দিনের ঐ দুঃখজনক ঘটনার ছায়া রেক্ট হাউসেও রেখাপাত করল। সকাল থেকেই মিঃ হুকুম চাঁদ বাইরে ছিলেন। দুপুরের দিকে তাঁর আরদালি যখন ষ্টেশন থেকে রেক্ট হাউসে এসেছিল। চা-এর ফ্ল্যাক্স ও স্যাণ্ডুইস নিতে, তখন সে ষ্টশনে দাঁড়ানো ট্রেনের কথা বেয়ারা ও সুইপারকে বলেছিল। সন্ধ্যার দিকে তারা ও তাদের পরিবারের সদস্যরা দূরে গাছের ওপরে অগ্নিশিখা দেখেছিল। ঐ অগ্নিশিখার আবছা! আভা ডাকবাংলোর খাকী রঙের দেয়ালেও দেখা গিয়েছিল।
দিনের কাজে হুকুম চাঁদ খুবই ক্লান্ত হয়ে পড়েন। তাঁর এই ক্লান্তি দৈহিক ছিল না। অসংখ্য লাশের দৃশ্য দেখে তিনি যেন বোবা হয়ে যান। কয়েক ঘণ্টা তাঁর সব অনুভূতি যেন একেবারে নিস্তেজ হয়ে গেছে। তিনি দেখলেন, একের পর এক লাশ। পুরুষ, মহিলা ও শিশুরা। ট্রেন থেকে তাদের বের করে নেয়া হচ্ছে কোন রকম সতর্কতা অবলম্বন না করেই, যেন বিছানাপত্ৰ নামানো হচ্ছে। সন্ধ্যার দিকে তিনি নিজেকে হতভাগ্য মনে করতে শুরু করলেন। দুঃখিতও হলেন। গাড়ি থেকে নামার পর তাঁকে মনে হলো তিনি বিষাদগ্ৰস্ত ও উদভ্ৰান্ত। বেয়ারা, সুইপার ও তাদের পরিবারের সদস্যরা তখনও ছাদের ওপর দাঁড়িয়ে আগুনের লেলিহান শিখা দেখছিল। ছাদ থেকে নেমে বেয়ারা দরজা না খোলা পর্যন্ত তাকে অপেক্ষা করতে হলো। তাঁর গোসলের পানি দেয়া হয়নি। হুকুম চাঁদ নিজেকে অবহেলিত মনে করলেন। তাঁকে আরও বেশি হতাশাগ্ৰস্ত মনে হলো। চাকর-বাকরের সামনেই তিনি বিছানায় গা এলিয়ে দিলেন। একজন তাঁর জুতা খুলে দিয়ে পা টিপতে লাগল। অন্য একজন বালতিতে করে পানি এনে বাথটাব, ভরে দিল। আকস্মিকভাবে ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব বিছানা থেকে উঠে গোসলখানায় গেলেন।
গোসল ও কাপড় বদলের পর হুকুম চাঁদ যেন নতুন করে শক্তি ফিরে পেলেন। পাখীর মৃদু বাতাস বেশ ঠাণ্ডা ও আরামদায়ক মনে হলো তাঁর। তিনি চোখের ওপর হাত রেখে আবার শুয়ে পড়লেন। বন্ধ চোখের সামনে ভেসে আসতে লাগিল ঐ দিনকার ঘটনার চিত্র একের পর এক। চোখ রগড়ে তিনি ঐ ঘটনার চিত্র মুছে ফেলতে চাইলেন। মানুষের চেহারা তাঁর দৃষ্টিতে প্রথমে কালো এবং পরে লাল হলো। কিন্তু চেহারাগুলো মিলিয়ে গেল না, তারা আবার ভেসে এলো তাঁর দৃষ্টিতে। একজন লোক নাড়ী-ভূড়ি ধরে আছে দু’হাত দিয়ে। তার চোখের ভাষায় ফুটে উঠেছে, দেখ, আমি কি পেয়েছি! ট্রেনের কামরার এক কোণে কয়েকজন মহিলা ও শিশু পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে আছে। ভয়ে ভীত চিহ্ন তাদের চেখের দৃষ্টিতে। তাদের মুখ খোলা। মনে হলো, তাদের প্রবল চিৎকার তখনই থেমে গেছে। অনেকের দেহে কোন আঁচড়ের দাগও নেই। কামরার আর এক পাশে বেশ কয়েকটা লাশ জানালার ধার ঘেষে পড়ে রয়েছে। তাদের চোখেও বিভীষিকার চিহ্ন। খোলা জানোলা দিয়ে হয়ত তাদের ওপরে এসে পড়েছে গুলি, বর্শা বা বড় পেরেক। ট্রেনের প্রক্ষালন কক্ষে বেশ কয়েকজন সবল যুবকের মৃতদেহ। তারা হয়ত নিরাপদ আশ্রয়ে বাঁচতে চেয়েছিল। গলিত লাশ, প্ৰস্ৰাব-পায়খানার গন্ধে বমির উদ্রেক করে। এই চিন্তা হুকুম চাঁদের হওয়ায় তাঁরও বমির ভাব হলো।
তাঁর দৃষ্টিতে স্পষ্ট হয়ে উঠল। লম্বা সাদা দাড়িওয়ালা একজন বৃদ্ধ কৃষকের ছবি। তাকে মৃত বলেই মনে হচ্ছিল না। সে বিছানাপত্র রাখার র্যাকের ওপর শুয়েছিল। নিচে কি ঘটছে তা যেন সে গভীর মনোযোগের সাথে দেখছিল। তার কান থেকে দাড়ি পর্যন্ত জমাট বাঁধা রক্তের ধারার চিহ্ন দেখা গেল। হুকুম চাঁদ তার ঘাড় ধরে ঝাঁকি দিয়ে বললেন, বাবা, বাবা তাঁর ধারণা ছিল সে বেঁচে আছে। সে বেঁচেই ছিল। তার শীতল হাত অদ্ভুতভাবে এগিয়ে এসে ম্যাজিষ্ট্রেট সাহেবের ডান পা জড়িয়ে ধরল। হুকুম চাঁদের দেহ থেকে যেন ঠাণ্ডা ঘাম বেরিয়ে এলো। তিনি চিৎকার করতে চাইলেন। পারলেন না। শুধু মুখ খুলতে সক্ষম হলেন। হাতটা পায়ের পাতা থেকে গোড়ালি এবং গোড়ালি থেকে হাঁটুতে এসে থামল। হাতটা জড়িয়ে ধরে আছে ম্যাজিষ্ট্রেট সাহেবের পা। হুকুম চাঁদ আবার চিৎকার করতে চাইলেন। তাঁর চিৎকার গলায় এসে আটকে গেল। হাতটা ক্রমেই ওপরের দিকে এগিয়ে আসছে। তাঁর মাংসল উরুর কাছে এসেই হাতটা হঠাৎ চিলে হয়ে পড়ল।
হুকুম চাঁদ গোঙাতে লাগলেন। তাঁর দেহটা যেন প্রচণ্ড একটা ধাক্কা খেলা। তিনি ভয়ে চিৎকার করে উঠলেন। তার দুঃস্বপ্ন ভেঙ্গে গেল। তিনি বিছানার ওপর উঠে বসলেন। তাঁর চোখে-মুখে ভয়ের ছাপ স্পষ্টভাবে দেখা গেল।
তাঁর পাশে একজন বেয়ারা দাঁড়িয়ে ছিল। তাকেও ভীতিবিহ্বল মনে হলো।
আমি মনে করলাম সাহেব খুব ক্লান্ত, এ সময় তার পা টিপে দেয়া দরকার।
হুকুম চাঁদ কথা বলতে পারলেন না। তিনি তাঁর কপাল থেকে ঘাম মুছে বালিশের ওপর শুয়ে পড়লেন। বিস্ময়ভরা কণ্ঠে তিনি বললেন, হায় রাম, হায় রাম। তাঁর দুর্বলতা প্রকাশ পেল এবং তিনি আরও ভীত হয়ে পড়লেন। তিনি নিজেকে খুব দুর্বল ও নির্বোধ মনে করলেন। কিছুক্ষণ পর মনে হলো, একটা শান্ত সমাহিত ভাব তার মধ্যে বিরাজ করছে।
হুইস্কি নিয়ে এসো।
বেয়ারা একটা ট্রের ওপর হুইস্কি, সোডা ও একটা গ্লাস নিয়ে এলো। মধুর রঙের মতো ঐ তরল পদাৰ্থ দিয়ে হুকুম চাঁদ গ্লাসের চার ভাগের এক ভাগ ভরে দিলেন। গ্লাসের বাকি খালি অংশটা বেয়ারা সোড়া পানি দিয়ে ভরে দিল। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব প্রায় এক চুমুকেই গ্লাসের অর্ধেকটা পান করে বিছানার ওপর চিৎ হয়ে শুয়ে পড়লেন। পেটে হুইস্কি পড়ার পর তাঁর শ্রান্ত স্নায়ুতন্ত্ৰ যেন আবার প্রাণ ফিরে পেল। বেয়ারাটা আবার তাঁর পা টিপতে শুরু করল। তিনি কড়ি কাঠের দিকে তাকিয়ে দেহটাকে একেবারে শিথিল করে দিলেন। তাঁর ক্লান্তি আনন্দঘন হয়ে উঠল। সুইপারটা বিভিন্ন কামরায় আলো জ্বলিয়ে দিল। হুকুম চাঁদের বিছানার পাশেই টেবিলের ওপর সে একটা ল্যাম্প রেখে দিল। একটা পতঙ্গ ল্যাম্পের কাচের চারদিকে ঘুরপাক দিয়ে কড়ি কাঠের দিকে উড়ে গেল। কয়েকটা টিকটিকি দেয়ালের অপর পাশ থেকে দেয়াল ঘেঁষে এগিয়ে এলো। পতঙ্গটি টিকটিকির নাগালের বাইরে দেয়ালে আঘাত খেয়ে আবার চিমনির কাছে ফিরে এলো। টিকটিকিগুলো তাদের উজ্জ্বল কালো চোখ দিয়ে তা প্রত্যক্ষ করল। পতঙ্গটি বার বার ওঠানামা করতে লাগল। হুকুম চাঁদ জানতেন যে, পতঙ্গটি কড়ি কাঠের কোন এক স্থানে এক সেকেন্ডের জন্য বসলেও টিকটিকিগুলো তাদের ছোট কুমিরের মতো চোয়ালের মধ্যে তাকে পুরে নেবে। সম্ভবত সেটাই তার পরিণতি। প্রত্যেকের পরিণতিই এই রকম। কেউ হাসপাতালে, কেউ বা ট্রেনে, আবার কেউ বা সরীসৃপের মুখে এই পরিণতির শিকার হয়। যেখানেই সে মরুক না কেন, পরিণতি সবার ক্ষেত্রে একই রকম। কেউ আবার বিছানায় থেকেও মৃত্যুবরণ করতে পারে। অনেকের ক্ষেত্রে আবার দেখা যায়, চারদিকে দুৰ্গন্ধ ছড়িয়ে না পড়া পর্যন্ত এবং চোখের পাতায় পোকা ওঠানামা ও মুখের ওপর টিকটিকি তাদের পাতলা চটচটে পেট নিয়ে ঘোরাফেরা না করা পর্যন্ত টেরই পাওয়া যায় না যে, সে মারা গেছে। হুকুম চাঁদ তাঁর দু’হাত দিয়ে চোখ-মুখ ঘষে নিলেন। নিজের মন থেকে কে কবে পালাতে পেরেছে। তিনি গ্লাসের বাকি অংশ এক ঢেকে গিলে রূপান্তরিত হলেন অন্য এক মানুষে।
হুকুম চাঁদের কাছে মৃত্যু একটা বৃদ্ধ সংস্কার হিসাবেই চিহ্নিত হয়েছে সব সময়। একটা মৃত সন্তান জন্ম দেয়ার পর তিনি তাঁর চাচিকে মারা যেতে দেখেছেন। তাঁর চাচির পুরো শরীরটাই যেন বিষাক্ত হয়ে গিয়েছিল। কয়েকদিন ধরে তাকে দেখা যায় মতিভ্রম অবস্থায়। তার পায়ের কাছে বিছানার পাশের দিকে লক্ষ্য করে তাকে পাগলের মতো হাত নাড়াতে দেখা গেছে। যেন মৃত্যুকে সে দূরে সরে যেতে বলছিল। মৃত্যুর আগে সে ভয়ে চিৎকার করে উঠেছিল। মৃত্যুর পর দেখা গেল তার দৃষ্টি দেয়ালের দিকে নিবদ্ধ। এ দৃশ্য হুকুম চাঁদের মন থেকে কোনদিন মুছে যায়নি। যুবক বয়সে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরের বাইরে শবদাহ। মাঠে ঘন্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে মৃত্যুর সাথে লড়াই করেছেন। তিনি দেখেছেন, ঐ মাঠে অমসৃণ বাঁশের খাটিয়ায় করে বিলাপ করতে করতে যুবক ও বৃদ্ধিকে আনতে। তারপর তাদের জেগেছে। মৃত্যুর তাৎক্ষণিক ভয়কে তিনি জয় করতে পারলেও মানুষের চূড়ান্ত পরিণতি যে মৃত্যু, এই ভাবনা তাঁর মনে স্থায়ী হয়ে আছে। এই ভাবনাই তাঁকে করে তুলেছে। দয়ালু, পরোপকারী ও সহনশীল। প্রতিকূল পরিবেশে প্রফুল্ল থাকার শিক্ষাও তিনি এই ভাবনা থেকে পেয়েছেন। শান্ত চিত্তে তিনি সন্তানের মৃত্যুকে গ্ৰহণ করেছেন। তিনি তাঁর অশিক্ষিত অনাকর্ষণীয় স্ত্রীকেও গ্রহণ করেছেন কোন অভিযোগ ছাড়াই। সব কিছুই তিনি মনে করেছেন যে, মানুষের মৃত্যুই হলো একমাত্র পরম ও চরম সত্য। অন্য সব কিছু, যেমন ভালবাসা, উচ্চাশা, গর্ব, সব ধরনের মূল্যবোধ ইত্যাদিকে গ্ৰহণ করা উচিত জীবনকে উপভোগ করার জন্য। এসব তিনি করেছেন স্পষ্ট চেতনা নিয়ে। তিনি উপহার গ্রহণ করেন এবং বন্ধুদের বিপদে তাদের সাহায্য করেন। কিন্তু তিনি দুনীতিপরায়ণ নন। তিনি মাঝে মাঝে পার্টিতে যোগ দেন, গান ও নাচের আয়োজন করেন। কোন কোন সময় যৌন মিলনের আয়োজনও করেন। কিন্তু তিনি কামুক বা নীতিহীন নন। এসব কিছুর পরিণতি কি? এটাই হুকুম চীদের জীবন দর্শন এবং এটা নিয়েই তিনি সুন্দরভাবে বেঁচে আছেন।
কিন্তু ট্রেন ভর্তি লাশ। অদৃষ্টবাদী হুকুম চাঁদের জন্য এটা সহ্যের বাইরে। মৃত্যুর অনিবাৰ্যতা সম্পর্কে তাঁর যে ধারণা তার সাথে তিনি বেপরোয়া হত্যাকাণ্ডের কোন সম্পর্ক খুঁজে পেলেন না। যে প্রচণ্ডতা নিয়ে এই ব্যাপক হত্যাকাণ্ড চালানো হয়েছে তা স্মরণ করে তিনি ভীতসন্ত্রস্ত হলেন। তার চাচির জিহবা কামড়ানো এবং মুখ দিয়ে রক্তক্ষরণ, শূন্যের দিকে তাকিয়ে থাকা ইত্যাদি দৃশ্য তাঁর চোখের সামনে ভেসে এলো ভয়ঙ্কর ভীতির ইঙ্গিত নিয়ে। হুইস্কির উত্তেজক ক্রিয়া তাঁকে এই ভয় থেকে মুক্তি দিতে সহায়ক হলো না।
কামরাটি হঠাৎ করে গাড়ির হেড লাইটের আলোয় আলোকিত হয়ে পুনরায় আগের মতো অন্ধকার হয়ে গেল। গাড়িটাকে সম্ভবত গ্যারেজে নিয়ে যাওয়া হলো। হুকুম চাঁদ রাতের আগমনে বেশ সচেতন হয়ে উঠলেন। চাকর-বাকর সবাই শীঘ্ৰ তাদের কোয়ার্টারে ফিরে গিয়ে স্ত্রী-পুত্র-কন্যার সাথে রাতে নাক ডাকিয়ে ঘুমাবে। বাংলোয় তিনি একাই থাকবেন। শূন্য কামরায় আরও থাকবে তাঁর সৃষ্ট মানুষের অপচ্ছায়া। না! না! তিনি তাঁর বেয়ারাকে ধারে কাছে কোথাও শুতে বলবেন। বারান্দায় থাকতে বলবেন? এতে তারা কি ধারণা করবে। তিনি ভয় পেয়েছেন? তিনি তাদের বলবেন যে, রাতে হয়ত তাদের প্রয়োজন হতে পারে। তাই তাদের ধারে কাছে থাকা দরকার। এতে তাদের ধারণার পরিবর্তন হতে পারে।
বেয়ারা!
সাহেব, তার দিয়ে তৈরী দরজা ঠেলে বেয়ারা এসে উপস্থিত হলো।
আজ রাতে আমার শোয়ার বিছানা কোথায় করলে?
সাহেবের বিছানা এখনও করা হয়নি। বেশ মেঘ আছে আকাশে, রাতে বৃষ্টিও হতে পারে। হুজুর কি বারান্দায় শোবেন আজ?
না, আজ আমি কামরায় শোব। ঘর ঠাণ্ডা না হওয়া পর্যন্ত ছেলেটা এক-দুই ঘণ্টা পাখা টানবে। আরদালিদের বারান্দায় ঘুমাতে বল। রাতে তাদের জরুরী কাজে প্রয়োজন হতে পারে। হুকুম চাঁদ তাদের দিকে না তাকিয়েই কথা শেষ করলেন।
আচ্ছা সাহেব। তারা শুতে যাওয়ার আগেই আমি তাদের বলে দেব। এখন কি রাতের খাবার এনে দেব?
হুকুম চাঁদ খাওয়ার কথা ভুলে গিয়েছিলেন।
না। আমি রাতে খাব না। শুধু আরদালিদের বলে দাও তারা যেন রাতে বারান্দায় ঘুমায়। ওখানে ড্রাইভারকেও থাকতে বলে। বারান্দায় যদি জায়গা না হয় তাহলে তাদের পাশের কামরায় ঘুমাতে বলবে।
বেয়ারা বাইরে চলে গেলে হুকুম চাঁদ নিজেকে কিছুটা হালকা মনে করলেন। তিনি যে ভয় পেয়েছেন একথা কাউকে তিনি আঁচ করতে দেননি। তাঁর চারপাশে কথাবার্তা শুনতে পেলেন। তারা বারান্দায় স্থান নির্বাচন নিয়ে তর্ক করছে, দরজার কাছে বিছানা পাতা, পাশের কামরা থেকে ল্যাম্প আনা, খটিয়া পাতার জন্য অন্য আসবাব সরানো ইত্যাদি কর্মচাঞ্চল্য হুকুম চাঁদকে আশ্বস্ত করল।
ঘরের মধ্যে আবার গাড়ির হেড লাইটের আলো চমকে উঠল। বারান্দার পাশেই গাড়ি থেমে গেল। হুকুম চাঁদ পুরুষ ও মহিলার গলা শুনতে পেলেন। এরপরই তিনি শুনতে পেলেন দরজায় ঘন্টাধ্বনি। তিনি বিছানার ওপর বসে তারের দরজা দিয়ে তাকিয়ে দেখলেন। দেখলেন সেই গায়িকার দলকে। একজন বৃদ্ধ মহিলা এবং অপরজন এক তরুণী। তাদের কথা তিনি ভুলেই গিয়েছিলেন।
বেয়ারা।
হুজুর।
ড্রাইভারকে বলো, সে যেন গায়িকার দলকে ফেরত পাঠিয়ে দেয়। চাকরবাকরদের বলো তাদের কোয়ার্টারে ঘুমাতে। দরকার হলে তাদের ডেকে পাঠাব।
এভাবে ধরা পড়ার জন্য হুকুম চাঁদ নিজেকে নির্বোধ ভাবলেন। চাকররা এ ঘটনায় নিশ্চয় হাসাহাসি করবে। কিন্তু এতে তাঁর কিছু যায়-আসে না। তিনি গ্লাসে নিজেই কিছুটা হুইস্কি ঢেলে নিলেন।
বেয়ারা আসার আগেই তারা বাল্লান্দা ত্যাগ করতে শুরু করল। অন্য কামরার ল্যাম্পটাও সরিয়ে দেয়া হলো। ড্রাইভার গাড়িতে স্টার্ট দিল। গাড়ির হেড লাইটও জ্বালালো। কিন্তু পরীক্ষণেই সুইচ অফ করে দিল। বৃদ্ধা মহিলাটি গাড়িতে না উঠে বেয়ারার সাথে তর্ক করতে শুরু করল। মহিলার গলা ক্রমইে বেড়ে চলল এবং তা যুক্তির সীমানা অতিক্রম করল। ঘরে গিয়ে সে ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবকেই উদ্দেশ করে বলল:
খোদাবন্দ, আপনার জয় হোক!
হুকুম চাঁদ তাঁর ধৈর্য হারিয়ে ফেললেন। যাও, তিনি চিৎকার করে বললেন। গত দিনের দেনা তোমাকে শোধ করতে হবে। যাও! বেয়ারা, ওকে তাড়িয়ে দাও!
মহিলার কণ্ঠ আর শোনা গেল না। সে দ্রুত গাড়ির মধ্যে এসে উঠল। গাড়ি যাত্রা শুরু করল। হুকুম চাঁদের বিছানার কাছে রইল কেবল একটা ল্যাম্প। তিনি উঠে ল্যাম্প ও টেবিলটা নিয়ে দরজার কোণায় রাখলেন। কয়েকটা পতঙ্গ ল্যাম্পের চিমনির চারপাশে ঘুরপাক খেল, কয়েকবার দেয়ালেও আঘাত খেলা। দেয়ালের ওপর থেকে টিকটিকি দেয়াল বেয়ে নেমে এলো ল্যাম্পের কাছে। একটা টিকটিকি গোপনে কিছু না জানার ভান করে লুকিয়ে ছিল। সুযোগ বুঝে সে পতঙ্গটাকে গালের মধ্যে পুরে নিল অতি সহজে। হুকুম চাঁদ পুরো ঘটনাটা দেখলেন উদাসীনভাবে।
দরজাটা মৃদুভাবে খুলে গেলো এবং বন্ধ হলো। একটা ছোট কালো মূর্তি কামরার মধ্যে প্রবেশ করল। মেয়েটির শাড়িতে রূপোর কাজ ছিল। ল্যাম্পের আলোয় তা ঝিকমিক করে উঠল এবং দেয়ালের ওপর একাধিক আলোর চিহ্ন দেখা গেল। হুকুম চাঁদ ফিরে তাকে দেখলেন। মেয়েটি তাঁর বড় বড় কালো চোখ দিয়ে তাঁকেই দেখছিল। তার নাকে একটা মুক্তা ছিল। সেটাও ঝিকমিক করে উঠল। সে খুব ভীত হয়ে পড়েছে মনে হলো।
এসেছ, ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব তার হাত ধরে ডাকলেন। নিজের পাশে তার বসারও জায়গা করে দিলেন।
তাঁর হাত দিয়ে মেয়েটির কোমর জড়িয়ে ধরলেন। তিনি তার উরু ও পেটে হাত বুলিয়ে দিলেন এবং অফুটন্ত স্তন নিয়ে খেলা করলেন। মেয়েটির কোন আবেগ দেখা গেল না। শক্ত হয়েই সে বসে রইল। হুকুম চাঁদ মেয়েটিকে একটু সরিয়ে দিয়ে ঘুম চোখে অস্পষ্টভাবে বললেন, এসো, শুয়ে পড়ি। ম্যাজিস্ট্রেটের পাশে মেয়েটি সোজাভাবে শুয়ে পড়ল। শাড়ির ঝিকিমিকি আলো তার মুখেও প্রতিবিম্বিত হলো। শুদ্ধ মাটিতে পানি ছিটালে যে গন্ধ পাওয়া যায় তেমনি একটা সুগন্ধের পারফিউম সে ব্যবহার করেছিল। তার নিঃশ্বাসে ছিল এলাচির গন্ধ, বক্ষে মধু! হুকুম চাঁদ তার দেহের সাথে নিজেকে শিশুর মতো আটকিয়ে গভীর ঘুমে নিমগ্ন হলেন।