২.৪৪ There is an Eye that never sleeps

There is an Eye that never sleeps
Beneath the wing of night;
There is an Ear that never shuts
When sink the beams of light.

পণ্ডিতমশাইয়ের জন্যে আমার খুব দুঃখ হচ্ছিল। ছোটদাদুর ভয়ংকর আক্রমণ, তারপরে অসীম কৃপা, সবই হল, কিন্তু মানুষটি বড় নিঃসঙ্গে আছেন। শাস্ত্র আর পাণ্ডিত্যের ভারে নুয়ে পড়েছেন। বাঁচার ইচ্ছা প্রবল, অথচ সময়ের বালুকণা অবিরত ঝরেই চলেছে। যৌবনে না হয় একটু বেহিসেবি ছিলেন। হয়তো টাকাপয়সার ব্যাপারে একটু হিসেবি। মানুষের সবটাই কি ভাল হতে পারে! মানুষ তো তা হলে ভগবান হয়ে যাবে! দুটো পা, দুটো হাত, দুটো কান, দুটো চোখ, অর্থাৎ পাপ আর পুণ্য। বৃদ্ধ মানুষটি আমার মধ্যে তার সন্তানকে দেখেছিলেন। আর হয়তো দেখা হবে না কোনওদিন। এইসব ঠুনকো সেন্টিমেন্টের অর্থ হয় না কোনও।

হরিশঙ্করের হাতে একটা শুকনো গাছের ডাল। গাছের ডাল, কচি বাঁশ, বেত, কুড়িয়ে পাওয়া পাথর এইসব হরিশঙ্করের প্রাণের জিনিস। প্রকৃতিতে মিলিয়ে যেতে হরিশঙ্কর ভীষণ ভালবাসেন। এত বড় মাপের মানুষকে সংসারে ধরে রাখা যায় না। অসম্ভব। আকাশ মানুষের জানলায় উঁকি দেয় বলে আকাশকে ছোট ভাবা, জানলার আকাশ ঘরের আকাশ ভাবা মূর্খতা। হরিশঙ্কর গুনগুন করে গান। গাইছেন। কেদারার আলাপ। পথ বন্ধুর। খন্দে ভরা। যখন ঝোঁপঝাঁপ গাছের দঙ্গলে ঢুকছি তখন। নিচ্ছিদ্র অন্ধকার। আর টেনিস বলের মতো আলো ভেসে ভেসে বেড়াচ্ছে। চিনতে পারিনি। হরিশঙ্কর বললেন, ভয় পেয়ো না। ভূত নয় জোনাকি। এর আলাদা রূপ।

এক জোনাকি দর্শনেই হরিশঙ্কর যেন সমাধিস্থ। সৃষ্টিবিজ্ঞানের সূক্ষ্মতায় চলে গেলেন। স্রষ্টার বিশাল পরিকল্পনা যে কতটা বিশাল তারই আলোচনা চলল! যেখানে যা প্রয়োজন, যতটা প্রয়োজন, সবই আছে। কিছু আবার রেখেছেন লুকিয়ে, গুপ্তধনের মতো করে। মানুষের অনুসন্ধানী প্রতিভা যাতে বাড়ে। মানুষের জ্ঞান-বিজ্ঞান যাতে আরও উন্নত হয়। যেমন অসুখ। অসুখ যেমন দিলেন, সঙ্গে সঙ্গে ওষুধের ব্যবস্থাও করে রাখলেন। খুঁজে নাও। দেহটাকে করে দিলেন ফিজিক্স কেমিস্ট্র কমবাইন্ড। স্টম্যাক একটা ল্যাবরেটরি। স্কেলিট্যান পারফেক্ট ফিজিক্স। হিঞ্জ, ফালক্রাম, গিয়ার, পিনিয়ান। ব্রেন। কম্পিউটার। চোখ ক্যামেরা। হরিশঙ্কর এতটাই অভিভূত যে হাঁটা বন্ধ হয়ে গেল।

অন্ধকারে আমরা দাঁড়িয়ে পড়লুম সেই ধ্বংসাবশেষের সামনে। কোনও এক সময় ছিল বিশাল প্রাসাদ। বাঁকুড়ার ইতিহাস তো সামান্য নয়। একসময় নাম ছিল জঙ্গলমহল। শুধু গণিত? ইতিহাসেও হরিশঙ্কর অপ্রতিদ্বন্দ্বী। কোথাকার ইতিহাস চাই? গ্রিস, রোম, ইজিপ্ট, অটোমান টার্ক, ভারত, এমনকী পশ্চিমবাংলার প্রতিটি জেলা।

আমরা যেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের তিন গেরিলা সোলজার। এইমাত্র প্যারাসুট নিয়ে আকাশ থেকে নেমে এসেছি মধ্যপ্রাচ্যের কোনও রণাঙ্গনের পশ্চাৎভূমিতে। সামনেই ফোর্ট নক্স। দুই জেনারেলে যুক্তি হচ্ছে। পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে! ঝিঁঝি পোকার ঐকতান যে কী ভয়ংকর হতে পারে, সে-ই টের পেলুম। দু’কানের পরদা যেন খুলে পড়ে যাবে!

হরিশঙ্কর আর ছোটদাদুর মুখের ওপর এক ভৌতিক আলো খেলা করছে। দু’জনকেই মনে হচ্ছে আমার অচেনা। হরিশঙ্কর হঠাৎ বললেন, ক্রিস্টাল অফ বীরভানপুর অ্যান্ড দেজুরি।

ছোটদাদু সঙ্গে সঙ্গে বললেন, প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন, পরীক্ষা করে বিশেজ্ঞরা রায় দিলেন…।

হরিশঙ্কর ধরে নিলেন, প্রাগৈতিহাসিক যুগেও এই জেলায় মানুষের বাস ছিল, আর সে মানুষ অরণ্যচারী কাঁচাখেকো মানুষ ছিল না, ছিল সুসভ্য। শিল্প নিদর্শন যা আবিষ্কৃত হয়েছে সেইটাই তার প্রমাণ। অন্ধকারের এই স্থূপটি কী? এনি আইডিয়া?

আদি রাজা ছিলেন মহারাজা সিংহ বর্মন। এটা তাঁর স্মৃতি নয়। শুশুনিয়া পাহাড়ের একপাশে পাথরের গায়ে বিরাট এক জ্বলন্ত চাকার তলায় নিজের কালকে, নিজের রাজত্বের কাহিনীকে কালজয়ী করে রেখে গেছেন। আমার মনে হয় এটা রাজা গোপাল সিংহের কালের।

কোন গোপাল সিংহ! সেই রাজপুত ব্রাহ্মণ, যাঁর রাজত্বসীমা ঘুরে দেখতে যোলো দিনেরও বেশি সময় লাগত। রাজস্ব থেকে বাৎসরিক আয়ের পরিমাণ ছিল তিরিশ থেকে চল্লিশ লক্ষ টাকা। শত্রু-দমনের কাজে যিনি জলকে ব্যবহার করেছিলেন শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে।

সেই সুজা খাঁ!

ঠিক, ঠিক বলেছিস। হান্ড্রেড আউট অফ হান্ড্রেড।

গোপাল সিংহের রাজত্ব ছিল দুর্ভেদ্য। সুজা খাঁ বিশাল বাহিনী নিয়ে আক্রমণ করেছিলেন। মনে পড়েছে?

পড়বে না! গোপাল সিংহর কী ট্যাকটিকস! এসো। এগিয়ে এসো। আরও এসো। একেবারে হাতের মুঠোয়। তারপরেই খুলে দেওয়া হল ড্যামের গেট। জলের তোড়ে সব হাবুডুবু।

কী রাজাই ছিলেন! হোয়াট এ কিং হি ওয়াজ। জমজমাট রাজত্ব। চুরি নেই, ডাকাতি নেই, চোর-জোচ্চর বাটপাড় নেই। দিগ্বিদিক থেকে বণিকরা আসছেন, ভ্রমণার্থীরা আসছেন। অ্যান্ড হোয়াট এ সিস্টেম! রাজসীমায় ঢোকামাত্রই নিরাপত্তার দায়িত্ব রাজপ্রহরীর। ঘাঁটির পর ঘাঁটি। প্রহরী এক ঘাঁটি থেকে আর এক ঘাঁটিতে এনে আর এক প্রহরীর হাতে দায়িত্ব দিয়ে ফিরে যাবে। রিলে সিস্টেম। শুধু হাতে ফিরবে না, ফিরবে রিসিট নিয়ে। পারসন ডেলিভার্ড। মুখ্য প্রহরী আবার রাজার কাছে নিয়মিত খবর পাঠাতে থাকবেন, অতিথি কেমন আছেন, কোথায় আছেন। গোপাল সিংহের রাজত্বে ঢোকা মানে, তুমি স্টেট গেস্ট। তোমার আর কোনও খরচ নেই। সব ফ্রি। থাকা খাওয়া। এমনকী তোমার সওদা, তোমার সম্পদ বয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যে বিনা পারিশ্রমিকে একজন বাহক পাবে। যদি তুমি কিছু হারিয়ে ফেলো, ধরো টাকার থলে, তা হলেও চিন্তার কিছু নেই। যিনিই সেই থলি কুড়িয়ে পান না কেন, সবচেয়ে কাছের কোনও গাছের ডালে ঝুলিয়ে রেখে তিনি নিকটবর্তী চৌকিতে গিয়ে সেই খবর দেবেন। চৌকিরক্ষক তেঁড়া পিটিয়ে সেই খবর সমস্ত জেলাবাসীকে জানিয়ে দেবেন।

ছোটদাদু বললেন, এই ধ্বংসাবশেষ হয়তো সেই গ্রেট কিং গোপাল সিংহের রাজত্বকালের।

একটা তোরণের মতো প্রবেশপথ। সময় যেন সলিড হয়ে গেছে। তারপর প্রবল জঙ্গল। টলের মতো জোনাকির আলো, ফুরফুরে বুদবুদের মতো ভাসছে। তারপর ছোট বড় অন্ধকারের টুকরো। ইতিহাসের অন্ধকার।

হরিশঙ্কর বললেন, আমি ভেতরে দু-এক কদম এগিয়ে দেখি। শুধু ইতিহাস নয়। রহস্যের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে।

ছোটদাদু বললেন, ইদানীং লক্ষ করছি তোর মধ্যে একটা ইনস্যানিটি আসছে। মাঝে মাঝে মনে হয় পাগলামি আসছে। এই অন্ধকারে যেখানে একটা শেয়াল ঢুকতে ভয় পায়, তুই সেখানে কী কারণে ঢুকবি? সাপের ছোবল বিছের কামড় খাওয়ার জন্যে? না কি পড়ে হাত পা ভাঙার জন্যে!

শোন, আদি পৃথিবীটা কেমন ছিল?

তুই আদিম মানুষ নোস!

আমি কিন্তু একেবারে মাথায় এক বিন্দু আলো দেখতে পাচ্ছি।

আমরা তাকালুম। সত্যিই তাই, একটা আলোর ফুটকি জ্বলছে নিবছে। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে একটা নয় দুটো বিন্দু। গা-টা হুঁত করে উঠল। অবশ্যই কোনও ভয়ংকর ডাকাত। হাওয়া থেকে টঙে চড়েছে। সিগারেটে টান মারছে।

ছোটদাদু হঠাৎ হেসে উঠলেন, ভায়া, ওটি একটি বৃহৎ আকারের পাচা, একটু বাতাস নিচ্ছেন। জানবে শিকারি পাখি শিকারি জন্তুর চোখ রাত্তিরবেলায় আগুনের মতো জ্বলে। হিংসার আগুন।

হরিশঙ্কর বললেন, ইউ আর রাইট। রাত যদি না হত আমি এই রেলিকস দেখে ছাড়তুম। এমন একটা জিনিস না দেখে চলে যেতে হচ্ছে, ভেরি স্যাড। ফেরার পথে আমাকে দেখতেই হবে।

তোর সঙ্গে আমি একমত। অতীতের চেয়ে দর্শনীয় আর কী আছে!

আমার হঠাৎ মনে হল, আমাদের কোনও অদৃশ্য শক্তি এখানে ধরে রেখেছে। যেভাবে দু’জনের কথাবার্তা আলোচনা চলেছে, তাতে মনে হচ্ছে এইখানেই রাত ভোর হয়ে যাবে। একপাশে বসে পড়লেই তো হয়!

হঠাৎ আলোচনা থেমে গেল। গোটাকতক প্যাঁচা চ্যাঁ চ্যাঁ করে ডেকে উঠল। ভয়ংকর ডাক। ছোটদাদু বললেন, একটা প্রহর শেষ হল। চলো, আমরা পা চালাই।

হরিশঙ্কর বললেন, এই সময়টায় আমি পৃথিবীর আহ্নিকগতি যেন অনুভব করতে পারি। পৃথিবী তার নিজের অ্যাকসিসে ধীরে ধীরে রিভম্ভ করছে। রাত থেকে দিন, দিন থেকে রাত। রাতের মতো সময় আছে। এমন ঘন, এমন একান্ত একটা সময়! সবকিছুই রহস্যাবৃত। আচ্ছা চলো। এগিয়ে পড়ি।

হঠাৎ ঝুনঝন শব্দ। যেন অনেক কঙ্কাল একসঙ্গে নৃত্য করছে। এ শব্দ আগে কখনও শুনিনি। হরিশঙ্কর চলতে গিয়ে থমকে দাঁড়ালেন, রাজপুরীতে নাচের আসর বসল নাকি?

ছোটদাদু বললেন, শব্দটার সঙ্গে পরিচয় নেই, তাই না!

আগে শুনিনি।

একসঙ্গে অনেক শজারু নাচছে কোথাও। রাতেরবেলা ওদের খুব আনন্দ হয়।

হরিশঙ্কর বলেন, দৃশ্যটা দেখে গেলে হত।

ছেড়ে দে, বিনা নিমন্ত্রণে না যাওয়াটাই ভাল।

আমরা হাঁটছি। একটা ভারী বাতাস বইছে। কষাকষা গন্ধ। জঙ্গলে কত গাছ! কোন গাছের কী গন্ধ। বলা কঠিন। আমাদের হাঁটার গতি একটু কমেছে। ইতিহাস আমাদের ভারাক্রান্ত করে তুলেছে। হঠাৎ ভীষণ একটা পচা গন্ধ এল নাকে।

ছোটদাদু বললেন, মেরেটেরে এনে ফেলে রেখে গেছে। পচা মড়ার গন্ধ।

জায়গাটা আমরা পেরিয়ে এলুম। জঙ্গল কমে আসছে। সামনেই একটা গ্রাম। মাঝরাতে ঘুমিয়ে আছে। ছোট্ট একটা মন্দির। মাথায় একটা সাদা পতাকা উড়ছে। একটা পথ মাঠের ওপর দিয়ে গ্রামের দিকে চলে গেছে। চালা বাড়ি জটলা পাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ঝুপুর ঝাপুর আমগাছ। খেজুরগাছ। মন্দিরটা আমাদের পাশেই পড়ল। সিমেন্ট বাঁধানো ছোট্ট লাল চাতাল। টগর কলকে আর জবা গাছ। মাঝরাতেই ফুল ফুটিয়ে বসে আছে।

ছোটদাদু বললেন, মিনিট পনেরো বসে গেলে কেমন হয়! জায়গাটা ভারী মিষ্টি। যে-ই করুক তার টেস্ট আছে।

হরিশঙ্কর আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার ঘড়িতে কটা বাজছে?

কবজির দিকে তাকিয়ে ভেতরটা ঘঁত করে উঠল। ঘড়িটা নেই। কোথায় গেল ঘড়ি! ভাববার চেষ্টা করলুম। হাতেই তো ছিল। সুইশ ঘড়ি। ওই নামের ঘড়ি আর বাজারে পাওয়া যায় না। এভার হার্ড। সোনার ঘড়ি। জ্যাঠামশাই আমাকে দিয়েছিলেন। মিষ্টি রঙের ডায়াল। সোনার কাঁটা। অপ্রচলিত গড়ন। পিতা হরিশঙ্কর হাতঘড়ি ব্যবহার করেন না। বাবু বাবু দেখায় বলে।

হরিশঙ্কর বললেন, কী হল? দেখতে পাচ্ছ না?

ভয়ে গলা শুকিয়ে গেছে। কোনওরকমে বললুম, ঘড়িটা দেখতে পাচ্ছি না।

সময় দেখতে পাচ্ছ না, না ঘড়িটাই দেখতে পাচ্ছ না!

আজ্ঞে, ঘড়িটাই দেখতে পাচ্ছি না।

তার মানে, মোহনের ওখানেই ফেলে চলে এলে!

মনে হচ্ছে পরেছিলুম।

এখন এই মুহূর্তে কী মনে হচ্ছে!

মনে হচ্ছে, ছোটদাদু আমার হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে আসছিলেন, সেইসময় যদি ব্যান্ড ছিঁড়ে পড়ে গিয়ে থাকে।

ছোটদাদু বললেন, ঘড়ি কি তুমি আজকাল ডান হাতে পরছ? তোমার ডান হাতই তো আমি ধরেছিলুম। তন্ত্রে নির্দেশ আছে কারওকে সঙ্গে নিয়ে বেরোতে হলে, ডান হাত ধরে বাঁ পা আগে ফেলতে হয়। এর ব্যতিক্রম তো হবার কথা নয়। ঘড়িটা তুমি ফেলেই এসেছ।

হরিশঙ্কর আর দ্বিতীয় কথা বললেন না। কোনও হাহাকার নেই, হায় হায় নেই। গেলে গেছে। পাওয়া গেলে পাওয়া যাবে। আপন মনে হাঁটতে শুরু করলেন। পথের মন্দির পেছনে পড়ে রইল। আমি আর ছোটদাদু পাশাপাশি হাঁটছি। ঘড়ি হারাবার বেদনায় অতিশয় কাতর, যেন ঘড়িটার জন্যেই বেঁচে ছিলুম এতকাল। কত স্মৃতি! দামও যথেষ্ট। ঘড়ি তো গেলই, সঙ্গে চলে গেল জ্যাঠামশাইয়ের স্মৃতি।

ছোটদাদু বললেন, খুব মন খারাপ?

ঘড়িটা তো খুবই দামি ছিল। সোনার বডি। কোম্পানিও উঠে গেছে। কত সাবধানে ব্যবহার করতুম! অ্যাকিউরেট টাইম দিত।

তুমি কতক্ষণ বেহুঁশ ছিলে?

বেহুঁশ মানে?

মানে নাগরদোলায় চড়লে। দু’পাক মারলে। চিনেবাদাম কিনলে। কদমতলায় কাঠের চাকার ওপর বসলে। তারপর হুশ হারালে। এই অবস্থায় কতক্ষণ কাটালে?

ছাত্রজীবনে প্রথম সিগারেট খেয়ে ধরা পড়ে যাওয়ার পর যে অবস্থা হয়, আমার সেই অবস্থা। ছোটদাদু জিজ্ঞেস করছেন, তখন তোমার হাতঘড়ি ছিল?

খেয়াল নেই দাদু।

কী করে থাকবে? তুমি তো সম্মোহিত ছিলে। তোমার হাতে ঘড়ি ছিল না। তুমি কী খেয়েছ মনে আছে?

না।

তুমি একটা ভয়ংকর পাল্লায় পড়েছিলে। তোমার জন্যেই ছিটকে বেরিয়ে আসতে হল আমাকে। এই দেখো, তোমার ঘড়ি আমার পকেটে।

ছোটদাদু ঘড়িটা বের করে আমার হাতে দিলেন। হারিয়ে পাওয়ার কী আনন্দ! সবচেয়ে প্রিয়জনের মুখের মতো সেই ঘড়ি। তাড়াতাড়ি হাতে পরতে গেলুম। ছোটদাদু বললেন, সকাল না হওয়া পর্যন্ত আমার পকেটেই থাক। পথের বিপদ কাটেনি এখনও।

ছোটদাদু ঘড়িটা আবার পকেটে পুরলেন।

সময়টা বাবাকে তা হলে বলে দিন।

ওর আর সময় জেনে কী হবে! ও কি অফিসে যাবে বলে বেরিয়েছে।

আবার আমাদের হাঁটার গতি বেড়ে গেল। যেন পেছন দিক থেকে অদৃশ্য কোনও শক্তি আমাদের ঠেলে নিয়ে চলেছে। চলার বেগ বাড়লেও আমার প্রশ্ন থামল না।

ছোটদাদু, মেলার ঘটনা জানলেন কেমন করে!

অতি সহজে। তোমাকে অনুসরণ করে।

কই আপনাকে তো দেখতে পাইনি কোথাও!

তুমি যদি আমাকে দেখতেই পাবে, তা হলে আমার গোয়েন্দাগিরির কী মানে রইল! ওটা বোঝার চেষ্টা কোরো না। শোনো, তুমি এমন এক সাধিকার পাল্লায় পড়েছিলে, যিনি ডাকিনী-হাকিনী চ বিদ্যাচতুষ্টয়ে সিদ্ধ। সহজিয়া বৌদ্ধ তান্ত্রিকদের মতোই এঁদের বিশ্বাস,

এত্থুসে সুরসুরি জমুণা এত্থুসে গঙ্গা সাঅরু।
এত্থুসে পআগ বণারসি এত্থুসে চন্দ দিবাঅরু॥

দেহেই সব। সুরেশ্বরী যমুনা, এখানে গঙ্গাসাগর, এখানেই প্রয়াগ বারাণসী, চন্দ্র, সূর্য, ক্ষেত্র, পীঠ, উপপীঠ, তীর্থক্ষেত্র ও সুখভূমি। তোমাকে বিন্দুসাধনার স্বাদ দিয়েছেন ওই শক্তিময়ী, কিন্তু তোমার আধার অন্য। তাই তোমাকে ঝটকা মেরে নিয়ে এলুম। ওই পথে গেলে তুমি পাগল হয়ে যাবে।

পাগল হয়ে যাব কেন?

তোমার কাম বেড়ে যাবে, তুমি ধারণ না করে বর্জন করবে, তোমার শরীর ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হবে। তোমার ক্ষয়রোগ হবে। তোমার মেধা কমে যাবে। তুমি জড় হয়ে যাবে। নিজের ইন্দ্রিয়ের ওপর অসম্ভব সংযম না থাকলে ওই পথ ধর্মের পথ না হয়ে ব্যভিচারের পথ হবে। দেখলে না, তুমি আসতে চাইছিলে না। সামান্য যেটুকু স্বাদ পেয়েছ, তাইতেই অস্থির হয়ে গেছ।

হরিশঙ্কর হঠাৎ থেমে পড়ে হাসতে লাগলেন।

ছোটদাদু জিজ্ঞেস করলেন, হাসির কারণ?

উলটোটা যদি হয়!

মানে?

আমাদেরই ডাকাত ভেবে গ্রামের লোক যদি পেটায়!

হুঁ, কথাটা তুই মন্দ বলিসনি। সে সম্ভাবনা অবশ্যই আছে।

তার মানে, ডবল রিস্ক। ডাকাতেও মারতে পারে, গ্রামের লোকও পেটাতে পারে। কিন্তু এতটা পথ চলে এলুম, এখনও একেবারেই নিরামিষ। ভেবেছিলুম ফাঁকা মাঠে অন্তত একটা ভূতও দেখতে পাব। সাধারণত খেজুরগাছের তলায় দর্শন হয়। সাদা কাপড় পরা মেয়েছেলে।

তোকে আমি বলিনি, এক-একবার আমরা চারজন হয়েছি। চতুর্থজন কে আমি বলতে পারব না। ঘাড় ঘোরালেই অদৃশ্য। এইবার বুঝে নে।

আমার বুক ঢিপঢিপ। পৃথিবীর যতরকম ভয় আছে সবই আমার আছে। কী পাল্লায় পড়া গেল! একজন ডাকাত হ্যান্ডল করবেন, আর একজন ভূত নাচাবেন। এইবার আমরা গভীরতর জঙ্গলে ঢুকলুম। হরিশঙ্করের কী আনন্দ! এই হল মানুষটির চরিত্রের অনন্য এক দিক। যত বিপদ তত আনন্দ। বল্লভভাই বলেছিলেন, ডেঞ্জার ইজ দি ব্রেদ অফ মাই লাইফ। এই আর একজন তার দোসর। আমাদের সামনে হাতে একটা গাছের শুকনো ডাল নিয়ে নেচে নেচে চলেছেন।

ছোটদাদু বললেন, আমি যখন টেররিস্টের দলে ছিলুম স্বদেশি আন্দোলনের সময়, তখন এই জঙ্গলে তিনটে রাত কাটিয়েছিলুম। তখন বুঝেছিলুম, বিদেশি পুলিশের চেয়েও মারাত্মক হল দিশি মশা। এই জঙ্গলের ভেতরেও একটা ধ্বংসাবশেষ আছে। সেইটাই হয়েছিল আমাদের আশ্রয়। বাড়িটার চারপাশ ভেঙে গেলেও মাঝখানটা আস্ত ছিল। সাদা পাথরের মেঝে। অবাক কাণ্ড, ছোট্ট একটা ঘরে এক দেবীমূর্তি, সিংহবাহিনী। মনের আনন্দে তিন দিন পুজো করলুম। বহু দূরে একটা আগুন দেখা গেল। হরিশঙ্কর বললেন, যাক মনোবাসনা পূর্ণ হল। ডাকাতে আগুন পোহাচ্ছে, এইবার আমাদের জীবনে একটা নতুন অভিজ্ঞতা হবে। নিজেদের একটু প্রস্তুত করে নাও।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *