ঢাকা থেকে কলকাতা
একাত্তরের মার্চ। সারা দেশ জ্বলে উঠেছে। বিএলএফের দুই শীর্ষ নেতা। শেখ ফজলুল হক মনি আর সিরাজুল আলম খান এক কাতারে। তাদের। অনুসারী ছাত্রলীগ নেতারা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ব্যানারে এককাট্টা। তাঁদের দ্বন্দ্ব-কোন্দল আপাতত উধাও। সিরাজুল আলম খানের খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন এস এম হলের তৃতীয় বর্ষের আবাসিক ছাত্র সুমন মাহমুদ। এটি সুমনের কাছে শোনা :
১৯ মার্চ সিরাজ ভাই বিকেলে এস এম হল থেকে আমাকে ডেকে নেন। রিকশায় চড়ে আমরা গেলাম গাউছিয়া মার্কেটে। নিচতলায় কোনার দিকে একটা দোকান ছিল। ইলেকট্রনিকসের জিনিসপত্র বিক্রি হতো। দোকানমালিক সম্ভবত সিরাজ ভাইয়ের পূর্বপরিচিত। সালাম বিনিময়ের পর সিরাজ ভাই একটা বস্তুর দিকে আঙুল দেখিয়ে বললেন, “দিস ওয়ান।’ দোকানমালিক এটা সামনে টেবিলের ওপর রাখলেন। সিরাজ ভাই দোকানমালিককে বললেন, এটা কীভাবে চালানো হয়, সেটা আমাকে দেখিয়ে দিতে। দেখলাম নতুন একটা জিনিস, আগে দেখিনি। এটা একটা থ্রি-ইন-ওয়ান। রেডিও, গ্রামোফোন ও রেকর্ডার একসঙ্গে। এটা নিয়ে আমি হলে চলে এলাম। সিরাজ ভাই আমাকে বলেছিলেন, কেউ একজন এসে আমার কাছ থেকে এটা নিয়ে যাবে। কে আসবেন, জানতে চাইলে উনি বললেন, শরীফ নুরুল আম্বিয়া। তিনি আর আসেননি। [১]
ওই সময় একটা রেডিও ট্রান্সমিটার বানানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। তবে এটি সফল হয়নি। ছাত্রলীগের সহসভাপতি শরীফ নুরুল আম্বিয়া বিষয়টি জানতেন। তাঁর সঙ্গে এ নিয়ে আমার কথা হয়। আমাদের কথাবার্তা ছিল এ রকম :
শরীফ নুরুল আম্বিয়া : ১৯৭০ সালের মার্চে ছাত্রলীগের কনফারেন্সের পর বঙ্গবন্ধু বুয়েটের টিচারদের সঙ্গে একটা মিটিং করতে চেয়েছিলেন, অথবা তার সঙ্গে বুয়েটের টিচারদের বৈঠকের একটা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু টিচারদের একটা বড় অংশ যদি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বসতে না চায়, তাহলে অল্প কয়েকজনকে নিয়ে বৈঠক করাটা দৃষ্টিকটু লাগতে পারে। এ জন্য এ পরিকল্পনা বাদ দেওয়া হয়। আমাদের প্ল্যান ছিল শর্ট রেঞ্জের একটা রেডিও ট্রান্সমিটার বানানো যায় কি না, মোবাইল। এ বিষয়ে আমাদের ধারণা ছিল না। আমাদের ইলেকট্রনিকসের টিচার নূরউল্লাহকে এটা অ্যাসাইন করা ছিল। উনি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করছিলেন। যাহোক, কাজটা হয় নাই।
আমাদের ব্যাচমেট ফজলুর রহমান খুব ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট। সে ওই টিমে জড়িত ছিল। আমি ছিলাম লিয়াজোম্যান। এটা একটা ইম্পর্ট্যান্ট বিষয় ছিল। ফজলুর রহমানের নামটা এখন আর কেউ বলে না। বাট হি ওয়াজ ডিপলি ইনভলভড ইন ইট। এখন বোধ হয় সে অস্ট্রেলিয়ার কোনো ইউনিভার্সিটির প্রফেসর। এক্সট্রা বিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট ছিল।
একাত্তরের ফেব্রুয়ারির শেষে পরিস্থিতি যখন খুব উত্তপ্ত, সিরাজ ভাই একদিন বলল, ওইটার অবস্থা কী?
এখনো ডেলিভারি স্টেজে না। যেহেতু এইটা আমার সাবজেক্ট, আমি এর টেকনিক্যাল দিক অতটা বুঝি না।
মার্চের মধ্যে রেডিও হবে কি না?
এইটা মার্চের প্রথম সপ্তাহের ঘটনা। আমি আবার ওদের বললাম, মার্চে রেডিও হবে কি না। ফজলুর রহমান বলল, ‘চান্স ইজ ভেরি লেস। ও আমার পাশের রুমেই থাকত। আমার রুম ৪০১, ওর রুম ৪০২।
মহিউদ্দিন আহমদ : কোন হল?
আম্বিয়া : শেরেবাংলা হল, নর্থ। আমি, হাসানুল হক ইনু, এহসান শামীম আর শাহ আলম এক রুমে থাকি। সিরাজ ভাইকে বললাম, এটা আর হচ্ছে না। এখন এই গবেষণার আর সময় নাই।
সিক্সটি নাইন মুভমেন্টের পর অনেকেই এ রকম করছে। নানা রকম বোমা বানানো, নানা তরিকা, সার্কিট সিস্টেম, ওয়াকিটকি– যাদের টেকনিক্যাল নলেজ আছে, তারা আইসা আমাদের বলত। মজার বিষয় হইল, আমরা যখন ইন্ডিয়া চইলা যাই, চৌকির নিচে এই সব রাইখা দিছিলাম।
মহি: আপনারা যখন এগুলো করতেছেন, তখন ওই দিকে জিয়াউর রহমান কালুরঘাটে দিয়া দিল একটা ঘোষণা।
আম্বিয়া : না, আমরা তো এসব করছি ২৫ মার্চের আগে।
মহি: এত চিন্তাভাবনা না করে একটা রেডিও সেন্টার তো দখল করা যেত, গেরিলা কায়দায়। সবাই তো বাঙালি, সহযোগিতা পেতেন।
আম্বিয়া : আমাদের তো লক্ষ্য ছিল একটা শর্ট রেঞ্জ মোবাইল রেডিও স্টেশন করা। আমি ২৫ মার্চের পর প্রথম ছয় দিন কেরানীগঞ্জে ছিলাম। তারপর দুই দিন নওয়াবগঞ্জে ছিলাম। তারপর ভাঙ্গায় ছিলাম। এভাবে এক মাস যদি টেম্পোটা ধইরা রাখতে পারি–এর চেয়ে বেশি এই প্ল্যানে পসিবল না। আমাদের চিন্তা ছিল একটা প্রলংগড ওয়ারের জন্য প্রস্তুত হওয়া। আমাদের মাথায় ছিল ভিয়েতনাম আর সেকেন্ড ওয়ার্ল্ড ওয়ারের সময়কার আরবান গেরিলা ওয়ার, প্রট্রেক্টেড ওয়ার। [২]
.
২
বাংলাদেশ স্বাধীন করার ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মনোভাব, এ ব্যাপারে ভারতের পরিকল্পনা, তাদের সঙ্গে যোগাযোগের পটভূমি–এসব বিষয়ের একটি অন্তরঙ্গ বিবরণ পাওয়া যায় ডা. আবু হেনার কাছ থেকে। আবু হেনা ছাত্রলীগের সাবেক নেতা। ১৯৬২ সালে তিনি বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি এবং ১৯৬৩ সালে ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে তিনি সিরাজগঞ্জের বেলকুচি আসন থেকে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। লেখককে দেওয়া সাক্ষাৎকারে আবু হেনা বলেন :
আমরা জাস্টিস ইব্রাহিমের বাসায় ছোট একটা স্টাডি সার্কেল করছিলাম-কেন স্বাধীনতা দরকার। ১৯৬৪-৬৫ সালের কথা। জিরো পয়েন্টের এই মোড়ে, সেক্রেটারিয়েটের কোনায়, ওইখানে একটি পেট্রলপাম্প ছিল। ওইখানে ওনার বাড়ি ছিল। স্টাডি সার্কেল থিকা উনি নেতৃত্ব দিতেন, বুদ্ধি দিতেন। ওনার মেয়ের জামাই ইশতিয়াক সাহেব, কাজী আরেফ, আমি, মাজহারুল হক বাকী, ইকবাল হলের ভিপি হারুন–আমরা সবাই স্টাডি সার্কেলে বসতাম। উনি আমাদের একটা পত্রিকা বানায়া দিতে চাইছেন। বলছেন, ‘গ্রিন রোডে আমার এক বিঘা জায়গা আছে। এইটা নাও, পত্রিকা বের করো। স্বাধীনতার জন্য লাগবে।’
ইব্রাহিম সাহেব বলতেন, মুজিবের মতো বাঘের বাচ্চা ছাড়া স্বাধীনতা হবে না। আমার সামনে বলছে ছয় দফা দেওয়ার আগে। ওরা আমাদের ছোবড়ার মতো ফেলে দিছে। দেশটা স্বাধীন করতে হবে।
আমি সিরাজ ভাইয়ের (সিরাজুল আলম খান) খুব কাছের লোক। সব ঘটনার সূত্রপাত আমি জানতাম। ওনাদের সঙ্গে ভারত সরকারের একটা সম্পর্ক ছিল। এই গ্রুপের সঙ্গে এখানে নেটওয়ার্কে যারা কাজ করত, তার মধ্যে রূপলাল হাউসের জমিদার, শ্যামবাজারের জমিদার–তার ছেলে-রূপা মুখার্জিরে বিয়া কইরা এখানে থাকতেছে। কালিদাস বৈদ্য। কে? একটা রাজনৈতিক দল বানাইছিল, গণমুক্তি দল। সেই দলে ছিল চিত্ত সুতার। পরে কলকাতায় চিত্ত সুতারের ওখানে গিয়া এদের সবার সঙ্গে পরিচয় হইছে। এই নেটওয়ার্কের সঙ্গে সিরাজদের একটা সম্পর্ক ছিল। এই নেটওয়ার্কের কাজ কী ছিল? টু ডিস্টার্ব ইস্ট পাকিস্তান। তারা বলত, ইস্ট পাকিস্তানে হিন্দুদের–মাইনরিটিকে অত্যাচার করা হচ্ছে। তাদের জন্য সেপারেট এনটিটি তৈরি করা দরকার।
‘স্বাধীন বঙ্গভূমি’ বানানোর জন্য ম্যাপ তৈরি হইছিল ইন্ডিয়ায়। আমি জানি এইগুলো মুজিব ভাই জানত। তাজউদ্দীনও জানত। আইয়ুব খান এটা জানতে পারছে, চিত্ত সুতারকে ধইরা জেলে পুরছে। জেল থিকা মুক্ত হইলে মুজিব ভাই ডাইকা পাঠাইল, ‘তুমি হিন্দু হিন্দু করতেছ, আমি বাঙালি বাঙালি করতেছি। আমার পক্ষে তুমি কাজ করো। তুমি ইন্ডিয়া চইলা যাও।’ চিত্ত সুতার কলকাতায় পাটের অফিস নাম দিয়া একটা বাড়িতে থাকে। ইন্ডিয়া বলছে, ‘তুমি তো আমাদের লোক। তাদের একজন লোক দাও।’
শেখ মনি একদিন আওয়ামী লীগ অফিসে বললেন, তোমাকে ক্যালকাটা যাইতে হবে। একজন তরুণ নেতা, যে ইংরেজি-বাংলা জানে, হিন্দি জানে, এই টাইপের একজন। ইলেক্টেড হইলে ভালো হয়।
উনি (মুজিব) বলতেন, বুড়ারা তো মন্ত্রী হইতেছে। আমি তো স্বাধীনতা চাই। আমার স্বাধীনতার সেনা হবি তোরা। ইলেক্টেড হইলেই তোরা নেতা হবি।’ এই নীতি নিয়া আমরা অনেকেই নির্বাচন করছি। ওনার বিশ্বাস ছিল আমাদের ওপর। [৩]
একাত্তরের মার্চে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারত নানাভাবে জড়িয়ে পড়ে। ভারতের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের আগে থেকেই যোগাযোগ ছিল। বরিশালের চিত্তরঞ্জন সুতার ছিলেন শেখ মুজিবের সঙ্গে ভারত সরকারের যোগাযোগের একটি মাধ্যম। এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায় ঢাকার ইংরেজি প্রোব ম্যাগাজিনকে দেওয়া ডা. আবু হেনার একটি সাক্ষাৎকারে। তাঁর সাক্ষাৎকারের অংশবিশেষ সংক্ষেপে এখানে উদ্ধৃত করা হলো :
একাত্তরের ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে মনি ভাই (শেখ ফজলুল হক মনি) আমাকে বললেন, ‘এখন কাজে নামতে হবে, জরুরি একটি কাজে তোমাকে কলকাতা যেতে হবে। সেখানে ভারত সরকারের একজন প্রতিনিধির সঙ্গে দেখা করতে হবে।’ আমি বললাম, মুজিব ভাই না বললে আমি কোথাও যাব না।
১ বা ২ মার্চ মুজিব ভাই আমাকে ডেকে বললেন, আমি ব্যস্ত মানুষ, সব সময় তোমার সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে পারব না। এখন থেকে যা বলার মনিই বলবে এবং এটা আমার কথা বলেই জানবে। তুমি ইংরেজি, হিন্দি, উর্দু ভালোই বলো। এ ছাড়া আমি তোমাকে বিশ্বাস করি এবং সে জন্যই তোমাকে বেছে নিয়েছি।’ এবার মনি ভাই আমাকে কিছু নির্দেশনা দিলেন এবং কলকাতায় চিত্তরঞ্জন সুতারের সঙ্গে দেখা করতে বললেন। আমার প্রতি নির্দেশ ছিল ভারতীয় কর্তৃপক্ষকে বলতে যে যুদ্ধ বাধলে তারা যেন সীমান্ত খোলা রাখে এবং অস্ত্র ও রেডিও ট্রান্সমিটার দিয়ে আমাদের সাহায্য করে।
আমি ৭ মার্চ রওনা হলাম এবং পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে রৌমারী-কুড়িগ্রাম হয়ে সীমান্ত পেরিয়ে কলকাতায় পৌঁছলাম। কিন্তু মনি ভাইয়ের কথামতো সুতারকে পেলাম না। কারণ, তিনি ভুজঙ্গভূষণ নাম নিয়ে কলকাতায় থাকতেন। অবশেষে ভবানীপুরে নর্দার্ন পার্কের কাছে ২১ রাজেন্দ্র রোডের ‘সানি ভিলায় তার সন্ধান পেলাম। সুতার তাঁর স্ত্রী ও সন্তানকে নিয়ে ওই বাড়িতে থাকতেন।
চিত্তরঞ্জন সুতার ১৯৫৪ সালে বরিশাল থেকে প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচিত হয়েছিলেন। আগে তিনি তফসিলি ফেডারেশনের সঙ্গে ছিলেন। পরে আওয়ামী লীগে যোগ দেন। ১৯৫৭ সালে আওয়ামী লীগ ভেঙে ন্যাপ হলে তিনি ন্যাপে যোগ দেন। কালিদাস বৈদ্যকে সঙ্গে নিয়ে তিনি গণমুক্তি পার্টি তৈরি করেছিলেন। পরে এই পার্টি আওয়ামী লীগের সঙ্গে একীভূত হয়। ১৯৬৮ সালে সুতার কলকাতায় চলে যান।
আমি কলকাতায় পৌঁছলাম ১০ বা ১১ মার্চ। ঢাকা ছাড়ার আগেই আমার কোড নম্বর ঠিক করে দেওয়া হয়েছিল ‘৯৯’। ঢাকার ভারতীয় ডেপুটি হাইকমিশন থেকে কলকাতার কর্তৃপক্ষকে এটি জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কলকাতায় সুতারের বাড়িতে আমি উঠলাম। দিল্লি থেকে দুজন ভদ্রলোক এলেন। তাঁরা ইন্দিরা গান্ধীর ঘনিষ্ঠ এবং বাংলায় কথা বলতে পারেন। তাঁদের নাম আমার মনে নেই। আমরা যখন কথা বলছিলাম, সুতারকে সেখানে থাকতে দেওয়া হয়নি।
আমি তাদের যা বলার তা বললাম। তারা বলল, ‘অস্ত্র দিয়ে তোমরা কী করবে? তোমাদের লোকদের পাঠিয়ে দাও, আমরা ওদের প্রশিক্ষণ দেব।’ অস্ত্রের ব্যাপারে ওরা কোনো প্রতিশ্রুতি দিল না। কিন্তু রেডিও ট্রান্সমিটার দিতে এবং সীমান্ত খোলা রাখতে রাজি হলো। শেষে বলল, ‘শেখ মুজিবকে বলল, আমাদের যেন একটি চিঠি দেয়। “দিদি, হেল্প আস, মুজিব” এটুকু লিখলেই যথেষ্ট।’
আমি বললাম, তোমরা পুরো জিনিসটাই দেরি করিয়ে দিচ্ছ। আমি ঢাকায় যাব, তারপর চিঠি নিয়ে আসব, এতে অনেক সময় নষ্ট হবে। ওরা বলল, এটা দরকার, উনি (ইন্দিরা) এটি চান। তারা আরও বলল, ‘রেডিও স্টেশন তৈরি আছে। বর্ডার খোলা থাকবে। বর্ডার পেরিয়ে যারাই আসবে, তাদের থাকার ব্যবস্থা করা হবে।’
আমি যশোর হয়ে ১৪-১৫ মার্চ ঢাকায় ফিরে এলাম এবং মুজিব ভাইকে সব খুলে বললাম। বললাম, ওরা একটা চিঠি চায়। মুজিব ভাই শুনলেন, কিছু বললেন না। তারপর তো ২৫ মার্চ ক্র্যাকডাউন হয়ে গেল। শেখ মুজিব গ্রেপ্তার হলেন। [৪]
আমি শুনেছিলাম ডা. আবু হেনা শেখ মুজিবের দূত হিসেবে এর আগেও কয়েকবার কলকাতায় গেছেন চিত্তরঞ্জন সুতারের কাছে। তথ্যটি তার কাছে যাচাই করতে চাইলাম। তিনি জানালেন, একাত্তরের মার্চের আগে তিনি যাননি। আমি একটু ফাঁপরে পড়ে গেলাম। কার কথা সত্য? ধোঁয়াশা কাটল শেখ শহীদুল ইসলামের সঙ্গে কথা বলে। তিনি ঢাকা কলেজে পড়ার সময় থেকেই (১৯৬২) শেখ মুজিবের বাড়িতে থাকতেন। সম্পর্কে নিকটজন। তিনি বেগম মুজিবের বড় বোনের ছেলে। তিনি অনেক ঘটনার সাক্ষী। তাঁর সঙ্গে আমার আলাপচারিতা ছিল আবু হেনার কলকাতা যাওয়া প্রসঙ্গে।
মহিউদ্দিন আহমদ : চিত্ত সুতারের সঙ্গে কি আপনার আগে কখনো দেখা হয়েছে? তাকে চিনতেন?
শেখ শহীদুল ইসলাম : দেখা হয়েছে, ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে।
মহি : কোন সালে?
শহীদ : ১৯৬৭ সালে। ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের পর ওনাকে অ্যারেস্ট করল না? আমি খালাম্মার (বেগম মুজিব) সঙ্গে গেছি খালুজানের সঙ্গে দেখা করতে। জেলগেটে দেখি ওনার (সুতারের) ওয়াইফ আর খালাম্মা কথা বলতেছে। ওনার ওয়াইফ ছিলেন একটা স্কুলের হেডমিসট্রেস। চিত্ত সুতারের নাম আগে শুনেছি, দেখা হয়। নাই। ওই দিন দেখা হইল। পান খাইতে খাইতে ধুতি পরা এক ভদ্রলোক আসলেন। খালাম্মা আমার সঙ্গে পরিচয় করায়। দিলেন–দাদা, এইটা আমার বোনের ছেলে। তখন আমি জানলাম যে ইনি চিত্ত সুতার।
মহি : উনি ইন্ডিয়া চলে যান কোন সালে?
শহীদ: ওনাকে জেল থেকে আগেই ছেড়ে দেওয়া হইছিল। জেলখানার ভেতরেই কনট্যাক্ট হইছিল। ইন্ডিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য বঙ্গবন্ধু তাঁকে দায়িত্ব দিছিলেন। ২১ রাজেন্দ্র রোডের বাড়ি থেকে হি ইউজড টু অপারেট। বনগাঁয়ের বাড়িটা, যেখানে পরে আমু ভাই থাকতেন, সেইটা ভাড়া নিল, তারপর আগরতলায় শ্রীধর ভিলা। তুরা আর শিলিগুড়িরটা পরে ভাড়া নিছে। কালশিতে (উত্তর প্রদেশে) আমাদের ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করছিল। আমাদের আবু হেনা–তাকে পাঠানো হইল টু মেক আ সার্ভে।
মহি : কোন ইয়ারে?
শহীদ : সত্তরের ইলেকশনের আগে। আবু হেনা কী করল? কায়েদে আজম কলেজের (পরে সোহরাওয়ার্দী কলেজ) বাবুলরে সঙ্গে নিয়া গেল। তখন বঙ্গবন্ধু এইটা স্টপ করে দিলেন। এরে নিয়া যাওয়া ঠিক হয় নাই। জানাজানি হইলে ইলেকশনটা বন্ধ করে দেবে। সুতরাং ইট ওয়াজ স্টপড। তা না হইলে আমরা ফার্স্ট ব্যাচ তো সেভেন্টিতেই চইলা যাই।
মহি: আবু হেনা ভাইকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম। উনি বলেছেন, একাত্তরের আগে কখনো যান নাই।
শহীদ : না না, যাইতে গিয়াই তো এই প্রবলেমটা হইল।
মহি : গিয়েছিল?
শহীদ : বিএসএফের কাছে ধরা পড়ল না? নদীর মধ্য দিয়া বর্ডার ক্রস করতে গেছিল, আবু হেনা আর বাবুল।
মহি: কোন জায়গায়, কোন নদী?
শহীদ : রাজশাহী, পদ্মা নদী দিয়া। ধরা পড়ার পর হি ওয়াজ সেন্ট ব্যাক। বাবুলও ছিল। উনি খালি খালি তারে নিয়া গেছে। [৫]
.
৩
সিরাজুল আলম খান আমাকে বলেছিলেন, গোপনে গড়ে ওঠা বিএলএফের হেডকোয়ার্টার ছিল কেরানীগঞ্জে রতন-গগন-মাখনের বাড়ি। গ্রামের নাম কলাতিয়া। রতনের ভাই বোরহানউদ্দিন গগন ১৯৭৩ সালে জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন।
আমরা জানতাম, একটা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি চলছে। যুদ্ধ সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারণা ছিল না। যুদ্ধের গল্প বইয়ে পড়েছি, সিনেমায় দেখেছি। ১৯৬৫ সালে ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের একটা যুদ্ধ হয়েছিল বটে। তবে সেটা সীমাবদ্ধ ছিল পশ্চিমে। পূর্ব পাকিস্তান ছিল যুদ্ধের বাইরে। যুদ্ধ যে কত ভয়াবহ হতে পারে, তা বোঝার ক্ষমতা আমাদের ছিল না।
মার্চ মাসজুড়ে পথে-ঘাটে অনেক স্লোগান হয়েছে, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো। আমার জানামতে, দেশের বিভিন্ন জায়গায় কয়েকটা বন্দুকের দোকান লুট হয়েছিল ওই সময়। ওই সব দোকানে পাখি। শিকারের জন্য সাধারণ বন্দুক কিংবা পয়েন্ট টু টু বোরের রাইফেল বেচাকেনা হতো। মার্চের প্রথম দিনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠসংলগ্ন জিমনেসিয়ামের পাশে একটা কামরায় ইউওটিসির অনেকগুলো ডামি রাইফেল ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা দরজা ভেঙে ওই ডামি রাইফেলগুলো নিয়ে আসে। এগুলো কাঁধে ঠেকিয়ে রাস্তায় ছাত্রলীগ আর ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীরা কয়েক দিন মিছিল-প্যারেড করে, ছবি তোলে। মার্চের তৃতীয় সপ্তাহে দুদু নামের এক সিরাজভক্ত রাতে ছাত্রলীগের কয়েকজনকে একটা টু টু বোরের রাইফেল হাতে নিয়ে দেখিয়েছিলেন এটা কীভাবে চালাতে হয়। ওটা দিয়ে বড়জোর হাঁস কিংবা বক শিকার করা যায়। আ স ম আবদুর রব উঁচু গলায় স্লোগান দিতেন–বাঁশের লাঠি তৈরি করো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো। তো বাঁশের লাঠি দিয়ে পিটিয়ে পাকিস্তানি সৈন্য এ দেশ থেকে বিদায় করা হবে, এই ছিল চিন্তা, এই ছিল প্রস্তুতি। মনে মনে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা ছিল প্রবল। কিন্তু যুদ্ধ সম্পর্কে নেতাদের বিন্দুমাত্র ধারণা ছিল না। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী হঠাৎ আক্রমণ করে বসলে আমরা সবাই দিশেহারা হয়ে যাই।
২৫ মার্চ রাতে বাংলাদেশের জনগণ আক্রান্ত হলো। দেশ একটি সংকটে পড়েছে এবং সংঘাতের দিকে যাচ্ছে, এটি অনুমিত ছিল। কিন্তু আক্রমণের ভয়াবহতা সবাইকে বিস্মিত করেছিল।
পাকিস্তানের সামরিক শাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে বাঙালির নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আলোচনা শুরু হয় ১৬ মার্চ। তাঁরা কয়েক দফা দলবলসহ, এমনকি একান্তেও বৈঠক করেন। দুই পক্ষের উপদেষ্টারা কয়েক দফা মিলিত হন। পাকিস্তানকে এক রেখে সংকট কাটানোর লক্ষ্যে একটা সংবিধানের খসড়া তৈরির কাজে তারা ব্যস্ত ছিলেন। শেখ মুজিব কোনো ধরনের সামরিক বিকল্পের কথা ভাবেননি। তিনি চেয়েছিলেন সমঝোতার মাধ্যমে একটা নিষ্পত্তি। দুই পক্ষের উপদেষ্টাদের মধ্যে শেষ যোগাযোগ হয়েছিল ২৪ মার্চ। ওই দিন শেখ মুজিবের পক্ষ থেকে ইয়াহিয়ার উপদেষ্টাদের জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল, দেশের নাম হবে ‘কনফেডারেশন অব পাকিস্তান’। প্রস্তাবিত সংবিধানে পাকিস্তানের দুই অংশের জন্য দুটি আলাদা সার্বভৌম সংসদ এবং আলাদা সংবিধানের কথা বলা হয়েছিল। আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব অপেক্ষা করছিলেন, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া একটি ঘোষণার মাধ্যমে বিষয়টি জাতিকে অবহিত করবেন এবং সংকটের একটি সুরাহা হবে। শেখ মুজিবের পক্ষে আলোচক দলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন কামাল হোসেন। ২৫ মার্চ সারা দিন তিনি একটি টেলিফোন কলের আশায় বসে ছিলেন। শেখ মুজিব রাত আটটার দিকে কামাল হোসেনের কাছে জানতে চেয়েছিলেন ফোনটি এসেছিল কি না। ফোন আর আসেনি।
কাউকে না জানিয়ে ইয়াহিয়া খান ২৫ মার্চ সন্ধ্যায় একটি বিশেষ বিমানে ঢাকা ছেড়ে করাচির পথে উড়াল দেন। বঙ্গবন্ধু তার ধানমন্ডির বাসায় অপেক্ষা করছিলেন, কখন আক্রমণটি আসবে। অবশেষে আক্রমণটি শুরু হলো মধ্যরাতে।
আওয়ামী লীগ এবং বিএলএফের শীর্ষ নেতৃত্ব তাকিয়েছিলেন শেখ মুজিবের দিকে, ছিলেন তাঁর নির্দেশের অপেক্ষায়। আক্রমণ এলে কীভাবে তা প্রতিরোধ করা হবে, কিংবা যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে কীভাবে তা মোকাবিলা করা যাবে, তার প্রস্তুতি ছিল না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের কাছ থেকে আওয়ামী লীগের হাইকমান্ডের চারজন সদস্য এবং বিএলএফের চার নেতা জানতেন, তাঁদের কোথায় যেতে হবে। আর জানতেন তাঁরা, যাঁদের এই তথ্যটুকু ওই নেতারা জানিয়েছিলেন। এঁদের সংখ্যা খুব বেশি না।
.
৪
আক্রমণের পর ঢাকার আশপাশে কয়েক দিন আত্মগোপন করে বা নিরাপদ স্থানে থেকে শীর্ষ নেতারা সবাই ছুটলেন ভারত সীমান্তের দিকে। তাঁদের কারও কারও গন্তব্য কলকাতার ভবানীপুরে, ‘সানি ভিলা’।
আবদুর রাজ্জাক এক সাক্ষাৎকারে আমাকে বলেছিলেন, আমরা সবাই বুড়িগঙ্গার অপর পারে কেরানীগঞ্জে শেল্টার নেব। আমাদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর যোগ দেওয়ার কথা। তিনি যেন নিরাপদে পালাতে পারেন, সে জন্য তার বাড়ির পেছন দিকের দেয়ালে একটা মই রাখা ছিল। [৭]
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে গ্রেপ্তার বরণের সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছেন, এটি সিরাজুল আলম খান জানতেন না। তিনি কেরানীগঞ্জের কলাতিয়ায় তাঁর জন্য অপেক্ষা করছিলেন। একাত্তরের এপ্রিলের শেষ দিকে আগরতলায় তাঁর সঙ্গে আমার যখন দেখা হয়, তিনি বলেছিলেন, ‘আমার বিশ্বাস ছিল মুজিব ভাই আসবেন। মনি আর তোফায়েল গগনের বাড়িতে দুদিন অপেক্ষা করে চলে গেল। কিন্তু আমি তাদের সঙ্গে গেলাম না। আমি আরও দুদিন সেখানে থাকলাম। শেষমেশ বুঝলাম, উনি অ্যারেস্ট হয়েছেন।’ [৮]
বিএলএফ নেতাদের পরবর্তী গন্তব্য হলো কলকাতা। কেউ আগে গেলেন, কেউ পরে। ২৫ মার্চ রাত থেকে কলকাতা পৌঁছানো পর্যন্ত ঘটনার একটি ফিরিস্তি দিয়েছেন তোফায়েল আহমেদ। তাঁর সঙ্গে আলাপচারিতায় যেটুকু জানলাম, তা এখানে তুলে ধরছি :
মহি : ২৫ মার্চের ক্র্যাকডাউনের সময় কোথায় ছিলেন?
তোফায়েল : আমি আর মনি ভাই একসঙ্গে ছিলাম। আমাদের সঙ্গে একটা গাড়ি ছিল। গাড়িটা দিয়েছিলেন ব্যবসায়ী জহিরুল ইসলাম। গাড়িতে আমার একটা ব্যাগ ছিল। ওতে কিছু জিনিসপত্র আর একটা রিভলবার ছিল। আমরা গাড়িটা বিজয়নগরে জহিরুল ইসলামের বাসায় রেখে মনি ভাইয়ের আরামবাগের বাসায় গেলাম। ২৭ মার্চ কারফিউ যখন একটু শিথিল হলো, তখন আমরা জহিরুল ইসলামের বাসায় গিয়ে ব্যাগটা নিয়ে আসলাম। গাড়িতেই রওনা দিলাম সদরঘাটের দিকে। তারপর নৌকা করে ওই পারে। গেলাম গগনদের বাড়ি, কেরানীগঞ্জের কলাতিয়ায়। ওইখানে সবার সঙ্গে দেখা হলো–সিরাজ ভাই, রাজ্জাক ভাই। ওইখানে আরও ছিলেন কামারুজ্জামান, মনসুর আলী, আবু হেনা ও আরও অনেকে।
মহি : কলাতিয়ায় কত দিন ছিলেন?
তোফায়েল; ওখান থেকে ২৯ মার্চ কামারুজ্জামান, মনসুর আলী, আবু হেনা, মনি ভাই আর আমি রওনা দিলাম। সারিয়াকান্দি, বগুড়া হয়ে বালুরঘাটে আবু হেনা আগে যে পথে ইন্ডিয়া গিয়েছিল, আমাদের সেই পথেই নিয়ে গেল। মাঝপথে মনসুর আলী সাহেব চলে গেলেন। বললেন, তিনি বাড়ি যাবেন। তিনি সারিয়াকান্দি থেকে নিজ বাড়িতে চলে গেলেন। আমরা বর্ডার ক্রস করে ভারতে গেলাম। আমাদের তো ঠিকানা দেওয়াই ছিল, ২১ রাজেন্দ্র রোড, নর্দার্ন পার্ক, কলকাতা। আবু হেনা তার রুট অনুযায়ী আমাদের নিয়ে গেছে। এপ্রিলের ৪ তারিখ আমরা চারজন কলকাতায় পৌঁছলাম। মনসুর আলী সাহেব পরে গেছেন।
মহি : সিরাজ ভাই কখন গেলেন?
তোফায়েল : সিরাজ ভাই, রাজ্জাক ভাই আমাদের সঙ্গে আসেন নাই। তাঁরা পরে এসেছেন। [৯]
যেহেতু গন্তব্য কলকাতা, মুজিবের অনুসারীদের দরকার একটি অবলম্বন। এমন একজন, যার সঙ্গে কলকাতার যোগাযোগ আছে। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যোগাযোগের দায়িত্ব পালন করেছিলেন আবু হেনা। তার দেওয়া বিবরণটি ছিল এ রকম:
২৫ মার্চ ঢাকায় ক্র্যাকডাউনের মধ্য দিয়ে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। ২৭ মার্চ ক্যাপ্টেন মনসুর আলী সাহেবকে নিয়ে রায়েরবাজার দিয়ে বের হওয়ার সময় কামারুজ্জামান সাহেবের সঙ্গে দেখা হয়। তিনজনে মিলে নদী পার হয়ে জিনজিরা দিয়ে পায়ে হেঁটে রওনা হলাম। পথে পেয়ে গেলাম গোলাম রসুল ময়নাকে। ময়না ছিলেন শেখ মনির ক্লাসমেট। তিনি আমাদের নিয়ে গেলেন কলাতিয়ার বোনের বাড়িতে। এটা ছিল রতন চেয়ারম্যানের বাড়ি। এখানে গিয়ে পেয়ে গেলাম শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ, শাজাহান সিরাজ এবং আ স ম আবদুর রবকে। বিকেলে এসে হাজির হলেন নূরে আলম সিদ্দিকী ও আবদুল কুদুস মাখন।
আমার ইচ্ছা ছিল গ্রামের বাড়িতে যাব। যেহেতু আমি আগেই কলকাতায় গিয়ে সবকিছু দেখে এসেছি, পথঘাট চেনা, তাই সবাই বলল, তোমাকে ছাড়া যাওয়া যাবে না। ফলে আমার সিদ্ধান্ত পাল্টাতে হলো। এখানে মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হলো–আমি, মনসুর আলী, কামারুজ্জামান, শেখ মনি, তোফায়েল–এই পাঁচজন একত্রে কলকাতা রওনা দেব। সিরাজুল আলম খান এবং আবদুর রাজ্জাক আরও কিছু দায়িত্ব সেরে পরে যাবেন।
নৌকায় করে আমরা মানিকগঞ্জে গেলাম। সেখানে হাবু মিয়ার (স্টেট মিনিস্টার ছিলেন) দেখা পেলাম। তাঁর বড় ভাই লেবু মিয়া আমাদের যমুনার পারে পৌঁছে দিলেন। সেখান থেকে দুই দিনের মাথায় ছোট্ট একটা লঞ্চে পৌঁছে গেলাম সিরাজগঞ্জে। এরপর বগুড়ার সারিয়াকান্দি হয়ে হিলি এবং সেখান থেকে সরাসরি কলকাতায় পৌঁছলাম। তবে মনসুর আলী সাহেব কলকাতায় গেলেন না। তিনি সারিয়াকান্দি থেকে আবার সিরাজগঞ্জে ফেরত গেলেন। বললেন, ‘সন্তানদের রেখে আমি যাব না।’ সাত্তার নামে আর্মির অবসরপ্রাপ্ত এক কমান্ডোকে তার সঙ্গে দিলাম। পরে মনসুর আলীকে নিয়ে কলকাতায় গিয়েছিলেন অধ্যাপক আবু সাইয়িদ।
সিরাজুল আলম খান তখন কী করছিলেন? তিনি প্রায়ই এস এম হলে সুমন মাহমুদের কামরায় থাকতেন। তাদের দুজনের দেখা ও কথা হতো নিয়মিত। ওই সময়ের একটি বয়ান পাওয়া যায় সুমনের ভাষ্যে। এখানে ২৫ মার্চ-পরবর্তী দুই সপ্তাহে সিরাজুল আলম খানের গতিবিধি উঠে এসেছে :
২৫ মার্চ সারা দিনই ছিল উত্তেজনায় ভরা। রাত সাড়ে ১০টায় থ্রি ইন-ওয়ান খুলে রেডিওতে বিবিসির সংবাদ শুনছিলাম। হঠাৎ হলের গেটের কাছ থেকে চিৎকার। কেউ আমার নাম ধরে ডাকছে–বাবুল, বাবুল। ততক্ষণে তিনি আমার কামরার দরজার কাছে চলে এসেছেন–সিরাজ ভাই। ‘হাঁক দিলেন, তাড়াতাড়ি বের হও।’
এস এম হলের ১৬৫ নম্বর কামরায় আমরা চারজন থাকি। এই কামরার একটা ইতিহাস আছে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সৈন্যদের ক্যাম্প ছিল এই হলে। এই কামরা স্টোর হিসেবে ব্যবহার করা হতো। কামরার ওপরে সিলিং, যা অন্য কোনো কামরায় ছিল না। দ্বিতীয়ত, ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক শেখ ফজলুল হক মনি এই কামরায় থাকতেন।
আমরা যে চারজন এই কামরার বাসিন্দা, তাদের দুজন আগেই বাড়ি চলে গেছে। এদের একজন হলো বদিউর রহমান (পরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান), আরেকজনের নাম রেজাউল, পরে কানাডায় চলে গেছে। আমি আর হাবিবুল্লাহ আছি।
আমি তড়িঘড়ি একটা লুঙ্গির মধ্যে কিছু কাপড়চোপড় আর থ্রি ইন-ওয়ানটা ভরে একটা বোঁচকা বানিয়ে ফেললাম। হাবিবুল্লাহও রেডি হলো। কী মনে করে কয়েক দিন আগে আমরা দুজন কমব্যাট বুট কিনেছিলাম। সেগুলোও সঙ্গে নিলাম। সিরাজ ভাই মোটরবাইক নিয়ে এসেছেন। রাস্তায় গাছ কেটে আড়াআড়ি করে ফেলে রাখা হয়েছে। এগুলো ব্যারিকেড। ফুটপাত দিয়ে মোটরবাইক ঠেলে ঠেলে যাচ্ছি। পলাশী রেলক্রসিং পার হয়ে আজাদ অফিসের দিকে গেলাম। লালবাগ কেল্লার ডান দিকে একটা গলি। সেখানে বস্তির মতো জায়গায় একটা ঘর। ইটের দেয়াল, টিনের চাল। রাস্তা বরাবর দরজা। আমানুল্লাহ নামের এক শ্রমিকনেতা থাকেন সেখানে। আমরা ওই ঘরে উঠলাম। হাবিবুল্লাহ আর আমি বের হলাম খাবারের খোঁজে। ১৫-২০ মিনিটের মধ্যেই আমরা মোড়ের দোকান থেকে পরোটা-মাংস নিয়ে ফিরলাম। তখনই শুরু হয়ে গেল। গোলাগুলি। সিরাজ ভাইকে বেশ পুলকিত মনে হলো।
এই যে, দেখেছ?
মানে অ্যাকশন শুরু হয়ে গেছে। একটু পরে শুরু হলো প্রচণ্ড শব্দ। ঘুমানোর প্রশ্নই আসে না। সারা রাত বসে বসেই কাটালাম।
আমরা বড়জোর ১৫ মিনিট ঘরের বাইরে ছিলাম। লালবাগ থানা তখন কেল্লার ভেতরে। হেঁটে যেতে চার-পাঁচ মিনিট লাগে। এর মধ্যে দৌড় দিয়ে সিরাজ ভাই থানা ঘুরে এসেছিল কি না, জানি না। জিজ্ঞেস করিনি, উনিও বলেননি। পরে শুনেছি, উনি নাকি ওই রাতে লালবাগ থানায় গিয়েছিলেন।
ভোরের আলো ফোঁটার আগেই বোঁচকা নিয়ে আবার বের হলাম। মোটরবাইক থাকল আমানুল্লাহর কাছে। পুরান ঢাকার সব অলিগলি সিরাজ ভাইয়ের চেনা। হেঁটে হেঁটে পৌঁছালাম। সোয়ারীঘাট। একটা নৌকায় উঠলাম। জায়গাটি আমার চেনা। সিরাজ ভাইয়ের সঙ্গে অনেকবার এসেছি এ জায়গায় বাঁশ কিনতে। প্যান্ডেল বানাতে, মশাল বানাতে বাঁশ লাগত প্রায়ই। এ ছাড়া মাইকের খুঁটি এবং মারামারির জন্যও বাশ লাগত।
নদী পার হয়ে গেলাম কামরাঙ্গীরচর। ভেজা পথ। কিছু দূরে আবারও নদী। আরেকটা নৌকায় উঠলাম। ওপারে নেমে একটু হেঁটে একটা বাড়িতে গেলাম। এক বর্ধিষ্ণু গৃহস্থের বাড়ি। এটা হলো মোস্তফা মোহসীন মন্টুর নানাবাড়ি। খোঁজ করে জানলাম, মন্টু ভাই কেরানীগঞ্জ থানায় গেছেন অস্ত্র আনতে।
কিছুক্ষণ পর মন্টু ভাই এলেন। সঙ্গে সাত-আটজন সশস্ত্র লোক। থানা থেকে অস্ত্রশস্ত্র সবই নিয়ে এসেছেন। সবাই একসঙ্গে বের হলাম। কিছু দূরে বড় একটা পুকুর। চারপাশে গাছপালা। পুকুরপাড়ে কিছু লোক হতাশ ভঙ্গিতে শুয়ে-বসে আছে। কারও কারও সঙ্গে রাইফেল। ২৫ জনের মতো। সবার কাপড় ভেজা। দেখেই বোঝা যায়, এরা ইপিআরের সৈন্য। রাতে নদী সাঁতরে এখানে এসেছে। সিরাজ ভাই ওদের সঙ্গে কথাবার্তা বললেন। এমন সময় হাবিবুল্লাহর ইচ্ছা হলো বাড়ি যাওয়ার।
কোথায় যাবা তুমি?
কাছেই সৈয়দপুরে লঞ্চঘাট আছে। ওখান থেকে লঞ্চে বাড়ি যেতে পারব। ২০টা টাকা দাও।
ওর বাড়ি কুমিল্লায় ধারিয়ারচর। ও চলে গেল। আমরা সবাই মন্টু ভাইয়ের নানাবাড়িতে দুপুরের খাবার খেলাম। ঢাকা শহর থেকে তুমুল শব্দ ভেসে আসছে। এর সঙ্গে ধোয়া। এদিকে এ বাড়িতে লোকজনের আসা-যাওয়ার বিরাম নেই। সিরাজ ভাই তাদের নিয়ে গ্রুপ গ্রুপ করে কথা বলছেন, এদিক-সেদিক পাঠাচ্ছেন। সন্ধ্যায় আমরা দুজন আবার বের হলাম। নদীর ঘাট থেকে একটা নৌকা নিলাম। আমাদের সঙ্গে আরও তিন-চারজন। ২৬ মার্চ সন্ধ্যা। ঢাকা শহরে আগুন জ্বলছে। মানুষ ছুটছে পাগলের মতো, নদী পার হচ্ছে।
নদীর মধ্য দিয়ে কিছুদূর গিয়ে আমরা একটা ঘাটে নামলাম। সেখানে কয়েকজন লোক দাঁড়িয়ে। সিরাজ ভাই তাদের সঙ্গে কথা বললেন। আমরা অন্ধকারের মধ্যেই হাঁটছি। এক ঘণ্টার বেশি হেঁটে একটা বাজারের মধ্যে এলাম। বেশ বড় একটা পুকুর। এক পাশে বড় বড় দুটি টিনের ঘর, মেঝে পাকা। জানলাম, এই গ্রামের নাম কলাতিয়া, এটা রতন-গগনদের বাড়ি। একটা ঘরে আমাদের দুজনকে থাকতে দিল। অন্যরা আমাদের পৌঁছে দিয়ে চলে গেছে। এভাবেই পার হলো ২৬ মার্চের রাত।
পরদিন ভোরে আবার গেলাম মন্টু ভাইয়ের নানাবাড়ি। সেখানে দেখলাম তোফায়েল আহমেদ, আবদুর রাজ্জাক, রতন-গগনদের ভগ্নিপতি ময়না ভাই এবং আরও কয়েকজন। দেখলাম ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, এ এইচ এম কামারুজ্জামান ও আবু হেনা বসে আছেন। এ ছাড়া শেখ ফজলুল হক মনি, নূরে আলম সিদ্দিকী, শাজাহান সিরাজ ও আবদুল কুদুস মাখনও আছেন। আমি আ স ম আবদুর রবের খোঁজ করলাম। শুনলাম, তিনি এখানে এসেছিলেন, চাঁদপুরে চলে গেছেন।
পরদিন ২৮ মার্চ। আমি রেডিওর নব ঘোরাচ্ছি। সকাল ১০টা সোয়া ১০টার দিকে চট্টগ্রাম বেতার ধরা পড়ল। তখন মেজর জিয়ার ঘোষণা শুনলাম। সঙ্গে সঙ্গে রেকর্ডার অন করে রেকর্ড করলাম। ‘জিয়া’ শব্দটির উচ্চারণ ছিল ‘ইয়া’। তোফায়েল ভাই মন্তব্য করলেন, ‘এইটা আবার কোন মেজর ইয়া।’
পরদিন মনসুর আলী, কামারুজ্জামান, শেখ মনি, তোফায়েল আহমেদ আর আবু হেনা চলে গেলেন একটা লঞ্চে। কেউ একজন এসে রিপোর্ট করল, তাজউদ্দীন আহমদ কেরানীগঞ্জ হয়ে নদী পার হয়ে চলে গেছেন, এখানে থামেননি। শাজাহান সিরাজ, নূরে আলম সিদ্দিকী ও আবদুল কুদুস মাখনও অন্য পথে চলে যান।
সকালে সিরাজ ভাই, রাজ্জাক ভাই আর আমি একসঙ্গে বের হলাম। সঙ্গে একজন গাইড। সারা দিন হেঁটে সন্ধ্যায় পৌঁছালাম সৈয়দপুরে। বাজারে একজন নাপিত বসেছিল কুপি জ্বালিয়ে। সিরাজ ভাই বসে পড়লেন ওখানে। নাপিত চুল হেঁটে দিল, দাড়ি গোঁফ কামিয়ে দিল। ওখানে দেখা হলো খসরু ভাই, হাসানুজ্জামান (জুডো মনি) এবং আরেকজনের সঙ্গে। সেখান থেকে আমরা লঞ্চে করে চলে গেলাম মুন্সিগঞ্জে, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেনের বাড়িতে। সেখান থেকে বড় একটা নৌকায় করে ওপারে গেলাম। খসরু ভাইয়ের কোমরে একটা পিস্তল গোজা। হাঁটতে অসুবিধা হচ্ছে। পিস্তলটা তিনি আমার বোঁচকার মধ্যে রাখলেন। রাতে চরের মধ্যে একটা বাড়িতে থাকলাম।
পরদিন ভোরে আবার হাঁটা শুরু। শরীয়তপুরের এক জায়গায় আমরা গেলাম ইত্তেফাক-এর সাংবাদিক আমির হোসেনের বাড়িতে। সেখানে কিছুক্ষণ জিরিয়ে নিয়ে আবার পথচলা। পথে একটা ঘোড়া জোগাড় করে খসরু ভাই তার ওপর চড়ে বসলেন।
আমরা পাঁচজন হাঁটছি। খসরু ভাই ঘোড়ায়। সঙ্গে রেডিও জাতীয় একটা জিনিস। দেখে গ্রামের লোকের সন্দেহ হলো। তারা আমাদের ঘেরাও করে ফেলল। পরে রাজ্জাক ভাইয়ের পরিচয় পেয়ে তারা বদলে গেল। রাজ্জাক ভাই ওই এলাকা থেকে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন।
সন্ধ্যায় পৌঁছালাম মাদারীপুর। আসমত আলী খান সেখানে জাতীয় পরিষদের সদস্য। তাঁর বাড়িতে উঠলাম। আসমত আলী খানের ছেলে শাহজাহান খান সেখানে ছিলেন। খবর পেয়ে এলেন ফণীভূষণ মজুমদার। এসডিও সাহেবের জিপ চেয়ে আনা হলো। ফণী মজুমদারকে সঙ্গে নিয়ে আমরা টেকেরহাট গেলাম। সেখান থেকে একটা লঞ্চে করে পরদিন ভোরে পৌঁছালাম মোল্লারহাট। আমার বাবা নিজামউদ্দিন আহমদ মোল্লাহাটের ওসি, থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। উনি তখন খুলনায়। আমাদের বাসায় তখন খুলনার এসপি সাহেবের পরিবার। তারা খুলনা থেকে এখানে চলে এসেছেন। আমরা থানার একটা ইন্সপেকশন কামরায় উঠলাম।
নাশতা খেয়ে রাজ্জাক ভাই, খসরু ভাই আর জুডো মনি বিদায় নিলেন। এসপি সাহেবের পরিবার ৪ এপ্রিল মোল্লাহাট ছেড়ে চলে যায়। আব্বা-আম্মা এসে যান বাসায়।
কলাতিয়া ছেড়ে যাওয়ার আগে সিরাজ ভাইকে একটা খাম দিয়েছিলেন মনি ভাই। ৯ এপ্রিল আমরা সকালে নৌকা করে মোল্লাহাটের পাশে টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে যাই। সেখানে অল্প কয়েকজন লোক ছিলেন। সিরাজ ভাই তাঁদের সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বললেন। কাছাকাছিই মনি ভাইয়ের স্ত্রী শামসুননেসা আরজু থাকেন। সিরাজ ভাই তাঁকে খামটা দিলেন। ভেতরে একটা চেক আর ছোট একটা চিরকুট।
টুঙ্গিপাড়ায় ফিরে আসার পর দেখা পেলাম বঙ্গবন্ধুর ছোট ভাই শেখ নাসের আর কামালউদ্দিন সিদ্দিকীর। কামাল সিদ্দিকী নড়াইলের এসডিও। সিরাজ ভাইকে আগে থেকেই চেনেন। শেখ নাসের টুঙ্গিপাড়ায় থেকে গেলেন। কামাল সিদ্দিকী, সিরাজ ভাই আর আমি লঞ্চে করে রওনা হলাম। ওই লঞ্চে করেই কামাল সিদ্দিকী এসেছিলেন। ঘণ্টা তিনেক পর রাত নয়টার দিকে পৌঁছালাম পিরোজপুরের হুলারহাট। আমরা রিকশা করে পিরোজপুর শহরে গেলাম। একটা ডাকবাংলোয় থাকার ব্যবস্থা হলো।
কিছুক্ষণ পর এক তরুণ এলেন। তিনি লেফটেন্যান্ট জিয়াউদ্দিন। কামাল সিদ্দিকী রাতে থাকার জন্য আরেক জায়গায় চলে গেলেন। পরদিন সকালে এল ছাত্রলীগের নেতা আবুল হাসিব খান। নাশতা খাওয়ার জন্য আমরা এসডিপিও ফয়জুর রহমানের বাসায় গেলাম। ওই সময় হাজির হলেন মেজর জলিল। তিনি বললেন, অস্ত্র লাগবে। তিনি লঞ্চে করে অস্ত্রের খোঁজে বের হয়েছেন। কামাল সিদ্দিকী, সিরাজ ভাই আর আমি ওই লঞ্চে উঠলাম। সঙ্গে মেজর জলিলের কয়েকজন লোক। সন্ধ্যার আগেই পৌঁছে গেলাম মোল্লাহাট।
আমার ছোট বোনের স্বামী নাজমুল আলম তখন খুলনার এনডিসি। তিনি কামাল সিদ্দিকীর বড় ভাইয়ের বন্ধু। আমাকে সেখানে রেখে তারা বেরিয়ে গেলেন। ১০ এপ্রিল সন্ধ্যা। নাজমুলও তাঁদের সঙ্গে গেলেন। সিরাজ ভাই বললেন, তিনি তিন-চার দিনের মধ্যে ফিরবেন। চতুর্থ দিন লঞ্চ এল। নাজমুলও ফিরে এলেন। কুষ্টিয়ার কুমারখালী থেকে অনেক অস্ত্র নিয়ে এসেছেন লঞ্চে করে। কুষ্টিয়া থেকে নূর আলম জিকুকে সঙ্গে নিয়ে কামাল সিদ্দিকী আর সিরাজ ভাই সীমানা পেরিয়ে ভারতে চলে গেছেন। অস্ত্রের চালান গেল পিরোজপুরে মেজর জলিলের কাছে। আমি মোল্লারহাটে অপেক্ষা করলাম ১০ জুলাই পর্যন্ত। সিরাজ ভাই আর আসেননি। কোনো সংবাদও পাঠাননি। [১১]
বদিউল আলম জগন্নাথ কলেজে বিএ পড়তেন। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সহসম্পাদক ছিলেন। থাকতেন জিন্নাহ হলে (এখন সূর্য সেন হল) রেজাউল হক মুশতাকের কামরায়। মুশতাক ছিলেন ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সহদপ্তর সম্পাদক। জিন্নাহ হলে ওই সময় ছাত্রলীগের সংগঠকদের মধ্যে আরও ছিলেন ছাত্রলীগের সহসম্পাদক আ ফ ম মাহবুবুল হক এবং হলের সংগঠক আফতাব আহমাদ। বদিউল ২৫ মার্চের পর তাঁর নিজের অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়েছেন এক সাক্ষাৎকারে :
বদিউল আলম : একাত্তরের ক্র্যাকডাউনের পর রেজাউল হক মুশতাক, আ ফ ম মাহবুবুল হক, আফতাব আহমাদ, রফিকুল ইসলাম আর আমি একসঙ্গে ছিলাম কেরানীগঞ্জে, মন্টু ভাইদের বাড়িতে। আমাদের ওখানে রেখে সিরাজুল আলম খান কোথায় চলে গেলেন, কিছুই বলে গেলেন না। আমরা ঠিক করলাম, ইন্ডিয়া চলে যাব। যাওয়ার আগে শহরে ঢুকলাম ২৭ মার্চ। হলে গিয়ে কাপড়চোপড় নিয়ে রওনা দিলাম ফরিদপুরের দিকে।
২৫ মার্চ রাতে মুশতাক আর আমি একসঙ্গে পলাশীতে ছিলাম। ২৬ মার্চ পুরান ঢাকায় চকবাজারে মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিনের বাসায় ভাত খেয়ে আমরা নদী পার হয়ে কেরানীগঞ্জে চলে যাই। মুশতাক সিরাজদিখান থেকে চাঁদপুর হয়ে চিটাগাং চলে যায়। আমি, আফতাব ভাই, মাহবুব ভাই, রফিক–চারজন একসঙ্গে রওনা দিয়ে ফরিদপুরে যাই। ওখান থেকে রাজবাড়ী যাওয়ার পথে একটা গাড়িতে সিরাজুল আলম খানের সঙ্গে দেখা। আমাদের গাড়িতে ওঠালেন। তারপর আমাদের নিয়ে কুমারখালীর এমপির বাড়িতে রেখে বললেন, ‘তোমরা এখানে থাকো।’ ওখানে এক দিন থাকার পর জানলাম ফরিদপুরে পাকিস্তানিরা অ্যাটাক করেছে। তখন আমরা রেললাইন ধরে হেঁটে কুষ্টিয়া শহরে চলে যাই। ওখানে এসপি ছিলেন মামুন সাহেব। তিনি বিদ্রোহ করলেন। তাঁদের সব অস্ত্র আমাদের ছেলেদের দিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু ইন্ডিয়া গেলেন না। পরে পাকিস্তানিদের হাতে নির্মমভাবে নিহত হন।
কুষ্টিয়ায় জানতে পারলাম, নদীয়ায় ‘জয় বাংলা ক্যাম্প’ হয়েছে। আমরা চুয়াডাঙ্গা হয়ে গেদে বর্ডার দিয়ে রানাঘাট পৌঁছালাম। ওপারে গিয়ে আমরা অঝোরে কেঁদেছি। আমাদের জন্য কোনো ডিরেকশন ছিল না।
রানাঘাট থেকে ট্রেনে যাচ্ছি নদীয়ার দিকে। ট্রেনে কয়েকজন আমাদের দেখে বলল, ‘আপনারা কি জয় বাংলার লোক?’ একজন বুড়ো লোক বলল, ‘সেই তো আসতে হলো দাদা, কী লাভ হলো মালাউনদের কেটে?’
আমরা নদীয়ায় নামলাম। গেলাম জয় বাংলা অফিসে। দেখি যে সেখানে দাঁড়িয়ে ফণীভূষণ মজুমদার। সেখান থেকে ফণীদাসহ আমরা শিয়ালদা গেলাম। খুঁজতে খুঁজতে পেয়ে গেলাম এমএলএ হোস্টেলে। সেখানে রব ভাই, শাজাহান সিরাজকে পেলাম। সেখানে ছিলেন যুব কংগ্রেসের নেতা প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি এবং ছাত্রনেতা সুব্রত মুখার্জি। শাজাহান সিরাজ তাদের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন। আমার হাতে ছিল চে গুয়েভারার গেরিলা ওয়ারফেয়ার। মুখার্জি এটা হাতে নিয়ে একটু উল্টেপাল্টে দেখে শাজাহান সিরাজকে বললেন, ‘দাদা, আপনার ছেলেদের তো দেখি লাল লাল ভাব!’
সেখান থেকে আমরা চলে যাই কিড স্ট্রিটে ডা. বিধান রায়ের বাড়ি। সেখানে থাকার ব্যবস্থা হলো। ট্রেনিংয়ে যাওয়ার আগে সেখানেই ছিলাম। তারপর তো বিএলএফের ট্রেনিং।
মহিউদ্দিন আহমদ : তোমরা যদি কলকাতায় না যেতে, এ যোগাযোগটা না হতো, তাহলে তো তোমরা বিএলএফে যেতে পারতে না? তোমাদের তো আগে কোনো ডিরেকশন দেওয়া হয়নি।
বদিউল : না, আমরা কোনো ডিরেকশন পাইনি।
মহি: তার মানে, আগে থেকে আমাদের প্রস্তুতি ছিল, এটা তো বলা যাবে না। তুমি ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সহসম্পাদক। অথচ তুমি জানো না কোথায় যেতে হবে!
বদিউল : সিরাজুল আলম খান তো আমাদের কেরানীগঞ্জে রেখে চলে গেলেন। তারপর রাজবাড়িতে দেখা। তখনো কিছু বলেননি।
মহি: ট্রেনিংয়েই তো তোমার সঙ্গে আমার দেখা হলো। এটা তো কাকতালীয়।
বদিউল : হ্যাঁ। রাজশাহীতে আমাদের লোক ছিলেন ডা. করিম। বর্ডার ক্রস করার পর তাঁকে তো বিএসএফ বেদম পিটিয়েছে, নকশাল মনে করে। আসলে কোনো যোগাযোগ বা সমন্বয় ছিল না। [১২]
শরীফ নুরুল আম্বিয়া ছিলেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শেষ বর্ষের ছাত্র। একই সঙ্গে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি। তিনি ছিলেন বুয়েটে সিরাজুল আলম খানের একজন। আস্থাভাজন সংগঠক। সবার মতো তিনিও চেয়েছিলেন একটা যুদ্ধ, দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ। কেমন ছিল তার প্রস্তুতি। এ নিয়ে তাঁর সঙ্গে আমার কথোপকথন এখানে তুলে ধরলাম :
মহি : ২৫ মার্চ রাতে আপনি কোথায় ছিলেন?
আম্বিয়া : ওয়ারীতে ছিলাম, ডাক্তার মাহমুদুর রহমানের বাসায়। উনি সম্পর্কে ইনুর খালাতো ভাই। আমাদের বানানো কিছু। জিনিসপত্র ছিল। এগুলো সালেহ মৌলভিকে দিলাম। সে বলল, আমি সিরাজ মিয়ার লোক, কোনো অসুবিধা নাই। পলাশীর বস্তিতে এগুলো রাইখা দিব।
রেললাইন ধরে আমরা যখন শহীদ মিনার পার হই, তখন মাথার ওপর দিয়া ট্রেসার বুলেট যাইতেছে। আমাদের সঙ্গে ছিল জগন্নাথ কলেজের নজরুল। ওয়ারীতে মাহমুদুর রহমানের বাসায় দুই দিন ছিলাম। ২৭ মার্চ আমরা এদিক-ওদিক হেঁটে সন্ধ্যার সময়। আজিমপুরে এলাম। ওয়েস্ট এন্ড হাইস্কুলে এক রাত থাকলাম। তখন জানলাম, নেতারা নদীর ওপারে চলে গেছে। পরদিন ওপারে গিয়ে এক দিন থাকলাম সৈয়দপুর ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যানের অফিসে। ওখানে ইপিআরের অনেকেই ছিল, রাইফেল হাতে। ওখানে আরেফ ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ হলো। পরে ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের নেতা ইয়াহিয়া খান পিন্টুর বাড়ি পাড়াগ্রামে ছিলাম। আমি, ইনু, আরেফ ভাই আর সেলিম ভূঁইয়া প্রায় এক মাস ছিলাম। ওখানে ওয়েট করলাম। কারণ, আরেফ ভাই। বলল, সাপ্লাই আসবে। মাঝেমধ্যে ঢাকা শহরে এসে যোগাযোগ। করতাম। কাউকে পেয়েছি, কাউকে পাই নাই।
এপ্রিল চলে যাচ্ছে। সাপ্লাই-টাপ্লাই আর আসে না। আরেফ ভাই অস্থির হয়ে গেছে। আমরা ঠিক করলাম নদীর ওপারে টুলু (মাজহারুল হক টুলু) ভাইয়ের বাড়ির কাছ দিয়ে বের হয়ে যাব। সেটা সম্ভব হলো না। কারণ, নদীর ওপারে আর্মি ক্যাম্প বসিয়েছে। পরে আমরা মানিকগঞ্জ হয়ে লঞ্চে পাবনা, তারপর হেঁটে কুষ্টিয়া হয়ে জলঙ্গি বর্ডার দিয়ে ইন্ডিয়া চলে গেলাম। বিএসএফ আমাদের অ্যারেস্ট করল। মানে হেফাজতে নিল। ওরা বলল, এখানে জয় বাংলা অফিস আছে, ওখানে যান। জলঙ্গির করিমপুরে রাজশাহীর এক ছাত্রনেতা ছিল। সে বলল, কলকাতায় গেলে সব নেতাকে পাওয়া যাবে। দুপুরে খাওয়াদাওয়া করে বাসে করে তিন ঘণ্টায় কলকাতা পৌঁছালাম।
মহি: চিত্ত সুতারের বাড়ি?
আম্বিয়া : না, প্রিন্সেপ স্ট্রিট। দেখলাম, ওখানে অনেক লোকজন থাকে, খাওয়াদাওয়া হয়, ডাল-ভাত। একটা ট্রানজিট ক্যাম্পের মতো। ওখানে কয়েক দিন ছিলাম। তারপর যোগাযোগ করে চিত্ত সুতারের বাড়িতে গেলাম। সেখানে সিরাজ ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হলো।
মহি : চিত্ত সুতারের বাড়ির রেফারেন্স পেলেন কোথায়?
আম্বিয়া : আরেফ ভাই জানতেন।
মহি: আরেফ ভাইসহ গেলেন?
আম্বিয়া : না। আরেফ ভাইয়ের শরীর খারাপ ছিল। তাকে রেখেই আমরা চলে এসেছিলাম। আমি, ইনু, সেলিম ভূঁইয়া–আমরা তিনজন। মানিকগঞ্জেই উনি লঞ্চ থেকে নেমে যান। তার মাইন্ডে অন্য কিছু ছিল কি না, জানি না।
মহি : টুলু ভাই আমাকে বলেছে, আরেফ ভাই কলকাতা গেছে জুনে।
আম্বিয়া : হ্যাঁ, আরেফ ভাই পরে গেছেন। আমরা তো গেছি মে মাসে। উনি মাসখানেক পরে গেছেন। তাকে চিনতে পারি নাই। মুখভর্তি দাড়ি। বিএসএফের কাছে আমরা সিরাজুল আলম খান আর আবদুর রাজ্জাকের নাম বলেছি। এটা রিপোর্টেড হইছে। ওনারা জানছেন। জানার পর আমাদের নিয়া গেছেন।
মহি : বিএসএফের সঙ্গে যোগাযোগ কি প্রিন্সেপ স্ট্রিটে?
আম্বিয়া : না, বর্ডারে। ইনুর কাছে পিস্তল ছিল। ওটা নিয়া গেছে। আমাদের দু-এক বেলা খাওয়ার টাকা আর বাসভাড়া দিছে।
সিরাজ ভাই বললেন, তোমরা রেডি থাকো। ব্যবস্থা হচ্ছে। তোমাদের ট্রেনিংয়ে যাইতে হবে। [১৩]
রায়হান ফিরদাউস (মধু) মুহসীন হলেই থাকত। আমরা একই ব্যাচের। হাতের লেখা সুন্দর। ছাত্রলীগের জন্য লিফলেট লেখা, পোস্টার আঁকা–এসব করত সে। ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতৃত্ব তো বটেই, সিরাজুল আলম খানের সঙ্গে তার সখ্য ছিল চোখে পড়ার মতো। ২৫ মার্চ-পরবর্তী সময়টি তার কেমন কেটেছে, এটি তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম। সে তার অভিজ্ঞতার বয়ান দিল এভাবে :
২৫ মার্চ রাতে আ ফ ম মাহবুবুল হক আর আমি একসঙ্গে ছিলাম। রাত কেটেছে বকশীবাজারের কাছে এক বাসায়। ২৬ মার্চ সকালে ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটির রেজিস্ট্রার বিল্ডিংয়ের কাছে কিছুক্ষণ ছিলাম। বিকেলে নদী পার হয়ে কেরানীগঞ্জে চলে যাই। ২৭ তারিখ ঢাকা শহরে একবার ঢুকেছিলাম। ওই সময় মাহবুব ভাইয়ের সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। বিকেলে আবার যাই কেরানীগঞ্জে। ২৮ তারিখ দেখা হয় রব ভাইয়ের সঙ্গে। আমরা দুজন ২৯ মার্চ দিঘলি হয়ে লঞ্চে চলে যাই চাঁদপুরে। রব ভাই এক পাতার একটা পত্রিকা বের করার প্ল্যান করেন, মুক্তিযুদ্ধ-টুদ্ধ–এই সবের খবর দিয়ে। তিন দিন পর রায়পুর হয়ে মাইজদী যাই, উঠি কচি ভাইয়ের বাড়ি। আমাকে ওখানে রেখে রব ভাই আগরতলা রওনা হয়ে যান। বলে যান, আমাকে খবর পাঠাবেন। খবর আর আসে না। আওয়ামী লীগ নেতা নুরুল হক, ছাত্রলীগের ইকবাল হলের নেতা ফজলে এলাহি আর আমি সপ্তাহখানেক পর ঠিক করলাম, আগরতলা যাব। গেলাম। কিন্তু সেখানে ঘোরাঘুরি করে পরিচিত কাউকে পেলাম না। তিনজনই মাইজদী ফিরে আসি। তারপর আমি চট্টগ্রামে চলে যাই।
অক্টোবরের শেষ দিকে আহমদ শরীফ মুনিরকে সঙ্গে নিয়ে আবার গেলাম আগরতলা। শ্রীধর ভিলায় পেলাম রব ভাইকে। দেখা হলো আরও অনেকের সঙ্গে। নভেম্বরের ২৩ তারিখ আমি কলকাতা যাই। সেখান থেকে শিলিগুড়িতে বিএলএফের পাংগা ক্যাম্পে। তার আগেই ট্রেনিং শেষ।
মার্চের কোনো এক সময় সিরাজ ভাই বলেছিলেন কী করতে হবে, কী কী করণীয়। ইন্ডিয়া যাওয়ার কথা কখনো বলেননি। [১৪]
.
তথ্যসূত্র
১. সুমন মাহমুদ
২. শরীফ নুরুল আম্বিয়া
৩. আবু হেনা
8. The Untold story of Dr. Abu Hena, interview by Anwar Parvez Halim, Probe, Issue 5, Volume 13, December 16-31, 2014, p. 19-22
৫. শেখ শহীদুল ইসলাম।
৬. তথ্য মন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার (১৯৮৫), বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র, পঞ্চদশ খণ্ড, ড. কামাল হোসেনের সাক্ষাৎকার’, পৃ. ২৭২-২৭৭
৭. আবদুর রাজ্জাক
৮. সিরাজুল আলম খান
৯. তোফায়েল আহমেদ
১০. The Untold Story of Abu Hena
১১. সুমন মাহমুদ
১২. বদিউল আলম
১৩, শরীফ নুরুল আম্বিয়া
১৪. রায়হান ফিরদাউস