২.৩ সন্ধ্যাবেলায় নূরজাহান

সেই যে সেদিনের সেই সন্ধ্যাবেলায় নূরজাহানকে এই বাড়িতে খুঁজতে এসেছিল দবির হামিদা সেই সন্ধ্যা থেকেই ঘুরেফিরে বহুকাল পিছনে ফেলে আসা একটা জীবনের কথা যখন তখন মনে পড়ে দেলোয়ারার। একজন মানুষের কথা মনে পড়ে।

সেই মানুষের নাম মজিদ, আবদুল মজিদ।

কতকাল আগের কথা! কতকাল আগে তাকে ছেড়ে চলে গেছেন সেই মানুষ। সৈয়দপুরের ওদিকে আরেক বিয়ে করে সংসার পেতেছেন, সেই সংসারের ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে গেছে। কিন্তু দেলোয়ারার সঙ্গে তালাক বলতে যা বোঝায় তা হয়নি। প্রকৃত অর্থে দেলোয়ারা এখনও তার বৈধ স্ত্রী। এই স্ত্রীর কাছে আর কখনও ফিরে আসেননি তিনি। পলকের তরেও আর দেখা হয়নি দুইজন মানুষের। আজ পঁয়ত্রিশ-চল্লিশ বছর।

সেদিনের পর থেকে এসব কথা খুব মনে পড়ে দেলোয়ারার। আবদুল মজিদ যে বেঁচে আছেন একথা জানেন তিনি। ঢাকায় বাসাবাড়ি নিয়ে থাকেন, পুরনা জীবনের কোনও কোনও মানুষের সঙ্গে পথেঘাটে কখনও কখনও দেখাসাক্ষাৎ হয়, দুই-চারটা কথা হয়, দুই-দশ বছরে সেসব কথা কখনও কখনও কানেও এসেছে দেলোয়ারার। শুনে কোনও কথা বলেননি তিনি, গোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেলেছেন।

কেন তাঁর সঙ্গে এমন করেছিলেন মানুষটি? কী দোষ ছিল তাঁর? কোন অপরাধে তার জীবন এমন তছনছ করে চলে গেলেন তিনি! নিজে ঠিকই গুছিয়ে নিলেন জীবন, দেলোয়ারাকে ঠেলে দিয়ে গেলেন বোনের সংসারে। পরের ঘরের সন্তানসন্ততিকে ঠিকই বুক দিয়ে আগলে বড় করলেন, শুধু প্রথম সন্তানটিকে ফেলে দিয়ে গেলেন মায়ের সঙ্গে। স্ত্রীর দিকে না হোক মেয়েটির দিকে তো ফিরে তাকাতে পারতেন! দূরে থেকেও তো কোনও না কোনওভাবে থাকতে পারতেন মেয়ের পাশে। অন্তত মেয়ের বিয়ের দিন তারও পরে কোনও না কোনওদিন তো এসে দাঁড়াতে পারতেন মেয়ের সামনে। মাফিনের জামাই ডালু হোসেন ভাল ছেলে। তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে খুবই সুখের জীবন এখন মাফিনের। মেয়ের জামাই কেমন হল, নাতি নাতকুড়রা কেমন হল, এইসব অছিলায়ও তো কোনও না কোনওদিন এসে দাঁড়াতে পারতেন মেয়ের সামনে। মেয়ে কি একটিও কটুকথা বলত তাকে। তেমন বেয়াদপ মেয়ে কি দেলোয়ারা জন্ম দিয়েছেন!

আজ গভীর রাতে ঘুম ভাঙার পর এসব কথা মনে পড়ল দেলোয়ারার।

ক’দিন ধরে রাত দুপুরে, ভোররাতে হঠাৎ হঠাই ঘুম ভেঙে যায় দেলোয়ারার। তারপর কিছুতেই আর ঘুম আসে না।

ভোররাতে ঘুম ভাঙলে ঘুম আর এলেও অসুবিধা নাই। খাটালে রাখা বালতিতে অজুর পানি থাকে। বদনা থাকে। উঠে অজু করে কেবিনে বসে ফজরের নামাজ পড়েন। তখনও ভোরের আলো ফোটে না। শেষ মাঘের ভোর থাকে কুয়াশায় মোড়া। কুয়াশা ভেঙে আলো আসতে সময় লাগে। নামাজ শেষ করার পরও অনেকটা সময় হাতে থাকে। দেলোয়ারার। সময়টা তিনি কোরান শরিফ পড়ে কাটান। রেহালের ওপর কোরান শরিফ রেখে, পাশে উসকে দেওয়া হারিকেন, হারিকেনের আলোয় পবিত্র কোরানের বাণী তাঁকে পৌঁছে দেয় অন্য এক জগতে। সেই ফাঁকে কখন ফুটে ওঠে দিনের আলো দেলোয়ারা টের পান না।

দুপুররাতে ঘুম ভাঙলে বড় কষ্ট। সময় কাটতেই চায় না। তখন মনে পড়ে জীবনের ফেলে আসা দিনের কথা। আবদুল মজিদের কথা।

আজও মনে পড়ল।

আবদুল মজিদ খুবই সুপুরুষ ছিলেন। লম্বা সুন্দর স্বাস্থ্য, গমগমে গলার আওয়াজ, মাথা ভরতি ঘন কোকড়া চুল, গোঁফদাড়ি নিখুঁতভাবে কামানো। চোখ যাত্রার নায়কদের মতো টানাটানা। সেই চোখে সহজে পলক পড়ত না। তার চোখের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যেত না। আবদুল মজিদের গায়ের রং ছিল কালোর দিকে। কথা বলতেন সুন্দর করে। কথার সঙ্গে মধুমাখা তো তাঁর ছিলই, আর ছিল মন ভুলানো হাসি। যে কারও সঙ্গে কথা বলার সময় ফাঁকে ফাঁকে ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করে বুঝিয়ে দিতেন তিনি খুবই শিক্ষিত মানুষ, অন্যের সঙ্গে তাঁর অনেক ব্যবধান। ময়মুরব্বিদের সঙ্গে কথা বলার সময় বিনয়ে গলে পড়তেন। আলতাবউদ্দিন সারেঙের ছোটমেয়ে দেলোয়ারার স্বামী হয়ে তিনি যখন মেন্দাবাড়িতে এসে উঠলেন, দশদিকের আত্মীয়স্বজন থেকে শুরু করে গ্রামের প্রায় সবাই আবদুল মজিদকে দেখে মুগ্ধ, তাঁর প্রশংসায় পঞ্চমুখ। সামনাসামনি দাঁড়িয়ে তো লোকে আর লোকের প্রশংসা করতে পারে না, সেটা শোভনও না, করতে হয় আড়ালে আবডালে। আরে ও মিয়া, হোনছো, জামাই পাইছে একখান মেন্দাবাড়ির বড় সারেঙে। চাম্পিয়ান। জামাই। আমাগো গেরামে এইরকম জামাই আর কেঐর নাই।

আবদুল মজিদের প্রশংসাও চলছিল এই ভাবেই, আড়ালে আবডালে।

আলতাবউদ্দিন সারেঙ তখন বেঁচে নাই, কয়েক বছর আগে গত হয়েছেন। গত হওয়ার আগে পাগল হয়ে গিয়েছিলেন। বদ্ধ না, আধাপাগল। দেলোয়ারার ছোট একটা ভাই ছিল, টগর। জ্বরে মাথায় বিকার হয়ে গেল। এক বিকালে কাজির পাগলার জলধর ডাক্তার এলেন দেখতে। কী একটা ইঞ্জেকশান দিলেন বিকার কমাবার জন্য। সেই ইঞ্জেকশানের পর টগরের শুধু হাই ওঠে, হাই ওঠে। ওই হাই ওঠা দেখে ডাক্তারি ব্যাগ হাতে অতিমোটা শরীর নিয়েও দ্রুত চলে গেলেন জলধর, ভিজিটও নিলেন না। তার কিছুক্ষণ পরই মায়ের কোলে মাথা রেখে গত হল টগর।

ভাইয়ের মৃত্যুর কথা বাবাকে গিয়ে বলেছিলেন আনোয়ারা। চিৎকার করে কাঁদছিলেন তিনি, বিলাপ করছিলেন, সেই বিলাপের ফাঁকেই বাগানের ছায়ায় হাতলআলা চেয়ারে বিকালবেলার আকাশের দিকে তাকিয়ে উদাস হয়ে বসে থাকা আলতাবউদ্দিন সারেঙকে আনোয়ারা বললেন, ও বাবা, বাবা, আপনে এহেনে বইয়া রইছেন আর ঐমিহি তো টগর মইরা গেছে!

হায় হায়! সব্বনাশ! টগর মইরা গেছে! বলে কয়েকবার বুক চাপড়ালেন তিনি, তারপর আবার উদাস হয়ে গেলেন।

এসবের কিছুদিন পর গত হলেন আলতাবউদ্দিন সারেঙ। জাহাজের চাকরিতে তাঁর একজন কর্মচারী ছিল, আলী আহম্মদ। ননায়াখালির লোক। আনোয়ারা দেলোয়ারার চেয়ে বয়সে বড়, এতই বাধুক আলতাবউদ্দিনের, আলতাবউদ্দিনকে ডাকত বাবা। আলতাবউদ্দিনও তাকে ছেলে হিসেবেই গ্রহণ করেছিলেন। বাড়ি এলে সঙ্গে নিয়ে আসতেন। বলতেন, আলী আহম্মদ আমার পোলা, পালক পোলা।

সেই পালক পোলা জাহাজ থেকে একবার আলতাবউদ্দিনের জমানো সবটাকা উধাও করে দিল আর খাবারের লগে কী কী সব মিশায়া দিল তাকে মেরে ফেলার জন্য। মারা আলতাবউদ্দিন গেলেন না, গেলেন পাগল হয়ে। সেই অবস্থায় বাড়ি এসে দিন কাটালেন কিছুদিন, বাগানের ছায়ায় বসে উদাস হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতেন, তারপর ছেলের মৃত্যুর কিছুদিন পর তিনিও ছেলের পথ ধরলেন।

সারেঙ নাই কিন্তু তাঁর নামডাকটা ছিল। সেই নামডাকের জোরে আবদুল মজিদের প্রশংসার লগে আলতাবউদ্দিন সারেঙের নামটাও উঠত। সারেঙ যেমন আলী আহম্মদকে ছেলে বানিয়েছিলেন আবদুল মজিদকে তেমন ছেলে বানিয়েছিলেন গ্রামের নিঃসঙ্গ ডাক্তার মনীন্দ্র ঠাকুর। হিন্দুর ঘরে মুসলমান ছেলে। ঠাকুর বলতেন, অর নামের লগেও আমার মিল আছে। বাপপোলার একরকমঐ নাম। আমি মনীন্দ্র ও মজিদ। দুইখান নামঐ শুরু হইছে ম দিয়া।

এই সুপুরুষ সুশীল, মানুষের প্রশংসা আর ভালবাসায় ডুবে থাকা মজিদের ভিতর ছিল আরেকজন মানুষ। বাইরের মানুষটির সঙ্গে তার কোন মিল নাই। আলী আহম্মদের মতো, উপরে এক ভিতরে আরেক। স্বার্থের কারণে হাতের মুঠায় বিষ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

দেলোয়ারার জন্য মজিদের সম্বন্ধ এনেছিল কামারগাঁওয়ের মতিউর, মতিউর রহমান। লতায় পাতায় দেলোয়ারাদের সে আত্মীয়। আলতাবউদ্দিন সারেঙের বেশ দূর সম্পর্কের ফুফাতো বোনের ছেলে। মজিদ ছিল মতিউরের বন্ধু। প্রস্তাবটা মতিউর দিয়েছিল তার মামা মন্তাজউদ্দিন শেখকে। মেন্দাবাড়ির পুব-দক্ষিণ কোণে মন্তাজউদ্দিনের এক ঘরের ছোট্ট বাড়ি। আগে জাহাজের ইঞ্জিন মিস্ত্রিরির হেলপার ছিলেন, ঘটনার কিছুদিন আগে স্ত্রীর প্ররোচনায় ওই কাজ ছেড়ে বাড়ি এসে গিরস্তি শুরু করেছেন। গোয়ালে দু’খানা দুধেল গাই গোরু, উত্তরের ভিটায় কাশের শুকনো পাতা আর পাটখড়ির চাল বেড়া দেওয়া। ছোট্ট রান্নাঘর। পশ্চিমের ভিটায় টিনের দোচালা ঘর, এক চিলতে উঠান আর একটি মাত্র ছেলে আমিনুল এই নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর সংসার মন্তাজউদ্দিনের। তখনও তার মেয়ে হামিদা জন্মায়নি। অতি বিনয়ী সরল আর ভাল মানুষ তিনি। মতিউরের প্রস্তাবের পর আগে মজিদের যত রকমের খোঁজখবর নেওয়া সম্ভব নিলেন। তারপর দেলোয়ারার মা আম্বিয়া খাতুনের কাছে গিয়ে এক বিকেলে পেশ করলেন, ভাবিছাব, দেলরার লেইগা একখান সমন্দ আনছি।

আম্বিয়া খাতুন ছোটখাটো একহারা গড়নের, তীক্ষ্ণবুদ্ধিসম্পন্ন, সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলা মানুষ। চিঠিপত্র লিখতে জানতেন, বাংলা পড়তে পারতেন। আলতাবউদ্দিন সারেঙের দ্বিতীয় স্ত্রী। মেন্দাবাড়ির বড় সারেঙের বউ হয়ে আসার সময় চামড়ায় বাঁধানো বিষাদ সিন্ধু’ বইখানা গভীর মমতায় বুকে জড়িয়ে নিয়ে এসেছিলেন। আজার সময়ে বইখানা। তিনি পড়তেন। বিষাদ সিন্ধু’র পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা মুখস্থ ছিল। কুমারভোগের খ-বাড়ির মেয়ে। বাবা আফজাল খাঁ পেশায় বনেদি দরজি। গ্রামের বাড়িতে স্ত্রীকে রেখে নিজে থাকতেন গাইবান্ধায়। ছয় মাসে-এক বছরে বাড়ি আসতেন। স্ত্রীর গর্ভে ছেলেমেয়ে আসত প্রায়ই, বাঁচত না। এসব কারণেই কি না কে জানে শেষ পর্যন্ত গাইবান্ধার পাট চুকিয়ে। গ্রামে ফিরে এসেছিলেন তিনি, মাওয়ার বাজারে দরজি দোকান খুলে বসেছিলেন। আশ্চর্য ব্যাপার তারপর তাঁর দুইটি ছেলেমেয়ে হল, আম্বিয়া আর আবেদীন, আল্লাহর রহমতে দুইজনেই তারা বেঁচে গেল।

এদিকে আলতাবউদ্দিন সারেঙের প্রথম বিয়ে হয়েছিল এই কুমারভোগ গ্রামেই। বিয়েতে তিনি একেবারেই রাজি ছিলেন না। কারণ পাত্রী তার পছন্দ ছিল না। তিনি নিজে সুন্দর পুরুষ। একটু মোটা ধাচের শরীর, গায়ের রং পাকা শবরিকলার মতো আর পাত্রী রীতিমতো কালো, অসুখে ধরনের রোগাপটকা শরীর, মুখে লাবণ্য নাই, হাসি নাই, যেন সারাক্ষণই দুনিয়ার ওপর বিরক্ত হয়ে আছেন। তবুও বিয়ে তাঁদের হয়েছিল, বছর দেড়েকের মাথায় একটি মেয়েও জন্মাল। সেই মেয়ের নাম আতবজান বিবি। দেলোয়ারারা ডাকে ‘আতবি বুজি’।

আতবজানের জন্মের বছর দুয়েকের মাথায় তার মা গলায় দড়ি দিল। হয়তো শরীরের ভিতরকার অচেনা অসুখ এবং স্বামীর অবহেলার কারণে বেঁচে থাকতে ভাল লাগেনি তার।

আলতাবউদ্দিন তখন জাহাজে। কলকাতা থেকে জাহাজ এসেছে নারায়ণগঞ্জে। সেখানে বসেই খবর পেলেন। তারপর সেই যে ময়মুরব্বিদের চাপে বিয়ে করে, স্ত্রীর সঙ্গে কয়েক রাত্রি কাটিয়ে সারেঙের কাজে গোয়ালন্দ ঘাটে গিয়ে জাহাজে চড়েছিলেন, এদিকে স্ত্রী গর্ভবতী হয়েছেন, যথা সময়ে একটি কন্যা সন্তান জন্ম দিয়েছেন, সেই কন্যা সন্তান হাঁটতে শিখে গেল, সব খবরই তিনি পেয়েছেন কিন্তু বাড়িমুখী আর হননি। না স্ত্রী না কন্যা কারও প্রতিই তার কোনও টান জন্মায়নি। কিন্তু মৃত্যু বলে কথা, তাও গলায় দড়ি দিয়ে মৃত্যু, আত্মহত্যা, তার ওপর ওইটুকু শিশুকন্যা ফেলে, এই ঘটনার পর যে মানুষের বুকের ভিতর সামান্যও মনুষত্ব আছে সে কেমন করে বাড়ি না ফিরে?

আলতাবউদ্দিনও ফিরেছিলেন। ফিরে দেখেন তাঁর মা-হারা কন্যা আহবজানকে পিতার স্নেহে বুকে তুলে নিয়েছেন মাজারো ভাই সালতাবউদ্দিন। আতবজানও সালতাবউদ্দিনকেই বাপ ডাকতে শুরু করেছে। দেখে তিনি শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিলেন।

বড়ভাইয়ের জন্য সালতাবউদ্দিনের ছিল বেজায় টান। ময়মুরব্বিদের চাপে বিয়ে করে ভাইয়ের জীবন ছেঁড়াভেড়া হয়ে গেছে ভেবে ভাইয়ের জীবন কেমন করে গুছিয়ে দেওয়া যায়, আতবজানকে কোলে নিয়ে প্রায়ই এসব ভাবতেন তিনি। তার নিজেরও ততদিনে সংসার হয়েছে। সংসারে দুইটি ছেলেমেয়ে, হাফিজুর রহমান, বাড়ির লোকে ডাকে হাবজা আর পরির মতো সুন্দর মেয়ে শাফিয়া খাতুন। আপন ছেলেমেয়ে তাঁর কাছে ভিড়তে সাহস পায় না কিন্তু আতবজান আছে তার পায়ে পায়ে। খেতখোলা দেখতে বিলবাওড়ে গেলেও আতবজানকে তিনি কোলে কাঁধে করে নিয়ে যান, মাওয়ার বাজারে ইলিশমাছ কিনতে গেলেও তার সঙ্গে আছে আতবজান।

কিন্তু বড়ভাইয়ের জীবন কেমন করে গুছিয়ে দেবেন সালতাবউদ্দিন, কেমন করে তাঁকে করবেন সংসারসুখী, এই চিন্তায় শেষ পর্যন্ত তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন ভাইকে আবার বিয়ে করাবেন। গোপনে মেয়ে দেখতে শুরু করলেন। খবর পেলেন কুমারভোগের আফজাল খা-র মেয়ে আম্বিয়া খাতুনের। আলতাবউদ্দিন নিজেও দেখলেন মেয়ে, পছন্দ হল। কিন্তু এই বাড়িতে মেয়ে বিয়ে দিতে চাইলেন না আফজাল খা। আলতাবউদ্দিন বিপত্নীক তাঁর একটা মেয়ে আছে সমস্যাটা এখানে না, সমস্যা হচ্ছে বাড়িটা। আফজাল খা জেনেছেন। বাড়িটা ছিল হিন্দুদের, জোরজবরদস্তি বাড়ি দখল করে সেখানে ঘরদুয়ার তুলে হিন্দুবাড়িকে মেন্দাবাড়ি করা হয়েছে। জবরদখলকারীদের কাছে মেয়ে বিয়ে দিবেন না তিনি।

কী করলে দিবেন?

আফজাল খা শর্ত দিলেন প্রকৃত মালিকের কাছে থেকে ন্যায্য দামে বাড়ি রেজিস্ট্রি করে নিতে হবে আর তাঁর মেয়েকে রাখতে হবে অতি সম্মানে, মেয়ে যা চাইবে তাই হবে। তার কোনও অমর্যাদা হতে পারবে না।

শর্ত মেনে নেওয়া হল। বাড়ির আসল মালিকের সঙ্গে সমঝোতা করে তাকে কিছু টাকাপয়সা দিয়ে লৌহজঙের সাব রেজিস্ট্রি অফিসে গিয়ে বাড়ি রেজিস্ট্রি করা হল আলতাবউদ্দিন সালতাবউদ্দিন আর ইন্তাজউদ্দিন এই তিন ভাইয়ের নামে। তারপর দ্বিতীয় বিয়ে হল আলতাবউদ্দিনের। আম্বিয়া খাতুন এই বাড়ির বড়বউ হয়ে এলেন। এসে নিজগুণে। স্বামী আর বাড়ির কর্তৃত্ব নিয়ে নিলেন নিজের হাতে। স্ত্রী প্রেমে মশগুল হয়ে গেলেন আলতাবউদ্দিন। আগে বছরের পর বছর যে মানুষ বাড়ি ফিরতেন না সেই মানুষই তারপর থেকে বছরে তিন মাস থাকেন বাড়িতে। একটার পর একটা সন্তান হতে লাগল তার। বেশির ভাগই আহুজ ঘরে মারা যেত। শেষ পর্যন্ত টিকল তিনজন, আনোয়ারা দেলোয়ারা আর টগর। সাত-আট বছর বয়সে টগরও চলে গেল।

স্বামী-সন্তানের শোক সামলেও নিজের মাথাটা ঠিক রাখতে পেরেছিলেন আম্বিয়া খাতুন, ব্যক্তিত্বটা ধরে রাখতে পেরেছিলেন। এজন্য মন্তাজউদ্দিনের প্রস্তাব শুনেই লাফিয়ে উঠলেন না। ধীর শান্ত গলায় বললেন, কোন গেরামের পোলা?

আম্বিয়া খাতুনের আচরণে মন্তাজউদ্দিন ধাক্কা খেলেন। তাঁর ধারণা ছিল মেয়ের জন্য সম্বন্ধ এসেছে শুনে ভাবিছাব একেবারে লাফিয়ে উঠবেন। কাছেপিঠে যাকেই পাবেন তাকেই ডেকে বলবেন, তাড়াতাড়ি জলচকি আন। ছোডমিয়ারে বইতে দে। তারপর একথাল মুড়ি দিবেন, বাড়িতে তৈরি নারকেল কোরা মিশানো অতি স্বাদের খাজুইড়া মিঠাই (খেজুরে গুড়) দিবেন মুঠ পরিমাণ। গুড় না থাকলে নারকেলের তোয়াক (রসের তৈরি ঝোলাগুড়) দিবেন মুড়ির ওপর ছড়িয়ে। জলচৌকিতে বসে আরামসে সেই মজাদার জিনিস খেতে খেতে পাত্রের নাড়িনক্ষত্রের হিসাব দিবেন মন্তাজউদ্দিন আর সেই ফাঁকে ভাবিছাব নিজ হাতে, অতিযত্নে তার জন্য তৈরি করবেন আগিলা দিনের মগের মতো কাঁচের কাপের এককাপ দুধ চা। কী স্বাদ সেই চায়ের দুধের পুরু সর ভাসে চায়ের উপর। মুখে দিলে মনে হয় এই জীবনে এত স্বাদের জিনিস আর কখনও খাওয়া হয়নি, হবেও না কোনওদিন।

মানুষ ভাবে এক, হয় আরেক।

দেলোয়ারার বিয়া নিয়ে ভাল রকমের উৎকণ্ঠায় আছেন আম্বিয়া খাতুন। বড়মেয়ে আনোয়ারার বিয়ের ঘটকালি করেছিল কাজির পাগলার মেছের ঘটক। সেই লোকটাকে লাগানো হয়েছে দেলোয়ারার জন্য পাত্র খুঁজে বের করবার কাজে। বেশ কয়েক মাস ধরে বিক্রমপুরের গ্রামে গ্রামে পাত্র খুঁজে বেড়াচ্ছে সে, আসতে যেতে টাকাপয়সা নিচ্ছে, কিন্তু উপযুক্ত পাত্রের সন্ধান পাচ্ছে না, এসব কথা মন্তাজউদ্দিন জানতেন। জানতেন বলেই তার ধারণা হয়েছিল সম্বন্ধর কথা শুনে আম্বিয়া খাতুন পাগল হয়ে যাবেন। মন্তাজউদ্দিনের জন্য কী রেখে কী করবেন দিশা পাবেন না।

তখন বসন্তকাল। ফাল্গুন মাসের মন কেমন করা বিকালবেলা। আনোয়ারা স্বামী সন্তান নিয়ে দেশে এসেছে বেড়াতে। দুপুরের ভাত খেয়ে গিয়াসউদ্দিন সাহেব চলে যান ফুফাতো সম্বন্ধী দলিল মন্নাফ সাত্তার জলিলদের সঙ্গে আড্ডা দিতে। এনামুল এই এত্তটুকু। বাড়ির অন্যান্য শরিকের পোলাপান ছানা সেন্টু রব মোতালেব তালেব জাহাঙ্গির এনামুলের বয়সের কাছাকাছি, তাদের সঙ্গে এনামুল চলে যায় খাইগোবাড়ির মাঠে ফুটবল খেলা দেখতে। কখনও কখনও পুরানবাড়ির মাঠেও ফুটবল খেলা হয়। এই বাড়ির গনি হামিদ ননী আর আলতাবউদ্দিনের প্রথম পক্ষের মেয়ে আতবজানের তিন ছেলে সেরু জহু নজু, সমেদ খাঁ-র নাতি আইয়ূব এই ক’জন মিলে ফুটবল খেলে। এনামুলরা এই খেলাও দেখে কোনও কোনওদিন। আবার নিজেরাও পুরনা ত্যানা প্যাচিয়ে প্যাচিয়ে ফুটবল বানিয়ে সেই ফুটবল নিয়ে ছুটাছুটি করে পুরানবাড়ির মাঠে। আনোয়ারার মেয়ে আকতার তখন বেশ ছোট আর মিলু তখনও কোলে। আকতারের বয়সি আনোয়ারার ছোটচাচা ইন্তাজউদ্দিনের মেয়ে ভানু। দুইজনে খুব ভাব। সারাক্ষণ গলাগলি করে আছে।

সেই বিকালে নিমতলার জোড়াচুলার পারে আমকাঠের সিঁড়ি পেতে বসেছিলেন আম্বিয়া খাতুন। মেয়ের জামাইকে তিনি ডাকেন খোকার বাপ। খোকার বাপ বিবিখানা পিঠা খুবই পছন্দ করেন। দুই চুলায় দুই খান বিবিখানা পিঠা বসিয়েছেন তিনি। বড়ঘরের দক্ষিণের ছেমায় পিঁড়ি পেতে বসেছে আনোয়ারা, তার পিঠের কাছে বসে হাফেজের বউ বিলি কেটে কেটে মাথা থেকে উকুন এনে মারছে। উকুন ধরার জন্য দুউ আঙুলের নখে একটা করে ঠোকর দেয় হাফেজের বউ আর সেই ঠোকরে আনোয়ারার চোখের ঢুলুঢুলু ভাব কেটে যায়।

দেলোয়ারা ছিল বাগানে। তার কোলে তখনও পর্যন্ত আনোয়ারার ছোটছেলে মিলু। মিলুকে খুবই ভালবাসে দেলোয়ারা। সেই বিকালে ছেলেটাকে নিয়ে নানারকম আদর সোহাগ করছিল সে। আর সেই ফাঁকে নিমতলার চুলারপারে তার বিয়ের কথা বলছিল মন্তাজউদ্দিন। পোলার বাড়ি ভাবিছাব কামারগাঁও।

পুরানবাড়ির ফতির মা এসে কিছুদিন ধরে থাকছে এই বাড়িতে। আম্বিয়া খাতুনের ফুটফরমাশ খাটে, বিনিময়ে তিনবেলার খাওয়া থাকা আর কখনও কখনও একখানা পুরনো শাড়ি। বড়ঘর থেকে কী কাজে বাইরে এসেছে সে, এসে দেখে মন্তাজউদ্দিন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। দেখে নিজ গরজেই জলচৌকি এনে দিয়েছে।

জলচৌকি দেখেও সহজে বসতে পারছিলেন না মন্তাজউদ্দিন। ভাবিছাব না বললে বসেন কী করে!

আম্বিয়া খাতুন বিবিখানা পিঠা নিয়ে ব্যস্ত। তবু এক ফাঁকে চোখ তুলে তাকালেন মন্তাজউদ্দিনের দিকে। আগের মতোই ধীর শান্ত গলায় বললেন, বহো।

মন্তাজউদ্দিন বিগলিত ভঙ্গিতে বসল। হাসিহাসি মুখ করে বলল, কামারগাঁওয়ের পোলা। আমাগো মতিউরের দোস্ত। দুই বছর আগে দোস্তালি পাতাইছে।

পোলাগো জাতবংশ কেমুন?

ভাল, বহুত ভাল। নামকরা বংশের পোলা। তয় এতিম। বাপ-মা কেঐ নাই। তিনভাই। বইন। বড় বইনের বিয়া অইছে হাতারপাড়া। ছোড ভাইডার নাম হামেদ আর পোলার নাম মজিদ। আবদুল মজিদ।

চিন্তিত চোখে মন্তাজউদ্দিনের দিকে তাকালেন আম্বিয়া খাতুন। বাপ মা নাই, বইনের বিয়া অইয়া গেছে, পোলাগ সংসার তাইলে চলে কেমতে?

মন্তাজউদ্দিন তার স্বভাবসুলভ হাসিমুখে বললেন, আপনের লগে মিছাকথা আমি কমুনা। বিয়াশাদির সমন্দে একখান মিছাকথা কইলে হেই একখান মিছা ঢাকতে দশখান মিছা কইতে অয়। তার বাদেও চাইপা রাখন যায় না কিছু। মিছা একদিন ধরা পড়েই।

হ মূইল্যবান কথা কইছো।

পোলাগ ভাবিছাব বাড়িঘর সংসারমংসার কিছু নাই। আত্মীয়স্বজনও নাই। এক বাইত্তে জাইগির থাইক্কা মেট্রিক পাশ করছে। ছোডভাই থাকে আরেক বাইত্তে। হেই ভাইও মনেঅয় লেখাপড়া করে। মজিদ ছাত্র ভাল। দেখতে শোনতে ভাল। লেখাপড়ার বেদম ইচ্ছা। ঢাকায় থাইক্কা কলেজে পড়তে চায়। যে অর পড়ার খরচা চালাইবো হেই বাইতে বিয়া করবো। মাইয়া বোবা কানা অইলেও আপিত্তি নাই। আল্লার রহমতে আমাগো দেলরা তো বোবাও না, কানাও না। মেন্দাবাড়ির রূপবতী মাইয়া। আর আপনে অইলেন লেখাপড়ার সমজদার। এতিম মিসকিন পোলা অইলে আপিত্তি নাই আপনের। আপনি খালি চান পোলাডা দেকতে ভাল আর বিদ্যান। আনোরার জামাইও তো অমুন। এতিম। দুইন্নাইতে কেঐ নাই। দেকতে ভাল আর মেট্রিক পাশ। এর লেইগাঐ মাইয়া বিয়া দিয়া জামাই আপনে এই বাইত্তে লইয়াইছেন। মজিদরেও এমনেঐ লইয়াহেন। দুই মাইয়ার দুই জামাইঐ ঘরজামাই।

মন্তাজউদ্দিনের কথা মনে ধরল আম্বিয়া খাতুনের। মন্তাজউদ্দিনের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে তিনি বললেন, কথা বুজলাম। তয় আমার অইলো এক কথা। আগে পোলা দেহান লাগবো আমারে। পোলা দেইক্কা যুদি পছন্দ হয় তাইলে আর কথা নাই। ঢাকায় রাইক্কা কলেজে তারে আমি পড়ামু। কোনও অসুবিদা নাই। তুমি খালি পোলাডারে লইয়াহো। আমারে দেহাও।

একথা শুনে ফুর্তিতে আর বাঁচেন না মন্তাজউদ্দিন। জলচৌকি ফেলে লাফিয়ে উঠলেন। থালভরতি মুড়ি, নারকেল কোরা মিশানো অতি স্বাদের খেজুরে গুড় আর দুধের সর ভাসানো চা কোনওটাই যে জোটেনি সেই দুঃখের কথা ভুলে গেলেন। উচ্ছ্বসিত গলায় বললেন, কাইলঐ মতিউররে আমি খবর দিতাছি। দুই-চাইর দিনের মইদ্যেঐ মজিদরে লইয়াইতে কইতাছি।

তিনদিনের দিন দুপুরের পর মজিদকে এনে হাজির করলেন মন্তাজউদ্দিন। সঙ্গে মতিউর ছাড়াও আছে মজিদের আরেকজন দোস্ত, মোস্তফা।

আম্বিয়া খাতুন মজিদকে দেখে মুগ্ধ। বাড়ির সবার অবস্থাও আম্বিয়া খাতুনের মতোই। আনোয়ারাও পছন্দ করলেন মজিদকে, কিন্তু তার স্বামী গিয়াসউদ্দিন সাহেব কোনও কথা বললেন না।

বাড়ির মহিলারাও আড়াল আবডাল থেকে দেখছিল মজিদকে। চোখে মুখে মুগ্ধতা সবার। হাসিহাসি মুখে এ ওর সঙ্গে হাকিকি করছে। মজিদকে নিয়ে আলোচনার জন্য বিভিন্ন বয়সির বিভিন্ন দল হয়েছে। আম্বিয়া খাতুনের পাশে আছেন তাঁর দুই জা, পাশের বাড়ি থেকে এসেছেন আমিনুলের মা, তিনি আছেন দেলোয়ারার সঙ্গে। আনোয়ারাও আছে দেলোয়ারার পাশে, তার পাশে আছে হাফেজের বউ। আকতার আর ভানু গলাগলি করে হাঁটছে বারবাড়ির দিকে। গনি হামিদ ননী আছে একদলে, তাদের সঙ্গে আছে সেরু জহু। নজু। রব মোতালেব তালেব, ছানা সেন্টু জাহাঙ্গির ওদের সঙ্গে আছে এনামুল। মিলুকে কোলে নিয়ে ঘুরছে ফতির মা। দলিল মন্নাফেরা আছে গিয়াসউদ্দিন সাহেবের পাশে। মনীন্দ্র ঠাকুর এসেছেন, পুরানবাড়ির নোয়াব আলী এসেছেন, সব মিলে জমজমাট অবস্থা।

মজিদের সঙ্গে কথাবার্তা যা বলার মনীন্দ্র ঠাকুরই বলছিলেন। কথায় পটু লোক তিনি। নানারকম মারপ্যাঁচ দিয়ে কথা বলছিলেন। মজিদের ওই এক কথা, আমি লেখাপড়া করতে চাই, বিএ এমএ পাশ করতে চাই। এ ছাড়া জীবনে আমার কিছু চাওয়ার নাই। আপনারা আমার লেখাপড়ার দায়িত্ব নিলে বিয়ে করতে আপত্তি নেই। মেয়েও দেখতে চাই না।

মজিদের পরিষ্কার কথা শুনে আম্বিয়া খাতুনের দিকে তাকালেন মনীন্দ্র। আম্বিয়া খাতুন চোখ ইশারা করলেন। অর্থাৎ তিনি রাজি। মনীন্দ্র তবু কথার প্যাঁচটা ছাড়লেন না, চালিয়েই গেলেন। ঠিক আছে তোমার লেখাপড়ার দায়িত্ব আমরা নিমু। তুমি তোমার গার্জিয়ানগো লইয়া আসো। তাগো লগে কথাবার্তা কই।

এক পলক মনীন্দ্রর দিকে তাকিয়েই চোখ নামিয়ে নিল মজিদ। আমার কোনও গার্জিয়ান নাই। আমি আমার গার্জিয়ান।

তোমার যে তেমুন কোনও আত্মীয়স্বজন নাই সেই খবর আমরা পাইছি। তয় তোমার তো বড় বইন আছে, বইনজামাই আছে তাগো নিয়াসো।

না তাগোও আমি আনতে চাই না।

ক্যা? অসুবিদা কী?

আমার ব্যাপারে অন্যের চিন্তা ভাবনা আমি ডিজলাইক করি।

ডিজলাইক কথাটা অনেকে বুঝল না। মনীন্দ্র ঠাকুর হাসিমুখে শব্দের অর্থটা বুঝিয়ে দিলেন। তারপর আবার মজিদকে নিয়ে পড়লেন। গার্জিয়ান ছাড়া মাইয়া তোমার কাছে আমরা কেমতে দেই, কও?

মাইয়া তো আপনেরা দিতাছেন না। মাইয়া এই বাইত্তে থাকবো। আমি আমার স্টাডির লেইগা চইলা যামু ঢাকায়। মাঝে মাঝে শ্বশুরবাড়িতে আসবো।

মজিদের এই ধরনের কথা অনেকের কাছেই ভাল লাগছিল না। একে নিজের বিয়ের সব কথা নিজেই বলছে তার ওপর শ্বশুরবাড়িতে থাকাটাকা ইত্যাদি কেমন যেন শোনাচ্ছিল। এই ধরনের কথা সবচেয়ে অপছন্দ গিয়াসউদ্দিন সাহেবের। তিনি খুবই চাপা স্বভাবের মানুষ। তবে তাঁর মুখে বিরক্তির ছাপ ফুটে উঠেছে। দলিল মন্নাফের পাশ থেকে নিঃশব্দে উঠে বাগানের দিকে চলে গেলেন তিনি। স্বামীকে ওভাবে চলে যেতে দেখে আনোয়ারা ব্যাপারটা বুঝলেন। তিনিও গেলেন পিছু পিছু। গিয়াসউদ্দিন সাহেবের তামাক খাওয়ার অভ্যাস। আনোয়ারা তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনেরে তামুক সাইজ্জা দিমু?

গিয়াসউদ্দিন সাহেব বিরক্ত মুখে বললেন, দেও।

আনোয়ারা তামাক নিয়ে আসার পর স্ত্রীকে বললেন, এমুন একখান বেদ্দপের কাছে মাইয়া বিয়া দেওনের লেইগা আম্মায় পাগল হইয়া গেছে ক্যা? তোমার বইনের কি বিয়া অইবো না?

আনোয়ারা বললেন, যার মাইয়া হেয় যুদি দিতে চায় আমগো অসুবিদা কী? দেউক।

অসুবিদা আছে।

কীয়ের অসুবিদা?

বেদ্দপটা আমার ভায়রা অইবো।

তখনই ফতির মা এসে ডাকল আনোয়ারাকে। ওই আনোরা, তর মায় তরে ডাক পাড়ে। জামাইরেও যাইতে কয়।

হুঁকা রেখে তারা বড়ঘরে গিয়ে ঢুকেছে। মজিদের সঙ্গে দেলোয়ারার বিয়ে ততক্ষণে পাকা। কাল দুপুরে বিয়ে হবে। মজিদ তার দুই বন্ধুসহ এই বাড়িতেই থাকবে আজ। কাল দুপুরে বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর কয়েকদিন এই বাড়িতে থেকে ঢাকা যাবে কলেজে পড়তে।

বেশ একটা সাজ সাজ রব পড়ল বাড়িতে। বিয়ের আয়োজনে যে যার মতো ব্যস্ত হল। মাওয়ার বাজারে গিয়ে সেই রাতেই হ্যাঁজাগবাতি নিয়ে এল গনি হামিদ ননী। সেরু জহু খাসি কিনে আনল দোগাছির এক গিরস্ত বাড়ি থেকে। মশলা বাটতে বসে গেল বাড়ির মহিলারা। হাজামবাড়ির অজুফা এসে বসল পিঁয়াজ কাটতে। মনীন্দ্র ঠাকুর কাজির পাগলা থেকে মাইক নিয়ে এলেন গানবাজনার জন্য। কিছু বমও আনলেন। রব মোতালেবরা ঠাসঠুস করে ফোঁটাতে লাগল সেইসব বম। হ্যাঁজাগের শো শো শব্দ আর ফকফকা সাদা। আলোয় মেন্দাবাড়ির চেহারা বদলে গেল।

এসবের মধ্যে কেবল বিষণ্ণ হয়ে আছেন একজন, গিয়াসউদ্দিন সাহেব। মজিদকে তাঁর পছন্দ হয়নি। একমাত্র শালির এরকম বিয়ে তার ভাল লাগছে না। সারারাত হ্যাঁজাগবাতির পাশে বসে মাইকে ‘নিমাই সন্ন্যাসীর পালা’ শুনলেন চুপচাপ আর মাঝে মাঝে নিজেই সাজিয়ে তামাক খেলেন। তারপর সকালবেলা ব্যাগ হাতে আম্বিয়া খাতুনের সামনে গিয়ে। দাঁড়ালেন। আমার যে ঢাকা যাইতে অয় আম্মা!

আম্বিয়া খাতুন চমকে উঠলেন। কন কী খোকার বাপ? দেলরার বিয়া আর আপনে যাইবেন ঢাকা!

হ যাইতে অইবো। ছুটি শ্যাষ। আউজকা গিয়া জয়েন না করলে চাকরি থাকবো না।

আউজকা গিয়া কেমতে জয়েন করবেন? অহন মাওয়ার ঘাট থিকা লঞ্চে উটলে ঢাকা গিয়া নামবেন বিয়ালে। অফিসে যাইবেন কুনসুম?

অফিসে যামু কাউলকা।

এইডা কোনও কথা অইলো?

কী করুম, এইডা ছাড়া উপায় নাই। চাকরি নষ্ট করতে পারুম না। আর আমি না থাকলেঐ কী? বেবাকতেঐত্তো আছে।

তারপরও নানারকমভাবে জামাইকে আটকাতে চেয়েছেন আম্বিয়া খাতুন, মেয়েকে বলেছেন জামাইকে ফিরাতে, দেলোয়ারাকে বলেছেন দুলাভাইকে ফিরাতে। কেউ পারেনি। আম্বিয়া খাতুনকে কদমবুসি করে মন্তাজউদ্দিনের বাড়ির ওপর দিয়ে পুবদিককার হালটে গিয়ে উঠলেন গিয়াসউদ্দিন সাহেব। এখান থেকে পায়ে হেঁটে মাওয়া, মাওয়া থেকে লঞ্চে ঢাকা।

স্বামীর পিছু পিছু হালট পর্যন্ত এসেছিলেন আনোয়ারা। নানারকম ভাবে বোঝাতে চেষ্টা করেছেন তাঁকে। এইডা আপনের ঠিক অইতাছে না। মাইনষে কইবো কী? জামাই আপনের পছন্দ অয় নাই, ঠিক আছে। বিয়াশাদি মাইনষের ভাইগ্যের ব্যাপার। যার ভাইগ্যে যেহানে আছে ওহানেই বিয়া অইবো। আপনে যে এইডা মাইন্না নিতাছেন না হেইডা মাইনষেরে বুজানের কাম কী? আইজ বিয়া অইয়া যাউক, আপনে কাইল যান।

স্ত্রীর কথা তোয়াক্কাই করলেন না গিয়াসউদ্দিন সাহেব। ফিরেও তাকালেন না। পা চালিয়ে মাওয়ার দিকে হাঁটতে লাগলেন।

আনোয়ারার তখন চোখ ভেসে যাচ্ছে। আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে তিনি দেখলেন হজরতদের বাড়ির সামনের খালের ওপরকার ভাঙাচোরা বাঁশের সাঁকোয় চড়েছেন গিয়াসউদ্দিন সাহেব। টলমল পায়ে সাঁকো পেরিয়ে যাচ্ছেন।

বিয়েতে গিয়াসউদ্দিন সাহেব থাকলেন না ঠিকই কিন্তু বিয়ে দেলোয়ারার হল ব্যাপক ধুমধাম করে। আর সেই যে বিয়ের আগের দিন মতিউর আর মোস্তফাঁকে নিয়ে এই বাড়িতে এসে উঠলেন আবদুল মজিদ, বন্ধুকে বিয়ে করিয়ে মতিউর মোস্তফা বিয়ের দুইদিন পর ঠিকই যে যার বাড়িতে ফিরে গেল আবদুল মজিদ আর কোথাও গেলেন না। এই বাড়িতেই থান গেড়ে বসলেন।

যাবেনই বা কোথায়? যাওয়ার জায়গা বলে কিছুই ছিল না তার। যে বাড়িতে জাইগির থেকে পড়তেন সেই বাড়িতে যাওয়ার কারণ ছিল না। বড়বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। সে থাকে তার শ্বশুরবাড়ি হাতারপাড়া গ্রামে। অবস্থা ভাল। তবে ছোট দুই ভাইয়ের খবর সে রাখে না। মজিদ তো বিয়েশাদি করে পায়ের তলায় শক্তমাটি পেয়ে গেল। কিন্তু ছোটভাই হামেদ!

কামারগাঁও না ভাগ্যকুল কোন গ্রামে যেন স্বচ্ছল এক গৃহস্থ বাড়িতে কাজ করত মজিদের ছোটভাই আবদুল হামেদ। কাজ করত আর স্কুলে পড়ত। একবার দেলোয়ারাদের বাড়িতে সে এসেওছিল। সেই আসাটা ছিল এক আশ্চর্য যোগাযোগ। যে বাড়িতে সে কাজ করত সেই বাড়ির কারও খুব অসুখ হয়েছিল। অসুখের কথা বলে ওষুদ নিতে অতদূর গ্রাম থেকে হামেদকে তারা পাঠিয়েছিল মনীন্দ্র ঠাকুরের কাছে। হামেদের পরনে ছিল ঢলঢলা একটা। হাফপ্যান্ট আর ছেঁড়া ময়লা নোংরা স্যান্ডো গেঞ্জি। মনীন্দ্র ঠাকুরের ঘরে ঢুকে ওষুদের আশায় বেঞ্চে বসেছিল। মনীন্দ্র ঠাকুরের স্বভাব ছিল অচেনা মানুষের সঙ্গে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে কথা বলা। অসুখের কথা জানার ফাঁকে ফাঁকে হামেদের কথাও জানার চেষ্টা করছিলেন। তিনি।

কথায় কথায় হামেদ বলে ফেলল এই গ্রামে তার ভাইয়ের শ্বশুরবাড়ি। শুনে তীক্ষ্ণচোখে ছেলেটির মুখের দিকে তাকিয়েছেন ঠাকুর। তাকিয়ে দেখতে পেলেন মজিদের সঙ্গে চেহারার খুব মিল। যা বোঝার বুঝে গেলেন। রোগীর ওষুধ না দিয়ে হামেদকে নিয়ে এলেন দেলোয়ারাদের বাড়ি।

তখন পড়ন্ত বিকাল। শ্বশুরবাড়ির বড়ঘরের বারান্দায় চেয়ারে বসে মজিদ তখন শাশুড়ির রান্না করা মুরগির রান খাচ্ছিলেন। মনীন্দ্র ঠাকুরের সঙ্গে হামেদকে দেখে খুবই বিরক্ত হলেন। আপন ছোট ভাইর সঙ্গে ব্যবহারটা করলেন এমন যেন সে কোনও মানুষই না, সে যেন কুত্তা বিলাই। মজিদের ব্যবহারে হামেদ অসহায় ভঙ্গিতে মাথা নিচু করে রইল আর মনীন্দ্র ঠাকুর এবং আম্বিয়া খাতুন রইলেন হতবাক হয়ে।

তারপরও দুইদিন এই বাড়িতে হামেদকে রেখে দিয়েছিলেন আম্বিয়া খাতুন। মাওয়ার বাজার থেকে নতুন হাফপ্যান্ট আর শার্ট কিনে এনে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন হামেদও তার ভাইর সঙ্গে এই বাড়িতে থেকে যাক। থাকতে হামেদ রাজিও হল। তবে যে বাড়িতে সে থাকে সেই বাড়িতে ওষুদটা পৌঁছে দিয়ে আসতে হবে আর তাদেরকে বলে আসতে হবে।

সেই যে ওষুধ পৌঁছাতে আর বলে আসতে গেল হামেদ, ইহজনমে আর মেদিনীমণ্ডল গ্রামে ফিরল না। নিশ্চয় ভাইয়ের ব্যবহারে বুকটা পুড়ে তার কয়লা হয়ে গিয়েছিল। গিরস্ত বাড়ির রাখাল হয়ে থাকা ভাল, তবু এরকম ভাইয়ের মুখ দেখা উচিত না।

আর মজিদের বড়বোনের ক্ষেত্রে ঘটেছিল অন্য ঘটনা। সেই বোন জানতই না মজিদ এভাবে বিয়ে করেছে। আত্মীয়স্বজনরাও কেউ জানত না। এসব ঘটনা দেলোয়ারাদের কানে। এল বিয়ের অনেকদিন পর। ততদিনে মজিদ ঢাকায় গিয়ে কায়দে আজম কলেজে ভরতি হয়ে গেছে। হস্টেলে থাকে। তবে কলেজ সে করেই না, শ্বশুরবাড়িতে এসে পড়ে থাকে। গনি হামিদ ননীর সঙ্গে দুস্তি, সেরু জহু নজুও আছে। পুরানবাড়ির খবির দবির আছে। সমবয়সিদের নিয়ে নাটক ফাংশান করে মজিদ। খানবাড়ির ছেলেরা ‘প্যারাডাইস ক্লাব’ করল দেখে দেলোয়ারাদের বাড়িতে সে করল ‘মুকুল সমিতি’। মুকুল সমিতির উপদেষ্টা আবদুল মজিদ নিজে আর সাধারণ সম্পাদক মোশারফ হোসেন গনি।

মুকুল সমিতি প্রতিষ্ঠার দিনটি এখনও স্পষ্ট মনে আছে দেলোয়ারার। ২৭ মার্চ ১৯৫৭ সাল। সেদিন পুরানবাড়ির মাঠে উদ্বোধনী সভার আয়োজন হল। প্রধান অতিথি শেখ মুজিবুর রহমান। সব ব্যবস্থা মজিদই করলেন। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান সাহেব আসতে পারলেন না। যুক্তফ্রন্টের আমল। কী কাজে শেখ সাহেব গেছেন করাচিতে। তার জায়গায় অতিথি হয়ে এলেন কোরবান আলী সাহেব। গ্রামে সাড়া পড়ে গেল।

এসব পছন্দ করছিলেন না আম্বিয়া খাতুন। দেলোয়ারারও ভাল লাগছিল না। তাঁরা চাইছিলেন যে কথা বলে বিয়ে করেছেন মজিদ সেই কাজটাই তিনি ঠিকঠাক মতন করুন। পড়াশুনা। মাঝেমধ্যে এসব নিয়ে মজিদের সঙ্গে কথাও বলতেন আম্বিয়া খাতুন, দেলোয়ারাও বলতেন। কিন্তু কারও কথাই তেমন পাত্তা দিতেন না মজিদ। গিয়াসউদ্দিন সাহেবের সঙ্গেও ততদিনে সম্পর্ক সুন্দর করে নিয়েছেন মজিদ। মিষ্টি করে দুলাভাই ডাকেন। তাঁকে, আনোয়ারাকে ডাকেন আপা। গিয়াসউদ্দিন সাহেবের ছেলেমেয়েরা মজিদকে খালু ডাকে না, ডাকে মামা। মজিদ মামা। গিয়াসউদ্দিন সাহেবের মেজোছেলে মিলুকে খুবই আদর করেন মজিদ। ঢাকায় থাকা অবস্থায় মিলুর টানে হস্টেল ফেলে কখনও কখনও জিন্দাবাহারের ওই একরুমের বাসায় গিয়েও অনেকদিন থেকেছেন।

এসবের ফাঁকে হাতারপাড়ার সেই বোনের বাড়িতে একবার যেতে হয়েছিল দেলোয়ারাকে। দুইদিন থাকতে হয়েছিল স্বামীর বড়বোনের বাড়িতে। বোন পালকি পাঠিয়েছিলেন। ছোটভাইর বউর জন্য যা যা করার সব করেছিলেন। বেদম স্নেহমমতা, আদরযত্ন।

আজও পরিষ্কার মনে আছে সেই দুইটা দিনের কথা। শ্বশুরবাড়ি বলতে যা বোঝায়, পালকি চড়ে প্রকৃত শ্বশুরবাড়িতে কখনও যাওয়া হয়নি দেলোয়ারার, যাওয়া হয়েছিল ননাসের বাড়িতে। সেই যাওয়াই সারাজীবনের স্মৃতি হয়ে আছে দেলোয়ারার। এত দুঃখময় জীবনের পরও সেই দুইটা দিনের কথা ভেবে এখনও অভিভূত হন তিনি। এখনও মনটা অন্যরকম হয়।

বিএ পড়ার আগ থেকেই মজিদ ঝুঁকে গিয়েছিলেন ছাত্র রাজনীতির দিকে। হস্টেলের এক বন্ধুর সঙ্গে একবার কী এক গন্ডগোল হল। বন্ধু তাঁর নামে কেস দিল ঢাকার কোতোয়ালি থানায়। ষোলো-সতেরো দিন জেল খেটে এলেন মজিদ। সেই সময় গিয়াসউদ্দিন সাহেব একদিন ছোট্ট মিলুকে নিয়ে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে গেলেন ভায়রাকে দেখতে। জেলের গরাদ ধরে এমন কান্না কাঁদলেন মজিদ, এমন অনুরোধ করলেন গিয়াসউদ্দিন সাহেবকে, যেমন করে থোক জেল থেকে যেন তাকে ছাড়ানো হয়।

ইস, কী উৎকণ্ঠার দিন সেইসব। জেল থেকে আসামি ছাড়াবার জন্য যে যা বলছে তাই শুনছেন আম্বিয়া খাতুন, তাই শুনছেন আনোয়ারা দেলোয়ারা। টাকাপয়সা যেখানে যা ছিল নিয়ে আম্বিয়া খাতুন ঢাকায় এসে বসেই রইলেন ছোট জামাইকে ছাড়াবার জন্য।

সেই ফাঁকে এক দুপুরে পাশের ঘরের তালেব আলী পুলিশ বিশটা টাকা খেয়ে ফেলল আম্বিয়া খাতুনের। পুলিশের পোশাক পরে ডিউটি থেকে ফিরে আচমকা বলল, কোন এক বড় সাহেবকে এখনই গিয়ে নগদ বিশটাকা ধরিয়ে দিলে আজ বিকালেই মজিদ ছাড়া পেয়ে যাবে।

গিয়াসউদ্দিন সাহেব তখন অফিসে।

আম্বিয়া খাতুন সরল বিশ্বাসে বিশটাকা দিয়ে দিলেন। অফিস থেকে ফিরে কথাটা শুনে ওই উৎকার দিনেও হাসলেন গিয়াসউদ্দিন সাহেব। শাশুড়িকে বললেন, টাকা কুড়িটা পানিতে গেছে।

হলও তাই। সন্ধ্যাবেলা বাসায় ফিরে তালেব আলী বলল, টাকা খেয়ে চেষ্টাটা সাহেব ঠিকই করেছেন কিন্তু কাজ হয়নি।

সবাই বুঝল টাকাটা আসলে তালেব আলী নিজেই খেয়েছে।

আজ রাতে এসব কথা একটার পর একটা মনে পড়ছিল দেলোয়ারার।

এখন কত রাত কে জানে! দেলোয়ারা শুয়ে আছেন কেবিনে, লেপের তলায়। তার পায়ের দিকে দুইখানা আলমারি। একটা মাঝারি সাইজের আর একটা ছোট। কারে ওঠার সিঁড়ির কাছে টিমটিম করে জ্বলছে হারিকেন। ম্লান একখানা আলো ফুটে আছে কেবিনে। নিরীহ ধরনের বয়স হওয়া একটা বেড়াল আছে দেলোয়ারার। সাদা রঙের। দেলোয়ারার পায়ে পায়েই থাকে। দেলোয়ারা যখন কেবিনে ঢোকেন, বিড়ালটাও ঢোকে। ঘুমায়ও দেলোয়ারার গা ঘেঁষে। এখন শুয়ে আছে দেলোয়ারায় বাঁপাশে, লেপের উপর। আরামে ঘরঘর শব্দ করছে। ঘুমন্ত বিড়ালের এইটুকু শব্দ ছাড়া কোথাও কোনও শব্দ নাই। খাটালে ঘুমাচ্ছে বাদলা, বারান্দায় রাবি আর মতলা। কারও কোনও শব্দ নাই। বাইরে একটা রাতপাখিও ডাকে না কোথাও, গিরস্ত বাড়ির কুকুররা ঘেউ দেয় না, শিয়াল ডাকে না। শেষ হয়ে আসা শীতের আমেজে সবকিছুই চুপচাপ। শব্দ পাওয়া যায় শুধু ঝিঁঝির। অবিরাম ডেকে যাচ্ছে।

এই অবস্থায় হঠাৎ করেই দেলোয়ারার মনে পড়ল আর একটা ঘটনা। তাঁর বিয়া হল। ছাপ্পান্ন সালে, সেটা বোধহয় আটান্ন সালের ঘটনা। নিজেকে হঠাৎ করেই ছাত্রনেতা বলতে শুরু করলেন আবদুল মজিদ। শ্বশুরবাড়ি থেকে টাকাপয়সা নিয়েও বিএ পরীক্ষা না দিয়ে, নানা রকমের তালবাহানা, নিজের মেয়েকে গলা টিপে ধরা ইত্যাদি ইত্যাদি সেরে আচমকাই ছাত্রনেতা বনে গেলেন। নিজের ছবির ব্লক করে ছোট্ট একটা পোস্টার ছাপালেন। সেই পোস্টারের কারণেই কিনা পুলিশ তাঁকে খুঁজতে লাগল। কয়েকখানা পোেস্টার আর ব্লক হাতব্যাগে ভরে মজিদ চলে এলেন শ্বশুরবাড়ি।

এই ঘটনা মনে হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে লেপের তলায় দেলোয়ারা কেমন কেঁপে উঠলেন। সেবার বাড়ি ফিরে সেই কয়েকখানা পোস্টার আর কাগজে জড়ানো ব্লকটা দেলোয়ারার কাছে। রাখতে দিয়েছিলেন মজিদ। অতিযত্নে জিনিসগুলি কেবিনের তালাবন্ধ ছোট আলমারিটার। নীচের তাকে বাড়ির পুরনা দলিল দস্তাবেজের সঙ্গে রেখে দিয়েছিলেন দেলোয়ারা। এই এতগুলি বছরে আর কখনও খুলে দেখা হয়নি। আজও সেই জায়গাটাতেই আছে।

কথাটা মনে হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দিশাহারা ভঙ্গিতে উঠে বসলেন দেলোয়ারা। মাথার কাছ থেকে চশমা নিয়ে পরলেন। কারে ওঠার সিঁড়ির কাছ থেকে হারিকেন এনে কাঁটা ঘুরিয়ে হারিকেনের আলো বাড়িয়ে মাঝারি সাইজের আলমারিতে রাখা একটা কৌটা থেকে চাবি বের করে ছোট আলমারিটা খুললেন। খুলে দ্রুত হাতে দলিল দস্তাবেজের আড়াল থেকে বের করলেন সেই কয়েকখানা পোস্টার আর কাগজে জড়ানো ব্লকটা। হারিকেনের উসকে দেওয়া আলোয় পোস্টার খুলে বসলেন।

আজকালকার দিনের পোস্টারের মতো না পোস্টারগুলি। বইয়ের পৃষ্ঠার চেয়ে একটুখানি লম্বা, একটুখানি চওড়া। অতি সস্তা কাগজে ছাপানো বলে এত যত্নে রাখার পরও কেমন। আবছা হয়ে গেছে লেখা ছবি। ভাজ দিয়ে রাখা জায়গাটা কবে কখন আপনা আপনি ছিঁড়ে গেছে!

তবু লেখাগুলির দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে রইলেন দেলোয়াররা, আবদুল মজিদের আবছা হয়ে যাওয়া ছবির দিকে তাকিয়ে রইলেন। এই তো সেই মানুষ জীবনটা যে একেবারেই তছনছ করে দিয়ে গেছে। কেন? কী দোষ ছিল দেলোয়ারার?

মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আবদুল মজিদকে এসব কথা কখনও জিজ্ঞাসা করা হয়নি। আজ এতকাল পর আবদুল মজিদের প্রায় মুছে যাওয়া ছবির দিকে তাকিয়ে কথাগুলি দেলোয়ারা বলে ফেললেন। কী করছিলাম আমি? কোন দোষে আপনে আমার জীবনডা এমুন কইরা দিলেন? একবারও আমার কথা আপনে ভাবেন নাই ক্যান, একবারও মাইয়াড়ার কথা ভাবেন নাই ক্যান? আরেকজনরে লইয়া নিজে তো নিজের লাহান সুখে থাকলেন, আমারে ক্যান ঠেইলা দিলেন সারাজীবনের দুঃখে! একটা জীবন যে আমার বৃথা গেল একবারও এই কথাডা আপনে ভাবলেন না!

কোন ফাঁকে যে চশমার তলা দিয়ে চোখের পানি গড়িয়ে নামল টের পেলেন না। দেলোয়ারা। মুখ নিচু করে পোস্টারের দিকে তাকিয়েছিলেন বলে তার চোখের পানি টপটপ করে পড়তে লাগল আবদুল মজিদের আবছা হয়ে যাওয়া ছবির ওপর।

.

ভোররাতে বানেছার ধাক্কা খেয়ে চৌকির বিছানায় উঠে বসল আজিজ। ঘুমভাঙা নির্বিকার গলায় মিনমিন করে বলল, কওন লাগবো না। বুজছি।

ঘণ্টার কাছাকাছি সময় আগে বেদনা উঠেছে বানেছার। এই নিয়ে সাতবার। তবু সেই প্রথমবারের মতন, প্রতিবারের মতন এবারও শুরুতে ব্যাপারটা সে চেপে রাখার চেষ্টা করেছে। যেন চেপে রাখলে গোপনেই মিটে যাবে সব। আপছে তার মাটির বিছানায় অন্যান্য পোলাপানের পাশে এসে শোবে আরেকজন। এখন যে কোলে আছে, সময়ে অসময়ে মায়ের বুকের দুধ নিয়ে যার খাবলা খাবলি সে মন খারাপ করে চলে যাবে দূরে, নতুনটা এসে সেই জায়গার দখল নিবে।

কোনওবারই এরকম হয় না। যে আসে জানান দিয়েই আসে। বানেছা চেপে রাখতে পারে না। স্বামীকে ডাকতে হয়ই।

আজও হল।

মাটির বিছানায় দুই মেয়ে আর কোলের ছেলে নিয়ে শুয়েছিল বানেছা। এই অবস্থায় বেদম ভারী হয়ে আসা তলপেট দুইহাতে চেপে কোনওরকমে উঠে দাঁড়াল। চৌকির ওপর তিনছেলের মধ্যিখানে শুয়ে থাকা স্বামীকে ধাক্কা দিল।

ধাক্কা খেয়ে সঙ্গে সঙ্গেই উঠল আজিজ। কথা দুইটা বলল। শুনে এই অবস্থায়ও বানেছা বেশ অবাক হল। মুখে মৃদু করুণ ধরনের গোঙানি ছিল। তবু বলল, কেমতে বুজলা?

আজিজ একটা হাই তুলল। তুমি উসপিস উসপিস করতাছিলা হেইডা আমি উদিস পাইছি।

তুমি তাইলে জাইগগা আছিলা?

না জাইগগা গেছি।

তয় ইট্টু পুরানবাড়ি যাও। আলার মা’রে লইয়াহো।

আজিজ আড়মোড় ভাঙল। বউয়ের পোলাপান হচ্ছে এটা তার কাছে এখন আর আগ্রহের ব্যাপার না। বরং সে খুবই বিরক্ত হয়। যদিও বানেছার ভয়ে মুখ খোলে না, গোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সংসারে আরেকজন এল, খাদ্যে ভাগ বসাবার একজন মানুষ বাড়ল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে চোখের অনেক ভিতরে লুকিয়ে থাকা অদৃশ্য খেরোখাতার কয়েকটা পৃষ্ঠাও ফরফর করে খুলে যায়। আশ্চর্য এক হিসাবনিকাশ চলতে থাকে।

এখনও, এই ভোররাতের আবছা আলো আঁধারি ঘরের চৌকিতে বসে থাকা আজিজের চোখের খুব ভিতরে আস্তে ধীরে খুলছিল সেই অদৃশ্য খেরোখাতা। তবু খুবই দায়সারা গলায় আজিজ বলল, বিয়াইন্না রাইত্রে গিয়া ডাইক্কা উডামু, নাকি ইট্টু দেরি করবা? ইট্টু ফসসা অইলে বাইর হই।

বানেছা মুখ ঝামটাল। এইডা কি হাগামুতা যে চাইপ্পা থাকুম? তুমি গেলে যাও নাইলে আমি পোলাগো ডাক দেই। অগো পাড়াই।

তারপরও একটু দোনোমোনো আজিজ করতে চাইল, এই অবস্থা থেকে তাকে বাঁচিয়ে দিল মেজ ছেলে হামেদ। মা-বাবার কথাবার্তায় ঘুমটা তার ভেঙে গিয়েছিল। মায়ের বেদনা উঠেছে, নতুন একজন কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই হাজির হবে সংসারে। বোধবুদ্ধি হওয়ার পর থেকে বছর বছর এরকমই দেখে আসছে সে, ব্যাপারটা তার কাছে নতুন কিছু না। তবু আজ এই ভোররাতে নতুন একজন মানুষ আসছে সংসারে, বিষয়টা হামেদকে উত্তেজিত করল। বলল, বাবার যাওনের কাম নাই। আমি আর দাদায় যাই।

ছেলের কথা শুনে আজিজ বেঁচে গেল। গদগদ গলায় বলল, হ যা বাজান, যা। তরা দুই ভাইয়েঐ যা। পোলাপান বড় অইলে মা-বাপের অনেক কাম তাগো করতে অয়।

একপাশে শুয়ে থাকা বড়ছেলে নাদেরকে ডাকল আজিজ। নাদু, উঠ বাজান, উঠ। দুই। ভাইয়ে মিলা পুরানবাড়ি যা।

নাদেরেরও ততক্ষণে ঘুম ভেঙেছে। চোখ ডলতে ডলতে উঠে বসল সে। কিন্তু বাগড়া দিল বানেছা। এতডু এতডু পোলা দুইডা এমুন বিয়াইন্না রাইতে ছাড়াবাড়ির সামনে দিয়া যাইবো?

আজিজ বলল, ক্যা? গেলে কী অইছে?

তুমি জানো না কথাডা আমি কীর লেইগা কইতাছি?

বুঝল আজিজ। বুঝেও পাত্তা দিল না। বলল, আরে না। তুমি যা কইতাছো হেইডা অহন নাই। আর অহনঐ আয়জান দিয়া দিবো। আয়জানের লগে লগে…

কথা শেষ না করে নাদের হামেদকে ঠেলে নামাল চৌকি থেকে। যা বাজান যা। দৌড়াইয়া যা। চাচিরে কবি অহন য্যান তগো লগে আইয়া পড়ে। দেরি য্যান না করে।

ততক্ষণে পরির ঘুম ভেঙেছে, পরির ছোট জরির ঘুম ভেঙেছে। মাটির বিছানায় শুধু বানেছার কোলের ছেলের ঘুম ভাঙেনি আর চৌকির ওপর ভাঙেনি কোলেরটার এক বছরের বড়ছেলে বদরুলের। আটজন মানুষের ছয়জনই জাগনা।

জরির স্বভাব হচ্ছে যে-কোনও পরিস্থিতিতেই বোনকে একটা ধাক্কা দেওয়া। এখনও দিল। কী হইছে রে বুজি? মা’র বেদনা উটছে?

কথায় কথায় বোনটিকে ধমকাবার স্বভাব পরির। এখনও ধমকাল। চুপ কর। কথা কবি না।

পরির আওয়াজ পেয়ে বানেছা কঁকাতে কঁকাতে বলল, পরি গো, উটছচ মা? উট। উইট্টা কুপিবাত্তি আঙ্গা? ঘরডা আন্দার।

পরি উঠে কুপি জ্বালাল। সঙ্গে সঙ্গে ঘরের দরজা খুলল হামেদ। বাইরে আলোর রেখা ফুটেছে কি ফোটেনি দেখল।

না, এখনও অন্ধকার। এখনও গাছপালা ঝোঁপঝাড় আর উঠান পালানের মাটিতে ডাকছে রাতপোকা। শেষ ফাল্গুনের শীতল হাওয়া বইছে। তালুকদার বাড়ির ওদিককার কোনও এক গাছের আগডালে বসে ডাকছে কোকিল। ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায় সেই ডাক ছড়িয়ে যাচ্ছে। দেশগ্রামের দিগ দিগন্তে।

বাড়িতে একটা ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে এই অবস্থায় হামেদ হঠাৎ করে আজ বয়সের চেয়ে অনেক বড় হয়ে গেছে। বড়ভাই নাদেরের চেয়ে বড়, মা-বাপের চেয়েও যেন বড় এমন গলায় বাইরের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে বলল, অহনতরি ম্যালা রাইত। পরি, হারিকেন আঙ্গা। হারিকেন লইয়া যাই।

সংসারের যে-কোনও কাজে পয়সার হিসেবটা আজিজ আগে করে। যে-কোনও কাজে চোখের ভিতর তার খুলতে থাকে সেই অদৃশ্য খেরোখাতা, আশ্চর্য এক হিসাবনিকাশ চলতে থাকেই। সেই হিসেবের জের ধরেই সে বলল, হারিকেন নেওনের কাম কী? চিমনি ফাডা। যুদি পুরা ভাইঙ্গা যায়? আর কেরাসিন তেলের দামও তো আইজকাল ম্যালা! দুই ভাইয়ে যাইতাছস, হারিকেন লাগবো ক্যা? মেন্দাবাড়ি ছাড়াইয়া যাইতে যাইতেঐত্তো ফসসা হইয়া যাইবোনে। আর চকে নামলে দেখবি চাইরমিহি ফকফইক্কা। হারিকেন নেওনের কাম নাই। বাজান। যা, মেলা দে।

ছেলের পক্ষ নিল বানেছা। আগের মতোই কঁকাতে কঁকাতে স্বামীকে একটা ধমক দিল। তুমি চুপ করো, তুমি কথা কইয়ো না। ওই পরি, হারিকেন আঙ্গাইয়া ভাইর হাতে দে। তাড়াতাড়ি কর।

দ্রুতই কাজটা করল পরি।

ঘুম ভাঙার পর একটাও কথা বলেনি নাদের। যা বলার হামেদই বলে যাচ্ছে। হারিকেন হাতে নিয়ে নাদেরকে সে বলল, ল দাদা, মেলা দেই। আয়।

নাদের তবু কথা বলল না। নিঃশব্দে হামেদের সঙ্গে উঠানে নামল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে উত্তরের ভিটির পিছন দিককার মটকুরা গাছের ডালপালার আড়ালে বসা একটা কাক দুইবার নরম গলায় কা কা করেই থেমে গেল।

বানেছার ব্যথা তখন আরেকটু বেড়েছে। ফলে মেজাজও খারাপ হয়েছে। ছেলেরা বেরিয়ে যাওয়ার পর আজিজ ফিকির করছিল ছোট ছেলের পাশে শুয়ে ঘণ্টা-দুই ঘণ্টার আরেকটা ঘুম দিয়ে ফেলবে। সেই ফাঁকে ছেলেরা ফিরে আসবে আলার মা’কে নিয়ে, সেই ফাঁকে উত্তরের ভিটির ভেঁকিঘরে নাড়ার উপর ছেঁড়াখোঁড়া হোগলা বিছিয়ে তার উপর আলার মা ধরণী বানেছাকে শুইয়ে গর্ভের অন্ধকার থেকে আলোকময় পৃথিবীতে টেনে হিঁচড়ে আনবে ছোট্ট নতুন একজন মানুষকে। ঘুমের তালে আজিজ কিছু টেরই পাবে না।

মতলবটা আজিজের কাজে লাগাতে দিল না বানেছা। তিরিক্ষি মেজাজে আচমকাই খ্যা খ্যা করে উঠল। আবার হুইতে চাইতাছো? ওই গোলামের পো, তর পোলাপান জন্ম দিতে বেদনায় মরি আমি আর তুই হুইয়া ঘুমাবি? উঠ, তাড়াতাড়ি উঠ। তুই নিজে গিয়া উত্তরের ঘরে আমার বিচনা কইরা দিবি। আহুজ পড়নের আগে পরের বেবাক কাম আইজ তরে দিয়া করামু আমি।

আজিজ অনুমানই করতে পারেনি হঠাৎ করে এই ধরনের আক্রমণের শিকার হবে। থতমত খেল সে, মিইয়ে গেল। শুয়ে পড়ার মতলব আর চোখের ঘুম কোথায় উধাও হয়ে গেল। মিনমিন গলায় কোনওরকমে বলল, তুমি এত চেইত্তো না। করতাছি, সব করতাছি আমি।

শিশুর মতন লেছড়ে পেছড়ে চৌকি থেকে নামল আজিজ। পরিকে বলল, পরি, কুপিডা লইয়া আমার লগে আয় মা। জরি, তুইও আয়। বেবাকতে মিলা কাম কাইজগুনি আউগাইয়া রাখি। আমরা কাম করতে করতে দেকবি আলার মা চাচিও আইয়া পড়ছে।

তিনজন মানুষ ঘর থেকে বেরুতে যাবে পরিকে বানেছা বলল, চাচি আহনের পর আমি ওই ঘরে গেলেগা তুই বেবাকতেরে লইয়া হাজামবাড়ি যাবি গা। আমার আহুজ পড়নের পর তর বাপে গিয়া তগো ডাইক্কা লইয়াইবো। তারবাদে রান্ধন বাড়ন করবি তুই। খালি আউজকার দিনডাঐ। কাইল থিকা আমিঐ আবার সব করুমনে।

পরি ধীরশান্ত গলায় বলল, আইচ্ছা।

তখনই এই ঘরের পুব-দক্ষিণ দিককার পিড়ার গর্তে মোরগমুরগির জন্য তৈরি করা খোঁয়াড়ে বসে ডাকাবুকা মোরগটা গলা খুলে বাগ দিয়ে উঠল। কুক কুরুক কুক।

.

মোবাড়ির উত্তর দিককার চকে নেমে হামেদ বলল, ওই দাদা, হারিকেনডা না আনলেও অইতো।

ঘুম ভাঙার পর, বাড়ি থেকে বেরিয়ে এতদূর আসার পর এই প্রথম কথা বলল নাদের। ক্যা?

হারিকেনটা ডানহাত থেকে বাঁহাতে আনল হামেদ। তার পরনে ইলাস্টিক লুজ হয়ে যাওয়া মোটা সুতি কাপড়ের হাফপ্যান্ট আর ঢলঢলা গেঞ্জি। যখন তখন ইলাস্টিক লুজ হওয়া প্যান্ট যাতে পেট গলিয়ে নীচে নেমে যেতে না পারে এই কারণে প্যান্টের দশা এরকম হওয়ার পর থেকে পেটটা সে যথাসম্ভব ফুলিয়ে রাখে। এখন হারিকেন হাত বদল। করার ফলে, ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলার ফলে পেটের ফোলাটা পলকের জন্য কমল আর সেই ফাঁকে প্যান্টটা নাভির নীচ ছাড়িয়ে প্রায় লজ্জার জায়গায় গিয়ে পৌঁছাতে চাইল। সঙ্গে সঙ্গে থাবা দিয়ে প্যান্ট ধরল হামেদ। জায়গামতো তুলে পেটটা ফুলিয়ে রেখে বলল, দেহচ না চাইরমিহি কেমুন ফসসা অইয়া গেছে। নাদের বলল, আসলে ফসসা হয় নাই।

তয়? তয় আমি দিহি ফসসা ফসসা দেকতাছি। উই যে উত্তর মিহি ফকিরবাড়ি, পশ্চিমে সেউলার বাড়ি তার লগেই পুরানবাড়ি। পুরানবাড়ির তালগাছটাও তো দেহা যাইতাছে।

রাইত দোফরেও চকে এমুন ফসসা ফসসা দেহা যায়।

আমাবইস্যার রাইত্রেও?

নাদের নির্বিকার গলায় বলল, হ।

এদিকে কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে পেটের ফোলাটা কমছিল হামেদের আর প্যান্ট ছ্যালছাল করে পড়ে যাচ্ছিল। একহাতে হারিকেন আরেক হাতে প্যান্ট সামলাতে ঝামেলাই হচ্ছিল তার। অবস্থাটা সামাল দেওয়ার জন্য ভাইকে বলল, দাদা, হারিকেনডা ইট্ট লবি?

নাদের বাপের স্বভাব পেয়েছে। যে কোনও কাজে গা বাঁচিয়ে চলার অভ্যাস। বলল, ক্যা?

আমার পেন্টুলডা পইড়া যাইতাছে।

হের লেইগা হারিকেন আমার ধরন লাগবো ক্যা?

একহাতে পেন্টুল আরেক হাতে হারিকেন লইয়া আটতে পারি না।

অনিচ্ছা সত্ত্বেও হারিকেনটা নিল নাদের। আইচ্ছা, দে।

ভাইর হাতে হারিকেন দিতে পেরে আরামের ভাব হল হামেদের। ফুর্তির গলায় বলল, ওই দাদা, তরে একহান কথা কমু?

হারিকেন হাতে হাঁটতে হাঁটতে নাদের বলল, ক।

আমার না বহুত ফুর্তি লাগতাছে।

ক্যা?

মা’র যে আবার আহুজ পড়ব!

কথাটা ভাল লাগল না নাদেরের। সে কোনও জবাব দিল না। পা চালিয়ে হাঁটার স্বভাব তার। হামেদ কিছুতেই ভাইর সঙ্গে তাল রাখতে পারে না। নাদেরের হাঁটার সঙ্গে তাল রাখতে হামেদকে হয় দৌড়াতে। এখনও দৌড়াচ্ছিল সে। একহাতে প্যান্টের লুজ হওয়া ইলাস্টিক চেপে ধরে ভাইর পাশাপাশি দৌড়াতে দৌড়াতে বলল, ওই দাদা, ক তো ইবার আমগো ভাই অইবো না বইন?

নাদের বিরক্ত গলায় বলল, কইতে পারি না।

আমার মনে হয় বইন।

চুপ কর। যা ইচ্ছা অউক গিয়া।

হামেদ বুঝল আলোচনাটা নাদের পছন্দ করছে না। কিন্তু তার যে কথা বলতে ইচ্ছা। করছে। এরকম শুনশান চক পাথালে হেঁটে যাচ্ছে ছোট ছোট দুটি ভাই, চুপচাপ না হেঁটে কথা বলতে বলতে হটাটা ভাল না! শুরুতে ঠিক বুঝতে পারেনি, অতি উৎসাহে বাপের কাজের ভার আগ বাড়িয়ে নিয়েছিল হামেদ, তখন ডরভয় জিনিসটা বুঝে উঠতে পারেনি কিন্তু বাড়ি থেকে বেরুবার পর থেকেই গা ছমছম করছে। মনের ভিতর থেকে থেকে চমকে ওঠার ভাব। যদিও গ্রাম গিরস্তের বাড়িতে বাগ দিতে শুরু করেছে মোরগ। খানবাড়ির মসজিদ থেকে খানিক আগে ভেসে আসছিল আজানের সুর। সেই সুরে আবিষ্ট হয়ে গিয়েছিল গ্রামপ্রান্তর। ফজরকালের আকাশ গাছপালা, শস্যের চকমাঠ আর মানুষের উঠান পালান, জলাভূমি বিরানভূমি সবই যেন মগ্ন হয়ে গিয়েছিল সেই সুরে। গিরস্তবাড়ির খোয়াড়ে বাগ। দিতে ওঠা মোরগেরা স্তব্ধ হয়েছিল, গাছপালার আড়ালে গলা খুলতে শুরু করা কাক, উঠোন পালানে চড়তে নামা দোয়েল পাখিরা মৌন হয়েছিল। ফাগুন রাতের শেষপ্রহরের উদাস হাওয়া বইতে বইতে যেন থেমে গিয়েছিল। যতক্ষণ সেই মহান সুর জেগেছিল ততক্ষণ ডরভয় কিছু ছিল না হামেদের। যখনই শেষ হয়েছে আজান তারপরই ভয়টা আবার শুরু হয়েছে। দুইভাইয়ে মিলে কথা বললে ভয় কাটত।

নাদের কথা বলতে চাচ্ছে না। দুইজন মানুষের একজন কথা না বললে আরেকজন বলে কেমন করে! একা একা কি কথা বলা যায়? নাকি একটা গান ধরবে হামেদ। কয়দিন আগে শিখা,

আমার সোনার ময়না পাখি
কোন দেশেতে গেলি উইড়ারে
দিয়া মোরে ফাঁকি রে
আমার সোনার ময়না পাখি!

এসময় গান গাওয়া কি ঠিক হবে!

আচ্ছা ভাইবোনের কথা না হয় না বলল নাদের, অন্যকথা কি বলবে না? ওই যে মা বাবা যে বিষয় নিয়ে কথা বলছিল সেই বিষয়ে কি বলবে না?

হামেদ খুব যেন চিন্তিত হয়েছে এমন গলায় বলল, ওই দাদা, তরে একহান কথা জিগামু?

নাদের গম্ভীর গলায় বলল, কী?

আমরা আহনের আগে মায় যে বাবারে কইলো, পোলা দুইডা এমুন বিয়াইন্না রাইতে ছাড়াবাড়ির সামনে দিয়া যাইবো, হুইন্না বাবায় কইলো…

হামেদের কথা শেষ হওয়ার আগেই নাদের বলল, তুই বোজচ নাই?

যেন কিছুই জানে না হামেদ, যেন কিছুই বোঝে না এমন গলায় বলল, না।

সত্যঐ বোজচ নাই?

সত্যঐ বুজি নাই। তুই আমারে বুজাইয়া ক।

কইতে পারি। ডরাইবি না তো?

গা ছমছম করে উঠল হামেদের। গোপনে একটা টোক গিলল। কোনওরকমে বলল, না ডরামু ক্যা? ডরের কী আছে?

আছে। তয় অহন নাই। আয়জান অইয়া গেছে। ফজরের আয়জান অইয়া গেলে ডরের কিছু থাকে না।

একথা শুনে ভরসা পেল হামেদ। তয় আর কী? ক।

খাড়ো, ছাড়াবাড়ি ছাড়াইয়া লই। এই বাড়ির সামনে দিয়া যাইতে যাইতে কমু না।

আইচ্ছা।

দুইভাই পা চালিয়ে হাঁটতে লাগল। তাদের সামনে বিশাল সব গাছপালা আর ঝোঁপঝাড় নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে নোয়াব আলী পঞ্চায়েতের ছাড়াবাড়ি। দিনের বেলায়ই গা ছমছমে পরিবেশ বাড়িটার, আর রাতেরবেলা তো কথাই নাই। বাড়ির দিকে তাকালেই মনের ভিতর তৈরি হয় ভয়।

এই বাড়ির উত্তর-পশ্চিম কোণে পুরানবাড়ি। বাড়ির দক্ষিণে বড়পুকুর, পশ্চিমে খোলা মাঠ। মাঠের পাশে খানবাড়ি থেকে কালিরখিলের দিকে চলে যাওয়া সড়ক। সড়কের পশ্চিমে বিল, বিলের পশ্চিমে গ্রাম কান্দিপাড়া, জশলদিয়া।

পুরানবাড়িতে, আলার মা-দাদিদের সীমানায় ওঠার তিনটা পথ আছে। সবচেয়ে সহজ পথ ছাড়াবাড়ির উপর দিয়ে উত্তর-পশ্চিম কোণের দিকে গেলেই দুই বাড়ির মাঝখানে পনেরো-বিশ কদমের উঁচু একটা পথ আছে সেই পথ ধরা। এই পথ নাদের হামেদ এখন ধরবে না।

আরেকটা পথ হল ছাড়াবাড়ির পুব দিককার নামায় আলতাবুদ্দিন সারেঙের যে বিশাল জমি, সেই জমি আর ছাড়াবাড়ির লগের উত্তর দিককার আলপথে খানিক গিয়ে, পশ্চিমে তোতাদের যে বাজাজমি সেই জমি ধরে পশ্চিমে গিয়ে ছাড়াবাড়ি আর পুরানবাড়ির পনেরো বিশ কাইকের পথটা ধরা।

না এই পথও নাদের-হামেদ ধরবে না। কারণ যে ভয়ের কথা মা-বাবা দুইজনে দুইভাবে বলছিল সেই ভয়টা ছাড়াবাড়ির এই কোনাটাতেই। জড়াজড়ি করে থাকা পুরানা দুইটা আমগাছ, যে গাছ আবার ছেয়ে আছে তেলাকুচ লতার গাঢ় সবুজ পাতায়, এই গাছ দুইটাতেই…

নাদের-হামেদ এখন ধরবে ছাড়াবাড়ির দক্ষিণের পথ। পথের একপাশে ছাড়াবাড়ি আরেকপাশে সমেদ খাঁ-র সরু খালের মতন পুকুর। পুকুরের ওপারে সমেদ খাঁ-র বাড়ির এক শরিক বেগমের মা’র সীমানা। এই জায়গাটুকু পেরিয়ে ওপাশে গেলেই উদাস একখানা মাঠ। মাঠের পশ্চিম দিক ঘুরে পুরানবাড়ির বড়পুকুরের পার ধরে যেতে হবে বাড়িতে। ঘুরপথ। তবু এপথেই যাবে দুইভাই।

শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় পথটুকু পেরিয়ে এল নাদের-হামেদ। ওপাশের মাঠে এসে একসঙ্গে হাঁপ ছাড়ল। আকাশ ততক্ষণে আর একটু ফরসা হয়েছে। চারদিকে রোয়াইল ফলের মতো সবুজাভ আলো।

হামেদ বলল, এইবার ক দাদা।

একহাত থেকে হারিকেন আরেক হাতে আনল নাদের। আবার জিগাই, হুইন্না তুই ডরাইবি না তো?

আরে না।

ছাড়াবাড়ির ওই আমগাছ দুইডায় একজন থাকে।

কথাটা বুঝেও না বোঝার ভান করল হামেদ। কেডা, কেডা থাকে? ওই দাদা, গাছে আবার মানুষ থাকে কেমতে?

নাদের হাসল। তুই বোজচ নাই?

নয়-দশ বছর বয়সেই বেদম পাকা পাকছে হামেদ। নাদের এখন যে কথা বলবে কথাটা সে বেশ ভাল করেই জানে। গাছে কে থাকে, কী বিত্তান্ত গ্রামের অন্য সবার মতো সেও সবই জানে। মা-বাবা কথা বলবার সময়ই বুঝেছে। বুঝে যে ভয় পায়নি তা নয়, ধারণা ছিল বাইরে এখন আর অন্ধকার নাই, ফরসা হয়ে গেছে চারদিক, এই অবস্থায় দুইভাই মিলে জায়গাটা পেরিয়ে যেতে পারবে। আমগাছে যে থাকে আজানের পর তার আর থাকার ক্ষমতা থাকবে না। আল্লাহর নাম শোনার সঙ্গে সঙ্গে লোকালয় থেকে উধাও হতে হয়। তাদের। এটা আল্লাহর কুদরত।

তখনও যে আজান হয়নি, দুই ছেলেকে ভরসা দেওয়ার জন্য, নিজের গা বাঁচাবার জন্য আজিজ যে আজানের নামেও মিথ্যা বলেছে খানিক আগে আজান হওয়ার পর দুইভাইয়েই তা বুঝেছে। বুঝে নাদেরের মনে কী হয়েছে কে জানে, হামেদের মনে হয়েছে, ভাইগ্য ভাল হারিকেন বুদ্দি কইরা লইয়াইছিলাম। লগে আগুন থাকলে তারা সামনে আইতে পারে না।

এতকিছু জেনে বুঝেও একেবারেই নাদান অবুঝ সেজে রইল হামেদ। সরল, বোকা গলায় বলল, না আমি বুজি নাই দাদা। তুই ক।

খোলামাঠ থেকে পুকুরপারে উঠল নাদের। গলা খাঁকারি দিল, বহুত পুরানা জিনিস হেয়। বহুতদিন ধইরা ওই গাছে থান লইছে।

বোজলাম। তয় জিনিসটা কী?

কনধনাইয়া (স্কন্ধকাটা)।

শব্দটা শুনেই গা কাঁটা দিল হামেদের। এমন যে হবে তা সে জানত। তবু এই ভয়ের মধ্যে কেমন যেন রোমাঞ্চ আছে। ভয় লাগে ভালও লাগে।

ইলাস্টিক লুজ হওয়া প্যান্ট দুইহাতে টেনে মাজার অনেক উপরে তুলল হামেদ। লুঙ্গির কায়দায় প্যান্টটায় দুইটা গোঁজ দিল। ফলে নাভির কাছে হাতের মুঠার মতন দলা পাকিয়ে রইল প্যান্ট। এখন আর পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা নাই। এখন আরামছে হাঁটা যাবে, আরামছে কথা বলা যাবে ভাইর সঙ্গে। প্যান্টের জন্য পেট ফুলিয়ে রাখতে হবে না।

ইস এই বুদ্ধিটা কেন যে আগে আসেনি মাথায়!

প্যান্ট সামলাতে গিয়ে দুইকাইক পিছনে পড়েছিল হামেদ। এখন একদৌড়ে ভাইয়ের পাশে চলে এল। অবাক বিস্ময়ের গলায় বলল, কনধনাইয়া?

হ। কনধনাইয়া কারে কয় জানচ?

জানি। কল্লামাথা কিছু নাই। খালি শইলডা। আর শইলভরা আনরসের লাহান চক্কু।

হ। রাইত বিরাইত চলাচল করে হেয়। এক পাও দেয় এই বাড়ির আমগাছ দুইহানের মাথায় আরেক পাও দেয় বিলেরবাড়ির শিমইল গাছটায়। দুই পাও দুই জাগায় দিয়া চেগাইয়া খাড়ইয়া থাকে। ওই টাইমে কেঐ যুদি হের পায়ের নীচ দিয়া মেলা দেয়, তাইলে আর রক্ষা নাই। দুই পাও দিয়া চাইপ্পা ধরে তারে। হেই চাপে কইলজা গইল্লা পানি অইয়া যাইবো। হেই পানি নাকমুখ দিয়া উকালের (বমির) লাহান বাইর অইয়া মরবো মানুষটা।

হামেদের গা আগের মতনই কাঁটা দিচ্ছে, আগের মতনই রোমাঞ্চ শরীরের পরতে পরতে। তবু সে বলল, আমি হুনছি আলার মা-দাদির তালগাছেও বলে কোনও কোনও রাইত্রে পাও দিয়া খাড়য় হেয়। হেই রাইত্রে বলে বাঐ (বাবুই) পাখিগুলি আর ঘুমায় না। খালি ক্যাচম্যাচ ক্যাচম্যাচ করে।

মুখ ঘুরিয়ে ভাইয়ের মুখের দিকে তাকাল নাদের। মুখ পরিষ্কার দেখতে পেল না। তবু বলল, ওই বান্দর, তয় বলে তুই কিছু জানচ না?

হামেদ ফিক করে হাসল। জানুম না ক্যা? বেবাকঐ জানি।

তয় যে আমারে কলি তুই কিছু বোজচ নাই?

তর মোক থিকা হোননের লেইগা কইছি। এই হগল হোনতে মজা লাগে।

ডর করে না?

হ ডরও করে আবার মজাও লাগে।

একটু থেমে হামেদ বলল, ওই দাদা, কনধনাইয়া বলে দিনেও দেহা যায়?

হ। কোনও কোনওদিন নিটাল দুইফরে, যহন চাইরমিহি কোনও মানুষজন থাকে না তহন গাছ থিকা নাইম্মা তারা ইট্ট চলাফিরা করে। তহন কেঐ কেঐ আতকা তাগো দেইখা হালায়।

বেগির মায় বলে বহুতবার দেখছে।

দেকতে পারে। আবার কালীসন্ধ্যায়ও তাগো কোনও কোনও সময় দেহা যায়। সন্ধ্যাকালেও তারা চলাফিরা করে। তয় তাগো সবথিকা বেশি দেহা যায় জোছনা রাইতে। ফকফইক্কা জোছনা রাইতে না, মাইটা জোছনায়। মাইটা জোছনায় চলাফিরা করতে তারা বহুত আরাম পায়।

ততক্ষণে চারদিক আরেকটু ফরসা, আরেকটু আলোকিত হয়েছে। চারপাশের গিরস্ত বাড়ির আঙিনায় জেগে উঠছে মানুষ গোরু বাছুর কুকুর বিড়াল। খোয়াড় থেকে ছাড়া পেয়েছে হাঁস মুরগি কবুতর। ওড়াউড়ি করছে কাক শালিক টুনটুনি আর দোয়েল। হাওয়ার সুরে সুর মিলিয়ে শিস দিচ্ছে দোয়েল বুলবুলি।

পুরানবাড়ির ভাঙন ছাড়িয়ে উপরের দিকে উঠতে উঠতে হামেদ বলল, দাদা, হারিকেন নিভাইয়া দে।

.

ফজর আজানের আগে আগে আজ ঘুম ভাঙল আলার মা’র।

সে শোয় খাটালের চৌকিতে। বড়ঘরটা পুবে-পশ্চিমে লম্বা। ঘরের পুব দিককার অর্ধেক জুড়ে কেবিন। কেবিনে বউ পোলাপান নিয়ে শোয় সেজোছেলে তোতা। তিন ছেলেমেয়ে তোতার। সেজোটা ছেলে। সে শোয় দাদির কাছে। দাদি-ন্যাওটা ছেলে। এই তো কেমন কুঁকড়ে মুকড়ে শুয়ে আছে দাদির বুকের কাছে।

তোতাও একদিন মা-ন্যাওটা ছিল। সারাক্ষণ থাকত মায়ের সঙ্গে সঙ্গে। আলার মা’র কোনও মেয়ে ছিল না বলে তোতা যেন ছিল অনেকটাই মেয়ের মতো। ঢংঢংও একটু মেয়েলি ধাচের। মায়ের সঙ্গে অনেক মেয়েলি কাজও সে করত। অন্য তিনভাই যখন মাঠেঘাটে চরে বেড়াত সে তখন মায়ের সঙ্গে ঘরের কোণে বাড়ির উঠান পালানে। কোনও কোনও বিকালে মেয়েলি ঢঙে বসে মায়ের মাথার উকুন পর্যন্ত মেরে দিত। বাড়ির অন্যান্য শরিক আর পড়শিরা বলত, আলার মা, তোতা তোমার পোলা না, তোতা তোমার মাইয়া। তোমার অইলো তিন পোলা এক মাইয়া।

সেই মেয়েলি ঢঙের ছেলে দিনে দিনে বড় হল। বিয়াশাদি করে ঘরগিরস্তি শুরু করল। অন্য তিনছেলে রোজগারপাতির ধান্ধায় কেউ গেল ঢাকায় কেউ ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর। বড় আলাউদ্দিন থাকে ঢাকার বংশালে। কোন সরকারি অফিসে পিয়নের কাজ করে। দেশগ্রামমুখী হয়ই না।

মেজো আর ছোট ছিল দিনাজপুরে। কাটা কাপড়ের দোকান দিয়েছিল দুই ভাই মিলে। বনিবনা হল না। শেষমেশ ভাগাভাগি হয়ে গেল দোকান। ছোট ছেলে দোকান রেখে ভাইয়ের ভাগের টাকা বুঝিয়ে দিল। সেই ভাই চলে গেল দিনাজপুর থেকে আরেকটু দূরে, ঠাকুরগাঁও। সেখানে গিয়ে দোকান করল। দুই-চার বছরে বউ পোলাপান নিয়ে কখনও কখন দেশগ্রামে আসে। এমনিতে মায়ের কোনও খোঁজখবর রাখে না। ক্কচিৎ কখনও বাড়ি এলে একটা-দুইটা সুতির মোটা ধাঁচের অল্প দামি শাড়ি, শীতকালে চাদর স্যান্ডেল এসব নিয়ে আসে। যে মা নয়মাস দশদিন গর্ভে রেখে পৃথিবীর আলো হাওয়ায় আনল, বেঁচে থাকতেও সেই মা এখন দূরের মানুষ।

তোতা ছাড়া অন্য ছেলেদের কথা ভাবলেই আলার মা’র কখনও কখনও মনে হয় সে যেন আসলে মানুষ না, সে যেন আসলে এক পাখি। তার আঙিনার তালগাছের মা বাবুই পাখি যেন সে। পুরুষ পাখির সঙ্গে মেলামেশার ফলে যৌবন বয়সে মা হয়েছিল। চারটা ডিম ফুটে চারটা ছানা হয়েছিল। একসময় পাখনার আড়ালেই ছিল তারা। ঝড় বৃষ্টি রোদ হাওয়া থেকে তাদেরকে সে রক্ষা করেছে। উড়তে শিখার পর অচেনা আকাশে উড়ে গেল তিনটা ছানা। আর ফিরে এল না। দুর্বলটা রয়ে গেল পাখনার তলায়। একটু বেশি বয়সে বিয়াশাদি করে সে চলে গেল আরেক নারীর আঁচলের তলায়। এও একরকমের আকাশ পাথালে উড়াল দেওয়া। এক চালার তলায় থেকেও বউ নিয়ে খাটাল আর কেবিনের মাঝখানকার দরজা বন্ধ করে সে হয়ে গেল দূরের মানুষ। আরেকজনের।

এও তো এক পাখিরই জীবন, বাবুই পাখির জীবন। যেন বা একগাছেই বাসা বেঁধেছে তারা কিন্তু কেউ কারও না।

আর সেই যে পুরুষ পাখিটি! পুরুষ বাবুইটি! সেও তো উড়ালই দিল! সেও তো আর ফিরে এল না! দুই-তিন কানি ধানের জমি, চারটা ছেলে আর পাঁচ শরিকের এই বাড়ির কয়েকগন্ডা ভিটামাটি, একটা চৌচালা বনেদিঘর, একটা রান্নাচালা আর রান্নাচালার মুখোমুখী একখান তালগাছ, যে তালগাছ জুড়ে বাবুই পাখির বাসা, এসব ফেলে পুরুষ পাখিটি উধাও হল। আর ফিরে এল না। আজ চল্লিশ বছর।

আজ রাতে ঘুম ভাঙার পর কেন যে এসব কথা মনে পড়ছিল আলার মা’র! জীবনের পরতে পরতে লুকিয়ে থাকা কত ছোটখাটো ঘটনা, কত দুঃখ বেদনার কথা যে মনে পড়ছিল!

মানুষটা ছিল ধার্মিক। ইমামতি করতে গিয়েছিল মতলবের ওদিককার এক গ্রামে। সেখানেই থাকত। ছয় মাস নয় মাসে একবার বাড়ি আসত। একবার, চল্লিশ বছর আগে, রোজার ইদের পর পর বাড়ি এল, ছোট ছেলে তখন পেটে। সেই শেষ আসা। মাসখানেক থেকে বিদায় নিল। তারপর আর কোনও খোঁজখবর নাই। মাসে-দুই মাসে একটা দুইটা পত্র আসত তার, চাচাতো ভাশুরের ছেলে খবিরকে দিয়ে সেই পত্রের জবাবও দিত আলার। মা। সেবার যাওয়ার পর পাঁচ মাস কেটে যায় চিঠিপত্রের নামগন্ধ নাই। খবিরকে দিয়ে দেড়-দুইমাসের মধ্যে তিন-চারখানা পত্র লেখাল আলার মা। তোতা হল। ছেলের জন্মের কথা জানানো হল, তবুও খবর নাই মানুষটার। বছর ঘুরে এল।

শেষ পর্যন্ত খবিরকে পাঠানো হল মতলবের সেই গ্রামে। সঙ্গে আলাও গেল। আলার তখন দশ-বারো বছর বয়স।

তারা ফিরে এল শুকনা মুখে। সেই গ্রামে মানুষটা নাই। সেই যে বাড়ি এসেছিল তারপর সেখানে নাকি আর ফিরেই যায়নি।

হায় হায়, তা হলে গেল কোথায়?

বছরখানেক আগে উধাও হয়ে যাওয়া মানুষ, এতদিন পর তাকে খুঁজবেই বা কোথায়? তবু ঢাকার টাউন থেকে শুরু করে যেখানে যত আত্মীয়স্বজন ছিল, এমনকী লতাপাতার আত্মীয়রাও যে যেমন করে পারে খোঁজখবর নেওয়ার চেষ্টা করেছে। না, হদিশই পাওয়া গেল না। উধাও তো উধাওই। আজ চল্লিশ বছর।

এখনও কোনও কোনও রাতে নির্জনে একা থাকবার সময় মানুষটার কথা মনে পড়ে। ছোটখাটো ফরসা রঙের মানুষটি। ফতুয়া আর লুঙ্গি পরে থাকত সব সময়। মাথায় টুপিটা থাকতই। হাসিমুখে নরম গলায় কথা বলত। নাকের তলাটা সুন্দর করে কামানো, গালভরতি সুন্দর চাপদাড়ি। চোখে অদ্ভুত এক উদাসীনতা ছিল তার। কারও মুখের দিকে তাকিয়ে কথা বলবার সময়ও মনে হত যার মুখের দিকে তাকিয়ে কথা বলছে আসলে সে তার মুখের দিকে তাকিয়ে নাই, তার চোখ যেন অন্যত্র, দূরে কোথায়, বহুদূরের কোন অচিনলোকে যেন চলে গেছে তার চোখ। সে যেন এই দুনিয়ার কিছুই দেখছে না, সে যেন দেখছে অন্য দুনিয়ার কোনও দৃশ্য।

আর কী মায়া মানুষের জন্য! কথায় আচরণে কাউকে দুঃখ দেওয়ার লেশমাত্র নাই। তখনও তোতা হয়নি, বাড়ি এসে ছেলে তিনটিকে যে কী ভালবাসত, কী যে আদর করত! বিলের তিন-চার কানি জমি ছিল বর্গা দেওয়া। বর্গাদাররা ধানপাটের অর্ধেকটা দিত, ইমামতির টাকা জমিয়ে জমিয়ে বেশ কিছু থোক টাকা বাড়ি আসার সময় নিয়ে আসত মানুষটা। তাতে দিন চলে যেত। খুব সুখ স্বাচ্ছল্যের জীবন ছিল না, আবার দুঃখকষ্টেরও ছিল না।

দুঃখকষ্ট শুরু হল মানুষটা উধাও হয়ে যাওয়ার পর। জমির আয়ে দিন চলে না। কোলেরটা নিয়ে চারটা এইটুকু এইটুকু ছেলে। বড়টা কাজিরপাগলা হাইস্কুলে ক্লাস ফোরে পড়ে। মেজো আর সেজো স্লেট পেনসিলে অ আ লেখে। ওইটুকুই। তারপর সব বন্ধ হয়ে গেল।

সংসার আলার মা চালায় কী করে? ভাশুর দেবর যে দুইজন এই বাড়ির অন্য শরিক তারা আছে তাদের নিয়ে। পাটাভোগে বাপের বাড়ি আলার মা’র। মা-বাবা দুইজনেই তখনও বেঁচে। ভাইরা সংসার চালায়। বোন দুইটার বিয়ে হয়েছে একজনের কোরহাটি আরেকজনের রাড়িখাল। সবাই সবাইকে নিয়ে আছে, আলার মা’র দিকে তাকায় কে?

এই বাড়ির বউ হয়ে আসার পর থেকেই বাড়ির বউঝিদের পোলাপান হওয়ার সময় গভীর একটা উৎসাহ নিয়ে আহুজ ঘরে (প্রসব ঘরে) ঢুকত সে। গভীর আগ্রহ নিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখত মানুষের জন্মমুহূর্তের রহস্য। এই করে করে কখন যে নিজের অজান্তেই কাজটার মধ্যে জড়িয়ে গেল, ধরণীর কাজটা শিখে ফেলল টের পেল না।

সেই দুর্দিনে এই কাজটাই শেষপর্যন্ত তার সহায় হয়ে দাঁড়াল। গ্রামের এবাড়ি ওবাড়ি, চারপাশের গ্রামের এবাড়ি ওবাড়ি, দুই দশদিন পরপরই তো মানুষ জন্মাচ্ছে। নিজগ্রাম ছাড়িয়েও আলার মা’র ডাক পড়তে লাগল। গরিব গিরস্তে একটাকা-দুইটাকা, অবস্থাপন্নরা পাঁচ-দশটাকা পর্যন্ত দেয়। আবার বাচ্চার মাথা ঘোয়ানির দিন (সাতদিনের দিন বাচ্চার মাথার চুল ন্যাড়া করে গোসল করানো। এটা একটা উৎসব) মেজবানির দাওয়াত খাওয়ায় চার ছেলেসহ, বিদায়বেলায় দেয় একখান সুতিশাড়ি।

পেশাটা লেগে গেল আলার মা’র। আর সুনাম এত ছড়াল, আল্লাহর কুদরতই কিনা কে জানে, আলার মা’র হাতে মরেই না। মায়েরা আরামে স্বস্তিতে প্রসব করে। সব মিলিয়ে দিন আস্তে ধীরে ঘুরতে লাগল।

তখনও আশায় আশায় দিন কাটে, মানুষটা হয়তো ফিরে আসবে। হায়রে মানুষের আশা!

আলার মা চেয়েছিল নিজের যত কষ্ট করতে হয় করবে কিন্তু ছেলে চারটাকে মানুষ করবে। লেখাপড়া শিখিয়ে শহরে বন্দরে চাকরিবাকরিতে পাঠাবে। আর স্বভাবচরিত্রে তারা যেন হয় তাদের বাপের মতো, ধার্মিক মায়াবী ভালমানুষ।

একজনও তেমন হল না। ফাইভ-সিক্সের পর আর পড়লই না আলা। পাটাভোগে গিয়ে মামাদের কাছে পড়ে থাকত। লায়েক বয়সে কাকে কাকে ধরে যেন ঢাকায় গিয়ে চাকরি নিল। বংশালের এক খাস ঢাকাইয়া বাড়িতে বিয়ে করল। মা-ভাইদের কথা ভাবলই না, ফিরেও তাকাল না কারও দিকে। নিজের ভাগের সম্পত্তি বিক্রি করে টাকা নিয়ে গেল।

এমন বাপের এমন স্বার্থপর ছেলে!

কথায় আছে বড় যে পথে যায় ছোটও যায় সেই পথে! আলার মা’র চার ছেলের ক্ষেত্রেই তাই হয়েছে। একটা সময়ে বড়ভাইয়ের পথ ধরল মেজো আর ছোট ছেলে। তারাও তাদের ভাগের জমি বিক্রি করে কাটা কাপড়ের ব্যাবসা করতে চলে গেল দিনাজপুরে। সেখানেই বিয়েশাদি করে আবার ভাগও হয়ে গেল দু’ভাইয়ে।

শুধু তোতা থেকে গিয়েছিল মায়ের কাছে। সঙ্গে তার ভাগের কানির ওপর ধানপাটের জমি। খুবই বৈষয়িক ছেলে সে। গিরস্তি করে, হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে জমি কিছু বাড়িয়েছে। ধরণীর কাজ করে মায়ের জমানো টাকাপয়সা ছলচাতুরি করে নিয়েছে, নিয়ে নিজের আখের মোটামোটি গুছিয়ে ফেলেছে।

তবে এই নিয়ে দুঃখ নেই আলার মা’র। আর যাই হোক এই একটা ছেলে তো তাকে ছেড়ে যায়নি। বউ নিয়ে দূরের মানুষ হয়েও তো কাছেই আছে। একই চালার তলায় তো আছে। এই বা কম কী! আর নিজে যেমন করে একদিন মা’র বুকে লেগে ছিল তেমন করেই তো তার ছেলেটিকে দিয়ে দিয়েছে মা’কে। এই তো তার বুক জুড়ে আছে সেই ছেলে!

বাইরে তখন আলোর রেখা ফুটছে। টিনের বেড়ার ফাঁকফোকর দিয়ে ঢুকে ঘরের জমাট অন্ধকার ম্লান করে দিয়েছে সেই আলো। তবু মানুষের মুখ এই আলোয় পরিষ্কার দেখা যায় না। কিন্তু নাতির মুখটা আলার মা দেখতে চাইলে। মুখ গোঁজ করে শুয়ে আছে ছেলেটি। যেন তোতাই শুয়ে আছে। যেন সময়টা আজ না, যেন সময়টা বছর চল্লিশেক আগে। সেই বয়সের অপত্যস্নেহই যেন এই মুহূর্তে ফিরে এল আলার মা’র হাতে। গভীর মমতায় নাতির মাথায় হাত বুলাতে লাগল সে।

ঠিক তখনই দরজা ধাক্কাতে ধাক্কাতে একটা কচিকণ্ঠ ডাকল, দাদি ও দাদি। দাদি। ওডেন। আমি আজিজ গাওয়ালের পোলা হামেদ। মা’র বেদনা উঠছে। আমাগো বাইত্তে যাওন লাগবো।

এই এতটা বয়সেও মানুষের জন্মের কথা শুনলে রোমাঞ্চিত হয় আলার মা। সেই প্রথম যৌবনে নিজে চারবার মা হয়েছে। প্রতিবারই আশ্চর্য এক ধরনের ভয় আর রোমাঞ্চে শরীর মন ভরে থাকত। বেদনা ওঠার পর থেকে সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগমুহূর্ত পর্যন্ত যে ভয়ানক। কষ্ট, সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর, তার মুখখানি দেখার পর কোথায় উধাও হত সেই কষ্ট। নিজে ধরণী হওয়ার পর থেকে, অন্য নারীর সন্তান জন্মে সহায়তা করতে গিয়ে সে টের পেত সন্তান যেন অন্যের না, তার নিজেরই হচ্ছে। সে নিজেই যেন আপন গর্ভের অন্ধকার থেকে আলোকময় পৃথিবীতে টেনে হিঁচড়ে বের করে আনছে একজন ছোট্ট মানুষ। তারপর সেই সন্তানের সঙ্গে দলা পাকিয়ে না পড়তে চাওয়া ফুল অনেক সময় যেন নিজেই নিজের গর্ভের অন্ধকারে হাত ঢুকিয়ে বের করে আনছে, নিজেই নিজের ধরণী।

আজ হল তার অন্য অদ্ভুত এক অনুভূতি।

বানেছার আবার বাচ্চা হবে একথা সে জানে। কিন্তু বেদনা উঠেছে শুনে এই ভোররাতে আচমকাই আলার মা’র মনে হল বেদনা বানেছার না তার নিজেরই যেন উঠেছে। খানিকবাদে নিজেই যেন নিজের গর্ভ থেকে বের করে আনবে এক নতুন মুখ।

অনুভূতিটা বেশিক্ষণ থাকল না তার। কয়েক মুহূর্ত। চৌকি থেকে নামতে নামতে সে বলল, নাম না কইলেও গলার আওজ হুইন্নাঐ তরে আমি চিনতে পারতাম হামেদ। বেদনা উটছে কুনসুম?

হামেদ না নাদের বলল, আমরা আহনের ম্যালা আগে।

আইচ্ছা। তয় তরা ইট্টু খাড়। অজু কইরা নমজ পইড়া লই।

হামেদ বলল, দেরি অইয়া যাইবো দাদি। বাবায় কইছিল…

দরজা খুলে আলার মা হাসিমুখে বলল, না দেরি অইবো না। তরা বেবাকটি ভাইবইন আমার হাতে অইছচ। তর মা’র দশা আমি জানি। নমজ পইড়া যাওনেরও ম্যালা পর তর মা’র আহুজ পড়বো।

ঘরের ওটায় রাখা মাটির পুরানা ঠিলা থেকে পানি নিয়ে অজু করল আলার মা। আবার ঢুকে গেল ঘরে। চৌকিতে উঠে নামাজ পড়তে বসল।

বাইরের সাদা উঠানে নাদের আর হামেদ তখন চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। কোন ফাঁকে কাঁটা মুচড়ে হারিকেন নিভিয়েছে নাদের, হামেদ যেন তা খেয়ালই করেনি। এই বাড়িতে এলে তার নজর থাকে তালগাছের মাথায়। তালগাছের পাতায় পাতায় বাবুই পাখির বাসা। বহুকাল ধরে আছে বাসাগুলি। পুরানা হচ্ছে, ঝরে যাচ্ছে আবার নতুন বাসা তৈরি করছে বাবুইরা। গ্রামের এত বাড়িতে এত তালগাছ কিন্তু পাখিগুলি কেন যে শুধু এই গাছটাতেই বাসা বাঁধে!

এখন সকালবেলার আলো ফুটে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে বাসা থেকে বেরুতে শুরু করেছে পাখিরা। ক্যাচম্যাচ করে মাতিয়ে তুলছে চারদিক। কেউ বসেছে তালের পাতায় ডগায়, কেউ বাসার মুখে। কেউ কেউ ওড়াউড়ি করছে।

হামেদ মুগ্ধ চোখে পাখি দেখতে লাগল। কখন যে কিছুটা সময় কাটল টের পেল না, কখন যে নামাজ শেষ করে, ঘরের দরজা টেনে তাদের সামনে এসে দাঁড়াল আলার মা, টের পেল না।

হামেদকে ওইভাবে গাছের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে আলার মা বলল, কী মিয়াভাই, বাঐ দেহনি?

কিন্তু হামেদ কথা বলবার আগেই তার মনে হল বাবুই পাখির বাসার সঙ্গে নারীগর্ভের কোথায় যেন মিল। এরকম এক বাসার ভিতরই জন্মায় মানুষ। প্রথমে ডিম, ডিম ভেঙে ছানা, চোখ ফুটতে সময় লাগে, হাত পা নাক মুখ গজাতে সময় লাগে, তারপর একদিন পরিপূর্ণ এক মানবসন্তান বেরিয়ে আসে, বাবুইয়ের বাসা থেকে যেমন করে ভোরবেলা বেরোয় পাখিরা।

তারপর আলার মা’র মনে হল দুনিয়াটাই বুঝি এক বাবুই পাখির বাসা। এক নারীগর্ভ। এই দুনিয়ার থেকে, বাবুই পাখির বাসা নারীগর্ভ থেকে একদিন বেরিয়ে যেতে হবে সবাইকে। বেরিয়ে কোথায় যেতে হবে? কোন সে অচিন দুনিয়ায়! কেমন আলো হাওয়া সেই দুনিয়ার! কেমন রং আকাশ আর নদীর, কেমন রং গাছের পাতায়! কোন সুরে সেই দুনিয়ার গান ধরে পাখিরা! কোন দুঃখ সুখে, আনন্দ বেদনায় বেঁচে থাকে মানুষেরা!

.

কুট্টি লো কুট্টি
তরে দিলাম ছুট্টি!

দোতালা ঘরের উঠানের দিককার সিঁড়ি ভেঙে নেমে আসার সময় কেন যে আজ সকালে এই কথাটা মনে পড়ল কুট্টির! সেই কোন ছোটবেলার কথা। কোনও কোনওদিন দুপুরে দুই-চারদিন পর ভরপেট একদিন খাওয়া হলে সেই আনন্দে বিকালের দিকে তাদের বাড়ির গরিব উঠানে বোনদের নিয়ে বউয়াছি খেলতো কুট্টি। ছোটবোনগুলি খেলত তারচেয়ে ভাল। প্রতিবারই তাকে হারিয়ে এই কথাটা বলত বোনরা।

কুট্টি লো কুট্টি।
তরে দিলাম ছুট্টি!

এতকাল পর কেন যে আজ সকালবেলা কথাটা কুট্টির মনে পড়ল! তবে এই নিয়ে বেশি ভাববার সময় পেল না সে। তার আগেই পরিকে দেখতে পেল আমরুজ তলা দিয়ে বিষণ্ণভঙ্গিতে হেঁটে আসছে। একটু যেন উদাসও মেয়েটি। হেঁটে আসছিল আনমনা ভঙ্গিতে। কুট্টিকে দেখে কেমন যেন একটু চমকাল।

সিঁড়ি ভেঙে কুট্টি তখন উঠানে। সকালবেলার রোদ গাছপালার আড়াল আবডাল থেকে এসে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে উঠানে। মৃদু একটা হাওয়া আছে। চালতাগাছের ওদিকটায় পাখি ডাকছে। সব মিলিয়ে নিঝুম নির্জন পরিবেশ। এই পরিবেশে মানুষ কি মানুষকে আপনের চেয়েও বেশি আপন মনে করে? পরিকে কি কুট্টি তাই মনে করল? নয়তো এতদিনকার চেনা ছোট্ট মেয়েটিকে কেন অতি মায়াবী চোখে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল সে। বছর আট সাড়েআট আগে চোখের সামনে জন্মানো মেয়েটি আজ যেন আচমকা কেমন বড়সড়। ছিট কাপড়ের সস্তা পুরানা ফ্রকের আড়ালে গাবের মুচির মতন দেখা দিয়েছে তার স্তনরেখা, মুখখানি যদিও বিষণ্ণ তবু তাতে লুকিয়ে আছে অন্যরকমের এক লাবণ্য। ড্যাবড্যাবে উদাস চোখ দুইটায় একটু যেন মেয়েলি লজ্জার ছোঁয়া। আহা কোন ফাঁকে এতখানি বড় হয়ে গেল মেয়েটি? যদিও কুট্টির কোনও রক্ত সম্পর্কের আত্মীয় না পরি, পরির বাপ আজিজ গাওয়ালকে কুট্টি ডাকে দাদা, গ্রাম গিরস্তের এবাড়ি ওবাড়ির মধ্যে এরকম সম্পর্ক তো থাকেই, সেই সম্পর্কে কুট্টিকে পরি ডাকে ফুবু। কুট্টি তাকে পরি বলেই ডাকে। কখনও কখনও আদর করে মা-ও ডাকে।

আজ সকালে তাই ডাকল। মুখোন হাসিতে ভরিয়ে বলল, কী গো মা, আইজ এত বিয়ানবেলা এই বাইত্তে?

পরি উদাস গলায় বলল, এমতেঐ।

কাঁধে হাত দিয়ে পরিকে কাছে টানল কুট্টি। না, এমতেঐ তুমি আহহ নাই। তোমার মনডা জানি কেমুন উড়ু উড়ু। মুকহান কেমুন হুগনা। কী অইছে গো মা?

হেমুন কিছু না। মা’র অহন আহুজ পড়বো।

শুনে কুট্টি লাফিয়ে উঠল। কও কী? এইডা তো আমোদের কথা। তুমি মন খারাপ করছো ক্যান?

পরি কথা বলল না। অন্যদিকে তাকিয়ে রইল।

কুট্টি বলল, বেদনা উটছে কুনসুম?

বিয়াইন্না রাইত্রে। আলার মা দাদিও আইয়া পড়ছে।

তুই যে এই বাইত্তে আইলি তর অন্য ভাইবইনরা কো?

মায় আমারে কইছিলো বেবাকতেরে লইয়া হাজামবাড়ি যাইতে। আহুজ পড়নের পর বাবায় গিয়া ডাইক্কা আনবো। জরিরে দিয়া অগো আমি পাডাই দিছি। আমি যাই নাই।

ক্যা?

ভাল্লাগছিল না।

পরির চিবুক তুলে ধরে কুট্টি আবার বলল, ক্যান গো মা?

এমতেঐ।

একটু থেমে বলল, তোমারে কয়ডা কথা জিগামু ফুবু। তুমি আমারে কইবা তো? তুমি আমার উপরে চেতবা না তো?

কুট্টি সুন্দর করে হাসল। তার আগে আমার যে আরও কথা আছে মা।

কও?

তর বড়ভাইরা কো? নাদের হামেদ? বাইত্তে না তো?

না। দাদিরে বাইত্তে আইন্না মুড়ি মিডাই খাইলো তারবাদে কোনমিহি জানি গেল গা।

তয় বাইত্তে অহন কে?

খালি বাবায়।

আইজ্জাদায় (আজিজ দাদায়) আইজ গাওয়ালে যায় নাই?

না। মা’র আহুজ পড়তাছে আর বাবায় যাইবো গাওয়ালে? তাইলে কি বাবার আর রক্ষা আছে!

আজিজ যে খুবই মেউন্না (মেনিমুখো) পুরুষ একথা গ্রামের সবার মতো তার ছেলেমেয়েরাও জানে। তবু মেয়ের মুখে বাবাকে নিয়ে এই ভঙ্গিমার কথাটা ভাল লাগল না কুট্টির। এই নিয়ে পরিকে সে কিছু বলল না। কথা অন্যদিকে ঘুরাল। তুই অহনতরি খাচ নাই কিছু?

হ খাইছি।

কী খাইছ?

মুড়ি মিডাই।

আমি কিছু খাই নাই। খালি বড়বুজানরে খাওয়াইয়া ঘর থিকা বাইর অইছি, দেহি তুই।

বড়বুজানরে কী খাওয়াইলা ফুবু?

পাউরুডি আর দুদ। দুদের মইধ্যে চিনি মিশাইয়া পাউরুডি ভিজাইয়া ভিজাইয়া খাওয়াইলাম।

পাউরুডি পাইলা কই?

ঢাকা থিকা মাজরো বুজানে পাড়াইছে। পরি, পাউরুডি খাবি?

পাউরুটির কথা শুনে চোখ চকচক করে উঠল পরির। উদাস বিষণ্ণ মুখে গভীর আগ্রহ দেখা দিল। বুজানের পাউরুডি তুমি আমারে খাওয়াইবা কেমতে?

হেইডা তর চিন্তা করন লাগবো না। তুই আমার লগে রান্নঘরে আয়। পাউরুডির লগে। আরেকহান জিনিসও তরে আমি খাওয়াইতাছি।

কুট্টির পিছন পিছন রান্নাঘরের দিকে পা বাড়িয়ে পরি বলল, কী জিনিস?

চা। বুজানের খাওনের দুদ থিকা অনেকহানি দুদ আইজ আমি হামলাইয়া রাকছিলাম। হেই দুদ দিয়া ঘন কইরা চা বানামু। দুইমুঠ চিনি দিয়া কড়া মিষ্টি করুম চা। তারবাদে হেই চায়ে পাউরুডি ভিজাইয়া ভিজাইয়া তরে খাওয়ামু আমি খামু আর….

কথা শেষ না করে থামল কুট্টি।

কথাটা ধরল পরি। আর?

কুট্টি একটু আমতা আমতা করল। তারপর বলল, আর ওই যে আলফুদাদায় আছে না, আলফুদাদায়, এই বাড়ির কামলা, তারে ইট্টু দিমু।

কুট্টির আমতা আমতা করার কারণ বুঝল না পরি। সরল গলায় বলল, হেয়ও অহনতরি কিছু খায় নাই?

রান্নাঘরে ঢুকে কুট্টি ততক্ষণে মাটির চুলায় আগুন জ্বেলেছে। অ্যালুমিনিয়ামের ছোট্ট হাঁড়িতে গরম পানি চড়িয়েছে। এইসব কাজ করতে করতেই বলল, খাইছে। খাইয়া ঘর থিকা বাইর অইছে।

কী খাইছে?

পান্তাভাত আর পিয়াইজ।

তুমি বিয়ানবেলা কী খাও ফুবু?

আমিও পান্তাভাত খাই।

আইজ খাও নাই ক্যা?

রোজ রোজ একপদের জিনিস খাইতে ভাল্লাগে না। আইজ বিয়ানে বুজানরে পাউরুডি আর দুদ খাওনের সময় আমারও ইচ্ছা করছে ওই জিনিস খাইতে। তয় দুদ অতো পামু কই? যেডু দুদ হামলাইয়া রাকছি তাতে চা অইবো। ঘন দুদের চা’র লগে পাউরুডি খাইতেও খুব সাদ।

তয় এত পাউরুডি তুমি পাইবা কই? আমারে লইয়া তিনজন মাইনষে খাইবো?

কুট্টি আবার হাসল। হেই চিন্তা তর করন লাগবো না। একলগে আষ্টহান পাউরুডি পাড়াইছে মাজারো বুজানে। পয়লা দিনঐ একহান আমি হামলাইয়া রাকছি। আইজ হেইডা বাইর করুম।

একটু থেমে মুখের মজাদার ভঙ্গি করে বলল, ভাল জিনিস একলা খাইয়া আরাম নাই, বুজলি? ভাল জিনিস বেকতে মিল্লা খাইতে অয়। তুই না আইলে খাইতাম আমরা দুইজনে। অহন খামু তিনজনে। দেকবি ভাগে কম পড়লেও খাইতে আমোদ লাগবো। আর এই বাইত্তে এতদিন ধইরা আমি কাম করি কীর লেইগা জানচ?

না।

কীর লেইগা বড়বুজানের গু-মুত ছাপ করি? এত কষ্ট করি তার লেইগা?

না।

খালি খাওনের লেইগা। খালি ভাল ভালই খাওনের লেইগা। তিনওক্ত ভরপেট খাওনের লেইগা। খিদার কষ্ট আমি সইজ্জ করতে পারি না, এর লেইগা।

হাঁড়ির পানিতে তখন বলক এসেছে। দেখে উঠে দাঁড়াল কুট্টি। তুই বয়, দুদ চিনি পাউরুডি ছাকনি চার কাপ বেবাক আমি লইয়াইতাছি।

কুট্টি যখন দোতালা ঘরের সিঁড়ির কাছে, উঠানে তখন দুইটা কাক নামছে আর একটা শালিক। কাক দুইটা তক্কে তক্কে আছে কোন ফাঁকে রান্নাঘরে ঢুকে কিছু একটা ঠোঁটে নিয়ে উড়াল দিবে আর শালিক পাখিটা উঠানের মাটিতে লাফিয়ে লাফিয়ে খাবার খুঁজছে। পরি তাকিয়ে তাকিয়ে শালিক পাখি দেখছে, দোতলাঘরের সিঁড়ি ভেঙে পাঁচটা ফুটফুটা ছানা নিয়ে খুবই আয়েশি ভঙ্গিতে নেমে এল বিলাইটা। চালচলনে ধীর শান্ত ভাব কিন্তু ছানাগুলি তিড়িং বিড়িং করছে।

বিড়াল দেখে কাক দুটা উঠে গেল পশ্চিমের চালে আর শালিক পাখিটা উড়াল দিল চালতাগাছের দিকে।

ফিরে এসে দ্রুত হাতে সব গুছগাছ করে ফেলল কুট্টি। প্রথমে টিনের মগে করে আনা। দুধ ঢেলে দিল হাঁড়ির পানিতে। তারপর দিল চিনি, তারপর চা-পাতা। কোলের কাছে আদুরে ভঙ্গিতে ধরা একখান পাউরুটি। যেন বুকের দুধ খাওয়া শিশুর মতো পাউরুটিখান লেগে আছে তার বুকে। হাজার কাজের ব্যস্ততায়ও কোনও কোনও মা যেমন করে কোলের শিশুকে বুকের দুধ খাওয়াইয়া ব্যস্ত রাখে, কুট্টির কোলে পাউরুটি অবস্থা তেমন।

দেখতে দেখতে হাঁড়ির চায়ে বলক এল। বলকানো গরম পানিতে দুধ চিনি চা-পাতা ফেলার পর নিস্তেজ হয়েছিল পানি। পলকেই আবার নতুন করে বলকাতে লাগল। হাঁড়ির তলায় জমা চিনি গলাবার জন্য পরিষ্কার হাতায় চা-টা কয়েকবার নাড়াচাড়া করল কুট্টি। সেই ফাঁকে বলক দিতে দিতে যেন দুধের মতো উতরাইয়া (উপচে) না পড়ে চা সেজন্য হাঁড়িতে ফুঁ দিতে লাগল। কুট্টির ফুয়ে ফুয়ে হাঁড়ি থেকে উঠল চায়ের গন্ধ। নির্জন মিয়াবাড়ি মাতোয়ারা হয়ে গেল। আর এই গন্ধে পরির মন মুখ থেকে উধাও হল বিষণ্ণতা, মনের ভিতরটা চনমন করে উঠল আশ্চর্য এক আনন্দে। মুখে ফুটে উঠল মুগ্ধতার হাসি। নিজের অজান্তেই আমুদে গলায় বলল, ইস চা-র ঘেরানডা কী! ঘেরানেঐ পেড ভইরা যায়!

চুলারপারে রাখা লুচনি দিয়ে চায়ের হাঁড়ি নামাল কুট্টি। মিষ্টি করে হাসল। খাইতে দেকবি কেমুন লাগে। এক চুমুকেঐ কম্মো সারা।

উঠানে তখন মা বিড়ালের সঙ্গে পাঁচটি ছানা। পুবদিক থেকে আসা রোদ রান্নাঘর ছাড়িয়ে কিছুটা দূরে গিয়ে পড়েছে। রান্নাঘরের ছেমায় অনেকখানি জায়গা ছায়াময়। বিড়ালটি আয়েস করে সেই ছায়ায় গা এলিয়েছে আর পাঁচটি ছানা তার কোলের কাছে দলা পাকিয়ে এ ওকে ধাক্কা দিয়ে দুধ খাওয়ার চেষ্টা করছে। বিড়ালটি প্রথমে খানিক উদাস হয়ে রইল তারপর কোনও কোনও ছানার ঘাড়মাথা চেটে দিতে লাগল।

চুলারপারে তিনটা মগ আগেই এনে রেখেছিল কুট্টি। একটা মগের পাশে কোরা রঙের পাতলা একটুকরা কাপড় ছিল। এটা ছাঁকনি। চুলা থেকে চায়ের হাঁড়ি নামাবার আগেই কাপড়ের টুকরাটা একটা মগের মুখে যত্ন করে মেলে দিয়েছিল। এখন দুইহাতে হাঁড়ি ধরে পরিকে বলল, ছাকনিডা ধইরা রাখ। চায় ঢালি।

পরি প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ধরতে গিয়েছিল, তারপরই ভয় পেল। আমার হাতের মইদ্যে আবার চা ঢাইলা দিবা না তো?

কুট্টি হাসল। আরে না ছেমড়ি।

কুট্টির কথামতনই ছাঁকনিটা ধরল পরি। নিপুণ হাতে চা ঢালল কুট্টি। একে একে তিনটা মগেই ঢালল। তবে প্রথম মগটায় একটু বেশি। তারপর ছাঁকনিতে জমা চায়ের পাতাসহ ছাঁকনি দলামোচড়া করে চায়ের খালি হাঁড়িতে রেখে দিল। কোল থেকে নামাল পাউরুটি।

তখুনি নিঃশব্দে, ছায়ার মতো চালতাতলার দিক থেকে রান্নাঘরের সামনে হেঁটে এল আলফু। কোন ফাঁকে কাক দুইটা আবার এসেছিল উঠানে, শালিক পাখিটা নেমেছিল। মাথায় কদমছাট চুল, লুঙ্গির ওপর মাজার কাছে গামছা বাঁধা, তাগড়া জোয়ান কালোপানা শরীর চকচক করছে ঘামে, এমন একজন মানুষকে হেঁটে আসতে দেখে পাখিগুলি ভয়ার্ত ভঙ্গিতে উড়াল দিল। কিন্তু বিড়ালটি নির্বিকার, সে নড়লই না। ছানাগুলিও গা করল না। তারা তাদের মতো খাদ্যের সংগ্রামে লিপ্ত হয়ে রইল।

আচমকা আলফুকে দেখবে ভাবেনি কুট্টি। কিন্তু দেখে ভাল লাগল। শরীর আর মনের ভিতর আজকাল যখন তখন হওয়া কাঁপনটা হল। চোখের তারা নেচে উঠল, মুখে ফুটে উঠল লাজুক মিষ্টি হাসি। একপলক আলফুর মুখের দিকে তাকিয়েই চোখ নামাল। বড় একখানা থালায় পাউরুটি রেখে, পাউরুটির উপরকার পাতলা কাগজ ছিঁড়তে ছিঁড়তে বলল, আপনে কেমতে আইলেন?

আলফু বলল, ক্যা হাঁইট্টা আইলাম।

কুট্টি আবার যেন লজ্জা পেল। না আমি মনে করছিলাম আপনে চাউলতা তলায় আছেন। আপনেরে গিয়া ডাইক্কা আনুম।

কীর লেইগা? কাম আছেনি?

না।

তয়?

চা বানাইছি। পাউরুডিও আছে। পরিরে লইয়া খামু। মনে করলাম আপনেরেও ডাক দেই। আপনেও আমাগো লগে খান।

আলফু দোনোমোনো গলায় বলল, বিয়ানে তো আমি খাইছি।

খাইছেন যে হেইডা তো আমি জানিঐ। আমিঐত্তো আপনের খাওনদাওন দেই।

হ। আইজও তুমিই দিলা।

কুট্টি আবার একপলক আলফুর দিকে তাকাল। পাউরুটির কাটা টুকরোগুলি ছাড়াতে ছাড়াতে বলল, পান্তাভাত পেড়ে থাকে কতক্ষুন? বহেন।

হাতের কাছে রাখা একখান পিড়ি এগিয়ে দিল আলফুকে।

কোমর থেকে গামছা খুলে তেলতেলে মুখটা গলাটা মুছল আলফু। গামছাটা ডানদিককার কাঁধে ফেলে রান্নাঘরের ছেমায় বসল। পরিকে বলল, তুই আইছচ কুনসুম?

পরি বলল, অনেকক্ষুন।

যে মগটায় বেশি চা সেই মগ আর চার টুকরা পাউরুটি আলফুকে দিল কুট্টি। নেন। চায়ে ভিজাইয়া ভিজাইয়া খান। বহুত সাদ লাগব।

নিঃশব্দে জিনিসগুলি নিল আলফু। খেতে শুরু করল।

পরির মগটা পরিকে দিল কুট্টি, নিজেরটা নিল। পরিকে দিল তিন টুকরা রুটি, নিজে নিল তিন টুকরা, চায়ে ভিজিয়ে ভিজিয়ে খেতে শুরু করল।

খেতে খেতে আলফু তখন অন্য একটা কাজ করছিল। নিজে যতবার মুখে দিচ্ছিল রুটি ততবারই রুটির পোড়া দিকটার কিছু না কিছু ছুঁড়ে দিচ্ছিল উঠানের কাক শালিকের দিকে, বিড়ালদের দিকে। মনোহর পাউরুটি মুখের কাছে পেয়ে ছানাদের দুধ দেওয়া ফেলে উঠে দাঁড়িয়েছে মা বিড়াল, টুকটাক করে খাচ্ছে পাউরুটি। তার দেখাদেখি ছানাগুলিও ছুটাছুটি করছে পাউরুটির লোভে। বিড়ালের দিকে ছুঁড়ে দেওয়া পাউরুটি ঠোঁটে তুলতে তক্কে তক্কে থাকছে কাকগুলি, কাকেরটা ছিনিয়ে নিতে ছুটছে বেড়ালেরা, শালিক পাখিটা নিরীহ ধরনের বলে এই টানাহ্যাঁচড়ার ভিতর ঢুকতে পারছে না। দূরে দাঁড়িয়ে অসহায়, ক্ষুধার্ত চোখে কাণ্ডটা দেখছে।

শালিক পাখিটার কথা ভেবে তার মুখের কাছে ছোট্ট একটা রুটির টুকরা ছুঁড়ে দিল আলফু। এই দেখে পরি খুব মজা পেল। হি হি করে হেসে বলল, আলফু কাকায় দিহি পোলাপানের লাহান করতাছে।

চায়ে বড় করে চুমুক দিয়ে আলফু বলল, পোলাপানের লাহান করি না মা। আমাগো খিদা আছে, অগোও তো আছে। আল্লার দুনিয়ার বেবাক জীবেরই পেট আছে, খিদা আছে। আমরা তিনজন মানুষ খাইতাছি আর অরা পেডের খিদা লইয়া চাইয়া রইছে এইডা আমার সইজ্জ অয় না মা। এর লেইগা এমুন করতাছি।

পরি বোধহয় আলফুর কথা বুঝতে পারল না। কুট্টি পারল। মনে পড়ল সেই দিনটির কথা। নিজের ভাগের খাবার নিয়ে দুপুরবেলা চালতাতলায় চলে গিয়েছিল আলফু। নিজে আধপেটা খেয়ে মাকুন্দা কাশেমকে খাইয়েছিল। সেদিন মানুষটার মনের অনেকখানিই যেন চিনে ফেলেছিল কুট্টি। আজ চিনল আরও অনেকখানি। চিনে চা পাউরুটি খাওয়ার কথা ভুলে অপলক চোখে আলফুর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।

পরি খেয়াল করল না ব্যাপারটা, আলফু করল। একপলক কুট্টির মুখের দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করে চা পাউরুটি খাওয়া শেষ করল। তারপর নিঃশব্দে উঠে দাঁড়াল, চালতাতলার দিকে চলে গেল।

কুট্টি তখনও তেমন করে তাকিয়ে আছে। তার চোখের সামনে পশ্চিম উত্তরভিটির ঘর দুইখানার মাঝখানকার চিরলপথে হারিয়ে যাচ্ছে মানুষ। পিছন থেকে তার কালোপানা কোমর পিঠ আর শক্তপোক্ত ঘাড় দেখা যাচ্ছে। এই দেখে শরীরের খুব ভিতরে আজ সকালে আবার অদ্ভুত এক রোমাঞ্চ হল কুট্টির, অদ্ভুত এক কাঁপন লাগল। নিজের অজান্তেই কুট্টি কেমন লাজুক হয়ে গেল।

চা পাউরুটি শেষ করে পরির মুখে তখন ভারী আরামদায়ক একটা লাবণ্য। হাসিমুখে কুট্টির দিকে তাকিয়েছে। তাকিয়ে খেয়াল করল কুট্টি বেশ আনমনা। চায়ের মগ সামনে, পাউরুটির খণ্ড হাতে, চা পাউরুটি মুখে দিচ্ছে না সে।

পরি বলল, কী অইছে ফুবু?

কুট্টি চমকাল। কো কী অইছে? কিচ্ছু না।

তয় এমুন টাসকি ধইরা রইছো ক্যা? খাইতাছো না ক্যা?

কুট্টি তাড়াতাড়ি চায়ে পাউরুটি চুবাল। তুই শ্যাষ করছ?

কুনসুম!

আর ইট্টু চা নিবি, আমার ভাগ থিকা আধাহান রুডি?

না।

ক্যা শরম করতাছে নি?

আরে না। আমি আর খাইতে পারুম না। আমার প্যাট ভইরা গেছে।

নিঃশব্দে কুট্টি তারপর নিজের খাওয়া শেষ করল। যখন শেষ কামড় রুটি মুখে দিয়েছে, দিয়েই চায়ের মগে চুমুক দিয়েছে তখনই পরি বলল, অহন হেই কথাডা তোমারে জিগামু ফুকু?

কুট্টি চায়ের মগ নামিয়ে আঁচলে মুখহাত মুছে আনমনা গলায় বলল, জিগা।

মাইনষের পোলাপান অয় ক্যা?

এই ধরনের একটা প্রশ্ন করবে পরি এটা কল্পনাও করেনি কুট্টি। পরির মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, কী কইলি তুই?

হ। মাইনষের পোলাপান অয় ক্যা? কেমতে অয়? এই যে বচ্ছর বচ্ছর মা’র ঘরে খালি আমরা হইতাছি এইডা কেমতে অয়? ক্যান অয়?

এইডা তরে আমি কেমতে বুজাই। তুই এত ছোড মাইয়া।

ছোড অই আর যাঐ অই তুমি আমারে বুজাও। আমার এইডা বুজতে অইবোঐ।

ক্যান?

মা’র যে বচ্ছর বচ্ছর খালি পোলাপান অয় এইডা আমার ভাল্লাগে না। বেদনা ওডনের পর মায় যে এত কষ্ট পায়, দেইক্কা আমার সইজ্জ অয় না। কান্দন আহে।

ও এর লেইগাঐ জানতে চাইতাছচ?

হ।

পরির মাথায় পিঠে মায়াবী ভঙ্গিতে হাত বুলাল কুট্টি। এইডা দুনিয়ার নিয়ম মা। মাইয়ারা বড় অইলে তাগো বিয়া অয়। বিয়া অওনের পর পোলাপান অয়।

এইডা আমি জানি। অয় কেমতে?

তুই যহন বড় অবি, তর যহন বিয়া অইবো, তহন বুজবি কেমতে অয়।

আমি ফুবু কোনওদিন বিয়া বমু না।

ক্যা?

বিয়া বইলেঐত্তো পোলাপান অইবো। পোলাপান অওন বহুত কষ্টের। মাসের পর মাস পেটহান ফুইল্লা থাকে। তারবাদে ওডে বেদনা। মা’রে দেহি বেদনার কষ্টে কেমুন কোঁকায়। তারবাদে পোলাপান হওনের পরও তো ঝামেলা কম না। তারে বুকের দুদ খাওয়াও, গোরুর দুদ তালমিচরি খাওয়াও। তেল ডলো। বেবাকঐ বহুত কষ্টের। আইচ্ছা ফুবু, এত কষ্টের পরও মাইনষে পোলাপান হওয়ায় ক্যা?

কুট্টি আবার হাসল। এইডাও তুই বড় অইলে বুজবি।

পরি এবার কুট্টির মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, মাইয়ারা ডাঙ্গর অইলে বিয়া ছাড়াও কি তাগো পোলাপান অয়?

কুট্টি থতমত খেল। তারপরই নিজেকে সামলাল। তুই অহন বাইত্তে যা পরি। দেকগা তর ভাইবইন অইলো নি? তুই ইট্টু বড় হ, এই হগল কথার বেবাক জব তরে আমি দিমু।

পরি উঠে দাঁড়াল। যাইতাছি। তয় নিজেগো বাইত্তে যামু না। যামু হাজামবাড়ি। নিজেগো বাইত্তে যাইতে আমার অহন ভাল্লাগবো না।

ক্যা?

অহনতরি যুদি আহুজ না পইড়া থাকে তয় মায় তো চিল্লাচিল্লি দাপড়া দাপড়ি করবো। হেইডা আমি সইজ্জ করতে পারুম না। মা’র আহুজ পড়নের পর বাবায় গিয়া আমগো। হাজামবাড়ি থিকা ডাইক্কা আনবো।

পরি চলে যাওয়ার পর আশ্চর্য এক অনুভূতি হতে লাগল কুট্টির। মনে হল তার শরীরের ভিতর, গর্ভের অন্ধকারে যেন অঙ্কুরিত হচ্ছে এক মানব শিশু। আস্তে ধীরে যেন বড় হচ্ছে সে। পৃথিবীর আলো হাওয়ায় যেন বেরিয়ে আসতে চাইছে কিন্তু শরীরে কুট্টির কোনও ব্যথা বেদনা নাই। আছে অপরিসীম এক রোমাঞ্চ, আছে অপরিসীম এক উত্তেজনা। গভীর এক ভাললাগা।

প্রায় সঙ্গে সঙ্গে আরেকজন মানুষের তাগড়া জোয়ান কালোপানা শরীর ভেসে উঠল কুট্টির চোখে। মাথাভরতি কদমছাট চুল তার, পাথরের মতো নির্বিকার মুখ। সেই নির্বিকার মুখেই যেন লুকিয়ে আছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম পুরুষের সৌন্দর্য। চোখ তার ভাটার মতো। পলক খুবই কম পড়ে চোখে, তবু সেই চোখেই যেন লুকিয়ে আছে দুনিয়ার সব মায়া।

কেন যে কুট্টি তারপর মনে মনে বলল,

কুট্টি লো কুট্টি
তরে দিলাম ছুট্টি!

.

বড়ঘরের ছেমায় বসে বিড়ি টানছে আজিজ।

উঠানের উত্তর কোনার চেঁকিঘরে শুয়ে প্রসব বেদনায় কাতরাচ্ছে বানেছা। বেলা অনেকখানি হয়েছে। আলার মাও এসেছে অনেকক্ষণ কিন্তু এখনও ভূমিষ্ঠ হয়নি সন্তান। কখন হবে আল্লাহ মালুম। কতক্ষণ ব্যথায় কাতরাবে বানেছা, আল্লাহ মালুম।

আজিজ শুনতে পাচ্ছিল বেশ শব্দ করেই বানেছাকে থেকে থেকে বুঝ দিচ্ছে আলার মা। এতো চিল্লাইস না ছেমড়ি। আর ইট্র সইজ্জ কর। এইবার কি তর পয়লা আহুজ পড়তাছে যে এমুন করতাছস?

বেদনা ওঠার পর প্রতিবারই মাথায় বিকার উঠে যায় বানেছার। বাচ্চা যত তলপেটের তলার দিকে নামে বিকারটা ততই ওঠে মাথার দিকে। তখন যা মনে হয় বলে ফেলে। বাছবিচার করে না কাকে কী বলছে। দুই-একবার তো আজিজের সঙ্গে সহবাস নিয়েও এমন আকথা কুকথা বলেছে শুনে কানে আঙুল দিতে হয়েছে আলার মা’র। ওই অবস্থায়ও ছনুবুড়ি সহ্য করতে পারেনি সেসব কথা। ছ্যা ছ্যা করে উঠেছে। ইস, পোলাপান য্যান আর কেঐর অয় না, পোলাপান য্যান অর খালি একলাঐ অইতাছে। এত যহন কষ্ট তয় বচ্ছর বচ্ছর হওয়ায় ক্যা? জামাইর লগে হোয়নের সময় মনে থাকে না।

একদিকে বউর কথা আরেক দিকে মায়ের, আজিজ পড়ে যায় মাঝখানে। সে আর কী করে, যেন কিছুই শুনছে না এমন ভঙ্গিতে উদাস হয়ে বিড়ি টানতে থাকে। কখনও কখনও ভার থেকে অকারণেই নামায় গাওয়ালের জিনিসপত্র, অকারণেই ঝাড়পোছ করে, আবার সাজায় ভার। কখনও পোলাপান নিয়ে নেমে যায় বাড়ির ভাঙনের দিকে। তাদের সঙ্গে গল্পগুজব করে। আসলে বানেছার চিৎকার আকথা কুকথা থেকে সরিয়ে রাখতে চায় নিজেকে পোলাপানকে।

এবার বানেছা নিজেই বেশ একটা বুদ্ধিমানের কাজ করেছে। আহুজ ঘরে ঢোকার আগেই পরিকে বলে গেছে সবাইকে নিয়ে মুড়ি মিঠাই খেয়ে যেন হাজামবাড়ি চলে যায়। অর্থাৎ পোলাপান বড় হয়েছে, এই অবস্থায় মায়ের আহুজ পড়ার সময়কার চিৎকার চেঁচামেচি যেন তাদের কানে না যায়।

ব্যাপারটা খুবই ভাল লেগেছে আজিজের। যাক বানেছা তা হলে মানুষ হয়ে উঠছে। দিনে দিনে বুদ্ধি বাড়ছে তার।

এখন আচমকা আলার মা’র কথা শুনে ব্যথায় কাতরাতে কাতরাতেও এমন একখান। গাল আলার মা’কে সে দিল, শুনে বিড়িতে টান দিতে ভুলে গেল আজিজ। বানেছাকে নিয়ে খানিক আগের ধারণা তছনছ হয়ে গেল। মনে মনে খুবই হায়আপশোস করল সে। ইস এইরকম একহান মাগিরে বিয়া করছি আমি! এইরকম একহান মাগির লগে হুইয়া বচ্ছর বচ্ছর পোলাপান হওয়াই। পুরুষাঙ্গ আমার বেলেড দিয়া কাইট্টা হালান উচিত।

তবে বানেছার ওই অশ্লীল গালাগাল গায়ে মাখল না আলার মা। সে এসবে অভ্যস্ত। দীর্ঘকাল ধরে মানুষের বাচ্চা হওয়াতে হওয়াতে বুঝে গেছে জন্ম দেওয়ার সময়কার কষ্টের কোনও তুলনা এই পৃথিবীতে নাই। জন্ম যে দেয়, কষ্টটা শুধু সেই বোঝে। আলার মা নিজেও তো চারবার মা হয়েছে। সুতরাং বানেছার ওপর একটুও রাগল না সে। বানেছার খোলা তলপেটে মায়াবী ভঙ্গিতে হাত বুলিয়ে শিশুকে আদর করার মতো গলায় বলল, এমুন কইরো না মা। ইট্টু সইজ্জ করো।

তারপর উঠে দাঁড়াল।

বানেছার চোখ তখন পাকা আমরুজের মতন ঘোলাটে হয়ে উঠেছে। দৃষ্টি অচেনা। মুখে ভয়ানক যন্ত্রণার ছাপ। গ্রাম সম্পর্কে আলার মা তার চাচি শাশুড়ি। এমনিতে খুবই সয়সম্মান। করে তার সঙ্গে কথা বলে। কিন্তু এখন বানেছা আর বানেছা নাই। এখন সে অন্য মানুষ। আলার মা’কে উঠতে দেখেই বিকারগ্রস্ত খেকুরে গলায় বলল, ওই মাগি, কই যাচ তুই? আমারে এই অবস্থায় হালাইয়া কই যাচ তুই?

কথাগুলি আলার মা গায়েই মাখল না। নির্বিকার গলায় বলল, ইট্টু বাইরে থিকা আহি মা?

ক্যা, বাইরে তর কোন নাঙ্গ আছে?

আলার মা ফোকলা মুখে হাসল। এমুন করিচ না মা। আমি আইতাছি।

আর কোনওদিকে না তাকিয়ে ঘরের ঝপ সরিয়ে বেরিয়ে এল। বানেছা তখন কোরবানির গোরুর অর্ধেক গলাকাটা হওয়ার পর কোনও কোনও গোরু যেমন জান্তব শব্দ করে, তেমন করছে।

এদিকে আলার মা’কে বেরিয়ে আসতে দেখেই দিশাহারা ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়িয়েছে আজিজ। কী অইলো চাচি? তুমি দিহি বাইর অইয়া আইলা?

আলার মা হাসল। না অন্য কিছু না। আহুজ পড়তে দেরি অইবো।

ও আইচ্ছা।

আবার আগের জায়গায় বসল আজিজ। দেরি কি বেশি অইবো?

মনে অয়।

একটু থেমে বলল, আজিজ, মুড়ি মিডাই কিছু আছেনি ঘরে?

হ চাচি আছে।

ডালায় কইরা আমারে ইট্টু দে বাজান। বেইল তো অনেকহানি অইছে। খিদা লাগছে আমার।

দিতাছি, দিতাছি।

বলে ব্যস্তভঙ্গিতে ঘরে ঢুকল আজিজ। বেতের ছোট ডালায় একডালা মুড়ি আর ছোট্ট একখান খেজুড়ি গুড়ের অর্ধেকটা এনে আলার মা’কে দিল। অ্যালুমিনিয়ামের গেলাসে করে এক গেলাস পানিও এনে দিল।

বড়ঘরের ওটায় নিজেই পিঁড়ি এনে বসেছে আলার মা। বসে ফোকলা মুখে গুড়মুড়ি খেতে লাগল। বানেছা তখনও সমানে কঁকাকঁকি করছে। আলার মা আজিজ কেউ তা পাত্তা দিচ্ছে না।

উঠানে বেশ রোদ। চারদিক খা খা করছে রোদে। আস্তে ধীরে তেতে উঠছে গ্রাম গেরস্তের উঠান পালান, ঘরবাড়ি। বাড়ির নামার দিককার আমগাছটার ডালে বসে হাঁ করে আছে একটা দাঁড়কাক। গরম বেশি পড়লে ক্লান্তিতে এমন ঠোঁট ফাঁক করে রাখে দাঁড়কাকগুলি।

এই সকালেই কি কাকের হাঁ করার মতন গরম পড়ে গেল? এখনও তো চোত বৈশাখ মাস এল না! এখনই এই! চোত বৈশাখে তা হলে কেমন গরম পড়বে এবার!

হাঁ করা দাঁড়কাকের দিকে তাকিয়ে আলার মা বলল, ইবার মনে হয় গরম বেশি পড়ব রে আজিজ।

আজিজ বলল, মনে অয়।

তর খেতে ধান অইছে কেমুন?

ইরি তো, মন্দ অয় নাই।

বর্গা দিছস কারে?

আর কারে, আরফাইন্নারে। তোমাগো খেতে অইছে কেমুন?

তোতা নিজে বোনে তো, ধানডা খুব ভাল অয়।

আমিও যুদি নিজে চুইতে (চষতে) পারতাম তাইলে আরও ভাল চালাইতে পারতাম সংসার।

একমুঠ মুড়ি মুখে দিয়ে আলার মা বলল, এমুন গলা হুগাইস না বাজান। আল্লার কাছে শুকুর কর। অহনও আল্লায় তরে ভালঐ রাকছে। গাওয়াল কইরা ভাল রুজি করচ, খেতের ধান আছে।

তারবাদেও সংসার ভাল চালাইতে পারি না।

কচ কী?

হ। কেমতে চালামু কও? এতডি পোলাপান!

শুনে আলার মা বিরক্ত হল। তয় পোলাপান এত হওয়াচ ক্যা?

কী করুম কও? পোলাপান হওয়ান না হওয়ান কি আমার হাতে?

তয় কার হাতে?

আল্লার হাতে।

এই হগল কথা কইচ না। এইডি আগিলা দিনের মাইনষের লাহান কথা। আইজকাল কত অষইদ-বিষইদ বাইর অইছে, মাইয়াগো অষইদ, বেডাগো জিনিস।

আজিজ লাজুক গলায় বলল, হ, ওই হগল আমি জানি।

তয়?

সম্পর্কে তুমি হও আমার চাচি, এই হগল কথা কেমতে কই তোমারে? তয় ইট্টুহানি খালি কই, আমি পারি না তোমাগো বউর লেইগা।

কী?

হ। আমি যা চাই হেয় তা চায় না।

বউ খালি পোলাপান চায়?

তাও না।

তয়?

কথাডা যে তোমারে কেমতে কই! অষইদ বিষইদ কোনও কিছু তোমাগো বউ মানতে চায় না। হের বলে ভাল্লাগে না।

মুড়ি শেষ করে ডালাটা নামিয়ে রাখল আলার মা। আমি তর কথা বুজছি। তয় বউডার এই দশার লেইগা তুইই দায়ী।

কেমতে?

তুই মেউন্না পোলা। বউডারে শাসন করতে পারচ নাই।

কেমতে শাসন করুম?

এই শাসন কেঐ কাঐরে হিগাইতে পারে না। এই লইয়া সাতহান পোলাপান অইবো তর। তর আর তর বউর অহনও যা বয়স এমতে চললে পোনরো-ষোলডা পোলাপান অইয়া যাইবো। বউরে এইডা বুজা। নাইলে না খাইয়া মরবি।

বানেছার কাতরানো তখন আরও বেড়েছে। কাতরানোর শব্দে আলার মা বুঝতে পারছে সময় ঘনিয়ে আসছে। উত্তরের ঘরের দিকে পা বাড়িয়েছে, আজিজ উঠে দাঁড়াল, খাড়ও চাচি।

আলার মা দাঁড়াল। কী?

তোমারে একহান কথা কইতে চাই।

ক।

তয় কথাডা গোপন। তুমি আর আমি ছাড়া কেঐ জানবো না।

আইচ্ছা ক।

তার আগে তুমি আমারে কথা দেও, তুমি আর আমি ছাড়া এইডা কেঐ জানবো না।

আইচ্ছা।

আজিজ আলার মা’র গা ঘেঁষে দাঁড়াল। কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলল, চাচি, বানেছা তো আমার কথা হোনে না। হোনলে বছর বছর পোলাপান অইতো না অর। তয় এই যে পোলাপান খালি অইতেই আছে, খাওনের মুখ খালি বাড়তাছে, আমি তো কুলাইতে পারি না চাচি। যদি এমুন কইরা পোলাপান খালি অইতেই থাকে তয় তো কয়দিন পরে ভাত জোটব না আমার।

ওদিকে বানেছা কাতরাচ্ছে এদিকে কথার সঙ্গে লেজ জুড়ে দিচ্ছে আজিজ, কথা যেন শেষই হয় না। আল্লায়ই জানে ওদিকে বানেছার বাচ্চা গর্ভ থেকে মাথা বের করে ফেলল কি না।

আলার মা বিরক্ত হল। অস্থির গলায় বলল, তাড়াতাড়ি ক ছেমড়া। বউর দশা ভাল না।

তবু যেন কথার লেজ গুটাতেই পারে না আজিজ। বলল, তুমি আমারে ইট্টু সাহাইয্য কর চাচি।

কী সাহাইয্য ক।

পোলাপান হওনের সময় বলে এমুন কোনও কোনও ব্যবস্থা আছে যা করলে পোলাপান আর কোনওদিন অয় না। ওইরকম একহান ব্যবস্থা তুমি কইরা দেও।

আলার মা বিনীত গলায় বলল, ওইরকম কোনও ব্যবস্থা আমি জানি না বাজান। ওই হগল অইলো ডাক্তারগো কাম। ডাক্তাররা পারে। আমি পারি না।

অনেক ধরণীরাও বলে পারে?

কইতে পারি না। তয় আমার মনে অয় না।

আর নাইলে অন্য একহান কাম করো।

কী কাম।

এমুন একহান ব্যবস্থা আইজ বানেছার ভিতরে কইরা দেও, বচ্ছর বচ্ছর পোলাপান অর হোক, তয় অয় য্যান মরা। জেতা পোলাপান য্যান আর না অয়।

শুনে হতভম্ব হয়ে গেল আলার মা। কোনওরকমে বলল, কচ কী বাজান?

হ।

এইরকম কোনও পথও আমার জানা নাই বাজান। জীবনভর ধরণীর কাম কইরা যাইতাছি, এমুন কথা কোনওদিন হুনিও নাই। এমুন কোনও পথ আছে, জানিও না। এইবারের বাচ্চাডা অইয়া যাওনের পর তুই বাজান বউরে ডাক্তারের কাছে লইয়া যাই। ডাক্তাররা ব্যবস্থা কইরা দিবো।

বানেছা মইরা গেলেও ডাক্তারের কাছে যাইবো না।

তয় তুই যা।

আমি গিয়া কী করুম?

বেডারা যাতে বাপ অইতে না পারে হেই ব্যবস্থাও ডাক্তারগো কাছে আছে।

বুজছি। অরাপেশন (অপারেশন)। কী টেমি জানি কয় হেই অরাপেশনরে। না গো চাচি হেইডা আমি করাইতে পারুম না। আমার ডর করে।

তয় আর করনের কিছু নাই।

আলার মা উত্তরের ঘরের দিকে পা বাড়িয়েছে, থাবা দিয়ে তার হাতটা ধরল আজিজ। তয় আর একহান কাম তুমি আমার কইরা দেও চাচি। এইবার যেইডা অইবো হেইডা যাতে না বাঁচে….।

আজিজের কথা শেষ হওয়ার আগেই রাগী বেঁজির মতন ফুঁসে উঠল আলার মা। কী, কী কইলি তুই? আমারে দিয়া তুই মানুষ খুন করাইতে চাচ? একমিনিটের আয়ু হোক নাইলে একশো বচ্ছরের হোক, মানুষ মানুষঐ। ওইরকম মানুষ খুন করতে কচ তুই আমারে? আমি মানুষরে জন্ম দিতে সাহাইয্য করি, মারতে না। আমি ধাত্রী, ঘাত্রী (ঘাতক অর্থে) না। তর বউর এই দশা না অইলে একটা মিনিটও তর বাইত্তে আমি থাকতাম না। প্রসব যন্ত্রণায় কষ্ট পাওয়া মাইনষেরে হালায় গেলে আল্লায় আমারে কোনওদিন মাপ করবো না। এর লেইগা তর বাচ্চাডা আমি হওয়াই দিয়া যাইতাছি। নাইলে থাকতাম না তর বাইত্তে। আরে তুই কেমুন মানুষ? কেমুন বেড়া? বউরে বুজাইতে পারচ না, নিজে ডরে বাপ অওনের খেমতা নষ্ট করতে চাচ না, চাচ অন্যেরে দিয়া মানুষ খুন করাইতে! ভিতরে ভিতরে তুই যে এত বদ এইডা কোনওদিন বুজি নাই আইজ্জা। তারবাদেও তরে যহন কথা দিছি এই হগল কথা। আমি কেঐরে কমু না। মনের মইদ্যে চাইপ্পা রাখুম।

আলার মা আর দাঁড়াল না। ঢেঁকিঘরে গিয়ে ঢুকল।

আজিজ তখন পুরানা গাছের মতো স্থির। মাটির দিকে তাকিয়ে নিথর হয়ে আছে। চোখের ভিতর এখন আর হিসাবের খেরোখাতাটা খুলল না তার। কাঁথার তলা থেকে কচ্ছপের মতন নিঃশব্দে মাথা বের করল তছি। মুখের কাছে বসা মা’কে ফিসফিসা গলায় বলল, বিয়ানবেলা বাইত্তে এত চিল্লাচিল্লি কীয়ের? এত পোলাপান আইলো কইত থিকা?

তছির মাথায় কদমফুলে প্রথম রেণু আসার মতো বিনবিন চুল। দিনরাত কাঁথার তলায় শুয়ে থাকার ফলে শ্যামলা মুখে চাপাপড়া ঘাসের রং ধরেছে। কথাবার্তা মানুষের সঙ্গে বলা হয় না বলে গলার স্বর ভারী আর অচেনা।

রোয়াইলতলার এই ছাপরাঘর একেবারেই ভাঙাচোরা। মাথার উপর টিনের চাল আছে। ঠিকই কিন্তু বৃষ্টিবাদলায় পানি চুয়ায় (পড়া অর্থে) নানান জায়গা দিয়ে। আর চারদিকের বেড়া, ঝাঁপ ওইসব টিকে আছে কোনওরকমে। বাঁশের বেড়ার চটিগুলির এমন অবস্থা, খলফাগুলির এমন অবস্থা, ছোট্ট পোলাপানের হাত লাগলেও হরমাইলের মতো পটপট করে ভেঙে যাবে। ফাঁকফোকরের অন্ত নাই বেড়াগুলিতে। ফলে সকাল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই, বাইরে আলো ফুটবার সঙ্গে সঙ্গেই বেড়ার ফাঁকফোকর আর টিনের চালের ছেদা দিয়ে। আলোটা সরাসরি ঘরেও ঢোকে। বাইর ঘর একসঙ্গেই আলোকিত হয়।

এখন অনেকখানি বেলা হয়েছে। বাইরে খা খা করছে রোদ। সেই রোদের অনেকখানিই নানান কায়দায় ঢুকেছে ঘরের ভিতর। অনেকখানিই আলোকিত করেছে ঘর। এই আলোয় বহুদিন পর যেন পাগল মেয়েটির মুখ দেখতে পেল তছির মা। কিন্তু মেয়েটিকে যেন চিনতে পারল না। এই মেয়েটি যেন তার সেই পাগল মেয়েটি না। যখন তখন মুখ খিঁচিয়ে ওঠা, রেগে গেলে চড় থাবড় কিল ঘুসিতে নাস্তানাবুদ করা, মুখে যা আসে তাই বলে বকাবাজি, যখন যেখানে ইচ্ছা চলে যাওয়া, মাথাভরতি উকুন, যখন তখন ঘচর ঘচর করে মাথা চুলকানো, আবার মায়ের ফাঁদে আটকা পড়া ভাইরবেটা বারেককে গভীর রাতে গিয়ে চুরি। করে এনে দাদির বুকে শুইয়ে দেওয়া, আজকের এই মেয়ে যেন সেই মেয়ে নয়। এ যেন অন্যমেয়ে। অচেনা মেয়ে।

আহা রে, কী জীবন কী হয়ে গেল মেয়েটির! তছি পাগলনির কোন পাপের শাস্তি হিসাবে রুস্তম রিকশাআলাকে এই গ্রামে পাঠিয়েছিলেন আল্লাহপাক। শ্রীনগরের ওদিকে এত রিকশাআলা থাকতে এনামুলই বা কেন শুধু রুস্তমকেই বেছে নিয়েছিল! দশটা টাকাই বা কেন দিয়েছিল তছিকে!

আর রুস্তম!

মানুষ হয়ে রুস্তমের ভিতরই বা কেন জেগে উঠেছিল এক কনধনাইয়া! যার শরীর ভরতি শুধুই চোখ। সেই চোখ দিয়ে যে শুধু দেখেছিল এক যুবতীর লোভনীয় অঙ্গ। মানুষের মতো চোখ দিয়ে সে কেন দেখেনি যুবতী হলেও মেয়েটি সুস্থ স্বাভাবিক না। জন্ম থেকে পাগল। তছির আচরণে শুরুতেই তো তার তা বুঝে যাওয়া উচিত ছিল।

নাকি সাত আশমানের উপরে বসা মহান আল্লাহপাক রুস্তমের মওত লিখেছিলেন এইভাবেই। সে নিজেই নিজের মওত রিকশায় বসিয়ে, মুরুলিভাজা খাওয়াবার লোভ দেখিয়ে মেদিনীমণ্ডল থেকে রিকশায় প্যাডেল মেরে নিয়ে গিয়েছিল শ্রীনগরের ওদিককার খালপারের সেই নির্জন ছাড়াবাড়িতে। আল্লাহর ইশারায়ই তছি নিয়েছিল আজরাইলের ভূমিকা।

যদি তাই হয়ে থাকে, তা হলে আল্লাহ কেন এইভাবে কষ্ট দিচ্ছেন তার পাগল মেয়েটিকে! কেন তার পাগল স্বাধীন উদ্দাম জীবন এভাবে নষ্ট করে দিলেন? কেন মেয়েটিকে বন্দি করলেন হতদরিদ্র ছাপরাঘরের মাটির বিছানায়, তালি পড়ে পড়ে পাথরের মতন ভারী হয়ে ওঠা কাঁথার তলায়! রাত গেল যার দিন হয়ে, আর দিন হয়ে গেল রাত। মেয়ের সঙ্গে তাল দিতে গিয়ে সহজ সরল সাদামাটা জীবন বদলে গেল দুঃখিনী মায়ের।

মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে এসব কথাই ভাবছিল তছির মা। চোখ ছলছল করছিল।

ঘরের ভিতরকার ছিটাফোঁটা আলোর দিকে তাকাতেও কষ্ট হচ্ছিল তছির। চোখ পিটপিট করছিল। এই অবস্থায় চাপা গলায় সে বলল, কী অইলো, কথা কওনা ক্যা মা? কী অইছে বাইত্তে? এত পোলাপান আইলো কইত থিকা?

মেয়ের দিক থেকে চোখ সরিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল তছির মা। আজিজ গাওয়ালের পোলাপান।

ক্যা অরা এত বিয়ানে আমগো বাইত্তে ক্যা?

আজিজের বউর আহুজ পড়তাছে।

হের লেইগা বেবাক পোলাপান এই বাইত্তে পাড়াইছে?

বেবাকটি না। নাদের আর হামেদরে দেকলাম না, পরিরে দেকলাম না। অরা মনে অয় অন্যবাইত্ত গেছে।

তছি আবার কাঁথার আড়ালে মুখ লুকাল। খানিক চুপচাপ থেকে বলল, পোলাপানের চিল্লাচিল্লিতে আমি জাইগা গেছি মা। অহন আর ঘুম আহে না।

হারারাইত ঘুমাইছচ। এতনি বেলা তরি ঘুমাইলি। অহন আবার ঘুম আইবো ক্যা? ঘুমেরও তো সীমা আছে।

কাঁথার তলা থেকে মুখ বের করল না তছি। ফিসফিসা গলায় বলল, আস্তে কথা কও মা, আস্তে কথা কও। কেঐ হুইন্না হালাইবো।

না হোনবো না। বাইত্তে কেঐ নাই। কে কইলো নাই? উই যে গাওয়ালের পোলাপানরা আছে।

অরা এইমিহি আইবো না। বারেকের লগে বড়ইতলায় সাচ্চারা (সাতচারা) খেলতাছে। আবদুলের বউ রান চড়াইছে, আবদুল গেছে রানাইদ্যা।

ক্যা, মোসলমানির কাম আছে?

হ। শীতের দিন গেছেগা। অহন তো আর লেপতোষকের কাম নাই। ফান মাসে মোসলমানির কাম অয়। এই একমাস কাম কইরা দু-তিন মাস চলবো। তারবাদে লাগবো ইরি ধান কাডন, তহন ধান কাটবো। বাইষ্যাকালে করবো মাছ ধরনের কাম। কোষা নাও লইয়া বিলে গিয়া দাঐন বাইবো। একলা মাইনষের ওপরে এতডি মাইনষের সংসার। মোখের মিহি পোলাডার আর চাওন যায় না। অন্য পোলাডি তো বাইত্তে রইলো না। মজিদ টঙ্গি, শফি কামরাঙ্গির চর। হাফিজদ্দি রানাইদ্য গিয়া বিয়া কইরা ঘরজামাই অইছে। বড় মাইয়াডার হৌর বাড়ি কুগইট্টা (কুকটিয়া), মাজারের দামলা। একজনেও মা। ভাইবইনের সমবাত লয় না। তারা আছে না মইরা গেছে, জানেও না। তরে আর আমারে লইয়া আবদুলের অইছে যনতরনা।

মা’র কথা শুনে তছি বিরক্ত হল। কিন্তু কাঁথার তলা থেকে মুখ বের করল না। চাপা রাগের গলায় বলল, এত প্যাচাইল পাড়তাছো ক্যা? এত প্যাচাইল পাড়তে তোমারে আমি কইছি?

তছির মা ভয় পেল। না কচ নাই মা।

তয়।

এমতেঐ কইয়া হালাইছি। বহুতদিন তর লগে কথা অয় না। এর লেইগা কথা কইতে ইচ্ছা করতাছে। তরে হালাইয়া কোনওহানে যাই না, তুই কেঁতার নীচে হুইয়া থাকচ আর আমি শিথানে বইয়া তরে পাহারা দেই।

হেইডা তো খালি দিনের বেলা।

হ। রাইত্তে চোরের লাহান উইট্টা তুই হাগতে মোততে যাচ, পুকঐরে গিয়া নাইয়া আহচ, ভাতপানি খাচ। আমি তহন বারেকরে লইয়া ঘুমাই। তর যহন দিন আমার তহন রাইত।

তছি কথা বলছিল কাঁথার তলা থেকেই, ধীর চাপা গলায়। যেন জোরে কথা বললেই শত্রুপক্ষ শুনে ফেলবে। যেন কাঁথার তলা থেকে মুখ বের করলেই শত্রুপক্ষ দেখে ফেলবে তাকে। সঙ্গে সঙ্গে লৌহজং থানায় গিয়ে দারোগা পুলিশকে খবর দিবে। ওই যে গলায় গামছার ফাঁস দিয়া খুন কইরা খালের পানিতে ফালাইয়া দেওয়া হইছিল রুস্তম রিকশাআলার লাশ, খুনটা কে করেছে জানেন! মেদিনীমণ্ডলের হাজামবাড়ির সংসার আলী হাজামের ছোটমাইয়া তছি পাগলিনি। সে এখন পলাইয়া আছে বাড়িতে। রোয়াইলতলার ছাপরা ঘরের মেঝেতে খড়নাড়ার বিছানার উপরে হোগলা পাইতা, তার উপর কাঁথা মুড়ি দিয়া পলাইয়া থাকে। দিনগুলি যার রাইত হইয়া গেছে, রাতগুলি হইছে দিন।

তারপর শয়ে শয়ে পুলিশ দারোগা আসবে এই বাড়িতে। চারদিক থেকে ঘেরাও করবে বাড়ি। এই হতদরিদ্র ঘরের করুণ বিষণ্ণ ঝাঁপ লাথথি দিয়ে ভেঙে কাঁথার তলা থেকে টেনে হিঁচড়ে বের করবে তছি পাগলনিকে। প্রথমে থানা হাজত, তারপর মুনশিগঞ্জ জেল, তারপর কোনও এক ভোরবেলা ফাঁসি।

এসব ভেবে কাঁথার তলায় ভয়ে কুঁকড়ে গেল তছি। থরথর করে কাঁপতে লাগল। ভয় উৎকণ্ঠা মাঘ মাসের শীতের মতো চারদিক থেকে প্যাচিয়ে ধরতে লাগল তাকে।

এই অবস্থায় সাহসের আশায় কথা বলতে ইচ্ছা করে মানুষের। তছিরও করল। আগের তুলনায় গলা আরও নিচু করে সে বলল, মাগো, ওমা, তোমার লগে বহুত প্যাচাইল পাড়তে ইচ্ছা করতাছে আমার।

তছির মা উদাস গলায় বলল, পাড়।

তয় আমি কেতার তল থিকাই পাড়ম। মুক বাইর করুম না।

ক্যা?

আলো আমার চোক্কে সয় না। ডর করে।

কীয়ের ডর? আমি ছাড়া কে আছে এহেনে? কারে ডাচ তুই?

কারে যে ডরাই হেইডা কইতে পারি না। তয় তুমি কইলাম আমার কথার জব দিবা আস্তে আস্তে। ঘরের ছেমুক দিয়া গেলেও য্যান কেঐ না হোনে।

তছির মা আবার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আইচ্ছা।

ওমা, গেরামের মাইনষে আমার কথা তোমারে জিগায় না?

কী জিগাইবো?

তছি পাগলনিরে দিহি আইজকাইল আর দেহি না? আগে রোজঐত্তো এই বাইত্তে ওই বাইত্তে যাইতো, বড় রাস্তায় গিয়া খাড়ইয়া থাকতো, আথালি পাথালি কাম করতো, যেই মিহি ইচ্ছা দৌড় দিতো, আথকা কী অইলো পাগলনির? অরে দেহি কোনওহানে দেহি না? ওমা, জিগায় না এই হগল কথা?

দুই-একজনে জিগাইছে?

কেডা কেডা?

মোবাড়ির দেলরায়, আজিজ গাওয়ালের বউ বানেছা, মিয়াবাড়ির কুট্টি।

তুমি কী কইছো?

কইছি তছির শইল ভাল না। পাগলামিডা এত বাড়ছে, পাগলামির চোডে তছি এক্কেরে বোবা অইয়া গেছে। কেঐর লগে কথা কয় না। কেঐর লগে দেহা করে না। কোনওহানে যায় না। বাইত থিকাঐ বাইর অয় না।

বাইত থিকা কী, কইতা ঘর থিকাঐ বাইর অয় না।

হ হেইডাও কইছি।

শুনে খুশি হল তছি। কইছো, সত্যঐ কইছো মা?

হ কইছি।

কেমতে কইছো কথাডা?

কইছি, মাথা পুরা খারাপ অইয়া গেছে দেইক্কা তছি গেছে তব্দ (স্তব্ধ) অইয়া। ঘর থিকা বাইর হয় না। হারাদিন হারারাইত কেঁতা মুড়া দিয়া হুইয়া থাকে।

ভাল করছো মা, ভাল করছে।

যেন হঠাৎ মনে পড়েছে এমন গলায় বলল, আমি যে নাইড়া অইয়া গেছি হেইডা কও নাই তো?

না। হেইডা কই নাই।

না কইয়া বহুত ভাল করছো।

অনেকদিন পর পাগল মেয়েটার সঙ্গে এত কথা হচ্ছে। কথা বলতে এত ভাল লাগছে তছির মা’র! মনে হচ্ছে এতদিনকার চেনা মেয়েটি যেন তার কোথায় চলে গিয়েছিল, কোথা থেকে যেন আবার ফিরে এসেছে তার কোলে। অনেকদিন পর মা-মেয়ে দু’জন দুইজনকে ফিরে পেয়ে যেন মনের সব জানলা দুয়ার খুলে বসেছে। যেখানে যত কথা জমে আছে সব যেন বলতে শুরু করেছে। না বললেও হয় এমন কথাও।

যেমন এখন তছির কথার পিঠে বলল, ক্যা, না কইয়া ভাল করছি ক্যা?

কাঁথার তলায় ফিক করে একটু হাসল তছি। আমার শরম করতো।

কীয়ের শরম?

এমুন ডাঙ্গর মাইয়া নাইড়া অয়নি?

হ ঠিক কথা।

দুইজন মানুষই একটু চুপ করে থাকে। তারপর তছি বলল, ওমা, ওই তিনজন মানুষ ছাড়া আর কেঐ আমার কথা জিগায় নাই?

আর কে জিগাইবো?

গেরামে দিহি এত মানুষ, আর কেঐ জিগায় নাই আমার কথা?

কেমতে জিগাইবো, ক?

ক্যা জিগাইতে অসুবিদা কী?

আরে ছেমড়ি আমারে পাইবো কই যে জিগাইবো?

ক্যা তুমি কোনও বাইত্তে যাও না?

এই এক-দেড়মাসের মইদ্যে খালি দুইডা বাইত্তে গেছি। মেন্দাবাড়ি আর আজিজ গাওয়ালের বাড়ি। মেন্দাবাড়ি গিয়া দেলরার লগে দেহা অইলো। হেয় জিগাইলো। আর বানেছার আবার আহুজ পড়বো দেইক্কা অরে একদিন দেকতে গেছি, ওই বাইত্তে কুট্টির লগেও দেহা অইলো।

বুজছি। তয় অন্যকোনও বাইত্তে যাও নাই ক্যা?

তর লেইগা যাই নাই, আবার ক্যা?

ক্যা আমি কী করছি?

তুই না কইছচ আমি য্যান সব সময় তর শিথানে বইয়া তরে পাহারা দেই।

তছি নরম মায়াবী গলায় বলল, হ মা কইছি।

এর লেইগাঐত্তো কোনও মিহি আমি যাই না।

তয় ইচ্ছা করলে তুমি যাইতে পারতা।

কেমতে?

আমি তো রাইত্রে ঘুমাই না, ঘুমাই দিনে। আমার ঘুমের ফাঁকে তুমি যাইতা গা।

ওই ফাঁকেঐত্তো দুইডা বাইত্তে গেছি। তয় গিয়া আমার মন টিকে নাই মা।

ক্যা?

তর লেইগা মনডা ছটফট করছে।

ক্যা গো মা, ছটফট করছে ক্যা?

মনে অইছে মাইয়াডা আমার ভাঙ্গাঘরে কেঁতার তলে পলাই রইছে। শিথানে বইয়া অরে আমি পাহারা দেই। আমি না থাকলে দারগা পুলিশ আইয়া যুদি অরে ধইরা লইয়া যায়? যুদি অরে ফাঁসি দেয়।

গলা ধরে এল তছির মা’র, চোখ ভরে পানি এল। হাঁ করে একটা শ্বাস ফেলে চোখের পানি সামলাল সে।

এই ফাঁকে আলতো করে মুখ থেকে কথাটা একটু সরাল তছি। সরিয়ে অপলক চোখে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।

আঁচলে চোখ মুছল তছির মা। মেয়ের মুখের দিকে তাকাল। কী রে মা, এমতে চাইয়া রলি ক্যা?

তোমার মুকহান দেকতে ইচ্ছা করলো মা।

ক্যা?

তোমার কথা হুইন্না।

আমি আবার কী কইলাম?

কী যে কইলা হেইডা আমি বুজছি আর বোজছে আমার আল্লায়। মাগো, তোমার লেইগা আমার খুব মায়া লাগে মা। কেঁতার তলে হুইয়া হুইয়া তোমার কথা বহুত ভাবি আমি।

কী ভাবো গো মা? ভাবি পাগল না অইয়া আমি যুদি ভাল মাইয়া অইতাম তয় আমারে লইয়া এমুন কষ্ট তোমার অইতো না। এতদিনে অন্য মাইয়াগো লাহান বিয়াশাদি দিয়া হালাইতা আমার। জামাইবাড়ি যাইতাম গা আমি। আমারে লইয়া তোমার কোনও চিন্তা থাকতো না।

এতক্ষণ ধরে তছির সঙ্গে কথা বলতে বলতে এই প্রথম তছির মা’র মনে হল জন্মের পর থেকে এতটা বড় হওয়া পর্যন্ত তছি কখনও, কোনওদিন স্বাভাবিক মানুষের মতো এতকথা বলেনি। আজই প্রথম বলছে। তা হলে গোপনে কি তছির কোনও বদল হয়েছে? কাঁথার তলায় চুপচাপ শুয়ে থাকতে থাকতে, দিনকে রাত আর রাতকে দিন করার ফলে কি ভিতরে ভিতরে স্বাভাবিক হয়ে গেছে সে! পাগলামি চলে গেছে তার! নাকি মানুষ খুন করার। অপরাধে মনটাই বদলে গেছে! আল্লাহপাকের ইশারায়ই কি হয়েছে এসব!

কিন্তু এই নিয়ে তছিকে কিছু বলা ঠিক হবে না।

মা যখন এসব ভাবছে তছি তখনও অপলক চোখে মায়ের মুখটা দেখছে। দেখতে দেখতে বলল, কেঁতার তলে হুইয়া হুইয়া আমি আইজকাইল আল্লারে বহুত ডাক পাড়ি মা। কত কথা যে কই তারে।

তছির মা ধরা গলায় বলল, কী কথা কও মা?

বেবাক কথা মনে থাকে না। যেইডা আছে হেইডা কই।

আইচ্ছা কও।

আল্লার কাছে কই, আল্লা গো, এই জনমে তো পাগল কইরা রাকলা, মানুষ খুন করাইলা, আবার যুদি কোনওদিন আমারে দুইন্নাইতে পাডাও, তাইলে পাগল কইরা পাডাইয়ো না। অন্য মাইয়াগো লাহান ভাল কইরা পাডাইয়ো। আর মানুষ খুন করাইয়ো না। আর যেই মা’র ঘরে জন্ম দিছ, আল্লা গো, এই মা’র ঘরে আমারে তুমি জন্ম দিয়ো।

তছির কথা শুনতে শুনতে নিজের অজান্তে কখন কাঁদতে শুরু করেছে মা। কখন চোখের পানিতে গাল ভাসতে শুরু করেছে তার সে তা টেরই পায়নি।

কাঁদতে শুরু করেছে পাগল মেয়েটিও। কাঁদতে কাঁদতে বলল, এই জীবন আমার ভাল্লাগে না মা। আমার আর সইজ্জ অয় না। ক্যান যে বেডারে আমি মারলাম! তার থিকা বেডায় আমারে নষ্ট করতে চাইছিল করতো। আমার নাইলে পেটপোট অইয়া যাইতো, পোলাপান অইয়া যাইতো। হেই পোলাপান কুলে লইয়া হাটেবাজারে ভিক্কা কইরা খাইতাম আমি। কত পাগলনিরাঐত্তো এমতে বাঁইচ্চা থাকে। আমিও থাকতাম। আমি ক্যান এমুন কামডা করলাম?

কাঁথার তলা থেকে হাত বাড়িয়ে মায়ের একটা হাত ধরল তছি। আকুল হয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল, মা মাগো, আমি ক্যান এমুন কামডা করলাম? আমি ক্যান বেডারে মাইরা হালাইলাম?

কান্নার ফাঁকে তছির মা’র মনে হল পাগল মেয়েটা তার আর পাগল নাই। মেয়েটা তার সুস্থ হয়ে গেছে। মনের ওপর মানুষ খুনের চাপে মন মাথা বদলে গেছে তার। এখন এই সুস্থ মেয়েটিকে দারোগা পুলিশের হাত থেকে কেমন করে বাঁচাবে সে। ফাঁসির দড়ি থেকে কেমন করে বাঁচাবে!

ভাঙনের দিক থেকে এই বাড়ির উঠানের দিকে উঠতে উঠতে আজিজ গাওয়ালের মেয়ে পরি তখন ছোটবোন জরিকে ডাকছিল। জরি রে, ওই জরি। কো তরা? কোনহানে?

এই শব্দে সামনে শত্রুর শব্দ পাওয়া কচ্ছপ যেমন করে মুখমাথা টেনে নেয় শক্ত খোলসের ভিতর ঠিক তেমন করে মুখমাথা কাঁথার তলায় লুকিয়ে ফেলল তছি। চোখ মুছে তছির মা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মনে মনে আল্লাহকে বলল, আল্লা গো আল্লা, আমার তছিরে তুমি বাঁচাইয়া রাইখো।

.

দুপুরের দিকে মেয়ে হল বানেছার।

মেয়ের মুখ দেখে খুশি সে হল কি হল না বোঝা গেল না। তবে নয়মাস দশদিন মেয়েটিকে পেটে করে বয়ে বেড়ানো আর আজ ভোররাত থেকে এই পর্যন্ত পাওয়া কষ্টের হাত থেকে বেঁচে যাওয়ার ফলে মুখে আরামদায়ক অবস্থা ফুটে উঠল। দেখে বাঁশের চোঁচ দিয়ে বাচ্চার নাড়ি কেটে সুতা পঁাচিয়ে গিঁটটু দিতে দিতে আলার মা বলল, মাইয়া দেইক্কা খুশি অইছচ?

বানেছা আরামের গলায় বলল, মাইয়া পোলা কোনওডা লইয়া আমার কোনও হায়আপশোস নাই। একটা অইলেই অইলো।

বাচ্চার নাভির কাজ শেষ করে, বহুদিনের অভিজ্ঞ হাতে বানেছার গর্ভ থেকে ফুল বের করে আনল আলার মা, গর্ভ একেবারেই পরিষ্কার হয়ে গেল বানেছার। বাচ্চাটা বানেছার কোলের কাছে শোয়াইয়া দিয়া যে পুরানা পাতলা কাঁথার উপর প্রসব করেছে বানেছা সেই কাঁথায় ফুল ইত্যাদি প্যাচিয়ে কথাটা একপাশে সরিয়ে রাখল।

প্রসব করাতে আসার সময় আলার মা’র সঙ্গে ছোট্ট একখান চটের ব্যাগ থাকে। সেই ব্যাগে নাড়িকাটার বাঁশের চেঁচ, নিজের জন্য ধোয়া একখান গামছা আর একটুকুরা বাংলা সাবান থাকে। আজ ঘরে ঢোকার আগে এক বালতি গরম পানি, একখান লোটা আর নয়তো বদনা এনে রাখে। কাজ শেষ করে মা এবং শিশুটিকে পরিষ্কার করে, নিজে সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে গামছায় হাত মুছতে মুছতে কাজটি সার্থকভাবে শেষ করবার জন্য আল্লাহর কাছে শোকর গুজার করে।

আজও করল। হে আল্লাহ, তোমার রহমতের দুয়ার আমার লেইগা খুইল্লা দিছ দেইক্কাঐ কামডা আমি ছহিসালামতে করতে পারলাম। তোমার কাছে হাজার হাজার শুকুর। যে জন্মাইলো আর যে জন্ম দিলো, তাগো তুমি হায়াত দরাজ কইরো আল্লাহ।

বানেছার দিকে তাকাল আলার মা। তরে তো নতুন কইরা কওনের কিছু নাই। সাতহান পোলাপান অইলো। তুই তো জানচঐ সব। তারবাদেও কই। মাইয়ারে বুকের দুদ দিবি। চামিচে কইরা তালমিছরির পানি আর ইট্টু ইট্টু মধু দিবি। মধু আবার বেশি দিচ না। কোনও কোনও বাচ্চা মধু সইজ্জ করতে পারে না। পেট নামাইবো। আর হারিকেনের মাথায় নরম ত্যানা চাইরভাজ কইরা দিয়া হেই ত্যানা ইট্টু ইট্টু গরম অইলেঐ ত্যানাডা দিয়া বাচ্চার নাভি ছেইক্কা দিবি। তাইলে নাভি তাড়াতাড়ি হুগাইয়া যাইবো।

বানেছা বলল, বুকের দুদ ছাড়া আর কিছুই দিতে পারুম না। তালমিছরি, মধু এই হগল পামু কই?

ক্যা আইজ্জারে ক মাওয়ার বাজারে গিয়া লইয়াহুক।

কাম নাই খরচের। পোলাপান আমার বুকের দুদ খাইয়াঐ বাঁচে।

তয় আর কী!

চটের ব্যাগ হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়াল আলার মা। আমি তাইলে গেলাম।

আইচ্ছা।

ঘর থেকে বেরুবার আগে শিশুটির দিকে একবার তাকাল সে। লালচে ছোট্ট একটা মানুষ। মাথায় পাতলা কয়েকটা চুল। ফোলা ফোলা চোখ দুইটা পিটপিট করে খোলার চেষ্টা করছে। একটু একটু নাড়াবার চেষ্টা করছে হাত-পা। কী নিষ্পাপ অসাধারণ সুন্দর মুখ। এই মুখের মানুষটি একদিন বড় হবে, দুনিয়াদারির ঘোরপ্যাঁচের ভিতর নিজের অজান্তে জড়িয়ে যাবে। কত সুখ দুঃখ আনন্দ বেদনার মুখোমুখি হবে। কত রাত কত দিন, কত সময় অসময় পেরিয়ে যাবে। আর মেয়েমানুষ হয়ে জন্মাবার ফলে দুইটা পেটের যন্ত্রণা জীবনভর পোহাতে হবে। একপেট ক্ষুধার আরেক পেট নারীর। এক পেট খাদ্যের আরেক পেট মায়ের। খাদ্যের পেট ভরাবার জন্য প্রতিমুহূর্তে করে যেতে হবে এক ধরনের যুদ্ধ আর কিশোরী হয়ে ওঠার পর থেকে, যতদিন পর্যন্ত মা হওয়ার ক্ষমতা থাকবে ততদিন। পর্যন্ত মা হওয়ার পেটখানিকে আগলে রাখতে হবে লোভী আততায়ী পুরুষের হাত থেকে। স্বামীসংসার হওয়ার আগে তো কথাই নাই, হওয়ার পরও পরপুরুষগুলি কুত্তার মতো ছোঁক। ছোঁক করবে, কখন সুযোগ আসবে, কখন খাবলা দেওয়া যাবে আর নয়তো লম্বা জিভ বের করে আচমকা একটা চাটা। কখন একটুখানি নষ্ট করে দেওয়া যাবে মেয়েটির শরীর! এই। কুকুরগুলির হাত থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য যে যুদ্ধ অবিরাম করে যেতে হবে সেই যুদ্ধের নাম নারীজীবন।

আহা কেন যে মেয়ে হয়ে জন্মাল শিশুটি!

আলার মা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর ঝপ খুলে বেরুতে যাবে, বানেছা বলল, আমারে কিছু কইয়া গেলা না চাচি?

আলার মা ম্লান হাসল। তরে আর কী কমু? তুই কি নতুন মা অইলি নি?

না তা অই নাই।

তয়?

তয় তোমারে আইজ একহান কথা কই চাচি। যতবার মা অই ততবারঐ আমার মনে হয়, এইবার পয়লা অইলাম।

কচ কী?

হ। আর একহান জিনিস আরচইজ্য লাগে। বেদনা ওডনের পর থিকা পোলাপান। অওনের আগ তরি এমুন বেদনা, মনে অয় মইরা যামু, আর বাঁচুম না। যেইনি পোলাপান অইয়া গেল, লগে লগে বেদনাডা বন্দ। কী শান্তি!

হ এইডা আল্লার কুদরত। তয় তুই যহন কইলিঐ, তরে তাইলে কই। আইল্লায় (মালশায়) লাকড়ির কয়লা লইয়া আগুন দিবি। কয়লার যে ধিকিধিকি আগুনডা অইবো হেই আগুনের তাপ লবি।

হ জানি তো। আইল্লাডা মাডিতে রাইক্কা এমুন কইরা খাড়ন লাগবো য্যান শাড়ির ফাঁক দিয়া তাপ উইট্টা যায় উপুর মিহি।

হ।

আমি সব সময় এইডা করি চাচি।

ইবারও করিচ।

আইচ্ছা।

একটু থেমে আলার মা বলল, আর দুয়েকহান কথা কমু তরে?

কও।

মনে কষ্ট লবি না তো?

না।

সাতহান পোলাপান অইছে, আর পোলাপান অওয়াইচ না।

এইডা কেমুন কথা কইলা চাচি? পোলাপান অওন কি আমগো হাতে? এইডা অইলো আল্লার হাতে।

না, তগো হাতে। তরা ইচ্ছা করলেঐ ঠেকাইতে পারচ। বানেছা একটু চুপ করে থেকে বলল, তোমার কথা আমি বুঝছি চাচি। অষইদ বিষইদের কথা কও তো। ওই হগল অষইদ খাইতে আমার ডর করে।

তর খাওনের কাম নাই। তর জামাইরে ক। বেড়াগো বেবস্থাও তো আছে।

হেইডাও আমি জানি।

তারপরই লাজুক হয়ে গেল বানেছা। খানিক আগে যার হাতে বাচ্চা হওয়াল তার মুখের দিকেই আর তাকাতে পারল না। মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে বলল, ওই হগল আমার ভাল্লাগে না। আমি আরাম পাই না।

ঠিক আছে এইডাও মাইন্না লইলাম। তয় তুই একহান কাম কর, আজিজরে দিগলির হাসপাতালে যাইতে ক। ওহানকার ডাক্তারগো লগে কথা কইতে ক। বেডারা যাতে বাপ না অইতে পারে তার তো আরও বেবস্থা আছে।

এইডাও আমি জানি। তয় তোমগো পোলায় হেইডা করাইতে চায় না। তার বলে ডর। করে।

ওইডা ডরের কোনও কামঐ না। তয় এতকথা তরে আমি আইজ ক্যান কইলাম জানচ, পোলাপান জন্ম দেওয়া খুব সোজা। খাওয়াইয়া পরাইয়া বাঁচাইয়া রাখা বহুত কঠিন। আর যুদি ঠিক মতন খাওয়াইতে পরাইতে না পারচ এই পোলাপানেঐ তগো অভিশাপ দিব। গাইল দিবো।

বানেছা কথা বলল না। চিন্তিত হয়ে রইল।

আলার মা বলল, রিজিগ দিয়াঐ বেবাকতেরে আল্লায় দুনিয়ায় পাড়ায়। তারবাদেও আল্লায় কইছে তোমরা সীমা লঙ্ঘন কইরো না। নিজের ভালমন্দ নিজে বুইঝা চইলো।

আলার মা আর দাঁড়াল না, ঝাঁপ খুলে উঠানে নামল।

আজিজ তখনও একই ভঙ্গিতে বসে আছে বড়ঘরের ছেমায়। তার পিছনে দুয়ার খোলা ঘরের মেঝেতে দেখা যাচ্ছে গাওয়াল করার হাড়ি পাতিল কলস বদনার ভার। এখন আর হাতে বিড়ি নাই আজিজের। চোখে উদাসীনতা। আলার মা’কে দেখে ম্লান গলায় বলল, বুঝছি। মাইয়া অইছে।

আজিজের উপর রেগে আছে আলার মা। গম্ভীর গলায় বলল, হ। তয় অহন হেই গিরস্তের লাহান ক,

গাই বিয়াইলো দামড়ি বাছুড়,
বউ বিয়াইলো মাইয়া।

আজিজ মাথা নিচু করে বলল, আর শরম দিয়ো না চাচি। বহুত ভুল কইরা হালাইছি। তয় আমার দিকটাও চিন্তা কইরো। এতডি পোলাপান লইয়া আর পারি না চাচি।

শেষ কথাটা এমন কাতরগলায় বলল, আলার মা’র মনটা নরম হল। বলল, বুজছি। বাজান, তর কথা আমি বুজছি। তয় আবারও কই, পোলাপান না হওনের ব্যবস্থা কর।

করুম চাচি, ডরভয় বাদ দিয়া কইরা হালামু।

লুঙ্গির কোচড় থেকে পাঁচ টাকার একটা নোট বের করল আজিজ। আলার মা’র দিকে এগিয়ে দিল। নেও চাচি।

টাকাটা আলার মা নিল না। বলল, ইবার টেকা আমি নিমু না বাজান।

ক্যা? রাগ করছো?

না। এই পাঁচহান টেকা আমি তর এই মাইয়াডারে দিয়া গেলাম। মাইয়ার কোনও অযত্ন তুই করি না বাজান। তর লেইগাঐ দুইন্নাইতে আইছে ও। অর অযত্ন করলে আল্লায় বেজার অইবো। আর যেই ঘরে হুইয়া তর মায় চইলা গেছে হেই ঘরের মাডিতেঐ মাইয়াডা তর অইছে। আইজ থিকা তুই মনে করবি এই মাইয়াডা তর মাইয়া না, এই মাইয়াডা তর মা। এক চেহারায় চইলা গেছে যেই মা, আরেক চেহারায় ফিরত আইছে হেয়। মা’র অযত্ন। করিচ না।

আজিজের কানে এসব কথার কিছুই গেল না। পাঁচটা টাকা বাঁচাতে পেরে আনন্দে একেবারে ফেটে পড়ছে। চোখের ভিতর খুলে গেছে হিসাবনিকাশের অদৃশ্য খেরোখাতা। লাভের পাতায় যোগ হচ্ছে পাঁচটাকা।

বয়সি শরীর নিয়ে আলার মা তখন পশ্চিম দিককার নামার দিকে মিলিয়ে যাচ্ছে।

.

জাহিদ খাঁ-র বাড়ি বরাবর পুকুর পারের হিজলগাছটার সামনে ছিল আলী আমজাদের কন্ট্রাক্টরি কাজের ছাপরাঘর। কাজ এগিয়ে যাওয়ার ফলে ঘরও এগিয়ে গেছে। এখন হযরতদের বাড়ি ছাড়িয়ে আরও অনেকখানি এগিয়ে ঘর। সেই ঘরে বসে আলী আমজাদ তদারক করে তার মাটিয়ালদের সর্দার হেকমতের আর ইয়ারদোস্তদের নিয়ে আড্ডা দেয়। সিগ্রেট বিড়ি চব্বিশঘণ্টাই চলছে, দিনদুপুরেও কখনও কখনও চলছে কেরু কোম্পানির মদ। সঙ্গে নিখিলের বোন ফুলমতির কষানো মুরগি, ঘিয়ে ভাজা পরোটা। ফলে ছাপরাঘরের আশপাশ সব সময়ই ম ম করছে নানা প্রকার গন্ধে আর আলী আমজাদ, আতাহার সুরুজ নিখিলদের হাসিঠাট্টা হইহল্লায়।

এদিকে হিজলতলা থেকে ছাপরাঘর উঠে যাওয়ার ফলে জায়গাটা ফাঁকা। শেষ ফাগুনের রোদেলা সকালবেলা আজ কেমন মনমরা হয়ে আছে জায়গাটা। আলার মা’কে নিজেদের বাড়ি আনবার পর, আলার মা ঢুকেছিল আহুজ ঘরে আর নাদের হামেদ ঢুকেছিল বড়ঘরে। জের থেকে মুড়ি আর টিনের পট থেকে খাজুরা মিঠাই বের করে পরি তখন ভাইবোনদের ভাগবাটোয়ারা করে দিচ্ছে। নাদের হামেদও নিয়েছিল তাদের ভাগ। তারপর গপাগপ মুড়ি মিঠাই খেয়ে, গেলাসভরতি পানি খেয়ে দুইভাই চলে এসেছে সড়কপারে। এদিক ওদিক অকারণে ঘোরাঘুরি করে শেষপর্যন্ত এসেছে হিজলতলায়।

আগে জায়গাটাতে খুব ঘাস ছিল। এখন ঘাসের বংশও নাই। শুধু মাটি, রুক্ষ সাদা মাটি। রাস্তার কারণে চেহারাটাই বদলে গেছে।

তবু এই বদল এখন আর চোখে লাগে না। অনেকদিন ধরে আগাচ্ছে রাস্তা, অনেকদিন ধরে একই দৃশ্য দেখছে দেশগ্রামের লোক। চোখ সয়ে গেছে তাদের। বদলটা টের পায় না। কারও কারও মনে হয় যেন এমনই ছিল জায়গাটা। আসলে কোনও বদল হয়নি।

হিজলতলায় দাঁড়িয়ে হামেদ বলল, ওই দাদা, মা’র আহুজ কি অহনতরি পড়ছে?

নাদের বলল, মনে অয় না।

তয় তো অহন বাইত যাওন যাইবো না।

না।

করবি কী?

কী করুম ক।

ল এহেনে বইয়া থাকি।

বইয়া কী করুম? বইয়া থাকতে ভাল্লাগবো?

লাগবো।

কেমতে?

তরে আমি কতডি কথা জিগামু। হেই কথার জব দিতে দিতে দেকবি দোফর অইয়া যাইবো। দোফরের মইদ্দে মা’র আহুজ পইড়া যাইবো। তহন বাইত যামুগা আমরা।

ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে হাসল নাদের। কী কথা জিগাবি?

হিজলতলার মাটিতে ইলাস্টিক লুজ হওয়া প্যান্ট নিয়ে বসে পড়ল হামেদ। বয়, কইতাছি।

নাদেরও বসল। ক।

পুবদিককার মাঠ ছাড়িয়ে, আমিন মুনশির বাড়ির লগের মাদ্রাসাঘর ছাড়িয়ে, সোজা পুবদিকে তালুকদার বাড়ির দক্ষিণ কোণে মাঠের মাঝখানে দাঁড়ানো বিশাল কড়ুই গাছটার দিকে তাকিয়ে হামেদ বলল, ওই গাছেও বলে একজন থাকে?

আচমকা এরকম একটা কথা! নাদের যেন বুঝতে পারল না। ভোররাতে আজ যেমন করে তার কথা বুঝতে পারেনি হামেদ এখন যেন তেমন করেই হামেদের কথা বুঝতে পারল না নাদের। ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বোকার মতো বলল, কেডা থাকে ওই গাছে?

হামেদ হাসল। বোজচ নাই?

এবার নাদেরও হাসল। বুজছি।

তার সমন্দে তুই জানচ?

হ জানি।

তয় আমারে ক দাদা। এই হগল হুনতে আমার বহুত আমোদ লাগে।

এই ধরনের গল্প করতে নাদেরও খুব মজা পায়। নড়েচড়ে জুত করে বসল। কড়ুইগাছে যে থাকে হে কইলাম কনধনাইয়া না।

তয়?

হেয় অইলো মাউচ্ছা ভূত।

মাউচ্ছা ভূত আবার কী?

যেই ভূতে খালি মাছ খায়। খালপার নাইলে বড় পুকঐর পার, বিলের মইধ্যে যে বড় বড় ডেঙ্গা (দিঘি) থাকে হেই হগল ডেঙ্গার চাইরমিহি থাকে। তালুকদার বাড়ির খালে তো অনেক মাছ, এর লেইগা খালের ইট্টু দূরে কড়ুইগাছটায় থান লইছে হেয়।

বুজছি। একবার বলে মেন্দাবাড়ির এনামুল দাদারে ধরছিলো।

হ।

কুনসুম?

খাড়া দোফরে।

কচ কী?

হ।

দোফরেও হেরা মাইনষেরে ধরে?

হ ধরে। নিটাল দোফরে। শনিবার নাইলে মঙ্গলবার।

এনামুল দাদারে ধরছিলো কবে?

মঙ্গলবার দোফরে।

হেয় ওহেনে গেছেলো ক্যা?

আউজকার কথা না তো। ম্যালাদিন আগের কথা। হেয় তহন বহুত ছোড। আমার লাহান অইবো। আমিনল মামাগো লগে গোয়ালিমান্দ্রার হাডে গেছিল। বড় একহান গজার মাছ কিন্না আমিনল মামায় কইছে তুই বাইত্তে যা গা, আমি পরে আমুনে। গজার মাছের কানসার ভিতর কাতা (নারকেলের ছোবড়ার চিকন দড়ি) ভইরা, ফাঁসের লাহান কইরা মাছহান ঝুলাইয়া দিছে এনামুল দাদার হাতে। হেয় পোলাপান মানুষ, কিছু বোজে নাই। মাছ হাতে লইয়া মেলা দিছে। কড়ুইতলায় আইতে আইতে দোফর অইয়া গেছে। চাইরমিহির খেতখোলায় কোনও মানুষ নাই, খালি রইদ। এমুন সোমায় পয়লা একহান বাতাস উটলো কড়ইগাছে। তুফান আইলে গাছ যেমন লড়ে, অতবড় কড়ইগাছটা অমুন লড়তে লাগলো। আর বাতাসে পচা মাছের গন্ধ। এনামুল দাদায় পোলাপান মানুষ, হেয় তো কিছু বোজে নাই। আথকা গাছের মাথায় দেহে কালা কাকলাসের লাহান একজন বইয়া রইছে। ইয়া লাম্বা লাম্বা হাত-পাও, এত্ত বড় বড় চারি (নখ), নাকহান দেড়হাত লাম্বা, চকুগুনি বউন্না গোডার লাহান, বড় মাইনষের হাতের পাঞ্জার লাহান এহেকখান দাঁত মোখে। ক্যাতকুতির (বগলের) তলে আর শইল্লে খালি পশম, খালি পশম। গাছের উপরে থিকাঐ একহান হাত বাড়াইয়া দিল এনামুল দাদার মিহি। নাকি গলায় কইল, গজার মাছটা আমারে দিয়া যা। এনামুল দাদায় মাছ দিবো কী, ওই চেহারা দেইক্কা এমুন এক চিক্কইর দিছে, তারবাদে দিছে দৌড়। হাতের মাছ কই ছিট্টা পড়ছে কে কইবো। চিকইর পাড়তে পাড়তে, দৌড়াইতে দৌড়াইতে আইয়া পড়ছে আমিন মুনশির বাড়ির সামনে। মুনশিসাবে তহন নমজ পইড়া বাইর অইছে। বাড়ির সামনে দিয়া চিক্কইর পাড়তে পাড়তে এনামুল দাদারে দেইক্কা ডাক দিছে। কী হইছে রে এনামুল? এমুন করচ ক্যা? মুনশিসাবরে এনামুল দাদায় সব কইলো। হুইন্না মুনশিসাবে কইলো আমিনলের উচিত অয় নাই মঙ্গলবাইরা দিনে একলা একলা তরে। এই রাস্তা দিয়া পাড়ান। মামা-ভাইগনা একলগে থাকলে হেয় কোনও ক্ষতি করতে পারতো না। অহনও পারবো না। আমার লগে যহন তর দেহা অইয়া গেছে অহনও তর আর কোনও ক্ষতি অইবো না। আয় আমার কাছে আয়। মুনশিসাবের সামনে গেল এনামুল দাদায়, মুনশিসাবে দোয়া পইড়া তার মাথায় ফুঁ দিয়া দিল। যা অহন বাইত যা। আর কিছু অইবো না। এনামুল দাদায় বাইত্তে আইয়া পড়ল।

ঘটনা শুনে প্রথমে মুগ্ধ হয়ে থাকল হামেদ। তারপর বলল, ওই দাদা, গজার মাছটা তো হেয় রাইক্কাঐ দিল। তারবাদে আবার ক্ষতি কী অইবো? মুনশিসাবের কথাডা তো আমি বুজলাম না।

নাদের বিরক্ত হল। আরে এইডা অইলো অন্যরকম ক্ষতি। হেরে দেইক্কা যেই ডরানডা এনামুল দাদায় ডরাইছিল, ওই ডরে হেই দিন তার জ্বর আইতে। হেই জ্বর আর ভাল অইতো না। হেই জ্বরেঐ এনামুল দাদায় যাইতো।

এবার কথাটা বুঝল হামেদ। স্বস্তির শ্বাস ফেলল। বুজছি, ইবার বুজছি।

মুনশিসাবে বহুত কামেলদার মানুষ আছিলো। হেয় একহান ফুঁ দিয়া দিলে মাইনষের অসুখবিসুখ ভাল অইয়া যাইতো।

মন্নান মাওলানা সাবেও বলে বহুত কামেলদার?

নাদের ভুরু কুঁচকে বলল, থো। ওই হালায় বদমাইশ। কাশেম কাকারে কেমতে খেদাইলো গেরাম থিকা! নূরজাহান বুজি বহুত ভাল কাম করছে। বেবাকতের সামনে হালার মোকে ছ্যাপ ছিড়াইয়া দিছে।

এসব কথা শুনতে ভাল লাগছিল না হামেদের। সে শুনতে চাচ্ছিল গা ছমছমে ভয়ের কথা। কায়দা করে সেদিকেই কথা ঘুরিয়ে নিল। ওই দাদা, মেন্দাবাড়ির বড় পুকইরডায় বলে শিকল আছে?

হ শিকল আছে ড্যাগও (ডেকচি। মেজবানি রান্নার তামার বড় হাঁড়ি) আছে।

দেকছে কেঐ?

হ কতজনে দেকছে। হাজামবাড়ির মজিদ একবার নাইতে নামছিল, সাঁতরাইতে সাঁতরাইতে জাহাঙ্গির কাকাগো বড়ঘর বরাবইর ভাঙ্গনের মিহি গেছে, হের পাও পঁাচাইয়া ধরছিল শিকলে। মজিদ জুয়ানমর্দ মানুষ দেইক্কা পানির নীচে দুই পাও দাপড়া দাপড়ি কইরা শিকল ছাড়াইয়া উটতে পারছিল। নাইলে ওইদিনঐ শিকলে হেরে পানির নীচে টাইন্না নিত। দুইদিন পর ভাইস্যা উটতো নাচ।

খাইছেরে।

হ। শিকলে সব সময় মানুষরে প্যাঁচ দিয়া ধরে। পাইনতে ডুবাইয়া মারে।

আর ড্যাগ?

ড্যাগে ভরা থাকে খালি কাঁচাটেকা।

কচ কী?

হ।

মাইনষে হেই টেকা নিতে পারে না?

ইচ্ছা করলে পারে।

কেমতে?

চাইলেঐ। তয় এর মইদ্যে একহান কথা আছে।

কী কথা?

একডেগ টেকার বিনিময়ে একজন মাইনষের জান দিতে অইবো।

শুনে হামেদ আকাশ থেকে পড়ল। আ?

হ। জাহাঙ্গির কাকার মায় একবার পাইছিল।

সত্যঐ?

তয় মিছানি?

ক না কেমতে পাইছিল?

নাদেরেরও ভালই লাগছে কথা বলতে। বেশ মগ্ন গলায় সে বলল, জাহাঙ্গির কাকার ছোডবইন সন্ধা (সন্ধ্যা) তহন পেড়ে। বাইষ্যাকাল। দাদি একা রাইতে সপনে দেহে তার ঘরের খাডালে বিরাট একহান ড্যাগ। মোখে একহান ঢাকনা। ঢাকনাডা ইট্টু ফাঁক অইয়া রইছে। হেই ফাঁক দিয়া দেহা যায় ভিতরে চকচক করতাছে কাঁচাটেকা। জাহাঙ্গির কাকার মায়, দাদি গেছে টেকা নিতে, লগে লগে ভিতরে থিকা আওজ অইলো, নিতে পারচ, বিনিময়ে আমারে একহান নাইরকল দেওন লাগবো। কথাডা হেয় বাড়ির ময়মুরব্বিগ কইলো। হুইন্না বেবাকতে কইলো, খবরদার রাজি অইয়ো না তুমি। এই নাইরকল হেই নাইরকল না, গাছের নাইরকল না। এই নাইরকল অর্থ পোলা। ড্যাগে তোমার একহান। পোলা নিতে চায়, বিনিময়ে তোমারে ওই টেকাডি দিবো। অহন তুমি কও কোনডা নিবা? দাদি কইল আমার টেকা লাগবো না। আমার সোনার চানরা বাইচ্চা থাউক।

তারবাদে?

তারবাদেও আরও দুইদিন ওই স্বপ্নডা দাদি দেকছে। ড্যাগে তারে কইছে টেকা নে, নাইরকল দে। স্বপ্নের মইদ্যেই দাদি কইছে, টেকা আমার লাগবো না। তুমি যাও গা। ড্যাগ তারবাদে পুকঐরে নাইম্মা গেছে।

দুইভাইই খানিক চুপ করে থাকে। কেউ কথা বলে না। সকাল ফুরিয়ে দুপুর ছুঁই ছুঁই তখন। রোদ তেজালো হয়েছে। হিজলের পাতায় একটুও হাওয়া নাই। এসময় হাজামবাড়ির দিকে চোখ গিয়েছে হামেদের, দেখে ছোট ভাইবোনদের নিয়ে পরি নেমে যাচ্ছে ভাঙনের দিকে। তাদের আগে আগে খালি গায়ে, উঁচু করে লুঙ্গি পরা আজিজ। দেখেই উত্তেজনা হল হামেদের। লাফিয়ে উঠে বলল, ওই দাদা, মা’র আহুজ পইড়া গেছে। ওই দেক বাবায় পরিগগা বাইত্তে লইয়া যাইতাছে।

নাদেরও দেখল তারপর উঠে দাঁড়াল। হ ঠিক কইছচ। ল আমরাও যাই।

সড়ক থেকে দৌড়ে চক বরাবর নেমে গেল দুই ভাই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *