স্টাডি সার্কেল শেষ হয়ে যাওয়ার পর অন্যরা চলে গেছে, অতীনরা দু’তিনজন তখনো বসে আড্ডা দিচ্ছে মানিকদার সঙ্গে। কিছুদিন আগেই মানিকদা খুব প্লুরিসিতে ভুগেছেন, এখনও তাঁর মুখখানা অনেকটা পাংশুমতন, শুধু তাঁর মনের জোরের চিহ্ন রয়েছে তাঁর দুটি উজ্জ্বল চোখে। এই অসুখ হলে ভালো ভাবে খাওয়াদাওয়া করতে হয়, কিন্তু মানিকদা মুড়ি তেলেভাজা খেয়ে পেট ভরান। দুধ উনি স্পর্শ করেন না, ডিমে অ্যালার্জি, কেউ বেশি করে মাছ মাংস খাবার পরামর্শ দিলে হেসে বলেন, পয়সা কোথায়? বাড়িতে মাংস রান্নার গন্ধ পেলেই বাড়িওয়ালা এসে কাঁক করে চেপে ধরবে। পাঁচ মাসের বাড়ি ভাড়া বাকি!
একসময় আবিদ আলি এ ঘরে ঢুকে বললেন, ও মানিকবাবু, আপনাদের পেছনে ফেউ লেগেছে, টের পেয়েছেন?
আবিদ আলি সাধারণত ফেরেন অনেক রাতে, তাঁর সঙ্গে স্টাডি সার্কেলের সদস্যদের দেখাই হয় না। শনি রবিবার উনি চলে যান কাকদ্বীপ।
মানিকদা চোখ নাচিয়ে বললেন, আমরা যদি বাঘ হই, তাহলে পেছনে তো ফেউ লাগবেই, তাতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই!
আবিদ আলি ওদের পাশে বসে পড়ে বললেন, না মশাই, ঠাট্টা নয়। গত সপ্তাহে একজন। লোক এসে জিজ্ঞেস করে গেল, আপনারা কারা, কেন এখানে আসেন এইসব হ্যাঁনো ত্যানো। মনে হলো, সাদা পোষাকের পুলিশ।
কৌশিক বললো, একটা স্পাই এখানে ঘুর ঘুর করে, আমি অনেকদিন দেখেছি।
মানিকদা বললেন, ঘুরুক না পাই, তাতে ক্ষতি কী আছে? আমরা তো গোপনে কিছু করছি। আমাদের পার্টি কি ব্যান্ড নাকি?
আবিদ আলি বললেন, সে লোকটা এমন ইঙ্গিত দিল, যেন এখানে গোপনে গোপনে বোমা বানানো হয়।
এই তো ফাঁকা ঘর, একটা সতরঞ্চি আর কিছু কাগজপত্তর ছাড়া আর কিছুই নেই, ভেতরে এনে দেখিয়ে দিলেই পারতেন!
আরও শুনুন না, কাল রাত এগারোটার সময় এক দঙ্গল ছেলে এসে বললো, তাদের এই ঘরটা ভাড়া দিতে হবে। আমি যত বলি যে আমার এ ঘর ভাড়া দেবার কোনো কোশ্চেনই ওঠে না, তারা শুনবে না। কংগ্রেসের ছেলে মনে হলো, তারা এখানে পার্টি অফিস করতে চায়।
আপনি বললেন না কেন, আপনি অলরেডি এই ঘর আমাদের ভাড়া দিয়েছেন?
ওরা জানলো কী করে মশাই যে আপনাদের আমি ভাড়ার রসিদ দিই না? রসিদ দেবোই বা কী করে, সাবলেট করা তো বেআইনী! ওরা বললো, ওদেরও রসিদ লাগবে না, ওরা দেড়শো টাকা ভাড়া দেবে!
এই একখানা ছোট ঘরের জন্য দেড়শো টাকা দেবে?
হ্যাঁ, আপনারা যে চল্লিশ টাকা দেন, তা ওরা জানে। আপনাদের দলের মধ্যে নিশ্চয়ই ওদের কোনো স্পাই আছে।
এসব জানা এমন কিছু কঠিন নয়। আমরাই কেউ কথায় কথায় অন্য লোকদের হয়তো কখনো বলেছি।
পমপম বললো, মানিকদা, অনুপমের খুড়তুতো ভাইটা কংগ্রেসী করে। বেশ পাণ্ডা গোছের। অনুপম নিশ্চয়ই ওকে বলে ফেলেছে।
বলাটা অন্যায় কিছু নয়। কত টাকা ঘর ভাড়া দিই, সেটা কি একটা সিক্রেট নাকি? আমাকেও কেউ জিজ্ঞেস করলে বলে দিতুম। তা হলে আবিদ আলি সাহেব, চল্লিশ টাকার বদলে দেড়শো টাকার অফার পেয়ে আমাদের কী তাড়াবেন ঠিক করেছেন?
আরে ছি ছি, আপনি একথা বললেন মানিকবাবু? আমি কি টাকার লোভে আপনাদের এই ঘরটা ব্যবহার করতে দিয়েছি? আমার ছোটখাটো ব্যবসা, আপনাদের দোয়ায় কোনোরকমে. চলে যায়। কিন্তু আপনারা তো কেউ এই পাড়ায় থাকেন না, পাড়ার ছেলেরা যদি এসে হামলা করে…
ভয় পাবেন না, ঐ ছেলেদের বলবেন আমার সঙ্গে দেখা করতে।
ভয় আমি পাই না। কাল অত রাতে এমন হল্লা করতে শুরু করলো, আশেপাশের ঘর থেকে ভিড় জমে গেল, ওরা আমায় চোখ রাঙাচ্ছিল, কেউ প্রতিবাদ করলো না। একটা ব্যাপার বুঝে দেখুন, আমি মাইনরিটি কমুইনিটির লোক, রুলিং পার্টিকে চটিয়ে আমি ফ্যাসাদে পড়তে চাই না। এখানে আমার ওপর জুলুম হলেও কেউ সাহায্য করতে আসবে না। এই যদি কাকদ্বীপ হতো, সেখানে যদি এরকম কোনো দল এসে আমার মুখের ওপর তড়পাতো, ইনসাল্লা, আমি তাদের পেছনে লাথি মেরে যদি ভূত না ভাগাতুম তো কী বলেছি?
আবিদ আলির চোখের দিকে কয়েক পলক তাকিয়ে থেকে মানিকদা নীরস গলায় বললেন, তাহলে আপনি কী বলতে চান? আমরা আর এখানে আসবো না।
আবিদ আলি গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন, আমি বলি কী, কিছুদিন আপনারা ক্লাস বন্ধ রাখুন, শিগগিরই ইলেকশান হবে শোনা যাচ্ছে, সেসব ঝঞ্জাট চুকে যাক, তারপর আবার দেখা যাবে।
মানিকদা বিরক্তির সঙ্গে বললেন, ইলেকশানের সঙ্গে আমাদের ক্লাস বন্ধ রাখার কী সম্পর্ক আছে! আমরা একটা জরুরি ডিসিশান নিচ্ছি, আমরা স্টাডি সার্কেলের একটা মুখপত্র ছাপিয়ে বার করবো এখান থেকে।
আবিদ আলিও এবার কড়া সুরে বললেন, ইলেকশানের কথা শুনে পাত্তা দিলেন না, তবু প্রত্যেকবার আপনাদের পাটি এত ক্যাণ্ডিডেট দাঁড় করায় কেন? কংগ্রেসীদের তো কোনোদিন পাওয়ার থেকে সরাতে পারবেন না, শুধু অ্যাসেম্বলিতে অপোজিশান পার্টি হয়ে গলা ফাটাবেন! এই তো আপনাদের বিপ্লব! না মশাই, আমার এই অ্যাড্রেস থেকে আপনাদের কোনো পত্রিকা-ফত্রিকা বার করা চলবে না। পুলিশ ওদের হাতে, এরপর পুলিশ এসে হুজ্জোত করবে!
আবিদ আলির সঙ্গে আরও কিছুক্ষণ তর্ক বিতর্ক হলো। বোঝা গেল, তিনি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন, তাঁর ফ্ল্যাটে আর স্টাডি সার্কেল চালাতে দিতে চান না। মানিকদাও অনড়, স্টাডি সার্কেল তিনি কিছুতেই বন্ধ রাখবেন না, তিনি এক মাসের নোটিস চান, তার মধ্যে অন্য একটা জায়গা ঠিক করে তারপর এই ঘর ছাড়া হবে।
ওরা সবাই নেমে এসে রাস্তায় দাঁড়ালো, মানিকদা একটা বিড়ি ধরিয়ে দুঃখিত ভাবে বললেন, আবিদ আলি কী রকম বদলে গেছে দেখলি? আগে ও আমাদের সাপোর্টার ছিল, এখন খুব টাকা পয়সা চিনেছে, আজ আমি ওর মুখে মদের গন্ধ পেলাম
কৌশিক বললো, মাইনরিটি কমুইনিটি বলে ভয় পাচ্ছে। কিন্তু এদিককার দোকানদারদের মধ্যে তো মুসলমান কম নেই। মানিকদা, এই ফ্রন্টে আমাদের বিশেষ কাজ করা হয়নি, এরা সবাই কংগ্রেসের সাপোর্টার…
রাত দশটা বেজে গেলেও রাস্তার লোক চলাচল খুব কম নেই। এটা বাজার এলাকা, কাছেই বেশ্যাপল্লী, খান্না সিনেমায় এখনো চলছে নাইট শো। অতীনদের পরীক্ষা শেষ হয়ে গেছে, তাদের বাড়ি ফেরার তাড়া নেই।
দুটি ছেলে রাস্তা পার হয়ে এসে ওদের কাছ ঘেঁষে দাঁড়ালো। দু’জনেরই পরণে চোঙা প্যান্ট ও রঙীন গেঞ্জি। হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। শুক ও সারীর গানের ভঙ্গির মতন এরা শুরু করলো কথাবার্তা।
এই চীনের দালালগুলোকে দেখছিস? সিক্সটি টু-তে যুদ্ধের সময় এরা বলেছিল ইন্ডিয়াই প্রথম চীনকে অ্যাটাক করেছে!
আর সিক্সটি ফাঁইভের যুদ্ধের সময় এরা কী বলেছিল?
তখনও বলেছিল ইন্ডিয়াই প্রথম অ্যাটাক করেছে। এরা সব সময় ইন্ডিয়ার দোষ দেখে।
এরা নেতাজী সুভাষচন্দ্রকে কী বলেছিল?
কুইসলিং! কুইসলিং! এ বাঞ্চোৎদের বাপ আগে ছিল রাশিয়া, এখন বাপ বদলেছে। এখন মাও সে তুং-কে বাবা মেনেছে!
তাহলে এরা এদের বাপের দেশে চলে যায় না কেন? ভুজি এঁড়ের মতন এখানে ল্যাজ তুলে লাফালাফি করে কেন?
পমপম হঠাৎ ওদের দিকে ফিরে চেঁচিয়ে বললো, অ্যাই, আমার গায়ে হাত দিয়েছো কেন? রাসকেল, ইডিয়েট!
একটি ছেলে পমপমের থুতনি ধরে বললো, খ্যাংরা কাঠির মাথায় আলুর দম, তোমার ঐ ছিরিঅঙ্গে কে হাত বোলাবে, মান্তু? চৌরঙ্গিতে চাঁদা তোলো গে যাও!
অতীন আর কৌশিক এ ছেলেদুটির এরকম অদ্ভুত কথাবার্তা শুনে বারবার মানিকদার দিকে তাকাচ্ছিল, কী ভাবে ওদের কথার প্রতিবাদ জানানো হবে তার একটা নির্দেশ চাইছিল। কিন্তু পমপমের গায়ে ওদের হাত দিতে অতীনরা দেখেনি, পমপমই ইচ্ছে করে ওদের কাছ ঘেঁষে এসেছে।
এবার পমপম আরও গলা চড়িয়ে রাস্তার লোকদের শোনাবার জন্য বললো, মেয়েদের গায়ে হাত দিচ্ছো, তোমাদের বাড়িতে মা-বোন নেই?
কৌশিক বললো, পমপম, তুমি সরে এসো!
অন্য পক্ষের একটি ছেলে বললো, ঢলানী মাগী, আমরা নিজেদের মধ্যে কথা বলছি, তার মধ্যে তুই মাথা গলাতে এসেছিস কেন রে? এটা পাবলিকের রাস্তা! যা, আশুতোষ অয়েল মিলে লাইন দিগে যা!
অতীন ছুটে গিয়ে সে ছেলেটির কলার চেপে ধরে চোয়ালে এক ঘুষি কষালো, তারপর দু’জনেই জড়ামড়ি করে পড়ে গেল রাস্তার ওপর।
অন্য ছেলেটি অমনি পেছন ফিরে চিৎকার করতে লাগলো, এই অজিত, হেবো, পঞ্চুদা…
কৌশিক দেখলো রাস্তার উল্টো দিকে, কোনাকুনি একটা বড় দল দাঁড়িয়ে আছে, তারা দৌড়োবার জন্য ঝুঁকেছে।
সামনেই একটা ট্যাক্সি, কৌশিক ঝট করে তার দরজা খুলে মানিকদাকে টানতে টানতে নিয়ে বললো, শিগগির উঠে পড়ুন, পল্পম চলে আয়…
ফিরে গিয়ে সে অতীনকে ছাড়াতে যেতেই অন্য ছেলেটির হাতে প্রচণ্ড এক ঘুষি খেল, ছিটকে গেল তার চশমা। তবু ওপারের দলটি এসে পৌঁছোবার আগেই তাদের ট্যাক্সিটা স্টার্ট নিল, দম্ দম্ করে কয়েকটা ইঁট এসে পড়লো ট্যাক্সির গায়ে, পেছন দিকে একটা বোমা ফাটলো।
মানিকদা থরথর করে কাঁপছেন, ভয়ে নয়, উত্তেজনায়, তাঁর দুর্বল শরীর এই আবেগ সামলাতে পারছে না, শক্ত হয়ে গেছে চোয়াল। অতীন তার বাঁ কাঁধটা চেপে ধরে বললো, হারামীর বাচ্চাটা আমায় কামড়ে ধরেছিল। জানোয়ার!
কৌশিক প্রচণ্ড ধমক দিয়ে বললো, অতীন, তুই ইডিয়টের মতন মাথা গরম করতে গেলি, ওরা তৈরি হয়ে এসেছিল, আমাদের ছাতু করে দিত!
ট্যাক্সি ড্রাইভারটি বললো, ঐসব গুণ্ডাদের সঙ্গে আপনারা লাগতে গিয়েছিলেন কেন? সঙ্গে। মেয়েছেলে রয়েছে, ভদ্দরলোকেরা কি ওদের সঙ্গে পারে?
অতীন বললো, ওরা পম্পমকে… তখনও আমরা কিছু বলবো না?
পম্পম কঠিন গলায় বললো, আমার জন্য কারুর সাহায্যের দরকার ছিল না, আমি নিজেই নিজেকে ডিফেণ্ড করতে পারি। আমি চেঁচিয়ে তোক জড়ো করে ওদের মার খাওয়াতুম!
কৌশিক বললো, এত রাতে… ওরা বোমা চার্জ করলে কেউ কাছে আসতো না।
অতীন বললো, আমরা এর বদলা নেবো, আমরা ছাড়বো না!
অতীন, তোকে চিনে রেখেছে, তুই এ পাড়ার দিকে চট করে আসিস না।
ট্যাক্সিটা আগে পৌঁছোতে গেল পমপমকে। তখনই কৌশিক পমপমের বাবাকে পুরো ঘটনাটা জানাতে চায়। কিন্তু মানিকদা রাজি হলেন না। কয়েকদিন আগে অশোক সেনগুপ্তর সঙ্গে প্রবল তর্কাতর্কির পর মানিকদার সঙ্গে তাঁর কথা বন্ধ হয়ে আছে।
মানিকদা আগে থাকতেন তাঁর দাদার সংসারে, রাজনৈতিক ব্যাপারে দাদার সঙ্গে মতবিরোধ হওয়ায় সে বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছেন এক বন্ধুর বাড়িতে। সেই বন্ধুটিও ইদানীং বেকার। শ্যামপুকুরের সেই বাড়িটাতে মানিকদাকে পৌঁছে দিতে এসে সেখানেও কিছুক্ষণ আলোচনা হলো এই ঘটনা নিয়ে। মানিকদার বন্ধু সুবিমলদা অতীনদের খুব ধমকালেন। কংগ্রেসের ঐ সব লুমপেন ক্যাডারদের সঙ্গে কনফ্রনটেশানে যাওয়া ওদের মোটেই উচিত হয়নি। ওরা তো ইচ্ছে করেই প্রভোক করতে এসেছিল। ইলেকশানের আগে ওরা বামপন্থীদের মারবে, জেলে ভরে দেবার চেষ্টা করবেই। মানিকদার দুর্বল শরীর, তাঁর গায়ে যদি হঠাৎ আঘাত লাগতো? এখন স্ট্র্যাটেজি হচ্ছে, ইলেকশান পর্যন্ত ওদের এড়িয়ে চলা।
মানিকদা বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, এখনো কথা বলতে পারছেন না, খাটে শুয়ে পড়লেন।
অতীন সুবিমলদাকে বললো, আমি আপনাদের ওসব স্ট্র্যাটেজি বুঝি না। আমায় কেউ
অপমান করতে এলে, মারতে এলে আমি ছাড়বো না। তাতে যা হয় হোক!
মানিকদাকে পৌঁছোনোর পর ওদের কাছে আর ট্যাক্সি ভাড়া নেই। এখনো ট্রাম চলছে। শ্যামপুকুরের মোড়ে, টাউন স্কুলের কাছে কয়েকজন যুবককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অতীনের শরীরে একটা ঝাঁকুনি লাগলো। ওরাই এখানে চলে আসে নি তো?
কৌশিক বললো, কোনোদিকে তাকাবি না, সোজা রাস্তাটা পার হয়ে যা!
মিনিট দশেক অধীরভাবে অপেক্ষা করবার পর যে ট্রামটা এলো, সেটাই শেষ ট্রাম, সামনে। বোর্ড ঝুলছে। সিনেমা-ভাঙা ভিড়ে ভর্তি হয়ে গেল সেটা।
এসপ্লানেডে নেমে পড়ার পর আর কোনো ট্রাম নেই। বাস আসবে কি না বলা শক্ত। এ পাড়ার ইংরিজি সিনেমাগুলো আগে আগে শেষ হয়ে যায়। রাস্তা ফাঁকা। রাস্তার রং যে কত কালো, তা রাত্তিরবেলা, দু’ধারে আলো-জ্বলা শূন্য পথ দেখলে বোঝা যায়। অসহ্য গুমোট গরমের রাত।
অতীন বললো, চল, হাঁটি! তোর চশমাটা গেছে, আর কোনো জায়গায় বেশি লেগেছে?
নাঃ! চশমাটা কুড়িয়ে নেবার সময় পেলুম না, তখন খুঁজতে গেলে… তোকে কামড়ে ধরেছিল!
হ্যাঁ, আমার কাঁধটা কামড়ে ও হাত দুটোকে ফ্রি করে নিজের কোমরে ঢোকাতে যাচ্ছিল, বোধহয় ছুরিটুরি বার করতো। হ্যাঁ রে, মানুষের দাঁতে বিষ আছে? টিটেনাস হতে পারে?
কী জানি! তোর খুব টিটেনাসের ভয়। দ্যাখ, সুবিমলদা ঠিকই বলেছে, ওদের দেখেই আমাদের চলে যাওয়া উচিত ছিল।
ওরা ঐ সব খারাপ কথা বলবে আর আমরা ল্যাজ গুটিয়ে পালাবো?। আমরা কি ছুরি-ছোরা চালাতে জানি, না যুযুৎসু জানি! আমরা শিখেছি শুধু বই মুখস্থ করে পরীক্ষার পড়া তৈরি করতে। যা প্র্যাকটিক্যালি কোনো কাজে লাগে না। আমাদেরও আগে তৈরি হতে হবে, আর্মস ব্যবহার করার ট্রেনিং নিতে হবে। তোর কি ও জায়গাটায় খুব ব্যথা করছে, অতীন?
না, ব্যথা বিশেষ নেই, কিন্তু এখনো রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে। এই, বাস, বাস!
একটা খালি একতলা সরকারি বাস মৃগী-রুগীর মতন কাঁপতে কাঁপতে এবং বিকট ঝকার ঝকার শব্দ করতে করতে আসছে, ওরা মাঝ রাস্তায় দাঁড়িয়ে পড়ে, হাত উঁচু করে বাসটা থামান্সে। সেটা যাচ্ছে গ্যারাজে, ভেতরে তিন চারজন কন্ডাকটর বসে ঢুলছে, ওদের তুলে নিতে আপত্তি করলো না।
পরীক্ষার পর এখন অতীন প্রায়ই দেরি করে বাড়ি ফেরে। তার ভাত ঢাকা দেওয়া থাকে, ছেলে বাড়ি ফেরার পর মমতা সেগুলো গরম করে দেন। যেদিন বাবা-মা ঘরে আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়েন, সেদিনও অতীন টের পায় যে কোনো এক সময় মা এসে দেখে যান, ছেলে ফিরেছে কি না।
ক’দিন ধরে মমতার শরীর ভালো যাচ্ছে না, খুব কাশি আর জ্বর। অতীন প্রায় নিঃশব্দে দরজা বন্ধ করলো। পা টিপে টিপে গেল খাবার ঘরে। মাকে সে আজ জাগাতে চায় না। যত বেশিক্ষণই সে বাইরে কাটাক, বাড়িতে ফেরা মাত্র যেন খিদেটা পেটের মধ্যে তাণ্ডব নাচ শুরু করে দেয়।
আজ মাছ রান্না হয়নি, ভাত, ডাল, ঝিঙে-পোস্ত আর ডিমের ঝোল। ঝোলটার মধ্যে একটা আঙুল ডুবিয়ে তারপর সেটা সে মুখে ঠেকিয়েই স্বাদ নিয়ে বুঝলো, এটা মায়ের রান্না নয়, ফুলদি বেঁধেছে। তাহলে আজ বোধহয় বেশি শরীর খারাপ হয়েছে মায়ের।
আজ যদি ঐ গুণ্ডাটা তার পেটে একটা ছুরি বসিয়ে দিত, তাহলে মাঝরাত্তিরে কিংবা ভোরবেলা কেউ এসে এবাড়িতে খবর দিত, অতীন মজুমদার মারা গেছে। তখন মা কী করতেন?
যারা পলিটিক্যাল ওয়াকার, যারা কোনো আদর্শের জন্য লড়াই করতে যায়, তাদের সকলেরই তো মা বাবা আছে! একটা সমাজ ব্যবস্থা পাল্টাবার জন্য মৃত্যুর ঝুঁকি তো নিতেই হবে। কিন্তু অন্য কোনো পরিবারে তো তার দাদার মতন একটা ছেলে হঠাৎ মরে যায়নি! দাদা চলে গিয়ে তাকে কী বিপদেই না ফেলে গেছে!
ঝিঙে-পোস্তটা ভালো হয়েছে বেশ। সবটা ভাত শেষ করার পরও অতীনের খিদে মিটলো না। খানিকটা ডিমের ঝোল আর একটা আলু রয়ে গেছে, আর একটু ভাত পেলে বেশ হতো! আরও ভাত কোথাও ঢাকা দিয়ে রাখা আছে কিনা দেখার জন্য অতীন উঠতে যেতেই চোখে পড়লো, একপাশে একটা ছোট বাটি, তার ওপর একটা কাঁচের প্লেট চাপা দেওয়া।
প্লেটটা তুলে দেখলো, তার মধ্যে খানিকটা পায়েস! এই গরমকালে পায়েস রান্না হয়েছে কেন, আজ কারুর জন্মদিন নাকি?
অতীন প্রথমেই নিজের জন্মতারিখটা মনে করলো। না, তার নয়। মায়েরও হতে পারে না, বাবার জন্মদিনটা যেন কবে? ফুলদি কিংবা মুন্নি, এদের মধ্যে একজনেরই হওয়া স্বাভাবিক!
তারপরেই হঠাৎ তার মনে পড়ে গেল। ১৬ই জুন, আজ তো তার দাদা পিকলুর জন্মদিন! কতদিন হয়ে গেল সে নেই, তবু এখনও মমতা প্রত্যেক বছর পিকলুর জন্ম তারিখে পায়েস রাঁধেন। দাদা পায়েস খেতে ভালোবাসতো! দাদা বেঁচে থাকতে কি তার প্রত্যেক জন্মদিনে পায়েস রান্না হতো? বোধহয় না। অতীন এখন বুঝতে পারে, সেইসময় তারা খুব গরিব হয়ে পড়েছিল, পিসিমারা বরানগরের বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছিলেন, দেওঘরে নিয়মিত টাকা পাঠাতে হতো বাবাকে… একদিন মাঝরাতে ঘুম ভেঙে অতীন শুনতে পেয়েছিল, গয়না বিক্রি নিয়ে বাবা ও মায়ের মধ্যে কথা কাটাকাটি…
পায়েস খেতে খেতে অতীন যেন তার দাদাকে চোখের সামনে দেখতে পেল। পরিষ্কার ছবি, একটুও মলিন হয়নি, ফর্সা, গেঞ্জি পরা পিকলু, হাতে একটা বই… দাদা কবিতা লিখতো না? সে কবিতাগুলো গেল কোথায়? কালকেই অতীন দাদার পুরোনো খাতাপত্র খুঁজে দেখবে।
আঁচাতে গিয়ে তার চোখে পড়লো, তুতুল-মুন্নিদের ঘরের দরজা বন্ধ থাকলেও তলা দিয়ে আলোর রেখা আসছে। তুতুল অনেক রাত জেগে পড়ে। পাশ করে ডাক্তার হয়ে গেছে তুতুল, এখনো তার পড়ার নেশা যায়নি।
অতীন আবার ঘাড়ে হাত বোলালো। শুয়োরের বাচ্চাটা অনেকখানি দাঁত বসিয়ে দিয়েছে। কৌশিক ঠিকই বলেছে, তার টিটেনাস-ভীতি আছে, হঠাৎ নাকি ব্যথার চোটে শরীরটা ধনুকের মতন বেঁকে যায়।
দরজাটা আস্তে ঠেলতেই খুলে গেল। এই ঘরের কিছু বদল হয়েছে, অতীন এর মধ্যে এই ঘরে আসেনি। আগে পাশাপাশি খাট ছিল, এখন দুটি খাট ঘরের দু’দিকের দেয়ালে, মাঝখানে একটা টেবিল, দেয়ালে বিদ্যাসাগরের ছবিটার দু’পাশে রবীন্দ্রনাথ ও লুই পাস্তুরের দু’খানা ছবি।
দরজার দিকে পেছন ফিরে টেল ল্যাম্পের আলোয় বসে পড়ছে তুতুল। অতীন খুব মৃদু গলায় ডাকলো, ফুলদি!
তুতুল মুখ ফেরাতেই অতীন তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকলো। সে মুন্নির ঘুম ভাঙাতে চায়,। মুন্নি দেয়ালের দিকে ফিরে পাশ বালিশ জড়িয়ে আছে।
তুতুল উঠে আসতেই অতীন চলে এলো নিজের ঘরের দিকে। ভেতরে এসে সে জিজ্ঞেস করলো, ফুলদি একটা কথা, কোনো মানুষ যদি অন্য একজন মানুষকে কামড়ে দেয়, তাহলে কি টিটেনাস কিংবা সেপটিক হতে পারে?
অতীনের মুখের দিকে কয়েক পলক তাকিয়ে, সামান্য হেসে তুতুল বললো, তুই নরখাদকদের দেশে গিয়েছিলি বুঝি? কোথায় কামড়েছে, দেখি?
অতীন লুকোবার চেষ্টা করলো না, জামার কলারটা ধরে কাঁধ পর্যন্ত খুলে ফেললো। এখন যেন তার বেশি জ্বালা করছে।
তুতুল সে জায়গাটা পরীক্ষা করতে করতে জিজ্ঞেস করলো, কোনো মেয়ে, না ছেলে? জামা ভেদ করে মাংসতে দাঁত বসে গেছে। কোনো মেয়ে যদি এরকম ভাবে কামড়ে দিয়ে থাকে, তাহলে আমি তোর চিকিৎসা করবো না। নিশ্চয়ই তুই কিছু বাঁদরামি করতে গিয়েছিলি!
মেয়েও না, ছেলেও না। রাস্তার একটা গুণ্ডা।
আজকাল বুঝি রাস্তার গুণ্ডাদের সঙ্গে কোলাকুলি করা হচ্ছে? একবার বাইরে থেকে ফিরে এলি ফোলা পা নিয়ে, আজ আবার এত রাত্রে…
আমাদের পার্টির ছেলেমেয়েদের ওপর ওরা হামলা করতে এসেছিল, আমাদের কোনো দোষ ছিল না, আমিও একটাকে দিয়েছি খুব ভোলাই–
রাস্তার গুণ্ডারা মানুষকে কামড়ে দেয়, এমন তো কখনো শুনিনি। গুণ্ডা না ক্যানিবাল? দাঁড়া, আমার ঘর থেকে অ্যান্টিসেপটিক লোশন নিয়ে আসি।
ফুলদি, মা যেন কিছু জানতে না পারে।
তুতুল একটু পরেই তুলল আর ওষুধ নিয়ে ফিরে এলো। স্পিরিট ভেজানো তুলোয় আগে জায়গাটা ঘষে নিল ভালো করে। তারপর ওষুধ লাগাতে লাগাতে বললো, তুলোর সঙ্গে কতখানি ময়লা উঠে এলো দ্যাখ। আজকাল ভালো করে চানও করিস না বুঝি?
আরে লাগছে, লাগছে, লাগিয়ে দিচ্ছো তুমি—
চুপ করে বসে থাক, বাচ্চাদের মতন ছটফট করলে মার লাগাবো। সামান্য একটু জ্বালা করবে।
ফুলদি, তুমি বিলেত যাচ্ছো?
তুতুলের হাতটা কেঁপে গেল। সে থেমে গিয়ে বিবর্ণ মুখে বললো, যাঃ, কী আজেবাজে কথা বলছিস বাবলু? তোকে এসব কে বললো?
আমি জানি। কালকেও তো লেটার বক্সে তোমার নামে একটা ইংল্যাণ্ডের স্ট্যাম্প মারা চিঠি ছিল।
ওদেশে আমার বন্ধু থাকতে পারে না? কেউ যদি চিঠি লেখে…
কৌশিকের দাদা অনীশদা, মেডিক্যাল কলেজে পড়ান, তুমি চেনো তো, উনি বলছিলেন, তুমি স্কলারশিপ পেতে পারো।
বাজে কথা! একদম বাজে কথা।
ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়াররা একটু ভালো রেজাল্ট করলেই বিলেত-আমেরিকায় যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়ে থাকে। ঐ সব ক্যাপিটালিস্ট দেশগুলোও এদের পাউণ্ড-ডলারের ঝুমঝুমি বাজিয়ে ডাকে। ওদের তো সুবিধে, আমাদের মতন গরিব দেশের সরকারি টাকায় ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার তৈরি হবে, ওরা তাদের ইউজ করবে।
তোদের এম-এস-সি পাশ করা ভালো ছাত্র-ছাত্রীরা বুঝি বিদেশে যায় না?
আমি তাদের মানুষ বলে গণ্য করি না। ফুলদি, তুমিও যে এদেশ ছেড়ে পালাতে চাইবে, তা আমি কল্পনাই করি নি।
তুই ভুল শুনেছিস, বাবলু। আমার যাওয়ার কোনো ইচ্ছে নেই, আমি কোনো স্কলারশিপের জন্য অ্যাপ্লাই-ও করিনি। আমি মাকে ছেড়ে, তোদের ছেড়ে কোথায় যাবো? এসব কথা মার সামনে কক্ষণো উচ্চারণ করবি না, বাবলু! কথা দে, তুই কিছু বলবি না, প্রমিস কর
সত্যি যাবে না? ঠিক আছে, আই প্রমিজ…
মানুষের দাঁতে হয়তো কোনো বিষ নেই। তুতুলের চিকিৎসার জন্যই হোক বা যে-জন্যই হোক পরদিন অতীনের কাঁধে কোনো ঘা হলো না, ব্যথাও হলো না। সকালবেলাই সে কৌশিককে নিয়ে মানিকদাকে দেখতে গেল।
মানিকদা বিছানায় শুয়ে আছেন, অনবরত কাশছেন। কথা বলতে গেলে বেশি কাশি হচ্ছে। সুবিমলদা বললেন, এটা অ্যালার্জির কাশি। প্লুরিসির পর ভালো মতন বিশ্রাম হয়নি, পুষ্টিকর খাবার খায়নি, এরকম চললে মানিকদার শরীর একেবারেই ভেঙে যাবে। ওর এখন উচিত ৬২৬
কিছুদিনের জন্য কোনো স্বাস্থ্যকর জায়গায় গিয়ে থাকা। পার্টি সংগঠন করতে গেলে শরীর মজবুত রাখা সবচেয়ে বেশি দরকার।
মানিকদার এক মামার বাড়ি জলপাইগুড়ি। সেখানে গিয়ে কিছুদিন থাকা যেতে পারে। কিন্তু এই অবস্থায় মানিকদাকে একা পাঠানো যায় না। কৌশিক আর অতীন দু’জনেরই পরীক্ষা হয়ে গেছে। এখনও রেজাল্ট বেরোয়নি, তারা মানিকদার সঙ্গে যেতে রাজি হয়ে গেল। ট্রেন ভাড়া জোগাড় করাও অবশ্য একটা সমস্যা, মানিকদার কাছেও টাকা নেই, সুবিমলদার হাতেও এখন কিছু নেই। অতীন নিজের যাওয়া আসার ভাড়া কোনোক্রমে জোগাড় করতে পারবে, কৌশিকদের অবস্থা একটু ভালো, ওদের স্টাডি সার্কেলের আর একজন সদস্য অনুপম ইচ্ছে করলে সবার টাকা দিয়ে দিতে পারে। কিন্তু তার বদলে স্টাডি সার্কেলের সব সদস্য-সদস্যাদের কাছ থেকে কিছুকিছু চাঁদা তোলাই ঠিক হলো। স্টাডি সার্কেল অবশ্য বন্ধ থাকবে না, আপাতত সুবিমলদার ঘরেই চলবে।
সুবিমলদা বললেন যে, জলপাইগুড়ির পার্টি ওয়াকাররাও মানিকদাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখবে। ওখানকার ডিস্ট্রিক্ট কমিটির একজন মেম্বারের সঙ্গে সুবিমলদার ভালো পরিচয় ছিল একসময়। খুব ভালো সংগঠক। জেলা কমিটির সেই সদস্যটির নাম চারু মজুমদার।