“লাঈছ বিন মোশান এবং ইউহাওয়া যারীদ বিন মুসায়্যিবকে মুহাম্মাদকে হত্যার উদ্দেশ্যে গড়ে তুলেছিল।” খালিদ কথাটি এমন ভঙ্গিতে বলে যার মধ্যে হাল্কা বিদ্রুপের ছোঁয়াও ছিল– “যারীদ মুসলমানদের হাতে নিহত হয় আর ইউহাওয়ার পরিণাম তো তোমরা তোমাদের চোখেই দেখেছ। এসব থেকে কিছু অনুধাবন করেছ আবু যুরাইয?”
“হ্যাঁ, আমি বুঝেছি।” বৃদ্ধ আবু যুরাইয জবাবে বলে, “লাঈছের জাদু থেকে মুহাম্মাদের জাদু অনেক শক্তিশালী। মানুষ ঠিকই বলে যে, মুহাম্মাদের হাতে জাদু আছে। এই জাদুরই নৈপুণ্য যে, মানুষ দলে দলে তার ধর্ম গ্রহণ করে চলেছে।… আর যাই বল, যারীদের হত্যাই প্রাপ্য ছিল।”
খালিদ বলেন “প্রিয় বন্ধু! ঐ প্রেতাত্মার ঘটনা নিশ্চয় মদীনায় পৌঁছে থাকবে। কিন্তু আমার বিশ্বাস সেখানে কেউই ভীতু নয়। ভীত হওয়া তো দূরের কথা মুহাম্মাদের অনুসারীরা তাও হয়ত বিশ্বাস করবে না যে, এটা কোন জিন, ভূত বা প্রেতাত্মা।”
“মুহাম্মাদের অনুসারীদের ভয় পাওয়ারই বা কি দরকার।” আবু যুরাইয বলে– “মুহাম্মাদের জাদু মদীনার চতুর্দিকে পরিবেষ্টিত। মুহাম্মাদকে কখনই হত্যা করা যাবে না। সে উহুদ যুদ্ধে মারাত্মকভাবে আহত হয়েও যথারীতি বেঁচে যায়। তোমাদের এবং আমাদের সম্মিলিত বিশাল বাহিনী মদীনার এক একটি ইট খুলে নিতে গেলে এমন ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় হয় যে, আমাদের সৈন্যরা প্রাণ নিয়ে পালিয়ে যায়। রণাঙ্গনে যেই মুহাম্মাদের সামনে গেছে সেই অস্ত্র সমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছে।… আরো একবার মুহাম্মাদের হত্যা প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার কথা জান?”
“শুনেছি।” খালিদ বলেন– “পুরোপুরি জানি না।”
“এটা খায়বারের ঘটনা” আবু যুরাইয বলে– “মুসলমানরা খায়বারে ইহুদীদের উপর হামলা করলে তারা মোকাবিলায় একদিনও টিকতে পারিনি।”
‘ধোঁকাবাজ জাতি ময়দানে লড়তে পারে না।” খালিদ বলেন– “ইহুদীরা অসি নয়, মগজ চর্চায় বেশ পটু। তারা আক্রমণ করে পিঠে, বুকে নয়।”
“তারা খায়বারে এমন করে।” আবু যুরাইয বলে– ইহুদীরা যদিও মোকাবিলা করে কিন্তু আগে থেকেই তাদের মধ্যে “মুহাম্মাদ ছিল ত্রাস’। আমি শুনেছি, মুসলমানরা খায়বারে আক্রমণ করতে এলে ইহুদীরা মোকাবিলা করতে নেমে আসে। তাদের অনেকেই মুহাম্মাদকে চিনত। একজন জোরে বলে ওঠে, মুহাম্মাদও এসেছে। পরে অন্যজনও চিৎকার করে বলে, মুহাম্মাদও এসেছে। ইহুদীরা যুদ্ধে নামলেও তাদের মধ্যে ‘মুহাম্মাদ ভীতি’ এত বেশী সঞ্চারিত হয় যে, প্রতিরোধ যুদ্ধে হাতিয়ার কে কার আগে গিয়ে সমর্পণ করবে এই প্রতিযোগিতায় মেতে উঠে।”
আবু যুরাইয খালিদকে খায়বার যুদ্ধের বিবরণ শুনিয়ে এক এক করে ইহুদী নারীর কাহিনীও শুনায়। খায়বার বিজয়ের পর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেখানে কয়েকদিন অবস্থান করেন এবং বনী আদীর ভাই আনসারীকে খায়বারের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। খায়বার বিজয়ের পর এখানে গণিমতের মাল ভাগ করার সময় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন– “ভবিষ্যৎ উম্মতের দারিদ্রের আশঙ্কা আমার না থাকলে প্রত্যেক বিজিত অঞ্চল মুজাহিদদের মধ্যে ভাগ করে দিতাম। বিজিত অঞ্চল, দেশকে ভবিষ্যৎ উম্মতের জন্য উত্তরাধিকার হিসেবে রেখে যাব।”
ইহুদীরা পরাস্ত হলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে ঘনিষ্ঠতা প্রকাশ করা আরম্ভ করে এমন কিছু দৃশ্যের অবতারণা করে, যার প্রত্যেকটি প্রমাণ করে যে, মুসলমানদের মহব্বতে ইহুদীদের হৃদয় ভরপুর। খায়বারে অবস্থানকালীন সময় এক ইহুদী মহিলা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে তার গৃহে খানার দাওয়াত দেয়। সে মহিলা এমন আবেগময় ভঙ্গিতে ভক্তি-শ্রদ্ধা প্রকাশ করে যে, তাকে নিরাশ করা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উচিত মনে করেননি। তিনি মহিলার বাড়ি যান। তাঁর সাথে বিশর নামে এক সাহাবীও ছিলেন। ইহুদী মহিলা যয়নব বিনতে হারেস রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানায় এবং তাঁর সামনে খানা পেশ করে মহিলা আস্ত দুম্বা ভুনা করেছিল। সে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে জিজ্ঞেস করে, দুম্বার শরীরের কোন অংশ আপনার পছন্দ? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাহুর কথা বলেন। এবং মহিলা দুম্বার বাহু কেটে আনে এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও হযরত বিশর রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর সামনে এনে রেখে দেয়।
হযরত বিশর রাযিয়াল্লাহু আনহু একটি গোস্তের টুকরো কেটে মুখে দিয়ে গিলে ফেলেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও একটি টুকরো মুখে দেন কিন্তু না গিলেই থু-থু করে ফেলে দেন।
“বিশর! খেয়ো না। কারণ এই গোস্তে বিষ মিশ্রিত রয়েছে।”
হযরত বিশর ইতোমধ্যেই এক টুকরো গিলে ফেলায় গোস্তের সাথে সাথে বিষও তার পেটে গিয়ে পৌঁছে।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন– “কি হে ইহুদীনী। আমার কথা সত্য নয় যে, তুমি এই গোস্তে বিষ মিশিয়েছ?”
ইহুদীনীর পক্ষে অস্বীকার করা সম্ভব হয়নি। তার অপরাধের প্রমাণ সামনে চলে আসে। হযরত বিশর রাযিয়াল্লাহু আনহু গলায় হাত দিয়ে উঠে দাঁড়ান এবং ঘুরে পড়ে যান। বিষ এত তীব্র ছিল যে, তিনি আর উঠতে পারেননি। বিষের যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে মরে যান।
“মুহাম্মাদ! শুনে রাখ” ইহুদীনী গর্বের সাথে স্বীকার করে বলে– “খোদার কসম! এটা আমার দায়িত্ব ছিল। আমি আমার দায়িত্ব পালন করেছি মাত্র।”
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সে ইহুদীনী এবং তার স্বামীকে হত্যার নির্দেশ দেন। খায়বারে ইহুদীদের সাথে তিনি যে সহানুভূতিমূলক আচরণ করতে চেয়েছিলেন এই ইহুদী নারীর জঘন্য মনোবৃত্তির কারণে তা পরিবর্তন করেন।
ইবনে ইসহাক লিখেন–“মারওয়ান বিন উসমান আমাকে বলে যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইন্তেকালের ২/৩ দিন পূর্বে তার পাশে বসা উম্মে বিশরকে বলেছিলেন উম্মে বিশর। আমি আজও দেহে ঐ বিষের প্রভাব অনুভব করছি যা খায়বারের জনৈকা ইহুদীনী গোস্তের সাথে মিশিয়েছিল। আমি গোশত মুখে দিয়েই উগরে দিয়েছিলাম। কিন্তু সেই বিষের প্রতিক্রিয়া আজও রয়েছে। এর মধ্যে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অন্তিম পীড়ার কারণ ছিল এই বিষই।
খালিদ বলেন– “মুহাম্মাদকে হত্যা করা কারো পক্ষে সম্ভব নয়।”
আবু যুরাইয বলে– “তার জাদু আর কতদিন চলবে? একদিন না একদিন তাকে হত্যার শিকার হতেই হবে।…” আবু যুরাইয খালিদের কাছে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করে– “মুহাম্মাদকে হত্যার কোন পরিকল্পনা তুমি করেছ?”
“কয়েকবার।” খালিদ জবাব দেন– “যেদিন আমার গোত্র বদরের ময়দানে পরাজিত হয় সেদিন থেকে স্বহস্তে মুহাম্মাদকে হত্যার ফিকির করছি। কিন্তু আমার কোন পরিকল্পনা কার্যকর হচ্ছে না।
আবু যুরাইয আগ্রহের সাথে বলে– “পরিকল্পনা আমাকে বলবে কি?”
“কেন নয়?” খালিদ জবাবে বলেন– “খুবই সাধাসিধে পরিকল্পনা। আর তা হলো খোলামাঠে সামনা-সামনি লড়াই করে মুহাম্মাদকে হত্যা করা কিন্তু একটি বাহিনীর বিরুদ্ধে আমার একার পক্ষে লড়াই করা সম্ভব নয়। পরপর তিন যুদ্ধে আমরা পরাজিত হয়েছি।
“খোদার কসম!” আবু যুরাইয হাসিতে ফেটে পড়ে বলে– আমি ভাবতেও পারিনি যে, ওলীদের বেটা এমন বোকা হতে পারে। আমি ইহুদীদের মত গোপন পরিকল্পনার কথা বলছি। আমি প্রতারণার পন্থার কথা বলছি। সামনা-সামনি লড়াই করে তুমি মুহাম্মাদকে কখনও হত্যা করতে পারবে না।”
“প্রতারণার মাধ্যমেও তুমি তাকে হত্যা করতে পারবে না।” খালিদ বলেন– “প্রতারণা কখনো সফল হয় না।”
বৃদ্ধ আবু যুরাইয খালিদের প্রতি ঝুঁকে পড়ে তার উন্মুক্ত বক্ষে হাতের আঙ্গুলের মাথা রেখে বলে– “অন্য কারো প্রতারণা ব্যর্থ হতে পারে কিন্তু ইহুদীদের প্রতারণা ব্যর্থ হবে না। কারণ হলো, প্রবঞ্চনা ইহুদীদের ধর্মের অংশ। আমি লাঈছ বিন মোশানের অন্তরঙ্গ বন্ধু। তার একটি কথা তোমাকে শুনাচ্ছি। লোকটি অত্যন্ত বিজ্ঞ। তার কথায় জাদু ভরা। সে তোমাকে কথার দ্বারাই জাদুগ্রস্ত করে দিতে পারে। সে বলে, বছরের পর বছর লেগে যাক, এমনকি কয়েক শতাব্দী লেগে গেলে অবশেষে ইহুদীবাদেরই বিজয় হবে। দুনিয়াতে সফলতা লাভ করলে একমাত্র প্রতারণাই কামিয়াব হবে। মুসলমানরা এখনও সংখ্যায় কম, ফলে তাদের মধ্যে একতা রয়েছে। এই সংখ্যা যখন বৃদ্ধি পাবে ইহুদীরা তখন তাদের মাঝে এমন বিভেদ সৃষ্টি করে দেবে যে, মুসলমানরা গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে। অথচ তারা ঘুণাক্ষরেও জানবে না যে, এর নাটের গুরু কে। মুহাম্মাদ তাদেরকে এক মঞ্চে রাখতে আর কতদিনই-বা বেঁচে থাকবে।”
খালিদ দাঁড়িয়ে যান। আবু যুরাইযও উঠে দাঁড়ায়। খালিদ দুই হাত সামনে প্রসারিত করে দেন। আবু যুরাইয তার হস্তদ্বয় নিজের হস্তদ্বয়ে পুরে নেয়। করমর্দন করে খালিদ স্বীয় অশ্বে চড়ে বসেন।
“কোথায় যাচ্ছ? তুমি তো বলে গেলে না” বিদায় মুহূর্তে আবু যুরাইয তাঁর গন্তব্য জানতে চেয়ে বলে।
খালিদ দৃঢ় কণ্ঠে বলেন “মদীনা!”
আবু যুরাইয শক খাওয়ার মত আঁৎকে উঠে জিজ্ঞাসা করে– “মদীনা?” “কি করতে যাচ্ছো সেখানে নিজের শত্রুর কাছে?”
“আমি মুহাম্মাদের জাদু দেখতে যাচ্ছি।” খালিদ তার কথা পূর্ণ করতে না দিয়েই ঘোড়া ছুটিয়ে দেন।
♣♣♣
কিছুদূর অগ্রসর হয়ে খালিদ পেছনে ফিরে দেখেন। আবু যুরাইযের কাফেলা দৃষ্টিগোচর হয় না। তিনি নিম্নভূমি ছেড়ে বেশ দূরে চলে গিয়েছিলেন। ঘোড়ার গতি কমিয়ে দেন। এ সময় আওয়াজ হতে থাকে “মুহাম্মাদ… জাদুকর।… মুহাম্মাদের জাদুতে শক্তি আছে।”
“না… না” তিনি মাথা ঝাঁকি দিয়ে নিজেকে নিজে বলেন– “মানুষ যেটা বুঝতে সক্ষম হয় না তাকে জাদু বলে চালিয়ে দিতে চায়। আর যার সামনে দাঁড়াতে পারে না তাকে জাদুকর বলে।… তারপরেও… রহস্য অবশ্যই কিছু না কিছু আছেই।… মুহাম্মাদের মধ্যে অলৌকিক কিছু অবশ্যই আছে।”
স্মৃতি তাকে কয়েকদিন পূর্বে টেনে নিয়ে যায়। আবু সুফিয়ান তাকে, ইকরামা এবং সফওয়ানকে বলেছিল যে, মুসলমানরা মক্কা হামলা করতে আসছে। দু’উষ্ট্রারোহীর মাধ্যমে আবু সুফিয়ান এ তথ্য জানতে পারে। তারা মুসলিম বাহিনীকে মক্কার দিকে ধেয়ে আসতে দেখেছিল।
খালিদ বাছাই করা তিনশত অশ্বারোহী নিয়ে পথিমধ্যেই মুসলমানদের প্রতিরোধ করতে পাহাড়ের খাদে খাদে পূর্ব থেকেই ঘাপটি মেরে থাকতে রওনা হয়। এ দুর্ধর্ষ বাহিনীকে তীব্রবেগে ছুটিয়ে নিয়ে যান তিনি। ত্রিশ মাইল দূরের একটি বিস্তীর্ণ পাহাড়ী অঞ্চল ছিল তার টার্গেট। তিনি জানতে পেরেছিলেন যে, মুসলিম বাহিনী ‘কারাউল গামীম’ থেকে এখনও বেশ দূরে। খালিদ চাচ্ছিলেন, মুসলিম বাহিনী আসার পূর্বে এখানে পৌঁছতে।
কারাউল গামীম মক্কা থেকে ত্রিশ মাইল দূরবর্তী পাহাড় অধ্যুষিত একটি এলাকার নাম। শত্রুর উদ্দেশে ওঁৎ পেতে থাকার জন্য স্থানটি খুবই উপযোগী ছিল। মুসলিম বাহিনী ইতোপূর্বেই সেখানে পৌঁছে গেলে হামলা চালানো দুঃসাধ্য হয়ে পড়বে।
তিনি পথিমধ্যে মাত্র দুই স্থানে যাত্রাবিরতি করেন। তিনি উভয় বিরতি স্থলে অশ্বারোহী বাহিনীকে উদ্দেশ করে ভাষণ দিতে গিয়ে বলেন– “এটা আমাদের জন্য অগ্নি পরীক্ষা। গোত্রের মান-মর্যাদা আমাদের উপরই নির্ভরশীল। আমরাই পারি তা রক্ষা করতে। পূর্ব পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে চাই আমরা। কারাউল গামীমের পাহাড়ী চক্করে ফেলে যদি আমরা মুসলিম বাহিনীকে বাধা দিতে না পারি তাহলে নিশ্চিত মক্কা মুসলমানদের পদানত হবে। আমাদের ভগ্নি, কন্যা তাদের বাঁদী দাসীতে পরিণত হবে। আমাদের সন্তানেরা তাদের গোলামে পরিণত হবে। উযযা এবং হুবলের নামে শপথ কর যে, আমরা কুরাইশ এবং মক্কার মর্যাদা রক্ষায় জীবন উৎসর্গ করব।”
তিনশ সৈন্যের সকলেই একযোগে গগন বিদারী শ্লোগান তোলে উযযা এবং হুবলের নামে আমরা জীবন কুরবান করব। একজন মুসলমানও জিন্দা ফিরে যেতে দেবো না।… কারাউল গামীমে মুসলমানদের রক্তগঙ্গা বইবে। মুহাম্মাদকে জীবিত ধরে মক্কায় নিয়ে যাব।… মুসলমানদের মাথার খুলি মক্কায় নিয়ে যাব।… কেটে টুকরো টুকরো করব।… মুছে ফেলব নাম-নিশানা।
তিনশ সৈন্যের এই দীপ্ত শপথে হযরত খালিদের বুক গর্বে ফুলে যায়। তিনি ওঁৎ পাতার জন্য খুবই উপযুক্ত জায়গা বেছে নেন। কার্যকর পরিকল্পনা তিনি হাতে নেন। তিনি শুধু অশ্বারোহী বাহিনী এই উদ্দেশ্যে নিয়ে যান যে, মুসলমানদের ইতস্তত বিক্ষিপ্ত করবেন এবং আচমকা আক্রমণ করে চোখের পলকে অদৃশ্য হয়ে যাবেন। মুসলমানদের অধিকাংশই ছিল পদাতিক। খালিদের বিশ্বাস ছিল যে, তিনশ দুর্ধর্ষ সৈন্য দ্বারা তিনি এক হাজার চারশ মুসলমানকে ঘোড়ার পদতলে পিষ্ট করে মারবেন। নিজস্ব সমর পরিকল্পনা ও বিচক্ষণতার উপর তার এতই আস্থা ছিল যে, তীরন্দাজ বাহিনী আনারও প্রয়োজন অনুমান করেন নি। অথচ পাহাড়ী অঞ্চলে তীরন্দাজ বাহিনীকে উঁচু স্থানে মোতায়েন করলে, নিচ দিয়ে অতিক্রমকারী মুসলমানদের তারা বেছে বেছে শিকার করতে পারত।
সম্মুখে এগিয়ে খালিদ তার বাহিনীকে কিছু সময়ের জন্য থামিয়ে আরেক বার তাদের প্রেরণা চাঙ্গা এবং প্রতিশোধ স্পৃহাকে শান দিয়ে দেন স্বীয় বাহিনীর বীরত্বের উপর তার যথেষ্ট আস্থা ছিল।
মুসলিম বাহিনী তখনও বেশ দূরে ছিল। খালিদ উষ্ট্রচালকের বেশে তিন-চারজনকে আগে পাঠিয়ে দেন। তারা মুসলমানদের সম্পর্কে খালিদকে অবহিত করছিল। কিছুক্ষণ পরপর তারা পালাক্রমে এসে মুসলমানদের গতিবিধি সম্পর্কে জানাচ্ছিল। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু গোয়েন্দাদের রিপোর্ট অনুযায়ী বাহিনীর চলার গতি বাড়াতে থাকেন। মুসলিম বাহিনী রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নেতৃত্বে স্বাভাবিক গতিতে কারাউল গামীমে খালিদের পাতা ফাঁদের দিকে এগুচ্ছিল।
খালিদ এই তথ্যের মর্ম উদ্ধার করতে পারেন না যে, মুসলমানরা সাথে করে বহু দুম্বা এবং বকরী নিয়ে আসছে। তিনি এই প্রশ্নের কোন সদুত্তর বের করতে পারেন না যে, তারা মক্কা আক্রমণ করতে আসছে অথচ দুম্বা, বকরী সাথে করে নিয়ে আসছে কেন?
তাদের মধ্যে হয়ত এই আশঙ্কা এসে থাকবে যে, অবরোধ দীর্ঘ হলে খাদ্য সংকট দেখা দিতে পারে।” খালিদের এক সাথি অভিমত ব্যক্ত করে বাস্ত বিকই এমন হলে তখন তারা এ সমস্ত পশু যবাই করে খাবে।… এ ছাড়া এ সমস্ত পশু কিইবা কাজে লাগতে পারে।”
“বেচারাদের জানা নেই যে, তারা মক্কা পর্যন্ত পৌঁছতেই পারবে না।” খালিদ বলেন– “তাদের কষ্ট করে আনা বকরী-দুম্বা আমরা মজা করে খাব।”
মুসলমানরা কারাউল গামীম থেকে পনের মাইল দূরে থাকতেই খালিদ অভীষ্ট পাহাড়ে এসে ঘাপটি মারেন। তিনি তার বাহিনীকে পাহাড়ের পাদদেশে একে অপর থেকে দূরত্ব বজায় রেখে অবস্থান নিতে বলেন এবং তিনি নিজে সামনে এগিয়ে যান। তিনি সামনের গিরিপথ পর্যন্ত অগ্রসর হন। সেখান দিয়ে কাফেলা এবং সৈন্যরা আসা-যাওয়া করত। তিনি এ স্থান পূর্বে বহুবার অতিক্রম করেছেন কিন্তু গিরিপথটি পূর্বে ঐ দৃষ্টিতে দেখেননি, যে দৃষ্টিতে এখন দেখছেন।
তিনি গিরিপথের ডানে-বামের উঁচু স্থানে উঠে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেন। নিচে নেমে মরু প্রান্তরের পিছনে যান এবং অশ্ব লুকানোর এমন স্থান খুঁজে বের করেন, ইশারা পাওয়া মাত্রই যেখান থেকে অশ্বারোহী বেরিয়ে অতর্কিতে মুসলমানদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে।
মার্চ মাসের শেষ দিন ৬২৮ খ্রিষ্টাব্দ। শীতের মৌসুম হলেও খালিদ এবং তার ঘোড়ার শরীর দিয়ে টপটপ করে ঘাম পড়ছিল। তিনি ঘাঁটি বেছে নিয়ে পুরো গিরিপথের বিভিন্ন স্থানে লুকিয়ে ফেলেন। এতক্ষণ যারা গোয়েন্দাগিরিতে লিপ্ত ছিল তাদেরকে আর সামনে যেতে দেন না। কেননা, মুসলমানরা তাদের মূল পরিচয় জেনে যাবার আশঙ্কা ছিল।
ধীরে ধীরে সময় বয়ে যায়। মুসলমানরাও কাছে চলে আসে। পাহাড়ী ফাঁদের অদুরে এসে তারা রাতের যাত্রাবিরতি করে।
পরদিন প্রত্যুষে ফযরের নামাযের পর মুসলমানরা রওনা হওয়ার জন্য যখন প্রস্তুত হয় তখন এক ব্যক্তি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে আসে।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন– “তোমার অবস্থা বলতে তুমি দৌড়ে দৌড়ে এখানে এসেছ এবং ভাল কোন সংবাদ নিয়ে আসনি।”
“হে আল্লাহর রাসূল!” মদীনার এই লোকটি বলে– “খবর ভালও নয় আবার বেশি খারাপও নয়।… মক্কাবাসীদের আচরণ সন্দেহজনক। আমি গতকাল থেকে কারাউল গামীমের পাহাড়ী এলাকায় ঘুরছি। খোদার কসম! যাদেরকে আমি দেখে এসেছি তারা আমাকে দেখেনি, আমি তাদের পুরো গতিবিধি সরেজমিনে দেখেছি।”
“এরা কারা?” রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞেস করেন।
“কুরাইশরা ছাড়া আর কারা হবে” লোকটি জবাবে বলে– “তারা সকলেই অশ্বারোহী। গিরিপথের আশে-পাশের প্রান্তরে তারা ঘাপটি মেরে বসে আছে।”
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জানতে চান তাদের সংখ্যা কত?
তিন-চারশ’র মাঝামাঝি।” রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ঐ গোয়েন্দা বলেন– “আমার চিনতে ভুল না হয়ে থাকলে তাদের সেনাপতি খালিদ বিন ওলীদ। তার কর্মব্যস্ত তা এবং ছোটাছুটি আমি সারাদিন চুপে চুপে লক্ষ্য করেছি। আমি তার এত কাছে যাই যে, সে আমাকে দেখা মাত্রই হত্যা করে ফেলত। খালিদ অশ্বারোহী দলকে গিরিপথের আশে-পাশে ছড়িয়ে দিয়ে গোপন রেখেছে। আমার ধারণা ভুল না হলে বলব, সে আমাদের অপেক্ষায় ওঁৎ পেতে বসে আছে।”
“আমাদের আগমনের খবর মক্কাবাসী জেনে থাকলে তারা মনে করবে যে, আমরা মক্কা অবরোধ করতে এসেছি।” সাহাবায়ে কিরামের মধ্যে হতে একজন বলেন।
“ঐ সত্তার কসম করে বলছি যার হাতে আমাদের সকলের জীবন।” রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন– “কুরাইশরা আমাকে যুদ্ধের জন্য আহবান করলেও আমি তাদের সাথে সংঘর্ষে যাব না। যে ইচ্ছা নিয়ে আমরা যাত্রা করেছি তা পরিবর্তন করব না। আমাদের লক্ষ্য মক্কায় গিয়ে উমরা পালন করা মাত্র। এই দুম্বা এবং বকরী কেবল কুরবানীর জন্য এনেছি। কুরাইশদের কারণে নিয়ত পরিবর্তন করে আল্লাহ পাককে নাখোশ করব না। রক্তপাত নয় আমরা উমরা করতে এসেছি।
এক সাহাবী জিজ্ঞাসা করেন– “হে আল্লাহর রাসূল।” “তারা গিরিপথে আমাদের গতিরোধ করলে তাদের রক্ত বইয়ে দেয়া তখনও কি আমাদের জন্য বৈধ হবে না?
এক দুই পা করে সাহাবায়ে কিরাম এসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পাশে সমবেত হতে থাকে। সৃষ্ট পরিস্থিতি সহজে উত্তরণের সম্ভাব্য উপায় নিয়ে মুক্ত আলোচনা হয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যুক্তিসঙ্গত মতামত মনোযোগ দিয়ে শুনতেন এবং তদানুযায়ী সিদ্ধান্ত দিতেন।
দীর্ঘ আলোচনা শেষে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। বিশজন চৌকস অশ্বারোহী বাছাই কর। তাদেরকে জরুরী দিক-নির্দেশনা দিয়ে সম্মুখে পাঠাও। তাদের প্রতি নির্দেশ ছিল, তারা কারাউল গামীম পর্যন্ত অতি সতর্কতার সাথে যাবে। তবে গিরিপথে প্রবেশ করবে না। তাদের প্রধান কাজ হলো, খালিদ বাহিনীর গতিবিধি লক্ষ্য করা। যদি খালিদ বাহিনী তাদের উপর হামলা করে তাহলে এভাবে রক্ষণাত্মক কৌশলী লড়াই করবে যে, ধীরে ধীরে পিছু হঁটে চারদিকে ছড়িয়ে পড়বে। তাদের আচার-আচরণ দ্বারা খালিদ বাহিনীকে এটা বুঝাবে যে, তারা মুসলমানদের অগ্রবাহিনী।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক সাথে দু’টি কৌশল গ্রহণ করেন। খালিদ বাহিনীর চোখে ধুলা দিতে অগ্রবাহিনীর বেশে বিশজন অশ্বারোহী তাদের দিকে প্রেরণ করেন। যাতে তারা এদের দেখে মনে করে এবং এই অপেক্ষায় থাকে যে, পেছনে মূল বাহিনী আসছে। সাথে সাথে তিনি অবশিষ্ট মুসলমানদের নিয়ে গতিপথ পরিবর্তন করেন। শত্রুর দৃষ্টি এবং অনর্থক রক্তপাত এড়াতে তিনি স্বাভাবিক রাস্তা ছেড়ে অস্বাভাবিক রাস্তা বেছে নেন। এ পথ যেমনি ছিল দুর্গম তেমনি ছিল দীর্ঘও। পথ বন্ধুর হলেও সংঘর্ষ এড়ানোই ছিল তাঁর মূল লক্ষ্য। সবচেয়ে বড় যে সমস্যা সামনে আসে তা হলো, এই নতুন দুর্গম পথ সম্বন্ধে মদীনাবাসীদের কারো জানা ছিল না।
♣♣♣
খালিদের দৃষ্টি মুসলমানদের অগ্রবর্তী দলটির উপর নিবদ্ধ হয়েছিল। কিন্তু অগ্রবর্তী বিশ অশ্বারোহী গিরিপথের কাছে এসে থেমে যায়। মাঝে মাঝে দুতিন অশ্বারোহী গিরিপথের মুখ পর্যন্ত আসত এবং এদিক-ওদিক লক্ষ্য করে ফিরে যেত। এই বিশজন যদি একত্রেও গিরিপথে প্রবেশ করত তবুও খালিদ তাদেরকে কিছু বলতেন না। কারণ তার আসল শিকার ছিল পেছনে। এই বিশজনের উপর হামলা করে তিনি ওঁৎ পেতে থাকার সংবাদ আগেভাগে প্রচার করতে চান না।
এটা বেশি দিনের ঘটনা নয়। কয়েকদিন পূর্বের মাত্র। একদিকে বিশ অশ্বারোহীর থমকে যাওয়া অপরদিকে দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হওয়া সত্ত্বেও মুসলমানদের মূল বাহিনী এখনও দৃষ্টিগোচর না হওয়ায় খালিদ খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন। সময়ের সাথে সাথে তার স্নায়ুচাপও বৃদ্ধি পেতে থাকে। তাহলে কি মুসলমানরা যাত্রা মুলতবি করেছে? নাকি ওঁৎ পেতে থাকার সংবাদ ফাঁস হয়ে গেছে এই প্রশ্ন তাকে বেকারার করে তোলে। এক সময় সহ্য করতে না পেরে তিনি এক উষ্ট্রারোহীকে ডেকে ছদ্মবেশে বাইরে পাঠান এবং মুসলমানরা এখন কোথায় ও কি করছে তা জেনে আসতে বলেন।
মুসলিম অশ্বারোহীগণ গিরিপথের আশেপাশে আনাগোনা অব্যাহত রাখে। এক-দুবার গিরিপথের মুখে এসে একটু অপেক্ষা করে আবার ফিরে যায়। কয়েকবার তারা অপর প্রান্ত দিয়ে পাহাড়ে প্রবেশ করে। খালিদ সন্তর্পনে সেদিকে যান। কিন্তু সেখান থেকেও তারা এক সময় বেরিয়ে পড়ে। এভাবে বিভিন্ন আচরণের মাধ্যমে বিশ মুসলিম অশ্বারোহী খালিদের দৃষ্টি তাদের দিকে নিবন্ধ রেখে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সহ মুসলমানদেরকে নিরাপদে খালিদ বাহিনীর ধরা-ছোঁয়ার বাইরে চলে যেতে সহযোগিতা করেন। খালিদ মূল বাহিনীকে আক্রমণের আশায় এই বিশজনকে হাতের নাগালে পেয়েও ছেড়ে দেন।
সূর্যাস্তের পর খালিদের প্রেরিত গোয়েন্দা ফিরে আসে।
গোয়েন্দা খালিদকে রিপোর্ট দেয় তারা সেখানে নেই।”
খালিদ তিরস্কারের সুরে জিজ্ঞাসা করেন– “তোমার চোখ কি মানুষ দেখাও ছেড়ে দিয়েছে?”
উষ্ট্রচালক বলে– “কেবল তাদেরকে দেখতে পারে, যারা বিদ্যমান থাকে। যাদের না থাকার কথা বলছি তারা আসলেই নেই। তারা অন্যত্র চলে গেছে। কোন দিকে গেছে তাও আমি বলতে পারি না।”
এ গোয়েন্দা রিপোর্ট খালিদকে গভীর চিন্তার মধ্যে ফেলে দেয়। ইতোমধ্যে পাহাড়ের উপর রজনীর গাঢ় আঁধারের পর্দা চেপে বসায় তার পক্ষে নতুন কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণেরও উপায় ছিল না। তিনি অস্থিরভাবে পায়চারি করতে থাকেন। হঠাৎ তার মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। মুসলমানদের অগ্রবর্তী যে দলটি গত কয়দিন ধরে এখানে রহস্যজনকভাবে ঘুরাফেরা করছে তাদের গ্রেপ্তার করে তথ্য সংগ্রহের সিদ্ধান্ত নেন তিনি। কিন্তু ততক্ষণে অনেক বিলম্ব হয়ে গেছে। তিনি অনুভব করেন যে, অগ্রবর্তী দলটিও আর আগের জায়গায় নেই। অন্যদিন ঘোড়ার হ্রেষা ধ্বনি ভেসে আসলেও আজ সে স্থানটি নীরব।
সকালে সূর্য যথারীতি উদিত হয়। পৃথিবীকে আঁধারের কবল থেকে মুক্ত করে মুঠি মুঠি আলো বিলিয়ে দেয়। কিছুক্ষণ পূর্বে যেখানে আঁধারের চাদর ছিল এখন সেখানে সোনালী আস্তরণ। এ প্রভাত মদীনাবাসীর জন্য আনন্দ বয়ে নিয়ে এলেও খালিদ বাহিনীর ব্যর্থতাকে আরো ব্যাপৃত করে। খালিদ ভোর হতেই গিরিপথ থেকে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসেন। কিন্তু হঠাৎ তার মুখ ম্লান হয়ে যায়। সারারাত যা ধারণা করেছিল তাই বাস্তব হল। অগ্রবর্তী দলটির কোন খোঁজ নেই। আশে-পাশে খুঁজেও তাদের টিকিটিও ধরা যায় না। চরমভাবে নিজের ব্যর্থতা অনুভব করতে থাকেন। মনের ইচ্ছা এবং সমস্ত যুদ্ধ পরিকল্পনা মাটির সাথে মিশে যায়। একবার তার মনে হয়েছিল, নিজেই আসফান পর্যন্ত গিয়ে খবর নিয়ে আসবেন। কিন্তু ধরা পড়ার ভয়ে সে পরিকল্পনা বাতিল করেন। চতুর্দিকে নজর রাখতে দুই-তিনজন সৈন্যকে উঁচু উঁচু পাহাড়ে অবস্থানের নির্দেশ দেন।
অর্ধ দিন চলে যায়। সন্তোষজনক কোন সংবাদ আসে না। মুসলমানদের অগ্রবর্তী বাহিনীর বিশ অশ্বারোহীরও হদিস নেই। তার আশা ছিল যে অগ্রবর্তী বাহিনী আবার আসবে। কিন্তু না, তাদের টিকিটিও পাওয়া যায় না। মধ্যাহ্নে কাছাকাছি সময়ে তার এক অশ্বারোহী দ্রুত ঘোড়া হাকিয়ে তার কাছে এসে থামে।
অশারোহী দ্রুতকণ্ঠে বলে– “শীঘ্র আমার সাথে আসুন। যা আমি দেখেছি তা আপনিও দেখবেন।”
খালিদ উদ্বেগের সাথে জানতে চান “তুমি কি দেখেছ?” অশ্বারোহী বলে– “উৎক্ষিপ্ত ধূলি। এমন ধূলি কোন কাফেলার হতে পারে না। তারা মুসলিম বাহিনী এটা কি হতে পারে না?”
খালিদ সঙ্গে সঙ্গে ঘোড়া ছুটিয়ে পাহাড়ী এলাকার বাইরে চলে আসেন। তিনি জমীন থেকে ধুলিঝড় উঠতে দেখেন।
খালিদ বলেন– “মহান দেবতার কসম মুহাম্মাদের মত বিচক্ষণ কুরাইশ গোত্রে আর একজনও নেই। সে আমার ধরা-ছোঁয়ার বাইরে চলে গেছে।”
মুসলমানরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নেতৃত্বে কারাউল গামীমের অপর পাশ দিয়ে মক্কার দিকে এগিয়ে গিয়েছিল। অগ্রবর্তী দলের বিশ অশ্বারোহীও বহুদূর ঘুরে পাহাড় অতিক্রম করে রাতেই মূল বাহিনীর সাথে গিয়ে মিলিত হয়। খালিদ ঘোড়া ঘুরিয়ে ছুটে চলেন। তিনি কারাউল গামীমের ভিতরে প্রবেশ করে চিৎকার এবং ঘোড়া নিয়ে পায়চারি করতে থাকেন।
“সবাই বেরিয়ে এস। মদীনাবাসীরা মক্কায় চলে গেছে। সকলে সামনে এস।”
মুহুর্তে ৩‘শ অশ্বারোহী তার সম্মুখে এসে দাঁড়ায়।
খালিদ অশ্বারোহীদের সম্বোধন করে বলেন– “তারা আমাদের চোখে ধুলা দিয়ে গেছে। তোমরা হয়ত বিশ্বাস করবে না যে, তারা চলে গেছে কেননা, এই গিরিপথ ব্যতীত এ এলাকা অতিক্রম করার দ্বিতীয় কোন পথ নেই।… এখন আমাদের জীবন-মরণ নিয়ে খেলতে হবে। সামান্য অলসতা করলেই তারা মক্কা ঘিরে ফেলবে। তারা বাজিতে জিতে যাবে। বুদ্ধির পরীক্ষায় হেরে যাব আমরা।”
আজ মদীনায় যাবার সময় মদীনার উপকণ্ঠে পৌঁছে খালিদের আরো মনে পড়ে যে, মুসলমান কর্তৃক মক্কা অবরোধের শঙ্কা তার থাকলেও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এই অপরূপ চালে তিনি ধন্য ধন্য করে উঠেছিলেন। তিনি নিজেও বড় যুদ্ধবাজ এবং অনুপম কুশলী ছিলেন। তিনি পরে অনুধাবন করতে পেরেছিলেন যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার বাহিনীকে ধোঁকা দিতে অগ্রবর্তী দলটি পাঠিয়েছিলেন। তারা সফলভাবে ধোঁকা দিতে পেরেছে। বিশজনের প্রতি তার দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে নিজে অন্য রাস্তা দিয়ে বেরিয়ে যান।
এটা জাদু নয়।” খালিদ মনে মনে বলেন– “নেতৃত্ব আমার হাতে এলে আমিও এমন চাল দেখাতে পারি।”
এ কথা সত্য যে, খালিদের পিতা তাকে এমন ট্রেনিং ও প্রশিক্ষণ দেয় যে, তাকে রণাঙ্গনের জাদুকর বললেও বাড়াবাড়ি হবে না। কিন্তু তিনি তার দক্ষতা ও প্রজ্ঞা কাজে লাগানোর সুযোগ পান না। কেননা, তার নেতা ছিল আবু সুফিয়ান। সে শুধু গোত্রপতিই নয়। গোত্রের সর্বাধিনায়কও ছিল। আবু সুফিয়ানের অধীনস্থ থাকায় তিনি নিজের পক্ষ থেকে কোন পরিকল্পনা প্রণয়ন ও তা কার্যকর করতে পারতেন না। এই অপারগতাসুলভ দুঃখ তার অন্তরে আবু সুফিয়ানের প্রতি ঘৃণা সৃষ্টি করেছিল।
♣♣♣
কয়েকদিন আগের এ ঘটনাটি তার এক এক করে মনে পড়ছিল। এক হাজার চারশ মুসলমান তার ফাঁদকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে মক্কাপানে এগিয়ে গিয়েছিল। তিনশ অশ্বারোহী নিয়ে পেছন থেকে আক্রমণের কোন চিন্তাই খালিদ করেন না। কেননা তিনি জানতেন, যে মুসলমানরা সংখ্যায় স্বল্প হওয়া সত্ত্বেও অধিক সংখ্যক শত্রুকে নাস্তানাবুদ করতে পারে, তাদেরকে এই তিনশ সৈন্য দ্বারা পরাস্ত করা সম্ভব নয়। কারণ, বর্তমানে মুসলমানদের সংখ্যা তাদের প্রায় চারগুণ।
তিনি কল্পনার চোখে মক্কা হাতছাড়া হয়ে যেতে দেখেন। এই আশংকার বাণও তার হৃৎপিণ্ডে খচখচ করে বিঁধতে থাকে যে, তার ফাঁদ ব্যর্থ হওয়ায় আবু সুফিয়ান তাকে তীব্র ভর্ৎসনা করবে, শুধু তাই নয়, কুরাইশদের পরাজয় এবং মক্কা পতনের জন্য তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হবে।
খালিদ তার বাহিনীকে একটি পথের ধারণা দিয়ে বলেন, মুসলমানদের আগেই মক্কায় পৌঁছতে হবে। এ পথের দূরত্ব অনেক বেশি হলেও মুসলমানদের চোখ এড়ানোই ছিল তার উদ্দেশ্য। নির্দেশ পাওয়া মাত্রই তিনশ অশ্বারোহী উল্কাবেগে ঘোড়া ছুটিয়ে দেয়। ভিন্ন পথের কারণে তিন মাইল দূরত্ব দেড় গুণ বৃদ্ধি পায়। খালিদ চলার গতি বৃদ্ধির মাধ্যমে এই অতিরিক্ত দূরত্ব পুষিয়ে নিতে প্রয়াসী হন।
খালিদের মনের বেগের চেয়ে অধিক বেগে ঘোড়া ছুটতে থাকে। উন্নত জাতের তেজি ঘোড়া সন্ধ্যার বেশ আগেই মক্কা পৌঁছে যায়। সেখানে মুসলমানদের বাতাস তখনও পৌঁছেনি। মক্কার লোকজন অসংখ্য ঘোড়া আনাগোনার শব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। আবু সুফিয়ানও বাইরে আসে।
আবু সুফিয়ান প্রথমেই জানতে চায়। “তোমাদের ফাঁদ সফল হয়েছে?”
খালিদ ঘোড়া হতে নামতে নামতে বলেন– “তারা ফাঁদে পা-ই দেয়নি, তুমি মক্কার চারপাশে এমন পরিখা খনন করাতে পার, মুহাম্মাদ মদীনায় যেমনটি করিয়েছিল?”
“তারা এখন কোথায়?” আবু সুফিয়ান কাঁপা কণ্ঠে জানতে চায়– “তাদের সম্পর্কে আমাকে কিছু বললে হয় না?”
“যে সময় তুমি তাদের সম্পর্কে জানবে এবং পরবর্তী করণীয় নিয়ে ভাববে তার মধ্যে তারা মক্কা অবরোধ করে ফেলবে সহজে।” খালিদ বলেন– “হুবল এবং উযযার মর্যাদার শপথ। তারা পাহাড় এবং মরুর বুক চিরে চিরে আসছে। যদি তারা কারাউল গামীমের অপর কোন পথ ধরে আসে তাহলে তারা মানুষ নয়। কোন পদাতিক বাহিনী সে স্থান এত দ্রুত অতিক্রম করতে পারে না, যত দ্রুত তারা অতিক্রম করে এসেছে।”
আবু সুফিয়ান বলেন– “খালিদ! একটু ঠাণ্ডা মস্তিষ্কে চিন্তা কর। খোদার কসম! আতঙ্কে তোমার কণ্ঠ কাঁপছে।”
হযরত খালিদ ফুঁসে ওঠে বলেন– “আবু সুফিয়ান, তোমার গুণ বলতে এতটুকু যে, তুমি আমার গোত্রপ্রধান। আমি তোমাকে পরিষ্কারভাবে বলতে চাই যে, তাদের পক্ষে মক্কার প্রতিটি ইট খুলে ফেলাও কোন কঠিন ব্যাপার নয়।”
খালিদ একথা বলে মাথা উঠালে তার অপর দুই সহসেনাপতি ইকরামা এবং সফওয়ানকে কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেন। তিনি এবার তাদের সম্বোধন করে বলেন– “তোমাদের নেতা কে? আজ ভুলে যাও। শুধু এতটুকু মনে রাখ যে, মক্কাপানে তুফান ধেয়ে আসছে। নিজের ঐতিহ্য ও ইজ্জত রক্ষা কর। এখানে দাঁড়িয়ে থেকে একে অপরের মুখের দিকে চেয়ে থেক না। মক্কা নগরী রক্ষা কর। দেব-দেবীদের বাঁচাও।”
মুহূর্তের মধ্যে সারা শহরে হুলস্থুল পড়ে যায়। যোদ্ধারা বর্শা, তীর-ধনুক এবং তরবারি নিয়ে মক্কা রক্ষায় বেরিয়ে পড়ে। নারী ও শিশুদেরকে দূর্গ সদৃশ স্থানে স্থানে স্থানান্তর করা হতে থাকে। যুবতী মহিলারাও যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়। এটা শুধু তাদের শহর এবং জান-মালের নয় বরং তাদের ধর্মের প্রশ্ন ছিল। তার গোত্র সমগ্র আরবে যুদ্ধ-বিগ্রহের জন্য প্রসিদ্ধ ছিল। তার পিতাকে আরবের লোকেরা ‘সমরপতি’ বলে অভিহিত করত। খালিদ নিজ গোত্রের যশ-খ্যাতি এবং গোত্রীয় ঐতিহ্য সমুন্নত রাখতে প্রাণান্তকর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন।
তিনি আবু সুফিয়ানকে এড়িয়ে যান। ইকরামা এবং সফওয়ানকে সাথে নিয়ে এমন পরিকল্পনা করেন, যার সুবাদে তিনি মুসলমানদেরকে শহর থেকে দূরে রাখতে সক্ষম হন। তিনি কিছু সংখ্যক সৈন্য এ উদ্দেশ্যে বাছাই করেন, যারা শহর থেকে বহু দূরে চলে যাবে এবং মুসলমানরা অবরোধ করলে পেছন থেকে অবরোধকারীদের উপর চড়াও হবে। কিন্তু বেশিক্ষণ না। বরং অতর্কিতে হামলা করে মুহূর্তে গায়েব হয়ে যাবে।
যোদ্ধাদের ব্যতিব্যস্ততা ও রণধ্বনির মাঝে কতক নারীর মিষ্টি-মধুর স্বরও ঝংকৃত হতে থাকে। সকলের আওয়াজ মিলে একটি আওয়াজের রূপ পায়। এই সম্মিলিত গানের কথার মধ্যে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হত্যার উল্লেখও ছিল। আবেগ সঞ্চার এবং রক্তে তোলপাড় সৃষ্টিকারী গান ছিল। কণ্ঠশিল্পীরা মক্কার অলি-গলিতে এই গান পরিবেশন করে বেড়ায়।
কয়েকজন সশস্ত্র উষ্ট্রারোহীকে মদীনা থেকে আসার পথে এবং আরো সম্ভাব্য দু’তিন দিকে এ উদ্দেশ্যে দ্রুত পাঠিয়ে দেয়া হয় যে, তারা মুসলমানদের অগ্রযাত্রার সংবাদ মক্কায় পৌঁছাতে থাকবে। মহিলারা উঁচু বাড়ির ছাদে উঠে মদীনার দিকে দেখতে থাকে। সূর্য ক্রমে নিচে নামছিল। মরুর আভা খুবই আকর্ষণীয় হয়। কিন্তু আজ মক্কার গোধুলি আভায় ছাপ ছাপ রক্ত দেখা যাচ্ছিল।
কোন প্রান্ত হতে উৎক্ষিপ্ত ধূলি ঝড় দেখা যায় না।
“তাদের এতক্ষণ চলে আসার কথা।” খালিদ ইকরামা ও সফওয়ানকে বলেন– “আমরা এত দ্রুত পরিখা খনন করতে পারব না।”
ইকরামা বলে– “আমরা পরিখার সাহায্যে লড়ব না।”
“আমরা তাদের অবরোধের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ব।” সফওয়ান বলে– “তাদেরকে দাঁড়াতেই দিব না।”
সূর্য অস্ত যায়। রাত গভীর থেকে গভীর হতে থাকে। কিছুই ঘটে না।
মক্কা সমগ্ররাত জেগে থাকে। আজ যেন সেখানে রাতই হয়নি। নারী, শিশু ও বৃদ্ধদেরকে কেল্লা সদৃশ স্থানে স্থানান্তর করা হয়। আর যারা যুদ্ধ করতে সক্ষম তারা সেনাপতির নির্দেশে শহরের বিভিন্ন পয়েন্টে স্থাপিত মোর্চা মজবুত করছিল।
রাত অর্ধেক পেরিয়ে যায় তবুও মদীনার লোকদের আসার কোন লক্ষণ দেখা যায় না।
এক সময় পুরো রাতও পেরিয়ে যায়।
♣♣♣
আবু সুফিয়ান জিজ্ঞাসা করে– “খালিদ! কই তারা?”
“তুমি যদি মনে কর যে, তারা আসবে না তাহলে নিঃসন্দেহে এটা একটা মারাত্মক ধোঁকা হবে; যার মধ্যে তুমি নিপতিত।” হযরত খালিদ জবাবে বলেন– “মুহাম্মাদের মগজ পর্যন্ত যাওয়ার ক্ষমতা তোমার নেই। যা সে চিন্তা করতে পারে তুমি তা মোটেও পার না। নিশ্চিত সে আসবে।”
এরই মধ্যে মুসলমানরা অন্যান্য কয়েকটি গোত্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে সর্বত্র তাদের প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিল। খায়বার যুদ্ধ এর মধ্যে অন্যতম। এ সমস্ত যুদ্ধে অংশগ্রহণের ফলে তারা রণ-অভিজ্ঞতায় পরিপূর্ণ অভিজ্ঞ হয়ে ওঠে।
খালিদ বলেন– “আবু সুফিয়ান! উহুদ প্রান্তরে মুসলমানদের যে রূপ তুমি দেখেছিলে এখন সে রূপ ভিন্ন দিকে মোড় নিয়েছে। তারা এখন যে কোন রণাঙ্গনে ত্রাস সৃষ্টি করতে সক্ষম। যুদ্ধ বিষয়ে তারা যথেষ্ট অভিজ্ঞতা লাভ করেছে। এখনও সামনে না আসাটাও তাদের একটি যুদ্ধ-কৌশল।”
আবু সুফিয়ান কিছু বলার জন্য মুখ খুলেছিল, ইতোমধ্যে এক উষ্ট্রারোহীর উদয় হয়। দ্রুতগামী একটি উট তাদের উদ্দেশে ছুটে আসতে থাকে। উষ্ট্রারোহী আবু সুফিয়ান এবং খালিদের কাছে এসে লাফ দিয়ে নিচে নামে।
“আমার চোখের দেখা হয়ত তোমরা বিশ্বাস করবে না।” আরোহী নেমেই বলে– “আমি মুসলমানদেরকে হুদায়বিয়াতে শিবির স্থাপন করে অবস্থান করতে দেখেছি।”
আবু সুফিয়ান উষ্ট্রারোহীর দাবি প্রত্যাখ্যান করে বলে– “সে মুহাম্মাদ এবং তার বাহিনী হতে পারে না।”
“খোদার কসম! আমি মুহাম্মাদকে তেমনভাবে চিনি যেমনভাবে তোমরা দু’জন আমাকে চেন।” উষ্ট্রারোহী বলে– “আমি আরো এমন কতিপয় লোকদের দেখেছি, যারা ইতোপূর্বে আমাদেরই লোক ছিল এবং পরে মুহাম্মাদের দলে যোগ দিয়েছে।”
মক্কা থেকে তের মাইল পশ্চিমে একটি স্থানের নাম ‘হুদায়বিয়া’। রক্তপাত এড়াতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা থেকে দূরবর্তী এই হুদায়বিয়া নামক স্থানে এসে শিবির স্থাপন করেন।
খালিদ বলেন– “আমরা তাদের উপর রাতে গেরিলা আক্রমণ করব। তাদেরকে স্বস্তিতে থাকতে দেব না। তারা যে পথ ধরে হুদায়বিয়া গেছে, সে পথ তাদের ক্লান্ত করে দিয়েছে। তাদের হাড় ভেঙ্গে যাবার উপক্রম। তারা ক্লান্তি ঝেড়ে স্বাভাবিক হয়ে মক্কা আক্রমণ করবে। আমরা তাদেরকে বিশ্রামের সুযোগ দিব না।”
“আমরা তাদেরকে সেখান থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য করতে পারি।” খালিদ বলেন– “গেরিলা বাহিনী প্রস্তুত কর।”
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শিবির প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা পূর্বেই সম্পন্ন করে রেখেছিলেন। অশ্বারোহী ইউনিট রাতে শিবিরের চতুর্দিকে টহল দিতে থাকে। দিনের বেলাও পাহারার ব্যবস্থা ছিল।
অশ্বারোহী টহল বাহিনী শিবিরের অল্পদূর দিয়ে আরেক অশ্বারোহী দলকে ধীরে ধীরে যেতে দেখে। মুসলিম টহল বাহিনী তাদের প্রতি এগিয়ে যায়। অপর অশ্বারোহী দলটি ছিল কুরাইশদের গেরিলা দল। তারা কড়া প্রহরা দেখে বহুদূর পর্যন্ত এগিয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর অন্য প্রান্ত দিয়ে ফিরে আসে এবং মুসলমানদের তাঁবু হতে অল্প দূরে একটু থেমে আবার চলে যায়।
দ্বিতীয় দিন কুরাইশ গেরিলা দলটি মুসলিম তাঁবুর বেশ কাছে চলে আসে। এ সময় মুসলমানদের একটি টহল বাহিনী টহল দিতে দিতে বেশ দূরে গিয়ে আবার ফিরে আসে। তারা তাঁবুর পাশে কুরাইশদের দেখে ঘিরে ফেলে। কুরাইশ গেরিলা দলটি মুসলমানদের ঘেরাও থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য তরবারি কোষমুক্ত করে। টহল বাহিনীর তরবারি পূর্ব থেকেই কোষমুক্ত ছিল। তারা ফুঁসে ওঠে। বীর বিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়তে চায় তাদের উপর। ইতোমধ্যে টহল বাহিনীর অধিনায়ক এসে তার বাহিনীকে অস্ত্র সংবরণ করতে বলে।
“তাদের বেরিয়ে যেতে দাও।” টহল-কমান্ডার বলে– “আমরা যুদ্ধের জন্যে এসে থাকলে তাদের একজনকেও প্রাণ নিয়ে ফিরে যেতে দিতাম না।”
কমান্ডারের হস্তক্ষেপে কুরাইশ গেরিলা দলটি নিরাপদে চলে যায় এবং আবু সুফিয়ানকে সমস্ত ঘটনা খুলে বলে।
আবু সুফিয়ান বলে– “আরো কিছু অশ্বারোহী পাঠাও। অন্তত একটি হামলা চালাও।”
এক অশ্বারোহী বলে– “নেতাজি। গেরিলা হামলা চালাতে আমরা বহু চেষ্টা করেছি। কিন্তু মুসলমানদের তাঁবুর আশে পাশে রাতদিন পাহারাদার ঘুরঘুর করে বেড়ায়।”
কুরাইশদের পক্ষ থেকে আরো কিছু অশ্বারোহী গেরিলা হামলার জন্য প্রেরণ করা হয়। তারা সন্ধ্যার একটু পর গেরিলা আক্রমণের উদ্যোগ নিলে মুসলিম টহল বাহিনী তাদের কয়েকজনকে আহত করে সেখান থেকে তাড়িয়ে দেয়।
মক্কাবাসীদের মধ্যে থমথমে অবস্থা বিরাজ করতে থাকে। তারা রাতে নিদ্রাও যেত না। অবরোধের ভয়ে সর্বক্ষণ জাগ্রত এবং সতর্ক থাকত। এভাবে একের পর এক কয়েকদিন অতিবাহিত হয়। হঠাৎ একদিন এক মুসলিম অশ্বারোহী মক্কায় প্রবেশ করে আবু সুফিয়ানের ঠিকানা জানতে চায়। উৎসুক জনতার ঢল নামে তার পেছনে পেছনে আবু সুফিয়ানের উদ্দেশে সে কি বার্তা নিয়ে এসেছে তা জানতে সবাই সাথে সাথে চলতে থাকে। আবু সুফিয়ান আগন্তককে দূর থেকে দেখে দ্রুত আসে। খালিদও আসেন।
“আমি আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বার্তা নিয়ে এসেছি।” মুসলিম অশ্বারোহী আবু সুফিয়ানকে তাঁর আগমনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানায় এবং বলে– আমরা উমরা করতে এসেছি মাত্র “যুদ্ধ করতে আসিনি। উমরা করে ফিরে যাব।”
আবু সুফিয়ান জানতে চায় অনুমতি না দেয়া হলে কি করবে? আমরা আল্লাহ্ তা’আলার নির্দেশ মান্য করি মক্কাবাসীর নয়। মুসলিম অশ্বারোহী বলে– “আমরা আমাদের এবং ইবাদতখানার মাঝে কাউকে অন্তরায় হতে দেই না। মক্কায় আমাদের প্রবেশে বাধা দিলে মক্কা ধ্বংসের নগরীতে পরিণত হবে। মক্কার অলি-গলিতে রক্তগঙ্গা বয়ে যাবে।…আবু সুফিয়ান। ধ্বংস নয় আমরা শান্তির পয়গাম নিয়ে এসেছি। নিরাপত্তার উপঢৌকন নিয়েই আমরা এখান থেকে ফিরে যেতে চাই।”
হযরত খালিদের ঐ মুহূর্তগুলো স্মরণ হচ্ছে যখন এই মুসলিম অশ্বারোহী গম্ভীর কণ্ঠে তাদেরকে ধমক দিচ্ছিল। খালিদের রক্তে আগুন ধরে যাওয়ারই কথা ছিল। কিন্তু কেন যেন তার রক্ত উত্তপ্ত হয় না। লোকটিকে তার খুবই ভাল লেগেছিল। তাঁর বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর তাকে মোহিত করে। আবু সুফিয়ান মুসলিম অশ্বারোহীকে সেদিন যে জবাব দিয়েছিল তাও তার খুব মনঃপূত হয়েছিল। আবু সুফিয়ান বলেছিল, উভয় পক্ষের দায়িত্বশীল ব্যক্তিগণ একত্রে বসে সন্ধির শর্তাবলী চুড়ান্ত করবে।
♣♣♣
উভয় পক্ষের আলোচনা সাপেক্ষে ‘হুদায়বিয়ার সন্ধি’ নামে একটি সন্ধিপত্র স্বাক্ষরিত হয়। মুসলমানদের থেকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বয়ং এবং কুরাইশদের পক্ষ থেকে সুহাইল বিন আমর এ সন্ধিপত্রে স্বাক্ষর করেন। এ সন্ধি মোতাবেক সিদ্ধান্ত হয়েছিল যে, মুসলমান এবং কুরাইশদের মধ্যে আগামী দশ বছরের মধ্যে কোন ধরনের যুদ্ধ-বিগ্রহ হবে না। মুসলমানরা এ বছর ওমরা না করে ফিরে গিয়ে আগামী বছর উমরা করতে আসবে এবং মক্কায় মাত্র তিনদিন অবস্থান করতে পারবে।
সন্ধির শর্ত মোতাবেক মুসলমানরা ফিরে গিয়ে পরের বছর আবার আসে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সহ অসংখ্য সাহাবায়ে কিরাম এখন মক্কায়। সকলের দেহে উমরার বেশ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন কুরাইশী। খালিদ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে ভাল ভাবেই চিনতেন। কিন্তু অনেক দিন পর আজ মক্কায় রাসূলকে দেখে তার মনে হতে থাকে, এ যেন অন্য কোন মুহাম্মাদ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নুরানী চেহারা, দৃঢ় ব্যক্তিত্ব এবং অনুপম আচরণে তিনি এমন মুগ্ধ ও মোহিত হন যে, তার মাথা হতে এই ধারণা দূর হয়ে যায় যে, ইনি সেই ব্যক্তি যাকে সে স্বহস্তে হত্যা করার পরিকল্পনা করত।
খালিদ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে একজন সেনাপতি হিসেবে দেখতে থাকেন এবং শ্রেষ্ঠ সমরবিদ হিসেবে তিনি তাকে স্বীকৃতি দিন। হুদায়বিয়ার সন্ধি পর্যন্ত মুসলমানরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নেতৃত্বে ছোট-বড় আঠাশটি যুদ্ধ করেছিলেন। একটি যুদ্ধে সাময়িক বিপর্যয় ছাড়া প্রতিটি যুদ্ধেই তারা একচেটিয়া প্রভাব ফেলতে সক্ষম হন।
মুসলমানরা নিরাপদে উমরার কাজ সম্পন্ন করে। এদিকে তিনদিন পরেই তারা ফিরে যায়। কিন্তু এ সীমিত সময়ে তাদের আচার-আচরণ, বিচক্ষণদের অন্তরে নীরবে দাগ কাটে। এদের অন্যতম হলেন খালিদ। প্রায় দুমাস হল মুসলমানরা মদীনায় চলে গেছে। মুসলমানরা চলে যাওয়ার পর খালিদ আরেক খালিদে রূপ নেন। তিনি এখন আগের মত মুসলমানদের বিরোধিতা করেন না। তার মস্তিষ্ক রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে হত্যা করার নিত্য-নতুন নীল নকশা প্রণয়ন করে না। কোলাহলপূর্ণ সরব জগৎ ছেড়ে ভাবেন নীরব সুদিন। নীরবে কাটে তার অধিকাংশ সময়। কিন্তু এ নীরবতা ছিল ঝড়ের আগাম বার্তা। একটি আসন্ন মনোবিপ্লব লুক্কায়িত ছিল এ রহস্যময় নীরবতায়। খালিদ ছিলেন রণাঙ্গনের মানুষ। যুদ্ধ ছিল তার পেশা। যুদ্ধ ছাড়া তিনি এতদিন কিছু বুঝেন নি, বুঝতে চাননি। ধর্ম-কর্ম বলতে তিনি কিছু বুঝতেন না। যুদ্ধই ছিল তার ধর্ম, প্রাণ সঞ্জীবনী শক্তি। ধর্মের ব্যাপারে তার তেমন কোন আগ্রহ ছিল না। তাই এ ব্যাপারে গভীরভাবে উপলদ্ধি করার প্রয়োজনও তিনি উপলদ্ধি করেন না। ধর্মগত বিরোধের কারণে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও কুরাইশদের মধ্যে এত রক্তক্ষয় তা নিয়েও তিনি কখনও ভাবেন নি। তার ধর্মের বাস্তবতা কতটুকু এবং মুহাম্মাদের প্রচারিত ইসলামের মর্মবাণী কি-তা তিনি কখনও যুক্তির কষ্টিপাথরে যাচাই করে দেখেন নি। আজ নতুন করে তার মধ্যে ভাবান্তর ঘটে। অতি কাছে থেকে মুসলমানদের দেখাই ছিল তার এ ভাবান্তরের সূচনা। মুসলমানদের সুন্দর স্বাচ্ছন্দময় তাদের জীবন-ধারা তার চিন্তার জগতে আলোড়ন সৃষ্টি করে। আরবের পৌত্তলিকতা সঠিক না কি মুহাম্মাদের প্রচারিত ইসলাম সত্য এ প্রশ্নটি তার হৃদয় মুকুরে উধিত হয়। ধর্ম-বিশ্লেষণের প্রতি তার দৃষ্টি পতিত হয় মানবজীবনে ধর্মের গুরুত্বই বা কতটুকু তাও তার গবেষণার মধ্যে শামিল হয়।
খালিদ দীর্ঘ গবেষণার পর প্রাপ্ত তত্ত্ব তার অন্যতম সহসেনাপতি এবং পারিবারিক সূত্রে তারই ভ্রাতুষপুত্র ইকরামাকে বলেন– “ইকরামা! আমি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছি।… আমি বুঝে গেছি।” “কি বুঝে গেছ খালিদ।” ইকরামা আগ্রহ ভরে জানতে চায়।
“মুহাম্মাদ জাদুকর নয়।” খালিদ বলেন– “এবং সে কবি নয়। মুহাম্মাদকে দুশমন মনে করা আমি ছেড়ে দিয়েছি। শুধু তাই নয়, আমি মুহাম্মাদকে আল্লাহর রাসূল বলেও মেনে নিয়েছি।”
“হুবল এবং উযযার শপথ! এটা তোমার ইয়ার্কি ছাড়া আর কিছুই নয়।” ইকরামা বলে– “কেউ বিশ্বাস করবে না যে, ওলীদের বেটা বাপ-দাদার ধর্ম ত্যাগ করছে।” “ওলীদের পুত্র পৌত্তলিক ধর্ম ত্যাগ করেছে।” খালিদ দৃঢ় কণ্ঠে বলেন।
মুহাম্মাদ আমাদের অসংখ্য মানুষ হত্যা করেছে, তা কি তুমি ভুলে গেছ?” ইকরামা বলে– “তুমি তার ধর্ম গ্রহণ করতে যাচ্ছ, অথচ আমরা যার রক্ত পান করতে উদগ্রীব!”
“তুমি যাই বল, আমি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি।” খালিদ সুস্পষ্ট ভাষায় তার মনোভাব জানিয়ে বলেন– “আমি বুঝে-শুনে ঠাণ্ডা মাথায় সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমার সিদ্ধান্তে আমি অটল অবিচল।”
সেদিন সন্ধ্যায় আবু সুফিয়ান খালিদকে তার বাসগৃহে ডেকে নেয়। ইকরামাও সেখানে উপস্থিত ছিল।
আবু সুফিয়ান খালিদকে জিজ্ঞেস করে– “মুহাম্মাদের কথার মারপ্যাচে তুমিও আটকে গেছ?”
“তুমি সত্যিই শুনেছ আবু সুফিয়ান।” খালিদ দৃপ্ত কণ্ঠে বলেন– মুহাম্মাদের কথা অনেকটাই গভীর, প্রভাবপূর্ণ।
ঐতিহাসিক ওকিদী লিখেন, আবু সুফিয়ান গোত্রপ্রধান হেতু সে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে বলে। অন্যথায় তাকে হত্যা করার হুমকি দেয়। খালিদ আবু সুফিয়ানের হুমকি মুচকি হেসে উড়িয়ে দেন। কিন্তু পাশে বসা হযরত খালিদের ভাতিজা ইকরামা আবু সুফিয়ান কর্তৃক চাচার এই অপমান সহ্য করতে পারে না। আবার ইকরামা নিজেও খালিদের সিদ্ধান্তের ঘোর বিরোধী ছিল।
ইকরামা ক্রোধান্বিত কণ্ঠে বলে– “আবু সুফিয়ান! আমি তোমাকে গোত্রপ্রধান মানি। কিন্তু তাই বলে খালিদকে যে ভাষায় তুমি হুমকি দিচ্ছ তা সহ্য করতে পারবোনা। তুমি খালিদকে ধর্মান্তরিত হতে নিষেধ করতে পার না। তারপরেও যদি তুমি খালিদের বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করো তাহলে খালিদের সাথে আমিও মদীনায় চলে গেলে তোমার অবাক হওয়ার মত কিছু থাকবে না।”
পরদিনই মক্কার মানুষের মুখে ছিল– “খালিদ ইবনে ওলীদ মুহাম্মাদের কাছে চলে গেছে।”
খালিদ মদীনা পানে এগিয়ে চলছেন। অতীত স্মৃতির মাঝে তিনি এমনভাবে হারিয়ে যান, যেন তিনি ঘোড়ায় চড়ে মদীনা নয়; বরং পায়ে হেঁটে ঘটনাবহুল অতীতে পায়চারী করছেন। তিনি এভাবে চলতে চলতে মদীনার এত কাছে চলে এলেন যে, উঁচু উঁচু ভবনের শীর্ষ চূড়াগুলো তার চোখের সামনে ভেসে উঠতে থাকে।
কেউ তার নাম ধরে ডাক দেয় “খালিদ!” কিন্তু তিনি এটাকে অতীতের খেয়ালী আওয়াজ ভেবে পাত্তা দেন না।
কিছুক্ষণ পর অশ্বের খুরধ্বনি শুনতে পেয়ে তিনি মাথা উঠিয়ে তাকান। তাকে লক্ষ্য করে দু’টি ঘোড়া পাশাপাশি ছুটে আসতে দেখেন। তিনি দাঁড়িয়ে যান। ঘোড়া তার কাছে এসে থেমে যায়। এক অশ্বারোহী ছিল তারই গোত্রের বিখ্যাত যোদ্ধা আমর ইবনুল আস। আর দ্বিতীয় ঘোড়ায় ছিল উসমান বিন তালহা। তারা তখনও ইসলাম গ্রহণ করেনি।
“তোমরা দুজন আমাকে মক্কায় ফিরিয়ে নিতে এসেছ?” খালিদ তাদেরকে লক্ষ্য করে প্রশ্ন ছুঁড়ে মারেন।
আমর ইবনুল আসের পাল্টা প্রশ্ন “তার আগে বল তুমি যাচ্ছ কোথায়?”
“তা তোমরা যাচ্ছ কোথায়?” খালিদ পুনরায় তাদেরকে প্রশ্ন করেন
“খোদার কসম! আমাদের জবাব তোমার মনঃপুত হবে না।” প্রশ্নের ধারাবাহিকতা পরিবর্তন করে উসমান বিন তালহা বলে– “আমাদের গন্তব্য মদীনা।”
“কথা পূর্ণ কর উসমান।” আমর ইবনুল আস পরিষ্কার ভাষায় তাদের উদ্দেশ্য বলে– “খালিদ! আমরা মুহাম্মাদের ধর্ম গ্রহণ করতে যাচ্ছি। আমরা মুহাম্মাদকে আল্লাহর সত্য নবী বলে স্বীকার করে নিয়েছি।”
“তাহলে তো আমরা একই পথের পথিক।” খালিদ উৎফুল্ল হয়ে বলেন– “এস আমরা একত্রে চলি।”
৬২৮ খ্রিষ্টাব্দের ৩১ মে ইসলামের ইতিহাসের দুই বিখ্যাত সেনাপতি খালিদ বিন ওলীদ এবং আমর ইবনুল আস এ দিন মদীনায় প্রবেশ করেন। তাদের সাথে ছিল উসমান বিন তালহাও। তিনজনই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দরবারে গিয়ে হাজির হন। সর্বপ্রথম হযরত খালিদ বিন ওলীদ ভিতরে প্রবেশ করেন। তার পেছনে আমর ইবনুল আস এবং উসমান বিন তালহা প্রবেশ করেন। তিনজনই একযোগে ইসলাম গ্রহণের আগ্রহ প্রকাশ করেন।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উঠে দাঁড়ান এবং এক এক করে সবাইকে আলিঙ্গনাবদ্ধ করেন।
♣♣♣
মদীনায় এসে হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু ইসলাম গ্রহণ করার পর তার মধ্যে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসে। এরই মধ্যে তিন মাস অতিক্রান্ত হয়ে যায়। তিনি বেশিরভাগ সময় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সান্নিধ্যে থেকে বিভিন্ন দিক থেকে উপকৃত হতেন। এ সময়ের মধ্যে কোন যুদ্ধের দামামা না বাজায় তার যুদ্ধ-নৈপুণ্য দেখানোর সুযোগ হয় না। যুদ্ধবিদ্যায় তার বিশেষ প্রজ্ঞা ও দক্ষতা ছিল। তার আভিজাত্য এবং বংশ মর্যাদাও সাধারণ আরবদের থেকে উন্নত ছিল। এরপরও তিনি কোনদিন সেনাপতি পদে বরিত হওয়ার দাবি করেননি। তিনি আজীবন নিজেকে একজন সাধারণ সিপাহী মনে করেন এবং তাতেই তিনি তুষ্ট থাকেন।
বর্তমান সিরিয়ার জর্দান এলাকায় তৎকালীন যুগে গাসসান গোত্র বসবাস করত। দূর দূর এলাকায় তারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। শক্তিধর হিসেবে এ গোত্রের সর্বত্র খ্যাতি ছিল। কারণ, তারা যেমন ছিল দুর্ধর্ষ যোদ্ধা তেমনি সংখ্যায়ও ছিল অনেক।
তখন রোমের সম্রাট ছিল হিরাক্লিয়াস। যুদ্ধবাজ এবং যুদ্ধ-প্রলয় হিসেবে তার খ্যাতি ছিল বিশ্বজুড়ে। ইসলাম দ্রুতগতিতে ব্যাপক প্রসার লাভ করছিল। হাজার হাজার কুরাইশ তখন ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে এসে গেছে। তাদের বিখ্যাত নেতা ও সেনাপতিরাও মদীনায় গিয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাতে বাইয়াত গ্রহণ করেছে। যার ফলে মুসলমানরা একটি শক্তিশালী জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ছোট ছোট কয়েকটি গোত্র ইসলামের পূর্ণ অধীনে চলে আসে।
মদীনাতে বিভিন্ন মাধ্যমে সংবাদ পৌঁছতে থাকে যে, গাসসান গোত্র মুসলমানদের ক্রমবর্ধমান শক্তি এবং ইসলামের অগ্রযাত্রা রুখতে মুসলমানদেরকে ময়দানে শক্তি পরীক্ষায় আহবান করতে চায় এবং এ উদ্দেশ্যে তারা ইতোমধ্যেই প্রস্তুতি নেয়াও শুরু করেছে। এ খবর প্রচার হয় যে, গাসসানের সর্বোচ্চ নেতা রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াসের সাথে সখ্য গড়ে তুলে তার সমরশক্তিকেও মুসলমানদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে চেষ্টা করছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গাসসানের শীর্ষ নেতার উদ্দেশে এক রাষ্ট্রীয় দূতকে এই বার্তা দিয়ে প্রেরণ করেন যে, আল্লাহ্ ব্যতীত কোন মাবুদ নেই। তিনি এক, অদ্বিতীয়। তাঁর কোন শরীক নেই। ইসলামই একমাত্র জীবন ব্যবস্থা। এর বাইরে যত ধ্যান-ধারণা আছে তা ধারণাপ্রসূত এবং মানব রচিত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সে বার্তায় গাসসানের শীর্ষ নেতাকে ইসলাম গ্রহণের আহবান জানান।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বার্তাটি এই উদ্দেশ্যে প্রেরণ করেন, যাতে গাসসান গোত্র রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াসের সমর শক্তির প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ না করে, বরং তারা ইসলাম গ্রহণ করুক। অতঃপর তাদেরকে মুসলমানদের সাথে একীভূত করে হিরাক্লিয়াসের খপ্পর থেকে রক্ষা করা হবে।
“আল্লাহর কসম! এর থেকে উত্তম কোন সিদ্ধান্তই হতে পারে না।” হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু এক বৈঠকে বলেন– “হিরাক্লিয়াস সৈন্য প্রেরণ করলে তার অর্থ হল– শক্তির এক তুফান ধেয়ে আসছে, যা সবাইকে উড়িয়ে নিয়ে যাবে।”
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দাওয়াত কবুল করার মধ্যেই গাসসানের মঙ্গল নিহিত।” অন্য আরেকজন মন্তব্য করে।
“রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আহবানে সাড়া না দিলে আমৃত্য হিরাক্লিয়াসের গোলাম হয়ে যাবে।” আরেকজন একথা সংযোজন করে।
রাষ্ট্রীয় দূত পৌঁছার আগেই হিরাক্লিয়াস গাসসানের এলাকায় চলে আসে। তার সাথে ছিল এক লাখ সৈন্য। গাসসানের শীর্ষ নেতা সঠিক সময়ে হিরাক্লিয়াসের আগমনের সংবাদ জানতে পারে। কিন্তু সে এতে উদ্বিগ্ন হয় না। কেননা ইতোপূর্বেই সে হিরাক্লিয়াসের দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক প্রেরিত দূত বসরায় যাচ্ছেন। কেননা বসরা ছিল গাসসানের রাজধানী। দূতের সাথে ছিল এক উষ্ট্রী বোঝাই পথের সম্বল ছাড়াও তিনজন প্রহরী।
দীর্ঘ সফরের পর দূত মুতায় গিয়ে পৌঁছেন। তিনি সামান্য বিশ্রাম নেয়ার জন্য ক্ষণিকের যাত্রা বিরতি করেন। কাছেই গাসসান গোত্রের একটি বসতি ছিল। বসতির সর্দারের নিকট খবর পৌঁছে যে, চারজন ভিনদেশী বসতির নিকটে বিশ্রাম নিচ্ছে। সর্দার শারাহবীল বিন আমর দূতকে তার কামরায় তলব করে এবং তার পরিচয় ও গন্তব্য জানতে চায়।
দূত জবাব দেন– “আমি মদীনার দূত; বসরা যাচ্ছি। আমি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বার্তা তোমাদের শীর্ষ নেতার নিকট বয়ে নিয়ে যাচ্ছি।”
শারাহবীল তিরস্কারের সুরে বলে– “কুরাইশ গোত্রের মুহাম্মাদের কথা বলছ? কি বার্তা নিয়ে যাচ্ছ?”
“বার্তার মূলকথা হলো, ইসলাম কবুল কর।” দূত জানান– “এবং ভ্রান্ত বিশ্বাস ত্যাগ কর।”
“আমাদের শীর্ষ নেতা এবং ধর্মের অপমান আমি সহ্য করব বলে ভাবছ?” শারাহবীল চড়া গলায় বলে–“বাঁচতে চাইলে এখান থেকেই মদীনা ফিরে যাও।”
বসরার পথ ত্যাগ করা আমার পক্ষে অসম্ভব।” দূত মদীনায় ফিরে যাবার আহবান প্রত্যাখ্যান করে বলেন– “এটা আল্লাহ ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হুকুম। এ হুকুম পালন করতে গিয়ে গর্বের সাথে নিজের জীবন কুরবান করব।”।
“আর আমি গর্বের সাথে তোমার জীবন কেড়ে নেব।” শারাহবীল এ কথা বলে এবং তার লোকদের প্রতি হত্যার ইঙ্গিত দেয়।
দূতের অপর তিন সঙ্গী কক্ষের বাইরে বসা ছিল। ভেতর থেকে তিন ব্যক্তি বের হয়। তারা কারো রক্তাক্ত লাশ টেনে-হিচড়ে বের করছিল। লাশের দেহ মস্তক বিচ্ছিন্ন থাকলেও দূতের সাথিয় লাশ শনাক্ত করে ফেলে। লাশের পিছনে পিছনে শারাহবীলও বাইরে আসে।
“তোমরা তার সঙ্গী ছিলে?” শারাহবীল তিন সাথিকে বলে– “আমি মনে করি তাকে ছাড়া তোমরা বসরা যাবে না।”
এক সাথি জবাব দেয় “না। বার্তা ছিল তার কাছে।”
শারাহবীল বলে– যাও, মদীনায় ফিরে যাও। আর মুহাম্মাদকে বল– “আমরা গোত্র এবং আকীদা-বিশ্বাসের অবমাননা সহ্য করি না। লোকটি বসরা গেলে সেখানেও নিহত হত।”
“খোদার কসম!” এক সাথি সাহস করে বলে– “আমরা মেহমানের সাথে এমন আচরণ করি না।”
“মেহমান মনে করেই আমি তোমাদের জীবন ভিক্ষা দিচ্ছি।” শারাহবীল বলে– “আশা করি লাশ ফেরৎ চেয়ে আমার কাছে আবেদন করবে না।”
মদীনার সবাই জানত যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দূত ইসলামের দাওয়াতী বার্তা নিয়ে বসরা গেছে। দুত কি জবাব নিয়ে ফিরে আসে তা জানতে সবাই আগ্রহী ছিল। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দূত ব্যতীত অপর তিন সঙ্গী ফিরে আসে। তাদের চেহারায় কেবল ক্লান্তির ছাপই ছিল না, বেদনা এবং ক্রোধও ঠিকরে পড়ছিল। তারা মদীনায় পা দিলে জনতা তাদের ঘিরে ভীড় করে।
“খোদার কসম!” আমরা বদলা নিব।” তিন মুহাফিজ সাথি হাত নাড়িয়ে একথা বলতে বলতে চলছিল– “মুতার শারাহবীলকে হত্যা করা আমাদের জন্য কর্তব্য হয়ে গেছে।”
এ হৃদয়বিদারক সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে মদীনার সবাই এক জায়গায় এসে সমবেত হয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও যথাসময়ে সংবাদ পান। দূত হত্যায় তিনি অত্যন্ত মর্মাহত হন। আরবের রীতি, হত্যার বদলে হত্যা। সমবেত জনতা “প্রতিশোধ প্রতিশোধ” বলে শ্লোগান দিচ্ছিল। বর্তমানের মত তৎকালীন যুগেও দূতিয়ালী প্রথা ছিল এবং শত্রুপক্ষের দূতকেও অপর পক্ষ সম্মান করত ও দূতকে নিরাপত্তা প্রদান করত। কারো দূত হত্যা করাকে যুদ্ধের শামিল বলে মনে করা হত।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ভারাক্রান্ত জনতার উদ্দেশে অশ্রুসিক্ত চোখে বেদনাহত কণ্ঠে বলেন– “প্রিয় মদীনাবাসী। আমি গাসসানীদের প্রতি যুদ্ধের বার্তা প্রেরণ করিনি। আমার বার্তা ছিল শান্তির বার্তা। আমি তাদেরকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার আহবান জানিয়েছিলাম মাত্র। যদি তারা শান্তির বার্তা উপেক্ষা করে যুদ্ধ করতে আগ্রহী হয় তাহলে আমরাও যুদ্ধ করতে পিছপা হব না।”
জনতা শ্লোগান তোলে– “আমরা লড়ব… প্রতিশোধ নেব… মুসলমানরা দুর্বল নয়। মুসলমানের রক্ত এত সস্তা নয়। আমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের মান রক্ষায় জীবন দিয়ে দিব।”
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নির্দেশে সে দিনেই মুজাহিদ বাহিনী প্রস্তুত হয়ে যায়। স্বতঃস্ফূর্তভাবে তিন হাজার মুজাহিদ যুদ্ধে নাম লেখান। সেনাপতির দায়িত্ব দেয়া হয় যায়েদ বিন হারেসা রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর স্কন্ধে।
যায়েদ শহীদ হলে সেনাপতি হবে জাফর বিন আবী তালেব।” যাবার প্রাক্কালে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলে দেন– জাফরও শহীদ হলে আব্দুল্লাহ ইবনে রাওহা হবে তার স্থলাভিষিক্ত। আব্দুল্লাহও শহীদ হয়ে গেলে তখন মুজাহিদরা তাদের মধ্য হতে একজনকে সেনাপতি নির্বাচন করে যুদ্ধ চালিয়ে যাবে।”
ঐতিহাসিক ইবনে সা’দ লিখেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পরপর তিনজন সেনাপতি নির্ধারণ করে মুজাহিদ বাহিনীকে দুআ করে বিদায় দেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত যায়েদ বিন হারেসা রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে ডেকে বলেন, মুতা পৌঁছেই প্রধান কাজ হল, আমাদের দূত হত্যাকারী শারাহবীলকে কতল করা। এরপর মুতা ও তার আশেপাশের মানুষকে ইসলামের প্রতি আহবান করবে। ইসলামের প্রকৃত পরিচয় তাদের সামনে তুলে ধরবে। তারা ইসলাম গ্রহণ করলে তাদের উপর হস্ত উত্তোলন করবে না।
এই মুজাহিদ বাহিনীতে হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু ছিলেন একজন সাধারণ সৈন্য তিনি কোন ইউনিট কিংবা ক্ষুদ্র দলেরও কমান্ডার ছিলেন না।
♣♣♣
রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াসের বাহিনী বর্তমান জর্দানের কোন এক স্থানে শিবির স্থাপন করে পূর্ব থেকেই অবস্থান করছিল। তারা গাসসান গোত্রের এলাকায় সেনা ছাউনি ফেলেছিল। ঐতিহাসিকদের ভাষ্যমতে রোম-সৈন্যসংখ্যা ছিল এক লক্ষ। বিশাল এ সেনাবহরে অত্র এলাকার বসতিগুলো ছেয়ে যায়। জমির ফসল, তাদের ঘোড়া এবং উট খেয়ে শেষ করে। জনগণের বাড়িতে যে খাদ্য সম্ভার এবং খেজুর সংরক্ষিত ছিল সৈন্যরা তা জোরপূর্বক কেড়ে নিয়ে যায়। যুবতী নারীদের ঠিকানা হয় কমান্ডারদের তাঁবু।
হিরাক্লিয়াসের তাঁবুটি ছিল চতুর্দিকে কারুকার্যখচিত মোটা পর্দা এবং উপরে বিচিত্র নক্শাগাঁথা ত্রিপালে ছাদ করা একটি ছোট্ট মহল। দামী কার্পেটে ফ্লোর মোড়ানো। প্রয়োজনীয় আসবাব পত্রেরও অভাব ছিল না। অধিকাংশটি স্বর্ণরৌপ্যের। গাসসান গোত্রের সর্বোচ্চ নেতা হিরাক্লিয়াসের সামনে হাঁটু গেড়ে বসা। হিরাক্লিয়াস স্বয়ং সসৈন্য আগমন সংবাদ পেয়ে সে মূল্যবান উপঢৌকন এবং তারই গোত্রের সেরা দশ-বারজন সুন্দরী যুবতী সাথে নিয়ে হিরাক্লিয়াসকে স্বাগত জানাতে গিয়েছিল। ঐ নারীদের দুই-তিনজন হিরাক্লিয়াসের উভয় পাশে বসা।
“তুমি আমাদের জানিয়েছ যে, মদীনার মুহাম্মদ তোমার প্রতি এই মর্মে বার্তা পাঠিয়েছিল যে, যেন তোমার গোত্র তার ধর্ম গ্রহণ করে।” হিরাক্লিয়াস গাসসানের নেতাকে বলে।
“আমি এটাও অবহিত করেছি যে, শারাহবীল নামক আমার এক আঞ্চলিক নেতা মদীনার দূতকে আমার নিকট পর্যন্ত পৌঁছতে না দিয়ে, তাকে মুতায় হত্যা করে।”
হিরাক্লিয়াস জিজ্ঞাসা করে– “মদীনাবাসীদের এমন কি শক্তি আছে যে, তারা দূত হত্যার প্রতিশোধ নিতে পারবে?”
শীর্ষ নেতা বলে– “তাদের শক্তি কম কিন্তু সাহস বেশি, তাদের উপর মুহাম্মাদের জাদু রয়েছে। প্রথম তাদের সম্পর্কে আমার নিকট সংবাদ পৌঁছলে আমি বিষয়টিকে তেমন আমলে নিইনি। কিন্তু ইতোমধ্যে তারা কয়েকটি রণাঙ্গনে লড়াই করেছে এবং প্রতিটিতেই বিজয় অর্জন করেছে। অথচ প্রতিটি যুদ্ধে প্রতিপক্ষের চেয়ে তাদের সংখ্যা ছিল অনেক কম। শুনেছি, মুহাম্মাদ এবং তার কমান্ডারদের যুদ্ধ-কৌশলের সম্মুখে কেউ টিকতে পারে না। আমার প্রতি তার ধর্ম গ্রহণের আহবান জানিয়ে পত্র প্রেরণ দ্বারা বুঝা যায় যে, সে নিজেকে বড় শক্তিমান ভাবছে।”
“এখন তোমার ইচ্ছা কি?” হিরাক্লিয়াস উলঙ্গপ্রায় এক তরুণীর হাত থেকে মদের পেয়ালা নিতে নিতে জানতে চায়।
“পরিষ্কার করে বললে এতে আমারও উপকার এবং আপনারও উপকার হবে।” শীর্ষ নেতা বলে– “আপনার সৈন্য আমি দেখেছি। আমার গোত্র কোন ছোট গোত্র নয়। বেশি না হলেও আপনার সমান সৈন্য সংখ্যা আমারও আছে। আপনি স্বদেশ থেকে দূরে। যুদ্ধ শুরু হলে আমরা নিজ ভূমিতে লড়ব। তখন এখানকার প্রতিটি শিশু আপনার শত্রু হয়ে যাবে।
হিরাক্লিয়াস মুচকি হেসে বলে– “তুমি আমাকে ধমক দিচ্ছ?”
যদি বাস্তবেই এটা ধমক হয় তাহলে আমি নিজেকেও তা দিচ্ছি।” গাসসানের শীর্ষ নেতা বলে– “আমি আপনাকে পারস্পরিক যুদ্ধের পরিণতির কথা বলছি মাত্র। আর তা যে আমাদের কারো জন্য মঙ্গলজনক হবে না তা আপনি ভালো করেই জানেন। তবে আমাদের যুদ্ধ থেকে মদীনাবাসীরা অবশ্যই ফায়দা লুটবে। নিজেদের রক্তক্ষয় না করে আসুন, আমরা উভয়ে জোট হয়ে মুসলমানদের ধ্বংস করি। বিজয় হলে প্রতিদান স্বরূপ আমি কিছুই চাইব না। বিজিত এলাকা হবে আপনারই। নিজ ভূখণ্ডে আমি ফিরে আসব।… নিজেরা যুদ্ধ করে শক্তি নষ্ট না করি। প্রথমে এমন এক শক্তিকে শেষ করি, যা মদীনা হতে আমাদের বিরুদ্ধে প্রস্তুত হচ্ছে।”
সম্রাট হিরাক্লিয়াস বলে– “আমি তোমার প্রস্তাব সমর্থন করছি।”
“তাহলে আপনার সৈন্যদের নিষেধ করে দিন যেন তারা গাসসানী কোন বসতিতে লুটপাট না করে।”
“হ্যাঁ, নিষেধ করব।” হিরাক্লিয়াস বলে– “মদীনাবাসীদের এখানে আসার অপেক্ষা করা ঠিক হবে না। আমরাই মদীনার দিকে এগিয়ে যাব।”
তাদের বেশি দিন বসে থাকতে হয় না। ইতোমধ্যেই মদীনার তিন হাজার মুজাহিদ মুতার উদ্দেশে মদীনা হতে অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছিল। মুতার কাছাকাছি ‘মাআন’ নামক স্থানে মুসলিম বাহিনী যাত্রা বিরতি করে। এই এলাকা এবং সম্মুখের অঞ্চলটি মুজাহিদদের একদম অপরিচিত। সামনের কোন খবরও তাদের জানা ছিল না। সামনে শত্রুসৈন্য আছে কি-না তা জানা অতীব জরুরী ছিল। থাকলে তারা সংখ্যায় কত এবং তারা কোন অবস্থায় আছে। এই তথ্যটুকু সংগ্রহ করতে তিন-চারজন মুজাহিদকে দরিদ্র উষ্ট্রচালকের বেশে সামনে প্রেরণ করা হয়।
এই গোয়েন্দা টিম রাতে কোথাও কাটিয়ে পরের দিন বিকেলে ফিরে আসে। তাদের সংগৃহীত তথ্য মুসলমানদের জন্য সুখকর ছিল না। তারা যেতে যেতে অনেক দূরে গিয়েছিল। সর্বপ্রথম দু’টি গাসসানী পরিবার তাদের নজরে পড়ে। তারা পূর্বের বাসস্থান ছেড়ে নতুন আবাসের উদ্দেশে কোথাও যাচ্ছিল। উভয় পরিবারের অধিকাংশ সদস্য ছিল যুবতী নারী। তাদেরকে বেশ ধনাঢ্য এবং প্রভাবশালী মনে হয়। তাদের পারিবারিক জিনিস পত্রে কয়েকটি উট বোঝাই ছিল। কাফেলা বিশ্রাম নিতে এক স্থানে থামে।
মুসলিম গোয়েন্দা টিমটি সেখানে যাত্রাবিরতি করে। তারা স্বল্প সময়েই গাসসানী কাফেলার সাথে ভাব জমিয়ে ফেলে। কিন্তু তাদের মুসলিম পরিচয় ঘুণাক্ষরেও প্রকাশ করে না। নিজেদের গন্তব্য বলতে গিয়ে বলে, তারা বসরা যাচ্ছে। সেখান থেকে বাণিজ্য পণ্য আনবে।
কাফেলার লোকেরা গোয়েন্দাদের সতর্ক করে বলে– “সামনে যেয়ো না; এখান থেকেই ফিরে যাও। রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াসের সৈন্যরা লুটপাট এবং হত্যা চালাতে চালাতে এগিয়ে আসছে। তোমাদের ধন-সম্পদ এবং উট তারা দেখলে নিয়ে যাবে। মেরে ফেলারও যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে।”
দীর্ঘক্ষণ ধরে চলতে থাকে হিরাক্লিয়াসের স্বয়ং সৈন্য নিয়ে আগমন সংক্রান্ত আলোচনা। গোয়েন্দারা কৌশল জেনে নেয় যে, রোমক সৈন্যের ভয়ে ভীত হলেও তারা নিজ চোখে তাদের দেখেনি। শুধু লোকমুখে শুনেছে যে, সৈন্য জর্দানে প্রবেশ করে লুটতরাজ চালাচ্ছে। যেহেতু তাদের মধ্যে নারীদের সংখ্যা বেশি সেজন্য তাদের রক্ষা করতে তারা অন্যত্র পালিয়ে যাচ্ছে।
হিরাক্লিয়াস সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানা গোয়েন্দা দলটির জন্য অপরিহার্য ছিল। কাজটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এবং বিপদজনক। তবুও তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আরো সম্মুখে অগ্রসর হয়ে গাসসানের একটি বসতিতে প্রবেশ করে এবং এই বলে নিজেদের অসহায়ত্ব প্রকাশ করে যে, আমরা বসরায় যাচ্ছিলাম পথিমধ্যে লুটেরা আমাদের সবকিছু লুট করে নিয়ে গেছে। লোকজন তাদের বিপদগ্রস্ত দেখে আপ্যায়ন করে এবং যথেষ্ট আন্তরিকতা ও আতিথেয়তা প্রদর্শন করে। গোয়েন্দারা তাদের কাছ থেকে সঠিক তথ্য পেয়ে যায়।
বাস্তব অবস্থা ছিল এই যে, হিরাক্লিয়াস এবং গাসসান গোত্রের মধ্যে মৈত্রীচুক্তি হয়েছে। গাসসানীরা নিজেদের সৈন্য হিরাক্লিয়াসের সৈন্যের মাঝে একত্র করে দেয়। সম্মিলিত বাহিনীর বর্তমান লক্ষ্য মদীনা। হিরাক্লিয়াসের সৈন্যসংখ্যা এক লাখ আর গাসসানী সৈন্য সংখ্যাও এক লাখ ছিল বলে ঐতিহাসিকগণ উল্লেখ করেছেন। তবে কোন কোন ঐতিহাসিক এ ব্যাপারে ভিন্নমত পোষণ করে বলেন, প্রত্যেকের এক লাখ করে নয়; বরং সম্মিলিত বাহিনী ছিল এক লাখ। প্রতিপক্ষের সৈন্যসংখ্যা নিয়ে মতভেদ থাকলেও মুসলমানদের সৈন্য সংখ্যা তিন হাজার ছিল।
এ গোয়েন্দা রিপোর্ট মুসলিম সেনানায়কদের গভীর চিন্তায় ফেলে দেয়। প্রতিপক্ষের বিশাল সৈন্যবহর বনাম নিজেদের সংখ্যার অতি স্বল্পতা বিবেচনা করে প্রত্যাবর্তন করাই ছিল পরিস্থিতির দাবি। কিন্তু তারা ফিরে যাবার কথা চিন্তাও করেনা। অবশ্য ‘মাআন’ থেকে সম্মুখে এগিয়ে যাবার পরিকল্পনা স্থগিত রাখে।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে রাওহা রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন– “আমরা ফিরে যাওয়ার অর্থ হিরাক্লিয়াস এবং গাসসানকে বিনা বাধায় হুড়হুড় করে মদীনা পর্যন্ত যাবার দাওয়াত প্রদান করা। আমরা এখানেই শত্রুদের গতিরোধ করব।”
হযরত যায়েদ বিন হারেসা রাযিয়াল্লাহু আনহু জানতে চান– মুষ্টিমেয় এ সৈন্য নিয়ে বিশাল বাহিনীর গতিরোধ করা কি আমাদের পক্ষে সম্ভব?”
হযরত জাফর ইবনে আবী তালেব হুংকার দিয়ে বলেন– “কোন্ রণাঙ্গনে আমরা সংখ্যায় স্বল্প ছিলাম না? পরামর্শ করে আমরা চূড়ান্ত কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে না পারলে কেউ মদীনায় গিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে পরবর্তী নির্দেশ জেনে আসুক।”
“আমরা এতটা সময় অপচয় করতে পারি না।” হযরত আব্দুল্লাহ রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন– শত্রুরা আমাদের এ সুযোগ দিবে না। খোদার কসম! আমি কিছুতেই একথা জানতে দিব না যে, আমরা প্রতিপক্ষের সৈন্য দেখে ভীত।”
হযরত আব্দুল্লাহ বিন রাওহা রাযিয়াল্লাহু আনহু বৈঠক থেকে উঠে মুজাহিদদেরকে এক জায়গায় সমবেত করে এমন জ্বালাময়ী বক্তব্য দেন যে, তিন হাজার মুজাহিদের তাকবীর ধ্বনিতে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। সেনাপতি হযরত যায়েদ বিন হারেসা রাযিয়াল্লাহু আনহু সম্মুখে এগিয়ে যাবার নির্দেশ দেন।
ঐতিহাসিকগণ লিখেন, তিন হাজার মুজাহিদ এক লাখ সৈন্যের মোকাবিলা করার সিদ্ধান্ত নিয়ে তারা নিজেদেরকে এক বিরাট পরীক্ষার সম্মুখীন করেন। ইতোমধ্যে হিরাক্লিয়াস এবং গাসসানের শীর্ষ নেতা খবর পেয়ে যায় যে, দূত হত্যার বদলা নিতে মদীনা থেকে মাত্র কয়েক হাজার সৈন্য আসছে। মুজাহিদদেরকে পদতলে পিষ্ট করতে হিরাক্লিয়াস এবং গাসসানের সম্মিলিত বাহিনীও যাত্রা শুরু করে।
♣♣♣
মুজাহিদ বাহিনী অগ্রসর হতে হতে ‘বালক’ গিয়ে পৌঁছে। আরো অগ্রসর হবার পরিকল্পনা তাদের ছিল। কিন্তু মুজাহিদ বাহিনী হতে তিন গুণ বেশি সৈন্য সমৃদ্ধ দুই প্লাটুন গাসসানী সৈন্য পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। হযরত যায়েদ বিন হারেসা রাযিয়াল্লাহু আনহু মুজাহিদ বাহিনীকে নিরাপদ দূরত্বে দাঁড় করান। তিনি একটি উঁচু স্থানে দাঁড়িয়ে এলাকাটি জরীপ করে নেন। এলাকাটি যুদ্ধের জন্য উপযোগী বলে তার কাছে মনে হয় না। পরবর্তী অন্যান্য সেনাপতিদের সাথে পরামর্শ সাপেক্ষে তিনি মুজাহিদ বাহিনীকে পিছনে সরিয়ে আনেন। গাসসানী সৈন্যরা এটাকে “পিছুটান ভেবে মুজাহিদদের পশ্চাদ্ধাবন করে।
হযরত যায়েদ রাযিয়াল্লাহু আনহু সমস্ত সৈন্য পিছু সরিয়ে এনে মুতায় সমবেত করে। দ্রুত বাহিনীকে যুদ্ধের কাতারে বিন্যস্ত করেন। তিনি মোট সৈন্যদেরকে তিনটি বাহিনীতে বিভক্ত করেন। ডান, বাম এবং মধ্য বাহিনী। ডান পার্শ্ব বাহিনীর কমান্ডার থাকেন হযরত উতবা ইবনে কাতাদা রাযিয়াল্লাহু আনহু। বাম পার্শ্ব বাহিনীর নেতৃত্বে হযরত উবায়া বিন মালেক রাযিয়াল্লাহু আনহু আর মধ্যবাহিনীর নেতৃত্বে থাকে স্বয়ং সেনাপতি হযরত যায়েদ রাযিয়াল্লাহু আনহু এর হাতে।
হযরত যায়েদ রাযিয়াল্লাহু আনহু উচ্চ কণ্ঠে কাতারবদ্ধ মুজাহিদদের উদ্দেশে বলেন– “আল্লাহ্ তা’আলার সত্য নবীর প্রেমিকগণ। আজ আমাদের প্রমাণ দিতে হবে যে, দুনিয়াতে একমাত্র আমরাই সত্যের পূজারী। বাতিলের হাত থেকে আজ আল্লাহর জমিন ছিনিয়ে আনতে হবে। বাতিলের সৈন্য দেখে ভীত হবে না।… মনে রেখ, এটা পেশী শক্তির লড়াই নয়। এটা সাহস, দৃঢ় মনোবল এবং বুদ্ধির লড়াই। আমি আপনাদের অধিনায়ক এবং পতাকাবাহীও। শত্রুর সৈন্য এত অধিক যে, আপনারা তাদের ভীড়ে হারিয়ে যাবেন। কিন্তু খবরদার! দেহ হারিয়ে গেলেও বুদ্ধি এবং প্রজ্ঞা হারিয়ে যেতে দিবেন না। আমরা এক সাথে যুদ্ধ করে এক সাথেই মরব।
একথা বলেই তিনি ইসলামের পতাকা হাতে তুলে নেন।
শত্রুদের পক্ষ থেকে প্রথমেই উড়ে আসে তীরের ঝাঁক। হযরত যায়েদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর নির্দেশে ডান এবং বাম পার্শ্বস্থ বাহিনী প্রসারিত হয়ে সম্মুখে অগ্রসর হয়। এটা ছিল সম্মুখ যুদ্ধ। মুজাহিদগণ ডানে-বামে আরো প্রসারিত হয়ে এগিয়ে যায়। যখন উভয় পার্শ্ববাহিনী অনেক দূর পর্যন্ত চলে যায় ঠিক সেই মুহূর্তে হযরত যায়েদ রাযিয়াল্লাহু আনহু মধ্য বাহিনীকে সম্মুখে এগিয়ে নিয়ে যান। তিনি ছিলেন সবার আগে। যুদ্ধে সাধারণত সেনাপতি মাঝখান থেকে সৈন্য পরিচালনা করে। কিন্তু মুজাহিদদের সাহস বৃদ্ধি ও প্রেরণা উজ্জীবিত রাখতে এ যুদ্ধে সেনাপতির জন্য সম্মুখে থাকা অপরিহার্য ছিল।
সেনাপতি হযরত যায়েদ বিন হারেসা রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর হাতে ইসলামের পতাকা থাকায় শত্রুপক্ষ তাঁর উপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালাতে থাকে। বায়ুর গতিতে তার লক্ষ্যে ঝাঁকে ঝাঁকে তীর ছুটে আসতে থাকে। ইতোমধ্যে কয়েকটি তীর তার দেহে বিদ্ধ হয়। আহত স্থান থেকে রক্ত গড়িয়ে যায়। তারপরেও তিনি পতাকা নিচু হতে দেন না। থামে না মুখের তর্জন-গর্জন। এক হাতে পতাকা ধরে অপর হাতে তরবারি চালাতে থাকেন। এক সময় তার দেহে বিদ্ধ হয় বর্শা। আর সোজা হয়ে বসে থাকা তার পক্ষে সম্ভব হয় না। তিনি ঘোড়ার পৃষ্ঠ হতে জমিনে লুটিয়ে পড়ে শহীদ হয়ে যান। হযরত যায়েদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর হাত হতে পতাকা পড়ে গেলে মুজাহিদরা কিছুটা হতাশ হয়ে যান। কিন্তু হযরত জাফর বিন আবী তালেব রাযিয়াল্লাহু আনহু ঝড়ের গতিতে এসে পতাকা উঠিয়ে নেন।
“আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রেমিকগণ।” হযরত জাফর রাযিয়াল্লাহু আনহু ঝাণ্ডা উড্ডীন করে জোরালো কণ্ঠে বলেন– “আল্লাহর শপথ! ইসলামের পতাকা ভূলুণ্ঠিত হতে পারে না।”
এরপর তিনি হযরত যায়েদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর দায়িত্ব নিজ স্কন্ধে তুলে নেন। নতুন সেনাপতি হযরত জাফর রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর জ্বালাময়ী ভাষণে সৈন্যদের সাময়িক জড়তা ও হীনতা মুহূর্তে দূর হয়ে যায়। মনোবল শত্রু-বিধ্বংসী শক্তিতে রূপ নেয়। বিশাল শত্রুবাহিনীর ভীড়ের মধ্যে মুজাহিদ বাহিনী হারিয়ে গেলেও তাদের মনোবল ছিল তুঙ্গে। শক্তি ছিল তাদের অটুট। নব উদ্যোমে মুজাহিদরা লড়তে থাকে। ক্ষুধার্ত সিংহের ন্যায় প্রতিপক্ষের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। নারাধ্বনির রব রণাঙ্গনে ভূমিকম্প সৃষ্টি করে। প্রতিপক্ষের কানে এ রব বজ্রধ্বনি হয়ে আঘাত হানে। তাদের দেশ থর থর করে কেঁপে ওঠে। এক অজানা আতঙ্ক তাদের গ্রাস করে ফেলে। নাটকীয়ভাবে যুদ্ধের ছন্দপতন ঘটে। এর বিপরীতে মুজাহিদ বাহিনী বীর-বিক্রমে যুদ্ধ করতে থাকে। তাদের সেনাপতিও সাধারণ সৈনিকের মত লড়তে থাকে। দীর্ঘক্ষণ তাদের পতাকা সমুন্নত ছিল।
কিছুক্ষণ পর পতাকা পতনের লক্ষণ দেখা দেয়। একবার উঁচু হয়, একবার নিচু হয়। পরবর্তী সেনাপতি হযরত আব্দুল্লাহ বিন রাওহা রাযিয়াল্লাহু আনহু দূর থেকে পতাকার উঠানামার দৃশ্য দেখতে পান। পতাকার এ উত্থান-পতনে তিনি বুঝতে পারেন পতাকাধারী আহত। তিনি পতাকা ঠিকমত সামাল দিতে পারছেন না। হযরত আব্দুল্লাহ রাযিয়াল্লাহু আনহু আহত সেনাপতির উদ্দেশে দৌড়ে আসেন। কিন্তু চারপাশে এমন ভয়াবহ সংঘর্ষ চলছিল যে, সেখানে দ্রুত পৌঁছার কোন সুযোগ ছিল না।
প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা করে হযরত আব্দুল্লাহ বিন রাওহা রাযিয়াল্লাহু আনহু সেনাপতির নিকটে যেতে সক্ষম হন। তিনি সেখানে পৌঁছতেই হযরত জাফর রাযিয়াল্লাহু আনহু পড়ে যান। তার সমস্ত শরীর ছিল রক্তস্নাত। শরীরে এমন কোন স্থান ছিল না, যেখানে তীর, বর্শা, বা তরবারির আঘাত লাগেনি। ক্ষত-বিক্ষত এবং ঝাঁজরা হয়ে যাওয়া দেহ নিয়ে এতক্ষণ পর্যন্ত হযরত জাফর রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর সোজা হয়ে বসে থাকা এক অলৌকিক ব্যাপার ছিল। মনে হয় পরবর্তী সেনাপতি হযরত আব্দুল্লাহ বিন রাওহা রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর অপেক্ষায় তার রূহ এতক্ষণ পতাকা ধারণ এবং যুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়ে আসছিল। হযরত জাফর রাযিয়াল্লাহু আনহু মাটিতে পড়েই শহীদ হয়ে যান। এদিকে হযরত আব্দুল্লাহ রাযিয়াল্লাহু আনহু যথা সময়ে পতাকার কাছে পৌঁছে যাওয়ায় পতাকা হযরত জাফর রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর হস্তচ্যুত হলেও ভূলুণ্ঠিত হয় না। তিনি পতাকা ক্ষিপ্রগতিতে লুফে নিয়ে উঁচু করে তুলে ধরেন। তাকবীর ধ্বনি দিয়ে মুজাহিদদের জানিয়ে দেন যে, পতাকা এবং সেনাপতির দায়িত্ব এখন তার হাতে।
শত্রু বাহিনীর এ দলটি ছিল মূল বাহিনীর একাংশ মাত্র। তারা ছিল দশ থেকে পনের হাজার। এদের সকলেই গাসসানী খ্রিষ্টান। তারা এই যুদ্ধকে ক্রুসেড (ধর্মযুদ্ধ) মনে করে প্রাণপণ লড়ছিল। বিশাল এ বাহিনীর বিপরীতে মাত্র তিন হাজার মুজাহিদ আর কিইবা করতে পারে। কিন্তু তাদের নেতৃত্ব এত বিচক্ষণ এবং সমর দৃষ্টিকোণ থেকে এত সঠিক ছিল যে, মুজাহিদ বাহিনী অপূর্ব রণকৌশল এবং কৃতিত্বের সাথে পাল্লা দিয়ে লড়ে যাচ্ছিল। তাদের যুদ্ধের ধরন ভাড়াটে লাঠিয়াল বাহিনীর মত ছিল না। কিন্তু তার পরও শত্রুসংখ্যা কয়েকগুন বেশি থাকায় মুজাহিদ বাহিনীর দুর্ভেদ্য প্রাচীরে ফাটল সৃষ্টি হতে থাকে। তাদের মাঝে বিক্ষিপ্ততা পরিলক্ষিত হয়। শত্রুর প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে কতক সৈন্য রণাঙ্গন ছেড়ে চলে আসে। কিন্তু তারা বেশি দূরে না গিয়ে নিকটেই অবস্থান করতে থাকে। অবশিষ্ট মুজাহিদরা চারজন, পাঁচজন মিলে রণে লিপ্ত থাকার মাধ্যমে বিক্ষিপ্ততার শিকার হওয়া থেকে বেঁচে যায়।
সমর বিশেষজ্ঞগণ লিখেন, গাসসানীরা মুসলমানদের এই এলোপাথাড়ি অবস্থা থেকে কোন ফায়দা নিতে পারে না। তার কারণ এই ছিল যে, মুসলমানগণ এমন বীরবিক্রম এবং এমন অপূর্ব রণদক্ষতার সাথে যুদ্ধ করে যে, ইতোমধ্যে গাসসানীদের মধ্যে মুসলমানদের সম্পর্কে এক অজানা ভীতি চেপে বসে। তারা মুসলমানদের এই বিক্ষিপ্ততাকেও এক ধরনের জঙ্গী কৌশল ভাবে। ঐতিহাসিকগণ লিখেন, মুসলিম সেনাপতি এবং কমান্ডারগণ উদ্ভূত পরিস্থিতি এভাবে সামাল দেন যে, পুরো বাহিনীকে আবার ঢেলে সাজাতে তারা তখনও যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিলেন তাদেরকে কৌশলে রণাঙ্গনের বাইরে নিয়ে আসেন।
এ সময় ইসলামী পতাকা আরো একবার ভূপাতিত হয়। এর অর্থ, তৃতীয় সেনাপতি হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে রাওহা রাযিয়াল্লাহু আনহুও শহীদ হয়ে যান। এ অবস্থায় মুসলমানদের অবস্থা আরো করুণ হয়ে পড়ে। তৃতীয়বার পতাকার পতন কোন শুভ লক্ষণ ছিল না; বরং তা অশুভ ইঙ্গিতবাহীই ছিল। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেই এই তিনজনকে সেনাপতি নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন। এখন সেনাপতি নির্বাচন করা মুজাহিদদের উপর কর্তব্য হয়ে পড়ে।
সেনাপতির অভাবে পতাকা মাটিতেই পড়েছিল। আর পতাকার পতন অর্থই পরাজয় বরণ করা। নেতৃস্থানীয় এক মুজাহিদ হযরত সাবেত বিন আরকাম রাযিয়াল্লাহু আনহু পতাকা উঁচু করে ধরে বলেন– তাড়াতাড়ি কাউকে সেনাপতি নির্বাচিত কর। ততক্ষণ আমি পতাকা উড্ডীন রাখছি।… আমি সাবেত বিন আরকাম বলছি।”
ঐতিহাসিক ইবনে সা’দ লিখেন, হযরত সাবেত রাযিয়াল্লাহু আনহু নিজেকে সেনাপতির যোগ্য বলে মনে করতেন না এবং তিনি মুজাহিদদের মতামত ছাড়া সেনাপতি হতেও ইচ্ছুক ছিলেন না। কেননা, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নির্দেশ ছিল, তিন সেনাপতি শহীদ হলে চতুর্থ সেনাপতি মুজাহিদরাই নির্বাচিত করবে। হযরত সাবেত রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর দৃষ্টি হযরত খালিদ বিন ওলীদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর উপর পতিত হয়। তিনি কাছেই ছিলেন। কিন্তু হযরত খালিদের ইসলাম গ্রহণের বয়স মাত্র তিন মাস হওয়ায় মুসলমানদের মধ্যে তার কোন ব্যক্তিত্ব তখনও পর্যন্ত প্রকাশ পাইনি। তা সত্ত্বেও হযরত সাবেত রাযিয়াল্লাহু আনহু হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর রণ-অভিজ্ঞতা সম্পর্কে অবগত থাকায় তিনি হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর দিকে পতাকা এগিয়ে দেন।
“খালিদ! নিঃসন্দেহে এই পদের যোগ্য তুমি” হযরত সাবেত রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন।
হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু অস্বীকার করে বলেন “না” আমি এখনও এর যোগ্য হইনি।”
লড়াই কিছুটা স্তিমিত হয়ে পড়ে। হযরত সাবেত রাযিয়াল্লাহু আনহু মুজাহিদদের আহবান করে বলেন, তোমরা খালিদকে পতাকা এবং সেনাপতির দায়িত্ব নিতে অনুরোধ কর। বেশিরভাগ মুজাহিদ হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর রণকৌশল যোগ্যতা সম্বন্ধে জানতেন এবং কুরাইশগোত্রে তাঁর যে বিরাট পদমর্যাদা ছিল তাও তারা জানতেন।
“খালিদ… খালিদ… খালিদ!” চতুর্দিক হতে আওয়াজ হতে থাকে– “খালিদ আমাদের সেনাপতি।”
হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু ক্ষিপ্রগতিতে পতাকা হযরত সাবেত রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর হাত থেকে নিজের হাতে নিয়ে নেন।
গাসসানীরা লড়াই চালিয়ে গেলেও সরে গিয়েছিল। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু জীবনে এই প্রথমবারের মত স্বাধীনভাবে রণনৈপুণ্য এবং নেতৃত্বের ঝলক দেখানোর সুযোগ পান। তিনি কয়েকজন সৈন্যকে নিজের পাশে পাশে রাখেন এবং তাদের দ্বারা দূতের কাজ নিতে থাকেন। নিজে ছুটোছুটি করেন এবং সেই সঙ্গে তলোয়ারও চালাতে থাকেন। এভাবে বহু প্রচেষ্টায় তিনি যুদ্ধে সক্ষম মুজাহিদ বাহিনীকে এক জায়গায় করে ঢেলে সাজান এবং তাদেরকে পিছনে সরিয়ে আনেন। গাসসানীরাও পিছে সরে যায়। তলোয়ারের ঝনঝনানী কিছুক্ষণের জন্য থেমে শুরু হয় তীরযুদ্ধ। উভয় পক্ষ হতে তীরের বর্ষণ হতে থাকে। খোলা আকাশ দিয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে তীর উড়ছিল।
হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু পরিস্থিতি বুঝে নেন। মুজাহিদ বাহিনীও তাদের মনোবল দেখেন। এসব মিলিয়ে যে যোগফল বের হয় তাতে এ ছাড়া কোন উপায় ছিল না যে, সম্মুখে আর অগ্রসর না হয়ে এখানেই যুদ্ধের ইতি টানা। কেননা মুজাহিদ বাহিনীর সাহায্যের কোন সুযোগ না থাকলেও শত্র বাহিনী প্রয়োজনীয় সাহায্য চাওয়ার আগেই পেয়ে যাচ্ছিল। তদুপরি খাদ্যসঙ্কট কিংবা জনবলের কমতি তাদের ছিল না।
যুদ্ধ ক্ষান্ত করা পরিস্থিতির দাবি হলেও হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু যুদ্ধ ছেড়ে পিছু হটতে চাচ্ছিলেন না। কেননা তার আশঙ্কা ছিল, পিছু হঁটে গেলে শত্রুরা দুর্বলতা মনে করে পশ্চাদ্ধাবন করতে পারে। আর যদি আসলেই তারা পশ্চাদ্ধাবন করে তখন এই মুষ্টিমেয় সৈন্যকে রক্ষা করা কোনমতেই সম্ভব হবে না। চূড়ান্ত ধ্বংসের মুখে পড়ে তিলে তিলে নিঃশেষ হয়ে যাবে।
হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু অনেক চিন্তা-ভাবনার পর এক দুঃসাহসিক সিদ্ধান্ত নেন। তিনি মুজাহিদ বাহিনীর সম্মুখে এসে দাঁড়ান এবং চোখের পলকে গাসসানীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। মুজাহিদ বাহিনী পতাকা এবং সেনাপতিকে সম্মুখে দেখে তাদের শীতল রক্ত টগবগ করে উঠে। ভেঙ্গে পড়া মনোবল ইস্পাতসম দৃঢ় হয়ে যায়। “হয় হরণ নয় তো মরণ” এই মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে ঘুরে দাঁড়ায়। যোগ্য সেনাপতির সুনিপুণ নেতৃত্বে ক্ষুধার্ত শার্দুলের ন্যায় মুজাহিদ বাহিনী একযোগে শত্রু বাহিনীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তাদের এই হামলা এতই ক্ষিপ্র গতির ছিল যে, সংখ্যাধিক্য সত্তেও গাসসানীদের পা নড়বড় হয়ে যায়। মুসলমানদের নারাধ্বনি ও আক্রমণ আগুনের গোলা হয়ে তাদের উপর পতিত হতে থাকে। কোন কিছু বুঝার আগেই তারা মুসলমানদের হাতে হত্যাযজ্ঞের শিকার হতে থাকে। তারা এক স্থানে দাঁড়িয়ে এ হত্যাযজ্ঞ চালায় না বরং জায়গা পরিবর্তন করে করে গাসসানীদের হত্যা করতে থাকে। মুজাহিদ বাহিনী যেখানেই যায় সেখানেই লাশের স্তূপ এবং রক্তগঙ্গা বয়ে যায়। মুসলমানরা ধূমকেতুর মত আভির্ভূত হয়ে চোখের পলকে কাজ করে হাওয়ায় মিলিয়ে যেত। পিছনে রেখে যেত লাশের স্তূপ আর আহতদের বুকফাটা আর্তনাদ। ঐতিহাসিকগণ লিখেন এবং হাদীসেও রয়েছে, হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু সেদিন মুষ্টিমেয় মুজাহিদ নিয়ে গাসসানীদের উপর এমন টর্নেডো সৃষ্টি করেন যে, আক্রমণের তীব্রতায় এক এক করে নয়টি তলোয়ার তার হাতে ভেঙ্গে যায়।
হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু দুঃসাহসিক এ হামলা করলেও অধিকক্ষণ এখানে অবস্থান করা উচিত মনে করেননি। তিনি কৌশলে মুজাহিদদের পশ্চাতে সরিয়ে আনতে চেষ্টা করেন। এতেও তিনি সফল হন। তিনি মুজাহিদদের জিহাদী জোশ এবং ইসলামের আকর্ষণে এ দুঃসাহসিক আক্রমণ করেন। আক্রমণের তীব্রতা এবং নারাধ্বনির কম্পনে গাসসানীরা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে। তারা দিশেহারা হয়ে পিছনে সরে যায়। তাদের মাঝেও হতাশা সৃষ্টি হয়। এ সময় মুজাহিদদের দক্ষিণ ভাগের কমান্ডার হযরত উতবা ইবনে কাতাদা রাযিয়াল্লাহু আনহু গাসসানীদের মধ্যভাগে আচমকা প্রবেশকরে তাদের সেনাপতি মালেককে হত্যা করে। সেনাপতির মৃত্যুতে গাসসানীদের অবশিষ্ট শক্তিও নিভে যায়। ভয়-আতঙ্ক এবং উদ্বেগে সংখ্যাধিক্য হওয়া সত্ত্বেও তারা অনেক পেছনে চলে যায়। চেইন অব কমান্ড না থাকায় পুরো বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়।
এই দুঃসাহসিক হামলার পেছনে হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর উদ্দেশ্য ছিল, প্রলয়ঙ্কারী তুফানের হাত থেকে মুজাহিদ বাহিনীকে হেফাজত করা। প্রচণ্ড আক্রমণ করে গাসসানীদের পিছু হটিয়ে দিয়ে মুজাহিদ বাহিনী নিয়ে নিরাপদে কেটে পড়াই ছিল তার মূল পরিকল্পনা। তিনি অত্যন্ত সাফল্যের সাথে এ কাজটি করেন এবং শত্রুপক্ষ পিছু হঁটে যেতেই তিনি মুজাহিদ বাহিনীকে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের নির্দেশ দেন। এভাবে এ অসম যুদ্ধ জয়-পরাজয় ব্যতীতই নিষ্পত্তি হয়।
এদিকে কিভাবে গুজব রটে যায় যে, মুজাহিদ বাহিনী পৃষ্টপ্রদর্শন করে ফিরে আসছে। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু এর নেতৃত্বে মুজাহিদ বাহিনী মদীনা পৌঁছা মাত্রই লোকজন ‘পলায়নপর বাহিনী’ বলে ধিক্কার দিতে থাকে। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু এসব পাত্তা না দিয়ে সোজা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সম্মখে গিয়ে রণাঙ্গনের আদি-অন্ত তুলে ধরেন। এদিকে বাইরে তিরস্কারের আওয়াজ ক্রমে জোরাল হচ্ছিল।
“রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জনতার উদ্দেশে নির্দেশ ছুঁড়ে বলেন– থামো!” এরা রণাঙ্গন হতে পলায়নপর সৈন্য নয়। যুদ্ধ করে এসেছে এবং ভবিষ্যতেও যুদ্ধ করতে থাকবে।… খালিদ ‘সাইফুল্লাহ্’ – আল্লাহর তরবারি।
ইবনে হিশাম এবং ওকিদী লিখেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পবিত্র মুখের এই বাক্যটি পরবর্তীকালে হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর উপাধিতে পরিণত হয়। “সাইফুল্লাহ”-আল্লাহর তরবারি। এরপর থেকে আল্লাহর পথে এ তরবারি সর্বদা কোষমুক্তই থাকে।
♣♣♣
কুরাইশদের সর্বোচ্চ নেতা আবু সুফিয়ান এতদিন হুঙ্কার ছেড়ে কথা বলতেন এবং মুসলমানদেরকে ‘মুহাম্মদী গ্রুপ’ বলে পাত্তা দিতনা কিন্তু এখন নীরব-নিস্তব্ধ। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর ইসলাম গ্রহণের পর আবু সুফিয়ান সেনাপতি থেকে গোত্রপ্রধানে পরিণত হয়ে যায়। তাকে দেখলে মনে হত, যুদ্ধ-বিগ্রহের সাথে লোকটির কোনই সম্পর্ক নেই। হযরত উসমান বিন তালহা রাযিয়াল্লাহু আনহু এবং হযরত আমর ইবনুল আস রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর মত প্রখ্যাত বীররাও তাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল। তার অধীনে এখন উল্লেখযোগ্য ছিল মাত্র দু’জন, ইকরামা ও সফওয়ান। আবু সুফিয়ান অনুভব করে যে, কুরাইশী শক্তি এখন খুবই দুর্বল।
স্ত্রী হিন্দা একদিন তাকে বলে– “তুমি কাপুরুষ হয়ে গেছ আবু সুফিয়ান! তুমি মদীনাবাসীদের এই সুযোগ দিচ্ছ যে, তারা নিরাপদে সৈন্য সংগ্রহ করবে এরপর আচমকা একদিন মক্কার উপর চড়াও হয়ে মক্কা দখল করে নিবে।”
আবু সুফিয়ান হতাশাব্যঞ্জক কণ্ঠে বলে– “আমার সাথে আর আছেই বা কে হিন্দা?”
“আমাকে ঐ ব্যক্তির স্ত্রী হিসেবে পরিচয় দিতে লজ্জা লাগে, যে নিজ আত্মীয়-স্বজন এবং স্ব গোত্রের নিহতদের হত্যার প্রতিশোধ নিতে ভয় পায়।” আবু সুফিয়ানের পৌরুষ লক্ষ্য করে হিন্দার নারী সুলভ বোমা নিক্ষেপ।
“আমি হত্যা করতে পারি।” আবু সুফিয়ান আহতস্বরে বলে– “আমি নিহত হতে পারি। আমি কাপুরুষ নই। ভীতু নই। আমি কোনমতেই স্বীয় অঙ্গীকার ভঙ্গ করতে পারব না।…হদায়বিয়াতে মুহাম্মাদের সাথে আমার যে কথা হয়েছে তা কি তুমি ভুলে গেছ?”… কুরাইশ এবং মুসলমানরা আগামী দশ বছর পর্যন্ত যুদ্ধে লিপ্ত হবে না। যদি আমি চুক্তি ভঙ্গ করে যুদ্ধে নামি আর মুসলমানরা বিজয়ী হয়?”
“তুমি যুদ্ধ করবে না। হিন্দা বিকল্প পরিকল্পনা পেশ করে বলে– “কুরাইশরাও যুদ্ধ করবে না। আমরা নেপথ্যে থেকে অপর কোন গোত্রকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিতে অবতীর্ণ করতে পারি। আমাদের মূল লক্ষ্য মুসলমানদের ধ্বংস। চাই তা যেভাবেই হোক। যারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করবে আমরা গোপনে তাদের সহযোগিতা করতে পারি।”
‘কুরাইশ ছাড়া মুসলমানদের বিরুদ্ধে লড়বে এমন দুঃসাহস কার? আবু সুফিয়ান বলে–“মুতায় হিরাক্লিয়াস এবং গাসসানের লক্ষাধিক সৈন্যের মোকাবিলায় মুসলমানদের সৈন্য সংখ্যা ছিল মাত্র তিন হাজার। আমার গোত্রের কোন ব্যক্তিকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণকারী অপর কোন গোত্রের সাহায্য করার অনুমতি দিব না।”
হিন্দা রুদ্র কণ্ঠে বলে– “ভুলে যেয়ো না আবু সুফিয়ান। আমি সেই নারী উহুদ রণাঙ্গনে যে হামযার পেট ছিড়ে কলিজা বের করে মুখে পুরে চিবিয়েছিলাম। তুমি আমার গরম রক্ত ঠাণ্ডা করতে পার কি?”
“তুমি হামযার লাশের পেট ফেঁড়ে ছিলে হামযার নয়।” আবু সুফিয়ান বিদ্রূপের হাসি হেসে বলে– “মুসলমানরা মৃত নয়।… আর তারা যাই হোক না কেন আমি চুক্তি ভঙ্গ করব না।
“চুক্তি তো আমিও লঙ্ঘন করব না।” হিন্দা বলে– “কিন্তু মুসলমানদের থেকে অবশ্যই বদলা নেব। আর সে বদলা হবে অত্যন্ত ভয়ঙ্কর। কুরাইশ গোত্রে এখনও বীর-বাহাদুর আছে।”
আবু সুফিয়ান আগ্রহভরে জানতে চায় “তা তুমি কি করতে চাও?”
“অচিরেই তুমি জানতে পারবে।” হিন্দা উত্তর পাশ কাটিয়ে যায়।
মক্কার পাশ্ববর্তী এলাকায় বনু খোজাআ এবং বনু বকর নামে দু’টি গোত্র বাস করত। তাদের মধ্যে পারস্পরিক বিবাদ ছিল অতি পুরোনো। হুদায়বিয়ায় মুসলমান বনাম কুরাইশদের মধ্যে আগামী দশ বছর কোন প্রকার সংঘর্ষে লিপ্ত হবে না বলে প্রতিজ্ঞা বদ্ধ হলে এই উভয় গোত্র সে চুক্তির আওতায় চলে আসে এভাবে যে, খোজাআ গোত্র মুসলমানদের আর বনু বকর গোত্র কুরাইশদের মিত্র হওয়ার ঘোষণা করে। হুদায়বিয়ার সন্ধি কুরাইশ আর মুসলমানদের মধ্যে হলেও খোজাআ এবং বনূ বকরের জন্য তা শান্তির পায়রা হয়ে যায়। কেননা, এ সন্ধির ফলে এবং দুই গোত্র চুক্তিবদ্ধ দু’পক্ষের পক্ষাবলম্বন করায় তাদের পারস্পরিক পুরাতন বৈরীতা এবং যুদ্ধ-বিগ্রহও বন্ধ হয়ে যায়।
কিন্তু ন্যায়-নীতির আচমকা সন্ধি ভঙ্গ করে বনু বকর কোন ঘোষণা ছাড়াই এক রাতে খোজাআ বসতির উপর চড়াও হয়। বনু বকরের চুক্তিভঙ্গ করার কারণ কারো জানা ছিল না। তবে এক বর্ণনামতে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, এর পেছনে হিন্দার কুটচাল ছিল। হিন্দার যুক্তি ছিল, খোজাআ গোত্র যেহেতু মুসলমানদের মিত্র তাই বনু বকর খোজাআ গোত্রের উপর হামলা করলে তারা মুসলমানদের সাহায্য চাইবে। মুসলমানরা অবশ্যই সাহায্য করবে। এদিকে কুরাইশরাও তৈরী থাকবে। মুসলমানরা বনু বকরের উপর হামলা করতেই কুরাইশরা ‘মিত্র রক্ষার’ দোহাই দিয়ে মুসলমানদের উপর হামলা করে অতীত পরাজয়ের বদলা নিবে।
অন্য এক তথ্যমতে বনু বকরের আক্রমণ মূলত গাসসানী খ্রিস্টান ও ইহুদীদের ষড়যন্ত্রের ফসল ছিল। তারা এভাবে নীলনক্সা আঁকে যে, যে কোন উপায়ে কুরাইশ এবং মুসলমানদের মিত্র গোত্রে যুদ্ধ বাঁধিয়ে দিতে পারলে মিত্রতার খাতিরে কুরাইশ এবং মুসলমানদের মাঝে সংঘর্ষ বেঁধে যাবে। বনু বকর খোজাআদের চেয়ে শক্তিশালী গোত্র ছিল। গাসসানী এবং ইহুদীরা বনু বকরের এক মেয়েকে অপহরণ করে নিয়ে খোজাআ গোত্রের এক বসতির কাছে রেখে আসে। এদিকে বনু বকরের সর্দারের নিকট গিয়ে বলে, খোজাআরা তার গোত্রের একটি মেয়েকে অপহরণ করে নিয়ে গেছে। বনু বকর গোপনে তদন্ত করে তাদের একটি মেয়েকে খোজাআর এক বস্তিতে পেয়ে যায়।
হিন্দা আবু সুফিয়ানকে কিছু না জানিয়েই বনু বকরের সাহায্যে কুরাইশদের কয়েকজন লোক পাঠায়। এদের মধ্যে কুরাইশদের প্রখ্যাত সেনাপতি ইকরামা এবং সফওয়ানও ছিল। রাতের আঁধারে অতর্কিতে হামলা হওয়ায় খোজাআর বিশজন লোক মারা যায়। হিন্দা গোপনে লোক পাঠালেও এ তথ্য ফাঁস হয়ে যায় যে, বনু বকরের হামলায় সহায়তা করতে কুরাইশদের পক্ষ থেকে লোক গিয়েছিল।
খোজাআ প্রতিরোধের কোন সুযোগই পায় না। অনর্থক তাদের বিশজন প্রাণ হারায়। খোজাআ দলপতি এই অন্যায় হামলার দাঁতভাঙ্গা জবাব দিতে সাহায্য প্রাপ্তির আশায় দুই তিনজন সাথি নিয়ে মদীনায় যায়। খোজাআ ছিল অমুসলিম গোত্র। খোজাআর এ প্রতিনিধিদল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সমীপে পৌঁছে জানায় যে, বনু বকর কুরাইশদের সহযোগিতায় আমাদের উপর আক্রমণ করে। কয়েজন কুরাইশ যোদ্ধাও এই আক্রমণে অংশ নেয়। তারা আরও জানায় যে, ইকরামা এবং সফওয়ানও এই হামলায় অংশগ্রহণ করেছিল। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অতিশয় ক্ষুব্ধ হন। এটা ছিল সরাসরি চুক্তি লঙ্ঘন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তৎক্ষণাৎ মুজাহিদদের যুদ্ধ প্রস্তুতির নির্দেশ দেন।
ঐতিহাসিকগণ লিখেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতিক্রিয়া ছিল অত্যন্ত কঠোর। ঘটনাটি যদি কেবল বনু বকর ও খোজাআর মধ্যে সীমাবদ্ধ হত তাহলে তিনি হয়ত অন্য সিদ্ধান্ত নিতেন। কিন্তু বনু বকরের উপর হামলায় কুরাইশদের বিখ্যাত সেনাপতি ইকরামা এবং সফওয়ান অংশগ্রহণ করায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, এ অপরাধ এবং সন্ধিভঙ্গের যাবতীয় দায়-দায়িত্ব কুরাইশদের উপরই বর্তায়।
“আবু সুফিয়ান হুদায়বিয়ার সন্ধি ভঙ্গ করেছে।” মদীনার অলি-গলিতে এই আওয়াজ প্রচার হতে থাকে –“রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নির্দেশে আমরা মক্কার একটি একটি করে ইট খুলে ফেলব।… কুরাইশদের এবার পায়ের উপর আছড়ে ফেলে তবেই আমরা ক্ষান্ত হবো।”
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নির্দেশে মক্কা আক্রমণের প্রস্তুতি চলতে থাকে।
আবু সুফিয়ান উড়ো খবরের মাধ্যমে এতটুকুই জানতে পারে যে, বনু বকর খোজাআ গোত্রের উপর গেরিলা ধরনের হামলা চালিয়েছে এবং এতে খোজাআ গোত্রের কিছু লোক নিহত হয়েছে। এ সংবাদ পাওয়ার পর তার মনে পড়ে যে, খুব ভোরে ইকরামা এবং সফওয়ানকে ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে কোথা হতে ফিরে আসতে দেখেছিল। সে তাদের নিকট জানতে চেয়েছিল যে, তারা এত ভোরে কোথা থেকে আসছে। তারা তাকে এই জবাব দিয়েছিল যে, আমরা ভোরের হাওয়ায় ঘুরতে গিয়েছিলাম। ভোরে মুক্ত বাতাসে একটু ঘুরে এলাম। আবু সুফিয়ান তাদের কথা বিশ্বাস করেছিল। কিন্তু যখন দুপুরে সে জানতে পারে যে, বনু বকর খোজাআর উপর হামলা করেছে তখন আবু সুফিয়ানের কাছে বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যায়। সে তখনই ইকরামা এবং সফওয়ানকে ডেকে পাঠায়।
“খোজাআ গোত্রে বনু বকরের হামলায় তোমরা ছিলেনা-এর স্ব পক্ষে তোমরা প্রমাণ দিতে পারবে?” আবু সুফিয়ান ক্রুদ্ধ কণ্ঠে তাদের নিকট জানতে চায়।
“তোমার কি স্মরণ নেই যে, বনু বকর আমাদের মিত্র?” সফওয়ান বলে– “মিত্র সাহায্যের জন্য আবেদন করলে তুমি পিঠ দেখাবে?”
“সবকিছু আমার স্মরণ আছে।” আবু সুফিয়ান বলে– “খোদার কসম! তোমরা ভুলে গেছ যে, কুরাইশ সর্দার কে?… আমিই তোমাদের সর্দার।… আমার অনুমতি না নিয়ে তোমরা কারো সাহায্যে এগিয়ে যেতে পার না।”
ইকরামা বলে– “আবু সুফিয়ান! আমি তোমাকে গোত্রপ্রধান বলে অবশ্যই স্বীকার করি। তোমার নেতৃত্বে অসংখ্য যুদ্ধ করেছি। তোমার প্রতিটি নির্দেশ সঠিকভাবে পালন করেছি। কিন্তু এখন দেখছি, তুমি গোত্রের মান সম্মান দিন দিন হারিয়ে দিচ্ছ। তোমার মনে ‘মদীনা-ভীতি’ গভীরভাবে জেঁকে বসেছে।”
আবু সুফিয়ান দৃঢ় কণ্ঠে বলে– “আমি গোত্রের সর্দার হয়ে থাকলে যে অন্যায় তোমরা করেছ তা আমি ক্ষমা করব না।”
ইকরামা পাল্টা বলে– “আবু সুফিয়ান! সে সময়ের কথা হয়ত তোমার মনে আছে, খালিদ মদীনায় চলে যাবার সময় তুমি তাকেও হুমকি দিয়েছিলে। আমি তখন তোমাকে বলেছিলাম, প্রত্যেকের ধর্মীয় স্বাধীনতা রয়েছে। যে যাকে ভালবাসে সে তার কাছে যেতে পারে। সেদিন আমি তোমাকে এ কথাও জানিয়ে দিয়েছিলাম যে, তুমি পদক্ষেপ পরিবর্তন না করলে আমিও সঙ্গ ত্যাগ এবং মুহাম্মাদের আনুগত্য করতে বাধ্য হব।”
“তোমরা বোঝ না যে, সম্মানিত ব্যক্তিগণ কখনো সন্ধি ভঙ্গ করে না।” আবু সুফিয়ান বলে– “তোমরা বনু বকরের সাহায্যার্থে গিয়ে এবং মুসলমানদের মিত্র গোত্রের উপর হামলা করে নিজ গোত্রের মুখে চুন-কালি লাগিয়েছ। যদি মনে করে থাক যে, মুহাম্মাদ প্রতিশোধ নিতে মক্কা আক্রমণ করলে তোমরা তা প্রতিহত করবে, তাহলে নিশ্চিত যে তোমরা অলীক স্বপ্ন এবং অনর্থক আত্মতুষ্টিতে লিপ্ত রয়েছ। মদীনার বন্যা ঠেকানোর সাধ্য তোমাদের নেই। কোন ময়দানে তোমরা মুসলমানদের ঠকিয়েছ? বিশাল বাহিনী নিয়ে তোমরা মদীনা অবরোধ করনি?”
সফওয়ান বলে– “অবরোধ ছেড়ে পিছু হটার নির্দেশ তুমিই দিয়েছিলে। তুমি আগে ভাগেই পরাজয় স্বীকার করে নিয়েছিলে।”
“আমি তোমাদের মত জেদী এবং অদূরদর্শী লোকদের কারণে পুরো গোত্রকে অপদস্থ ও লাঞ্ছিত করতে পারি না।” আবু সুফিয়ান বলে– “আমি মুসলমানদের সাথে প্রতারণা করতে পারি না। আমি মুহাম্মাদকে সমস্ত ঘটনাটি জানিয়ে বলব যে, আমাদের এক মিত্র গোত্র মুসলমানদের এক মিত্র গোত্রের উপর হামলা করেছে। আমার অজান্তে কুরাইশদের কতিপয় লোকও তাদের সাথে শরীক হয়। এর অর্থ এই নয় যে, আমি চুক্তি ভঙ্গ করেছি। আমি মুহাম্মাদকে জানাব যে, কতিপয় অদূরদর্শীর পদস্খলন সত্ত্বেও কুরাইশরা হদায়বিয়া সন্ধির উপর অটল।”
আবু সুফিয়ান ইকরামা এবং সফওয়ানকে সেখানে রেখেই দ্রুত চলে যায়।
সে দিনই আবু সুফিয়ান মদীনার উদ্দেশে রওনা দেয়। শত্রুর কাছে সে নিজে চলে যাওয়ায় মক্কার জনগণ খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। তার বিরুদ্ধে স্লোগান উঠতে থাকে। তার স্ত্রী হিন্দা জনগণের মাঝে ঘুরে ঘুরে সবাইকে উত্তেজিত করতে থাকে। আবু সুফিয়ানের বিরুদ্ধে গর্জে উঠতে জনগণকে প্ররোচিত করে।
মদীনায় পৌঁছে আবু সুফিয়ান প্রথমে যে দরজায় নক করে তা ছিল তার কন্যা উম্মে হাবীবা রাযিয়াল্লাহু আনহা-এর ঘর। দরজা খুলে পিতাকে দেখে কন্যা আনন্দের পরিবর্তে তার চেহারায় এসে জমা হয় রাজ্যের কালো মেঘ। কন্যা ইসলাম গ্রহণ করলেও এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সহধর্মিনী হলেও পিতা তখনও ইসলামের ঘোরতম শত্রু ছিল। শুধু শত্রই নয়; শত্রুপ্রধানও। তাই পিতার আগমনে কন্যার খুশি হওয়ার কথা থাকলেও শত্রুপ্রধান এবং অমুসলিম বিবেচনায় খুশির মুহূর্তেও কন্যার মুখে হাসি ফোটে না।
পিতা নিজ কন্যার ঘরে প্রবেশ করতে পারে না?” আবু সুফিয়ান কন্যার নির্লিপ্ততা দেখে জানতে চায়।
উম্মে হাবীবা রাযিয়াল্লাহু আনহা বলেন– “পিতা যদি ঐ সত্যধর্ম গ্রহণ করে, যা তার কন্যা গ্রহণ করেছে তাহলে কন্যা পিতার পদতলে নিজের আঁখিযুগল বিছিয়ে দিতে প্রস্তুত।”
আবু সুফিয়ান বলে– “বেটি। আমি খুব পেরেশান হয়ে এসেছি। আমি শান্তি ও বন্ধুত্বের বার্তা নিয়ে এসেছি।”
উম্মে হাবীবা রাযিয়াল্লাহু আনহা বলেন– “বেটি কি করতে পারে? আপনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে যান।”
মেয়ের এই অসহযোগিতায় আবু সুফিয়ান নিরাশ হয়ে সেখান থেকে চলে আসে। এখন সরাসরি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট যাবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়। রাস্তায় অনেক পরিচিত মুখ সে দেখতে পায়। যারা কুরাইশ গোত্রের ছিল এবং এর আগে তাকে নেতা মানত। এক সময়ের পরিচিত ব্যক্তিরা এখন তার দিকে অপরিচিতের মত তাকায়। সে তাদের দুশমন ছিল। তার বিরুদ্ধে অনেক যুদ্ধ করেছে। উহুদ যুদ্ধে এই আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দা মুসলিম শহীদের পেট ফেঁড়ে তাদের নাক-কান কেটে তা দিয়ে হার বানিয়ে গলায় পড়েছিল।
আবু সুফিয়ান মদীনাবাসীর উৎসুক জনতার মাঝ দিয়ে যেতে থাকে এবং এক সময় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে চলে যায়। সে হাত বাড়িয়ে দিলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম করমর্দন করেন। কিন্তু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অমনোযোগী ও উদাসীনতা দেখান। কেননা ইতোপূর্বেই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জেনে যান যে, বনু বকর কুরাইশদের ছত্রছায়ায় খোজাআ গোত্রের উপর আক্রমণ করেছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরাইশদেরকে এখন বিশ্বাসঘাতক হিসেবে দেখছেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মত হচ্ছে এমন শত্রুর একমাত্র জবাব হচ্ছে– সৈন্য পাঠাও, যাতে তারা এ কথা মনে করার সুযোগ না পায় যে, আমরা দুর্বল।
আবু সুফিয়ান বলে– মুহাম্মাদ! আমি এ ভুল ধারণা নিরসন করতে এসেছি যে, আমি হুদায়বিয়ার চুক্তি লঙ্গন করিছি। বনু বকরের সাহায্যে কতিপয় কুরাইশ আমার অনুমতি না নিয়ে গেলে সেটা আমার অপরাধ নয়। আমি চুক্তি ভঙ্গ করিনি। তুমি চাইলে চুক্তি নবায়ন করতে পার আমি প্রস্তুত।”
ঐতিহাসিক ইবনে হিশাম বর্ণনা করেন যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবু সুফিয়ানের দিকে ফিরেও তাকান না এবং তার সাথে কোন কথাও বলেন না।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এ নীরবতা আবু সুফিয়ানের মধ্যে খুব আতঙ্ক সৃষ্টি করে। সে ভয়ে সেখানে বেশিক্ষণ বসার সাহস পায় না। নীরবে উঠে এসে হযরত আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর সাথে দেখা করে।
“মুহাম্মাদ আমার কোন কথাই শুনতে আগ্রহী নয়।” আবু সুফিয়ান আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে গিয়ে বলে– “আবু বকর! তোমরা তো আমাদেরই গোত্রের লোক। খোদার কসম! আমরা বাড়ীতে আগত মেহমানের সাথে এমন আচরণ করি না যে, সে কি বলতে এসেছে তাও শুনি না। আমি বন্ধুত্বের প্রস্তাব নিয়ে এসেছি। আমি যুদ্ধ-বিগ্রহ বর্জনের চুক্তি করতে এসেছি।”
“আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তোমার কথার কোন জবাব না দিয়ে থাকলে আমিও তোমার কথার কোন জবাব দিতে পারি না।” হযরত আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন– আবু সুফিয়ান। তুমি শোননি যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-আল্লাহর প্রেরিত রাসূল! তুমি আল্লাহ্র রাসূলের এ আহবানও শোননি যে, আল্লাহ্ এক। তিনি ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই?… তুমি শুনে থাকলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দুশমন হলে কেন?”
“তুমি আমাকে কোন সাহায্য করবে না আবু বকর?” আবু সুফিয়ানের কণ্ঠে বিনয়ের সুর।
“না।” হযরত আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু এর দৃঢ় কণ্ঠ– “আমরা আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর হুকুমের তাবেদার।
আবু সুফিয়ান হতাশ হয়ে মাথা নিচু করে চলে যায়। এবং হযরত উমর রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর ঠিকানা সংগ্রহ করে তার সামনে গিয়ে বসে।
“ইসলামের শীর্ষ দুশমনকে মদীনায় দেখে আমি হতবাক।” হযরত উমর রাযিয়াল্লাহু আনহু আবু সুফিয়ানকে কোন কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই বলেন– “আল্লাহর কসম! তুমি ইসলাম গ্রহণ করে আসনি।”
আবু সুফিয়ান মদীনায় আগমনের উদ্দেশ্য হযরত উমর রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে খুলে বলে এবং তাকে এটাও জানায় যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার সাথে কথা পর্যন্ত বলেননি এবং হযরত আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহুও তাকে কোন প্রকার সহযোগিতা করেননি।
“আমার অধীনে পিপিলিকার ন্যায় দুর্বল সৈন্য থাকলেও তবুও আমি তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব।” হযরত উমর রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন– “তুমি আমার একার নও; আমার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং আমার ধর্মের শত্রু। আমার পদক্ষেপও তাই হবে যা আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নেন।”
আবু সুফিয়ান হযরত ফাতেমা রাযিয়াল্লাহু আনহা এবং হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর সাথে সাক্ষাৎ করেও কারো করুনা ভিক্ষা পায়না। সে ব্যর্থ-হতাশ হয়ে মদীনা ত্যাগ করে। তার ঘোড়ার গতি ছিল শ্লথ। ঘোড়ার মস্তকও ছিল অবনত।
আবু সুফিয়ান চলে গেলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অধিক হারে সৈন্য সমাবেশের নির্দেশ দেন। তিনি আরও বলেন, এত বিশাল পরিসরে যুদ্ধের প্রস্তুতি নাও, যেন কুরাইশরা চিরকাল আনুগত্য স্বীকার করতে বাধ্য হয়। তারা যেন মাথা তুলে দাড়াতে না পারে। তিনি আরো নির্দেশ দেন, সৈন্যরা অতি দ্রুত ক্ষিপ্রতার সাথে যাবে এবং সর্বোচ্চ গোপনীয়তা রক্ষা করা হবে যাতে তাদের অগোচরেই মক্কা ঘিরে ফেলা যায় অথবা মক্কার নিকটে এত দ্রুত পৌঁছে যেতে হবে, যাতে কুরাইশরা সাহায্যের জন্য তাদের মিত্রগোত্রকে আহবানের সুযোগ না পায়।
♣♣♣
মদীনাবাসীরা রাতের বিছানা ছেড়ে দেয়। তীর-বর্শা তৈরীতে সবাই ব্যস্ত। ঘোড়া, উটও প্রস্তুত করা হয়। পুরনো তলোয়ারে শান এবং নতুন তলোয়ার তৈরীর ধুম পড়ে যায়। নারী-শিশুও প্রস্তুত হয়। সার্বিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ এবং প্রস্তুতির চালচিত্র সরেজমিনে দেখার জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং শীর্ষস্থানীয় সাহাবাগণ ছুটোছুটি করতে থাকেন।
মদীনার ঘরে ঘরে যুদ্ধ প্রস্তুতি চললেও একটি মাত্র ঘরে ভিন্ন প্রকৃতির প্রস্তুতি চলছিল। এই ঘরটি অমুসলিমের। একজন মেহমান সেখানে এসেছিল। ঘরে লোকজন বলতে এক বৃদ্ধ, এবং আধা বয়সী এক পুরুষ, এক যুবতী, আধা বয়স্কা এক মহিলা এবং দু’তিনটি শিশু ছিল।
‘আমি মুসলমানদের মনোভাব বুঝে এসেছি।” আগন্তুক বলে– “তাদের অভিপ্রায় অগোচরে মক্কা ঘেরাও করা। নিঃসন্দেহে মুহাম্মাদ যুদ্ধ-বিদ্যায় পাকা। সে যা বলেছে তা বাস্তবে পরিণত করে দেখাবে।”
বৃদ্ধ চোখ কপালে তুলে জানতে চায় তা আমরা কি করতে পারি?”
আগন্তক বলে– “জনাব আমরা কিছু না পারলেও অন্তত মক্কাবাসীকে তো সাবধান করতে পারি। তাদেরকে এই পরামর্শ দিয়ে উপকার করতে পারি যে, প্রস্তুতি নাও। এতে মুসলিম বাহিনী মক্কায় পৌঁছলেও তাদের শক্তি কমে যাবে, ভাটা পড়বে আবেগে।
“আমার উপাস্যের কসম!” বৃদ্ধ আবেগময় কণ্ঠে বলে– বুদ্ধিমান। ইহুদীবাদের সত্য পূজারী। খোদা তোমাকে যথেষ্ট বিচক্ষণতা দান করেছেন। তুমি কি নিজে মক্কা যেতে পার না?”
আগন্তুক বলে– “না” মুসলমানরা এখন যে-কোন অমুসলিমকে সন্দেহ করছে। আমি ইহুদী এ কথা তারা জানে আমি গেলে তারা সন্দেহ করবে।… তখন আমার জীবন নিয়ে টানাটানি দেখা দেবে। অথচ আমার বেঁচে থাকার প্রয়োজন আছে। মুসলমানরা যাদের হত্যা করেছে আমাকে ঐ ইহুদীদের রক্তের প্রতিশোধ নিতে হবে। আমার শিরা-উপশিরায় বনু কুরাইযার রক্ত বহমান। মুসলমানদেরকে টার্গেট করা আমার ফরজ। এই ফরজ পালনে নাকাম হলে খোদা আমাকে ঐ কুকুরের ন্যায় মৃত্যু দিবেন যার সমস্ত শরীরে দগদগে ঘা এবং বিষাক্ত। প্রতিশোধ অত্যন্ত গোপনে নিতে চাই। ধরা পড়তে চাই না। মুসলমানদেরকে মরণ কামড় এবং বিষাক্ত দংশনের জন্য আমার বাঁচার প্রয়োজন আছে।”
বৃদ্ধ নিজের অপারগতা তুলে ধরে বলে– “মক্কা অনেক দূরের পথ। ঘোড়া বা উটে চড়ে এত দীর্ঘ সফর করা সম্ভব নয়। আর করলেও মুসলমানদের আগে মক্কায় পৌঁছতে পারব বলে মনে হয় না। গুরুত্বপূর্ণ এ কাজ কোন শিশু বা মহিলা দ্বারাও অসম্ভব। আমার পুত্র ছিল; কিন্তু সে অসুস্থ।”
“আমার দেয়া পুরস্কারের দিকে একবার তাকাও”-আগন্তুক বলে, “এ কাজটি করে দিতে পারলে পুরস্কার ছাড়াও আমরা তোমাকে আমাদের মাজহাবের অন্তর্গত করে আমাদের নিরাপত্তায় নিয়ে নিব।”
আধা বয়স্কা মহিলা বলে– “আমাকে এ কাজের ভার দেয়া যেতে পারে? তোমরা আমার উটনী দেখতে পাওনি? উটনীর পিঠে তোমরা কখনও আমাকে দেখনি? এত দ্রুতগামী উটনী মদীনায় কারো নেই।”
ইহুদী বলে– “তুমিই পার একাজটি করতে। উট এবং বকরীর পাল বাইরে নিয়ে যাবে। কেউ তোমাকে সন্দেহের চোখে দেখবে না। এমন ভাব দেখাবে যে, তুমি প্রতিদিন এ সমস্ত পশু চরাতে নিয়ে যাও। আজও সেই নিয়ম অনুযায়ী নিয়ে যাচ্ছ। পশু চরাতে চরাতে মদীনা থেকে কিছু দূর গিয়ে তোমার উটনীর উপর চেপে বসবে।
ইহুদী একটি চিরকুট মহিলার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে– “চিরকুটটি চুলের বেনীর ভিতর লুকিয়ে ফেল। উটনী দ্রুত হাঁকিয়ে আবু সুফিয়ানের কাছে গিয়ে এই চিরকুটটি তাকে হস্তান্তর করবে।
চিরকুটটি নিয়ে মহিলা বলে যাবতীয় পুরস্কার আমার অপর হাতে তুলে দাও এবং এই নিশ্চয়তায় আমার ঘর থেকে বের হও যে, মুসলমানরা যখন মক্কা থেকে ফিরবে তখন তাদের সংখ্যা অর্ধেকে নেমে আসবে। তাদের মস্তক থাকবে অবনত এবং সকলের কপালে থাকবে পরাজয়ের কলংক।
ইহুদী তিন টুকরা স্বর্ণ মহিলার হাতে তুলে দিয়ে বলে– “এটা ঐ পুরস্কারের অর্ধেক চিরকুটটি আবু সুফিয়ানকে দিয়ে ফিরে এলে যা আমি তোমাকে দিব।”
“আমি কাজ সম্পন্ন করে জীবন নিয়ে ফিরে আসতে না পারলে কি হবে?” মহিলা জিজ্ঞাসা করে।
“অবশিষ্ট পুরস্কার তোমার অসুস্থ স্বামী পাবে।”
পত্রবাহক মহিলা উট-বকরী চরাতে মাঠের দিকে যায়। সে পশুগুলো হাঁকাতে হাঁকাতে নিয়ে যাচ্ছিল। কেউ এদিকে খেয়াল করে না যে, অন্যান্য উটের পিঠ শূন্য থাকলেও একটি উটনীর পিঠ আরোহণের জন্য তৈরী ছিল। উটনীর পিঠে পানির মশক এবং খাদ্যভর্তি একটি থলেও ছিল। মহিলা পশুপাল শহর থেকে অনেক দূরে নিয়ে যায়।
দীর্ঘ সময়ের পর ইহুদী গৃহে অবস্থানরত অপর তরুণীকে বলে– “সে বোধহয় চলে গেছে। তুমি গিয়ে পশু গুলো গৃহে নিয়ে আস।”
তরুণী হাতে লাঠি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। কিন্তু সে শহরের বাইরে যাবার পরিবর্তে শহরের ভিতর যায়। কাউকে খোঁজ করার মত সে এদিক-সেদিক ঘুরতে ঘুরতে যাচ্ছিল। সে একটি গলি দিয়ে যেতে যেতে একটি খালি মাঠে এসে দাঁড়ায়। ময়দানে মুসলমানরা ঢাল-তলোয়ার নিয়ে অস্ত্রচালনার প্রশিক্ষণ দিচ্ছিল। ময়দানের অপর প্রান্তে উট দৌড়ের কসরত চলছিল। দর্শকদের প্রচণ্ড ভীর ছিল।
তরুণী দর্শকদের চারপাশে ঘোরাফেরা করতে থাকে। সে কাউকে খুঁজছিল। তরুণীর এই অস্বাভাবিক আচরণ অপর এক তরুণের নজরে পড়ে। সে দ্রুত পায়ে তার পিছু নেয় এবং নিকটে গিয়ে চাপা গলায় ডাক দেয়– “যারিয়া।” তরুণী চমকে উঠে তাকায় এবং তার চেহারা থেকে পেরেশানীর ছাপ মুহুর্তে চলে যায়।
“সেখানে যাও কথা আছে।” তরুণী ঝটপট বলে দ্রুত সামনের দিকে যেতে থাকে।
‘সেখানে’র দ্বারা চারণভূমির প্রতি ইঙ্গিত ছিল। তরুণ পূর্ব হতে এ ইঙ্গিত সম্পর্কে জানা থাকায় কথা না বাড়িয়ে পূর্বের জায়গায় ফিরে আসে এবং মোক্ষম সুযোগের অপেক্ষা করতে থাকে।
যারিয়ার ঐ ইঙ্গিতকৃত স্থানে যেতে অনেক সময় লেগে যায় যেখানে পত্রবাহক মহিলা পশু চরাতে নিয়ে যেত। যারিয়া উট-বকরী নির্দিষ্ট চারণভূমিতেই দেখতে পায়। তবে ছিল না সেখানে পত্রবাহক মহিলা আর তার উটনী। যারিয়া চারণভূমির পাশে গিয়ে এমন নাটকীয় ভঙ্গিতে বসে যে সে এখানে বকরী চরাতেই এসেছে। তরুণী স্থির হয়ে বসে না। বারবার দাঁড়িয়ে শহরের দিকে চায়। তাকে উদ্দেশ্য করে কেউ আসতে সে দেখতে পায় না। সে আবার উদ্বিগ্ন হয়। পশ্চিম দিগন্তে সূর্য অস্ত যেতে প্রস্তুতি নিচ্ছে তখন তাকে আসতে দেখা যায়। যারিয়া তাকে আসতে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে বসে যায়।
“উহ্ উবায়েদ।” যারিয়া তাকে কাছে টেনে বসাতে বসাতে বলে– “তুমি বেশ দেরী করে ফেলেছ আমি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ছিলাম।”
‘আমি তোমাকে উদ্বেগের দাওয়াই বলে দিইনি?” উবায়েদ বলে– “আমার ধর্ম গ্রহণ করলে তোমার যাবতীয় দুশ্চিন্তা দূর হয়ে যাবে। ইসলাম গ্রহণ না করা পর্যন্ত আমি তোমাকে স্ত্রী হিসেবে বরণ করতে পারি না। চিন্তা করে বলতো, এভাবে লুকিয়ে লুকিয়ে আর কতদিন আমাদের সাক্ষাৎ হতে পারে।”
যারিয়া বলে– “আমার ভালবাসা ধর্মের অধীন নয়। আমি তোমার সত্তার পূঁজা করি। স্বপ্নেও তোমার দেখা পাই। কিন্তু আজ আমার অন্তরে জগদ্দল পাথর এসে পড়েছে।”
উবায়েদ উৎসুক হয়ে জানতে চায়– “কেমন করে?”
মুসলমানরা মক্কা আক্রমণ করতে যাচ্ছে।” যারিয়া বলে– তুমি যেয়ো না উবায়েদ। তোমার ধর্মের দোহাই দিয়ে অনুরোধ করি তুমি যেয়ো না।… ঘটনাক্রমে এমন না হয়…।”
মক্কাবাসীদের দেহে এখন আর এমন শক্তি নেই যে, তারা আমাদেরকে মোকাবিলা করবে।” উবায়েদ বলে– কিন্তু যারিয়া। তাদের মধ্যে শক্তি থাক আর না থাক আমার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যদি আমাকে আগুনে ঝাঁপ দিতে বলেন তাহলে আমি সে নির্দেশও যথাযথ পালন করব।… অন্তরে ব্যথা নিওনা যারিয়া। আমাদের এই আক্রমণ এমন গোপনীয় হবে যে, মক্কাবাসী আক্রমণ সম্পর্কে তখন জানতে পারবে যখন আমাদের তরবারি তাদের মস্তকের উপর ঝিলিক দিয়ে উঠবে।
“এমনটি হবে না উবায়েদ।” যারিয়া আবেগের আতিশয্যে উবায়েদের মাথা নিজের বক্ষে টেনে নিয়ে বলে– “যা ভেবেছ তা কস্মিন কালেও হবে না। তারা ওঁৎ পেতে বসে থাকবে। আজ রাতের শেষ প্রহর কিংবা আগামী কাল প্রত্যুষে আবু সুফিয়ানের নিকট এ বার্তা পৌঁছে যাবে যে, তোমাদের অগোচরে মুসলমানরা তোমাদের ধ্বংস করতে আসছে।… তুমি যেয়ো না উবায়েদ। কুরাইশ এবং তাদের মিত্ররা সার্বিক প্রস্তুতি নিয়ে বসে থাকবে।”
‘একি বলছ যারিয়া!” উবায়েদ বিদ্যুতের শক খাওয়ার মত তার বক্ষ থেকে মাথা উঠিয়ে জিজ্ঞাসা করে– “আবু সুফিয়ানের নিকট কে বার্তা পাঠিয়েছে?”
“এক ইহুদী।” যারিয়া সব কিছু ফাঁস করে দেয়– “আর বার্তা বয়ে নিয়ে গেছে আমার বড় ভাইয়ের স্ত্রী।… এখন আমার ভালবাসার গভীরতা অনুমান কর উবায়েদ। যে তথ্য ফাঁস করার কথা ছিল না, তা আমি তোমাকে জানিয়ে দিলাম। এর একমাত্র উদ্দেশ্য, যেন কোন বাহানায় তুমি থেকে যাও। কুরাইশ ও অন্যান্য গোত্র মুসলমানদের এমন মার দিবে যে, একান্ত সৌভাগ্যবান ব্যক্তিই শুধু জীবন নিয়ে ফিরে আসতে পারবে।”
উবায়েদ যারিয়ার নিকট হতে জেনে নেয় যে, তার ভাবী কিভাবে এবং কখন রওনা হয়েছে। উবায়েদ লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ায় এবং যারিয়ার আন্তরিক ভালবাসা উপেক্ষা করে মদীনা পানে ছুটে চলে। পেছন দিক থেকে যারিয়ার এই আহবান তার কর্ণকুহরে বেজে উঠে বারবার “উবায়েদ।… দাঁড়াও উবায়েদ।” অতঃপর একসময় উবায়েদ যারিয়ার দৃষ্টির আড়ালে চলে যায়।
♣♣♣
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে সবিস্তারে জানানো হয় যে, এক মহিলা দ্রুতগামী উটনীতে চড়ে আবু সুফিয়ানের বরাবর একটি পত্র চুলের বেণীতে করে লুকিয়ে নিয়ে গেছে। মহিলাটি এখন সম্ভবত রাস্তাই আছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তৎক্ষণাৎ হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু এবং হযরত জুবাইর রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে ডেকে ঐ মহিলা এবং তার উটনীর নমুনা সম্পর্কে বলে দিয়ে ঐ মহিলাকে পথেই গ্রেপ্তার করতে প্রেরণ করেন।
হযরত আলী এবং হযরত জুবাইর রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর আরবের উন্নত জাতের তেজি ঘোড়া ছিল। তারা তখনই প্রস্তুত হয়ে মক্কা অভিমুখে উল্কা বেগে ঘোড়া ছুটিয়ে দেন। এ সময় সূর্য অস্ত যাচ্ছিল। মদীনা থেকে তারা অনেক দূরে চলে যাওয়ার পর সূর্য পুরোপুরি ডুবে যায়। আঁধারের পর্দা ভেদ করে তারা এগিয়ে চলে মহিলাকে গ্রেফতার এবং পত্র উদ্ধারের উদ্দেশে।
পরের দিন পূর্বাকাশে সূর্য উদয়ের সাথে সাথে তারাও মদীনায় এসে উপস্থিত হন। তাদের দু’অশ্বের সাথে একটি উটনী রয়েছে। উটনীর পিঠে বসা ছিল এক মহিলা। কয়েকজন লোক ঐ মহিলাকে দেখেই চিনতে পারে। মহিলাকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সম্মুখে হাজির করা হয়। তার চুলের বেণীতে লুক্কায়িত পত্রটিও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাতে হস্তান্তর করা হয়। পত্র পাঠ করে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর চেহারা রক্তিম হয়ে যায়। পত্রের বিবরণ ছিল অত্যন্ত ভয়ানক। মহিলা নিজের অপরাধ স্বীকার করে এবং এর মূল হোতা যে ইহুদী তার নামও বলে দেয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাষ্ট্রীয় গোপন তথ্য পাচারের অভিযোগে ঐ মহিলাকে হত্যার নির্দেশ দেন। কিন্তু ঐ ইহুদী বিপদের আভাস পেয়ে পূর্বেই সটকে পড়ে। কোথাও তাকে খুঁজে পাওয়া যায় না। এ পত্র মক্কায় পৌঁছলে মুসলমানদের পরিণাম হত অত্যন্ত ভয়াবহ। মক্কা অভিযানের নেতৃত্ব দেন স্বয়ং আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রস্তুতি পর্যবেক্ষণ এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে যাত্রার নির্দেশ দেন।
এ অভিযানে অংশগ্রহণ করে দশ হাজার পদাতিক ও অশ্বারোহী সৈন্য। এ বাহিনীতে মদীনার পার্শ্ববর্তী বসতির নও মুসলিমরাও ছিল। ঐতিহাসিকগণ লিখেন, মুসলিম বাহিনী পথ অতিক্রমকালে আরো দুতিন গোত্র তাদের সাথে যোগ দেয়। প্রায় সকল মুসলিম-অমুসলিম ঐতিহাসিকের মন্তব্য হলো, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নেতৃত্বে মুজাহিদ বাহিনীর চলার গতিতে ছিল অত্যন্ত ক্ষিপ্রতা এবং এ যুদ্ধাভিযানে সৈন্যসংখ্যা ছিল দশ হাজার।
মুসলিম বাহিনী মক্কার উত্তর-পশ্চিমে ‘মাররুজ্জাহরান’ নামক উপত্যকায় গিয়ে পৌঁছে। এটা ছিল মক্কা থেকে আনুমানিক দশ মাইল দূরে। এই উপত্যকার একাংশের নাম ফাতেমা উপত্যকা। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আন্তরিক ইচ্ছা অত্যন্ত সফলতার সাথে পূরণ হয়। তিনি চেয়েছিলেন, মক্কাবাসীদের ঘুমে রেখে তাদের ঘাড়ে চেপে বসবেন। মক্কার এত কাছে পৌঁছার পরও মক্কাবাসীদের কোন খবর ছিল না। এখন জানলেও কোন সমস্যা নেই। কারণ, কুরাইশদের পক্ষে এখন পার্শবর্তী গোত্রকে সাহায্যের আহ্বানের কোন সুযোগ ছিল না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কার অবস্থা এবং জনগণের গতিবিধি জানতে বিভিন্ন বেশে কয়েকজন লোক মক্কার আশেপাশে পাঠিয়ে দেন।
কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে মদীনাবাহিনী আবার চলতে থাকে। যু’ফা নামক স্থানে এসে মক্কার দিক হতে একটি কাফেলাকে ক্রমান্বয়ে এগিয়ে আসতে দেখা যায়। কাফেলাকে আরো নিকটে আসার সুযোগ দেয়া হয়। নিকটে এলে দেখা যায় তারা আর কেউ নয়; খোদ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর চাচা ও তার পরিবারের সদস্যবৃন্দ।
হযরত আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহু তার পরিজনদের নিয়ে মদীনা যাচ্ছিলেন। হযরত আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে নিয়ে যাওয়া হয়।
“কি আব্বাস!” রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন– “মক্কায় মহাপ্রলয় হতে যাচ্ছে বলেই কি তুমি মক্কা থেকে পালিয়ে যাচ্ছ?”
“খোদার কসম! এ ব্যাপারে মক্কাবাসীদের কোন খবরই নেই যে, মুহাম্মাদের বাহিনী তাদের মাথার উপর খাড়া।” হযরত আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন– “আমি তোমার আনুগত্য মেনে নেয়ার উদ্দেশ্যে মদীনায় যাচ্ছিলাম।”
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার ভুল ভেঙ্গে দিয়ে বলেন– “আমার না আব্বাস! আনুগত্য ঐ সত্তার কর, যিনি এক এবং যার কোন অংশীদার নেই। তিনিই একমাত্র ইবাদাতের উপযুক্ত। আমি তাঁর প্রেরিত নবী মাত্র।
হযরত আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহু ইসলাম গ্রহণ করেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বুকে টেনে নিয়ে আলিঙ্গন করেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ সংবাদে অত্যন্ত আনন্দিত হন যে, মক্কাবাসী নিশ্চিন্তে নাকে তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছে।
হযরত আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহু পরিস্থিতি ভয়াবহ দেখে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলেন, কুরাইশরা তো আমাদেরই রক্ত। দশ হাজার সৈন্যের বিশাল বাহিনীর পদতলে কুরাইশদের নারী এবং শিশুরাও পিষ্ট হয়ে যাবে। তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে আরো জানান যে, কুরাইশদের বর্তমান মানসিকতা পূর্বের মত নেই। তাদের মাঝে ইসলাম গ্রহণের এক ঢেউ জেগেছে। তাদেরকে ইসলাম কবুলের একটি শেষ সুযোগ দিলে হয় না?”
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে বলেন, তাহলে তুমি নিজেই মক্কা যাও এবং আবু সুফিয়ানকে গিয়ে জানাও যে, মুসলমানরা মক্কা দখল করতে আসছে। মক্কাবাসী বাধা দিলে একজনকেও জ্যান্ত ছাড়া হবে না। বিনা রক্তপাতেই সে যেন মক্কা নগরী মুসলমানদের হাতে দিয়ে দেয়।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে মক্কা যেতে কেবল অনুমতিই দেন না; তাকে নিজের খচ্চরটিও বাহন হিসেবে দিয়ে দেন।
আবু সুফিয়ান মদীনা থেকে বড় উদ্বেগজনক প্রতিক্রিয়া নিয়ে মক্কায় গিয়েছিল। সে ছিল যথেষ্ট অভিজ্ঞ। মুসলমানদের বীরত্ব এবং দৃঢ়তা সম্পর্কেও সে ভাল করে জানত। সে সর্বক্ষণ আশঙ্কা করত যে, এই বুঝি মুসলমানরা মক্কা আক্রমণ করল। স্ত্রী হিন্দা, সেনাপতি ইকরামা ও সফওয়ান তার সাহস বাড়াতে চেষ্টা করত কিন্তু এবং জাতির ধ্বংসই কেবল তার চোখে ভাসতে থাকে। তার দুশ্চিন্তার শেষ ছিল না।
একদিন সে এত বিচলিত হয়ে পড়ে যে, সহ্য করতে না পেরে ঘোড়ায় চড়ে মক্কার বাইরে চলে আসে। তার মন বারবার বলছিল যে, অচিরেই কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। এই চিন্তা তাকে আতঙ্কের আরো গভীরে নিক্ষেপ করে। সে মনকে এই বলে সান্ত্বনা দেবার ব্যর্থ চেষ্টা করে যে, এই মুহূর্তে একমাত্র ঘটার যা আছে তা হলো মুসলমানরা মক্কা দখল করতে আসবে। এই ধারণা তার মনে এমন ঝড় তোলে যে, সে মদীনার পথে একাকী এটা দেখতে বেরিয়ে পড়ে যে, মদীনা বাহিনী এসে তো পড়েনি? বাতাসেও এক ধরনের পরিবর্তনের পূর্বাভাস তার কাছে প্রকট হয়ে উঠতে থাকে। যতই সে এগিয়ে যায় এ বাতাস ততই ভারী মনে হতে থাকে।
এহেন গভীর এলোপাথাড়ি চিন্তার মধ্য দিয়ে তার ঘোড়া তাকে কয়েক মাইল দূরে নিয়ে আসে। বহু দূরের একটি দৃশ্য দেখে তার চিন্তায় ছেদ পড়ে। খচ্চরের পিঠে চেপে হযরত আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে আসতে দেখে সে। আবু সুফিয়ান বিস্মিত হয়ে অশ্ব থামায়। তার চোখে হাজার প্রশ্ন। চেহারায় উদ্বেগ উৎকণ্ঠা।
আবু সুফিয়ান দূর থেকেই প্রশ্ন করে– “আব্বাস! তুমি পুরো পরিবার নিয়ে গিয়েছিলে না? তাহলে আবার একা ফিরে এলে কেন?”
“আমার পরিবার নিয়ে তোমার ভাবতে হবে না।” হযরত আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, “পদাতিক, অশ্বারোহী এবং উষ্ট্রারোহী মিলে দশ হাজারের এক বিশাল বাহিনী মক্কার এত নিকটে এসে গেছে যে, তাদের নিক্ষিপ্ত তীর মক্কার যে কোন দরজা নিশানা করতে পারে। এ বিশাল বাহিনীর আক্রোশ থেকে মক্কা রক্ষা করা তোমার পক্ষে কি সম্ভব? সাহায্যের জন্য কাউকে ডাকার সুযোগ আছে? সন্ধিচুক্তি তোমার সেনাপতি ভঙ্গ করেছে। মুহাম্মাদকে আমি আল্লাহর রাসূল বলে স্বীকৃতি দিয়েছি। তারা সর্বপ্রথম তোমাকে হত্যা করবে। তুমি আমার সাথে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট গেলে একটা রক্ষা পেতে পার।”
“খোদার কসম! আমি জানতাম, এমন একটা মুহূর্ত অবশ্যই আসবে।” আবু সুফিয়ান বলে– “চল, আমি তোমার সাথে যাচ্ছি।”
সন্ধ্যার পর হযরত আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহু আবু সুফিয়ানকে নিয়ে মুসলিম সেনা ক্যাম্পে প্রবেশ করে। এ সময় হযরত ওমর রাযিয়াল্লাহু আনহু প্রহরীদের সাবধানতা সম্পর্কে খোঁজ নিচ্ছিলেন। তিনি আবু সুফিয়ানকে দেখে অগ্নিগোলা হয়ে উঠেন এবং বলেন, আল্লাহর দ্বীনের এই দুশমন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অনুমতি ব্যতীরেকে আমাদের ক্যাম্পে প্রবেশ করেছে। হযরত ওমর রাযিয়াল্লাহু আনহু আবু সুফিয়ানকে কতল করার অনুমতি চাইতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর তাঁবুর দিকে দ্রুত যান। হযরত আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহুও তখন সেখানে গিয়ে পৌঁছান। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হত্যার অনুমতি না দিয়ে আবু সুফিয়ানকে সকালে আসতে বলেন। হযরত আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহু আবু সুফিয়ানকে রাতে নিজের সাথে রাখেন।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সকালে আবু সুফিয়ানকে জিজ্ঞেস করেন– “আবু সুফিয়ান! তুমি জান আল্লাহ এক, তার কোন অংশীদার নেই; তিনিই একমাত্র মা’বুদ এবং তিনিই সকলের সাহায্যকারী?”
আমার বিশ্বাস হয়ে গেছে যে, এতদিন যে সমস্ত মূর্তির পূঁজা করতাম তারা প্রতিমা ছাড়া আর কিছুই নয়।” আবু সুফিয়ান বলে– “তারা আমাকে সাহায্য করার ক্ষমতা রাখে না।”
তাহলে কেন তুমি স্বীকৃতি দিচ্ছ না যে, আমি ঐ আল্লাহর রাসূল, যিনি একমাত্র মাবুদ?” রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞেস করেন।
“আমার দ্বারা হয়ত এটা স্বীকৃত দেয়া সম্ভব হবে না যে, তুমি আল্লাহর রাসূল।” আবু সুফিয়ান অপারগতার সুরে বলে।
হযরত আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহু ক্রোধকম্পিত কণ্ঠে বলেন– “আবু সুফিয়ান! তুমি আমার তরবারিতে তোমার মস্তক দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করতে চাও?” এরপর হযরত আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বলেন– “হে আল্লাহর রাসূল! আবু সুফিয়ান একটি জাতির সরদার সে প্রভাবশালী এবং সম্ভ্রান্তও বটে সে স্বেচ্ছায় এসেছে।”
হযরত আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর কথায় আবু সুফিয়ানের মধ্যে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন দেখা দেয়। তার জবান থেকে সহসা বেরিয়ে যায়– “মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল!… আমি স্বীকৃতি দিলাম আমি মেনে নিলাম।”
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আবু সুফিয়ান রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে বলেন– “যাও। মক্কায় গিয়ে ঘোষণা করে দাও যে, যারা আবু সুফিয়ানের গৃহে আশ্রয় নিবে তারা মুসলমানদের তরবারি থেকে নিরাপদ থাকবে। যারা বাইতুল্লায় প্রবেশ করবে তারাও নিরাপদ। এমনকি যারা নিজ নিজ ঘরে দরজা বন্ধ করে অবস্থান করবে তারাও নিরাপদ।”
“হযরত আবু সুফিয়ান রাযিয়াল্লাহু আনহু সঙ্গে সঙ্গে মক্কায় রওনা হয়ে যান। এদিকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কেরাম রাযিয়াল্লাহু আনহুমা-কে নিয়ে এক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে বসেন। আলোচনার মূল বিষয় ছিল, আবু সুফিয়ান ইসলাম কবুল করলেও ইকরামা এবং সফওয়ানের মত প্রখ্যাত সেনাপতি এখনও মক্কায় রয়েছে। তারা কি যুদ্ধ ছাড়া মক্কার পতন মেনে নিবে? সাহাবায়ে কেরাম নির্ধারিত এ বিষয়ে স্বাধীন মতামত ও বিজ্ঞ পরামর্শ পেশ করতে থাকেন।
উট বিদ্যুৎ গতিতে ছুটে আসছিল। মক্কার কাছাকাছি পৌঁছলে উষ্ট্রারোহী চিৎকার করে বলতে থাকে– “উযযা এবং হুবলের কসম! মদীনার বাহিনী ‘মাররুজ্জাহরায় ছাউনী ফেলেছে। আমাদের নেতাকে আমি সেখানে যেতে দেখেছি।… কুরাইশরা! সাবধান! মুহাম্মাদের সৈন্যরা আসছে।” সে উট বসিয়ে তার পিঠ থেকে নামার পরিবর্তে লাফ দিয়ে নিচে অবতরণ করে।
যেই এ আওয়াজ শুনে সেই দৌড়ে আসতে থাকে। সে কারো দিকে না তাকিয়ে ভয়ার্ত ভাবে বলে যাচ্ছিল, মদীনার সৈন্য মাররুজ্জাহরান পর্যন্ত চলে এসেছে। আবু সুফিয়ানকে সেদিকে যেতে দেখেছি। মক্কার জনগণ তার চারপাশে জড়ো হতে থাকে।
এক প্রবীণ লোক তাকে বলে– “আবু হাসান। হয়ত তোমার মাথা ঠিক নেই নতুবা তুমি মিথ্যা কথা বলছ।”
“আমার কথা মিথ্যা মনে করলে অচিরেই এর পরিণতি দেখতে পাবে।” উষ্ট্রারোহী আবু হাসান বলে– “কাউকে জিজ্ঞেস করে দেখ, আমাদের নেতা সেদিকে যাওয়ার কারণ কী? সে একথা বলে আবার জোরে জোরে বলতে থাকে, “কুরাইশরা। মুসলমানরা ভাল নিয়তে আসেনি।”
আবু হাসানের চিৎকার এ গলি-ও গলি অতিক্রম করে এক সময় আবু সুফিয়ান রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর স্ত্রী হিন্দার কানে গিয়ে পৌঁছে। সে জ্বলন্ত অঙ্গারের মত জ্বলে উঠে বাইরে বের হয়ে আসে। আবু হাসানকে ঘিরে রাখা জনতার সারি ভেদ করতে করতে সে আবু হাসানের কাছে আসে।
হিন্দা আবু হাসানের জামার কলার ধরে বলে– “আবু হাসান। আমার তরবারি মুহাম্মাদের রক্ত পান করতে উদগ্রীব। তুই কেন নিজের গর্দান আমার তরবারিতে কাটাতে এলি? তুই জানিস না যার উপর মিথ্যা অপবাদ দিচ্ছিস সে আমার স্বামী এবং কুরাইশ জাতির নেতা?”
আবু হাসান বলে– “আপনার তরবারি ঘর থেকে নিয়ে আসুন। কিন্তু আপনার স্বামী এলে তাকে জিজ্ঞেস করবেন, সে কোথা থেকে এসেছে।
হিন্দা জিজ্ঞাসা করে–“মুহাম্মাদ সৈন্য নিয়ে এসেছে, একথাই তুই বলছিস?”
আবু হাসান বলে– “খোদার কসম! আমি নিজ চোখে যা দেখেছি মুখে তা বলছি।”
হিন্দা বলে– “তোর কথা সত্য হলে মুসলমানরা মৃত্যু সাথে করেই এনেছে।”
এ সময় হযরত আবু সুফিয়ান রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে আসতে দেখা যায়।
♣♣♣
মক্কার জনগণ এখন এক ময়দানে দাঁড়ানো। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অভিযানের খবর আর গোপন থাকে না। কিন্তু এখন জানলেও কোন অসুবিধা নেই। বড় জোড় তারা নিজেরা প্রস্তুতি নিতে পারত। সাহায্যের জন্য কাউকে ডাকার পথ ছিল সম্পূর্ণ বন্ধ।
হযরত আবু সুফিয়ান রাযিয়াল্লাহু আনহু আসছিলেন। নেতার আগমনে জনতার আওয়াজ বন্ধ হয়ে যায়। হিন্দা জনতাকে ডানে-বামে ধাক্কা দিতে দিতে আগে চলে যায়। তার চেহারা ছিল বিস্ফোরণোন্মুখ। তার চোখ থেকে আগুন ঠিকরে পড়ছিল। হযরত আবু সুফিয়ান রাযিয়াল্লাহু আনহু জনতার মাঝে এসে ঘোড়া থামান। স্ত্রী হিন্দাকে অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মত ছুটে আসতে দেখেও তিনি সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করেন না।
হযরত আবু সুফিয়ান রাযিয়াল্লাহু আনহু উচ্চকণ্ঠে বলেন– “প্রিয় কুরাইশ জাতি। প্রথমে আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শোন এরপর কোন কথা থাকলে বলবে। আমি তোমাদের নেতা। তোমাদের মান-মর্যাদা রক্ষা করা আমার পবিত্র দায়িত্ব ও কর্তব্য।… মুহাম্মাদ এত বেশি সৈন্য নিয়ে এসেছে যে, তাদের মোকাবিলা করতে গেলে তোমরা নির্ঘাত ধ্বংস হয়ে যাবে। নারী ও দুর্বল শিশুদের রক্ষা কর। আসন্ন বাস্তবতা মেনে নাও। পালিয়ে যাবার পথও তোমাদের জন্য বন্ধ।”
‘সম্মানিত নেতা। আপনিই বলে দিন, এখন আমরা কি করব?” জনতার পক্ষ থেকে আওয়াজ আসে।
“মুহাম্মাদের আনুগত্য স্বীকার করা ছাড়া দ্বিতীয় কোন পথ নেই।” হযরত আবু সুফিয়ান রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন।
‘খোদার কসম! এরপরেও মুসলমানরা আমাদেরকে ক্ষমা করবে না।” জনগণের ভয়ার্ত আওয়াজ আবার শোনা যায়– “তারা নিহতদের প্রতিশোধ নিবে। তারা প্রথমেই আপনাকে হত্যা করবে। কারণ, উহুদে আপনার স্ত্রীই তাদের লাশের বিকৃতি ঘটিয়েছিল।
হিন্দা একাকী দাঁড়িয়ে কালনাগিনীর মত ফুঁসছিল।
“আমি তোমাদের সকলের জীবনের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে এসেছি।”
হযরত আবু সুফিয়ান রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন–“আমি মুহাম্মাদের সাথে সাক্ষাৎ করে এসেছি। তিনি বলেছেন, যারা আমার ঘরে আশ্রয় নিবে তারা মুসলমানদের তলোয়ার থেকে নিরাপদ থাকবে।”
“মক্কার সকল মানুষের ঠাঁই আপনার ঘরে হবে? একজন প্রশ্ন করে।
হযরত আবু সুফিয়ান রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন– “না। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেছেন যে, যারা নিজ নিজ ঘরের দরজা বন্ধ করে ভিতরে অবস্থান করবে তারাও নিরাপদ। যারা কাবা ঘরে গিয়ে আশ্রয় নিবে তাদেরকেও কিছু বলা হবে না। তারা শত্রু হিসেবে শুধু তাদেরকেই গণ্য করবে, যারা অস্ত্র নিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসবে।” এরপর তিনি ঘোড়া থেকে নেমে আসেন এবং বলেন, “তোমাদের নিরাপত্তা এবং সম্মান তাতেই নিহিত যে, তোমরা তাদেরকে প্রিয় বন্ধু এবং সহোদরের মত অভ্যর্থনা জানাবে।
কুরাইশদের জনৈক সেনাপতি গর্জে উঠে বলে– “আবু সুফিয়ান! আমাদের হত্যাকারীদের অভ্যর্থনা আমরা তরবারি এবং বর্শা দ্বারা জানাব।”
“আমাদের তীর মক্কার অদূরেই তাদেরকে অভ্যর্থনা জানাবে।” কুরাইশদের অপর অভিজ্ঞ সেনাপতি সফওয়ান বলে, “দেবতাদের কসম! দরজা বন্ধ করে আমরা ঘরে বসে বসে মাছি মারব না।”
হযরত আবু সুফিয়ান রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন– “পরিস্থিতি বিবেচনা কর ইকরামা। বিচক্ষণতার সাথে কথা বল সফওয়ান। তারা তো আমাদেরই লোক। খালিদ তাদের সাথে যোগ দিলেও এটা তো এড়াতে পারবে না যে, তার বোন ফাখিতা তোমার স্ত্রী। তোমার স্ত্রীর ভাইকে তুমি কতল করতে পারবে? … তোমার মনে নেই যে, আমার মেয়ে উম্মে হাবীবা মুহাম্মাদের স্ত্রী? তুমি বিশ্বাস করতে চাইবে না যে, কুরাইশ জাতির ইজ্জত ও সম্মানের খাতিরে আমি মদীনা গেলে আমার ঔরসজাত সন্তানই আমার কথা শুনতে অস্বীকার করেছিল। আমি মুহাম্মাদের ঘরের খাটে বসতে গেলে উম্মে হাবীবা বিছানার চাদর টেনে ফেলেছিল।… পিতা কখনো মেয়ের দুশমন হতে পারে না সফওয়ান।”
ইকরামা, সফওয়ান এবং আরো দুই-তিনজন লোক ছাড়া উপস্থিত সকলেই নীরব ছিল। ঐতিহাসিকগণ লিখেন, তাদের এই নীরবতাই বলে দিচ্ছিল যে, তারা হযরত আবু সুফিয়ান রাযিয়াল্লাহু আনহু এর পরামর্শ গ্রহণ করে। এতে হযরত আবু সুফিয়ান রাযিয়াল্লাহু আনহু এর চেহারাতে স্বস্তির চিহ্ন ফুটে ওঠে। কিন্তু তার স্ত্রী হিন্দা এতক্ষণ দূরে দাঁড়িয়ে ফুঁসতে ফুঁসতে এবার ছোঁ মারতে দ্রুতগতিতে হযরত আবু সুফিয়ান রাযিয়াল্লাহু আনহু এর দিকে এগিয়ে যায়। সবাইকে বিস্ময়ের ঘোরে ঠেলে দিয়ে সে সোজা গিয়ে হযরত আবু সুফিয়ান রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর কেশ জোরে মুষ্টিবদ্ধ করে ধরে।
“সকলের আগে তোকে হত্যা করব।” হিন্দা হযরত আবু সুফিয়ান রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর গোঁফ ধরে হেঁচকা টান দিয়ে বলে-কাপুরুষ বুড়ো কোথাকার! তুই আজ জাতির ইজ্জত মাটিতে মিশিয়ে দিলি?” এরপর সে আবু সুফিয়ান এর গোঁফ ছেড়ে দিয়ে তার মুখে জোরে থাপ্পড় কষে জনতাকে বলে– “তোমরা এই বুড়োকে হত্যা করছ না কেন, যে মুসলমানদের হাতে তোমাদের লাঞ্ছনা-অবমাননার কথা বলছে?”
ইবনে সা’দ লিখেন, হিন্দা তার স্বামীর সাথে এমন অপমানজনক আচরণ করায় জনতার মাঝে পিনপতন নীরবতা নেমে আসে। হযরত আবু সুফিয়ান রাযিয়াল্লাহু আনহু জ্যান্ত মূর্তি হয়ে যান। ইকরামা এবং সফওয়ান তাদের মাঝখানে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়।
“আমরা যুদ্ধ করব হিন্দা।” সফওয়ান বলে – তাকে ছেড়ে দাও। মুহাম্মাদের জাদুতে সে আক্রান্ত।”
দুপুরের আগে আগে কুরাইশ জাতি দু’শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়ে। অধিকাংশ ছিল লড়াই না করার পক্ষে। বাদ বাকীরা ইকরামা, সফওয়ান ও হিন্দার পক্ষ অবলম্বন করে।
সন্ধ্যার পর সফওয়ান ঘরে ফেরে। তার স্ত্রী ফাখিতা হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর বোন, সেও হযরত আবু সুফিয়ান রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর কথা শুনছিল।
“তুমি গোত্রপতির প্রধানের বিরুদ্ধাচরণ করেছ বলে যে খবর শুনছি তা কি সত্য?” ফাখিতা স্বামী সফওয়ানকে জিজ্ঞেস করে।
“তার আনুগত্য করলে পুরো জাতির ইজ্জত ভূলুণ্ঠিত হয়ে যায়।” সফওয়ান বলে, “গোত্রপতি কাপুরুষ হলেও গোত্রের কাপুরুষ হওয়া উচিত নয়। সে গোত্রের শত্রুকে বন্ধু হিসেবে মেনে নিলেও তারা কখনও গোত্রের বন্ধু হতে পারে না।”
তাহলে কি তুমি মুসলমানদের মোকাবিলা করতে চাও?” ফাখিতা স্বামীকে প্রশ্ন করে।
শত্রু দরজার সামনে দিয়ে বুক ফুলিয়ে ঘুরবে আর তোমার স্বামী ঘরের কোণে স্ত্রীর আঁচলের নিচে বসে থাকবে– এটা তুমি ভাবলে কি করে? আমার হাত কি ভেঙ্গে গেছে? আমার তরবারি কি দ্বিখণ্ডিত? ঐ লাশ দেখে তুমি গর্ব করবে না, যা তোমার ঘরের দরজায় জনগণ একথা বলে পৌঁছে দিয়ে যাবে যে, এই তোমার স্বামীর লাশ; দেশ ও জাতির জন্য বীরত্বের সাথে লড়াই করে প্রাণ দিয়েছে? না কি ঐ স্বামী তোমার অতি প্রিয়, যে তোমার আঁচলের নীচে লুকিয়ে থাকবে আর মানুষ তোমাকে ভর্ৎসনা করে বলবে, এ এক কাপুরুষ এবং আত্মমর্যাদাহীন ব্যক্তির স্ত্রী, যে স্বীয় বসতি এবং উপাসনালয় শত্রুর হাতে তুলে দিয়েছে।… তুমি আমাকে কোন্ অবস্থায় দেখতে চাও?”
“তোমাকে নিয়ে চিরকাল গৌরব করি সফওয়ান।” ফাখিতা বলে, “মহিলারা আমাকে বলে তোমার স্বামী জাতির নয়ন তারা। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি কিছুটা ভিন্ন। তোমার পাশে এসে দাঁড়াবার লোক নেই বললেই চলে। শুনেছি মদীনাবাসীদের সংখ্যা অনেক। আমার ভাই খালিদও এখন তাদের দলে। সে কেমন বাহাদুর তা তুমি ভাল করেই জান।”
সফওয়ান বলে– “তোমার ভাইয়ের ভয় আমাকে দেখাচ্ছ ফাখিতা?”
“না, প্রিয়। ফাখিতা বলে– “তার সাক্ষাৎ পেলে তাকেও আমি ঐ কথাই বলতাম যা তোমাকে বলছি।…সে আমার ভাই। তোমার হাতে নিহত হতে পারে। তার হাতে তুমিও নিহত হতে পার। আর যাই কর, তোমরা একে অপরের মোকাবিলা করো না। আমি তার বোন আর তোমার স্ত্রী। তোমার লাশ হোক কিংবা খালিদের আমার জন্য উভয় শোক সমান হবে।”
“এ কথার মধ্যে কোন নতুনত্ব নেই ফাখিতা!” সফওয়ান বলে– বিভেদের মাত্রা এত প্রকট যে, তা পিতা-পুত্র এবং ভাই-ভাইয়ের মাঝে শত্রুতা সৃষ্টি করে দিয়েছে। যদি আমি তোমার রক্তের সম্পর্কের প্রতি খেয়াল রাখি তাহলে…।”
“আমার রক্তের সম্পর্ক বিবেচনা করার প্রয়োজন নেই।” ফাখিতা তার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলে– “গোত্রের সর্দারের ইচ্ছা লড়াই না হোক। তিনি মুহাম্মাদের আনুগত্য স্বীকার করে নেয়ার পক্ষপাতী। তাহলে তুমি কেন লড়াইয়ের ইচ্ছা ত্যাগ করছ না? তোমার পাশে খুব কম লোকই পাবে।”
সফওয়ান সিদ্ধান্তের ভঙ্গিতে জানায় “আমি আনুগত্য স্বীকার করব না।”
“তাহলে আমার এই কথাটি অন্তত রাখ যে, তুমি খালিদের সামনা-সামনি হবে না। আমার মা তাকে প্রসব করেছে। আমরা উভয়ই একই মায়ের দুধ পান করেছি। সে যেখানেই থাক, বোন এটাই শুনতে চায় যে, তার ভাই বেঁচে আছে।… আমি বিধবা হতে চাই না সফওয়ান!”
সফওয়ান তিরস্কার করে বলে– ভাইয়ের প্রতি এত মায়া থাকলে তাকে গিয়ে বল, সে যেন মক্কার ধারে কাছেও না আসে। সে আমার সামনে এলে আত্মীয়তার বন্ধন চিরদিনের জন্য ছিন্ন হয়ে যাবে।”
ফাখিতার নয়ন-জল সফওয়ানের ইচ্ছায় বিন্দুমাত্র পরিবর্তন ঘটাতে পারে না।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরেকটি পদক্ষেপ হিসেবে কতক লোককে তিনি বিভিন্ন বেশে মক্কার চারদিকে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। তাদের কাজ ছিল, মক্কা থেকে কেউ বেরিয়ে কোথায় যেতে দেখলে তাকে তৎক্ষণাৎ বন্দি করা। এর উদ্দেশ্য ছিল এই যে, কুরাইশরা যেন তাদের মিত্রগোত্রকে সাহায্যের জন্য আহবান করতে না পারে।
দ্বিতীয় দিনই দুই উষ্ট্রারোহীকে বন্দি করে নিয়ে আসা হয়। বাহ্যিক দৃষ্টিতে তাদেরকে সাধারণ মুসাফির মনে হচ্ছিল। তাদেরকে মুসলিম সেনা ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। সামান্য হুমকিতেই তারা নিজেদের পরিচয় জানিয়ে দেয়। একজন ছিল ইহুদী আর অপরজন কুরাইশী। তারা মক্কা থেকে কয়েক মাইল দূরে বনূ বকরকে এটা জানাতে যাচ্ছিল যে, মুসলমানরা ‘মারকুজ্জাহরান’ নামক স্থানে এসে শিবিরে অবস্থান করেছে। গ্রেপ্তারকৃত দু’বন্দির মারফত বনু বকরের উদ্দেশে এ বার্তা পাঠানো হচ্ছিল যে, তারা যেন রাতের অন্ধকারে মুসলমানদের উপর গেরিলা আক্রমণ চালায় এবং এর জন্য আরো দু’এক গোত্রকে নিজেদের সাথে নিয়ে নেয়। বার্তায় একথা উল্লেখ ছিল যে, মুসলমানরা মক্কা ঘেরাও করলে তারা যেন অন্যান্য গোত্র সাথে নিয়ে পেছন দিক হতে মুসলমানদের উপর আক্রমণ করে।
ধৃত গোয়েন্দাদের নিকট জানতে চাওয়া হয়, মক্কায় যুদ্ধের প্রস্তুতি কেমন চলছে? জবাবে তারা বলে, আবু সুফিয়ান যুদ্ধের পক্ষে নয়। অধিকাংশ লোক তাকে সমর্থন করছে। ইকরামা এবং সফওয়ানই কেবল লড়তে চায়। তবে তাদের পক্ষে খুব কম লোক রয়েছে। তাদেরকে ইকরামা এবং সফওয়ান পাঠিয়েছে।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেনাপতিসহ অন্যান্য দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গকে জানিয়ে দেন যে, মক্কাবাসী তাদের শহর রক্ষায় অস্ত্রধারণ করবে-এমন মানসিকতা নিয়েই আমাদের মক্কায় প্রবেশ করতে হবে। তিনি মোট সৈন্যদেরকে চারটি গ্রুপে ঢেলে সাজান। কেননা, তৎকালে মক্কা প্রবেশের রাস্তা ছিল চারটি। প্রতিটি রাস্তা পাহাড় অধ্যুষিত। প্রতি গ্রুপের জন্য একটি রাস্তা নির্ধারণ করে দেয়া হয়। মক্কা যাওয়ার আদেশ হলে এ রাস্তা দিয়েই তাদের যেতে হবে।
সৈন্যদেরকে চারটি গ্রুপে বিভক্ত করলেও একটি গ্রুপে সৈন্যসংখ্যা কিছু বেশি রাখা হয়। এ গ্রুপের কমান্ডিং থাকে হযরত আবু উবায়দা রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর হাতে।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও এ গ্রুপের সাথে ছিলেন। এক গ্রুপের অধিনায়ক ছিলেন হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু একটি গ্রুপের হযরত যুবাইর রাযিয়াল্লাহু আনহু এবং চতুর্থ গ্রুপটির অধিনায়ক ছিলেন হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু।
ঐতিহাসিকগণ লিখেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এই পরিকল্পনায় অসাধারণ বিচক্ষণতার প্রমাণ ছিল। চারটি রাস্তা দিয়ে মক্কার দিকে এগিয়ে যাবার মূল লক্ষ্য ছিল, মক্কা প্রতিরক্ষা বাহিনীকে চার অংশে বিক্ষিপ্ত করে দেয়া। যদি তারা মুসলমানদের অগ্রযাত্রা কোন এক বা দু’রাস্তায় প্রতিরোধ করে তাহলে অন্য গ্রুপ এগিয়ে গিয়ে শহরে ঢুকে পড়বে। এ পরিকল্পনার আরেকটি লাভ হলো, মক্কাবাসী যুদ্ধ না করলেও কোন রাস্তা দিয়ে পালাবার উপায় ছিল না।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পরিকল্পনার সাথে সাথে এ নির্দেশও দেন যে, কুরাইশরা প্রতিরক্ষার জন্য অস্ত্র হাতে না নিলে তাদের উপর আক্রমণ করা যাবে না। নিরাপত্তার জবাব নিরাপত্তার মাধ্যমেই দিতে হবে। কোথাও সংঘর্ষ হলে আহতদের হত্যা করা যাবে না; বরং তাদের চিকিৎসা করতে হবে। যারা বন্দি হবে তাদের উপর কঠোর হওয়া যাবে না, তাদের হত্যা করা যাবে না, তাদেরকে যুদ্ধবন্দিও মনে করা যাবে না। এমন কি তাদের কেউ পলায়ন করতে চাইলে সে সুযোগ দিতে হবে।
সার্বিক নির্দেশনা দেয়ার পর চার গ্রুপকে নির্ধারিত নিজ নিজ পথে এগিয়ে যাবার নির্দেশ দেয়া হয়।
♣♣♣
৮ম হিজরীর রমযানের ২০ তারিখ, ১২ ই জানুয়ারী ৬৩০ খ্রিষ্টাব্দ। মুসলিম বাহিনীর তিনটি গ্রুপ নিজ নিজ রাস্তা দিয়ে মক্কায় প্রবেশ করে। এ তিন পথে চলতে গিয়ে মুজাহিদদের প্রতি একটি তীরও বর্ষিত হয় না। শহরের প্রতিরক্ষা বলতে কিছুই ছিল না। কুরাইশদের একটি তরবারিও খোলা ছিল না। জনগণ যার যার ঘরে অবস্থান করছিল। কোন ঘরের ছাদে নারী, শিশু দাড়িয়ে ছিল। মুসলিম বাহিনী ছিল সর্বোচ্চ সতর্ক। শহরের নীরবতা সন্দেহজনক ছিল। অবস্থা বলছিল, এ নীরবতা ঝড়ের পূর্বাভাস।
কিন্তু শহর থেকে কোন ঝড় ওঠে না। ঝড় তোলার মত লোক ছিল ইকরামা ও সফওয়ান। এ সময় তারা শহরে ছিল না। আরো কিছু লোক শহরের বাইরে ছিল। নিকটবর্তী কোথাও লুকিয়ে ছিল।
এ সমস্ত লোক রাতের অন্ধকারে শহরের বাইরে গিয়েছিল। তাদের সাথে তীরন্দাজও ছিল। তারা একটি ক্ষুদ্র বাহিনীতে পরিণত হয়। যে পথে খালিদ বাহিনীর মক্কা যাবার কথা ছিল এই ক্ষুদ্র দলটি সেই পথে এক পাহাড়ি স্থানে ওঁৎ পেতে বসে থাকে। ইকরামা এবং সফওয়ানের জানা ছিল না যে, এ পথে আসা মুসলিম দলটির কমান্ডার হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু। কুরাইশদের একজন পাহাড়ের উঁচুতে উঠে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছিল। সে হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে চিনে ফেলে। লোকটি হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে দেখেই দৌড়ে নিচে নেমে আসে।
লোকটি পেরেশান হয়ে ছুটে এসে বলে– “সফওয়ান! তুমি অনুমতি দিলে তোমার স্ত্রীর ভাইকে হত্যা করতে পারি।… আমার চোখ ধোঁকা দিতে পারে না। আমি খালিদকে স্বচক্ষে দেখেছি।”
সফওয়ান বলে– “জাতির মর্যাদা ও সম্মানের প্রশ্নে আর কোন কিছুই আমার নিকট প্রিয় নয়। খালিদ যদি আমার ভগ্নিপতিও হত তবুও আজ আমি আমার বোনকে বিধবা করে দিতাম।”
কে কার ভাই এটা আজ দেখার সময় নয়। কে কার স্বামী, কে কার পিতা এ প্রশ্নও আজ অর্থহীন।” ইকরামা বলে– খালিদ যদিও আমার ভাই কিন্তু সে আজ আমার দুশমন।”
হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর বাহিনী আরো সামনে অগ্রসর হলে তাদের লক্ষ্যে তীরের প্রথম ঝাঁকটি উড়ে আসে। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু সৈন্যদের থামতে নির্দেশ দেন।
হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু জোর কণ্ঠে বলেন–“কুরাইশ সম্প্রদায়। আমার পথ ছেড়ে দাও সম্পূর্ণ নিরাপদ থাকবে। আমাদের রাসূলের নির্দেশ আছে, কেউ হাতিয়ার না ধরলে তাকে কিছু না বলার।… নিজের জীবনটা তোমাদের নিকট প্রিয় না? আমি তোমাদের মাত্র একটি সুযোগ দিতে চাই।”
তীরের আরেকটি ঝাঁক উড়ে আসে।
“আমরা তোমার রাসূলের নির্দেশ মানতে বাধ্য নই খালিদ।” ইকরামা গর্ব করে বলে– “সাহস থাকলে আরো একটু এগিয়ে এস। আমরা তোমারই পুরাতন সাথি যোদ্ধা… সফওয়ান এবং ইকরামা…। তুমি জীবিত অবস্থায় মক্কায় প্রবেশ করতে পারবে না।”
হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু তীরের দ্বিতীয় ঝাঁক থেকে শত্রুর অবস্থান শনাক্ত করে ফেলেন। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু তার অধীনস্থ বাহিনীকে কিছুটা পেছনে সরিয়ে আনেন এবং কিছু সৈন্যকে পাহাড়ের উপর দিয়ে সামনে এগিয়ে শত্রুর উপর হামলা করতে প্রেরণ করেন। ইকরামা এবং সফওয়ান হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু কর্তৃক পাহাড়ের উপর দিয়ে প্রেরীত দলটি দেখতে পায় না।
শত্রুর অজান্তে এই দলটি তাদের ঘাড়ের উপর লাফিয়ে পড়ে। নিচ থেকেও হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু দুর্বার হামলা চালান। এ হামলা এত তীব্র গতির ছিল যে, কুরাইশরা বেশিক্ষণ টিকে থাকতে পারে না। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু উপর দিক থেকে আক্রমণ করান এবং নিচের দিক থেকেও। ফলে অতি সহজে এবং অতি দ্রুত কুরাইশরা পালাতে বাধ্য হয়।