২.২ জনহীন হিজলের পশ্চিম কূল

জনহীন হিজলের পশ্চিম কূল তার হাসিতে যেন শিউরে উঠল। ঘন গাছপালার মধ্য থেকে একটা। কোকিল পিকপিক শব্দ করে উড়ে চলে গেল; এক ঝাক শালিক বসে ছিল মাঠের মধ্যে, তারা কিচমিচ কলরব করে, পাখায় ঝরঝর শব্দ তুলে উড়ল আকাশে। সে হাসি যেন পাতলা লোহার কতকগুলো ছুরি কি পাত ঝনঝনিয়ে মাটিতে পড়ে গেল।

গঙ্গারাম আবার তার দিকে ফিরে চাইলে। ভাদুও তাকালে আবার।

আবারও হেসে উঠল পিঙলা।

গঙ্গারাম এবার বললে হাসিস না তুকে বলছি মুই।

ভাদু মৃদুস্বরে বললে—সাথে লোক রইছে গ কন্যে। ছিঃ! ঘরের কথা লিয়ে পরের ছামুতে—না, ইটা করিস না।

পিঙলা তখন খানিকটা পরিতৃপ্ত হয়েছে। অনেক কাল হেসে এমন সুখ সে পায় নাই। এবার তার খেয়াল হল, সঙ্গে বাবুদের বাড়ির লোক রয়েছে। তাদের সামনে এ কথার আলোচনা সঙ্গত। হবে না। মনে পড়ল মা-মনসা ও বেনেবেটির কাহিনীর কথা। মা বেনেবেটিকে বলেছিলেন কন্যে, সব দিক পানে চেয়ো, কেবল দক্ষিণ দিক পানে চেয়ো না। বেনেবেটির অদৃষ্ট, আর নরে নাগে বাস হয় না। একদিন সে নাগেদের দুধ জ্বাল না দিয়ে পড়ল ঘুমিয়ে। নগেরা গিয়েছিল। বিচরণ করতে। পাহাড়ে অরণ্যে সমুদ্রে নদীতে বিচরণ করে তারা ফিরল। ফিরে তারা দুধ খায়—দুধের জন্য এল। এসে দেখে, বেনে বোন ঘুমুচ্ছে—তারা কেউ তার হাত চাটলে, কেউ গা চাটলে, কেউ পা চাটলে, কেউ ফেঁসফুসিয়ে বললেও বেনে বোন, খিদে পেয়েছে, তুই ঘুমুবি কত? বেনেবেটির ঘুম ভাঙল, লজ্জা হল, ধড়মড়িয়ে উঠে বললে—এই ভাইয়েরা, একটু সবুর কর, এখুনি দিচ্ছি। হুড়মুড়িয়ে খড় তালপাতা নিয়ে উনুন জ্বাললেন, দুড়দুড়িয়ে জ্বাল দিলেন, টগরগিয়ে দুধ ফুটল; বেনেবেটি কড়া নামালেন। তারপর হাতায় দুধ মেপে কাউকে দিলেন বাটিতে, কাউকে গেলাসে, কাউকে খোরায়, কাউকে পাথরের কটোরায়, কাউকে কিছুতে অর্থাৎ হাতের কাছে যা পেলেন তাতেই দুধ পরিবেশন করে বললেন-খাও ভাই।

আগুনের মত গরম দুধ, সে দুধে মুখ দিয়ে কারুর ঠোঁট পুড়ল, কারুর জিভ, কারুর গলা, কারুর বা বিষের থলি পুড়ে গেল। যন্ত্রণায় সহস্র নাগ গর্জে উঠল। তারা বললে—আজ বেনেকন্যেকে খাব।

মা-মনসার টনক নড়ল, আসন টলল, তিনি এলেন ছুটে। বললেন—থাম্‌ থাম্।

না, খাব আজ বেনে-কন্যেকে। সহস্ৰ নাগের বিষে মরুক জ্বলে—আমরা জ্বালায় মরে গেলাম।

মা বললেন—দশ দিনের সেবা মনে কর, এক দিনের অপরাধ ক্ষমা কর্। দশ দিন সেবা করতে গেলে একদিন ভুলচুক হয়—অপরাধ ঘটে। ক্ষমা করতে হয়।

নাগেরা ক্ষান্ত হল সেদিন, বললে—আর একদিন হলে ক্ষমা করব না কিন্তু।

মা বললেন—তার দরকার নাই বাবা। কন্যেকে স্বস্থানে রেখে এস গিয়ে। নরে নাগে বাস। হয় না। আমি বলছি, রেখে এস।

বেনে-কন্যে মর্তে স্বস্থানে আসবেন। উদ্যোগ হল, আয়োজন হল। বেনে-কন্যে ভাবলেন—এই তো যাব, আর তো আসব না। তা সব দিক দেখেছি, কেবল দক্ষিণ দিক দেখি নাই। মায়ের বারণ ছিল। এবার দেখে যাই দক্ষিণ দিক।

ঘরের বন্ধ-করা দক্ষিণের দুয়ার খুললেন। খুলেই শিউরে উঠলেন। সামনেই মা-বিষহরি। বিষবিভোর রূপ ধরে বসে আছেন, যে রূপ দেখে স্বয়ং শিব অভিভূত হয়ে ঢলে পড়েছিলেন। নাগ-আসনে বসেছেন, নাগ-আভরণে সেজেছেন, বিষের পাথার গষে পান করছেন আবার উগরে দিচ্ছেন, সঙ্গে সঙ্গে সে পাথার সহস্র গুণ বিশাল হয়ে উথলে উঠছে। সে বিষপাথারের স্পৰ্শ লেগে নীল আকাশ কালো হয়ে গিয়েছে, বাতাস বিষের গন্ধে ভরে উঠেছে, সে বাতাস অঙ্গে লাগলে জ্বলে যায়, নিশ্বাসে নিলে জ্ঞান বিলুপ্ত হয়। এই রূপ দেখেই ঢলে পড়ে গেলেন। বেনে-কন্যা। ওদিকে অন্তর্যামিনী মা জানতে পেরেছেন, তিনি বিষহরির বিষময়ী মূর্তি সংবরণ করে অমৃতময়ী রূপ ধরে এসে তার গায়ে অমৃত স্পৰ্শ বুলিয়ে দিলেন, জিজ্ঞাসা করলেন-ও বেনেবেটি, কি দেখলি বল?

—না মা, আমি কিছু দেখি নাই।

–ও বেনেবেটি, কে দেখলি বল্‌?

–না মা, আমি কিছু দেখি নাই।

—ও বেনেবেটি, কি দেখলি বল?

–না মা, আমি কিছু দেখি নাই।

মা তখন প্রসন্ন হয়ে বলেছিলেন—তুই আমার গোপন কথা ঢাকলি স্বর্গে—তোর কথা আমি ঢাকব মর্তে। গোপন কথা ঢাকতে হয়, যে ঢাকে তার মহাপুণ্য। সেই মহাণ্য হবে তোর। স্বৰ্গ অমৃতের রাজ্য, সেখানে মা বিষ পান করেন বিষ উদার করেন—সে যে দেবসমাজে কলঙ্কের কথা। মায়ের এই মূর্তির কথা বেনেবেটি স্বীকার করলে, স্বর্গে প্রকাশ পেলে, মায়ের কলঙ্ক রটত।

মোর ঢাকলি স্বর্গে, তোর ঢাকব মর্ত্যে মা-বিষহরির কথা।

থাক গঙ্গারামের গোপন কথা—দশের সামনে ঢাকাই থা। পিঙলা নীরব হল। প্রসন্ন। অন্তরেই পথ চলতে লাগল।

দ্রুতপদে হেঁটে চলল।

হিজলের পশ্চিম কূলের মাঠের ভিতর দিয়ে চলে গিয়েছে পথ। পথে একটু ধুলো। গঙ্গার পলিমাটি-মিহি ফাগের মত নরম। ফাগুনের তিন পহর বেলায় পৃথিবী উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে, পায়ের তলায় ধুলো তেতে উঠেছে, বাতাসে গরমের অ্যাঁচ লেগেছে। এ বাতাসে পিঙলার সর্বদেহে যেন একটা নেশার জ্বালা ধরে যাচ্ছে। মাঠে তিল-ফসলে বেগুনি রঙের ফুল ফুটেছে। একেবারে যখন চাপ হয়ে ফুল ফুটবে তখন কি শোভাই হবে! কতকগুলি ফুল তুলে সে খোপায়

জলে।

গঙ্গারাম বললে—তিলফুল তুল্যা খোঁপায় দিলি-তিলশুনা হবে তুকে। চৈতলক্ষ্মীর কথা জানিস?

–জানি। তিলশুনা তো খেটেই যেছি অমনিতে, যাবার সময় তুকে দিয়া যাব গজমতির হার। চৈতলক্ষ্মীর কথা যখন জানিস, তখন মা-লক্ষ্মী যাবার কালে বেরাহ্মণীকে গজমতির হার দিয়া গেছিল—সে কথাও তো জানি।

গজমতির হার–অজগর সাপ।

ব্ৰতকথায় আছে, ব্রাহ্মণী ছদ্মবেশিনী লক্ষ্মীকে হতশ্রদ্ধা করতেন, অপমান করতেন। কিন্তু লক্ষ্মী যখন স্বরূপে আত্মপ্রকাশ করে বৈকুণ্ঠে যাবার জন্য রথে চড়ছেন, তখন প্রলুব্ধা ব্রাহ্মণী ছুটে গিয়ে বললে,-মা, একজনকে এত দিলে, আমাকে কি দেবে দিয়ে যাও।

তখন মা হেসে বললেন—তোমার জন্য হুড়কোকোটরে আছে গজমতির হার।

ব্রাহ্মণী ছুটে এসে হাত পুরলেন হুড়কোকোটরে। সেখানে ছিল এক অজগর, সে তাকে দংশন করলে।

গঙ্গারাম হাসলে। এ কথা সে জানে। পিঙলার মনের বিদ্বেষের কথাও সে জানে। আজ সত্যই তাকে লক্ষ্য করেই সে সড়কিটা ছুঁড়েছিল। কিন্তু পিঙলা জাত-কালনাগিনী। নাগিনী মুহূর্তে অদৃশ্য হয়। ওই নাগিনী-এই কথা বলে চোখের পলক ফেল, দেখবে কই, কোথায়?… নাই নাগিনী। ব্যাধের উদ্যত বাণ ছাড়া পেতে পেতে সে মায়াবিনীর মত মিলিয়ে যায়। ঠিক তেমনিভাবেই পিঙলা আজ ডোঙার উপর থেকে অদৃশ্য হয়েছিল। লক্ষ্য করা পর্যন্ত পিঙলা তার সড়কির ফলার ঠিক সামনে ছিল। সড়কি ছাড়লে গঙ্গারাম ব্যস, নাই। তখন ডোঙার উপর শূন্য, হিজল বিলের জল তখন দুলছে, পিঙলা তখন জলের তলায়। গঙ্গারাম হাজার বাহবা দিয়েছে মনে মনে।

বাহাবাহাবাহ! পিঙলা চলছে—যেন হেলেদুলে চলছে। দেখে বুকের রক্ত চলকে ওঠে। গঙ্গারামের চোখে আগুন জ্বলে।

গঙ্গারামগঙ্গারাম। সে দুনিয়ার কিছু মানে না। সব ভেলকিবাজি, সব ঝুট। সব ঝুট। কন্যে? হিহি করে হাসতে ইচ্ছে করে গঙ্গারামের।

ভাদু পথে চলছে আর মন্ত্র পড়ছে, মধ্যে মধ্যে একটা দড়িতে গিঠ বাঁধছে। এখান থেকেই সে মন্ত্ৰ পড়ে গিঠ দিয়ে বাঁধন দিচ্ছে, রোগীর দেহে বিষ যেন আর রক্তে না ছড়ায়। যেখানে রয়েছিস গরল, সেইখানেই থির হয়ে দাঁড়া; এক চুল এগুলো তোকে লাগে মা-বিষহরির কিরা। নীলকণ্ঠের কণ্ঠে যেমন গরল থির হয়ে আছে—তেমুনি থির হয়ে থাক্। দোহাই মহাদেবের নীলকণ্ঠের! দোহাই আস্তিকের! মা-বিষহরির বেটার!

পৃথিবীতে নাগ-নাগিনীকে বলে মায়াবী। যে ক্ষণে তারা মানুষের চোখে পড়ে, যে ক্ষণে মানুষ চঞ্চল হয়, বলেওই সাপ!—সেই ক্ষণেই নাগ-নাগিনী লোকচক্ষুর অগোচর হয়। মিলিয়ে তো যায় না, লুকিয়ে পড়ে। মায়াটা কথার কথা মিলিয়ে যাবার শক্তি ওদের নাই, ওরা চতুর; যত চতুর তত ত্বরিত ওদের গতি, তাই লুকিয়ে পড়ে। কিন্তু তার চাতুরী বেদের চক্ষে ছাপি থাকে না। সাপের চেয়েও বেদে চতুর, তার চাতুরী সে ধরে ফেলে। লুকিয়ে পড়েও বেদের হাত থেকে রেহাই পায় না। সাপের হাঁচি বেদেয় চেনে।

পিঙলা বলে—কিন্তু একজনের কাছে কোনো চাতুরীই খাটে না রে। বাবা গ! ইন্দ্ররাজার হাজার চোখ-ধরমদেবের হাজার চোখ নাই, একটি চোখ মাঝ-ললাটে—সে চোখের পলক নাই, তার দৃষ্টিতে কিছু লুকানো যায় না, কোনো চাতুরী খাটে না।

বারবার সেই কথা বলে পিঙলা সাবধান করে দিলে গঙ্গারামকে।–চাতুরী খেলতে যাস না, চাতুরী খেলতে যায় না।

গঙ্গারাম দাঁত বার করে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালে। কোমরের কাপড়টা সেঁটে বাঁধছিল সে। বললে-চুপ কর তু। গঙ্গারাম ভাদু দুজনেই কোমরে কাপড়ের সঙ্গে জড়িয়ে নিয়েছে দুটো গোখুরা। রাজবাড়িতে নাগ যদি থাকে তো ভালই, একটা থাকলে তিনটে বের হবে। দুটো থাকলে চারটে বের হবে। না থাকলে, দুটো পাওয়া যাবেই। সাপ থাকে ঘরের অন্ধকার কোণে। সেখানে গর্ত দেখে গর্তটা খুঁড়বার সময়-চতুর বেদে সুকৌশলে কোমরে বাধা সাপ দুটোকে ছেড়ে দিয়ে ধরে আনবে, বলবে—এই দেখেন সাপ!

মোটা শিরোপা মিলবেই। পিঙলার এটা ভাল লাগল না। অধর্ম করবে সাঁতালীর বেদেরা? মেটেল বেদেরা করে, ইসলামী বেদেরা করে—তাদের সাজে। সে সাবধানে করে দিলে। কিন্তু গঙ্গারাম দাঁত বার করে ঘাড় বেঁকিয়ে বললে—চুপ কর তু।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে পিঙলা বললে—বেশ, তাই চুপ করলাম, তোদের ধরম তোদের ঠাঁই!

 

বাবুদের পাঁচক বামুন বাঁচে নাই। সে মরে গিয়েছিল। তারা আসবার আগেই শেষ হয়ে গিয়েছিল। মেটেল বেদে, ডাক্তার, অন্য জাতের ওঝা-কেউ কিছু করতে পারে নাই।

পরের দিন সকালে সাপ ধরার পালা। বাইরে নয়, ঘরেই আছে সাপ।

প্রকাণ্ড বড় বাড়ি। পাকা ইটের গাঁথনি। চারিপাশ ঘুরে গণ্ডি টেনে দিয়ে এল। তার পর ভিতরে বাহিরমহল থেকে পুরনো মহলে ঢুকল। ওই মহলেই পাঁচক বামুনকে সর্পাঘাতে মরতে হয়েছে।

উঠানে বসে খাড়ি দিয়ে ঘরের ছক এঁকে মাটিতে হাত রেখে বসল ভাদু। হাত গিয়ে ঢুকল ছকের ভঁড়ার-ঘরে। এবার বেদেরাও উঠান থেকে গিয়ে ঢুকল ভাড়ার-ঘরে। অন্ধকার ঘর। তাদের নাকে একটা গন্ধ এসে ঢুকল। আছে। এই ঘরেই আছে। আলো চাই। আনুন আলো।

স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে পিঙলা সকলের পিছনে। দেখছে সে।

গঙ্গারাম হাঁকলে—আলো আনেন, হাঁড়ি আনেন। দু-তিনটা ঘঁড়ি আনেন। লাগ একটা লয় বাবা-দুটো-তিনটা। একটা পদ্মলাগ মনে লিচ্ছে। ধরব, বন্দি করব। শিরোপা লিব। আনেন।

—সবুর। হাঁক উঠল পিছন থেকে। ভারী গলায় কে হাঁকলে।

চমকে উঠল পিঙলা। গঙ্গারাম ফিরে তাকালে। ভাদু চোখ তুললে।

একজন অপরূপ জোয়ান লোক, মাথায় লম্বা চুল, মুখে দাড়িগোঁফ, হাতে তাবিজ, গলায় পৈতে, গৌরবর্ণ রঙ, সবল দেহ, চোখে পাগলের দৃষ্টি–লোকটি এসে দাঁড়াল সামনে। তার সে পাগলা চোখ গঙ্গারামের কোমরের কাপড়ের দিকে। চোখের চাউনি দেখে পিঙলা মুহূর্তে সব বুঝতে পারলে। কেঁপে উঠল সে। কি হবে? সাঁতালীর বিষবেদেকুলের মানমর্যাদা এই রাজবাড়িতে উঠানের ধুলার সঙ্গে মিশিয়ে দিয়ে যেতে হবে?

মা-বিষহরি গ! বাবা মহাদেব গ! উপায় কর। মান্য বচাও। যে সাঁতালীর বিষবেদের মন্ত্রের হাঁকে একদিন গর্ত থেকে নাগ বেরিয়ে এসে ফণা ধরে দাঁড়াত সেই সাঁতালীর বিষবেদেরা আজ চোর সেজে মাথা হেঁট করে ফিরবে? মেটেল বেদেরা আসবে, টিটকারি দেবে; এতবড় রাজার বাড়িতে নাগবন্দি দেখতে এসেছে কত লোক, মান্যগণ্য মানুষ তারা। বিষবেদেদের চোর। অপবাদ পথের দুপাশে ছড়াতে ছড়াতে তারা চলে যাবে। উপায় কর মা-বিষহরি।

লোকটি গম্ভীরস্বরে বললে—বেরিয়ে আয় আগে।

–আজ্ঞা?

–আগে তোদের তল্লাস করব। দেখব তোদের কাছে সাপ আছে কি না! দু হাত উপরে তুলে দাঁড়াল গঙ্গারাম। চোখ তার জ্বলে উঠল। কোমরে তার কাপড়-জড়ানো অবস্থায় বাঁধা রয়েছে সেই কালকের ধরা পদ্মনাগ। মরিয়া বেদের ইচ্ছা—কাপড় খুলে পদ্মনাথ বের করতে গিয়ে নাগ যদি ওকে কামড়ায় তো কামড়াক। ভাদুর কোমরেও আছে একটা গোখুরা। সে তার কোমরে হাত দিচ্ছে, খুলে ছুঁড়ে দেবে কোণের অন্ধকার দিয়ে। কিন্তু সতর্ক পাগলাটার চোখ নেউলের মত তীক্ষ্ণ। সে বললে খবরদার! সাঁড়া, উঠে দাঁড়া। দাঁড়া।

সে গলার আওয়াজ কি! বুকটা যেন গুরগুর করে কেঁপে উঠছে।

–চল, বাইরে চল্‌।

—ঠাকুর! সামনে এসে দাঁড়াল নাগিনী কন্যা পিঙলা। সঙ্গে সঙ্গে একটানে খুলে ফেললে তার পরনের একমাত্র লাল রঙের খাটো কাপড়খানা, পূর্ণ উলঙ্গিনী হয়ে দাঁড়াল সবার সামনে। চোখ তার জ্বলছে—সে চোখ তার নিম্পলক। দুরন্ত ক্ষোভে উত্তেজনায় নিশ্বাস ঘন হয়ে উঠেছে, নিশ্বাসের বেগে দেহ দুলছে। বললে—দেখ ঠাকুর, দেখ। নাগ নাই, নাগিনী নাই, কিছু নাই; এই দেখ।

সমস্ত জনতা বিস্ময়ে স্তম্ভিত নির্বাক হয়ে চেয়ে রইল উলঙ্গিনী মেয়েটার দিকে।

পরমুহূর্তেই মেয়েটা তুলে নিলে কাপড়খানা।

কাপড় পরে গাছকোমর বেঁধে সে গঙ্গারামের হাত থেকে টেনে নিলে শাবলখানা। বললে–মুই ধরব সাপ। আনেন আলো, আনেন হাঁড়ি। থাক্ গ, তোরা হোথাই দাঁড়িয়ে থাক্। মুই ধরব। সাপ—সাঁতালীর বেদের গায়ে হাত দিবেন না। অপমান করবেন না।

****

শাবল দিয়ে ঠুকলে সে পাকা মেঝের উপর। নিরেট জমাট ইট-চুনের মেঝেঠং—ঠং শব্দ উঠতে লাগল। কোণে কোণে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে এগিয়ে চলল বেদের মেয়ে। তার পিছনে সেই লোকটি।

হাতের আলো তুলে ধরে পিঙলা দেখলে। লাল ধুলোর মতওই ওখানে কি? একেবারে ওই প্রান্তে একটা বন্ধ দরজার নিচে জল-নিকাশের নালার মুখে? জোরে নিশ্বাস নিলে সে। ক্ষীণ একটা গন্ধ যেন আসছে। দ্রুপদে এগিয়ে গেল। হাতের আলোটা রেখে সেই ঝুরো ধুলো তুলে নিয়ে শুকলে। মুখ ফিরিয়ে ডাকলে সেই ঠাকুরকে।

–আসেন ঠাকুর, দেখেন। –

-পেয়েছিস?

–হাঁ। শাবল দিয়ে সে ঠুকলে। ঠং করে শব্দ উঠল।

–কই? ও তো নিরেট মেঝে।

–আছে। ওই দেখ ফাপা। সে আবার ঠুকলে এক কোণে। এবার শব্দটা খানিকটা অন্য। রকম। আরও জোরে সে টুকলে। –দেখ।

—গর্ত কই?

–চৌকাঠের নিচে, জল যাবার নালির ভিতর।

–খোঁড় তবে।

পাকা মেঝের উপর শাবল পড়তে লাগল।

দুয়ারের ওপার থেকে ভাদু বললে—সবুর রে বেটি, হুঁশিয়ার মা-জননী।

–ক্যানে?

–দাঁড়া, মুই যাই। দেখি একবার।

—না রে বাবা, মুই লতাদের নাগিনী কন্যে, ভরসা রাখু আমার পরে। সজ্জনকে দেখায়ে। দিই সাঁতালীর বিষবেদের কন্যের বাহাদুরি। কি বুলছিস তু বল, হোথা থেকেই বল্।

ভাদু বললে গর্তের মুখ কোথাকে?

—দুয়ারের চৌকাঠের নালাতে, ঠিক মাঝ চৌকাঠে।

–খুঁড়ছিস কোথা?

–ডাহিনের কোণ।

–বাঁয়ের কোণ দেখেছিস ঠুক্যা? পরখ করেছিস?

চমকে উঠল পিঙলা। তাই তো। উত্তেজনায় সে করেছে কি?

ভাদু বললে—মনে লাগছে চাতর হবে। গত বর্ষায় দেড় কুড়ি ভেঁকা বেরালছে। দেখু, ঠুকা দেখ আগে।

এবার পিঙলা বায়ের কোণে শাবল ঠুকলে। হাঁ। আবার ঠুকলে। হাঁ-হাঁ।

ভাদু বললে—এক কাম কর কন্যে।

হাঁ, হাঁ। আর বুলতে হবে নাই গ বাবা! আগে গর্তের মুখ খুল্যা এক মুখ বন্ধ করি দিব।

—হাঁ। ভাদু সানন্দে বলে উঠল—বলিহারি মোর বিষহরির নন্দিনী, মোর বেদেকুলের কন্যে! ঠিক বলেছিস মা! হাঁ। তারপরেতে এক এক কর্যা খোড়, এক এক কোণ। সাবধান, হুঁশিয়ারি করে।

শাবল পড়তে লাগল।

লাল কাপড়ে গাছকোমর বাধা কালো তন্বী মেয়েটার অনাবৃত বাহু দুটো উঠছে নামছে, আলোর ছটাও ঝিকঝিক করে উঠছে নামছে। ঘেমে উঠছে কালো মেয়ে। হাঁটু গেড়ে বসেছে সে। বুকের ভিতর উত্তেজনায় থরথর করছে। মান রক্ষে করেছেন আজ বিহরি। তার জীবন আজ ধন্য হয়েছে, সে সাঁতালী বিষবেদেকুলের মান রক্ষে করতে পেরেছে। উলঙ্গিনী হয়ে সে দাঁড়িয়েছিল—তার জন্য কোনো লজ্জা নাই, কোনো ক্ষোভ নাই তাঁর মনে।

মাঝখানের গর্তের মুখ খানিকটা খুললে সে। লম্বা একটা নালা চলে গেছে এদিক থেকে ওদিক। ডাইনে বসবাসের প্রশস্ত গর্ত, বায়েও তাই, মধ্যে নালাটা নাগ-নাগিনীর রাজপথ। সদর-অন্দরের রাস্তাঘর। খোয়া দিয়ে ঠুকে বন্ধ করে দিলে সে বাঁ দিকের মুখ। তারপর শাবল চালালে ডাইনের গর্তের উপর। জমাট খোয়া উঠে গেল। খোয়ার নিচে মাটি, তার উপর ঘা মেরে বিস্মিত হয়ে গেল পিঙলা। কোনো সাড়া নাই।

আবার মারলে ঘা। কই? কোনো সাড়া নাই। তা হলে ওপাশে চলে গেছে? তবু সে খুঁড়লে। প্রশস্ত মসৃণ একটি কাটা হাড়ির মত গর্ত—এই তো চাতর। তাতে এক রাশি সাদা ডিম। এবার সে বাঁ দিকে মারলে শাবল।

নাঃ, আবার তার ভুল হচ্ছে। এবার সে বন্ধ-করা নালার মুখ খুলে দিলে। তারপর আঘাত করলে গর্তে।

ঠুং ঠং ঠুং-ঠুং ঠুং-ঠুং।

গোঁ–! গোঁ–গো! গৰ্জন উঠতে লাগল সঙ্গে সঙ্গে। উত্তেজনায় নেচে উঠল বেদেনীর মন।

আঃ, মাথার চুল এসে পড়ছে মুখে।

শাবল ছেড়ে দিয়ে—চুল এলিয়ে গেছে—আবার চুল বেঁধে নিলে শক্ত করে। তারপর মারলে শাবল। শাবলটা ঢুকে গেল ভিতরে। সঙ্গে সঙ্গে সে সতর্ক হয়ে বসল। হাঁ, এবার আয় রে আয়নাগ-নাগিনী আয়। পিঙলা তৈরি। স্থিরদৃষ্টি, উদ্যত হাত, বসল বেদেনী এক হাঁটুর উপর ভর দিয়ে। বা হাতে শাবলখানা আরও একটু বসিয়ে দিলে চেপে। এবার গর্জন করে বেরিয়ে এল এক প্রকাণ্ড গোখরা। মুহূর্তে বেদের মেয়ে ধরলে তার মাথা।

–আ!

সঙ্গে সঙ্গে আর একটা। হাঁ–দুটো, দুটোই ছিল। নাগ আর নাগিনী।

–হুঁশিয়ার বেদেনী। চেঁচিয়ে উঠল পিছনের সেই পাগল ঠাকুর।

—থাম ঠাকুর।–গর্জন করে উঠল বেদের কন্যে। সঙ্গে সঙ্গে সে উঠে ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে উঠানে দাঁড়াল। বিচিত্র হয়ে উঠেছে সে নারীমূর্তি, দুই হাতে দুটো সাপের মাথা ধরে আছে। সাদা সাপ দুটো তার কালো নধর কোমল হাত দুখানায় পাকে পাকে জড়িয়ে। ধরেছে। তাকে পিষছে। কালো মেয়ে উঠানে দাঁড়িয়ে হাঁকলে–জয় বিষহরি!

তারপর ডাকলে—ধর্‌ গ, খুল্যা দে–কালের পাক খুল্যা দে। শুনছিস গ!

ছুটে এল ভাদু। গঙ্গারামকে ডাকলে–-গঙ্গারাম!

কিন্তু তার আগেই ওই পাগলা ঠাকুর তার বিচিত্র কৌশলে পাক খুলে টেনে নিলে নাগ দুটোকে, হাঁড়ির মধ্যে পুরে দিলে। পিঙলা উঠানে পা ছড়িয়ে বসে হপাতে লাগল আর অবাক হয়ে দেখতে লাগল ঠাকুরের কাজ। এ ঠাকুর তো সামান্য নয়! ঠাকুরকেই সে হাত জোড় করে বললে, আমাকে জল দিবেন এক ঘটি?

ঠাকুরই এল জলের ঘটি নিয়ে। বললে—সাবাস রে কন্যে! সাবাস! কিন্তু এক ঢোকের বেশি জল খাবি না। তোকে আমি প্রসাদী কারণ দোব। কারণ খাবি। মহাদেবের প্রসাদ। ওরে কন্যে, আমি নাগু ঠাকুর।

নাগু ঠাকুর। রাঢ় দেশের নাগের ওঝা নাগেশ্বর ঠাকুর! সাক্ষাৎ ধন্বন্তরি! ভূমিষ্ঠ হয়ে লুটিয়ে পড়ল পিঙলা তার পায়ে।

নাগু ঠাকুর তার মাথায় হাত বুলিয়ে বললে—সাবাস, সাবাস! হাঁ, তু সাক্ষাৎ নাগিনী কন্যে!

ভাদু গঙ্গারাম—তারাও ভূমিষ্ঠ হয়ে প্রণাম করল—নাগু ঠাকুর, ওরে বাপ রে!

পাগল নাগু ঠাকুরের শ্মশানে-মশানে বাস, সে কোথা থেকে এল। পিঙলা নিজের জীবনকে ধন্য মানলে; নাগু ঠাকুরকে সে দেখতে পেয়েছে। শিবের মত রঙ, তারই মত চোখ। পাগলপাগল ভাব নাগু ঠাকুরের।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *