“ইকরামা কোথায়?” হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু চিৎকার করে ডাকতে থাকেন– “সফওয়ান কোথায়?”
তারা উভয়ই পালিয়ে গেছে। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর আক্রমণের প্রচণ্ডতা তারা সহ্য করতে পারে না। এবং হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর চোখে পড়ার আগেই তারা লাপাত্তা হয়ে যায়। কুরাইশ সৈন্যদেরও হদিস পাওয়া যায় না। বারটি লাশ ফেলে তারা পালিয়ে যায়। সংক্ষিপ্ত এই সংঘর্ষে হযরত যায়েশ বিন আশআর রাযিয়াল্লাহু আনহু এবং হযরত কুয বিন যাবির ফিহরী রাযিয়াল্লাহু আনহু শহীদ হন।
মুসলিম বাহিনীর তিনটি অংশ অনেক আগেই মক্কায় প্রবেশ করেছে। অথচ হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর বাহিনীর এখনও পর্যন্ত কোন খবর নেই। সকলেই চিন্তিত, উদ্বিগ্ন। মক্কার জনগণ কোনরূপ বাধার সৃষ্টি করেনি। তাহলে হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু ও তাঁর বাহিনী কেন আসছে না? এমন জল্পনা-কল্পনা চলতে থাকে সেনাবাহিনীতে। সংবাদ সংগ্রহের উদ্দেশে এক লোককে পাঠানো হয়। সে ফিরে এসে জানায়, হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু দু’জন মুসলমানের লাশ নিয়ে আসছেন। তার বাহিনীর হাতে কুরাইশদের বারজন যোদ্ধা নিহত হয়েছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ সংবাদ শুনে খুবই রাগান্বিত হন। তিনি ভাল করেই জানতেন যে, খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু যুদ্ধ-প্রেমিক। তাই তিনি মনে করেন যে, কোনরূপ প্রতিরোধ ছাড়াই সে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছে। ফলে উভয় পক্ষের এই হতাহতের ঘটনা ঘটেছে।
হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু বিনয়ের সাথে বলেন যে, ইকরামা ও সফওয়ানের সাথে কুরাইশদের কতক লোক ছিল। তারা উপর্যুপরি তীর ছুড়ে তাদের গতিরোধ করে। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে আরো জানান যে, তিনি তাদেরকে একবার সুযোগ দিয়েছিলেন কিন্তু তারা জবাবে আরেক ঝাঁক তীর বর্ষন করে।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আবু সুফিয়ান রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে জিজ্ঞেস করেন, ইকরামা এবং সফওয়ান কোথায়? হযরত আবু সুফিয়ান রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, তারা মক্কা রক্ষা করতে যুদ্ধের জন্য কোথায় যেন গিয়েছে। হযরত আবু সুফিয়ান রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর এ জবাবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বিশ্বাস হয় যে, হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু যুদ্ধের সূচনা করে নি; বরং আত্মরক্ষার জন্য তাকে হাতিয়ার তুলে নিতে হয়।
মক্কার চুড়ান্ত পতন ঘটে। আল্লাহর ঘর বাইতুল্লাহ মুসলমানদের পূর্ণ অধিকারে চলে আসে।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিজয়ীর বেশে মক্কাতে প্রবেশ করেন। এ সময় তার সাথে ছিলেন হযরত উসামা বিন যায়েদ রাযিয়াল্লাহু আনহু হযরত বেলাল রাযিয়াল্লাহু আনহু এবং হযরত উসমান রাযিয়াল্লাহু আনহু। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করেন প্রায় সাত বছর পূর্বে। দীর্ঘ সাতটি বছর পরে নয়ন ভরে মক্কার চতুর্দিক দেখেন। এলাকাবাসীর দিকে তাকান দরজায় দরজায় এবং ছাদে দাঁড়ানো নারী-শিশুর প্রতি দৃষ্টি দেন। এর মধ্যে অনেকে চেনা, পরিচিত মুখ ছিল। তিনি চারদিকে নজর বুলাতে বুলাতে সামনে অগ্রসর হন। দীর্ঘদিন পর স্বাধীনভাবে বাইতুল্লাতে প্রবেশ করেন। এবং সাত বার কাবা শরীফ প্রদক্ষিণ করেন। অন্তরের গভীর থেকে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করেন। এ সময় মক্কার জনগণ ছিল নির্বাক। চোখে-মুখে ভরপুর উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। আজ তাদের বিরুদ্ধে কি হুকুম জারী হয় এই দুশ্চিন্তায় তাদের ঘুম হচ্ছিল না। যারা এতদিন মুসলমানদের নানাভাবে কষ্ট দিয়েছে তাদের দুশ্চিন্তা ছিল তুঙ্গে। আজ সমগ্র মক্কায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে জাদুকর বলার দুঃসাহস কারো নেই।
কুরাইশরা হাতিয়ার সমর্পণের সাথে সাথে পরিণতি ভোগের জন্য খুবই আতঙ্কিত অবস্থায় ছিল। তখনকার আরবে অবমাননা এবং হত্যার শাস্তি বড় মর্মন্তুদ হত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যদিও ঘোষণা করেছিলেন যে, যারা মুসলমানদের কিছু বলবে না তাদেরকে কিছু বলা হবে না; এরপরেও কুরাইশদের মধ্যে বিরাজ করছিল ভয়ানক আতঙ্ক।
“কুরাইশ জাতি!” রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নতশীরে দণ্ডায়মান জনতার উদ্দেশে দাঁড়িয়ে তাদের জিজ্ঞাসা করেন– “তোমরাই বল, আজ তোমাদের সাথে কেমন আচরণ করা হবে।”
উপস্থিত সকলে সমস্বরে বলে তারা উত্তম আচরণ এবং ক্ষমার আশাবাদী।
স্ব স্ব ঘরে ফিরে যাও।” রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সবাইকে বিস্মিত করে দিয়ে বলেন– “তোমাদেরকে ক্ষমা করা হল।”
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জীবনের ঐতিহাসিক মুহূর্তের একটি হলো, বাইতুল্লায় সংরক্ষিত মূর্তিগুলোর প্রতি মনোযোগ প্রদান। পবিত্র কাবায় মোট ৩৬০ টি মূর্তি ছিল। এর মধ্যে হযরত ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম-এর প্রতিকৃতির ছিল একটি। এ মূর্তির হাতে ছিল তীর। মন্দিরের পুরুহিত এ তীরের মাধ্যমে শুভাশুভ নির্ণয় করত।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাতে ছিল মোটা এবং মজবুত একটি লাঠি। তিনি এ লাঠি দ্বারা মূর্তিগুলো চূর্ণ করতে শুরু করেন। এ সময় তিনি হযরত ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম-এর রীতি অনুসরণ করেন। হযরত ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম-এর মত তিনি মূর্তি ভাঙ্গার সময় যবানে বলতে থাকেন–“সত্য সমাগত মিথ্যা বিতারিত… মিথ্যার পতন অবশ্যম্ভাবী।” ঐতিহাসিকগণ লেখেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর লাঠির প্রতিটি আঘাতে কা’বার চার দেয়াল থেকে যেন এই আওয়াজের প্রতিধ্বনি হচ্ছিল। কা’বার ভিতর থেকে মূর্তির ভগ্নাংশ উঠিয়ে বাইরে নিক্ষেপ করা হয়। কা’বা চিরদিনের জন্য ইসলামী জগতের ইবাদাত খানায় পরিণত হয়।
এরপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কার ব্যবস্থাপনার প্রতি মনোযোগ দেন। কুরাইশ ও পার্শ্ববর্তী অন্যান্য গোত্রের লোকেরাও ইসলাম কবুল করতে আসতে থাকে।
মূর্তি কেবল কাবা ঘরেই ছিল না। মক্কার আশে-পাশে বহু এলাকার মন্দিরে ছিল। সেখানেও যথাযোগ্য মর্যাদায় মূর্তি ছিল এবং মানুষ এগুলোর পূঁজা করত। তৎকালীন সময়ের উল্লেখযোগ্য মূর্তি ছিল উযযা। কয়েক মাইল দূরে নাখলার এক মন্দিরে এ মূর্তিটি ছিল। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ মূর্তি ভাঙ্গার দায়িত্ব হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু কে দিয়েছিলেন। তিনি ৩০ জন অশ্বারোহী নিয়ে এই গুরুত্বপূর্ণ কাজে যাত্রা করেন। এভাবে অন্যান্য স্থানের মূর্তি ধ্বংস করতে বিভিন্ন দল প্রেরণ করা হয়।
উযযা শুধু একাই ছিল না। সে গুরুত্বপূর্ণ দেবী হওয়াতে তার সাথে আরো অনেক ছোট ছোট দেবী ছিল। মন্দিরের সামনে পৌঁছলে পুরোহিত সম্মুখে এসে দাঁড়ায়। মূর্তি না ভাঙ্গতে সে অনেক অনুনয়-বিনয় করে।
“উযযা প্রতিমাটি আমাকে দেখাও।” হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু উম্মুক্ত তরবারি হাতে পুরোহিতকে নির্দেশ দেন।
পুরোহিত মৃত্যুর ভয়ে আর কোন কথা না বাড়িয়ে মন্দিরের একটি সুড়ঙ্গ দ্বার দিয়ে সামনে এগিয়ে চলে। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু তার পিছু পিছু যান। একটি কক্ষ পার হয়ে আরেকটি কক্ষে যান। সেখানে একটি চত্বরে সুন্দর আকৃতির একটি দেবীমূর্তি ছিল। পুরোহিত প্রতিমার প্রতি ইশারা করে এবং নিজে প্রতিমার সামনে বিছানো কার্পেটে শুয়ে পড়ে। মন্দিরের দাসীরাও চলে আসে। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু তরবারির আঘাতে সুন্দর মূর্তিটি ভেঙ্গে চুরমার করে দেন। এবং সাথিদেরকে মূর্তির ভগ্নাংশ বাইরে নিক্ষেপ করতে বলেন।
মূর্তি ভাঙ্গার কারণে পুরোহিত চিৎকার করে আর দাসীরা সুর তুলে কাঁদতে থাকে। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু ছোট ছোট দেবীগুলোও মাটির সাথে মিশিয়ে দেন। এরপর তিনি পুরোহিতের প্রতি গর্জন করে বলেন– “এখন তুমি তাকে দেবী বলে বিশ্বাস কর, যে নিজেকে একজন মানুষের হাত হতে রক্ষা করতে পারে না?”
পুরোহিত হু হু করে কাঁদতেই থাকে। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু বিজয়ীর বেশে ঘোড়ায় চড়ে বসেন। অন্যান্য অশ্বারোহীদেরও প্রত্যাবর্তনের নির্দেশ দেন। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু ৩০ অশ্বারোহী নিয়ে মন্দির থেকে বেশ দূরে চলে গেলে ক্রন্দনরত পুরোহিত জোরে অট্টহাসি দিয়ে ওঠে। মন্দিরের দাসীরাও হাসতে থাকে।
“উযযাকে অবমাননা করার দুঃসাহস কারো নেই।” পুরোহিত বিজয়ের ভঙ্গিতে বলে– “এককালের উযযার পূজারী খালিদ এই ভেবে বড় প্রসন্ন যে, সে উযযার প্রতিমা গুড়িয়ে দিয়েছে।… উযযা জীবিত চিরকাল জীবিত থাকবে।
হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু ফিরে এসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে খবর দিয়ে বলেন– “হে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আমি উযযা মূর্তি ধুলিস্যাত করে দিয়ে এসেছি।”
“কোথায় ছিল এই মূর্তি” রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জানতে চান।
হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু সে মন্দির এবং তার কক্ষের বর্ণনা দেন, যেখানে তিনি মূর্তিটি দেখেন এবং পরে গুড়িয়ে দিয়েছিলেন।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন– “তুমি উযযা মূর্তি ভাঙ্গতে পারনি খালিদ। পুনরায় যাও এবং আসল মূর্তি ভেঙ্গে আস।”
ঐতিহাসিক বর্ণনা অনুযায়ী উযযার দু’টি মূর্তি ছিল। একটি আসল, মানুষ এটির পূঁজা করত। দ্বিতীয়টি ছিল নকল। সম্ভবত মুসলমানদেরকে ধোঁকা দিতে এটি তৈরি করা হয়েছিল।
হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর রক্ত টগবগ করে ওঠে। তিনি অশ্বারোহীদের নিয়ে আবার নাখলায় যান। মন্দিরের পুরোহিত দূর থেকে অশ্বারোহীদের দেখে মন্দিরের পাহারাদারদের ডেকে পাঠায়।
“তারা আবার আসছে।” পুরোহিত বলে– “হয়ত কেউ তাদেরকে বলে দিয়েছে যে, আসল মূর্তি মন্দিরে এখনও রয়ে গেছে। তোমরা উযযার মর্যাদা রক্ষা করবে না? এটা করলে উযযা দেবী তোমাদের ধন-সম্পদে ভরপুর করে দেবেন।
“গুরুজী! চিন্তা করে কথা বলুন।” এক নিরাপত্তাকর্মী বলে– “এত অশ্বারোহীর মোকাবিলা আমাদের মত দু’তিনজন দ্বারা করা সম্ভব?”
উযযা বাস্তবে দেবী হয়ে থাকলে অবশ্যই সে নিজেকে রক্ষা করে নিবে।” আরেক প্রহরী বলে। “দেব-দেবী মানুষের হেফাজত করে। মানুষ কখনও দেবতাদের হেফাজত করে না।
পুরোহিত তাদের উস্কে দিতে ব্যর্থ হয়ে বলে– “ঠিক আছে, উযযা নিজের হেফাজত নিজেই করবে।”
হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর ঘোড়া কাছে এসে পড়ে। মন্দিরের নিরাপত্তাকর্মীরা পূজারীদের সাথে নিয়ে পালিয়ে যায়। পুরোহিতের বিশ্বাস ছিল, তার দেবী নিজেকে মুসলমানদের হাত থেকে অবশ্যই বাঁচাতে পারবে। এই ভেবে সে এক তরবারি নিয়ে উযযার গলায় ঝুলিয়ে দেয়। পুরোহিত নিজেও মন্দিরের পশ্চাৎ দ্বার দিয়ে সটকে পড়ে।
হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু মন্দিরে প্রবেশ করে কক্ষে কক্ষে উযযা মূর্তি খুঁজতে থাকেন। খুঁজতে খুঁজতে একটি চমৎকার কক্ষের প্রতি তার চোখ আটকে যায়। তিনি কক্ষের অভ্যন্তরে উঁকি দিয়ে দেখেন। সামনের চত্বরেই উযযার প্রতিমা স্থাপিত ছিল। তার গলায় ঝুলছিল একটি তরবারি। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু প্রথমবার যে মূর্তিটি ধ্বংস করেছিলেন এটি ছিল হুবহু তার মত। মূর্তিটির পায়ের কাছে দামী আগরবাতি জ্বলছিল। কক্ষের চাকচিক্য এবং মোহিতকর সৌরভ থেকে যে কেউ বুঝতে পারে যে, এটি একটি উপাসনালয়।
হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু মূর্তির দিকে এগিয়ে যেতে থাকলে সম্পূর্ণ বিবস্ত্র এক সুন্দরী যুবতী তার সামনে এসে দাঁড়ায়। বিবস্ত্র নারীটি কাঁদতে থাকে এবং মূর্তি না ভাঙ্গার জন্য অনুনয়-বিনয় করে। ঐতিহাসিকের মতে হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে লক্ষ্যচ্যুত করতে এ নারীটি উলঙ্গ হয়ে আসে এবং তার ক্রন্দনের একমাত্র কারণ ছিল, হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর আবেগে ভাটা সৃষ্টি করা। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু উলঙ্গ নারীর প্রতি দৃষ্টি না দিয়ে মূর্তির উদ্দেশে এগিয়ে যান। কিন্তু হতভাগ্য নারী দু’হাত ডানে-বামে প্রসারিত করে হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর পথ রোধ করতে থাকে। বাধ্য হয়ে হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু খাপ থেকে তলোয়ার বের করেন এবং ঐ নারীর উপর এমন জোরে আঘাত করেন যে, এক আঘাতেই তার নগ্ন দেহ দু’টুকরো হয়ে দুদিকে ছিটকে পড়ে। এরপর তিনি ক্রোধে ফেটে পড়ে মূর্তির কাছে যান এবং আঘাতে আঘাতে তাকে কয়েক টুকরো করে দেন। শক্তি এবং কল্যাণের দেবী নিজেকে একজন মানুষ থেকে বাঁচাতে পারে না।
হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু মন্দির থেকে বেরিয়ে দ্রুত ঘোড়া ছুটিয়ে দেন। তার সাথিরাও পেছনে পেছনে আসতে থাকে। মক্কায় পৌঁছে হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর খেদমতে হাজির হন।
হযরত খালিদ বলেন–“আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। “আমি উযযা মূর্তি গুড়িয়ে এসেছি।”
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন–“হ্যাঁ খালিদ। এবার তুমি উযযার আসল মূর্তি ভেঙ্গেছ। এই অঞ্চলে আর কোনদিন মূর্তিপূজার চর্চা হবে না।”
♣♣♣
কুরাইশদের হার না-মানা সেনাপতি ইকরামা মক্কার পথে হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু এর সাথে শেষ যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে আত্মগোপন করেছিল। সে এবং সফওয়ান কুরাইশ সরদারের নির্দেশ অমান্য করেছিল। ইকরামা তার ভবিষ্যৎ খুবই অন্ধকার দেখে সে ভাল করেই জানত যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার সদ্য অপরাধ আদৌ ক্ষমা করবেন না। কারণ, সে মুসলিম বাহিনীর এক অংশের উপর হামলা করে তাদের দু’জন সৈন্যকে শহীদ করে দিয়েছে। ইকরামা আত্মগোপন করলেও তার স্ত্রী ছিল মক্কায়।
ইতিহাসে লেখা আছে যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা বিজয়ের পর চারজন মহিলা এবং ছয়জন পুরুষের হত্যার ঘোষণা দেন। তারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন চক্রান্ত করেছিল। এই টপটেনের মধ্যে হিন্দা ও ইকরামা ছিল শীর্ষে। হিন্দার অপরাধ ছিল কল্পনারও বাইরে। কেউ মুসলমান হলেই সে তার রক্ত পান করতে উদগ্রীব হয়ে পড়ত।
ইকরামার স্ত্রী মক্কায় ছিল। মক্কা বিজয়ের দু’তিন দিন পর এক ব্যক্তি ইকরামার গৃহে আসে।
“বোন” আমি তোমার জন্য আগন্তুক। লোকটি ইকরামার স্ত্রীকে বলে– “ইকরামা আমার বন্ধু। আমি বনু বকর গোত্রের মানুষ।… তোমার জানা আছে যে, ইকরামা এবং সফওয়ান মুসলমানদের প্রতিরোধ করতে চেয়েছিল। কিন্তু তাদের সাহায্যকারী ছিল অতি নগণ্য। ঘটনাক্রমে তাদের মোকাবিলা হয় প্রখ্যাত সমর বিশারদ খালিদের সাথে। আর তার বাহিনীর সংখ্যাও ছিল অনেক।”
ইকরামার স্ত্রী বলে– “সবই আমি জানি। সবই আমার কানে এসেছে।… আমার অপরিচিত ভাই! বলো, সে এখন কোথায় আছে? সে জিন্দা আছে তো?
আগন্তুক বলে– “ইয়ামান যাচ্ছে বলে সে আমাকে জানিয়েছিল। সে যেখানেই যাক সেখানেই তোমাকে ডেকে নিবে। সে কার নিকট গেছে তাও আমি জানি। আমি তোমাকে এতটুকু জানাতে এসেছি যে, সে আর মক্কায় ফিরে আসবে না।”
“এখানে না আসাই তার জন্য মঙ্গলজনক” ইকরামার স্ত্রী বলে– সে এলেই সঙ্গে সঙ্গে তাকে হত্যা করা হবে।”
“তুমি তৈরী থাকো।” আগন্তুক বলে– তার সংবাদ এলেই আমি তোমাকে তার কাছে পাঠিয়ে দিব। তুমি তার নিকট গিয়ে পৌঁছলে সে তোমাকে সাথে নিয়ে হাবশায় চলে যাবে।”
আগন্তুক নিজের নাম ও এলাকার পরিচয় দিয়ে চলে যায়।
দু’দিন পর ইকরামার স্ত্রী পূর্ব নির্দেশনা অনুযায়ী বনু বকরের এলাকায় যায় এবং ঐ ব্যক্তির সাথে সাক্ষাৎ করে, যে তাকে ইকরামার সংবাদ জানিয়েছিল।
“তুমি ইকরামার কাছে যেতে এসেছো?” ইকরামার বন্ধু জানতে চায়। ইকরামার স্ত্রী বলে– “আমি তাকে ফিরিয়ে আনতে যাচ্ছি।”
তুমি কি ভুলে গেছ যে, সে এলেই তাকে কতল করা হবে?” লোকটি অবাক হয় এবং বিস্ময়ের সাথে জানতে চায়।
“তাকে কতল করা হবে না।” ইকরামার স্ত্রী বলে– “আমি ইসলাম গ্রহণ করেছি এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার আবেদনের প্রেক্ষিতে আমার স্বামীকে মাফ করে দিয়েছেন।”
“তুমি মুহাম্মাদকে আল্লাহর রাসূল বলে মেনে নিলে?” লোকটি বিস্ফোরিত নেত্রে জিজ্ঞাসা করে।
ইকরামার স্ত্রী নিঃসঙ্কোচে জবাব দেয় “হ্যাঁ, মেনে নিয়েছি।”
হযরত মুহাম্মাদের সাথে তোমার কোন চুক্তি হয়েছে।” ইকরামার বন্ধু বলে, “হয়ত সে তোমার সামনে এই শর্ত দিয়েছে যে, তুমি আর ইকরামা ইসলাম কবুল করলে…।”
“না।” ইকরামার স্ত্রী তার কথা নাকচ করে বলে– “মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল। তার সাথে আমার এমন কোন চুক্তি হয়নি। আর তিনি তাদের মত নন, যারা চুক্তি করে বশ্যতা মেনে নিতে বাধ্য করেন। আমি স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে তার কাছে আমার স্বামীর দণ্ডাদেশ মওকুফের আবেদন নিয়ে গিয়েছিলাম। মুহাম্মাদ ছিল আমার খুব পরিচিত। কিন্তু এখন তাকে দেখার পর আমার মন বলে তিনি সেই মুহাম্মাদ নন, যিনি একদিন আমাদেরই লোক ছিলেন। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট আমি ফরিয়াদ নিয়ে যাওয়ার পর তার চোখে আমি এমন দ্যুতি দেখেছি, যা সাধারণত কারো মধ্যে দেখা যায় না। আমার ভয় ছিল, মুহাম্মাদ হয়ত বলবে, ইকরামার স্ত্রীকে জামানত হিসেবে আটকে রাখ। স্ত্রীর মায়ায় হয়ত ইকরামা ফিরে আসবে অন্যথায় একদিন তাকেই কতল করা হবে। কিন্তু মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে এক অসহায় নারী মনে করে অত্যন্ত সম্মানজনক আচরণ করেন। আমি নিবেদন করি, আমার সন্তানদের ইয়াতিম করবেন না, আমার স্বামীর অন্যায় আচরণের শাস্তি আমাকে এবং আমার সন্তানদের দিবেন না। জবাবে তিনি বলেন, আমি ইকরামাকে ক্ষমা করে দিলাম।… আমি আনন্দের আতিশয্যে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হস্ত মোবারকে চুমো খাই। আমি বলতে পারি না, কোন সে অদৃশ্য শক্তি ছিল যা আমাকে এ কথা বলায় যে, “আমি অন্তঃকরণ থেকে স্বীকার করছি যে, মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল। আমি ঐ আল্লাহকে এক বলে স্বীকৃতি দিলাম যিনি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে রেসালাত দান করেছেন।”
ইকরামার বন্ধু জিজ্ঞেস করে– “আর তুমি মুসলমান হয়ে গেলে?”
ইকরামার স্ত্রী বলে– “হ্যাঁ। আমি তখনই মুসলমান হয়ে যাই।… আমাকে তার কাছে নিয়ে চল আমি তাকে ফিরিয়ে আনব।”
ইকরামার বন্ধু বলে– “আমি অবশ্যই বন্ধুর হক আদায় করব। চল, আমি তোমার সাথে ইয়ামানে যাচ্ছি।”
অনেক দিন পর ইকরামা স্ত্রীর সাথে পবিত্র মক্কায় প্রবেশ করে। নিজের বাড়িতে যাওয়ার আগে প্রথমে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর খেদমতে হাজির হয়। বিগত দিনের যাবতীয় অপরাধের নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়ে ইসলাম কবুল করে।
ঠিক ঐ দিন সফওয়ানও এসে হাজির হয়। সে পালিয়ে জেদ্দা পারি জমিয়েছিল। তার এক বন্ধু তার কাছে যায় এবং বুঝায় যে, সে একজন বিখ্যাত সেনাপতি। তার মর্যাদা সম্পর্কে অবশ্যই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অবগত। তাকে আরো জানানো হয় যে, কুরাইশদের অবস্থান এখন আগের মত নেই। পরিস্থিতি পাল্টে গেছে।… সফওয়ান যুদ্ধপ্রিয় হলেও খুবই বিচক্ষণ ছিল। সে তার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে বন্ধুর সাথে মক্কায় ফিরে এসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সামনে গিয়ে ইসলাম কবুল করে।
হযরত আবু সুফিয়ান রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর স্ত্রী হিন্দা ইসলাম কবুল করবে এ কল্পনা কারো ছিল না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার হত্যার হুকুম বলবৎ রেখেছিলেন। সে পলাতক ছিল। হযরত আবু সুফিয়ান রাযিয়াল্লাহু আনহু এর আগেই ইসলাম কবুল করেছিলেন। হিন্দা পলাতক থাকা অবস্থায়ই জানতে পারে যে, হযরত ইকরামা রাযিয়াল্লাহু আনহু এবং সফওয়ান রাযিয়াল্লাহু আনহু ইসলাম কবুল করেছেন, এরপর সে জনসম্মুখে উপস্থিত হয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে পেলে নিশ্চিত কতল করে ফেলবেন– একথা জেনেও সে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকেও মাফ করে দেন। অতঃপর সে ইসলাম কবুল করে।
মক্কার আশে-পাশে এবং দুরে-কাছে কিছু গোত্রের বসবাস ছিল। তাদের অনেকেই ছিল মূর্তিপূজক আর অনেকই ছিল নাস্তিক। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে সত্য ধর্মের স্বীকৃতি দিতে আহবান জানান। সৈন্যরা এ সমস্ত আহবান বয়ে নিয়ে যায়। কিন্তু তাদেরকে কোন প্রকার হামলা না করা এবং যুদ্ধ-বিগ্রহ এড়িয়ে চলতে নির্দেশ দেয়া হয়।
মক্কার দক্ষিণে ছিল তিহামা অঞ্চল। এখানকার বাসিন্দারা অধিকাংশই ছিল দুর্ধর্ষ। তারা একত্রে বসবাস না করে বিক্ষিপ্তভাবে বাসস্থান গড়ে তুলেছিল। তাদের ব্যাপারে এ আশঙ্কা ছিল যে, তারা হয়ত মোকাবিলা করতে আসবে। এ কারণে সে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় একটি বাহিনী প্রেরণ করা হয়। তার কমান্ডার নিযুক্ত করা হয় মহাবীর হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে। সৈন্যরা সকলেই ছিল অশ্বারোহী। মক্কা থেকে প্রায় ৫০ মাইল দূরে ইয়ালামলাম পাহাড় পর্যন্ত ছিল হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর সফর।
খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর বাহিনী প্রস্তুত। রওনা হয়ে যায় খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর বাহিনী। ৫০ মাইল দূরে ছিল তাদের গন্তব্য। কিন্তু ১৫ মাইল যেতে না যেতেই আরেকটি দুর্ধর্ষ গোত্র বনু যাজিমা তাদের গতিরোধ করে। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু সৈন্যদেরকে যুদ্ধের জন্য বিন্যস্ত করেন। বনূ যাজিমা পুরো যোদ্ধার বেশে ময়দানে নেমে আসে।
“আমরা যুদ্ধ করতে আসিনি।” হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু ঘোষণা করেন– “ইসলাম গ্রহণের দাওয়াত দিতে এসেছি আমরা।”
“ইতোপবেই আমরা ইসলাম গ্রহণ করেছি।” বনু যাজিমার পক্ষ থেকে জবাব দেয়া হয়– “আমরা নামাযও পড়ি।”
“আমরা প্রতারণার ফাঁদে পা দিতে আসিনি।” হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু বলিষ্ঠ কণ্ঠে বলেন– “বাস্তবেই তোমরা মুসলমান হয়ে থাকলে হাতিয়ার ফেলে দাও।”
‘বনু যাজিমা! সাবধান!” বনু যাজিমার পক্ষ থেকে কার গর্জন শোনা যায়, “তাকে আমি চিনি। সে মক্কার ওলীদের পুত্র খালিদ। তার উপর আস্থা রাখা যায় না। হাতিয়ার সমর্পণ করলে সে আমাদের কতল করবে।… অস্ত্র সমর্পণ করবে না।”
‘আল্লাহর কসম! আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর তরফ থেকে যুদ্ধ না করার নির্দেশ না থাকলে দেখতাম, তোমরা অস্ত্র সমর্পণ কর কি না।” হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, “আমরা বন্ধু হয়ে এসেছি। আল্লাহর দ্বীন জোর করে চাপিয়ে দিতে আসিনি। আমাদের বন্ধু মনে কর এবং আমাদের সাথে এসে হাত মিলাও।”
কুরাইশদের সংবাদ কী?” বনু যাজিমার তরফ থেকে জানতে চাওয়া হয়।
“মক্কা গিয়ে দেখবে।” হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন– “আবু সুফিয়ান, ইকরামা এবং সফওয়ান ইসলাম গ্রহণ করেছেন।”
বনু যাজিমা হাতিয়ার সমর্পণ করে। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু অশ্বথেকে নেমে আসেন এবং বনু যাজিমার সর্দারের সাথে আলিঙ্গন করেন। গোত্রের সবাই ইসলামের ছায়াতলে চলে আসে।
মুসলমানদের জন্য মক্কা কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে পরিণত হয়। দৃষ্টান্ত অনেকটা ঐ সূর্যের ন্যায় যার কিরণ দূর-দিগন্তব্যাপী বিকশিত হতে থাকে। তবে পার্থক্য হলো, সূর্যের বিপক্ষে কেউ অবস্থান নেয় না। কিন্তু ইসলামের উত্থানের বিরুদ্ধে শত্রুরা সংগঠিত ও ঐক্যবদ্ধ হচ্ছিল।
♣♣♣
পবিত্র ভূমি মক্কা থেকে কয়েক মাইল দূরে অবস্থিত তায়েফ। ৮ম হিজরীর শাওয়াল মোতাবেক ৬৩০ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারীর এক রজনীতে সেখানে রাতের-বিনোদন চলছিল। শরাবের উৎকট গন্ধে বাতাস ভারী ছিল। নাচের জন্য তায়েফের আশ-পাশ হতে সেরা সেরা নর্তকীর আগমন ঘটেছিল। তাদের উলঙ্গদেহের নৃত্য আর রূপের ঝলক আমন্ত্রিত অতিথিবৃন্দকে মাতাল করে দিয়েছিল।
মক্কার উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের দুর্ধর্ষ ‘হাওয়াযিন’ গোত্রের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ ছিল এই বিনোদন অনুষ্ঠানের মেহমান। তায়েফ ও আশ-পাশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষিপ্তভাবে অবস্থানরত সাকীফ গোত্রের সর্দার ছিল এ অনুষ্ঠানের আয়োজক। অতিথিবৃন্দের উপর নিজেদের ক্ষমতা, এবং আন্তরিকতার প্রভাব বিস্তারের লক্ষ্যে তারা এমন আড়ম্বর এবং বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল।
দুই নর্তকী নৃত্য করছিল। উপস্থিত দর্শকবৃন্দ অপলক নেত্রে অবলোকন করছিল। অতিথিগণও তন্ময় হয়ে যায়। সবাই যখন নৃত্য আর সঙ্গীতের সুরে হারিয়ে যায় ঠিক সেই মুহূর্তে স্বাগতিক গোত্রের নেতা মালিক বিন আওফ আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। হাতে মৃদু তালি বাজায়। নীরব হয়ে যায় বাদ্যযন্ত্র। নর্তকীরা মূর্তির মত দাড়িয়ে যায়। তাদের প্রশ্নবোধক দৃষ্টি মালিক বিন আওফের প্রতি নিবদ্ধ হয়। অতিথিবৃন্দের মধ্যেও নিস্তব্ধতা নেমে আসে। সব অনুষ্ঠান মুহুর্তে নীরব নিস্তব্ধ হয়ে যায়। মঞ্চ থেকে গ্যালারী-সর্বত্র পিনপতন নীরবতা। সবার দৃষ্টি মালিক বিন আওফের দিকে। কোনরূপ আহবান কিংবা দৃষ্টি আকর্ষণ করা ছাড়াই সকলেই তার দিকে চেয়ে থাকে।
মালিক বিন আওফের বয়স আনুমানিক ৩০ বছর হবে। নৃত্য এবং শরাবের আসরের সে ছিল মধ্যমণি। কিন্তু রণাঙ্গনে তার রূপ পরিবর্তন হয়ে যায়। তাকে তখন মনে হত এক জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরি। তরবারি চালানো, তীর নিক্ষেপ এবং অশ্বারোহণে কেবল সে দক্ষ ছিলনা; বরং সমর বিষয়েও বড় প্রজ্ঞার অধিকারী ছিল। এ সকল গুণের কারণেই সে গোত্রের সেনাপতির আসনে বসে ছিল। যুদ্ধ ছিল তার অত্যন্ত প্রিয়। যুদ্ধের নাম শুনলেই সে ছুটে যেতে চাইত। ঠাণ্ডা মাথায় এ বিষয়ে চিন্তা করার বিলম্ব সহ্য হত না। তার যুদ্ধ চাল শত্রুর জন্য অত্যন্ত ভয়ঙ্কর হত। কুরাইশ গোত্রে এক সময় হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর যে অবস্থান ছিল, ঠিক তেমনি অবস্থান ছিল মালিক বিন আওফের স্বীয় গোত্রে।
‘আমরা প্রচুর গিলেছি।” মালিক বিন আওফ নৃত্য থামিয়ে সকলকে সম্বোধন করে বলে– “আমরা শরাবের পাত্রগুলো শূন্য করে ফেলেছি। আমরা নৃত্যরত যুবতীদের দ্বারা মোহিত হয়েছি। আমাদের সম্মানিত অতিথিবৃন্দ এই আতিথ্য এবং এই বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠান উদযাপনের কারণ অনুধাবন করতে পেরেছেন?… আমি আপনাদেরকে কেবল আনন্দ বিনোদনের জন্য সমবেত করিনি। আপনাদের আত্মমর্যাদাবোধ চাঙ্গা করার জন্য আমি আপনাদেরকে এখানে আমন্ত্রণ জানিয়েছি।”
“হাওয়াযিনের মর্যাদাবোধ ভূলণ্ঠিত হয়ে পড়েছিল কবে মালিক বিন আওফ?” হাওয়াযিন গোত্রের এক নেতা প্রশ্ন করে– “এসব বাদ দিয়ে বল, আমাদের মর্যাদাবোধে কে আঘাত করেছে?”
মালিক বিন আওফ বলে “মুসলমানরা! মুহাম্মাদ এমন কি করেছে… মুহাম্মাদ সম্পর্কে আপনারা কি জানেননা? ঐ মুহাম্মাদের কথা আপনারা ভুলে গেছেন, যে হাতে গোনা কয়েকজন অনুসারী নিয়ে মক্কা থেকে পালিয়ে ইয়াসরিবে (মদীনায়) গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল?”
“জানি, ভাল করেই চিনি তাকে দু’তিন জন বলে ওঠে– “আমরা এটাও জানি যে, সে নিজেকে খোদার নবী বলে দাবী করে।”
“আমরা তাকে নবী হিসেবে মানি না।”একান্ত কেউ নবী হলে সে ছাকীফ গোত্র থেকে হত, হাওয়াযিন গোত্র থেকে হত।”
মালিক বিন আওফ বলে– “সে নবী হোক বা না হোক। আমি আপনাদেরকে এটা জানাতে চাই, যে মক্কা থেকে একদিন মুহাম্মাদ প্রাণ নিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল, বিস্ময়কর হলেও সত্য যে, সে এখন বর্তমান মক্কার শাসক। সমগ্র মক্কায় এখন তার শাসন চলছে। তার সমরশক্তি দিন দিন বেড়েই চলেছে। কুরাইশরা তার সামনে হাতিয়ার সমর্পণ করেছে। প্রায় সকলেই তার ধর্ম মেনে নিচ্ছে। আবু সুফিয়ান ইকরামা এবং সফওয়ানের মত বিখ্যাত যোদ্ধারাও মুহাম্মাদের ধর্ম মেনে নিয়েছে। খালিদ বিন ওলীদ তো বহু আগেই এই নতুন ধর্মমতের অনুসারী হয়ে গেছে।… মুসলমান মক্কা বিজয় করে সমস্ত মূর্তি ভেঙ্গে মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছে।”
“কুরাইশদের যদি আত্মমর্যাদাবোধ এবং স্বীয় ধর্মের প্রতি টান থাকত তাহলে তারা তাড়াহুড়া করে আত্মসমর্পণ না করে, বরং বীর বিক্রমে লড়ে মরত।” আরেকজন মন্তব্য করে।
“এখন তারকা ভরা আকাশ চেয়ে চেয়ে দেখবে যে, হাওয়াযিন এবং ছাকীফ গোত্রের আত্মমর্যাদাবোধ কেমন লৌহবৎ।” মালিক বিন আওফ বলে।
“আমাদের কেউ মুহাম্মাদের জীবন সংহার করুক, এটাই কি তোমার অভিলাষ?” হাওয়াযিন গোত্রের এক নেতার প্রশ্ন– “তোমার বক্তব্যের সারমর্ম যদি এটাই হয় তাহলে এ দায়িত্ব নিঃশংকোচে আমার কাঁধে অর্পণ করতে পার।”
“এখন মুহাম্মাদকে হত্যা করলে কোন লাভ হবে না।” মালিক বিন আওফ বলে– “তাকে হত্যা করলে তার ভক্তরা তাকে নিজেদের হৃদয়ে ধারণ করে রাখবে। তাদের সংখ্যা এত বৃদ্ধি পেয়েছে যে, এখন একজনকে হত্যা করার দ্বারা তারা ঐ পথ ত্যাগ করবে না। যে পথে তাদের নিক্ষেপ করা হয়েছে।”
“শোনা যায় মুহাম্মাদের হাতে নাকি জাদু আছে।” হাওয়াযিন গোত্রের এক নেতা বলে– “সে যার দিকে তাকায়, সেই তার ভক্ত হয়ে পড়ে।”
“যেখানে তলোয়ার চলে সেখানে জাদুর অস্তিত্ব থাকতে পারে না।” হাওয়াযিন গোত্রের আরেক নেতা নিজের তরবারির বাটে হাত রেখে বলে– “মালিক! তোমার পরিকল্পনা পরিষ্কার করে বল। আমরা তোমার সাথে আছি।”
“আমি বলতে চাই ঐক্যবদ্ধভাবে আমরা যদি মুহাম্মদের ইসলাম প্রতিহত না করি তাহলে তা প্লাবনের মত বৃদ্ধি পেতে থাকবে এবং একদিন এ প্লাবন আমাদেরও ভাসিয়ে নিয়ে যাবে।” মালিক বিন আওফ বলে– “সেদিন হাওয়াযিন বলতে কেউ থাকবে না, বনু ছাকীফের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে না। কুরাইশ গোত্রকে যারা জোর করে জিম্মী বানিয়ে রেখেছে আমরা তাদেরকে মক্কার ভিতরেই শেষ করে দিব।… জিম্মী হওয়ার অর্থ আপনারা বুঝতে পেরেছেন?”
মালিক বিন আওফ সকলের দিকে চোখ বুলিয়ে বলে, “না বুঝলে আমি বলছি।” – এরপর সে পিছনে ফিরে তাকায়।
মালিক বিন আওফের পিছনের সারিতে মেহমানদের মাঝে শুভ্র দাড়িওয়ালা এক অশীতিপর বৃদ্ধ বসা ছিল। তার গায়ের রং অন্যদের তুলনায় ফর্সা ছিল। অতিশয় দুর্বলতা হেতু তার মাথা কাঁপছিল এবং কোমর বক্র ছিল। তার হাতে দেহ সমান লম্বা লাঠি ছিল। গায়ে ছিল লম্বা জুব্বা, যা কাঁধ থেকে পায়ের গোড়ালী পর্যন্ত। সব মিলিয়ে উপস্থিত দর্শকের চোখে সে ছিল কোন পণ্ডিত নতুবা ধর্মগুরু। মালিক বিন আওফের ইশারায় সে আসন ছেড়ে উঠে মালিকের কাছে আসে।
“স্রষ্টার রহমত বর্ষিত হোক তোমার উপর বৃদ্ধ বলে– “যে দেবতার উপাসনা তুমি কর তিনি তোমার সন্তান-সন্ততির হেফাজত করুন। দাসত্বের তাৎপর্য না বুঝতে পারলে আমাকে জিজ্ঞাসা কর। আমার চার যুবতী কন্যা আজ মুসলমানদের হাতে বাঁদী। দু’যুবক পুত্র মুসলমানদের গোলাম। তারা তরবারি চালনা এবং অশ্বারোহিতে পটু ছিল। কিন্তু তরবারি স্পর্শ করা এবং ঘোড়ার ধারে কাছে যাওয়া তাদের অনুমতি নেই। আমাকে বাড়ী থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে।
তোমরা বোধ হয় ভুলে গেছ, কুরাইশরা মদীনা অবরোধ করলে মুসলমানরা প্রতিরক্ষা হিসাবে শহরের চতুর্দিকে পরিখা খনন করেছিল। কুরাইশদের পক্ষে সে পরিখা অতিক্রম করা সম্ভব হয়নি। এরপর প্রলয়ংকরী তুফানের দরুন প্রথম থেকেই হীনতার শিকার কুরাইশ সৈন্যের মনোবল ভেঙ্গে যায়। ফলে তারা মক্কায় ফিরে যায়।
ছাকীফ গোত্রের এক সর্দার জোরালো কণ্ঠে বলে– “জনাব! আপনার কথাবার্তায় বুঝা যায়, আপনি ইহুদী। আচ্ছা বলুন তো, আপনার ইহুদী গোত্র সে সময় মুসলমানদের সাথে প্রতারণা করেছিল যে কথা আমরা শুনেছিলাম তা কি সত্য?”
“হ্যাঁ, যা শুনেছ সবই সত্য।” বৃদ্ধ বলে– “আমাদের প্রতারণা! আমরা পিছন থেকে মুসলমানদের পৃষ্ঠদেশে খঞ্জর বসাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু এর আগেই কুরাইশরা রণে ভঙ্গ দেয়। প্রতারণার ফাঁদে ফেলে মুসলমানদেরকে দুর্বল করে দেয়া ছিল আমাদের প্রধান কর্তব্য ও দায়িত্ব। কিন্তু তাদের তরবারি বড় ধারালো। আমাদের সকল পরিকল্পনা কেটে টুকরো টুকরো করে দিয়েছে।”
ছাকীফ গোত্রের আরেক নেতার স্পষ্টবাদী প্রশ্ন “মাননীয় ইহুদী? আপনার গোত্র হত্যার প্রতিশোধ নিতে আপনি আমাদেরকে প্ররোচিত করতে এসেছেন”?
এ সময় আরেক বয়োবৃদ্ধ আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। তার নাম দুরায়দ বিন ছম্মাহ।
দুরায়দ বিন ছম্মাহ গর্জে উঠে বলে– “চুপ কর। আমরা বনী ইসরাঈলের রক্তের প্রতিশোধ নিব না। এখনও তোমরা দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভোগছ? সন্দেহের আবর্তে নিপতিত? এ বাস্তবতা অনুধাবনের সময় কি এখনও হয়নি যে, মুসলমানদের উপর আক্রমণ করে আমরা যদি আজ তাদের রক্ত আমাদের তরবারিকে পান না করাই এবং তাদের আহতদেরকে ঘোড়ার পদতলে পিষ্ট না করি, তাহলে সেদিন বেশি দূরে নয় যেদিন তারা আমাদেরকে হত্যা করে কন্যা, বোন ও স্ত্রীদেরকে দাসী এবং পুত্রদেরকে গোলাম বানাবে।
“তাদের অশ্ব তায়েফের অলি-গলিতে চিঁহি চিঁহি রবে প্রদক্ষিণ করার আগেই কি এটা সমীচিন নয় যে, আমাদের অশ্ব তাদের লাশগুলো মক্কার অলি-গলিতে পিষ্ট করুক?” মালিক বিন আওফ আবেগ আপ্লুত কণ্ঠে বলে– “বনী ইসরাঈলের এই ভদ্রলোক আমাদের নিরাপত্তার আশ্রয় গ্রহণ করেছেন। তিনি তার গোত্রের যে করুন পরিণতির কথা বর্ণনা করেছেন আমি আপনাদেরকে ঐ পরিণতি হতে বাঁচাতে চাই।… চল, লাত দেবীর নামে শপথ করি যে, মক্কার মূর্তিধ্বংসকারী মুহাম্মাদ ও তার অনুসারীদের খতম করে তবেই আমরা স্ত্রীদের কাছে যাব এবং তাদেরকে আমাদের মুখ দেখাব।”
ইসলাম দিবাকরের আলো যখন চতুর্দিকে প্রসারিত হচ্ছিল তখন আরব ভূখণ্ডে ব্যাপকভাবে মূর্তিপূজা হত। উপাস্য নির্বাচনের ব্যাপারে দল-মত-গোত্র-বর্ণে বিভিন্নতা থাকলেও উপাসনার বেলায় সবাই ছিল এক মতাদর্শী। পূজা আরাধনার ব্যাপক চর্চা চললেও তারা আবার আস্তিক ছিল। তারা আল্লাহর অস্তি ত্ব বিশ্বাস করত। তাদের দোষ ছিল, আল্লাহ্ পর্যন্ত পৌঁছতে তারা মাঝখানে মাধ্যম হিসেবে বিভিন্ন কল্পিত দেব-দেবীদের অস্তিত্ব টেনে আনত। তাদের বিশ্বাস ছিল, এ সমস্ত মূর্তির সন্তুষ্টি ছাড়া আল্লাহকে পাওয়া সম্ভব নয়। মূর্তির মন জয় করতে তারা কিছু প্রথা চালু করেছিল। তায়েফে পূজার মূর্তির নাম ছিল ‘লাত’। এটা কোন মানব বা দানবাকৃতি ছিল না। এটা ছিল মূলত বিরাট একটি পাথর। এটি চতুর্ভুজের মত ছিল। কোন কোন ঐতিহাসিকের মতে, এই পাথরটি প্রাকৃতিকভাবে একটি বিশাল চত্বরের মত পড়ে ছিল। অতীতে এক সময় হয়ত এখানে কেউ কোন মূর্তি স্থাপন করেছিল। কিন্তু ইসলামের আবির্ভাব কালে এখানে কোন মূর্তি ছিল না। আশে-পাশের লোকেরা এই চত্বরেরই পূজা করত।
৬৩০ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারী মাসে হাওয়াযিন গোত্র ছাকীফ গোত্রের অতিথি হয়ে তায়েফে এসেছিল। এবং ছাকীফ গোত্রকে মক্কা আক্রমণের জন্য উত্তেজিত করেছিল এ সময় হাওয়াযিনের এক নেতা প্রস্তাব করে যে, জ্যোতিষী ডেকে ভাগ্য গণনা করা হোক আমাদের আক্রমণ সফল হবে কি-না। ভাগ্য নির্ধারক তীর দ্বারা এই ফলাফল নির্ণয় করা হত। মূর্তির হাতে একটি থলে থাকত। তাতে অনেকগুলো তীর থাকত। কিছু ‘হা’ না– কি ‘না’। চিহ্নিত তীরই হত ফলাফল; ভাল-মন্দ নির্ণয়।
ভাগ্য নির্ণয়ের ক্ষেত্রে পুরোহিতের তুলনায় জ্যোতিষীর মর্যাদা ছিল বেশি। জ্যোতিষী হত জ্ঞানী-বিচক্ষণ। সহজে হৃদয় জয় করার অনেক দুর্বোধ্য মন্ত্র তাদের জানা থাকত। জ্যোতিষী ভাগ্য নির্ণয় ছাড়াও অদৃশ্যের খবর জানত। মানুষ তাদের প্রতিটি কথা সত্য বলে বিশ্বাস করত।
পরদিন ভোরে হাওয়াযিন এবং ছাকীফ গোত্রের দু শীর্ষ নেতার সামনে জনৈক জ্যোতিষী বসা ছিল। তারা কোন কথা বলার পূর্বেই জ্যোতিষী কথা বলে ওঠে।
“আমি গায়েবের খবর নিতে পারি এবং ভূত-ভবিষ্যতে ডুব দিয়ে বলে দেব যে, ভবিষ্যত কেমন হবে এবং তাতে কি কি ঘটবে অন্তরে কি আছে তাও বলতে পারব” জ্যোতিষী চোখ বন্ধ করেই বলে– “তোমরা কোন কথা না বলে তোমরা কি বলতে এসেছ, আমার মুখে শোন। তোমরা যাদের উপর আক্রমণ করতে মনস্থ করেছ তাদেরকে এক প্রকার ঘুমন্ত মনে করতে পার। তারা মক্কা দখল করে এখন তার শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠায় ব্যস্ত। মক্কায় কর্তৃত্বের ভিত্তি মজবুত করতে ব্যস্ত। মক্কায় এখনও তাদের শত্রু আছে। মুহাম্মাদের ধর্ম সবাই মেনে নেয়নি।”
দুরায়দ বিন ছম্মাহ বলে– “সম্মানিত জ্যোতিষী! আপনি দয়া করে বলুন, মুহাম্মাদের অগোচরে আমরা তাকে বাগে আনতে পারব কি-না? আমাদের অতর্কিত আক্রমণ মুসলমানদের কোমড় গুড়িয়ে দেবে কি-না?”
জ্যোতিষী আকাশের দিকে চায় এবং কিছুক্ষণ দুর্বোধ্য ভাষায় মন্ত্র পড়ে বলে– “ভবিষ্যতের পর্দা ফাঁক করে দেখলাম।… তোমাদের হামলা হবে অতর্কিতে। তোমাদের তরবারি যখন তাদেরকে কচুকাটা করতে থাকবে তখনই তারা টের পাবে, শাহরগ স্পর্শিত তলোয়ারের আঘাত থেকে কে নিজেকে রক্ষা করতে পারে?… এটাই উপযুক্ত সময়, এটাই অপূর্ব সুযোগ। মুসলমানরা একবার নিজেদেরকে গুছিয়ে নিতে পারলে তোমাদের আশা আর পূর্ণ হবে না। উল্টো মুসলমানরাই তোমাদের পিছু ধাওয়া করে তোমাদের ধন-সম্পদ এবং নারীদেরকে তোমাদের লাশের উপর দিয়ে টেনে হেঁচড়ে নিয়ে যাবে।… এখন শুভাশুভ যাচাই করার আর দরকার নেই। ‘লাত’ দেবী নিজেই হামলার পক্ষে ইঙ্গিত দিয়ে জিজ্ঞাসা করেছে, আমার পূজারীদের তরবারি এখনও কোষাবদ্ধ কেন?”
এক নেতা জিজ্ঞাসা করে “কোন নজরানা লাগবে?”
জ্যোতিষী বলে, “তোমাদের কাছে ‘হাম’ থাকলে তা নজরানা হিসেবে দিতে পার। আর না থাকলে দরকার নেই। তবে স্বীয় গোত্রকে জোর দিয়ে বলবে, তারা যেন রণাঙ্গনে পৃষ্ঠপ্রদর্শন না করে। এ যুদ্ধে রক্ত এবং প্রাণ উৎসর্গ করতে হবে।… হামের খোঁজে সময় অপচয় করো না।… যাও, আমি তোমাদেরকে সব কিছু জানিয়ে দিলাম। মক্কায় মুসলমানরা খুবই ব্যস্ত। তারা এখন রণসাজে সজ্জিত নয়। এটা মোক্ষম সুযোগ। এ সুযোগের সদ্ব্যবহার কর। সুযোগ একবার হাতছাড়া হয়ে গেলে তখন আফসোস ছাড়া আর কিছুই করার থাকবে না।”
যে উটের বংশধারা চতুর্থ স্তরে উন্নীত হয় তাকে ‘হাম’ বলে। সে সময় মানুষ এ ধরনের উট উপাস্যের নামে ছেড়ে দিত। এ উটকে অতি পবিত্র ভেবে কেউ তাকে কোন কাজেই ব্যবহার করত না। এদের দেহে সাংকেতিক চিহ্ন থাকত এ ধরনের উট যার সামনেই পড়ত সে তাকে সম্মান করত এবং ভাল খাদ্য দ্বারা তাকে আপ্যায়ন করাত।
হাওয়াযিন এবং ছাকীফ গোত্রের শীর্ষনেতারা জ্যোতিষীর সুবাক্য নিয়ে চলে গেলে জ্যোতিষী অন্তপুরে চলে যায়। সেখানে আগে থেকেই ঐ ইহুদী বসা ছিল, গতকাল অনুষ্ঠান চলাকালে মালিক বিন আওফ যাকে ইঙ্গিতে বলেছিল যে, সে যেন সকলের জিম্মী হয়ে থাকার তাৎপর্য বুঝিয়ে দেয়।
“আমি তোমার দায়িত্ব পালন করেছি।” জ্যোতিষী ঐ ইহুদীকে বলে– “এরা মক্কায় রওনা হতে আর বিলম্ব করবে না।”
বৃদ্ধ ইহুদী জানতে চায় তারা কি সফল হতে পারবে?”
“বীরত্ব এবং বিচক্ষণতার মধ্যে সফলতা রয়েছে।” জ্যোতিষী বলে, “যদি তারা কেবল আবেগের উপর নির্ভর করে লড়াই করে এবং বুদ্ধিমত্তার পরিচয় না দেয়, তাহলে মুহাম্মাদের সুশিক্ষিত সৈন্যেরা তাদেরকে শোচনীয়ভাবে পরাস্ত করবে।… আমার পুরস্কার কই?”
“তোমার পুরস্কার সাথে করেই নিয়ে এসেছি।” বৃদ্ধ ইহুদী তার এ কথা বলে একজনকে ডাক দেয়।
অপর কামরা থেকে এক সুন্দরী নারী বের হয়ে আসে। বৃদ্ধ ইহুদী তার জোব্বার পকেট থেকে দু’টি স্বর্ণের টুকরো বের করে এনে জ্যোতিষীকে দেয়।
“আমি আগামীকাল সকালে এসে এই যুবতীকে নিয়ে যাব।” বৃদ্ধ ইহুদী বলে।
“আমি তোমাকে একটি কথা বলতে চাই।” জ্যোতিষী বলে, “আমি তোমার অনুরোধে সাড়া দিয়ে তাদেরকে এখনই মক্কা আক্রমণ করতে উস্কে দিয়েছি। কিন্তু তাদের নেতারা খুবই অভিজ্ঞ এবং বুদ্ধিমান। তারা পরিস্থিতি অনুধাবন করতে সক্ষম। তাদের বৃদ্ধ সর্দার দুরায়দ বিন ছম্মাহ পূর্ব থেকে অবগত যে, মক্কায় মুসলমানরা এখনও সবকিছু সামাল দিতে পারেনি। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা বিধানসহ অনেক কাজ এখনও তাদের সামনে রয়েছে। তাদের উপর হামলা করার এটাই উপযুক্ত সময়। হাওয়াযিন এবং ছাকীফ গোত্রের শীর্ষ নেতারা এ বিষয়ের সত্যতা যাচাই করতে আমার নিকট এসেছিল। খুব ভাল হয়েছে যে, তাদের আসার পূর্বেই তুমি গোপনে আমার কাছে এসে সবকিছু অবগত করিয়েছ।”
বৃদ্ধ ইহুদী বলে– “আমার একমাত্র লক্ষ্য মুসলমানদের ধ্বংস সাধন করা।”
♣♣♣
ঐতিহাসিকগণ লিখেন, হাওয়াযিন এবং ছাকীফ গোত্রয় বেশ শক্তিশালী ছিল। মুসলমান কর্তৃক মক্কা বিজয় হলে তাদের আশঙ্কা হয় যে, তারা পৃথক পৃথক এলাকায় বাস করে এবং বসতি এলাকার সংখ্যাও প্রচুর। তারা এক জায়গায় থাকে না; বহু দূরে দূরে তাদের আবাস। মুসলমানরা প্রত্যেকটি এলাকা দখল করে তাদেরকে টুকরো টুকরো করে দিতে পারে। নিজেদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার দেখে তারা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছে যে, বিভিন্ন গোত্রকে ঐক্যবদ্ধ করে সম্মিলিতভাবে মুসলমানদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে।
উভয় গোত্র যুদ্ধ করতে সক্ষম লোকদের নিয়ে হুনাইনের কাছাকাছি আওতাস নামক স্থানে চলে যায়। মুসলমানরা তাদের বসতির উপর আক্রমণ করে তাদের সমূলে ধ্বংস করছে– একথা বলে তাদের নেতারা পাশ্ববর্তী আরো কয়েক গোত্রকে নিজেদের সাথে মিশিয়ে নেয়। মোট সংখ্যা দাঁড়ায় ১২ হাজার। এই সম্মিলিত বাহিনীর সর্বাধিনায়ক নিযুক্ত হয় মালিক বিন আওফ। তার অনুমতি ছিল, কেউ ইচ্ছা করলে তার স্ত্রী, পুত্র-কন্যাসহ গৃহপালিত পশুও সাথে নিয়ে যেতে পারবে। এই অনুমতির পিছনে তার এই যুক্তি ছিল যে, মক্কার অবরোধ বেশ দীর্ঘ হতে পারে। ফলে এ সময় সৈন্যদের স্ত্রী, পুত্র ও গৃহপালিত পশুর ব্যাপারে চিন্তা হতে পারে যে, তারা কেমন আছে। এই ঢালাও অনুমতি হতে প্রায় সকলেই ফায়দা লাভ করে। ফলে সৈন্যদের তুলনায় তাদের স্ত্রী সন্তানদের সংখ্যা ছিল কয়েকগুণ বেশি। উটও ছিল অগণিত।
দুরায়দ বিন ছম্মাহ ছিল অত্যন্ত বৃদ্ধ। যুদ্ধে যাবার সামর্থ্য তার ছিল না। কিন্ত সৈন্যদের প্রয়োজনীয় দিক-নির্দেশনা দিয়ে সময় মত লড়ানোর যোগ্যতা তার মত আর কারুর ছিল না। সর্বাধিনায়ক মালিক বিন আওফের বড় গুণ হল তার আবেগ ছিল অস্বাভাবিক। দুরায়দকে সাথে করে নিয়ে আসা হয় তার অভিজ্ঞতার কারণে।
সৈন্যরা আওতাসে এসে অবস্থান নিলে দুরায়দ বিন ছম্মাহ এসে সৈন্যদের সাথে মিলিত হয়। বেলা তখন অপরাহ্ন। সন্ধ্যা সমাগম। সেনা ছাউনিতে আসা মাত্রই তার কানে ছোট ছোট শিশুদের কান্নার আওয়াজ ভেসে আসে এবং বকরী, গাধার সন্ধ্যাকালীন ডাক। সে একজনের কাছে জানতে চায়, সৈন্যদের সাথে ছোট ছোট শিশুরা এবং বকরী-গাধা কে নিয়ে এসেছে? তখন তাকে জানানো হয় যে, পরিবার-পরিজন এবং চতুষ্পদ জন্তু সাথে করে নিয়ে আসতে সেনাপতি কেবল অনুমতিই দেয়নি; বরং এ ব্যাপারে বেশ উৎসাহিত করেছে।
দুরায়দ বিন ছম্মাহ সেনাপতি মালিক বিন আওফের তাঁবুতে গিয়ে জিজ্ঞাসা করে “এ তুমি কি করলে? এমন সেনাবাহিনী আমার দৃষ্টিতে এই প্রথম, সেনাবাহিনীর পরিবর্তে যাদেরকে বাসস্থান পরিবর্তনকারী কোন কাফেলা বলে মনে হচ্ছে।”
মালিক বিন আওফ বলে– “জনাব। আপনার বিচক্ষণতা ও অভিজ্ঞতার ব্যাপারে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। কিন্তু আমার মাথায় যে পরিকল্পনা এসেছে তা সারা জীবন আপনার কল্পনায় আসেনি। আমি সৈন্যদেরকে একথা বুঝিয়েছি যে, অবরোধ বেশ দীর্ঘ হতে পারে। তখন যেন স্ত্রী-পরিজন ও চতুষ্পদ জন্তুর কথা মনে না পড়ে সে জন্য এদের সাথে আনতে বলেছি। কিন্তু আমার উদ্দেশ্য ভিন্ন। আমি মক্কা অবরোধ করব না। গিয়েই হামলা শুরু করব। মুসলমানদের অজান্তে তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ব। আপনি জানেন যে, মুসলমানরা খুবই সুকৌশলী এবং বিচক্ষণ। তারা অভিনব কৌশলে লড়তে থাকবে। আমাদের সৈন্যরা তাদের বীরত্ব এবং চালের সম্মুখে টিকতে নাও পারে। কিন্তু যখন তাদের মনে পড়বে যে স্ত্রী, পুত্র, স্বজন এবং পশু-প্রাণীর মায়ায় জীবন বাঁচাতে পালাব, আমরা পলায়ন করলে তাদের জীবন ধ্বংসের সম্মুখীন হবে তখন তারা এ চিন্তা না করে জীবন বাজি রেখে বীর বিক্রমে যুদ্ধ করবে।”
“অভিজ্ঞতা বয়সের দ্বারা অর্জিত হয় মালিক।” দুরায়দ বলে, “তোমার মধ্যে প্রেরণা আছে। আছে আত্মমর্যাদাবোধ এবং সাহসিকতা। কিন্তু বুদ্ধি তোমার এখনও পরিপক্ক হয়নি। পরিবার-পরিজনের কারণে সৈন্যদের মনোযোগ এখন সামনে নয়, পেছনে থাকবে। সর্বদা এই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা তাদের মাঝে বিরাজ করবে যে, শত্রুরা সৈন্যদের উপর পাল্টা হামলা চালালে তারা দ্রুত স্ত্রী পরিজনের কাছে এসে দাঁড়াবে, যেন অন্তত তারা শত্রুদের থেকে নিরাপদ থাকে।… এক বিরাট দুর্বলতা তুমি সাথে করে এনেছ। মুহাম্মাদের-নেতৃত্বের ধারণা তোমার নেই। তার অধীনে প্রখ্যাত এবং নামকরা সেনাপতিরা রয়েছে। তারা স্বল্প সময়ে আমাদের দুর্বলতা আঁচ করতে পেরে এই দুর্বল পয়েন্টে আঘাত হানবে। তারা সৈন্যদের চেয়ে স্ত্রী-সন্তান ও চতুষ্পদ জন্তুর উপর হামলা করতে বারবার চেষ্টা করবে। তাদের সাথে না নিয়ে এখানে রেখে যাও আর শুধু সৈন্যদের নিয়ে মক্কায় রওনা হও।”
মালিক বিন আওফ বলে– “সম্মানিত শায়েখ! বর্তমানে বয়সের ভারে একদিকে আপনার অভিজ্ঞতা প্রচুর হলেও অন্যদিকে বোধশক্তিতে কমতি সৃষ্টি হয়েছে। সেনাপতি আমি, তাই নির্দেশ চলবে আমারই। প্রয়োজন মনে করলে আপনার কাছে পরামর্শ চাইব। আপনি এখন আসতে পারেন।”
ঐতিহাসিকগণ লিখেন, মালিক বিন আওফ দুরায়দের পরামর্শ গ্রহণ না করে বরং উল্টো তাকে অপমান করে। মালিকের কাছে তার কথার মূল্য না থাকলেও অন্যদের কাছে যথেষ্ঠ গুরুত্ব ছিল। কিন্তু তিনি শুধু এই কারণে চুপ হয়ে যান যে, এখন নিজেদের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্বের সময় নয়।
মালিক বিন আওফ দুরায়দকে বলে– “সৈন্যদের ব্যাপারে আপনার অন্য কোন পরামর্শ থাকলে বলতে পারেন।”
“আমার যা করার তা তোমাকে জানানো ব্যতীতই আমি করব।” দুরায়দ বলে– “আমার মধ্যে যদিও লড়ার শক্তি নেই কিন্তু অন্যদের লড়াতে পারি।”
এরপর দুরায়দ নিজ তাঁবুতে গিয়ে বিভিন্ন গোত্রের নেতাদেরকে ডেকে পাঠায়। তারা একত্রিত হলে তাদের উদ্দেশে শুধু এতটুকু বলে যে– সংঘবদ্ধ হয়ে আক্রমণ করবে। পরস্পর বিচ্ছিন্ন হবে না। সমস্ত সৈন্যকে জানিয়ে দেবে, যদ্ধের পূর্বেই যেন প্রত্যেকে নিজ নিজ তরবারির খাপ ভেঙ্গে ফেলে দেয়।”
তৎকালীন আরবের নিয়ম ছিল, যুদ্ধে তরবারির খাপ ভেঙ্গে ফেললে তার অর্থ ছিল, লোকটি যুদ্ধ করতে করতে প্রাণ দিবে; পৃষ্ঠপ্রদর্শন করবে না। পরাজিত হবে না। তরবারির খাপ ভেঙ্গে ফেলাকে বিজয় বা মৃত্যুর ঘোষণা বলে মনে করা হত।
দুরায়দ গোত্রপতিদের ডেকে স্ত্রী-পরিজন ও চতুষ্পদ জন্তু আওতাসে রেখে শুধু সৈন্যদেরকে মক্কা যেতে বলে একথা কোন ইতিহাসে পাওয়া যায় না। তবে দু’জন ঐতিহাসিকের মতে, মূল যুদ্ধের সময় কেবল হাওয়াযিন গোত্রের পরিজন চতুস্পদ জন্তু সাথে ছিল।
♣♣♣
মুসলমানদের বিরুদ্ধে বহু গোত্রের ঐক্য জোট হওয়ার এটা ছিল দ্বিতীয় ঘটনা। মালিক বিন আওফ এই আশায় সম্মিলিত বাহিনী নিয়ে রওনা হয় যে, তারা অতর্কিতে হামলা করবে। তার বাহিনীর এতদিন মক্কায় চলে যাওয়ার কথা। চলার গতিও হত বেশ দ্রুত। কিন্তু অন্যান্য গোত্রের আওতাসে এসে মূল বাহিনীর সাথে মিলিত হওয়ার কথা থাকায় অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাদের এখানে বিলম্ব হয়ে যায়।
শুধু সৈন্য থাকলেও তারা এতদিন রওনা হতে পারত। কিন্তু সৈন্যসংখ্যার চেয়ে পরিজন এবং চতুষ্পদ জন্তু ও তাদের গৃহস্থালী মালামাল অধিক থাকায় আওতাস হতে তাদের রওনা হতে বেশ দেরী হয়। এ সময় মক্কার অলি-গলিতে একটি আওয়াজ সবাইকে চমকে দেয়।
“মুসলমান! সাবধান প্রস্তুত হও।” এক উষ্ট্রারোহী রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বাসভবনের দিকে যাচ্ছিল আর এই আহবান করছিল– “আল্লাহর কসম! যা আমি স্বচক্ষে দেখেছি, তা তোমাদের কারো চোখ দেখেনি।”
একজন তাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করে– “কি হৈ-চৈ করে ফিরছ? থাম স্থির হয়ে বল, কি দেখে এসেছ?”
“রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলব।” লোকটি পথে না থেমে যেতে যেতে বলে– “প্রস্তুত হও। হাওয়াযিন এবং ছাকীফের সৈন্যরা”…।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার কাছে বিস্তারিত তথ্য পেয়ে যান যে, হাওয়াযিন এবং ছাকীফ গোত্রের সাথে অন্যান্য গোত্রের হাজার-হাজার লোক আওতাসের কাছে জড়ো হয়েছে। তাদের উদ্দেশ্য মক্কা আক্রমণ করা এবং তারা রওনা হওয়ার উপক্রম। ইতিহাসে ঐ ব্যক্তির নাম পাওয়া যায় না। ঐতিহাসিকদের বর্ণনা মতে শুধু এতটুকু জানা যায় যে, বহুজাতিক বাহিনীর সমবেত হওয়ার কথা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আগেই অবগত হয়ে যান।
এ সমস্ত ঐতিহাসিক এবং পরবর্তী বিশ্লেষকদের মতে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ইচ্ছা ও চেষ্টা এটাই ছিল, যে কোন উপায়ে যুদ্ধ-বিগ্রহ এড়িয়ে চলা এবং যে সমস্ত অমুসলিম শক্তি মুসলমানদেরকে দুশমন ভাবে এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে তাদের প্রতি সহমর্মিতা, শান্তি ভ্রাতৃত্বের পয়গাম প্রেরণ করা।
একদিকে এই ইচ্ছা, অপরদিকে ৬৩০ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারী মাসে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যুদ্ধে গমনের মত অবস্থায় ছিলেন না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে পরামর্শ দেয়া হয় যে, শহরের পুনর্গঠন সাময়িকভাবে স্থগিত রেখে শহরের প্রতিরক্ষার দিকে দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন। সকল প্রস্তুতি নিয়ে শত্রুর হামলা প্রতিহত কিংবা অবরোধের অপেক্ষা করা উচিত।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পরামর্শদাতাদের পরামর্শ এই বলে আমলে নেননি যে, আমরা এখানে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ করে বসে থাকলে যখন প্রতিপক্ষ টের পাবে যে, আমরা সতর্ক এবং কেল্লা বন্ধ করে বসে আছি, তখন শত্রুরা মক্কা থেকে অনতি দূরে তাঁবু গেড়ে এই অপেক্ষায় বসে থাকবে যে, আমরা প্রতিরক্ষায় সামান্য শৈথিল্য প্রদর্শন করি, আর তারা এই সুযোগে শহর অবরোধ করে ফেলবে অথবা একযোগে হামলা করবে। এটা খাল কেটে কুমির আনার মতই মহাবিপদ হবে। কারণ তারা তখন আমাদের জন্য সার্বক্ষণিক বিপদের কারণ হয়ে থাকবে।
সে যুগের উদ্ধারকৃত বিভিন্ন প্রমাণাদি হতে জানা যায় যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুসলমানদের জন্য তিনটি যুদ্ধনীতি প্রণয়ন করেন। ১) শত্রু নিজ ভূখণ্ডে থেকে আহ্বান করলে তখন পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়া। ২) শত্রুর ইচ্ছা এবং উদ্দেশ্য জেনে গেলে নিজ ভূখণ্ডে বসে থেকে শত্রুর অপেক্ষায় না থাকা; বরং নিজেরা এগিয়ে গিয়ে তাদের উপর হামলা করা এবং ৩) সার্বক্ষণিক যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে থাকা। শত্রুদের মধ্যে এই উদ্বেগ রাখতে হবে যে, যে কোন সময় মুসলমানরা তাদের যুদ্ধের প্রতি আহ্বান করতে পারে অথবা তাদের বিরুদ্ধে কোন ষড়যন্ত্র করলে বিদ্যুৎগতিতে মুসলমানরা তাদের পাল্টা জবাব দিবে।
“না, তা হতে পারে না।” মালিক বিন আওফ নিজের তাঁবুতে বসে ফুঁসে ফুঁসে দু’পা মাটিতে বারবার আছড়ে বলে– “তারা ঝড়ের গতিতে কিভাবে এখানে পৌঁছল? তাহলে কি আমাদের মধ্যে গাদ্দার রয়েছে যে অনেক আগেই আমাদের আগমনের সংবাদ তাদেরকে জানিয়ে দিয়েছে?”
“বিশ্বাস না হয় তুমি নিজে গিয়ে দেখে আস মালিক!” বৃদ্ধ দুরায়দ বিন ছম্মাহ বলে– “তোমার চোখ তোমাকে বিভ্রান্ত করবে না।”
“আমি মিথ্যা কথা বলে থাকলে স্বয়ং দেবতা লাতের সাথে ধোঁকাবাজি হবে।” “ঐ ব্যক্তি বলে, সে মুসলমানদের সংখ্যা কম-বেশি দশ হাজার হবে বলে বর্ণনা করেছিল। এবং সে এটাও বলেছিল যে, তারা হুনাইনের নিকটে এসে অবস্থান করছে। সে আরো বলে– “তারা তাঁবু স্থাপন না করে সর্বক্ষণ প্রস্তুত হয়ে আছে। আর একথাও মিথ্যা নয় যে, এ বাহিনীর সেনাপতি খোদ মুহাম্মাদ।”
মালিক বিন আওফ ক্ষোভে ফেটে পড়ছিল। সে অতর্কিতে মুসলমানদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে চেয়েছিল। সে আওতাস থেকে মক্কায় রওনার নির্দেশ দিয়েছিল। কিন্তু অল্পক্ষণ পরেই সে জানতে পারে যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনী তাদের অনতি দূরে হুনাইনের কাছে চলে এসেছে এবং তারা মোকাবিলার জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত।
দুরায়দ বলে– “ক্রোধ তোমার মেধাকে দুর্বল করবে মালিক। এখন অবরোধ আর অতর্কিতে হামলার চিন্তা বাদ দাও এবং মুসলমানদের সাথে যেখানে তোমার মোকাবিলা হবে সেখান থেকে ফায়দা লুটতে পার কি-না সেই চেষ্টা কর। শত্রুকে প্রতারিত করতে তোমার জুড়ি নেই। তোমার মধ্যে সাহসের অভাব নেই। তাহলে এত চিন্তার কি আছে? আমি তোমার পাশে আছি। আমি তোমাকে আবার বলছি, হাওয়াযিন গোত্র, পরিবার-পরিজন ও চতুষ্পদ জন্তু সাথে এনে ভাল করেনি। এস আমার সাথে। হুনাইন উপত্যকা ভালভাবে নিরীক্ষণ করে পলিসি গ্রহণ করি।”
যেখানে যুদ্ধের সম্ভাবনা ছিল সে এলাকা পরিদর্শনে তারা চলে যায়।
♣♣♣
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে আগত মুজাহিদ সংখ্যা ছিল ১২ হাজার। এদের মধ্যে দু’হাজার ছিল মক্কার নও মুসলিম, যারা মাত্র ক’দিন পূর্বে ইসলাম গ্রহণ করেছে। অনেকে এই নও মুসলিমদের উপর আস্থা রাখার পক্ষপাতী ছিলেন না। কিন্তু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর উপর সম্পূর্ণ আস্থা থাকায় তিনি তাদেরকেও সাথে নেন। হযরত আবু সুফিয়ান রাযিয়াল্লাহু আনহু, হযরত ইকরামা রাযিয়াল্লাহু আনহু এবং হযরত সফওয়ান রাযিয়াল্লাহু আনহুও নও মুসলিম ছিলেন। এই তিনজনই নেতৃস্থানীয় এবং সেনাপতির যোগ্য ছিলেন। নও মুসলিমদের প্রতি এদের অনেক প্রভাব ছিল। স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়েই এরা যুদ্ধে নাম লেখায়। ঐতিহাসিকগণ লেখেন, তারা মুজাহিদদের জন্য কম-বেশি ১০০ বর্মের ব্যবস্থা করেছিলেন।
৬৩০ খিষ্টাব্দের ২৭ শে জানুয়ারী ৮ম হিজরীর ৬ই শাওয়াল। এ দিন ভোরে ১২ হাজার মুজাহিদ রওনা হন। ৩১ শে জানুয়ারী বিকেলে তারা হুনাইনে গিয়ে পৌঁছেন। তাদের যাত্রা ছিল বিদ্যুৎগতির। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পূর্বেই অবগত ছিলেন যে, হাওয়াযিন ও ছাকীফ গোত্র চরম যুদ্ধবাজ। তাদের নেতা দুরায়দ এবং মালিক বিন আওফের যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শিতা ও কুটচাল সম্পর্কেও তিনি জ্ঞাত ছিলেন। এইজন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বনু সালীমের ৭০০ মুজাহিদকে রাখেন এবং খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে তাদের কমান্ডার নিযুক্ত করেন।
মক্কা থেকে ১১ মাইল দূরে অবস্থিত একটি উপত্যকার নাম হুনাইন। কোথাও কোথাও উপত্যকাটি বিস্তীর্ণ হয়ে সাত মাইল দীর্ঘ হয়েছে। আবার কোথাও এর চেয়ে কম প্রস্থ ছিল। উপত্যকাটি হুনাইনের দিকে যতই এগিয়ে যায় তার প্রশস্ত তা ততই কমতে থাকে। হুনাইনের কাছে গিয়ে এ প্রশস্ততা মাত্র ৪৪০ গজে নেমে আসে। এখান থেকে উপত্যকাটি উপরে উঠে যায়। অল্পদূর এগিয়ে তা একটি গিরিপথে রূপ নেয়। কখনো বামে মোড় এবং ডানে বাঁক হয়ে সরু পথটি অন্য আরেকটি উপত্যকার সাথে মিলিত হয়। এই বিপজ্জনক স্থানের নাম ‘নাখলাতুল ইয়ামনিয়া’। এ স্থানটি খুবই সংকীর্ণ ছিল।
মুজাহিদ বাহিনী গোয়েন্দা মারফৎ সংবাদ রেখেছিল যে, প্রতিপক্ষ আওতাসের নিকটে তাঁবু ফেলে আছে। কিন্তু রাতের আঁধারের কাছে তারা ধরা পড়ে অথবা বলা যায়, তারা এটার কোন প্রয়োজনই অনুভব করেনি যে, রাতের দুশমনের গতিবিধির উপর নজর রাখা দরকার। এর কারণ ছিল তারা সম্মিলিত বাহিনীর রওনা হওয়ার কোন লক্ষণ দেখতে পায়নি। পুরো ক্যাম্পে মৃত্যুর নীরবতা বিরাজ করছিল। কোন তৎপরতা তাদের নজরে পড়েনি।
৬৩০ খ্রিষ্টাব্দের ১লা ফেব্রুয়ারী ৮ম হিজরীর ১১ই শাওয়াল সকালে মুজাহিদ বাহিনী আওতাসের উদ্দেশে অগ্রসর হতে থাকে। পরিকল্পনা ছিল, শত্রু শিবিরে অতর্কিতে হামলা করা। অগ্রযাত্রা ছিল সুশৃঙ্খলই। সর্বাগ্রে ছিল বনু সালীমের মুজাহিদ বাহিনী। এদের কমান্ডার হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু ছিলেন সর্বাগ্রে।
মুজাহিদ বাহিনী ছিল ১২ হাজার। এঁদের সবাই ছিল সুশৃঙ্খল এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। কিন্তু এই সুশৃঙ্খল বাহিনীর সাথে আরেকটি বিশৃঙ্খল বাহিনীও ছিল। তারা ছিল ২০ হাজার। এরা মক্কার আশে-পাশের এলাকার ছিল। মূল সৈন্যদের সাহায্যার্থে এরা সাথে গিয়েছিল।
এখানে একটি ঘটনা উল্লেখযোগ্য আর তা হলো, বিশাল এ বাহিনী দেখে কোন কোন সাহাবী গর্ব ভরে বলেন, “আজ এমন কে আছে যে আমাদের পরাজিত করতে পারে।” দুজন ঐতিহাসিক লিখেন, এই গর্বের মধ্যে অহংকারের আভাষও ছিল।
হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু ছিলেন সর্বাগ্রে। হুনাইন উপত্যকার সংকীর্ণ স্থানে তিনি যখন প্রবেশ করেন তখন দিবাকর সবেমাত্র উঠছিল। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু দ্রুত অশ্ব ছুটিয়ে দেন এবং অশ্বের গতি তীব্র থেকে তীব্রতর করেন। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু ছিলেন আবেগতাড়িত যোদ্ধা। নিজের নেতৃত্বের প্রতি তার শতভাগ আস্থা ছিল। অমুসলিম অবস্থায় কুরাইশ সরদার হযরত আবু সুফিয়ান রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর প্রতি তার যে প্রধান অভিযোগ ছিল যে তিনি তাকে ইচ্ছেমত লড়তে দেননি। তাঁর ইসলাম গ্রহণের পেছনে এটাও একটি বড় কারণ ছিল যে, তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সৈন্য পরিচালনায় এক ব্যতিক্রমধর্মী নৈপুণ্য দেখেছিলেন, যা তাকে খুবই মোহিত করেছিল। খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু ইসলাম গ্রহণের পূর্বে ইকরামা রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে বলেছিলেন, আমার যুদ্ধাবেগ এবং যুদ্ধক্ষেত্রে আক্রমণাত্মক ভঙ্গির মূল্যায়ন শুধু মুসলমানরাই করতে পারে।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর সমর দক্ষতার যে যথেষ্ট মূল্যায়ন করেছিলেন তার উত্তম প্রমাণ হল, তিনি এই বিশাল বাহিনীর অগ্রগামী বাহিনীর অধিনায়ক ছিলেন।
পূর্বগগনে সূর্যোদয়ের সময় হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর বাহিনী ছিল গিরিপথের সংকীর্ণ জায়গায়। আচমকা আসমান-জমিন ভেঙ্গে পড়তে থাকে। হাওয়াযিন, ছাকীফ ও অন্যান্য গোত্রের সম্মিলিত বাহিনীর গগনবিদারী শ্লোগানে বজ্রধ্বনির ন্যায় কানফাটা আওয়াজ ওঠে এবং বৃষ্টির ন্যায় তীরের ঝাঁক আসতে থাকে। ডান-বামের চত্বর এবং অনতি দূরের পর্বত শৃঙ্গ হতে এ সমস্ত তীর ছুটে আসে।
এটা ছিল প্রতিপক্ষের কৌশলী ফাঁদ। মালিক বিন আওফ এবং দুরায়দ বিন ছম্মাহ দিনের বেলায় ক্যাম্পে কোনরূপ তৎপরতা প্রকাশ হতে দেয়নি। তাদের নীরবতার কারণে মনে হতে থাকে এটা কোন সেনাক্যাম্পই নয়। কোন কাফেলার যাত্রাবিরতি শিবির মাত্র। সন্ধ্যার পর মালিক বিন আওফ সৈন্যদেরকে হুনাইনের সংকীর্ণ গিরিপথে তীরন্দাজ বাহিনীকে রাস্তার দু’পাশের গোপন স্থানে অবস্থান করতে বলে।
তীরের বর্ষণ যেমনি ছিল অতর্কিত তেমনি পরিমাণেও ছিল অসংখ্য। মুজাহিদদের অশ্ব তীরের আঘাতে আহত হয়ে নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে এলোপাথাড়ি দৌড়তে থাকে। তীরের আঘাত থেকে যারা রক্ষা পায় তারাও পিছনে চলে আসার চেষ্টা করে। ফলে এতে তীর বর্ষণ তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে ওঠে। অশ্ব ও সওয়ারী উভয়ই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করে হুলস্থুল পড়ে যায়।
হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু তীর বর্ষার মাঝে দাঁড়িয়ে চিৎকার দিয়ে বলছিলেন, “পালিয়ো না; পৃষ্ঠপ্রদর্শন করো না। মোকাবিলা কর। আমরা শত্রুদেরকে…।” অশ্ব এবং অশ্বারোহীদের হুলস্থুল এমন ভয়ানক অবস্থার সৃষ্টি করেছিল যে, হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর আহবান কেউ শুনতে পায়নি। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর দেহে মোট কতটি তীর বিদ্ধ হয়েছে এটা দেখারও কারো সুযোগ ছিল না। অথচ তিনি একটুও পিছু না হঁটে তীর-বৃষ্টির মাঝে দাঁড়িয়ে তার বাহিনীকে মোকাবিলার জন্য চিৎকার করে আহ্বান করেছিলেন। অবশেষে তিনিও পলায়নপরদের ভীড়ে পড়ে যান এবং ভীড় তাকে ঠেলতে ঠেলতে এমনভাবে দূরে সরে আসে যেন কোন প্রবল স্রোত তাঁকে ভাসিয়ে এনেছে।”
পলায়নপর বাহিনীর বেশামাল ধাক্কা একদিকে সরে যায়। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর দেহে এত আঘাত লাগে যে, তিনি ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে যান এবং অজ্ঞান হয়ে জমিনে লুটিয়ে পড়েন।
মূল বাহিনী আসছিল অগ্রগামী বাহিনীর পিছনে। এই বাহিনীতে উশৃঙ্খল সেচ্ছাসেবক দলও ছিল। অগ্রগামী বাহিনী পেছনে পালিয়ে এলে মূল বাহিনীতেও ছোটাছুটি শুরু হয়ে যায়। অগ্রগামী বাহিনীর অনেকের গায়ে তীর বিদ্ধ ছিল; তাদের পোশাক ছিল রক্তেরঞ্জিত। অশ্বের দেহেও অসংখ্য তীর ছিল। মালিক বিন আওফের সৈন্যদের ফালফাটা শ্লোগান শোনা যাচ্ছিল। এই অবস্থায় মুসলিম বাহিনী বিক্ষিপ্ত হয়ে পিছে সরে যায়।
কোন কোন ঐতিহাসিকের অভিমত, যারা আন্তরিকভাবে ইসলাম গ্রহণ করেনি এবং সৈন্যদের মাঝে তারা এমনভাবে হুলস্থুলকে বৃদ্ধি করে যেমন পেট্রোলের সংযোজন আগুনকে বৃদ্ধি করে। তারা নিজেরা শুধু পলায়নই করেনি অন্যদের মাঝেও আতঙ্ক ছড়িয়ে দেয়। দু’কারণে তারা আনন্দিত ছিল। ১. নিজেদেরকে যুদ্ধ থেকে বাঁচাতে পেরেছে এবং ২. মুসলমানরা পলায়নপর; তাদের পরাজয় ঘটেছে।
কিছু সংখ্যক মুসলমান পালিয়ে যেখান থেকে যাত্রা শুরু করেছিল সেখানে গিয়ে পৌঁছে। পলায়নপর অধিকাংশ সৈন্য এখানে এসে আশ্রয় নেয়। যারা রণাঙ্গন থেকে পালিয়ে ফিরে আসে তাদের বেশির ভাগই জানে না আসল ঘটনা কি? আর শত্রুরাই বা কোথায়, যাদের ভয়ে সৈন্যরা এভাবে পালাচ্ছে? পলায়নের গতি এতই তীব্র ছিল যে উট এবং ঘোড়ার সংঘর্ষ পর্যন্ত হচ্ছিল। পদাতিকরা এ সমস্ত ঘোড়া এবং উটের পদতলে পিষ্ট হওয়া থেকে আত্মরক্ষা করতে রাস্তার দু’পার্শে ছোটাছুটি করছিল।
♣♣♣
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সৈন্যদের এ অবস্থা দেখে বিস্ময়ে ‘থ’ হয়ে যান। সৈন্যরা যে রাস্তা দিয়ে পালাচ্ছিল তিনি সে রাস্তায় গিয়ে দাঁড়ান। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে এ সময় নয়জন অশ্বারোহী ছিলেন। উল্লেখযোগ্য চারজন হলেনঃ ১. হযরত উমর রাযিয়াল্লাহু আনহু; ২. হযরত আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহু; ৩. হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু এবং ৪. হযরত আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু।
“মুসলমানগণ!” রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উচ্চ আওয়াজে আহ্বান করতে থাকেন “কোথায় যাচ্ছ তোমরা? আমি এদিকে দাঁড়ানো। আমি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলছি।… আমার দিকে লক্ষ্য কর। আমি মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ এখানে দাঁড়ানো।”
মুসলমানরা দিক-বিদিক হয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পাশ দিয়েই পালাতে থাকে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আহ্বান কারো কানে পৌঁছে না। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে কোথাও দেখা যায় না। তিনি ওদিকে কোথাও অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলেন। এ সময় হাওয়াযিন গোত্রের কতক লোককে উট এবং ঘোড়ায় চড়ে পলায়নপর মুসলমানদের পশ্চাদ্ধাবনে আসতে দেখা যায়। তাদের সামনে ছিল এক উষ্ট্রারোহী। শত্রুপক্ষের পতাকাবাহী ছিল সে। হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু এক মুসলমানকে সাথে নেন এবং উষ্ট্ররোহীর পেছনে দৌড় দেন। কাছে গিয়ে হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু ঐ উটের পিছনের পায়ে তরবারি চালিয়ে পা কেটে ফেলেন। উট কাত হয়ে পড়ে গেলে আরোহীও দূরে ছিটকে পড়ে। হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু আরোহীকে সোজা হয়ে বসার সুযোগ না দিয়ে ধড় থেকে মস্তক বিচ্ছিন্ন করে ফেলেন।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি টিলার উপর গিয়ে দাঁড়ান। এমন সময় শত্রুপক্ষের জনৈক ব্যক্তি তাকে চিনতে পেরে চিৎকার করে বলতে থাকে –“ঐ যে মুহাম্মাদ… তাঁকে হত্যা কর।” এ আহ্বান শুনে ছাকীফ গোত্রের কিছু লোক ঐ টিলার উপর উঠতে থাকে যেখানে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দাঁড়িয়ে ছিলেন। সাহাবায়ে কেরাম একযোগে তাদের উপর আক্রমণ করেন। সংক্ষিপ্ত সংঘর্ষে তারা পালিয়ে যায়। তাদের একজনও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত পৌঁছতে সক্ষম হয়নি।
‘মালিক বিন আওফের নিকট আমি পরাজিত হব না।” রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন– “এত সহজে সে কি করে বিজয় লাভ করতে পারে।”
দিক-বিদিক হয়ে ছোটাছুটিরত সাহাবায়ে কেরামকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দেখেন। শত্রুপক্ষের তৎপরতাও গভীরভাবে লক্ষ্য করেন। তিনি নিজ সৈন্যদের চেয়ে শত্রুপক্ষের সৈন্যদের গতি ও অবস্থান পর্যবেক্ষণ করতে থাকেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সমর জ্ঞানের আলোকে অনুভব করেন যে, প্রাথমিক অবস্থায় সফল হওয়ায় মালিক এত খুশি যে, পরবর্তী চালের কথা তার মাথায় আসেনি। মুসলিম বাহিনীর এলোপাথাড়ি পলায়ন থেকে সে পুরোপুরি ফায়দা লুটতে পারেনি। সমরকুশলী হিসেবে মালিকের নামধাম থাকায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ধরে নিয়েছিলেন যে, একটু পরেই মালিক বাহিনী মুসলমানদের পশ্চাদ্ধাবন করতে আসবে। কিন্তু পশ্চাদ্ধাবনে আগত সৈন্যসংখ্যা যেমনি ছিল কম, তেমনি তারা সুশৃঙ্খলও ছিল না।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অগ্রবর্তী বাহিনীকে পিছু হঁটে আসতে দেখেছিলেন। কতজন শহীদ বা জখমী হয়েছে তারও একটি ধারণা নিয়েছিলেন। আসলে কয়েকটি অশ্ব এবং তার আরোহী তীর বিদ্ধ হয় মাত্র। শহীদ হয়নি একজনও। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অনুমান করতে সক্ষম হন যে, শত্রুরা তীরন্দাজীতে পরিপক্ক নয় এবং তারা তাড়াহুড়োর শিকার। তারা দক্ষ এবং বুদ্ধিমান হলে এত তীরের মাঝে একজনেরও বেঁচে থাকার কথা ছিল না।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পাশে দাঁড়ানো সাহাবায়ে কেরামের দিকে নজর বুলান। হযরত আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর প্রতি তার চোখ আটকে যায়। হযরত আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর গলায় আওয়াজ অস্বাভাবিক উচ্চ ছিল। অনেক দূর-দূরান্ত হতে শোনা যেত। দৈহিক দিক দিয়েও তিনি দীর্ঘকায় ছিলেন।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন– “আব্বাস! তোমার প্রতি আল্লাহর রহমত বর্ষিত হোক। মুসলমানদের আহ্বান কর। তাদেরকে এখানে আসতে বল।”
হযরত আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহু সর্বোচ্চ আওয়াজে ডাকতে শুরু করেন– “আনসার ভায়েরা! মদীনাবাসী!…. মক্কার জনগণ… এস… আল্লাহর রাসূলের কাছে এস।” হযরত আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহু বিভিন্ন গোত্র এবং বিশেষ লোকদের নাম ধরে ধরে ডাকতে থাকেন।
সর্বপ্রথম আসে আনসাররা। তাদের সংখ্যা ছিল কম। কিন্তু একে অপরকে দেখে এগিয়ে আসতে থাকে। মক্কার অন্যান্য গোত্রের কিছু লোকেরাও আসে। সর্বমোট একশজনের মত হয়। এ সময় পিছু হঁটা মুসলমানদের পশ্চাদ্ধাবনে অনেক হাওয়াযিনকে আসতে দেখা যায়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ একশ সাহাবীকে আগত শত্রুসেনাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার নির্দেশ দেন।
মুজাহিদ বাহিনী পিছন দিক থেকে তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। হাওয়াযিনের লোকেরা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যায়। তারা আক্রমণ ঠেকাতে চেষ্টা করে কিন্তু মুজাহিদ বাহিনী তাদের সে সুযোগ দেয়নি। অধিকাংশই প্রাণ নিয়ে পালিয়ে যায়। নিহত এবং আহতরা সেখানেই পড়ে থাকে।
আকস্মিক বাঁধার সম্মুখীন হওয়ায় ক্ষণিকের জন্য মুজাহিদ বাহিনীর মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিল মাত্র। এর আগে তারা প্রতিপক্ষ হতে কয়েক গুণ কম সৈন্য নিয়েও বীর বিক্রমে লড়াই করে বিজয়ের মুকুট ছিনিয়ে এনেছে। মুজাহিদগণ বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নেয়ার পর যখন দেখে যে, হযরত আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর আহ্বানে মুসলমানরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পাশে এসে জড়ো হচ্ছে এবং শত্রুরা মুসলমানদের এক ক্ষুদ্র দলের পাল্টা আক্রমণে টিকতে না পেরে পালিয়ে গেছে এবং তারা এটাও দেখে যে, হাওয়াযিন ও ছাকীফরা তাদের পশ্চাদ্ধাবন করতে আসছে না তখন কয়েক হাজার মুজাহিদ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে ফিরে আসে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দ্রুত তাদের মাঝে শৃঙ্খলা বিধান করে যুদ্ধের জন্য বিন্যস্ত করেন এবং শত্রুর উপর হামলা করার নির্দেশ দেন।
হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু ছিলেন লাপাত্তা। উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠায় কারো মাথায় এই খেয়াল আসে না যে, একটু তালাশ করে দেখবে, কে কোথায় এবং কিভাবে আছে।
যে সংকীর্ণ গিরিপথে এক সময় মুজাহিদদের উপর বজ্রের আঘাত পড়েছিল এখন সে স্থানটিই সম্মিলিত বাহিনীর জন্য মৃত্যু ফাঁদে পরিণত হয়। হাওয়াযিন গোত্র খুব দুর্ধর্ষ হেতু তাদেরকে রণাঙ্গনে সামনে রাখা হয়। সন্দেহ নেই যে, তারা যুদ্ধবাজ ছিল। কিন্তু মুসলমানদের বজ্র আক্রমণের সামনে তারা দাঁড়াতেই পারে না। মুসলমানরা সর্বোচ্চ বীরত্ব প্রকাশের মাধ্যমে ঐ ভীতিবোধও নিরসন করতে চায়, একটু ভুলের কারণে যার সম্মুখীন ইতোপূর্বে তাদের হতে হয়েছিল।
এটা ছিল সরাসরি যুদ্ধ। মুসলমানরা তরবারি চালনায় এমন চমক সৃষ্টি করে যে, একের পর এক পড়তে থাকে হাওয়াযিনদের লাশ। আর তাদের অধিকাংশ পলায়নের আয়োজন করছিল। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রণাঙ্গনের নিকটবর্তী একটি উঁচু স্থানে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তার পাক জবানে বার বার উচ্চারিত হচ্ছিল।
“আমি সত্য নবী; কোন সন্দেহ নেই,
আমি আব্দুল মুত্তালিবের পৌত্র; কোন ভুল নেই।”
হাওয়াযিন প্রচণ্ড মার খেয়ে পিছনে হাঁটতে থাকে। তারা আক্রমণাত্মক অবস্থা থেকে রক্ষণাত্মক অবস্থায় চলে আসে। তারা ক্রমেই দুর্বল হতে থাকে। তাদের পেছনে ছাকীফ গোত্রের সৈন্যরা প্রস্তুত ছিল। মালিক বিন আওফ চিৎকার করে করে হাওয়াযিনদের পশ্চাতে সরিয়ে নেয়। ছাকীফ গোত্রের নতুন বাহিনী দ্রুত হাওয়াযিনদের শূন্যস্থান পূরণ করে। এ সময় মুসলমানরা বেশ ক্লান্ত কিন্তু বনু ছাকীফ সতেজ। শুরু হয়ে যায় আবার অগ্নিপরীক্ষা। শক্তি এবং ক্লান্তির বিচারে মুসলমানদের পাল্লা নিচু হলেও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপস্থিতি এবং তার উৎসাহ মুসলমানদের শক্তি বৃদ্ধি এবং ক্লান্তি দূর করে তাদের মাঝে দৃঢ়তা ও জিহাদী জযবা সরবরাহ করেছিল।
মুসলমানদের তরবারি ও বর্শার আঘাতে যে বজ্র নিচু ছিল এবং উচ্চকিত শ্লোগানে যে হুঙ্কার ছিল ছাকীফ গোত্রের উপর তা ভয়ানক ত্রাস সৃষ্টি করে। ছাকীফের যুদ্ধবাজ সৈন্যদের যুদ্ধ-খ্যাতি থাকলেও তারা দ্রুত পিছু হটতে থাকে। এক সময় তাদের উট ও ঘোড়া নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। এতে শত্রু-শিবিরে সেই তাণ্ডব শুরু হয়, যা প্রভাতে গিরিপথে মুসলমানদের মধ্যে হয়েছিল। ইতোপূর্বে হাওয়াযিনরাও শোচনীয়ভাবে পিছু হটেছিল। এবার ছাকীফদের পিছু হাঁটতে দেখে অন্যান্য ছোট গোত্রগুলোর মনোবল যুদ্ধ ছাড়াই হুড়মুড় করে ভেঙ্গে যায়। তারা জীবন বাঁচাতে এলোপাথাড়ি পালাতে থাকে।
মালিক বিন আওফ সংকীর্ণ রাস্তার অদূরে দলছুট সৈন্যদের একত্রিত করছিল। তার অবস্থা বলছিল, সে আক্রমণাত্মক পজিশন থেকে নিজ বাহিনীকে আত্মরক্ষামূলক প্রাচীরে পরিণত করতে সৈন্য বিন্যস্ত করছিল।
মালিকের এই সৈন্যবিন্যাস রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দেখে দ্রুত নিজ সৈন্যদের কাছে আসেন। তিনি দেখতে পান যে, পূর্বে যারা গিরিপথের শিকার হয়ে আতঙ্কিত হয়ে চলে গিয়েছিল তারাও ইতোমধ্যে চলে এসেছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অশ্বারোহীদের সম্মুখে আসতে বলেন। মুহূর্তে অশ্বারোহী বাহিনী পদাতিক বাহিনী হতে আলাদা হয়ে যায়। তিনি তাদেরকে বিশেষভাবে বিন্যস্ত করে নির্দেশ দেন যে, হাওয়াযিনদেরকে দাঁড়াতে এবং সংগঠিত হওয়ার সুযোগ দেয়া যাবে না। বিদ্যুৎ গতিতে তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়।
এ অশ্বারোহী বাহিনীতে বনু সালীমের ঐ সকল অশ্বারোহীও ছিল, গোপন স্থান থেকে যাদের লক্ষ্যে সর্বপ্রথম তীর বর্ষিত হয়েছিল। আর সে তীর বর্ষণে মুসলমানদের সংঘবদ্ধতা লণ্ডভণ্ড হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এবার তাদের সাথে পূর্বের কমান্ডার হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু ছিলেন না। তিনি তখনও কোথাও অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলেন।
এবার এ অশ্বারোহী বাহিনীর নেতৃত্ব অর্পণ করা হয় হযরত যুবাইর বিন আওয়াম রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর কাঁধে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে এ নির্দেশ দেন যে, সামনের গিরিপথটি মালিক বিন আওফের কব্জায়। তাকে ওখান থেকে বেদখল দাও।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নতুনভাবে আবার যুদ্ধের ডোল হাতে তুলে নেন। তার ইঙ্গিতে হযরত যুবাইর বাহিনী টর্নেডো বেগে হাওয়াযিন বাহিনীতে আঘাত হানে। তার বাহিনীর তলোয়ারে বিদ্যুতের স্ফুরণ ঘটতে থাকে। ফলে হাওয়াযিনের হতবিহ্বল বাহিনী অল্পসময়ও টিকতে পারে না। যে যার পথে প্রাণ নিয়ে পড়ি মরি করে গিরিপথ ছেড়ে চলে যায়। গিরিপথটি ছিল বেশ দীর্ঘ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যুবাইর বাহিনীকে গিরিপথে অবস্থানের নির্দেশ দিয়ে বলেন, এখন থেকে এটাই হবে আমাদের যুদ্ধক্যাম্প।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কালবিলম্ব না করে আরেকটি অশ্বারোহী বাহিনী প্রস্তুত করে ফেলেন। এ বাহিনীর কমান্ডার নিযুক্ত করেন হযরত আবু আমের রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে আওতাসের নিকটে অবস্থিত সম্মিলিত শত্রবাহিনীর ক্যাম্প আক্রমণ করার দায়িত্ব দেন।
“খালিদ…খালিদ এখানে” অনেক দূর থেকে একজন আওয়াজ দিয়ে বলে “এখানে তিনি পড়ে আছেন।”
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক প্রকার দৌড়ে হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর নিকট গিয়ে পৌঁছান। তখনও তিনি অজ্ঞান ছিলেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর ভূলুণ্ঠিত শরীরের পাশে বসে তার মাথা থেকে পা পর্যন্ত ফুঁক দেন। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর চক্ষু খুলে যায়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত খালিদের খোলা চোখে দীর্ঘক্ষণ স্বীয় চোখ স্থাপন করেন। অল্পক্ষণপরই হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু উঠে বসেন। তার দেহে বিদ্ধ তীরের আঘাত তেমন গভীর ছিল না। দ্রুত তীর বের করে ব্যান্ডেজ করা হয়।
হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন “আল্লাহর রাসূল! আমি যুদ্ধ করব আমি এখন যুদ্ধের সম্পূর্ণ উপযুক্ত।”
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে বলেন যুবাইরের বাহিনীতে শরীক হয়ে যাও। কমান্ড দেয়ার মত স্বাভাবিক অবস্থা তোমার মাঝে এখনও হয়নি।
হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু সঙ্গে সঙ্গে একটি ঘোড়ায় চেপে বসেন। তার বস্ত্র ছিল রক্তে রঞ্জিত। তিনি ঘোড়া ছুটিয়ে দ্রুত হযরত যুবাইর রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর বাহিনীতে শরীক হয়ে যান। তিনি হযরত যুবাইর রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে জিজ্ঞেস করেন, এখন করণীয় কী? হযরত যুবাইর রাযিয়াল্লাহু আনহু তাঁকে জানান যে, আওতাসের নিকটবর্তী হাওয়াযিনের তাঁবুতে হামলা করা। কিন্তু এ আক্রমণের নেতৃত্ব দিবেন হযরত আবু আমের রাযিয়াল্লাহু আনহু।
আওতাস হুনাইন উপত্যকা থেকে দূরে ছিল। মালিক বিন আওফ হাওয়াযিন বাহিনীকে এই আওতাস পর্যন্ত তাড়িয়ে নিয়ে যায়। তাদেরকে সেনাক্যাম্পের আশে-পাশে ছড়িয়ে দেয়। প্রতিরোধ দেয়াল হিসেবে মালিক তাদেরকে এভাবে সেনা ক্যাম্পের চতুর্দিকে এনে দাঁড় করায়। কারণ, ক্যাম্পের মধ্যে ছিল সৈন্যদের পরিবার-পরিজন এবং চতুষ্পদ জন্তু। এখন এরাই বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অভিজ্ঞ দুরায়দ বিন ছম্মাহ মালিককে এই বলে বকাবকি করতে থাকে যে, বারবার নিষেধ করা সত্ত্বেও মালিক কেন তাদের নিয়ে আসল। এই নারী, শিশু ও গৃহপালিত জন্তুর প্রাণ রক্ষা করাই এখন তাদের জন্য দায় হয়ে গেছে। মুসলমানদের হাত থেকে কিভাবে এদের রক্ষা করবে?
♣♣♣
হযরত আবু আমের রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর বাহিনী আওতাস অভিমুখে চলছে। ক্যাম্পের কাছা-কাছি পৌঁছলে হাওয়াযিনরা প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তোলে। যুদ্ধজয় কিংবা মুসলমানদের ছিন্নভিন্ন করে মক্কা দখলের জন্য নয়; বরং মুসলমানদের হাত থেকে নিজেদের পরিবার-পরিজন এবং চতুষ্পদ জন্তুগুলো রক্ষার জন্য লড়ে। এটা ছিল আরেকটি মারাত্মক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। এখানে যুদ্ধ কৌশল অর্থহীন। বাহাদুরীর জয় জয়কার ছিল। অশ্বারোহী এবং পদাতিক বাহিনী লড়তে লড়তে পুরো উপত্যকায় ছড়িয়ে পড়ে।
হযরত আবু আমের রাযিয়াল্লাহু আনহু একাই শত্রুপক্ষের নয় অশ্বারোহীকে জমের ঘরে প্রেরণ করেন। কিন্তু দশম জনের হাতে নিজে শহীদ হয়ে যান। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পূর্বেই হযরত আবু আমের রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর স্থলবর্তী নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন তাঁর চাচাত ভাই হযরত আবু মুসা রাযিয়াল্লাহু আনহু। তিনি সঙ্গে সঙ্গে দায়িত্ব বুঝে নেন এবং নিজ বাহিনীর প্রেরণা বাড়াতে থাকেন।
হাওয়াযিনরা প্রথমে প্রবল প্রতিরোধ সৃষ্টি করলেও এখন তারা বৃক্ষের পাকা ফলের মত টপটপ করে পড়ে যেতে থাকে। তাদের নিহত ও আহতের সংখ্যা ক্রমে বাড়তে থাকে। তাদের দুরবস্থা ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। এদিকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত যুবাইর রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর ঐ বাহিনীকে দ্রুত হযরত আবু মুসা রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর বাহিনীর সাহায্যে এগিয়ে যেতে নির্দেশ দেন, যাদেরকে তিনি গিরিপথ, সংরক্ষণে রিজার্ভ রেখেছিলেন। হাওয়াযিনের দ্রুত পরাজয় ঘটাতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যুবাইর বাহিনীকে প্রেরণের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন।
হযরত যুবাইর রাযিয়াল্লাহু আনহু তাঁর বাহিনীকে আক্রমণে এগিয়ে যাবার নির্দেশ দিলে দ্রুতগতিতে ঘোড়া অশ্বারোহীকে নিয়ে ছুটতে থাকে। এ সময় হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর অশ্ব ছিল সকলের আগে।
হাওয়াযিনের মনোবলে আগে থেকেই ফাটল ধরেছিল। মুসলমানদের নতুন এই বাহিনীর বজ্রাঘাত তারা সহ্য করতে পারে না। এর আগেই তাদের আহতদের সংখ্যা বিপুল পরিমাণে হয়ে গিয়েছিল। দুই অশ্বারোহী ইউনিটের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিপাকে হাওয়াযিনের ব্যুহ তছনছ হয়ে যায়। তারা স্ত্রী, পুত্র, পরিজন ছেড়ে পালাতে থাকে। রাস্তা পরিষ্কার হলে মুসলিম বাহিনী সহজেই তাদের ক্যাম্প ঘিরে ফেলে।
ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গোত্রের যোদ্ধারা হাওয়াযিন এবং ছাকীফের মত শক্তিশালী গোত্রকে পালাতে দেখে তারা ক্ষণিকের জন্যও সেখানে বিলম্ব করে না। যুদ্ধ-বাতাস গায়ে না লাগতেই তারা যুদ্ধের ময়দান হতে সটকে পড়ে সোজা নিজ নিজ এলাকায় ফিরে যায়। মালিক বিন আওফকে রণাঙ্গনের কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। তাকে পাওয়া সম্ভব ছিল না। নিজ শহর তায়েফ রক্ষার চিন্তা তাকে পাগল করে তুলেছিল। সে শেষ দিকে এসে তার গোত্রের অন্যান্য সরদারদেরকে বলেছিল, মুসলমানরা যে প্রেরণা নিয়ে আসছে, তা থেকে সহজেই বুঝা যায় যে, তারা তায়েফ আক্রমণ করে সেখানকার প্রতিটি ইট খুলে ফেলবে। এই আশঙ্কাকে সামনে রেখে সে ছাকীফ গোত্রের সমস্ত বাহিনীকে কৌশলে যুদ্ধ থেকে আলাদা করে তায়েফ চলে যায়।
মালিক বিন আওফ যখন তায়েফ রক্ষায় ব্যস্ত তখন হুনাইন প্রান্তরে চলছিল কিয়ামতের বিভীষিকা। হাওয়াযিনের স্ত্রী-সন্তানদের গগনবিদারী কান্না আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। পুরো হুনাইন উপত্যকা মুসলমানদের অধিকারে চলে আসে। মক্কা থেকে আগত বেসামরিক স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী আহত মুজাহিদদের নিয়ে যায়। আহত শত্রুরা মাটিতে পড়ে কাতরাতে থাকে। অনেকে ধুঁকে ধুঁকে মরছিল। এদের দলে বৃদ্ধ দুরায়দ বিন ছম্মাহও ছিল। সে বৃদ্ধ হলেও জাতির ক্রান্তিকালে কম্পিত হাতে তলোয়ার উঠিয়ে নেয় এবং লড়তে লড়তে নিহত হয়।
গনিমতস্বরূপ মুসলমানরা আহত এবং বন্দি শত্রুদের থেকে বিপুল পরিমাণ যুদ্ধাস্ত্র এবং ঘোড়া পায়। এ ছাড়া ৬ হাজার নারী-শিশু, ২৪ হাজার বকরী এবং প্রচুর রৌপ্য তাদের হস্তগত হয়।
চূড়ান্ত বিজয় লাভ করে মুসলমানরা। কিন্তু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের বিজয় উদযাপন করতে দেন না। তিনি সিদ্ধান্ত নেন যে, মালিককে স্থির হতে দাঁড়াবার এবং সৈন্য সুসংগঠিত করার সুযোগ দেয়া হবে না। তিনি বিপজ্জনক সাপের মাথা থেতলে দিতে চান। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নির্দেশে গনিমতলব্ধ নারী শিশু, চতুষ্পদ জন্তুসহ অন্যান্য সম্পদ একটি বাহিনীর মাধ্যমে যি’ক আরানায় পাঠিয়ে দেয়া হয়। পরবর্তী নির্দেশ না আসা পর্যন্ত তাদেরকে সেখানেই থাকতে বলা হয়। পরদিনই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নির্দেশে মুজাহিদ বাহিনী তায়েফ পানে অগ্রসর হয়। এখানে ঘোরতর সংঘর্ষের আশঙ্কা ছিল।
হুনাইন যুদ্ধের বিবরণ পবিত্র কুরআনের সূরা তওবায় উল্লেখিত হয়েছে। কতক সাহাবা যুদ্ধ আরম্ভ হওয়ার পূর্বে নিজেদের সংখ্যাধিক্য দেখে মন্তব্য করেছিলেন; আজ আমাদের পরাজিত করতে পারে এমন কে আছে। এই বিশাল শক্তির মোকাবিলা কে করতে পারে? সূরা তাওবায় বর্ণিত :
“আল্লাহ তোমাদের সাহায্য করেছেন অনেক ক্ষেত্রে বিশেষ করে হুনাইনের দিনে, যখন তোমাদের সংখ্যাধিক্য তোমাদের আনন্দিত করেছিল, কিন্তু তা তোমাদের কোন কাজে আসেনি এবং দুনিয়া প্রশস্ত হওয়া সত্ত্বেও তোমাদের জন্য সংকুচিত হয়েছিল। অতঃপর পৃষ্ঠপ্রদর্শন করে পলায়ন করেছিলে।…
অতঃপর আল্লাহ অবতীর্ণ করেন নিজের তরফ থেকে সান্ত্বনা তাঁর রাসূল ও মুমিনদের প্রতি এবং অবতীর্ণ করেন এমন সৈন্যবাহিনী যাদেরকে তোমরা দেখতে পাওনি। আর শাস্তি প্রদান করেন কাফেরদের এবং এটি হল কাফেরদের কর্মফল।” (সূরা তওবাঃ ২৫-২৬)
♣♣♣
অন্তত একবার পড়ুন
ইতিহাস মুক। সমর বিশেষজ্ঞগণ বিস্মিত। সকলের অবাক জিজ্ঞাসা– ইয়ারমুকের যুদ্ধে মুসলমানরা রোমীয়দের কিভাবে পরাজিত করল? রোমীয়দের সেদিন চূড়ান্ত পরাজয় ঘটেছিল। এ অবিশ্বাস্য ঘটনার পর বাইতুল মুকাদ্দাস পাকা ফলের মত মুসলমানদের ঝুলিতে এসে পড়েছিল।
এটা ছিল অভূতপূর্ব সমর কুশলতার ফল। ইয়ারমুক যুদ্ধে হযরত খালিদ বিন ওলীদ রাযিয়াল্লাহু আনহু যে সফল রণ-কৌশল অবলম্বণ করেছিলেন আজকের উন্নত রাষ্ট্রের সেনা প্রশিক্ষণে গুরুত্বের সাথে তা ট্রেনিং দেয়া হয়।
ইসলামের ইতিহাস অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ির সম্মুখীন হয়ছে। বিভিন্ন ঐতিহাসিক এবং জীবনীকার কোন কোন ঘটনায় পদখলনের শিকার হয়েছেন। একই ঘটনা একাধিকরূপে চিত্রিত হয়েছে। ফলে তা হতে সত্য ও বাস্তব তথ্য আহরণ পাঠকের জন্য গলদঘর্মের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।…
এ উপন্যাসের প্রত্যেকটি ঘটনা সত্য-সঠিকরূপে পেশ করতে আমরা বহু গ্রন্থের সাহায্য নিয়েছি। সম্ভাব্য যাচাই-বাছাই করেছি এবং অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর তা লিখেছি।
যে ধাঁচে এ বীরত্বগাঁথা রচিত, তার আলোকে এটাকে কেউ উপন্যাস বললে বলতে পারে, কিন্তু এটা ফিল্মি স্টাইল এবং মনগড়া কাহিনী ভরপুর বাজারের অন্যান্য ঐতিহাসিক উপন্যাসের মত নয়। এর পাঠক উপন্যাসের চাটনিতে ‘ঐতিহাসিকতার পথ্য’ গলধঃকরণ করবেন গোগ্রাসে। এতে ঐতিহাসিকতা বেশী, ঔপন্যাসিকতা কম।
এটা কেবল ইতিহাস নয়, ইসলামী ঐতিহ্যের অবয়ব। মুসলমানদের ঈমানদীপ্ত ঝাণ্ডা। পূর্বপুরুষের গৌরব-গাঁথা এবং মুসলিম জাতির জিহাদী জযবার প্রকৃত চিত্র। পাঠক মুসলিম জাতির স্বকীয়তা জানবেন, সাহিত্যরস উপভোগ করবেন এবং রোমাঞ্চ অনুভব করবেন।
বাজারের প্রচলিত চরিত্রবিধ্বংসী উপন্যাসের পরিবর্তে সত্যনির্ভর এবং ইসলামী ঐতিহ্যজাত উপন্যাস পড়ুন। পরিবারের অপর সদস্যদের পড়তে দিন। নিকটজনদের হাতে হাতে তুলে দিন মুসলিম জাতির এ গৌরবময় উপাখ্যান।
এনায়েতুল্লাহ আলতামাশলাহোর, পাকিস্তান