দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
জাঁ ভলজাঁ আবার ধরা পড়ে।
এই বেদনাদায়ক ঘটনার খুঁটিনাটির মধ্যে যাব না আমরা। আমরা শুধু মন্ত্রিউল-সুর মের-এ সংঘটিত ঘটনাবলির মাস কয়েক পরে দুটি সংবাদপত্রে যে দুটি সংবাদ প্রকাশিত হয়, তা তুলে ধরব। এ বিষয়ে প্রথম সংবাদটি প্রকাশিত হয় ১৮২৩ সালের ২৫ জুলাই তারিখে। এই সংবাদে যে বিবরণ প্রকাশিত হয় তা হল এই;
পাশ দ্য ক্যালো জেলায় সম্প্রতি এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে। ম্যাদলেন নামে এক নবাগত ব্যক্তি এই অঞ্চলে এসে কয়েক বছরের মধ্যে সম্পূর্ণ এক নতুন পদ্ধতিতে এই অঞ্চলের এক পুরনো ও ক্ষয়িষ্ণু শিল্পকে পুনরুজ্জীবিত করে তোলে। এ শিল্প হল জপের মালা আর কাঁচ তৈরির কারখানা। এই শিল্পের প্রকৃত উন্নতি সাধন করে সে প্রচুর ধন সঞ্চয় করে এবং এই আঞ্চলিক শিল্পের উন্নয়নে তার অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ এই অঞ্চলের অধিবাসীরা তাকে মেয়র নির্বাচিত করে। সম্প্রতি পুলিশ আবিষ্কার করে মঁসিয়ে ম্যাদলেন নামদারী এই লোকটি একজন জেল-ফেরত কয়েদি এবং ১৭৯৬ সালে চুরির অপরাধে সে কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়। তার আসল নাম হল জাঁ ভলজাঁ। সে পুনরায় কারারুদ্ধ হয়। এবার গ্রেপ্তার হবার আগে সে মঁসিয়ে লাফিক্তের ব্যাংক থেকে প্রায় পাঁচ লক্ষ ফ্ৰ তুলঁবার চেষ্টা করে এবং এই টাকা সে ব্যবসায় বৈধভাবে অর্জন করে ওই ব্যাংকে জমা রাখে। তুলঁ’র কারাগারে দ্বিতীয়বার যাবার আগে জাঁ ভলজাঁ তার সব টাকা কোথায় রাখে, তা জানা যায়নি।
ওই একই দিনে জার্নাল দ্য প্যারিসে আর একটি বিবরণ প্রকাশিত হয়। এ বিবরণটি আরও বিস্তৃত। তাতে বলা হয়, সম্প্রতি জাঁ ভলজাঁ নামে একজন জেলমুক্ত আসামির ফৌজদারি আদালতে বিচার হয়। এই দুবৃত্ত পুলিশের প্রহরাকে ফাঁকি দিয়ে এড়িয়ে যেতে সমর্থ হয়। সে তার নাম পাল্টে এই প্রদেশের উত্তরাঞ্চলের ছোট্ট শহরটাতে এক গুরুত্বপূর্ণ শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে এবং সেই শহরের মেয়র নির্বাচিত হয়। ঘটনাক্রমে পুলিশ কর্তৃপক্ষের অক্লান্ত উদ্যমের ফলে তার আসল পরিচয় উদ্ঘাটিত হয় এবং তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। তার এক রক্ষিতা ছিল। রক্ষিতাটি ওই শহরেরই একটি মেয়ে এবং তার গ্রেপ্তারের সংবাদ শুনে যে আঘাত পায়। সে আঘাত সহ্য করতে না পেরে সে মারা যায়। পুলিশ গ্রেপ্তার করা সত্ত্বেও এই শয়তানটি তার হারকিউলেস-সুলভ শক্তির জোরে পুলিশ-হাজত থেকে পালিয়ে যায়। কিন্তু সে যখন তিন-চার দিন আগে প্যারিস থেকে মঁতফারমেলের দিকে যাচ্ছিল তখন পুলিশ তাকে আবার ধরে। মনে হয়, যে সময়টা সে বাইরে ছাড়া ছিল সেই সময়ের মধ্যে একটা বড় ব্যাংক থেকে প্রায় ছয়-সাত লক্ষ ফ্রা’র মতো তার জমানো টাকা তুলে নেয়। মামলার বিবরণে দেখা যায় এই টাকাটা সে কোথায় রেখেছে তা সে নিজে ছাড়া আর কেউ জানে না এবং পুলিশ তা আবিষ্কার করতে পারেনি। যাই হোক, জাঁ ভলজাঁ বিচারে আজ হতে আট বছর আগে বড় সড়কে এক সশস্ত্র ডাকাতির অভিযোগে অভিযুক্ত হয় এবং সে অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হয় সে। এমন কতকগুলি নির্দোষ ছেলের ওপর সে এই ডাকাতি করে যারা ঘুরে ঘুরে শহরের নর্দমা ও নানা জঞ্জাল পরিষ্কার করে।
অপরাধী আসামি তার পক্ষে কোনও উকিল দেয়নি। অভিযোগকারী সরকারি অ্যাটর্নি তার স্বভাবসিদ্ধ বাগ্মিতার দ্বারা প্রমাণ করেন যে আসামি একজন পাকা চোর এবং সে মেদি অঞ্চলের কুখ্যাত ডাকাতদলের একজন সদস্য ছিল। এইভাবে সে দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হয়। এই রায়ের বিরুদ্ধে সে কোনও আবেদন করেনি। কিন্তু রাজা তার করুণার বশবর্তী হয়ে মৃত্যুদণ্ড মওকুব করে তাকে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড দান করেন। জাঁ ভলজাঁকে তুলঁ’র কারাগারে পাঠানো হয়।
জেলখানায় যাওয়ার পর জাঁ ভলজাঁকে এক নতুন নম্বর দেওয়া হয়। এক নতুন কয়েদি হিসেবে তার নম্বর হয় ৯৪৩।
মঁসিয়ে ম্যাদলেন মন্ত্রিউল অঞ্চল থেকে যাওয়ার পর ওই অঞ্চলের সমৃদ্ধিও চলে যায়। ধরা দেবার আগে জাঁ ভলজাঁ যা ভেবেছিল তাই ঘটে। তার চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গে শহরের কর্মোদ্যম নষ্ট হয়ে যায়। একটা চালু কারখানা, একটা উন্নত শিল্পপ্রতিষ্ঠান ভেঙে যায় ধীরে ধীরে। ইতিহাসে এই ধরনের ঘটনা ঘটে মাঝে মাঝে। আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পরও এমনি ঘটেছিল গ্রিসে। শুরু হয় তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা। নিমপদের সেনানায়করা রাজা হয়ে বসে। কারখানার ফোরম্যানরা মালিক হয়ে বসে। শুরু হয় ঈর্ষান্বিত প্রতিদ্বন্দ্বিতা। ম্যালেনের বিরাট কারখানাগুলো বন্ধ হয়ে যায়। তার গড়া বাড়িগুলো একে একে ধ্বংস হয়ে যায় এবং কারখানার শ্রমিকরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। অনেকে শহর ছেড়ে চলে যায়, অনেকে নতুন কাজ পায়। তখন শহরে বড় শিল্পের কাজ সব বন্ধ হয়ে যায়। ছোট ছোট শিল্পের কিছু কাজ অবশ্য হয়। কিন্তু স্বার্থ আর লাভের দিকটাই দেখা হয়। নিঃস্বার্থ জনকল্যাণের সব কাজ বন্ধ হয়ে যায়। ম্যাদলেন সব কাজ-কারবারের কেন্দ্রস্থলে থেকে সবকিছু দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনা করত। সকলকে কাজে অনুপ্রাণিত করত। তার অবর্তমানে সব জায়গায় শুরু হয় শুধু দ্বন্দ্ব আর প্রতিযোগিতা, কে কাকে ঠকাতে পারে, কে কত বেশি স্বার্থ পূরণ করতে পারে, কে কার গলা কাটতে পারে–সর্বত্র তারই চলে প্রতিদ্বন্দ্বিতা। যে শক্তি দিয়ে ম্যাদলেন তার বিরাট শিল্পপ্রতিষ্ঠানের সমস্ত কর্মকেন্দ্রগুলোকে বেঁধে রেখেছিল, সে সুতো ছিঁড়ে যায়। ফলে সবকিছু শিথিল ও পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। প্রতিষ্ঠানের প্রশাসন দুর্বল হয়ে পড়ে। উৎপাদনের মান নিম্নস্তরে নেমে যায়। ক্রেতারা আস্থা হারিয়ে ফেলে। অর্ডার আসা বন্ধ হয়ে যায়। আয় কমে যাওয়ায় শ্রমিকের বেতনের হার কমে যায়, অনেক শ্রমিক কর্মচ্যুত হয়ে পড়ে। ফলে কোম্পানি দেউলে হয়ে পড়ে। গরিব বেকারদের কর্মসংস্থানের উপায় বিলুপ্ত হয়ে যায় একে একে।
ক্রমে সরকারও বুঝতে পারে কিছুর একটা অভাব ঘটেছে। আদালতের যে রায়ে ম্যাদলেন জাঁ ভলজাঁয় পরিণত হয় সেই রায় বার হবার চার বছরের মধ্যেই মন্ত্রিউল-সুর-মের অঞ্চলে কর আদায়ের খরচ দ্বিগুণ বেড়ে যায়। মঁসিয়ে দ্য ভিলেলে ১৮২৭ সালে আইনসভায় এ বিষয়ে সদস্যদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
.
২.
এ বিষয়ে আরও কিছু বলার আগে একটি বিশেষ ঘটনার বিস্তৃত বিবরণ দান করা উচিত। ঘটনাটি মঁতফারমেলের পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে সেই সময়ই ঘটে। এই ঘটনা থেকে সেকালের দেশের শাসন কর্তৃপক্ষের মনোভাব সম্বন্ধে একটা ধারণা পাওয়া যাবে।
সেকালে মঁতফারমেল অঞ্চলে এক প্রাচীন কুসংস্কার ছিল। অন্যান্য আর পাঁচটা কুসংস্কারের মতোই যেমন অদ্ভুত তেমনি তাৎপর্যপূর্ণ। সাধারণত যা বিরল, যা অদ্ভুত তার প্রতি আমাদের একটা শ্রদ্ধা আছে। মঁতফারমেলের কুসংস্কারটিও এই ধরনের এক কুসংস্কার।
ওই অঞ্চলের অধিবাসীরা বিশ্বাস করত শয়তান আবহমান কাল থেকে তার সঞ্চিত সব ধনসম্পদ কোনও এক গভীর বনের মধ্যে লুকিয়ে রাখে। স্থানীয় অনেক গৃহবধূ বলত, মাঝে মাঝে এক-একদিন সন্ধ্যার প্রাক্কালে বনের প্রান্তদেশে কসাই বা গাড়িচালকের মতো দেখতে হাতে বোনা কাপড়ের তৈরি মোটা পোশাকপরা কালো রঙের একটা অদ্ভুতদর্শন লোককে দেখেছে তারা। সে লোকের মাথার টুপির বদলে থাকত দুটো শিং।
তারা বলত সেই অস্বাভাবিক অপ্রাকৃত লোকটার সঙ্গে যাদেরই দেখা হত তাদেরই মৃত্যু ঘটত। কিন্তু তাকে যারা দেখতে পেত তাদের দেখা হওয়ার ধরন অনুসারে তিনভাবে মৃত্যু ঘটত। সেই অনুসারে মৃত্যুকালেরও তারতম্য দেখা যেত। লোকটার সঙ্গে যখনি কারও দেখা হত তখনি দেখা যেত সে হয় গরুর জন্য ঘাস কাটছে অথবা একটা গর্ত খুঁড়ছে। যদি কোনও লোক তাকে ঘাস কাটতে দেখে তার কাছে যেত তা হলে তার বাড়ি ফেরার পর এক সপ্তার মধ্যে তার মৃত্যু ঘটত। আর যদি কোনও লোক সেই লোকটাকে মাটি খুঁড়তে দেখত এবং গর্ত খুঁড়ে গর্তটা বুজিয়ে সে চলে যাবার পর। সেই গর্ত থেকে তার গুপ্তধন তুলে আনত তা হলে তার এক মাসের মধ্যে মৃত্যু হত। আর যদি কোনও লোক তাকে দেখে আগ্রহ না দেখিয়ে চলে যেত অন্য দিকে অথবা ছুটে পালিয়ে যেত তা হলে তার এক বছরের মধ্যে মৃত্যু ঘটত।
ফলে ওখানকার জনগণ যখন দেখল লোকটাকে চোখে দেখলে মৃত্যু হবেই দু দিন আগে বা পরে, তখন তার গুপ্তধনটা নিয়ে মরাই ভালো। এই ভেবে অনেকেই সেই শয়তানটাকে চোখে দেখতে পেলেই সেই জায়গায় গিয়ে মাটি খুঁড়ে তার গুপ্তধন চুরি করে আনার চেষ্টা করত। সে ধন এক মাসের বেশি ভোগ করতে না পারলেও তারা তা ছাড়ত না।
জাঁ ভলজাঁ মন্ত্রিউল থেকে যখন গ্রেপ্তার হয় এবং গ্রেপ্তার হবার পর পুলিশ-হাজত থেকে পালিয়ে এসে দিনকতক মুক্ত থাকে, তখন সে মঁতফারমেলে যায়। তখন দেখা যায় সেই গাঁয়ের বুলাত্রিউল নামে একজন লোক গাঁয়ের পাশে একটা বনের মাঝে বিশেষ এক আগ্রহের সঙ্গে যাওয়া-আসা করছে। বনের প্রতি তার এই অস্বাভাবিক আগ্রহ দেখে অনেকের মনে সন্দেহ জাগে। লোকটা রাস্তা মেরামতের কাজ করত। সে একবার জেল খেটেছিল। পুলিশ তার ওপর কড়া নজর রাখত। ফলে সে কোনও কাজকর্ম পেল না। স্থানীয় পৌরসভার কর্তৃপক্ষ তাই লোকটাকে দিয়ে কম বেতনে রাস্তা মেরামতের কাজ করাত।
স্থানীয় অধিবাসীরা বুলাত্রিউলকে ভালো চোখে দেখত না। সে ছিল অতিমাত্রায় বিনয়ী। তার এই বিনয়ের আতিশয্যটাও ছিল সন্দেহজনক। যেসব দস্যু অন্ধকারে পথে রাহাজানি করত তাদের সঙ্গে তার নাকি যোগাযোগ ছিল। সে অতিমাত্রায় মদ খেত।
কিছুদিন থেকে বুলাত্রিউল সকালের দিকে রাস্তা মেরামতের কাজ ফেলে রেখে বনের মাঝে গিয়ে ঘোরাফেরা করছিল। এটা অনেকেরই চোখে পড়ল। সন্ধের দিকে এক-একদিন বনের গভীরে গিয়ে কোনও একফালি ফাঁকা জায়গায় মাটি গাঁইতি দিয়ে খুঁড়ে কিসের খোঁজ করত। গাঁয়ের যেসব মেয়ে সেই সময় সেই বনপথ দিয়ে যাওয়া-আসা করত তারা তাকে দেখে শয়তান বিলজিবাব ভাবত। তার পর তারা দেখত বুলাত্রিউলকে। অবশ্য বুলাত্রিউলও কম ভয়াবহ নয়। বুলাত্রিউলও মেয়েদের দেখে ঘাবড়ে যেত। সে দমে গিয়ে তার কাজটাকে লুকোবার চেষ্টা করত। তার আচরণ ও কাজকর্ম সত্যিই রহস্যজনক ছিল গাঁয়ের লোকদের কাছে।
গাঁয়ের মেয়েরা বলাবলি করত, নিশ্চয় শয়তান এসে যে গুপ্তধন পুঁতে রেখে যায়, তা বুলাত্রিউল দেখেছে। তাই সেই গুপ্তধনের খোঁজ করছে সে। দার্শনিক ভলতেয়ারের শিষ্যরা আশ্চর্য হয়ে বলল, বুলাত্রিউল শয়তানকে ধরবে, না শয়তান বুলাত্রিউলকে ধরবে।
একথা শুনে গাঁয়ের বৃদ্ধারা তাদের বুকের উপর ক্রসচিহ্ন আঁকল।
ক্রমে বুলাত্রিউল বনে ঘোরাঘুরি করা বা খোঁজাখুঁজি করার কাজটা বন্ধ করে তার দৈনন্দিন কাজে মন দেয়। ফলে ব্যাপারটার সেখানেই নিষ্পত্তি হয়ে যায়।
তবু কিছু লোকের আগ্রহ রয়ে যায়। তারা ভাবতে থাকে বনের মাঝে শয়তানের কোনও অতিপ্রাকৃত গুপ্তধন না থাকলেও বুলাত্ৰিউলের এই কাজের পেছনে নিশ্চয় কোনও রহস্য আছে। আর সে রহস্যের কথা বুলাত্রিউল জানে। যেসব লোক এ ব্যাপারে দুর্মর আগ্রহ দেখায় তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আগ্রহ দেখায় একজন স্কুলমাস্টার আর হোটেলমালিক থেনার্দিয়ের। এই থেনার্দিয়েরের সঙ্গে সবার ভাব ছিল এবং বুলাত্রিউলের সঙ্গেও তার ঘনিষ্ঠতা ছিল।
থেনার্দিয়ের একদিন একজনকে বলল, ও তো জেলে গিয়েছিল। কে জেলে যাচ্ছে, সেটা আমাদের জানার কথা নয়।
থেনার্দিয়ের আর একদিন সন্ধেবেলায় বলে, বুলাত্রিউল বনের মাঝে যেসব রহস্যময় কাজ করেছে সে বিষয়ে আইন নিশ্চয় অনুসন্ধান চালায় এবং দরকার হলে শারীরিক পীড়নের মাধ্যমে তার কাছ থেকে সব কথা বার করে নেবে। জিজ্ঞাসাবাদের সময় যদি দলের পদ্ধতিমূলক পীড়ন চালানো হয় তা হলে বেশিক্ষণ কথাটা সে চেপে রাখতে পারবে না।
থেনার্দিয়ের বলল, ঠিক আছে, ওকে মদ খাইয়ে প্রশ্ন করে কথা বার করে নিতে হবে।
সুতরাং তারা এক ভোজসভার আয়োজন করল এবং বুলালিউলকে খুব মদ খাওয়াল। বুলাত্রিউল খুব বেশি করে মদ খেল, খুব কথা বলল। প্রচুর মদ খেয়েও সে তার বিচার-বুদ্ধি ঠিক রেখেছিল। অবশেষে সেই স্কুলমাস্টার আর থেনার্দিয়ের ব্যর্থ হয়ে এক সিদ্ধান্তে উপনীত হয়।
একদিন খুব সকালে বুলাত্রিউল যখন বনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল তখন একটা ঝোঁপের মাঝে একটা গাঁইতি আর শাবল পড়ে থাকতে দেখে। তার মনে হল সে যেন ঝোঁপের মধ্যে ওগুলো লুকিয়ে রেখে গেছে। তার মনে হল জলবাহক পিয়ের সিক্স থের রেখে গেছে এগুলো। তখন সে আর এ নিয়ে বেশি কিছু ভাবল না।
কিন্তু সেদিন সন্ধেবেলায় কী মনে হতে বুলাত্রিউল বনে গিয়ে একটা গাছের আড়ালে লুকিয়ে রইল। সে ভাবল যে ওইগুলো রেখে গেছে সে নিশ্চয় সন্ধের সময় খোঁড়াখুঁড়ির কাজ করবে। কিছুক্ষণ থাকার পর সে দেখল একটা লোক রাস্তা থেকে বনের মধ্যে ঢুকে পড়ল। সে দেখল লোকটা এ অঞ্চলের বাসিন্দা নয়। তবে সে লোকটাকে চিনত। পরে থেনার্দিয়ের কথাটা ব্যাখ্যা করে বলে, বুলাত্রিউল লোকটাকে নিশ্চয় জেলে থাকাকালে দেখেছে। তার মানে লোকটাও একদিন জেলের কয়েদি ছিল। বুলাত্রিউল কিন্তু লোকটার নাম বলতে চায়নি এবং এ বিষয়ে বেশ একটা জেদ ধরেছিল। বুলাত্রিউল সেদিন সন্ধ্যায় দেখল লোকটা বাক্স বা সিন্দুকের মতো চারকোনা একটা জিনিস নিয়ে আসছে।
প্রথমে ব্যাপারটা দেখে আশ্চর্য হয়ে গেল বুলাত্রিউল। বিস্ময়ের ঘোরে প্রথমে লোকটাকে অনুসরণ করার কথাটা মনেই হয়নি তার। যখন কথাটা মনে হল তখন খুব দেরি হয়ে গেছে। লোকটা বনের মধ্যে ঢুকে গেল। আকাশে চাঁদ ছিল। দু-এক ঘণ্টা পরে লোকটাকে আবার দেখা গেল। তখন তার হাতে গাঁইতি আর শাবল ছিল, কিন্তু চারকোনা বাক্সটা ছিল না। বুলাত্রিউল ভয়ে তার কাছে গেল না। লোকটা তার থেকে তিনগুণ বলবান। তার ওপর তার হাতে একটা লোহার রড আর একটা গাঁইতি আছে। সে যদি বুঝতে পারে বুলাত্রিউল তাকে লক্ষ করছে তা হলে সম্ভবত তাকে খুন করত তাকে চিনে ফেলেছে বলে। তবে তার হাতে শাবল আর গাঁইতি দেখে সে বুঝতে পারে ব্যাপারটা কী। সে সকালে ঝোঁপের মাঝে ওই শাবল আর গাঁইতি পড়ে থাকতে দেখে। সে বুঝতে পারে লোকটা নিশ্চয় কিছু পুঁতে রাখছিল। বাক্সটা ছোট বলে তাতে কোনও মৃতদেহ রাখা সম্ভব নয়, তাই নিশ্চয় কোনও টাকাকড়ি বা ধনরত্ন ছিল।
এই ভেবেই সে বনের মধ্যে যেখানেই কোনও ফাঁকা জায়গাতে কোনও খোঁড়া মাটি দেখতে পেয়েছে সেখানেই মাটিগুলো সরিয়ে দেখেছে তার ভেতরে কিছু আছে কি না। কিন্তু তার সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। সে কিছুই পায়নি।
ক্রমে মঁতফারমেলের লোকেরা এ ব্যাপারে সব আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। গায়ের সব মেয়েরা বলাবলি করতে থাকে, রাস্তা মেরামঁতকারী লোকটা শুধু শুধু হৈচৈ করে বসল। কিন্তু কিছুই পেল না। নিশ্চয় শয়তানটা এখনও আসা-যাওয়া করে।
.
৩.
১৮২৩ সালের অক্টোবর মাসের শেষের দিকে ওরিয়ন নামে একটা জাহাজ তুলঁ’র ডকে মেরামতের জন্য এসে লাগে। জাহাজটা ভূমধ্যসাগরের নৌবাহিনীর অন্তর্গত একটা জাহাজ। জাহাজটা ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
১৮২৩ সালটা রাজতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠার বছর এবং এই বছরেই ফ্রান্সের সঙ্গে স্পেনের যুদ্ধ চলছিল। আসলে ফ্রান্সের জনগণের বিপ্লব ব্যর্থ করে সেখানকার রাজতন্ত্রকে সুদৃঢ় ও শক্তিশালী করতে চায়। ফরাসি বিপ্লবের যে গণতান্ত্রিক ভাবধারা তখন ইউরোপের বিভিন্ন দেশে আগুনের ফুলকির মতো ছড়িয়ে পড়ছিল, সে ভাবধারার মূলোচ্ছেদ করতে চেয়েছিল রাজতন্ত্রী ফ্রান্সে। তবে এ যুদ্ধে ফরাসি বাহিনী স্পেনের বিপ্লবী সেনাদলের ওপর যে নিষ্ঠুরতা ও বর্বরতার পরিচয় দেয় তা ভয়াবহ বলেও ফরাসি সৈন্যদের তাতে সায় ছিল না। বরং তারা সামরিক শৃঙ্খলার খাতিরে অবস্থার চাপে বাধ্য হয়েই তা করে।
অথচ ফরাসি সামরিক কর্তৃপক্ষ তাদের সৈন্যদের এই শৃঙ্খলাবোধকেই ফরাসি জাতির স্বতঃস্ফূর্ত সম্মতি বলে ধরে নেয়। ফরাসি রাজতন্ত্র ভেবেছিল স্পেনের রাজতন্ত্রকে সুদৃঢ় করার পর তারা নিজেদের দেশের রাজতন্ত্রের ভিত্তি সুদৃঢ় ও শক্তিশালী করে তুলঁবে।
এবার ওরিয়ন জাহাজটির কথায় আসা যাক।
ওরিয়ন নামে যুদ্ধজাহাজটি ছিল ফরাসি নৌবাহিনীর একটি অঙ্গ। স্পেনের সঙ্গে যুদ্ধের সময় তার কাজ ছিল ভূমধ্যসাগরে পাহারা দিয়ে বেড়ানো। ঘটনাক্রমে ঝড়ের আঘাতে তা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় তুলঁ’র বন্দরে মেরামতের জন্য আসে। বন্দরে কোনও যুদ্ধজাহাজ এলেই তা স্থানীয় জনসাধারণের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তার ওপর ওরিয়ন জাহাজটা ছিল আকারে বেশ বড়। যে কোনও বড় বস্তুর প্রতি জনগণের একটা স্বাভাবিক আগ্রহ থাকে।
যে কোনও যুদ্ধজাহাজ প্রতিকূল প্রাকৃতিক শক্তির ওপর মানুষের জয় ঘোষণার এক। যন্ত্রবিশেষ। সবচেয়ে হালকা জিনিস দিয়ে তৈরি সবচেয়ে ভারী এই জিনিসটি কঠিন তরল ও বায়বীয় এই তিন রকমের ভিন্ন ভিন্ন পদার্থের সঙ্গে কখনও ভিন্ন ভিন্নভাবে, আবার কখনও-বা একই সঙ্গে কাজ করে যেতে হয়। ওরিয়নের তলায় ছিল এগারোটা লোহার চাকা, যা দিয়ে সে সমুদ্রের জল কেটে যেত এবং বাতাস কাটাবার জন্য সাধারণ জাহাজের থেকে অনেক বেশিসংখ্যক পাখনা ছিল। এর মধ্যে ছিল একশো কুড়িটি কামান। সব কামান যখন গর্জন করত তখন তা বজ্রগর্জনকেও হার মানাত। এর লণ্ঠনের আলোগুলো অন্ধকার রাতে উজ্জ্বল নক্ষত্রের রূপ ধারণ করত। ওরিয়নের কামানগুলো যখন গর্জন করত তখন তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার জন্য তার ধ্বংসাত্মক অস্তিত্বটা প্রকটিত করার জন্য উত্তাল তরঙ্গমালার সৃষ্টি করত। ওরিয়নের আর একটা শক্তি ছিল। সেটা হল তার কম্পাস বা দিকনির্ণয় যন্ত্র। এই যন্ত্রের সাহায্যে সে এর আগে ক্রমাগত উত্তর দিকে যেতে থাকে। সুতরাং ওরিয়ন ছিল ঝোড়ো হাওয়ার কাছে রজ্জবদ্ধ বস্তুর দৃঢ়তায় অটল, জলের কাছে ছিল কাঠের মতো শক্ত, পাথরের কাছে লোহা বা তামা, অন্ধকারে আলো আর ঘনত্বের কাছে ছিল সূর্যের মতো।
একটি যুদ্ধজাহাজ কী কী উপাদানে গড়া এবং তাতে কী কী থাকে, তা দেখতে হলে তুলঁ বন্দরের ডকইয়ার্ডে একবার যেতে হয়। সেখানে যখন জাহাজ তৈরির কাজ চলে তখন। তা দেখতে হয়। একটি ইংরেজ যুদ্ধজাহাজের প্রধান মাস্তুলটা সমুদ্রের জলতল থেকে দুশো সত্তর ফুট উঁচু। একটা যুদ্ধজাহাজ তৈরি করতে এত কাঠ লাগে যে সে জাহাজকে একটা ভাসমান বন বলা যেতে পারে। আজকের যুগের যুদ্ধজাহাজ দাঁড় টেনে চালানো হয় না। তা চলে পঁচিশ হাজার অশ্বশক্তিসম্পন্ন এক বৈদ্যুতিক ইঞ্জিনের দ্বারা। তবু প্রাচীন যুগের জাহাজগুলোর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল ক্রিস্টোফার কলম্বাস। তিনি যে জাহাজটি ব্যবহার করেন সে জাহাজটি সত্যিই এক আশ্চর্যের বস্তু। সে জাহাজ ছিল মানুষের এক অপূর্ব সৃষ্টি। যেসব বিক্ষুব্ধ তরঙ্গমালার মধ্য দিয়ে তাকে পথ করে যেতে হত, সেই সব তরঙ্গমালার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার জন্য তার ছিল অপরাজেয় অফুরন্ত শক্তি।
তথাপি একথা সত্য যে একটি বিরাট যুদ্ধজাহাজের উত্তুঙ্গ মাস্তুল বড় রকমের ঝড়ের কবলে পড়লে তা ছিন্নভিন্ন বৃক্ষশাখার মতো ভেঙেচুরে উড়ে যেতে পারে। তার নোঙরের বড় বড় শিকলগুলোও মুচড়ে ভেঙে যেতে পারে, তার বড় বড় কামানগুলোর গর্জন প্রবল ঝড় ও সমুদ্রগর্জনের শব্দের মধ্যে ডুবে যেতে পারে। একটি যুদ্ধজাহাজের বিপুল ধ্বংসাত্মক শক্তির সমস্ত প্রাচুর্য ও ঐশ্বর্য বৃহত্তর এক প্রাকৃতিক শক্তির কাছে বাধ্য হয় হার মানতে। এত বড় শক্তি কিভাবে ব্যর্থ ও নস্যাৎ হয়ে যায়, তা দেখাটা জনগণের কাছে এক ভীতিপ্রদ ব্যাপার। এই জন্যই সব সমুদ্রবন্দরের ডকে এমন কৌতূহলী জনতার ভিড় জমে। তুলঁ’র ডকে ও জেটিতেও তাই প্রতিদিন দর্শকদের ভিড় জমছিল ওরিয়নকে দেখার জন্য।
ঝড়ের আঘাতে আহত হয় ওরিয়ন তাই তুলঁতে আসে তার রোগ সারাতে।
একদিন সকালবেলায় দর্শকদের এক জনতা এক দুর্ঘটনা প্রত্যক্ষ করে।
সেদিন সকালে একজন নাবিক যখন জাহাজের মাথায় পালগুলো সরাচ্ছিল তখন হঠাৎ সে তার ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। হঠাৎ জনতার মধ্য থেকে এক ভীতিবিহ্বল চিৎকার উঠল। তারা দেখল নার্বিকটি দড়ির উপর দাঁড়িয়ে কাজ করতে করতে হঠাৎ পা ফসকে পড়ে গিয়ে পাশের দড়িটা হাত দিয়ে ধরে ঝুলতে লাগল। তার তলায় ভয়ঙ্কর সমুদ্র যেন তাকে গ্রাস করার জন্য উদ্যত হয়ে আছে।
তার চাপে ভয়ঙ্করভাবে দুলতে লাগল দড়িটা। সে যতই উপরে ওঠার চেষ্টা করতে থাকে ততই দড়িটা ভীষণভাবে দুলতে থাকে। স্থানীয় জেলেদের থেকে নেওয়া নাবিকদের কেউ বিপদের ঝুঁকি নিয়ে তার সাহায্যে এগিয়ে যেতে সাহস করল না। সে ক্রমশই ক্লান্ত ও অবসন্ন হয়ে পড়ছিল। হাত দুটো দড়ি থেকে একবার খসে পড়লেই সে সমুদ্রে পড়ে যাবে। তার মুখখানা ভয় আর বেদনায় বিহ্বল হয়ে উঠেছিল। জনতা গভীর আগ্রহের সঙ্গে অপেক্ষা করছিল। তারা জানত কেউ তাকে উদ্ধার করার জন্য এগিয়ে আসবে না। সুতরাং তারা শুধু সেই মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা করছিল যখন সে দড়িটা ছেড়ে দিয়ে সমুদ্রের জলে পড়ে যাবে। দড়িটা একটা বৃন্ত আর লোকটা যেন একটা পাকা ফল অথবা শুকনো পাতা।
হঠাৎ দেখা গেল একজন শ্রমিক কাজ করতে করতে এক বনবিড়ালের মতো জাহাজের উপরে উঠে গেল। তার পর যে দড়িটা ধরে সেই বিপন্ন নাবিকটি ঝুলছিল সে দড়িটার একটা প্রান্ত টেনে সেটা শক্ত করে বেঁধে দিল। তার পর সে ক্ষিপ্রগতিতে বিপন্ন নাবিকের কাছে তার কোমর ধরে তাকে দড়ি ছেড়ে দু হাত দিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরতে বলল। লোকটা তাই করলে সে এবার দড়িটা দু হাত দিয়ে ধরে তার প্রান্তে গিয়ে জাহাজটাতে উঠে পড়ল। আর এক মুহূর্ত দেরি হলে বিপন্ন নাবিকটি দড়ি ছেড়ে পড়ে যেত।
উদ্ধারকারী লোকটি ছিল এক জেল-কয়েদি। তুলঁ’র জেলখানা থেকে কিছু কয়েদিকে সরকারি জাহাজ মেরামতের কাজের জন্য আনা হয়েছিল। তার মাথার টুপিটা হাওয়ায় উড়ে যাওয়ায় তার মাথার সাদা চুলগুলো দেখা যাচ্ছিল। লোকটি ছিল যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত। সে বয়সে যুবক না হলেও তার গায়ে ছিল প্রচুর শক্তি। বিপন্ন নাবিককে কেউ উদ্ধার করতে না যাওয়ায় সে এগিয়ে যায়। সে তাদের অফিসারের কাছে গিয়ে এজন্য অনুমতি চায় এবং অফিসার অনুমতি দিলে সে হাতুড়ির ঘা দিয়ে তার পায়ের শিকলটাকে ভেঙে ফেলে। অবশেষে সে বিপন্ন লোকটিকে ধরে নিয়ে জাহাজের উপরতলা থেকে নিচের তলায় ডেকের উপর নিয়ে আসে।
জনতা এক বিপুল হর্ষধ্বনিতে ফেটে পড়ে। এমনকি জেলখানার কড়া অফিসারদের চোখেও জল আসে। ডকে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েরা আনন্দে একে অন্যকে জড়িয়ে ধরল। জনতা একবাক্যে চিৎকার করে ধ্বনি দিতে লাগল, এই কয়েদিকে মুক্তি দিতে হবে।
উদ্ধারকারী কয়েদি লোকটি তখন তার কাজের জায়গায় আবার ফিরে যেতে লাগল। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যে উদ্ধারের কাজ করতে গিয়ে তার হাত-পা অবসন্ন হয়ে পড়ে। সে মাতালের মতো টলছিল। একসময় তাড়াতাড়ি করে যেতে গিয়ে সে টলতে টলতে হঠাৎ জলে পড়ে যায়। জনতার দৃষ্টি এতক্ষণ তার ওপর নিবদ্ধ ছিল। সে পড়ে যেতে জনতা আবার চিৎকার করে ওঠে।
যেখানে সে পড়ে গেল সে জায়গাটা বিপজ্জনক। কারণ আর একটা যুদ্ধজাহাজ ওরিয়নের পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। দুটো জাহাজের মাঝখানে সে পড়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে তার উদ্ধারের জন্য নৌকো নামানো হল জাহাজ থেকে। কিন্তু কয়েদি লোকটির কোনও দেখা পাওয়া গেল না। মনে হল সে যেন দুটো জাহাজের মাঝখান দিয়ে ডুবে ডুবে দূর। সমুদ্রে চলে গেছে।
রাত্রি পর্যন্ত ডুবন্ত লোকটির উদ্ধারের কাজ চলতে লাগল। কিন্তু তার দেহটিকে কোথাও দেখা গেল না।
পরদিন স্থানীয় সংবাদপত্রে একটি সংবাদ প্রকাশিত হল।
১৭ নভেম্বর, ১৮২৩ সাল। গতকাল এক কয়েদি ওরিয়ন জাহাজের উপর কাজ করার সময় একটি বিপন্ন নাবিককে উদ্ধার করার পর সমুদ্রের জলে পড়ে গিয়ে ডুবে যায়। তার দেহটিকে পাওয়া যায়নি। মনে হয় আর্থেনালের জেটির তলায় আবর্জনার মধ্যে তার দেহটা আটকে পড়েছে। লোকটির জেলখানার রেজিস্ট্রির নম্বর হল ৯৪৩০ এবং তার নাম হল জাঁ ভলজাঁ।