২.০৯ চারদিকে শত্রু
ট্রানটর… অরাজক সময়ের মাঝামাঝি, ট্র্যানটর ছিল রহস্যের কুয়াশায় ঢাকা। বিপুল ধ্বংসযজ্ঞের মধ্যবর্তী সময়ে ছোট এক কৃষকগোষ্ঠী সেখানে বসবাস করত…
–এনসাইক্লোপেডিয়া গ্যালাকটিকা
.
জনবহুল গ্রহের রাজধানী শহরের পেসপোর্টের ব্যস্ততার সাথে তুলনা করার মতো কিছু নেই, কখনো ছিলও না। প্রকাণ্ড মেশিনগুলো নির্দিষ্ট স্থানে অলসভাবে বিশ্রাম নিচ্ছে। স্পেসশিপের দ্রুত আগমন-নির্গমন যেন বিশাল ইস্পাতের সমুদ্রে ছোট ছোট ঢেউ। যান আগমন-নির্গমনের পুরো প্রক্রিয়াটি ঘটে প্রায় নিঃশব্দে।
পোর্টের পঁচানব্বই ভাগ স্কয়ার মাইল এলাকা ব্যবহার করা হয় প্রকাণ্ড মেশিন এবং সেগুলোর নিয়ন্ত্রকদের জন্য। মাত্র পাঁচ ভাগ স্কয়ার মাইল এলাকা ব্যবহৃত হয় বিশাল জনসমুদ্রের জন্য যারা এই পোর্টকে গ্যালাক্সির সকল নক্ষত্রে পৌঁছানোর স্টেশন হিসাবে ব্যবহার করে।
যদি কোনো যান কখনো গাইডিং বিম অনুসরণ করতে ব্যর্থ হয় এবং প্রত্যাশিত ল্যাণ্ডিংয়ের স্থান থেকে আধামাইল দূরে বিশাল বিশ্রাম কক্ষের ছাদের উপর ক্র্যাশ করে–তা হলে কয়েক হাজার মানুষকে চিহ্নিত করার জন্য শুধু পাতলা অর্গানিক ধোয়া এবং ফসফেটের কিছু গুড়ো পড়ে থাকবে। যাই হোক সেফটি ডিভাইস ব্যবহারের কারণে এ ধরনের দুর্ঘটনা কখনো ঘটেনি।
বিশাল জনসমুদ্রের একটা উদ্দেশ্য রয়েছে। তারা কোথাও যাচ্ছে, তারা সারি বেঁধে এগোচ্ছে; বাবা মায়েরা বাচ্চাদের শক্ত করে ধরে রেখেছেন; মালপত্রগুলো দক্ষভাবে সামলানো হচ্ছে।
আর্কেডিয়া ডেরিল, ধার-করা পোশাক পরে অপরিচিত পৃথিবীর অদ্ভুত পরিস্থিতির মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে। পোশাকের মতো তার জীবনটাও ধার-করা মনে হচ্ছে। এই গ্রহের বিশাল উন্মুক্ততা তার কাছে মনে হচ্ছে বিপজ্জনক। তার এখন প্রয়োজন একটা বদ্ধ জায়গার অনেক দূরে মহাবিশ্বের অপরিচিত কোনো প্রান্তে–যেখানে এখনো মানুষের পা পড়েনি।
সে দাঁড়িয়ে আছে, বয়স চৌদ্দর কিছু বেশি, কিন্তু আশি বছরের বৃদ্ধার মতো উদ্বিগ্ন, পাঁচ বছরের শিশুর মতো ভীত।
শত শত অপরিচিত লোক তাকে ধাক্কা দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। তারা সবাই কী। দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনার? তাকে ধ্বংস করবে, কারণ সে জানে কোথায় রয়েছে দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশন।
বজ্রপাতের মতো একটা কণ্ঠস্বর তার চিৎকারটাকে গলার ভেতরেই জমিয়ে দিল।
‘দেখ, মিস,’ অধৈর্য স্বরে পিছনের যাত্রী বলল, ‘তুমি কী টিকেট মেশিন ব্যবহার করছ না শুধু দাঁড়িয়ে আছ?’
হঠাৎ করেই আর্কেডিয়া উপলব্ধি করল সে অনেকক্ষণ ধরে টিকেট মেশিনের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ক্লিপারে নির্দিষ্ট অর্থ জমা দিয়ে নিচে গন্তব্যস্থান চিহ্নিত বাটনটিতে চাপ দিলে মেশিনই টিকেট এবং বাকি পয়সা ফেরত দেবে। খুব সহজ কাজ। পাঁচ মিনিট ধরে কারো দাঁড়িয়ে থাকার প্রয়োজন নেই।
ক্লিপারে দুশ-ক্রেডিটের একটা বিল দেওয়ার পর হঠাৎ করেই ট্র্যানটর’ লেখা বাটনটি তার চোখে পড়ল। ট্রানটর, মৃত এম্পায়ারের মৃত রাজধানী–যে-গ্রহে সে জন্মেছে। স্বপ্নাচ্ছন্নের মতো সে বাটনটি টিপে দিল। কিছুই ঘটল না, শুধু একটা লেখা জ্বলজ্বল করছে ১৭২.১৮-১৭২.১৮-১৭২.১৮
এই পরিমাণ বিল কম হয়েছে। দুশ-ক্রেডিটের আরেকটা বিল দিল সে। মেশিন টিকেট বের করে দিল, তারপরই খুচরো বিল।
টিকেট নিয়েই সে দৌড় দিল, পিছনে তাকাল না।
কিন্তু কোথায় যাবে। চারদিকেই শত্রু।
একই সাথে দুই দিকে লক্ষ্য করতে করতে হাঁটছিল বলে সে লোকটাকে খেয়াল করেনি। লোকটার নরম পেটে তার মাথা ডুবে গেল। কেঁপে উঠল ভয়ে। একটা হাত তার বাহুদুটো আঁকড়ে ধরায় বেপরোয়াভাবে ছোটার চেষ্টা করল সে। পারল না।
লোকটা তাকে নরমভাবে ধরে রেখেছে। ধীরে ধীরে তার দৃষ্টি স্বচ্ছ হলে সে লোকটাকে দেখতে পেল। বেটে এবং মোটা। মাথায় ঘন সাদা চুল, ব্যাকব্রাশ করার ফলে তার লাল গোলাকার মুখে একটা বেমানান আভিজাত্য তৈরি হয়েছে।
‘কী ব্যাপার?’ শেষ পর্যন্ত কথা বলল, অকপট কৌতূহল নিয়ে, ‘তুমি ভয়। পেয়েছ।‘
‘দুঃখিত,’ ফিসফিস করে বলল আর্কেডিয়া। ‘আমাকে যেতে হবে। মাফ করবেন।‘
লোকটা তার কথা পুরোপুরি উপেক্ষা করে বলল, ‘তোমার টিকেট পড়ে যাবে,’ তারপর আর্কেডিয়ার দুর্বল আঙুল থেকে টিকেটটা নিয়ে পরিপূর্ণ সন্তুষ্টির সাথে সেটা দেখল।
‘যা ভেবেছিলাম, তারপর চিৎকার করে উঠল ষাঁড়ের মতো ‘মমাহ্!’
এক মহিলা দ্রুত তার পাশে এসে দাঁড়াল, আরো বেটে এবং আরো গোলগাল।
‘পপা,’ তিরস্কারের ভঙ্গিতে বলল মহিলা, ভিড়ের মাঝে তুমি চিৎকার করছ কেন? লোকজন তোমার দিকে এমনভাবে তাকাচ্ছে যেন তুমি পাগল। এটা কী তোমার নিজের খামার?
নীরব আর্কেডিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ওর ব্যবহার ভালুকের মতো,’ তারপর আরও ধারালো ভাবে বলল, ‘পপা, মেয়েটাকে যেতে দাও। কী করছ তুমি?’
কিন্তু পপা শুধু তার সামনে টিকেট দোলাল, ‘দেখ,’ সে বলল, ‘এই মেয়ে ট্র্যানটরে যাবে।‘
মমার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, ‘তুমি ট্রানটর থেকে এসেছ? ওর হাত ছেড়ে দাও পপা, আমি বলছি।’ হাতের ভারি বোঝা একপাশে নামিয়ে রেখে জোড় করে আর্কেডিয়াকে বসিয়ে দিল। বসো,’ সে বলল, ‘নিজের পা দুটোকে বিশ্রাম দাও। এক ঘণ্টার আগে কোনো শিপ নেই, আর বসার জায়গাগুলো সব লোফারদের দখলে। তুমি ট্র্যানটর থেকে এসেছ?’
আর্কেডিয়া গভীর শ্বাস নিল। শুষ্ক কণ্ঠে বলল, ‘আমার জন্ম হয়েছে সেখানে।‘
খুশিতে হাততালি দিল মমা, আমরা এখানে এসেছি একমাস, কিন্তু নিজের গ্রহের কারো সাথে দেখা হয়নি। খুব ভাল লাগছে। তোমার বাবা-মা’–সে অনিশ্চিতভাবে এদিক সেদিক তাকাল।
‘আমি বাবা-মার সাথে আসিনি,’ আর্কেডিয়া বলল, সতর্কভাবে।
‘একা? তোমার মতো ছোট একটা মেয়ে?’ রাগ এবং সহানুভূতির সাথে বলল মমা, ‘সেটা কী করে সম্ভব?’
‘মমা,’ তার জামার হাত ধরে টান দিল পপা, ‘আমাকে বলতে দাও। কোথাও একটা গণ্ডগোল আছে। আমার মনে হয় এই মেয়ে ভয় পেয়েছে।‘ যদিও সে ফিসফিস করে বলছে কিন্তু আর্কেডিয়া শুনতে পারল। ‘দৌড়াচ্ছিল–আমি তার দিকে লক্ষ্য রাখছিলাম এবং কোথায় যাচ্ছে সেদিকে খেয়াল না করেই সে দৌড়াচ্ছিল। সরে দাঁড়াবার আগেই আমার সাথে ধাক্কা খায়। তার পরের ঘটনা তুমি জান। আমার মনে হয় সে সমস্যায় পড়েছে।‘
‘তুমি মুখ বন্ধ রাখো, পপা। যে কেউ ধাক্কা খেতে পারে। সে তার জিনিসপত্রের পোটলার উপর বসে পড়ল, পোটলাটা ফেটে পড়ার উপক্রম হলো অতিরিক্ত চাপে, একটা হাত আর্কেডিয়ার কাঁধের উপর ফেলে রেখেছে। তুমি কার ভয়ে পালাচ্ছ, সুইট হার্ট? আমাকে বলতে ভয় পেয়ো না। আমি তোমাকে সাহায্য করব।’
মহিলার ধূসর স্নেহার্ড চোখের দিকে তাকাল আর্কেডিয়া, তার ঠোঁট কাঁপছে। বুদ্ধির এক অংশ বলছে যে এরা দুজন ট্রানটরের বাসিন্দা। তাকে সাহায্য করতে পারে, এর পরে কী করবে বা কোথায় যাবে সেটা ঠিক করার আগ পর্যন্ত তাকে আশ্রয় দিতে পারে। আরেক অংশ বেশ জোরালোভাবেই বলছে- যে তার মা বেঁচে নেই, সে এই মহাবিশ্বের সাথে একা লড়তে ভয় পাচ্ছে এবং তার মন চাইছে এই মহিলার শক্ত স্নেহশীল দুটো হাতের ভেতর নিজেকে বলের মতো গুটিয়ে রাখতে, যদি তার মা বেঁচে থাকতো, সে হয়তো–সে হয়তো….
এবং সেই রাতে প্রথমবারের মতো আর্কেডিয়া কাঁদল; কাদল শিশুর মতো, কাঁদতে পেরে খুশি হলো সে; মহিলার পুরোনো আমলের পোশাকের এক অংশ সে ভিজিয়ে ফেলল সম্পূর্ণ, দুটো নরম হাত তাকে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে রেখে মাথায় হাত বুলাতে লাগল।
অসহায়ভাবে তাদের দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে পপা, ব্যস্তভাবে রুমাল বের করে এগিয়ে দিল। মমার চোখে মৃদু তিরস্কার। ভিড়ের কেউ ছোট দলটার দিকে তাকিয়ে নেই। তারা সম্পূর্ণ একা।
শেষপর্যন্ত কান্না থামল এবং আর্কেডিয়া লাল হয়ে যাওয়া চোখ রুমাল দিয়ে মুছতে মুছতে হাসল দুর্বলভাবে। ‘গোলি,’ সে ফিসফিস করে বলল, ‘আমি–’
‘শশশ, শশশ। কথা বলো না,’ নরম সুরে বলল মমা, কিছুক্ষণ বিশ্রাম নাও। সুস্থির হয়ে বসো। তারপর বলো কী হয়েছে। দেখো আমরা সব সামলে নেব, সব ঠিক হয়ে যাবে।’
সাহস সঞ্চয় করতে লাগল আর্কেডিয়া। এই দুজনকে সত্য কথা বলতে পারবে না। কাউকেই বলতে পারবে না এবং একটা মিথ্যা কাহিনী তৈরি করার মতো। স্থিরতা সে এখনো ফিরে পায়নি।
আস্তে করে বলল, ‘এখন একটু ভাল লাগছে।’
‘ভালো,’ মমা বলল। এখন বল কেন তুমি বিপদে পড়েছ। তুমি কী করেছ? অবশ্য যাই তুমি করে থাক, আমরা তোমাকে সাহায্য করব; তবে সত্য কথা বলতে হবে।’
‘ট্রানটরের একজন বন্ধুর জন্য যা করা প্রয়োজন সব করব, তাই না, মমা?’ পপা যোগ করল।
‘তুমি চুপ থাকো, পপা।’ মমা মুখ ঝামটা দিয়ে বলল।
.
আর্কেডিয়া তার পার্স ঘাটছে। লেডি সেলিয়া জোর করে পোশাক পালটে দেওয়ার পর নিজের এই একটা জিনিসই তার সাথে রয়েছে। যা খুঁজছিল সেটা পেয়ে মমার হাতে দিল।
‘এই আমার কাগজপত্র,’ আত্মপ্রত্যয়হীন গলায় বলল। পাতলা সিনথেটিক পার্চমেন্ট, এখানে আসার প্রথম দিনই ফাউণ্ডেশনের এম্বাসেডর ইস্যু করেছিলেন এবং তার উপর যথাযথ কালগানিয়ান কর্তৃপক্ষের সই রয়েছে। অসহায়ভাবে কাগজটা মমা দেখল তারপর পপার হাতে দিল। পপা খুঁটিয়ে দেখল।
সে বলল, ‘তুমি ফাউণ্ডেশন থেকে এসেছ?’
‘হ্যাঁ। কিন্তু আমার জন্ম হয়েছে ট্রানটরে। এখানে লেখা আছে।‘
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ। আমার মনে হয় ঠিকই আছে। তোমার নাম আর্কেডিয়া, তাই না? খুব সুন্দর ট্রানটরিয়ান নাম। কিন্তু তোমার আঙ্কেল কোথায়? এখানে লেখা আছে তুমি এসেছিলে হোমির মা-এর সাথে, তোমার আঙ্কেল।‘
‘তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।’ বিষণ্ণ সুরে বলল আর্কেডিয়া।
‘গ্রেপ্তার করা হয়েছে!’ একসাথে বলল দুজন। ‘কেন?’ মমা জিজ্ঞেস করল। ‘তিনি কী করেছিলেন?’
মাথা নাড়ল সে। ‘আমি জানি না। আমরা বেড়াতে এসেছিলাম। লর্ড স্ট্যাটিনের সাথে আঙ্কেল হোমিরের কিছু কাজ ছিল কিন্তু–‘ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
পপা বেশ প্রভাবিত। লর্ড স্ট্যাটিনের সাথে। মম্-ম্-ম্, তোমার আঙ্কেল মনে হয় খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি।
‘ব্যাপারটা কী নিয়ে আমি জানি না, কিন্তু লর্ড স্ট্যাটিন চেয়েছিল আমি যেন থাকি—’
বলেই সে থেমে গেল, মমা উৎসুকভাবে জিজ্ঞেস করল, ‘কেন তোমাকে থাকতে বলেছিল?’
‘আমি নিশ্চিত নই। সে… সে আমার সাথে একটা ডিনার করতে চেয়েছিল, কিন্তু আমি না করি, কারণ আমি চেয়েছিলাম আঙ্কেল হোমিরও আমাদের সাথে থাকবেন।’
মুখ কিছুটা ঝুলে পড়েছে পপার, কিন্তু প্রচণ্ড রেগেছে মমা। ‘তোমার বয়স কতো, আর্কেডিয়া?’
‘প্রায় সাড়ে চৌদ্দ।‘
মমা গভীর শ্বাস নিয়ে বলল, ‘এরকম মানুষের চেয়ে রাস্তার কুকুরও অনেক ভাল। তার কাছ থেকেই তুমি পালাচ্ছ, তাই না?’
উপর নিচে মাথা নাড়ল আর্কেডিয়া।
মমা বলল, ‘পপা, অনুসন্ধানে গিয়ে খোঁজ নাও ট্রানটরের শিপ কখন ছাড়বে, তাড়াতাড়ি।‘
কিন্তু পপা, এক পা বাড়িয়েই থেমে গেল। মাথার উপর থেকে একটা জোরালো যান্ত্রিক শব্দ ভেসে আসছে। পাঁচ হাজার জোড়া চোখ একযোগে উপরে তাকাল।
‘পুরুষ এবং মহিলাগণ,’ শব্দগুলো তীক্ষ্ণ এবং স্পষ্ট। এক ভয়ঙ্কর ফেরারি আসামি ধরার জন্য এয়ারপোর্ট চারদিকে ঘিরে ফেলা হয়েছে। কেউ ঢুকতে পারবে না। বেরোতে পারবে না। অনুসন্ধান খুব দ্রুত সম্পন্ন করা হবে এবং এই সময়ের মধ্যে কোনো শিপ পোর্টে অবতরণ করবে না বা পোর্ট ছেড়ে যাবে না, তাই কারো যাত্রা ব্যাহত হবে না। আবারও বলছি কারো যাত্রা ব্যাহত হবে না। চারদিকে গ্রিড বিছানো হচ্ছে। গ্রিড না সরানো পর্যন্ত কেউ নির্দিষ্ট স্কয়ারের বাইরে যেতে পারবে না, অন্যথায় আমরা নিউরোনিক চাবুক ব্যবহার করতে বাধ্য হব।’
আর্কেডিয়ার মনে হলো গ্যালাক্সির সমস্ত বিপদ যেন একটা বলের মতো তাকে আঘাত করতে আসছে। তার কথাই বোঝানো হচ্ছে। কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু কেন–
সেলিয়া তার পালানোর ব্যবস্থা করে দিয়েছে এবং সেলিয়া দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনের এজেন্ট। তা হলে এই খোঁজাখুঁজির মানে কী? সেলিয়া কী ব্যর্থ হয়েছে? সেলিয়া ব্যর্থ হতে পারে? নাকি এটাও তার জটিল পরিকল্পনার একটা অংশ।
এক মুহূর্তের জন্য আর্কেডিয়ার ইচ্ছে হল দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলে যে সে ধরা দেবে, তাদের সাথে যাবে, সে…
কিন্তু মমার হাত শক্তভাবে তার কব্জি ধরে রেখেছে। ‘জলদি! জলদি! ওরা কাজ শুরু করার আগেই আমাদের লেডিজ রুমে যেতে হবে।’
আর্কেডিয়া বুঝতে পারল না। শুধু অন্ধের মতো অনুসরণ করল। যান্ত্রিক শব্দের প্রতিধ্বনি এখনও মিলিয়ে যায়নি, প্রত্যেকেই যার যার জায়গায় স্থির হয়ে গেছে। তারা ভিড় ঠেলে এগুলো।
গ্রিড নেমে আসছে এবং পপা হা করে সেগুলোর নেমে আসা দেখছে। সে গ্রিডের কথা শুনেছে, পড়েছে, কিন্তু কখনো এর শিকার হয়নি। গ্রিড হচ্ছে রেডিয়েশন বিম দিয়ে তৈরি আড়াআড়ি ও সমান্তরালভাবে পরস্পরছেদি উজ্জ্বল আলোর নেটওয়ার্ক। আলোর রেখাগুলো ক্ষতিকারক নয়। শুধু মনে হয় উপর থেকে একটা বিশাল জাল নেমে আসছে এবং ফাঁদে আটকানোর একটা অনুভূতি তৈরি করে।
কোমর সমান উচ্চতায় নেমে এসেছে গ্রিড, প্রতিটি উজ্জ্বল রেখার মাঝে দশ ফুট করে দূরত্ব। তার একশ স্কয়ার ফুটের মাঝে পপা দেখল, সে একাই রয়েছে। অন্যান্য স্কয়ারে বেশ ভিড়। কিন্তু সে তাদের কাছে যেতে পারবে না। যেতে হলে যে কোনো একটা আলোর রেখা অতিক্রম করতে হবে। ফলে সতর্ক সংকেত বেজে উঠবে এবং উপর থেকে নিউরোনিক চাবুক এসে আঘাত করবে।
অপেক্ষা করতে লাগল সে।
অপেক্ষমাণ লোকদের মাথার উপর দিয়ে দূরে একসারি নিরাপত্তারক্ষীকে দেখতে পারছে সে, আলোকোজ্জ্বল এক স্কয়ার থেকে আরেক স্কয়ারে অনুসন্ধান চালাচ্ছে। দীর্ঘক্ষণ পর একজন রক্ষী তার স্কয়ারে এসে একটা নোট বইয়ে সতর্কভাবে কো অর্ডিনেটস লিখল।
‘পরিচয়পত্র!’
বের করে দিল পপা এবং লোকটা অভিজ্ঞ দৃষ্টিতে পরীক্ষা করতে লাগল।
‘আপনি প্রীম পালভার, ট্রানটরের স্থায়ী বাসিন্দা, এক মাস ধরে কালগানে আছেন, এখন ট্রানটরে ফিরছেন। শুধু বলুন, হ্যাঁ অথবা না।’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ।’
‘কালগানে আপনি কেন এসেছিলেন?
‘আমি আমাদের খামার সমবায় সমিতির বণিক প্রতিনিধি। কালগানের কৃষি অধিদপ্তরের সাথে বাণিজ্যিক চুক্তি করার জন্য এসেছিলাম।’
‘হুম-ম-ম। কাগজপত্রে বলা হয়েছে সাথে আপনার স্ত্রীও আছেন। কোথায় তিনি?’
“প্লিজ, আমার স্ত্রী–’ সে নির্দেশ করল।
‘হেন্টো,’ চিৎকার করল রক্ষী। আরেকজন রক্ষী তার সাথে যোগ দিল।
প্রথমজন শুষ্ক কণ্ঠে বলল, ‘শুধু ঝামেলা। নামটা লিখে রাখ।‘ পপার কাগজ নির্দেশ করে বলল।
‘আর কেউ আছে সাথে?’
‘আমার ভাতিঝি।’
‘কোথায় সে? ঠিক আছে, ঠিক আছে, আমি জানি। ভাতিঝির নামটাও লিখে রাখো, হেন্টো। কি নাম? লেখো আর্কেডিয়া পালভার। আপনি এখানেই অপেক্ষা করুন পালভার। আমরা আপনার স্ত্রীর সাথেও কথা বলব।’
পপার অপেক্ষা যেন আর শেষ হবে না। তারপর অনেক অনেকক্ষণ পর মমাকে আসতে দেখা গেল, আর্কেডিয়ার হাত ধরে রেখেছে। পিছন পিছন দুই রক্ষীও আসছে।
তারা পপার স্কয়ারে প্রবেশ করল এবং বলল, ‘এই ঝগড়াটে মহিলাই কী আপনার স্ত্রী?’
‘হ্যাঁ,’ শান্তভাবে বলল পপা।
‘তাহলে আপনি তাকে বলে দিন যে ফার্স্ট সিটিজেনের রক্ষীদের সাথে যে সুরে কথা বলছেন তাতে তিনি বিপদে পড়বেন। রাগে কাঁধ সোজা করে দাঁড়াল রক্ষী। ‘এইই আপনার ভাতিঝি?’
‘হ্যাঁ।‘
‘আমি ওর কাগজপত্র দেখতে চাই।’
স্বামীর দিকে সরাসরি তাকিয়ে আস্তে করে মাথা নাড়ল মমা।
কিছুক্ষণ চুপ থেকে পপা ক্ষীণ হেসে বলল, ‘আমার মনে হয় না আমি দেখাতে পারব।’
‘পারবেন না বলে আপনি কী বোঝাতে চাচ্ছেন?’ একটা হাত বাড়িয়ে দিল। রক্ষী। তাড়াতাড়ি দিন।
‘কূটনৈতিক অধিকার’, পপা নরম সুরে বলল।
‘মানে?’
‘আমি বলেছি যে আমি বণিক প্রতিনিধি। কালগান সরকারের কাছে আমি বিশেষ সুবিধা প্রাপ্তির অধিকার রাখি। আমার কাগজপত্রেই তার প্রমাণ রয়েছে। সেগুলো আপনি দেখেছেন এবং আমি চাই না আপনি আমাদের আর বিরক্ত করেন।‘
কয়েক মুহূর্তের জন্য রক্ষী লোকটা পিছিয়ে গেল। ‘আমাকে আপনার কাগজপত্র দেখতেই হবে। আদেশ।‘
‘তুমি ভাগো’ হঠাৎ করে চিৎকার করল মমা। যখন প্রয়োজন হবে তোমাকে ডেকে আনব। তুমি একটা ভাড়।’
লোকটার ঠোঁটদুটো চেপে বসল। এদের উপর নজর রাখো, হেন্টো। আমি লেফটেন্যান্টকে ডেকে নিয়ে আসি।
‘ঠ্যাং ভেঙে দেব!’ পিছন থেকে বলল মমা। কেউ একজন হেসে উঠেই থেমে গেল।
অনুসন্ধান এখন শেষ পর্যায়ে। গ্রিড নামানো থেকে এই পর্যন্ত পয়তাল্লিশ মিনিট পার হয়েছে। ক্ষেপে উঠছে সবাই। লেফটেন্যান্ট ডিরিজ দ্রুত পায়ে এগিয়ে এল।
‘এই মেয়েটাই?’ বর্ণনার সাথে পুরোপুরি মিলে যায়। সমস্ত আয়োজনই তো একটা শিশুকে ধরার জন্য।
‘মেয়েটার কাগজপত্র দেখান দয়া করে।‘
পপা শুরু করল, ‘আমি আগেই বলেছি–’
‘আমি জানি আপনি কী বলেছেন এবং আমি দুঃখিত, লেফটেন্যান্ট বলল, কিন্তু আমি আদেশ অমান্য করতে পারব না। পরে আপনি প্রতিবাদ জানাতে পারবেন। কিন্তু এখন বাধা দিলে বল প্রয়োগ করতে বাধ্য হবো।’
লেফটেন্যান্ট চুপ করে ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করছে।
পপা নিরুপায়ভাবে বলল, তোমার কাগজগুলো আমার কাছে দাও, আর্কেডিয়া।
প্রচণ্ড ভয়ে গুটিয়ে গেল আর্কেডিয়া। কিন্তু পপা মাথা নেড়ে বলল, ‘ভয় পেয়ে, আমার কাছে দাও।’
সে অসহায়ভাবে কাগজগুলো হস্তান্তর করল। পপা সেগুলো মেলে খুব ভালোভাবে দেখে অন্যজনের হাতে দিল। লেফটেন্যান্টও খুঁটিয়ে দেখল। অনেকক্ষণ পর চোখ তুলে আর্কেডিয়ার দিকে তাকিয়ে কাগজগুলো ফিরিয়ে দিয়ে বলল, সব ঠিক আছে। চল যাওয়া যাক।
চলে গেল সে এবং দুই মিনিটের মধ্যে উঠিয়ে নেওয়া হল গ্রিড। মুক্তি পেয়েই সকলের কোলাহল বেড়ে গেছে।
আর্কেডিয়া বলল, ‘কীভাবে…কীভাবে–’
‘চুপ, কথা বলো না।‘ পপা বলল, ‘চলো শিপে গিয়ে উঠি। এতক্ষণে বোধহয় পোর্টে চলে এসেছে।’
.
শিপে তারা একটা স্টেটরুম এবং ডাইনিং রুমে একটা টেবিল বুক করে রেখেছে। কালগান থেকে দুই আলোকবর্ষ দূরে আসার পর আর্কেডিয়া আবার কথাটা তুলল।
‘লোকগুলো আমাকেই ধরতে এসেছিল, মি. পালভার। তাদের কাছে নিশ্চয়ই আমার বর্ণনা ছিল। তারপরও আমাকে ছেড়ে দিল কেন?’
রোস্ট করা মাংস খেতে খেতে পপা হাসল। ‘আসলে আর্কেডিয়া, খুকি, খুব সোজা ব্যাপার। যখন তুমি প্রতিনিধি, ক্রেতা বা প্রতিযোগী সমবায়গুলোর সাথে কাজ করবে তখন তুমিও কিছু কৌশল শিখতে পারবে। বিশ বছর ধরে আমি এগুলো শিখেছি। লেফটেন্যান্ট যখন তোমার পরিচয়পত্র মেলে ধরেছে তার ভিতরে সে ছোট করে ভাঁজ করা পাঁচশ ক্রেডিটের একটা বিল পেয়েছে। সহজ, না?’
‘আমি অবশ্যই আপনাকে ফিরিয়ে দেব, আমি মোটামুটি ধনী।‘
‘আচ্ছাহ্, পপা ব্রিবত হয়ে পড়ল, হাত নেড়ে বিষয়টা উড়িয়ে দিল। নিজের পৃথিবীর একজনের—’
আর্কেডিয়া বাঁধা দিল, ‘যদি সে-টাকাটা না নিয়ে আমাকে ঘুষ প্রদানের অভিযোগে গ্রেফতার করত।‘
‘পাঁচ শ ক্রেডিট ফিরিয়ে দিয়ে? এ ধরনের লোকদের আমি তোমার চেয়ে ভাল চিনি, মেয়ে।‘
আর্কেডিয়া জানে সে মানুষ চিনে না। এই দুজনকেও সে বুঝতে পারছে না। সেই রাতে বিছানায় শুয়ে খুব ভালভাবে চিন্তা করে সে বুঝতে পারল কোনো প্রকার ঘুষই তাকে বন্দি করা থেকে একজন লেফটেন্যান্টকে বিরত করতে পারে না। যদি না সেটা পূর্বপরিকল্পিত হয়। তারা তাকে ধরতে চায়নি, যদিও প্রতি পদক্ষেপে সে রকমই বোঝাতে চেয়েছে।
কেন? তার যাত্রা নিরাপদ করতে এবং ট্রানটরে। এই অপরিচিত সহৃদয় দম্পতী কি দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনের এক জোড়া হাতিয়ার, ঠিক তার মতোই অসহায়।
অবশ্যই!
নাকি ভুল হচ্ছে?
কোনোভাবেই লাভ হচ্ছে না। সে কীভাবে লড়বে। যা-ই সে করছে সবই হয়তো সেই ভয়ংকর প্রতিপক্ষের ইচ্ছা অনুযায়ী করছে।
কিন্তু তাদের নিশ্চিহ্ন করতেই হবে। তাকে পারতেই হবে! পারতেই হবে! পারতেই হবে!
.
২.১০ যুদ্ধ শুরু
জানা বা অজানা কোনো কারণে গ্যালাক্সির সকল সদস্য ইন্টারগ্যালাকটিক স্ট্যাণ্ডার্ড টাইমের মৌলিক একক, সেকেণ্ড, স্থির করেছে যে সময়ের মধ্যে আলো ২,৯৯,৭৭৬ কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করে। কমবেশি ৮৬,৪০০ সেকেণ্ডে ধরা হয় এক ইন্টারগ্যালাকটিক স্ট্যাণ্ডার্ড দিন; এবং ৩৬৫ দিনে ধরা হয় এক ইন্টারগ্যালাকটিক স্ট্যাণ্ডার্ড বছর।
কেন ২,৯৯,৭৭৬? অথবা ৮৬,৪০০? অথবা ৩৬৫?
ঐতিহ্য, বলেন ঐতিহাসিকরা। কারণ বিভিন্ন ধরনের রহস্যময় সংখ্যাতাত্ত্বিক সম্পর্ক, বলেন আধ্যাত্মবাদী, ধর্মবাদী সংখ্যাতাত্ত্বিক এবং মেটাফিজিসিস্টরা। কারণ মানুষের উৎপত্তি যে গ্রহে সেই গ্রহের নিজস্ব ঘূর্ণন এবং নক্ষত্র প্রদক্ষিণের সময়সীমা থেকে এ ধরনের সম্পর্কের উদ্ভব হয়েছে; খুব অল্প সংখ্যক লোক এই কথা বলেন।
কেউই সঠিক বলতে পারে না।
যাই হোক, যে তারিখে ‘হোবার ম্যালো’ ফাউণ্ডেশন ক্রুজার—’ফিয়ারলেস’-এর নেতৃত্বে কালগানিয়ান স্কোয়াড্রনের মুখোমুখি হয় এবং একটা অনুসন্ধান দলকে তাদের ক্রুজারে আসতে বাধা দিয়ে ধ্বংস হয়ে যায় সেই তারিখটা ছিল ১৮৫;১১৬৯২ জি.ই.। অর্থাৎ কেম্বল ডাইন্যাস্টির প্রথম সম্রাটের সময় থেকে শুরু করে গ্যালাকটিক যুগের ১১,৬৯২তম বছরের ১৮৫তম দিন। এছাড়াও তারিখটা ছিল ১৮৫;৪১৯ এ.এস.-গণনা করা হয় সেলডনের জন্মের দিন থেকে অথবা ১৮৫;৩৪৮ ওয়াই. এফ.–গণনা করা হয় ফাউণ্ডেশনের প্রথম দিন থেকে। কালগানের কাছে তারিখটা ছিল ১৮৫;৫৬ এফ. সি–গণনা করা হয় মিউল কর্তক ফার্স্ট সিটিজেন শিপ চালু করার দিন থেকে। যে দিনের ভিত্তিতেই যুগের সূচনা হোক না কেন বছরগুলো এমনভাবে ঠিক করা হয়েছে যে প্রতিটি ক্ষেত্রেই একই দিন হবে।
এছাড়াও গ্যালাক্সির মিলিয়ন সংখ্যক পৃথিবীগুলোতে নিজস্ব গতির উপর ভিত্তি করে নিজস্ব স্থানীয় সময় রয়েছে।
কিন্তু যে-হিসাবই ধরা হোক না কেন, ১৮৫;১১৬৯২-৪১৯-৪৮-৫৬–অথবা অন্য কিছু পরবর্তীকালে ঐতিহাসিকেরা এই দিনটাকেই চিহ্নিত করেছেন স্ট্যাটিনিয়ান যুদ্ধের শুরু হিসাবে।
কিন্তু ড. ডেরিলের কাছে এই দিনটা শুধু আর্কেডিয়া টার্মিনাস ত্যাগ করার পর বত্রিশতম দিন। এই দিনগুলোতে কীভাবে তিনি নিজেকে স্থির রাখছেন সেটা কারো বিবেচ্য বিষয় নয়।
কিন্তু এলভিট সেমিকের ধারণা সে অনুমান করতে পারে। সে বৃদ্ধ এবং বলতে ভালবাসে যে তার মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যেখানে তার চিন্তা প্রক্রিয়া স্থির এবং অপ্রশস্ত। তার দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হয়ে আসছে, মনের ক্ষীপ্রতা কমে গেছে।
.
মোটা ঠোঁট বাঁকা করে সেমিক বলল, এই জিনিসটা নিয়ে তুমি কিছু করছ না কেন?
কথাগুলো বাস্তব জগতে ফিরিয়ে আনল ডেরিলকে। কর্কশ কণ্ঠে বললেন, ‘আমরা যেন কোন পর্যন্ত এগিয়েছি?’
গম্ভীর দৃষ্টিতে তাকে পর্যবেক্ষণ করল সেমিক, ‘বরং মেয়ের ব্যাপারে কিছু করা উচিত।‘ তার ফাঁকা হলুদ দাঁত বের করে বলল।
কিন্তু ডেরিল শীতল গলায় উত্তর দিলেন, ‘প্রশ্ন হচ্ছে তুমি কী নির্দিষ্ট মাত্রার রেজোনেটর যোগাড় করতে পারবে?’
‘আমি বলেছি পারব কিন্তু তুমি শোনোনি—’
‘দুঃখিত, এলভিট। ব্যাপারটা এরকম, আর্কেডিয়ার নিরাপত্তার প্রশ্নের চেয়ে এখন আমরা যা করছি সেটা গ্যালাক্সির প্রত্যেকের কাছে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। অন্তত আমি এবং আর্কেডিয়া বাদে সকলের কাছে এবং আমি সংখ্যাগরিষ্ঠের পক্ষে। রেজোনেটরটা কত বড় হবে?’
সেমিককে সন্দেহগ্রস্ত দেখালো, ‘ঠিক জানি না। তুমি ক্যাটালগ দেখতে পারো।‘
‘অনুমান এক টন, এক পাউণ্ড? একটা ব্লকের মতো লম্বা?’
‘ওহ, আমি ভেবেছিলাম তুমি সঠিক জান। জিনিসটা ছোট।’ সে তার বুড়ো আঙ্গুলের প্রথম দাগ পর্যন্ত নির্দেশ করে দেখালো, ‘এতটুকু।‘
‘ঠিক আছে। তুমি এটার মতো কিছু তৈরি করতে পারবে?’ তিনি দ্রুত প্যাডে একটা স্কেচ এঁকে বৃদ্ধ পদার্থবিজ্ঞানীর দিকে এগিয়ে দিলেন। সেমিক সন্দেহ নিয়ে দেখল, তারপর মুখ টিপে হাসল।
‘তুমি জান, আমার বয়সে ব্রেইন ঠিকমতো কাজ করে না। তুমি আসলে কী করতে চাও?’
ডেরিল দ্বিধাগ্রস্তভাবে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলেন যেন অন্যজন বুঝতে পারে, যেন তাকে বলতে না হয়। কিন্তু লাভ হলো না। তাই তিনি ব্যাখ্যা করে বোঝালেন।
সেমিক মাথা নাড়ছে। তোমার হাইপার রিলে দরকার হবে। একমাত্র এই জিনিসটাই দ্রুত কাজ করতে পারবে। অনেকগুলো।
‘কিন্তু তৈরি করা যাবে?’
‘হ্যাঁ, নিশ্চয়ই।‘
‘কারো মনে সন্দেহ না জাগিয়ে সবগুলো যন্ত্রাংশ তুমি সংগ্রহ করতে পারবে?’
উপরের ঠোঁট প্রসারিত করে সেমিক বলল, ‘পঞ্চাশটা হাইপার রিলে যোগাড় করা কঠিন হবে। আমি সারাজীবনেও এতগুলো ব্যবহার করিনি।’
‘আমরা এখন একটা প্রতিরক্ষা প্রজেক্টে কাজ করছি। চিন্তা করে একটা কোনো পথ বের করতে পারো না? খরচ কোনো ব্যাপার না।‘
‘হুম্ম-ম্। হয়তো পারব।’
‘যন্ত্রটা তুমি কত ছোট করে বানাতে পারবে?’
‘ক্ষুদ্র আকারের হাইপার রিলে…তার…টিউব স্পেস, কয়েকশ সার্কিট বসাতে হবে।’
‘আমি জানি। কত বড় হবে?’
সেমিক হাত দিয়ে আকৃতি বোঝালো।
‘অনেক বড়, ডেরিল বললেন। আমি আমার বেল্টে জিনিসটা বসাতে চাই।’
ধীরে ধীরে তিনি স্কেচ আঁকা কাগজটা গুটিয়ে একটা বল বানালেন। তারপর ছাইদানিতে ফেলে দিলেন। মুহূর্তের মধ্যে আগুনের ক্ষুদ্র শিখা সেটিকে পুড়িয়ে নিশ্চিহ্ন করে দিল।
‘তোমার দরজায় কে?’
ডেস্কের উপর দিয়ে ঝুঁকে দরজার ওপরে বসানো স্ক্রিনে দেখল সেমিক। ‘এন্থর। সাথে আরও কেউ আছে।’
ডেরিল চেয়ার পিছিয়ে নিলেন। ‘ওকে এই ব্যাপারে কিছু বলল না, সেমিক।‘
.
পিলীয়াস এন্থর ঝড়ের বেগে ঘরে ঢুকল। ‘ড. ডেরিল, ড. সেমিক–ওরাম ডিরিজ।’
তার সাথের লোকটা লম্বা, দীর্ঘ, সোজা নাক তার মুখটাকে বিষণ্ণ করে তুলেছে। ড. ডেরিল একটা হাত বাড়িয়ে দিলেন।
এন্থর হালকাভাবে একটু হাসল। ‘পুলিশ লেফটেন্যান্ট ডিরিজ,’ সে ঘোষণা করল, তারপর একটু জোর দিয়ে বলল, ‘কালগানের।‘
ঝট করে তার দিকে তাকালেন ডেরিল। কালগানের পুলিশ লেফটেন্যান্ট ডিরিজ’, তিনি পুনরাবৃত্তি করলেন, ধীরে ধীরে। তাকে এখানে নিয়ে এসেছ। কেন?
‘কারণ এই লোকই কালগানে শেষবারের মতো আপনার মেয়েকে দেখেছে। থামুন।‘
এন্থর তাড়াতাড়ি দৌড়ে গিয়ে দুজনের মাঝখানে দাঁড়াল। ধীরে ধীরে কিন্তু অনেকটা অভদ্রের মতো জোর করে সে বৃদ্ধ লোকটাকে চেয়ারে বসতে বাধ্য করল।
‘কী করতে চান আপনি?’ এন্থর কপাল থেকে একগোছা বাদামি চুল সরাল, পা দোলাতে লাগল ডেস্কে বসে। আমি মনে করেছিলাম আপনার জন্য ভাল সংবাদ আনতে পেরেছি।’
সরাসরি পুলিশটাকেই জিজ্ঞেস করলেন ডেরিল, ‘আমার মেয়েকে আপনি শেষ দেখেছেন বলতে সে কী বোঝাচ্ছে? সে কী মৃত? দয়া করে ভূমিকা বাদ দিয়ে বলুন।‘ উৎকণ্ঠায় তার মুখ সাদা হয়ে গেছে।
লেফটেন্যান্ট ডিরিজ ভাবলেশহীন গলায় বলল, ‘শেষ দেখেছি’ একটা কথার কথা। সে এখন কালগানে নেই। এই পর্যন্ত জানি।’
‘শুনুন,’ এন্থর বলল, ‘আমাকে সরাসরি বলতে দিন। যদি আমি নাটক করে থাকি, ডক, সেজন্য দুঃখিত। আমি ভুলেই গিয়েছিলাম যে আপনারও অনুভূতি আছে। প্রথম কথা লেফটেন্যান্ট ডিরিজ আমাদেরই একজন। তার জন্ম কালগানে, কিন্তু তার বাবা ফাউণ্ডেশনের লোক। তার আনুগত্যের জন্য আমি জামিন থাকব।’
‘এবং মান-এর কাছ থেকে দৈনিক রিপোর্ট বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর থেকেই আমি তার সাথে যোগাযোগ করেছি—’
‘কেন?’ রাগের সাথে বাধা দিলেন ডেরিল। আমার মনে হয় আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে এই বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেব না। তুমি আমাদের এবং তাদের দুজনের বিপদ বাড়িয়ে তুলছ।’
‘কারণ,’ সমান তেজে উত্তর আসল, এই খেলায় আমি আপনার চেয়ে বেশিদিন ধরে আছি। কারণ কালগানে আমার কিছু নিরাপদ যোগাযোগ মাধ্যম রয়েছে, যা আপনার নেই। কারণ আমি গভীরভাবে চিন্তা করে কাজ করি, বুঝেছেন?
‘আমার মনে হয় তুমি পুরোপুরি পাগল হয়ে গেছ।‘
‘আপনি আমার কথা শুনবেন?’
নীরবতা, এবং চোখ নামিয়ে নিলেন ড. ডেরিল।
আধো হাসিতে এন্থরের ঠোঁট বেঁকে গেল, ‘ঠিক আছে, ডক। আমাকে কয়েক মিনিট সময় দিন। বল ডিরিজ।’
ডিরিজ সহজভাবে বলতে লাগল, ‘আমি যতদূর জানি ড. ডেরিল, আপনার মেয়ে এখন ট্র্যানটরে। অন্তত পেসপোর্টে আমি তার কাছে ট্র্যানটরের টিকেট দেখেছি। তার সাথে ছিল ঐ গ্রহের একজন বণিক প্রতিনিধি যে দাবি করছিল মেয়েটা তার ভাতিঝি। আপনার মেয়ের মনে হয় অনেক আত্মীয়স্বজন। ট্র্যানটরিয়ান লোকটা আমাকে ঘুষ দেওয়ারও চেষ্টা করেছিল–বোধহয় ভেবেছিল পার পেয়ে যাবে।‘
‘সে কেমন আছে?’
‘অক্ষত, আমি যতটুকু দেখেছি। ভীত। সেজন্য তাকে দোষ দেওয়া যায় না। পুরো ডিপার্টমেন্ট তার পিছনে লেগেছিল। আমি এখনো জানি না কেন।‘
ডেরিল দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বহুকষ্টে হাত দুটোর কাঁপুনি থামালেন। তা হলে সে ঠিক আছে। ‘এই বণিক প্রতিনিধি, কে সে? এখানে তার ভূমিকা কী?’
‘আমি জানি না। ট্রানটর সম্বন্ধে আপনি কিছু জানেন?’
‘একসময় আমি সেখানে বসবাস করেছি।’
‘ট্রানটর এখন কৃষিনির্ভর পৃথিবী। প্রধানত পশুখাদ্য এবং খাদ্যশস্য রপ্তানি করে। উন্নত জাতের! পুরো গ্যালাক্সিতে সেগুলো তারা বিক্রি করে। এক ডজন বা তারও বেশি সমবায় খামার রয়েছে এবং প্রত্যেকেরই বৈদেশিক প্রতিনিধি রয়েছে। এই লোকটার ব্যাপারে আমি কিছুটা জানি। আগেও সে কালগানে এসেছে, প্রত্যেক বারই স্ত্রীকে সাথে নিয়ে। পুরোপুরি সৎ এবং একেবারেই বিপজ্জনক নয়।’
‘হুম-ম-ম, এন্থর বলল। আর্কেডিয়ার জন্ম হয়েছে ট্রানটরে, তাই না?’ ড. ডেরিল মাথা নাড়লেন।
‘কিছুটা পরিষ্কার হলো। সে পালাতে চেয়েছিল দ্রুত এবং দূরে এবং ট্র্যানটরই তার কাছে যথার্থ মনে হয়েছে। আপনার কী মনে হয়?’
‘এখানে ফিরে আসেনি কেন?’ ডেরিল বললেন।
‘সম্ভবত তাকে তাড়া করা হচ্ছে এবং সম্পূর্ণ উল্টো দিকে পালানোই তার কাছে মনে হয়েছে ভাল।‘
ড. ডেরিলের আর কোনো প্রশ্ন করার ইচ্ছে হলো না। ঠিক আছে তাহলে, ট্রানটরে সে নিরাপদে থাকুক, এই অন্ধকার বিপদসংকুল গ্যালাক্সির কোনোখানে একজন যতটুকু নিরাপদ থাকতে পারে থাকুক। তিনি ধীর পায়ে দরজার দিকে হাঁটা ধরলেন। এন্থরের মৃদু ছোঁয়া পেয়ে থামলেন, কিন্তু ঘুরে দাঁড়ালেন না।
‘আমি আপনার সাথে আসতে পারি, ডক?’
‘এস,’ যান্ত্রিক প্রত্যুত্তর।
.
সেই সন্ধ্যায় ড. ডেরিল অস্থির হয়ে রইলেন। রাতের খাবার খেলেন না। ব্যাকুল আগ্রহ নিয়ে এনসেফালোগ্রাফিক এনালাইসিস-এর জটিল গণিত নিয়ে বসলেন, কিন্তু কোনো অগ্রগতিই হলো না।
মধ্যরাতের কিছু আগে তিনি আবার লিভিং রুমে এসে ঢুকলেন।
পিলীয়াস এন্থর তখনো সেখানে ছিল, ভিডিওর কন্ট্রোল নাড়ছে। পায়ের শব্দ পেয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল।
‘হাই। আপনি এখনো ঘুমাননি? আমি একঘণ্টা ধরে ভিডিওর সামনে বসে আছি, বুলেটিন ছাড়া অন্য কিছু শোনার চেষ্টা করছি। মনে হয় এফ, এস হোবার ম্যালো তার গতিপথ থেকে সরে গেছে এবং অনেকক্ষণ যাবৎ কোনো যোগাযোগ নেই।’
‘তাই? ওরা কী সন্দেহ করছে?’
‘আপনার কী মনে হয়? কালগানিয়ানদের চাতুরি। রিপোর্ট পাওয়া গেছে যে, স্পেসের যেখান থেকে হোবার ম্যালো শেষবার যোগাযোগ করেছিল সেখানে কালগানিয়ান ভেসেলও দেখা গেছে।’
কাঁধ ঝাঁকালেন ডেরিল এবং এন্থর সন্দেহ নিয়ে কপাল ঘষল।
“দেখুন, ডক,’ সে বলল, ‘আপনি বরং ট্রানটরে চলে যান। ‘কেন যাব?’।
‘কারণ আপনি এখানে আমাদের কোনো কাজে আসবেন না। আপনি নিজের মধ্যে নেই। স্বাভাবিক। তা ছাড়া ট্রানটরে গেলে আপনার একটা লাভও হবে। প্রাচীন ইম্পেরিয়াল লাইব্রেরিতে সেল্ডন কমিশনের সম্পূর্ণ রেকর্ড রয়েছে।’
‘না! এই লাইব্রেরি কারো কোনো সাহায্যে লাগবে না।‘
‘এক সময় এবলিং মিসকে সাহায্য করেছিল।‘
‘তুমি কীভাবে জান? হ্যাঁ, সে বলেছিল যে দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশন সে খুঁজে পেয়েছে এবং মাত্র পাঁচ সেকেণ্ড পরেই আমার মা তাকে হত্যা করে যেন মিউলকে জানাতে না পারে। কিন্তু তাকে মেরে ফেলায় আমাদের পক্ষেও বলা সম্ভব নয় মিস আসলেই জানতে পেরেছিল কিনা। তা ছাড়া ঐ রেকর্ডগুলো থেকে আজ পর্যন্ত কেউ প্রকৃত সত্য বের করতে পারেনি।’
‘এবলিং মিস, আপনি নিশ্চয় জানেন কাজ করছিল মিউলের মাইণ্ডের চালিকা শক্তির অধীনে।
‘আমি জানি, কিন্তু মিস-এর মাই, সেই সময়ে ছিল একেবারেই অপ্রকৃতিস্থ। তুমি বা আমি কী স্পষ্ট করে বলতে পারব অন্য কারো ইমোশনাল কন্ট্রোলে থাকা একটা মাইণ্ডের প্রকৃত অবস্থা কী হয়! তার ক্ষমতা বা দুর্বলতা? যাই হোক আমি ট্রানটরে যাচ্ছি না।’
এন্থরের ভুরু কুঁচকে গেল ‘ম্পেস, আমি আপনাকে বুঝতে পারছি না। দেখে মনে হয় আপনার বয়স দশ বছর বেড়ে গেছে। নরক যন্ত্রণা ভোগ করছেন। এখানে আপনি গুরুত্বপূর্ণ কোনো কাজ করছেন না। আপনার জায়গায় আমি হলে সোজা গিয়ে মেয়েকে নিয়ে আসতাম।’
‘ঠিক! আমিও তাই করতে চাই। সেজন্যই করছি না। এন্থর, বোঝার চেষ্টা কর। তুমি একটা খেলা খেলছ–আমরা দুজনেই খেলছি–এমন একপক্ষের সাথে যাদের সাথে লড়বার শক্তি আমাদের নেই।
‘পঞ্চাশ বছর ধরে আমরা জানি দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশন সেলডনিয়ান গণিতের প্রকৃত বংশধর। তুমিও ভালভাবেই জান যে গ্যালাক্সির সবকিছুই তাদের হিসাব অনুযায়ী হয়। জীবন আমাদের কাছে আরোপিত দুর্ঘটনার সমন্বয়। তাদের কাছে জীবন উদ্দেশ্যমূলক এবং আগে থেকেই হিসাব করা।’
‘কিন্তু তাদেরও দুর্বলতা রয়েছে। তাদের কাজ পুরোপুরি পরিসংখ্যান নির্ভর এবং মানুষের দলীয় আচরণের উপরই শুধু প্রয়োগ করা যায়। এখন ইতিহাসের পূর্বনির্ধারিত গতিপথে আমার একক ভূমিকা কী আমি জানি না। সম্ভবত কোনো নির্দিষ্ট ভূমিকা নেই, যেহেতু সেলডনের মতে একক আচরণ অনির্ণায়ক এবং স্বাধীন। কিন্তু আমি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি এবং তারা তারা, তুমি বুঝতে পারছ—হয়তো–আমার সম্ভাব্য আচরণ ধরতে পেরেছে। তাই আমি আমার অনুভূতি, ইচ্ছা, সম্ভাব্য আচরণ অস্বীকার করে চলেছি।‘
‘আমি বরং তাদের প্রত্যাশার বাইরে আচরণ করব। আমি এখানেই থাকব, যদিও আমার ব্যাকুল ইচ্ছা ট্র্যানটরে যাওয়ার।’
তিক্তভাবে হাসল তরুণ। আপনি নিজের মাইণ্ড প্রতিপক্ষ যতটুকু বুঝতে পারে ততটুকুও বুঝতে পারেন না। ধরুন–তারা হয়তো আপনার চিন্তাধারা বুঝতে পেরেছে, চিন্তাধারা নয় বরং বলা যায় আপনার যুক্তি কী হবে সেটা তারা আগেই বুঝতে পেরেছে।
‘সেক্ষেত্রে পালানোর উপায় নেই। ট্রানটরে যাওয়ার ব্যাপারে তুমি এই মুহূর্তে যে যুক্তি দেখালে, সেটাও তারা হয়তো আগেই বুঝতে পেরেছে। একটা সীমাহীন চক্র। এই চক্রের কতটুকু অনুসরণ করতে পেরেছি সেটা কোনো ব্যাপার না। আমি যাব অথবা থাকব। মেয়ের বিপদের অর্থ এই না যে আমি যেখানে আছি সেখানেই থাকব। কারণ তারা কিছু না করলেও আমি এখানেই থাকব। কাজটা করা হয়েছে আমাকে সরানোর জন্য, তাই আমি থাকব।’
‘তা ছাড়া, এন্থর সব ঘটনাতেই হয়তো দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনের হাত নেই। আর্কেডিয়ার সাথে তাদের হয়তো কোনো সম্পর্ক নেই, সে হয়তো ট্রানটরে নিরাপদেই থাকবে।’
‘না,’ এন্থর বলল, ধারালো গলায়, ‘এখন আপনি মূল বিষয় থেকে সরে যাচ্ছেন।‘
‘তোমার কাছে বিকল্প ব্যাখ্যা আছে?’
‘হ্যাঁ আছে–যদি আপনি শোনেন।‘
‘ওহ, চালিয়ে যাও। আমার ধৈর্যের অভাব নেই।’
‘ঠিক আছে, তা হলে আপনি নিজের মেয়েকে কতটুকু চিনেন?
‘একজন মানুষ আরেকজন মানুষকে কত ভালোভাবে জানতে পারে? অবশ্যই আমার জানাটা পর্যাপ্ত নয়।‘
‘আমার বেলায়ও কথাটা সত্য–কিন্তু অন্ততপক্ষে আমি নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে তাকে বিচার করেছি। প্রথমত সে ভীষণ রোমান্টিক, অভিজাত বিদ্বান ব্যক্তির একমাত্র সন্তান, ভিডিও এবং বুক-ফিল্মের কল্পিত জগতের মধ্যে বেড়ে উঠেছে। সে এসপায়োনেজ এবং রহস্যের এক নিজস্ব জগতে বাস করে। দ্বিতীয়ত সে যথেষ্ট বুদ্ধিমতী; আমাদের নিশ্চিহ্ন করে ফেলার মতো বুদ্ধিমতী। আমাদের প্রথম আলোচনা শুনে ফেলার পরিকল্পনা করে সে সফল হয়েছে। মান এর সাথে কালগানে যাওয়ার পরিকল্পনা করে সে সফল হয়েছে। তৃতীয়ত তার পিতামহী, আপনার মায়ের উপর তার অপরিসীম ভক্তি রয়েছে।’
‘আমি লেফটেন্যান্ট ডিরিজের কাছ থেকে সম্পূর্ণ রিপোর্ট পাই। এ ছাড়াও কালগানে আমার সোর্স আছে সবগুলো চেক করি। আমরা জানতে পারি লর্ড অব কালগান প্রথমে মানকে মিউলের প্রাসাদে যাওয়ার অনুমতি দেয়নি, কিন্তু আর্কেডিয়া লেডি সেলিয়া– ফার্স্ট সিটিজেনের একজন ভাল বন্ধু তার সাথে কথা বলার পর হঠাৎ করেই অনুমতি দেয়।‘
ডেরিল বাধা দিলেন, ‘এত কিছু তুমি কীভাবে জানলে?’
‘একটা উপায়ে, আর্কেডিয়াকে ধরার জন্য ডিরিজ মানকে জেরা করে। তাদের আলোচনার সম্পূর্ণ বর্ণনা আমার কাছে পৌঁছেছে।‘
‘এবং এই লেডি সেলিয়া। গুজব রয়েছে যে তার প্রতি স্ট্যাটিনের আর কোনো আগ্রহ নেই। কিন্তু এই গুজবের কোনো ভিত্তি নেই। সে শুধু মানুকে অনুমতি দেওয়ার জন্য স্ট্যাটিনকে রাজি করায়নি, বরং সবার সামনেই আর্কেডিয়ার পালানোর ব্যবস্থা করে দিয়েছে। স্ট্যাটিনের প্রাসাদের প্রায় একডজন সৈনিক সেদিন সন্ধ্যায় তাদের দুজনকে এক সাথে দেখেছে। তারপরও সেলিয়াকে কোনো শাস্তি দেওয়া হয়নি। যেখানে আর্কেডিয়াকে স্ট্যাটিন চেয়েছিল বন্দি করতে।’
‘কিন্তু তোমার সিদ্ধান্ত কী?’
‘আর্কেডিয়ার পালানোর ব্যবস্থা ছিল পূর্বপরিকল্পিত।’
‘আমি যেমন বলেছি।‘
‘এবং আর্কেডিয়া বুঝতে পারে ব্যাপারটা পূর্বপরিকল্পিত; আর্কেডিয়ার মতো মেয়ে সবখানেই ষড়যন্ত্র খুঁজে পায়। এখানেও পেল এবং আপনার মতো যুক্তি অনুসরণ করল। তারা চেয়েছিল সে ফাউণ্ডেশনে ফিরুক তার বদলে চলে গেল ট্রানটরে। কিন্তু ট্রানটরে কেন?’
‘বলো কেন?’
‘কারণ সেখানেই বেইটা, তার আদর্শ, মিউলকে পরাজিত করে। সচেতন বা অবচেতন ভাবে ঘটনাটা তার মনে গেঁথে রয়েছে। অবাক হবো না যদি আর্কেডিয়া একই শত্রুর কাছ থেকে পালায়।’
‘মিউল?’ ডেরিল অত্যন্ত ভদ্রভাবে জিজ্ঞেস করলেন।
‘অবশ্যই না। সে পালাচ্ছিল দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনের কাছ থেকে। আপনি কী ভেবেছেন এই সর্বগ্রাসী বিপদ থেকে কালগানও মুক্ত?’
‘যেভাবেই হোক আমরা দুজন সিদ্ধান্তে এসেছি আর্কেডিয়ার পালানো ছিল পূর্বপরিকল্পিত, ঠিক? তাকে খোঁজা হচ্ছিল এবং পাওয়াও যায়। কিন্তু ডিরিজ ইচ্ছাকৃতভাবেই তাকে যেতে দেয়। কী করে সম্ভব হলো? কারণ সে আমাদের লোক। কিন্তু তারা জানল কীভাবে? তারা কী আগেই জানত ডিরিজ বিশ্বাসঘাতক।‘
‘তুমি বলতে চাচ্ছ কালগানিয়ানরা সত্যি সত্যি আর্কেডিয়াকে বন্দী করতে চেয়েছিল। সত্যি বলতে কী তুমি আমাকে ক্লান্ত করে তুলেছ, এন্থর। তোমার কথা শেষ কর; আমি ঘুমাব।’
‘তাড়াতাড়িই শেষ করব।’ এন্থর পকেট থেকে কয়েকটা এনসেফালোগ্রাফ বের করল। “ডিরিজের ব্রেইন ওয়েভ, এন্থর বলল, স্বাভাবিকভাবে, সে ফিরে আসার পর তৈরি করা হয়েছে।’
‘ড. ডেরিল দেখতে পারছেন এবং যখন তিনি চোখ তুললেন তার মুখ সাদা হয়ে গেছে। তাকে কন্ট্রোল করা হয়েছে।’
‘ঠিক। আমাদের লোক বলেই সে আর্কেডিয়াকে ছেড়ে দেয়নি। বরং ছেড়ে দিয়েছে দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনের প্রভাবে।‘
‘এমনকি টার্মিনাসে নয়, ট্রানটরে যাচ্ছে জানার পরও।‘
এন্থর কাঁধ ঝাঁকাল। ‘তাকে সেভাবেই পরিচালিত করা হয়েছে। সে শুধুই একটা মাধ্যম। আর্কেডিয়া তাদের প্রত্যাশার বিপরীত পথ বেছে নিয়েছে এবং হয়তো নিরাপদ। অথবা বলা যায় ততক্ষণ পর্যন্ত নিরাপদ যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিকে নিজেদের অনুকূলে নিয়ে আসতে পারে–’
সে থেমে গেল। ভিডিওর ছোট সতর্কবাতি জ্বলছে নিভছে। অর্থাৎ কোনো গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ হচ্ছে। ডেরিলও দেখলেন এবং দীর্ঘদিনের অভ্যাস বশে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভিডিও চালু করলেন। তারা মাঝখান থেকে শুনছেন কিন্তু শেষ হওয়ার আগেই বুঝতে পারলেন যে হোবার ম্যালো বা তার যতটুকু অবশিষ্ট আছে খুঁজে পাওয়া গেছে এবং পঞ্চাশ বছরের মধ্যে এই প্রথম ফাউণ্ডেশন আবার যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ল।
এন্থরের চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। ‘ঠিক আছে, ডক্, আপনি শুনেছেন। কালগান আক্রমণ শুরু করেছে এবং কালগান দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনের অধীনে রয়েছে। আপনি কী মেয়েকে অনুসরণ করে ট্রানটরে যাবেন?’
‘না। আমি ঝুঁকি নেব। এখানেই।‘
‘ড. ডেরিল। আপনি আপনার মেয়ের মতো বুদ্ধিমান নন।’ সে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল তারপর কোনো কথা না বলেই চলে গেল।
আর ড. ডেরিল অনিশ্চয়তার মাঝে ডুবে গেলেন।
ভিডিও বিরতিহীনভাবে ফাউণ্ডেশন ও কালগানের মধ্যেকার যুদ্ধের প্রথম ঘণ্টার ছবি প্রদর্শন করছে এবং উত্তেজিত বর্ণনা দিয়ে চলেছে।
.
২.১১ লড়াই
ফাউণ্ডেশনের মেয়র হাত দিয়ে খুলি কামড়ে থাকা ঘন চুল আচড়ানোর ব্যর্থ চেষ্টা করলেন। দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। আমরা অনেক সময় নষ্ট করেছি; অনেক সুযোগ নষ্ট করেছি। আমি কোনো অভিযোগ করতে চাই না ড. ডেরিল, কিন্তু আমরা হারতে বাধ্য।
ডেরিল শান্তভাবে বললেন, ‘আস্থা হারানোর কোনো কারণ নেই, স্যার।‘
‘আস্থার অভাব! আস্থার অভাব! গ্যালাক্সি, ড, ডেরিল, অন্যান্য কারণগুলোকে আপনি কীভাবে বিচার করবেন? এদিকে আসুন–’
তিনি ডেরিলকে প্রায় টেনেই একটা স্বচ্ছ ডিম্বাকার কাঠামোর কাছে নিয়ে গেলেন। কাঠামোর চারদিকে রয়েছে একটা সাবলীল ফোর্স ফিল্ড। মেয়রের স্পর্শে সেখানে গ্যালাক্সির ত্রিমাত্রিক মডেল উজ্জ্বল হয়ে উঠল। পঁাচানো স্প্রিংয়ের মতো।
‘হলুদ রঙ দ্বারা চিহ্নিত, মেয়র বললেন, উত্তেজিতভাবে, ‘স্পেসের এই অংশগুলো নিয়ন্ত্রণ করছে ফাউণ্ডেশন; লাল রঙ চিহ্নিত অংশগুলো রয়েছে কালগানের অধীনে।
‘গ্যালাক্টোগ্রাফি, মেয়র বলে চলেছেন আমাদের প্রধান শত্রু। আমাদের দুর্বল কৌশলগত অবস্থান নিয়ে এডমিরালদের মনে কোনো সন্দেহ নেই। খেয়াল করুন। আমাদের শত্রুরা রয়েছে কেন্দ্রের আশপাশে। যে-কোনো দিক থেকেই তারা আমাদের ঠেকিয়ে দিতে পারবে। অনায়াসেই নিজেদের রক্ষা করতে পারবে।’
‘আমরা ছড়িয়ে রয়েছি। ফাউণ্ডেশনের অন্তর্ভুক্ত বসতিগুলোর গড় দূরত্ব কালগানের দূরত্বের প্রায় তিনগুণ। যেমন সান্তানি থেকে লক্রিস যেতে আমাদের দুহাজার পাঁচশ পারসেক পথ পাড়ি দিতে হয় কিন্তু তাদেরকে যেতে হয় মাত্র আটশ পারসেক। যদি আমরা–’
ডেরিল বললেন, ‘সবই আমি জানি, স্যার।‘
‘এবং আপনি বুঝতে পারছেন না যে এর অর্থ হচ্ছে পরাজয়।‘
‘এই যুদ্ধে দূরত্বের চাইতে বড় কিছু রয়েছে। আমি বলছি আমরা হারব না। একেবারেই অসম্ভব।‘
‘আপনি কীভাবে বলছেন যে আমরা হারব না?’
‘কারণ সেল্ডনস প্ল্যানের নিজের মতো একটা ব্যাখ্যা আছে আমার।’
‘ওহ,’ মেয়রের ঠোঁট বেঁকে গেল। তিনি পিছনে একহাত দিয়ে আরেক হাত ধরে দাঁড়ালেন। তাহলে আপনিও দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনের অতীন্দ্রিয় সাহায্যের উপর ভরসা করেন।‘
‘না, বরং ভরসা করি অবশ্যম্ভাবী সহযোগিতার উপর এবং সাহস ও ধৈর্যের উপর।‘
এবং নিজের আত্মবিশ্বাস থাকলেও তিনি ভয় পেলেন—
যদি–
যদি এন্থরের কথাই ঠিক হয় এবং কালগানকে ঐ মেন্টাল যাদুকররা তাদের সরাসরি হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করে। যদি তাদের উদ্দেশ্য হয় ফাউণ্ডেশনকে পরাজিত ও ধ্বংস করা। তাহলে? না! হতে পারে না।
এবং এখনও—
তিক্ততার হাসি হাসলেন তিনি। সেই একই অবস্থা। সবসময় অস্বচ্ছ গ্রানাইটের ভেতর দিয়ে দেখার ব্যর্থ চেষ্টা, শত্রুর কাছে যা অত্যন্ত স্বচ্ছ।
.
লর্ড অব কালগান যে গ্যালাকটিক মডেলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে সেটা হুবহু মেয়র এবং ডেরিলের মডেলের জমজ। পার্থক্য শুধু মেয়র ছিলেন গম্ভীর, কিন্তু স্ট্যাটিন হাসছে।
এডমিরালের জমকালো ইউনিফর্ম তার বিশাল দেহের সাথে মানিয়ে গেছে চমৎকার। গাঢ় লাল রঙের অর্ডার অব দ্য মিউল’ পদকের স্যাশ ডান কাঁধ থেকে কোমর পর্যন্ত বুকের উপর কোনাকুনি জড়িয়ে আছে। এই পদক দিয়েছিল পূর্ববর্তী ফার্স্ট সিটিজেন, যাকে সে ছয়মাসের মধ্যে ক্ষমতাচ্যুত করে। বাম কাঁধে লাগানো রয়েছে চকচকে রূপালি পদক।
তার সাথে রয়েছে জেনারেল স্টাফদের ছয়জন। প্রত্যেকের ইউনিফর্ম তার মতোই চাকচিক্যময়। আরও রয়েছে তার ফার্স্ট মিনিস্টার, বৃদ্ধ, হালকা-পাতলা–অন্য সবার সামনে একেবারে নিপ্রভ।
স্ট্যাটিন বলল, আমার মনে হয় সিদ্ধান্তগুলো পরিষ্কার। অপেক্ষা করার সামর্থ্য আমাদের আছে। আর অপেক্ষার প্রতিটি মুহূর্ত তাদের মনোবলের উপর এক একটি আঘাত। যদি নিজেদের শাসিত প্রতিটি অংশ তারা রক্ষা করতে চায়, তাহলে তাদের শক্তি কমে যাবে। তখন আমরা একসাথে দুজায়গায় হামলা চালাব এখানে এবং এইখানে।’ সে গ্যালাকটিক মডেলে অবস্থানগুলো দেখাল। দুটো সাদা রেখা লাল অংশ থেকে হলুদ অংশের দিকে ছুটে গেল এবং টার্মিনাসকে একপাশে আলাদা করে ফেলল। যদি তারা ছড়িয়ে না পড়ে এক জায়গায় জড়ো হয় তা হলে স্বেচ্ছায় তাদের ডোমিনিয়নের দুই-তৃতীয়াংশ আমাদের হাতে ছেড়ে দেবে। এর ফলে ফাউণ্ডেশনে বিদ্রোহের ঝুঁকি বাড়বে।
ফার্স্ট মিনিস্টারের পাতলা কণ্ঠস্বর নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করল। ‘ছয়মাসের মধ্যে,’ সে বলল, ‘ফাউণ্ডেশন আরও শক্তিশালী হয়ে উঠবে। আমরা জানি, তাদের প্রচুর সম্পদ আছে, সংখ্যার দিক দিয়ে তাদের নেভী আমাদের চাইতে শক্তিশালী; তাদের জনশক্তি অপ্রতিরোধ্য। বরং ঝটিকা আক্রমণ চালানোই নিরাপদ।‘
তার কথায় কেউ প্রভাবিত হলো না। লর্ড স্ট্যাটিন হেসে বলল, ‘ছয় মাস বা এক বছর, যদি প্রয়োজন হয়–আমাদের কোনো ক্ষতি হবে না। এই সময়ের মধ্যে ফাউণ্ডেশন নিজেদের প্রস্তুত করতে পারবে না। প্রস্তুত হতে পারবে না কারণ তারা গভীরভাবে বিশ্বাস করে দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশন তাদের রক্ষা করবে। কিন্তু এইবার করবে না।’
ঘরের প্রত্যেকটি লোক অস্বস্তি নিয়ে তাকিয়ে আছে।
‘তোমাদের আত্মবিশ্বাস কমে গেছে, আমার মনে হয়।‘ সে বলল, ঠাণ্ডা গলায়। ‘ফাউণ্ডেশনে আমাদের যে এজেন্ট আছে তার রিপোর্ট আবার ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন আছে, অথবা মি. হোমির মান, ফাউণ্ডেশন এজেন্ট–যে এখন আমাদের পক্ষে কাজ করছে–তার রিপোর্ট। তোমরা যেতে পার।‘
স্ট্যাটিন মুখে হাসি নিয়ে তার ব্যক্তিগত চেম্বারে ঢুকল। হোমির মানকে নিয়ে সে প্রায়ই অবাক হয়। মেরুদণ্ডহীন লোকটা তার কথা রেখেছে। প্রচুর তথ্য দিচ্ছে–বিশেষ করে যখন সেলিয়া সামনে থাকে।
মুখের হাসি প্রশস্ত হলো। বোকা লোকটা শেষ পর্যন্ত সেলিয়ার কাজে লাগছে। অন্তত মিষ্টি কথা দিয়ে মা-এর কাছ থেকে কাজ আদায় করতে পারছে, কোনো সমস্যা ছাড়াই। সেলিয়া অত্যন্ত ঈর্ষাপরায়ণ। পেস! যদি ডেরিলের মেয়েটা থাকত–এখনও সেলিয়ার মাথা সে পাউডার বানায়নি কেন?
কারণটা বুঝতে পারল না।
হয়তো সেলিয়া মান্-এর সাথে জড়িয়ে পড়েছে এবং মাকে তার প্রয়োজন। সেই প্রথম যুক্তি দিয়ে বলেছে যে দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনের অস্তিত্ব নেই। তার এডমিরালদের জন্য এই নিশ্চয়তার প্রয়োজন রয়েছে।
আর এখন—
সে মাথা ঝাঁকিয়ে চিন্তাগুলো দূর করে দিল।
.
২.১২ পরিত্যক্ত পৃথিবী
ট্র্যানটর নিঃশেষিত এবং পুনর্জন্ম লাভ করা এক পৃথিবী। গ্যালাক্সির কেন্দ্রে অত্যুজ্জ্বল নক্ষত্রের ভিড়ে নিস্প্রভ এক পাথরের মতো অতীতের স্মৃতি ও ভবিষ্যতের স্বপ্ন নিয়ে বেঁচে আছে।
এক সময় ছিল যখন এই গ্রহের ধাতব আবরণের ভিতর থেকে সীমাহীন কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা স্টারডোমের সর্বশেষ প্রান্তকেও রেখেছিল শক্ত বাধনে। পুরো গ্রহ ছিল। একটা মাত্র শহর, বাস করত চারশ বিলিয়ন প্রশাসনিক কর্মকর্তা; গ্যালাকটিক এম্পায়ারের পরাক্রমশালী রাজধানী।
এম্পায়ার যখন ধ্বংস হয় তখন ট্রানটরের কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা একেবারে নিঃশেষ হয়ে পড়ে। বিশাল ধ্বংসযজ্ঞের সময় যে ধাতব আবরণ পুরো গ্রহকে আবৃত করে রেখেছিল সেগুলো হাস্যকরভাবে দুমড়ে মুচড়ে যায়।
যারা টিকে থাকতে পেরেছিল তারা ধাতব পাত খুলে খাদ্য ও গবাদি পশুর বিনিময়ে অন্যান্য গ্রহের নিকট বিক্রি করে দেয়। আবার উন্মুক্ত হয়ে পড়ে মাটি এবং এই গ্রহ ফিরে যায় তার শুরুতে। প্রাগৈতিহাসিক চাষাবাদের যুগে, ভুলে যায় তার মহান অতীত।
কিন্তু এখনও পুরোনো অতীতের ছিটেফোঁটা আকাশ সমান উঁচুতে তিক্ত এবং গম্ভীর নীরবতায় পুঞ্জীভূত হয়ে আছে।
.
দিগন্তের কাছে ধাতব কাঠামোগুলো দেখলে দম বন্ধ হয়ে যায় আর্কেডিয়ার। পালভাররা যে গ্রামে থাকে সেই গ্রামের ঘরবাড়িগুলো গায়ে গায়ে লাগিয়ে তৈরি করা–ছোট এবং প্রাগৈতিহাসিক। চারপাশের বিস্তৃত মাঠে পাকা ফসলের কারণে হলদে সোনালি রঙের মনে হয়।
কিন্তু সেখানেই, গন্তব্যসীমার অদূরেই রয়েছে, অতীতের স্মৃতি। রাজকীয় মহিমা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, উজ্জ্বল হয়ে আছে। যেখানে ট্র্যানটরের সূর্যের আলো পড়ছে মনে হয় সেখানে যেন আগুন ধরে গেছে। ট্রানটরে আসার পর আর্কেডিয়া একদিন সেখানে গিয়েছিল। মসৃণ এবং জোড়াহীন পেভমেন্ট বেয়ে উপরে উঠে এবং ঝুঁকি নিয়ে ধূলি ধূসরিত কাঠামোর ভিতরে প্রবেশ করে, ভাঙা দেওয়াল এবং পার্টিশনের ফাঁকফোকর দিয়ে আলো ঢুকছিল।
দম বন্ধ করা অনুভূতি।
সে ফিরে আসে, ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে নামে যতক্ষণ পর্যন্ত না পায়ের নিচে মাটির পর্শ পায়। এবং ঘুরে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকে। দ্বিতীয়বার বিষণ্ণ গাম্ভীর্যতা ভঙ্গ করার সাহস তার হয়নি।
জানে এই পৃথিবীর কোনখানে সে জন্মেছিল, প্রাচীন ইম্পেরিয়াল লাইব্রেরির কাছে, যা ছিল ট্রানটরের চেয়েও সমৃদ্ধশালী। সবচেয়ে ভাবগম্ভীর, সবচাইতে পবিত্র। সবগুলো পৃথিবীর মধ্যে, মহাবিপর্যয়ের হাত থেকে একমাত্র এই লাইব্রেরিই রক্ষা পায় এবং প্রায় এক শতাব্দী ধরে ছিল স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং অক্ষত।
সেখানেই হ্যারি সেন্ডন এবং তার সঙ্গীরা কল্পনাতীত জাল তৈরি করেছেন। সেখানেই এবলিং মিস গোপন রহস্য ভেদ করেন এবং তাকে হত্যা করার আগে বিপুল বিস্ময়ে সেখানেই বসেছিলেন।
এই ইম্পেরিয়াল লাইব্রেরিতেই তার পিতামহ-পিতামহী মিউলের মৃত্যুর আগে দশবছর বাস করেছেন, তারপর তারা নবগঠিত ফাউণ্ডেশনে ফিরে যান।
এই ইম্পেরিয়াল লাইব্রেরিতেই তার বাবা স্ত্রীকে নিয়ে এসেছিলেন দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশন খুঁজতে, কিন্তু ব্যর্থ হন। সেখানেই তার জন্ম এবং সেখানেই তার মায়ের মৃত্যু হয়।
লাইব্রেরিটা দেখতে চায় সে, কিন্তু পালভার তার গোল মাথা নেড়ে না করেছে। ‘প্রায় হাজার মাইল দূরে, আর্কেডি, এবং এখানে অনেক কাজ পড়ে আছে। তা ছাড়া যাওয়াটা ঠিক হবে না। ওটা একটা পবিত্র স্থান–’
কিন্তু আর্কেডিয়া জানে লাইব্রেরি দেখার কোনো ইচ্ছা পালভারের নেই; মিউলের প্রাসাদের মতো একই কারণ। ভয় এবং কুসংস্কার।
কিন্তু এই বেঁটে লোকটার উপর সে রাগ করতে পারছে না। প্রায় তিনমাস হতে চলল সে ট্রানটরে এসেছে এবং পুরোটা সময়, তারা দুজন–পপা এবং মমা তার সাথে খুব ভালো ব্যবহার করে চলেছে—
বিনিময়ে সে কী দিয়েছে? বরং তাদেরকে অনিবার্য বিপদের দিকে ঠেলে দিয়েছে। সে কী বলে দেবে যে তাকে যারা রক্ষা করার চেষ্টা করবে তারা সবাই বিপদে পড়বে। না! ওই দুজনকে সে জানাবে না।
তার অনুশোচনা হচ্ছে কিন্তু এ ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।
ব্রেকফাস্ট করার জন্য নিচে নামল সে। কথা বলার শব্দ পেল।
.
সার্টের কলারের নিচে ন্যাপকিন খুঁজে প্রীম পালভার বিতৃষ্ণা নিয়ে ডিম পোচের বাটি টেনে নিল।
‘গতকাল আমি শহরে গিয়েছিলাম, মমা,’ মুখ ভর্তি খাবার নিয়ে বলল সে।
‘শহরের খবর কী, পপা?’ নিরাসক্ত গলায় জিজ্ঞেস করল মমা, বসে আছে। টেবিলটা ভাল মতো দেখে লবণ আনার জন্য আবার উঠল।
‘আহ, খুব একটা ভালো না। কালগান থেকে একটা শিপ এসেছিল সাথে ছিল সেখানকার ঋররের কাগজ। যুদ্ধ শুরু হয়েছে সেখানে।‘
‘যুদ্ধ! তাই! ঠিক আছে, ওদের বুদ্ধি না থাকলে নিজের মাথা ফাটাতে দাও। তোমার বিল এখনো আসেনি? ‘পপা, আমি আবারও বলছি। বুড়ো কসকারকে সতর্ক করে দাও যে এই পৃথিবীতে আরও সমবায় আছে। ওরা তোমাকে যে পরিমাণ দেয় সেটা বান্ধবীদের কাছে জ্বলতে আমার লজ্জা করে, কিন্তু এইবার অন্তত তারা লজ্জিত হবে।’
বিরক্তির সাথে বলল পপা, ‘দেখ ব্রেকফাস্ট করার সময় আমাকে বাজে কথা বলতে বাধ্য করো না, তাহলে গলায় খাবার আটকে মরব,’ বলেই মাখন লাগানো টোস্টের উপর রাগ ঝাড়ল। নরম সুরে যোগ করুল, ‘লড়াই হচ্ছে ফাউণ্ডেশন এবং কালগানের মধ্যে। দুই মাস ধরে লড়াই চলছে।‘
হাত নেড়ে স্পেস ফ্লাইটের ভঙ্গি করে দেখাল সে।
‘হুম-ম-ম কার কী অবস্থা?’
‘ফাউণ্ডেশনের অবস্থা ভালো না। কালগানে তো তুমি দেখেছুই; সবাই সৈনিক। ওরা তৈরি হয়েই ছিল। ফাউণ্ডেশন তৈরি ছিল না, আর তাই–বুম!’
হঠাৎ করেই মমা কাঁটাচামচ নামিয়ে রেখে চাপাস্বরে বলল, ‘বোকা!’
‘হাহ?’
‘মাথা মোটা! তোমার এই বড় মুখটা সবসময়ই চলছে৷’
দ্রুত নির্দেশ করুল সে এবং যখন পপা কাঁধের উপর দিয়ে তাকাল, দেখল আর্কেডিয়া দাঁড়িয়ে আছে দরজার সামনে, পাথরের মূর্তির মতো।
‘ফাউণ্ডেশন যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে?’ জিজ্ঞেস কবুল আর্কেডিয়া।
অসহায়ের মতো মমার দিকে তাকাল পপা, তারপর উপর নিচে মাথা নাড়ল।
‘এবং তারা হারছে?’
আবারও মাথা নাড়ল।
আর্কেডিয়ার মনে হল তার দম বন্ধ হয়ে যাবে, ধীর পায়ে টেবিলের দিকে এগিয়ে এল। সব শেষ হয়ে গেছে? জিজ্ঞেস করল ফিসফিসিয়ে।
‘সব শেষ?’ পপা পুনরাবৃত্তি করে বলল। ‘কে বলেছে সব শেষ হয়ে গেছে? যুদ্ধে অনেক কিছুই হতে পারে। আর…আর–’
‘বসো ডার্লিং,’ তাকে শান্ত করার জন্য নরম সুরে বলল মমা। ‘খাওয়ার আগে বেশি কথা বলা ঠিক না।‘
কিন্তু আর্কেডিয়া সেদিকে কান দিল না। কালগানিয়ানরা কী টার্মিনাসে পৌঁছে গেছে?’
‘না,’ জোর দিয়ে বলল পপা। ‘খবরটা গত সপ্তাহের, এবং টার্মিনাস এখনও লড়ছে। আমি সত্যি বলছি এবং ফাউণ্ডেশন এখনও শক্তিশালী। তোমাকে খবরের কাগজটা এনে দেব?’
‘হ্যাঁ!’
খাওয়া শুরু করল সে কিন্তু চোখ খবরের উপর। সাপ্তানি এবং কোরেল হাতছাড়া হয়ে গেছে–বিনা যুদ্ধে। ইফনি সেক্টরে ফাউণ্ডেশন নেভির একটা স্কোয়াড্রন ধরা পড়ে এবং প্রায় প্রত্যেকটি শিপ ধ্বংস হয়ে গেছে।
আর এখন ফাউণ্ডেশন আবার প্রথম মেয়র সেলভর হার্ডিনের গড়ে তোলা চার সেক্টর নিয়ে সংগঠিত যুক্তরাজ্যে পরিণত হয়েছে। কিন্তু তারা এখনও লড়ছে এবং এখনও হয়তো সুযোগ আছে–এবং যত যাই ঘটুক, তার বাবাকে জানাতেই হবে। যে কোনোভাবে তার বাবার কানে কথাটা পৌঁছাতেই হবে। তাকে পারতেই হবে।
কিন্তু কীভাবে? এই যুদ্ধের সময়।
নাস্তা শেষ হওয়ার পর সে পপাকে জিজ্ঞেস করল, নতুন মিশন নিয়ে আপনি আবার বাইরে যাবেন, মি. পালভার?
পপা একটা বড় চেয়ার নিয়ে সামনের লনে রোদে বসেছে। মোটা মোটা আঙ্গুলের ফাঁকে জ্বলছে একটা পেট মোটা চুরুট। দেখে মনে হয় মহাসুখী।
‘মিশন?’ পপা জিজ্ঞেস করল, অলসভাবে। কে জানে। কী সুন্দর অবকাশ আর আমার ছুটি এখনও শেষ হয়নি। নতুন মিশনের কথা উঠছে কেন? তোমার অসুবিধা হচ্ছে। আর্কেডি?
‘আমার? না, এখানে আমার ভালই লাগছে। আপনি আমার সাথে খুব ভালো ব্যবহার করছেন, আপনি এবং মিসেস পালভার।‘
হাত নেড়ে কথাগুলো উড়িয়ে দিল সে।
আর্কেডিয়া বলল, ‘আমি যুদ্ধের কথা ভাবছিলাম।’
‘ওই ব্যাপার নিয়ে বেশি ভেবো না। তুমি কী করতে পারবে। কিছু যদি করতে নাই পার, তা হলে ভেবে ভেবে কষ্ট পাবে কেন?
‘কিন্তু আমি ভাবছিলাম যে ফার্মিং ওয়ার্ল্ডগুলো ফাউণ্ডেশনের হাতছাড়া হয়ে গেছে। সেখানে এখন সম্ভবত খাদ্য সংকট চলছে।’
অস্বস্তিতে ভুগছে পপা। ‘চিন্তা করো না। সব ঠিক হয়ে যাবে।’
আর্কেডিয়া শুনলই না। ‘আমি যদি তাদের জন্য খাদ্য নিয়ে যেতে পারতাম। আপনি জানেন, মিউলের মৃত্যুর পর ফাউণ্ডেশন বিদ্রোহ করে, কিছু সময়ের জন্য টার্মিনাস হয়ে পড়ে বিচ্ছিন্ন এবং জেনারেল হ্যান প্রিচার, যে মিউলের উত্তরসূরি হিসাবে অল্প সময়ের জন্য ক্ষমতায় ছিল, টার্মিনাস অবরোধ করে। সে সময় চরম খাদ্য সংকট দেখা দেয় এবং আমার বাবাকে তার বাবা বলেছিলেন যে খাওয়ার জন্য তাদের কাছে সহজপ্রাপ্য ছিল শুকনো এমিনো এসিড, স্বাদ ছিল ভয়ানক। একটা ডিমের দাম দাঁড়িয়েছিল দুশ ক্রেডিট। তারপর অবরোধ উঠিয়ে নিলে সান্তানি থেকে খাদ্য নিয়ে শিপ এসেছিল। সময়টা ছিল অবশ্যই খুব কষ্টের। সম্ভবত এখনও সেই ধরনের পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে।’
একটু চুপ থেকে আর্কেডিয়া বলল, আমি বাজি রেখে বলতে পারি ফাউণ্ডেশন এখন খাদ্যের জন্য দ্বিগুণ, তিনগুণ বা তারও বেশি দাম দিতে রাজি। যদি কোনো সমবায় খামার, যেমন এই ট্র্যানটর থেকেই যদি কেউ কাজটা শুরু করে, তারা কিছু শিপ হারাতে পারে, কিন্তু যুদ্ধ শেষ হওয়ার আগেই তারা মিলিওনেয়ার হয়ে যাবে। ফাউণ্ডেশনের ট্রেডাররা এভাবেই প্রচুর লাভ করতেন। প্রতি ট্রিপেই প্রায় দুই মিলিয়ন ক্রেডিট লাভ। তাও আবার একটা শিপের পণ্য বেচে।’
পপ তাকিয়ে আছে, চুরুট কখন হাত থেকে পড়ে গেছে খেয়ালই নেই। খাদ্য সরবরাহের চুক্তি, হাহ? হুম– কিন্তু ফাউণ্ডেশন অনেক দূরে।
‘ওহ্, আমি জানি। যদি নিয়মিত শিপ লাইনার ধরে যান তাহলে সম্ভবত ম্যাসিনা বা স্নাসিক-এর চেয়ে বেশি কাছে পৌঁছতে পারবেন না এবং তারপর পথ দেখানোর জন্য একটা ছোট স্কাউটশিপ বা অন্য কিছু ভাড়া করতে হবে।’
মনে মনে হিসাব করতে লাগল পপা।
দুই সপ্তাহের মধ্যে মিশনের সমস্ত প্রস্তুতি সম্পন্ন হল। মমা সারাক্ষণ প্রতিবাদ জানিয়ে চলেছে–প্রথমত পপা একগুয়ের মতো বিপদের ঝুঁকি নিচ্ছে বলে। তারপর তাকে সাথে নিতে রাজি না হওয়ায়।
পপা বলল, ‘মমা, তুমি বুড়ি মেয়েমানুষের মতো আচরণ করছ কেন? তোমাকে সাথে নিতে পারব না। কাজটা পুরুষলোকের। যুদ্ধটাকে তুমি কী মনে কর? মজা? ছেলেখেলা?’
‘তা হলে তুমি যাচ্ছ কেন? তুমি কী পুরুষ, বুড়ো ভাম–একপা আর একহাত কবরে দিয়ে রেখেছ। অল্প বয়সের কাউকে যেতে দাও তোমার মতো ফাঁকা মাথার বুড়ো যাবে কেন?’
‘আমার মাথা ফাঁকা না,’ সম্মান বাঁচাতে তীব্র প্রতিবাদ করল পপা। ‘আমার মাথায় এখনও প্রচুর চুল আছে। তাছাড়া আমি কেন কমিশন নেব না? অল্প বয়সের কেউ নেবে কেন? শোনো, এই ট্রিপে প্রায় মিলিয়ন ক্রেডিট রোজগার হতে পারে।‘
মমা সেটা জানে, তাই আর প্রতিবাদ করল না।
যাওয়ার আগে আর্কেডিয়া তার সাথে দেখা করল।
‘আপনি টার্মিনাসে যাবেন?’ জিজ্ঞেস করল সে।
‘কেন নয়? তুমি নিজেই বলেছ তাদের রুটি, চাল, আলু প্রয়োজন। চুক্তিতে রাজি হলেই তারা জিনিসগুলো পাবে।
‘তা হলে একটা কথা, যদি আপনি টার্মিনাসে যান…আমার বাবার সাথে দেখা করবেন?’
পপার মুখ সহানুভূতিতে আর্দ্র হয়ে উঠল, ‘ওহ–তোমাকে বলতে হবে না। নিশ্চয়ই আমি তার সাথে দেখা করব। বলব যে তুমি নিরাপদে রয়েছ এবং সবকিছু ঠিক আছে, আর যুদ্ধ শেষ হলে আমি তোমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাব।’
‘ধন্যবাদ। আমি বলে দিচ্ছি কীভাবে তাকে খুঁজবেন, উনার নাম ড. টোরান ডেরিল, থাকেন স্ট্যানমার্কে। টার্মিনাস সিটির একটু বাইরে, একটা ছোট বায়ুন নিয়মিত সেখানে যাতায়াত করে। আমরা থাকি ৫৫, চ্যানেল ড্রাইভ-এ।‘
‘দাঁড়াও, আমি লিখে নেই।‘
‘না, না,’ প্রবল বেগে হাত-পা নেড়ে বাধা দিল আর্কেডিয়া। কোনো কিছুই লিখে রাখবেন না। আপনি অবশ্যই মনে রাখবেন–এবং কারো সাহায্য ছাড়া আমার বাবার সাথে দেখা করবেন।’
ধাঁধার মধ্যে পড়ে গেল পপা। তারপর কাঁধ ঝাঁকাল। ‘ঠিক আছে, তাহলে, তোমরা থাকো স্ট্যানমার্ক, ৫৫ চ্যানেল ড্রাইভ এবং যেতে হবে আকাশযানে। ঠিক আছে?’
‘আরেকটা জিনিস।‘
‘বল?’
‘আমার পক্ষ থেকে উনাকে কিছু কথা বলতে পারবেন?’
‘নিশ্চয়ই।‘
‘কথাগুলো আমি আপনার কানে কানে বলতে চাই।’
একটু নিচু হয়ে আর্কেডিয়ার দিকে মাথা এগিয়ে দিল সে, আর্কেডিয়া তার কানে ফিসফিস করে কথাগুলো বলল।
বিস্ময়ে পপার চোখ গোল হয়ে গেছে। এই কথাগুলো আমাকে বলতে হবে? কোনো অর্থ বুঝতে পারছি না।’
‘তিনি বুঝবেন আপনি কী বলছেন। শুধু বলবেন খবরটা আমি পাঠিয়েছি এবং আমি জানি যে তিনি এই কথাগুলোর অর্থ বুঝবেন। আমি যেভাবে বলেছি ঠিক সেভাবেই বলবেন। একটুও যেন ব্যতিক্রম না হয়। আপনি ভুলবেন না তো?’
‘কীভাবে ভুলব। পাঁচটা ছোট শব্দ, শোনো’
‘না, না।’ আচমকা বলল সে এবং নিজের অনুভূতির গভীরতা দেখে নিজেই অবাক হল। বলবেন না। আমার বাবা ছাড়া অন্য কারো সামনেই বলবেন না। প্রতিজ্ঞা করুন।
পপা আবারও কাঁধ ঝাঁকাল। ‘করলাম প্রতিজ্ঞা! ঠিক আছে!’
‘ঠিক আছে, দুঃখিত স্বরে বলল আর্কেডিয়া। পেসপোর্টে যাওয়ার জন্য পপা যখন এয়ার ট্যাক্সিতে উঠছে তখন তার মনে হল সে যেন পপার মৃত্যু পরোয়ানায় সই করেছে। তার সাথে আর দেখা হবে না।
ফিরে গিয়ে মমার মুখোমুখি হতে তার ভয় করছে। এই সহৃদয় পরিবারটিকে সে যে বিপদে ফেলেছে সেই অনুশোচনায় তাকে হয়তো আত্মহত্যা করতে হবে।