পিতৃতান্ত্রিক কাল ও ধ্রুপদী মহাযুগ
প্রথম খণ্ড । ভাগ ২ – ইতিহাস । পরিচ্ছেদ ৩
নারী সিংহাসনচ্যুত হয়েছিলো সম্পত্তির ব্যক্তিমালিকানার আগমনে, এবং শতাব্দী পরম্পরায় তার ভাগ্য জড়িয়েআছে সম্পত্তির ব্যক্তিমালিকানার সঙ্গে : তার ইতিহাসের বড়ো অংশই জড়িত উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া বিষয়সম্পত্তির ইতিহাসের সাথে। এ প্রথার মৌলিক গুরুত্ব বোঝা যায় সহজে যদি একথা মনে রাখি যে মালিক তার অস্তিত্ব স্থানান্তরিত, বিচ্ছিন্ন করে তার সম্পত্তির মধ্যে; সে একে নিজের জীবনের থেকেও বেশি মূল্য দেয়; এটা প্রবাহিত হয় এ-মরজীবনের সংকীর্ণ সীমা পেরিয়ে, এবং শরীর মাটিতে মিশে যাওয়ার পরও টিকে থাকে–ঘটে অমর আত্মার পার্থিব ও বস্তুগত একত্রীভবন। তবে এ-বেঁচে থাকা সম্ভব হয় যদি সম্পত্তি থাকে মালিকের হাতে : মৃত্যুর পরও এটা তার হতে পারে যদি এটা তাদের অধিকারে থাকে, যাদের মধ্যে সে নিজেকে প্রক্ষেপিত দেখতে পায়, যারা তার। সুতরাং পুরুষ নারীর সাথে তার দেবতা ও সন্তান ভাগাভাগি করে নিতে রাজি নয়। পিতৃতান্ত্রিক ক্ষমতার কালে পুরুষ সম্পত্তির মালিকানা ও দানের সমস্ত অধিকার ছিনিয়ে নেয় নারীর কাছে থেকে।
সেদিক থেকে দেখতে গেলে, তার কাছে এটা যুক্তিসঙ্গতই মনে হয়েছিলো। যখন স্বীকার করা হয় যে নারীর সন্তানেরা আর তার নয়, ওই স্বীকৃতি অনুসারেই নারীটি যে-দল থেকে এসেছে, তার সাথে সন্তানদের কোনো বন্ধন থাকে না। বিয়ের মাধ্যমে নারী আর এক গোত্রের কাছে থেকে আরেক গোত্রের ঋণগ্রহণ নয় : সে যে-গোত্রে জন্মেছিলোসে-গোত্র থেকে সমূলে উৎপাটিত করে আনা হয় তাকে, এবং অন্তর্ভুক্ত করা হয় স্বামীর দলে; স্বামী তাকে কেনে যেমন কেউ কেনে গোয়ালের জন্যে পশু বা দাস; স্বামী তার ওপর চাপিয়ে দেয় তার গৃহদেবতাদের; এবং নারীটির গর্ভের সন্তানেরা অন্তর্ভুক্ত হয় স্বামীর পরিবারের। যদি নারী উত্তরাধিকারী হতো, তাহলে সে পিতার পরিবারের বেশ কিছু সম্পত্তি হস্তান্তরিত করতে স্বামীর পরিবারে; তাই সযত্নে তাকে বাদ দেয়া হয় উত্তরাধিকার থেকে। উল্টোভাবে, যেহেতু নারী কিছুর মালিক নয়, সে মানুষের মর্যাদাও পায় না; সে নিজেই হয়ে ওঠে পুরুষের উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত বিষয়সম্পত্তির অংশ : প্রথমে পিতার, পরে স্বামীর। কঠোর পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থায় পিতা জন্মের মুহূর্ত থেকে পুত্র ও কন্যা সন্তানদের হত্যা করতে পারে; কিন্তু পুত্রের বেলা সমাজ অস্বাভাবিকভাবে খর্ব করে তার ক্ষমতা : প্রতিটি সুস্থ নবজাতক পুত্রকে বাঁচতে দেয়া হয়, অন্যদিকে শিশুকন্যাদের অরক্ষিত রাখার রীতি ছিলো খুবই ব্যাপক। আরবদের মধ্যে শিশুহত্যা ছিলো ব্যাপক : জন্মের সাথে সাথেই কন্যাশিশুদের গর্তে ছুঁড়ে ফেলে দেয়া হতো। শিশু কন্যাকে বাঁচিয়ে রাখা ছিলোপিতার বিশেষ মহানুভবতা; এমন সমাজে পুরুষের বিশেষ দয়ায়ই নারী বেঁচে থাকতে পারে, পুত্রের মতো বৈধভাবে নয়। প্রসবের পর প্রসূতির অশৌচের কাল হয় দীর্ঘতর যদি শিশুটি হয় মেয়ে : হিব্রুদের মধ্যে, লেভিটিকাস নির্দেশ দিয়েছে পুত্র জন্ম নিলে যতো দিন অশৌচ পালন করতে হবে কন্যা জন্ম নিলে অশৌচ পালন করতে হবে তার থেকে দুমাস বেশি। যে-সব সমাজে ‘রক্তের মূল্য’-এর প্রথা আছে, সেখানে নিহত ব্যক্তিটি স্ত্রীলিঙ্গের হলে মূল্য হিশেবে দাবি করা হয়অল্প মুদ্রা : পুংলিঙ্গের সাথে তুলনায় তার মূল্য ততোটা একজন স্বাধীন পুরুষের তুলনায় একটি দাসের মূল্য যতোটা।
যখন সে কিশোরী হয়ে ওঠে, তার ওপর থাকে তার পিতার সমস্ত কর্তৃত্ব; যখন তার বিয়ে হয়, তখন তার পিতা সে-কর্তৃত্ব কড়ায়গন্ডায় হস্তান্তরিত করে স্বামীর হাতে। স্ত্রী যেহেতু দাসের মতো, ভারবাহী পশুর মতো, বা অস্থাবর সম্পত্তির মতো স্বামীর সম্পত্তি, তাই পুরুষ স্বাভাবিকভাবেই গ্রহণ করতে পারে যত ইচ্ছে তত স্ত্রী; শুধু আর্থনীতিক বিবেচনার ফলেই বহুবিবাহ থাকে বিশেষ সীমার মধ্যে। স্বামী নিজের খেয়ালে ছেড়ে দিতে পারে স্ত্রীদের, সমাজ তখনতাদের কোনোই নিরাপত্তা দেয় না। অন্যদিকে, নারীকে রাখা হয় কঠোর সতীত্বের মধ্যে। ট্যাবু থাকা সত্ত্বেও মাতৃধারার সমাজে মেনে নেয়া হয় আচরণের ব্যাপক স্বাধীনতা; বিবাহপূর্ব কুমারীত্ব সেখানে বিশেষ দরকার হয় না, এবং ব্যভিচারকেও বিশেষ কঠোরতার সাথে শাসন করা হয় না। এর বিপরীতে, যখন নারী হয়ে ওঠে পুরুষের সম্পত্তি, স্বামী চায় স্ত্রীটি হবে কুমারী এবং সে কঠোর দণ্ডের ভয় দেখিয়ে স্ত্রীর কাছে দাবি করে সম্পূর্ণ সতীত্ব। কোনো উপপতির সন্তানকে সম্পত্তির উত্তরাধিকারী করার ঝুঁকি নেয়া হচ্ছে চরম অপরাধ; তাই দোষী স্ত্রীকে হত্যা করার সমস্ত অধিকার আছে গৃহস্বামীর। যতোদিন ব্যক্তিমালিকানা প্রথা টিকে থাকবে, স্ত্রীর অসতীত্বকে ততোদিন গণ্য করা হবে রাজদ্রোহিতার মত অপরাধ বলে। আইনের সমস্ত বিধি, যেগুলো আজো ব্যভিচারের ক্ষেত্রে মেনে চলে অসাম্য, সবগুলোই যুক্তি দাঁড়করায় স্ত্রীর মহাঅপরাধের ওপর, যে পরিবারের মধ্যে নিয়ে আসে একটি জারজ। এবং যদিও নিজের হাতে আইন তুলে নেয়ার অধিকার অগাস্টাসের কাল থেকেই বিলুপ্ত, নেপোলিয়নি বিধি আজো জুরির অধিকার অর্পণ করে স্বামীর হাতে, যে নিজেই প্রয়োগ করেছে ন্যায়বিচার।
যখন স্ত্রীটি একই সময়ে অন্তর্ভুক্ত হতো পৈতৃক গোত্রে ও দাম্পত্য পরিবারের, তখন সে দু-ধরনের বন্ধনের মধ্যে বেশ খানিকটা স্বাধীনতা রক্ষা করতে পারতো; এবন্ধন দুটি ছিলো বিশৃঙ্খল ও এমনকি পরস্পরবিরোধী, যার একটি স্ত্রীটিকে রক্ষা করতো অন্যটি থেকে : উদাহরণস্বরূপ, প্রায়ই সে নিজের পছন্দমতো স্বামী গ্রহণ করতে পারতো, কেননা বিয়ে ছিলো একটা ঐহিক ঘটনা মাত্র, যা সমাজের মৌল সংগঠনের ক্ষতি করতো না। কিন্তু পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সে তার পিতার সম্পত্তি, যে তার সুবিধামতো মেয়েকে বিয়ে দিতো। তারপর স্বামীর চুলোর সাথে জড়িয়ে থেকে সে স্বামীর অস্থাবর সম্পত্তির বেশি কিছু হতো না এবং হতো সে-গোত্রের অস্থাবর সম্পত্তি, যাতে ফেলা হয়েছে তাকে।
যখন পরিবার ও ব্যক্তিমালিকানানির্ভর উত্তরাধিকার প্রশ্নহীনভাবে থাকে সমাজের ভিত্তি, তখন নারী থাকে সম্পূর্ণরূপে অধীনস্থ। এটা ঘটে মুসলমান জগতে। এর সংগঠন সামন্ততান্ত্রিক; অর্থাৎ কোনো রাষ্ট্রই বিভিন্ন গোত্রকে সমন্বিত ও শাসন করার মতো শক্তি অর্জন করেনি : পিতৃতান্ত্রিক প্রধানের ক্ষমতা খর্ব করার মতো কারো শক্তি নেই। আরবরা যখন রণলিপ্সু ও বিজয়ী ছিলো তখন সৃষ্টি হয়েছিলো ধর্মটি, সেটি নারীকে করেছে প্রচন্ড অবজ্ঞা। কোরানঘোষণা করেছে : ‘পুরুষ নারীর থেকে শ্রেষ্ঠ কেননা আল্লা তাকে বিশেষ গুণ দিয়ে শ্রেষ্ঠত্বে ভূষিত করেছে এবং এজন্যে যে তারা নারীদের উপঢৌকন দেয়’; সেখানে নারীদের কখনো প্রকৃত ক্ষমতা ছিলো না। অতীন্দ্রিয় মর্যাদাও ছিলো না। বেদুইন নারী কঠোর পরিশ্রম করে, সে হাল চাষ করে ও বোঝা বহন করে : এভাবে সে তার স্বামীর সাথে স্থাপন করে একটা পারস্পরিক নির্ভরতার সম্পর্ক; সে মুখ খোলা রেখে স্বাধীনভাবে চলাফেরা করে। বোরখায় ঢাকা ওঅবরোধবাসিনী মুসলমান নারী আজো অধিকাংশ সামাজিক স্তরে একধরনের দাসী।
তিউনিশিয়ার এক আদিম পল্লীর ভূগর্ভস্থ এক গুহার ভেতরে বসে থাকা চারটি নারীকে আমি দেখেছিলাম, তাদের কথা আমার মনে পড়ছে : বৃদ্ধা এক চোখ কানা দাঁতহীন স্ত্রীটি, যার মুখমণ্ডল ভীষণভাবে বিধ্বস্ত, একটি ছোট্ট মালশার ওপরে তীব্র ঝাঁজালো ধোঁয়ার মধ্যে রাঁধছিলো ময়দার পিণ্ড; আরো দুটি স্ত্রী, কিছুটা কম বয়সের, কিন্তু একই রকমে বিধ্বস্ত, শিশু কোলে নিয়ে বসে ছিলো, একজন বুকের দুধ দিচ্ছিলো শিশুকে; আর তাঁতের সামনে বসে রেশম, সোনা, আর রুপোতে অলঙ্কৃত প্রতিমার মতো এক তরুণী বুনছিলো পশম। আমি যখন সেই বিষাদাচ্ছন্ন গুহাসীমাবদ্ধতা, জরায়ু, ও সমাধির রাজ্য-ছেড়ে বারান্দা দিয়ে ওপরে দিনের আলোর দিকে এলাম, তখন দেখলাম পুরুষটিকে, সে পরেছে শুভ্র পোশাক, অত্যন্ত সুসজ্জিত, মুখে হাসি, ঝলমলে। সে বাজার থেকে ফিরছিলো, যেখানে সে অন্যান্য পুরুষের সাথে বিশ্বের নানা কথা বলেছে; সে যে-বিশ্বের অন্তর্ভুক্ত, যে-বিশ্ব থেকে সে বিচ্ছিন্ন নয়, তার সে-বিশাল বিশ্বের কেন্দ্র অবস্থিত এ-বিশ্রামস্থলে সে কয়েক ঘন্টা কাটাবে। ওই বৃদ্ধা জীর্ণ নারীদের জন্যে, আর ওই তরুণীটির জন্যে, যে ওই বৃদ্ধাদের মতোই দ্রুত ক্ষয় হয়ে যাবে, এ-ধোঁয়াচ্ছন্ন গুহা ছাড়া আর কোনো বিশ্ব নেই; এ-গুহা থেকে তারা বেরোয় শুধু রাতে, নিঃশব্দে, বোরখায় ঢেকে।
বাইবেলের সময়ের ইহুদিদের ছিলো এ-আরবদের মতো একই প্রথা। গৃহপতিরা ছিলো বহুবিবাহকারী; আর তারা খেয়ালখুশি মতো ছেড়ে দিতে পারতো স্ত্রীদের; বিয়ের সময় তরুণী স্ত্রীকে অবশ্যই হতে হতো কুমারী, নইলে বিধান ছিলো কঠোর শাস্তির; ব্যভিচার ঘটলে স্ত্রীকে হত্যা করা হতো পাথর ছুঁড়ে; স্ত্রীকে রাখা হতো গৃহস্থালির কাজের মধ্যে বন্দী, যেমন প্রমাণ করে বাইবেলের সতী ভার্যার চিত্র : ‘সে চায় পশম ও শণ… সে রাত থাকতে ওঠে… রাতেও তার প্রদীপ নেভে না… সে আলস্যের অন্ন গ্রহণ করে না’। যদিও সে সতী ও পরিশ্রমী, কিন্তু অনুষ্ঠানাদিতে সে অশুচি, ট্যাবুতে ঢাকা; বিচারালয়ে তার সাক্ষ্য গৃহীত হয় না। ইক্লিজিয়াসটেস নারী সম্পর্কে প্রকাশ করেছে জঘন্যতম ঘৃণা : ‘আমি নারীকে মৃত্যুর থেকেও বিষাক্ত দেখি, যার মন হচ্ছে ফাঁদ ও জাল, এবং তার হাত হচ্ছে পাশ… সহস্রের মধ্যে আমি অন্তত একটি পুরুষ পেয়েছি; কিন্তু ওই সবগুলোর মধ্যেও আমি একটি নারী পাই নি’। ধর্মের বিধান না হলেও সামাজিক প্রথা ছিলো যে স্বামীর মৃত্যু হলে বিধবাটি তার ভাইদের কোনো একজনের কাছে বিয়ে বসবে।
প্রাচ্যদেশীয় অনেক সমাজে লেভিয়েট নামে একটি প্রথা আছে। সব ব্যবস্থায়ই, যেখানে নারী থাকে কারোঅভিভাবকত্বে, সেখানে একটি সমস্যার মুখোমুখি হতে হয় যে কী করতে হবে বিধবাদের নিয়ে? চরম সমাধান হচ্ছে তাদের স্বামীর সমাধিতে উৎসর্গ করা। তবে ভারতেও এ-বিধান এমন ধ্বংসযজ্ঞকে অত্যাবশ্যক করে তোলে নি; মনুর বিধানে স্বামীর মৃত্যুর পর বিধবার বেঁচে থাকার অনুমতি আছে। সমারোহপূর্ণ আত্মহত্যাগুলো কখনোই অভিজাতদের একটা ঢঙ ছাড়া বেশি কিছু ছিলো না। সাধারণত বিধবাদের তুলে দেয়া হতো স্বামীর উত্তরাধিকারীদের হাতে। লেভিরেট প্রথা অনেক সময় রূপ নেয় একপত্নীবহুস্বামী বিয়ের; বিধবার ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তা দূর করার জন্যে একটি পরিবারের সব ভাইকে করা হতো একটি নারীর স্বামী, এ-প্রথা গোত্রকে স্বামীর সম্ভাব্য বন্ধ্যাত্বের সমস্যা থেকেও রক্ষা করতো। সিজারের এক বিবরণে পাওয়া যায় যে ব্রিটানিতে পরিবারের সব পুরুষের থাকতো কয়েকটি সাধারণ স্ত্রী।
সর্বত্র অবশ্য পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থা চরমরূপে প্রতিষ্ঠিত হয় নি। ব্যাবিলনে হাম্মুরাবির বিধানে নারীদের দেয়াহয়েছিলো কিছু অধিকার; সে পৈর্তৃক সম্পত্তির কিছু অংশ পেতো, এবং তার বিয়ের সময় পিতা পণ দিতো। পারস্যে বহুবিবাহ ছিলো সামাজিক রীতি; সেখানে চাওয়া হতো যে স্ত্রী হবে স্বামীর একান্ত বাধ্য, বিয়ের বয়স হলে তার পিতা ঠিক করতো পাত্র; তবে অধিকাংশ প্রাচ্য সমাজের তুলনায় সেখানে স্ত্রী পেতো অনেক বেশি মর্যাদা। অজাচার নিষিদ্ধ ছিলো না, এবং ভাইবোনের মধ্যে বিয়ে হতো প্রায়ই। স্ত্রী পালন করতো সন্তানদের শিক্ষার দায়িত্ব–ছেলেদের সাত বছর বয়স, আর মেয়েদের বিয়ে পর্যন্ত। পুত্র অযোগ্য হলে সে স্বামীর সম্পত্তির একটি অংশ পেতো; আর সে যদি হতো‘সুবিধাপ্রাপ্ত স্ত্রী’, তাহলে পেতো অপ্রাপ্তবয়স্ক শিশুদের কর্তৃত্ব এবং যদি স্বামী কোনো প্রাপ্তবয়স্ক পুত্র না রেখে মারা যেতো, তাহলে ব্যবসা চালানোর দায়িত্বও পেতো। বিয়ের বিধান স্পষ্টভাবে নির্দেশ করতো যে গৃহস্বামীর উত্তরপুরুষ থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সেখানে প্রচলিত ছিলো পাঁচ ধরনের বিয়ে : (১) নারীর যদি পিতামাতার সম্মতিতে বিয়ে হতো, তাহলে তাকে বলা হতো ‘সুবিধাপ্রাপ্ত স্ত্রী’; তার সন্তানেরা হতো তার স্বামীর। (২) যদি নারীটি পিতামাতার একমাত্র সন্তান হতো, তাহলে তার প্রথম সন্তানকে পাঠিয়ে দেয়া হতো তার পিতামাতার কাছে, যাতে সে তাদের মেয়ের স্থান নিতে পারে; এর পর স্ত্রীটি হতো ‘সুবিধাপ্রাপ্ত স্ত্রী’। (৩) যদি কোনো পুরুষ অবিবাহিত অবস্থায় মারা যেতো, তার পরিবার পণ দিয়ে বিয়ের মাধ্যমে বাইরে থেকে গ্রহণ করতে কোনো নারীকে, তাকে বলা হতো ‘পোষ্য স্ত্রী’; তার অর্ধেক সন্তান হতো মৃতের, অর্ধেক হতো তার জীবিত স্বামীর। (৪) নিঃসন্তান কোনো বিধবা যদি বিয়ে বসতো, তাকে বলা হতো ‘বাঁদী স্ত্রী’; তার সন্তানদের অর্ধেক দিতে হতো তার মৃত স্বামীকে। (৫) যদি কোনো নারী পিতামাতার সম্মতি ছাড়া বিয়েবসতো, তাহলে সে পিতামাতার সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হতো না, যতো দিন না তার জ্যেষ্ঠ পুত্র বয়োপ্রাপ্ত হয়ে নিজের মাকে তার পিতার কাছে ‘সুবিধাপ্রাপ্ত স্ত্রী’ হিসেবে দান করতো; এর আগেই স্বামী মারা গেলে তাকে অপ্রাপ্তবয়স্ক বলে গণ্য করা হতো এবং রাখা হতো কারো কর্তৃত্বে। প্রত্যেক পুরুষই যাতে উত্তরাধিকারী রেখে যেতে পারে পোষ্য স্ত্রী ও বাঁদী স্ত্রীর প্রথা সে-ব্যবস্থা করে, ওই সন্তানদের সাথে সে যদিও রক্তের সম্পর্কে জড়িত নয়। আমি ওপরে যা বলছিলাম এটা সেকথা প্রমাণ করে; পুরুষেরা যাতে মৃত্যুর পরও পৃথিবীতে ও পাতাললোকে অর্জন করতে পারে অমরতা, সেজন্যেই পুরুষেরা উদ্ভাবনা করেছিলো এ-সম্পর্কটি।
মিশরেই শুধু নারীরা ছিলো সবচেয়ে সুবিধাজনক অবস্থায়। দেবী মাতারা স্ত্রী হওয়ার পরেও রক্ষা করতো তাদের মর্যাদা; দম্পতি ছিলো ধর্মীয় ও সামাজিক একক; নারীদের মনে করা হতো পুরুষের সঙ্গী ও পরিপূরক। তার ইন্দ্রজাল এতো কম বৈরি ছিলো যে এমনকি অজাচারের ভীতিকেও জয় করা হয়েছিলো এবং নির্দ্বিধায় সম্মিলিত করা হয়েছিলো বোন ও স্ত্রীকে। নারীদের ছিলো পুরুষদের মতো একই অধিকার, বিচারালয়ে ছিলো একই ক্ষমতা; নারী উত্তরাধিকারী হতো, সম্পত্তির মালিক হতো। এ-অসাধারণ সৌভাগ্যজনক পরিস্থিতি অবশ্য আকস্মিকভাবে ঘটে নি : এটা ঘটেছে এ-কারণে যে প্রাচীন মিশরে ভূসম্পত্তির মালিক ছিলো রাজা এবং উচ্চবর্ণের পুরোহিত ও সৈনিকেরা; সাধারণ মানুষেরা শুধু ভূমি ব্যবহার করতে এবার শস্য ভোগ করতে পারতো–ভূমি থাকতো মালিকদের সাথে অচ্ছেদ্য। উত্তরাধিকারপ্রাপ্ত সম্পত্তির বিশেষ মূল্য ছিলো না, এবং ভাগ করে দিতে কোনো অসুবিধা হতো না। উত্তরাধিকারপ্রাপ্ত বিষয়সম্পত্তি না থাকায় নারী রক্ষা করতে পারতো মানুষের মর্যাদা। বাধ্যবাধকতা ছাড়াই সে বিয়ে করতো এবং বিধবা হয়ে গেলে আবার নিজের ইচ্ছেমতো বিয়ে করতো। পুরুষেরা বহুবিবাহ করতো; সব সন্তানই যদিও ছিলো বৈধ, তবু একজনই থাকতোপ্রকৃত স্ত্রী, যে একা স্বামীর সাথে ধর্মকর্মে সঙ্গী ছিলো ও বৈধভাবে বিবাহিত ছিলো; অন্যরা ছিলো অধিকারহীন দাসী মাত্র। বিয়ের ফলে প্রধান স্ত্রীর মর্যাদা বদল ঘটতো না : সে মালিক থাকতো তার সম্পত্তির এবং স্বাধীনভাবে ব্যবসা করতে পারতো। যখন ফারাও বোখোরিস ব্যক্তিমালিকানা প্রবর্তন করে, তখন নারীরা এতো শক্তিশালী অবস্থানে ছিলো যে সে তাদের উৎখাত করতে পারে নি; বোখোরিস সূচনা করে চুক্তির কালের, এবং বিয়ে হয়ে ওঠে একটি চুক্তি।
ছিলো তিন ধরনের বিয়ের চুক্তি : একটি ছিলো দাসীত্বমূলক বিয়ে; নারীটি হতে পুরুষটির সম্পত্তি, তবে অনেক সময় নির্দেশিত থাকতো যে পুরুষটির আর কোনো উপপত্নী থাকবে না; একই সময়ে বৈধ স্ত্রীকে গণ্য করা হতোপুরুষটির সমান, এবং তাদের সমস্ত সম্পত্তিতে ছিলো তাদের সমান অধিকার; প্রায়ই বিবাহবিচ্ছেদের সময় স্বামীটি স্ত্রীকে কিছু অর্থ দিতে সম্মত হতো। এ-প্রথা থেকে পরে উদ্ভূত হয় এক ধরনের চুক্তি, যা বিশেষভাবে সুবিধাজনক ছিলোস্ত্রীটির জন্যে : স্বামীটি স্ত্রীটির ওপর পোষণ করতো এক কৃত্রিম আস্থা। ব্যভিচারের দণ্ড ছিলো কঠোর, কিন্তু উভয়পক্ষেরই ছিলো বিবাহবিচ্ছেদের স্বাধীনতা। এসব চুক্তি প্রয়োগ প্রবলভাবে হ্রাস করে বহুবিবাহ; নারীরা সম্পদের ওপর একচেটে অধিকার ভোগ করে ও উত্তরাধিকারসূত্রে দিয়ে যায় তাদের সন্তানদের, যার ফলে দেখা দেয় একটি ধনিকতান্ত্রিক শ্ৰেণী। টলেমি ফিলোপাতের আদেশ জারি করে যে নারীরা আর তাদের স্বামী কর্তৃক প্রদত্ত ক্ষমতা ছাড়াসম্পত্তি হস্তান্তর করতে পারবে না, এটা তাদের পরিণত করে চিরঅপ্রাপ্তবয়স্ক মানুষে। তবে এমনকি যখনও তাদের ছিলো একটি বিশেষাধিকারপ্রাপ্ত মর্যাদা, প্রাচীন বিশ্বে যা ছিলো অনন্য, তখনও নারীরা সামাজিকভাবে পুরুষের সমতুল্য ছিলো না। ধর্মে ও শাসনকার্যে অংশী হয়ে তারা রাজপ্রতিভূ হিসেবে কাজ করতে পারতো, তবে ফারাও ছিলো পুরুষ; পুরোহিত ও সৈনিকেরা ছিলো পুরুষ; বাইরের কর্মকাণ্ডে তারা পালন করতো গৌণ ভূমিকা; এবং পারিবারিক জীবনে তাদের কাছে দাবি করা হতো পারস্পরিকতাহীন আনুগত্য।
গ্রিকদের রীতি ছিলো অনেকটা প্রাচ্যদেশের মতোই; তবে তাদের মধ্যে বহুবিবাহ ছিলো না। কিন্তু কেনো, তা অজ্ঞাত। এটা সত্য যে একটা হারেম রাখা সব সময়ই ব্যয়বহুল : এটা সম্ভব মহিমামণ্ডিত সলোমনের পক্ষে, আরব্যরজনীর সুলতানদের পক্ষে, সেনাপতি, ধনিকদের পক্ষে, যারা মত্ত হতে পারতো কোনো বিশাল হারেমের বিলাসব্যসনে; গড়পরতা মানুষ তিন-চারটি স্ত্রী নিয়েই সন্তুষ্ট ছিলো; চাষীদের খুব কম সময়ই থাকতো দুটির বেশি স্ত্রী। এছাড়াও– মিশর বাদে, যেখানে কোনো বিশেষ ব্যক্তিমালিকানাধীন বিষয়সম্পত্তি ছিলো না–উত্তরাধিকারপ্রাপ্ত বিষয়সম্পত্তিকে অখণ্ডিত রাখার জন্যে পৈতৃক সম্পত্তিতে জ্যেষ্ঠ পুত্রকে দেয়া হয় বিশেষ অধিকার। এর ফলে স্ত্রীদের মধ্যে গড়ে ওঠে একটা স্তরক্রম, অন্যদের তুলনায় প্রধান উত্তরাধিকারীর মাতা লাভ করে বিশেষ মর্যাদা। যদি স্ত্রীর নিজের থাকতো কোনো সম্পত্তি, যদি সে পেতো কোনো পণ, তাহলে স্বামীর কাছে সে গণ্য হতো একজন ব্যক্তি হিশেবে : স্বামীটি স্ত্রীর সাথে জড়িত হতো এক ধর্মীয় ও একান্তু বন্ধনে।
সন্দেহ নেই এ-পরিস্থিতির ফলেই মাত্র একটি স্ত্রীকে স্বীকৃতি দেয়ার প্রথা গড়ে উঠেছিলো। কিন্তু সত্য হচ্ছে যে গ্রিক নাগরিকেরা বাস্তবে ছিলো বহুবিবাহী, কেননা তারা তাদের কামনা চরিতার্থ করতে পারতো নগরের বেশ্যাদের সাথে এবং তাদের গাইনিকিউমের দাসীদের সাথে। ‘আত্মার সুখের জন্যে আমাদের আছে গণিকা,’ বলেছেন দিমোসথিনিস, ‘কামসুখের জন্যে আছে উপপত্নী, এবং পুত্রলাভের জন্যে আছে স্ত্রীরা।‘ স্ত্রী যখন রুগ্ন, অসুস্থ, গর্ভবতী, বা প্রসবের পর সেরে উঠতে থাকতো, তখন গৃহস্বামীর শয্যায় স্ত্রীর বদলে স্থান পেতো উপপত্নী; তাই গাইনিকিউম আর হারেমের মধ্যে খুব বেশি পার্থক্য ছিলো না। অ্যাথেন্সে স্ত্রী বন্দী থাকতো অবরোধের মধ্যে, বন্দী থাকতো কঠোর আইনের বিধানে, এবং তাদের ওপর চোখ রাখতো বিশেষ ম্যাজিস্ট্রেটরা। সে সারাজীবনভর থাকতো চির-অপ্রাপ্তবয়স্ক, থাকতো একজনঅভিভাবকের কর্তৃত্বে; সে তার পিতা হতে পারতো, স্বামী হতে পারতো, স্বামীর উত্তরাধিকারী হতে পারতো, আর এসবের অবর্তমানে অভিভাবক হতো রাষ্ট্র, যার প্রতিনিধিত্ব করতো সরকারি কর্মকর্তারা। এরা ছিলো তার প্রভু, এবং কোনো বস্তুর মতো সে ছিলো তাদের অধিকারে; আর অভিভাবকদের কর্তৃত্ব প্রসারিত ছিলো তার শরীর ও সম্পত্তি পর্যন্ত। অভিভাবক ইচ্ছেমতো কর্তৃত্ব হস্তান্তরিত করতে পারতো : পিতা তার মেয়ের বিয়ে দিতে পারতো বা মেয়েকে দত্তক দিতে পারতো; স্বামী তার স্ত্রীকে ছেড়ে দিয়ে আরেক স্বামীর কাছে হস্তান্তরিত করতে পারতো। তবে গ্রিক আইন স্ত্রীর জন্যে একটা পণের ব্যবস্থা করতো, যা ব্যয় হতো তার ভরণপোষণে এবং বিয়ে ভেঙে গেলে সেটার সবটা তাকে ফিরিয়ে দিতে হতো; আইন বিশেষ ক্ষেত্রে বিবাহবিচ্ছেদের অধিকার দিতে স্ত্রীকে; তবে এগুলোই ছিলো তাকে দেয়াসমাজের একমাত্র নিশ্চয়তা। সমস্ত ভূসম্পত্তি উত্তরাধিকারসূত্রে পেতো পুত্ররা।
পুরুষপরম্পরা অনুসারে উত্তরাধিকারভিত্তিক সমাজে একটি সমস্যা দেখা দেয়, তা হচ্ছে যদি কোনো পুরুষের উত্তরাধিকারী না থাকে তখন ভূসম্পত্তির কী ব্যবস্থা হবে। গ্রিকরা এপিক্লেরেৎ নামে একটি প্রথা তৈরি করে : নারী উত্তরাধিকারীকে অবশ্যই তার পিতার পরিবারের জ্যেষ্ঠতম আত্মীয়কে বিয়ে করতে হতো; এভাবে পিতা তার জন্যে যে-সম্পত্তি রেখে যেতো, তা থেকে যেতো একই দলের সন্তানদের মধ্যে। এপিক্লেরে নারী উত্তরাধিকারী ছিলো না। ছিলোপুরুষ উত্তরাধিকারী উৎপাদনের উপায় মাত্র। এ প্রথা তাকে নিক্ষেপ করে পুরুষের দয়ার তলে, কেননা তাকে যান্ত্রিকভাবে দান করা হতো পরিবারের প্রথম জন্মপ্রাপ্ত পুরুষটির কাছে, যে অধিকাংশ সময়ই হতো বৃদ্ধ।
যেহেতু নারীপীড়নের কারণ নিহিত পরিবারকে স্থায়িত্ব দেয়ার ও উত্তরাধিকারপ্রাপ্ত বিষয়সম্পত্তি অখণ্ড রাখার বাসনার মধ্যে, তাই নারী পরিবার থেকে যতোখানি মুক্তি পায় ততোখানি মুক্তি পায় পরাধীনতা থেকে; যদি কোনোসমাজ ব্যক্তিমালিকানা নিষিদ্ধ করার সাথে পরিবার প্রথাও অস্বীকার করে, তাহলে তাতে নারীর ভাগ্য বেশ উন্নত হতে বাধ্য। স্পার্টায় প্রচলিত ছিলো সংঘব্যবস্থা এবং এটাই ছিলো একমাত্র গ্রিক নগর, যেখানে নারীর অবস্থা ছিলো প্রায়পুরুষের অবস্থার সমান। মেয়েদের লালনপালন করা হতো ছেলেদের মতো; স্ত্রী তার ঘরে বন্দী থাকতো না; আর স্বামী স্ত্রীর সাথে দেখা করতে পারতো চুপিসারে, রাতের বেলা; এবং স্ত্রীর ওপর স্বামীর অধিকার এতো কম ছিলো যে সুসন্তান জন্মানোর প্রয়োজনে অন্য যে-কোনো পুরুষ তার স্ত্রীর সাথে মিলনের দাবি করতে পারতো। যখন উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত বিষয়সম্পত্তি লোপ পায়, তখন ব্যভিচারের ধারণাও লোপ পায়; সব সন্তানের মালিক হয় নগর; আর নারীদের তখন উৎসাহের সঙ্গে এক প্রভুর দাসী করে রাখা হয় না; বা, উল্টোভাবে, বলা যায় নাগরিকদের কোনো ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও বিশেষ পূর্বপুরুষ না থাকায় তাদের মালিকানায় কোনো নারীও থাকে না। নারীদের ভোগ করতে হয়েছে মাতৃত্বের দাসত্বশৃঙ্খল, যেমন পুরুষদের ভোগ করতে হয়েছে যুদ্ধের দাসত্বশৃঙ্খল; তবে এ-নাগরিক দায়িত্ব পূরণের বাইরে তাদের স্বাধীনতার ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয় নি।
যে-মুক্ত নারীদের কথা বলা হলো, তাদের ও পরিবারের দাসীদের পাশাপাশি গ্রিসে ছিলো বেশ্যারাও। প্রাচীন মানুষেরা অতিথিবৎসল বেশ্যাবৃত্তিও পালন করতো—অচেনা অতিথিদের আপ্যায়ন করা হতো নারী দিয়ে, নিঃসন্দেহে এর ছিলো অতীন্দ্রিয় যৌক্তিকতা–এবং ছিলো ধর্মীয় বেশ্যাবৃত্তি, যার লক্ষ্য ছিলো উর্বরতার রহস্যময় শক্তি সবার মঙ্গলের জন্যে অবারিত করে দেয়া। প্রথাটি প্রচলিত ছিলো ধ্রুপদী মহাযুগে। হিরোদোতাস বর্ণনা করেছেন যে খ্রিপূ পঞ্চম শতকে ব্যাবিলনের প্রতিটি নারী বাধ্য ছিলো জীবনে একবার মুদ্রার বিনিময়ে মাইলিত্তার মন্দিরে কোনো অচেনা পুরুষের কাছে দেহদানে, যে-অর্থ সে দান করতো মন্দিরে; তারপর সে ঘরে ফিরে যেতো সতীজীবন যাপনের জন্যে। আধুনিক কালেও ধর্মীয় বেশ্যাবৃত্তি প্রচলিত ছিলো মিশরের নর্তকীদের মধ্যে ও ভারতের বাঈজিদের মধ্যে, যারা ছিলো সম্ভ্রান্ত অভিজাত গায়িকা ও নর্তকী। তবে সাধারণত মিশরে, ভারতে, পশ্চিম এশিয়ায় ধর্মীয় বেশ্যাবৃত্তি পরিণত হয় বৈধ ভাড়াটে বেশ্যাবৃত্তিতে, কেননা যাজকতন্ত্র দেখতে পায় যে ব্যবসাটা বেশ লাভজনক। এমনকি হিব্রুদের মধ্যেও ভাড়াটে বেশ্যাবৃত্তি প্রচলিত ছিলো।
গ্রিসে, বিশেষ করে সমুদ্র-উপকূল ধরে, দ্বীপগুলোতে, ও ভ্রমণকারীতে পরিপূর্ণ নগরগুলোতে, ছিলো অনেক মন্দির, যেখানে পাওয়া যেতো পিন্ডারের ভাষায় ‘আগন্তুকদের প্রতি আতিথ্যপরায়ণ যুবতীদের’। তাদের উপার্জিত অর্থ যেতো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে–অর্থাৎ, পুরোহিতদের কাছে ও পরোক্ষভাবে তাদের ব্যয়নির্বাহের জন্যে। বাস্তবে ছিলো–কোরিন্থ ও অন্যান্য স্থানে নাবিকদের ও ভ্রমণকারীদের কামক্ষুধা মেটানোর ভণ্ডামো, এবং এটা পরিণত হয়েছিলো অর্থগৃধ্নু বা ভাড়াটে বেশ্যাবৃত্তিতে। সোলোন একে পরিণত করে বেশ্যাবৃত্তির প্রতিষ্ঠানে। সে এশীয় ক্রীতদাসী কিনতে থাকে এবং তাদের আটকে রাখে অ্যাথেন্সে অবস্থিত ভেনাসের মন্দিরের কাছাকাছি ‘সংকেতস্থল’-এ, যেগুলো বন্দর থেকে বেশি দূরে ছিলো না এর পরিচালনার ভার ছিলো পর্নোত্রোপোই-এর হাতে, যারা পালন করতো প্রতিষ্ঠানের আর্থিক পরিচালনার দায়িত্ব। প্রতিটি মেয়ে মজুরি পেতো, আর শুদ্ধ লাভটুকু যেতো রাষ্ট্রের কোষে। পরে খোলা হয় ব্যক্তিমালিকানাধীন বেশ্যালয়, কাপেইলিম্বা, যাতে একটি লাল উল্কি ব্যবহৃত হতো ব্যবসার চিহ্ন হিসেবে। অনতিপরেই ক্রীতদাসী ছাড়াও নিম্ন শ্রেণীর গ্রিক নারীদেরও গ্রহণ করা হয় সেখাকার বাসিন্দা হিশেবে। ওই ‘সংকেতস্থল’গুলোকে এতো আবশ্যক গণ্য করা হয় যে সেগুলো স্বীকৃতি পায় শরণলাভের অলঙ্ঘনীয় স্থান বলে। তবে বেশ্যারা ছিলো মর্যাদাহীন, তাদের কোনোসামাজিক অধিকার ছিলো না, তাদের সন্তানদের অব্যাহতি দেয়া হতো তাদের ভরণপোষণ থেকে, তাদের পরতে হতোনানা রঙের একটি বিশেষ পোশাক, সাজতে হতো কুসুমস্তবকে, এবং কুঙ্কুম দিয়ে চুল রাঙাতে হতো।
ওই ‘সংকেতস্থল’-এর নারীরা ছাড়াও ছিলো স্বাধীন বারবনিতারা, যাদের ফেলা যায় তিনটি শ্রেণীতে। পতিতারা, যারা ছিলো আজকের অনুমতিপ্রাপ্ত বেশ্যাদের মতো; বাঈজিরা, যারা ছিলো নর্তকী ও বংশীবাদক; এবং অভিজাত গণিকারা, বিলাসিনী নারীরা, যাদের অধিকাংশই আসতো কোরিন্থ থেকে, যারা গ্রিসের সুবিখ্যাত পুরুষদের সাথে গড়েতুলতো স্বীকৃত সম্পর্ক, পালন করতো আধুনিক কালের ‘বিশ্বরমণীর’ মতো ভূমিকা। প্রথম শ্রেণীটি সংগৃহীত হতো মুক্তিপ্রাপ্ত নারীদের ও নিম্ন শ্রেণীর গ্রিক মেয়েদের মধ্য থেকে; তারা শোষিত হতো দালালদের দ্বারা এবং যাপন করতোদুর্বিষহ জীবন। দ্বিতীয় শ্রেণীটি গায়িকা হিসেবে প্রতিভার জন্যে কখনো কখনো ধনাঢ্য হয়ে উঠতো; এদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত লামিয়া, যে ছিলো মিশরের এক টলেমির উপপত্নী, পরে যে হয় টলেমিকে পরাস্তকারী মেসিদনিয়ার রাজা দিমিত্রিয়াস পোলিওরকেতেসের উপপত্নী। তৃতীয় ও শেষ শ্ৰেণীটির অনেকে গৌরব অর্জন করেছে তাদের প্রেমিকদের সাথে। নিজেদের ও তাদের ভাগ্যকে স্বাধীনভাবে চালানোর অধিকারী ছিলো তারা, ছিলো বুদ্ধিমান, সুসংস্কৃত, কলানিপুণ; তাদের সঙ্গদানের মোহিনীশক্তিতে মুগ্ধ ছিলো যারা, তাদের কাছে তারা গণ্য হতো ব্যক্তিরূপে। তারা যেহেতু মুক্তি পেয়েছিলো পরিবার থেকে এবং বাস করতো সমাজের প্রান্তিক এলাকায়, তারা মুক্তি পেয়েছিলো পুরুষ থেকেও; তাই পুরুষদের কাছে তারা গণ্য হতো সহচর, প্রায় সমতুল্য, মানুষ হিসেবে। আস্পাসিয়া, ফ্রাইনে, লায়াসের মধ্যে রূপ লাভ করেছিলো পরিবারের শ্রদ্ধেয় মাতার ওপর স্বাধীন নারীর শ্রেষ্ঠত্ব।
এসব উজ্জ্বল ব্যতিক্রম বাদ দিলে, গ্রিসের নারীদের পরিণত করা হয়েছিলো আধাক্রীতদাসীতে, যাদের এমনকি অভিযোগ করার স্বাধীনতাও ছিলো না। ধ্রুপদী মহাযুগে নারীদের কঠোরভাবে অবরুদ্ধ করে রাখা হতো গাইনিকিউমে, নারীমহলে; পেরিক্লেস বলেছিলো সে-ই শ্রেষ্ঠ নারী, যার সম্পর্কে পুরুষেরা সবচেয়ে কম কথা বলে। প্লাতোরাষ্ট্রপরিচালনায় মহিলাদের অন্তর্ভুক্ত করার ও মেয়েদের মানবিক শিক্ষা দেয়ার প্রস্তাব দিলে আরিস্তোফানেস তীব্র গালিগালাজ করেন তাঁকে। তবে জেনোফোনের মতে স্বামী ও স্ত্রীরা ছিলো পরস্পরের অচেনা, এবং সাধারণত স্ত্রীদের হতে হতো সদাসজাগ গৃহিণী–সতর্ক, মিতব্যয়ী, মৌমাছির মতো পরিশ্রমী, এক আদর্শ তত্ত্বাবধায়ক। নারীদের এ-হীনাবস্থা সত্ত্বেও গ্রিকরা ছিলো প্রচণ্ড নারীবিদ্বেষী। প্রাচীন প্রবচনরচয়িতাদের থেকে ধ্রুপদী লেখকেরা পর্যন্ত, নারী ছিলোধারাবাহিক আক্রমণের বিষয়; তবে তারা চরিত্রহীনতার জন্যে আক্রান্ত হতো না। কেননা এদিকে প্রচন্ডভাবে নিয়ন্ত্রণে ছিলো নারী এবং আক্রান্ত হতো না তাদের কামক্ষুধার জন্যেও; বিয়ে যে-বোঝা ও ঝামেলা চাপিয়ে দেয় পুরুষদের ওপর, তারই জন্যে আক্রান্ত হতো নারীরা। দজ্জাল স্ত্রী ও বিবাহিত জীবনের দুঃখযন্ত্রণার বিরুদ্ধে গ্রিগ নাগরিকদের সমস্ত ক্ষোভ রূপায়িত হয়েছে জানতিপ্পির মধ্যে।
রোমে পরিবার ও রাষ্ট্রের মধ্যে বিরোধই নির্ধারণ করে দেয় নারীর ইতিহাস। এত্রুস্কান সমাজ ছিলো মাতৃধারার, এবং সম্ভবত রাজতন্ত্রের কালেও রোমে প্রচলিত ছিলো মাতৃধারা ব্যবস্থায় গোত্রবহির্ভুত বিবাহ : লাতিন রাজারা উত্তরাধিকারসূত্রে একে অন্যের হাতে ক্ষমতা দেয়নি। এটা নিশ্চিতভাবে ঠিক যে তারকুইনের মৃত্যুর পরই প্রতিষ্ঠিত হয়পিতৃতান্ত্রিক কর্তৃত্ব; কৃষিসম্পত্তি, ব্যক্তিমালিকানাধীন ভূমি–সুতরাং পরিবার–হয় সমাজের ভিত্তির একক। নারীকে শক্তভাবে জড়িত করা হয় উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত বিষয়সম্পত্তির সাথে এবং তাই পরিবারের বংশের সাথে। গ্রিক নারীদের যতোটুকু নিরাপত্তা দেয়া হয়েছিলো, রোমের আইন সেটুকু থেকেও বঞ্চিত করে নারীদের; সে যাপন করে আইনগতভাবে সামর্থহীনের ও দাসত্বের জীবন। তাকে বাদ দেয়া হয় রাষ্ট্রীয় ব্যাপার থেকে, তার জন্যে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ হয় সমস্ত ‘পুরুষসুলভ’ পদ; এবং সামাজিক জীবনে সে হয় স্থায়ীভাবে অপ্রাপ্তবয়স্ক। তাকে রাখা হয় একজন অভিভাবকের কর্তৃত্বে।
নারীর প্রথম অভিভাবক ছিলো তার পিতা; পিতার অনুপস্থিতিতে পুরুষ আত্মীয়রা পালন করতো এ-দায়িত্ব। যখন নারীর বিয়ে হতো, সে চলে যেতো স্বামীর হাতে; ছিলো তিন ধরনের বিয়ে : কনফেরাতিও, এতে দম্পতিটি ফ্লেমেন দায়ালিস-এর সামনে জুপিটারের বেদিমূলে উৎসর্গ করতো একটি আটার পিঠে; কোএম্পতিও, এটা ছিলো এক কাল্পনিক বিক্রয়, যাতে কৃষিজীবী পিতা স্বামীর কাছে বিক্রি করতো মেয়েকে; এবং উসুস, এটা ছিলো এক বছরব্যাপী সহবাসের ফল। এসবই ছিলো ‘মানু’, যার অর্থ হচ্ছে পিতা বা অন্য কোনো অভিভাবকের বদলে স্বামীর কর্তৃত্ব লাভ; স্ত্রী হয়ে উঠতো তার কোনো কন্যার মতোই, এবং এরপর স্ত্রীর দেহ ও সম্পত্তির ওপর স্বামীর থাকতো পূর্ণ অধিকার। কিন্তু যেহেতু রোমের নারীরা একই সাথে অন্তর্ভুক্ত ছিলো পিতার ও স্বামীর বংশে, তাই দ্বাদশ বিধি আইনের কাল থেকে দেখা দেয় বিরোধ, যা ছিলো তাদের আইনগত মুক্তির মূলে। আসলে মানু সম্বলিত বিয়ে নারীর পৈতৃক অভিভাবকদের সর্বস্বান্ত করে তোলে। পৈতৃক অভিভাবকদের রক্ষার জন্যে প্রবর্তিত হয় সিনে মানু নামে এক ধরনের বিয়ে; এতে নারীর সম্পত্তি থেকে যায় তার অভিভাবকের কর্তৃত্বে, স্বামী শুধু পায় নারীটির দেহের অধিকার। এমনকি এ-ক্ষমতাও স্বামীকে ভাগ করে নিতে হতো স্ত্রীর পিতার সাথে, যার ছিলো কন্যার ওপর চূড়ান্ত কর্তৃত্ব। গার্হস্থ্য বিচারপরিষদকে ক্ষমতা দেয়াহয়েছিলো সে-সব বিবাদ মিটিয়ে দেয়ার, যেগুলোর ফলে স্বামী ও পিতার মধ্যে বিরোধ বাঁধতে পারতো; এ-বিচারপরিষদ স্ত্রীকে অনুমতি দিতো পিতার পক্ষ থেকে স্বামীর প্রতি বা স্বামীর পক্ষ থেকে পিতার প্রতি পুনর্বিচার প্রার্থনার; এবং নারী এদের কারো অস্থাবর সম্পত্তি ছিলো না। এছাড়াও, যদিও পরিবারসংস্থা ছিলো খুবই শক্তিশালী, পিতা ও গৃহস্বামী সবার কাছে সে গণ্য হতো নাগরিক বলে। তার কর্তৃত্ব ছিলো অসীম, সে ছিলো স্ত্রী ও সন্তানদের নিরঙ্কুশ শাসক; তবে এরা তার সম্পত্তি ছিলো না; বরং সর্বসাধারণের মঙ্গলের জন্যে সে নিয়ন্ত্রণ করতো তাদের জীবন। স্ত্রী, যে পৃথিবীতে আনতো সন্তান এবং যার গৃহস্থালির কাজের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিলো খামারের কাজ, সে ছিলো দেশের জন্যে অত্যন্ত মঙ্গলজনক এবং তাকে ভক্তি করা হতো গভীরভাবে।
এখানে আমরা একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ সত্য লক্ষ্য করি, যার মুখোমুখি হবো আমরা ইতিহাসের ধারাব্যাপী : বিমূর্ত অধিকার নারীর বাস্তব পরিস্থিতি নির্দেশের জন্যে যথেষ্ট নয়; এটা বড়ো অংশে নির্ভর করে তার অর্থনীতিক ভূমিকার ওপর; এবং অনেক সময় বিমূর্ত অধিকার ও বাস্তুব ক্ষমতার ভিন্নতা ঘটে ব্যস্তানুপাতিকভাবে। আইনে গ্রিক নারীদের থেকে বেশি দাসত্ববন্ধনে আবদ্ধ থাকা সত্ত্বেও বাস্তবে রোমের নারীরা অনেক বেশি গভীরভাবে অঙ্গীভূত ছিলোসমাজের সাথে। গাইনিকিউমে গুপ্ত থাকার বদলে গৃহে সে বসতো বসতবাড়ির কেন্দ্রস্থলে; সে দাসদের কাজ পরিচালনা করতো; সে সন্তানদের শিক্ষা দেখাশুনো করতো, এবং বিশেষ বয়স পর্যন্ত তাদের প্রভাবিত করতো। সে স্বামীর সঙ্গে ভাগ করে নিতো শ্রম, তাকে গণ্য করা হতো সম্পত্তির সহমালিক। স্যাবাইন নারী লুক্ৰেতিয়া ও ভার্জিনিয়ার মতো কিংবদন্তি থেকে বোঝা যায় নারীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতো ইতিহাসে; কোরিওলানাস আত্মসমর্পণ করেছিলো তার মা ও স্ত্রীর অনুনয়ের কাছে; রোমান গণতন্ত্রের বিজয় অনুমোদন করে লুকিনিয়াসের আইন তৈরি হয়েছিলো তার স্ত্রীর প্রেরণায়। ‘সর্বত্র পুরুষেরা শাসন করে নারীদের ওপর’, বলেছিলেন কাতো, ‘আর আমরা যারা শাসন করি সব মানুষকে, তারাই শাসিত হই আমাদের নারীদের দিয়ে’।
নারী পেয়েছিলো তার স্বাধীনতার একটি নিশ্চয়তাও; পিতা তাকে পণ দিতে বাধ্য ছিলো। বিয়ে ভেঙে গেলে এ-পণ তার পুরুষ আত্মীয়দের কাছে ফেরত যেতো না, এবং এটা তার স্বামীর অধিকারেও কখনো থাকতো না; নারীটি যে-কোনো সময় বিবাহচ্ছেদের মাধ্যমে এটা স্বামীর কাছে থেকে ফেরত চাইতে পারতো, ফলে তার কাছে অনুগ্রহ প্রার্থনা ছাড়া স্বামীর কোনো উপায় থাকতো না। প্লউতুসের মতে, ‘পণ গ্রহণ করে, সে বিক্রি করে দিয়েছে তার ক্ষমতা’। প্রজাতন্ত্রের সমাপ্তি থেকে মাতাও সন্তানদের কাছে পিতার সমান মর্যাদার অধিকারী হয়ে ওঠে; কর্তৃত্ব লাভ করে বা স্বামী যদি হতো দুরাচারী, সে পেতে সন্তানদের অধিকার। হাদ্রিয়ানের কালে সেনেটের একটি আইনে তাকে ক্ষমতা দেয়া হয়। যদি তার তিনটি সন্তান থাকে এবং তাদের কেউ সন্তানহীন মারা যায়–যদি তারা মৃত্যুর আগে ইচ্ছেপত্র রেখে না যায়, তাহলে তাদের প্রত্যেকের সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হওয়ার অধিকার সে পায়। মার্কুস অউরেলিউসের শাসনকালে রোমন পরিবারের বিবর্তন পূর্ণতা লাভ করে : ১৭৮ অব্দ থেকে, পুরুষ আত্মীয়দের ওপর জয়ী হয়ে, সন্তানেরা হয় তাদের মায়ের উত্তরাধিকারী; তারপর থেকে পরিবার গড়ে ওঠে কনইউঙ্কতিও সাঙ্গিউনিস-এর ভিত্তির ওপর; এবং মায়ের মর্যাদা হয় পিতার সমান; কন্যারা উত্তরাধিকারী হয় ভাইদের মতোই।
তবে ওপরে আমি যে-বর্ণনা দিয়েছি, তার বিরোধী একটি প্রবণতা দেখতে পাই রোমান আইনের ইতিহাসে; পরিবারের মধ্যে নারীদের স্বাধীন করেও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা তাকে আবার নিয়ে নেয় নিজের কর্তৃত্বে; এটা তাকে আইনগত অধিকারহীন করে তোলে নানাভাবে।
এটা সত্য যদি নারী হয় ধনী ও স্বাধীন, তাহলে লাভ করে এক পীড়াদায়ক গুরুত্ব; তাই দরকার হয়ে পড়ে তার কাছে থেকে এক হাত দিয়ে তা ফিরিয়ে নেয়া, অন্য হাত দিয়ে তাকে যা দেয়া হয়েছে। যখন হানিবল হুমকি দিচ্ছিলো রোম আক্রমণের, তখন রোমের নারীদের বিলাসিতা নিষিদ্ধ করে গৃহীত হয় ওপ্পিয়ান আইন; বিপদ কেটে গেলে রোমেরা ওই আইন বাতিলের দাবি জানায়। এক বক্তৃতায় কাতো এটা রাখার দাবি করেন; কিন্তু ময়দানে মাতৃদের উপস্থিতিতে দিনটি যায় তাঁর বিপক্ষে। পরে কঠোরতর নানা আইন প্রবর্তনের প্রস্তাব করা হয়, কিন্তু তাতে তারা সফল হয় নি। এগুলো ধাপ্পাবাজির থেকে বেশি কিছু করতে পারে নি। শুধু বিজয়ী হয় সেনেটের ভেল্লেয়ীয় আইন, যাতে নারীদের নিষিদ্ধ করা হয় অন্যদের ‘মাধ্যস্থ করা’–অর্থাৎ অন্যদের সাথে চুক্তি করা নিষিদ্ধ করা হয়–যা তাকে বঞ্চিত করে প্রায় সব আইনসঙ্গত অধিকার থেকে। এভাবে যখন নারী লাভ করছিলো সম্পূর্ণ মুক্তি, তখনই দৃঢ়ভাবে জ্ঞাপন করা হয় তার লৈঙ্গিক নিকৃষ্টতা, যাতে পাই পুরুষপ্রাধান্যের যৌক্তিকতা প্রতিপাদনের এক অসাধারণ উদাহরণ, যে সম্পর্কে আমি বলেছি : যখন কন্যা, স্ত্রী, বা বোন হিসেবে খর্ব করা হয় নি নারীর অধিকার, তখন লিঙ্গানুসারে অস্বীকার করা হয়পুরুষের সাথে তার সাম্য; প্রভুত্বমূলক দাম্ভিক রীতিতে অভিযুক্ত করা হয় ‘মূঢ়তা, লিঙ্গের দুর্বলতা’কে।
সত্য হচ্ছে যে মাতৃরা তাদের নতুন স্বাধীনতার বিশেষ সদ্ব্যবহার করতে পারে নি; তবে এও সত্য যে একে একটি সদর্থক ব্যাপারে পরিণত করার অধিকার তাদের দেয়া হয় নি। এ-দুটি বিরোধী প্রবণতার ফলাফল- একটি ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী প্রবণতা, যা নারীকে মুক্ত করে পরিবার থেকে এবং স্থিতিমূলক প্রবণতা, যা ব্যক্তি হিশেবে তার স্বায়ত্তশাসনকে খর্ব করে, তার পরিস্থিতিকে করে তোলে ভারসাম্যহীন। উত্তরাধিকারসূত্রে সে সম্পত্তি লাভ করতে পারতো, পিতার সাথে সন্তানদের ওপর তার ছিলো সমান অধিকার, সে সাক্ষ্য দিতে পারতো। পণপ্রথার কল্যাণে সে মুক্তি পেতো দাম্পত্য পীড়ন থেকে, নিজের ইচ্ছেয় সে বিবাহবিচ্ছেদ ও পুনর্বিবাহ করতে পারতো; তবে সে মুক্তি পেয়েছিলো শুধু নেতিবাচক রীতিতে, কেননা তার শক্তিকে প্রয়োগ করার মতো কোনো বাস্তব কাজ তাকে দেয়া হয় নি। আর্থনীতিক স্বাধীনতা থেকে যায় বিমূর্ত, কেননা এটা কোনো রাজনীতিক ক্ষমতা সৃষ্টি করে না। এভাবে এমন ঘটে যে, কর্ম করার সমান সামর্থ্যের অভাবে রোমের নারীরা শুধু বিক্ষোভ প্রদর্শন করে : তুমুল কোলাহলের মধ্যে জড়ো হয় তারা নগর ভরে, বিচারালয় অবরোধ করে, ষড়যন্ত্রের ইন্ধন জোগায়, প্রতিবাদ করে, গৃহযুদ্ধ বাঁধায়; শোভাযাত্রার সময় তারা খুঁজে বের করে দেবমাতার মূর্তি এবং টাইবারের তীর ধরে তাকে বহন করে, এভাবে তারা রোমে চালু করে প্রাচ্য দেবদেবীদের; ১১৪ অব্দে দেখা দেয় ভূষিত কুমারীদের কেলেঙ্কারি এবং তাদের সংঘকে নিষিদ্ধ করা হয়।
যখন পরিবারের বিলুপ্তি পারিবারিক জীবনের প্রাচীন গুণাবলিকে নিরর্থক করে তোলে ও বাতিল করে দেয়, তখন আর নারীর জন্যে থাকে না কোনো প্রতিষ্ঠিত নৈতিকতা, কেননা বাইরের জীবন ও তার নৈতিকতা তার কাছে রয়ে যায়অগম্য। নারীরা বেছে নিতে পারতো দুটি সমাধানের, একটি : তাদের পিতামহীদের মূল্যবোধকে একগুয়েভাবে শ্রদ্ধা করে যেতে পারতো বা কোনো মূল্যবোধকেই স্বীকার
না করতে পারতো। প্রথম শতকের শেষ দিকে ও দ্বিতীয় শতকের শুরুর দিকে আমরা দেখতে পাই যে প্রজাতন্ত্রের কালে যেমন তারা ছিলো তাদের স্বামীদের সঙ্গী ও সহযোগী তেমনভাবেই জীবন চালাচ্ছে বহু নারী : প্লোতিনা অংশী ছিলেন ত্রাজানের গৌরব ও দায়িত্বের; সাবিনা তাঁর জনহিতকর কাজের সাহায্যে নিজেকে এতোটা বিখ্যাত করে তোলেন যে জীবেকালেই মূতিতে মূর্তিতে তাঁকে দেবীত্বে উন্নীত করা হয়; তাইবেরিউসের অধীনে আমির্লিউস স্কারুসের মৃত্যুর পর বেঁচে থাকতে অস্বীকার করেন সেক্সতিনা, এবং পোম্পোনিউস লাবিউসের মৃত্যুর পর পাস্কিয়া; সেনেকার সাথে নিজের রগ কেটে ফেলে পাউলিন; অনুজ প্লিনি বিখ্যাত করে তুলেছেন আরিয়ার ‘এতে ব্যথা লাগছে না পায়েতুস’কে; অনিন্দ্য স্ত্রী ও অনুরক্ত মাতা হিশেবে ক্লদিয়া রিউফিনা, ভার্জিনিয়া, ও সুলপিকিয়াকে প্রশংসা করেছেন মার্তিয়াল। তবে বহু নারী ছিলো, যারা মাতৃত্ব অস্বীকার করেছিলো এবং বিবাহবিচ্ছেদের হার বাড়িয়ে তুলতে সাহায্য করেছিলো। আইন তখনও নিষিদ্ধ করেছে ব্যভিচারকে, তাই অনেক মাতৃ এতো দূর পর্যন্ত গিয়েছিলো যে তারা বেশ্যা হিশেবে তাদের নাম লিখিয়েছে, যাতে তারা চালিয়ে যেতে পারে তাদের ইন্দ্রিয়পরতন্ত্রতা।
ওই সময় পর্যন্ত লাতিন সাহিত্য সব সময়ই নারীদের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়েছে, কিন্তু তার পর ব্যঙ্গলেখকেরা উঠে-পড়ে লাগে তাদের বিরুদ্ধে। আদি প্রজাতন্ত্রে রোমের নারীদের পৃথিবীতে একটা স্থান ছিলো, তবে বিমূর্ত অধিকার ও আর্থনীতিক মুক্তির অভাবে তারা শৃঙ্খলিত ছিলো; পতনের কালের রোমের নারীরা ছিলো ভ্রান্ত মুক্তির উৎপাদন, তাদের ছিলো শূন্যগর্ভ স্বাধীনতা এমন এক বিশ্বে, যেখানে পুরুষেরা ছিলো সর্বময় প্রভু : নারী মুক্ত ছিলো– কিন্তু অহেতুক।