০২. প্রাচীন যুগ থেকে মধ্যযুগ : বিশ্বজুড়েই যুদ্ধাভিযান এবং রক্তধারা
মধ্যযুগ (The Middle Ages) হল ইউরোপীয় ইতিহাসের একটি সময়কাল। এটি ৪৭৬ সাল থেকে শুরু হয়েছে, যে সময়ে রোমান সাম্রাজ্যের সমাপ্তি ঘটেছিল এবং ১৪৯২ সালে ক্রিস্টোফার কলম্বাসের নবজগত আবিষ্কারের পূর্ব পর্যন্ত গিয়ে শেষ হয়েছে। একে মধ্যযুগ বলার কারণ হল, সেই সময়, যখন কিনা সাম্রাজ্যবাদী রোমের পতন ঘটে এবং প্রাচীন আধুনিক ইউরোপের সূচনা হয়। এই সময়কালকে মধ্যযুগীয় সময় (Medieval Age), অন্ধকারের যুগ (the Dark Ages) এবং (ইসলাম এবং খ্রিস্টধর্মের উত্থানের কারণে) আধ্যাত্মিক বিশ্বাসের যুগও (the Age of Faith) বলা হয়। সংকীর্ণভাবে ব্যবহৃত হলে, অন্ধকারের যুগ বলতে ৪৭৬ থেকে ৮০০ সালকে বোঝানো হয়, যে সময়ে চার্লিম্যাগ্নি সিংহাসনে আরোহণ করেছিলেন। ভারতের যুগ বিভাজনটা একটু অন্যরকম। ইউরোপীয় বিভাজনের মতো নয়। একটু দেখে নেওয়া যাক— (১) প্রাচীন। ভারতের ইতিহাস। (প্রস্তর যুগ থেকে ১২০৬ সালে পর্যন্ত) (২) মধ্যযুগের ভারতের ইতিহাস।(১২০৬ থেকে ১৭৫৭ বা ১৮৫৭ সালে পর্যন্ত ) (৩) আধুনিক ভারতের ইতিহাস। (১৮৫৭ সাল থেকে ১৯৬৪ বা বর্তমান সময় পর্যন্ত)।
ইতিহাসে পড়েছি মধ্যযুগ মানে অন্ধকার যুগ। পঞ্চম শতকে রোম সভ্যতার পতনের পর প্রায় ১০০০ বছর ইউরোপে নেমে আসে অজ্ঞানতার অন্ধকার। পঞ্চম শতক থেকে চতুর্দশ শতককে তাই বলা হয় ‘অন্ধকার যুগ’। সত্যিই কি তাই? মধ্যযুগ অন্ধকার যুগ ছিল ইউরোপের ক্ষেত্রে। কিন্তু বাকি বিশ্বের ক্ষেত্রে বিশেষণ সত্যি ছিল না। যেমন পঞ্চম শতকে রোমান সাম্রাজ্যের পতনের সময় থেকে পঞ্চদশ শতককে সাধারণ ইউরোপের মধ্যযুগ বা অন্ধকারময় যুগ বলা যায়। গোটা বিশ্বেই এটা বলা হলেও দেশ হিসাবে সময়কাল পৃথক পৃথক। বোঝাই যায় এ নির্ণয় সুপরিকল্পিত। যেমন ভারতের যে মধ্যযুগকে অন্ধকার যুগ বলা হয়, সে যুগটি মূলত মুসলিম শাসনের যুগ। এটাও সুপরিকল্পিতভাবেই নির্ণয় করা হয়েছে। অন্ধকার যুগ কেন? স্বর্ণযুগই-বা নয় কেন? আসলে এটা ছিল মুসলমানদের স্বর্ণযুগকে আড়াল করার অভিসন্ধি। ৭৫০ সাল থেকে ১২৫৮ সাল পর্যন্ত সময় ইসলামের স্বর্ণযুগ বা ইসলামী রেনেসাঁ হিসাবে পরিচিত। কিন্তু এটা ভুলিয়ে দেওয়া হল, যাতে ভারতের মুসলিমরা কোনোভাবেই নিজেদেরকে গৌরবান্বিত বোধ করতে না-পারে। অথচ ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় মুসলিম শাসনের যুগ মূলত আলোকিত যুগ, যা আধুনিক বৈজ্ঞানিক যুগের অগ্রদূত হিসাবে কাজ করেছে। যেটাকে আধুনিক যুগ বলা হয়, তা শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এই মধ্যযুগের ভিতের উপর। অস্বীকার করবেন কীভাবে? আধুনিক যুগ যেমন শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এই মধ্যযুগের ভিতের উপর, ঠিক তেমনি মধ্যযুগও শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে প্রাচীন যুগের ভিতের উপর। মাঝখান থেকে মধ্যযুগকে উড়িয়ে দিলে আধুনিক যুগ মুখ থুবড়ে পড়বে। আসলে একটি গভীর চক্রান্ত থেকে মধ্যযুগকে অন্ধকার ও বর্বর যুগ হিসাবে আখ্যা দেওয়া হচ্ছে। একইসঙ্গে ইসলামকে জ্ঞান বিজ্ঞান ও প্রগতির পথে একটি অন্তরায় হিসাবে বিবেচনা করা হচ্ছে। কিন্তু চাইলেই সব পারা যায় না। ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে, মধ্যযুগে মুসলমানদের অগ্রগতির পিছনে ইসলাম ছিল মূল চালিকাশক্তি। শুধু বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি নয়; অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামরিক ও সংস্কৃতিতে মুসলমানরা ছিল অপ্রতিদ্বন্দ্বী। এ যুগের প্রতি ইতিবাচক ধারণা পোষণ করার মানে হল বিজ্ঞানে মুসলমানদের শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করে নেওয়া। মুসলমানদের বিরুদ্ধে ক্রুসেড পরিচালনাকারীদের পরবর্তী প্রজন্ম অত্যন্ত সুচিন্তিতভাবে মধ্যযুগের সত্যিকার ইতিহাস বিকৃত করার চেষ্টা করেছে। ক্রুসেড বিষয়ে পরে আলোচনা করব।
অধ্যাপক জি. সারটন তার ‘Introduction to the history of science’ গ্রন্থে অকপটে তা স্বীকার করেছেন। তিনি বলেন— “সংক্ষেপে বলতে গেলে অত্যন্ত দুর্বল সূত্রের উপর জোর দেওয়ায় এবং পাশ্চাত্য ধ্যান-ধারণার প্রতি একান্তভাবে অনুগত থাকায় ইতিহাস বিশারদগণ মধ্যযুগের বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারা সম্পর্কে আমাদেরকে পুরোপুরি মিথ্যা ধারণা দিয়েছেন। মধ্যযুগেই প্রাচ্যবাসীরা শ্রেষ্ঠতম অগ্রগতি অর্জন করেছিল। ইতিহাসবিশারদগণ মধ্যযুগকে একটি অন্ধকার যুগ হিসাবে আখ্যায়িত করার প্রচলিত ধারণা বাতিল করার পরিবর্তে বরং তাঁরা এ ধারণাকে আরও জোরালো করতে সফল হয়েছেন। বস্তুতপক্ষে মধ্যযুগ ছিল অন্ধকার। তবে অধিকাংশ ঐতিহাসিক আমাদের কাছে এ সময়ের কেবলমাত্র অন্ধকারময় দিকটিই তুলে ধরেছেন (শিল্প হল একমাত্র ব্যতিক্রম)। এ যুগ কখনও আমাদের অজ্ঞতার চেয়ে বেশি অন্ধকার ছিল না।” অধ্যাপক জি, সারটন আরও লিখেছেন— “এখানে মুষ্টিমেয় কিছু নাম উল্লেখ করাই যথেষ্ট হবে। সমসাময়িককালে পাশ্চাত্যে তাঁদের সমতুল্য কেউ ছিল না। তারা হলেন— জাবির ইবনে হাইয়্যান, আল কিন্দি, আল খাওয়ারিজমি, আল ফরগানি, আল রাজি, সাবেত ইবনে কোরা, আল বাত্তানি, হুনাইন ইবনে ইসহাক, আল ফারাবি, ইব্রাহিম ইবনে সিনান, আল মাসুদি, আল তাবারি, আবুল ওয়াফা, আলি ইবনে আব্বাস, আবুল কাসিম, ইবনে আল জাজারি, আল বেরুনি, ইবনে সিনা, ইবনে ইউনুস, আল কাশি, ইবনে আল হাইসাম, আলি ইবনে ঈসা আল গাঁজালি, আল জারকাব, অমর খৈয়াম। গৌরবোজ্জ্বল নামের তালিকা দীর্ঘ করা মোটেও কঠিন হবে না। যদি কেউ আপনার সামনে উচ্চারণ করে যে, মধ্যযুগ ছিল বৈজ্ঞানিক দিক থেকে অনুর্বর, তাহলে তাঁর কাছে এসব নাম। উল্লেখ করুন। তাঁদের সবাই ৭৫০ থেকে ১১০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত একটি সংক্ষিপ্ত সময়ে সমৃদ্ধি লাভ করেছিলেন।”
মধ্যযুগীয় বর্বরতা’ –এই শব্দবন্ধনী সুশীল সমাজের অনেকেই মধ্যযুগ’ আর ‘বর্বরতা’-কে সমার্থক বিবেচনা করে থাকে। এটা মূলত অমানুষিক ও নির্দয় কার্যকলাপকে ‘মধ্যযুগীয় বর্বরতা’ বলে বিশেষায়িত করার প্রবণতা। কারও নীতি-আদর্শ ও চিন্তাধারার নিন্দা করতেও এই বাগধারাটি হামেশাই ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এখন প্রশ্ন জাগতে পারে, ইতিহাসের কোন্ সময়টি আসলে মধ্যযুগ? সেই সময়ে কিই-বা এমন ঘটেছিল, যার জন্য প্রাচীন ও প্রাগৈতিহাসিক এবং ঔপনিবেশিকতার কালপর্ব ছাপিয়ে ‘মধ্যযুগের বর্বরতা’ অমোচনীয় হয়ে গেছে?
ঐতিহাসিকরা ৫০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৫০০ শতাব্দী পর্যন্ত কালপর্বকে মধ্যযুগ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই হাজার বছরের ইতিহাস বিশ্বময় ইসলাম ধর্মের প্রসার এবং মুসলমান শাসকদের বিজয়গাথায় পরিপূর্ণ হয়েছে। একথা দ্বিধাহীনভাবে বলা যায়। আরবের ‘আইয়ামে জাহেলিয়াত’ বা ‘অন্ধকার যুগ’-এর অবসান ঘটে মধ্যযুগের ঊষাকাল ৬১০ সালে হজরত মোহাম্মদের আন্দোলনের মাধ্যমে। এসময়েই আরববাসীরা কোরান প্রাপ্ত হয়। মদিনায় রাষ্ট্রগঠন এবং মক্কা বিজয়ের মধ্য দিয়ে অবসান ঘটে আরবের বর্বর যুগের। খোলাফায়ে রাশেদিনের দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমরের খিলাফতের সময়ে সূচিত হয় ইসলামের বিজয় অভিযান। ইসলামের প্রেরণায় গোটা মধ্যপ্রাচ্যে পুনর্জাগরণ ঘটে। ফিলিপ কে. হিট্টি লেখেন, “হাজার বছর পাশ্চাত্য অধীনতায় থাকার পর পুনরায় আত্মপ্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল গোটা মধ্যপ্রাচ্য।” পতন ঘটে রোম সাম্রাজ্যের। বাইজেনটাইন ও পারস্য সাম্রাজ্য মুসলিম খেলাফতের অধীনে চলে আসে। মধ্যযুগের ইতিহাস এমন নয় যে, অবিমিশ্র সুখ ও সমৃদ্ধির। আবার এমনও নয় যে, বর্বরতা ও স্বেচ্ছাচারিতায় ইতিহাসের সমস্ত কালপর্বকে ছাপিয়ে গিয়েছিল। মানবিকতা ও বর্বরতা, সুশাসন ও স্বেচ্ছাচারিতা, উৎকর্ষ ও অনুকৃষ্টতা সবকালেই কমবেশি ছিল এবং আছে। কিন্তু ইসলাম ও মুসলমানদের বিকাশ ও বিজয়ের সহস্র বর্ষকে পাশ্চাত্যের ইতিহাসবিদগণ বর্বরতার যুগ হিসাবে কেন বিশেষায়িত করেছেন তা সহজেই অনুমেয়। অথচ এই মধ্যযুগে জ্যোতির্বিজ্ঞান, রসায়ন, শিল্প-সাহিত্য ও দার্শনিক চিন্তার বিপুল বিকাশ ঘটে।
এ তো গেল আরবের কথা, আমরা যদি ভারত উপমহাদেশের প্রেক্ষাপটে মধ্যযুগের মূল্যায়ন করি, তাহলে দেখতে পাওয়া যায় উৎকর্ষ অর্জনের অব্যাহত প্রয়াস এ সময়েই। মধ্যযুগে আমাদের এই উপমহাদেশ কোন অখণ্ড সাম্রাজ্যভুক্ত ছিল না। ছিল অসংখ্য শাসক আর অসংখ্য ক্ষুদ্র-বৃহৎ রাষ্ট্র, যা ছিল রাজার রাজ্য। পঞ্চম শতাব্দীতে গুপ্তযুগকে সুবর্ণযুগ বলা হলেও গুপ্তযুগের শাসনও হীনবল হতে শুরু করেছিল। ১১০০ শতাব্দী আগে পর্যন্ত এই উপমহাদেশে মুসলমান শাসকের আগমন তেমনভাবে ঘটেনি। ১১০০ এবং ১২০০ শতাব্দী নাগাদ ভারত উপমহাদেশের বেশিরভাগ অঞ্চলই মুসলিম শাসকদের দখলে চলে যায়। মুসলিম বিজয়ের পর ভারত উপমহাদেশে সামাজিক ও রাজনেতিক সম্পর্কের নতুন মেরুকরণ শুরু হয়ে যায়। হিন্দু-মুসলিম বৌদ্ধদের মেলবন্ধন রচিত হতে শুরু করে এই সময়েই। বিদেশাগত মুসলমানরা যেমন এই অঞ্চলের সনাতন সংস্কৃতির অনেক কিছুই মেনে নেয়, তেমনই সনাতন ধর্মাবলম্বীরাও বহিরাগত ইসলাম জীবন-সংস্কৃতির বহু কিছু আপনার করে নেয়। এটাও ভারত উপমহাদেশে নতুন বিষয় নয়। বহিরাগতের আগমন এই উপমহাদেশে এর আগেও প্রচুর মানুষ এসেছে এবং আদি বাসিন্দারা তাঁদের বরণ করে নিয়েছে। সেই বহিরাগত মানুষরাও অতি দ্রুত মিশে গেছে উভয়ের সংস্কৃতি বিনিময়ের মধ্য দিয়ে যেমন, তেমনই ভারতীয় সভ্যতায় গ্রিক সভ্যতার প্রভাবও কোনোভাবেই অস্বীকার করা যাবে না।
আর-একটু পিছন দিকে যদি হাঁটি তাহলে দেখতে পাবো ভারত উপমহাদেশে আর্যরা তাঁদের প্রতিষ্ঠিত বিশাল সাম্রাজ্যে ধর্মভিত্তিক মতবাদের হানাহানিতে লিপ্ত ছিল। সেই হানাহানি ব্রাহ্মণ্যবাদ ও বৌদ্ধবাদের মধ্যে, ব্রাহ্মণ্যবাদ ও চার্বাকবাদের মধ্যে। বারবার যুদ্ধবিধ্বস্ত হয় ভারত উপমহাদেশ। যে যুদ্ধের ভয়ংকর রূপে ফুটে উঠেছে রামায়ণ, মহাভারত ও পুরাণগুলিতে। তারপর গ্রিক আলেকজান্ডারের ভারত অভিযানের ফলে এই হানাহানিতে যুক্ত হল নতুন মাত্রা। সিন্ধু ও পাঞ্জাবে কিছুকালের জন্য প্রতিষ্ঠিত হল গ্রিকদের শাসন। রামায়ণ, মহাভারত ও পুরাণগুলিতে আমরা যে যবনদের উল্লেখ পাই, সেই যবন আসলে এই গ্রিকরাই। আর্যরা গ্রিকদেরই ‘যবন’ বা ‘ম্লেচ্ছ’ বলে ঘৃণার চোখেই দেখত। এরপর ভয়ংকর হুন সম্প্রদায় এই উপমহাদেশে ঢুকে পড়ে এবং পাঞ্জাব, রাজপুতানা এবং মালব এলাকায় সাম্রাজ্য স্থাপন করে। এই দুর্ধর্ষ বিদেশাগতরা ছিল আর্যদের মতো মধ্য এশিয়ার এক যাযাবর জনগোষ্ঠী। এদের রাজত্বের অবসান হয় আনুমানিক ৫৩২ সাল পর্যন্ত। হুনশক্তির অবসানে ভারত উপমহাদেশে চারটি শক্তির উদ্ভব ঘটে– (১) গৌড়রাজ্যে রাজা শশাঙ্ক প্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্মণ্যবাদী শক্তির উত্থান, (২) থানেশ্বর বর্ধনবংশীয় বৌদ্ধশক্তি, (৩) কনৌজে মৌখরী বংশীয় বৌদ্ধশক্তি এবং (৪) মালবে কনিষ্ঠ গুপ্তবংশীয় ব্রাহ্মণ্যবাদী শক্তি। সপ্তম শতকের প্রথমার্ধ কেটে যায় গৌড়রাজ শশাঙ্ক আর থানেশ্বররাজ হর্ষবর্ধনের মধ্যে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে। এ সময় গোটা উপমহাদেশে বিভিন্ন বংশের নামে অসংখ্য রাজ্য প্রতিষ্ঠা হল। এ সময় বা তারও আগে থেকেই ব্রাহ্মণ্যবাদ ও বৌদ্ধবাদে হানাহানিতে সম্পূর্ণভাবে বিপর্যস্ত হয়ে গেল বৌদ্ধশক্তি। গোটা উপমহাদেশের স্বতন্ত্র সংস্কৃতির একটা জোড়াতালির সমন্বয়ে ব্রাহ্মণ্যবাদ প্রভাবিত যা কিছু বিধিবিধান, তা হিন্দুধর্ম হয়ে সাধারণ আচার-সর্বস্ব হয়ে গেল। ওই সময়ের মানুষ ভুলেই গেল গৌরবোজ্জ্বল বৈদিক যুগের কথা। সাধারণ মানুষের ঘাড়ে নেমে এলো চরম লাঞ্ছনার যুগ। বিশেষ করে শূদ্র ও বৌদ্ধদের জীবন বিষময় হয়ে উঠল। ঠিক এ সময়ে মুসলিম প্রবেশের ফলে ব্রাহ্মণ্যবাদীরা হুমকির মুখে পড়ে গেল। চার্বাক, বৌদ্ধ ধ্বংস করা বিজয়ী ব্রাহ্মণ্যবাদী রাজারা এবার বিজিতের দলে।
যাই হোক, গোটা মধ্যযুগ ব্যাপী ভারত উপমহাদেশে দেখা যায় শক্তিশালী গ্রামীণ সমাজ এবং সামাজিক শৃঙ্খলা অবশ্যই ছিল। শাসকরাও প্রচুর জনকল্যাণকর কাজ করেছেন। প্রজাপালনে তাঁদের যথেষ্ট নজর ছিল। সুলতানি আমলে এই উপমহাদেশে বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষা ও সাহিত্যের সবিশেষ উৎকর্ষতাও লাভ করে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্য এই সময়ে নবতর বিকাশের পথ খুঁজে পায়। অসংখ্য সাহিত্য রচিত হয়েছে সুলতানদের তত্ত্বাবধানে। বেশিরভাগই ধর্মসাহিত্য। হিন্দুরা যেমন হিন্দুদের ধর্ম নিয়ে সাহিত্য রচনা করেছেন, মুসলিমরাও হিন্দুধর্ম বিষয়ক সাহিত্য রচনা করেছেন। যেমন হোসেন শাহের সেনাপতি ও চট্টগ্রামের শাসনকর্তা পরাগলি খাঁর নির্দেশে কবীন্দ্র পরমেশ্বর ‘পাণ্ডববিজয় কাব্য’ বা পরাগলি মহাভারত রচনা করেছিলেন।
এরপর ঐতিহাসিক ম্যাগনাকাটা সনদের মাধ্যমে ব্রিটেনের রাজনীতির নতুন বিকাশ ঘটাতে যাত্রা শুরু করে। তারপর এটাও অসত্য নয় যে, মধ্যযুগে বিশ্বের কোনো কোনো অঞ্চলে নৃপতি এবং সামন্ত শ্রেণির দ্বারা অত্যাচার-শোষণ অব্যাহত ছিল। আর এই উপমহাদেশে বৈদিক যুগ থেকে চলে আসা ক্রীতদাস প্রথাও বহাল ছিল যথারীতি। ছিল সতীদাহ প্রথার অসংখ্য কুপ্রথা। এইসব নৃশংসতা ও অমানুষিকতার কোনোটিই কিন্তু মধ্যযুগের সৃষ্ট নয়, সর্বব্যাপীও নয়। দেশ-কাল ও পাত্রের প্রভেদ ছিল। কাজেই কোনো একটি যুগকে বিশেষায়িত করার আগে ইতিহাসের নিবিড় পাঠ একান্ত প্রয়োজন।
এ-কথা সত্য, মধ্যযুগে যুদ্ধ, সাহিত্য, রাজনীতি, ধর্মের বিকাশ, জীবনাচরণের পরিবর্তন ইত্যাদি সব কিছুরই যেন মোড় ঘুরে যায়। পরিবর্তনের যুগসন্ধিক্ষণ বলা চলে। বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকেই মধ্যযুগ বাক্যটি বিভিন্ন কথা-বার্তায়, পত্র-পত্রিকায় ও ম্যাগাজিনে ব্যাপক উচ্চারিত হয়ে আসছে। তবে এই উচ্চারণটি এখনও পর্যন্ত ঘৃণ্য আকারেই উচ্চারিত হয়ে আসছে। একদল কূপমণ্ডুকতার আশ্রয় গ্রহণকারী শিক্ষিতজনেরা মধ্যযুগ বলতে ইসলামি সভ্যতার যুগকেই নির্দেশ প্রদান করে। মধ্যযুগের সকল বর্বরতা আর অজ্ঞতার গ্লানিগুলো ইসলামের উপর চাপিয়ে দিয়ে ইসলামি সভ্যতাকে কলুষিত করার হীন ও ব্যর্থ প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। তাঁরা মধ্যযুগের তুলনায় আধুনিক যুগকে উন্নত ও শ্রেষ্ঠতম যুগ বলে আখ্যায়িত করে প্রকারান্তরে পাশ্চাত্য সভ্যতারই গুণকীর্তন গেয়ে তাকে অন্য সভ্যতাসমূহের উপর প্রাধান্য দিয়ে সুউচ্চ আসনে বসানোর অবিরাম প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে।
আমরা যদি মধ্যযুগের আলোকে তাবৎ বিশ্বের সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থানকে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করতে চাই, তাহলে আমরা আলোচনার সুবিধার্থে বিশ্বকে প্রাচ্য ও প্রতীচ্য এই দুটি ভাগে বিভক্ত করে আলোচনাটি সংক্ষিপ্তভাবেই শুরু করতে পারি। সংক্ষিপ্তভাবেই মধ্যযুগের ইসলাম আর আধুনিক পাশ্চাত্য সভ্যতার মাঝে নিবন্ধন আকারে একটি আলোচনার অবতারণা করব। যাতে যাঁরা মধ্যযুগের বর্বরতা’ বলতে শুধু ইসলামি সভ্যতাকে চিহ্নিত করে তাকে কলুষিত করার এহেন ঘৃণ্য কাজ চালিয়ে যাচ্ছে, তাঁদের জন্য মোটামুটি একটি উত্তর হয়ে যায়। সাধারণত মধ্যযুগ বলতে কোন্ যুগটাকে বোঝায় তা নিয়ে উপর প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের ঐতিহাসিকদের মধ্যে ব্যাপক বিতর্ক আছে। কেউ কেউ চতুর্থ শতাব্দী থেকে চতুর্দশ শতাব্দী পর্যন্ত সময়টাকে ‘মধ্যযুগ” বলে আখ্যায়িত করেছেন। আবার কেউ পঞ্চম শতাব্দী থেকে পঞ্চদশ শতাব্দী পর্যন্ত যুগকে মধ্যযুগ বলেছেন। কেউ আবার একাদশ শতাব্দী থেকে সপ্তদশ শতাব্দী পর্যন্ত কালকেই মধ্যযুগ বলেছেন।
চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে এক ঐতিহাসিক আর-এক ঐতিহাসিকে মতামতগুলোর মধ্যে বিস্তর ফারাক। কেন? কারণ কথিত জ্ঞানী ও পণ্ডিতরা মধ্যযুগের বর্বরতা বলতে মূলত ইসলামি সভ্যতার যুগকেই কলুষিত করার অপপ্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। সুতরাং প্রতীচ্য তথা ইউরোপের ঐতিহাসিকরা ইউরোপে ইসলামের উত্থান ও পতনের যুগকে আর প্রাচ্য তথা ভারতীয় ঐতিহাসিকরা ভারতে ইসলামের উত্থান ও পতনের যুগকে মধ্যযুগের বর্বরতার যুগ হিসাবে চিত্রিত করা হয়েছে। ইউরোপে ইসলামের উত্থান ঘটেছিল অষ্টম শতাব্দীতে এবং পতন। হয়েছিল পঞ্চদশ শতাব্দীতে। পাশাপাশি এটাও মনে রাখতে হবে ভারতে ইসলামের উত্থান ঘটেছিল একাদশ শতাব্দীতে এবং পতন হয়েছিল অষ্টাদশ শতাব্দীতে। আবার কোনো কোনো ঐতিহাসিক চরম বিদ্বেষমূলক একপেশে নীতি অবলম্বন করে ইসলামি সভ্যতার মূল অষ্টম শতাব্দী থেকে দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত সময়কে মধ্যযুগ বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন। আদতে ওই সময়টিই ছিল ইসলামি সভ্যতার চরম উৎকর্ষতার যুগ। মধ্যযুগটাকে যেভাবেই বিশ্লেষণ করা হোক না-কেন মুসলিম শাসনকাল তারই অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং ওই সময়ে প্রাচ্যের ইসলামি সভ্যতা আর প্রতীচ্যের খ্রিস্টান জগৎ নিয়ে আলোচনা করলেই বোধ করি বিষয়টি আরও পরিষ্কার হবে। ভারতীয় হিন্দু সভ্যতা) সভ্যতা ভারতেই সীমাবদ্ধ। বহিঃবিশ্বে তার কোনো প্রভাব নেই। অথচ প্রাচীন ভারত কিন্তু কখনোই ভারতীয় উপমহাদেশের মধ্যেই ছিল না। ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ও সংস্কৃতি ছড়িয়ে পড়েছিল দক্ষিণের শ্রীলঙ্কা, ইন্দোনেশিয়া, জাভা, বালি, মালদ্বীপ পর্যন্ত। আজ সেখানে বৌদ্ধ কিংবা মুসলিমদের আধিপত্য। ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতি এইসব ভূখণ্ড ধরে রাখতে পারেনি।
মধ্যযুগের ইসলামি সভ্যতার মূল্যায়ন করতে গিয়ে কেনেথ এইচ, ক্ৰান্ডাল বলেন— “সকলেই জানেন খ্রিস্টান তথা পাশ্চাত্য জগত যখন অন্ধকার যুগে নিমজ্জিত ছিল, তখন চিনের সীমানা থেকে শুরু করে আটলান্টিক মহাসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকায় বিশাল সাম্রাজ্যের অধিকারী ছিলেন মুসলমানরা। বিভিন্ন কৃষ্টির সমবায়ে নতুন যে ইসলামী সভ্যতার সূত্রপাত হয় তা নবম, দশম ও একাদশ শতকে পরিপূর্ণরূপে বিকাশ লাভ করে। মধ্যযুগে ইসলামের এই সমৃদ্ধ ভাণ্ডার থেকে পাশ্চাত্যজগত বহু কিছু গ্রহণ করেছে এবং এভাবেই পঞ্চদশ ও ষষ্ঠদশ শতকে ইউরোপীয় রেনেসাঁর সূত্রপাত ঘটেছে।” রবার্ট ব্রিফল্ট তাঁর এক গ্রন্থে বলেন— “সম্ভবত আরববাসীদের দ্বারা প্রভাবিত না-হলে আধুনিক ইউরোপীয় সভ্যতার ক্রমবিকাশের পূর্ববর্তী পর্যায়গুলি অতিক্রম করে বর্তমান রূপ লাভ করতে সক্ষম হত না। ইউরোপের বিজ্ঞানে চরম উন্নতি বলতে আমরা যা বুঝি তা প্রাচীন গ্রিকদের অক্লান্ত অনুসন্ধান ও উৎসাহ, নতুন শিক্ষা পদ্ধতির আবিষ্কার। এই উৎসাহ ও পদ্ধতিসমূহ ইউরোপীয় ভূখণ্ডে আরববাসীদের দ্বারা প্রচলিত হয়েছিল।” মধ্যযুগের ইসলামি সভ্যতা অতি আলোকিত ও বিকশিত হয়েছে ঐতিহাসিক হিট্টির বক্তব্য থেকে। তিনি বলেন— “অষ্টম শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রারম্ভ পর্যন্ত আরবি ভাষাভাষী লোকেরা সমগ্র বিশ্বের সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রধান আলোর দিশারী ছিলেন। তাঁদের মাধ্যমে প্রাচীন বিজ্ঞান ও দর্শন এমনভাবে পুনর্জীবিত, সংযোজিত ও সম্প্রসারিত হয় যে, এর ফলে পশ্চিম ইউরোপে রেনেসাঁর উন্মেষ সম্ভবপর হয়েছে।” এইসব প্রথিতযশা খ্যাতিমান ঐতিহাসিক ও চিন্তাবিদদের বক্তব্যগুলো থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, মধ্যযুগের বর্বরতার সঙ্গে ইসলামি সভ্যতার বিন্দুমাত্র সম্পৃক্ততা নেই। বরং মধ্যযুগটা ছিল ইসলামি সভ্যতার আলোকিত যুগ। সে সময়কালে ইসলামি সভ্যতা তার জ্ঞানের আলোকবর্তিকা থেকে নিঃসৃত আলোকরশ্মিগুলো দ্বারা বিকিরণ দিয়ে যাচ্ছিল বিশ্বের সর্বত্র। যে সময়টাতে ইউরোপ আফ্রিকা ও দূরপ্রাচ্যের অঞ্চলগুলো জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিক্ষাদীক্ষায় ছিল দূর থেকে বহু দূরে। অজ্ঞতা আর বর্বরতার আধারে নিমজ্জিত ছিল, সেই সময়টাতে আরব উপদ্বীপ থেকে জ্ঞানের বিকিরণগুলো আলোকিত ও উদ্ভাসিত হয়ে প্রতিভাত করে যাচ্ছিল আঁধারে থাকা জনপদগুলোকে।
যেসমস্ত মুসলিম মনীষীরা জ্ঞান-বিজ্ঞান, দর্শন ও সাহিত্যে তাঁরা ঘটিয়েছেন অভূতপূর্ব মহাবিপ্লব, মানবজীবনে সৃষ্টি করেছেন মহাজাগরণ। তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন, ইমাম আবু হানিফা, ইমাম বুখারী, জাবের ইবনে হাইয়্যান, ইমাম গাজ্জালী, আল ফারাবী, আল বাত্তানী, আলবেরুনী, ওমর খৈয়াম, ইবনে সিনা, ইবনে নাফিস, রুমী, ইবনে রুশদ, মহাকবি ফেরদৌসী। ইবনে খালদুন, যিনি হলেন আধুনিক সমাজবিজ্ঞান ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক। প্রভূত মনীষীদের জন্ম ও মৃত্যুই হল মধ্যযুগে। অর্থাৎ অষ্টম শতাব্দী থেকে চতুর্দশ শতাব্দীর শেষভাগের মধ্যেই। আর ওই মনীষীদের বাদে এরকম আরও হাজারো মুসলিম বিজ্ঞানী ও দার্শনিক রয়েছেন, যাঁদের থেকে প্রবাহিত হয়েছে জ্ঞানের ফল্গুধারা। এঁরা সবাই আবির্ভূত হয়েছেন ওই মধ্যযুগেই। তা ছাড়া মধ্যযুগের ওই সময়টাতে ইসলামি বিশ্বে এমন কতিপয় বিখ্যাত মহাবিদ্যাপিঠ প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল, যে সময়টাতে প্রতীচ্য কিংবা দূরপ্রাচ্যের কোথাও তাঁর ন্যূনতম অস্তিত্বও ছিল না। আব্বাসীয় আমলে ৮০৯ সালে ইরাকের বাগদাদে প্রতিষ্ঠিত হয় বাইতুল হিকমাহ নামক বিশ্ববিদ্যালয়। জ্ঞানের আদানপ্রদানের জন্য আল মামুন অসংখ্য জ্ঞানীগুণি ব্যক্তিকে বাইতুল হিকমাহতে নিয়ে আসেন। নবম থেকে ত্রয়োদশ শতক পর্যন্ত পারসিয়ান ও খ্রিস্টান সহ অসংখ্য পণ্ডিত ব্যক্তি এই গবেষণা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত ছিল। আরবিতে গ্রন্থ অনুবাদ ও সংরক্ষণের পাশাপাশি পণ্ডিতরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে মৌলিক অবদান রাখেন। আল মামুনের শাসনামলেই মানমন্দির স্থাপিত হয়। এসময় এই প্রতিষ্ঠানটি গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা, চিকিৎসাবিজ্ঞান, আলকেমি, প্রাণীবিদ্যা, ভূগোল ও মানচিত্র। অঙ্কনবিদ্যা সহ বিভিন্ন জ্ঞানচর্চার অপ্রতিদ্বন্দ্বী স্থান হয়ে ওঠে। নবম শতকের মধ্যভাগে বাইতুল হিকমাহ ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে বৃহৎ গ্রন্থভাণ্ডার। মোঙ্গলদের বাগদাদ অবরোধের সময় শহরের পতন হলে গ্রন্থভাণ্ডারটি ধ্বংস হয়ে যায়। মরক্কোর ফাস নগরীতে ৮৫৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় কারাভিন বিশ্ববিদ্যালয়। মিশরে ৯৭০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় বিশ্বখ্যাত আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯৬৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় আর-এক বিশ্ববিখ্যাত বিদ্যাপীঠ নিজামিয়া বিশ্ববিদ্যালয় এবং অষ্টম শতাব্দীতে স্পেনের কর্ডোবায় প্রতিষ্ঠিত হয় কর্ডোবা বিশ্ববিদ্যালয়, যা আলোকিত করেছিল সমগ্র ইউরোপকে। যেসব ইউরোপীয় মনীষীগণ আধুনিক বিশ্বসভ্যতার রূপকার, যাঁরা জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতিটি শাখায় বিচরণ করে পাশ্চাত্যকে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায় তাঁদের সবাই পৃথিবীতে জন্মেছেন মধ্যযুগের পরেই। অর্থাৎ পঞ্চদশ শতাব্দীর পর থেকেই। তাঁদের এমন একজন খুঁজে পাওয়া যায় না যাঁরা পঞ্চদশ শতাব্দীর আগে আবির্ভূত হয়েছেন। তাঁদের মধ্য হতে অন্যতম হলেন গ্যালিলিও গ্যালিলাই, নিকোলাস কোপানিকাস, টমাস আলভা এডিসন, জর্জ বার্নাড শ, আইজাক নিউটন, আলবার্ট আইনস্টাইন, উইলয়াম শেক্সপিয়র, লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি, লুই পাস্তুর, আব্রাহাম লিংকন, জন কিটস, চালর্স ডারউইন, কালমার্কস, অলভিল রাইট, উইলবার রাইট, বারট্রান্ড রাসেল ও ফ্রান্সিস বেকনসহ আরও অনেক মনীষী। এঁদের সবার আবির্ভাবই হল পঞ্চদশ শতাব্দী থেকে উনবিংশ শতাব্দীর মাঝে। বলা যায় এঁরাই আধুনিক পাশ্চাত্য সভ্যতার ভিত রচনা করে দিয়েছেন এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের পদ-প্রদর্শক ছিলেন আরববাসীরাই।
মধ্যযুগে ইউরোপ বর্বরতার কোন শীর্ষে এবং দৈন্যদশার কোন পর্যায়ে উপনীত ছিল তার সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় রবার্ট ব্রিফল্টের ভাষায়। তিনি তাঁর রচিত এক গ্রন্থে বলেন— খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতাব্দী থেকে দশম শতাব্দী পর্যন্ত ইউরোপ গভীর আধারে নিমজ্জিত ছিল এবং তা ক্রমান্বয়ে আরও প্রকট ও ভয়াবহতার দিকেই ধাবিত হচ্ছিল। তখনকার ভয়-ভীতি ও বর্বরতা ছিল প্রাচীন কালের ভয়-ভীতি ও বর্বরতার চেয়েও বহুগুণ বেশি। কারণ তার উদাহরণ ছিল এক বিরাট সভ্যতার লাশের, যে লাশে পচন ধরে তা গলে গিয়েছিল। সেই সভ্যতার চিহ্নাদি লোপ পাচ্ছিল এবং তার উপর ধ্বংসের মোহর অঙ্কন ছিল। সে সমস্ত দেশ যেখানে ওই সভ্যতা ও সংস্কৃতি চরম উৎকর্ষ লাভ করেছিল। যেমন ইটালি, ফ্রান্স, সেখানে ধ্বংসের তাণ্ডব, অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলারই রাজত্ব বিরাজমান ছিল।” মধ্যযুগে ইসলামি সভ্যতা ও ইউরোপ কোনো পর্যায়ে ছিল তা আরও প্রতিভাত হয় মহাত্মা গান্ধীর উক্তি থেকে। তিনি বলেন— “প্রতীচ্য যখন অন্ধকারে নিমজ্জিত, প্রাচ্যের আকাশে তখন উদিত হল এক উজ্জ্বল নক্ষত্র এবং অর্ধ পৃথিবীকে তা দিল আলো ও স্বস্তি। ইসলাম মিথ্যা ধর্ম নয়, শ্রদ্ধার সঙ্গে হিন্দুরা তা অধ্যয়ন করুক, তা হলে আমার মতোই তাঁরা একে ভালোবাসবে।
সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে সপ্তম শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে বাংলা ভাষার জন্ম বলে অধিকাংশ পণ্ডিত মত প্রকাশ করেন। এই সময় থেকে শুরু করে ১২০০ সাল পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন যুগ। প্রাচীন যুগের নিদর্শন একমাত্র সাহিত্য বৌদ্ধ সহজিয়াতান্ত্রিক মহাজনদের রচিত চর্যাপদ প্রথম স্তরের বাংলা ভাষায় রচিত। প্রাচীন যুগের পর ১২০৪ সাল থেকে মধ্যযুগের সূত্রপাত এবং ১৮০০ সাল তার বিস্তার। ১৮০০ সালের পর থেকে আজ অবধি আধুনিককাল। সাহিত্যের ইতিহাসের এই যুগ বিভাগ মূলত রাজনৈতিক পরিবর্তন ধরেই করা হয়ে থাকে। অবশ্য কোনো শাসক পরিবর্তন হলেই যুগান্তর ঘটে না। নতুন জাতির সঙ্গে রাজনৈতিক-সামাজিক সাংস্কৃতিক পরিচয় নতুন মনন ও সংস্কৃতির জন্ম দেয়। নতুন মন-মত-ধর্ম-আচার-মনন-দর্শন ও সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয়ের ফলে ব্যষ্টির চিন্তা-চেতনায় যে অভিঘাত আসে, তারই প্রভাবে বাহ্যজীবনে সমাজে-আচারে-আচরণে এককথায় মানস ও ব্যাবহারিক জীবনে যে পরিবর্তন ঘটে, তাতেই ঘটায় যুগান্তর। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের যুগ বিভাগ সম্পর্কে এই হল ধারণা।
বস্তুত মধ্যযুগেই পৃথিবীর মানুষকে অন্ধকার ও অজ্ঞতা থেকে আলো ও জ্ঞানের জগতে নিয়ে আসে। মধ্যযুগে বঙ্গদেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয়, সাহিত্য, শিক্ষা ও সংস্কৃতির অগ্রগতির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক পরিবর্তনসাপেক্ষে বখতিয়ার খিলজি কর্তৃক বঙ্গদেশ জয়ের পরই লক্ষ্মণ সেনের রাজত্বের পতনের মধ্য দিয়ে বঙ্গদেশের সাহিত্যের প্রাচীন যুগের সমাপ্তি ঘটে। স্বাভাবিকভাবেই নতুন এক জাতির সংস্পর্শে বঙ্গদেশী মানুষের মন ও মননে এবং সামাজিক, ব্যাবহারিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে পরিবর্তন শুরু হয়। ফলে এদেশের মানুষ নবতর জীবনবোধ ও নতুন চিন্তাভাবনা ধ্যান-ধারণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ওঠে। ইতিহাসের স্বাভাবিক নিয়মেই তা ঘটেছিল। এদেশের হিন্দু ও বৌদ্ধরা যাঁরা এতদিন শাসক শ্রেণি ও ব্রাহ্মণদের নির্যাতন ও শোষণের শিকারে পরিণত হয়েছিল, তাঁদের মৃতপ্রায় দেহে নতুন আশা ও নতুন প্রাণের সঞ্চার ঘটায় ইসলাম। সেন আমলে তো বৈশ্য ও শূদ্রদের মানুষ বলেই মনে করা হত না। তাঁদের পশুর মতো চোখে দেখা হত। মুসলমানরা যখন বিজিত দেশের মানুষের কাছে ইসলামের নীতি-আদর্শ প্রচার করলেন, তখন দীর্ঘকালের উৎপীড়িত শোষিত মানুষগুলো নতুন জীবনের স্বপ্নে বিভোর হয়ে উঠল। তাঁরা ইসলাম এবং মুসলমানদের বরণ করে সহযাত্রী হয়ে গেল। ১২০০ থেকে ১৩৫০ সাল পর্যন্ত বাংলার জীবন ও সংস্কৃতি তুর্ক আঘাতে ও সংঘাতে ধ্বংসে ও অরাজকতায় মূৰ্ছিত অবসন্ন হয়েছিল। খুব সম্ভব, সেসময়ে কেউ কিছু সৃষ্টি করার মতো প্রেরণাই পাননি। অন্তত বাংলা ভাষায় যদি তখন কিছু লেখা হয়েও থাকে, তার একটি ছত্রও আমাদের হাতে এসে পৌঁছায়নি। বাংলা ছাড়া অন্য ভাষায় যা লেখা হয়েছে, তাও সামান্য। এই সন্ধিযুগের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস। হচ্ছে তাই সাহিত্য শূন্যতার ইতিহাস। এই সাহিত্য শূন্যতার জন্য যে তুর্ক বিজয়ের ভয়াবহতাকেই দায়ী করা হয়েছে, সেই ভয়াবহতার চিত্রাঙ্কন করেছেন অন্য আর-একজন ঐতিহাসিক— “যখন লক্ষ্মণ সেনের সভাকে কেন্দ্র করিয়া সংস্কৃত কাব্য সাহিত্যের নতুন নতুন পরীক্ষা চলিতে ছিল, ঠিক সেই মুহূর্তে তাতার-তুর্কি খোরাসানের মরু-পর্বতবাসী ইসলাম ধর্মাবলম্বী একদল অশ্বারোহী বিদ্যুৎগতিতে বাঙালাদেশের কিয়দংশ অধিকার করিয়া ফেলিল। তার পরে শারীরিক বল, সমরকুশলতা ও বীভৎস হিংসতার দ্বারা বাঙালাও তার চতুস্পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে ইসলামের অর্ধচন্দ্রখচিত পতাকা প্রোথিত হইল। ১৩০০ হইতে ১৫০০ শতাব্দীর শেষভাগ পর্যন্ত প্রায় দুইশত বৎসর ধরিয়া এই অমানুষিক বর্বরতা রাষ্ট্রকে অধিকার করিয়াছিল। এই যুগ বঙ্গ সংস্কৃতির তামস যুগ।… এই সময় বর্বর শক্তির আঘাতে বাঙালী চৈতন্য হারাইয়া ছিল।”
এই সময়ে উঁচু মানের সাহিত্য সৃষ্টি না-হওয়ার কারণ নির্ণয় করতে গিয়ে ড. সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় বলেছেন— “তুর্কিদের বাংলা বিজয়কালে দেশের উপর দিয়া একটি ঝড় বহিয়া গিয়াছিল। ১২০০ হইতে প্রায়। দেড়শত বৎসর ধরিয়া বাংলাদেশের সাহিত্য বা বিদ্যাচর্চার বিশেষ নিদর্শন পাওয়া যায় না। এই দেড়শত বৎসর ধরিয়া মুসলমান তুর্কিদের হাতে বাংলার হিন্দু-বৌদ্ধ সংস্কৃতি বিশেষ বিপন্ন হইয়া পড়িয়াছিল, এটি একটি যুগান্তরের কাল দেশময় মারামারি, কাটাকাটি, নগর ও মন্দির ধ্বংস অভিজাত বংশীয় ও পণ্ডিতদের উচ্ছেদ প্রভৃতি অরাজকতা চলিয়াছিল। এ সময়ে উঁচু মানের সাহিত্য সৃষ্টি হওয়া অসম্ভব।” ড. সুকুমার সেনের অভিমতও একইরূপ। তিনি বলেন— “তুর্কি আক্রমণের ফলে বাঙালির বিদ্যা ও সাহিত্যচর্চার মূলে কুঠারাঘাত পড়িল। প্রায় আড়াইশত বৎসরের মতো দেশ পিছাইয়া গেল। দেশে শান্তি নাই, সুতরাং সাহিত্যচর্চা তো হইতেই পারে না।” ড. মুহাম্মদ শহিদুল্লাহও বলেছেন— “এই সময় যুদ্ধবিগ্রহে বাংলাদেশে নিরবচ্ছিন্ন শান্তি ছিল না। সেইজন্য সাহিত্যচর্চা নামমাত্র ছিল। বস্তুত মুসলমান অধিকারকাল হইতে এই সময় পর্যন্ত কোনো বাংলা সাহিত্য আমাদের হস্তগত হয় নাই। আমরা এই ১২০১ হইতে ১৩৫২ পর্যন্ত সময়কে বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগের অন্ধকার বা সন্ধিযুগ বলিতে পারি।” অপরদিকে প্রখ্যাত ঐতিহাসিক রাখালদাস বন্দোপাধ্যায় বলেছেন– “এই সময়কার হিন্দু রচিত কোনো ইতিহাস নাই। সেই রাষ্ট্রবিপ্লবের যুগে কোনো বিদেশি পর্যটক গৌড়বঙ্গ ভ্রমণে আসেন নাই, সুতরাং মুসলমান রচিত মুসলমান বিজয়ের ইতিহাস হইতেই এ সমস্ত পূরণের চেষ্টা করিতে হইবে। কিন্তু সমসাময়িক ও পরবর্তী মুসলিম ঐতিহাসিকদের রচিত কোনো ইতিহাসেই তুর্কি অত্যাচারের এই ভয়াবহতার কথা উল্লেখ নাই। তা হলে বর্তমান পণ্ডিতগণ এসব তথ্য পেলেন কোথায়? নাকি এসব কাহিনি তাঁদের স্বকপোলকল্পিত?”
অনেকে মনে করেন বাংলা সাহিত্যের এই আদি মধ্যযুগের সাহিত্যের দুষ্প্রপ্যতা ও তার জন্য তুর্কি বিজয়ের ভয়াবহতার কথা বলার সময় এই পণ্ডিতগণ ইউরোপীয় ইতিহাসের মধ্যযুগকে সামনে রেখে বিচার করেছেন। ইউরোপীয় ইতিহাসের মধ্যযুগের চিত্র সংক্ষেপে অংকন করেছেন একজন ঐতিহাসিক –“রোমান সাম্রাজ্যের অধঃপতন হইতে শুরু করিয়া ১৫০০ খ্রিস্ট-অব্দ পর্যন্ত ইউরোপীয় মধ্যযুগ বিস্তৃত। খ্রিঃ ২৩৬ অব্দ হইতে ফ্রাঙ্ক, আলমনি, গ্লথ, ভ্যাগতাল প্রভৃতি বর্বর ও অর্ধবর্বর জাতির আক্রমণের ফলে রোমের হেলেনীয় সংস্কৃতির প্রাণরস ধীরে ধীরে শুষ্ক হইয়া আসিল। পঞ্চম শতাব্দীর মধ্যে এই বর্বর জাতিসমূহ রোম সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরীণ দুর্বলতার সুযোগ লইয়া দক্ষিণ ইউরোপ ও উত্তর আফ্রিকার দুর্মদ শক্তির আধিপত্য স্থাপন করে। ইহার পর হইতে ইউরোপে মধ্যযুগের আরম্ভ। এই মধ্যযুগের আদি ‘তামসযুগ’ (The Dark Age) নামে উল্লেখিত হইয়া থাকে।” ইউরোপের পঞ্চম শতাব্দীর তামস যুগের লক্ষণ ধরেও ধ্যান ধারণা নিয়ে বঙ্গদেশের ত্রয়োদশ শতাব্দীর ইতিহাস বিচার করা সম্পূর্ণ অনুচিত। তুর্কি মামলুক বলবনিদের সঙ্গে ইউরোপের ফ্রাঙ্ক, আলমন্নি গথ জাতিসমূহের সঙ্গে কোনো তুলনাই চলতে পারে না। ইউরোপের এই বর্বর জাতির অভ্যুত্থানের সময়, বলা যেতে পারে, প্রায় সমগ্র পৃথিবীই সভ্যতার আলোক থেকে দূরে সরে গিয়ে অন্ধকারে সমাচ্ছন্ন ছিল। তাই ইউরোপে সেদিন বর্বর শক্তিসমূহ এক একটি সভ্যতা সংস্কৃতি ধ্বংস করেছে, সৃষ্টি করেনি কিছুই। আবির্ভাবের কাল থেকে অতি অল্প দিনের মধ্যে ইসলাম অর্ধপৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে এবং দেশে দেশে নিগৃহীত, অত্যাচারিত শোষিত মানুষের মধ্যে আশা ও মুক্তির আলোক প্রজ্জলিত করে। ইসলামের উদার নীতি ও সাম্য মৈত্রী ভ্রাতৃত্বের আদর্শে উজ্জীবিত তুর্কিজাতি নব মানবতার বাণী বহন করে নিয়ে এসেছিল বাংলাদেশে। তাঁদের আগমনেই সর্বপ্রথম বাঙালি জাতির চেতনার উন্মেষ ঘটে। তাই তুর্কিরা বিজিত জাতির উপর অত্যাচার চালিয়ে ছিল এসব ধারণা করা মোটেই ঠিক নয়।
তুর্কিরা বঙ্গদেশে এসেছিল রাজ্য স্থাপন করতে, লুটপাট করে স্বদেশে ফিরে যাওয়ার জন্য নয়। ফলে রাজনৈতিক কারণেই অনাচার রোধ করে দেশে শান্তি ফিরিয়ে এনে দেশবাসীর মনে আস্থা স্থাপন করা। প্রয়োজন ছিল। তাই এ কথা অনুমান করতে কষ্ট হয় না যে, সেদিন শাসকের পরিবর্তনে সমগ্র জনমণ্ডলীর উপর কোনো চাপই সৃষ্টি হয়নি। ঐতিহাসিক ক্ষিতিমোহন সেন বলেছেন –“এ দেশে আসিয়া মুসলমান রাজারা সংস্কৃত হরফে মুদ্রা ও লিপি ছাপাইয়াছেন, বহু বাদশা হিন্দু মঠ ও মন্দিরের জন্য দানপত্র দিয়েছেন। সে সব ঐতিহাসিক নজির দিন দিন নতুন করিয়া বাহির হইতেছে। মুসলমান বিজেতারা এ দেশে রাজ্য স্থাপন করেই হিন্দু পাইক (পদাতিক সৈন্য) ও কর্মচারী নিয়োগ করিতে থাকেন। রাজ্য শাসনে ও রাজস্ব ব্যবস্থায় এমন কি সেনাপত্যেও হিন্দুর প্রাধান্য সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল এবং গৌড়ের সুলতানরা মুসলমান হলেও রাজকার্য প্রধানত হিন্দুর হাতেই ছিল।” সুকুমার সেন লিখেছেন –“অধিকাংশ আফগানই তাহাদের জায়গিরগুলি ধনবান হিন্দুদের হাতে ছাড়িয়া দিতেন। এই জায়গিরগুলির ইজারা ধনশালী হিন্দুরা লইতেন এবং ইজারা ব্যবসায় বাণিজ্যের সমস্ত সুবিধা ভোগ করিতেন। পাঠান রাজত্বকালে জায়গিরদারেরা দেশের ভিতরে রাজস্ব আদায়ের কাজে হস্তক্ষেপ করেননি। দেশের শাসন ও শান্তি রক্ষার জন্য হিন্দুদের উপরই তাঁদের নির্ভর করতে হত। সেই জন্য পাঠান আমলে হিন্দু ভূস্বামী ও অধিকারীদের যথেষ্ট উল্লেখ দেখা যায়।” ঐতিহাসিক বিনয় ঘোষও লিখেছেন– “তুর্কিগণ বাংলাদেশে লুণ্ঠন, নরহত্যা, মঠমন্দির বিহার ধ্বংস ইত্যাদি করে অত্যাচার চালিয়ে অরাজকতা সৃষ্টি করেছিলেন, এ কথা অনায়াসে স্বীকার করে নেওয়া যায় না। বরং ইতিহাস থেকে আমরা তার বিপরীত চিত্রই পাই।”
এছাড়া রাজশক্তি কর্তৃক স্থানীয় অধিবাসীদের জোরপূর্বক ব্যাপকভাবে ধর্মান্তরিতকরণের কথাও মোটেই বিশ্বাস যোগ্য নয়। মুসলিম সেনাপতিরা দেশ জয় ও ধর্মপ্রচারের উভয় দায়িত্ব পালন করলেও কোনো দেশে তাঁরা কোনোদিনও স্থানীয় অধিবাসীদের জোরপূর্বক ইসলাম গ্রহণে বাধ্য করেছেন, এমন কোনো নজির নেই।
বৌদ্ধদের পতনের পর কর্ণাট থেকে আগত ব্রাহ্মণেরা (সেন বংশীয়) বঙ্গদেশের শাসনভার হস্তগত করেন। ব্রাহ্মণ্য ধর্মের পুনরুত্থান ও পুনঃসংস্থাপনের চেষ্টায় সেনরাজগণ সমাজে বর্ণভেদ প্রথা চালু করেন। শাসনকার্য, বিদ্যাচর্চা, পূজাপার্বণ, সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চা ইত্যাদি সমস্ত দায়িত্ব ছিল ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়দের হাতে। ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়রা উচ্চপদে আসীন থেকে সমগ্র সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করতেন। রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কাজে সাধারণ মানুষের কোনো অধিকার ছিল না। বর্ণাশ্রমের ভিতরে শূদ্ররা এবং বাইরে স্থানীয় অধিবাসীরা এঁদের হাতে নির্যাতিত হয়েছে দীর্ঘদিন ধরে। চাঁড়াল, চামার, দুলে, মালো, বারুই প্রভৃতি অন্ত্যজরা ‘অধম সংকর’ বলে হিন্দু সমাজে নিগৃহীত হত। কৌলিন্য শাসিত এবং স্মার্ত বর্ণাশ্রম সমাজ ব্যবস্থার দ্বারা হিন্দুসমাজ ‘অধম সংকর’দের বাইরে ঠেলে দিচ্ছিল। সেইসব অধম সংকররা ব্রাহ্মণ্যধর্ম ছেড়ে দলে দলে বৌদ্ধধর্মে চলে আসছিল ইসলাম আসার আগে। তাই ব্রাহ্মণ্যবাদীদের কাছে বৌদ্ধরাও শত্রু হিসাবে প্রতিপন্ন হল। তাই বৌদ্ধদের প্রতিও সুবিচার করেনি তাঁরা। এই হিন্দুসমাজে অশ্রদ্ধেয় ‘পাষণ্ডি বৌদ্ধগণ নানা দিক দিয়ে নিপীড়িত হচ্ছিলেন। এ সময়েই ব্রাহ্মণদের সাংস্কৃতিক অধঃপতন শুরু হয়। সংস্কৃত ছিল রাজভাষা, এ ভাষা চর্চা করার অধিকার সাধারণ মানুষের তো ছিলই না, অধিকন্তু ব্রাহ্মণ পণ্ডিতরা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বিকাশের বিরুদ্ধাচারণ করায় বাংলাচর্চা সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। সে সময় সাহিত্য রচনা হত কেবলমাত্র সংস্কৃত ভাষায়। বাংলা ভাষায় সাহিত্য রচনা করার কথা কেউ স্বপ্নেও ভাবেনি। কারণ এ সম্পর্কে ব্রাহ্মণ পণ্ডিতরা শাস্ত্রীয় বিধান ও প্রচার করে নিদান দিয়ে রেখেছিলেন— “অষ্টাদশ পুরানানি রামস্য চরিতানি চা/ভাষায়ং মানবঃ শ্রুত্বা রৌরবং নরকং ব্ৰজেং”। অর্থাৎ অষ্টাদশ পুরাণ ও রামচরিত মানব ভাষায় (দেশজ ভাষা, এক্ষেত্রে বাংলা ভাষা) শ্রবণ করলে রৌরব নরকে স্থান হবে। অতএব বুঝতে কোনো অসুবিধা হয় না যে, উঁচু মানের বাংলা সাহিত্য সৃষ্টি না-হওয়া এবং বাংলা সাহিত্য চর্চার মূলে কুঠারাঘাত পড়ার জন্য তুর্কিদের দায়ী করা আসলে শাক দিয়ে মাছ ঢাকার প্রয়াস। তবে মধ্যযুগের শুরুতে বাংলা সাহিত্য না-হলেও মাঝামাঝিতে যথেষ্ট পরিমাণে শ্রেষ্ঠ বাংলা সাহিত্য রচনা হয়েছে, যা বাংলা সাহিত্যে শ্রেষ্ঠ সম্পদ হয়ে থাকবে।
হিন্দু সমাজের বিধানদাতাদের কাছে যাঁরা ছিল শূদ্র ও অস্পৃশ্য পর্যায়ের, ইসলাম তাঁদের দিল মুক্ত মানুষের অধিকার এবং শুধু তাই নয়, ব্রাহ্মণদের উপরও প্রভুত্ব করার ক্ষমতা। ইসলাম প্রবেশের ফলে বঙ্গদেশে বাঙালির ভাষা সাহিত্য ও সংস্কৃতির সেদিন নবদিগন্ত উন্মোচিত হয়েছিল। এ কৃতিত্বের সম্পূর্ণটাই সেদিনের মুসলিম শাসনের। বিদ্যাচর্চা ও সাহিত্যচর্চা কোনোদিনই বন্ধ হয়নি। তার প্রমাণ এ সময় সংস্কৃত ভাষায় বেশকিছু গ্রন্থ রচিত হয়েছিল। অনায়াসে ধারণা করা যায় সাধারণ মানুষের ভাষা বাংলারও সাহিত্য রচিত হয়েছিল। জানা যায় ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষের দিকে গৌড়ের সুলতান নাসিরউদ্দিন মাহমুদ শাহের প্রেরণা ও পৃষ্ঠপোষকতা সর্বপ্রথম মহাভারতের বাংলা অনুবাদ হয়। রামাই পণ্ডিতের শূন্য পুরাণের অন্তর্গত ‘নিরঙ্গনের রুম্মা’ নামক গাথা জাতীয় ছড়া ত্রয়োদশ শতাব্দীতে রচিত বলে পণ্ডিতেরা মনে করেন। ঐতিহাসিক রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতামত হল— “ইহা স্থির সিদ্ধান্ত যে, শ্রীযুক্ত বসন্তরঞ্জন মহাশয় শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’-এর যে পাণ্ডুলিপি আবিষ্কার করিয়াছেন তাহা ১৩৮৫ খ্রিস্ট-অব্দের পূর্বে, সম্ভবত চতুর্দশ শতাব্দীর প্রথমার্থে লিখিত হইয়াছিল।” এই মত স্বীকার করে নিলে শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের রচনাকাল আমাদের আলোচ্য সময়ের মধ্যে পড়ে। এই সময়ের সাহিত্য মূলত ধর্মীয় বিষয় নির্ভর ছিল। প্রথমদিকের সমস্ত রচনাই ছিল পদ্যমূলক, গদ্যমূলক রচনা চালু হয় অনেক পরে। তুলোট কাগজে লেখা পুথির মাধ্যমে সাহিত্যচর্চা চলত। অনেক ভাষাবিদ অন্ধকার যুগকে স্বীকার করেন না। এসময় ডাক ও খনার বচন রচিত হয়েছে। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের লেখকরাও উল্লেখ করেছেন বৈষ্ণব মতকে কেন্দ্র করে রচিত বৈষ্ণব সাহিত্য রচনা হয়েছে এ সময়েই। এছাড়াও পঞ্চাদশ শতকে শ্রীচৈতন্যদেবের ভাব-বিপ্লবকে কেন্দ্র করে গোটা বাংলা সাহিত্যে বৈষ্ণব সাহিত্যেরও জন্ম হয়। বৈষ্ণব ধর্মের প্রবর্তক শ্রীচৈতন্যদেব কোনো গ্রন্থ লিখে যাননি। অথচ তাঁকে ঘিরেই জন্ম হয় সাহিত্যের। বৈষ্ণব পদাবলি সাহিত্যর সূচনা ঘটে চতুর্দশ শতকে বিদ্যাপতি ও চণ্ডীদাসের সময়ে। তবে ষোড়শ শতকে এই সাহিত্যের বিকাশ হয়। বৈষ্ণব পদাবলির প্রধান অবলম্বন রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলা। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কবিতাগুলোর একটি হস্তলিখিত পাণ্ডুলিপি উদ্ধার করা হয় ১৯০৯ সালে। বিষ্ণুপুর শহরের নিকটবর্তী কাকিল্যা গ্রামের জনৈক দেবেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের বাড়ি থেকে বসন্তরঞ্জন রায় বিদ্বল্লভ এটি আবিষ্কার করেন। বড় চণ্ডীদাস নামের মধ্যযুগের এক কবি এটি রচনা করেন। চর্যাপদে বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম ব্যবহার সম্পর্কে ধারণা দেয়। আবার শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে বাংলা ভাষা একটি নতুন আঙ্গিকে উপস্থাপন করা হয়েছে। মৈথিলী ভাষায় লেখা বিদ্যাপতির পদাবলি বাংলা কবিতায় বিশেষ প্রভাব রেখেছিল। বিদ্যাপতি পঞ্চদশ শতকের মৈথিল কবি। বঙ্গদেশে তাঁর প্রচলিত পদাবলির ভাষা ব্রজবুলি। অনেক বাঙালি কবি এই ভাষায় কবিতা রচনা করেছেন। মঙ্গলকাব্যগুলিও এসময়েই রচিত হয়েছে। মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্য ছিল কাব্যপ্রধান। হিন্দুধর্ম, ইসলাম ও বাংলার লৌকিক ধর্মবিশ্বাসগুলিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল এই সময়কার বাংলা সাহিত্য।
মধ্যযুগের প্রথম মুসলমান কবি শাহ মুহম্মদ সগির পঞ্চদশ শতকে প্রণয়োপখ্যান জাতীয় কাব্য ‘ইউসুফ জোলেখা’ রচনা করেন। এর বাইরে অনুবাদ সাহিত্য মধ্যযুগের অনেকখানি অংশ জুড়ে আছে। এ ধারার সূত্রপাত হয় কবি কৃত্তিবাস কর্তৃক রামায়ণের ভাবানুবাদের মাধ্যমে। পরবর্তীতে বাংলায় অনূদিত হয়েছে অসংখ্য গ্রন্থ। মধ্যযুগের বিশাল পরিসর জুড়ে ছিল মঙ্গলকাব্য। দেবদেবীর মাহাত্ম্যসূচক এই কাব্যধারার সূত্রপাত হয় পনেরো শতকে। তবে ষোলো শতকে এর সর্বাধিক প্রসার ঘটে। ধর্মমঙ্গল, মনসামঙ্গল, শিবমঙ্গল বা শিবায়ন, চণ্ডীমঙ্গল ইত্যাদি এ পর্যায়েরই নানা শাখা। এই ধারার অন্যতম কবি মাণিক দত্ত, কানাহরি দত্ত, বিজয়গুপ্ত, বিপ্রদাস পিপিলাই, কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম চক্রবর্তী, ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর প্রমুখ। শ্রীচৈতন্যদেবের (১৪৮৬ ১৫৩৩) আবির্ভাবের ফলে বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগ সমৃদ্ধির পথে অনেকখানি এগিয়ে যায়। মধ্যযুগেই আরাকানের রাজসভায় বাংলা সাহিত্যের চর্চা আরম্ভ হয়। এছাড়া শাক্ত পদাবলি, নাথসাহিত্য, পিরসাহিত্য, বাউল ও অপরাপর লোকসঙ্গীত, ময়মনসিংহ গীতিকা, পূর্ববঙ্গ-গীতিকা, মহাভারতের ভাবানুবাদ ইত্যাদি অমূল্য সাহিত্য মধ্যযুগেরই সৃষ্টি।
মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের বিস্তৃত অঙ্গন জুড়ে অনুবাদ সাহিত্যের চর্চা হয়েছিল এবং পরিণামে এই সাহিত্যের শ্রীবৃদ্ধিসাধনে অনুবাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা অপরিসীম। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে যে অনুবাদের ধারাটি সমৃদ্ধি লাভ করে তাতে সৃজনশীল লেখকের প্রতিভা কাজ করেছিল। সে কারণে মধ্যযুগের এই অনুবাদকর্ম সাহিত্য হিসাবে মর্যাদা লাভ করেছে। চোদ্দো-পনেরো শতকে আমাদের লেখ্য সাহিত্যও সংস্কৃত-অবহটঠ থেকে ভাব ভাষা-ছন্দ গ্রহণ করেছে, পুরাণাদি থেকে নিয়েছে বর্ণিত বিষয় ও বর্ণনাভঙ্গি এবং রামায়ণ-মহাভারত-ভাগবত প্রণয়োপাখ্যান-ধর্মশাস্ত্র প্রভৃতি সংস্কৃত-ফারসি-আরবি-হিন্দি থেকে অনূদিত হয়েছে বাংলা ভাষায়। এভাবেই আমাদের লিখিত বা শিষ্ট বাংলা ভাষা-সাহিত্যের বুনিয়াদ নির্মিত হয়েছিল।
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে বৈষ্ণব পদাবলি সাহিত্য একটি বিস্তৃত কালপর্ব জুড়ে বিন্যস্ত। প্রাক-চৈতন্যযুগে বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস এবং চৈতন্য ও চৈতন্য পরবর্তী যুগে গোবিন্দদাস, জ্ঞানদাস বিশেষভাবে খ্যাতিমান হলেও আরও বহু কবি বৈষ্ণব ধর্মাশ্রিত পদ লিখেছেন। তবে ধর্মবর্ণ-নির্বিশেষে পদাবলি চর্চার এই ইতিহাস চৈতন্যের ধর্মান্দোলনের পরই ছড়িয়েছিল। বৈষ্ণব পদাবলির মূল বিষয়বস্তু হল কৃষ্ণের লীলা এবং মূলত মাধুর্যলীলা। বস্তুত পৃথিবীর অন্যান্য মধ্যযুগীয় সাহিত্যের মতোই এগুলিও বিশেষভাবে ধর্মাশ্রিত ও বৈষ্ণব ধর্মের তত্ত্ববিশ্বের উপরে প্রতিষ্ঠিত। তবে যে-কোনও ধর্মের মতোই বৈষ্ণব ধর্মতত্ত্বেরও অনেকগুলি ঘরানা ছিল। এর মধ্যে তাত্ত্বিকভাবে সবচেয়ে প্রভাবশালী ছিল বৃন্দাবনের বৈষ্ণবগোষ্ঠী। এছাড়া মধ্যযুগে হয়েছে রাজসভার সাহিত্যচর্চা। রাজসভার সাহিত্য হল রাজার পৃষ্ঠপোষকতায় রচিত সাহিত্য। মধ্যযুগের প্রধান রাজসভার কবি ছিলেন আলাওল (১৫৯৭-১৬৭৩) এবং ভারতচন্দ্র প্রমুখ। মহাকবি আলাওল ছিলেন আরাকান রাজসভার প্রধান কবি। তিনি আরবি ও ফারসি ভাষায় কাব্য রচনা করেছিলেন। ব্রজবুলি ও মঘি ভাষাও তাঁর আয়ত্তে ছিল। প্রাকৃত পৈঙ্গল, যোগশাস্ত্র, কামশাস্ত্র, অধ্যাত্মবিদ্যা, ইসলাম ও হিন্দু ধর্মশাস্ত্র ক্রিয়াপদ্ধতি, যুদ্ধবিদ্যা, নৌকা ও অশ্ব চালনা প্রভৃতিতে বিশেষ পারদর্শী হয়ে আলাওল মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে এক অনন্য প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন। আলাওলের ‘পদ্মাবতী’ (১৬৪৮ সাল) ছিল সবচেয়ে বিখ্যাত ও বিতর্কিত মহাকাব্য। এছাড়া সতীময়না লোরচন্দ্রানী (১৬৫৯ সাল), সপ্ত পয়কর (১৬৬৫ সাল), সয়ফুলমুলুক-বদিউজ্জামাল (১৬৬৯ সাল), সিকান্দরনামা (১৬৭৩ সাল), তোহফা (১৬৬৪ সাল), রাগতালনামা ইত্যাদি রচনা করেছেন। মধ্যযুগের শেষ এবং আধুনিক যুগের প্রধান কবি ছিল ভারতচন্দ্র। তিনি তার ‘অন্নদামঙ্গল কাব্যের মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যে অমর হয়ে আছেন।
মধ্যযুগের (১২০০ সাল থেকে ১৮০০ সাল) সমগ্র পরিসর জুড়েই বাংলা কাব্যের একচ্ছত্র আধিপত্য লক্ষণীয়। বিবিধ শাখা-প্রশাখায় বিভক্ত ছিল এই সাহিত্যচর্চা। এখানে এ সময়ের বিভিন্ন শাখার উল্লেখযোগ্য কবির একটি। সম্মিলিত তালিকা দেওয়া যায়। তালিকা প্রস্তুতে কোনো ধরনের ক্রম অনুসরণ করা হয়নি— বড় চণ্ডীদাস, শাহ মুহম্মদ সগির, আলাওল, ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর, শ্রীচৈতন্যদেব, হেয়াত মামুদ, মুকুন্দরাম চক্রবর্তী, দৌলত কাজী, কৃত্তিবাস ওঝা, সাবিরিদ খান, চন্দ্রাবতী, দৌলত উজির বাহরাম খান, দুর্লভ মল্লিক, শেখ ফয়জুল্লাহ, ময়ূর ভট্ট, আবদুল হাকিম, মালাধর বসু, বিদ্যাপতি, দ্বিজ বংশীবদন, চম্পাগাজী, মাগন ঠাকুর, মাধব কন্দলী, রামানন্দ যতি, দ্বিজ তুলসী, মানিকরাম দাস।
ওয়াকিল আহমদ তাঁর ‘বাংলা সাহিত্যের পুরাবৃত্ত’ (পৃ. ১০৫)-এ লিখেছেন— “বাংলা সাতিহ্যের কথিত ‘অন্ধকার যুগ’ মোটেই সাংস্কৃতিক বন্ধ্যাত্বের যুগ ছিল না। ধর্মশিক্ষা শিল্পচর্চার দায়িত্ব যাঁদের উপর ন্যস্ত ছিল, তাঁরা সীমিত আকারে হলেও শিক্ষা সাহিত্য চর্চায় নিয়োজিত ছিলেন। তবে কী হিন্দু কী মুসলমান কেউ লোকভাষা বাংলাকে গ্রহণ করেননি। বাংলা সাহিত্যের নিদর্শন না-থাকার এটাই মুখ্য কারণ।” সংস্কৃত ভাষার প্রভাব, আধিপত্য ও আগ্রাসন কাটিয়ে বাংলা ভাষা যে নিজস্ব অস্তিত্ব প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে, সেটাই বড়ো কথা।
বাকি রইল যুদ্ধ-বিগ্রহ। মধ্যযুগকে ‘যুদ্ধের যুগ’ বললে মোটেই অত্যুক্তি হয় না। হ্যাঁ, গোটা বিশ্বে নিরন্তর যুদ্ধ বিগ্রহ প্রাচীন যুগেও ছিল। কিন্তু মধ্যযুগের যুদ্ধের সঙ্গে সঙ্গে ছিল ধর্মীয় প্রসারণের প্রয়াস। তবে ধর্ম প্রসারের উদ্দেশ্য ছিল গৌণ। মুখ্য ছিল সম্পদশালী ভূখণ্ডে ঢুকে ভাগ্যান্বেষণ করা। কেউ লুঠপাট করে নিজের দেশে ফিরে গেছে। কেউ কেউ এ দেশে শাসক হিসাবে আজীবন থেকে গেছে। বলতে গেলে তখন গোটা বিশ্বই ছিল যুদ্ধরত। সব যুদ্ধই ছিল সাম্রাজ্য বিস্তারের যুদ্ধ। ক্ষুদ্র রাষ্ট্র বৃহৎ হচ্ছিল, আবার বৃহৎ রাষ্ট্র টুকরো টুকরো হয়ে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হচ্ছিল। শুধুমাত্র মুসলিমরাই ভারত উপমহাদেশে ঢুকে স্থানীয় রাজাদের সঙ্গে যুদ্ধ করে শাসন নিজেদের হাতে তুলে নিয়েছিল, তা নয়। এ সময় এই উপমহাদেশের অসংখ্য রাজ্যের রাজারাও যথেষ্ট যুদ্ধবাজ ছিল। মগধ সাম্রাজ্য (৫৪৫ খ্রিস্টপূর্ব), মৌর্য সাম্রাজ্য (৩২১-১৮৪ খ্রিস্টপূর্ব), চোল সাম্রাজ্য (২৫০ খ্রিস্টপূর্ব), সাতবাহন সাম্রাজ্য (২৩০ খ্রিস্টপূর্ব), কুষাণ সাম্রাজ্য (৬০-২৪০ সাল), গুপ্ত সাম্রাজ্য (২৮০-৫৫০ সাল), পাল সাম্রাজ্য (৭৫০-১১৭৪ সাল), রাষ্ট্রকুট (৭৫৩-৯৮২ সাল), মারাঠা সাম্রাজ্য (১৬৭৪-১৮১৮ সাল), শিখরাষ্ট্র (১৭৯৯-১৮৪৯ সাল) শিখ সাম্রাজ্য (১৭১৬-১৮৪৯ সাল) ছাড়াও অসংখ্য যুদ্ধবাজ সাম্রাজ্যবাদী রাজা ছিল এই উপমহাদেশে। কোনো যুদ্ধই রক্তপাতহীন ধ্বংসহীন হয় না। দেশীয় রাজারা নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ বিগ্রহ হলেও অন্যের সাম্রাজ্য দখল করতে সক্ষম হলেও উপমহাদেশের বাইরে থেকে আসা আক্রমণকারীদের কাছে হেরে ভূত হয়েছে অথবা শর্তসাপেক্ষে বশ্যতা স্বীকার করে নিয়েছে। যাঁরা বা যেসব রাজারা বশ্যতা স্বীকার করে নিয়েছিল, তাঁরাই মুসলিম শাসকদের অধীনে থেকে উঁচু পদগুলি অলংকৃত করেছিল এবং বংশপরম্পরায় পরিবার নিয়ে আয়েসী জীবনযাপন করে গেছেন। হাজার বছরে একবারের জন্যেও টু ফাঁ করেননি তাঁরা।
শুধু ভারত উপমহাদেশেই নয়, সেসময় গোটা বিশ্বেই সাম্রাজ্য বিস্তারের লড়াই চলছিল। এমন কোনো দেশ বা মহাদেশ ছিল না যেখানে শাসকরা যুদ্ধরত ছিল না। রাজাদের সঙ্গে সঙ্গে প্রজারাও সর্বদা তটস্থ থাকত। এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ চলছিল উপনিবেশ যুগের আগে পর্যন্ত। তবে উপনিবেশ যুগেও রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়েছিল, তবে সেই যুদ্ধে ধরন খানিক পৃথক। এ বিষয়ে আমরা পরে আসতে পারি। আপাতত আমরা ভারত উপমহাদেশের বাইরে মধ্যযুগের বিশ্বটা দেখে নিতে চাই।
১০৯৫ খ্রিস্টাব্দে পোপ দ্বিতীয় আরবানের আহ্বানে সূচিত হয়েছিল ইতিহাসের এক কলঙ্কজনক অধ্যায়, ক্রুসেড। জেরুজালেম তথা পবিত্র চার্চ অব হলি দ্য সেপালচার (এটা মূলত জিশুখ্রিস্টের সমাধিস্থল) উদ্ধারের অছিলায় ইউরোপের সশস্ত্র খ্রিস্টান বাহিনী মুসলিম জনগোষ্ঠীর উপর চাপিয়ে দিয়েছিল কয়েক শতাব্দী ব্যাপী রক্তক্ষয়ী এক যুদ্ধ। অপেক্ষাকৃত আধুনিক মারণাস্ত্র সজ্জিত খ্রিস্টানদের কাছে পরজিত হয়ে হারিয়ে যেতে বসেছিল মুসলিম জাতি। ঠিক এমনই এক সন্ধিক্ষণে যুদ্ধক্ষেত্রে হাজির হল কুর্দ সালদিন আইয়ুবি। শুরু হল নতুন উদ্দীপনায় মহাযুদ্ধ। জেরুজালেম সহ মধ্যপ্রাচ্য থেকে পাততাড়ি গোটাতে বাধ্য হয় খ্রিস্টানরা। দীর্ঘ কয়েক শতাব্দী ধরে অব্যাহত ছিল এই যুদ্ধ। আক্রমণ পালটা আক্রমণের ভিতর দিয়ে পেরিয়ে গেছে অনেকগুলো প্রজন্ম। একসময় খ্রিস্টান রাজাদের হাত থেকে যুদ্ধের নিয়ন্ত্রণ সরসরি নিজ হাতে তুলে নেন ক্ষমতালিল্লু পোপেরা। তখন তাঁরা নিজ জাতির বিরুদ্ধেই পরিচালিত করেছেন ক্রুসেডের শক্তিকে। পরিণামে নিজেদের রক্তেই নিজেদেরই রঞ্জিত হতে হয়েছে।
একাদশ-ত্রয়োদশ শতকের মধ্যে মুসলিম অধিকার থেকে জেরুজালেম উদ্ধারের নামে ইউরোপের খ্রিস্টান বাহিনী ও মানুষদের রক্তক্ষয়ী ধর্মযুদ্ধের বিভিন্ন অভিযানকেই ‘ক্রুসেড’ বলা হয়ে থাকে। খ্রিস্টান বাহিনীর শ্লোগানে জেরুজালেম উদ্ধারের সংকল্প উচ্চারিত হলেও কার্যত এসব যুদ্ধাভিযান ছিল সমগ্র আফ্রো-এশীয় মুসলিম শক্তি তথা মুসলিম উম্মাহকে নির্মূল করার দানবীয় বাসনা। খ্রিস্টান ঐতিহাসিক হিট্টির কথায় –“ক্রুসেড ছিল মুসলিম প্রাচ্যের বিরুদ্ধে খ্রিস্টান প্রতীচ্যের তীব্র প্রতিক্রিয়া ও ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ।” আর-এক ঐতিহাসিক গিবনের কথায় –“খ্রিস্টান ইউরোপের অর্বাচীন, বর্বর ও অশিক্ষিত লোকেরাই ক্রুসেডে যোগদান করে।”
প্রাচ্য মুসলিমদের রাজ্য বিস্তার ও বাণিজ্য প্রাধান্যের খ্রিস্টান প্রতীচ্য সর্বোচ্চ ধর্মগুরু পোপ দ্বিতীয় আরবানের নির্দেশে যে সর্বাত্মক ক্রুসেড শুরু করে তার ব্যাপ্তিকাল ১০৯৬ সাল থেকে ১২৯১ সাল পর্যন্ত টানা প্রায় ২০০ বছর। এই ২০০ বছরের নয়বার নয়টি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়েছে। নয়টি প্রধান ধর্মযুদ্ধের কাল উল্লেখে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতপার্থক্য থাকলেও প্রফেসার আতিয়ারের বক্তব্য অনুযায়ী প্রথম ধর্মযুদ্ধের সময়কাল ১১৪৬-১১৪৮ সাল, দ্বিতীয় ধর্মযুদ্ধের সময়কাল ১১৪৬-১১৪৮ সাল, তৃতীয় ধর্মযুদ্ধের সময়কাল ১১৮৯-১১৯২ সাল, চতুর্থ ধর্মযুদ্ধের সময়কাল ১১৯৯-১২০৪ সাল, পঞ্চম ধর্মযুদ্ধের সময়কাল ১২১৭-১২২১ সাল, ষষ্ঠ ধর্মযুদ্ধের সময়কাল ১২২৮-১২২৯ সাল, সপ্তম ধর্মযুদ্ধের সময়কাল ১২৪৯-১২৫৪ সাল, অষ্টম ধর্মযুদ্ধের সময়কাল ১২৭০ সাল এবং নবম ধর্মযুদ্ধের সময়কাল ১২৯১ সাল। নড়বড়ে মুসলিম রাজশক্তিকে পরাস্ত করা ছাড়া খ্রিস্টানদের প্রধানতম লক্ষ্য ছিল মুসলিম নিধন, যার অকাট্য প্রমাণ পাওয়া যায় খ্রিস্টানদের দ্বারা এন্টিয়ক ও জেরুজালেম দখলের পর নির্মম গণহত্যা। এন্টিয়কে খ্রিস্টান হামলাকারীরা প্রায় ১০,০০০ মুসলিম হত্যা করে। অসংখ্য মানুষের উপর চালায় অকথ্য অত্যাচার ও দানবীয় নির্যাতন। প্রফেসার মেয়ার লিখছেন– “গভর্নর ও তাঁর অনুচরবর্গ ছিলেন একমাত্র জীবিত পলাতক মুসলিম। বিজয়ের প্রমত্ততা, ধর্মীয় অন্ধ গোঁড়ামি এবং তিন বছরের অবরুদ্ধ কষ্টের স্মৃতি ফেটে পড়ল ভয়ংকর এক রক্তস্নানের মধ্য দিয়ে, যাতে ধর্মযোদ্ধারা ফালি ফালি করে কেটে ফেলল ধর্মবর্ণনির্বিশেষে প্রতিটি মানুষকে, যাঁরাই দুর্ভাগ্যক্রমে এসে পড়ল তাঁদের তরবারির নাগালের মধ্যে। শবদেহ আবৃত রাস্তা দিয়ে পায়ের গোঁড়ালি সমান রক্তধারা পেরিয়ে অতিকষ্টে তাঁরা হেঁটে যেতে লাগল। … এই খ্রিস্টান বর্বরতায় গভীরভাবে স্তব্ধবাক হয়ে গেল মুসলিম দুনিয়া।” শুধু হত্যালীলাই নয়, চলছিল আশেপাশের বিভিন্ন দেশগুলির দখল। কখনো মুসলিমরা দখল করেছে খ্রিস্টান অধ্যুষিত দেশ, কখনো খ্রিস্টানরা দখল করেছে মুসলিম অধ্যুষিত দেশ। এইভাবে একটার পর একটা ধর্মযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। ১২১৬ সাল পোপ তৃতীয় ইননোসেন্টের নেতৃত্বে যে ষষ্ঠ ধর্মযুদ্ধ হয়, খ্রিস্টানরা এই যুদ্ধে পরাজিত হলেও তাতে ৭০,০০০ মুসলিম নিধন হয়। ১২৪৪ সালে অষ্টম ধর্মযুদ্ধে খ্রিস্টানদের দখল থেকে মুসলিমরা জেরুজালেম উদ্ধার করে। ১২৯১ সালে নবম ও শেষ ধর্মযুদ্ধে মুসলিম বাহিনী খ্রিস্টান অধিকৃত সমস্ত দেশই দখল করে নেয়। বস্তুত খ্রিস্টানদের পরাজয়ের মধ্য দিয়ে ধর্মযুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে।
কিন্তু কেন সংঘটিত হয়েছিল এই ক্রুসেড? কেন ঘটেছিল মুসলিম প্রাচ্যের বিরুদ্ধে খ্রিস্টান প্রতীচ্যের এই তীব্র ঘৃণা-বিদ্বেষের বহিঃপ্রকাশ? মুসলিমরা তথাকথিত ‘বর্বর’, ‘রক্তপিপাসু’ বলে? খ্রিস্টানরাও কত বড়ো নর রক্তপিপাসু তা এই গ্রন্থের বিভিন্ন আলোচনায় উঠে আসবে। তখন দেখতে পাবো খ্রিস্টানদের রক্তের নেশার কাছে মুসলিমরা একেবারই শিশু। আজকের দিনেও এই খ্রিস্টান জাতিরা মুসলিমদের বিরুদ্ধে বিষ ঢেলেই চলেছে। উদ্দেশ্য তাঁদের অপকর্মগুলি চাপা দিয়ে রাখা। চাপা থাকবে না।
আরব দেশগুলিতে ‘অন্ধকার যুগ’ (আইয়ামে জাহেলিয়া) চলছিল, ঠিক সেই সময় পুড়িয়ে দিয়েছিল আলেকজান্দ্রিয়ার বৃহত্তম গ্রন্থাগার, যেখানে রক্ষিত ছিল কঠোর পরিশ্রমের ফসল হাতে লেখা লক্ষ লক্ষ গ্রন্থ। এ ঘটনা বিশ্বের কাছে প্রভূত ক্ষতি বলাই যায়। চিরতরে হারিয়ে গেল সেই সময়ের ইতিহাস, বিজ্ঞান, সাহিত্য, ধর্ম ইত্যাদি। গ্রিকবীর আলেকজান্ডারের শাসনামলেই আলেকজান্দ্রিয়া হয়ে ওঠে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী ও গুরুত্বপূর্ণ শহর। এরপর খ্রিস্টপূর্ব ২৮৮ অব্দে টলেমি- ১, ফেলেরনে’র দিমিত্রিয়াসের তত্ত্বাবধানে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘লাইব্রেরি অব আলেকজান্দ্রিয়া। লাইব্রেরিটি এথেন্সে অবস্থিত অ্যারিস্টটলের বক্তৃতা কক্ষের আদলে নির্মাণ করা হয়েছিল। ধ্বংস হওয়ার আগে পর্যন্ত প্রায় ৬০০ বছরের জ্ঞান-বিজ্ঞানের সকল শাখার সকল আবিষ্কার ও দলিলের সাক্ষী হয়ে ছিল এই লাইব্রেরি। প্রথমদিকে লাইব্রেরিটি গ্রিকদের কাব্য, সংগীত ও সাহিত্যের দেবী ‘Muse’ নামে মন্দির হিসাবে ব্যবহৃত হলেও ধীরে ধীরে তা বিদ্যালয়, গবেষণাকেন্দ্র ও গ্রন্থাগার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে এবং সে যুগের পণ্ডিত ব্যক্তিরা গবেষণা ও নিজেদের তত্ত্ব-চিন্তা প্রকাশ করার জন্য দলে দলে এখানে এসে জড়ো হতেন। মূল লাইব্রেরিটি শহরের অভিজাত অংশে অবস্থিত ছিল এবং এর পাশেই একটি সংরক্ষণাগার ছিল। এর বিস্তৃতি এতই ছিল যে, আরেকটি সাহায্যকারী অংশ যেটি “Daughter Library” হিসেবে পরিচিত ছিল, যেটি শহরের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সেরাপিয়াম নামক অংশে নির্মাণ করা হয়। লাইব্রেরিটি সমস্ত ভাষা, সংস্কৃতি এবং নারী-পুরুষের জন্য উন্মুক্ত ছিল। প্রায় ১০০ জন পণ্ডিত সর্বক্ষণের জন্য এখানে অবস্থান করে লেখালেখি, গবেষণা, অনুবাদ, অনুলিপি প্রভৃতি কার্য সম্পাদন করতেন। অনেকের মতে প্রাচীন আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরিতে ৭ লক্ষের মত চামড়া বা কাগজে পেঁচানো প্রাচীন গ্রন্থ, ১ লক্ষেরও উপর ছাপানো গ্রন্থ কাঠের শেলফে সংরক্ষিত ছিল। এর মধ্যে অ্যাসিরিয়া, গ্রিস, পারস্য, মিশর, ভারতবর্ষ প্রভৃতি অঞ্চলের মূল্যবান দলিলও ছিল।
জ্ঞান-বিজ্ঞানের ইতিহাসের সবচেয়ে সমৃদ্ধ এই লাইব্রেরিকে এক করুণ পরিণতির শিকার হতে হল। আলেকজান্দ্রিয়ার লাইব্রেরি ধ্বংসের বেশ কয়েকটি কাহিনি প্রচলিত আছে, প্রাচীন ও বর্তমান সুত্রানুসারে ৪টি ঘটনাকে এই লাইব্রেরি ধ্বংসের কারণ হিসাবে চিহ্নিত করা যায়। প্লুটার্ক, গ্যালিয়াস, মারসেলিনাস, অরোসিয়াসের তথ্য মতে, জুলিয়াস সিজার যখন ৪৮ খ্রিস্ট-পূর্বে টলেমির (Xll) সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত ছিলেন। তখন আলেকজান্দ্রিয়া আক্রমণের সময় তাঁর সৈন্যরা দুর্ঘটনাবশত লাইব্রেরিটি পুড়িয়ে ফেলে। ধারণা করা হয় এরপরও লাইব্রেরিটির অস্তিত্ব বিদ্যমান ছিল। কিন্তু সম্রাট অরেলিয়ান ২৭৫ সালের দিকে পালমিরার রানি জেনোবিয়ার বিদ্রোহ দমন করতে গিয়ে প্রচণ্ড যুদ্ধাবস্থায় লাইব্রেরির মূল অংশটি যে এলাকায় অবস্থিত ছিল তা পুরোপুরি ধ্বংস করে ফেলেন। কিন্তু সাহায্যকারী অংশ যেটি সেরাপিয়ামে অবস্থিত ছিল, সেটি অক্ষত থাকে। ৩৯১ সালের দিকে সম্রাট থিয়োডোসিয়াস একটি অধ্যাদেশ জারি করে প্যাগান মতবাদকে নিষিদ্ধ করেছিলেন। যার ফলশ্রুতিতে আলেকজান্দ্রিয়ার প্যাট্রিয়ার্ক থিয়োফেলাস প্যাগান উপাসনালয়গুলো বন্ধ করে দিয়েছিলেন। ফলে প্যাগানদের হাতে নির্মিত সেরাপিয়ামে অবস্থিত লাইব্রেরির অতিরিক্ত অংশটিও ধ্বংস করে ফেলা হয়। সর্বশেষ যে ব্যক্তিকে এই লাইব্রেরি ধ্বংসের জন্য দায়ী করা হয়, তিনি হলেন খলিফা ওমর। ৬৪০ সালে মুসলমানরা আলেকজান্দ্রিয়া জয় করে। সিরীয় খ্রিস্টান লেখক বার হিব্রাইউসের গ্রন্থ হতে জানা যায় যে, খলিফা ওমরের সেনাপতি তাঁকে এই লাইব্রেরির গ্রন্থগুলি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন— “যদি গ্রন্থগুলি কোরানের মতবাদকে স্বীকার করে তবে এগুলোর প্রয়োজন নেই, আর যদি এগুলো কোরান বিরোধী হয় তবে তা ধ্বংস করো।” এর ফলে গ্রন্থগুলি পুড়িয়ে ফেলা হয়। তবে এই লেখকের লেখার ঐতিহাসিক ভিত্তি তেমন জোরাল নয়।
আলেকজান্দ্রিয়ার লাইব্রেরির ধ্বংস এবং প্রথম নারী গণিতবিদ হাইপেশিয়ার হত্যাকাণ্ডের পর সূচনা ঘটে জ্ঞান বিজ্ঞানের অন্ধকার যুগের। এই ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে বেশ কয়েক শতক লেগে যায়, ষষ্ঠদশ শতাব্দীর দিকে আইজ্যাক নিউটন সহ অন্যান্য বিজ্ঞানীরা তাঁদের নিত্যনতুন মতবাদে যেন বিজ্ঞানের পুনর্জন্ম ঘটল। এরপর জ্ঞান-বিজ্ঞানের একের পর এক আবিষ্কারের পথ ধরে আমরা পৌঁছে গিয়েছি আজকের এই আধুনিক সভ্যতায়। আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরি ধ্বংসের প্রায় ১৫০০ বছর পর ঘটল এক ঐতিহাসিক ঘটনা। ১৯৭৪ সালে আলেকজান্দ্রিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে গঠিত হল একটি কমিটি, যারা সিদ্ধান্ত নিলেন আলেকজান্দ্রিয়ার লাইব্রেরি পুনঃনির্মাণ করা হবে এবং এজন্য তারা প্রাচীন লাইব্রেরিটির কাছাকাছি একটি স্থান নির্বাচন করেন। খুব শীঘ্রই তাঁদের এই সিদ্ধান্ত চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে এবং পৃথিবীর বিভিন্ন ব্যক্তিবর্গ ও প্রতিষ্ঠান ব্যাপকভাবে সাড়া দেয়। এ উদ্যোগের অন্যতম প্রধান সমর্থক ছিলেন মিশরের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট হোসনি মুবারাক।
১৯৯০ সালে মিশরের আসওয়ানে একটি কনফারেন্সে লাইব্রেরিটি পুনঃনির্মানের জন্য ৬৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রাথমিক ফান্ড হিসেবে নির্ধারণ করা হয়, যার সিংহভাগই আসে আরব রাষ্ট্রগুলো হতে। এরপর ১৯৯৫ সালে লাইব্রেরীটির নির্মান কাজ শুরু হয় এবং এটি নির্মান করতে সর্বমোট খরচ হয় ২২০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। আনুষ্ঠানিকভাবে লাইব্রেরিটি উদ্বোধন করা হয় ২০০২ সালে। পৃথিবীর বুকে আরেকবার দৃশ্যমান হয় আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরিটি। বিশাল এই প্রোজেক্টের মধ্যে আছে ৮০ লক্ষ বই রাখার মতো শেলফের ব্যবস্থা এবং মূল পাঠকক্ষটি প্রায় ৭০ হাজার বর্গ মিটারের, যা ১১টির মতো চৌবাচ্চার উপর অবস্থিত। মূল কমপ্লেক্সে একটি বিশাল কনফারেন্স সেন্টার, ৪টি মিউজিয়াম, ৪টি গ্যালারি আছে। মূল পাঠকক্ষের উপরে রয়েছে ৩২ মিটার দীর্ঘ কাঁচ দিয়ে ঘেরা ছাদ, সমুদ্রের দিক থেকে দেখলে যাকে sundial (প্রাচীনকালে ব্যবহৃত সময় গণনার যন্ত্র) মতো মনে হয়। দেয়াল তৈরি করা হয়েছে ধূসর বর্ণের আসওয়ান গ্রানাইট দিয়ে, যাতে ১২০ রকমের হস্তলিপি খোদাই করা আছে। লাইব্রেরীতে ইন্টারনেট আর্কাইভে গ্রন্থ, দলিল সমূহের অনুলিপি সংরক্ষিত আছে, প্রয়োজনবোধে সেখান থেকে এসপ্রেসো বুক মেশিনের সাহায্যে বই প্রিন্ট করে নেওয়া যায়। (আহমাদুর রহমান অনিক)
যাই হোক, আরব দেশগুলিতে ‘অন্ধকার যুগ’-এ আরব ভূখণ্ডের নেতা হিসাবে আবির্ভাব হলেন হজরত মোহম্মদ। একাধিক যুদ্ধ ও বশ্যতার মধ্য দিয়ে আরবে অন্ধকার যুগের অবসান হল। প্রতিষ্ঠা হল ইসলাম ধর্ম। পারস্য, বাইজানটাইন সাম্রাজ্যের সিরিয়া, জর্ডন, প্যালেস্টাইন ও মিশরের বিশাল ভূখণ্ড এবং সাইপ্রাসর দেশগুলি ইসলামি রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হল। অন্ধকার যুগের অবসানের পর খোলাফায়ে রাশেদা যুগের অবসান ঘটিয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হল বংশানুক্রমিক মুসলিম রাজতন্ত্র। বিলুপ্ত হল রাষ্ট্রপরিচালনায় খলিফাঁকে পরামর্শদানকারী মজলিশ। খলিফাই হলেন রাষ্ট্রের সর্ব ক্ষমতার অধিকারী। খলিফারা মুয়াবিয়া ইসলামি শাসনের পরিবর্তে প্রচলিত ও প্রতিষ্ঠিত করলেন মুসলিম শাসনের ধারা।
৬১০ সালে পারস্যবাসীরা পূর্বাঞ্চলের গ্রিক সাম্রাজ্যে অভিযান চালায়। ৬১৪ সালে তাঁরা ইহুদিদের যোগসাজসে অধিকার করে নেয় জেরুজালেম। সে সময় নিধনযজ্ঞ চালিয়ে অভিযানকারীরা ৬৫,০০০ হাজার খ্রিস্টানকে হত্যা করে এবং ৩৫,০০০ জন মানুষকে দাস হিসাবে বিক্রি করে দেয়। এরপরেও এই যুদ্ধ চলতে থাকে আরও কিছুকাল। ফলে উভয়পক্ষই শক্তিক্ষয়ের মাধ্যমে দুর্বলতর হয়ে পড়ে। এমন একটা সময়ে জেরুজালেম ইসলামের দখলে চলে আসে। ৬৩৮ সালে ইসলামি রাষ্ট্রের খলিফা হজরত উমরের সময়েই জেরুজালেম এসে যায় মুসলিমদের অধিকারে। এই অধিকার সুরক্ষিত ছিল একাদশ দশকের শেষ পর্যন্ত। এ সময়েই শুরু হয়ে যায় মুসলিমদের বিরুদ্ধে খ্রিস্টাব্দে বিধ্বংসী যুদ্ধ, যে যুদ্ধ ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধ বলে পরিচিত।
একথা অনস্বীকার্য যে ধর্মীয়-সামাজিক-বাণিজ্যিক-মনস্তাত্ত্বিক কারণগুলি বিদ্যমান থাকলেও ধর্মীয় কারণটিই ছিল মুখ্য। ক্রুসেডের অর্থ ‘ধর্মযুদ্ধ’ হলেও ১০৯৫ সাল থেকে শুরু করে ১২৯১ সাল পর্যন্ত চলমান ক্রুসেডের কোনো ধর্মের প্রতিষ্ঠা বা প্রচার কিংবা রক্ষার জন্য সংঘটিত কোনো যুদ্ধক্রম ছিল না। তা ছিল মূলত ভৌগোলিক ও ধর্মীয় পরিচয়ে মুসলিম ও খ্রিস্টান বলে চিহ্নিত দুটি জনগোষ্ঠী মধ্যে একের বিরুদ্ধে অন্যের, প্রকৃত প্রস্তাবে, মুসলিমদের বিরুদ্ধে খ্রিস্টানদের সীমাহীন ঘৃণা-বিদ্বেষ ও নির্মূল করে দেওয়ার তীব্র বাসনার প্রকাশরূপে এক উন্মুক্ত রক্তখেলা। আফ্রো-এশীয় মুসলিমদের বিরুদ্ধে ইউরোপীয় খ্রিস্টানদের এক দানবিক ধ্বংসোল্লাস। বৃহত্তরভাবে প্রাচ্যের বিরুদ্ধে প্রতীচ্যের এক নির্মম মোকাবিলা। এ সময় এক সম্প্রদায় অন্য সম্প্রদায়ের ঘোরতর শত্রু, এক জাতি অন্য জাতির চরম বৈরী, এক গোত্র অন্য গোত্রের রক্তপিপাসু, অবক্ষয়। লোভ, লালসা, জিঘাংসা, হত্যা, লুণ্ঠনের অবাধ রাজত্বের যুগ চলছিল গোটা বিশ্বজুড়ে। সেই প্রেক্ষাপটে ভারত উপমহাদেশে মুসলিম সম্প্রদায়ের আক্রমণ ও শাসনকে আলাদা করে দেখার কোনো যৌক্তিকতা নেই। যুদ্ধ সবসময় লোকসানের হয় না, অসংখ্য প্রাণের বিনিময়ে লাভও বয়ে আনে। পরিবর্তন আনে শাসনতন্ত্রের। খলিফাতন্ত্র, রাজতন্ত্র, সামন্ততন্ত্র, একনায়কতন্ত্র হয়ে এখন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা কোনোটাই বিনা রক্তপাতে হয়নি। ক্রুসেডের ফলেও ইউরোপবাসী মুসলিমদের কাছ থেকে মেরিনার্স কম্পাসের ব্যবহার, উন্নতমানের কৃষিপদ্ধতি ও শিল্পজাত দ্রব্যাদি সম্বন্ধে প্রত্যক্ষ জ্ঞান ইত্যাদি। ঐতিহাসিক হিট্টি বলেন –“প্রাচ্য অপেক্ষা প্রতীচ্যের জন্য ক্রুসেড ছিল অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ।” ঐতিহাসিক টয়েনবি বলেন– “ক্রুসেডের ফলেই আধুনিক ইউরোপ জন্ম লাভ করেছে।” আজ খ্রিস্টধর্ম অনুসারীরা সারা বিশ্বে এক নম্বরে। দুই নম্বরে আছে ইসলাম। এই এক নম্বর আর দুই নম্বরের লড়াই আজও চলছে। খ্রিস্টানরা ভাবছে এই বোধহয় মুসলিমরা তাঁদের এক নম্বর কেড়ে নেবে। সেই ভয় খ্রিস্টানরা নানা কায়দায় হিন্দুসহ অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদেরও ভয় ঢুকিয়ে দেওয়ার কাজ করে যাচ্ছে। ভারতে খ্রিস্টানদের (ব্রিটিশ) অনুপ্রবেশের উদ্দেশ্যও মুসলিম-বিদ্বেষ, ধর্মযুদ্ধেরই অংশ। মুসলিমরাও ভাবছে কীভাবে এক নম্বর হওয়া যায়। সত্যি কথা বলতে এই দুটি ধর্মানুসারীরাই শয়নে-স্বপনে ভাবে গোটা বিশ্ব তাঁদেরই ধর্মের ছায়াতলে আসুক। পৃথিবীতে তাঁদের ধর্ম ছাড়া আর কোনো ধর্মের অনুসারীদের অস্তিত্ব থাকতেই পারে না। যদিও বাস্তবে তা অসম্ভব, তাহলেও গোটা বিশ্বের ১৯৫ টি দেশের মধ্যে ৫০ টি দেশই (শিয়া ও সুন্নি সহ) নিরঙ্কুশ ইসলাম অনুসারীদের দখলে। এছাড়াও অসংখ্য দেশ আছে যেখানে ইসলাম অনুসারীরা সংখ্যার বিচারে দ্বিতীয় স্থানে আছে। অপরদিকে খ্রিস্ট অনুসারীদের নিরঙ্কুশ দেশ (ক্যাথলিক, প্রোটেস্ট্যান্ট ও অর্থোডক্স সহ) হল ৯৯ টি। এছাড়াও অসংখ্য দেশে খ্রিস্ট ধর্মের অনুসারীরা সংখ্যার বিচারে দ্বিতীয় স্থানে আছে। তা সত্ত্বেও ‘প্যান ইসালামিক’ শব্দদুটি খুব শোনা যায়, কিন্তু ‘প্যান খ্রিস্টবাদ’ শোনা যায় না।
শুধু মধ্যযুগের দেশগুলিতে যুদ্ধ লেগেই থাকত তা কিন্তু নয়। প্রাচীন যুগ থেকে প্রাক-মধ্যযুগেও প্রচুর হয়েছে। তখন হামুরাবির (২১০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) সময়েও এক সফল সিমেটিক আক্রমণ হয় মিশরে। ২৭৫০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দের কাছাকাছি সময়ে সারগন বলে একজন সেমিটিক দলপতি সমস্ত সুমেরিয়া দেশ অধিকার করেছিলেন। পারস্য উপসাগর থেকে ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত বিস্তীর্ণ ‘পৃথিবীর’ তিনিই ছিলেন ‘অধীশ্বর। তিনি ছিলেন নিরক্ষর ও প্রচণ্ড বর্বর। দক্ষিণ পারস্যের কিছু বেশি নিগ্রয়েড ইলামাইট জাতির লোকেরাই হল প্রথম যাবাবর, যাঁদের দ্বারা আদিম সভ্যতার ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে এসেছিল। তাঁরা এসেছিল বণিক এবং লুণ্ঠনকারী হিসাবে। অবশেষে তাঁদের মধ্যে আরও দুঃসাহসিক পরিকল্পনা নিয়ে দলপতিদের আবির্ভাব হল। এ সময়ে মূলত এক দলপতির সঙ্গে অন্য দলপতির যুদ্ধ হত। মূলত দুর্বল দলপতির সঙ্গে সবল দলপতির যুদ্ধ। সিমেটিক বিজয়ীরা কখনোই মিশরীয়দের সঙ্গে মিশে যেতে পারেনি। তাঁদের সবসময় বিদেশি ও বর্বর হিসাবে শত্রুর চোখে দেখা হত।
পিরামিড তৈরি হওয়ার অনেক আগেই লোহিত সাগরের বুকে জাহাজ চলেছিল। ৭০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যেই ভূমধ্যসাগর ও পারস্য উপসাগরের বুকে জাহাজ দেখা দিয়েছিল। এগুলোর বেশিরভাগ ছিল জেলেদের জাহাজ। এদের মধ্যে কেউ বাণিজ্য করত, কেউ লুণ্ঠন করত। তবে এঁরা সর্বদাই সশস্ত্র থাকত। এইসব জাহাজের নাবিকেরা যেখানে লুট করত এবং যেখানে লুট করতে পারত না সেখানে বাণিজ্য করত এবং বাণিজ্য করতে করতে এলাকা অধিকৃত করে শাসন চালাত। এই বাণিজ্য আর লুণ্ঠনকে কেন্দ্র করেই স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে বেঁধে যেত যুদ্ধ। এঁরা জলদস্যু নামে পরিচিত ছিল। ভাস্কো-ডা-গামা তেমনই একজন জলদস্যু। প্রাচীন পৃথিবীর সেই বিশাল বিশাল জাহাজগুলি ছিল দাঁড়টানা এবং সেগুলি তীর ঘেঁষে চলত। জাহাজের এইসব নাবিকরা যুদ্ধবন্দিদের দিয়ে দাঁড়গুলি টানাত। তখনকার দিনে যুদ্ধবন্দিদের ‘ক্রীতদাস’ রূপেই দেখা হত।
ব্যাবিলনে যখন হামুরাবির আমল ছিল তখন তাঁরা বণিক, ভবঘুরে ও ঔপনিবেশিক হিসাবে গোটা ভূমধ্যসাগরীয় নিন্মভূমির দখল নিয়েছিল স্থানীয়দের হত্যা করে বা হটিয়ে দিয়ে। পুরোনো আইবেরীয় বাস্ক অধিবাসীদের হটিয়ে দিয়ে এঁরা স্পেনে বসতি স্থাপন করে এবং জিব্রাল্টার প্রণালীর ভিতর দিয়ে সমুদ্রের ধারে অভিযান চালায়। এঁদের আক্রমণের ফলে ঈজীয় জাতির লোকেরা পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্নই হয়ে গেল। নোসোজ সভ্যতাও ধ্বংস হয়েছিল বহিঃদেশীয়দের লুঠতরাজ ও অগ্নিকাণ্ডে।
মেসোপটেমিয়া ও নিলনদের দুই সভ্যতায় মধ্যে প্রায় হাজার বছর ব্যাপী যুদ্ধ ও হত্যাকাণ্ড চলেছিল। মেসোপটেমিয়ায় ছিল ব্যাবিলনের শাসন, পরে হিটাইটরা ও দামাস্কাসের সিরীয়রা ক্ষণস্থায়ী হলেও প্রাধান্য লাভ করে। সেই সুদূর অতীতে বড়ো বড়ো দিগ্বিজয়ীর যেমন আবির্ভাব হয়েছিল, তেমনি আবার মিলিয়েও গিয়েছিল। যেমন মিতান্নির রাজা তুশরাত্তা, যিনি নিনেভে আক্রমণ করে অধিকার করেছিলেন। আসিরিয়ার রাজা প্রথম তিগলাথ পিলেজার, যিনি ব্যাবিলন আক্রমণ করে অধিকার করেছিলেন। সে সময় আসিরীয়রা সবচেয়ে বড়ো এবং ভয়ংকর সামরিক শক্তি হয়ে উঠেছিল। তৃতীয় তিগলাথ আর জবরদখলকারী রাজা সারগনের আমলে আসিরিয়া এক বৃহৎ সামরিক জাতিতে পরিণত হয়েছিল। আসিরিয়ারাই প্রথম রাষ্ট্র, যাঁরা নির্মম বলপ্রয়োগ নীতির প্রবর্তন করে। আসিরীয়রা প্রথম অস্ত্রে লোহার ব্যবহার করে এবং লোহার অস্ত্র দিয়ে সেনাবাহিনীকে সুসজ্জিত করে। প্রায় দশ শতাব্দীর মিশরের ইতিহাসে মিশর অ্যামিবার মতো একবার সংকোচন একবার প্রসারণ হচ্ছিল। মিশর ভূখণ্ডের সীমানার পরিমাণে কোনো স্থায়ীত্ব ছিল না। শুধু মিশর বলেই নয়, পৃথিবীর কোনো দেশেরই ভূখণ্ডের সীমানারেখার কোনো স্থায়ীত্ব থাকত না। সেই ‘জোর যাঁর মুলুক তাঁর’ যুগে মিশরের মতো ব্যাবিলন, আসিরিয়া, হিটাইট, সিরিয়ার মতো সিমেটিক রাষ্ট্রগুলো কখনো পরস্পর পরস্পরকে গ্রাস করছিল, কখনো-বা হজম করতে না-পেরে উগড়ে দিচ্ছিল।
কৃষ্ণসাগর ও কাস্পিয়ান সাগরের উত্তর-পূর্বদিক ঘিরে এগিয়ে আসছিল মিড় ও পারসিকরা। এঁদের সঙ্গেই একীভূত ছিল শক ও সর্মেশিয়ানরা। এরপর আর্মেনিয়ানরা উত্তর-পূর্ব কিংবা উত্তর-পশ্চিম থেকে, সাগর প্রাচীরের উত্তর-পশ্চিম থেকে বলকান উপদ্বীপের মধ্যে দিয়ে এলো সিমেরিয়ানরা ও ফ্রিজিয়ানরা এবং আজ যাঁদের আমরা গ্রিক বলি, সেই হেলেনীয়রা এলো। এইসব জাতিরা সবাই ছিল হানাদার দস্যু ও লুণ্ঠনকারী। এঁরা কখনো পূর্বদিকর সীমান্ত প্রদেশে হানা দিয়ে লুটতরাজ করত। আবার কখনো পশ্চিমদিকের এলাকা দখল করে সুসভ্য ঈজীয়দের তাড়িয়ে দিচ্ছিল। ঈজীয়রা এইসব আর্যদের নাগালের বাইরে গিয়ে নতুন দেশে নতুন ঘর খুঁজছিল। এটুস্কানরা পালিয়ে গিয়েছিল মধ্য ইটালির বিস্তীর্ণ অরণ্যে। এঁদের কয়েকটা দল ভূমধ্যসাগরের দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলে কয়েকটা শহর গড়ে তুলেছিল। এঁরা পরবর্তীতে ফিলিস্তাইন বলে পরিচিত হয়। আর্যরাও ভয়ংকর আক্রমণাত্মক গোষ্ঠী ছিল। তবে আপাতদৃষ্টিতে আর্যজাতিগুলো সম্পূর্ণভাবে বিজয়ী হলেও রাজদণ্ড আর্যদের হাতে আসার বহুদিন পর পর্যন্ত আর্য, সেমিটিক, মিশরীয় ভাবধারা এবং কর্মপদ্ধতির মধ্যে সংগ্রাম চলতে থাকে। এই আর্যরা জার্মান, চিন, ভারত প্রভৃতি মহাদেশ উপমহাদেশ ঢুকে প্রবল ধ্বংসলীলা চালিয়েছিল স্থানীয় আদিবাসীদের উপর। ভারতে স্থানীয় আদিবাসীদের উপর আর্যদের ধ্বংসলীলার কাহিনি রামায়ণ, মহাভারত ও পুরাণগুলিতে লিপিবদ্ধ হয়েছে।
খ্রিস্টীয় অষ্টম শতাব্দীতে মেসোপটেমিয়াতে সেসব বর্বর যুগকে পিছনে ফেলে এগিয়ে চলি। পিছনে ফেলে আসব যখন একটা নগর অধিকার করা মানেই ছিল নির্বিচারে নিরীহ মানুষদের হত্যা এবং লুঠতরাজ। দ্বিতীয় নেকো সিরিয়া আক্রমণকালে ৬০৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মেগিদোর যুদ্ধে জুডার রাজা জোসায়াকে পরাজয় ও হত্যা করে। পূর্ব এশিয়া মাইনরের লিভিয়া রাজ্যের ধনী রাজা ক্রিসকে জয় রাজা সাইরাস বিখ্যাত হয়েছিলেন। তিনি ৫৩৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ব্যাবিলনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র অভিযান করে। নগর-প্রাকারের বাইরে যুদ্ধ হয় এবং নগরের প্রবেশদ্বার খুলে দেওয়া হয়। বিনা যুদ্ধে সৈন্যরা নগরে প্রবেশ করে। প্রথম দারিয়ুসের পারসিক সাম্রাজ্য ছিল তখন পর্যন্ত সর্বপ্রথম বৃহত্তম। সমগ্র এশিয়া মাইনর, সিরিয়া, প্রাচীন আসিরীয় ও ব্যাবিলনীয় সাম্রাজ্যের সবটা, মিশর, ককেসাস ও কাস্পিয়ান সাগরের তীরবর্তী সমগ্র অঞ্চল সবই এই সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল।এমনকি ভারত উপমহাদেশের সিন্ধুনদ পর্যন্ত বিস্তার ছিল।
জুডিয়াতে হিব্রু নামে এক সেমিটিক জাতি ছিল। জুডিয়ার রাজধানী ছিল জেরুজালেম। দক্ষিণে মিশর ও উত্তরে সিরিয়া, সিরিয়া, আসিরিয়া ও ব্যাবিলনের পরিবর্তনশীল সাম্রাজ্য— দু-পাশের এই সমস্ত বৃহৎ সাম্রাজ্যের ইতিহাসের এঁরা অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। পৃথিবীর ইতিহাসে এই হিব্রু জাতিই প্রথম লিপিবদ্ধ সাহিত্য সৃষ্টি করেছিল, যে লিপিবদ্ধ সম্পদের নাম ‘ওল্ড টেস্টামেন্ট’। সেখানে উল্লেখ আছে সে সময়কার ইতিহাস, সমাজকে শৃংখলাবদ্ধ করতে আইন-অনুশাসন, স্তোত্র, জ্ঞান-সম্ভার, কবিতা, কল্পগল্প, রাজনৈতিক বিষয় ইত্যাদি। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ অথবা পঞ্চম শতাব্দীতে এটা প্রোফেটদের হাতে আসে।
ব্যাবিলনে বন্দি হওয়ার আগে পর্যন্ত (৬০৮ খ্রিস্টপূর্ব) হিব্রুরা খুব একটা সভ্য অথবা ঐক্যবদ্ধ জাতি ছিল না। চালদীয় রাজা নেবুকাডনেজার দি গ্রেট জেরুজালেম শহরটি লুঠ করে পুড়িয়ে দেয়। এরপর রাজা সাইরাস ব্যাবিলন দখল করে। ব্যাবিলনের বন্দিদশা হিব্রুদের সভ্য ও ঐক্যবদ্ধ করে তোলে। নিজেদের সাহিত্য সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল, তীব্রভাবে আত্মসচেতন এবং রাজনীতিক এক জাতি হিসাবে স্বদেশ জুডিয়াতে ফিরে নিবিড়ভাবে ওল্ড টেস্টামেন্টের অনুসারী হয়। বুক অব জাজেসে তাঁদের সংগ্রাম ও বিপর্যয়ের ইতিহাস পাবেন। খ্রিস্টপূর্ব সপ্তদশ শতাব্দীতে মনে হতে পারত যে, হয়তো সেমিটিক শাসকেরাই গোটা দুনিয়ার সভ্য জগতের সব জায়গায় প্রভূত্ব করবে। তাঁরা বিরাট আসিরীয় সাম্রাজ্য শাসন করেছে ও মিশর জয় করেছে। আসিরিয়া, ব্যাবিলন, সিরিয়া সবই সেমিটিক। তাঁরা পরস্পর পরস্পরের মধ্যে বোধগম্য ভাষায় কথা বলত। কিন্তু ঘটনাবহুল শতাব্দীর মধ্যে যেসব সুসভ্য সেমিটিক জাতি হেরে গিয়ে চাপা পড়ে গেল, তাঁদের মধ্যে শুধু একটাই জাতি ঐক্যবদ্ধ থেকে তাঁদের প্রাচীন ঐতিহ্যকে আঁকড়ে ছিল, তাঁরা হল ছোট্ট ইহুদি জাতি। তার পরের ঘটনা ইতিহাস। ইহুদিরা বাইবেল তৈরি করেছে না বলে বরং বলা ভালো বাইবেল ইহুদিদের তৈরি করেছে। শুধু জেরুজালেম নয়– স্পেন, আফ্রিকা, আরব, পুবদেশে যেখানেই ফিনিসীয়রা পদার্পণ করেছিল, সেখানেই ইহুদিদের সমাজ গড়েছিল। তাঁরা সকলেই বাইবেল দিয়ে এক সূত্রে বাঁধা। আসলে জেরুজালেম ছিল তাঁদের। নামমাত্র রাজধানী, কিন্তু তাঁদের আসল মহানগর ছিল এই মহাগ্রন্থ– বাইবেল। ধর্মের ইতিহাসে বাইবেল যেন মানবসমাজের কাছে এ এক নতুন ধরনের বিষয়। ইহুদি জাতির বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে ইতিহাসে শুধু নতুন ধরনের সমাজই নয়, নতুন ধরনের মানুষও দেখা গেল। এই যে নতুন ধরনের মানুষের কথা বললাম, এঁরা হলেন প্রফেট। বিভক্ত হিব্রু জাতিকে ঘিরে যতই বিপদ ঘনাতে লাগল ততই এই প্রফেটদের গুরুত্ব বাড়তে লাগল। এই প্রফেটরা ছিল বিভিন্ন শ্রেণি থেকে উদ্ভূত মানুষ। ইহুদিদের সবচেয়ে বড়ো শক্তি ছিল অদৃশ্য ঈশ্বর আর মানসিক একতা। এটা আগে বোঝা যায়নি কিংবা এর জন্য আগে থাকতে পরিকল্পনা করেও হয়নি। পুরোহিত বা রাজনীতিকরাও করেনি।
প্রফেট এজেকিয়েল ছিলেন পুরোহিত শ্রেণির মানুষ। প্রফেটরা একমাত্র সত্যস্বরূপ ঈশ্বর ছাড়া কারও কাছে মাথা নোয়াতেন না। তাঁদের না ছিল কোনো পরোয়ানা, না ছিল কোনো দীক্ষা। এই প্রফেটরা শুধু ধর্ম উপদেশ দিতেন তা কিন্তু নয়, তুখোড় রাজনীতিও করতেন। মিশরের বিরুদ্ধে কিংবা আসিরিয়া বা ব্যাবিলনের বিরুদ্ধে ইহুদিদের প্রণোদিত করতেন। আবার পুরোহিত সম্প্রদায়ের অলসতা এবং রাজাদের গুরুতর পাপের নিন্দাও করতেন। আমরা আজ যাকে সমাজসংস্কার বলি, সেই কাজেও কেউ কেউ মন দিয়েছিলেন। তাঁরা যেখানেই যেতেন সেখানেই বাইবেলের বাণীও যেত। সেখানেই তাঁরা এক নতুন ধর্মচেতনার বিস্তার করতেন। তাঁরা সাধারণ মানুষকে পুরোহিত আর মন্দির পার করে রাজা ও রাজদরবার অতিক্রম করে ধর্মরাজ্যের মুখোমুখি এনে দাঁড় করিয়ে দিত। মানুষের ইতিহাসে এখানেই ইহুদিদের চরম গুরুত্ব। ভাবলে অবাক হতে হয় বন্দিদশাকালীন এক শ্রেণির মানুষের মাথাতেই এসেছিল এরকম নতুন ভাবনা এবং প্রফেটের হাত ধরেই এক শক্তির সূচনা হল। শুরু হল প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের প্রথম অধ্যায়। ধর্মের ইতিহাসে মানুষকে প্রথম ধর্মের অনুশাসনে বেঁধে দিল ইহুদিদের প্রফেটরা। হিব্রুদের বিভিন্ন শ্রেণির সেমিটিক মানুষদের প্রথম ঐক্যবদ্ধ করেছে ইহুদিরাই।
ইহুদি প্রফেটরা যখন চিরন্তন সার্বভৌম এক ন্যায়বান ঈশ্বর এবং মধ্যে সরাসরি নৈতিক দায়িত্বের এক নতুন বোধ জাগিয়ে তুলছিলেন, তখন গ্রিক দার্শনিকরা মানুষের মনকে মানসলোকে অভিযানের এক নতুন পন্থা ও চেতনার তালিম দিচ্ছিলেন। গ্রিক উপজাতিগুলো আর্য ভাষাভাষীর মূল কাণ্ডের একটা শাখা। তৎকালে গ্রিকরাও ছিল প্রচণ্ড রকমের বর্বর ও আক্রমণাত্মক। এঁরা মূলত মূর্তিপুজোয় বিশ্বাসী। গ্রিকদের মূর্তির ধারণার প্রভাব ভারতের দেবদেবীর মধ্যে ব্যাপক পরিমাণে আছে। ভারতীয়দের মতো গ্রিকদেরও গল্প-পুরাণ আছে– ইলিয়ড ও অডিসি। গ্রিক জাতিও বহু দেশে উপনিবেশ স্থাপন করেছিল। কিন্তু যে ভৌগোলিক পরিস্থিতি গ্রিক রাজ্যগুলিকে বিচ্ছিন্ন ও বিভিন্নরূপী করে রেখেছিল, তা তাঁদের বড়ো হতে দেয়নি। সবচেয়ে বড়ো রাজ্যগুলি ইংল্যান্ডের অনেক কাউন্ট্রির চেয়ে ছোটো ছিল। আদর্শ ও সহানুভূতির একতা থাকা সত্ত্বেও সংযুক্ত হওয়ার কোনোরকম ইচ্ছা তাঁদের ছিল না। তবে খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীর উল্লেখযোগ্য এই অনুসন্ধিৎসু গ্রিক জাতিই পৃথিবীর প্রথম দার্শনিক এবং প্রথম জ্ঞান-প্রেমিক। আবার এই গ্রিকরাই নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করায় পারদর্শী ছিল, বিশেষ করে স্পার্টান গ্রিকরা। স্পার্টান গ্রিকরা গ্রিস অভিযানে নগর ধ্বংস করেছিল। সেই ধ্বংস এতটাই বিধ্বংসী ছিল যে সেই খবর শুনে দারিয়ুসের মৃত্যু হয়। তাঁর মৃত্যুর পর পুত্র জেরেক্সেস গ্রিকদের ধ্বংস করার জন্য চার বছর ধরে নিজেকে প্রস্তুত করতে থাকে। সেই ভয় অবশ্য সমস্ত গ্রিকদের ঐক্যবদ্ধ করে দিয়েছিল। তখন পর্যন্ত পৃথিবীতে যত বিশাল সৈন্যবাহিনী দেখা গেছে, জেরেক্সের সৈন্যবাহিনী ছিল সবচেয়ে বিশাল। থার্মোপাইলির সংকীর্ণ গিরি-সংকটে স্পার্টান গ্রিক সেনাধ্যক্ষ লিওনিতাসের অধীনে মাত্র ১৪০০ সেনার ছোট্ট বাহিনী নিয়ে এই বিশাল বাহিনীকে পরাস্ত করে। একেবারে বিধ্বস্ত করে দেয়। প্রত্যেকটি সেনার মৃত্যু হয়েছিল। এরপর হয়েছিল পেলোপনেসীয় যুদ্ধ (৪৩১ থেকে ৪০৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)। এই যুদ্ধে গ্রিস ক্ষয় হয়েছিল। ৩৫৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ম্যাসিডোনিয়ার রাজা হয়েছিলেন উচ্চাশার অধিকারী ফিলিপ। প্রথমেই তিনি রাজ্য বৃদ্ধি ও সৈন্যদল পুনর্গঠন করার কাজ শুরু করেন। তিনিই প্রথম তাঁর পদাতিকদের ঘনসন্নিবদ্ধ একটা বস্তু হিসাবে যুদ্ধ করালেন এবং অশ্বারোহী বাহিনী আবিষ্কার করলেন। এর আগে অশ্বারোহী বলতে মেঘের মতো একঝাঁক খণ্ডযোদ্ধা হিসাবে, আলাদা আলাদা এবং বিশৃঙ্খলভাবে যুদ্ধ করত। যাই হোক, নবনির্মিত বাহিনীর সাহায্যে ফিলিপ থেসালির মধ্য দিয়ে গ্রিস পর্যন্ত তাঁর রাজ্যের সীমানা বিস্তার করল এবং তাঁর মিত্রদের বিরুদ্ধে কিরোনিয়া যুদ্ধে (৩৩৮ খ্রিস্টপূর্ব) সমস্ত গ্রিসকে পদানত করলেন। এমতাবস্থায় সমস্ত গ্রিক রাষ্ট্রের এক মিলিত সভায় ফিলিপকে পারস্যের বিরুদ্ধে এক গ্রিক-ম্যাসিডনীয় মৈত্রীর সেনানায়কের পদে নিয়োগ করা হল। ৩৩৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এই বহু পূর্বকল্পিত অভিযানের পথে এশিয়ায় প্রবেশ করে। কিন্তু শেষরক্ষা হল না। তাঁকে গুপ্তহত্যা করা হয়। সম্ভবত তাঁর রানি অর্থাৎ আলেকজান্ডারের মা অলিম্পিয়াসের প্ররোচনায় এই গুপ্তহত্যা হয়েছিল। মূলত স্বামী ফিলিপ দ্বিতীয়বার বিয়ে করায় তিনি ঈর্ষান্বিত হয়ে এ কাজটি করেছিলেন।
আলেকজান্ডারের বয়স মাত্র ১৮, তখন কিরোনিয়ার যুদ্ধে তিনি অশ্বারোহী বাহিনীর নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। মাত্র ২০ বছর বয়সে বাবার রেখে যাওয়া কাজ হাতে নিয়ে পারসিক অভিযানে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন এবং সফলভাবে পরিচালনা করেছিলেন। তিনি এশিয়ায় ঢুকলেন এবং গ্রানিকাসের যুদ্ধে তাঁর বাহিনীর চেয়ে সামান্য বড়ো একটা পারসিক বাহিনীকে পরাজিত করেন এবং এশিয়া মাইনরের বেশ কয়েকটা নগর দখল করেন। এরপর অপ্রতিরোধ্য আলেকজান্ডার একের পর এক বিধ্বংসী অভিযান করেন। একের পর এক দেশ আলেকজান্ডারের কাছে বশ্যতা স্বীকার করতে থাকল। আক্রান্ত, লুণ্ঠিত ও ধ্বংসের মধ্য দিয়ে আলেকজান্ডারের বিজয়ের রথ এগিয়ে চলল। আলেকজাটো ও আলেকজান্ড্রিয়ায় বিশাল শহর তৈরি করে ফেলার পর পশ্চিম ভূমধ্যসাগরের ফিনিসীয়রা ইতিহাস থেকে হঠাৎ করে উধাও হয়ে গেল। এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই অন্যান্য বাণিজ্যনগরেও ইহুদিদের আবির্ভাব হল। আলেকজান্ডার তাঁর বাহিনী নিয়ে ব্যাবিলনে পৌঁছোলেন। তারপর সুসায় ও পার্সিপোলিসে। সেখানে এক মত্ত উৎসবের শেষে তিনি রাজাধিরাজ দারিয়ুসের প্রাসাদ পুড়িয়ে ছাই করে দেন এবং দারিয়ুসকে হত্যা করা হল। না, দারিয়ুসকে আলেকজান্ডার নিজের হাতে হত্যা করেননি, হত্যা করেছেন তাঁর সেনারা। এরপর তিনি এ-রাজ্য সে-রাজ্য দখল শেষে কাবুল আর খাইবার পথ দিয়ে ভারত উপমহাদেশে ঢুকে পড়লেন এবং তছনছ করলেন, লুঠ করলেন। অবশেষে পৌরবের রাজা পুরুষোত্তমের (পুরু নামেই পরিচিত। পুরু কোনোদিনই ভারতের রাজা ছিলেন না। তিনি ভার উপমহাদেশের অন্তর্গত পৌরব রাজ্যের রাজা ছিলেন। পৌরব রাজ্যটি হল ঝিলাম বা বিতস্তা ও চেনাব বা চন্দ্রভাগা নদীদ্বয়ের মধ্যবর্তী ভূখণ্ড— যা পাঞ্জাব, পাকিস্তান এবং বিপাশা নদীর অববাহিকার অন্তর্ভুক্ত।) সঙ্গে এক বিরাট যুদ্ধে লিপ্ত হলেন। ৩২৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দের আলেকজান্ডারের সঙ্গে যুদ্ধে পরাজিত হন রাজা পুরু। এরপর রাজা পুরু আলেকজান্ডারের অধীনে সামন্তরাজা হিসাবে রাজত্ব চালাতেন। আলেকজান্ডার ৩২৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সুসায় ফিরে যান। ফিরে এসে তিনি তাঁর জয়লব্ধ বিশাল রাজ্য ঐক্য ও শৃঙ্খলাবদ্ধ করার বন্দোবস্ত করতে লাগলেন। পারসিক ও ব্যাবিলনীয় মহিলাদের সঙ্গে ম্যাসিডনীয় সেনানায়কদের বিবাহের ব্যবস্থা করলেন রাজনৈতিক কৌশলগতভাবে। এই বিবাহের ফল কী হয়েছিল তা আর দেখে যেতে পারেননি আলেকজান্ডার। ৩২৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ‘সামান্য জ্বরে তাঁর মৃত্যু হল। জ্বরে মৃত্যু হওয়াটা সে সময়ে জলভাতের মতো ব্যাপার ছিল। জ্বর মানেই মৃত্যু নিশ্চিত।
বৃহৎ গ্রিক সাম্রাজ্য সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নানা উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে বর্তমানে একটি ক্ষুদ্র রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। বর্তমান গ্রিকদের পূর্বপুরুষরা হলেন এক সময়ের পৃথিবী বিজয়ী প্রাচীন গ্রিক সভ্যতা, বাইজানটাইন সাম্রাজ্য এবং চার শতাব্দীর অটোমান সাম্রাজ্য। খ্রিস্টধর্ম বিকাশের পূর্ব পর্যন্ত এখানে হেলেনীয় সংস্কৃতি ছিল। ১২০৪ থেকে ১৪৫৮ সালের মধ্যে ধর্মযুদ্ধ বা ক্রুসেডের সময় ধর্মের নামে প্রতিষ্ঠিত সেনাদল দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিল। প্রাচীন গ্রিসের চূড়ান্ত পর্যায় হল খ্রিস্টানকরণের যুগ, যা শুরু হয় চতুর্থ শতাব্দীর ষষ্ঠ শতাব্দীর প্রথম দিক পর্যন্ত। হেলেনীয় সংস্কৃতি থেকে ইহুদি সংস্কৃতি তারপর ৪০০ বছরের ইসলাম সংস্কৃতি (ওসমানি খেলাফতের আওতাধীন) থেকে এখন খ্রিস্টধর্ম (অর্থোডক্স ৯৭%, বাকিরা মুসলিম)। পশ্চিমা শিল্প-সাহিত্য সংস্কৃতির উপর গ্রিক পুরাণের প্রভাব অনেক। ইউরোপে খ্রিস্টধর্মের ব্যাপক প্রসার সত্ত্বেও ধ্রুপদি সংস্কৃতির সেই প্রভাব অটুট রয়েছে যুগ যুগ ধরে। কিন্তু গ্রিসের পৌরাণিক ধর্ম ও অনুসারীদের অবস্থা ক্রমেই সংকুচিত হয়ে এসেছে। ইতিহাস বলছে, আনুমানিক ৩১২ সালে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষা নেন তৎকালীন রোমান সম্রাট কনস্ট্যান্টাইন। এরপর ৩৮০ থেকে ৩৯৩ সালের মধ্যে সম্রাট প্রথম থিওড়োসিয়াস বেশ কয়েকটি আদেশ জারি করে প্রাচীন ধর্মের চর্চা নিষিদ্ধ করেন। কিন্তু প্রাচীন সেই লৌকিক ধর্ম, মূল্যবোধ, দর্শন ও জীবনধারাকে ফিরিয়ে আনতে চায় গ্রিকদের একটি অংশ। তাঁদের মতে, যোড়শ শতাব্দীর বেশি সময় ধরে খ্রিস্টধর্ম দখল করে রেখেছে গ্রিসকে।
ওসমানি খেলাফতের উত্তরসূরি দ্বিতীয় মোহাম্মদ ফাতেহর সময় গ্রিসের রাজা কনস্টান্টাইন কনস্টান্টিনোপলের সিংহাসনে আসীন ছিলেন। সুলতান মোহাম্মদ ফাতেহ তাঁর পূর্বসূরিদের মতো কনস্টান্টিনোপল দখলের উদ্যোগ নিচ্ছেন জেনে রাজা কনস্টান্টাইন পশ্চিম ইউরোপের খ্রিস্টান রাজাদের কাছে সাহায্যের আবেদন করেন। সমঝোতার খাতিরে তিনি তখন রোমান ক্যাথলিক চার্চের অনেক দাবিদাওয়া মেনে নেন। এতে গ্রিক অর্থোডক্স চার্চের নেতারা খেপে যান। গ্রিক অর্থোডক্স চার্চের প্রধান গ্র্যান্ড ডিউক নোটারাস বলেন, রোমান সম্রাটের মুকুট অপেক্ষা তিনি ওসমানি সুলতানের পাগড়ি দেখতে বেশি পছন্দ করেন। ১৯৫৩ সালের ২৫ মে সুলতান মোহাম্মদ ফাতেহ কনস্টান্টাইনের প্রতিরোধ ভেঙে ফেলে কনস্টান্টিনোপলে প্রবেশ করেন। যুদ্ধে গ্রিসের রাজা নিহত হন। কনস্টান্টিনোপলে ইসলামের পতাকা উড়তে শুরু করে। কনস্টান্টিনোপল দখলের পর মোহাম্মদ ফাতেহ গ্রিক অর্থোডক্স চার্চের কর্তৃপক্ষকে একটি সনদ প্রদান করেন। খ্রিস্টানদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি অবাধে প্রতিপালনের অধিকার স্বীকৃত হয়। সুলতান নির্দেশ দেন যেন কোনো গির্জা ও উপাসনায়গুলোর অসম্মান না করা হয় এবং পাদরি, মহিলা, শিশু ও অক্ষমদের যেন কোনো ধরনের কষ্ট না দেওয়া হয়। যুদ্ধকালে যেসব খ্রিস্টান শহর ছেড়ে পালিয়েছিল, মোহাম্মদ ফাতেহ তাঁদের স্বগৃহে ফিরে আসার আহ্বান জানান। তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে বহু খ্রিস্টান কনস্টান্টিনোপল ফিরে আসে। পরবর্তী সময়ে সেখানে ওসমানি খেলাফতের রাজধানী স্থানান্তর করা হয়।
বর্তমানে গ্রিসের মোট জনসংখ্যার মধ্যে বর্তমানে ৪.৭ শতাংশ মুসলিম। ইতিহাস বলছে, সময়টি ছিল ১৮১৪ সাল। ওডেসাতে চারজন গ্রিক বণিক ‘হিটারিয়া ফিলকি’ নামে এক গুপ্ত কমিটি গঠন করে। ১৮২০ সালে এর সদস্যসংখ্যা এসে দাঁড়ায় দুই লাখে। ইউরোপে ওসমানি খেলাফতের অবসান ঘটিয়ে প্রাচীন গ্রিক সাম্রাজ্যের মতো একটি নতুন গ্রিক সাম্রাজ্য গঠন ছিল এই সমিতির লক্ষ্য। ইতিহাসবিদ লেনপুল বলেন, “স্বাধীনতার উচ্চাদর্শ এই সব বিদ্রোহকে যতখানি না উদ্দীপিত করেছিল, তার চেয়ে বেশি করেছিল রাশিয়ার উস্কানি।” তৎকালীন ওসমানি খেলাফতের উত্তরসূরি দ্বিতীয় মিসরের মোহাম্মদ আলির সৈন্যরা গ্রিক বিদ্রোহীদের প্রায় কোণঠাসা করে ফেলেছিল। এ সময় প্রাচীন সভ্যতার লীলাভূমি গ্রিসের প্রতি ইউরোপীয়দের মনে সহানুভূতি জেগে ওঠে। ১৮২৭ সালে রাশিয়া, ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের মিলিত বাহিনী নাভারিনোর নৌযুদ্ধে ওসমানি নৌবাহিনীকে পরাজিত করে। ১৮২৮ সালে গ্রিসের বিরুদ্ধে নতুন সামরিক অভিযান চালিয়ে ওসমানি বাহিনী আবারও পরাজিত হয়। অবশেষে ১৮২৯ সালে ওসমানি খেলাফত গ্রিসের স্বাধীনতা মেনে নিতে বাধ্য হয়। (সূত্র : উসমানি খেলাফতের ইতিকথা, পৃ. ৪৬)
পরবর্তী সময়ে সেখানে মুসলিমরা কোণঠাসা হয়ে যায়। গড়ে উঠতে দেওয়া হয়নি কোনো মসজিদ। বাতাসে ভাসতে দেওয়া হয়নি আজানের ধ্বনি। ইসলাম সম্পর্কে ছড়ানো হয় বিভিন্ন মিথ্যাচার, যাতে ইসলামের প্রতি মানুষের ঘৃণার সৃষ্টি হয়। এটি মূলত গ্রিক অর্থোডক্স চার্চের সূক্ষ্ম পরিকল্পনা ছিল। তাঁদের বাচ্চাদের শিক্ষা দেওয়া হত— তুর্কিরা ৪০০ বছরেরও বেশি সময় গ্রিস দখলে রেখেছিল। তাঁদের বইপুস্তক মতে, ইসলাম আসলে কোনো ধর্মই ছিল না, হজরত মোহাম্মদকে নবি মনে করা হত না। তাঁকে কেবল মনে করা হত বুদ্ধিমান নেতা ও রাজনীতিবিদ। তিনি ইহুদি ও খ্রিস্টানদের আইন একত্র করে তাঁর নিজস্ব ধ্যানধারণা গড়ে নিয়েছিলেন, বিশ্ব জয় করেছিলেন। অথচ প্রখ্যাত লেখক আরনল্ড টয়েনবি তাঁর শাসনসংক্রান্ত ‘Study of History’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন— “রোমান ও সাসানীয় সাম্রাজ্যের বিজিত প্রদেশগুলোতে বিকল্প ‘ইসলাম বা মৃত্যু’ ছিল না; বরং ছিল ইসলাম কিংবা অতিরিক্ত কর।” এই নীতি ঐতিহ্যগতভাবেই এর জ্ঞানালোকপ্রাপ্ত ও কুসংস্কারমুক্ততার জন্য প্রশংসিত হয়েছিল, যখন অনেক পরে ইংল্যান্ডে লাওডিসিয়ান রানি এলিজাবেথ অনুসরণ করেছিলেন।” বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যযুগীয় ইসলাম বিষয়ক অধ্যাপক মার্লিন সোয়াটজের মতে, বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যে ইহুদি জনগোষ্ঠীর বেশিরভাগ তাঁদের নির্যাতনের শিকার হওয়ার কারণে অসন্তুষ্ট ছিল, ফলে মুসলিম সেনাবাহিনীকে স্বাগত জানিয়েছিল। আর মুসলিম শাসনে ইহুদি সংস্কৃতি নতুন করে বিকশিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছিল। [সূত্র : ইসলামবিহীন বিশ্ব-২৩ (দৈনিক নয়া দিগন্ত)] গ্রিসের ইহুদি যুগ ছিল সুবর্ণযুগ। এই দেশ পশ্চিমা বিশ্বের জ্ঞানবিজ্ঞানের সূতিকাগার। এ সময়েই সময়েই জন্মেছিলেন এইসব মহান মানুষেরা, যাঁরা আজ দেবতাতুল্য –পিথাগোরাস, প্লেটো, অ্যারিস্টটল, সক্রেটিস, গ্যালেনাস, হিপোক্রেটিস, হেরোডেটাস, ইউক্লিড প্রমুখ।
চিন সভ্যতায় কতকগুলি উপজাতি ছিল যাঁদের ভাষা ও জীবনযাত্রার ধরন প্রায় একরকম। উপজাতিদের পরিচয় হল– হুন, মঙ্গোল, তুর্ক, তাতার ইত্যাদি। তাঁরা বারবার বদলেছে, বিভাজিত হয়ে গেছে, আবার মিলেছে, পুনরায় মিলেছে। ঠিক যেভাবে উত্তর ইউরোপের আর মধ্য এশিয়ায় নর্ডিক জাতিগুলি বদলেছে। চিনের একেবারে গোড়ার দিককার সভ্যতা মোটেই মোঙ্গলীয় ছিল না। যেমন ইউরোপ বা পশ্চিম এশিয়ার একেবারে গোড়ার সভ্যতা নর্ডিক বা সেমিটিক ছিল না। ১৭৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে চিনে ছিল ছোটো ছোটো রাজ্য ও নগররাষ্ট্রের এক বিরাট সম্মিলন। কেন্দ্রীয় কর প্রদান করত ঈশ্বরের পুত্রদের, এঁরা মূলত পুরোহিত বা রাজা। ১১২৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে শাঙ বংশের আধিপত্য শেষ হল। শাঙ বংশের পর এলো চৌ বংশ। দীর্ঘ চৌ আমলে চিন। ক্রমশ খণ্ড খণ্ড হয়ে গেল। হুনদের মতো এক জাতি এসে ছোটোছোটো নগর গড়ে তুলল। কর প্রদান বন্ধ করে তাঁরা স্বাধীন হয়ে উঠল। এইভাবে খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে চিনে পাঁচ হাজার থেকে ছয় হাজার প্রায় স্বাধীন রাষ্ট্র ছিল। চিনের ইতিহাসে এই সময়টাকে ‘বিশৃঙ্খলার যুগ বলা হয়ে থাকে। কনফুসিয়াস ছিলেন সেই সময়ের এক অভিজাত বংশের লোক। এই বিশৃঙ্খল যুগে তিনি গভীর যন্ত্রণা বোধ করতেন। তিনি উৎকৃষ্টতর শাসনব্যবস্থা এবং জীবনযাপনের এক আদর্শ মনের মধ্যে গঠন করে রাষ্ট্র থেকে রাষ্ট্রে এমন রাজপুত্রের সন্ধানে ঘুরেছেন, যিনি তাঁর শাসনতান্ত্রিক এবং শিক্ষামূলক ধারণাগুলোকে বাস্তবে রূপ দেবেন। দুর্ভাগ্যবশত সেই স্বপ্নের রাজপুত্রকে তিনি খুঁজে পাননি।
এদিকে ততদিনে উত্তর চিন, হোয়াং হো নদীর চিন চিন্তায় ভাবনায় ক্রমশ কনফুসিয়ান হয়ে উঠছিল। অপরদিকে দক্ষিণ চিন, ইয়াং সিকিয়াং নদীর চিন তাওধর্ম গ্রহণ করল। সেইসময় থেকে চিনে সবসময় একটা সংগ্রাম ও সংঘর্ষ লেগেই থাকত। উত্তর চিন আর দক্ষিণ চিনের পৃথক ধর্মীয় ভাবধারার সংঘর্ষ, যেটা পরে পিকিং ও নানকিঙের সংঘর্ষ। অর্থাৎ উত্তর চিনের নিয়মতান্ত্রিক, ঋজু এবং রক্ষণশীলতার সঙ্গে দক্ষিণে শিল্পীসুলভ, আলগা, অবিশ্বাসী এবং পরীক্ষনিরীক্ষারতদের সংঘর্ষ। সে সময়ে মোটামুটি তিনটি স্তরের শক্তি তখনকার অবস্থায় প্রাধান্য করত। ৎশি ও ৎশিন শক্তি ছিল উত্তর চিনের এবং চু ছিল দক্ষিণ চিনের একটা আক্রমণকারী সামরিক শক্তি। শেষ পর্যন্ত খুশি ও ৎশিন মৈত্রী স্থাপন করে চু-কে বশ্যতা স্বীকার করাতে বাধ্য করল এবং চিনে নিরস্ত্রীকরণ শান্তির একটা সাধারণ সন্ধি স্থাপন করল। ৎশিনের শক্তি ক্রমশ প্রাধান্য লাভ করল। চৌয়ের পুত্র শি হোয়াংতি রাজা হন। এই রাজা বা সম্রাটকেই ‘প্রথম বিশ্বজনীন সম্রাট’ বলা হয়। শি হোয়াংতি টানা ৩৬ বছর রাজত্ব করেছিলেন। তাঁর শক্তিশালী রাজত্বকাল চিনের অধিবাসীদের পক্ষে ঐক্য এবং সমৃদ্ধির এক নতুন যুগের সূচনা হয়। উত্তর মরুভূমির হুন আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে তিনি এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করেন। লক্ষাধিক হত্যাকাণ্ড সাঙ্গ করে ভবিষ্যতে তাতার জাতি (মঙ্গোল জাতি) যাতে আক্রমণ করতে না পারে, সেজন্য তিনি চিনে সুউচ্চ ও বিশাল দৈর্ঘ্যের প্রাচীর নির্মাণের কাজ শুরু করে দেন। প্রাচীর প্রসঙ্গে বলতে হয় সে সময় প্রায় প্রতিটি রাজা বা শাসক বহিঃশত্রুর আক্রমণকে প্রতিরোধ করতে প্রাচীর নির্মাণ বা পরিখা খনন করত। আমাদের ভারত উপমহাদেশের অভ্যন্তরে অসংখ্য ক্ষুদ্র-বৃহৎ স্বাধীন রাজাও এরকম করতেন। রাজস্থানে এখনও সেইরকম প্রাচীর আছে, যা আজ দর্শনীয় স্থান। এই প্রাচীর দৈর্ঘ্যের বিচারে চিনে প্রাচীরের পরেই। পরবর্তীকালে অসংখ্য প্রাচীর বা পরিখা সরিয়ে দেওয়া হলেও রাজস্থানের মতো চিনের প্রাচীরটিও আজও রয়ে গেছে। কারণ ভেঙে ফেলার কোনো প্রয়োজন হয়নি।
যাই হোক, চিন রাজনৈতিকভাবে একিভূত হওয়ার পর খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীর শেষে সাতটি প্রভাবশালী বৃহৎ রাজ্য স্বাধীনভাবে টিকে ছিল। বেশ কিছু বছর এই সাতটি রাজ্য পরস্পরের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত ছিল। এই সময়টিকে বলা হয় ‘আন্তঃরাজ্য যুদ্ধাবস্থার যুগ’ (Warring States period)। খ্রিস্টপূর্ব ২৫৬ পর্যন্ত স্থায়ী হলেও চৌ রাজবংশ মূলত আলংকারিক রাজা ছিলেন। প্রকৃত ক্ষমতা তাঁদের হাতে ছিল না। এই যুগের চূড়ান্ত সম্প্রসারণ শুরু হয় কিন রাজা ইঙ জেঙের শাসনকালে। তিনি অন্য ছয়টি শক্তিশালী রাজ্যকে একত্রিত করেন। খ্রিস্টপূর্ব ২১৪ সালে তিনি পার্শবর্তী আরও এলাকা আধুনিক চিনের জিংজিয়ান, ফুজিয়ান, গাঙডঙ এবং গাংগক্সি তাঁর রাজ্যের সঙ্গে যুক্ত করেন। তাঁর সম্রাজ্যের আকার বৃদ্ধি পায় এবং তিনি নিজেকে চিনের সম্রাট হিসাবে ঘোষণা করেন। চিনের ইতিহাসে তিনিই ছিলেন প্রথম সম্রাট (কিন শি হুয়াং)।
খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ সাল থেকে চিনের শাঙ সাম্রাজ্যের (১৬০০ থেকে ১০৪৬ খ্রিস্ট-পূর্ব) আমলে লিখিত ও গ্রহণযোগ্য ইতিহাস পাওয়া যায়। প্রাচীন ইতিহাস গ্রন্থ যেমন ‘Record of Grand Hiatorian’ (১০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে) এবং ‘Bamboo Aynals’-এ সিয়া সাম্রাজ্যের উল্লেখ পাওয়া যায়। তখন থেকে শাঙ সাম্রাজ্যের আমল পর্যন্ত লিখিত কোনো দলিল দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করার কোনো উপায় চিনাদের জানা ছিল না। ঝউ রাজবংশের (১০৪৬ থেকে ২৫৬ খ্রিস্ট-পূর্ব) আমলে চিনের সংস্কৃতি, সাহিত্য ও দর্শনের প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়। খ্রিস্ট পূর্ব অষ্টম শতাব্দী থেকে ঝউ শাসকরা নানা রকম অভ্যন্তরীণ ও বহিঃশত্রুর চাপের কাছে নতি স্বীকার করতে শুরু করে এবং এক সময় বিভিন্ন ছোটো ছোটো রাজ্যে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এই ক্ষয়িষ্ণু অবস্থা ‘শরৎ’ ও ‘বসন্ত পর্যায় (Spring and Autumn period) থেকে শুরু হয় এবং আন্তঃরাজ্য যুদ্ধাবস্থা (Warring States period) এই সময়ে পূর্ণতা পায়। এই সময়কালটি ছিল চিনের ইতিহাসের অন্যতম ব্যর্থ রাষ্ট্রীয় শাসনামল। এই ব্যর্থ রাষ্ট্রীয় শাসনামলের সময় ছিল ১৯২৭ সালে চিনের গৃহযুদ্ধ পর্যন্ত। বহু রাজ্য ও যুদ্ধবাজ নেতাদের শাসনামলে চৈনিক রাজবংশগুলো চিনের একটি অংশ শাসন করত। যার সীমানা বর্তমান জিংজিয়ান এবং তিব্বত পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। ২২১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে কিন শি হুয়াং বিভিন্ন যুদ্ধরত রাজ্যগুলোকে একত্রিত করে কিন বংশের একটি ক্ষুদ্র সাম্রাজ্য (হুয়াংডি) প্রতিষ্ঠা করেন এবং চৈনিক সাম্রাজ্যের ইতিহাসের ধারা শুরু করেন। পরবর্তী রাজবংশগুলো একটি জনপ্রশাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিল, যা ক্রমে তৎকালীন চিনের বিশাল এলাকায় চৈনিক সম্রাটের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে সাহায্য করে। চিনের সর্বশেষ সাম্রাজ্য ছিল কিন সাম্রাজ্য (১৬৪৪ থেকে ১৯১২), যার উচ্ছেদের পর ১৯১২ সালে রিপাবলিক অব চায়না এবং ১৯৪৯ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী চিন প্রতিষ্ঠিত হয়। চিনের প্রাচীন ও মধ্যযুগের শাসকদের একনজরে দেখে নিই। তাহলে ছবিটা পরিষ্কার হবে।
ছিন সাম্রাজ্য (খ্রিস্টপূর্ব ২২১ থেকে ২০৬ অব্দ) : চিন তখন হান, ওয়েই, চাও, ছি, ছু এবং ইয়ান এই ছয়টি রাষ্ট্রে বিভক্ত ছিল। রাজা ছিন শি হুয়াং এই ছয়টি রাজ্যকে একত্রিত করে ছিন সাম্রাজ্য গড়ে তুলেন। তখনকার দিনে রাজা বা শাসকের নামেই সাম্রাজ্য বা রাষ্ট্রের নাম হত। পৃথিবীর সব সাম্রাজ্যেই এমন হত। সে সময়ের শাসকরা মনে করত সাম্রাজ্য তাঁরই মালিকানা। আগে বলেছি ইতিহাসে তিনি প্রথম চৈনিক সম্রাট হিসাবে পরিচিত। দুর্ধর্ষ বর্বর তাতার জাতির (হুন বা মঙ্গোল জাতি) হাত থেকে চিনকে রক্ষা করার জন্য তিনি সমগ্র চিনের উত্তর সীমান্ত জুড়ে প্রাচীর নির্মাণের উদ্যোগ নেন। যা চিনের মহাপ্রাচীর নামে পরিচিত। যদিও বর্তমানে সেই প্রাচীরের সামান্য কিছু অংশের অস্তিত্ব আছে। ছিন শি হুয়াং তাঁর প্রধানমন্ত্রী লি শিংকে সঙ্গে নিয়ে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংস্কার করন। এছাড়া শি হুয়াংয়ের অবদানগুলোর মধ্যে অন্যতম হল কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা, একক আইন ও ধারা প্রণয়ন, লেখ্য ভাষার প্রবর্তন এবং মুদ্রার প্রচলন।
পশ্চিম হান : লিউ বাং হান বংশ প্রতিষ্ঠা করেন। এক গৃহযুদ্ধে স্বল্পস্থায়ী কিন বংশের পতন হয়। হান শাসনামল ছিল চিনের ইতিহাসের স্বর্ণযুগ। হান শাসকরা রাজনৈতিক স্থায়িত্ব ও উন্নতির পাশাপাশি পরবর্তী দুই সহস্রাব্দের জন্য চৈনিক সাম্রাজ্যকে একটি কঠিন ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠা করার প্রয়াস পান। এই শাসনামলে চৈনিক সাম্রাজ্য মূল চিন’ (চিনের ১৮ প্রদেশ) পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। পশ্চিমের ভূখণ্ডও চৈনিক সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। কনফুশীয় মতবাদ সরকারিভাবে মৌলভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হয়। এই মতবাদ চৈনিক সভ্যতার সঠিক রূপায়ণে অবদান রাখে। এই শাসনকালে কলা, সংস্কৃতি এবং বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব উন্নতি সাধিত হয়। হান সম্রাজ্যের গভীর এবং দীর্ঘস্থায়ী প্রভাবের কারণে সমগ্র চিন জাতির মানুষ একসময় ‘হান’ হিসাবে পরিচত ছিল। এই হান জাতি বর্তমান চিনের সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতিগোষ্ঠী।
সিন সাম্রাজ্য : নবম খ্রিস্টাব্দে দখলদার ওয়াং মাং দাবি করেন যে, হান বংশের উপর স্বর্গাদেশ ছিল, তা আর বলবৎ নেই। তিনি হান শাসনামলের সমাপ্তি ও স্বল্পস্থায়ী ‘সিন’ (নতুন) বংশ প্রতিষ্ঠার ঘোষণা করেন। ওয়াং মাং ভূমি ও অর্থনৈতিক সংস্কারের পাশাপাশি দাস প্রথা রোহিতকরণ এবং ভূমি জাতীয়করণ পুনর্বণ্টন সহ বেশ কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করেন। সাধারণ কৃষকদের স্বার্থে গৃহীত এ সমস্ত প্রকল্প ভূমির মালিক ধনাঢ্য ব্যক্তি ও পরিবারের সমর্থন পায়নি। ক্ষমতার অস্থিরতা, বিশৃঙ্খলা, বিদ্রোহের জন্ম দেয়, সেই সঙ্গে অনেক অঞ্চল সম্রাটের হাতছাড়া হয়ে যায়। হলুদ নদীর আকস্মিক বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটায়। বন্যা ও পলিমাটির আস্তরণ বিশাল এলাকায় কৃষক জনগোষ্ঠীকে বাস্তুচ্যুত করে। ২৩ খ্রিস্টাব্দে একদল ক্রুদ্ধ কৃষক ওয়াং মাংকে তাঁর প্রাসাদেই হত্যা করে।
পূর্ব হান : সম্রাট গুয়াংউ জমিদার ও ধনাঢ্য ব্যবসায়ীদের সাহায্যে হান বংশকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। পুরোনো রাজধানী জিয়ানের কিছু আগে নতুন হান রাজধানী স্থাপন করার জন্য এই নতুন হান সাম্রাজ্যের নামকরণ করা হয় পূর্ব হান বংশ। সম্রাট মিং ও জাং আরও অধিক কর্মক্ষম প্রশাসনযন্ত্রের সাহায্যে হানদের হৃত গৌরব পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হন। পাশাপাশি সামরিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও প্রচুর উন্নতি পরিলক্ষিত হয়। হানদের হাতে জিয়ংজু সম্রাজ্যের পতন ঘটে। রাষ্ট্রদূত ও সেনাপতি বান চাও পামির পর্বতের মধ্য দিয়ে কাস্পিয়ান সাগর পর্যন্ত সাম্রাজ্যের সীমানা বিস্তার করেন। সিল্ক রুটের সূচনা হয়, বৈদেশিক বাণিজ্যের পথ সুগম হয় সেই সঙ্গে চিনে বৌদ্ধ মতবাদের আগমন হয়। পূর্ব হান শাসনকাল ছিল প্রাচীন চিনের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রভূত উন্নতির কাল। বিশেষ করে কাই লুনের কাগজের আবিষ্কার এবং বহুবিদ জ্যাং হেংয়ের অগণিত অবদান।
রাজ্যত্রয় (২২০ থেকে ২৮০ সাল) : খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীতে ভূমি দখল, বহিঃশত্রুর আক্রমণ এবং বিভিন্ন গোত্র ও খোঁজাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-বিবাদের কারণে চৈনিক সাম্রাজ্যের পতন শুরু হয়। ১৮৪ সালে ‘হলুদ পাগড়ি বিদ্রোহ দেখা দেয়, সেই সঙ্গে সূচনা হয় যুদ্ধবাজ নেতাদের যুগ। এসব হাঙ্গামার সময় তিনটি সাম্রাজ্য তাঁদের আধিপত্য বিস্তারে সচেষ্ট ছিল। এই সময়টি চৈনিক ইতিহাসে ‘রাজ্যত্রয়’ (Three Kingdoms) হিসাবে পরিচিত। Romans of the three Kingdom’ সাহিত্যকর্মে এসময়কার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। চাও কাও ২০৮ সালে চিনের উত্তর অংশ পুনঃএকত্রীকরণ করেন। পরবর্তীতে তাঁর পুত্র ২২০ সালে উই বংশ প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন। উইয়ের প্রতিদ্বন্দ্বী শু এবং উ বংশ তাঁদের স্বাধীনতা ঘোষণা করে। ফলশ্রুতিতে চিন তিনটি স্বাধীন ও পৃথক রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়ে পড়ে। ধীরে ধীরে কিন ও হান শাসনকালের কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা ধীরে ধীরে ভেঙে পরে এবং রাজনৈতিক ক্ষমতা কিছু বৃহৎ পরিবারের হাতে চলে আসে। ২৬৫ সালে জিন বংশ উইদের। ক্ষমতা থেকে উৎখাত করে এবং ২৮০ সালে তাঁরা চিনকে ঐক্যবদ্ধ করে। তবে এই ঐক্য ক্ষণস্থায়ী ছিল।
জিন সাম্রাজ্য (২৬৫ থেকে ৪২০ সাল) : অ-হান অভিবাসীদের বিদ্রোহের পর উত্তর চিন হাতছাড়া হয়ে যায়। বিদ্রোহীরা লুয়াঙ এবং চাংয়ান দখল করে নেয়। এছাড়া রাজপুত্রদের মধ্যে পারস্পরিক সংঘাত জিন শাসনকে ক্রমেই দুর্বল করে ফেলে। একজন জিন রাজকুমার নানজিং সম্রাট হন ৩১৭ সালে। ইতিহাসে এই নতুন সম্রাজ্য পূর্ব জিন সাম্রাজ্য নামে পরিচিত ছিল। এই সাম্রাজ্য পরবর্তী এক শতাব্দী পর্যন্ত টিকে ছিল। উত্তর চিন কয়েকটি পৃথক ও স্বাধীন রাজ্যে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এসব রাজ্যের বেশিরভাগই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল Xiongnu, Xianbei, Jie, Dj এবং Qiang শাসকদের দ্বারা। এসব শাসকরা হান জাতিভুক্ত ছিল না। তাঁরা ছিল তুর্কি, মোঙ্গল এবং তিব্বতীয় জাতিগোষ্ঠীর মানুষ।
উত্তর ও দক্ষিণের রাজবংশ (৪২০ থেকে ৫৮৯ সাল) : পঞ্চম শতাব্দীর শুরুতে চিন নতুন একটি যুগে প্রবেশ করে যা উত্তর ও দক্ষিণের রাজবংশ’ নামে পরিচিত। এ সময় উত্তর ও দক্ষিণ চিনে সমান্তরাল অথচ পৃথক শাসনক্ষমতা বিরাজমান ছিল।
সুই সাম্রাজ্য (৫৮৯ থেকে ৬১৮ সাল) : সুই রাজবংশ মাত্র ২৯ বছর টিকে ছিল। কিন্তু স্বল্পকালের শাসন চিনের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। সুইরা চিনকে পুনরায় একত্রিক করে। তাঁরা রাষ্ট্রযন্ত্রে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যেগুলো পরবর্তী শাসকরা গ্রহণ করেছিলেন। এ সময়কার গুরুত্বপূর্ণ অবদানগুলোর মধ্যে অন্যতম হল— তিনটি বিভাগে বিভক্ত সরকার ব্যবস্থা, ছয়টি মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা, মুদ্রাব্যবস্থা, প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার উন্নতি, মহাপ্রাচীরের সম্প্রসারণ এবং বৌদ্ধ ধর্মকে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা দান ইত্যাদি। কিনদের মতো সুই সম্রাটরাও প্রাপ্ত সম্পদের অতিরিক্ত ব্যবহার শুরু করেন, যার ফলে তাঁদের পতন ত্বরান্বিত হয়।
তাং সাম্রাজ্য (৬১৮ থেকে ৯০৭ সাল) : ৬১৮ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট গাউজু তাং রাজবংশের প্রতিষ্ঠা করেন। এই শাসনকাল ছিল কলা, সাহিত্য, বিশেষ করে কাব্যসাহিত্য এবং কারিগরি উৎকর্ষের স্বর্ণযুগ। এঁর শাসনকাল বৌদ্ধধর্ম সাধারণ মানুষের ধর্ম হিসাবে প্রতিষ্ঠা পায়। তাং সাম্রাজ্যের রাজধানী চাংগাঙ ছিল তৎকালীন বিশ্বের সর্ববৃহৎ নগরী। দ্বিতীয় তাং সম্রাট তেইজং যাযাবর জাতির বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান পরিচালনা করেন। রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে চিন সাম্রাজ্যের সীমানা আরও বিস্তৃতি লাভ করে। তিনি ছোটো ছোটো প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোকে ট্রিবিউটারি ব্যবস্থার অন্তর্গত করেন। তাং রাজবংশের সমৃদ্ধির পিছনে ছিল একটি শক্তিশালী কেন্দ্রীয় আমলাতন্ত্র। তিনটি বিভাগ ও ছয় মন্ত্রণালয়ে বিভক্ত প্রশাসনযন্ত্র একই সঙ্গে রাজপরিবারের সদস্য ও মেধাবী কর্মকর্তাদের দ্বারা পরিচালিত হত। রাজকীয় পরীক্ষার মাধ্যমে এ সব কর্মকর্তাদের বাছাই করা হত। এসব প্রশাসনিক ব্যবস্থা পরবর্তী শাসকরাও বহাল রাখেন।
পঞ্চ বংশ ও দশ রাজ্য (৯০৭ থেকে ৯৭০ সাল) : ৯০৭ থেকে ৯৭০ সাল পর্যন্ত চিনের ইতিহাসের রাজনৈতিক অনৈক্যকে বলা হয় ‘পঞ্চ বংশ ও দশ রাজ্যর শাসনামল। দীর্ঘ অর্ধশত বছর যাবৎ চিন ছিল একটি বহুরাজ্য শাসিত অঞ্চল। পাঁচটি রাজবংশ একের পর এক উত্তরাঞ্চলের সাবেক চিন সাম্রাজ্যের কেন্দ্রগুলির শাসন ক্ষমতা দখল করে। একই সময়ে দক্ষিণ ও পশ্চিম চিনে দশটি রাজ্যের শাসন অপেক্ষাকৃত স্থায়ী ছিল।
সং, লিয়াও, ঝিন এবং পশ্চিম সিয়া সাম্রাজ্য (৯৬০ থেকে ১২৩৪ সাল) : ৯৬০ খ্রিস্টাব্দে সং বংশ চিনের অধিকাংশ অঞ্চলের শাসন ক্ষমতা দখল করে এবং কাইফেঙে (বিয়নজিং) রাজধানী স্থাপন করে। চিন অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হয়। এ সময় কিতাল লিয়াও মাঞ্চুরিয়া, মোঙ্গলিয়া এবং উত্তর চিনের কিছু অংশ শাসন করত।
ইউয়ান সাম্রাজ্য (১২৭১ থেকে ১৩৬৮ সাল) : জুৰ্চেন (furchen) ছিলেন ঝিন বংশের প্রতিষ্ঠাতা, যিনি মোঙ্গলদের দ্বারা পরাজিত হয়েছিলেন। এরপর মোঙ্গলরা দক্ষিণ সং প্রদেশের দিকে অগ্রসর হলে এক দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। এটাই ছিল চিনের প্রথম যুদ্ধ যেখানে আগ্নেয়াস্ত্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই যুদ্ধের পরবর্তী সময়কে বলা হয় পাক্স মঙ্গোলিকা (Pax Mongolica)। এ সময় মার্কো পোলো ও অন্যান্য ইউরোপীয় পরিব্রাজকরা চিন ভ্রমণ করেন এবং চিন সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্য ইউরোপে পৌঁছোয়। ইউয়ান শাসনকালে মোঙ্গলদের দুইটি অংশে ভাগ করা হয়— একটি অংশ স্তেপে থেকে যায় এবং আর-একটি অংশ চৈনিক রীতিনীতি গ্রহণ করে। চেঙ্গিস খানের পৌত্র কুবলাই খান ইউয়ান বংশ প্রতিষ্ঠা করেন। ইউয়ান শাসনকালেই সর্বপ্রথম বেইজিং থেকে সমগ্র চিন সাম্রাজ্য পরিচালিত হয়। এর আগে ঝিন সম্রাটদের রাজধানী ছিল বেইজিং। কিন্তু তাঁরা সমগ্র চিনের শাসক ছিলেন না।
মিং সাম্রাজ্য (১৩৬৮ থেকে ১৬৪৪ সাল) : ইউয়ান বংশ এক শতাব্দীরও কম সময়ে চিনের শাসন ক্ষমতায় ছিল। মোঙ্গলদের শাসনের বিরুদ্ধে এ সময়ে চৈনিক জনগণের মনে অসন্তোষ তৈরি হয়েছিল। ঘন ঘন প্রাকৃতিক দূর্যোগ আঘাত হানার পর এই অযোন্তোষ ১৩৪০ সালে ব্যাপক কৃষক বিদ্রোহে রূপ নেয়। ১৩৪৮ সালে মিং বংশ ইউয়ান বংশকে উৎখাত করে। ব্যাপক নগরায়ন হতে থাকে। ভিনদেশি আতঙ্ক বা জেনোফোবিয়া অথবা নব্য-কনফুসিয়াজম ধারণার ব্যাপক প্রচলন সত্ত্বেও মিং শাসিত চিন বহিঃবিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল না। মিং শাসকরা একটি দৃঢ় এবং জটিল কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল। ক্রমেই মিং শাসকরা একচ্ছত্র স্বৈরশাসকে পরিণত হয়।
কিং সাম্রাজ্য (১৬৪৪ থেকে ১৯১১ সাল) : কিং রাজবংশ চিনের ইতিহাসের সর্বশেষ রাজবংশ। মাধুসরা এই বংশ প্রতিষ্ঠা করে। অ-হান চৈনিক কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত দ্বিতীয় রাজবংশ যাঁরা সমগ্র চিন শাসন করেছিল। মাথুরা পূর্বে জুৰ্চেন (Jurchen) নামে পরিচিত ছিল। যাঁরা উত্তর-পশ্চিম চিনে মিং শাসিত এলাকার বাইরে মহাপ্রাচীরের অপর প্রান্তে বসবাস করত। মিং বংশের শেষ শাসকদের কাছে তাঁরা একসময় বড়ো রকম হুমকিস্বরূপ ছিল। বিশেষ করে নুরচাই যখন সমস্ত জুৰ্চেন উপজাতিদেরকে সংঘবদ্ধ করে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে। যদিও শেষ মিং সম্রাট চংজেন এক কৃষক বিদ্রোহের পর ১৬৪৪ সালে সিংহাসনচ্যুত হওয়ার পর আত্মহত্যা করেন। মাঞ্চুরা একজন প্রাক্তন মিং সেনাপতির সঙ্গে সন্ধিবদ্ধ হয়ে চিন আক্রমণ করে। প্রথমে বেইজিং দখল করে রাজধানী হিসাবে ঘোষণা করেন। পরে ধীরে ধীরে দক্ষিণের এলাকাগুলো দখল করে নেয়। মাঞ্জু শাসনকালে ব্যাপক হত্যালীলা চালানো হয়। সর্বমোট ২৫ মিলিয়ন মানুষ প্রাণ হারান। চিনের অর্থনীতির ব্যাপক ক্ষতি হয়। এসময় মাঞ্চুরা ঐতিহ্যগতভাবে চিনা সরকারের কনফুশিয়ানের নিয়ম গ্রহণ করে। এই। কারণে তাঁদের চিনা রাজবংশ হিসাবে বিবেচনা করা হত। মাঞ্চুরা ‘বেণী আদেশ’ বলে সকল হান-চৈনিকদের চুলে বেণী বাঁধতে বাধ্য করে। সমস্ত সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মাধুদের প্রথাগত পোশাক পরিধান করার আদেশ দেওয়া হয়। যদিও সাধারণ হান বংশদ্ভুত চিনারা তাঁদের পছন্দমতো পোশাক পরিধান করতে পারত। কিয়ালং সম্রাটের শাসনকালে কিং সাম্রাজ্য সমৃদ্ধির সৰ্বোচ্চ শিখরে পৌঁছোয়। চিন সম্রাট তখন পৃথিবীর এক-তৃতীয়াংশ জনগণকে শাসন করত। উনিশ শতকে এসে চিন সাম্রাজ্য ক্রমশই দুর্বল হয়ে পড়ে। এবং পশ্চিমা শক্তির দ্বারা নানা হুমকির সম্মুখীন হয়। ১৮৪০ সালে প্রথম আফিম যুদ্ধে চিন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের কাছে পরাজিত হয়। ১৮৪২ সালে নানকিং চুক্তির মাধ্যমে হংকং তাঁদের হাতছাড়া হয়ে যায়। এসময়ে চিনে তাইপিং বিদ্রোহ (১৮৫১-১৮৬৪) দেখা দেয়। এটি একটি খ্রিস্টান ধর্মালম্বীদের বিদ্রোহ, যাঁরা এক যুগেরও বেশি সময় ধরে এক-তৃতীয়াংশ চৈনিক ভূমি শাসন করেছে। ১৮৬৪ সালে তৃতীয় নানকিং যুদ্ধে তাঁরা পরাজিত ও নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। সৈন্যবাহিনীর সংখ্যা বিবেচনায় এটি ছিল উনিশ শতকের সবচেয়ে বড়ো যুদ্ধ। এ যুদ্ধে ২০ মিলিয়ন মানুষের মৃত্যু হয়। এসময়ে বেশ কিছু ধারাবাহিক বেসামরিক অসন্তোষ দেখা যায়। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল, পুন্টি-হাক্কার যুদ্ধ, নিয়ান বিদ্রোহ, দুঙ্গা বিদ্রোহ এবং প্যান্থে বিদ্রোহ। এসব বিদ্রোহ সফলভাবে দমন করা হলেও তার জন্য প্রচুর মূল্য দিতে হয়েছিল। হতাহতের সংখ্যা ছিল প্রচুর। এসব কারণে কেন্দ্রীয় রাজকীয় কর্তৃপক্ষ দুর্বল হয়ে পড়ে।
চিনের মুসলিমদের ঐতিহাসিক দলিল অনুযায়ী, চিনে ইসলাম এসেছিল সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাসের হাত ধরে, যিনি মোহাম্মাদের মৃত্যুর ২০ বছরেরও কম সময়ের মধ্যে ৬৫১ সালে ইসলামের তৃতীয় খলিফা ওসমানের দ্বারা দূতদের নেতা হয়ে চিনে তৃতীয়বারের মতো চলে আসেন। ট্যাং সম্রাট গাওজং তাঁদেরকে সাদরে অভ্যর্থনা জানান এবং ক্যান্টনে স্মারক মসজিদ নির্মাণ করতে আদেশ করেন। এটি ছিল দেশটির প্রথম মসজিদ, যা নবি মোহাম্মদের স্মৃতি রক্ষার্থে তৈরি হয়। হুই কিংবদন্তি অনুসারে চিনে ৬১৬-১৭ সালে সাহাবিদের চিন ভ্রমণের মাধ্যমেই চিনে ইসলামের সূচনা ঘটে। আধুনিক ঐতিহাসিকরা যুক্তি দেখাচ্ছেন যে, চিনে ওয়াক্কাসের আসার কোনো সাক্ষ্যপ্রমাণ নেই। তাঁরা বিশ্বাস করেন না যে, মুসলিম কূটনীতিক ও বণিকগণ ট্যাং চিনে মধ্যযুগের শুরুর কয়েক দশকের মধ্যে পৌঁছেছিলেন। ট্যাং রাজবংশের বিশ্বজনীন ও অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতি, মধ্য এশিয়ার সঙ্গে এর ব্যাপক যোগাযোগ এবং চিনের শহরে বাস করা মধ্য এশীয় ও পশ্চিম এশীয় অমুসলিম বণিক চিনে ইসলামের সূচনায় সাহায্য করেছিল। ট্যাং রাজবংশের (৬১৮-৯০৭ সাল) বর্ষবিবরণে তা শি শিরোনামের। অধীনে প্রথম কোনো চৈনিক লিখিত দলিলে আরবদের সম্পর্কে জানা যায়। তা শি বা দা শি হচ্ছে তাজির চৈনিক শব্দ, পারস্যের লোকেরা আরবদেরকে ‘তাজি’ নামে সূচিত করতেন। ৭১৩ সালের একটি তথ্যে দা শি দূতদের আসার কথা জানা যায়। চিনে মুসলিমদের প্রথম প্রধান উপনিবেশে আরব ও পারস্যের বণিকরা ছিলেন। ৭৫১ সালে তালাসের যুদ্ধের সময় ট্যাং রাজবংশ ও আব্বাসীয় খলিফাঁদের মধ্যে দ্বন্দ্ব থাকলেও এর পরপরই এই দুই রাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্কের উন্নতি ঘটে। ৭৫৬ সালে সম্ভবত পারস্য এবং ইরাকিদের নিয়ে একটি প্রতিনিধি দলকে আন লুশানদের বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে সম্রাট সু শুঙকে সাহায্য করার জন্য কানসুতে পাঠানো হয়। এরপর ৫০ বছরেরও কম সময়ের মধ্যে মধ্য এশিয়ায় তিব্বতীয়দের আক্রমণের বিরুদ্ধে ট্যাং এবং আব্বাসীয়দের মধ্যে জোট তৈরি হয়। খলিফা হারুন উর রশিদের (৭৬৬-৮০৯ খ্রিস্টাব্দ) একটি দল চ্যাংগানে পৌঁছেছিল। এই তথ্য সংরক্ষিত আছে যে, গুয়াংঝৌতে কোন্দলের কারণে একটি বৃহৎ মুসলিম উপনিবেশ ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল এবং সেখানকার লোকজন পালিয়ে গিয়েছিল। এই সম্প্রদায় একটি বিশাল মসজিদ (হুয়াইশেং মসজিদ নির্মাণ করেছিল, যা ১৩১৪ সালে আগুনে পুড়ে ধ্বংস হয় এবং ১৩৪৯ থেকে ১৩৫১ সালে এটিকে পুনর্নির্মাণ করা হয়। ট্যাং রাজবংশের সময়, আরব (তা শি) ও পারসিক (পো সি)। বণিকদের একটি ধীরপ্রকৃতির ধারা সিল্ক সড়ক ও সমুদ্রপথ ধরে কুয়াংঝৌ বন্দর হয়ে চিনে প্রবেশ করে। এদের সমস্ত অভিবাসীই মুসলিম ছিলেন না, কিন্তু এঁদের অনেকেই যাঁরা চিনে থেকে গিয়েছিলেন, তাঁরা চিনের মুসলিম জনগোষ্ঠী এবং হুই নৃগোষ্ঠীর ভিত্তি তৈরি করে। পারস্যের অভিবাসীরা পোলো, তাঁদের কুইসাইন, তাঁদের বাদ্যযন্ত্র এবং ঔষধ সম্পর্কিত তাঁদের জ্ঞান চিনে পরিচিত করার।
ইতোমধ্যে শক, গথ, হুন, ভ্যান্ডাল প্রভৃতি বর্বর গোষ্ঠীর আক্রমণে পশ্চিমাঞ্চলীয় রোমান সাম্রাজ্য বিধ্বংস হয়েছে। সেখানে সামন্ততন্ত্র প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে এবং কালক্রমে সেই সামন্তব্যবস্থা থেকে উদ্ভূত হয়েছে বিভিন্ন ইউরোপীয় রাজ্য। আর ক্রমবর্ধমান শক্তির অধিকারী হয়েছে খ্রিস্টীয় যাজকতন্ত্র। পূর্বাঞ্চলীয় গ্রিক সাম্রাজ্যেও রাষ্ট্রশক্তির উত্থান-পতন হয়েছে। উত্থান-পতনের ছায়া মুসলিম সাম্রাজ্যেও পড়েছে। ১০৫০ সালের দিকে এশিয়া মাইনরে উদ্ভব হল তুর্কিদের কর্মকাণ্ড। এইসব তুর্কিরা ছিল ইসলামে নব দীক্ষিত। প্রকৃত ইসলামী আদর্শ থেকে দূরে এদের অবস্থান। এইসব তুর্কিরা শক্তিতে ছিল প্রবল। বাগদাদি খলিফার আনুগত্য মেনে নিয়ে সাম্রাজ্য সংরক্ষণের কাজে মনোযোগী হলেও তাঁদের দৌরাত্ম্য প্রতিরোধ করতে সম্রাট ডায়োজিনিস রোমেনাসের নেতৃত্বে কনস্ট্যান্টিনোপলের বিশাল বাহিনী এগিয়ে গেল। অবশ্য ১০৭১ সালে মানজিকার্টের যুদ্ধে পূর্বাঞ্চলীয় সম্রাটের এই বিশাল বাহিনী পরাস্ত ও পর্যদস্ত হল। সেইসঙ্গে এশিয়া মাইনরে তুর্কি সুলতানের আধিপত্য সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল। তুর্কি শাসক সেলজুক সুলতান মালিক শাহর শাসনামলে (১০৭৩-১০৯২) মুসলিম সাম্রাজ্যের সীমানা পূর্বে কাশ্মীর থেকে পশ্চিমে ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত, উত্তরে জর্জিয়া থেকে দক্ষিণে ইয়েমেন পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করে। অন্যদিকে এ সময় এশিয়া মাইনরে বাইজানটাইন সাম্রাজ্যেরও অবসান ঘটে।
খ্রিস্টোত্তর প্রথম দুই শতাব্দী ধরে খ্রিস্টধর্মের ক্রমবর্ধমান অনুসারীর সংখ্যাকে এক নতুন আদর্শ ও সংস্কারের সমাজে দৃঢ়বদ্ধ করে রোমান সাম্রাজ্যে বিস্তার লাভ করেছিল। সম্রাটরা কখনো তাঁদের বিরুদ্ধাচরণ করতেন, কখনো-বা প্রশ্রয় দিতেন। দ্বিতীয় ও তৃতীয় শতাব্দীতে এই নতুন ধর্মকে দমন করার চেষ্টা হয়েছিল। ৩০৩ সালে ও পরবর্তী কয়েক বছরে সম্রাট ডায়োক্লেশিয়ানের আদেশে অনির্বচনীয় অত্যাচার করে। গির্জাগুলোতে সংরক্ষিত প্রচুর ধনসম্পদ বাজেয়াপ্ত করা হয়। সমস্ত বাইবেল ও ধর্ম সম্বন্ধীয় রচনাও বাজেয়াপ্ত ও ধ্বংস করা হয়। খ্রিস্টানদের আইনে আশ্রয় থেকে বঞ্চিত করা হয় এবং তাঁদের উপর হত্যালীলা চালানো হয়। ক্রমবর্ধমান খ্রিস্টান সমাজকে ডায়োক্লেশিয়ানের নিগ্রহ কোনোমতেই দমন করা সম্ভব হল না। অনেক দেশেই জনগণের অধিকাংশ এবং অনেক রাজকর্মচারী খ্রিস্টান হয়ে যাওয়ায় এই নিগ্রহ বিশেষ কার্যকরী হতে পারেনি। ৩১৭ সালে সম্রাট গ্যালেরিয়াস এই ধর্মের প্রতি ঔদার্যপূর্ণ এক রাজাজ্ঞা ঘোষণা করেন। গ্যালেরিয়াসের মৃত্যু হলে কনস্ট্যান্টাইন দি গ্রেট রোমান জগতের একচ্ছত্র অধীশ্বর হন। তিনি সমস্ত দেবত্বের অধিকার ত্যগ করে সেনাবাহিনীর ঢাল ও তলোয়ারের অগ্রভাগে খ্রিস্টধর্মের প্রতীক প্রতিষ্ঠা করেন। কয়েক বছরের মধ্যেই সমস্ত সাম্রাজ্যে খ্রিস্টধর্ম রাজধর্ম হিসাবে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। শুরু হয় এভাবেই। শেষ হয় বর্তমানে ১৯৫ দেশের মধ্যে ৯৯ টি দেশই খ্রিস্টধর্মের দেশে। প্রতিদ্বন্দ্বী ধর্মগুলি আশ্চর্য দ্রুততার সঙ্গে খ্রিস্টধর্মের সঙ্গে একীভূত হয়ে গেল, অথবা চিরকালের জন্য বিলুপ্ত হয়ে গেল। পঞ্চম শতাব্দী থেকেই শুরু থেকেই খ্রিস্টানদের তাণ্ডবনৃত্য। পঞ্চম শতাব্দীর থেকেই রোমান সাম্রাজ্যে পুরোহিত ও ধর্মমঠ বলতে শুধুমাত্র খ্রিস্টান পুরোহিত ও ধর্মমঠই অবশিষ্ট ছিল।
সমগ্র তৃতীয় শতাব্দী ধরে রোমান সাম্রাজ্যের শাসকরাও ভয়নক বর্বর আক্রমণ করত। এ যুগের সম্রাটরা সামরিক স্বৈরাচারীদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত থাকত। শত্রুর ভয়ে বারবার রাজধানীর স্থান পরিবর্তন করতে হত। রাইন ও দানিয়ুবের তীর ধরে সমগ্র রাজ্য-সীমান্ত জুড়ে আক্রমণকারীরা আক্রমণ করত। ফ্র্যাংক এবং অন্যান্য জার্মান উপজাতিরা রাইন নদী পর্যন্ত এসেছে। উত্তর হাঙ্গেরিতে এসেছে ভ্যান্ডালরা। পূর্বতন ডাসিয়া এবং বর্তমান রুমানিয়াতে এসেছে ভিসিগথ বা পশ্চিমী গথরা। এঁদের পিছনে দক্ষিণ রাশিয়ার পূর্ব গথ বা অস্ট্রোগথরাও এসেছে। এঁদের পিছন পিছন এসেছে ভলগা এলাকার অ্যালানরা। মঙ্গোলীয়রা ইউরোপের দিকে অগ্রসর হয়ে তাঁদের অভিযান চালিয়েছে।
সে সময়ে লুণ্ঠনকারীদের মধ্যে সবচেয়ে নিষ্ঠুর, বর্বর ও দুর্ধর্ষ জাতি ছিল মোঙ্গলীয় হুন বা তাতার। এঁরা মূলত কাস্পিয়ান সাগরের নিকটবর্তী অঞ্চলে বসবাস করত। এঁদের একটি দল চিন সীমান্তের কাছে চলে আসে। চিনের ইতিহাস থেকে জানা যায়, এঁদের একটি দল চিনের হান রাজ্যের সীমান্ত বরাবর পৌঁছোয়। হান সরকার হুন জাতির অভিজাত সম্প্রদায়ের সঙ্গে বিয়ের মাধ্যমে আত্মীয়ের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে শান্তি বজায় রাখার চেষ্টা করেছিল। প্রথমদিকে শান্তি বজায় ছিল, কিন্তু হুন জাতির সর্দাররা অন্য লোকের প্ররোচনায় হান রাজ্যের সঙ্গে সুসম্পর্ক ছিন্ন করেন। খ্রিস্টপূর্ব ১৫৮ খ্রিস্টাব্দে হুন জাতির যোদ্ধারা হান রাজ্যের সীমান্ত অঞ্চলে আক্রমণ করে। এইসময় এঁরা স্থানীয় অধিবাসীদের হত্যা করে এবং তাঁদের সম্পত্তি কেড়ে নেয়। এই জয়ের পরেও এঁরা যাযাবর স্বভাবের কারণে মধ্য এশিয়ায় বিভিন্ন অংশে ভ্রমণের ভিতর দিয়ে প্রবেশ করে। ১৫০ খ্রিস্টাব্দের দিকে এঁরা ককেশাস অঞ্চলের একটি জাতিতে বৃহৎ জাতিতে পরিণত হয়। ৩৭০ খ্রিস্টাব্দের ভিতরে এঁরা ভোলগা নদীর তীরে বসবাস করা শুরু করে। ৩৭০ সালের পরে ভোলগা নদী অতিক্রম করে কৃষ্ণসাগরের তীরবর্তী অ্যালান জাতির এলাকায় প্রবেশ করে। হুনরা এই অঞ্চলের অ্যালানদের সঙ্গে মিলিত হয়ে একটি মিশ্র জাতির সৃষ্টি করে। কিন্তু একসময় এই মিলিত জাতি হুন নামেই পরিচিতি লাভ করে। এই সময় এঁরা এঁদের নিকটবর্তী গথিক রাজ্যে বসতি স্থাপন শুরু করে। এই সময় গথিক রাজা এৰ্মানারিক আত্মহত্যা করলে তাঁর ভাইয়ের ছেলে ভিথিমিরিস রাজত্ব লাভ করেন। ভিথিমিরিস হুন এবং অ্যালানদের বিতারিত করতে গেলে একটি বড় ধরনের যুদ্ধের সূত্রপাত হয়। এই যুদ্ধে ভিথিমিরিস নিহত হন। গথিকরা এরপর এই অঞ্চল থেকে বিতারিত হয়। ভিথিমিরিসের একমাত্র পুত্র ভিডেরিকাস তাঁর সেনাবহিনীর সঙ্গে দেশ ত্যাগ করেন। এরপর হুনরা ভিজিগথ অঞ্চলে প্রবেশ করে।
৩৭৬ সালে গথিক জাতির সঙ্গে এঁদের যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে গথিকরা পরাজিত হলে গথিক রাজা আত্মহত্যা করে। এরপর এঁরা এথানারিক রাজ্য আক্রমণ করে। এই যুদ্ধে এথানারিকরা পরাজিত হয়ে তাঁদের রাজ্য ত্যাগ করে কার্পেথিয়ানসে প্রবেশ করে। এই যুদ্ধের পর রোমানরা এঁদেরকে বহিরাগত জাতি হিসাবে আখ্যায়িত করে। ৩৮০ সালে এঁরা প্যানোনিয়া অঞ্চলে বসতি স্থাপন করে। ৩৯৫ সালে এঁরা রোমান সাম্রাজ্যের পূর্বাঞ্চলে ব্যাপক আক্রমণ করে। ৪৬৯ সালের দিকে ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের একটি বিশাল অংশ জুড়ে রাজত্ব কায়েম করতে সক্ষম হয়। ইউরোপ বিজয়ী হানদের বলা হয় “কৃষ্ণ হুন’। পশ্চিমাঞ্চলীয় হুনদের বলা হয় শ্বেত হুন’। এঁরা খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতকে পারস্যের সাসানীয় বংশের সম্রাট ফিরোজ শাহকে পরাজিত ও হত্যা করে পারস্য দখল করে। খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতকের ভিতর এঁরা বল দখল করে। এঁদের একটি শাখার নেতা তোরমানের নেতৃত্বে গান্ধার এবং পাঞ্জাব দখল করে। এরপর তাঁর পুত্র মিহিরকুল ৫১৫ সালে ভারতের একটি বিশাল অংশ দখল করে নেয়। কিন্তু পুষ্যভূতি ও কনৌজের মুখারীদের আক্রমণের ফলে এঁরা দুর্বল হয়ে পড়ে। পরে এঁরা আর মধ্য এশিয়ার দিকে ফিরে যায়নি। স্থানীয় রাজপুতদের সঙ্গে মিশে গিয়ে পুরোপুরি ভারতীয় হয়ে যায়। ভারতের হুন শাসনের সময় দুইজন রাজার কথা বিশেষভাবে জানা যায়। এঁরা হলেন তোরমান এবং মিহিরকুল। মিহিরকুল প্রথম দিকে বৌদ্ধধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকলেও পরে তিনি প্রচণ্ড বৌদ্ধধর্ম বিদ্বেষী হয়ে পড়েন। এই সময় তিনি বৌদ্ধদের উপর অকথ্য নির্যাতন চালান। এমনকি নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংসের অভিযোগও আছে তাঁর বিরুদ্ধে। হুন শাসক মিহিরকুলই প্রথম বৌদ্ধবৃষ্টি নালন্দা আক্রমণ করেন।
আটিলা দ্য হান। নিজেকে যিনি পরিচয় দিতেন ‘স্কার্য অফ গড’ নামে। যার বাংলা করলে দাঁড়ায়— ঈশ্বরের চাবুক! হান সাম্রাজ্য আটিলার মৃত্যুর পর একরকম ক্ষয়িষ্ণু হয়ে পড়ে। এর ফলে রোমানরা আবারও ক্ষমতার কেন্দ্রে চলে আসে। ইতিহাস বরাবরই ক্ষমতাসীনরাই লিখে এসেছে। ভিয়েতনামের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের হেরে যাওয়ার পর এই নিয়ে যেমন খুব বেশি উচ্চবাচ্য হয়নি, তেমনি ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীটি পুরো ব্যাপারটিকে প্রায় আড়ালে নিয়ে গেছে। একই ব্যাপার ঘটেছে হানদের ক্ষেত্রেও। রোমানদের ইতিহাসে হানদেরকে অভিহীত করা হয়েছে বর্বর জাতি হিসেবে। সেইসঙ্গে আটিলাকে বলা হয়েছে, বর্বর সেনানী। সবই ঠিক আছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, ইতিহাসের পাতায় পাতায় রক্তের বন্যা বইয়ে দেওয়া রোমানরা নিজেদেরকে দাবি করেছে মহান জাতি হিসাবে। আটিলা দ্য হান মোঙ্গল সম্রাট চেঙ্গিস খানের চেয়ে কোনো অংশে কম ছিলেন না। রণকৌশল, চাতুর্য, নির্মমতা সব দিক থেকেই তিনি ছিলেন বিধ্বংসী। ঠিক চেঙ্গিস খানের মতোই, প্রচণ্ড নির্মমভাবে গণহত্যা করে একের পর এক সমস্ত কিছু জয় ও দখল করেন। ঐতিহাসিক কেলি লিখেছেন, রোমানরা তাঁদের রাজধানী বাঁচানোর জন্য একের পর এক শহর, সেনাবাহিনীর পর সেনাবাহিনী আটিলার সামনে দাঁড় করিয়ে দিতে থাকে। তখন পর্যন্ত মানুষ ভাবত, রোমানরা অপরাজেয়। আটিলা দ্য হানই প্রথম এই কথাকে সর্বাঙ্গে ভুল প্রমাণিত করে দিলেন। কচুকাটা হতে লাগল সৈন্যদল। একের পর এক শহর নগর মুখ। থুবড়ে পড়তে লাগল। ষষ্ঠ শতকের ইতিহাসবিদ মার্সেলিনাস লিখেছেন, “শহর, দূর্গ, রাজধানীর আশেপাশের সবকিছুকে ধুলোয় মিশিয়ে সামনে এগোতেই থাকলেন আটিলা দ্য হান। প্রায় ৭০টির মতো রোমান শহর ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেন। এই পর্যায়ে এসে সম্রাট দ্বিতীয় থিওডোসিয়াস বাধ্য হলেন আটিলার সঙ্গে আর-এক দফা শান্তিচুক্তি করতে। কিন্তু আগের সেই মূল্যে আটিলা রাজি হলেন না। বাৎসরিক ২,১০০ পাউন্ড স্বর্ণ রাজস্ব দেওয়ার চুক্তিতে আটিলাকে রাজি করানো হয়। ঐতিহাসিকদের মতে, যুদ্ধ করার চেয়ে, এই রাজস্ব দেওয়াটা বরং পূর্ব রোমানদের ক্ষেত্রে খরচ কম হয়েছিল। আর এটুকু তাঁদের সামর্থ্যের তুলনায় ছিল নিতান্ত অল্প।” এর মধ্য দিয়ে আটিলা দ্য হান এবং পূর্ব রোমানদের যুদ্ধ আপাতত মুলতুবি হয়। এরপর পশ্চিমের দেশগুলোও আটিলার মনোযোগের কেন্দ্র হয়ে ওঠেছিল।
পঞ্চম শতাব্দীর দ্বিতীয় চতুর্থাংশে হুনদের মধ্যে যে এক বিরাট সামরিক নেতার অভ্যুত্থান হয়, তার নামই আটিলা। তাঁর শক্তি সম্বন্ধে আমাদের ধারণা অত্যন্ত অস্পষ্ট এবং অবিশ্বাস্য। তিনি যে শুধু হুনদের উপর প্রভূত করতেন তা নয়, বহু জার্মান জাতিরও তিনি অধীশ্বর হয়েছিলেন। তাঁর সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি ছিল রাইন নদীর তীর। থেকে শুরু হয়ে মধ্য এশিয়ার সমতলভূমি পর্যন্ত। গ্রিক ও রোমানদের সঙ্গে হুনদের প্রধান তফাত হল, গ্রিক ও রোমানরা লুণ্ঠন ও হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সঙ্গে সাম্রাজ্যও বিস্তার করত। হুনরা কেবল আক্রমণ ও লুণ্ঠন করেছে, কিন্তু স্থায়ীভাবে বসবাস করেনি। তবে ঐতিহাসিক গিবনের মতে, “আটিলা সত্তরটিরও বেশি নগর-রাজ্য ধ্বংস করেছিলেন।” ৪৫১ সালে আটিলা তাঁর দৃষ্টি রোমান সাম্রাজ্যের লাতিনভাষী অংশের দিকে দিলেন এবং গল আক্রমণ করেন। উত্তর গলের প্রত্যেকটি শহর তিনি লুণ্ঠন করেন। ফ্রাংক, ভিসিগথ ও রাজসৈন্য একত্রে তাঁর বিরুদ্ধে দাঁড়ায় এবং ট্রয়েসের এক নিদারুণ বিধ্বংসী যুদ্ধে তিনি পরাজিত হন এবং দেড় লক্ষ থেকে তিন লক্ষ সামরিক মানুষ হত্যা করেছিল। পরের বছর তিনি ভিনিসিয়া দিয়ে ইটালিতে ঢোকেন এবং অ্যাকুইলিয়া ও পাদুয়া পুড়িয়ে ছাই করে দেন এবং মিলান লুঠ করেন। ৪৫৩ খ্রিস্টাব্দে এক যুবতীর সঙ্গে বিয়ের ভোজসভার ঠিক পর পরেই আটিলার মৃত্যু হয়। তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে তাঁর লুণ্ঠিত রাজ্যগুলি ভেঙেচুরে টুকরো টুকরো হয়ে যায়।
পশ্চিম ও মধ্য ইউরোপের সর্বত্রই বর্বর দলপতিরা রাজা ডিউক বা অন্য কোনো নামে রাজত্ব করছিলেন। কার্যত এঁরা স্বাধীন ছিলেন। গোটা বিশ্বে তখন হাজার হাজার এরকম স্বাধীন লুণ্ঠনকারী শাসক ছিল। পৃথিবীর প্রাচীন সাম্রাজ্যগুলি সবই ছিল ধর্ম-সাম্রাজ্য, কোনো দেব বা দেবীর উপাসনাকে কেন্দ্র করে রাষ্ট্রগুলি গড়ে উঠত। আলেকজান্ডারকেও ‘দৈবপুরুষ’ বলে মনে করা হত। যুদ্ধ, তিক্ততম ধর্মতত্ত্ব ও মানুষের সাধারণ অনাচার –এই ছিল সে যুগের রাষ্ট্রজীবন। যখন বাইজান্টাইনরা বা পারস্য উত্তর দেশের বর্বরদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত থাকত না, তখন তাঁরা এশিয়া মাইনর ও সিরিয়ায় বীভৎস ধ্বংসলীলা শুরু করত।
সেসময়ে অনেকে ভেবেছিলেন সমগ্র ইউরোপ ও এশিয়া মাত্র কয়েক শতাব্দীর মধ্যে মঙ্গোলীয় প্রভূত্ব কর্তৃক শাসিত হবে। হয়তো এমনটাই হত ইতিহাসে গতিপথ মেনে। হয়তো একজন মোঙ্গলীয় সম্রাট দানিয়ুব থেকে প্রশান্ত মহাসাগর পর্যন্ত রাজত্ব করবে এবং তুর্কি বংশ সমগ্র বাইজানটাইন, পারস্য সাম্রাজ্য, মিশর ও ভারত উপমহাদেশের অধিকাংশের অধিপতি হবে। এসব যাঁরা ভেবেছিলেন, তাঁরা সেসময় আরব মরুভূমিকে ধর্তব্যের। মধ্যে আনেননি। ইউরোপে লাতিন অঞ্চলের পুনঃশক্তি অর্জনের ক্ষমতাকে ছোটো করে দেখেছিল এবং আর মরুভূমির নিহিত শক্তিকে অবজ্ঞা করেছিল। কারণ আরব ছিল ছোটো ছোটো বিবদমান যাযাবরী উপজাতিদের আশ্রয়স্থল। চলমান ইতিহাসের দিক বদল হল একসময়। নেতৃত্ব উঠে এলো সুযোগ্য ও বিচক্ষণ ব্যক্তির হাতে, যিনি সকল বিবদমান জাতিকে এক ছাতার নিচে আনতে দারুণভাবে সফল হলেন। স্পেন থেকে চিন সীমান্ত পর্যন্ত তাঁরা তাঁদের রাজত্ব ও ভাষা বিস্তার করল। তাঁরা পৃথিবীতে এক নতুন ও সুশৃঙ্খল সভ্যতা এনে দিল। সৃষ্টি করল নতুন এক ধর্ম ও ধর্মভিত্তিক অনুশাসন, যা আজ পর্যন্ত পৃথিবীর অন্যতম প্রধান শক্তি আছে। তাঁর চল্লিশ বছর বয়সের আগে পর্যন্ত জগতের সমক্ষে নিজেকে উল্লেখযোগ্য করার মতো কিছু করেননি, সেই তিনিই চল্লিশ বছর বয়সের পর এক ঐতিহাসিক যুগের সূচনা করে দিলেন –তাঁর নাম হজরত মোহাম্মদ। পৃথিবীর সমস্ত মুসলিমদের কাছে তিনি প্রাণপ্রিয় নবি। ধর্মচিন্তার পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে তিনি সমাজ ও রাষ্ট্রভাবনার পরিবর্তন আনলেন। শুধু সাম্রাজ্য বৃদ্ধিই নয়, সবাইকে এক ধর্মে আনাও তাঁর সংকল্প ছিল। বহু ঈশ্বরকে এক ঈশ্বরে (Monotheism) পরিণত করলেন। সে সময় মক্কা ছিল পৌত্তলিক নগর। সে সময়ে সে দেশে অনেক ইহুদি বাস। আরবের দক্ষিণাংশে ইহুদিরাই বাস করত। একেশ্বরবাদ ধারণা উদ্ভব হওয়ার আগে গ্রিস, রোম সহ পৃথিবীর সমস্ত ভূখণ্ডেই পৌত্তলিকতা বহমান ছিল। একাধিক দেব-দেবতার উপাস্য ছিল। মোহাম্মদ মূর্তি নিষিদ্ধ করলেন, বললেন ঈশ্বরের কোনো আকার নেই। ইহুদি ও খ্রিস্টানরা একেশ্বরবাদী হলেও মূর্তি নিষিদ্ধ নয়। তাই জিশুর মূর্তি থাকলেও মোহাম্মদের কোনো মূর্তি নেই। একমাত্র হিন্দুধর্মে একেশ্বরবাদের (একমেবম অদ্বিতীয়) পাশাপাশি বহুশ্বরবাদের প্রচলন আছে। পাশাপাশি আস্তিকও আছে, নাস্তিকও আছে। উভয়ই সত্য বলে মানা হয়। বহুশ্বর আছে, তাই বহু মূর্তিও আছে। পৃথিবীর আর কোনো ধর্মেই বহুশ্বরবাদের চিহ্ন পর্যন্ত নেই।
যাই হোক, মোহশ্মদের ধর্মীয় চিন্তাধারায় যে ইহুদি ও খ্রিস্টান ধারণায় অত্যন্ত বেশি প্রভাবিত ছিল, তাতে কোনো বিতর্কের অবকাশ নেই। গোড়ার দিকে তাঁর চারপাশে একটি ছোটো ভক্তের দল গড়ে তুলে তিনি প্রচলিত পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে সেই মক্কা শহরে ধর্মোপদেশ দিতে শুরু করলেন। তিনি তাঁর প্রচারিত ধর্মকে নির্দোষ ও সুসম্পূর্ণ করার ব্রত গ্রহণকারী আল্লার নির্বাচিত ‘শেষ পয়গম্বর’ বলে নিজেকে ঘোষণা করেন। তিনি এও বলেন, আব্রাহাম এবং জিশুখ্রিস্ট তাঁরই পূর্বসূরী। আল্লাহর প্রত্যাদেশকে সুসম্পূর্ণ এবং নির্দোষ করার জন্য তাঁকে নির্বাচিত করা হয়েছে। তাঁর ধর্মপ্রচারের গতি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে শত্রুও বৃদ্ধি পেতে থাকল। সেই শত্রু অবশ্যই ইহুদি ও খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মানুষরা। অবশেষে তাঁকে হত্যা করার এক ষড়যন্ত্র সৃষ্টি হল। এর ফলস্বরূপ নেমে এলো ইহুদি ও খ্রিস্টান বিরোধী আয়াত।
শেষপর্যন্ত মক্কা ও মদিনার মধ্যে যুদ্ধ বাধল এবং একসময়ে সন্ধিও স্থাপিত হল। সন্ধিতে বলা হল এক সত্য ঈশ্বর এই বাণী এবং মোহাম্মদকে মক্কা স্বীকার করল। কিন্তু মক্কা পৌত্তলিক থাকার সময়ে যেমন ছিল তেমনই থাকবে। তীর্থযাত্রার বাণিজ্যে কোনো ক্ষতি না করে মোহাম্মদ মক্কায় এক সত্য ঈশ্বর প্রতিষ্ঠা করলেন। এর পর বিভিন্ন যুদ্ধের মধ্য দিয়ে তিনি কীভাবে সাম্রাজ্য ও ইসলামের বিস্তার ঘটালেন, তা প্রথম খণ্ডেই উল্লেখ করেছি। ৬৩২ সালে তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত মোহাম্মদ তাঁর শক্তি আর বুদ্ধি দিয়ে ইসলামকে বিস্তার করলেন নরমে গরমে। কথিত আছে যে, ইসলাম সাম্রাজ্যের সত্যিকারের প্রতিষ্ঠাতা যত-না মোহাম্মদ ছিলেন তার চেয়ে বেশি ছিলেন তাঁর প্রাণপ্রিয় বন্ধু ও সাহায্যকারী আবু বকর। মোহাম্মদ যদি আদি ইসলাম ধর্মের মন ও কল্পনাশক্তি হন, তবে আবু বকর ছিলেন তার বিবেক ও প্রাণশক্তি। মোহাম্মদ যখনই কোনো সিদ্ধান্তে দ্বিধান্বিত হতেন, তখন আবু বকর তাঁকে সামলাতেন। ইসলাম ধর্ম সম্পূর্ণরূপে অবতারিক ধর্ম হলেও তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর উপর যাতে দেবত্ব আরোপ করা না-হয় তার জন্য মোহাম্মদ যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করেছিলেন। অনুরূপ গৌতম বুদ্ধও চেয়েছিলেন যাতে কেউ তাঁর উপর দেবত্ব আরোপ না-করে। বুদ্ধ সফল না-হলেও মোহাম্মদ সফল হয়েছেন। তাই বুদ্ধকে ‘ভগবান’ বলা হয়, মোহাম্মদকে ‘নবি”।
মোহাম্মদের মৃত্যুর পর আবু বকর হলেন খলিফা (Caliphete)। মোহাম্মদ ৬২৮ সালে পৃথিবীর সমস্ত সম্রাটকে যে পত্র লিখেছিলেন তারই পথানুসারে সহজভাবে ও বিবেচনার সঙ্গে সমস্ত পৃথিবীকে আল্লাহর অধীন করার মনোবা নিয়ে নিজেকে প্রস্তুত করতে থাকলেন। ছুটে চলল ইসলামের বিজয়রথ। ৬৩৪ সালে এয়ারমুকের যুদ্ধে বাইজানটাইন বাহিনী চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল। পারস্যের সঙ্গে যুদ্ধে মনোবল হারিয়ে পঙ্গু সম্রাট হেরাক্লিয়াস চুপ করে বসে দেখলেন তাঁর চোখের সামনে সিরিয়া, দামাস্কাস, অ্যান্টিওক, পামিরা, জেরুজালেম এবং অবশিষ্ট তাঁর সমস্ত বিজিত দেশ মুসলিমদের দখলে চলে গেল। জনগণেরও অধিকাংশই ইসলাম ধর্মে প্রবেশ করল। এরপর মুসলিম আক্রমণকারীরা পূর্বদিকে দৃষ্টি দিল। ৬৩৭ সালে পারসিকরা একেবারে বিধ্বস্ত হল আরবদের সঙ্গে যুদ্ধে। এরপর সম্পূর্ণ পারস্য বিজয় করল এবং পশ্চিম তুর্কিস্থান ও আরও পূর্বে চিন পর্যন্ত অগ্রসর করল। এইভাবে মুসলিমরা বহু দেশ আক্রমণ করল এবং দখল নিয়ে শাসন করতে শুরু করে দল। গোড়ার দিকে আরবরা রাজনীতিতে প্রবণতা ছিল না, অভিজ্ঞতাও ছিল না। পরে যত দিন গেছে তত রাজনীতিতে দক্ষ হয়ে উঠেছিল।
প্রায় তেইশো বছর আগে গ্রিকরাজা আলেকজান্ডার যখন ভারত আক্রমণ করেছিলেন, সেইসময় মগধের শাসন ক্ষমতায় ছিল নন্দবংশ। এই বংশের বীরত্বের কথা জানতে পেরে আলেকজান্ডারের সৈন্যরা মগধ আক্রমণের সাহস পায়নি। বস্তুত নন্দবংশের রাজা ধননন্দ ছিলেন প্রবল অত্যাচারী। আলেকজান্ডার যখন পাঞ্জাবে ছিলেন, সেসময় যুবক চন্দ্রগুপ্ত তাঁর সঙ্গে পরিচয় করতে গিয়েছিল। কিন্তু আলেকজান্ডারের ভয়ে চন্দ্রগুপ্ত বিন্ধ্যপর্বতে পালিয়ে গিয়েছিলেন। সেখানে ব্রাহ্মণ পণ্ডিত ও বিচক্ষণ চাণক্যের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। এদিকে চাণক্য নানা কারণে ধননন্দের উপর ক্ষুব্ধ ছিলেন। তিনি সুযোগ খুঁজছিলেন কীভাবে ধননন্দকে শায়েস্তা করা যায়। চন্দ্রগুপ্তকে চাণক্য তাঁর প্রতিহিংসা মেটাতে চান। তাঁরই বুদ্ধি নিয়ে চন্দ্রগুপ্ত বহু সৈন্য সংগ্রহ করেন এবং যুদ্ধে। ধননন্দকে পরাজিত করে মগধের সিংহাসনে বসেন। চন্দ্রগুপ্ত সিংহাসনেই রাজ্যবিস্তারের দিকে মন দিয়েছিলেন। সাম্রাজ্য বাড়ানোর দিকে মনোনিবেশ করলেন। পশ্চিমে সৌরাষ্ট্র থেকে দক্ষিণে মহিশূর পর্যন্ত। রাজ্যবিস্তার করেছিলেন চন্দ্রগুপ্ত। এছাড়া গ্রিক শাসক সেলুকাসকে পরাজিত করে কাবুল, কান্দাহার ও হিরাট দখল করেছিলেন। এইভাবে একসময় ভারত উপমহাদেশে বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তোলে। এসব বিনা রক্তপাতে হয়নি, বিনা হত্যায় হয়নি।
মৌর্যবংশের পতনের পর কুষাণ বংশ ভারত উপমহাদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিল। চিনদেশ থেকে আসা ইউ-চি জাতির যাযাবর শ্রেণির লোক ছিলেন কুষাণরা। সেখানকার শুনু উপজাতির কাছে পরাজিত হয়ে ইউ-চিরা ক্রমশ পশ্চিমদিকে সরে যেতে কাবুলে এসে পৌঁছোয়। তারপর উপমহাদেশের পাঞ্জাব অঞ্চলে প্রবেশ করে। কিউই-শাং নামে এক উপজাতি নেতা অন্য চার নেতাকে হত্যা করে সমগ্র উপজাতির একছত্র নেতা হন। তাঁর নামানুসারে এই বংশের নাম হয় কিউই-শাং বা কুষাণ বংশ। কুষাণ বংশের উল্লেখযোগ্য শাসক ছিলেন কনিষ্ক। উজ্জয়িনী, সাকেত, কৌশাম্বী, পাটলিপুত্র ও চম্পা নগরী পর্যন্ত কনিষ্কের সাম্রাজ্য বিস্তৃত ছিল। উত্তরে কাশ্মীর থেকে দক্ষিণে বিন্ধ্যপর্বত এবং পূর্বে বারাণসী ও পশ্চিমে পাঞ্জাব পর্যন্ত কনিষ্ক তাঁর বিশাল সাম্রাজ্য। এইসব সাম্রাজ্য বিস্তার বিনা রক্তপাতে হয়েছিল? কনিষ্ক ছিলেন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। অশোকের পর তিনিই ভারত উপমহাদেশে বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন।
একটা সময় কুষাণ সাম্রাজ্যের পতন ঘটলে দীর্ঘ সময়কাল এই উপমহাদেশে কোনো বিশাল সাম্রাজ্য ছিল না। অবশেষে প্রথম চন্দ্রগুপ্ত উত্তর-পশ্চিম ভারতের বিস্তৃত অঞ্চল, উত্তরপ্রদেশের পূর্বাংশ, বিহার, বঙ্গদেশ পর্যন্ত তাঁর সাম্রাজ্য বিস্তৃত ছিল। সমুদ্রগুপ্তের শাসনকালে উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের অসংখ্য রাজা তাঁর কাছে পরাজিত হয়েছিল। তিনি আর্যাবর্ত, মধ্য ভারত ও দক্ষিণ ভারত অভিযান করেছিলেন। কামরূপ, নেপাল, পাঞ্জাব, মালব প্রভৃতি রাজ্যের রাজারা বশ্যতা স্বীকার করে। সমুদ্রগুপ্তের যুদ্ধনীতি অনুসরণ করে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত মালব ও সৌরাষ্ট্র দখল নিয়েছিলেন। গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের পর থানেশ্বরের রাজা হর্ষবর্ধন তাঁর সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন। হর্ষবর্ধন দক্ষিণ ভারতের কোন অংশের দখল নিতে পারেনি। শুধুমাত্র উত্তর ভারতেই তাঁর সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন। দক্ষিণ ভারতের চালুক্য বংশের রাজা দ্বিতীয় পুলকেশীর কাছে প্রবল বাধা পেয়ে আর দক্ষিণ ভারত অভিযানে যাননি। হর্ষবর্ধনের পরেই ভারত উপমহাদেশে ধীরে ধীরে মুসলিম শাসন শুরু হতে থাকে।
উনবিংশ শতকের দ্বিতীয় দশকের শুরুতেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। গ্রেট ওয়ার হিসাবে পরিচিত একটি বৈশ্বিক যুদ্ধ, যা ১৯১৪ সালে ২৮ জুলাই ইউরোপে শুরু হয় এবং ১১ নভেম্বর ১৯১৮ সাল পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। ৬০ মিলিয়ন ইউরোপীয়সহ আরও ৭০ মিলিয়ন সামরিক বাহিনীর সদস্য ইতিহাসের অন্যতম বৃহত্তম এই যুদ্ধে একত্রিত হয়। এটি ছিল ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ সংঘাতের একটি এবং এর ফলে পরবর্তী সময়ে এর সঙ্গে যুক্ত দেশগুলোর রাজনীতিতে বিরাট পরিবর্তন হয়। অনেক দেশে এটা বিপ্লবের সূচনা করে। ১৯১৪ সালের ১৮ জুন বসনিয়ার রাজধানী সারায়েভো শহরে অস্ট্রিয়ার যুবরাজ আর্চডিউক ফ্রাঞ্জ ফার্ডিনান্ড এক সার্বের গুলিতে নিহত হন। অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি এই হত্যাকাণ্ডের জন্য সার্বিয়াকে দায়ী করে এবং ওই বছরের ২৮ জুলাই সার্বিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এ যুদ্ধে দুই দেশের বন্ধু রাষ্ট্রগুলো ধীরে ধীরে জড়িয়ে পড়ে। এতে যোগ দিয়েছিল সে সময়ের অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী সমস্ত দেশ। এভাবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূচনা হয়। তবে অস্ট্রিয়ার যুবরাজের হত্যাকাণ্ডই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের একমাত্র কারণ ছিল না। উনিশ শতকে শিল্পে বিপ্লবের কারণে সহজে কাঁচামাল সংগ্রহ এবং তৈরি পণ্য বিক্রির জন্য উপনিবেশ স্থাপনে প্রতিযোগিতা এবং আগের দ্বন্দ্ব-সংঘাত। ইত্যাদিও প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের কারণ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে একপক্ষে ছিল উসমানীয় সাম্রাজ্য, অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি, জার্মানি ও বুলগেরিয়া। যাদের বলা হত কেন্দ্রীয় শক্তি। আর অপরপক্ষে ছিল সার্বিয়া, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জাপান, ইতালি, রুমানিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। যাদের বলা হত মিত্রশক্তি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ৯০ লক্ষ যোদ্ধা ও ৫০ লক্ষ নিরীহ সাধারণ মানুষ নিহত হয়। প্রায় ১ কোটি সৈন্য এবং ২ কোটি ১০ লক্ষ সাধারণ মানুষ আহত হয়, এদের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ছিল ১,১৬,৫১৬ (এক লক্ষ ষোলো হাজার পাঁচশত ষোলো) জন। চারটি সাম্রাজ্যের পতন ঘটে। রোমান সাম্রাজ্য বা রুশ সাম্রাজ্য ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে, জার্মান ও অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্য ১৯১৮ সালে এবং অটোমান সাম্রাজ্য ১৯২২ সালে। অস্ট্রিয়া, চেকোস্লোভাকিয়া, এস্তোনিয়া, হাঙ্গেরি, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া এবং তুরস্ক স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে আত্মপ্রকাশ হয়। অটোমান সাম্রাজ্যের অধীনে থাকা অধিকাংশ আরব এলাকা ব্রিটিশ ও ফরাসি সাম্রাজ্যের অধীনে আসে। ১৯১৭ সালে বলশেভিকরা রাশিয়ার এবং ১৯২২ সালে ফ্যাসিস্টরা ইতালির ক্ষমতায় আরোহণ করে। এ যুদ্ধের অন্য ফল হল ইনফ্লুয়েঞ্জা, বিশ্বব্যাপী ৫ কোটি মানুষের মৃত্যু হয়েছিল।
একই শতকে আরও একটি মহাযুদ্ধ শুরু হল চারের দশকে এসে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ মানবসভ্যতার ইতিহাসে এ যাবৎকাল পর্যন্ত সংঘটিত সর্ববৃহৎ এবং সবচেয়ে ভয়াবহ যুদ্ধ। ১৯৩৯ সাল থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত, এই ছয় বছর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়সীমা ধরা হলেও ১৯৩৯ সালের আগে এশিয়ায় সংগঠিত কয়েকটি সংঘর্ষকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অংশ হিসাবে গণ্য করা হয়। তৎকালীন বিশ্বে সকল পরাশক্তি এবং বেশিরভাগ রাষ্ট্রই এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে এবং দুইটি বিপরীত সামরিক জোটের সৃষ্টি হয়— মিত্রশক্তি আর অক্ষশক্তি। এই মহাসমরকে ইতিহাসের সবচেয়ে বিস্তৃত যুদ্ধ বলে ধরা হয়, যাতে ৩০টি দেশের সব মিলিয়ে ১০ কোটিরও বেশি সামরিক সদস্য অংশগ্রহণ করে। অংশগ্রহণকারী রাষ্ট্রসমূহ খুব দ্রুত একটি সামগ্রিক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে এবং সামরিক ও বেসামরিক সম্পদের মধ্যে কোনোরকম পার্থক্য না করে তাঁদের পূর্ণ অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতা প্রয়োগ করা শুরু করে। এছাড়া বেসামরিক জনগণের উপর চালানো নির্বিচার গণহত্যা, হলোকস্ট (হিটলার কর্তৃক ইহুদিদের উপর চালানো গণহত্যা), পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম পারমাণবিক অস্ত্রের প্রয়োগ প্রভৃতি ঘটনায় কুখ্যাত এই যুদ্ধে প্রায় ৫ কোটি থেকে সাড়ে ৮ কোটি মানুষ মৃত্যুবরণ করে। এসব পরিসংখ্যান এটাই প্রমাণ করে যে, এটাই পৃথিবীর ইতিহাসে নৃশংসতম যুদ্ধ।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে সংঘটিত হিটলারের বর্বরতার মতো হিটলারের মিত্র দেশগুলো কেউ কারও থেকে কম যায়নি। পশ্চিমী গণমাধ্যমের বদান্যতায় হিটলারের সেইসব পৈশাচিক গণহত্যা ও পরিকল্পনার বিবরণ পরবর্তীতে যেভাবে বিশ্বের ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হয়েছে, সে তুলনায় অন্য দেশগুলির বর্বরতার কাহিনি মাটির নীচে চাপা পড়ে গেছে। এমন বহু গণহত্যা ও বর্বরতার কাহিনি ইতিহাস থেকে মুছে গেছে। হিটলারের মিত্র জাপানিরা এশিয়ায় (বিশেষ করে চিন আর কোরিয়াতে) যে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে, তার নজির ইতিহাসে খুবই বিরল। এই জাপানি তাণ্ডবকে নানকিং ম্যাসাকার’ও (nanking-massacre) বলা হয়ে থাকে। ১৯৩৭ সালের শেষের দিকে জাপান চিন দখল করতে শুরু করে। এমনিতেই চিন ও জাপানের মধ্যে বিরোধ বহু পুরোনো। সে সময় জাপান সরকার তাঁদের দেশের সীমানা বৃদ্ধির জন্য উদগ্রীব ছিল। যুদ্ধ লেগেই ছিল। শুরু হল চিন-জাপানের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। যুদ্ধের সময় চিন পাল্লা দিয়ে জাপানের সঙ্গে লড়াই করেছে যাতে প্যাসিফিক ও পূর্ব এশিয়ায় জাপানি প্রভুত্ব ঠেকানো যায়। এই যুদ্ধে ২০ মিলিয়ন চিনের নাগরিকের মৃত্যু হয়। এই ২০ মিলিয়নের ১৭ মিলিয়নই ছিলেন নিরীহ বেসামরিক নাগরিক। জাপানিরা নিষ্ঠুরভাবে নিরস্ত্র চিনাদের হত্যা করেছে। এ যুদ্ধের মধ্যেই ১৯৩৭ সালের ডিসেম্বর মাসে জাপানিদের হাতে চিনের তৎকালীন রাজধানী নানকিংয়ে ঘটে এক নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞ। জাপানিরা নানকিং ম্যাসাকারের সূচনা নানকিং দখল করার আগেই শুরু হয়েছিল। নানকিংয়ের দিকে এগিয়ে আসার সময় জাপানিরা পথে যা পেয়েছে তা-ই ধ্বংস করেছে। যাঁরাই ওদের হাতে ধরা পড়েছে তাঁদেরকেই হত্যা করা হয়েছে। জাপানি সৈন্যদের উপর নির্দেশ ছিল সমস্ত বন্দিকে হত্যা করতে হবে। বিচিত্র উপায়ে তাঁরা বে-সামরিক চিনাদের হত্যা করত। কে, কার আগে নিজ হাতে ১০০ জন চিনাকে হত্যা করতে পারবে সে নিয়ে দুজন জাপানি অফিসার মুকাই এবং নদার মাঝে একটি ব্যক্তিগত প্রতিযোগিতাও শুরু করেছিল। এই প্রতিযোগিতায় কে কতগুলো খুন করেছে তার অগ্রগতির প্রতিবেদন শীর্ষস্থানীয় জাপানি পত্রিকাগুলোতে ছাপা হত। নানকিংয়ের পথের গ্রামগুলো পোড়াতে পোড়াতে তাঁরা একসময় নানকিং পৌঁছে যেত। গরিব, ধনী কেউই তাঁদের হাত থেকে রেহাই পায়নি। বেশিরভাগ মৃতদেহ যেখানে হত্যা করা হত সেখানেই ভোলা অবস্থায় রেখে জাপানিরা অগ্রসর হত। বিজিতদের লুট, হত্যা ও ধর্ষণ করা সৈন্যদের অধিকারে পরিণত হয়েছিল। ১৯৩৭ সালের ১৩ ডিসেম্বর থেকে পরের ছয় সপ্তাহে জাপানিরা নানকিংয়ের সাধারণ মানুষদের হত্যা ও নির্বিচারে ধর্ষণ করেছে। এ সময় প্রায় ৮০,০০০ মহিলাকে ধর্ষণ করেছে। জাপানি সেনারা চিনা সৈন্য খোঁজার নাম করে প্রতিটি ঘরে ঢুকে নারী ও শিশুকন্যাদের বের করে এনে গণধর্ষণ করেছে। ধর্ষণের বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ধর্ষিতাদের হত্যা করা হয়েছে। হত্যা করেই তাঁরা ক্ষান্ত হয়নি। হত্যার আগে যতরকমভাবে সম্ভব মহিলাদের কষ্ট দেওয়া হত। গর্ভবতী মহিলাদের পেট কেটে গর্ভের শিশুকে বের করে ফেলত জাপানি সৈন্যরা। যুবতী মেয়েদের দিনে ছয়-সাতবারও ধর্ষণের প্রমাণ পাওয়া যায়। তরুণীদের যৌনদাসী হিসাবে ব্যবহারের জন্য নানকিং থেকে বিভিন্ন জাপানি ক্যাম্পে প্রেরণ করা হয়েছিল। শিশুরাও জাপানি বর্বরতা থেকে রেহাই পায়নি। বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বহু শিশুকে হত্যা করা হত। বলাই বাহুল্য, জাপানিরা হত্যাকারীরা কেউই মুসলিম ছিল না।
পৃথিবীর ইতিহাস আসলেই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের ইতিহাস। লক্ষ লক্ষ বার রক্তাক্ত হয়েছে এই পৃথিবীর মাটি। এই অধ্যায়ে গুটিকয়েক দেশের যুদ্ধ বিষয়ক প্রসঙ্গ উল্লেখ করলাম। একটা চিত্র দেওয়ার চেষ্টা করলাম মাত্র। এটাই সমগ্র বিশ্বের চিত্র তা বলা যাবে না। হিমশৈলীর চূড়ামাত্র। সমগ্র বিশ্বের যুদ্ধ ও আক্রমণের ইতিহাস আলোচনা করা যেত বইকি। তাতে কলেবর বৃদ্ধি হত। লাভের লাভ কিছু হত না। আমার গ্রন্থের মূল বিষয়ও নয়। আমরা এরপর উপনিবেশ যুগের আলোনায় ঢুকতে পারি।