2 of 3

২.৪৩ তুতুল একা একা

তুতুল একা একা কারুর বাড়িতে কখনো যায়নি। মেডিক্যাল কলেজ ও বাড়ির রাস্তা ছাড়া শহরের রাস্তাঘাট বিশেষ চেনে না। কিন্তু জয়দীপের বাড়িতে তাকে একবার যেতেই হবে। দু’দিন আগে সে হাসপাতাল থেকে বাড়িতে ফিরেছে, তারপর কেমন আছে সে খবর পাওয়া যায় নি। শিখা আর হেমকান্তির কথা ছিল তুতুলকে নিয়ে যাওয়ার, কিন্তু সাড়ে পাঁচটা বেজে গেলো, ওরা এলো না। আর দেরি করা যায় না।

সে মুন্নিকে জিজ্ঞেস করলো, আমার সঙ্গে যাবি এক জায়গায়?

মুন্নির আপত্তি নেই, বাড়ির বাইরে যাবার যে-কোনো সুযোগ পেলেই সে খুশী। এই সদ্য মুন্নির কাছে পৃথিবীটা বড় হতে শুরু করেছে। কয়েকদিন আগে হঠাৎ তাদের স্কুল বাসটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল, মুন্নিকে হেঁটে হেঁটে বাড়িতে ফিরতে হয়েছিল, বড় রাস্তার পাশে পাশে ছোট ছোট গলির দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে তার মনে হচ্ছিল, ঐ সব গলির মধ্যে বাড়িগুলো কী রকম? ওখানে কারা থাকে?

প্রতাপ এখনও বাড়িতে ফেরেন নি। সুপ্রীতি ও মমতা তুতুলের সঙ্গে মুন্নিকে ছাড়তে আপত্তি করলেন না। ওরা যাবে নিউ আলিপুর, বেশি দূরের রাস্তা নয়। জয়দীপের কথা মমতা আর সুপ্রীতি দু’জনেই জানেন, তার জন্য ওরাও খুব চিন্তিত।

একটা হালকা হলদে রঙের শাড়ি পরেছে তুতুল। ছিপছিপে, লম্বা শরীর তার, চুলে সে খোঁপা বাঁধে না। মুন্নিও লম্বা হতে শুরু করেছে, এর মধ্যেই সে তুতুলের কাঁধ ছুঁয়েছে প্রায়। সে পরেছে একটা কচি কলাপাতা রঙের ফ্রক।

রাস্তায় বেরিয়েই মুন্নি বললো, আমি কিন্তু আগে ফুচকা খাবো।

তুতুলের এখন নিজস্ব উপার্জন হয়েছে, তার হাতব্যাগে কিছু টাকা থাকে। কিন্তু সে ফুচকা, আলু কাবলি ইত্যাদি খাবার একেবারেই পছন্দ করে না, রাস্তায় কতরকম ধুলোময়লা ওতে মেশে, যে-লোকটা ফুচকা দেয় সে টক-জলের হাঁড়িতে হাত ডোবায়, তার জলে কতরকম দৃষিত জীবাণু আছে তার ঠিক কী! সে বললো, ওসব খেতে হবে না, আমি তোকে আইসক্রিম খাওয়াবো।

মুন্নি তবু কিছুক্ষণ ফুচকার জন্য বায়না ধরলেও তুতুল তাকে প্রশ্রয় দিল না। কালিঘাট স্টপে দুটি আইসক্রিমের কাপ কিনে দু’জনে আগে শেষ করলো, তারপর উঠে পড়লো সাত নম্বর বাসে।

দুটি লোক লেডিজ সিট ছেড়ে দিতে ওরা জায়গা পেয়ে গেল। যে-দুটি লোক উঠে দাঁড়ালো, তাদের মধ্যে একজন বললো, আরে, মুন্নি, কেমন আছিস রে তোরা?

মুন্নি চোখ তুলে বললো, কানুকাকা?

কানু প্রথমে তুতুলকে লক্ষ করেনি। এর পরেই তুতুলকে দেখে সে বললো, ও তুতুল, কত বড় হয়ে গেছিস রে! তুই তো এখন পুরোপুরি ডাক্তার হয়ে গেছিস, তাই না? আমার শালাও

তোর সঙ্গে পাশ করেছে, তার নাম অনিরুদ্ধ, চিনিস তো?

বাসের ভিড়ের মধ্যে এই রকম যে-কোনো কথাই অন্য যাত্রীরা খুব মন দিয়ে শোনে, তারা মুখের দিকে তাকায়, সেইজন্য বাসের মধ্যে জোরে জোরে কথা চালানো তুতুলের পছন্দ নয়। সে শুধু মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানালো।

মুন্নি উঠে দাঁড়িয়ে বললো, কানুকাকা, তুমি বসো।

কানু তার ঘাড় ধরে চেপে বসিয়ে দিয়ে বললো, আরে না, না, তুই বোস, তুই বোস, আমার গাড়িটা কারখানায় দিয়েছি, তাই ক’দিন আমায় বাসে চাপতে হচ্ছে।

তুতুল আরও সঙ্কুচিত বোধ করলো। কানুকাকার যে নিজস্ব গাড়ি আছে সে কথাটা বাসের যাত্রীদের না জানালে কি চলতো না?

কানু আবার জিজ্ঞেস করলো, এদিকে কোথায় যাচ্ছিস রে, তোরা? আমার ওখানে আসবি নাকি, চল না?

মুন্নি মাথা নেড়ে বললো, না, না, আমরা এখন নিউ আলিপুরে যাচ্ছি, ফুলদির এক বন্ধুর বাড়িতে।

কানু অবশ্য নেমে পড়লো টালিগঞ্জ ফাঁড়ির কাছে। তার আগে সে শুনিয়ে গেল নিজের সম্পর্কে অনেক খবর। শুধু বাসের যাত্রীদের মনোযোগ টানার জন্যই নয়, এসব খবর সে মুন্নি ও তুতুল মারফত প্রতাপকে জানাতে চায়। আনোয়ার শা রোড ছাড়িয়ে মাত্র সাত মিনিটের হাঁটা পথে সে একটি বাড়ি কিনেছে, তার তৃতীয় সন্তান জন্মেছে দু’মাস আগে, তার বড় মেয়েটি ক্লাসে সেকেণ্ড হয়েছে, দেওঘরের জামাইবাবু তার কাছে এক হাজার টাকা ধার চেয়ে চিঠি লিখেছে, ইত্যাদি।

কানু নামবার পর মুন্নি চুপি চুপি জিজ্ঞেস করলো, আচ্ছা ফুলদি, কানুকাকা আমাদের বাড়িতে আর আসে না কেন?

তুতুল বললো, কী জানি!

মুন্নি বললো, অনেকদিন আগে, বাবা একদিন কানুকাকাকে খুব মেরেছিল, আমার মনে আছে!

তুতুল বললো, চুপ, ওসব কথা বলতে নেই।

নিউ আলিপুরে নেমে ওদের খানিকক্ষণ ঠিকানা খোঁজাখুঁজি করতে হলো। যদিও জয়দীপের বাড়িতে এর আগে তুতুল দু’বার এসেছে বন্ধুদের সঙ্গে। কিন্তু এখন সে বাড়ি চিনতে পারছে না। একজন রিকশাওয়ালা পৌঁছে দিল ওদের।

সামনে লোহার গেট বসানো বাড়ি, ভেতরে খানিকটা বাগান। গেটের সামনে একটি ফুচকাওয়ালাকে ঘিরে চার-পাঁচটি ছোট ছেলেমেয়ে দাঁড়িয়ে। মুন্নি মুচকি হেসে তুতুলের দিকে তাকাতেই তুতুল ভুরু নাচিয়ে নিষেধের ভঙ্গি করলো। মুন্নি এখানে ফুচকা খাবে না তা ঠিকই, তবু ফুলদির বন্ধুর বাড়ির ছেলেমেয়েরাও যে ফুচকা খায়, এটা দেখে তার মজা লেগেছে।

দোতলার বারান্দায় গেঞ্জি পরা একজন মধ্যবয়স্ক, সুঠাম পুরুষ দাঁড়িয়ে, তিনি তুতুলকে দেখতে পেয়ে বললেন, কুকুর বাঁধা আছে, সোজা ওপরে উঠে এসো।

জয়দীপের ঘরটির তিনদিকে জানলা, প্রচুর আলো বাতাস, এরকম ঘরে ঢুকলেই মন ভালো লাগে। তিনটি বালিসে মাথা হেলিয়ে আধো শোওয়া হয়ে জয়দীপ আগাথা ক্রিস্টির উপন্যাস পড়ছিল, তুতুলকে দেখে বইটি নামিয়ে রাখলো, কিন্তু কোনো সম্ভাষণ করলো না, হাসলো না, তাকিয়ে রইলো সোজা।

জয়দীপের দাদা শঙ্কর আর ওদের মা এসেছেন সঙ্গে সঙ্গে। তুতুল জিজ্ঞেস করলো, শিখা ওরা আসে নি? আসবে বলেছিল?

মা বললেন, না, আর তো কেউ আসে নি। তুমি এসেছো, খুব ভালো করেছো, দ্যাখো তো, খোকা আমাদের কারুর সঙ্গে কথা বলতে চায় না। কী যে হয়েছে, এরকম করলে চলে? সব ডাক্তার বলেছেন, ভয়ের কিছুই নেই!

তুতুল এগিয়ে গিয়ে জয়দীপের একটা হাত ধরে বললো, কেমন আছো, আজ? জয়দীপের দৃষ্টি একইরকম স্থির, কোনো উত্তর দিল না।

মা বললেন, বহ্নিশিখা, তুমি ঐ চেয়ারটায় বসো। খানিকক্ষণ থাকো, ও নিশ্চয়ই তোমার সঙ্গে কথা বলবে। এই মেয়েটিকে আমি ভেতরে নিয়ে যাই?

অচেনা বাড়িতে এসে মুন্নি তার দিদির পাশ ছাড়তে চায় না। কিন্তু তুতুল বুঝলো, জয়দীপকে কথা বলাতে গেলে ঘরে অন্য কারুর না থাকাই ভালো। সে হেসে বললো, মাসিমা, এ আমার মামাতো বোন, ফুচকা খেতে খুব ভালোবাসে, আপনাদের গেটের সামনে একটা ফুচকাওয়ালা রয়েছে দেখছি, ও বরং সেখানেই যাক।

মুন্নি সঙ্গে সঙ্গে বললো, না, আমি এখন ফুচকা খাবো না।

তুতুল চোখ দিয়ে মিনতি করে বললো, তাহলে মাসিমার সঙ্গে ভেতরে যা না মুন্নি। তোর বয়েসী একটি মেয়ে আছে এ বাড়িতে, তার ঘরে গিয়ে বোস। অনেক বই আছে…

অন্যরা বেরিয়ে যাবার সময় শঙ্কর দরজাটা টেনে বন্ধ করে দিয়ে গেলেন।

জয়দীপের হাতে হাত রেখে তুতুল কিছুক্ষণ চুপ করে চেয়ে রইলো। কণ্ঠার হাড় জেগে গেছে জয়দীপের, চোখের নিচে গাঢ় কালো ছাপ, নাকটা খাড়া দেখাচ্ছে। খেলোয়াড়-সুলভ স্বাস্থ্য ছিল তার।

তুতুলের নিজেরই কথা-না বলা রোগ হয়েছিল। সেইসব দিনগুলি তার ভালোই মনে আছে। কিছুতেই বাড়ির লোকজনের সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করতো না। যদিও কোনো যুক্তি ছিল না, কিন্তু মনকে বোঝানো যেত না সেই যুক্তি দিয়ে। অন্যদের অধিকাংশ কথাই মনে হতো অর্থহীন। কত তুচ্ছ কথা নিয়ে মানুষ সারা দিন মুখ চালায়!

এই জয়দীপ ছিল কী দুর্দান্ত, দুরন্ত ও উচ্ছঙ্খল। মেডিক্যাল কলেজে প্রথম দুটো বছর সে তুতুলকে কম জ্বালিয়েছে! চিঠি লিখেছে বেনামীতে, কাটুন এঁকেছে ব্ল্যাক বোর্ডে, রাস্তায় যখন তখন সামনে এসে দাঁড়িয়ে অদ্ভুত সব মন্তব্য করেছে। এক সময় শুধু এই জয়দীপের জন্যই তুতুল ডাক্তারি পড়া ছেড়েই দেবে ভেবেছিল। এই শেষ বছরটিতেই জয়দীপের সঙ্গে তার ভাব হয়, জয়দীপই তার মানসিক জড়তা কাটিয়ে দিয়েছে বলতে গেলে। পড়াশুনোতেও সাহায্য করেছে, অ্যানাটমি প্র্যাকটিক্যালে তুতুল খুব নার্ভাস বোধ করতো, জয়দীপ তাকে ধরে রাখতে জোর করে। ফাইন্যাল এম বি বি এস-এ জয়দীপ আর সে প্রায় একই রকম রেজাল্ট করেছে।

জয়দীপের বাঁ কানের ঠিক নিচে একটা বেশ বড় মতন আঁচিলের মতন ছিল, হঠাৎ সেদিকে নজর পড়লে মনে হতো জয়দীপ বুঝি এক কানে দুল পরেছে। শুধু বন্ধুবান্ধবরা নয়, জয়দীপ নিজেও হাসিঠাট্টা করতো সেই আঁচিলটা নিয়ে। পরীক্ষার পর থেকেই জয়দীপের সেই আঁচিলটা বড় হতে শুরু করে, ক্রমশ সেটা একটা রয়াল গুলির মতন হয়ে যায়, সুতরাং সেটা কেটে বাদ দেওয়া ছাড়া উপায় নেই। ওদের সাজারির প্রফেসর ডাঃ জি, ব্যানার্জি নিজে ওটা অপারেশন করে দেবেন বলেছিলেন। অপারেশানের নির্দিষ্ট তারিখের ঠিক দুদিন আগে জয়দীপ কলুটোলার মোড়ের কাছে হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায়, তার সঙ্গে তখন হেমকান্তি আর প্রদীপ ছিল, ওরা জয়দীপকে ধরাধরি করে নিয়ে আসে এমারজেন্সীতে। একঘণ্টা পরে জ্ঞান ফিরলেও জয়দীপ মাথায় অসহ্য ব্যথা নিয়ে ছটফট করছিল…

জয়দীপের চোখ থেকে চোখ সরিয়ে তুতুল একবার ডান দিকের জানলাটার দিকে তাকালো। জানালার ঠিক বাইরেই একটা কৃষ্ণচূড়া গাছ, এই মধ্য এপ্রিলে সেটা ফুলে ভরে গেছে। বেশ হাওয়া দিচ্ছে আজ, আন্দোলিত ডালপালাগুলি দেখলে মনে হয়, এইখানটায় বাতাসের রং লাল। কোথায় যেন শানাই বাজছে। কয়েক মুহূর্তের জন্য অন্যমনস্ক হয়ে গেল তুতুল, তাতেই তার চোখ জ্বালা করে আসছিল, সঙ্গে সঙ্গেই সে আবার মনটা ফিরিয়ে, চোখকে সংযত করে বললো, বাঃ, তোমার জানলার ধারে কী সুন্দর একটা গাছ!

জয়দীপের দৃষ্টি এখন তীব্র, এখনও সে কথা বলছে না। মাথার ব্যথার জন্য বা অপারেশনের জন্য জয়দীপের বাকশক্তির যে কোনো ক্ষতি হয়েছে তা নয়, সে ইচ্ছে করে কথা বলছে না, যেন তীব্র এক অভিমানে সে মৌন।

তুতুল আবার বললো, হেমকান্তি আর শিখা একটু পরেই নিশ্চয়ই এসে পড়বে। জানো জয়দীপ, একটা মজার কথা শুনবে? কাল প্রথম আমি প্রাইভেট প্র্যাকটিসে রোজগার করলুম। আমাদের বাড়িওয়ালার ছেলের হঠাৎ রাত্তিরবেলা নাক দিয়ে রক্ত পড়তে শুরু করেছিল, আমায় ডেকে পাঠালো, এমন কিছু ব্যাপার নয়, বুঝতেই পারছো, আমি টাকা নিতে চাইনি, টাকা নেবার কোনো প্রশ্নই ওঠে না, কিন্তু ওরা কিছুতেই ছাড়বে না, ডাক্তারকে ভিজিট না দিলে নাকি রুগীর অকল্যাণ হয়, জোর করে আমার ব্যাগে কুড়িটা টাকা গুঁজে দিল। তাহলে আমার ফি ঠিক হয়ে গেল, কুড়ি টাকা? বাড়িওয়ালা নিজে এসে আমার মামাকে আবার বলে গেল, আমি নাকি খুব ভালো ডাক্তার, একবার ওষুধেই কাজ হয়েছে, এবার থেকে ওরা সবাই আমাকেই দেখাবে!

একলা একলা হাসতে গিয়ে থেমে গেল তুতুল। জয়দীপকে কথা বলতে গিয়ে সে নিজে। বেশি কথা বলে ফেলছে, এরকম তার স্বভাব নয়। তার নিজের কানেই নিজের কথাগুলো অদ্ভুত লাগছে। হেমকান্তিরা যদি এসে পড়তো…

হাতব্যাগ খুলে সে একটি ছোট প্যাকেট বার করে বললো, আমার প্রথম ভিজিটের টাকায় তোমার জন্য একটা জিনিস কিনে এনেছি। এর মধ্যে কী আছে বলো তো!

প্যাকেটটা জয়দীপের হাতে সে গুঁজে দিল। জয়দীপ সেটা ঠেলে সরিয়ে দিল না বটে, কিন্তু খুলেও দেখলো না, রেখে দিল মাথার কাছে।

কানের নিচের আলুটা নেই, শেলাইও কেটে দেওয়া হয়েছে, মুখখানা এখন অনেক পরিষ্কার দেখাচ্ছে। সে কি নিজে দাড়ি কামিয়েছে না বাড়িতে নাপিত এসে কামিয়ে দিয়েছে? জয়দীপের মতন ছেলে চুপচাপ বিছানায় শুয়ে থাকবে, কোনো কথা বলবে না, এ যেন বিশ্বাসই করা যায় না।

আগাথা ক্রিস্টির বইটা তুলে নিল তুতুল। সেটা দেখিয়ে সে আবার বললো, তুমি আমার সঙ্গে কথা বলবে না? তা হলে… এই বইটা আমার পড়া, কে খুনী এক্ষুনি বলে দেবো!

জয়দীপ এবারে খাটের অন্যদিকে সরে গিয়ে বেড সাইড টেবিলের ড্রয়ার খুলে সিগারেট-দেশলাই বার করলো। ডাক্তার ব্যানার্জি জয়দীপের সিগারেট খাওয়া একেবারে নিষিদ্ধ করে দিয়েছেন, কিন্তু তুতুল বুঝলো, এখন তাকে বারণ করে লাভ নেই। বরং সে মুখ ঝুঁকিয়ে বললো, দাও, আমি দেশলাই জ্বেলে দিচ্ছি।

জয়দীপ এতে আপত্তি করলো না। তুতুল তার সিগারেট ধরিয়ে দেবার পর খানিকটা ধমকের সুরে বললো, এটা কী হচ্ছে তোমার? কেন কথা বলছো না?

সিগারেটে বড় টান দিয়ে আস্তে আস্তে জয়দীপ বললো, যারা সত্যি কথা বলে না, তাদের সঙ্গে আমার কথা বলতে ইচ্ছে করে না।

তুতুল ঝাঁঝের সঙ্গে বললো, আমি… আমি মিথ্যে কথা বলি কখনো?

তুতুলের একখানা হাত শক্ত করে চেপে ধরে জয়দীপ জিজ্ঞেস করলো, তাহলে বলো, বায়োপসির রিপোর্ট কী?

তুতুলের যেন হঠাৎ দম আটকে গেছে, সে কোনো কথা বলতে পারছে না। তার ধারণা ছিল, একটা ডুপ্লিকেট রিপোর্ট জয়দীপকে দেখানো হয়ে গেছে। হেমকান্তিরাই সে ব্যবস্থা করেছে।

তুতুলের হাতে একটা জোরে ঝাঁকুনি দিয়ে জয়দীপ আবার জিজ্ঞেস করলো, বলো?

–রিপোর্ট তুমি দেখো নি?

–একটা ফস রিপোর্ট দেখিয়ে আমাকে ভোলাবার চেষ্টা। আমি ছেলেমানুষ? গাঁজায় দম দিয়ে ডাক্তারি পাশ করেছি? আসল রিপোর্টে আছে কারসিনোমা, তাই না?

এবারে তুতুলের চুপ করে থাকার পালা। মাথা হেঁট করে সে তার শাড়ির পাড় দেখছে। যদিও সে বুঝতে পারছে, তার নীরবতা এখন মস্ত বড় ভুল, যতই সে দেরি করছে ততই ভুল হয়ে যাচ্ছে, তবু তার গলায় স্বর আসছে না।

তুতুলের হাত ছেড়ে দিয়ে জয়দীপ পুরোপুরি শুয়ে পড়ে বললো, মাথার একঘেয়ে ব্যথাটা এখনো কেউ কমাতে পারলো না।

বন্ধ দরজার ওপাশে কে যেন দাঁড়িয়ে আছে। খুব সম্ভবত জয়দীপের মা। তিনি কি জয়দীপের কথাগুলো বুঝতে পারছেন? তবু জয়দীপ যে কথা বলছে, তা বুঝতে পেরেই তিনি খুশী।

তুতুল মুখ তুলে বললো, একেবারে ফাস্ট স্টেজ, এমন কিছুই ব্যাপার নয়।

জয়দীপ বললো, এটাও মিথ্যে কথা। একটু মধু মাখানো খুব তেতো মিথ্যে।

তুতুল এবারে জোর দিয়ে বললো, না, এটা মোটেই মিথ্যে নয়। একটুও মিথ্যে নয়। শোনো, আমাদের স্যার, মানে ডক্টর ব্যানার্জি তোমাকে একটা কথা জানাতে বলেছেন। উনি নিজেও আসবেন। তুমি যদি লন্ডনে গিয়ে চিকিৎসা করাতে চাও, উনি সব ব্যবস্থা করে দেবেন।

ঘরের ছাদের দিকে তাকিয়ে জয়দীপ বললো, আমিও লন্ডনে যাবার কথা ভেবেছি। এত সহজে আমি ফুরিয়ে যেতে চাই না, আই শ্যাল ফাঁইট টু দা লাস্ট।

তুতুল জয়দীপের বুকে হাত রেখে ব্যাকুলভাবে বললো, জয়দীপ, বিশ্বাস করো, এই স্টেজে একদম সারানো যায়, তুমি পারফেক্টলি নমল জীবন যাপন করতে পারবে, স্যার বারবার বলেছেন।

জয়দীপ খানিকটা ঠাট্টার সুরে বললো, একদম সেরে যাবে, তাই না? বেশ ভালো কথা। লন্ডনেই যাবো। তুমিও চলো। তুমিও আমার সঙ্গে চলো।

–আমি? আমি কী করে যাবো?

-–কেন, যাবে নাই বা কেন? ওখানে এফ আর সি এস করে আসবে। আমি যদি সেরে উঠি আমিও তো ওখানে পড়বো।

–তা বলে কি আমি যেতে পারি? আমার পক্ষে সম্ভব নয়।

–কেন, অসম্ভব কিসের? লন্ডনে আমার বড় মামা থাকেন, বেলসাইজ পার্কের কাছে নিজের বাড়ি, আমি ছেলেবেলায় একবার লন্ডনে গিয়েছিলুম, সে বাড়ি দেখে এসেছি, তুমি প্রথম কিছুদিন সেখানে থাকতে পারো। এদেশ থেকে যারা যায়, তারা অনেকেই প্রথমে আমার বড়মামার ওখানে ওঠে। উনি খুশী হয়ে থাকতে দেন, ওঁর অবস্থা বেশ ভালো। বড়মামা নিজেও ডাক্তার, ওখানে অ্যাডমিশনের ব্যবস্থা করে দিতে পারবেন।

–আমার যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না, জয়দীপ।

–তুমি না গেলে আমি যাবোই না।

–এটা তোমার ছেলেমানুষী! ঠিক বাচ্চা ছেলের মতন তুমি গাল ফুলিয়ে কথা বলছে।

–তোমার প্যাসেজ মানির কথা ভাবছো? যদি জোগাড় করতে না পারো, আমার কাছ থেকে ধার নেবে। লজ্জার কিছু নেই, পরে শোধ দিয়ে দেবে আমাকে।

–তুমি বুঝতে পারছে না, আমার মা আছেন, মাকে ফেলে কী করে যাবো?

–তুমি কি তোমার মায়ের কাছে চিরকাল থাকবে নাকি?

-–মা আমাকে ছাড়বেন না।

–তোমার মা যদি তোমাকে আঁকড়ে ধরে রাখেন, সেটা তাঁর স্বার্থপরতা। ঠিক আছে, তোমার মাকে আমি বুঝিয়ে বলবো। আমি সব ব্যবস্থা করবো তোমার জন্য।

–জয়দীপ, প্লীজ! বুকের ওপর রাখা তুতুলের হাতের ওপর নিজের হাত রেখে জয়দীপ হুকুমের সুরে বললো, তুমি না গেলে আমি যাবো না। আমার বুক ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করো, তুমি যাবে?

দরজা ঠেলে ঢুকে পড়লো হেমকান্তি আর শিখা। শিখা বললো, এমন ট্রাফিক জ্যামে পড়ে গিয়েছিলুম

জয়দীপ ওদের দিকে না তাকিয়ে তুতুলের চোখের দিকে সেই আদেশের দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো, সে তুতুলের মুখ থেকে শপথটা শুনতে চায়। তুতুল হাতটা সরিয়ে নিতে গেল, পারলো না।

হেমকান্তি ওদের এই অবস্থায় দেখে বললো, প্রেমালাপ হচ্ছে, ডিসটার্ব করলাম বুঝি?

তুতুল এবারে জোর করে সরিয়ে নিল নিজের হাত।

এর পর আর বেশিক্ষণ সে রইলো না, তার ফিরতে দেরি হয়ে যাবে। মুন্নির পড়াশুনোনা আছে। হেমকান্তিরা তাকে ধরে রাখার চেষ্টা করেও পারলো না।

হেমকান্তিরা এসে পড়ায় তুতুল স্বস্তি পেয়েছে। শেষ পর্যন্ত তাকে প্রতিজ্ঞা করতে হয় নি। আর একটু সময় পেলে জয়দীপ নিশ্চয়ই তার মুখ থেকে কথা আদায় করে নিত। জয়দীপের পাগলামি। বিলেত যাওয়া কি মুখের কথা, জয়দীপদের অনেক পয়সা-টাকা আছে, জয়দীপ যেতে পারে। হেমকান্তিও যাবার চেষ্টা করছে। হেমকান্তিই জয়দীপকে দেখাশুনো করতে পারবে ওখানে।

এর পর কদিনের মধ্যেই জয়দীপের যাওয়ার ব্যবস্থা দ্রুত ঠিকঠাক হয়ে গেল। ওর শরীর ভেঙে পড়ছে। তুতুল জয়দীপকে আরও কয়েকবার দেখতে এসেছে, কিন্তু কখনো তার ঘরে একা থাকেনি। জয়দীপ যে তুতুলের মায়ের সঙ্গে কথা বলবে বলেছিল, তা সম্ভব হয় নি জয়দীপের একা চলাফেরার ক্ষমতা ছিল না, সে চাইলেও তাকে বাড়ি থেকে বেরুতে দেওয়া হয় নি।

সহপাঠী, বন্ধুবান্ধবরা দল বেঁধে গেল দমদম এয়ারপোর্টে জয়দীপকে সি-অফ করতে। যাওয়ার দিনটিতে জয়দীপকে বেশ সুস্থ দেখাচ্ছে, সে হাঁটছে সাবলীল ভাবে, হাসি-ঠাট্টা করলো কয়েকজনের সঙ্গে, অনেকটা যেন পুরোনো জয়দীপ।

তুতুল রয়েছে একটু দূরে-দূরে। জয়দীপের আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে অনেক সুন্দরী সুন্দরী মেয়ে ঘিরে আছে তাকে। কত ফুল এসেছে জয়দীপের জন্য।

ধপধপে সাদা শাড়ী পরা জয়দীপের মা চিন্ময়ী সর্বক্ষণ দাঁড়িয়ে আছেন ছেলের পাশে। আজ তাঁর মুখখানা পরিষ্কার, কোনো দুশ্চিন্তার রেখা নেই। হেমকান্তির যাওয়ার কথা ছিল জয়দীপের সঙ্গে, কিন্তু তার বাবা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায় হেমকান্তির যাওয়ার দিন পিছিয়ে দিতে হয়েছে, জয়দীপ লণ্ডনে একাই যাবে। চিন্ময়ী জানেন তাঁর ছেলের কী অসুখ, তবু তিনি ভেঙে পড়েননি। একটুও, অন্তত বাইরে থেকে দেখে কিছুই বোঝা যায় না। চিন্ময়ীকে দেখে খুব শ্রদ্ধা হয় তুতুলের।

অন্যদের সঙ্গে কথা বলতে বলতেও জয়দীপ মাঝে চোখ তুলে তাকাচ্ছে তুতুলের দিকে। তুতুলকে সে কাছে আসতে ইঙ্গিত করছে। তবু তুতুল থাকছে দূরে দূরে। বিদায় নেবার সময় জয়দীপ যদি বেশী আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে, তাহলে সে সামলাবে কী করে? জয়দীপের সঙ্গে তার সম্পর্কটা যে শুধু বন্ধুত্বের, তা অনেকেই বোঝে না। জয়দীপ অবশ্য কয়েকবার প্রেমের কথা বলার চেষ্টা করেছে, ঠিক প্রেমের কথাও নয়। সে এমন ভাব দেখিয়েছে যেন তুতুল তার নিজস্ব সম্পত্তি, তুতুল অবশ্য জয়দীপের সে ভাবনার একটুও প্রশ্রয় দেয়নি। জয়দীপকে সে অগ্রাহ্য করতেও পারেনি, অথচ বন্ধুর বেশী আর কিছু মনেও করেনি।

হঠাৎ বাথরুমে যাবার নাম করে জয়দীপ চলে এলো তুতুলের কাছে। নিচু গলায় বললো, আমি পৌঁছেই সব ব্যবস্থা করে চিঠি দেবো। টিকিট পাঠিয়ে দেবো। মনে থাকে যেন, আমার বুকে হাত রেখে প্রতিজ্ঞা করেছে।

তুতুল বলতে গেল, না, না, আমি তো প্রতিজ্ঞা করিনি। বুকে হাত রেখেছিলুম শুধু। আমি যেতে পারবো না, জয়দীপ।

কিন্তু একেবারে বিদায়ের সময় এরকম কথা উচ্চারণ করতে পারলো না তুতুল। যদি জয়দীপ আবার পাগলামি শুরু করে। যদি আঘাত পায়। থাক, পরে চিঠিতে জানিয়ে দিলেই হবে। এখন তার চোখ জ্বালা করছে, চোখে এত জ্বালা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *