2 of 3

২.৩৭ তিনতলার এই ঘরখানি

তিনতলার এই ঘরখানি সদ্য তৈরি হয়েছে। দেয়ালে ধপধপে সাদা চুনকাম, জানলা-দরজায় টাটকা সবুজ রং, এখনো সেই রঙের গন্ধ যায়নি। এ ঘরে কেউ বসবাস শুরু করেনি, কয়েকটি এলোমেলো ছড়ানো চেয়ার ছাড়া আর কোনো আসবাব নেই।

জানলার কাছে দাঁড়িয়ে আছে দিলারা, জানলার ওপাশের আকাশ আজ বেশ পরিষ্কার নীল। দু দিন ধরে ঢাকায় বেশ শীত পড়েছে। দিলারার অঙ্গে একটি হলুদ শাড়ি, তার ওপরে একটি কাশ্মীরী শাল জড়ানো। দীর্ঘাঙ্গী সে, নাকটি তীক্ষ্ণ, টানাটানা দুই চোখে আজ কোনো জলের চিহ্ন নেই।

একখানা দেয়াল-ঘেঁষা চেয়ারে বসে আছে বাবুল। সে চোখ তুলতেই দিলারার সঙ্গে তার চোখাচোখি হলো। লেখাপড়া জানা বুদ্ধিমতী মেয়ে দিলারা, সে জানে বাবুলকে কোন নিভৃত আলোচনায় পাঠানো হয়েছে।

বাবুল কথা শুরু করতে পারছে না, জড়তাশূন্য, পরিষ্কার কণ্ঠে দিলারাই বললো, আপনিও আমাকে নিষেধ করতে এসেছেন, তাই না বাবুল মিঞা?

কয়েক পলক দিলারার দিকে চেয়ে থেকে তারপর দুদিকে নিঃশব্দে মাথা নেড়ে বাবুল না জানালো।

ওষ্ঠে সামান্য হাসি ফুটয়ে দিলারা বললো, থ্যাঙ্ক ইউ। আমার ভরসা ছিল, আপনি পেটি প্যারোকিয়ালিজম নিয়ে মাথা ঘামান না।

প্যারোকিয়ালিজম কথাটা শুনে বাবুলের হঠাৎ পরকীয়া শব্দটা মনে পড়ে গেল। দিলারা কিছুদিন আগেও পরকীয়া ছিল, এখনও পরকীয়া হতে যাচ্ছে, এর মধ্যে বাবুল চৌধুরীর ভূমিকা কী থাকতে পারে? পল্টনদের যত সব পাগলামি। একটি শিক্ষিতা, প্রাপ্তবয়স্ক মেয়েকে কি জোর করে আটকানো যায়? তবে, এটাও বিস্ময়ের যে দিলারার স্বামীর মৃত্যু হয়েছে মাত্র দু’ মাস আগে, এর মধ্যেই সে দ্বিতীয় বিবাহে সম্মত হয়েছে।

–মঞ্জু ভাবী আর আপনার ছেলে কেমন আছে?

–ভালো।

–ঢাকাতেই আছে?

বাবুল সামনের দিকে দু’বার মাথা ঝোঁকালো। হঠাৎ বেশ জোরে হেসে উঠে দিলারা বললো, বাবুলমিঞা, আপনি যে আমার সাথে এই ভাবে কথা বলতে এসেছেন, মঞ্জু ভাবীর পারমিশান। নিয়েছেন?

–কারুর সাথে কথা বলতে গ্যালেও বউয়ের পারমিশান নিতে হয় বুঝি? দু’পা এগিয়ে এসে মুখখানা একটুখানি নিচু করে দিলারা বললো, আপনার মনে আছে, আমরা অনেকে মিলে একবার নারায়ণগঞ্জে পিকনিক করতে গেছিলাম? আপনি তখন সবে মাত্র শাদী করেছেন। আমি আপনার সঙ্গে কথা বলতে গেলেই আপনি ভাবীর দিকে এমনভাবে তাকাচ্ছিলেন যেন আমার কথার উত্তর দিতে গেলে ভাবীর অনুমতির প্রয়োজন। আমি তো তখনও প্রায় কলকাতার মেয়ে ছিলাম, আমি জানতাম না যে ঢাকায় কোনো নিউলি ম্যারেড পুরুষের সাথে অন্য মেয়েদের কথা বলতেও নাই!

অনুযোগটি এমনই সত্য যে বাবুল প্রতিবাদ করতেও পারলো না। অন্য যে কোনো মেয়ের সঙ্গেই কথা বলতে গেলে মঞ্জুর অনুমতি নেবার প্রশ্ন ছিল না, মঞ্জুর মন সেরকম ঈষাপ্রবণ নয় মোটেই। কিন্তু তাদের বিয়ের ঠিক আগেই পল্টনরা অনেকে মিলে বলাবলি করতে শুরু করেছিল যে দিলারার সঙ্গে বাবুলের বিয়ে হলে তারা সবাই খুশী হতো, দিলারাও মনে মনে বাবুলকে খুব পছন্দ করে। বাবুল চেয়েছিল, সেই কথাটা যেন মঞ্জুর কানে না যায়, মঞ্জু শুনে ফেললে কি দিলারাকে পছন্দ করতে পারতো? নারায়ণগঞ্জের পিকনিকে সে যেতে বাধ্য হয়েছিল, কিন্তু বিয়ের পর কয়েক বছর সে পারতপক্ষে পল্টনদের বাড়ির দিকও ঘেঁষেনি।

কথা ঘোরাবার জন্য বাবুল বললো, নিউলি ম্যারেড কাপলাররা পরস্পরের দিকে একটু বেশি তাকায়। সেটা কি অস্বাভাবিক?

দিলারা বললো, আপনার বিয়ের সময় আপনি আমাদের বাড়িশুদ্ধ সবাইকে দাওয়াত দিয়েছিলেন, আমাকে আপনি নিজের থেকে তো কিছু বলেনইনি, আমার নামও দুলাভাইকে বলেন নাই। তারপর আর একবার, তখন আমারও বিয়ে হয়ে গেছে, পিকচার প্যালেসে হঠাৎ দেখা, একেবারে সামনা-সামনি, আপনি মঞ্জু ভাবীকে সাথে নিয়ে গিয়েছিলেন, কিন্তু হঠাৎ মুখ ফিরায়ে নিলেন, যেন আমারে দেখতেই পান নাই, কিংবা দেখেও ভাবলেন, আমি একটা কথা বলার যোগ্য মানুষই না…

এই শীতের মধ্যেও বাবুলের কান দুটি উষ্ণ হয়ে এলো। দিলারা প্রত্যেকটি ঘটনা মনে রেখেছে, তার কণ্ঠস্বরে মর্মভেদী শ্লেষ। আগে সে তাকে বাবুলভাই বলতো, আজ বলছে বাবুলমিঞা। এই একটি বিষয়ে বাবুল নিজের অক্ষমতার কথা ভালো করেই জানে, সে মেয়েদের সঙ্গে কিছুতেই সহজ স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে পারে না, সে দিলারাকে প্রবোধ দেবার কোনো ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না।

দিলারা আবার জানলার কাছে চলে গেল। জানলার বাইরে আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো, যে সময় আপনি আমার সাথে দুটা মিষ্টি কথা বললে, আমার দিকে একটু ফিরে চাইলে আমার প্রাণ নেচে উঠতো, সেই সময় আপনি আমার দিকে একবারও ফিরেও তাকান নাই। আজ আপনে এসেছেন আমাকে লাহোরে যেতে নিষেধ করতে। আমি লাহোরে না গিয়ে যদি ঢাকায় থাকি, তাতে আপনার কী আসে যায়, সত্যি করে বলেন তো?

বাবুল নিবার্ক, নত মস্তক।

কিছুক্ষণ এরপর ঘরের মধ্যে নিস্তব্ধতা। বাবুল এখন পালাতে পারলে বাঁচে। নিজেকে তার জবাইয়ের পাঁঠা বলে মনে হচ্ছে। অথচ সে উঠে চলেও যেতে পারছে না। দু একবার আড় চোখে সে দেখছে দিলারাকে। তেজস্বিনী দিলারা হঠাৎ যেন বেশি সুন্দরী হয়ে উঠেছে।

একটু পরে কণ্ঠস্বর বদলে দিলারা জিজ্ঞেস করলো, আপনি লাহোরে গ্যাছেন কোনোদিন?

বাবুল বললো, না, আমার ওয়েস্ট পাকিস্তানে যাওয়া হয় নাই।

–একবার গিয়া নিজের চোখে দেখে আসেন। আপনারা তো ঘরে বসে বসেই সব কিছু বুঝে যান। ঢাকার তুলনায় লাহোরের সোসাইটি অনেক নর্মাল। হিপোক্রেসি নাই। তারা যা বিশ্বাস করে, জীবনেও তা মানে। আপনারা বলেন যে ওয়েস্ট পাকিস্তানীরা আমাদের এক্সপ্লয়েট করে। প্রত্যেক ওয়েস্ট পাকিস্তানীই কি তাই? সেখানে গরিব নাই? সেখানে একজনও সৎ মানুষ নাই?

এবারে কথা খুঁজে পেয়ে বাবুল বললো, না, না, আমি তা মনে করি না। কোনো দেশেরই জনসাধারণকে আমি দুশমন মনে করি না। অবশ্যই সেদিকে অনেক সৎ মানুষ আছে।

–আমার মা নাই। লাহোরের একজন মহিলার কাছ থেকে আমি মাতৃস্নেহের স্বাদ পেয়েছি অনেককাল পর। তিনি আমাকে পুত্রবধূ করে নিতে চান।

–আমার কোনো আপত্তি নাই, দিলারা।

–বহুৎ শুক্রিয়া, চৌধুরী সাহেব।

বাবুল উঠে দাঁড়িয়ে বললো, মাই কংগ্রাচুলেশা। আশা করি লাহোরের সেই মহিয়সী মহিলার পুত্রটিও তোমাকে খুশী করবে।

এমন শুষ্কভাবে শেষ কথা বলে চলে যাওয়া উচিত নয় ভেবে দরজার কাছে গিয়ে বাবুল আবার ফিরে তাকিয়ে বললো, ঢাকা থেকে একজন সুন্দরী মেয়ে কমে যাবে, সেইটুকুই যা আমাদের দুঃখ।

অদ্ভুত তীক্ষ্ণ স্বরে হেসে দিলারা বললো, আমার হাজব্যাণ্ড ঢাকাতেই পোস্টিং নিচ্ছেন। কয় মাস পরে আমি ঢাকাতেই এসে থাকবো। কিন্তু তাতে কি আপনার কিছু যাবে আসবে? আমাদের বাড়িতে দাওয়াত দিলেও কি মঞ্জু ভাবী আপনাকে পারমিশান দেবে?

আর কোনো উত্তর না দিয়ে বাবুল ঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলো নিচে। পল্টনদের সঙ্গে দেখা না করে সে সদর দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল। কামাল ও জহির ছুটে এলো তাকে ধরবার জন্য, ততক্ষণে বাবুল মোড়ের মাথায় পৌঁছে গেছে।

কামাল জিজ্ঞেস করলো, কী হইলো? প্রথম প্রেমিকের কথা শুনে কি একটুও মন গললো দিলারা বেগমের।

বাবুলের এমনই মেজাজ খারাপ হয়ে গেছে যে সে জোরের সঙ্গে কামালের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললো, কেন তোরা আমাকে এরকম বিরক্ত করিস? জানিস যে আমি এসব পছন্দ করি না!

জহির বললো, জানতাম, বাবুলের দ্বারা কিছু হবে না। বাবুল যে বেশি বেশি মরালিস্ট! ফাঁকা ঘরে পাঠানো হইলো, আমরা নিচে পাহারা দিতেছিলাম, কেউ ডিসটার্ব করতো না, বাবুল যদি দিলারাকে জড়িয়ে ধরে কয়েকটা চুমা টুমা খেতো।

বাবুলের ফর্সা মুখখানা টকটকে লাল হয়ে গেছে, সে ক্রুদ্ধ চোখে তাকালো বন্ধুদের দিকে।

কামাল তার পিঠে একটা চাপড় দিয়ে বললো, ছাড়ান দে ওসব কথা। যা হবার তা তো হবেই। নবাব-জমিদারদের দিন গ্যাছে, এখন তো সুন্দরী মেয়েরা আর্মি অফিসার আর বড় বড় ব্যবসায়ীদেরই ভোগে লাগবে। ওয়েস্ট পাকিস্তানীরা আমাদের এদিককার সোনাদানা, ফরেন এক্সচেঞ্জ সবই নিয়া ফাঁক কইরা দিল, সুন্দরী সুন্দরী মাইয়াগুলারেও নিয়া যাবে, এ আর বেশি কথা কী?

জহির বললো, বাদ দে, বাদ দে! চল বাবুল, এখন আমরা একখানে যাবো।

বাবুল বললো, এখন আমি বাড়ি যাবো।

কামাল বললো, বাড়ি তো যাবিই, তার আগে একটা জায়গায় ঘুরে যাই।

জাহির বললো, কাছেই, গোল্ডেন গুজ হোটেলে। একজনের সাথে তোর আলাপ করিয়ে দেবো। খুব জরুরী কথা আছে।

বাবুলের আপত্তি ওরা শুনলো না, প্রায় জোর করেই টেনে নিয়ে গেল।

সন্ধে হয়ে এসেছে, পথে অজস্র সাইকেল রিকশার জটলা। ওরাও দুটি সাইকেল রিকশা নিল। বিভিন্ন মসজিদ থেকে ভেসে আসছে মাগরেবের আজানের সুর। একটি সিনেমা হলের সামনে উর্দু সিনেমার লাইনে টিকিটের জন্য হঠাৎ মারামারি শুরু হয়ে গেছে।

নিউ মার্কেটের কাছেই গোল্ডেন গুজ হোটেল, মাঝারি ধরনের। কাউন্টারের ম্যানেজারটি কামালের চেনা, সে আদাব জানালো। ওরা উঠে এলো দোতলায়। একটি ঘরের দরজায় কামাল নির্দিষ্ট ছন্দে তিনটি করে তিনবার টোকা দিতে খুলে গেল দরজা। লাউঞ্জ শুট পরা একজন সুদর্শন যুবক দরজা খুলে হাসি মুখে বলল, ইউ আর লেইট।

ঘরে ঢুকে দরজার ছিটকিনি বন্ধ করে দিল কামাল। তারপর বাবুলের দিকে হাত ছড়িয়ে দিয়ে বললো, আলাপ করায়ে দিই। ইনি বাবুল চৌধুরী, এর কথা তোমাকে বলেছিলাম, আর এই হচ্ছে সিরাজুল আলম খান, আমরা সবাই আলম বলে ডাকি, লণ্ডনে থাকে। আলম একটা বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছে আমাদের কয়েকজনের সাথে কথা বলতে।

আলম বললো, বসেন, আগে বসেন সবাই। চা কফি কিছু খাবেন, তাইলে আনতে বলি। যদিও দা টি দে আর সারভিং হিয়ার ইজ টেস্টলেস। আমরা লণ্ডনে অনেক ভালো চা খাই।

জহির বললো, না, বিকালে দুই তিন কাপ খেয়েছি, এখন দরকার নাই।

–অন্য কিছু ড্রিংকস নেবেন? সাম হার্ড ড্রিংকস, তাও আছে আমার কাছে।

-–থাক, এখন থাক। তোমার সিগারেট দাও বরং।

বাবুল ধূমপানও করে না, অন্য তিনজন সিগারেট ধরালো। আলম বাবুলের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করলো, আপনি ইকোনমিক্স পড়ান? ইউ কে-তে আসেন নাই কখনো? আসেন একবার!

বাবুল শুকনো ভাবে বললো, হ্যাঁ, যাবো কোনো সময়ে।

–আপনার বড় ভাই একটা নিউজ পেপার চালান? আমরা আপনাগো সাপোর্ট চাই। আমরা সব পারটির কাছেও অ্যাপ্রোচ করতাছি।

–আমরা মানে?

জহির বললো, আমি বুঝয়ে বলি। আগে ব্যাকগ্রাউণ্ডটা জানা দরকার। বাবুল, তুই লণ্ডনের “উত্তর সূরি” গ্রুপের নাম শুনেছিস? আলম এসেছে সেই গ্রুপের পক্ষ থেকে।

আলম বললো, এখন “উত্তর সূরি” নামটা বিশেষ চালু নাই। এখন আমাদের গ্রুপের নাম ‘ইস্ট পাকিস্তান হাউজ’। আমরা নর্থ লণ্ডনে হাইবেরি হিল-এ একটা বাড়ি কিনেছি, সেই বাড়ির নাম ইস্ট পাকিস্তান হাউজ। সেখান থেকে আমরা দুটো সাপ্তাহিক কাগজ বার করি, ইংরেজি আর বাংলায়, এশিয়ান টাইড’ আর ‘পূর্ব বাংলা’। সে বাড়িতে আমাদের মিটিং হয়, এক অংশে কিছু ছাত্রও থাকে।

দরজায় টক টক শব্দ হতেই আলম থেমে গেল। কামাল উঠে দরজা খুলে সামান্য ফাঁক করে কথা বললো যেন কার সঙ্গে। তারপর মুখ ফিরিয়ে জিজ্ঞেস করলো, আলম, তোমার সাথে। দেখা করার জন্য কে যেন এসেছে নিচে।

আলমের মুখে সামান্য যেন আশঙ্কার ছায়া খেলে গেল। সে জিজ্ঞেস করলো, কে? নাম বলেছে কিছু?

কামাল বাইরের লোকটিকে প্রশ্ন করে জেনে নিয়ে বললো, না, নাম বলে নাই।

আলম তার চিবুকটা নোখ দিয়ে চেপে ধরে কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করে বললো, আর কারুর তো আসার কথা নাই। কে আসবে? কামাল, তুমি একটু নিচে গিয়ে লোকটাকে দেখে আসবে?

কামাল দরজা টেনে দিয়ে বেরিয়ে গেল। সে না ফেরা পর্যন্ত বাকি তিনজন একেবারে চুপ। আলম একটা সিগারেট শেষ হতে না হতেই ধরালো আর একটা।

কামাল ফিরে এসে হাসি মুখে বললো, যতসব বখেরা! উটকো ঝঞ্ঝাট! অন্য এক আলম সাহেবকে খুঁজতে এসেছে। হোটেলের ম্যানেজার বোঝে নাই। তাকে আমি এবারে ভালো করে বলে দিয়ে এসেছি।

আলম বললো, ঠিক আছে। হ্যাঁ, যা বলছিলাম। আমরা এতদিন…

বাবুল বললো, আমি আপনাদের গ্রুপের অ্যাকটিভিটির কথা কিছু কিছু জানি। আপনারা স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের দাবি তুলেছিলেন।

–জী। তবে সেটা এতদিন ছিল থিয়োরিটিক্যাল দাবি। ওয়েস্ট পাকিস্তান আমাদের কতখানি এক্সপ্লয়েট করে সেই চিত্র তুলে ধরে আমরা দেখাতে চেয়েছি যে স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান গড়া ছাড়া আমাদের আর বাঁচার পথ নাই। এখন সেই দাবিকে কাজে পরিণত করার সময় এসেছে।

জহির বললো, লণ্ডনে বসে এরকম দাবি তোলা সহজ! এখানে ঐ কথাটা একবার রাস্তায় গিয়ে উচ্চারণ করে দ্যাখ না!

আলম বললো, টাইম ইজ রাইপ নাউ। ইণ্ডিয়া-পাকিস্তান যুদ্ধে আইয়ুব অপদস্থ হয়েছে। এই যুদ্ধে লাভ কী হলো? শুধু সৈন্যক্ষয় আর ধনক্ষয়। ইণ্ডিয়াকে ঠাণ্ডা করতে পেরেছে? কাশ্মীর দখল করতে পেরেছে? ওয়েস্ট পাকিস্তানেও আইয়ুব এখন আন-পপুলার। বাঙ্গালীদের এখন বোঝাতে হবে যে আমাদের জান-মালের কোনো দায়িত্বই ওয়েস্ট পাকিস্তানীরা নেবে না। তারা শুধু শোষণই করবে। আমাদের রক্ত চুষে ওয়েস্ট পাকিস্তানের বাইশটা ফেমিলি ধনী হবে। এই অবস্থায় আমরা ওদের সাথে সব সম্পর্ক ছিঁড়ে ফেলবো না কেন?

–সেটা কি অত সোজা?

–জনমত গঠন করতে হবে। আমাকে পাঠানো হয়েছে সব পলিটিক্যাল লিডারদের সঙ্গে কথা বলতে। সিকস্টি থ্রি-তে শেখ মুজিব যখন লণ্ডনে এসেছিলেন সোহরাওয়ার্দি সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে, তখন আমরা মুজিবকে বুঝাতে গিয়েছিলাম। উনি তখন আমাদের কথা মানেন নাই। স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রস্তাব শুনে উনি আঁতকে উঠে বলেছিলেন, আমি বড় জোর সায়ত্তশাসন চাই, তার বেশি না। তাছাড়া উনি সোহরাওয়ার্দি সাহেবকে ভয় পেতেন, ওঁর কথার ওপর কথা বলতে পারতেন না। কিন্তু এখন সিচুয়েশান অনেক চেইঞ্জড়। শেখ মুজিব এখন আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্ট, তাঁর সর্বময় ক্ষমতা, আমি কাল তাঁর সাথে দেখা করবো, অ্যাপয়েন্টমেন্ট করেছি।

জহির জিজ্ঞেস করলো, কে তোকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করিয়ে দিল?

আলম বললো, আমার লণ্ডনের সোর্স আছে। আমরা বিদেশে প্রচারের ভার নেবো, আইয়ুব লণ্ডনে কমনওয়েলথ কনফারেন্সে গেলে আমরা বিক্ষোভ দেখাবো। ফরেন প্রেসের কাছে আমাদের দাবির কথা জানাবো। এখানে প্রচারের জন্য, জনমত সংগঠনের জন্য আমরা তোমাদের সাহায্য চাই।

বাবুল বললো, স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান গড়া একটা অবাস্তব প্রস্তাব। আমি থিয়োরিটিক্যালিও এই প্রস্তাব সমর্থন করি না। এটা মিসগাইডেড চিন্তা!

আলম ও কামাল একসঙ্গে কিছু বলতে গিয়ে দু’জনেই থেমে গেল, অবাক হয়ে তাকালো।

জহির জিজ্ঞেস করলো, কেন, তুই এটাকে মিসগাইডেড চিন্তা বলছিস কেন?

বাবুল গম্ভীরভাবে বাঁ হাতের পাঞ্জা তুলে কর গুনতে গুনতে বললো, এক নম্বর, যে-কোনো ভাবে পাকিস্তানকে দুর্বল করার চেষ্টা দেশদ্রোহীতারই নামান্তর। দেশের মানুষ তা সহ্য করবে না। দুই নম্বর, আইয়ুবের নেতৃত্বে এখন চীনের সাথে পাকিস্তানের বন্ধুত্ব হয়েছে, এই সময়ে আইয়ুবকে প্যাঁচে ফেলায়ে দিলে চীনের সাথেই শত্রুতা করা হবে। কোনো সোসালিস্ট তা চাইতে পারে না। তিন নম্বর, আওয়ামী লীগ একটা ন্যাশনালিস্ট পেটি বুর্জোয়াদের পার্টি, তাদের নেতৃত্বে এদেশে কোনোদিন টোটাল সোসালিজম আসতে পারে না। ওয়েস্ট পাকিস্তানীদের বদলে বাঙালী বুর্জোয়া এলিটদের হাতে ক্ষমতা তুলে দিলে সাধারণ মানুষের কী লাভ হবে? এ দেশেও বাইশটি ধনী পরিবারের সৃষ্টি হবে। চার নম্বর, এখন আইয়ুবের হাত শক্ত করে, চীনের সাথে আরও ঘনিষ্ঠতা করে আমাদের উচিত টোটাল রেভলিউশনের জন্য তৈরি হওয়া। সর্বাত্মক বিপ্লব ছাড়া পথ নাই। এখনো তার সময় আসে নাই। এখন ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইস্ট পাকিস্তান মুভমেন্ট করতে গেলে সর্বাত্মক বিপ্লবের প্রস্তুতিরই ক্ষতি হবে!

কামালরা যেন দমবন্ধ করে বাবুলের কথা শুনছিল, এবারে কামাল বড় একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললো, তুই দেখছি বুড়া মৌলানা ভাসানীর ন্যাপের সুরে সুর মিলায়ে এখনও কথা বলছিস।

জহির বললো, তুই গোপনে গোপনে এখনো ন্যাপের মিটিং-এ যাস, তাই না? তাই তোরে প্রায়ই দেখতে পাওয়া যায় না।

আলম বলল, কিন্তু আপনি যে টোটাল রেভলুশানের কথা বলছেন, এই ধর্মের ধ্বজাধারী দেশে তা কতদিনে হবে? ততদিন ওয়েট করতে গ্যালে যে দেশটা একেবারে সর্বস্বান্ত হয়ে যাবে? আগে আমরা স্বাধীন হই, তারপর আমরা সমাজতন্ত্রের পথে আগিয়ে যাবো!

বাবুল জোর গলায় বললো, আমাকে এখানে শুধাশুধি ডেকে আনা হয়েছে। আমি স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান গঠন একটুও সমর্থন করি না। বরং আপনাদের এই চেষ্টার আমি বিরোধিতা করবো।

তর্কাতর্কিতে বেজে গেল রাত সাড়ে দশটা। এতক্ষণ ঘড়ি দেখার কথা কারুরই মনে ছিল। হঠাৎ খেয়াল হতে বাবুল উঠে দাঁড়ালো। শেষের দিকে বাবুলের সঙ্গে আলমের প্রায় ঝগড়া বেঁধে যাবার উপক্রম। দিলারার সামনে বাবুল বিশেষ কিছু কথা বলতে পারেনি কিন্তু রাজনীতির ব্যাপারে তার জিহ্বা অতি ধারালো।

বাবুল উঠে দাঁড়াতেই আলম তাকালো কামালের দিকে। কামাল সঙ্গে সঙ্গে বললো, না, না, সে বিষয়ে চিন্তা নাই। বাবুল, আলম যে এই হোটেলে আছে এবং সে কী উদ্দেশ্যে এসেছে, সে কথা আশা করি তুই অন্যদের বলে দিবি না। আলম এখানে গোপনে এসেছে।

জহির বললো, মতের বিরোধীতা থাকলেও বাবুল তো আমাদের বন্ধু। সে কখনো বিট্রে করবে না।

বাবুল কোনো উত্তর দিল না, বেরিয়ে এলো। রাস্তায় এসে রিকশা পাওয়া গেল না সহজে, বাড়ি ফিরতে তার আরও অনেক রাত হলো।

মঞ্জু কোনোদিনই ঘুমিয়ে পড়ে না। একতলায় সিরাজুলদের ঘরে বাতি জ্বলছে না, কিন্তু সিঁড়িতে ও ওপরে আলো আছে। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে বাবুল ভাবলো, একটু গরম পানি পেলে এখন একবার স্নান করে নিতে পারলে ভালো হতো। তর্ক করে মাথা গরম হয়ে গেছে, সহজে ঘুম আসতে চাইবে না। স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান না ঘোড়ার ডিম! লণ্ডনে আমোদ-আহ্লাদের মধ্যে থেকে শৌখিন চিন্তা। কামাল, জহিররাও ঐ মাকাল ফলের মতন চেহারার ছেলেটার কথা শুনে মেতেছে। লাউঞ্জ সুট পড়ে হোটেলে বসে থাকে, তার আবার বাঙালীদের জন্য দরদ!

এত রাত্রে মঞ্জুকে গরম পানির কথা বলা যায় না। সে ঢুকে গেল গোসলখানায়। খুব খিদে লেগেছে, মঞ্জু এর মধ্যে খাবার বেড়ে ফেলবে।

আজ যে বাবুল দিলারার সঙ্গে দেখা করেছে একটি নিভৃত ঘরে, সে কথা কি মঞ্জুকে বলা উচিত? গোপন করবারই বা কী আছে? কয়েকদিন ধরেই মঞ্জুর মন-মেজাজ ভালো নেই, হঠাৎ যদি দপ করে জ্বলে ওঠে? এত রাতে ওসব ঝঞ্ঝাট আর তার ভালো লাগবে না। বাবুল ঠিক করলো, পরে কোনো এক সময় মঞ্জুকে গল্পচ্ছলে বলে দিলেই হবে।

খাবার টেবিলে বসে বাবুল ভাতের সঙ্গে কপির তরকারি মেখে খানিকটা খাওয়ার পর ভাবলো, বাড়িতে ঢুকে সে এ পর্যন্ত মঞ্জুর সঙ্গে একটা কথাও বলেনি। কিছু একটা তো বলা উচিত। সে বললো, বাঃ, সবৃজিটা তো বেশ ভালো হয়েছে। তুমি নিজে বেঁধেছো নাকি?

মঞ্জ সে প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করলো, তুমি আবার পলিটিক্স করত্যাছো, তাই না?

মুখ তুলে বাবুল বললো, পলিটিকস? কিসের পলিটিকস?

মঞ্জু একই রকম সুরে বললো, পার্টি। পার্টির কাজে যাও। তাই তোমার বাড়ি ফেরতে দেরি হয়। আবার তুমি জেলে যাবে!

–যাঃ, এসব বাজে কথা কে বলেছে তোমাকে?

–যখন স্বরূপ নগর থিকা আসি, তুমি কথা দিছিলা, তুমি পার্টি-পুট্টি, পলিটিকস আর করবা। কথা দাও নাই? তুমি আমার জন্য আর সুখুর জন্য ঐ সব ছাড়বা।

–কথা দিছিলাম ঠিকই।

–তুমি কথা রাখো নাই। তুমি আবার জেলে যাইতে চাও!

হা-হা করে হেসে উঠলো বাবুল। অদ্ভুত কথা, কেউ কি সাধ করে জেলে যেতে চায়? জেলখানার মতন জায়গা বাবুল চৌধুরীর একেবারেই পছন্দ নয়!

কথা ঘুরিয়ে সে বললো, তোমার মামুনমামা আজ আসেন নাই? রোজই তো তোমাগো খবর নিতে আসেন, আমি জেলে গেলেই বা তোমার এত চিন্তা কী!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *