২.৪১
অবনীমোহনের সঙ্গে একদিন হাটে গিয়ে বিনু দেখে এসেছিল, একদানা ধানচাল পাওয়া যাচ্ছে না। নদীর পাড় ঘেঁষে সারি সারি আড়তগুলো তালাবন্ধ। বিনু শুনে এসেছিল, এখান থেকে বিশ মাইল উত্তরে গিরিগঞ্জ নামে যে বাজারটা আছে সেখানে ক’টা ধানচালের দোকান লুট হয়ে গেছে।
সেই থেকে অবস্থা দিন দিন আরও খারাপ হয়ে যাচ্ছে। সারা রাজ্য থেকে খাদ্যশস্য উধাও হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে দূর দূরান্তের হাট থেকে লুটপাটের খবর আসে। চারদিকের গ্রামগুলো থেকে, নদীর চরগুলো থেকে আরও যা খবর পাওয়া যায় তা ভয়াবহ। ধানচাল নেই, তাই ওসব জায়গার বাসিন্দারা মেটে আলু, মিট কুমড়ো, কচু, কন্দ, শাপলা শালুক সেদ্ধ করে প্রথম দিকে চালিয়েছে। তারপর আমাপাতা, জামপাতা, শিউলি পাতা, যা পেয়েছে তাই খেয়েছে। এখন নাকি ইঁদুর, খরগোশ পুড়িয়ে খাচ্ছে।
ধানচাল উধাও হবার পর হেমানাথের বাড়ি লোকজনের আনাগোনা বেড়ে গেছে। প্রতিদিনই দুপুরে আট দশ জন করে বাইরের লোক খেয়ে যাচ্ছে। আজকাল নিবারণ পিওন প্রায়ই আসে। এছাড়া এ গ্রামের, ও গ্রামের চেনা-অচেনা কত মানুষ যে আসছে। ঠিক দুপুরবেলা বার-বাড়ির উঠোনে এসে করুণ গলায় তারা বলে, অতিথ আসলাম গো মা-ঠাইরেন, পাঁচ দিন প্যাটে ভাত পড়ে নাই।
এ তো গেল দুপুরবেলার কথা, রাতের অন্ধকারে যুগীপাড়া-ঋষিপাড়া-নমঃশূদ্রপাড়ার বৌ-ঝিরা আসে। স্নেহলতাকে বলে, দুই মুঠা চাউল দ্যান গো বইনদিদি, তিনদিন আখা (উনুন) ধরাই নাই।
চিরদিন স্নেহলতা বা হেমনাথ দিয়ে এসেছেন, কাউকে কখনও বিমুখ করেন নি। এই দুঃসময়েও তারা দিয়েই যাচ্ছেন। কিন্তু এভাবে কতদিন চলবে, কে জানে।
প্রতি বছরই মাঠ থেকে ধান উঠবার পর খোরাকির চাইতে কিছু বেশি রেখে বাদবাকি বেচে দেন হেমনাথ। যেভাবে লোকজন খেয়ে যাচ্ছে, যুগীপাড়া-ঋষিপাড়ার বউ-ঝিরা চাল নিচ্ছে, তাতে নিজেদেরই হয়তো একদিন উপোস দিয়ে থাকতে হবে। কিন্তু পরের কথা ভেবে স্নেহলতা বা হেমনাথ মন ভারক্রান্ত করেন না। পরে যা হবার হবে, এখন মানুষের প্রাণ তো বাঁচুক।
.
দেখতে দেখতে আরেক পুজো চলে গেল।
পুজোর পর মাঠের জলে যখন টান ধরল, ধানের শিষগুলো গাঢ় সবুজ হয়ে এল, সেইসময় একদিন হরিন্দ এবং তার দুই মোষের মতো ঢাকী কাগা বগা রাজদিয়ার রাস্তায় ঢেঁড়া দিয়ে গেল। যার যত নাও আছে, তিন দিনের ভিতরে হগল থানায় জমা দিবা। গরমেনের হুকুম। জমা না দিলে বিপদ আছে–
বিনু স্কুলে যেতে যেতে ঢেঁড়া শুনে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, নৌকো জমা দিতে হবে কেন?
হরিন্দ যা বলল তা এইরকম। জাপানিরা যে কোনও দিন পূর্ব-বাংলায় এসে পড়তে পারে। এসেই যদি নৌকো পেয়ে যায়, মিত্রশক্তির পক্ষে বিপদ ঘটে যাবে। তাই সতর্কতা এবং নিরাপত্তার কারণে নৌকো আটক করা হচ্ছে। বিপদ কেটে গেলেই ফেরত দেওয়া হবে।
বিনু একাই না, রাজদিয়ার আরও অনেকে হরিন্দদের চারপাশে ভিড় জমিয়েছিল। তাদের ভেতর ভীত, সন্ত্রস্ত গুঞ্জন উঠল, হে ভগমান, নাও হইল আমাগো হাত-পাও। নাও যদিন আটকায়, আমরা কী করুম? খাম কী?
এইবার মরণ, মরণ—
তিন দিনের মধ্যেই দেখা গেল, খাল-বিল-নদী শূন্য করে থানার পাশের মস্ত মাঠটায় অসংখ্য নৌকো উঠে এসেছে। গাছি, ভাউলে, মহাজনী, কোষ, একমাল্লাই, দু’মাল্লাই, চারমাল্লাই কত রকমের যে নৌকো তার লেখাজোখা নেই।
শুধু রাজদিয়ারই নয়, চারদিকের গ্রাম-গঞ্জ-জনপদ, সব জায়গার নৌকোই আটক করা হয়েছে।
নৌকো আটকের পর একটা সপ্তাহও কাটল না।
সেদিন স্কুলে যাবার সময় বিনু দেখতে পেল, নদীর পাড়ে বিরাট ভিড় জমেছে। পায়ে পায়ে এগিয়ে একটা অদ্ভুত দৃশ্য দেখে সে বিমূঢ় হয়ে যায়।
শত শত লোক নদী সাঁতরে রাজদিয়ার দিকে আসছে। তারা পাড়ে উঠতেই কে যেন জিজ্ঞেস করল তোমরা কুনখানের মানুষ?
আগন্তুকদের মধ্যে একজন বলল, চরবেউলার।
নদী সাতইরা আইলা যে?
কী করুম, গরমেন নাও লইয়া গ্যাছে। হেয়া ছাড়া আমাগো চরে এক দানা চাউল নাই। পোলামাইয়া লইয়া না খাইয়া জান যায়।
আরেকজন বলল, হুদা (শুধু) আমাগো চর নিকি, কুনোচরেই চাউল নাই। দ্যাখেন না,দুই-একদিনের ভিতরে আরও কত মানুষ রাইজদায় আসে।
সত্যিই দেখা গেল, কয়েকদিনের মধ্যে অসংখ্য মানুষ খাদ্যের আশায় রাজদিয়াতে হানা দিল।
লোকগুলো সারাদিন মানুষের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরে বেড়ায় আর গোঙানির মতো শব্দ করে বলে, দু’গা ভাত দিবেন মা, ইউ ফ্যান দিবেন–
বিমর্ষ হেমনাথ বলতে লাগলেন, দুর্ভিক্ষ–দুর্ভিক্ষ শুরু হয়ে গেছে।
.
২.৪২
শুধু নদীর চরগুলো থেকেইনয়, চারদিকের গ্রাম-গঞ্জ থেকেও খাদ্যের সন্ধানে কত মানুষ যে রাজদিয়া ছুটে এল। এমনকি আঞ্জুমান বেবাজিয়ানীরা পর্যন্ত এসেছে। থানা থেকে তাদের নৌকোও ‘সিজ’ করে নিয়েছে। যুদ্ধ ভাসমান বেদে-বহরকেও রেহাই দেয় নি।
আজকাল সমস্ত রাজদিয়া জুড়ে দিনরাত শুধু শোনা যায়, মা জননী, দু’গা ভাত দ্যান, ইট্র ফ্যান দ্যান। না খাইয়া খাইয়া শরীলে আর দ্যায় না।
রাস্তায় বেরুলেই চোখে পড়ে কঙ্কালসার প্রেতের মতো দলে দলে মানুষ দুর্বল, অশক্ত পায়ে টলমল করে হাঁটছে। এক দুয়ার থেকে তাড়া খেয়ে যাচ্ছে আরেক দুয়ারে।
অবশ্য রাজদিয়াবাসীরা একেবারে নির্দয় নয়। সব বাড়ি থেকে চাল ডাল যোগাড় করে শহরের দু’মাথায় দু’টো লঙ্গরখানা খোলা হয়েছে। সারাদিন পর বেলা হেলে গেলে মাথাপিছু দু’হাতা করে তরল ট্যালটেলে খিচুড়ি দেওয়া হতে লাগল।
কিন্তু দেশজোড়া দুর্ভিক্ষের বিরুদ্ধে দু’টো মোটে লঙ্গরখানা খাড়া করে কতক্ষণই বা যুদ্ধ চালানো যায়! কটা লোককেই বা খাওয়ানো চলে!
কাজেই চারদিকে চুরির হিড়িক পড়ে গেল।
বাজার থেকে ধান চাল উধাও হবার পর থেকেই চুরি শুরু হয়েছিল। কিন্তু এখন যা চলেছে তার সঙ্গে আর কিছুর তুলনাই হয় না।
থালা-ঘটি-বাটি-গাড়-বদনা, কাসা বা পেতলের এক টুকরো বাসনও বাইরে ফেলে রাখার উপায় নেই। রান্না করা ভাত-তরকারি পর্যন্ত নিয়ে যাচ্ছে। তবে সব চাইতে বেশি যা চুরি হচ্ছে তা ধান।
কার্তিকের মাঝামাঝি মাঠের জল নেমে গিয়েছিল। রাজদিয়ার দক্ষিণে এসে দাঁড়ালে, যতদূর চোখ যায়, এখন শুধু ধান, ধান আর ধান।
সবে অঘ্রাণ পড়েছে। এই মাসের শেষ থেকে আমনের মরশুম। ধানের শিষগুলো এখনও কাঁচাই রয়েছে। তাতে সোনালি আভা লাগেনি। সবুজ তুষের ভেতরকার শস্য এখনও যথেষ্ট পুষ্ট নয়। তা হলে কি হবে, রাতের অন্ধকারে ক্ষুধার্ত মানুষ মাঠকে মাঠ কাঁচা ধানই কেটে নিয়ে যাচ্ছে।
ধানই যদি চলে যায়, সারা বছর লোকে খাবে কী? চুরি ঠেকাবার জন্য রাজদিয়ার সব বাড়ি থেকে ছেলে যোগাড় করে ডিফেন্স পার্টি তৈরি হল।
ডিফেন্স পার্টির দুটো কাজ। প্রথমত, রাত জেগে জেগে জমির ধান পাহারা দেওয়া। দ্বিতীয়ত, নদীর ধারে ধারে ঘুরে মহাজনী নৌকাগুলোর ওপর নজর রাখা।
এ অঞ্চলের প্রায় সব নৌকোই যুদ্ধের কল্যাণে ‘সিজ’ করা হয়েছে। তবে ‘স্পেশাল পারমিট’ নিয়ে কেউ কেউ দু’একখানা রাখতে পেরেছে। যেমন ব্যবসাদারেরা।
যুদ্ধ আর দুর্ভিক্ষ শুরু হবার পর ধানচাল জামা কাপড়ের কারবারীরা আর মানুষ নেই। দুঃশাসনের মতো সারা দেশকে বিবস্ত্র এবং নিরন্ন করে তারা মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
রাতের অন্ধকারে বেশি লাভের আশায় ব্যবসায়ীরা নৌকো বোঝাই করে রাজদিয়ার ধান চাল এবং অন্যান্য সব শস্য দূর-দূরান্তে পাচার করে দিতে চাইছে। ডিফেন্স পার্টি তা হতে দেবে না। ঘুরে ঘুরে তারা মহাজনী নৌকো ধরছে।
সব বাড়ি থেকেই দু’টি একটি করে যুবক নেওয়া হয়েছে ডিফেন্স পার্টিতে। ঠিক ওই বয়সের ছেলে হেমনাথের বাড়িতে নেই। কাজেই বিকেই দলে নিতে হল।
যুদ্ধের দৌলতে রাজদিয়ায় তো কম ছেলে নেই। সবাইকে একসঙ্গে রাত জাগতে হয় না। ছোট ছোট গ্রুপে ভাগ হয়ে পালা করে তারা জাগে। আজ এর পালা পড়লে কাল ওর। সপ্তাহে দুদিন জাগতে হয় বিনুকে।
ছেলেরা রাত জাগবে। তাই বাড়ি বাড়ি চাঁদা তুলে পাঁচ ব্যাটারির বড় বড় অনেকগুলো টর্চ কেনা হয়েছে, চা আর মুড়মুড়ে এস’ বিস্কুটের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
প্রথম দিন রাত জাগতে এসে বিনু দেখল, তার দলে শ্যামল আর অশোকও রয়েছে।
মজিদ মিঞার হাতে মার খাবার পর অশোক শ্যামলের সঙ্গে তেমন মিশত না বিনু। অশোকরাও। খুব সম্ভব মার খেয়েছে। মজিদ মিঞা ওদের বাড়ি গিয়েও সিগারেট খাবার কথা বলে এসেছিল। মারটার খাবার পর দু’পক্ষই পরস্পরকে মোটামুটি এড়িয়ে যাচ্ছিল।
ডিফেন্স পার্টিতে তার দলে অশোকরা না থাকলেই ভাল হত। বিনুর খুব অস্বস্তি হতে লাগল।
বিনুদের দলে সবসুদ্ধ বারটি ছেলে। তাদের কাজ হল, নদীর পাড়ে ঘুরে ঘুরে ধান চাল বোঝাই মহাজনী নৌকো খোজা। টর্চ নিয়ে তারা বেরিয়ে পড়ল।
প্রথম দিকে বিনু অশোকদের সঙ্গে কথা বলছিল না। অশোকরাও মুখ বুজেই ছিল। আড়চোখে তিন জন তিন জনকে দেখে যাচ্ছিল শুধু।
নদীর পাড়ে এসে অশোক আর পারল না। বিনুর কাছে নিবিড় হয়ে এসে বলল, সেই লোকটা সেদিন তোমাকে কান ধরে বাড়ি পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছিল?
বিনু বুঝল, মজিদ মিঞার কথা বলছে অশোক। বিব্রতভাবে বলল, হ্যাঁ।
লোকটা এক নম্বরের ডাকাত।
বিনু উত্তর দিল না।
অশোক আবার বলল, বাড়ি নিয়ে গিয়ে তোমাকে মেরেছিল?
মুখ নিচু করে বিনু মাথা নাড়ল।
অশোক আবার বলল, খুব?
হ্যাঁ। মারের চোটে জ্বর এসে গিয়েছিল।
গভীর সহানুভূতির গলায় অশোক বলল, ইস, এমন করে কেউ মারে! খানিক নীরব থেকে আবার বলল, আমাকেও বাবা খুব মার দিয়েছিল।
তাই নাকি?
মারতে মারতে বাড়ির বাইরে বার করে দিয়েছিল। ঠাকুমা গিয়ে আমাকে ফিরিয়ে এনেছে।
এতক্ষণ শ্যামল চুপ করে ছিল। এবার মুখ খুলল, তোমাদের শুধু মেরেই ছিল, আমার অবস্থা কী হয়েছিল জানো?
ধীরে ধীরে বিব্রত ভাবটা কেটে যাচ্ছিল বিনুর। উৎসুক সুরে সে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছিল?
শ্যামল বলতে লাগল, মার তো খেয়েছিলামই, তার ওপর দুদিন কিছু খেতে দেয় নি।
আহা রে–
দেখা গেল তিনজনেই তিনজনের দুঃখে দুঃখী, সমব্যথী। একটি রাত একসঙ্গে জাগবার আগেই তাদের বন্ধুত্ব আবার আগের মতো গাঢ় হয়ে গেল।
.
ওধারে লালমোরের গির্জা আর এধারে সারি সারি মিষ্টির দোকানগুলোর সামনে ঘন হিজলবন। নদীর দীর্ঘ পাড় ধরে ডিফেন্স পার্টির ছেলেরা কতবার যে টহল দেয়। নদীর জলে সন্দেহজনক কিছু নড়তে দেখলেই তারা থমকে দাঁড়ায়, একসঙ্গে পাঁচটা টর্চ জ্বলে ওঠে।
সবে অঘ্রাণ পড়েছে। কিন্তু এরই ভেতর জল-বাংলার এই ছোট্ট নগণ্য শহরটিতে শীত নেমে গেছে।
নদীর দিক থেকে যে উলটোপালটা জলো হাওয়া ঘোড়া ছুটিয়ে যায় তা বরফের মতো ঠান্ডা। গুঁড়ো গুঁড়ো হিমে নদী, আকাশ, দূরের ঝাউবন, সারি সারি হিজলগাছ কিংবা রাজদিয়া শহরের বাড়িঘর, মিলিটারি ব্যারাক–সব কেমন যেন ঝাঁপসা।
সারা গা আলোয়ানে মুড়ে, কানে মাথায় কম্ফোর্টার জড়িয়েও শীত কাটে না।
একদিন ডিফেন্স পার্টির সঙ্গে ঘুরতে ঘুরতে মানিক বলল, আজ বড় ঠান্ডা, না? মানিক নাহা। বাড়ির ছেলে, মাসখানেক হল কলকাতা থেকে এসে এখানকার কলেজে বি.এ’তে ভর্তি হয়েছে। বিনুদের গ্রুপটার সে. নেতা।
অন্য ছেলেরা হি হি কাঁপতে কাঁপতে বলল, হ্যাঁ মানিকদা—
একটা জিনিস খেলে শীতটা কিন্তু কেটে যেত।
কী?
পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বার করে দেখাল মানিক।
আবার সিগারেট! বিনু চমকে উঠল। লক্ষ করল, অশোক শ্যামলও খুব একটা আরাম বোধ করছে না।
বিনু বলল, আমি তো সিগারেট খাই না। মজিদ মিঞার মারের কথা ভেবে মনে আর সুখ নেই তার। অশোক শ্যামলও তাই বলল।
মানিক বলল, যা শীত! এক আধটা খেলে গা গরম হয়ে যাবে। হি হি করে কাঁপছ। কাপুনি বন্ধ হবে। নাও নাও, সবাই একটা করে নিয়ে ধরিয়ে ফেল।
কিন্তু—
কী?
কেউ যদি দেখে ফেলে?
এই শীতের রাত্তিরে তোমাদের সিগারেট খাওয়া দেখবার জন্যে লোকের বাইরে বেরুতে বয়ে গেছে। সবাই লেপ মুড়ি দিয়ে ঘুমোচ্ছ, দেখ গে। সিগারেট টেনে ভাল করে পেয়ারাপাতা চিবিয়ে বাড়ি যাবে, কেউ টেরও পাবে না।
কিন্তু–
আবার কী?
আপনি রয়েছেন।
আমার কাছে লজ্জা কী। আমরা সবাই বন্ধু—ফ্রেন্ড–
কোনও অজুহাতই খাটল না, একটা করে সিগারেট নিতেই হল সবাইকে।
আবার সিগারেট খাওয়া শুরু হয়েছে। ডিফেন্স পার্টিতে রাত জাগতে এসে শুধু কি সিগারেট খাওয়া, আরও চমকপ্রদ সব ব্যাপার ঘটতে লাগল।
একদিন রাত্রিবেলা বিনু আর শ্যামলকে অন্য সবার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে অশোক বলল, আজ আর আমরা ওদের সঙ্গে সঙ্গে নদীর পাড়ে ঘুরব না।”
বিনু শুধেলো, তা হলে কী করবে?
এক জায়গায় যাব।
কোথায়?
চোখ টিপে রহস্যময় হেসে অশোক বলল, চল না। গেলেই বুঝতে পারবে। দারুণ মজা হবে।
অশোক শ্যামল এবং বিনুকে নিয়ে মল্লিকদের ঝুপসি বাগান পেরিয়ে একটা ঘরের বন্ধ জানালার সামনে এসে দাঁড়াল।
বিনু বলল, এখানে কী?
চাপা গলায় অশোক বলল, একদম চুপ। কথা না বলে জানালায় কান দিয়ে দাঁড়াও।
দিন কয়েক আগে মল্লিকদের ছোট ছেলে সুখরঞ্জনের বিয়ে হয়েছে। এটা তাদেরই ঘর। বিনু তা জানে। খুব নিচু গলায় সে কথা অশোককে বললও।
বিরক্ত সুরে অশোক বলল, ছেলেটা তো খালি বক বক করে! মুখ বুজে জানালায় একটু কান পাতো ভাই–
জানালায় কান রাখতেই সমস্ত শরীর ঝিমঝিম করতে লাগল। সুখরঞ্জন যা যা বলে তার বউকে আদর করছে, এমন সব সোহাগের ভাষা আগে কখনও শোনেনি বিনু।
অনেকক্ষণ পর সুখরঞ্জনদের গলা ঘুমে জড়িয়ে এল। তখন অশোক বলল, চল—
বাগানের বাইরে বড় রাস্তায় এসে অশোক আবার বলল, কিরকম লাগল?
শ্যামল শিস টানার মতো শব্দ করে বলল, সত্যি মজাদার।
কী বলেছিলাম?
বিনু বলল, এখানকার খবর তুমি কি করে জানলে?
মুরুব্বিআনা চালে হেসে অশোক বলল, অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। একটু থেমে আবার বলল, আরও অনেক জায়গার খবর আমি জানি।
বল না, বল না—
একদিনে সব শুনে ফেললে তারপর কী করবে? একটু ধৈর্য ধর।
.
এরপর থেকে ডিফেন্স পার্টির সঙ্গে রাত জাগতে এসে তিনজন এক ফাঁকে সরে পড়ে। যুবতী স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে যুবকেরা যেখানে শুয়ে থাকে, বিনুরা গিয়ে তাদের ঘরের জানালায় কান পাতে।
তা ছাড়া, রাজদিয়ার রাস্তায় কত দৃশ্য চোখে পড়ে। হুস হুস করে যে মিলিটারি জিপগুলো ছুটে যায় তার ভেতর দেখা যায়, আমেরিকান টমির গলা জড়িয়ে নারীদেহ ঝুলছে। ঝাউবনের মধ্যে নিগ্রো সৈন্যগুলো কোত্থেকে যেন মেয়েমানুষ জুটিয়ে এনে এই শীতের রাতে নরকের খেলা শুরু করে দেয়।
একদিন এক বাড়িতে কান পাততে গিয়ে বিশ্রী ব্যাপার ঘটে গেল।
বিনুরা দেখল, শীতের রাত্তিরে এরা জানালা খুলে শুয়েছে।
খুব চাপা গলায় অশোক বলল, ভালই হয়েছে। এতদিন খালি শুনেছি, এবার ভেতরকার মজা দেখতে পাব।
পা টিপে টিপে তিনজন জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। অন্য সব বাড়ির জানালায় কান রেখে বিনুরা যা শুনেছে, এখানেও তা-ই শুনতে পেল। গাঢ় গলায় পুরুষটি তার সঙ্গিনীকে আদরের কথা বলছে, মাঝে মাঝে চুমু খাবার শব্দ।
উত্তেজনায় তিনজন মুখ বাড়াতে লাগল। কিন্তু ঘরের ভেতর আলো নেই, তা ছাড়া ওরা মশারি টাঙিয়ে শুয়েছে। চোখে শান দিয়েও কিছুই দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না।
বাইরে হিমের ভেতর অস্থির হয়ে উঠল বিনুরা। হঠাৎ শ্যামল এক কান্ড করে বসল, বোম টিপে হাতের টর্চটা জ্বেলে ফেলল। মশারির গায়ে আলো পড়তেই দুটি ঘনবদ্ধ যুবক যুবতী ছিটকে দু’ধারে সরে গেল। তারপরেই যুবকটি তীক্ষ্ণ গলায় চেঁচিয়ে উঠল, কে, কে রে, চোর–
মেয়েটিও চেঁচাতে লাগল, চোর, চো–
ততক্ষণে আলো নিবিয়ে ফেলেছে শ্যামল। একমুহূর্ত বিমূঢ়ের মতো দাঁড়িয়ে থাকল তারা। তারপর সারা বাড়ির দরজা জানালা খোলার আওয়াজ কানে আসতেই উধ্বশ্বাসে ছুট লাগাল এবং চোখের পলকে এর চেঁকিঘরের পাশ দিয়ে, ওর বাগানের ভেতর দিয়ে, তার উঠোন ডিঙিয়ে নদীর পাড়ে এসে পড়ল।
নদীর পাড়ে স্টিমারঘাটের কাছে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে অশোক শ্যামলকে বলতে লাগল, তুমি কী ছেলে বল তো! ফস করে টর্চ জ্বেলে দিলে!
কাজটা যে ভাল হয় নি, শ্যামল আগেই বুঝতে পেরেছিল। সে চুপ করে থাকল।
অশোক আবার বলল, টর্চটা জ্বেলেছিলে জ্বেলেছিলে, একটু পরে যদি জ্বালতে—
শ্যামল বলল, পরে জ্বাললে কী হত?
চোখের তারা নাচিয়ে অশোক বলল, আরও মজা দেখতে পেতে।
একধারে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল বিনু। ভয়ে উত্তেজনায় তার বুকের ভেতরটা ভীষণ কাঁপছিল। আর সেই কাঁপুনির মধ্যে, কেন কে জানে, ঝুমার কথা খুব মনে পড়ে যাচ্ছিল তার।
.
২.৪৩
রাজদিয়ায় আসার পর কিছুদিন বেশ ভালই ছিলেন সুরমা। কাগজের মতো সাদা ফ্যাকাসে শরীরে লালচে আভা দেখা দিয়েছিল। নিষ্প্রভ চোখে আলোর খেলা শুরু হয়েছিল, রুগ্ণ মুখে লাবণ্য ফুটি ফুটি করছিল। চোখের কোলে, শীর্ণ আঙুলের মাথায় রক্তের সঞ্চার চোখে পড়ছিল।
কিন্তু কদিন আর। তারপরই আবার অসুস্থ হয়ে পড়লেন সুরমা। টিপটিপে বৃষ্টির মতো একটানা অসুখ চলছিলই। তার মধ্যেই ভাত খেতেন, স্নান করতেন, হেঁটে চলে বেড়াতেন।
কিন্তু এ বছর শীত পড়তেই একেবারে শয্যাশায়ী হয়ে পড়েছেন সুরমা। লারমোর রোজ সকালবেলা একবার করে তাকে দেখে যান। সুরমার অসুখটা হার্টের, হৃৎপিন্ডটি খুবই দুর্বল। তার ওপর নানারকম স্নায়বিক উপসর্গ রয়েছে।
এবার শুয়ে পড়বার পর থেকেই কেমন যেন হয়ে গেছেন সুরমা। যত দিন যাচ্ছে, মৃত্যুভয় চারদিক থেকে তাকে যেন ঘিরে ধরতে শুরু করেছে। প্রায় সারাদিনই ক্ষীণ সুরে তিনি বলে যান, ওগো, সুধা সুনীতির বিয়ের ব্যবস্থা কর।
অবনীমোহন বলেন, হবে হবে, আগে তুমি সেরে ওঠ।
এবার আমি আর উঠব না। মন বলছে, এই শোওয়াই আমার শেষ শোওয়া।
কী আজে বাজে বলছ! ঠিক সেরে উঠবে তুমি, আবার আগের মতো সুস্থ হবে।
বিচিত্র হাসেন সুরমা, যতই ভোলাতে চাও না, এবার আর আমার রেহাই নেই। বেচে থাকতে থাকতে সুধা সুনীতির বিয়ে দাও। দেখে শান্তিতে চোখ বুজি।
সুরমা কোনও কথাই যখন শুনবেন না তখন কী আর করা। সুধার জন্য হিরণকে একরকম ঠিক করাই আছে। শুধু হিরণের ঠাকুরদা আর জেঠাইমাকে কথাটা জানাতে হবে। হেমনাথ যখন আছেন তখন তার কথার ওপর ওঁরা কিছু বলবেন না। হিরণ সম্বন্ধে তার মতামতই চুড়ান্ত।
সুনীতির সঙ্গে আনন্দর বিয়ের ব্যাপারে অবনীমোহন আর হেমনাথ একদিন রামকেশবের বাড়ি গেলেন। তারপর রামকেশব শিশির এবং স্মৃতিরেখার সঙ্গে পরামর্শ করে মধুপুরে আনন্দর বাবাকে চিঠি লেখা হল। ইকুয়েশনের সময় ওঁরা ওখানে চলে গেছেন। শিশির স্মৃতিরেখা এবং রামকেশবও আনন্দর বাবাকে চিঠি লিখলেন।
দিন কয়েকের ভেতর উত্তর এসে গেল। ছেলে বড় হয়েছে, তাকে সংসারী করবার জন্য আনন্দর বাবা পাত্রীর খোঁজ করছিলেন। সুনীতিকে যদি ছেলের পছন্দ হয়ে থাকে, এ বিয়েতে তার আপত্তি নেই। শিগগিরই তিনি রাজদিয়া আসছেন। সাক্ষাতে অন্য কথা হবে।
দিন পনেরর ভেতর মধুপুর থেকে আনন্দর বাবা-মা ভাই-বোনেরা এসে পড়ল। হেমনাথ এবং অবনীমোহনের সঙ্গে কথা বলে, সুনীতিকে দেখে আনন্দর বাবা এবং মা খুবই সন্তুষ্ট। এক কথায় বিয়ে ঠিক হয়ে গেল। স্থির হল, মাঘ মাসে ধান কাটার পর বিয়েটা হবে।
বিয়ের ক’দিন আগে এক দুপুরবেলায় মাঠের দিক থেকে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে ছুটতে কুমোরপাড়ার হাচাই পাল এসে হাজির। ভয়ে চোখের তারা ঠিকরে বেরিয়ে আসছে তার।
স্নেহলতা উঠোনের একধারে তুলসী মঞ্চের পরিচর্যা করছিলেন। সুধা-সুনীতি বিনু-ঝিনুক, বাড়ির সবাই দাঁড়িয়ে ছিল।
হাচাই পালের ওই রকম উদ্ভ্রান্ত চেহারা দেখে স্নেহলতা চমকে উঠলেন, কী হয়েছে রে হাচাই?
হাঁপাতে হাঁপাতে হাচাই পাল বলল, সুন্দি কাউঠার খোঁজে মাঠে গেছিলাম। গিয়া দেখি বাঘ। দেইখাই লৌড় (দৌড়) দিলাম–
বাঘ!
হ বৌ-ঠাইরেন—
এই বাঘ নিয়ে দিন সাতেকের মধ্যে এক মজার ব্যাপার ঘটে গেল।
.
২.৪৪
কুমোরপাড়ার হাচাই পালই শুধু না, ক’দিনের মধ্যে বাঘটাকে আরও অনেকে দেখল। যেমন মৃধাবাড়ির ছলিমুদ্দিন, গোঁসাইবাড়ির সহদেব, নিকুঞ্জ কবিরাজ, অধর সাহা, মনা ঘোষ–এমনি আরও অনেকে।
কেউ বলল, বাঘটা দু’হাত লম্বা। কেউ বলল, আট হাত। কেউ বলল, দশ হাত। যত দিন যেতে লাগল লোকের মুখে মুখে বাঘটার দৈর্ঘ্য-প্রস্থ-উচ্চতা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে লাগল।
নিজের অস্তিত্ব প্রমাণ করবার জন্য বাঘটাও যেন উঠে পড়ে লেগে গেছে। আজ এ বাড়ির ছাগল পাওয়া যাচ্ছে না, কাল ও বাড়ির গোরুর খোঁজ নেই, পরশু সে বাড়ির হালের বলদ নিরুদ্দেশ। একদিন তো যুগীপাড়ার একটা ছেলেই নিখোঁজ হয়ে গেল। মাঠের মাঝখানে নলখাগড়ার ঝোপে খানকয়েক হাড় ছাড়া ছেলেটার আর কোনও চিহ্নই পাওয়া গেল না।
এদিকে রাজদিয়াকে ঘিরে দশ আরওখানা গ্রামে সন্ত্রাসের রাজত্ব শুরু হয়ে গেছে। কনট্রোলের দোকান থেকে কেরোসিন উধাও হবার পর সন্ধে নামতে না-নামতেই চারদিক নিশুতি হয়ে যাচ্ছিল। আজকাল বিকেল থাকতেই বাঘের ভয়ে ঘরে খিল পড়ে যায়।
সব চাইতে অসুবিধে হয়েছে বিনু আর ঝিনুকের। তারা যে তেমন বড় হয়েছে, এ কথাটা স্নেহলতা বা বাড়ির আর কেউ মানতেই চায় না। এখন কিছুদিন স্কুলে ছুটি চলছে। বেলা বেড়ে রোদ বেশ চনচনে হয়ে উঠলে তবে তারা ঘরের বার হতে পারে, আবার বিকেলবেলা রাজদিয়ার সব লোক বাইরে থাকতে থাকতেই তাদের ঘরে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। বাড়ির চৌহদ্দির বাইরে যাবার উপায় নেই তাদের। স্নেহলতার ভয়, বাঘটা তাকে তাকে আছে। রাজদিয়ার কয়েক হাজার লোকের ভেতর থেকে বেছে বেছে তার নাতি-নাতনী দুটোকে টপ করে মুখে তুলে নিয়ে যাবে।
স্নেহলতা লক্ষ্মণের গন্ডি কেটে দিয়েছেন। পেছনে রান্নাঘর, সামনে উঠোন, দক্ষিণে মধুটুকুরি আমের গাছ ও উত্তরে চেঁকিঘর–এই চতুঃসীমার মধ্যে বন্দি হয়ে থাকতে কার আর ভাল লাগে! এমনকি বাগান এবং পুকুরেও একা একা যাওয়া বারণ।
অন্য কিছুর জন্য নয়, ঝুমার জন্যই খুব খারাপ লাগে বিনুর। সারাদিন ছটফট করে এ ঘর ও ঘর করে বেড়ায় সে। উঠোন জুড়ে চঞ্চল পায়ে ঘুরপাক খেতে থাকে।
ঝিনুক কিন্তু ভারি খুশি। পুবের ঘরের উঁচু পৈঠের ওপর বসে পা নাচাতে নাচাতে কৌতুকের চোখে সে বিনুর অস্থিরতা দেখতে থাকে। একসময় খুব আস্তে করে ডাকে, বিনুদা–
বিনু বলল, কী বলছ?
তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে, না?
কষ্ট কেন?
ঝিনুকের চাপা ঠোঁটের মাঝখানে হাসির একটু আভা ফুটে উঠেই চকিতে মিলিয়ে যায়। সে বলে, সারাদিন বাড়িতে আটকে আছ বলে–
চোখমুখ কুঁচকে বিরক্ত, রাগ-রাগ গলায় বিনু বলতে থাকে, সমস্ত দিন বাড়ি বসে থাকতে কারোর ভাল লাগে?
ঠিকই তো।
দিদার কী যে ভয়, রাস্তায় বেরুলে এত লোক থাকতে বাঘ এসে যেন আমাকেই গিলে ফেলবে।
কয়েক পলক বিনুর দিকে তাকিয়ে থেকে গলার স্বর আরও নামিয়ে ফেলে ঝিনুক, একে বেরুতে পারছ না। তার ওপর–
তার ওপর কী?
ঝুমাদের বাড়ি যাওয়া হচ্ছে না। ঝুমাদের বাড়ি যেতে পারলে এত কষ্ট, এত রাগ হত না। তাই না বিনুদা?
চোখের তারা স্থির করে ঝিনুকের দিকে তাকায় বিনু। বুঝতে চেষ্টা করে মেয়েটা কি কিছু আভাস পেয়েছে? বলে, তোমার কি মনে হয়, রাস্তায় বেরুলেই আমি ঝুমাদের বাড়ি যাই? বিনুর গলা অল্প অল্প কাপে।
ঝিনুক হঠাৎ উদাস হয়ে যায়, কী জানি–
আর বিনু এক মুহূর্তও সেখানে দাঁড়ায় না। বড় বড় পা ফেলে আবার এ ঘরে ও ঘরে এবং উঠোনে ঘুরতে থাকে। ঘুরতে ঘুরতে ভাবে, কুমাই শুধু না, এই ঝিনুক মেয়েটিই কি কম রহস্যময়ী!
.
বাঘের উৎপাত দিন দিন বেড়েই চলল। রক্তের স্বাদ যখন একবার সে পেয়েছে তখন কি সহজে থামবে?
এদিকে থানা থেকে ঢেঁড়া দিয়ে পনের কুড়ি মাইলের ভেতর যত গ্রাম-গঞ্জ আছে, সব জায়গার লোককে সাবধান করে দেওয়া হয়েছে। বাঘ মারবার জন্য মোটা টাকা পুরস্কারও ঘোষণা করা হয়েছে।
এত এত ব্যাপার যখন ঘটে গেল তখন কি আর আনন্দ চুপ করে বসে থাকতে পারে? বাঘ মারার দায়িত্ব সে নিজের কাঁধে তুলে নিল। একদিন দুপুরবেলা বিনুরা দেখতে পেল, পুকুরের ওধারে চারদিকের গ্রামগুলো থেকে কয়েক শ’ যুবক এবং প্রৌঢ়কে জড়ো করে ফেলেছে সে। এই মুহূর্তে তার গায়ে পুরোপুরি শিকারির সাজ। কাঁধ থেকে বন্দুক ঝুলছে, গলায় টোটার মালা, কোমরে মস্ত ভোজালি।
মাঘের মাঝামাঝি এই সময়টায় মাঠে জল নেই, ধানও কাটা হয়ে গেছে। আনন্দকে ঘিরে বিরাট জনতা ধানকাটা মাঠের ওপর গোল হয়ে বসে পড়ল।
এত লোক যখন রয়েছে তখন ভয়ের কোনও কারণ নেই। স্নেহলতাকে বলে বিনু ধানখেতে ছুটল।
জনতার বেশির ভাগই চাষী শ্রেণীর মানুষ। দুর্ভিক্ষে হেজেমজে যাবার পর যারা কোনও রকমে টিকে আছে তারা ছুটে এসেছে। উৎকন্ঠিতের মতো লোকগুলো আনন্দের দিকে তাকিয়ে ছিল।
আনন্দ বলছিল, বাঘটাকে তোমরা মারতে চাও, এই তো?
সবাই সমস্বরে বলল, হ সাহেববাবু। শালার বাঘের লেইগা পরানে শান্তি নাই। কুনদিন কার বাড়ি। গিয়া যে আকাম কইরা আইব।
সাহেববাবু সম্ভাষণটা খুব সম্ভব আনন্দের হ্যাঁট-বুট-প্যান্ট এবং গুলি-বন্দুকের সম্মানে।
আনন্দ বলল, সে তত ঠিকই।
বাঘ কার কী ক্ষতি করেছে, তাদের কতখানি দুর্দশার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, এরপর লোকগুলো সে সব কাহিনী বলে যেতে লাগল।
সব শুনে আনন্দ বলল, বাঘ আমি মেরে দিতে পারি। তবে–
তয় কী? জনতা উন্মুখ হল।
আমার কথামতো তোমাদের চলতে হবে।
নিয্যস চলুম।
এরপর উদ্দীপ্ত ভাষায় ছোটখাটো একখানা বক্তৃতা দিল আনন্দ। তার সারমর্ম এইরকম। প্রথমত, সবাইকে লাঠি এবং সড়কি বানিয়ে নিতে হবে। ঘরে ঘরে শাঁখ, কাঁসর, নিদেন পক্ষে একটুকরো টিন মজুদ রাখতে হবে। কেউ যদি বাঘটাকে দেখতে পায়, সঙ্গে সঙ্গে নিজের গ্রামে গিয়ে খবর দেবে। আর খবর পেলেই যত শাঁখটাখ আছে, একসঙ্গে বাজাতে হবে। এক গ্রামের বাজনার আওয়াজ পেলে আরেক গ্রাম বাজাতে শুরু করবে। এই ভাবে চারদিকের গ্রামগুলো সর্তক হয়ে যাবে।
শুধু শাঁখ কাঁসর বা টিন বাজালেই চলবে না। চেঁচিয়ে ধ্বনিও দিতে হবে, বন্দে মাতরম্’, কালী মাঈকি জয়’ কিংবা আল্লা হো আকবর। ধ্বনিটা কানে গেলে চুপ করে বসে থাকলে চলবে না। প্রতিধ্বনিও দিতে হবে। তারপর লাঠি সড়কি নিয়ে সব দিক থেকে বাঘটাকে ঘিরে পিটিয়ে মেরে ফেলা হবে। তাতেও যদি সুবিধে না হয়, আনন্দ এবং তার বন্দুক তো আছেই।
পরিকল্পনার কথাটা বলে ঘুরে ঘুরে সগর্বে জনতাকে একবার দেখে নিল আনন্দ। তারপর আবার শুরু করল, ফন্দিটা কেমন?
সবাই চেঁচিয়ে পেঁচিয়ে সায় দিল, চোমকার সাহেববাবু, চোমৎকার–
এবার বাঘের আর নিস্তার নেই, বুঝলে?
এরকম চমকপ্রদ একখানা পরিকল্পনার পর বাঘের আয়ু যে নেহাতই ফুরিয়ে এসেছে, সে সম্বন্ধে জনতার সন্দেহ থাকল না। উৎসাহে উদ্দীপনায় তাদের চোখ চক চক করতে লাগল।
আনন্দ বলল, তা হলে ওই কথাই রইল—
হ।
হঠাৎ এই সময় একজন বলে উঠল, বাঘেরে আমরা যহন ঘিরা ধরুম, আপনে আমাগো লগে থাকবেন তো?
বাঁ হাতের তালুতে প্রচন্ড ঘুষি কষিয়ে আনন্দ বলল, নিশ্চয়ই। আমি না থাকে তোমাদের চালাবে কে?
লোকগুলো একেবারে নিশ্চিন্ত হয়ে গেল। নিজেদের মধ্যে তারা বলাবলি করতে লাগল, সাহেববাবু আমাগো লগে থাকব। শালার বাঘের এইবার যম আসছে।
আনন্দ বলল, কথা হয়ে গেল। এখন তোমরা বাড়ি যাও। আর হ্যাঁ, যতদিন না বাঘটা মারা পড়ছে, প্রতি সপ্তাহে রবিবার করে এখানে মিটিং হবে। দুপুর বেলা তোমরা চলে আসবে। যদি বাঘ মারার অন্য কোনও ভাল ফন্দি মাথায় আসে, তোমাদের বলে দেব।
আইচ্ছা।
বাঘের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে যে যার বাড়ি চলে গেল। হতভাগ্য প্রাণীটা জানতেও পারল তার বিরুদ্ধে কী ভীষণ ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে।
মিটিং শেষ হলে আনন্দকে ধরে বাড়ি নিয়ে এল বিনু। সুধা সুনীতি উঠোনই ছিল। ঠোঁট টিপে হাসতে হাসতে সুধা বলল, বাবা, একেবারে বীরবেশে যে! দ্যাখ দিদি, দ্যাখ
সুনীতি চোরা চোখে আনন্দকে দেখে নিয়ে মুখ নিচু করল। তারপর নখ খুঁটতে লাগল। তার মুখে মৃদু কৌতুকের হাসি আলতোভাবে লেগে রইল।
সুধা এবার এগিয়ে এসে চোখ বড় বড় করে বলল, বন্দুক, টোটার মালা, ভোজালি–যেভাবে সেজেছেন, তাতে বাঘটাকে না মারলেও চলবে।
ভুরু অল্প কুঁচকে আনন্দ বলল, কেন?
এই বীরবেশ একবার যদি বাঘটাকে দেখিয়ে দিতে পারেন, রাজ্য ছেড়ে সে পালিয়ে যাবে।
আনন্দ কী বলতে যাচ্ছিল, বলা হল না। স্নেহলতা কোথায় ছিলেন, আনন্দকে দেখতে পেয়ে ছুটে এলেন। বললেন, এস দাদা, এস–
তারপর যতক্ষণ আনন্দ এ বাড়িতে রইল, সুধা তার পেছনে লেগে থাকল।
.
দু’চার দিনের ভেতর দেখা গেল, রাজদিয়া এবং চারপাশের গ্রামগুলোতে একটা সুপারি গাছ কিংবা বয়রা বাঁশও আর আস্ত নেই। সব লাঠি এবং সড়কি হয়ে গেছে।
প্রথমে ঠিক হয়েছিল, রবিবার রবিবার ধানকাটা ফাঁকা মাঠে মিটিং বসবে। এক রবিবার পরই সিদ্ধান্তটা বাতিল করে দিল আনন্দ। নতুন করে স্থির হল, রোজ সবাইকে আসতে হবে। বাঘ বলে কথা!
দু’চারদিন যাতায়াতের পর হঠাৎ একদিন আনন্দ বলল, বাঘ মারা সহজ ব্যাপার না, বুঝলে?
সবাই সমস্বরে বলে উঠল, হেয়া আর বুঝি না!
এর জন্য সকলকে এক মন, এক প্রাণ হতে হবে।
আইজ্ঞা হেয়া তো হইতেই হইব।
আমি ভাবছি—
চারপাশের বিপুল জনতা দম বন্ধ করে উৎসুক চোখে তাকিয়ে রইল।
আনন্দ বলল, সৈন্যদের মতো তোমাদের প্যারেড করতে হবে। তাতে একসঙ্গে কাজ করার প্রেরণা পাবে।
পেরেট কী? ওই লেফট রাইট করা।
পরের দিন থেকেই প্যারেড শুরু হল। দেখা গেল, কেউ লুঙ্গি মালকোচা দিয়ে পরেছে। তার পাশেই হয়তো একজনের পরনে খাটো ধুতি এবং ফতুয়া, গলায় তিনলহর তুলসীর মালা। তার পরের লোকটি পাজামা পরে এসেছে।
নানারকম বেশভূষা আনন্দর পছন্দ নয়। দু’একদিন দেখে আনন্দ বলল, তোমরা এক কাজ কর।
কী?
সবাই একটা করে খাকি প্যান্ট আর সাদা হাফ শার্ট করিয়ে নাও। একরকম পোশাক পরলে দেখতে ভাল, কাজেরও সুবিধে।
এইবার জনতা বিদ্রোহী হয়ে উঠল, কী যে কন সাহেববাবু, তার ঠিক ঠিকানা নাই। এই আকালে খাইতে না পাইয়া মরতে বসছি। আপনে কন পেন্টুল-জামা বানাইতে! এই কারবারে আমরা নাই।
পাছে সেনাদল ভেঙে যায়, এই আশঙ্কায় আনন্দ বলল, আচ্ছা থাক, শার্ট টটি বানাতে হবে না।
ধুতি-লুঙ্গি-পাজামার বিচিত্র সমন্বয়ের ভেতর বিপুল সমারোহে প্যারেড চলতে লাগল।
প্যারেড করতে করতে বাঁয়ের জায়গায় ডান পা তুললে রক্ষা নেই, অমনি আনন্দের হাতের বেত পায়ের গোছে এসে পড়ে। আনন্দের চোখকে ফাঁকি দেওয়া সহজ নয়।
প্যারেড শুরু হবার পর বেশ কিছুদিন বাঘটাকে আর দেখা গেল না। তার বিরুদ্ধে যে গভীর ষড়যন্ত্র চলছে, এ খবর কি সে জেনে ফেলেছে? যাই হোক, মানুষ খানিকটা নিশ্চিন্ত হতে পেরেছে, তবে সর্তক আছে। সন্ধের আগে আগেই যথারীতি ঘরে ঢুকে খিল দিচ্ছে তারা। এইভাবেই চলতে লাগল।
.
২.৪৫
হঠাৎ একদিন সকালবেলা বারুইবাড়ির প্রাণবল্লভ মাঠের দিক থেকে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে ছুটতে এবং চেঁচাতে চেঁচাতে হেমনাথের বাড়ি এসে হাজির, খাইছে রে খাইছে, আমারে খাইয়া ফেলাইল রে–
পুব-পশ্চিম-উত্তর-দক্ষিণ, চারদিকের ঘর থেকে সুধা-সুনীতি বিনু-ঝিনুক অবনীমোহন-হেমনাথ, সবাই ছোটাছুটি করে বেরিয়ে এলেন।
উদ্বিগ্ন মুখে হেমনাথ শুধোলেন, কী হয়েছে প্রাণবল্লভ, কী হয়েছে?
প্রথমটা কথা বলতে পারল না প্রাণবল্লভ। হাত-পা-ঠোঁট, তার সারা শরীর ভয়ে থর থর কাঁপছে। হাত ধরে তাকে বারান্দায় বসালেন হেমনাথ। বললেন, আগে শান্ত হ। পরে বলবি।
কাঁপা, ভাঙা ভাঙা গলায় প্রণবল্লভ বলল, ইট্টু জল বড়কত্তা–
জল খেয়ে খানিকটা শান্ত হল প্রাণবল্লভ। তারপর যা বলল, সংক্ষেপে এইরকম। ভোরবেলা মেটে আলুর সন্ধানে সে ধানকাটা মাঠে গিয়েছিল। আলের ধারে ঘুরে ঘুরে দু’চারটে যোগাড়ও করেছিল। ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ তার চোখে পড়ে, দক্ষিণের চকে মাঠের মাঝখানে গুটিসুটি মেরে বাঘটা শুয়ে আছে।
প্রাণবল্লভের কথা শেষ হলে অত্যন্ত ব্যস্ত হয়ে হেমনাথ বললেন, সুধাদিদি সুনীতিদিদি, শিগগির শাঁখ বাজা। বাঘের খবর পেলেই আনন্দ শাঁখ টাখ বাজাতে বলেছিল না? সেদিনকার মিটিং-এর কথা কারোর জানতে আর বাকি নেই।
সুধা সুনীতি ছুটে গিয়ে ঘর থেকে শাঁখ বার করে আনল, তারপর দুই বোন গাল ফুলিয়ে জোরে জোরে ফুঁ দিতে লাগল।
প্রাণবল্লভের ভয় কেটে গিয়েছিল। লাফ দিয়ে উঠোনে নেমে আকাশে হাত ছুঁড়ে চেঁচিয়ে উঠল সে, বন্দে মাতরম–
বন্দে মাতরম-এর এরকম প্রয়োগ আগে কখনও দেখে নি বিনু।
প্রায় সঙ্গে সঙ্গে এ পাড়া, সে পাড়া এবং দূর-দূরান্ত থেকে শাঁখ কাসর এবং টিন পেটাবার আওয়াজ ভেসে আসতে লাগল। সেই সঙ্গে মুহুর্মুহু শোনা যেতে লাগল, বন্দে মাতরম্–
কালী মাঈকী জয়—
মুসলমান পাড়ার দিক থেকে আওয়াজ আসতে লাগল, আল্লা হো আকবর–
তারপরেই হো হো চিৎকারে দিগদিগন্ত তোলপাড় করে অসংখ্য মানুষ বেরিয়ে পড়ল। সবার হাতে লাঠি আর সুপারি কাঠের সড়কি।
হেমনাথ প্রাণবল্লভকে বললেন, যা শিগগির, আনন্দকে বাঘের খবরটা দিয়ে আয়।
স্নেহলতা বললেন, যা চেঁচামেচি আর কাসর ঘন্টার আওয়াজ, তাতে খবর পেতে কি তার বাকি আছে?
তবু যাক।
প্রাণবল্লভ রামকেশবের বাড়ি ছুটল। কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে খবর দিল, সে একাই না, আরও অনেকে আনন্দকে বাঘের খবর দিতে গিয়েছিল। কিন্তু আনন্দকে পাওয়া যাচ্ছে না।
হেমনাথ বললেন, সে কী! কাজের সময় সেনাপতিই নিরুদ্দেশ!
প্রাণবল্লভ কী বলতে গিয়ে থেমে গেল। হেমনাথের মুখের দিকে তাকিয়ে ইতস্তত করতে লাগল।
তার মনের কথাটা যেন পড়তে পারলেন হেমনাথ। বললেন, কিছু বলবি?
হ।
বল না—
অপরাধ যদি না ন্যান কথাখান কই–বলে হাতজোড় করল প্রাণবল্লভ।
হেমনাথ অবাক, অপরাধ নেব কেন?
হাতজোড় অবস্থাতেই প্রাণবল্লভ বলল, আমার মনে হইল সাহেববাবু বাড়িতেই আছে, ভিতরে তেনার গলাও য্যান পাইলাম। কিন্তুক মা-ঠাইরেনরা কইয়া দিল তেনি নাই–
হেমনাথ ধমকের গলায় বললেন, কী যা-তা বলছিস!
বিশ্বাস যান না বড়কত্তা?
না।
বিশ্বাস না যাওনেরই কথা। কিন্তুক—
কিন্তু কী?
সাক্ষী আছে।
কে সাক্ষী?
প্রাণবল্লভ একে একে নাম করে যেতে লাগল, গণকবাড়ির মহেন্দর, কামারবাড়ির নিমাই, সোনারুবাড়ির অনন্ত, কালিমুদ্দিন মাঝি, বরকাতুল্লা নিকারিকত মাইনষের নাম কমু?
এত লোক আনন্দের খোঁজে গিয়েছিল। হেমনাথের চোখেমুখে এবং কণ্ঠস্বরে বিস্ময়।
হ। বাঘ দেখলে তেনিই তো খপর দিতে কইছিল।
একটু চুপ করে থেকে হেমনাথ বললেন, আচ্ছা, তুই যা এখন—
প্রাণবল্পভ চলে গেল।
ওদিকে আরেক কান্ড চলছিল, লাঠি সড়কি নিয়ে রাজদিয়ার লোক তো মাঠের দিকে ছুটছিলই। দিগন্তের ওপারে কৃষাণ গ্রামগুলো থেকে শত শত মানুষ ছুটে আসছিল। তাদের হাতেও লাঠি সড়কি এবং নানারকম অস্ত্র।
শাঁখ কাঁসর এবং টিন পেটাবার আওয়াজ আসছিলই। সেই সঙ্গে মুহুর্মুহু শোনা যাচ্ছিল, বন্দে মাতরম্।
কালী মাঈকি জয়—
আল্লা হো আকাবর—
ধান-কাটা শীতের মাঠ পানিপথ কি হলদিঘাটের যুদ্ধক্ষেত্রের চেহারা নিতে শুরু করেছে। বিনু হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে উঠল, আমি মাঠে যাব দিদা–
মাঠে কেন রে দাদাভাই? স্নেহলতা চমকে উঠলেন।
বাঘ মারা দেখতে।
না না, ওখানে তোমাকে যেতে হবে না। জোরে জোরে প্রবলবেগে হাত নাড়তে লাগলেন স্নেহলতা, চোখেমুখে তার ভয়ের ছায়া পড়ল।
আমি যাবই– ঘাড় গোঁজ করে পা ছুঁড়তে লাগল বিনু। শাঁখ কসরের শব্দ, অবিরল বন্দে মাতরম্ আর আল্লাহ আকবর’ তার রক্ত চঞ্চল করে তুলেছে।
ওখানে কী হবে, কেউ বলতে পারে! বাঘটা যদি কোনও রকমে ছিটকে তোর কাছে চলে আসে–
আমি ওই হিজলগাছের মাথায় চড়ে দেখব–দূর মাঠের দিকে আঙুল বাড়িয়ে দিল বিনু।
স্নেহলতা বললেন, গাছে টাছে চড়তে হবে না। তুই ঘরে গিয়ে বোস। জানলা দিয়ে যেটুকু দেখা যায় তার বেশি দেখবার দরকার নেই।
বিনু শুনল না, ঊর্ধ্বশ্বাসে মাঠের দিকে ছুটল। আজ আর তাকে বাড়িতে আটকে রাখা গেল না। মাঠজোড়া রণভূমি তাকে বিপুল আকর্ষণে টেনে নিয়ে গেল।
পেছনে স্নেহলতার ভীত, ব্যাকুল কণ্ঠস্বর শোনা যেতে লাগল, হেমনাথ আর অবনীমোহনকে তিনি বলছেন, তোমরা ছেলেটাকে আটকালে না? আজ কী যে হবে! যাও যাও, ওকে ফেরাও
হেমনাথরা কী উত্তর দিলেন, বিনু শুনতে পেল না। তার আগেই ছায়াচ্ছন্ন ঝুপসি বাগান পেরিয়ে, মাঘের নিস্তরঙ্গ পুকুর পেছনে ফেলে, ফসলশূন্য ফাঁকা মাঠে এসে পড়ল।
চারদিক থেকে জনতা গোল হয়ে বৃত্তাকারে ছুটছে। সন্মোহিতের মতো তাদের পিছু পিছু দৌড়তে লাগল বিনু।
দক্ষিণের চকে এসে দেখা গেল, সত্যি সত্যি মাঠের মাঝ-মধ্যিখানে বাঘটা শুয়ে আছে। চারধার থেকে গোল হয়ে জনতা ঝড়ের মতো নেমে আসছিল। বাঘটা যখন সিকি মাইলের মতো দূরে সেই সময় কেউ যেন মন্ত্র পড়ে হঠাৎ তাদের থামিয়ে দিল।
একধারে সারি সারি অনেকগুলো হিজল গাছ। বিনু আর দেরি করল না, সব চাইতে উঁচু গাছটার মগডালে চড়ে বসল। ভাটির দেশে শ্বশুরবাড়িতে চলে যাবার আগে বিনুকে গাছে চড়া শিখিয়ে দিয়েছিল যুগল।
শাঁখ কাসরের আওয়াজ থেমে গেছে। কালী মাঈকী জয়’, কিংবা আল্লা হো আকবর’-ও আর শোনা যাচ্ছে না। জনতা যুদ্ধক্ষেত্রে এসে যেন বিমূঢ় হয়ে গেছে।
হঠাৎ কে যেন চেঁচিয়ে উঠল, সাহেববাবু কই?
আট দশটা লোক চিৎকার করে বলল, বাড়িত্ নাই।
অহন কী করা?
সাহেববাবু তো কইছিল, বাঘ দেখলে তেনারে খপর দিতে। তেনি নাই, আমরা ফিরাই যাই।
হগলেরে তাইলে ফিরনের কথা কইয়া দ্যাও। বাঘ মারণ বইলা কথা! সাহেববাবুনা থাকলে আমাগো চালাইব কে?
একটা লোক চিৎকার করে ফেরবার কথা বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই বাজিতপুরের জোয়ান ছেলে হালিম বলল, কিছুতেই না। অ্যাঙ্গুর আইসা ফিরা যামু না। সুযুগ যহন পাইছি, শালার বাঘেরে নিকাশ করুম। বলেই আকাশের দিকে হাতের লাঠিটা ছুঁড়ে চেঁচাল, আউগাও (এগোও) ভাই হগল–
নিমেষে জনতার ভেতর সাড়া পড়ে গেল।
আল্লা হো আকবর—
কালী মাঈকী জয়—
তারপরেই বাঘটাকে ঘিরে মানুষের বৃত্ত ছোট হয়ে আসতে লাগল। কিন্তু জন্তুটা যখন তিনশ’ গজের মতো দূরে, লোকগুলো আবার থেমে গেল।
আনন্দ নেই। সেনাপতিত্ব আজ হালিমের দখলে। প্রেরণা দেবার জন্য পেছন থেকে আবার সে চেঁচিয়ে লাগল, আউগাও ভাইরা, আউগাও
ঠেলে ঠেলে জনতাকে আরও অনেকখানি এগিয়ে নিয়ে গেল হালিম। কিন্তু বাঘটা যখন এক শ’ গজ দূরত্বে তখন আর পারা গেল না।
এতদূর থেকে লাঠি সড়কি দিয়ে অন্তত বাঘ মারা যায় না। হালিম শূন্যে ঘুষি ছুঁড়তে ছুঁড়তে সমানে চেষ্টাতে লাগল, আওগাও ভাইরা, আউগাও–
কিন্তু এত অনুপ্রেরণাতেও কাজ হল না। লোকগুলো একেবারে অনড়, কেউ যেন পেরেক ঠুকে মাটিতে তাদের পা আটকে দিয়েছে।
ওদিকে আরেকটা ব্যাপার ঘটল। বাঘটা ঘুমিয়েছিল, হঠাৎ এত চেঁচামেচি শুনে গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়াল।
হিজল গাছের মাথা থেকে বিনুর মনে হল, বাঘটা দশ হাতও না, বার হাতও না, ছ’সাত হাতের মতো লম্বা। হলুদ শরীরে তার কালো কালো ডোরা।
কাঁচা ঘুমটা ভেঙে যাবার জন্য খুব সম্ভব বাঘটা বিরক্ত হয়েছিল, এবং এত লোকজন দেখে কিছুটা বিস্মিত, কিছুটা হকচকিত। সে সামনের দিকে তাকাল। সঙ্গে সঙ্গে শ’খানেক লোক অস্ত্র টস্ত্র ফেলে। প্রাণপণে ছুটল, এবং নিমেষে দিগন্তের ওপারে অদৃশ্য হয়ে গেল। এবার বাঘটা তাকাল ডানদিকে, তক্ষুনি দু’আড়াইশ লোক আর নেই। অনেকে মালকোঁচা দিয়ে লুঙ্গি পরে এসেছিল, ছুটবার সময় কাছা খুলে যাওয়ার লুঙ্গিতে পা আটকে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। ধান কেটে নিয়ে যাবার পর যে গোড়াগুলো মাঠময় ছড়িয়ে আছে তাতে হোঁচট খেয়েও অনেকে পড়ে যাচ্ছে। পড়েই তক্ষুনি উঠে পড়ছে, এবং ধাঁ করে পেছনে একবার তাকিয়ে নিয়েই আবার ছুটছে।
সামনে পেছনে, যেদিকেই বাঘটা তাকাচ্ছে, এক অবস্থা। মুহূর্তে সব ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। চারদিকে তাকাতে তাকাতে সেনাপতির সঙ্গে একবার তার শুভদৃষ্টি হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে দেখা গেল একটা ডোরাকাটা লাল লুঙ্গি আর সবুজ জামা প্রায় উড়ে গিয়ে আধ মাইল দূরের একটা খালে ঝাঁপিয়ে পড়ল।
কেউ যখন আর নেই, সেই সময় বাঘটা অলস পায়ে চকের এক প্রান্তে উলুখড়ের জঙ্গলে গিয়ে ঢুকল। তারপর হিজল গাছ থেকে নেমে ছুটতে ছুটতে বাড়ি ফিরে এল বিনু।
কিছুক্ষণের মধ্যে বাঘ শিকারের ব্যাপারটা দিকে দিকে রটে গেল।
হাসতে হাসতে হেমনাথ বললেন, যেমন আনন্দটা তেমনি তার প্যানজার বাহিনী।
বিনু শুনতে পেল সবার কান বাঁচিয়ে সুধা সুনীতিকে বলছে, আচ্ছা বীরপুরুষের গলায় মালা দিবি দিদিভাই–
সুনীতি মুখ তুলতে পারছিল না। মাটির সঙ্গে সে যেন মিশে যেতে চাইছে।
.
দিন চারেক পর খবর পাওয়া গেল, বাঘটা মারা পড়েছে। ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব লঞ্চে করে রাজদিয়া আসছিলেন। নদীর বাঁকে বাঘটাকে দেখে গুলি করে মেরেছেন।
বাঘের ভয়ে আনন্দ যে বাড়ি থেকে বেরোয় নি, এই কথাটা কেমন করে যেন চারদিকের গ্রামগঞ্জগুলোতে রটে গিয়েছিল। খবরটা যে শুনেছে সে-ই হেসেছে।
এদিকে সেদিনকার সেই মজার ঘটনাটির পর আনন্দর আর দেখা নেই। আগে দিনে দুবার করে হেমনাথের বাড়ি আসছিল, এখন রামকেশবের বাড়ির একটা ঘরে সে নাকি নির্বাসন বেছে নিয়েছে।
একদিন হেমনাথ গিয়ে আনন্দকে ধরে আনলেন। রগড়ের গলায় বললেন, আরে দাদা, তোমার এত লজ্জাটা কিসের?
আনন্দ খুবই বিব্রত বোধ করছিল। উত্তর দিল না।
হেমনাথ আবার বললেন, লজ্জার কিছু নেই, বুঝলে ভাই। বড় বড় সেনাপতি যারা–যেমন ধর রোমেল, মন্টোগোমারি, দ্য গল–ফ্রন্টে হেঁজিপেঁজি সোলজারের গায়ের গন্ধ শুকতে শুকতে কি তারা লড়ে? তারা দূরে দূরে বসে কলকাঠি নাড়ে। তুমি ঘরে বসে থেকে আদর্শ জেনারেলের মতো কাজ করেছ। একটু থেমে আবার বললেন, ভয় নেই, এর জন্যে সুনীতিদিদি বর বদল করবে না। কী বলিস রে দিদিভাই?
সুধা-সুনীতি-বিনু ঝিনুকরা কাছেই ছিল। সুনীতি ছুটে পালিয়ে গেল।
সুধা চোখের তারায় আর ঠোঁটের প্রান্তে ধারাল হাসিটা হেসে বিঁধিয়ে বিধিয়ে বলল, কী বীরপুরুষ, বোঝা গেল। কাঁধে বন্দুক, কোমরে ভোজালি, গলায় টোটার মালা ঝোলানোই সার।