২.২ তৃতীয় ষড়যন্ত্র

তৃতীয় ষড়যন্ত্র
সোমবার জানুয়ারি ৪, ২১১০ ঘণ্টা।

রেস তার মাথাটা নিচু করতেই অটোমেটিকের আরেক দফা গুলি এসে আছড়ে পড়ল তবে পাশের পাথরের দেয়ালে।

হঠাৎ, অপ্রত্যাশিতভাবে অন্য আরেকটি জায়গা থেকে গুলিবর্ষণ শুরু হল, অন্ধকার রাতে ঠিক তার মাথার ওপর। কোথাও থেকে খুব কাছ থেকে।

রেস চোখ খুলে ওপরের দিকে তাকাল, দেখল সে সরাসরি তাকিয়ে আছে একটা চপারের স্পটলাইটের দিকে। চোখ বন্ধ করে ফেলল সে, চোখের দৃষ্টি ধাধিয়ে দিয়েছে স্পটলাইটের আলো।

হাত দিয়ে আলো আড়াল করে তাকাল, ধীরে ধীরে তার দৃষ্টি ফিরে এল এবং তারপরেই সে বুঝতে পরল নতুন এই গুলিবর্ষণের উৎসটা তার উপর শুয়ে থাকা শরীরের আশেপাশে কোথায় থেকে, স্পটলাইট বরাবর গুলি করা হচ্ছে।

ভ্যান লিওয়েন। ওর বডিগার্ড।

এম-১৬ থেকে গুলি করছে।

ঠিক তারপরেই অ্যাটাক হেলিকপ্টারগুলোর একটি মাথার ওপর গর্জন করতে লাগল, ওটার নোটর ব্লেড প্রচণ্ড শব্দে ঘুরছে, ওটার সাদা স্পটলাইট টাওয়ারের ওপর ঘোরাঘুরি করছে, ভ্যান লিওয়েনের সামনের কাদায় এসে আঘাত করল সাইড-মাউন্টেড কামানের গোলা, কামানের প্রচণ্ড শব্দে টাওয়ারের মাথায় অটোমেটিক বন্ধুকের গুলিবর্ষণের শব্দ চাপা পড়ে গেল।

রেসের এয়ারপিস থেকে উন্মত্ত চিৎকার বেরিয়ে আসছে :

তারা কোথায় দেখতে পাচ্ছি না—

—অনেক লোক!

হঠাৎ ন্যাশের কণ্ঠস্বর শুনতে পেল সে: ভ্যান লিওয়েন, সিজ ফায়ার! সিজ ফায়ার!

এক মুহূর্ত পরেই বন্ধ হল সিজ ফায়ার এবং সেই সাথে থেমে গেল বন্দুকযুদ্ধ, এরপর ভীতিকরভাবে সবকিছু স্থির হয়ে গেল। শুধু মাথার উপর অনবরত চক্কর দিচ্ছে একজোড়া অ্যাটাক হেলিকপ্টার, ওগুলোর কর্কশ সাদা আলোয় ভেসে যাচ্ছে নিচের সবকিছু, রেস দেখল ওদেরকে অন্তত বিশজন লোক ঘিরে ফেলেছে, তাদের প্রত্যেকের পরনে কালো ড্রেস, হাতে সাবমেশিন গান।

.

টেম্পলের সামনে, শূন্যে স্থির হয়ে থাকল অ্যাটাক কপ্টার দুটো, স্পটলাইটের আলো নিচের দিকে তাক করা। হেলিকপ্টার দুটো আমেরিকার তৈরি এএইচ-৬৪ অ্যাপাচি অ্যাসল্ট চপার সরু, ভয়ঙ্কর দেখতে আক্রমণাত্মক পাখি।

জঙ্গলের কিনারা থেকে ধীরে ধীরে এগিয়ে এল ছায়ামূর্তির দলটা।

সবাই তারা ভারি অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত। কারো হাতে এমপি-৫, কারো হাতে এ্যাক্সট্রিমলি হাইটেক স্টেয়ার-এ ইউ জি অ্যাসল্ট রাইফেল।

নিজের কাছে নিজেই বিস্মিত হল, সামনে ধরে থাকা অস্ত্রগুলো সম্পর্কে তার জ্ঞানের কথা ভেবে।

এর সবই মার্টির ভুলে, সত্যি সত্যিই।

ডারপা-র ডিজাইন ইঞ্জিনিয়ার এবং এলভিস প্রিসলি ফ্যান হওয়া ছাড়া তার সবগুলো পিন নাম্বার এবং কম্পিউটার পাশওয়ার্ড হল একই নাম্বার-৫৩৩১০৭৬১ কিংস আর্মি সিরিয়াল নাম্বার), রেসের ভাই মার্টি একজন চলমান বন্দুকের বিশ্বকোষ।

এমনকি ছোটবেলায়, রেস তাকে শেষ বারের মতো দেখেছিল নয় বছর আগে, যখন ওরা স্পোর্টস শপে যেত, মার্টি সবসময়ই ফায়ার আর্ম সেকশনে গিয়ে বন্দুকের তৈরি মডেল এবং প্রস্তুতকারক কারা সবই শনাক্ত করে দিত তার ছোটভাইকে। এখন অদ্ভুত ব্যাপারটা হল, মার্টিকে ধন্যবাদ তার অবিরাম পর্যবেক্ষণকে, রেসের হঠাৎ মনে হল সে নিজেও শনাক্ত করতে পারছে।

চোখ পিটপিট করল, বর্তমানে ফিরে এল, সশস্ত্র কমান্ডোরা রেসের সামনে জড়ো হচ্ছে।

সবার ড্রেস কালো–জেটব্ল্যাক কমব্যাট ফেটি, জেটব্ল্যাক ওয়েবিং, জেটব্ল্যাক গ্লাভ আর বুট।

 তবে ইউনিফর্মের সবচেয়ে নজরকাড়া জিনিসটা পরেছে তারা মুখে। ওগুলো পোরসেলিনের তৈরি কালো হকি মাস্ক, পিচ কালো মাস্কটি চোখ ছাড়া মুখের বাকি সব ঢেকে রেখেছে। ওগুলো পরে থাকায় কমান্ডোরদেরকে ঠাণ্ডা, অমানুষ, রোবট বলে মনে হচ্ছে রেসের।

 একজন কমান্ডো দ্রুত এগিয়ে এসে ভ্যান লিওয়েনের হাত থেকে এম-১৬টা ছিনিয়ে নিল।

 এরপর কালো কাপড় পরিহিত লোকটা রেসের ওপর ঝুঁকে কালো মাস্কের আড়ালে হাসল।

গুটেন এ্যাবেন্ড, বলল সে রেসের পায়ে শক্ত ভাবে আঘাত করে।

.

বৃষ্টিটা থামছে না।

ন্যাশ, কোপল্যান্ড এবং লরেন বোল্ডারটার দিকে পেছনে ফিরে দাঁড়িয়ে রয়েছে, প্রত্যেকের হাত যার যার মাথার পেছনে শক্তভাবে ধরা। নিরস্ত্র গ্রিন বেরেটরাও দাঁড়িয়ে আছে তাদের পাশে।

হতচকিত ভাবটা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেননি ওয়াল্টার চেম্বারস, মুখোশ পরা কমান্ডোদেরকে ভয়ে ভয়ে দেখছে। গ্যাবি লোপেজ ওদের দিকে ঠাণ্ডা দৃষ্টিতে তাকাল।

অন্যদের পাশে এনে দাঁড় করান হল ভ্যান লিওয়েন আর রেসকে।

কালো কাপড় পরিহিত লোকগুলোকে বোঝার চেষ্টা করছে রেস। তাকিয়ে রইল ওদের কালো মাস্কের দিকে। এই মাস্ক আগেও দেখেছে রেস। দাঙ্গা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে দক্ষিণ আফ্রিকার রায়ট পুলিশ ব্যবহার করে, ছুঁড়ে মারা পাথর কিংবা অন্য কোনো বস্তু থেকে নিজেদের রক্ষা করবার জন্য।

বৃত্ত তৈরি করে দাঁড়ান কমান্ডোদের পেছনে পুরুষ আর মহিলাদের আরেকটা দলকে দেখা যাচ্ছে। তাদের পরনে নেই কোনো ইউনিফর্ম কিংবা মাস্ক। তাদের পরনে সিভিল ড্রেস, হাইকিং ড্রেস, লরেনের মতো নয়।

 ওরা বিজ্ঞানী, ভাবল রেস। জার্মান বিজ্ঞানীরাও থাইরিয়ামের তৈরি আইডলের খোঁজে চলে এসেছে।

প্রবেশপথের দিকে তাকাল সে, প্রকাণ্ড বোল্ডার প্রতিটি দিক থেকে তার বেরিয়ে রয়েছে, সক্ট-ডিটোনেটিং সি-২ এক্সপ্লোসিভ।

ঠিক তারপরই, একজন কমান্ডো এগিয়ে এসে নিজ হাতে খুলল কালো হকি মাস্ক।

রেস উত্তেজিত, এক ধরনের প্রত্যাশা নিয়ে অপেক্ষা করছে, প্রাক্তন টাসি এজেন্ট হেনরিক অ্যানিসটাজকে দেখতে পাবে, যার নেতৃত্বে জার্মান খুনিরা মনাস্টেরিতে সন্ন্যাসীদের নৃশংসভাবে খুন করেছে।

কমান্ডো তার মুখোশ খুলল।

ভুরু কোঁচকাল রেস। একে চেনে না ও।

 এই লোক আনিসটাজ নয়।

গোলগাল, ভাঁজ পরা লোকের মতো ছাই রঙা চেহারায় এক দৃঢ়সংকল্প বুড়ো।

রেস নিশ্চিত নয় সে মুক্ত নাকি ভীত।

জার্মান লিডার কিছু বলল না বলে দৃঢ়ভাবে রেসের পাশ দিয়ে চলে গেল এবং গুটিশুটি মেরে দরজার সামনে গেল।

পরীক্ষা করে দেখল নানা ধরনের তার যেগুলো বেরিয়ে এসেছে পাথরের ভেতর থেকে তারপর সে ক্যাবেলটা ফেলে দিয়ে ফ্রাঞ্চ ন্যাশের দিকে এগিয়ে গেল।

তাকিয়ে রইল অবসরপ্রাপ্ত আর্মি কর্নেলের দিকে, মেপে দেখল তাকে।

তারপর হঠাৎ এক পাক ঘুরে চিৎকার করে তার ট্রুপকে অর্ডার করল। ফিল্ডওয়েহল ডিয়েট্রিচ, ব্রিংগেন সাই সাই ইনস ভফ আন্ড স্পারেন সাই সাই ইন! হাউপ্টমান ভন ডাকসেন, ব্যারিটেন সাই এলেস ভর উম ডেন ট্যাম্পল জু ওফনেন।

 রেস মনে মনে কথাগুলো অনুবাদ করে ফেলল : সার্জেন্ট ডিট্রিচ, ওদেরকে গ্রামে নিয়ে গিয়ে বন্দী করে রাখুন। ক্যাপ্টেন ডন ডার্কসেন, টেম্পলের প্রবেশ পথ খোলার ব্যবস্থা করুন।

****

ডিয়েট্রিচ এবং ছয়জন মাস্ক পরিহিত জার্মান কমান্ডো পথ দেখাল দশ বন্দিকে, সবাইকে অসম্মানের সঙ্গে রোপ ব্রিজ পার করান হল, তারপর নামান হল প্যাঁচান পথ ধরে।

নিচে নেমে আসার পর সরু ফাটলে ঢোকান হল, বন্দিদেরকে মালভূমি হয়ে বিশ মিনিট হেঁটে পৌঁছে গেল তারা গ্রামে।

গ্রামটা বদলে গেছে।

বিরাট একজোড়া হালজেন ফ্লাডলাইট প্রধান সড়ক আলোকিত করে রেখেছে। যে দুটো হেলিকপ্টারকে রেস দেখেছিল টাওয়ারের মাথায় চক্কর দিতে সে দুটো এখন রাস্তার মাঝখানে বসিয়ে রাখা হয়েছে। প্রায় এক ডজন জার্মান ট্রুপার নদীর কিনারায় দাঁড়িয়ে পানির দিকে তাকিয়ে রয়েছে।

তাদের দৃষ্টি অনুসরণ করে আমেরিকান টিমের হিউ দুটোকে দেখতে পেল রেস, পানির কিনারায় ভাসছে। ঝকঝকে অ্যাপাচির তুলনায় ফ্রাঙ্ক ন্যাশের হিউ দুটোকে পুরানো আর স্নান মনে হল।

তারপর খেয়াল করল রেস, জার্মান কমান্ডোরা কি দেখছে আসলে।

হিউ দুটোকে ছাড়িয়ে আরো সামনে চলে গেছে তাদের দৃষ্টি, নদীর সারফেসের দিকে, অবিরাম রাতের বৃষ্টি ঝরছে।

একটি সী-প্লেন।

সাধারণ কোনো সী-প্লেন নয় ওটা। ডানা দুটোর বিস্তার অন্তত দুশো ফুটের কম হবে না। পেটের যে অংশটা পানিতে বিশ্রাম নিচ্ছে সেটাও বিরাট, ওদের কার্গো প্লেন হারকিউলিসের চেয়েও বড় হবে। ডানার তলায় ঝুলছে চারটে টারবোজেট ইঞ্জিন। প্রতিটি ডানা থেকে বেরিয়ে আছে দুটো করে কন্দজ আকৃতি পন্টুন, পানি ছুঁয়ে প্লেনটার ভারসাম্য রক্ষা করছে।

ওটা একটা অ্যান্টোনভ এন-১১১ অ্যালবাট্রস, এটিই সম্ভবত দুনিয়ার সবচেয়ে বড় সী-প্লেন।

ধীরে ধীরে ঘুরে যাচ্ছে বিশাল প্লেনটা নদীর সারফেসে। রেস এবং অন্যরা নদীর পার্শ্ব রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে, পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে জার্মান সার্জেন্ট ডিয়েট্রিচ। ঘোরা শেষ হতে তীরের দিকে পিছু হটল।

নরম কাদায় এসে ঠেকতেই পেছনের লোডিং র‍্যাম্প বেরিয়ে এলো পেছন দিক থেকে।

র‍্যাম্প শক্ত মার্টি স্পর্শ করার সাথে সাথেই দুটো ভেহিকল র‍্যাম্প বেয়ে সগর্জনে এগিয়ে এল- প্রথমটা যেকোনো দুর্গম এলাকায় চালাবার উপযোগী আট চাকার গাড়ি, দেখতে ট্যাংকের মতে, দ্বিতীয়টি হার্ড-টপড হামভি।

 আর্মারড ভেহিকল দুটো ব্রেক কষে মূল সড়কের মাঝখানে দাঁড়িয়ে পড়ল। রেস সহ বন্দিদেরকে ওগুলোর দিকে হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। দুটো গাড়ির পাশে আসতেই রেস দেখল আরো দুজন জার্মান কমান্ডো টেক্স রাইকার্ট এবং ডুগী কেনেডিকে নিয়ে আসছে তাদের দিকে।

 জেন্টেলম্যান, জার্মান ভাষায় তার দলের কমান্ডোদের বলল। সৈন্য আর সরকারি লোকদের এটিভি-তে তোলো। বাকি সবাইকে ঢোকাও হামভিতে। লক করার পর দুটো ভেহিকলই অচল করে দাও।

ন্যাশ, কোপল্যান্ড ছয়জন গ্রিন বেরেটকে ট্যাংকের মতো দেখতে ভেহিকলে ভোলা হয়েছে। রেস, লরেন, লোপেজ এবং চেম্বারসকে বন্দি করা হয়েছে হামভির ভেতরে।

 হামভি বড় আকৃতির জিপের মতো দেখতে, তবে অনেক বেশি চওড়া, আর ছাদটা নিরেটদর্শন রি-ইনফোর্সড মেটাল দিয়ে তৈরি। এটার জানালায় লাগান হয়েছে লেক্সান গ্লাস, এই মুহূর্তে বন্ধ সেগুলো।

ওদেরকে হামভিতে তোলার পর জার্মান কমান্ডোদের একজন বনেট উঁচু করে ইঞ্জিনের দিকে ঝুঁকল। রেডিয়েটর-এর নিচে হাত ঢুকিয়ে একটা বোতামে চাপ দিল সে-থক!—-হামভির সবগুলো দরজা আর জানালা সঙ্গে সঙ্গে লক হয়ে গেল।

একে বলে পোর্টেবল জেলখানা, ভাবল রেস।

চমৎকার!

.

ওদিকে রক টাওয়ারের মাথায় শুরু হয়েছে জার্মানদের কর্মব্যস্ততা।

 ওখানে জার্মান সোলজার যারা রয়েছে তারা সবাই ফলশিট্রপেন জার্মান আর্মির ক্র্যাক র‍্যাপিড রেসপন্স ইউনিটের সদস্য, যেমন দক্ষ তেমনি কুশলী।

এই স্কোয়াডের লিডার জেনারেল গুনথার সি, ক, কাঁচাপাকা চওড়া গোঁফো মানুষটি ঠাণ্ডা দৃষ্টিতে ফ্রাঙ্ক ন্যাশকে দেখেছে আগেই, জার্মান ভাষায় নির্দেশ দিল। মুভ, মুভ, মুভ! কাম অন! হাতে সময় কম!

তার লোকজন সর্বত্র দৌড়াদৌড়ি করছে, নিজের চারদিকে চোখ বুলিয়ে কোথায় কী হচ্ছে দেখছে ক।

বোল্ডারটার তলা থেকে সমস্ত সি-২ এক্সপ্লোসিভ সরিয়ে ফেলা হয়েছে, ওগুলোর বদলে রশি দিয়ে বাঁধা হয়েছে ওটাকে, গোটা টিম রশিগুলো টানার জন্য তৈরি হয়ে গেল, একটা ডিজিটাল ভিডিও ক্যামেরা সেট করা হয়েছে, টেম্পল খোলার অনুষ্ঠানটা ধারণ করা হবে।

সন্তুষ্ট চিত্তে মাথা ঝাঁকাল কল্ব।

তারা সবাই তৈরি।

এবার ভেতরে ঢোকার সময়।

.

হামভির ছাদে জোরে ড্রাম বাজাচ্ছে বৃষ্টি।

ড্রাইভিং সিটে বসে রয়েছে রেস। ওর পাশের প্যাসেঞ্জার সিটে বসেছেন ওয়াল্টার চেম্বারস। লরেন আর গ্যাবি লোপেজ বসেছে পেছনে।

উইন্ডশিল্ড আর বৃষ্টির ভেতর দিয়ে রেস দেখল গ্রামের জার্মান সৈন্যরা একটা মনিটরকে ঘিরে ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে, আগ্রহ নিয়ে কী যেন দেখছে সবাই।

ভুরু কুঁচকাল রেস।

তারপর সে দেখল হামভির ড্যাসবোর্ডের সেন্ট্রাল কনসলে একটা ছোট টেলিভিশন স্ক্রিন–ওই জায়গায় সাধারণ গাড়িতে রেডিও থাকে। সে ভাবল যদি হামভির ইঞ্জিন বন্ধ করে দেওয়া হয় তা হলে ইলেকট্রিক্যাল সিস্টেমে প্রভাব পড়বে। ছোট্ট টেলিভিশনটা সুইচ টিপে পাওয়ার অন করল।

ধীরে ধীরে একটা ছবি ফুটল স্ক্রিনে।

টেম্পলের সামনের দৃশ্য দেখা যাচ্ছে, বোল্ডারের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে জার্মানরা। টেলিভিশনের স্পিকার থেকে তাদের কথাবার্তা বেরিয়ে আসছে:

ইচ কান নাইকট গ্রাউবেন, দাস সাই প্রাংসটফ ভেরওয়েনডেন ওলটেন। ঈশ হাটে দাস গেসামটে গোবাউড়ে জুম আইনস্ট্রজ ব্রিঙ্গজেন কোমেন। মাক ডাই সাইলে ফেস্ট।

কী বলছে ওরা? জানতে চাইল লরেন।

বোল্ডারের তিনদিকে তোমরা যে এক্সপ্লোসিভ বসিয়েছিলে সেগুলো সরিয়ে নিচ্ছে ওরা, বলল রেস। ওদের ধারণা সি-২ গোটা কাঠামোটাকে গুঁড়িয়ে দেবে। বিস্ফোরকের বদলে রশি ব্যবহার করছে।

একটা জার্মান নারীকণ্ঠ ভেসে এল স্পিকারে, জার্মান ভাষায় কী যেন বলছে।

ওদেরকে অনুবাদ করে শোনাল রেস: চেষ্টা করে দেখ হেডকোয়ার্টারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পার কিনা। ওদেরকে জানাও টেম্পলে পৌঁছেছি আমরা এবং ইউনাইটেড স্টেটস এ্যানকাউন্টার হয়েছে। ইন্ট্রাকশনের অপেক্ষায় রইলাম–

তারপর সে আবার বলতে শুরু করল।

ওয়াজ ইস্ট মিট ডেম আন্ডেরেন আমেরিকানিশেন টিম? ও সিন্ড ডাই জেটজ?

সে কি? রেস বিস্ময়ে ভাবল।

 ডেস আন্ডেরে আমেরিকানিশেন টিম?

প্রথমে তার মনে হল সে ঠিক শোনেনি।

কিন্তু শুনেছে। সে নিশ্চিত এ ব্যাপারে।

 কিন্তু এ মুহূর্তে তাতে কিছু করার নেই—

ভুরু কুঁচকাল রেস, অন্যদের জন্য অনুবাদ করল না কথাটা।

স্ক্রিনে দেখা যাচ্ছে বোল্ডারটাতে লুপ পরানো হচ্ছে।

এ্যালেস ক্লার, মাচট ইউ ফার্টিগ—

 ঠিক আছে। রেডি হও।

স্ক্রিনের লোকগুলো টান টান করল রশিগুলো।

জাইট এন?

এবার… টান!

টাওয়ারের মাথা, রশি জড়ান বোল্ডার ধীরে ধীরে নড়ছে, প্রবেশপথের পাথুরে মেঝেতে ঘষা খাচ্ছে সশব্দে।

আটজন জার্মান কমান্ডো টানছে রশিগুলো, দৈত্যকার বোল্ডারটাকে চারশো বছরের পুরানো আশ্রয় থেকে টেনে বের করে আনছে।

ধীরে ধীরে নিজের জায়গা থেকে সরে এসে ঘন কালির মতো কালো একটা প্রবেশপথ খুলে দিল ওটা।

বোল্ডার সরে যেতেই গুন্থার কল দ্রুত এগিয়ে এসে উঁকি দিয়ে টেম্পলের ভেতরে তাকাল।

দেখল তার পায়ের নিচ থেকে একপ্রস্থ ধাপ নেমে গেছে, হারিয়ে গেছে গাঢ় অন্ধকারে।

ঠিক আছে, জার্মান ভাষায় বলল সে। এন্ট্রি টিম। তোমাদের পালা।

 হামভিডে। ঘাড় ফিরিয়ে লরেনের দিকে তাকাল রেস।

ওরা ভেতরে ঢুকছে।

টাওয়ারের ওপর, ফুললি লোডেড জার্মান কমান্ডো সামনে এগিয়ে এল। এরা হল এন্ট্রি টিম।

তরুণ কুর্ট ভন ডার্কসেন এদের লিডার, প্রত্যেকের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র, মার্চ করে ক-এর কাছে টেম্পলের দরজায় এসে দাঁড়াল তারা।

সহজে কাজ সারবে, তরুণ ক্যাপটেনকে বলল কন্দ। আইডলটা খুঁজে বের করো, তারপর বেরিয়ে এসো–

কোথাও কিছু নেই, এবং সতর্কতা ছাড়া, ওদের চারদিকে তীক্ষ্ণ শিস দেওয়ার মতো কয়েকটা আওয়াজ শোনা গেল।

থওট-থওট-থওট-থওট-থওট-থওট!

পরমুহূর্তে স্ম্যাক! লম্বা আর তীক্ষ্ণ কী যেন একটা গেঁথে গেল পুরু শ্যাওলায় ঢাকা টেম্পলের দেয়ালে, ঠিক ক-এর মাথার পাশে।

বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে জিনিসটার দিকে তাকিয়ে থাকল কল্ব।

ওটা একটা তীর।

হামভির ছোট টেলিভিশন স্ক্রিনে চিৎকার চেঁচামেচির সাথে দেখতে পেল ওরা ঝাকে। ঝাঁকে তীর ছুটে আসছে টেম্পলের সামনে জড়ো হওয়া জার্মানদের দিকে।

ওয়াজ জুম টিউফেল!

 ডুকট ইউচ! ডুকট ইউচ!

 কী হচ্ছে ওখানে? লরেন বলল, পেছনের সিট থেকে সামনের দিকে ঝুঁকল।

 রেস তার দিকে ঘুরল। দেখে মনে হচ্ছে ওরা আক্রান্ত হয়েছে।

বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে উঠে কমান্ডোরা এমপি-৫ আর সাইর এ ইউ জি তুলে গুলি চালাল। টেম্পলের খোলা প্রবেশপথের দিকে পেছন ফিরে পজিশন নিয়েছে তারা, গুলি করছে তীর যেদিক থেকে আসছে।

টেম্পলের প্রবেশপথের আড়াল থেকে উঁকি দিয়ে অন্ধকারে তাকাল ওরা সকলে, বাইরের দিকটা দেখছে, তীরের উৎস খুঁজছে।

প্রবেশপথের আড়ালে দাঁড়িয়ে গুস্থার কন্ব অন্ধকারের দিকে তাকাল, শত্রুর খোঁজে।

একটু পরে দেখতে পেল।

 ক্যানিয়নে জড়ো হয়েছে বেশ কিছু ছায়া আইডল।

সব মিলিয়ে পঞ্চাশজন হতে পারে–রোগাটে মানুষের আকৃতির, জার্মান কমান্ডোদের লক্ষ্য করে প্রাচীন অস্ত্র কাঠের তীর ছুঁড়ছে।

কুবিন ভাবল–কী জ্বালা!

.

টিভির স্পিকার থেকে বেরিয়ে আসা জার্মানদের চেঁচামেচি শুনতে পাচ্ছে রেস।

টেম্পল টিম! কী ঘটছে ওখানে?

আমরা আক্রান্ত হয়েছি। আবার বলছি, আমরা আক্রান্ত হয়েছি!

কারা তোমাদের আক্রমণ করেছে?

ইন্ডিয়ান বলে মনে হচ্ছে। রিপিট। ইন্ডিয়ান। নেটিভ। তীর ছুঁড়ছে। তবে মনে হচ্ছে আমরা ওদেরকে হটিয়ে দিচ্ছি–অপেক্ষা করো? না, এক মিনিট অপেক্ষা করো। ওরা পিছু হটছে। ওরা পিছু হটছে।

এক মুহূর্ত পর অটোমেটিক গানফায়ারের আওয়াজ থেমে গেল এবং চারদিক দীর্ঘ নীরবতা।

কিছু নেই।

 আরো নীরবতা।

 স্ক্রিনে দেখা যাচ্ছে জার্মানরা সতর্কতার সঙ্গে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে, তাদের আগ্নেয়াস্ত্র থেকে ধোয়া বেরুচ্ছে তখনো।

হামভির ভেতরে চেম্বারসের সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় হল রেসের।

 এলাকায় একদল আদিবাসী আছে, বলল রেস।

*

ভারি গলায় নির্দেশ দিচ্ছে গুন্থার কল্ব।

 হরগেন! ভেল! এক স্কোয়াড নিয়ে ওপরে ওঠো, কিনারা জুড়ে একটা পেরিমিটার তৈরি করো! ঘুরে ভন ডিকশেন আর তার এন্ট্রি টিমের দিকে তাকাল সে। ঠিক আছে, ক্যাপ্টেন, তোমরা এখন টেম্পলে ঢুকতে পার।

এন্ট্রি টিমের পাঁচ সৈনিকের সামনে টেম্পলের অন্ধকার প্রবেশপথ।

 অন্ধকার ও ভীতিকর অবস্থায় ওদের সামনে মুখ ব্যাদান করে দাঁড়িয়ে আছে।

সাবধানে এগোল ক্যাপ্টেন ডিকশেন, হাতে আগ্নেয়াস্ত্র। পৌঁছে এক মুহূর্ত ইতস্তত করল সে, চওড়া পাথরের ধাপ ধরে নিচে নেমে গেছে টেম্পল। সিঁড়ির প্রথম ধাপে পা দিয়ে থ্রোট মাইকে বলল, আমার সামনে আমি পাথরের সিঁড়ি দেখতে পাচ্ছি।

.

এখন সিঁড়ি বেয়ে নেমে যান, ভন ডার্কসেনের গলা ভেসে এল হামভির স্পিকারে।

পাঁচজন কমান্ডো ধীরপায়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেল যতক্ষণ পর্যন্ত না শেষ সৈনিকের মাথা দৃষ্টির আড়ালে বলে না গেল ততক্ষণ পর্যন্ত মনোযোগ দিয়ে ইমেজের দিকে তাকিয়ে রইল রেস। এখন শুধু খালি পাথরের দরজা ছাড়া কিছুই দেখা যাচ্ছে না।

ক্যাপটেন, রিপোর্ট, কল্বের কণ্ঠস্বর ভেসে এল ভন ডার্কসেনের হেডসেটে। এইমাত্র পাথরের সঁতসেঁতে সিঁড়ির নিচে নেমে এসেছে, তার ফ্ল্যাশলাইটের আলো অন্ধকার ফালাফালা করে দিচ্ছে।

সরু একটা পাথরের দেয়ালের টানেলে দাঁড়িয়ে রয়েছে সে বেশ খানিক দূর এগিয়ে ধীরে ধীরে মোচড় খেয়ে ডান দিকে ঘুরে গেছে টানেলটা। মেঝেটা নিচের দিকে ঢালু, বাঁকান পথে অন্ধকার টেম্পলের পথ নেমে গেছে। দুপাশের দেয়ালে বড় আকারের চোরা কুঠুরি দেখা যাচ্ছে।

সিঁড়ির নিচে পৌঁছেছি আমরা, বলল সে। সামনে একটা বাঁকা টানেল দেখতে পাচ্ছি। ওটা ধরে এগিয়ে যাচ্ছি আমি।

পরস্পরের কাছ থেকে যথেষ্ট দূরত্ব রেখে এগোল এন্ট্রি টিমের সদস্যর সাবধানে ধীরে ধীরে পা ফেলে। ফ্ল্যাশ লাইটের আলো ভেজা চকচকে দেয়ালে খেলা করছে। ফোঁটা খসে পড়ার শব্দের প্রতিধ্বনি তুলছে টেম্পলের গভীর কোথাও।

ভন ডার্কসেন বলল, টিম, এক নম্বর বলছি। সাড়া দাও।

এন্ট্রি টিমের বাকি সদস্যরা দ্রুত সাড়া দিল:

দুই বলছি।

 তিন।

চার।

পাঁচ।

টানেল ধরে আবার এগোচ্ছে দলটা।

.

হামভির ভেতর টিভি স্ক্রিনের দিকে ঝুঁকে পড়েছে ওরা সবাই, জার্মান এন্ট্রি টিমের ফিসফাস কথাবার্তা শুনছে ওরা। অনুবাদ করল রেস।

 –এত ভিজে জায়গাটা, চারদিকে পানি।

সাবধানে, দেখেশুনে পা ফেল।

 এই সময় টিভির স্পিকার থেকে তীক্ষ্ণ একটা চিৎকার ভেসে এল।

কী ওটা? দ্রুত জানতে চাইল বন ডার্কসেন। টিম সাড়া দাও।

 দুই বলছি।

 তিন।

চার।

এবং তারপর নীরবতা

প্রত্যাশা নিয়ে অপেক্ষা করছে রেস, শেষ সৈন্যটা সাড়া দেবে। কিন্তু সে সাড়া দিল না।

না, পাঁচ সাড়া দেয়নি।

টেম্পলের ভেতরে ঘুরে দাঁড়াল ভন ডার্কসেন।

ফ্রেডেরিখ, টানেল ধরে ফিরে আসার সময় হিসহিস করল সে, সঙ্গীদের পাশ কাটাল।

প্যাঁচান টানেল ধরে খুব বেশি দূর এগোয়নি ওরা এবং এখন ওরা পিচকালো অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে, একমাত্র আলোই হল ওদের ফ্ল্যাশলাইটের আলো।

ওদের পেছনে, মোচড় খাওয়া টানেলের শেষ মাথায় নীল চাঁদের আলো খুব অল্পই পৌঁছাচ্ছে নির্দেশ করছে ওপরে ওঠার পথ।

ভন ডার্কসেন পেছন দিকে তাকাল।

 ফ্রেডেরিখ! ফিসফিস করল অন্ধকারে। ফ্রেডেরিখ! কোথায় তুমি?

ঘুরল সে।

দেখল তার লোক এখন মাত্র দুজন দাঁড়িয়ে আছে পেছনে। তৃতীয়জনকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না।

ফেলে আসা পথের দিকে আবার ফিরল ভন ডার্কসেন, মাইক্রোফোনে কিছু বলতে যাচ্ছে, এই সময় দেখল অস্বাভাবিক বড় একটা ছায়া বাকটার মাথায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। স্থির হয়ে গেল সে। কথা বলার সকল শক্তি হারিয়ে ফেলেছে।

চাঁদের আলোয় ওটার আকৃতি পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে।

দেখতে বেশ ভীতিকর।

ওটার ঘাড়ের কালো পেশির ওপর হালকা নীল চাঁদের আলো পড়ে চকচক করছে। ভন ডার্কসেনের ফ্লাশলাইটের আলোয় ক্ষুরের মতো ধারাল দাঁত চকচক করছে।

হতবুদ্ধিকর পরিস্থিতিতে জার্মান ক্যাপ্টেন এখনো ওটার দিকে তাকিয়ে আছে।

ওটার আকার বিশাল।

হঠাৎ পেছন থেকে লাফ দিয়ে চলে এলো একই আকৃতির দ্বিতীয় জন্তুটা। নিশ্চয়ই ভেতরে লুকিয়ে ছিল ওগুলো, ভাবল ভন ডার্কসেন।

 নিচু হয়ে অপেক্ষা করছিল। অপেক্ষা করছিল সে আর তার সঙ্গীরা কখন পাশ কাটাবে, আর পাশ কাটিয়ে সামনে এগোলেই ফিরে যাওয়ার পথ বন্ধ করে দেবে।

 মুহূর্তের মধ্যে প্রথম জন্তুটা লাফ দিল। ভন ডার্কসেন কোনো সুযোগই পেল না। এত বিশাল আকার নিয়ে এরকম ক্ষিপ্রতা অবিশ্বাস্য এবং এক সেকেন্ডের মধ্যে ওটার খোলা চোয়াল তার পুরোটা দৃষ্টিপথ ঢেকে দেওয়ায় চিৎকার শুরু করল কুর্ট ভন ডার্কসেন।

.

টিভির স্পিকার থেকে আর্তনাদের আওয়াজ বেরুচ্ছে।

রেস এবং অন্যান্যরা চোখে-মুখে আতঙ্ক নিয়ে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছে।

এন্ট্রি টিমের শেষ তিনজন চিৎকার এবং আক্রমণের শব্দ বাতাসে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল। অল্পক্ষণ পরেই, রেস গুলির শব্দ শুনতে পেল, কিন্তু এক সেকেন্ড পরেই গুলি এবং চিৎকার থেমে গেল আর তারপরেই নীরবতা।

দীর্ঘক্ষণ নীরবতা।

 টিভির স্ক্রিনে টেম্পলের খোলা প্রবেশপথ দেখছে রেস।

ভন ডার্কসেন, ফ্রেডেরিখ, নিলসন। রিপোর্ট।

টেম্পলের ভেতর থেকে কেউ সাড়া দিল না।

তারপর স্পিকার থেকে নতুন একটা কণ্ঠস্বর ভেসে এল।

রেস একবার দ্রুত তাকাল লরেনকে।

 দম আটকান গলার শব্দ, হাঁফাচ্ছে এবং আতঙ্কে।

স্যার, আমি নিলসন! রিপিট, আমি নিলসন! ওহ্ গড… গড, হেল্প আস! এই জায়গা ছেড়ে পালিয়ে যান, স্যার! পালিয়ে যান সুযোগ থাকতে…

স্ম্যাক!

কিছু একটার সঙ্গে সংঘর্ষের শব্দ হল যেন।

যেন নিলসন নামের মানুষটাকে বিশাল কিছু একটা ঠাক্কা মেরেছে।

বিশৃঙ্খল একটা ধাক্কাধাক্কির শব্দ এবং তারপরই রেস শুনতে পেল সেটাকে ছাপিয়ে উঠল একটা গর্জন।

এত জোরাল, এবং গভীর যেন একটা সিংহ ডাকছে।

তেজি, অনুনাদ এবং ভীতিকর,

রেসের চোখ গেল টেলিভিশনের স্ক্রিনের দিকে এবং সাথে সাথে জমে গেল।

 সে ওটা দেখল।

অন্ধকার খোলা মুখ থেকে বেরিয়ে আসছে ওটা।

টেম্পেলের দরজার মুখ থেকে দেখল একটা বিশাল কালো প্রাণী বেরিয়ে আসছে, রেস তার পেটের ভেতর প্রচণ্ড অসুস্থ বোধ করল।

কারণ সে জানে যে, ওই মুহূর্তে, ওদের সব টেকনোলজি বন্দুক, স্বার্থপরতাকে ঘৃণা করে পাওয়া গেল চমৎকার একটা শক্তির উৎস, টাওয়ারের মাথায় অবস্থিত মানুষগুলো মানব জাতীয় বিকাশের নিয়ম-কানুন ভঙ্গ করছে।

কিছু দরজা তখন পর্যন্ত খোলা হয়নি।

.

টাওয়ারের মাথায় জেনারেল কন্দ সহ দশ-বারোজন জার্মান হাঁ করে তাকিয়ে থাকল টেম্পলের খোলা মুখ থেকে এইমাত্র বেরিয়ে আসা জন্তুটির দিকে।

দেখতে সুন্দর।

চার পায়ে দাঁড়ান অবস্থায় পুরোপুরি পাঁচ ফুট উঁচু ওটা, সারা শরীর কালো লোমে ঢাকা মিশকালো মাথা থেকে পা পর্যন্ত।

দেখতে অনেকটা জাগুয়ারের মতো।

একটা বিশাল কালো জাগুয়ার।

মেঘের সঙ্গে লুকোচুরি খেলায় ব্যস্ত চাঁদের আলোয় ওটার বিরাট দুই চোখ যেন হলুদ দ্যুতি ছড়াচ্ছে, রাগে কুঁচকে ভুরু থাকা পেশির স্তূপসহ কাধ, ছোরার মতো দাঁত, দেখতে শয়তানের মতো।

 তারপর সাথে সাথে নরম নীল চাঁদের আলো যা টেম্পলটাকে আলোকিত করে রেখেছিল তা সরে গিয়ে আকাশের এক কোণে বিদ্যুৎ চমকাল, সেই সঙ্গে কড় কড়াৎ করে কোথাও একটা বাজ পড়ল। পরক্ষণে গর্জে উঠল দানবটা।

ওটা হয়তো কোনো ধরনের সংকেত।

কারণ গর্জনটা থামতে না থামতে আরও প্রায় বারোটা বিশাল কালো বিড়াল টেম্পলের অন্ধকার থেকে ছুটে বেরিয়ে এলো বাইরে। এবং টাওয়ারের উপর দাঁড়িয়ে থাকা জার্মানদের ওপর হামলে পড়ল।

প্রত্যেকের সঙ্গে অ্যাসল্ট রাইফেল আর সাব মেশিনগান থাকার পরও, জার্মান অভিযাত্রী দলের সদস্যরা কোনো সুযোগই পেল না।

বিড়ালগুলো অসম্ভব বেগবান। অসম্ভব ক্ষিপ্র। প্রচণ্ড শক্তিশালী। স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বিজ্ঞানী আর সৈনিকদের ভিড়টার উপর প্রচণ্ডতা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল ওগুলো, ছিঁড়ে ফালা ফালা করে ফেলল ওদের লোফাললাফি করল, ক্ষতবিক্ষত করে ফেলল।

 দু একজন সৈনিক কয়েকটা গুলি করতে পেরেছে। একটা বিড়াল আহত হয়ে দড়াম করে আছড়ে পড়ল মার্টিতে, মাংসপেশী প্রচণ্ড আক্ষেপ করতে লাগল।

কিন্তু তাতে কোনো লাভ হল না, চারপাশ দিয়ে ছুটে যাওয়া বুলেটগুলোকে গ্রাহ্য করছে না, আর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সৈনিকদের সবাইকে কাবু করে ফেলল। দাঁত দিয়ে মাংস ছিঁড়ে আনছে, কামড় বসাচ্ছে গলায়। শক্তিশালী থাবা বসিয়ে শ্বাসরোধ করে কাবু করে ফেলছে।

আর্তচিৎকারে ভারি হয়ে উঠল রাতের আকাশ।  

প্রাণ হাতে করে ছুটছে জেনারেল গুন্থার কল্ব।

পাথরের সিঁড়ি বেয়ে নামার সময় ভেজা ফার্ন গাছের পাতা ঝাঁপটা মারছে মুখে, এই সিঁড়িপথই তাঁকে ঝুলন্ত সেতুতে পৌঁছে দেবে।

ব্রিজে একবার পৌঁছাতে পারে, ভাবছে সে, তারপর ওপারে পৌঁছে নিচু পাঁচিল থেকে বাঁধনটা খুলে দিতে হবে, তাহলে রক টাওয়ারে আটকা পড়বে বিড়ালগুলো।

ভেজা পাথরের স্ল্যাবের উপর দিয়ে নামছে কন্তু, নিজের নিঃশ্বাসের শব্দ খুব জোরাল শোনাচ্ছে কানে, তবে তার পেছনে ডালপালা ভেঙে বিরাট কিছু একটার ধেয়ে আসার আওয়াজ আরো বেশি জোরাল হয়ে উঠছে। ফার্ন গাছের ডাল চড় মারছে গালে, তবে গ্রাহ্য করছে না সে। প্রায় পৌঁছে গেছে-~~~

ওই তো!

সে দেখতে পেল।

রোপ ব্রিজ!

নিজের কয়েকজন লোককেও দেখতে পেলেন সে রক টাওয়ারের হত্যাযজ্ঞকে পেছনে ফেলে পালাচ্ছে।

শেষ কয়েকটা ধাপ টপকে কারনিসে নেমে এলো কল্ব।

 যাক, সে পেরেছে।

এরপরই একটা কিছু ভারি, তাঁর পিঠে চড়ে বসল। আছাড় খেল জার্মান জেনারেল।

 শক্ত ভাবে আছড়ে পড়েছে সে, মুখটা পড়েছে আগে কারনিসের ভেজা পাথরে ওপর। হাত দিয়ে মরিয়া হয়ে মেঝে আঁচড়াল সে, উঠে বসার চেষ্টা করল আবার কিন্তু হঠাৎ একটা কালো থাবা মেরে সাথে চেপে ধরল তাকে।

আতঙ্কে মুখ তুলে তাকাল।

বিড়ালগুলোর একটা।

একটা তার উপর দাঁড়িয়ে আছে।

দানব আকৃতির কালো বিড়ালটা গভীর, একাগ্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে, যেন কৌতূহল নিয়ে পরীক্ষা করছে অদ্ভুত ছোট্ট প্রাণীটি বোকার মতো কী করে, ভাবতে পারল ওটাকে ফাঁকি দিয়ে পালান সম্ভব।

 কল্ব ভীত চোখে ওটার হলুদ চোখের দিকে তাকাল। পরমুহূর্তে রক্ত হিম করা একটা গর্জন ছেড়ে ওর দিকে মুখটা নামিয়ে আনতে লাগল। কত্ব চোখ বন্ধ করে সব শেষের অপেক্ষায় রইল।

.

গ্রামটা নীরব হয়ে গেছে।

মনিটরের সমানে জড়ো হওয়া বারোজন জার্মান হতভম্ব হয়ে পরস্পরের দিকে তাকাচ্ছে।

ওদের স্ক্রিনে ওরা দেখতে পেল নিজেদের কমরেডরা টাওয়ারের ওপর এদিক ওদিক দৌড়াদৌড়ি করছে। মাঝেমধ্যে, ওরা দেখতে পেল একজনকে স্ক্রিনের পাশ দিয়ে ছুটে যেতে আর এমপি-৫ থেকে গোলা ছুঁড়তে ছুঁড়তে, তারপর মুহূর্তে দেখা গেল একটা বিশাল বিড়াল জাতীয় প্রাণীর দেহ।

হাসেলডর্ফ, ক্রেইগার, সার্জেন্ট ডিয়েট্রিচ খেঁকিয়ে উঠল। পশ্চিমের লগ-ব্রিজ তুলে নাও। দুজন জার্মান সৈনিক ভিড় থেকে বেরিয়ে গেল।

তরুণ রেডিও অপারেটরের দিকে ফিরল ডিয়েট্রিচ। ওপরের ওদের কারো সঙ্গে যোগাযোগ করতে পেরেছ?

 চেষ্টা তো করছি, স্যার, কিন্তু কেউ সাড়া দিচ্ছে না, জবাব দিল রেডিও অপারেটর।

 চেষ্টা করতে থাক।

.

হামভির বৃষ্টি ভেজা উইন্ডশিল্ড দিয়ে ডিয়েট্রিকে দেখছে রেস। আর জার্মান কমান্ডো মনিটর অ্যাসেম্বেল করার সময় হঠাৎ শুনতে পেল একটা চিৎকার।

সাথে সাথে সে আশেপাশে তাকাল।

নদী সংলগ্ন পথ ধরে জার্মান সৈনিকদের একজনকে ছুটে আসতে দেখা গেল।

পাগলের মতো হাত ওপরের দিকে নাড়তে নাড়তে চিৎকার করে কমান্ডো বসছে, শেনেল, জুম ফ্লাগযুগ! শেনেল, জুম ফ্লাগযুগ! সাই কোমেন!

জলদি! প্লেনে ওঠো! তাড়াতাড়ি প্লেনে ওঠো! ওরা আসছে!

লোকটার পেছনে দিগন্ত, আবার বিদ্যুৎ চমকাল ছুটন্ত কমান্ডোর পেছন পথটা, মুহূর্তের জন্য উদ্ভাসিত হয়ে উঠল আর রেস দেখতে পেল ওর পেছনে কী যেন আসছে।

ওহ্, মাই গড…

দৈত্যাকার বিড়ালের মতো জন্তু কয়েক মিনিট আগে টেম্পল থেকে বেরিয়ে এসেছে।

তবে হামভির ছোট টিভির স্ক্রিনে দেখা জন্তুটির আকার বোঝা যায় না।

 ভীতিকর।

মাথাটা নিচু করে ছুটছে সরু হয়ে যাওয়া কান দুটো পেছন দিকে সাঁটা, ছোটার সঙ্গে তাল মিলিয়ে কাঁধের শক্তিশালী পেশিতে ঢেউ উঠছে।

ক্ষিপ্র অথচ সাবলীল একটা ভঙ্গি আছে ছোটার মধ্যে। ভারসাম্য, শক্তি আর গতির প্রকাশ কিন্তু।

জার্মান কমান্ডো প্রাণপণে দৌড়াচ্ছে, কিন্তু পেছনের বিশাল জন্তুটাকে ফাঁকি দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই তার। ছুটতে ছুটতে এদিক ওদিক সরে যাওয়ার চেষ্টা করল সে, পথের পাশে গাছের আড়াল নিল। কিন্তু বিড়ালটা বেশি ক্ষিপ্র। দ্রুতগতি চিতার মতো দেখাচ্ছে ওটাকে, শক্তিশালী পা নিখুঁত ভাবে অ্যাডজাস্ট করছে, শিকারের নড়াচড়া নকল করছে হুবহু, কখনো বা দিকে সরে যাচ্ছে, কখনো কাত হচ্ছে ডান দিকে। মাঝখানের মাধ্যাকর্ষণের টানটা হালকা রেখে নিজের পদক্ষেপ ভুল করছে না।

ওটা অসহায় জার্মানটার ওপর ভয়াবহরূপে এগিয়ে আসছে, দ্রুত মাঝখানের ব্যবধান কমে আসতে, ওটা যখন খুব কাছে চলে এসেছে, বিশাল বড় বিড়ালটা লাফ দিল

বিদ্যুতের চমক শেষ হতে অন্ধকার হয়ে গেল আকাশ, নদীর ধারের পথটাও হারিয়ে গেল।

নীরবতা।

অন্ধকার।

তারপর রেস আর্তনাদ শুনতে পেল।

হঠাৎ আবার বিদ্যুৎ চমকাতেই নদীর ধার আলোকিত হয়ে উঠলে পর তার সামনের অবয়টা দেখতে পেল সে, অনুভব করল রেসের রক্ত বরফ হয়ে যাচ্ছে।

বিশাল কালো বিড়ালটা কমান্ডোর দুপাশে পা দিয়ে দাঁড়িয়েছে, মস্ত মাথা ধরাশায়ী মানুষটার কাঁধের কাছে নুয়ে আছে। অকস্মাৎ ঝটকা মেরে চোয়াল দুটো উপরদিকে তুলল ওটা, ছিঁড়ে আনার আওয়াজের সঙ্গে মৃত কমান্ডোর গলা শরীর থেকে আলাদা করে ফেলল।

আবার বিদ্যুৎ চমকাল, এবং পরমুহূর্তে বিজয়ের উল্লাসে হুংকার ছাড়ল একটা।

হামভির ভেতর ঝাড়া এক মিনিট কেউ কিছু বলল না।

নীরবতা ভাঙল ওয়াল্টার চেম্বারস। আমরা বিশাল বড় বিপদে পড়েছি।

ভুল বলেনি। ঠিক সেই মুহূর্তেই গাছপালা ভেঙেচুরে বাকি কালো বিড়ালগুলো নদী ঘেঁষা রাস্তায় উঠে এলো। সকল জীবিত প্রাণী আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু।

.

বিড়ালগুলো গ্রামের ওপর হামলে পড়ল চারদিক থেকে, ডিয়েট্রিচ এবং তার দলবলকে ধরে ফেলল, ওরা তখন মনিটরের সামনে বোকার মতো জড়ো হয়ে ছিল শহরের কেন্দ্রবিন্দুতে, ওদেরকে একেবারে হকচকিয়ে দিল।

নরক থেকে ধেয়ে আসা বাদুরের মতো মূল সড়ক ধরে লাফাতে লাফাতে ছুটে এলো ওগুলো। ঝাঁপ দিয়ে পড়ল দাঁড়িয়ে থাকা জার্মান কমান্ডোর ওপর, কামড়ে ছিঁড়ে ফেলছে গলা।

রেস নিশ্চিত হতে পারছে না সংখ্যায় বিড়াল কটা। প্রথমে দশটা গুনেছিল, তারপর বারোটা, তারপর পনেরো।

জেসাস।

তারপর হঠাৎ গুলির আওয়াজ হল, দেখতে পেল সেই দুই জার্মান সৈনিক, ডিয়েট্রিচ যাদেরকে পশ্চিমদিকের লগ-ব্রিজে পাঠিয়েছিল, হাসেলডর্ফ আর ক্রিগার বিড়ালগুলোকে লক্ষ্য করে গুলি চালাচ্ছে।

 দুই কমান্ডো দুটো ভয়ঙ্কর জন্তুকে গুলি করে ফেলে দিল–দুটোই গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে ছিটকে পড়ল কাদায়-ওগুলোর শরীরকে অনায়াস ভঙ্গিতে লাফ দিয়ে টপকে এল অন্য কয়েকটা বিড়াল, ধরে ফেলল তাদেরকে।

একটা বিড়াল লাফ দিয়ে হাসেলডফের পিঠে চড়ল, তারপর ছিঁড়ে ফেলল তার। মেরুদণ্ড। আরেকটা স্রেফ চোয়াল বসাল ক্রিগারের গলায় মড় মড় আওয়াজ তুলে ভেঙে ফেলল ঘাড়।

 গ্রামের বাকি অংশকে দাঙ্গাবিধ্বস্ত একটা এলাকা বলে মনে হচ্ছে, এখনো বেঁচে থাকা জার্মান সৈনিকরা মরিয়া হয়ে দিকবিদিক ছুটছে–দুই অ্যাপাচি হেলিকপ্টারের দিকে, কুঁড়েগুলোর দিকে, আবার কেউ নদীর দিকে মরিয়া হয়ে ভয়ঙ্কর বিড়ালগুলোর হাত থেকে বাঁচার জন্য।

চপারে ওঠো! একজন চেঁচাচ্ছে। চপারে।

ইঞ্জিনের আওয়াজ শুনে ঘাড় ফেরাল রেস, দুটো অ্যাপাচিরই রোটর ব্লেড ধীরে ধীরে ঘুরতে শুরু করেছে।

প্রাণ হাতে করে দুই চপারে ছুটছে জার্মান সৈনিকেরা, কিন্তু ছোট আর রোগাটে ওগুলো প্রতিটিতে শুধু একজন পাইলট আর একজন গানার বসার জায়গা আছে।

প্রথম অ্যাপাচি শূন্যে উঠতে শুরু করেছে, আতঙ্কিত একজন কমান্ডো ছুটে এসে লাফ দিল, উঠে পড়ল ল্যান্ডিং স্ট্রীট-এ, হ্যাচকা টান দিয়ে খুলে ফেলল ককপিটের দরজা। কিন্তু ভেতরে ঢোকার সুযোগ হল না তার, লাফ দিয়ে স্ট্রাট-এ চড়ে বসল একটা বিড়াল, তাকে থাবা দিয়ে নিজের পথ থেকে একপাশে সরিয়ে দরজা দিয়ে ককপিটে ঢুকে পড়ল ওটা, লম্বা লেজ চাবুকের মতো এ-পাশে ঝাঁপটা মারছে।

এক সেকেন্ড পর ককপিট উইন্ডোর ভেতর দিক রক্তে লাল হয়ে উঠল, সেই সঙ্গে মার্টি থেকে দশ ফুট উপড়ে পাগলামি শুরু করল চপার।

ডানদিকে মারাত্মকভাবে কাত হল ওটা, দ্রুতগতির কারণে ঝাপসা একটা ঝলকের মতো লাগছে রোটর ব্লেডগুলোকে। অন্য অ্যাপাচির দিকে এগোল ওটা, হঠাৎ নাকের নিচে বসান ছয় ব্যারেল নিয়ে রোটারি কামানটা কীভাবে যেন জ্যান্ত হয়ে উঠল, গোটা গ্রামটাকে সুপার-মেশিন গান ফায়ারে ক্ষতবিক্ষত করছে।

চারদিকে ছুটছে ঝক ঝক ট্রেসার বুলেট।

একটা বুলেট লাগায় রেসের হামভির উইন্ডস্ক্রিনে মাকড়সার জাল সৃষ্টি করেছে।

ঝট করে মাথাটা নামিয়ে নিয়েছে রেস, তবে তার আগে কমলা রঙের একটা আগুন ঝলসে উঠতে দেখল নদীর তীরে বেঁধে রাখা ওদের একটা হিউ হেলিকপ্টারের গোটা টেইল সেকশন জুড়ে।

তারপর হঠাৎ, যেন ফোর্থ অব জুলাই-এর আকাশের দিকে আতসবাজি ছুটছে, মার্টিতে আছাড় খাওয়া অ্যাপাচির পড় থেকে দুটো হেলফায়ার মিসাইল বেরিয়ে এলো।

একটা মিসাইল কাছাকাছি পাথরের কুঁড়েতে লাগল, ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল সেটা, আরেকটা ছুটল ভিলকাফোর মূল সড়ক ধরে, সরাসরি এগোচ্ছে নদীতে পার্ক করা সী প্লেনটার দিকে শুমম!–খোলা লোডিং র‍্যাম্প হয়ে সী প্লেনে ঢুকল ওটা, কার্গো বে-র ভেতরে।

এক সেকেন্ড লাগল কিছু ঘটতে।

পরমুহূর্তে বিরাট সী প্লেনটা বিস্ফোরিত হল, বিস্ফোরণটা ছিল বিশাল, ধাক্কাটাও ছিল বেশ ভালো। এক মুহূর্তে এন্টোনোভের দেয়াল উড়ে গেল এবং পুরো প্লেনটা নাটকীয়ভাবে একটু ওপরে উঠল তারপর ডুবে যেতে শুরু করল, সেই সঙ্গে স্রোতের টানে ধীরে ধীরে ভাটির দিকে সরে যাচ্ছে।

ইতোমধ্যে যে অ্যাপাচিটা এত কিছুর জন্য দায়ী, এখনো সেটা উন্মত্ত ভঙ্গিতে নিজের যমজের দিকে এগোচ্ছে। দ্বিতীয় কপ্টারের পাইলট মরিয়া হয়ে চেষ্টা করছে। ওটার পথ থেকে সরে যেতে, কিন্তু সময় পাওয়া গেল না। প্রথম অ্যাপাচির ঘুরন্ত রোটর ব্লেড দ্বিতীয়টার ব্লেডে আঘাত করল, কর্কশ ধাতব সংঘর্ষে ভরে গেল বাতাস।

তারপর হঠাৎ প্রথম অ্যাপাচির ব্লেড দ্বিতীয় অ্যাপাচির ফুয়েল ট্যাংক চিরে দিল। সেকেন্ডের মধ্যে অগ্নিকুণ্ড হয়ে উঠল কপ্টার দুটো, ভিলকাফোরের মূল সড়কে ছড়িয়ে পড়ছে সেই আগুন।

রেস মুখ ফেরাল ভয়ানক ওই দৃশ্য থেকে, তাকাল সামনের সিটে তার পাশে বসা ওয়াল্টার চেম্বারসের দিকে।

জিসাস ক্রাইস্ট, ওয়াল্টার বলল সে, কী ঘটল দেখলেন?

ওয়াল্টার জবাব দিল না।

 ভুরু কোঁচকাল রেস। ওয়াল্টার? কী হল?

 ঘ-র-র-র-র

আওয়াজটা শুনে স্থির হয়ে গেল রেস।

তারপর ধীরে ধীরে চেম্বারসের মুখের দিকে আরো ভালো করে তাকাল ও। বইয়ের পোকা ছোটখাট অ্যানথ্রপলজিস্টের চোখ দুটো সসারের মতো বড় হয়ে উঠেছে, মনে হল দম ফেলতেও পারছে না।

তাকিয়ে আছে রেসের কাঁধের উপর দিয়ে পেছনের দিকে।

ধীরে, খুব ধীরে, ঘাড় ফেরাল উইলিয়াম রেস।

প্রকাণ্ড একটা বিড়াল জানালায় এসে দাঁড়িয়েছে।

 ডানদিকের জানালায়।

ওটার কালো মাথা বিশাল বড়। গোটা জানালা ঢাকা পড়ে গেছে। ভয়ঙ্কর জন্তুটা কিছু করছে না, সরু হলুদ চোখ দিয়ে শুধু দেখছে রেসকে।

এবার ওটা গর্জন ছাড়ল। গভীর, অনুরণিত গম্ভীর আওয়াজ।

 ঘ-র-র-র-র।

ওটার বুক ওঠা-নামা করতে দেখছে রেস, নিচের ঠোঁট ছুঁয়ে বেরিয়ে আসা লম্বা আর সাদা দাঁত দেখতে পাচ্ছে। হঠাৎ দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে খেঁকিয়ে উঠল জন্তুটা, এবং সাথে সাথে একটা লাফ দিল, সেই সঙ্গে গোটা হামভি প্রচণ্ড একটা ঝাঁকি খেল।

ঘাড় ফিরিয়ে সামনে তাকাল রেস।

আরেকটা বিড়াল এইমাত্র লাফ দিয়ে হামভির বনেটে চড়ে বসেছে।

বনেটে ওটা দাঁড়িয়েছে পেছনের পায়ে ভর দিয়ে, সামনের পা দুটো বনেটে শুইয়ে রেখেছে, হলুদ চোখে রেস আর চেম্বারসকে গভীর দৃষ্টিতে দেখছে, আত্মার ভেতর ঢুকতে চাইছে।

রেস তার থ্রোট মাইক স্পর্শ করল। আহ, ভ্যান লিওয়েন। তুমি কি শুনতে পাচ্ছ?

জবাব নেই।

 স্ক্রি-ই-ই-ই-ই-ই-চ।

বনেটের কালো বিড়ালটা ধীরে ধীরে সামনে বাড়াল পা, নখর দিয়ে ইস্পাতের হুড আঁচড়াচ্ছে। একই সময়ে, দ্বিতীয় বিড়ালটা, রেসের বাঁ দিকে, নাক দিয়ে পুঁতো মেরে হামভির দরজা পরীক্ষা করছে।

রেস তার থ্রোট মাইকে টোকা দিতে লাগল। ভ্যান লিওয়েন!

তার এয়ার পিসে ভ্যান লিওয়েনের গলা ভেসে এলো। প্রফেসর, আমি আপনাকে দেখতে পাচ্ছি। আপনাকে দেখতে পাচ্ছি।

মুখ তুলে তাকাল রেস, সবগুলো গাড়ি স্থির হয়ে রাস্তায় কাদার মধ্যে দাঁড়িয়ে রয়েছে, ওদের হামভি থেকে খুব বেশি দূরে নয়।

এ কি দেহরক্ষীর দায়িত্ব পালন করার নমুনা। রেস বলল।

টেক ইট ইজি, প্রফেসর। হামভির ভেতর থাকলে আপনি নিরাপদ।

 বনেটের কালো বিড়ালটা সামনের বাঁ পা ফাটল ধরা উইন্ডস্ক্রিনে ঢুকিয়ে দিল।

উইন্ডস্ক্রিন বিস্ফোরিত হল, একরাশ টুকরো কাঁচের সঙ্গে ভেতরে ঢুকল পা, স্থির হল রেসের মাথার ইয়াঙ্কি ক্যাপ থেকে দুইঞ্চি দূরে।

ভ্যান লিওয়েন!

অল রাইট, অল রাইট! কুইকলি! ড্যাশবোর্ডের তলায় দেখুন, ভ্যান লিওয়েন বলল। গ্যাস পেড়ালের কাছে। স্টিয়ারিং কলামের নিচের দিকে কালো রাবারের একটা বোম আছে।

খুঁজছে রেস।

পেয়েও গেল।

কী করব?

চাপ দিন ওটায়!

চাপ দিল রেস, সঙ্গে সঙ্গে গর্জে উঠল হামভির ইঞ্জিন।

 নষ্ট হয়ে যায় নি এখনো। রেস জানে না কেন, তাতে কি। কাজ তো করছে।

স্টিয়ারিং হুইলের নিচ থেকে মাথাটা উঁচু করল সে, দেখল চোখের সামনে হাঁ। করে রয়েছে বনেটে দাঁড়ান কালো বিড়ালটার মস্ত চোয়াল।

হিসসস শব্দ করে খেঁকিয়ে উঠল ওটা। এত কাছে, উষ্ণ আর পচা টক টক গন্ধ সহ ঝড়ো নিঃশ্বাস অনুভব করছে রেসের সারা মুখে। সদ্য তৈরি উইন্ডস্ক্রিনের ফাঁক গলে গাড়ির ভেতর ঢোকার জন্য শরীরটাকে মোচড়াচ্ছে বড় বিড়ালটা, মানুষের মাংসের লোভে।

সিটের পিঠে যথাসম্ভব সেঁটে আছে রেস, হিংস্র জন্তটায় দাঁত যাতে নাগাল না পায়, আত্মরক্ষার তাগিদে ড্রাইভার সাইডের জানালার দিকে সরে যেতে হচ্ছে ওকে, ঘাড় ফেরাতেই দেখল চোয়াল দ্রুত বেগে এগিয়ে আসছে ওর দিকে।

দ্বিতীয় বিড়ালটা জানালায় বাড়ি মারল। সাসপেনশনের উপর ঘন ঘন দোল খাচ্ছে হামভি, লাফাচ্ছে বিড়ালের ওজন এবং ধাক্কার ফলে। বিদ্যুৎচমকের আকৃতিতে ফাটল ধরল ড্রাইভারের পাশের জানালার কাঁচে।

কিন্তু গাড়ির ইঞ্জিন তখনো চলছিল, এবং এটাই লক্ষ্য করার ব্যাপার। ঝাঁকি খেয়ে চলতে শুরু করল, রেস গিয়ারস্টিকটা চেপে ধরল, কোন গিয়ারটা ধরেছে সেটা দেখার সময় নেই, ধরেছে একটা, অ্যাক্সলেক্টার চেপে ধরল মেঝের সাথে।

হামভি বুলেটের বেগে পিছিয়ে গেল ভিলকাফোরের কদৰ্মাক্ত পথ ধরে।

জেসাস, ও রিভার্স গিয়ারটা ধরেছে।

যখন বিশাল আকারে জিপ গ্রামের এবড়ো খেবড়ো পথ ধরে পিছিয়ে গেল, তখন বনেটের ওপরে বসে থাকা বিড়ালটার হামভির গতিবেগে বিস্মিত হয়ে যেতে পারে, উইন্ড স্ক্রিন থেকে ভয়ঙ্কর প্রাণীটার মাথাটা সরে গেল, ভাঙ্গা কাঁচের ভেতর দিয়ে তার সামনের থাবাটা ঢুকিয়ে দিল, রেসকে ধরার চেষ্টা করছে।

 রেস পিছিয়ে গেল যতটা পারা যায়, আবার হাত থেকে নিজের শরীরটা বাঁচিয়ে রাখল, এক্সেলেটারে চাপ দিল আরো জোরে।

হামভি একটা গর্তে আঘাত করল, লাফিয়ে উপরে উঠে গেল এক মুহূর্তের জন্য, আবার মার্টিতে আছড়ে পড়ল সজোরে। বিড়ালটা তখনো বনেটের ওপর ক্ষিপ্তভাবে রেসকে ধরার চেষ্টা করছে আর আর্মাড গাড়িটা ছুটে চলল বৃষ্টিভেজা রাস্তা ধরে উল্টো দিকে, সম্পূর্ণ অনিয়ন্ত্রিতভাবে।

উইল, দেখ! চেঁচিয়ে উঠল লরেন।

 কী? রেস জিজ্ঞেস করল।

আমাদের পেছনে!

 কিন্তু পেছন ফিরে তাকাতে পারল না রেস।

উইন্ডস্ক্রিনের ভেতর ঢুকে পড়ে আরো একটু লম্বা হয়ে ওর বুকটাকে ছিঁড়ে ফেলতে চাইছে বিড়ালটা।

উইল, থাম! আমরা নদীতে পড়তে যাচ্ছি!

মুখ তুলে তাকাল রেস।

 ও কি নদীর কথা বলল।

তাকাতেই রিয়ার-ভিউ মিররে কালো নদীটাকে দেখতে পেল সে, অগভীর পানিতে আমেরিকানদের একটা হিউ দাঁড়িয়ে আছে।

 রেস আঁকড়ে ধরল হুইল, কিন্তু কাজ হল না। বনেটের ওপরের বিড়ালের আতঙ্কে হামভির ব্যাকওয়ার্ড স্পিড কন্ট্রোলের বাইরে চলে গেছে।

দ্রুত হুইল ঘোরাল রেস, চাপ দিল ব্রেকে। কিন্তু চাকাগুলো পিচ্ছিল কাদায় আটকে গিয়ে পিছলাতে শুরু করেছে। হামভি এখন ওর নিয়ন্ত্রণের বাইরে। গাড়িটা কাদায় পিছলাতে লাগল, কন্ট্রোলের বাইরে চলে গেছে। এবং তারপর হঠাৎ, কি ঘটেছে জানার আগেই, বিশাল গাড়িটা নদীর কিনারা থেকে লাফ দিল, নদীতে পড়তে যাচ্ছে।

.

হামভি উড়ে গেল, নদীর কিনার থেকে ছিটকে গিয়ে উড়ে গিয়ে অগভীর পানিতে ভেসে থাকা হিউর কাঁচের তৈরি গম্বুজের উপর পড়ল হামভি।

সংঘর্ষের ধাক্কায় গাড়ি আর হেলিকপ্টার দুটোই নদীর মূল অংশে ছিটকে পড়ল। হামভির বনেট থেকে বিড়ালটাকে হিউ হেলিকপ্টারের ওপর দিয়ে উড়িয়ে নিয়ে গেল, মাঝ নদীতে ছিটকে পড়েছে বিড়ালটা, ছলকে উঠল পানি।

মাত্র কয়েক সেকেন্ড পরেই ভয়ঙ্কর কুমিরের মতো দেখতে কেইমানগুলো ঘেঁকে ধরল ওটাকে।

প্রচণ্ড গর্জন ছেড়ে মরিয়া হয়ে লড়াই করল বিড়ালটা, অবশেষে শত্রুর সংখ্যার কাছে হার মানতে হল, ডুবে গেল পানির তলায়।

তীরের কাছাকাছি রয়ে গেল শুধু হামভি-হিউ-র অদ্ভুতদর্শন সঙ্কর, প্রায় অর্ধেকটা ডুবে, তীর থেকে বিশ ফুট দূরে।

হামভির আঘাতে সামনের গম্বুজ ভেঙে গুঁড়িয়ে গেছে এবং এই মুহূর্তে চপারটার সামনের ভাঙা অংশ থেকে বেরিয়ে রয়েছে চওড়া জীপের মতো দেখতে গাড়িটি। তবে হিউ-র রোটর হাউজিং আর টেইল সেকশনের কোনো ক্ষতি হয়নি। কিম্ভুত আকৃতির গোটা কাঠামোর মাথায় ওটার বোটর দুটো স্থির হয়ে রয়েছে, সম্পূর্ণ অক্ষত

হামভির ভেতর নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করছে রেস।

ওর বাঁ দিকে সবুজাভ ঘোলা পানি জানালায় বাড়ি মারছে, ফুটো দিয়ে ভেতরে ঢুকছে, ফিনকি দিয়ে। জানালা দিয়ে বাইরে তাকালে অ্যাকুরিয়ামের ওয়াটারলাইনের উপর-নিচ, দুটোই দেখতে পাচ্ছে ওরা।

নরকের অ্যাকুরিয়াম এটি।

জানালা দিয়ে, পাঁচটা দৈত্যাকার কেইমানের পেট দেখতে পাচ্ছে রেস, সবগুলো ওর সঙ্গে দূরত্ব কমিয়ে আনার জন্য নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা করছে। ওদের লেজগুলো এদিক-ওদিক নড়ছে, হামভির দিকে ডাইভ দিয়েছে তাদের শরীরগুলো।

পরিস্থিতি আরো খারাপ করে তুলল উইন্ডস্ক্রিনের গর্ত দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়া পানি, রেসের জিনস ভিজে গেল, পায়ের কাছে অগভীর পুকুর তৈরি হচ্ছে।

ওর পাশে বসা ওয়াল্টার চেম্বারস উদভ্রান্তের মতো বলে যাচ্ছে, ওহ মাই গড! ওহ মাই গড! ওই মাই গড! চেম্বারসের পেছনে গ্যাবি লোপেজকে দেখতে পেল রেস তার বা চোখের উপর ইঞ্চিখানেক লম্বা একটা ক্ষত দেখা যাচ্ছে। নিশ্চয়ই চপারের গায়ে হামভি আছড়ে পড়ার সময় আঘাতটা পেয়েছে সে।

 এখান থেকে আমাদের বেরুনো দরকার! চেঁচিয়ে বলল লরেন।

 কী বলছ! রেস চেঁচিয়ে বলল। উইন্ডস্ক্রিনের ফাঁক দিয়ে লাফিয়ে ভেতরে ঢুকল বড় বড় দাঁতলা বিরাট একটা সিলভার মাছ, সরাসরি ওর কোলে পড়ে লাফাতে লাগল।

রেসের বাঁ দিকে কিছু একটা ধাক্কা দিল, সিট থেকে প্রায় পড়ে যাচ্ছিল ও, সেই সাথে হামভি বেশ জোরে ঝাঁকি খেল।

ঘাড় ফেরাতে দেখল ওর পাশের জানলায় ঝুলে রয়েছে বিশাল সাইজের একটা কালো কেইমান, ফাটল ধরা কাঁচের ভেতর দিয়ে ক্ষুধার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওর দিকে।

ওহ, ম্যান, বলল সে।

 দৈত্যাকার সরীসৃপটাকে জানালার সামনে থেকে পিছু হটতে দেখল রেস।

 ওই, ম্যান…

 কী? কী? পাশ থেকে জানতে চাইল ওয়াল্টার চেম্বারস।

ওটা আবার ধাক্কা দিতে যাচ্ছে! চেঁচিয়ে উঠল রেস, সিট টপকে পেছন দিকে চলে যাচ্ছে। মুভ, ওয়াল্টার! মুভ নাও!

পরমুহূর্তে সিট টপকাতে ব্যস্ত হয়ে উঠল, চেম্বারস কেইমানটাও পিছু হটা শেষ করে ছুটে আসছে। এক সেকেন্ড পর ড্রাইভার সাইডের জানালার কাঁচ বিস্ফোরিত হল।

 কাঁচ বৃষ্টির পিছু নিয়ে পানির তোড়সহ হুড়মুড় করে হামভির ভেতরে ঢুকে পড়ল আঁশে ঢাকা কেইমানটা, হামভির সামনের সিটে চলে এসেছে ওটা।

প্রকাণ্ড শরীর ছোট্ট জায়গাটার সবটুকু দখল করে নিয়েছে। রেস তার পা দুটো ঝট করে ব্যাক সিটে টেনে নিল, হাঁ করা চোয়াল ওগুলোর নাগাল পাওয়ার ন্যানো সেকেন্ড আগে।

কিন্তু ওয়াল্টার চেম্বারস দেরি করে ফেলেছে। পা দুটোকে সময় মতো সরিয়ে নিতে পারল না। প্রচণ্ড বাড়ি মেরে ওগুলোকে প্যাসেঞ্জার সাইডের দরজায় ঠেলে দিল কেইমানটা, চেপে ধরে রাখল ওখানে।

 চেম্বারস চেঁচাচ্ছে। লেজ শক্ত আর পিঠ বাঁকা করে তাকে আরো যুৎসইভাবে আটকাবার চেষ্টা করছে কেইমানটা।

ব্যাকসিট থেকে ওটার শুধু বিশাল পিঠ আর লম্বা লেজটা দেখতে পাচ্ছে রেস, বিশাল প্রচণ্ড শক্তিতে এদিক-ওদিক চাবুকের মতো আছড়ে পড়ছে লেজটা।

তারপর হঠাৎ এত দ্রুত হকচকিয়ে দিল রেসকে, চেম্বারসকে মুখে নিয়ে যে জানালা দিয়ে ভেতরে ঢুকেছিল সেটা দিয়েই বেরিয়ে গেল কেইমানটা।

নো-ও-ও-ও-! জানালা দিয়ে অদৃশ্য হওয়ার সময় আর্তনাদ করে উঠল চেম্বারস।

আতঙ্কিত দৃষ্টি বিনিময় করল রেস আর লরেন।

 এখন আমরা কি করব? চেঁচিয়ে বলল সে।

 কীভাবে জানব আমি? চারদিকে চোখ বুলিয়ে পরিস্থিতিটা দেখবার সময় ভাবল রেস।

গাড়ির সামনের সিটের দিকটা দ্রুত পানিতে ভরে উঠছে। ফলে বাদিকে কাত হয়ে যাচ্ছে হামভি এবং সেই সঙ্গে আরো নিচু হচ্ছে।

গাড়িটা পানিতে তলিয়ে যাবার আগে বেরিয়ে পড়ি। দ্রুত বলল রেস। জলদি, তোমার দিকের জানালা খোলো! এখন ওগুলো খোলার কথা।

সামনের পানি গাড়ির পেছনেও চলে আসছে, নিজের দিকের জানালা খুলছে লরেন। ওদিকে গাড়িটা একটু বেশি উঁচু ফলে জানালাটা পুরোপুরি খোলার পর শুধু রাতের ঠাণ্ডা বাতাস পাওয়া গেল।

 আরেকটা কেইমান হামভির ড্রাইভারের জানালা দিয়ে হুড়মড় করে ভেতরে ঢুকে পড়ল, গাড়ির সামনের অংশে জমে ওঠা পানিতে ঝপাৎ করে পড়ল সেটা।

বেরিয়ে পড়! চিৎকার করে বলল রেস। ছাদে উঠে যাও!

লরেন দ্রুতই বেরুল। এক সেকেন্ডের মধ্যে হামভি থেকে বেরিয়ে ছাদে পৌঁছে গেল সে। এরপর ঘোরে পাওয়া, আচ্ছন্ন গ্যাবির পালা। ব্যাকসিটের উপর দিয়ে সরে এসে খোলা জানালার দিকে এগোল সে। পেছন থেকে তার কোমরের দুপাশ ধরে ঠেলল রেস, ছাদ থেকে হাত বাড়িয়ে দিল লরেন, টেনে তাকে নিজের পাশে তুলে নিল।

ড্রাইভার সিটের কেইমানটা লেজ খাড়া পিঠ বাকা করে শিকার খুঁজছে।

সামনের সিটে পানি ঢুকছে। গাড়ির পেছনে পানি এখন কোমর সমান।

আরেকটা কেইমান হামভির পেছনে, বাঁ দিকে জানালায় গুতো মারল এর ফলে ঝাঁকি খেল পুরো গাড়িটা। ঘাড় ফেরাতেই রেস দেখল হামভির পুরোটা বাম দিক পানির নিচে তলিয়ে গেছে!

ইতোমধ্যে জানালা দিয়ে মাত্র অর্ধেকটা বেরুতে পেরেছে গ্যাবি লোপেজ, শেষ জন হল রেস।

 গ্যাবির পা দুটো ঠেলে জানালার বাইরে বের করে দিচ্ছে ও, ধাতব একটা কর্কশ আওয়াজ হল হামভির কোথাও।

নাটকীয় ভঙ্গিতে গোটা গাড়ি ডানদিকে ঘুরে গেল।

রেস প্রথমে ভাবল আরেকটা কেইমান তো মেরেছে। কিন্তু ব্যাপারটা তা নয়। এবার গাড়ির সবটুকু নড়ছে, গতি পাচ্ছে। নড়ছে…

ভাটির দিকে।

ওহ্ গড, রেস মনে মনে ভাবল।

নদীর স্রোত টান দিয়েছে ওদেরকে নিচের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এটা ঘটতে পারে না, সে বলল।

এরপর আরেকটা পরিচিত ঝাঁকি এল, একটা কেইমান বাঁ দিকের জানালায় গুতো মারল।

কী করছ, গ্যাবি! চিৎকার শুরু করল রেস ডান দিকের জানালার ভেতরে, ওর নাকের সামনে তার পা দুটো ঝুলছে।

ইতোমধ্যে সামনের সিটের কেইমানটা যেন বুঝে ফেলল রেস এবং অন্যান্যরা কোথায়। পিছু হটার চেষ্টা করল ওটা, যাতে লাফ দিয়ে ব্যাকসিটে পৌঁছাতে পারে।

গ্যাবি।

 প্রায় পৌঁছে গেছি… পাল্টা চেঁচাল গ্যাবি।

হারি আপ!

তারপর হঠাৎ রেসের চোখের সামনে থেকে গ্যাবির পা দুটো অদৃশ্য হয়ে গেল। ছাদ থেকে লরেনের চিৎকার ভেসে এল, গ্যাবিকে তুলে নিয়েছি, উইল! জানালা লক্ষ্য করে লাফ দিল রেস, ফাঁক গলে বেরিয়ে গেল মাথাটা, দেখল লরেন আর গ্যাবি ওর উপর ছাদে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

মেয়ে দুটো দ্রুত নিচু হয়ে ওর হাত ধরল, গাড়ি থেকে টেনে বের করল পুরো শরীরটা। রেনের পা দুটো জানালা গলে বেরিয়ে যাবার এক সেকেন্ড পর ব্যাকসিটে পৌঁছে ওগুলোকে লক্ষ্য করে কামড় বসাল কেইমানটা, মাত্র এক মিলিমিটারের জন্য নাগাল পেল না।

ওদিকে গ্রামে, ন্যাশ, কোপল্যান্ড এবং অন্য ছয় আমেরিকান সৈন্য হ্যান্ডকাফ পরা অবস্থায় অল-টেরাইন ভেহিকলে বসে একের পর এক বাইরের দুঃস্বপ্ন উন্মোচিত হতে দেখছে ঠিক তখনি তাদের আর্মারড ভেহিকেলের স্লাইডিং সাইড ডোর এক টানে বাইরে থেকে খুলে ফেলা হল, সঙ্গে সঙ্গে ভেতরে ঢুকে পড়ল বৃষ্টি এবং বাতাস, কাঁপিয়ে দিল এটিভির ভেতরটা।

দুজন জার্মান ঢুকল সারা শরীর ভেজা তাদের কাদামাখা পা গাড়ির মেঝেতে থপ থপ আওয়াজ করছে। ইস্পাতের বিরাট দরজাটা নিজেদের পেছনে বন্ধ করে দিল তারা। এটিভি-র ভেতরটা নীরব হয়ে গেল আবার।

ন্যাশ আর তার সঙ্গীরা কথা না বলে আগন্তুক দুজনকে দেখছে।

একজন তরুণ, একজন তরুণী।

দুজনেই ভিজে জবজবে হয়ে আছে, সম্পূর্ণ কাদায় মোড়া। পরনে সিভিল ড্রেস, ব্লু জিনস আর সাদা টি-শার্ট, তবে চোখে লাগল যেটা: দুজনেই গোরটেক্স হিপ হোলস্টার পরে আছে, সেগুলোয় শোভা পাচ্ছে এমকে-১৮ পিস্তল। নেভি ব্লু রঙের বুলেটপ্রুফ ভেস্ট-ও পরেছে তারা। চেহারা, পরিচ্ছদ দেখে মনে হচ্ছে। আন্ডারকাভার পুলিশ।

লোকটা লম্বা-চওড়া, শক্ত-সমর্থ এবং ব্যারেলের মতো বুকটা। মেয়েটি ছোটখাট, তবে অ্যাথলেটিক, মাথায় ছোট করে ছাঁটা পার অক্সাইড-ব্লন্ড চুল।

লোকটি আর সময় নষ্ট করল না, সোজা এগিয়ে এসে আমেরিকানদের হ্যান্ডকাফ খুলতে শুরু করল।

আপনারা এখন আর বন্দি নন, পরিষ্কার ইংরেজিতে বলল সে। আমরা সবাই এখন একদল। আসুন, যে-কজনকে পারা যায় বাঁচাতে চেষ্টা করি।

রেস, লরেন এবং লোপেজ হামভির ছাদে দাঁড়িয়ে থাকলেও ওদেরকে অচল বলা যায় না, কারণ জোড়া লেগে থাকা হামভি হিউ স্রোতের টানে আড়ষ্ট ভঙ্গিতে ভাটির দিকে ভেসে চলেছে।

 সামনে ভগ্নপ্রায় নড়বড়ে কাঠের জেটিটা দেখতে পাচ্ছে রেস, দশ গজ দূরে হবে। মনে হচ্ছে ওটার পাশ ঘেঁষেই এগোবে ওরা। এটাই তাদের সুযোগ।

 হামভি-হিউ আবার কেঁপে উঠল, সেই সঙ্গে আরো একটু ডুবল। এই মুহূর্তে নদীর সারফেস থেকে এক ফুট উপরে রয়েছে হামভির ছাদ, হিউ রয়েছে সামান্য একটু বেশি উপরে। কিন্তু ভাটির দিকে প্রতি গজ এগোবার সময় দুটোই দুই ইঞ্চি করে নেমে যাচ্ছে পানিতে।

খুব কাছে চলে এসেছে।

খুব কাছে।

আরো এক গজ ঢালের দিকে নেমে গেল।

কেইমানগুলো ওদেরকে ঘিরে চক্কর দিচ্ছে।

জেটি যখন আর আট গজ দূরে, নদীর ছলকান পানি হামভির ছাদের নাগাল পেয়ে গেল, ওদের পায়ের তলায় পানি চলে এল। তাড়াতাড়ি পিছিয়ে এসে হিউ-র নোটর হাউজিং-এ উঠে পড়ল ওরা তিনজন।

পাঁচ গজ দূরে।

 দ্রুত ডুবছে।

হিউ-র নোটর হাউজিং থেকে ফ্লাড লাইটের আলোয় আলোকিত গ্রামটার উপর চোখ বুলাল রেস। এখন ফাঁকা ওটা, একমাত্র নড়াচড়া বলতে মূল সড়ক ধরে বিড়ালের ছায়া স্যাৎ করে ছুটে যাওয়া। জীবিত মানুষজনের চিহ্নমাত্র নেই কোথাও। কিছু নেই।

 এই সময় ব্যাপারটা খেয়াল করল রেস।

অল-ট্যারাইন ভেহিকল গায়েব হয়ে গেছে।

 আট চাকার ট্যাঙ্কের মতো দেখতে এটিডি-র মধ্যে ন্যাশ, কোপল্যান্ড এবং গ্রিন বেরেট।

থ্রোট মাইকে কথা বলল রেস। ভ্যান লিওয়েন, কোথায় আপনি?

আমি এখানে, প্রফেসর।

 কোথায়?

এটিভি খুলে দুই জার্মান আমাদের সঙ্গী হয়েছে এবং হ্যান্ডকাফ খুলে দিয়েছে। গ্রামটা ঘুরে দেখছি আমরা উদ্ধার করার মতো কাউকে যদি পাই।

ওই কাজই যদি করে থাকেন, তাহলে ত্রিশ সেকেন্ডের মধ্যে কেন জেটির কাছে আসছেন না?

দশ-চার, প্রফেসর আমরা আসছি ওখানে।

জেটি এখনো তিনগজ দূরে, অথচ হামভির ছাদ পুরোপুরি পানির তলায় চলে গেল।

ঠোঁট কামড়াল রেস।

যদিও পানির উপর উঁচু হয়ে থাকা হিউ-র রোটর হাউজিঙে দাঁড়িয়ে রয়েছে ওরা, কিন্তু জেটিতে পৌঁছাতে হলে হামভির ডোবা ছাদে পা ফেলতে হবে ওদেরকে।

ভেসে থাক, বাছা! মনে মনে বলল ও।

দুই গজ।

হামভির ছাদ এখন ছয় ইঞ্চি পানির নিচে।

এক গজ।

 পুরো এক ফুট নিচে।

 আচ্ছন্ন গ্যাবির কাঁধে একটা হাত রাখল লরেন।

ঠিক আছে, বাছা, বলল সে। গ্যাবিকে আগে তুলে দিব। তুমি মাথাটা ধরার পরই, ঠিক আছে?

ঠিক আছে।

হামভি-হিউ জেটির পাশে চলে এসেছে।

রোটর হাউজিং থেকে লাফ দিয়ে পানিতে ডোবা হামভির ছাদে পড়ল লরেন আর গ্যাবি, ওদের হাঁটু পর্যন্ত ডুবে গেল।

পানি ছলকে আরো দুই পা এগোল ওরা, তারপর গ্যাবিকে জেটির দিকে ছুঁড়ে দিল লরেন। পরমুহূর্তে নিজেও লাফ দিল, ঠিক সে মুহূর্তে এক জোড়া বিশাল ক্রোকোডাইল তার পেছনে ছুটে এসে চোয়াল ফাঁক করল।

উইল চলে এসো, জেটি থেকে চেঁচিয়ে বলল সে।

রেস নিজেকে প্রস্তুত করল ডুবে যাওয়া হামভির ছাদের ওপর লাফিয়ে পড়ার জন্য। সে ধারণাই করতে পারছে না কেমন দেখাবে-তাকে জিন্স, টি-শার্ট এবং বেসবল ক্যাপ মাথায় দিয়ে ডুবন্ত হেলিকপ্টারের মাথায় দাঁড়িয়ে আছে কেইমান পরিবেষ্টিত আমাজনিয়ান নদীর মাঝখানে।

আমি এখানে কি করে এলাম? ভাবল সে।

তারপর, কোনো সতর্কতা ছাড়াই, পুরো হামভি-হিউ মিলিত অদ্ভুত যন্ত্রটা নাটকীয়ভাবে একদিকে কাত হতে লাগল, আরো এক ফুট ডুবে গেল।

ভারসাম্য হারাল রেস, পানিতে পড়ে যাচ্ছে, তবে দ্রুত সামলে নিল। মুখ তুলতে দেখল পরিস্থিতি আরো বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে।

হামভির ছাদ এখন কম করেও তিন ফুট পানির নিচে।

লাফ দিয়ে ওখানে পড়ার পর ওর নড়াচড়ার গতি কমে যাবে। কেইমানগুলো সুযোগটা নিশ্চয়ই হাতছাড়া করবে না।

হিউ-র অবস্থাও ভালো নয়।

চপারের রোটর হাউজিঙে দাঁড়িয়ে থাকলে কী হবে, সেটাও ইঞ্চিখানেক পানির তলায় চলে গেছে।

মরিয়া হয়ে চারদিকে তাকাল রেস, দেখল হিউ-র শুধু রোটর ব্লেড দুটো পানির উপর উঁচু হয়ে আছে।

 চট করে একবার জেটির উপর চোখ বুলাতে গিয়ে এটিভি-টাকে দেখতে পেল রেস, ব্রেক কষে জেটির গোড়ায় থামল, আট চাকার পাশে টানা দরজা খুলে গেল, ভেতরে ভ্যান লিওয়েন আর স্টটকে দেখা যাচ্ছে, গ্যাবিকে সেদিকে টেনে নিয়ে চলেছে লরেন।

কাঁধের উপর দিয়ে তাকিয়ে চেঁচিয়ে উঠল লরেন। উইল, লাফ দাও!

আবার টলমল করছে হিউ, এবার রেসের জুতো পুরোপুরি সারফেসের নিচে ডুবে গেল।

 চপার ডুবে গেছে, পানির উপর ভেসে আছে শুধু ওটার রোটর ব্লেড।

 রোটর ব্লেড… ভাবল সে।

 হয়তে সে পারবে…

না।

ওর ওজন অনেক ভারে নুয়ে পড়বে ওগুলো।

ঝট করে ঘুরে জেটির দিকে তাকাল রেস। তিনটে বড় কেইমান স্থির হয়ে আছে, অর্ধেকটা করে পানির নিচে, পজিশন নিয়েছে পুরানো কাঠের জেটি আর ওর মাঝখানে।

হয়তো…

দ্রুত হাত বাড়িয়ে একটা রোটর ব্লেড ধরল রেস। তারপর যত জোরে পারা যায় ত্রিশ ফুট লম্বা ইস্পাতের পাতটাকে ঘোরাবার চেষ্টা করল।

স্রোতের টানে এখনো ভাটির দিকে ভেসে চলেছে ডুবে যাওয়া হিউ।

রোটর ব্লেড ঘুরল, সামনের ডগা প্রায় ছুঁয়ে দিল জেটিটাকে, ফলে নদীর উপর নিচু একটা ব্রিজের মতো দেখতে লাগছে ওটাকে, সংযোগ সৃষ্টি করেছে হিউ এবং কাঠের জেটির মাঝে।

আবার টলে উঠল হিউ, আরো ইঞ্চি দুয়েক ডুবল, আর ঠিক এই সময় প্রকাণ্ড কালো একটা আকৃতি পানির বিস্ফোরণ ঘটিয়ে মাথাচাড়া দিল রেসের পাশে। রিফ্লেক্স অ্যাকশন, পা দুটো যতটা সম্ভব ফাঁক করল ও, পা দুটোর মাঝখান দিয়ে বেরিয়ে গেলে কেইমানটা, ঝপাৎ করে পড়ল হিউ-এর উল্টোদিকের পানিতে।

খুব কাছ দিয়ে গেছে, মনটা সরব হয়ে উঠল। এবার এগোও!

শেষবারের মতো তাকাল মুক্তির পথটার দিকে রোটর ব্লেড, দশ ইঞ্চি চওড়া ইস্পাতের একটা সেতু, নদীর সারফেস থেকে মাত্র এক ফুট উঁচুতে ঝুলছে।

যাও এবার!

এবং সে করলও তাই।

.

তিন পা এগিয়ে দেখল জেটি এখনো বিশ ফুট দূরে। জেটি, নিরাপত্তা, রক্ষা পাওয়া

অর্ধেক দূরত্ব পেরিয়ে এসেছে, অনুভব করল ওর নিচে ডেবে যাচ্ছে রোটর ব্লেড, ওয়াটার লেভেলে চলে আসছে। নিচু হয়ে তিন কেইমানের পিঠ ছুঁতে যাচ্ছে ওটা।

 ভারসাম্য ঠিক রাখতে ব্রিজের উপর নাচছে রেস, ব্রিজটা টিকে আছে কেইমানগুলোর পিঠকে অবলম্বণ করে।

লম্বা পা ফেলে রোটর ব্লেডের শেষ মাথায় পৌঁছাল ও, শূন্যে উঠে পড়েছে ও, জেটির কিনারায় বুক দিয়ে পড়ল শরীরটা।

 পা দুটো পানি থেকে তুলে নাও, মনটা চিৎকার করে উঠল ভেতর ভেতর, মনে হল তার পা দুটো কালো পানিতে আছাড় খাচ্ছে।

বিদ্যুৎবেগে পানি থেকে তুলে ফেলল পা দুটো আর শরীরটাকে জেটির উপর গড়িয়ে নিরাপদ দূরত্বে সরে এলো সে।

প্রফেসর চলে আসুন! হঠাৎ ভ্যান লিওয়েনের ক্ষীণ কণ্ঠস্বর ঢুকল তার কানে।

রেস চোখ তুলতে দেখল জেটির শেষ মাথায় দাঁড়িয়ে রয়েছে এটিভি, পাশের স্লাইডিং দরজাটা খোলা।

তারপরই, তার চোখের কোণে একটা নড়াচড়া ধরা পড়ল, এটিভির মাথায় তাকাতেই দেখল, লাফ দিয়ে সেটাকে টপকে আসছে প্রকাণ্ড একটা কালো বিড়াল, নখরগুলো সামনে বাড়ান কোনোর ভঙ্গিতে অল-টেরাইন ভেহিকলের ওপর থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ছে।

দানব প্রাণীটা জেটিতে নামল, তার কাছ থেকে ঠিক পাঁচ ফুট দূরে। ওর সামনে দাঁড়িয়ে থাকল ওটা, কাঁধ দুটো নিচু করে রেখেছে, কান জোড়া খুলিতে সাঁটা, ঠোঁট ভজ খাচ্ছে, লাফ দেওয়ার আগের মুহূর্তে টান পড়ছে সমস্ত পেশিতে..

এবং তার পরই জন্তুটার পায়ের তলা থেকে নড়বড়ে সেতুটা সরে গেল।

কোনো শব্দ হয়নি। আগে থেকে কিছুই বোঝা যায়নি।

পুরানো কাঠের জেটি বিড়ালটাকে নিয়ে নেমে গেল পানিতে। গোঙানি আর চাপা গর্জনের মাঝে তলিয়ে গেল কালো পানিতে।

সময় মতো ভাগ্য আমার সহায় ছিল, রেস বলল।

কেইমানগুলো চারদিক থেকে ছুটে আসছে ওটার দিকে। পানিতে পরা বিড়ালটাকে নিয়ে রক্তাক্ত মহোৎসব শুরু হয়ে গেল এক জোড়া কেইমানের।

এই সুযোগটাই নিল রেস, লাফ দিয়ে সদ্য তৈরি ফাঁকটা পার হয়ে এলো এবং ছুটল এটিভির দিকে।

গাড়ির ভেতর ঢুকল রেস, ওর পেছনে ইস্পাতের দরজাটা টেনে বন্ধ করে দিল ভ্যান লিওয়েন, দরজার গায়ে চৌকো একটা ছোট্ট জানালা আছে, ঘুরে সেটা দিয়ে বাইরে তাকাল সে।

যা দেখল এক কথায় অপ্রত্যাশিত।

দেখল বিড়ালটা, কালো বিড়ালটা যেটা কয়েক সেকেন্ড আগে জেটিতে ওর পথ আগলে ছিল, পানি থেকে ধীরে ধীরে জেটিতে উঠে আসছে। নখর থেকে টপটপ করে রক্ত ঝরছে, এবড়োখেবড়ো মাংসের ফালি ঝুলছে চোয়াল থেকে, পানি টপটপ করে পড়ছে চকচকে দাঁতগুলো থেকে।

জন্তুটার বুক ঘনঘন ওঠা-নামা করছে, বোঝাই যাচ্ছে লড়াই করে চরম ক্লান্ত হয়ে পড়েছে ওটা।

কিন্তু জন্তুটা জীবিত আছে।

লড়াইয়ে জিতেছে।

 এইমাত্র ওটা দুটো প্রকাণ্ড কেইমানের সাথে লড়াই করে জিতে এসেছে।

রেস ধপ করে বসে পড়ল এটিভি মেঝেতে। সম্পূর্ণ পরিশ্রান্ত ওর পেছনে ঠাণ্ডা ধাতুর দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করল।

চোখ বন্ধ করার পরই, সে শুনতে পেল শব্দটা।

বাইরে বিড়ালের নখ এবং নাকের ভেঁস ভোস শব্দ শুনতে পেল, কাছেই, বেশ জোরে, বিশাল।

 শুনতে পেল ওগুলোর থাবা মার্টিতে দাবড়ানোর শব্দ। শুনতে পেল মৃত জার্মান কমান্ডোদের হাড়গোড় ভাঙ্গার মড়মড় শব্দ। এমনকি শুনতে পেল কাছেই কোথাও গোঙানির শব্দ।

এরপরই রেস ঘুমিয়ে পড়ল, তবে ঘুমানোর আগে সে এক ভয়ঙ্কর চিন্তা নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।

এখান থেকে কি করে বের হব?

.

চতুর্থ ষড়যন্ত্র
মঙ্গলবার, জানুয়ারি ৫, ০৯৩০ ঘণ্টা।

স্পেশার এজেন্ট জন-পল ডিমোনাকো সাদা ধবধবে করিডোর দিয়ে সাবধানে এগিয়ে গেল, যাতে বডিব্যাগে তার পা না পড়ে যায়।

সকাল ৯:৩০ জানুয়ারি ৫, আর ডিমোনাকো এফবিআই-র ডিরেক্টরের ডাকে সাড়া দিয়ে মাত্র এসে পৌঁছেছে ৩৭০১ নর্থ ফেয়ারফ্যাক্স ড্রাইভ ইন-এ।

 বিশ্বের অন্যদের মতে, ডিমোনাকো জানেই না যে আগের দিন ডারপা হেডকোয়ার্টারে চোর ঢুকেছিল। যা কিছু সে জানে তা হল ৩:৩০ মিনিটে ডিরেক্টর একটা ফোন পান ওভাল অফিস থেকে একজন চার তারকার এ্যাডমিয়ালের কাছ থেকে যে যতটা দ্রুত সম্ভব ফেয়ারফ্যাক্স ড্রাইভে একজন শ্রেষ্ঠ ডোমেস্টিক এ্যান্টি টেররিস্ট এজেন্ট পাঠান হয়।

তার শ্রেষ্ঠ এজেন্ট হল জন-পল ডিমোনাকো।

জে.পি. ডিমোনাকোর বয়স হল বাহান্ন, ডিভোর্সি, এবং কোমরের বেরটা একটু কমেছে। মাথায় পাতলা বাদামী চুল এবং চোখে পরেছে হর্ন-রিমড় চশমা। তার পরনে ছাইরঙা পলিস্টার সূত্রটা কেনা হয়েছে ১৯৯৪ সালে জে.সি. পেনি থেকে একশো ডলারে, অথচ ভারসেস টাইটা কিনেছে তিনশো ডলার দিয়ে গত বছর। এগুলো সবই ছিল জন্মদিনের উপহার ছোট মেয়ের কাছ থেকে—পাশাপাশি হাল ফ্যাশনের।

 পোশাকে তার বোধশক্তি থাকার পরেও, ডিমোনাকো এফবিআই-র অ্যান্টি টেররিস্ট (ডোমেস্টিক) স্পেশাল এজেন্টের দায়িত্বে আছে গত চার বছর ধরে, কারণ সে অন্য যে কোন মানুষের চেয়ে আমেরিকার টেররিজম সম্পর্কে বেশি জানে।

সাদা ধবধবে হলওয়ে দিয়ে হেঁটে যাবার সময় ডিমোনাকো দেখল তার পায়ের কাছে মেঝেতে পড়ে আছে আর একটি বডিব্যাগ। ওটার ওপরের দেয়ালে রক্তের ছিটে। টালিতে ওই ব্যাগটা যোগ করল সে। দশটা হল যোগ করে।

এখানে কি ঘটেছে?

একটা বাঁক ঘুরল এবং সাথে সাথে দেখতে পেল করিডোরের শেষে ল্যাবরেটরিতে ঢোকার মুখে ছোটখাটো একটা জটলা।

জটলার বেশিরভাগ মানুষ পরে আছে ইউএস নেভির গাঢ় নীল রঙের পাটপাট করা পোশাক।

একজন বিশ বছর বয়সী লেফটেন্যান্ট তার সঙ্গে হলওয়ের পরে করিডোরে সম্মুখিন হল।

স্পেশাল এজেন্ট ডিমোনাকো?

 জবাবে ডিমোনাকো তার আইডি দেখিয়ে দিল।

এই দিকে, প্লিজ! কমান্ডার মিশেল আপনার অপেক্ষায় রয়েছেন।

তরুণ লেফটেন্যান্ট তাকে ল্যাবরেটরিতে নিয়ে গেল। ল্যাবে ঢোকার সাথে সাথে নীরবে দেয়ালে রাখা সিকিউরিটি ক্যামেরায়, পুরু হাইড্রলিক দরজা, আলফা-নিউমেরিক লক, সবই ডিমোনাকোর দৃষ্টিগোচার হল।

ঈশ্বর, এ তো একটা ভল্ট।

স্পেশাল এজেন্ট ডিমোনাকো? ওর পেছন থেকে কেউ ডেকে উঠল। ডিমোনাকো এক পাক ঘুরতেই দেখতে পেল ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছে হান্ডসাম তরুণ অফিসার। ছাব্বিশ বছর বয়স, নীল চোখ এবং ছোট করে ছাঁটা ব্লন্ড চুল, যেন একজন নেভি পোস্টার বয়। বেশ কিছু কারণে ডিমোনাকো তাকে পাত্তা না দিয়ে পাড়ল না, ও তাকিয়ে আছে ঘনিষ্ঠ দৃষ্টিতে।

হ্যাঁ, আমি ডিমোনাকো।

কমান্ডার টম মিশেল। নেভাল ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেটিভ সার্ভিস।

 এন সি আই এস, ডিমোনাকো মনে মনে ভাবল। কৌতূহলোদ্দীপক।

যখন সে ফেয়ারফ্যাক্স ড্রাইভে এসে পৌঁছল ডিমোনাকো তখনো খেয়াল করে নি এই দালানে প্রবেশপথে নেভি সার্ভিসম্যানরা পাহারা দিচ্ছে। ডি সি-তে এমনতর নির্দিষ্ট ফেডারেল বিল্ডিং আর্ম ফোর্সের নির্দিষ্ট ব্রাঞ্চের লোক পাহারা দিবে তা বিচিত্র কিছু নয়। উদাহরণ স্বরূপ, ফোর্ট মীডে, এনএসএ-র হেডকোয়ার্টার, আসলে ওটা একটা আর্মি কম্পাউন্ড। অন্যদিকে, হোয়াইট হাউজ, পাহারা দিয়ে থাকে ইউনাইটেভ স্টেটস মেরিন কর্পস। ডারপা-কে যে ইউএস নেভি পাহারা দিচ্ছে তাতে ডিমোনাকো তেমন অবাক হয়নি। এর ফলে সকল নেভি পোশাক পরিহিতরা এখানে কেন তার ব্যাখ্যা পরিষ্কার হয়ে গেল।

 কিন্তু না। এনসিআইএস যদি এখানে থাকেই, তার মানে কিছু একটা পুরোপুরি ঘটেছে। কিছু একটা যা এই ফেডারেল বিল্ডিং প্রটেক্টে ব্যর্থ হয়েছে। কিছু একটা ভেতরের…।

 আমি জানি না আমাকে আপনার মনে আছে কি না, মিশেল বলল। তবে ছয়মাস আগে কোয়ান্টিকোতে আমি আপনার সেমিনারে আপনাকে দেখেছি। দ্বিতীয় সংশোধনী এবং মিলিশিয়া গ্রুপের উত্থান।

তাহলে তাই মিশেলকে ও আগেই দেখেছে।

প্রতি তিনমাসে, ইউনাইটেড স্টেটস-এ ডমেস্টিক টেররিস্ট অর্গানাইজেশনের ওপর কোয়ানটিকোডে ডিমোনাকো একটা করে সেমিনারে বক্তব্য রাখে। তার লেকচারে দেশের আরো মিলিশিয়া গ্রুপের মেক-আপ আউটলাইন, মেথড এবং ফিলোশোফি তুলে ধরে, গ্রুপগুলো যেমন প্যাট্রিয়টস, হোয়াইট অ্যারিয়ান রেজিস্টেন্স কিংবা রিপাবলিকান আর্মি অব টেক্সাস।

ওকলাহামা সিটিডে বোমা বিস্ফোরণ এবং টেক্সাসের আমারিলো কোলটেক্স নিউক্লিয়ার উইপনস ফেসিলিটি অরবোধ হওয়ার পর থেকে ডিমোনাকোর সেমিনারের চাহিদা বেয়ে যায়। বিশেষ করে আর্মড ফোর্সের ভেতর যাদের বেস এবং দালান ওইসব ডোমেস্টিক টেররিস্টদের আক্রমণে উৎসের মধ্যে থাকে।

তোমার জন্য কি করতে পারি, কমান্ডার মিশেল? ডিমোনাকে জিজ্ঞেস করল।

বেশ, প্রথমে, আপনার নিশ্চয়ই কোনো সন্দেহ নেই যে, এই ঘরে যা কিছু দেখবেন বা শুনবেন তা কঠোরভাবে ক্লাসিফাইড

আমাকে দিয়ে তুমি কি করাতে চাও?

 ডিমোনাকো এ ধরনের প্রতিশ্রুতিতে কথা না রাখায় বিখ্যাত।

গভীরভাবে শ্বাস নিল মিশেল। যা কিছু আপনি দেখছেন, একটা…ঘটনা…. ঘটেছে গতকাল সকালে। সতেরোজন সিকিউরিটি স্টাককে হত্যা করা হয়েছে এবং অস্ত্র লুট করা হয়েছে। এ কাজটা যে করেছে ডমেস্টিক টেররিস্ট অর্গানাইজেশনের একটি গ্রুপ তা বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ আছে, আর তাই আপনাকে ডেকে পাঠান।

 উনিই কি? উনিই কি? কোনো একজায়গা থেকে আওয়াজটা ভেসে এলো কশ গলায়।

ডিমোনাকো ঘুরে দেখল ধূসর বর্ণের গোঁফ এবং মাথার চুল ছোট করে ছাঁটা এক কঠিন চেহারার ক্যাপ্টেন এগিয়ে আসছে কমান্ডার মিশেলের দিকে।

ক্যাপ্টেন মিশেলের দিকে তাকিয়ে আছে। আমি আপনাকে আগেই বলেছি ওটা ছিল একটা ভুল। পুরোপুরি ভেতরকার ব্যাপার। এফবিআই-কে এখানে জড়ানোর কোনো প্রয়োজন আমাদের নেই।

 স্পেশাল এজেন্ট ডিমোনাকো, মিশেল বলল, আর সকল বিষয়ে তদন্তের দায়িত্বে আছেন–

কিন্তু কমান্ডার মিশেল, মনে হচ্ছে, শুনতে পেলাম এই ধাঁধার সমাধান যেন ধীরেসুস্থে হয়, আরোনসন সরস মন্তব্য করল।

 ডিমানাকো ভালো করে ভারনন আবোনসনকে পর্যবেক্ষণ করে বুঝতে পারল তার চেয়ে দুবছরের বড় হবে এবং তার অধস্তনঃ কমান্ডার মিশেলের চেয়ে এক যুগের বাজে ভাবে অভিজ্ঞ।

আমার কোনো উপায় নেই, স্যার, মিশেল বলল। প্রেসিডেন্ট ইনসিস্ট

প্রেসিডেন্ট ইনসিস্ট…. আরোনসন ফোঁস ফোঁস করে শ্বাস ফেলে বলল।

 বান্টিমোর ফ্রিওয়ে ঘটনা পুনরাবৃত্তি ঘটুক সেটা তিনি চাইছেন না।

 আহ, ডিমোনাকো ভাবল। তাহলে এই।

১৯৯৭ সালের ক্রিশমাসের দিন ডারপার চিহ্নহীন ট্রাক নিউইয়র্ক থেকে ভার্জিনিয়ায় আসার পথে বান্টিমোর বেল্টওয়েতে হাইজ্যাক হয়। ওই ট্রাক থেকে ষোলোটি জে-৭ নেট প্যাক এবং আটচল্লিশটা প্রোটোটাইপ এক্সপ্লোসিভ চার্জ–ছোট ক্রোম এবং প্লাস্টিক টিউব দেখতে অনেকটা ল্যাবরেটরির শিশির মতো, চুরি যায়।

কিন্তু ওগুলো সাধারণ কোনো এক্সপ্রোসিভ ছিল না। ওগুলোকে বলা হয়ে থাকে এম ২২ আইসোটেপ চার্জ, কিন্তু ডারপা-য় ওগুলোকে বলে থাকে পকেট ডাইনামো।

খুবই সাধারণ, পকেট ডাইনামো হল হাই-টেম্পারেচার লিকুইড কেমিক্যাল টেকনোলজির বিবর্তনমূলক অর্জন। ইউনাইটেড স্টেটস আর্মি এবং ডারপার এ্যাডভান্স অর্ডিন্যান্স ডিভিশনের ডেরের বছরের ঐকমত। শ্রমের ফল, এম-২২ ল্যাবরেটরিতে তৈরি ক্লোরিনের উপাদানের আইসোটোপ যা দুশ গজের বৃত্তের ভেতর যা কিছু আছে সবই এক বিস্ফোরণে নিশ্চিহ্ন করে ফেলতে পারে। এটা তৈরি করা হয়েছে ছোটখাটো স্যাবোটাজ কিংবা সার্চ এবং ডেস্ট্রেীয় মিশনে ব্যবহারের জন্য, যে মিশনে পেছনে ফেলে আসা সব কিছু নিশ্চিহ্ন করাই হল মূল উদ্দেশ। এম-২২-এর আইসোটোপিক বিস্ফোরণ থার্মোনিউক্লিয়ার বিস্ফোরণের মতো, কিন্তু আফটার-ইফেক্টে রেডিও অ্যাকটিভ থাকে না।

বান্টিমোর ফ্রিওয়ে ঘটনা ডিমোনাকো জানে, তাহল, আর্মিই তদন্তের ভার নিজেদের কাঁধে নিয়েছে।

দুঃসাহসিক এই ডাকাতির দুদিন পর আর্মির তদন্তকারী আভাস পান চুরি যাওয়া অস্ত্রগুলোর অবস্থান এবং এফ বি আই আর সি আই এর সাথে তেমন কোনো আলোচনা না করে, এক স্কোয়াড গ্রিন বেরেট পাঠান হয় উত্তর আইডাহোয় অবস্থানরত আন্ডারগ্রাউন্ড মিলিশিয়া গ্রুপের হেডকোয়ার্টারে ঝাঁপিয়ে পড়তে। দশজন মারা যায় সেই ঘটনায়, বারো জন আহত হয়। পরে জানায় যায় গ্রুপটা ভুল ছিল। আসলে, দেখা গেল বিপজ্জনক নয় এমন প্যারামিলিটারি গ্রুপ রয়েছে আশেপাশে, অনেকটা টেররিস্ট সেলের চেয়ে গান ক্লাব হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তাদের ঘরে কোনো আইসোটোপ এক্সপ্লোসিভ পাওয়া গেল না। এসিএলইউ এবং এনআরএ-র ছিল কার্য দিবস।

 জেট প্যাক এবং এম-২২ আর পাওয়া গেল না। স্পষ্টত প্রতীয়মান হয় যে, ডিমোনাকো মনে মনে ভাবল, প্রেসিডেন্ট এখানে আরেকটি লজ্জাজনক পরিণতি চান না। এই কারণেই তাকে এখানে ডেকে আনা হয়েছে।

তো, আমাকে কি দেখাতে চাইছেন আপনি? জিজ্ঞেস করল সে।

এটা, কিছু একটা পকেট থেকে বের করে ডিমোনাকোর হাতে তুলে দিল।

ওটা একটা পরিষ্কার এভিডেন্স ব্যাগ।

ভেতরে ছিল একটা রক্ত লাগা বুলেট।

কাছেই একটা টেবিলে বসে ডিমোনাকো রক্ত লাগা বুলেটটা পরীক্ষা করতে লেগে গেল।

কোথা থেকে এটা আনা হয়েছে, সিকিউরিটিদের শরীর থেকে?

না, মিশেল বলল। ডেলিভারি ভ্যানের ড্রাইভারের শরীর থেকে, যে ডেলিভারি ভ্যানটা ঢোকার চেষ্টা করেছিল। একমাত্র তাকেই পিস্তলের গুলিতে হত্যা করা হয়েছে।

ক্যাপ্টেন অ্যারোনসন আরো যোগ করল, ওরা গ্যারেজ গার্ডদের অতিক্রম করার জন্য ওকে ব্যবহার করে, মাথা বরাবর পয়েন্ট-ব্ল্যাঙ্ক র‍্যাঞ্জে গুলি করা হয়।

কলিং কার্ড, ডিমোনাকো বলল।

 উহ-হু।

টাভস্টেন কোরের মতো… ডিমোনাকো মনোযোগ দিয়ে বুলেটটাকে দেখতে দেখতে বলল।

আমরাও তাই ভেবেছি, অ্যারোনসন বলল। এবং আমরা এও জানি, ইউনাইটেড স্টেটস-এ একটি মাত্র টেররিস্ট অর্গানাইজেশন টাঙস্টেনের তৈরি গোলাবারুদ ব্যবহার করে। ওকলাহামা ফ্রিডম ফাইটার।

হাতে ধরা বুলেটটা থেকে চোখ সরাল না ডিমোনাকো। তা ঠিক, তবে ফ্রিডম ফাইটাররা–

–জানা আছে এমন ধরনের কাজ করে থাকে, অ্যারোনসন বাধা দিয়ে বলল। স্পেশাল ফোর্সের মতো ঢোকা, ভিকটিমের মাথায় দুবার টোকা, মিলিটারি টেকনোলজির চুরি।

মনে হচ্ছে আপনি আমার যে কোনো একটি সেমিনারে গিয়েছিলেন, ক্যাপ্টেন অ্যারোনসন, ডিমোনাকো বলল।

হ্যাঁ, আমি গিয়েছি, অ্যারোনসন বলল, তবে আমি এ ধরনের ফিল্ডে নিজেকে বিশেষজ্ঞ মনে করি। নেভাল সিকিউরিটি আপগ্রেডের জন্য এ ধরনের গ্রুপদের নিয়ে পড়াশোনা করেছি। আপনি জানেন হয়তো, এ ধরনের গ্রুপের ওপর আমরা চোখ রেখেছি।

তাহলে তো আপনি জানেন যে ফ্রিডম ফাইটাররা টেক্সানদের সাথে জমি নিয়ে যুদ্ধে লিপ্ত আছে, ডিমোনাকো বলল।

অ্যারোনাস ঠোঁট কামড়ে ভ্রু কুঁচকাল। সে এই ব্যাপারটার কিছুই জানে না। তীক্ষ্ণ চোখে ডিমোনাকোর দিকে তাকাল, জবাব দেওয়া থেকে বিরত থাকল।

 ডিমোনাকো তার হর্ম-রিমন্ড গ্লাসের আড়াল থেকে দুই নেভাল অফিসারের দিকে তাকাল। ওরা দুজনই কিছু লুকোচ্ছে তার কাছে।

জেন্টলম্যান। এখানে কি ঘটেছে?

অ্যারোনসন এবং মিশেল দৃষ্টি বিনিময় করল।

কি বলতে চাইছেন আপনি? মিশেল জিজ্ঞেস করল।

আমি আপনাদের সাহায্য করতে পারি না যতক্ষণ পর্যন্ত না জানতে পারছি এখানে কি ঘটেছে। কি চুরি গেছে।

অ্যারোনসন মুখ বিকৃত করল। তারপর বলল, ওরা সুপারনোভা নামে একটা ডিভাইসের পেছনে ছুটে বেড়াচ্ছে। জানে কোথায় গেলে পাওয়া যাবে। ওরা সবগুলো কোড জানে, তাদের কাছে আছে সবগুলো কার্ড কী। ওরা নির্ভুলভাবে এবং দ্রুততার সাথে চলাফেরা করেছে অনেকটা কমান্ডো স্টাইলে।

 ডিমোনাকো বলল, ফ্রিডম ফাইটারদের আক্রমণকারী দলটা ভালো তবে এই ধরনের বড় জায়গায় অপারেশন চালানোর ক্ষমতা নেই। খুবই ছোট দল, সম্ভবত দুই কিংবা তিনজন মানুষ এসেছিল। তাই তারা আক্রমণ করেছে সট টার্গেটে– কম্পিউটার ল্যাব, লো-লেভেল সরকারী অফিস–যে সব জায়গা থেকে ওরা খুব সহজেই টেকনিক্যাল ডাটা যেমন ইলেকট্রিক্যাল শিমেটিক্স কিংবা স্যাটেলাইট ওভারপাশ সময়। কিন্তু সবচাইতে জরুরি হল, ওরা আক্রমণ করেছে এমন জায়গায় যেখানে গার্ডের সংখ্যা ছিল কম। এমন কোনো দুর্গ নয়। ওরা প্রথম এবং প্রধানতম টেকনো-নাটস, ফুল-ফ্রন্টাল অ্যাজল্ট স্কোয়ার্ড নয়।

 কিন্তু এরাই একমাত্র গ্রুপ যারা জানে টাঙস্টেনের তৈরি গোলাবারুদ ব্যবহার করতে, অ্যারোনসন বলল।

তা ঠিক।

তাই তারা হয়তো তাদের অপারেশন বৃদ্ধি করেছে, অ্যারোনসন বলল আত্মতৃপ্তির সাথে। হয়তো তারা বড় কোনো কিছু করার জন্য ঝাঁপ দিয়েছিল।

সম্ভবত।

এটা সম্ভবত, অ্যারনসন ঘঘাত ঘোত করে বলল। স্পেশাল এজেন্ট ডিমোনাকো, আমি কিছু কিছু পরিষ্কার বুঝতে পারিনি। যে ডিভাইসটা এখান থেকে চুরি গেছে সেটা ইউনাইটেড স্টেটসের ভবিষ্যত প্রতিরক্ষার কাজে ব্যবহার করা হত। ভুল হাতে পড়লে বিপর্যয় নেমে আসবে। এখন সিল টিম অপেক্ষায় আছে। ফ্রিডম ফাইটারদের তিনটি জায়গায় আক্রমণ করার জন্য। কিন্তু আমার ঊর্ধ্বতনরা জানতে চাচ্ছেন ব্যাপারটা সঠিকভাবে করা হয়েছে। তারা আরেকটি বান্টিমোর চাচ্ছেন না। আমরা আপনার কাছে স্বীকৃতি চাইছি যে এই ডাকাতিটা ওরাই করেছে।

বেশ…. ডিমোনাকো শুরু করল।

আসলে এটা নির্ভর করছে টাঙস্টেন বুলেটের ওপর। তবে কিছু ঘটনার জন্য ডিমোনাকো তার আঙ্গুল দিয়ে ছুঁয়ে দেখছে না, তার সমস্যা হতে পারে….

 এজেন্ট ডিমোনাকো, অ্যারোনসন বলল, আমাকে নমুনাটা দিন। আপনার জ্ঞান অনুযায়ী, ওকলাহামা ফ্রিডম ফাইটার ছাড়াও ইউনাইটেড স্টেটসে কোনো প্যারামিলিটারি গ্রুপ আছে যারা টাঙস্টেনের তৈরি গোলাবারুদ ব্যবহার করে?

না, ডিমোনাকো বলল।

ধন্যবাদ।

এবং এরপরেও অ্যারোনসন, ডিমোনাকো আর মিশেলের দিকে একটা শুকনো দৃষ্টিতে তাকাল তারপর হেঁটে গেল কাছের টেলিফোনের দিকে, একটা নাম্বারে ডায়াল করে বলল, অ্যারনসন বলছি। অ্যাসল্ট অপারেশন শুরু করো। আবার বলছি। অ্যাসল্ট অপারেশন শুরু করো। ওই বেজন্মাদের শুইয়ে দাও।

.

দিনের আলো ফুটতে শুরু করেছে।

 জেগে উঠে রেস দেখল এটিভির দেয়ালে হেলান দিয়ে রয়েছে। মাথাব্যথাটা আরো বেড়েছে কাপড়চোপড় এখনো ভেজা।

এটিভির পাশের স্লাইডিং দরজা খোলা। বাইরে কথাবার্তার আওয়াজ শুনতে পেল।

আপনারা এখানে কি করছেন?

 আমার নাম মার্ক গ্রাফ এবং আমি একজন ফলশ্রিমটুপেন-এর লেফটেন্যান্ট

 জায়গা থেকে উঠে বাইরে বেরিয়ে এলো রেস।

সকাল হয়েছে এবং গ্রামটা ঢাকা পড়ে আছে কুয়াশার পাতলা চাদরে। এটিভি এখন মূল সড়কের মাঝখানে পার্ক করা, বিরাট আর্মারড ভেহিকল থেকে বেরিয়ে আসার পর চারদিকে কুয়াশার ধূসর দেয়াল দেখে কয়েক সেকেন্ড দিশেহারা বোধ করল ও, তারপর ধীরে ধীরে ভিলকাফোরের মূল সড়ক পরিচিত মনে হল।

 স্থির হয়ে গেল রেস।

 রাস্তাটা সম্পূর্ণ খালি।

কাল রাতের ক্ষতবিক্ষত দেহগুলো অদৃশ্য হয়েছে। সেগুলোর বদলে কাদার ছোটবড় স্তূপ আর পানি ভর্তি গর্ত দেখা যাচ্ছে।

অদৃশ্য হয়ে গেছে কালো বিড়ালগুলো যেগুলোকে সে দেখেছিল।

দেখল ন্যাশ, লরেন এবং কোপল্যান্ড ওর বাঁ দিকে দুর্গের কাছে দাঁড়িয়ে রয়েছে। কাছাকাছি রয়েছে ছয়জন গ্রিন বেরেট, তাদের সঙ্গে গ্যাবি লোপেজকে দেখা যাচ্ছে।

ওদের পাশে আরো পাঁচজন দাঁড়িয়ে আছে।

চারজন পুরুষ, একজন মেয়ে।

বুঝল, এরা বেঁচে যাওয়া জার্মান।

তাদের মধ্যে দুজন জার্মান মিলিটারি ফেটিগ পরে আছে–সৈনিক। বাকি সবার পরনে সিভিল ড্রেস, এদের মধ্যে দুজনকে, এক তরুণ আর এক তরুণী দেখে আন্ডারকাভার পুলিশ মনে হচ্ছে। প্রত্যেকে অস্ত্র ছাড়া।

রেসকে দেখতে পেয়ে এগিয়ে এলো সার্জেন্ট ভ্যান লিওয়েন।

আপনার মাথার অবস্থা কেমন?

যাচ্ছেতাই, বলল রেস। এখানকার খবর কী?

ভ্যান লিওয়েন পাঁচজন জার্মানকে ইশারায় দেখাল। ওরা সে রাতে বেঁচে ফিরে আসতে পেরেছে। দুজন এটিভিতে ঝাঁপিয়ে পরে ঢুকে আমাদের বন্ধন মুক্ত করেছে। আমরা অন্য তিনজনকে ভোলা সহ আপনাকে জেটি থেকে তুলেছি।

মাথা ঝাঁকাল রেস।

তারপর সরাসরি তার চোখে চোখ রেখে বলল, আমার একটা প্রশ্ন আছে, তোমার জন্য।

ইয়েস?

হামভির ভেতরে রাবারের বাটনের কথা তুমি জানলে কি করে, জার্মানরা বন্ধ করে দেওয়ার পরই ওটা স্টার্ট হয়ে যায়।

ভ্যান লিওয়েন ওর দিকে তাকিয়ে হাসল। আমি যদি বলে দেই তাহলে আপনাকে আমি হত্যা করব।

 ঠিক আছে, তাই করো।

দাঁত বের করে হাসল ভ্যান লিওয়েন। তারপর সে বলল, সারা পৃথিবীতে আমর্ড ফোর্সদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় হামভি এবং এটিভি মতো ফিল্ড ভেহিকলগুলোকে পোর্টেবল প্রিজন হিসেবে ব্যবহারের জন্য। আপনি বন্দীদের গাড়ির ভেতর ঢুকিয়ে বাইরে থেকে লক করে দিন, ব্যস বন্দী হয়ে যাবে।

 সারা পৃথিবীতে ইউনাইটেড স্টেটস ফিল্ড ভেহিকল সরবরাহে প্রথম সারিতে আছে। হামভি, উদাহরণ স্বরূপ, ইন্ডিয়ানার সাউথ ব্যান্ডে এএম জেনারেল কোম্পানীতে তৈরি হয়।

এই জিনিসটা অনেকেই জানে না, আমেরিকার তৈরি ফিল্ড ভেহিকলে একটা সেফটি রিলিজ বাটন থাকে, ওই বাটনটার কাজ হল যেখানে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল ঠিক সেখান থেকে স্টার্ট নিবে। থিওরিটা হল এই যে কোনো ইউএস ভেহিকলে আমেরিকান কাউকে বন্দী করে রাখা যাবে না। এরপরেও একমাত্র ইউএস মিলিটারিদের জানান হয় যে ওই সেফটি বাটনটা কোথায় থাকে। ওটা একটা ট্র্যাপ ডোর, জানে শুধু আমেরিকার সৈন্যরা।

এই বলে ভ্যান লিওয়েন ওর দিকে একটা হাসি উপহার দিয়ে দ্রুত এগিয়ে গেল দুর্গে অন্যদের সঙ্গে যোগ দিতে। রেস-ও তার পিছু নিল।

ও এবং ভ্যান লিওয়েন অন্যদের সাথে দুর্গে মিলিত হল।

ওরা আসার পর দেখতে পেল দুর্গের সামনে দাঁড়িয়ে নিরস্ত্র এক জার্মানের সঙ্গে কথা বলছে ফ্রাঙ্ক ন্যাশ। এই লোকটিকেই নিজের নাম বলতে শুনেছে রেস, ফলশ্রিমট্রপেন-এর একজন লেফটেন্যান্ট।

তা হলে আপনিও আইডলটা পাবার আশাতেই এখানে এসেছেন? জানতে চাইল ন্যাশ।

মাথা নাড়ল গ্রাফ।

ডিটেলে কিছু আমি জানি না, বলল সে। আমি সামান্য একজন লেফটেনান্ট, মিশনের সবটুকু আমার জানা নেই।

অন্য একজন জার্মানের দিকে ইশারা করল সে। আপনি মিস্টার কার্ল শ্রোয়েডারের সঙ্গে কথা বলে দেখতে পারেন। মিস্টার শ্রোয়েডার হলেন বুন্ডেসমিনালাস্ট-র একজন স্পেশাল এজেন্ট। বান্ডেসওয়ের এই মিশনে বিকেএ র সাথে সংযোগ সৃষ্টি করছে।

বিকেএ? ন্যাশকে বিস্মিত দেখাল।

বুন্ডেসকিমিনালস্ট যুক্তরাষ্ট্রের এফবিআই-এর মতো কিংবদন্তি খ্যাতি আছে। মাঝেমধ্যে বলা হয় বিশ্বের সবচাইতে ভালো ফেডারেল ইনভেস্টিগেট ব্যুরো। কিন্তু, এখন ওটা নির্ভেজাল একটা পুলিশ ফোর্স, যা ন্যাশকে কনফিউজ করে দিচ্ছে। ওটার তো একটা আইডলের খোঁজে পেরুতে চলে আসার কথা নয়।

হারানো একটা ইনকান আইডলের সঙ্গে বিকেএ-র কী সম্পর্ক? শ্রোয়েডারকে জিজ্ঞেস করলেন তিনি।

এক মুহূর্ত চিন্তা করল শ্রোয়েডার, যেন সিদ্ধান্ত নিচ্ছে ন্যাশকে কতটুকু জানান যায়। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে–বোধ হয় ভাবছে, কাল রাতে হত্যাযজ্ঞের কথা।

আপনি যা ভাবছেন ব্যাপারটা আসলে তা নয়, বলল সে।

 কি বলতে চাইছেন?

আইডলটা আমরা অস্ত্র তৈরির জন্যে চাইছি না, সরাসরি বলল শ্রোয়েডার। আসলে আপনারা যা ভাবছেন তা নয়, আমার দেশের কোনো সুপারনোভাও নেই।

তা হলে আইডলটা কেন আপনাদের দরকার?

আমাদের প্রয়োজন খুবই সাধারণ, জবাব দিল শ্রোয়েডার, অন্য কেউ পাওয়ার আগে ওটা আমাদের পেতে হবে।

কারা? জানতে চাইলেন ন্যাশ।

যারা পিরানিজের মঠে সন্ন্যাসীদের হত্যা করল, বলল শ্রোয়েডার। যারা কিডন্যাপ করার পর খুন করল অ্যাকাডেমিক আলবার্ট মুলারকে, গত বছরের শেষ দিকে পেরুর উল্কা সম্পর্কে তাঁর লেখাটা ছাপা হবার পর।

ওরা কারা।

একটি টেররিস্ট অর্গনাইজেশন যারা নিজেদেরকে শূটজস্টাফেল টটেনকপভারবান্ডে বলছে–এসএস বাহিনীর সবচেয়ে নিষ্ঠুর ডেথ হেড ডিটাচমেন্ট। হিটলারের এসএস বাহিনীর সবচেয়ে নিষ্ঠুর ইউনিট, যে-সব সৈন্যরা দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় নাৎসি কনসেনট্রেশন ক্যাম্প চালাত। নিজেদের স্ট্রমটুপার বলে থাকে।

স্টর্মস্ট্রুপার? লরেন জিজ্ঞেস করল।

ওরা জার্মানির এলিট প্যারামিলিটারি ফোর্স যারা আস্তানা গেড়েছে চিলির কলোনিয়া অ্যালমানিয়ায়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের শেষ দিকে এক্স-আউৎসউইজ লেফটেন্যান্ট ওডিলো হেরহার্ডট এদেরকে গঠন করে।

 আউৎসউইজ ক্যাম্প বেঁচে আসা মানুষদের কাছে জানা গেছে, হেরহার্ডট একজন সাইকোপ্যাথ, মানুষ খুন করে মজা পায়। স্পষ্টতই রুডলফ হস, আফসউইজের কমান্ডেন্ট তাকে খুব পছন্দ করতেন, যুদ্ধের শেষ বছরগুলোতে অভিভাবকহীনের মতো লালন করতে থাকে। বাইশ বছর বয়সে হেরহার্ডট এসএস ফোর্সের ওবারস্টার্ম ফুয়েরার কিংবা লেফটেন্যান্ট পদে উন্নীত হয়। এরপর, যদি হস তার দিকে নির্দেশ করে, এর এক সেকেন্ড পরে আপনি হেরহার্ডটের পি-৩৮ এর ব্যারেলের মুখোমুখি হবেন।

রেস ঢোক গিলল।

শ্রোয়েডার বলে যেতে লাগল। আমাদের রেকর্ড অনুযায়ী, হেরহার্ডটের বয়স হল উনআশি বছর। কিন্তু স্টর্মস্ট্রুপার অর্গানাইজেশনে, তার কথাই হল আইন। তার র‍্যাঙ্ক হল এসএস ওবারস্টগ্রুপেনফুয়েরার জেনারেল।

 স্টর্মস্ট্রুপার হল এককভাবে একটি ঘৃণ্য দল, শ্রোয়েডার বলল। ওরা প্রবলভাবে সমর্থন করে সকল নিগ্রো এবং ইহুদিদের হত্যা, সারা পৃথিবীতে গণতান্ত্রিক সরকার ধ্বংসকারী এবং সবচেয়ে বেশি জরুরি ব্যাপার হল, জার্মানিতে একটি নাজি সরকার পুনঃস্থাপন করা এবং হেরেনভক দৌড়ে সামিল হবে যাতে পৃথিবীটা শাসন করতে পারে।

 জার্মানিতে একটি নাজি সরকারকে বসান? প্রতিষ্ঠানিকভাবে পৃথিবীটাকে শাসন করবে? কোপল্যান্ড অবিশ্বাস্য গলায় বলল।

এক সেকেন্ড, রেস বলল। আপনি নাজি সম্পর্কে বলছেন। এই নব্বই দশকে।

হ্যাঁ, শ্রোয়েডার বলল। নাজি। মর্ডান-ডে নাজি।

ফ্রাঙ্ক ন্যাশ বলল, কোলোনিয়া অ্যালামেনিয়াকে মনে করা হত প্রাক্তন নাজি অফিসারদের স্বর্গরাজ্য। ষাট দশকের দিকে আইলার সেখানে কয়েকদিন থেকেছিল। আইখম্যানও।

মাথা ঝাঁকাল শ্রোয়েডার। কালোনিয়া, অ্যালামানিয়ায় ঘেসো জমি, লেক, বাভারিয়ান স্টাইলের বাড়ি-ঘর সবই আছে, গোটা এলাকাটা কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘেরা, গার্ড টাওয়ার থেকে নজরদারির ব্যবস্থা আছে, চব্বিশ ঘণ্টা টহল দেয় সশস্ত্র গার্ডরা, সঙ্গে থাকে ডোবারম্যান পিনশার।

বলা হয়ে থাকে পিনাশের আমলে, সরকারের কাছ থেকে প্রোটেকশন পাওয়ার বিনিময়ে, কলোনিয়া অ্যালমানিয়াকে ডিক্টেটরের আনঅফিশিয়াল টরচার সেন্টার হিসেবে ব্যবহার করার সুযোগ করে দিয়েছিল হেরহার্ডট। মানুষকে এখানে পাঠান হত অদৃশ্য করে দেয়ার জন্যে। হেরহার্ডট এবং তার নাজি কলোনি তল্লাশির বিকেএ-র মতো বিদেশী সংস্কার হাত থেকে বাঁচিয়ে রেখেছিল মিলিটারি সরকার।

ঠিক আছে, বুঝলাম, বলল ন্যাশ। কিন্তু ওরা এর ভেতরে ঢুকল কি করে?

দেখুন, হের ন্যাশ, ওটাই হল সমস্যা, শ্রোয়েডার বলল। স্টর্মস্ট্রুপারের কাছে একটা সুপারনোভা আছে।

স্টর্মস্ট্রুপারের কাছে একটা সুপারনোভা আছে? যেন আকাশ থেকে পড়লেন লয়েড।

হ্যাঁ।

জিসাস…

 হের ন্যাশ, প্লিজ। আপনাকে বুঝতে হবে। আমি বিশ বছর ধরে কাউন্টার টেরোরিস্ট কাজের সঙ্গে জড়িত, কিন্তু স্টর্মস্ট্রুপারের মতো কোনো গ্রুপের দেখা পাইনি। এদের ফাইনান্স ভালো, সংগঠন ভালো, এরা ঐতিহ্যের প্রতি নিবেদিত, আর নিষ্ঠুরতার দিক থেকে রুথলেস।

দুধরনের লোককে নিয়ে দলটাকে নতুন করে গড়া হয়েছে–সৈনিক আর বিজ্ঞানী। কোনো অপরাধ করার কারণে বান্ডেসওয়ের থেকে যখনই কোনো জার্মান সৈন্যকে বের করে দেয়া হয়েছে, সঙ্গে সঙ্গে তাকে দলে টেনে নিয়েছে। হেনরিক অ্যানিসটাজের দলকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে আর্ট অব টেরর, টর্চার এবং গুপ্তহত্যার।

 অ্যানিসটাজ কি একজন স্টর্মস্ট্রুপার? ন্যাশ বলল। আমার একটা অস্পষ্ট ধারণা আছে যে সে জার্মান ইন্টেলিজেন্সে কাজ।

আর পারেনি, শ্রোয়েডার বলল তিক্ত গলায়। ইস্টার্ন ব্লক ধসে পড়ার পর, অ্যানিসটাজ চুক্তি ভিত্তিতে জার্মান সরকার নিয়ে আসে নির্দিষ্ট সমস্যা দেখভাল করার জন্য। তবে এটা আমাদের বাধায় দৃষ্টিগোচর না হওয়ায় যথেষ্ট।

অ্যানিসটাজ এক মার্শিনারি, একজন ভাড়াটে খুনী। এটা ঠিক যে অন্য কারো অফারের তুলনায় আমাদের পারিশ্রমিকটা বেশি ছিল এবং সে দুপক্ষেরই অফিসারের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে তাদের শত্রু বানিয়ে ফেলে।

আমাদের কাছে এটা কোনো সারপ্রাইজ হিসেবে আসেনি, ঘটনা ঘটনায়। স্টর্মস্ট্রুপার হিসেবে অ্যানিসটাজের ট্যাঙ্ক দ্রুত উপরের দিকে উঠতে থাকে। আমাদের বিশ্বাস সে এখন ওয়াবগ্রুপেনফুয়েয়ার। একজন লেফটেন্যান্ট জেনারেল। হেরহার্ডটের পরের স্থান।

সান অব এ বিচ…।

বিজ্ঞানীদের ব্যাপারেও, শ্রোয়েডার কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, একই তত্ত্ব প্রয়োগ করা হয়। স্টর্মস্ট্রুপার প্রলোভিত করে উচ্চশিক্ষিত পুরুষ এবং মহিলাদের যারা প্রজেক্ট নিয়ে কাজ করে যা মডার্ন জার্মানিতে দেখা যায় না।

উদাহরণস্বরূপ যখন দেয়াল ভেঙ্গে পড়ল, পূর্ব জার্মানীর বিজ্ঞানীরা এনএ গ্রেনেড তৈরি করল, নাইট্রিক এসিড পূর্ণ গ্রেনেড ভয়াবহভাবে আহত হবে তবে আঘাতপ্রাপ্ত মারা যাবে না, পরে কোনো কাজ খুঁজে পাবে না। স্টর্মস্ট্রুপাররা সব সময় ওই ধরনের লোক খুঁজে বেড়ায় এবং তারা ভালো পারিশ্রমিকই দেয় তাদেরকে।

কিভাবে? কোপল্যান্ড জিজ্ঞেস করল। এত টাকা এরা পায় কোত্থেকে?

ডক্টর কোপল্যান্ড, আধুনিক নাজিদের টাকার কোনো অভাব নেই। ১৯৯৪ সালে বিকেএ সুইস ব্যাঙ্কের একটা অ্যাকাউন্টের কথা জানতে পেরেছিল, সন্দেহ হয়েছিল সেটা স্টর্মস্ট্রুপারের হতে পারে, তাতে জমা ছিল প্রায় অর্ধ বিলিয়ন মার্কিন ডলার–দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় লুঠ করা আর্টিফ্যাক্ট বিক্রি করে এরচেয়ে অনেক বেশি টাকা পেয়েছে ওরা।

 অর্ধ বিলিয়ন ডলার, নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে বলল রেস।

জেন্টেলম্যান, শ্রোয়েডার বলল, এই স্টর্মস্ট্রুপাররা প্লেন হাইজ্যাক করে না। তারা ফেডারেল অফিসিয়ালদের খুন করে না, বোমা মেরে উড়িয়ে দেয় না ফেডারেল বিল্ডিং। তাদের লক্ষ্য আরো অনেক বড় ধরনের বিজয়, যে বিজয় গোটা পৃথিবীর শাসন ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ পাল্টে দেবে।

 আর এখন আপনার ধারণা তাদের কাছে একটা সুপারনোভা আছে? ন্যাশ বলল।

তিনদিন আগে পর্যন্ত অপ্রমাণিত সন্দেহ ছিল আমাদের, বলল স্রোয়েড়ার। তবে এখন আমরা ব্যাপারটা নিশ্চিতভাবে জানি। মাস ছয়েক আগে বিকেএ-র সার্ভেইলান্স এজেন্টরা চিলিতে গিয়ে কলোনিয়া অ্যালমানিয়ার ছবি তোলে, তাতে ওডিলো হেরহার্ডটের সঙ্গে এক লোককে হাঁটতে দেখা গেছে। পরে তাকে ডক্টর ফ্রিৎজ ওয়েবার বলে চিহ্নিত করা হয়। হের ন্যাশ, আপনি নিশ্চয়ই জানেন কে এই ডক্টর ওয়েবার।

 হ্যাঁ, কিন্তু, ভুরু কুঁচকে একটু থামল। ফ্রিৎজ ওয়েবার জার্মান বিজ্ঞানী, স্নায়ুযুদ্ধের সময় পেন্টাগনের একটা প্রজেক্টে কাজ করত, পরমাণু বিজ্ঞানী, জিনিয়াস, কিন্তু সাইকোপ্যাথ। তিনি অন্যতমদের মধ্যে প্রথম বলেন যে পৃথিবী ধ্বংস করার ডিভাইস বানান সম্ভব। ১৯৯৪ সালে যখন তার বয়স তিরিশ, তিনি তখন নাজি এ্যাটমিক বোম্ব প্রজেক্টে ছিলেন। কিন্তু এরপর এটা বলা হয়েছে যে ওয়েবার অজনপ্রিয় নাজিদের জন্য টর্চার এ্যাক্সপেরিমেন্টে ব্যস্ত: ওরা একজন মানুষকে বরফ ঠাণ্ডা পানিতে ডুবিয়ে দিয়ে মনিটরিং করত কতক্ষণ সে বেঁচে থাকে। কিন্তু আমি জানতাম যুদ্ধের পর ওয়েবারকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে…

 শ্রোয়েডার মাথা ঝাঁকাল। তাই ছিল। ডক্টর ফ্রিজ ওয়েবার ১৯৪৫ সালের অক্টোবর মাসে নুরেনবার্গ এক আদালতে মানবতার বিরুদ্ধে ক্রাইম করাতে বিচার করা হয়। অপরাধ প্রমাণিত হওয়াতে বিচারে ফাঁসির আদেশ হয়। ১৯৪৫ সালের বাইশ নভেম্বর তার কার্লসবার্গ জেলখানায় ফাঁসি কার্যকরীও করা হয়। তবে সত্যি সত্যি তার ফাঁসি দেওয়া হয়েছে কিনা তা নিয়ে বহু বছর বির্তক ছিল। কারণ পরে অনেক লোক পুরো দশক ধরে তাকে দেখেছে বলে দাবি করেছে, আয়ারল্যান্ডে, ব্রাজিলে আর রাশিয়ায়।

শ্রোয়েডার গম্ভীর গলায় বলল, আমাদের বিশ্বাস যে সোভিয়েতরা ওয়েবারকে উৎসাহীত করেছে ফাঁসির রাতে তাকে কার্লসবার্গ থেকে বের করে নিয়ে আসতে, তার জায়গায় অন্য একজনকে ঢুকিয়ে দিয়ে। জীবন বাঁচানোর বিনিময়ে সোভিয়েতরা তাকে দিয়ে নিজেদের পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি প্রোগ্রামের কাজে লাগায়। কিন্তু ১৯৯১ সালে যখন সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন হল, বিকেএ ওয়েবারে খোঁজ শুরু করল, কোথাও কোনো খোঁজ পাওয়া গেল না। পৃথিবী থেকে যেন উধাও হয়ে গেছে।

ভেঙ্গে পড়ার মাত্র আট বছর পর একটা নাৎসি টেরোরিস্ট অর্গানাইজেশনের উদয় হয়, যোগ করল ন্যাশ।

কারেক্ট। কাজেই ওই পর্যায়ে আমরা ধরে নিয়েছিলাম নাজিরা সম্ভবত ছোটখাট একটা কনভেনশনাল নিউক্লিয়ার ডিভাইস বানাচ্ছে। কিন্তু ফ্রেঞ্চ পিরানিজ মঠে সন্ন্যাসীদের খুন করে স্টর্মস্ট্রুপাররা যখন কিংবদন্তী সান্টিয়াগো ম্যানুস্ক্রিপ্ট নিয়ে গেল, বলল শ্রোয়েডার। যখন জানা গেল ম্যানুস্ক্রিপ্টে আশ্চর্য একটা আইডলের কথা বলা হয়েছে, তখন এই দুটো বিষয়কে তৃতীয় একটা ঘটনার সঙ্গে এক করে দেখার সুযোগ সৃষ্টি হলো পেরুতে আলবার্ট মুলারের আবিষ্কার করার উল্কার গর্ত, হঠাৎ করেই আমাদের সন্দেহ বাস্তব চেহারা পেয়ে গেল। হয়তো ওয়েবারের তত্ত্বাবধানে স্টর্মস্ট্রুপাররা স্রেফ প্রচলিত একটা নিউক্লিয়ার বোমা বানাচ্ছে না, হয়তো একটা সুপারনোভা তৈরি করতে পেরেছে ওরা, আর সেজন্যেই তাদের থাইরিয়াম দরকার।

 এবং তারপর, তিনদিন আগে, যেদিন ফ্রেঞ্চ পিরানিজে হামলা হল, চিলিতে আমাদের সার্ভেইলান্স টিম এটা পিক করে।

বুক-পকেট থেকে ভাঁজ করা একটা কাগজ বের করে ন্যাশের দিকে বাড়িয়ে ধরল স্রোয়েডার। তিনদিন আগে পেরুর কোথাও থেকে একটা সেলুলার ফোনের মাধ্যমে যোগাযোগ করা হয়েছিল কলোনিয়া অ্যালমানিয়ার মেইন ল্যাবের সঙ্গে।

ন্যাশ জার্মান ট্রান্সক্রিপ্টটা রেসের দিকে এগিয়ে দিল, রেস অনুবাদ করে শোনাল।

কণ্ঠ ১… থেকে প্রাথমিক অপারেশন চালাতে হবে… বাকিটা…আমার।

কণ্ঠ ২… ডিভাইস সম্পর্কে…রেডি?

কণ্ঠ ১… আমেরিকান মডেলের ওপর ভিত্তি করে আওয়ারগ্লাস ফরমেশন অ্যাডাল্ট করা হয়েছে…একটা টাইটেনিয়াম অ্যালয় ইনার চেম্বারের ওপর ও নিচে বসান হয়েছে দুটো থার্মোনিউক্লিয়ার ডিটোনেটর। ফিল্ড টেস্ট আভাস দিচ্ছে যে… ডিভাইসটা… অপারেশনাল। এখন শুধু আমাদের দরকার…আইরিয়াম।

 কণ্ঠ ২… চিন্তার কিছু নেই, অ্যানিসটাজ ওদিকটা দেখছে…

কণ্ঠ ১… মেসেজটার ব্যাপারে?

কণ্ঠ ২… আইডলটা পাওয়া মাত্র পাঠান শুরু করে দেব…ইইউ-এর সকল প্রধানমন্ত্রী আর প্রেসিডেন্টের আরো একই সঙ্গে ইন্টারনাল ইমার্জেন্সি হটলাইন-এর সাহায্যে মার্কিন প্রেসিডেন্টের কাছেও… মুক্তিপণ চাওয়া হবে…একশো বিলিয়ন মার্কিন ডলার… নয়তো আমরা ডিভাইসটা ডিটোনেট করব…

ন্যাশ কাগজটার দিকে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল।

সবাই চুপ হয়ে গেছে।

দুটো লাইন রেসের মাথায় ঢুকে গেল: একশো বিলিয়ন মার্কিন ডলার, নয়তো আমরা ডিভাইসটা ডিটোনেট করব।

জিসাস এইচ ক্রাইস্ট।

শ্রোয়েডারের দিকে ফিরল ন্যাশ। তা এ-সব বিষয়ে কী ব্যবস্থা নিয়েছেন আপনারা?

 দু ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে, জার্মান বলল। দুটো আলাদা মিশন, প্রতিটি পরিকল্পনা করা হয়েছে যদি একটি দল ব্যর্থ হয় তাহলে অন্য দলটি যোগান দিবে।

মিশন এক হল, নাজিদের আগে থাইরিয়ামের পুতুলটা উদ্ধার করা, তা করার জন্যে সান্টিয়াগো ম্যানুস্ক্রিপ্টের একটা কপি সংগ্রহ করেছি ওটাই পথ দেখিয়ে এখানে নিয়ে এসেছে আমাদেরকে। স্টর্মস্ট্রুপারদের আগে পৌঁছেছি আমরা, কিন্তু আমরা ভাবিনি টেম্পলের ভেতরে একদল কালো বিড়াল অপেক্ষা করছে।

শ্রোয়েডারের কথা শোনার সময় রেসের মনে কিছু একটা ধরা পড়ল, কিছু একটা যা জার্মান এজেন্ট বলেছিল। কোথায় যেন একটা অসঙ্গতি আছে, কিন্তু চিহ্নিত করা যাচ্ছে না।

মাথা ঝাঁকিয়ে চিন্তাটা বের করে দিয়ে বর্তমানে ফিরে এলো।

আর মিশনের দ্বিতীয় ভাগটা কি? ন্যাশ জিজ্ঞেস করল।

কলোনিয়া অ্যালমানিয়া থেকে ওদেরকে বের করে দেওয়া, বলল শ্রোয়েডার। তিনদিন আগে ওই টেলিফোন আলাপ শোনার পর নতুন চিলি সরকারের সঙ্গে একটা চুক্তিতে আসি আমরা, চিলিয়ান সিকিউরিটি গার্ডসহ বিকেএ অফিসাররা সার্চ ওয়ারেন্ট নিয়ে কলোনিয়া আলমানিয়ায় যাবে।

তারপর?

 যদি ধরে নেই প্ল্যান মতো সবকিছু এগোচ্ছে তা হলে এই মুহূর্তে বিকে এজেন্ট আর চিলিয়ান ন্যাশনাল গার্ড কলোনিয়া অ্যালমানিয়ায় হানা দিয়ে বাজেয়াপ্ত করছে স্টর্মস্ট্রুপারদের সুপারনোভা। যে-কোনো মুহূর্তে ওদের কাছ থেকে একটা রেডিও আপডেট আশা করছি আমি।

.

ঠিক সেই মুহূর্তে, ছয়শো মাইল দূরে, চিলিয়ান ন্যাশনাল গার্ডের দশ টনী একটা ট্রাক কলোনিয়া অ্যালমানিয়ার গেট ভেঙে সগর্জনে ভেতরে ঢুকে পড়ল।

প্রচণ্ড গতিতে ছুটে যাওয়া ট্রাকটার পিছুপিছু জলপাই রঙের ইউনিফর্ম পরা একদল চিলিয়ান সৈন্যও ঢুকল ভেতরে। তাদের পেছন পেছন ব্লু অ্যাসল্ট হেলমেট পরা বারোজন জার্মান এজেন্ট এবং সোয়াট গিয়ার পরা একদল কম্পাউন্ডে ঢুকে পড়ল।

 কলোনিয়া অ্যালমানিয়া বেশ বড় একটা এস্টেট, বিশ হেক্টরের মতো। সবুজ ঘাসে ঢাকা মাঠের পেছনে মাথা তুলে রয়েছে খয়েরী টিলা আর পাহাড়। বাভারিয়ান স্টাইলের কটেজ এবং ব্লু লেক আর ছবির মতো সুন্দর সব কটেজ ভারি সুন্দর লাগছে কর্কশ, শুকনো এলাকায়।

ন্যাশনাল গার্ড দরজা-জানালা ভেঙে প্রতিটি দালান আর ভবনে ঢুকে পড়ল। তাদের মূল টার্গেট হল ব্যারাক হল। কমপাউন্ডের মাঝখানে সেটা, দেখতে অনেকটা হ্যাঙ্গারের মতো।

কয়েক মিনিট পরেই ব্যারাক হলের দরজাও ভাঙা হল হুড়মুড় করে ভেতরে ঢুকল ন্যাশনাল গার্ড এবং বিকেএ এজেন্টরা।

ঢোকার পর থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল।

প্রকাণ্ড হল, এর শুরু থেকে শেষপর্যন্ত সারির পর সারি খালি বাঙ্ক বেড় পড়ে রয়েছে। প্রতিটি বিছানা পরিপাটি করে রাখা, দেখে মনে হয় আর্মি ব্যারাক।

একটাই সমস্যা, কেউ নেই।

কমপাউন্ডের বাকি অংশ থেকে দ্রুত রিপোর্ট আসতে লাগল।

পুরো কমপাউন্ডটা খালি কলোনিয়া অ্যালমানিয়ায় কেউ নেই।

ব্যারাক হলের পাশের দালানটায় একটা ল্যাবরেটরি দালান রয়েছে, দুজন জার্মান টেকনিক্যাল এজেন্ট সামনে গাইগার কাউন্টার নিয়ে বাতাসে রেডিওঅ্যাকটিভিটি মাপছে। তাদের ছোটখাট ডিটেকশন ইউনিট জোরাল শব্দ করছে

এজেন্ট দুজন এরপর কমপাউন্ডের মেইন ল্যাবরেটরিতে ঢুকল আর সাথে সাথে লাল হয়ে উঠল তাদের গাইগার কাউন্টার।

আমরা ল্যাব টিম, সমস্ত ইউনিটকে বলছি, মেইন ল্যাবে প্রচুর পরিমাণে ইউরেনিয়াম আর প্লটোনিয়াম থাকার সংকেত পাওয়া যাচ্ছে।

 প্রথম এজেন্ট একটা দরজার সামনে এসে দাঁড়াল। কাঁচ দিয়ে ঘেরা একটা অফিসে ঢোকা যায় ওটা দিয়ে।

হাতের যন্ত্রটা বন্ধ দরজার দিকে বাড়িয়ে ধরল সে, তার গাইগার কাউন্টার চার্ট ছেড়ে বেরিয়ে গেল।

সঙ্গীর সঙ্গে চট করে দৃষ্টি বিনিময় করল সে। তারপর দরজাটা খুলল, সেই সাথে টান পড়ল তারে।

বিস্ফোরিত হল গোটা কলোনিয়া অ্যালমানিয়া।

পৃথিবীটা কেঁপে উঠল।

অন্ধ করা অত্যুজ্জ্বল একটা সাদা আলো প্রতিটি দিকে ছুটল, নিজের পথে যা কিছু পেল নিঃশেষে মুছে ফেলছে সব, পুরো এলাকা বিলিয়ন বিলিয়ন দেশলাইয়ের কাঠির মতো জ্বলে উঠল, কংক্রিট সাইলোগুলো ধুলোয় পরিণত হল এক মিলিসেকেন্ডে, ব্যারাক হল-এর পাঁচশো গজ পরিধির মধ্যে সব কিছু বাষ্প হয়ে উড়ে গেল চোখের নিমেষে, সেই সাথে একশো পঞ্চাশজন চিলিয়ান ন্যাশনাল গার্ড আর বারোজন বিকেএ এজেন্টসহ।

যখন ওরা ওটার ব্যাপারে সাক্ষাৎকার নিচ্ছিল তখন আশেপাশে গ্রামের মানুষেরা বলল যে দিগন্তে আকস্মিক আলোর ঝলকানি দেখতে পায় তারা তারপরই একটা বিশাল আকারে কালো ধোঁয়ায় মাশরুম দেখে আকাশের দিকে উঠে যেতে।

কিন্তু ওরা সাধারণ গ্রামবাসী।

ওরা জানে না যে ওরা থার্মোনিউক্লিয়ার বিস্ফোরণের বিবরণ দিয়েছিল।

.

গ্রিন বেরেটকে আদেশ দিয়ে জার্মানদের রেডিও স্যাটেলাইট ইকুইপমেন্ট মূল সড়কে বের করে আনিয়েছে ন্যাশ।

দেখা যাক আপনাদের এজেন্টরা চিলি থেকে কী মেসেজ দেয়, শ্রোয়েডারকে বলল।

পোর্টেবল রেডিও কনসোলের ঢাকনি খুলে কি-বোর্ডের বোতাম টিপতে শুরু করল শ্রোয়েডার, ন্যাশ, স্কট আর গ্রিন বেরেট সদস্যরা তাকে ঘরে দাঁড়িয়ে আছে, সবার চোখ কনসোলের স্ক্রিনে।

বৃত্তের বাইরে দাঁড়িয়ে রয়েছে রেস।

 কেমন লাগছে আপনার? হঠাৎ একটি নারীকণ্ঠ ভেসে এলো রেসের পেছন থেকে।

ঘাড় ফেরাল রেস। ভেবেছিল লরেনকে দেখবে, কিন্তু জার্মান সেই তরুণী, বড় বড় চোখ দুটো থেকে যেন নীল জ্যোতি বেরুচ্ছে।

ছোটখাট হলেও, ভারি সুন্দর গড়ন। দাঁড়িয়ে আছে হাত দুটোকে অলসভঙ্গিতে নিতম্বে রেখে, নির্মল হাসিটা যেন বলতে চাইছে তোমাকে একটু অন্যরকম লাগছে।

ছোটখাট বোতামের মতো নাক এবং মাথায় সোনালি চুল, টি-শার্ট আর জিনসে দারুণ মানিয়েছে তাকে। সাদা টি-শার্টের উপর বুলেটপ্রুফ ভেস্ট পরেছে সে, নিতম্বে দেখা যাচ্ছে কালো চামড়ার হোলস্টার গোর-টেক্স এমন একটা শ্ৰোয়েডার পড়েছে। শ্রোয়েডারের মতো তার হোলস্টারটাও খালি।

মাথা এখন কেমন? জিজ্ঞেস করল তরুণীটি। কথা সামান্য জার্মান এক্সেন্ট রয়েছে। রেসের পছন্দ হয়েছে।

ব্যথা করছে, বললে সে।

করবেই, বলল তরুণীটি, এগিয়ে এসে রেসের ভুরু স্পর্শ করল। আমার মনে হয় হামভিটা কপ্টারের ওপর আছড়ে পড়ার সময় মাথায় চোট পেয়েছেন আপনি। তারপর কপ্টারের রোটরে চড়ে দেখালেন, ওটা ছিল নির্ভেজাল অ্যাড্রেনালিনের কাজ।

তার মানে আপনি আমাকে হিরো বলতে রাজি নন? সব কৃতিত্ব অ্যাড্রেনালিনের?

 হাসল মেয়েটি, সুন্দর হাসি। অপেক্ষা করুন, বলল সে, আমার মেডিসিন প্যাকে কোডিন আছে। আপনার মাথাব্যথা সেরে যাবে।

ঘুরে এটিভির দিকে এগিয়ে গেল সে।

শুনুন…রেস বলল। আপনার নাম কি?

ঘাড় ফিরিয়ে আবার হাসল মেয়েটি। সুন্দর নিক্ষের মতো হাসি।

আমার নাম রেনে বেকার। বিকেএ-এর স্পেশাল এজেন্ট। পেয়েছি, হঠাৎ বলল শ্রোয়েডার, পোর্টেবল রেডিওটার পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

রেডিও কনসোলের সামনে জড়ো হওয়া লোকগুলোর দিকে এগোল রেস।

ন্যাশের কাঁধের উপর দিয়ে তাকিয়ে স্ক্রিনে জার্মান ভাষার একটা তালিকা দেখল। অনুবাদ করল সে:

কমিউনিকেশনস স্যাটেলাইট ট্রান্সমিশন লগ ৪৪-৭৬/ বিকেএ ৩২

১.  ১.৪.৯৯  ১৯৩০  বিকেএ এইচকিউ  পেরু টিম রিপোর্ট স্টাটাস

২.  ১.৪.৯৯  ১৯৫০  এক্সটেনশন সোর্স  সিগন্যাচার ইউ এইচ এফ সিগন্যাল  

৩.  ১.৪.৯৯  ২২৩০  বিকেএএইচকিউ  পেরু টিম রিপোর্ট স্টাটাস

 ৪.  ১.৫.৯৯ ০১৩০  বিকেএএইচকিউ  পেরু টিম রিপোর্ট স্টাটাস

৫.  ১.৫.৯৯  ০৪৩০  বিকেএএইচকিউ পেরু টিম রিপোর্ট স্টাটাস

 ৬.  ১,৫.৫৯৯  ০৭১৬  ফিল্ড (চিলি) )  এরাইভড় সান্টিয়াগো, হেডিং ফর কোলোনিয়ার অ্যালমেনিয়া

৭.  ১.৫.৯৯  ০৭৩০  বিকেএএইচকিউ  পেরু টিম রিপোর্ট স্টাটাস

 ৮.  ১.৫.৯৯  ০৯৫৮  ফিল্ড (চিলি)।  হ্যাভ অ্যারাইভড কোলোনিয়া অ্যালমেনিয়া, বিগিনিং সারভেলেন্স।

 ৯.  ১.৫.৯৯  ১০৩০  বিকেএএইচকিউ  চিলি টিম, আর্জেন্ট সিগন্যাল চিলি টিম আর্জেন্ট সিগন্যাল

 ১০.  ১.৫.৯৯  ১০৩৭  ফিল্ড (চিলি)  চিলি টিম আর্জেন্ট সিগন্যাল

 ১১.  ১.৫.৯৯  ১০৫১  বিকেএএইচকিউ  পেরু টিম রিপোর্ট ইমিডিয়েটলি।

ভুরু কুঁচকে গেল রেসের।

এটা হল কমিউনিকেশন সিগন্যালের একটা লিস্ট যা বিকেএ-র পেরুভিয়ান ফিল্ড টিম নিয়েছিল। তাকিয়ে দেখার পর বোঝা যায়, ওটা বিকেএ-র হেডকোয়ার্টার থেকে গতকাল রাত ৭.৩০ মিনিট থেকে প্রতি তিনমিনিট পরপর স্টাটাস আপডেট রিসিভ করতে অনুরোধ করেছে, সেই সাথে মাঝে মাঝে চিলির অন্য বিকেএ-র টিমের ম্যাসেজ রিসিভ করতেও অনুরোধ করেছে।

দশম মেসেজটা-চিলি থেকে পাঠান–মেসেজটা রেসের মনোযোগ আকৃষ্ট করল–জার্মান শব্দ লেখা আছে বড়বড় করে ড্রিংজেন্ড—জরুরি।

শ্রোয়েডারও দেখেছে ওটা।

সে দ্রুত ট্যাব করে, দশম মেসেজে নেমে এল তারপর এ্যান্টার বাটনে চাপ দিল।

পুরো স্ক্রিন জুড়ে মেসেজটা দেখা দিল। জার্মান ভাষায় লেখা মেসেজটা দেখল রেস, অনুবাদ করল :

মেসেজ নাম্বার : ০৫০১৯৯-০১০

ডেটেড : জানুয়ারি ৫, ১৯৯৯

রিসিভড এ্যাট : ১০৩৭ (লোকাল টাইম-পেরু)

 রিসিভড ফ্রম :  ফিল্ড টিম (চিলি)

 সাবজেক্ট; চিলি টিম আর্জেন্ট সিগন্যাল; চিলি টিম আর্জেন্ট সিগন্যাল।

 মেসেজ ইজ এজ ফলোজঃ অ্যাটেনশোন পেরু টিম। অ্যাটেনশোন পেরু টিম। দিস ইজ চিলি সেকেন্ড ইউনিট। রিপিট, দিস ইজ চিলি সেকেন্ড ইউনিট। ফাস্ট ইউনিট ইজ ডাউন। রিপিট। ফাস্ট ইউনিট ইজ ডাউন। ১৫ মিনিটস এগো ফার্স্ট ইউনিট এন্টার্ড কলোনিয়া অ্যালমেনিয়া ইন কনসার্ট উইথ বিলিয়ান ন্যাশানাল গার্ড। রিপোর্টেড এন্টায়ার কম্পাউন্ড ডেজার্টেড। রিপিট। ফার্স্ট ইউনিট রিপোর্টেড এন্টায়ার কম্পাউন্ড ডেজার্টেড। প্রিলিমিনারি টেস্টিং রিভিল্ড হাই ট্রেস লেভেলস অব ইউরেনিয়াম এন্ড লুটোনিয়াম ওর। বাট বিফোর ফার্দার ডাটা কুড বি অবটেইলড এ ডিটোনেশেন ওকার্ড ইনসাইড দ্য ডিটোনেশেন অ্যাপিয়ার্স টু হ্যাভ বিন নিউক্লিয়ার। রিপিট। ডিটোনেশেন অ্যাপিয়ার্স টু হ্যাভ বিন নিউক্লিয়ার। এন্টায়ার ফার্স্ট ইউনিট হ্যাঁজ বিন লস্ট। রিপিট। এন্টায়ার ফার্স্ট ইউনিট হ্যাঁজ বিন লস্ট। মাস্ট এজিউম স্টর্মস্ট্রুপারস আর অলরেডি এন রুট টু পেরু।

আতঙ্কে মেসেজ থেকে চোখ সরাল রেস।

বিকেএ টিম পৌঁছানর সময় কলোনিয়া আলেমেনিয়া টিম সে সময় ছিল না। ওটা একটা বুট্রিাপ ছিল, পা রাখার সাথে সাথে বিস্ফোরিত হয়।

ঠাণ্ডা একটা স্রোত রেসের মেরুদণ্ড বেয়ে নেমে গেল শেষ লাইনটা চোখে পড়ার সাথে সাথে :

মাস্ট এজিউম স্টর্মস্ট্রুপারস আর অলরেডি এন রুট টু পেরু।

.

হাতঘড়ি দেখল রেস।

১১.০৫

এখানে তারা কখন পৌঁছাবে বলে মনে করছেন? শ্রোয়েডারকে জিজ্ঞেস করল ন্যাশ।

 তা বলা সম্ভব নয়, জবাব দিল শ্রোয়েডার। কারণ জানাই তো যায়নি ঠিক কখন কম্পাউন্ড ত্যাগ করেছে তারা। দুদিন আগেও হতে পারে দুঘণ্টা আগেও হতে পারে। আবার চিলি থেকে এখানকার পথ বেশি দূর নয়। আমাদের ধরে নিতে হবে খুব কাছে চলে এসেছে তারা।

 স্কটের দিকে ফিরল ন্যাশ। ক্যাপ্টেন, আমি চাই পানামা স্টেশনের সঙ্গে যোগাযোগ করে ওদেরকে তুমি জিজ্ঞেস করো আমাদের এক্সট্রাকশন টিম কখন পৌঁছাবে এখানে। বলবে আমাদের ফায়ারপাওয়ার দরকার, এখনই।

ঠিক আছে। ডুগীর উদ্দেশে মাথা ঝাঁকিয়ে রেডিও ইউনিটের দিকে চলে গেল স্কট।

কোচরেন, বলল ন্যাশ। যে হিউটা টিকে আছে, ওটার অবস্থা কী?

মাথা নাড়ল বাজ কোচরেন। গুলি লেগেছে। হিউটা হামলা করার সময় অ্যাপাচিটা পাগলামি শুরু করেছিল বিড়ালগুলো আক্রমণের সময়। গুলি লেগে টেইল রোটর আর ইগনিশন পোর্টের ক্ষতি হয়েছে।

কতক্ষণ লাগবে মেরামত করতে?

 এখানে আমাদের যন্ত্রপাতি যা আছে, ইগনিশন পোর্ট মেরামত করা সম্ভব, তবে বেশ সময় লাগবে। আর টেইল রোটরের কথা যদি বলেন, ওটা ছাড়া তো আর ওড়া সম্ভব নয়, ওটা মেরামত করা খুব কঠিন হবে। আমার মনে হয় দ্বিতীয় একটা সিস্টেম করে ব্যবহার করতে পারি, তবে নতুন একটা এক্সেল এবং রোটর সুইচ দরকার, যা আমরা এখানে পাব না।

সার্জেন্ট। হিউটাকে আবার ওড়ার ব্যবস্থা করো। যেভাবে পার, বলল ন্যাশ।

ইয়েস, স্যার।

 বৃত্ত থেকে বেরিয়ে গেল কোচরেন, সঙ্গে করে টেক্স রাইকার্টকে নিয়ে গেল।

 নীরব হয়ে এল পরিবেশটা।

তার মানে এখানে আমরা আটকা পড়ে গেছি… লরেন বলল।

এক দল সন্ত্রাসীদের সাথে… গ্যাবি লোপেজ বলল।

 ইচ্ছে করলে পায়ে হেঁটে এখান থেকে সরে যেতে পারি আমরা, রেস পরামর্শ দিল।

ক্যাপ্টেন স্কট ঘুরল ন্যাশের দিকে। এখানে থাকলে, মারা পড়ব সবাই।

আর যদি আমরা চলে যাই নাজিরা আইডলটা পেয়ে যাবে, বলল কোপল্যান্ড।

এবং একটা ওয়ার্কেবল সুপারনোভা আছে ওদের কাছে, বলল লরেন।

সুযোগ দেওয়া যাবে না, দৃঢ়কণ্ঠে বলল ন্যাশ। না, একটি মাত্র কাজই করার আছে আমাদের।

কী কাজ?

 নাজিরা এখানে পৌঁছানোর আগেই আইডলটা পেতে হবে আমাদেরকে।

ঝিরঝির করে আবার বৃষ্টির মাঝে নদীর কিনার ঘেঁষা পথ ধরে সাবধানে এগোচ্ছে। তিন সৈনিক।

সামনে রয়েছে ক্যাপ্টেন স্কট আর করপোরাল চাকি উইলসন, তাদের এম-১৬ ডানদিকের ঘন জঙ্গলের দিকে তাক করা। নিঃসঙ্গ জার্মান প্যারাট্রুপার গ্রাফ এখন আমেরিকান এম-১৬ ব্যবহার করছে, ওদের পিছুপিছু এগোচ্ছে সে, নজর রাখছে নিজের পেছনেও।

প্রত্যেকের হেলমেটের পাশে একটা করে খুদে ফাইবার-অপটিক ক্যামেরা ফিট করা আছে, গ্রামে রয়ে যাওয়া অফিসারদের কাছে ইমেজ পাঠাবে।

কিছুক্ষণ পর পাহাড়ের সেই ফাটলটার সামনে পৌঁছাল তিনজনের দলটা, এই ফাটল রক টাওয়ার আর টেম্পলের পথ দেখাবে।

স্কট মাথা ঝাঁকাতে উইলসন বড় করে একটা নিঃশ্বাস নিয়ে সরু পাথুরে প্যাসেজের ভেতর ঢুকে পড়ল, হাতের অস্ত্র সামনে বাড়ান।

গ্রামে, রেস আর বাকি সবাই মনিটরের দিকে তাকিয়ে আছে, স্টক, উইলসন এবং গ্রাফকে ফাটল ধরে এগোতে দেখছে। কমান্ডোদের পাঠান ইমেজ একই মনিটরে ধরা পড়ছে, তবে আলাদা তিনটে চৌকো ঘরে, ভৌতিক সাদা-কালোয়।

প্ল্যানটা সহজ।

স্কট, উইলসন এবং গ্রাফ টেম্পলে ঢুকে আইডলটা সংগ্রহ করবে, ওই সময় গ্রিন বেরেট আর অন্য জার্মান প্যারাট্রুপার অবশিষ্ট হিউ হেলিকপ্টারটা সারিয়ে তুলবে। আইডলটা পাওয়া গেলে ওরা আর দেরি করবে না, ভিলকাফোর ছেড়ে উড়ে যাবে, নাজী টেররিস্টরা এসে পৌঁছানোর আগেই।

আমরা কি একটা কথা একদম ভুলে যাচ্ছি না? রেস বলল।

যেমন? ন্যাশ জিজ্ঞেস করল।

বিড়ালগুলোর কথা। ওগুলোর কারণেই আমাদের এই অবস্থা হয়েছে না? কোথায় ওগুলো?

 দিনের আলো ফুটতে ওগুলো গ্রাম ছেড়ে চলে গেছে, রেসের পেছন থেকে বিশুদ্ধ ইংরেজিতে বলল কেউ।

ঘুরে তাকাতে চতুর্থ, অর্থাৎ শেষ জার্মান লোকটিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল রেস।

শ্রোয়েডার, গ্রাফ এবং মোঙ্কের তুলনায় একদম আলাদা ওরা যেমন শারীরিক শক্তিতে বলিয়ান, এই মানুষটা তাদের চেয়ে বয়সে অনেক বড়, পঞ্চাশ হবে। শারীরিক গঠন অ্যাথলেটিক নয়। তার শরীরে লক্ষণীয় বিষয়টা হল ছাই রঙা দাড়ি। লোকটাকে পছন্দ হচ্ছে না রেসের। হয়তো চোখে-মুখে গর্ব আর জেদের ভাবটাই তার কারণ।

 ভোরের দিকে বিড়ালগুলো মালভূমির দিকে চলে গেছে, লোকটা জ্ঞান দানের সুরে বলল। আমার ধারণা টেম্পলের ভেতর, নিজেদের আস্তানায় ফিরে গেছে ওগুলো। ঠোঁট বাকা করে হাসল। ওগুলোর কয়েকটা প্ৰজন প্রায় চারশো বছর গাঢ় অন্ধকারে কাটিয়েছে, কাজেই দিনের আলো তাদের সহ্য হওয়ার কথা নয়।

 দাড়িওয়ালা লোকটা, জার্মানদের স্বভাব মতো একটা হাত বাড়িয়ে দিল। আমি ডক্টর জোহান ক্রাউশ, হ্যামবুর্গ ইউনিভার্সিটির জুলজিস্ট ও ক্রিপটোজুলজিস্ট। ম্যানুস্ক্রিপ্টের বিশেষ একটা জন্তু সম্পর্কে পরামর্শ দেয়ার জন্য এই মিশনের সদস্য করা হয়েছে আমাকে।

ক্রিপটোজুলজিস্ট কাকে বলে? জানতে চাইল রেস।

যিনি মিথিকাল পশু নিয়ে পড়াশোনা করেন, বলল ক্রাউশ।

 মিথিকাল পশু…।

হ্যাঁ। বিগফুট, লক নেস মনস্টার, ইয়েতি, ইংলিশ মুর-এর গ্রেট ক্যাট, আর অবশ্যই, সে আরো যোগ করল, দক্ষিণ আমেরিকার রাপা।

আপনি এই জন্তুগুলো সম্পর্কে জানেন? জিজ্ঞেস করল রেস।

শুধু যাচাই না করা অসমর্থিত সাইটিং, স্থানীয় লোকগীতি আর হিয়েরোগ্লিফ থেকে যতটুকু শিখেছি। তবে ক্রিপটোজুলজির সৌন্দর্যই এখানে, এতে এমন পশুকে স্টাডি করতে হবে যে পশুকে স্টাডি করা সম্ভব নয়, কারণ আসলে কেউ প্রমাণ করতে পারে না যে ওগুলোর অস্তিত্ব আছে।

তাহলে আপনি মনে করছেন যেগুলো দ্বারা আমরা আক্রান্ত হয়েছিলাম সেগুলো মিথিকাল জন্তু, রেস বলল। ওগুলো আমার কাছে মিথিকাল মনে হয় নি।

ক্রাউশ বলল, কমবেশি প্রতি পঞ্চাশ বছর পরপর অস্বাভাবিক মৃত্যুর একটা ঢেউ ওঠে অ্যামাজন রেইনফরেস্টের। ওই সময় রাতের বেলা এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে যাবার সময় লোকজন গায়েব হতে শুরু করে। বিরল দুএকটা ক্ষেত্রে সকালবেলা তাদের অবশিষ্ট পাওয়া যায়, দেখা গেছে শরীর থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়েছে।

 স্থানীয় লোকেরা রাতের এই দয়ামায়াহীন খুনি জন্তুর নাম দিয়েছিল, যে নাম জেনারেশনের পর জেনারেশন আজও এই অঞ্চলে প্রচলিত ওরা ওটাকে ডাকে রাপা নামে।

ক্রাউশ ভালো করে রেসের দিকে তাকাল। আমাদের আসলে স্থানীয় লোকগীতির প্রতি মনোযোগ দিতে হবে। শত্রুকে বুঝতে হলে এটা দরকার।

কিভাবে?

ধরুন, এক বিষয়, এই এর সাহায্যে আমরা আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী বিড়ালগুলোর বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জানতে পারব।

কী ধরনের?

বেশ, প্রথমেই ধরা যাক, রাপা মূলত নিশাচর প্রাণী। স্থানীয় লোকদের অবশিষ্ট সকালে পাওয়া গেছে। আর আমাদের নিজস্ব অভিজ্ঞতাও বলে যে ভোরে আলো দেখে পালিয়ে গেছে এই বিড়ালগুলো। অর্থাৎ, এগুলো নিশাচর। শুধু রাতের বেলা শিকার করে এবং বিশ্রামে যায় দিনের বেলা।

কয়েক প্রজন্ম ধরে ওই টেম্পলে আটকা পড়ে থাকলে, রেস বলল, ওগুলো বেঁচে আছে কীভাবে? খাচ্ছে কী?

 তা আমি বলতে পারব না, বলল ক্রাউশ, ভুরু কোঁচকান দেখে মনে হল সিরিয়াস হয়ে উঠেছে, যেন জটিল কোনো ম্যাথেমেটিক্যাল সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে।

মুখ তুলে মালভূমির দিকে তাকাল রেস, ওখানেই রয়েছে রহস্যময় টেম্পলটা। তির্যক বৃষ্টির একটা চাদর ওটার পুবদিকের পাথুরে মুখ আড়াল রেখেছে।

এখন তা হলে কী করছে ওগুলো? বলল সে।

আমার ধারণা, ঘুমাচ্ছে, বলল ক্রাউশ, টেম্পলের ভেতরে সেজন্যেই আমাদের দলকে আইডলটা আনতে পাঠাবার আদর্শ সময় এটা।

***

স্কট, উইলসন এবং গ্রাফ সরু প্যাসেজ থেকে বেরিয়ে এসে পা রাখল আশ্চর্য সুন্দর গরটার গোড়ায়, অগভীর পানি ভর্তি লেকে।

ক্যানিয়নের ভেতরটা অস্বাভাবিক অন্ধকার। দিনের অল্প আলো ঘন কালো মেঘ আর গহ্বরের কিনারায় জন্মান সারি সারি গাছ বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। দেয়ালের প্রতি চিড় আর ফাটল গাঢ় ছায়ায় ঢাকা।

 স্কট আর উইলসন সামনে রয়েছে। তাদের এম-১৬-র ব্যারলে আটকান ছোট ফ্ল্যাশলাইটের আলো পথ দেখাচ্ছে ওদেরকে।

ঠিক আছে- থ্রোট মাইকে বলল স্কুট।

ঢালু পথটা ধরে এখন আমরা ওপরে উঠছি, মনিটরের স্পিকার থেকে ভেসে এলো তার কণ্ঠস্বর।

স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে রয়েছে রেস, টানটান উত্তেজনায় স্কট, উইলসন এবং গ্রাফকে পানি থেকে উঠে এসে গর্তটার বাইরের দিকে দেয়াল কেটে তৈরি সরু পথ ধরেছে।

জোহান বললেন, শত্রু সম্পর্কে আরো একটা ব্যাপার মনে রাখতে হবে আমাদেরকে, প্রথম ওগুলো দৈত্যাকার বিড়াল। নিজেদেরকে ওগুলো বদলাতে পারে না। তারা বিড়ালের মতো চিন্তা করে, বিড়ালের মতোই আচরণ করে।

মানে?

 মানে হল গ্রেট ক্যাটদের শুধু একটি প্রজাতি, চিতা, ধাওয়া করে শিকার ধরে।

অন্যান্য গ্রেট ক্যাটরা কীভাবে শিকার করে?

কয়েক ধরনের কৌশলই আছে। ভারতবর্ষের বাঘ লতাপাতার আড়াল নিয়ে অপেক্ষায় থাকে, কখনো হয়তো কয়েক ঘণ্টা যতক্ষণ ওই জায়গায় শিকার না পৌঁছায়। শিকার যথেষ্ট কাছে এলে তারপর হামলা করে।

অন্যদিকে, আফ্রিকার সিংহ, সফিসটিকেটেড প্যাক-হান্টিং মেথড ব্যবহার করে। এ-ধরনের একটা টেকনিকে, হরিণদের সামনে একটা সিংহ অলস ভঙ্গিতে ঘোরাফেরা করতে থাকে, সেই ফাঁকে তার সঙ্গী সিংহীরা চুপিসারে পৌঁছে যায় হরিণগুলোর পেছনে। খুবই বুদ্ধিদীপ্ত একটা কৌশল এবং কাজেরও। তবে একই সঙ্গে অস্বাভাবিক।

 কেন? রেস জিজ্ঞেস করল।

কারণ এর জন্যে সিংহদের মধ্যে এক ধরনের যোগাযোগ থাকার প্রায়াজন হয়।

মনিটরের দিকে ফিরল রেস।

প্যাচান পথ ধরে অল্প একটু এগিয়ে তিন সৈনিক, ফলে গর্তটার গোড়ায় জমে থাকা পানি থেকে এই মুহূর্তে মাত্র দশ ফুট উপরে রয়েছে তারা।

করপোরাল উইলসনের ক্যামেরা ভিউ দেখছে রেস, পানির সমতল বিস্তৃতি ধরা পড়েছে তাতে কিন্তু হঠাৎ পানির সারফেসে ক্ষীণ একটা নড়াচড়া ধরা পড়ল ওর চোখে।

পানির ঠিক নিচের কোনো কিছু থেকে খুদে ঢেউ তৈরি হওয়ার মতো।

কী ওটা? বলল সে।

কী ওটা?

উইলসন, বলল রেস, মাইক্রোফোনের দিকে ঝুঁকল। এক সেকেন্ডের জন্যে ডান দিকে তাকান, পানিতে।

গ্রাফ এবং স্কট নিশ্চয়ই রেসের কথা শুনতে পেয়েছে, কারণ পরমুহূর্তে ক্যামেরার ডানদিকে ঘুরে গেল, মনিটরের তিনটে চৌকো ঘরেই পানির বিস্তৃতি দেখা যাচ্ছে, যে পানি রক টাওয়ারের গোড়াটাকে বৃত্তাকারে ঘিরে রেখেছে।

 আমি তো কিছু দেখছি না… বলল স্কট।

 ওই যে! বলল রেস, পানিতে আরেকটা ছোট্ট ঢেউ-এর দিকে আঙুল তুলল, মনে হল কোনো প্রাণীর লেজের বাড়ি লেগে তৈরি হয়েছে। কোনো প্রাণী সৈন্য তিনজনের দিকে এগোচ্ছে।

কী ব্যাপার…? বলল স্কট, সামনে পানির চওড়া বিস্তৃতির দিকে তাকিয়ে রয়েছে।

 লেকের সারফেস ধরে ছোট একটা ঢেউ অস্বাভাবিক দ্রুত বেগে এগিয়ে আসছে তাদের দিকে।

ভুরু কোঁচকাল স্কট। তারপর সাবধানে একটা পা ফেলে পথের কিনারায় সরে এসে দাঁড়াল, দশফিট নিচে নেমে গেছে পানি সারফেস।

উঁকি মেরে কিনারা দিয়ে তাকাল।

 তিনটে কালো বিড়াল দেখতে পেল সে, সরাসরি নিচের প্রায় খাড়া দেয়াল বেয়ে উঠে আসছে উপরে।

দ্রুত এম-১৬ তুলল স্কট, ঠিক সেই মুহূর্তে কুচকুচে কালো একটা প্রকাণ্ড আকৃতি গাঢ়, লম্বা ফাটল থেকে লাফ দিয়ে তার পিঠে চড়ল, তাকে নিয়ে ঝপাৎ করে পড়ে গেল নিচের পানিতে। পরমুহূর্তে আরো কয়েকটা কালো আকৃতি ছেকে ধরল তাকে।

মনিটরে চোখ রেখে স্কটের দৃষ্টিতে রোমহর্ষক দৃশ্যটা দেখছে রেস। ক্ষুরের মতো ধারাল দাঁতগুলো একঝলক দেখতে পেল শুধু, মানুষের হাত-পা আক্ষেপে ছটফট করছে, চাপা ঘড়ঘড় আওয়াজকে ছাপিয়ে উঠল স্কটের হাঁপানোর শব্দ আর নিস্তেজ হয়ে আসা চিৎকার।

তারপর পানির নিচে চলে গেল ক্যামেরা আর স্ক্রিন খালি হয়ে গেল, থেমে গেল সব আওয়াজ।

এম-১৬-র ট্রিগারটা টেনে ধরে রেখেছে জার্মান সৈন্য গ্রাফ একের পর এক বুলেট বেরুচ্ছে বন্দুকের নল থেকে।

কিন্তু বেশিক্ষণ অর গুলি চালাতে পারল না–ধপ! উপর থেকে তার ঘাড়ে নামল একটা বিশাল বিড়াল, অনেক উপরে পাথুরে পাঁচিলের মাথায় ওত পেতে ছিল ওটা।

পথের আরো খানিকটা সামনে রয়েছে চাকি উইলসন, আওয়াজ শুনে ঝট করে ঘুরে দাঁড়াল, দেখল চারপেয়ে একটার সঙ্গে মরিয়া হয়ে লড়াই করছে জার্মান প্যারাট্রুপার গ্রাফ।

পরক্ষণে–চচ্চড়–করে একটা আওয়াজের সঙ্গে গ্রাফের ঘাড় থেকে গলাটা ছিঁড়ে বের করে আনল ওটা, সঙ্গে সঙ্গে নিথর হয়ে গেল গ্রাফের শরীর।

ফ্যাকাশে হয়ে গেল উইলসন। ওহ।

গ্রাফের শরীরের উপর দাঁড়িয়ে রয়েছে ওটা, ধীরে ধীরে মুখ তুলে সরাসরি উইলসনের চোখের দিকে তাকাল।

স্থির হয়ে গেল উইলসন। সামনে এগোচ্ছে বিশাল বিড়ালটা, গ্রাফের শরীরটাকে টপকে এল।

নড়ছে না উইলসন।

বিদ্যুৎবেগে ঘুরল উইলসন। সামনে আরেকটা প্যান্থার দেখতে পেল তার পথ আগলে দাঁড়িয়ে আছে।

দৌড়াবার জায়গা নেই।

 লুকাবার পথ নেই।

আবার ঘুরল উইলসন এবং পাথরের দেয়ালে তৈরি চওড়া ফাটল আর গর্তগুলোর উপর চোখ বুলাল, ভাবল ওগুলোর একটা হয়তো তাকে বাঁচাতে পারে। বেশ বড় একটা ফাটলের দিকে পা বাড়াতে যাচ্ছে। সে সময় ফাটলের ভেতর থেকে মুখের কাছে সরে এসে ওর দিকে তাকাল একটা বিড়াল। এবং তারপর হঠাৎ ঝাঁপিয়ে পড়ল বিশাল বিড়ালটা। বিড়ালটার চোয়াল ওর দিকে অবিশ্বাস্য দ্রুততায় এগিয়ে এলো তারপর সব অন্ধকার।

মনিটরের দিকে হতবিহ্বল হয়ে তাকিয়ে আছে সবাই।

ও মাই গড, নিঃশ্বাস ফেলল গ্যাবি লোপেজ।

 শিট, লরেন বলল।

অবশিষ্ট চার গ্রিন বেরেট এখনো মনিটরের দিকে তাকিয়ে রয়েছে, কথা নেই মুখে।

জার্মান জুলজিস্ট ক্রাউসের দিকে ফিরল রেস। ওগুলো শুধু রাতে বেরোয়, তাই না?

ইয়ে, দাড়ি চুলকাচ্ছে ক্রাউশ। আসলে গর্তের গোড়াটা খুব অন্ধকার, তাই দিনের বড় একটা সময় ওখানে কাটাচ্ছে ওগুলো

কেনেডি, ন্যাশ ডাকল তীক্ষ্ণ কণ্ঠে, এক্সট্রাকশন টিমের খবর কী?

চেষ্টা করছি, কিন্তু পানামার সঙ্গে যোগাযোগ হচ্ছে না, স্যার, বলল ডুগী। রেডিও প্যাকে কাজ করতে করতে। সিগন্যালগুলো ঠিকমত যাচ্ছে না।

চেষ্টা করে যাও, বলে হাতঘড়ি দেখল ন্যাশ।

১১:৩০ বাজে।

শিট! বলল তিনি।

ভাবছে রোমানোর কথা এবং তার টিমের শেষবার রিপোর্ট পেয়েছে, কাল সন্ধ্যা ৭:৪৫ কুজকো থেকে টেক-অফ করেছে ওরা। এতক্ষণে এখানে পৌঁছে যাওয়ার কথা। তাদের হলটা কি? নাজিরা গুলি করে আকাশ থেকে ফেলে দেয়নি তো? কিংবা টোটেমের সংকেত বুঝতে ভুল করায় পথ হারিয়ে ফেলেছে?

যাই ঘটে থাকুক, বেঁচে থাকলে একটা ব্যাপার নিশ্চিত, শেষপর্যন্ত ঠিকই তারা গ্রামে পৌঁছাবে।

এর মানে হল দুই দল শত্রু ভিলকাফোরের দিকে আসছে।

 শিট, আবার বলল সে।

 ডুগী এগিয়ে এলো।

এক ঘন্টা আগে রওনা হয়েছে এক্সট্রাকশন টিম। পানামা থেকে, সঙ্গে আছে। তিনটে চপার: দুটো কোমাঞ্চি, একটা ব্ল্যাক হক। ওরা আন্দাজ করছে, সন্ধের আগে পৌঁছে যাবে, ১৭০০ টার সময়। একটা ইউএইচএফ সিগন্যাল অন করেছি, ওরা যাতে সেটা ধরে এখানে পৌঁছায়।

 ডুগী যখন তার খবর রিপোর্ট করল ন্যাশের কাছে, তখন একটা অদ্ভুত চিন্তা রেসের মাথায় এল : আর্মি কেন তাদেরকে কুজকো থেকে বের করে দিচ্ছি না? পানামা থেকে কেন ওরা চপার পাঠাচ্ছে?

যে পথে ওরা এসেছিল ঠিক সেই পথেই ওদের বেরিয়ে যাওয়াটাই সহজ পথ।

ঠিক সেই মুহূর্তে সান্টিয়াগোর ম্যানুস্ক্রিপ্টের একটা লাইন মাথায় ঝিলিক দিয়ে উঠল।

চোর কখনোই বেরিয়ে যাবার একই পথ ব্যবহার করে না।

ন্যাশ ফিরে তাকাল ভ্যান লিওয়েনের দিকে। আমরা কি এসএটি-এসএন নেটওয়ার্কের এক্সেস নিতে পারব? সে বলল এটা হল স্যাট-সান স্যাট-সান নেটওয়ার্ক।

জ্বি, স্যার, পারব।

সেন্ট্রাল ইস্টার্ন পেরু ওদিকটায় সেট করুন। আমি জানতে চাই নাজি বেজন্মাগুলো ঠিক কোথায় আছে। কোচরেন।

ইয়েস, স্যার।

ভিলকাফোরের স্যাটেলাইট ইমেজগুলো দেখাও আমাকে। আমাদেরকে ডিফেন্সিভ পজিশন নিতে হবে।

ইয়েস, স্যার।

এসএটি-এসএন কি? গ্যাবি লোপেজ জিজ্ঞেস করল।

ট্রয় কোপল্যান্ড জবাব দিল। এসএটি-এসএন হল স্যাটেলাইট এ্যারোস্পেস ট্রেকিং এন্ড সার্ভেলেন্স নেটওয়ার্কের প্রথম অক্ষরগুলো। এটা অনেকটা সাসাস-এর মতে, ইউএস নেভির হাইড্রোফোন বিস্তার ঘটায় উত্তর আলান্টিকে শত্রুপক্ষের সাবমেরিন ডিটেক্ট করার জন্য।

 সোজা কথায়, এসএটি-এসএন হল ছাপ্পান্ন জিওসিক্রোনাস স্যাটেলাইট, যা পৃথিবীর কক্ষপথের খুব কাছ থেকে চক্কর দিচ্ছে, বিশ্বের এয়ারস্পেস, এরোপ্লেন থেকে এরোপ্লেনে মনিটর করা হয়।

 যদি এত সহজ ব্যাখ্যা হয়ে থাকে, শুকনো গলায় বলল রেস, তাহলে আমি জটিল কিছু শুনব না।

কোপল্যান্ড তাকে পাত্তা দিল না।

যে কোনো এয়ারক্রাফটের সাতটা ভিন্ন ধরনের পর্যবেক্ষণীয় বস্তু থাকে রাডার, ইনফ্রা-রেড, ভিজুয়াল, কনট্রেইলস, ইঞ্জিন স্মোক, একুয়েস্টিক এবং ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ইমিশেনস। এসএটি-এএন স্যাটেলাইট এগুলোর সবকটিই ব্যবহার করতে তথ্য সংগ্রহ করে সারা পৃথিবীর যে কোনো একক এয়ারক্রাফটের, সেটা মিলেটারি হোক, সিভিলিয়ান হোক।

কর্নেল ন্যাশ এখন পেরুর পুবদিকে মাঝখানের একটা স্ন্যাপশট চাচ্ছেন যাতে তিনি সব কটা প্লেন চিহ্নিত করতে পারেন। সেই ছবি থেকে, আমরা আমাদের নাজি বন্ধুদের দেখতে পাব এবং হিসেব করতে পারব ওরা এখানে আসার পর কতক্ষণ থাকতে পারব।

রেস চোখ তুলে তাকাল ন্যাশের দিকে।

গভীর চিন্তায় ডুবে গেল সে, এটা প্রত্যাশিত, কারণ এরই মধ্যে নিজের তিনজন লোককে হারিয়েছে সে।

কী ভাবছেন আপনি? জিজ্ঞেস করল রেস।

ওই আইডলটা আমাদেরকে পেতেই হবে, বলল ন্যাশ। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। এখন থেকে যে কোনো মুহূর্তে পৌঁছে যাবে নাজিরা কিন্তু বিড়ালগুলোকে পাশ কাটাবার কোনো উপায় দেখছি না।

মাথা তুলল রেস।

তারপর সে বলল, ওগুলোকে পাশ কাটাবার উপায় একজনের অন্তত জানা ছিল।

কার?

আলবার্তো সান্টিয়াগো।

কী?

 বোল্ডারটার কথা মনে আছে, টেম্পলের দোরগোড়ায় আটকে ছিল?

হ্যাঁ…

তাতে একটা সতর্কবলি লেখা ছিল: কোনো অবস্থাতেই ভেতরে ঢুকবে না। ভেতরে মৃত্যু ঝুলে আছে। বাক্য দুটোর নিচে এ.এস ইনিশিয়াল ছিল। পুরো ম্যানুস্ক্রিপ্টটা আমার পড়ার সুযোগ হয়নি, তবে বুঝতে অসুবিধে হয় না যে আমাদের মতো একই সমস্যায় পড়েছিল সান্টিয়াগো আর রেনকো। তারা। ভিলকাফোরে আসার আগে কেউ একজন টেম্পলটা খুলে রাপাগুলোকে ছেড়ে দিয়েছিল।

 তবে যেভাবেই হোক, রেস বলল, বিড়ালগুলোকে আবার ভেতর ফেরত পাঠাবার একটা উপায় খুঁজে বের করেছিল সান্টিয়াগো। তারপর বোল্ডারের গায়ে বাক্য দুটো খোদাই করে সে, যে কেউ যদি এটা খুলতে চায় তার জন্যে।

 এখন, আমরা ম্যানুস্ক্রিপ্ট ঘেঁটে এই গ্রামটা খুঁজে বের করব এবং আমরা ভালোভাবেই সেটা করব, তবে যে কপিটা আমি পড়েছিলাম তা ছিল অসম্পূর্ণ। আমি বাজি ধরে বলতে পারি যে সান্টিয়াগোর ম্যানুস্ক্রিপ্টেই আছে কি করে ওই বিড়ালগুলোকে এড়িয়ে যাওয়া যাবে।

কিন্তু আমাদের কাছে অন্য কোনো ম্যানুস্ক্রিপ্ট নেই, ন্যাশ বলল।

আমি বাজি ধরে বলতে পারি ওরা পারবে, রেস ইশারা করল বেঁচে থাকা চার জামানের দিকে।

শ্রোয়েডার চোখের ইশারায় সম্মতি দিল।

এবং আমি আপনার ওপর বাজি ধরতে পারি যে ভিলকাফোরের লোকেশনের অংশের পরের অংশটা অনুবাদ করেন নি, তাই না? রেস বলল।

না, শ্রোয়েডার বলল। আমরা করিনি।

ন্যাশের চেহারায় নতুন এক আশার আলো দেখা দিল। শ্রোয়েডারের দিকে তাকাল।

আপনার ম্যানুস্ক্রিপ্টটা নিয়ে আসুন, বলল সে। এখনি আসুন।

কয়েক মিনিট পর শ্রোয়েডার একটা কার্ড বোর্ডের ভেতর রাখা একগাদা কাগজ রেসের হাতে তুলে দিল। কাগজের বাণ্ডিলটা রেসের কাছে যে বাণ্ডিলটা ছিল তার চেয়েও মোটা।

সম্পূর্ণ ম্যানুস্ক্রিপ্ট।

আমার মনে হয় না তোমাদের চারজনের টিমের কেউ একজন অনুবাদক আছে? ন্যাশ জিজ্ঞেস করল বিকেএ-র লোকটাকে।

শ্রোয়েডার মাথা নেড়ে বলল। না। রক টাওয়ারে বিড়াল আক্রমণে আমাদের ভাষাবিদ নিহত হয়েছেন?

রেসের দিকে ঘুরলেন ন্যাশ। তাহলে এখন এটা সম্পূর্ণ আপনার, প্রফেসর, ভাগ্য ভালো যে আপনাকে সঙ্গে পেয়েছি।

***

রেস এটিভি-তে ফিরে গেল ম্যানুস্ক্রিপ্টের বাকি অংশ পড়ার জন্য।

বিশাল বড় আর্মার্ড ভেহিক্যালের ভেতর নিরাপদে ঢোকার পর, সে নতুন ম্যানুস্ক্রিপ্টের ফোল্ডারটা খুলল। দেখল একটা জেরোক্স কপির কাভার সিট।

কাভার সিটটা অদ্ভুত, আগে দেখা কপির তুলনায় একেবারে আলাদা। মূল পার্থক্যটা হল এই কভার সিটটা একেবারে সাধারণ।

শিরোনাম হল, ইনকাদের সাথে মঙ্কদের সম্পর্ক খুব বাজে হাতের লেখা। একটা জিনিস নিশ্চিত সৌন্দর্য এবং জাঁকজমকটা লেখকের কাছে মূল্য ছিল না।

এবং এটাই রেসকে ধাক্কা দিল।

এটাই হল আসল সান্টিয়াগোর ম্যানুস্ক্রিপ্টের একটি ফটোকপি।

 আলবার্তো সান্টিয়াগোর লেখা ডকুমেন্টের জেরোক্স কপি।

পাতা উল্টে গেল রেস। পাতার পর পাতা সান্টিয়াগোর হাতের লেখা তার সামনে খোলা।

পড়তে লাগল সে, এবং খুব দ্রুত পেয়ে গেল সেই জায়গাটা যেখানে সে পড়াটা আকস্মিকভাবে থামিয়ে দিয়েছিল শেষবার পড়ার সময়, ওই অংশটা হল রেনকো, সান্টিয়াগো এবং ক্রিমিনাল বাসেরিও ভিলকাফোরে আসার পর দেখতে পেল ধ্বংস, দেখতে পেল রাস্তায় ছড়িয়ে ছিটেয়ে পড়ে আছে মানুষের মৃতদেহ, রক্তে ভেজা…

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *