এই নবাবগঞ্জের ইতিহাসে এ এক মর্মান্তিক কাহিনী। জমিদারি উঠে গেছে ইণ্ডিয়া থেকে। সেই ১৯৫৮ সালের আইনে জমিদারি রাখা এখন বেআইনী হয়ে গেছে। কিন্তু নবাবগঞ্জ থেকে বুঝি তা তখনও নিঃশেষ হয় নি। নিঃশেষ হয় নি সেই জমিদারির দাপট। জমি আর তখন জমিদারের নয়, সরকারের। সরকারের বিনা অনুমতিতে বেশি জমি রাখা নিষিদ্ধ। কিন্তু আইন যেমন আছে আইনের ফাঁকও তো আছে তেমনি। সেই আইনের ফাঁক দিয়ে কোনও জমিদারের কোনও জমিই হাতছাড়া হয় নি। শুধু জমির মালিকের নাম বদলিয়েছে। আগে যেখানে ছিল নরনারায়ণ চৌধুরীর নাম সেখানে বসেছে কুল-বিগ্রহের নাম। বাড়িতে কুল বিগ্রহও আবার একটা নয়, একশোটা। একশোটা কুল-বিগ্রহের নাম বসেছে মালিকানার খতিয়ানে। সব কুল-বিগ্রহের প্রত্যেকের ভাগে পড়েছে পঁচাত্তর বিঘে জমি। অর্থাৎ জমির মালিক সেই মালিকই আছে, শুধু দাখলে কাটা হয় বেনামে। কুল-বিগ্রহরা পাথরের ঠাকুর। ঠাকুরের না আছে পেট না আছে ক্ষিধে। এমন কি খাবার হজম করবার ক্ষমতাও নেই কোনও ঠাকুরের। কিন্তু বেনামদার যারা তাদের মোটা মোটা পেট আছে, বাঘের মত ক্ষিধেও আছে। আর আছে হজম করবার অমানুষিক ক্ষমতা।
একদিন নরনারায়ণ চৌধুরী তিন পুরুষ আগে যখন এখানে এই সম্পত্তির পত্তন করেন তখন কল্পনাও করেন নি যে, একদিন আবার এই সম্পত্তি-বিলোপ আইন হবে। কিন্তু আইনটা যখন হলো তখন প্রথমে একটু ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন তিনি। তবে কি গভর্নমেন্ট সব জমি গ্রাস করে নেবে নাকি?
কিন্তু অভয় দিলেন উকিলবাবু। উকিলবাবু হাসলেন–গভর্নমেন্ট আইন করলেই বা, আমরা আছি কী করতে কর্তাবাবু? আইন তৈরি করা যেমন গভর্মেন্টের কাজ, আমাদের কাজ তেমনি আইন ভাঙার রাস্তা বাতলে দেওয়া–
কর্তাবাবু বললেন–তাহলে আইন বাতলে দিন–
উকিলবাবু হাসতে হাসতে বললেন–আমাকে কত দেবেন বলুন? আমার পাওনাটা?
কর্তাবাবু বললেন–যা চাইবেন তাই-ই দিতে হবে। শতকরা পাঁচ টাকা খরচ না-হয় দেব আপনাকে–
তা সেই ব্যবস্থাই হলো। উকিলবাবুই বুদ্ধি দিলেন–তাড়াতাড়ি কিছু মন্দির আর ঠাকুর তৈরি করে ফেলুন কর্তাবাবু। মাটির ঠাকুর করলে তেমন কিছু খরচ হবে না। রোজ বাড়িতে ঠাকুর-সেবা আরম্ভ করে দিন। পুরুত রাখুন আলাদা আলাদা–আর তারপর সেই সব ঠাকুরের নামে পঁচাত্তর বিঘে করে জমি-জমার দলিল করে ফেলুন। দেখি, গর্ভমেন্ট কী করে। আর তখন আমি তো আছিই–
তা চৌধুরীবাড়িতে আগে থেকেই কুল-বিগ্রহ ছিল। পরে তাদের সংখ্যা বেড়ে একশো হলো। শেষ পর্যন্ত আইন যখন চালু হলো দেখা গেল মাত্র পঁচাত্তর বিঘে জমি-জমার মালিক হলেন নরনারায়ণ চৌধুরী আর বাকি ছেলে, পুত্রবধূ আর ঠাকুরদের নামে এমনভাবে জমি জমা ভাগ হলো যাতে এক তিল জমি সরকারের ভাগে না পড়ে।
সুতরাং কাগজে-কলমে জমিদারি-প্রথা বিলোপ হয়ে গেল বটে, কিন্তু জমিদার যেমন ছিল তেমনিই রয়ে গেল। রয়ে গেল আগেকার সেই আয়-আদায় আর সঙ্গে সঙ্গে রয়ে গেল তাদের দাপট। আর তার সঙ্গে রয়ে গেল বংশী ঢালীরাও।
বংশী ঢালীদের কাজ কিছু থাকুক আর না-থাকুক তাদের খাওয়া-পরার ব্যবস্থা করতে হয়, মাসোহারা দিয়ে যেতে হয়। কাজ দিলাম তো ভালো আর যখন কাজ দিলাম না তখন বসে থাকো।
এমনি অনেকবার অনেক কাজের ভারই পড়েছে বংশী ঢালীর ওপর।
বড় বিশ্বাসী কর্মচারী বংশী ঢালীরা। সুখ-শান্তির দিনে তারা খেতে পাচ্ছে কি না তা দেখবার দায় নেই কর্তাবাবুদের। কিন্তু বিপদের দিনে তারাই ভরসা। তারাই বুক দিয়ে বাঁচায় কর্তাবাবুদের।
আজ এতদিন পরে আবার ডাক পড়েছে সেই বংশী ঢালীর।
বাড়িতে যখন সবাই কাজে ব্যস্ত তখন কেবল তারই কাজ ছিল না। এখন যেন সেও একটা কাজ পেলে। এতক্ষণ শুধু বাড়ির শোভা হয়ে সে ঘুরে বেড়িয়েছে। কাজের লোক যে সে চুপ করে থাকেই বা কী করে!
কর্তাবাবুর ঘর থেকে বেরিয়ে সে নিচেয় এল। চারিদিকে হৈ চৈ। লোকজনের আনাগোনায় সমস্ত বাড়িটা তখন গমগম করছে। কিন্তু তাতে তার কিছু আসে যায় না। তার কাজ সকলের চোখের আড়ালে। সে কাজ কেউ দেখতে পাবে না। জানতে পারবে না তার বাহাদুরি। জানবে শুধু সে আর তার সাকরেদরা। আর জানতে পারবে তার অন্নদাতা মালিক। যে জানলে তার খাওয়া-পরা জুটবে, তার চাকরি বজায় থাকবে।
নিচেয় নেমেই আর দাঁড়াল না সেখানে বংশী ঢালী। একেবারে সোজা গিয়ে হাজির হলো বার বাড়িতে। বার বাড়িতে পালকি থেকে নেমে কালীগঞ্জের বউ তখন মাথার ঘোমটাটা ভালো করে টেনে দিলে।
প্রকাশ মামা সামনে গিয়ে অভ্যর্থনা করলে–আসুন আসুন মা জননী–
কালীগঞ্জের বউ-এর পরনে একটা গরদের পাটভাঙা থান। আজকে একটা বিশেষ দিন বলে বিশেষ ভাবেই সেজেগুজে এসেছে। আসবার তার ইচ্ছে ছিল না তেমন। কিন্তু আবার না এসেও থাকতে পারে নি। একবার মনে হয়েছিল বিনা নিমন্ত্রণে যাওয়াটা ঠিক হবে কি। কিন্তু কে তাকে নেমন্তন্ন করবে! নারায়ণ তার নাতির বিয়েতে তাকে নেমন্তন্ন করবে। এটা আশা করাও অন্যায়। কালীগঞ্জের বাজার থেকে একটা শাড়ি কিনে নিয়ে এসেছিল নতুন বউকে দেবার জন্যে। পনেরো টাকা দাম নিয়েছে শাড়িটার।
কালীগঞ্জের বউ-এর তেমন পছন্দ হয় নি শাড়িটা। বলেছিল–হ্যাঁ রে দুলাল, এর থেকে ভালো শাড়ি একটা পেলিনে?
দুলাল বললে–এর চেয়ে ভালো শাড়ি আর দিতে হবে না মা, কেউ তো আপনাকে এ বিয়েতে নেমন্তন্নও করে নি–
কালীগঞ্জের বউ বলেছিল–নেমন্তন্ন না-করলেই বা, নায়েব মশাই না-হয় আমাকে নেমন্তন্ন করে নি, কিন্তু তার নাত-বৌ কী দোষ করলো, বল্? সে তো এর মধ্যে নেই। তাকে কেন খারাপ শাড়ি দিতে যাবো?
তা তখন আর সে-শাড়ি বদলাবার সময়ও ছিল না বলতে গেলে। তাড়াতাড়ি সেই শাড়িখানাই একটা কাগজে মুড়ে নিয়ে চলে এসেছিল। পালকির ভেতরে আসতে আসতে কালীগঞ্জের বউ-এর কেবল মনে পড়ছিল খোকার সেই কথাগুলো–তোমার টাকা আমি ফেরত দেবই কালীগঞ্জের বউ, তোমার টাকা না দিলে আমি বিয়েই করতে যাবো না–
আহা! ঠাকুর্দা যাই হোক, তার নাতিটা তো কোন দোষ করে নি।
পালকির ভেতরে বসেই কালীগঞ্জের বউ বলেছিল–তোরা একটু পা চালিয়ে চল দুলাল, নতুন বউ বিকেল বেলা নবাবগঞ্জে আসবে, তাকে শাড়িটা দিয়ে সন্ধ্যের আগেই ফিরে আসতে চাই–
সত্যিই সন্ধ্যের আগেই ফিরে আসতে চেয়েছিল কালীগঞ্জের বউ। হয়ত মন বলছিল সন্ধ্যের আগে ফিরে না এলেই বুঝি কোনও বিপদ ঘটবে। কিন্তু কে জানত সে-বিপদ এমন ভয়াবহ বিপদ হয়ে উঠবে! কে জানতো সে-বিপদ এমনই বিপদ যে এ-জন্মের মত তা কাটিয়ে তার কালীগঞ্জে ফিরে আসা হবে না। আর কে-ই বা জানতো কালীগঞ্জের সেই বিপদই নবাবগঞ্জের চৌধুরী-বংশের বিপদ হয়ে এমন করে সমস্ত কিছু ধ্বংস করে দেবে!
সত্যিই, এমনি করেই হয়ত ইতিহাস তার আপন গতিপথ পরিবর্তন করে। নইলে একদিন যে-সূর্য কালীগঞ্জের আকাশে উদয় হয়ে কালীগঞ্জেই অস্ত গিয়েছিল তা যে আবার একদিন নবাবগঞ্জের আকাশকেও অন্ধকার করে দেবে তা-ই বা কে ভাবতে পেরেছিল। নইলে হর্ষনাথ চক্রবর্তী হয়ত যাবার আগে তাঁর স্ত্রীকে সাবধান করে দিয়ে যেতেন। যাবার সময় হয়ত সহধর্মিণীকে বলে যেতেন–ওগো, ওই আমার নায়েবকে তুমি বিশ্বাস কোর না। নায়েব নরনারায়ণ চৌধুরীকে বিশ্বাস করলে একদিন তোমার সর্বস্ব নিঃশেষ হয়ে যাবে। বলে যেতেন–সম্পত্তি রক্ষা করতে গেলে কাউকেই বিশ্বাস করতে নেই। বলে যেতেন–আত্মবিশ্বাসের চেয়ে বড় বিশ্বাস আর কিছু নেই। আরো বলে যেতেন–সম্পত্তি এমনই জিনিস যা শুধু নায়েব কেন নিজের ছেলেকেও বিশ্বাসহন্তা করে তোলে।
কিন্তু সেদিন হর্ষনাথ চক্রবর্তীর গৃহিণী বড় সহজ সরল মানুষ ছিল। সংসারে যে তাকে একদিন এমন করে একলা হয়ে যেতে হবে তাও কখনও কল্পনা করতে পারে নি সে। কর্তা ছিলেন মহাপ্রাণ মানুষ। গৃহিণীও তাই। নদীতে যখন স্নান করতে যেতেন তিনি সঙ্গে লোক যেত মাথায় ছাতি ধরে। যেন রোদ না লাগে কর্তার শরীরে। কোঁচানো কাপড় যেত স্নান করে উঠে পরবার জন্যে। আর যেত কাঁসার বাটিতে আধ সের তেল।
গৃহিণী দেখতে পেয়ে একদিন বলেছিল–অত তেল কি তোমার নিজের গায়ে মাখো নাকি?
কর্তা শুনে হাসতেন। বলতেন–না গো, ঘাটে যারা আসে তারা বড় গরীব মানুষ, তাদের তেল কেনবার পয়সা নেই। আমি তেল মাখি, তারাও মাখে–
শুধু তেল নয়। একবার গৃহিণীর ব্রত উদ্যাপন উপলক্ষে গ্রামের সব লোককে খেতে নেমন্তন্ন করা হয়েছিল। খেতে যাবার আগে হঠাৎ কর্তার নজরে পড়লো গামলা-ভর্তি রসগোল্লা ভাসছে। বললেন–দেখি দেখি, খেয়ে দেখি একটা কেমন পাক হয়েছে—
রসগোল্লা খেলেন একটা।
কিন্তু রসগোল্লাটা মুখে দিয়েই থু-থু করে ফেলে দিলেন।
বললেন–না, এ মিষ্টি কাউকে খেতে দিতে পারবে না, এ বাসি মিষ্টি, টক হয়ে গিয়েছে। ফেলে দাও–
শুধু ফেলে দেওয়া নয়। পাছে কাক-পক্ষীতেও খায় সেই জন্যে মাটিতে গর্ত করে সেই আড়াই মণ ছানার তৈরি রসগোল্লা সব পুঁতে ফেলা হলো। তারপর আবার রাতারাতি নতুন করে তৈরি হলো রসগোল্লা। তবে সকলেরই পাতে মিষ্টি পরিবেশন করা হলো।
এ-সব ঘটনা কালীগঞ্জের লোক যেমন জানে, এই নরনারায়ণ চৌধুরীও তেমনি জানেন। অথচ সেই চক্রবর্তী মশাই-এর গৃহিণীর এমন সর্বনাশ করতে তাঁরও কিনা বাধলো না।
শেষ সময়ে নরনারায়ণকেই ডেকেছিলেন সেদিন হর্ষনাথ চক্রবর্তী। বলেছিলেন–এবার আমার যাবার বন্দোবস্ত করো নারায়ণ
নরনারায়ণ যাওয়ার কথা শুনে অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। বলেছিলেন–কোথায় যাবেন খুঁজুর?
হর্ষনাথ বলেছিলেন–নবদ্বীপ—
নবদ্বীপের কথা শুনে নরনারায়ণ সেদিন একটু অবাকই হয়ে গিয়েছিলেন।
বলেছিলেন–নবদ্বীপে যাবেন কেন হুজুর?
হর্ষনাথ বলেছিলেন–যা বলছি তাই করো, গাড়ি যুততে বলো–
তাই সেই ব্যবস্থাই হয়েছিল। কর্তা নবদ্বীপে যাবেন হুকুম হয়েছে। কর্তার হুকুমের আর নড়চড় নেই। গাড়ি চললো। সমস্ত দিন চলে সন্ধ্যেবেলা একটা নদীর ধারে এসে গাড়ি পৌঁছুল। জিজ্ঞেস করলেন–এ কোথায় এলাম?
নরনারায়ণ বললেন–আজ্ঞে কেষ্টগঞ্জ—
কর্তা বললেন–আমি তামাক খাবো–আমার কলকে গড়গড়া নিয়ে এসো–
সঙ্গের লোক আবার ছুটলো কালীগঞ্জে। কর্তার তামাক খাবার ইচ্ছে হয়েছে। তার নিজের গড়গড়া, ফরসি, সব কিছু আনা চাই। তিনি সেই কেষ্টগঞ্জের নদীর ঘাটেই আস্তানা গাড়লেন। পরের দিন সব কিছু এসে হাজির হলো। তখন সেই নিজের অভ্যস্ত গড়াগড়ার ওপর কলকে বসিয়ে তামাক খেলেন। দুচার টান দিলেন গড়গড়ায়। ধোঁয়া বেরোল। আর তারপর সেটা নরনারায়ণের হাতে দিলেন। বললেন–আর না, আমার এইটুকু আসক্তি ছিল, এবার তাও গেল, এখন চলো–
তখন গাড়ি আবার চললো নবদ্বীপের পথে—
কিন্তু এসব কথা আজকে আর কে শুনবে? কাকে শোনাবে কালীগঞ্জের বউ? একজন যে এসব ঘটনার সাক্ষী ছিল সেও আজ সব ভুলে বসে আছে। সেদিনকার সেই নায়েব আজ আর সেদিনকার সেই মনিবকে মনে রাখতে চায় নি। মনে রাখলে নবাবগঞ্জের সেই সব কিছু সম্পত্তি সোজা কালীগঞ্জের বউ-এর কাছেই ফিরিয়ে দিতে হয়। কিন্তু তা তো আর সম্ভব নয়। তাই কালীগঞ্জের বউকে দেখলেই তার মেজাজটা বিগড়ে যায়। বলে–যা যা দীনু, বল্ আমার শরীরটা খারাপ, আমার সঙ্গে দেখা হবে না–
আর তা ছাড়া নিজের সৌভাগ্যের দিনে কে আর অতীতের সেই অন্ধকার দাসত্বের দিনগুলোর কথা মনে রাখে! কালীগঞ্জের বউ-এর নাম শুনলেই যেন কেবল মনে পড়ে যায় সেই পনেরো টাকা মাইনের চাকরিটার কথাগুলো। কে যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে চায় তার পুরানো চোহারাটাকে। বলে–ওই দ্যাখ, ওকে চিনতে পারিস!
নরনারায়ণ চৌধুরী চিৎকার করে ওঠেন–কৈলাস–কৈলাস—
কৈলাস গোমস্তা বলে–আজ্ঞে, এই তো আমি, আমি তো আপনার পাশেই রয়েছি–
–ও–বলে যেন শান্ত হন। যেন আবার তিনি বাস্তব জগতে ফিরে আসেন। বলেন–দেখ কৈলাস, আজকাল কেবল আমার এই রকম হয়। মনে হয় যেন আমার কাছে কেউ নেই। তুমি আমার কাছে কাছে থাকবে সব সময়–
কিন্তু সেদিন বংশী ঢালী ঘরের বাইরে চলে যাবার পরই কর্তাবাবু আবার ডাকলেন—কৈলাস–
কৈলাস বাইরেই দাঁড়িয়েছিল। ডাক পেয়েই ভেতরে এল। বললে–আমাকে ডাকছিলেন?
–হ্যাঁ, তুমি কোথায় যাও? আমি তোমাকে বলেছি না সব সময় তুমি আমার কাছে কাছে থাকবে?
কৈলাস বললে–আজ্ঞে, আপনি যে এখুনি আমাকে বাইরে যেতে বললেন
কর্তাবাবু বললেন–দেখ কৈলাস তক্কো কোর না, তোমার ওই বড় দোষ, তুমি বড় মুখে মুখে তক্কো করো। তোমাকে আমি বারবার বলেছি আমার কাছাকাছি থাকবে। দেখছো, আমার সিন্দুকটা পাশে রয়েছে, এতে টাকাকড়ি আছে, কখন কে আসে তার ঠিক নেই– তুমি…….
তারপর হঠাৎ থেমে গিয়ে কী যেন কান পেতে শুনতে লাগলেন।
বললেন–একটা কীসের যেন শব্দ হলো না কৈলাস
কৈলাস গোমস্তাও শব্দটা শুনতে চেষ্টা করলে। বললে–হ্যাঁ, ও তো মেয়েরা শাঁক বাজাচ্ছে নিচেয়–
কর্তাবাবু ধমকে উঠলেন–মেয়েরা শাঁখ বাজাচ্ছে সে তো আমিও শুনতে পাচ্ছি। সে শব্দ নয়, আর একটা শব্দ শুনতে পেলে না?
কৈলাস গোমস্তা বললে–আজ্ঞে না।
কর্তাবাবু বললেন–তুমি দেখছি দিন-দিন কানে কালা হয়ে যাচ্ছে। যাও, শুনে এসো কীসের শব্দ হলো ওখানে–
কৈলাস গোমস্তা তাড়াতাড়ি উঠে নিচেয় চলে যাচ্ছিল, কিন্তু কর্তাবাবু ধমক দিলেন। বললেন–তুমি আবার কোথায় যাচ্ছো?
–আজ্ঞে নিচেয়।
–আজ্ঞে নিচেয়! তোমাকে বলেছি না তুমি সব সময় আমার কাছে কাছে থাকবে। আমার কাছে সিন্দুকে টাকা রয়েছে, বলেছি না তোমাকে?
কৈলাস গোমস্তা কথাটা শুনে আবার তার নিজের জায়গায় এসে বসলো। কিন্তু ওদিকে হর্ষনাথ চক্রবর্তী মশাই তখন নবদ্বীপে চলেছেন। তাঁর জীবনের কাজ শেষ হয়ে গিয়েছে। তাঁর আর কোনও আসক্তি নেই তখন। নাবালক ছেলে দু’জন রইলো, গৃহিণী রইলো। আর রইলো- নায়েব নরনারায়ণ! জমি-জমাও রইল অনেক। অনেক কিছুই তিনি রেখে গেলেন। কিন্তু যাবার সময় কিছুই সঙ্গে নিলেন না। যাবার সময় কারো সঙ্গে কিছু থাকেও না। একলাই এসেছিলেন সংসারে, সেই সংসার ফেলে একলাই আবার চলে যাচ্ছেন। আসক্তি নেই, কামনা নেই, আকাঙ্খাও আর নেই। একমাত্র আসক্তি ছিল তাঁর ওই তামাকটার ওপর। তা সেটাও গেল। সেটাও তিনি ত্যাগ করলেন। এবার মুক্তি। এবার আর কোনও কিছুই তাঁকে আকর্ষণ করতে পারবে না।
নায়েব নরনারায়ণ সঙ্গে চলেছেন। চলতে চলতে একদিন নবদ্বীপ শহরে এসে পৌঁছুলো।
কর্তা বললেন–চলো, আমাকে রাধামাধবের আশ্রমে নিয়ে চলো।
তাঁর কথামত সেই রাধামাধবের আশ্রমেই তাঁকে তোলা হলো। কিন্তু সেখানেও বেশি দিন তাঁকে থাকতে হলো না। দুদিন পরেই কর্তা বললেন–এবার আমার সময় হয়েছে নরনারায়ণ, আমাকে গঙ্গায় নিয়ে চলো
নায়েব নরনারায়ণ তাকে গঙ্গার ধারে নিয়ে গেলেন। কর্তা সিঁড়ি দিয়ে গঙ্গার জলে নামলেন। প্রথমে হাঁটু-জল। তারপর কোমর। তারপর বুক। সেই বুক-জলেই দাঁড়ালেন কর্তা।
সত্যিই, এ-সব কথা আজ এই বিয়েবাড়ির উৎসবের মধ্যে ভাবা অন্যায়। ওই ওপরের দোতলায় যে পঙ্গু মানুষটি লোহার সিন্দুক আঁকড়ে ধরে জীবন কাটাচ্ছেন তারও এ-সব কথা ভাবতে নেই। ভাবলে আজ এই তার নাতির বিয়ে পণ্ড হয়ে যাবে। এই অতিথি-অভ্যাগতে ভরা জমজমাট ঐশ্বর্যের ওপর কালো ছায়া পড়বে। জীবনের সার সত্য মোক্ষ নয়, শান্তি নয়, ত্যাগও নয়। আসল সত্য হলো এই ঐশ্বর্য, এই জাঁকজমক আর এই সিন্দুক। কালীগঞ্জের হর্ষনাথ চক্রবর্তী নির্বোধ ছিলেন তাই তিনি আসক্তি ত্যাগ করেছিলেন। নবদ্বীপের গঙ্গার ঘাটে গিয়ে নিজের মুক্তি চেয়েছিলেন। কিন্তু আমি ত্যাগে বিশ্বাস করি না, মুক্তিতে বিশ্বাস করি না, অনাশক্তিতেও বিশ্বাস করি না। আমি বাঁচতে চাই। এই জমি-জমা জাঁকজমক-ঐশ্বর্য-বিলাস সব কিছুর মধ্যে জড়িয়ে থেকে বাঁচতে চাই। আমি বাঁচতে চাই আমার আমির মধ্যে দিয়ে। বাঁচতে চাই আমার সন্তানের মধ্যে দিয়ে। আমি বাঁচতে চাই আমার বংশ-পরম্পরার উত্তরাধিকারের মধ্যে দিয়ে। যে সেই বাঁচার পথে অন্তরায় হবে তাকে আমি নিপাত করবো, নিঃশেষ করবো। আমার বংশী ঢালী সেই নিঃশেষ করার পথে আমাকে সাহায্য করবে। সেই জন্যেই তো আমি তাকে মাসোহারা দিয়ে রেখেছি।
বংশী ঢালী যখন বার বাড়ির উঠোনে গিয়ে দাঁড়ালো, তখন কালীগঞ্জের বউ সেখানে নেই। এমন কি তার সেই পালকিটারও চিহ্ন নেই সেখানে।
প্রকাশ মামা মা-জননীকে নিয়ে তখন একেবারে ভেতর-বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছে। কালীগঞ্জের বউ সম্বন্ধে চৌধুরীবাড়িতে যত অশ্রদ্ধাই থাক, তার সঙ্গে চৌধুরী বংশের ঐশ্বর্যের ক্ষীণ সূত্রটার কথা জানতে কারো বাকি ছিল না। অন্ততঃ আর কেউ না-জানুক চৌধুরী বাড়ির গিন্নী সে কথা জানে।
–কোথায় গো, বৌমা কোথায়?
কালীগঞ্জের বৌ এতবার এবাড়িতে এসেছে টাকার তাগাদা করতে কিন্তু এমনি করে কখনও অন্দরমহলের চৌহদ্দির মধ্যে আসে নি।
বৌমা ব্যস্ততার মধ্যেও চিনতে পেরেছে। বললে–আসুন আসুন মা–
–কালীগঞ্জের বৌ বললে–আমাকে তুমি চিনতে পারবে না বৌমা। আমার নাত-বৌ এসেছে বাড়িতে তাই আশীর্বাদ করতে এলুম। তুমি আমাকে তাড়িয়ে দেবে না তো বৌমা?
–ওমা, তাড়িয়ে দেব কেন আপনাকে!
কালীগঞ্জের বৌ বললে–না, আমাকে তো আসতে কেউ নেমন্তন্ন করে নি বৌমা, আমি এমনিই এসেছি, আমাকে তুমি এত খাতির কোর না। আমি শুধু নাতবউকে আশীর্বাদ করেই চলে যাবো…কই, নাত-বউ কোথায়?
নয়নতারা তখন একটা ঘরের মধ্যে ঘোমটা দিয়ে চুপ করে বসে ছিল। আশেপাশে আরো ক’জন পাড়ার বৌ-ঝি বসে আছে।
গৌরী পিসী সঙ্গে করে নিয়ে গেল। বললে–বৌমা, এঁকে প্রণাম করো, ইনি হচ্ছেন কালীগঞ্জের জমিদারের বৌ, তোমার গুরুজন–
কালীগঞ্জের বৌ হাতের পাট করা শাড়িখানা এগিয়ে দিতেই নয়নতারা সেখানা হাত বাড়িয়ে নিলে। তারপর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলে।
–থাক্ থাক্ মা, আশীর্বাদ করি সুখী হও, শ্বশুর-শাশুড়ী-স্বামী-ছেলেমেয়ে নিয়ে সুখে সংসার করো–
বলে আর দাঁড়ালো না সেখানে। যেন চলে আসতে পারলেই বাঁচে। যেন সকলের চোখের আড়ালে চলে যেতে পারলেই তৃপ্তি পায়। মুখ নিচু করে যেমন এসেছিল তেমনি আবার বার বাড়ির দিকে চলে গেল।
গৌরী পিসি বাইরে আসতেই প্রীতি জিজ্ঞেস করলে–কী রে, মাগী চলে গেছে?
গৌরী পিসী বললে–হ্যাঁ, বিদেয় হয়েছে–
–কী দিয়ে বৌ-এর মুখ দেখলে রে?
–সে আর বলো না বৌদি। একটা বাঁদি-পোতার গামছা–
–সে কী রে? গামছা? গামছা দিয়ে আমার ছেলের বৌ-এর মুখ দেখলে?
গৌরী বললে–তা সে গামছাই একরকম বলতে পারো। আমাদের বিবিগঞ্জের হাটে জোলাদের হাতে বোনা যেমন শাড়ি পাওয়া যায় তেমনি।
–কত দাম হবে?
–তা তিন টাকাও হতে পারে, পাঁচ টাকাও হতে পারে—
প্রীতি বললে–ঢং, ঢং দেখে আর বাঁচিনে, তবু যদি নেমন্তন্ন করে ডেকে আনা হতো তো তাও বুঝতুম–
গৌরী বললে–অথচ মাগীর দেমাক দেখ না, কর্তাবাবুকে সেবার কত গালাগালি দিয়ে গেল, এখন আবার এসেছে ভাব-ভালবাসা দেখাতে–লজ্জাও করে না মা, ছিঃ!
প্রীতির সেসব মনে ছিল না। বললে–গালাগালি দিয়েছিল? কর্তাবাবুকে? কী গালাগালি দিয়েছিল রে?
–ওমা তোমার মনে নেই, ওই বার বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে সেবার বলে নি–তুমি নিব্বংশ হবে নারাণ, আমি বামুনের মেয়ে হয়ে তোমাকে শাপমন্যি দিয়ে গেলুম তোমার বংশ থাকবে না–কত কী কথা বলে যায় নি?
প্রীতি বললে–ওমা, তুই আমাকে আগে মনে করিয়ে দিলিনে কেন? আমি তাহলে আজ ঝাটা ঘষে দিতুম মাগীর মুখে?
তা বটে। গৌরীও সেই কথাই বললে। কালীগঞ্জের বউ-এর মুখে খ্যাংরা ঝাঁটা ঘষে দিলেই বুঝি ভালো হতো! এই সদানন্দর বিয়ের ব্যাপারেই কি কম বাগড়া দিয়েছে কালীগঞ্জের বউ? যাতে বিয়ে ভেঙে যায় সেই জন্যে খোকাকে পর্যন্ত নিজের বাড়িতে সমস্ত রাত আটকে রেখেছিল। এখন লজ্জা নেই তাই আবার ঢং করে একটা তিন টাকা দামের গামছা দিয়ে বৌ-এর মুখ দেখতে এসেছে।
কিন্তু ভেতর বাড়িতে যখন এসব মন্তব্য চলেছে কালীগঞ্জের বউ তখন সোজা বার বাড়ির উঠোনে গিয়ে দুলালকে খুঁজছে। কোথায়, দুলালরা কোথায় গেল! তাদের পালকি! পালকিটাই বা গেল কোথায়?
প্রকাশ মামা বাইরে শামিয়ানা খাটানো নিয়ে ব্যস্ত ছিল। হঠাৎ পালকিটা দেখতে পেয়ে বললে–তোমরা এখেনে কেন হে? এখানে পালকি রেখে আমার জায়গা আটকে রেখেছে। কেন? যাও যাও, বাইরে যাও
দুলালরা পালকি সরিয়ে নিয়ে একেবারে রাস্তার ওপারে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল। আর ভেতরের দিকে চেয়ে দেখছিল। মা-জননী এখনও আসছে না কেন? কালীগঞ্জে ফিরে যেতে যে রাত পুইয়ে যাবে!
সদানন্দ সামনে দিয়ে যেতে গিয়েই পালকিটা তার নজরে পড়লো। এ তো চেনা পালকি!
বললে–হ্যাঁ গো, এ পালকি কার? কালীগঞ্জের বউ এসেছে নাকি?
দুলাল বললে–আজ্ঞে হ্যাঁ, মা-জননী এসেছে–
–তা কোথায় তিনি?
–ভেতরে গেছেন–
সদানন্দ আর দাঁড়াল না। এক দৌড়ে ওপরে দাদুর ঘরে চলে গেল। কালীগঞ্জের বৌ এখানে এসেছে নাকি কৈলাস কাকা?
কৈলাস গোমস্তা কী বলবে ভেবে পেলে না। তারপর বললে–আমি তো ঠিক জানি নে খোকাবাবু–
কর্তাবাবুর কানেও কথাটা গিয়েছিল। বললেন–কে? কে কথা বললে–কৈলাস? খোকা না?
কিন্তু সদানন্দ আর সেখানে দাঁড়ালো না। তাহলে নিশ্চয় ভেতর-বাড়িতে গেছে।
–মা!
–কী রে খোকা?
–হ্যাঁ মা কালীগঞ্জের বউ এসেছে বুঝি? কোথায়?
–এই তো এখুনি বউর মুখ দেখে চলে গেল।
সদানন্দ বললে–কিন্তু এখানেই কোথাও আছে, পালকি যে বাইরে রয়েছে দেখলুম–
বলে তাড়াতাড়ি বাইরে বেরিয়ে গেল আবার। কীর্তিপদবাবু তার ঘরের মধ্যে বসে তামাক খাচ্ছিলেন। নাতিকে দেখে বললেন–এই যে খোকা, কোথায় গিয়েছিলে?
কিন্তু ও-সব বাজে কথা বলবার তখন সময় ছিল না সদানন্দর। সেখান থেকে সোজা বার বাড়িতে গিয়ে একেবারে প্রকাশ মামার সঙ্গে মুখোমুখি দাঁড়ালো।
–মামা, কালীগঞ্জের বৌ এসেছে বুঝি?
–হ্যাঁ, দেখলাম তো তাই।
–কিন্তু গেল কোথায়? কোথাও তো দেখতে পাচ্ছিনা–বাবার কাছে চণ্ডীমণ্ডপে আছে নাকি?
সেখান থেকে চণ্ডীমণ্ডপে। সদানন্দর মনে হলো এক মুহূর্ত দেরি হলে যেন আর কালীগঞ্জের বউকে দেখতে পাবে না সে। কিন্তু বিয়েবাড়িতে তো আসবার কথা ছিল না কালীগঞ্জের বউ-এর। তবে কি দাদুর কাছে টাকা চাইতে এসেছে? দাদু কি টাকা দিয়েছে তাহলে? দাদু কি তাহলে কথা রেখেছে? সেই দশ হাজার টাকা!
ভাবতে ভাবতে সমস্ত বাড়িটা চষে ফেলতে লাগলো সদানন্দ। এত ভিড় চার দিকে! সমস্ত লোকের মুখের দিকে চেয়ে চেয়ে খুঁজতে লাগলো তার সেই আসল লক্ষ্যবস্তুটাকে। কই, কোথায় গেল কালীগঞ্জের বউ? পালকি থাকতে তো হেঁটে ফিরে যাবে না এখান থেকে।
শেষকালে সে আবার ফিরে এল সদরে। তখনও দুলালরা বার বাড়ির দিকে হা করে চেয়ে আছে।
–কী গো, তোমাদের মা-জননী এসেছে?
–আজ্ঞে হ্যাঁ, আমরা তো মা-জননীর জন্যেই হা-পিত্যেশ করে তখন থেকে দাঁড়িয়ে আছি। সন্ধ্যের আগেই রওনা দেবার কথা আমাদের–
–তাহলে দেখি, কোথায় গেল—
বলে সদানন্দ আবার ভেতরের দিকে ঢুকলো। হ্যাজাগ বাতি লাগানো হচ্ছে গেটের ওপর। প্রকাশ মামা কোমরে তোয়ালে বেঁধে সেই তদারক করতেই ব্যস্ত। বাজে কাজে সময় নষ্ট করবার অবসর নেই তার। চারিদিকে তীক্ষ্ণ নজর। সদানন্দকে দেখেও যেন দেখলে না প্রকাশ মামা।
কিন্তু বংশী ঢালী তার কাজে কখনও ঢিলে দেয় নি জীবনে। সে যে কখন নিঃশব্দে সকলের চোখের আড়ালে তার ডিউটি শেষ করে বসে আছে তা কেউ জানতে পারে নি। কিন্তু এটাও যে খুব সোজা কাজ তা নয়। কালীগঞ্জে যখন চক্রবর্তী মশাই-এর কাছে সে কাজ করতো তখন সে এই কালীগঞ্জের বউকেই একদিন মা-জননী বলে ডেকেছে। একদিন এরই নিমক খেয়েছে। কিন্তু বংশী ঢালীরা টাকার জন্যে সব করতে পারে। টাকার বদলে তাদের নিমকহারামী করতেও বুঝি বাধে না?
–কে? ওখানে কে?
বংশী ঢালীরা তখন নিঃশব্দে তাদের কাজ সমাধা করে ফেলেছে।
–কে? কে ওখানে?
সদানন্দর মনে হলো চণ্ডীমণ্ডপের পেছনে আতা গাছের ঝোঁপের তলার অন্ধকারে যেন ফিসফিস করে কারা কথা বলছে।
সদানন্দ কাছে যেতেই বংশী ঢালী অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এল।
সদানন্দ জিজ্ঞেস করলে–বংশী, এখানে অন্ধকারে কীসের একটা আওয়াজ হলো না? যেন মেয়েমানুষের গলার মত আওয়াজ পেলাম–
বংশী অবাক হয়ে গেল–মেয়েমানুষের গলার আওয়াজ! এখানে মেয়েমানুষের গলার আওয়াজ কোত্থেকে আসবে খোকাবাবু?
–তা তুমি এখেনে এখন কি করছিলে? সবাই কাজ করছে আর তুমি এই অন্ধকারে দাঁড়িয়ে কী দেখছো?
বংশী বললে–না, এই আমার ঘরে ঢুকেছিলাম, এখন বেরোচ্ছি–
বলে কথা এড়াবার জন্যে তাড়াতাড়ি বার বাড়ির লোকজনের ভিড়ের দিকে চলে গেল। কিন্তু সদানন্দর কেমন সন্দেহ হলো। এ জায়গাটা একেবারে নিচ্ছিদ্র অন্ধকার ঘুরঘুট্টি। বংশী চলে যাবার পর সদানন্দও চলে আসছিল। কিন্তু আবার সেই অন্ধকারের দিকেই ফিরে গেল। বংশীকে দেখলেই কেমন ভয় করতে সদানন্দর। ও এমন সময় এখানে একলা থাকবার লোক তো নয়। আর এদিক থেকেই তো আওয়াজটা এসেছিল। মেয়েমানুষের গলার মত আওয়াজ।
বংশীর ঘরের দরজাটা ঠেলে খুলতে গেল সে। কিন্তু মনে হলো যেন তালা ঝুলছে। অন্ধকারের মধ্যে তালাটায় হাত দিলে। হাত দিয়ে নাড়ালে। আর বোধ হয় তাড়াতাড়িতে ভালো করে তালায় চাবি লাগানো হয় নি। সঙ্গে সঙ্গে সেটা খুলে গেল। সদানন্দ ঘরের মধ্যে চেয়ে দেখবার চেষ্টা করলে। মনে হলো ভেতরে যেন তখনও কার গলার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে
কিন্তু বংশী তারই মধ্যে আবার এসে হাজির হয়েছে তখন।
–এখানে কি করছো খোকাবাবু?
–ঘরের ভেতরে কী বংশী? গোঙ্গাচ্ছে কে?
বংশী ঢালী সেকথার উত্তর না দিয়ে বললে–কর্তাবাবু তোমাকে ডাকছে খোকাবাবু, লোক এসেছে, তাড়াতাড়ি ডেকেছে–
–আমাকে? আমাকে ডেকেছে?
বংশী ঢালী বললে–হ্যাঁ–এখুনি দেখা করে এসো–
–কিন্তু তোমার এই ঘরের মধ্যে কে?
বংশী ঢালী বললে–ঘরের মধ্যে আবার কে থাকবে? আমি তো তালা-চাবি দিয়ে রেখেছিলাম। খুললে কে? বলে ট্যাঁকের ঘুনসী থেকে একটা চাবি বার করে বোধ হয় তালাটা আবার বন্ধ করবার চেষ্টা করতে লাগলো।
–কিন্তু ঘরের মধ্যে কার গলার আওয়াজ শুনলুম, ওখানে কে আছে বলো তো? বলো ওখানে কি হয়েছে? কে আছে ওখানে?
কিন্তু বংশী ঢালী অত সহজে ভাঙবার পাত্র নয়। বললে–তুমি ভূত দেখেছ খোকাবাবু, ভূতের ভয় লেগেছে তোমার নিশ্চয়।
সদানন্দ বললে–বাজে কথা রাখো, বলো ভেতরে কী হয়েছে? বলো ভেতরে কে আছে? তুমি নিশ্চয় কালীগঞ্জের বউকে ভেতরে আটকে দিয়েছ–এখনও বলল কে ওখানে?
বংশী ততক্ষণে দরজায় বেশ করে তালাচাবি বন্ধ করে আবার চলে যাচ্ছিল। সদানন্দ ছাড়লে না, বললে–বলো, কে ওখানে আছে? কাকে তালাচাবি বন্ধ করে রেখেছ?
বলতে বলতে বংশীর পেছন-পেছন একেবারে সদরের বার বাড়ির কাছে এসে পড়েছিল। প্রকাশ মামা দেখতে পেয়েছে। বললে–এ কী রে, তোর গেঞ্জিতে এত রক্ত কেন?
.
এসব অনেক দিন আগেকার ঘটনা। তবু এতকাল পরে চৌবেড়িয়া থেকে বেরিয়ে নবাবগঞ্জের পথে যেতে যেতে সেইদিনকার সেই সব কথাগুলোর যেন নতুন মানে করবার চেষ্টা করতে লাগলো সদানন্দ। এতকাল পরে নবাবগঞ্জে গেলে সেখানে কী দেখবে কে জানে! সেই নবাবগঞ্জ কি আর সেরকম আছে! ইতিহাসের কষ্টিপাথরে যখন সব জিনিসেরই আসল নকল যাচাই হয়ে যায় তখন নবাবগঞ্জেরও হয়ত একটা নতুন যাচাই হয়ে গেছে নিশ্চয়ই। সেই ফুলশয্যার আগের রাত্রের সেই দুর্ঘটনার কথা আজ সে ছাড়া কি আর কারো মনে আছে! আর মনে থাকলেও তার জীবনে এ ঘটনার তাৎপর্য যেমন করে ছায়াপাত করেছে তেমন করে আর কার জীবনে ছায়াপাত করবে? শুধু নবাবগঞ্জ কেন, পৃথিবীতে কোনও দুর্ঘটনাই তো কাউকে চিরকালের মত এমন অভিভূত করে রাখে না। সংসারে বোধ হয় তাই সে-ই একমাত্র ব্যতিক্রম। সে তো আর সকলের মত সুখে-স্বচ্ছন্দে স্ত্রী-পুত্র-সংসার নিয়ে আপোস করে চললেই পারতো! কেন তবে সব থাকতে সে এই চৌবেড়িয়ার অতিথিশালায় অজ্ঞাতবাসের দুর্ভোগ সইছে!
পরের দিন কেষ্টগঞ্জ থেকে পুলিস এসে সেই কথাই জিজ্ঞেস করেছিল।
বলেছিল–আপনি কেমন করে বুঝলেন যে এখানে খুন হয়েছিল? খুন হলে তো রক্তের দাগ থাকবে!
সদানন্দ বলেছিল–কিন্তু আমার গেঞ্জিতে রক্তের দাগ লেগে রয়েছে, আমার কাপড়ে রক্তের দাগ লেগে রয়েছে, আমার হাতেও তখন রক্তের দাগ লেগে ছিল। সে দাগ সবাই দেখেছে–
পুলিসের দারোগাবাবু তার আগেই কর্তাবাবুর সঙ্গে দরজা বন্ধ ঘরের মধ্যে আধ ঘণ্টারও বেশি কথাবার্তা বলেছে। সদানন্দ জানতো না ফয়সালা যা হবার তা সেখানেই সব কিছু হয়ে গেছে। এসব ব্যাপারে ফয়সালার জন্যে কর্তাবাবুর সিন্দুকের ভেতরে সব সময়েই মশলা মজুদ থাকে। সেই মশলা দিয়েই নরনারায়ণ চৌধুরী এতদিন রাজত্ব করে আসছেন। প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠা প্রতাপ সব কিছু কায়েম করে সকলের মাথার ওপরে বসে আছেন। শুধু পুলিসের দারোগা কেন কোর্টের জজ থেকে শুরু করে আদালতের পেয়াদা পর্যন্ত ওই মশলার জোরে তাঁর কাছে মাথা নীচু করেছে।
তাই কেষ্টগঞ্জের দারোগার কানে সেদিন সদানন্দর কথাগুলো ভালো লাগে নি।
দারোগাবাবু জিজ্ঞেস করেছিল–কিন্তু কাকে খুন করা হয়েছে?
সদানন্দ বলেছিল–কালীগঞ্জের বউকে। কালীগঞ্জের জমিদারের বিধবা স্ত্রী–
–কিন্তু তাঁকে তো নেমন্তন্ন করা হয় নি। তিনি কেন ফুলশয্যার আগের দিন বিনা নিমন্ত্রণে আসতে যাবেন?
সদানন্দ বলেছিল–তাই যদি হয় তাহলে তিনি গেলেন কোথায়? কালীগঞ্জেও তো তিনি নেই। তিনি তো কালীগঞ্জেও ফিরে যান নি। তার পালকি-বেহারাদেরও তো খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এমন কি তার পালকিটাও তো কোথাও নেই।
সত্যিই এ বড় আশ্চর্য কাণ্ড! কালকে যে মানুষটাকে সবাই দেখেছিল, একখানা শাড়ি নিয়ে এসে নতুন বউকে আশীর্বাদ করে গেছে, সে মানুষটা এমন করে অদৃশ্য হলোই বা কী করে! এমন কি তার পালকিটা পর্যন্ত রাতারাতি অদৃশ্য হয়ে গেল কী করে!
কিন্তু সাক্ষ্য দেবার সময় সবাই বললে–কই, আমি তো পালকি দেখি নি!
দারোগাবাবু বারবার সবাইকে জিজ্ঞেস করলেন–আপনারা কেউই দেখেন নি কালীগঞ্জের বউকে?
সবাই একবাক্যে বললে–আজ্ঞে না, আমাদের কাজকর্ম ছিল, কারো দিকে দেখবার মত সময় ছিল না তখন।
–আর আপনি? আপনি দেখেছেন? আপনিই তো সদরে দাঁড়িয়ে শামিয়ানা খাটাচ্ছিলেন। সবাই বললে।
প্রকাশ মামার কাজের তখনও শেষ হয় নি। পুলিস দেখে তার পিত্তি জ্বলে গিয়েছিল। বললে–আমি? আমাকে বলছেন দারোগাবাবু? আমার কি মরবার ফুরসৎ আছে? যতক্ষণ না ফুলশয্যা কাটে ততক্ষণ আমার মরবার পর্যন্ত ফুরসৎ নেই
সদানন্দ মাঝখানে বলে উঠলো–কিন্তু মামা তুমি তো কালীগঞ্জের বউকে পালকি থেকে নামতে দেখেছ, তুমিই তো বেয়ারাদের সদর থেকে পালকি সরিয়ে নিয়ে যেতে বলছে! এখন তুমি সব বেমালুম ভুলে গেলে?
দারোগাবাবু বললে–আপনি থামুন, আমি যাকে জিজ্ঞেস করছি তিনিই উত্তর দেবেন।
তারপর প্রকাশ মামার দিকে চেয়ে দারোগাবাবু আবার বলতে লাগল–তারপর কখন আপনার শামিয়ানা খাটানো শেষ হলো?
প্রকাশ মামা বললে–ধরুন তখন মাঝ-রাততির–
–তখনও কি কিছু সন্দেহ করেছিলেন যে এ বাড়িতে কেউ খুন হয়েছে?
প্রকাশ মামা বললে–রাম, সে সন্দেহ করতে যাবো কেন? ওই আমার, ভাগ্নেই কেবল সকলকে বলে বেড়াতে লাগলো কালীগঞ্জের বউ কোথায় গেল, কালীগঞ্জের বউ কোথায় গেল! তা আমি বললুম কালীগঞ্জের বউ কোথায় আবার যাবে? কালীগঞ্জেই আছে কিন্তু ও কিছুতেই তা শুনবে না। শেষ পর্যন্ত সেই রাত্তিরে আমার ভাগ্নে কালীগঞ্জে গেল। গিয়ে যখন ফিরে এল তখন আমার ঘড়িতে রাত প্রায় একটা। সেখানেও নেই। তখন পাগলের মতন ছটফট করতে লাগলো। তখন আমি বললুম–এতই যদি তোর সন্দেহ তাহলে পুলিসে খবর দে! আমার কথাতে তখন ও আপনার কাছে গেল–
–আপনি তাহলে বলতে চান এ বাড়িতে কেউই খুন হয় নি?
প্রকাশ মামা বললে–তা হলে তো আমিই আগে জানতে পারতুম। তখন সকলের আগে আমিই আপনাকে গিয়ে খবর দিতুম।
পুলিসের কাজ বড় নিখুঁত। বিশেষ করে কেষ্টগঞ্জের পুলিসের। তারা নবাবগঞ্জের নরনারায়ণ চৌধুরীর কোনও কাজেই কোনও দিনই খুঁত পায় নি। এর আগে নবাবগঞ্জে যতবার লাঠিবাজি হয়েছে, জমি দখল হয়েছে, বিশেষ করে সেই যেবার বারোয়ারিতলার অশ্বথ গাছের ডালে কপিল পায়রাপোড়া গলায় দড়ি দিয়েছিল, কোনও বারেই কেষ্টগঞ্জের দারোগারা কোথাও কোনও খুঁত পায় নি। প্রত্যেকবারই নবাবগঞ্জে এসেছে, এসে কর্তাবাবুর দোতলার দরজা বন্ধ ঘরে বসে বসে নিরিবিলিতে সব মামলার ফয়সালা হয়ে গেছে, কোর্ট পর্যন্ত আর সে-সব গড়ায় নি।
আর আশ্চর্য ওই বংশী ঢালীর দল! তাদের যেন কোনও যুগেই শাস্তি হতে নেই। তারা যেমন সেই ইতিহাসের আদি যুগেও ছিল, তেমনি এখনও আছে, আবার সুদূর ভবিষ্যতেও তারা থাকেবে। তাদের জন্যে পেনাল-কোড তৈরী হয়েছে, থানাপুলিস, কোট-কাছারির ব্যবস্থা হয়েছে, জজ-ম্যাজিস্ট্রেটদের মোটা মাইনে দিয়ে পোষা হয়েছে। তবু তারা নিঃশেষ হয় নি। তাদের বংশ বেড়েই চলেছে বরাবর। এ যে কেমন করে সম্ভব হয় তা হয়ত ওই নরনারায়ণ চৌধুরীরাই একমাত্র বলতে পারেন, আর বলতে পারে তাদের সিন্দুকের টাকা। আর টাকা তো মানুষ নয়, আর টাকার মুখও নেই, তাই হয়ত সে মুখের ভাষাও নেই। যদি ভাষা থাকতো তা হলে বলতো–আমিই সব, আমিই সৃষ্টি, আমিই স্থিতি, আবার আমিই প্রলয়। একাধারে আমিই নরনারায়ণ চৌধুরী, আমিই বংশী ঢালী আবার আমিই পুলিস। উকিল-জজ-আসামী-ফরিয়াদী সব কিছুই আমি। সুতরাং আমাকেই তোমরা মনে-প্রাণে ভজনা করো।
সেইজন্যেই সেদিন বংশী ঢালীর ভয় ছিল না। খোকাবাবু যখন কালীগঞ্জের বউকে সারা বাড়ির ভেতরে খুঁজে বেড়াচ্ছে তখন বংশী ঢালীরা গা-ঢাকা দিয়ে আতা গাছের অন্ধকারে চণ্ডীমণ্ডপের দরজার তালা আবার খুলেছে। তাদের সব কাজ পাকা হাতের কাজ। আগের বারে তাড়াতাড়িতে কাজটা কেঁচে গিয়েছিল। তাই খোকাবাবুর গেঞ্জিতে-ধুতিতে রক্ত লেগে গিয়েছিল। এবার আর তা নয়। এবার সমস্ত ঘরের মেঝে, দেয়াল, দরজা-জানলা জল দিয়ে ধুয়ে একেবারে সাফ করে ফেললে। তারপর সেই চণ্ডীমণ্ডপের খিড়কী দিয়ে লাশটা নিয়ে উধাও হয়ে গেল একদল। আর গেল পালকি বেহারাদের অদৃশ্য করে দিতে। বেহারারা তখনও সদরের সামনে মা-জননীর জন্যে হা-পিত্যেশ করে দাঁড়িয়ে ছিল।
একজন কাছে গিয়ে বললে–হ্যাঁ গো, কালীগঞ্জের লোক এখানে কারা?
দুলাল বললে–আমরা গো বাবু, আমরা–
লোকটা বললে–আরে, তোমাদেরই তো খোঁজাখুঁজি হচ্ছে। এতক্ষণ তোমাদের খুঁজে খুঁজে হয়রান। তোমরা বার বাড়ির উঠোনে ছিলে, তোমাদের আবার বাইরে আসতে কে বললে?
–আজ্ঞে, একজন বাবুমশায় তো আমাদের এখেনেই দাঁড়াতে বললে। আমাদের জন্যে তাঁর কাজের অসুবিধে হচ্ছিল।
–কী মুশকিল দেখ দিকিনি। আর এদিকে মা-জননী তোমাদের খুঁজে খুঁজে মরছে। খুব লোক যা’হোক তোমরা।
–তা মা জননী কোথায়?
–আরে, তিনিই তো ডেকে পাঠিয়েছে তোমাদের। এসো, আমার সঙ্গে এসো, পালকি তুলে নিয়ে এসো–
–কিন্তু কোথায় মা-জননী? কোন দিকে?
তখন চৌধুরীবাড়িতে হ্যাজাগবাতি জ্বলে উঠেছে। পুকুরপাড়ে মিষ্টির ভিয়েন বসেছে, তারও ও-পাশে আলোর ব্যবস্থা হয়েছে। মাছ-মাংস কাটা হচ্ছে। আর একদিকে লোহার কড়ায় গরম ঘিয়ের ওপর ময়দার লুচিগুলো ফোস্কার মত ফুলে ফুলে উঠছে। বাড়ির লোকজন খাবে, খাবে বাড়ির কর্তা-গিন্নিকুটুম। তার সঙ্গে খাবে নতুন বউ।
নয়নতারা বিকেল থেকে এসে ঘরের মধ্যে এক জায়গায় বসে আছে। আগের রাতে বাসর-ঘরে ঘুমোতে পারে নি। তারপর সকাল বেলা কাঁদতে কাঁদতে ট্রেনে উঠেছে। তখন থেকে ঘোমটা দেওয়া অবস্থায় সমস্ত রাস্তাটা কাটিয়েছে। এ বাড়িতে এসে যে বেশি করে যত্ন করেছে সে হলো গৌরী পিসী।
গৌরী পিসীরই যেন যত জ্বালা। বললে–ওলো, তোরা একটু সর তো বাছা, বউমাকে একটু হাঁফ ছাড়তে দে। সর বাছা তোরা সব–এখন তোরা যার-যার বাড়ি যা, কালকে আবার বউ দেখতে আসিস–
তারপর নয়নতারার হাতখানা ধরলে।
বললে–এসো বউমা এসো, মুখ-হাত-পা ধুয়ে নাও, কুয়ো-পাড়ে চলো—
তা ব্যবস্থা ভালোই করেছিল। কুয়োর কাছে একপাশে খানিকটা জায়গা চাটাই দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছিল নতুন বউ-এর জন্যে। একটু আড়াল হবে। নতুন বউ তো আর আমাদের মত গা খুলে চান করতে পারবে না। তার জন্যে আড়াল চাই। চান করবে, সাবান মাখবে, গা ডলবে।
গৌরী পিসী বললে–তুমি বউমা লজ্জা করো না যেন। খিদে-টিদে পেলে বলবে। এ এখন থেকে তোমারই বাড়ি মনে করে নাও। প্রথম প্রথম বাপ-মায়ের জন্যে একটু মন কেমন করবে বটে, কিন্তু তারপর দেখবে যখন সেয়ামীর ওপর মন বসে যাবে তখন আর কেষ্টনগরে যেতেই মন চাইবে না। সোয়ামী এমন জিনিস গো–
সমস্ত অচেনা পরিবেশের মধ্যে নয়নতারার কাছে তখন সব কিছুই খারাপ লাগছিল। শুধু ভালো লাগছিল গৌরী পিসির কথাগুলো।
গৌরী পিসী বলল–আমি তোমার আপন পিস-শাশুড়ী নই গো, আপন পিস-শাশুড়ী নই! তুমি বুঝি ভাবছো আমি তোমার আপন পিস-শাশুড়ী?
নয়নতারা কী আর উত্তর দেবে! ‘হ্যাঁ’ ‘না’ কিছুই তার মুখ দিয়ে বেরোল না।
গৌরী পিসী বললে–আমার সামনে লজ্জা করো না বউমা, তোমার গায়ের বেলাউজ খুলে ফেল, আমি পিঠে সাবান মাখিয়ে দিই–
তবু নয়তারার কেমন লজ্জা করতে লাগলো।
গৌরী পিসী বললে–খোল খোল, লজ্জা কী, কাক-পক্ষীতে দেখতে পাবে না তোমাকে, তোমার চানের জন্যেই তো এই জায়গা তৈরি হয়েছে–
এবার নয়নতারা প্রথম কথা বলে উঠলো। বললে–আপনারা কোথায় চান করেন?
–আমরা? আমরা সবাই ওই পুকুরে। পুকুরে বাঁধানো ঘাট আছে। তোমার শাশুড়ীও সেখানে চান করে। প্রথম প্রথম তুমি এই কুয়োপাড়ে চান করো। শেষকালে একটু পুরোন হয়ে গেলে তুমিও আমাদের মত পুকুরের ঘাটের পৈঁঠেতে বসে চান করবে–
নয়নতারার পিঠে তখন গৌরী পিসী ঘষ ঘষ করে সাবান ঘষতে আরম্ভ করেছে।
সাবান ঘষতে ঘষতেই গৌরী পিসী বললে–আমাদের এইটুকু জায়গায় চান করে সুখ হয় না মা। তোমার শাশুড়ী আর আমি তো আগে সাঁতার কেটেছি কত…তা তুমি সাঁতার জানো তো বউমা?
–সাঁতার? আমি তো সাঁতার জানি না?
–সাঁতার জানো না? তা তোমাদের কেষ্টনগরে বুঝি বাড়িতে পুকুর-ঘাট নেই?
নয়নতারা বললে–না, আমাদের টিউবওয়েল আছে—
গৌরী বললে–ও আমি দেখেছি, ওই সদার মামার বাড়িতে ওই কল আছে, টিউবকল। ঢেঁকির মত পাড় দিতে হয়, বুঝতে পেরেছি। তা তোমার ভাবনা নেই বউমা, আমি তোমাকে সাঁতার শিখিয়ে দেব। এই দু’চার দিন ঝাঁপাই ঝুড়লেই তোমার রপ্ত হয়ে যাবে, তখন দেখবে জল ছেড়ে আর উঠতে ইচ্ছে করবে না–
তারপর গা-ধোওয়া, ভিজে কাপড় ছেড়ে শুকনো কাপড় বদলানো, মুখে পাউডার মাখা, চুল আঁচড়ে নতুন খোঁপা বাঁধা সবই করিয়ে দিলে গৌরী পিসী। নয়নতারার জন্যে নতুন ঘর। ঘরের ভেতর নতুন খাট, নতুন আলমারি, নতুন গদি-বিছানা।
গৌরী পিসী নয়নতারাকে সেই ঘরের মধ্যে নিয়ে গেল।
বললে–এই দেখ, এই হলো তোমার শোবার ঘর। কালকে এইখানে তোমার ফুলশয্যে হবে–
নয়নতারা দেখলে।
গৌরী পিসী বললে–আজ একটা রাত কোনও রকমে নাক-কান বুঁজে কাটাও, কাল রাত থেকে এখেনে তোমরা দুজনে শোবে।
নয়নতারা এর জবাবেও কিছু বললে–না। শুধু কান দিয়ে কথাটা শুনলো।
কিন্তু বেশিক্ষণ সে ঘরে থাকা হলো না। পেছন থেকে শাশুড়ীর গলা শোনা গেল –ওলো, ও গৌরী, বউমাকে খেতে দিয়েছিস?
সত্যিই খাবার কথা মনে ছিন না গৌরী পিসীর। বললে–চলো বউমা, ওদিকে তোমার শাশুড়ী আবার রাগ করবে, এসো এসো। এখন আর এসব দেখে কী হবে! কাল থেকে তো এখেনেই চিরকাল কাটাতে হবে তোমাকে। তখন দরজায় হুড়কো দিয়ে থাকবে তোমরা, কাউকেই আর ভেতরে ঢুকতে দেবে না। এসো–
ভেতরে জলখাবারের বন্দোবস্ত হয়েছিল। শাশুড়ী বললে–এখন এই মিষ্টি কটা খেয়ে নাও বউমা, তারপরে রাত্তিরের খাওয়া পরে খেও। তখন পেট ভরে লুচি তরকারি মাছ মাংস খেও–গৌরী, ঠাণ্ডা জল দে বাছা বউমাকে–
মিষ্টিগুলোর দিকে চেয়ে নয়নতারা ভাবছিল অত খাবে কী করে! হঠাৎ বাইরে যেন কীসের আওয়াজ হলো। কীসের আওয়াজ! মুখটা তুলতেই হঠাৎ চোখে চোখ পড়ে যাওয়াতে মাথায় ঘোমটা টেনে দিলে। সদানন্দ!
সদানন্দ ভেতরে এসে নয়নতারাকে দেখে প্রথমে একটু দাঁড়ালো। তারপর ডাকলে–মা, মা কোথায়?
মা আসবার আগেই গৌরী পিসীকে দেখে বললে–পিসী, কালীগঞ্জের বউ এখানে এসেছে?
গৌরী পিসী তো অবাক। বললে–হ্যাঁ এসেছিল, কিন্তু সে তো চলে গেছে–
–কোথায় চলে গেছে? কোন দিকে?
ততক্ষণে মা এসে গেছে ভাঁড়ার ঘরের দিক থেকে। বললে–কী রে খোকা? কী চাস?
সদানন্দ বললে–কালীগঞ্জের বউ ভেতরবাড়িতে এসেছিল?
–কেন? তার সঙ্গে তোর কী দরকার?
সদানন্দ বললে–দরকার আছে। তুমি বলো না কোন্ দিকে গেল?
–তা কী দরকার তাই বল না। তাকে তো নেমন্তন্ন করা হয় নি, কিছুই না, তবু সে কেন আসে এ বাড়িতে? আবার বুঝি তোকে টেনে নিয়ে গিয়ে তার বাড়িতে আটকে রাখবে? ভারি তো একটা তিন টাকা দামের বাঁধিপোতার গামছা দিয়ে আদিখ্যেতা করতে এসেছে। যেন আমরা গামছা কিনতে পারি না, আমাদের গামছা কেনবার যেন পয়সা নেই! ঢং, মাগী ঢং দেখাতে এসেছে
সদানন্দ রেগে গেল। বললে–তোমার ওসব কথা শুনতে চাই নি আমি, আমি যা জিজ্ঞেস করছি তারই জবাব দাও তুমি, বলো কালীগঞ্জের বউ ভেতর-বাড়িতে এসেছিল কি না–
মা বললে–তা সে যদি এসেই থাকে তো তোর কী? তোর সঙ্গে তার কীসের সম্পর্ক?
সদানন্দ বললে–আমার সম্পর্কের কথা আমি বুঝবো, আমি যা জিজ্ঞেস করছি আগে তার জবাব দাও তুমি—
নয়নতারা চুপ করে সব শুনছিল। এরই সঙ্গে তার কাল বিয়ে হয়েছে। মানুষটাকে খুব রাগী লোক বলে মনে হলো তার কাছে। কিন্তু কালীগঞ্জের বউ কে! বাসর-ঘরে তো এরই কথা হয়েছিল, এখন মনে পড়লো। অথচ আশ্চর্য, এ যে এত রাগী মানুষ চেহারা দেখে তো তা বোঝা যায় না।
কিন্তু ততক্ষণে সদানন্দ সেখান থেকে চলে গিয়েছে। তারপরে আরো রাত হলো। মেয়েদের ভিড়ের মধ্যে বসে বসে আরো অনেক মেয়েলী কথা কানে এল। সবাই তার রূপ দেখে প্রশংসা করছে। সবাই বলছে এমন বউ নাকি হয় না। কথাগুলো শুনতে খুব ভালো লাগলো নয়নতারার। নিজের রূপের প্রশংসা আগেও সে অনেক শুনেছে। বাপের বাড়ির লোকেরা বলতো এ মেয়ে যে বাড়িতে যাবে সে বাড়ি আলো করে রাখবে। বলতো যার সঙ্গে এ মেয়ের বিয়ে হবে সে নাকি বড় ভাগ্যবান। তাহলে এমন রাগারাগি কেন করলে তার সামনে? আর চব্বিশ ঘণ্টা পরেই তো ওই মানুষটার সঙ্গে তাকে একটা বিছানায় এক ঘরে কাটাতে হবে? তাহলে তারই সামনে মার সঙ্গে কেন অত রাগারাগি করতে গেল? তার রূপ দেখে তো তার ভুলে যাওয়া উচিত ছিল! একটা দিনের জন্যেও সে তার রাগ সামলাতে পারলে না? তাহলে কীরকম চরিত্রের মানুষ ও!
তারপর সবাই খেতে বসলো। তাদের মধ্যে নয়নতারাও খেতে বসেছে। খেতে খেতে কত লোকের কত কথা তার কানে এল। কত হাসাহাসি, কত গল্প। সকলেরই নজর নতুন বউ-এর দিকে। ভালো ভালো জিনিস তার পাতে দিয়েছে শাশুড়ী। নয়নতারার মনে হলো শাশুড়ী মানুষটা কিন্তু ভালো।
একবার শাশুড়ী বললে–কই বউমা, তুমি তো কিছু খাচ্ছো না? খাও, এরকম না খেলে চলবে কেন? মাছ খাচ্ছো না যে, ঝাল হয়েছে বুঝি? তুমি বুঝি ঝাল খাও না?
নয়নতারা ঘাড় নেড়ে ইঙ্গিতে জানালে সে ঝাল খায়। আর তা ছাড়া ঝাল সে খাক আর নাই খাক, সব জিনিস ‘হ্যাঁ’ বলতেই সে শিক্ষা পেয়েছে মার কাছে।
মা বলতো–শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে শাশুড়ী যা বলে তাই শুনবে মা, ‘না’ বোল না যেন।
–ঝাল খাও? তা হলে আর একখানা মাছ দেব, খাবে?
গৌরী পিসী বললে–জিজ্ঞেস করছো কেন বউদি, দাও না আর একখানা মাছ।
খেতে খেতে কেবল মার কথাই মনে পড়তে লাগলো নয়নতারার। এমন করে মাও তাকে খাওয়াতো আর বকতো। বলতো–কোথায় কাদের বাড়িতে পড়বি তখন হয়ত পেটই ভরবে না তোর। এখন দিচ্ছি খেয়ে নে। মেয়েমানুষ হয়ে যখন জন্মেছ তখন সব রকম অবস্থার জন্যে তোমাকে তৈরি হয়ে থাকতে হবে মা। বিয়ের আগে আমার কত বায়নাক্কা ছিল, এখন সে-সব কোথায় চলে গেল মনেও পড়ে না আর–
অচেনা মুখ অজানা দেশ, অদেখা পরিবেশ। তাই মার কথাগুলোই বারবার মনে পড়তে লাগলো নয়নতারার।
গৌরী পিসী হঠাৎ ভাবনার মাঝখানে বললে–চলো বউমা। শোবে চলো—
একটা বড় খাট। শ্বশুরের শোবার ঘর। সেখানেই সেদিনকার মত নয়নতারার শোবার ব্যবস্থা হয়েছে। একপাশে শাশুড়ী আর তার পাশে নতুন বউ। বাপের বাড়িতেও বয়েস হবার সঙ্গে সঙ্গে মা তাকে পাশে নিয়ে শুতো। আজই প্রথম অন্য বিছানায় অন্য লোকের পাশে শোওয়া। কাল থেকে আবার আর একজনের পাশে শুতে হবে তাকে।
আস্তে আস্তে চারদিকের সমস্ত শব্দ থেমে এল। রাত বাড়ছে। একটা পাতলা তন্দ্রার মধ্যে মনে হোল যেন কেষ্টনগরে মাও তাকে ভাবছে। মারও তার মতন একলা শুয়ে শুয়ে ঘুম আসছে না হয়ত। মারও যেন মনে হচ্ছে খুকুর কথা। খুকু সেখানে খেলে কিনা, খুকুর চোখে ঘুম এল কিনা। খুকু সেখানে এতক্ষণে হয়ত শাশুড়ীর পাশে শুয়ে মার কথা ভাবছে। আশ্চর্য, মেয়েমানুষের জীবনটাই ভগবান এক আশ্চর্য ধাতুতে গড়েছে! ছোটবেলা থেকে খাইয়ে-পরিয়ে মানুষ করে অন্য লোকের হাতে তুলে দিতে হয়। তারপর সেখানেই সে থাকবে। চিরকালের মত থাকবে। বাবা মার কথা আর ভাববে না। তখন তার নতুন সংসার নিয়েই মেতে থাকবে। তার সেই সংসারকেই সে নিজের সংসার বলে প্রাণপণে আঁকড়ে ধরে থাকবে। এই-ই নিয়ম। সংসারে আদিকাল থেকে বুঝি এই নিয়মই চলে আসছে মানুষের জীবনে।
–কই বউমা, তোমার ঘুম আসছে না বুঝি?
নয়নতারা একটু নড়তেই শাশুড়ী বোধ হয় বুঝতে পেরেছে।
শাশুড়ী বললে–নতুন জায়গা তো, তাই অসুবিধে হচ্ছে। দুদিন বাদে তখন আবার সব অভ্যেস হয়ে যাবে। ঘুমোও, ঘুমোতে চেষ্টা করো। কাল আবার বউভাত, সকাল থেকেই হই-চই শুরু হয়ে যাবে। তখন আর এক দণ্ডের জন্যে দু’চোখ এক করতে পারবে না। যতটুকু এখন পারো একটু ঘুমিয়ে নিতে চেষ্টা করো—
নয়নতারা দু’চোখ বুজে মার কথাগুলোই আবার ভাবতে শুরু করলে। মার কথা ভাবলেই মনটা কেমন আনন্দে ভরে যায়। সেই অন্ধকারের মধ্যে মার কথা ভাবতেই তার ভালো লাগলো তখন। সঙ্গে সঙ্গে নয়নতারার দু’চোখ যেন কখন ঘুমে জড়িয়ে এল।
নয়নতারা স্বপ্ন দেখতে লাগলো। ঠিক স্বপ্ন নয়, অথচ যেন স্বপ্নই! মন খারাপ দেখে বাবা যেন সান্ত্বনা দিচ্ছে–খুকুর কথা ভেবো না তুমি, সে খুব ভালো জায়গায় পড়েছে গো, সে কত বড় বাড়ি, কত জমি-জমা তাদের। তার সেখানে কোনও কষ্ট নেই, সে খুব আরামে আছে, তুমি তার কথা ভেবে মন খারাপ করো না
আসবার সময় মা নয়নতারাকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু খেয়েছিল। বলেছিল–জন্ম এয়োস্ত্রী হয়ে থাকো মা, স্বামীর মন যুগিয়ে চলো, আশীর্বাদ করি হাতের শাঁখা সিঁথির সিঁদুর যেন তোমার অক্ষয় হয়…।
কথাগুলো বলছিল বটে মা কিন্তু মেয়েও যত কাঁদছিল মাও তত কাঁদছিল। তাদের দেখাদেখি আশেপাশে যারা দেখছিল তাদের চোখও আর শুকনো ছিল না। তারপর ট্রেনের টাইম হয়ে যাচ্ছিল। ঘন ঘন তাগাদা দিচ্ছিল বরকর্তা–কই বেয়াই মশাই, এত দেরি হচ্ছে কেন, ওদিকে যে ট্রেন ছেড়ে দেবে–মা-লক্ষ্মীকে একটু তাড়াতাড়ি করতে বলুন—
হঠাৎ যেন তন্দ্রাটা ভেঙে গেল। তন্দ্রাটা ভাঙতেই নয়নতারা ধড়মড় করে চারদিকে চেয়ে দেখলে। একেবারে অন্য পরিবেশ। এখানে কেষ্টনগরের মত দেরি করে ঘুম থেকে উঠলে চলবে না। পাশের দিকে চেয়ে দেখলে জায়গাটা খালি। শাশুড়ী কখন বিছানা ছেড়ে উঠে চলে গেছে টের পায় নি। আর দেরি করলে না সে। বিছানা ছেড়ে উঠলো। হঠাৎ মনে পড়লো ঘোমটা দিতে হবে। আগের মত আর মাথা খালি রাখলে চলবে না।
–ওমা, তুমি উঠেছ?
গৌরী পিসী চুপি চুপি ঘরে উঁকি মেরে দেখতে এসেছিল বউ উঠেছে কিনা। উঠেছে দেখে বললে–ঘুম হয়েছিল তো বউমা? চা খাবে? চা খাওয়া অভ্যেস আছে তোমার?
নয়নতারা বললে–না–
–অভ্যেস নেই? অভ্যেস থাকলে বলল। বলতে লজ্জা করো না। আমাদের এখানে চা হয়। চা খাওয়ার লোক আছে এখানে। তোমার যে মামা-শ্বশুরকে দেখেছো, তোমাকে কেষ্টনগর থেকে এখানে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন, উনি চা খান, চা না হলে ওঁর একদণ্ড চলে না–
বাড়িটাতে তখন আবার লোকজনের গোলমাল শুরু হয়ে গেছে। আজ বউভাত। বিকেলের পর থেকেই লোকজনের আসা শুরু হবে। তার জন্যে চারদিকে ম্যারাপ বাঁধা হয়ে গেছে। তারপর কেষ্টনগর থেকে বাবা ফুলশয্যের তত্ত্ব পাঠাবে। বিপিন আসবে। তার কাছ থেকেই মা-বাবার খবর পাওয়া যাবে। হয়ত মা-বাবা আসতেও পারে। এখন থেকে সারা দিন আর বিশ্রাম নেই কারো।
–নাও নাও বউমা, কুয়োপাড়ে জল দিয়েছে, কাপড়-চোপড় নিয়ে যাও, চান করতে হবে। চলো আমি দেখে দিচ্ছি কোন্ শাড়িটা পরবে তুমি–
সকাল বেলা এবাড়িটার আবার অন্য চেহারা। কাল রাত্রে এখানকার অন্য চেহারা দেখেছে সে। তখন চারদিকের এই গাছপালাবাগান-পুকুর দেখে কেমন যেন জঙ্গল জঙ্গল মনে হয়েছিল তার কাছে। আর আজ রোদ ওঠবার পর সব যেন ধুয়ে মুছে পরিষ্কার হয়ে গেছে। সব কিছু যেন তার কাছে ভালো লাগতে লাগলো।
ততক্ষণে গ্রাম থেকে আরো কজন বউ-ঝি তাকে দেখতে এসেছে। কাল সন্ধ্যেবেলা যারা আসতে পারে নি তারা আজ দিনের আলোয় নতুন বউকে দেখবে। গরীব গ্রামের বউ-ঝি সব। খালি গা, খালি পা। জমিদার বাড়ির নতুন বউকে তারা দূর থেকে একবার শুধু দেখে যাবে। আর তারপর সন্ধ্যেবেলা এসে পাতা পেতে পেট ভরে খাবে আর ছাঁদা বেঁধে নিয়ে যাবে।
হঠাৎ কে যেন একজন দৌড়তে দৌড়তে ভেতরে এল।
–খুড়ীমা, পুলিস এসেছে বার বাড়িতে–
–পুলিস? পুলিসকে আবার কে নেমন্তন্ন করতে গেল রে? পুলিস কী করতে এল রে আবার? বউ দেখবে নাকি?
কথাটা তখন চারদিকেই রটে গেছে। পুলিস-দারোগা কী করতে আসে এখানে! কোনও চুরি ডাকাতি হয়েছে নাকি! না খুনখারাবি!
খবর এল–দারোগাবাবু ওপরে কর্তাবাবুর ঘরে বসে কথা বলছে–
–তাহলে উনি কোথায়? তোদের চৌধুরী মশাই?
–ছোটবাবুও তো সঙ্গে রয়েছেন।
–আর প্রকাশ? প্রকাশ কোথায় গেল। তাকে একবার আমার কাছে ডেকে আন তো বাবা–
সঙ্গে সঙ্গে একজন দৌড়লো শালাবাবুকে ডাকতে। নয়নতারার কানে সব কথাই যাচ্ছিল। তারও কেমন অবাক লাগলো। চুরি! ডাকাতি! খুন! কে কী চুরি করলো! আর যদি খুনই হয় তো কে-ই বা কাকে খুন করলো!
ছেলেটা আবার দৌড়তে-দৌড়তে ভেতরে এল। শাশুড়ী জিজ্ঞেস করলে–কী রে শালাবাবু কী বললে? আসছে?
–হ্যাঁ খুড়ীমা, শুনলাম কে নাকি এখেনে খুন হয়েছে, তাই পুলিস এয়েছে–
–খুন!
নয়নতারার মাথাটা এক মুহূর্তে যেন বোঁ-বোঁ করে ঘুরে উঠলো। খুন! খুন এখানে কখন হলো! কে খুন হলো! কে খুন করলো! কাকে খুন করলো!
নতুন জায়গায় এসে নতুন পরিবেশে কেমন যেন ভয় করতে লাগলো নয়নতারার। এ কেমন বাড়িতে তার বিয়ে হলো! বিয়ের পরের দিনই খুন! গৌরী পিসী সামনে দিয়ে যেতেই নয়নতারা তাকে ডাকলে–পিসীমা, পুলিস এসেছে শুনলুম, শুনলুম কে নাকি খুন হয়েছে?
গৌরী পিসী কথাটা হেসে উড়িয়ে দিলে। বললে–কে জানে বৌমা কে খুন হয়েছে, কার কপাল পুড়েছে–
নয়নতারা তবু ছাড়লে না। বললে–ওই যে কে এসে বলে গেল, তুমি শোন নি?
গৌরী পিসী বললে–আমার কি শোনবার সময় আছে বৌমা, যত ঝক্কি সব আমার ঘাড়ে চাপিয়েছে সবাই। তুমি ও-নিয়ে মাথা ঘামিও না বৌমা, ও-সব ভাববার অনেক লোক আছে এবাড়িতে। খানিক পরেই ফুলশয্যের তত্ত্ব আসবে, তাদের খাওয়া-দাওয়ার বন্দোবস্ত করতে হবে, তারপর গাঁ-সুদ্ধ নেমন্তন্ন হয়েছে, তাদের ঝামেলা সমস্ত আমাকে পোয়াতে হবে–
বলতে বলতে আবার কোন্ দিকে অদৃশ্য হয়ে গেল গৌরী পিসী।
বাড়ির ভেতরে তখন তুমুল কাজের ব্যস্ততা। কারোর যেন সময় নেই। শুধু কয়েকজন গ্রামের বউ-ঝি গিন্নীবান্নী মানুষ তার মুখের দিকে হাঁ করে চেয়ে আছে। যেন এক আজব বস্তুর সন্ধান পেয়েছে তারা নয়নতারার মধ্যে! যেন নয়নতারা তাদের মত মেয়েমানুষ নয়! যেন নয়নতারা অন্য জগতের জীব! তারা তার শাড়ি দেখছে, গয়না দেখছে, গায়ের রং দেখছে। মাথার খোঁপা দেখছে, চোখে চোখ রেখে যেন নয়নতারাকে গিলতে চাইছে সবাই।
হঠাৎ সেই মানুষটার গলা শোনা গেল আবার–মা, মা, মা কোথায়?
নয়নতারা মাথার ঘোমটাটা আরো বড় করে নিচের দিকে টেনে দিলে।
.
জীবনের সঙ্গে মৃত্যুর একটা সহজ সম্পর্ক থাকেই। আমরা তা স্বীকার করি আর না-ই করি। একদিন সদানন্দর জন্ম হয়েছিল এই বাড়িতে। সেদিন এখানে উৎসব হয়েছিল বেশ ঘটা করে। ওই দাদুই সেদিন একটা সোনার হার দিয়ে নাকি নাতির মুখ দেখেছিল! রাণাঘাট থেকে মামলার শুনানী ছেড়ে নবাবগঞ্জে চলে এসেছিল। ভেবেছিল এই জন্ম এই আবির্ভাব এক শুভ-সূচনা। নিজের বংশকে চিরকালের মত সুপ্রতিষ্ঠিত করতেই এই জন্ম। কিন্তু সেদিনকার সেই শুভ-সূচনাকে এই এতদিন পরে এই হত্যা দিয়ে এই মৃত্যু দিয়ে কেন অভিষিক্ত করতে হলো। এও কি সদানন্দর জীবনের ক্রমবিকাশের পক্ষে এতই অপরিহার্য ছিল? কে জানে? নইলে হয়ত সদানন্দর জীবন এমন হতো না। সদানন্দ হয়ত আর পাঁচজনের মত এই নবাবগঞ্জের বংশধর হয়ে দাদু আর চৌধুরী মশাই-এর মত প্রজা খাতক আর সেরেস্তার কাগজপত্রের মধ্যেই জীবন কাটিয়ে দিত।
তাই সেদিন যখন চৌধুরীবাড়িতে সবাই বৌভাতের উৎসব-অনুষ্ঠানের আয়োজনে হিম সিম খেয়ে মরছে তখন সদানন্দ একবার কালীগঞ্জ আর একবার থানা-পুলিস নিয়ে ব্যস্ত হয়ে আকাশ-পাতাল পরিশ্রম করে বেড়াচ্ছিল।
কিন্তু দারোগাবাবু কোথাও কিছু খুঁত পেলে না। আতা গাছের তলায় চণ্ডীমণ্ডপের পেছনে বংশী ঢালীর যে আস্তানা ছিল সেখানেও সরেজমিনে তদন্ত করলে। কিন্তু সেখানে সব কিছুই স্বাভাবিক। কোথাও কিছু ব্যতিক্রম নেই।
অথচ এখানেই কাল মেয়েমানুষের গলার আর্তনাদ শুনতে পেয়েছিল সদানন্দ। অন্ধকারের মধ্যে অবশ্য স্পষ্ট কিছু দেখতে পাওয়া যায়নি। কিন্তু তার মনে হয়েছিল যেন কেউ কাউকে সেখানে খুন করে ফেলে রেখে গেছে। তখন যেন মানুষটা পুরোপুরি জ্ঞান হারায়নি। তখনও যেন চেষ্টা করলে তাকে বাঁচানো যায়। আর সেখানেই তার হাতে আর গেঞ্জিতে রক্তের ছাপ লেগেছিল।
দারোগাবাবু বললে–কিন্তু আমি তো কিছু অস্বাভাবিক দেখছি না এখানে–
বংশী ঢালীকেও জেরা করলো দারোগাবাবু। বংশী ঢালী বললে–হুজুর, আমি তো রাত্তিরে এখানেই শুয়েছি, আমার হাতে পায়ে তো রক্তের দাগ লাগেনি–
–তাহলে সদানন্দবাবুর গেঞ্জিতে রক্তের দাগ কোত্থেকে এলো?
–তা আমি কী করে জানবো হুজুর।
–বাড়িতে আর কোথাও কি মাছ মাংস কাটা হচ্ছিল?
–হ্যাঁ হুজুর, বাড়িতে অনেক লোক খাবে, খোকাবাবু সেখানে গিয়েছিলেন, হয়ত সেখানেই রক্ত লেগে থাকবে–
–শুধু বংশী ঢালী নয়, প্রকাশ মামাও সেই একই কথা বললে—
সদানন্দ বললে–তাই-ই যদি হবে দারোগাবাবু, তাহলে কালীগঞ্জের বউ গেল কোথায়? কালীগঞ্জে আমি কাল রাত্তিরেই গিয়েছিলুম, সেখানে তো তিনি ফিরে যাননি। সঙ্গের পালকি বেহারারাও ফিরে যায়নি কেউ। তারা তাহলে সবাই গেল কোথায়?
দারোগাবাবু বললে–সে এনকোয়ারি করবে কালীগঞ্জের দারোগা। কালীগঞ্জ আমার এক্তিয়ারের বাইরে।
–তাহলে? তাহলে একটা লোক খুন হয়ে যাবে আর আপনারা কেউ তার কোনও প্রতিকারই করবেন না? একজন নির্দোষ মানুষ অকারণে তার প্রাণ হারাবে? আপনি তাহলে একবার নিজে কালীগঞ্জে চলুন। নিজে সেখানে গিয়ে একবার একোয়ারি করুন–
কিন্তু সদানন্দ তখন জানতো না যে পাপেরও শেকড় থাকে। গাছের শেকড়ের মত পাপের শেকড়ও সারা দেশময় সারা পৃথিবীময় শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে নিজের অস্তিত্ব বজায় রাখে। আরো জানতো না যে দারোগা নবাবগঞ্জের খুনের তদন্ত করতে এসে কোনও খুঁত পায় না, কালীগঞ্জের দারোগার চরিত্রেও এই দারোগার পাপের রক্ত তার শেকড়ের শাখা বিস্তার করে রেখে দিয়েছে। বংশী ঢালীদের পাপ আবিষ্কার করে এমন সাধ্য শুধু নবাবগঞ্জের দারোগার কেন পৃথিবীর কোনও গঞ্জের দারোগারই বুঝি নেই।
কিন্তু তবু হাল ছাড়বার পাত্র নয় সদানন্দ। তবু সদানন্দ বললে–না, আমি তাহলে কালীগঞ্জের দারোগার থানায় যাই–
প্রকাশ মামা বললে–আরে তুই কি সত্যিই পাগল হলি সদা?
সদানন্দ বললে–পাগল আমি, না তোমরা? তোমরা সবাই পাগল। শুধু পাগল নয়, তোমরা শয়তান….
কথাটা বলে সদানন্দ বাইরে বেরিয়ে চলে যাচ্ছিল। প্রকাশ মামা তাকে ধরে ফেললে। বললে–কোথায় চললি তুই?
সদানন্দ বললে—কালীগঞ্জে–
প্রকাশ মামা বলে উঠলো-কালীগঞ্জে যাবি? কিন্তু বাড়িতে যে আজ তোর বৌভাত রে? তোর ফুলশয্যে
–বৌভাত ফুলশয্যা তো আমার কী?
–তার মানে? তোর বৌভাত তোর ফুলশয্যা, তোর জন্যেই তো এই সব কিছু! আমি যে এই খেটে মরছি, এ কার জন্যে? তোর জন্যেই তো! এই যে হাজার হাজার টাকা খরচ হচ্ছে, এ সবই তো তোর জন্যে আর তোর বউ-এর জন্যে! তুই-ই তো মজা মারবি, আর আমরা তো শুধু বুড়ো আঙুল চুষবো–
সদানন্দ বললে–কিন্তু আমার জন্যেই যদি এত সব, তাহলে আমার টাকা দিলে না কেন তোমরা?
–টাকা?
–হ্যাঁ, কালীগঞ্জের বৌকে যে দশ হাজার টাকা দেবার কথা ছিল তা দিলে না কেন দাদু? টাকা দিলে তো কোনও গণ্ডগোলই হতো না আর! তাহলে আমিও কিছু বলতুম না। টাকা তো দিলেই না, তার ওপর পাছে টাকা দিতে হয় তাই কালীগঞ্জের বৌকে খুন পর্যন্ত করলে বংশী ঢালীকে দিয়ে–
প্রকাশ মামা বললে–খুন? খুন হলে তুই বলতে চাস পুলিস-দারোগা টের পেত না? খুন বললেই ওমনি খুন করা যায়? তুই যা-তা বলছিস কেন?
সদানন্দর চোখ দিয়ে ততক্ষণে জল গড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে।
প্রকাশ মামা সদানন্দর চোখে জল দেখে থমকে গেল। বললে–এ কি রে, তুই কাঁদছিস? আজকে এত বড় একটা শুভদিনে তুই চোখের জল ফেলছিস! ছিঃ…
সদানন্দর তখন আর কথা বলবার ক্ষমতা নেই যেন। বললে–আমাকে ছাড়ো তুমি মামা, আমাকে ছাড়ো–-ছেড়ে দাও–
প্রকাশ মামা তখন আরো জোরে জাপটে ধরলে সদানন্দকে। বললে–পাগলামি করিস নে সদা, ছেলেমানুষি করবার তোর বয়েস নেই আর। এ সব জিনিস দশ বছর আগে করলে তখন মানাতো। এখন লোকে নিন্দে করবে তোর। তা ছাড়া এখুনি ফুলশয্যের তত্ত্ব আসবে। কেষ্টনগর থেকে, তারপর তোর শ্বশুর-শাশুড়ী আসবে–তারপর গা-সুষ্টু লোককে নেমন্তন্ন করা হয়েছে, তারা সব শুনে কী ভাববে বল তো…
হঠাৎ কীর্তিপদবাবু সেখান দিয়ে যেতে গিয়ে ঘটনাটা দেখে অবাক হলেন। প্রকাশ তার নাতিকে অমন করে জাপটে ধরে আছে কেন? সঙ্গে সঙ্গে কাছে এলেন। জিজ্ঞেস করলেন–কী রে প্রকাশ, খোকাকে অমন করে ধরে কী করছিস? ও কী করেছে?
প্রকাশ সদানন্দকে তেমনি করে জড়িয়ে ধরেই বললে–দেখুন না পিসেমশাই আপনার নাতির কাণ্ড! পালিয়ে যাচ্ছে বাড়ি ছেড়ে–
–পালিয়ে যাচ্ছে মানে? কেন পালাচ্ছে? কোথায় পালাচ্ছে?
প্রকাশ মামা বললে—কালীগঞ্জে–
–কালীগঞ্জে? কালীগঞ্জে কার কাছে? আচ্ছা, ব্যাপারটা কী বল্ তো রে প্রকাশ? কাল থেকে কালীগঞ্জের বৌ-এর কথা শুনছি, কে সে? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।
প্রকাশ মামা বললে–সে পিসেমশাই পরে আপনাকে সব বুঝিয়ে বলবো, এখন একে ধরে না রাখলে সব কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে–
কীর্তিপদবাবু বললেন–পরে আর তোর সময় হয়েছে। পুলিসের দারোগা কেন এসেছিল তাও তো কেউ কিছু বললি নে। সবাই বলছে এখন সময় নেই, পরে বলবে! আর পরে কখন সময় হবে? আমি মরে গেলে তখন কে শুনতে আসবে–
প্রকাশ মামা সে কথায় কান না দিয়ে চেঁচিয়ে ডাকতে লাগলো–দীনু, ও দীনু–
দীনু আসবার আগে চৌধুরী মশাই-এর কানে গেল প্রকাশের চিৎকারের শব্দ। বারান্দায় মুখ বাড়িয়ে দেখেই বেরিয়ে এলেন। শুধু তিনি একাই নন্। কাণ্ড দেখে অনেকেই এসে জুটলো। বিয়েবাড়ির ভিড়ের মধ্যে এমন কাণ্ড দেখে অনেকেই এসে জটলা করলো।
দীনু দৌড়তে দৌড়তে এসে জিজ্ঞেল করলে–আমায় ডাকছিলেন শালাবাবু–
কিন্তু ততক্ষণে জায়গাটা ভিড়ে ভিড় হয়ে গেছে। সাধারণ লোক যারা কাজকর্ম করতে ব্যস্ত তারাও হাতের কাজ ফেলে এসে কাছে দাঁড়ালো। ওদিকে ভিয়েনের জায়গায় পুরোদমে কাজ চলছিল। মিষ্টিগুলো তৈরি করে গামলায় তুলে এক-এক করে ভাঁড়ারে গিয়ে জমা করে আসছে। আর পুকুরের পাড়ে ময়দা মাখা হচ্ছিল। সন্ধ্যে হবার পর লুচি ভাজতে আরম্ভ করবে। তার আগে ডাল, মাছের কালিয়া, মাংস রান্না করে ভাঁড়ারে তোলা হচ্ছে।
চৌধুরী মশাই বিচক্ষণ লোক। তিনি কোনও দিনই বেশি কথা বলেন না। সামান্য একটুখানি শুনেই বললেন–প্রকাশ, এখান থেকে সরে এসো, বড় লোকের ভিড়–চণ্ডীমণ্ডপে নিয়ে এসো খোকাকে, ওখেনে গিয়ে শুনবো সব–
কীর্তিপদবাবু একবার শুধু বলতে চেষ্টা করলেন ব্যাপারটা কী তাই খুলে বলো না তোমরা, আমি যে কিছুই বুঝতে পারছি না–
চৌধুরী মশাই শ্বশুরের দিকে চেয়ে বললেন–ও কিছু না, ও নিয়ে আপনি কিছু ভাববেন না —
বলে প্রকাশের সঙ্গে চণ্ডীমণ্ডপের দিকে সদানন্দকে নিয়ে চললেন। কিন্তু কীর্তিপদবাবু জামাই-এর কথায় খুশী হলেন না। তিনিও জামাই-এর পেছন পেছন চলতে লাগলেন। বললেন–ভাববো না মানে? সব কাজে তোমরা কেবল আমাকে ভাবতে বারণই করছে, তা আমিও তো একটা মানুষ, না কী? আমি বুড়ো হয়েছি বলে আমায় কিছু জানতে নেই?
কিন্তু কে আর তাঁর মত বুড়ো মানুষের কথায় কান দেয়। তিনি যে এত সম্পত্তি করেছেন, তিনি যে এত টাকার মালিক, তার জন্যেও কেউ তাঁর কোনও মূল্য দিচ্ছে না। তিনিও পেছনে-পেছনে চণ্ডীমণ্ডপে গিয়ে সকলের সামনে দাঁড়ালেন। বললেন–আমাকে তোমরা কেউ কিছু বলছো না কেন? আমি বুড়ো হয়েছি বলে কি তোমাদের কিছু সাহায্যও করতে পারবো না?
চৌধুরী মশাই শ্বশুরের এই অন্যায় কৌতূহল বরদাস্ত করতে পারছিলেন না। বললেন– আপনি বৃদ্ধ হয়েছেন, আপনাকে আমরা এ-সব ব্যাপারের মধ্যে কষ্ট দিতে চাই না। আপনি তামাক খান না নিজের ঘরে বসে–দীনু আপনাকে তামাক সেজে দিচ্ছে–
–তুমি থামো! সব কথায় কেবল আমার বয়েস দেখাও কেন?
কীর্তিপদবাবু রেগে গেলেন এবার। বলতে লাগলেন কী হয়েছে তাই বলো!
তারপর সকলকে অগ্রাহ্য করে একেবারে সোজা সদানন্দকে ধরলেন।
বললেন–কী হয়েছে বলো তো দাদা? তোমার কী হয়েছে? তুমি কাঁদছো কেন? আমি এসে পর্যন্ত দেখছি তুমি যেন কী রকম হয়ে গেছ! গায়ে-হলুদের দিনে তুমি কোথায় লুকিয়ে রইলে। তারপর সকাল বেলা পুলিস-দারোগা এসে কী সব তদন্ত করে গেল। তারপর এখন আবার এই কাণ্ড। বলো তো এসব কী ব্যাপার? আমার কাছে কিছু লুকিও না–
হঠাৎ কৈলাস গোমস্তা এসে হাজির হলো।
বললে–বেয়াই মশাই, আপনাকে কর্তাবাবু একবার ডেকেছেন—
কীর্তিপদবাবু বললেন–দাঁড়াও বাপু, এখন এই ব্যাপারটার একটা ফয়সালা হয়ে যাক্–
ওদিকে ভিড়ের লোকজন আস্তে আস্তে সবাই এসে হাজির হয়েছিল চণ্ডীমণ্ডপের সামনে। প্রকাশ মামার এতক্ষণে সেদিকে নজর পড়েছে। তাদের দিকে চেয়ে তেড়ে গেল–এই, তোরা এখানে কী করতে এসেছিস, যা বেরিয়ে যা এখেন থেকে। কাজকর্ম কিছু নেই তোদের? যা, এখান থেকে ভাগ–
ক্রমে ক্রমে খবরটা বাড়ির ভেতরেও পৌঁছে গেল। খোকা নাকি বাড়ি থেকে চলে যাচ্ছিল, শালাবাবু তাকে ধরে রেখেছে। ছোটবাবু সকলকে ডেকে নিয়ে গেছে চণ্ডীমণ্ডপে।
প্রীতি ভাঁড়ার ঘরের কাজে ব্যস্ত ছিল।
কথাটা শুনেই বললে–কেন, চলে যাচ্ছিল কেন খোকা? কোথায় যাচ্ছিল?
গৌরী পিসী বললে–চুপ করো বউদি, অত চেঁচিও না। নতুন বউ-এর কানে যাবে শেষকালে, একটু গলা নামিয়ে কথা বলো–
কর্তাবাবু নিজের ঘরে বসে তখন ছটফট করছিলেন। কৈলাস গোমস্তা ফিরে আসতেই বললেন কী হলো? বেয়াই মশাই এলেন না?
–হ্যাঁ, আসছে।
–খোকাকে আটকে রাখতে বলেছো তো? যেন পরশু দিনের মত বেরোতে না পারে!
–হ্যাঁ বলেছি। ছোটবাবু ধরে রেখেছেন খোকাবাবুকে।
–যদি কোনোও ফাঁকে বেরিয়ে যায়? শেষকালে ফুলশয্যার দিন যেন কেলেঙ্কারি করে না বসে।
কৈলাস গোমস্তা বললে–না, সে ব্যবস্থা পাকা হয়ে গেছে। খোকাবাবুকে আর একলা ছাড়া হবে না। বংশীকেও বলে দিয়েছেন ছোটবাবু, যেন তার ওপর নজর রাখে।
ততক্ষণে কীর্তিপদবাবু এসে গেলেন। এসেই বললেন–বড় চিন্তায় পড়লুম বেয়াই মশাই, খোকা তো আগে এরকম ছিল না। ছোটবেলায় কত মজার মজার কথা বলতো। আর এখন একেবারে অন্য রকম হয়ে গিয়েছে দেখছি
কর্তাবাবু বললেন–বড় বেয়াড়া হয়ে গেছে আজকাল। কারো কথা শোনে না–
কীর্তিপদবাবু বললেন–ভালোই করেছেন যে বিয়েটা দিয়ে দিয়েছে, বিয়েটা কম বয়সে দিয়ে দেওয়াই ভালো
কর্তাবাবু বললেন–আরো আগে বিয়ে দিয়ে দিলেই ভালো হতো। কিন্তু ভালো-মতো পাত্রী তো এতদিন পাওয়া যাচ্ছিল না–তাই–
কীর্তিপদবাবু প্রবীণ বিচক্ষণ মানুষ। বললেন–দেখুন বেয়াই মশাই, বয়েস হয়েছে বলে কেউ আমাদের কথাই শুনতে চায় না আর, যেন আমরা কখনও কম বয়েসের ছিলাম না। এই-ই হয় বেয়াই মশাই, এই-ই হয়–
কর্তাবাবু বললেন–ওসব আর ভাববেন না বেয়াই মশাই, আমাদের যুগ চলে গেছে, আমরা বাতিল–
কীর্তিপদবাবু বললেন–কিন্তু কী ব্যাপারটা বলুন তো, খোকা ওরকম বেয়াড়া হলো কেন? কে কালীগঞ্জের বউ? তার কী হয়েছে?
কর্তাবাবু বললেন–পাগলের কথার কি মনে আছে? সেই কথায় আছে না, পাগলে কী-ই না বলে আর ছাগলে কী-ই না খায়! আপনি তামাক খান, কৈলাস, বেয়াই মশাইকে তামাক দিতে বলো–
কিন্তু এ প্রসঙ্গ বেশিক্ষণ চললো না। কথার মধ্যেই বাধা পড়লো। হঠাৎ নিচে থেকে শাঁখ বাজার আওয়াজ হলো।
–ওই ফুলশয্যার তত্ত্ব এসেছে বোধ হয় কেষ্টনগর থেকে। কৈলাস যাও যাও, দেখে এসো–
সত্যিই তখন একতলায় হই-হই ব্যাপার। বিপিনই ফুলশয্যার তত্ত্ব নিয়ে এসেছে দলের মাথা হয়ে। অনেক দূর থেকে তত্ত্ব এসেছে। শাঁখ বাজার শব্দ শুনেই গ্রাম থেকে ছেলে বুড়ো ছুটে এসেছে। অন্তত বারোজন লোক হবে। সকলের হাতেই জিনিসপত্র। রেল বাজার থেকে চারখানা গরুরগাড়ি ভর্তি জিনিসপত্র তারা নিয়ে এসেছে। বড় বড় বারকোষ, হাঁড়ি, থালা, ফলের ঝুড়ি, ছানার মিষ্টি, ফুলের ঝোড়া, দই-এর হাঁড়ি, কোচানো শাড়ি। জামাই এর ধুতি-পাঞ্জাবি।
–ঠাকুর, কড়ায় লুচি ছেড়ে দাও, বারোজন লোকের মতন। একসঙ্গে খেতে বসবে–
ভেতর বাড়িতেও সাজ-সাজ রব পড়ে গেল। চওড়া জরির শান্তিপুরে শাড়ি পরে বাড়ির গিন্নী সমস্ত কিছু তদারক করছে। আশেপাশের বাড়ি থেকে পাড়ার বুড়ী গিন্নী বান্নি মানুষেরা এসে পরামর্শ দিচ্ছে। কেউ পান সাজতে বসেছে। কেউ তরকারি কুটছে।
বেহারী পালের বউ ক’দিন থেকেই আসছে। বিয়েবাড়ির কাজ-কর্ম করে দিয়ে অনেক রাত্রে আবার নিজের বাড়ি চলে যায়।
সেদিন বললে–হ্যাঁ বউমা, সদার নাকি কী হয়েছে?
প্রীতি বললে–কী আবার হবে মাসীমা? কই, সদার তো কিছু হয়নি–
–শুনলুম নাকি সদা বলছে বাড়ি থেকে পালিয়ে যাবে। গাঁয়ে কত রকমের কথা উঠেছে, উনি নাকি বারোয়ারিতলা থেকে শুনে এসেছেন–
প্রীতি বললে–কী জানি মাসীমা, তুমি তো এ কদিন আসছো, নিজের কানে কিছু শুনেছ?
বেহারী পালের বউ সেই কথা বললে। বললে–আমি তো কর্তাকে তাই-ই বললুম, বললুম সদার যদি বউ পছন্দ না হয়ে থাকে তো আমার কানে সে-কথা একবার আসতোই–
প্রীতি বললে–পাড়ার লোকের কথা ছেড়ে দাও মাসীমা। পাড়ার লোকে তো অনেক কথাই বলে। তুমি নিজের চোখেই তো বউ দেখলে। অমন বউ কজনের বাড়িতে দেখেছ বলতে পারো? ছেলের অপছন্দ হবার মত কি বউ করেছি আমি? বলুক দিকিনি কেউ–
কিন্তু তখন অত কথা বলবার আর সময় নেই কারো। তবু বেহারী পালের বউ বললে–তোমার গুণের ছেলে বউ, পাস করা ছেলে, তুমি যদি এমন বউ ঘরে না আনবে তো কে আনবে বলো? কার এমন সাধ্যি আছে?
কথার মাঝখানেই গৌরী পিসী এসে বাধা দিলে। বললে–শুনেছ বউ, কেষ্টনগর থেকে তোমার বেয়াই-বেয়ান কেউই আসছে না–
–কেন?
–তাই তো শুনলুম। ফুলশয্যের লোকেরা এসে তাই তো বলছে। বলছে পণ্ডিত মশাই এখানে এসে তো কিছু খাবেন না। তাই আর আসেননি। আর অনেক দূরের রাস্তা। ওরা সবাই বউমার সঙ্গে দেখা করতে চাইছে–
–তা বউমার কাছে নিয়ে যা না ওদের।
নয়নতারা তেমনি করেই চুপ-চাপ বসে ছিল। তার আগেই সাজানো-গোছানো হয়েছে বউকে। নতুন একখানা বেনারসী পরেছে। গা-ভর্তি গয়না। বিপিন আসতেই নয়নতারা চোখ তুলে চাইলে।
জিজ্ঞেস করলে–বাবা আসবে না বিপিন?
বিপিন বললে–না দিদিমণি, তা তুমি ভালো আছে তো? কোনও অসুবিধে হচ্ছে না তো?
সেকথার উত্তর না দিয়ে নয়নতারা বললে–আর মা? মা কেমন আছে?
–মা একটু কান্নাকাটি করছিল। কিন্তু এখন চুপ করেছে। বলছে মেয়ে যখন হয়েছে তখন তো পর হয়ে যাবেই।
নয়নতারা বললে–তুমি গিয়ে মাকে বোল আমি এখানে খুব ভালো আছি, আমার কোনও অসুবিধে হচ্ছে না। তোমাদের খাওয়া-দাওয়া হয়েছে?
–হ্যাঁ দিদিমণি। খুব খেয়েছি পেট ভরে। বড় বড় মাছ, মাংস, মিষ্টি, দই খুব খেয়েছি। তোমার শাশুড়ী খুব ভালোমানুষ, নিজে দাঁড়িয়ে থেকে আমাদের খাইয়েছেন। এখানকার সবাই-ই খুব ভালো লোক। সঙ্গে নিয়ে যাবার জন্যে আবার চার হাঁড়ি মিষ্টি দিয়েছেন এঁরা–
কিন্তু বেশিক্ষণ কথা বলবার সময় হলো না। বাইরে ততক্ষণে আবার শানাই বেজে উঠলো। একে একে আবার লোকজন আসতে লাগলো নয়নতারার ঘরে। নবাবগঞ্জ ঝেটিয়ে লোক আসবে আজ। এ তারই সূচনা। সব অচেনা মুখ। তারা এসে ঘর জোড়া করে বসলো। সকলের চোখই নয়নতারার দিকে। নয়নতারা বুঝতে পারলো সবাই তার মুখের দিকেই হাঁ করে দেখছে। আজকে বুঝি সমস্ত সন্ধ্যেটাই এই রকম চলবে। আজকে নয়নতারাই বুঝি এবাড়ির সব চেয়ে বড় আকর্ষণ!
কর্তাবাবু একসময় ছেলেকে ডেকে পাঠালেন। চৌধুরী মশাই আসতেই কর্তাবাবু জিজ্ঞেস করলেন–কী খবর, ও-দিকের খবর কী?
চৌধুরী মশাই বললেন–সব তো ঠিকই চলছে। ফুলশয্যার লোকদের সকলকে খাইয়ে দাইয়ে পাঠিয়ে দিলুম। তাদের তো আবার ট্রেন ধরতে হবে–
কর্তাবাবু বললেন না, আমি ও কথা বলছি না, বলছি খোকা কোথায়?
চৌধুরী মশাই বললেন–খোকা আর তো কোনও গণ্ডগোল করছে না–
–ওই তোমাদের বুদ্ধি! গণ্ডগোল না করলেও, কখন কী করে ফেলে তা কি বলা যায়? আমি যে বলেছিলাম একটু চোখে চোখে রাখতে, রেখেছ?
চৌধুরী মশাই বললেন–হ্যাঁ, তার জন্যে তো প্রকাশকে বলে রেখেছি–
–প্রকাশ কে?
–আমার শালা। সে পাকা লোক। তার চোখ এড়াতে পারবে না খোকা—
কর্তাবাবু বললেন–তবেই হয়েছে। তোমাকে বলেছি না তুমি নিজে একটু নজর রাখবে। একলা ছাড়বে না ওকে মোটে, আর বংশীদেরও বলে রেখেছ?
–হ্যাঁ, বলেছি।
–বংশীরা যেন সবাই মিলে ওর আশেপাশে থাকে। যেন চোখের আড়াল না করে, বলে দিও–
চৌধুরী মশাই বললেন–হ্যাঁ, বলে রেখেছি
–ঠিক আছে, যাও, তুমি ও-দিকটায় দেখ গিয়ে, আমার এদিকে তোমাকে বেশি আসতে হবে না–
চৌধুরী মশাই আর দাঁড়ালেন না। চলে গেলেন। নিচের অনেক লোকজনের শব্দ কানে এল। সকলে খেতে বসেছে। সমস্ত বাড়িটাতেই অতিথি-অভ্যাগতের ভিড়। বাইরে থেকে শানাই বাজতে শুরু করেছে। কর্তাবাবু যেন খানিকটা নিশ্চিন্ত হলেন মনে মনে। ফুলশয্যাটা কাটলেই পুরোপুরি নিশ্চিন্ত হতে পারবেন। তারপর একটা রাত কাটলেই আর ভয় নেই। তখন খোকা আস্তে আস্তে সংসারী হয়ে উঠবে। তখন পাগলামি চলে যাবে তার। ওই বেয়াই মশাই যা বলেছেন তাই হবে। কাঁধে জোয়াল পড়লেই মানুষের দায়িত্ববোধ আসে।
ক্রমে আরো লোকের ভিড় বাড়লো। আওয়াজের মাত্রা আরো বেড় গেল। নবাবগঞ্জের আকাশে অঘ্রাণ মাসের রাত আরো ঘন হলো। তার মনে পড়তে লাগলো সেই নবদ্বীপের ঘাটে বুক-জলে নেমে হর্ষনাথ চক্রবর্তীর শেষ কথাগুলো। আশ্চর্য! প্রথমে হাঁটু-জল, তারপরে কোমর-জল। তারপরে বুক-জল, তারপরে গলা-জল। তখন সূর্য উঠেছে নতুন। গঙ্গার ঘাটে আরো কিছু স্নানার্থী এসেছে। তারাও ব্যাপারটা লক্ষ্য করছিল।
–নারাণ!
কর্তাবাবু বললেন–বলুন হুজুর–
হর্ষনাথ চক্রবর্তী বললেন–আমি চললুম নারাণ। ওদের ভার তোমার ওপর রেখে দিয়েই চললুম। তুমি ওদের দেখো—বুঝলে–
কর্তাবাবু বলেছিলেন–আপনি কিছু ভাববেন না হুজুর, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন–
হর্ষনাথ চক্রবর্তী বললেন–তুমি যদি না–ও দেখো, তবু আমার কিছু বলবার নেই নারাণ, আমার কিছু করণীয়ও নেই, আমার সব আসক্তি আজ দূর হয়ে গেছে। ভেবেছিলাম তামাকের আসক্তিটাই আমি কাটিয়ে উঠতে পারব না। তা এখন সে আসক্তিটাও দূর করেছি। এখন চলি-বলে তিনি সংস্কৃত শ্লোক আবৃত্তি করতে লাগলেন।
জবাকুসুমসংকাশং
কাশ্যপেয়ম্ মহাদ্যুতিং…
সূর্যস্তব পাঠ করতে লাগলেন হর্ষনাথ চক্রবর্তী মশাই অনেকক্ষণ ধরে। কর্তাবাবু ওসব সংস্কৃত বোঝেন না। তিনি তখনও জলের ভেতর দাঁড়িয়ে হুজুরকে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। তারপর একসময় হঠাৎ তিনি নির্বাক হয়ে গেলেন। চোখ দুটো ঊর্ধনেত্র হলো। আর তারপরেই সব শেষ!
কোথায় গেলেন তিনি। আর কোথায় রইলেন নরনারায়ণ চৌধুরী। তিনি আসক্তি ত্যাগ করতে পেরেছিলেন। কিন্তু কর্তাবাবু কোন্ দুঃখে আসক্তি ত্যাগ করবেন। তাঁর যে এখনও অনেক কামনা-বাসনা বাকি! এখনও অনেক আকাঙ্খা তার। এই আজ খোকার বউ-ভাত। এখনই খোকা সংসারী হলো। তারপর একদিন তার সন্তান হবে। তারপরে সেই সন্তানেরও আবার একদিন সন্তান হবে। এমনি করে তিনিই এই বংশধারার পরিক্রার মধ্যে অনন্তকাল ধরে বেঁচে থাকবেন। তাঁর বংশের শাখা-প্রশাখার মধ্যেই তিনি অজর-অমর হয়ে নিঃশ্বাস প্রশ্বাস ত্যাগ করবেন। তবেই হয়ত তখন তাঁর চিরকালের সাধ-আহ্লাদ-আশা মিটবে। তার আগে কিছুতেই নয়।
অনেক রাত্রে বাইরের কল-কোলাহল স্তিমিত হয়ে এল। নয়নতারাকে ফুলশয্যায় বসিয়ে দিলে বেহারী পালের বউ।
বললে–বেশি রাত কোর না মা আজ, ঘুমিয়ে পড়, নইলে তোমারও শরীর খারাপ হবে, সদার শরীরও খারাপ হবে, কাল থেকেই তো তোমাদের শরীরের ওপর দিয়ে ধকল যাচ্ছে–
ফুলের গন্ধ এসে নাকে লাগছিল নয়নতারার। চারিদিকেই ফুল। ফুলের পাহাড় চারদিকে। অনেক ফুল যোগাড় করা হয়েছিল। পদ্মফুল এসেছিল চৌধুরীদের বিল থেকে। নয়নতারার কেমন যেন ভয় করতে লাগলো। মা বাবা কেউই এল না। এ বাড়িতে সবাই পর। কেউই তার আপন নয়। তবু শ্বশুর-শাশুড়ী সবাই-ই কাল থেকে খুব ভালো ব্যবহার করে আসছে–
শাশুড়ী বার বার বলেছে–লজ্জা করো না বউমা। পেট ভরে খাও। মনে করো না যেন এখানে তোমার কেউ নেই। তোমার শ্বশুরও আমাকে তোমার কথা বার বার জিজ্ঞেস করেছেন। আর একটা সন্দেশ দেব?
তারপর যখন আরো রাত হলো হঠাৎ ঘরের দরজাটা আবার খুলে গেল। নয়নতারা আন্দাজে বুঝতে পারলে কে ঘরে ঢুকেছে। কিন্তু সাহস করে চোখ তুলে চাইতে পারলে না। বুকটা থর-থর করে কাঁপতে লাগলো। মনে হলো যেন সে অজ্ঞান হয়ে যাবে।
সদানন্দ সবে ঘরে ঢুকেছে।
পেছন থেকে প্রকাশ মামা বললে–দরজায় খিল দিয়ে দে রে, খিল দিয়ে দে—
কিন্তু তবু যেন তার হাত উঠতে চাইল না। প্রকাশ মামা আবার পেছন থেকে তাগিদ দিলে–কই রে সদা, খিল দিলি নে?
খাওয়া-দাওয়ার পর থেকেই প্রকাশ মামা কানে কানে বলছিল–আমি যা বলেছি, সব তোর মনে আছে তো? ভুলিস নি তো?
সদানন্দ বললে–কী?
–মনে নেই? তোকে এত করে পাখি-পড়ানো করে শিখিয়ে দিলুম আর এখন কিনা তুই বলছিস কী? তোকে নিয়ে আমি কি করবো বল দিকিনি।
সদানন্দ এ-কথার কিছু জবার দিলে না।
প্রকাশ মামা বললে–আরে ফুলশয্যের রাত একবারই তো আসে মানুষের জীবনে, তুই দেখছি শেষকালে সব গুবলেট করে ফেলবি। আমার মান-ইজ্জৎ সব ডোবাবি। ভাগ্নেবউ শেষকালে আমার নামেই খোঁটা দেবে। বলবে এমন বরের সঙ্গে আমার বিয়ে দিয়েছে যে একটা আস্ত আনাড়ির ডিম–
কিন্তু সদানন্দ সেই ঘরের মধ্যে ঢুকতেই যেন তার মাথার ওপর বিকট শব্দে একটা বাজ ভেঙে পড়লো। সামনের দিকে চাইতেই মনে হলো কে যেন ছাদের কড়িকাট থেকে ঝুলছে। মুখটা যেন চেনা-চেনা। যেন ঠিক কপিল পায়রাপোড়া…… পরনের কাপড়টা গলায় ফাঁস দেওয়া….. ঝুলছে…..
পেছন থেকে প্রকাশ মামা আবার তাগিদ দিলে কই রে, সদা, দিলি নে? খিল দে–
কর্তাবাবুর কাছে রিপোর্ট দিতে গেলেন চৌধুরী মশাই। বললেন–সব নিশ্চিন্তে চুকে গেছে বাবা–
কর্তাবাবু এই খবরটার আশাতেই রাত জেগে বসেছিলেন। বললেন–আর খোকা?
পেছনে প্রকাশ মামাও ছিল। সে এগিয়ে গিয়ে বাহাদুরি নেবার চেষ্টা করলে।
বললে–আমি এই এখুনি তাকে ঘরের মধ্যে ঠেলে ঢুকিয়ে দিয়ে তবে সেখান থেকে আসছি–আর যেতে কি চায়, ঠেলে ঘরে ঢুকিয়ে দিলাম–
–ঘরে খিল দিয়েছে তো?
প্রকাশ মামা বললে–খিল দিতে কি চায়? প্রথমে দিচ্ছিল না, তারপর আমি পিছন থেকে তাগিদ দিয়ে দিয়ে খিল্ বন্ধ করিয়ে তবে ছেড়েছি…
কর্তাবাবু নিশ্চিন্ত হলেন। একটা আত্মতৃপ্তির দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল তাঁর বুক থেকে। অবশ পা দুটো অভ্যাসমত ছড়াবার চেষ্টা করলেন। কিন্তু ব্যর্থ চেষ্টা করেও পারলেন না।
তারপর বললেন–আচ্ছা, ঠিক আছে, যাও, এবার তোমরা বিশ্রাম করো গে—
.
শুধু যে তাতে কর্তাবাবুই নিশ্চিন্ত হলেন তা-ই নয়, হয়ত নবাবগঞ্জের চৌধুরীবাড়ির সবাই-ই নিশ্চিন্ত হলেন। চৌধুরী মশাইও নিশ্চিন্ত হলেন। যাক, আর কোনও দুর্ভাবনা নেই। ঈশ্বরের ইচ্ছেই পূর্ণ হলো। সদানন্দ এতক্ষণে নতুন বউ-এর আকর্ষণে গা ঢেলে দিয়ে অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ সব ভুলে গিয়েছে। আর কোনও দুর্ভাবনা কারো নেই, আর কোনও আশঙ্কাও নেই কারো। যা ভয় ছিল সকলের তা হলো না। সব সমস্যা নির্বিঘ্নে সমাধা হয়ে গেল। তিন দিন আগেও যে সমস্যা সকলের অশান্তির কারণ হয়ে উঠেছিল তার সমাধি হলো। কোথা থেকে এক পুরোন ইতিহাসের কুটিল স্মৃতি সাপ হয়ে ফণা তুলেছিল। মনে হয়েছিল সেই ফণা বুঝি এ সংসারের সুখ-শান্তি-ঐশ্বর্যের মাথায় ছোবল মেরে সব কিছু ধ্বংস করে দেবে। কিন্তু আর তা হবার সম্ভাবনা নেই। এবার নয়নতারা এসেছে। ফুলশয্যার ওপর নয়নতারার চোখ-ভোলানো রূপ আর মন-ভোলানো ভালবাসা সব কিছু সন্দেহের কাঁটা নির্মূল করে দিয়েছে। আর ভয় নেই। এবার ঘুমোও। নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ো সবাই। তোমাদের অনেক ঝঞ্ঝাট গেছে এ কদিন ধরে। গায়ে-হলুদের আগের দিন রাত্রে যেদিন থেকে সদানন্দ নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছিল সেই দিন থেকেই তোমাদের অনেক ঝঞ্ঝাট গেছে। তারপর অনেক ঝড়-ঝাপটা অতিক্রম করে শেষরক্ষা করেছে বংশী ঢালী। যেটুকু বংশী ঢালী পারেনি, সেটুকু শেষ করবে নতুন বউ নয়নতারা। নয়নতারাই আজ ফুলশয্যার রাত্রে সদানন্দকে জীবনের আসল মানে বুঝিয়ে দেবে। নয়নতারাই বুঝিয়ে দেবে মহাপুরুষরা যা কিছু বলে গিয়েছেন তা বইতে ছাপাবার জন্যে, স্কুলে কলেজে পড়াবার জন্যে, পড়ে পরীক্ষায় পাস করবার জন্যে, কিন্তু জীবন আলাদা জিনিস। সে জীবনে একমাত্র সত্য হলো ভোগ। ভোগ তার সংসারের বিলাসের মধ্যে দিয়ে, তার অর্থ উপার্জনের মধ্যে দিয়ে। আর সেই ভোগের পথে যত বাধা আসে তা যে-কোনও উপায়ে অপসারণের মধ্যে দিয়ে। এরই নাম হলো জীবন!
কর্তাবাবুও ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু তার ঘোরটা যেন চট করে একটু ভেঙে গেল। মনে হলো কে যেন কাঁদছে। যেন কাছাকাছি থেকে কারো কান্নার আওয়াজ আসছে!
এই আনন্দের দিনে এত রাত্রে কে আবার কাঁদে! অভ্যাসগত ডাকলেন—দীনু–
অন্য সময় হলে দীনু সঙ্গে সঙ্গে এসে হাজির হতো। হুকুম তামিল করবার জন্যে দীনুর মত অত বাধ্য মানুষ তিনি আর দেখেন নি। কালীগঞ্জের কর্তাবাবুর কাছে যখন তিনি কাজ করতেন তিনি নিজেও অত বাধ্য হয়ে হুকুম তামিল করেন নি কখনও।
কর্তাবাবুর ডাকে কেউ-ই সাড়া দিলে না। তা না সাড়া দিক। আহা সারা দিন খাটুনির পর বোধ হয় দীনু ঘুমিয়ে পড়েছে। ঘুমোক। ঘুমোক সে। কিন্তু জানতে ইচ্ছে করছিল কে কাঁদছে! অথচ কাঁদার তো কথা নয় কারো। আজকে তো আনন্দের দিন। আজকে তাঁর নাতির বিয়ে। বিয়ে ঠিক নয়, ফুলশয্যে। আজকে তো তাঁর প্রজারা এসে তাঁর নাতবউকে আশীর্বাদ করে গেছে। আজকে সবাই তাঁর বাড়িতে এসে পাত পেতে পেট ভরে খেয়ে গিয়েছে। কেউ কেউ খাবার পর ছাঁদা বেঁধেও নিয়ে গেছে। গ্রামে তো আজ আর কেউই উপবাসী নেই। সবাই পরিতৃপ্ত, সবাই পরিশ্রান্ত। এখন তারা যে-যার বাড়িতে গিয়ে নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছে। এখন কেন তারা কাঁদতে যাবে! কীসের দুঃখ তাদের!
কর্তাবাবু আবার চোখ দুটো জোর করে বুজিয়ে প্রাণপণে ঘুমোবার চেষ্টা করলেন। কিন্তু কর্তাবাবু তখনও জানতেন না যে তিনি ঘুমোতে চেষ্টা করলেও ইতিহাসের কখনও ঘুমোতে নেই। ইতিহাস ঘুমোয় না বলেই আজ কালীগঞ্জের বউকে বেঘোরে প্রাণ দিতে হয়। ইতিহাস ঘুমোয় না বলেই এত রাত্রে তার কানে চাপা আর্তনাদ ভেসে আসে। ইতিহাস ঘুমোয় না বলেই তাঁর নাতি বিয়ের দিন বাড়ি থেকে পালিয়ে কালীগঞ্জে গিয়ে আশ্রয় নেয়। আবার ইতিহাস ঘুমোয় না বলেই তাঁর নাতি বিয়ে করে বউ নিয়ে এসেই টাকা চায়!
কিন্তু সে-সব কথা এখন থাক। এখন সবাই সুখী, এখন সকলের শান্তি। এখন সবাই ঘুমোও। আমি অসুস্থ লোক, আমার বয়েস হয়েছে, আমি জেগে থাকলেও তোমরা ঘুমোও।