2 of 3

২.৪৮ বড় তেঁতুল গাছ

এত বড় তেঁতুল গাছ বড় একটা দেখা যায় না। এদিককার ঝোঁপ-জঙ্গল অনেকটাই সাফ হয়ে গেছে, কিন্তু তেঁতুল গাছটার গায়ে কেউ কুড়ুল ছোঁয়ায়নি। এই গাছে প্রচুর কাক-চিলের বাসা, এই গাছের নিচে ছায়া অনেকখানি।

এই তেঁতুল গাছটাকে হারীত মণ্ডলের খুব চেনা লাগে, খুব আপন মনে হয়। ঘরের দাওয়ায় বসে সে এক এক সময় এক দৃষ্টিতে তেঁতুল গাছটার দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর দু’হাত। জুড়ে কপালে ঠেকিয়ে চোখ বুজে বলে ওঠে, জয় জয় গুরু, জয় বাবা কালাচাঁদ!

এক শো পনেরো ডিগ্রি গরমে শুকিয়ে ঝাঁঝরা হয়ে গেছে মাটি। পূর্ব বাংলায় একটা চলতি কথা ছিল ফুটি ফাটা, এখানকার ভূমি অবিকল ফুটিফাটারই মতন। এই গরমে পোকা মাকড়রাও গর্ত ছেড়ে বেরুতে চায় না। তবু মানুষকে বেরুতে হয়। তাদের কারুর কারুর মাথায় খেজুর পাতার টোকা। হারীত মণ্ডলকে বসে থাকতে দেখলে তারাও বলে ওঠে, জয় জয় গুরু! জয় বাবা কালাচাঁদ!

এই সুভাষ কলোনির অনেকেই এখন সাধক গুরু কালাচাঁদের ভক্ত। যদিও কালাচাঁদকে তারা কেউ চোখে দেখেনি। একমাত্র হারীত মণ্ডলই তাঁকে দেখেছে, তাও স্বপ্নে। বছর খানেক আগে হারীতের প্রথম এই স্বপ্ন দর্শন হয়। সেই সময়টাও ছিল বৈশাখ মাস, শুধু দিনের বেলা নয়, রাতেও এত গরম যে মনে হয় সূর্য অস্ত যায়নি, জঙ্গলের আড়ালে কোথাও লুকিয়ে আছে। সেই বৈশাখের এক শেষ রাতে এক জটাজুটধারী মহাপুরুষ হারীত মণ্ডলের কুটিরে আবির্ভূত হয়েছিলেন। বেদব্যাস মুনির মতন তাঁর দাড়ি ছাড়িয়ে গেছে তাঁর নাভি, তাঁর মাথায় গঙ্গাধর শিবের মতন জটা, তাঁর চক্ষু দুটি কিন্তু বড় কোমল, পদ্ম-পলাশ বর্ণ শ্রীরামচন্দ্রের মতন। মনে হয় তাঁর বয়েসের গাছ-পাথর নেই। তিনি শান্ত অথচ গম্ভীর কণ্ঠে বলেছিলেন, ওরে হারীত, আমারে চেনোস না? তোর বাপ কৈলাশ, তার বাপ আছিল ধরণীধর, তারে আমি দীক্ষা দিছিলাম। তোগো জইন্যে আমার মন এখনও কান্দে রে, বাপধন।

স্বপ্ন ভাঙার পর হারীত সর্বাঙ্গে ঘাম নিয়ে ধড়মড় করে উঠে বসেছিল। বেশ কিছুক্ষণ তার ঘোর ভাঙেনি, যেন বোধ হচ্ছিল, সেই তেজঃপুঞ্জ মহাপুরুষ তার ঘরে সশরীরেই উপস্থিত হয়েছিলেন। আস্তে আস্তে হারীতের মনে পড়েছিল যে তাঁর ঠাকুর্দা যশোরের বিখ্যাত তন্ত্র সাধক কালাচাঁদ বাবার শিষ্য হয়েছিলেন বটে। সে তো বহুকাল আগেকার কথা!

এই স্বপ্নের কথা হারীত তার স্ত্রী পারুলবালা এবং তারই সমবয়েসী যশোদাদুলাল ছাড়া আর কারুকে বলেনি। কিন্তু যেহেতু এই কলোনির নিস্তরঙ্গ জীবনে প্রায় কোনো ঘটনাই ঘটে না, তাই এরকম একটা ব্যাপারও পাঁচ কান হতে দেরি হয় না।

দশদিন বাদে আবার হারীতের সেই একই স্বপ্নদর্শন হলো। এবার সেই সাধক কালাচাঁদ হারীতের সঙ্গে অনেক কথা বললেন, তার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কথাটি হলো এই যে, শিগগিরই হারীত এবং তার মতন অন্যসব উদ্বাস্তুদের দুঃখ ঘুচে যাবে, সুদিন আসবে। তিনি স্বয়ং এসে সেই সুদিনের সন্ধিক্ষণটি জানিয়ে যাবেন।

এই দ্বিতীয় দৈববাণীর ঘটনায় হারীত এত উত্তেজিত হয়ে পড়ে যে বিছানা থেকে উঠতে গিয়ে সে চৈতন্য হারিয়ে ফেলে টলে পড়ে যায় এবং তারপর সাতদিন প্রবলজ্বরে ভোগে। জ্বরের ঘোরে প্রলাপের মধ্যে সে শুধু ওই স্বপ্নের কথাই বলতে থাকে।

সুদিনের আশ্বাস যেন বাতাসে আগুনের মতন ছড়িয়ে যায়। শুধু সুভাষ কলোনি নয়, আশ পাশের আরও আট দশটা কলোনির মানুষ ছুটে আসে হারীতের সেই প্রলাপ শোনার জন্য।

তারপর থেকেই হারীত এখানকার অনেকের গুরু। পুলিশের মারের ভয়ে হারীত আর উদ্বাস্তুদের নেতা হতে চায় না, গুরুও হতে চায় না, কিন্তু সে সাধক কালাচাঁদের বকলমে গুরু। আগে হারীতের কথা পরামর্শ শুনে অনেকে তর্ক করতো, প্রতিবাদ করতো, কিন্তু এখন মাত্র দু’চারজন ছেলে ছোঁকরা ছাড়া আর সবার কাছে হারীতের প্রতিটি কথাই যেন বেদবাক্য।

হারীত নিজে প্রায়ই সেই স্বপ্নের কথা ভাবে। স্বপ্ন কখনো সত্যি হয়! কিন্তু এরকম অদ্ভুত স্বপ্ন সে দেখলোই বা কেন? স্বপ্নে সে তন্ত্রসাধক কালাচাঁদকে দেখেছে এর মধ্যে কোনো ভুল নেই, তিনি সুদিন আসার কথাও বলেছেন, কিন্তু কী করে তিনি বললেন? যশোরের কালাচাঁদ স্বামী কি এতদিন বেঁচে থাকতে পারেন? সে যে অসম্ভব। হারীত মিথ্যে কথা বলে তার কাছের মানুষদের ধোঁকা দিতে চায় না, কিন্তু সে যে এই প্রকার স্বপ্ন দেখেছে, তা তো মিথ্যে নয়!

দিনের বেলা ঝাঁকড়া তেঁতুল গাছটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হারীতের এক এক সময় মনে হয়, এই গাছটার সঙ্গে যেন মহাপুরুষ কালাচাঁদের কোথায় মিল আছে। ঠিক কী রকম, যে মিল তা সে বলতে পারবে না।

এখানে খবরের কাগজ আসে না। রেডিও নেই। রিলিফ অফিসের বাবুদের কাছ থেকে মাঝে মাঝে বাইরের পৃথিবীর কিছু কিছু খবরাখবর পাওয়া যায়। তা ছাড়া গুজবের জন্ম হতে বাধা নেই। গত বছর হারীত তার পূর্ব পুরুষের গুরুদেবকে স্বপ্ন দেখার কিছুদিন পরেই খবর এলো যে ইণ্ডিয়া ও পাকিস্তানে সাঙ্ঘাতিক যুদ্ধ বেধে গেছে। সঙ্গে সঙ্গে সুভাষ কলোনির সব মানুষ দারুণ উত্তেজিত হয়ে উঠলো, চতুর্দিকে রটে গেল যে এইবার ইণ্ডিয়া পাকিস্তান আবার এক হয়ে যাবে! ইণ্ডিয়াতে গান্ধী-প্যাটেল-নেহরু কেউ বেঁচে নেই, পাকিস্তানে জিন্না-লিয়াকত-সোহরাওয়ার্দিরা কেউ নেই। যারা দেশ ভাগ করেছিল তারা সব মৃত, তবে এখন দুটো আলাদা দেশকে কে সামলাবে? লালবাহাদুর শাস্ত্রী বা আইয়ুব খাঁর নাম উদ্বাস্তুরা আগে কখনো শোনেনি, তারা ধারণা করে নিল, এরা অতি শিশু! সবাই ভিড় করে এল হারীত মণ্ডলের কাছে। তা হলে সুদিন এসে গেল?

হারীত মণ্ডল তাদের অযথা স্তোকবাক্য দিতে পারলো না। স্বপ্নদৃষ্ট মহাপুরুষ তাঁকে সুদিনের সন্ধিক্ষণের কথা জানিয়ে দেবেন বলেছিলেন, কিন্তু তিনি এর মধ্যে আর স্বপ্নে আসেন নি। হারীতের নিজেরও ভ্যাবাচ্যাকা খাবার মতন অবস্থা।

যুদ্ধ শেষ হয়ে যাবার খবরও এক সময় এই কলোনির মানুষের কানে এলো। কিন্তু সুদিন এলো না। বরং প্রতিদিনের জীবনযাত্রা আরও কঠিন। রিলিফ অফিসের বাবুদের কেমন যেন আলগা আলগা ভাব। জওহরলাল নেহরুর মেয়ে ইন্দিরা গান্ধী দিল্লির সিংহাসনে বসেছেন, কিন্তু তিনি উদ্বাস্তুদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে এ পর্যন্ত একটা কথাও বলেননি।

হারীত মণ্ডল আরও দু’বার গুরু কালাচাঁদ সাধককে স্বপ্নে দেখেছে, তিনি কী যেন বলতেও চেয়েছেন, হারীত কিছুই বুঝতে পারে নি। হারীতের কানে যেন তখন তালা লেগে যাবার মতন অবস্থা। দু’বারই ঘুম থেকে জাগার পর হারীত ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেছিল অনেকক্ষণ।

পারুলবালার উপদেশ অগ্রাহ্য করেও হারীত তেঁতুল গাছতলায় মিটিং ডেকে সবাইকে জানিয়েছিল যে সে স্বপ্নে গুরুদেবকে আবার দেখলেও তিনি তাতে কোনো নির্দেশ দেননি বা দিলেও সে বুঝতে পারে নি। সুদিনের সংকেতের জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনো গতি নেই।

এই সরল স্বীকারোক্তিতে হারতের জনপ্রিয়তা কমে যাবার বদলে বেড়েছে।

হারীতের পরিবারটি এখন ছোট। কুরুদ শিবির ছাড়ার সময় তার মেয়ে গীতা আর তার জামাই মাধব বিদ্রোহ জানিয়ে উড়িষ্যার কটকের দিকে চলে যায়। তাদের সঙ্গে ছোট একটি দলও গিয়েছিল। তাদের কয়েকজন পুলিশের গুলিতে মরেছে, অনেকে ছন্নছাড়া হয়ে গেছে। কিন্তু গীতা আর মাধবের খবর পাওয়া গেছে অনেকদিন পর। মাধব খুদারোড স্টেশনে কুলিগিরি করে এবং এক বস্তিতে বাড়ি ভাড়া নিয়ে উদ্বাস্তু পরিচয় ঘুচিয়েছে। এর মধ্যে গীতা একদিন দেখা করতে এসেছিল হারীত ও পারুলবালার সঙ্গে, খুদা রোডে চলে এলে যে বাবা-মায়েরও একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে, সে প্রলোভনও সে দেখিয়েছিল, কিন্তু হারীত হেসে উড়িয়ে দিয়েছে সে প্রস্তাব। কলোনির অন্য লোকজনদের ছেড়ে তার চলে যাওয়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। অগত্যা গীতা তার ছোট ভাইকে নিয়ে গেছে নিজের কাছে। সে-ও ভবিষ্যতে খুদা রোডের কুলি হবে কিংবা রিক্সা চালাবে, এরকম আশা করা যায়।

হারীতের পালিতা কন্যা গোলাপী আর তার ছেলে নবা রয়ে গেছে তাদের পরিবারে। নবা পারুলবালার বেশ ন্যাওটা, নিজের মাকে সে বলে দিদি আর পারুলবালাকে বলে মা। পারুলবালার ধারণা, নবার চেহারা ও স্বভাব চরিত্র যেন অবিকল তাঁর প্রথম সন্তান ভুলু অর্থাৎ সুচরিতের মতন। অল্প বয়েসে ভুলুও এরকম দুরন্ত ছিল।

ভুলুর কথা মনে পড়লে পারুলবালা এখনো মাঝে মাঝে চোখের জল ফেলেন। তাঁর ধারণা, লেখা পড়া শিখে ভুলু একদিন জজ-ম্যাজিষ্ট্রেট হবে, কিন্তু সে কি তার বাবা-মায়ের কথা ভুলে যাবে? যে সন্তান বাবা মায়ের কথা মনে রাখে না, তাকে লেখা পড়া শিখিয়ে লাভ কী? বরং জমি চাষ করলে সে সংসারের কিছু সাহায্য করতে পারতো!

হারীত মণ্ডলও সুচরিতের কথা প্রায়ই ভাবে বটে কিন্তু স্ত্রীর মতন উতলা হয় না। সুচরিতের কাছে কয়েকখানা চিঠি লিখেও উত্তর পাওয়া যায়নি। চন্দ্রা নামের সেই উগ্র সমাজসেবিকাটি অবশ্য হারীতকে বলেই দিয়েছিলেন, আপনি যখন চলেই যাচ্ছেন, পশ্চিম বাংলায় থেকে লড়ে যাবার মতন মনের জোর আপনার নেই, তখন আর পিছুটান রাখবেন না। আপনি যদি নিজেদের দুঃখ দুর্দশার ঘ্যানঘ্যানানি জানিয়ে ছেলেকে বারবার বিরক্ত করেন তা হলে ওর লেখা পড়া হবে না। ছেলেকে আমার হাতে দিয়ে যাচ্ছেন, নিশ্চিন্ত মনে চলে যান। এইটুকু শুধু মনে রাখবেন। আপনাদের যাই-ই হোক না কেন, আপনাদের ছেলে ঠিক দাঁড়িয়ে যাবে!

হারীত মণ্ডল ভাবে, সুচরিত লেখা পড়া শেষ করুক, দাঁড়িয়ে যাক, সমাজের একজন বিশিষ্ট মানুষ হিসেবে গণ্য হোক। তারপর ভাগ্যে যদি থাকে, ছেলের সঙ্গে একদিন না একদিন দেখা হবেই। যদি না-ও হয়, তাদের একজন বংশধর অন্তত এদেশে সসম্মানে বসবাস করুক।

একটা আশ্চর্য ব্যাপার এই যে, চন্দ্রা নামের মহিলাটি অযাচিতভাবে হারীতদের এত উপকার করলেও তার মুখ হারীতের এখন ভালো করে মনে পড়ে না। তাঁর ঠিকানা লেখা কাগজটাও কোথায় হারিয়ে গেছে। বরং মনে পড়ে তালতলার সুলেখার কথা। মনে পড়া মাত্রই যেন হারীতের বুকের ভেতরটা আলোকিত হয়ে যায়। অত নরম, অত সুন্দর কি কোনো মানুষ হয়? সমস্ত দুঃখ-দুর্দশার মধ্যেও ঐ একটি মুখের ছবি যেন সব আক্ষেপ ভুলিয়ে দিতে পারে। এক এক দিন কোণ্ডাগাঁওতে গিয়ে বিভিন্নমুখী বাস দেখে হারীতের তীব্র ইচ্ছে হয়, একবার একটা রায়পুরগামী বাসে চড়ে বসলে হয় না, সেখান থেকে কলকাতা গিয়ে একবার শুধু সুলেখাকে দেখে আসার জন্য।

গোলাপীর ছেলে নবা খুব দুরন্ত হলেও তাকে সামলানো যায়, কিন্তু গোলাপীকে নিয়েই এখনও কিছু কিছু সমস্যা আছে। গোলাপীর অতীত ইতিহাস অনেকেই ভোলেনি। যৌন কাহিনী সব সময়ই মুখরোচক। গোলাপীর বিয়ে হয়নি তবু তার একটি সন্তান আছে, সুতরাং গোলাপী নিজেই একটি সশরীর গল্প। হারীত অবশ্য পশ্চিমবাংলা ছাড়বার পর সবাইকে বারবার বলেছে যে অরক্ষণীয়া হবার পর গোলাপীর সঙ্গে একটি কলাগাছের বিয়ে দেওয়া হয়েছে, কিন্তু কলাগাছের রক্ত মাংসের পিতৃত্বের কথা এই কলিযুগে কেউ বিশ্বাস করতে চায় না।

গোলাপীর এখন পূর্ণ যৌবন, এই অভাগিনী মেয়েটা না খেয়ে না দেয়েও কী করে যে শরীরটা এত সুঠাম রেখেছে কে জানে! সন্তান সমেত গোলাপীকে কোনো দোজবরে পুরুষও বিয়ে করতে চায় না। তবু অনেকেই তার চার পাশে ঘুরঘুর করে। হারীত নিজে চাষবাসের কাজ করে না, গোলাপীই মাঠে যায়, সুতরাং তাকে একা পাওয়ার সুবিধে আছে। দিন দুপুরে কেউ কেউ গোলাপীর কাছে কুপ্রস্তাব করে। স্বামী নেই এমন বেওয়া স্ত্রীলোককে সবাই মনে করে সহজলভ্যা। একবার যে অসতী হয়েছে তার বেশ্যা হতে দোষ কী?

কলোনির তিন জন মানুষের প্রতি হারীত তীক্ষ্ণ নজর রেখেছে। এরাই গোলাপীকে নষ্ট করার জন্য দিন দিন দুঃসাহসী হয়ে উঠছে। এদের শাস্তি দেওয়া হারীতের পক্ষে খুব সহজ। সে নিজে অধিকার ফলাতে চায় না, কিন্তু সে জানে যে তার মুখের কথাই এখানে আইন। সে সামান্য ইঙ্গিত করলে দুশো-তিনশোজন লোক ঐ তিনজনের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। তবু হারীত প্রকাশ্যে ওদের কিছু বলে না।

হারীতের বেশি চিন্তা গোলাপীকে নিয়েই। হতভাগিনীর একবার ঠকেও শিক্ষা হয়নি। একবার সে মরতে বসেছিল, মরতে চেয়েও ছিল, কিন্তু তারপর কয়েকটা বছর কেটে যাবার পর সুস্থ শরীর নিয়ে এখন শরীরের সবকটা দাবিই মেটাতে চায়। হারীত লক্ষ করেছে, বাড়ির মধ্যে শান্ত, নম্র হয়ে থাকলেও গোলাপী যখন বাড়ির বাইরে যায়, তখন চোখ মুখ ঘুরিয়ে কথা বলে, তার ঠোঁটে ফুটে ওঠে পাতলা হাসি। অথচ গোলাপীকে বাড়ির মধ্যে সর্বক্ষণ তো আটকে রাখাও যায় না। গোলাপীই এই সংসার চালায়। হারীত মণ্ডল রিলিফের খাদ্য পাবার জন্য অফিসের সামনে লাইন দিতে পারে না, তার ভক্তরাই তাকে নিষেধ করেছে, দরকার হলে তারা প্রত্যেকের ভাগ থেকে এক মুষ্টি দেবে। সুতরাং গোলাপীকেই যেতে হয় প্রতি সপ্তাহে।

গোলাপীর মধ্যে মাতৃত্বের ভাবও বেশ কম। অবাঞ্ছিত সন্তানের জন্ম দিয়েছে সে। সেই সন্তানের প্রতি তার মায়া পড়েনি। প্রায় জন্মের পর থেকেই তার ছেলেটা পারুলবালার কোলে আশ্রয় পেয়েছে, কিছুতেই সে গোলাপীকে মা বলে ডাকে না। হারীত ভাবে, গোলাপীকে যদি কেউ বিয়ে করতে চাইতো, তা হলে নবাকে নিয়ে কোনো সমস্যা ছিল না, সে থেকে যেত পারুলবালার কাছে। কিন্তু কে বিয়ে করবে গোলাপীকে?

একদিন হারীত কলোনির বাইরে বড় রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে যোগানন্দ নামে একটি ছেলেকে হাতছানি দিয়ে ডাকলো, তারপর তার কাঁধে হাত দিয়ে হাঁটতে লাগলো উল্টো দিকে।

এদিকে এখনো ছাড়া ছাড়া জঙ্গল রয়ে গেছে, দূরে দেখা যায় কয়েকটি টিলা। দণ্ডকারণ্য শুনে যে ভয়াবহ জঙ্গলের কথা মনে আসে, তেমন গভীর জঙ্গল এদিকে ওরা দেখেনি। কোরাপুট জেলার সোনাগড়ায় ওরা মাত্র তিনমাস ছিল, সেখানে সাংঘাতিক জলকষ্ট, বরং এখানে চলে এসে অনেকটা স্বস্তি পেয়েছে।

গাড়ি গাড়ি ইট-সিমেন্ট আসছে, একটু দূরেই তৈরি হচ্ছে বড় একটা সরকারি অফিস। গত মাসে একটা ইস্কুলও খোলা হয়েছে। মনে হয় এদিককার কলোনিগুলো পাকা হয়ে গেল, আর কোথাও যেতে হবে না ওদের।

গরমে রাস্তা এমন তেতে গেছে যে পা রাখা যায় না। এ বছর এদিকে একদিনও বৃষ্টি হয়নি। চৈত্র মাসটা শুধু ঝড়ের ওপর দিয়ে গেল, কিন্তু সেই ঝোড়ো বাতাস কোনো মেঘ উড়িয়ে আনলো না। সবাই চাষের জন্য তৈরি হয়ে বসে আছে, বৃষ্টির অপেক্ষায়। সেচের কোনো ব্যবস্থা নেই, কাছাকাছি নদী-নালা নেই, বৃষ্টিই একমাত্র ভরসা।

যোগানন্দকে নিয়ে হারীত রাস্তা ছেড়ে জঙ্গলের মধ্যে ঢুকলো। অধিকাংশ গাছের পাতা শুকিয়ে কালচে হয়ে গেছে। গাছের ছায়াতেও যেন শান্তি নেই, হাওয়ায় যেন আগুনের হল্কা। মাঝে মাঝে বড় বড় পাথরের চাং পড়ে আছে, সেগুলো স্পর্শ করার উপায় নেই। খানিকটা ঝোঁপ মতন জায়গা বেছে নিয়ে বসবার আগে, হারীত ভালো করে দেখে নিল সাপখোপ আছে কিনা। এদিকে বড় সাপের উৎপাত।

বসে পড়ে হারীত কাঁধের গামছা দিয়ে মুখ মুছলো, দাড়ি কামানো ছেড়ে দিয়েছে হারীত, মাথার চুলও ছাঁটে না, তার শীর্ণ লম্বা শরীরটা সাধু সাধুই দেখায় আজকাল। শুধু একটা ধুতি পরা, এই গরমে গেঞ্জি গায়ে দেবারও প্রশ্ন ওঠে না।

যোগানন্দর মুখখানা শুকিয়ে গেছে। হারীত তাকে একা ডেকে এনেছে বলেই বিপদের আশঙ্কা করেছে সে। কলোনির দু’তিনজন মানুষ দেখেছে তাকে হারীতের সঙ্গে যেতে। এতক্ষণ হারীত তার সঙ্গে একটা কথাও বলেনি।

হারীত যোগানন্দর চোখের দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে রইলো। সে দৃষ্টি সহ্য করতে পারে না যোগানন্দ, সে মুখ নিচু করে। হারীত তার থুতনিটা ধরে তুলে বললো, চেয়ে থাক আমার দিকে।

যোগানন্দর সবাঙ্গ কেঁপে উঠলো, সে হারীতের পায়ের ওপর আছড়ে পড়ে বললো, বড়কত্তা, আমারে ক্ষমা করেন!

হারীত যোগানন্দের রুক্ষ চুলে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো স্নেহের সঙ্গে। নরম গলায় বললো, ওঠ, আমার কথা শোন।

যোগানন্দ আবার সোজা হয়ে বসার পর হারীত তার কাঁধে হাত রেখে বন্ধুর মতন বললো, যোগা, তুই আমার মাইয়া গোলাপীরে খুব পছন্দ করোস, তাই না?

যোগানন্দ বিস্ফারিত ভাবে চেয়ে রইলোহারীতের দিকে। কোনো কথা বলতে পারলো না। হারীত মৃদু হেসে আবার বললো, আমি বুঝি রে, বুঝি! জুয়ান বয়স, রক্ত চনমন করে, তোর মতন বয়স কি আমার ছিল না? তা শোন, যোগা, তোর যখন গোলাপীরে অ্যাতই মনে ধরছে, তুই অরে বিয়া কইরা ফ্যালা! আমি সব ব্যবস্থা কইরা দিমু।

বেশ স্বাস্থ্যবান পুরুষ এই যোগানন্দ, কিছুদিন আগেই সে দা দিয়ে কুপিয়ে একটা ভাল্লুক মেরেছে, সরকারি অফিসের বাবুদের সঙ্গে সে চোটপাট করে কথা বলে, সেই যোগানন্দেরও চোখ ছলছলিয়ে এলো, হারীতের এই কথা শুনে, কম্পিত গলায় সে বললো, বড় কত্তা, আর কোনোদিন আমি ক্ষমা করেন, ক্ষমা করেন, আমার ঘরে বউ আছে।

–জানি, জানি, তোর বউ আছে। সেই বউটারে গলা টিপা মাইরা ফালা। তুই ভাল্লুক মারছোস, একখান মাইয়া মানুষরে মারতে কী লাগে? বউটার ঘেটি ভাইংগা পুড়াইয়া ঝুড়াইয়া দে, তারপরে গোলাপীরে বিয়া কইরা তুই সুখে ঘর কর।

গোঁয়ার হলেও যোগানন্দর এইটুকু অন্তত বোঝার ক্ষমতা আছে যে হারীতের এই সব কথাই মারাত্মক ধরনের ঠাট্টা। হারীত কখনো সোজাসুজি কথা বলে না। সে আবার হারীতের পা ধরলো।

–আমারে কী শাস্তি দেবেন কন্, আমি আপনের পা ছুঁইয়া কিরা করতেছি, আর কোনোদিন আমি গোলাপীরে… আমি তারে নিজের বুইনের মতন দ্যাখবো।

আস্তে আস্তে মাথা দোলাতে লাগলো হারীত। সামনের শিমূল গাছটায় একটা কাক শুকনো, খরখরে গলায় অবিশ্রান্ত ডেকে যাচ্ছে। সেটার দিকে তাকিয়ে হারীত বললো, অত সহজ না রে! একবার কোনো মাইয়া মানুষের জইন্য প্রলোভন হইলে তারে আর মা বুইন ভাবে দেখা যায় না। মানুষের মনটারে কি লাগাম পরানো যায়? তোরে আমি দোষ দেই না, যোগা! নিমাই আর হারানরেও দোষ দেই না, আমি তো জানি, আমার মাইয়ারও দোষ আছে। সে তোগো টানে। বুঝি, আমি সবই, কিন্তু কী করি ক তো? মাইয়াডারে তো ফেলাইয়া দিতে পারি না।

যোগানন্দ আবার কোনো শপথ করতে যাচ্ছিল, তাকে থামিয়ে দিয়ে হারীত বলতে লাগলো, এক মাইয়া নষ্ট হইলে অনেকগুলান ঘর ভাঙে। সমাজে পোকা লাগে। দ্যাখ, দ্যাশ-ঘর ছাইড়া আইছি কিন্তু জাইত ধরম তো ছাড়ি নাই। চোখের সামনে কিছু ঘটলে সহ্য করি ক্যামনে? আবার গোলাপীর কষ্টটাও বুঝি! তুই এক কাম কর যোগা, তুই গোলাপীরে নিয়া পলাইয়া যা! রায়পুরে যা, বড় শহর, সেখানে একটা কাজ-কাম জুটাইতে পারবি না?

–অমন কথা আমারে বলবেন না বড় কত্তা! আমি বাপ-মায়ের নাম লইয়া কই, আর কোনোদিন আমি গোলাপীরে অইন্য চক্ষে দ্যাখলে আমার চক্ষু যেন ক্ষইয়া যায়… আমি ওরে পাহারা দিমু, যাতে অইন্য কেউ… আমি নিমাই আর হারানরেও কইয়া দিমু… বড় কত্তা, আপনে একটা কথা বোধহয় জানেন না, রিলিফ অফিসের সুধীর দাস, তার সাথে গোলাপীর হঠাৎ দপ করে জ্বলে উঠে হারীত বললো, কে? কী বললি?

যোগানন্দ কাচুমাচু হয়ে জানালো যে রিলিফ অফিসের একজন ক্লার্ক সুধীর দাস, তার সঙ্গে গোলাপী গোপনে গোপনে দেখা করে, সেই লোকটির মতলব ভালো নয়, যোগানন্দ আর হারান দু জনে মিলে গোলাপীকে এই ব্যাপার নিয়ে একদিন সাবধান করতে গিয়েছিল…

হারীত দাঁতে দাঁত চেপে বললো, তারে আমি বলি দেবো! তার গায়ের চামড়া ছুলে লবন ছিটাবো! আমাগো কলোনির কেউ যদি বান্দরামি করে তারে আমি ক্ষমা করতে পারি, কিন্তু কোনো ভদ্দরলাকের ছাওয়াল যদি আমার মাইয়ার গায় হাত-ছোঁয়ায়, তারে আমি ছাড়বো না। তারে খুন কইরা আমি ফাঁসি যাবো!

যোগানন্দর সঙ্গে আরও কিছুক্ষণ কথা বলে হারীত বুঝলো যে তার নজরের আড়ালেও অনেক কিছু ঘটে যায়। সুধীর দাসের ব্যাপারটা সে জানতোই না কিন্তু সম্পর্কটা অনেকদূর গড়িয়েছে। গোলাপীও যোগানন্দ-নিতাইদের বিশেষ পাত্তা দেয় না, তার ঝোঁকও ঐ সুধীর দাসের দিকে। সুধীর দাস বিবাহিত কিনা জানা যায় না, এখানে সে একা থাকে।

যোগানন্দ আরও বললো যে, একদিন ওদের দু’জনকে হাতে নাতে ধরে ফেলে তারপর ওদের জোর করে বিয়ে দিলে কেমন হয়?

হারীত রাগের সঙ্গে সে প্রস্তাবটা উড়িয়ে দিল। জোর করে বিয়ে দিলে বাড়িতে নিয়ে গিয়ে দাসী করে রাখবে কিংবা দু’চারদিন পরে দূর দূর করে তাড়িয়ে দেবে। হারীত ওদের আর একদিনও প্রশ্রয় দিতে চায় না। আজই সে সুধীর দাসের সঙ্গে কথা বলতে চায়।

উঠে দাঁড়িয়ে সে যোগানন্দের চুলের মুঠি চেপে ধরে বললো, তুই যদি আমারে মিছা কথা বলিস, তাইলে তুই প্রাণে বাঁচবি না!

যোগানন্দ বললো, বড় কত্তা, আপনে যদি আমারে মারেন, তাতে দুঃখ নাই, কিন্তু আপনে আমারে ঘেন্না করলে তা সহ্য করতে পারুম না।

–চল, এখনই চল।

দু’জনে বেরিয়ে এলো জঙ্গল থেকে। দুপুর এখন খুব গাঢ়, এই সময় রিলিফ অফিসে জন-মনুষ্য থাকবে না জানা কথা, তবু দু’জনে হাঁটতে হাঁটতে গেল সেই পর্যন্ত। সরকারি কর্মচারিদের মেস খানিকটা দূরে, সেই পর্যন্ত যাবে কিনা তাও একবার ভাবলো হারীত। যোগানন্দ ভুলিয়ে ভালিয়ে তাকে নিরস্ত করলো।

হারীতের মাথার মধ্যে কষ্ট হচ্ছে। সুধীর দাসকে যদি গোলাপীই আকৃষ্ট করে থাকে, তাহলে শাস্তি তো আগে গোলাপীরই প্রাপ্য। কিন্তু গোলাপীর ব্যাপারে যেন হারীত অন্ধ। কুপার্স ক্যাম্পে সেই ঘটনার সময় হারীত সক্কলের বিরুদ্ধে গোলাপীর পক্ষ নিয়েছিল। সকলেই মনে করেছিল, গোলাপীই পাপীয়সী, পুরুষরা পুরুষদের দোষ দেখে না।

চোখ বুজে হারীত মহাপুরুষ কালাচাঁদকে স্মরণ করলো। তিনি যদি এই সময় কোনো নির্দেশ দিতেন! অনেকদিন তিনি স্বপ্নে দেখা দেন না, হারীতের জীবনটা শূন্য বোধ হয়।

কলোনির মধ্য থেকে একটা গোলমাল শোনা গেল। স্ত্রী কণ্ঠের চিৎকারই বেশি। গরমে তিতিবিরক্ত হয়ে এখানকার স্ত্রীলোকেরা এমনিতেই মাঝে মাঝে ঝগড়া শুরু করে দেয়, ওতে গুরুত্ব দেবার কিছু নেই, কিন্তু আজকের চ্যাঁচামেচির মধ্যে যেন খানিকটা আর্তনাদের সুর আছে।

হারীত জোরে পা চালালো।

একটা ভিড় জমেছে তেঁতুল গাছটার নিচে। হারীত প্রথমেই দেখলো গোলাপীকে, তার মুখখানা যেন এখন অন্যরকম মনে হলো। তার ছেলে নবা কাঁচা তেঁতুল পাড়তে ঐ তেঁতুল গাছে উঠেছিল, সেখান থেকে পড়ে গেছে, পারুলবালা জোড়াসনে বসে নবাকে কোলে শুইয়ে রেখেছে, আর একজন তার মাথায় ঢালছে জল।

গুরুর পদে উত্তীর্ণ হবার পর হারীত এখানকার চিকিৎসকও হয়েছে। সে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলে অনেকের রোগভোগ সেরে যায়। তাকে দেখে একটা গুঞ্জন উঠলো। কিন্তু প্রিয় নাতির এই বিপদ দেখেও হারীতের মনে কোনো চাঞ্চল্য এলো না, তার মাথা জোড়া অশান্তি। কাছে এসেও সে দাঁড়িয়ে রইলো চুপ করে।

পারুলবালা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, তুমি পোলাডারে দ্যাখবা না? হারীত স্ত্রীর মুখের দিকে অকারণ চেয়ে রইলো কয়েক পলক। তারপর জিজ্ঞেস করলো, কী হইছে? নবু, এই নবু, ওঠ!–

নবা কোনো উত্তর দিল না। সে উপুড় হয়ে আছে, অনেকে ভাবছে তার জ্ঞান নেই।

হারীত আরও কাছে এসে ঝুঁকে নবার এক হাত ধরে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বললো, ওঠ! ওঠ!

পারুলবালা জোর করে ধরে রাখার চেষ্টা করলেও হারীত নবাকে টেনে দাঁড় করালো। তার মুখখানা আমসিবর্ণ হয়ে গেছে, নাকের ফুটো দিয়ে গড়াচ্ছে রক্তের ধারা। কিন্তু চোখে জল নেই।

হারীত জিজ্ঞেস করলো, কী হইছে তোর, হাত ভাঙছে, না পা ভাঙছে?

নবা দু’পায়ে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছে না। এক পায়ে চোট লেগেছে তার। ফ্যালফ্যাল করে তাকাচ্ছে সে হারীতের দিকে।

হারীত তার দুটো হাত ধরে উঁচু করলো, তারপর বললো, হাঁট, আমার সাথে হাঁট! দেখি কিছু ভাঙছে নাকি?

ভিড় ফাঁক হয়ে গেল, হারীত তার নাতির হাত ধরে দশ পা এদিকে দশ পা ওদিকে হাঁটলো। তারপর চকিতে একবার মুখ ফিরিয়ে গোলাপীকে দেখে নিয়ে সে নবাকে বললো, ওঠ, আবার গাছে ওঠ। তোর কিছু হয় নাই!

এবার পারুলবালা এসে বললো, অরে ছাড়ো, ঘরে লইয়া যাই! শুইয়া থাকুক কিছুক্ষণ। হারীত হঠাৎ প্রচণ্ড জোরে চেঁচিয়ে বললো, না! ও ঘরে যাবে না! গাছে চড়তে গিয়া একবার আছাড় খাইলেই ভয় পাবে ক্যান? আবার গাছে ওঠবে। ওঠ নবু। আমি কাঁচা তেঁতুল খাবো। আন আমার জইন্যে।

নবা কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, সে ভয়ার্ত ভাবে চাইছে পারুলবালার দিকে।

হারীত তার ঘাড় চেপে ধরে টানতে টানতে গাছের কাছে এনে বললো, ওঠ, ওঠ, তোকে ওঠতেই হবে।

গোলাপী ছুটে এসে হারীতের হাত জড়িয়ে ধরে বললো, বাবা, ওরে ছাড়েন! ও আর কোনোদিন গাছে ওঠবে না!

হারীত গোলাপীকেও ঠেলে সরিয়ে দিয়ে বললো, আলবাৎ ওঠবে। এখনই ওঠবে! তোরা সইরা যা!

বিড়ালছানার মতন নবাকে সে দু’হাতে তুলে গাছের গুঁড়িতে জড়িয়ে দিল।

তারপর সরে এসে বললো, ওঠ, ভয় নাই, ওঠ! জয় জয় গুরু! জয় বাবা কালাচাঁদ!

এবার অন্য সবাই চেঁচিয়ে উঠলো, জয় জয় গুরু, জয় বাবা কালাচাঁদ। সেই ধ্বনিতে গোলাপীর কান্নার শব্দ চাপা পড়ে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *