২.৩ সেন্ট মেরি কিন্ডারগার্টেন স্কুল

২.৩

সেন্ট মেরি কিন্ডারগার্টেন স্কুল নামটি যত ভারী, সেই তুলনায় স্কুলটি বেশ ছোট। একটি দোতালা বাড়ির একতলার পাঁচখানা ঘর ভাড়া নিয়ে স্কুলটি চলে। বাড়ির মালিক আর তাঁর স্ত্রী, দুজনেই বুড়ো-বুড়ি, থাকেন দোতলায়। তাদের তিন ছেলেমেয়েই থাকে বিদেশে। একটি মাত্র কাজের লোক, তারও বয়েস প্রায় ষাট।

একতলার ঘরগুলি ছাড়া পেছন দিকে রয়েছে একটা বেশ বড় উঠোন, তার একপাশে অনেকগুলি ফুলের টব। সেদিকেই দুটো বাথরুম, আর একটা ছোট ঘর, সঙ্গে এক টুকরো বারান্দা। সেই ঘরে থাকে সেই স্কুলের আয়া লক্ষ্মীমণি, বারান্দায় তার রান্নাঘর।

স্কুলের এক দারোয়ান ও একজন বেয়ারাও আছে। বেয়ারাটি রাত্তিরে থাকে না, দারোয়ানটি স্কুলের একটা ঘরেই শোয়।

স্কুলটি বড় রাস্তার ওপরে নয়, একটা গলির মধ্যে, তবে সেখান দিয়ে দুটো গাড়ি পাশাপাশি যেতে পারে। গলিটা যেখানে বড় রাস্তায় পড়েছে, সেখানে একটি পুরোনো আমলের রেস্তোরাঁ, চপ কাটলেট বিক্রি হয়।

সকালের দিকে এ রেস্তোরাঁয় বিশেষ কেউ আসে না। এখন বেলা এগারোটা, শুধু একটা টেবিলে তিনজন ব্যক্তি বসে আছে অনেকক্ষণ ধরে। দেখলে সাধারণ ভদ্রলোক বলেই মনে হবে। কোনও সন্দেহ করারই উপায় নেই যে এই তিনজনের মধ্যে দুজনই বেশ উচ্চপদের পুলিশ অফিসার, অন্যজনের বয়েস কম হলেও এসেছে দিল্লি থেকে।

ঘণ্টাখানেক কেটে গেছে, শুধু-শুধু বসে থাকা যায় না, কাপের পর কাপ চা অর্ডার দিয়ে যাচ্ছেন এঁরা।

বর্ধন বললেন, আর কতক্ষণ বসে থাকব? আর কত চা খাব? একটা চিংড়ির কাটলেট খেলে মন্দ হত না। ওহে কবির, দ্যাখো না, চিংড়ির কাটলেট পাওয়া যায় কিনা। তুমি দাম দেবে।

দোকানের মালিক বসে আছেন এক কোণের কাউন্টারে। কবির সেই দিকে চেয়ে বললেন, তিনটে চিংড়ির কাটলেট পাঠিয়ে দিন না।

মালিক ঘড়ঘড়ে গলায় বললেন, কাটলেট এখনও তৈরি হয়নি। কেক খাবেন?

বর্ধন ফিসফিস করে বললেন, ওই কেকগুলো কতদিনের বাসি, তা কে জানে। এত বেলাতেও চিংড়ির কাটলেট তৈরি হয় না, এ দোকান চালাবে কী করে? এ দোকান উঠে গিয়ে এখানে ওষুধের দোকান হল বলে!

দুর্লভ বলল, কেন, ওষুধের দোকান কেন? অন্য কোনও দোকানও হতে পারে।

বর্ধন বললেন, আমি দেখেছি, ওষুধের দোকানের কোনও মার নেই। যে পাড়াতেই খোলো, ঠিক চলবে, সব সময়ে দোকানে ভিড়।

বর্ধন হেসে বললেন, সেই ছাত্র বয়েসের পর আর কখনও…সে কতকাল আগের কথা, আমাদের নর্থ ক্যালকাটায় এরকম অনেক চায়ের দোকান ছিল…এ স্কুলটার কখন ছুটি হবে?

খুব সম্ভবত বারোটায়।

 আরও এক ঘণ্টা এখানে বসে থাকতে হবে?

স্যার, আপনার মতন একজন এত বড় অফিসার এই সামান্য একটা কেস নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন, এ কথা শুনলেও তো কেউ বিশ্বাস করবে না। আপনি আর কেন বসে থাকবেন? যা করবার, আমরা দুজনেই ম্যানেজ করব।

কেন যে মাথা ঘামাচ্ছি, তা আমি নিজেই জানি না। মানবিকতা বনাম আইন। একটা অসহায় মেয়েকে সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে দেওয়া কিংবা তাকে জেলে পাঠানো। সিদ্ধান্ত নেওয়া খুব কঠিন। তবে কী জানো, এখানে বসে থাকতে বেশ মজাও লাগছে। যেন ছেলেবেলায় ফিরে গেছি। যে কাজ সাধারণ একজন সাব ইনস্পেকটরের করার কথা, সে কাজ নিয়ে বসে আছি আমরা তিনজন। মেয়েটি যদি দোষী না হয়, তাহলেও তার জীবনটা নষ্ট করে দেওয়ার অধিকার কি আমাদের আছে?

আরও দুকাপ করে চা পান করার পর স্কুলে ছুটির ঘণ্টা বাজল।

এই টেবিল থেকে স্কুলের প্রবেশদ্বারটি স্পষ্ট দেখা যায়। এর মধ্যে অনেক গার্জেন এসে ভিড় করেছেন সেখানে। তাদের মধ্যে মহিলাই বেশি।

কলকল করতে করতে বেরিয়ে আসতে লাগল ছেলেমেয়েরা। সঙ্গে-সঙ্গে রাস্তাটা যেন বর্ণময় হয়ে উঠল। বাচ্চাদের ঝলমলে হাস্যময় মুখ, মায়েদের কতরকম শাড়ির রং।

বর্ধন বললেন, মায়ের হাত ধরে একটা পাঁচ বছরের শিশু হাঁটছে, এটা পৃথিবীর একটা অন্যতম সুন্দর দৃশ্য। আমি এসে ভালোই করেছি। কতদিন একসঙ্গে এত বাচ্চা দেখিনি। আমার নাতনির কথা মনে পড়ছে। তার বয়েস চার বছর, দূর বিদেশে থাকে, আমি শুধু কমপিউটারে ছবি দেখি।

নানারকম রিকশা, গাড়িতে রাস্তাটা ভরতি হয়ে গেল।

আবার মিনিট দশেকের পর সব খালি।

এবার বেরুলেন শিক্ষয়িত্রীরা। মোট পাঁচজন। তারও একটু পরে প্রধান শিক্ষিকা।

কবির বললেন, ওই যে আমার বন্ধুর স্ত্রী বিশাখা। ওঁকে কি ডাকব? ওঁর সঙ্গে আগে কথা বলব?

কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করে বর্ধন বললেন না, থাক। এখনই ওঁকে কিছু বলার দরকার নেই। আগে মেয়েটির সঙ্গে কথা বলে দেখি। কী যেন ওর নাম, সরস্বতী না কালী?

লক্ষ্মীমণি। আমরা কি এবার স্কুল বাড়িটার মধ্যে ঢুকব?

সেটাও বোধহয় ঠিক হবে না। তুমি একা গিয়ে ওকে ডেকে আনতে পারবে?

তা পারব। কিন্তু আমরা কোথায় কথা বলব? এই চায়ের দোকানে?

ধ্যাৎ! তা আবার হয় নাকি? তোমার অফিসেও বোধহয় নিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না। কেউ না কেউ উঁকিঝুঁকি মারবে!

দুর্লভ সিং খানিকটা বিরক্তভাবেই বলল, আমরা ওকে নিয়ে এত চিন্তা করছি কেন? এটা আমাদের অফিশিয়াল ডিউটি। ওকে অফিসে ডেকে নিয়ে জেরা করাই তো স্বাভাবিক। আমরা কি শুধু-শুধু সময় নষ্ট করছি না?

কবির বললেন, ইয়েস, আমাদের কিছুটা সময় নষ্ট হচ্ছে ঠিকই। কিন্তু আমরা এতটা সাবধান হচ্ছি, তার কারণ, আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করছি, যাতে ওকে বাঁচানো যায়। এখানকার সবাই জানে, একটা গ্রামের গরিব পরিবারের স্বামী-পরিত্যক্তা মেয়ে, অসহায় কিন্তু সৎ, এই স্কুলে আয়ার কাজ করছে। এই কাজ পেয়ে লক্ষ্মীমণি সুস্থভাবে বাঁচার অধিকার পেয়েছে। ওকে যে পাচারকারিরা ধরে নিয়ে গিয়েছিল, তারপর অনেক ঘাটের জল খেয়েছে, কিছুদিন বেশ্যাবৃত্তিও করেছে বাধ্য হয়ে, তা একবার জানাজানি হয়ে গেলে, সঙ্গে-সঙ্গে ওর চাকরি যাবে। ওর সামনে তখন আর দুটি মাত্র রাস্তা খোলা থাকবে। হয় বেশ্যাবৃত্তিতে আবার ফিরে যাওয়া অথবা আত্মহত্যা করা। কেউ কেউ আত্মহত্যাও করে। গত মাসেই এরকম একটা কেস হয়েছে।

বর্ধন নিঃশব্দে মাথা নাড়লেন।

দুর্লভ বলল, কিন্তু ও যদি একটা খুনের ব্যাপারে জড়িত থাকে, তাহলে তো ওকে শাস্তি পেতেই হবে। ওকে দয়া দেখাবার কি অধিকার আছে আমাদের?

কবির বললেন, শাস্তির যোগ্য হলে শাস্তি পেতেই হবে। ক্ষমা করার অধিকার আমাদের নেই, তা জানি। কিন্তু সত্যি সত্যি ও সেই অপরাধ করেছে কিনা, তা আগে এস্টাব্লিশ করা দরকার। সেইজন্যই আমরা যতদূর সম্ভব সাবধানে এগোতে চাই। একটা পুরুষমানুষকে থানায় ডেকে নিয়ে জেরা করলে মানুষ কিছু মনে করে না। কিন্তু একটা মেয়েকে…মানুষের মনে একবার সন্দেহ ঢুকলে আর যায় না।

বর্ধন রাস্তার দিকে তাকিয়ে বললেন, স্কুল বাড়ি থেকে এখন যে বেরিয়ে আসছে, সে

কবির এক পলক দেখেই বললেন, ওই তো লক্ষ্মীমণি!

বর্ধন বললেন, এই রে, ও কোথায় যাচ্ছে?

কবির বললেন, হাতে একটা থলে। খুব সম্ভবত বাজারে। তরকারি-টরকারি কিনবে।

বর্ধন বললেন, বারোটা বেজে গেছে। এখন কেউ বাজারে যায়? এখন কী পাবে?

কবির বললেন, স্যার, গরিব মানুষরা এই সময়েই বাজারে যায়। এখন ঝড়তি-পড়তি জিনিস পাওয়া যায় সস্তায়। একটু-একটু পচা মাছ বিক্রি হল জলের দরে।

বর্ধন উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আরে, ও বাজারে ঢুকে পড়লে আমরা আর ওকে পাব কী করে? ওকে এক্ষুনি ধরতে হবে।

টেবিলের ওপর চায়ের দাম রেখে ওঁরা হুড়মুড়িয়ে বেরিয়ে এলেন বাইরে।

লক্ষ্মীমণি ওঁদের সামনে দিয়েই চলে গেল।

তিনজন হাঁটতে লাগলেন তার পিছু পিছু।

কয়েক পা গিয়েই থেমে গিয়ে বর্ধন বললেন, একটা মেয়েকে ফলো করব আমরা তিনজন মদ্দা, পাড়ার লোক আমাদেরই না মেয়ে-ধরা মনে করে পিটুনি দিতে শুরু করে।

নিজের রসিকতায় তিনি নিজেই জোরে হেসে উঠলেন।

কবির বললেন, আপনারা দাঁড়ান স্যার, আমি ওর সঙ্গে কথা বলছি।

তিনি এগিয়ে গেলেন দ্রুত পায়ে।

লক্ষ্মীমণি এক জায়গায় রাস্তা পার হওয়ার জন্য দাঁড়িয়েছে। কবির তার পাশে এসে যেন হঠাৎ দেখতে পেয়েছেন, এই ভাবে বললেন, আরে, তুমি সেই লক্ষ্মীমণি না? আমায় চিনতে পারছ?

লক্ষ্মীমণি মোটেই ভয় পেল না কবিরকে দেখে। খুব স্বাভাবিকভাবে বলল, কেন চিনব না! আপনিই তো সেই সাহেব, আমার প্রাণ বাঁচিয়েছেন!

ঝট করে ঝুঁকে সে কবিরের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল।

 কবির বললেন, তুমি তো একটা চাকরি করো, তাই না? এখানেই থাকো?

লক্ষ্মীমণি বলল, হ্যাঁ, সাহেব, ইস্কুলেই আমাকে থাকার একটা জায়গা দিয়েছে। আমি আর যাব কোথায়?

তুমি একাই থাকো?

জি। নিজেই বেঁধেবেড়ে খাই।

এখন বাজারে যাচ্ছ?

জি, দেখি যদি কিছু চুনো মাছ পাই। আজ আমার সোয়ামি দেশ থেকে রাতে আসবে। আমার হাতের রান্না খেতে চায়। যেদিন আসে, খেয়েদেয়েই যায়।

কবির একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। এর স্বামী একে বিক্রি করে দিয়েছিল। কোনওক্রমে উদ্ধার পেয়ে এ ফিরে এসেছে, কিন্তু এর স্বামী-শাশুড়ি আর একে ফেরত নেবে না। নিজেদের সংসারে স্থান দেওয়ারও প্রশ্ন নেই। তবু সেই স্বামীটি এর সঙ্গে দেখা করতে আসে, এখানে খেয়ে যায়, কিছু টাকাও নেয় বোধহয়। মানুষ আর কত নির্লজ্জ হৃদয়হীন হতে পারে। আর বাঙালি মেয়েরা সহ্য করে নেয় সবকিছু।

কবির বললেন, শোনো, তোমার সঙ্গে একটু দরকার আছে। তুমি আমাদের কাছে যা স্টেটমেন্ট, মানে ইয়ে যে এজাহার দিয়েছিলে, তার সবটা লিখে রাখা হয়নি। আমাদের রেকর্ড রাখতে হয়। তাই তুমি চলো আমার সঙ্গে, বেশি না, ঘণ্টাখানেকের জন্য। আমার সঙ্গে গাড়িতে উঠবে?

লক্ষ্মীমণি এস্তভাবে বলল, না, না সাহেব, আপনার সঙ্গে গাড়িতে যেতে পারব না। এদিককার দোকানের লোকেরা আমাকে চেনে, তারা কে কী ভাববে! কোথায় যেতে হবে বলুন, আমি নিজেই চলে যাব।

কবির বললেন, সেটাই ভালো। তুমি বরং, এখান থেকে ওই বাসে ওঠো। টিকিট কাটার সময় বলবে, ন্যাশনাল লাইব্রেরি। বলতে পারবে? জাতীয় গ্রন্থাগার, এটা মনে রাখতে পারবে? আচ্ছা থাক, বলবে চিড়িয়াখানা। সেখানে বাস থামলেই নেমে পড়ো। ভালো করে জিগ্যেস করে চিড়িয়াখানায় নামবে।

লক্ষ্মীমণি ঘাড় হেলিয়ে বলল, আচ্ছা।

কবির ওর বাসে ওঠা পর্যন্ত অপেক্ষা করলেন রাস্তার এপারে।

সেই বাসে চিড়িয়াখানায় পৌঁছবার আগেই কবিরদের গাড়ি সেখানে উপস্থিত। লক্ষ্মীমণি বাস থেকে নামতেই কবির বললেন, এবার তুমি গাড়িতে ওঠো, এখানে কেউ তোমায় চিনবে না।

সে গাড়িতে ওঠার পর বর্ধন বললেন, হুঁ, তোমারই নাম পদ্ম? বয়েস তো বেশি না? তোমার দুটো ছেলেমেয়ে থাকে কী করে?

লক্ষ্মীমণি হি হি করে হেসে উঠল।

কবিরও মৃদু হেসে বললেন, স্যার, এর নাম পদ্ম নয়, লক্ষ্মী। ওর বয়েস প্রায় বত্রিশ। এই বয়েসের মেয়ের দুটি ছেলেমেয়ে তো থাকতেই পারে। গ্রামের এইসব মেয়ের তো বিয়েই হয় চোদ্দ-পনেরো বছর বয়সে।

বর্ধন বললেন, চাইলড় ম্যারেজ? ভেরি ব্যাড, ভেরি ব্যাড।

এর মধ্যেই ঠিক করা হয়েছিল, বসা হবে বর্ধন সাহেবের বাড়িতে। গাড়ি ঢুকল গেট দিয়ে। বিশাল কমপ্লেক্স। পঁচাশিখানা ফ্ল্যাট, বর্ধনেরটা চোদ্দ তলায়।

লিফট দিয়ে ওপরে উঠে আসার পর লক্ষ্মীমণি একেবারে থ। কোনও বাড়ির এত উঁচুতলায় সে কখনও আসেনি। জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইল।

বর্ধন বললেন, ওই যে দেখতে পাচ্ছ, গঙ্গা? আর ওই সেতুটার নাম বিদ্যাসাগর ব্রিজ।

লক্ষ্মীমণি এবার বলল, গঙ্গা নদী? রোজ ঘুম থেকে উঠেই আপনি মা গঙ্গাকে দেখতে পান? তা হলে আপনার খুব পুণ্য হয়।

বর্ধন বললেন, পুণ্য? কী জানি। পুলিশের চাকরিতে তো শুধু পাপই জমে ওঠে।

খাওয়ার ঘরে গোল টেবিলটাতেই বসা হল। লক্ষ্মীমণি কিছুতেই এত বড়-বড় সাহেবদের সামনে চেয়ারে বসবে না, সে দাঁড়িয়েই থাকতে চায়।

বর্ধন ধমক দিয়ে তাকে জোর করে বসালেন।

তারপর তিনি বললেন, সকাল থেকে চা খেয়ে আমাদের পেট ঢোল হয়ে গেছে, আর চা চলবে না। এখন ডিউটির সময় বিয়ারও খাওয়া যাবে না। সুতরাং কিছু অফার করছি না।

দুর্লভ বলল, স্যার, আগে আমাদের কাজটা সেরে নেওয়া হোক।

কবির বললেন, শোনো লক্ষ্মী, আমি তোমায় কয়েকটা প্রশ্ন জিগ্যেস করব। বাংলায় বলে তারপর এনাকে ইংরিজিতে বুঝিয়ে দেব। তোমার সঙ্গে যখন আমার শেষ কথা হয়, তখন তুমি আমাকে দুটো-একটা মিথ্যে বলছিলে কী?

সবাইকে অবাক করে দিয়ে, অস্বীকার না করে, সঙ্গে-সঙ্গে সে উত্তর দিল, তা বলেছি। বোধহয়!

কবির বললেন, কেন বলেছিলে, আমরা তো তোমার ওপর কোনও জোর-টোর করিনি?

লক্ষ্মী বলল, কী জানি কেন। মাঝে-মাঝে মুখ দিয়ে এমনিই বেরিয়ে আসে। তা ছাড়া সব সত্যি কথা বললে অনেকে বিশ্বাস করে না।

বর্ধন এক হাতে নিজের থুতনি ঘষতে ঘষতে বললেন, তা ঠিক, সত্যিটাই অনেক সময় বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না। সামটাইমস টুথ ইজ স্ট্রেঞ্জার দ্যান ফিকশান।

কবির জিগ্যেস করলেন, কলকাতায় ফিরে আসার আগে, তুমি দিল্লির রাজেন্দ্রনগরের একটা বাড়িতে ছিলে। তাই তো?

হ্যাঁ বাবু, সেটা বেশ বড় বাড়ি। পাকা বাড়ি। রান্নাঘরের পাশে ফিরিজ ছিল।

সে বাড়ি ছাড়লে কেন?

ওরে বাবারে, সে বাড়িতে একদিন যে একটা মানুষ খুন হল। ভাবলেও এখন গায়ে কঁটা দেয়। একজন বাবু আর একজন বাবুকে গুলি করে খুন করল। তারপর সে খুনিবাবুটা দুমদুম করে গুলি চালাতে-চালাতে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এল। তাই দেখে ভয়ে আমি দৌড় লাগালাম। আমার জামা কাপড় সব ফেলে–

দুর্লভ বলল, এটাও ঠিক নয়। সহদেব আচারিয়া গুলিতে খুন হয়নি। তার বডিতে কোনও বুলেট উন্ড ছিল না, মাথাভরতি কাঁচ।

কবির লক্ষ্মীকে জিগ্যেস করলেন, তুমি যে বাইজিটির কাছে কাজ করতে, তার ঘরেই খুন হয়েছিল। তুমি তখন ছিলে সে ঘরে? খুনটা নিজের চোখে দেখেছ?

না, আমি তখন ঘরের বাইরে। গুলির আওয়াজ শুনেছি। তারপর একটা বাবু বন্দুক হাতে বেরিয়ে এল।

সেই দুই বাবুর চেহারা তোমার মনে আছে? কেমন চেহারা ছিল?

বাবুদের চেহারা যেমন হয়। সুন্দর মতন, ফরসা, একজনের মাথা-ভরতি চুল, অন্যজনের। একটু-একটু টাক। একজন সিল্কের পাঞ্জাবি পরা, হাতে একটা লোহার বালা। অন্যজন প্যান্টুল আর জামা

যার হাতে লোহার বালা, সে-ই তো খুন হল?

না, না। অন্য বাবুটা। যার হাতে লোহার বালা, সেই তো ঘর থেকে বেরিয়ে এসেও গুলি চালাতে লাগল, আমি তখন ভয়ে এক কোণে

দুর্লভ বলে উঠল, রং রং। সহদেব আচারিয়ার হাতেই লোহার বালা ছিল। খুন হয়েছে। সে। ডেডবডিতেও সেই লোহার বালা ছিল।

কবির লক্ষ্মীকে জিগ্যেস করলেন, তোমার ঠিক মনে আছে? সিঁড়ি দিয়ে কে নেমে এসেছিল?

লক্ষ্মী ঘাড় কাৎ করে জোর দিয়ে বলল, স্পষ্ট মনে আছে বাবু, ঘরের মধ্যে অন্য লোকটা মরে পড়ে রইল, আর এই লোকটা ধুতি আর কুর্তা পরা, ধুতি খুলে গেছে, ষাঁড়ের মতন চাঁচাতে চাচাতে সিঁড়ি দিয়ে নামছে। এই বাবুটাকে তো আগেও দু-তিনবার দেখেছি ও বাড়িতে, সেই লোহার বালা পরত। একদিন ওই লোহার বালা দিয়ে সোডার বোতলের ছিপি খুলেছিল।

কবির এবার মুখ ফিরিয়ে দুর্লভকে জিগ্যেস করলেন, ডেডবডির পোশাক কী ছিল?

দুর্লভ মাথা নেড়ে বলল, ধুতি কুর্তা। হাতে লোহার বালা।

কবির বললেন, তা হলে, অ্যাকরডিং টু লক্ষ্মী, যে খুন হয়েছিল, সে শিউলাল ঝা। কিন্তু শিউলাল তো খুন হয়নি। সে কয়েকদিন পরে নিজেই এসেছিল থানায়–

দুর্লভ বলল, খুন তো হয়েছিল একজন, সেটা শিওর। ডেডবডি পাওয়া গেছে। সময়টাও মিলে গেছে।

বর্ধন বললেন, সব কিছুই যে গুলিয়ে যাচ্ছে হে।

টেবিলের ওপর রাখা একটা কাচের জার থেকে তিনি একটা গেলাশে জল ঢালতে গেলেন। জলভরতি ভারী জারটা তিনি ধরে রাখতে পারলেন না, সেটা পড়ে গেল মেঝেতে। বিকট শব্দে সেটা টুকরো-টুকরো হয়ে গেল, জল গড়াতে লাগল চারদিকে।

বর্ধন বললেন, এঃ হে, হে। মনার মা, মনার মা

একজন স্থূলাঙ্গিনী মহিলা বেরিয়ে এলেন ভেতর থেকে। বর্ধন কিছু বলার আগেই তিনি বকুনি দিয়ে বললেন, আবার ভেঙেছেন? এই নিয়ে তিনটে ভাঙল একমাসে। কী করে করেন!

বর্ধন একটু অপ্রস্তুত ভাবে বললেন, পড়ে গেল, কী করব। একটা ঝটা আনো–

এর মধ্যেই লক্ষ্মীমণি পাশের বাথরুমে ঢুকে একটা ঝাটা আর একটা ঘর মোছা ন্যাতা গোছের নিয়ে এল। পরিষ্কার করতে শুরু করল উবু হয়ে বসে।

বর্ধন তাকে বললেন, আরে, আরে, তুমি ওসব কী শুরু করলে? ওঠো-ওঠো।

লক্ষ্মীমণি অবাক হয়ে বলল, পরিষ্কার করব না? ভাঙা কাঁচ, যদি পায়ে ফোটে!

মনার মা রান্নাঘরে কিছু একটা চাপিয়ে এসেছিল, সেটা সামলে আবার ফিরে আসার মধ্যেই লক্ষ্মীমণি নিপুণ হাতে সব কাঁচ একপাশে সরিয়ে জল মুছে ফেলেছে।

কবির তাকে বললেন, ঠিক আছে, হয়েছে। এবার উঠে বসো

দুর্লভ বলল, স্যার, এবার আমি ওকে জেরা করতে পারি? তুম হিন্দি সামঝো?

লক্ষ্মী বলল, হিন্দি? একটু একটু।

দুর্লভ হিন্দিতে জিগ্যেস করল, তুমি গীতা চাওলা বলে কারুকে চেনো?

দু-দিকে মাথা নেড়ে লক্ষ্মীমণি বলল, না।

তুমি যার কাছে কাজ করতে, তার নাম কী?

 জানেমন বিবি।

নাম ভাঁড়িয়ে থাকতে পারে। তার চেহারা কেমন?

পাতলা পানা। খুব ফরসা। কোমরটা খুব সরু আর বুকের এই জাগাটা, বেশ চওড়া। ঠোঁট সব সময় লাল। মাথার চুল একটু কুঁকড়া কুঁকড়া।

গীতা চাওলার সঙ্গে পুরোপুরি মিলে যাচ্ছে। তার ঘরে একজন খুন হয়েছিল। তুমি বললে, হাতে বালা পরা সহদেব আচারিয়া তার দোস্ত শিউলাল ঝা-কে খুন করে পালিয়ে যায়। এটা ঠিক নয়। শিউলাল ঝা বেঁচে আছে। তা হলে তুমি মিথ্যে বলছ কেন?

মিথ্যে তো বলিনি। যা দেখেছি, তাই বললাম। ধুতি পরা বাবুটাকেই আমি বন্দুক হাতে সিঁড়ি দিয়ে নামতে দেখলাম।

ঠিক আছে। সেটা আমরা পরে সম্ভ করব। সেই খুনের ঘটনার পর তুমি ওই বাড়িতে কতদিন ছিলে?

থাকি নাই তো? ভয়ে দৌড় দিছি।

কবির বললেন, তুমি স্টেটমেন্ট দিয়েছিলে, ওই বাড়ি থেকে বেরিয়ে সোজা দৌড়ে বেরিয়ে গিয়ে পুলিশের কাছে আশ্রয় চেয়েছিলে। এখন দেখা যাচ্ছে, তোমার এ কথাটাও সত্যি নয়।

লক্ষ্মীমণি চুপ করে রইল।

দুর্লভ বলল, অফ কোর্স মিথ্যে কথা। রেকর্ডে আছে, ওই ঘটনার সাতদিন পর দিল্লি পুলিশ একটা স্মাগলারদের ডেন রেইড করে পাঁচটি বাংগালি মেয়েকে উদ্ধার করে। তাদের মধ্যে একজন ছিল সরিফন বিবি। এখন অবশ্য শোনা যাচ্ছে, সরিফন বিবি আগেই ডেড। তার বদলে এই মেয়েটি ছিল সেই দলের মধ্যে।

কাচের জারটি ভাঙার লজ্জা কাটিয়ে ওঠবার জন্য বর্ধন নিজেই এবার জিগ্যেস করলেন, তুমি পুলিশের কাছে নিজে ধরা দাওনি?

লক্ষ্মী বলল, না।

 বর্ধন আবার বললেন, তবে, এই মিথ্যেটি বলেছিলে কেন?

বড়বাবু, পুলিশের কাছে কি নিজে যাওয়ার সাহস আছে। পুলিশের নামেই তো বুকটা কাঁপে। ওই সব খুন-জখমের ব্যাপার দেখে বুকটা ধড়াস-ধড়াস করছিল। আমি আর গোলাপি নামে আর একজন দৌড়ে-দৌড়ে রাস্তায় এদিক-ওদিক ঘুরি। গোলাপি বলল, সে আগে একটা বাড়িতে কাজ করত, সেখানে গেলে থাকা যাবে, তাই একটা অটো রিকশা চেপে চলে গেলাম সেখানে। সেখানেই লুকিয়ে ছিলাম। সাতদিন পর পুলিশ আমাদের উদ্ধার করে। পুলিশ তখন খুনের কথা কিছু বলে নাই, আমরাও মুখ খুলি নাই।

দুর্লভ বলল, স্যার, ওর এই কথাটাও মিথ্যে। খুনের পর আরও অন্তত চারদিন এই মেয়েটি সেই বাড়িতেই ছিল। এর ঘরের মেঝেতেই মেঝেটা খুঁড়ে লাশটা পুঁতে রাখা হয়েছিল। একটা খাট পেতে ঠান্ডা মাথায় এ সেখানে শুয়ে থেকে পুলিশের চোখে ধুলো দিয়েছিল।

কবির বলেন, এটাই সত্যি, তাই না?

লক্ষ্মীমণি খানিকটা বিভ্রান্ত ভাবে বলল, আমি? সেখানে শুয়েছিলাম? না, না, আমি না, আমি না। সরিফন হতে পারে। সরিফন আমাদের সঙ্গে পালায়নি।

সরিফন বিবি? তুমি যে বলেছিলে, সরিফনকে তুমি চেন না? সরিফন তোমাদের সঙ্গে একই বাড়িতে ছিল। আগে তো একবারও বলনি?

লক্ষ্মীমণি তিনজনের মুখের দিকে পর্যায়ক্রমে তাকিয়ে বলল, বলি নাই ঠিকই। যখন ও লাইনে ছিলাম, তখন আমাদের বারবার করে শিখায়ে দিয়েছিল, একজন কেউ ধরা পড়লে কিছুতেই অন্যদের নাম বলবে না। পুলিশ জিগ্যেস করলেও বলবে না। তা ছাড়া, আপনে বলছিলেন সরিফন বেঁচে নাই। তাই আর কিছু বলি নাই।

দুর্লভ বলল, স্যার, যা বোঝবার বুঝে গেছি। এ মেয়ে অতি তুখোড় মিথ্যেবাদী। খুনের পর লাশটা গায়েব করার ব্যাপারে এ নিশ্চিত সাহায্য করেছে। এখন ওকে অ্যারেস্ট করা ছাড়া আর কোনও উপায় নেই।

কবির বললেন, লক্ষ্মীমণি, আমরা আর তোমার কোনও কথায় বিশ্বাস করতে পারছি না। খুনের পরেও তুমি ওই বাড়িতে…

লক্ষ্মীমণি এবার আর্ত গলায় চিৎকার করে বলল, না, আমি না, আমি না। বিশ্বাস করেন, মা কালীর দিব্যি। ওই বাবুটা যখন গুলি চালাইলো, তারপর আর দশ মিনিটও সেই বাড়িতে থাকি নাই। আর কোনওদিন সেদিকে যাই নাই। সরিফন ছিল, তার শরীর খারাপ, খুব জ্বর, আর ওই বাড়িতে দারোয়ানের সঙ্গে তার আশনাই ছিল, তাই সে আসতে চায় নাই।

দুর্লভ বলল, আর কি কথা বাড়াবার দরকার আছে! এবার এই মেয়েটিকে আপনারা দিল্লি পুলিশের হাতে ছেড়ে দিন।

কবির খানিকটা বিরক্ত ভাবেই বললেন, লক্ষ্মী, তোমাকে এখন দিল্লিতে যেতেই হবে। আমাদের আর তোমাকে আটকে রাখার উপায় নেই।

হুহু করে চোখ ফেটে জল এল লক্ষ্মীর। সে হাউহাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলল, না, না, আমি আর দিল্লিতে যাব না! আবার আমি ওই চক্করে পড়তে চাই না। এখন আমি কত শান্তিতে আছি, আমার স্বামী আমাকে নেয় না, আমার ছেলেমেয়েকে কাছে পাই না। তবু, তবু, খেয়ে পরে মানসম্মান নিয়ে বেঁচে আছি। ইস্কুলের চাকরিটা আমার কী ভালো যে লাগে, ছোট ছোট সব দুধের ছেলেমেয়ে, তাদের মুখগুলি দেখলেও শান্তি লাগে, আমি আর কিছু চাই না–

চেয়ার থেকে নেমে মাটিতে হাঁটুগেড়ে বসে সে হাত জোড় করে বলতে লাগল, এই কয়টা বছর, কত অপমান সয়েছি, কত মার খেয়েছি, আমার এই শরীরটা নিয়ে কত অত্যাচার হয়েছে, এখন বাবুগো, যেটুকু শাস্তি পেয়েছি, সেটুকু বাপ-মায়ের নামে কিরে কেটে বলছি, ওই খুনের ব্যাপারে আমি আর কিছু জানি না–

অন্য তিনজন পুরুষই নীরব। তাদের মুখ পাথরের মতন।

কাঁদতে কাঁদতে একই কথা বলতে বলতে লক্ষ্মীমণি হঠাৎ একসময় থেমে গেল। আঁচল দিয়ে চোখমুখ মুছে একেবারে শান্ত গলায় বলল, ঠিক আছে, আমারে ধরে নিয়ে যান। দুই হাত বাঁধুন। পুলিশ একবার দিল্লিতে নিয়ে গেলে আমার কী যে হবে জানি না। আমারে জেলে দিন। ফাঁসি দিন। মেয়েমানুষ হয়ে জন্মেছি, লেখাপড়া শিখিনি, পুরুষমানুষ আমাদের নিয়ে যা খুশি করতে পারে, বিয়ে করেও আবার বিক্রি করে দিতে পারে, আড়কাঠিরা যেখানে-সেখানে ঠেলে দেয়, প্রতিটি রাত্তিরেই সারা শরীরটা ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকে। কখনও মরতে চাইনি, তবু মরলেই বুঝি আসল শান্তি। আমারে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দিন, এ পৃথিবী থেকে এক আপদ বিদায় হবে। হ্যাঁ, আমিই সেই বাবুটারে খুন করেছি। আর কেউ দোষী নয়। আমি, আমি, আমি! আমার জীবনের কোনও দাম নেই!

বর্ধন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, এটা যদি অভিনয় হয়, তা হলে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কারটা অন্তত ওকে দেওয়া উচিত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *