মুক্তিযুদ্ধ
কলকাতায় বিএলএফ নেতারা সবাই মিলিত হলেন ভবানীপুরের সানি ভিলায়। এখন তারা কী করবেন? তাঁদের এই ঠিকানা মুখস্থ করিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। এর বাইরে তারা কিছু জানতেন না। ২৫ মার্চ-পরবর্তী সময়টুকুতে শেখ মুজিব তাদের পাশে নেই। অচেনা পরিবেশে থিতু হতেও সময় লাগে। পরে তাঁরা যে কর্মযজ্ঞে জড়িয়ে পড়েছিলেন, তার সূত্রপাত কীভাবে হলো, এ নিয়ে আমি কথা বলেছিলাম সিরাজুল আলম খানের সঙ্গে। উনি সরাসরি কিছু বলেন না। একটু ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে জবাব দেওয়া তাঁর। স্বভাব। আমাদের আলাপচারিতা ছিল এ রকম:
মহিউদ্দিন আহমদ : ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আপনাদের যোগাযোগ হলো কীভাবে?
সিরাজুল আলম খান : ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে বাংলাদেশ সরকারের শপথ নেওয়ার অনুষ্ঠানে ঘোরাফেরা করছি। এমন সময়। একজনকে দেখলাম, হাতে একটা অ্যাটাচি ব্যাগ। তিনিও যেন। কাউকে খুঁজছেন। তাঁর সঙ্গে কথাবার্তা হলো। মনে হলো, আমরা যাকে খুঁজছি, ইনিই তিনি। তিনি যাদের খুঁজছেন, আমরাই সেই। লোক। তিনি একজন সরকারি কর্মকর্তা।
মহি: তাঁর নাম কী?
সিরাজ : নামটা যেন কী, মনে নেই।
মহি: স্মরণ করার চেষ্টা করুন। ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে নামটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
সিরাজ : মনে পড়েছে। তার নাম ব্যানার্জি। বাঙালি।
মহি: পুরো নাম বলুন। বাঙালিদের মধ্যে লাখ লাখ ব্যানার্জি আছে।
সিরাজ : পুরো নাম মনে পড়ছে না।
মহি : আপনাদের ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা তো হলো জেনারেল উবানের মাধ্যমে। তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ হলো কীভাবে?
সিরাজ : ব্যানার্জির মাধ্যমে জেনারেল উবানের সঙ্গে দেখা হয়। [১]
সিরাজুল আলম খানের ব্যাখ্যায় আমি সন্তুষ্ট হতে পারিনি। মনে হলো তিনি কিছু লুকোচ্ছেন। ঘটনার পাঁচ দশক পরও কেন এই লুকোচুরি, তা তিনিই জানেন।
কলকাতায় বিএলএফ নেতারা একসঙ্গে পৌঁছাননি। সবার আগে গেছেন শেখ ফজলুল হক মনি ও তোফায়েল আহমেদ। সবার শেষে গেছেন সিরাজুল আলম খান। সেখানে তাঁরা নিজেদের কীভাবে সংগঠিত করলেন, এ প্রশ্ন করেছিলাম তোফায়েল আহমেদকে। তার সঙ্গে আমার কথোপকথন ছিল এ রকম :
মহিউদ্দিন আহমদ : কলকাতায় বিএলএফ অর্গানাইজড হলো কীভাবে?
তোফায়েল আহমেদ : চিত্ত সুতারের বাসায় বৈঠক হলো ফণীন্দ্রনাথ ব্যানার্জির সঙ্গে। আমরা তাকে বলি নাথবাবু। তাঁর মাধ্যমেই সব ব্যবস্থা হলো। তিনি ছিলেন ভারত সরকারের প্রতিনিধি।
মহি: সব ব্যবস্থাপনা, যোগাযোগ নাথবাবুর মাধ্যমে?
তোফায়েল : হ্যাঁ। আমাদের ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা হলো। আমরা চারজন চারটি অঞ্চলের দায়িত্বে। মনি ভাই চট্টগ্রাম বিভাগ এবং ঢাকা বিভাগের ঢাকা জেলার দায়িত্ব নেন। রাজ্জাক ভাইয়ের দায়িত্বে ছিল বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলা। সিরাজ ভাই নর্থ বেঙ্গলের দায়িত্বে, পাবনা বাদে রাজশাহী বিভাগের অন্য জেলাগুলো। আমি দায়িত্ব পেলাম খুলনা বিভাগের। তখন বরিশাল তো খুলনা বিভাগের মধ্যেই ছিল। পাবনা আর ফরিদপুর জেলাও ছিল আমার অধীনে। সিরাজ ভাই থাকতেন শিলিগুড়ি। রাজ্জাক ভাইয়ের ক্যাম্প ছিল মেঘালয়ের তুরা। মনি ভাইয়ের হেডকোয়ার্টার হলো আগরতলা। একমাত্র আমি থাকতাম কলকাতা। ব্যারাকপুরে আমার দপ্তর। আমাদের টাকাপয়সা দিতেন নাথবাবু। তার কাছ থেকে টাকা আমিই রিসিভ করতাম। তারপর আলাদা প্যাকেট করে অন্য তিনজনের কাছে পাঠাতাম।
কলকাতার হিন্দুস্তান ইন্টারন্যাশনাল হোটেলে আমরা নাথবাবুর সঙ্গে বৈঠক করতাম। অর্থ, অস্ত্র আর ট্রেনিং–সবই আমাদের দিতেন ইন্দিরা গান্ধী, নাথবাবুর মাধ্যমে।
মহি : ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে আপনারা কখনো দেখা করেছেন?
তোফায়েল; চারজন একসঙ্গে করি নাই। আমরা মেইনলি মিটিং করতাম ডি পি ধরের সঙ্গে। এভরি মান্থ, মিনিমাম একবার।
মহি: কোথায়?
তোফায়েল : কলকাতায়, হিন্দুস্তান ইন্টারন্যাশনালে। ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা হয়েছে আমার। আমি কলকাতায় থাকতাম। দিল্লি গেলাম। আমাকে ডাকল। নাথবাবুই পাঠিয়েছে আমাকে। টু বি ফ্র্যাংক, আমার সঙ্গেই দেখা হয়েছে।
মহি: তাহলে ওনার সঙ্গে আপনার একবারই দেখা হয়েছে, দিল্লিতে। বাকি তিনজনের হয়নি।
তোফায়েল : দেখা হয়নি। হলে তো আমি জানতাম।
মহি: জেনারেল মানেকশর সঙ্গে আপনাদের কখনো দেখা হয়েছে?
তোফায়েল : হ্যাঁ। মানেকশর সঙ্গে তো দেখা হয়েছেই। স্বাধীনতার পর যখন বাংলাদেশে এল। ওখানে দেখা হয় নাই।
মহি: র-এর পরিচালক আর এন কাওয়ের সঙ্গে কি দেখা হয়েছে? একাত্তরে?
তোফায়েল : আমার সঙ্গে দেখা হয়েছে অনেকবার।
মহি: মুজিববাহিনীকে তো র-এর সাপোর্টে…
তোফায়েল : ওই তো, সে-ই তো।
মহি: জেনারেল উবানের সঙ্গে প্রথম দেখা হলো কখন?
তোফায়েল : উবানের সঙ্গে প্রথম দেখা হলো দেরাদুনে।
মহি: ট্রেনিংয়ের সময়?
তোফায়েল : হ্যাঁ। তারপর নিয়মিত দেখা হতো। [২]
এভাবেই বিএলএফের সংযোগ তৈরি হলো ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা র এর সঙ্গে। নাথবাবু, অর্থাৎ ফণীন্দ্রনাথ ব্যানার্জি ছিলেন র-এর কর্মকর্তা। এই সংস্থার অধীনে ছিল স্পেশাল ফ্রন্টিয়ার ফোর্স, যার প্রধান ছিলেন মেজর জেনারেল সুজন সিং উবান। উবান বিএলএফের সশস্ত্র প্রশিক্ষণের দায়িত্বে ছিলেন।
.
২
শেখ মুজিবের প্রতিনিধি হিসেবে চিত্তরঞ্জন সুতার আগে থেকেই কলকাতায় ছিলেন। কালিদাস বৈদ্য কলকাতায় পৌঁছান একাত্তরের ১৩ এপ্রিল। শুরু হলো তাদের সলাপরামর্শ। কালিদাস বৈদ্যের বয়ানে জানা যায় :
চিত্তবাবুর ছদ্মনাম ছিল সত্যব্রত রায় আর আমার নাম রতন রায়। বাংলাদেশের ভেতরে হিন্দুদের ওপর নৃশংস অত্যাচারের ভয়াবহ খবর শুনে আমরা বিচলিত হয়ে পড়ি। তার জন্য চিত্তবাবু ও আমি এক গোপন আলোচনায় বসি। সেই ভয়াবহ পরিস্থিতি কীভাবে মোকাবিলা করা যায়, সেই পথের অনুসন্ধানই ছিল আমাদের মূল আলোচ্য বিষয়। সেদিনের আলোচনায় দুটি পথের কথা আমরা চিন্তা করি। তার প্রথমটি হলো হিন্দু ছেলেদের আলাদাভাবে গোপনে ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা। আর দ্বিতীয়টি হলো মুক্তিবাহিনী ছাড়াও আরও একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বাহিনী গঠন করা।
বৈঠকের শেষের দিকে চিত্তবাবু প্রস্তাব করেন এই বাহিনীর নাম হবে মুজিববাহিনী। সঙ্গে সঙ্গে আমি তার স্বীকৃতি জানাই। ওই দিন আরও আলোচনা হয়, মুজিববাহিনীর নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব থাকবে উক্ত চারজন ছাত্রনেতার হাতে (মনি, সিরাজ, রাজ্জাক, তোফায়েল)। আমরা বিশেষভাবে আলোচনা করি যে প্রথমে সিরাজুল আলমের সম্মতি পেলেই প্রস্তাবটির পক্ষে চার ছাত্রনেতার সমর্থন পাওয়া সহজ হবে। কেননা, শেখ মনি তার মামার নামের বাহিনীর বিরোধিতা কখনোই করবেন না। মনি ও সিরাজুল একমত হলে রাজ্জাক ও তোফায়েল কোনো বিরোধিতা করবে না। এই প্রস্তাবে সম্মতি আদায় করার দায়িত্ব চিত্তবাবু নিজেই নিলেন। অন্যান্য প্রসঙ্গের মধ্যে একেবারে গুরুত্বহীনভাবে প্রথমেই সিরাজুল আলমের কাছে তিনি প্রসঙ্গটি তুললেন। সঙ্গে সঙ্গে সিরাজুল আলম তা লুফে নেন।
এই প্রস্তাব গ্রহণের পর ছাত্রনেতারা মনে করল ভারত সরকার প্রস্তাবটির অনুমোদন দিলে ও সেভাবে কাজ করলে বাংলাদেশের সামরিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা তাদের হাতেই যাবে। ফলে। বাংলাদেশ সরকার কখনোই তাদের মতের বাইরে যেতে পারবে। না। সিরাজুল আলমের কথামতো তারা চিত্তবাবুকে জানিয়ে দেয় যে এই ট্রেনিংয়ের কথা সম্পূর্ণ গোপন রাখতে হবে। ভারত সরকারের প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান সেনাপতি ছাড়া কেউ তা জানতে পারবে না। আর জানতে পারবে শুধু ভারপ্রাপ্ত ট্রেনিং অফিসার। বাংলাদেশ সরকার ও এর সেনা বিভাগের কেউ তা জানতে পারবে না, বাংলাদেশের প্রধান সেনাপতিও নয়। এই প্রস্তাবটি পরের দিনই বিশেষ নির্ভরযোগ্য ব্যক্তির মাধ্যমে অতি গোপনে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তিনি সঙ্গে সঙ্গে তার অনুমোদন দেন। তার পরেই জেনারেল উবানের অধীনে তাড়াতাড়ি মুজিববাহিনীর গোপন ট্রেনিং শুরু হয়। খুব সম্ভব মে মাসের মাঝামাঝি সে টেনিং শুরু হয়। [৩]
এই চার যুবনেতা, যাদের কালিদাস বৈদ্য ছাত্রনেতা হিসেবে উল্লেখ করেছেন, তাঁদের সম্পর্কে বৈদ্যের মূল্যায়নটি প্রাসঙ্গিক। তাঁর মতে, এই চার নেতার নেতৃত্বের ঐতিহাসিক অবদানের জন্যই মুজিব ধীরে ধীরে ও ধাপে ধাপে এত উঁচুতে উঠতে পেরেছিলেন। সরকার গঠনের আগপর্যন্ত তাদের কথাই ছিল শেষ কথা। অথচ সরকার গঠনের সময় তাদের মতামত নেওয়া তো দূরের কথা, তারা কিছুই জানতে পারল না। তাতে তাদের ব্যক্তিত্বে চরম আঘাত লাগে। চিত্তবাবুর বেলায়ও তাই।’ কালিদাস বৈদ্য যুবনেতাদের সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন :
এই চারজন ছাত্রনেতার মধ্যে সিরাজুল আলম খান ছিল কিছুটা চরমপন্থী, চিন্তাশীল, পরিশ্রমী, সৎ, নির্ভীক, আপসহীন বিশেষ ব্যক্তিত্বশালী নেতা। জন্মগত চেতনা ও ব্যক্তিত্বের অধিকারী হয়ে নিজের গুণেই সে জননেতা হওয়ার অধিকার অর্জন করে। সাংগঠনিক শক্তি তার মধ্যে বিশেষভাবে দেখা দেয়। সমাজবাদে তার বিশ্বাস ছিল। চীনপন্থী, বিশেষ করে ট্রটস্কিপন্থী বলেই তাকে মানুষ অভিহিত করত। আমার কাছে সে ছিল একজন আয়রনম্যান। আবদুর রাজ্জাক ছিল নরমপন্থী, সৎ, কর্মঠ ও আপসকামী নেতা। তার সাংগঠনিক শক্তি খুব ভালো ছিল। সে-ও সমাজবাদে বিশ্বাসী ছিল। তবে সে ছিল রাশিয়াপন্থী। শেখ মনি ছিল চিন্তাশীল, চতুর ও সুযোগসন্ধানী নেতা। সাংগঠনিক ক্ষমতা ছিল, কিন্তু পূর্বোক্ত দুজনের মতো নয়। তবে মামার জোরে সে পুষিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করত। কেননা, সে ছিল মুজিবের ভাগনে ও সমাজবাদের কট্টর। বিরোধী। সিরাজুল আলম খানের সঙ্গে ছিল ব্যক্তিত্ব ও নেতৃত্বের সংঘাত। তোফায়েল আহমেদ এদের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ। তার মধ্যে তখনো তেমনভাবে কোনো বিশেষ গুণ ধরা না গেলেও তার মধ্যে সাংগঠনিক শক্তি ছিল, তা নিশ্চিন্তে বলা যায়। সে ছিল চতুর ও কিছুটা সুযোগসন্ধানী নেতা। সে-ও কট্টর সাম্যবাদবিরোধী। [৪]
.
৩
ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর (আইবি) অনেকগুলো শাখার একটি ছিল পাকিস্তান ডেস্ক’। আইবির যুগ্ম পরিচালক এস শঙ্করণ নায়ার এর দেখভাল করতেন। তাঁর ছদ্মনাথ ছিল কর্নেল মেনন। উল্লেখ করা যেতে পারে যে ১৯৬৭ সালের জুলাই মাসে তাঁর সঙ্গে বৈঠক করার জন্য পাকিস্তান নৌবাহিনীর লে. কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেনের প্রতিনিধি হিসেবে স্টুয়ার্ড মুজিবুর রহমান ও আলী রেজা আগরতলা গিয়েছিলেন। ১৯৬৮ সালে ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ চলাকালে বিষয়টি জানাজানি হয়েছিল। [৫]
১৯৬২ সালে চীনের সঙ্গে এবং ১৯৬৫ সালে পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধে ভারতের যে সামরিক বিপর্যয় ঘটেছিল, তা থেকে বেরিয়ে এসে গোয়েন্দা কাঠামো ঢেলে সাজানো দরকার হয়ে পড়েছিল। ১৯৬৮ সালের ১ অক্টোবর আইবির একটি অংশ কেটে নিয়ে তৈরি হয় রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইং-সংক্ষেপে ‘র’ (R&AW)। ঠিক হলো, আইবি কাজ করবে দেশের ভেতরে আর ‘র’ কাজ করবে দেশের বাইরে। প্রধানমন্ত্রীর সচিব পরমেশ্বর নারায়ণ হাকসার (পি এন হাকসার) এবং আইবির কর্মকর্তা রামেশ্বর নাথ কাও (আর এন কাও) হলেন র-এর কারিগর। কাও হলেন এর প্রথম পরিচালক। তাঁকে প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ের অতিরিক্ত সচিব করা হলো। হাসারের পরামর্শ অনুযায়ী র-এর কাজ চালানোর জন্য কাওকে দেওয়া হলো অবাধ স্বাধীনতা। [৬] হাকসার পরে মুখ্য সচিব এবং কাও সচিব হয়েছিলেন।
আইবির পাকিস্তান ডেস্ক পুনর্গঠিত হয়ে র-এর অন্তর্ভুক্ত হলো। এর দায়িত্ব পান ফণীন্দ্রনাথ ব্যানার্জি। তিনি হলেন র-এর পূর্বাঞ্চলের প্রধান। তাঁর অফিস কলকাতায়। তাঁর ডেস্কেই চালু হলো নতুন প্রকল্প, ‘বাংলাদেশ অপারেশন’ [৭]।
কর্নেল মেননের লোকেরা আগে থেকেই পূর্ব পাকিস্তানে গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছিলেন। গোয়েন্দারা পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর ভেতরে এবং বাইরে অনেকের সঙ্গেই সংযোগ তৈরি করেছিলেন। এঁদের মধ্যে ছিলেন। মেজর খালেদ মোশাররফ, মেজর সফিউল্লাহ এবং আবদুল কাদের সিদ্দিকী। কাদের সিদ্দিকী পরে বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী ও র-এর ‘অপারেটিভদের মধ্যে যোগাযোগের মাধ্যমে হয়েছিলেন বলে ভারতীয় সাংবাদিক অশোক রায়না তাঁর ইনসাইড র বইয়ে উল্লেখ করেছেন। [৮]
১৯৬৯ সালের মার্চে র-এর একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি যদি তাদের মনমতো না হয়, তাহলে ভারতের সঙ্গে পাকিস্তান যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে। ভারত সরকার এ বিষয়ে জয়েন্ট ইন্টেলিজেন্স কমিটির রিপোর্টের অপেক্ষায় ছিল। ১৯৬৯ সালের মে মাসে প্রধানমন্ত্রীকে দেওয়া র-এর আরেকটি প্রতিবেদনে বলা হয়, পাকিস্তান যুদ্ধের জন্য তৈরি হচ্ছে এবং এ জন্য ভারতকে ‘সার্জিক্যাল ইন্টারভেনশনে যেতে হবে। র-এর প্রতিবেদনে ভবিষ্যৎ ঘটনাপ্রবাহের পূর্বাভাস ছিল।’ [৯]
একাত্তরের ঘটনাপ্রবাহের সূত্র খুঁজতে হলে আরও পেছনে যেতে হবে। ১৯৬২। সালের ২০ অক্টোবর চীনের সেনাবাহিনী যুক্তরাজ্যের চাপিয়ে দেওয়া সীমান্তরেখা ‘ম্যাকমোহন লাইন’ পেরিয়ে হিমালয় অঞ্চলে ঢুকে পড়লে ভারত-চীন যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। ২০ নভেম্বর চীন একতরফা যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করার এক সপ্তাহ আগে ১৪ নভেম্বর ভারত সরকার তৈরি করে একটি বিশেষ বাহিনী–স্পেশাল ফ্রন্টিয়ার ফোর্স (এসএফএফ)। তিব্বত থেকে আসা উদ্বাস্তুদের নিয়ে গড়া এই বাহিনীর কাজ ছিল চীনের (তিব্বত) ভেতরে ঢুকে ঝটিকা আক্রমণ চালানো। সামরিক ভাষায় এ ধরনের হামলাকে বলা হয় ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’। এই বাহিনীর একটি সাংকেতিক নাম ছিল এস্টাবলিশমেন্ট টোয়েন্টি টু। এসএফএফের ইন্সপেক্টর জেনারেল হিসেবে নিয়োগ পান মেজর জেনারেল সুজন সিং উবান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ বাহিনীর হয়ে ইউরোপে ২২তম পার্বত্য রেজিমেন্টে এবং উত্তর আফ্রিকায় একটি ডেজার্ট স্কোয়াড্রনের নেতৃত্ব দিয়ে তিনি খ্যাতি পেয়েছিলেন। [১০]
এসএফএফের সদর দপ্তর স্থাপন করা হয় দেরাদুন শহরের ১০০ কিলোমিটার দূরে চাকরাতা নামক স্থানে। আট হাজার সদস্য নিয়ে এই বাহিনীর যাত্রা শুরু। যুক্তরাষ্ট্রের কেনেডি প্রশাসনের সহায়তায় মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ এবং ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা আইবির প্রশিক্ষণ পেয়ে এই বাহিনীর সদস্যরা অপ্রচলিত ধারায় যুদ্ধ, বিশেষ করে দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় গেরিলাযুদ্ধের কলাকৌশল ভালোভাবেই আয়ত্ত করেছিলেন। এই বাহিনীকে প্রথমে আইবি এবং পরে র-এর হাতে ন্যস্ত করা হয়। [১১]
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ঢাকায় পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর আক্রমণ শুরু হলে বঙ্গবন্ধু নানাজনের পরামর্শ সত্ত্বেও বাড়িতেই থেকে যান। র-এর ভাষ্যে জানা যায়, আক্রমণের কয়েক দিন আগে মুজিব তাঁর অনুসারীদের ভারতে চলে যাওয়ার ব্যাপারে সম্মতি দেন। তাদের একজন হলেন তাজউদ্দীন আহমদ। আরও যারা সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে যান, তাঁদের মধ্যে ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, খন্দকার মোশতাক আহমদ, সিলেট আজাদ (আবদুস সামাদ আজাদ) এবং চারজন ছাত্রনেতা শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমেদ। কলকাতায় কিছুক্ষণ অপেক্ষা করিয়ে তাজউদ্দীনকে দিল্লি নিয়ে যাওয়া হয় এবং তারপরই তৈরি হয় মুজিবনগর (সরকার)। যে চারজন ছাত্রনেতা ভারতে গিয়েছিলেন, তাঁরা নিজেদের মুজিবের প্রতিনিধি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হন। তাঁদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স–বিএলএফ। [১২]
র-এর সঙ্গে বিএলএফের যোগাযোগের সূত্রপাত করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। প্রয়োজনের সময় কোথায় যেতে হবে, এ নির্দেশনাটুকু তিনি আগেই দিয়ে রেখেছিলেন। জেনারেল উবানের সঙ্গে বিএলএফ নেতাদের সরাসরি যোগাযোগ হয় এপ্রিলের শেষের দিকে। এ প্রসঙ্গে উবানের ভাষ্যটি এ রকম :
গোলযোগের অশান্ত দিনগুলোতে আমরা একদল নিবেদিতপ্রাণ যুবনেতার কথা জানতে পারলাম, যারা বাংলাদেশে বেশ পরিচিত। তারা হলেন শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমেদ। তাদের মনে হলো অত্যন্ত অনুপ্রাণিত করতে অথবা মরতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এবং বাংলাদেশের ভেতরে ও বাইরে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে তাদের নেতৃত্বের গ্রহণযোগ্যতা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত ছিল। দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হলো, অস্থায়ী সরকার এঁদের তেমন মর্যাদা দিতে প্রস্তুত ছিল না। তারা চাইছিল, এঁরা মুক্তিবাহিনীর নেতৃত্বে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করবে ও যুদ্ধে অংশ নেবে। কিন্তু এই যুবনেতাদের তাতে দৃঢ় আপত্তি ছিল। তারা মুজিববাহিনী নামে অভিহিত হতে পছন্দ করলেন। তারা তাদের পুরোনো সহকর্মীদের ক্যাডার হিসেবে বেছে বেছে সত্যায়িত করলেন।
ক্যাবিনেট সেক্রেটারিয়েটের সেক্রেটারি শ্রী আর এন কাও এ সময় আমার ঊর্ধ্বতন সিভিলিয়ান কর্মকর্তা ছিলেন। আওয়ামী লীগের যুব উইংয়ের নেতৃত্ব এবং খোদ সংগঠনটি সম্পর্কে বিস্তারিত গোয়েন্দা তথ্য জানার সুযোগ তার হয়েছিল। তাঁর গভীর উপলব্ধি ছিল যে, তিনি আমার তত্ত্বাবধানে যে যুবনেতাদের দিয়েছিলেন, কেবল তাদের দ্বারাই আসল কাজটি হবে এবং তাদের বাংলাদেশের সবচেয়ে স্পর্শকাতর রাজনৈতিক অঞ্চলে কাজ করার জন্য বিশেষ মর্যাদা দেওয়া দরকার। তিনি তাঁদের প্রতি অস্থায়ী সরকারের মন্ত্রীদের ঈর্ষার কথা জানতেন তাঁদের আপসহীন মনোভাবের জন্য এবং মন্ত্রীদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও অভিসন্ধির জন্য। [১৩]
বিএলএফ সদস্যদের প্রশিক্ষণের দায়িত্ব নিয়েছিল এসএফএফ। জেনারেল উবান নিজেই প্রশিক্ষণের দায়িত্বে ছিলেন। বিএলএফের জন্য প্রশিক্ষণ ক্যাম্প চালানো, সামরিক প্রশিক্ষণ দেওয়া, অস্ত্র সরবরাহ, সবকিছুর আয়োজন হয়েছিল এসএফএফের মাধ্যমে। এসবের অনুঘটক ছিল ‘র’। বিএলএফের চার নেতার প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে ছিল আগরতলা (ত্রিপুরা), তুরা (মেঘালয়), পাংগা (শিলিগুড়ি, পশ্চিমবঙ্গ) এবং ব্যারাকপুরে (কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ) চারটি ট্রানজিট ক্যাম্প। [১৪]
বাংলাদেশ সরকারের কমান্ড কাঠামোর অধীনে সীমান্তের বিভিন্ন জায়গায় মুক্তিবাহিনীর তরুণদের জন্য খোলা হয়েছিল অনেকগুলো প্রশিক্ষণশিবির। এসব শিবির পরিচালনা, সামরিক প্রশিক্ষণ এবং অস্ত্র সরবরাহের সমন্বয় হতো র-এর মাধ্যমে। তবে ওই শিবিরগুলো পরিচালনা করতেন বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিরা। পরে বিএলএফসহ মুক্তিবাহিনীর অনেকেই একে অপরের দিকে আঙুল তুলে কে র-এর এজেন্ট আর কে এজেন্ট নয়, এ নিয়ে অনেক বাদানুবাদ করেছেন। সবকিছুর গোড়া ছিল এক জায়গায়। পুরো ব্যবস্থাটির সমন্বয় হতো ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের মাধ্যমে।
এই কাঠামোর মধ্যে মাঠপর্যায়ের সমন্বয়কারী ছিলেন পূর্বাঞ্চলে র-এর প্রধান ফণীন্দ্রনাথ ব্যানার্জি। প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ের সচিব এবং র-এর পরিচালক কাও ছিলেন তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। কাও ছিলেন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সরাসরি নিয়ন্ত্রণে। তার পাশে ছিলেন আরও দুজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব পি এন হাকসার এবং সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ জেনারেল স্যাম মানেকশ। [১৫]
বিএলএফ সদস্যদের আলাদা প্রশিক্ষণ এবং তাদের বাংলাদেশ সরকারের কমান্ড কাঠামোর বাইরে থাকার কারণে গুঞ্জন ও প্রচার ছিল যে এই বাহিনী র-এর তৈরি এবং এর পেছনে সিআইএর হাত আছে। এই প্রচারে বাম ধারার কোনো কোনো রাজনীতিবিদের হাত ছিল। তাদের এ রকম মনে হওয়ার যথেষ্ট কারণ ছিল। বিএলএফে কেবল ছাত্রলীগের সদস্যদেরই নেওয়া হয়। অবশ্য শ্রমিক লীগের অনেকেই বিএলএফের প্রশিক্ষণ পেয়েছিলেন। শ্রমিক লীগের শীর্ষ নেতা আবদুল মান্নান, রুহুল আমিন ভূঁইয়া, সাইদুল হক সাদু প্রমুখ প্রথম ব্যাচেই প্রশিক্ষণ নেন।
ছাত্রলীগের সামনের কাতারের নেতা-কর্মীদের একটা বড় অংশ বিএলএফের প্রশিক্ষণ পেয়েছিলেন। প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো দুটি স্থানে। একটি ছিল দেরাদুনের কাছে তান্ডুয়া, অন্যটি ছিল আসামের হাফলং। প্রশিক্ষণ দিতেন এসএফএফের কর্মকর্তারা। বিএলএফকে অনেকেই নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখলেও এর তরুণ সদস্যদের আন্তরিকতা ও দেশপ্রেম ছিল প্রশ্নাতীত। বিএলএফের সাধারণ সদস্যরা জানতেনই না কীভাবে তাঁদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা হয়েছে। তাদের শুধু এটুকু ধারণা দেওয়া হয়েছিল যে স্বয়ং ভারতের প্রধানমন্ত্রী তাদের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছেন। এমনকি প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধান দুই নেতার সন্তান বিএলএফের প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। তাঁরা হলেন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের ছেলে শেখ জামাল এবং ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের ছেলে সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। ছাত্রলীগের নেতাদের মধ্যে শুধু সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকীকে এর বাইরে রাখা হয়েছিল। তাকে বিএলএফে না নেওয়ার ব্যাপারে চার নেতার মধ্যে ঐকমত্য ছিল। একটি যুদ্ধ করা কিংবা যুদ্ধ জয়ের জন্য একটি বাহিনী গড়ে তোলার জন্য যে মানসিক দৃঢ়তা, সাহস, বুদ্ধি ও প্রস্তুতি থাকা দরকার, তার যথেষ্ট অভাব ছিল। যে যা-ই দাবি করুন না কেন, বিএলএফের ঘর গোছানোর কাজটা সম্পন্ন হয়েছিল র-এর তত্ত্বাবধানে। বিএলএফের সঙ্গে র-এর যোগাযোগের সূচনাপর্বে আবু হেনার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। তার বিবরণে জানা যায় :
শুরুর দিকে তো কাজ করার মতো লোকই ছিল না। তোফায়েল ঘরের বাইরে বের হতে ভয় পেত। কারণ, সেখানে চীনপন্থী নকশালদের ভয় ছিল। তারা দেয়ালে দেয়ালে পোস্টার লাগিয়েছিল, শেখ মুজিবের কালো হাত ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও। তোফায়েল ছিলেন জনপ্রিয়। ছাত্রনেতা, ডাকসুর ভিপি। উনসত্তরের গণ-আন্দোলনের সময় দেশের পত্রপত্রিকায় তার ছবি ছাপা হতো। স্বভাবতই তার ভয় ছিল। নকশালরা চিনে ফেললে মেরে ফেলতে পারে, এ জন্য তাঁকে বের হতে দিতাম না। আমি বরং বাইরে যেতাম। আমার ছদ্মনাম ছিল নিতাই চন্দ্র দাশগুপ্ত। রাজ্জাকের নাম ছিল রাজু, তোফায়েল হলেন তপন, শেখ মনি হলেন মনিবাবু আর সিরাজ হলেন সরোজদা। সরোজদা থেকে পরবর্তী সময়ে তিনি দাদা হয়ে গেলেন। [১৬]
.
৪
বিএলএফ কলকাতায় কীভাবে সংগঠিত হলো, কীভাবে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা হলো, বিএলএফ নেতাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সমন্বয় কেমন ছিল, বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে তার সম্পর্ক কেমন–এসব বিষয়ে একটা খোলামেলা বক্তব্য দিয়েছেন আমির হোসেন আমু। বয়স এবং রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার দিক থেকে তিনি বিএলএফের শীর্ষ দুই নেতার সমসাময়িক। তাঁর সঙ্গে আমার কথোপকথন ছিল এ রকম :
আমির হোসেন আমু : বাষট্টি সাল থিকা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ইন্ডিয়ার যে লিয়াজো, সেখানে পরিষ্কার বলা ছিল, তরুণ, যুবক, ছাত্র–শেখ মুজিব যাদের পাঠাবে, তাদের ট্রেনিং দিতে হবে। তাদের অস্ত্র দিতে হবে। এবং ইন হিজ অ্যাবসেন্স, মনি ইজ দ্য মেইন। এই সিগন্যাল তারই ছিল। মনি যেইটা ভুল করছে, তিনজনকে একসঙ্গে রাখছে। এইটা তার গ্রেট মিসটেক।
দুই নম্বর হইল, ২৫ মার্চ তো পার হইয়া গেল। যাইয়া ওইখানে মুজিববাহিনী গঠন-টঠন কইরা, তখন তো মুজিববাহিনী না বিএলএফ, চাইরজনে চাইরটা সেক্টর ভাগ কইরা লইয়া গেল। আমি ১৭ মে বর্ডার ক্রস করছি।
মহিউদ্দিন আহমদ : এত দিন ভেতরে ছিলেন?
আমু : আমি তো খুলনা, বাগেরহাট, বরিশাল–সব জায়গায় যুদ্ধে সাপ্লাই দিছি। সব তো পলায়া গেছে গা!
মহি: মেজর জলিল-টলিল?
আমু : সব পলায়া গেছে। মঞ্জু ভাই, মেজর জলিল, দুইজনই পলায়া গেছে। আমি আর ক্যাপ্টেন বেগ পোলাপান-টোলাপান লইয়া বাগেরহাট-খুলনায় ট্রাক পাঠানো, অস্ত্র পাঠানো, খাবার পাঠানো–বরিশাল তো তখন ফ্রি।
যা-ই হোক, আমি ১৭ মে বর্ডার ক্রস কইরা গেলাম। যাওয়ার পর হঠাৎ ফণী মজুমদার আর আবদুর রব সেরনিয়াবাত, আধা ঘণ্টা পর অফিসে আসছে।
মহি : এটা কোন অফিস?
আমু : বাংলাদেশ সরকারের অফিস। এখানে বসত শাহ মোয়াজ্জেম হোেসেন আর মাগুরার মন্ত্রী ছিল যে, উনি। এরা বসত। আমি আবার ঠাট্টা করলাম। ওনাদের পরনে ধুতি-পাঞ্জাবি। কিছুক্ষণ পরে কামারুজ্জামান সাব আইছে। তারও ধুতি-পাঞ্জাবি। আমি কইলাম যে ভাই, ওরা যে স্লোগান দিছে, আপনারা তো বাস্তবায়ন কইরা দিলেন।
কী স্লোগান?
জয় বাংলা জয় হিন্দ, লুঙ্গি ছাইড়া ধুতি পিন্দ। এই যে ধুতি পাঞ্জাবি পরছেন, যদি এর ফটো দিয়া দেয়? কামারুজ্জামান আমার দিকে তাকায়া রইছে।
তুমি কী কইলা?
এইটা পরলেন কেন?
বোঝবা নে, কয় দিন থাহো।
এই কথাবার্তার মধ্যে দুইজন আসল, সেরনিয়াবাত সাহেব আর ফণী মজুমদার। আমারে দেইখা জড়ায়া ধইরা কান্নাকাটি। বলল, তোর থাকার জায়গা অন্য জায়গায়। এগো লগে থাকিস না। আমারে নিয়া নর্দার্ন পার্কের এই পারে গাড়ি দিয়া নামায়া বলে, ওই দালান, মাঠটার মধ্য দিয়া হাইটা ওই বাড়িতে উঠবা।
মহি : সানি ভিলা?
আমু : হ্যাঁ। আমি গেলাম, দেখি সিরাজুল আলম খান, আমারে দেইখা উইঠ্যা ধরবে কি ধরবে না, এই অবস্থা। তয় থামল। ব্যাপারটা কী?
আমু সাহেব, আমি দুঃখিত, আপনারে জড়ায়া ধরতে পারলাম না। আমি চিকেনপক্স থিকা উঠছি। এই জন্য ধরলাম না। আপনি সিঁড়িতে উইঠা বাঁ পাশে দেখবেন দেড় তলায় একটা রুম আছে। ওইখানে দুইটা খাট। একটা খাট আপনার। আরেকটা খাট তোফায়েলের। একটা খালি। ওইখানে গিয়া শুইয়া পড়েন। রেস্ট নেন, পরে কথা হবে। আর যদি খাওয়াদাওয়া করেন, পাঠায়া দেব।
না, আমি এখন খাব না।
আমি শুইয়া একদম ঘুমায়া পড়ছি। আমার হুঁশ নাই। সন্ধ্যায় তোফায়েল আইসা ঠেইল্যা-মেইল্যা জাগায়া, এই, ওঠেন ওঠেন।
উঠলাম।
এই যে আপনার ব্রাকেট।
আমার তো কাপড়চোপড় নাই।
সব কিন্যা-টিন্যা দিল। দেওয়ার পর কইল যে, ভদ্র হইয়া যাবেন, এই অবস্থায় যাবেন? মন্ত্রীগুলার লগে দেহা করবেন না?
নিয়া গেল মন্ত্রীদের লগে দেহা করতে। নজরুল সাবের লগে দেখা হইল, মনসুর আলী সাবের লগে দেখা হইল। মনসুর আলী সাব আবার একটু ডাকল। ‘তোমার কাছে তো কিছু নাই। এইটা রাখো।’ আমারে দুই হাজার টাকা দিল। বলল, ‘রাখো, কাজে লাগবে। ডাক্তার-টাক্তার দেখাও, চিকিৎসা করাও। তারপর কাজে নামো।’ তারপর আইলাম মোশতাকের রুমে। তার তো ওই রকম–কপালে একটা চুমা দেওয়া, জড়ায়া ধরা। তারপর নিল ওসমানীর রুমে, নিচতলায়। আমারে দেইখ্যাই কয়, ‘সাইন।’ একটা ফাইল বাইর কইরা, কয়েকটা কাগজ, কয় ‘সাইন ইট। নূরুল ইসলাম মঞ্জু আর মেজর জলিল বরিশালে ন্যাশনাল ব্যাংক (এখন সোনালী ব্যাংক) ভাইঙ্গা ছয় কোটি টাকা নিয়া আসছে। এইহানে সই দাও।’
আরে ধেৎ, আমি জানি না কিছু।
আমি তো রাস্তা চিনলাম। পরের দিন। তোফায়েল বলল, আপনি রেস্ট নেন, আমি ঘুইরা আসি।
না, আমি একটু ঘুরতে যামু।
গাড়ি লাগবে না?
না, গাড়ি লাগবে না।
ঠিক আছে। আমি ট্যাক্সি নিয়া যাই। আপনি এই গাড়িটা নিয়া যান। আপনি ট্যাক্সি-ম্যাক্সি পারবেন না।
আমি গেলাম থিয়েটার রোডে, মন্ত্রীগো মহল্লায়। এর মধ্যে ওবায়দুর রহমান, মিজান চৌধুরী আর বিপুর বাপ…
মহি : হামিদ সাহেব।
আমু : হামিদ সাব তো হোটেলের মতো একটা বিরাট রুমে থাকত, অনেকেই থাকত। আমারে পাইয়াই,
অ্যাই, তোমার চাকরি হইয়া গেল।
কী চাকরি, মিজান ভাই?
তুমি মোটিভেটর হবা। পলিটিক্যাল মোটিভেটর। সমস্ত মুক্তিযোদ্ধাকে তুমি দেখবা। বোঝো না? যুদ্ধের ব্যাপার। আর্মিওলারা ওদের মতো বোঝাবে। আমাদের পলিটিক্যাল লিডারশিপ থাকবে না। সুতরাং পলিটিক্যাল লিডারশিপ যাতে থাকে, এভাবে আমরা কিছু চিন্তাভাবনা করতেছি। তুমি মোটিভেটর হবা। তোমার গাড়ি, বাড়ি, টাকাপয়সা, হেলিকপ্টার, গার্ড–সব থাকবে। তুমি যখন যেখানে যাবা, সব ফ্রি।
ঠিক আছে।
আমরা চিঠি ইস্যু কইরা দেই?
দেন।
চিঠি হয়তো তাজউদ্দীন সাব ইস্যু করবে। কথাবার্তা কইয়া আমি আইছি। বিকালবেলা সিরাজুল আলম খান, তোফায়েল, রাজ্জাক–বললাম এই ব্যাপার। আমার তো চাকরি হইয়া গেল।
কী চাকরি?
এই চাকরি। সিরাজুল আলম খান কয়, ধ্যাৎ, আমু সাহেব, আপনে চুপ করেন তো? মনি আসবে দুই দিন পর আগরতলা থেকে। তার আসার পর আপনার ব্যাপারে আমরা সিদ্ধান্ত নেব।
ঠিক আছে।
তারপর, বইসা আছি। রোজ এদিক-ওদিক যাই, ঘোরাফেরা করি। খোঁজখবর রাহি-টাহি। একদিন সকালবেলা গেছি। গিয়া দেহি ২০-৩০ জন লোক ঘেরাও করা। তুমুল ঝগড়া, তাজউদ্দীন অ্যান্ড ওসমানী।
মহি: থিয়েটার রোডের অফিসে?
আমু : আরে মাঠের সামনে। সবাই দেহি তামশা দেহে। আমার গেছে মেজাজ খারাপ হইয়া। ভিড় ভাইঙ্গা ঢুইকা তাজউদ্দীন সাবের পাশে গিয়া কইলাম, আপনি প্রধানমন্ত্রী। বিদেশের মাটি। ক্যাপ্টেন নূর ছিল তখন ওসমানীর এডিসি। নূররে কইলাম, সরো। ওসমানী সাবরে কইলাম, কী ব্যাপার? বিদেশের মাটিতে ঝগড়া করবেন? চলেন, রুমে চলেন। নূররে কইলাম, ওরে সরাও। এইটাতে নূর খুব ইমপ্রেসড ছিল যে এ রকম একটা সিচুয়েশন আমি ট্যাকল করছি।
তারপর মনি আসল। এরা চারজন আমারে নিয়া বসল। তখন পর্যন্ত চিত্ত সুতারের লগে আমারে দেহা করায় নাই। এত সিক্রেসি মেনটেইন করে। আমি কিন্তু একদিন তারে দেখছি। আমি কিছু কই নাই। চিত্ত সুতার কিন্তু আমার বাড়ির কাছেই থাকে। আমার এলাকার লোক। আমি তাদের কইলাম, আমার চাকরি হইয়া গেছে, ভাই, আমি আর তোমাগো লগে থাকব না। আমি এত বড় জায়গা থুইয়া তোমাগো এহানে আইয়া থাকমু কেন।
সিরাজুল আলম খানের কিছু গুণ ছিল। মনিরা বলতেছে, আমাদের সঙ্গে থাকবা তুমি। সিরাজুল আলম খান পয়েন্ট আউট করল, উনি কীভাবে থাকবে? আমরা তো চারজন চার সেক্টর ভাগ করছি। তার মধ্যে তো উনি থাকতে পারে না। এখন তুমি কীভাবে অ্যাডজাস্ট করবা, সেইটা বলো। ওনাকে তো স্ট্যাটাস দিয়া রাখতে হবে। তখন ঠিক হইল…তোফায়েলের আন্ডারে হইল সাতটা জেলা। কুষ্টিয়া, পাবনা, খুলনা, যশোর, ফরিদপুর, পটুয়াখালী, বরিশাল। পাবনা আর কুষ্টিয়া থাকবে তোফায়েলের কাছে আর বাকি পাঁচটা আসবে আমার কাছে, যেহেতু এই অঞ্চল আমি আগে থাকতেই নার্সিং করছি। বাট এইটা আমাদের মধ্যে। ইন্ডিয়ান গভমেন্টের কাছে তো এইটা আর যাচ্ছে না। এই অ্যারেঞ্জমেন্ট আমাদের মধ্যে হইল। একটা সান্ত্বনা পুরস্কারের মতো দেওয়া হইল আরকি।
আমি ভাবলাম, ঠিক আছে। নিজেরা আছি, থাহি, দেহি কী হয়। আমি কিন্তু দ্বিতীয় দিনই বুইজ্জা ফেললাম, তিনজন একদিকে, একজন একা। মনি একা। সিরাজুল আলম খান, রাজ্জাক, তোফায়েল মোটামুটি এক। তখন মনি আবার চইল্যা গেছে আগরতলা। সে আসল। আমি তারে প্রথম দিনই এই কথা বললাম। সেই দিন চিত্ত সুতারের সঙ্গে। আমরা পাঁচজন একসঙ্গে বসলাম। তখন আলোচনা হইল যে মুক্তিবাহিনী-মুক্তিফৌজ তো একাকার। আমাদের আইডেন্টিটি কী? আমি বললাম, তোমরা আইডেন্টিটি হিসাবে বিএলএফ না রাইখা। মুজিববাহিনী রাখো। তাইলে আইডেন্টিটি হইয়া যায়।
সিরাজুল আলম খান কইল, প্রস্তাবটা ভালো। নেওয়া যায়। চিত্ত সুতার কইল, হা, নিয়া নেন। এই মুজিববাহিনী নামকরণ হইল। সমর্থন বাই সিরাজুল আলম খান, বাট প্রপোজড বাই মি।
আরেকটা কাজ আমি করছি। সেটা এরা লেখবে না। লেহে না। জিনিসটা হইল, অ্যাট ওয়ান টাইম, ইন্দিরা গান্ধীর যে মূল অ্যাডভাইজার ছিল, ডি পি ধর, সে ছিল তাজউদ্দীন সাবের ফ্রেন্ডের। মতো। তাজউদ্দীন সাব তাকে কনভিন্স করছিল যে গভমেন্টের আন্ডারে ছাড়া কোনো ফোর্স রাখা যাবে না। ইন্ডিয়ান গভমেন্ট এইটা এনশিওর করবে। মুজিববাহিনী-টাহিনী এই সব বিলুপ্ত কইরা দিতে হবে। আন্ডার আওয়ার গভমেন্ট আনতে হবে। ডি পি ধর এইটা হয়তো ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে আলাপ করে নাই। যেহেতু পরবর্তীকালে আমাদের প্রস্তাবটা পাস হইছে। ডি পি ধর করছে কি, জেনারেল মানেকশ আর জেনারেল উবান, যে আমাদের মেইন ট্রেইনার ছিল, তাদের নিয়া প্রোগ্রাম দিছে ক্যালকাটায়। প্রপোজাল হইল, ডিজলভ। আমাদের মার্জ করাবে গভমেন্টের আর্মির সঙ্গে। এই প্রপোজাল নিয়া তারা আসছে। আমাদের যে মূল হোতা, মি. নাথ, নাথবাবু এই মেসেজটা দিল যে ওনাদের আসার উদ্দেশ্য হইল তোমাদের। ডিজম্যান্টেল কইরা দিয়া বাংলাদেশ গভমেন্টের অধীনে নিয়া যাওয়া।
নাথবাবু ইস্টার্ন জোনে র-এর চিফ ছিল। সে-ই মুজিববাহিনীর মেইন আর্কিটেক্ট। সে ঢাকা ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে মারা গেছে, আফটার লিবারেশন। উনি আমাদের এই মেসেজটা দিল। তখন মিটিং বসল, কী করা যাবে।
জিনিসটা যখন আলোচনা হয়, একেকজন একেক কথা কয়। আমি কইলাম, দেখো, অফেন্স ইজ দ্য বেস্ট ডিফেন্স। চিত্তবাবু বলল, কী বলতে চাও? আমি বললাম, ঠিক আছে, তোমাগো সিদ্ধান্ত তোমরা দিলা। আমাগো রাখবা না, হেল্প করবা না। কিন্তু আমরা গভমেন্টের সঙ্গে যাব কি যাব না, দ্যাট ইজ আওয়ার ডিসিশন। এইটা ডিকটেট করার অধিকার তোমার নাই। আমরা এইখানে থাকব, না দেশের ভিতরে যাইয়া যুদ্ধ করব, না অন্য কোথাও যাব, ইট ইজ আওয়ার ম্যাটার। উই উইল টেক আওয়ার ডিসিশন। তোমাদেরটা তোমরা সামলাও। আমি বললাম, এই কথা কও। তারপরে দেখবা। যদি ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে আলাপ করে, তখন আইবে নতুন প্রস্তাব নিয়া, তোমরা আর কী চাও, কী কী হেল্প চাও। যদি না চাও, আমি আজ রাত্রেই চইলা যাব। লেইখা দিলাম। নাথবাবু আর চিত্ত সুতার আমার প্রস্তাব অ্যাকসেপ্ট করল। এর বাইরে কোনো প্রস্তাব নাই।
চাইরজন তো অফিশিয়াল। এই প্রস্তাব দেওয়ার মতো সাহস ওদের নাই। আমারে তো অফিশিয়ালি পাঠাইতেও পারতেছে না। তখন শেখ মনিরে বলা হইল, তুমি এই প্রস্তাব দাও। শেখ মনি কয়, না, সিরাজ দেবে। সিরাজ কথা কইতে রাজি না। হে তো পিছে পিছে ফাল পাড়ে। সামনে তো ভোকাল না। কোনো জায়গায়ই না। পার্টিতেও ছিল না।
শেষকালে শেখ মনি প্রস্তাবটা কায়দা কইরা দিছে। আমরা আপনাদের সিদ্ধান্ত শুনলাম। আপনারা আপনাদের ডিসিশন নেন, আমরা আমাদের ডিসিশন নেব।’
খাওয়াদাওয়ার পর এরা যখন চইলা যায়, জেনারেল উবান আইসা মনি ভাইরে থ্যাংকস দিল। বলল, তোমরা রাইটলি প্লেস করছ। নাউ, উই উইল সি। আমি এখন এইটার ব্যাপারে লুক আফটার করব।’ মনি তো অবাক, উবান এইটা অ্যাকসেপ্ট করতাছে! আমি বললাম, উবান এটা পারসু করবে।
আমি তাদের বললাম, পরে আমরা চাইব এয়ার লিফটিং, এয়ার ড্রপিং। আমরা নিজেদের ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করার কথা বলব। আর্মস ট্রেনিং আমরা যাদের দিচ্ছি, এরা আমাদের কন্ট্রোলে থাকবে না। পলিটিক্যাল কন্ট্রোল থাকবে না, যদি আমরা আর্মস ট্রেনিং না নেই। আমরা যতই নেতা হই, আমাদের ওরা মানবে না। আমাগো ট্রেনিং নিতে হবে। আমাদের নিজস্ব ইন্টেলিজেন্স ডিপার্টমেন্ট খুলতে হবে। আমরা যাদের কুরিয়ার হিসাবে কাজ করাচ্ছি, এদের ইন্টেলিজেন্স ট্রেনিং দিতে হবে। এর পরিধি বাড়াইতে হবে। এই সব প্রস্তাব আমি রেডি করলাম। ঠিক ২১ দিনের মাথায় তারা আসল। আমাদের যা যা প্রস্তাব, সব অ্যাকসেপ্ট করল। প্রথমে ৯ দিন, ১১ দিন, তারপর ২১ দিন আমরা ভিআইপি ট্রেনিং নিছি।
ওই দিন রাত একটার পর সিরাজুল আলম খান আমারে রুম থিকা নিয়া গেল। নর্দার্ন পার্কের মধ্যে বেঞ্চ। কয়, আমু সাব, নিশ্চয়ই আপনার কাছে কোনো ইনফরমেশন আছে। তা না হইলে আপনি এই স্ট্যান্ড নিলেন কেন। আপনি কী করে ঝুঁকি নিলেন যে আমরা যেখানে খুশি সেখানে যাব, যাদের খুশি তাদের হেল্প নেব। নিশ্চয়ই এর মধ্যে ব্যাপার আছে।
থাকতে পারে। আপনে কী কইতে চান, সেইটা বলেন।
আমার কাছে তো প্রস্তাব আছে। আমাদের ২০ হাজার ছেলেকে লিফট কইরা নিয়া যাবে। পৃথিবীর সবচেয়ে আধুনিক ট্রেনিং আর অস্ত্রশস্ত্র দিয়া আমাদের পাঠায়া দিবে।
কারা?
ইসরায়েল।
আইজকা এইটা কইলাম। এইটা আমি কারোরে কই না। তহন থিকাই আমি জানি তার ইসরায়েলি লাইন। নাইলে ইসরায়েলের কথা কবে কেন?
মহি : আমার মনে হয় না। অনেকে অনেক সময় বাগাড়ম্বর করে না? ওনার কোনো ইন্টারন্যাশনাল লাইন-ফাইন ছিল বলে আমার মনে হয় না।
আমু : ছিল। ইন্টারন্যাশনাল লাইন না থাকলে…ইন্ডিয়ার লগে একটা লাইন তো তার ছিল।
মহি: সেইটা থাকতে পারে।[১৭]
একাত্তরের যুদ্ধে ইসরায়েল প্রসঙ্গ উঠেছিল। এ সময় ইসরায়েল সরকার ভারতের ডানপন্থী রাজনীতিকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। তারা বাংলাদেশের। কয়েকজন সাংসদের মাধ্যমে ইসরায়েলের কাছে সাহায্যের প্রস্তাব দিয়েছিল। এটা জানতে পেরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমদের একান্ত সচিব কামালউদ্দিন সিদ্দিকী সিপিআইএমের পত্রিকায় তথ্যটি জানিয়ে দেন। সংবাদটি ওই পত্রিকায় ছাপা হয়। এরপর ইসরায়েলি লবির তৎপরতা বন্ধ হয়ে যায়।[১৮]
ওই সময় ভারত অবশ্য ইসরায়েলের কাছ থেকে অস্ত্র সহযোগিতা পেয়েছিল। ভারত তখন অস্ত্র জোগাড়ের জন্য মরিয়া। সুইজারল্যান্ড ও অস্ট্রিয়ার মধ্যবর্তী ছোট্ট দেশ লিচেনস্টেইনে অবস্থিত অস্ত্র তৈরির প্রতিষ্ঠান ‘সালগাদ’ ইসরায়েলের জন্য অস্ত্র তৈরি ও জোগান দিত। পি এন হাকসার ১৯৬৫ সালে লন্ডনে ভারতের ডেপুটি হাইকমিশনার থাকাকালে সালগাদের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শ্লোমো জাবলুডোয়িচের সঙ্গে পরিচিত হন। হাকসারের অনুরোধে জাবলুডোয়িচ ৩ আগস্ট ১৯৭১ লন্ডনে ভারতের ডেপুটি হাইকমিশনার প্রকাশ কাউলের সঙ্গে দেখা করে ভারতে অস্ত্র সরবরাহের ব্যাপারে সাধ্যমতো চেষ্টা করবেন বলে আশ্বাস দেন। তিনি ইরান ও তুরস্কের জন্য তৈরি অস্ত্রের চালান সরাসরি ভারতে পাঠিয়ে দেন। এ ছাড়া ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর মজুত থেকে কিছু অস্ত্র আকাশপথে ভারতে পাঠানো হয়। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী গোল্ড মেয়ার ইন্দিরা গান্ধীকে এক চিঠিতে জানান, ভারতের বিপদের সময় ইসরায়েল অতীতেও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল এবং এখনো তা করে যাচ্ছে। চিঠিতে তিনি অস্ত্র সাহায্যের প্রতিদান হিসেবে ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের ইঙ্গিত দেন। ইন্দিরা এই অনুরোধ এড়িয়ে যান। [১৯]
.
৫
বিএলএফ নেতাদের, বিশেষ করে শেখ ফজলুল হক মনি ও সিরাজুল আলম খানের মধ্যকার দ্বন্দ্ব তখনকার মতো চাপা পড়ে থাকলেও একেবারে নিঃশেষ হয়ে যায়নি। ভেতরে-ভেতরে এটা প্রকাশ পেত। ছাত্রলীগের যারা প্রশিক্ষণে যেতেন, তাঁদের মধ্যে এটা কোনো লুকানো ব্যাপার ছিল না। আমির হোসেন আমুর চোখে এটা ভালোভাবেই ধরা পড়েছিল। আমি এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন :
আমু : আমি মনিরে নোটিশ করলাম, তোমরা তো ওয়ান ইজ টু ফোর না, তুমি একা। তুমি বোঝো এটা? সে আমার ওপর খেইপা গেল। অ্যা, তুমি আইসাই ক্লিক আরম্ভ করছ?
সে বিশ্বাস করল না। ১৫ দিন পরে আইসা আমারে খুইজ্জা বাইর করছে। নানা, তুমি কেমনে বোঝলা? ঘটনা তো ঠিক।
মহি : আপনাকে নানা ডাকত?
আমু : হ। কয়, তুমি এইটা ঠিক কইরা দাও।
বাই দিস টাইম, সেরনিয়াবাত সাহেব সিআইটি রোডে একটা বাসা করল। মনি আমারে কইল, তুমি সেরনিয়াবাত সাবরে বলো, আমাদের জন্য ভাত পাক করতে। তুমি, আমি, তোফায়েল ওখানে খাব। তুমি তোফায়েলরে কবা, চলো তোফায়েল, আইজ একসঙ্গে ভাত খাই, খালুজানের বাসায়। তারপর খাবার টেবিলে বইয়া যা কবার আমি কব।
বাই দিস টাইম তোফায়েলের সঙ্গে ইনডাইরেক্টলি আলাপ-সালাপ কইরা আমি একটা জায়গায় আইছি। ওরেও বুঝছি আমি। আমি কী, এইটাও মোটামুটি ওরে বুঝতে দিছি। খাবারের টেবিলে বইসা আমি আলাপ উঠাইলাম। এর আগে খালুজানরে কইছি, আজকে আমাগো লগে আপনি বইয়েন না, আপনি আলাদা খাইয়েন।
একপর্যায়ে তোফায়েল কইলো, মনি ভাই, আমি আপনের সঙ্গে আছি। আমু ভাইরে কন রাজ্জাক ভাইরে ঠিক করতে। আমি কইলাম, আমি সেইটা জানি। আমি রাজ্জাকের সঙ্গে আলাপ করব।
রাজ্জাকরে আমি একদিন ধরলাম, কী মিয়া? দুইজনে হইল বন্ধু। এদের মধ্যে গ্রুপিং করলা? মিলায়া থাকো। আর না হইলে এক জায়গায় আসো। ফরিদপুর-টরিদপুর কও। দুইজনে বন্ধুত্ব আছে তো। এমন তো না যে শত্রুতা। তুই-তাই, হাসি-ঠাট্টা–সবই একসঙ্গে হয়। অসুবিধা কী? দুইজনরে মিলায়া রাখো। আলাদা করো কেন?
আরে, তুই বুঝবি না। ওর ব্যাপার হইছে…
কী ব্যাপার হইছে? আমারে ভাইঙ্গা কও? দরকার হয় আমি থাকমু তোমাগো লগে। পলিটিক্যালি তুই আমাদের সঙ্গে। মনিরে তুই ছাড়তে পারবি না। বাসায় যায় একা হইয়া যাবি।
মহি : আপনারা তো সেভেনটি ওয়ানে তাজউদ্দীন আহমদের বিরুদ্ধে অনাস্থা এনেছিলেন।
আমু : আমরা না। মূলত শেখ মনি এইটার মধ্যে ছিল। ইনিশিয়েটর ছিল। তখন কিন্তু রাজ্জাক-টাজ্জাক সব এক ছিল। আপটু সেভেনটি ফোর, মনি-রাজ্জাক-তোফায়েল এই ব্যাপারে এক ছিল।
মহি: তাজউদ্দীন যে প্রধানমন্ত্রী হলেন, তিনি তো কারও সঙ্গে কথা বলেননি, আলোচনা করেননি। কেউ তো জানত না।
আমু : এইটা চিত্ত সুতাররা অ্যাকসেপ্ট করছিল না। তখন আলোচনা হইল যে, না, যেহেতু বিদেশের মাটিতে একটা গভমেন্ট ফর্ম হইছে, এইটা নিয়া কনটেস্ট করা ঠিক হবে না। এইখানে আমি একটা কথা বলি। সে প্রথমে একটা ঢাকাইজম তুলছিল। ঢাকাইজমের এমপিদের সে এক করছিল। বিভিন্ন জায়গায় জোনাল কাউন্সিলের যে ইলেকশনগুলো হইত, তার নিজস্ব লোক সেটআপ করার চেষ্টা করছিল। খুলনা-বরিশাল বেল্টে সে মহসিনরে দেওয়ার চেষ্টা করছিল, আবদুর রব সেরনিয়াবাতের বিরুদ্ধে। নুরুল ইসলাম মঞ্জু এহানে ট্যাগ দিল। ঢাকায় ইলেকশন হয় নাই। এহান থিকা ছয়জনরে নিয়া ওইখানে ভোটার করল। আমরা আবার ঢাকা থিকা রফিক-টফিকরে নিয়া, ছয়জনরে নিলাম, মমতাজ বেগম, খুলনার মহিলাকে নিয়া আমরা আবার সেরনিয়াবাত সাবরে মেজরিটি করলাম। তারে ইলেক্টেড কইরা নিয়া আইলাম। তখন থিকাই কিন্তু ঢাকাইজম, তাজউদ্দীন সাব একটা গ্রুপ সৃষ্টি করছে। এইটা বঙ্গবন্ধু জানে। জানার পর, যে কারণে সে মোশতাকরে সরায় নাই। ব্যালেন্স রাখছে। মোশতাকরে তো রাখার কারণ ছিল না। মোশতাক তো আইডেন্টিফায়েড। বঙ্গবন্ধু চিন্তা করছে, মোশতাকরে যদি সরায়া দেই, তাইলে তাজউদ্দীন তো…হইয়া যাবে। তাজউদ্দীনরে যতক্ষণ সাইজ না করা যাবে, ততক্ষণ মোশতাকরে রাখতে হবে। এই ব্যালেন্স পলিটিকস করতে যাইয়া সে মোশতাকরে রাখছে। কারণ, নজরুল সাব তো টিমিড টাইপের লোক। হে তো ভোকাল না। ভোকাল ছিল মিজান চৌধুরী, ওবায়দুর রহমান–এরা।
তাজউদ্দীন গ্রুপের প্রথম মিটিং হয় হোটেল শিলটনে। তখন শিলটন-লিটন দুইটা হোটেল ছিল বোধ হয়, ছোট হোটেল, কিন্তু ভালো। লিটন হোটেলে মালেক উকিল সাব থাকত। ওইখানে প্রায়ই বসত। ওবায়দুর রহমান, মিজান চৌধুরী, মালেক উকিল, নুরুল হক। নুরুল হক আবার তাজউদ্দীন সাবের লগে ব্যালেন্স করত। তারপর হামিদ সাহেব বসত। ঢাকার মধ্যে গাজী গোলাম মোস্তফা ঠিক ছিল। ইভেন ময়েজউদ্দিনও পাল্টে গেছিল। কেরানীগঞ্জের দিকে এমপি ছিল রফিক। রাজিউদ্দিন রাজুও তাজউদ্দীনের পক্ষে ছিল। রাজুর সঙ্গে তো আমার ঝগড়া হইছে এই গ্রুপিং নিয়া, কলিকাতায় বইসা। [২০]
.
৬
ট্রেনিং পেয়ে মুজিববাহিনীর সদস্যরা বাংলাদেশে গোপনে ঢোকার সময় একটি দল হঠাৎ বিএসএফের নজরে পড়ে। বিএসএফ সদস্যদের চ্যালেঞ্জের মুখে তারা ধরা পড়ে। পরে একটি বিশেষ ফোন পেয়ে তাদের বাংলাদেশের ভেতরে ঢুকতে সাহায্য করে। কিন্তু ব্যাপারটি জানাজানি হয়ে যায়। তাতে বাংলাদেশ সরকার ও তার প্রধান সেনাপতি ভীষণ চটে যান। চটে যান ভারতের পূর্বাঞ্চলের সেনাপ্রধান জেনারেল অরোরাও। তারা মুজিববাহিনীর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে গিয়ে বুঝতে পারেন যে, এই বাহিনীর খুঁটি বড় শক্ত। এটা জেনে তারা মুজিববাহিনীর সঙ্গে একটা সমঝোতায় আসেন।[২১]
প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের বিরুদ্ধে বিএলএফ নেতারা ওপরে ওপরে এককাট্টা হলেও তাঁর সঙ্গে সিরাজুল আলম খানের আলাদা একটা সম্পর্ক ছিল। তাজউদ্দীনের ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি ক্ষোভ ছিল শেখ মনির। এমনকি তাজউদ্দীনের অনুগত কাউকেই তিনি সহ্য করতে পারতেন না। বলিয়াদির আহরাম সিদ্দিকী ছিলেন তাজউদ্দীনের ঘনিষ্ঠ। তাঁকে নিয়ে কলকাতায় রীতিমতো একটা ঝগড়া হয়। কলকাতায় সানি ভিলায় থাকাকালে একটি ছোট্ট ঘটনাকে কেন্দ্র করে শেখ মনির সঙ্গে আবু হেনার ভুল-বোঝাবুঝি হয়। এ কারণে আবু হেনা বিএলএফের সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করেন। আবু হেনার বিবরণে জানা যায় :
আমি তাকে (মনি) গাইড করে কলকাতায় নিয়ে গেলাম। অথচ সেখানে গিয়ে তিনি চেহারা পাল্টে ফেলেন। সিরাজ ভাইয়ের নির্দেশে আমি বলিয়াদির আহরাম সিদ্দিকীকে এক রাতের জন্য কামারুজ্জামানের সিটে থাকতে দিয়েছিলাম। এ নিয়ে মনি ভাই আমার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন। সে রাতে প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছিল। মনি ভাই বৃষ্টির মধ্যেই আহরাম সিদ্দিকীকে বের করে দিতে বলেন। অথচ আহরাম সিদ্দিকী ছিলেন তিন দিনের অভুক্ত। শূন্য হাতে অসুস্থ অবস্থায় তিনি দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে কলকাতায় পৌঁছেছিলেন। আমরা গেছি যুদ্ধ করতে। অথচ সামান্য ঘটনা নিয়ে মনি ভাই যে আচরণ করলেন, তা ছিল অমানবিক। সে রাতেই ওখান থেকে বেরিয়ে। গেলাম। আমার পূর্বপরিচিত নিরঞ্জন বোসের ২৬ পাম অ্যাভিনিউর বাসায় উঠলাম। নিরঞ্জনের বাড়ি ছিল খুলনায়। পরে সিরাজ ভাই আমাকে মুজিববাহিনীতে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ জানালেও আমি রাজি হইনি। [২২]
১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে পাঠ করা স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারব্যবস্থার কথা উল্লেখ থাকলেও সরকারের মূল সমন্বয়ক ছিলেন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। শুরু থেকেই এই সরকারের সঙ্গে বিএলএফ তথা মুজিববাহিনীর দ্বন্দ্ব ছিল এবং তাজউদ্দীনকে নানা সময়ে মুজিববাহিনী নেতাদের, বিশেষ করে শেখ ফজলুল হক মনির তোপের মুখে পড়তে হয়। এই দ্বন্দ্বের প্রেক্ষাপট সবাই জানতেন না। ফলে সরকারের, বিশেষ করে সরকারি কর্মকর্তাদের অনেকের চোখেই মুজিববাহিনীকে নেতিবাচকভাবে দেখা হতো। এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ দেখা গেছে সরকারের সচিব হোসেন তৌফিক ইমামের ভাষ্যে :
স্বাধীনতাসংগ্রামের কঠিনতম সময়ে আরেকটি বিশৃঙ্খলা এবং মাঝেমধ্যে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো মুজিববাহিনীর কার্যকলাপে। বিশেষ করে শেখ মনি কেন জানি না, কিছুতেই মন্ত্রিপরিষদের কর্তৃত্ব মানতে চাইতেন না। আমার সন্দেহ হয়, তাঁর এই আচরণের পেছনে অদৃশ্য কোনো শক্তির হাত থাকতে পারে। খন্দকার মোশতাক কোনো কোনো সময় ইন্ধন জোগাতে পারেন। তবে শেখ মনির ক্ষমতার উৎস ছিল ভারতীয় ‘র’ (RAW) নামক গোপন প্রতিষ্ঠান। এরাই মুজিববাহিনীকে সংগঠিত করে এবং ট্রেনিং ও অস্ত্র সরবরাহ করে। সমস্যার সৃষ্টি হতো তখনই, যখন মুজিববাহিনীর সদস্য, বিশেষ করে কমান্ডোরা নিয়মিত বাহিনীর ওপর কর্তৃত্ব করতে চাইত। তাতে সেক্টর কমান্ডাররা ক্ষুব্ধ হতেন, অভিযোগ করতেন প্রধান সেনাপতি ওসমানীর কাছে; তিনি মন্ত্রিসভার বৈঠকে উত্তেজিতভাবে এটা উত্থাপন করে দ্রুত প্রতিবিধান চাইতেন। প্রধানমন্ত্রী সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ভারত সরকারের কাছে এই বিষয়ে প্রতিকার পাননি। আমার উপস্থিতিতেই কর্নেল ওসমানী কয়েকবার অব্যাহতি চেয়েছেন মুজিববাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হওয়ায়। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী অনেক বুঝিয়ে তাঁকে শান্ত। করতেন।
আরেকটি ঘটনার আমি প্রত্যক্ষদর্শী। সেটা অক্টোবর মাসে। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী পূর্ব রণাঙ্গন পরিদর্শনে গিয়ে আগরতলা সার্কিট হাউসে অবস্থান করছিলেন। শেখ মনি ও তার কয়েকজন সহযোগী অত্যন্ত উত্তেজিতভাবে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর
বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক বক্তব্য দিতে থাকেন। সবাই বেশ অবাক হয়ে গিয়েছিলাম সেদিন। যৌথ কমান্ড গঠনের চিন্তাভাবনা শুরু হতেই এই বিশৃঙ্খলা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায়। সেটা সেপ্টেম্বরের প্রথম দিকেই। ভারত সরকারের পক্ষ থেকে ডি পি ধরকে নীতিনির্ধারণী কমিটির চেয়ারম্যান (মন্ত্রীর মর্যাদায়) নিয়োগের পর ধীরে ধীরে বিভিন্ন ভারতীয় সংস্থার মধ্যে বাংলাদেশের ব্যাপারে সমন্বয় অনেক স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সম্ভবত RAW তখন থেকে মুজিববাহিনীর রাশ টেনে ধরে। এরপর কর্নেল ওসমানীর জন্য, বিশেষ করে মুক্তিবাহিনীর চেইন অব কমান্ড বজায় রাখতে বড় কোনো অসুবিধা হয়েছে বলে আমার জানা নেই। [২৩]
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে বিএলএফ তথা মুজিববাহিনীর প্রশিক্ষণের পাশাপাশি হিন্দু যুবকদের আলাদা প্রশিক্ষণ দিয়ে একটি স্বতন্ত্র বাহিনী তৈরির প্রস্তাব দিয়েছিলেন চিত্তরঞ্জন সুতার ও কালিদাস বৈদ্য। ভবিষ্যতে স্বাধীন বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তার কথা ভেবে কিংবা অনিশ্চয়তার আশঙ্কায় এ ধরনের একটি বাহিনী প্রস্তুত রাখার গুরুত্ব তাঁরা বুঝতে পেরেছিলেন। অবশেষে সেই প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাটি হলো। ফণীন্দ্রনাথ ব্যানার্জিই ব্যবস্থা করে দিলেন। ট্রেনিং কার্যক্রম চালানো হয় গোপনে। সপ্তাহে প্রায় ৬০০ তরুণকে প্রশিক্ষণের জন্য নিয়ে যাওয়া হতো। এভাবে ২ হাজার ৫০০ জন যাওয়ার পর তাদের প্রশিক্ষণ শেষ হওয়ার আগেই ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। প্রশিক্ষণের কাজও বন্ধ হয়ে যায়। [২৪] এ ব্যাপারে কালিদাস বৈদ্য বলেছেন :
ট্রেনিংয়ের প্রস্তাবটি অনুমোদনের সঙ্গে সঙ্গে এ বাহিনীকে আমি গণমুক্তি বাহিনী নাম দিই। যেহেতু একটি গোপন বাহিনী, সেহেতু নামও গোপন থাকল। এখানে উল্লেখ করার বিশেষ প্রয়োজন আছে যে চিত্তবাবু আড়াল থেকে মুজিববাহিনী চালানোর দায়িত্ব নেন। আমার ওপর দায়িত্ব পড়ে সেই গণমুক্তি বাহিনীকে আড়াল থেকে চালানো। তবে মুজিববাহিনী শেষ পর্যন্ত গোপনীয়তা ত্যাগ করে সদরে এল, কিন্তু গণমুক্তি বাহিনী সদরে আসার সুযোগটি আর পেল না। কুম্ভকর্ণের ঘুমের মতো সে ঘুমিয়ে পড়ল। সে ঘুম কবে ভাঙবে, তা কেউ জানে না। [২৫]
.
৭
অক্টোবরে বিএলএফের জেলা পর্যায়ের প্রতিনিধিসহ প্রায় ৭০ জনের একটি সম্মেলন হয় দেরাদুনের পাশে কালশিতে। এটি ছিল একটি অস্থায়ী প্রশিক্ষণকেন্দ্র। বিএলএফের নেতারা জানতেন, তাঁরা তাঁদের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের অনুপস্থিতিতে একটি বিশেষ ব্যবস্থায় প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। জয়লাভের পর তাদের নেতা অনুপস্থিত থাকবেন, এটা কারও কাম্য ছিল না। তবে আশঙ্কা ছিল, তিনি জীবিত ফিরে না-ও আসতে পারেন। তাঁর অনুপস্থিতিতে রাজনৈতিক নেতৃত্ব, সামরিক বাহিনী ও আমলাতন্ত্র থেকে সম্ভাব্য যে বিরোধিতা বা আক্রমণ আসতে পারে, তার পরিপ্রেক্ষিতে ভবিষ্যৎ রাজনীতি ও রণকৌশল নির্ধারণের গুরুত্ব সম্পর্কে বিএলএফ নেতারা একমত হন। সিদ্ধান্ত হয়, সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় শেখ মুজিবের রাজনৈতিক আদর্শ–গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে ধারণ করে যে দর্শন, তাকে শেখ মুজিবের নামে পরিচিতি দিতে হবে। সিরাজুল আলম খান প্রস্তাব করেন, এই দর্শনের নাম হবে ‘মুজিববাদ’। সবাই এ প্রস্তাব গ্রহণ করেন। ওই সম্মেলনে বিএলএফের নাম আনুষ্ঠানিকভাবে মুজিববাহিনী রাখা হয়। [২৬]
প্রশিক্ষণ শুরু হয়েছিল মে মাসের শেষ দিকে। শেষ হলো অক্টোবরে। উল্লেখ করা যেতে পারে যে ছাত্রলীগের লাখ লাখ সদস্য বিএলএফের সন্ধান পাননি। সবচেয়ে জনপ্রিয় এই ছাত্রসংগঠনের অনেক তরুণ মুক্তিযুদ্ধের সশস্ত্র প্রতিরোধপর্বে সরাসরি অংশ নেওয়ার জন্য মরিয়া ছিলেন। কিন্তু তারা অনেকেই জানতেন না কোথায় বিএলএফ, কোথায় গেলে এর প্রশিক্ষণ পাওয়া যাবে। তাদের একটা বড় অংশ বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিদের তত্ত্বাবধানে গড়ে ওঠা প্রশিক্ষণ ক্যাম্পগুলোতে গিয়ে হাজির হতেন এবং প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র নিয়ে দেশের ভেতরে ঢুকতেন। এঁদের পরিচিতি ছিল ‘ফ্রিডম ফাইটার’ বা এফএফ নামে। অনেক জায়গায় বিএলএফ ও এফএফের মধ্যে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছিল। আবার অনেক জায়গায় তারা একই কমান্ড কাঠামোর অধীনে যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। এদের একজন ছিলেন চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ার খোদা বখশ চৌধুরী। তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র, থাকতেন জিন্নাহ হলে (সূর্য সেন হল)। আমাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি তাঁর বিচিত্র অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন এভাবে :
একদিন খবর পেলাম সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধারা রাঙ্গুনিয়ায় এসেছে। এদের নেতৃত্বে আছেন আমার দূরসম্পর্কের এক আত্মীয়। আমার ডাক পড়ল। আমি তাদের একজন সদস্য হিসেবে সব রকমের কাজে অংশ নিতে থাকি। মুক্তিবাহিনী ও মুজিববাহিনীর পার্থক্য স্থানীয়ভাবে ছিল না। সবার একটাই লক্ষ্য, পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীকে এ দেশ থেকে তাড়াতে হবে। এ সময় আমার মনে একটা চিন্তা ঢুকল, সশস্ত্র যোদ্ধা হওয়া ছাড়া সিভিলিয়ান সমর্থক হয়ে সর্বোচ্চ অবদান রাখা যায় না। সিদ্ধান্ত নিলাম, ভারতে যাব এবং ট্রেনিং নিয়ে ফিরে এসে যুদ্ধ করব।
দুজন সঙ্গী ও একজন গাইড নিয়ে রাঙ্গুনিয়া থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের গভীর জঙ্গলের মধ্য দিয়ে বিরতিহীনভাবে পায়ে হেঁটে এক সন্ধ্যায় রামগড়ের পাকিস্তানি আর্মি ক্যাম্প এড়িয়ে ফেনী নদী পার হয়ে সীমান্তের ওপারে ত্রিপুরার একটা ছোট বাজারে পৌঁছাই। কুপি বাতির আলোয় একটা চায়ের দোকানে দেখলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচিত মুখ ভিপি আ স ম আবদুর রব, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ নেতা স্বপন কুমার চৌধুরী এবং চট্টগ্রামের ছাত্রলীগ নেতা এস এম ইউসুফ বসে আছেন। তাঁরা জানতে চাইলেন, আমার আসতে এত দেরি হলো কেন। তারপর তিনজনের মধ্যে শুরু হলো কানে কানে কথা। অবশেষে রব ভাই বললেন, মুজিববাহিনীর সর্বশেষ দলটি ট্রেনিংয়ে চলে গেছে। আর ট্রেনিং হবে না। তাঁরা আমাকে ১ নম্বর সেক্টরে হরিণা ক্যাম্পে যেতে বললেন। সেখানে একটা তাঁবুতে ঠাই হলো।
কয়েক দিন পর এক সন্ধ্যায় একটা নির্দিষ্ট জায়গায় হাজির হওয়ার নির্দেশ পেলাম। সেখানে গিয়ে দেখলাম ট্রেনিং শেষ করে একটি মুক্তিযোদ্ধা দল অপেক্ষা করছে। তাদের জন্য একজন প্লাটুন কমান্ডার নিয়োগ করা হবে। আমাকেই কমান্ডার হিসেবে ঘোষণা করা হলো। দলটির সবাই রাঙ্গুনিয়ার অধিবাসী, বেশির ভাগই রাঙ্গুনিয়া কলেজের ছাত্র। আমাকে নিয়ে সংখ্যা হলো ৩৯। কাকতালীয়ভাবে সেক্টর ওয়ানের এই গেরিলা প্লাটুনের নম্বরও হলো ৩৯। আমার সঙ্গে পুরো দলের এই প্রথম পরিচয়। আমার নেতৃত্বে আসা দলটির উপনেতা ছিলেন রাঙ্গুনিয়া কলেজের ছাত্র ইউনিয়নের একজন প্রভাবশালী নেতা। দলের সদস্যদের বেশির ভাগই ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী-সমর্থক। ছাত্রলীগের কোনো কর্মী-সমর্থকের নেতৃত্ব ছাড়া দলটিকে দেশের ভেতরে পাঠানো হবে না, এমন সিদ্ধান্তই নেতারা নিয়েছিলেন। আমি সেই শূন্যস্থান পূরণ করলাম। দেশের ভেতরে এসে আমরা সবাই মুজিববাহিনীর সঙ্গে এককাট্টা হলাম। [২৭]
.
৮
বিএলএফের দুটি প্রশিক্ষণশিবিরে ৬ হাজার ৮০০ তরুণকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। দেশের ভেতরে গিয়ে ছাত্রলীগ কর্মীদের খুঁজে বের করা, চারটি ট্রানজিট ক্যাম্প বা বেস ক্যাম্প চালানো, প্রশিক্ষণের পর তরুণদের দেশের ভেতরে পাঠানো ইত্যাদি খরচ মেটানোর জন্য ৭৬ লাখ টাকার একটা বাজেট তৈরি করেছিলেন বিএলএফ নেতারা। বরাদ্দ হয়েছিল ৭০ লাখ টাকার কিছু বেশি। কয়েক কিস্তিতে টাকাটা দেওয়া হয়। ২ লাখ টাকার মতো বাকি ছিল। ওই টাকা দেওয়া হয় পরে। যুদ্ধ শেষে ৩১ জানুয়ারি ১৯৭২ ঢাকায় মুজিববাহিনীর অস্ত্রসমর্পণ অনুষ্ঠানে আসা সদস্যদের যাতায়াতের জন্য ওই টাকা খরচ করা হয়েছিল। [২৮]
ছাত্রলীগের মেয়েদের জন্য আলাদা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা হয়েছিল আগরতলায়। এসএফএফের কর্মকর্তারা এই প্রশিক্ষণ দেন।
এ সময় আরেকটি ঘটনার কথা উল্লেখ করা দরকার। ইয়াহিয়া খান ২৮ ডিসেম্বর ১৯৭১ ঢাকায় পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডেকেছিলেন। কলকাতায় আশ্রয় নেওয়া আওয়ামী লীগের জাতীয় পরিষদ সদস্যরা যাতে বেশি সংখ্যায় ঢাকায় ফিরে এই অধিবেশনে যোগ দিতে পারেন, সে জন্য পাকিস্তানি গোয়েন্দারা গোপনে চেষ্টা চালায়। কলকাতায় বাংলাদেশবিরোধী ষড়যন্ত্র আগে থেকেই ছিল। ভারত সরকারের ইঙ্গিতে কলকাতায় থাকা মুজিববাহিনীর সদস্যরা জাতীয় পরিষদ সদস্যদের পাহারা দিতে শুরু করে। তাদের এই বলে হুমকি দেওয়া হয় যে যারা ঢাকায় যাওয়ার চেষ্টা করবে, তাদের গুলি করে মারা হবে। অন্যদিকে ভারতীয় গোয়েন্দাদেরও বাংলাদেশের জাতীয় পরিষদ সদস্যদের চলাফেরার প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়, যাতে কেউ দেশে ফিরে যেতে না পারে। [২৯]
অনেক আওয়ামী লীগ নেতা শরণার্থীজীবনের কষ্ট এবং অনিশ্চয়তা সহ্য করতে পারছিলেন না। তাঁরা অনেকেই ভারত সরকারের মনোভাব জানতেন না, জানতেন না কবে এই সংকটের নিষ্পত্তি হবে। অন্যদিকে ইয়াহিয়া খানেরও জানা ছিল না সামনের দিনগুলোতে তার জন্য কী অপেক্ষা করছে। একাত্তরের ২০ ডিসেম্বর তিনি ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে ছিটকে পড়েছিলেন। ক্ষমতা ছেড়ে দেন জুলফিকার আলী ভুট্টোর হাতে।
বিএলএফের প্রথম সারির নেতারা সবাই সামরিক প্রশিক্ষণ নিলেও অধিকাংশই মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশ নিতে দেশের ভেতরে যাননি। তাঁরা আগাগোড়া সংগঠকই থেকে গেছেন। ব্যতিক্রম ছিলেন শেখ ফজলুল হক মনি। বিএলএফের সদস্যরা প্রশিক্ষণ নিয়ে অস্ত্র হাতে দেশের ভেতরে ঢোকা শুরু করেন জুলাইয়ের শেষ দিকে। জেনারেল উবানের নেতৃত্বে পূর্বাঞ্চলে ২৩ নভেম্বর শুরু হয় ‘অপারেশন ইগল’। তারা মিজোরাম হয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে ঢোকেন। বিএলএফের কয়েকজন সদস্য নিয়ে শেখ মনি তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন। বিএলএফের অন্য তিন কমান্ডার দেশে ঢোকেন ডিসেম্বরে যুদ্ধ। শেষ হওয়ার পর। যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হবে এবং তাঁরা সামনে থেকে এর নেতৃত্ব দেবেন, এমনটি তারা ভেবে থাকলেও তার আগেই যুদ্ধ শেষ করার ভারতীয় পরিকল্পনাটি হয়তো জানা ছিল না।
মে মাস থেকে শুরু করে যুদ্ধের শেষ দিন পর্যন্ত বিএলএফের কয়েকজন সিনিয়র সদস্য দেরাদুনের ক্যাম্পে থেকে গিয়েছিলেন। তাঁদের মূল কাজ ছিল প্রশিক্ষণ নিতে আসা তরুণদের জন্য পলিটিক্যাল মোটিভেটর হিসেবে কাজ করা। এঁদের মধ্যে ছিলেন হাসানুল হক ইনু, শরীফ নুরুল আম্বিয়া, আ ফ ম মাহবুবুল হক, মাসুদ আহমেদ রুমি প্রমুখ। এ বিষয়ে আমি কথা বলি আম্বিয়ার সঙ্গে :
মহিউদ্দিন আহমদ : আপনি তো পুরো সময়টা তান্ডুয়াতে ছিলেন?
শরীফ নুরুল আম্বিয়া : হ্যাঁ।
মহি : ডিসেম্বরে বাংলাদেশে এলেন?
আম্বিয়া : হ্যাঁ। বিজয় দিবসের পরে আমরা দেরাদুন থেকে রওনা দিয়েছি। আমি, ইনু, মাহবুব। রুমি আগেই চলে গিয়েছিল।
মহি: দেরাদুনে আপনারা এত দিন কেন থাকলেন?
আম্বিয়া : যুদ্ধের শেষ দিকে আমাদের দিকে নজর দেওয়ার ফুরসত বোধ হয় ওদের ছিল না। সন্ধ্যার পর আমরা ব্ল্যাকআউটে বসে থাকতাম। অ্যাকচুয়ালি আমরা তো ট্রেনিং সেক্টরে ছিলাম। শেষ পর্যন্ত আমরা ১৫-১৬ জন ছিলাম। একে অন্যের খোঁজ রাখা আর চা খাওয়া, এই ছিল কাজ। [৩১]
একাত্তরের ৩ ডিসেম্বর ভারতের সশস্ত্র বাহিনী বাংলাদেশ ভূখণ্ডে ঢুকে পড়ে এবং পাকিস্তানিদের সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। তাদের পরিচয় হয় ‘মিত্রবাহিনী। ৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি দেয় ভারত। পরদিন ৭ ডিসেম্বর স্বীকৃতি দেয় ভুটান। মুজিববাহিনীর মোটিভেটররা তখনো তান্দুয়ায় অলস সময় কাটাচ্ছেন।
‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো/ বাংলাদেশ স্বাধীন করো’ উচ্চারণে যারা একদা সোচ্চার ছিলেন, তাদের নেতারা কেউ অস্ত্র হাতে নেননি। ছাত্রলীগের জ্যেষ্ঠ নেতা আ স ম আবদুর রব, শাজাহান সিরাজ, আবদুল কুদুস মাখন, মনিরুল ইসলাম–এরা সবাই যুদ্ধের শেষ দিন পর্যন্ত ভারতে ছিলেন। অন্যান্য রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতৃত্বের আচরণ ছিল একই রকম। পৃথিবীতে অনেক দেশেই স্বাধীনতা ও মুক্তির লড়াই হয়েছে, হয়েছে জনযুদ্ধ। বাংলাদেশ সম্ভবত ব্যতিক্রম, যেখানে শীর্ষ রাজনৈতিক নেতৃত্ব যুদ্ধে সরাসরি অংশ নেননি। সবাই সংগঠক। বাংলাদেশের ভেতরে সশস্ত্র প্রতিরোধযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণকারীর চেয়ে ভারতীয় ভূখণ্ডে থেকে যুদ্ধ করা লোকের সংখ্যা বেশি।
সবচেয়ে হতাশাজনক বিষয় হলো, মুজিববাহিনীর শীর্ষ নেতারা তাদের যোদ্ধাদের পরিত্যাগ করেছেন। সামনে থেকে যুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া তো দূরে থাক, সদস্যদের তালিকাটি পর্যন্ত সংরক্ষণ করেননি। ফলে এই বাহিনীর অনেকেই রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাননি। অথচ ব্যক্তিগত যোগাযোগ ও উদ্যোগের মাধ্যমে নেতারা অনেকেই নিজেদের জন্য স্বীকৃতি আদায় করে নিয়েছেন। নেতৃত্বের এই আচরণ ছিল দুঃখজনক।
মনে হলো যুদ্ধটা হঠাৎ করেই শেষ হয়ে গেছে। দেশে অনেক লোকের হাতে অস্ত্র। কেউ কারও কথা শুনছে না। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ঢাকা স্টেডিয়ামে মুজিববাহিনীর অস্ত্রসমর্পণ অনুষ্ঠানে গুরু-শিষ্য বঙ্গবন্ধু ও সিরাজুল আলম খানের মিলন বারবার অস্ত্রসমর্পণ করার আহ্বান জানালেও কেউ তাতে কান দিচ্ছে না। সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে যে কোনো রকমের সংহতি নেই, তা স্পষ্ট বোঝা যায়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব দেশে ফিরে এলেন ১০ জানুয়ারি ১৯৭২। দেশের হাল ধরলেন তিনি। সবাইকে অস্ত্র জমা দিতে বললেন। বিভিন্ন বাহিনী ঘটা করে অস্ত্র জমা দেওয়ার আয়োজন করল। কার কাছে কী পরিমাণ অস্ত্র আছে এবং কতগুলো অস্ত্র জমা পড়েছে, তার কোনো হিসাব রাখা হয়নি। কোথাও পেশাদারত্বের ছাপ ছিল না। প্রসঙ্গটি উঠে এসেছে খোদা বখশ চৌধুরীর দেওয়া সাক্ষাৎকারে :
পাকিস্তানি সৈন্যদের আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে শেষ হলো যুদ্ধ। মুজিববাহিনীর আঞ্চলিক কমান্ডার শেখ ফজলুল হক মনি আমাদের থানার মুক্তিযোদ্ধাদের স্কটের নিরাপত্তায় রাঙামাটি থেকে চট্টগ্রামে এলেন। পরদিন চট্টগ্রাম শহরে মুক্তিযোদ্ধাদের সমাবেশে বঙ্গবন্ধুর। দেশে ফিরে না আসা পর্যন্ত অস্ত্র জমা না দেওয়ার জন্য কঠোর নির্দেশ জারি করলেন।
বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে আসার পর ৩১ জানুয়ারি ঢাকা স্টেডিয়ামে অস্ত্রসমর্পণের তারিখ ঠিক হয়। আমরা নির্ধারিত তারিখে স্টেডিয়ামে হাজির হই এবং সব অস্ত্র জমা দিই। আমাদের বলা হলো, স্টেডিয়ামে সব অস্ত্র রেখে আমরা যেন খালি হাতে বেরিয়ে যাই। ১ নম্বর সেক্টরে দস্তখত করে আমি যে অস্ত্র গ্রহণ করেছিলাম, তা কেউ বুঝে নিল না। কেউ আমাকে কোনো প্রাপ্তিস্বীকারের রসিদ দিল না। অস্ত্রসমর্পণের
কোনো প্রমাণ ছাড়াই আমার মুক্তিযুদ্ধ শেষ হলো।৩২ বাহাত্তরের ৩১ জানুয়ারি ঢাকা স্টেডিয়ামে মুজিববাহিনীর সদস্যরা প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবের কাছে অস্ত্র জমা দেওয়ার জন্য সমবেত হন। মাঠের মধ্যেই একটা মঞ্চ বানানো হয়েছিল। গ্যালারি ছিল দর্শক-শ্রোতায় ভরা। শেখ মুজিব মঞ্চে ওঠার পর সিরাজুল আলম খান ডান হাত ওপরে তুলে স্লোগান দেন, ‘বঙ্গবন্ধু বঙ্গবন্ধু’। চারদিক থেকে প্রতিধ্বনি হলো, ‘জিন্দাবাদ জিন্দাবাদ’। এরপর তিনি কণ্ঠ সপ্তমে চড়িয়ে আওয়াজ তুললেন, ‘মুজিববাদ মুজিববাদ’। আবারও শোনা গেল ‘জিন্দাবাদ জিন্দাবাদ’। মঞ্চে অন্যান্যের মধ্যে ছিলেন শেখ ফজলুল হক মনি, আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ এবং শ্রমিকনেতা আবদুল মান্নান। তারা একে একে শেখ মুজিবের পায়ের কাছে স্টেনগান রাখলেন এবং পা ধরে সালাম করলেন। ছাত্রলীগের তরুণেরা বেশ কয়েক দিন স্লোগানে স্লোগানে ঢাকার রাজপথ মুখর করে রাখলেন–বিশ্বে এল নতুন বাদ, মুজিববাদ মুজিববাদ।
.
তথ্যসূত্র
১. সিরাজুল আলম খান
২. তোফায়েল আহমেদ
৩. বৈদ্য, পৃ. ১৫৮-১৫৯
৪. ওই, পৃ. ১৫০-১৫১
৫. Raina, Ashoka (1981), Inside Raw: The Story of India’s Secret Service, vikas Publishing House, New Delhi, p. 50; বেগম, সাহিদা, পৃ. ৮৩
৬. Ramesh, Jairam (2018), Interwined Lives: P. N. Haksar and Indira Gandhi. Simon & Schuster India, New Delhi, p. 121-122
৭. Raina, p. 48
৮. Ibid, p. 50-51
৯. Ibid, p. 55
১০. Rehman, 1 (2017), Himalayan Challenge: India’s Conventional Deterrent and the Role of Special Operations Forces along the Sino-Indian Border, Naval War College Review, Winter 2017, p. 109-142; Sinha, D & Balakrishnan, R (2016). Employment of India’s Special Operation Forces, ORE Issue Brief, No. 150, June 2016
১১. lbid
১২. Raina, p. 54
১৩. উবান, মেজর জেনারেল (অব.) এস এস (২০০৫), ফ্যান্টামস অব চিটাগাং : দ্য ফিফথ আর্মি ইন বাংলাদেশ, ঘাস ফুল নদী, ঢাকা, পৃ. ২০-২১
১৪. বিএলএফের সদস্য হিসেবে লেখকের ব্যক্তিগত স্মৃতি ও অভিজ্ঞতা।
১৫. Raina, p. 55-57
১৬. The Untold Story of Dr. Abu Hena
১৭. আমির হোসেন আমু
১৮. তথ্য মন্ত্রণালয়, ড. কামাল সিদ্দিকীর সাক্ষাৎকার, পৃ. ২০৯-২১০
১৯. Raghavan, Srinath (2013), 1971: A Global History of the Creation of Bangladesh. Harvard University Press, Massachusetts, p. 182-183
২০. আমির হোসেন আমু
২১. বৈদ্য, পৃ. ১৫৯-১৬০
২২. Untold story of Dr. Abu Hena
২৩. ইমাম, এইচ টি (২০০৪), বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১, আগামী প্রকাশনী, ঢাকা, পৃ. ৭৯
২৪. বৈদ্য, পৃ. ১৬৩-১৬৪
২৫. ওই
২৬. ইসলাম, মনিরুল (২০১৩), জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও সমাজতন্ত্র, জ্যা পাবলিকেশনস, ঢাকা, পৃ. ১৯৩
২৭. খোদা বখশ চৌধুরী
২৮. সিরাজুল আলম খান
২৯. বৈদ্য, পৃ. ১৬৫-১৬৬; সিরাজুল আলম খান
৩০. উবান, পৃ. ১০৩
৩১. শরীফ নুরুল আম্বিয়া
৩২. খোদা বখশ চৌধুরী।