2 of 3

২.৪৬ দোতলা থেকে কল্যাণী ডাকছেন

দোতলা থেকে কল্যাণী ডাকছেন, অলি, অলি!

অলি শুনতে পেয়ে একটু অবাক হলো। তাদের লম্বাটে ধরনের তিনতলা বাড়ি, যখন তখন একতলা-তিনতলায় ওঠানামা করতে হয়, তবু এ বাড়িতে কারুর নাম ধরে চেঁচিয়ে ডাকার প্রথা নেই। বিমানবিহারী বা কল্যাণী কেউই কখনো উঁচু গলায় কথা বলেন না। অলি ভুরু কুঁচকে ভাবলো, মা কোনো কারণে ব্যস্ত হয়ে তার খোঁজ করছে, জগদীশকে পাঠালেই তো পারতো। নিশ্চয়ই ফাঁকিবাজ জগদীশটা ধারে কাছে নেই, আর একটা নতুন ছেলে এসেছে ফটিক, সে আবার কানে কম শোনে।

অলি বসে আছে পড়ার টেবিলে, আর তার খাটে শুয়ে আছে বর্ষা। আজ সকাল থেকেই। তারা এক সঙ্গে পড়াশুনো করছে। বর্ষার এক মামাতো ভাই হঠাৎ এসে উপস্থিত হয়েছে কানপুর থেকে, সেই জন্য তাদের বাড়িতে জায়গা নেই, অথচ পরীক্ষার আর মাত্র সাতাশ দিন বাকি।

বর্ষার বরাবরই শুয়ে শুয়ে পড়া অভ্যেস, কারণ তার কোনো নিজস্ব পড়ার টেবিলই নেই। ঘণ্টার পর ঘণ্টা সে উপুড় হয়ে বইয়ের পাতায় চোখ আটকে রাখতে পারে। অলি আবার সারা দিন শুয়ে শুয়ে পড়ার কথা চিন্তাই করতে পারে না।

অলি উঠে দাঁড়িয়ে বললো, এই, আমি একটু আসছি রে।

বর্ষা চোখ তুললো না, ভালো করে শুনলোই না অলির কথা, মুখ দিয়ে একটা অস্পষ্ট শব্দ করলো শুধু।

আজ অলি চুল বাঁধেনি, বিকেলবেলায় শাড়ি-জামা বদল করেনি। একটা সাধারণ গোলাপী শাড়ি পরা, তার চুল আজ প্রায় বর্ষার মতনই উলুসথালুস। দিশি ফাউন্টেন পেন ব্যবহার করার বেশি বেশি ঝোঁক অলির, সেই পেনের কালি আঙুলে লাগবেই, খানিকটা কালি কখন যে তার থুতনিতে লেগেছে, তা সে খেয়ালই করেনি।

বাইরের সিঁড়ির রেলিং ধরে উঁকি মেরে অলি মাকে দেখতে পেল না। ওপর থেকেই সংলাপ সেরে নেওয়া অলির ধাতে নেই, সে নেমে এলো দোতলায়।

অফিস ঘরের দরজার কাছে আসতেই কল্যাণী বললেন, আয় অলি, ভেতরে আয়।

এ ঘরে অন্য অতিথি আছে, পাক্কা সাহেবের মতন স্যুট পরা একজন মধ্যবয়স্ক সুপুরুষ, তাঁর পাশে জর্জেটের শাড়ি-পরা একজন মহিলা। মহিলাটির প্রসাধন বেশ উগ্র, আই লাইনার দিয়ে চোখ আঁকা, ভুরুর ঠিক নিচে সবুজ আই শ্যাডো, চোখের পাতায় ম্যাসকারা।

এই দু’জনের দিকে দু’ পলক তাকিয়েই অলির মনে পর পর কয়েকটি ভাব খেলে গেল। এই গরমে মহিলাটি জর্জেটের শাড়ি পরে আছেন কী করে? ইনি বেশ ডাকসাইটে ধরনের সুন্দরী, কিন্তু এত মেক-আপ না নিলেই বোধ হয় আরও বেশি ভালো দেখাতো। ভদ্রলোক স্যুটের সঙ্গে ওয়েস্ট কোট পর্যন্ত পরেছেন, বাবা, আজকাল ওয়েস্ট কোট তো প্রায় দেখাই যায় না। বাইরের লোকের সামনে এভাবে হঠাৎ তাকে ডাকবার মানে কী? মায়ের কি আগে থেকে বলে দেওয়া উচিত ছিল না? অলির ব্লাউজের একটা বোতাম ছেঁড়া!

বিমানবিহারী বললেন, অলি, তুই এঁদের চিনিস তো? জাস্টিস পি এন মিত্র আর মিসেস মিত্র।

এই বিচিত্র দম্পতিকে আগে কখনো দেখে থাকলেও অলির মনে নেই। সে হ্যাঁ কিংবা না কিছুই বললো না, মুখে সৌজন্যের হাসি ফোঁটালো।

কল্যাণী তাকিয়ে আছেন অলির চোখের দিকে। তিনি নিঃশব্দে যে আদেশ দিচ্ছেন তা বুঝতে পেরেও অলি শুধু দু’হাত তুলে নমস্কার জানালো। মাত্র পাঁচজন নারী-পুরুষ ছাড়া সে আর কারু পায়ে হাত দিয়ে কখনো প্রণাম করবে না, ঠিক করে ফেলেছে।

বিমানবিহারী মহিলা-অতিথিটির দিকে তাকিয়ে বললেন, আতরদি, তুমি তো অলিকে চেনো? আমাদের কেষ্টনগরের বাড়িতে এসছিলে।

মহিলা তাঁর ভুরু বাঁকিয়ে বললেন, ওকে কত ছোট দেখিছি, ফ্রক পরে দৌড়াদৌড়ি করতো, মাথার চুল কোঁকড়া ছিল না? এখন তো রীতিমতন ইয়াং লেডি!

জাস্টিস মিত্র বললেন, তুমি প্রেসিডেন্সিতে ইংলিশ অনার্স নিয়ে পড়ছো? শম্ভ…মানে, এস এন ব্যানার্জি, তোমাদের এখনও পড়ান?

অলি মাথা হেলিয়ে বললো, হ্যাঁ, উনি হেড অফ দা ডিপার্টমেন্ট।

–ঐ শম্ভু ছিল আমার ক্লাস মেট, লন্ডনেও আমরা একই অ্যাপার্টমেন্ট হাউসে…

জাস্টিস মিত্রের বাংলা বলার একটা নিজস্ব কায়দা আছে। গলার আওয়াজটি মিষ্টি, বাংলা শব্দগুলো উচ্চারণ করেন ইংরিজি কায়দায়,’ যেমন তোমাদের কথাটা বললেন, তো-ও-মা-আ-দের, পড়ান’ হলো পওড়ান!

জজ-পত্নী উঠে এসে অলির হাত ধরে বললেন, বসো, একটু বসো আমাদের সঙ্গে, আমরা কাছেই এক জায়গায় এসেছিলুম…

শনিবার বিকেল সোওয়া পাঁচটা, এই সময় মানুষ তো মানুষের বাড়িতে বেড়াতে আসতেই পারে, অলির পক্ষেই এই সময়টাতেও বই নিয়ে বসে থাকা অস্বাভাবিক। বাড়িতে অতিথি এলে তার আলাপ করা উচিত। টুকিটাকি কথা চলতে লাগলো।

জজ-পত্নী জিজ্ঞেস করলেন, তোমার আর একটি মেয়ে আছে না? সে কোথায়, বিমান?

কল্যাণী বললো, ছোট মেয়ে এই সময় নাচের ইস্কুলে যায়।

–একদিন মেয়েদের নিয়ে এসো আমাদের বাড়িতে। তুমি তো আমাদের বাড়ি চেনো, বিমান?

–মে ফেয়ারের সেই বাড়ি তো? হ্যাঁ, গেছি একবার। জাস্টিস মিত্র অলির দিকে তাকিয়ে বললেন, আমাদের একটি মাত্র ছেলে। সে বিলাতে গেছে ব্যারিস্টারি পড়তে। নেক্সট মানথে একবার আসবে। তুমি তার সঙ্গে আলাপ করলে। নিশ্চিত খুশি হবে। ইংলিশ লিটরেচারে তার খুব ইরেস্ট আছে।

অলি বললো, আমার সামনের মাসে পরীক্ষা।

–হ্যাঁ, পরীক্ষার পরই এসো। আমার ছেলে আসবে নেক্সট মাসের ফোর্থ উইকে, তারপর ফাইভ উইকস এখানে থাকবে।

বিমানবিহারী বললেন, অলি একটু দেখবি, জগদীশ কোথায় গেল? একটু চা—

জজ-পত্নী বললেন, না, না, চায়ের জন্য ব্যস্ত হবেন না।

অলি উঠে পড়ে একতলার রান্নাঘর থেকে জগদীশকে খুঁজে বার করলো। মৃদু বকুনি দিল তাকে, তারপর চা ও জলখাবারের নির্দেশ দিয়ে সে আর অতিথিদের কাছে ফিরলো না, চলে এলো তিনতলায়।

বিছানার ওপর উঠে বসে বর্ষা এখন একটা সিগারেট ধরিয়েছে। অলির মুখের রক্তিম আভা তার চোখ এড়ালো না।

অলি বর্ষার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো, দে, আজ আমিও একটু সিগারেট খাবো।

বর্ষা জিজ্ঞেস করলো, কী হয়েছে রে? মাসিমা তোকে বকলেন নাকি?

অলি জোর করে মুখে হাসি ফুটিয়ে বললো, হঠাৎ মা বকবে কেন? নিচে দু’জন অতিথি এসেছে, মা আমায় ডেকে ওঁদের পাত্রী দেখালেন।

–অ্যাঁ?

–হ্যাঁ রে। তুই জাস্টিস পি এন মিত্র-র নাম শুনেছিস? একেবারে টপ সোসাইটির লোক, ওঁর স্ত্রীকে নাকি অল্প বয়েসে মেমসাহেব বলে ভুল করা হতো, বিজয়লক্ষ্মী পন্ডিতের সঙ্গে ওঁর বন্ধুত্ব আছে, ব্রিটিশ আমলে বেঙ্গলের গভর্নর কেসির বউয়ের সঙ্গে উনি ব্যাডমিন্টন খেলেছেন, এই সব এইমাত্র শুনলুম। ওঁদের একমাত্র ছেলে ইংল্যান্ডে ব্যারিস্টারি পড়ে, তার সঙ্গে আমায় মানাবে না?

–তুই, তুই এরকম সাজপোশাক নিয়ে…যাঃ, তুই বানিয়ে বলছিস, অলি?

–বিশ্বাস না হয় নিচে গিয়ে দেখে আয়। ওঁরা বোধ হয় চেয়েছিলেন, ‘তুমি যেমন আছো, তেমনি এসো, আর করো না সাজ।’

–আমার সত্যিই একবার ওঁদের দেখে আসতে ইচ্ছে করছে রে!

–উঁকি মেরে আসতে পারিস। ভেতরে ঢুকে কথাও বলতে পারিস। জজের থেকে তার বউ বেশি ইন্টারেস্টিং। তবে দেখিস, তোকে যেন আবার পছন্দ করে না ফেলে! আমার চান্সটা নষ্ট করে দিস না ভাই!

বর্ষা সত্যি উঠে সিঁড়ি পর্যন্ত গেল। তারপর আবার ফিরে এসে ঘরের দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে বললো, নাঃ, নিজেকে চেক করলুম। যদি ওঁদের সামনে উল্টো-পাল্টা কিছু বলে ফেলি, তোর বাবা-মা দুঃখ পাবেন। তুই সত্যি বিয়ে করতে রাজি আছিস নাকি রে, অলি?

উত্তর না দিয়ে অলি মুচকি মুচকি হাসতে লাগলো।

বর্ষাও হেসে উঠে বললো, মেলোমশাই-মাসিমাকে এত ওল্ড ফ্যাশা বলে তো মনে হয়নি কোনোদিন। বাড়িতে তোক ডেকে মেয়ে দেখানো…এতে পর্যন্ত রাজি হলেন?

–বাবা কোনো কিছুতেই না বলতে পারেন না।

–তোকে ওঁরা গান গাইতে বলেনি? শক্ত ইংরিজি শব্দের বানান জিজ্ঞেস করেননি? একটু হাঁটো তো মা, বলে পায়ের কোনো খুঁত আছে কিনা দেখার চেষ্টা করেননি?

–প্রায় সেই রকমই। জজমশাই দু লাইন শেক্সপীয়ার কোট করে আমার দিকে চোখ সরু করে তাকালেন, কোন নাটকের সেটা আমি ধরতে চাইছি কি না জানতে চাইছিলেন।

–তুই বললি?

–কিছুই বলিনি। বললে বলা উচিত ছিল মিস কোট করেছেন। উনি ওথেলো থেকে বলতে গেলেন :

Keep up you bright Swords, for the dew will rust them
Good Signior, you shall more command with years
Than with your weapons…

এর মধ্যে শেষের with-টা বাদ দিয়ে ফেললেন।

–হঠাৎ এই লাইনগুলো কোট করার মানে?

–অল্প বিদ্যা ভয়ংকরী! নিজের বয়েসের কথা বলতে গিয়ে…

দুই সখী এবার হাসলো অনেকক্ষণ ধরে। যে-কোনো উচ্চ পদ ও প্রতিষ্ঠানের প্রতি বর্ষার একটা অবজ্ঞার ভাব আছে, সে চুটিয়ে ঠাট্টা করলো নানা রকম। তারপর এক সময় সে বললো, এবারে আমি উঠি রে, অলি।

অলি বললো, কেন, বোস না। এরপর চা খেয়ে সেকেণ্ড পেপারটা একটু পড়বো।

বর্ষা তার চুলের গোছায় একটা গিট বাঁধতে বাঁধতে বললো, নাঃ, বিকেল হয়ে গেল, এখন তোদের বাড়িতে অনেক লোকজন আসবে।

–আর কেউ আসবে না। এ ঘরে আসবে না।

–ঐ পাগলা অতীনটা যদি এসে পড়েনা বাবা, আমি পালাই!

–যদি আসেই বা, তুই কি বাবলুদাকে ভয় পাস নাকি?

–ভ্যাট, তোর ঐ প্যাংলা চেহারার বাবলুদাকে আমি ভয় পেতে যাবো কেন, কোনো ছেলেকেই আমি ভয় পাই না। কিন্তু…আমার মনে হয়…ঐ অতীন মজুমদার আমাকে ঠিক পছন্দ করে না। আমার দিকে কীরকমভাবে যেন তাকায়… আমাকে বোধ হয় সন্দেহ করে।

অলি সঙ্গে সঙ্গে বর্ষার কথার প্রতিবাদ করতে পারলো না। এ কথা তো ঠিকই, অতীন বর্ষাকে পছন্দ করে না, বর্ষার প্রসঙ্গ উঠলেই ‘তোর ঐ ফেমিনিস্ট বন্ধুটা’ বলে ঠাট্টা করে, যদিও বর্ষার সামনে সে কিছু বলে না।

কিন্তু একটা শব্দে তার খটকা লাগলো। সে বলল, সন্দেহ মানে, তোকে কী সন্দেহ। করবে?

বর্ষা বললো, ও হয়তো ভাবে, আমি তোকে খারাপ করে দিচ্ছি। আমি তোকে বখাচ্ছি!

অলি বললো, আ-হা-হা-হা!

বর্ষা অলির একটি হাত ধরে তার পাশে নিজের অন্য হাতটি রেখে বললো, দ্যাখ অলি, তুই যে আমার থেকে বেশি ফর্সা তাই-ই না, তোর হাত কত নরম, তুলতুলে, আঙুলগুলো সরু সরু, আটিস্টিক, আর আমার হাত শক্ত, কড়া কড়া। দশ-এগারো বছর ধরে আমি নিজের বাড়ির বাসনপত্তর মাজি, ঘর ঝাঁড় দিই, রান্না করি…তোর থেকে আমার অভিজ্ঞতা কত বেশি, আমার যখন তের বছর বয়েস, আমার এক কাকা আমাকে মোলেস্ট করেছিল, আমি যত রকম খারাপ গালাগাল শুনেছি, তুই কল্পনাও করতে পারবি না, তুই কখনো গয়নার দোকানে গয়না বিক্রি করতে গেছিস একা একা? আমাকে যেতে হয়েছিল, কলেজে ভর্তি হবার আগে, দাদাকে না জানিয়ে মায়ের একটা গয়না বউবাজারের এক দোকানে…আমাকে প্রথমেই কী বললো জানিস, কোন বাড়ি থেকে গয়নাটা চুরি করেছো? আমাকে ভেবেছিল কোনো বাড়ির ঝি…আর একজন জিজ্ঞেস করলো, এই, তুই বুঝি হাড়কাটায় থাকিস?…অলি, তুই জানিস, কাকে হাড়কাটা বলে? থাক, তোর জেনে দরকার নেই… সেদিন আমি এমন ভয় পেয়েছিলুম, ভেবেছিলুম ওরা আমাকে পুলিসে ধরিয়ে দেবে…সেই দোকানে আর একটা লোক বসেছিল, এখনও মনে আছে তার চেহারা, কালো, রোগা,সিল্কের জামা-পরা, গায়ে আতরের গন্ধ, সে আমায় বলেছিল, খুকী, তুমি গয়না বিক্রি করো না, আমার সঙ্গে চলো, তোমায় টাকাটা দিয়ে দেবো…সে লোকটাও ছিল বদমাইশ…।

হঠাৎ থেমে গিয়ে বর্ষা একটুক্ষণ চুপ করে বসে রইলো হাঁটুর ওপর থুতনি ঠেকিয়ে। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, জগদীশ আমাদের চা দেবে না?

অলি জিজ্ঞেস করলো, তোর তের বছর বয়েসে…তোর কাকা তোকে মোলেস্ট করেছিল মানে?

–সে সব ডিটেইলস্ তোর শুনে দরকার নেই…তখন আমরা আরপুলি লেনের একটা বাড়িতে দেড়খানা ঘরে গাদাগাদি করে থাকতুম, বাবা সদ্য মারা গেছে…ঐ রকমভাবে অনেক ফ্যামিলিই তো থাকে, একখানা দেড়খানা ঘরে সাত-আটজনসে সব পরিবারের মরালিটি একেবারে অন্য রকম…সবচেয়ে বেশি সাফার করে উঠতি বয়েসের মেয়েরা–এক এক সময় আমার কী কষ্ট যে হতো, নিরিবিলিতে একটু পড়াশুনোর জায়গা পেতুম নাঃবেড়াল যেমন তার বাচ্চা মুখে করে ঘোরে, সেই রকম আমি বই বুকে নিয়ে একবার ছাদে, একবার সিঁড়িতে…

দরজায় শব্দ হতেই অলি উঠে গিয়ে দরজা খুলে জগদীশের কাছ থেকে চায়ের পেয়ালা নিতে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো, এক কাপ? আমার জন্য আনিস নি?

জগদীশ বললো, ধরো না। তোমার জন্য দুধ আনছি একটু পরে।

অলি লজ্জা পেয়ে ধমক দিয়ে বললো, দুধ আনতে হবে না, তুই আমাকেও চা দে।

বর্ষা বললো, তুই দুধ খা না, অলি। তোর অভ্যেস।

–না, আমি মোটেই রোজ বিকেলে দুধ খাই না। এই জগদীশটার মাথায় কিছু নেই…এই, যা, চা আন। আমাদের জন্য বিস্কুট আর সন্দেশও আনবি.

ফিরে এসে অলি বললো, বর্ষা, তোর ছেলেবেলার কথা বল্।

বর্ষা হেসে বললো, সে শোনবার মতন কিছু নয়। একঘেয়ে ব্যাপার। প্রেসিডেন্সিতে ঢোকবার আগে, জানিস, আমি ভাবতুম, আমাদের জীবনটা তো এই রকমই, এইটাই যেন স্বাভাবিক। তারপর তোদের মতন কয়েকজনের সঙ্গে মিশে, তোদর বাড়িতে এসে বুঝতে পারলুম, আমাদের জীবনের এত তফাত যেন আলাদা আলাদা গ্রহ…তোরা কত সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম জিনিস উপভোগ করতে পারিস, গানবাজনা, ছবি,তারপর ধর প্রেম-ভালোবাসা…ফুল ফোঁটার মতন প্রেমও তো আস্তে আস্তে…প্রথমে কলি, তারপর একটু একটু করে পাপড়ি মেলা, তারপর সৌরভ, এর পর তো প্রজাপতি বা মৌমাছি আসবে…আমার এক জ্যাঠতুতো বোন ছিল, জানিস, ছিল মানে এখনও আছে, বিয়ে হয়ে গেছে…এক সময় আমাদের বাড়ির দুখানা বাড়ি পরেই থাকত, তার যখন পনেরো বছর বয়েস, তখনই সে ওদের বাড়িওলার ছেলের সঙ্গে কয়েকবার শুয়েছে…শুনে আমার যা গা ঘিন ঘিন করছিল:-তুই ভেবে দ্যাখ, ভালোবাসা কাকে বলে তা জানলেই না, তার আগেই শরীর চিনে গেল, তাও একটা লম্পটের সঙ্গে, সে লোকটা আমার ঐ বোনকে শেষ পর্যন্ত বিয়ে করেনি। তা নিয়ে অনেক ঝঞ্জাট হয়েছিল…কী কদর্য, অশ্লীল ব্যাপার-এই সব দেখে দেখে পুরুষ জাতটার ওপরেই আমার রাগ জন্মে গেছে।

অলি মৃদু স্বরে বললো, কিন্তু মনীশ? তুই ওকে আগের মতন আর বকাঝকা করিস না দেখেছি।

–হ্যাঁ, মনীশটা একেবারে নাছোড়বান্দা। ও আমার মধ্যে কী যে পেয়েছে! আমার না আছে রূপ, না আছে কোনো গুণ, সব সময় চ্যাটাং চ্যাটাং কথা বলি…তবু ও আমার কাছে…তোর কথা না হয় বাদই দিলুম, অলি, তোর কাছে ঘেঁষতে অনেক ছেলেই ভয় পাবে, কিন্তু দেবযানী, শ্বেতী, কুমকুম এই সব সুন্দরীরা থাকতেও

–খুব হচ্ছে, না বর্ষা? তোর এরকম টল, সুন্দর ফিগার, তুই পড়াশুনোয় এত ব্রাইট

–ব্রাইট না ছাই! স্কলারশিপ না পেলে এম-এ পড়তে পারবো না, তাই দাঁতে দাঁত চেপে সব মুখস্থ করে যাচ্ছি…আমি মনীশকে বলেছি, দ্যাখো বাপু, যতই আমার পেছনে ঘোরো, অন্তত দশ বছরের আগে আমার সঙ্গে ঘরটর বাঁধার কথা স্বপ্নেও মনে স্থান দিও না! এই পরীক্ষার পরেই আমি চেষ্টা করবো, আমার দাদার সংসার থেকে আলাদা হয়ে যেতে। বৌদি আমার মায়ের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করে না। বৌদি থাক তার নিজের সংসার নিয়ে। আমি মেয়ে হয়ে জন্মেছি বলেই কি নিজের বিধবা মায়ের দায়িত্ব নিতে পারবো না? ছেলেদেরই যে সব সময় শুধু বুড়ো বাপ-মায়ের দায়িত্ব নিতে হবে তার কী মানে আছে? আমি একটা মিশনারি স্কুলে চাকরি পেতে পারি, মোটামুটি একজনের সঙ্গে কথা হয়ে গেছে, সকালবেলা সাড়ে ছ’টা থেকে সাড়ে দশটা পর্যন্ত ক্লাস, ভালো মাইনে দেবে, আলাদা বাড়ি ভাড়া করে মা আর ছোট বোনটাকে নিয়ে যাবো, ছোট বোনটাকে লেখাপড়া শেখাবো, তারপর সে যা খুশি করবে, আমি অন্তত পি এইচ ডি না করে অন্য কিছু ভাববো না।

–তুই অনেক দূর পর্যন্ত প্ল্যান করে ফেলেছিস দেখছি।

–তুই বুঝি ভবিষ্যতের কথা কিছু ভাবিসনি?

-না।

–তোর বাবা-মাই ভাবছেন। হ্যাঁরে, অলি, ঐ বাবলুদা তোকে চুমু খেয়েছে?

অলি কোনো উত্তর দিল না, বর্ষার দিকে তাকিয়ে রইলো।

বর্ষা আবার জিজ্ঞেস করলো, তুই ওর সঙ্গে শুয়েছিস একদিনও?

এবারে অলি কাতরভাবে বর্ষার হাত ধরে বললো, বর্ষা, প্লীজ, ওভাবে কথা বলিস না!

শোওয়া-টোওয়ার কথা এমন অনায়াসে বলে বর্ষা যেন জল-ভাতের মতন ব্যাপার। কিন্তু শোনা মাত্র অলির বুকে দুম দুম করে শব্দ হয়।

বর্ষা বললো, কেন জিজ্ঞেস করছি জানিস? শোন, তোকে একটা ঘটনা বলা হয়নি। গত মাসে মনীশ আমাকে একদিন ব্যারাকপুরে বেড়াতে নিয়ে গেল। আমি তো আগে কখনো যাইনি, সেদিন ভাবলুম, ঠিক আছে, দেখাই যাক না। সবাই ভাবে আমার কোনো রসকষ নেই, আমার মধ্যে নাকি একটুও রোমান্টিসিজম নেই, তাই ভাবলুম দেখা যাক, গঙ্গার ধারে কোনো ছেলের মুখে প্রেমের কথা শুনতে কেমন লাগে। ব্যারাকপুরে একটা গান্ধী ঘাট হয়েছে জানিস তো, বেশ সুন্দর জায়গা, মনীশ আমাকে সেটা দেখাবার নাম করে নিয়ে গেল…আসলে অন্য মতলোব, জানিস তো! ব্যারাকপুরে ওর দাদার বাড়ি, দাদারা সবাই ওয়ালটেয়ার বেড়াতে গেছে, সেই বাড়ির চাবি মনীশের কাছে…সেই বাড়িতে ঢুকেই মনীশ আমাকে তিনটে চুমু খেল!

অদ্ভুত ধরনের একটা হাসি দিয়ে অলির মুখের দিকে তাকিয়ে বর্ষা জিজ্ঞেস করলো, তুই বিশ্বাস করছিস না আমার কথা?

-–কেন বিশ্বাস করবো না! ঠিক তিনটেই?

-–শোন না! মনীশটা পাগলের মতন করছিল, তাই আমি প্রথমে দুটো চুমু অ্যালাউ করলুম।

–অ্যালাউ করলি? উইদাউট এনি পারটিসিপেশান?

–হ্যাঁ। তাও করেছি, মনীশ বললো, ওর পিঠে হাত রেখে জড়িয়ে ধরতে। সত্যি কথা বলছি, খুব একটা খারাপ লাগেনি। দারুণ ভালো যে কিছু, একেবারে আহা মরি ব্যাপার, তাও না! ঠিক আছে, মাঝে মাঝে কখনো-সখনও চলতে পারে।

অলি হাসতে লাগলো।

–তুই হাসছিস? বাকিটা শোন! সন্ধে হয়ে গেছে তখন, তিনতলার বারান্দা থেকে জ্যোৎস্নার গঙ্গা দেখাবে বলে মনীশ আমাকে নিয়ে এলো বেডরুমে। আমাকে সিডিউস করে যাচ্ছে, আমার সঙ্গে শুতে চায় আর কি! ঐ বাড়ির চাবি খোলার পর থেকেই আমি ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তা করছিলুম…আমার সেক্স নিয়ে কোনো ইনহিবিশান নেই, আমার বাড়িতে এমন কোনো গার্জেনও নেই যে বেশি রাত করে ফিরলে বকুনি দেবে, আমার যা ইচ্ছে হবে, আমি তা করতে পারি। কিন্তু আমার ইচ্ছে করলো না! তোকে আমি সিনসিয়ারলি বলছি, আমার মনের ভেতর থেকে কোনো সাড়া পেলুম না, একটা ফাঁকা বাড়ি পাওয়া গেছে বলেই…হোল আইডিয়াটা আমার কাছে রিপেলিং মনে হলো, আমি মনীশকে বললুম, নাথিং ডুয়িং, ফরগেট ইঁট

–মনীশ জোর করতে চায় নি?

–আমার ইচ্ছে না থাকলেও কেউ আমার ওপর জোর করবে? আমি তো এখন আর সেই বারো-তের বছরের কচি খুকিটি নেই! মনীশকে বললুম, ওসব হবে না। তখন মনীশ কাকুতি-মিনতি করে আর একবার চুমু খেতে চাইলো, সেটাই হলো থার্ড চুমু! তারপর অনেকক্ষণ এমনি এমনি বসে গল্প করলুম রে!

জগদীশ দ্বিতীয় কাপ চা ও সন্দেশ দিয়ে গেছে। সেগুলো খেতে খেতে অলির মনে পড়লো বাবলুদার সঙ্গে তার মেমারি থেকে কৃষ্ণনগর যাওয়ার দিনটার কথা। কিন্তু বর্ষাকে সে কথা তার বলতে ইচ্ছে করলো না। মনীশের সঙ্গে বাবলুদার কোনো তুলনাই চলে না।

একটুক্ষণ আপন মনে খুঁটে খুঁটে সন্দেশ খেতে খেতে বর্ষা হঠাৎ একটা অন্য রকম মুখ। তুললল। সঙ্কটের ছায়া মাখানো, একটু যেন বিষণ্ণ। নিজে উঠে গিয়ে দরজাটা ভালো করে বন্ধ করে দিয়ে এসে সে আর একটি সিগারেট ধরালো। তারপর আস্তে আস্তে বললো, এবার তোকে আমি একটা কথা বলবো, অলি, যা শুনলে তুই হয়তো রেগে যাবি। কিন্তু কথাটা আমার বলাই উচিত, চেপে রাখার কোনো মানে হয় না। এ কথা শোনার পর তুই যদি তোর বাড়িতে আমাকে আসতে বারণ করে দিস, তাহলে আর আমি আসবো না, তবু আমাকে বলতেই হবে।

অলির মুখখানা বিবর্ণ হয়ে গেল। কী এমন কথা বলতে চায় বর্ষা? সে কোনো কঠিন কথা শুনতে চায় না। সে কি অজান্তে কখনো বর্ষার সঙ্গে কোনো রকম খারাপ ব্যবহার করেছে? এ বাড়ির অন্য কেউ?

বর্ষা বললো, সেদিন মনীশ অত করে চাইলেও কেন আমার ইচ্ছে করলো না? কেন কোনো ছেলের সঙ্গে একা একা ঘুরে বেড়াতে কিংবা গল্প করতে আমার তেমন আগ্রহ হয় না? আমি নিজের মনটা অ্যানালাইজ করার চেষ্টা করি। আমার আগে কয়েকটা তিক্ত অভিজ্ঞতা হলেও…তারা তো কেউ বন্ধু ছিল না। কিন্তু এখনও যে-সব ছেলের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়, তাদের কারুর সঙ্গেই…তোকে একটা পরিষ্কার সত্যি কথা বলি, গত দু মাস ধরে এই প্রশ্নটা আমার মাথার মধ্যে খুব ঘুরছে, আমি কি লেসবিয়ান?

অলি সঙ্গে সঙ্গে বললো, যাঃ!

–এ রকম তো হতেও পারে। অনেকের ক্ষেত্রে এটা একটা বায়োলজিক্যাল ফ্যাটের মতন, বিদেশে অনেকে অ্যাকসেপ্ট করে নিয়েছে, হোমো-সেক্সয়ালরা যদি সংখ্যায় এত বেশি হতে পারে…দু’তিন বছর আগে কলকাতায় অ্যালেন গীংসবার্গ বলে একজন বীটনিক কবি এসেছিল, সঙ্গে তার বউ, সে একজন পুরুষ!

–এ সব কথা আমার শুনতে ইচ্ছে করছে না রে, বর্ষা!

–আমার কথাটা তোকে শুনতেই হবে। অলি, আমি যখন বাড়িতে একা একা থাকি, তখন মনীশ বা অন্য ছেলেদের কথা আমার বিশেষ মনে পড়ে না, আমার প্রায় সর্বক্ষণ মনে পড়ে তোর কথা। তোর সঙ্গে দু’তিন দিন দেখা না হলে আমার মন ছটফট করে। কোনো দিন যদি তোর সঙ্গে একটু খারাপ ব্যবহার করি, পরে সে জন্য আমার এত মন খারাপ লাগে, কিংবা, তুই যদি আমার সঙ্গে ভালো করে কথা না বলিস, তুই যদি অতীন মজুমদারের সঙ্গে চলে যাস…ওর সঙ্গে আমার ভাব হলো না কেন জানিস, ওকে আমি আসলে ঈষা করি। তোকে আমি এত ভালোবাসি, ও তার ওপর ভাগ বসাচ্ছে…অতীনও নিশ্চয়ই সেটা বোঝে, তাই আমাকে পছন্দ করে না।

অলির কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে গেছে, সে কোনো কথা বলতে পারছে না। সে তাকাতেও পারছে না বর্ষার দিকে।

–আমি তোকে ভালোবাসি, অলি! যে-কোনো সুন্দর কিছুর কথা মনে পড়লেই তোর মুখটা আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে, সেদিন ব্রাউনিং-এর কবিতাগুলো পড়তে পড়তে আমি ভাবছিলুম, এই সব কথাই যেন আমি তোকে বলতে চাই…অলি, আমি কি সত্যি লেসবিয়ান? আমি কি তোদের ছেড়ে চলে যাবো? আমার খুব কষ্ট হচ্ছে, তবু তবু…আজ যখন প্রসঙ্গটা উঠলোই, তুই আমাকে একটা এক্সপেরিমেন্ট করার চান্স দিবি?

অলি তবু চুপ করে আছে দেখে বর্ষা তার থুতনিতে আঙুল ছুঁইয়ে জিজ্ঞেস করলো, তুই আমার কথা শুনছিস না?

অলি মুখ না তুলেই বললো, শুনছি।

–আমি এর মধ্যে ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে গিয়ে লেসবিয়ানিজম নিয়ে পড়াশুনো করেছি। আমি মিলিয়ে দেখে সিওর হতে চাই, অলি, একবার যদি এক্সপেরিমেন্ট করি, অলি, একবার…

–কী?

–একটু উঠে দাঁড়া।

বর্ষা নিজেই অলিকে দাঁড় করলো, ফেলে দিল তার বুকের আঁচল। তারপর দরজায় পিঠ দিয়ে সে আলিঙ্গন করলো অলিকে। অলির অনিচ্ছুক হাত দুটি জড়িয়ে নিল নিজের গলায়, অলির গালে সে গাল ঠেকিয়ে রাখলো।

অলি বাধা দিল না। একটা কথাও বললো না। মাত্র দু’এক সপ্তাহ আগেই সে একটা পেপার ব্যাক উপন্যাসে লেসবিয়ানদের কথা পড়েছে। অবাস্তব কিছু নয়। তবু তার যেন সাঙ্ঘাতিক ভয় করছে। যেন কোথাও যেতে যেতে চেনা রাস্তা হঠাৎ শেষ হয়ে গেছে, একটা খাদের কিনারে দাঁড় করানো হয়েছে তাকে।

বর্ষা তাকে জড়িয়ে ধরে আছে–কতক্ষণ-যেন মিনিটের পর মিনিট…অনেকক্ষণ কেটে যাচ্ছে।

বর্ষা তার একটা হাত বুলোচ্ছে অলির পিঠে। তার উরু দুটি অলির উরুর সঙ্গে জোড়া। বর্ষা তার হাতটি সামনের দিকে এনে একবার অলির বুকে রাখলো। সঙ্গে সঙ্গে সে অলিকে ছেড়ে দিয়ে ছুটে গিয়ে পড়লো বিছানায়। উপুড় হয়ে সে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো।

অলি আরও ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। তা হলে কী হলো শেষ পর্যন্ত, খাদের কিনারে এসে কি বর্ষা পড়ে গেল নিচে? বর্ষার মতন মেয়ে যে কাঁদতে পারে, তা যেন কল্পনাই করা যায় না। অলি এখন কী করবে।

একটুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে অলি বিছানার কাছে এসে বললো, এই বর্ষা, কী হলো? এই—

বর্ষা মুখ তুললো। সত্যি চোখের জলে তার মুখখানা মাখামাখি, কিন্তু সে হাসছে। অলিকে

আবার জড়িয়ে ধরে সে বললো, আমার দারুণ আনন্দ হচ্ছে রে! তুই আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছিস, অলি, অন্য যে-কোনো মেয়ে আমাকে ভুল বুঝতো।

অলিকে ছেড়ে সে আঁচল দিয়ে মুখ চোখ মুছলো। তারপর শান্ত গলায় বললো, তোর ঐ পাগলা অতীনটাকে বলিস, আমার ওপর রাগ করার কোনো দরকার নেই। আমি ওর ভালোবাসায় ভাগ বসাবো না। আমি লেসবিয়ান নই!

–কেউ কি তোকে লেসবিয়ান বলেছে? তুই নিজেই তো–

–জানিস, কোনো গোপন কঠিন অসুখ হলে যেমন কারুকে বলা যায় না, সেই রকমই প্রায় গত একটা মাস…আমি অবসেড হয়ে গিয়েছিলুম, আমি সত্যি ভেবেছিলুম…আমি লেসবিয়ান, আমাকে সবাই অসট্রাসাইজ করে দেবে…কিন্তু আমি যাকে ভালোবাসি, আজ তাকেই সত্যি সত্যি ফিজিক্যালি জড়িয়ে ধরে দেখলুম, অন্তত পাঁচ মিনিট তো হবেই, আমার কোনো সেক্স-ইমপাস এলো না, আমার একবারও ইচ্ছে করলো না তোকে চুমু খেতে…কিংবা…তার মানে মেয়েদের শরীরের প্রতি আমার আকর্ষণ নেই…তোর প্রতি আমার যে ভালোবাসা, সেটা পিওরলি ইমোশানাল, তার মধ্যে কোনো সেক্স নেই.

বর্ষার চোখ আবার সিক্ত হয়ে গেল, ধরা গলায় সে বললো, আমার যে কী আনন্দ হচ্ছে, অলি, যেন আমার নতুন জন্ম হলো।

অলি এবারে দুষ্টুমী করে বললো, কিন্তু তুই যখন আমাকে জড়িয়ে ধরেছিলি, আমার তে তখন বেশ ভালো লাগছিল। তা হলে কি আমি লেসবিয়ান?

বর্ষা বললো, ভ্যাট, একটা চাঁটি খাবি। অতীনটা একটা লাকি ডগ, তোর মতন মেয়েকে ভালোবেসে ধন্য হয়ে যাবে।

–তুই অনেক কিছুই ধরে নিচ্ছিস, বর্ষা। বাবলুদা যে আমাকে ভালোবাসে তাই বা তোকে কে বললো? মেলামেশা করলেই ভালোবাসা হয়? বাবলুদা তো আমাকে নিজের মুখে কোনোদিন ওসব কিছুই বলেনি!

–ওর টাইপটাই আলাদা। ওরা মুখে গদোগদো প্রেমের ডায়লগ দেবে না কক্ষনো! ঐ অতীনটা এক একদিন কফি হাউসে এসে যতই পাগলামি করুক, ওর কিন্ত একটা সিরিয়াস দিক আছে, সে জন্য আমি ওকে একটু একটু শ্রদ্ধাও করি। ও দেশের কথা ভাবে, এই দেশের সিসটেমটা বদলাতে চায়। হ্যাঁরে, অতীন মজুমদার কম্যুনিস্ট, তাই না?

অলি দুদিকে মাথা নাড়লো।

–ওদের সায়েন্স কলেজের পুরো ব্যাচটাই ক্যুনিস্ট। আমাদের ইংলিশ ডিপার্টমেন্টের ছেলেগুলো সব কেমন যেন ম্যাদামারা। মনীশকে আমার তেমন পছন্দ হয় না কেন আজ বুঝতে পারলুম। কারণ, ও মেয়েলি।

বই-খাতা টেনে নিয়ে বর্ষা এবার গম্ভীরভাবে বললো, নাও, গার্লস, ব্যাক টু ওয়ার্ক। অনেক সময় নষ্ট হয়েছে। এখন তাহলে সেকেণ্ড পেপারটা ঝালানো হোক।

বর্ষা বাড়ি ফিরে গেল ন’টার সময়। তার পরেও অলি পড়তেই লাগলো। জগদীশ তাকে খাবার জন্য ডাকতে এলেও সে গেল না। বর্ষা চলে যাবার পর তার বিকেলের ঘটনাটা মনে পড়ে গেছে। উদ্ভট সাজপোশাক করা দু’জন নারী-পুরুষের সামনে বাবা-মা তাকে ডেকে নিয়ে গিয়ে অপমান করেছে। এখন বাবা-মা’র সামনে গেলেই অলির ঝগড়া হবে।

বিমানবিহারী নিজেই একটু পরে এলেন অলির ঘরে।

দুবার তাঁর ডাক শুনেও অলি মুখ ফেরালো না। বিমানবিহারী কাছে এসে মেয়ের পিঠের কাছে দাঁড়িয়ে বললেন, যুগ পাল্টেছে, আজকাল পুরুষ মানুষদের কী দুর্দশা! সব সময় ভয়ে ভয়ে থাকতে হয়। সারা জীবন বউয়ের ভয়ে কাঁটা হয়ে রইলুম, এখন মেয়ের ভয়ে কাঁপছি। ওরে একবারও তাকাচ্ছিস না, আমাকে কি ভস্ম করে দিবি নাকি?

অলি মুখ ফেরাতেই তিনি আঙুল তুলে বললেন, রাগের কথা, বকুনির কথার আগে আমার কথা শুনতে হবে। দুটো মাত্র কথা। এক নম্বর হলো, জাস্টিস মিত্র আর ওঁর স্ত্রীকে আমরা নেমন্তন্ন করে ডেকে আনি নি, ওঁরা নিজের থেকেই এসেছেন, সোস্যাল ভিজিট। ওঁরা তোর সঙ্গে আলাপ করতে চাইলেন, সে ক্ষেত্রে না বলাটা অভদ্রতা নয়? ওঁদের দু’জনের আলটিরিয়ার মোটিভ যাই-ই থাকুক না কেন, আমরা নিদোষ।

আর দু নম্বর কথা হলো, এটা আমি শুধু নিজের দায়িত্বে বলছি, তোর মা আমার সঙ্গে এক মত নাও হতে পারেন, সেটা হচ্ছে, আমি মেয়ের বিয়ে দেবার জন্য মোটেই ব্যস্ত নই। আমার ছেলে নেই, শুধু শুধু মেয়েদের হুড়োতাড়া করে বিয়ে দিয়ে বাড়ি খালি করতে চাইবো কেন? যত দেরি হয় ততই তো ভালো। আমার দুটি কন্যারই যখন ইচ্ছে হবে বিয়ে করবে। আর তোরা যদি বিয়ে করতে একেবারেই না চাস, তাতেও আমার আপত্তি নেই…

বাবা-মেয়ে পরস্পরের দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইলো অপলক। অলির চোখ নরম হয়ে এসেছে, বাবাকে যে সে কতখানি ভালোবাসে, এই রকম এক এক সময় যেন নতুন করে টের পায়।

বিমানবিহারী হেসে বললেন, খাবার টেবিলে সব ঠাণ্ডা হচ্ছে, আমি এখনও খাইনি, আজ রাত্তিরে কি মেয়ের সঙ্গে একসঙ্গে খাওয়ার সৌভাগ্য আমার হতে পারে? বেশ চনমনে খিদে পেয়েছে…

উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে অলি ভাবলো, একমাত্র বিয়ে করা ছাড়া, বাবার কথা শুনে পৃথিবীর আর যে-কোনো কাজ করতে পারে সে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *