২.৩২ You stand upon the threshold

You stand upon the threshold of your Century.
Here is the Cradle in which you wept.
There lie the worlds that await you!

আবার জেগে উঠেছে প্রেতপুরী। ভেতর থেকে ভেসে আসছে মেয়েদের কলকাকলি। প্রবল শব্দে কে কাপড় থুপছে? আমি চিত হয়ে পড়ে আছি বিছানায়। রান্নার সুবাস আসছে নাকে। দুর্বল শরীর স্বপ্ন দেখছে। অতীত যেন ফিরে আসছে। একঘরে জ্যাঠামশাই আর একঘরে বাবা। মা আর জ্যাঠাইমা হাসতে হাসতে গল্প করতে করতে কুটনো কুটছেন। রাঁধুনি বামুন তেলে ফোড়ন ছেড়েছেন। সুখী বেড়ালটা একপাশে থুপ্লি মেরে বসে আছে আধবোজা চোখে। কী সদ্ভাব, কী ভরভরন্ত চেহারা সংসারের! একটা হাবাগবা ইজের-পরা ছেলে ঘরে ঘরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। লাল চকচকে মেঝে। চুনকাম করা সাদা দেয়াল। জ্যাঠামশাই নিঃসন্তান। সংসারের একটি মাত্র ছেলে, তার কত আদর! সুখ হল শিশিরের মতো। ভোরের নরম আলো যতক্ষণ, ততক্ষণই তার আয়ু। কাল এক নিষ্ঠুর ধুনুরি। সুখের তুলো সব পিজে দেয় তার যন্ত্র চালিয়ে। সবাই গেছে চলে, একটি মাধবী শুধু…।

হরিশঙ্কর ঘরে এসে একটা চেয়ার টেনে খাটের পাশে বসলেন। স্থির চোখে তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে। অস্বস্তিতে চোখ নামিয়ে নিলুম। মানুষকে ভেদ করার ক্ষমতা আছে ওই চোখে। হঠাৎ প্রশ্ন করলেন, কী বুঝলে?

প্রশ্নটারই অর্থ খুঁজে পেলুম না। বললুম, আজ্ঞে?

ফিসফিস করে বাতাসের শব্দে বললেন, ডানার জোর না থাকলে পাখি উড়তে পারে না। তোমার ডানায় এখনও সেই জোর আসেনি।

একেই দুর্বল আমি, প্রখর সেই ব্যক্তিত্বের সামনে নিজেকে কীটের মতো মনে হতে লাগল। ভেতরে যেন ছেঁড়া ন্যাকড়া ঠাসা। যারা কাগজ কুড়োয় তাদের কাঁধের বস্তার মতো। সৎ সাত্ত্বিক কোনও চিন্তা নেই। কেবল ঘিনঘিনে দেহবাসনা।

ডানাদুটো কী বলো তো? ভেবেছ কোনওদিন? ভাবার অবসর হয়নি। আদর্শ ও চরিত্র। আদর্শ কাকে বলে? সমস্ত জীবনের স্বাভাবিক পরিণতির দিকে নজর রেখে সফল জীবনের ছক তৈরি করা। চরিত্র হল, অভ্যাসের দাসত্ব না করা। নৌকোর দাঁড় দেখেছ? দু’পাশে দুটো। একই সঙ্গে তালে তাল মিলিয়ে চলে, জলে ওঠাপড়া করে। মন আর আদর্শ এই দুটো হল দাঁড় আর সংযম হল। দাঁড় বাইবার তাল, ছন্দ। কোনওটাই তোমার আয়ত্তে আসেনি। নিজেকে দর্শন করার ক্ষমতাটাও জাগাতে পারোনি। তোমার এখনও চোখ ফোটেনি। কুকুরের ছানা দেখেছ? সবে জন্মেছে? চোখ ফোটেনি? মায়ের কোলের কাছে সবক’টা একসঙ্গে তালগোল পাকাচ্ছে। একটাই প্রবৃত্তি, দুধ খাবে, কিন্তু অন্ধ। গুতোগুতি। হঠাৎ ঠোঁটে এসে গেল তো গেল। চোখ নেই, লক্ষ্য নেই, পরিকল্পনা নেই– আছে প্রবৃত্তি। তুমি সেই দৃষ্টিহীন কুকুরশাবক। প্রবৃত্তিমার্গে অন্ধের মতো তালগোল। পাকাচ্ছ। শুনতে তোমার খারাপ লাগছে। তোমার ফ্যাকাসে মুখ আরও ফ্যাকাসে হয়ে উঠছে, কান্ট হেলপ। তোমাকে সুযোগ দিয়েছিলুম, নিজের মতো চলার। ইউ হ্যাভ ফেলড মিজারেবলি। কানামাছির মতো ঘুরপাক খেয়েছ। সাধনা করবে, সাধক হবে। সাধনা কাকে বলে? হোয়াট ইজ দ্যাট? কোনও ধারণা আছে? এনি আইডিয়া? প্রবেবলি নট। টেল মি, সাধু কাকে বলে?

হাঁ করে তাকিয়ে রইলুম তাঁর মুখের দিকে। এতদিনের জমে থাকা সব তিরস্কার একসঙ্গে নেমে আসছে। সাধু কাকে বলে? কোনও সংজ্ঞা খুঁজে পাচ্ছি না। গেরুয়া? সংসার ত্যাগ? কোনটা? আশ্রম? ধ্যানধারণা? নিরামিষ আহার? মাথায় আসছে না। মিউমিউ করে বললুম, কাকে বলে?

হরিশঙ্করের ঠোঁটের কোণে সামান্য একটু হাসি খেলে গেল, খুব সহজ আবার খুবই কঠিন সাধনার পথ। স্মৃতি কাকে বলে জানো?

আমি যেন ইন্টারভিউ দিতে বসেছি। কোনওরকমে বললুম, মনে রাখাটাই স্মৃতি।

হরিশঙ্কর মৃদু হেসে বললেন, প্রায় হয়েছিল। শুধু একটা একারের জন্যে হল না। মনে রাখা নয় মন রাখা। কোথায় রাখবে? রাখবে নিজের কর্ম, নিজের প্রবৃত্তির ওপর। মনের তিন অবস্থা, সংকল্পক মন, অস্মিতা বা অহংকার মন, আর বুদ্ধিতত্ত্ব বা মহত্ত্ব মন। এই তিনটে আলাদা আলাদা নয়। এক জায়গায় জড়াজড়ি হয়ে বসে আছে। কেমিস্ট্রির ছাত্র তুমি। তোমার সহজেই বোঝা উচিত। একে বলে, কম্পাউন্ড বা যৌগ। সাধকের কাজ হল বিশ্লেষণ। তিনটেকে আলাদা করে বোঝার স্থির। চেষ্টা। সংকল্প যেখানে ওঠে তাকে বলা হয় মন। এর ঠিক ওপরের যে আমি-বোধ তাকেই বলা হবে অস্মিতা বা অহংকারতত্ত্ব। সেইটাই আমাদের প্রথম আমিত্ববোধ। এই আমির নিয়ন্ত্রণে আমাদের। সমস্ত কাজ। এক মহাসাধকের সুন্দর একটি উদাহরণ শোনো। এক গৃহকর্তার পাঁচজন ভৃত্য। কর্তা সবার ওপরে থেকে সকলে খাটান। সকলের কাজকে সুসমঞ্জস করেন। একজন মালী হয়তো গাছ। লাগালে, আর একজন তাতে জল দিলে, একজন চারপাশের আগাছা উঠিয়ে ফেললে। এমন কখনই হবে না, একজন যখন গাছ লাগাল, অপরজন এসে তা উপড়ে দিল। এই যে সকলে মিলেমিশে কাজ করে তার একটাই কারণ, ওপরে একজন কর্তা, একটা আদর্শ, একটা নির্দেশ আছে। মনের ওপরের স্তর থেকে নীচের স্তরের দিকে লক্ষ রাখাটাই হল সাধনা। ধরো আমার মনে রাগ আসছে। সাধারণ মানুষ রেগে সব তছনছ করবে। সাময়িক উন্মাদ হয়ে যাবে। সাধকের কী হবে? সঙ্গে সঙ্গে ওপরের মন টের পাবে, আমি রাগতে চলেছি। রাগ আমার ক্ষতি করবে। আমি রাগব না। আমার ভোগবাসনা আসছে, আমি ভোগ করব না। আমার আলস্য আসছে, আলস্যে গা ঢেলে দেব না। সংকল্প করা আর সংকল্প রক্ষা করাই হল নীচের মনের ওপর ওপরের মনের নিয়ন্ত্রণ। একেই বলে স্মৃতি সাধনা। তুমি মানুষ, তোমার নীচের স্তরে অস্থিরতা থাকবে। তা থাকুক, ক্ষতি নেই, কিন্তু ওপরের স্তর থেকে যেন লক্ষ থাকে। স্বস্থ মানে আত্মস্থ, আত্মস্থ মানে আমি কী করছি তা লক্ষ রাখা। রাগে আত্মভাব হারিয়ে ফেলছি। ভাঙছি, চুরছি, গালাগাল দিচ্ছি। কাজটাই সেখানে বড় হয়ে উঠছে

আর যে কাজ করে সেই আমি হয়ে যাচ্ছে তার ভৃত্য। সাধু কে? না যিনি তার নীচ প্রবৃত্তির ভৃত্য। নন। বৌদ্ধদের নিধ্যান আর সম্প্রজন্য সাধনও এইরকম। নিধ্যান মানে ভেতরে ভেতরে স্মরণ করা। অভীষ্ট স্থির করো। অভীষ্ট চিন্তা করো। অভীষ্ট কী তা বলা হল না। সেটা তোমাকেই বেছে নিতে হবে। সবকিছু থেকে নিজেকে আলাদা করে দেখতে থাকাটাই হল স্মৃতিসাধন। তোমার পক্ষে কি স্বস্থ থাকা সম্ভব? ঈশ্বর তোমার ভেতরেই আছেন। সদা বসন্তং হৃদয়ারবিন্দে। স্বস্থ না হলে দর্শন। তো পাবে না বাপু। তুমি তো অস্থির! তুমি তো তোমার দেহের ভৃত্য। তোমার প্রবৃত্তি তো তোমাকে বাদর নাচ নাচাচ্ছে। কী? শুনতে খুব খারাপ লাগছে, তাই না?

আপনি কোনওদিনই আমার মধ্যে ভাল কিছু দেখতে পাননি।

তা বটে। তোমাকে তো আমি সুযোগ দিয়েছিলুম, তুমি তোমার আশ্রমে গেলে না কেন? কেন এই বাড়িতে নববৃন্দাবন খুলে বসলে? তোমার জন্যে এই বাড়িতে একটা আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে গেল। এই কেন-র কোনও সন্তোষজনক উত্তর কি তুমি দিতে পারবে?

আমি আপনার অপেক্ষায় ছিলুম।

তা হলে আমি যখন তোমার হাত ধরেছিলুম, তখন তুমি সেই হাত ছাড়িয়ে নিয়েছিলে কেন?

ভেবেছিলুম আমি লায়েক হয়ে গেছি, তারপর দেখলুম আমি একেবারে অসহায়। আমি কোনও ডিসিশন নিতে পারি না, ভিতু। অতীত আর স্মৃতির মধ্যে বসে প্যানপ্যান করে কাদি। আপনি যতদিন ছিলেন না, প্রতি মুহূর্তেই বলেছি, ও ফাদার! টেক মাই হ্যান্ড। আপনি ছাড়া আমার জীবন অচল।

হরিশঙ্কর আমার কপালে হাত রাখলেন। তার চোখদুটো এইবার ছলছল করছে। আমার শরীরে অদ্ভুত এক অনুভূতি খেলছে। শক্তির এক তরঙ্গ। প্রবল এক ইচ্ছার স্রোত। হাত যেন নীরব ভাষায় বলছে, উত্তিষ্ঠত জাগ্রত প্রাপ্য বরান নিবোধত। ক্ষুরস্য ধারা নিশিতা দুরত্যয়া দুর্গং পথস্তৎ কবয়ো বদন্তি ॥ জীবনের একেবারে নীচের তলায় ইন্দ্রিয় সুখভোগের লালসায় পড়ে আছ। ওঠো। উচ্চজ্ঞান, উন্নত জীবনলাভের চেষ্টা করো। আত্মজ্ঞানে জ্ঞানী হও। নিজের চেষ্টায় হয়তো পারবে। না। টেক মাই হ্যান্ড। আমার হাত ধরো। পথ যতই দুর্গম হোক আমি তোমাকে নিয়ে যাব।

আমার হাত রাখলুম কপালের সেই হাতে। মনে মনে অনুভব করলুম এই সেই হাত, যে-হাত কখনও কোনও অপবিত্র কাজ করেনি। কারও কাছে নতি স্বীকার করেনি। আত্মবিশ্বাসে ইস্পাত কঠিন। প্রবল একটা শক্তির ধারায় আমি স্নাত হলুম। সমিধের অভাবে যে-যজ্ঞাগ্নি নির্বাপিত হয়ে এসেছিল, সেই আগুন আবার লকলকিয়ে উঠল। হরিশঙ্কর যেন উপনিষদের উদ্যত-বজ্র পুরুষ! কী আশ্চর্য! একটা সদ্ভাবের প্লাবন বয়ে চলেছে ভেতরে। কে যেন ভেতরে বসে বেদগান করছেন। প্রাণাগ্নয় এবৈতস্মিন পুরে জাতি। স্পর্শে প্রাণ অগ্নি জ্বলে উঠল। আঙুলে আঙুল জড়িয়ে রইল বেশ। কিছুক্ষণ।

জামা শুকোতে দেবার গোটাকতক হ্যাঁঙার নিয়ে জয়নারায়ণ ঘরে ঢুকে বললেন, রেকনসিলিয়েশন হচ্ছে। বাঃ জাহ্নবী ও যমুনার মিলন! ঠিক এই মুহূর্তে পাখোয়াজের সঙ্গে ধ্রুপদ গাইতে ইচ্ছে করছে।

করলে কী হবে? তুমি তো বাজে কাজে ব্যস্ত হয়ে আছ।

জয়নারায়ণ শিশুর মতো মুখ করে বললেন, না না, আমি তো মেয়েদের দলে ঢুকে গজালি করছি না। একগাদা জামাকাপড় কাঁচলুম, আর তারই ফাঁকে ফাঁকে একটু কথা বলছিলুম।

জামাকাপড় মেয়েরা কেচে দিতে পারছে না?

বলেছিল। অফার দিয়েছিল। আমি পারি না। নিজের জামাকাপড় অন্যে কেচে দেবে ভাবলেও কেমন লাগে।

দ্যাটস গুড। চরিত্রটা তা হলে ঠিক রাখতে পেরেছ এখনও। ক্লীব হয়ে যাওনি!

জয়নারায়ণ লাজুক হেসে বললেন, এতদিনে আপনার কাছ থেকে একটা গুড ক্যারেক্টার সার্টিফিকেট পেলুম। না, গান না-গেয়ে আর আর থাকা যাচ্ছে না। দিস ইজ হাই টাইম লাইক হাই টাইড।

তা হলে বসে পড়ো, আমি তোমার সঙ্গে তবলায় বসছি। হরিশঙ্কর উঠে পড়লেন। জয়নারায়ণ হ্যাঁঙার ক’টা বিছানার একপাশে রেখে মেঝেতে মাদুর বিছোলেন। হারমোনিয়ম এসে গেল। জয়নারায়ণ ধ্যানস্থ হলেন। হরিশঙ্কর তবলায় হাতুড়ির ঠুকঠাক শুরু করলেন। জয়নারায়ণ। হারমোনিয়মে হাত রাখলেন। একঝলক সুর খেলে গেল ছররার মতো। প্রথমেই নেমে এল সংস্কৃত
তমেব ভাণ্ডমনুভাতি সর্বং তস্য ভাসা সর্বমিদং বিভাতি ॥

কঠোপনিষৎ-এর এই শ্লোকটি স্বামীজির অতি প্রিয় ছিল। সূর্য, চন্দ্র, অগ্নি, জ্যোতিষ্মন যত কিছু সবই ব্রহ্মের কাছে নিষ্প্রভ। ব্রহ্মের আলোয় সবকিছু আলোকিত। ব্রহ্মের জ্যোতিতেই জগৎ আলোকিত। মাতুল জয়নারায়ণ নিমেষে তৈরি করে ফেললেন তপোবন হরিশঙ্কর স্তব্ধ। জয়নারায়ণ আড়া ঠেকায় গান ধরলেন। স্বামীজির সেই বিখ্যাত রচনা,

নাহি সূর্য, নাহি জ্যোতিঃ, নাহি শশাঙ্ক সুন্দর,
ভাসে ব্যোমে ছায়াসম ছবি বিশ্ব-চরাচর।

বিছানায় উঠে বসলুম। মেয়েরা কাজ ফেলে ছুটে এসেছে। অক্ষয় কাকাবাবু রাঁধছিলেন মনে হয়, কোমরে গামছা জড়ানো, হাতে খুন্তি। পথ দিয়ে যেতে যেতে এক সমঝদার আহা আহা করে উঠলেন। আমার ভেতরে অন্যলোকের দরজা খুলে গেল। আরও দু’জন ঘরে এসে ঢুকলেন, যাঁদের এইসময় আসার কথাই নয়। আশ্চর্য ব্যাপার। একজন হরিদ্বারের সেই সন্ন্যাসী। অন্যজন মেনিদা। তবলা বাজাতে বাজাতে হরিশঙ্কর মাথা নত করে নমস্কার জানালেন। কাকিমা একটা আসন পেতে দিলেন সন্ন্যাসীকে। মেনিদা মেঝেতেই বসে পড়লেন।

মাতুল এক গান থেকে আর এক গানে চলে গেলেন। এইবার একতালা বাউল, আর কেন মন এ সংসারে, যাই চলো সেই নগরে/ যেথা দিবানিশি পূর্ণশশী আনন্দে বিরাজ করে। সঙ্গে সঙ্গে মেনিদার পকেট থেকে খঞ্জনি বেরিয়ে এল। সে কী গান! সকলেরই মাতোয়ারা অবস্থা। আনন্দের বন্যা বইছে। দক্ষিণের খোলা জানলা দিয়ে মাঝে মাঝে গরম বাতাসের ঝলক খেলে যাচ্ছে। এমনই তালের খেলা আমার পা দুটো নাচতে চাইছে। একসময় শেষ হল গান। সবাই সন্ন্যাসীকে প্রণাম করছেন। আমি প্রণাম করতেই মৃদু হেসে বললেন, বেটা বাচ গিয়া।

অবাক হবারই কথা। জানলেন কেমন করে! দেখা গেল সবই তিনি জানেন, যা যা ঘটেছে। ছবির। মতো বলে গেলেন সব। এমনকী সাপের ছোবল। শেষে বললেন, বেটা তোমার মৃত্যু হত। তাই আমি তোমাকে অমৃত ফল খাইয়ে গিয়েছিলুম। তা হলে শোনো অদ্ভুত এক ঘটনার কথা। স্বপ্নে নয়, সন্ন্যাসীর আশ্রমে দিব্য শরীরে আমার মাতামহ দর্শন দিয়ে বলেছিলেন, নাতিটার একটা বিপদ আসছে, আপনি একটা কিছু করুন। আমি আমার সাধ্যমতো চেষ্টা করেছি, বাকিটা প্রভুর কৃপা।

হরিশঙ্কর জানতে চাইলেন, অমৃত ফলটা কী? আপনার কাছে আর একটা আছে? তা হলে অ্যানালিসিস করে দেখতুম, অ্যাক্টিভ ইনগ্রিডিয়েন্টস কী আছে? বিজ্ঞানের উপকার হত।

সন্ন্যাসী বললেন, হিমালয়ের ফল হিমালয়েই থাক। সাধুসন্ন্যাসীদের সহায়। ও জেনে কোনও লাভ নেই। দুর্গমের ফল দুর্গমেই থাক। আমাদের কাজ হয়ে গেছে, আবার কী? আর তো আমাদের প্রয়োজন নেই। সোমরস ছিল। ফর্মুলা ইজ লস্ট। সমুদ্রমন্থনে অমৃত উঠেছিল। সেই অমৃতের ফর্মুলা কী? জেনে লাভটা কী হবে? আমরা তো ব্যবসা করব না। তবে আপনি সায়েন্টিস্ট, আপনার কৌতূহল হওয়া স্বাভাবিক।

অলৌকিককে আমি লৌকিকে আনতে চাই, যাতে জড়বাদীরা ধাপ্পা বলে উড়িয়ে দিতে না পারে।

দরকার নেই। অবিশ্বাসীরা অবিশ্বাসীই থাকুক। দ্যাট ইজ গড়স ডিজায়ার।

জয়নারায়ণ বললেন, মহারাজ, আপনি আমার বাবাকে দেখলেন? কেমন আছেন তিনি? কোথায় আছেন?

মামা এমন আকুল হয়ে প্রশ্ন করলেন, যেন সাধুজি ঠিকানাটা বললেই তিনি এখনই ছুটে যাবেন দেখা করতে। কিন্তু সে এমন একটা জায়গা যেখানে দেহ নিয়ে যাওয়া যায় না। দেহ ফেলে যেতে হয়। সেই লোকের অধিবাসীরা মায়াদেহ ধারণ করে হয়তো আসতে পারেন।

সন্ন্যাসী বললেন, তিনি কোন লোকে আছেন বলা সম্ভব নয়। জীবনের পরপারে অনন্ত লোক। কে-ই বা জানে তার কথা, সবই কল্পনা, সবই অনুমান। মৃত্যু আর পুনর্জন্ম এই বৃত্তাকার পথে আত্মার ভ্রমণকে চিন ও তিব্বতি ধর্মশাস্ত্রে বলে বার্দো জার্নি। ভারী সুন্দর ধারণা। মৃত্যুর পর দেহমুক্ত আত্মা পরলোকের পথ ধরে ভ্রমণে বেরোয়। একটা পাক মেরে ফিরে আসে মাতৃজঠরে। এই স্বাধীন ভ্রমণে তারা আমাদের কাছে আসতে পারেন, আমরা যেতে পারি না, কারণ আমরা দেহে আবদ্ধ, পৃথিবীর নিয়ম মেনে আমাদের চলতে হয়।

জয়নারায়ণ জিজ্ঞেস করলেন, তিনি কি আবার জন্মগ্রহণ করবেন?

সেটা তার ইচ্ছে। যদি করেনও আমরা জানতে পারব না। তিব্বতি সাধকদেরই সেই ক্ষমতা আছে। আমাদের নেই। কী আর করা যাবে! বৌদ্ধরা বেশ মজা করেছেন। তারা ফর্ম, মানে জীবাকারকে বলছেন ‘সে’, আর শূন্যাকারকে বলছেন, কুং’, এইবার দুটি অবস্থাকে একটি সূত্রে গেঁথেছেন। সেই সূত্রের নাম হৃদয়সূত্র। সেই সূত্রে সব একাকার, That which is form is just that which is emptiness. আমরা আছি, আকার, আকৃতি, দেহ, জীব, বস্তু, আছি শূন্যতাকে ঘিরে। একটা বুদবুদ। ভেতরটা ফাঁকা, and that which is emptiness is just that which is form. বেটা, হোয়াট ইজ এ উইন্ডো, হোয়াট ইজ এ ডোর? একটা ফাঁকা জায়গা। এ প্যাঁচ অফ এম্পটিনেস, কিন্তু প্রয়োজনীয়। দরজা আর জানলা ছাড়া ঘর হয় না, অ্যান্ড উই মেক ইট। প্ল্যান করে তৈরি করা হয়। একটা ফর্ম কিন্তু শূন্য। নাথিং ইজ দেয়ার। আকার নিরাকার, নিরাকার আকার, দুটোই সত্য, দুটোই মিথ্যা অ্যান্ড ভেরি ইন্টারেস্টিং। বেটা, আমি এখন যাই। দেখা করে গেলুম। আবার কবে আসব জানি না।

হরিশঙ্কর বললেন, আজ আপনাকে কিছু গ্রহণ করতে হবে।

করেছি। সংগীত। আর কিছুর প্রয়োজন নেই। ওটা বাহুল্য। ভাল থাকুন। বি হ্যাপি। সন্ন্যাসী চোখ বুজিয়ে স্থির হয়ে বসে রইলেন কিছুক্ষণ। কেউ পেলেন কি না জানি না, আমার নাকে একটা সুগন্ধের ঝাঁপটা এল।

সন্ন্যাসী আঙুল দিয়ে মেঝেতে একটা ত্রিভুজ এঁকে আসন ছেড়ে উঠে পড়লেন। কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থাকার পর বললেন, নিজেকে জানতে চান? দি স্টাফ, হুইচ ইউ আর মেড অফ?

সবার আগে মাতুল উৎসাহী হলেন, হ্যাঁ হ্যাঁ অবশ্যই জানতে চাই।

হরিশঙ্কর বললেন, কীভাবে জানা যাবে?

সন্ন্যাসী হেসে বললেন, জাস্ট পুট ইয়োর ফাস্ট ফিঙ্গার অন দি সেন্টার অফ দি ইম্যাজিনারি ট্রাংগল। মাতুল আঙুল দিতে গিয়েও থমকে গেলেন। সন্ন্যাসী বললেন, টাচ ইট।

জয়নারায়ণ আঙুল ছোঁয়ালেন। সঙ্গে সঙ্গে মুখের চেহারা করুণ হয়ে উঠল। কতদিনের বেদনা ফুটে উঠল মুখে। জলে ভরে এল চোখ। অসীম বিষণ্ণতায় নিমজ্জিত হলেন।

সন্ন্যাসী বললেন, ইউ আর মেড অফ সরো। দুঃখ দিয়ে তৈরি। দুঃখের পথেই রিয়েলাইজেশন। একে একে সবাই এগিয়ে এলেন। আঙুল রাখলেন অক্ষয় কাকাবাবু। ছটফট করে উঠলেন। সন্ন্যাসীর দিকে তাকালেন। তিনি বললেন, এনার্জি। মুকু হাত ছোঁয়াল। পাথরের অহল্যার মতো বসে রইল কিছুক্ষণ। সন্ন্যাসী বললেন, তুমি রিজিডিটি। অনমনীয়তা দিয়ে তৈরি। সুরঞ্জনার পালা এল। আঙুল ছুঁইয়েই সে টানটান খাড়া। কে যেন তাকে ওপর দিকে টানছে। ধারালো মুখ আরও ধারালো। সন্ন্যাসী বললেন, ইউ আর অল অ্যাম্বিশন। তুমি বড়, আরও বড় হতে চাও। আমার পালা এল। ভয়ে। ভয়ে আঙুল রাখলুম। সঙ্গে সঙ্গে আমার শরীরটা কুঁকড়ে ছোট হয়ে এল। জমির সঙ্গে মিশে যেতে চাইছে। সন্ন্যাসী বললেন, ইউ আর মেড অফ ফিয়ার। তোমার উপাদান হল ভয়। এইবার হরিশঙ্কর। আমরা তাকিয়ে আছি। অসীম কৌতূহল। এমন একজন বজ্ৰপুরুষের সত্তাটা কী? কী দিয়ে তৈরি? হঠাৎ মেনিদা বললেন, আমি আগে সেরে নিই। হরিশঙ্কর বললেন, অলরাইট। সব শেষে আমি। মেনিদা আঙুল রাখলেন। পাগলের মতো হাসতে লাগলেন। সন্ন্যাসী বললেন, হি ইজ এম্পটি। এ ম্যান উইদাউট সোল। এইবার হরিশঙ্কর। তার প্রথম আঙুল ধীরে ধীরে এগোচ্ছে ত্রিভুজের দিকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *