সেখান থেকে বেরিয়ে গঙ্গাস্নান করে একটা ময়রার দোকানে ঢুকে কিছু খেয়ে আবার গিরিধারীর বাড়িতে এসে ধুতিগুলো শুকোতে দিয়ে শুয়ে পড়লুম।
বেলা প্রায় চারটে নাগাদ গিরিধারী এসে হাজির হল। সে তো এতদিন পরে আমাদের দেখে একেবারে অবাক! বললে, আমি মনে করলুম, তোরা কলকাতায় ফিরিয়ে গিয়েছিস; ভাবলুম কি ভালোই হল, ঘরের ছেলে ঘরে ফিরিয়ে গেল।
আমরা গিরিধারীকে রাজকুমারীর কথা বলতেই সে চমকে উঠে বললে, ওরে বাবা! সেটা তো ডাইনি আছে রে! প্রাণ লিয়ে সেখান থেকে ফিরে এসেছিস, তোদের ভাগ্য ভালো আছে। বাবা বিশ্বনাথ রক্ষা করিয়েছেন। জয় বাবা বিশ্বনাথ!
আমরা বললুম, যা হবার তা হয়ে গিয়েছে দাদা, এবার আমাদের একটা চাকরি-বাকরি জুটিয়ে দাও।
গিরিধারী বললে, মুন্সী মাধোলালের দপ্তরে তোদের কাজ তো একরকম ঠিকই হয়েছিল সব, তোরাই কোথা গায়েব হোইয়ে গেলি, তো হামি কি করবে বল্?
গিরিধারী আরও বললে, আজই সন্ধের সময় এক বড়লোকের পরিবারবর্গকে নিয়ে তাকে ‘বিদ্ৰাবন’ যেতে হচ্ছে। দিল্লি, আগ্রা সফর করে কাশীতে ফিরে আসতে অন্তত পনেরো-বিশ দিন লাগবে।
এ-কথার আর কি উত্তর দেব? হয়তো আমাদের মুখ-চোখের করুণ অবস্থা দেখে গিরিধারীর অন্তরে দয়া হল। সে আশ্বাস দিয়ে বললে, এ-ক’টা দিন কোনো-রকমে কাটিয়ে দে, কাশীতে ফিরে হামি তোদের একটা-না-একটা ব্যবস্থা করিয়েই দেব, জয় বাবা বিশ্বনাথ!
নিরাশার ঘন অন্ধকারে একটুখানি আশার আলো পেয়ে উৎসাহিত হয়ে উঠলুম। তাকে বললুম, পনেরো-বিশ দিন দেখতে দেখতে কেটে যাবে দাদা, আমাদের কাছে যে কয়েকটা টাকা আছে, তাতে একবেলা খেয়ে কোনোরকমে কাটিয়ে দেব। শুধু রাতে যাতে এখানে শুতে পারি তার একটু ব্যবস্থা করে দিয়ে যাও।
আমাদের কথা শুনে গিরিধারী হেসে বললে, এখানে শুবি তার আবার ব্যবস্থা কি করব রে? এ তো তোদের নিজেদেরই বাড়ি আছে, বেপরোয়া শুয়ে পড়বি।
গিরিধারী তখুনি চলে গেল। বাজারে তার কিছু জিনিসপত্র কিনতে হবে। দেখলুম, সে বেশ খুশিই আছে। পুরনো মালদার যজমানের গিন্নি বউ সব এসেছে, তাদের নিয়ে সফর করতে হবে,–নগদে সোনাদানায় বেশ মোটা রকমের কিছু আশা আছে।
আমরা সন্ধ্যাবেলায় বেরিয়ে এদিক-ওদিক ঘুরে-ফিরে বিশ্বনাথের পুজো দেখে বাজার থেকে কচৌড়ি-পুরি মেরে রাত্রি প্রায় ন’টার সময় গিরিধারীর বাড়িতে ফিরে এলুম। একটা ঠাকুরদালানের মতন জায়গা, খিলেনগুলোর ফাঁকে ফাঁকে তেরপলের পর্দা দেওয়া–শীত আটকাবার জন্যে। খান দশ-পনেরো দড়ির খাঁটিয়া পড়ে আছে পাশাপাশি, বাকি জায়গাটা ফাঁকা। আমাদের পুঁটলিটাকে দু-ভাগ করে দুটো বালিশ করে নিয়ে দুজনে দুটো খাটে র্যাপার মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়া গৈল। কিন্তু ঘুম আর কিছুতেই আসে না। প্রথমত খাটটি একেবারে উপবাসী খটমলে ভরা, তার ওপরে মাসখানেক ধরে নিশ্চিত্ত আরামে লেপ-চাপা দিয়ে গদিতে শুয়ে অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল খারাপ। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শীতের ঠেলায় বেনের পুঁটুলির মতন গড়াতে আরম্ভ করেছি, এমন সময় হৈ-হৈ করে গিরিধারীদের একজন ছড়িদার বোধ হয় জন-পঞ্চাশেক বেহারী যাত্রী নিয়ে এসে হাজির হল। ছড়িদার আমাদের ঠেলে তুলে দিয়ে বললে, কে তোমরা? বেরিয়ে যাও এখান থেকে।
বললুম, আমরা গিরিধারী পাণ্ডার যজমান।
কিন্তু ছড়িদার ব্যাটা কোনো কথাই শুনতে চায় না। তার সঙ্গে আরও তিন-চারজন স্ত্রী-পুরুষ মিলে চিৎকার করতে আরম্ভ করে দিলে। প্রায় আধঘণ্টা-টাক চেঁচামেচি ঝগড়াঝাঁটি চলবার পর তারা আমাদের একরকম টেনে সেই দালান থেকে উঠোনে নামিয়ে দিয়ে ঝঝপ্ করে তেরপলের পর্দাগুলো ফেলে গালগল্প শুরু করে দিলে।
এইটুকু বয়সের মধ্যে আমার জীবনে অনেক বিচিত্র অভিজ্ঞতাই হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু শীতকালের শেষরাত্রে পশ্চিমের মতন জায়গায় একেবারে আচ্ছাদনহীন আকাশের তলায় বসে রাত্রিযাপন এই প্রথম। সে যে কি অভিজ্ঞতা, তা শীতকাতর কলকাতাবাসী ছাড়া অন্যের পক্ষে বোঝা হয়তো কিছু কঠিন হবে। পরিতোষ আমারই মতন শীতকাতর তো ছিলই, তার ওপর সে ছিল অস্বাভাবিক রকমের ঘুমকাতর।
কি আর করব! উঠোনের একবারে মাথা মুড়ি দিয়ে দুজনে থেবড়ে বসলুম। ঠান্ডায় একেবারে জমে যাওয়ার অবস্থা, ঘণ্টাখানেক সেইভাবে বসে থাকতে থাকতে পরিতোষের কানের এমন যন্ত্রণা শুরু হল যে, সে ছোট ছেলের মতন চেঁচিয়ে কাঁদতে আরম্ভ করে দিলে। ঘরের মধ্যে পঞ্চাশ-ষাট জন স্ত্রী-পুরুষ বাতি জ্বেলে শুয়ে বসে তামাক খাচ্ছে আর সশব্দে গল্পগুজব করছে, আর বাইরে দুটো লোক সেই শীতে বসে রয়েছে–তাদের মধ্যে একজন কানের যন্ত্রণায় তারস্বরে চিৎকার করছে, কিন্তু একজনও বাইরে এসে একবারও জিজ্ঞাসা করলে না যে, তোমাদের কি হয়েছে?
যা হোক, কোনোরকমে কালরাত্রি প্রভাত হল। গিরিধারীর বাড়ি ছেড়ে আমরা রাস্তায় বেরিয়ে পড়লুম। পরিতোষের কানের যন্ত্রণা একটু কমার সঙ্গে সঙ্গে আমার শুরু হল দাঁতের যন্ত্রণা। রাস্তায় ঘুরতে ঘুরতে একজায়গায় একটা চায়ের দোকান দেখে দুজনে দু-কাপ চা খেয়ে আবার ঘুরতে লাগলাম। কোতোয়ালির কাছে একটা হোমিওপ্যাথিক ওষুধের দোকান দেখে ঢুকে পড়া গেল। ডাক্তার বাঙালি, বয়সও বেশি নয়। আমাদের রোগের অবস্থা ও কারণ শুনে ভেবে-চিন্তে এক ড্রাম ওষুধ দিলেন, দাম দু-আনা। সারাদিনে তিনবার করে খেতে হবে, দুজনের একই ওষুধ।
হোমিওপ্যাথি, তুমি ধন্য! দু-আনার মধ্যে ডাক্তারের ফী ও ওষুধের দাম হয়ে গেল। ওইসঙ্গে পথ্যের ব্যবস্থাটাও যদি করে দিতে পার, তাহলে দশ বছরের মধ্যে ভারতের সমস্ত মেডিক্যাল কলেজ ও ইস্কুলকে পাততাড়ি গুটিয়ে Quit India করতে হবে।
এক ফোঁটা করে ওষুধ সেইখানেই খেয়ে আধঘণ্টা-টাক বসে থেকে সেখান থেকে বেরিয়ে পড়লুম। হোমিওপ্যাথিতে বিশ্বাস না থাকলেও, সত্যি কথা বলতে কি, ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই আমার দাঁতের সেই অসহ্য যন্ত্রণা একেবারে কমে গেল। পরিতোষও বললে, তার কানের যন্ত্রণা অনেক কম পড়েছে।
রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছি-উদ্দেশ্যহীন ভ্রমণ। রাত্রে কোথায় থাকব ঠিক নেই, ভোজনং যত্র তত্র তো কদিন থেকেই শুরু হয়েছে। অথচ চার-পাঁচ দিন আগেই এইসব রাস্তায় কি নিশ্চিন্ত মনেই ঘুরে বেড়িয়েছি! পুরুষের ভাগ্য ও নারীর চরিত্র যে দেবতাও জানতে পারে না–এ সত্য আমাদের অজ্ঞাত ছিল না। কিন্তু নারীচরিত্রের সঙ্গে পুরুষের ভাগ্য যে বি অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত, সেই সত্য মর্মে মর্মে উপলব্ধি করে ভাগ্যবিধাতার পায়ে মনে মনে গড় করতে করতে রাজঘাট ইস্টিশানে গিয়ে উপস্থিত হাওয়া গেল।
ইস্টিশানে বসে বসে দুজনে পরামর্শ করে ঠিক করা গেল, গিরিধারী যতদিন না ফিরে আসে ততদিন কাশীর বাইরে কোনো একটা ছোট শহরে গিয়ে আত্মগোপন করা যাক। সেখানে কোনো ধর্মশালায় একটি ঘরে থাকব, নিজেরাই রান্না করে খাব। পনেরো-বিশ দিনে তাতে পাঁচ টাকার বেশি খরচ হবে না। বাড়ির গ্যাড়া-মারা টাকার দশটি টাকা তখনও অবশিষ্ট ছিল, তার ওপরে জয়া-গিন্নির কুড়ি টাকা–একুনে ত্রিশটি টাকা তখনও আমাদের হাতে মজুত। এও ঠিক হল, মাস ছয়েক কোনোরকমে কাটতে পারলে, ততদিনে জয়া-গিন্নী ফিরে আসবে, তখন আর কোনো ভাবনা থাকবে না। বড়লোক না হতে পারলেও সুখে খেয়েদেয়ে দুজনে কাশীতে কাটিয়ে দিতে পারা যাবে। এই ঠিক করে কাশীর কাছাকাছি একটা স্টেশনের টিকিট কেটে সেখান থেকে আমরা বেরিয়ে পড়লুম।
বেলা প্রায় বারোটার সময় আমরা এক নতুন জায়গায় এসে পৌঁছলুম। ছোট্ট জনবিরল শহর, একদিন কিন্তু সে-স্থান জনবহুল ছিল। চওড়া মাটির রাস্তা, দু-পাশে বড় বড় ভাঙা বাড়ি অতীত সমৃদ্ধির সাক্ষীস্বরূপ দাঁড়িয়ে আছে। ইস্টিশানের একটু দূরেই প্রকাণ্ড ধর্মশালা, রাজবাড়ির মতন ফটক, বোধ হয় তিন শতাব্দী আগে তৈরি হয়েছিল। অসংখ্য ঘর, তার অধিকাংশই ভাঙা। উঠোনময় দেড়-মানুষ-সমান জঙ্গল হয়ে আছে। ধর্মশালার জীর্ণতার সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষা করে তার রক্ষকের চেহারাও তেমনই। তারা পুরুষানুক্রমে এই ধর্মশালা রক্ষা করে আসছে, বছরে দশ টাকা মাইনে পেয়ে। আমরা পনেরো-বিশ দিন থাকতে চাই শুনে সে দার্শনিকের হাসি হেসে ফেললে, সারি জিন্দিগী এখানে থাকতে পার, কেউ তোমাদের মানা করবে না। ফটকের পাশেই তার থাকবার ঘরের সঙ্গে লাগা একটা ঘর দেখিয়ে বললে, এই ঘরে থেকে যাও
ঘরের মেঝে মাটির। লোকটা দুটো খাঁটিয়া এনে বললে, মাটিতে শুয়ো না। বিচ্ছুতে কেটে দিলে বড় তকলিফ হবে।
খাঁটিয়া ভাড়া কত লাগবে জিজ্ঞাসা করায় সে বললে, যা খুশি দিও, তোমাদের অবস্থা তো আমারই মতন দেখছি।
বাজার থেকে চাল, ডাল, কাঠ, নুন, মশলা, ঘি, পেঁয়াজ, আলু, হাঁড়ি, সরা কিনে নিয়ে এসে খিচুড়ি চড়িয়ে দেওয়া গেল। বোধ হয় সর্বসমেত বারোটা পয়সা খরচ হয়েছিল। চারদিন বাদে চাল-ডাল পেটে পড়ায় মহাপ্রাণী একটু ঠান্ডা হলেন। বেলা প্রায় পাঁচটার সময় সেই যে শুয়ে পড়লুম ঘুম ভাঙল পরদিন সকালবেলায়।
ঘুম থেকে উঠে সরাইয়ের কুয়ো থেকে নিজেরাই জল তুলে স্নান করে এক এক ফোঁটা হোমিওপ্যাথিক ওষুধ খেয়ে ঠিক করলুম; জায়গাটা একটু ঘুরে ফিরে দেখে দুপুরবেলা ভাত আর মাংস রাঁধা যাবে। আমাদের কাছে তালা ছিল না। কাজেই নিজেদের সম্বল পুঁটুলিটা বগলদাবা করে বেরিয়ে পড়া গেল।
অতি দরিদ্র দেশ। রাস্তার দু-ধারে অধিকাংশ বাড়িই একতলা। মাঝে মাঝে এক-আধখানা বড় বাড়ি দেখা যায় বটে, কিন্তু সেগুলির অবস্থা আরও জীর্ণ, ‘কোনোমতে আছে পরাণ ধরিয়া। রাস্তায় প্রায় একহাঁটু করে ধুলো, একখানা এক্কা গেলে চারিদিক অন্ধকার হয়ে যায়। মাঝে মাঝে এক-আধখানা আস্ত বাড়ি দেখা যায় বটে; কিন্তু সে খুবই কম। রাস্তায় ছোট ছেলেমেয়ে খেলা করছে, ধূলিধূসরিত তাদের দেহ, দেখে মনে হয়, সাতজন্মে স্নান করে না, দেহের বসনও তেমনই ময়লা ও শতচ্ছিন্ন। কিন্তু তবুও তারা সুস্থ এবং পুষ্ট।
ঘুরতে ঘুরতে আমরা একটা চওড়া ও অপেক্ষাকৃত পরিষ্কার রাস্তায় এসে পৌঁছুলুম। পরামর্শ করতে লাগলুম, কাশীতে চাকরি করলেও এখানেই একটা বাড়ি ভাড়া করে থাকা যাবে। এখানে ভালো খাসীর মাংসের সের চোদ্দো পয়সা। সকালবেলা চার পয়সার জিলিপি খেয়ে পরিতৃপ্তি লাভ করা গেছে। ধরাতলে এমন স্বর্গও আছে, আমাদের কল্পনার অতীত ছিল।
চলতে চলতে রাস্তার ধারে একজায়গায় দেখলুম, একটা দড়ির খাঁটিয়ার ওপরে আচিট ময়লা একখানা ভিজে ন্যাকড়া পেতে এক অতি বৃদ্ধা তার ওপরে ঘুঁটের মতন বড় বড় বড়ি দিচ্ছে।
দাঁড়িয়ে গেলুম মজা দেখতে। বুড়ির যেমন চেহারা, তেমনই ময়লা কাপড় আর তার বড়ির রঙও তেমনই; কিন্তু কি তৃপ্তিদায়ক গন্ধ বেরুচ্ছিল সে বড়ি থেকে, তা কি বলব! আমরা দাঁড়িয়ে বড়ি-দেওয়া দেখছি আর আমাদের দেশের বড়ির সঙ্গে সেই বড়ির তুলনামূলক সমালোচনা করছি, এমন সময় বৃদ্ধা ঘাড় তুলে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমাদের দেখে গজগজ করে কি বকতে আরম্ভ করে দিলে।
বুড়ি বড়ি দিচ্ছে আর বকবক করছে, আমরা তখনও দাঁড়িয়ে আছি দেখে এবার সে খাঁটিয়া থেকে নেমে এসে চিৎকার করে আমাদের গালাগালি দিতে আরম্ভ করলে। আমরা তো অবাক। কি হয়েছে, আমরা কি অপরাধ করেছি কিছুই ঠিক করতে না পেরে যতই তাকে প্রশ্ন করি, ততই সে ক্রুদ্ধ হয়ে হাত নেড়ে অঙ্গভঙ্গি করে গালাগালি দিতে থাকে। দেখতে দেখতে সেই জনবিরল রাস্তায় দু-চারজন লোকও দাঁড়াতে আরম্ভ করলে। কোথা থেকে একপাল ছেলে এসে জুটল। তারা বুড়িকে কি-একটা কথা বলামাত্র সে তেলে-বেগুনে জ্বলে তাদের মারতে ছুটল। বয়স্ক যারা তাদের মধ্যে কেউ কেউ আমাদের বললে, যাও বাবু নিজেদের কাজে যাও, ও-মাগির মাথা খারাপ।
আমরা তো একেবারে হতভম্ব।
এইরকম হাঙ্গামা চলেছে, এমন সময় দূরে হাততালি ও চিৎকার শুনে আমরা ফিরে দেখি, সেখান থেকে একটু দূরে রাস্তার বিপরীত দিকের একটা একতলার ছাদে কতকগুলো লোক ঝুঁকে আমাদের দেখছে আর একজন জোরে হাততালি দিচ্ছে। আমরা তাদের দিকে ফিরতেই সেই লোকটা হাতছানি দিয়ে আমাদের ডাকতে লাগল। আমরা বুড়িকে ছেড়ে সেই বাড়িটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালুম। লোকটা ওপর থেকে হেসে হেসে বললে, কি, বাংগালী তো?
আমরা তো অবাক। জিজ্ঞাসা করলুম, আমাদের বলছেন?
হাঁ হাঁ, তোমাদেরই বলছি। তোমরা বাংগালী তো?
আজ্ঞে হাঁ।
তো সোজ্হা এই সিড়হি দিয়ে উপরে চলে এস।
বাড়ির মধ্যে ঢুকে দেখলুম, বাঁ-পাশে একটা মইয়ের মতন খাড়া সিঁড়ি। ওপর থেকে একটা মোটা দড়ি ঝুলছে, সেটার ওপর ভর না করলে ওপরে ওঠা সম্ভব নয়।
সিঁড়ি বেয়ে তো দুজনে কোনোরকমে হেলে-দুলে ওপরে ওঠা গেল। একটা বড় ছাদ। রাস্তার ধারের পাঁচিল ঘেঁষে একখানা খাট পাতা, তার ওপরে সুন্দর কাজ করা একখানা শতরঞ্চির ওপরে বসে রয়েছে সেই ব্যক্তি, যে আমাদের ওপরে আসতে আহ্বান করেছিল। তার মাথায় একটা ছিটের রামপুরী টুপি, যার নাম আজ গান্ধী-টুপি। গায়ে ঢিলে-হাতা মলমলের পাঞ্জাবির ওপরে পটুর দিশি ওয়েস্টকোট, বাংলাদেশে যার নাম আজ জওহর-কোট। লুঙ্গি পরা, কিন্তু বাঁ পা-টার প্রায় কুঁচকি অবধি তুলে রাখা হয়েছে। পা-টা এমন শুকনো ও দোমড়ানো যে, দেখে মনে হয়, যেন তার ওপর দিয়ে মিলিটারি লরি চলে গিয়েছে–ছুঁচ-সুতো দিয়ে একটা সুতির ফতুয়া সেলাই করে চলেছে বনবন করে। হাত চলার সঙ্গে সঙ্গে অনর্গল বকে চলেছে। কথাবার্তার ধরন শুনলেই মনে হয়, বেশ মজলিশি লোক। বাঁ-পাশে মাথা-সমান উঁচু একটা বাঁশের লাঠি পড়ে রয়েছে। শুকিয়ে হরতুকীর মতন চেহারা হয়ে গেলেও তার বয়স ত্রিশের চাইতে বেশি বলে মনে হয় না। সে যে একদিন সুপুরুষ ছিল, তার চিহ্নও কিছু অবশিষ্ট রয়েছে সেই চেহারায়। একপাশে একরাশ বিড়ি ও একটা দেশলাই। খাটের ওপরে ও নীচে নানা বয়সের বোধ হয় পনেরো-বিশ জন লোক–কেউ বসে, কেউ-বা দাঁড়িয়ে।
আমরা ওপরে ওঠবার কিছুক্ষণ পরে একবার আমাদের দিকে বেশ হাসি-হাসি মুখে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বিশুদ্ধ বাংলায় সে জিজ্ঞাসা করলে, কি বাবা, ঘসে ছকেছ তো? কোথায় ঘর?
কলকাতায়।
ঘসে না ছকে দুই বন্ধুতে সল্লা করে যদি একটা তেজারৎ করতে তো কত ভালো হত? এই মন্তব্য প্রকাশ করে উপস্থিত বন্ধুদের উদ্দেশে চোস্ত উর্দুতে সে বললে, এই হচ্ছে বাংগালীর রীত্। কিছুতেই খুশি নয়। ঘরে বসে নিশ্চিন্ত আরামে দিন কাটাচ্ছিল, মাথায় যে কি ভূত সওয়ার হল, ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছে।
জিজ্ঞাসা করলে, নাম কি?
নাম বললুম। সে বলল, বসো, দাঁড়িয়ে কতক্ষণ থাকবে?
আমরা খাটের একপাশে বসলুম। এতক্ষণে চারপাশের লোকদের ভালো করে দেখবার অবসর হল। দেখলুম, দু-একজন হিন্দু ছাড়া সকলেই মুসলমান। যার যখন প্রয়োজন হচ্ছে, সে উঠে এসে একটা বিড়ি ধরিয়ে আবার নিজের জায়গায় গিয়ে বসছে।
গল্পগুজব চলছে। তার কিছু বুঝতে পারছি, কিছু পারছি না। মধ্যে মধ্যে আমাদের সম্বন্ধে কেউ কেউ মন্তব্য করছে। আমাদের আহ্বানকারী ঘাড় নীচু করে বনবন করে সেলাই করে চলেছে, মাঝে মাঝে মুখ তুলে খানিকটা গড়গড় করে কথা বলে আবার ঘাড় নীচু করে সেলাইয়ে মন দিচ্ছে। আমরা চুপ করে বসে আছি উজবুগের মতন। এমন সময়ে সেই সোজা সিঁড়ি বেয়ে আসরে একটি ভদ্রলোক এসে উপস্থিত হলেন। তাঁর মাথায় জরিদার টুপি, কিন্তু সে-জরি প্রায় কালো হয়ে এসেছে। দামি কিন্তু শতচ্ছিন্ন শেরওয়ানী অঙ্গে, তার ওপরে বোধ হয় পাঁচশো বছরের পুরানো একটা পাট-করা জামেয়ার, তার অবস্থাও তেমনই।
লোকটি আসরে উপস্থিত হওয়ামাত্র সকলেই উঠে তাকে কুর্নিশ করলে। আমাদের আহ্বানকারী তাকে দেখে সেলাম করে বললে, তশরিফ রাখিয়ে নবাবসাহেব।
তারপরে উর্দুতে দুজনের বাক্যালাপ শুরু হল, তার কিছু বুঝলুম, কিছু বুঝলুম না। নবাবসাহেব বললেন, ছোটেসাহেবের দুশমনের তবিয়ত দিন-বদিন যে খারাপই হতে চলেছে, তা একবার দেলীতে গিয়ে হসিাহেবকে দেখালে হয় না? বলেন তো, বাবুজীর কাছে প্রস্তাব করি।
ছোটেসাহেব সেলাইয়ের ফোঁড় তুলতে তুলতে মিষ্টি হেসে জবাব দিলে, নবাবসাহেব, আপনার বহুৎ মেহেরবানি, খোদা আপনার মঙ্গল করুন। আপনি আমায় ভালোবাসেন, তাই এমন প্রস্তাব করছেন, কিন্তু মালাকুল-মওৎ যাকে টেনেছে, কোনো আদমজাদের সাধ্য নেই যে তাকে রক্ষা করে।
ছাদসুদ্ধ লোক সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠল, খোদা না করে ছোটেসাহেব, অ্যায়সা না কহিয়ে-
নবাবসাহেব ধীরে ধীরে প্রশ্ন করলেন, তাপ আজকাল কত ডিক্রি উঠছে?
ছোটেসাহেব উদাসভাবে বললেন, বগলে আর বাত্তি নিই না। সারাদিনই জ্বর থাকে, সন্ধেবেলা খুব বাড়ে, পরমাত্মার নাম করতে করতে শুয়ে পড়ি।
মিনিট দশ-পনেরো আদর-আপ্যায়নের পর নবাবসাহেব বিদায় নিলেন। যতক্ষণ তিনি ছিলেন, ততক্ষণ অন্য লোকগুলো সব চুপ করে ছিল। তিনি চলে যেতেই আবার সকলে সমস্বরে কথা বলতে শুরু করে দিলে। তারপরে বিড়ির তাড়া শেষ হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একে একে সকলে বিদায় নিয়ে চলে গেল.।
সকলে চলে যাওয়ার পর লোকটি আমাদের বললে, তো শর্মাজী, রায়সাহেব, কি মতলোব? আমাদের বাড়িতে থাকবে?
বললুম, আপনি দয়া করে আশ্রয় দিলেই থাকব।
আমার কথা শুনে ভদ্রলোক একটু ম্লান হাসি হেসে বললে, আরে, দয়া কিসের! কে কার ওপর দয়া করতে পারে ভাইয়া? আমাদের বাড়িতে কত বাংগালীর ছেলে এসে থাকল। দু-পাঁচ বছর রইল, তাদের মায়া পড়ে গেল, তারপর একটু সুবিধা কোথাও বুঝলে বা বড়েসাহব–আমার বড়ভাই কিছুগালিমন্দ করলে কি, আর সরে পড়ল। বলছি, তোমরা সেরকম সরে পড়বে না তো?
পরিতোষ বললে, আমাদের তাড়িয়ে না দিলে কেন চলে যাব?
লোকটি আবার হেসে বললেন, হামি কিংবা বহেন্জী অর্থাৎ দিদিমণি তোমাদের কখনও চলে যেতে বলব না। আরে, বহেনজীর পাল্লায় পড়লে তো তোমাদের একেবারে জেহেলখানা হয়ে গেল। আর বাবুজী তো দেবতা, সে কখনও কোনো চাকরকেই কিছু বলে না, তো তোমরা তো মেহমান আছ।
কিছুক্ষণ চুপচাপ কাটবার পর সে বললে, আমি তো ভাই, মরীজ আছি, সকালবেলা বিছানা থেকে উঠে এখানে এসে বসি, সারাদিন এমনই কেটে যায়, সন্ধেবেলা নিজেদের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ি।
আমি জিজ্ঞাসা করলুম, আপনার কি অসুখ?
একটু ম্লান হেসে বাঁ পা-টা দেখিয়ে দিয়ে সে বললে, এই পায়ের হাড়ে দিক্ হয়েছে।
ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারলুম না। জিজ্ঞাসা করলুম, দিক্ কি?
ছোটেসাহেব কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললে, আরে যক্ষ্মা—যক্ষ্মা।
কথাটা যেন কিরকম লাগল। হাড়ে যক্ষ্মা, মাথায় কলেরা, জিভে অর্শ বা হাতে ঊরুস্তম্ভ–এইসব অসমাজিক ব্যামোর রেওয়াজ আমাদের ছেলেবেলায় চলতি ছিল না।
বললুম, হাড়ে আবার যক্ষ্মা হয় নাকি?
ছোটেসাহেব বললে, বাবুজী বলেছেন। বাবুজী বড় ডাক্তার, তোমরা ছেলেমানুষ, কিছুই জান না। সারাদিন যন্ত্রণার শেষ নেই, জ্বর লেগেই আছে। সঝের সময় তাপ বাড়তে থাকে, সে-সময় কেউ কাছে থাকে না। দিদিমণি তো সারা দিন ও রাত বাড়ির কাজ নিয়েই আছে। তবু বেচারা রোজ সে-সময় এসে আমার গায়ে হাত বুলিয়ে দেয়। তোমরা থাকলে সে-সময় একটু কাছে বসে গল্পসল্প করলে ভালো লাগবে।
ছোটেসাহেবের কথার কি জবাব দোব তাই ভাবছি, এমন সময় একটা কাঁসার গেলাস হাতে দিয়ে ওই-দেশীয়া এক বৃদ্ধা ছাতে এসে হাজির হল। বৃদ্ধা একটু এগিয়ে এসে তার নিজের ভাষায় বললে, কি রে ছোটে! কেমন আছিস?
ছোটেসাহেব কোনো কথা না বলে সেলাই থামিয়ে তার হাত থেকে গেলাসটা নিয়ে এক ঢোকে সবটা খেয়ে গেলাসটা আবার তার হাতে ফিরিয়ে দিলে। বৃদ্ধা-গেলাসটা খাটের পায়ার কাছে রেখে সেই ময়লা পায়েই বিছানায় উঠে বসে ছোটেসাহেবের পিঠে আস্তে-আস্তে হাত বুলিয়ে দিতে শুরু করে কি আওড়াতে লাগল, আর ছোটেসাহেব ক্ষিপ্তহস্তে সেলাইয়ের ফোঁড় তুলতে থাকল।
কিছুক্ষণ এইভাবে নিঃশব্দে কাটবার পর বৃদ্ধা বললে, দিন ও রাত কি সেলাই করিস বল্ দিকিন! তোর বাপ কি তোকে জামা তৈরি করে দেয় না, না তার পয়সার অভাব আছে? ছোটেসাহেব হেসে জবাব দিলে, আহিয়া, আমি মরলে এই জামাটা পরিয়ে শ্মশানে পাঠিয়ে দিস। খবরদার, বাজারের কেনা জামাটামা দিসনি যেন।
দেখতে দেখতে বৃদ্ধার চক্ষু অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠল, তারপরে নিঃশব্দে তার দুই তোবড়ানো গাল বেয়ে চোখের জল ঝরে পড়তে লাগল। ছোটেসাহেব সে দৃশ্য দেখতে পেলে না, কারণ বৃদ্ধা বসে ছিল তার পিঠের কাছে।
সেলাইয়ের আরও কয়েকটা ফোঁড় দিয়ে ছোটেসাহেব আমাদের বাংলায় বললে, এই যে মেয়েমানুষটা দেখছ, এ আমাদের ভাই বোন সবাইকে মানুষ করেছে। এ আমাকে মায়ের চাইতে বেশি ভালোবাসে।
এতক্ষণে বৃদ্ধা আমাদের দিকে ফিরে ভালো করে দেখে জিজ্ঞাসা করলে, কারা এরা?
ছোটেসাহেব হাসতে হাসতে বললে, আরে, দেখে বুঝতে পারছিস না, এরা বাড়ি থেকে ভেগেছে। এই রাস্তায় ঘোরাফেরা করছে দেখে, ডেকে নিয়ে এসেছি। এরা এখানেই থাকবে।
বৃদ্ধা কিছুই মন্তব্য করলে না। ছোটেসাহেব আরও কিছুক্ষণ সেলাইয়ের ফোঁড় তুলে বললে, আহিয়া, এদের মুখ দেখে মনে হচ্ছে, ভালো ঘরের ছেলে এরা, এরা পালাবে না।
বৃদ্ধা এবার নিজের মনে খানিকক্ষণ গজগজ করে বকে বললে, আরে দূর, তুইও না যেমন, ও কারুকে বিশ্বাস নেই। লহিত ও সূদনের মতন ছেলে ক’টা হয়?
ছোটেসাহেব সেলাই বন্ধ করে বললে, যা বলেছিস আহিয়া! লহিত আর সূদনের মতন ছেলে আর হয় না। জানো রায়সাহেব, শৰ্মাজী, শুনো। বাবুজী তখন সরকারি চাকরি থেকে পেনসিন নিয়ে বাঁস্ বেরিলিতে চাকরি নিয়েছেন। আমার উমর তখন দশ কি বারো, একদিন বাবুজীর সঙ্গে বাজারে জামা কিনতে বেরিয়েছি, দেখি দুটো বাংগালীর ছেলে, একেবারে নাদান, আমারই হাম–উমর্ হবে, বিমর্ষ হয়ে রাস্তার ধারে বসে রয়েছে। বেরিলিতে যত বাংগালীর ঘর আছে তাদের সবাই আমাদের চেনা, এরা তাদের কেউ নয়। বাবুজী জিজ্ঞাসা করলে, তোমাদের বাড়ি কোথায়? তাঁরা কাঁদতে কাঁদতে বলে ফেললে যে, তারা ঘরসে ভেগে পচ্চিম চলে এসে এখন মুশকিলে ফেঁসে গেছে। সাবাস বাংগালী, দশ বছরের ছেলে বাবা ঘরসে ভেগেছে! বাবুজী তাদের ভুলিয়ে ভালিয়ে বাড়িতে নিয়ে এসে একেবারে আমার মায়ের জিম্মে করে দিলে।
সেই থেকে তারা আমাদের ঘরেরই ছেলে হয়ে গেল, আর বাড়ি ফিরলে না। একই–বয়সি কিনা, তাই আমার সঙ্গে তাদের এমন ভাব হয়ে গেল যে, লোকে মনে করত, আমরা বুঝি সব মায়ের পেটের ভাই। আমার মায়ের তো লহিত ছাড়া এক লাও চলত না। বহেন্জী তখন ছিল শ্বশুরাল, আমার বড়েভাই বিয়ে করেনি, মা’র সেবা করবার কেউ নেই। লহিত মার খুব সেবা করত। রোজ সঝের সময় দু-ঘণ্টা করে মা’র গোড় দাবানো, এখানে সেখানে নিয়ে যাওয়া, লহিত ছাড়া মা’র আর একদণ্ডও চলে না।
এইরকম প্রায় দশ বছর কেটে যাওয়ার পর সেবারে বেরিলিতে ভারি চেচক্ শুরু হয়ে গেল। কোথা থেকে লহিত বেচারা চেচক্ নিয়ে এল। বাবুজী শহরের সেরা সেরা ডাক্তার দেখালে কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না। বেচারার চোখ দুটো আগেই নষ্ট হয়ে গেল। সে বলতে লাগল, মা, আমার চোখই যখন নষ্ট হয়ে গেল, তখন আর বেঁচে থেকে লাভ কি? মা তাকে বোঝাতে লাগল, যতক্ষণ আমার চোখ আছে বেটা, ততক্ষণ তোর ভাবনা কি? আমি গেলে ছোট্কা রইল, সুদন রইল তারা তোকে দেখবে।
কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না। দু-মাসে ভুগে লহিত বেচারা চলে গেল, আমার মায়ের কোলেই মাথা রেখে সে ঘুমিয়ে পড়ল।
আমার মা তো বেহোঁস হয়ে সেই মুর্দা জড়িয়ে ধরে পড়ে রইল, শেষকালে বাবুজী এসে তাকে ছাড়িয়ে নিলে। মা যে সেই পাশ ফিরলে সাতদিন আর উঠল না। শেষকালে আমার এই আহিয়া, এই মেয়েমানুষটা, তাকে তুলে নাওয়ালে খাওয়ালে।
এতখানি এক-নাগাড়ে বলে ছোটেসাহেব একটু দম নিয়ে বৃদ্ধার উদ্দেশ্যে বললে, আহিয়া, তুমহে ইয়াদ্ হায় উও সব বাতেঁ?
আহিয়া গজগজ করে কি বললে, বুঝতে পারলুম না।
পরিতোষ জিজ্ঞাসা করলে, সুদন কোথায়?
ছোটেসাহেব সেলাই থামিয়ে তার দিকে চেয়ে বলতে আরম্ভ করলে, আরে ভাইয়া, তার আসল নাম হচ্ছে মদন। আমার মা তাকে ‘সূদন’ বলে ডাকত। সেই থেকে মসূদন সূদন হয়ে গেছে। লহিত মারা যাবার পর বাবুজী সূদনের চাকরি করে দিলে মিউনিসিপ্যালিটিতে, বাইশ টাকা মাইনেয়। সে বেচারি মাইনের সব টাকা এনে আমার মায়ের হাতে দিত। এইরকম যেতে-না-যেতেই লহিত আমার মাকেও টেনে নিলে। মাও ওই চেচকেই মরে গেল।
এতক্ষণে ছোটেসাহেবের কণ্ঠে একটু যেন অশ্রুর আমেজ পাওয়া যেতে লাগল। সে বলে চলল, মা মারা যাবার সঙ্গে সঙ্গে বাবুজী ওখানকার চাকরি ছেড়ে দিয়ে কাশীতে চলে এলেন। সূদন ওইখানেই রয়ে গেল, আজ সে আশি টাকা তখোয়া পায়। সূদন বেচারা বড় ভালো। আগে পুজো ও বড়দিনের ছুটিতে দু’বার করে বাড়ি আসত, কিন্তু আমার অসুখ বাড়বার খবর পেয়ে আজকাল দু-তিন মাস অন্তরই একবার-দু’বার করে এসে আমাকে দেখে যায়। সে তো চাকরি ছেড়ে দিয়ে আমার কাছে চলে আসতে চায়, কিন্তু বাবুজী আর দিদিমণি তাকে চাকরি ছাড়তে দেয় না। সূদন যতদিন এখানে থাকে, ততদিন বেশ ফুর্তিতেই দিন কাটে, এই তো দিন-পনেরো আগে সে গেলে।
ছোটেসাহেব আবার কিছুক্ষণের জন্যে চুপ করে বোঁ বোঁ করে সেলাই করে যেতে লাগল। তারপর হঠাৎ একবার মুখ তুলে বললে, আমি এবার সূদনকে বলে দিয়েছি ভাইয়া, এবারে লহিত আমাকেও টেনেছে, কবে নিয়ে যাবে সেই আশায় বসে আছি। আর এ যন্ত্রণা সহ্য করতে পারছি না।
দেখতে দেখতে ছোটেসাহেবের চোখদুটো জলে ভরে উঠল; কিন্তু বেশ বুঝতে পারলুম যে, সেই দুর্বলতাকে দমন করবার জন্যে সে প্রাণপণ চেষ্টা করছে। হঠাৎ ছোটেসাহেব ঘাড় নীচু করে আবার সেলাইয়ে মন দিলে।
মানুষের জীবনে অথবা মানুষের মনে প্রেম ও শোক–এই দুটি অনুভূতিই প্রধান। প্রেমের মতন শোকও অজানা-অপরিচিতকে আপনার করে, দূরকে নিকটে টেনে নিয়ে আসে, অনাত্মীয়কে পরমাত্মীয় করে তোলে। শোকাশ্রুই পলাতকা অতীতকে ফিরিয়ে নিয়ে আসে বর্তমানের বাহুবন্ধনে। আজ সকালে নিদ্রাভঙ্গের সঙ্গে সঙ্গে ভগবানের নাম করে যখন উঠে বসেছিলুম, তখন এই পরিবারের সুখদুঃখ তো দূরের কথা, তাদের অস্তিত্ব সম্বন্ধে কোনো জ্ঞানই আমার ছিল না। এই মৃত্যুপথযাত্রী পঙ্গু যুবকের মুখের কয়েকটি কথা আর ওই বৃদ্ধার কয়েক ফোঁটা অশ্রুজল তাদের সঙ্গে আমাদের অচ্ছেদ্য বন্ধনে বেঁধে ফেললে। কে কোথাকার লহিত আর সূদন, যাদের কখনও চোখেও দেখিনি, তারা হয়ে উঠল আমাদের জীবনবন্ধু। চোখের সামনে যেন দেখতে লাগলুম, আমাদেরই মতন দুটি অসহায় বালক পথের ধারে বিষণ্ণ মুখে বসে আছে। ক্ষুধা তৃষ্ণা ও ভবিষ্যতের অন্নবস্ত্রের চিন্তায় যখন তারা দিশাহারা, সেই সময় অতি অপ্রত্যাশিতভাবে দেবদূতের মতন এসে এই সংসারের কর্তা তাদের তুলে নিয়ে এলেন নিজের গৃহে, সেই থেকে এই গৃহই তাদের আপন হয়ে গেল। এদের দুঃখসুখের সঙ্গেই তাদের জীবনসূত্র জড়িয়ে গেল চিরদিনের জন্যে।
বেলা বেড়েই চলল। আমরা দুটিতে চুপ করে বসে আছি আর ভাবছি, লোকটা যে থাকতে বললে, কিন্তু সে-সম্বন্ধে আর কোনো কথাই বলছে না তো! বুড়িও কোনো কথা কয় না। সেও কলের মতন ছোটেসাহেবের পিঠে হাত বুলিয়ে চলেছে, মাঝে মাঝে ঢুলে তার মাথাটা ছোটেসাহেবের পিঠে গিয়ে ঠেকছে; কিন্তু সে নির্বিকার, বেঁ-বোঁ করে সেলাইয়ের ফোঁড় তুলে চলেছে, মাঝে মাঝে ছুঁচের গর্তে সুতো ভরে নিয়ে আবার সেলাই শুরু করছে।
বোধ হয় ঘণ্টা-খানেক এইভাবে চুপচাপ কাটাবার পর ছোটেসাহেব বুড়ির দিকে ফিরে তার কানে কানে কি বললে, শুনতে পেলুম না।
বৃদ্ধা ধীরে-সুস্থে খাট থেকে নেমে গেলাসটা তুলে নিয়ে বালিশের তলায় হাত ঢুকিয়ে দিয়ে কি নিয়ে গজগজ করতে করতে নীচে নেমে গেল।
ছোটেসাহেব আমাদের সঙ্গে গল্প করতে লাগল, তার বাবার কাশীতে মস্ত ডিপেন্সারি, ওখানকার যত রইস আছে প্রায় সবার বাড়িরই তিনি গৃহ-চিকিৎসক, কাশী-নরেশের বাড়ি থেকেও তাঁর ডাক আসে। সব জায়গা থেকেই মাসোহারা পান, এতেই তাঁর প্রায় পাঁচশো টাকা আমদানি আছে, এ ছাড়া কাশীর সিরোলে বড় বাড়ি আছে, নীচে বড় দাওয়াখানা, সকাল-সন্ধেয় প্রায় দু-তিন-শো রুগি আসে, তাদের ওষুধ বিক্রি করেও দৈনিক প্রায় শতখানেক টাকা রোজগার আছে। সে ব্যবসা বড়েভাই দেখে; বাবুজী তা থেকে কিছুই পায় না, সে-ই সব মেরে দেয়। মাঝে মাঝে বহেন্জী হাঙ্গামা-হুঁজ্জৎ করে তার কাছ থেকে সংসার খরচ বাবদ দু-পাঁচ-শো টাকা আদায় করে নেয়। আমার ভাইটা হচ্ছে বদমাইশ। সব টাকা মাগি, ইয়ার আর সরাবেই ফুঁকে দেয়। বাবুজী একেবারে শিবের মতন, সে তো কিছু বলে না; কিন্তু বহেন্জী হচ্ছেন একেবারে পহলোয়ান, বড়েভাইয়ের মতন দশটা মরদকে সে গায়ের জোরেই ঠান্ডা করে দিতে পারে। দাওয়াখানার হিসাবপত্তর সব বহেন্জী দেখে, এই নিয়ে হর্হপ্তা ঘরে ভাইবোনে খুনোখুনি চলতে থাকে।
কিছুক্ষণ অবধি সেলাই-ফোঁড়াই চলবার পর ছোটসাহেব মুখ তুলে বললেন, বহেন্জীর নিজের টাকার অভাব নেই, সে আমার জন্যেই–ভাইয়ার সঙ্গে লড়াই ঝগড়া করে। বেচারা তো জানে না যে, আমার দিন খতম হয়ে এসেছে।
এবার আমি বললুম, আপনি বৃথাই ভয় পাচ্ছেন। আপনি ঠিক সেরে উঠবেন।
ছোটেসাহেব একটু হেসে সেলাইটা একপাশে রেখে ডান পায়ের আচ্ছাদনটা তুলে বললেন, এ পা-টা দেখছ?
তারপর বাঁ পা-টা দেখিয়ে বললে, এই পা-টাও এমনিই ছিল, এখন দুটোতে তফাৎ দেখ।
দেখলুম, দুটো পায়ে আকাশ-পাতাল তফাৎ হয়ে গিয়েছে, তবুও তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললুম এ পা-টাও সারবে, তবে পা-টা পঙ্গু হয়ে যাবে।
ছোটেসাহেব হেসে সেলাইটা তুলে নিয়ে বললে, শর্মাজী, তোমরা ছেলেমানুষ। আমার চাইতে কম আজ কম দশ-পনেরো বছরের ছোট হবে, তোমরা কি জান?
আমাদের কথাবার্তা চলছে, এমন সময় একটা লোক দু-হাতে দু-থালা জলখাবার নিয়ে এসে আমাদের সামনে রেখে দিয়ে চলে গেল। ছোটেসাহেব বললে, নাও রায়সাহেব, শর্মাজী, কিছু জল খেয়ে নাও। এ-বেলা তো ভাতটাত কিছুই হল না।
বিশেষ অনুরোধ আর করতে হল না। বেলা তখন দ্বিপ্রহর–ক্ষুধাও বেশ চনচনে হয়েছিল। দেখতে-না-দেখতে থালা সাফ হয়ে গেল। যে লোকটা খাবার দিয়ে গিয়েছিল, সে-ই একটা গেলাস ও একটা জল-ভরা ঘটি নিয়ে এসে আমাদের জল খাইয়ে গেল।
একটু পরে ছোটেসাহেব আমাদের বললে, কি বিড়ি-টিড়ি ফোঁকা অভ্যেস আছে নাকি?
বললুম, অভ্যেস না থাকলেও মাঝে মাঝে ফুঁকে থাকি, আপত্তি কিছুই নেই।
আমাদের কথা শুনে সে কিছুক্ষণ পেছনের তাকিয়ার ওপর শুয়ে নির্বিকার হয়ে আকাশের দিকে চেয়ে রইল। তারপরে উঠে পাশের সেই লম্বা বাঁশের লাঠিটার ওপর ভর করে দাঁড়াল। দেখলুম, তার সেই পঙ্গু দোমড়ানো পাখানি জমি থেকে বোধ হয় হাতখানেক উঁচুতে নড়বড় করে ঝুলতে লাগল। ডান হাত দিয়ে সেই পা-খানি লাঠির চারিদিকে এক-ফের জড়িয়ে এক অদ্ভুত ভঙ্গিতে নেংচে নেংচে ছাদের এক কোণের ঘেরা বারান্দা দিয়ে বোধ হয় বাড়ির ভেতরে চলে গেল। কিছুক্ষণ কেটে যাবার পর পরিতোষ বললে, সরাইওয়ালাকে যে মাংস কেনবার জন্যে পয়সা দিয়ে আসা গেল, তার কি হবে?
দেখা যাক কি হয়! বরাতে মাংস খাওয়া আজ নেই বলেই তো মনে হচ্ছে।
কথাবার্তা চলছে, এমন সময় ছোটেসাহেব সেইরকম লাঠির ওপরে ভর দিয়ে করুণ কাতরধ্বনি করতে করতে ফিরে এল, হাতে তার এক বান্ডিল বিড়ি।
বিড়ির বান্ডিলটা আমার হাতে দিয়ে বললে নাও শর্মাজী, পিত্তও।
তারপর তেমনই কাতরাতে কাতরাতে খাটের ওপরে গিয়ে বসে পড়ল। আমরা দুজনে দুটো বিড়ি ধরিয়ে মোক্ষম টান মেরে কাশতে আরম্ভ করে দিলুম। ছোটেসাহেব আমাদের দিকে চেয়ে সহাস্যবদনে বললে, কি খুব কড়া বুঝি?
কাশতে-কাশতে বললুম না, অনেকদিন টানিনি কিনা, তাই কাশি হচ্ছে।
বান্ডিলটা তোমাদের কাছে রেখে দাও, ফুরিয়ে গেলে আমাকে বোলো।
এই বলে সে তাকিয়ায় হেলান দিলে। কিছুক্ষণ সেইভাবে থেকে বললে, শর্মাজী, একটু লেছি ভাই, কিছু মনে কোরো না, এই মিনিট পাঁচেক, চলে যেয়ো না যেন।
বললুম, না না, মনে করব কি! আপনি নিশ্চিত্তে শুয়ে পড়ুন।
ছোটেসাহেব বালিশে মাথা দিয়ে চোখ বুজে ফেলল। আমরা দুটিতে বসে বসে বিড়ি ফুঁকতে লাগলুম। অনেকদিন পরে ধোঁয়ার আস্বাদ পেয়ে ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই বোধ হয় গোটা-পঁচিশেক বিড়ি শেষ করে ফেললুম। বিড়ি ফুঁকছি আর অদৃষ্ট এবার আমাদের কি নতুন প্যাঁচ মারলে তারই গবেষণা চলছে। দেখতে দেখতে ছাতের একপাশ থেকে রোদ গড়াতে গড়াতে রাস্তায় নেমে পড়ল। ছোটেসাহেব তেমনই পড়ে আছে খাটের ওপরে চোখ বুজে একপাশ ফিরে কুঁকড়ে-শুঁকড়ে। একবার উঠে গিয়ে তার কপালে হাত দিয়ে দেখলুম, আগুনে গরম–বোধ মতো অভিজ্ঞতা যার আছে, সে-ই জানে।
ছোটেসাহেবের কথা শুনে আমাদের চোখে জল এসে গেল। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে তাকে বললুম, আপনি আমাদের এত উপকার করলেন আর আপনার নামটি পর্যন্ত আমরা জানতে পারলুম না!
ছোটেসাহেব বললে, আরে, আমার নাম বিশ্বনাথ বন্দ্যোউপাধ্যায়, আমার ভাইয়ের নাম শ্রীঅমরনাথ বন্দ্যোউপাধ্যায়। আমাদের ঠাকুরের নাম ডাক্তার শিবনাথ বন্দ্যোউপাধ্যায়। তোমরা আমার ছোটভাইয়ের মতন। আমাকে বিশুদা বলে ডেকো।
এতখানি বলেই সে আবার বালিশে মাথা রেখে চোখ বুজে ফেললে।
বসে আছি তো বসেই আছি। দেখতে দেখতে রোদ পড়ে যেতে লাগল। ব্যাপারটা রাজকুমারীর বাড়ির চেয়েও রহস্যজনক হয়ে উঠছে দেখে আমরা ঠিক করলুম, আর কিছুক্ষণ দেখে আস্তে আস্তে নেমে চলে যাব। এমন সময় দু’জন যণ্ডা-ষণ্ডা চাকর ছাতে এসে উপস্থিত হল। ছোটেসাহেব চোখ বুজে অজ্ঞানের মতন পড়ে ছিল, তাদের সাড়া পেয়ে সে চোখ চেয়ে বিবিজ্ করে কি বললে। তারপর তারা তাকে চ্যাংদোলা করে তুলে নিয়ে চলে গেল। যাবার সময় ছোটেসাহেব বললে, আমি ঘরে শুতে যাচ্ছি, তোমরা চলে যেয়ো না যেন।
বিশুদা চলে যাওয়ার পর অনেকক্ষণ কেটে গেল। আমরা উঠি-উঠি করছি, এমন সময় আহিয়া এসে বললে, চল, তোমাদের ভেতরে ডাকছে।
আবার সেই মইয়ের মতন সোজা সিঁড়ি বেয়ে নেমে একটা সরু গলিপথ দিয়ে আমরা বাড়ির ভেতর চললুম। প্রকাণ্ড একটা উঠোন, উঠোনের এক কোণে তিনটে মুলতানী গাই বাঁধা রয়েছে–এমন সুন্দর গরু কলকাতার লোকের চোখে কমই পড়ে। সেই উঠোন পেরিয়ে আবার একটা আধা-অন্ধকার লম্বা গলিপথ পার হয়ে দালান। সেই দালানের এক কোণ দিয়ে সিঁড়ি। অপেক্ষাকৃত চওড়া হলেও প্রায় সেই মইয়ের মতন সোজা। সেই সিঁড়ি প্রায় হামাগুড়ি মেরে অতিক্রম করে ওপরে একটা বড় দালানে পৌঁছলুম। দালানের গায়ে একসারে পাশাপাশি তিন-চারটে ঘর। বৃদ্ধা কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে একটা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ঘুরে আমাদের বললে, এই যে, এদিকে এস। আমরা–আমি আগে আর পেছনে পুঁটুলি-বগলে পরিতোষ–অতি সঙ্কোচের সঙ্গে পা পা করে সেই ঘরের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালুম। দেখলুম, ঘরের মধ্যিখানে আমাদের দিকে প্রসন্ন দৃষ্টিতে চেয়ে একটি নারী দাঁড়িয়ে রয়েছেন। সদ্যোস্নাতা, মাথার মাঝখানে চুড়োর মতন উঁচু করে চুল বাঁধা। একখানা ধবধবে সাদা পাতলা ফিনফিনে থান পরা। তার ভেতর দিয়ে দেহের প্রায় সবই দেখা যাচ্ছে। বয়স কুড়ি থেকে ত্রিশের কোনো একটা জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। দেহলতা, দাঁড়াবার ভঙ্গি, চোখের দৃষ্টি ও মাথার সেই চুড়ো মিলিয়ে একটি নিষ্কম্প দীপশিখার সঙ্গে তার তুলনা করা চলে। বার-বাড়ির সেই পঙ্গু, ভগ্নস্বাস্থ্য যুবকের যেন এটা উল্টো পিঠ। এরকম উদ্ধত যৌবনশ্রী এর আগে আর আমার চোখে পড়েনি।
মিনিট-খানেক আমাদের দিকে সেইভাবে চেয়ে থেকে তিনি বললেন, খুব কষ্ট হয়েছে তো? ছোট্কার কোনো আক্কেল নেই। সারাদিন নিজের কাছে বসিয়ে রেখে ‘গাল-গল্প করলে আর বাড়ির ভেতর একটা খবর পর্যন্ত পাঠালে না! সারাটা দিন খাওয়া হয়নি তো?
আমি বললুম, না, আমাদের কষ্ট কিছুই হয়নি। সকালবেলা খেয়েই বেরিয়েছিলুম। দুপুরে তো আপনি খাবার পাঠিয়েছিলেন, তাই খেয়েছি।
জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার নাম কি?
নাম বললুম। পরিতোষের নাম শুনে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, তোমরা কি জাত? হয় একশো চার ডিগ্রি জ্বর হবে। কপালে হাত দেওয়া মাত্র ধরা গলায় সে বললে, আহিয়া! হাত সরিয়ে নিয়ে আবার নিজের জায়গায় ফিরে এসে বসলুম। কি করব তাই পরামর্শ করতে লাগলুম।
পরিতোষ বললে, চল সরাইয়ে ফিরে যাই।
কিন্তু ভদ্রলোক বার বার অনুরোধ ও মিনতি করে বলেছে তার কাছে থাকবার জন্যে। এইসব আলোচনা চলছে, এমন সময় ও-বেলাকার সেই বৃদ্ধা আবার একটা গেলাস হাতে নিয়ে ছাতে এসে উপস্থিত হল।
বৃদ্ধা খাটের কাছে গিয়ে বেশ উচ্চস্বরে হাঁক ছাড়লে, আরে ছোটে .
ছোটেসাহেব চমকে চোখ চেয়ে বললে, আহিয়া, আয়ি তুম্?
তার পরে ক্যাঁকাতে ক্যাঁকাতে উঠে বসে বৃদ্ধার হাত থেকে গেলাসটা নিয়ে এক চুমুকে সেটা নিঃশেষ করে ফিরিয়ে দিতে দিতে বললে, শঙ্কর আর ভরতকে পাঠিয়ে দে, আমাকে ঘরে নিয়ে যাবে।
বৃদ্ধা জিজ্ঞাসা করলে, তাপ এসেছে বুঝি?
ছোটেসাহেব চোখ বুজেই বললে, ওঃ, বড়ি তকলিফ!
বৃদ্ধা সিঁড়ির দরজার দিকে অগ্রসর হল। ছোটেসাহেব তাকে ডাক দিলে, আহিয়া, শুন্।
বৃদ্ধা কাছে আসতে সে আমাদের দেখিয়ে বললে, এদের কথা বহেন্কে বলেছিস? সারাদিন যে এদের খাওয়া-দাওয়া হল না, সেই সকাল থেকে বসে আছে বেচারারা-
ছোটেসাহেবের কথা শুনে বুড়ি একেবারে চিৎকার করে উঠল, হায় রামা! আমাকে কি তুই কিছু বলেছিস? সে মাগি শুনলে তো আমার জান খেয়ে ফেলবে। বলবে, মেহমানদের এতক্ষণ বসিয়ে রেখেছিস! হায় রামা! অনেক তো দেখালি, আর কেন, এবার আমাকে টেনে নে।–বলতে বলতে বুড়ি দেওয়ালে ঢকাঢক করে মাথা কুটতে আরম্ভ করে দিলে।
বুড়ি আরও হাঙ্গামা লাগাবার উপক্রম করছিল, এমন সময় ছোটেসাহেব চেঁচিয়ে উঠল, হারামজাদি–নিগোড়ে! আমাকে না খেয়ে কি তুই মরবি? চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে তো শেষ করে এনেছিস। যে ক’টা দিন আছি, একটু শান্তি দে।
কথাগুলো শুনে বুড়ি এক্কেবারে চুপ হয়ে গেল। ছোটেসাহেব বললেন, যা বহেন্জীকে বল্গে যা, আমি বলে দেব, সে কিচ্ছু বলবে না তোকে।
বুড়ি আর কোনো কথা না বলে কাঁপতে কাঁপতে নীচে নেমে গেল। ছোটেসাহেব আমাদের দিকে ফিরলে, দেখলুম, তার চোখ-দুটো রাঙা টকটকে হয়ে উঠেছে। একটুখানি হাসবার চেষ্টা করে সে বলে, আজকের তাপটা খুবই চড়েছে বলে মনে হচ্ছে। একটুখানি লে মনে করে একেবারে শুয়ে পড়েছিলুম, কিছু মনে করো না ভাই, তোমাদের বড় তকলিফ হল। কাল থেকে আর এমন হবে না।
আমি বললুম, না না, আমাদের কোনো তকলিফ হয়নি। আপনি কেন এসব কথা বলছেন?
ছোটেসাহেব বললে, না ভাই, তোমাদের রাস্তা থেকে ডেকে নিয়ে এসে এখানে বসিয়ে আমি শুয়ে পড়লুম! কি বলব, আমায় মাপ করো ভাইয়া, বড় কসুর হয়ে গেল আমার।
এতদিন পরে এই জাতক লেখার তাড়নায় সেই সুপ্ত স্মৃতিকে খোঁচা দিয়ে দিয়ে জাগিয়ে তুলছি আর মনে হচ্ছে, সেদিনের সঙ্গে আজকের দিনের কত তফাৎ হয়ে গিয়েছে! আজ ভারতবাসী পূর্ণস্বাধীনতা-প্রয়াসী, অর্থে সামর্থ্যে আজ তারা অনেক উন্নত, অনেক সমৃদ্ধ। কিন্তু মানুষের প্রতি মানুষের ব্যবহার—-সেদিক দিয়ে যে তারা কত দরিদ্র হয়ে পড়েছে, তা আমার
পরিতোষ বললে, আমরা কায়স্থ।
তিনি বললেন, আমাদের সূদনও কায়স্থ। তোমাদের সঙ্গে কিছুই নেই বোধ হয়?
তারপরে মৃদু হেসে বললেন, পালাবার সময় কে আর জিনিসপত্র নিয়ে পালায়! কি বল? পরিতোষটা এতক্ষণ আমার পেছনেই দাঁড়িয়ে ছিল। স্ত্রীলোকের সামনে এলে অতিশয় লজ্জিত হয়ে পড়াই ছিল তার স্বভাব। হঠাৎ তার মনে যে কি অনুপ্রেরণা এল বুঝতে পারলুম না, সড়াক করে এগিয়ে এসে তাঁকে একটা প্রণাম করে ফেললে। তার দেখাদেখি আমিও একটা প্রণাম করলুম। প্রণামের পালা শেষ হবার পর তিনি হেসে বললেন, আমাকে কি বলে ডাকবে?
‘মাসি’ বলব, কি ‘দিদি’ বলব, এই নিয়ে মনের মধ্যে জল্পনা চলেছে, এমন সময় তিনি নিজেই তার সমাধান করে দিয়ে বললেন, আমাকে ‘দিদিমণি’ বলে ডাকবে, কেমন?
ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালুম।
দিদিমণির কথাবার্তার মধ্যে পশ্চিমি সুরের একটু আমেজ থাকলেও বিশুদার মতন তিন ভাগ উর্দু নেই। কথাবার্তা ও হালচালের মধ্যে শুদ্ধ বাঙালি-ঘরেরই পরিচয় পাওয়া যায়।
এবার তিনি বৃদ্ধাকে ডেকে ঠেট-হিন্দিতে বলতে লাগলেন, বড়েভাইয়ের ঘরে এদের দুটো নতুন বিছানা পেতে দাও। অমুক জায়গা থেকে নতুন বালিশ নেবে, অমুক স্থানে যে-সব তোশক আছে তা থেকে নিও না, অমুক ঘরে কাঠের সিন্দুকে বালিশের ওয়াড় ও বিছানার চাদর আছে, ইত্যাদি।
বৃদ্ধার প্রতি বক্তব্য শেষ করে আমাদের বললেন, আমার বড়েভাইয়ের ঘরে তোমাদের শোবার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। বাড়িতে ঘরের অভাব নেই, তবে সব ঘরই আসবাব-জিনিসপত্রে ঠাসা। একটা ঘরের জিনিসপত্র সরিয়ে দিয়ে তোমাদের ঘর করে দেব। কয়েকটা দিন এখন ওই ঘরেই থাক। আমার দাদা প্রায় কাশীতেই থাকে। সপ্তাহে একদিন কি দু-দিনের বেশি বাড়ি আসে না, কোনো অসুবিধা হবে না তোমাদের।
আহিয়া চলে গেল আমাদের বিছানাপত্রের ব্যবস্থা করতে। দিদিমণি দালানে একখানা শতরঞ্চি পেতে আমাদের নিয়ে বসে বাড়ির কথা, কেন বাড়ি থেকে পালিয়েছি, পালিয়ে কতদিন কোথায় ছিলুম, ইত্যাদি সব কথা জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন। দিদিমণি বললেন, তাঁর বাবা সেই ভোরের ট্রেনে চলে যান কাশীতে শুধু এক লোটা দুধ খেয়ে। সকাল-সন্ধে সেখানেই খাবার ব্যবস্থা আছে। বাড়ি ফেরেন রাত্রি দশটার ট্রেনে, স্টেশন থেকে বাড়ি ফিরতে প্রায় সাড়ে দশটা বেজে যায়। আজ যদি তোমরা ঘুমিয়ে পড়, তা হলে আর তুলব না, কাল ভোরবেলা তুলে দেব, বাবুজীর সঙ্গে দেখা করবে। না হলে বাবুজী রবিবারে বাড়িতে থাকেন, সেই দিন দেখা হবে।
আমি বললুম, আমাদের ভোরবেলাতেই তুলে দেবেন।
দিদিমণি জিজ্ঞাসা করলেন, রাত্তিরে রুটি খেতে কোনো অসুবিধা হবে না তো?
কিছু না।
আচ্ছা, চল, তোমাদের ঘরে যাই।–বলে দিদিমণি উঠে ঘরের মধ্যে ঢুকে একখানা ধবধবে সাদা শাল গায়ে দিয়ে বেরিয়ে এলেন। তারপরে সেই প্রায়ান্ধকারের মধ্যে এ-গলি সে-গলি, উঁচু-নীচু পথ দিয়ে আমাদের একটা বড় ঘরে নিয়ে এলেন। ঘরের মেঝেতে একদিকে একটা দু-জনের মতন বড় বিছানা, আর-একদিকে একজনের মতন একটা বিছানা পাতা। ঘরের মধ্যে ঢুকে সেই বড় বিছানাটা দেখিয়ে আমাদের তিনি বললেন, ওইটে তোমাদের বিছানা, এটা দাদার বিছানা।
ঘরের দেওয়ালে খুব উজ্জ্বল একটা দেওয়াল-গিরি জ্বলছিল। দেখলুম, এ-বাড়িতে রেড়ির তেলের কারবার একেবারেই নেই। ঘরের আর-এক দেওয়ালে ছোট্ট চৌকো একখানা আয়না ঝোলানো রয়েছে। আর-একদিকে ঘরের মেঝেয় একটা বড় কাঠের সিন্দুক, এ ছাড়া ঘরে আসবাব আর কিছুই নেই।
দিদিমণি হেসে পরিতোষকে বললেন, তোমার সম্পত্তি ওই সিন্দুকের ওপর রেখে দাও, ভয় নেই, কেউ নেবে না।
পরিতোষ লজ্জিত হয়ে সিন্দুকের ওপরে আমাদের পুঁটুলিটা রেখে দিলে। দিদিমণি বললেন, আচ্ছা, এবার চল, আমার ঘর দেখবে।
আবার তিনি আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে চললেন। তখন সন্ধে হয়ে গিয়েছে, চারদিক ঘোর অন্ধকার, আমরা একরকম হাতড়ে হাতড়ে চলেছি তাঁকে অনুসরণ করে। এই ঘরের পরেই অন্ধকার ছাত, তারই মাঝামাঝি রেলের গুমটির মতন একটা চোরা-কুঠুরি গোছের ঘর। তারই কয়েক গজ দূরেই একটা প্রকাণ্ড চার-জানলাওয়ালা হল-ঘরে দিদিমণি আমাদের নিয়ে এলেন। ঘরের একদিক জুড়ে প্রকাণ্ড একটা পালং, বোধ হয় চার-পাঁচটা জোয়ান তাতে গড়িয়ে গড়িয়ে শুতে পারে। পালঙের ওপর চমৎকার বাহারী মশারি–মশারি যে এত সুন্দর ও বাহারী হতে পারে তা এই প্রথম দেখলুম। ঘরের চারধারে সুন্দর ও সুদৃশ্য ছোট-বড় দেরাজ, আলমারি; লোহার সিন্দুকই বোধ হয় তিন-চারটে। এই ঘরে নিয়ে এসে দিদিমণি বললেন, এইটে আমার ঘর।
তারপরে একটু চুপ করে থেকে বললেন, কেমন সাজানো! পছন্দ হয়?
বললুম, চমৎকার!
ঘরের এক কোণে একটা উর্দি-পরা ষণ্ডা-গোছের চাকর টুলের ওপরে বসে ছিল। আমাদের ঢুকতে দেখে সে উঠে দাঁড়াল। দিদিমণি এবার তাকে হিন্দিতে কি বলে আমাদের বললেন, লোকটা সারাদিন এই ঘরে পাহারা দেয়। রাত্রিবেলা আর-একটা লোক এই চোরা-কুঠুরিতে শুয়ে থাকে পাহারা দেবার জন্যে।
তারপরে অপেক্ষাকৃত মৃদুস্বরে বললেন, ঘরে অনেক দামী জিনিস আছে কিনা। আমি তো সারাদিন অন্য ঘরে থাকি, রাত্রে বাবুজীকে ঘুম পাড়িয়ে ঘরে ফিরতে রাত্রি প্রায় বারোটা বেজে যায়, ততক্ষণ এরা পাহারা দেয়! আমি ঘরে এলে পাহারা চলে যায় চোরা-কুঠুরিতে, সকালে আবার পাহারা বদলি হয়। রাতে আমার ঘরে আহিয়া শোয়।
দিদিমণির খাটের পাশেই দেখলুম, একটা স্ট্যান্ডে দুটো দো-নলা বন্দুক সাজানো রয়েছে। বললুম, দিদিমণির কি শিকার-করা অভ্যেস আছে নাকি? বিছানার পাশেই বন্দুক কিসের জন্য? দিদিমণি বললেন, আরে ভাই, শিকার-খেলার অভ্যেস তো খুবই ছিল এককালে, নিশানাও ছিল খুব ঠিক, কিন্তু সে-সব এখন চুকে-বুকে গেছে। ও-দুটো আছে মানুষ শিকারের জন্যে। এখানে ডাকাতের ভয় আছে কিনা, যদি দরকার হয় তাই রাখা।
আবার সেই লোকটাকে কি বলে দিদিমণি বললেন, চল, এবার ছোট্কার কাছে যাই।
সেই ঘর থেকে বেরিয়ে আবার খানিকটা ছাত, তার পরে আর-একটা চোরা-কুঠুরি, তার পরেই বিশুদার ঘর। বিশুদার ঘরের কাছাকাছি পৌঁছেই শুনতে পাওয়া গেল, ঘরের ভেতরে খুব মজলিশ চলেছে। ঘরের দরজায় একটা লোক বসেছিল, দিদিমণিকে দেখেই সে উঠে দাঁড়ালে। দিদিমণি তাকে বললেন, শঙ্কর ছোটেসাহেবকে বল, আমি এসেছি।
এই বলেই তিনি পাশের চোরা কুঠুরিতে ঢুকে আত্মগোপন করলেন, শঙ্কর ভেতরে চলে গেল।
কয়েক মিনিট পরেই ঘর থেকে দশ-বারোটা লোক হুড়মুড় করে বেরিয়ে ছাতের এক কোণের একটা গলিপথ দিয়ে বেরিয়ে গেল, বোধ হয় সেই ছাতে যেখানে সকালে আমরা এসে বসেছিলুম। লোকগুলো বেরিয়ে যাবার পর শঙ্কর চোরা-কুঠুরির সামনে গিয়ে কি বলতেই দিদিমণি বেরিয়ে এসে আমাদের বললেন, এস।
বিশুদার ঘরে ঢুকলুম। ঘরখানা প্রায় দিদিমণির ঘরের মতনই বড়। মেঝেতে ঘর-জোড়া বিছানা। দু-দিকের দেওয়ালে দুটো উজ্জ্বল কোরোসিনের বাতি জ্বলছে, ঘর একেবারে ধোঁয়ায় অন্ধকার হয়ে আছে। চারিদিকে, এমনকি বিছানার ওপরে পর্যন্ত, বিড়ির টুকরো আর দেশলাইয়ের কাঠি। দুটো-তিনটে সটকার মাথায় কলকের ওপরে তখনও গগন করে ছোট ছোট গুল জ্বলছে। বিছানার এক কোণে একটা উঁচু গদির ওপর আধশোয়াভাবে পিঠে বালিশ দিয়ে বিশুদা বসে আছে।
ঘরের মধ্যে ঢুকে দিদিমণি সেই বিছানার ওপর দিয়ে ছুটে গিয়ে বিশুদাকে একরকম জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞাসা করলেন, ভাইয়া, কেমন আছিস?
ভাই-বোনের সম্বন্ধ একেবারে বাঙালি ঘরের মতন হলেও উর্দুতে কথাবার্তা শুরু হল। দিদিমণি বলতে লাগলেন, ছোটে, তুই কেন কিছু খাচ্ছিস না? এমন করে ক’দিন বাঁচবি ভাই? বাবুজী বললে, দুধ আর গোশতের সোরবা না খেলে তুই বাঁচবি না। খাওয়া-দাওয়া একেবারে ছেড়ে দিলি কেন?
বিশুদা বলতে লাগল, বহেন, খেতে যে পারি না ভাই। তুই বুঝছিস না, তুই তো কিছুতেই মানবি না, কিন্তু আমি বেশ বুঝতে পারছি, আমার দিন প্রায় শেষ হয়ে এল। সারাদিন বাদে তুই এলি–কোনদিন এসে দেখবি, তোর ছোটে আরি শ্বাস ছেড়েছে।
পাঁচ মিনিট আগে এই ঘরে হাসির হা চলছিল, আমরা নিজের কানে শুনেছি।
দেখতে দেখতে দিদিমণির চোখে অশ্রু দেখা দিল। অত্যন্ত ধরা গলায় করুণকণ্ঠে তিনি বলতে লাগলেন, ছোটে, তুই চলে গেলে আমি কি নিয়ে থাকব ভাই–আমার আর কি রইল?
দিদিমণির অশ্রু ও করুণ কণ্ঠের চাইতে করুণতর হাসি হেসে বিশুদা বললে, বহেন, পরমাত্মার দয়ার সীমা নেই। দেখ, আমি চলে যাবার আগেই সে তোকে এই দুটো ভাই এনে জুটিয়ে দিয়েছে।
আমরা দিদিমণির দু-পাশে–একটু পেছনে বসে ছিলুম। বিশুদা কথাটা বলামাত্র দিদিমণি একবার পাশ ফিরে আমাদের দেখে আবার ভাইয়ের দিকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন।
ছোটেসাহেব বলতে লাগল, এই শর্মাজী ও রায়সাহেব-এরা তো এখনও বাচ্চা, তুই এদের নিজের মতন তৈরি করে নে। এদের মুখ দেখেই বুঝতে পারা যায়, এরা শরীফ ঘরের ছেলে। তার পরে একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে বললে, আর সূদন তো রইল–আমি গেলে তাকে আর চাকরি করতে দিস নে, কাছে এনে রাখিস।
কিছুক্ষণ নিস্তব্ধ। তার পরে বিশুদা আমাকে ডেকে তার অদ্ভুত বাংলাভাষায় বললে, দেখো শর্মাজী, আমার দিদিমণিকে তোমরা দেখো। বেচারা বড় দুঃখীলোক আছে, ওর সাথ কখনও ছেড়ো না।
এই অবধি বলেই বিশুদা একদৃষ্টে সামনের দিকে চেয়ে রইল। দিদিমণি বাঁ হাতখানা দিয়ে ভাইকে জড়িয়ে ধরে ছিল। আমি ঠিক তার পাশেই অথচ একটু পেছনে বসে ছিলুম। সেই অবস্থাতেই সে তার ডান হাতখানা হাতড়ে হাতড়ে আমার বাঁ হাতটা আস্তে ধরে ফেললে। সে স্পর্শের মধ্যে সঙ্কোচ ছিল বটে, কিন্তু অনুনয় ছিল অতি গভীর। এক হাতে মুমূর্ষু ভাই, যার সঙ্গে ছেলেবেলা থেকে সে একত্রে বেড়ে উঠেছে, সারাজীবনের কত সুখ-দুঃখের স্মৃতি যার সঙ্গে জড়িত–মুষ্টিবদ্ধ বালুকণার মতন যত জোরে সে তাকে আঁকড়ে ধরছে তত তাড়াতাড়িই তার জীবনকণা নিঃশেষ হয়ে চলেছে, এ-কথা যে সে বুঝতে পারছে না তা নয়–অন্য হাতে অজানা, অপরিচিত, অনাত্মীয়, নবাগত আমরা। দু-দিকে দুই তরফকে নিয়ে দিদিমণি বসে রইল। আমি দেখতে লাগলুম, তার দুই চোখ দিয়ে নিঃশব্দে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগল বিশুদার ডান কাঁধের ওপর।
প্রকাণ্ড হল-ঘর, দুটো দেওয়ালগিরিতেও ঘরের সবটা আলোকিত হয়নি। দূর প্রান্তরে কোণগুলোতে অন্ধকার জমা হয়ে রয়েছে। বিশুদা অশ্রুবিহীন উদাস দৃষ্টিতে সেই অন্ধকারের দিকে চেয়ে রইল। বিড়ি ও গড়গড়ার ধোঁয়াগুলো ঠান্ডার চোটে স্তম্ভিত হয়ে কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘরের মাঝখানে স্থির হয়ে শূন্যে ঝুলতে থাকল। একবার পরিতোষের মুখের দিকে চেয়ে দেখলুম, তার বড় বড় টানা চোখ-দুটোতে অশ্রু টলটল করছে। সব স্থির নিস্তব্ধ–এরই মধ্যে স্থাণুর মতন আমরা চারটি প্রাণী বসে রইলুম।
আজ শীতের এই সন্ধ্যায়, আলোকহীন কলিকাতা নগরীর মধ্যে নির্বান্ধব পুরীতে একটা ঘরে একলা বসে এই জাতক লিখছি। মাথার ওপরে কালিমালিপ্ত বিজলীবাতির ফানুস জ্বলছে, তা থেকে আলোর চাইতে অন্ধকারই বিকিরণ করছে বেশি। জগদ্ব্যাপী মারণ-যজ্ঞের মন্ত্র মাথার ওপর দিয়ে গর্জন করতে করতে আকাশময় ছুটোছুটি করছে। চারিদিকে মৃত্যু ছাড়া আর কথা নেই, মৃত্যু ছাড়া আর সংবাদ নেই, মৃত্যু ছাড়া আর কাব্য নেই। প্রভাত-সূর্য উঠছে মৃত্যু-সংবাদ নিয়ে, পূর্ণিমার চাঁদ সে তো মৃত্যুরই দূত। বসে বসে মৃত্যুর কথাই মনে হচ্ছে। মৃত্যু–সে তো আমার অজানা নয়। শৈশব থেকে আজ পর্যন্ত বারে বারে আমি মৃত্যুর রূপ দেখেছি কত ভাবে! আমার কত প্রিয়জনকে যে সে নিয়ে চলে গিয়েছে, তার আর ঠিকানা নেই। কিন্তু গভীরভাবে মৃত্যুর কথা এর আগে কখনও চিন্তা করিনি। আজ অকস্মাৎ অনুভব করলুম, ধীরে, সন্তর্পণে, অতি অতর্কিতে মৃত্যু এসে দাঁড়িয়েছে আমার সম্মুখে, অতি নিকটে। এত নিকটে যে, একটুখানি হাত বাড়ালেই তাকে ছুঁতে পারা যায়। মৃত্যুর কথা ভাবতে ভাবতে দূর-অতীতের আর-এক শীত সন্ধ্যার সেই ছবিখানা মনের মধ্যে ফুটে উঠেছে। মনে হচ্ছে, সেই অন্ধকার গৃহকোণের দিকে চেয়ে-চেয়ে মৃত্যুপথযাত্রী বিশুদার মনে সেদিন কি ভাবের উদয় হচ্ছিল!
বোধ হয় আধ ঘণ্টা সেইরকম চুপচাপ কাটবার পর দিদিমণি বিশুদাকে বললে, ‘খানকয়েক হালকা লুচি আর একটু মাংসের সোরবা পাঠিয়ে দিচ্ছি, খেয়ে ফেল্।
এতক্ষণে বিশুদা বাংলায় বোনের কথার উত্তর দিলে, তুই তো কিছুতেই মানবি না। পাঠিয়ে দে, যদি খেতে পারি তো খাব।
এবার দিদিমণি উঠে দাঁড়াল, সঙ্গে সঙ্গে আমাকেও টেনে তুললে, কারণ আমার বাঁ হাতখানা তখনও সে তেমনই চেপে ধরে ছিল।
বিশুদার ঘর থেকে বেরিয়ে এলুম। আমাদের ঘরের কাছে এসে দিদিমণি বললে, তোরা ততক্ষণ ঘরে গিয়ে আরাম কর, খাবার তৈরি হতে দেরি হবে, আমি একটু দেখিগে যাই। বই পড়বি?
ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাতে দিদিমণি বললে, আচ্ছা, আমি পাঠিয়ে দিচ্ছি।
দিদিমণি চলে গেল। আমরা ঘরের মধ্যে ঢুকে নির্দিষ্ট বিছানায় শুয়ে গল্প করতে লাগলুম। প্রথমেই পরিতোষ ধরা-ধরা গলায় বললে, গুরুমার চেয়ে এরা ঢের ভালো লোক। এদের ছেড়ে কখনও যাব না।
আমি চুপ করে বইলুম, কারণ গুরুমা যে কিরকম লোক সে-সম্বন্ধে আজও আমার কোনো স্পষ্ট ধারণা হয়নি। মৃত্যুর মতন আজও সে আমার কাছে রহস্যই হয়ে আছে।
কিছুক্ষণ চুপচাপ কাটবার পর পরিতোষ বললে, জয়া ফিরে এলে তাকে এইখানেই একটা বাড়ি ভাড়া করে এনে রাখা যাবে। তারও কাশীর ওই হুল্লোড় ভালো লাগে না।
এবার আমি তাকে একটু খোঁচা মেরে দিয়ে বললুম, তুই কি মনে করেছিস, তোর কথা শুনে কাশী ছেড়ে জয়া এখানে চলে আসবে? মেয়েমানুষকে তা হলে এখনও চিনতে পারিসনি তুই।
আমার কথা শুনে পরিতোষ বললে, জয়া তোর রাজকুমারীর মতন নয়। আমি বললে সে আমার জন্যে হাসতে হাসতে প্রাণ দিতে পারে।
পরিতোষ ভাগ্যবান! জয়া সম্বন্ধে এই ধারণা নিয়েই সে ইহলোক থেকে বিদায় নিয়েছে। বোধ হয় পনেরো-বিশ মিনিট বাদে বিকেলবেলাকার সেই ভরত এসে খান তিন-চার বাংলা বই আমাদের দিয়ে চলে গেল। আমরা এক-একখানা বই নিয়ে শুয়ে পড়তে আরম্ভ করে দিলুম।
পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়েছিলুম। ভরত আমাদের জাগিয়ে খাবার ঘরে নিয়ে গেল। রান্নাঘরের এক কোণে কাঠের উনুনে হিন্দুস্থানী ঠাকুর রাঁধছে, কাছেই একটা মোড়ার ওপর দিদিমণি বসে। দেখলুম, দুটো বড় বড় পিঁড়ির সামনে দুখানা খালি থালা পাতা রয়েছে। আমরা সেখানে উপস্থিত হওয়ামাত্র দিদিমণি বললে, নাও, বসে পড়, আর রাত করে কি হবে?
ঠাকুর গরম-গরম রুটির দু-পিঠে ঘি মাখিয়ে আমাদের থালার ওপরে দিয়ে গেল। দিদিমণি দু-বাটি মাংস আমাদের দুই থালার পাশে রেখে বললে, আর কিছু নেই, এই দিয়েই খেতে হবে।
দুটি বেশ বড় বাটি ভর্তি ঘন দুগ্ধ মেরে আহার সমাধা করে ঘরে এসে লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়া গেল।
.
শীতের প্রত্যূষে ঘুমটি যখন জমেছে, ঠিক সেইসময় দিদিমণি আমাদের ঘরে এসে চেঁচামেচি করে আমাদের তুলে বললে, চল, বাবুজীর সঙ্গে দেখা করবে না?
তখনও ফর্সা হয়নি; কিন্তু দেখলুম, তার স্নান হয়ে গিয়েছে। মাথার ওপরে তেমনই চুড়ো করে চুলের রাশি, গায়ে শুধু একখানি দামী শাল জড়ানো।
দিদিমণির সঙ্গে গিয়ে আমরা ঢুকলুম সেই ঘরে–কাল বিকেলবেলা যেখানে তার সঙ্গে প্রথম দেখা হয়েছিল। ঘরের মধ্যে ঢুকে দেখলুম, পেন্টুলান ও হাঁটু অবধি ঝোলা গরম-কোট-পরা একটি ভদ্রলোক খাটের ওপরে বসে রয়েছেন। রোগা, লম্বা, মাথার চুল অধিকাংশই কাঁচা, তবু দেখলে মনে হয়, বেশ বয়স হয়েছে। তাঁর পাশে একটা নীচু জলচৌকির ওপর একটা কাঁসার ঘটি বসানো, শঙ্কর চাকর পায়ের জুতোর ফিতে বেঁধে দিচ্ছে।
আমরা ঘরে ঢুকেই তাঁকে প্রণাম করতেই তিনি দাঁড়িয়ে উঠে বললেন, বেঁচে থাক বাবা, বেঁচে থাক। আমার মেয়ে মনোরমা কাল রাতে তোমাদের সব কথা আমায় বলেছে। তোমরা এসেছ, ভালোই হয়েছে। এখানে থাক, মন-টন খারাপ লাগলে বাড়ি চলে যেয়ো, সেখানে কিছুদিন থেকে আবার চলে আসবে।
দিদিমণি তাঁর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বললে, ওরা আর বাড়ি যাবে না বলেছে। জলচৌকির ওপর থেকে ঘটিটা তুলে নিয়ে আলগোছে প্রায় সের-দেড়েক দুধ ঢঢক্ করে উদরস্থ করে তিনি বললেন, মা-বাপ রয়েছেন, মধ্যে মধ্যে বাড়ি যাবে বইকি। ছেলেমানুষ, মন খারাপ করবে না?
দিদিমণি আমার দিকে এসে বললে, কি, মন খারাপ হবে নাকি?
যেন সমস্যাটার সমাধান বাপের সামনে এখুনি হয়ে যাক।
আমি বললুম, না, মন খারাপ কেন হবে?
দিদিমণি বাপের দিকে চেয়ে বললে, ওই শোন, কিছু মন খারাপ হবে না। কেন মন খারাপ হবে, এও তো নিজের বাড়ি–কি বল ভাই?
বৃদ্ধ পিতা এ-কথার কোনো জবাব না দিয়ে খানিকটা প্রাণখোলা হাসি হেসে বললেন, কানের অসুখ কার?
দিদিমণি পরিতোষকে দেখিয়ে দিতে তিনি তাকে আলোর কাছে নিয়ে গিয়ে অনেকক্ষণ ধরে কান টেনে টেনে পরীক্ষা করে বললেন, ও কিছু না, আমি আসবার সময় ওষুধ নিয়ে আসব।
বাবুজী চলে গেলেন। দিদিমণি বললে, চল্, তোদের ঘরে যাই।
ঘরে এসে একখানা লেপ তিনজনে পায়ের ওপর চাপা দিয়ে বসলুম। দিদিমণি বলতে লাগল, তোরা এসেছিস, এবার একটু গল্প করে বাঁচব। সূদন চলে গেছে সে আজ পনেরো-বিশ দিন হয়ে গেল, সেই থেকে বাবুজী ছাড়া আর বাংলায় কথা কইবার লোক পাইনে।
বাবুজীর কথা উঠল। দিদিমণি বললে, আমার বাবুজী সত্যযুগের লোক, ও-রকম লোক হয় না। কি মজলিশি লোকই ছিলেন, আমার মাতাজী মারা যাবার পর থেকে ওই এক রকম হয়ে গেছেন, আর কারুর সঙ্গেই মেলামেশা করেন না। নির্জনে বাস করবার জন্যে এখানে এই বাড়ি কিনেছেন। তা ওঁর বাড়ি কেনাই সার হয়েছে। সপ্তাহের ছ’দিন তো একরকম কাশীতেই কাটে, রবিবার দিনটা শুধু বাড়িতে থাকেন। বাবুজীর আস্কারা পেয়েই তো আমার বড়ভাইটা নষ্ট হয়ে গেল। মাতাজী ওকে দু’চক্ষে দেখতে পারতেন না। আমার মাতাজী দেবী ছিলেন তিনি চলে যেতেই তো সংসারটা ছন্নছাড়া হয়ে গেল।
দিদিমণির গলা ধরে গেল। আর কিছু না বলে সে চুপ করলে।
জিজ্ঞাসা করলুম, এই শীতে এত ভোরে আপনি স্নান করেন কি করে?
দিদিমণি হেসে বললে, এখন কি রে! স্নান করেছি সেই কখন! আমি উঠি ঠিক চারটেয়। উঠে গরুর জন্যে যে চাকর আছে তাদের তুলে দিই গাইদের জাব দেবার জন্যে। তারপরে ঘণ্টাখানেক ধরে তেল মাখি। স্নান সেরে এসে বাবুজীকে তুলে দিই, তিনি স্নান করতে যান। ওদিকে শুতে শুতে প্রায় রাত্রি বারোটা বেজে যায়। রাত্তিরে এই তিন-চার ঘণ্টার বেশি আমার ঘুমের দরকার হয় না। শুধু দুপুরবেলা ঘণ্টা-দুয়েকের জন্যে শুই, তার মধ্যে এক ঘণ্টা পড়ি, আর এক ঘণ্টা ঘুমোই। দিনের বেলা বেশি ঘুমুলে–বাবা, মোটা হয়ে যাব, এমনিতেই তো হাতি হয়ে দাঁড়িয়েছি। এবার খাওয়া কমাতে হবে।
আমাদের কথাবার্তা হতে হতে চারিদিক ফরসা হয়ে গেল। বাড়িঘর ঝাঁট দেওয়া ও চাকর-বাকরদের আওয়াজ আসতে লাগল চারদিক থেকে। দিদিমণি জিজ্ঞাসা করলে, চা খাবি?
চায়ের কথা শুনে আনন্দে মন নেচে উঠল। বললুম, চায়ের ব্যবস্থা আছে নাকি?
দিদিমণি উৎসাহিত হয়ে বললে, আরে চায়ের আমার ভারি শখ। ছোট্কা আর আমি ছাড়া বাড়ির আর কেউ চা খায় না, তা আজকাল ছোট্কা চা ছেড়ে দিয়েছে বলে নিজের জন্যে আর তৈরি করি না। খাবি?
বললুম, আমাদের তো জন্মাবধিই চা খাওয়ার অভ্যেস, কিন্তু বাড়ি থেকে পালিয়ে অবধি অভ্যেস ছুটে গিয়েছে, কোথায় পাব চা বিদেশ-বিভুঁয়ে?
দিদিমণি মুখে একবার চক্চক্ আওয়াজ করে বললে, বেচারা!
তার পরে উঠে দাঁড়িয়ে বললে, তোরা বস্, আমি চা পাঠিয়ে দিচ্ছি।
দিদিমণি চলে গেল। আমরা, মুখ-টুখ ধুয়ে চায়ের প্রত্যাশায় বসে রইলুম, কিন্তু চা আর আসে না। প্রায় ঘণ্টাখানেক অপেক্ষা করবার পর একজন চাকর এক থালা গরম জিলিপি আর দু-গেলাস গরম দুধ নিয়ে এসে হাজির হল। চা আর বরাতে হল না মনে করে সেইগুলিরই সদ্ব্যবহার করে বিড়ি ফুঁকতে আরম্ভ করে দিলুম। কিন্তু বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না, একটু পরেই দু-বাটি চা এসে হাজির হল। চা-পানান্তে বিশুদার আড্ডায় গিয়ে বসলুম। সেখানে গিয়ে দেখি, সেই ভোরেই দু-পাঁচজন লোক এসে হাজির হয়েছে। বিশুদা তার সেলাইয়ের তল্পি কোলে নিয়ে সেইরকম পা ছড়িয়ে বসে তাদের সঙ্গে গল্প করছে।
.
ভারতবর্ষের পূর্বপ্রান্তে এই যে বাংলাদেশ–অতি বিচিত্র দেশ এ, বিচিত্রতর এখানকার অধিবাসীদের হালচাল। ভারতের পুরাতন ইতিবৃত্তে পাওয়া যায় যে, সেকালে এ-দেশে এলে প্রায়শ্চিত্ত করতে হত। বাংলাদেশের বাইরের অনেক পণ্ডিত ব্যক্তি বলে থাকেন, এ-দেশ পাণ্ডববর্জিত, অর্থাৎ পাণ্ডবেরা নাকি এ-দেশেও কখনও আসেননি। অবশ্য পাণ্ডবদের মতন অসভ্যরা, যদি এ-দেশে না এসে থাকেন, তাতে আমাদের কোনো ক্ষতিই হয়নি। যে-দেশে ছোট ভাইয়ের স্ত্রীর মুখ দেখলে প্রায়শ্চিত্ত করতে হত, সেখানে ভাদ্দর-বউকে নিয়ে পাড়া জানিয়ে ঘরে খিল লাগানোর প্রতিক্রিয়া যে কি হত, তা ভাবলে আর জ্ঞান থাকে না–কারণ পাণ্ডবদের ধর্মবন্ধু, মতান্তরে ধর্মপিতা, কৃষ্ণচন্দ্রের লীলাখেলাকে ধর্মসাধনের অঙ্গ করে আধ্যাত্মজগতের পাকা সড়ক দিয়ে যেভাবে আমরা তেড়ে উন্নতির মার্গে আরোহণ করে চলেছিলুম, অত্যাচারী ব্রিটিশ গবর্মেন্ট বাধা না দিলে বৃন্দাবনের স্থান নির্ণয় করতে হয়তো আজ ঐতিহাসিকেরা হিমসিম খেয়ে যেতেন। তাই বলছিলুম, পাণ্ডববর্জিত যদি হয়ে থাকি, তাতে আমাদের কোনো দুঃখই নেই। দুঃখ এই যে, এ-দেশ ঈশ্বরবর্জিত।
ভারতের পূর্বপ্রান্তে পূর্ব-সমুদ্রের কোলে এই যে বাংলাদেশ–এ-দেশের অর্ধেক জল ও ‘তার অর্ধেক জঙ্গল। এরই মধ্যে এখানে যেটুকু ডাঙাজমি আছে, সেইটুকুই আমাদের চাষ ও বাসভূমি। প্রকৃতির লীলানিকেতন এই দেশ–পৃথিবীর আর কোনো দেশে ষড়ঋতুর আবির্ভাব হয় না; কিন্তু তথাপি অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, বন্যা, ঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও মহামারী–একটা-না-একটার উৎপাতে বঙ্গবাসী আবহমানকাল থেকেই পুলকিত হয়ে আসছে। এ ছাড়া সর্পভীতি ও অন্য জানোয়ারের ভয় তো আছেই। সবার ওপরে বিদেশিরাজস্নেহাতিশয্যের প্ররোচনায়-পালিত প্রতিবেশী কর্তৃক স্ত্রীকন্যাপহরণের অত্যাচার-সে তো প্রায় গা-সওয়া হয়ে গেছে।
এই দেশ–যেখানে ব্রাহ্মণেরা পর্যন্ত মৎস্যমাংসভুক্, সেই দেশকে সারা আর্যাবর্ত ঘৃণা করলেও কোনোদিনই তারা একে অবহেলা করতে পারেনি। তার কারণ আর্যাবর্তবাসীর ঔদার্য নয়, তার কারণ বাঙালির পৌরুষ ও শক্তিমত্তা।
এই ঈশ্বরবর্জিত দেশ থেকে যুগে যুগে আচার্যেরা গিয়েছেন আর্যাবর্তের দিকে দিকে শিক্ষাদানের জন্য। দর্শন-বিজ্ঞান, কাব্য-ন্যায়ের নব নব উন্মেষশালিনী প্রতিভায় এ-দেশ চির-প্রদীপ্ত।
ইংলন্ডীয় ক্রিশ্চানেরা আসবার অনেক আগে থেকে এখানকার অধিবাসীরা আর্যাবর্তের স্থানে স্থানে ছড়িয়ে পড়েছে কার্যব্যপদেশে। তারা যেখানেই গিয়েছে, সেই দেশকেই আপনার করে নিয়েছে। শিক্ষায়, সেবায় ও সমাজসংস্কারে তারা নিজেদের ব্যাপ্ত করে দিয়েছে সেখানকার জনসাধারণের মধ্যে–যুগে যুগে তারা সেখানকার অধিবাসীদের শ্রদ্ধা অর্জন করেছে।
কিন্তু পরবাসী হলেও মাতৃভূমির সঙ্গে নাড়ীর যোগ তাদের কখনও বিচ্ছিন্ন হয়নি। মাতৃভূমির কোনো লোক, তা সে ভ্রমণব্যপদেশেই হোক বা দুর্দশায় পড়েই হোক, তাদের আশ্রয়প্রার্থী হলে, সে ব্যক্তি যে শ্রেণীর লোকই হোক-না-কেন, যথাসাধ্য তার সাহায্য করেছে, নিজের পরিবারের মধ্যে তাকে আপনার করে নিয়েছে। বাইরে এদের হালচাল যাই হোক-না-কেন, বাঙালির বৈশিষ্ট্য, বাংলা ভাষা, বাঙালির পোশাক ও বাঙালির খাদ্য তারা ত্যাগ করেনি।
এইরকম এক বাঙালি পরিবারের মধ্যে জন্মগ্রহণ করেছিলেন আমাদের বর্তমান আশ্রয়দাতা, যুক্তপ্রদেশ ও পাঞ্জাব এই দুই প্রদেশের সীমান্তে কোনো এক শহরে। লাহোরের মেডিক্যাল ইস্কুল থেকে পাস করে কিছুকাল সৈন্যদলে কাজ করে. সিভিল চাকরিতে বদলি হয়ে সম্মানের সঙ্গে চাকরি শেষ করে তিনি অবসরগ্রহণ করেছিলেন।, বিবাহ করেছিলেন বাংলাদেশেরই এক পল্লীগ্রামের মেয়েকে। দশ বছরের মেয়ে চব্বিশ-পঁচিশ বছরের যুবকের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে কাঁদতে কাঁদতে চলে এসেছিল এই দূর বিদেশে। তারপর বোধ হয় বার দুই-তিন বাপের বাড়ি আসবার সুবিধা হয়েছিল, তারপরেই স্বামীর ঘর নিজের ঘর হয়ে গেল। অদ্ভুত বাঙালি মেয়ে, জগতে তাদের তুলনা নেই।
ওপরে যাদের কথা উল্লেখ করলুম, তারা ছাড়াও আর-এক শ্রেণীর বাঙালি আর্যাবর্তের স্থানে স্থানে ছড়িয়ে আছে, মাতৃভূমির সঙ্গে যোগসূত্র তাদের ছিন্ন হয়ে গিয়েছে। এরা বাংলাভাষা, বাঙালির বেশ ও খাদ্য ভুলে গিয়েছে; কিন্তু বাঙালির সঙ্গে নাড়ীর টান এখনও ছিন্ন হয়নি। তাই বাঙালি কারুকে দেখতে পেলে অতি বিনীতভাবে নমস্কার করে সঙ্কোচের সঙ্গে বলে ম্যয় বংগালী হুঁ। এঁরা প্রায় সকলেই ব্রাহ্মণ। নাম জিজ্ঞাসা করলে বলে, অমুক ভট্টাচারী কিংবা অমুক ঘাংগোলি। এঁদের পূর্বপুরুষেরা বিদেশে গিয়েছিলেন কোনো মন্দিরের পৌরোহিত্য, কোনো রাজকার্য কিংবা সেনানীর চাকরি নিয়ে, ব্যবসাসূত্রেও কেউ কেউ গিয়েছিলেন। পুরুতের কাজ নিয়ে যাঁরা গিয়েছিলেন, তাঁদের বংশধরেরা এখনও পৌরোহিত্যই করছেন। যাঁরা অন্য কাজে গিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে অনেকেই হয়েছেন জমিদার, কেউ কেউ বা রাজসরকার থেকে জায়গীর পেয়ে হয়েছেন সর্দার। এঁদের ছেলেদের বিয়ে হয় অতি মুশকিলে। পরিবারের মধ্যে চারটি ছেলে থাকলে দুটির বিয়ে হয়, আর দুটিকে অবিবাহিতই থাকতে হয়। প্রত্যেক ছেলের বিয়ের সময়েই এঁরা প্রথমেই খাস ‘বাঙালির ঘরের মেয়ে খোঁজেন। তারপরে খোঁজেন যুক্তপ্রদেশের আধা-বাঙালির ঘরে। সেখানেও না পেলে শেষে নিজেদের মধ্যেই, কিন্তু সগোত্রে নয়, বিয়ে দেন।.
এইরকম ঘরের একটি ছেলের সঙ্গে একবার আমার বন্ধুত্ব হয়েছিল। সে বেচারা বিয়ে করেছিল কাশীতে। স্ত্রীকে সে ভালোবাসত বললে ঠিক বলা হয় না, তাকে সে দেবীর মতন পুজো করত। দু-পাঁচ বছর অন্তর স্ত্রী বাপের বাড়ি যেত, সেখানে থেকে সে বাংলায় চিঠি লিখত স্বামীকে। আমার বন্ধু সেই চিঠি বগলে নিয়ে দশ মাইল দূরে এক আধা-বাঙালির কাছে যেত চিঠি পড়াবার জন্যে, আর তাকে দিয়েই সেই চিঠির জবাব লিখিয়ে ডাকঘরে ফেলে দিয়ে বাড়ি আসত। এদের বাড়িতে বার-কয়েক নিমন্ত্রণ খেতে গিয়েছি। প্রথমবারে মেয়েরা কেউ সামনে বেরোয়নি। তারপর ছেলেমানুষ দেখে মা-খুড়ির দল বেরুলেন, ইয়া-ইয়া পেশোয়াজের মতন ঘেরওয়ালা সব ‘লাহেঙ্গা’ পরা, কেউ-বা যোধপুরের মেয়ে, কেউ-বা বিকানীরের। নতুন বউয়ের দেখাদেখি অল্পবয়সিরা শাড়ি পরতে আরম্ভ করেছে, তাই নিয়ে সংসারে অশান্তির সীমা নেই।
এইরকম একটি পরিবার, যাদের পূর্বপুরুষ রাজকার্যব্যপদেশে কোনো এককালে রাজপুতানার পাহাড়-ঘেরা কোলে এক রাজ্যে গিয়েছিল বসবাস করতে। নিজেদের শৌর্য ও কর্মকুশলতায় তারা সেখানকার প্রথম শ্রেণীর সর্দারের পরে উন্নীত হয়েছিল। রাজ্য ছোট হলেও তাদের জমিদারি ছিল বিপুল। পাহাড়ের ওপরে প্রাসাদ, বাড়িতে চার-পাঁচ-শো লোক, এই পরিবারের বড় ছেলের সঙ্গে দিদিমণির বিয়ে হয়েছিল। সেখানকার মহারাজা নিজে উদ্যোগী হয়ে এই বিয়ের ঘটকালি করেছিলেন। দিদিমণির মা-বাবা মনে করলেন, তাঁদের মেয়ের নেমন রাজরানীর মতন রূপ ও হালচাল, তেমনই ঘরে ভগবান তার বরও জুটিয়ে দিলেন। কিন্তু ভবিতব্য ছিল অন্য, কারণ শ্বশুরবাড়ি থেকে প্রথমবার ফিরে এসেই দিদিমণি প্রকাশ করলে যে, তার স্বামী আধ-পাগলা। তবে অত্যাচার কিছু করে না, শুধু সারারাত তার পা-দুটো জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকে।
কিন্তু এরকমও বেশিদিন চলল না। বিয়ে করে ভালো ভালো মাথাওয়ালা লোকেরই মেজাজ বিগড়ে যায়, আধ-পাগলা তো দূরের কথা!
একদিন এই আধ-পাগলা ফুর্তির চোটে মারলে লাফ পাহাড়ের ওপর থেকে গভীর খাদে, দিদিমণি মাথার সিঁদুর মুছে ফিরে এল বাপের বাড়ি।
তারপরে চলল লড়াই বিষয়-আশয় নিয়ে। শেষকালে মহারাজা মাঝখানে পড়ে প্রায় লাখখানেক টাকা দিয়ে তাদের ঝগড়া মিটিয়ে দিলেন। দিদিমণির নামে টাকাটা তার বাবা আগ্রার বাঙাল-ব্যাঙ্কে জমা করে দিলেন। গয়না ইত্যাদি স্ত্রীধন সব বাড়ির সিন্দুকে উঠল। চেক কাটবার জন্যে সে ইংরেজি শিখতে লাগল, আমরা দেখেছি তার হাতের লেখা মুক্তোর মতন। সেই থেকে সে বাপের বাড়িতেই আছে।
মা মারা যাওয়ার পর বাপের বাড়ির সারা সংসারের ভার স্বেচ্ছায় তুলে নিলে সে নিজের মাথার ওপর। সেই ভোর চারটের সময় উঠে গরুর চাকরদের তুলে দেওয়া। তারপরে স্নান সেরে দুধ গরম করে বাপকে খাইয়ে তাঁকে কাশী পাঠিয়ে দেওয়া। প্রায় পনেরোটি ঝি-চাকরকে খাইয়ে বেলা একটার সময় আহারাদি শেষ করে সে নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ে। বছর-পাঁচেক আগে বিছানার চাদরের মতো লম্বা-চওড়া একখানা ‘হিতবাদী’ ও একখানা ‘বসুমতী’ সাপ্তাহিক তার বাবা কাশী থেকে কিনে এনেছিলেন, তারই একখানা নিয়ে পড়তে আরম্ভ করে। প্রতিদিন এই কাগজের সম্পাদকীয় থেকে আরম্ভ করে বিজ্ঞাপন পর্যন্ত পড়ে ঘণ্টা-খানেকের জন্যে ঘুমিয়ে পড়ে। কাগজ-দুখানায় যত বই, ওষুধ ও দৈব-মাদুলির বিজ্ঞাপন আছে, দিদিমণি তা সব ভি. পি-তে নিয়ে এসে ঘরে জমা করে রেখেছে। ঘুম থেকে উঠে আবার সংসারের কাজে লেগে যাওয়া, ঘড়ি ধরে রুগ্ন ভাইয়ের ওষুধ ও পথ্য পাঠানো–এসব ছাড়া কাশীর দাওয়াখানার হিসাব তো আছেই। গরুদের শিঙে ও ক্ষুরে একদিন যদি চাকরেরা তেল মাখাতে ভুলে যায় তো হুলস্থূল বাধে বাড়িতে। সমস্ত সংসার ঘড়ির কাঁটার মতো চলেছে, একটু এদিক-ওদিক হবার জো নেই।
দিদিমণির বাবা, বয়স তাঁর প্রায় পঁচাত্তর। জীবনব্যাধি থেকে মুক্তি পাবার দিন তাঁর ঘনিয়ে এসেছে। স্ত্রীর মৃত্যুর পর সব ছেড়ে ছুঁড়ে যে-কটা দিন বাঁচেন, নির্জনবাস করবার জন্যে এখানে বাড়ি কিনেছিলেন; কিন্তু কিছুদিন চুপচাপ বসে থাকবার পর আবার কর্মসাগরে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। একদিন তাঁর সংসার ছিল বৃহৎ। নিজের অনেক ছেলেপিলে ছিল, তা ছাড়া বাইরের কত ছেলে, কত আত্মীয়স্বজন তাঁর বাড়িতে মানুষ হত। জজমে সংসার, সবার ওপরে ছিল লক্ষ্মীরূপা স্ত্রী, কিন্তু মৃত্যু এসে একে একে প্রায় সকলকেই নিয়ে গেছে। একদিন তাঁর একলার আয়ে সংসার খরচ কুলোত না, আজ প্রয়োজনের অতিরিক্ত অর্থানুকূল্যে ভাগ্যবিধাতা তাঁর ভাণ্ডার পূর্ণ করে দিচ্ছেন; কিন্তু লোক নেই, কে ভোগ করবে, তাই মাসে মাসে উদ্বৃত্ত অর্থ ব্যাঙ্কে গিয়ে জমা হচ্ছে। একটা মেয়ে, সেও বিধবা। দুটো ছেলের একটা কবে যায় তার ঠিক নেই, আর-একটা হতচ্ছাড়া। কিন্তু কোনো কিছুতেই তাঁর আয়োজনও নেই, বিসর্জনও নেই। তাঁর দিন যে ঘনিয়ে এসেছে সে-কথা তিনি জানেন, কিন্তু মৃত্যুর পর মেয়ের যে কি হবে সে-বিষয়ে কোনো চিন্তাই তাঁর নেই।
দিদিমণির ছোট ভাই, তার কথা আগেই বলেছি।
আমাদের দিনগুলি কাটতে লাগল পরম আনন্দে। পরিতোষের সঙ্গে বিশুদার ভারি ভাব জমে গেল, সে প্রায় সারাদিনই তার সঙ্গে কাটায়।
দিদিমণি আমাকে দিয়ে তার নিজের টাকার হিসাব, সংসার খরচের হিসাবপত্র লেখাতে আরম্ভ করলে। সকালবেলাটা আমার এই করতেই কেটে যায়। বাবুজী প্রতিরাত্রেই দাওয়াখানার একটা হিসাব নিয়ে আসতেন আর সকালবেলায় প্রতিদিন সেই হিসাব একটা পাকা খাতায় আমাকে টুকে রাখতে হত। দিদিমণি বলতে লাগল, তুই আসায় যে আমার কি সুবিধা হয়েছে, তা কি বলব!
কিছুদিন যেতে-না-যেতেই পরিতোষ বিশুদার, আর আমি দিদিমণির লোক হয়ে গেলুম। দুপুরবেলা খাওয়া-দাওয়া সেরে দিদিমণি যখন গড়ায়, তখন তার কাছে বসে মাথার পাকা চুল খুঁজতে হয়। কোনোদিনই পাকা চুল পাওয়া যায় না; সে বলে, অনেক আছে, তুই দেখতে পাস না। শেষকালে চুল চিরে চিরে, তার মধ্যে আঙুল চালিয়ে মাথায় সুড়সুড়ি দিতে হয়। সে ঘুমিয়ে পড়লেই একখানা বই নিয়ে শুয়ে পড়ি। কোনো কোনো দিন দিদিমণি গল্প করে-তাদের সংসারের, তার শ্বশুরবাড়ির গল্প। তার বড় ভয়, ছোটকা মরে গেলে, বাবুজী চলে গেলে তার কি হবে?
আমি বলি আমরা রয়েছি, তোমার ভাবনা কি দিদি?
দিদিমণি উঠে বসে থুতনিতে হাত দিয়ে সজলকণ্ঠে বলে, সত্যি বলছিস?
সত্যি বলছি।
দিদিমণি আমার চোখের দিকে চেয়ে-চেয়ে কি দেখে নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।
একদিন আমি তাকে বললুম; বাবুজী ও বিশুদা যদি সত্যিই চলে যায়, তা হলে আমরা দেশভ্রমণে বেরিয়ে যাব। ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত হয়ে পড়লে আবার কিছুদিনের জন্যে এখানে ফিরে আসব, আবার বেরিয়ে পড়ব।
আমার প্রস্তাবটা তার খুবই ভালো লাগল। সেই থেকে প্রায় প্রতিদিনই দেশভ্রমণের কথা শুরু হল। দুপুরবেলা তার পাশে বসে কখনও চলে যাই পৃথিবীর প্রান্তে সেই মেরুজ্যোতির দেশে, কখনও-বা ঘুরে বেড়াই হিমালয়ের শিখরে শিখরে, কখনও-বা সুইত্জারল্যান্ডের হ্রদে স্মিমবোটে চড়ি, কখনও-বা কন্যাকুমারীর মন্দিরে বসে থাকি। সারা পৃথিবী ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ি, সেদিন আর বই পড়া হয় না।
এক অস্থির ছাড়া বাড়ির কথা মনেই হয় না, একা দিদিমণি আমার মা বোন দিদি সবার স্থান দখল করে বসল।
মধ্যে মধ্যে মনে হয়, দেশভ্রমণের সময় মাকেও নিয়ে আসব। একদিন দিদিমণির কাছে সেকথা বলামাত্র আনন্দে লাফিয়ে উঠে সে বললে, এখন কোনোরকমে তাঁকে নিয়ে আসতে পারিস না?
বললুম, মাকে আনতে গেলে আমায় তারা ধরে ফেলবে, আর আসতেই দেবে না।
নিরুৎসাহ হয়ে সে বললে, আচ্ছা, এখন তা হলে থাক্
এবার এদের বড়ভাইয়ের কথা বলি। এ-বাড়িতে ঢুকে অবধি শুনে আসছিলুম যে, সে-লোকটা মাতাল, লম্পট, জুয়াড়ী, বাড়ির সুখদুঃখের সঙ্গে তার কোনো সহানুভূতিই নেই। শুধু বাপের ভালোমানুষির সুযোগে সে দু-হাতে সংসারের টাকা শুষছে আর ওড়াচ্ছে। এইসব শুনে তার প্রতি একটা বিরুদ্ধ ভাব মনের মধ্যে জমা হয়েই ছিল। দুই বন্ধুতে তার সম্বন্ধে অনেক আলোচনাও হত এবং এ-কথাও আমরা বলাবলি করেছি যে, আমাদের মতন ভাইয়ের পাল্লায় পড়লে দু-দিনে চাঁদকে ঠান্ডা করে দিতুম।
দিদিমণিদের বাড়িতে আসার বোধ হয় সাত-আট দিন বাদে একদিন রাত্রি প্রায় সাড়ে-দশটার সময় সেই চাঁদের উদয় হল আমাদের ঘরে।
দিদিমণি আমাদের বিশেষ করে বলে দিয়েছিল, রাত্রে আলো একেবারে নিবিয়ে শুয়ো না। এখানে চোর, ডাকাত, বিচ্ছু, করায়েৎ ইত্যাদির উৎপাত আছে।
আমাদের বাতিটা খুব নামিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়তুম। দরজাটা ভেজানোই থাকত, কারণ বাইরের ছাতে সারারাত্রি পাহারা থাকত।
সে-রাত্রে ঘুমিয়ে পড়বার পর হঠাৎ কার ভারী গলার আওয়াজে ঘুমটা ভেঙে গেল। চটকা ভেঙে যেতেই উঠে বসে পরিতোষকে ঠেলে তুলে দিলুম। দেখলম, সামনেই একটা লোক দাঁড়িয়ে, মিশ্-কালো, লম্বা-চওড়া চেহারা, মুখময় বসন্তের দাগ, তাতে একজোড়া ঝাঁটার মতন গোঁফ, ঘর ধান্যেশ্বরীর গন্ধে একেবারে ভরপুর, চোখ-দুটো লাল টকটকে–বোধ হয় ধ্যানেশ্বরীর ওপরে গাঁজাও চড়েছে। পশ্চিমি ধাঁচে কোমরে ধুতি বাঁধা। সে এক বীভৎস দৃশ্য। বদ্যিনাথ তার কাছে কন্দর্প বললেও অত্যুক্তি হয় না।
উঠে বসতেই লোকটা ভারী গলায় ধমকের সুরে বললে, লাটসাহেবের পোতরা, বাতি জ্বেলেই শুয়ে পড়েছ! বাবার ঘরের তেল পেয়েছ, না?
আমরা আর কি বলব! প্রথম সম্ভাষণেই এমন পুলকিত হলুম যে, আর বানিষ্পত্তি হল না। ইতিমধ্যে বড়েসাহেব গা থেকে শালখানা খুলে ঘরের এক কোণে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন। তারপরে লম্বা কোটটা খুলে কাঠের সিন্দুকটা টিপ করে ছুঁড়লেন বটে, কিন্তু সেখানা সিন্দুকের দশ হাত দূরে গিয়ে পড়ল, আর তিনি টাল খেয়ে নাচের ভঙ্গিতে দু-পাক ঘুরে গেলেন–কাছেই দেওয়াল থাকায় সে-যাত্রা সামলে গেলেন বটে, কিন্তু আমরা আর থাকতে না পেরে হেসে উঠলুম।
আমাদের হাসি শুনে বড়েসায়েব উর্দুলেখার ভঙ্গিতে হেঁটে এসে আমাদের বিছানায় বসেই চিৎকার করে বললেন, কি, মকরা হচ্ছে আমার সঙ্গে! জান তোমাদের মতন পাঁচ-সাতটা লোক খুন করে এই বাড়ির উঠোনে পুঁতে রেখেছি!
কি সর্বনাশ! অন্তরাত্মা চিৎকার করতে লাগল, জয় বাবা বিশ্বনাথ! ডাইনির কবল থেকে উদ্ধার করে শেষকালে ডাকাতের খপ্পরে এনে ফেললে কেন বাবা? অতি দুর্দিনেও যে আড়াই টাকা খরচ করে তোমার পুজো দিয়েছি।
কি করব, কি বলব, তাই ভাবতে লাগলুম। একবার মনে হল, ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে পালিয়ে যাই দিদিমণির কাছে। ইতিমধ্যে পরিতোষটা বলে ফেললে, দিদিমণি রাত্রে বাতি নিবোতে বারণ করে দিয়েছেন, তাই আলো জ্বলছে।
চুপ রহো।–বলে লোকটা এমন চিৎকার করে উঠল যে, ছাতের পাহারাদার কিছু হয়েছে মনে করে একবার উঁকি দিয়ে চলে গেল।
বোধ হয় মিনিট-খানেক চুপ করে থেকে লোকটা বললে, বাবুজীর কাছে তোমাদের সব খবর শুনেছি। বাড়ি থেকে ভেগে আসা হয়েছে, না? আমাকে বাবুজী পাওনি, ঠান্ডা করে দোব।
রাজকুমারীর বাড়ি থেকে বেরিয়ে প্রতিজ্ঞা করেছিলুম যে, যা হবার হবে, ঝগড়া-মারামারির দিকে আর কখনও যাব না। কিন্তু সে-কথা আমার মনে থাকলেও পরিতোষ সাফ ভুলে গিয়েছিল। হঠাৎ সে বলে ফেললে, কি করবেন আপনি? মারবেন? কেন মারবেন? কি করেছি আমরা আপনার? বাড়িতে না রাখতে চান, বলে দিন, আমরা বেরিয়ে যাচ্ছি।
পরিতোষের কথা শুনে লোকটা এমন তিড়বিড়িয়ে উঠল যে, মনে হল, তার গায়ে যেন নাইট্রিক অ্যাসিড ছিটিয়ে দেওয়া হয়েছে। ষাঁড়ের মতন একটা ভয়াবহ গর্জন করে সে বললে, কি! আবার চোপরা করা হচ্ছে মুখের ওপর! মারব বিছুয়া।–বলে সাঁ করে কোমর থেকে সাপের মতন অ্যাকাব্যাকা একখানা চক্চকে ছোরা বের করে ধরলে একেবারে পরিতোষের নাকের ওপর। তারপর কটমট করে চেয়ে ঘন ঘন নিশ্বাস ফেলতে ফেলতে বলতে লাগল, আজ তোমাদের শেষদিন।
“আজ তোমাদের শেষদিন”–এই ভবিষ্যদ্বাণী ইতিপূর্বে বাবার মুখেও বহুবার শুনেছি। শেষদিনের শেষমুহূর্ত অবধি পৌঁছবার সুযোগ না হলেও পিতৃপুণ্যের জোরে সে-পথের অনেকখানিই আমার জানা ছিল। কিন্তু এই ভবিষ্যদ্বাক্যকে নিশ্চিত সাফল্যে পরিণত করবার এমন পরিপাটি ব্যবস্থা তাঁর হাতে ছিল না, তাই এতখানি ভয় ইতিপূর্বে আর কোনোদিনই পাইনি। পরিতোষের তো কথাই নেই, এত বয়স অবধি বাপের হাতে একটা চড় পর্যন্ত কখনও সে খায়নি।
বড়কর্তা বিছুয়া ঘুরিয়ে পরিতোষকে শাসাতে আরম্ভ করে দিলে, সেই ফাঁকে আমি ছুটলুম দরজার দিকে দিদিমণিকে খবর দিতে। আমাকে ছুটতে দেখে বড়কর্তা চেঁচিয়ে উঠল, এইও, কোথায় যাচ্ছ?
বললুম, দিদিমণির কাছে যাচ্ছি, একটু কাজ আছে।
আচ্ছা, চলে এস এদিকে। কিচ্ছু বলব না, এস এদিকে।
দিদিমণির নাম করতেই দেখলুম, লোকটা একেবারে নরম হয়ে গেল। আমি ফিরে এসে তার কাছ থেকে একটু দূরে বসে পড়লুম। পরিতোষও ইতিমধ্যে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ ব্যবধানে গিয়ে একটা মোটা গিদ্দে কোলে নিয়ে উঁচু হয়ে বসল। আমি বসতেই লোকটা বললে, আজ আর কিছু বললুম না। ফের যদি আমার সঙ্গে কোনোদিন মশ্করা করতে দেখি তো জানসে মেরে দেব।
তারপর ছোরাটাকে তিনবার চুকচুক করে চুমু খেয়ে কোমরে গুঁজতে গিয়ে আবার সেটাকে বার করে এনে বললে, খুন পিলাব বলে একে বার করলুম, কিন্তু এখন যদি একে কিছু না দিয়ে খাপে পুরি তো অধর্ম হবে। এই কথা বলে সে একবার পরিতোষের ও একবার আমার মুখের দিকে বিমর্ষভাবে তাকাতে থাকল, অর্থাৎ তোমাদের দুজনের মধ্যে যেই হোক একটু রক্ত একে দাও।
আমার মাথার ওপরেই দেওয়ালে সেই আরশিটা ঝুলছিল। টপ করে উঠে মুখ দেখবার ভান করে আয়নাটা দেওয়াল থেকে খুলে নিলুম, উদ্দেশ্য, যদি লোকটা পরিতোষের ওপর কোনো অত্যাচার করতে উদ্যত হয় তো এক আয়নার ঘায়ে তাকে গোলোকধামের অন্তত মাঝপথ অবধি পৌঁছে দেব।
কিন্তু আমাদের আর কোনো কথা না বলে সে নিজের উরুতের কাপড়টা তুলে ছোরার মুখ দিয়ে খ্যাঁচ করে খানিকটা কেটে ফেললে, সেই ক্ষতমুখ দিয়ে ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটতে লাগল। সেই রক্তে আমাদের বিছানার খানিকটা লাল হয়ে গেল। কিছুক্ষণ রক্ত বেরুবার পর সে বললে, ছেঁড়া ন্যাকড়া-ট্যাকড়া আছে?
বললুম, ন্যাকড়া তো নেই।
বড়কর্তা আর কোনো কথা না বলে ছোরাটা কোমরে গুঁজে উঠে পড়ল। তারপর টলতে টলতে গিয়ে নিজের বিছানার চাদরের খানিকটা পড়পড় করে ছিঁড়ে ফেললে। আমরা মনে করলুম, হয়তো এবার উরুতে ব্যান্ডেজ বাঁধা হবে। কিন্তু তা না করে আবার সেইরকম টলতে টলতে কাছে এসে বললে, শিলাই আছে?
দেশলাইটা দিতেই সেই চাদর-ছেঁড়া ন্যাকড়ায় আগুন লাগিয়ে দিলে। তারপরে সেই জ্বলন্ত ন্যাকড়া ক্ষতস্থানে চেপে ধরে মুখ থেকে হ্যাঁক হ্যাঁক করে খানিকটা থুতু বের করে তার ওপরে চাপাতে লাগল। কিছুক্ষণ এইরকম করবার পর বললে, যাক, থেমে গিয়েছে রক্ত-পড়া।
দেশলাইটা মেঝে থেকে তুলে বড়েসাহেব আমাদের কাছে এসে বললে, তোমাদের তদির ভালো, আজ ভারি বেঁচে গেলে।
এবার আমি বেশ মিষ্টি করে বললুম, আপনি আমাদের বড়ভাই, আপনি যদি মেরে ফেলেন তো আমরা কি করতে পারি বলুন, মরে যেতে হবে।
আমার কথা শুনে বড়কর্তার মেজাজটা বেশ নরম হয়ে গেল। সে বললে, আচ্ছা, আমায় বড়ভাইয়ের মতন মানিস তো?
নিশ্চয়।
তো, যা জিজ্ঞাসা করব ঠিক-ঠিক জবাব দিবি?
নিশ্চয়।
মিথ্যে বললে, আমায় চেনো না, জিন্দা মাটিতে গেড়ে দেব। ও তোমার বাবুজী, কি মনোরমা, কি তোদের বাপ এলেও বাঁচাতে পারবে না।
এ-কথার আর কি উত্তর দেব! গভীরভাবে গবেষণায় মন দেওয়া গেল, বাবুজী বা মনোরমা কি করবেন জানি না; কিন্তু সত্যিই যদি আমার বাবা এ-সময়ে এখানে উপস্থিত হন, তাহলে এই জিন্দা গেড়ে দেবার শুভকার্যে তিনি এ-ব্যক্তিকে সাহায্য করবেন, কি বাধা দেবেন, তাই নিয়ে মনের মধ্যে তোলপাড় চলতে লাগল।
আমার চিন্তাধারাকে চমক দিয়ে বড়কর্তা খিঁচিয়ে উঠল, কি, সাচ্-সাচ্ বলবি তো?
এবার পরিতোষ বললে, নিশ্চয়ই বলব, আপনি জিজ্ঞাসাই করুন না।
বড়েসাহেব এবার চক্ষু বুজে কি ভাবতে আরম্ভ করলে তা সে-ই জানে। আমার মনে হতে লাগল যে, লোকটা বোধ হয় বদ্যিনাথের বন্ধু। কাশীতে হয়তো আমাদের নামে ঢি-ঢি পড়ে গিয়েছে, সে-সব কথা জানতে পেরে এ ব্যক্তি রাজকুমারী সম্বন্ধেই কোনো প্রশ্ন করে বসবে। কিন্তু আমার সব আন্দাজ ব্যর্থ করে দিয়ে চোখ বুজেই সে প্রশ্ন করলে, রোজ কতখানি করে কোকেন খাওয়া হয়?
বলেন কি মশায়! কোকেন-টোকেন আমরা খাই না।
বাড়ি থেকে ভেগেছ বাবা, আর কোকেন খাও না! ন্যাকা বোঝাচ্ছ আমাকে?
এ-কথার আর কি জবাব দেব! বাড়ি থেকে ভাগতে হলে যে আগে থাকতে কোকেন খাওয়ার অভ্যেস করতেই হবে, এমন কোনো শাস্ত্রের সঙ্গে ইতিপূর্বে আমাদের পরিচয় হয়নি। চুপ করে আছি, এমন সময় বড়দা বললে, আচ্ছা দেখি, জিভ বের কর তো।
আমার একে একে জিভ বের করে দেখালুম, কিন্তু সে-ব্যক্তি তাতেও সন্তুষ্ট না হয়ে উঠে কুলুঙ্গিগুলো হাতড়ে হাতড়ে কি খুঁজতে লাগল। কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজির পর আমাদের কাছে ফিরে এসে লোকটা বললে, কি বাবা ঠিক সরিয়েছ তো?
কি?
মোমবাতি। আমার বড় একটা মোমবাতি ছিল, সেটা পাচ্ছি নে।
আমি বললুম, আপনার মোমবাতি কোথায় গেছে আমরা তা জানি না। আমরা এসে অবধি ও-কুলঙ্গিতে হাত পর্যন্ত দিইনি।
পরিতোষের দিকে চেয়ে দেখলুম, রাগে তার চোখ-দুটো রাঙা হয়ে উঠেছে। একটা কিছু হাঙ্গামা বাধাবার জন্যে যেন উন্মুখ হয়ে উঠেছে।
আবহাওয়াটা ঠান্ডা করবার চেষ্টায় আমি বেশ মিষ্টি করে বললুম, এত রাত্রে মোমবাতি কি হবে বড়দা? বাজার থেকে কিনে নিয়ে আসব?
বড়কর্তা বললে, তোরা কতখানি করে কোকেন খাস তা এক্ষুনি ধরে ফেলতে পারতুম মোমবাতিটা পেলে।
কি করে?
মোমবাতির টোসা জিভে ফেললেই বুঝতে পারা যাবে। যদি কোকেন খাওয়ার অভ্যেস থাকে তো মোমবাতির টোসা পড়লে জিভে লাগবে না, আর না হলে জিভ পুড়ে যাবে।
কি সর্বনাশ! মনে মনে বিশ্বনাথকে প্রণাম জানিয়ে বললুম, ভাগ্যে লোকটা মোমবাতি পায় নি!
হঠাৎ পরিতোষ চেঁচিয়ে উঠল, আপনি রোজ কতখানি করে কোকেন খান?
বড়কর্তা বোধ হয় কল্পনাও করতে পারেনি যে, আমাদের তরফ থেকে এমন কোনো প্রশ্নের সম্ভাবনা হতে পারে। প্রশ্নটা কানে যেতেই প্রথমে সে চমকে উঠল। তারপর পরিতোষের দিকে কটমট করে চাইতে লাগল। গোড়ার দিকে লোকটার হালচাল ও বিছুয়ার রূপ দেখে মনের মধ্যে যে ভয়ের সঞ্চার হয়েছিল, এতক্ষণ কথাবার্তার ফলে সে-ভয় অনেকটা কেটে গিয়েছিল। হঠাৎ পরিতোষের গলায় অতি-পরিচিত সুর শুনে আমার মনও সাহসে ভরে উঠল। আমি তড়াক করে উঠে গিয়ে আয়নাটা দেওয়াল থেকে নামিয়ে দু-হাত দিয়ে ধরে দাঁড়িয়ে রইলুম। পরিতোষ আমার দিকে একবার দেখে নিয়ে বোধ হয় নিশ্চিন্ত হয়ে আবার সেই সুরেই বড়কর্তাকে বললে, যাও, বাপের সুপুত্র হয়ে ভদ্রলোকের মতন বিছানায় শুয়ে পড়গে। রাত-দুপুরে বাড়িতে এসে মাতলামি করতে লজ্জা করে না? এক্ষুনি না শুয়ে পড়লে বাবুজীকে গিয়ে খবর দেব।
কি আশ্চর্য! লোকটা কয়েক সেকেন্ড সেইরকম কটমট দৃষ্টিতে পরিতোষের দিকে চেয়ে থেকে বললে, আচ্ছা দেখে নেব!
তারপর কোমরে সেই ছোরা-গোঁজা অবস্থাতেই নিজের বিছানায় গিয়ে দড়াম করে শুয়ে পড়ল।
কাপুরুষদের হালচাল সর্বত্রই একরকম।
বড়েভাই শুয়ে পড়তেই আয়নাটা দেওয়ালের গায়ে ঝুলিয়ে দিয়ে আমি পরিতোষের পাশে এসে বসলুম। দেখলুম, লোকটা বার পাঁচ-সাত পাশ বালিশ জড়িয়ে এপাশ-ওপাশ করেই একবার চিত হয়ে স্থির হয়ে গেল। ঘুমিয়ে পড়ল দেখে আমরা আমাদের বিছানার চাদরটা টেনে-টুনে ঠিক করে পেতে শুয়ে পড়বার আগে দুজনে দুটো বিড়ি ধরিয়ে টানতে আরম্ভ করলুম।
বিড়ি টানছি আর ফিসফিস করে কথা বলছি। পরিতোষ বলতে লাগল, এই মালকে নিয়ে রাত কাটানোর চেয়ে আবার সরাইয়ে ফিরে যাই চল্। বাবা, সুখের চেয়ে স্বস্তি ভালো।
আমি বললুম, কাল দিদিমণিকে জিজ্ঞাসা করে যা করবার করা যাবে।
পরিতোষ বললে, আমি বিশুদাকে বলব।
আমাদের কথাবার্তা চলছে, এমন সময় বড়কর্তা ঘুমের ঘোরেই চিৎকার করে উঠলো, মারুঙ্গা শালেকো বিছুয়া—একদম জাসে মার দুঙ্গা।
চমকে উঠে একটু দূরে সরে গেলুম। তারপর ছুরি মারব, কাটারি মারব জ্যান্ত পুঁতে ফেলব প্রভৃতি ভয়ানক ব্যঞ্জনাপূর্ণ হুঙ্কার চলল প্রায় ঘণ্টা-দুয়েক। আমরা তো কাঠ হয়ে দেওয়াল ঘেঁসে বসে রইলুম।
চিৎকার থেমে গেলে কোনো আওয়াজ না করে সন্তর্পণে লেপ চাপা দিয়ে শুয়ে পড়া গেল। কিন্তু আধ ঘণ্টা যেতে-না-যেতে বড়কর্তার নাকডাকা শুরু হল। বাপ রে! সে কি আওয়াজ। বিছুয়া মারুঙ্গা, জিন্দা গাঢ় দুঙ্গা প্রভৃতি গর্জন তার কাছে কিছুই নয় বললেই চলে। তাও যদি একটানা নাকডাকা হয় তো সে কোনোরকমে সহ্য করা চলে। এ যেন থেকে-থেকে মনে হতে লাগল, কে যেন তার গলাটা টিপে দম বন্ধ করে মারছে। এ শ্রেণীর বিপদে এর আগে কখনও পড়িনি। ঠায় জেগে বসে থাকতে থাকতে স্রেফ ক্লান্তিতে শেষরাত্রের দিকে একসময় কখন ঘুমিয়ে পড়লুম।
ভোর হতে-না-হতে অন্য দিনের মতন দিদিমণি ঘরের মধ্যে এসে চেঁচামেচি জুড়ে দিলে, কি রে? এখনও ঘুমুচ্ছিস, ওঠ ওঠ।
সারারাত জেগে মাথা তখনও অসম্ভব ভারী বোধ হচ্ছিল, তবুও দিদিমণির আওয়াজ পেয়ে উঠে বসলুম। দিদিমণি আমাদের বিছানার কাছে এসে বললে, কি রে, এখনও শুয়ে? শরীর ভালো তো?
তারপরে আমাদের লেপের একধারটা তুলে বিছানায় বসতে গিয়েই বললে, এ কিসের দাগ রে! এত রক্ত এল কোথা থেকে?
বড়কর্তা কোনো ভোরে উঠে চলে গিয়েছিল, তা আমরা জানতেও পারিনি।
আমরা প্রথমটা কোনো কথাই বলতে পারলুম না। দিদিমণি আবার বললে, এ তো রক্তের দাগ দেখছি!
পরিতোষ চুপ করে রইল। আমি গতরাত্রের সমস্ত বৃত্তান্ত আস্তে আস্তে তাকে খুলে বললুম। সে-ইতিহাস শুনতে শুনতে দিদিমণির মুখখানা লাল হয়ে উঠল। বোধ হয় মিনিট-পাঁচেক চুপ করে থেকে সে বললে, ললিত ও সূদনের পেছনেও ও ওইরকম করে লাগত।
আমরা আর কোনো কথা না বলে চুপ করে রইলুম। দিদিমণি আমাদের বিছানায় না বসে একটু দূরে মেঝের ওপরেই বসে পড়ল।
সব চুপচাপ। বাইরে ছাতে কুয়াশা ও সূর্যকিরণের জাল-বোনা চলেছে, সেই দিকে চেয়ে আছি–চোখ দেখছে এক, মন ভাবছে আর। এমন সময় চমক ভাঙিয়ে দিদিমণি অতি করুণসুরে বললে, আমাকে একবার খবর দিতে পারলি নে?
বললুম, ঘর থেকে বেরুতেই পারলুম না।
দিদিমণি ম্লানমুখে আরও কিছুক্ষণ বসে থেকে একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। তার পর চিৎকার করে ডাকতে আরম্ভ করলে, শঙ্কর, ভরত, আহিয়া, ইত্যাদি, ইত্যাদি।
দেখতে দেখতে বাড়িসুদ্ধ ঝি, চাকর, ঠাকুর, পাহারাদার, এমনকি গরুর চাকরেরাও পর্যন্ত এসে দাঁড়াল। দিদিমণি পাগলের মতো হিন্দি-উর্দুতে কি-সব বলতে লাগল তাদের। তার পরে ছুটতে ছুটতে বিশুদার ঘরে গিয়ে চেঁচাতে আরম্ভ করে দিলে–তার কিছু বুঝলুম, কিন্তু অনেক কথাই বুঝতে পারলুম না। একটা কথা বার বার শুনতে পেলুম, আজ বাবুজী আসুন।
চাকরবাকর সব সন্ত্রস্ত হয়ে চারিদিকে দৌড়ঝাঁপ করতে লাগল, আর আমরা দুটিতে সেই রক্তাক্ত বিছানায় বসে বসে দুধ আর জিলিপির অপেক্ষা করতে লাগলুম।
ওদিকে রোদ উঠে গেল। বসে বসে দেখছি, চাকরেরা ছাতের ওপর দিয়ে দৌড়োদৌড়ি করছে, কোথায় বা দুধ আর কোথায় বা গরম জিলিপি। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে কিছুই এল না দেখে বিশুদার ছাতে গিয়ে উপস্থিত হওয়া গেল।
আমাদের দেখে বিশুদা বললে, শুনলুম কাল রাতে আমার বড়ভাইটা এসে খুব হাঙ্গামা বাধিয়েছিল। দিদিমণি তো ক্ষেপে আগুন হয়ে গিয়েছে, সকালবেলা এসে আমাকে খুব গালিগালাজ করে গেল।
বিশুদার আড্ডায় লোক-সমাগম হতে আরম্ভ হল। সেই বিড়ির শ্রাদ্ধ আর ‘ছোটেসাহেব’ ‘ছোটেসাহেব’।
সেদিন লক্ষ করলুম, বিশুদার অনেক বন্ধুর সঙ্গেই পরিতোষের বেশ ভাগ জমেছে। এই ক’দিনের মধ্যে সে-ও হিন্দি উর্দু বলতে আরম্ভ করেছে। তার উর্দু বলবার ভঙ্গি শুনে আমার হিংসে হতে লাগল।
কিছুক্ষণ পরে আমাদের দু’জনের জন্যে দু-কাপ চা নিয়ে আহিয়া এসে হাজির হল। চা-পান হওয়ামাত্র আহিয়া বললে, তোমায় ভেতরে ডাকছে।
আহিয়া চলে গেল। বিশুদা আমাকে বললে, দিদিমণিকে তোমাদের আলাদা ঘর করে দিতে বলবে। নইলে আমার বড়ভাইটা সুবিধের লোক নয়। নেশার ঝোঁকে হয়তো সত্যি-সত্যিই কোনোদিন বিছুয়া মেরে দেবে! নেশাখোরকে বিশ্বাস নেই।
জিজ্ঞাসা করলুম, বড়দা কি নেশা করেন?
বিশুদা সেলাই থামিয়ে মুখ তুলে বললে, জিজ্ঞাসা কর যে, কি নেশা করেন না! ভোরবেলা থেকে ঠাররা (দিশি মদ) তো লেগেই আছে। তার ওপরে গাঁজা, আফিম, চরস ও কোকেন রোজ চাই। তা ছাড়া বাবুজীর দাওয়াখানায় আরও কত রকমের নেশার জিনিস আছে, তার সব নাম আমার জানা নেই। ও একটা ভয়ানক লোক, সাপের বিষ পেলে চেটে নিলে পারে– আমাদের কথাবার্তা চলছে, এমন সময় আহিয়া আবার এসে বললে, তোমাদের দুজনকেই ভেতরে ডাকছে।
বাড়ির ভেতরে গিয়ে দেখলুম, দিদিমণির ঘরের সঙ্গে একেবারে লাগা একখানা অপেক্ষাকৃত ছোট ঘর থেকে মালপত্র বের করে সেটা ধোয়া-পৌঁছা হয়েছে। ভরত, শঙ্কর ব্যস্ত হয়ে ছুটোছুটি করছে। দিদিমণি গাছকোমর বেঁধে একধারে দাঁড়িয়ে হুকুম চালাচ্ছে।
ইতিমধ্যে দুখানা খাট পেতে তার ওপরে বিছানা পাতা হয়েছে। একটা নতুন ‘ডিমার’-এর দেওয়ালগিরি ও একখানা বড় চৌকোনা আয়না দেওয়ালে টাঙানো হয়েছে। একধারে একটা বেঁটে সুদৃশ্য দেরাজ। দিদিমণি দেরাজটা দেখিয়ে বললে, এর মধ্যে তোমরা কাপড়-চোপড় রাখবে। তারপর বললে, কেমন, ঘর পছন্দ হয়েছে?
বললুম, চমৎকার ঘর।
দিদিমণি ভরত ও শঙ্করকে বললে, মেঝেতে একটা নতুন দরি পেতে দাও।
তারপরে আমার হাত ধরে পরিতোষকে বললে, আয় আমার ঘরে।
নিজের ঘরে আমাদের নিয়ে গিয়ে দিদিমণি একটা বড় আলমারি খুললে। দেখলুম, আলমারির মধ্যে থাকে থাকে বোধ হয় পঞ্চাশটা হাত-বাক্স সাজানো রয়েছে। দিদিমণি বললে, দেখ্! এগুলোর মধ্যে সব গয়না আছে। আমাদের বাবার ঠাকুরমা থেকে আমার পর্যন্ত এই চার পুরুষের গয়না। দু-তিন মাস অন্তর এই বাক্সগুলো খুলে আমি দেখি, সব ঠিক আছে, না, খোয়া গেছে। আজ দুপুরবেলা আর ঘুমানো হবে না–এগুলো সব দেখতে হবে। এই কথা বলবার জন্যে ডেকেছি তোদের। দুপুরবেলা না ঘুমিয়ে সোজা চলে আসবি এই ঘরে, কারুকে কিছু বলিস না যেন।
দুপুরবেলা খাওয়া-দাওয়া সেরে দিদিমণির ঘরে গিয়ে ঢুকলুম আর প্রায় গুটিপঞ্চাশেক বাক্সের গয়না মিলিয়ে হিসাব করে যখন তোলা হল, তখন বেলা গড়িয়ে গিয়েছে। সে বোধ হয় তখনকার দিনের হিসাবে প্রায় লক্ষ টাকা দামের গয়না। প্রত্যেকটি হার, বাজু, জশম, রতনচূড় ও কানবালার বিচিত্র ইতিহাস! এক-একটি গয়না এক-একটি ছোট গল্প। আমি অতি অলস তাই সে-সব কাহিনির রূপ দিতে পারলুম না, না হলে সে গয়নার বাক্সগুলোর ওপরেই একটা বড় সাহিত্য রচিত হতে পারত। অতীত দিনের কত হাসি ও অশ্রু যে সেগুলোর সঙ্গে জড়িত, সেদিন হালকা হাসির সঙ্গে যে রূপকথা শুনেছিলুম, তার কিছু মনে পড়ছে কিছু পড়ছে না। পরিতোষও বেঁচে নেই যে, তাকে জিজ্ঞাসা করে পাঠক-পাঠিকার মনোরঞ্জন করতে পারি। একটা কাহিনির কথা আজও মনের মধ্যে জ্বলজ্বল করছে, সেই কথাই উল্লেখ করছি।
একটা ছোট হাত-বাক্স থেকে একটা হার বের করে দিদিমণি দাঁড়িয়ে উঠে হারছড়া নিজের গলায় ঝুলিয়ে দিলে। দেখলুম, হারগাছা প্রায় তার পা অবধি লুটিয়ে পড়ল। দিদিমণি বসে গলা থেকে হারটা খুলে আমাকে বললে, এটা কতদিনের পুরনো বলতে পারিস?
গয়না সম্বন্ধে আমি অত্যন্ত অজ্ঞ ছিলুম, আজও সেই অজ্ঞতা কেটেছে এমন কথা বলতে পারিনে। আমার মা’র কানের ডিম থেকে ডগা অবধি প্রতি কানে পাঁচটা করে ফুটো ছিল, কিন্তু একটা ফুটোতেও কখনও দুল, মাকড়ি কিংবা টাপ কোনোদিন দেখিনি, তার কারণ তাঁর জোটেনি। দু-হাতে চারগাছা করে চুড়ি আর এক হাতে একটা একপয়সা দামের লোহা, এই ছিল তাঁর অলঙ্কার। আমরা লায়েক হয়ে মা’র লোহা সোনা দিয়ে বাঁধিয়ে দিয়েছিলুম। দু-তিনগাছা হার তৈরি করিয়েছিলেন, কিন্তু তা পরত মেয়েরা। আমার অন্য মা (পিসিমা) ছিলেন বিধবা তাই গয়নার বালাই তাঁর অঙ্গে ছিল না। আমার বড়দির স্বামী সে-যুগে ন’-শো টাকা মাইনে পেতেন, যার দাম আজকের দিনে অন্তত পাঁচ হাজার টাকা। দিদির সঙ্গেও চারগাছা করে চুড়ি দুগাছা অমৃতি-পাকের বালা, গলায় একটা চিক্চিকে সরু হার, কানে দুটো টাপ, আর বাঁধানো লোহা–আজকের দিনে সোনার দাম পাঁচ গুণ বেড়ে যাওয়া সত্ত্বেও অতি গরিব ঘরেও যা তুচ্ছ বলে বিবেচিত হয়, তা ছাড়া আর কোনো গয়না তাঁর অঙ্গে দেখিনি। আমাকে গয়না সম্বন্ধে কোনো প্রশ্ন করা বৃথা। সেই হারগাছার রঙ মলিন হয়ে গেলেও বুঝতে পারলুম, সেটা সোনার বটে, কারণ সোনা ছাড়া যে ভদ্রলোকের মেয়ের গয়না হয় না সে-জ্ঞান ছিল টল্টনে।
হারগাছা আমার হাতে দিয়ে দিদিমণি বললে, ওজনটা দেখ।
আমার মনে হল, সেটা প্রায় আধ সের ভারী হবে। কিন্তু দিদিমণি বললে আধ সেরের চেয়েও বেশি। এটার ওজন পঞ্চাশ ভরিরও কিছু বেশি হবে।
দিদিমণি বলতে লাগল, এই হারগাছা আমার ছোট্ঠাকুমা’র অর্থাৎ বাবুজীর ছোটকাকীর। বাবুজীর ঠাকুরদাদা নিমকির দেওয়ানি, কমিসারিয়টে চাকরি ও নানারকম ব্যবসা করে অনেক টাকা রোজগার করে পশ্চিমে বড় জমিদারি করেছিলেন। অবিশ্যি তাঁর বাবাই প্রথমে পশ্চিমে আসেন, ইংরেজ তখনও এ-দেশে রাজা হয়নি।
বাবুজীর ঠাকুরদা চারটে নাবালক ছেলে রেখে চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সেই মারা যান। আমাদের বড়মা’র বয়স বোধ হয় তখন ত্রিশ হবে। সেই থেকে তিনি নিজের হাতে বিষয়-সম্পত্তি নিয়ে দোর্দণ্ড প্রতাপে জমিদারি চালাতে লাগলেন। ছেলেরা বড় হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে একে একে তাদের বিয়ে দিয়ে বউ আনলেন। কিন্তু ছোট ছেলের বিয়ে আর দিতে পারেন না। সবার ছোট হওয়ার ফলে আদর পেয়েছিলেন তিনি বেশি। তাই দাদাদের ও মায়ের আদরে তাঁর দেহ যেমন বাড়ল, বিদ্যে-বুদ্ধি সেই অনুপাতে কিছুই হল না। অনেক ঘটক-ঘটকী লোকজন লাগানোর পর বাংলাদেশের এক ব্রাহ্মণের ঘরে ছোটঠাকুরদার বিয়ের ঠিক হল। কুলীন তাঁরা, মেয়ের বয়স প্রায় পনেরো, অতি গরিব, তাই পশ্চিমের বড়লোকের মুখ্যু ছেলের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিতে রাজি হয়েছিলেন তাঁরা।
আমার বড়মা সব ছেলেদেরই পাঠিয়ে দিলেন সেখানে, ছোটভাইয়ের বিয়ে দিয়ে একেবারে বউ নিয়ে যেন চলে আসে।
তখনকার দিনে নৌকো ও গাড়ি চড়ে যাতায়াত করতে হত। সেখানে পৌঁছতে প্রায় দু-মাস সময় লাগত।
ছোটঠাকুরমা’র বাপেরা উচ্চ পণ্ডিতের বংশ ছিলেন বটে, কিন্তু তাঁদের সঙ্গতি ছিল অল্প। তার ওপরে ভদ্রলোক চার-পাঁচটি মেয়ের বিয়ে দিয়ে এমনিতেই কাত হয়ে পড়েছিলেন। ওদিকে বড়লোকের বাড়িতে মেয়ের সম্বন্ধ হয়েছে। সে-বাড়ির গিন্নির কড়া মেজাজ ও খাণ্ডারবানিত্বের কিছু কিছু সংবাদও তাঁরা শুনতে না পেয়েছিলেন তা নয়। এদিকে কোনো সঙ্গতি নেই, তার ওপরে এর পরেও আর একটি মেয়ের বিয়ে দিতে হবে, যদিও সে তখনও নেহাত শিশু। ভাবনা-চিন্তায় ভদ্রলোক একেবারে পাগলের মতন হয়ে গেলেন।
তাঁরা ছিলেন শাক্ত। পুরুষানুক্রমে বাড়িতে সাড়ে-তিন হাত উঁচু অষ্টধাতুর এক কালীমূর্তি পূজিতা হতেন। আর কোনো উপায় না দেখে তিনি গৃহবিগ্রহের পায়ের ওপর পড়ে বললেন, মা গো! বংশপরম্পরা ধরে আমরা তোর সেবা করে আসছি, কখনও তোর কাছে কোনো ভিক্ষা চাইনি। এবার আমায় উদ্ধার কর্, নইলে তোর পায়ের তলায় পড়ে না-খেয়ে মরব।
সেই রাত্রে মা তাঁকে স্বপ্ন দিলেন দেখ, আমার গলায় যে লম্বা হারগাছা আছে, সেইটে ভাঙিয়ে মনোজবার গয়না গড়িয়ে দে। আমার ছোট্ঠাকমা’র নাম ছিল মনোজবা।
বিয়ের দিন ভদ্রলোক আমার বড়ঠাকুরদা অর্থাৎ আমার বাবার বাবার হাতে এই হারছড়া দিয়ে বললেন, আমার আর সঙ্গতি নেই; আপনারা বড়লোক, যদি ইচ্ছে হয় তো ভাদ্রবউকে এটি ভেঙে গয়না গড়িয়ে দেবেন, নয়তো নিজেদের গৃহ-বিগ্রহের গলায় ঝুলিয়ে দেবেন।
আমার ঠাকুরদা ছিলেন ভালো লোক আর ছোট্ঠাকমা ছিলেন অপূর্ব সুন্দরী। মেয়ে দেখে তাঁরা আর কোনো আপত্তি না করে ছোটভাইয়ের বিয়ে দিয়ে বউ ও তার সঙ্গে এই হারগাছা নিয়ে বাড়ি চলে এলেন।
আগেই বলেছি, বড়মা’র ছিল দোর্দণ্ড প্রতাপ ও বচন ছিল অতি কঠিন। বউরা শাশুড়ির ভয়ে তটস্থ থাকতেন। ছোট্ঠাকমা বাড়িতে পা দিতে-না-দিতে তাঁর বাপের বাড়ির দারিদ্র্য উল্লেখ করে তিনি খোঁটা দিতে শুরু করলেন। অথচ আমরা মায়ের কাছে শুনেছি যে, আমাদের বড়মা’র বাপেরা এত গরিব ছিল যে, তাঁকে টাকা দিয়ে কিনে আনতে হয়েছিল, সেই ছোটলোকের ঘরের মেয়ে নিয়ে আসার ফলে আমাদের এতবড় বংশ লোপ হয়ে গেল।
যা হোক, ছোটঠাকুমা ছিলেন খাস বাংলাদেশের মেয়ে। মাস কয়েকের ভেতরেই তিনি বাড়ির বউদের মধ্যে এমন একটা স্বাধীনতার আবহাওয়া এনে ফেললেন যে, তারা শাশুড়ির অন্যায়ের বিরুদ্ধে একটু-আধটু প্রতিবাদ করতে শুরু করে দিলে।
আমাদের ছোট্ঠাকুরদা ছিলেন অতিশয় ভীরুপ্রকৃতির লোক। তিনি না পারতেন মা’র বিরুদ্ধে কোনো কথা বলতে, না পেরে উঠতেন স্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়া করতে।
শেষকালে কোনো উপায় না দেখে সে-বেচারি প্রাণের দায়ে আত্মরক্ষার জন্যে এক সন্ন্যাসীর কাছে দীক্ষা নিয়ে গেরুয়া বসন পরে বাড়ির এক কোণে নিরালা একখানা ঘরে গিয়ে আশ্রয় নিলেন। এজন্যে বড়মা ছোট্ঠামার ওপর আরও চটে গেল। দিনরাত ঝগড়াঝাঁটি, বাড়ি একেবারে অশান্তির আগার হয়ে উঠল। সারাদিন ধরে বাড়ির গিন্নী ছোটবউয়ের নামে ছেলেদের কাছে নালিশ করেন; ওদিকে সারারাত ধরে বউয়েরা নিজেদের স্বামীর কাছে বলতে থাকে, ছোট যা করে ঠিকই করে। অন্য কেউ হলে তোমাদের মাকে ঝেঁটিয়ে বিষ ঝেড়ে দিত। বিষয় তোমাদের, তোমার মায়ের নয়।
মাঝে থেকে স্বামীদের জীবন হয়ে উঠল অতিষ্ঠ।
ছোঠাকুরদার সঙ্গে কারুর সম্পর্ক নেই। তিনি দিনরাত নিজের ঘরে জপতপ করেন, কিন্তু ছোঠাকুমা’র কাছে তাঁর ওসব বুজরুগি চলত না। তিনি স্বামীকে বলতেন, ওসব ভণ্ডামো তোমার মায়ের সঙ্গে চালিও, সন্ন্যেসী হবার ইচ্ছে ছিল তো বিয়ে করেছিলে কেন?
ছোট্ট্ঠাকমা রোজ রাত্রি দশটার সময় জোর করে ছোট্ঠাকুরদার ঘরে ঢুকে কোনোদিন মাঝরাত্রে আর কোনোদিন-বা সারারাত্রি ধরে তাঁর স্বর্গে যাবার পথ পরিষ্কার করে তবে বেরুতেন।
এইরকম দশ-পনেরো বছর চলবার পর একবার ছোট্ঠাকমা’র বাপের বাড়ি থেকে দুখানা চিঠি এল–একখানা তাঁর নামে আর একখানা বড়মা’র নামে। তাঁরা লিখেছেন, ছোট বোনের বিয়ে, যদি আসতে পার তো সুখী হব। তুমি বড় ঘরের বউ হয়েছ, এর চেয়ে বেশি অনুরোধ করা আমাদের শোভা পায় না।
ছোট্ঠাকমা বললেন, বাপের বাড়ি যাব।
বড়মা বললেন, বাপের বাড়ি থেকে চিঠি এলেই কি সেখানে যেতে হবে নাকি? অত আবদার
চলবে না।
ছোট্ট্ঠাক্মা কোনো কথা না বলে ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়লেন।
বড়মা বললেন, মরুক্গে, আমি ছেলের আবার বিয়ে দেব।
ছোট্ঠাক্মা সেই যে বিছানায় শুলেন, সাত দিন না-খাওয়া না-কিছু
আমার ছোট্ট্ঠঠাকুরদা উদাসীন। স্ত্রী খেলে কি না-খেলে সেদিকে কোনো খেয়ালই নেই। প্রতিদিন নিজের খাওয়া-দাওয়া সেরে ঘরে গিয়ে যথারীতি দরজা দিতে লাগলেন, একবার স্ত্রীর ঘরে উঁকি মেরেও দেখেন না, লোকটা মরে গেল কি না!
আমার নিজের ঠাকুরদার নাম ছিল সদাশিব, চরিত্রেও ছিলেন তিনি সদাশিব। বাড়ির ছোটবউ না খেয়ে শুকিয়ে মরছে, বাড়িসুদ্ধ স্ত্রী-পুরুষ মিলে প্রায় পঞ্চাশ-ষাটজন লোক সকলেই উদাসীন, শুধু মেজো-ঠাকুরদার দুই ছেলে দিনরাত ছোটকাকির মাথার দু-পাশে বসে হাওয়া করছে আর কাঁদছে। আর কেউ সেদিকে উঁকি মেরেও দেখে না। বাড়ির গিন্নি তো গৃহদেবতার কাছে দু-বেলা মানত করছেন, নারায়ণ, এই যেন ওর শেষ শোওয়া হয়।
এইরকম চলছে; এমন সময় একদিন রাত-দুপুরে আমাদের বড়ঠাকুরদা অর্থাৎ আমার নিজের ঠাকুরদা স্ত্রীর মুখে সব শুনে তখুনি স্ত্রীর সঙ্গে ছুটলেন ছোটবউয়ের ঘরের দিকে। ঘরে ঢুকে ভাদ্দর-বউকে নিজের হাতে বিছানায় বসিয়ে আদর করতে করতে বললেন, মা-লক্ষ্মী! তুমি আমার কুলবধূ। এরকম করে না খেয়ে মরলে যে আমার অকল্যাণ হবে, মা। কি চাই তোমার, আমাকে বল।
ছোট্ঠামার অবস্থা তখন খারাপ। তিনি হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, আমার ছোট বোনের বিয়ে, আমি বাপের বাড়ি যাব।
ঠাকুরদা বললেন, এই কথা! তা আমাকে এতদিন জানাওনি কেন মা? আমি তোমায় নিজে নিয়ে যাব সেখানে; তুমি খাওয়া-দাওয়া কর।
সেই রাত্রে একটু একটু করে গরম দুধ খাইয়ে ছোঠাকুমাকে চাঙ্গা করে তিনি নিজে তাঁকে কোলে করে তুলে নিয়ে এসে নিজের ঘরের বিছানায় শুইয়ে কয়েক দিন শুশ্রূষা করে তাঁকে সুস্থ করে তুললেন।
এদিকে বাড়িময় ঢিঢি-ছিছি পড়ে গেল। ভাশুর হয়ে ভাদ্দর-বউয়ের অঙ্গ স্পর্শ করার জন্যে মেয়ে-মহলে শুরু হল তুমুল আন্দোলন, এই আন্দোলনের নেত্রী ছিলেন বাড়ির গিন্নি–আমাদের বড়মা।
বড়মা ছোট ছেলের কাছে গিয়ে-গিয়ে তাঁর স্ত্রী ও নিজের বড় ছেলের নামে মিলিয়ে বানিয়ে-বানিয়ে যা-তা কুৎসা করতে লাগলেন। কিন্তু ছোটকর্তা নির্বিকার, মুখে ভালোমন্দ কোনো কথা নেই, নির্দিষ্ট সময়ে স্নান ও আহার সেরে তিনি প্রতিদিন যথাসময়ে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা দিতে লাগলেন।
দিন-কয়েকের মধ্যে ছোট্ঠাকমা বেশ সুস্থ হয়ে উঠলেন। নৌকা ঠিক হয়ে গেল। সন্ধ্যাবেলা যাত্রার শুভমুহূর্ত।
যাত্রার দিন সকালবেলা স্নান করে ছোট্ঠাকমা গিয়ে ঢুকলেন ছোট্ঠাকুরদার ঘরে। সেই যে দরজা বন্ধ হল, সারাদিন খুলল না, সন্ধ্যার প্রাক্কালে ছোট্ঠাক্মা সেই ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। আমার নিজের ঠাকুরমা, ঠাকুরদা আর ছোট্ঠাকমা সন্ধ্যা উতরে যাবার পরই বেরিয়ে পড়লেন নৌকোয় সুদূর বাংলাদেশের এক গ্রামের উদ্দেশে, প্রকৃতি অনুকূল হলেও যেখানে পৌঁছতে সেকালে অন্তত চল্লিশ দিন লাগত।
যা হোক, ছোট্ঠাকমা তো বাপের বাড়ি পৌঁছলেন, তখনও তাঁর বোনের বিয়ের আট-দশ দিন দেরি আছে। ছোট বোনের বিয়ে, তাই সব বোনেরাই বাপের বাড়িতে এসে জুটেছিল। গরিবের ঘরে আনন্দ-উৎসবের আর অন্ত নেই। কথায় বলে, নদীতে নদীতে মিলন হয়, কিন্তু বিয়ে হবার পর বোনে বোনে আর মিলন হয় না। তাই এতদিন পর সব বোন একত্র হওয়ায় সেই ব্রাহ্মণের ঘরে আনন্দের প্রবাহ ছুটল।
এই সময়, বিয়ের বোধ হয় দিন-দুই আগে তাঁদের বাড়িতে এক অভাবনীয় কাণ্ড ঘটে গেল। আগেই বলেছি, ছোটঠাকুমাদের বাড়িতে পূর্বপুরুষের এক কালীঠাকুর প্রতিষ্ঠিত ছিল। একদিন সকালে তাঁর জেঠামশাই পুজো করতে গিয়ে দেখতে পেলেন, ঠাকুরানীর গলায় সেই সোনার হারগাছা ঝুলছে, অনেকদিন আগে ছোট্ট্ঠাকমা’র বিয়ের জন্যে যেটিকে খুলে নেওয়া হয়েছিল।
সংবাদ পেয়ে দেশসুদ্ধ স্ত্রী-পুরুষ ছুটে এল তাঁদের বাড়িতে। সবাই সে-কাণ্ড দেখে অবাক, তারস্বরে সবাই চিৎকার করতে লাগল, জয় মা কালী! এমন জাগ্রত দেবী কালীঘাটেও নেই। সেদিন গভীর রাত্রে ছোট্ঠাকমা’র বাবা তাঁকে ঘুম থেকে তুলে আড়ালে ডেকে নিয়ে বললেন, মনোজবা, এ-কাজ তুই কেন করলি মা? তোর শাশুড়ি জানাতে পারলে তো আমাদের চোদ্দপুরুষ উদ্ধার করবে, আর তোকেও আস্ত রাখবে না।
ছোট্ঠাক্মা ন্যাকা সেজে বললেন, কি করেছি বাবা?
সেই হারগাছা এনে তুই মায়ের গলায় ঝুলিয়ে দিয়েছিস?
ছোট্ঠাকমা বললেন, কে বলেছে এ-কথা! সে-হার তো আমার শাশুড়ির সিন্দুকে বন্ধ আছে। এ ব্যাপারের বিন্দুবিসর্গও আমি জানি নে।
আতপচাল আর কাঁচকলা-সেদ্ধ-খেকো বামুনের আর কত বুদ্ধি হবে! ছোট্ঠাক্মা যা বললেন, তিনি তাই বিশ্বাস করলেন।
এসব গল্প ছোট্ঠাক্মা আমার বড়ঠাকুমা অর্থাৎ আমার নিজের ঠাকুমা’র কাছে করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন তাঁর বড়বউকে অর্থাৎ আমার মাকে, মা’র মুখে আমরা শুনেছি।
যা হোক, বোনের বিয়ে-টিয়ে হয়ে যাবার পর ছোট্ঠাকমা তো শ্বশুরবাড়ি ফিরে এলেন। শাশুড়ির বিনা হুকুমে বাপের বাড়ি যাওয়ার অপরাধে এখানে নানা ভাবে তাঁর ওপর নির্যাতন শুরু হল। শুধু তিনি নন, তাঁর বড় জা অর্থাৎ আমার নিজের ঠাকুরমাকেও উঠতে-বসতে খোঁটা খেতে হতে লাগল। বড়মা এবার একটা নতুন চাল চাললেন। তিনি মেজো ছেলে ও মেজো বউকে বড় ছেলে ও বড় বউয়ের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করতে আরম্ভ করে দিলেন।
ওদিকে অসম্ভাবিতরূপে হার ফিরে আসার ব্যাপারকে উপলক্ষ করে ছোট্ঠাকমা’র বাপের বাড়ির অবস্থার হু-হু করে উন্নতি হতে লাগল। দেখতে দেখতে চারিদিকে এই ঘটনার কথা পল্লবিত হয়ে রটতে লাগল। দূর-দূরান্তর থেকে লোক এসে এ-হেন জাগ্রত কালীর পায়ে লুটিয়ে পড়ে মুঠো-মুঠো টাকা দিয়ে পুজো দিতে লাগল। যে দেবী সর্ববসনবিবর্জিতা হয়ে নিজের শিবকে পদদলিত করেছেন, নরকপাল যাঁর গলায়, যিনি কপালকুণ্ডলা, সামান্য দিয়ে-দেওয়া সোনার হারের প্রতি তাঁর কখনও কোনো লোভই থাকতে পারে না–এ কথা লোকে বুঝতে পারলে না।
মাস ছয়েক এইভাবে কেটে যাওয়ার পর একদিন আসল কালী জাগ্রতা হলেন। মেজঠাক্মা ছিলেন বড়মা’র গুপ্তচর। তিনি একদিন কার কাছে সন্ধান পেয়ে শাশুড়িকে গিয়ে লাগিয়ে দিলেন, ছোটবউ বাপের বাড়িতে সেই হারগাছা ফিরিয়ে দিয়ে এসেছে।
আর যায় কোথা! বাড়িতে একেবারে ভূমিকম্প শুরু হয়ে গেল। বড়মা ছোট্ঠাকমা’র মা-বাপ তুলে যাচ্ছেতাই করে গালাগালি আরম্ভ করলে। সেই সঙ্গে আমার নিজের ঠাকুমাকেও গালাগালি দিতে লাগল। ছোট্ঠাকমা’র দলে রইল বড়ঠাকমা অর্থাৎ আমার নিজের পিতামহী আর ওদিকে বড়মা আর মেজঠাকুমা।
বড়মা ছোট্ঠাকমাকে বলতে লাগল, তোকে জুতিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দেব। ছোট্ঠাক্মা বললে, কার বাপের সাধ্যি আমাকে জুতিয়ে বার করে একবার দেখি! আমি আমার স্বামীর ভাত খাই। কোনো ছোটলোকের মেয়ের ভাত খাই না।
ঝগড়ার সময় বড়মা’র কাছেই দাঁড়িয়ে ছিলেন মেঠাকুরদা। ছোট্ঠাকমা’র মুখে এই কথা শুনে তিনি চেঁচিয়ে উঠলেন, আমার মাকে অপমান করলে জ্যান্ত পুঁতে ফেলব, ওসব ভাদ্দরবউ-টউ মানব না।
একটু দূরেই ছিলেন সেঠাকুরদা, তিনি বললেন, মেজদা, ওসব মেয়েমানুষের ঝগড়ায় থেকো না, কি দরকার!
মেঠাকুরদা চেঁচিয়ে উঠলেন, চুপ কর্ শুয়োরের বাচ্চা।
সেজো কর্তা বললেন, তোর বাপ শুয়োরের বাচ্চা।
দুই ভাইয়ে খুনোখুনি হয় আর কি! মেঠাকুমা মাঝে পড়ে তখনকার মতন হাঙ্গামা আর হতে দিলেন না।
এদিকে মেঠামা’র দুটো ছেলে ছিল ছোট্ঠাকমা’র ন্যাওটা। তিনি এ-বাড়িতে যখন বউ হয়ে এসেছিলেন, তখন তাদের একটার বয়স ছিল পাঁচ আর একটার দুই, সেই থেকে ছোট্ঠাক্মাই তাদের মানুষ করে তুলেছিলেন, ছোটমাকেই তারা মা বলে জানত। এই ব্যাপারের সময় তাদের একজনের আঠারো-উনিশ বছর বয়স, সে কলেজে পড়ে; আর একজনের একটা পাস দেবার সময় হয়েছে। ছোটমায়ের এই লাঞ্ছনা দেখে তারা দুই ভাইয়ে নিজের বাপ ও ঠাকুরমা’র সঙ্গে লাগিয়ে দিল বচসা। আমার বাবা ও নিজের কাকাদের তখন বেশ বয়স হয়েছে। বাবার বিয়ে পর্যন্ত হয়ে গিয়েছে, মা তখন কনে-বউ।
মেঠাকুরদা নিজের ছেলেদের ওইরকম ঔদ্ধত্য দেখে তেড়ে এসে তাদের আক্রমণ করলেন। ছোট্ঠাক্মা তাদের বাঁচাতে গিয়ে ভাশুরের হাতে দু-চারটে চড়-চাপড়ও খেলেন। বড়মা তারস্বরে চিৎকার করে আমাদের ঠাকুমা ও ছোঠামার চোদ্দোপুরুষ তুলে গালাগালি দিতে আরম্ভ করলেন।
আমার নিজের কাকারা এতক্ষণ নিরপেক্ষই ছিলেন। কিন্তু বড়মা যখন তাঁদের মাকেও যাচ্ছেতাই করে গালিগালাজ করতে আরম্ভ করলেন, তখন তাঁরাও ক্ষেপে গিয়ে তাঁদের ঠাকুরমাকে বললেন, খবরদার বুড়ি! আমাদের মাকে গালাগাল করলে জুতো মেরে বাড়ি থেকে বের করে দেব।
সে এক বীভৎস কাণ্ড!
যাক, তখনকার মতন হাঙ্গামা থেমে গেল বটে, কিন্তু তাঁরা স্থির করলেন, আর এক-অনে থাকবেন না, বিষয় আলাদা করে নেবেন।
আদালতে দরখাস্ত পেশ করা হল, বিষয় চার সমান ভাগে বিভক্ত করে দেবার জন্যে। সেই সঙ্গে ছোট্ঠাকমাও দরখাস্ত পেশ করলেন যে, তাঁর স্বামী পাগল, স্বামীর বিষয় তিনি তদারক করবেন।
বড় ও সেজো ভাই সাক্ষ্য দিলেন, ছোটবউ যা বলছেন তা সত্য এবং তাঁদের মতে এ-ব্যবস্থা ভালোই হবে। ছোটকর্তা কিন্তু নির্বিকার।
মেঠাকুরদা মায়ের প্ররোচনায় ছোট্ঠামার দরখাস্তের বিরুদ্ধে আপত্তি করে এক দরখাস্ত পেশ করলেন। মামলা বেশ ঘোরালো হয়ে উঠল।
এইরকম ব্যাপার চলেছে, এমন সময় আমার বাবা চাকরি পেয়ে মাকে নিয়ে চলে গেলেন ভারতবর্ষের উত্তর-সীমান্ত-প্রদেশে।
দেখতে দেখতে মামলা খুবই প্যাঁচালো হয়ে উঠল। হাঁড়ি সব আলাদা হয়ে গেল। বাড়িতে পুষ্যির দল ছিল অগুনতি, তারা কেউ এর দলে, কেউ ওর দলে ভিড়ে পড়ল। নগদ টাকা, সব বউয়ের গয়নাগাঁটি তখনও বাড়ির গিন্নির কবলে। মেঠাকুরদার উকিলেরা এসে গিন্নির সঙ্গেই পরামর্শ করে। মেজোকর্তার দুই ছেলে তাদের নিজেদের বাপ-ঠাকুমা ছেড়ে তাদের বড়মা, সেজোমা ও ছোটমা’র–অর্থাৎ আমার ঠাকুমা, সেজঠাকুমা ও ছোট্ঠাকমা’র দলে, সেখানেই তাদের খাওয়া-দাওয়া-শোওয়া।
এইরকম জমজমাট ব্যাপার চলেছে, এমন সময় হঠাৎ একদিন দুপুরবেলায় কোথা থেকে ছোটঠাকমা’র বাবা এসে হাজির হলেন। কি ব্যাপার! কথায়বার্তায় জানতে পারা গেল, এই হারগাছার জন্যে তাঁর বেয়ান যাচ্ছেতাই করে গালাগালি দিয়ে চিঠি লিখেছিলেন, তাই তিনি সেটা নিজে নিয়ে এসেছেন ফিরিয়ে দেবার জন্যে।
বড়মাকে হারগাছা ফিরিয়ে দিয়ে তিনি এ-বাড়িতে জলগ্রহণ না করে ধুলোপায়েই বিদায় নিলেন। যাবার আগে ছোট্ঠামার সঙ্গে তাঁর কি কথা হল, এ-বাড়ির কেউ জানে না।
এদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়ে শহরের অন্য এক বাঙালি ব্রাহ্মণের বাড়িতে দিন-দুই থেকে তিনি ফিরে গেলেন নিজের দেশে, যাবার আগে মেয়ের সঙ্গে একবার দেখাও করলেন না।
এই ব্যাপারের বোধ হয় দিন-তিনেক বাদে একদিন সকালবেলা উঠে দেখা গেল ছোট্ঠাক্মা বাড়িতে নেই। তিনি দুখানা চিঠি লিখে রেখে গিয়েছিলেন–একখানা তাঁর বড় জা অর্থাৎ আমার পিতামহীকে আর একখানা তাঁর স্বামীকে।
স্বামীকে লিখেছিলেন, আমাকে এমন অপমান করবার যদি ইচ্ছা ছিল, তো আমাকে বিয়ে করেছিলে কেন? তোমার মতন অপদার্থকে আমি স্বামী বলে স্বীকার করি না, আমি তোমাকে ত্যাগ করলুম।
আমার ঠাকুমাকে লিখেছিলেন, তোমাদের সর্বনাশ ঘনিয়ে এসেছে। এ-বাড়ির মধ্যে তোমাদের স্নেহ-ভালোবাসাই আমার মনে সঞ্চিত হয়ে রইল। আমার দুই ছেলে নরেন আর সুরেন–অর্থাৎ আমার মেঠাকুরদার দুই ছেলে-তাদের তোমরা দেখো, এই আমার শেষ অনুরোধ। আমাকে ভালোবাসে বলে তাদের অশেষ দুর্গতি হল। তোমরা দুজনে আমার প্রণাম গ্রহণ কর। আমার বউমা–অর্থাৎ আমার মা–তাকে আমি আশীর্বাদ করে যাচ্ছি, সে সুখী হবে। আমার আশীর্বাদ নিষ্ফল হবে না। আমার খোঁজ কোরো না। কারণ তোমাদের মতন ছোটলোকের ঘরে আমি আর পদার্পণ করব না।
দিদিমণি অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে বলতে লাগলেন, আমার ছোট্ঠাকমা’র যখন বিয়ে হয়, তখন তাঁর পনেরো বছর বয়েস ছিল, আর যখন তিনি চলে গেছেন তখন তাঁর বয়েস ছত্রিশ। এই একুশ বছর একাধারে স্বামীর অবহেলা ও শাশুড়ির গঞ্জনা সহ্য করতে করতে শেষকালে অসহ্য হওয়ায় অভিমানে তিনি গৃহত্যাগ করে চলে গেলেন। তিনি সুন্দরী ছিলেন বটে, কিন্তু ছত্রিশ বছর বয়সে সে-সৌন্দর্যের ওপর ভরসা করে কুলত্যাগ করা চলে না। একুশ বছর ধরে প্রতিদিনের সঞ্চিত অভিমানের সেই দীর্ঘশ্বাস, সতীলক্ষ্মীর সেই নিদারুণ অভিসম্পাতে দেখতে দেখতে এই বিরাট পরিবার পাত হয়ে গেল।
ছোট্ঠাকমা’র সেই চিঠি পড়ে আমার ঠাকুরমা একেবারে বিছানা নিলেন। ঠাকুরদা তাঁকে আশ্বাস দিতে লাগলেন, তুমি কেন অমন করছ? তোমার কিচ্ছু ভাবনা নেই, মেয়েমানুষ সে, যাবে কোথায়? আমি তাকে ঠিক ধরে আনব।
আমার দুই কাকা–মেঠাকুরদার দুই ছেলে–তারা ছিল ছোটমা-অন্তপ্রাণ। তারা প্রতিজ্ঞা করলে, ছোটমাকে যদি কোনোদিন পাই তো ঘরে ফিরব, না হলে এই শেষযাত্রা–বলে তারা লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে তাদের বড়মা, অর্থাৎ আমার ঠাকুরমা’র কাছ থেকে টাকাকড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেল, আজও তারা বাড়ি ফেরেনি।
আমার বড়মা বললেন, যে মাগি নিজের ভাশুরের সঙ্গে নষ্ট হতে পারে, সে যে কুলত্যাগ করবে তার আর বড় কথা কি!
তার পরে পনেরো বছরের মধ্যে এই সংসার দেখতে দেখতে শূন্য হয়ে গেল। বাড়িতে প্লেগ আসবার আগে বাড়িময় যেমন এখানে-ওখানে মরা ইঁদুর পড়ে থাকতে দেখা যায়, ঠিক তেমনিই ভাবে এঘরে-ওঘরে লোক মরতে লাগল।
আমার ঠাকুমা ছোট্ঠাকমা’র সেই চিঠিখানাতে প্রতি রাত্রে একটা করে সিঁদুরের টিপ দিয়ে নমস্কার করে তবে শুতে যেতেন। তিনি মারা যাবার সময় চিঠিখানা আমার মাকে দিয়ে গিয়েছিলেন। মা-ও তাঁর শাশুড়ির মতন রোজ সন্ধের সময় সেটাতে সিঁদুরের টিপ দিয়ে পুজো করতেন। আমরা সে-চিঠি দেখেছি, কিন্তু সিঁদুরের ছাপে ছাপে তার অক্ষরগুলো এমনই ঝাপসা হয়ে গিয়েছিল যে, তার কিছুই পড়তে পারা যেত না।
মা যখন মারা যান, তখন আমি শ্বশুরবাড়িতে। মাথার সিঁদুর খুইয়ে বাড়িতে এসে অবধি আর সেখানা দেখতে পাচ্ছি না।
এই অবধি বলে, দিদিমণি চুপ করলে।
.
তখন ঘরের মধ্যে বেশ অন্ধকার হয়ে এসেছিল। খোলা জানলাগুলো দিয়ে দেখা যাচ্ছিল বাইরের সামান্য আলো। দিদিমণি একটা জানলার ভেতর দিয়ে দৃষ্টি প্রসারিত করে দিলে সুদূর অতীতে–তাদের সংসারের ঘটে-যাওয়া ঘটনাগুলির দিকে, আর আমার মন ডুব দিলে সেই অপূর্ব কারুণ্য-রসসাগরের অতল তলে। মনের মধ্যে ছায়াবাজির মতন দিদিমণি-বর্ণিত মুখগুলো একে একে ভেসে উঠতে লাগল। সদ্য-শ্রুত অতীত দিনের কাহিনিগুলি ধীরে ধীরে আমার মানসপটে এসে জমা হতে আরম্ভ করলে। মনে হতে লাগল, তারা যেন সকলেই আমার চেনা, আমি যেন এই পরিবারেরই একজন। গৃহবিগ্রহের তুমুল আলোড়নে আমি যেন একবার এ-পক্ষ একবার ও-পক্ষে আন্দোলিত হচ্ছি। বাড়ির বয়স্কেরা আমাকে তিরস্কার করছেন, তুই ছেলেমানুষ, এ-সবের মধ্যে তুই আসিসনি; যা, নিজের লেখাপড়া করগে যা। কিন্তু বয়সে বালক হলেও বিধাতার অভিশাপে আমি যে স্থবির, এ-কথা কাকে বোঝাই, কি করে বোঝাই! আমার মনে হতে লাগল, আমি যেন সেই অভিশপ্ত প্রাসাদের কক্ষে অতৃপ্ত আত্মার মতন এখান থেকে সেখানে, সেখান থেকে ওখানে ছুটোছুটি করে বেড়াচ্ছি, কিন্তু আমার মনের কথা কেউ বোঝে না। সেই ঘটনাস্রোতের ওপরে থেকে-থেকে জ্বলজ্বল করে তাঁরই মুখচ্ছবি ফুটে উঠতে লাগল, যাঁকে কেন্দ্র করে এই অপূর্ব কাব্য রচিত হয়েছে। আমি যেন তাঁকে জড়িয়ে ধরে বললুম, ছোটমা, এদের মাপ কর, সংসারটাকে রক্ষা কর।
আমি স্পষ্ট অনুভব করতে লাগলুম, তাঁর চুম্বন আমার মস্তক, ললাট ও চক্ষুতে। সেই উপেক্ষিতা আহিতাগ্নিকার অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠস্বর আমার কানে এসে বাজতে লাগল–তোদের সর্বনাশ হবে, তোদের বংশে বাতি দিতে কেউ থাকবে না।
তাঁর অভিমানসঞ্জাত উষ্ণ দীর্ঘশ্বাস আমার চোখে মুখে এসে লাগতে লাগল।
সেই নির্মম নিস্তব্ধতার মধ্যে বিশুদার ঘরের আড্ডা থেকে কখনও-বা একটু হাসির টুকরো, কখনও অসংলগ্ন একখণ্ড উচ্চ রব ছিকে এসে আমাদের তন্মনস্কতায় ধাক্কা দিয়ে-দিয়ে জানিয়ে দিতে লাগল, সে কাহিনি ভেসে গিয়েছে, নিত্য নতুন ঘটনার আবর্ত সৃষ্টি করে কালস্রোত ছুটে চলেছে।
সেইভাবে বসে থাকতে থাকতে আমার মাথার মধ্যে সিদ্ধির নেশার মতন চিন্তা তালগোল পাকিয়ে যেতে লাগল। আমি স্পষ্ট অনুভব করতে লাগলুম, আজ যে ঘটনা অতীতের গর্ভে বিলীন হয়ে গিয়েছে, একদিন নিশ্চিতরূপে তা ভবিষ্যতের গর্ভে বিরাজ করছিল। এই যে আমি আজ এই সন্ধ্যায় অজানা দেশের এক অপরিচিতা নারীর মুখে তাদের গৃহবিগ্রহের ইতিহাস শুনে মুহ্যমানের মতন স্থির হয়ে বসে আছি, এ ঘটনাও একদা ভবিষ্যতের গর্ভে নিশ্চিত ছিল। বর্তমান শুধু ভবিষ্যতের গর্ভ থেকে ঘটনাবলীকে টেনে এনে অতীতের গর্ভে ঠেলে ফেলে দিচ্ছে।
সময়ের এই নতুন রূপ মনের মধ্যে নানা ভাবে প্রতিফলিত হতে লাগল। চিন্তার সেই তালগোলের মধ্যেও থেকে-থেকে বুকের মধ্যে কে যেন চিৎকার করে উঠতে লাগল, কিছু নাই, কিছু নাই, সব ঝুটা হ্যায়।
চিন্তা-সাগরের কোন অতলে তলিয়ে গিয়েছিলুম তার ঠিক নেই; হঠাৎ শঙ্কর চাকর ঘরের বাতি জ্বেলে দিতেই চটকা ভেঙে গেল।
দিদিমণির দিকে চেয়ে দেখলুম, সেই হারগাছা নিয়ে অস্বাভাবিক এক দৃষ্টিতে সে আমার দিকে চেয়ে আছে, পরিতোষ ঘাড় নীচু করে মেঝেতে যেন কি দেখছে। আমার চোখে চোখ পড়তে অদ্ভূত একরকম হাসি হেসে দিদিমণি আবার আরম্ভ করলে-
আমার ঠাকুরদা ও ঠাকুরমা দু-তিন দিনের তফাতে মারা গিয়েছিলেন। বাবা কর্মস্থান থেকে ছুটি নিয়ে এসে শ্রাদ্ধ-শান্তি সেরে আবার ফিরে গেলেন। যাবার সময় আমার দুই কাকাকে সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন, আর এক কাকা বাড়িতে রইলেন আমাদের হয়ে মামলা তদারক করতে, তখনও মামলার কোনো কিনারাই হয়নি। আমার দুই কাকা পটপট করে মারা গেলেন। সব ঠাকুরদাদের গুষ্টি সাফ হয়ে যাবার পরও কিন্তু ভূষণ্ডি কাকের মতন বড়মা তখনও বেঁচে রইলেন। ভাগ্যে আমরা দূরে চলে গিয়েছিলুম! কিন্তু তাতেও কি রক্ষে আছে! তা না হলে পাপের প্রায়শ্চিত্ত হবে কি করে?
এদিকে মামলায় মামলায় বিষয় ফাঁক হয়ে গেল। শেষকালে আমার যে কাকা মামলা তদারকের জন্যে বাড়িতে ছিলেন, তিনি তাঁর ঠাকুরমাকে নিয়ে এক ভাড়াটে বাড়িতে গিয়ে উঠলেন, তাঁদের ভরণপোষণের জন্যে বাবা টাকা পাঠাতে থাকলেন। তখন বড়মা’র বয়স একশো চার বছর। তখনও বুড়ি বেশ শক্ত সমর্থ, উঠে হেঁটে বেড়ায়, নিজের রান্না নিজে করে, রাত্রে একটা বড় গয়নার বাক্স পাশ-বালিশের মতন জড়িয়ে শুয়ে থাকে। এই যে-সব গয়না দেখছিস, এ আমাদের ছোটকাকা কিছু কিছু করে আমাদের বাড়িতে চালান করে দিয়েছিল।
কিন্তু বুড়ির কপালে আরও দুঃখ ছিল, কারণ বড়মা মারা যাবার দিন-পনেরো আগে হঠাৎ ছোটকাকা মারা গেলেন। বাড়িতে একটা মাত্র চাকর ছিল। সে-ই বড়মা’র জল তোলা, বাজার করা, রান্নার জোগান দেওয়া ইত্যাদি করত। একদিন রাত্রে সে লোকটা বড়মাকে খুন করে গয়নার বাক্স নিয়ে চম্পট দিলে। বাড়িতে দ্বিতীয় লোক নেই, মড়া পচে ঢোল হয়ে গন্ধ বেরুতে পাড়ার লোক পুলিশে খবর দিলে। তারা এসে মুর্দাফরাশ দিয়ে লাশ টেনে নিয়ে পুড়িয়ে দিয়ে বাবাকে খবর দিলে।
আমার মা বলতেন, ছোটমা তাঁকে বড় ভালোবাসতেন, ছোটমার অভিসম্পাতের বিষ তাঁকে লাগবে না। কিন্তু তাও তো হল না ভাই। একে একে আমার ভাইয়েরা পটপট করে মরে গেল। বড়দা বিয়ে করলে না, ছোট্কাও তো চলল, মেয়ের দিক দিয়েও যে বংশের চিহ্ন থাকবে, তাও তো হল না।
এই অবধি বলে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থেকে দিদিমণি বললে, এই কুবেরের ধন আমি আগলে বসে আছে; জানি না, বরাতে কি আছে!
তারপরে একটা গয়নার বাক্স খুলে দু-তিন মুঠো আংটি তুলে নিয়ে বেছে বেছে একটা হীরের আংটি বের করে পরিতোষের ডান হাতের অনামিকায় পরিয়ে দিয়ে দিদিমণি আমাকে বললে, স্থবির, এর মধ্যে থেকে তোর যেটা পছন্দ হয় নিয়ে পর।
আমার মন তখন অত্যন্ত ভারী হয়ে আছে, আংটির কথা শুনেই আমার নিজের বগলোস-আংটি ও সেইসঙ্গে লতুর কথা মনে পড়ল। আমি বললুম, এখন থাক দিদিমণি, আর একদিন দিনের বেলায় দেখে-শুনে বেছে নেব।
এখানে আশ্রয় পেয়ে আমাদের দিনগুলি কাশীর চেয়ে অনেক ভালো কাটতে লাগল। কাশীতে ছিল একটানা জীবন–খাওয়া-দাওয়া, গঙ্গাস্নান ও রাজকুমারীর অঙ্গসেবা। খালি মিষ্টি কথা ও মিষ্টি কাজ–একঘেয়ে একটানা জীবন। রাজকুমারীর ঐন্দ্রজালিক ব্যবহারের মধ্যে বৈচিত্র্য ছিল নিশ্চয়, কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যেই তা অভ্যাসে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। বৈচিত্র্য যত চমকপ্রদ হোক না কেন, প্রতিদিনের অভ্যাসে তার মাধুর্য নষ্ট হয়ে যায়।
দিদিমণিদের বাড়িতে আশ্রয় পেয়ে মনে হতে লাগল, যেন আমরা একটা পরিবারের মধ্যে বাস করছি। বাড়িতে লোক মাত্র তিনজন–বাবুজী, বিশুদা ও দিদিমণি;কিন্তু সেই ভোর পাঁচটা থেকে রাত্রি এগারোটা অবধি সেখানে গোলমাল হাঙ্গামা-হুঁজ্জুতের অন্ত নেই। এর মধ্যে বড়কর্তা যেদিন দয়া করে বাড়ি ফেরেন, সেদিন তো বৈচিত্র্যের আর সীমা থাকে না।
ঘর আলাদা হয়ে যাওয়ায় বড়কর্তা আমাদের ওপর হাড়ে চটে গেলেন। সেই ব্যাপারের পর যতবার সে বাড়িতে আসত, প্রতিবারই অন্তত ঘণ্টাখানেক ধরে আমাদের ঘরে এসে হাঙ্গামা লাগাত। পরিতোষ রাগ করলেও প্রতিবারেই আমি তাকে খোশামোদ করে করে তার নিজের ঘরে নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দিতুম। একেবারে অজ্ঞান হয়ে পড়বার ঠিক পূর্ব-মুহূর্তে প্রতিবারই সে বলত, তুমি শালা আচ্ছা লোক আছ, লেকিন উও শালেকো ম্যয় জিন্দা গাঢ় দুঙ্গা —
জন্মজন্মান্তরে শত্রুতা না থাকলে এমন ব্যাপার সম্ভব হয় না। নব্যতন্ত্রের দার্শনিক আমার এই ইঙ্গিতে হয়তো মৃদু হাসবেন, তার উত্তরে আমিও মৃদু হাসলাম মাত্র।
মাঘ মাস শেষ হয়ে ফাল্গুন পড়ে গেল, কিন্তু তখনও সেখানে বেশ কটকটে শীত। এমনই একদিন বেলা প্রায় বারোটার সময় রাস্তার ধারের ছাতে বসে ফতুয়া সেলাই করতে করতে হাত-পা কাঁপতে কাঁপতে বিশুদা অজ্ঞান হয়ে পড়ল। পরিতোষ ছুটতে ছুটতে এসে বাড়ির ভেতর খবর দিলে। আমি আর দিদিমণি তখন সংসারের হিসাব লিখছিলুম। সংবাদ পেয়ে সবাই ছুটলুম বার-বাড়িতে। এক-মুহূর্তে বাড়িময় হৈ-চৈ পড়ে গেল। পরিতোষ বললে, আমি বাবুজীকে কাশী থেকে ডেকে নিয়ে আসি।
তখুনি টাকাকড়ি নিয়ে সে বেরিয়ে গেল।
সন্ধে হয়ে এসেছে, এমন সময় পরিতোষ বাবুজীকে কাশী থেকে নিয়ে এল। ঘণ্টা-দুই আগে বিশুদার জ্ঞান হয়েছিল, কিন্তু জ্ঞান হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার জ্বর উঠল বোধ হয় এক-শো পাঁচ ডিগ্রি। জ্বরের ঘোরে সে একরকম আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে রইল। বাবুজী পরিতোষের মুখে সমস্ত ঘটনা শুনে একরাশ মিশ্চার ও পেটেন্ট ওষুধ নিয়ে এসেছিলেন। তিনি এসেই বিশুদাকে এক দাগ ওষুধ খাইয়ে দিয়ে কাপড়-চোপড় ছাড়তে চলে গেলেন।
পরিতোষ বেচারি সারাদিন কিছুই খায়নি। দিদিমণি তাকে টেনে নিয়ে চলে গেল খাওয়াতে, আমি আর আহিয়া রুগির কাছে বসে রইলুম।
দেখতে দেখতে অন্ধকার ঘোর হয়ে এল। সেদিন বিশুদার ঘরে বাইরের লোকজন কেউ নেই। বন্ধুবান্ধবেরা বাইরে থেকেই তার খোঁজ নিয়ে ক্ষুণ্ণ মনে যে-যার ফিরে যেতে লাগল।
ভরত এসে একটা দেওয়ালগিরি জ্বালিয়ে দিয়ে চলে গেল।
বিশুদা বুকের ওপর হাত-দুটো জোড় করে শুয়ে, মুখে প্রকাশ না করলেও তার যে খুবই কষ্ট হচ্ছে তা স্পষ্ট বোঝা হচ্ছে। সাপের ফোঁসফোঁসানির মতন তার নিশ্বাসের একঘেয়ে আওয়াজ ঘরের মধ্যে গুমরে গুমরে প্রতিধ্বনিত হয়ে চলল। আহিয়া তার শিয়রে বসে কপালে বোধ হয় পুরানো-ঘি ঘষছে, আর আমি একপাশে বসে’ নির্নিমেষ নয়নে তার মুখের দিকে চেয়ে আছি, এমন সময় বিশুদা চোখ খুলে যেন কাকে খুঁজতে লাগল।
আমি বললুম, বিশুদা আমি স্থবির। দিদিমণিকে ডাকব?
অদ্ভুত এক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ আমার দিকে চেয়ে সে বললে, স্থবির! একবার মাকে ডেকে দে তো! ওপরের ঠাকুরঘরে মা আছে, বল্ গিয়ে, বিশুদা ডাকছে।
তক্ষুণি ছুটে গিয়ে বাবুজীকে ডেকে নিয়ে এলুম। তিনি এসে আবার কিছুক্ষণ পরীক্ষা করে কোনো কথা না বলে চলে গেলেন।
রাত্রি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিশুদার অসুখ খুবই বাড়াবাড়ি হতে লাগল। আমি, পরিতোষ, দিদিমণি তার কাছে বসে কেউ-বা বাতাস, কেউ-বা মাথায় জলপটি দিতে লাগলুম। এর মধ্যে বাবুজী আর-একবার এসে তাকে দেখে গেলেন।
অনেক রাত্রে বিশুদা স্থির হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে দেখে দিদিমণি আমাদের জন্যে বালিশ ও লেপ নিয়ে এসে বললে, তোরা আজ এইখানেই শুয়ে পড়।
পরিতোষটা ছিল অত্যন্ত ঘুমকাতর। এই কয়েকদিনের মধ্যেই বিশুদার সঙ্গে তার একটা আন্তরিক যোগ দাঁড়িয়ে গিয়েছিল বলেই সে এতক্ষণ ঘুমোয়নি। দিদিমণি বলামাত্র সে শুয়ে পড়ল, যেমন শোয়া অমনই ঘুম।
দিদিমণি আমাকে বললে, স্থবির, তুইও শুয়ে পড়। আমি এখুনি আসছি।—বলে সে বেরিয়ে গেল।
আহিয়া তখনও বিশুদার মাথার কাছে বসে পাঁচ মিনিট অন্তর ন্যাকড়া ভিজিয়ে জলপটি দিয়ে চলেছিল। খানিকক্ষণ তার দিকে চেয়ে থেকে আমি বললুম, আহিয়া, এবার তুমিও শুয়ে পড়।
আহিয়া করুণ দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে কি যেন বললে, কিন্তু তার গলা দিয়ে কোনো শব্দই বেরুল না।
আমার চোখে ঘুম নেই, বসে বসে ভাবছি, দিদিমণি এলে শোয়া যাবে। চারিদিকে নিস্তব্ধ; বিশুদার নিশ্বাসের সেই সাঁ-সাঁ আওয়াজ কমে গিয়েছে। অতীত দিনের অনেক ঘটনার কথা হালকাভাবে মনের ওপর দিয়ে ভেসে যেতে লাগল। অনেকক্ষণ দিদিমণির অপেক্ষা করে করে একটা বিড়ি ধরিয়ে ছাতে বেরিয়ে গেলুম।
কৃষ্ণপক্ষ রাত্রি, বাইরে ঘন অন্ধকার। শুধু বিশুদার ঘরের খোলা-দরজা দিয়ে একটু আলোর টুকরো ছাতে এসে পড়েছে–বিরাট কালো ফ্রেমে বাঁধানো ছোট একখানা ঘষা আয়নার মতন। মেঘবিহীন আকাশে তারা ঝকঝক করছে, হাওয়া না থাকলেও কনকনে ঠান্ডা। আমি মাথা অবধি র্যাপারটা মুড়ি দিয়ে এক জায়গায় উবু হয়ে বসে পড়লুম।
বসে বসে ভাবছি আকাশ-পাতাল, হঠাৎ মনে হল, ছাতের আলসের ওপর একখানা হাত ছড়িয়ে তার ওপর মাথা রেখে কে যেন দাঁড়িয়ে আছে। যে দাঁড়িয়ে আছে, তার কাপড় পরবার ভঙ্গি দেখে মনে হল, যেন সে নারী। কিন্তু সে রোগা কি মোটা, কালো কি ফরসা, তা সেই অন্ধকারে কিছুই ধরবার জো নেই। সে-দৃশ্য দেখে ভয়ে আমার সর্বাঙ্গে কাঁটা দিয়ে উঠল। মনের মধ্যে সাহস সঞ্চয় করে ডাক দিলুম, দিদি, দিদিমণি!
কিন্তু ও-পক্ষ থেকে কোনো জবাব এল না। অথচ সে-মূর্তি সেইভাবেই দাঁড়িয়ে রইল। এবার বুকের মধ্যে ভয়ানক ঢিপঢিপ করতে আরম্ভ করে দিলে। একটু দূরেই, দিদিমণির ঘরের কাছেই পাহারাদার বসে আছে; কিন্তু তাকে ডাকবার ক্ষমতাও রহিত হয়ে গেল। জীবনের অনেক অভিজ্ঞতার ঠিক বর্ণনা করা যায় না। বাবার মারের ভয়, ক্লাস-প্রমোশন না পাওয়ার ভয়, ইস্কুল থেকে তাড়িয়ে দেওয়া ইত্যাদি অনেকরকম ভয়ের অভিজ্ঞতা আমার জীবনে হয়ে গিয়েছে, কিন্তু এ-ভয়ের তুলনায় সেসব কিছুই নয়। কয়েক-হাত দূরেই ঘরের দরজা খোলা রয়েছে, কিন্তু উঠে যে সেখানে চলে যাব সে-শক্তি নেই। পক্ষাঘাতগ্রস্তের মতন আমি অনড় হয়ে বসে রইলুম। এক মুহূর্ত একটা যুগের মতন মনে হতে লাগল। চোখের সামনে দেখলুম, সে মূর্তি দ্রুত চলে গেল বিশুদার সকালবেলাকার আড্ডার ছাতের দিকে। আর দেরি না করে আমি ছুটে ঘরের মধ্যে গিয়ে লেপের তলায় ঢুকে হাঁপাতে লাগলুম।
ওইরকম ধড়মড় করে ঘরের মধ্যে ঢুকতে দেখে আহিয়া একটু সন্দেহ-দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে থেকে বিশুদার শিয়র থেকে উঠে এসে আমাকে জিজ্ঞাসা করলে, কি হয়েছে?
ততক্ষণে আমার মনে সাহস ফিরে এসেছে। লেপখানাকে বাগাতে বাগাতে বললুম, কিছু না, বড্ড শীত লাগছে।
আহিয়া আমার কাছ থেকে গিয়ে বিশুদার শিয়রে বসতে-না-বসতে দিদিমণি এসে উপস্থিত হল, পেছনে ভরত চাকরের কাঁধে বালিশ ও লেপ। আমার পাশেই বালিশ ও লেপ রেখে ভরত বেরিয়ে গেল। একবার বিশুদার কপালে হাত দিয়ে উত্তাপ দেখে ঘরের দরজাটা ভেজিয়ে
সে আমার পাশে এসে বসল।
আমার ঘুম ছুটে গিয়েছিল, এবার উঠে বসলুম। আমাকে বসতে দেখে দিদিমণি জিজ্ঞাসা করলে, কি রে, এখনও ঘুমোসনি?
কিছুতেই ঘুম আসছে না দিদি।
আচ্ছা তুই শুয়ে পড়, আমি তোর গায়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছি, এখুনি ঘুমিয়ে পড়বি।
এবার আমি জিজ্ঞাসা করলুম, দিদিমণি, একটু আগে কি তুমি ছাতের কোণে দাঁড়িয়েছিলে?
কই! না তো। আমি তো এতক্ষণ বাবুজীর কাছে বসে ছিলুম।
ঠিক ভয় না হলেও সর্বাঙ্গে কাঁটা দিয়ে উঠল।
দিদিমণি একবার আহিয়ার দিকে চেয়ে নিয়ে ফিসফিস করে আমাকে জিজ্ঞাসা করল, কেন রে, কিছু দেখেছিস নাকি?
বললুম, হ্যাঁ।
দিদিমণি জিজ্ঞাসা করলে, মেয়েমানুষ?
বললুম, হ্যাঁ।
কিছুক্ষণ পাথরের মতন স্থির হয়ে বসে থেকে সে বলল, ছোট্কা তাহলে আর বাঁচবে না। কেউ মারা যাবার আগেই ও দেখা দেয়।
ভয়ে দু-হাত দিয়ে তাকে আঁকড়ে ধরলুম।
দিদিমণি আমার গায়ে হাত বুলোতে বুলোতে বললে, ভয় কি! তোর কিছু ভয় নেই, বরঞ্চ তোর ভালোই হবে, দেখে নিস।
দিদিমণি পাশে শুয়ে আমার লেপের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে গায়ে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। এবার তার কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলুম, ও কে দিদিমণি?
দিদিমণি আমার কানে ফিসফিস করে বললে, ছোঠাকুরমা।
.