ফ্লোরা
কর্ডোভার হেরেমে সেই জৌলুস নেই ইতিপূর্বে যা ছিল। আমীরে স্পেন মাদ্রিদে ছিলেন যেখানে রক্ত নদী বয়েছে। মাদ্রিদে বিদ্রোহ দমন করতে গিয়ে বহু সেনা শহীদ হয়েছেন। যখমীদের ফিরিস্তিও কম নয়। মাদ্রিদ লাশের শহরে পরিণত। কর্ডোভা এজন্য মর্মাহত, নিঝুম পুরীতে পর্যবসিত। কর্ডোভাবাসী শেষ পর্যন্ত বিজয় সংবাদ পায়। তবে এতে উদ্ভট বানোয়াট সংবাদও অন্তর্ভুক্ত ছিল। যাদের ছেলে এই যুদ্ধে শামিল ছিল তার বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছিল। সর্বত্র খবর ছড়িয়ে পড়ে আমীরে স্পেন আগামীকাল আসছেন।
হেরেম সেজেছে নয়া দুলহানের বেশে। জৌলুসহীন হেরেমের আজ শেষ রাত। ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ সংঙ্গীতজ্ঞ তার বাদ্যযন্ত্র নিয়ে বসে গেছে। যিরাব বাদ্যযন্ত্রে প্রাণ এনেছেন। তিনি এর প্রতি সর্বপ্রথম মুসলিম সমাজে আকর্ষণ সৃষ্টি করেছেন।
তিনি রোমান গীত শুরু করেন। এই সংগীতের আবিস্কারক তিনি নিজেই। তার সুরলহরী হৃদয়তন্ত্রীতে ঝড় তোলে। তার সেতারার সুর উজ্জীবন শক্তি। দরোজার পিঠ করে তিনি সুর তুলে চলেছেন। তার সুরের শব্দমঞ্জুরীতে নারী সৌন্দর্যের পিরামিড দরজায় ফুটে ওঠে। নারীমূর্তি যিরাবের সুরে তন্ময়। যিরাব ওদিকটায় তাকালে দেখত প্রতিচ্ছবি। এই প্রতিচ্ছবিই তার সুরে ও আবেগের পরতে পরতে জড়িয়ে আছে। নারী সুষমার বাস্তব প্রতিচ্ছবি সুলতানা।
আমীরে স্পেন কর্ডোভায় ছিলেন না বিধায় সুলতানা স্বাভাবিক অবস্থায় ছিলেন। তার রেশমী কোমল একরাশ কুন্তল ঘাড়ের শোভা বর্জন করে চলেছে। কাঁধ খোলা। দর্শকের দৃষ্টি এখানে পড়লে চমকে উঠতে বাধ্য। যিরাবের সেতারে সুর তাকে মোহিত করে তোলে। দরজার সম্মুখে দাঁড়িয়ে নিজকে আগে জাগিয়ে পরে যিরাবকে জাগাতে চায় সে। তার ধারণা যিরাবের সামনে গেলে তন্ময়তা কেটে যাবে।
যিরাব গানের কলি দোহরায়। ওই গানের প্রতিপাদ্য নারী সুষমা। জান্নাতের হর-ই কেবল হতে পারে তার কল্পনার সেই নারী। সুলতানা দিল-দিমাগে ঝড় তোলে। একসময় বাড়ে সুরের মূর্ঘনা। সুলতানার কথায় ভেঙ্গে যায় যিরাবের সংগীত সাধনা, তোমার গানের সেই নারী কেবল আমিই হতে পারি। এ আমার সৌন্দর্য ও প্রেমের সংগীত। আমার সৌন্দর্য-পূজার কি অপার কসরত।
সুলতানা যিরাবের দিকে এগিয়ে যায়। সেতারের তার থমকে যায়। বলে, তুমিই আমার কল্পনার ছবি?
সুলতানার মুচকি হাসি দুঠোঁটে খেলে যায়। যিরাবের হাত তার ভোলা কাধ স্পষ্ট করে। সুলতানা হাসে। হাসিতে জলতরঙ্গের ঢেউ। জড়িয়ে ধরে কাপেটে বসায়। বলে, আমায়ও সেতারের অনুভূতি কখনো পাগল করে তোলে। সে আওয়াজে তোমার প্রতিচ্ছবি ভেসে ওঠে। এমতাবস্থায় দেখি তুমি হাজির।
আমি কি কোন নাগিনী যে সাপুড়ের বাঁশির মোহতানে হাজির হয়ে যাই?
সত্যিই তুমি নাগিনী সুলতানা। তোমার বিষেও সৌন্দর্য রয়েছে। রয়েছে যাদু ও নেশা। সুলতানা! আমি সেই লোক যে দোর্দণ্ড প্রাতপশালী শাসক, আলেম ও বীর বিক্রম আঃ রহমানের ওপর প্রভাব ফেলে বিজয়ী হয়েছি। তুমি দেখে থাকবে আমীর-উমরাগণ পর্যন্ত আমার মাধ্যমে তার দেখা পায়। আমার দ্বারাই তায়-তদ্বির করে। কিন্তু তুমি সামনে এলে মনে হয় আমি পরাজিত হয়ে গেছি, তুমি আমায় দংশন করেছ, আমার ওপর তোমার যাদু কার্যকরী হয়েছে।
কিন্তু তোমার সংগীতকে আমি দংশন করব না। তুমি চাচ্ছ তোমার সংগীতের অপমৃত্যু ঘটুক, পরে স্পেন-নাগিনী তোমার সুরেলা আওয়াজে না আসুক, না ঝাকুক। সর্বোপরি নাগিনীকে সংগীতের সুতোয় বাঁধবে এবং তোমার হয়ে বাঁচবে। যিরাব প্রভু! আমি তোমার। তোমারই থাকব। এসো! আবেগ রেখে খানিক বাস্তব জগতের কথা বলি। যিরাবকে আকর্ষণ করতে গিয়ে কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল সুলতানা। তার চুলের উষ্ণ পরশ লাগছে যিরাবের গায়ে, সে বলল; আমাদের স্বপ্নের জগতে এক কালনাগিনী ছোবল মেরেছে।
নিশ্চয়ই সে মোদাচ্ছেরা! যিরাব বললেন, মোদাচ্ছেরা স্পেন সম্রাটের ভেতরের পৌরুষকে উদ্দীপ্ত করেছে-এই বলতে চাও তো!
সম্রাটের ওপর প্রভাব ফেলে জয়ী হয়েছ– এ দাবী মিথ্যা হয়ে গেছে তোমার। তিনি আমাদের হাতছাড়া হয়ে গেছেন। সুলতানা বলল।
সুলতানা! আর্তনাদ করে বললেন যিরাব, তোমার কখনো মনে পড়ে নি– ভালবাসা আমাকে এমন পথেও নিয়ে যায় যেখানে আমাদের যাওয়া উচিত নয়। আমি সঙ্গীত সম্রাট।
তুমি সম্রাট নও গোলাম। এক বাদশাহর গোলাম। কি করে ভুলে গেলে, সালারগণ তোমাকে দরবারী গায়ক বলে থাকেন। আত্ন প্রবঞ্চনার শিকার হয়ো না। তোমাকে সিংহাসনে দেখতে চাই। এই আশায় বেঁচে থাকব, তুমি হবে রাজা আমি তোমার ক্রীতদাসী।
তুমি আমার হৃদয়ের রাণী! এসো আরো নিকটে এসো।
মুচকি হেসে সুলতানা তার আরো কাছে যায়। যিরাব সুলতানার চোখে চোখ রাখেন। চোখের মাঝে সুলতানার দীঘল কালো চুল আড় হয়ে দাঁড়ায়। সঙ্গীত যাদুর ওপর নারী সুষমা প্রভাব ফেলে। ছোট্ট অথচ ক্ষীণকণ্ঠে বেরোয়, যিরী! মোদাচ্ছেরা নামের কণ্টক বিদায় কর।
দীর্ঘক্ষণ তারা আবেগের জগতে ডুবে থাকে। এর মধ্যে শরাবের পেগ পরিবেশিত হয়।
কাউকে পথের কাঁটা মনে করে দূর করার স্বপ্ন মুছে ফেল মন থেকে; যিরাব বললেন, আমি মোদাচ্ছেরাকে আমার প্রভাব বলয়ে আনছি।
তুমি ভুল পথে চলছ- সে কথা বলছ কেন? মুচকি হেসে বলল সুলতানা।
আমার মন বলছে আমার চলার পথেকে যেন বাধার পাহাড় হয়ে আছে। তুমি খায়েশ ও স্বপ্নের মরুতটে বিচরণ করছ।
তুমি সত্যিই মহাবিজ্ঞ যিরী। আমাদের মনে রাখা দরকার যে, আমরা উভয়েই মুসলমান, এ থেকে আমাদের চোখ ফিরানোর জো নেই। খ্রীস্টান যে হারে ধর্মীয় অনুভূতি নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে তাতে বোঝা যাচ্ছে, ইসলাম এদেশ থেকে অচিরেই বিদায় নিতে চলেছে। জানো এরপর কি হবে? তুমি হবে খ্রীস্টান দরবারের গায়ক আর আমি খ্রীস্ট সম্রাটের দাসী। এলোগেইছ তোমাকে সবকিছু খুলে বলেছে। তুমি মুসলিম আমীর-নাজিরদের অহযীব-তামাদুন বদলে দিয়ে তাদের ইসলামবিমুখ করায় তিনি যারপরনাই খোশ হয়েছেন। যে খ্রীস্ট শাসন অচিরেই এখানে কায়েম হতে যাচ্ছে আমরা তাদের সাথে টক্কর দেয়ার ঝুঁকি নিতে যাব কেন? আমরা স্রেফ স্পেন সম্রাটকে আমাদের যাদুকাঠিতে মোহন্দ্র করে রাখব। তিনি কাল আসছেন। মোদাচ্ছেরাকে বলল, সে যেন তার থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলে। তিনি এক্ষণে মোদাচ্ছেরার প্রভাবে প্রভাবিত।
একেতো সুলতানার নেশা এর ওপর আবার মদের নেশা। গভীর রাত। যিরাব সুলতানাকে মাতাল করতে গিয়ে নিজেই মাতাল বনে গেছেন। বলেন, আমি এক্ষুণি মোদাচ্ছেরার কাছে যাচ্ছি।
***
খাদেমার মাধ্যমে যিরাবের আগমন বার্তা পেয়ে দরজায় তাকে অভ্যর্থনা জানান মোদাচ্ছেরা। তিনি কিছুটা অবাক হন যে, এ লোক এত রাতে এখানে কেন?
দরজায় যিরাবকে দেখা গেল। তিনি বললেন, স্পেন-সম্রাটের অপেক্ষায় প্রহর কিভাবে শুনছেন মোদাচ্ছে?
স্পেন সম্রাট নয়- স্পেন আমীর বলুন! ইসলামে কোন সম্রাট হয় না মুহতারাম যিরাব। আপনি রাজনীতিজ্ঞ। আপনি বোঝেন না, এক জন আমীর কি করে সম্রাট হয়ে যান? আমাদের খলিফা পর্যন্ত সম্রাট নন। সম্রাট কেবল আল্লাহ। বলুন এতে করে আপনার অভিমত।
বুদ্ধির সম্রাট মোদাচ্ছেরার অকল্পনীয় কথায় ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যান। সৌন্দর্যে সুলতানা অপেক্ষা মোদাচ্ছেরা কোনো অংশে কম নন। মোদাচ্ছেরা বরং সুলতানার চেয়ে অধিক আকর্ষণীয়। যিরাব এভাবে তার বেডরুমে প্রবেশ করেছিলেন যেন তিনি সামান্য এক হেরেমের স্ত্রী। কিন্তু মোদাচ্ছেরার ভাব-গাম্ভীর্যপূর্ণ কথায় তিনি নিজকে যতটা হামবড়া মনে করছিলেন ততটা নন।
আপনি বসবেন কি? বললেন মোদাচ্ছেরা।
এদিক থেকে যাচ্ছিলাম তাই আপনার এখানে হয়ে যাওয়া-এই আর কি। বসতে বসতে বললেন যিরাব।
মুহতারাম যিরাব! আপনার মেধা ও বিচক্ষণতার সামনে আমি কিছুই নই। সূর্যের সামনে চেরাগের যতটা তুলনা ততটাও নই আমি। আপনার চেহারা বলে দিচ্ছে, এদিক থেকে যাওয়াচ্ছলে আমার এখানে আসেন নি, বরং আমার উদ্দেশ্যেই আপনার আসা। বলুন। আপনারার কি খেদমত করতে পারি। আপনার স্মৃতিশক্তির প্রতি শ্রদ্ধা রেখে বলছি, আমাকে হেরেমের সাধারণ নারী মনে করলে ভুল করবেন-আমি আমীরের স্ত্রী।
যিরাব হেসে বললেন, সুন্দরী নারীদের ধারণাই এমন যে, প্রতিটি পুরুষ তাকে ভিন্ন নযরে দেখে থাকে। আপনার ধারণা এ পর্যন্ত ঠিক যে, আমি এমনিতেই আপনার কাছে আসিনি, এসেছি কিছু বলতে। আপনার ধারণা ভুল যে, আমি আপনার স্বামীর অনুপস্থিতির সুযোগ নিতে এসেছি। সুলতানার প্রতি আমার অতটা আকর্ষণ যতটা আপনার প্রতি। আপনাদের দুজনের পার্থক্যটাও আমার অজানা নয়।
এত দীর্ঘ ভূমিকার দরকার কি মুহতারাম যিরাব! কেন বলছেন না, আমীর ও সুলতানার মাঝে যেন না পড়ি আমি! সুলতানা এক আকর্ষণীয় কবিতা, সে আপনার সংগীতও। যে ওটা শোনে মত্ত হয়ে পড়ে, এ এক বাস্তবতা। বাস্তবিক কবিতা তবে কাউকে মত্ত করে না। স্পেন-আমীর আমার স্বামী, কিন্তু আমার কতৃত্বে নন। উনি প্রথমে দেশের সুলতান, এরপর কারো স্বামী। সেই দেশে তাকে খেলাফত কিংবা রাজ্যের প্রতি উদাসীন দেখলে সেটা শুধরে দেয়া অপরিহার্য দায়িত্ব। তিনি এরপরও উদাসীন থাকলে আমার ওপর তাকে হারাম মনে করব।
সুলতানার নেশা যিরাবের মগজ থেকে দূরীভূত হল। মোদাচ্ছেরা বলে চলেছেন, সুলতানার ওপর এমন কোন বিধি-নিষেধ নেই। তিনি বিলাস ও সাজ-সজ্জার এক পিরামিড।
তার শক্তি তো এখানেই। এই সৌন্দর্যই ধ্বংসাত্মক অস্ত্র। সে যে ফেত্না সৃষ্টি করতে পারে, তা পার না তুমি। তোমার সত্ত্বার শানে আমার আকর্ষণ। তাই বলতে চাচ্ছি, সুলতানার সাথে শুক্রতার কি না নিতে। সে চায়, আমীরে স্পেন ময়দানে ময়দানে বিচরণ করুক। তিনি ফ্রান্সে সৈন্য প্রস্তুত করছিলেন। তার এখানে প্রশাসনিক কাজে থেকে যাওয়া দরকার ছিল। তুমিই তাকে এমন এক শব্দে আবেগতাড়িত করে তুলেছিলে যদ্দন তিনি হেরেম ছেড়ে তলোয়ার হাতে তুলে নিয়েছেন।
ফ্রান্স ও গোথকমূর্চে কাফেরদের সাথে স্পেনের জানবাষ মুজাহিদরা যে সময় জীনপণ লড়াই করবে সেক্ষেত্রে আমার স্বামী সে সময় হেরেমে এক সংগীতজ্ঞ ও খ্যামটা-কুলটা সুন্দরীর সম্মোহনি শক্তিতে বিভোর-এ আমি চাইনি। স্বামী সোহাগের চেয়ে মুসলিম নারীরা জ্ঞাতি সোহাগকে প্রাধান্য দিয়ে থাকে।
মোদাচ্ছেরা! আমি তোমায় আবেগে প্রীত। শুধু বলতে চাই, এখানে অভিজ্ঞ সালার রয়েছেন। উবায়দুল্লাহকে তুমি কি মনে কর। আমীরে স্পেনের অনুপস্থিতিতে সে কি নেতৃত্ব দেয়ার অযোগ্য?
না, অযোগ্য নয়। সালার মূসা, আঃ রউফ, করন ঐতিহাসিক যুদ্ধ করে চলেছেন, কাজেই আমীরে স্পেনের সাম্প্রতিককালের অভিযানে না গেলেও চলত।
যিরাব যখন বক বক করছিল তখন মোদাছেরা চেয়ার ছেড়ে উঠে কামরায় পায়চারী করছিল। তার চাল চলনে ছিল এক শ্রেণীর প্রভাব-দাপটের ছাপ। পায়চারী করতে করতে তিনি যিরাবের কাছে এগিয়ে আসেন। তিনি মাথাটা নীচু করে যিরাবের মুখের কাছে এনে সোফায় বসে পড়েন। বলেন, আপনার মুখ থেকে শরাব ও দেহ থেকে সুলতানার প্রসাধনীর ঘ্রাণ আসছে। যে কথা আপনি বলতে এসেছেন, তা সুলতানার এসে বলা দরকার ছিল। কিন্তু তিনি আসলেন না। তার সাথে আমার কথা হয়েছে। আপনি এক মহান লোক খোদা তায়ালা আপনাকে উঁচু মাকাম দান করেছেন। আপনার মেধা-বিবেকেও শেষ পর্যন্ত এক সুন্দরী নারী প্রভাব ফেলল?
মুহতারাম যিরাব! আপনি আপনার কথা সেরে ফেলেছেন। এবার আমার বলার পালা। সুলতানার মত আমাকে স্পেন-আমীরের মনোরঞ্জনের ইচ্ছে নেই। তার হৃদয়ের কোণে ঠাঁই না থাকলে আমাকে হেরেমে রাখতেন না, বিবাহ করতেন না। হেরেমের অন্যান্য নারীদের মত দাসী বানিয়ে রাখতেন। আমার সম্পর্ক কোনো ব্যক্তি বিশেষের সাথে নয়- সম্পর্ক গোটা জাতির সাথে। স্পেনে যে বিদ্রোহাগ্নি দাউ দাউ করে জ্বলছে তার নেপথ্যে ফ্রান্স সম্রাট লুই ও আল-ফার হাত। এরা ইসলামের মূলোৎপাটন করতে চায়। মাদ্রিদে অভূত্থান ঠিক তখনই হলো যখন আমাদের বাহিনী ফ্রান্স অভিমুখে ধেয়ে যেতে লাগল। এটা এক ষড়যন্ত্রের ফসল। কাফের গোষ্ঠী অ্যুত্থান করে ফ্রান্স অভিযান রুখেছিল। এখন হয়ত সম্রাট লুই ও আল-ফাঞ্চ মাদ্রিদের খ্রীস্টানদের ক্ষতিপূরণ দিয়ে অন্য কোথাও বিদ্রোহ করতে চেষ্টা করবে। আমার দৃষ্টি এক্ষণে কেবল সেদিকেই।
আপনার প্রতি খেয়াল রেখো মোদাচ্ছেরা!
মুহতারাম যিরাব! আপনার প্রতি যে শ্রদ্ধা-সম্মান আমার আছে তাকে আপনি আহত করে চলেছেন। আমি বলেছিলাম, আপনার মুখে মদ ও শরীরে সুলতানার প্রসাধনীর সুবাস। আপনার জামার ওপর লম্বা চুলটি ঝুলে আছে তা সুলতানা ছাড়া আর কার?
যিরাব দ্রুত জামার দিকে তাকিয়ে দেখলেন তার সাদা জামায় লম্বা একগাছি চুল জড়িয়ে আছে। আঙ্গুলে পেঁচিয়ে তা আলাদা করলেন ও ফরাশে ছুঁড়ে মারলেন।
তিনি কাল আসছেন। মোদাচ্ছেরা বললেন, আসছে আমাদের ফৌজ শহীদী ও যখমী কাফেলা আসছে। তাদের মিছিলে বহু মায়ের পুত্র থাকছে না। থাকছে না বহু বোনের ভাই। বহু পিতা থাকছে না, বিধবাদের স্বামী থাকছে না। তারা স্বভূমি থেকে বহু দুরে মাটির নীচে শুয়ে গেছেন। তাদের যখন কেউ গলা কেটে ফেলেছেন, যন্ত্রণায় আহ-উহ করছেন তখন আপনার গালে মদের উকট গন্ধ আর দেহে সুন্দরীর লম্বা চুল ছিল। যখন ইসলামী পতাকায় রক্তের ছিটে লাগছিল তখন সুন্দরী কুলটা নারীর বাহুবন্ধনে থেকে ভাবছিলেন, আমীরে স্পেনের ওপর কোন নারীর প্রভাব থাকা দরকার।
মোদাচ্ছেরা! যিরাব আহত কণ্ঠে বলেন, সত্যিই তুমি বড্ড আবেগ প্রবণ। তোমাকে বলতে এসেছিলাম, সে তোমাকে আবদুর রহমানের কাছে বিতর্কিত করে তুলবে। তোলার শক্তি তার আছে।
সে কথা আমাকে খুলে বলার দরকার নেই মুহতারাম যিরাব! আমি সবকিছু বুঝেছি। আপনি বলতে চাচ্ছিলেন, আবদুর রহমান ও সুলতানার মাঝে এলে আমাকে হত্যা করা হবে এইতো! কিন্তু আপনার যবানে আছে যাদু। বড্ড চৌকস আপনার মেধা। বড্ড সতর্ক ভরে কথা বলেছেন। যাদুর প্রভাব তার ওপর পড়ে যার মধ্যে ঈমানের লেশমাত্র নেই। যিরাব মোদাচ্ছেরার চেহারায় গভীর নফরে তাকান। সুলতানার চেয়ে তাকে সুন্দরী ও আকর্ষণীয় লাগছে– এটা তার আত্মিক সৌন্দর্য। যিরাব যাতে পুড়ে মরছেন, পারছেন না তার তাপ সহ্য করতে। তিনি ভাবছেন, সুলতানার দূত হয়ে এখানে আসা ঠিক হয়নি। মোদাচ্ছেরা বলে চলেছেন,
আমি কাউকে ভয় করি না। যে বিষয়টি নিয়ে আপনারা আমাকে শাসাচ্ছেন আমি একে থোড়াই পরোয়া করি। ইসলামের জন্য আমি জীবন ওয়াকফ করেছি। স্বামীর সাথে আমার সম্পর্ক ততক্ষণ থাকছে যতক্ষণ তিনি ইসলামের সাথে সম্পৃক্ত রয়েছেন। আপনি ধীমান মিঃ যিরাব! আপনার অজানা নয় যে, মুসলিম বধূমাতারা সুলতানা হওয়া শুরু করলে মুসলিম সাম্রাজ্য সংকুচিত হতে হতে কাবা শরীফ পর্যন্ত গিয়ে ঠেকবে। ইসলামী স্মৃতিবহ হিসেবে কেবল কাবাই থাকবে। পরে অমুসলিমরা বলবে, এ সেই জাতির নিশানা যাদের মেয়েরা শালীনতা পরিত্যাগ করে নগ্ন হয়েছিল। তাদের লজ্জা-শরম শিকায় তুলে রেখেছিল। পর পুরুষের সামনে নিজের স্বকীয়তা হায়েনার মত তুলে ধরেছিল। তারা এমন সন্তান জন্ম দিয়েছিল যাদের সন্তান-সন্ততিরা স্বাধীনতা ও আযাদী শব্দটি পর্যন্ত ভুলে গিয়েছিল।
তুমি যা বলছ আমি খুব ভালভাবেই অবগত।
এ কথা যিনি সর্বপ্রথম আমার কানে দিয়েছিলেন তিনি এর ব্যাখ্যাও দিয়েছিলেন। তিনি আমার স্বামীর বাবা আল হাকাম। টলেডো অভিযানে শাহাদতের পূর্ব মুহূর্তে এ কথা বলেছিলেন। মুহতারাম যিরাব। আপনাকে আরো কিছু বলার আছে আমার। আপনি স্রেফ সগীতজ্ঞ নন। খোদা যে গুণে আপনাকে গুণান্বিত করেছেন, যে গুণ দ্বারা আপনি জনতাকে পাগল করে তোলেন, একে ব্যক্তিস্বার্থে ব্যবহার করবেন না। আপনার মহান বিবেক দ্বারা অন্যকে গোমরাহ করবেন না। খোদা ধনদৌলত দিলে গরীবদের পোকা মাকড় মনে করবেন না। খোদা তায়ালা শক্তি দিলে অধীনদের গোলাম করবেন না।
তুমি আমাকে দর্শন শোনাচ্ছ কেন? আমি তোমাকে নষ্ট করতে আসিনি। সুলতানার কোপানল থেকে বাঁচাতেই আমার আসা।
আপনার চেহারায় আমি এক ধরনের চিন্তা ও পেরেশানি লক্ষ্য করছি। ভয় নেই আমীরের কানে এর কিছুই দেব না আমি।
তোমাকে ধমক দেয়া আমার অভিপ্রায় নয়। তোমার প্রতি সহানুভূতি প্রকাশই গভীর রাত্রে আমাকে এখানে ডেকে এনেছে।
***
শহরবাসী বীর সেনানীদের অভিনন্দন জানাতে উপকণ্ঠে ছুটে গিয়েছিল। তম্মধ্যে মুসলিম-খ্রীস্টান সকলেই শামিল ছিল। কর্ডোভায় আগেভাগেই খবর পৌঁছেছিল মাদ্রিদ বিদ্রোহের। সকলে জেনেছিল অবরোধের কথা। ফৌজ শহরের দ্বারে পা রাখতেই নারা ধ্বনি দিল। রাস্তাঘাট ও বাড়ীর বেলকনি থেকে নারীরা পুষ্পবৃষ্টি বষর্ণ করতে লাগল। আবদুর রহমানের রথের পেছনে সুলতানা, শেফা ও অন্যান্য হেরেমের নারীরা চলছিল। মোদাচ্ছেরা একটি পৃথক ঘোড়ার সওয়ার। তার ঘোড়াটি আবদুর রহমানের গাড়ীর সাথে লাগোয়া। এই চার নারী আবদুর রহমানের নয়নমণি। এদের মোদাচ্ছেরাই একমাত্র বিবাহিতা স্ত্রী। শাহী রেওয়াজ মোতাবেক সকলেই উপকণ্ঠে এসেছে। যিরাব ও অন্যান্য আমলারা দূরত্ব বজায় রেখে পেছনে চলছে।
বিশেষ কোন ঘটনা, কোনো কথা? আবদুর রহমান মোদাচ্ছেরাকে জিজ্ঞেস করেন।
না তেমন কিছু না। দোয়া ও কল্যাণ কামনার মধ্যে আমার বিগত দিনগুলো অতিবাহিত হয়েছে। বিদ্রোহী নেতাকে গ্রেফতার সম্ভব হয়েছে কি? মোদাচ্ছেরা বললেন।
হাত থেকে ফসকে গেছে। ওদের ধরা খুব সহজ ছিল না। এলাকাটা মুসলিম অধ্যুষিত হলে ধরা যেত। খ্রীস্টানরা তাদের পালাবার সুযোগ করে দিয়েছে। যিরাব ও সুলতানা কেমন ছিল।
ওদের সাথে আমার দেখা হয়নি। অভিযান নিয়েই দিন-রাত চিন্তা ছিল আমার।
যিরাবের ঘোড়া সুলতানার টাঙ্গার কাছাকাছি ছিল। হাতের ইশারায় তাকে কাছে ডাকল। যিরা তার কাছে এলো। সুলতানা বললো, দেখছ যিরাব! হতচ্ছাড়ি এখানেই তার কানভারী করা শুরু দিয়েছে। আর তুমি বলছ তাকে নিয়ে আমাদের কোনো ভয় নেই।
এদিকে আবদুর রহমানকে মোদাচ্ছেরা প্রশ্ন করেন, বিদ্রোহের শংকা এখন কেটে গেছে কি?
না, ওরা আমাদের তখতে তাউস উল্টানোর যোগসাজশ করছে। এজন্য যারপরনাই কোরবানী করছে। সামান্য এই অভিযানে ওরা দমবে না।
এখানকার মুসলমানদের মধ্যে উত্তেজনা ও আবেগ পয়দা হলে বিদ্রোহের শংকা বহুলাংশেই দূরীভূত হবে। আমাদের শংকা নও মুসলিমদের নিয়ে। এরা দুমুখো গোখরা। আমাদের জন্য ওরা ফাঁদ পেতে চলছে।
কাফের সম্প্রদায় তার সুন্দরী নারীদের নানাভাবে ব্যবহার করছে। আপনার অনুমতি পেলে আমি মুসলিম যুবতীদের গোয়েন্দা করে শহরের খবরাখবর নিতে থাকব। ওদের সেনা প্রশিক্ষণেরও দরকার।
না।
কেন? আপনি কি ইতিপূর্বে যখমীদের পট্টি বাঁধা ও সেবা শুশ্রূষা কারার জন্য নারীদের নেন নি?
এতে দুর্ণাম হতে পারে। বলে তিনি নারারত শহরবাসীদের উদ্দেশ্যে হাত নাড়েন।
মোদাচ্ছেরার সাথে কৃত্রিম আলাপ করায় সুলতানা ভেতরে ভেতরে জ্বলে খাক। বার বার সে যিরাবের প্রতি তাকায়। যিরা তা দেখেও দেখেন না।
***
সড়ক সংলগ্ন একটি দ্বিতল বাড়ীতে জনৈকা সুন্দরী তরুণী দাঁড়িয়ে এ দৃশ্য দেখছিল। বীর সেনানীদের তাদের দৃষ্টি মাঝে মধ্যে ইমারত থেকে ভেসে আসা পুষ্পবৃষ্টির দিকে তাকায়। তারা দেখত জানালা ও বেলকনি থেকে তরুণীরা ও গৃহবধূরা ফুল ছিটাচ্ছে। ব্যতিক্রম শুধু দ্বিতল বাড়ীর তরুণীটি। তার হাতে কোনো ফুল নেই। মুখে নেই আনন্দের লেশ। চেহারায় এক প্রকার বির্ষের ছাপ। আবদুর রহমানের দিকে তাকানোর সময় ঘৃণায় তার মনটা তেতো হয়ে ওঠে। আচমকা কারো হস্তস্পর্শে ওই তরুণী সম্বিত ফিরে পায়। কে যেন তাকে ডাকে, ফ্লোরা! তরুণী ঘাড় কাত করে পেছনে তাকায়। ওর মা পেছনে।
তুমি তো পুষ্প ছিটাওনি। এমন কি নাড়ছ না হাতও। ফ্লোরা! ওখান থেকে সরে এসো। তোমার বাবা নীচে দাঁড়ানো। স্পেন সম্রাটকে দেখার পরও ফুল ছিটাওনি দেখলে উপরে এসে তিনি কেয়ামতের বিভীষিকা কায়েম করবেন।
আমি এদের প্রতি পু থু নিক্ষেপ করতেও ঘৃণা করি। আমি কি ওই সেনানীদের ওপর ফুল ছিটাব যারা খ্রীস্টানদের কচুকাটা করে এসেছে? ধর্মরক্ষা কি আমাদের অভিপ্রায় নয়? ইসলামকে উত্তত করা কি আমাদের এখনকার দাবী নয়? ফ্লোরা বলল।
ভূলে যেও না মা। তোমার বাবা মুসলমান। আমরা নাম কাওস্তের মুসলমান সন্দেহ হতেই তিনি আমাদের হত্যা করে ফেলবেন।
কেন ফ্লোরা গর্জে ওঠে, তাহলে তুমি আমাকে খ্রস্টের শিক্ষা দিয়েছিলে কেন? আজ আবার মুসলমানদের প্রতি ঘৃণা প্রদর্শনে বাদ সাধছ কেন? আমার বাবা তোমার স্বামী না হলে সত্যিই তাকে খুন করে ফেলতাম। তোমার প্রেমের প্রতি আমার করুণা হয়, এজন্যই বড় কষ্ট করে নিজকে মুসলমান বাবার কন্যা বলে মনকে সান্ত্বনা দেই। অথচ খ্রীস্টান যীশু আমার পথ প্রদর্শক। খ্রীস্টানদের জন্য আমি জীবনোসর্গ করেছি। আমার বাবার প্রতি তোমার অনুরাগ আছে। তুমি তার শৃঙ্খলে আবদ্ধ– আমি নই।
হ্যাঁ ফ্লোরা! তোমার বাবার প্রতি আমার টান অকৃত্রিম। এতদসত্ত্বেও ধর্মানুরাগ থেকে বেরিয়ে আসতে পারিনি।
***
১৮ বছরের পুরানো কথা।
তখন ফ্লোরার মায়ের বয়স ১৮। এই সময় স্পেন শাসক ছিলেন আল-হাকাম। স্পেনের করদরাজ্য কতলুয়ানা ছিল খ্রীস্টান অধ্যুষিত। এখানে মাঝে মধ্যে মুসলিম ফৌজ যাতায়াত করত। কতলুয়ানাবাসী ছিল নেহাৎ ধুরন্ধর ও পিশাচ প্রকৃতির। তারা মুসলিম বাহিনীর প্রতি প্রতারণামূলক অসংখ্য হামলা করেছে। সত্যি বলতে কি কতলুয়ানা খ্রীস্টান ষড়যন্ত্রের আখড়ায় পর্যবসিত হয়েছিল।
জনৈক মুসলিম সংবাদদাতা (ইতিহাসে যার নাম খুঁজে পাওয়া যায় নি। যিনি পরবর্তী ফ্লোরার বাপ হয়েছিলেন) কর্ডোভায় এ মর্মে খবর দেন যাতে এক ন্যক্কারজনক ষড়যন্ত্র ফাঁস হয়ে যায়। এটা মুসলিম অফিসারের কৃতিত্ব। ইনি ওঁৎ পেতে ছদ্মবেশে এই তখ্যোদ্ধার করেন ও কর্ডোভায় জানান। তৎক্ষণাৎ মুসলিম ফৌজ রওয়ানা হয়। তারা কতলুয়ানায় ঝড়ো বেগে উপস্থিত হয়। সংবাদদাতা এই বাহিনীর পথ প্রদর্শক। তিনি ষড়যন্ত্রকারীদের ধরিয়ে দেন। কিন্তু সশস্ত্র শহুরে বিদ্রোহীরা ফৌজের মুখোমুখি হয়। খ্রিস্টান নারীরা পর্যন্ত অলি গলিতে মুসলিম ফৌজকে আক্রমণ করে। মুসলিম সেনাপতি কালবিলম্ব না করে বাড়ীতে বাড়ীতে আগুন ধরাল। ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে বিদ্রোহীরা অস্ত্র সমর্পণ করে।
শহুরে লোকদের আবেগ-উদ্দীপনা এ কথার সাক্ষ্য দিচ্ছিল তারা জঙ্গী প্রশিক্ষণ নিয়েছে। পাশাপাশি এ তথ্যও উদঘাটিত হয় যে, শহুরেদের লেবাছে ফ্রান্স বাহিনীর অসংখ্য সেনা এখানে এসেছিল।
মুসলিম ফৌজর জ্বালানো গোটা শহরের অর্ধেক জ্বলে ছাই হয়ে গেল। এলাকাবাসী বাইরে বেরিয়ে এল।
দুদিন পর।
সংবাদদাতা কোনো কাজে শহরের বাইরে এলেন। পাহাড়ী এলাকা অতিক্রম করতে গিয়ে তিনি নারী কন্ঠের আর্তনাদ শুনতে পেলেন। তিনি. ঘোড়ার গতিপথ বদলালেন। দেখলেন, জনাতিনেক লোক, এরা ফৌজ নয়। জনৈক সুন্দরী তরুণী নারীর পোষাক খামচাচ্ছে। সে ঘোড়র নিকটে দাঁড়ানো। ওই লোক খাপ থেকে তলোয়ার বের করলেন এবং ঘটনাস্থলে গিয়ে উপস্থিত হলেন। ওই তিন লোক তরুণীকে এভাবে টানা হেঁচড়া করছিল যে, তারা অন্য কারো উপস্থিতি ঠাহর করতে পারল না।
তার ঘোড়া কাছে এলে ওরা আঁচ করল, কিন্তু ততক্ষণে তার উদ্যত তলোয়ারের ডগা একজনের বক্ষছেদন করে ফেলছে। তিনি বর্শার মত তলোয়ার নিক্ষেপ করেই হত্যা করেছিলেন। এবার ঘোড় থামিয়ে দুজনের দিকে এগিয়ে গেলেন। ওরা তরুণীকে ছেড়ে তাকে আক্রমণ করতে উদ্যত হলো। খাপ থেকে বের করল তলোয়ার। ছিনতাইকারীরা দুদিক থেকে তাকে ঘিরে নিল। তিনি বিত্তহস্ত–ওদের হাতে অস্ত্র।
এই আগন্তুকের মৃত্যু অনিবার্য মনে হচ্ছিল। এ সময় ত্রাণকর্তার সাহায্য জরুরী মনে করল তরুণী। সে নিহত ছিনতাইকারীর তলোয়ার দ্বারা ওদের ওপর হামলা করলো। শেষ পর্যন্ত ছিনতাইকারীরা সকলেই মারা গেল। অবশ্য উদ্ধারকর্তা মারাত্মক যখমী হলেন।
তরুণী তার ওড়না ছিঁড়ে ক্ষতে পট্টি বাঁধলেন। এ সময় সে কান্না জড়ানো কণ্ঠে বলে, আমি এক খ্রীস্টান। মুসলিম সেনানীরা আমাদের ঘরে আগুন লাগায়। আমাদের সকলে মারা গেছে। আমি প্রাণভরে পালাচ্ছিলাম। রাতে লুকিয়ে ছিলাম। সকালে ওখান থেকে বেরিয়ে অজানার উদ্দেশ্যে বেরোই। এ সময় এরা আমাকে ছিনতাই করার চেষ্টা করে।
উদ্ধারকর্তা জিজ্ঞাসা করেন, তোমার গন্তব্য এক্ষণে কোথায়? সে বলল,জানি না।
তুমি যেখানে যেতে চাও সেখানে তোমাকে পৌঁছে দেব। বললেন তিনি।
তরণীর অবস্থা তখন খুবই করুণ। সে তার পায়ে পড়ল। তিনি বললেন, আমি মুসলমান। তোমাকে সাথে নিতে পারব না। যুবতী জেদ ধরে বলল, গেলে কোথায়ও আপনার সাধেই যাব।
আমার দেহটা ছাড়া আর কিছুই নেই এক্ষণে। একেই এখন পেশ করতে পারি। এর বিনিময়ে আপনার সাথে নিয়ে চলুন এবং শহরের কোনো পাদ্রীর কাছে সোপর্দ করবেন। বলল তরুণী।
আমি কোনো গোনাহের কাজ করব না। তুমি নিরাশ্রয়, অসহায় ও একাকী। আমি তোমার দেহ ওভাবে গ্রহণ করব না। আমার সাথে গেলে আমাদের ধর্ম গ্রহণ করতে হবে। আমার স্ত্রীত্বে আসতে হবে।
তরুণী খানিক ভেবে বলল, হা হা। ধর্মান্তরিত হয়ে হলেও আপনার স্ত্রীত্বে বরণ করতে রাজি। আপনার মত মানুষই হয় না। আমার মত সুন্দরী বাগে পেয়েও যার এতটুকু আকর্ষণ নেই তাকে স্বামী হিসেবে পাওয়া সৌভাগ্যের ব্যাপার বটে।
আগন্তুক যুবতীর গলায় ক্রুশ ঝুলছে, তিনি কুশমালা হাতের মুঠোয় নিয়ে ফেলেন। ক্রুশদণ্ড সামান্য তখনও তার হতে ছিল। ওটা যমীনে ফেলে পায়ের তলায় পিষলেন। বললেন, চলো আমার সাথে।
তিনি ছিনতাইকারীদের ঘোড়াগুলো কজা করলেন। একটিতে তরুণীকে চাপিয়ে অপর দুটির লাগাম হাতে নিয়ে কতলুয়ানার উদ্দেশ্যে চললেন। তার ক্ষতস্থান থেকে রক্ত পড়ছিল বেয়ে। আস্তে আস্তে হয়ে আসছিলেন নিস্তেজ। শহরে তার চিকিৎসা হয়। মাসখানেক পরে তরুণী মুসলমান হয়ে গেলে ওই অফিসারে সাথে তার বিবাহ হয়।
তরুণীটি ধর্মপ্রান খ্রীস্টান সম্প্রদায়ের। চরম মুসিবতে নিজকে এই লোকের হাতে সোপর্দ করে বিবাহত্বে আসার পর নিজ ধর্মের টান হৃদয় থেকে মুছতে পারলেন না, আবার একে ছাড়তেও পারলেন না। এই লোক না থাকলে হয়ত তিনি বর্বরদের পাশবিক হামলার শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করতেন।
একদিকে উদ্ধারকর্তার প্রেম অপরদিকে খ্রীস্টধর্মের টান। সর্বোপরি পরিবারের সকলের মৃত্যুশোক তিনি কি করে ভুলবেন। স্বামী তার সেই লোক-ই যিনি নিজে খ্রীস্টান বিদ্রোহীদের ষড়যন্ত্র ফাঁস করেছেন। তার পরিবারে মর্মান্তিক মৃত্যুর মূলে বহলাংশেই দায়ী তার স্বামী। তার মনে নেই কত সহস্র খ্রীস্টান অগ্নিকংকাল হয়েছে এবং কত নারী বাদী হয়েছে। তার এই স্বামী গলা থেকে ক্রুশমালা শুধু ছিঁড়েই ক্ষ্যান্ত হননি, পায়ের তলে পিষেছেনও। কুশদণ্ড তিনি চোখের ওপর রেখেছেন চিরদিন- কিন্তু তিনি তা দিয়েছেন পায়ের তলে। মুসলিম স্বামীকে তিনি ধর্মান্তরকরণের কথা বলেছেন। বলেছেন তার প্রতি অগাধ আকর্ষণের কথাও, কিন্তু হৃদয়ের কোণে জমাট খ্রীস্টধর্মের যে অগাধ মমতা তা বলেননি, জানতেও দেননি কোনদিন।
***
অনেক চেষ্টা করার পরও মনে প্রাণে ইসলামকে গ্রহণ করতে পারেননি তিনি। এক বছর পর তার কোলজুড়ে একটি কন্যা সন্তান আসে। বাবা তার নয়নের মণির সুন্দর নাম রেখেছিলেন। ইতিহাসে ওই নামটি অবশ্য সংরক্ষিত নেই। মা তাকে ফ্লোরা নামে ডাকেন। বাবা এতে আপত্তি জানান না। ফ্লোরা নামকেই মা চয়েজ করেন। ইতিহাসে সে এ নামেই খাতে।
ফ্লোরা সেই নাম যে বহু কাহিনীর জন্মদাতা। এই নামে অসংখ্য নাটক লেখা হয়েছে। সাহিত্যের পাতায় এই ফ্লোরার প্রেমে মুসলিম সেনাপতি ও শাহযাদাদের তড়পাতে দেখা যায়। কোনো সাহিত্যিক তাকে ক্লিওপেট্রা বলে খেতাব দিয়েছেন। কিন্তু বাস্তবের সাথে এসব নাটক-উপন্যাসের কোন মিল নেই। মুসলিম ইতিহাসবেত্তাদের পাশাপাশি অমুসলিম ইতিহাসবেত্তারা পর্যন্ত ফ্লোরারে মত ইসলাম বেরিতার প্রতিভূ ছিল। এই মেয়ের দ্বারাই স্পেন থেকে মুসলিম উৎখাতের প্রেরনার উৎস পেয়েছিল তাবৎ খ্রীস্টান শক্তি। ইসলাম বৈরিতার এই ষড়যন্ত্র-কন্যার মাধ্যমে খ্রীস্টান জাতি তাদের দলে অসংখ্য মানুষকে ভেড়ায়। এই আন্দোলনকে ইতিহাসে মোয়াল্লেদ (মুসলিম হটাও আন্দোলন) বলা হয়।
ফ্লোরার মা ছিল এই আন্দোলনের পুরোধা। দ্বীনদার এক মুসলিমের স্ত্রী, নামটাও ইসলামী। কিন্তু মনে প্রাণে কট্টর খ্রীস্টান। তাই তিনি ফ্লোরাকে আশৈশব খ্রীস্টত্ব শিক্ষা দিয়ে আসছেন। স্বামীর প্রতি অগাধ প্রেম থাকায় তিনি প্রকাশ্যে ইসলাম ছাড়তে পারেননি। আবার খ্রীস্টত্বের ঘোষণাও দিতে পারেননি। মন থেকে বাপ-দাদার ধর্ম মুছে ফেলতে চেয়েছেন বারংবার, কিন্তু পারেন নি। কুশ তার শৈশবের খেলা ছিল, যৌবনের ছিল মাবুদ। ১৮ বত্সরের যুবতীর দেহ থেকে খ্রীস্টত্ব পড়ত টপকে টপকে।
এক মুসলিমের সাথে বিবাহ। এর থেকেই সন্তান। অবশ্য প্রতিপালন মুসলিম হিসেবে হয়নি। হয়েছে মনের কোণে লুকানো খ্রীস্টত্বেই। গর্ভে আসার পর ফ্লোরার মা একবার স্বপ্নে কি দেখে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। স্বামী তাকে বুকে চেপে ধরে। বাচ্চাদের মত সান্ত্বনা দেন। কোরআনের আয়াত পড়ে ফুঁক দেন। নিজের গালে উভয় হাত রেখে বড় চোখ করে তাকিয়ে বলেন, আগুন লেগেছে আগুন! উঠে দেখ! কে যেন ঘরে আগুন লাগিয়েছে। মানুষ পোড়া গন্ধ তোমার কানে আসছে না? কে যেন জ্বলে ছাই হচ্ছে।
যখন তার পুরোপুরি হঁশ আসে তখন স্বামীর কোলে মাথা গুঁজে ফুঁপিয়ে কাঁদছিলেন। স্বামী তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন, যুবতী মেয়েদের প্রথম সন্তান গর্ভে আসলে একটু আধটু এ রকম আছর হয়েই থাকে। কাজেই ভয়ের কিছু নেই। স্বামী কাছে থাকলে এ ধরনের আছরে তেমন কোন ক্ষতি হয় না।
ফ্লোরার মা স্বামীর ওই বৃত্তান্তকে দুঃস্বপ্ন বলে মেনে নেন। কিন্তু বেশ কিছুদিন পর স্বপ্নে গীর্জার ঘন্টাধ্বনি শুনতে পান। আওয়াজটা খুবই অস্বাভাবিক। বিলকুল গরিলার মত গর্জন। পরে এই আওয়াজ অগ্নিরূপ ধারণ করে দূর দরাজ পর্যন্ত তার শিখা ছড়িয়ে দেয়। তিনি ভয়ে গির্জার উদ্দেশ্যে ছুটতে থাকেন। আগুনের রোশনাই আকাশ ছুঁই ছুঁই। আকাশ লালচে বর্ণ ধারণ করেছে। এই বর্ণ তার কাছে খুব ভাল লাগে। তিনি চলতে চলতে বুকে হাত রাখেন। ওখানে কুশের অস্তিত্ব অনুভব করেন। বুকে যেন চাঁদের কুশ চমকাচ্ছে। ক্রশটি তিনি হাতের মুঠোয় পুরেন।
এক সময় খুলে যায় চোখ। হাত তখনও বক্ষদেশে ঘুরে ফিরছে। ওখানে এক্ষণে কুশ নেই। মনে পড়ে মাসচারেক আগে উদ্ধারকালে তার এই উদ্ধারকর্তা ক্রুশ গলার থেকে ছিনিয়ে পদতলে পিষ্ট করছিল। কুশ অপমানের জ্বালায় তিনি পুড়ে মরেন। সেই স্বামী আজ তার পাশে দিব্যি নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। এই লোক যদি তাকে জোরপূর্বক বিবাহ করত তাহলে নির্ঘাত হত্যা করে বসতেন তিনি। পরে কোনো গীর্জায় নাব্রত পালন করতেন। কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে অঙ্গুলি হেলনের শক্তি-সুযোগ নেই যে।
হাত দুটি তখনও বক্ষদেশে। অন্ধকার আকাশে স্বপ্নে দেখা সেই বর্ণ এখনও বিদ্যমান। কামরায় গরিলার আওয়াজের প্রতিধ্বনি ভাসছে। এক সময় তর্জনী আঙ্গুল দ্বারা বুকে ক্রুশ আঁকেন। এতে মনে সান্ত্বনা আসে।
এখান থেকেই তার প্রেমে বিভাজন আসে। এর সপ্তাহ খানেক পরে তিনি স্বপ্নে যেন কার ডাক শুনতে পান, তুমি খ্রীস্টের পূজারিণী–মুসলিম নও। আবার দেখেন, আগুন জ্বলছে, মানুষ পুড়ছে। চাঁদের আলোয় ছোট ছোট হাজারো ক্রুশ বাতাসে ভেসে চিকচিক করছে। মুসলিম সৈনিকরা এগুলো নামিয়ে পিষ্ট করছে। তিনি সৈনিকদের বারণ করেন, কেউ তার ডাকে সাড়া দেয় না। ভাঙ্গা কুশ হাতড়ান, পান না। শেষ পর্যন্ত বুকে হাত দিয়েই ক্রুশ অঙ্কন করে মনকে প্রবোধ দেন।
স্বপ্নে তিনি এখন আর ভয় পান না। স্বামীর সেই বৃত্তান্ত মন থেকে বের করে দেন। স্বপ্ন দেখার পর অনপোলব্ধিগতভাবে নিজে একটা বৃত্তান্ত করতেন। স্বপ্নের তাবীর বুঝতেন, তিনি খ্রীস্টানের ওপর দৃঢ় থাকার নির্দেশ পাচ্ছেন। যে নির্দেশ পাচ্ছেন তা তাকে শুনতে হবে, বুঝতে হবে।
স্বপ্নে নির্দেশাবলীকে তিনি গ্রহণযোগ্য ও সত্যি বলে মেনে নেয়ার পর তার হৃদয়ে প্রশান্তি আসে। এদিকে স্বামী তার দিকে প্রেমময় দৃষ্টিতে তাকাল তিনি সব কিছু ভুলে যান। আপনার সত্তা, ব্যক্তিত্ব ও আভিজাত্য সবকিছু স্বামী সত্তার মাঝে লীন করে দেন। প্রেম এমন এক মহৌষধ যাতে স্বামীর অঙ্গ বনে যান স্ত্রী। অঙ্গাঙ্গি এই সম্পর্ক মানুষকে সব কিছু ত্যাগ করতে তালিম দেয়। ব্যাপারটা ফ্লোরার মাকেও উদগ্রীব করে। উপলব্ধিগতভাবে তিনি এই দ্বি-চারী মনোভাব সমর্থন করতেন না। তবে সচেতনভাবেই ধর্মের টানটা কেন যেন তার মাঝে এসেই যেত। শরীরের রক্ত যেন খ্রীস্টত্বই জপত তার মাঝে।
***
তার স্বামী গোয়েন্দা বিভাগের কর্মকর্তা। দায়িত্ব পালনে তাকে বাড়ীর বাইরে থাকতে হত। তার উপস্থিতিতে স্ত্রী নামায আদায় করতেন, তার থেকে কোরআনের সবক নিতেন, কিন্তু তিনি ঘরের বাইরে গেলে খ্রীস্টের উপাসনা শুরু করতেন। বাড়ীর নিকটেই একটি গীর্জা ছিল। এর থেকে ঘন্টাধ্বনি আসত। তিনি ঘন্টার আওয়াজ শুনেই ওখানে হাজির হতেন।
স্বামীর ছিল দুটি ঘোড়া। একটি অনেক আগের আরেকটি ছিনতাইকারীদের থেকে নেয়া। এই ঘোড়া ছিল তার সুবর্ণ বাহন।
একদিন বাড়ী থেকে বের হবার সময় স্বামী তাকে বললেন, ঘোড়ার পায়ে লোহার কড়া (জুতো) পরানো দরকার। বিশেষ কাজে আমি কর্ডোভার বাইরে যাচ্ছি। বাইরের থেকে তুমি জুতা লাগিয়ে নিও। তিনি বাড়ী ছাড়ার পর স্ত্রী ঘোড়ায় চেপে জুতো লাগানোর তালাশে বের হলেন। কেউ তাকে বলেছিল, হাশেম কর্মকার ভালো জুতো বানাতে পারে, সে বর্শার বেয়নেট বানায়, বানায় তলোয়ার, খঞ্জর ও তেগও। মাঝবয়সী সাধারণ গোছের এই কর্মকার। ছোটখাট সংসার। শহরের মানুষ তাকে এক নামেই চেনে।
১৮ বছরের নজরকাড়া সুন্দরীর আগমনী দেখে হাশেম তার নিটোল গালের দিকে হা করে তাকিয়ে থাকে। যুবতীর দুঠোঁটে মুচকি হাসি। সেই হাসির ছটা মুখে রেখেই তিনি প্রশ্ন করেন-খ্রীস্টান বুঝি?
যুবতী সহসাই উত্তর দেয়, না।
তাহলে নও মুসলিম?
হ্যাঁ, মুচকি হেসে হাশেম বলেন, এখানে কি উদ্দেশ্যে?
হাশেম কাজ ছেড়ে বাইরে আসেন এবং ঘোড়র জুতো খুলতে থাকেন। কাজ করার পাশাপাশি যুবতীর সাথে তিনি কথা চালিয়ে যান। যুবতী অবাক নয়নে লক্ষ্য করেন, লোকটার কাজের চেয়ে মুখ চলছে বেশী। সামান্য আলোচনার পর তিনি ধারণা করেন লোকটার খপ্পরে পড়ছেন তিনি। চির পরিচিত মানুষের মত অকৃত্রিম আলাপচারিতা শুরু হয়। যুবতীর দোদুল্যমান মনোব তাকে এই আলাপে আরো আগ্রহী করে তোলে। স্বামী ও ধর্মের দোদুল্যমানতা প্রকাশের একটা অভয়ারণ্য মনে করেন এই কর্মকার। এক পর্যায়ে তিনি বলে ফেলতে চান মনঃকষ্টের কথা। স্বামী ও খ্রীস্টধর্মের দ্বন্দ্ব সংঘাতের কথা। কিন্তু হাশেমকে মুসলমান জানতে পেরে নিজকে সংযত করে নেন।
১৮ বছর পর্যন্তু খ্রীস্টান থাকলে, কি বুঝে সংঘাতধর্মী একটি ধর্ম গ্রহণ করলে? কেন করলে? প্রশ্ন হাশেমের।
কিছু একটা বুঝেই করেছি। কিন্তু ও প্রশ্ন কেন আপনার?
তোমার থেকে কোনো তথ্যোদ্ধার উদ্দেশ্যে নয় আমার। অভিজ্ঞতা আমার প্রচুর আমি ইতিপূর্বে খ্রীস্টান ছিলাম। একটি কারণে মুসলমান হয়ে যাই। সে বহু পুরনো কথা। মুসলমান হলেও হৃদয় থেকে খ্রীষ্টের শিক্ষা ভুলতে পারিনি। গভীর রাতে গীর্জার ঘন্টাধ্বনি আমার কানে গুঞ্জনে তোলে। তখন মনের কি অবস্থা হয় তা ভুক্তভোগী মাত্রই অনুমান করতে পারে।
আপনার এই অভিজ্ঞতার ভোজা আমিও একজন। এ রকম দোদুল্যমান রোগী আমি। সত্যিই, শত চেষ্টা করেও ধর্মীয় টান তনুমন থেকে মুছতে পারছি না।
হাশেম কাজ ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন এবং তার স্বামীর পেশা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন। যুবতী অনভিজ্ঞ। স্বামী তাকে বলেছিলেন, তার পেশা সম্পর্কে কাউকে কিছু না জানাতে। তিনি ছিলেন গোয়েন্দা, সাধারণ মানুষ তাকে মুন্সী বলেই জানত। যুবতী বললেন, আমার স্বামী সরকারী গোয়েন্দা। আরো বললেন, কতলুয়ানার ঈসায়ী বিদ্রোহে আমার স্বামী গোয়েন্দগিরি করেছিলেন। স্পেনের আমীর তাকে এর জন্য বিশাল এনামও দিয়েছেন।
একথা কেন বলছ না কতলুয়ানা। পাইকারী খ্রীস্টান হত্যাযুদ্ধের মূল নায়ক তোমার স্বামীই। হাশেম বলল।
এ হত্যাকাণ্ড তো অবধারিত ছিলই। ঈসায়ীরা সশস্ত্র বিদ্রোহে নেমে পড়েছিল। আমাদের যুবতী মেয়েরা ছাদে চড়ে মুসলিম সেনাযাত্রীদের পাথর বর্ষণ করেছিল। অসংখ্য ফৌজ মারা পড়েছিল সেদিন আমাদের হাতে। ফৌজ এরপরও আমাদের ছেড়ে দেবে কেন?
তুমি মুসলিম পক্ষে ওকালতি করে চলেছ।
হ্যাঁ। আমি মুসলমানদের বিপক্ষে কথা বলতে পারি না। কেননা আপনিও একজন মুসলমান। দ্বিতীয়ত আমার স্বামীও মুসলমান। তিনি আমাকে তিন তিনজন হিংস্র : মানবজন্তু থেকে উদ্ধার করেছিলেন। হাশেমকে পুরো ঘটনা শোনানোর পর তিনি বললেন,
তিনি আমার সতীত্ব রক্ষা করেছেন। এর প্রতিদানে নিজকে তার কাছে সোপর্দ করলে তিনি অস্বীকৃতি জানান। বলেছিলেন, বিবাহের শর্তে তোমাকে গ্রহণ করতে পারি। জেনে শুনেই তারা স্ত্রীত্বে এসেছি আমি।
তিনি তোমাকে তার বাণী মনে করেন।
না। হৃদয়ের রাণী মনে করেন। স্বপ্নঘোরে চিৎকার করে উঠলে তিনি আমাকে তার বুকে সেভাবেই চেপে ধরেন যেভাবে বাল্যকালে দুঃস্বপ্নে মা তার বুকে আমাকে চেপে ধরতেন।
দুঃস্বপ্নে ভয় পাও কেন? আমিও প্রথমদিকে অমন স্বপ্ন দেখতাম। ধর্মান্তর করনের শুরুতে অমন একটু আধটু হয়। দুধর্মের মানসিক টানাটানিতে মানুষ দোদুল্যমান হয়ে থাকে। আমার ওপর দিয়ে যা বয়ে গেছে ঠিক তা-ই এখন বয়ে যাচ্ছে তোমার ওপর দিয়ে।
হ্যাঁ, আপনার অনুমান যথার্থ।
আমার সাথে প্রাণ খুলে আলাপ করতে দ্বিধাবোধ কর না। বেশক আমি মুসলমান কিন্তু এর পাশাপাশি রক্তমাংসের গড়া একজন মানুষও। আমাকে স্রেফ কর্মকার মনে না করলে সবকিছু খুলে বল। তোমাকে কিছু প্রশ্ন করলে আমার উপর অবস্থা রেখ। তোমার বাড়ীঘর জ্বলে ছাই। জ্বলে ছাই আমার ঘরও। টলেডো বিদ্রোহকালে আমি মুসলমান হই। তদানীন্তন স্পেন শাসক ছিলেন আল হাকাম। ঘটনা ৮১৩ খ্রীস্টাব্দের ঘটনা। টলেডোতে খ্রীস্টানরা বিদ্রোহ করেছিল। স্পেনশাসক বড় কড়া নির্দেশ দিলেন। তিনি ফরমান জারী করে বললেন, গোটা শহরে আগুন লাগিয়ে দাও। তোমাদের শহরে তো তা-ই করা হয়েছে।
মুসলিম ফৌজ ঈসায়ীদের ঘরে আগুন লাগাল। আগুনের লেলিহান শিখা আমার ঘরকে গ্রাস করল। তাদেরকে বললাম, আমি মুসলমান, নও মুসলিম। সৈনিকরা বলল, তুমি বিদ্রোহী, খ্রীস্ট পূনর্জাগরণের কর্মী। তুমি মোয়াল্লেদ। মোয়াল্লেদ-এর অর্থ জানো? এটি আরবী শব্দ। অর্থ ধর্মান্তরিত হয়ে সাবেক ধর্মের প্রতি টান থাকা।
আমি সৈনিকদের বললাম, আমার ঘর তল্লাশি করে দেখ। এখানে তোমাদের কোরআন শরীফ ছাড়া অন্য কোনো ধর্মের নিশানা পাবে না। ওরা আমার কথা এজন্য বিশ্বাস করতে পারল না যে, নও মুসলিমরাই উপরোক্ত বিদ্রোহে মদদ জুগিয়েছিল। ওরা আমার ঘরে আগুন লাগাল। আমার স্ত্রী ছিল, ছিল দুটি বাচ্চা। ওরা প্রাণরক্ষার্থে বেরিয়ে ঘোড়ার পদতলে পিষ্ট হয়ে মারা গেল। কেউ আমার ফরিয়াদে কান দিল না। আমি ঘরছাড়া হয়ে গেলাম। হয়ে গেলাম নিঃসঙ্গ। কোনো হাকীমের সন্ধানে কর্ডোভায় এলাম। স্পেন আমীরের সাথে দেখা করারও চেষ্টা করলাম। তার কাছে আমার প্রতি নিষ্ঠুর জুলুমের কাহিনী শোনাতে চেয়েছিলাম। হয়ত বা সামান্য ক্ষতিপূরণ পাব এই ছিল মনে আশা। কিন্তু আমার ওই আশা মনের কোণেই জমা থাকল, আমীর পর্যন্ত যাওয়া সম্ভব হলো না। আল হাকাম ছিলেন বিলাসী। চাটুকারে তার দরবার ঠাসা। কবিরা তার দরবারে নিরলস কাব্যচর্চা করত। প্রজাদের বাঁচা-মরা নিয়ে তার কোন চিন্তা ছিল না। বেঁচে থাকার একটা অবলম্বন দরকার ছিল। কর্মকারের কাজ একটু আধটু জানতাম। সেটাকেই শেষ পর্যন্ত জীবিকা নির্বাহের অবলম্বন বানালাম।
এতে আপনি খুশী? আপনি তৃপ্ত কি?
দেখো। আমার ব্যক্তি জীবন নিয়ে আর কিছু বলো না। তুমি এক গোয়েন্দার স্ত্রী। তোমার স্বামী ঘূর্ণাক্ষরেও জানলে আমি গ্রেফতার হয়ে যাব। চারদিকেই ষড়যন্ত্র আর যোগসাজশের প্রয়াস। যার ওপর সামান্য সন্দেহ হচ্ছে তাকেই আটকানো হচ্ছে। তোমার স্বামী গোয়েন্দা বলে ভুলে করেছ। গোয়েন্দারা খুবই চালাক। তাকে আমাদের এই অমানিশার কথোপকথনের কথা জানতে দিও না। আর কারো কাছেই তোমার স্বামীর পরিচয় দিতে যেও না। স্বামীর সাথে যে কথা বলতে পার না আমার সাথে তা নির্বিবাদে বলতে পার। তোমাকে আমার মেয়ে ও বোন বলেই মনে করব। আমার হৃদয় ক্ষত-বিক্ষত। খুব সম্ভব তোমার ভেতরটাও তথৈবচ।
আমার স্বামীকে কখনো এ কথা বলবেন না তো-আজকের আলাপচারিতার কিছু?
আমি তোমার সাথে প্রতারণা করছি না। আমার কাছে যাওয়া-আসা জারী রেখো। বড় নিঃসঙ্গ আমি। এ জগতে কেউ নেই আমার। সত্যি বলতে কি, আমার ধর্মও নেই। মুসলমানদের ব্যবহারে আমি ত্যক্ত-বিরক্ত। ধর্মের শাসন-অনুশাসন স্রেফ প্রজাদের জন্য প্রযোজ্য শাসকদের জন্য নয়। মুসলমানদের মধ্যে আজ এটাই হয়ে চলেছে। স্পেন বিজেতারা বলেছিলেন, ইসলাম গোটা ইউরোপে ছড়িয়ে দেবেন, কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, এরা একদিন এদেশ থেকেই বিতাড়িত হবে। হতে বাধ্য। বলল হাশেম।
বাড়ীর পথ ধরার সময় যুবতী অনুমান করলেন, লোকটা স্রেফ কর্মকারই নন তার ব্যক্তিত্বে রয়েছে আকর্ষণ– সাধারণ মানুষের বেলায় এমনটা দেখা যায় না।
***
ইতিহাস নীরব থাকেনি। এগিয়ে চলেছে তার গতিপথে। ইতিহাসের বাঁকে তাই দেখা যায় হাশেমের আলোচনা। তিনি সত্যিই ছিলেন চৌকস, ছিলেন মোয়াল্লেদ। মুসলমানদের অমানবিক আচরণ নও মুসলিমদের বিক্ষুব্ধ করে তুলেছিল। ঘোড়ার লৌহজুতো বানাতে মানুষ তার কাছে আসত। তম্মধ্যে খ্রীস্টান-মুসলিম উভয়ই ছিল। তিনি খ্রীস্টানদের মন জয় করতে চেষ্টা করেন। অতি গোপনে তিনি খ্রীষ্টান পুনর্জাগরণ বাহিনী গড়ে তোলেন। তিনি সকলকে ফ্লোরার বাপ থেকে সতর্ক করেন। বলেন, রহস্যভেদী এ টিকটিকি থেকে সাবধান।
ফ্লোরার মা তার কাছে যাতায়াত করে থাকেন। পীরের আসনে বসান তাকে। তিনি হাশেমকে মনের খবরটা দিয়ে বলেন, কিছুতেই ইসলামকে মনে ঠাই দিতে পারছি না। আরো বলেন,
আমার স্বপ্ন নিছক স্বপ্নই নয়। সত্যিই এটি এক প্রাঞ্জল দিক নির্দেশনা।
হা! এটা নির্দেশনা। তবে স্বামীকে ইসলাম বৈরিতার ব্যাপারটা বুঝতে দিও না। পরবর্তীতে হাশেম তাকে বলেন, তুমি এখনো স্বামীকে উপেক্ষা করতে পার না। উপেক্ষা করলে মারা পড়বে।
স্বামীহীনা হতে চাই না। এ লোকটার সাথে আমার প্রেম ততটুকু যতটুকু খ্রীস্টত্বের সাথে। তার ছায়াতলে থেকেই খ্রীস্টত্বের মুক্তির জন্য সম্ভব সব কিছু করব, নয়ত আমি পাগল হয়ে যাব।
তুমি সন্তানের মা হতে চলেছ। ছেলে হোক মেয়ে হোক তাকে বাবার অজান্তে খ্রীস্টত্বের তালিকা দিও। তার হৃদয়ে মুসলিম বিদ্বেষ পয়দা করো এবং সে অবস্থায় ছেড়ে দিও। পরবর্তী সন্তানের বেলায় এই ঝুঁকি নিতে যেও না। কেননা তার বাবা জেনে যাবে। সে অবস্থায় তোমার পরিণতি খারাপ হয়ে যাবে। যে সন্তানকে তুমি খ্রীস্টান বানাবে নিজের ভবিষ্যৎ সে নিজেই গড়ে নেবে এবং তোমার আত্মার প্রশান্তি আনবে। খ্রীস্ট ধর্মের জন্য তুমি একটা কাজ করতে পার। তোমার স্বামী সরকারী গোয়েন্দা। তুমি তার প্রাইভেট সেক্রেটারী হয়ে ভেতরের খবরাখবর সংগ্রহ করে। তার কাছে অনবরত জানতে থাকবে, খ্রীস্ট ধর্মের বিরুদ্ধে তার প্রোগ্রাম কি। এতে পরিবর্তন আসছে কি-না? যদি আমাদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ দেখ তৎক্ষণাৎ আমাদের অবহিত করো।
হাশেমের এই কথায় যুবতীর আত্মিক প্রশান্তি আসে। রহস্যভেদী তার যে স্বামীর চোখ ভূগর্ভের ষড়যন্ত্রও উদ্ধার করতে পারত, প্রেমের আড়ালে তার স্ত্রী যে ইসলাম উ স্থাতের ষড়যন্ত্র করছে, ঘূর্ণাক্ষরেও তা জানতে পারল না।
***
ফ্লোরা ভূমিষ্ঠ হলো। বাবার রাখা নাম সম্পর্কে ইতিহাস নিশুপ। ফ্লোরার একটু বুঝসুঝ হলে মা তাকে শিক্ষা দিলেন, সত্য চিরন্তন ধর্ম সেতো খ্রীস্টান ধর্ম। ইসলাম কোনো ধর্মই নয়। ফ্লোরার বয়স এক বছর হলে তার একটি ভাই জন্ম নেয়। বছর দুয়েক পরে ওদের আরেকটি বোন হয়। ভায়ের নাম বদর। সে তার বাবার মত হয়। মার দৃষ্টি নিবদ্ধ থাকত ফ্লোরার ওপর।
১৩/১৪ বছর বয়সে ইসলামের প্রতি ফ্লোরার ঘৃণা এত চরমে পৌঁছে যে, সে তার বাবাকে বাবা ও ভাইকে ভাই ডাকা পর্যন্ত ছেড়ে দেয়। মা তাকে মজলুম খ্রীস্টানদের কাহিনী শোনাতেন, মুসলমানদের তিনি জালিম হিসেবে চিহ্নিত করতেন। মেয়েকে সে সব স্বপ্নের কথাও শোনাতেন যেগুলো তিনি বিয়ের প্রথম দিকে দেখে থাকতেন। ফ্লোরাকে কখনও বাইরে যেতে দিনে না। ও কোনো তথ্য ফাঁস করে দেয় কি-না ভয় কেবল এটাই। আশপাশের লোকেরা অকে মুসলিম ঘরানার সন্তান বলেই মনে করত।
সেই ফ্লোরার বয়স যখন ১৮ তখন বেলকনিতে দাঁড়িয়ে স্পেন শাসক আবদুর রহমানের বিজয় কাফেলা অবলোকন করছিল। তার চেহারা ক্রমশ কুঁচকে যাচ্ছিল ঘৃণায়। মা তাকে বললেন, ফৌজের চলার পথে ফুল ছিটিয়ে দাও, হ্যান্ডশেক করো। তোমার বারা নীচে কোথাও আছেন। তিনি এ.অবজ্ঞার কথা জানলে কিয়ামত কায়েম, করবেন। ফোরা মায়ের কথায় ক্ষেপে গিয়ে বলল, আমি কি ঐ দুশমন জাতির চলার পথে ফুল ছিটাব যারা মাদ্রিদের অলিগলিতে খ্রীস্টানদের রক্তে প্লাবিত করেছে? মা তাকে বললেন, রাগ সংবরণ করো মা! কিন্তু নিজের হাতে যে আগুন তিনি জ্বেলেছেন, তা নেভার নয়। যে ঘৃণা হৃদয়ে তিনি পয়দা করেছেন তা কভু মিটে যাবার নয়।
মা ফ্লোরা জানালার কপাট বন্ধ করে বলল, আমি এখন আর এ ঘরে থাকতে পারি না।
আরে বেকুফ নাকি! কোথায় যাবে তুমি?
কোনো গীর্জায় আশ্রয় নেব। যদি থাকি এখানে.তাহলে বাবা-ভাইকে হত্যা করেই।
মেয়ের মুখে সজোরে চপেটাঘাত করে মা বললেন, বাবা-ভাইকে হত্যা করার জন্যই কি তোকে আমি খ্রীস্ট শিখিয়েছি?
হ্যাঁ হ্যাঁ, ফ্লোরা চিৎকার দিয়ে বলল, এই শিক্ষাই তুমি আমার দিয়েছ যে, মুসলিম জাতি হিংস্র, বর্বর। ওরা খ্রীস্টের দুশমন।
মায়ের চোখে পানি এসে গেল। নিজের ভুলের প্রায়শ্চিত্ত অনুভব হলো তার। তিনি মেয়েকে মেহার্ভ কণ্ঠে বললেন, খ্রীস্টান ছেলের সাথে বিবাহ দেয়ার জন্যই তোমাকে খ্রীস্টত্ব শিক্ষা দিয়েছি। আমার রক্তের একটা ধারাকে খ্রীষ্টত্বের সাথে মিলাতেই তোমাকে খ্রন বানিয়েছি। আর তুমি কি-মা তোমার বাবাকে আমায় তালাক দেয়ার পথ সুগম করছে।
আমি খ্রীস্টান মা! শুধুই খ্রীস্টান। এটা মুসলমানদের ঘর। এ ঘরের প্রতি আমার প্রচণ্ড ক্ষোভ ও ঘৃণা। কামরায় একটি বজ্রকণ্ঠ শোনা গেল, কি কি বললে তুমি? তুমি খ্রীস্টান?
মা-মেয়ে চকিতে দরজার দিকে তাকাল। এখানে ফ্লোরার ভাই বদরকে দেখা গেল ওরা জানতে পারেনি বদর ছাদে উঠেছিল। সেখান থেকে নামার পথে এই কথা তার কানে যায়। ওর বয়স ১৭। এ বয়সে তাকে হ্যান্ডসাম হিরো মনে হয়। মা-বোন উভয়ের মাঝে এসে দাঁড়ায় সে।
ও অন্য কারো কথা বলছিল বেটা! শোন বলছি তোমাকে………..
তুমি নও আমিই বলছি ওকে। ফ্লোরা বলল, তুমি মিথ্যা বলবে না। অতঃপর সে ভাইকে লক্ষ্য করে বলল, সত্যিই আমি খ্রীস্টান। আমার স্বধর্মের লোকদের হত্যাকারীদের আমি ধর্ম গ্রহণ করতে পারি না। ফ্লোরা ইসলামের বিরুদ্ধে বড় মানহানির কথা বলল।
বদর অগ্রসর হয়ে বোনকে এত জোরে থাপ্পড় মারল যে, টাল সামলাতে না পেরে সে দেয়ালে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। সে অন্যান্য মেয়েদের মতই ক্রন্দন না করে হন হন করে অন্য কামরায় চলে গেল। ওপাশের কামরায় একটি তলোয়ারও দুটি বর্শ। বদর তার পিছু নিল। ফ্লোরা খাপ থেকে তলোয়ার বের করছিল, বদর গিয়ে ওর হাত থেকে তলোয়ার ছিনিয়ে নিল। চড়, কিল ও ঘুষি দিয়ে তাকে পালংক থেকে নীচে ফেলে দিল। মা ও ফ্লোরার ছোট বোন বদরের রাগ সংবরণ করতে ব্যর্থ হলো। ফ্লোরা আধাবেশ। মা ওকে জড়িয়ে ধরলেন।
***
বদর মাকে সাথে নিয়ে বেরোল এবং দরজায় ছিটকিনি বাইরে থেকে লাগিয়ে দিল। মাকে বলল,
মা ওর মনে খ্রীস্টত্বের প্রতি এত গভীর আকর্ষণ সৃষ্টি করেছে কে? নিশ্চয় তুমি জানো। মা তার সন্তানের মনের খবর জেনে থাকেন। এবার সে বোনকে বললো, তুই জানিস কিছু?
বোন অজ্ঞতা প্রকাশ করল। মা-ও একই কথা জানালেন। বদর বলল, আমার বাবাকে এ অজ্ঞতা জানিয়ে আশ্বস্ত করতে পারবে কি? ওর সাথে কোনো না কোনো খ্রীষ্টানের সাথে অতি অবশ্যই যোগাযোগ আছে।.ওর সাথে কোনো মুসলমানের সাথে সম্পর্ক হলে সে অবশ্যই খ্রীস্টন হত্যা নয়- জেহাদ বলে বোঝাত। মুসলমানরা এটাকে ধর্মযুদ্ধ মনে করে। মাড্রিঙ্গ কি হয়েছিল? তুমি তাকে পৈত্রিক প্রদেশ কতলুয়ানার কাহিনী শুনিয়েছে।.ওখানে লড়াই শুরু করেছিল কে? এর পূর্বে টলেডোয় কি হয়েছিল? আমর মুসলমান মা! ইসলাম প্রচার-প্রসার আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। মুসলমানদের কোরআন কাফেরদের ফেত্না মূলোপাটন করতে বলে, যতক্ষণ না ফেনা নির্মূল না হয়।
ক্রন্দন ছাড়া মা আর কোন জবাব দিলেন না।
বাবা আগামীকাল আসছেন। তিনি আসার আগ পর্যন্ত ওকে ওই ঘর থেকে বেরোতে দিও না।
গভীর রাত।
ফ্লোরার চোখে ঘুম নেই।
সন্ধ্যার দিকে ওর ছোট বোন খাবার নিয়ে এসেছিল, কিন্তু সে বলল, এ ঘরের পানি পানও আমার জন্য হারাম। শেষ পর্যন্ত মা এলেন। ফ্লোরা পূর্ববৎ বেঁকে বসল। গভীর রাতে ফ্লোরা পালংক থেকে নামল। বদ্ধ দরজায় লাগাল কান। ওপাশের কামরার তিনটি প্রাণী ঘুমের ঘোরে। কোথাও কোন সাড়াশব্দ নেই। জানালার ছিটকিনি খোলে সে। এখান থেকে নীচের দিকে তাকায়। লাফ দিয়ে নামা সম্ভব নয়। ফ্লোরার মৃত্যুভয় নেই। মুসলমানদের রক্তে হোলিখেলার প্রতিজ্ঞা নিয়ে ফেলেছে সে। ইতোমধ্যে জানালা পথে বেরিয়ে লঘুপায়ে পাশের বাড়ীর ছাদে যাওয়ার চেষ্টা করে। এক সময় বহু সতর্কতার সাথে সে ওপাশের বাড়ীর ছাদে পৌঁছায়। এবার ওই ছাদ থেকে কি করে নামা যায় চিন্তা কেবল সেটাই। ছাদ থেকে উঠানের দিকে তাকায়। চোখে ভেসে ওঠে কাঠের একটা সিঁড়ি। এ বাড়ীর বাসিন্দাদের ফ্লোরা চেনে। জনৈক বৃদ্ধের এক জোয়ান বেটা ও তার স্ত্রী থাকে। ঘর থেকে পালানোর সময় সে লম্বা একটা হোরা নিয়ে এসেছিল এতদসত্ত্বেও জোয়ান পুরুষের সাথে লড়াই করার শক্তি কৈ তার। মনে মনে ভয় পায় সে।
এ ভয় এক সময় বাস্তবে রূপ নিল। জোয়ান লোকটা ছাদে কারো পায়ের আওয়াজ শুনে উঠানে এলো। ছাদের দিকে গভীর নযরে তাকিয়ে দেখল কোনো মহিলা বিচরণ করছে। এক সময় সে তরতর করে সিঁড়িতে ওঠে। ফ্লোরা এবার গ্যাড়াকলে পড়ে গেল। পালানোর কোনো পথ নেই।
আচমকা একটি দুষ্ট বুদ্ধি তার মনে চেপে বসল। প্রেম অভিনয় এ মুহূর্তে বাঁচার একমাত্র মাধ্যম। লঘু পায়ে ফ্লোরা সিঁড়ি মুখে এগিয়ে গেল। যুবকটা সিঁড়ি বেয়ে উঠছে। হাঁটু চৌকাঠে রেখে ঝুঁকে ঠোঁটে হাত রেখে সে বলল, জোরে কথা বলো না। আমি ফ্লোরা।
ফ্লোরা? যুবক হতকিত হয়ে গেছে, তুমি এখানে?
ওপরে এসো বেকুফা চুপ থাকো।
আত্মসৌন্দর্যে বিমুখ ছিল ফ্লোরা। জোয়ানকে মায়াজালে আটকাতে তার সময় লাগল না। যুবকটির দিকে সে বড় চোখ করে তাকাতে লাগল। ফ্লোরার দৃষ্টি বলছিল, সে ক্ষুধার্ত, কোন যুবক যা মেটাতে পারে। গভীর এই নিশুতি রাতে তার আচমকা আবির্ভাব যুবকের জন্য অলৌকিকই বটে।
যুবক সম্বিত ফিরে পেয়ে বলল, তুমি এখানে কেন?
তোমার সাথে মিলন আছে। বলে সে যুবকের হাতে দুঠোঁট নামিয়ে দিল। আবেগাতিশয্যে বলল, হৃদয়ে এতদিন জগদ্দল পাথর চেপে বসে ছিলাম, শত প্রবোধ সত্ত্বেও মনকে বুঝতে পারলাম না। এইমাত্র স্বপ্নে দেখছিলাম তোমায়। চোখ খুলে গেলাম ঘাবড়ে। জানিনা কি সেই আকর্ষণ যা আমাকে এখানে ডেকে এনেছে। এসো কাছে এসো প্রিয়।
ফ্লোরা ভরন্ত যৌবনা। পিনোন্নত বক্ষ যুব সমাজকে হাতছানি দেয়। পুরুষ তাতে পুড়ে মরতে বাধ্য। ফ্লোরাকে সে বুক চেপে ধরল। ফুসফুস থেকে তার শ্বাস বের করে নিতে চায় যেন। ফ্লোরা যুবকের দেহে মিশে যায়। তার দীঘল কালো চুল যুবকের মুখে জড়িয়ে যায়। ফ্লোরা বলল, চলো বাইরে যাই! বাড়ীর কেউ জেগে গেলে বিপদ।
উভয়ে সিঁড়ি বেয়ে নামতে লাগল শিকারী বিড়ালের মত লঘুপায়ে।
*
যুবক নেহায়েত সতর্কতা অবলম্বনপূর্বক দরজা খুলল। তার বুড়ো বাবা ও যুবতী স্ত্রী টের পেল না। সে আগে চুলল, ফ্লোরা পেছনে। তার বাড়ী থেকে দূরে এসে দাঁড়াল। এই এলাকাটি অনাবাদী।
কোথায় যাবে? ফ্লোরাকে প্রশ্ন করল।
ও দিক।
সেদিক তারা চলতে লাগল। ফ্লোরা তার অজান্তে ছোরা বের করল। আগ বাড়িয়ে তার কাঁধে হাত রাখল। যুবক পেছনে ফিরতেই তার বুকে ছোরাটা আমূল ঢুকিয়ে দিল। ছোরাটা একটা ঢুকে গেল যে, ওটা বের করতে তাকে বেশ কষ্ট করতে হল। যুবক সামান্য আওয়াজ করারও সুযোগ পেল না। ফ্লোরার দিকে একবার বড় চোখ করে তাকিয়ে সে মুখ থুবড়ে পড়ল এবং শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করল।
আমি তোমাকে ঘৃণা করি ………ঘৃণা ………. শুধু ঘৃণা। মুবকের রক্ত জামায় মুছে হন হন করে ছুটতে লাগল।
***
গভীর রাতে ও স্পেন শাসক মহলে এসে পৌঁছাল। এদিকে তখন মহলে আলোকসজ্জা যা জমকালো রাতকে দিনে পরিণত করছিল। সর্বাগ্রে তিনচারজন কবি আবদুর রহমানের শানে চাটুকারিতামূলক কাব্যচর্চা করছিল। তাদের জমজমাট কাব্যে স্পেন শাসক দিগ্বিজয়ী বিশ্ব বিজেতা হিসেবে চিহ্নিত। তার তলোয়ারকে শেরে খোদার তলোয়ারের সাথে তুলনা কলেন। তাদের কাব্যের ভাষ্যে আবদুর রহমান ইহুদী নাসারাদের জন্য যমদূত। তার সামনে মাথা ওঠালে সে মাথা আর আস্ত থাকে না। তুমি মূর্তি হলে আমরা তোমাকে পূজা করতাম।
পরে সারিবদ্ধ খোশামোদীরা তাকে তোহফা পেশ করতে লাগল। দিতে লাগল চুমো, এ থেকে তার জুতোও বাদ যায় না। এরপর অর্ধনগ্ন নৃত্যশিল্পী নেচে গেয়ে তার মনোরঞ্জন করতে চেষ্টা করে। এদের সংগীত পরিচালক যিরাব।
আবদুর রহমানের ডান পার্শ্বে সুলতানা আর বামপার্থে মোদাচ্ছেরা। অন্যান্য বিবি ও বাদীরা পেছনে। বিজয়োৎসবের এই আসরে সমস্ত মালার স্বয়ং উপস্থিত। তারা শাসককে দেখছিলেন। তাদের ধারণা, এ আরেক আবদুর রহমান।
এ লোককে আমরা অভিযানে ব্যস্ত রাখতে চাই। বললেন আবদুর রউফ সালারদের।
তার কাছে জৌলুস ও ইন্দ্রীয়পরায়ণতার এত উপকরণ ভালো নয়।
উবায়দুল্লাহ বললেন,
চাটুকার কবির্গ শব্দের জাদুতে তাকে মোহিত করে চলেছে এবং ইসলামের শেকড় কাটছে। আমাদের দুশমন আড়মোড়া দিয়ে জাগছে। এগুলো বিষ, যা তিনি গিলে চলেছেন।
আমার যদ্দুর ধারণা, টলেডোর খ্রীস্টানরা জেগে উঠবে।
মূসা বললেন, বিদ্রোহের এই পরম্পরা উৎখাত করে যাব আমরা।
পন্থা এর একটাই- ফ্রান্সে হামলা, সম্রাট লুই এর-মস্তকচুর্ণ। এই লোক স্পেনের খ্রীস্টানদের মদদ দিয়ে চলেছে। সে স্পেনকে খণ্ডবিখণ্ড করতে চায়। বিদ্রোহীদের এক স্থানে কচুকাটা করলে অপরস্থানে ওরা মাথা তুলে দাঁড়ায়।
***
যখন স্পেন শাসক নৃত্য শিল্পীদের যৌন উন্মাতাল দেহের ভাজে ডুবে ছিলেন, যখন তার ভেতরের পৌরুষত্ব খাবি খাচ্ছিল তখন হাশেম কর্মকারের দরজায় করাঘাত পড়ল।. হাশেমের দেহে এক্ষণে আর সেই দম নেই, ফ্লোরার মা প্রথমদিকে আসায় যা ছিল। তখন ফ্লোরা তার মায়ের পেটে। ১৮ বছর পেরিয়ে গেছে। এক্ষণে তার চেহারায় যৌবনের ইতিহাস। ৫৫/৬০-এর মাঝামাঝি বয়স ছিল, দিল-দেমাগ অবশ্যই আগের চেয়েও তুখোড়। তার গুপ্ত দলের শেকড় বেশ বিস্তার লাভ করছে। মাদ্রিদের বিদ্রোহ দমন করা হলে তিনি অন্য কোথাও বিদ্রোহ করার পাঁয়তারা করছিলেন। তার এবারের দৃষ্টি টলেডো।
দরজায় করাঘত হলে তিনি চমকে ওঠেন। ড্রয়ারে লুকানো ছোরা নিয়ে বের হন এবং দরজা খোলেন। জনৈক তরুণীকে দেখে তার আক্কেল গুম।
আমি ফ্লোরা। বলে ফ্লোরা ফওরান ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, জনৈক মুসলিম প্রতিবেশীকে হ্যাঁ করে এসেছি। এসেছি বাড়ী থেকে পালিয়ে। বলো এখন কি করব? হাশেমকে সে পুরো ঘটনা জানিয়ে গেল।
ফ্লোরা ইতিপূর্বে বেশ কবারহাশেমের কাছে এসেছে। হাশেমও তাকে ইসলামের বিরুদ্ধে উকে দিয়েছে। প্রেম নিয়ে তার কোনো উচ্চাভিলাস নেই। তার প্রেম খ্রীস্টরে মাঝে, এর জন্যে সে পাগলপারা।
হাশেম বলল, আমি তোমাকে আমার কাছে রাখব না। সকাল হতেই এখানে লোকজনের আনাগোনা শুরু হবে। তোমাকে জনৈক পাদ্রীর কাছে নিয়ে যাব।
পীর দরজায় করাঘাত পড়তে তিনিও চমকে ওঠেন। কে আসতে পারে এখন? মাদ্রিদ বিদ্রোহে পত্রী-গ্রেফতারের হিড়িক পড়লে এদের সকলে ভয়ার্ত ছিলেন। কিন্তু দরজা খুললে প্রাণে পানি এলো। দেখলেন জনৈক সুন্দর যুবক ও বৃদ্ধ একলোক। যুবক ভেতরে ঢুকে আচকান ও ছদ্মবেশ খুলে ফেলল। হাশেম বলল,
ও ফ্লোরা। ওর সম্পর্কেই আপনাকে ইতিপূর্বে অবহিত করেছি। ওর মা আপনার সাথে বেশ কবার সাক্ষাৎ করেছেন। মেয়েটা আজ ঘর থেকে পালিয়ে এসেছে। হাশেম পুরো ঘটনা তাকে শুনিয়ে গেলেন।
বৃদ্ধ পাদ্রী ফ্লোরার রূপে মুগ্ধ হয়ে গেলেন।
তুমি খুবই সুন্দরী ফ্লোরা। স্পেন শাসকদের শেষ করতে তোমার এ রূপ কাজে লাগবে। তুমি সালারদের মাঝে দ্বন্দ্ব লাগাতে পার। তোমার এক চিলতে মুচকি হাসি মুসলিম সালারদের রণাঙ্গনে আমাদের কয়েদী বানাতে পারে। বর্তমান স্পেন শাসক তোমার মতো তাক লাগানো সুন্দরী পেলে হৃদয় থেকে স্পেনকে মুছে দিতে পারে এটাই তার দুর্বলতম দিক। তুমি তাকে ও তার সালারদের মাঝে ঘৃণা সৃষ্টি করতে পার, কিন্তু এর জন্য তোমাকে……।
ইজ্জত খোয়াতে হবে এই তো। কিন্তু আমি আমার কুমারীত্ব খোয়াতে চাই না। কুমারী মরিয়মের দাসী আমি। জানি, মুসলিম শাসক, সালার, আমীর-উজিররা সুন্দরী নারী রক্ত-মাংসের ঘ্রাণ পেলে নিজ দায়িত্ব ভুলতে বসে। কিন্তু কোনো মুসলমানের ঘ্রাণ নিতে পারব না আমি।
আমাকে ভাবতে দাও ফ্লোরা। এখানে তুমি নিরাপদ থাকবে। নিজকে সংযত কর, আবেগ তাড়িতের পরিণাম ভাল হয় না। বলে পাদ্রী হাশেমকে জিজ্ঞেস করলেন, আর কোনো খবর,
পরিস্থিতি বিস্ফোরনোমুখ। আমি কর্মকার, আমি লোহা ঠাণ্ডা করা অপেক্ষা গরম করার পক্ষপাতী। লোহা কিভাবে গরম করতে হয় তা আমার জানা আছে। মাদি থেকে বহুলোক টলেডো পালিয়ে গেছে। আমার লোকজন ওখানে হাজির। ওরা নেতৃত্বে আমাকে চাইছে। ভাবছি কি করি।
ভেবো না হাশেম। পাদ্রী বললেন, প্রদেশটা তোমার। অতএব নেতৃত্বও তোমাকে নিতে হবে। জানি জঙ্গী নেতৃত্ব দেয়ার অভিজ্ঞতা নেই তোমার, কিন্তু তোমার বুদ্ধিমত্তা অজেয়-বিরল। লোকদের আবেগে তুমি ঘৃতাহুতি দিতে পার। এমন যোগ্যতা আর কারা মাকে দেখছি না আমি। তুমি না হয় একবার টলেডো ঘুরে এসো। ওখানে এলোগেইছ কিংবা ইলিয়ার কারো না কারো সাথে দেখা হবে।
কিছুক্ষণ আগে শুনতে পেয়েছি, আবদুর রহমান বিজয়োৎসবে গলা অবধি ডুবে গেছেন। সুলতানা আজ তাকে নয়া শরাব দিয়েছেন। স্পেন শাসক বিলাসিতার রসিক কিন্তু শরাব পান করেন না। আমি শুনেছি মোদাচ্ছে নারী তার এক স্ত্রী রয়েছে, সে তাকে মুঠোয় পুরেছে। সুলতান শবতের মধ্যে আজ পাব মিশ্রণ করে দেবে।
ওই শাসককে নিয়ে আমাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। মাথাব্যথা যত তার সালারদের নিয়ে। এসব সালারদের সামনে স্বর্ণবাপ ফেলতে হবে। ফ্লোরার মত নারীদের পেশ করতে হবে। তথাপিও দেখবেন ওরা পাথরের মূর্তি। ওরা বড্ড স্বাধীনচেতা। স্পেনের সিংহশাসক। স্বাধীনতাকে ঈমানের অংশ মনে করে।
কিন্তু এই সালারদের মাঝে ক্ষমতার লোভ পয়দা করতে পারলে দেখবে ওদের সেনাবল নষ্ট হয়ে যাবে। সালার ক্ষমতায় এলে বাদশাহ হয়ে যায়। এবং দুশমনকেও দোস্ত ভাবা শুরু করে। ফলে এদের কোনো ধর্ম থাকে না। কোনো জাতিকে ধ্বংস করতে হলে তাদের নেতৃস্থানীয় লোকদের মাঝে ক্ষমতার বাসনা পয়দা করে দাও। ওরা একে অপরের রক্তলোলুপ হয়ে উঠবে। ফলে জাতি ক্ষুধার্ত থাকবে চারিত্রিক অবক্ষয় দেখা দেবে, প্রতাপে ভাটা পড়বে।
এদিকেও একটু খেয়াল করবেন। টলেডোর পরিস্থিতি উত্তপ্ত রাখতে হবে। এবার এ তরুণীকে সামলান। আমি যাচ্ছি। বলে হাশেম বেরিয়ে গেল।
***
ফ্লোরাও প্রতিবেশীর ঘরের সকলে বিমর্ষ, পেরেশান। ফ্লোরা নেই। নেই বৃদ্ধের জোয়ান পুত্রও। পুরুষ হওয়ায় বৃদ্ধ ভাবলেন তার ছেলে ফিরে আসবে। কিন্তু ফ্লোরা তো মেয়ে। সে বদ্ধঘরের জানালা পথে পালিয়েছে। সে পথে পালানো খুব সহজ নয়।
জোরার জোয়ান প্রতিবেশী বাড়ীতে এলো। জিন্দা নয়; মুর্দা হয়ে। লোকালয়ের উপকণ্ঠে ঘেরাবিষ্ক তাকে উদ্ধার করা হয়েছে। স্বপিন্ডে তার আঘাত। ফ্লোরা যে তার হতা, ও সন্দেহটুকু কারো হয়নি।
ফ্লোরার বাবা এলেন। বদর তাকে বোনের যাবতীয় কাহিনী ও খ্রীস্টান হবার কথা জানান। ফ্লোরার মাকে বাবা বললেন, ওর অন্তর্ধানে তোমার হাত রয়েছে অবশ্যই। তুমি মোয়াল্লেদ হয়েছে বলে আমার ধারণা। বিগত ২০ বছর ধরে আমাকে ধোঁকা দিয়ে আসছ।
না’ জোড় হাত করে স্ত্রী স্বামীর পদতলে লুটিয়ে পড়লেন, আমাকে অপবাদ দেবেন না। আমি আপনাকে ধোঁকা দেইনি। নিজ হাতে আমাকে হত্যা করুন তবুও আমার প্রেমের প্রতি সন্দিহান হবেন না। খুব সম্ভব খ্রীষ্টান মেয়েদের সাথে মিশে ওর এই দশা। ওরাই ওর দেমাগ খারাপ করে দিয়েছে। বদর ওর ওপর অমানুষিক অত্যাচার চালিয়েছে- পালাবার কারণ এও হতে পারে। পানিতে ডুবে মল কি-না কে জানে।
আমি ফ্লোরাকে দীর্ঘদিন ধরে দেখে আসছি। আমার অপর দুসন্তানের চেয়েও কেমন যেন ভিন্ন ধাতুর। কখনও নামায় পড়তে দেখেনি। তিনি খানিক চিন্তা করে বললেন, আমি এক গোয়েন্দা। বুঝতে বাকী নেই, কোখা গেছে ও। সিংহশাবক
তিনি পুত্রকে সঙ্গে করে বেরিয়ে গেলেন। চাপলেন বাপ-বেটা পৃথক দুটি ঘোড়ায়। সাথে নিলেন জনাচারেক সৈনিক। গিয়ে উঠলেন একটি গীর্জায়। ওখানকার পাত্রীকে বললেন, রাতে জনৈকা তরুণী তোমার এখানে এসেছে। তাকে তাড়াতাড়ি বের করে দাও।
আপনি গীর্জা ও আমার বসত-বাড়ী তল্লাশি করে দেখতে পারেন। পাদ্রী অনুনয় করে বললেন,
তরুণীর সাথে আমার সম্পর্ক কিসের?
সৈনিকরা এই পাদ্রীকে গ্রেফতার করল। গেল আরেকটি গীর্জায়। এই গীর্জায় পাদ্রীও পূর্বের পাদ্রীর মত অজ্ঞতা প্রকাশ করলেন।
আমরা জানি গীর্জাগুলো আজকাল যড়যন্ত্রের আখড়ায় পরিণত। ফ্লোরার বাবা বললেন, একে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে চলো।
সৈনিকরা তাকে চ্যাংদোলা করে নিয়ে চলল। প্রথম পাদ্রীও এদের সাথে। এদের ওপর অত্যাচার শুরু করলে আচমকা একটি নারীকণ্ঠ সকলকে হতবাক করে দিল, আমার ধর্মগুরুদের ছেড়ে দাও। আমাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে চলো।
কণ্ঠটি ফ্লোরার। সে বলে চলেছে, আমি তাদের অপমান সইতে পারি না। তাই স্বেচ্ছায় ধরা দিয়েছি।
বদর তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। মেরে আধামরা করে ফেলল, কিন্তু সে কাঁদল না, চিৎকার দিল না, কাউকে সাহায্যও করতে বলল না। বলছিল, আমি খ্রীস্টান। কুমারী মরিয়মের দাসী। এমন কি ইসলামের নামে যাচ্ছেতাই গাল দিল।
থামো। সৈনিক বলল, ধর্ম ব্যক্তিগত ব্যাপার এজন্য তাকে শাস্তি দেয়া যায় না। তবে ইসলামের অপমান অবশ্যই শাস্তিযোগ্য অপরাধ। দেশের প্রচলিত আইনে তার সাজা হবে। তাকে আদালতে ওঠাব আমরা।
আদালতে ওঠানো হলে ফ্লোরা ইসলামের নামে আপত্তিকর অশ্লীল মন্তব্য করল। বিজ্ঞ কাজী বললেন, তুমি মৃত্যুদণ্ডের যোগ্য। সুন্দরী বলে তোমায় ছেড়ে দিয়ে আরেক ফেনার আশংকা রয়েছে।
বাবার, হৃদয়ে এবার সন্তানের প্রেম উথল উঠল। আর যাই হোক ফ্লোরা তার মেয়েতো। তিনি ঠিক আদালতের সামনে আর্জি পেশ করলেন, আদালত যদি তার ক্ষমা মঞ্জুর করে তাহলে আমি ওর জামিন নিতে পারি। ও আমার কলজের টুকরা। সঠিক রাস্তায় আনতে পারব বলে আমার বিশ্বাস।
আদালত এই আর্জি কবুল করছে। কিন্তু এক বছরের মত তাকে ঘরে নজরবন্দী করে রাখত্বে যুব। সেখানে থাকবে নারী-প্রহরা যারা তাকে দীক্ষা দেবে।
ফ্লোরাকে একটি ঘরে আটকে রাখা হলো। দেয়া হলো তার প্রহরা হিসেবে সুশিক্ষিতা তিন নারীকে। ফ্লোরা নির্লিপ্ত হয়ে গেল। সে কেবল জছে, পালানোর উপায়।