The people that walked in darkness have seen a great light.
ভগবান কে, এই প্রশ্নের সমাধান কোনওকালেই হবে না। আমিও ভগবান হতে পারি। পিতা হরিশঙ্কর হয়তো একটু পরেই বলবেন, ওয়র্ক ইজ গড। আবার হয়তো পরমুহূর্তেই বলবেন, ম্যাথেমেটিক্স ইজ গড। আমার কাছে এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় প্রয়োজনীয়, হরিশঙ্করকে যেভাবেই হোক আটকানো। বালিশের তলা থেকে পিসিমার চিঠিটা বার করে তার হাতে দিলুম।
নিতে নিতে বললেন, কার চিঠি?
উত্তরের অপেক্ষায় না থেকে পড়তে শুরু করলেন। মুখের চেহারা পালটাচ্ছে। পড়া শেষ করে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমার কী সিদ্ধান্ত?
ভয়ংকর সমস্যা।
হরিশঙ্কর বাজ পড়ার মতো চমকে উঠলেন, সমস্যা বলছ কেন?
এত বড় একটা পরিবার ঘাড়ে এসে পড়বে।
নোংরা একটা বাথরুমে ঢুকলে মানুষের মুখের চেহারা যেমন হয়, হরিশঙ্করের মুখের চেহারা সেইরকম হল। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, এমন একটা কথা তুমি বলতে পারলে? ঘাড়ে এসে পড়বে। অসহায় একটা পরিবার অনাহারে নির্যাতনে দিন কাটাচ্ছে, তাদের বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব। তোমার নেই?
আপনি চলে গেলে আমি একা কী করে সামলাব?
আমি যদি মরে যেতুম, তুমি তোমার পিসিমাকে সাহায্য করতে না? না আমার বোন বলে দায়িত্বটা একা আমারই? কী তোমার মনোভাব? কী শিক্ষা পেলে তুমি? মঠ-মিশনে গিয়ে কী পেলে তুমি? কী হল তোমার? এখনও গেল না আঁধার!
শরীর খারাপের জন্যেই বোধহয় মেজাজ হঠাৎ বিগড়ে গেল। বলেই ফেললুম, আমার একার রোজগারে অত বড় একটা ফ্যামিলি সামলানো সম্ভব? কারও পক্ষেই কি সম্ভব?
হরিশঙ্কর হাঁটুতে চাপড় মেরে বললেন, আলবাত সম্ভব। পৃথিবীতে অসম্ভব বলে কিছু নেই, যদি মানুষের ইচ্ছে থাকে। কম রোজগারে এর চেয়ে কত বড় পরিবার প্রতিপালিত হচ্ছে। তুমি দেখতে চাও? একসময় আমাদের যৌথ পরিবার কত বড় ছিল, আমার বাবার সামান্য রোজগার। আমরা কি মরে গেছি? ভেসে গেছি? ধরো তোমার যদি আরও কয়েকটি ভাইবোন থাকত, আর আমি যদি মরে যেতুম, তা হলে তুমি কী করতে? বাবার বউ বাবার ছেলেমেয়ে বলে সব ফেলে রেখে পালাতে?
সেটা অন্য কেস।
অন্য কেস নয়। দুটো কেসই সমান। কেবল মনটা অন্য। নিজের ভাবতে পারলে দুটোই সমান। তোমার স্বার্থ জেগেছে। তুমি এখন নিজের সংসারের স্বপ্ন দেখছ। নিজের সুখের স্বপ্ন, নিজের ভোগের স্বপ্ন। এই বাড়িটা খুব পুরনো হয়ে গেছে, তোমার একটা নতুন বাড়ি চাই। সেখানে তোমার সুন্দরী স্ত্রী। একটি-দুটি ছেলেমেয়ে। সম্ভব হলে ছোট একটা গাড়ি। সুখী পরিবার ভোগ আর স্বার্থের বেড়া দিয়ে ঘেরা। ত্যাগ কাকে বলে তোমার ধারণা নেই। ছেলেবেলা থেকে একা মানুষ হয়েছ, একাই থাকতে চাও।
আমার মাথা ঝাঝা করছে। কানদুটো গরম আগুন। আমি দেখতে পাচ্ছি আমার ক্ষুদ্র আমি রাগে তিড়বিড় করছে। চিৎকার করতে ইচ্ছে করছে, তীব্র ভাষা ব্যবহার করতে ইচ্ছে করছে। ক্ষণকাল। আগের আধ্যাত্মিক শিক্ষা অকেজো মনে হচ্ছে। নৌকো যেমন মাঝনদীতে ঝড়ের ঢেউয়ে টলমল করে, আমাতেও সেই ক্রোধের দুলুনি। কণ্ঠস্বর অতি কষ্টে স্বাভাবিক রেখে বললুম, এ আমার। স্বার্থপরতা নয়, ভয়। আমার ভয় করছে।
হরিশঙ্করের ঠোঁটে সেই বাঁকা হাসি, ভয় থেকেই স্বার্থপরতা আসে। সহোদর ভাই। হারাবার ভয়েই মানুষ স্বার্থপর হয়। নাথিং টু লুজ অ্যান্ড নাথিং টু ফিয়ার। তোমার ভয়টা কীসের? কমফর্ট হারাবে, হারাবে যা খুশি তাই করার স্বাধীনতা। জীবন বাঁধা পড়ে যাবে। জীবনের এতটা পথ ফাঁইট করতে করতে আসার পর আমি ভেবেছিলুম, এইবার একটু মুক্তি অর্জনের অধিকার সংসার। আমাকে দেবে। তা আর হল না। আবার আমাকে কোমর বেঁধে জলে নামতে হবে। আবার শুরু করতে হবে গোড়া থেকে। এই বুড়ো বয়সে আবার আমি চাকরির সন্ধানে বেরোব, দশটা-পাঁচটা। আবার ঠেলব সংসারের চাকা।
সাহস করে বললুম, আমরা যদি না থাকতুম।
থেকে কী করে ভাবা যায় আমি নেই! আমি আমার জন্যেই আছি আর কারও জন্যে নেই, এ। ভাবনা তো আমার পক্ষে অসম্ভব। অল রাইট, তুমি তোমার ভাবনা ভাবো, আমি আমার ভাবনা। যে-বোন আমার কোলে-পিঠে মানুষ হয়েছে, তাকে আমি ফেলতে পারব না। বরং ফেলে দেব আমার গবেষণা।
গবেষণা? অবাক হয়ে গেলুম। হরিশঙ্কর গবেষণা করতে গিয়েছিলেন। জানতে ইচ্ছে করছে, কী গবেষণা? কোথায় সেই গবেষণাগার? এখনই সেই প্রশ্ন করলে কোনও উত্তর দেবেন না। তার আগে নিজের দুর্বল চরিত্রের পুনরুদ্ধার প্রয়োজন। হরিশঙ্করের চোখে নিজের উজ্জ্বল মূর্তি তুলে ধরতে হবে। তিনি ধরেছেন ঠিক, নিজের সুখ বিসর্জন দিতে হবে এই ভয়েই আমি কাতর। আমার ফুরফুরে জীবন নষ্ট হয়ে যাবে। সেই গান মনে পড়ছে এক হাতে মোর পূজার থালা আর এক হাতে মালা। এক হাতে আমার ত্যাগের বড়াই, আর এক হাতে নারীদেহের স্পর্শ। এমন একটা ভণ্ড শয়তান কী করে হরিশঙ্করের পুত্র হল! দেবতা সৃষ্টি করলেন অপদেবতা। মধ্যপ্রাচ্যের আমির হবার কিংবা মোগল বাদশা হবার সব গুণ আমার মধ্যে বর্তমান। হারেম, ঝরোখা, গোলাপবাগিচা, ঝুলা, কোয়েলিয়া, বাইনাচ, রাঙা পানীয়ের গেলাস। মনে একেবারে মথুরা। ধরেছেন ঠিক। হরিশঙ্কর ধরবেন না তো কে ধরবেন! অন্তর্দর্শী।
একটু নড়েচড়ে বসতে হল। এখনই ঠিক করে ফেলতে হবে জীবন আমার কোন পথে চলবে। বিদ্রোহী হওয়া সম্ভব নয় আমার পক্ষে। একটা ব্যক্তিত্বকে অনুসরণ করতেই হবে। এ ছাড়া আমার অস্তিত্ব বিপন্ন হবে। বেশ জোর গলায় বললুম, আমি আপনার সঙ্গেই আছি। বলুন আমাকে কী করতে হবে?
হরিশঙ্কর স্থির চোখে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, আমিও তোমার সঙ্গে আছি। আমাদের দুজনকেই আবার সংসারে ঢুকতে হবে। অন্যের সংসারে। আমি পুরুলিয়ার ঝালদায় গালা দিয়ে একটা রিসার্চ শুরু করেছিলুম। ফল সংরক্ষণে গালার ব্যবহার। গালার সঙ্গে রং মিশিয়ে ল্যাক পেন্ট, যা দিয়ে শিল্পীরা ছবিও আঁকতে পারবেন। আর চেয়েছিলুম চাচগালা তৈরি করতে গিয়ে যেসব কর্মীর দু’হাতের আঙুল ক্ষয়ে গিয়ে পঙ্গু হয়ে গেছে তাদের পুনর্বাসন। মিশনারিরাই আমাকে সাহায্য করছিলেন, আমার সেই কাজটা বন্ধ হয়ে যাবে। এখানেই আমাকে একটা কিছু করতে হবে। কোনও ব্যাবসা কি ছেলে পড়ানো। এ জীবনে বড় কিছু আর করা গেল না। স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে গেল।
না, তা হবে না। আপনি যা শুরু করেছেন শেষ করুন। আমি একাই টানব।
কী করে? তোমাকে তো দেরাদুনে যেতে হবে।
বলে কয়ে কলকাতাতেই থাকব। প্রোমোশনের দরকার নেই।
তা হয় না। আমি জীবন শেষ করতে চলেছি, তুমি চলেছ শুরু করতে।
আচ্ছা এমন হয় না, আমরা সবাই পুরুলিয়ায় সেটল করলুম। আপনার কাজে আমিও সাহায্য করলুম। আমাকে ওঁরা মাইনে দেবেন না?
পিন্টু, এ-ও এক ধরনের কর্মসন্ন্যাস। এটা ঠিক চাকরি নয়। সেবা।
তা হলে আসুন আমরা দুজনে মিলে এখানেই একটা কেমিকেল ইন্ডাস্ট্রি করি। আপনার বহুদিনের স্বপ্ন। ছেলেবেলায় আমাকে বলতেন, কারও দাসত্ব যাতে করতে না হয় সেই চেষ্টা কোরো। আমি পারিনি। তোমার মধ্যে আমি আমার স্বপ্নের রূপায়ণ দেখতে চাই। আসুন না, আমরা একটা পরিকল্পনা তৈরি করি। কত কী-ই তো করা যায়। অনেকেই তো অনেক কিছু করছেন।
এইরকম একটা ইচ্ছে আমারও হচ্ছে। সাত্ত্বিক থেকে রাজসিক।
আপনি চেষ্টা করলে অসম্ভবও সম্ভব হবে। আপনি অসাধ্য সাধন করতে পারেন। আমার অনেক কল্পনা আপনাকে ঘিরে। আপনি একজন বড় ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট হয়েছেন। কত মানুষ কাজ করছেন আপনার প্রতিষ্ঠানে। সাদা অ্যাপ্রন পরে নিজের ল্যাবরেটরিতে নিজের কাজ করছেন আপনি। চোখে সোনার চশমা। এই বাড়িটা ভেঙে নতুন একটা বাড়ি হয়েছে। চারপাশে সুন্দর বাগান। গ্যারেজে সাদা রঙের ঝকঝকে একটা গাড়ি। মাঝে মাঝেই আপনি বিলেতে যাচ্ছেন। বিদেশিরা আসছেন আপনার প্রতিষ্ঠানে। সুন্দর একটা অফিস। টাইপরাইটারের খটখট শব্দ। কেমিকেলসের গন্ধ।
উত্তেজনায় আমি ঘরে পায়চারি শুরু করলুম। একটা কিছু করতে হবে। নিজেদের জন্যে, অন্যের জন্যে। এপাশ থেকে ওপাশ, ওপাশ থেকে এপাশ। মনে হচ্ছে আমিই হরিশঙ্কর। যত পাক মারছি ততই মনে হচ্ছে আমি বড়লোক হয়ে যাচ্ছি, লাখোপতি, কোটিপতি। হালকা লাগছে শরীর। সব বিষণ্ণতা কেটে যাচ্ছে। ঘরের আলোর পাওয়ার বাড়ছে। তখন আমি ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি রাখব। ড্রেসিংগাউন পরে বাথরুম থেকে বেরোব। স্লিপিং সুট পরে নেটের মশারিতে শোব।
হরিশঙ্কর বললেন, এইবার তুমি একটু স্থির হয়ে বসতে পারো। প্রায় মাইলখানেক পায়চারি হল। ইন্ডাস্ট্রি ইজ নট ওয়াকিং। লোকে হজমের জন্যে বেড়ায়।
আমার ভেতরে একটা শক্তি আসছে। ডু আই মাস্ট।
ইংরেজি ভাষার একটা শক্তি আছে, কিন্তু আমাদের কিছু করতে হলে করতে হবে বাংলায়। তুমি বোসো। দেখো ডক্টর রয় এখন চিফ মিনিস্টার। আমাকে একটু পছন্দও করেন। কংক্রিট একটা স্কিম তার সামনে ফেলতে পারলে টাকার অভাব হবে না।
আমার আর তর সইছে না, বললুম, কালই তা হলে চলুন।
দরজার কাছ থেকে জয়নারায়ণ বললেন, না না কাল কী করে যাবেন? এখনও দিন সাতেক আমাকে কলকাতায় থাকতেই হবে। রেকর্ডিং আছে, রিহার্সাল আছে। ট্রেনের টিকিট কেটে রিজার্ভেশন করতে হবে।
জয়নারায়ণ ঘরে ঢুকতে ঢুকতে আমার কথার শেষটা শুনেছেন। প্রথম দিকটা শুনতে পাননি। ফিনফিনে আদ্দির পাঞ্জাবি, কঁচি ধুতি। হরিশঙ্কর বললেন, চললে কোথায়? বরযাত্রী?
জয়নারায়ণ বললেন, ড্রেস দেখে বলছেন? বেশি মিহি হয়ে গেছে, তাই না?
ভেতরের গেঞ্জি দেখা যাচ্ছে। একটু অবসিন হয়ে গেছে। তোমার মতো একজন কালচারড মানুষের এটা নজরে পড়ল না? আরে ছি ছি।
জয়নারায়ণ লজ্জায় কাচুমাচু হয়ে গেলেন। নিজের দিকে তাকিয়ে বললেন, এটা তা হলে পালটানো দরকার?
অফকোর্স! এই পোশাকে লোক চরিত্রহীন হয়ে যায়।
জয়নারায়ণ বললেন, আসল কালপ্রিট তা হলে এই পাঞ্জাবিটা?
হ্যাঁ, তোমার শাঁস দেখা যাচ্ছে।
এ তো তা হলে আর কোনওদিনই পরা যাবে না। তা হলে কী করব এটাকে? ভাল করে কাচিয়ে মেয়েমহলে চালান করে দাও, চা কার কাজে লেগে যাবে। এটা আসলে। ফিল্টার ক্লথ। তোমাকে ভুল করে পাঞ্জাবির কাপড় বলে গছিয়ে দিয়েছে।
পাঞ্জাবিটা চা কার কাজে ব্যবহার করা যাবে জেনে মাতুল জয়নারায়ণ ভয়ংকর খুশি হলেন, যাক একটা ভাল কাজে লাগবে। কোনও চায়ের পাতাই আর লিক করবে না। গুঁড়ো চা-ও ব্যবহার করা যাবে। গুঁড়ো চায়ে বেশ আয় দেয়। সংসারের সেভিংস হবে।
তা হবে। তবে ছাকনিটা একটু কস্টলি হয়ে গেল।
না, খুব একটা কস্টলি হবে না। সাড়ে তিন গজ কাপড় আছে, অনেকগুলো পিস বেরোবে। জয়নারায়ণ বেশ খুশি হয়ে ভিতরে চলে গেলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে এসে হরিশঙ্করের সামনে দাঁড়ালেন। যেন পরীক্ষার রেজাল্ট বেরিয়েছে, এখন অভিভাবক কী বলেন। হরিশঙ্কর বললেন, হ্যাঁ এইবার ঠিক হয়েছে। ট্রানসপেরেন্ট থেকে ওপেক। তা তুমি যে বড় বাধ্য ছেলের মতো আমার কথা শুনলে?
শুনব না? আপনার হাই টেস্ট। তা কালই যাবেন ঠিক করছেন?
না না, আমরা একটা ব্যাবসা করার পরিকল্পনা করছি। ম্যানুফ্যাকচারিং ইন্ডাস্ট্রি।
জয়নারায়ণ লাফিয়ে উঠলেন, উঃ, সেই কারণেই বলে গ্রেট মেন থিঙ্ক অ্যালাইক। আমিও সেই কথাই ভাবছি বেশ কয়েক মাস ধরে। আসুন তা হলে লেগে পড়ি। মিউজিক্যাল ইনমেন্ট। হারমোনিয়ম তৈরি হবে। স্কেলচেঞ্জ, কাপলার। টিউনিংটা আমি ভালই পারব। কোম্পানির নাম হবে চ্যাটার্জি ফুট। রিডে মাদার অফ পার্লস। বেলোয় রুপোর পাতের ডেকরেশন। এক একটা হারমোনিয়ম বেরোবে যেন ওয়ার্ক অফ আর্ট। সুর ঝরবে ঝরনাধারার মতো।
মিউজিক্যাল ইনমেন্টস পারবে না জয়। ওর জন্যে একটা ট্র্যাডিশন গড়ে তুলতে হয়। একটা হাউস। তোমাদের গানের ঘরানার মতো বাদ্যযন্ত্রেরও ঘরানা আছে। সেই ট্র্যাডিশন গড়ে উঠতে উঠতেই আমরা ভবসাগরের পারে চলে যাব।
তা হলে আর কী করা যাবে? জয়নারায়ণের উৎসাহ ভেঙে পড়ল।
হরিশঙ্কর বললেন, আমার মাথায় একটা এসেছে। সেটা আমার লাইন। পারফিউমস।
মানে সেন্ট! জয়নারায়ণ নড়েচড়ে বসলেন, তা হলে আমি হব পাবলিসিটি অফিসার। যেসব আসরে যাব গায়ে মেখে যাব। একেবারে মাত হয়ে যাবে। সবাই জিজ্ঞেস করবেন, কী মেখেছেন? কোথায় পাওয়া যায়? ওয়াইড পাবলিসিটি। নাম রাখা হবে সমীরণ। নাঃ বাংলা নাম চলবে না। ইংরিজি নাম রাখতে হবে। প্রাইভেট অ্যাফেয়ারস, সিক্রেট টাচ, অ্যাফেকশন, কিস, এইসব।
হরিশঙ্কর মৃদু হাসছেন, বললেন, এ পারফিউম সে পারফিউম নয় স্যার। এ হবে স্পেশ্যাল ব্লেন্ড। বড় বড় সাবান কোম্পানি, পাউডার-স্নো কোম্পানি, এমনকী ওষুধ কোম্পানিও এই ব্লেন্ড কিনবে। তারাই ব্যবহার করবে। এর বেশির ভাগটাই এখনও বিদেশ থেকে আসে। বম্বেতে একটা মাত্র প্রতিষ্ঠান হয়েছে। এই ব্লেন্ডিং একটা মস্ত বড় আর্ট। জানেনা তো পারফিউমকে ফিক করতে হয়।
মানে? সুগন্ধী কি ফার্নিচার যে ফিকস করতে হবে?
ভাল পারফিউম মানে শুধু ভাল গন্ধ নয়, লাগাবার পর অনেকক্ষণ যেন গন্ধটা থাকে। লাগালুম আর সঙ্গে সঙ্গে উড়ে গেল, তা যেন না হয়। এর জন্যে প্রয়োজন হয় ফিকসেটিভের। বেড়ালের নাড়িভুড়ি থেকে তৈরি হয় সিভেট। সিভেট, স্যান্ডাল এইসব হল ফিকসেটিভ। যাক, এইসব আলোচনা অর্থহীন। আমরা ভাবছিলুম ডক্টর রায়ের কাছে একবার যাব আমাদের এই পরিকল্পনা নিয়ে। তোমার কী মত?
খুব ভাল হবে। ওয়ান্ডারফুল।
তুমি এখন চললে কোথায় সেজেগুজে?
সুরঞ্জনাকে পৌঁছে দিয়ে আসি। বাড়ি যাবে বলছে।
এই যে বললে আজ থাকবে, রাতে আমার কাছে বসবে অঙ্ক নিয়ে।
মেয়েদের মত তত মিনিটে মিনিটে বদলায়।
ওকে ডেকে আনন।
সুরঞ্জনা এল। কোনও সাজগোজই নেই। এলোমেলো হয়ে আছে। মাতুল জয়নারায়ণের মতোই। লম্বা। চেহারার ধার কী! তরোয়ালের মতোই। সুরঞ্জনাকে দেখলে আমার লজ্জা আসে নিজের ওপর। যেমন স্মার্ট, তেমনি বুদ্ধিদীপ্ত। আমি এক ম্যাদামারা। বাসী লুচি। ভিজে দেশলাই। শরীরে একটু শক্তি এলেই নিজের সংস্কারে লেগে যাব। সাদা ফিনফিনে শাড়ি, হালকা হলুদ রঙের ব্লাউজ।
হরিশঙ্কর বললেন, তুমি চলে যাচ্ছ?
কই না তো! কোথায় যাব? বাড়িতে তো কেউ নেই। এই জমজমাট বাড়ি ছেড়ে কেউ যেতে পারে? আনন্দের হাটবাজার।
জয়নারায়ণ বললেন, কী বলেছিলুম আপনাকে? মিলিয়ে নিন।
হরিশঙ্কর সুরঞ্জনাকে বললেন, যাও। এই প্রশ্ন করার জন্যেই ডেকেছিলুম। তোমরা কী করছ?
আমরা কাকিমার গল্প শুনছি। কিছু বলবেন? কিছু করতে হবে?
জয়নারায়ণ বললেন, করতে হবে না? চা না খেয়ে কতক্ষণ থাকা যায়? এক রাউন্ড হয়ে যাক।
সুরঞ্জনা বললে, আর কিছু? চায়ের সঙ্গে কোনও টা?
নো টা। সিম্পল চা।
সুরঞ্জনা আড়চোখে আমার দিকে তাকিয়ে চলে গেল। এই মেয়েটির প্রতি হরিশঙ্করের একটা মমতা জন্মেছে বেশ বোঝাই যাচ্ছে। বোধহয় বিজ্ঞানের ছাত্রী বলে। কিংবা বন্ধুকন্যা বলে। মুকুর ওপর এই স্নেহটা কিন্তু আসেনি। মুকুর দুর্ভাগ্য।
আমরা তিনজনেই থম মেরে বসে আছি। হঠাৎ খোলা জানলা দিয়ে হুস করে একটা চামচিকি ঢুকে ঘরের মধ্যে পাক মারতে লাগল। বোমারু বিমানের মতো। জয়নারায়ণ সঙ্গে সঙ্গে চেয়ার থেকে খসে পড়লেন মেঝেতে। পারলে খাটের তলায় ঢুকে যান। হরিশঙ্করের দৃষ্টি জয়নারায়ণের দিকে। গভীর আগ্রহে দেখছেন আরও কী করতে পারে। কত দূর যেতে পারে। চামচিকির যা স্বভাব। উন্মাদের মতো ঘরময় লাট খাচ্ছে। জয়নারায়ণের ঘাড় নিচু। মাথার ওপর দু’হাতের আড়াল।
হরিশঙ্কর বললেন, যতটা নিরাপদ ভাবছ নিজেকে ততটা নিরাপদ জায়গা ওটা নয়। মাঝে মাঝে ডাইভ মারছে। তুমি বুকে হেঁটে খাটের তলায় গেলে ভাল করতে। তার আগে অবশ্য ভেবে নাও, কোনটা তোমার ভাল লাগবে, চামচিকির লাথি না আরশোলার খোঁচা!
জয়নারায়ণ করুণ কণ্ঠে বললেন, আমার এই বিপদের মুহূর্তে আপনারা কোনও সাহায্যেই আসছেন না! চামচিকির ব্যালে দেখছেন।
হরিশঙ্কর বললেন, আর দেখাচ্ছে কোথায়? সবচেয়ে সমঝদার দর্শক যাকে ভেবেছিল তার এই দশা দেখে লজ্জায় ঘরের আকাশ ছেড়ে বাইরের আকাশে ফিরে গেছ। তুমি এইবার ভূমিতল ছেড়ে চেয়ারতলে ফিরে আসতে পারো। তোমার অমন সাদা ধবধবে ধুতি ময়লা হয়ে গেল।
জয়নারায়ণ ঘাড় তুলে সাবধানে চারপাশ দেখতে দেখতে বললেন, আত্মরক্ষার সময় জামাকাপড় তুচ্ছ হয়ে যায় চাটুজ্যেমশাই। চামচিকির লাথি খেলে কী হয় জানেন? অস্টিওম্যালাইটিস। হাড়ে চুন জমে সব গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে পড়ে যায়।
কোথায় পড়বে? বাইরে?
না, দেহের থলের মধ্যেই।
বাবা, এটা তো জানা ছিল না। কোন ডাক্তারি শাস্ত্রে লেখা আছে জয়?
সব কি আর শাস্ত্রে থাকে চাটুজ্যেমশাই? কিছু থাকে মানুষের বিশ্বাসে। চামচিকি হল ইল-ওমেন। অশুভকারী।
হরিশঙ্কর বললেন, চামচিকি হল আত্মা। সেকথা জানো কি? হয়তো কোনও ভাল সোল এসেছিল। তুমি তাকে উপেক্ষা করলে।
জয়নারায়ণ শিশুর মতো মুখের ভাব নিয়ে তাকিয়ে রইলেন হরিশঙ্করের দিকে।