দ্বিতীয় অধ্যায় । ইসলাম ধর্ম । কোরানের অলৌকিকতা
পূর্বে বলা হয়েছে একটি দৃষ্টিগ্রাহ্য অলৌকিক শক্তি প্রদর্শনের জন্য মক্কার পৌত্তলিকদের পক্ষ থেকে মুহাম্মদের প্রতি যে বারবার দাবি করা হয়েছিল, তিনি সে দাবি পূরণে আগ্রহী ছিলেন না। মুহাম্মদের ভাষ্যমতে তিনি শুধুমাত্র শুভসংবাদ এবং সতর্কবাণী পৌছে দিতে এসেছেন। অপরদিকে কোরানের অলৌকিকতার ব্যাপারে তিনি সম্পূর্ণ ভিন্ন মনোভাব পোষণ করতেন। মুহাম্মদ নিজে কোরান তৈরি করেছেন কিংবা অন্য ব্যক্তিরা তার মুখ দিয়ে কোরানের বাণী প্রচার করছে, মক্কার সংশয়বাদীদের এমন দাবির প্রত্যুত্তরে তাদের প্রতি কোরানে একটি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়া হয় : “তারা কি বলে, “সে (মুহাম্মদ) এ বানিয়েছে?” বলো, তোমরা যদি সত্য কথা বল তবে তোমরা এ-ধরনের দশটি সুরা আনো আর আল্লাহ ছাড়া অন্য যাকে পার ডেকে আনো। (১১ সুরা হুদ ; আয়াত ১৩)। একই ধরনের দাবি সুরা বাকারার ২৩ নং আয়াতে রয়েছে : ‘আমি আমার দাসের প্রতি যা অবতীর্ণ করেছি তাতে তোমাদের কোনো সন্দেহ থাকলে তোমরা তার মতো কোনো সুরা আনো।’ এবং সুরা ইউনুসের ৩৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে : “তারা কি বলে, সে (মুহাম্মদ) এ রচনা করেছে? বলো, তবে তোমরা এর মতো এক সুরা আনো, আর যদি তোমরা সত্য কথা বল তবে আল্লাহ ছাড়া অন্য যাকে পারো ডাকো। এ-ধরনের চ্যালেঞ্জ এক ধরণের বালখিল্যতা, এবং তা যুক্তির হেত্বাভাসের মধ্যে পড়ে। প্রথমত, কোরানের মতো সুরা যাচাই করার পন্থা বা বৈশিষ্ট্যাবলী কি হবে, এ-বিষয়ে কোরানে কিছু বলা হয়নি। কেউ যদি কোরানের মতো সুরা রচনা করতে চান, তবে কোন কোন নির্দেশক দিয়ে পরিমাপন করা হবে ঐ সুরা আদৌ কোরানের মতো বা এর সমতুল্য হয়েছে কি-না, বা তার শ্রেষ্ঠত্ব কিভাবে নির্ধারণ করা হবে? কোরানে এ-বিষয়ের কোনো উত্তর পাওয়া যায় না। দ্বিতীয়ত, কোরান গদ্যছন্দে রচিত অনন্য গ্রন্থ। কোরানের মতো সুরা বলতে আসলে কী বোঝানো হয়েছে? কোরানের মতো সুরা যদি কেউ লিখেন সেটা স্বাভাবিকভাবে কোরান হবে না। সেটা ভিন্ন হবে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ওমর খৈয়ামের বিশ্ববিখ্যাত কবিতা বা বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্যের ভাষাজ্ঞান, রচনাশৈলীকে অনুকরণে কেউ কোনো কিছু রচনা করলেও এগুলো মোটেও খৈয়াম বা রবীন্দ্রের সাহিত্য বলে গণ্য হবে না। কারণ তাঁদের রচনা সাহিত্যের জগতে সর্বজনস্বীকৃত অনন্য সৃষ্টি। তেমনি কোরান, তৌরাত, জবুর, ইঞ্জিল, গীতাও এরকম একেকটি অনন্য গ্রন্থ। এগুলোর সাহিত্যমান নিয়ে তুলনা করা, শ্রেষ্ঠত্ব নির্ধারণ করা জটিল ও দুঃসাধ্য। তৃতীয়, সাহিত্যের দুটি বিষয়ের তুলনা অনেকাংশে আপেক্ষিক। একেক জনের কাছে একেক রকম মনে হতে পারে। হতে পারে বাংলাভাষী কোনো ব্যক্তির দৃষ্টিতে রবীন্দ্র-সাহিত্য হচ্ছে সাহিত্যের মানদণ্ড। একে মাপকাঠি ধরে অন্য সাহিত্য বিচার করা হয়। আবার অন্যের কাছে রবীন্দ্র-সাহিত্য সনাতন-ঘরানার মনে হতে পারে। আধুনিক, উত্তর-আধুনিক সাহিত্যগুলোর বৈশিষ্ট্যগুলোকে তিনি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশক মনে করতে পারেন তুলনামূলক বিচারের জন্য। আবার কারো কাছে গ্রিক কবি হোমারের ইলিয়ড, ওডিসি হচ্ছে অসাধারণ মহাকাব্য আবার কারো কাছে সেকেলে ধরনের লোকগাঁথা মনে হতে পারে। ইংরেজ সাহিত্যিক শেক্সপিয়ের, শেলির সাহিত্য সম্পর্কেও এরকম মূল্যায়ন হতে পারে। এ-অবস্থায় অত্যন্ত স্পর্শকাতর ধর্মগ্রন্থ এর বাণীকে সাহিত্যমান অনুযায়ী বিচার করাটা আপেক্ষিক ও জটিল বিষয়। পঞ্চমত, সময়ের সাথে সাথে ভাষার পরিবর্তন ঘটে। বাক্য গঠন, ভাবের প্রকাশ, শব্দসম্ভার, শব্দের বানান, ব্যবহার, উচ্চারণসহ একাধিক রূপ এবং ব্যাকরণগত পরিবর্তন ঘটে থাকে। এই পরিবর্তন কোনো ভাষার জীবনীশক্তি এবং প্রবহমানতার বহিঃপ্রকাশ। একবিংশ শতকের কোনো ব্যক্তির পক্ষে চাইলে চর্যাপদ-যুগের সাহিত্য রচনা করা সম্ভব নয়। তেমনি হাজার ধরে আরবি ভাষাতেও পরিবর্তনপরিবর্ধন সাধিত হয়ে চলছে। তাই বর্তমানকালে রচিত কোনো সুরা ও কোরানের সুরার মধ্যে ভাষাগত, সাহিত্যমানগত পার্থক্য থাকবেই। ফলে এই দুয়ের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের তুলনা করা বা এরূপ কোনো মূল্যায়ন অনর্থক।-অনুবাদক। মক্কার পৌত্তলিকদের তরফ থেকে কোরান কাল্পনিক কাহিনীতে পরিপূর্ণ বলে আরেকটি অভিযোগ ছিল। আর কেউ যখন তাদের নিকট আমার আয়াত আবৃত্তি করা হয় তখন তারা বলে, “আমরা তো শুনলাম, ইচ্ছা করলে আমরাও এরকম বলতে পারি, এ তো শুধু সেকালের উপকথা। (সুরা আনফাল ; আয়াত ৩১)। আল-তাবারির দ্যা হিস্ট্রি অব আল-তাবারি’ (ভলিউম ৭) গ্রন্থের বর্ণনা অনুযায়ী, পারস্য দেশ ভ্রমণকারী কুরাইশ গোত্রের বিখ্যাত কবি নদর বিন আল-হারিস (আল-হিরার লাখমিদ রাজার দরবারের রাজকবি ছিলেন একসময়) নবির এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেন। তিনি ফেরদৌসি নামে সুন্দর একটি কবিতা লিখে গণজমায়েতে পাঠ করে শুনালেন এবং দাবি করেন কোরানে যেভাবে আদ, সামুদ, লুত, নুহ, সাবা প্রভৃতি সম্প্রদায়ের কাহিনী বলা হয়েছে, তার থেকে অনেক সুন্দর করে পারস্যের বিখ্যাত রুস্তম-ইসফানদার এররাজকীয়ও বীরত্বপূর্ণ কাহিনী-গাথা বলতে পারেন। কবি নদর বিন আল-হারিসকে পরবর্তীতে বদরের যুদ্ধে বন্দী করা হয় এবং নবির আদেশক্রমে আলি বিন আবু তালিব তাঁকে শিরোচ্ছেদ করেন। সুরা বনি-ইসরাইলের ৮৮ নম্বর আয়াতে কবি নদরের বক্তব্যের প্রেক্ষিতে বলা হয়েছে : ‘বলো, যদি এ-কোরানের মতো কোরান আনার জন্য মানুষ ও জিন একযোগে পরস্পরকে সাহায্য করে তবুও তারা এর মতো আনতে পারবে না।’(১৭:৮৮)।
মুহাম্মদ কোরানকে নিজের নবুওতির সনদপত্র হিসেবে বিবেচনা করতেন। এই কিতাব যে মুহাম্মদ ঐশীগুণে লাভ করেছেন, সেসম্পর্কে মুসলিম পণ্ডিতগণ একমত। যদিও বাগিতা ও বিষয়বস্তুর দিক দিয়ে কোরান কতটুকু অলৌকিক, এ-বিষয়ে অনেক বিতর্ক রয়েছে। মুসলিম পণ্ডিতগণ সাধারণভাবে উভয়দিক দিয়ে একে অলৌকিক বলে মনে করেন। কোনো নিরপেক্ষ পর্যালোচনা নয়, বরং কোরানের প্রতি আবেগপূর্ণ গভীর বিশ্বাসই এই মতামতের প্রধান অবলম্বন। এক্ষেত্রে অমুসলিম পণ্ডিতেরা এমন অনেক শক্ত ভিত্তি খুঁজে পেয়েছেন, যেগুলোর উপর দাঁড়িয়ে কোরানের বোধগম্যতা ও বাগিতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়। কোরানের বক্তব্যের যে ব্যাখ্যার প্রয়োজন রয়েছে সে ব্যাপারে মুসলিম পণ্ডিতেরা আগেই ঐক্যমতে পৌঁছেছেন। বিশিষ্ট তফসিরকারক জালাল উদ্দিন আল-সুয়ূতি (১৪৪৫-১৫০৫ খ্রিস্টাব্দ) রচিত কিতাব আল ইতকান ফি উলুম আল-কোরান’(২৮) এর একটি পুরো অধ্যায় এই বিষয়ে রচিত। শুধুমাত্র উসমানীয় যুগের সংকলিত-সম্পাদিত কোরানের মূল অংশের সমালোচনামূলক সংশোধনের মাধ্যমে পাঠ্যাংশের ক্রমান্বয়িকতার ভুল বিন্যাসই নয়, কোরানের ভাষারীতিও অনেক ক্ষেত্রে জটিলতার সৃষ্টি করে।
মুসলিম পণ্ডিতদের মাঝে ধর্মীয় গোঁড়ামি এবং অত্যুক্তি চেপে বসার আগে ইব্রাহিম আন-নাজ্জামের (৭৭৫-৮৪৫ খ্রিস্টাব্দ) মতো অনেক মুতাজিলা দার্শনিক প্রকাশ্যে স্বীকার করেছেন কোরানের বিন্যাস ও বাক্যগঠন অলৌকিক কিছু নয় এবং অন্য কোনো খোদাভীরু মানুষের পক্ষে একই ধরনের কাজ কিংবা এর থেকেও বেশি সাহিত্যমানসমৃদ্ধ কাজ করা সম্ভব। নাজ্জাম বলেন, ভাগ্যগণনাকারীদের ভবিষ্যদ্বাণীকে যে অর্থে অলৌকিক হিসেবে বলা হয়, কোরান সে অর্থে অলৌকিক নয়। তবে পূর্বে সংঘটিত ঘটনাসমূহের সঠিক পরিণামদশী হিসেবে কোরানকে অলৌকিক বলা যেতে পারে। পারস্যের ধর্মতাত্ত্বিক এবং একসময়ের মুতাজিলাপন্থী ইবনে ইসহাক আল-রাওয়ানদির (৮২৭-৯১১ খ্রিস্টাব্দ) মতে, নাজ্জামের এই উক্তিগুলো প্রচলিত ধর্মমতের বিরোধী। আব্দুল কাদের আল-বাগদাদি (মৃত্যু ৪২৯ হিজরি বা ১০৩৭ খ্রিস্টাব্দ) তাঁর কিতাবুল-ফারক বায়নাল-ফিরাক’ বইয়ে (এখানে বিভিন্ন ধর্মীয়-সম্প্রদায়ের মধ্যে পার্থক্য তুলে ধরা হয়েছে) নাজ্জামকে দোষারোপ করার জন্য ধর্মদ্রোহিতাকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করেছেন। আল-বাগদাদির মতে নাজ্জামের বক্তব্য কোরানের সুরা বনি-ইসরাইলের ৮৮ নম্বর আয়াতের সুস্পষ্ট বিরোধী, যেখানে বলা হয়েছে, ‘কোরান সর্বদাই অ-অনুকরণীয়, মানুষ এবং জিনেরা যৌথভাবে চেষ্টা করলেও একে অনুকরণ করতে পারবে না। ’
নাজ্জামের শিষ্য ও মৃত্যুপরবর্তী গুণগ্রাহীরা, যেমন ইবনে হাজম এবং আল-খাইয়াত নাজ্জামকে সমর্থন করে কলম ধরেছেন। শীর্ষস্থানীয় মুতাজিলাপন্থী অনেক ইসলামি চিন্তাবিদ নাজ্জামের যুক্তিগুলো প্রচার করেছেন। তারা নাজ্জামের দর্শনের সাথে কোরানের বক্তব্যের কোনো বিরোধ খুঁজে পাননি। তাদের অনেকগুলো যুক্তির মাঝে একটি ছিল, আল্লাহ নবি মুহামদকে কোরানের অনুরূপ আয়াত তৈরির ক্ষমতা দেননি, তবে অন্য যেকোনো সময়ে এবং স্থানে কোরানের আয়াতের অনুরূপ শব্দাবলি তৈরি করা সম্ভব এবং তা এমন কোনো কঠিন কাজ নয়। ধারণা করা হয় সিরিয়ার প্রখ্যাত অন্ধকবি আবু আল আলা আল-মারি (৯৭৩-১০৫৮ খ্রিস্টাব্দ) আল-ফুসুল ওয়া আল-গায়াত নামের ছড়াধর্মী ধর্মব্যাখ্যানটি (যার একটি অংশ আজও অবশিষ্ট আছে) কোরানের ব্যঙ্গাত্মক অনুকরণে রচনা করেছেন।
কোরানের বাক্যসমূহ অসম্পূর্ণ এবং সম্পূর্ণভাবে বোধগম্য হবার ক্ষেত্রে এগুলির ব্যাখ্যার প্রয়োজন হয়। এতে অনেক বিদেশি শব্দ, অপ্রচলিত আরবি শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে এবং অনেক শব্দ রয়েছে যেগুলোকে স্বীয় সাধারণ অর্থে ব্যবহার করা হয়নি। লিঙ্গ এবং সংখ্যার অন্বয়সাধন না করে বিশেষণ এবং ক্রিয়াপদের ধাতুরূপ করা হয়েছে। অনেক সময় সংশ্লিষ্টতা নেই এমন অপ্রয়োজনীয় ও ব্যাকরণগতভাবে ভুল সর্বনাম পদ ব্যবহার করা হয়েছে এবং ছন্দবদ্ধ অনুচ্ছেদসমূহে এমন অনেক বিধেয় পদ ব্যবহার করা হয়েছে যার সাথে সংশ্লিষ্ট অনুচ্ছেদে আলোচ্য মূল বিষয়ের সাথে এগুলোর কোনো মিল নেই। ফলে ভাষাগত এমন অনেক অগ্রহণযোগ্য বিষয়াদি কোরানের সমালোচকদের (যারা কোরানের বোধগম্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেন) সমালোচনার সুযোগ করে দিয়েছে। এই সমস্যাগুলো নিষ্ঠাবান মুসলমানদের মনেও যথেষ্ট প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। ফলে কোরানের তফসিরকারকরা কোরানের বক্তব্যের ব্যাখ্যা খুঁজতে বাধ্য হয়েছেন। কোরান অধ্যয়নের ক্ষেত্রে মতভিন্নতার পিছনে যেসব কারণ রয়েছে, এ বিষয়টি তাদের মধ্যে অন্যতম।
যেমন সুরা মুদদাসসির-এর প্রথম আয়াতের কথা উল্লেখ করা যায় ; ওহে, তুমি যে কিনা নিজেকে চাদরে ডেকে রেখেছ। এখানে চাদরে ডেকে রাখা বা চাদরাবৃত – এর গ্রহণযোগ্য আরবি শব্দ হচ্ছে মুদদাসসির’। কিন্তু বহুল প্রচলিত একটি মতানুযায়ী এটি হওয়া উচিত মুতাদাসসের । তেমনি সুরা মুজ্জামিলের প্রথম আয়াত ; ওহে, তুমি যে কিনা নিজেকে চাদরে জড়িয়ে রেখেছা এই চাদরাবৃত বা চাদরে জড়িয়ে থাকা শব্দটি আরবি কোরানে মুজ্জামিল পাঠ করা হয়, কিন্তু প্রচলিত
মতানুযায় এটি হওয়া উচিৎ মুতাজামিল। সুরা নিসার ১৬২ নম্বর আয়াত; কিন্তু তাদের মধ্যে যারা স্থিতপ্রজ্ঞ তারা ও বিশ্বাসীরা তোমার প্রতি যা অবতীর্ণ করা হয়েছে এবং তোমার পূর্বে যা অবতীর্ণ করা হয়েছে তাতেও বিশ্বাস করে এবং যারা নামাজ পালনকারী, জাকাত দেয় এবং আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস করে আমি তাদেরকে বড় পুরস্কার দেব। এখানে পালনকারী: শব্দটি কোরানের এই আয়াতে কর্মকারকে ব্যবহৃত হয়েছে, কিন্তু আস্থা-স্থাপনকারী, বিশ্বাসী, ঋণপরিশোধকারী শব্দগুলো যে নিয়মাত্মক রূপে ব্যবহার করা হয়, তা সেই অর্থে ব্যবহার করা ব্যাকরণসম্মত। সুরা হুজুরাত-এর ৯ নম্বর আয়াত : বিশ্বাসীদের দুই দল দ্বন্দুে লিপ্ত হলে তুমি তাদের মধ্যে ফয়সালা করে দেবে…। কোরানের এই আয়াতটিতে উল্লেখিত দ্বন্দুে লিপ্ত হলো ক্রিয়াপদটি বহুবচন অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে, কিন্তু এটি বক্তব্য অনুযায়ী শুধুমাত্র দ্বিপক্ষীয় অর্থে ব্যবহার করা উচিত ছিল। সুরা বাকারা-এর ১৭৭ নম্বর আয়াত : ‘পূর্ব ও পশ্চিম দিকে তোমাদের মুখ ফেরানোতে কোনো পুণ্য নেই; কিন্তু পুণ্য আছে আল্লাহ, পরকাল, ফেরেশতা, সব কিতাব ও নবিদের উপর বিশ্বাস করলে…।” এই আয়াতটিতে জেরুজালেম থেকে মক্কার দিকে প্রার্থনার দিক পরিবর্তন করার ফলে ইহুদিদের কাছ থেকে যে প্রশ্ন উঠেছিল সে সম্পর্কে বলা হয়েছে। ভাষাশৈলীর দিক দিয়ে অসাধারণ হলেও আয়াতটিতে আভিধানিক জটিলতা রয়েছে। তফসির আল-জালালাইনের মন্তব্য হচ্ছে আয়াতের দ্বিতীয় অংশে পুণ্য (বা সৎকর্ম, ন্যায়নিষ্ঠা)-এর আরবি শব্দ হিসেবে বের ব্যবহৃত হয়েছে, যার আসল অর্থ হচ্ছে পুণ্যবান ব্যক্তি। বিশিষ্ট ব্যাকরণবিদ মুহাম্মদ বিন ইয়াজিদ আল-মুবাররাদের (মৃত্যু : হিজরি ২৮৫ বা ৮৯৮ খ্রিস্টাব্দ) মতে, এই আয়াতে ব্যবহৃত বের শব্দটি আসলে ‘বার ( ধাৰ্মিক বা পুণ্যবান ব্যক্তি) হিসেবে উচ্চারণ করা উচিত। এটি বের’ শব্দের গ্রহণযোগ্য একটি প্রকরণ। মুহাম্মদ বিন ইয়াজিদের এই মন্তব্যের কারণে তৎকালীন কট্টরপন্থীরা তাঁর ধর্মবিশ্বাস নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন এবং কোরানবিরোধিতার অভিযোগ তুলে কুৎসা প্রচার করেছিলেন।
সুরা তাহা-এর ৬৩ নম্বর আয়াতটিতে নবি মুসা ও তাঁর ভাই হারুন সম্পর্কে ফেরাউনের লোকদের মন্তব্য প্রকাশ পেয়েছে : ‘ওরা বলল, ‘এরা দুজন নিশ্চয় জাদুকর, তারা জাদুবলে তোমাদেরকে দেশ থেকে তাড়াতে চায়। এবং তোমাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে একেবারে নস্যাৎ করতে চায়। (২০:৬৩)। এরা দুজন জাদুকর বলতে ফেরাউনের লোকেরা নবি মুসা ও তাঁর ভাই হারুনকে বুঝিয়েছে। এক্ষেত্রে এরা দুজন শব্দ দুটির ক্ষেত্রে কোরানে আরবি ‘হাদানে শব্দটি নিয়মাত্মকরূপে ব্যবহার করা হয়েছে, কিন্তু এটা এখানে কর্মকারকে (হাদায়নে) হওয়া উচিত ছিল। কারণ তা একটি পরিচিতিমূলক বর্ণনা অংশের পর এসেছে। কথিত আছে যে খলিফা উসমান এবং নবির বিবি আয়েশা এই আয়াতে হাদানে না বলে হাদায়নে পাঠ করতেন। কট্টরপন্থীদের মত অনুযায়ী, কোরান আল্লাহর বাণী। এখানে কোনো ভুল থাকতে পারে না। এখানে মুসলমানদের সর্বসমত সিদ্ধান্ত লিপিবন্ধ আছে। খলিফা উসমান এবং বিবি আয়েশা হাদানের স্থলে হাদায়নে ব্যবহার করতেন তা মিথ্যে এবং দূরভিসন্ধিমূলক। তফসির আল-জালালাইনের মন্তব্য হচ্ছে, আয়াতটিতে এই দ্বৈতবিভক্তি তিনটি ক্ষেত্রে প্রকাশিত হয়েছে। নিয়মাত্মক ও কর্মকারক উভয় ক্ষেত্রেই আয়ন হিসেবে উচ্চারিত হবার প্রয়োজন নেই। যদিও বিশিষ্ট ভাষাবিদ এবং কোরান-বিশেষজ্ঞ আবু আমর বিন আল-আলা (মৃত্যু হিজরি ১৫৪ বা ৭৭০ খ্রিস্টাব্দ) খলিফা উসমান এবং বিবি আয়েশার মতোই এই আয়াতে হাদায়নে উচ্চারণ করতেন।
সুরা নুর-এর ৩৩ নম্বর আয়াতের একটি মনুষোচিত এবং অভিবাদনীয় নির্দেশ থেকে তৎকালীন সময়ে প্রচলিত নির্দয় এবং অমানবিক একটি আচরণের পরিচয় মেলে তোমাদের দাসীরা সতীত্ব রক্ষা করতে চাইলে, পার্থিব জীবনের টাকা-পয়সার লোভে তাদেরকে ব্যভিচারিণী হতে বাধ্য করো না। তবে কেউ যদি তাদেরকে বাধ্য করে, তাদের ওপর সেই জবরদস্তির জন্য আল্লাহ তো তাদেরকে ক্ষমা করবেন, দয়া করবেন। তৎকালীন আরব-সমাজে দাসী-মালিক যারা নিজেদের দাসীদেরকে দিয়ে পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করত এবং উপার্জিত অর্থ নিজেদের পকেটে রাখত, এই আয়াতে সুস্পষ্টভাবে তাদেরকে এ-কাজ থেকে নিবৃত্ত হতে বলা হয়েছে। আয়াতের প্রথম বাক্য থেকে প্রতীয়মান হয় যে, নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোরপূর্বক এই কাজে প্রবৃত্ত হওয়ার কারণে আল্লাহ এই দাসীদের ক্ষমা করে দেবেন। তবে আয়াতের উপসংহারের বাক্য থেকে প্রতীয়মান হচ্ছে যে, যেসব ব্যক্তি নিজেদের দাসীদের পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করে, আল্লাহ সেই ব্যক্তিদের প্রতি দয়া ও করুণা করেছেন। এই প্রচ্ছন্ন বাক্যটি থেকে প্রকৃত অর্থে মহানুভবতার কোনো পরিচয় পাওয়া যায় না। কোরান সম্পর্কে মুতাজিলা দার্শনিক ইব্রাহিম আন-নাজ্জামের মতামত পূর্বে বলা হয়েছে। তিনি শুধু একা নন, মুতাজিলা দার্শনিক হিশান বিন আমর আল-ফুয়াতি (মৃত্যু হিজরি ২১৮ বা ৮৩৩ খ্রিস্টাব্দ) এবং আব্বাস বিন সোলায়মানের (মৃত্যু হিজরি ২৫০ বা ৮৬৪ খ্রিস্টাব্দ) মতো আরও অনেক বিজ্ঞ ব্যক্তি রয়েছেন যারা একইমত পোষণ করতেন। তাঁদের প্রত্যেকেই ছিলেন নিষ্ঠাবান ধাৰ্মিক। তারা নিজেদের যৌক্তিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং একনিষ্ঠ বিশ্বাসের মধ্যে কোনো পার্থক্য তৈরি করতেন না।
প্রভাবশালী আরব মনীষী আবুল-আলা আল-মারি তাঁর নিজের কিছু লেখাকে কোরানের সমতুল্য বলে মনে করতেন। সারকথা হচ্ছে, কোরানে আরবি ভাষার সাধারণ নিয়মাবলী ও গঠনশৈলী থেকে অন্তত একশটি বিচ্যুতি লক্ষ করা যায়। বলা বাহুল্য, কোরানের তফসিরকারকদের এই অসংলগ্নতাগুলোকে ব্যাখ্যা এবং সমর্থনীয় করতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছে। তাঁদেরই একজন হচ্ছেন পারস্যের বিখ্যাত ইসলামি পণ্ডিত ও ভাষাবিদ এবং জার-আল্লাহ (আল্লাহর প্রতিবেশি) খেতাবে ভূষিত আলজামাখশারি, পুরো নাম আবু আল-কাশিম মাহমুদ ইবনে উমর আল-জামাখশারি (জন্ম হিজরি ৪৬৭ বা ১০৭৫ খ্রিস্টাব্দ-মৃত্যু হিজরি ৫৩৮ বা ১১৪৪ খ্রিস্টাব্দ) যার সম্পর্কে একজন মুরীয় (উত্তর-পশ্চিম আফ্রিকার আরব মুসলমান) লেখক বলেছেন, ‘ব্যাকরণঅনুরাগী এই তাত্ত্বিক একটি গুরুতর ভুল করেছেন। আরবি ব্যাকরণের সাথে মিল রেখে কোরান পড়ানো আমাদের দায়িত্ব নয়। বরং আমাদের উচিত সম্পূর্ণ কোরান যেভাবে আছে সেভাবে একে গ্রহণ করা এবং আরবি ব্যাকরণকে এর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে তোলা। ’
একটি নির্দিষ্ট পর্যায় পর্যন্ত দাবিটি সমর্থনযোগ্য। একটি জাতির শ্রেষ্ঠ বক্তা এবং লেখকেরা মাতৃভাষার ব্যাকরণগত নিয়মাবলীকে সম্মান করেন এবং ভাবপ্রকাশের ক্ষেত্রে জনসাধারণের কাছে দুর্বোধ্য এবং অগ্রহণযোগ্য শব্দাবলী ব্যবহার থেকে বিরত থাকেন। যদিও অনেক ক্ষেত্রে স্বাধীনভাবে শব্দচয়ন তাদের জন্য প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠে। প্রাক-ইসলামি যুগে আরবে যথেষ্ট পুথিশাস্ত্র-কাব্যলোকগাঁথা রচিত হয়েছে এবং ব্যাকরণের কাঠামোও দাঁড়িয়ে ছিল। মুসলমানদের কাছে ইসলাম-পূর্ববর্তী সকল সাহিত্য-রচয়িতার সৃষ্টিকর্ম থেকে উৎকৃষ্ট যে কোরান, একে অবশ্যই ব্যাকরণের সাথে সবচেয়ে বেশি সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে।
তথাপি ওই মুরীয় লেখক কর্তৃক জামাখশারির নিন্দা, লেখকের বক্তব্যকেই পাল্টা সমালোচনার একটি ভিত্তি করে দিয়েছে। কারণ লেখকের বক্তব্য প্রচলিত দাবিকেই উল্টিয়ে দেয়। আর এই দাবিটি হচ্ছে কোরান আল্লাহর বাণী। কোরানের একটি ভক্তি সৃষ্টিকারী মাধুর্যপূর্ণ বাগিতা রয়েছে, যা সকল মানুষের পক্ষে অর্জন করা সম্ভব নয়। যে ব্যক্তির মাধ্যমে কোরান অবতীর্ণ হয়েছে, সঙ্গত কারণেই তিনি একজন নবি। মুরীয় লেখকের মতে, কোরান ভুলভ্রান্তিহীন যেহেতু তা আল্লাহর বাণী এবং এতে ব্যাকরণগত যেসব ভুল রয়েছে সেগুলো আরবি ব্যাকরণের নিয়মাবলী পরিবর্তনের মাধ্যমেই সংশোধন করতে হবে। অন্যকথায়, সংশয়ী বা অবিশ্বাসীদের প্রশ্নের উত্তরে মুহাম্মদের নবুওতিকে প্রমাণ করতে যেখানে অধিকাংশ মুসলিম কোরানের বাগিতাকে উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করেন, মুরীয় লেখক সেখানে কোরানের স্বগীয় উৎপত্তি ও মুহাম্মদের নবুওতিকে স্বীকার করে সিদ্ধান্তে পৌছালেন যে, কোরানের বিষয়বস্তু এবং শব্দাবলী সম্পর্কিত আলোচনা গ্রহণযোগ্য নয়।
একই সাথে বলা যায়, কোরান আসলেই স্বতন্ত্র এবং অসাধারণ। প্রাচীন আরবের প্রথমদিকের সাহিত্যে এর মতো কোনো দৃষ্টান্ত চোখে পড়েনি। মক্কায় অবতীর্ণ সুরাগুলোয় আমরা অনেক আগ্রহোদীপক এবং চিত্তাকর্ষক কাব্যিক অনুচ্ছেদ দেখতে পাই। এগুলো থেকে নবির চিন্তাশক্তি এবং বক্তৃতা দেবার সহজাত প্রতিভার পরিচয় পাওয়া যায় এবং তাঁর মানুষকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা সম্পর্কে অনুমান করা যায়। একটি চমৎকার উদাহরণ হতে পারে সুরা নজম। যদি আমরা এখান থেকে ৩২ নম্বর আয়াতটি উহ্য রাখি যা মদিনায় অবতীর্ণ হলেও কোনো এক অজানা কারণে খলিফা ওসমান এবং তার সংগ্রাহকগণ এই আয়াতকে মক্কি সুরার অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন।
জেরুজালেমের বালিকাগণ, যাদের স্তন গিলিয়াদ পর্বতের ছাগলের ন্যায় শুভ্র, তাদের সাথে কাটানো সময়ের উল্লেখ ব্যতিরেকে সলোমনের গানের একটি চিত্রকল্পীয় হৃদয়গ্রাহী স্মৃতিচারণের মাধ্যমে সুরা নজম উল্লাসের সাথে প্রচারক হিসেবে মুহাম্মদের ভূমিকা ও তাঁর পয়গম্বরীয় ঔজ্জ্বল্য এবং দূরদৃষ্টি ব্যাখ্যা করেছে। যদিও আরবি ভাষার এই শব্দের ঐক্যতান, ছন্দ এবং সৌন্দৰ্য্য স্বাভাবিকভাবেই অন্য ভাষায় প্রকাশ করা যথেষ্ট কঠিন, তারপরও সুরা নজমের প্রথম ১৮টি আয়াত নিম্নে উল্লেখিত অনুবাদের মাধ্যমে মুহাম্মদের দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তিসত্তার উচ্চাকাঙ্ক্ষার খানিকটা ইঙ্গিত পাওয়া যায় :
শপথ অস্তমিত নক্ষত্রের তোমাদের সঙ্গী বিভ্রান্ত নয়, পথভ্রষ্টও নয়
আর সে নিজের ইচ্ছেমতো কোনো কথা বলে না।
এ প্রত্যাদেশ যা তার ওপর) অবতীর্ণ হয়।
তাকে শিক্ষা দেয় এক মহাশক্তিধর° /
বুদ্ধিধর (জিবরাইল) আবির্ভূত হল উর্ধ্বে দিগন্তে।
তারপর সে তার কাছে এলো খুব কাছে
যার ফলে তাদের দুজনের মধ্যে দুই ধনুকের ব্যবধান রইল।
তখন তিনি তার দাসের প্রতি যা প্রত্যাদেশ করার তা প্রত্যাদেশ করলেন।
সে যা দেখছিল তার হৃদয় তা অস্বীকার করেনি।
সে যা দেখেছিল তারা কি সে-সম্বন্ধে তর্ক করবে?
নিশ্চয় সে তাকে আরেকবার দেখেছিল,
শেষ সীমান্তে অবস্থিত সিদরা গাছের নিকট
যার কাছেই ছিল জনাতুল মাওয়া।
তখন সিদরা গাছটা ছেয়ে ছিল যা দিয়ে ছেয়ে থাকে।
তার দৃষ্টিবিভ্রম হয়নি বা দৃষ্টি লক্ষ্যচ্যুতও হয়নি।
সে তার মহান প্রতিপালকের নিদর্শনগুলো নিশ্চয় দেখেছিল। (৫৩:১-১৮) ।
পরামর্শ গ্রহণের জন্য মানুষের কাছে অনেক পথই খোলা রয়েছে এবং সুরা নজমে পরবর্তীতে আল্লাহ নবিকে এ বিষয়টির সাথে পরিচয় করিয়ে দেন; অতএব যে আমাকে স্মরণ করতে বিমুখ তাকে উপেক্ষা করে চলো; সে তো কেবল পার্থিব জীবনই কামনা করে। ওদের জ্ঞানের দৌড় তো ঐ পর্যন্ত। তোমার প্রতিপালক নিশ্চয় ভালো জানেন কে তাঁর পথ থেকে ভ্ৰষ্ট; আর তিনিই ভালো জানেন কে সৎপথ পেয়েছে। (৫৩: ২৯-৩০)।
শোনা যায়, মুহাম্মদের চাচা আবু লাহাবের পত্নী উম্মে জামিল একদিন নবির কাছে গিয়ে বিদ্রুপ করে বললেন, “আমরা আশা করছি তোমার ভেতরের শয়তান তোমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছে। এটি ছিল বাণী নাজিলে বিঘ্ন হবার সময়কালীন ঘটনা। সে-সময় নবি এতোটাই নিরাশ এবং মানসিকভাবে বিধ্বস্ত ছিলেন যে, পাহাড়চূড়া থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যার কথা পর্যন্ত ভেবেছিলেন। ধারণা করা হয় সুরা দোহা নাজিলের সময়ও এই বিঘ্ন ঘটেছিল, তবে এই সূরাটিও খুবই শ্রুতিমধুর :
শপথ দিনের প্রথম প্রহরের তার শপথ রক্রির যখন তা আচ্ছন্ন করে?
তোমার প্রতিপালক তোমাকে ছেড়ে যাননি ও তোমার ওপর তিনি অসন্তুষ্ট নন।
তোমার জন্য পরকাল ইহকালের চেয়ে ভালো।
তোমার প্রতিপালক তো তোমাকে অনুগ্রহ করবেনই আর তুমিও সন্তুষ্ট হবে।
তিনি কি তোমাকে ভুল পথে পেয়ে পথের হদিস দেননি?
তিনি তোমাকে কি অভাব দেখে অভাবমুক্ত করেননি?
সুতরাং তুমি পিতৃহীনদের প্রতি কঠোর হয়ে না
আর য়ে সাহায্য চায় তাকে ভৎসনা করো না
আর তুমি তোমার প্রতিপালকের অনুগ্রহের কথা বর্ণনা করো। (৯৩১-৯)।
কোরানের প্রতি সুবিচার করলে স্বীকার করতে হবে এটা অবশ্যই বিস্ময়কর। মক্কায় নাজিলকৃত অপেক্ষাকৃত ছোট সুরাগুলোর কাব্যিক ভাব ব্যক্ত করার জাদুকরি ক্ষমতা রয়েছে এবং সেই সাথে বিশ্বাসের প্রেরণাদায়ক। সুরায় ব্যবহৃত ভাষাশৈলীর কোনো নজির আরবি ভাষায় এর পূর্বে দেখা যায়নি। একজন মানুষ যিনি কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভ করেননি, তার মুখ থেকে ভাবের এমন বহিঃপ্রকাশ সত্যিই বিস্ময়কর। এদিক থেকে বিবেচনা করলে, কোরানকে অলৌকিক হিসেবে গণ্য করা সমর্থনযোগ্য।
তবে অনেক বিশেষজ্ঞ মুহাম্মদকে ‘নিরক্ষর’ মানতে রাজি নন। তাঁদের মতে কোরানে ব্যবহৃত ‘উম্মি’ শব্দটির অর্থ আসলে নিরক্ষর নয়, বরং ইহুদি নয় এমন ব্যক্তির কথাই বুঝানো হয়েছে। তাঁরা বক্তব্যের সপক্ষে কোরানে উল্লেখিত পৌত্তলিক, অইহুদি, এবং অ-খ্রিস্টান আরবদের উদাহরণ দেখিয়েছেন। এই অ-ইহুদি’শব্দটি কোরানের সুরা জুমআর আয়াত ২-এ ব্যবহৃত হয়েছে এভাবে: ইনিই সেই ব্যক্তি যাকে অ-ইহুদিদের মধ্য থেকে নবি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এরকম উদাহরণ কোরানের আরও কয়েকটি আয়াতে দেখতে পাওয়া যায়, যেমন : সুরা বাকারা ; আয়াত ৭৫; সুরা ইমরান ; আয়াত ২০ ও ৭০; সুরা আ’রাফ ; আয়াত ১৫৭-১৫৮। তথাপি প্রচলিত ধারণা, তথ্য এবং সে যুগের প্রথাসমূহের উপর নির্ভর করে সাধারণভাবে এটা বিশ্বাস করা হয় যে, মুহাম্মদ লিখতে জানতেন না, যদিও শেষ জীবনে হয়তো দু’একটি শব্দ পড়তে পারতেন। কোরানে যেমন বলা হয়েছে: তুমি তো এর পূর্বে কোনো কিতাব পড়নি, বা নিজ হাতে কোনো কিতাব লেখনি যে মিথ্যাবাদীরা সন্দেহ করবে!’ (সুরা আনকাবুত ; আয়াত ৪৮)। ওরা বলে, এগুলো তো সেকালের উপকথা যা সে লিখিয়ে নিয়েছে। এগুলো সকাল-সন্ধ্যা তাঁর কাছে পাঠ করা হয়। (সুরা ফুরকান ; আয়াত ৫)। কোরানের এই আয়াতগুলো থেকে বিশ্বাস করা হয় যে, নবি মুহাম্মদ লিখতে-পড়তে জানতেন না, এটা পৌত্তলিকরা ধারণা করত। নবি মুহামদ লিখতে-পড়তে জানতেন না, এ-বিষয়ে ইসলামের ইতিহাস ও হাদিসে প্রচুর ভিন্নতথ্য রয়েছে। পশ্চিমের অনেক ইসলাম-বিশেষজ্ঞ যেমন ফরাসি মার্কসবাদী ইতিহাসবিদ ও সমাজতাত্ত্বিক ম্যাক্সিম রডিনসন এবং স্কটিস ইতিহাসবিদ উইলিয়াম মন্টোগমেরি’র মতে নবি মুহাম্মদ নিরক্ষর ছিলেন না। তাঁদের মতে, কোরানে নবিকে একেবারে নিরক্ষর বা লিখতে-পড়তে জানেন না বলে বোঝানো হয়নি বরং শুধু বোঝানো হয়েছে নবি ইতিপূর্বে ইহুদি-খ্রিস্টানদের ধর্মগ্রন্থ (তৌরাত, ইঞ্জিল) পাঠ করেননি। পশ্চিমা পণ্ডিতরা তাঁদের বক্তব্যের সমর্থনে সুরা আনকাবুতের ৪৮ নম্বর আয়াত হাজির করেন। তাঁদের মতে এই আয়াতে কিতাব বলতে ইহুদি-খ্রিস্টানদের ধর্মগ্রন্থের কথা কেন্দ্রভূমি এবং নবুওত প্রাপ্তির পূর্বে ছোটবেলা থেকে একাধিকবার নবি বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে মক্কার বাইরে গিয়েছেন। সেই বহির্বাণিজ্যে তিনি যথেষ্ট যোগ্যতার ছাপ রেখেছিলেন। একজন বণিকের যদি সামান্য অক্ষর জ্ঞান না থাকে এবং হিসাব-নিকাশ চালানোর মতো গণনা দক্ষতা না থাকে তাহলে বাণিজ্যে দক্ষতা অর্জন করা কঠিন। লেখা-পড়া জানা বিবি খাদিজা প্রথমে মুহাম্মদকে বাণিজ্যে দক্ষতার কারণে মুগ্ধ হয়ে বৈদেশিক বাণিজ্যের পরিচালকরুপে নিয়োগ দিয়েছিলেন, যা পরবর্তীতে তাঁদের মধ্যে পরিণয়ের দিকে সম্পর্ক গড়ায়। খাদিজার মতো একজন ব্যবসায় সফল-অভিজ্ঞ রমণী তাঁর ব্যবসার বৈদেশিক দায়িত্ব একজন নিরক্ষর ব্যক্তির ওপর ছেড়ে দিবেন কেন? এছাড়া প্রচুর হাদিসেও রয়েছে : (১) উসরা হতে বর্ণিত, ছয় বছরের আয়েশার সাথে বিয়ের কাবিন রসুল মুহাম্মদ নিজেই লিখেছেন। (দ্রষ্টব্য ; বুখারি শরিফ, ভলিউম ৭, বুক ৬২ নম্বর ৮৮)। (২) ইয়াজিদ ইবনে উকাইশের জন্য। বক্তব্য হচ্ছে : “তোমরা যদি অন্য কোনো ঈশ্বর বাদ দিয়ে একমাত্র আল্লাহকে মেনে নাও, মুহামদকে আল্লাহর রসুল বলে স্বীকার করো, জাকাত দাও, নামাজ পড়ো তবে আল্লাহ এবং তাঁর রসুলের কাছ থেকে নিরাপত্তা পাবে। এরপর লোকটিকে জিজ্ঞেস করা হল, এই বার্তা কে লিখে দিয়েছে? লোকটি উত্তর দিল আল্লাহর রসুল’। (দ্রষ্টব্য : আবু দাউদ শরিফ,
বুক ১৯, নম্বর ২৯৯৩)। (৩) আল বারা হতে বর্ণিত, নবি ওমরা পালনের উদ্দেশ্যে মক্কায় গেলে তাঁকে ঢুকতে দেয়া হয়নি, যতক্ষণ না তিনি রাজি হন মক্কাবাসীর সাথে একটি চুক্তি করতে। তিন দিন অপেক্ষার পর তিনি শান্তি চুক্তি করতে রাজি হলেন। চুক্তিতে লেখা হলো আল্লাহর নবি মুহাম্মদের (দঃ) পক্ষ হতে…। মক্কার লোকেরা প্রতিবাদ করে উঠলেন। তারা মুহামদকে ‘আল্লাহর নবি বলে স্বীকার করতে চাইলেন না। বললেন, মুহামদ, আব্দুল্লাহর পুত্র, এটাই লেখা হোক। এ নিয়ে দ্বন্দুে যখন চুক্তি প্রায় ভেঙ্গে যাবার উপক্রম তখন মুহামদ হজরত আলিকে নির্দেশ দিলেন, চুক্তিপত্র হতে আল্লাহর নবি শব্দ কেটে দিতে। কিন্তু আলি রাজি না হওয়ায় মুহাম্মদ চুক্তিপত্র হাতে নিয়ে নিজ হাতে কেটে দিলেন এবং আল্লাহর নবি শব্দটির বদলে যোগ করলেন “আব্দুল্লাহর পুত্র। (দ্রষ্টব্য ; বুখারি শরিফ, ভলিউম ৫, বুক ৫৯ নম্বর ৫৫৩)।-অনুবাদক)।
কোরানকে বিষয়বস্তুগত কারণে অনেকে অলৌকিক মনে করেন। এক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছে এতে এমন কোনো নতুন ধারণা নেই যা পূর্বে অন্যদের দ্বারা ব্যক্ত হয়নি। কোরানের সকল বক্তব্যই স্বীয়-প্রতিষ্ঠিত এবং সর্বজনস্বীকৃত। কোরানে বর্ণিত কাহিনীসমূহ ইহুদিখ্রিস্টানদের ধর্মীয় লোক-কাহিনীর অবিকল কিংবা সামান্য পরিবর্তিত রূপ। সিরিয়ার ভ্রমণের সময় মুহাম্মদ এই দুই সম্প্রদায়ের রাব্বি এবং সন্ন্যাসীদের সাথে পরিচিত হয়েছিলেন এবং তাঁদের সাথে আলাপচারিতাও করেছিলেন। এছাড়া আদ এবং সামুদ অধিবাসীর বংশানুক্রমে প্রাপ্ত কিছু কাহিনীর সাথে কোরানে বর্ণিত কাহিনীগুলোরও মিল পাওয়া যায়।
নিরপেক্ষভাবে বিশ্লেষণ করলে নবি মুহাম্মদের মহত্ত্বকে কোনোভাবেই খাটো করা যায় না। একটি কুসংস্কারাচ্ছন্ন, অনৈতিক, নিন্দনীয় সমাজ, যেখানে পেশিশক্তি ছাড়া অন্য কোনো আইন কাজ করে না এবং নির্দয়তার উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত সেই সমাজের একজন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা-বঞ্চিত মুহাম্মদ সাহসিকতার সাথে অসংখ্য মন্দকাজ ও পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন। সেই সাথে অন্যান্য সম্প্রদায়ের পূর্ব-অভিজ্ঞতাসমূহকে পুনঃপুনঃ ব্যক্ত করার মাধ্যমে উচ্চতর আদর্শ প্রচার করেছিলেন।
মুহাম্মদের এই উদ্যোগ তাঁর সহজাত প্রতিভা, আধ্যাত্মিক শক্তি, নৈতিক জ্ঞান ও ভক্তিভাবের পরিচায়ক। একজন কথিত নিরক্ষর ব্যক্তির মুখ থেকে নিঃসৃত সুরা আবাসা যেন তাঁরই ব্যাকুল হৃদয়ের স্পন্দন। সুরা আবাসা খুবই গীতিময়, সুরালায়িত এবং প্রবল আধ্যাত্মিক, যা হাফিজের কবিতা ছাড়া প্রকাশ করা অসম্ভব। তবে সুরা আবাসা এর ১৭-৩৩ আয়াতগুলোয় অসম্পূর্ণ প্রকাশ ঘটেছে :
মানুষ ধ্বংস হোক সে কত অকৃতজ্ঞ।
তিনি তাকে কী থেকে সৃষ্টি করেছেন
তিনি তাকে শুরু থেকে সৃষ্টি করেন
তারপর তার জন্য পথ সহজ করে দেন তারপর তার মৃত্যু ঘটান ও তাকে কবরস্থ করেন।
এরপর যখন ইচ্ছা তিনি তাকে পুনর্জীবিত করবেন।
না তিনি তাকে য় আদেশ করেছেন সে তা পালন করে নি।
আমি প্রচুর বারিবর্মণ করি
তারপর ভূমিকে বিদীর্ণ করি
এবং তার মধ্যে উৎপন্ন করি
গাছগাছালির বাগান ফল ও গবাদি খাদ্য।
এ তোমাদের ও তোমাদের আনআমের (চতুস্পদ প্রাণী) ভোগের জন্য।
যেদিন মহানাদ (কেয়ামত) আসবে ( ৮০:১৭-৩৩)।
মূলত অসাধারণ এবং নান্দনিক আধ্যাতিক উপদেশের মাধ্যমে মুহাম্মদ তাঁর চারপাশের মানুষকে একটি অপেক্ষাকৃত ভালোপথে চালিত করতে চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু নৈতিক শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে কোরানকে অলৌকিক বলে বিবেচনা করা যাবে না। মুহাম্মদ সেই সকল মূল্যবোধের পুনরাবৃত্তি করেছেন, যেগুলো পূর্ববর্তী শতাব্দীগুলোয় বিশ্বজুড়ের মানবসমাজের বিভিন্ন স্থানেই উদ্ধৃত হয়েছে। কনফুসিয়াস, বুদ্ধ, জরথ্রস্ত, সক্রেটিস, মুসা, এবং যিশুও একই ধরনের বা কাছাকাছি মূল্যবোধ প্রচার করেছেন।
কোরানে অনেক আইন ও বিধি রয়েছে যা মুহাম্মদকে ইসলামের আইনপ্রণেতা হিসেবে তুলে ধরে। যে বিষয়টি অবশ্যই মনে রাখা দরকার তা হলো, কোরানে বর্ণিত আইন-কানুন তৈরি হয়েছিল বিচ্ছিন্ন ঘটনাবলীর নিমিত্তে এবং নির্যাতিত মানুষের আবেদনের প্রেক্ষিতে। ফলে এই আইনগুলোর মাঝে কিছু অসঙ্গতি রয়েছে এবং বাতিলকারী এবং বাতিলকৃত উভয় বিধিই কোরানে রয়ে গিয়েছে। একথাও ভুললে চলবে না যেইসলামিক আইন-বিধিবিধানগুলো মুসলমান বিশেষজ্ঞদের দীর্ঘকালীন প্রচেষ্টার ফসল, যা ইসলামি যুগের প্রথম তিন শতাব্দীতে তৈরি হয়েছে। কোরানে বর্ণিত আইনগুলো সংক্ষিপ্ত এবং মুহাম্মদের জন্মের দেড়শ বছর পর তৈরি হওয়া বিশাল সংখ্যক মুসলমান জনগোষ্ঠীর প্রয়োজন মেটানোর জন্য এগুলো পর্যাপ্ত ছিল না।
ইসলামে সিয়াম (রোজা বা উপবাস) পালনের প্রথা এসেছে ইহুদিদের ধর্ম থেকে। ইসলাম-পূর্ব আরবে আরবি ক্যালেন্ডার অনুযায়ী মহরম মাসের (হিব্রু ক্যালেন্ডার অনুযায়ী তিশরি’ মাস) দশম দিনে ইহুদিরা রোজা রাখতেন। আরবি ভাষায় আশুরার দিন (হিব্রুভাষায় আশর) নামে এ-দিবস পরিচিত। ইহুদিদের তৌরাতের ভাষ্যানুযায়ী এ-দিনে ঈশ্বরের আশীবাদ নিয়ে নবি মুসা ইসরাইলের সন্তানদের ফেরাউনের আক্রমণ থেকে রক্ষা করেন। ইহুদিদের ধর্মে এ-দিনের অনুষ্ঠানের নাম ‘জম কিপার’। ইহুদিরা জম কিপারের সময় প্রায় ২৫ ঘণ্টা উপবাস পালন করেন এবং সিনাগগে গিয়ে প্রার্থনা করেন, দান-খয়রাত করেন। নবি মুহাম্মদের মদিনায় গমনের পরে এবং প্রার্থনার দিক যখন জেরুজালেম থেকে মক্কার দিকে পরিবর্তিত হল, রোজার সময়সীমা তখন একদিন থেকে বেড়ে দাঁড়ালো দশ দিনে, অর্থাৎ মহরম মাসের দশ দিন নামে পরিচিত হলো। পরবর্তীতে মুসলমান ও ইহুদিদের মাঝে যখন চূড়ান্ত বিচ্ছেদ হয় তখন পুরো রমজান মাসকে রোজা পালনের জন্য সংরক্ষণ করা হলো।
প্রতিটি ধর্মে প্রার্থনা প্রচলিত রয়েছে। এক বা একাধিক দেবতার প্রতি ভক্তি নিবেদন এবং বিচার কামনা প্রতিটি ধর্মের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ইসলাম ধর্মে একজন মুসলমানের সর্বপ্রথম কর্তব্য হলো প্রার্থনা করা; এবং এই প্রার্থনা ব্যতিক্রমী ইসলামি-পদ্ধতি অনুযায়ী পালন করা হয়। তবে কোরানে গুরুত্বপূর্ণ এই বিষয়ে কোনো প্রকার বিস্তারিত নির্দেশনা দেয়া হয়নি। নবি মুহাম্মদের ত্রিশ বছরে মক্কায় অবস্থানকালে এবং মদিনায় হিজরতের প্রথম দেড় বছরে মুসলমানরা ইহুদিদের মতো একই দিক বা অভিমুখে (কিবলা) প্রার্থনা করতেন। যা মূলত জেরুজালেমে অবস্থিত সবচেয়ে দূরের মসজিদ (বা প্রার্থনাস্থান) হিসেবে পরিচিত ছিল।
মক্কায় মুসলমানদের তীর্থযাত্রা হিজ প্রতিষ্ঠিত হবার পর আরবের বিভিন্ন জাতীয় প্রথাও প্রতিষ্ঠিত ও চিরস্থায়ী রূপ লাভ করে। হজের (জুলহজ মাসে তীর্থযাত্রা) এবং ওমরা’র সকল অনুষ্ঠানাদি, যেমন সেলাইবিহীন ঢিলেঢালা বস্ত্র পরিধান, কালো পাথরকে চুমু খাওয়া কিংবা স্পর্শ করা, সাফা এবং মারওয়া পাহাড়ের মধ্যে দৌড়ানো, আরাফাতে অবস্থান এবং শয়তানের প্রতি পাথর নিক্ষেপের প্রথা ইসলাম-পূর্ব যুগেও আরবে পৌত্তলিকদের মধ্যে প্রচলিত ছিল এবং সামান্য কিছু পরিবর্তন সাপেক্ষে এগুলো ইসলামে বজায় থেকেছে।
পৌত্তলিক আরবরা কাবা ঘরকে প্রদক্ষিণকালে লাত, ওজা, মানাতসহ আরও অনেক গোত্র দেবতার নাম উচ্চারণ করত। যেমন ‘হে মানাত, আমি তোমার আদেশ পালন করতে প্রস্তুত’(লাব্বায়েকা) এবং দেবদেবীদের নাম ধরেও উচ্চারিত হতো। ইসলামে এই ধরনের সম্মোধনের রীতি আল্লাহকে সম্বোধন দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং তা পরিবর্তিত হয়ে দাঁড়ায়, ‘লাব্বায়েকা আল্লাহুমা লাকবায়েকা!”
পৌত্তলিক আরবেরা তীর্থযাত্রার মাসে শিকার করাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। কিন্তু নবি মুহাম্মদ তীর্থযাত্রার (হজ) যে দিনগুলোতে (ইহরাম) হাজিরা নিজেদেরকে উৎসর্গের জন্য ব্যয় করেন শুধুমাত্র সেই দিনগুলোর জন্য এই নিষেধাজ্ঞাকে বহাল রাখলেন। পৌত্তলিক আরবরা অনেক সময় নগ্ন হয়ে কাবা ঘরকে প্রদক্ষিণ করত। ইসলাম তা নিষিদ্ধ করে সেলাইবিহীন বস্ত্র পরিধানের রীতি প্রচলন করে। পৌত্তলিক আরবদের কোনো কোনো গোত্রে উৎসর্গকৃত প্রাণীর মাংস খাওয়ায় বিধি-নিষেধ ছিল। কিন্তু নবি এই নিষেধাজ্ঞা তুলে দেন।
মক্কা বিজয়ের পর কাবা ঘরে রক্ষিত কুরাইশদের মূর্তিগুলোকে ধ্বংস করা হয় নবি মুহাম্মদের নির্দেশে এবং মুসলমানরা সাফা এবং মারওয়া পাহাড়ের মধ্যে দৌড়ানোর যে প্রথা প্রচলিত ছিল তা থেকে বিরত থাকেন। কারণ পূর্ববর্তীকালে এই দুই পাহাড়ের চূড়ায় দুজন দেবীর পাথরের প্রতিমা ছিল এবং পৌত্তলিকরা দুই পাহাড়ের মধ্যবর্তীস্থানে দৌড়ার মাধ্যমে এবং প্রতিমাগুলোকে চুমু দিয়ে কিংবা স্পর্শ করে সৌভাগ্য অর্জনের চেষ্টা করত। যা হোক, এ-বিষয়ে একটি ঐশী বাণী নাজিল হয় ; নিশ্চয় দুটি পাহাড় সাফা ও মারওয়া আল্লাহর নিদর্শনসমূহের অন্যতম। সুতরাং যে আল্লাহর ঘরে হজ বা ওমরা করে, তার জন্য এই দুটি প্রদক্ষিণ করলে কোনো পাপ নেই। (২:১৫৮)। অর্থাৎ কোরানের এই আয়াত সাফা-মারওয়া পাহাড়ের দৌড়কে শুধুমাত্র পাপমুক্তই করল না, একই সাথে এই দুই পাহাড়কে আল্লাহর নিদর্শনকারী হিসেবে ঘোষণা দিল। [কাবা সম্পর্কে পূর্ববর্তি আব্রাহামিক ধর্মীয় কিতাবসমূহে কোনো বিবরণ পাওয়া যায় না। এমনকি উপাস্য আল্লাহ সম্পর্কেও না। এগুলো যদি কেবলমাত্র পৌত্তলিকদের পবিত্র তীর্থস্থান ও উপাস্য না হত তবে পূর্ববর্তী ইসা বা মুসার কিতাবে অবশ্যই কোনো না কোনো উল্লেখ থাকত। কাবার সাথে ইব্রাহিমের যে যোগসূত্র দাবি করা হয় সেটা অপ্রমাণিত এবং অত্যন্ত অস্বাভাবিক -অনুবাদক।]
পারস্যের খোরাসান প্রদেশে জন্মগ্রহণকারী বিশিষ্ট মনীষী, ঐতিহাসিক এবং দার্শনিক আবু আল-ফাথ মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল করিম আল-শাহরাস্তানি (১০৮৬-১১৫৩ খ্রিস্টাব্দ) ধর্ম ও ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ইতিহাস নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ রচনা করেছেন। তাঁর রচিত কিতাব আল-মিলওয়াল ওয়া আল-নিহাল’কে ধর্মতত্ত্ব ও দর্শনবিদ্যার প্রথমদিককার সুশৃঙ্খল ব্রুপদী গ্রন্থ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ইউনেস্কোর অর্থায়নে বইটির সর্বপ্রথম ফরাসি সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে ১৯৮৬ সালে এবং পরবর্তীতে ১৯৯৩ সালে।-অনুবাদক। আল-শাহরাস্তানি তাঁর ওই ধ্রুপদী বইয়ে লিখেছেন, ইসলামের অনেক পালনীয় বিধি এবং রীতিসমূহ পৌত্তলিক আরবদের প্রথাসমূহের ধারাবাহিক রূপ, যা তারা ইহুদিদের কাছ থেকে গ্রহণ করেছেন।
ইসলাম-পূর্ব যুগে মা, মেয়েকে এবং পিতার স্ত্রীকে বিয়ে করা নিষিদ্ধ ছিল এবং একই সাথে দুই সহোদরাকে বিয়ে করাও সামাজিকভাবে গ্রহণ করা হতো না। মৃতদেহকে স্পর্শ করার পর পুণ্যস্নান, পরিষ্কার পানি দিয়ে মুখ ধোয়া, জোরে শ্বাস টেনে পানিকে নাসারন্ধ পর্যন্ত তুলে ফেলা, মাথার চুলে তেল মাখা, মেসওয়াক বা দাঁত খিলাল ব্যবহার করা, মলত্যাগের পর ধৌতকরণ, বগল এবং শ্রোণিদেশের চুল কামানো, খৎনাকরণ এবং চোরের ডান হাত কেটে ফেলা ইত্যাদি রীতি ইসলাম আসার পূর্বে তৎকালীন আরবের পৌত্তলিক অধিবাসীরা পালন করত, যেগুলোর বেশিরভাগ তাঁরা ইহুদিদের কাছ থেকে গ্রহণ করেছিল।
পৌত্তলিক আরবদের আইন থেকে ইসলামের যে দুটি আইন ব্যতিক্রমী, সেগুলো হলো পবিত্র যুদ্ধে (জিহাদ) অংশগ্রহণ এবং জাকাত প্রদান করা। অন্য যেকোনো আইনি-কাঠামোতে তুলনামূলক কোনো বাধ্যবাধকতা আরোপ না করার কারণ হল, অন্যান্য আইনপ্রণেতাদের থেকে নবি মুহাম্মদের উদ্দেশ্য ভিন্ন ছিল। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল একটি রাষ্ট্র গঠন। আর নবি বুঝতে পেরেছিলেন একটি রাষ্ট্র কখনোই সেনাবাহিনী ও আর্থিক উৎস ব্যতীত গঠিত হতে পারে না। জিহাদে অংশগ্রহণের এই ব্যতিক্রমী ও নজিরবিহীন ইসলামি আইনটিকে মুহাম্মদের দূরদৃষ্টি এবং বাস্তবতাবোধের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। মক্কায় প্রণীত অসাধারণ আধ্যাত্মিক সুরাগুলো যখন অকার্যকরী প্রমাণিত হলো, তখন যে একমাত্র সমাধানটি তিনি খুঁজে পেলেন তা হল, যুদ্ধের মাধ্যমে ফয়সালা করা।
যুদ্ধ করতে সক্ষম একটি সেনাবাহিনী, যেখানে প্রতিটি সৈনিকই যুদ্ধ করতে বাধ্য, এমন একটি সেনাবাহিনীকে ভরণ-পোষণ করা ব্যয়সাপেক্ষ। গনিমতের মাল এবং সম্পত্তি পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা হয়তো সৈন্যদের যুদ্ধে আগ্রহী করে তুলতে পারে। কিন্তু তা সত্ত্বেও অধিক নিরাপদ এবং স্থায়ী একটি আয়ের উৎসের প্রয়োজন রয়েছে যা কিনা ইসলামি আইনে জাকাতের মাধ্যমে নিশ্চিত করা হয়েছে।
নবসৃষ্ট সমাজের সীমাবদ্ধতা এবং প্রয়োজনীয় দিকগুলো মুহাম্মদের গঠনমূলক চিন্তাধারায় স্থান পেয়েছে। তাঁর সকল উদ্যোগই এই সমাজের মঙ্গলের জন্য গ্রহণ করেছেন। যেমন নেশাজাতীয় দ্রব্য নিষিদ্ধকরণ। এটি আরেকটি ব্যতিক্রমী ইসলামি-আইন যা প্রাথমিকভাবে সামাজিক পরিস্থিতিকে বিবেচনা করে প্রণীত হয়েছিল। আরবরা আবহাওয়াগত কারণে উষ্ণ রক্তের, সহজে উত্তেজিত হয়ে যায় এবং উচ্ছঙ্খল প্রকৃতির হবার কারণে অবাধ-লভ্য নেশাজাতীয় পানীয় পান করে তারা বিভিন্ন অশোভন আচরণ করত এবং সমাজে বিশৃংখল পরিস্থিতি তৈরি করত। এই নিষেধাজ্ঞা তিনটি ধাপে জারি হল : প্রথমত, সুরা বাকারার এই আয়াত :-লোকে তোমাকে মদ ও জুয়া সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে, বলো, দুয়ের মধ্যেই মহাদোষ, মানুষের জন্য উপকারও আছে, কিন্তু উপকারের চেয়ে ওদের দোষই বেশি।’(২:২১৯)। পরবর্তীতে সুরা নিসার এই আয়াত যা মদিনায় একজন লোক মাতাল অবস্থায় নামাজে হাজির হলে আয়াতটি নাজিল হয়েছিল ; হে বিশ্বাসিগণ! তোমরা নেশাগ্রস্ত অবস্থায় নামাজের কাছে যেয়ো না, যতক্ষণ না তোমরা কী বলছ তা বুঝতে পার…। (৪:৪৩)। সবশেষে সুরা মায়িদার দুটি আয়াতে এই নিষেধাজ্ঞা চিরস্থায়ী রূপ লাভ করে হে বিশ্বাসিগণ মদ, জুয়া, মূর্তি ও ভাগ্যপরীক্ষার তীর ঘৃণ্য বস্তু, শয়তানের কাজ। সুতরাং তোমরা তা বর্জন করো যাতে তোমরা সফল হতে পার। শয়তান তো মদ ও জুয়ার দ্বারা তোমাদের মধ্যে শক্রতা ও বিদ্বেষ ঘটাতে এবং আল্লাহর ধ্যানে ও নামাজে তোমাদেরকে বাধা দিতে চায়! তা হলে তোমরা কি নিবৃত্ত হবে না?’(৫৯০-৯১)। সুরা বাকারার ২১৯ নম্বর আয়াত এবং সুরা মায়িদার ৯০ নম্বর আয়াতের উভয়টিতেই মদ্যপানকে জুয়ার সাথে তুলনা করা হয়েছে এবং শেষ আয়াতে মূর্তিপূজা এবং তীরের মাধ্যমে ভাগ্যপরীক্ষা করাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে; যেগুলো ইসলাম-পূর্ব আরবে পৌত্তলিকরা সাহায্য লাভের আশায় করত। সুরা মায়িদার ৯১ নম্বর আয়াতে মদ ও জুয়াকে এগুলোর বিষয়গত কারণে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এই আয়াতটি অবতীর্ণ হয়েছিল একটি বিশ্রী ঘটনা ঘটার পর। এই আয়াতের দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী মদ্যপান ও জুয়া খেলা আরবদের মধ্যে অশান্তি এবং বিশৃংখলা সৃষ্টি করেছে।
বহুগামিতা, বিবাহবিচ্ছেদ, ব্যভিচার, অবৈধযৌনসম্পর্ক, পায়ুসঙ্গম এবং আরও অনেক বিষয়ে কোরানের প্রত্যাদেশগুলো রচিত হয়েছে মূলত ইহুদি-আইনের সংশোধিত রূপ হিসেবে এবং আরবে প্রচলিত পূর্ববর্তী প্রথাগুলোর অনুসরণে। অলৌকিকতা আসলে শতাব্দীকাল ধরে ধোঁয়াশার জালে ঘেরা নয় এবং একমাত্র দুর্বল চিত্তের নিকট গ্রহণীয় সংস্কার নয়। বরং এটি জীবন্ত এবং অর্থবহ বিষয়। কোরানের বাগিতা কিংবা এর নৈতিক এবং আইনি-দৃষ্টিভঙ্গির কোনোটিই অলৌকিক নয়। একজন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাবঞ্চিত এবং দরিদ্র ব্যক্তি মুহামদ প্রায় একা নিজ জাতির তীব্র বাধা অতিক্রম করে একটি স্থায়ী ধর্ম প্রতিষ্ঠায় সফলকাম হয়েছেন। গোত্র-প্রথায় বিভক্ত বিচ্ছিন্ন জাতিগুলোকে একটি রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসতে পেরেছেন। এর ফলে বেপরোয়া মানুষগুলোকে অনুগত লোকে পরিণত করে নবি নিজস্ব ইচ্ছায় চালিত করতে পেরেছেন।
নবি কোরানকে নিয়ে গর্ব প্রকাশ করেছেন এবং একে নিজের নবুওতির প্রত্যয়নপত্র রূপে দাবি করেছেন। তাঁর মতে কোরান আল্লাহর প্রেরিত বাণী এবং জনতার কাছে বার্তা প্রেরণের মাধ্যম হচ্ছেন মুহাম্মদ। আরবি ওহি শব্দের অর্থ হচ্ছে প্রত্যাদেশ কিংবা উন্মোচিত করা; কোরানে এটি ষাটবার ব্যবহৃত হয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তা একজন ব্যক্তির মনে কোনো কিছু ঢুকিয়ে দেয়ার অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে এটি আবার দ্রুত সঞ্চারণশীল ইঙ্গিতাৰ্থে ব্যবহৃত হয়েছে। এ-কারণে প্রতিটি প্রত্যাদেশের পর নবি উদ্বিগ্ন থাকতেন যাতে একজন হস্তলিপিকর তা তৎক্ষণাৎ লিখে ফেলেন। নবির এই তাড়াহুড়া করার প্রবণতার প্রমাণ কোরানে
পাওয়া যায়। যেমন সুরা তাহায় বর্ণিত হয়েছে: তোমার ওপর আল্লাহর প্রত্যাদেশ সম্পূর্ণ হওয়ার পূর্বে কোরান পড়তে তুমি তাড়াতাড়ি করো না আর বলো, হে আমার প্রতিপালক! আমার জ্ঞান বাড়িয়ে দাও। (২০:১১৪)। এবং সুরা কিয়ামায় বর্ণিত হয়েছে : “এ (প্রত্যাদেশ) তাড়াতাড়ি (আয়ত্ত) করার জন্য তুমি এর সঙ্গে তোমার জিব নেড়ো না। এ-সংরক্ষণ ও আবৃত্তি করানোর (ভার) আমারই। সুতরাং যখন আমি পড়ি তুমি সেই পাঠের অনুসরণ করো। তারপর এর বিশদ ব্যাখ্যার (দায়িত্ব) আমারই। (৭৫:১৬-১৯) |
নবি মুহাম্মদের এই তাড়াহুড়া করার প্রবণতা থেকে ‘ওহি নাজিলের সময় তাঁর মানসিক অবস্থার পরোক্ষ-পরিচয় পাওয়া যায়। তার অন্তরাত্মা সেই সময় যে আলোয় আলোকিত হত, তা কোনো স্বাভাবিক অভিজ্ঞতা ছিল না। আবু সাইদ আল-কাদরি (মৃত্যু হিজরি ২৬১ হিজরি বা ৮৭৫ খ্রিস্টাব্দ) মদিনাবাসী সাহাবি। তিনি প্রচুরসংখ্যক হাদিসের বর্ণনা দিয়েছেন। তাঁর মতে, নিবি মুহাম্মদ অনুরোধ করেছেন, কোরান ব্যতীত আমার অন্য কোনো ভাষ্য লিখে রেখ না! কেউ যদি কোরান ছাড়া আমার কোনো ভাষ্য লিখে রাখে, তাহলে সে যেন সে-গুলো মুছে ফেলে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হচ্ছে ওহি নাজিলের সময়ে নবি মুহাম্মদ অসংলগ্ন হয়ে পড়তেন। সম্ভবত একটি তীব্র আভ্যন্তরীণ প্রচেষ্টার প্রয়োজন হতো। সহি বুখারির একটি হাদিস রয়েছে,
নবির স্ত্রী আয়েশা থেকে বর্ণিত : হারেস বিন হিশাম একবার নবিকে প্রশ্ন করেছিলেন, (ওহি নাজিল হওয়ার) এই অনুভূতিগুলো কেমন?” নবি জবাব দিলেন, “সবচাইতে তীব্র হলো ঘণ্টাধ্বনির মতো যেগুলো বন্ধ হবার পরেও আমার মনে বেজে যায়। কোনো কোনো সময় একজন ফেরেশতা মনুষ্যরূপে আবির্ভূত হন এবং আমি বিষয়টি অনুধাবন করা মাত্র তিনি অদৃশ্য হয়ে যান।
বিবি আয়েশার বক্তব্য অনুযায়ী, ‘ওহি লাভের সময় নবির ভ্রন্থেকে ঘাম নির্গত হতো, এমনকি শীতের দিনেও আয়েশার বক্তব্যের সমর্থনে বুখারি, সাফওয়ান বিন বালির (মক্কা বিজয়ের পর তাঁর পিতা ইসলাম গ্রহণ করেন) প্রসঙ্গ উপস্থাপন করে বলেন : ওহি নাজিলের সময়কালে বালি মুহামদকে পর্যবেক্ষণ করতে ইচ্ছা প্রকাশ করেন। একদিন একজন ব্যক্তি সুগন্ধি-মাখা একটি আলখাল্লা পরে এসে নবির কাছে জানতে চাইল সে এই কাপড় পরে ওমরা পালনকালে উৎসর্গের ভাবাবস্থা অর্জন করতে পারবে কিনা। মুহাম্মদের উপর তখন ওহি নাজিল হয়। হজরত ওমর বালিকে সামনে আসার সংকেত দিলেন। বালি ভেতরে প্রবেশ করে দেখলেন নবি প্রায় ঘুমন্ত অবস্থায় রয়েছেন, তিনি নাক ডাকছিলেন এবং তাঁর ওপর আল্লাহ-প্রদত্ত গায়ের রঙ ঠিকরে পড়ছিল। কিছুক্ষণ পর নবি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসলেন এবং প্রশ্নকারীকে আহ্বান করলেন। নবি তাঁকে বললেন, সে যেন প্রথমে ওই আলখাল্লাটি পরিষ্কার পানি দিয়ে তিনবার ধুয়ে একে সুগন্ধিমুক্ত করে এবং তারপর হজের বিধানের মতোই নিজেকে ওমরা পালনে উৎসর্গ করে।’