০৮. পরিনায়ক
বাবরের মুনশীর আঁকা ফারগানার সীমারেখা চিহ্নিত পার্চমেন্টের ভাঁজ শীর্ণ শিবহুল ছোট ছোট হাতে সমান করতে করতে এসান দৌলতের দৃষ্টিতে সন্তুষ্টি ভাসে। কোনোমতে আঁকা মানচিত্রে, উত্তর-পূর্বের বরফাবৃত পর্বত থেকে প্রবাহিত হয়ে এর শীতল জল পাহাড়ের মাঝ দিয়ে বয়ে এসে প্রশস্ত উপত্যকার উপর দিয়ে দুরন্ত মেয়ের উজ্জ্বলতায় এঁকেবেঁকে বয়ে যাওয়া দেখাবার বদলে জাক্সারটাসকে পূর্ব-পশ্চিমে সোজাসুজি বহমান দেখানো হয়েছে। অবশ্য সেটার কোনো দরকারও নেই। গুরুত্বপূর্ণ হলো, সিন্দুরে রঙের কালিতে চিহ্নিত শহর আর গ্রামের মন ভরিয়ে তোলা সংখ্যা যা এখন বাবরের নিয়ন্ত্রণাধীন।
দু’বছরের বন্দি জীবন কাটালেও ফারগানার অভিজাতদের রাজনৈতিক আনুগত্য, তাদের দুর্বলতা আর উচ্চাকাক্ষা সম্বন্ধে জ্ঞান তার বিন্দুমাত্র ফিকে হয়নি। রক্তের জটিল সম্পর্ক আর আনুগত্য সম্পর্কে যা কিছু জানবার সবই এসান দৌলতের নখদর্পণে। কিন্তু তারচেয়েও বড় কথা তিনি যেন মানুষের মনের ভিতরটা পড়তে পারেন। এক লহমায় তাদের দুর্বলতা, অহেতুক গর্ববোধ আর অহমিকা বুঝে নিয়ে কিভাবে সেটা নিজেদের সুবিধার্থে কাজে লাগানো যায়। তার নির্দেশনায়, বাবরের ভিতরে প্ররোচিত করার ক্ষমতা জন্ম নিচ্ছে, সেই সাথে নিপূণভাবে নিজ উদ্দেশ্যসিদ্ধির দক্ষতা, নিজের এই দক্ষতা সম্পর্কে বাবর এতদিন অজ্ঞ ছিলো ইতিমধ্যে কয়েকজন প্রভাবশালী গোত্রপতিকে নিজের পক্ষে আনতে সফল হয়েছে। অন্যেরা, ক্ষমতার ভারসাম্যে পরিবর্তন আঁচ করতে পেরে নিজেরাই তার সাথে যোগ দিয়েছে। তাদের হিসাবে বাবর এখনই তাদের পুরস্কৃত করতে না পারলেও অচিরেই এমন সময় আসবে, যখন সে উদারভাবে তাদের আজকের বঞ্চনা ভরিয়ে দেবে।
নিজের ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক প্রজ্ঞা এবং তার সতত বিকাশমান সেনাবাহিনীর সহায়তায় বাবর ধীরে ধীরে পূর্বদিকে চাপ বৃদ্ধি করতে থাকে। গত ছয়মাসে তার সেনাবাহিনীর কাছে কারনন, কাস্সান আর সোখ দূর্গের পতন হয়েছে। শেষের দুটো আপসে আত্মসমর্পন করেছে এবং অবশেষে সে আকশিকে চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলতে শুরু করেছে। জাহাঙ্গীরকে সিংহাসনচ্যুত করাটা এখন কেবল সময়ের। ব্যাপার এবং সে নিশ্চিত শীঘ্রই আবার ফারগানার সুলতান হিসাবে সে পরিচিত হবে। কিন্তু শীতকালটা শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাকে ধৈর্য ধারণ করতেই হবে। মানচিত্রের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট কামড়ে সে ভাবে। বরফাবৃত প্রেক্ষাপটের বুকে জীবন্ত কিছুই দেখা যায় না- কদাচিৎ খাবারের সন্ধানে দু’একটা হরিণ বা শিয়ালকে এদিক ওদিক দৌড়ে যেতে দেখা যায়। আর শীতল আকাশের বুকে চিলের আঁক অসতর্ক হঁদুরের খোঁজে ডানা ভাসিয়ে উড়ে বেড়ায়। দূর্গ প্রাকারে জমে থাকা সূচাগ্র তুষারিকা বলে দেয়, অভিযানের সময় এটা না। আর বাতাস এতো শীতল সে শ্বাস নিলে যে কোনো মানুষের বুক ব্যাথা করবে।
“বাবর মনোযোগ দিয়ে শোন। তোমার সাথে আমার কিছু জরুরি আলাপ আছে। তোমার আম্মিজান আর আমি ঠিক করেছি এবার তোমার বিয়ের বয়স হয়েছে। তোমার এখন সতের বছর বয়স। কিন্তু তার চেয়েও যেটা গুরুত্বপূর্ণ হলো উপযুক্ত সম্বন্ধ তোমার অবস্থানকেই শক্তিশালী করবে।”
এসান দৌলত বিজয়দৃপ্ত ভঙ্গিতে তার দিকে তাকায়। “সব বন্দোবস্ত সম্পন্ন হয়েছে অন্তত নৈতিকভাবে বলা চলে। আমি আর তোমার আম্মিজান যখন বন্দি ছিলাম, তখনই আমরা পরিকল্পনা করতে শুরু করি। বন্দিদশা থেকে মুক্তি লাভ করার সাথে সাথে আমরা সম্ভাব্য সম্বন্ধের কথা প্রচার করতে থাকি এবং দুদিন আগে বার্তাবাহক আমার কাছে সুসংবাদ নিয়ে এসেছে। আমি যে পরিবারের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের কথা মনে মনে ভেবে রেখেছিলাম তারা তাদের সম্মতি জানিয়েছে। যদি তুমি সম্মতি দাও এবং আমি তোমার অখুশি হবার কোনো কারণ অবশ্য দেখতে পাচ্ছি না- বরফ গলতে শুরু করা মাত্র তুমি তোমার নবপরিণীতা স্ত্রীকে গ্রহণ করার জন্য রওয়ানা দেবে।”
বাবর হতবাক হয়ে নানীজানের দিকে তাকিয়ে থাকে, চোয়াল ঝুলে পড়ে এবং বলার মতো কোনো কথা খুঁজে পায় না। এমনকি তার বিচক্ষণ নানীজান এতো চিন্তা ভাবনা করে কাকে তার স্ত্রী হিসাবে মনোনীত করেছে সেটা পর্যন্ত জিজ্ঞেস করার কথা তার মনে থাকে না।
***
বাতাসে এখনও শীতলতা বিরাজ করছে, কিন্তু শীতের প্রকোপ কমার সাথে সাথে শাহরুখিয়ার দেয়ালের উপরে উজ্জ্বল সবুজ ছোপের আকৃতি ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে। জেনানামহলে অচিন্তনীয় উত্তেজনা বিরাজ করছে- খানজাদা আসন্ন বিয়ে ছাড়া অন্য কোনো বিষয়েই কথা বলতে পারছে না। আস্তাবল থেকে ঘোড়া দেখে আঙ্গিনার উপর দিয়ে হেঁটে আসবার পথে বাবর আমুদে ভঙ্গিতে ভাবে। শীতকালের জন্য জমানো খাবার খেয়ে ঘোড়াগুলো শীর্ণ আর খিটমিটে মেজাজের হয়ে পড়েছে। আস্তাবলের দেয়ালের গায়ে তাদের পায়ের খুরের দাগে স্পষ্ট ফুটে উঠেছে পাহাড়ের বুক চিরে আবার ছোটার জন্য তাদের অসহিষ্ণু আকাক্ষা। ঘোড়াগুলোর জন্য বাবরের মন সহানুভূতিতে ভরে উঠে। তার নিজেরও একই অবস্থা।
বস্তুত পক্ষে, অসহিষ্ণুতা ছাপিয়ে অন্য কিছু একটা তাকে আপুত করে ফেলেছে। সে ক্রুদ্ধ হয়ে উঠছে। শাহী পরিবারের সদস্যদের বিয়ের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত পছন্দ অপছন্দের চেয়ে রাজনৈতিক কারণ আর আনুগত্যের বন্ধনটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছেলেবেলা থেকেই সে এই কথাটা শুনে বড় হয়েছে। সে যখন নিতান্তই শিশু, তখনই তার জন্য সম্ভাব্য বিবাহাৰ্থ বাগদানের কথা হয়েছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এমনকি আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ের কথা আলোচিত হয়েছিলো। কিন্তু তার আব্বাজানের আকস্মিক মৃত্যু এবং তার ভাগ্যের উত্থান পতনের কারণে তারা সবাই পিছিয়ে গিয়েছে। তখন থেকে, সে মনে মনে ভেবে রেখেছিলো উপযুক্ত সময় আসলে বিয়ের ব্যাপারে সে নিজেই সিদ্ধান্ত নেবে। দেখা যাচ্ছে তার আম্মিজান আর নানীজান একজন সুলতানের চেয়ে তার সাথে অর্বাচীন কিশোরের মতো ব্যবহার করছে। নিজেদের ভিতরে সবকিছু আগে ঠিক করে নিয়ে একেবারে শেষ মুহূর্তে পুরো বিষয়টা অনিবার্য হিসাবে তার সামনে হাজির করেছে। যদিও এসান দৌলতের ধারণা এই কাজের জন্য তার অভিনন্দন প্রাপ্য এবং সে তাকে শ্রদ্ধা আর পছন্দ করলেও এই মুহূর্তে নানীজানের গলাটা মুচড়ে দিতে পারলে সে শান্তি পেত।
কিন্তু অন্যদিকে আম্মিজানের চোখের নিরব আনন্দ, তিনি যা কিছু সহ্য করেছেন এবং তার মরহুম আব্বাজানের সাথে আম্মিজানের বিয়ে কেবল রাজনৈতিক কারণে আয়োজন করা হলেও পরবর্তীতে তা একটা সফল বিয়েতে পরিণত হওয়া সম্পর্কে তার ব্যাখ্যা শোনার পরে, বাবর প্রতিবাদ করার মতো কোনো যুক্তি খুঁজে পায় না। আর নিজের মনে সে জানে সেটা উচিতও হবে না। এই দুই মহিলার কথাই ঠিক: বিয়ের বন্ধনের মাধ্যমে সৃষ্ট শক্তিশালী মৈত্রীর অতিরিক্ত সমর্থন তার প্রয়োজন। এই জুড়ির ব্যাপারে তার সব অমাত্যই বলেছে এর চেয়ে ভালো পছন্দ আর সমঝোতা হতে পারে না, যদিও সেটা বলার সময়ে তারা বৃথাই তার নাম নিয়েছে। বাবর ওয়াজির খানকে যখন বলেছে যে কি পরিকল্পনা করে হচ্ছে। তখন তার মুখের হাসি। আর বিস্ময়ের অভাব দেখে সে ঠিকই বুঝতে পারে যে পুরো ব্যাপারটা দানা বাঁধবার আগে তার সাথে ঠিকই অন্তত আলোচনা করা হয়েছে।
আর মাত্র কয়েকদিন পরেই, সে জামমীন প্রদেশের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবে। ফারগানার দক্ষিণ-পশ্চিমে দক্ষিণ সীমান্তের কাছে সাত দিনের দূরত্বে বিয়ের আয়োজন করা হয়েছে। সবাই তার জন্য যাকে বধূ হিসাবে নির্বাচিত করেছে তার নাম আয়েশা। জামমিনের শাসক আর মাঙ্গলিঘ গোত্রের সর্দার, ইবরাহিম সারুর বড় মেয়ে। আয়েশা বয়সে তার চেয়ে দুই বছরের বড়। সে দেখতে কেমন হবে? সে কি গ্রান্ড উজিরের মেয়ের মতো চমৎকার দেহ-সৌষ্ঠবের অধিকারী, নাকি শত্রুরা তার জন্য মুখে গন্ধওয়ালা কোনো উটনী খুঁজে বের করেছে? বাবর কাঁধ ঝাঁকায়। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ইবরাহিম সারু একজন ক্ষমতাবান সর্দার আর এখন পর্যন্ত বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়ে তিনি কোনো পক্ষ অবলম্বন করেননি। এখন থেকে তার অধীনস্ত সেনাবাহিনী। বিশেষ করে তার দুর্ধর্ষ তীরন্দাজ বাহিনী- বাবরের নেতৃত্বে তার ন্যায়সঙ্গত অধিকার পুনরুদ্ধারের অভিযানে অংশ নেবে। এই বিষয়টার দিকে লক্ষ্য রেখে, এসান দৌলত তাকে বারবার একটা কথাই পাখিপড়ার মত করে পড়িয়েছে মেয়ে দেখতে কেমন সেটা কোনো ব্যাপারই না। রাতের দায়িত্ব যথাযথের চেয়েও ভালভাবে সম্পূর্ণ করতে তার কিশোর রক্তের কোনো অসুবিধাই হবে না। আর তাছাড়া সে অবশ্যই পরে আরো দার পরিগ্রহ করতে বা উপপত্নী রাখতে পারবে। বাবর তার আম্মিজানের মহলে প্রবেশ করলে সেখানে খুতলাঘ নিগার বা এসান দৌলত কাউকেই দেখতে পায় না। কিন্তু খানজাদাকে একটা কাঠের ছোট বাক্স থেকে কিছু ক্ষুদ্র অলঙ্কার মেঝেতে ঢেলে আনমনে বাছতে দেখে। “আমি কি এগুলো আয়শাকে দিতে পারি? তার কি এসব পছন্দ হবে?” সে ছোট ছোট রুবি বসানো সোনার সুক্ষ তারের একটা ঝালরের মতো কানের দুল এবং দুলের নিচে মুক্তার একটা তিরতির করে কাঁপছে, দেখিয়ে জানতে চায়।
“তোমার ইচ্ছা হলে দিও।” বাবর কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে। তার নবপরিণীতা বধূকে তার দেয়া উপহার সামগ্রী- ফুলের নকশা করা রেশমের গাইট, মশলার বস্তা, সোনার তৈরি ভারী কণ্ঠহার আর বাজুবন্ধ যা বহু শতাব্দি ধরে ফারগানার শাহী পরিবারের স্মারক হিসাবে বিবেচিত হয়ে আসছে- সবই তার আম্মিজান আর নানীজানের পছন্দ করা এবং তিন সপ্তাহ আগে ভারী প্রহরায় জামমীন পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। সে তার সম্ভাব্য হবু শ্বশুরের জন্য সোনার মোহর, নিখুঁত শৃঙ্গযুক্ত পাঠা, খুরের পেছনের আর সামনের অংশে সাদা কেশগুচ্ছ রয়েছে এমন কালো স্ট্যালিয়নের একটা নিখুঁত জোড়া পাঠিয়েছে। বলতে দ্বিধা নেই এই একটা উপহার পাঠাতে তার খুব কষ্ট হয়েছে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে সে তার সাধ্য অনুযায়ী বরপণ দিয়েছে। সেটা অবশ্য ইবরাহিম সারুর মতো সর্দারের মর্যাদা অনুরূপ হয়নি। বাবর আবার চিন্তা করে সর্দার এই বিয়েতে কেনো মতো দিলো? তিনি নিশ্চয়ই বিশ্বাস করেন যে বাবরের সালতানাত্তীন অবস্থা বেশি দিন বজায় থাকবে না। নিঃসন্দেহে তিনি তার মেয়েকে সুলতানা হিসাবে দেখলে এবং বাবরের উত্তরাধিকারীর নানা হতে পারলে খুশিই হবেন। আর সেজন্য কে তাকে অপরাধী সাব্যস্ত করবে? উচ্চাকাঙ্ক্ষা বড় সুন্দর। “বা আমি এটাও দিতে পারি?” নিজের অলঙ্কারের দঙ্গলে ভাইয়ের হবু বউয়ের জন্য পছন্দসই উপহার খুঁজতে ব্যস্ত খানজাদার কালো চুল সুযোগ পেয়ে চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছে।
বাবর সহসা নিজেকে নিয়ে লজ্জিত হয়ে পড়ে। সাম্প্রতিক সময়ে খানজাদা আনন্দ করার অবকাশ পায়নি বললেই চলে। তার জন্য বোনের এতো আনন্দ- এবং এতোটা উদার আর ভোলা-মনের পরিচয় দেয়াতে তার খুশিই হওয়া উচিত। আয়েশার চেয়ে সে অবশ্য বয়সে বড়ই হবে। তাদের এবার উচিত হবে বোনের জন্য উপযুক্ত স্বামী খোঁজা। সে আবার যখন ফারগানার সুলতান হবে, তখন সে বোনের জন্য ভালো একটা ছেলে খুঁজে বের করবে বলে নিজের কাছে নিজে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়। এবং নিজের বিয়ের সময়ে যেমন তার সাথে আলোচনা করা হয়েছে এর চেয়ে বেশিই সে বোনের সাথে বিয়ের ব্যাপারে আলোচনা করবে।
দু’সপ্তাহ পরের ঘটনা। বাবর দাঁড়িয়ে থেকে খুতলাঘ নিগার, এসান দৌলত আর খানজাদাকে শীতের কামড় বসানো বাতাসের হাত থেকে বাঁচতে ভারী উলের পরত দেয়া আলখাল্লায় আবৃত অবস্থায় বড় চাকাঅলা, ছই দেয়া গরুর গাড়িতে উঠতে দেখে। পুরো গাড়িটা ভেড়ার চামড়ার মোটা পরত দিয়ে মোড়া আর ভেতরে পুরু গালিচা পাতা রয়েছে, আর লোকের দৃষ্টি থেকে আরোহীদের আড়াল করতে লাল রঙের পর্দার ঝালর ঝুলছে গাড়িটায়। গাড়িটার সাথে যে সাদা রঙের চারটা ষাড় জোতা হয়েছে বিয়ের উপলক্ষ্যের তাদের সবগুলোর শিং সোনালী রঙ করা হয়েছে আর তাদের চওড়া, পেষল কাঁধের উপরের জোয়ালগুলো নীল আর সোনালী রঙের। বাবর তার প্রিয় কালো কেশরযুক্ত বাদামী রঙের ঘোড়ার পিঠে উঠে বসতে, ঘোড়াটাও উত্তেজনা আঁচ করতে পেরে প্রাণোচ্ছল, বল্পিত ভঙ্গিতে দু’পা শূন্যে তুলে লাফালাফি আরম্ভ করে। আবার জিনে উপবিষ্ট হতে পেরে সে বর্তে যায় এবং ঘোড়াটার মালিশ করা চকচকে ঘাড়ে পরম মমতায় একটা চাপড় বসিয়ে দেয়। সে একটা শক্তিশালী রক্ষীবাহিনীর নেতৃত্ব দিয়ে বাইসানগারকে শাহরুখিয়ায় রেখে ওয়াজির খান আর পাঁচশ সুসজ্জিত যোদ্ধার একটা বাহিনী নিজের সাথে রাখে। বিয়ের খবর ছড়িয়ে গেছে এবং অনেকেই- যাদের মধ্যে কিছু বিরূপভাবাপন্ন জামমীনের উদ্দেশ্যে তাদের দক্ষিণমুখী যাত্রা আগ্রহের সাথে পর্যবেক্ষণ করবে। কিন্তু এমন একটা সুসজ্জিত বাহিনী সাথে গুপ্তদূত আর অশ্বারোহী প্রহরী দল থাকায় বাবর এবার গুপ্তহামলার কোনো আশঙ্কা করে না।
দূর্গের তোরণদ্বারের কাছে রক্ষীদের জন্য নির্মিত ভবনের কাছে দাঁড়িয়ে ওয়াজির খান শেষবারের মতো বাইসানগারের সাথে শেষ মুহূর্তের কিছু গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা সেরে নেয়। কথা শেষ করে সে অসমান খাড়া সিঁড়ি বেয়ে নিচের আঙ্গিনার উদ্দেশ্যে নামতে শুরু করে। সেখানে এক সহিস তার ঘোড়া অবদমিত শক্তির কারণে দাপাদাপি আর নাক ঝাড়তে শুরু করতে তাকে সামলে রাখতে হিমসিম খেয়ে যায়। বাবর ভাবে, বছরখানেক আগের তুলনায় এখন ওয়াজির খানের হাঁটতে কতো কষ্ট হচ্ছে। খুঁড়িয়ে হাঁটার এই উপসর্গটা তার সাথে কবর অব্দি যাবে।
অবশেষে, হেলেদুলে এগিয়ে চলা ষাড়ের গাড়ির সামনে থেকে বাবর আর ওয়াজির খান ধীরে ধীরে দূর্গের ঢালু পথ বেয়ে বের হয়ে এসে এবং তৃণভূমির মাঝ দিয়ে সামনের দিকে এগোতে থাকে যেখানে অস্থায়ী শিবির স্থাপনের জন্য খচ্চরে টানা গাড়িতে প্রয়োজনীয় তাঁবু, রসদ আর অন্যান্য সরঞ্জামাদি নিয়ে অগ্রবর্তী দল ইতিমধ্যে পৌঁছে গেছে। আর অবশ্যই এসব সামগ্রীর সাথে আরো আছে বিয়েতে পরিহিত পোশাক-পরিচ্ছদ, তার হবু স্ত্রীর পরিবারের লোকদের জন্য আরও উপহার উপঢৌকন, যার ভিতরে রয়েছে তার শ্বশুরের জন্য একটা হলুদ চোখের বাজপাখি।
পুরো বহরটা ধীরে ধীরে দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে। কিছুক্ষণ আগে শাহরুখিয়ার দূর্গের প্রাকারবিশিষ্ট ছাদ থেকে বিদায় জানিয়ে বাজানো ড্রামের আওয়াজের বদলে এবার দখল করে বনের মর্মর ধ্বনি, চাকার ক্যাচকোচ, জোয়ালের সাথে বাঁধা ঘণ্টা ধ্বনি, মালবাহী খচ্চরের ঘোতঘোত শব্দ এবং নরম মাটির উপর দিয়ে দুলকিচালে ছুটে চলা অশ্বারোহী বাহিনীর খুরের বোল।
প্রতিদিন ওয়াজির খানের নিয়োজিত রক্ষীবাহিনী কাফেলার চারপাশে সর্তক পাহারায় থাকে। কিন্তু শান্ত উপত্যকা আর তৃণভূমিতে আসন্ন প্রসবিনী গর্ভবতী ভেড়ী আর তার পাল ছাড়া কোনো নড়াচড়াই চোখে পড়ে না। মাঝে মাঝে ধীর গতির কারণে আর ভবিষ্যতের গর্ভে কি অপেক্ষা করছে সে জন্য অস্থির হয়ে বাবর দেহরক্ষীর একটা ছোট দল নিয়ে ঘোড়া ছোটায়।
মুখে এসে ধাক্কা দেয়া বাতাস সে দারুণ উপভোগ করে। তার বাবার ইন্তেকালের পরে সে এমন স্বাধীনতা উপভোগ করেনি। এই মুহূর্তে, সমরকন্দ হাতছাড়া হওয়া বা ফারগানার বিশ্বাসঘাতকতা কিছুই তাকে স্পর্শ করতে পারে না। তার কাঁধে চেপে বসা দায়িত্বের বোঝা- অন্যদের প্রতি তার নৈতিক কর্তব্য, অবশ্য পালনীয় দায়িত্ব আর লক্ষ্য অর্জনের চাপ- যা তাকে প্রায়শই নির্মমভাবে ভারাক্রান্ত করে তুলেছে মনে হয় যেনো গড়িয়ে নেমে যায়। অনেকটা বসন্তের আগমনের মতো একটা অনুভূতি, যখন তীব্র শীতের কারণে মাসের পর মাস ভেড়ার কয়েক স্তর পুরু চামড়ার নিচে কাটাবার পরে সে অবশেষে সবকিছু ঝেড়ে ফেলে পিঠের উপরে সূর্যের উষ্ণতা অনুভব করতে পারে। তাকে বহন করা ঘোড়ার গলার কাছে ঝুঁকে এসে বাবর তার মন থেকে সব ভাবনা ছুঁড়ে ফেলে দেয়। সে যা নিয়ে এই মুহূর্তে চিন্তা করতে চায় না সেসব কিছুর উপরে বিস্মৃতির চাদর বিছিয়ে দেয়।
যাত্রা শুরু করার পরে ষষ্ঠ দিন দুপুরে, ষাঁড়ের গাড়ির পাশে প্রশান্ত মনে বাবর যখন ঘোড়ার পিঠে উপবিষ্ট হয়ে এগিয়ে চলেছে এবং যে সময়ে তারা একটা পাহাড়ের ঢালের পাদদেশের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। দূরে দিগন্তের নিচে কালো-আলখাল্লা পরিহিত একদল ঘোড়সওয়ারের একটা সারি দেখা যায়। ওয়াজির খান সাথে সাথে চামড়ার দাস্তানাযুক্ত হাত উঁচু করে থামবার সংকেত দেয়।
“ওয়াজির খান, কি মনে হয় আপনার? ওরা কারা? মালিক ঘোড়সওয়ার?” বাবর চোখ কুঁচকে তাকিয়ে জানতে চায়। কিন্তু বৈশিষ্ট্যসূচক কিছু- কোনো নিশান, বা কোনো পতাকা- তার চোখে কিছুই আটকায় না। ঘোড়সওয়ারের দলটা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে কেবল তাকিয়ে থাকে।
“সুলতান, তারাই সম্ভবত। আমরা নিশ্চয়ই তাদের সীমান্তের কাছে পৌঁছে গেছি। কিন্তু আমাদের অগ্রবর্তী রক্ষীবাহিনী এসে কিছু না জানানো পর্যন্ত নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না।”
“ঠিক আছে। তারপরেও, নিশ্চিত হতে আরও গুপ্তদূতের দল পাঠাও আর একটা রক্ষণাত্মক বিন্যাসে কাফেলাকে বিন্যস্ত কর।”
ওয়াজির খানের বাছাই করা বারোজন যোদ্ধার একটা দলকে কোমরে তরবারি ঝুলিয়ে, পর্যাণে রণকুঠার এমনভাবে রাখা যেনো হাত বাড়ালেই পাওয়া যায় এবং এতোক্ষণ পিঠে বাঁধা বৃত্তাকার ঢাল বাম হাতে চামড়ার ফালি দিয়ে দৃঢ়ভাবে আটকে নিয়ে, বাবর দ্রুতবেগে শিবির ত্যাগ করতে দেখে। দলের শেষ দু’জন যোদ্ধা বর্শা বহন করছে। সবকিছুর জন্যই প্রস্তুত থাকা ভালো। কি হচ্ছে সেটা নিয়ে মেয়েরা হয়তো উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে বুঝতে পেরে, বাবর ঘোড়া নিয়ে দুলকিচালে ষাঁড়ের গাড়ির কাছে এগিয়ে যায় এবং ঘোড়ার পিঠ থেকে ঝুঁকে পড়ে চামড়ার পর্দার ভেতরে মাথা প্রবেশ করায়। “সামনে সম্ভবত ইবরাহিম সারুর অশ্বারোহীরা রয়েছে কিন্তু তাদের পরিচয় সম্পর্কে আমাদের নিশ্চিত হতে হবে। আমরা আমাদের গুপ্তদূতদের ফিরে আসবার জন্য অপেক্ষা করছি। কিন্তু সেই অবসরে আমরা নিজেদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করছি।” তার আম্মিজান আর খানজাদা ঘুমে চুল ঢুল করলেও, এসান দৌলতের উজ্জ্বল চোখজোড়া সতর্ক, সে মাথা নাড়ে। “ঠিক আছে। কোনো সুযোগ দেবার প্রয়োজন নেই।”
কয়েক মিনিট পরে, ওয়াজির খান তার তীরন্দাজদের আশেপাশের গাছপালা আর পাথরের আড়ালে আত্মগোপন করে থাকতে আদেশ দেয়। ষাড়ের গাড়ির চারপাশে মালবাহী গাড়িগুলোকে বৃত্তাকারে বিন্যস্ত করে অবশিষ্ট সৈন্যদের দিয়ে একটা রক্ষণাত্মক ব্যুহ রচনা করে। কিন্তু সব আয়োজন শেষে অপেক্ষার পালা যেনো আর শেষ হতে চায় না। বাবর কান খাড়া করে রাখে। বাতাসে ভেসে আসা কোনো অবাঞ্ছিত শব্দ শুনতে চেষ্টা করে। কোথাও কিছু নড়াচড়া শব্দ শোনা যায় না। তারপরে তাদের মাথার উপরে পাহাড়ের ধারে ছাগলের একটা পালের গলায় বাঁধা ঘণ্টার বেসুরো সুর শোনা যায়। পালটা খেদিয়ে আনা রাখাল ছেলেটা নিচের দৃশ্যপটের দিকে আতঙ্কিত চোখে তাকিয়ে দেখে এবং হাতের লাঠিটা পাগলের মতো আন্দোলিত করে ছাগলের পালকে পুনরায় চোখের আড়ালে নিয়ে যায়।
বাবরের লোকেরা অবশেষে দুলকিচালে ফিরে আসে। তাদের পেছন পেছন কালো আলখাল্লা পরিহিত ঘোড়সওয়ারের দল হাজির হয়। বাতাসের হাত থেকে বাঁচার জন্য তাদের মুখে পটি বাধা। সব কিছুই নিশ্চয়ই ঠিক আছে। ঘোড়সওয়ারের দল কাছে আসতে, বাবর তাদের একজনের বহন করা নিশানে লাল বাজপাখি দেখতে পায় যেটা মোঙ্গলিঘ গোত্রের প্রতীক। সে নিজের ঘোড়া কয়েক কদম সামনে নিয়ে যায়। তারপরে বাদামী দানবটার লাগাম টেনে ধরে আগন্তুকদের পৌঁছাবার জন্য অপেক্ষা করে।
“ফারগানার বাবর মির্জাকে স্বাগত জানাই।” দলটার নেতৃত্ব দেয়া অশ্বারোহী জিনে বসে থাকা অবস্থায় ঝুঁকে পড়ে তাকে অভিবাদন জানায়। শক্তিশালী দর্শন লোকটা মুখের কালো পটি খুলতে, বাবর তার কালো দাড়ি, চোয়ালের চওড়া হাড় এবং তার উপরে বিশাল কালো অন্তদৃষ্টিসম্পন্ন একজোড়া চোখ, অদ্ভুতভাবে তার মণিতে হলুদের ছোপ রয়েছে। লোকটার বয়স আনুমানিক চল্লিশ বছর। “আমি ইবরাহিম সারু, মোঙ্গলিঘদের সর্দার। আমি আপনাকে আর আপনার পরিবারকে স্বাগত জানাই। আজ আপনারা আমার অতিথি আর আগামীকাল বাবর আপনি আমার পুত্রে পরিণত হবেন।” ইবরাহিম সারু যদিও বাবরের মাতৃভাষা তূর্কীতে কথা বলছে, কিন্তু তার বাচনভঙ্গির কারণে শব্দগুলোকে কেমন অপরিচিত মনে হয়। মোঙ্গলিঘদের আদিবাসস্থান ছিলো পারস্যে- ফার্সী আজও সম্ভবত তাদের মাতৃভাষা।
বাবর এবার ঝুঁকে ফিরতি অভিবাদন জানায়। “আপনাকে ধন্যবাদ। আপনি আমাদের সম্মানিত করেছেন।”
“আমাদের অস্থায়ী ছাউনি এখান থেকে দু’ঘণ্টার দূরত্বে অবস্থিত। আমরা আপনাদের জন্য অপেক্ষা করছিলাম আর পাহারা দিচ্ছিলাম। আমি নিজে এসেছি কারণ, আমি ব্যক্তিগতভাবে আপনাকে প্রথমে স্বাগত জানাতে চেয়েছি।”
বাবর আবার ঝুঁকে অভিবাদন জানায় এবং পাহাড়ের ঢাল বেয়ে ধীরে ধীরে ইবরাহিম সারুকে অনুসরণ করতে তার ঘোড়ার পেটে খোঁচা দেয়।
***
বৃত্তাকার যে তাঁবুটা বাবরকে রাত কাটাবার জন্য দেয়া হয়, সে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে খুঁটিয়ে দেখে স্বীকার করতে বাধ্য হয় যে যথেষ্ট সুন্দরভাবেই তাঁবুটা সাজানো হয়েছে। শুকনো চামড়া দিয়ে সেলাই করা দশ ফুট উঁচু দেয়ালের পুরোটা লাল আর নীল বুননের পর্দা দিয়ে ঢাকা। কুণ্ডলীকৃত সাপের মতো দেখতে পিতলের মোমদানিতে মোমবাতি জ্বলছে। মোমদানিগুলো আবার স্বর্ণালী আভাযুক্ত আস্ত নীলকান্তমণির ভিত্তির উপরে স্থাপিত। গাঢ় নীল রঙের যে তাকিয়ায় সে মাথা দিয়ে শুয়ে আছে সেটার উপরে সোনার জরির পুরু কারুকার্য তার ঘাড়ের পেছনে সুড়সুড়ি দেয় এবং গদিটাকে মনে হয় মোটা কাপড়ের একটা ঢাউস ব্যাগ যার উপরে পুরু পিচ্ছিল কিংখাব দেয়া। তাঁবু ভেতরের পুরো মেঝে চামড়ার পুরু আস্তরণ দিয়ে ঢাকা।
সমরকন্দের সাথে এর কোনো তুলনাই চলে না কিন্তু ইবরাহিম সারু অতিথিদের জন্য এমন জাঁকজমকপূর্ণ শিবির স্থাপন করতে তার সাধ্যের অতীত চেষ্টা করেছে। আগের দিন রাতে তারা যখন এখানে এসে পৌঁছায়, দেখে সারি সারি তাঁবু বাবরের লোকদের জন্য যে তাঁবুগুলো সেগুলোর উপরে ফারগানার হলুদ নিশান উড়ছে এবং তার কেন্দ্রে রয়েছে বাবরের নিজস্ব বিশাল আনুষ্ঠানিক তবু একটা। দৃষ্টিনন্দন দৃশ্য। কোনো সন্দেহ নেই ইবরাহিম সারুও ঠিক তাই চেয়েছে।
কারুকাজ করা ধাতব বকলেশ দিয়ে আটকানো প্রবেশ দ্বারের পর্দার ফাঁক দিয়ে গুটিগুটি পায়ে প্রবেশ করা আলোর তীব্রতা দেখে বাবর ধারণা করে অনেক আগেই সকাল হয়েছে। সে গত রাতে ইবরাহিম সারুর কারুকাজ করা চাদোয়া আর প্রবেশ পথ পর্যন্ত গালিচা বিছানো তাঁবুর দরবার মহলে আয়োজিত পোলাও, ভেড়ার মাংসের কাবাব, মাটির নিচে জন্মানো সজি আর কড়া পানীয় সহযোগে আয়োজিত নৈশভোজের কথা চিন্তা করে। বাবরের ইচ্ছা ছিলো সন্ধ্যেটা এসান দৌলত, খুতলাঘ। নিগার আর তার বোনের সাথে মেয়েদের তাবুতে কাটায়। কিন্তু সেটা অবশ্য সম্ভব না। পুরোটা সন্ধ্যাটা তাকে হাসি হাসি মুখে বসে বাজিকরের ভেল্কি, আগুন-খেকোর দক্ষতা, নিপূণ দড়াবাজের কসরত, এবং নাদুসনুদুস দেখতে বাঈজিদের কোমরের দুলুনি দেখতে হয়েছে। যারা নিজেদের ভরাট বুক আর নিতম্ব আঁকাবার ফাঁকে সরাসরি তার চোখের দিকে তাকিয়ে থেকেছে। এরপরে, সে হাসি হাসি মুখে বসে তার নিজের আর ইবরাহিম সারুর লোকদের একসাথে নাচগান করার ফাঁকে, শীঘ্রই তারা একে অপরের সহযোদ্ধায় পরিণত হবে বলে পরস্পরের স্বাস্থ্য পান করতে দেখেছে। যতক্ষণ না তারা সুরার নেশায় বিভ্রান্ত হয়ে মেঝেতেই শুয়ে ঘুমিয়ে না পড়েছে।
বাবর যে অনায়াসে যে কোনো লোকের মত পান করতে পারে। গত রাতে অল্পই পান করেছে, আশা করেছে যে ইবরাহিম সারু হয়তো তাদের আসন্ন মৈত্রীর বন্ধন সম্পর্কে তার সাথে কথা বলতে চাইবেন। অনেক কিছু আলাপ করার বাকী আছে। সে নিশ্চিত, তার হবু শ্বশুরের সাহায্যে আকশি আক্রমণ করে কয়েক সপ্তাহ না হোক অন্তত কয়েক মাসের ভিতরে সে তার সিংহাসন উদ্ধার করতে পারবে। তারপরে সমরকন্দ থেকে তার চাচাতো ভাই মাহমুদকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করাটা কেবল সময়ের ব্যাপার। কিন্তু ইবরাহিম সারু এসবের আশপাশ দিয়ে যায় না, কেবল সামাজিকতা রক্ষার্থে মামুলি কথাবার্তা বলে এবং বাবরও অনুভব করে এমন আনন্দের সময়ে যুদ্ধের আলোচনা করাটা অভদ্রতা হবে, সে তখন নিজেকে সংযত করে।
গায়ের উপর থেকে বাবর নরম চামড়ার কম্বল, যার নিচে সে আরামে রাত কাটিয়েছে, সরিয়ে উঠে বসে। ভবিষ্যতের গর্ভে কি অপেক্ষা করছে ভেবে সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। নিজের পরিস্থিতি আর নিজের উপরে সে যুগপৎ অস্থির হয়ে উঠছে। এই মুহূর্তে এক অচেনা তরুণীকে বিয়ে করার বদলে সে তার লোকদের নিয়ে যুদ্ধে যাবার জন্য যে কোনো কিছু করতে রাজি আছে। কিন্তু সে একজন সুলতান, বীর আর যোদ্ধা এবং এখন সে প্রাপ্তবয়স্ক একজন পুরুষ। পাহাড়ে কাটানো সেইসব নিঃসঙ্গ সময়ে সে কত রাত শক্ত মাটির উপরে শুয়ে মাথার উপরের শীতল রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে কোমল, উষ্ণ নারীদেহের কথা কল্পনা করেছে?
সে কেন তাকে সঙ্গ দিতে কাউকে ডেকে পাঠায়নি? তার অবশ্য নির্দিষ্ট কোনো পছন্দ ছিলো না। সম্ভবত সেটা ছিলো পিতৃহীন একমাত্র ছেলের বিনয়াভিমান। এমনও হতে পারে সেই পরিস্থিতিতে কোনো সন্তানের জনক হবার ব্যাপারে সে। অনিচ্ছুক ছিল? সম্ভবত নিজের মর্যাদা রক্ষার ব্যাপারে অতিরিক্ত সচেতন সে চায়নি বারবণিতাদের সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত করতে বা সেরকম মেয়ে তার কাছে আসুক সে ব্যাপারেও তার আপত্তি ছিলো। তার আগে অনেক শাহজাদাই তাদের সাথে মানানসই না এমন নারীর কল্যাণে সালতানাৎ হারিয়েছে। কিন্তু আজ রাতে একজন নারীকে আলিঙ্গন করতে তার মালিক হিসাবে নিজেকে কল্পনা করার অনুভূতি কেমন সে অনুভব করবে। তার কৃতজ্ঞ থাকা উচিত।
তার শ্বশুরের সৌজন্যতাবশত জোর করে পাঠানো চারজন পরিচারককে সে হাততালি দিয়ে ডাকে। আজ তার বিয়ে এবং তার অবশ্যই উচিত নীতিনিয়মের শুদ্ধতা উদযাপন করা। তাঁবুর বাইরে থেকে তাদের ভেসে আসা আলাপচারিতার আওয়াজ সে শুনতে পায় এবং তার ইশারা শুনে তারা ভিতরে প্রবেশ করে তাঁবুর পর্দা উঠিয়ে দিলে সূর্যের আলোয় ভেতরটা আলোকিত হয়ে উঠে।
বাবরের বিয়ের পোশাক- হরিণের নরম চামড়ার তৈরি শালোয়ার, হলুদ রেশমের তৈরি খাটো আস্তিনযুক্ত আজানুলম্বিত আঁটসাট বহির্বাস, সাথে তার মরহুম আব্বাজান নিজের বিয়েতে যে সোনার ভারী কোমরবন্ধনী ব্যবহার করেছিলেন সেটা এবং উপরে পরার জন্য তামার কারুকার্যখচিত আলখাল্লা- আগের রাতে সবই গাঁটরি খুলে বের করে গম্বুজাকৃতি একটা সিন্দুকে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। একটা উঁচু নীল মখমলের টুপি, খানজাদা যেটাতে ছোট ছোট মুক্তা যত্ন নিয়ে বসিয়েছে এবং সাথে ঈগলের পালকের তৈরি শিরস্ত্রাণ কাছেই একটা টুলের উপরে রাখা।
দু’ঘণ্টা পরে হাম্মামখানার তাঁবুতে গরম পাথরের উপরে ফোঁটানো পানিতে গোসল করার পরে তার পরিচারকের দল টাটকা তাজা ঔষধি লতাগুল্ম দিয়ে তার দেহ ভালো করে রগড়ে মুছে দেয়। তার লম্বা চুল সুগন্ধি তেল দিয়ে আচড়িয়ে দেয় এবং তাকে তার নির্বাচিত পোশাকে সজ্জিত করলে, বাবর পুরো দিনের মতো প্রস্তুত হয়। সূর্যের আলোয় পা রাখতে তার উষ্ণীষের ঈগলের পালকের লম্বা ছায়া প্রতি পদক্ষেপের সাথে সাথে মাটির অনেক দূর পর্যন্ত নাচতে নাচতে এগিয়ে যায়।
সহসা শিবিরের অন্যপ্রান্ত থেকে কর্ণবিদারী একটা চিৎকার ভেসে উঠে। “সুলতান, জেনানামহলের দিক থেকে আসছে।” বাবরের অভিব্যক্তিতে বিভ্রান্তির ছায়া দেখতে পেয়ে তার একজন পরিচারক বলে। “বধূকে তারা বিদায় জানাচ্ছে ঠিক যেভাবে আর কয়েক ঘণ্টা পরে সে নিজের কুমারীত্বকে বিদায় জানাবে।” মেয়ের কণ্ঠের তীব্রতা বৃদ্ধি পেয়ে এখন প্রায় আর্তনাদের মত শোনায়। আওয়াজটা মোটেই শ্রুতিমধুর না- ফারগানার গ্রামে বিয়ের সময় যেমন হর্ষোৎফুল্ল গানের আওয়াজ শোনা যায় তার সাথে এর কোনো মিলই নেই। বিলাপের সাথেই বরং এর মিল বেশি।
বাবরের তাঁবুর পাশে তৈরি করা আরেকটা তাঁবুর নিচু প্রবেশপথ দিয়ে সুন্দর পোশাকে সজ্জিত ওয়াজির খানকে ঝুঁকে বের হয়ে আসতে দেখে বাবরের মনটা খুশিতে ভরে উঠে। “সুলতান, আপনার বিবাহ দিবসে আমার অভিবাদন গ্রহণ করুন।” ওয়াজির খানের এক চোখের দৃষ্টিতে উষ্ণতার ছোঁয়া এবং সে আজ তার পাশে থাকবে ভেবে বাবর কৃতজ্ঞবোধ করে। “সুলতান, আপনি কি প্রাতঃরাশ করেছেন?”
“আমি মোটেই ক্ষুধার্ত নই। কিছুক্ষণ আগেই আমি পানি পান করেছি।”
ওয়াজির খানের অভিব্যক্তিতে বাবর সহমর্মিতা দেখতে পায়।
“আমাদের রক্ষীদল শীঘ্রই এখানে এসে উপস্থিত হবে আপনার সাথে সহচর হিসাবে বিবাহ মণ্ডপে যাবে বলে।”
“ওয়াজির খান…” বাবর বুঝতে পারে না সে কি বলতে চায় এবং সে কিছু ভাববার আগেই আকাশ বাতাস প্রকম্পিত করে ঢাক ঢোল বেজে উঠতে রমণীদের আতঙ্কজনক বিলাপের শব্দ চাপা পড়ে যায় এবং সে দেখে ওয়াজির খানের লোকেরা ফারগানার উজ্জ্বল হলুদ রঙের পোশাকে সজ্জিত হয়ে দু’সারিতে এগিয়ে আসছে এবং তাদের সামনে রয়েছে তার নিজস্ব যন্ত্রীদল। একটা সহিস বাবরের বাদামী বর্ণের আজদাহাটার লাগাম ধরে টেনে আনে। আজকের বিশেষ উপলক্ষের জন্য একটা উজ্জ্বল হলুদ রঙের পর্যানের কাপড় তার বস্ত্রাবরণ হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে। লেজ আর কেশর হলুদ ফিতা দিয়ে বেণী করা আর মাথায় সোনালী-বাদামী বর্ণের বাঘের চোখ পাথরের তৈরি সাজ।
বাবর জিনে উঠে বসে এবং তার লোকদের ঘোড়ার লাগাম ধরে গত রাতে যেখানে ভোজসভা হয়েছিলো সেই একই তাঁবুর সভাগৃহের দিকে নিয়ে যাবার অনুমতি দেয়। এখন সেখানে ইবরাহিম সারু তার মেয়েকে নিয়ে তার জন্য অপেক্ষা করছেন। বাবর জিনের উপর থেকে নামতে, কালো পোশাকে সজ্জিত মাঙ্গলিঘ রক্ষীবাহিনী তাকে অভিবাদন জানায়। তূর্যনাদের মাঝে ধীরে ধীরে সে গাঢ় বেগুনী মখমলের আলখাল্লা পরিহিত ইবরাহিম সারুর দিকে এগিয়ে যায়, যেখানে সে দাঁড়িয়ে রয়েছে তাকে অভ্যর্থনা জানাতে।
তিন ফুট উঁচু জাফরিকাটা কাঠের পর্দা দিয়ে আলাদা করা একপাশে ইবরাহিম সারুর দরবারের রমণীরা রয়েছে। তাদের মুখের নিচের অংশ নেকাবের আড়ালে। কিন্তু হাল্কা আবরণীর উপরে তাদের ঘন আর লম্বা পাপড়ির নিচের কালো চোখ তাকে পরিষ্কার কৌতূহলে জরিপ করছে। তাদের কেন্দ্রে, সম্মানিত স্থানে, সে তার। নানীজান, আম্মিজান আর বোনকে দেখতে পায়। মাথা আর ঘাড় ভালো করে সোনার তারাখচিত একটা নীল রঙের শাল দিয়ে আবৃত করে পিঠ সোজা করে বসে আছেন এসান দৌলত। খুতলাঘ নিগারের পরণে একটা ঢিলেঢালা হলুদ জোব্বা এবং কয়েক গাছি মুক্তার মালা গলার শোভা বাড়িয়েছে। গর্বিত চোখে বাবরের দিকে তাকিয়ে আছেন। যখন খানজাদার চোখ- মাঙ্গলিঘ রমণীদের চেয়ে অনেক বেশি কমনীয়- চকচক করে।
বিশাল তাঁবুটার ঠিক কেন্দ্রে, মেরুন রঙের গালিচা পাতা মঞ্চের উপরে তার স্ত্রী সোনালী তাকিয়ায় বসে আছে। ধূপ দিয়ে সুবাসিত করা কয়লা ভর্তি ঝুড়ি তার সামনে জ্বালিয়ে রাখা হয়েছে। ফলে সোনালী কাপড়ের তৈরি মস্তকাবরণের নিচে থেকে বের হয়ে আসা দুধসাদা রঙের ভারী কাপড়ের নেকাবই তাকে আড়াল করে রাখেনি, মাথার উপরের ছাদে অবস্থিত গবাক্ষের খুলে রাখা পর্দার দিকে বাতাসের সাথে পাঁক খেয়ে উঠে যাওয়া ধোঁয়ার কুণ্ডলীও তাকে ঢেকে রেখেছে। বাবর তার দিকে হেঁটে যেতে, আয়েশা স্থাণুর ন্যায় বসে থাকে। বাবর যে শীঘ্রই তার শৌহর হবে সে বিষয়ে কোনো ধরণের সচেতনতা তার মাঝে প্রকাশিত হয় না। আয়েশার অভিব্যক্তি দেখতে তার ইচ্ছা করে।
ভেরীর আওয়াজ স্লান হয়ে আসে এবং মুহূর্তের জন্য চারপাশে নিথর নিরবতা নেমে আসে।
“আয়েশা!” তার বাবার ডাক শুনে, মেয়েটা উঠে দাঁড়ায়। তাকে লম্বাই দেখায় কিন্তু স্থূলকায়া নাকি ক্ষীণাঙ্গী, দেহসৌষ্ঠব সাবলীল নাকি অন্যরকম, বাবর কিছুই বুঝতে পারে না। সে কেবল মেয়েটার লম্বা পায়ে মেহেদীর ভরাট বরফিকাটা নকশা লক্ষ্য করে।
“এদিকে এসো।” ইবরাহিম সারু বাবরকে মঞ্চে উঠে তার হবু বধূর মুখোমুখি হতে ইশারা করে। এরপরে, তিনি নিজের মেয়েকে বোরখার ভেতর থেকে ডান হাত বের করে তার দিকে এগিয়ে দিতে বলে। হাতটা ধরে। তিনি সেটা বাবরের ডান হাতের উপরে স্থাপন করেন। আয়েশার হাত শুষ্ক আর শীতল।
কালো আলখাল্লা পরিহিত, শ্মশ্রুমণ্ডিত লম্বা এক মোল্লা এবার এগিয়ে আসে এবং মন্দ্র, অনুনাদক কণ্ঠে কিছু আবৃত্তি করে। কিছু সুরেলা কণ্ঠে সুর করে বলে, যা সম্ভবত দোয়া বা আশীর্বাদ হবে বলে বাবর মনে করে। সে যদিও পুরোটা মনোযোগ দিয়ে শুনে, কিন্তু সে বুঝতে পারে না কোনো ভাষায় লোকটা কথা বলছে। খুব সম্ভবত ফার্সী হবে। অবশেষে মোল্লার দোয়া শেষ হয় এবং বুকের কাছে কোরান শরীফ ধরে সে পিছিয়ে আসতে, ইবরাহিম সারু এক মুঠো শস্য তরুণ দম্পতির উপরে ছিটিয়ে দেন। পুরুষকণ্ঠের সম্মিলিত ঐক্যতানে পুরো তাবুটা গমগম করে উঠে এবং সহসা মুঠি ভর্তি আঁশযুক্ত শস্যদানা বাতাসে ভাসতে থাকে। মাঙ্গলিঘ মেয়েরা বাতাসে ডানামেলা পাখির ঝাঁকের মতো উঁচু আর কর্ণবিদারী উলুধ্বনি দিতে শুরু করে।
আয়েশা বাবরের দিকে ঘুরে দাঁড়ায়। বাবর হাসে এবং আয়েশার কাছ থেকে কোনো ধরণের ইঙ্গিতের আশা করে। কিন্তু এক মুহূর্ত নিরবে দাঁড়িয়ে থেকে সে হাতটা টেনে সরিয়ে নেয় এবং মঞ্চ থেকে নেমে যায়। মাঙ্গলিঘ মেয়েরা সাথে সাথে কাঠের আবডালের আড়াল থেকে উঠে দাঁড়ায় এবং সবাই এগিয়ে এসে আয়েশার উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে। বাবর তাজ্জব হয়ে দেখে, আনন্দে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠে, তার কাছ থেকে তারা দুধসাদা রঙের নেকাব টেনে নিয়ে, ঘূর্ণির বৃত্তাকারে ঘোরাতে শুরু করে এবং তার পরণের পোশাকের পলকা আবরণ টেনে ছিঁড়ে।
সর্দার আর তার পরিবার এসব কি শুরু করেছে? বাবর তাকিয়ে দেখে তাঁবুতে প্রবেশের মুখের কাছে ওয়াজির খান দাঁড়িয়ে রয়েছে। বাবর জানে তার নিজের অভিব্যক্তির মতোই তারও অবশ্যই কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থা। আবডালের আড়ালে এখনও নম্র ভঙ্গিতে বসে থাকা খানজাদার চোয়াল ঝুলে পড়ে আমোদর আভাস পেয়ে। এসান দৌলত আর খুতলাখ নিগার সোজা আড়ষ্ঠ ভঙ্গিতে সামনের দিকে তাকিয়ে থাকে। যেনো এসব অদ্ভুত ব্যাপারে আগ্রহী হবার শিক্ষা তাদের দেয়া হয়নি।
আয়েশা তখনও অর্ধেক আবৃত। এমন সময় যন্ত্রীদল তাদের পিতলের লম্বা বাঁশি, করতাল, ঘণ্টা আর শক্ত করে বাঁধা চামড়ার ঢোল একসাথে বাজাতে শুরু করে দেয়। আয়েশার কাছ থেকে মেয়েরা পেছনে সরে আসে এবং হাত দিয়ে তালি দিয়ে পা ঠুকে তালে তালে তারা গান গাইতে শুরু করে। বাবর এবার টের পায় যে ঘরে উপস্থিত লোকেরা তাঁবুর দেয়ালে পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়েছে এবং মেয়েরা নববধূর চারপাশে একটা মানব ব্যুহ তৈরি করেছে যে, সে আর আয়েশার বাবাই কেবল তাকে দেখতে পাবে। আয়েশা এবার সর্পিল ভঙ্গিতে নাচতে শুরু করে, মোচড়ায়, বৃত্তাকারে ঘুরতে থাকে যতক্ষণ না মুখের নিচের অংশ ঢেকে রাখা নেকাব ছাড়া, ঝালরের শেষ অংশটুকু দেহ থেকে খসে পড়ে।
বাবর এবার দেখে এক জোড়া কয়লার মতো কালো চোখ চঞ্চল দৃষ্টিতে তাকে দেখছে। তার মাথার চুল পরিপাটি করে বেণী করা এবং ছোট মাথার চারপাশে। সেটা কুণ্ডলী করে বেঁধে রাখা হয়েছে। তার লম্বা দেহ, পরনের গাঢ় বেগুনী রঙের শালোয়ার গোড়ালীর কাছে কুঁচকে জমে আছে। আর উধ্বাঙ্গের আঁটসাটো কাঁচুলির কারণে তার তলপেট উন্মুক্ত হয়ে আছে, লম্বা, জালি জালি অন্তর্বাস দিয়ে তার বেঁধে রাখা স্তনযুগলকে দেখে মনে হয় ছোট আর পেষল। একটা গাঢ় রঙের পাথর- খুব। সম্ভবত নীলা- তার নাভিতে দ্যুতি ছড়াচ্ছে।
“তাকে গ্রহণ করো। সে এখন তোমার।” ইবরাহিম সারু আয়েশার দিকে বাবরকে ঠেলে দেন। “বিয়ের শয্যা তোমাদের জন্য অপেক্ষা করছে- যাও। তাকে উপভোগ করো, ভোজসভা তারপরে আরম্ভ হবে…”
বাবরের হতবাক হওয়া অভিব্যক্তি দেখে তার শ্বশুর হেসে ফেলে। “ফারগানার শাহজাদাদের দুপায়ের মাঝে কি আগুন জ্বলে না?”
বাবরের মুখ লাল হয়ে উঠে এবং সে আয়েশার হাত ধরে। ইবরাহিম সারু একটা আলখাল্লা নিজের মেয়েকে পরিয়ে দিয়ে, দু’বার হাততালি দিতে যন্ত্রীদল উঠে দাঁড়ায়। দু’সারি অবস্থান নিয়ে তারা এখনও তাদের সেই উদ্দাম বাদ্য বাজাতে থাকে।
“তোমার বাসরশয্যা পর্যন্ত তারা বাজনা বাজিয়ে যাবে। আমি আমার অভিজাতদের সাথে তোমাকে অনুসরণ করবো।” ইবরাহিম সারুর মুখে একটা চওড়া হাসি ফুটে আছে।
যন্ত্রদলের বিড়ালের মতো চিৎকার করে বাজনার সাথে বিয়ের শোভাযাত্রা ইবরাহিম। সারুর দৃষ্টিনন্দন তাঁবু থেকে সূর্যালোকে বের হয়ে আসতে বাবরের মাথা দপদপ করতে শুরু করে। জেনানামহলের কাছেই বাসরশয্যার তাবু স্থাপন করা হয়েছে। ফারগানার হলুদ আর জামমীনের কালো লাল নিশানে সেটা জমকালোভাবে সাজানো। বাবর ভাবে, এটা মোটেই প্রীতিকর দৃশ্য নয়।
যন্ত্রীদল ছড়িয়ে গিয়ে, প্রবেশ পথের দু’পাশে অবস্থান নেয়। বাবর আয়েশাকে নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করার সময়ে পরিচারকের দল ভূমিতে কপাল ঠেকিয়ে সেজদার ভঙ্গিতে অবস্থান করে। তাদের পরণে লাল আর কালো পোশাক। বিশাল তাঁবুটা পুরু গালিচা দিয়ে ঢাকা। কিন্তু বাবর যেমনটা আশা করেছিলো তার চেয়ে অনেক বেশি নিরাভরণ। তাঁবুর ঠিক কেন্দ্রে একটা ঢাউস গদি ধূসর ফুলের ছোপ দেয়া রেশমের কিংখাব দিয়ে ঢাকা। যা দুপাশে দুই বিশাল মোমবাতির ঝাড় আলোকিত করে রেখেছে। গদির উপরে একটা চতুর্ভূজাকৃতি কাঠের কাঠামো থেকে সারি সারি কাঠবিড়ালের চামড়া ঝুলছে। যা টেনে দিয়ে শয্যার চারপাশে একটা আবডাল তৈরি করা যায়। পুরো তাঁবুতে আর কিছু নেই। না কোনো আয়না, না কোনো সিন্দুক বা না কোনো বসার টুল।
বাবর পুরো পরিস্থিতির সাথে ধাতস্থ হবার আগেই কোলাহলরত মেয়েরা আয়েশাকে নিয়ে এসে গদির উপরে বসিয়ে চারপাশে পর্দা টেনে দেয়। যাতে তাকে দেখা না যায়। এক মুহূর্ত পরে পুরুষ পরিচারকবৃন্দ বাবরের পোশাক খুলতে শুরু করে। ব্যগ্র, কৌতূহলী আঙ্গুল মাথা থেকে পাগড়ি তুলে নিয়ে তার বর্হিবাস আর জোব্বার বাঁধন আলগা করে। শালোয়ার বন্ধনমুক্ত করে দু’পা থেকে পর্যায়ক্রমে বুট খুলতে শুরু করলে বাবর বহু কষ্টে তাদের ধমক দেয়া থেকে নিজেকে বিরত রাখে। নিমেষের ভিতরে বাবর নিজেকে নগ্ন দেখতে পায়। পরিচারকের দল এবার একটা রেশমের আলখাল্লায় তাকে মুড়ে দিয়ে, কিছু একটা বলতে শুরু করে। তারা কি বলছে বাবর বুঝতে পারে না, কিন্তু আন্দাজ করে পর্দার পেছনে থাকা মেয়েদের উদ্দেশ্যে কিছু একটা বলেছে যারা দ্রুত চোখের দৃষ্টি অন্যদিকে করে তাবু থেকে বেরিয়ে যায়। পুরুষ পরিচারকের দল তাদের অনুসরণ করে যাবার আগে তাঁবুর প্রবেশপথের পর্দা শক্ত করে আটকে দিয়ে যায়।
সে আর আয়েশা এখন একা। এক মুহূর্তের জন্য সে ইতস্তত করে। তারপরে আলখাল্লাটা তার গা থেকে খসে পড়তে দেয়, সে বাসরশয্যার দিকে এগিয়ে যায় এবং পর্দা টেনে সরিয়ে দেয়। আয়শা নগ্ন দেহে ভেতরে শুয়ে আছে, তার মাথার চুল এখনও শক্ত করে বেণী করা রয়েছে কিন্তু তার দেহের কোমল বাঁক চড়াই উতরাই পুরোপুরি তার দৃষ্টির সামনে অবারিত হয়ে রয়েছে। তার পেলব বাহু, লম্বা সাবলীল উরুতে বাবর বিয়ের মণ্ডপে তার পায়ের পাতায় মেহেদীর যে বিস্তৃত আল্পনা দেখেছিলো সেই একই আল্পনা আঁকা। তার স্তনবৃন্ত টকটকে লাল রঙ করা এবং চারপাশে মেহেদীর বৃত্ত আঁকা। বাবরের নগ্নতার দিকে সে যেভাবে তাকিয়ে থাকে সে তার ভিতরে বিচলিত করার মতো এক ধরণের শীতলতা অনুভব করে। সে কি ভাবছে? তার ক্ষতচিহ্নগুলো অন্তত একটা বিষয় প্রমাণ করে যে সে কোনো বালক না বরং রক্তপাত ঘটিয়েছে এমন যোদ্ধা।
বাবর এবার ঝুঁকে তার পাশে বসে এবং তার পাশে এমনভাবে শোয় যাতে তাদের পরস্পরের দেহ পাশাপাশি থাকলেও স্পর্শ করে না। এক মুহূর্ত পরে কিছু বলে না। কারণ সে বুঝতে পারে না কি বলা উচিত-সে নিজের ভদ্র কিন্তু অনুসন্ধানী হাত আয়েশার কোমরের উষ্ণ তুকে স্থাপন করে এবং সে কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখাতে, সাহসী হয়ে উঠে সে তার হাত কটিদেশের নমনীয় বাঁকে প্রণয়স্পর্শে আলোড়িত করে। তারপরেও কোনো প্রতিক্রিয়া হচ্ছে না দেখে সে উরুর মধ্যবর্তী ত্রিভূজাকৃতি অন্ধকারের দিকে অনিশ্চিত ভঙ্গিতে এগিয়ে যায়।
বাবর সহসা টের পায় তার তরুণ রক্ত আর কোনো বাধা মানতে চাইছে না। সারা দিনের উত্তেজনা যেনো তার ভিতরে নিমেষে বিস্ফোরিত হয়ে মারাত্মক একটা শারীরিক আকাঙ্ক্ষায় পরিণত হয়, যা অবশ্যই নিবৃত্ত করতে হবে। সে এবার নিজেকে আয়েশার উপরে তুলে নিয়ে আসে এবং ব্যগ্র হাতে তার স্তনের কোমলতা আনাড়ি ভঙ্গিতে আঁকড়ে ধরতে চায়। সে তার মাঝে উপগত হতে চায় কিন্তু অপারগ হয়। তার নিচে শুয়ে থাকা শরীরটা আড়ষ্ঠ আর দলা হয়ে পড়ে থাকে। সে মাথা তুলে আয়েশার চোখের দিকে তাকায়। তার সাহায্য কামনা করে, কিন্তু সেখানে তার জন্য কোনো উষ্ণতা দেখতে পায় না। তার নিরব আবেদনে সাড়া দেবার বা সক্রিয় ভূমিকার চেয়ে খেলোয়াড়ী ভূমিকায় আবিভূর্ত হবার কোনো আগ্রহ নেই সেখানে কেবল, তার কাছে অন্তত তাই মনে হয়, তার অনভিজ্ঞ আনাড়ি আচরণের জন্য কূপিত অভিব্যক্তি।
কামনা তাড়িত হয়ে, সে আবার চেষ্টা করে এবং কঠোরভাবে এগিয়ে যেতে চায়, অবশেষে সাফল্যের সাথে আয়শাতে উপগত হয়। ছন্দোবদ্ধ ভঙ্গিতে নড়াচড়া আরম্ভ করতে সে আয়েশার কাঠিন্য টের পায় এবং তারপরে সে তীক্ষ্ণ জোরাল কণ্ঠে একবার আর্তনাদ করলে আয়েশার কাঠিন্য ধীরে ধীরে সহজ হয়ে আসে। হাঁফাতে হাঁফাতে সে আরো গভীর অনুসন্ধানে রত হয়। আরো গভীরে, বাকি সবকিছু সম্পর্কে বিস্মৃত হয়ে পড়ে। অবশেষে ঘামে ভেজা দেহে নিঃশেষ হয়ে সে আয়েশার উত্তান দেহের উপরে নেতিয়ে পড়ে।
নিজের শিরা উপশিরায় রক্তের ধাবমান গতি তখনও হ্রাস না পাওয়াতে, বাবরের কয়েক মুহূর্ত সময় দরকার হয় নিজেকে ফিরে পেতে। মনে পড়ে সে কোথায় আছে, আর একটু আগে কি ঘটে গেছে। নিজেকে ফিরে পেয়ে, সে আয়েশার উপর থেকে উঠে বসে। তার চোখের দিকে তাকাতে চাইলে রাজ্যের অনীহা এসে তাকে ঘিরে ফেলে। তারপরে, শেষ পর্যন্ত সে তার দিকে তাকায়, দেখে মেয়েটা একটুও নড়েনি, আর তার মুখের অভিব্যক্তি আগের মতই দুর্বোধ্য, নিষ্প্রাণ আর স্পর্শের অতীত। সে হয়তো নিজের জন্য একটা স্ত্রী পেয়েছে কিন্তু পুরো বিষয়টা এভাবে ঘটবে বলে সে কল্পনা করেনি। বাবর উঠে বসে এবং তার দিকে পিঠ ফিরাবার আগে স্যাটিনের চাদরে আয়েশার কোমরের নিচে চুঁইয়ে জমা হওয়া রক্তের দাগ ঠিকমত খেয়ালও করে না, যা উপযুক্ত সময়ে বিয়ের দিন তার কৌমার্য ভঙ্গের স্মারক হিসাবে সর্বসাধারণের সামনে প্রদর্শিত হবে।