২.২ সকালে প্রথম ফোনটা

২.২

সকালে প্রথম ফোনটা এল বর্ধনের কাছ থেকে।

কবির তখন প্রথমবার চা পান করে দাড়ি কামাচ্ছে। এই সময় টিভি খোলা থাকে, সকালবেলা বেশ কয়েকটা চ্যানেলেই গানবাজনা হয়। তাঁর ছেলে মিঠুন তাকে কর্ডলেস ফোনটা এনে দিল।

বর্ধন খানিকটা হাসি মিশিয়ে জিগ্যেস করলেন, কী হে কবির সাহেব, ঘুম ভাঙালাম নাকি? কটার সময় বিছানা ছেড়ে ওঠো?

কবির বললেন, স্যার, আমি তো অনেকক্ষণ উঠেছি. রোজই এই সময় উঠি।

উহুঃ, তা ঠিক নয়। খুব দরকার পড়লে তুমি ভোর পাঁচটাতেও জেগে উঠে রেডি হতে পারো, তা জানি। আবার এক একদিন নাকি সকাল দশটা পর্যন্ত ঘুমোও? রোদ্দুর উঠে গেলে, পাখি-টাখি ডাকে, গাড়ি-ঘোড়ার পা-পোঁ শুরু হয়ে যায়, তার পরেও মানুষ কী করে ঘুমোতে পারে, তা আমি কিছুতেই বুঝি না!

স্যার, আমি বেলা দশটা পর্যন্ত কোনওদিনই ঘুমোই না। অফিস যেতে হয়।

গত মাসের সাত তারিখে তুমি সাড়ে দশটা পর্যন্ত ঘুমোওনি?

ও, সেদিন, মানে, আগের রাত্তিরে আমি হোল নাইট জেগে গান শুনেছিলাম, আপনি সেই সকালটার কথা মনে করে রেখেছেন?

শুধু গান শোনা, নাকি এক বোতল স্কচও শেষ করেছিল, অ্যাঁ? আমি সব খবর রাখি। কাল বউমার কাছে বকুনি খেয়েছ?

খুব বেশি নয়। আমায় তো প্রায়ই বলেন, পুলিশের চাকরি ছেড়ে দিতে!

চাকরি থেকে বরখাস্ত না হলে কোনও পুলিশই নিজে থেকে চাকরি ছাড়ে না। যাই হোক, তুমি আজ সকালে দুর্লভ সিং-কে তোমার বাড়িতে আসতে বলেছ?

জি, স্যার।

আমাকে কিছু বলেনি। আমি নিজেই নিজেকে ইনভাইট করছি। সেলফ ইনভাইটেড, আমিও একটু পরে আসছি তোমার বাড়িতে।

ইউ আর মোস্ট ওয়েলকাম, স্যার।

ব্রেকফাস্ট করিনি এখনও। খাওয়াবে নিশ্চয়ই। নীলোফার খুব চমৎকার চিজ-ওমলেট বানায়। একবার খেয়েছিলাম, মুখে এখনও স্বাদ লেগে আছে। বাড়িতে আমাকে ডিম খেতে দেয় না, বলে কিনা কোলেস্টেরল হাই। তাই অন্যের বাড়িতে গিয়ে খাই। আজও খাব, ডাবল ডিমের ওমলেট।

সাড়ে নটার একটু আগে, দুর্লভ সিং এখনও পৌঁছোয়নি, এসে গেলেন বর্ধন। ছেলেমেয়েদের জন্য একগাদা চকলেট এনেছেন, নীলোফারের জন্য এনেছেন একটা শান্তিনিকেতনী চামড়ার ব্যাগ। তিনি এদের পরিবারিক বন্ধু, কখনও খালি হাতে আসেন না।

পুলিশের নিয়ম অনুযায়ী কবির এঁকে কোনওরকম ব্যক্তিগত সম্বোধন করতে পারেন না, কিন্তু নীলোফার মানে না সেসব। বর্ধন সাহেব তার কাছে অতুলদা।

দরজা খুলেই নীলোফার বলল, এ কী, অতুলদা, আপনি এই একমাসেই অনেক রোগা হয়ে গেছেন?

বর্ধন করুণ মুখ করে বললেন, বাড়িতে যে কিছু খেতে দেয় না! বউটা আমাকে কেন যে রেখে কেটে পড়ল, ছেলেমেয়েরা কাছে থাকে না, বাড়িতে আছে এক হাউজ কিপার, অতি জাঁদরেল, সব সময় বলে, মিষ্টি খাবে না, পাঁঠার মাংস খাবে না। সম্পর্কে সে আবার আমার দুরসম্পর্কের দিদি হয়, একটু ইংরিজি ফিংরিজিও জানে, তাই আমাকে বকুনি দেওয়ার তার অধিকার আছে। না খাইয়ে খাইয়েই আমাকে মেরে ফেলবে।

এ পি বর্ধন এমনিতেই বেশ লম্বা, এখন কিছুটা রোগা হয়ে আরও লম্বা দেখায়, অনেকটা ল্যাকপেকে ধরনের। তাকে দেখলে পুলিশ বলে মনেই হয় না।

নীলোফারের দিকে তাকিয়ে চক্ষে ঝিলিক দিয়ে তিনি বললেন, আজ সিরিয়াস আলোচনা হবে। তোমার স্বামীর চাকরি থাকে কিনা ঠিক নেই।

বলেই হাসতে লাগলেন। তাঁর কোন কথা সিরিয়াস আর কোনটা রসিকতা, তা বোঝা দায়।

নীলোফার বলল, চাকরি গেলেই বাঁচি। তাহলে আমরা বহরমপুরে গিয়ে থাকব।

কবিরের চেহারা সুগঠিত, সুন্দর। বয়েস সাতচল্লিশ। পুরো ধরাচুড়ো পরলে তাকে পুলিশের বড় অফিসার হিসেবে বেশ মানায়। বাড়িতে তিনি পাজামা ও সাদা পাঞ্জাবি পরতে ভালোবাসেন।

বসবার ঘরে এসে একটা সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে বর্ধন বললেন, দুর্লভ এখনও আসেনি, তার আগে সরিফন বিবির কেসটা কী শুনি?

কবির বললেন, দিল্লির পুলিশ মেয়ে-পাচারকারিদের হাত থেকে উদ্ধার করে কয়েকটি মেয়েকে আমার কাছে পাঠিয়েছিল। ছ-সাত মাস আগে। মেয়েগুলির নামের যে লিস্ট ছিল, তার মধ্যে একটি নাম নিয়ে প্রথম থেকেই গোলমাল হয়। একটি নাম ছিল সরিফন বিবি। অথচ মেয়েগুলির কারুরই ওই নাম নয়। অন্তত কেউ স্বীকার করেনি। দু-তিনজন বলেছিল, সরিফন বিবি আগেই মারা গেছে। সরিফন বিবির যা ডেসক্রিপশন ছিল, তার সঙ্গে আবার লক্ষ্মীমণি নামের একটি মেয়ের সঙ্গে অনেকটা মিলে যায়। কিন্তু সে প্রবল ভাবে অস্বীকার করে।

বর্ধন জিগ্যেস করলেন, সে যে মিথ্যে কথা বলছে না, তা তুমি ঠিক বুঝেছিলে?

ইয়েস স্যার। তাকে আমি অনেক ভাবে গ্রিল করেছি। এটা শিওর, সে মুসলমান নয়, হিন্দু।

কী করে বুঝলে?

যে গ্রামে তার বাড়ি, তার স্বামীর নাম, দুটি ছেলেমেয়ে আছে, এসব ট্রেস করা গেছে, সব মিলেছে। লক্ষ্মীমণি ডেফিনিটলি এক গরিব হিন্দু বাড়ির বউ ছিল। অন্য একটা গ্রামে সরিফন বিবি নামেও একজন হাউজ ওয়াইফের কথা জেনেছি, অনেকদিন তার কোনও খোঁজখবর নেই, সে গ্রামের লোকেরও ধারণা, সরিফন আর বেঁচে নেই। সে মেয়েটিও পাচার হয়ে গিয়েছিল। এদের কেউ কেউ মারাও যায়। লক্ষ্মীমণিও বার দু-এক মরতে-মরতে বেঁচে গেছে।

এই লক্ষ্মীমণি দিল্লির রাজেন্দ্রনগরের বাড়িতে ছিল, তা স্বীকার করেছে। তবু তুমি তাকে বেকসুর ছেড়ে দিলে।

তার কাহিনি শুনলে আপনিও ছেড়ে দিতেন স্যার।

আহা-হা, কবিরসাহেব, আমি তোমার মতন অত দয়ার অবতার নই। শোনো, এই লক্ষ্মীমণি। আর সরিফন এক হোক বা না হোক, একটা বীভৎস মার্ডারের সঙ্গে জড়িত। যে ছোকরাটি খুন হয়েছে, সে একটা বড় ব্যবসায়ীর বাড়ির ছেলে, দু-একজন মন্ত্রী-টন্ত্রীর সঙ্গেও যোগাযোগ আছে। ছেলেটা বড়লোকের বখাটে সন্তান, মদ-মেয়েমানুষ নিয়ে ফুর্তি করে টাকা ওড়াত, সে মরেছে, আপদ গেছে। কিন্তু খুনিকে তো শাস্তি দিতেই হবে। সেটা পুলিশের ডিউটি। এবার বলো, লক্ষ্মীমণির কাহিনিটা কী? এ-সব গল্পই তো একইরকম হয়। গরিবের সংসার, আড়কাঠিরা তক্কেতক্কে থাকে, কোনও মেয়ের একটু স্বাস্থ্য ভালো দেখলে তাকে ভাগিয়ে নিয়ে বিক্রি করে দেয়। কিছু চালান হয়ে যায় অন্য দেশে।

না স্যার, এর কাহিনিটা অন্যরকম।

এই সময় দুর্লভ সিং এসে পড়ল, হাতজোড় করে নমস্কার করে বলল, সরি, সরি, আমার একটু লেট হয়ে গেল, ট্রাফিক জ্যাম ছিল।

বর্ধন বললেন, ঠিক আছে, বসো। চা-টা আসছে। তার আগে আমরা ওই লক্ষ্মীমণি নামের মেয়েটির ব্যাকগ্রাউন্ড শুনে নিই। কবির, তুমি হিন্দিতে বা ইংরিজিতে বলল, না হলে ও বুঝবে না।

দুর্লভ বলল, আমি কুছু কুছু বাংগালা বুঝি।

বর্ধন বললেন, কুছু কুছু বুঝলে তো হবে না। পুলিশের কাজে পুরোপুরি বুঝতে হবে। নাও, কবির, শুরু করো। সংক্ষেপে বলবে। লক্ষ্মীমণির স্বামী ছিল, ছেলেমেয়ে ছিল, কিন্তু প্রচণ্ড অভাব, ছেলেমেয়েদের খেতে দিতে পারে না, তাই আড়কাঠিদের প্রলোভনের ফাঁদে পা দিয়েছিল, তাই তো? তারপর?

কবির বললেন, না স্যার, ঠিক তা নয়। ওদের সংসারে অত অভাব ছিল না। সারা বছর মোটামুটি খাওয়া-পরা জুটে যেত। একটা ছেলে স্কুলেও পড়ত। লক্ষ্মীমণি রথের মেলা দেখতে যাওয়ার পথে পাচারকারিরা তাকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে ধরে নিয়ে যায় ঠিকই, কিন্তু আসলে তার স্বামী ও শাশুড়ি বউটিকে আগেই বিক্রি করে দিয়েছিল ওদের কাছে।

গা ঝাড়া দিয়ে উঠে বসে বর্ধন বললেন, অ্যাঁ? বিক্রি করে দিয়েছিল? মেয়ে পাচার করার মতো মেয়ে বিক্রি করাও তো ক্রিমিনাল অফেনস! এটা জানার পরেও তুমি ওই শাশুড়ি আর স্বামীটিকে অ্যারেস্ট করোনি? হোয়াই? এ জন্যও তোমার নামে চার্জশিট দেওয়া যেতে পারে।

তা দিন। আসল ব্যাপার হচ্ছে, ওই শাশুড়ি আর স্বামী টাকার লোভে বউটাকে বিক্রি করেনি।

তবে কি বউটাকে পছন্দ হয়নি? সেও তো একই কথা।

না, স্যার, তাও নয়। শাশুড়ি আর স্বামী দুজনেই পরে কেঁদেছিল। স্বামীর একটা ছোট ভাই ছিল, তাকে সবাই ভালোবাসত। ছেলেটির নাম বিরাজ, সে লেখাপড়া শিখে চাকরিও করত। বিয়ে করেনি, সংসারটা প্রায় সে-ই চালাত। এই বিরাজের ক্যানসার ধরা পড়ল। ক্যানসারের চিকিৎসায় কত খরচ, তা আমরা সবাই জানি। আমাদের দেশে এই ধরনের পরিবারের কি ক্যানসারের চিকিৎসা করার সামর্থ্য থাকে? অথচ সবাই বাঁচতে চায়। ওরা কিছু-কিছু জমিজমা বিক্রি করে চিকিৎসা চালাল। তাতেও সুরাহা হল না। ছেলেটি দু-দিন ভালো থাকে, আবার শয্যাশায়ী হয়। কষ্টও পেয়েছে খুব। তখন ওদের হাতে বিক্রি করার মতন আর কিছু নেই, শুধু লক্ষ্মীমণির শরীর ছাড়া। মরিয়া হয়ে সেই পথই নিয়েছিল ওরা।

ছেলেটি শেষ পর্যন্ত বেঁচেছে?

সেটাই বড় ট্র্যাজেডি। বাঁচেনি। ততদিনে লক্ষ্মীমণি অনেক দূরে। তার জীবনও নষ্ট হয়ে গেছে। এটাই আমাদের দেশের একটা বাস্তব ছবি। এ জন্য আপনি কজনকে অ্যারেস্ট করবেন?

হুঃ!

তারপর লক্ষ্মীমণি বেশ কয়েকবার হাত বদল হয়ে, কয়েকবার মারা পড়তে-পড়তেও শেষ পর্যন্ত দিল্লির রাজেন্দ্রনগরের ওই বাড়ি থেকে পালিয়ে নিজেই পুলিশের হাতে আশ্রয় চায়। পুলিশই তাকে উদ্ধার করে আমাদের কাছে পাঠিয়ে দেয়। দিল্লির পুলিশ এ ক্ষেত্রে খুব ভালো কাজ করেছে।

দুর্লভ এবার বলল, স্যার, আই বেগ টু ডিফার। গল্পটা এখানে মিলছে না। আমাদের কাছে স্পষ্ট রিপোর্ট আছে, সে মোটেই স্বেচ্ছায় ধরা দেয়নি। মার্ডার হওয়ার পরেও সে কয়েকদিন ওই বাড়িতে ছিল। তারও একমাস পরে করোলবাগের একটা ব্রথেলে পুলিশ রেইড করে। কয়েকজনকে উদ্ধার করে। তাদের মতে এই সরিফন বিবি কিংবা লক্ষ্মীমণি যাই-ই হোক, সেও একজন।

কবির বললেন, এই অংশটা সে আমার কাছে মিথ্যে বলেছে। এর আগের ঘটনাতেও সে কিছু কিছু মিথ্যে বলার চেষ্টা করেছিল।

বর্ধন বললেন, মিথ্যে তো বলবেই। একটা মেয়ে খেতে পাবে না, বিক্রি হবে, বারবার রেল্ড হবে, মার খাবে, অপমানের চূড়ান্ত হবে, তবু সে সবসময় সত্যকে আঁকড়ে ধরে রাখবে? মিথ্যে কিংবা ফ্যানটাসি তৈরি করবেই। সত্যি নামটা শুধু ভদ্রসমাজের একচেটিয়া সম্পত্তি, গরিবদের জন্য নয়।

দুর্লভ আর কবির দুজনেই হেসে ফেললেন।

কবির বললেন, আপনার এ কথাটা মানতে পারলাম না স্যার। সত্যি কথাটা মোটেই ভদ্রসমাজের একচেটিয়া সম্পত্তি নয়। বরং তারাই মিথ্যে কথা বেশি বলে। পলিটিশিয়ানদের দেখুন না। এমনকি আমরাও আমাদের বউয়ের কাছে…

বর্ধন বললেন, আই সাপোস, ইউ অল আর রাইট। যাক গে, মরুক গে, এবার বলো, লক্ষ্মীমণি সম্পর্কে তদন্ত কমপ্লিট না করে, এমনকি আমাকেও কোনও রিপোর্ট না দিয়ে তুমি তাকে ছেড়ে দিলে কেন?

স্যার, পুলিশের কাজ কি মানুষকে শাস্তি দেওয়া? মানুষকে বাঁচানোও নয়? যদি তাকে ঠিক পথে ফেরানো যায়, বেঁচে থাকার নতুন করে সুযোগ দেওয়া যায়?

কাম অন, ওসব বড়-বড় কথা আমাকে শোনাবার দরকার নেই। আমরা বিচারক নই, শুধু আইনের রক্ষক। আইন হচ্ছে অন্ধ। সাহেবদের দেশে দেখেছোই তো, জাস্টিস নামে একটা মেয়ের মূর্তি আছে, তার চোখ বাঁধা। কাজেই আমাদের কাছে বিচারের কথা বলো না, শুধু পদ্ধতির কথা বলল। কেন তাকে ছেড়ে দিলে?

এর মধ্যে ওমলেট, টোস্ট, চা ইত্যাদি এসে গেছে। খাওয়াও চলেছে।

বর্ধনের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে কবির কাতর চক্ষে তার দিকে তাকিয়ে বললেন, স্যার, চা পানের পর আর নিজেকে সামলাতে পারি না। আপনি পারমিশান দিলে একটা সিগারেট কি খেতে পারি?

বর্ধন বললেন, কী সিগারেট খাবে, প্যাকেটটা দেখি।

সেটা হাতে নিয়ে তিনি অনেকখানি ভুরু তুলে বললেন, তুমি একটা ডি আই জি র‍্যাঙ্কের পুলিশ অফিসার, তুমি এত বিশ্রী, সস্তা সিগারেট খাও? লোকে দেখলে কী বলবে বলো তো? বলবে, তুমি নিশ্চয়ই একটা ঘুষখোর, তাই এত গরিব সেজে থাকো। মাই ডিয়ার কবির সাহেব, পুলিশকে যে কতদিন থেকে কতরকম সমালোচনা সহ্য করতে হয়, তা তুমি জানো না? কিছু পুলিশ তো আছেই, যারা ডিজঅনেস্ট টু দা পাওয়ার অফ এক্সট্রিম, তাদের জন্য আমাদেরও অনেক বদনাম মাথা পেতে নিতে হয়। কাল থেকে ভালো সিগারেট খাবে। দাও, আমাকেও একটা দাও।

দুর্লভ বলল, শ্যাল উই কাম টু দা পয়েন্ট স্যার?

বর্ধন বললেন, ব্যস্ততার কিছু নেই। ধরে নাও, এখানেই আজ আমাদের অফিস হচ্ছে।

কবির বললেন, পুলিশ মাঝে-মাঝেই কিছু পাচার হওয়া মেয়েদের উদ্ধার করে। আমরা জেরা করি, খোঁজখবর নিই, তারপর তাদের ভাগ্যে কী হয়, সে সম্পর্ক কি আপনাদের কোনও অভিজ্ঞতা আছে? খুব সম্ভবত নেই, কিন্তু আমি জানি। নাইনটি নাইন পারসেন্ট মেয়েদেরই আর তাদের বাড়িতে ফেরত নেওয়া হয় না। এ ব্যাপারে হিন্দু কিংবা মুসলমান সব সমান। যদি কোনও উদার পরিবার ফেরত নিতেও চায়, তা হলেও গ্রামের লোকেরা আপত্তি করে। সেইসব মেয়েদের তাড়িয়ে দেবেই। তারপর? আজকাল দু-একটি এন জি ও হয়েছে, তারা এইসব মেয়েদের নিয়ে কাজ করে। পুলিশ তাদের কাছেও সাহায্য চায়। কিন্তু সেই সব স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাই বা কী করবে, এত মেয়েদের আশ্রয় দেওয়ার মতন সংস্থান তাদের নেই। সরকারি কয়েকটা মহিলা আশ্রমেও সব মেয়ের জায়গা হয় না। আর প্রায় অধিকাংশ মহিলা আশ্রমেরই এতই অব্যবস্থা যে অনেক মেয়ে মনে করে, এর চেয়ে মরে যাওয়াও ভালো। অনেক মেয়েই পালায়। কোথায় পালাবে? বাঁচতে হবে তো। এবার তারা নিজেরাই আবার গিয়ে কোনও বেশ্যাপল্লীতে আশ্রয় নেয়। তারা পাকাপাকি যৌনকর্মী হয়ে যায়। আমি এর স্ট্যাটিসটি আপনাদের দেখাতে পারি।

বর্ধন বললেন, আঃ, বড় বেশি লেকচার হয়ে যাচ্ছে। জেনারেল ছেড়ে পার্টিকুলারে এসো। এই মেয়েটির কী হল?

লক্ষ্মীমণি সম্পর্কে তার শাশুড়ি আর স্বামীর খানিকটা সহানুভূতি থাকলেও তারা আর ওকে ফেরত নিতে পারবে না। গ্রামের লোকের বাধা তো আছেই। তা ছাড়া পাচারকারিরাও এসে টাকা ফেরত চাইবে। একমাত্র উপায়, যদি এই মেয়েদের কোনও চাকরি জুটিয়ে দেওয়া যায়।

দুর্লভ বলল, এদের কে চাকরি দেবে? এরা লেখাপড়া জানে না, হাউজ ওয়াইফ হিসেবে অন্য কোনও কাজও শেখেনি। তা ছাড়া যদি একবার জানাজানি হয়ে যায় সে যে একসময় প্রস্টিটিউট ছিল, তাহলে তাকে কেউ বাড়ির ঝিয়ের কাজও দেবে না। দিল্লিতে এরকমই হয়।

কবির বললেন, ইউ আর রাইট। বাংলাতেও একই রকম। সেইজন্যই আমি লক্ষ্মীমণির কেসটা কোর্টে তুলতে চাইনি, যাতে বেশি জানাজানি হয়। আমার এক লেখক বন্ধু আছেন, মিস্টার বিনায়ক ঘোষাল, তিনি ওর জন্যে একটা চাকরি ঠিক করে দিয়েছিলেন।

বর্ধন সাহেব আবার সোজা হয়ে বসে বললেন, বিনায়ক ঘোষাল? যে এমন সব কঠিন কঠিন কবিতা লেখে যার মাথামুণ্ডু কোনও মানেই বোঝা যায় না!

কবির বললেন, স্যার, বিনায়ক গল্প-উপন্যাসও লেখে, সেগুলো কিন্তু বুঝতে কোনও অসুবিধে হয় না।

বর্ধন বললেন, গল্প-উপন্যাস আমি পড়ি না। কবিতাগুলো পড়ে–

কবির বললেন, সে কি স্যার, আপনি গল্প-উপন্যাস পড়েন না, অথচ কবিতা পড়েন? সাধারণত এর উলটোটাই তো হয়।

বর্ধন বললেন, লম্বা-লম্বা গল্প-উপন্যাস পড়ার আমার সময় নেই। ছোটবেলা থেকেই কবিতা পড়ি, রবীন্দ্রনাথের অন্তত সাতশো কবিতা আমার মুখস্থ।

স্যার, আপনাদের ওই যে কী যেন বলে, দৈত্যকুলে প্রহ্লাদ, আপনি দেখছি তাই। পুলিশ সার্ভিসে কেউ এত কবিতা পড়ে না। ইটস আ রেকর্ড!

চোপ! কাজের কথা বলো। তা সেই লেখক একটা এক্স-প্রস্টিটিউটকে কী কাজ দেবে? আমি তো ভেবেই পাচ্ছি না।

আমার বন্ধু বিনায়ক লক্ষ্মীমণির পুরো কেসটা জানে। তাকে আমি জিগ্যেস করেছিলাম, তুমি যদি এই মেয়েটিকে নিয়ে একটা গল্প লিখতে, তা হলে তার শেষ পরিণতি কী হবে? মেয়েটাকে কী ভাবে বাঁচাবে? বিনায়ক বলল, আমি ওকে নিয়ে গল্প লিখবই না। কারণ, ওকে বাঁচাবার কোনও রাস্তা আমি দেখতে পাচ্ছি না। যদি জোর করে বাঁচিয়ে দিই, ও একটা স্বাভাবিক জীবন ফিরে পায়, তা হলে সেটা হবে বাজে গল্প। পাঠকরা বলবে, ওটা উইশ ফুলফিলমেন্ট। ইচ্ছাপূরণ। অবাস্তব। ওরকম গল্প আমি লিখি না।

লেখকরা তো সব অবাস্তব গল্পই লেখে। কলমের খোঁচায় যাকে তাকে মেরে দেয়, আবার যাকে তাকে বাঁচায়। কনান ডয়েল যেমন শার্লক হোমসকে একবার মেরে দিয়েও আবার বাঁচিয়ে তুলেছিলেন। ওসব লেখক-টেখকের কথা ছাড়। কাজের কথা বলো। সে এখন কোথায়?

না, স্যার, এই লেখকের একটা ভূমিকা আছে। বিনায়ক আমাকে বলেছিল, আমি লক্ষ্মীমণিকে নিয়ে গল্প লিখতে পারব না। কিন্তু বাস্তব জীবনে হয়তো কিছু সাহায্য করতে পারি। আমাকে দু-দিন সময় দাও। দু-দিন পরে সে সত্যিই একটা ব্যবস্থা করে দিল।

ব্যবস্থা মানে?

লক্ষ্মীমণির জন্য একটা কাজ জুটিয়ে দিল। সে এখন চাকরি করছে।

বর্ধন জুতো খুলে রেখেছিলেন, এবার জুতোয় পা গলাতে-গলাতে বললেন, চলো, চলো, তা হলে আর দেরি করা কেন? সে কোথায় চাকরি করছে? চলো, গিয়ে মেয়েটাকে ধরি।

কবির বললেন, দাঁড়ান, দাঁড়ান, স্যার। আর একটু কথা আছে।

আবার কী কথা? আমরা কি সারা সকাল বসে-বসে তোমার গল্প শুনব?

দুর্লভ বলল, আমাকে আজ সন্ধের ফ্লাইটেই দিল্লি ফিরে যেতে হবে। মেয়েটিকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়া বিশেষ জরুরি।

কবির বর্ধনের দিকে তাকিয়ে বললেন, স্যার, মেয়েটিকে দিল্লি পাঠানো কি ঠিক হবে? এই স্টেজে?

বর্ধন রেগে উঠে বললেন, তার মানে? সে যদি দিল্লিতে একটা ক্রাইম করে থাকে, তা হলে ইনভেস্টিগেশানের জন্য তাকে তো পাঠাতেই হবে দিল্লিতে।

কবির বললেন, আমি তার সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ কথা বলে যা বুঝেছি, তার পক্ষে মানুষ খুন টুন করা একেবারেই সম্ভব নয়। সে একটা সাধারণ বাঙালি ঘরের সরল স্বভাবের মেয়ে।

বর্ধন বললেন, কবির, তোমার কি মনে হয়েছে না হয়েছে, সেটা এক্ষেত্রে খুব জরুরি নয়। দিল্লি পুলিশ যখন তাকে চাইছে, তুমি নিজের দায়িত্বে তাকে আটকে রাখতে পারো না।

দুর্লভ বলল, সে হয়তো নিজে খুন করেনি। কিন্তু সে একজন অ্যাকসেসরি, সে খুনের চিহ্ন লোপাট করতে সাহায্য করেছে। সেটাও একটা ক্রাইম। আসল দোষীকে খুঁজে বার করার জন্য তাকে জেরা করা খুব দরকার।

বর্ধন জিগ্যেস করলেন, সে মেয়েটি কী কাজ করছে এখন?

আমার বন্ধু এই লেখকের বউ একটা বাচ্চাদের স্কুলের হেডমিসট্রেস। সেই স্কুলে একজন আয়া কাম হেল্পিং হ্যাঁন্ডের পোস্ট আছে। লক্ষ্মীমণিকে সেই কাজ দেওয়া হয়েছে। সে মোটামুটি ভালোই মাইনে পায়, থাকার জায়গাও আছে ওখানেই, একমাত্র শর্ত, তার পূর্ব পরিচয় যাতে কেউ জানতে না পারে। বাচ্চাদের স্কুল তো! গার্জেনরা যদি শোনে, অমনি প্রথমে ফিসফাস, তারপর জোরাল আপত্তি…সেইজন্যই আমি চেয়েছিলাম, যাতে কোনও পাবলিসিটি না হয়…। স্যার, এ কাজটা আমি নিজের দায়িত্বে করেছি, এ জন্য যদি আমাকে কোনও শাস্তি দিতে হয় তো দিন। আমি আজই রেজিগনেশান সাবমিট করতে রাজি আছি।

বেশ কিছু মুহূর্ত তিনজনই নীরব।

একটা দীর্ঘশ্বাস টেনে বর্ধন বললেন, যাক গে, তোমার সম্পর্কে কী অ্যাকশান নেওয়া হবে, সেটা পরের ব্যাপার। আপাতত ওই লক্ষ্মীমণি না কী যেন, সেই মেয়েটিকে আমাদের চাই। এই খুনের কেসটার ব্যাপারে আমাদের জানতে হবে। সে কোথায়? তুমি জানো নিশ্চয়ই।

কবির বললেন, জানি, অবশ্যই। কিন্তু সে কথা আপনাদের বলব কিনা, তা ভেবে উঠতে পারছি না।

বর্ধন বললেন, হুমায়ুন, ইটস টু মাচ। তুমি একটা মেয়েকে আইন-টাইন না মেনেই ছেড়ে দিয়েছ। এখন, তুমি তার হোয়ার অ্যাবাউটস্ জেনেও আমাদের বলতে চাইছ না। এটা কি মামাবাড়ির আবদার নাকি? পুলিশ হয়ে এ কীরকম তোমার ব্যবহার?

কবির বললেন, স্যার, আমি পুলিশ ঠিকই। কিন্তু আমি একজন মানুষও তো বটে। আপনারা তো শুনেছেন যে সে একটা বাচ্চাদের স্কুলে আয়ার কাজ করে। তার কাজের বেশ সুনামও হয়েছে। তার ছেলেমেয়েরাও আসে তার কাছে। এখন একগাদা পুলিশ গিয়ে যদি তাকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে, তা হলেই তার পূর্ব পরিচয় জানাজানি হয়ে যাবে। তখন তার চাকরি রাখা মুশকিল হবে। সে একটা স্বাভাবিক জীবনযাপন করছে, আপনারা তাকে পাঠাবেন জেলে? মানুষকে সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে দেওয়াই কি আমাদের কাজ নয়? বর্ধন বললেন, তা বলে আইনের বাইরে তো আমরা যেতে পারি না। আইন অনুযায়ী সে যদি কোনও অপরাধ করে থাকে, তা হলে তাকে তো শাস্তি পেতেই হবে। মানবিক কারণে যদি তাকে ছেড়ে দিতে হয়, তবে পারেন শুধু বিচারক। পুলিশের সে অধিকার নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *