২.২ শীতের বেলা

শীতের বেলা ফুরাতে সময় লাগে না। দুপুর শেষ হওয়ার আগেই বিকাল হয়ে যায়। আজ যেন আরও তাড়াতাড়ি হল।

রান্না শেষ করে চুলার আগুন নিভিয়ে দিয়েছে মরনি কিন্তু বউয়ার হাঁড়ি নামায়নি। আগুন নিভে যাওয়ার পরও তাপ থেকে যায় চুলায়। সেই তাপে হাঁড়ি রেখে ঘাটপারে গেছে গোসল করতে। ঝপাঝপ কয়েক বদনা পানি ঢেলেছে মাথায়। কাপড় ছায়া বদলে, ব্লাউজ বদলে গামছা ভিজা চুলে জড়িয়ে একহাতে এক বদনা পানি, অন্যহাতে চিপড়ানো কাপড়চোপড় নিয়ে উঠোনে এসেছে। ভিজা কাপড় উঠানের তারে মেলে দিয়ে, পানির বদনা দরজার সামনে রেখে ঘরের তালা খুলেছে তারপর বউয়ার হাঁড়ি নিয়ে ঘরে এসেছে। ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করে দুইজন মানুষের জন্য বউয়া বেড়েছে টিনের থালায়।

চৌকির উপর কাঁথা মুড়া দিয়ে একই ভঙ্গিতে শুয়ে আছে নূরজাহান। একটুও শব্দ করছে না। এমনকী তার শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ পর্যন্ত পাওয়া যায় না।

এমন নিঃসাড়ে কেমন করে ঘুমায় মানুষ!

নাকি ভয়ে আতঙ্কে নড়তে ভুলে গেছে নূরজাহান! শব্দ করা তো দূরের কথা শ্বাসপ্রশ্বাস ফেলতেও ভয় পাচ্ছে!

প্রথমে যে থালায় বউয়া বেড়েছে মরনি থালাটা মজনুর। মজনু ছাড়া আর কাউকে কখনও এই থালায় খেতে দেয়নি সে। আজ ঘোরের মধ্যে আছে বলে কি নূরজাহানের জন্য মজনুর থালায় বউয়া বাড়ল! নাকি মজনুর মতো নূরজাহানের জন্যও আছে তার গভীর মমতা! অপত্যস্নেহ! নাকি সেই যে বোনের মৃত্যুর পর অসহায় শিশু মজনুকে যেমন করে বুকে আশ্রয় দিয়েছিল, বুকের তাপে যেমন করে বাঁচিয়ে রেখেছিল তাকে, আজ বহুকাল পর ঠিক সেই সময়ের মতো আরেকটি সময় এসেছে। মজনুর মতো আরেকটি অসহায় শিশু এসে আশ্রয় নিয়েছে তার বুকে। তাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যই কি মজনুকে আর নূরজাহানকে নিজের অজান্তেই একাকার করে ফেলেছে মরনি! এজন্যই কি মজনুর থালায় নূরজাহানের জন্য বউয়া বাড়ল!

একবার মজনুর কথা মরনির মনেও হল। সেই যে বাড়ি থেকে গেল ছেলেটি তারপর আর কোনও খোঁজখবর নাই। একটা পত্র তো লেকতে পারে, একটা সমবাত তো দিতে পারে কেঐর কাছে! মা’র মন যে পোলার লেইগা কান্দে পোলায় সেইটা বোঝে না। পোলা কাছে নাই, মা’র যে খাইতে পরতে মন চলে না, সংসার কর্মে উদাসীনতা, বিছানায় শুয়ে ঘনঘন দীর্ঘশ্বাস পড়ে, ঘুম আসে না, ছেলে এসব বোঝে না কেন! বুকের ধন চোখের আড়াল হলে তাকে নিয়ে কত কুডাক ডাকে মায়ের মন! ছেলের কোনও বিপদ আপদ হল কি না, জ্বরজ্বারি অসুখবিসুখ হল কি না, এসব ভেবে গভীর রাতে ঘুম ভেঙে মায়ের যে চোখ ভেসে যায়, ছেলে কেন এসব বোঝে না! কেন পত্র লেখে না মা’কে! কেন কোনও খবর দেয় না!

বউয়া বেড়ে নূরজাহানকে ডাকতে যাওয়ার আগে মনে মনে একবার মজনুকে ডাকে মরনি। বাজান রে, ও বাজান, আমার কথা তর মনে অয় না? আমি তর আপনা মা না দেইখা আমার কথা তুই ভুইলা থাকস? আমি তো তর কথা ভুলি না বাজান। আমি তো হারাদিন হারারাইত খালি তর কথা মনে করি। মনে মনে খালি তর নাম লই। আমি তর আপনা মা না অইতে পারি, তুই আমার আপনা পোলা। তর লাহান আপনা আমার আর কেঐ নাই।

চৌকির সামনে দাঁড়িয়ে মরনি তারপর নূরজাহানকে ডাকে। নূরজাহান, ও নূরজাহান।

দুইবার ডাকার পরই চমকায় সে। হায় হায় এতো জোরে ডাক পাড়ন তো ঠিক অয় নাই! কে কোনহানদা (কোনখান দিয়ে) হুইন্না হালাইবো! তাইলে আর এতকষ্ট করলাম ক্যা? ঘরের ভিতরে কাতাকাপড়ের নীচে হামলাইয়া (সামলিয়ে) থুইলাম, দুয়ারে তালা দিয়া থুইলাম, মাইনষে যুদি হুইন্নাই হালায়, বুইজ্জাই যায় তাইলে আর লাব অইলো কী?

মরনি গলা নামায়, সাবধানি স্বরে ডাকে, নূরজাহান, নূরজাহান। ও নূরজাহান, ওঠ মা। ওঠ। বউয়া রানছি। দুগগা (দুটো) মোকে দে।

নূরজাহান সাড়া দেয় না, নড়ে না।

মরনি আবার ডাকে। নূরজাহান, ও নূরজাহান।

নূরজাহান তবু সাড়া দেয় না।

কাঁথার উপর দিয়ে আস্তে করে নূরজাহানকে ধাক্কা দেয় মরনি। কী রে হোনচ না? কত ঘুমাচ? ও নূরজাহান।

তবু সাড়া নেই নূরজাহানের। তবু সে নড়ে না।

এবার একটু চিন্তিত হল মরনি। কী অইলো? মাইয়াডা লড়েচড়ে না ক্যা? ডরে ভয়ে বেউস অইয়া গেলনি? দাঁত লাইগ্না (দাঁত কপটি) গেলনি?

নূরজাহানের মাথার দিক থেকে কাঁথা সরায় মরনি। মুখটা বের করে নূরজাহানের। চোখ বুজে পড়ে আছে নূরজাহান। মুখ শুকনা, ফ্যাকাশে। ভয়ানক এক ভয় এবং আতঙ্ক ঘুমঘোরেও যেন মুখ ছেড়ে যায়নি নূরজাহানের। বটের ছায়ার মতো ছায়া ফেলে রেখেছে মুখে। এই মুখের দিকে তাকিয়ে বুক তোলপাড় করে উঠল মরনির। মনে মনে নূরজাহানকে সে বলল, ক্যান এমুন কাম করলি তুই! ক্যান নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারলি! ক্যান এমুন বিপদ ডাইক্কা আনলি! অহন যে ডরে ভয়ে মরতাছস অহন তরে কে বাঁচাইবো!

আবার আল্লাহকে ডাকে মরনি। ইয়া হে আল্লাহ, তোমার রহমতের দুয়ার এই মাইয়াডার লেইগা খুইল্লা দেও। মাইয়াডারে তুমি বাঁচাও।

আল্লাহকে ডাকতে ডাকতে কোন ফাঁকে নূরজাহানের কপালে হাত রেখেছে মরনি। রেখেই চমকে উঠেছে। যেন নিজের অজান্তে চিতইপিঠা ভাজার তপ্ত খোলা ছুঁয়ে দিয়েছে। হায় হায় এমুন গরম ক্যা শইল? এমুন জ্বর আইলো কুনসুম? জ্বরে বেউস হইয়া গেছেনি মাইয়াডা? এর লেইগাই আমার ডাক হোনে নাই! আমি যে ডাক পারতাছি এর লেইগাই উদিস পায় নাই!

বউয়া বেড়ে রাখার কথা ভুলে গেল মরনি। ক্ষুধার কথা ভুলে গেল। দিশাহারা ভঙ্গিতে গালে কপালে হাত বুলাতে লাগল নূরজাহানের। চাপা উদ্বিগ্ন গলায় ডাকতে লাগল, নুরজাহান ও নূরজাহান। হোন না? ও নূরজাহান!

নূরজাহান নড়ে না, সাড়া দেয় না।

নিজেকে নিজে মরনি বলল, মনে হয় দাঁত লাইগ্‌গা গেছে।

নূরজাহানের মুখের উপর ঝুঁকে দুইহাতে নূরজাহানের মুখটা ফাঁক করল মরনি। দাঁতে দাঁত লেগে আছে কি না দেখল। দেখে আশ্বস্ত হল। না দাঁত লাগেনি। শুধু বেহুঁশই হয়েছে। হয়তো আচমকা কাঁপিয়ে এসেছে জ্বর। জ্বরের ধাক্কা সামলাতে না পেরে বেহুশ হয়ে গেছে। প্রচণ্ড ভয় পেলে কোনও কোনও মানুষের এমন জ্বর আসে। জ্বরটা বেশি আসে অল্প বয়সি পোলাপানের।

নূরজাহানকে নিয়ে এখন কী করবে মরনি! কেমন করে সামলাবে মেয়েটিকে! কেমন করে তার জ্বর কমাবে, হুশ ফেরাবে! এই অবস্থায় মাথায় পানি ঢালা ছাড়া কোনও উপায় নাই। কিন্তু পানিটা মরনি দিবে কী করে! বালতি ভরা পানি দরকার, বদনা দরকার। সব ব্যবস্থা করে পানি না হয় দিল, ভিতর থেকে দরজাও বন্ধ করে রাখল ঘরের কিন্তু পানি দেওয়ার শব্দটা! বদনার নল দিয়ে বেহুঁশ মেয়েটির মাথায় যখন পানি ঢালতে থাকবে সেই পানি এসে পড়বে বালতির পানিতে, ছরছর একটা শব্দ হবে, সেই শব্দে যে কেউ অবাক হবে। ঘরের ভিতর শব্দ কীসের?

যদিও তেমন কেউ এই বাড়িতে আসে না, বাড়িটা নির্জন পড়ে থাকে। তবু সাবধান থাকতে হবে মরনির। লোকে যদি জেনেই যায় নূরজাহানকে নিজের ঘরে লুকিয়ে রেখেছে। মরনি তা হলে আর লাভ হল কী! সব চেষ্টাই তা হলে বিফলে গেল! এদিকে মাথায় পানি না দিয়েও উপায় নাই। যেরকম জ্বর, মাথায় পানি দিয়ে এই জ্বর না কমালে হুঁশ ফিরবে না নূরজাহানের। জ্বরের চোটে মাথার রগ ছিঁড়ে যাবে। মাথার রগ ছিড়লে নূরজাহানকে আর বাঁচাতে পারবে না কেউ।

যদি বাঁচানোই না গেল তা হলে আর লুকিয়ে রেখে লাভ কী! এক মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাতে গিয়ে আরেক মৃত্যুর হাতেই যদি সঁপে দেওয়া হয় মেয়েটিকে, তা হলে আর লাভ কী!

তবু সবদিক সামলে নূরজাহানকে বাঁচিয়ে রাখতে চাইল মরনি। বালতি ভরে পানি আনতে পুকুরঘাটে গেল না। ঘরের কোণ থেকে পুরানা বালতিটা নিয়ে, নাড়া দিয়ে তৈরি। বিড়ার ওপর রাখা খাওয়ার পানির ঠিলা থেকে আধা ঠিলা পানি বালতিতে ঢেলে চৌকির কাছে এনে রাখল। নিঃশব্দে দরজা খুলে যতদূর চোখ যায় একবার দেখে চট করে পানি ভরতি বদনাটা ঘরে এনে আবার দরজা লাগিয়ে দিল। তারপর অচেতন নূরজাহানকে হাছড় পাছড় করে টেনে তার মাথাটা চৌকির বাইরের দিকে এনে, মাথার তলায় পানির বালতি রেখে শব্দ যতটা বাঁচিয়ে পারা যায় বাঁচিয়ে বদনার নল দিয়ে পানি ঢালতে লাগল। একহাতে পানি ঢালে আরেক হাতে নূরজাহানের মাথার ঘন চুলে বিলি কেটে পানিটা যেন মাথার তালুতে গিয়ে লাগে সেই ব্যবস্থা করে। চুলের জটে আটকে পানি যদি তালুতে না লাগে তা হলে লাভ কী! তালু ঠান্ডা না হলে জ্বর কমবে না। রগ ছিড়া ঠেকানো যাবে না।

ছরছর শব্দে বদনার পানি নূরজাহানের তালু ভিজিয়ে মাথার তলায় রাখা বালতিতে গিয়ে পড়ে। স্বচ্ছ পানি অস্বচ্ছ হয়। জ্বরের তাপ ধুয়ে দেওয়ার ফলে শীতলতা কমে আসে পানির। তবু সেই পানি আবার বদনা ভরে তোলে মরনি, আবার ঢালে নূরজাহানের মাথায়। পানি ঢালে আর বিড়বিড় করে সুরা ইয়াসিন পড়ে। ইয়া-সীন। ওয়াল কুরআনিল হাকীম। ইন্নাকা লামিনাল মুরসালীন। আ’লা সিরাত্বিম মুসতাক্বীম। তানযীলাল আযীযির রাহীম।

অদূরের মেঝেতে টিনের থালায় পড়ে থাকে বউয়া, বাইরে গম্ভীর হয়ে ওঠে শীতের বিকাল, পেটের ক্ষুধা পেটেই মরে যায়, কোনও কিছুই যেন খেয়াল থাকে না মরনির।

দশ-বারো বদনা পানি মাথায় ঢালার পর হঠাৎ করেই যেন নূরজাহানের চোখের দিকে তাকায় মরনি। তাকিয়ে চমকে ওঠে। কোন ফাঁকে চোখ মেলে তাকিয়েছে নূরজাহান। এমন অসহায় কাতর চোখে তাকিয়ে আছে মরনির মুখের দিকে, একবারও যেন পলক পড়ে না। সেই চোখে।

নূরজাহানের জ্ঞান ফিরেছে দেখে বুকে চেপে থাকা ভয় কেটে গেল মরনির। মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বদনা বালতির পাশে নামিয়ে রেখে যেন নিজের কাছে নিজে বলছে এমন স্বরে বলল, আল্লায় রহম করছে। উস অইছে।

নূরজাহানের চোখে তবু পলক পড়ে না। আগের মতোই মরনির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। সেই চোখের দিকে তাকিয়ে গভীর মমতায় বুক ভরে যায় মরনির। নূরজাহানের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলে, কী গো মা, এমুন কইরা চাইয়া রইছ ক্যা?

নূরজাহান কথা বলবার আগেই দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে কে ডাকল, পিসি ও পিসি।

মরনি নূরজাহান দু’জনেই চমকে উঠল। এতক্ষণের মায়াবী চোখ ভয়ার্ত হয়ে গেল নূরজাহানের। কাঁথার ভিতর থেকে হাত বের করে দুইহাতে মরনির একটা হাত আঁকড়ে ধরল। জ্বরে তখনও পুড়ছে হাত কিন্তু মরনি তা খেয়াল করল না। প্রথমে দিশাহারা হল, তারপর ফিসফিস করে বলল, তুই ডরাইচ না। আমি বুজছি কেডা। কাতা মুড়া দিয়া চুপচাপ পইড়া থাক। আমি দেখতাছি।

নিজেই কাঁথা দিয়ে আগের মতো ঢেকে দিল নূরজাহানকে। গলা চড়িয়ে জিজ্ঞস করল, কেডা রে, আ?

বাইরে থেকে সাড়া এল, আপনে আমারে চিনতাছেন না পিসি? এই গেরামে আমি ছাড়া কেডা আপনেরে পিসি ডাকে?

অন্য সময় হলে একথার জবাব দিত মরনি। বলত, ক্যা, ফুলমতি কয় না?

এখন ওইভাবে কথা বলবার সময় নাই। খুবই সাধারণ গলায় মরনি বলল, নিখিলা নিরে?

বাইরে থেকে সাড়া দিল নিখিল। হ।

বুকটা ধক করে উঠল মরনির। এসময় নিখিল এই বাড়িতে এল কেন! সে আতাহারের দোস্ত। দিনরাত আতাহারের সঙ্গে টো টো করে বেড়ায়। আতাহারকে ছেড়ে মরনির কাছে এল কেন! আতাহারই পাঠায়নি তো নিখিলকে! সারা গ্রাম খুঁজে নূরজাহানকে না পেয়ে আতাহাররা কি এখন একেকজন একেক বাড়িতে খুঁজতে বেরিয়েছে নূরজাহানকে! নিজে এক বাড়িতে গেছে, সুরুজকে আলমকে পাঠিয়েছে এক বাড়িতে, নিখিলকে পাঠিয়েছে এই বাড়িতে! যেখানেই থাকুক, কোথায় আছে নূরজাহান এটা শুধু জানা দরকার। তারপর কীভাবে নূরজাহানকে ধরতে হবে, কোন বাড়ির দরজা ভাঙতে হবে ওইসব তারা পরে দেখবে।

ভয়ে উৎকণ্ঠায় গলা শুকিয়ে গেল মরনির। কোনওরকমে সে বলল, কীর লেইগা?

নিখিল সরল গলায় বলল, কাম আছে।

কী কাম?

আছে। দুয়ার খোলেন, কইতাছি।

বাইরে থিকাই ক।

ক্যা, হুইয়া রইছেননি?

খানিক আগে ইয়াসিন সুরা পড়ছিল যে মানুষটি সে এখন নির্বিকার গলায় মিথ্যা বলল। হ, হুইয়া রইছি।

কষ্ট কইরা ইট্টু ওডেন। লাব অইবো।

কীয়ের লাব?

দুয়ার না খেললে কেমতে কই?

এসব নিখিলের চালাকি না তো! কোনও না কোনও অছিলায় মরনিকে দিয়ে দরজা খোলাচ্ছে সে। দরজা খুলবার পরই চট করে ঘরের ভিতর ঢুকে যাবে। চৌকির কাছে গিয়ে কথা তুলে দেখবে কে শুয়ে আছে।

আবার এমনও হতে পারে নিখিল শুধু একা আসেনি এই বাড়িতে। সঙ্গে আতাহারও আছে। আলম সুরুজও আছে। উঠানে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে তারা। কথা বলাচ্ছে শুধু নিখিলকে দিয়ে। মরনি দরজা খুলবার সঙ্গে সঙ্গে ঢুকে যাবে ঘরে। কাঁথার তলা থেকে বের করে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাবে নূরজাহানকে। মরনির চিৎকার চেঁচামেচি পাত্তা দিবে না।

এই পরিস্থিতিতে কী করবে মরনি? কেমন করে রক্ষা করবে নূরজাহানকে?

মরনি কাতর গলায় বলল, পরে আহিচ বাজান। আমি অহন উটতে পারতাছি না। শইলডা ভাল না।

নিখিল নরম গলায় বলল, হেইডা আমি বোজতাছি। তয় আমিও কোনও পথ না দেইক্কা আইছি। অনেক বাইত্তে বিচড়াইছি। পাই নাই দেইক্কাঐ আপনের কাছে আইছি।

নিখিলের কথা শুনে বুকের ধুকধুকানি আরও বেড়ে গেল মরনির। কোনওরকমে বলল, কী বিচড়াইতাছস?

কুঁকড়া (মোরগ, মুরগি)।

কথাটা যেন বুঝতে পারল না মরনি। বলল, কী?

কুঁকড়া, কুঁকড়া।

কীয়ের কুঁকড়া?

দুগগা কুঁকড়া কিনুম। বেইল নাই তো, অহন বাজারে গেলেও পামু না। যেই যেই বাইত্তে কুঁকড়া বেচে বেবাক বাইত্তেঐ গেছি। কেঐর কাছে নাই।

মরনি খুবই আন্তরিক গলায় বলল, হ্যরইত্তাগো বাইত্তে গেছস?

গেছি। নাই।

বেগির মা’র কাছে?

হ। ইননইত্তার মার কাছেও গেছি। কোনওহানে পাই নাই। শেষমেশ আইছি আপনের কাছে।

আমার কুঁকড়া নাই বাজান।

কন কী? এই যে দিহি উডানে কত কুঁকড়া? মিথ্যাটা ধরা পড়ার ফলে একটু থতমত খেল মরনি। তবে পলকেই তা সামলাল। হ আছে। তয় বেচি না।

না বেইচ্চা এতো কুঁকড়া দিয়া কী করেন?

পাইল্লা পুইল্লা ডাঙ্গর করি। ডাঙ্গর অওনের পর আন্ডা পাড়ে।

আন্ডাও তো আপনে বেচেন না!

না। উমে বহাই। ছাও অয়।

এমতে চললে তো বাড়িঘর কুঁকড়ায় ভইরা যাইবো।

যাউক।

মজনুরে কুঁকড়া জব কইরা খাওয়ান না?

পোলায় চাইলে খাওয়াই।

তয় আরেক পোলায় যে আইজ চাইতাছে অরে খাওয়াইবেন না ক্যা?

কথাটা বুঝতে পারল না মরনি। বলল, কোন পোলায়?

যেই পোলাডা এতক্ষুন ধইরা দুয়ারের সামনে খাড়ইয়া ঘেংটি (অনুনয়, বিনয়) পাড়তাছে। বইনের পোলা আর ভাইয়ের পোলা তো একরকম। বইনের পোলায় কয় মাসি, ভাইয়ের পোলায় কয় পিসি। আমরা হিন্দু অইছি তো কী অইছে, বাবায় তো আপনেরে বইন কয়। আমি তো আপনেরে পিসি কই।

এবার নিখিলকে মৃদু একটা ধমক দিল মরনি। এত প্যাচাইল পারিচ না ছেমড়া, অন্য বাইত্তে যা।

নিখিল একটুও দমল না। বলল, কোন বাইত্তে যামু কইয়া দেন। যাই।

ফকির বাড়ি যা।

গেছি। পাই নাই।

কেরফাইন্নার বাড়ির উলটামিহি, খালের ওইপারে, হযরতগো বাড়ির পশ্চিমের বাইত্তে এক বুড়ি থাকে। ম্যালা কুঁকড়া পালে বুড়ি। হুনছি কুঁকড়া বেইচ্চাঐ খায়।

আর কওন লাগবো না। হেই বাইত্তেও গেছি। ড্যাকরা ড্যাকরি একখানও নাই। তিনডা বুড়া কুঁকড়া আছে। উমে বইছে। উমা কুঁকড়া খাওন যায়নি? গোস্ত অয় ঘোড়ার গোস্তের লাহান।

মরনি কথা বলে না, চুপ করে থাকে।

নিখিল খুবই মায়াবী গলায় ডাকল, পিসি।

ক।

দুগগা কুঁকড়া বেচেন। উপায় না দেইক্কা আপনের কাছে আইছি। জানি কুঁকড়া আপনে বেচেন না। তাও আইছি। বিপাকে পইড়াঐ আইছি।

বাইত্তে মেজবান আইছেনি?

না। দরকার আমগো বাড়ির না।

তয় কোন বাড়ির লেইগা কুঁকড়া বিচড়াইতাছস?

কোনও বাড়ির লেইগা না। আতাহারের লেইগা।

আতাহারের নাম শুনে কেঁপে উঠল মরনি। আড়চোখে একবার চৌকির দিকে তাকাল। কাঁথার তলায় নূরজাহান কুঁকড়েমুকড়ে আছে। নিখিলের গলা শুনে যতটা কুঁকড়ে ছিল আতাহারের নাম শুনে আরও কুঁকড়েছে।

নূরজাহানের কারণেই যেন আতাহারকে নিয়ে কথা বলতে চাইল মরনি। বাড়ির কামে যুদি না লাগে তয় কুঁকড়া দিয়া আতাহার করবো কী?

ওইযে কনটেকদার সাবে আছে, সড়কে মাডি হালাইতাছে, তার ঘরে বইয়া কষাইন্না গোস্ত খাইবো।

রাইন্ধা দিবো কেডা?

দিদি।

ফুলমতি?

হ।

মরনি একটু থেমে খুবই নরম গলায় বলল, আমি কুঁকড়া বেচুম না বাজান। তুই অন্যমিহি যা।

কথাটা শুনে নিখিল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তয় আর কী করুম, আতাহাররে গিয়া কই। আতাহারের মনমিজাজ আইজ বহুত খারাপ। কুঁকড়া না পাইলে আরও খারাপ অইবো। রাইত্রে কোন বাইতে গিয়া খোয়াড় সুদ্দা লইয়াইবো কে জানে। চকে আইন্না কুঁকড়াডি বাইর কইরা খোঁয়াড়ডা হালাই থুইয়াইবো।

নিখিলের সঙ্গে কথা বলতে বলতে নূরজাহানকে নিয়ে পাওয়া ভয়টা কেমন যেন কমে আসছিল মরনির। এখন নিখিলের কথার ধরনে বুঝল নূরজাহানকে খুঁজতে তার বাড়িতে আসেনি নিখিল। সত্যি সত্যি মোরগ মুরগির জন্যই এসেছে। নয়তো এতক্ষণ ধরে এই একটা বিষয় নিয়ে কথা বলত না। তবে নিখিলের কথায় অন্য রকমের একটা ভয় মরনির হল। পয়সা দিয়ে কিনতে চাওয়ার পরও, এত করে বলবার পরও মরনি যখন দুইটা মুরগি বেচতে রাজি হয়নি, আতাহারের কথা শোনার পরও রাজি হয়নি, নিখিল গিয়ে নিশ্চয় আতাহারকে এসব বলবে। সব শুনে আতাহার খুব রাগ করবে। কষানো মুরগি খাওয়ার লোভ যখন তার একবার হয়েছে যেমন করে হোক তা সে খাবেই। এই বাড়িতে ড্যাকরা মুরগি আছে নিখিলের কাছ থেকে তা সে শুনবে। শুনে রাতে এসে যদি খোয়াড়টা তুলে নিয়ে যায়, কী করবে মরনি! যদি জানেও আতাহাররা কাজটা করেছে, কার কাছে বিচার দিবে! বিচার দিলেই বা লাভ কী! আতাহারের বিচার করবে কে! বিচার দিতে গেলে উলটো বিপদেও পড়বে মরনি। আতাহার তার শত্রু হয়ে যাবে। সে একা মানুষ বাড়িতে থাকে, রাতদুপুরে এসে আতাহার যদি ঘরে আগুন দেয়! চরের ডাকাতদের ঠিক করে যদি পাঠায় মরনির ঘরে ডাকাতি করতে! মজনু থাকে ঢাকায়। বাড়িতে আসার পর সেই ছেলের যদি ক্ষতি করে! যদি রাস্তাঘাটে ধরে ছুরি মেরে দেয়!

অন্য সব ভয় মন থেকে মুছে ফেলতে পারল মরনি, মজনুকে নিয়ে পাওয়া ভয়টা মুছতে পারল না। বুক কাঁপতে লাগল তার।

তারপর অন্যরকম করে ব্যাপারটা ভাবতে লাগল মরনি। যদি নিখিলের কথায় রাজি হয়ে দুইটা মোরগ মুরগি সে বিক্রি করে তা হলে নগদ সত্তর-আশি টাকা হাতে আসবে। নিখিল গিয়ে যখন আতাহারকে বলবে, কোনও বাড়িতে কুঁকড়া না পাইয়া মরনি পিসির কাছে গেছি। সে তর কথা কুঁকড়া বেচতে রাজি হইল। শুনে আতাহার নিশ্চয় মরনির ওপর খুশি হবে। তার বাড়িতে এসে খোয়াড় তুলে নিয়ে যাওয়ার কথা ভাববেই না। এমনকী নূরজাহানকে খুঁজতেও এই বাড়িতে আসবে না। সব দিকই রক্ষা হয় মরনির।

মরনি বলল, গেছস গা নিরে নিখিলা? বাইরে থেকে সাড়া দিল নিখিল। না পিসি। কই যামু, কী করুম কিছু বোজতাছি না। কুঁকড়া জোগাড় না করতে পারলে আমার উপরেও খুব চেতবে আতাহার। আমরা হিন্দু মানুষ। দেশগেরামে এমতে থাকি ডরে ডরে। তার উপরে যুদি আতাহার থাকে চেইত্তা, কেমুন বিপদ না? ফুলমতি দিদি বাইল্য বিধবা। বয়স তেমুন অয় নাই। আমার থিকা দুই-তিন বছরের মাত্র বড়। অরে লইয়া বাপ মায়ে তো চিন্তায় থাকে, আমিও থাকি। কোনহানদা কী অইয়া যাইবো, কে কইবো?

নিখিলের কথায় আশ্চর্য রকমের এক অসহায়ত্ব টের পেল মরনি। ফুলমতিকেও তার নূরজাহানের মতন মনে হল। মান্নান মাওলানার মুখে থুতু ছিটিয়ে যে বিপদে নূরজাহান আছে, কিছু না করেও যেন সেই একই বিপদে আছে ফুলমতি। একজোড়া কুঁকড়া বিক্রি করলে এই দুইজন মানুষকেও যেন উদ্ধার করতে পারে মরনি।

তবু আগের ভঙ্গিটা বজায় রাখার জন্য মরনি বলল, তুই তো দেহি ভাল এক ফাঁপরে হালাইলি আমারে।

আপনের কীয়ের ফাঁপর? ফাঁপরে পড়ছি আমি। আপনে কুঁকড়া বেচলে বেচবেন না বেচলে না বেচবেন।

হ আসল ফাঁপরডা তরঐ। তাও তুই আমার কাছে যহন আইছস, তর কথা হুইন্না আমিও ইট্ট ফাঁপরে পড়ছি।

ইচ্ছা করলেঐ আপনে আমারে এই ফাঁপর থিকা রেহাই দিতে পারেন।

কী করুম চিন্তা করতাছি।

আর চিন্তা কইরেন না। একশো টেকার একখান লোট দিতাছি। ডেকি দেইক্কা দুইডা কুঁকড়া দেন।

কোন দুইটা কুঁকড়া দেওয়া যায় মনে মনে চিন্তা করে ফেলেছে মরনি। তবে সেই দুইটার দাম সত্তর-আশি টাকার বেশি হবে না। একশো টাকা পেলে লাভটা ভালই হয়।

মরনি বলল, এমুন কইরা কথা কইতাছস, আর না করতে পারছি না। খাড়ো।

কথাগুলি বলেই আগের চিন্তাটা আবার হল মরনির। এসবই নিখিলের চালাকি না তো! সঙ্গে আতাহাররা দাঁড়িয়ে নাই তার সঙ্গে! নূরজাহানকে খুঁজতে আসেনি তো তারা!

কিন্তু এত কথা হয়ে যাওয়ার পর এখন আর দরজা না খুলে উপায় নাই।

মরনি একটা বুদ্ধি বের করল। ঢেউটিনের বেড়ায় নাটবল্টর ফুটা দুই-একটা থাকেই। দরজার দু’পাশের বেড়ায় আছেই। খুঁজে একটা বেরও করল মরনি। সেই ফুটা দিয়ে উঠানের দিকে তাকাল।

না আতাহাররা কেউ নাই। শুধু নিখিল অসহায় ভঙ্গিতে বসে আছে ঘরের সামনের তক্তায়।

খুদের হাঁড়ি থেকে একমুঠ খুদ আঁচলে নিল মরনি। অতি সাবধানে দরজা খুলল। একজন মানুষ কোনওরকমে গলতে পারে শুধু এটুকুই ফাঁক করল। বাইরে বেরিয়েই চটপটে হাতে শিকল তুলে দিল দরজায়। নিখিল এসবের কিছুই খেয়াল করল না।

আড়চোখে নিখিলের দিকে তাকাল মরনি, আঁচল থেকে খুদ তুলে উঠানে ছড়িয়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির উঠান পালানে চরে বেড়ানো মোরগ মুরগি সব ছুটে এল। দিকপাশ

তাকিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল খুদের উপর। শুধু সেই ছাওটা এল না। রান্নাচালার ওদিকে চরছিল। গলা তুলে এদিকে একবার তাকাল কিন্তু কোনও আগ্রহ দেখাল না।

মরনি একবার ছাওটাকে দেখল, তারপর যে দুই-চারটে খুদ তখনও লেগে আছে আঁচলে সেইগুলি ঝেড়ে ঝেড়ে ফেলল।

নিখিল ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছে। মুখটা হাসিহাসি। ভিতরে ভিতরে খুবই গদগদ হয়েছে বোঝা যায়। বলল, কোন দুইডা দিবেন পিসি?

আঙুল তুলে একই বয়সের একজোড়া কুঁকড়া দেখাল মরনি। ওই দুইডা

হ।

একটা মোরগ একটা মুরগি?

হ।

দুইডাঐ মোরগ দেওন যায় না?

না, নাই। থাকলে দিতাম।

একটু থেমে বলল, ক্যা খালি মোরগ অইলে সুবিদা কী?

মোরগটা আতাহারে ইট্টু বেশি পছন্দ করে।

রান্দনের পর গোস্ত মোরগের না মুরগির বোজে কেমতে?

হেইডা আমিও চিন্তা কইরা পাই না। আতাহার জানি কেমতে বোজে। কষাইন্না গোস্ত মোকে দিয়াঐ কইয়া দেয় গোস্ত মোরগের না, মুরগির। তয় আইজ মনে হয় এতকিছু খ্যাল করবো না। আইজ আতাহারের মন মিজাজ বহুত খারাপ।

সব জেনেও অবুঝের মতো প্রশ্ন করল মরনি। ক্যা, কী অইছে আইজ?

নিখিল যেন আকাশ থেকে পড়ল। আপনে জানেন না?

না।

কন কী?

হ। কী জানুম? কী হইছে?

গেরামে তো সাই (দারুণ) একখান কাম অইছে। নূরজাহান তো কাম কইরা লাইছে। উপরে উপরে খুবই উতলা হওয়ার ভান করল মরনি। কী করছে ক তো আমারে। আগের জায়গায় আবার তাকাল নিখিল। কুঁকড়া দুইডা ধরেন, কইতাছি।

ঘরের পুব কোণে আছে পলোটা। এখন দরজা খুলে সেই পলো আনতে যাওয়া ঠিক হবে। থাবা দিয়েই কুঁকড়া ধরতে হবে। কাজটা কঠিন না। মরনির পায়ের কাছেই নির্ভয়ে খুদ খুঁটে খাচ্ছে মোরগ মুরগিগুলি। যে দুইটা বিক্রি করবে সে দুইটা আছে একেবারে গলায় গলায়। আচমকা থাবা দিয়ে মোরগটা ধরে ফেলল মরনি। নিখিলের হাতে দিয়ে বলল, ধর বাজান। আমি আরেকখান ধরি।

একহাতে শক্ত করে মোরগের দুই ঠ্যাং চেপে ধরল নিখিল। আগের কায়দায় মুরগিটাও ধরল মরনি। নিখিলের হাতে দিয়ে বলল, এইবার ক।

ঘটনাটা বলল নিখিল। শুনে হতবাক হওয়ার ভান করল মরনি। যেন এই প্রথম শুনছে এমন ভঙ্গিতে বলল, হায় হায় কচ কী?

হ পিসি।

এত সাহস ছেমড়ির অইলো কেমতে?

কে কইবো?

মাওলানা সাবে অরে কী করছে?

কিছু করে নাই।

আতাহারে?

ও ও কিছু করে নাই।

ছেমড়ি অহন কো?

কইতে পারি না। গাছি আর গাছির বউরে দেইক্কাইলাম আতাহারগো বাইত্তে।

কী করতাছে?

হেইডা কইতে পারি না। আমি বেশিক্ষন আছিলাম না। মনে অয় মাইয়ার লেইগা। হাতপাও ধরতে গেছে। মাইয়ারে মনে হয় বাইত্তে হামলাইয়া থুইয়া গেছে।

খুবই হায় আপশোস করার ভঙ্গিতে মরনি বলল, এমুন কাম ছেমড়ি করলো ক্যা?

কে কইব? মনে হয় মাকুন্দার দশা দেইক্কা মাথা বিগড়াইয়া গেছিলো। বিগড়ানের কথাঐ। যেই মাইর মারছে বেড়ারে, চোর সাজাইয়া জেলে দিছে, হেইডা দেকলে কেঐর মাথা ঠিক থাকে না পিসি।

মরনি সরল গলায় বলল, চোর সাজাইবো ক্যা? তুই দিহি কইলি গোরু চুরি করতে গেছিলো মাকুন্দা!

গলা সামান্য নিচু করে নিখিল বলল, এইডা আতাহারের বাপে আর আতাহারে বানাইছে।

কী?

হ। আপনে যুদি কেরে না কন তয় আপনেরে আমি সব কইতে পারি।

কমু না। কিরা কাইরা কন।

মরনি হাসল। আইচ্ছা করলাম। তুই কোনওদিন হুনবি না যে তর এই হগল কথা আমি কেঐরে কইছি। আমার পোলা মজনুর কিরা।

মজনুর কথা শুনে ভরসা পেল নিখিল। হাসিমুখে বলল, তয় কওন যায়। মজনুর কিরা কারলে হেই কিরা আপনে ভাঙবেন না। জান গেলেও ভাঙবেন না।

মাকুন্দা কাশেমের আসল ঘটনাটা খুলে বলল। শুনে মরনি স্তব্ধ হয়ে গেল। দুঃখী মুখ করে বলল, এইডা কোনও কথা অইলো? নির্দোষ মানুষটারে এমুন কইরা মারলো? এমুন কইরা জেলে দিল? কোনও দোষ করে নাই তাও দোষের ভাগী করলো?

মরনির সঙ্গে গলা মিলাল নিখিল। হ পিসি। মাওলানা অইলে কী অইবো আতাহারের বাপে মানুষ ভাল না। বদ। একবার কোনও মাইনষের উপরে চেতলে অরে খাইছে। জাইত সাপের লাহান। জাইত সাপরে যেমুন দুঃকু দিলে মাইনষের পিছে পিছে আহে, রাইত দোফরে ঘরে ঢুইক্কা ঠোকর দিয়া যায়, আতাহারের বাপে অইলো ওইরকম।

তয় মাওলানা সাবের লগে তো কোনও অন্যায় করে নাই মাকুন্দা।

করছে। উই যে ছনুবুড়ির জানাজা পড়তে হেয় যায় নাই আর তার বাড়ির গোমস্তা হইয়া মাকুন্দায় গেছে, এইডা অইলো অন্যাই। এইডা হেয় মনে রাখছে।

মরনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। না কামডা ভাল অয় নাই।

হ এমুন কাম ভাল হয় কেমতে?

নিখিলের হাতে অসহায় ভঙ্গিতে ঝুলছে কুঁকড়া দুইটা। সেদিকে তাকিয়ে নূরজাহানের কথা মনে হল মরনির। নূরজাহানও তো এমন এক অসহায় ভঙ্গিতে ঝুলে আছে মান্নান মাওলানার হাতে। যখন তখন তাকে জবাই করবেন তিনি।

মরনি বলল, তয় নূরজাহান আথকা তারে ছ্যাপ ছিডাইতে গেলো ক্যা?

নূরজাহান জানতো মাকুন্দার কোনও দোষ নাই।

কেমতে জানতো?

আমার মনে অয় মাকুন্দায় অরে কইছে।

তুই বুজলি কেমতে?

দিনে তো অগো বাইত্তেঐ আছিল মাকুন্দা। একদিন নূরজাহানের পিছে পিছে সড়ক মিহি আইছিলো।

তুই দেকছস?

ন। কনটেকদার সাবে দেকছে। হেয় আমগো বেবাকতেরে কইছে।

মরনি আর কথা বলল না চিন্তিত হয়ে গেল।

নিখিল বলল, কী চিন্তা করেন পিসি?

নূরজাহানের কথা।

হ, খুব বিপদ ছেমড়ির।

তর কী মনে হয়, আতাহাররা অরে কী করব?

আতাহারের বাপে পুলিশ দারগাগো সামনে কইছে, নাদান ছেমড়ি, অরে আমি মাপ কইরা দিলাম।

শুনে মুখ উজ্জ্বল হয়ে গেল মরনির। সত্যঐ কইছে?

হ।

তয় তো বাঁইচ্চাঐ গেল ছেমড়ি।

না বাঁচে নাই।

ক্যা?

আপনে এত সোজা মানুষ পিসি! মাইনষের সব কথা বিশ্বাস করেন। কইলাম না মাওলানা সাবে জাইত সাপের লাহান। পুলিশ দারগাগো সামনে, গেরামের বেবাক মাইনষের সামনে নিজেরে ভাল দেহানের লেইগা কথাডা হেয় কইছে। আদতে কি হেইডা করববানি? ভিতরে ভিতরে জ্বলতাছে না? নূরজাহানরে হেয় ছাড়বোনি? শোদ কোনও না কোনওভাবে লইবোঐ। হেয় না লইলেও আতাহারে লইবোঐ। কনটেকদার সাবের ঘরে বইয়া কষাইন্না গোস্ত খাইতে খাইতে আইজ হেই হগল প্যাচাইলঐ পাড়বো।  

তুই থাকবি না লগে?

হ।

তারপরই নিখিলকে মিনতি করল মরনি। তুই আমার একখান কাম করবি বাজান?

কন।

করবিনি আগে ক।

করুম। আপনে আমার লেইগা করছেন আমি করুম না ক্যা?

আমি তর লেইগা কী করছি?

এই যে কুঁকড়া বেচলেন আমার কাছে। আপনে যুদি না বেচতেন তাইলে আমি একটা ফাঁপরে পড়তাম না? কন কী কাম?

নূরজাহানরে লইয়া কী চিন্তাভাবনা করে আতাহারে তুই জানবি না?

হ জানুম।

যা জানবি আমারেও জানাবি।

কথাটা শুনে থতমত খেয়ে গেল নিখিল। হাঁ করে মরনির মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।

মরনি বলল, কী অইলো?

নিখিল স্বাভাবিক হল। কিছু না।

করবি না আমার কামড়া?

ধীর গম্ভীর গলায় নিখিল বলল, করুম। তয় আপনেরে দুই একখান কথা জিগাই?

জিগা।

এই হগল জাইন্না আপনের লাব কী?

কিছু না।

তয় জানবেন ক্যা?

মাইয়াডার লেইগা আমার খুব মায়া লাগে।

মায়া লাগলেই বা এই হগল জাইন্না আপনে কী করবেন? অরে বাঁচাইতে পারবেন?

চেষ্টা কইরা দেহুম। আল্লায় রহম করলে বাঁচবো ছেমড়ি। আল্লায় বাঁচাইলে বাঁচবো। তুই যুদি বেবাক কিছু আমারে জানাচ আমি অরে সাবধান করতে পারুম, দরকার অইলে কোনওহানে নিয়া হামলাইয়া থুইয়ামু। জান দিয়া চেষ্টা করুম ছেমড়ি যাতে বাঁচে। এই বম্বে (বয়সে) অর য্যান কোনও ক্ষতি না অয়।

মরনির কথা শুনে অদ্ভুত চোখ করে খানিক তার দিকে তাকিয়ে রইল নিখিল। তারপর শান্ত গলায় বলল, আপনেরে আমি বেবাক কিছু জানামু পিসি। আপনে চিন্তা কইরেন না। আতাহারগো লগে থাইক্কাও আমি আসলে থাকুম আপনের লগে। আমিও চেষ্টা করুম। নূরজাহানরে বাঁচাইতে।

.

হামিদা ফোঁস ফোঁস করে কাঁদে আর হাঁটে।

তার আগে আগে দ্রুত পা চালিয়ে হাঁটছে দবির। মান্নান মাওলানার বাড়ি থেকে বেরুবার পর থেকেই এভাবে হাঁটছে সে, বাড়ির দিকে যাচ্ছে। মুখটা গম্ভীর। কোনওদিকে তাকাচ্ছে না। সঙ্গে যে হামিদা আছে, সে যে তার সঙ্গে হাঁটার তাল রাখতে পারছে না, ফোঁস ফোঁস করে কাঁদছে, কিছুই যেন টের পাচ্ছে না দবির। বাড়ির কাছাকাছি আসার পর দূরত্বটা হামিদার সঙ্গে যেন একটু বেশি বেড়ে গেল। ব্যাপারটা দবির খেয়াল করল না, করল হামিদা। আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে দৌড়ে স্বামীর কাছে এল। পিছন থেকে দবিরের হাত টেনে ধরল। বাইত্তে যাইতাছ ক্যা?

দবির থমকে দাঁড়াল। গম্ভীর মুখে স্ত্রীর দিকে তাকাল। থমথমা গলায় বলল, তয় কই যামু?

মাইয়াডারে বিচড়াইবা না?

না।

এবার দুইহাতে দবিরের হাত ধরল হামিদা। কান্নাকাতর গলায় বলল, এমুন কইরো না। এমুন নিদয় অইয়ো না। আগে মাইয়াডারে বিচড়াইয়া বাইর করো। তারবাদে যত ইচ্ছা মারো কাডো আমি কিছু কমু না। মাইয়াডা কই গেছে গা, কই আছে না জাইন্না বাইত্তে তুমি কেমতে যাইতাছো? কেমতে অহন বাইত্তে গিয়া থাকবা তুমি? কেমতে ভাতপানি খাইবা, কেমতে ঘুমাইবা?

আগের মতোই গম্ভীর গলায় দবির বলল, এই হগল আমি জানি না।

বিকাল শেষ হয়ে আসছে। গ্রামের চকেমাঠে একত্রে নামছে কুয়াশা আর অন্ধকার। যে যার গাছে ফিরছে পাখিরা। উত্তরের হাওয়াটা বইছে। সেই হাওয়া বাঁচিয়ে কুপিবাতি জ্বালছে গিরস্তবাড়ির বউঝিরা। এসময় হাঁড়ি পাতা শেষ করে বাড়ি ফিরে দবির। আজ সে-কাজে যাওয়া হয়নি। পুরনো হাঁড়িতেই রস ঝরবে আজ। দিনে ঝরা রসে আগেই। আধাআধি ভরে থাকবে হাঁড়ি। রাতে ঝরা রসে দুপুর রাতেই কানায় কানায় ভরে উঠবে। তারপর থেকে হাঁড়ি উপচে তলায় পড়বে। দবিরেরও ক্ষতি, গিরস্তেরও ক্ষতি। এমন ক্ষতি গাছিজীবনে কখনও হয়নি দবিরের। এই প্রথম। প্রথম বলেই হয়তো গিরস্তে তেমন কিছু মনে করবে না। তা ছাড়া নূরজাহানের কথাও তো শুনে ফেলেছে সবাই। বুঝবে কেন গাছ ঝুরতে আসতে পারেনি দবির। কেন দিনে ঝরা হাঁড়ির রস নামাতে পারেনি, কেন পারেনি হাঁড়ি বদলাতে।

কিন্তু কাল যখন গাছ ঝুরতে বাড়ি বাড়ি যাবে দবির তখন হবে আরেক ঝামেলা। গিরস্তরা মুখিয়ে থাকবে নূরজাহানের কথা জানবার জন্য। এক প্যাচাল হাজারবার পাড়তে হবে দবিরের। তারপরও কত মানুষের কত কথা! দেশগেরামে এক কথারই হাজার চেহারা। একেকজন একেক রকমভাবে তুলবে কথাটা, একেক রকমভাবে বলবে। তার উপর নূরজাহান হচ্ছে মেয়ে। বদলোকেরা কত কথা বানাবে ওইটুকু মেয়েকে নিয়ে। কত ঠাট্টা মশকরা, কত হাসাহাসি, কত ইতর কথাবার্তা হবে। কোনও না কোনওভাবে সব কথাবার্তাই কানে আসবে দবিরের। এত কথা শুনে কেমন করে গ্রামে থাকবে সে!

সন্ধ্যা হয়ে আসা অন্ধকার আর কুয়াশার দিকে তাকিয়ে এসবই এখন ভাবছিল দবির। হামিদা যে তার হাত ধরে রেখেছে, কাতর অনুনয় করছে মেয়েকে খুঁজতে যাওয়ার, কিছুই খেয়াল করছে না।

হামিদা বলল, খাড়ঐ রইলা ক্যা? লও।

দবির নির্বিকার গলায় বলল, কই যামু?

মাইয়া বিচড়াইতে।

কই বিচড়ামু?

গেরামে। বেবাক বাইত্তেঐ যামু। যেই বাইত্তে আছে হেই বাইত্তে থনেঐ লইয়ামু।

আর নিজেগো বাড়ি যে খালি পইড়া রইলো?

থাউক।

কও কী তুমি? রাইত অইয়াইলো, বাড়িডা খালি পইড়া থাকবো? ঘরদুয়ার খোলা পইড়া থাকবো?

থাউক, ডর নাই। মুকসেইদ্দা জেলে। মুকসেইদ্দা ছাড়া চোর ধাউর আর কে আছে গেরামে?

গেরাম কি আর গেরাম আছেনি? সড়কের কামে কতপদের মানুষ আইছে গেরামে। এক মুকসেইদ্দা জেলে হাজার মুকসেইদ্দা বাইরে। কোনহান দিয়া কে চুরি করবো কিছু বোজবা না। এক কাম করো, তুমি বাইত্তে যাও আমি যাই নূরজাহানরে বিচড়াইতে।

কথা এমন স্বাভাবিক গলায় বলল দবির, যেন মা-বাবার সঙ্গে রাগ করে কোনও বাড়িতে গিয়ে বসে আছে নূরজাহান, গিয়ে তাকে শুধু নিয়ে এলেই হল। এতবড় একটা কাণ্ড যে নূরজাহান করেছে, মাথার উপর যে তার এতবড় বিপদ তা যেন সে বুঝতেই পারছে না, তা যেন তার মনেই নাই।

হামিদা খুবই অবাক হল। স্বামীর চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, কও কী তুমি?

দবির বলল, ক্যা, খারাপ কী কইলাম?

আমার মাইয়ার এতবড় বিপদ আর তুমি আমারে গিয়া বাড়ি পইর (পাহারা) দিতে কও? কোন হিরা জহরত আছে তোমার বাইত্তে যে চোরে লইয়া যাইবো?

হিরা জহরত না থাউক, টুমটাম তো আছে? পিতলের কলসি বদনা, থাল বাসন।

শুনে তেড়ে উঠল হামিদা। ওই হগল ছাইভস্ম চোরে নিলে নেউকগা। আমার মাইয়ার থিকা ওই হগল বড় অইলোনি?

তাইলে তুমি মাইয়া বিচড়াইতে যাও, আমি গিয়া বাড়ি পইর দেই।

এই রাইত বিরাইতে একলা একলা মাইয়া বিচড়াইতে যামু আমি?

গেলে কী অইবো?

আমি যে মাইয়াছেইলা এইডাও তুমি ভুইলা গেছ?

না ভুলি নাই। ভুলুম ক্যা?

তয়?

তয় তুমি তো অল্প বইষ্যা মাইয়া না। তোমার আবার ডরের কী আছে?

কী আছে হেইডা বোজলে কথাডা তুমি কইতা না। নিজেঐ কইলা গেরাম আর গেরাম নাই। সড়কের কামে কতপদের মানুষ আইছে। এই হগল মানুষরা গেরামের বউঝিগো চিনে না। আন্ধাইরা রাইতে কোনহানদা কারে ধইরা বইবো কে জানে। ধরলে কি আর জুয়ান বুড়ি বুজবো?

অন্য সময় হলে এসব কথা শুনে হামিদার সঙ্গে ঠাট্টা মশকরা করত দবির। এখন সেই মন নাই। দবির গম্ভীর হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

হামিদা বলল, আমার কথা অহন তোমার খারাপ লাগবো। মনে করবা বিপদে পড়ছো দেইক্কা আমি তোমারে খোঁড়া দিতাছি। খোঁড়া না, আসল কথা। আমার মাইয়ার আইজ যেই দশা এই দশার লেইগা তুমি দায়ী। নিজে দায়ী অইয়া মাইয়ারে তুমি নিদানে হালাইবা, নিজেঐ আবার মাইয়ার উপরে রাগ করবা, অহন তুমি হেইডা পারবা না। বাপ অওন বহুত সোজা, মা অওন কঠিন। বাপ অয় মাইনষে এক মিনিটে, মা অয় দশমাস দশদিনে। এক মিনিটে বাপ অয় দেইক্কাঐ পোলাপানের দরদ বাপেরা বোজে না, বোজে মায়। আমার মাইয়ার বিপদ আমি যেমতে বোজতাছি তুমি ওমতে বোজতাছে না। বোজলে বাড়িঘরের চিন্তা তোমার অইতো না।

দবির কোনওরকমে বলল, অর উপরে আমার বহুত রাগ।

আর আমার রাগ তোমার উপরে।

ক্যা?

ওই যে কইলাম মাইয়ার এই দশা তোমার লেইগা। আমার কথা হোনলে এমুন। অইতো না। তুমি মনে করতা আমি খালি মাইয়াডারে শাসন করি। মাইয়ার ভালমন্দ বুঝি, অরে বাইত্তে থিকা বাইর অইতে দিতে চাই না। দুই-একদিন বাইন্দাও থুইছি। ক্যান এমুন করছি আইজ হেইডা তুমি বোজবা। বেডারা তো হারাদিন বাইত্তে বইয়া থাকে না। তারা থাকে খেতখোলায়, আডে বাজারে। পোলাপানরে বেশিক্ষন দেহে না। এর লেইগা আলগা আহ্লাদখান বাপেগো ইট্টু বেশি থাকে। বাইত্তে আইয়াঐ পোলাপান লইয়া আহ্বাদে এক্কেরে গইল্লা যায়। মায় শাসন করলে উলটা তারে বকাবাজি করে। মনে করে পোলাপানের লেইগা ইট্টুও মায়া নাই মা’র। এইডা অইল পুরুষপোলাগো দোষ। মায়। তো হারাদিন বাইত্তে থাকে, চোকের সামনে থাকে পোলাপান, কুঁকড়ার লাহান কাউয়ার হাত থিকা পোলাপানগো বাঁচায় মায়, চিলের হাত থিকা বাঁচায়। সমায় সমায় জিদ কইরা পোলাপানগো আবার ঠোকরও দেয়, খাওন দিতে চায় না। এইডা অইলো শাসন। এই শাসনডা করে দেইক্কাঐ পোলাপানডি ঠিক থাকে। কাউয়া চিল দেকলেঐ মা’র পাকের (পাখনা, ডানা) নীচে আইয়া পলায়। মা’র শাসনডা যদি না থাকতো তাইলে পলাইতো না। যহন তহন কাউয়া চিলে ছোঁ দিয়া লইয়া যাইতো। তোমার মাইয়ার হইছে হেই দশা। আমার পাকের নীচে থাকলে কাউয়া চিলে আইজ ছে দিতে পারতো না অরে। তুমি আহ্লাদ কইরা অরে আমার পাকের নীচ থিকা বাইর কইরা দিছো। তোমার লেইগা আমার মাইয়ারে আইজ কাউয়া চিলে ঠোকরাইবো আর তুমি চাইয়া চাইয়া দেকবা আমি বাইচ্চা থাকতে হেইডা অইবো না। আমার লগে তোমার যাওন লাগবো, মাইয়া বিচড়াইয়া বাইর করন লাগবো। জীবনে কোনওদিন কোনও কিছু লইয়া তোমারে আমি কিছু কই নাই। এতো প্যাচাইল হারা জীবনেও তোমার লগে আমি পাড়ি নাই। আইজ পাড়তাছি। মাইয়ার লেইগা পাড়তাছি। তুমি বাঁইচ্চা থাকতে আমার মাইয়ার যুদি কোনও সব্বনাশ অয় তাইলে তোমার গাছ ঝেরনের ছ্যান দিয়া তোমার কল্লা আমি কাইট্টালামু। এক মিনিটের বাপ অইয়া দশমাস দশদিনের মা’রে তুমি কষ্ট দিবা হেইডা পারবা না। লও আমার লগে।

হামিদার কথা শুনতে শুনতে নিজের অজান্তেই যেন স্তব্ধ হয়ে গেছে দবির। এই কি এতদিনকার চিনা হামিদা! তার স্ত্রী, মেয়ের মা! এতদিন ধরে দেখা এত নরম নিরীহ মানুষটি ভিতরে ভিতরে তা হলে এরকম! মেয়ের জন্য এত টান ভালবাসা তার! এই ব্যাপারটা দবির তো কখনও টের পায়নি! দবির তো কখনও দেখেনি মেয়েকে একটু আদর। করে কথা বলছে হামিদা, একটু আদর করে কিছু খাওয়াচ্ছে। ঘুমিয়ে থাকা মেয়েটির গায়ের কাপড় ঠিক করে দিচ্ছে। শীতে কুঁকড়ে থাকা মেয়েটির গায়ে তুলে দিচ্ছে কাঁথা কাপড়। জীবনভর তো মেয়েকে শুধু শাসন করতেই দেখেছে, ধমকাধমকি করতে দেখেছে। এই অমুক জাগায় গেলি ক্যা? তমুক করলি ক্যা? যখন তখন গুমগুম কিল মারতে দেখেছে মেয়ের পিঠে, চড়চাপড় ঠোকনা মারতে দেখেছে, আদরটা তো দেখেনি!

এই কি তা হলে আসল মায়ের আদর! উপরে উপরে শাসন ধমক, ভিতরে ভিতরে সন্তান ছাড়া কিছু বোঝে না!

হামিদার কথা ভেবে দবির তারপর দিশাহারা হয়ে গেল। মনের ভিতরটা উথালপাথাল করে উঠল তার। আশ্চর্য এক কৃতজ্ঞতায় হামিদার উপর মন ভরে গেল। দুইহাতে হামিদার মাথাটা বুকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছা করল দবিরের। জড়িয়ে ধরে বলতে ইচ্ছা করল, আমার মাইয়াডার লেইগা তোমার এমুন টান? এমুন টান তোমার মাইয়াডার লেইগা? আমি। কুনোদিন বুঝতে পারি নাই। এমুন টান মনের মইদ্যে কেমতে হামলাইয়া থুইছো তুমি? মাইয়াডা আইজ এমুন কাম না করলে তো তোমার এই টানডা আমি কুনোদিন বুঝতে পারতাম না। বুজতাম মাইয়াডারে তুমি দুই চোকে দেখতে পারো না। মাইয়াডার লেইগা মায়া মহব্বত খালি আমারঐ।

করা হয় না কিছুই দবিরের। বলা হয় না কিছুই। কান্নায় গলা বুজে আসে তার, চোখ ছলছল করে ওঠে। অন্ধকারে কুয়াশায় মুখোমুখি দাঁড়িয়েও হামিদা তা দেখতে পায় না। সে আছে মেয়ের চিন্তায়।

দবির ধরা গলায় বলল, লও তাইলে যাই।

শুনে ছটফট করে উঠল হামিদা। হ লও।

কোন বাইত্তে যাইবা আগে?

তুমি কও।

কোন কোন বাইত্তে বেশি যায় তোমার মাইয়ায়?

বেশি যায় হালদার বাড়ি। মজনুগগা ঘরে। তারবাদে হাজামবাড়ি যায়, মেন্দাবাড়ি যায়, মিয়াবাড়ি যায়।

মোবাড়ির সব ঘরে নূরজাহান যায় না। যায় খালি দেলরা বুজিগো ঘরে।

হ।

তয় হেই বাইত্তেঐ আগে লও।

ক্যা? আগে তো পড়বো মিয়াবাড়ি আর হাজামবাড়ি।

ছনুবুজিগো বাড়িও পড়বো। তয় এই তিন বাইত্তে নূরজাহান আইজ যায় নাই।

কেমতে বোজলা?

তিনডা বাড়িঐ সড়কের সামনা সামনি।

হেতে কী অইছে?

মাওলানা সাবের বাড়ি থিকাও এই বাড়িডি সামনে। মাওলানা সাবের বাড়ির সামনের কোনও বাইত্তে গিয়া পলাইবো না তোমার মাইয়ায়। তারবাদে হাজামরা অইলো গরিব। হেই বাইত্তে পলানের জাগা নাই। ছনুবুজি মইরা যাওনের পর হেই বাইত্তে নূরজাহান অহন। যায় না। আজিজের বউ বানেছা অরে দেকতে পারে না, ও ও দেকতে পারে না বানেছারে। যাইতে পারে মিয়া বাইত্তে। কুট্টির লগে খাতির আছে। আবার আলফুর কথা চিন্তা কইরা নাও যাইতে পারে।

ক্যা, আলফু কী করছে?

কিছু করে নাই। নূরজাহান চিন্তা করতে পারে ও যে এই বাইত্তে পলাইয়া রইছে আলফু যুদি এই কথা কেঐরে কইয়া দেয়?

তোমার মনে অয় এতকিছু ও চিন্তা করছে।

হ আমার মনে অয়।

ক্যা?

মাইয়া তোমার চালাক আছে। এই দিককার কোনও বাইত্তে গিয়া যুদি ও পলায় তাইলে পলাইছে মোবাইত্তে। দেলরা বুজিগো ঘরে। চিন্তা করছে দেলরা বুজিগো ঘরে থিকা অরে কেঐ ধইরা নিতে পারবো না। মাওলানা সাবে না, আতাহারে না।

ক্যা?

দেলরা বুজির বড়বইন আনোরা (আনোয়ারা) বুজির বড়পোলায় গেরামে মজজিদ করতাছে। মাওলানা সাবরে বানাইবো ইমাম। হের লেইগা দেলরা বুজিগো লগে মাওলানা সাবে অহন চুদুরবুদুর (তালবাহানা, শয়তানি বদমায়েশি) করতে সাহস পাইবো না। দেলরা বুজি যুদি জাগা দেয় নূরজাহানরে তাইলে তার কাছ থিকা নূরজাহানরে কেঐ ধইরা নিতে পারবো না।

শুনে আনন্দে যেন আত্মহারা হয়ে গেল হামিদা। কও কী?

হ।

এইডা বহুত ভাল কথা। লও তাইলে দেলরা বুজিগো বাইত্তেঐ আগে যাই। নূরজাহান। ওই বাইত্তে থাউক না থাউক দেলরা বুজিরে গিয়া কই আমগো মাইয়াডারে আপনে বাঁচান। আপনে মাওলানা সাবরে কন মাইয়াডা না বুইজ্জা আকাম কইরালাইছে, অরে আপনে মাপ কইরা দেন। অর কোনও ক্ষতি আপনে কইরেন না।

হামিদার কথা শুনে দবিরও উৎফুল্ল হল। হ এইডা দামি কথা কইছো। দেলরা বুজি যুদি মাওলানা সাবরে কয় তাইলে তার বাপের সাইদ্দ নাই নূরজাহানরে কিছু কয়।

তয় আর দেরি কইরো না, তাড়াতাড়ি লও।

ততক্ষণে ঘোর অন্ধকার চারদিক। অন্ধকারে কুয়াশায় ঢেকে গেছে মানুষের ঘরবাড়ি, খেতখোলা মাঠপথ। উত্তরে হাওয়ায় শনশন করে গাছের পাতা, শীতে জবুথবু হয়। গ্রামপ্রান্তর। অন্ধকার কুয়াশা তোয়াক্কা করে না দুইজন মানুষ। তীব্র শীত তোয়াক্কা করে না। একজন আরেকজনের হাত ধরে, পায়ের তলার মেঠোপথ ঠাওর করে মেন্দাবাড়ির দিকে হেঁটে যায়।

.

হারিকেনের আলোয় সাদা থান পরা দেলোয়ারাকে অচেনা মানুষ মনে হয়। যেন এ দুনিয়ার কেউ নন তিনি, যেন অন্য কোনও দুনিয়া থেকে হঠাৎ করেই চলে আসছেন মেদিনীমণ্ডল গ্রামের তিন মেন্দাবাড়ির এক বাড়িতে, যে বাড়ির আরেক নাম সারেঙ বাড়ি। তিন ভাইয়ের দুইজন ছিলেন জাহাজের সারেঙ আর একজন কেরানি। যেন কোনও এক দূরগামী জাহাজে। করেই বাপ-চাচারা কেউ অচেনা কোনও দেশ থেকে আজ এই সন্ধ্যায় দেলোয়ারাকে নিয়া আসছেন এই বাড়িতে, এই ঘরে। বহুদূর পথ অতিক্রম করে আসতে হয়েছে বলেই বুঝি চোখের চশমায় তার জমেছে দুনিয়ার সব ধুলা। হারিকেনের ম্লান আলোয় কিছুই বুঝি দেখতে পাচ্ছিলেন না তিনি। এজন্যই বুঝি সাদা থানের খুঁটে এখন চশমার কাঁচ মুচছেন। কাঁচ মুছতে মুছতেই বুঝি তার মনে পড়ল অদূরে বসে থাকা বাদলার কথা। কিন্তু বাদলার দিকে তিনি তাকালেন না। ধীরে শান্ত গলায় বললেন, অ্যাই ছেমড়া, পড়চ না ক্যা?

বড়ঘরের মাঝের কামরায় পুরনা উঁচু পালঙ্ক দক্ষিণ দিককার জানালার সঙ্গে পুবে-পশ্চিমে পাতা। পালঙ্কের পা এবং মাথার দিকে ফুল পাখি লতা পাতার কারুকাজ। বিক্রমপুর অঞ্চলের আগের দিনের হিন্দু কাঠমিস্ত্রিদের স্বভাব ছিল শিল্পীদের মতো। অতিযত্নে, অনেক অনেকদিন সময় নিয়ে বনেদি বাড়ির আসবাবপত্রের কাজ করত তারা। বার্মা মুলুক থেকে আসা মহামূল্যবান সেগুনকাঠের আসবাবপত্রে হাতুড়ি বাটাল চালাত সোনার সূক্ষ্ম কাজে পারদর্শী সোনারুদের ভঙ্গিতে। অতিযত্নে, দরদে মায়ায় কাঠের গায়ে ফুটিয়ে তুলত আশ্চর্য সব শিল্পকর্ম। সবশেষে লাগাত রং। গৃহস্থবাড়ির হিসেবি বউঝিরা কেউ কেউ গাছের তেঁতুল খোসা ছাড়িয়ে দলা দলা করে জমিয়ে রাখে হড়িকুড়ির অন্ধকারে, বছর-দুই বছর রাখার পর যেমন রং হয় সেই তেঁতুলের, আসবাবপত্রে লাগানো রঙের রং ঠিক তেমন। পঞ্চাশ-একশো বছরে চটে না সেই রং, বরং যত দিন যায় রং যেন আরও জেঁকে বসে, রঙের জেল্লা যেন আরও খোলতাই হয়।

যে পালঙ্কে বসে আছেন দেলোয়ারা সেই পালঙ্কটি এইরকম।

শুধু পালঙ্ক কেন, ঘরের সব আসবাবই এইরকম। সেইসব মহান কাঠমিস্ত্রিদের জাদুকরি হাতের মায়া আর যত্নে গড়া।

পালঙ্কের ওপাশে উত্তরের বেড়ার সঙ্গে মাঝারি সাইজের একটা আলমারি। মাথার দিকে পায়ের দিকে পালঙ্কের মতোই কারুকাজ। পাল্লা সাদামাটা কিন্তু হ্যাঁন্ডেলের কাছে গোল ভারী ধরনের নীল-সাদার মিশেল দেওয়া শিশুদের মুঠার মাপের একখানা পাথর বসানো। অন্ধকারেও জুলজুল করে পাথর। এই পাথরটাই আসলে হ্যাঁন্ডেল। ধরে আলতো করে টানলেই নরম ভঙ্গিতে খুলে যায় পাল্লা। পাল্লার গায়ে ওই পাথরটাই একমাত্র শিল্পকর্ম। সাদামাটা পাল্লার সৌন্দর্য হাজারগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। আচমকা পাল্লার দিকে তাকালে পাথরটাই চোখে পড়ে আগে।

কাঠের আলমারির লাগোয়া পশ্চিমে নিচু ধরনের ছোট্ট একখানা চৌকি। জলচৌকি না, তারচেয়ে একটু বড়। একই রঙের, একই কাঠের। পায়া চারটা কারুকার্যময়। এই চৌকির ওপর, এককোণে রাখা কুপিবাতি রাখার কাঠের গাছ। গাছার ওপর জ্বলছে ঝকঝকে পিতলের কুপি। গাছার চেহারা দেখে বোঝা যায় এইটুকু সামান্য আসবাবও একই যত্নে তৈরি করা হয়েছে। ছোট দীনহীন বলে অবহেলার চিহ্ন নাই।

চৌকির তলায় এখন মাটির ধুপতি রাখা। সন্ধ্যাবেলা ধূপ দেওয়া হয়েছে ঘরে। ধূপের ধুমায় (ধোঁয়ায়) শীতকালের মশাগুলো দিশাহারা হয়ে ঘর ছাড়ে আর বন্ধ ঘরের আনাচে কানাচে লুকিয়ে থাকা ভ্যাপসা গন্ধ দূর হয়।

আজও হয়েছে।

এখনও ধূপের ধুমা পুরাপুরি মিলিয়ে যায়নি। ব্যস্ত কৃষকের টানে টানে কার মাথায় বসা কলকি থেকে যেমন করে ওঠে তামাকের ধুমা ঠিক তেমন একটা ধুমার রেখা উঠছে ধুপতি থেকে। সঙ্গে আছে ধূপের পবিত্র গন্ধ। ঘরের বাতাস সেই গন্ধে বিভোর হয়ে আছে।

পালঙ্কের মাথার দিকে ঢেলান দিয়ে বসে আছেন দেলোয়ারা। পায়ের কাছে জ্বলছে ঝকঝকে কাঁচের বায়েজিদ হারিকেন। হারিকেনের ওপাশে আসনপিড়ি করে বসে আছে বাদলা। তার সামনে খোলা সীতানাথ বসাক প্রণীত আদর্শলিপি। কয়েকদিন ধরে সন্ধেবেলা বাদলাকে পড়তে বসাচ্ছেন দেলোয়ারা। বাদলার বাপ মতলেবকে দিয়ে কাজির পাগলা বাজার থেকে আদর্শলিপি কিনে আনিয়েছেন। কাজির পাগলা বাজারের সঙ্গে আছে বিরাট হাইস্কুল, কাজির পাগলা এ টি ইন্সটিটিউশন। ছাত্রছাত্রীদের সুবিধার জন্য সেই বাজারে বইখাতার দোকান হয়েছে বিস্তর।

কিন্তু পড়ায় তেমন মনোযোগ বাদলার নেই। অ আ-টাই শেষ করতে পারছে না দশ-বারো দিনে। পড়তে বসে বইয়ের চেয়ে অন্যদিকে মনোযোগ বেশি। আচমকা অদ্ভুত অদ্ভুত প্রশ্ন করে। আজ যেমন করল, বুজি, আপনেগো বাড়ির ঘরগুনি জাহাজের লাহান ক্যা?

বাদলার এই বুজি ডাকটা শুনলে গা জ্বলে দেলোয়ারার। মা-বাপে যাকে বুজি ডাকে ছেলেও তাকে ওই একই ডাক কেমন করে ডাকে!

অন্যদিন হলে এই নিয়ে কথা বলতেন দেলোয়ারা। আজ বললেন না। আজ মনটা বুঝি একটু অন্যরকম হয়ে আছে তাঁর। কদিন আগে ঢাকা থেকে ফিরলেন। মেয়ের শুনে এলেন ডায়াবেটিস ধরা পড়েছে। মাসে মাসে ডায়াবেটিক হাসপাতালে যেতে হচ্ছে। সকাল বিকাল নিয়ম করে হাঁটতে হচ্ছে বাড়ির ছাদে। হাসপাতাল থেকে কোন খাওয়া কতটুকু খেতে হবে তার একটা চার্ট করে দিয়েছে। এই এতটুকু ভাত, এইটুকু সবজি, মাছমাংসের পরিমাণ শিশুরা যতটুকু খেতে পারে তার চেয়েও কম। মিষ্টি জাতীয় খাবার হারাম। আহা, এই খেয়ে মানুষ বাঁচতে পারে! ফেরার পর থেকে যখন তখন মেয়েটার কথা খুব মনে হয়। মনে হলেই মনটা যায় উদাস হয়ে। ঢাকায় গেলেন ছাড়াবাড়িটা এনামুলকে রেজিস্ট্রি করে দেওয়ার জন্য। বোনপো মসজিদ করবে, কত আনন্দের কথা, গিয়ে শুনলেন মেয়ের হয়েছে ডায়াবেটিস। কেমন লাগে! আনন্দ আর বেদনা কেন যে পাশাপাশিই থাকে! কেন যে একসঙ্গেই আসে!

আজ মেয়ের কারণেই মন উদাস দেলোয়ারার। এজন্যই বাদলার কথা গায়ে লাগল না তার। আনমনা গলায় বললেন, পড়তে বইয়া খালি আবল তাবল কথাঐ মনে অয় তর?

বুজির গলা নরম দেখে সাহস বেড়ে গেল বাদলার। কেননা একখানা হাসি হেসে বলল, হ, পড়তে বইলে খালি এহেকটা কথা মনে অয়। বইয়ের মিহি চাইয়া থাকলে মনে অয়।

দেলোয়ারা কথা বললেন না। ভুলে গেলেন খানিক আগেই বাদলাকে তিনি বলেছিলেন, পড়চ না ক্যা?

বাদলা বলল, ও বুজি, কইলেন না?

কাচ মোছা অনেকক্ষণ আগেই শেষ হয়েছে। চশমা এখনও হাতেই ধরা, পরা হয়নি। এবার পরলেন দেলোয়ারা। সঙ্গে সঙ্গে চেহারা অন্যরকম হয়ে গেল তার। কীরকম গম্ভীর, ভারিক্কি ধরনের।

চশমা পরলে যে চেহারা একরকম বুজির, না পরলে আরেক রকম এই ব্যাপারটা অনেকদিন ধরেই খেয়াল করছে বাদলা, কিন্তু এই নিয়ে জিজ্ঞাসা করা হয়নি কিছু। মনে মনে বাদলা এখন ভেবে রাখল বুজি যদি আজ পড়া নিয়ে তেমন কিছু না বলেন তা হলে এই প্রশ্নটাও সে আজ করবে। তারপরও যদি বিরক্ত বুজি না হন তা হলে মনের ভিতর অনেকদিন ধরে জমে থাকা ইচ্ছাটার কথাও সাহস করে বলে ফেলবে। যদি রাজি বুজি কোনওরকমে হয়ে যান তা হলে তো কথাই নাই। খায়েসটা পূরণ হবে। আর যদি না-ও। হন তাতেও ক্ষতি নাই বাদলার। এইসব কথাবার্তা বলতে বলতে রাত হয়ে যাবে। মা এসে ডাকবে ভাত খেতে। ভাত খেতে ডাকা মানে আজ রাতের মতো পড়া শেষ। সেটাও তো একরকমের লাভ বাদলার!

দেলোয়ারা বললেন, বই ভোলা রাইককা অন্য প্যাচাইল পাড়ন যায় না।

বাদলা বলল, আমি তো প্যাচাইল পাডুম না। প্যাচাইল পাড়বেন আপনে আর হুনুম আমি।

তাও বই বন্ধ করন লাগে।

করুম?

হ করবি না!

যেন খুবই আনন্দের কাজ করছে এমন ভঙ্গিতে আদর্শলিপি বন্ধ করল বাদলা। হাসিমুখে তাকাল দেলোয়ারার মুখের দিকে। ইবার কন।

দেলোয়ারা বললেন, আমার বাপে আছিল জাহাজের সারেঙ। জাহাজখান আছিল বিটিশ কোম্পানির। জাহাজের নাম বেলফাস্ট। বাবার জাহাজে আমি একবার গেছিলাম। জাহাজ লইয়া বাবায় আইছিল নারাইনগইঞ্জে। বুজি আমি আর মায় গেছিলাম জাহাজ দেকতে। আলী আহম্মদ দাদায় আইয়া আমগো লইয়া গেছিল। গেলাম ইস্টিমারে কইরা। বাইষ্যাকাল। আছিল। বাড়িত থিকা কেরায়নাও কইরা গেলাম দিগলি। দিগলি থিকা উটলাম ইস্টিমারে। বিয়ালে গিয়া নামলাম নারইনগইঞ্জ। নাইম্মা দেহি বাবায় খাড়ই বইছে। লইয়া গেল হের জাহাজে। কী কমু তরে, কী সোন্দর যে জাহাজখান! কেফিন (কেবিন) আছে, ড্যাক (ডেক) আছে, ছাদ আছে।

কেফিন কথাটা শুনে বাদলা খুবই আমোদ পেল। এই ঘরেও তো কেফিন আছে!

হ। ঘরের ছয়আনি জাগা পাডাতন কইরা, ওডনের সিঁড়ি দিয়া এই ঘরে যেমুন কেফিন বানান অইছে ঠিক এমুন কেফিন আছিল ওই জাহাজে। আসলে ঘরখান বাবায় বানাইছিল হের জাহাজের মতন কইরাঐ। দেহচ না এই ঘরের ভিতরে আসলে চাইরখান ঘর। একটা ঘরের ভিতরেঐ টিনের বেড়া দিয়া দিয়া চাইরখান ঘর বানান অইছে। মাঝখানে মাঝখানে আবার দুয়ার। উত্তরমিহি, তরা যেহেনে থাকচ বাবায় ওইডার নাম দিছিল বারিন্দা, আমরা যেহেনে বইয়া রইছি এইডা হইল খাডাল (খাটাল) আর পুবমিহি, যেহেনে বইয়া আমরা ভাত খাই ওইডা হইল খোপ। জাহাজের সারেঙ যেই কেফিনে থাকে, হেই কেফিনে বছরের পর বছর থাকতে থাকতে বাবার অব্বাস অইয়া গেছিল। এরলেইগা এই ঘরেও কেফিন বানাইছে। বাইত্তে আইলে কেফিনে না হুইলে তার ঘুম আইতো না। আসল কথা জাহাজ ছাড়া অন্যকোনও জাগায় হুইলে তার ঘুম আইতো না। এর লেইগা ঘরডারে জাহাজের লাহান কইরা বানাইছিল। এই ঘরে আইয়া হানলে তার মনে অইতো জাহাজেই হানছে। কেফিনে ঘুমাইয়া থাকলে মনে অইতো জাহাজের কেফিনে ঘুমাইয়া রইছে। একদিন হুনলাম মা’রে কইতাছে, এই ঘরে বইয়া থাকলে, হুইয়া থাকলে তার বলে মনে অয় ঘরের নীচে গাঙ্গের পানি। গাঙ্গের পানির ঢেউয়ে জাহাজ যেমুন দোলে বাবায় বলে এই ঘরেও হেই দুলুনি উদিস পায়।

একটু থামলেন দেলোয়ারা। তারপর বললেন, বাবার দেহাদেহি আমার দুই চাচায়ও একপদের ঘর উডাইলো বাইত্তে। তারাও তো জাহাজের সারেঙ কেরানি আছিল, তাগো সবাবও বাবার লাহানঐ। ঘরের তলে গাঙ্গের ঢেউয়ের উদিস না পাইলে ঘুম আহে না। এইবার বুজছচ আমাগো বাড়ির ঘরগুনি জাহাজের লাহান ক্যা?

বাদলা সরল মুখ করে হাসল। হ বুজি, বুজছি।

হাসির ফলে হারিকেনের আলোর একটা রেখা গিয়ে পড়ল বাদলার ডান পাশের গজাতে। পলকের জন্য ভারী সুন্দর দেখাল ছেলেটিকে। কালো মিষ্টি মুখটি যেন আরও মিষ্টি হয়ে গেল। মোটা কাঁচের চশমার ভিতর থেকে দৃশ্যটি দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলেন দেলোয়ারা। বাদলার কথা যেন শুনতেই পেলেন না।

বাদলা তখন মনে মনে ভাবছে এবার দ্বিতীয় প্রশ্নটা বুজিকে সে করবে।

দেলোয়ারা বললেন, বই খোল।

বাদলা একটু চমকাল। কী করুম?

বই খোলতে কইছি। গল্পগুজব শেষ। অহন আবার পড়া। তাড়াতাড়ি বই খোল।

শরীর বাইং মাছের (বাইন মাছ) মতো একটা মোচড় দিল বাদলা। মুখের মজাদার ভঙ্গি করে বলল, আইজ আর না পড়লে অয় না বুজি?

ক্যা? অসুবিদা কী তর?

পড়তে ভাল্লাগতেছে না।

রোজঐত্তো ভাল্লাগে না। না ভাল্লাগলে লেকাপড়া অইবো না। তর পিছে বেগার খাইট্টা আমার লাব কী?

বাদলা আবার মিষ্টি করে হাসল। না বুজি, লেকাপড়া আমার অইবো। আপনে দেইনে কাইল থিকা কেমুন পড়াডা আমি পড়ি। হাজ থিকা রাইত দোফর তরি পড়ুম।

এবার দেলোয়ারাও হাসলেন। আমি তর লেইগা অতরাইত তরি বইয়া থাকুম না। আমি রাইত জাগতে পারি না। আমার ঘুম আহে।

আপনের জাগনের কাম নাই।

তয় তরে পড়াইবো কে?

আপনে আমারে পড়া দেহাই দিয়া ঘুমাইয়া যাইবেন। আমি একলা একলা পড়ুম।

আইচ্ছা, দেহুমনে কেমুন পড়া তুই পড়চ।

বাদলা কথা বলল না। রহস্য করে হাসল।

দেলোয়ারা বললেন, অহন মতলবখান কী? কী করতে চাচ?

আর একখান কথা জিগামু।

জিগা।

চোক্কে চশমা দিলে আপনের চেহারা থাকে একরকম আর চশমা না দিলে থাকে আরেক রকম। আপনের চেহারাডা এমুন ক্যা?

দেলোয়ারা হাসলেন। ইস তুই যে কী বানকাউর অইছচ! কেমুন কেমুন কথা যে জিগাচ! এই ছেমড়া, এই যে তুই অহন শাটপেন ফিন্দা আমার সামনে বইয়া রইছচ, তরে যেমুন দেহা যাইতাছে, শাটপেন যদি ফিন্দা তুই না থাকতি, তুই যুদি থাকতি লেংটা তাইলে কি তরে এমুন দেহা যাইতো না কি অন্যরকম দেহা যাইতো?

অন্যরকম দেহা যাইতো। লেংটা মানুষ আর শাটপেন ফিন্দা মানুষ এক অইলোনি?

আমার চশমাড়াও এমুন। চশমা অইলো চোক্কের শাটপেন। দিলে একরকম না দিলে আরেকরকম।

শুনে মজা পেল বাদলা। হি হি করে একটু হাসল। তারপর বহুদিনকার খায়েশের কথাটা সাহস করে বলে ফেলল। ও বুজি, আপনের চশমাড়া আমারে ইট্ট দিবেন।

দেলোয়ারা অবাক হলেন। ক্যা? চশমা দিয়া তুই কী করবি?

আমি ইট্টু চোক্কে লাগাইয়া দেকতাম আমারে কেমুন দেহা যায়। আর চশমার আয়নার ভিতরে থিকা ঘরদুয়ার মানুষজন কেমুন দেহা যায়।

না চশমা তরে দেওন যাইবো না।

একথা শুনে দমে যাওয়ার কথা বাদলার কিন্তু সে দমল না। সে যেন জানতই এভাবেই বলবেন দেলোয়ারা। যেন পরের কথাটা বলবার জন্য তৈরিই ছিল। সেভাবেই বলল, আমি বহুত সাবদানে লাগামু। ভাঙবো না। একবার লাগাইয়া আপনেরে দিয়া দিমু।

দেলোয়ারা বললেন, না হের লেইগা না রে ছেমড়া।

তয়?

চশমার আয়নায় পাওয়ার আছে। ছোড জিনিস বড় দেহা যায়। চোক্কের জুতি কইম্যা আইলে, ছোড জিনিস চোকে যহন মাইনষে দেকতে পারে না তহন চকু পরীক্ষা কইরা ডাক্তাররা চশমা লাগাইতে দেয়। যাগো চকু ভাল, পাওয়রআলা চশমা লাগাইলে তাগো ভাল চকু খারাপ অইয়া যায়। তুই পোলাপান মানুষ, তর চক্ক ভাল। আমার চশমা লাগাইলে চকু খারাপ অইয়া যাইবো।

এসব কথায় বাদলার মন ভরল না। ভাবল চশমাটা বুজি তাকে লাগাতে দিবে না বলে এসব বলছেন। প্রথমে মুখটা একটু কালো করল সে, তারপর অনুনয়ের ভঙ্গি করল। না বুজি, চকু আমার খারাপ অইবো না। একবার লাগাইয়াঐ লগে লগে খুইল্লা হালামু। এত তাড়াতাড়ি চক্কু নষ্ট অইবো কেমতে? আপনে ইট্টু দেন।

বাদলার অনুনয়ের ভঙ্গিটা মায়াবী। দেখে মনটা নরম হল দেলোয়ারার। তবু নরম ভাব তিনি দেখালেন না। রাগী ভাব বজায় রেখে বললেন, তুই বহুত ঘেংটি পারইন্যা পোলা। যা আলমারি থিকা আয়নাডা লইয়ায়।

বাদলা অবাক হল। এত রাইত্রে আয়নাডা কী করবেন আপনে?

আমি কিছু করুম না। করবি তুই। চশমা লাগাইয়া আয়নার মিহি না চাইলে বুজবি কেমতে কেমুন দেহা যাইতাছে তরে!

একথা শুনে আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেল বাদলা। লাফ দিয়ে পালঙ্ক থেকে নামল। আলমারি খুলে দেলোয়ারার ব্যবহারের হাতআয়নাটা নিয়ে এল।

দেলোয়ারা চোখ থেকে চশমা খুললেন। হাসিহাসি মুখে আঁচলে কাঁচ মুছে বাদলার দিকে তাকালেন। এই ছেমড়া, মোক উডা। চা আমার মিহি।

বাদলা মুখ তুলে তাকাল। দুই হাতে নিজের চশমা বাদলার চোখে পরিয়ে দিলেন। দেলোয়ারা। লগে লগে এতদিনকার চেনা চেহারা অচেনা হয়ে গেল বাদলার। বয়স বহুগুণ বেড়ে গেল ওইটুকু ছেলের। যদিও চশমা ছাড়া চোখে প্রায় কিছুই দেখতে পান না দেলোয়ারা, তবু অপলক চোখে হাসিহাসি মুখ করে বাদলার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

বাদলার কচি মুখ তখন গভীর আনন্দে ফেটে পড়ছে। চশমার ভিতর তার চোখ দেখাচ্ছে অলৌকিক চোখের মতো। হি হি করে হাসছে সে। হাসতে হাসতেই দেলোয়ারার হাতআয়না মুখের সামনে তুলে ধরল, নিজের চশমা পরা চেহারা দেখতে চাইল। প্রথমে ভেবেছিল পালঙ্কের ওপর যেখানে ছিল তার আদর্শলিপি ঠিক সেই জায়গায় আয়না রেখে মুখ নিচু করে তাকাবে আয়নার দিকে। ওই করতে গেলে চশমা খুলে পড়বে চোখ থেকে। এমনিতেই ঢলঢল করছে জিনিসটা। মাথা উঁচু করে কানের সঙ্গে আটকে রাখতে হচ্ছে। যদি কোনওরকমে চোখ থেকে একবার পড়ে যায়, চশমার ক্ষতি হোক বা না হোক দেলোয়ারা সাবধান হয়ে যাবেন, জান দিয়ে ফেললেও দ্বিতীয়বার আর চশমা পরতে দেবেন না বাদলাকে। এই ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে বাদলা হাতআয়না তুলে ধরল তার চোখের সামনে। আয়নার ভিতর তাকিয়ে দেখতে পেল তার এতদিনকার চেনা মুখটা আর তার নিজের নাই, অন্যের হয়ে গেছে। এই মুখ বাদলা চেনে না, তার দশ বছরের জীবনে এরকম মুখ সে। আর কারও দেখেনি।

কিন্তু মুখে বাদলার হি হি করা হাসিটা আছেই।

বারান্দার চৌকি থেকে ছেলের এই হাসি শুনতে পেল রাবি। মতলেব আজ কামলা দিতে গিয়েছিল কুমারভোগের পিয়ার খাঁ-র বাড়িতে। বাড়ির পুবের ভিটির চৌচালা ঘরের একদিককার টিনের বেড়ার দুইখানা টিন জং ধরে একেবারেই খয়ে গেছে। আঙুল দিয়ে। খোঁচা দিলে কাগজের মতো ফুটা হয়ে যায়, সেই ফুটার মুখ দুইআঙুলে চেপে ধরে আস্তে করে টানলেই কাগজের মতোই প্যার পার করে ছিঁড়ে যাবে টিন। তার ওপর ঠিক ওদিককারই একটা খামে লেগেছে উইপোকা। খামটাও বদলাতে হবে। সীতারামপুরের নন্দ মিস্ত্রিকে নেওয়া হয়েছে কাজে। তার সঙ্গে ধরাধরির জন্য একজন কামলা লাগে। দেশগ্রামে কামলা আজকাল পাওয়াই যায় না। সবাই লেগে গেছে সড়কের কাজে, আলী আমজাদের মাটিয়াল হয়েছে। মতলেবের শরীরস্বাস্থ্য জুতের না। ভাঙাচোরা শরীর কাকতাড়ুয়ার মতো। হাঁটাচলা মেয়েলি ঢঙের। ভারী কাজ বলতে গেলে করতেই পারে না। দুই-চার গ্রামের গৃহস্থবাড়িতে কামলা মতলেব ঠিকই দেয়, তবে সেসব তেমন কোনও কাজ না। অনেকটা ফুটফরমাস খাটা। এজন্য কামলা হিসাবে কদর মতলেবের একেবারেই নাই। না পারতিকে লোকে তাকে ডাকে, যখন কাউকে না পায় তখন। মতলা আছে ছাই ফেলতে ভাঙা কুলার মতো।

পিয়ার খাঁ-র ছেলেরাও কাউকে না পেয়ে মতলাকে ডেকেছিল। কাজ যা করার নন্দ মিস্ত্রিই করেছে, মতলা শুধু এটা ওটা এগিয়ে দিয়েছে, ওই ফুটফরমাস খাটা আর কী। তাতেই রোজ হচ্ছে সত্তর টাকা। দুপুরবেলা ভরপেট ভাত। সঙ্গে ছিল নলা মাছের তরকারি। এত আরামের কাজ করেও সন্ধ্যাবেলা মতলা বাড়ি ফিরেছে পুঁকতে ধুঁকতে। যেন অতিরিক্ত পরিশ্রমে একেবারেই ভেঙে পড়েছে। হাঁটাচলার শক্তি নাই। বাড়ি ফিরেই বারান্দার চৌকিতে উঠে শুয়ে পড়েছে। রাবির কাজ ছিল আজ খাইগো বাড়ির ওদিককার বেপারি বাড়িতে। ধান বানার কাজ। সারাদিন ধান বেনে আড়াই-তিন সেরের মতো চাল পেয়েছে। দুপুরের ভাতও দেয়নি গিরস্তে। তবু শরীর ঠিক আছে তার। বিকালবেলা আঁচলে চাউল নিয়ে বাড়িতে এসে নিমতলার চুলায় ভাততরকারি বেঁধেছে, ফাঁকে ফাঁকে ছেলে খেয়ে গেছে বুকের দুধ, তবু ক্লান্ত হয়নি রাবি। রান্নাবান্না শেষ করে অবেলায় খেয়ে নিয়েছে অল্প একটু ভাত। এটা আসলে দুপুরের খাওয়া। তারপর সন্ধ্যাবেলা ঘরের কুপিবাতি জ্বেলে, ধূপ ধুমার কাজ সেরে এসে লেগেছে স্বামীর সেবায়। মতলা সটান শুয়ে ঘুমাচ্ছে আর রাবি তার হাত-পা টিপে দিচ্ছে। এই করতে করতে নিজেরও ঝিমুনি এসেছিল, তখন শোনে খাটালের দিকে হি হি করে হাসছে বাদলা।

রাবির ঝিমুনি কেটে গেছে।

কী ব্যাপার, বাদলা বসল পড়তে, এখন দেখি মহা আনন্দে হাসছে।

স্বামীর হাত-পা টিপা ফেলে রাবি এসে দাঁড়িয়েছে খাটাল আর বারান্দার মাঝখানকার দরজায়। দাঁড়িয়ে দেখে দেলোয়ারা বুজির চশমা পরে তার ছেলে অচেনা মানুষ হয়ে গেছে। চোখের সামনে আয়না ধরে নিজেকে দেখছে আর তার সামনে বসে তাকে দেখছেন। দেলোয়ারা বুজি। এই দৃশ্য দেখে রাবিও খুব মজা পেল, নিজের অজান্তে ঠোঁটে তার ফুটে উঠল গভীর পরিতৃপ্তির হাসি।

মা’কে বাদলা দেখতে পেল না। চশমা পরার আনন্দে বিভোর হয়ে আছে। একসময়। আয়নায় নিজেকে দেখা শেষ করে কী মনে করে দক্ষিণ দিককার জানালার দিকে তাকিয়েছে। শীতসন্ধ্যা বসে যাওয়ার পরও জানালাটা আজ বন্ধ করা হয়নি। চশমা পরা চোখে সেই খোলা জানালার দিকে তাকাল বাদলা, তাকিয়ে আপাদমস্তক কেঁপে উঠল। শিরদাঁড়া বেয়ে লম্বা একটা ক্যারা যেন নেমে যেতে লাগল। এ কী, জানালার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে কারা? পাশাপাশি দুইখান মুখ। দেখতে মানুষের মুখের মতো ঠিকই কিন্তু মানুষের মুখের তুলনায় পাঁচ-দশগুণ বড়। চোখগুলি একেকজনের গোরুর চোখের মতো, নাকগুলি ধুন্দুলের মতো মোটা, কানগুলি ধানঝাড়ার কুলার মতো। একজনের মুখে দাড়ি গোঁফ, আরেকজনের মাথার চুল লম্বা। কিন্তু চুলদাড়ি মানুষের চুলদাড়ির মতো না। মিয়াবাড়ির পুকুরে বছরভর যে কচুরিগুলি আছে সেই কচুরির ছোবার মতো ঝিমকালো, লম্বা মোটা চুলদাড়ি। তা হলে কি ঠাকুরবাড়ির বাঁশঝাড়ে যে দুইজন থাকেন তারা দুইজন আজ দূরে কোথাও না গিয়ে এই মেন্দাবাড়িতেই চরতে এসেছেন? বাগানের দিককার জানালা খোলা পেয়ে একত্রে দুইজন উঁকি মেরেছেন ঘরের ভিতর! মানুষের সংসার দেখছেন!

বাদলার দম বন্ধ হয়ে এল! চোখের চশমার কথা ভুলে গেল সে।

ঠিক তখনই জানালার বাইরে দাঁড়ানো দুইজনের একজন করুণ গলায় ডাকল, দেলরা। বুজি, ও দেলরা বুজি, দুয়ারডা ইট্টু খোলেন।

এই গলা শুনে ভয়টা বাদলার পলকেই কাটল। শিরদাঁড়া বেয়ে নামতে থাকা লম্বা মতো ক্যারা চট করেই যেন কোথায় উধাও হয়ে গেল। বাদলা বুঝল, না তেনারা ঠাকুরবাড়ির বাঁশঝাড় থেকে আসেননি! তেনারা মানুষ! চোখে চশমা আছে বলে মানুষের মুখ মানুষের মতো দেখতে পায়নি বাদলা, দেখেছে তেনাদের মুখের মতো।

আর চোখে চশমা নেই বলে দেলোয়ারার হয়েছে আরেক অবস্থা। চশমা ছাড়া চোখে প্রায় কিছুই দেখতে পান না তিনি। সবকিছুই অপরিষ্কার, সব কিছুর উপরই ফিনফিনা কুয়াশার আবরণ। চেনা মানুষের মুখ অচেনা, আবছা হয়ে যায়। যেন বাস্তবে দেখছেন না। তিনি, যেন দেখছেন স্বপ্নে কল্পনায়।

এখনও সেই অবস্থাই হয়েছে। জানালার বাইরে মানুষের গলা শুনে সেদিকে তিনি। তাকিয়েছেন ঠিকই, আবছা মতন দুইজন মানুষের মুখ দেখতেও পাচ্ছেন কিন্তু চিনতে পারছেন না মানুষ দুইজন কারা?

গলা কেমন পরিচিত! যেন বহুবার এই গলা শুনেছেন দেলোয়ারা। স্বভাব মতোই ধীর শান্ত গলায় তিনি তারপর জিজ্ঞাসা করলেন, কেডা?

জবাব আসার আগেই বারান্দা আর খাটালের মাঝখানকার দরজায় দাঁড়ানো রাবি বিরক্তির গলায় বলল, আপনে চিনতে পারেন নাই বুজি? গাছি আর গাইচ্ছানি।

ও আইচ্ছা। দুয়ার খুইলা দে রাবি।

বাদলার চোখের দিকে হাত বাড়ালেন দেলোয়ারা। দে রে ছেমড়া, চশমা দে।

বাদলার খুলতে হল না, দেলোয়ারাই চশমা খুলে নিলেন। আঁচলে চট করে দুইখান। মোছা দিয়ে চোখে পরলেন। বাদলা দেখতে পেল এই কিছুক্ষণ আগের দেলোয়ারা বুজি আর সেই বুজি নাই, অন্য মানুষ হয়ে গেছেন। চশমার কারবারটাই মজার। ভোজবাজির মতো। চোখে থাকলে একরকম না থাকলে আরেকরকম। সে নিজেই তো আজ চশমার গুণে অন্যরকম হয়ে গিয়েছিল। দবির হামিদাকে দেখেছে তেনাদের মতো। কালীসন্ধ্যায় জোড় বেঁধে যেন গ্রাম দেখতে বেরিয়েছিল। চশমা খুলতেই মানুষ হয়ে গেছে।

রাবি ততক্ষণে দরজা খুলে দিয়েছে, দবির-হামিদা ঘরে ঢুকেছে। দু’জনেরই মুখে। উৎকণ্ঠা। শরীরে (চেপে বসা শীতভাব যেন মুখের চামড়া টেনে ভিতর দিকে নিয়ে যাচ্ছে। ফলে চোখ মুখ নাক ঠোঁট যেন জায়গা মতো নাই তাদের, যেন এদিক ওদিক হয়ে গেছে।

ঘরে ঢুকেই দিশাহারা ভঙ্গিতে চারদিক তাকাতে লাগল হামিদা। সদ্য জন্ম-দেওয়া বাছুর চোখের আড়াল হয়ে গেলে যেমন দৃষ্টি হয় গাইগোরুর, হামিদার চোখের দৃষ্টি তেমন, চঞ্চলতা তেমন। ব্যাপারটা দেলোয়ারা বাদলা খেয়াল করল না, করল রাবি, করে মুখের বিরক্তভাব আরও বেড়ে গেল তার। হামিদার দিকে তাকিয়ে রাগী গলায় বলল, যেই চিন্তা কইরা এই বাইত্তে আইছো হেই চিন্তা বাদ দেও।

কথাটা বুঝতে পারলেন না দেলোয়ারা। রাবির মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ওই ছেমড়ি, কী কচ তুই? কী চিন্তা কইরা আইছে?

আপনে বোজেন নাই বুজি?

না।

গাছি আর গাইচ্ছানি তো আইছে মাইয়া বিচড়াইতে!

তারপরও যেন ব্যাপারটা পুরাপুরি বুঝতে পারলেন না দেলোয়ারা। অবুঝের মতো মুখ। করে রাবির দিকে তাকিয়ে রইলেন।

দবির-হামিদার সঙ্গে কথা বলবার সময় রাবির চেহারা একরকম, রাগ বিরক্তিতে ভরা, দেলোয়ারার সঙ্গে কথা বলার সময় সেই রাগ বিরক্তির চিহ্নও থাকে না, একেবারেই অন্যরকম, বিনয়ী হাসিহাসিভাব মুখে। সেই মুখে দেলোয়ারাকে রাবি বলল, আপনে হোনেন নাই বুজি গাছির মাইয়ায় আইজ কী কাম করছে?

দেলোয়ারা নিরীহ গলায় বললেন, হুনুম না ক্যা, হুনছি।

তারবাদে মাইয়া তো গাছির বাইত্তে যায় নাই।

শুনে দেলোয়ারা চমকালেন। তয় কই গেছে?

হেইডা কেঐ কইতে পারে না।

কচ কী? সব্বনাইশ্যা কথা। রাইত বিরাইত অইয়া গেছে, কই গেছে গা ডাঙ্গর মাইয়া!

দেলোয়ারার কথায় দবির বুঝে গেল এই বাড়িতে আসেনি তার মেয়ে, এই বাড়িতে সে নাই। হামিদাও বুঝল, বুঝেও অবুঝের মতো কথা বলল। আমি তো মনে করছি এই বাইত্তে আইয়া পলাই রইছে আমার মাইয়ায়। ও বুজি, যুদি পলাই থাকে, ডাক দেন অরে। আমরা অরে কিছু কমু না।

একথা শুনে রেগে যাওয়ার কথা দেলোয়ারার। কী, আমার কথা তুই বিশ্বাস করতাছচ? আমি তর লগে মিছাকথা কই? তর মাইয়ায় আমার কোনহানকার ইস্টিকুডুম যে তারে আমি আমার ঘরে পলাই থাকতে দিমু? আবার হেই মাইয়ার লেইগা আমি মিছাকথা কমু? রাইত বিরাইত অইয়া গেছে অহনও বাইত্তে যায় নাই দেইক্কা যেই চিন্তা আমি করছি, হেই চিন্তার পর এই কথা তর মনে অইল কেমতে?

কিন্তু দেলোয়ারা কিছু বললেন না। বুঝদার মানুষ, বুঝলেন মেয়ের চিন্তায় দিশাহারা হয়ে আছে বলে কথাবার্তার ঠিক নাই হামিদার। হামিদার জায়গায় যে-কোনও মা’ই এমন করত। আজ যদি তাঁর মেয়ের ক্ষেত্রে এমন কিছু ঘটত তিনি কি হামিদার মতোই আচরণ করতেন না!

তবে হামিদার কথাটা ধরল রাবি। দবির- হামিদাকে দেখেই বিরক্ত হয়েছে সে। যে মা বাবার মেয়ে এমন কাজ করতে পারে তাদের ওপর বিরক্ত না হয় কোন লোকে! ঘটনাটা রাবি দুপুরেবেলাই শুনেছিল। এই সমস্ত কথা পলকে ছড়িয়ে যায় সারাগ্রামে। বেপারি বাড়ির পুবের শরিকের রান্নাঘরের ঢেকিতে ধান বানছিল রাবি। তখনই যেন কে এসে ঘটনাটা বাড়িতে বলেছে। পলকে সেই কথা বাড়ির বউঝিদের মধ্যে ছড়িয়ে গেছে, রান্নাঘরে রাবির কানে এসেছে। তখন থেকেই নূরজাহান আর তার মা-বাপের উপর রেগে আছে রাবি। এত্তবড় সাহস অতডু ছেমড়ির! মাওলানা হুজুরের লাহান কামেলদার মাইনষের মাকে ছ্যাপ ছিড়াইয়া দেয়! এই মাইয়া জন্ম দিছে কেমুন মা-বাপে!

এখন হাতের কাছে দবির-হামিদাকে পেয়ে বুকের ভিতর চেপে থাকা রাগ ঝেড়ে দিতে চাইল রাবি। হামিদার দিকে তাকিয়ে আচমকা বলল, এই বাইত্তে আইয়া পলাই থাকনের সাহস তোমার মাইয়ার অইতো না। অইলেও অন্য শরিকের ঘরে অইতো, এই ঘরে অইতো না। দেলরা বুজি কিছু না কইলেও আমি অরে পলাই থাকনের জাগা দিতাম না। চুলে ধইরা বাইর কইরা দিতাম। ইতর মাইয়া, কোন সাহসে হুজুরের মোকে ছ্যাপ ছিড়াইয়া দিল? কাইস্যা অর কোনহানকার লাং অইছে যে তার লেইগা হুজুররে অপমান করবো?

লাং কথাটা শুনে বিরক্ত হলেন দেলোয়ারা। গম্ভীর গলায় ধমক দিলেন রাবিকে। এই ছেমড়ি, বকাবাজি করি না।

দেলোয়ারার ধমকে দমল রাবি কিন্তু সেই ভাব দবির-হামিদাকে বুঝতে দিল না। আগের মতোই তেজি গলায় বলল, বকাবাজি তো আপনেরঐ করনের কথা বুজি। আপনে করতাছেন না দেইক্কা আমি করতাছি। এইডা কেমুন কথা অইলো? হুজুরের লাহান কামেলদার মাইনষের মোকে ছ্যাপ ছিড়াইয়া দেয়! পরানে ডর নাই অর? ও জানে না। হুজুরে বড়দোয়া (বদদোয়া) দিলে ছারখার অইয়া যাইবো ও। আল্লার খাসবান্দা হ্যায়, মোক দিয়া যা কইবো তাঐ অইবো। বাদলার লেইগা তারে আমি কইছিলাম, অরে একখান ফুঁ দিয়া, দেন হুজুর, ও য্যান আর মোতালেইব্বাগো ওই মিহি কইতর দেকতে না যায়। হুজুরে যেদিন ফুঁ দিয়া দিল, হেদিন থিকা বাদলা আর কইতর দেকতে যায় না। ভাল অইয়া গেছে আমার পোলায়।

মায়ের কথা শুনে দেলোয়ারার পায়ের কাছে বসা বাদলা ফিক করে হাসল। না মা, মিছা কতা। ভাল আমি অই নাই। হুজুরের ফুয়ে আমার কোনও কাম অয় নাই। অহনও রোজঐ কইতর দেকতে যাই। মোতালেব কাকায় গাইল দেয় তাও যাই। হেদিন গর্দানডা ধইরা একখান ধাক্কা দিল, আরেকদিন একটা লাত্তি দিছে, তোমারে এই হগল কথা কই না। কইলে যে ওইমিহি তুমি আমারে যাইতে দিবা না! কইতর দেকতে আমার খুব মজা লাগে। কইতরের লেইগা লাত্তিগুতা খাওনও ভাল।

বাদলার কথা শুনে মুখ টিপে টিপে হাসতে লাগলেন দেলোয়ারা আর রাগে অপমানে রাবির গেল মুখ লাল হয়ে। চোখ পাকিয়ে ছেলের দিকে তাকাল সে। দাঁতে দাঁত চেপে বলল, চুপ কর গোলামের পো। মা’র মোকে মোকে কথা! রাক, কইতর দেহন তর আমি বাইর করতাছি।

মায়ের কথা একদমই পাত্তা দিল না বাদলা। সরল গলায় বলল, অহন আর প্যাচাইল পাইড়ো না মা। যাও, ভাত বাড়ো গিয়া। আমার খিদা লাগছে।

রাবি মুখ ঝামটে বলল, আমি বাড়তে পারুম না। যা, তর বাপরে ডাইক্কা উড়া, দুইজনে মিল্লা ভাত বাইড়া খা গা।

আদর্শলিপিটা বুকের কাছে ধরে পালঙ্ক থেকে নামল বাদলা। অতি নির্বিকার ভঙ্গিতে মায়ের পাশ দিয়ে বারান্দায় চলে গেল।

রাবির ভঙ্গিভাঙ্গি দেখে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল দবির-হামিদা। মাথা নিচু করেছিল। এখন প্রায় একসঙ্গেই মাথা তুলল দুইজনে। দেলোয়ারাকে দবির তার স্বভাবসুলভ বিনয়ী গলায় বলল, বুজি, আমার মাইয়ায় যে বিষম অন্যাই করছে হেইডা আমি বুজছি। বুইজ্জাঐ হুজুরের কাছে গেছিলাম।

দেলোয়ারা চমকালেন। কচ কী? মাওলানা সাবের বাইত্তে তরা গেছিলি?

হ। হেই বাইত থিকাঐ আপনেগো বাইত্তে আইলাম। মাওলানা সাব, আতাহার বেবাকতেঐ আছিল। আমরা মনে করছিলাম আতাহারে অর দলবল লইয়া মাইয়াডারে ধইরা নিয়া অগো বাইত্তে আটকাইয়া রাকছে। গিয়া দেকলাম, না। অমুন কাম অরা করে। নাই। বাপ পোলা দুইজনেঐ রাগ অইয়া রইছে, তারপরও মাওলানা সাবে আমারে কইলো, তর মাইয়ায় পোলাপান মানুষ, ভুল কইরা লাইছে, অরে আমি মাপ কইরা দিছি। যা।

মাওলানা সাহেব নূরজাহানকে মাফ করে দিয়েছেন শুনে বেশ বড় রকমের একটা ধাক্কা খেল রাবি। মুখে কোনও কথা জুটল না তার। ভুরু কুঁচকে দবিরের দিকে তাকিয়ে রইল।

তাকিয়ে দেলোয়ারাও ছিলেন। মুখ দেখে বোঝা যায় তিনি যেন বেশ আশ্বস্ত হয়েছেন। বললেন, তয় তো ভালঐ অইছে। আমিও বুজছি, কামডা তর মাইয়ায় বুইজ্জা করে নাই। আথকা কইরা হালাইছে। তারবাদে গেছে ডরাইয়া। ডরাইয়াঐ কোনও বাইত্তে গিয়া পলাই রইছে।

কথা শেষ করে দবির হামিদার দিকে তাকালেন দেলোয়ারা। চশমার ভিতর থেকে নতুন করে যেন দেখতে পেলেন দুইজন মানুষের মুখের উপর চেপে থাকা অসহায়ত্ব। দেখে আশ্চর্য এক মায়া হল তার। বললেন, মাওলানা সাবে যহন মাপ কইরা দিছে তাইলে আর ডর নাই। যা, দেক কোন বাইত্তে পলাই রইছে মাইয়ায়। বিচড়াইয়া বাইর কর। তয় সিয়ানা মাইয়া, শইল্লে হাত উডাইচ না অর। মায় মারতে মারতে পারে মাইয়ারে, বাপের কইলাম উচিত না মাইয়ার শইল্লে হাত উড়ান। দউবরা, তুই কইলাম মারিচ না মাইয়াডারে। ধমক ধামক দিয়া শাসন করিচ, মরিচ না।

দবির বুঝে গেল তার মেয়েটির জন্য ভাল রকমের একখান টান দেলোয়ারা বুজির আছে। আজকের আগে এভাবে ব্যাপারটা সে কখনও টের পায়নি। দেলোয়ারার প্রতি ভারী। একটা কৃতজ্ঞতা বোধ জন্মাল। এই সুযোগে আসল কথাটাও বলে ফেলতে চাইল।

তার আগেই দেলোয়ারা বললেন, বয় তরা। খাড়ই রইলি ক্যা?

ঘরে ঢোকার পর থেকেই কেবিনের সিঁড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে দবির হামিদা। এখন দেলোয়ারা বুজি বসতে বলেছেন শুনে দুইজন প্রায় একসঙ্গেই বসল কেবিনের সিঁড়িতে, গা ঘেঁষাঘেঁষি করে। বসেই বড় করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল হামিদা। তারপর কনুই দিয়ে দবিরকে একটা গুতা দিল। কথা কও বুজিরে।

হামিদার দিকে তাকিয়ে দবির বলল, হ কই।

দেলোয়ারা শুনলেন তাদের কথা। নিজ থেকেই বললেন, কী কথা রে?

আড়চোখে খাটাল এবং বারান্দার মাঝখানকার দরজার দিকে তাকাল দবির। রাবি এখনও দাঁড়িয়ে আছে কি না দেখল। না নাই। কোন ফাঁকে বারান্দার পুবকোণে গিয়ে ঢুকেছে। জায়গাটার উত্তর পাশে টিনের বেড়া, তারপর দুই-আড়াই হাত পরিমাণ ফাঁকা জায়গা তারপর চৌকি। এই ফাঁকা জায়গাটুকুতেই খাবারের হাড়ি পাতিল, থাল বাসন রাবির। সেখানে কুপি জ্বেলে বসেছে সে। খুবই মনোযোগ দিয়ে স্বামী সন্তানের ভাত বাড়ছে। বাদলা আর মতলা আসনপিড়ি করে বসে আছে চৌকিতে। কুপির আলোয় দেখা যাচ্ছে মতলার মুখে দুনিয়ার বিরক্তি। যেন ঘুম থেকে ডেকে তুলে ভাত খেতে বসিয়ে খুবই অন্যায় করা হয়েছে তার সঙ্গে। আর যে রাবি খানিক আগে খুবই চটাং চটাং কথা বলছিল মাওলানা সাহেবের পক্ষ ধরে, ছেলের সঙ্গে রাগারাগি করছিল, এখন স্বামী সন্তানের জন্য ভাত বাড়তে বসে কুপির আলোয় সেই মানুষটিই যেন অন্য মানুষ হয়ে গেছে। একই মানুষের ভিতর কত রকমের চেহারা যে বসিয়ে রেখেছেন আল্লাহতালা! কখন যে কোন চেহারা বেরিয়ে আসে, মানুষ নিজেও তা জানে না।

রাবি কাছেপিঠে নাই এবং এদিকে তার মনও নাই দেখে দবির খুবই স্বস্তি বোধ করল। দেলোয়ারার দিকে তাকিয়ে হাত কচলাতে কচলাতে বলল, মাওলানা সাবরে তো আপনে ভাল কইরাঐ চিনেন বুজি। মোকে আমারে ঠিকঐ কইছে যে আমার মাইয়ারে হেয় মাপ কইরা দিছে, এই হগল হেয় মনে রাকবো না, আমার মাইয়ার কোনও ক্ষতি করবো না, তয় আমি কইলাম তার কথা বিশ্বাস করি নাই।

দেলোয়ারা অবাক হলেন। ক্যা, বিশ্বাস করচ নাই ক্যা?

তার মোকে এক অন্তরে আরেক। বেবাকঐ হেয় মনে রাকবো। জাইত সাপের লাহান সুযোগ পাইলেঐ নূরজাহানরে হেয় খাইবো।

দেলোয়ারা চিন্তিত হলেন। হ, কথা মন্দ কচ নাই। মাওলানা অইলে কি অইবো, হেয় মানুষ ভাল না। তয় তর মাইয়াডারে সাবদানে রাকিচ। যহন তহন বাড়িত থিকা বাইর অইতে দিচ না, এমিহি ওমিহি যাইতে দিচ না।

দবির অসহায় গলায় বলল, হেইডা নাইলে না দিলাম, কিন্তু এই কইরা কি মাইয়াডারে আমি বাঁচাইতে পারুম! মাইয়ার ক্ষতি যুদি হেয় করতে চায় যেমতে অমতেঐ তো করতে পারবো! আর হের পোলায় তো আছে, আতাহার, বাপে যুদি খালি কয়, ধইরা লইয়া আয় ছেমড়িরে, রাইতে দলবল লইয়া আমার বাইত্তে আইয়া উটবো হেয়, দুয়ার ভাইঙ্গা আমার মাইয়ারে ধইরা লইয়া যাইবো। কেমতে আমি তাগো হাত থিকা আমার মাইয়ারে বাঁচামু?

দবিরের কথা শুনে চিন্তিত হয়ে গেলেন দেলোয়ারা। উদাস মুখে হারিকেনের আলোর দিকে তাকিয়ে রইলেন।

দেলোয়ারার এই উদাসীনতা খেয়াল করল হামিদা। এই ঘরে এসে ঢোকার পর থেকে তেমন কোনও কথা সে বলেনি। সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। দেলোয়ারা উদাস হয়ে সেই সুযোগ এনে দিল। দবিরকে ঠেলেঠুলে উঠে দাঁড়াল সে। দেলোয়ারার সামনে এল। আচমকা শিশুর ভঙ্গিতে দেলোয়ারার পা চেপে ধরল। কাতর করুণ গলায় বলল, আমার মাইয়াডারে আপনে বাঁচান বুজি। নিজের মাইয়া মনে কইরা বাঁচান। আপনে ছাড়া অরে কেঐ বাঁচাইতে পারবো না।

দেলোয়ারা বিব্রত হলেন। পা থেকে দুই হাতে হামিদার হাত ছাড়াতে ছাড়াতে বললেন, হায় হায় করচ কী! ছাড়, পাও ছাড়। আমি কেমতে তর মাইয়ারে বাঁচামু?

হামিদার দেখাদেখি দবিরও ততক্ষণে উঠে এসেছে। হামিদা কথা গুছিয়ে বলতে পারবে ভেবে বলল, হ বুজি, আপনে ছাড়া আমার মাইয়াডারে কেঐ বাঁচাইতে পারবো না। মানুষ দুইজনকে আশ্বস্ত করার জন্য দেলোয়ারা বললেন, তগো কথা আমি ঠিক মতন বোজতাছি না। বয় তরা, কথাডা আমারে বুজাইয়া ক। কেমতে তগো মাইয়ারে আমি বাঁচাইতে পারি!

দেলোয়ারার পা ছেড়ে হামিদা ততক্ষণে সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোন ফাঁকে চোখের কোল বেয়ে নেমেছে কান্না। মুখে আঁচল চেপে নিঃশব্দে কাঁদছে সে।

হামিদার দিকে তাকিয়ে গভীর কষ্টের এক কান্না দবিরেরও বুক ঠেলে উঠল। সেই কান্না দমিয়ে ধরা গলায় সে বলল, আপনেরা যা কইবেন মাওলানা সাবে অহন হেইডাঐ হোনবো। আপনের বইনপোয় মজজিদ করতাছে গেরামে, মাওলানা সাবে অইবো হেই মজজিদের ইমাম। আপনেগো মজজিদের ইমাম আপনেগো কথা না হুইন্না পারবো না। বুজি, মাওলানা সাবরে খবরদা আপনে এই বাইত্তে আনান। আনাইয়া হেরে কন, নূরজাহান না বুইজ্জা কামডা করছে, পোলাপান মানুষ, অরে হেয় মাপ কইরা দেউক, অর কোনও ক্ষতি য্যান হেয় না করে।

দেলোয়ারা চিন্তিত গলায় বললেন, তর কি মনে হয় আমি কইলেঐ মাওলানা সাবে বেবাক ভুইল্লা যাইবো? কোনও ক্ষতি তর মাইয়ার করবো না?

হ আমার মনে অয়। আপনেগো কথা হালানের ক্ষমতা তার নাই। অহন হেয় আপনেগো কাছে বান্দা (বাঁধা)।

হামিদার মতন করে দবিরও ধরতে চাইল দেলোয়ারার পা। কিন্তু পায়ের দিকে হাত বাড়িয়েই অতি সংকোচে সেই হাত আবার সরিয়েও নিল। দেলোয়ারা বুজির পা ধরা কি তার ঠিক হবে? সে পুরুষমানুষ, হোক পা, তবু তো মেয়েমানুষের শরীর। বুজি যদি বিরক্ত হন, সহজ মনে না নেন ব্যাপারটা তা হলে খারাপ হবে! হামিদা ধরেছিল ঠিক আছে, দবির তো ধরতে পারে না!

পা ধরার কাজটা মুখেই সারতে চাইল দবির। করুণ দুঃখী গলায় বলল, বুজি, আমি আপনের পায় ধরি বুজি, আল্লারস্তে আমার মাইয়াডারে আপনে বাঁচান। আপনেরও তো মাইয়া আছে, মাইয়ার দরদ আপনে বোজেন, নিজের মাইয়া মনে কইরা আমার মাইয়াডারে আপনে বাঁচান।

শেষদিকে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারল না দবির। হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল।

দবিরের কান্না যেন কানেই গেল না দেলোয়ারার। দবির হামিদাকে যেন আর দেখতেই পেলেন না তিনি। চশমার ভিতর থেকে তাঁর চোখের দৃষ্টি চলে গেল বহুকাল পিছনে ফেলে আসা এক জীবনে। এই ঘরে, এই পালঙ্কেই এক দুপুরে ঘটেছিল ঘটনা। তাঁর মেয়ে মাফিনের তখন সাত-আট মাস বয়স। মেয়েকে এই পালঙ্কে শুইয়ে রেখে দেলোয়ারা গিয়েছিলেন রান্নাঘরে। খরালিকাল। মা তখনও বেঁচে আছেন। বড়বোন আনোয়ারা স্বামী-সন্তান নিয়ে থাকেন ঢাকায়। জিন্দাবাহার থার্ডলেনের চিপাগলির ভিতর বাসা। বাড়িটার এদিক ওদিক কোথাও কোথাও ছাপরাঘর, কোথাও কোথাও পাকা মেঝে, চারদিকে দেওয়াল আর মাথার ওপর টিন এমন খুপরি খুপরি ঘর। পুবদিকে কুয়াতলা, তার পাশ দিয়ে এক চিলতে স্যাঁতস্যাঁতে পথ চলে গেছে পায়খানাঘরে। বহু পুরনাকালের ইটের গাঁথনি তোলা পায়খানা, মল ধারণের জায়গায় মাটির গামলা বসানো। সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে সেই পায়খানা ঘরে উঠলেই গায়ে কাঁটা দেয়। মলমূত্রের বীভৎস গন্ধে নাড়ি উলটে আসে, আর শরীর শক্ত হয়ে যায় পায়খানা ঘরের দেওয়াল জুড়ে স্থির হয়ে থাকা। তেলাপোকা দেখে। কী সাইজ একেকটার! কী রং!

পায়খানাঘরে যাওয়ার পথে কুয়াতলা থেকে আসা একখানা ড্রেন। বাড়ির পোলাপানরা। এই ড্রেনেই কর্ম সারে। হলুদ মলে থিকথিকা হয়ে থাকে ড্রেন। বাড়ির হাওয়ায় শুধুই মলের গন্ধ।

কত পদের ভাড়াটে সেই বাড়িতে! গেটের দিককার একটা ছাপরা ঘরে থাকে আমির, সে হচ্ছে চিনাবাদামঅলা, লায়ন সিনেমাহলের সামনে বসে চিনাবাদাম বেচে। কেরামতের বাপ রিকশাআলা, যতক্ষণ বাড়িতে থাকে বউর সঙ্গে শুধুই ঝগড়া, আজিজ হচ্ছে পৌরসভার ভূঁইমালি, ভিক্টোরিয়া পার্কে তার কাজ। ফল ফুলের গাছে পানি দেয়, খুরপি নিড়ানি চালিয়ে গাছের গোড়ার মাটি আলগা করে, আগাছা সাফ করে। বুড়া মতন একজন মিস্ত্রি আছে, নয়া বাজারে টুকরি মাথায় ঘুরে বেড়ায়। আর আছে নিয়াসা, প্রাণবন্ত এক যুবতী। ঢাকাইয়া কুট্টি। উর্দু-বাংলার মিশেল দেওয়া অদ্ভুত ভাষায় কথা বলে। নিয়াসার স্বামী কোথায় কী কাজ করে কে জানে! সকালে বেরিয়ে ফিরে অনেক রাতে। বাড়ির লোকজন তাকে দেখেই না। দেখে শুধু নিয়াসাকে। তাও নিজের ঘরে নিয়াসা বলতে গেলে থাকেই না। কখনও এই ঘরে, কখনও ওই ঘরে। হি হি করে হাসছে, ঠাট্টা মজা করছে। সবার সঙ্গেই আত্মীয়তা, সবার সঙ্গেই প্রাণের সম্পর্ক। একাই ওই বীভৎস বাড়িটি যেন আনন্দের বন্যায় ভাসিয়ে রেখেছে সে।

এই বাড়ির পশ্চিমে, বাড়ির অর্ধেক জুড়ে উত্তর-দক্ষিণে লম্বা একখান দালান ঘর। সামনে বিশাল চওড়া বারান্দা, বারান্দার পর দুইটা কামরা। উঠান থেকে পাঁচ ধাপ সিঁড়ি ভেঙে এই দালানে উঠতে হয়। বাড়ির দুইজন বনেদি ভাড়াটে থাকেন এই দুই কামরায়। উত্তরের কামরায় ফিরোজার বাপ। ফিরোজা মমতাজ আর বাবুল এই তিন সন্তান ভদ্রলোকের। বউ নিয়ে পাঁচজনের সংসার। পেশায় পুলিশের হাবিলদার। নাম তালেব আলী। দক্ষিণের কামরায় থাকেন গিয়াসউদ্দিন সাহেব। তার ডাকনাম গগন। দেলোয়ারার বড়বোন আনোয়ারার স্বামী। ডিএমসি অর্থাৎ ঢাকা মিউনিসিপ্যাল কমিটি, তারও আগে পৌরসভা, এই পৌরসভার কেরানি তিনি। নিরীহ, নরম ধরনের মানুষ। কারও সাতেপাঁচে নাই। আঠারো-উনিশ বছরেই বিয়ে সেরে ফেলেছিলেন। বছর বছর পিতা হচ্ছেন। তিনবছর আগে যমজ ছেলেমেয়ে হল এই বাড়িতে। তখন দেলোয়ারা এসে বোনের কাছে ছিলেন। তখনই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে গিয়েছিলেন বাড়ির চেহারা। মন্দ লাগেনি পরিবেশটা। অসুবিধা করেছিল শুধু ওই পায়খানা ঘরের তেলাপোকাগুলি আর হাওয়ায় ভেসে বেড়ানো মলের গন্ধ। এই কারণেই ওই বাড়িতে আর কখনও যেতে চাননি দেলোয়ারা। বোনকে বলে গিয়েছিলেন, এরপর পোলাপান হওয়ার সময় যেন এই বাড়িতে আর না থাকেন তিনি, গ্রামের বাড়িতে যেন চলে আসেন।

আনোয়ারা করেছেনও তাই। পোলাপান হওয়ার সময় হলেই চলে আসেন মেদিনীমণ্ডলে। স্বামী ঢাকায়। সপ্তাহে সপ্তাহে তিনিও আসেন বাড়িতে। স্ত্রীর জন্য না, পোলাপানের জন্য ভীষণ টান তাঁর। বেশিদিন ছেলেমেয়েদের না দেখে থাকতে পারেন না। আর খাওয়া দাওয়ারও অসুবিধা। আনোয়ারা না থাকলে তাকে খেতে হয় আজিজের ঘরে। আজিজ মেদিনীমণ্ডলেরই ছেলে। নিজেদের বাড়ি ছিল না। বুড়ি মা’কে নিয়ে থাকত আমিনুলদের বাড়িতে। বড় একটা ভাই ছিল, নাম পাইন্না। প্রথমে পাইন্না মরেছে তারপর মরেছে তার বাপ। অনেককাল আগে বড়ছেলে মরার পরও আজিজের মা’কে সবাই পাইন্নার মা বলে। ডাকে। মরেও বড়ছেলেটি জড়িয়ে ছিল তার মায়ের সঙ্গে। আজিজকে তেমন করে ঘেঁষতে দেয়নি মায়ের কাছে। তবে আজিজ আর তার মা গিয়াসউদ্দিন সাহেবের খুবই ভক্ত। তিনিই পৌরসভায় ভূঁইমালির চাকরিটা আজিজকে নিয়ে দিয়েছেন, জিন্দাবাহারের ওই বাড়িতে পাঁচ টাকা মাসিক ভাড়ায় একখান ছাপরা ঘরও নিয়ে দিয়েছেন। সুতরাং তার ব্যাপারে আজিজ আর তার বুড়ি মায়ের কৃতজ্ঞতার সীমা পরিসীমা নাই। আনোয়ারা না থাকলে আজিজের ঘরেই খেতে হয়। আজিজ এখনও বিয়ে করেনি, বুড়িমা রাধে খুব খারাপ। দুইবেলা ওই খাবার মুখে রোচে না গিয়াসউদ্দিন সাহেবের। এই কারণেও সপ্তাহে সপ্তাহে শ্বশুরবাড়ি চলে আসেন তিনি।

সেবারও বাড়িতেই ছিলেন। আনোয়ারার আবার পোলাপান হবে। গিয়াসউদ্দিন সাহেব এসেছেন স্ত্রীকে শ্বশুরবাড়িতে রেখে যেতে। অফিস থেকে তিনদিনের ছুটি নিয়ে এসেছেন। চারদিনের দিন পড়বে রোববার। সেদিন দুপুরের ভাত খেয়ে পায়ে হেঁটে রওনা দিবেন শ্রীনগর। সেখান থেকে কেরায়া নৌকোয় করে যাবেন আলমপুর। আলমপুর থেকে লঞ্চে চড়ে রাত আটটা-নয়টায় গিয়ে পৌঁছাবেন ঢাকায়। পরদিন সোমবার সকালে জিন্দাবাহার থেকে হেঁটে চলে যাবেন লক্ষ্মীবাজার, মিউনিসিপ্যালিটি অফিসে।

এ সময় একদিন ঘটল সেই ঘটনা।

.

নিমের পাতায় পাতায় সেদিন চৈত্র দুপুরের উদাসী হাওয়া। মাঠে মাঠে উঠছিল চৈতালী ঘূর্ণি। ফসল তুলে নেওয়া শূন্য চকমাঠে হঠাত্র ধুলা আর খড়কুটা নিয়ে ঘুরতে থাকে পাগল হাওয়া। ঘুরতে ঘুরতে খড়কুটা আর ধুলা নিয়ে উঠে যায় শূন্যে। বিক্রমপুর অঞ্চলে এই ঘূর্ণিকে বলে ‘বানাডুলি’। বানাড়ুলিকে ভয়ও করে লোকে। কুসংস্কার আছে বানাডুলি আসলে কোনও হাওয়া না, বানাডুলি এক অশুভ শক্তির চলাফিরা। যেদিক দিয়ে বয়ে যাবে, বয়ে যাওয়ার সময় যদি কোনও মানুষ পড়ে এই শক্তির আওতায়, কোনও না কোনও ক্ষতি সেই মানুষের হবেই। এজন্য বানাডুলি দেখলেই গ্রামের মানুষজন দৌড়ে দূরে সরে যায়, বুকে থু থু করে ছিটায় থুতু। মানুষের থুতুর বদগন্ধে নাকি সেই অশুভ শক্তি কাছে ভিড়ে না, ক্ষতি করতে পারে না মানুষের।

সেই দুপুরে বারবাড়ির দিকে গিয়ে ফকির বাড়ির সামনের চোয়া জমিতে হঠাই একটা বানাডুলি উঠতে দেখেছিলেন দেলোয়ারা। গিয়েছিলেন এনামুলকে ডাকতে। বাড়ি আসার পর থেকে প্রতি দুপুরেই ছানা সেন্টু তালেব জাহাঙ্গিরের সঙ্গে নতুন পুকুরে ডুবাডুবি করতে যায় এনামুল। ঘণ্টা দু’-ঘণ্টা পানি থেকে ওঠার নাম নাই। বহু ডাকাডাকির পর যখন উঠে আসে, চোখ তখন কোড়াপাখির চোখ। একটু বেশি চঞ্চল হয়েছে ছেলেটা, বেশি দুরন্ত। বাড়ি এলে কী রেখে কী করবে দিশা পায় না। এবার এসেই তো মাওয়ার বাজার থেকে লাল সাদা হলুদ নীল কয়েক তা ঘুড়ির কাগজ কিনে এনেছে, কয়েক কাঠিম ঘুড়ির সুতা, মাঝারি সাইজের লাটাই। ঠাকুরবাড়ির বাঁশঝাড় থেকে কঞ্চি কেটে এনে ছানা সেন্টুর সঙ্গে দুইদিন ধরে ধারালো দা দিয়ে কঞ্চি চেঁছে চেঁছে ঘুড়ির কামিনী বানিয়ে বড়ঘরের বারান্দায় আগিলা দিনের গাবদা গোবদা যে টেবিলটা আছে সেই টেবিলের উপর রেখে দিয়েছে। আজ সকাল থেকে কাঁচের কতগুলি পুরনো শিশি বোতল বহুক্ষণ ধরে ভেঙে গুঁড়া করেছে, তারপর পাটায় সেই গুঁড়া ফেলে পুতা দিয়ে মশলা ফাঁকি করার মতো ফাঁকি করেছে। দুইদিন। ধরে একটা হাঁড়িতে হাজামবাড়ির গাবগাছ থেকে গাব পেড়ে এনে একেকটা গাব কয়েক টুকরা করে ভিজিয়ে রেখেছে। দুইদিন ভিজে গা থেকে সব আঠা ছেড়ে দিয়েছে গাব। গাবের আঠার সঙ্গে তারপর ঘুড়ির কাগজের সঙ্গে কিনে আনা এক পুরিয়া লাল পাউডার রং মিশিয়েছে, কাঁচের ফাঁকি মিশিয়েছে। তার আগে যে কয় কাঠিম সুতা কিনেছিল সেই সুতা একটা লাটাইতে পাচিয়েছে। ছানা সেন্টু দুই ভাইয়ের আছে বড় লাটাই। তিনজন মিলে এইসব জিনিসপত্র নিয়ে এসেছে বাগানে। তারপর এনামুলের লাটাই থেকে সুতার মাথা বের করে গিঁট দিয়েছে ছানা সেন্টুর লাটাইয়ে। সেন্টুর হাতে তাদের লাটাই, এনামুলের হাতে এনামুলেরটা। বাগানের গাছপালার ফাঁকফোকর দিয়ে চৈত্র মাসের রোদ এসে খা খা করছে এমন রোদে দুইজন চলে গেছে দুইদিকে। এনামুল পশ্চিমে কাউয়াঠুইট্টা (কাকটুটো) আমগাছটার কাছে আর সেন্টু পুবদিকে বউন্নাগাছের কাছে। মাঝখানে ছানা গাবের আঠার সঙ্গে রং আর কাঁচের গুড়ার মিশেল দেওয়া ভাণ্ড (পাত্র) হাতে। ভাণ্ড থেকে হাতের মুঠায় পদার্থটা তুলে, সেই মুঠা দিয়ে আলগা করে ধরেছে সুতা, বউম্লাগাছের গোড়া থেকে সেন্টু পটু হাতে তার লাটাইয়ে সুতা প্যাচাতে শুরু করেছে, এপাশ থেকে এনামুলের লাটাই ঘুরে ঘুরে সুতা ছাড়ছে, ওপাশে সেই সুতো গিয়ে প্যাচাচ্ছে সেন্টুর লাটাইতে, মাঝখানে গাবের আঠা রং আর কাঁচের গুঁড়ায় মাঞ্জা হচ্ছে সুতা। রোদে শুকোচ্ছেও একসঙ্গে। বাড়ির পোলাপান সবাই সুতার দুইপাশে দাঁড়িয়ে মাঞ্জা দেওয়া দেখছে। মাঞ্জা দেওয়া সুতা দিয়ে দুই-একদিনের মধ্যেই পুরানবাড়ির মাঠে কাটাকুট্টি খেলা শুরু হবে। আজ বিকাল থেকে ঘুড়ি বানানোর কাজও শুরু করবে এনামুলরা।

এই বাড়িতে তখন পোলাপানের অভাব নাই। হাফেজের সংসারে ছানা সেন্টুর পরও মিন্টু মাখন শিলি জন্মেছে, সালতাবউদ্দিনের ঘরে আলমগীর, সন্ধ্যা, ইন্তাজউদ্দিনের ঘরে ভানুর পর জন্মেছে খোকন। আর আনোয়ারার ঘরে দুই বছর আগে যমজ ছেলেমেয়ে বাদল আর রওশন, তারপর আরেক মেয়ে খোদেজা। দেলোয়ারার ঘরে জন্মেছে মাফিন। মাফিনের তখন সাত-আট মাস বয়স।

দুপুর তরি এই করে এনামুলরা গেছে নতুন পুকুরে ডুবাডুবি করতে। ওই আরেক মজার কাজ পোলাপানের।

কিন্তু দুপুর ফুরাতে চলল এখনও ফিরছে না এনামুল। ছেলেকে তুলে আনতে বোনকে পাঠিয়েছেন আনোয়ারা। রান্নাবান্না শেষ হয়েছে, পোলাপানরা সব আগে খাবে, তারপর বড়রা। মাফিনকে বারান্দায় ঘুম পাড়িয়ে দেলোয়ারা গেছেন এনামুলকে ডাকতে। স্বামী মজিদকে দেখে গেছেন ছোটকাকার বাংলাঘরে গনি হামিদ ননীর সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছেন। গিয়াসউদ্দিন সাহেব গেছেন হাবজাদাদার (হাফেজ দাদা) ঘরে। ভাবীছাব তামাক সেজে দিয়েছেন, গুড়ুক গুড়ুক করে তামাক টানছেন আর টুকটাক কথাবার্তা বলছেন। এই অবস্থায় ফকিরবাড়ির সামনের চোয়া খেতে বানাডুলি দেখে বুকটা কেঁপে উঠেছিল দেলোয়ারার। বাড়ি থেকে নামেননি তিনি, নতুন পুকুরের সামনেও যাননি, বারবাড়িতে দাঁড়িয়েই এনামুলকে ডেকেছিলেন। এনামুল, ওই এনামুল, তাড়াতাড়ি উট বাজান। বাইত্তে আয়। তর মায় ডাক পাড়তাছে। ওই এনামুল।

খালার ডাক শুনে একলাফে পারে উঠল এনামুল। আইতাছি আম্মা, অহনঐ আইতাছি। বলে আবার লাফ দিয়ে পড়ল পানিতে।

বানাডুলি দেখার পর থেকে মনটা চাপ ধরে আছে, তার উপর বছরখানেক ধরে মজিদের সঙ্গে তেমন বনিবনা নাই, কাল রাতেও কিছু খ্যাচর ম্যাচর হয়েছে। ততদিনে মজিদের চরিত্র দিনের আলোর মতো পরিষ্কার সবার কাছে। পড়ার কথা বলে মাসের পর মাস টাকা নিয়ে পড়েননি তিনি। দুই দুইবার বিএ পরীক্ষা দেননি। সব জেনে আম্বিয়া খাতুন তার টাকাপয়সা বন্ধ করে দিয়েছেন। তারপর থেকে শ্বশুরবাড়িতে বসে আছেন মজিদ। শাশুড়িকে পটাতে না পেরে কয়দিন ধরে বউর সঙ্গে ঘ্যানঘ্যান করছেন। এইডা আমার শেষ প্রমিজ। এইবার টেকা দিতে কও, পরীক্ষার ফিস জমা দেওনের ডেট পার হইয়া যাইতাছে। টেকা জমা দিয়া পরীক্ষা আমি দিয়াসি।

দেলোয়ারার এক কথা। না, মইরা গেলেও মা’রে আমি টেকার কথা কইতে পারুম না। মায় আরও আগেঐ টেকা বন্ধ কইরা দিত, আমার লেইগা পারে নাই। আমি কইয়া কইয়া টেকা লইয়া দিছি আপনেরে। আর পারুম না।

এই নিয়ে কথা কাটাকাটির ফাঁকে এক রাতে ঠাস করে দেলোয়ারার গালে থাবড়ও মেরেছিলেন মজিদ। নিঃশব্দে সেই থাবড় হজম করেছেন দেলোয়ারা। চুপচাপ কেঁদেছেন, কেঁদে বালিশ ভিজিয়েছেন। আম্বিয়া খাতুন বা বাড়ির অন্য কাউকে বুঝতে দেননি কিছু।

সেই দুপুরে বারবাড়ি থেকে ফিরার পথে গনি হামিদদের বাংলাঘর থেকে দেলোয়ারার পিছু নিলেন মজিদ। বড়ঘরের বারান্দায় এসেই বললেন, শেষবারের লাহান তোমারে আমি কইতাছি, আম্মারে তুমি টেকা দিতে কও। এই বাইত্তে আমার আর এক সেকেন্ডও পরান টিকতাছে না। আমি ঢাকা যাইতে চাই, পরীক্ষা দিতে চাই।

স্বামীর মুখের দিকে তাকালেন না দেলোয়ারা। মাফিন শুয়ে আছে বারান্দার চৌকিতে, কাঁথার বিছানায়, পিঠে দুই-চারটা ঘামাচি হয়েছে ওই অত্তটুকু মেয়ের, আনমনে ঘুমন্ত মেয়ের পিঠের ঘামাচি মারতে লাগলেন।

খরচোখে দেলোয়ারার দিকে তাকিয়ে মজিদ বললেন, তুই যুদি আমার কথা না হোনচ তাইলে অহন অন্য একখান কাম করুম আমি।

দেলোয়ারা হতভম্ব। এতদিন কাইজ্জাকিত্তন হয়েছে কিন্তু কোনওদিন মজিদ তাকে তুইতুকারি করেননি। আজ তাও করছেন। কোন অধঃপথে গেছে লোকটা!

দেলোয়ারার মুখে কথা জুটল না। ঘুমন্ত মেয়ের পিঠে হাত রেখে ফ্যালফ্যাল করে স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

রাগে ক্রোধে মজিদের তখন চোখ ঠিকরে বেরুচ্ছে। কালোকোলো সুন্দর চেহারার মানুষটাকে অসুরের মতন দেখাচ্ছে। চাপা গলায় বললেন, একদিন থাবড় মারছি, আর তরে আমি কিছু কমু না। জেন্টেলম্যানদের পক্ষে ওয়াইফের গায়ে হাত উঠান ঠিক না। তয় তর মাইয়াডারে আমি অহন ফিনিশ কইরা ফালামু। গলায় টিবিদা মাইরা ফালামু।

মজিদের কথা বিশ্বাস করেননি দেলোয়ারা। ভেবেছেন তাঁকে ভয় দেখাবার জন্য এসব কথা বলছেন তিনি। বাপ হয়ে আপন মেয়েকে গলা টিপে মেরে ফেলতে পারে কেউ!

তবে পলকেই দেলোয়ারার বিশ্বাস তছনছ হয়ে গেল। সত্যি সত্যি ঘুমন্ত মাফিনের গলা টিপে ধরতে গেলেন মজিদ। সঙ্গে সঙ্গে এতদিনকার নিরীহ নরম দেলোয়ারা একেবারে অন্য মানুষ হয়ে গেলেন। লাফিয়ে উঠে প্রচণ্ড এক ধাক্কা দিলেন মজিদকে। আচমকা এমন ধাক্কা ভাবতে পারেননি মজিদ, উলটে গিয়ে পড়লেন চৌকির একপাশে। আর ছো মেরে মাফিনকে কোলে তুলে দেলোয়ারা তখন প্রাণ ফাটানো চিৎকার করছেন। মাইরা হালাইলো, আমার মাইয়ারে মাইরা হালাইলো।

আচমকা এরকম চিৎকারে বাড়ির লোকজন যে যেখানে ছিল ছুটে এসেছিল। ঘুম ভেঙে ভয়ার্ত স্বরে চিৎকার শুরু করেছিল মাফিন। মজিদ তখন উঠে বসেছেন। কাঁদতে কাঁদতে দেলোয়ারা তখন ঘটনা বর্ণনা করছেন সবাইকে। শুনে সবাই হতভম্ব, শুধু ননী ছুটে গিয়ে প্রচণ্ড এক থাবড় মারল মজিদের গালে। সেই থাবড়ে এমন করে আবার চৌকিতে গড়িয়ে পড়লেন মজিদ, যেন অজ্ঞান হয়ে গেছেন।

এই অবস্থায় এনামুল করেছিল একটা অদ্ভুত কাজ। বাড়িতে চিৎকার চেঁচামেচি শুনে নতুন পুকুর থেকে উঠে এসেছে। পরনে ভিজা ইংলিশপ্যান্ট। ঘরে এত লোকজন দেখে খালি গায়ে তার বোধহয় লজ্জা হয়েছিল। শরীর মোছার কথা ভুলে, ভেজা প্যান্ট বদলাবার কথা ভুলে শুকনা একটা হাওয়াই শার্ট পরে নিয়েছে। তাড়াহুড়ায় বোম লাগাতে ভুলে গেছে। ততক্ষণে ঘটনাটাও পুরা সে জেনেছে। ঘরভরতি মানুষজন তখন এইসব আলোচনা নিয়ে ব্যস্ত, অজ্ঞানের ভান করে মজিদ পড়ে আছেন চৌকিতে, তাঁর দিকে কেউ ফিরেও তাকাচ্ছে না। এনামুল করল কী, টেবিলের উপর থেকে ঘুড়ির একটা কামিনী নিল, নিয়ে কেউ যেন না দেখতে পায় এমন ভঙ্গিতে সেই কামিনী দিয়ে মজিদকে একটা বাড়ি দিল। এনামুলের কচিমুখে তখন অদ্ভুত এক রাগ ক্রোধ খেলা করছে। ওই একই কায়দায় বেশ কয়েকটা বাড়ি সে মজিদকে দিয়েছিল। অদূরে দাঁড়িয়ে পাঁচ-ছয় বছরের মিলু এই দৃশ্য দেখে ফিক ফিক করে হাসছিল।

দবির-হামিদার মুখ থেকে নূরজাহানের কথা শুনে আজ অনেকদিন পর বহুকাল পিছনে ফেলে আসা সেই দিনটির কথা মনে পড়ল দেলোয়ারার। সেই মর্মান্তিক দুপুরবেলাটির কথা মনে পড়ল। তার বুকে ভয়ে চিৎকার করছে মাফিন আর মাফিনকে চেপে ধরে রাখা বুকের অনেক ভিতরে দেলোয়ারা টের পাচ্ছিলেন মৃদু একটা ভয়ের কাঁপন। ঘোরতর বর্ষার দিনে তেলাকুচ পাতার উপর যখন টপটপ করে ঝরে আকাশভাঙা বৃষ্টি, সেই বৃষ্টির তোড়ে যেমন করে কাঁপে তেলাকুচের অসহায় পাতা, দেলোয়ারার বুকের কাঁপন ছিল তেমন। যে পিতা জন্ম দিয়েছেন মেয়ে, বার্মিজ সুন্দরী মেয়েদের মতো যার নাম রেখেছেন মাফিন, সেই পিতাই সামান্য টাকাপয়সার কারণে গলা টিপে ধরেন ওইটুকু অবুঝ মেয়ের! মেরে ফেলতে চান তাকে!

দেলোয়ারা সেদিন কাঁদতেও পারেননি। সেই দুপুরে তিনি আর নরম নিরীহ চুপচাপ ভাবুক ধরনের দেলোয়ারা নন। সেই দুপুরে স্বামীকে সন্তানের মৃত্যুদূত হিসাবে দেখে, ডিম ঘিরে কুণ্ডলী পাকিয়ে থাকা কালজাত যেমন ধারেকাছে শত্রুর সাড়া পেলে কচুপাতার মতো ফণা তুলে হিসহিস করে, যেন ধারেকাছে যাকে পাবে তাকেই ছোবল দিবে, তেমন ফণা তোলা এক কালজাত যেন সেদিন দেলোয়ারা। মা কালজাতের ডিম আগলাবার মতো করেই মাফিনকে সেদিন আগলে ছিলেন তিনি।

নূরজাহানের কথা শুনে আজ সেই সময়ের অনুভূতি যেন ফিরে এল দেলোয়ারার। যেন নূরজাহান তাঁর সেই সেদিনের ছোট্ট মাফিন, মেয়েটিকে যেন মজিদের মতো করে গলা টিপে ধরেছেন মান্নান মাওলানা। তার দশ আঙুলের চাপ থেকে যেমন করে হোক নূরজাহানকে তার বাঁচাতে হবে।

তবে সেদিনের মতো তেজালো ভাব এইসব ভাবনার পরও নিজের ভিতর জেগে উঠতে দেখলেন না দেলোয়ারা। অনুভূতিটা কীরকম যেন মনের ভিতর, স্মৃতিসত্তার ভিতর উঠেই মিলিয়ে গেল। সেদিনকার মতো ফুঁসে উঠতে পারলেন না তিনি। আসলে নিজের সন্তান। আর অন্যের সন্তানের মধ্যে দুস্তর এক ব্যবধান সৃষ্টিকর্তার বিধানেই তৈরি হয়েছে। ইচ্ছা করলেও মানুষ সেই বিধান ভাঙতে পারে না।

তবু দবির-হামিদাকে আশ্বস্ত করলেন দেলোয়ারা। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, এত ঘাবড়াইছ না তরা। রাখে আল্লায় মারে কে! আল্লায় যুদি তগো মাইয়ারে বাঁচায় তাইলে দুইন্নাইর কেঐ অরে মারতে পারবো না। আমি মাওলানা সাবরে কমুনে। অহন যা মাইয়া বিচড়া গা (গিয়া)।

দবির-হামিদা বেরিয়ে যাওয়ার পরও একই ভঙ্গিতে অনেকক্ষণ বসে রইলেন দেলোয়ারা। পালঙ্কে ঢেলান দিয়ে হারিকেনের আলোর দিকে তাকিয়ে আছেন তো তাকিয়েই আছেন। যেন ওইটুকু আলো তাঁর চোখের অনেক ভিতরে ঢুকে দীর্ঘকাল পেছনে ফেলে আসা এক জীবনের প্রায় সবখানি আলোকিত করে ফেলেছে। সেই জীবনটাকে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছেন তিনি, সেই জীবন থেকে আজকের জীবনে যেন ফিরতেই পারছেন না।

খাটালের দক্ষিণের জানালাটা খোলা, দরজাটা খোলা। বাইরের ঘুটঘুটা অন্ধকারে নিশ্চিন্তে ডাকছে ঝিঁঝিপোকা। মাঘ মাসের যে শীতে বাঘও কাবু হয়, কথায় বলে মাঘের শীত বাঘের গায়’– সেই মধ্য মাঘের শীত খোলা দরজা জানালা দিয়ে ইচ্ছামতো ঢুকছে, ঘর আর বাইরের মধ্যে এখন কোনও ব্যবধান নাই, তবু শীত যেন টের পাচ্ছেন না। দেলোয়ারা।

এই অবস্থা থেকে তাকে ফিরিয়ে আনল বাদলা। খাওয়াদাওয়া শেষ করে একখান তেল চিটচিটা ল্যাডল্যাড়া বালিশ আর একেবারেই পুরনা, তালির পর তালি পড়তে পড়তে ওজনদার হয়ে গেছে এমন একখান কথা কোনওরকমে বয়ে এনে পালঙ্কের পায়ের দিকটায় ফেলল বাদলা। অবাক হল। হায় হায়, বুজি দিহি অহনও বইয়া রইছে!

খোলা দরজা জানালা চোখে পড়ল বাদলার। গায়ে পুরনা মোটা গেঞ্জি আছে বাদলার, তবু খোলা দরজা জানালা দেখে যেন অযথাই তীব্র শীত টের পেল সে। হাত ভাঁজ করে বুকের কাছে ধরে, যেন শীতে মরে যাচ্ছে এমন ভাব করে বলল, এর লেইগাঐত্তো কই এমুন কাল (শীত) লাগে ক্যা? জিনালা (জানালা) দুয়ার দুইডাইত্তো খোলা।

দেলোয়ারা কথা বললেন কি বললেন না তোয়াক্কা না করে প্রথমে দরজাটা বন্ধ করল সে, যত্ন করে ডাসা লাগাল তারপর লাফিয়ে পালঙ্কে উঠে ঢাকাস চকাস করে বন্ধ করল জানালা। জানালার খিল লাগাবার খুটুর খাটুর শব্দে যেন পিছনের জীবন থেকে ফিরে এলেন দেলোয়ারা। বড় করে একটা শ্বাস ফেললেন।

পালঙ্কের পায়ের কাছটায় বাদলা তখন তার কথা বিছাচ্ছে। কাঁথা বিছিয়ে বালিশ রাখল জায়গা মতো তারপর শুয়ে পড়েই বিছানো কাঁথার অর্ধেকখানেক তুলে এমন করে গায়ে দিল, অপঘাতে মরা বেওয়ারিস লাশ যেমন করে পাটি হোগলায় প্যাচিয়ে নদীতে ফেলা হয়, বাদলাকে দেখাচ্ছে ঠিক তেমন। প্যাচানো কিশোর লাশ। শরীর কাঁথার ভিতর, শুধু মুখটা বেরিয়ে আছে। সেই মুখ বাদলা ঘুরিয়ে রেখেছে দেলোয়ারার দিকে। দাঁত বের করে হাসছে। দেলোয়ারা তার দিকে তাকাতেই বলল, আইজ থিকা আমি এহেনে হুমু।

অনেকক্ষণ পর এই প্রথম কথা বললেন দেলোয়ারা। ক্যা? মায় কইছে আমি ডাঙ্গর অইয়া গেছি। ডাঙ্গর পোলাপান মা-বাপের লগে হোয় না। কয়দিন বাদে বলে আমার মোসলমানিও করাইয়া দিবো।

দেলোয়ারা কথা বললেন না। তবু বাদলা খানিক অপেক্ষা করল দেলোয়ারা বুজি কিছু বলেন কি না, বলছেন না দেখে বলল, আপনে এমনে বইয়া রইলেন ক্যা বুজি? ওডেন, ভাতপানি খান, হুইতে যান। রাইত দুইফর অইয়া গেল!

হ উডি। বলে ভারী ধরনের শরীর থেকে পা দুইখান প্রথমে নামালেন দেলোয়ারা। যেখানে বসে আছেন পালঙ্কের তলায় সেই বরাবর স্পঞ্জের স্যান্ডেল জোড়া। দুইপায়ে স্যান্ডেল পরে উঠে দাঁড়ালেন। রাবিকে ডাকলেন। ওই রাবি, খোপে আয়। ভাত দে।

খাওয়াদাওয়া সেরে মতলা তখন জায়গা মতো শুয়ে পড়েছে আর রাবি হাঁড়ি পাতিল থাল বাসন প্রায় গুছিয়ে এনেছে। দেলোয়ারার ডাক শুনে বলল, হারিকল লইয়া আপনে খোপে যান বুজি, আমি আইতাছি।

দেলোয়ারা নরম ভঙ্গিতে হারিকেনের হ্যাঁন্ডেলটা ধরলেন।

.

মেন্দাবাড়ি থেকে বেরিয়ে মিয়াবাড়ির উপর দিয়ে ঠাকুরবাড়িতে উঠেছিল দবির-হামিদা। একপাশে গুহের বাড়ি। রাস্তার কাজ শুরু হওয়ার পর থেকে আশপাশের ছাড়াবাড়িগুলি আর। ছাড়াবাড়ি নাই, মাটিয়ালরা দখল করে নিয়েছে। নৌকার ছইয়ের মতো বাঁশ হোগলার ছই তুলে তার তলায় রাত কাটায় চারপাশের সব ছাড়াবাড়িতে। গুহের বাড়ি, ঠাকুর চৌধুরী। বাড়ি, সব বাড়িরই একই অবস্থা। সকাল থেকে সন্ধ্যা তরি কাজ করে যে যার গোড়া হাতে ফিরে আসে আস্তানায়, তারপর কুপিবাতি জ্বেলে রান্নার কাজে ব্যস্ত হয় কেউ কেউ, কেউ কেউ আয়েশি কায়দায় বসে তামাক বিড়ি টানে, কেউ কেউ গল্পগুজব হাসিঠাট্টা করে। রাত দুপুর তরি রমরমা থাকে বাড়িগুলি, লোকজনের সাড়া শব্দ আর কুপিবাতির আলোয় মুখর থাকে। সুতরাং এদিককার পথ ধরতে অসুবিধা হয়নি দবির-হামিদার।

আগিলা দিন হলে সন্ধ্যার পর এই পথ মরে গেলেও ধরত না মেদিনীমণ্ডলের কোনও লোক। ওই যে যে বছর ইন্ডিয়া-পাকিস্তান যুদ্ধ হল সেইবছর বর্ষাকালে মনীন্দ্র ঠাকুর আর ধীরেন্দ্র চৌধুরী খুন হওয়ার পর বাড়িটা গেল ছাড়াবাড়ি হয়ে, অন্ধকার হয়ে। এমনিতেই গাছপালার অভাব ছিল না বাড়িতে, ছাড়াবাড়ি হওয়ার পর গেল জংলা হয়ে। ঝোঁপজঙ্গল গাছপালায় এমন অবস্থা হল, দিন দুপুরেও একা এবাড়ির দিকে পা ফেলত না লোকে। অনেকগুলি দিন কেটেছে এইভাবে। স্বাধীনতার পরও বেশ কতগুলি বছর ছাড়াই পড়ে ছিল বাড়িগুলি। তার আগ থেকেই জলিল ভেন্ডার চেষ্টা তদবির করে বাড়িগুলি লিজ নেওয়ার চেষ্টা করছিল, মাওয়ার ওদিককার নিজামউদ্দিন সাহেবও চাইছিলেন লিজ নিতে, এখনও বোধহয় মামলা মোকদ্দমা চলছে বাড়ি নিয়ে, দবির পুরাপুরি জানে না এইসব মামলা মোকদ্দমার কথা, তবে রাস্তার কাজ শুরু হওয়ার পর ছাড়াবাড়িগুলি যে বসত বাড়ির চেহারা নিয়েছে এতে সে খুব খুশি। এই যে এখন রাতেরবেলা ঠাকুরবাড়ির উপর দিয়ে মেয়ে বিচড়াতে যাচ্ছে, লোক বসতি না হলে কি এটা সম্ভব হত!

কিন্তু যাচ্ছে কোন বাড়িতে দবির?

ঠাকুরবাড়িতে উঠে ঠিক এই প্রশ্নটাই তাকে করল হামিদা। কোনমিহি মেলা দিলা?

পা চালিয়ে হাঁটতে হাঁটতে দবির বলল, তুমি বোজো নাই?

হ বুজছি। মনেঅয় মরনি বুজির বাইত্তে যাইতাছো।

ঠিক কইছো। আমার মনেঅয় মাইয়া তোমার ঐ বাইত্তেঐ আছে।

আমারও মনেঅয়। মরনি বুজি ছাড়া হারাদিন অরে হামলাইয়া থোওনের আর কোনও মানুষ নাই এই গেরামে।

ক্যা? তোমার মাইয়ার লগে তো গেরামের বেবাক মাইনষেরঐ খাতির, বেবাক বাইত্তেঐত্তো যায়! মরনি বুজি ছাড়া অরে কেঐ জাগা দিবো না ক্যা?

হেইডা আমি কইতে পারুম না। তয় আমার মনে অইলো।

হামিদার সঙ্গে কথা বলতে বলতে দবির টের পেল দেলোয়ারা বুজির সঙ্গে কথা বলে আসার পর থেকে নূরজাহানকে নিয়ে উৎকণ্ঠা কমে আসছে। মনে হচ্ছে নিশ্চয় দেলোয়ারা বুজি মাওলানা সাহেবকে বলবেন, দরকার হলে এনামুলকে দিয়ে বলাবেন, আর তাঁদের কথা ফেলবার ক্ষমতা নিশ্চয় মওলানা সাহেবের নাই। ক্ষমতা থাকলেও এখন তিনি তাদের কথা ফেলবেন না নিজের স্বার্থে। এনামুল সাহেব মসজিদ করবেন, সেই মসজিদের ইমাম হবেন তিনি। এসব ভেবে বুকে এখন অনেক বল পাচ্ছে দবির, ভরসা পাচ্ছে। ঠাকুরবাড়ির সীমানা ছাড়িয়ে চৌধুরীবাড়ির দক্ষিণের পুকুর পাড় দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বলল, একখান কথা আইজ আমি বুজছি, এমনে দেকবা মাইনষের লগে অনেক মানুষ, সুখের দিনে, আমদের দিনে দেকবা মাইনষের আকাল নাই, বিপদ আপদের দিনে দেকবা, হায় হায়। তোমার লগে দিহি কেঐ নাইকা। শয়ে শয়ে মাইনষের দুই-একজন কোনওমতে আছে তোমার লগে। ওই টাইমে যারা থাকলে তারা অইলো তোমার আসল দরদী। আউজকা আমগো এই বিপদে দরদী খালি দেলরা বুজি, দরদী খালি মরনি বুজি।

হামিদা বলল, বোজলাম তোমার কথা। তয় মরনি বুজির বাইত্তে গিয়া যুদি মাইয়া না পাও?

পামুঐ। ওই বাইত্তেঐ আছে মাইয়া। মরনি বুজির লাহান আদর গেরামের অন্য কেঐ তোমার মাইয়ারে করে না। জান দিয়া অইলেও তোমার মাইয়ারে হেয় বাঁচাইবো। এইডা জানে দেইক্কাঐ তোমার মাইয়ায় ওই বাইত্তে গেছে।

এইডা তোমার অহন মনে অইতাছে ক্যা? আগে মনে অই নাই ক্যা? তাইলে মওলানা সাবের বাইত্তে, মোবাইত্তে আমগো যাওনঐ লাগতো না। সোজা মরনি বুজিগো বাইত্তে গিয়া মাইয়াডারে লইয়াইতাম।

মেয়ের জন্য হামিদার এই টান আজ বিকাল থেকেই টের পাচ্ছে দবির। পেয়ে মনটা কীরকম এক ভাল লাগায় ভরে যাচ্ছে! ইচ্ছা করছে দু’হাতে বুকে জড়িয়ে ধরে হামিদার মাথা। মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে আদর করতে করতে বলে, আমার মাইয়াডারে তুমি এত আদর কর এইডা আমি জানতাম নাগো। আমি তোমার উপরে খুব খুশি, খুব খুশি।

কিন্তু বুকে হামিদার মাথাটা জড়িয়ে ধরল না দবির, চৌধুরীবাড়ির পশ্চিমের সীমানা ছাড়িয়ে নামার দিকে নামতে নামতে, একপাশে রঙ্গু দারোগার বাড়ি, আরেক পাশে ইন্নতদের বাড়ি, মাঝখানকার উঁচু রাস্তার ঘুটঘুটা অন্ধকারে পিছনে দিকে হাত বাড়িয়ে হামিদাকে টেনে আনল কাছে, তার একটা হাত ধরল। আমারে একখান কথা দেও তুমি?

স্বামীর আচরণে হামিদা থতমত খেয়েছে। প্রথমে মনে হয়েছে দিনের আলোয় যেন এরকম খোলামেলা জায়গায় দবির তার হাত ধরেছে, হোক সে তার স্বামী, স্বামী হয়েছে বলেই কি রাস্তাঘাটে হাত ধরতে পারে! লজ্জাশরম নাই মানুষের! ঝটকা মেরে হাত ছাড়াতে চেয়েছে হামিদা, মুখে প্রায় এসে গিয়েছিল, করো কী তুমি? মাইনষে দেকলে কী কইব? তারপরই মনে হয়েছে, এখন রাত, অন্ধকার চারদিক, কেউ তাদেরকে দেখছে না।

তবু হাত ছাড়িয়ে নিল হামিদা। বলল, কও দিহি হুনি, কী কথা?

করুণ অনুনয়ের গলায় দবির বলল, মাইয়াডারে তুমি কিছু কইবা না! মারবা ধরবা না। অরে!

একথা শুনে হামিদার গলা রুক্ষ হল। এই হগল আল্লাইদ্যা প্যাচাইল অহন পাইরো না। তাড়াতাড়ি আডো, ম্যালা রাইত অইছে। ওই বাইত্তে মাইয়া না পাইলে চিন্তায় মইরা যামু আমি।

দবির আর কোনও কথা বলল না। দ্রুত হেঁটে দুইজন মানুষ তারপর মজনুদের সীমানায় উঠল। পাটাতন ঘরটার সামনে এসে দাঁড়াল।

রাত বলতে গেলে এখনও তেমন হয়ইনি। তবু শীতের রাত বলে সন্ধ্যারাতই গভীর রাত। গ্রাম গিরস্তের বাড়িঘর নিঝুম হয়ে গেছে। মজনুদের দিকটা যেন নিঝুম হয়েছে একটু বেশি। অবশ্য দিনেরবেলাও এদিকটা নিঝুমই থাকে। বোনপো মজনুকে নিয়ে দুইজন মানুষের সংসার মরনির বহুদিনের। স্বামী মারা যাওয়ার পর থেকে মজনুকে নিয়েই আছে। এই মজনুও এখন নাই। কয়েক মাস হল খালাকে ছেড়ে ঢাকায় গিয়ে খলিফাগিরি শিখছে। বাড়িতে এখন মরনি একা। কথা বলার মানুষটা পর্যন্ত নাই। সুতরাং নিঝুম তো এদিকটা হবেই!

দিনেরবেলা তবু শব্দ কিছু থাকে। মরনির সংসারকর্ম, গাছগাছালিতে পাখপাখালির ডাক, উঠান পালানে চরে বেড়ানো মোরগ মুরগির কোনও কোনওটির হঠাৎ হঠাৎ ডেকে ওঠা এসব তো আছেই, তার উপর আছে উত্তরের শরিক ভাসান গাছির পোলাপান বউঝিদের হাঁকডাক, কাইজ্জাকিত্তন, হাসি কান্না ছুটাছুটি। গোয়াল থেকে আচমকা হাম্বা দিয়ে নির্জনতা ভাঙে কোনও কোনও গাই গোরু। ভাসান গাছির বড়পোলা হিরু বাড়িতে থাকলে দুপুরের পর কখনও কখনও আড়বাঁশিতে একটুখানি বিচ্ছেদের সুর তোলে। সব মিলে নির্জনতা তখন কমই।

ওদিকে উত্তর-পশ্চিমের শরিক রহমান হালদার সারাদিন ব্যস্ত খেতখোলা আর গাই গোরু চরানোর কাজে। সংসার আগলাচ্ছে বউ আর বুড়িমা। পোলাপান অনেক রহমানের, বউটা চুপচাপ ধরনের, পোলাপানরা পাত্তা দেয় না মা’কে। তাদেরকে সামলায় রহমান হালদারের মা। বুড়ি খুবই দাপুটে ও দজ্জাল ধরনের। যখন তখন কিলচড় লাগাচ্ছে নাতি নাতকুড়দের, বকাবাজি করে শাসন করছে। চিলের মতো তীক্ষ্ণ গলা তার, অবিরাম সেই গলায় চিৎকার করে যাচ্ছে। মজনুদের সীমানা থেকে সারাক্ষণই শুনা যাচ্ছে তার চিল্লাবিল্লি শব্দ।

কিন্তু সন্ধ্যা হলেই সব শুনশান, সব নিঝুম। কোথাও কোনও শব্দ নাই, শুধু ঝিঁঝিপোকার ডাক।

মজনুদের দিকটায় ঝিঁঝিপোকা যেন আজ একটু বেশি ডাকছে। বেশি ডেকে নিঝুম ভাবটা যেন বেশি গাঢ় করে ফেলছে। এই গাঢ় নিঝুমতায় দুইজন মানুষ এসে দাঁড়িয়েছে। মজনুদের পাটাতন ঘরের সামনে। দবির-হামিদা। বুক জুড়ে দুইজনেরই অদ্ভুত এক আশা ও শঙ্কা। নূরজাহান কি এই ঘরে আছে! যদি থাকে তা হলে তো ভালই, যদি না থাকে তা হলে এই শীতের রাতে গ্রামের কোথায়, কোন বাড়িতে তাকে আবার খুঁজতে যাবে দিশাহারা মা-বাবা! কোথায় পাবে তারে!

ঘরের ভিতর নিবুনিবু করে বুঝি হারিকেন জ্বালিয়ে রেখেছে মরনি। পাটাতন ঘরের ফাঁক ফোকর দিয়ে সেই আলোর অতি ক্ষীণ একটা রেখা এসে পড়েছে গাঢ় অন্ধকারে। এই আলোর রেখাটুকুর দিকে তাকিয়ে হামিদা বলল, কী অইলো, খাড়ই রইলা ক্যা? ডাক দেও মরনি বুজিরে। দেহ ঘরে মাইয়া আছেনি।

এই ঘরের সামনে এসে একটু আনমনা হয়েছিল দবির। কী করবে না করবে বুঝতে পারছিল না। হামিদার কথায় বুঝতে পারল। টিনের বেড়ায় শব্দ করে দুই-তিনটা থাবড় মারল। বুজি, ও বুজি, ঘুমাইছেননি? বুজি।

প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ভিতরে কে যেন কাকে হাকিকি করে কী বলল চারদিক গভীর নির্জন বলে, ঘরে মরনি ছাড়া অন্য কেউ আছে কি না আন্দাজ করবার জন্য কান খাড়া করে রাখার ফলে হাকিহুকিটা পরিষ্কারই শুনতে পেল হামিদা। শুনে তীব্র উত্তেজনায় বুক ফেটে গেল। তার। দবিরের একটা হাত ধরল সে। আছে, এই ঘরেঐ আছে আমার মাইয়া।

দবিরও শব্দটা খেয়াল করেছে। সেও সমান উত্তেজিত। নিচু গলায় বলল, কেমতে বুজলা?

অর গলা হুনছি আমি। হাকিকি কইরা মরনি বুজিরে কইল, আমার বাপে আইছে।

তখনই সাড়া দিল মরনি। কেডা? গাছি নি?

হ বুজি।

খাড়ও দুয়ার খোলতাছি।

কয়েক মুহূর্ত মাত্র, তবু এই সময়টুকুর অপেক্ষা যেন সহ্য হয় না দুইজন মানুষের। মনে হয় অনন্তকাল ধরে যেন তারা এক বন্ধঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে, যে ঘরের ভিতর বন্দি হয়ে আছে তাদের সাত রাজার ধন এক মানিক।

দরজা খোলার আগে ঘরের কোণ থেকে হারিকেন হাতে নিয়েছে মরনি, নিবুনিবু আলো খানিকটা উসকে দিয়েছে। এখন দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে হারিকেন থেকে তেড়েফুড়ে আসা আলো ঘরের ছেমা পুরাটা আলোকিত করে ফেলেছে। সেই আলোয় দবির-হামিদার উদ্বিগ্ন মুখ দেখতে পেল মরনি। দেখে বুকটা হু হু করে উঠল তার। আহা রে মেয়ের চিন্তায় মরতে বসেছে দুটি মানুষ!

দবির-হামিদা কিছু বলবার আগেই মরনি বলল, তোমরা এত রাইত কইরা আইলা ক্যা? আমি তো মনে করছি দোফর নাইলে বিয়ালে আইবা! হারাদিন খালি তোমগো পথ চাইলাম, তোমরা আইলা না। আইলা রাইত দুইফরে! আহো, ঘরে আহো।

দবির দিশাহারা গলায় বলল, নূরজাহান আছে আপনের কাছে?

শুনে মরনি কিছু বলল না, মুখ ঝামটাল হামিদা। বুজির কথা হোননের পরও তুমি তারে জিগাইতাছো? সরো।

দবিরকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে, উঁচু ভিটিতে ছানাপোনা চরতে দেওয়া মুরগি আকাশে আততায়ী চিল দেখে যেমন করে লাফিয়ে উঠে ডানার আড়ালে লুকাতে চায় ছানাদের ঠিক সেই ভঙ্গিতে লাফ দিয়ে মজনুদের পাটাতন ঘরে উঠে গেল হামিদা, চৌকির কাছটায় ছুটে গেল।

মা-বাবার সাড়া পেয়েই মুমূর্ষ ভঙ্গিতে বিছানায় উঠে বসেছিল নূরজাহান। মাজা তরি দলামোচড়া করা কাঁথা। এইসব কাঁথা কাপড়ের মধ্যে যেন ঝাঁপ দিয়ে পড়ল হামিদা। দুইহাতে পাগলিনির মতো জড়িয়ে ধরল নূরজাহানকে। হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলল, এইডা তুই কী করছস মা? এইডা তুই ক্যান করছস! নিজে তো মরলিঐ আমাগোও মাইরা হালাইলি!

দবিরও ততক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছে মা-মেয়ের সামনে। তারও চোখ ভেসে যাচ্ছে কান্নায়। কোনওরকমে মা-মেয়ের পাশে বসে সেও এক হাতে জড়িয়ে ধরেছে নূরজাহানকে। নূরজাহান কাঁদছে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বড় রকমের অন্যায় করে ফেলা শিশুর মতো আধো আধো গলায় বলছে, আমি বুজি নাই মা। আমি কিছু বুজি নাই। কাশেম কাকারে দেইক্কা আমার জানি কেমুন লাগলো। এর লেইগাঐ, এর লেইগাঐ ছ্যাপ আমি ছিডাইছি। হুজুরের মোকে গিয়া যে লাগবো আমি বোজতে পারি নাই মা।

নূরজাহানের কথা শুনে হামিদা কোনও কথা বলল না, কাঁদতেই লাগল। কথা বলল দবির। হাউমাউ করা কান্নার গলায় বলল, এমুন বিপদ ক্যান ঘটাইলি তুই? আল্লায় ক্যান তরে দিয়া এই কামডা করাইলো? কী অন্যায় আমরা করছি তার কাছে? কী অন্যায় তুই করছস তার কাছে?

তিনজন মানুষের কান্নায় ভারী হয়ে উঠেছে ঘরের ভিতরকার শীতরাত্রি। অদূরে এই ফাঁকে দরজার খিল তুলে সেখানেই স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মরনি, হাতে এখনও ধরা হারিকেন। তিনজন মানুষের গভীর কষ্ট আর অসহায়ত্বের কান্না দেখে বুক ফেটে যেতে চাইছে তার। মানুষের দুঃখকষ্ট কান্নাকাটি একদমই সহ্য করতে পারে না সে। যে কারও। দুঃখকে তার মনে হয় নিজের দুঃখ, কষ্টকে মনে হয় নিজের কষ্ট। অন্যের কান্নাকাটিতে তারও চোখ ভেসে যায়, অন্যের কান্নায় মরনি নিজেও কাঁদে। এখনও সেই কান্নায় বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কাঁদছিল সে। ইচ্ছে করছিল সেও গিয়ে দাঁড়ায় তার চৌকিতে বসা তিনজন অসহায় মানুষের পাশে। নিজের চোখ মুছে সান্ত্বনা দেয় তাদেরকে। দবির হামিদাকে বলে, কাইন্দো না, কাইন্দো না তোমরা। মাইয়ার মিহি চাও, মাইয়ারে বাঁচানের চেষ্টা করো। না বুইজ্জা কামডা ও করছে ঠিকঐ, তারবাদে তো মরতে বইছে। জ্বর আইয়া পড়ছে মাইয়ার। কাইপ্পা কাইপ্পা জ্বর আইছে। অহন যাও, তাড়াতাড়ি বাইত লইয়া যাও মাইয়ারে। ভাতপানি খাওয়াইয়া আগে এই দশা থিকা বাঁচাও। তারবাদে কপালে যা আছে তাঐ অইবো। আল্লায় যুদি বাঁচায় তাইলে অরে আর মারবো কে?

কিন্তু এসব কথার একটিও বলা হয় না মরনির। হারিকেন হাতে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে নিঃশব্দে কাঁদে সে। ওদিকে মানুষের এই কান্নাকাটি আর হারিকেনের উসকে ওঠা আলো দেখে পলোর ভিতর উঠে দাঁড়িয়েছে চিলের মুখ থেকে আঙিনায় এসে পড়া সেই মুরগি ছানাটি। গলা টানা দিয়ে ব্যাপারটা বুঝতে চাইছে। কুন কুন করে দুই-তিনবার শব্দও করল।

.

আদিলউদ্দিন বাড়ি ফিরে রাত অনেকটা হয়ে যাওয়ার পর।

মরনি তখন গভীর ঘুমে। বাড়ি নিঃসাড়, নিস্তব্ধ। চারদিকে শুধুই ঝিঁঝিপোকা ডাকে, কীট পতঙ্গ ডাকে। কখনও কখনও মাথার উপর দিয়ে উড়ে যায় রাতচরা বাদুড়। রহমান হালদারের সীমানায় আছে শেয়াল রঙা একখান কুকুর। খুবই নিরীহ স্বভাবের নির্জীব ধরনের কুকুর। মরদা কিন্তু বয়স হয়ে যাওয়ার ফলে যৌবনকালের তেজটা আর নাই। গা ভরতি ঘা, খানে খানে লোম উঠে চোয়া হয়ে গেছে। পিঠের উপর শিড়দাঁড়ার হাড় পরিষ্কার ফুটে আছে। তবু কুকুর। প্রভুভক্ত জীব। রাতেরবেলা তিন শরিকের যে কারও সীমানায় মানুষের পায়ের শব্দ পেলে ধুলামাটিতে মুখ গুঁজে পড়ে থাকা কুকুরটা গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে। সামর্থ্য অনুযায়ী ছুটে এসে দেখে কে এল।

বেশ কিছুদিন ধরে আদিলউদ্দিনকেও।

প্রথম প্রথম অচেনা ছিল মানুষটা। তখন খেউক খেউক করত। দিনে দিনে চিনা হয়ে গেছে, এখন আর তেমন করে না। আদিলউদ্দিনকে দেখলেই ছুটে এসে লেজ নাড়ায়, কুঁই কুঁই শব্দে আদুরে ভাব করে। তারপর আদিলউদ্দিন তার ঘরে ঢুকে যাওয়ার পর কুকুরটা। ফিরে যায় রহমান হালদারের সীমানায়।

আদিলউদ্দিন বাড়ি থেকে বেরোয় বিয়াইন্না রাইতে (ভোররাত), মরনি ঘুম থেকে উঠে দুয়ার খোলার অনেক আগে। দিনে আর কখনও ফিরা হয় না। ফলে এই বাড়িতে গোড়া নিতে এসে দক্ষিণের ভাঙাচোরা ছোট্ট ঘরটায় আশ্রয় পাওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত দুইজন মানুষের আর দেখা হয়নি। মরনি জানে রাতেরবেলা নিজের সীমানায় সে একা না, উঠানের দক্ষিণ পাশে, বড়ঘরের মুখোমুখি ঘরটায় মাটির মতো নিঃশব্দে পড়ে থাকে আরেকজন মানুষ। রাতের আঁধারে কখন আসে সেই মানুষ, কখন যায়, সে ছাড়া আর কেউ তা জানে না। কোথায় খায় সেই মানুষ, কোথায় পেশাব পায়খানা সারে, কোথায় নাইয়াধুইয়া সাফ সুতরা হয়, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করে কি না কে জানে, করলে অজু করে কোথায়, নামাজ আদায় করে কোথায়, মানুষটাকে গোড়া দেওয়ার পর থেকে কখনও কখনও এই ভাবনাও ভেবেছে মরনি। তার ভাবনার কথাও সে ছাড়া আর কেউ জানে না।

তবে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় ঠিকই করে আদিলউদ্দিন। প্রায়ই কাজা হয়, তবু করে। কাজা হয় আলী আমজাদের ভয়ে। লোকটা মানুষ না, পিশাচ। কাজের সময় ধর্মকর্ম, জীবন মরণ কিছুই বোঝে না। একটু এদিক ওদিক করলেই কোকসায় লাথথি। সে তদারকিতে থাকলে নামাজ কাজা হবেই।

হেকমত অন্যরকম। দিলে রহম একটু আছে তার, দয়ামায়া আছে। নামাজ পড়ার সময়। চাইলে দেয়। কোনওরকমে সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলতে পারলেই হল, বাজান, নমজ পড়ুম।

লগে লগে একহাত থেকে ছাতা বদলে অন্যহাতে নিবে। সাবধানি চোখে চারদিক তাকিয়ে হাসিমুখে বলবে, কনটেকদার সাব মনে অয় ঘরে গেছে আর নাইলে মটরসাইকেল লইয়া গেছে মাওয়া। বাজারে বইয়া দোস্তগো লগে চা সিকরেট খাইতাছে। যান এই ফাঁকে নমজটা পইড়া হালান।

প্রথম প্রথম ব্যাপারটা বুঝতে পারেনি আদিলউদ্দিন। নামাজের সময় হলেই, খাইগো বাড়ির মসজিদ থেকে আজানের শব্দ ভেসে এলেই মাটি টানার গোড়া পথের পাশে রেখে, রাস্তার কাজের জন্য দুইপাশ থেকে মাটি কেটে তোলার ফলে যে খাল মতো হয়েছে, সেই খালের কোথাও কোথাও জমেছে টলটলা পানি, আর নয়তো পথপাশের কোনও পুকুরে নেমে গেছে অজু করতে। অজু সেরে মাজায় বান্ধা গামছা পাগড়ির মতন মাথায় প্যাচিয়ে পথপাশের কোনও ঘাসভরতি মাঠে নামাজটা সেরে নিয়েছে আদিলউদ্দিন। নামাজ পড়ার ব্যাপারেও যে নিজের স্বার্থটুকুকেই শুধু দেখতে পারে কোনও মুসলমান, ওই নিয়ে কথা বলতে পারে, বকাঝকা মাইর ধইর করতে পারে কোনও নামাজি লোককে, এটা কল্পনাও করেনি আদিলউদ্দিন। কিন্তু এরকম ঘটনাই একদিন ঘটিয়েছিল আলী আমজাদ।

আলী আমজাদের কথায় বইতে পারার তুলনায় বেশি মাটি ভরে দিয়েছিল একজন আদিলউদ্দিনের মোড়ায়। ভারে ঘাড় বেঁকা হয়ে আসছিল লোকটির, বেশির ভাগ পাকা দাড়িগোঁফের আড়ালে ফেটে পড়তে চাইছিল মুখ, গলার দুইপাশে আঙুলের মতন ফুলে উঠেছিল রগ, আর চোখ বেরিয়ে আসতে চাইছিল ঠিকরে। তবু টলমল পায়ে সেই বোঝা বয়ে নিচ্ছিল আদিলউদ্দিন।

তখন শীতকালের খাড়া দুপুর। রোদ ছিল তেজালোলা। অতিরিক্ত ভার মাথায় ছিল বলে বয়সি শরীর ফুটা করে আদিলউদ্দিনের বেরুচ্ছিল নুনঘাম। জায়গা মতো মাটি ফেলার। সঙ্গে সঙ্গে খাইগোবাড়ির মসজিদ থেকে ভেসে এসেছিল জোহরের আজান। মাওলানা মহিউদ্দিন সাহেবের ললিত গলার আজান শুনেই খানিক আগে মাথায় চেপে থাকা অতিরিক্ত ওজনের কষ্ট ভুলে গিয়েছিল আদিলউদ্দিন। মোড়া পথের পাশে রেখে মতলেব মুদির বাড়ির দক্ষিণের পুকুরে নেমেছিল অজু করতে।

রাস্তার ধারের হিজলগাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে তীক্ষ্ণচোখে আদিলউদ্দিনকে দেখছিল আলী আমজাদ। শুরু থেকেই বুঝতে পারছিল কী উদ্দেশ্যে পুকুরের দিকে যাচ্ছে সে। তখনও কিছু বলেনি। অজু সেরে মাজার গামছা মাথায় দিয়ে পশ্চিম দিককার নামার মাঠে মাত্র। নামাজে দাঁড়াবে আদিলউদ্দিন, পিছন থেকে এসে ঘেঁটি চেপে ধরল আলী আমজাদ। কী রে চুতমারানির পো, কামের টাইমে চুদুর বুদুর?

মুখ ফিরিয়ে ভয়ার্ত চোখে আলী আমজাদের দিকে তাকিয়েছে আদিলউদ্দিন। নমজের সময় অইছে বাজান, নমজ পড়তে খাড়ইছি।

গর্জে উঠেছে আলী আমজাদ। এইডা তর নমজ না, এইডা তর ইতরামি!

কন কী বাজান? কীয়ের ইতরামি?

ওই যে তর গোড়ায় বেশি মাডি দেওয়া অইছে, একবার ওই বোজা টাইন্নাঐ আরামের আশায় ইতরামি কইরা নমজের ভং ধরছস।

না বাজান না। আমি অমুন মানুষ না। আল্লার কাম লইয়া ইতরামি করুম না। যুদি করি আল্লার এই মাড়িতে আমার কব্বর অইবো না। আপনে আমার কথা বিশ্বাস করেন, আমি কোনও ভং করি নাই।

তবু আদিলউদ্দিনকে একটা ধাক্কা দিয়েছিল আলী আমজাদ। আইজ তরে আমি ছাইড়া দিলাম। আর কোনওদিন যুদি দেহি আমার কাম হালাইয়া তুই কোনও চুদুর বুদুর করতাছস তাইলে তরে আমি খাইছি।

তারপর থেকে আলী আমজাদ ধারেকাছে থাকলে সময় মতো নামাজ পড়া হয় না আদিলউদ্দিনের। ফজরের নামাজ সে মরনির বাড়িতে পড়ে বেরোয়। জোহর আছর কোনও কোনওদিন মাগরিবের নামাজ পর্যন্ত কাজা পড়তে হয়। যেদিন সন্ধ্যা হয়ে যাওয়ার পরও মাটি কাটা শেষ করতে চায় না আলী আমজাদ, হ্যাঁজাক জ্বালিয়ে কাজ চালিয়ে যায়, সেদিন মাগরিবের নামাজও সময় মতো পড়া হয় না আদিলউদ্দিনের।

জোহরের নামাজ সে পড়ে নেয় ঠাকুরবাড়ির আঙিনায় বসে, শেষ দুপুরে খাওয়ার ছুটির সময়। মাটিয়ালের কাজ নেওয়ার পর পরই অন্যান্য মাটিয়ালদের সঙ্গে তিনবেলার খাওয়ার বন্দোবস্ত আদিলউদ্দিন করে নিয়েছে। হাঁসাড়ার ওদিককার একজন যুবক বয়সি হিন্দু মাটিয়াল আছে পবন, ঠাকুর বাড়িতে অন্যান্য মাটিয়ালদের সঙ্গে নৌকার ছইয়ের মতন ছাপরা করে থাকে। ছয়জনের একটা দল আছে তার। সে ছাড়া সবাই মুসলমান। ছয়জনে একত্রে রান্নাবান্না করে খায়। একেকদিন একেকজনের রান্নার পালা। যার যেদিন রান্না থাকে সে সেদিন কাজে যায় না। সকাল থেকেই রান্নার কাজে লেগে যেতে হয়। ছাপরার সামনে থানইট সাজিয়ে চুলা তৈরি করা হয়েছে। লাকরি খড়ি ম্যাচ কেরাসিন, হাঁড়ি পাতিল সব আছে হাতের কাছে। মাছ কোটার বঁটি, মশলা বাটার পাটাপুতা, তারপরও ছয়জন মানুষের তিনবেলার রান্না সারতেই দিন কাবার। কিন্তু মুশকিল হয়েছে একটা দিন নিয়ে। সপ্তাহে তো সাতদিন, ছয়জনে না হয় ছয়দিনের রান্না চালাচ্ছে, আর একটা দিনের কী হবে! কে কাম কামাই করে ওই দিনের রান্নাটা করবে?

এই সমস্যা মিটিয়ে দিয়েছিল আদিলউদ্দিন।

পবন ছেলেটা ফুর্তিবাজ ধরনের, প্রাণবন্ত আর মানুষের জন্য মায়ামমতায় ভরা মন। এখানে কাজে আসার পর থেকেই আদিলউদ্দিনের জন্য মায়া পড়েছিল তার। যে বয়সে বাড়ির উঠানে বসে আরামের দিন কাটাবার কথা মানুষটার, ছেলেরা রোজগার করে খাওয়াবে, সেই বয়সে এই অমানুষিক কষ্টের কাজ করতে এসেছে কতটা কষ্টে পড়ে এটা প্রায়ই ভেবেছে পবন। সময় অসময়ে ছোটখাটো বিপদ আপদে আদিলউদ্দিনের পাশেও দাঁড়িয়েছে সে। যেমন নিজে অতিরিক্ত মাটি বোঝাই গোড়া মাথায় নিয়ে আদিলউদ্দিনকে দেওয়ার চেষ্টা করেছে হালকা ধরনের বোঝ। আলী আমজাদকে বুঝতে দেয়নি কিছু। আবার যেদিন পবনের কাজ থাকে কোদালে মাটি কেটে গোড়ায় ভরে দেওয়ার সেদিনও খুবই সূক্ষ্মভাবে আদিলউদ্দিনের গোড়ায় সে মাটি ভরে দিয়েছে হালকা করে, অর্থাৎ কোনও কোনওভাবে লোকটিকে একটু বাঁচিয়ে নেওয়া।

এই পবনই আদিলউদ্দিনকে ডেকে নিয়েছিল তাদের দলে। তাদের একদিনের রান্নার সমস্যাও মিটে, আদিলউদ্দিনেরও তিনবেলা খাওয়ার পাকা বন্দোবস্তও হয়। বন্দোবস্তের আগে ভাত খেতে আদিলউদ্দিনকে যেতে হত মাওয়ার বাজারে। এতটা দূর যাওয়া আসা, বিরাট ঝামেলা। খাওয়াদাওয়া শেষ করে দুই-চাইর মিনিট জিরাবার সময়ও হত না।

পবন অবশ্য তাকে বলেছিল, কাকা, আপনে কইলাম আমগো লগে থাকতেও পারেন। যেই ছইয়ের নীচে আমরা ছয়জন থাকি ওহেনে আপনেও থাকতে পারেন। শীতের দিনায় খালি চাপাচুপি অইবো, খরালিতে কোনও অসুবিদা নাই। তহন তো ভোলা আসমানের তলায় নাইলে গাছতলায় হুইয়া থাকলেও রাইত কাইট্টা যাইবো।

আদিলউদ্দিন হাসিমুখে বলেছে, না বাজান, থাকনের জাগা আমার আছে।

এই পবনদের সঙ্গে খেতে শুরু করার পর থেকেই দুইটা পয়সার মুখ আদিলউদ্দিন দেখছে। সাতজন মানুষ একসঙ্গে খায় বলে খরচাটা কম। বাজারের হোটেলে তিনদিন খেলে যে খরচা সেই খরচায় পবনদের সঙ্গে পুরা সপ্তাহ খাওয়া যায়। খাওয়াও ভাল, একদম ঘরবাড়ির বউঝিদের হাতের রান্নার মতো। খাওয়ার পর কয়েকদণ্ড জিরানোনাও যায়। সব মিলিয়ে মাস দেড়েক ধরে ভালই আছে আদিলউদ্দিন। হাতে পাঁচ-সাতশো টাকাও জমেছে।

এই টাকা দিয়ে কী করবে আদিলউদ্দিন? কাকে দিবে? কে আছে তার?

এসব ভেবেই আজ রাতে মরনির বাড়ি ফিরেছিল সে। ভেবেছিল মরনিকে ডেকে তুলে তার সঙ্গে একটু পরামর্শ করবে। টাকাটাও জমা রেখে দিবে তার কাছে। সে মাটিয়াল মানুষ, মাজায় বান্দা তবিলে টাকা রেখে দিয়েছে ঠিকই কখন কোন অঘটন ঘটে যাবে, অন্ধকারে বাড়ি ফিরার পথে কে কবে ছিনিয়ে নিবে টাকাটা। তারচেয়ে মরনির কাছে থাকলে নিরাপদে থাকবে।

মরনির ঘরের সামনে আজ রাতে এসে দাঁড়াবার পর আদিলউদ্দিন টের পেল ঘরের ভিতর কারা যেন কান্নাকাটি করছে। পাটাতন ঘরের ফাঁকফোকর দিয়ে এসে পড়েছে হারিকেনের আলো।

কারা এসেছে আজ মরনির ঘরে? মিলিত স্বরে এমন দুঃখবেদনার কান্না কাঁদছে কারা!

গ্রামে ঘটে গেছে আজ অদ্ভুত এক কাণ্ড। নূরজাহান নামের একটা কিশোরী মেয়ে মান্নান মাওলানা সাহেবের মুখে থুতু ছিটিয়ে দিয়েছে পুলিশ দারোগার সামনে। মাওলানা সাহেবের বাড়ির পুরানা গোমস্তা মাকুন্দা কাশেম গোরু চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়েছিল। সব মিলিয়ে ভালরকম ভজঘট।

কিন্তু মরনির ঘরে এভাবে কাঁদছে কারা?

আদিলউদ্দিনের ইচ্ছা হল দরজায় ধাক্কা দিয়ে মরনিকে সে ডাকে, জিজ্ঞাসা করে কে কাঁদে, কী হয়েছে। কিন্তু এ করতে গেলেই তো ঘরের ভিতরকার লোকেরা জেনে যাবে আদিলউদ্দিনের কথা, মরনি একটা বিপাকে পড়বে।

এসব ভেবে মনের ইচ্ছা মনে চেপে রাখে আদিলউদ্দিন। বাড়িতে এসে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে রহমান হালদারের কুকুরটা এসে আহ্লাাদ জানাতে শুরু করেছে। কুকুরটাকে পাশ কাটিয়ে নিজের ঘরে এসে ঢুকল আদিলউদ্দিন, দরজা বন্ধ করল। পবনদের সঙ্গে খাওয়াদাওয়া সেরেই অজু করে নিয়েছিল। এখন ঘুটঘুইট্টা অন্ধকার বিছানায় নামাজে দাঁড়াল সে। নামাজের শেষ পর্যায়ে, পরম করুণাময়ের উদ্দেশে মোনাজাতের জন্য দুইহাত তুলেই। একজন মানুষের কথা মনে পড়ল আদিলউদ্দিনের। তার প্রথম ঘরের সন্তান মজনু। কেমন। আছে সে?

মজনুর জন্য বুকটা তোলপাড় করতে লাগল তার! গাল বেয়ে নামল গভীর কষ্টের কান্না! অন্ধকার ঘরে পরম করুণাময়ের উদ্দেশে তোলা মোনাজাতে সে বলল, ইয়া হে আল্লাহ, ইয়া রাব্দুল আল আমীন, যেই পোলারে জন্ম দিয়াও আমি তার মিহি ফিরা চাই নাই, তার কথা ভাবি নাই, আমার হেই পোলাডারে তুমি ছহি ছালামতে রাইখো। অরে তুমি বাঁচাইয়া রাইখো।

.

কীরে মুকসেইদ্দা চোরা, আছস কেমুন?

লঞ্চের সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে নিজেকে এই প্রশ্নটা করল মুকসেদ আলী। মাওয়ার যে ঘাটে এখন লঞ্চ ভিড়ে সেটা কোনও পাকাপাকি ঘাট না। শেহের আলী পিয়নের বাড়ি বরাবর ভাঙনের দিকে আইডব্লিউটি-এর ছোট্ট একখান জেটি বান্ধা। এই জেটিতে এসে লাগে লঞ্চ। সিঁড়ি নামিয়ে দিলে যাত্রীরা নামে।

বহু বছর ধরে মাওয়ার এদিকটা ভাঙতে ভাঙতে গত কয়েক বছর হল ভাঙনটা থেমেছে। পদ্মার এদিক ওদিক চর পড়তে শুরু করেছে। একবার চর পড়তে শুরু করলে ভাঙন কমে আসে। তবে ভাঙনে ভাঙনে এলাকার সর্বনাশ যা হওয়ার অনেকদিন আগেই হয়ে গেছে। কত গ্রাম, কত বসত ভিটা, কত জমি, মাঠ বিলীন হয়ে গেছে।

আজ যেখানে মাওয়ার লঞ্চঘাট আর বাজার, এই বাজার লঞ্চঘাট এখানে ছিল না। বাজার ছিল এখনকার বাজার থেকে, কালিরখিলের মাঠ থেকে বেলদার বাড়িগুলি ছাড়িয়ে। আধামাইল দক্ষিণে। শ্রীনগর থেকে গোয়ালিমান্দ্রা হয়ে হলদিয়ার দিকে চলে যাওয়া একটা খাল গোয়ালিমান্দ্রার হাটের উত্তরে কাজিরপাগলার দিকে ঢুকে গেছে। সেই খাল সীতারামপুর। হয়ে দক্ষিণ মেদিনীমণ্ডলের ভিতর দিয়ে মাওয়ার বাজারের পাশ দিয়ে পদ্মায় পড়েছিল। বাজারের লগে রিশিপাড়া (মুচিপাড়া), খালের ধারে। রিশিপাড়ার দক্ষিণ দিকটায় ছিল পূজামণ্ডপ। তিনদিকে বাঁশের বেড়া, সামনেটা ভোলা আর মাথার উপর ঢেউটিন ফেলা মণ্ডপে বছরভর কোনও না কোনও মূর্তি দাঁড়িয়ে থাকত।

এই পূজামণ্ডপের ডানদিকে খালের পার ধরে একখানা রাস্তা চলে গেছে বাজারের দিকে। রাস্তা গিয়ে শেষ হয়েছে ছোট্ট একখানা মাঠে। মাঠের উত্তরে খালের উপর কাঠের পুল। পুলের ওপারে তিন-চাইরখান টিনের ঘরে অফিস কাছারি। দক্ষিণে, মাঠের পশ্চিমকোণে হাজার হাজার ঝুরি নামানো বিশাল বটগাছের দক্ষিণ দিককার তলায় পোস্ট অফিস। পোস্ট অফিসের নাক বরাবর দক্ষিণে দুই সারি টিনের ঘরের দোকানপাট, মাঝখানকার ফাঁকা জায়গায় কাঁচা বাজার। মাছচালার লগে, পুবদিকে একখান পালকি আরেকখান মাফা (ডুগি) নিয়ে বসে থাকত উড়িয়া বেহারারা।

রিশিপাড়ার পূজামণ্ডপের নাক বরাবর যে পায়েচলা পথ সেটা সোজা চলে গেছে মাওয়ার বাজার হাতের ডাইনে রেখে নদীর ঘাটে। পূজামণ্ডপ থেকে কিছুদূর আগালেই ডানপাশে পথের ধারে ছিল একজোড়া জামগাছ। জামগাছের পেছনে ছোট্ট একখণ্ড শস্যজমি। বছরভর আখ জন্মে থাকত সেই জমিতে। জামগাছ দুইটার মুখ বরাবর পুবপাশেও আখের জমি, দিনেরবেলাও আবছায়া হয়ে থাকত জায়গাটা।

বাজার ছাড়িয়ে পশ্চিম-দক্ষিণ কোণে খাল আর নদীর মুখে ছিল লঞ্চঘাট। তখন জেটি ছিল না। নদীতীরের চটান মাটি ভাঙনের দিকে এসে দাঁড়াত লঞ্চ, লম্বা সিঁড়ি নামিয়ে দিত। ওই সিঁড়ি বেয়ে টলমল পায়ে ওঠানামা করত যাত্রীরা।

নদীর ওইদিককার তীর ধরে মানুষের ঘরবাড়ি ছিল। আর ছিল জেলে নাও। কোনওটা ডাঙায় তোলা, আলকাতরা গাব দেওয়া হয়েছে, মেরামত হচ্ছে কোনও কোনওটা। নদীতীরে ইলিশের জাল শুকাতে দিয়েছে জেলেরা। পড়ন্ত বিকালে নদীতীরে বসে বিড়ি কুঁকছে কোনও কোনও আয়েশি জেলে।

বেশিকাল আগের কথা না এসব। স্বাধীনতার পনেরো-বিশ বছর আগের কথা। তারপর বছর বছর ভাঙন। কোথায় গেল সেই নদীর ঘাট, মাওয়ার সেই বাজার, বটতলার পোস্ট অফিস। কোথায় গেল জোড়া জামগাছ, আখের খেত, রিশিপাড়া আর তাদের পূজামণ্ডপ। বাজারের পশ্চিম কোণে, নদীতীরের দুই একটি বাড়িঘর আর বাজারখোলার মাঝখানে কানি দুই তিনেক জমিন ছিল, সেই জমিনে একবার বিশাল প্যান্ডেল বেঁধে সার্কাস হয়েছিল। এলাকার মানুষজন ভেঙে পড়েছিল সার্কাস দেখতে। কোথায় নদীর কোন অতলে তলিয়ে গেছে সেই জমি!

তারপর মাওয়ার বাজার শুধু পিছিয়েছে। কয়েক বছর একজায়গায় থাকে বাজার, পদ্মার ভাঙন শুরু হয় আর পিছাতে থাকে বাজার। আজ শেহের আলী পিয়নের বাড়ি বরাবর নদীর ঘাটে লঞ্চ থেকে নেমে সেই পুরানা লঞ্চঘাট আর মাওয়ার বাজার, রিশিপাড়া সব যেন চোখের উপর পরিষ্কার দেখতে পেল মুকসেদ। রিশিবাড়িগুলির চারপাশে ছিল কলাগাছ। খরালিকালের নদী থেকে আসা হাওয়ায় অবিরাম বুক পিঠ দেখাত কলাপাতা। সেরকম কলাপাতার ছায়ায় ছায়ায় কতদিন মাওয়ার বাজারে হেঁটে গেছে মুকসেদ।

এখনকার লঞ্চঘাটে ছোট ছোট দুইখান বিড়ি সিগ্রেট আর পানের দোকান। জের বয়াম ভরা বিস্কুট আছে, পাঁউরুটি কলা আছে দোকানে। শিশুদের দুই-চারটা প্লাস্টিকের খেলনাপাতি আছে। রাজা কনডোমের লম্বা মতন বাক্সও আছে, মায়া বড়ির বাক্স আছে। লঞ্চ থেকে নামা যাত্রীদের কারও কারও যে এসব জিনিসের দরকার সেকথা বেশ ভালই বুঝতে পারছে চতুর দোকানিরা।

বুঝতে না পারার কথাও না। দুই-চার-ছয় মাস পর পর বাড়ি ফিরে ঢাকা মুনশিগঞ্জ চাঁদপুরে চাকরিবাকরি কায়কারবার করা লোকজন। বাড়ি ফিরে স্ত্রীর সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য দিকপাশ ভাববার সময় থাকে না। তখন তো এসব জিনিসের দরকার পড়বেই! তা ছাড়া দেশগেরামের মানুষ কি আর আগের মতো বলদ এখন! মানুষ গেছে বুদ্ধিমান হয়ে। বছর বছর সন্তান উৎপাদনে তাদের আজকাল আগ্রহ নাই।

মুদিদোকান দুইটার পাশে একখান চায়ের দোকানও আছে। এই দোকানের সামনে। দাঁড়িয়ে পলকের জন্য নিজের ছেলেটার কথা মনে পড়ল মুকসেদের। নিজের ঔরসে জন্মেও যে হয়ে গেছে অন্যের সন্তান।

এই নিয়ে দীর্ঘশ্বাস পড়ল না মুকসেদের। দোকানিকে এককাপ চা দিতে বলে উদাস হয়ে নদীর দিকে তাকিয়ে রইল। পকেটে সিজার্স সিগ্রেটের প্যাকেট আছে, চা খেয়ে সিগ্রেট ধরাবে সে।

তখন শেষ বিকালের রোদে পাকা মিষ্টি কুমড়ার রং ধরেছে। পদ্মার পানি আর নদীতীরের চটান মাটি থেকে একটু একটু করে সরে যাচ্ছে রোদ। শেহের আলি পিয়নের বাড়ির গাছপালা আর ঘরদুয়ারের আড়ালে আবডালে জমছে হালকা অন্ধকার। চা খেতে খেতে সেই অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে রইল মুকসেদ।

দোকানের ভিতর দিকে বসা একজন লোক চোখ সরু করে মুকসেদের দিকে তাকাল। আপনেরে চিনা চিনা লাগে! বাড়ি কই?

ঘাড় ঘুরিয়ে লোকটার দিকে তাকাল মুকসেদ। মেদিনমণ্ডল।

মেদিনমণ্ডল কোন বাড়ি?

কইলে চিনবেন?

চিনুম না ক্যা?

আপনের বাড়িও মেদিনমণ্ডল?

না, কুমারবুগ।

কুমারবুগ কোন বাড়ি?

পিয়ার খাঁ-র বাড়ির দক্ষিণের বাড়িঐ আমগো।

আর আমগো বাড়ি অইলো মান্নান মাওলানার বাড়ির লগে। হের বাড়ি থিকা তিন-চাইর কাইক (পা)।

নাম কী আপনের?

চা শেষ করে সিগ্রেট ধরাল মুকসেদ। চায়ের পয়সা দিতে দিতে বলল, আসল নাম কইলে চিনবেন?

লোকটা হাসল। থাউক, কওনের কাম নাই। আমি আপনেরে চিনছি। আইলেন কই থিকা?

মুনশিগইঞ্জ থিকা।

লোকটা আবার হাসল। বুজছি।

তারপর লঞ্চঘাটে আর দাঁড়ায়নি মুকসেদ। বাজারের দিকে হাঁটা দিয়েছে। পরনে উঁচু করে পরা নীল সাদায় মিশানো লুঙ্গি আর মরাপাতা রঙের ফতুয়া। মুখে কাঁচা পাকায় মিশানো ঘন দাড়ি মোচ। মাথার চুলও দাড়ি মোচের মতোই, কাঁচা পাকা, তবে এই বয়সেও বেজায় ঘন। বহুদিন কাচি পড়েনি চুলে, লম্বা হয়েছে বেশ। জেল থেকে বেরিয়েই সেলুনে যাওয়া উচিত ছিল। সময়ের অভাবে যাওয়া হয়নি। আধঘণ্টার মধ্যে ঢাকার লঞ্চ এসে লাগবে মুনশিগঞ্জ ঘাটে। সেই লঞ্চ পদ্মা ধরে লৌহজং হয়ে যাবে ভাগ্যকূল, মাঝখানে থামবে মাওয়ার ঘাটে। এই লঞ্চ ধরতে পারলে আজ সন্ধ্যায়ই বাড়ি যাওয়া যায়। আর নয়তো আজকের বাকি দিনটা রাতটা মুনশিগঞ্জে কাটাতে হয়।

ইব্রাহিম অবশ্য অন্য একটা বুদ্ধি দিয়েছিল। বলেছিল, লও আগে কোনও হইটালে বইয়া। ভাত খাই। তারবাদে আমার লগে লও ঢাকা। কলতাবাজারে আমার সমন্দির বাসা। হেই বাসায় আউজকা রাইতটা থাইক্কা কাইল বিয়ানে সদরঘাট থিকা লঞ্চে উইট্টো। ঢাকার টাউনে হারা রাইত সেলুন খোলা থাকে। ওহেন থিকা খেরি অইয়া (চুল কাটানো, ক্ষৌরিকর্ম অর্থে) লইয়ো।

শুনে মুকসেদ বলেছে, এত হাঙ্গামার কাম নাই। আমি অহনকার লঞ্চটাই ধরি। তুই ঢাকা যা, তর কাম সাইরা আয়। বুদ্ধি পরামর্শ যা করনের তারবাদে করুম নে। টেকা পয়সার হিসাবও পরে অইবো নে। অহন তিনশো টেকা দিয়া যা আমারে।

ইব্রাহিমের কাছ থেকে তিনশো টাকা নিয়ে লঞ্চে চড়েছিল মুকসেদ।

এখন বিকাল শেষ হয়ে গেছে। মাওয়ার বাজারে এখন কি নাপতাদের কাউকে পাওয়া যাবে! খেরিটা আজই করা দরকার। মোচ দাড়ি আর রাখবেই না। একেবারেই কামিয়ে ফেলবে। চুলটাও করবে কদমছাট যাতে লোকে চট করে দেখেই তাকে আর চিনতে না পারে। এবার মনের ভিতর অন্য রকমের একটা চিন্তা আছে তার। দেখা যাক রূপ বদলে সেই চিন্তা কাজে লাগানো যায় কি না!

.

মাওয়ার বাজারে ঢোকার মুখে পথের ধারে দুলালের সেলুন।

হাত তিন-চারেক লম্বা কালো রঙের সাইনবোর্ডে সাদা অক্ষরে লেখা দুলাল সেলুন’। মাথার উপর চার-পাঁচখান ঢেউটিন ফেলে, চারদিকে বাঁশের বেড়া, সস্তা ধরনের কাঠের নড়বড়ে দরজা, ভিতরে ঠিক দরজা রঙের কাঠের বাক্স, বাক্সের উপর হাত দুয়েক লম্বা এবং চওড়া মুখ দেখার আয়না লাগানো, তার সামনে হাতআলা চেয়ার, মুখ দেখার আয়নার তলায় ক্ষুর কচি বিভিন্ন রকমের চিরুনি, ছোট্ট অ্যালুমিনিয়ামের বাটিতে রাখা সাবান, সাবানের পাশে বহু ব্যবহারে ম্লান হয়ে যাওয়া মুখ কামানোর কাজে ব্যবহার করার বুরুশ ব্রাশ), বুরুশের পাশে অর্ধেক খালি হওয়া ডেটলের শিশি, বড় এক টুকরা ফিটকিরি, ঘাড়ে লাগিয়ে গোড়া থেকে চুল ছেটে তোলার হ্যাঁন্ডেলঅলা একখান যন্ত্র, পুরানা (তোয়ালে) আর কামাবার সময় খরিদ্দারের (খদ্দেরের) গায়ে জড়িয়ে রাখার সাদা সস্তা ধরনের কাপড়, এই হচ্ছে দুলালের সেলুন। মাটির মেঝের একপাশে দুই-তিনজন লোক বসতে পারে এমন একখান বেঞ্চ আছে। বেড়ার গায়ে পুরনো খবরের কাগজ আঠা দিয়ে খুবই যত্ন করে সঁটা হয়েছে। বেড়ার একদিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শহিদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের রঙিন পোস্টার পাশাপাশি লাগানো। তার তলায় সাদা লম্বা কাগজে বড় বড় করে লেখা রাজনৈতিক আলোচনা নিষেধ।

দুলালের সেলুনে এখন পুরনা হ্যাঁজাক জ্বলছে। বাতিটার একদিককার ভাঙা কাঁচে সাদা কাগজ লাগিয়ে রাখা হয়েছে। তাপে তাপে কাগজটা হলুদ বর্ণ হয়ে গেছে। ভিতরে ম্যান্টেলের এককোনা খুলে পড়েছে। শো শো শব্দ আছে বাতিটার। তবু এই বাতির আলোয় দুলালের সেলুন আলোকিত। আলো পছন্দ করা কয়েকটা পোকা এসে ওড়াউড়ি করছে হ্যাঁজাক বাতির চারপাশে। এই বাতির দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে বেঞ্চে বসে আছে দুলাল। তার পাশে রাখা কালো রঙের ছোট্ট টেপ রেকর্ডার। তাতে সাবিনা ইয়াসমিনের গান হচ্ছে ‘এই মন তোমাকে দিলাম।

মুকসেদ এসে দুলালের সেলুনে ঢুকল।

খরিদ্দার দেখলে খুবই পুলকিত হওয়ার স্বভাব দুলালের। মুকসেদকে দেখেও হল। তড়াক করে লাফিয়ে উঠেই হাসিমুখে সালাম দিল। আছোলামালাইকুম।

সালামের জবাব দিল না মুকসেদ। দুলালের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি আমারে চিনো?

দুলাল আগের মতোই হাসিমুখে বলল, না।

মুকসেদ হাঁপ ছাড়ল। তয় ঠিক আছে।

তারপর চেয়ারটায় গিয়ে বসল। দুলাল এসে দাঁড়াল তার পিছনে। সামনে রাখা আয়নার ভিতর দিয়ে মুকসেদের মুখের দিকে তাকাল। মুখ বানাইবেন? দাড়িমোচ ছাঁটবেন?

না হালাই দিমু।

পুরা হালায় দিবেন?

হ।

আইচ্ছা। মাথার চুলও তো লাম্বা অইছে। খেরি করবেন?

হ। চুল এক্কেরে গিনি গিনি (অতিছোট অর্থে) কইরা দিবা।

দুলাল আর কথা বলল না। নাপলি কাজের সাদা কাপড় মুকসেদের গলা থেকে হাঁটু তরি নামিয়ে দিল, তারপর গলার কাছে গিঁটটু দিয়ে বেঁধেই চিরুনি আর কেঁচি হাতে নিল। আগে খেরিডা করি তারবাদে মোক বানামুনে।

আইচ্ছা। তয় চুল একদোম ছোড করবা। কদমছাঁট।

দুলাল হাসল। আইচ্ছা।

তারপর খুটখুট করে কাঁচি চালাতে লাগল।

মুকসেদের স্বভাব হচ্ছে ক্ষৌরকর্মের সময় ঘুমানো। চেষ্টা করেও চোখ বেশিক্ষণ খোলা রাখতে পারে না। এখন এই চেয়ারে বসার পর পরই, দুলাল তার মাথায় কাঁচি লাগাবার পর পরই চোখ টানতে শুরু করেছে। তারপরও মুকসেদের খুব ইচ্ছা করছে দুলালের সঙ্গে কথা বলার। কারণ লোকটাকে সে চিনতে পারছে না। এই এলাকায় সেলুন দিয়ে বসেছে অথচ মুকসেদ চিনে না, এ কেমন কথা! না হয় বছরখানেক পর নিজের এলাকায় এসেছে। সে, এই এক বছরে সড়কের কাজে ম্যালা নতুন লোকজন এসে থান গাড়ছে এলাকায়, নাপিতও সেইরকম কেউ কি না বোঝা দরকার।

মুকসেদ বলল, নাম কী তোমার?

দুলাল তার স্বভাব মতো হাসিমুখে বলল, দুলাল। সেলুনে ঢোকনের আগে সাইনবোর্ড দেহেন নাই? দুলাল সেলুন। আমার নামঐ দুলাল।

বাড়ি কই?

পুব কুমাড়বুগ। চন্দ্রের বাড়ির মাডের দক্ষিণে।

ইন্দু না মোসলমান?

দুলাল আবার হাসল। মোসলমান।

দোকান দিছো কবে?

বেশিদিন না। সাত-আষ্ট মাস অইছে। আগে দোকান আছিল না। জলচকি লইয়া শিমইল্লা (শিমুলিয়া) বাজারে বইতাম। ওই মিহি কাম কাইজ কম। অহন কাম কাইজের জাগা অইল মাওয়া। রাস্তার কামে মানুষজনের আকাল নাই এই মিহি। নাইলে দেহেন না, দ্যাশ গেরামে রাইত্রে নাপতের দোকান খোলা থাকেনি?

হ ঠিকঐ কইছো।

আপনেগো বাড়ি কোন গেরামে? এই দ্যাশের মানুষ তো? নাকি অন্য কোনওহান থিকা আইছেন?

আয়নার ভিতর দিয়ে দুলালের মুখের দিকে তাকাল মুকসেদ। হাসল। তোমার কী মনে অয়?

মুকসেদকে হাসতে দেখে দুলালও হাসল। বোজতে পারতাছি না।

কথা হুইন্নাও বোজতাছো না?

হ হেইডা বোজতাছি।

কী বোজতাছো কও তো?

কথা হুইন্না তো আমগো দ্যাশের মানুষঐ মনে অয়।

হ তোমগো দ্যাশের মানুষঐ আমি।

কোন গেরামের?

গ্রামের নাম বলল মুকসেদ।

শুনে দুলাল বলল, মেদিনমণ্ডলের মানুষ আপনে, তয় আপনেরে তো কোনওদিন দেহি। নাই। দ্যাশ গেরামে থাকেন না?

না।

তয় থাকেন কই?

নানান জাগায়।

করেন কী?

বিজনিস আছে আমার, বিজনিস।

কীয়ের বিজনিস?

নানান পদের। যহন যেই বিজনিসে সুবিদা অয় ঐডা করি।

কথা অন্যদিকে ঘোরাল মুকসেদ। তুমি ইন্দু না মোসলমান জিগাইছি দেইখা কিছু মনে করো নাই তো?

দুলাল তার মতো করে হাসল। না মনে করুম ক্যা? এতে মনে করবার কী অইলো?

তয় আমারে জিগাও, ক্যান কথাডা আমি জিগাইলাম?

লোকটার কথাবার্তার ধরন বেশ মজার। কথা বলতে ভাল লাগছিল দুলালের। কথাটা জিজ্ঞাসা করবার আগে মুকসেদের নাম জানতে চাইল সে। নামটা বলল মুকসেদ। তারপর দুলালের জিজ্ঞাসা করার ধার না ধেরে বলল, আমগো দ্যাশে আগে নাপলি করতো ইন্দুরা। তোমার নাম হইল দুলাল। দুলাল কইলাম ইন্দু মোসলমান দুই জাতের মাইনষের নামঐ হইতে পারে।

হ ঠিকঐ কইছেন।

এর লেইগাঐ জিগাইছি। আমগো দ্যাশ তো আগিলা দিনে ইন্দুতে ভরা আছিলো। কালিরখিল, কুমারবুগ মেদিনমণ্ডল বেবাকঐ আছিলো ইন্দু গেরাম। এই মাওয়ার বাজারে জলচকিতে বইয়া নাপতালি করতে নিতাই। ধোয়া লুঙ্গি আর সাদা শার্ট ফিনতো। কথাবার্তা ভদ্রলোকের লাহান। আর দেখতে যে কী সোন্দর আছিল নিতাই! যাত্রা সিনামার হিরুগো লাহান। নিতাইয়ের মিহি চাইলে খালি চাইয়া থাকতে অইতো। চক্ক ফিরান যাইতো না। নিতাইয়ের লাহান সোন্দর পুরুষোেলা জিন্দেগিতে আমি দেহি নাই।

দুলাল বলল, হেয় কো অহন? মইরা গেছেনি?

আরে না মিয়া। আমগো থিকা বম্বে (বয়সে) কম। বাইচ্চাঐ আছে।

থাকে কই?

এই দ্যাশে আর থাকে না। কইলকাত্তা গেছে গা। দুইবার এই দ্যাশ থিকা ইন্দুরা ইন্ডিয়ায় গেছে। একবার অইলো পার্টিশনের সময় আরেকবার অইলো স্বাধীনতা যুইদ্ধের সময়। নিতাই গেছে স্বাধীনতা যুইদ্ধের সময়। তয় কইলকাত্তায় ভালঐ আছে। তোমার লাহান সেলুন দিছে।

আপনে হোনলেন কার কাছে?

আমগো গেরামের বহুত মানুষ আছে যারা ফুটুর ফুটুর কইলকাত্তা যায় আর আহে। বেলাকার (ব্যাকার)। বেলেক করতে যায়। নিতাইয়ের লগে তাগো দেহা অয়। দ্যাশের মাইনষেরে বহুত খাতির করে নিতাই। এই বেলেকারগো মোখেঐ আমি নিতাইয়ের কথা হুনছি।

মুকসেদের মাথার চুলে কদমছাটটা তখন পুরাপুরিই দিয়ে ফেলেছে দুলাল। চুলে কদমছাট পড়ার ফলে চেহারা অনেকখানিই বদলেছে মুকসেদের। এখন দাড়িমোচ কামানো হলে পুরাপুরিই বদলাবে। এই বদলটা দেখবার জন্যই দুলালের লগে কথা বলে চোখের টানটা সরিয়ে রাখতে চাইছে মুকসেদ! কিছুতেই ঘুমাতে চাইছে না!

আধঘণ্টা পর দুলালের দোকান থেকে অন্য চেহারার মানুষ হয়ে বেরুল মুকসেদ।

কোনও কোনও মানুষ টাকি মাছের মতন। বিপদ আপদের হাত থেকে খালি পিছলে যায়, খালি পিছলে যায়। বিপদ এসে থাবা দিয়ে ধরে ঠিকই, ধরার লগে লগে থাবার ফাঁক ফোকর দিয়ে ছাট করে পিছলে যায়। অবিকল টাকি মাছ।

গ্রাম দেশে শীতকালের খাল বিল পুকুর ডোবায় হাতিয়ে মাছ ধরার নিয়ম আছে। মাজা পানিতে নেমে উপুড় হয়ে, থুতনি পানিতে ছুঁই ছুঁই, এই অবস্থায় পানির তলায় দুইহাতে ঠাওর করে করে মাছ ধরা। যেসব মাছ কাদায় থাকে হাতিয়ে হাতিয়ে সেই মাছগুলিই শুধু ধরা যায়। যেমন শিং মাগুর কই ভেদা টাকি। কখনও কখনও পুঁটি ট্যাংরা খলিসা বাইল্লা ফলি পাবদা এসব মাছও পাওয়া যায়। হাতিয়ে হাতিয়ে কোনও মাছ ধরার ক্ষেত্রেই কোনও অসুবিধা নাই, অভ্যস্ত হাতে আরামছে ধরা যায়। সমস্যা করে শুধু টাকিমাছ। মুঠ করে ধরার পরও পিছলে যায়। বিপদের হাত থেকে জীবনভর যেমন করে পিছলাচ্ছে। মুকসেদের তিরিশ-চল্লিশ বছরের চোরজীবনের সঙ্গী সীতারামপুরের ইব্রা জোলা। আজতক যতবার ধরা পড়েছে মুকসেদ ঠিক ততবারই ধরা পড়ার কথা ইব্রার, কিন্তু ধরা সে পড়েনি। দারোগা পুলিশ ঠিকই তার বাড়িতে গিয়ে হানা দিয়েছে হানা দিয়ে কোনও লাভ হয়নি তাদের। না কোনও চোরাইমাল তারা পেয়েছে, না পেয়েছে ইব্রা জোলাকে। মাল সামানসহ কেমন কেমন করে যেন উধাও হয়ে গেছে ইব্রা। দারোগা পুলিশ আসার খবর কেমন করে পেয়েছে, কোথায় চোখের পলকে উধাও হয়ে গেছে এই রহস্য ইব্রা ছাড়া কেউ জানে না। মুকসেদ দুই-চারবার জানতে চেয়েছে, ইব্রা কোনও জবাব দেয়নি। মিটিমিটি হেসেছে।

ইব্রার পুরা নাম ইব্রাহিম। সীতারামপুরের লোক। সীতারামপুরের বেশির ভাগ লোক তাঁতি, কারিকর। ইব্রাহিমও তাই। কিন্তু নামের সঙ্গে তার লেগে আছে ‘জোলা’ কথাটা। এলাকার লোক ইব্রাহিমকে বলে ইব্রা জোলা, মুকসেদকে যেমন বলে মুকসেইদ্দা চোরা।

বিক্রমপুর অঞ্চলে জোলা কথাটা গালের পর্যায়ে। সুধীজনরা জানেন হিন্দু ধর্মের যারা কাপড় বোনার কাজ করে অর্থাৎ তাঁতের কাজ করে তাদেরকে বলে ‘তাতি’ আর মুসলমান যারা এই কাজ করে তাদেরকে বলে ‘জোলা’। শব্দটা কী এমন দোষ করেছে যে কারণে এটা গালের পর্যায়ে চলে গেছে একথা কেউ ঠিকঠাক বলতে পারবে না। তবে শ-দেড়শো বছর আগ থেকেই এই অঞ্চলের জোলারা নিজেদেরকে ‘কারিকর’ বলতে পছন্দ করছে। বলে আসছেও। দেশগ্রামে কখনও কখনও এমনও হয়েছে কারিকরদের কাউকে ইচ্ছাকৃতভাবে ভুল করে জোলা বলেছে কেউ, সঙ্গে সঙ্গে তুলকালাম হয়ে গেছে। সীতারামপুরের লোকেরা। লাঠি সড়কি নিয়ে বেরিয়েছে। গ্রামের চেয়ারম্যান মেম্বাররা, মাতব্বররা বিচার সালিশ করে সেই ঝগড়া মিটিয়েছে। হিন্দু থেকে মুসলমান হওয়া একটি শব্দের এ কেমন অপরাধ কে জানে!

ইব্রাহিমের ক্ষেত্রে ব্যাপারটি অন্যরকম। আড়ালে আবডালে এমনকী সামনাসামনিও যে লোকে তাকে ইব্রা জোলা বলে ডাকে, ইব্রাহিম রাগ বিরক্ত কোনওটাই হয় না। সে তার মতো আছে। তাঁতি জোলা কারিকর কোনওটাতেই যেন কিছুই এসে যায় না তার। বাড়িতে সাতখান তাঁত। আপন আর চাচাতো ভাই বেরাদররা সবাই, এমনকী বাড়ির বউঝিরা তরি তাঁত চালায়। প্রতি মঙ্গলবার গোয়ালিমান্দ্রার হাটে গিয়ে শাড়ি লুঙ্গি গামছা বিক্রি করে আসে। ইব্রার ছেলে থাকলে তারাও নিশ্চয় এতদিনে এই পেশায়ই ঢুকে যেত। হয়তো বাপের চুরির মালসামান রাখার আর বিক্রি করার পেশাটাও ধরত। সেই পেশা আড়ালে আবডালে। লোকের চোখের সামনে তাঁতই চালাত! প্রথম জীবনে ইব্রাও তাই করেছে। দিনভর তাঁতের কারবার, রাতভর মুকসেইদ্দা চোরার চুরির মাল সামলানো। দিঘলির চোরাইমাল কিনাবেচার মহাজনদের সঙ্গে যোগাযোগ টাকা পয়সার লেনদেন। ছেলে থাকলে। ছেলেরাও নিশ্চয় তাই করত। ছেলে ইব্রার নাই। আছে তিনটা মেয়ে। জ্ঞাতিগোষ্ঠীর মধ্যেই। বিয়া হয়েছে মেয়েদের। বড় তো তাদের নিজের বাড়িরই বউ। বড়চাচার মাজারো পোলা ইউনুসের বড়পোলা রমজানের লগে বিয়া হইছে। মেয়ের নাম ফরিদা। বাড়ির লোকে ডাকে ফরি। প্রথমে একটা ছেলে হয়েছে ফরির, তারপর যমজ মেয়ে। পোলাপান সামলেও স্বামী শ্বশুরের কাপড় বোনার কাজে হাত লাগায় সে। খুবই পরিশ্রমী স্বভাবের মেয়ে।

অন্য মেয়ে দুইটা আরজু আর গুনাই। ইব্রা জোলার বাড়ির দুই-তিন বাড়ি এদিক ওদিক বিয়া হয়েছে। একটা দুইটা পোলাপান দুইজনেরই আছে। সংসার তারা ভালই করছে। তবে ছোটমেয়ে গুনাই ছোটবেলা থেকেই রোগাভোগা। শরীর কোনওদিনই ভাল থাকে না। আজ এটা কাল ওটা লেগেই আছে। জামাইটার নাম ফইজু। খুবই নির্বিরোধ ধরনের সোজা মানুষ। রোগা বউ নিয়েই বেদম সুখে আছে।

তিন মেয়ের বিয়া হয়ে যাওয়ার পর ইব্রা গেছে ঝাড়া হাত-পা হয়ে। সংসারে মন নাই। মুকসেদের সঙ্গে লেগে থাকা ছাড়া কোনও কাজও করে না। মুকসেদ জেলে গেলে উকিল মোক্তার ধরে তার জামিনটামিন করানোর কাজটা গুরুত্ব দিয়ে করে। বহুদিন ধরে এই একই কাজ করছে বলে মুনশিগঞ্জ কোর্টের বেশির ভাগ উকিলই তার পরিচিত। কোর্টের কর্মচারীরাও পরিচিত। ফলে কাজটা সে ভালভাবেই করতে পারে। মুকসেদের টাকাপয়সা তো তার কাছেই থাকে। থাকলে হবে কী, ইচ্ছামতো খরচাটা ইব্রা কখনও করে না। খুবই হিসাবি মানুষ সে। চোরের শাগরেদ হয়েছে বলেই যে অসৎ চরিত্রের হবে তা না। একটা পয়সাও এদিক ওদিক করার অভ্যাস নাই। টাকাপয়সা নিয়ে এই এতগুলি বছরে ইব্রার সঙ্গে মুকসেদের কখনও গন্ডগোল হয়নি। ইব্রার হিসাবে আজ পর্যন্ত কোনও গরমিল মুকসেদ পায়নি। চোর হয়েও যে নীতিবান হতে পারে কেউ ইব্রা তার প্রমাণ।

আর আরেক মানুষ হল ইব্রার বউ জহুরা। তিন মেয়ের বিয়া হওয়ার পর সেও গেছে সংসার উদাসী হয়ে। বাড়িতে, নিজের ঘরে বলতে গেলে সে থাকেই না। দিনভর পড়ে থাকে মেয়েদের জামাই বাড়িতে, তাদের ঘরে। মেয়েদের ঘরের নাতিনাতনিরা হচ্ছে তার জান। সারাদিন তাদের নিয়ে ব্যস্ত থাকে। শুধু রাতেরবেলা এসে নিজের ঘরে শোয়। নাতিনাতনির বাইরে যে তার কোনও আপনজন আছে, স্বামী ইব্রাহিম যে এখনও জীবিত সে-কথা যেন তার মনেই থাকে না। মুকসেদকে ছাড়াবার কাজে দিনের পর দিন যে মুনশিগঞ্জে পড়ে থাকে, বাড়ি যে ফিরে না, তাও যেন টের পায় না। কোনও কোনও সময় যে ঢাকায় জহুরার বড় ভাইর বাসায় গিয়েও থাকছে ইব্রাহিম সে-কথাও জানে না জহুরা, জানার কোনও আগ্রহও যেন তার নেই। সব মিলে অদ্ভুত সম্পর্ক। একসঙ্গে থেকেও দুইজন মানুষ যেন একসঙ্গে নাই, দুইজন মানুষ যেন আলাদা। ইব্রা জোলা আছে মুকসেদকে নিয়ে, জহুরা আছে তার মেয়ে আর নাতি-নাতকুড়দের নিয়ে।

দুলালের সেলুন থেকে বেরিয়েই ইব্রা আর তার সংসারের এসব কথা আজ মনে পড়ল মুকসেদের! কোন মুহূর্তে কোন কথা যে মনে পড়ে মানুষের মানুষ নিজেও তা জানে না। নিজের এই দীর্ঘ জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে মুকসেদ জেনেছে মানুষের শরীরের ভিতর যেখানেই লুকিয়ে থাক মন, মন এক গভীর রহস্যময় বস্তু। মন চিন্তা করবে মনের মতো। শাসন মানতে চায় না।

পকেট থেকে সিজার্স সিগ্রেটের প্যাকেট বের করল মুকসেদ, ম্যাচ বের করল। সিগ্রেট ধরিয়ে ভাবল কোন পথে এখন বাড়ি যাবে সে। ঢাকা থেকে উঁচু হয়ে আসা সড়ক ধরবে, নাকি কালিরখিলের ওদিককার পথ!

তারপর অবশ্য কালিরখিলের পথ ধরেই গ্রামের দিকে হাঁটা দিয়েছে মুকসেদ। এদিক দিয়ে গেলে নিজেদের বাড়ি একটু ঘুরপথ হয়, তবু এই পথটাই মুকসেদ ধরল। সিগ্রেট টানতে টানতে মাঘ সন্ধ্যার অন্ধকার গ্রাম পথে হাঁটতে হাঁটতে আশ্চর্য রকমের এক আনন্দে ডুবে যাচ্ছিল সে।

দবির গাছির বাড়ির সামনে এসেই মনের আনন্দময়তায় চিড় ধরে গেল মুকসেদের। এরকম সন্ধ্যারাতে কুপি বাতির আলো নাই কেন বাড়িতে! শীতকালের সন্ধ্যা অনেকখানি হয়ে যাওয়ার পর নিশ্চয় গাছবুরা শেষ করে বাড়ি ফিরে দবির। কাঁধের ভার উঠানে নামিয়ে বাড়ির লগে ডোবায় গিয়ে হাত-পা ধুয়ে ঘরে এসে ঢোকে। খোলা দরজার সামনে বসে তামাক খায় বউবেটির লগে গল্প করে। তাদের মাঝখানে তখন কুপিও জ্বলে। সন্ধ্যার অন্ধকারে কুপি বাতি না জ্বাললে দোষ (অকল্যাণ অর্থে) হয় গিরস্তের। দবিরের বউ নিশ্চয় তা জানে! তা হলে বাড়িটা আজ এমন অন্ধকার কেন? এমন নীরব নিঝুম হয়ে আছে কেন? বাড়িতে কি লোকজন নাই?

মুকসেদের মনের ভিতর তিরিশ-চল্লিশ বছরের পুরনো চোরটা আড়মোড় ভাঙল। জেলখানায় এতদিন শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে ছিল চোর। এইমাত্র যেন ঘুম ভেঙেছে তার, হাই তুলে আড়মোড় ভাঙতে শুরু করেছে।

হাতের সিগ্রেট ফেলে মুকসেদ দবির গাছির বাড়িতে এসে উঠল। উঠে বেদম খুশি। সত্যি বাড়িতে কেউ নাই! নিটাল বাড়ি, বড়ঘরের দুয়ারও ভোলা।

এই দেখে মনের ভিতর আড়মোড় ভাঙা চোরটি মুকসেদের উঠে বসল, পুলকিত হল। এরকম নিটাল বাড়ি পড়ে আছে, তার ওপর দুয়ার ভাঙার কষ্টও নাই, দুয়ার আছে খোলা, এই ধরনের সুযোগ সমগ্র চোরজীবনেই কম পেয়েছে মুকসেদ। জেল থেকে বেরিয়েই গ্রামে যেদিন ফিরল সেদিনই এরকম সুযোগ, মুকসেদের মনে হল দেশগ্রামের ময়মুরব্বিরা যে বলে ‘আল্লায় যারে দেয় তারে ছাপ্পড় ফাইড়া দেয়’ কথাটা একদম সত্য। গ্রামে আসার দিনই মুকসেদের মতো চোরকে আল্লাহ আজ ছাপ্পড় ফেড়েই দিচ্ছেন। আল্লাহর কাছে সব মানুষই সমান। চোর সাধু সবাই। সবাইকেই তিনি দেন।

দবির গাছি গরিব মানুষ। কী এমন সম্পদ আছে তার ঘরে যে মুকসেদ চুরি করবে! রস বেচা দুই-চারশো টাকা হয়তো আছে, পিতল কাঁসার দুই একটা থাল বাসন, গেলাস, লোটা বদনা কলসি, অ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়ি গামলা, লোহার কড়াই এসব ছাড়া আর কী থাকে এই ধরনের গিরস্ত ঘরে! বউবেটির সোনা রুপার গহনা থাকবার কথা না। থাকলেও নাকফুল কানের মাড়কি (মাকড়ি)। সেসব জিনিস ঘরে নিশ্চয় সাজিয়ে রাখে না গরিব গিরস্ত বাড়ির বউঝিরা, সেসব থাকে অঙ্গে। সুতরাং এই বাড়ি থেকে আজকের এই সন্ধ্যারাতে কী চুরি করবে মুকসেদ! পিতল কাঁসার টুমটামের চেয়ে নগদ টাকাটা পেলে ভাল হত। কোঁচড়ে নিয়ে ঝাড়া হাত-পায়ে বাড়ি গিয়ে উঠতে পারত।

টাকাটা মুকসেদ পাবে কোথায়? খুঁজবে কেমন করে? চুরির কাজে টর্চ লাইট জরুরি। মুকসেদের সঙ্গে থাকেও। আজ নাই। থাকবে কী করে! জেলখানায় কি চুরি করার অস্ত্র সঙ্গে রাখতে দেয়! ইচ্ছা করলে টর্চ একটা জোগাড় করতে পারত মুকসেদ। ইব্রা যে তিনশো টাকা দিয়েছে সেই টাকা থেকে ছোট্ট একটা টর্চ কিনতে পারত। কিনা হয়নি মনে ছিল না বলে। তা ছাড়া আজই যে টর্চের দরকার হবে তাই বা কে জানত!

ইস এখন টর্চ লগে থাকলে সেই জিনিসের বোতাম টিপে টিপে ঘরের পটপাটি আনাচ কানাচ ব্যাগ সুটকেস বা ট্রাঙ্ক জাতীয় জিনিসগুলি ঘেঁটে ঘেঁটে দেখা যেত নগদ টাকা দবির কোথায় রেখেছে!

তারপরই মুকসেদের মনে হল পকেটে সিগ্রেট ধরাবার ম্যাচ আছে, ম্যাচের কাঠি জ্বেলে জ্বেলে কি চুরির কাজটা সারা যায় না!

কিন্তু কত কাঠি জ্বালবে সে! কতক্ষণ পারবে ওভাবে টাকা খুঁজতে। ম্যাচও অর্ধেকের বেশি শেষ হওয়া। কাঠি বেশি নাই।

মুকসেদের মেজাজ খারাপ হল। ধুত্তরি! আল্লাহর কারবারই এমন। সুযোগ দিয়েও কোথায় যেন একটা প্যাঁচ রেখে দেন। হব হব করেও যেন কাজ সহজে হতে চায় না।

তারপর একটু জেদ হল মুকসেদের। যা আছে কপালে, ম্যাচের কাঠি জ্বেলেই টাকা খোঁজার চেষ্টা সে করবে, চুরির চেষ্টা করবে।

নিঃশব্দে দবির গাছির ঘরে ঢুকে গেল মুকসেদ। পকেট থেকে ম্যাচ বের করে জ্বালল। ম্যাচের ডগার ওইটুকু বারুদের জ্বলে ওঠায় তেমন কোনও কাজই হল না। অন্ধকার ঘরের মুঠ পরিমাণ জায়গা আলোকিত হল। সেই আলোয় ঘরের ভিতরকার তেমন কিছুই স্পষ্ট হল না, তেমন কিছুই চোখে পড়ল না। তবু চেষ্টা মুকসেদ করতে লাগল। ঘরের একেকটা দিকে যায় আর একটা করে কাঠি জ্বালে। যতক্ষণ সম্ভব ধরে রাখে জ্বলন্ত কাঠি। হাতে যখন ছ্যাকা লাগে তখন ফেলে দেয়। এইভাবে তাক রসির শিকায় রাখা পটপাটি, চৌকির তলায় রাখা টিনের ফুলপাখি আঁকা ভাঙাচোরা সুটকেস, হাঁড়ি, মুড়ির জের এসব কোনওরকমে হাতিয়ে হাতিয়ে দেখল মুকসেদ। কোথাও একটা পাই পয়সাও পেল না। এদিকে ম্যাচের কাঠিও ফুরিয়ে আসছে। তবে এই ফাঁকে পিতলের ভারী ধরনের একটা বদনা আর মাঝারি মাপের একখান কলসি চোখে পড়ে গেল মুকসেদের। টাকা না পেয়ে সে ভাবল এই জিনিসই নিয়ে যাবে। মন্দ কী! এখন হাতে করে নিয়ে নিজেদের বাড়িতে রাখবে, দুই একদিন পর ইব্রা ঢাকা থেকে ফিরলে তাকে দিয়ে দিলে সে দিঘলির ভাঙারিদের খবর দেবে, তারা ইব্রার বাড়িতে এসে নগদ টাকা দিয়ে কিনে নিয়ে যাবে। কম বেশি যা হোক টাকা কিছু আসবে। চুরিটা ব্যর্থ হল না।

শেষ পর্যন্ত এই কাজটাই মুকসেদ করল। ম্যাচের কাঠি যখন দুই-তিনটায় এসে ঠেকেছে তখন পিতলের কলসি বদনা হাতে নিল। গভীর অন্ধকার ঠেলে দবির গাছির ঘর থেকে বেরিয়ে এল। কিন্তু উঠানে নেমে মনের মধ্যে কেমন একটা কামড় দিল মুকসেদের। আচ্ছা এই গিরস্তের কোনও বড় রকমের বিপদ আপদ হয়নি তো! আচমকা খুব কাছের কারও মৃত্যুসংবাদ পেয়ে সব ফেলে ছুটে যায়নি তো তারা! মৃত্যুর মতোই কোনও বিপদ এসে ঝাঁপিয়ে পড়েছে তাদের উপর, সেই বিপদ ঠেকাতে বাড়ির মানুষজন সবাই এতটাই উদগ্রীব হয়েছে, অন্য কোনও দিকেই আর খেয়াল নাই। শূন্য বাড়ি, দুয়ারখোলা ঘর কোনও কিছুতেই তাদের আর মন ছিল না। নাকি তারা জানে গ্রামের দাগিচোর মুকসেদ এখন জেলে। মুকসেদ গ্রামে না থাকলে শূন্য বাড়িতে দুয়ারখোলা ঘর পেয়েও আর কেউ আসবে না চুরি করতে!

এরকম চুরি কি আজকের আগে কখনও করেছে মুকসেদ! মানুষজন নাই, বাড়ির ঘরদুয়ার খোলা পড়ে আছে, রাতও তেমন হয়নি, মাত্র সন্ধ্যা, সন্ধ্যারাতে চুরি সত্যি মুকসেদ করেনি। এই ধরনের চুরি কি সত্যিকারের চুরি নাকি? এই ধরনের কাজ করে একেবারেই নিচুস্তরের ছ্যাচড়া চোরেরা! পকেটমার, গোরু ছাগল মুরগিচোর, বাজার হাট গঞ্জে দোকানি। আর পাইকারদের সামান্য জিনিস হাতসাফাই করা ওসব তো উঁচড়া চোরদের কাজ! মুকসেদ কি ওই স্তরের চোর! না তো! সে তো জীবনে এতটা নীচে কোনওদিন নামেনি। চুরি সে করেছে ঠিকই সেই চুরির কাজটাও করেছে বেশ সম্মানের সঙ্গে। গিরস্তের আথাল থেকে গোরু চুরিটা বহু রকমের সুযোগ পাওয়ার পরও কোনওদিন করেনি মুকসেদ। গিরস্ত বাড়ির লাকড়িখড়ি রাখার ভাঙাচোরা ঘরে ভেড়া বরকি (ছাগল) রাখে গিরস্তে, মুরগি রাখে কাঠটিনের বাক্সের মতো খোয়াড়ে। ওসব চুরি অতি সহজ। পরিশ্রমই লাগে না। ইচ্ছা করলেই করা যায়। মুকসেদ কখনও করেনি। সে তার দলবল নিয়ে চিন্তা ভাবনা করে প্রথমেই বের করেছে কোন গ্রামের কোন বাড়ি অবস্থাপন্ন গিরস্তের। কোন বাড়িতে চুরি করতে গেলে ধরা পড়ার সম্ভাবনা নাই, নগদ টাকা পয়সা সোনাদানা যা পাওয়া যাবে তাতে ভালই পোষাবে। এই চিন্তার পর চুরির পদ্ধতি বের করেছে। প্রথমেই সিঁদ কাটতে হবে ঘরের। সিঁদ কেটে গায়ে চপচপে তেল মাখা একটি চোর প্রথমে ঢুকবে ঘরে, ঢুকে আস্তে করে খুলে দিবে দরজা, সেই দরজা দিয়ে অন্যরা ঢুকে টর্চ জ্বেলে জ্বেলে চুরি করবে। চুরির সময় সব চোরের গায়েই চপচপা তেল মাখা থাকবে। লুঙ্গি থাকবে শক্ত করে কাছা মারা, যাতে আচমকা লুঙ্গি টেনে না ধরতে পারে চুরির উদিস পাওয়া ঘুম ভাঙা কোনও গিরস্ত। জাপটে ধরলেও যাতে পিছলে যাওয়া যায় সেই কারণে ওরকম করে তেলমাখা থাকবে গায়ে। তারপরও ধরা বহুবার পড়তে হয়েছে মুকসেদকে। ওই যে কথা আছে ‘দশদিন চোরের একদিন সাধুর’ কথাটা সত্য। চোরদের বহুবিধ কায়দার পরও ধরা তাদেরকে কখনও না কখনও পড়তেই হয়। সেসব অন্যকথা। আসল কথা হচ্ছে এই এতদিনকার চোরজীবনে ওইসব কায়দায়ই চুরিটা মুকসেদ করেছে। আজকের মতো কখনও করেনি।

আজকেরটা কি চুরি না হ্যাঁচড়ামি! যেভাবে চুরিটা আজ মুকসেদ করছে এই চুরিতে গৌরব নাই। এই চুরি যে কেউ করতে পারে! শূন্য বাড়ি, দুয়ার খোলা, এই ধরনের বাড়িতে চুরি করতে আসল চোর লাগে না। মুকসেদ তো আসল চোর। এই ধরনের চুরি সে করবে কেন?

এইসব ভেবে মুকসেদের অহংকারে বেশ বড় রকমের একটা ঘা লাগল। তা ছাড়া যে দুইটা জিনিস সে চুরি করেছে ভাঙারিদের কাছে বেচলে কয় টাকাই বা দাম হবে! এই সামান্য জিনিসের জন্য এতদিনকার সত্যিকার চোরজীবনকে কলুষিত করবে মুকসেদ! না এই কাজ সে করবে না।

অন্ধকারে দবির গাছির ঘরের খোলা দুয়ার আন্দাজ করে মুকসেদ আবার ভিতরে ঢুকল, ঢুকে কলসি বদনা পায়ের কাছে রেখে প্রথমে ম্যাচ জ্বালল তারপর জিনিস দুইটা জায়গা মতন রেখে ঘর থেকে বেরিয়ে এল। উঠানে এসে বেশ একটা আরাম পেল সে। যাক ঠিক কাজটাই শেষ পর্যন্ত করেছে। মুকসেদের ইচ্ছা করল সিগ্রেট ধরাতে। বুকপকেটে হাত দিয়ে সিগ্রেটের প্যাকেট আর ম্যাচ বেরও করতে গেল তখনই মানুষের পায়ের শব্দ পাওয়া গেল। দুই-তিনজন মানুষ যেন হেঁটে আসছে এই বাড়ির দিকে। নিশ্চয় দবির গাছি আর তার বউবেটি হবে। এই অবস্থায় সিগ্রেট ধরাতে পারল না মুকসেদ। কেউ টের পাওয়ার আগেই বাড়ির পিছনে দিক দিয়ে চকে নামল। দ্রুত পা চালিয়ে কিছু দূর এসে হালটে উঠল, উঠে সিগ্রেট ধরাল। বুক জুড়ে মুকসেদের বেশ একটা স্বস্তির ভাব।

1 Comment
Collapse Comments
احمد عبد القیوم الإیزادی March 18, 2023 at 11:43 am

লেখক যেমন ফালতু, তার লেখাও তেমন ফালতু!
ড: মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ স্যারের ভাষায় ” বটতলার বাজে উপন্যাস!”

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *