শ্লোগান বনাম সত্য
স্বাধীনতা লাভের আগে দেশপ্রেমের মন্ত্র ছিল এদেশের অধিকাংশ আদর্শবাদী মানুষের মূলমন্ত্র। শহীদের আত্মত্যাগ ছাড়া স্বাধীনতা অর্জন করা যায় না, এ কথাই সেদিন আমরা বারবার বলেছি। দেশ গড়বার কাজে এর সঙ্গে আরও কিছু করা আবশ্যক, বিশেষত নিয়মিত শ্রমের অভ্যাস ও যুক্তিবাদী মন।
জাতি হিসাবে আমরা অলস। কথাটা হয়ত রূঢ় শোনাবে, তবু বলা দরকার। আলস্যজর্জর একটা দেশে দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি ঘটলে যে-সব সমস্যা দেখা দেয় আমাদের সমস্যা বহুলাংশে তাই। একটা জীর্ণ কৃষি ও শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে পাকে পাকে জড়িয়ে এটাই আমাদের আর্থিক উন্নতির পথে সবচেয়ে বড় অন্তরায় হয়ে আছে। একথাটা আমাদের পরিষ্কারভাবে বুঝতে হবে। আজ দেশ জুড়ে দুর্নীতির কথা অনেক শোনা যাচ্ছে। দুর্নীতি নিন্দনীয় সন্দেহ নেই। যে-ধন অন্যায়ভাবে লব্ধ তার বন্টন নিয়ে সমাজের স্বাভাবিক সংহতি ভেঙে পড়ে অন্যায়ে আত্মসম্মানবোধ দুর্বল হয়; অন্যায়ে অন্যায় প্রশ্রয় পায়। কিন্তু এদেশের মূল ব্যাধি আলস্য। তাই আমাদের দুর্নীতির নিন্দাতেও কোথাও একটা ফাঁকি থেকে যায়; অপরের নিন্দাটা আমরা ব্যবহার করি নিজের কর্তব্যবিমুখতার আচ্ছাদন হিসাবে। অথবা কুৎসাকীর্তনটাই একটা মধুর আলস্যের মত আমাদের পেয়ে বসে। আলস্যের নিন্দায় আমাদের মন তেমনভাবে সাড়া দেয় না। অথচ আর্থিক উন্নতির ইতিহাসের শিক্ষা এই যে, অন্য বহু দোষকে সে-ইতিহাস ক্ষমা করেছে, কিন্তু আলস্যকে করেনি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আজ জীবনধারণের মান খুব উন্নত। কঠিন পরিশ্রমে সেটা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু ওদেশের বন্ধুরাও আশা করি বলবেন না যে, ওখানে দুর্নীতি ছিল না অথবা নেই। শিল্পোন্নয়নের প্রথম যুগেও দুর্নীতি প্রকট ছিল। সোভিয়েত দেশের শত্রু না-হয়েও বলা সম্ভব যে ওদেশ দুর্নীতিমুক্ত নয়। অপরপক্ষে। জার্মানী-জাপান-ইংল্যাণ্ড অথবা অন্য যে-কোনো দেশেরই নাম করা যাক না কেন, নিয়মিত শ্রমের অভ্যাস ছাড়া কোথাও আর্থিক উন্নতি সম্ভব হয়নি।
এদেশে ধর্মঘট ইত্যাদির ফলে ক’ঘণ্টা অথবা কী পরিমাণ শ্রমশক্তি নষ্ট হয়েছে তার হিসাব কেউ কেউ করেছেন। কিন্তু কাজের সময়ে আলস্য এবং নিছক সময়ানুবর্তিতার। অভাবে কী পরিমাণ শ্রমশক্তি নষ্ট হয়েছে তার কোনো হিসাব নেই। সে-হিসাবটা যদি সম্ভব হত তবে দেখা যেত যে এতে করে দেশের সম্পদের যে-অপচয় অহরহ ঘটছে তার তুলনা নেই। এই অপচয় যতদিন না আমাদের বিবেককে পীড়িত করবে ততদিন আমরা পৃথিবীতে প্রাগ্রসর দেশ হবার যোগ্যতা অর্জন করতে পারব না। এই অযোগ্যতাকে গালভরা বুলি দিয়ে আবৃত করবার চেষ্টা শাক দিয়ে মাছ ঢাকবার মতই হাস্যকর ব্যর্থ। প্রচেষ্টা।
বামপন্থী মহলে একটা কথা প্রায়ই বলা হয়ে থাকে। কথাটা এই যে শোষকশ্রেণীর
অবসান না-হওয়া পর্যন্ত শোষিতের মনে কর্মে উৎসাহ আশা করা যায় না। শোষণতত্ত্বের। বিস্তারিত আলোচনা এখানে সম্ভব নয়। কিন্তু মনে রাখা আবশ্যক যে, সাম্যবাদী সোভিয়েত দেশ ও ধনতান্ত্রিক জাপান উভয় দেশেই শ্রমিকের ভিতর কর্মনিষ্ঠা দেখা গিয়েছে। আর্থিক উন্নতির জন্য সামাজিক নানা পরিবর্তন প্রয়োজন। কিন্তু কতটা পরিবর্তন অথবা কী ধরনের পরিবর্তন চাই, এ বিষয়ে ইতিহাসনির্দিষ্ট কোনো একমাত্র পথ নেই। গত বিশ বছরের ভিতর শিল্পের উন্নতি পূর্ব জার্মানিতে একভাবে হয়েছে, পশ্চিম জার্মানীতে ভিন্নভাবে। কোনো বিশেষ দেশের আর্থিক বিন্যাস কী হবে অথবা হওয়া বাঞ্ছনীয় সেটা সে দেশের বিশেষ অবস্থার উপর নির্ভর করছে।
মনে রাখা ভালো যে, শিল্পায়নের প্রথম পর্যায়ে কি-ধনতান্ত্রিক কি-সমাজতান্ত্রিক উভয় ব্যবস্থাতেই শ্রমিক সাধারণকে স্বল্প মজুরীতে কাজ করতে হয় এবং নানাপ্রকার ক্লেশ স্বীকার করে নিতে হয়। চীন ও সোভিয়েত দেশ সম্বন্ধেও এ কথাটা সত্য। সম্প্রতি সোভিয়েত দেশের একটি পত্রিকায় চীন সম্বন্ধে লেখা হয়েছে “কয়েকটি দেশের অর্থনীতিবিদের মূল্যায়নে প্রকাশ, চীনের জনপ্রতি শস্যোৎপাদন ১৯৫৭ থেকে ১৯৬৬তে শতকরা ১৫ ভাগ কমে গিয়েছে। সমাজবাদী দেশসমূহের মধ্যে চীনই একমাত্র দেশ যেখানে শ্রমিক শ্রেণীর জীবনযাত্রার মানের কোনো উন্নতি হয়নি, বরং অবনতি হয়েছে।” (ইজভেস্তিয়া, ১০ এপ্রিল, ১৯৬৭)। মন্তব্যটি সম্পূর্ণ ন্যায়সঙ্গত নয়। সোভিয়েত লেখকদের মনে রাখা উচিত যে, আর্থিক পরিকল্পনার প্রথম বিশ-পঁচিশ বছরে ওঁদের দেশেও শ্রমিকদের জীবনযাত্রার মানের বিশেষ কোনো উন্নতি ঘটেনি। এই প্রথম পর্যায়টা কেটে গেলে তারপর অবশ্য অবস্থার উন্নতি অনেকটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে এবং এটাও ধনতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক উভয় দেশ সম্বন্ধেই সত্য। কিন্তু আপাতত আমরা আর্থিক উন্নয়নের প্রথম পর্যায়ে।
চীনের লালরক্ষীরা নাকি দেশের “ধনতান্ত্রিক অধঃপতনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করছেন। প্রকারান্তরে যে কথাটা এতে স্পষ্ট তা হল এই যে, সাম্যবাদের পেয়ালা ওঁরা মুখে তুলে দেখেছেন “ধনতন্ত্রের মতো তা বিস্বাদ ঠেকেছে। যে-কথাটা ওঁরা মানতে চাইছেন না তা হল এই যে এটাই স্বাভাবিক। পোল্যাণ্ড-হাঙ্গারী থেকে সোভিয়েত-চীন পর্যন্ত সব দেশেই দেখা গিয়েছে যে এটাই নিয়ম কিন্তু উদাহরণের প্রয়োজন নেই। আর্থিকভাবে অনুন্নত একটা দেশের উপর বিশেষ নামধারী কোনো দলকে বসিয়ে দিলেই জীবন মধুর হয়ে উঠবে অথবা সমাজে অন্যায়ের অবসান ঘটবে এ চিন্তাটা সত্য তো নয়ই, এমন কি প্রকৃত প্রস্তাবে মার্কসীয়ও নয়। কোনো দল বড় বিপদ ঘটাতে পারে, তার সম্বন্ধে সাবধান হওয়া আবশ্যক। কিন্তু বড় সুখ কোনো দলই আনতে পারে না; এ বিষয়ে বাস্তববাদী হওয়াই ভালো। উন্নতির বিভিন্ন পথের ভিতর কোনো একটির প্রতি আমাদের কারও কারও খানিকটা পক্ষপাতিত্ব থাকতে পারে। কিন্তু সেটার অতুলনীয় শ্রেষ্ঠত্বে বিশ্বাস স্থাপন করা স্বপ্নবিলাস মাত্র। এই বিলাসটা দেশের পক্ষে বিপজ্জনক হতে পারে।
অতএব গোড়ার কথাতেই আবার ফিরে আসা যাক। আওয়াজে দেশের সম্পদ বাড়ে, কাজে বাড়ে না। সেই কর্মের অভ্যাসের সঙ্গে যোগ করা প্রয়োজন যুক্তিবাদী মন। এদেশে আমরা সবাই ভক্তিবাদে বিশ্বাসী তাই যুক্তিবাদের কথাটা একটু জোর দিয়ে বলা প্রয়োজন। যুক্তিবাদই যথেষ্ট কিনা সে তর্কে আপাতত যাব না। সেই অসাধারণ মানুষের কথাও বলব না যাঁকে কোনো নিয়মে বাঁধা যায় না। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের কথাই বলছি। সেখানে প্রেমেরও স্থান আছে। কিন্তু শুধু প্রেম যথেষ্ট নয়, সে দেশপ্রেমই হোক আর জীবপ্রেমই হোক। যুক্তিনিষ্ঠারও প্রয়োজন আছে। এ কথাটা বড় সহজে মেনে নিলে সেই গ্রহণটাও বর্জনের সামিল হয়ে দাঁড়ায়। কাজেই একটু ব্যাখ্যা প্রয়োজন।
আমাদের বৈষয়িক জীবনে দৈনন্দিন কাজে অনুরাগ-বিরাগমুক্ত যুক্তির দৃষ্টির একটা সাধারণ উপযোগিতা আছে। প্রতিদিনের বেচাকেনার সম্পর্কে এটা স্পষ্ট। বিক্রেতা বিক্রয় করেন নিজের স্বার্থে, ক্রেতাও কেনেন নিজের স্বার্থে; এ নিয়ে মানঅভিমানের প্রশ্ন উঠে না। অথচ দু’টি স্বতন্ত্র স্বার্থ আত্মীয়তার বন্ধনহীন দু’টি স্বার্থ–যে পরস্পরের পরিপূরক হতে পারে, এ কথাটা অন্ধপ্রেম সহজে মানতে চায় না। প্রেম যাকে আপন বলে কাছে টানতে পারে না তাকেই সন্দেহের চোখে দূরে ঠেলে দেয়। নবজাগ্রত জাতীয়তাবোধ বিদেশকে এমন একটা প্রেম-ও-সন্দেহের মিশ্র দৃষ্টিতে দেখে থাকে। বিদেশের সঙ্গে হয় আমাদের ভাই-ভাই সম্পর্ক, নয় তো আমরা শত্ৰু। এটা কিন্তু যুক্তিসঙ্গত বিচার নয়।
বিদেশী সাহায্য ও মূলধন গ্রহণের ব্যাপারে আমাদের এই মনোভাবটা প্রকট। সমালোচকদের যুক্তি শুরু হয় এই ভাষাতে, “শুধু কি নিঃস্বার্থ ভারতপ্রেম থেকে ওরা আমাদের সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছে। ওরা টাকা ধার দিচ্ছে নিশ্চয়ই নিজের স্বার্থের মুখ চেয়েই।” কিন্তু এটা কোন যুক্তি নয়। ওঁদের স্বার্থে ওঁরা দেবেন, আমাদের স্বার্থে আমরা নেব–অথবা নেব না। নেওয়া-না-নেওয়াটাই একমাত্র কথা নয়; চিন্তা পরিচ্ছন্ন রাখা দরকার। ওঁদের যাতে লাভ আমাদের তাতেই ক্ষতি, এই প্রত্যয়টা যুক্তিসহ নয়। আত্মরতির ওটা বিপরীত পিঠ। সতর্কতা ভালো; কিন্তু শুধু নিঃস্বার্থ অপরের সঙ্গে বৈষয়িক সম্পর্কে আবদ্ধ হব এই প্রতিজ্ঞা করে যিনি সংসারে প্রবেশ করবেন অচিরেই তাঁকে গুহাবাসী হতে হবে। অবশ্য আত্মকেন্দ্রিকতার মতোই মাত্রাহীন পরনির্ভরতাও বিপজ্জনক। এদেশে আমরা একই সঙ্গে আত্মকেন্দ্রিক ও পরনির্ভর। শিশুসুলভ অসহায় নির্ভরতা ও অকৃতজ্ঞতায় অভ্যস্ত দেশের এই মনটাকে একটু বহিমুখী করা প্রয়োজন।
বেচা-কেনার ক্ষেত্রে যে-কথাটা সত্য বৃহত্তর অর্থে জীবনের আরও নানা ক্ষেত্রে সেটা অন্তত অংশত প্রযোজ্য। পরিপূরক স্বার্থের ভিত্তিতেই সমাজে সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। আবার সহযোগিতা মাত্রই শতাধীন, অর্থাৎ সহযোগীদের কে কি পাবেন এ সম্বন্ধে কয়েকটি লিখিত অথবা অলিখিত নিয়মে আবদ্ধ। এই শর্তগুলি সমাজের বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হয়। স্বামী-স্ত্রীর ভিতর সহযোগিতার অলিখিত বিধানও গত শতাব্দীতে যা ছিল আজ আর তা নেই। শিল্পের ক্ষেত্রেও তাই। আমাদের চায়ের বাগানে কুলি ও ম্যানেজারের ভিতর যে সম্পর্ক সুইডেনের শিক্ষিত শ্রমিকের সঙ্গে শিল্পপতির সেই সম্পর্ক নয়। যুক্তিবাদী দৃষ্টি বাস্তব অবস্থার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সমাজে উচ্চতর সহযোগিতার নব নব রূপ অন্বেষণ করে এবং জীবনে তাকে প্রতিষ্ঠিত হতে সহায়তা করে। এই গঠনমূলক মনোভাব নিয়ে যে-কর্মপ্রয়াস ও সংগ্রাম তাতেই দেশের মঙ্গল।
যুক্তি বলতে যদি শুধু তর্কের নিয়ম বুঝি তো যুক্তিবাদ যথেষ্ট নয়। অবশ্য ন্যায়শাস্ত্রও উপেক্ষণীয় নয়; কিন্তু সমাজকে সুস্থ রাখবার জন্য যে-যুক্তিবাদী মন প্রয়োজন সেটা মূলত তর্কের নিয়ম নিয়ে নয় বরং জীবনের প্রতি একটা বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে। এই উদার দৃষ্টিভঙ্গীর বিরুদ্ধে উগ্ৰ অসহিষ্ণুতার বিদ্রোহ এ দেশে ও বিদেশে আমরা বার বার দেখেছি। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে বিনষ্ট করেছে অন্ধ বিদ্বেষ। মতবাদের স্বাধীন আলোচনাকে স্তব্ধ করতে চেয়েছে চরিত্রহননের কুৎসিত চিৎকার।
এই শেষ কথাটা বিশেষভাবে বলতে হল কারণ ইদানীং চরিত্রশিকারীরা আবার মৃগয়ায় মত্ত হয়েছেন। এই অভাবপীড়িত দেশে বিদেশী সরকারের কাছ থেকে প্রকাশ্য অথবা গোপন সাহায্য গ্রহণের অভিযোগটা সহজে ছড়ায়। ডাঙ্গে ও মানবেন্দ্র, এমন কি সুভাষচন্দ্র, এবং বামপন্থী ও দক্ষিণপন্থী প্রায় সকল দলের বিরুদ্ধেই কখনও-না-কখনও এই অভিযোগ শোনা গিয়েছে। (সম্প্রতি রামমনোহর লোহিয়া দন্ত করে বলেছেন যে, একমাত্র তাঁর দলই নাকি এই পাপ থেকে মুক্ত!) এ বিষয়ে প্রয়োজনমত অনুসন্ধান করবার দায়িত্ব আমাদের পুলিশ ও গোয়েন্দা বিভাগের। কিন্তু মতামতের দ্বন্দ্বটা ইতিমধ্যে স্বাধীন ও যুক্তিনিষ্ঠ রাখা প্রয়োজন। কোনো মত সত্য হলে সেটা গ্রহণীয়; মিথ্যা হলে যুক্তির সাহায্যেই তার ভ্রান্তি প্রমাণ করা সম্ভব। এই ঋজু বিচারনিষ্ঠা গণতান্ত্রিক সমাজের মহামূল্য সম্পদ। বিচারহীন বিদ্বেষ হট্টগোলে গণতন্ত্রের শত্রুদের অবশেষে জয় হয়। এতে দেশের সমূহ ক্ষতি।
আর্থিক পরিবর্তনের প্রথম পর্যায়ে ভাঙাগড়ার মাঝখানে ব্যক্তিতে-ব্যক্তিতে ভুল-বোঝাবুঝি ও সম্প্রদায়ে-সম্প্রদায়ে দ্বন্দ্ব তীব্র হয়ে ওঠার সম্ভারনা। এরই মাঝে সামাজিক সহযোগিতার নতুন ভিত্তি রচনা করতে হয়। এই যোহার কাজেই চাই যুক্তির ব্যবহার। প্রেম আমাদের অনাত্মীয়কে আত্মীয় ভাবতে শেখায়। কিন্তু বৃহৎ সমাজে এমন বহুলোকের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতে হয় যাঁদের আমরা স্বতঃস্ফূর্ত স্নেহে কাছে টানতে পারি না; তবু তাঁদের প্রতিও ন্যায়বিচার রক্ষা করে চলা প্রয়োজন। এমন বহু লোকের সঙ্গে যোগসূত্রে আবদ্ধ হতে হয়, যাঁদের মতামত আমাদের বিপরীত, কিন্তু তাঁদের প্রতিও সহিষ্ণু হওয়া আবশ্যক। এটাই যুক্তির শিক্ষা। যাঁদের আমরা আত্মীয় করে তুলতে পারিনি সেই অনাত্মীয় অপরের প্রতিও ন্যায় ও সহিষ্ণুতার ন্যূনতম শর্ত রক্ষা করে আমরা সমাজে সেই সভ্য পরিমণ্ডল সৃষ্টি করি যাতে গঠনের কাজ সহজ হয়, কলহে ও অনিয়মে সমাজ অকারণে দুর্বল হয় না। দেশকে গড়তে যদি শ্রমের অভ্যাস চাই তবে সেই সৃষ্টিকে অহেতুক বিনাশের হাত থেকে বাঁচাবার জন্য চাই যুক্তিতে বিশ্বাসী, ভয় শূন্য মন।
গণযুগ ও গণতন্ত্র (১৯৬৭)