টার করেছিলেন। সকলের চিৎকার, কামড়ালেই জলাতঙ্ক। হরিশঙ্কর বলেছিলেন একটি কথা, মোহর মানুষ নয়। সবাই ঠোঁট উলটেছিল। বলেছিল, কামড়ালেই বুঝবেন মোহর মানুষ না কুকুর! হরিশঙ্করের হাতে ছোট একখণ্ড কাঠ, প্ল্যাস্টার অফ প্যারিসের টিন, ব্যান্ডেজ। তিনবার টুসকি মেরে মোহরের সামনে বসলেন। সঙ্গে সঙ্গে থেমে গেল মোহরের কান্না। মোহর লেজ নাড়ছে। হরিশঙ্কর নিপুণ একটি প্ল্যাস্টার করে উঠে দাঁড়ালেন। কারও মুখে কোনও কথা নেই।

একটা স্টেশনারি দোকান তখনও খোলা ছিল। ছোটদাদু একগাদা বিস্কুট কিনলেন। বাড়ির সামনে এসে রকের ওপর বিস্কুটগুলো ছড়িয়ে দিলেন। মোহর আর পন্টুর ভোজন শুরু হল। পন্টু মোহরের ছেলে। খাওয়ার আগে দু’জনেই আকাশের দিকে মুখ তুলে তাদের বিখ্যাত সেই উল্লাসের ডাকটি ছাড়ল।

কানে আসছে গান। মাতুল জয়নারায়ণ দোতলায় গান ধরেছেন,

পড়িয়ে ঘোর সংকটে ডাকি তোমায় অকপটে।
নিকটে বারেক আসি দাঁড়াও না।
পক্ষ হইয়ে বিপক্ষ, প্রতিপলে করে লক্ষ, দিতেছে দারুণ মন বেদনা।
দুটি খুঁটির উপরে, দিয়াছ রহিতে ঘরে, ঘুণ ধরে সে যে আর থাকে না।

সুরটা মনে হচ্ছে খট। আমার মাতামহের কণ্ঠে শুনেছি এই গান, রাম দত্তের লেখা। আমাদের বিখ্যাত সদরের কালোয়াতি দরজা খোলাই ছিল। ঠেলতেই হড়াস হয়ে গেল। তিন ভঁজ দরজা পৃথিবীর কোথাও আছে কি? একমাত্র এই বাড়িতে।

সিঁড়ির মাথায় প্রথমেই দেখা হল মুকুর সঙ্গে। আনন্দের উল্লাস, আপনারা এসেছেন?

আরও কিছু বলত, পিসিমাদের দেখে থমকে গেল। জড়োসড়ো হয়ে উঠে আসছে চারটি প্রাণী।

পিসিমার মাথায় মোটা ব্যান্ডেজ। এটা পিসির নিজের বাড়ি, তবু কী সংকোচ!

জয়নারায়ণ বেরিয়ে এলেন গান থামিয়ে। পরিবেশ বদলে গেল। জয়নারায়ণ হইহই করে বললেন, আশাদি, তুমি তা হলে এলে? মাথাটা ফাটালে কী করে?

পিসিমা অবাক হয়ে বললেন, জয়, তুমি? কেমন আছ তোমরা? কতদিন পরে দেখা! তুমি আগের চেয়ে আরও ফরসা হয়েছ। কী সুন্দর দেখতে হয়েছে তোমাকে!

সবাই বারান্দায়। কেউই সাহস করে ঘরে ঢুকছে না। মুকু পিসিমার ছেলেমেয়েদের হাত ধরে বললে, নতুন জায়গা। আড়ষ্ট লাগছে তাই না? চলো ভেতরে চলো। ভয় কী?

হরিশঙ্কর ডাকলেন, মুকু!

অতন্দ্র প্রহরীর মতো উত্তর, মেসোমশাই।

তোমার অনেক কাজ। ছেলেমেয়ে তিনটেকে ফলাও করে চানের ব্যবস্থা করে দাও। সাবানের কৃপণতা কোরো না। চুলে উকুন থাকা অসম্ভব নয়। তার ব্যবস্থা কাল হবে। পরিষ্কার জামাকাপড় পরাও। জামাকাপড়, বলে হরিশঙ্কর হোঁচট খেলেন। ছোটদাদুকে বললেন, গ্রেট মিস্টেক। প্রলিফিক ব্লান্ডার।

ছোটদাদু বললেন, কী হল আবার?

আমাদের উচিত ছিল এক সেট করে জামাকাপড় কিনে আনা। এখন এরা কী পরবে!

মুকু বললে, আপনি ভাববেন না মেসোমশাই। আমি ইমপ্রোভাইস করছি।

হরিশঙ্কর বললেন, এই তো চাই! যাও মা। তুমি এদের ইনচার্জ।

রান্নাঘরে কাকিমা রাঁধছিলেন। বেরিয়ে এলেন। এসেই গুনতে শুরু করলেন এক দুই তিন চার। নিজের মনেই বললেন, পার হেড আটখানা, তার মানে আরও ছাপ্পান্ন খানা রুটি। আধখানা কুমড়ো, দু’সের আলু। মাছ হবে না। দুধ আছে, সুজি দিয়ে পায়েস হবে। মুকু!

কাকিমা মুকুকে ডাকলেন। দু’সের আটা বের করে ঠাসতে শুরু করি।

হরিশঙ্কর বললেন, চিন্তার কিছু নেই। আমি সাফা হয়ে এসে তোমাকে সাহায্য করছি।

পিসিমা বললেন, ছোটদা, আমি আছি।

মুকু বললে, আমি কী করতে আছি!

আমাদের বাড়ির পুরনো রীতি অনুসারে মাঝরাতে জেগে উঠল সংসার। জয়নারায়ণ রান্নার এক্সপার্ট। তিনি বসে গেলেন হামানদিস্তা নিয়ে। ভাজা মশলা গুঁড়ো করতে। কুমড়োর ছক্কায় ভাজা মশলা না পড়লে জমে না। তালে তালে হামানদিস্তা চলেছে। জয়নারায়ণ বলছেন, প্রথমটা ঢিমে তিনতাল, তারপর ঝাঁপতাল, তারপর দাদরা। দাদরায় মশলা মিহি।

মুকুর মাথা খাটানোর ফলে গোটাকতক ক্লাউন বেরিয়ে এল ভেতরের ঘর থেকে। পিসতুতো ভাই একটা আন্ডারওয়ার পরেছে। বিশাল তার সাইজ, ফলে মনে হচ্ছে থ্রি কোয়ার্টার পায়জামা। তার ওপর হরিশঙ্করের সুবৃহৎ হাতাঅলা গেঞ্জি। সেটা আর গেঞ্জি নেই, মনে হচ্ছে পাঞ্জাবি। মেয়েদুটো পরেছে মুকুর শাড়ি, পাটে পাটে জড়িয়ে। জ্যান্ত মমির মতো পায়ে পায়ে ঘুরছে। বাড়ি একেবারে জমজমাট। রান্নার হুঁকছোঁক শব্দ। চাকি বেলনে রুটি ঘুরছে গোল হয়ে।

.

একপাশে বসে বসে ঢুলছিলুম। মুকু এসে বললে, তুমি আগে খেয়ে শুয়ে পড়ো না! তোমাকে দেখে আমার কষ্ট হচ্ছে।

শুয়ে পড়লে বাবা বকবেন। আর শোবই বা কোথায়? এতগুলো মানুষের বিছানার কী ব্যবস্থা হবে? ক’টা মশারি লাগবে জানো?

সে ভাবনা তোমার নয়, আমার। তোমাকে যা বলছি তাই করো। তোমাকে ভূতের মতো কাহিল দেখাচ্ছে।

মুকুর কী উপমা! ভূতের মতো কাহিল! মুকুকে একেবারে গার্ডেন-ফ্রেশ দেখাচ্ছে। শিশির-ভেজা গোলাপের মত। টুসটুসে গাল, টসটসে ঠোঁট। আকাশি রঙের শাড়ি। মুকুর নিজস্ব একটা সুগন্ধ আছে, লিলিফুলের মতো। আজ যদি কেউ কোথাও না থাকত, তা হলে মুকুর কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়তুম, সাবিত্রীর কোলে সত্যবানের মতো। অরণ্যের গল্প বলতে বলতে ঘুমিয়ে পড়তুম। স্বপ্ন দেখতুম, দামোদরের কূল ছাপিয়ে বান আসছে। প্রতিমুহূর্তে মানুষের প্রায় প্রতিটি ইচ্ছারই মৃত্যু হয়। মন হল ইচ্ছার মহাশ্মশান। মনে হচ্ছে হাত বাড়িয়ে মুকুর গোল কবজিটা ধরি। বুকের কাছে মাথাটা একটু রাখি। উপায় নেই, একটা ছেলে একটা মেয়ে, সংসারের যত পাপের উৎস! লেবরেটরিতে আমরা যেরকম কালচার প্লেট তৈরি করি, এক জীবাণুর সঙ্গে আর এক জীবাণুকে মিলিয়ে, ছেলে আর মেয়ে সেইরকম পাপের কালচার প্লেট।

এই ঘোর বেশিক্ষণ স্থায়ী করা গেল না, ওঘর থেকে হরিশঙ্করের ডাক এল, প্লিজ হেলপ মি। ছোটদাদু তার সেই অসাধারণ লাল সিল্কের লুঙ্গি পরে অনাবৃত ঊর্ধ্ব-দেহে বসে আছেন মহাযযাগী। প্রশস্ত ফরসা বুকে স্ফটিকের মালা শীতল আগুনের মতো খণ্ড-শোভা ধরেছে। হরিশঙ্কর আমাদের সেই বিখ্যাত মর্গের পাল্লা খুলেছেন। একটা আলমারি। ছোট একটা ঘরই বলা চলে। জয়নারায়ণ ধরে আছেন টর্চ।

হরিশঙ্কর বললেন, আমাদের সেই উৎসবের মশারিটা বের করতে হবে।

তাঁবুর মতো বিশাল তার আকৃতি। ভেতরে দশ-বারোজন স্বচ্ছন্দে সিধিয়ে যেতে পারে। হরিশঙ্কর পরিকল্পনামতো তৈরি করিয়েছিলেন। মশার উৎপাতে জর্জরিত। সন্ধের পর চলতে গেলে ধাক্কা লাগে। মাথায় খেলল মশারি দিয়ে ঘরের মধ্যে ঘর হবে। ঘরের অন্তর্বাস। তার ভেতর চেয়ার, টেবিল, যাবতীয় আয়োজন। পড়া তো যাবেই, তেমন হলে খানা খেতেও অসুবিধে হবে না। চাটনি আর গুড় তো খাওয়ার উপায় নেই। চাটনিতে মশার আত্মবলি, গুড় হল মশার কদমা। পরিকল্পনা। মতো চলেছিল বেশ কিছুদিন। বাধ সাধলে আমাদের প্রিয় বেড়াল। মশারির গা বেয়ে চড়চড়িয়ে চালে গিয়ে ওঠে। চাল ঝুলে গেল। সেখানে সার্কাসকুমারীর মতো তার হরেক কসরত। লেখাপড়া তো মাথায় উঠলই। মশারিরও অস্ত্রোপচার। সে যে কী নিদারুণ দুষ্টুমি, অথচ কী সুইট!

সেই গ্রাম-বিশেষ মশারির সন্ধানে একদিক থেকে আমি, একদিক থেকে মুকু অ্যাডভেঞ্চারে ঝাঁপিয়ে পড়লুম।

আমি ভয় করব না ভয়, করব না। দু’বেলা মরার আগে…।

জয়নারায়ণ বললেন, এর তো আলাদা একটা মৌজা, দাগনম্বর, খতিয়ান নম্বর থাকা উচিত, আলাদা পোস্টাপিস! আচ্ছা চাটুজ্যেমশাই, আর ইউ শিয়োর, যে এর মধ্যে অন্য আর কোনও প্রাণীর বসবাস নেই, যেমন ধরুন আরশোলা?

হরিশঙ্কর বললেন, আরশোলাকে আমি প্রাণী বলেই গণ্য করি না। ও আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাসের মতো। ভয় হল ইঁদুর।

জয়নারায়ণ একটু পিছিয়ে গেলেন। বলতে লাগলেন, সাবধান! সাবধান! লাফ না মারে।

হরিশঙ্কর বললেন, ওদের সাবধান করার আগে নিজের পালাবার পথটা দেখে রাখো। জয়, তুমি যদি কোনও আর্মির জেনারেল হতে তা হলে কী দশা হত!

চাটুজ্যেমশাই, ছোটখাটো প্রাণীকেই আমি একটু সমীহ করি। বড়দের আমি ভয় পাই না। আপনি একটা বাঘ আনুন, আমি মালকোষ মেরে ঠান্ডা করে দেব।

এদিকে লেপ কম্বল, বাড়তি বালিশের তূপে আমাদের দধিমন্থন চলেছে। সাদামতো গোল গোল গোটাকতক কী পুটপুট করে মেঝেতে পড়ে গড়িয়ে গেল। মাতুল লপ্রদান করে বললেন, গোখরো সাপের ডিম।

হরিশঙ্কর বললেন, আই অ্যাম সরি জয়। ওগুলো ন্যাপথলিনের বল।

শব্দ করে একটা পিতলের পিলসুজ মেঝেতে পড়ে কিছুদূর গড়াল। জয়নারায়ণ বললেন, শব্দটা শুনলেন চাটুজ্যেমশাই! পারফেক্ট পঞ্চমে স্টার্ট করে গান্ধার ছুঁয়ে নেমে গেল, বিশুদ্ধ ভূপালী।

হরিশঙ্কর বললেন, ওইজন্যেই তোমাকে ভালবাসি জয়। সংগীত তোমার ধ্যানজ্ঞান। সত্যিই তুমি গন্ধর্ব। বহুত হাঁটকাহাঁটকির পর সেই মশারির গোলা বেরোল। হরিশঙ্কর বললেন, সাবধানে খোলো। দু-চারটে আরশোলা বেরোতে পারে।

আরশোলা নয় কিছু উচ্চিংড়ে পুটপাট লাফিয়ে এদিক ওদিকে চলে গেল। সেই তালে মাতুল একটু নাচানাচি করলেন। হরিশঙ্কর বললেন, জয়, তোমার নাচের দক্ষতাও অস্বীকার করা যায় না। এটা ন্যাচারাল, না শিখেছিলে?

জয়নারায়ণ বললেন, আজ্ঞে আরসোলাই আমার গুরু। সেই ছেলেবেলা থেকেই তালিম দিয়ে আসছে। এটা যা দেখলেন, ককরোচ ড্যানস।

অনেকটা কথাকলির মতো।

সেই রাতে বারান্দায় বিশাল পঙক্তি ভোজ। পরপর বসে গেছি। জয়নারায়ণ বললেন, বেশ বিয়ে বাড়ি বিয়ে বাড়ি লাগছে।

আমার পাশে আমার পিসতুতো ভাই। চুপিচুপি বললে, এরা জল দেবে না?

চুপিচুপি বললুম, এদের নিয়ম খেতে বসে জল না খাওয়া। কড়া নিয়ম। খাওয়ার পাতে জল খেলে হজমশক্তি কমে যায়। গ্যাস্ট্রিক অ্যাসিড ডাইলুট হয়ে যায়। অম্বলের ব্যায়রাম হয়।

আমার যে গলায় আটকে যাচ্ছে।

কড়িকাঠের দিকে তাকাও, নেমে যাবে।

ছোটদাদু আমার আর একপাশে। তিনি বললেন, বলেছ ভাল। ওপর দিকে তাকালে সব বাধা সরে যায়।

.

মুকু একটা জায়গান্টিক বিছানা তৈরি করেছে। দেখার মতো। সেই বিশাল মশারি। পিসিমার পুরো পরিবার সেই মশারির ভেতর। পিসিমার ছোট মেয়ে হঠাৎ ফোঁস ফোঁস করে কান্না শুরু করল। পিসিমা বললেন, শুরু হল। কঁদছিস কেন? বলবি তো কী হয়েছে। কী বলবে? ওই বালিকার গুছিয়ে বলার ভাষা আছে কি? একটা সংসার চুরমার হয়ে যাওয়ার বেদনা। একটা গ্রাম, চেনা পরিবেশ, পরিচিত জীবন ছেড়ে আসার বেদনা। শিকড়সুদ্ধ তুলে এনে ভিন্ন এক মাটিতে বসিয়ে দেওয়া। মুকু মেয়েটিকে কোলের কাছে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়ল। সে তখন স্বপ্ন দেখছে সবুজ মাঠ, একটি ছাগলছানা, ছাতা বগলে পণ্ডিতমশাই, যত খেলার সাথী। দূর থেকে ভেসে আসছে কিশোরীকণ্ঠের ডাক– উষি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *