১১ই জুন ১৯৬৬ ॥ শনিবার
জেলার সাহেবকে খবর দিলাম, আমি দেখা করতে চাই। তিনি খবর পাঠালেন নিজেই আসবেন দেখা করতে। তিনিও শুনেছেন মায়ের অবস্থা ভাল না। বাইরে বসে দেখতে লাগলাম, একটা মোরগ একটা মুরগি আর একটা বাচ্চা মুরগি আপন মনে ঘুরে ঘুরে পোকা খেতেছে। আমার বাবুর্চি খাবার থেকে কোনোমতে কিছু কিছু বাঁচাইয়া এই কয়টা মুরগি জোগাড় করেছে। ছোট ছোট যে মাঠগুলি পড়েছিল আমার ওয়ার্ডে সেগুলিতে দূর্বা ঘাস লাগাইয়া দিয়াছিলাম। এখন সমস্ত মাঠটি সবুজ হয়ে উঠেছে। বৃষ্টি পেয়ে তাড়াতাড়ি বেড়ে চলেছে। দেখতে বড় সুন্দর হয়েছে জায়গাটি। এরই মধ্যে ঘুরে ঘুরে বেড়ায় মুরগিগুলি। অনেকক্ষণ বসে রইলাম। ফুলের গাছ চারদিকে লাগাইয়াছিলাম, নতুন পাতা ছাড়তে শুরু করেছে। বড় চমকার লাগছে। আজকে সূর্যের জোর নাই, বেশ মেঘলা দিন। খুবই বাতাস বইছে। ঘরে ফিরে এসে বসলাম। দেখি কম্পাউন্ডার সাহেব আসছেন। বহুদিন দেখা হয় নাই। সিভিল সার্জন সাহেব জেল ভিজিট করেন সপ্তাহে দুইবার। কিন্তু দুই সপ্তাহ আমাকে দেখতে আসেন নাই। বোধ হয় আজ আসবেন। আধা ঘণ্টা পরে জেলের ডাক্তার সাহেবদের সাথে নিয়ে আমাকে দেখতে আসলেন। চিন্তা করে শরীর খারাপ করতে নিষেধ করলেন। খোদার রহমতে মা ভাল হয়ে যাবেন তাহাও বললেন। খুব খোদাভক্ত লোক। এই বয়সে হজ্ব করেও এসেছেন। দেরি করতে পারেন না, অনেক কাজ। কাজ নাই শুধু আমাদের মতো বিনা বিচারে বন্দি হতভাগাদের!
আমি আবার বই নিয়ে শুয়ে পড়লাম। কাজতো একটাই। আমি তো একা থাকি। আমাকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে। একাই থাকতে হবে। জেলার সাহেব সিকিউরিটি ব্রাঞ্চের ডিপুটি জেলার সাহেবকে নিয়ে আসলেন। বসতে দিয়ে বললাম, আপনার অনেক কাজ, বহু লোককে রাস্তা থেকে ধরে এনে জেল দিয়েছে—তাদের বন্দোবস্ত করা, তবু কষ্ট দিতে বাধ্য হলাম। বললাম, ‘আমাকে কেন একলা রাখা হয়েছে? আমার সহকর্মীদের কেন কনডেম সেলের মধ্যে রেখেছেন? তাদের মাত্র দেড়টাকা দেওয়া হয়েছে খাবার জন্য। অন্যান্য ডিপিআর ও রাজবন্দিদের এক জায়গায় রাখতে পারেন। তারা দেখাশোনা করে নিজের পাকের বন্দোবস্ত করতে পারে। ২৬ সেলে পুরানা সিকিউরিটি আছে। তারা এক জায়গায় আছে, তাদের পাকের বন্দোবস্ত তারাই করে। তাদের সামনেই পাক হয়। ডিপিআরদের এক এবং দুই নং ওয়ার্ডে রেখেছেন। তারা এক সাথে তাদের পাকের বন্দোবস্ত করে থাকে এবং তাদের সামনেই পাক হয়। ডিভিশন পাওয়া কয়েদিরা এক জায়গায় থাকে, তাদেরও আলাদা পাক হয়। আমি একলা থাকি, আমার সামনেই পাক হয়। আমার সহকর্মীরা কি অন্যায় করেছে, কেউ কি জেলের আইন ভেঙেছে যে এক জায়গায় থাকতে পারেন না, আর একসাথে পাক হতে পারে না? এদের কাউকে ডিভিশন দেওয়া হয় নাই। এক সাথে মিলেমিশে খাওয়া-দাওয়ার বন্দোবস্ত করলে আপনাদের কি ক্ষতি হয়? আমার মনের অবস্থাও খারাপ, মা অসুস্থ। অনেক লোক গুলি খেয়ে মারা গেছে। বহুলোককে গ্রেপ্তার করে আনা হয়েছে। আমি এই অবস্থায় একলা থাকলে শরীর ভেঙে পড়বে। তার একই উত্তর, তাদের হাতে কিছুই নাই। উপর থেকে যা হুকুম আসে তাদের তাই করতে হয়। অন্য কোনো রাজবন্দিদের বা ডিপিআরদের বেলায় বোধ হয় উপরের হুকুম আসে না-কোথায় কাকে রাখতে হবে। শুধু কি আওয়ামী লীগারদের বেলায় এই অন্যায় ব্যবস্থা! তিনি বললেন জেলের ডিআইজি সাহেবকে তিনি বলবেন। তিনি কিছু করতে পারেন না, তার হাতে কিছুই নাই।
তাদের মুখের ভাব দেখে বুঝলাম সত্যই তাদের হাতে কিছুই নাই। কয়েদিদের কোথায় রাখা হবে জেল কর্তৃপক্ষ জানেন না। তবে দায়িত্ব। তাদের। কোনো কিছু গোলমাল হলে এরাই আবার দায়ী হবে।
জেলার সাহেব ও ডিপুটি জেলার সাহেব চলে গেলেন। আমি গোসল করে খেতে বসেছি, দেখি ইলিশ মাছ, নারিকেল দিয়ে পাক করেছে। জিজ্ঞাসা করলাম এটা আবার কি? এ তো কোনোদিন খাই নাই, এ আবার কেমন? বাবুর্চি বললো, একজন বলেছিল তাই পাকালাম। বললাম আমিতো এখানেই ছিলাম। জিজ্ঞাসা করলেই ভাল হতো। যাহা হউক, কিছু খেয়ে কাগজ নিয়ে শুয়ে পড়লাম। কাগজ পড়তে পড়তে ঘুম আসে, কিন্তু ঘুমাতে চাই না। দিনে ঘুমালে রাতে তা হলে আর ঘুমাতে পারব না।
সর্বনাশ! ট্রেন দুর্ঘটনায় বহুলোক মারা গেছে। অনেক জখম হয়েছে। এখনও পুরা খবর পাওয়া যায় নাই। দুর্ঘটনা কুমিল্লা জেলার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কাছে হয়েছে। ব্রিটিশ আমলের লাইন। সেখানে একটু খারাপ হলে মেরামত করা হয়। পুরাপুরি এর একটা মেরামত হওয়া প্রয়োজন। কে খেয়াল করে! পূর্ব বাংলার রেলওয়ের দুরবস্থা আমার খুব জানা আছে। ট্রেনে চড়ে বহু ভ্রমণ আমি করেছি। দুই চারটি নতুন ট্রেন ছাড়া আর সকলগুলিই ব্রিটিশ আমলের। এমন কোনো ট্রেন নাই যাতে বৃষ্টি নামলে পানি পড়ে না। তবে পানি যখন ট্রেনে পাওয়া যায় না, তখন খোদার পানি পড়তেই বা আপত্তি কি! কিছুদিন পূর্বে যখন আমাকে সিলেট থেকে গ্রেপ্তার করে ময়মনসিংহ নেওয়া হয় তখন এক ফার্স্ট ক্লাসে আমি ছিলাম, দুই পুলিশ ইন্সপেক্টারও ছিলেন। হঠাৎ বৃষ্টি হলো, আমরা অনেক কষ্টে আত্মরক্ষা করার চেষ্টা করলাম, কিন্তু সমস্ত কামরাটি ভিজে গেল। বললাম চলুন অন্য ঘরে যাওয়া যাক। তারাও আমার সাথে পাশের ঘরে এসে আশ্রয় নিল। সেখানেও পানি পড়ে, তবে একটু অল্প পরিমাণে। খাবার পানি তো কোনো ট্রেনেই পাওয়া যায় না। পায়খানা প্রস্রাব করার পানিও অনেক সময় থাকে না। কোন মন্ত্রী যেন বলেছেন ‘সাবোটাস’! ঠিকই বলেছেন, সাবোটাস তো নিশ্চয়ই, কারণ কেন্দ্রীয় সরকারই ‘সাবোটাস’ করেছে দীর্ঘ ১৭ বত্সর!
ভারতবর্ষ যখন ভাগ হয় এবং পাকিস্তান রাষ্ট্র যখন কায়েম হয় তখন রেলওয়ের ক্ষতিপূরণ পাওয়া গিয়েছিল সংখ্যানুপাতে। পূর্ব বাংলা টাকা বেশি পেয়েছিল ভাগে। দুঃখের বিষয়, যতদূর পশ্চিম পাকিস্তান রেলওয়ের উন্নতি হওয়া প্রয়োজন ছিল তাহা করে নিয়ে পূর্ব বাংলার রেলওয়ে আলাদা করে প্রদেশের হাতে দেওয়া হলো। সেই পরিমাণ ক্ষতিপূরণ কি দেওয়া হয়েছে? ভাল ভাল ইঞ্জিন ও বগিগুলি পূর্ব বাংলা থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে নেওয়া হয়। কতগুলি নিয়েছে তার হিসাব কি তারা দিয়েছে? আজ পর্যন্ত চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা পর্যন্ত একটি ডাবল লাইন করা হয় নাই।
পশ্চিম পাকিস্তানে যেয়ে দেখুন কত বাহার। বিরোধী দল ও স্বতন্ত্রদল পূর্ব বাংলার আইন পরিষদের কক্ষ ত্যাগ করেছেন রেল দুর্ঘটনার মুলতবি প্রস্তাব অবৈধ ঘোষণার প্রতিবাদে। মুলতবি প্রস্তাব করে কেন এরা! বলবে, ডিবেট করবে, চলে আসবে। মাহিনা ও পাসগুলি থাকলেই তো চলে! চমৎকার আইন সভা! দুনিয়ায় এর নজির নাই।
এ তো মৌলিক গণতন্ত্র, এর সৃষ্টিকর্তা জনাব আইয়ুব খান। নিজকে পাকাপাকিভাবে ক্ষমতায় রাখার ব্যবস্থা। জনগণের কি প্রয়োজন এতে? মৌলিক গণতন্ত্রী আছে, টাকা আছে, সরকারি কর্মচারী আছে। আইয়ুব সাহেব আছেন ক্ষমতার শীর্ষে আর তার দুই ছোট লাট মোনায়েম খান সাহেব আর পশ্চিম পাকিস্তানে কালাবাগের খান সাহেব তো আছেন। চিন্তা কি?
সিলেটে ভয়াবহ বন্যায় বহু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, আবার অনেক জায়গায় ঝড়েও যথেষ্ট মানুষ মারা গেছে ও ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়েছে। জানি না সরকারি সাহায্য কত পরিমাণ পৌঁছাবে। সরকারি সাহায্যের নমুনা আমার জানা আছে, কারণ কক্সবাজারে ধ্বংসলীলা আমি দেখে এসেছি।
বিকালে হাসপাতালের দিকে চেয়ে দেখতে পাই শাহাবুদ্দিন চৌধুরী আমার দিকে চেয়ে আছেন। তাঁকে সালাম দিলাম এবং তাড়াতাড়ি সুস্থ হউন এই কামনা করলাম। বহুদূর, কথা বললে শুনবে না, আর বলাও উচিত নয়, আইনে বাধা আছে। দেখি বাদশা মিয়া (বাবু বাজারের) আমাকে সালাম দিচ্ছে। বেচারা জেল খাটতে খাটতে শেষ হয়ে গেল। তার শক্তি ও টাকাই তার কাল। বাদশা মিয়ার পিছনে দাঁড়াইয়া অনেকে আমাকে পিঠ দেখাল কেমন করে পুলিশ অত্যাচার করেছে। অনেকের মাথায় ব্যান্ডেজ, আহত হয়ে হাসপাতালে আছে। শুনলাম প্রায় ৪০/৫০ জন হাসপাতালে আছে। ক্ষোভে দুঃখে মনে মনে বললাম, মার খাও। তোমাদের জাত ভাইয়ের লাঠির বাড়ি ও বন্দুকের গুলি খাও। জেল জুলুম তোমাদের কপালে আছে। কারণ তোমরা তো পরাধীন বাঙালি জাতি। পরাধীন জাতের কপালে এমন লাঞ্ছনা ও বঞ্চনা হয়েই থাকে। এতে আর নতুনত্ব কি?
লেখাপড়া করতে ইচ্ছা হয় না। সময়ও কাটে না, জেলে রাতটাই বেশি কষ্টের। আবার যারা আমার মতো একাকী নির্জন স্থানে থাকতে বাধ্য হয়-যাকে ইংরেজিতে বলে ‘Solitary Confinement’—তাদের অবস্থা কল্পনা করা যায় না।
১২ই জুন ১৯৬৬ ॥ রবিবার
সকালে যখন হাঁটাহাঁটি করতেছিলাম তখন শুনলাম ৮২জন ছেলে জুন গ্রেপ্তার করেছে তাদের দুইটি ব্লকে রাখা হয়েছে। সর্বমোট ৮টা ছোট ছোট সেল, চার হাত চওড়া আট হাত লম্বা। দুই নম্বর ব্লক খালি করে খুব ভোরে একজনকে এনে রাখা হয়েছে। নাম আবদুল মান্নান। ভাবতে লাগলাম কোন মান্নান? জিজ্ঞাসা করলাম, চটকল শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক কি না, কেউ বলতে পারল না। কোন ধারায় গ্রেপ্তার করেছে, বলল ডিপিআর না। খোঁজ নিয়ে জানলাম মামলা দিয়েছে নারায়ণগঞ্জ, তাতেই তাকে গ্রেপ্তার করেছে। ডিভিশন দেয় নাই। এক কাপড়ে এসেছে। জুতা খুলে রেখেছে গেটে। গামছা নাই, কাপড় নাই, কোনো জামা নাই, যে জামাটি গায়ে দিয়ে এসেছে তা ছাড়া। আমি তাড়াতাড়ি কিছু কাপড়চোপড় পাঠাইয়া দিলাম যাতে আপাতত চলতে পারে। ভাত নিতে যখন সেল থেকে বের হলো আমি দাঁড়িয়েছিলাম ওকে দেখতে। দেখলাম সত্যিই শ্রমিক নেতা মান্নান। তাকে বললাম, ‘চিন্তা করিও না, জামিনের চেষ্টা করতে হবে।’
কিছুই তো আমার ভাল লাগছে না। মায়ের খবর না পাওয়া পর্যন্ত মনকে সান্ত্বনা দিতে পারছি না। বাগানের কাজে হাত দিলাম। আবার ঘরে ফিরে এলাম। গতকালের কাগজগুলি আবার ভাল করে দেখতে লাগলাম। অর্থমন্ত্রী শোয়েব সাহেব ১৯৬৬-৬৭ সালের বাজেট পেশ করেছেন। রাজস্ব খাতে আয় ধরা হইয়াছে ৫৬৩ কোটি ৫৬ লক্ষ টাকা। ব্যয় হইবে ৩৭২ কোটি ১০ লক্ষ টাকা। ১২৭ কোটি ৭৮ লক্ষ টাকা প্রদেশের ভাগে যাবে। রাজস্ব খাতে ৬৩ কোটি ৬৮ লক্ষ টাকা উদ্বৃত্ত থাকবে। উন্নয়ন খাতে আর্থিক বৎসরে ৪৪২ কোটি ৭৩ লক্ষ টাকা আয় হইয়াছে, ব্যয় বরাদ্দ হইয়াছে ৪৭৯ কোটি ২৯ লক্ষ টাকা। উন্নয়ন খাতে ৩৬ কোটি ৫৬ লক্ষ টাকা ঘাটতি পড়িবে। নূতন কর বসাইয়াছে তাহাতে ৩৭ কোটি ১৫ লক্ষ টাকা আদায় হইবে। কেরোসিন, লবণ, সাবান অন্যান্য জিনিসের উপর কর ধার্য হয়েছে। ডাক মাশুলও বাড়াইয়াছে। দেশরক্ষা খাতে ২২৫ কোটি টাকা ব্যয় বরাদ্দ ধরা হইয়াছে। ১৯৬৫-৬৬ সালে ১৩৬ কোটি টাকা ছিল। যে কর ধার্য করা হইয়াছে তাহার সবটাই গরিবকে দিতে হইবে। শোয়েব সাহেব যে অর্থনীতি চাল করিয়াছেন তাহাতে গরিবকে আরও গরিব করিয়া কয়েকজন বড় লোক ও শিল্পপতিকে সুযোগ-সুবিধা করিয়া দিবার ষড়যন্ত্রই কায়েম হইবে।
সরকার ক্রমাগত কর ধার্য করিয়া জনসাধারণের দুঃখ দুর্দশা বাড়াইয়া চলিয়াছেন। শোয়েব সাহেব অর্থনীতিতে একচেটিয়া পুঁজিপতিদের স্বার্থ রক্ষা করিয়া চলিয়াছেন। তার বাজেটে এই শিল্পপতিদের ১৯৭০ সাল পর্যন্ত ট্যাক্স হলিডে’ ভোগের ব্যবস্থা রাখিয়াছেন। কিন্তু গরিব জনসাধারণ বোধ হয় আর আলো জ্বালাইয়া রাতের খাবার খেতে পারবে না। খাবার জন্য কিছুই থাকবেও না। দেশ রক্ষা খাতে যে শতকরা ৬৫ ভাগ ব্যয় করা হবে এর মধ্যে পূর্ব বাংলা কতটুকু পাবে? ৫/১০ ভাগ এর বেশি নিশ্চয়ই না।
দেখেই খুশি হলাম যে আমি ও আমার সহকর্মীরা অনেকেই জেলে আটক থাকা অবস্থায়ও আওয়ামী লীগ নেতা ও কর্মীরা শান্তিপূর্ণ গণআন্দোলন চালাইয়া যাওয়ার সঙ্কল্প করিয়াছে। রক্ত এরা বৃথা যেতে দিবে না। সৈয়দ নজরুল ইসলাম এক্টিং সভাপতি, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের। তাঁর সভাপতিত্বে ১১ ঘন্টা ওয়ার্কিং কমিটির সভা হয়েছে। মিজানুর রহমান চৌধুরী জাতীয় পরিষদে যোগদান করতে পিন্ডি চলে গেছে। ১৭ই, ১৮ই, ১৯শে জুন ‘জুলুম প্রতিরোধ দিবস উদ্যাপন করার আহ্বান জানাইয়াছে আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটি ১৬ই আগস্টের পূর্বে সমস্ত গণবিরোধী ব্যবস্থার অবসান দাবি করিয়াছে। তা না করিলে ১৬ই আগস্ট থেকে জাতীয় পর্যায়ে গণআন্দোলন শুরু করা হবে। মনে মনে ভাবলাম আর কেউ আন্দোলন নষ্ট করতে পারবে না। দাবি আদায় হবেই।
৬ দফার বাস্তবায়নের সংগ্রাম আওয়ামী লীগ অব্যাহত রাখবে তাও ঘোষণা করেছে। এখন আর আমার জেল খাটতে আপত্তি নাই, কারণ আন্দোলন চলবে।
ভাবতে লাগলাম কর্মীদের টাকার অভাব হবে। পার্টি ফান্ডে টাকা নাই। আমিও বন্দোবস্ত করে দিয়ে আসতে পারি নাই। মাসে যে টাকা আদায় হয় তাতে অফিসের খরচটি চলে যেতে পারে। তবে আমার বিশ্বাস আছে, অর্থের জন্য কাজ বন্ধ হয়ে থাকে না। জনসমর্থন যখন আওয়ামী লীগের আছে, জনগণের প্রাণও আছে। আমি দেখেছি এক টাকা থেকে হাজার টাকা অফিসে এসে দিয়ে গিয়াছে, যাদের কোনো দিন আমি দেখি নাই। বোধ হয় অনেককে দেখবোও না। ভরসা আমার আছে, জনগণের সমর্থন এবং ভালবাসা দুইই আছে আমাদের জন্য। তাই আন্দোলন ও পার্টির কাজ চলবে।
সন্ধ্যার একটু পূর্বে বরিশাল থেকে বাবু চিত্ত সুতারকে নিয়ে এসেছে। আমার সামনেই বিশ সেলের ৫নং ব্লকে রেখেছে। এখানে পাবনার রণেশ মৈত্রও থাকেন। পরীক্ষা দিতে এসেছেন। দুইজন এক সাথেই থাকবে। ইনি এমপি ছিলেন, খুব নিঃস্বার্থ কর্মী। তাঁকেও ডিভিশন দেওয়া হয় নাই। তার কাছ থেকে খবর পেলাম আমার ভগ্নিপতির সাথে জাহাজে দেখা হয়েছে, আমার মা অনেকটা ভাল। মনে একটু শান্তি পেলাম।
চিত্তবাবু বললেন, অন্যান্য দল ভুল করেছে আওয়ামী লীগের ডাকে সাড়া না দিয়ে। আর আলাপ হতে পারল না। কারণ আমি রাস্তায় ছিলাম তাই একটু কথা হলো। তারপর তারা যার যার ব্লকে চলে গেল। আমি আমার ব্লকে একা, একেবারে একা। কথা বলারও লোক নাই, কয়েকজন সাধারণ কয়েদি ছাড়া। ডাক পড়েছে, বুড়া জমাদার সাহেব বন্ধ করতে এসেছেন। হ্যারিকেন জ্বালিয়ে কাগজ কলম নিয়ে আমার লেখার কাজে বসে পড়লাম।
১৩ই জুন ১৯৬৬ ॥ সোমবার
আজকাল খুব ভোরেই ঘুম থেকে উঠি। স্বাস্থ্য রক্ষা করারও চেষ্টা করি। বাইরে বসার জায়গায় যখনই বসেছি দেখি ইউনুস এসে হাজির। ঝাড় দেওয়ার কাজ করে। ইউনুসের বিশ বছরের সাজা হয়েছে। খুনের মামলা। সে বলে কিছুই জানি না। এর বেশি কিছু গোছাইয়া বলতে পারে না। আমাকে এসে ধরেছে, একটা কলম মাইরা দেন না, আমি খালাস হয়ে যাই। আপনি সইটা দিলেই হয়। রোজই দুই একবার একই কথা বলে থাকে। আজ আর ছাড়ছেই না। জমাদার, সিপাহি যেই আসে তারা ওকে বলে, সাহেবকে ভাল করে ধর, তা হলেই খালাস। জমাদার সিপাহিদের সে অনুরোধ করে গেটটা খুলে দিতে। তাহারা এখন মজা করে আমাকে দেখাইয়া দেয়। এক জমাদার সাহেব খুব রসিক মানুষ। বলে, ‘খালিখালি কি কাজ হয় পাকিস্তানে? কিছু খরচ টরচ করো। ইউনুসের কয়েক টাকা জমা আছে। মেট, পাহারা সকলকে বলে কিছু বাজার আনাইয়া দিতে। দুই টাকার বাজার, সিগারেট যে এনে দিবে তাকে আধা দিবে। বাকিটা আমাকে ও জমাদার সাহেবকে খাওয়াবে। সকলেই ওকে নিয়ে খেলা করে। আজ সত্য সত্যই সে বাজার আনতে গেটে রওয়ানা হয়েছে। অফিসে জমা টাকা থেকে সিগারেট, বিড়ি কিনে দেয়। এখন আর বিড়ি না, সকলে সিগারেট বা তামাক খায়।
আমি বললাম, ইউনুস কোথায় যাও?’ বলে বাজার আনতে যাই, স্যার। আমি রাগ করে বললাম, যদি বাজার আনো তবে আর আমি কলম মারব না। সে চুপ করে দাঁড়াইয়া রইল। না বাজার সে আনবে না, যদিও সিপাহি ও কয়েদিরা বলছে। কি করে ওকে বোঝাই আমার কলম যে ভোলা হয়ে গেছে। এ কলমে যে আজ আর কাজ হয় না। আমিও যে একজন ওরই মতো বন্দি সেটা আমি শত চেষ্টা করেও বোঝাতে পারি না। সকলেই ওকে নিয়ে তামাশা করে। ও যে একেবারে পাগল হয়ে যেতে পারে তাহা আমি সকলকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম। এখন এমন অবস্থা হয়েছে, কেউ কিছু না বললেও, সে আমার কাছে চলে আসে, আর ঐ একই কথা।
খবরের কাগজ এসেছে, আমিও এরমধ্যে খেয়ে নিয়েছি। সিলেটের বন্যায় দেড়লক্ষ লোক গৃহহীন। ১০ জন মারা গেছে। কত যে গবাদি পশু ভাসাইয়া নিয়া গেছে তার কি কোনো সীমা আছে! কি করে এদেশের লোক বাঁচবে তা ভাবতেও পারি না। তার উপর আবার করের বোঝা।
ডক্টর নূরুল হুদা সাহেব পূর্ব পাকিস্তানের বাজেট পেশ করেছেন। এক কোটি ১৬ লক্ষ টাকা নূতন কর ধার্য করেছেন। রাজস্ব খাতে আয় দেখাইয়াছেন ১১৮ কোটি ২৭ লক্ষ আর ব্যয় দেখাইয়াছেন ৯৮ কোটি ২৮ লক্ষ টাকা। উদ্বৃত্ত ১৯ কোটি ৯৯ লক্ষ টাকা। উন্নয়ন খাতে ব্যয় বরাদ্দ করেছেন ২৩০ কোটি, প্রাপ্ত সম্পদ ২০৪ কোটি ৬৯ লক্ষ টাকা। মোট ঘাটতি ২৫ কোটি ৩১ লক্ষ টাকা।
কত কর মানুষ দিবে! কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী শোয়েব সাহেব বলেছেন, জনসাধারণ অধিকতর সচ্ছল হইয়াছে তাই কর ধার্য করেছেন। তিনি যাদের মুখপাত্র এবং যাদের স্বার্থে কাজ করেছেন তারা সচ্ছল হয়েছেন। তাদের করের বোঝা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। শিল্পপতি ও বড় ব্যবসায়ীরা আনন্দিতই শুধু হন নাই, প্রকাশ্যে মন্ত্রীকে মোবারকবাদ দিয়ে চলেছেন। আর জনসাধারণ এই গণবিরোধী বাজেট যে গরিব মারার বাজেট বলে চিৎকার করতে শুরু করেছে।
পাকিস্তান নাকি ইন্দোনেশিয়াকে চৌদ্দ কোটি টাকা ঋণ দিতে রাজি হয়েছে। যে সরকার ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে দুনিয়া ভর ঘুরে বেড়াচ্ছে, আমেরিকা সাহায্য না দিলে যারা বাজেট পেশ করতে পারে না, দিন দিন জনগণের উপর করের বোঝা চাপাইয়া অতিষ্ঠ করে তুলেছে, তারা আবার ঋণ দিতে রাজি! এভাবেই আমরা ইসলামের খেদমত করছি! কারণ না খেয়ে অন্যকে খাওয়ানো তো ইসলামের হুকুম। দয়ার মন আমাদের। এমন প্রেম ভালবাসা-ই তো আমাদের নীতি হওয়া উচিত! কাপড় যদি কারও না থাকে তাকে কাপড়খানা খুলে দিয়ে রাস্তা দিয়ে হেঁটে বাড়ি চলে আসবা। আমাদের সরকারের অবস্থাও তাই।
মা আরোগ্যের দিকে যেতেছে। ছোট ভাই নাসের তাকে খুলনায় নিয়ে এসেছে চিকিৎসার জন্য। মনটা আমার একটু ভাল। বিকালে আবার পূর্বের মতো প্রায় এক ঘণ্টা জোরে জোরে হাঁটাহাঁটি করি। আমার বাঁচতে হবে, অনেক কাজ বাকি রয়েছে।
একটু গরম কম পড়েছে, রাতে ঘুম হয় আজকাল বেশ।
১৪ই জুন ১৯৬৬ ॥ মঙ্গলবার
ভোরের দিকে বৃষ্টি হতেছিল। তাড়াতাড়ি উঠেছি জানলা বন্ধ করতে। বিছানা ভিজে যাবে। উঠে দেখি মেট উঠে জানালা বন্ধ করেছে। আমি আবার শুয়ে পড়লাম, বিজলি পাখা বন্ধ করতে বললাম, কারণ বেশ একটু ঠান্ডা পড়েছে। আবার ঘুমাইয়া পড়লাম, উঠতে অনেক দেরি হয়ে গেল। উঠেই দেখি চা প্রস্তুত। খেয়ে বাইরে হাঁটতে বেরুলাম। মুরগিটা অসুস্থ হয়ে পড়েছে, তাকে যেন কি কি ওষুধ খাইয়েছে বাবুর্চি। বলল, একটু ভাল। আমাকে বলল, মোরগটা জবাই দিয়ে ফেলি। বললাম, না, দরকার নাই। ও বেশ বাগান দিয়ে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায়। ওর চলাফেরার ভঙ্গিমা দেখে আমার ভাল লাগে।
আজ থেকে হাইকোর্টে আমার হেবিয়াস কর্পাস মামলার শুনানি হবে। কি হবে জানি না। অন্যায়ভাবে আমাকে গ্রেপ্তার করেছে, ডিপিআরএ গ্রেপ্তার চলেছে। ঘাটাইল আওয়ামী লীগ অর্গানাইজিং সেক্রেটারি মোহাম্মদ আলি মোক্তারকে গ্রেপ্তার করে ময়মনসিংহ জেলে পাঠাইয়াছে।
Rawle Knox (Daily Telegraph, June ৭, ১৯৬৬) East Pakistan’s Case’ এই নামে একটি প্রবন্ধ লিখেছেন। তাঁর ব্যক্তিগত মতামত। কাগজ যে কোনো মতামত দিতে পারে তাতে আমার কিছুই বলা উচিত না। তবে পূর্ব পাকিস্তানের উপর জুলুমের খবর আজ আর ছাপে নাই। ৬ দফা দাবি পেশ করার সাথে সাথে দুনিয়া জানতে পেরেছে বাঙালিদের আঘাত কোথায়? বাঙালিদের রাজনৈতিক স্বাধীনতা, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আত্মপ্রকাশের স্বাধীনতা এমনকি ব্যক্তিগত স্বাধীনতা কিছুই নাই। ১৯ বৎসর পর্যন্ত চলেছে শোষণ আর লুণ্ঠন। এখন এরা বুঝে ফেলেছে এদের জুলুম করার কায়দা কৌশল। তবে আর বেশি দিন নাই। যদিও জাতি হিসেবে বাঙালি পরশ্রীকাতর জাতি। পরশ্রীকাতরতা দুনিয়ার কোনো ভাষায় খুঁজিয়া পাওয়া যাবে না, একমাত্র বাংলা ভাষা ছাড়া। এটি আমাদের চরিত্রের সাথে ওতপ্রোতভাবে মিশে আছে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও ব্রিটিশ সরকার যেভাবে বাংলাকে শোষণ করেছিল তার চেয়েও উলঙ্গভাবে পশ্চিম পাকিস্তানি কলোনিয়াল শোষকরা পূর্ব বাংলাকে শোষণ করছে। ইংরেজদের শাসনের সময়ও ইংরেজকে সাহায্য করবার জন্য বাঙালির অভাব হয় নাই। আজও হবে না। তবে যারা ত্যাগ করতে পেরেছে—ত্যাগ করে যাক, দুঃখ ও আফসোস করার কোনো দরকার নাই। সাংবাদিক Rawle Knox একটি সত্য কথা লিখেছেন, ‘If Rawalpindi continues to belive that the revolutionary spirit of Bengal is something of a joke, the Pakistani capital could be making quite a mistake.’
পাকিস্তানের মঙ্গলের জন্য আমারও মনে হয় ৬ দফা দাবি মেনে নেওয়া উচিত শাসকগোষ্ঠীর বিশেষ করে আইয়ুব খান ও তার অনুসারীদের। তা না হলে পরিণতি ভয়াবহ হওয়ার সম্ভাবনা আছে। বাঙালির একটি গো আছে, যে জিনিস একবার বুঝতে পারে তার জন্য হাসিমুখে মৃত্যুবরণও করতে পারে। পূর্ব বাংলার বাঙালি এটা বুঝতে পেরেছে যে এদের শোষণ করা হতেছে চারদিক দিয়ে। শুধু রাজনৈতিক দিক দিয়েই নয়, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দিক দিয়াও।
আমি বিকালে সেলের বাইরে বসে আছি। কয়েকজন ছোট ছোট বালক জামিন পেয়ে বাইরে যেতেছে। খুব তাড়াতাড়ি হাঁটছে, মনে হয় যেতে পারলেই বাঁচে; থাকতে আর চায় না, এই পাষাণ-কারার ভিতরে। আমার কাছে এসে থেমে গেল। বলল, আমরা চললাম স্যার, আপনাকে বাইরে নেওয়ার জন্য আবার আন্দোলন করব।
আমি বললাম, ‘যাও, সকলকে আমার সালাম দিও। আমার জন্য চিন্তা করিও না।’
ওদের দিকে আমি চেয়ে রইলাম। ওদের কথা শুনে আনন্দে আমার বুকটি ভরে গেল। মনে হলো এটা তো আমার কারাগার নয়, শান্তির নীড়। এই দুধের বাচ্চাদের কথা শুনে কিছু সময়ের জন্য আমার দুঃখ ভুলে গেলাম। শক্তি পেলাম মনে। মনে হলো পারব! বহুদিন জেল খাটতে পারব। এরাও যখন এগিয়ে এসেছে দেশের মুক্তির আন্দোলন তখন কে আর রুখতে পারে?
আমি যে একলা থাকি এ কথা কখনও আমার মন থেকে যায় না। এতে আমার শরীর নষ্ট হবার সম্ভাবনা আছে। আমাকে ও আওয়ামী লীগ কর্মীদেরই সরকার বেশি কষ্ট দিতে চায় কারাগারে বন্দি করে।
রাতে আমাকে গল্প শোনাল এক কয়েদি-কি করে ডাকাতি করেছে তাদের দল। ডাকাতি পূর্বে করে নাই। তবে আসামি হওয়ার পরে ধরা না দিয়ে মামলার খরচ যোগাড় করার জন্য তিনটা ডাকাতি করেছে। তবে যে ডাকাতি মামলায় তার জেল হয়েছে তাতে তার কোনো দোষ নাই, কারণ সে ঐ ডাকাতির দলে ছিল না। আরও বলল, “আর ডাকাতি করব না। কোনোমতে যে কয়দিন বেঁচে আছি, ছেলেমেয়ে নিয়ে থাকতে পারলেই হলো। তবে ভয় হয় টাকা দিতে না পারলে অন্য কোনো মামলায় আসামি না হয়ে পড়ি। যাই হোক না কেন, আর ডাকাতি করব না ছেলেমেয়ে নিয়ে সুখে বাস করতে চাই।
১৫ই জুন ১৯৬৬ ॥ বুধবার
আজ আমার ছেলেমেয়েরা আসতেও পারে, কারণ ১৫ দিন হয়ে যায়। আমিও একটা দরখাস্ত করেছি, মায়ের অবস্থা জানবার জন্য তাড়াতাড়ি আমার স্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করতে চাই। অনুমতি না আসা পর্যন্ত তো সঠিক খবর পাব না। চিন্তা না করতে চাইলেও চিন্তা আসে।
আমার বাবুর্চি একটা কবুতরের বাচ্চা পালে। তাকে আদর করে কোলে নিয়ে বেড়াই। এখনও কাপড়ের ছোট্ট থলিয়া বানাইয়া তার ভিতর ভিজা চাউল দিয়ে তারপর একটা ফুটো করে খাবার খাওয়াতে হয়। এখন একটু একটু উড়তে শিখেছে। চুপচাপ কিছু সময় তারপর দেয় ছুট। একেবারে পাকের ঘরের দিকে ছুটলো। মানে আমাকে আর ধরতে হলো না। বাচ্চাটা বাবুর্চিকে দেখলে মনে করে সেই বোধ হয় তার সব কিছু।
আজ বাইরে অনেক সময় বসে রইলাম। অনেক কথা মনে আসে! নানা বিষয়ের অনেক কথা। বরিশালের মি. চিত্তসূতার ও পাবনার রণেশ মৈত্র আমার সামনেই বিশ সেলে আছেন। আগে মাঝে মাঝে দরজা খুলতো, আজ থেকে কড়া হুকুম, দরজা খোলাই হবে না।
কি ভীষণ দুরবস্থা! যদিও ভিতরে সামান্য জায়গা আছে তবুও মন দেখতে চায় বাহিরটাকে। তাই মনের উপর এই ভীষণ অত্যাচার। বন্দি লোকগুলি অন্ধ হয়ে যাবে, না হয় স্বাস্থ্য একবারে ভেঙে যাবে-বাইরে যেয়ে যেন আর কোনো কাজ করতে না পারে-এটাই স্বৈরাচারী সরকারের উদ্দেশ্য। আমি দূর থেকে অনেকক্ষণ দেখলাম, দরজা খোলা হলো না। পরে খবর নিয়ে জানলাম কড়া হুকুম, জমাদার সিপাহির চাকরি থাকবে না। আমার সাথে যেন কোনোমতে কথা না বলতে পারে। কথা তো আমরা বলতেও পারি না। দরজা খুললে দরজার কাছে দাঁড়ালে দূর থেকে একে অন্যকে শুভেচ্ছা জানাতে পারি। এর বেশি তো আর না। আমার অবস্থা হয়েছে, পর্দানসিন জানানা’র মতো, কেউ আমাকে দেখতেও পারবে না, আমিও কাউকে দেখতে পারব না। কেউ কথা বলতে পারবে না, আমিও পারব না।
আমার উপর সরকারের কড়া নজর। জেলের ডি.আই.জি. সাহেবকে বলেছি, জেলের আইন ভঙ্গ করে আমাকে একাকী রেখেছেন। জেল আইনে কাহাকেও বিনা অপরাধে, Solitary Confinement’—রাখার নিয়ম নাই। এটা আইন বিরুদ্ধ, তবুও আপনারা আইন ভঙ্গ করে চলেছেন। উপরের হুকুম’ বলে আপনারা চুপ করে থাকেন। আমাকে হুকুম দেখান, আমি আপত্তি করব না। একাকী থাকবো যত কষ্টই হয়। ডিআইজি সাহেব বললেন, আমি উপরের সাথে আলাপ করে আপনাকে জানাবো। কি হবে সে আমি জানি, তবে পরে আমাকে দোষ দিতে পারবেন না। আমি বিনা প্রতিবাদে অত্যাচার সহ্য করার লোক নই।
সময় কাটছে না, খবরের কাগজ পাঠাতে দেরি করছে। বসে আছি গেটের দিকে চেয়ে, কখন আসে, ১২টা, ১টা, ২টা বেজে গেল-কাগজ এল না। তখন বাধ্য হয়ে ডিউটি জমাদার সাহেবকে বললাম, কি অন্যায়, ২টা বেজে গেল, আর এখনও খবরের কাগজ জেল অফিস থেকে আসছে না। মেহেরবানী করে খবর নেন কাগজ দিবে কি দিবে না? যদি একেবারেই না দেয় সে অন্য কথা। আমরা বুঝতে পারি রাজা বাদশার আমলের বন্দিখানায় আছি। সকাল ৮টা থেকে ৯টার মধ্যে হকাররা কাগজ দিয়ে যায়, আর একটা দস্তখত করে ভিতরে পাঠাতে সময় লাগে পাঁচ ঘণ্টা, ছয় ঘণ্টা। এর কোনো অর্থ বুঝতে আমার সত্যই কষ্ট হয়। ইচ্ছা করলেই ১০টার মধ্যে কাগজ আমাদের দিতে পারে। বন্দির তো কোনো মতামত নাই। আর এদের ইচ্ছা বলেও কোনো পদার্থ নাই। কাগজ দেখে মনে হলো, ১৪ তারিখে আমাদের মামলা শুরু হয় নাই হাইকোর্টে।
ইংল্যান্ড থেকে আমাকে এক তারবার্তা পাঠাইয়াছে ‘প্রবাসী বাঙালীরা সমগ্র বৃটেনে শহীদ দিবস পালন করবে ১৭ ও ১৮ জুন। ব্রিটেনস্থ পাকিস্তানিদের প্রতিষ্ঠান প্রগতি ফ্রন্টের জেনারেল সেক্রেটারি এস এম হোসেন বৃটেনের সকল পাকিস্তানি নাগরিক ও পাকিস্তানি সংস্থাসমূহের প্রতি সাফল্যজনকভাবে শহিদ দিবস উদ্যাপনের দ্বারা অত্যাচারী জালেমশাহীর পাশবিক কার্যকলাপের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জ্ঞাপনের আহ্বান জানান।
তিনি বলেন, বর্তমান সরকারের অত্যাচার, নির্যাতন, শোষণ, দুর্নীতি, অবিচার ও অগণতান্ত্রিক কার্যকলাপের অবসানের জন্য আমাদের সংঘবদ্ধভাবে আওয়াজ তুলিতে হইবে।
এই সংবাদ দৈনিক আজাদ কাগজে ৭ই জুন ৩১ জ্যৈষ্ঠ তারিখে বাহির হয়েছে।
বৃটেনস্থ পাকিস্তানিদের পক্ষ হইতে জনাব হোসেন ও পাকিস্তান সমিতির প্রেসিডেন্ট জনাব আফরোজ বখত দেশ ও জনগণের জন্য সাহসিকতাপূর্ণ সংগ্রাম পরিচালনা ও দুঃখ ভোগের জন্য পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি অভিনন্দন জানাইয়া এক তারবার্তা প্রেরণ করিয়াছেন।
তারবার্তায় তাহারা বলেন, “প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য আপনি যে সংগ্রাম চালাইয়া যাইতেছেন তাহাতে আমাদের সমর্থন রহিয়াছে। এই আন্দোলনকে নৈতিক, আর্থিক ও সামাজিক প্রভৃতি সর্বপ্রকার সাহায্য দানের জন্য আমরা প্রস্তুত রহিয়াছি। আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন যে আমাদের প্রাণদানকারী ভ্রাতাদের রক্তপাত ব্যর্থ যাইবে না। আমরা তাহাদের জন্য ও একই উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য কাজ করিয়া যাইতেছি—জনসাধারণের প্রতি ইহাই আমাদের বাণী।
জাতীয় পরিষদের ভিতর ও বাহিরে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম পরিচালনার উদ্দেশ্যে তারবার্তায় জনাব নূরুল আমীনের প্রতিও অভিনন্দন জ্ঞাপন করা হয়।
তারবার্তায় পূর্ব পাকিস্তানের সাম্প্রতিক রক্তপাতের তীব্র নিন্দা করা হয় এবং বলা হয় যে ইহার ফলে পাকিস্তানের ইতিহাসে সর্বাধিক কলঙ্কময় অধ্যায়ের সৃষ্টি হইল।
তারবার্তায় জাতীয় সংহতির স্বার্থে রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তিদান ও দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানান হয়।
এই তারবার্তা আমার কাছে পৌঁছায় নাই। কারণ আমাকে আইবি ডিপার্টমেন্ট দিবে না। কোনো কাগজপত্র চিঠি বই খাতা যদি আনতে হয় তবে এদের মাধ্যমে আসবে। ইচ্ছা করলে না দিয়াও পারে। বলবার কিছুই নাই। এমনকি স্ত্রীর সাথে বা ছেলেমেয়েদের সাথে দেখা করতে হলে গোয়েন্দা বিভাগের কর্মচারী সামনে বসে থাকবে, কোনো রাজনৈতিক কথা বলি কিনা শুনবে।
যখন প্রবাসী পাকিস্তানিরাও অত্যাচারের প্রতিবাদ করতে শুরু করেছে এবং ন্যায্য দাবি সমর্থন করিতে শুরু করিয়াছে তখন সাফল্যের আর বেশি দিন নাই। বন্ধুদের তারবার্তার উত্তর যখন দিতে পারলাম না, তখন নীরবে তাদের মঙ্গল কামনা করি। আর প্রতিজ্ঞা করি হতভাগা ভাইদের রক্তকে বৃথা যেতে দিব না।
সাড়ে চারটায় জেলের লোক এসে বলল-চলুন আপনার দেখা আসিয়াছে, আপনার স্ত্রী ও ছেলেমেয়ে বসে আছে জেল অফিসে। তাড়াতাড়ি রওয়ানা করলাম। দূর থেকে দেখি রাসেল, রেহানা ও হাচিনা চেয়ে আছে আমার রাস্তার দিকে। ১৮ মাসের রাসেল জেল অফিসে এসে একটুও হাসে না—যে পর্যন্ত আমাকে না দেখে। দেখলাম দূর থেকে পূর্বের মতোই আব্বা আব্বা বলে চিৎকার করছে। জেল গেট দিয়ে একটা মাল বোঝাই ট্রাক ঢুকেছিল। আমি তাই জানালায় দাঁড়াইয়া ওকে আদর করলাম। একটু পরেই ভিতরে যেতেই রাসেল আমার গলা ধরে হেসে দিল। ওরা বলল আমি না আসা পর্যন্ত শুধু জানালার দিকে চেয়ে থাকে, বলে আব্বার বাড়ি’। এখন ওর ধারণা হয়েছে এটা ওর আব্বার বাড়ি। যাবার সময় হলে ওকে ফাঁকি দিতে হয়। ছোট মেয়েটার শুধু একটা আবদার। সে আমার কাছে থাকবে। আর কেমন করে কোথায় থাকি তা দেখবে। সে বলে, থেকে যেতে রাজি আছি। রেণু বলল, মাকে আমার ছোট ভাই খুলনা নিয়ে গেছে। একটু ভালর দিকে। ঢাকা আনা সম্ভব হবে না সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত। হাচিনার কলেজ বন্ধ, তাই খুলনা যেতে চায়। বললাম, যেতে দাও মা’র একটু খেদমত হবে। জামালের শরীর খারাপ, গলা ফুলে রয়েছে। এ বড় খারাপ ব্যারাম। রেণুকে তাই বললাম, ডাক্তার দেখাইও। স্কুলে যেতে পারবে না। এছাড়াও আরো অনেক কথা হলো।
রাশেদ মোশাররফ ঢাকা শহর আওয়ামী লীগের সহ-সম্পাদক। আমার বাড়ির কাছে থাকে। তাহার বিবাহের তারিখ ১২ই জুন ঠিক ছিল, বিবাহের কার্ডও ছাপান হয়েছিল। তাকে গ্রেপ্তার করে জেলে আনা হয়েছে। রেণু দুঃখ করে বলল, সে তো বিবাহ নিয়াই ব্যস্ত ছিল, তাকে যে কেন ধরে এনেছে! এদের গ্রেপ্তারের কোনো তাল নাই। ছোট ছোট দুধের বাচ্চাদের ধরে নিয়ে এসেছে রাস্তা থেকে, রাতভর মা মা করে কাঁদে। একজন মহিলা, এক ভদ্রলোকের বাড়িতে কাজ করে। এরই মাধ্যমে সংসার চালায়, বড় গরিব। তার ছয় বৎসরের ছেলেকে নিয়ে চলেছে সেই বাড়িতে কাজ করতে। গাড়ি থামাইয়া পুলিশ ডাক দেয়, এই ছেলে শোন। ছেলেটি এগিয়ে গেছে, তাকেও গাড়িতে উঠাইয়া নিয়েছে। মহিলাটি চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করেছে। কে কার কথা শোনে! একেবারে জেলে নিয়ে এসেছে। এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে। মোনায়েম খান সাহেবের দৌলতে।
প্রায় এক ঘন্টা রেণু এবং আমার ছেলেমেয়েদের সঙ্গে ছিলাম। সংসারের ছোটখাট আলাপ। ওদের বলেছি আর কোনো কষ্ট নাই; একাকী সঙ্গীবিহীন আছি। মানিক ভাইকে বলতে বললাম, তিনি যেন চীফ সেক্রেটারিকে বলেন কেন এই অত্যাচার? আমার স্ত্রী বলল, মানিক ভাইর সাথে দেখা করব। সাক্ষাতের সময় শেষ হয়ে গেছে আর দেরি করা চলে না। তাই বিদায় দিলাম ওদের। রাসেলকে গাড়ির কথা বলে কামালের কাছে দিয়ে সরে এলাম।
কে বুঝবে আমাদের মতো রাজনৈতিক বন্দিদের বুকের ব্যথা। আমার ছেলেমেয়েদের তো থাকা খাওয়ার চিন্তা করতে হবে না। এমন অনেক লোক আছে যাদের স্ত্রীদের ভিক্ষা করে, পরের বাড়ি খেটে, এমনকি ইজ্জত দিয়েও সংসার চালাতে হয়েছে। জীবনে অনেক রাজবন্দির স্ত্রী বা ছেলেমেয়ের চিঠি পড়ার সুযোগ আমার হয়েছে। সে-করুণ কাহিনী কল্পনা করতেও ভয় হয়।
যারা স্বার্থের জন্য আমাদের বৎসরের পর বৎসর কারাগারে বন্দি করে রেখেছ কিছুদিন যে ক্ষমতায় ছিলাম তখন তাদের কাহাকেও গ্রেপ্তার করে জেলে বন্দি করে রাখি নাই। এমনকি জেলগেটে এসে রাজবন্দিদের মুক্তি দিয়েছিলাম।
এখানকার স্বৈরশাসকদের বি. টীম ও সি. টীম এখন অন্য ভোল্ ধরে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত। তারাই আজ জুলুম করছে আমাদের উপর। যদি কিছুদিনের জন্য জেল দিয়ে সেলের মধ্যে ২৪ ঘণ্টা দরজা বন্ধ করে রেখে একবার লছমি খাবার দিতাম, তবে জীবনেও আর রাজনীতির নাম নিত না। জেল বন্দি করার সাথে বন্ড দিয়া বাহির হয়ে যেত। অথচ এমন অনেক রাজবন্দি এখনও জেলে আছে, যারা প্রায় অন্ধ হয়ে গেছে; হাঁটতে চলতেও পারে না, খেয়ে হজম করতেও পারে না। প্রায় ১৩/১৪ বৎসর—পাকিস্তান হওয়ার পরেই জেলে আছে। তারা জানে জেলেই তাদের মরতে হবে বোধ হয়, তবুও বন্ড দেয় নাই। এই সমস্ত ত্যাগী রাজনৈতিক নেতাদেরও আমরা শ্রদ্ধা করি। এঁদের উপর যারা জুলুম করে, তারা কত বড় নিষ্ঠুর হতে পারে তা ভাষায় প্রকাশ করা কষ্টকর। আমার ভাষা নাই তাই লিখতে পারলাম না।
আবার কারাগারের ক্ষুদ্র কুঠুরিতে ফিরে এসে অপেক্ষা করতে থাকি জমাদার সাহেবের আগমনের জন্য। তালাবন্ধ হতে হবে। যথারীতি আমার গুহার মধ্যে রাতের জন্য শুভাগমন করিয়া তৃপ্তির নিশ্বাস ফেললাম।
যেদিন বাচ্চাদের সাথে সাক্ষাৎ হয়, ওরা চলে যাবার পরে মন খারাপ লাগে। আমাদের মতো ‘দাগী’দেরও মন খারাপ হয়। পরে আবার ঠিক হয়ে যায়।
১৬ই জুন ১৯৬৬ ॥ বৃহস্পতিবার
ঘুম থেকে উঠেই খবর পেলাম ইত্তেফাক কাগজের কোনো এক বড় অফিসারকে গ্রেপ্তার করে এনেছে। ভাবলাম কে হবে, মানিক ভাই ছাড়া! খবর কেহই সঠিক বলতে পারছে না। পাগলের মতো সকলকেই জিজ্ঞাসা করলাম। কেহই ঠিক মতো বলতে পারে না। এমনভাবে প্রায় এক ঘণ্টা কেটে গেল। আমি চুপ করে বসে আছি, খবর আমাকে জানতেই হবে। বুঝতে পেরেছি মানিক ভাই, কিন্তু পাকাপাকি খবর পাচ্ছি না। একটু পরেই একজন বলল, তফাজ্জল হোসেন সাহেবকে ভোরবেলা নিয়ে এসেছে। ১০ নম্বর সেলে রেখেছে। আমার মনে ভীষণ আঘাত লাগল খবরটায়। এরা মানিক ভাইকেও ছাড়ল না? এরা কতদূর নেমে গেছে। পাকিস্তানের সাংবাদিকদের মধ্যে তার স্থান খুবই উচ্চে। তাঁর কলমের কাছে বাংলার খুব কম লেখকই দাঁড়াতে পারে। বিশেষ করে তার রাজনৈতিক সমালোচনার তুলনাই হয় না। তার নিজের লেখা রাজনৈতিক মঞ্চ, পড়লে দুনিয়ার অনেক দেশের রাজনৈতিক অবস্থা বুঝতে সহজ হয়। সাধারণ লোকেরও তাঁর লেখা বুঝতে কষ্ট হয় না। তাকে এক অর্থে শ্ৰেষ্ঠ কথাশিল্পী বলা যেতে পারে।
তিনি কোনোদিন সক্রিয় রাজনীতি করেন নাই। তার একটি নিজস্ব মতবাদ আছে। সত্য কথা বলতে কাহাকেও তিনি ছাড়েন না। আইয়ুব খান সাহেবও তাকে সমীহ করে চলেন। তিনি মনের মধ্যে এক কথা আর মুখে এক কথা বলেন না। তিনি হঠাৎ রেগে যান, আবার পাঁচ মিনিট পরে শান্ত হয়ে পড়েন। কেহ ভাবতেই পারবেন না তাহার মুখ খুবই খারাপ, মুখে যাহা আসে তাহাই বলতে পারেন। অনেক সময় আমার তার সাথে মতের অমিল হয়েছে। গালাগালি ও রাগারাগি করেছেন, কিন্তু অন্য কেহ আমাকে কিছু বললে, আর তার রক্ষা নাই, ঝাপাইয়া পড়েন। আমাকে তিনি অত্যধিক স্নেহ করেন। আমিও তাকে বড় ভাইয়ের মতো শ্রদ্ধা করি। কোনো কিছুতে আমি সিদ্ধান্ত নিতে না পারলে তার কাছে ছুটে যাই। তিনিই আমাকে সঠিক পথ দেখাইয়া দেন। সোহরাওয়ার্দী সাহেবের মৃত্যুর পরে তাঁর কাছ থেকেই বুদ্ধি পরামর্শ নিয়ে থাকি। কোনো লোভ বা ভ্রুকুটি তাকে তাঁর মতের থেকে সরাতে পারে নাই। মার্শাল ল’র সময়ও তাঁকে গ্রেপ্তার করে জেলে নেওয়া হয়। সোহরাওয়ার্দী সাহেবকে গ্রেপ্তার করার পরেও তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। আবার আজও তাঁকে গ্রেপ্তার করে এনেছে। তার উপর অনেকেরই ঈর্ষা এবং আক্রোশ রয়েছে।
এরা অনেকেই মনে করে আমি যাহা করি সকল কিছুই তাঁর মত নিয়ে করে থাকি। আমার দরকার হলে আমিই তাঁর কাছে যাই পরামর্শের জন্য। তিনি কখনও গায়ে পড়ে কোনোদিন পরামর্শ দেবার চেষ্টা করেন নাই। তবে তাঁর সাথে আমার মনের মিল আছে, কারণ ২৫ বৎসর এক নেতার নেতৃত্ব মেনে এসেছি দুইজন। অনেকেই সোহরাওয়ার্দী সাহেবের সাথে বেইমানী করেছেন। আমরা দুইজন একদিনের জন্যও তার কাছ থেকে দূরে যাই নাই। পাকিস্তানের বিশেষ করে পূর্ব বাংলার জনসাধারণের জন্য ইত্তেফাক যা করেছে তা কোনো খবরের কাগজই দাবি করতে পারে না। এদেশ থেকে বিরুদ্ধ রাজনীতি মুছে যেত যদি মানিক মিয়া এবং ইত্তেফাক না থাকতো। একথা স্বীকার না করলে সত্যের অপলাপ করা হবে। ১৯৫৮ সালের মার্শাল ল’ জারি হওয়ার পর থেকে হাজার রকমের ঝুকি লইয়াও তিনি এদেশের মানুষের মনের কথা তুলে ধরেছেন।
ছয় দফার আন্দোলন যে আজ এত তাড়াতাড়ি গণআন্দোলনে পরিণত হয়েছে এখানেও মানিক ভাইয়ের লেখনী না হলে তা সম্ভব হতো কিনা তাহা সন্দেহ! আমি যাহা কিছু করি না কেন, তাহা মানিক ভাইয়ের দোষ, সরকারের এটাই ভাবনা ! ভারতবর্ষ যখন পাকিস্তান আক্রমণ করল তখন যেভাবে ইত্তেফাক কাগজ সরকারকে সমর্থন দিয়েছে এবং জনগণকে উদ্বুব্ধ করেছে-ত্যাগের জন্য ও মাতৃভূমিকে রক্ষার জন্য, ইত্তেফাকের পাতা খুললেই তাহা দেখা যাবে। তবুও আজ তাকে ডিপিআরএ গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এখন বুঝতে কারও বাকি নাই কেন জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার করছেন না সরকার। দেশরক্ষা করার জন্য যে আইন করা হয়েছিল সে আইন আজ রাজনৈতিক কর্মীদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করছে। খবরের কাগজের স্বাধীনতার উপর পর্যন্ত হস্তক্ষেপ করিতেছে। এমনকি মানিক মিয়ার মতো সম্পাদককেও দেশরক্ষা আইনে গ্রেপ্তার করতে একটু লজ্জা করল না। তফাজ্জল হোসেন সাহেব, যাকে আমরা সকলে মানিক ভাই বলে ডাকি তিনি শুধু ইত্তেফাকের মালিক ও সম্পাদক নন, তিনি আন্তর্জাতিক প্রেস ইনস্টিটিউটের পাকিস্তান শাখার সভাপতি এবং প্রেস কোর্ট অব অনারের সেক্রেটারি।
১৯৫৯ সালে আমি যখন জেলে ছিলাম আমাকে তখনও একাকী রাখা হয়েছিল। মানিক ভাইকে গ্রেপ্তার করে পুরানো ২০ সেলে রাখা হয়েছিল। সকালে ও বিকালে কয়েক মুহুর্তের জন্য আমার সাথে তার দেখা হতো। তখন তিনি বোধ হয় একমাস কি দেড়মাস ছিলেন। মানিক ভাইকে খুবই কষ্টে রাখা হয়েছিল। ১৯৬২ সালে গ্রেপ্তার হয়ে তাকে আমি জেল গেটে এসে পাই। যতদিন জেলে ছিলাম একসাথেই ছিলাম। সকলে খালাস হয়ে গেলেও আমি আর মানিক ভাই ছিলাম। মানিক ভাই অসুস্থ হয়ে বাইরের হাসপাতালে গেলে আমি একলাই ছিলাম। কয়েকদিন পরেই আমাকে মুক্তি দেওয়া হয়।
আজ আমাকে রাখা হয়েছে সেল এলাকায়। এখানে ভয়ানক প্রকৃতির লোক, একরারী আসামি, জেল আইন ভঙ্গ করার জন্য সাজাপ্রাপ্ত আসামি, আর পাগলা গারদ। এই এরিয়ার সবগুলোই সেল। মোট ৯৩টা সেল আছে। আমার ঘরটা বাদে। এটা সেল না, সেলের থেকে একটু বড়। তবে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে উঁচু দেয়াল। শুধু সুবিধা হলো ঘরটার সামনে কিছু জায়গা আছে। কিছু গাছ-গাছালি আছে বলে ফুলের ও ফলের বাগান করতে পারি। এদের কাছে থাকতে আমার আপত্তি নাই, কারণ বোধ হয় নিজেও আমি ‘ভয়ানক’ প্রকৃতির লোক। মানে ভয়ডর একটু কম।
মানিক ভাই ও আওয়ামী লীগ কর্মীদের রাখা হয়েছে আমার থেকে অনেক দূরে। দেখা হওয়ার উপায় নেই। ১০ সেলে মানিক ভাই ও সহকর্মীরা কি করে আছে ভাবতে আমার কষ্টই হয়। নিচু সেল, জানলা নাই, একটা দরজা তাও আবার সামনে দেওয়াল দিয়ে ঘেরা। উপরের থেকে নাকি হুকুম আসে কাকে কোথায় রাখতে হবে। জেল কর্তৃপক্ষের হাতে কিছুই নাই। আমি প্রতিবাদ করলাম। আমার কাছে না দেয় তাতে আপত্তি নাই, কিন্তু এমন জায়গা দেওয়া হউক যেখানে তাহারা মানুষের মতো বাস করতে পারেন। জেল কর্তৃপক্ষকে বলে বলে হয়রান হয়ে গেছি। তবে আমার কাছে খবর আছে, এক ভদ্রলোক বলে দেন কোথায় কাকে রাখতে হবে।
মানিক ভাইয়ের লেখা পড়ব না এটা আমার একটা দুঃখ। দিন যে কিভাবে কেটে গেল বলতেও পারি না। খবরের কাগজে মানিক ভাইয়ের গ্রেপ্তারের কোনো খবর নাই। বোধ হয় খুব ভোরে গ্রেপ্তার করেছে।
সমস্ত পূর্ব বাংলায় এবারও বন্যা হবে। সিলেট তো শেষই হয়ে গিয়াছে বলে মনে হয়। ময়মনসিংহ, ফরিদপুর, বগুড়া, রংপুর, পাবনায়ও বন্যা হবে। ঢাকাও বাদ যেতে পারে না। পূর্ব বাংলার লোকের দশা কি হবে তাই ভাবছি। এর উপর আবার করের বোঝা সরকার চাপাইয়া চলছে।
১৭ই জুন ১৯৬৬ ॥ শুক্রবার
ভীষণ বৃষ্টি। বাইরে যাওয়ার উপায় নাই। বারান্দায় ঘুরলাম, বারান্দায় কয়েকজন কয়েদি আশ্রয় নিয়েছে। একজন খবর দিল রফিক সাহেব নামে আমাদের দলের একজন নেতা এসেছেন। তাকেও দশ সেলে রাখা হয়েছে। চলেছে গ্রেপ্তার সমানে। মনে হয় মোনায়েম খান সাহেব ৭ তারিখের পরে আরও ক্ষেপে গেছেন। বোধ হয় ভুলে গেছেন, যে লোক বেশি রাগান্বিত ও অধৈর্য হয়ে পড়ে শেষ পর্যন্ত তাকেই হারতে হয়। মাথা ঠান্ডা রেখে যে সংগ্রাম চালাইয়া যায় শেষ পর্যন্ত তারই জয় হয়। রফিক আমার বহুদিনের সহকর্মী। কলিকাতা থেকেই একসাথে রাজনীতি করেছি। তবে মাঝে অনেকবার এদিক ওদিক করেছে। সেই জন্য সহকর্মীদের মধ্যে অনেকে ওকে বিশ্বাস করতে চায় না। এবার যখন আবার আওয়ামী লীগে ফিরে এল তখন সত্যই ওকে আমি বিশ্বাস করেছি, কারণ এখন আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় যাবার কোনো সম্ভাবনা নাই। কোনোদিন ওকে কেহ গ্রেপ্তার করতে পারে নাই। ১৯৪৯, ১৯৫২, ১৯৫৪ প্রত্যেক বারেই রফিক কেটে পড়েছে। তাই মনে মনে বললাম, ‘বার বার ঘুঘু তুমি খেয়ে যাও ধান?’ এবার যে সে ভাগতে চেষ্টা করে নাই, তার প্রমাণও পেয়েছি। সভা সমিতিতে যেয়ে জোর বক্তৃতা করেছে আমাদের গ্রেপ্তারের পরেও। মনে হয় আওয়ামী লীগের কাকেও আর বাইরে রাখবে না। বোধ হয় এখনও অনেককে ধরতে চেষ্টা করছে। কেউ কেউ বোধ হয় আত্মগোপন করে কাজ চালাইয়া যেতেছে।
মানিক ভাইয়ের কাছেই রেখেছে রফিককে। ভালই হয়েছে একজন সাথী পেয়েছেন। যারা ১০ সেলে আছে তারা মানিক ভাইকে সমীহ করে চলে। নিশ্চয়ই দূরে দূরে থাকতে চেষ্টা করবে।
ন্যাপ দলীয় মশিউর রহমান আইন পরিষদে যাহা বলিয়াছেন তাহাতে কোনো লোক আশ্চর্য না হয়ে পারবে না। সরকারি দলের সমর্থকরা যাহা বলিয়াছেন তিনি সেই কথাগুলি আরও জোরে জোরে বলিয়াছেন। তিনি তাদের সুরে সুর মিলাইয়া বলিয়াছেন যে, পূর্ব পাকিস্তানে গোলমাল সৃষ্টি করার জন্য মার্কিন গোয়েন্দা বিভাগ (সিআইএ) অর্থ প্রদান করিয়াছে। গত সপ্তাহে প্রদেশে যে ধর্মঘট হইয়াছে তাহাতে মার্কিন গোয়েন্দা বিভাগের অর্থ সাহায্য দেওয়া হইয়াছে বলিয়া তিনি জানান। এরা আবার প্রগতির কথা বলে! পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের দাবি, রাজবন্দিদের মুক্তির দাবি, শ্রমিক ও কৃষকদের দাবি আজ নূতন নয়। তিনি যখন ১৯৪৭-৫৭ সাল পর্যন্ত মুসলিম লীগের সদস্য ছিলেন, প্রত্যেকটা গণআন্দোলনকে নস্যাৎ করার জন্য রংপুরে গুন্ডা লেলাইয়া দিতেন। বাংলা ভাষার আন্দোলনকে ধ্বংস করার জন্য নিজে কর্মী ও ছাত্রদের উপর গুন্ডামি করার চেষ্টা করেছেন। ১৯৫৪ সালের মুসলিম লীগের টিকিট নিয়ে যখন জামানতের টাকা বাজেয়াপ্ত হয়েছিল তখন ১৯৫৬ সালে পৃথক নির্বাচন সমর্থন করে মুসলিম লীগের ঝান্ডা নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন। সারাজীবন দালালির রাজনীতি করে বেড়াইয়াছেন, আবার রাতারাতি ১৯৫৭ সালে ‘প্রগতিবাদী হয়ে ন্যাপে যোগ দিয়াছেন। আর যারা এই স্বায়ত্তশাসন ও গণতন্ত্রের আন্দোলনের জন্য সারাজীবন অত্যাচার নির্যাতন সহ্য করেছে এবং মামলার আসামি বা রাজবন্দি হিসেবে বৎসরের পর বৎসর কারাগারে কাটাইয়াছে, তাদের সম্বন্ধে এই সমস্ত নীচ কথা উচ্চারণ করা তার পক্ষেই সম্ভবপর। সরকারের সাথে গোপনে পরামর্শ করে যে লোক জাতীয় পরিষদের সদস্য হয়, রাওয়ালপিন্ডি আর করাচী ঘুরে পারমিটের ব্যবসা করে বেড়ায়, তাহার কাছে একটা সংগ্রামী রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান সম্বন্ধে এবং জনগণের গণআন্দোলন সম্বন্ধে এই সব কথা শোভা পায় কিনা জনগণ বিচার করবে।
আজ এতগুলি লোক গুলি খেয়ে জীবন দিল। শত শত লোক কারাগারে বন্দি অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে। শত শত লোকের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারী পরোয়ানা ঝুলছে। শত শত মামলা ছাত্র রাজনৈতিক কর্মীদের বিরুদ্ধে শুরু হয়েছে সে সম্বন্ধে কোনো সহানুভূতি যে পার্টির নেতারা দেখান না, তাদের পক্ষে সবই সম্ভবপর। আমি জানি এই সকল কথা বললে এরা পিন্ডি বসে পারমিটের ব্যবসা করার আরও সুযোগ পাবে। কত হাজার টন সিমেন্টের পারমিট করাচী থেকে এনে কার কাছে বিক্রি করেছেন—একথাও আমার জানা আছে। আমি বন্দি, আমার সহকর্মীরা বন্দি, তা না হলে তাকে ও তাদের নেতাদের কি উত্তর দিতে হয় তা আমি জানি। জনগণ তাদের পিছনে নাই, এখন উপরতলার রাজনীতি করেন। শুধু সাম্রাজ্যবাদ’ বলে চিৎকার করে আর সাম্রাজ্যবাদের দালালদের তলে তলে সমর্থন করে সাম্রাজ্যবাদকে ধ্বংস করা যাবে না। গণআন্দোলনে বিশ্বাস করেন, জনগণের উপর নির্ভর করেন। ৬ দফা শুনে ঘাবড়াবেন না, এ দাবি জনগণের দাবি। আপনার ‘নেতা মওলানা ভাসানী সাহেবকে ময়দানে নামান। আইয়ুব সাহেবের দলে তো আপনারা আছেনই এবং সাহায্য নিয়ে থাকেন। অবস্থা কি আপনাদের? এ নেতার সম্বন্ধে আমার এতখানি না লেখলেও চলত, কারণ এদের কথার দাম বাঙালি দেয় না। আন্দোলন কখনও বাইরে থেকে আমদানি হয় না। বাংলাদেশের লোকের প্রাণ আছে। পারমিটের টাকা দিয়া গণআন্দোলন হয় না। আপনার জানা উচিত সিআইয়ের এজেন্টরাই পাকিস্তান শাসন করছে। নূতন এজেন্টের দরকার হয় নাই, আর হবেও না। আর দরকার হলেও আপনাদের মতো এজেন্ট অনেক পাবে তারা। কারণ তারা বোধ হয় জানে আপনাদের চরিত্র। এজেন্সির রাজনীতি আপনাদের নেতারাই করে থাকেন।
ইত্তেফাক কাগজ আসে নাই। এর পরিবর্তে আমাকে ‘দৈনিক পাকিস্তান’ দিয়েছে। কারণ জিজ্ঞাসা করলে বলল, কাগজ বন্ধ, সরকার নাকি বন্ধ করে দিয়েছে। আর খবর পেলাম রাতে মানিক ভাইয়ের কাছে একটা নোটিশ দিয়ে গিয়াছে। আমার মনে হলো সরকার নিশ্চয়ই কাগজ বন্ধ করে দিয়েছে। মোনায়েম খান সব পারে, ‘বানরের হাতে শাবল’! যে যতটুকু ক্ষমতা হজম করতে পারে তাকে ততটুকু দেওয়া উচিত। দুঃখের বিষয় ক্ষমতার অপব্যবহার যে সে করবে সে সম্বন্ধে সন্দেহ নাই। আইয়ুব সাহেব নাকি তাকে পূর্ব বাংলাকে ঠিক রাখার জন্য সব ক্ষমতা দিয়েছেন।
আজ আর সঠিক খবর পেলাম না। মানিক ভাইকে যেখানে রেখেছে, সেখান থেকে খবর আনা খুবই কষ্টকর। এতবড় আঘাত পেলাম তা কল্পনা করতে বোধ হয় অনেকেই পারবে না। প্রথম থেকেই এই কাগজের সাথে আমি জড়িত ছিলাম।
সারাদিন একই চিন্তা। এবার জেলে এসে একদিনও শান্তিতে থাকতে পারলাম না। ঘরে বাইরে করতে করতে দিন চলে গেল। রাতটাও কেটে গেল একই চিন্তায়। আগামীকাল খবরের কাগজ এলে সঠিক খবর পাওয়া যাবে এই আশায় রইলাম। আমি বলে দিয়েছি দৈনিক পাকিস্তান রাখবো না, সংবাদ’ কাগজ যেন দেওয়া হয়। পূর্বে ছিল ইত্তেফাক, আজাদ, অবজারভার, মর্নিং নিউজ আর ডন। এখন সংবাদও আসবে। ইত্তেফাকের কি হবে এখন ঠিক বলতে পারি না।
১৮ই জুন ১৯৬৬ ॥ শনিবার
সূর্য উঠেছে। রৌদ্রের ভিতর হাঁটাচলা করলাম। আবহাওয়া ভালই। তবুও একই আতঙ্ক ইত্তেফাকের কি হবে! সময় আর কি সহজে যেতে চায়। সিপাহি, জমাদার, কয়েদি সকলের মুখে একই কথা, ইত্তেফাক কাগজ বন্ধ করে দিয়েছে।’
ঘরে এসে বই পড়তে আরম্ভ করলাম। এমিল জোলা-র লেখা ‘তেরেসা রেকুইন’ (Therese Raquin) পড়ছিলাম। সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তিনটা চরিত্রজোলা তাঁর লেখার ভিতর দিয়া। এই বইয়ের ভিতর কাটাইয়া দিলাম দুই তিন ঘণ্টা সময়।
আজ সিভিল সার্জন আসলেন আমাকে দেখতে। শরীরের অবস্থা জিজ্ঞাসা করলেন। বললাম ভালই আছি, ভালই থাকতে হবে। তিনি কাজের লোক, দেরি না করে চলে গেলেন। আমিও বাইরে বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। বহুদিন পর্যন্ত দুটি হলদে পাখিকে আমি খোঁজ করছি। ১৯৫৮-৫৯ সালে যখন ছিলাম এই জায়গাটিতে তখন প্রায়ই ১০টা/১১টার সময় আসত, আর আমগাছের এক শাখা হতে অন্য শাখায় ঘুরে বেড়াত। মাঝে মাঝে পোকা ধরে খেত। আজ ৪০ দিন এই জায়গায় আমি আছি, কিন্তু হলদে পাখি দুটি আসল না। ভাবলাম ওরা বোধ হয় বেঁচে নাই অথবা অন্য কোথাও দূরে চলে গিয়াছে। আর আসবে না। ওদের জন্য আমার খুব দুঃখই হলো। যখন ১৬ মাস এই ঘরটিতে একাকী থাকতাম তখন রোজই সকাল বেলা লেখাপড়া বন্ধ করে বাইরে যেয়ে বসতাম ওদের দেখার জন্য। মনে হলো ওরা আমার উপর অভিমান করে চলে গেছে।
খাবার কাজটি কোনোমতে শেষ করে খবরের কাগজের অপেক্ষায় রইলাম। আজও অনেক দেরি হলো কাগজ আসতে। ডিউটি জমাদার সাহেবকে বললাম, আপনি ডিউটিতে আসার পর থেকে কাগজ দেরি করে আসতে শুরু করেছে। কাগজ আসতে দেরি হলে আমার ভীষণ রাগ হয়। দুই এক সময় কড়া কথাও বলে ফেলি।
প্রায় তিনটার সময় কাগজগুলি কয়েদি পাহারা নিয়ে এল। পাকিস্তান দেশরক্ষা আইন বলে ‘নিউনেশন প্রেস’ বাজেয়াপ্ত করিয়াছে সরকার। এই প্রেস হইতে ইত্তেফাক, ইংরেজি সাপ্তাহিক ঢাকা টাইমস’ ও বাংলা চলচ্চিত্র সাপ্তাহিক ‘পূর্বাণী’ প্রকাশিত হইত। পুলিশ প্রেসে তালা লাগাইয়া দিয়াছে। ইত্তেফাক কাগজ বন্ধ হইয়া গিয়াছে। পূর্বের দিন ইত্তেফাক ও নিউনেশন প্রেসের মালিককে দেশরক্ষা আইনে গ্রেপ্তার করিয়া ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ১০ সেলে বন্দি করিয়া রাখা হইয়াছে। পূর্ব পাকিস্তানে ইত্তেফাক সকল কাগজের থেকে বেশি ছাপা হয়। এর পাঠকের সংখ্যা অসংখ্য। বাংলার গ্রামে গ্রামে ইত্তেফাক পরিচিত। দেশরক্ষা আইনের বলে অন্য কোনো কাগজকে এত বড় আঘাত করা হয় নাই। ইত্তেফাক কাগজ বন্ধ করে এবং তাহার মালিক ও সম্পাদককে গ্রেপ্তার করে ৬ দফার দাবিকে বানচাল করতে চায়। কিন্তু আর সম্ভব হবে না। এতে আন্দোলন আরও দানা বেঁধে উঠবে। যার পরিণতি একদিন ভয়াবহ হবে বলে আমার বিশ্বাস। কি করে আইয়ুব খান সাহেব মোনায়েম খান সাহেবকে এ কাজ করতে অনুমতি বা নির্দেশ দিলেন আমার বুঝতে কষ্ট হয়।
খবর নিয়ে জানলাম মানিক ভাই প্রস্তুত হয়েই ছিলেন, সে জন্য একটুও মুষড়ে পড়েন নাই। আমি কিছুটা হতাশ হয়ে পড়েছিলাম। কারণ কোনো প্রেসেই আওয়ামী লীগের কোনো প্যামফলেট ও পোস্টার ছাপাইতে দেওয়া হইতেছে না। যে প্রেসই ছাপায় তার মালিককে দেশরক্ষা আইনে গ্রেপ্তার করে। প্যামফলেট ছাপানো বেআইনি নয়। এমনকি কালো ব্যাজ ছাপার জন্যে ‘দি বেঙ্গল প্রিন্টিং প্রেসের মালিককে গ্রেপ্তার হতে হয়েছে। বোঝা গেল গণতান্ত্রিক আন্দোলন করে দাবি আদায় করতে তারা দিবে না। একদলীয় রাষ্ট্র পরিচালনা করতে চায়। পূর্ব বাংলায় এটা বেশি দিন চলতে পারে না। আন্দোলনকে ভিন্ন গতি নিতে এরা বাধ্য করছে-যা আমরা চাই নাই। ইত্তেফাক বন্ধ হতে পারে কিন্তু ইত্তেফাক যা চায় তা জনগণেরই দাবি এবং মনের কথা।
এখন আর কাগজ পড়তে বেশি সময় আমার দরকার হয় না। মর্নিং নিউজে’র হেড লাইনগুলি দেখলেই বুঝতে পারি কি লিখতে চায়। আজাদ আওয়ামী লীগের কিছু কিছু সংবাদ দেয়। সংবাদ’ তাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে যেগুলি দরকার তাই ছাপায়। অবজারভার বোধ হয় একটু ভয় পেয়েছে। আশ্চর্য হয়ে চিন্তা করলাম, খবরের কাগজের সম্পাদকরা আজ পর্যন্ত প্রতিবাদ করে একটি বিবৃতিও দিল না-এমন কি সহকর্মী ইত্তেফাকের সম্পাদকের মুক্তি চেয়েও না। ইত্তেফাককে যদি অত্যাচার করে ধ্বংস করতে পারে তবে কেউই রেহাই পাবে না। একটু সবুর করলেই দেখতে পাবেন। আমার মনে হয়, আমার সহকর্মীরা যারা বাইরে আছেন তারা এই অত্যাচারের প্রতিবাদ করে যদি দরকার হয়, গ্রেপ্তার হয়ে তাদের জেলে আসা উচিত।
মার্কিন সরকার পাকিস্তান ও ভারতকে পূর্ণ অর্থনৈতিক সাহায্য প্রদান পুনরায় শুরু করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। পাক-ভারত যুদ্ধের সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উভয় দেশকে সাহায্য প্রদান বন্ধ করে দিয়েছিল। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর হইতে বলা হইয়াছে বর্তমানে পাক-ভারতের মধ্যে শান্তি ফিরিয়া আসিয়াছে। তবে আপাতত কাহাকেও সামরিক সাহায্য দিবে না। প্রেসিডেন্ট মি. লিন্ডন বি জনসন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জনাব আইয়ুব খান ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধীর সাথে ওয়াশিংটনে বসিয়া আলাপ করিয়া খুশি হইয়াছেন। নিজের দেশকে এত হেয় করে কোনো স্বাধীন দেশের সরকার এরূপভাবে সাহায্য গ্রহণ করতে পারে না। শুধু সরকারকে অপমান করে নাই, দেশের জনগণ ও দেশকেও অপমান করেছে। ভিক্ষুকের কোনো সম্মান নাই। তবে শোয়েব সাহেব যে অর্থনীতি এখানে চালাইতেছেন তাতে ইহা ছাড়া আইয়ুব সাহেবের উপায় বা কি ছিল? একমাত্র সমাজতন্ত্র কায়েম করলে কারও কাছে এত হেয় হয়ে সাহায্য নিতে হতো না। দেশের জনগণেরও উপকার হতো। এখন তো কিছু কিছু লোককে আরও বড় লোক, আর সমস্ত জাতিকে ভিখারী করা ছাড়া উপায় নাই। পুঁজিপতিদের কাছে পাকিস্তানকে কি বন্ধক দেওয়া হলো জীবনের তরে? মওলানা ভাসানী সাহেব কোথায়? কি বলেন? আইয়ুব সাহেবের হাতকে শক্তিশালী করে পুঁজিপতি ও সাম্রাজ্যবাদীদের হাত থেকে বের করে এনে সোসালিস্ট ব্লকে যোগ দিতে তিনি নাকি সক্ষম হবেন! তাই তিনি আইয়ুব সাহেবের সমস্ত অগণতান্ত্রিক পন্থাকে সমর্থন করেছেন। আর আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য দলকে সাম্রাজ্যবাদীদের দালাল বলে গালি দিয়েছেন। এখন তো প্রমাণ হয়ে গেছে মওলানা সাহেব ও তাঁহার দলের কিছু সংখ্যক লোক সাম্রাজ্যবাদীদের দালালের দালালি করেছেন।
আমার এক বন্ধু এমপিএ ছিলেন ১৯৫৭ সালে। মওলানা সাহেব যখন ন্যাপ করলেন ইস্কান্দার মির্জার সাহায্যে প্রগতিশীল বৈদেশিক নীতির ধুয়া তুলে, তখন ন্যাপ পার্লামেন্টারি পার্টি গঠন করে আওয়ামী লীগ থেকে সমর্থন উঠাইয়া নিলেন এবং আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলো। তখন তিনি ন্যাপের এক পার্টি মিটিংয়ে বলেছিলেন, আওয়ামী লীগকে সমর্থন করা চলবে না। কে এস পি, নিজামে ইসলাম, মুসলিম লীগ কোয়ালিশনকে সমর্থন করা উচিত। তখন কিছু কিছু সদস্য তার প্রতিবাদ করে বলেছিলেন, এই সমস্ত দল কি সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলন করতে পারে? এরা ইস্কান্দার মির্জার দালালি করছে। ইস্কান্দার মির্জা আওয়ামী লীগ কোয়ালিশন সরকারকে ধ্বংস করতে চায়। আওয়ামী লীগ তো বন্দিদের মুক্তি দিয়েছে, ব্যক্তি স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে। যুক্ত নির্বাচনের জন্য যুদ্ধ করছে। কেমন করে আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে এই সমস্ত নীতি বিবর্জিত দলদের সমর্থন করতে পারা যায়! মওলানা ভাসানী সাহেব তার উত্তর দিয়েছেন এই কথা বলে, মিশরের নাসের যদি সমাজতন্ত্র করতে পারে, তবে ইস্কান্দার মির্জাকেও একবার পরীক্ষা করে দেখলে অন্যায় কি? এরপরেই জানা গেল মওলানা সাহেব ইস্কান্দার মির্জার সাথে গোপন সন্ধিতে যোগ দিয়েছেন, সোহরাওয়ার্দী নিধন যজ্ঞে। তার নীতি আমার জানা আছে। জেলে বসে আইয়ুব সাহেবের কাছে কি কি চিঠি দিয়েছেন তাও আমার জানা আছে।
জুলফিকার আলী ভুট্টোর দিন ফুরাইয়া এসেছে। একটু দেরি করুন দেখতে পাবেন, আপনার সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী নেতা, আইয়ুব খান সাহেবের রূপ। বৃদ্ধকালে সরকারি ব্যয়ে একটু বিদেশে ঘুরবার সুযোগ পেয়েছেন। দুনিয়া দেখতে কেহ আপত্তি করে না। জনগণের সাথে আর ছল চাতুরি না করাই শ্রেয়। আওয়ামী লীগ কর্মীরা ও জনগণ যখন জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার ও গণতন্ত্রের দাবির জন্য গুলি বুক পেতে নিতেছে, যখন কারাগার ভরে গিয়াছে তখন তাহার দলেরই দুই একজন নেতা এর মধ্যে সাম্রাজ্যবাদীর হাত দেখতে পেয়েছেন। এই অত্যাচারের প্রতিবাদও করেন নাই। জনগণ এদের চিনে ফেলেছে, সে সম্বন্ধে আমার কোনো সন্দেহ নাই।
আওয়ামী লীগের ডাকে জনগণ জুলুম প্রতিরোধ দিবস পালন করছে খবর পেলাম, আর সরকারও অত্যাচারের স্টিম রোলার চালাইয়া যেতেছে। দেখা যাক কি হয়।
বিকালটা ভালই ছিল। বৃষ্টি হয় নাই। হাসপাতালে আহত কর্মীরা দরজার কাছে দাঁড়াইয়া আছে। নারায়ণগঞ্জের খাজা মহিউদ্দিন ও অন্যান্য কর্মীরা এবং সাহাবুদ্দিন চৌধুরী সাহেবও হাসপাতালে আছেন। তিনিও নেমে এসেছেন দরজার কাছে। আমি একটু এগিয়ে যেয়ে ওদের বললাম, চিন্তা করিও না। কোনো ত্যাগই বৃথা যায় না। দেখ না আমাকে একলা রেখেছে। সিপাই সাহেবের মুখ শুকাইয়া গেছে, কারণ কথা বলা নিষেধ, চাকরি যাবে। আমি এদের ক্ষতি করতে চাই না, তাই চলে এলাম আমার জায়গায়। শুধু ওদের দূর থেকে আমার অন্তরের স্নেহ ও ভালবাসা জানালাম। জানি না আমার কথা ওরা শুনেছিল কিনা, কারণ দূর তো আর কম না!
সূর্য বিদায় নিয়েছে, জেলখানায় একটু পূর্বেই বিদায় নেয়। কারণ ১৪ ফিট দেয়াল দাঁড়াইয়া আছে আমাদের চোখের সম্মুখে।
২৬ সেলের সিকিউরিটি বন্ধুরা আমাকে একটা রজনীগন্ধার তোড়া উপহার পাঠাইয়াছে। আমার পড়ার টেবিলের উপর গ্লাসে পানি দিয়ে রাখলাম। সমস্ত ঘরটি রজনীগন্ধার সুমধুর গন্ধে ভরে গিয়েছে। বড় মধুর লাগলো। বিশেষ করে ঐ ত্যাগী বন্ধুদের-যারা জীবনের ২৫ থেকে ৩০ বৎসর নীতি ও দেশের জন্য জেল খেটেছেন, আজও খাটছেন। তাদের এই উপহার আমার কাছে অনেক মূল্যবান। শুধু মনে মনে বললাম, তোমাদের মতো ত্যাগ যেন আমি করতে পারি। তোমরা যে নীতিই মান না কেন, তাতে আমার কিছু আসে যায় না। তোমরা দেশের মঙ্গল চাও, তাতে আমার সন্দেহ নাই। তোমরা জনগণের মুক্তি চাও এ কথাও সত্য। তোমাদের আমি শ্রদ্ধা করি। তোমাদের এই উপহার আমার কাছে অনেক মূল্যবান।
রাত কেটে গেল। এমনি অনেক রাত কেটে গেছে আমার। প্রায় ছয় বৎসর জেলে কাটিয়েছি। বোধ হয় দুই হাজার রাতের কম হবে না, বেশি হতে পারে। আরও কত রাত কাটবে কে জানে? বোধ হয় আমাদের জীবনের সামনের রাতগুলি সরকার ও আইবি ডিপার্টমেন্টের হাতে।
১৯শে জুন ১৯৬৬ ॥ রবিবার
ঘরটা তো আমাদের এক মাত্র জায়গা-যা একটু বাহিরে হাঁটাহাঁটি করতাম তাও বন্ধ। বৃষ্টি চলছে সমানে। বারান্দা দিয়ে হাঁটতে চেষ্টা করলাম, কিন্তু বারান্দাটা ভিজে গিয়েছে। পায়খানায় যাওয়ার উপায় নাই। পানি পড়ে সমস্ত শরীরটা ভিজে যাবে। ছাতাও নাই। চা প্রস্তুত হয়ে গেছে, খেয়ে নিয়ে ঘরের ভিতরই ঘুরতে আরম্ভ করলাম। প্রায় ৯টায় বৃষ্টি থামলে আমি বের হয়ে পড়লাম। দেখলাম বরিশালের বাবু চিত্তরঞ্জন সুতারও দাঁড়াইয়া আছেন তাঁর সেলের দরজার কাছে। বুঝলাম তার অবস্থাও আমার মতো। আমার ঘরের একটা সামান্য বারান্দা আছে। কিন্তু তাঁর সেলে তাও নাই। বৃষ্টি থেমেছে, তাই বের হয়ে পড়েছে একটু হাঁফ ছেড়ে বাঁচতে। তাহাকেও আলাদা করে রাখার হুকুম দিয়েছে। বরিশাল জেলে ছিলেন। মাসে অন্ততপক্ষে স্ত্রী ও ছেলের সাথে দেখা হতো। তা আর হবে না। কষ্ট দেও, যত পার। আমাদের আপত্তি নাই। আমরা নীরবে সবই সহ্য করব ভবিষ্যৎ বংশধরদের আজাদীর জন্য। আমাদের যৌবনের উন্মাদনার দিনগুলি তো কারাগারেই কাটিয়ে দিলাম। আধা বয়স পার হয়ে গেছে।
আর চিন্তা কি? এই নিষ্ঠুর ব্যবহারের বিচার একদিন হবেই। দেখেও যেতে পারি, আর না দেখেও যেতে পারি। তবে বিশ্বাস আছে, হবেই।
আবার বৃষ্টি। তাড়াতাড়ি পাকের ঘরে উপস্থিত হলাম। দেখি কি পাক করছে?’ বাবুর্চি বলল, ‘পটল ভাজি করছি, পেঁপেও পাক করব। মাছ এখনও আসে নাই। কিছু সময় দাঁড়াতে হলো। দেখলাম কিভাবে পাক করবে। পানি পড়ে ঘর দিয়ে। আধা ঘর ভিজে গিয়েছে। একটু পরে আমি জমাদার সাহেবকে বললাম খবর দিতে। এভাবে চলতে পারে না।
কম্পাউন্ডার সাহেব এলেন আমার এখানে ইনজেকশন দিতে। বললাম ‘বসেন, কেমন আছেন?’ বলল, ‘কেমন থাকব। স্বল্প বেতনের কর্মচারী, জীবনটা কোনোমতে কাটাইয়া নিয়ে যাচ্ছি।’ তার কাজ শেষ করে তিনি চলে গেলেন।
আমি বই নিয়ে বসে পড়লাম। মনে করবেন না বই নিয়ে বসলেই লেখাপড়া করি। মাঝে মাঝে বইয়ের দিকে চেয়ে থাকি সত্য, মনে হবে কত মনোযোগ সহকারে পড়ছি। বোধ হয় সেই মুহূর্তে আমার মন কোথাও কোনো অজানা অচেনা দেশে চলে গিয়েছে। নতুবা কোনো আপনজনের কথা মনে পড়েছে। নতুবা যার সাথে মনের মিল আছে, একজন আর একজনকে পছন্দ করি, তবুও দূরে থাকতে হয়, তার কথাও চিন্তা করে চলেছি। হয়ত বা দেশের অবস্থা, রাজনীতির অবস্থা, সহকর্মীদের উপর নির্যাতনের কাহিনী নিয়ে ভাবতে ভাবতে চক্ষু দু’টি আপনা আপনি বন্ধ হয়ে আসছে। বই রেখে আবার পাইপ ধরালাম।
সাড়ে এগারটায় জেলের কয়েদিদের খাবার সময় হয়ে যায়। এরা গোসল করে খাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে যায়। বালতিতে ডাল, টিনের বড় এক পাত্রে ভাত আর একটি বালতিতে তরকারি। কয়েদিরা দফায় দফায় এসে বিলাইয়া যায়। ভাত নিয়ে যে যেখানে পারে বসে খেয়ে নেয়। মেশিনের মতো চলে। আমার কিন্তু একটার পূর্বে খাওয়া অসম্ভব। তাই সাড়ে বারটা বা ১টায় গোসল করতে যাই। আজ বহুক্ষণ ভাবলাম গোসল করব কিনা। মেট বলল, না করলে শরীর খারাপ হবে। বসে পড়তে পড়তে পিঠে একটা ব্যথা হয়েছে। খুব তেল মালিশ করে গোসল করে এলাম। খাবার পরেই কাগজ এসে হাজির।
ব্যাপার কি! ভুট্টো সাহেব নাই! বিতাড়িত। ছুটি চেয়েছেন, পেয়েছেনও। সসম্মানে তাড়াইয়া দেওয়ার একটা ফন্দি। আমেরিকার ধাক্কা আইয়ুব সাহেব সামলাইবেন কেমন করে! শোয়েব সাহেবের দৌলতে তিনি যে অর্থনীতি কায়েম করতে চলেছেন তাহাতে আমেরিকা ছাড়া আর কে সাহায্য করতে পারে! আমেরিকা যেখানে সাহায্য দিতে চায় সেখানে অধীনস্ত না করে অর্থ সাহায্য দেয় না। পণ্ডিত জওহরলালের মতো ত্যাগী, কর্মঠ, শিক্ষিত প্রধানমন্ত্রীও কৃষ্ণ মেননের মতো বৈদেশিক মন্ত্রীকে আমেরিকার চাপে সরায়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। আর আমাদের আইয়ুব সাহেব যাদের বদৌলতে ক্ষমতায় বসেছেন, যাদের দৌলতে ক্ষমতায় টিকে আছেন, কেমন করে সেই মুরব্বীদের বেজার করবেন? ভাই ভুট্টো আমার কথাগুলি মনে করে দেখবেন নিশ্চয়ই। যখন হঠাৎ আমার সাথে মোলাকাত হয়ে গিয়াছিল তখন তাকে বলেছিলাম, বেশি দিন আর বাকি নাই, আপনারও দিন ফুরাইয়া এসেছে। ডিকটেটরের ধর্ম নাই। সে শুধু নিজকে চেনে এবং নিজের স্বার্থে আঘাত লাগলে কাহাকেও ছাড়ে না। আমেরিকানরা যে আইয়ুব সাহেবকে ছাড়তে পারে না তাহাও আমার বুঝতে বাকি নাই। এমন নেতা আমেরিকা চায় যারা জনগণের সাথে সম্বন্ধ রাখে না। আইয়ুব সাহেব বিবৃতি দিয়েছেন, বৈদেশিক নীতি পূর্বের মতো চলবে। এর কোনো পরিবর্তন হবে না। আমরা জানি যে, কোনোদিন পরিবর্তন করতে পারবেন না।
শনিবার রাতে পূর্ব পাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়নের কার্যকরী পরিষদের সভায় দৈনিক ইত্তেফাক, সাপ্তাহিক ঢাকা টাইমস ও সাপ্তাহিক পূর্বাণীর মুদ্রণালয়, নিউ নেশন প্রিন্টিং প্রেস বাজেয়াপ্তকরণ, সংবাদপত্রের উপর বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা, দেশরক্ষা আইনে জনাব তফাজ্জল হোসেন, রণেশ দাশগুপ্ত, সত্যেন সেনসহ অন্যান্য সাংবাদিক গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে আগামী সোমবার একদিন প্রতীক ধর্মঘট পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।
দি নিউ নেশন প্রিন্টিং প্রেস বাজেয়াপ্তকরণের উপর স্বতন্ত্র দলের নেতা জনাব আসাদুজ্জামানের ও গণপরিষদ সদস্যের অধিকার সংক্রান্ত মুলতবি প্রস্তাব এবং বিরোধীদলের নেতা আবদুল মালেক উকিলের আনীত মুলতবি প্রস্তাব স্পিকার সাহেব কর্তৃক অগ্রাহ্য করার প্রতিবাদে বিরোধী ও স্বতন্ত্র দলীয় সদস্যরা পরিষদ কক্ষ ত্যাগ করেন।
বিরোধী দলের ও স্বতন্ত্র দলের সদস্যরা কালো ব্যাজ পরিধান করেন। কারণ জুলুম প্রতিরোধ দিবস পালন করা হইতেছে ১৭, ১৮, ১৯ তারিখে। পূর্ব বাংলার প্রায় সমস্ত জেলায় ১৪৪ ধারা জারি করেছে। জুলুম প্রতিরোধ দিবস পালন করতে দেওয়া হবে না। নেতা ও কর্মীদের গ্রেপ্তার করে, শান্তিপূর্ণ শোভাযাত্রার উপর গুলি করে, প্রেস বন্ধ করে দিয়ে গ্রেপ্তারী পরোয়ানা দিয়ে কিছু দিনের জন্য আন্দোলন বন্ধ রাখা যায়, বেশি দিন না।
বিকাল বেলা বৃষ্টি একটু কম হলেও মাঝে মাঝে চলছে। মাজায় ব্যথা বেশি, হাঁটতেও পারলাম না। রাত কেটে গেল। রাতে ভীষণভাবে বৃষ্টি হলো। ঘুম ঠিকই হয়েছে, তবে মাঝে দু’বার ঘুম ভেঙে গিয়েছিল।
২০শে জুন ১৯৬৬ ॥ সোমবার
হৈ হৈ রৈ রৈ ব্যাপার! কি হয়েছে জিজ্ঞাসা করলাম। আমার ফুলের বাগানের এক অংশের কিছু মাটি ধ্বসে পড়েছে। ভিতরে অনেকদূর দেখা যায়। কি ব্যাপার এখানে কি আছে? কেউ বলে ভিতরে কিছু নিশ্চয়ই হবে। কোনোদিন এই ঘটনা ঘটে নাই। মাটি ধ্বসে নিচের দিকে গিয়াছে। আমি দেখলাম জমাদার ছুটে এসেছে। চীফ হেডওয়ার্ডারকে খবর দেওয়া হয়েছে। কি করা যায়? আমি আমার মেট, পাহারা মেম্বরকে বললাম, পুরনো আমলের একটি পানির কুয়া ছিল বলে মনে হয়। জায়গাটি গোলাকার, চারদিকে ইট দিয়ে বাঁধা। অনেকেই বলল, তাই হবে। এরপর শুনলাম জেলার সাহেবকে খবর দেওয়া হয়েছে। জেলার সাহেব দেখতে আসবেন। তখন আমি হাসতে হাসতে বললাম, মনে হয় ভিতরে কিছু আছে। জেলখানার এই জায়গাটি শায়েস্তা খানের আমলে লালবাগ ফোর্টের অংশ ছিল। এখানে নবাবদের ঘোড়াশালা, হাতিশালাও ছিল। আমি যে ঘরটিতে থাকি সেটা ঘোড়া থাকার মতোই ঘর। দেখলে বোঝা যাবে এখানে ঘোড়াই রাখা হতো।
ইংরেজরা এই অংশটাকে কয়েদখানায় পরিণত করেছে। আমি হাসতে হাসতে বললাম, এই গর্তের মধ্যে টাকা পয়সা সোনা রুপা পাওয়া যেতে পারে। অনেকেই গম্ভীর হয়ে শুনল। অনেকে বিশ্বাস করতেও আরম্ভ করল। জেলার সাহেব জেলের ডিআইজি সাহেবকেও খবর দিলেন। এটা বন্ধ করা চলবে না, যে পর্যন্ত এটিকে ভাল করে না দেখা হবে। চিত্ত বাবুর সাথে সামান্য আলাপ করলাম দূর থেকে। যদিও খুব কাছে থাকেন, তবে তার সেল ছেড়ে বাইরে আসার হুকুম নাই। তাঁকে বরিশাল থেকে নিয়ে এসেছে। কি জন্য এনেছে তিনি বলতে পারেন না। তাকেও আলাদা করে রাখার হুকুম। তবে তার সাথে একজনকে রাখা হয়েছে।
আজও খুব বৃষ্টি হলো। বৃষ্টি হলেই কেমন যেন হয়ে যায় মনটা। লাইব্রেরিতে বই আনতে পাঠালাম। আজ আর বই পাওয়া যাবে না। আমার নিজের কিছু বই আছে, কয়েকদিন চালাতে পারব।
ভয়াবহ বন্যায় পূর্ব বাংলার মানুষ সর্বস্বান্ত হয়ে গেল। প্রত্যেক বৎসর এ রকম হলে মানুষ বাঁচবে কেমন করে? এখনই দেশের অবস্থা খারাপ। তারপর আছে ট্যাক্স বা কর। আবার বন্যায় ফসল নষ্ট। এই দেশের হতভাগা লোকগুলি খোদাকে দোষ দিয়ে চুপ করে থাকে। ফসল নষ্ট হয়েছে, বলে আল্লা দেয় নাই, না খেয়ে আছে, বলে কিসমতে নাই। ছেলেমেয়ে বিনা-চিকিৎসায় মারা যায়, বলে সময় হয়ে গেছে বাঁচবে কেমন করে! আল্লা মানুষকে এতো দিয়েও বদনাম নিয়ে চলেছে। বন্যা তো বন্ধ করা যায়, দুনিয়ায় বহু দেশে করেছে। চীন দেশে বৎসরে বৎসরে বন্যায় লক্ষ লক্ষ একর জমি নষ্ট হতো। সে বন্যা তারা বন্ধ করে দিয়েছে। হাজার কোটি টাকা খরচ করে ক্রুগ মিশনের মহা পরিকল্পনা কার্যকর করলে, বন্যা হবার সম্ভাবনা থাকে না। এমনকি বন্যা হলেও, ফসল নষ্ট করতে পারবে না। এ কথা কি করে এদের বোঝাব! ডাক্তারের অভাবে, ওষুধের অভাবে, মানুষ অকালে মরে যায়-তবুও বলবে সময় হয়ে গেছে। আল্লা তো অল্প বয়সে মরবার জন্য জন্ম দেয় নাই। শোষক শ্ৰেণী এদের সমস্ত সম্পদ শোষণ করে নিয়ে এদের পথের ভিখারি করে, না খাওয়াইয়া মারিতেছে। না খেতে খেতে শুকায়ে মরছে, শেষ পর্যন্ত না খাওয়ার ফলে বা অখাদ্য খাওয়ার ফলে কোনো একটি ব্যারাম হয়ে মরছে, বলে কিনা আল্লা ডাক দিয়েছে আর রাখবে কে?
কই গ্রেট বৃটেনে তো কেউ না খেয়ে মরতে পারে না। রাশিয়ায় তো বেকার নাই, সেখানে তো কেহ না খেয়ে থাকে না, বা জার্মানি, আমেরিকা, জাপান এই সকল দেশে তো কেহ শোনে নাই-কলেরা হয়ে কেহ মারা গেছে? কলেরা তো এসব দেশে হয় না। আমার দেশে কলেরায় এত লোক মারা যায় কেন? ওসব দেশে তো মুসলমান নাই বললেই চলে। সেখানে আল্লার নাম লইবার লোক নাই একজনও; সেখানে আল্লার গজব পড়ে না। কলেরা, বসন্ত, কালাজ্বরও হয় না। আর আমরা রোজ আল্লার পথে আজান দিই, নামাজ পড়ি, আমাদের ওপর গজব আসে কেন? একটা লোক না খেয়ে থাকলে ঐ সকল দেশের সরকারকে দেশ ছেড়ে পালাতে হয়। আর আমার দেশের হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ লোক দিনের পর দিন না খেয়ে পড়ে আছে, সরকারের কোনো কর্তব্য আছে বলে মনেই করে না।
তাই আমাদের দেশের সরকার বন্যা এলেই বলে ‘আল্লার গজব’। কিছু টাকা দান করে। কিছু খয়রাতি সাহায্য ও ঋণ দিয়ে খবরের কাগজে ছেপে ধন্য হয়ে যায়। মানুষ এভাবে কতকাল চলতে পারবে সে দিকে ভ্রুক্ষেপ নাই। বড় লোকদের রক্ষা করার জন্যই যেন আইন, বড়লোকদের আরও বড় করার জন্যই মনে হয় সিপাহি বাহিনী। এই দেশের গরিবের ট্যাক্সের টাকা দিয়েই আজ বড় বড় প্রাসাদ হচ্ছে, আর তারা দু’বেলা ভাত পায় না। লেখাপড়া, চিকিৎসা ও থাকার ব্যবস্থা ছেড়েই দিলাম। বন্যায় শত শত কোটি টাকার জাতীয় সম্পদ নষ্ট হয়ে যাইতেছে প্রত্যেক বৎসর। সেদিকে কারও কোনো কর্তব্য আছে বলে মনে হয় না।
পাকিস্তানে রাজধানী একটা আছে করাচীতে, আরও দুইটা রাজধানী তৈয়ার করিতেছে। একটা রাওয়ালপিন্ডি, আধা রাজধানী, আর একটা রাওয়ালপিন্ডি থেকে ১২ মাইল দূরে ইসলামাবাদে। খরচ হবে ৫০০ কোটি টাকা। পূর্ব বাংলায় একটা তথাকথিত উপ রাজধানী শহরের সেরা জায়গা নিয়ে করছে।
একে রাজধানী না, পূর্ব বাংলাকে ধোঁকা দেওয়ার জন্য প্রোপাগান্ডা রাজধানী করা হতেছে।
পশ্চিম পাকিস্তানের করাচী পূর্বেই রাজধানী ছিল, তারপর মধ্যবর্তী রাজধানী রাওয়ালপিন্ডি। তারপর ইসলামাবাদ। আর পূর্ব বাংলার বন্যা বন্ধ করার জন্য টাকার অভাব! এ দুঃখের কথা কাকে জানাব।
বাংলাদেশ শুধু কিছু বেঈমান ও বিশ্বাসঘাতকদের জন্যই সারাজীবন দুঃখ ভোগ করল। আমরা সাধারণত মীর জাফর আলি খার কথাই বলে থাকি। কিন্তু এর পূর্বেও ১৫৭৬ সালে বাংলার স্বাধীন রাজা ছিল দাউদ কারানী। দাউদ কারানীর উজির শ্রীহরি বিক্রম-আদিত্য এবং সেনাপতি কাদলু লোহানী বেঈমানি করে মোগলদের দলে যোগদান করে। রাজমাবাদের যুদ্ধে দাউদ কারানীকে পরাজিত, বন্দি ও হত্যা করে বাংলাদেশ মোগলদের হাতে তুলে দেয়। এরপরও বহু বিশ্বাসঘাতকতা করেছে এই বাঙালি জাত। একে অন্যের সাথে গোলমাল করে বিদেশি প্রভুকে ডেকে এনেছে লোভের বশবর্তী হয়ে। মীরজাফর আনলো ইংরেজকে, সিরাজদ্দৌলাকে হত্যা করল বিশ্বাসঘাতকতা করে। ইংরেজের বিরুদ্ধে এই বাঙালিরাই প্রথম জীবন দিয়ে সংগ্রাম শুরু করে; সিপাহি বিদ্রোহ শুরু হয় ব্যারাকপুর থেকে। আবার বাংলাদেশে লোকের অভাব হয় না ইংরেজকে সাহায্য করবার। ইংরেজদের বিরুদ্ধে আন্দোলনরত এই মাটির ছেলেদের ধরিয়ে দিয়ে ফাঁসি দিয়েছে এদেশের লোকেরাই সামান্য টাকা বা প্রমোশনের জন্য।
পাকিস্তান হওয়ার পরেও দালালি করার ললাকের অভাব হলো না—যারা সব কিছুই পশ্চিম পাকিস্তানে দিয়ে দিচ্ছে সামান্য লোভে। বাংলার স্বার্থ রক্ষার জন্য যারা সংগ্রাম করছে তাদের বুকে গুলি করতে বা কারাগারে বন্দি করতে এই দেশে সেই বিশ্বাসঘাতকদের অভাব হয় নাই। এই সুজলা-সুফলা বাংলাদেশ এত উর্বর; এখানে যেমন সোনার ফসল হয়, আবার পরগাছা আর আগাছাও বেশি জন্মে। জানি না বিশ্বাসঘাতকদের হাত থেকে এই সোনার দেশকে বাঁচানো যাবে কিনা!
ইত্তেফাক কাগজ বন্ধ, মনের খোরাক তো পাওয়া যাবে না। তবুও কাগজগুলি বসে বসে দেখি। ইত্তেফাক বন্ধ করল কে?
বিকালে সিনিয়ার ডিপুটি জেলার সাহেব আসলেন সেই গর্ত দেখতে। বললাম, দেখুন তো কিছু পাওয়া যায় কিনা এর ভিতরে। ভদ্রলোক হিন্দু। ভয়েতে আমার সাথে বেশি কথা বলেন না। হা-না, বলেই কেটে পড়তে পারলে বাচেন। চলে গেলে শুনলাম এটা এইভাবেই থাকবে, আগামীকাল ডিআইজি সাহেব দেখে যাহা বলবেন তাহাই করা হবে।
খেতেই আমার ইচ্ছা হয় না যেন কেন। অসুস্থ হয়ে পড়ার পর থেকে এই অবস্থা হয়েছে। খেতে ইচ্ছাও বেশি হয় না। মেট ও বাবুর্চি বলে, তবে পাকাই কেন, যদি কিছু না-ই খাবেন? বললাম, তোমরা খাও। যা খাই তাতেই আমার চলবে। রাত্র শুরু হয় আমাদের সন্ধ্যা থেকে, কারণ সন্ধ্যার পরেই জেলখানার সব দরজা বন্ধ। সমস্ত কয়েদিদের বাইরে থেকে তালা বন্ধ করে দেওয়া হয় সূর্যাস্ত হওয়ার সাথে সাথেই। এত বড় রাত কাটানো খুব কষ্টকর। আজ আর ঘুমাতে পারলাম না। মেহেরবানি করে একটা পাগল ক্ষেপে গিয়ে চিৎকার শুরু করেছে। দিনের বেলা হলে একটা বন্দোবস্ত হতো, পাগলা সেলের অন্যপাশেও সেল আছে। কিন্তু রাতে কোনো উপায় নাই। তাই আল্লা আল্লা করে রাতটা কাটাতে হলো।