What a great happiness not to be me!
জবা গলা বড় একটা ব্লাউজ পরেছে। গলা আর বুকের ওপরের অনেকটা উন্মুক্ত। সুঠাম ঢলঢলে শরীর। বুকের ওপর দুলছে সোনার লকেট। জবা সাধাবণ মেয়ের চেয়ে বেশ লম্বা। সুখেনটা একটা রিয়েল গাধা। এমন একটা বউ পেয়েও সুখী হতে পারল না ইডিয়েট। মানুষের জীবনে সুন্দর একটা মেয়ে যে কী ফুল ফোঁটাতে পারে অনেক মোটা মাথাই তা বোঝে না।
জবা আঁচলে চোখ মুছে বলল, আমি যাই। পরে আবার আসব। পিন্টুদা, তুমি কখনও প্রেম করে। বিয়ে কোরো না। প্রেম বলে কিছু নেই। সংসারে ঢুকলেই প্রেম জ্বলে যায়। দেহটাই সব। মনটা কিছু নয়। ওই নরকের কীট আমাকে কীভাবে যে ভোগ করেছে, তুমি কল্পনা করতে পারবে না। ওটা মানুষ নয়, ষাঁড়।
জবা নীচে নামছে। অসহায় একটা মেয়ে। ঈশ্বর আমাকে যদি সেই সাহস দিতেন, আমি জবাকে নিয়ে কোথাও একটা গুছিয়ে বসতুম। মেয়েটা ভীষণ সরল আর ইমোশনাল বলেই ঠকে গেছে। এইবার নোংরা আর লোভী সমাজ ওকে গ্রাস করবে। দশ বছর পরে জবার কী হবে আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। বারেবারে ঠকার জন্যেই ও পৃথিবীতে এসেছে। সিঁড়ির বাঁকে গিয়ে জবা আমার দিকে তাকাল। চোখদুটো বর্ষার আকাশের মতো। মুখে অদ্ভুত একটা হাসি। জবা বললে, আমার জন্যে ভেবো না। কিছু আশা, আশাই থেকে যায়।
জবা নেমে গেল। খুব ইচ্ছে করছে জবাকে ডেকে ফেরাই। মানুষ যেভাবে জলে কি আগুনে ঝপায়, সেইভাবে ঝপ মারি। সবাই তো হিসেব-নিকেশ করে ভাল হতে চায়, আমি না হয় খারাপই হয়ে গেলুম। লোকে বাহবা বাহবা না করে, না হয় ছিছি-ই করল। মন্দিরের প্রদীপ না হয়ে, একটি মেয়ের অন্ধকার মনেরই না হয় প্রদীপ হলাম। চতুর্দিকে রাষ্ট্র হয়ে যাক হরিশঙ্করের ছেলে নষ্ট হয়ে গেছে। আমি তো তাদের কাছে হাত পাততে যাব না। আমার শিক্ষা, জ্ঞান, উপার্জন সবই ঠিক থাকবে। হরিশঙ্করই যখন নেই, তখন আর আমার ভয় কীসের! আজই এই মুহূর্তে আমাদের একটা গোপন সিদ্ধান্ত হয়ে যেতে পারে। পৃথিবী যেমন চলছে সেইরকমই চলবে। কারও কোনও ক্ষতি হবে না। শুধু একটা ছেলে আর একটা মেয়ে সুখের একটা কোণ খুঁজে পাবে। দেরাদুনে আমার চাকরিতে ফিরে গেলে জবাকে ওই পরিবেশে ভয়ংকর মানাবে। জবা মুকু নয়। অনবরত শাসনে আমাকে আড়ষ্ট করে দেবে না। জীবনের ভাল দিক খারাপ দিক দুটোই জানে। একটা মানুষ সবসময় ভাল থাকতে পারে না। কখনও ভোগী, কখনও যোগী। মন্দিরে যেতে পারে, আবার সেই সব জায়গায় ফুর্তি করতেও যেতে পারে। মনের অবস্থা যখন যেমন। একটু আগে জবা শুয়ে ছিল। শরীর ছেড়ে দিয়ে অলস ভঙ্গিতে নায়িকার মতো। তার দেহ থেকে নানা তরঙ্গ ছড়াচ্ছিল। আমার মন দুলছিল হেলছিল। কাবু হচ্ছিল। মজে আসছিল। নেশা ধরছিল। এখন এই বাড়ি নির্জন। কাক ডাকছে। গরম নিশ্বাসের মতো ফিকে বাতাসে খাতার পাতা অল্প অল্প কাঁপছে। রসের মতো অল্প ঘাম। টনটনে শরীর। জবাকে ডাকতে পারি। মনের সব সংস্কার ফেলে দিতে পারি। বর্তমানই সব। আমার অতীত নেই, ভবিষ্যতও নেই। বর্তমান চলে গেলে যা আসবে, যেভাবে আসবে সেইটাই আমার ভবিষ্যৎ। তারপর? গান থেমে যাবার পর সুরের রেশ। সুন্দর একটা ঘুম ভাঙার আবেশ। একটা আশীর্বাদ। চওড়া মসৃণ একটা পিঠে দিশাহারা ছোট্ট একটি পিঁপড়ে। নিরালায় নিঃশব্দে খসে পড়া একটি ফুল। গাছের পাতায় বহুক্ষণ থেমে যাওয়া বৃষ্টির নোলকের মতো এক ফোঁটা জল। কী? এবার ওঠো। বাড়ি যাবে না? আমার ঘুম পেয়েছে। দুটো হাত এগিয়ে আসছে। আমি আবার তলিয়ে যাব পাহাড়-নদী-উপত্যকায়, একটা দিনের মতো, একটা রাতের মতো। ভাবতে ভাবতেই জবা চলে গেল। এ জীবনটা আমি শুধু ভেবেই যাই। আর সময় আমার ওপর দিয়ে চলে যাক সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো।
হঠাৎ মনে হল, পিতা হরিশঙ্করের জন্যে উতলা হয়ে কী হবে! বেশ তো লায়েক হয়েছি। সুযোগ যখন পেয়েছি তখন বেশ মাংস কষার মতো পেঁয়াজ রসুন মশলা দিয়ে জীবনটাকে কষি। একটু ভোগ করি বিলিতি কায়দায়। মুকু গেছে ভাল হয়েছে। সে ছিল আমার বিবেকের চোখ, প্রতি মুহূর্তে সে আমাকে স্মরণ দিত, সাবধান। মনে রেখো, তুমি কার ছেলে! কোনও বেচাল চলবে না। সরে বোসো। আলাদা শোও। ধর্মের পানে কর্মের সুপুরি দিয়ে খিলি তৈরি করো। ভক্তির জরদা মেশাও। মুকুর মতো স্ত্রী স্বামীকে ধোলাইও দিতে পারে। ঈশ্বর যখন পাঁচিলের ওপাশে জবাকে এনে ফেলেছেন, তখন আর সুযোগের অবহেলা করা কেন! জবা তো একসময় আমাকে উন্মাদই করেছিল। নেমে পড়ি আসরে। এখনই অথবা কখনওই নয়। ভয়ংকর একটা রোমাঞ্চ আছে এই অবৈধ ব্যাপারটার ভেতর।
এই পাপ চিন্তায় আচ্ছন্ন হয়ে দাড়ি কামাচ্ছিলুম। প্রস্তুত হয়ে থাকি। মামা যদি আজই রাঁচির ট্রেন ধরেন, আমি পিছু ছাড়ছি না। না, আজ কী করে যাবেন? গভীর রাতেও তো প্রোগ্রাম আছে। রাত সাড়ে দশটার সময় বেতারের ঘোষক বলবেন, এখন জয়জয়ন্তী রাগে খেয়াল শোনাবেন। ঠোঁটের ওপর ব্লেডটা একবার হোঁচট খেল। চিনচিন করে উঠল জায়গাটা। সঙ্গে সঙ্গে সাবান ফুড়ে ফুটে উঠল এক বিন্দু রক্ত। নীচের ঠোঁটে গড়িয়ে এল রক্তের ধারা। এ আবার কী হল! কী ছিল ওখানে?
ঠোঁটটা ধুয়ে ফেললুম। সঙ্গে সঙ্গে আবার রক্ত। বোধহয় একটা ব্রণ হয়েছিল। আমার খেয়াল ছিল না। কী করি এখন? রক্ত তো বন্ধ হচ্ছে না। অসম্ভব জ্বালা। মনে হল চুনই ওষুধ। চুন টিপে দিলে রক্ত বন্ধ হতে পারে।
সামনের পান-বিড়ির দোকানে চুন চাইতে গেছি, মালিক কেষ্টদা ভয় ধরিয়ে দিলেন, করলে কী? ওষ্ঠ ব্রণ ভয়ংকর জিনিস। ব্লেড মেরে দিলে!
দোকানের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুন চেপে ধরলুম। রক্ত বন্ধ হল। কিন্তু স্বস্তি পেলুম না। দেখতে দেখতে ওপরের ঠোঁটটা ফুলে উঠল। আড়ষ্ট ব্যথা। স্নান করার সময় গায়ে জল ঢালামাত্রই শীত করে উঠল। জল একেবারেই ভাল লাগছে না। চোখ জ্বালা করছে। মাথা ঝিম মেরে আসছে। কোনওরকমে স্নান শেষ করে আয়নার সামনে দাঁড়ালুম। ঠোঁটটা আরও ফুলে বনমানুষ কি ওরাং ওটাং-এর মতো হয়ে গেছে। চেহারা দেখে নিজেরই ভয় করছে। কপালে হাত রেখে মনে হল, বেশ জ্বর এসে গেছে। তাই এত শীত করছে। অক্ষয় কাকাবাবুর ভবিষ্যৎবাণী তা হলে ফলে গেল। আজই সেই তৃতীয় দিন। একটা বিপদ আসছে। এই তো সেই বিপদ। এখন আমার কী করা উচিত! বেশ ভালই লাগছে। একেবারে অসহায়। পরামর্শ দেবার মতো কেউ নেই। মামাকে আমি চিনি। বড়লোক-ঘেঁষা মানুষ। কোথায় গিয়ে বসে আছেন কে জানে! আজ আর ফিরবেন বলে মনে হচ্ছে না। বেলা একটা বাজল। উনুন জ্বেলে রান্না করার প্রশ্নই ওঠে না। খেতেও পারব না। কোনওরকমে ঘরে এসে পিতা হরিশঙ্করের খাটে ধপাস করে উলটে পড়লুম। চাদরটা পালটাব ভেবেছিলুম, জবা শুয়ে গেছে। সেই ভাবনাটা চলে গেছে। এখন বেশ ভালই লাগছে। বোধহয় জবার দিকে মনটা ঝুঁকেছে বলেই। ভালবাসা, কে বলতে পারে! কখন টলটল করে উঠবে ভেতরে তালশাঁসের জলের মতো। আর আমার কোনও ক্ষমতাও নেই যে তুলব, ঝাড়ব, নতুন একটা পাতব।! জবার ওপরই শুয়ে পড়ি। আশ্চর্য, জবার শরীরের কথা চিন্তা করলে যন্ত্রণার কথা আর মনে থাকছে না। জবা ঈশ্বরের চেয়ে শক্তিশালী। সাধ্যসাধনাতেও তিনি আসেন না। ঈশ্বরের আর একটা প্রবলেম হল, এত রূপ, কোন রূপে আমি চিন্তা করব! চলচ্চিত্রের মতো একের পর এক এসে, জড়ভট্টি হয়ে তালগোল পাকিয়ে, শেষে যেন মনের কুস্তি! কোনও পাচেই পেড়ে ফেলা যায় না। ধোঁয়া ধরার কসরত। সেই তুলনায় জবা কত স্থির। যে-জায়গাটা স্মরণ করছি, সেইটাই সামনে এসে স্থির হচ্ছে। শুধু স্থির নয়, আনন্দ আর আকাঙ্ক্ষা জাগাচ্ছে। সেই গানের মতো, যতইনা পাবে, তত পেতে চাবে, ততই বাড়িবে পিপাসা তাহার। এই জায়গাটায় জবার মাথা ছিল। এইখানে শরীরের মধ্যভাগ। এই জায়গায় হাটুদুটো। উত্তেজিত পদযুগল। সাদা ক্রমশ দুধসাদা হয়ে রহস্য হয়ে গেছে নীল অন্তর্বাসে।
জ্বর আরও বেড়ে গেল। যেখানে হাত রাখছি সেই জায়গাটা গরম হয়ে উঠছে। বেশ জমে গেল তা হলে! ওষ্ঠ ব্রণ সেপটিক, মানে মৃত্যু অবধারিত। ভালই হবে। আর একবার ভাল করে জন্মাব। অক্ষয়বাবুর মতো বিশাল এক শরীর চেয়ে নোব, আর তার ভেতর ফিট করে দেব পিতার চরিত্র ও মেধা। মামার সংগীত-প্রতিভাও নিতে পারি। স্বর্গে গিয়ে প্রথমেই দিদিকে খুঁজে বের করে ক্ষমা চেয়ে নোব। মাকে বলব, তার চলে আসার পর আমার বেঁচে থাকার বৃত্তান্ত। নন্দনকাননে কিছুদিন রেস্ট নেবার পর পৃথিবীতে ফিরে আসব।
গোটা মুখ থমথম করছে। এপাশ ওপাশ করলে যেন মল বাজছে ঝমঝম। চোখের মণি নীচের দিকে নামালে নিজের গাল ঠোঁট পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি আয়না ছাড়াই। ফুলে উঠে চোখের কোলে চলে এসেছে। কী মজা! এ-ও জীবনের এক অভিজ্ঞতা। ঈশ্বরকে ডেকে লাভ নেই। মন দেবী থেকে সরে গেছে মানবীতে। কেউ কি আসবে না আমার এই অসহ্য যন্ত্রণার মুহূর্তে! চাঁ চা করে ডাকছে শালিক। মাঝে মাঝে ইলেকট্রিক শকের মতো যন্ত্রণার তীব্র একটা খোঁচা মাথার দিকে উঠে যাচ্ছে।
বহুক্ষণ ধরে টেলিপ্যাথিতে জবাকে ডাকছি। আসছে না কেন? তিনটে বেজে গেছে। রোদ মরে আসছে। কত তাড়াতাড়ি জায়গাটা বিষিয়ে উঠল! ধুপ করে ছাতে একটা শব্দ হল। বেশ ভারী একটা কিছু পতনের শব্দ। বোধহয় জবা পাঁচিল টপকাল। অনেক দিনের পুরনো অভ্যাস, আবার ঝালিয়ে নিচ্ছে। ছাতের সিঁড়িতে পায়ের শব্দ। মলের ঝুমকোর চুনুর চুনুর শব্দ। পরক্ষণেই জবা ঘরে এল। হলদে শাড়ি, আটপৌরে সাদা ব্লাউজ। শাড়িটা গ্রামের মেয়েদের মতো উঁচু করে পরা। গাছকোমর আঁচল। চুলের খোঁপা বেদেনির মতো। ঝুরঝুরে কিছু কপালে এলোমেলো।
জবা আমার দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বললে, এ কে?
এই একই প্রশ্ন তো আমারও। এ কে? সন্ন্যাসী, গৃহী, লম্পট, ভণ্ড, শয়তান? কোনটা?
জবা বললে, এই কয়েক ঘণ্টার মধ্যে কী করে ফেললে? মারামারি করে এলে নাকি?
জবা সাবধানে আমার মাথার পাশে খাটের ধারে বসল। মুখের ওপর ঝুঁকে পড়ে বলল, কী সাংঘাতিক অবস্থা! কী করে করলে এমন?
জবার মুখটা ভীষণ সুন্দর। কিছু পাপ কিছু পুণ্য মিশে বড় আকর্ষণীয়। বিদেশি চলচ্চিত্রের নায়িকার মতো। কুমারী নয় বলেই অন্য এক ধরনের চটক এসেছে। এই যন্ত্রণার মধ্যেও আমার সৌন্দর্যবোধ ঠিক আছে দেখে মনে হল, মৃত্যু আসন্ন হলেও সমাসন্ন নয়। একদিন-দুদিন লড়ে যেতে পারব। বিপরীত স্টেশন থেকে ট্রেন ছেড়েছে, এখন আসতে যতদিন লাগে। শুনেছি মরণকালে মানুষের মাংসে রুচি চলে যায়। বুকে মৃদঙ্গ বাজে। মনে মহাদেব নৃত্য করেন। আমার ওইসব কিছুই হচ্ছে না। বরং জবার নিটোল পশ্চাদ্দেশ আমার ডান কান ছুঁয়ে আছে বলে শরীরে অন্য আর এক ধরনের যন্ত্রণা টের পাচ্ছি। চলেই যখন যাব, তখন জবার আপত্তি না থাকলে জীবনের শেষ নারীসঙ্গ করে যাব কি? আর হয়তো মনুষ্যজীবন পাব না। প্রেম, প্রীতি, ভালবাসা, সৌন্দর্য দেখার চোখ, কবিতার মতো শরীর, নৃত্য, গীত, নিষিদ্ধ সম্পর্ক, ছোটখাটো পাপ, একটু পদস্খলন, অপরাধী বিবেক, আসক্তি, নিরাসক্তি এই মানব জীবনের যত মশলা, সবই হয়তো একবার। জবার হাতটা নিজের হাতে টেনে নিলুম। কোমল অনভিজ্ঞ কুমারী হাত নয়, ঝানু হাত। নখের মাথা সামান্য সামান্য ক্ষয়ে গেছে। সংসারের কাজেকর্মে খসখসে। হাত মানুষের জীবনযাপনের সাক্ষী। কর্মীর হাত, বিলাসীর হাত, দুঃখীর হাত, খুনির হাত, তবলিয়ার হাত, সেতারির হাত। নিজেকেই নিজে ধমক লাগালুম। জ্বরের ঘোরে ব্যথার তাড়সে মন ভুল বকছে।
জবা আমার হাতে চাপ দিয়ে বড় স্নেহের গলায় বললে, বললে না তো কী হয়েছে? মুখ থুবড়ে পড়ে গেছ?
মনে মনে হাসলুম, অনুমানটা তোমার নেহাত মিথ্যে নয়। এমন পড়া পড়েছি, আর উঠতে পারব কি না জানি না। মুখে বললুম যা হয়েছে।
জবা বললে, তা হলে আমি ডাক্তার ডেকে আনি।
কাঁচের শার্সির গায়ে লেবড়ে থাকা উঁশ মাছি যেমন বুজুর বুজুর শব্দ করে, সেইরকম একটা শব্দ বেরোল আমার মুখ দিয়ে, এখন ডাক্তার কোথায় পাচ্ছ জবা! সন্ধের পর পাবে। এখন তারা বিশ্রাম নিচ্ছেন।
জবা বললে, আমি সব পারি। ডক্টর মিত্রের বাড়ি আমি চিনি। ঠিক ধরে আনব।
তুমি আমার কাছে থাকো। আমার ভীষণ ভয় করছে। আমাকে ছেড়ে চলে যেয়ো না।
অদ্ভুত একটা আকর্ষণ বোধ করছি। অদ্ভুত একটা শান্তি। দুটো জীবন প্রায় এক ধাঁচের। দু’জনেরই এক হাল। সমান অসহায়। দু’জনেই পরিত্যক্ত। একজন স্বামী। আর একজন পিতা। বার্ডস অফ দি সেম ফেদার ফ্লক টোগেদার।
জবা বললে, কীসের ভয়! তোমার নিশ্চয় খাওয়াও হয়নি!
আর খাওয়া, আমি ঠোঁট ফাঁক করতেই পারছি না।
জবা কিছুক্ষণ কী ভাবল। আমার আঙুলগুলো নিজের আঙুলে নিয়ে নাড়াচাড়া করল। শেষে একটা যেন কিছু খুঁজে পেল। আমার বুকের ওপর হেলে পড়ে বললে, একটা কাজ করি। সরু একটা পেঁপের ডাল কেটে আনি। এক বাটি দুধ গরম করি। তুমি সেই ডালটা দিয়ে চোঁচোঁ করে খেয়ে নাও।
জবার লকেটটা আমার বুকের কাছে দুলছে। শীত করছিল বলে পাখা বন্ধ। জবার টিকোলো নাকের ডগায় তিলফুলের মতো ঘাম। বুকের খোলা অংশটা ভিজেভিজে। মন কেমন করানো অতি কোমল, অতি নিভৃততম আরও কিছু। আমি লকেটটায় হাত দিলুম। বড় সুখ। জবাকে আমি একদিন আদর করতে চেয়েছিলুম। পৃথিবীকে যখন বিদায় জানাতে হবেই, তখন আর দেরি কেন! মানুষ যখন মরে তখন তো তার সবই বেরিয়ে যায় প্রাণবায়ুর সঙ্গে। দেহের সঙ্গেই পুড়ে ছাই হয়ে যায় তার নাম, আদর্শ, চরিত্র। তবে! এই আমার শেষ ইচ্ছে। জবাকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরলুম। ভরাট এক অনুভূতি। এর বেশি কিছু সম্ভব নয়! শরীরে কুলোবে না।
জবা বললে, অমন কোরো না। তোমার লেগে যাবে। জ্বরে তোমার গা পুড়ে যাচ্ছে!
জবার আঁচল খুলে লুটিয়ে পড়েছে আমার বুকে। জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। এর অর্থ আমি বুঝি। জবা উঠে দাঁড়াল। নিজেকেই প্রশ্ন করল, এই জ্বরে দুধ দেওয়া কি ঠিক হবে? বলতে বলতে বেরিয়ে গেল। বাইরের রাস্তায় ছেলেরা শোরগাল তুলে চলেছে। স্কুলের ছুটি হয়েছে। ওই জীবনটা ছেড়ে এসেছি আমি। লোভনীয় জীবন। আবার ফিরে পেতে হলে মরে যেতে হবে। জীবন হল নদীর মতো। উৎসের দিকে আর ফিরতে পারে না। সাগরের টানে এগিয়েই চলে। ক্রমশ আচ্ছন্ন হয়ে আসছে আমার চেতনা। রঙিন কাঁচের মধ্যে দিয়ে পশ্চিমের রোদ এসেছে। এটা তার নিত্য আসা। ধর্মশালার অতিথির মতো। সারাদিনের তীর্থভ্রমণ শেষ করে, বোঝা নামিয়ে বসা। বড় কষ্ট হচ্ছে। খুবই যন্ত্রণার মৃত্যু হবে। পিতা হরিশঙ্কর বলতেন, যন্ত্রণা সহ্য করবে বীরের মতো। উঁ অ্যাঁ করবে না। পরাজিত হবে না। হাসবে। গান গাইবে। মনটা তুলে নেবে। অন্য চিন্তা করবে। তবু আমার মুখ দিয়ে মাঝেমধ্যে উঁ অ্যাঁ বেরিয়ে পড়ছে। কতটা সময় চলে গেল হিসেব নেই। মাথাটা ছিঁড়ে যাচ্ছে। হঠাৎ জবা ঘরে এল ডক্টর মিত্রকে নিয়ে। ঠিক ধরে এনেছে।
বিছানার পাশে একটা চেয়ারে বসলেন ডক্টর মিত্র। তিনি আমাদের পারিবারিক চিকিৎসক নন। আমাদের ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান ডক্টর সেন। সেই কারণেই একটু অস্বস্তি বোধ করছেন। যেন। পরস্ত্রীর গায়ে হাত দিচ্ছেন। জবা মনে হয় সবই বলেছে। ঠোঁটটা ভাল করে দেখে, চার পাশ আঙুল দিয়ে আলতো আলতো করে টিপে বললেন, ভয়ংকর কাণ্ড। ওয়ান পার্সেন্ট কেস।
জবা বললে, তার মানে কী ডাক্তারবাবু?
মানে হল, একশোতে একজন বাঁচে। এ বড় সাংঘাতিক ব্যাপার-ইরিসিপ্লাস। সোজা ব্রেনে গিয়ে ধাক্কা মারবে। ইস, বিশ্রী কাণ্ড করে বসে আছে। দেখি কী হয়! তেড়ে সালফার ড্রাগস চালাই। একটা পাউডার দোবো, ঠোঁটের ওপর সাবধানে ছড়িয়ে দিয়ো। হরিশঙ্করবাবু কোথায়?
জবা বুদ্ধি করে বললে, কয়েক দিনের জন্যে বাইরে গেছেন।
তবে যে শুনলুম, তিনি জলে ডুবে আত্মহত্যা করেছেন।
জবা বললে, যাব্বাবা, এ আবার কে রটালে? একখানা পাড়া বটে।
ডাক্তার বললেন, তা যা বলেছ! এক কাজ করো, তাঁকে টেলিগ্রাম করে আসতে বললো। কেস কোন দিকে যাবে বলতে পারছি না।
আবার দুজনেই বেরিয়ে গেল। জবা সদর পর্যন্ত গিয়েছিল ডাক্তারবাবুকে এগিয়ে দিতে। ফিরে এসে বললে, হ্যাঁগো, তোমার কাছে কিছু টাকাপয়সা আছে?
হ্যাঁগো, শব্দটা ভীষণ ভাল লাগল। এইভাবে স্ত্রীরা স্বামীকে সম্বোধন করে। ভীষণ একটা আন্তরিকতা। দুটো মহাদেশের মাঝখানে অর্থহীন দুটো শব্দের সেতু। জবাকে ইশারায় কাছে ডাকলাম। লকেটটা বাঁ হাতে একটু তুলে আঁচল দিয়ে বুক আর গলা মুছল। পাশে এসে বললে, কী বলো?
ও ঘরে গিয়ে আলমারিটা খোলো। গোল একটা বাক্স দেখবে। সেই বাক্সটার দুটো তলা। একেবারে নীচের তলায় টাকা আছে। চাবি আলমারিতেই ঝুলছে।
যতক্ষণ কথা বললুম জবা চোখ বড় বড় করে ওপর নীচে ঘাড় দোলাল, যেন ছাত্রী। মাস্টারমশাই কিছু বোঝাচ্ছেন। জবা চলে গেল পাশের ঘরে।
পৃথিবীতে এমন কেন হয় না! মানুষ মানুষের খুবই ছোটখাটো সুখের বাধা হবে না। কিছু দিতে হবে না, শুধু বাধা দেব না। সুখেন বলবে, ঠিক আছে জবা, তোমাকে আমি ছেড়ে দিলুম। পিতা হরিশঙ্কর হাসিমুখে বলবেন, ঠিক আছে পিন্টু, সংসার তুমি করবে। তোমার যদি মনে হয় জবার মতো সংসারে ইতিমধ্যেই পোড়-খাওয়া অভিজ্ঞ এক মহিলা তোমাকে সুখী করতে পারবে, তা হলে আমার আর আপত্তি কীসের! পাড়ার লোকজন বলবে, ঠিকই তো, ঠিকই তো। বিলেতে এইরকম অনবরতই হচ্ছে। তারাও মানুষ আমরাও মানুষ। মানুষের সুখটাই আমাদের কাছে বড়। যে যেখানে আছ সুখী হও। আমরা তো অন্যভাবে সাহায্য করতে পারব না, আমরা বাধা না দিয়ে, ছিছি না করে তোমাদের সাহায্য করব। আর জবা বলবে, এতদিন আমি যা খুঁজছিলুম তাই পেয়ে গেছি। আর আমার কিছু চাইবার নেই। জীবন-জাহাজ এইবার বন্দর খুঁজে পেয়েছে। তখন আমি বাগান-ঘেরা ছোট একটা বাড়ি করব। স্মৃতিভারাতুর এই অভিশপ্ত প্রাচীন কেল্লাটি আমরা পরিত্যাগ করব। স্মৃতির কঙ্কালরা এখানে দোল খাক। মাঝরাতে হা হা করে হাসুক অট্টহাসি। সেই নতুন বাংলো বাড়ির সবচেয়ে ভাল ঘরটিতে থাকবেন পিতা হরিশঙ্কর। মামার আনা গোলাপ গাছগুলো দিয়ে জানলার বাইরে ছোট্ট একটা বাগান সাজাব। যাতে তিনি জানলায় বসে দেখতে পান ফুলের বাহার। জবা কোমরে আঁচল জড়িয়ে, শাড়িটাকে একটু উঁচু করে পরে ঝারি নিয়ে জল দেবে। ছোট্ট রুমালের মতো একটা লন থাকবে। শেষবেলায় জবা আর হরিশঙ্কর সেখানে বসবেন, ভিজে মাটি, ঘাস, রোদ, ফুলের গন্ধ। হরিশঙ্কর রাতের আকাশ থেকে তারা খুঁজে খুঁজে জবাকে কনস্টিলেশন চেনাবেন। গাছের ডালে চেনবাঁধা দোলা বাতাসে মৃদু মৃদু দুলবে। তারই অস্ফুট শব্দ। কাঠের মেঝেআলা একটা ঘর থাকবে। জবা সেখানে নাচ শিখবে। স্কুলে ভাল নাচত। হরিশঙ্কর নাচ। বোঝেন, তাল বোঝেন, ছন্দ বোঝেন। ছেলেবেলায় আমাকে নাচ শেখাতেন। জবা হবে তারই ছাত্রী। কাঠের পাটাতনে পায়ে তাল ঠোকার শব্দ। ঘুঙুরের বোল। তবলায় হরিশঙ্করের ছটফটে আঙুল। মামার হারমোনিয়ম আর গলা। জবার লাল ব্লাউজ ঘামে ভিজে আরও লাল। এরপর রাত যখন গম্ভীর হয়ে যাবে, কালো আকাশের ছায়াপথ ধরে তারারা প্রদীপ হাতে নিয়ে যখন বেরোবে তীর্থযাত্রায়, তখন হরিশঙ্করের টেবিলে জ্বলবে একটি মাত্র আলো, সামনে খোলা কঠিন গণিতশাস্ত্রের বই। পাশে খাতা। সমাধান খুঁজে ফিরবেন যেসব সমস্যার আজও সমাধান হয়নি। জবা একসময় এসে আলোটা নিবিয়ে দেবে। হাত ধরে বলবে, আজ আর নয়, এইবার শুতে হবে। ফিনফিনে নীল মশারির মধ্যে তিনি ধ্যানস্থ। হবেন। ঝকঝকে গেলাসে জল এগিয়ে দেবে জবা। গুড নাইট।
আমার জ্বরের বিকারে মহাজীবন অরণ্যে একটা মায়ামৃগের পেছনে সুপ্ত ইচ্ছার ধনুর্বাণ নিয়ে। ছুটতে লাগলুম। কত কী দেখছি জীবনের শেষ পাতায় এসে। জবা কালো চুলে ঘষে ঘষে তেল মাখছে। দু’হাতের বাড়তি তেল মুখে মাখতে মাখতে আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। গায়ে জামা নেই। শাড়ির আঁচল। মেয়েরা তেল মাখলে ভীষণ ভাল দেখায়। তেলের মিষ্টি লেবুলেবু গন্ধ। জবা আমাকে বলছে, উনুনে ডাল চাপানো আছে। আমি ঝট করে চানটা করে আসি। তুমি একটু নজর রেখো। এসে বাবাকে চা করে দিচ্ছি। রান্নাঘরটা হবে বাইরে বাগানের একপাশে। বাথরুমে জল। পড়ার শব্দ। বাঁধানো নর্দমা দিয়ে ভেসে ভেসে যাবে সাবানের ফেনা। জবার মসৃণ বুক-পিঠ-তলপেট বেয়ে ফুলের মতো নেমে এসেছে গোলাপ, চামেলি। সব যেন ধন্য ধন্য রবে ছুটে চলেছে। ভীষণ একটা সুখের দৃশ্য। স্বাস্থ্য নিয়ে বেঁচে থাকার সুস্থ দৃশ্য।
দিনের শেষ আলোটুকু সরে গেল। কেউ নেই। জবা গেছে প্রেসক্রিপশন নিয়ে ওষুধ আনতে। কোনওরকমে উঠলুম। আলোটা জ্বালতে হবে। এক একবার পা ফেলছি, গোটা মুখ ঝনঝন করে উঠছে, জল-ভরতি হটব্যাগের মতো। আয়নার সামনে দাঁড়াবার সাহস হল না। হয়তো নিজের। বদল ঘটোৎকচ ভেসে উঠবে। ভাল দেখতেও পাচ্ছি না। চোখ ঢেকে গেছে। আবার এসে শুয়ে পড়লাম। একটা মাথার চুলের কাটা পড়ে আছে। ভঙ্গিটা দু’পা ছড়ানো মৃত সৈনিকের মতো। জবার চুল থেকে খুলে পড়েছে। আলোটাকে মনে হচ্ছে থলথলে মাছের পিত্ত।
কখন কী হল! ঘর ভরে গেছে। অনেকে এসেছেন। টিপ, টিপের মা, জবা। বিষ্টুদার গলাও পেলুম একবার। ঠোঁটটা সাবধানে ফঁক করিয়ে জবা কিছু পাউডার ঢেলে দিল মুখে। কোথা থেকে একটা ফিডিং কাপ এনেছে। ফলের রসের মতো কী একটা চলে গেল ভেতরে। কপালে কার নিশ্বাস পড়ল। টিপের। আমাকে ঘিরে মহা কাণ্ড চলেছে। সকলেই এসেছেন আমাকে বিদায় জানাতে। জাহাজ কখন বন্দর ছাড়ে!
একে একে পায়ের শব্দ নেমে গেল সিঁড়ি দিয়ে। ঘরে আবার বাতাস খেলল। শুধু জবা ফুলের মতো ঝুঁকে আছে আমার দিকে। মনে হল চোখদুটো ছলছল করছে। অতি কষ্টে বললুম, তুমি এইবার বাড়ি যাও।
আর তুমি? টসটস করে কয়েক ফোঁটা জল পড়ল আমার বুকে।