২.৪৮ Every man is the architect

Every man is the architect of his own fortune,
Every man is the son of his own works.

কোনও কোনও সময় বেঁচে থাকলেও মানুষের মরে যাওয়ার মতো একটা অনুভূতি হয়। বোধ, বুদ্ধি, সব লোপাট হয়ে যায়। নিজেকে মনে হয় চলমান যন্ত্রের মতো। এক ঝলকের দেখা কিন্তু কিছুতেই ভুলতে পারছি না সেই দৃশ্য। কেবলই ভাবছি, এমন একটা দেহ এমন একটা সৌন্দর্য মানুষ ধ্বংস করে কীভাবে! কী ভেবে? পাথরে-কোদা শরীর, যেন খাজুরাহোর মন্দিরগাত্র থেকে একটা মূর্তি খুলে পড়ে গেছে। চরিত্র যাই হোক, প্রকৃত সাধিকা কি না সে বিচারেও যাচ্ছি না, সুন্দরী এক মানবী, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। কোথায় যেন বিমলাদির সঙ্গে একটা সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায়। আমার চোখ পাপীর চোখ, ভোগীর চোখ। নিজেকে তিরস্কার করতে ইচ্ছে করছে।

হরিশঙ্কর পাশেই ছিলেন। ছোটদাদুকে বললেন, জীবনের আর একটা ভয়ংকর অভিজ্ঞতা হয়ে গেল। মনে হচ্ছে সহজে নিষ্কৃতি পাওয়া যাবে না। আইন বেশ আষ্টেপৃষ্ঠে জড়াবে। জেল, প্রাণদণ্ড সবই হয়ে যেতে পারে। মন্দ হবে না। আমার ধারণা, ফঁসি বেশ আরামদায়ক। গলার কাছে বেশ একটা টান পড়ে তো! শিরাটিরা বেশ ছেড়ে যায়।

ছোটদাদু সংশোধন করলেন, ছেড়ে যায় না, ছিঁড়ে যায়।

ছেঁড়ার আগে ছেড়ে যায়।

তোর কোনও দুঃখ হচ্ছে না?

কীসের দুঃখ? কার জন্যে দুঃখ? এ গ্রুপ অফ ক্রিমিন্যালস। তোদের এই ধর্মটাকে দেশ থেকে বিদায় কর।

ধর্মকে তো বিদায় করা যাবে না ভাই। ওটা মানুষের সঙ্গেই জন্মেছে। পাখি থাকলে ডিম থাকবে, ডিম থাকলে পাখি। তুই যা দেখছিস, এ হল ধর্মের ব্যভিচার। এর মধ্যে সেক্স আছে, গ্রিড আছে। ধর্ম এখানে ভেক। ধর্মের আড়ালে অনাচারের খেলা।

তোরা এইটাকে কন্ট্রোল করতে পারছিস না কেন?

কারণ ধর্মের জগতে কোনও পুলিশ নেই। তোমরা ধর্মাবতার বলে যাদের আদালতে বসিয়ে রেখেছ, তাদের এক্তিয়ারে এই অধর্মটা পড়ে না। ধর্মের আদালতের ধর্মাবতার হল মন। সত্যপথে মন করো আরোহণ প্রেমের আলো জ্বালি চলো অনুক্ষণ/ সঙ্গেতে সম্বল রেখো পুণ্যধন, গোপনে অতি যতনে ॥ লোভ মোহ আদি পথে দস্যুগণ পথিকের করে সর্বস্ব লুণ্ঠন/ পরম যতনে রাখো রে প্রহরী শম দম দুই। জনে ॥

ছোটদাদু সম্পূর্ণ ভাবস্থ হয়ে বিখ্যাত গানের লাইন বলছেন। সামান্য সুরও আছে। এমন অদ্ভুত রচনা অযোধ্যানাথ পাকড়াশীর, হরিশঙ্করও তন্ময় হয়ে গেছেন। স্বামীজির বড় প্রিয় গান। ঠাকুরকে প্রায়ই। শোনাতেন। ছোটদাদু পরের অনবদ্য লাইনক’টি বলছেন, সাধুসঙ্গ নামে আছে পান্থধাম, শ্রান্তি হলে তথায় করিও বিশ্রাম। পথভ্রান্ত হলে শুধাইও পথ, সে পান্থ-নিবাসী জনে । যদি দেখো পথে ভয়ের আকার প্রাণপণে দিয়ে দোহাই রাজার/ সে পথে রাজার প্রবল প্রতাপ, শমন ডরে যাঁর শাসনে ॥

হঠাৎ তাকিয়ে দেখি, হরিশঙ্করের দু’চোখ বেয়ে নিঃশব্দে জলের ধারা নেমেছে। এই মূর্তি আমার চেনা, ক্ষতবিক্ষত এক যোদ্ধার। জতুগৃহ দগ্ধ হয়ে যাওয়ার পর যদি জীবিত কেউ দগ্ধাবশেষ থেকে উঠে আসতে পারতেন, তার চেহারা এইরকম হত। মনের চেহারা। হরিশঙ্কর তার নিখুঁত উচ্চারণে ‘সাবিত্রী’র কয়েকটি লাইন বললেন,

Ardent from the sack of happy peaceful homes/ And gorged with slaughter, plunder, rape and fire/ They made of human selves their helpless prey/ A drove of captives led to lifelong woe.

অফিসার এগিয়ে এসে ফিসফিস করে বললেন, কেস খুব ঘোরালো। দুটো কু পাওয়া গেছে। ইদারার লাশের মুঠোয় কিছু চুল পাওয়া গেছে। ভৈরবীর মুঠোয় একটা তাবিজ। লাশের মুঠোয় মেয়েদের চুল থাকলে ব্যাপারটার একটা সহজ সমাধান হয়ে যেত। মুঠোয় পুরুষের চুল। তার মানে তৃতীয় আর একজন একসঙ্গে এই ডবল মার্ডারের জন্যে দায়ী। সে কে? গভীর জলের ব্যাপার।

হরিশঙ্কর খুব সহজ গলায় বললেন, আমাদের মধ্যে কারওকে অ্যারেস্ট করতে চান?

অফিসার অবাক হয়ে বললেন, আপনাদের অ্যারেস্ট করব কেন? আপনারা তো এই একটু আগে স্পটে এলেন। এসব কাল মাঝরাতের ঘটনা। আমাদের প্রথম সন্দেহভাজন লোক হল ভৈরবীর স্বামী।

হরিশঙ্কর বললেন, আমার বোন আশাকে সন্দেহ হয় না?

ছোটদাদু অবাক হয়ে হরিশঙ্করের মুখের দিকে তাকালেন। কত সহজে একজন মহিলাকে বিপদের দিকে ঠেলে দিচ্ছেন। হরিশঙ্কর যেন আসামি পক্ষের উকিল!

অফিসার বললেন, না, হচ্ছে না। দুর্বল মহিলার দ্বারা এ কাজ সম্ভব নয়।

সারারাত ওই দাওয়ায় শুয়ে থেকে এত বড় একটা ঘটনা টের পেল না!

তার সহজ ব্যাখ্যা, মহিলা রাতে ত্রিসীমানায় ছিলেন না।

কোথায় ছিল তা হলে?

ছোটদাদু বললেন, তুই কি আশাকে অপরাধী প্রমাণ করতে চাস?

হরিশঙ্কর সকলকে অবাক করে বললেন, মিথ্যে কথা বলবে কেন?

অফিসার বললেন, আশ্চর্য মানুষ আপনি! সত্যের জন্যে এত বড় একটা বিপদ ডেকে আনতে চাইছেন! আপনি ঠিকই বলছেন, উনি সত্য গোপন করছেন।

তারিণীবাবু বললেন, সত্যটা আমি বলছি, আশা আমার কাছে ছিল। আমি অবিবাহিত পুরুষ। জায়গাটা শহর নয় গ্রাম, হাজার কথা হবে, সেই কারণেই মিথ্যা বলেছে। আমি একটু দেখাশোনা করি বলে ইতিমধ্যেই অনেক কথা হয়েছে। সেসব আমি গ্রাহ্য করিনি। তবু একটু সাবধান হতেই হয়। আমি শিক্ষক।

হরিশঙ্কর বললেন, তার মানে কোথাও একটু পাপবোধ আছে!

ছোটদাদু সামান্য ধমকের সুরে বললেন, কী হচ্ছে হরিশঙ্কর?

হরিশঙ্কর অম্লান বদনে বললেন, সবকিছু পরিষ্কার হয়ে যাওয়া ভাল। লুকোচুরিটাই পাপ। আশা আমাদের সত্য কথাটা বললেই পারত। আমরা তো গ্রামের লোক নই। আই হেট লায়ারস দ্যান মার্ডারারস, দ্যান প্রস্টিটিউটস।

যেন বাজ পড়ল! আমরা সবাই স্তম্ভিত। তারিণীবাবুর মুখটা ভীষণ করুণ দেখাল।

অফিসার বললেন, কথা বাড়িয়ে লাভ নেই, আপনারা সোজা কলকাতায় চলে যান। দায়িত্ব আমার। এখন ট্রেন নেই। বাসে করে বর্ধমানে চলে যান। সেখান থেকে লোকাল ধরে কলকাতা। এইসব ভুলে যান। আমি আর সময় দিতে পারছি না। আমার এলাকায় খুন এই প্রথম।

সদলে আবার আমরা রাস্তায়। যথারীতি হরিশঙ্কর আবার একটা সমস্যা তৈরি করে ফেললেন, এদের জিনিসপত্তরের কী হবে? সবই তো পড়ে রইল!

ছোটদাদু বললেন, ও সবই এখন পুলিশের হেফাজতে। সুখে থাকতে ভূতের কিল খেয়ে লাভ কী?

আশার ছেলেমেয়ের স্কুল ট্রান্সফার সার্টিফিকেটের কী হবে?

সব, সব হবে। পরে হবে। ঠিক সময়ে হবে।

আবার আমাদের চলা শুরু হল। এইবার আর স্টেশনের দিকে নয়, বাসস্ট্যান্ডের দিকে। আর যেন পারা যাচ্ছে না। শরীর ভেঙে আসছে। বিমলাদি বলেছিলেন, থেকে যাও তুমি। বিদ্রোহী সন্তান হয়ে যদি রয়ে যেতুম, তা হলে অন্য এক ধরনের অভিজ্ঞতা হত। হয়তো ভেড়া হয়ে যেতুম। ভয়ও ছিল। ইদারায় না পড়ে হয়তো গলায় দড়ি দিতে হত। এখন বুঝতে পারছি, মেলায় বিমলাদি আমাকে কী করেছিলেন। যা কোনওদিন কেউ করবে না। বাসস্ট্যান্ডে এসে হরিশঙ্কর বললেন, খাওয়াদাওয়ার প্রয়োজন আছে?

সকলেই সমস্বরে বললেন, না। কারও কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না।

আমরা বাসে উঠে বসলুম। কারও মুখে কোনও কথা নেই। আমরা বেঁচে ফিরছি, না মরার জন্যে দল বেঁধে চলেছি, মনের অবস্থা দেখে বোঝার উপায় নেই। বিষণ্ণ, বিভ্রান্ত। হরিশঙ্কর পকেট থেকে ছোট্ট একটা নোটবুক বের করে মগ্ন হয়ে আছেন। আমি ঠিক তার পেছনে বসে যতটুকু দেখতে পাচ্ছি, তাইতে মনে হচ্ছে লেখা আছে উদ্ধৃতি। ছোটদাদু বসেছেন হরিশঙ্করের পাশে।

ছোটদাদু জিজ্ঞেস করছেন, কীসে ডুবে গেলি?

হরিশঙ্কর বললেন, নোটস। এতে কিছু কিছু পয়েন্টস লেখা আছে। মেডিক্যাল গাইডসের মতো, লিভিং গাইডস। প্র্যাকটিক্যাল নোটস ফর এফেক্টিভ লিভিং। কীভাবে তুমি বাঁচবে। সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার গণিত। মানুষ গাছে সার দেয়, পেটে দানাপানি দেয়, অভিভাবকহীন নিঃসঙ্গ মনকে মানুষ কী দেয়! অনাথ বালকের মতো বসে আছে ফুটপাথে। ঢোলসহরত করে মিছিল যাচ্ছে। আলোর রোশনাই দিয়ে, দেখছে। সেজেগুজে বড়মানুষের মেয়ে যাচ্ছে, দেখছে। ঝকঝকে মোটরগাড়ি যাচ্ছে, দেখছে। দুটো লোক ঝগড়া করতে করতে যাচ্ছে, দেখছে। কেউ ভুট্টা খেতে খেতে চলেছে, দেখছে। রাত হল, দেখছে। পথ নির্জন থেকে নির্জনতর হয়ে গেল। নিবে গেল দীপাবলী। বন্ধ হয়ে গেল বাহারি সব দোকান। রাতের বাতাস বহে গেল রাজপথের ছেঁড়া কাগজ উড়িয়ে। অনাথ বালক বসে আছে দেয়ালে ঠেসান দিয়ে। কেউ এসে হাত ধরে বলবে না, চলো, ওঠো, রাত হল। কেউ তাকে গরম জলে চান করাবে না, ভাল পোশাক পরিয়ে সেন্ট ছিটিয়ে দেবে না, গরম খাবার খাইয়ে নরম বিছানায় শুইয়ে দেবে না। মধ্যরাতের নির্জন পথে একা বালক। নিরাশ্রয় একটি পাখি। সেই মনের ধাত ধরতে পারে আমার এই ছোট্ট খাতা। আমি এটাকে আরও বড় করব। নাম হবে, মাই এনকাউন্টার উইথ লাইফ। জীবন পথিক।

বাস চলেছে প্রচণ্ড গতিতে। আমার পাশে জানলার ধারে আমার পিসতুতো ভাই। বাসে এখনও তেমন ভিড় হয়নি। চিৎকার চেঁচামেচি তেমন শুরু হয়নি। মানুষের কপচাকপচি। ভাইয়ের চোখ বুজে আসছে। মুখ দেখে মনের ভাব পড়া যাচ্ছে না। বাস কলকাতার দিকে যাচ্ছে, না যাচ্ছে। অনিশ্চিত এক ভবিষ্যতের দিকে! আকাশে প্যারাসুট নিয়ে ঝাঁপ মারার মতো, একমাত্র বাতাসই ভরসা।

ছোটদাদু বলছেন, তার একটা টুকরো শোনা না!

শুনবি? তা হলে শোন, সুইচ অফ সুইচ অন। কখনও তুমি থাকবে কখনও তুমি থাকবে না। মন বসাবে, মন তুলবে। উপমা পাখি। ডালে বসল, ফল ঠোকরাল, শিস দিল, পোকামাকড়ের দিকে নজর গেল, হঠাৎ উড়ে চলে গেল একসময়। মনের দেহ-যুক্তি, দেহ-বিযুক্তি। ঘটনার মধ্যে দেহ আছে, কিন্তু মন নেই। পাখি উড়তে পারে, মন কেমন করে উড়বে। ঘুড়ি ওড়ে, ঘুড়ির লেজ ওড়ে কেমন করে? ঘুড়ির সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করে। মন উড়বে ভাব আর ভাবনার লেজ ধরে। মনকে তল্লাশ দিতে হবে, যাও মন পাহাড়চুড়োয়, যাও মন সমুদ্রের ঊর্মিমালায়, যাও মন আমাজনের রনফরেস্টে। ক্ষুদ্র থেকে বিশালের দিকে ঠেলে দাও। এইটা রপ্ত করার জন্যে ছোটখাটো ব্যায়াম অভ্যাস করা যেতে পারে। যেমন বাস চলার এই শব্দে তুই কি আমার শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছিস?

ছোটদাদু বললেন, না।

আচ্ছা, এইবার চেষ্টা কর।

ছোটদাদু কিছুক্ষণ স্থির থেকে বললেন, এইবার পাচ্ছি।

কোন কায়দায় পেলে?

কিছুই না মনটাকে গুটিয়ে নিয়ে এলুম। সবকিছু থেকে সরিয়ে উৎকর্ণ হতেই শুনতে পেলুম।

ছোটদের ম্যাগাজিনে এক ধরনের ধাঁধা ছাপা হয় দেখেছিস? একটা ম্যাপের মতো, রোড ম্যাপ। একগাদা পথ। একটার ঘাড়ের ওপর দিয়ে আর একটা চলে গেছে, দুটোকে জড়িয়ে তৃতীয় আর একটা। সব পথই কিছু দূর পর্যন্ত গিয়ে আর নেই। আটকে গেছে। এর মধ্যে শেষ পর্যন্ত যাওয়ার একটা পথই খোলা আছে। সেটাকে খুঁজে নিতে হলে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি চাই, কনসেনট্রেশন চাই। পৃথিবীর জটিল আবর্ত থেকে পথ চিনে লক্ষ্যে পৌঁছোবারও সেই একই কায়দা। দৃষ্টি স্থির, মন স্থির। প্লেন থেকে নীচে তাকালে কী দেখবে? ছবির মতো পড়ে আছে জনপদ। নদী, খাল, ব্রিজ, পথ, বাড়ি, মনুমেন্ট, গির্জা, মন্দির। কোথাও কোনও জটিলতা নেই। কোনটা কোথায়, কোথায় শুরু, কোথায় শেষ, একেবারে পরিষ্কার ছবি। জীবন থেকে সরে গিয়ে জীবনের নকশা দেখে নিতে হয় মাঝে মাঝে। মনকে সরাও, মনকে ঢোকাও। ঘাড়-মুখ গুঁজড়ে সংসারে পড়ে থেকো না। সবেতেই আছি আবার কিছুতেই নেই। ইউ লিড এ লাইফ অ্যান্ড লার্ন দি আর্ট অফ লিভিং।

ছোটদাদু বেশ আগ্রহের সঙ্গে বললেন, বেশ বলেছিস তো! তোর নোটবুকে আর কী আছে?

বাস থামছে, বাস চলছে। আমার পিসতুতো ভাইয়ের মাথাটা আমার ডান কাঁধে নেমে এসেছে। গভীর ঘুমে কাদা। অন্য কোনও সহযাত্রী হলে জাগিয়ে দিয়ে বলতুম, সোজা হয়ে বসুন। এখন একটা কেমন করুণার ভাব আসছে। কী অসহায়! দুটো বোন। তাদের লেখাপড়া, বিয়ে। এই ছেলেটিকেই হতে হবে পিলার, হতে হবে ছাতা। কত রাজপথ জনপথ পেরিয়ে মরুভূমি সাগরের সীমানায় এই ছেলেটিকে যেতে হবে। তেল চিটচিটে চুল। জামার কাঁধে ছোপ পড়ে যাবে। আমার শহুরে মনের সংকীর্ণতায় নিজেকেই নিজে ধমক দিলুম। কাধটাকে আরও এগিয়ে দিলুম মাথাটা যাতে পড়ে না যায়।

হরিশঙ্কর বলছেন, মানুষ যখন বাঁচতে শেখে তখন তার জীবন শেষ হয়ে আসে। আমাদের স্কুল কলেজের আধুনিক শিক্ষা বড় একপেশে। রোজগার করতে শেখায়, সুখে বাঁচার কায়দাটা শেখায় না।

সুখে বাঁচার কায়দাটা কী?

দুঃখটাকে মেনে নেওয়ার মানসিক প্রস্তুতি। রিক্ততার মধ্যে পূর্ণতার অনুভূতি। প্রত্যাশা বর্জিত জীবন। আমাকে কেউ কিছু দেবে না, পারলে কেড়ে নেবে, পথ আর বাধা দুটোই থাকবে একসঙ্গে। কেউ আমার প্রশংসা করবে না, নিন্দাই করবে। আমাকে নিয়ে আলোচনা হবে না, হবে সমালোচনা। আমার কোনও বন্ধু থাকবে না, সকলেই শত্রু। সকলেই আমাকে ব্যবহার করবে। যারা কাছে আসবে, আসবে স্বার্থের কারণে। স্বার্থ ফুরিয়ে গেলে আর চিনতে পারবে না। আমার ভাল হলে সবাই দুঃখ পাবে, খারাপ হলে ভয়ংকর আনন্দ হবে। তোমাকে শুধু দিতে হবে, পাবে না কিছুই। পৃথিবীতে ভালবাসা নেই, আছে ঘৃণা। জীবন একটা খেলা, চালে ভুল হলেই হার। তা হলে তোকে একটা কবিতা শোনাই :

The world won’t care if you quit
And the world won’t whine if you fail;
The busy world won’t notice it,
No matter how loudly you wail.
Nobody will worry that you
Have relinquished the fight and gone down
For it’s only the things that you do
That are worth while and get your renown.
The quitters are quickly forgot;
Of them the world spends little time;
And a few e’er care that you’ve not
The courage or patience to climb.
So give up and quit in despair
And take your place back on the shelf
But don’t think the world’s going to care;
You are injuring only yourself.

কী অসাধারণ স্মৃতি হরিশঙ্করের! এই কবিতাটা আমাকে একসময় মুখস্থ করিয়েছিলেন। কোথাও এতটুকু বিস্মরণ হল না। অপূর্ব উচ্চারণ। কখনও কোনও রেফারেন্স দিতে হলে বইয়ের পাতা ওলটাতে হয় না। আমাকে একদিন কথামৃত খুলে দেখিয়েছিলেন স্মৃতির রহস্যটা কী! শ্রীরামকৃষ্ণ মহিমাচরণকে বলছেন, আর এক আছে ধৈয্যরেতা। আগে রেতঃপাত হয়েছে, কিন্তু তারপর বীর্যধারণ। বারো বছর ধৈর্যরেতা হলে বিশেষ শক্তি জন্মায়। ভিতরে একটি নতুন নাড়ি হয়, তার নাম মেধা নাড়ি। সে নাড়ি হলে সব স্মরণ থাকে– সব জানতে পারে।

হরিশঙ্কর আন্ডারলাইন করে রেখেছেন ঠাকুরের উক্তি, বীর্যপাতে বলক্ষয় হয়। স্বপ্নদোষে যা বেরিয়ে যায়, তাতে দোষ নাই। ও ভাতের গুণে হয়। ওসব বেরিয়ে গিয়েও যা থাকে, তাতেই কাজ হয়। তবু স্ত্রীসঙ্গ করা উচিত নয়। শেষে যা থাকে, তা খুব রিফাইন হয়ে থাকে। লাহাদের ওখানে গুড়ের নাগরি সব রেখেছিল, নাগরির নীচে একটি একটি ফুটো করে, তারপর এক বৎসর পর দেখলে; সব দানা বেঁধে রয়েছে। মিছরির মতো। রস যা বেরিয়ে যাবার, ফুটো দিয়ে তা বেরিয়ে গেছে।

হরিশঙ্করের স্মৃতির রহস্য এই মেধা নাড়ি। ছোটদাদুরও স্মৃতিশক্তি অসাধারণ। দুই যোগী আমার সামনের আসনে পাশাপাশি। হরিশঙ্কর তার সামনের আসনের জানলার ধারের ভদ্রলোককে বললেন, চলন্ত বাসে অনবরত ওইভাবে থুতু ফেললে পেছনে যারা বসে আছে তাদের গায়ে লাগে।

ভদ্রলোক গম্ভীর গলায় বললেন, কোথায় ফেলব? নিজের কোলে?

হরিশঙ্কর বললেন, তখন থেকে অত থুতু ফেলছেন কেন? আপনার মনে হয় কৃমি হয়েছে। ভাল ওষুধ আছে হোমিওপ্যাথিতে, সিনা থার্টি।

ভদ্রলোক বললেন, আপনাকে আমার ডাক্তারি করতে বলিনি। চুপচাপ বসুন।

হরিশঙ্কর মৃদু হাসলেন। জামার বুকপকেট থেকে এক টুকরো কাগজ বের করে একটা কোণ ছিঁড়ে গোল করে পাকিয়ে নিজের নাকে ঢুকিয়ে সুড়সুড়ি দিতে লাগলেন। এইবার যা হবে আমি জানি। ভয়ে সিঁটিয়ে রইলুম। নির্ঘাত মারামারি। হরিশঙ্কর বরদাস্ত করেন না অসভ্যতা। বিশাল একটা হাঁচি একেবারে ভদ্রলোকের ঘাড় তাক করে। আপ্লুত করার মতো নিখুঁত একটি হাঁচি। বম্ব-ব্লাস্টের মতো।

ভদ্রলোক ঘাড় ঘুরিয়ে বললেন, এ কী অসভ্যতা?
হরিশঙ্করও বললেন, এ কী অসভ্যতা!
ভদ্রলোক বললেন, গায়ে লাগছে না?
হরিশঙ্কর বললেন, গায়ে লাগছে না?
ভদ্রলোক বললেন, আশ্চর্য।
হরিশঙ্কর বললেন, আশ্চর্য!
ভদ্রলোক বললেন, অদ্ভুত।
হরিশঙ্কর বললেন, অদ্ভুত। যেন আয়নায় বিম্ব আর প্রতিবিম্ব। বাস ছুটছে হইহই করে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *