২.২ চন্দনপুর ইস্টিশানে

বনওয়ারী গিয়েছিল চন্দনপুর ইস্টিশানে মনিবের সঙ্গে।

মাইতো ঘোষ ট্রেনে চাপলেন। বনওয়ারীকে চার আনা বকশিশ করে বললেন—খুব ট্রেন ধরিয়েছিস। ও, বুড়ো বয়সে এখনও খুব জোর তোর! প্রশংসা করলেন তিনি।

বনওয়ারী হেঁট হয়ে প্রণাম করে হাসতে লাগল। বললে তা আজ্ঞেন, আরও কোশখানেক এই গমনে যেতে পারি আজ্ঞেন।

ঘোষ বললেন–বাপ রে বাপ, ছুটতে হয়েছে আমাকে!

—কি করব আজ্ঞেন! চা খেতে দেরি করে ফেললেন আপুনি। সতর গমনে না এলে এনারে ধরতে লারতেন। উনি তো দাঁড়ান না। টায়েন হলেই ছেড়ে দ্যান।

হাসতে লাগলেন ঘোষ। বনওয়ারী গামছা দিয়ে কপালের শরীরের ঘাম মুছলে। স্থূল। গড়নের পাথরের মূর্তির মত শরীর ঘামে ভিজে গিয়েছে। কানের পাশ দিয়ে জুলফি বেয়ে ঘাম গড়িয়ে পড়ছে সদ্য-স্নান-করানো কষ্টিপাথরের মূর্তির মত।

ট্রেন ছেড়ে দিলে; বনওয়ারী আবার প্রণাম করে বললে—আমার নেবেদনটা’ তা হলে—

–হবে। দাদাকে বলে দিয়েছি। আমগাছ কটা আর বাঁশঝাড় পঁচটা লিখে দিস।

—তা দিতে হবে বৈকি আজ্ঞেন।

–বেশ।

গাড়ি চলে গেল। বনওয়ারী ইস্টিশানের নিমগাছতলাটায় ছড়ানো ইটগুলোর মধ্যে দুখানা টেনে উপরে উপরে রেখে একটু উঁচু করে নিয়ে বসল। আর তাড়া নাই। জিরিয়ে নিয়ে একটি কাজ আছে, সেই কাজটি সেরে তবে ফিরবে। বেশ ফুরফুর করে হাওয়া দিচ্ছে; হাওয়ার সঙ্গে রয়েছে মিঠে গন্ধ-বন-আউচ ফুলের সুবাস। এখানকার মাঠের আলের উপর, রাস্তার ধারে অনেক বন-আউচের গাছ। ইস্টিশানের দক্ষিণ দিকটা একেবারে জাঙল-বাঁশবাঁদি পর্যন্ত খোলা। চন্দনপুরের মাঠ একেবারে খালি—কাটা ধানের গোড়া ছাড়া আর কিছু নাই। খাখা করছে। বাবুলোকের গ্রাম। এ গ্রামের মাঠে অন্য ফসল হয় না এখন। হয়, তবু বাবু মহাশয়দের ওদিকে খেয়াল নাই। ধান ছাড়া আর সবই তারা খরিদ করে খান। মেলা পয়সা, বিস্তর টাকা-কেনইবা এইসব চাষের হাঙ্গামা তারা করবেন! এই যে চন্দনপুরের বড়বাবুরা জাঙলের কুঠিডাঙাটা কিনলেন, ওখানে কি ওঁরা এইসব চাষ করবেন বলে কিনলেন? চৌধুরীদের অবস্থা খারাপ হয়েছে-“মা-লক্ষ্মী ছেড়েছেন, ওরা সবই বিক্রি করছে, পতিত ডাঙাটাও বিক্রি করলে। মাইতো ঘোষ নিজে বলে গেলেন—ঘঘাষেরা কিনতে চেয়েছিলেন ওটা। কিন্তু ঘোষেদের কাছে বিক্রি করতে চাইলে না চৌধুরীরা। হাজার হলেও জাতজ্ঞাত তো। শেষে সেধে দিয়ে এল চন্দনপুরের বাবুদের; এখন বাবুরা যে অংশটার মাটি ভাল, অল্পস্বল্প ডোবে, মানে পলি পড়ে অথচ ফসল নষ্ট হয় না, সেই অংশটা কাটিয়ে জমি করবেন, বাকিটা বিলি করবেন; কতক কতক প্রজাবিলি করবেন, সেলামী নেবেন, খাজনা নেবেন। সেসব নেবেন জাঙলের মোড়ল মহাশয়েরা। বাকি যা থাকবে তাই পাবে পরম, বনওয়ারী, জাঙলের হাড়িরা, চন্দনপুরের শেখেরা। তাদের বন্দোবস্তের শর্ত আলাদা; শর্ত হল—কড়ারী খাজনার শর্ত। সেলামী নেবেন না। তবে তারা পতিত ভেঙে যে জমি করবে দশ বছর পরে সে জমিদারের হবে। খাজনার শর্ত হল প্রথম দু বছর বা তিন বছর খাজনা নেবেন না, তারপর এক বছর সিকি খাজনা, তার পরের বছর আধা খাজনা নেবেন, তারপর চলবে পুরো খাজনা। এগার বছরের বছর জমি হবে জমিদারের। কারণ, বার বছর হলেই নাকি তার স্বত্ব হয়। এগার বছরের পরে আর একটা বন্দোবস্ত হবে আর দশ বছরের জন্য। বিক্রি করতে পাবে না, করলেও তা আইনে টিকবে না, জমিদার কেড়ে নেবেন। তবে বিক্রি না করে চাষ করে যাও; খাজনা দাও, জমিদার মহাশয়ের সঙ্গে নিয়ে ভক্তি শ্রদ্ধা করে চল, কেউ কিছু বলবে না যতদিন খুশি ভোগ করে যাও। বাস্। সেইজন্যই তো ‘পিতিপুরুষে’ বলে গিয়েছেন—“আশ্চয়’ করবি লক্ষ্মীমন্তকে, মা-লক্ষ্মী মনিবের ঘরে ঢুকবেন, মনিবের উঠানে মায়ের পায়ের ধুলো অবশ্যই পড়বে, তাই কুড়িয়ে মাথায় করে আনবি, তাতেই তোর ‘সেগুষ্ঠি’র ‘প্যাট’ ভরবে। এতটুকু মিথ্যে নয় পিতিপুরুষের কথা। এই বনওয়ারীদের কথাই ধর না! ঘোষ মহাশয়ের ঘরে লক্ষ্মী এলেন। বনওয়ারীদের বাপ তাকে আশ্চয় করলে— সেই কল্যাণেই বনওয়ারীর বাবা হল কাহারপাড়ার মাতব্বর। ঘোষ-বাড়ির লক্ষ্মীর পায়ের ধুলোয় বনওয়ারীর বাপের অবস্থা সচ্ছল হল। নইলে তখন তো মাতব্বর ছিল ওই হেঁপো রোগী নয়ানের বাবা। নয়ানের কর্তাবাপের নিজের দু বিঘে জমি, চৌধুরী বাড়ি আশ্চয়ে’ বাস, তাদের সোনা-ফলানো জমি ওরা ভাগে করত। নয়ানের ঠাকুরদা মরদও ছিল জব্বর, হাঁকডাকও খুব। ‘ঘরভাঙারাই’ তখন মাতব্বর। নয়ানদের বংশটার নাম সেকালে ছিল ‘ঘরভাঙাদের গুষ্টি। আগের আমলে ওদের ঘর ছিল নীলের বাঁধের দক্ষিণ পাড়ে সব থেকে নিচু জায়গায়; আশ্চর্যের কথা, গোটা ঘরে বাস করা ওদের কখনও ঘটত না, প্রতি বছরই বর্ষার সময় ভাঙত। কোনোবার পুরো ঘরটাই ভাঙত, কোনোবার একটা দেওয়াল, কোনোবার-বা আধখানা দেওয়াল; এ ভাঙতেই হত। সেই অবধি ওদের বাড়ির নাম ঘরভাঙাদের বাড়ি। তারপর যখন নয়ানের কত্তাবাবা জাঙলের চৌধুরী মহাশয়দের ‘আশ্চয়ে এল—চৌধুরী-বাড়ির মা-লক্ষ্মীর পায়ের ধুলো কুড়িয়ে এনে নতুন ঘর করলে তখন আর মায়ের কৃপায় সে ঘর ভাঙল না। তবে নয়ানের ঠাকুরদাদা পিতিপুরুষের কথা মেনেছিল, ঘরখানা গোটা করেও দেওয়ালের মাথায় হাতচারেক লম্বা হাতখানেক চওড়া জায়গা দেওয়াল সম্পূৰ্ণ না করে মজবুত বাখারির বেড়া দিয়ে রেখেছিল। ভাগ্যমন্তের ‘আশ্চয়’চৌধুরী-বাড়ির মা-লক্ষ্মীর পায়ের ধুলোর কৃপা ছাড়া সেটা আর কি? চৌধুরী-বাড়ির পতন হল, সঙ্গে সঙ্গে ঘরভাঙা কাহার-বাড়ির মাতব্বরি গেল। মাতব্বর হল। বনওয়ারীর বাপ। বাপের পর বনওয়ারী মাতব্বর হয়েছে। ঘোষেদের আশ্চয়ে রয়েছে, ঘোষেদেরও চলছে বাড়বাড়ন্ত, বনওয়ারীরও যে বাড়বাড়ন্ত চলবে তাতে বনওয়ারীর সন্দেহ নাই। এখন সেদিন ওই কালোবউয়ের কাছে সায়েবডাঙা বন্দোবস্তির কথা শুনে ওই জমি খানিকটা নেবার মতলব হয়েছে, সেই কথা ভাবতে ভাবতে আর একটা কথা তার মনে হয়েছে। চন্ননপুরের বড়বাবুদের এখন এ চাকলার মধ্যে বাড়বাড়ন্ত, বাবুদের ‘আশ্চয়’ যদি একটু পায়, যদি এঁদের মা-লক্ষ্মীর পায়ের ধুলো আঙুলের ডগায়ও একটু তুলে আনতে পারে, তবে তো তার ঘরেও মা-লক্ষ্মী উথলে উঠবেন।

বনওয়ারীর মনে এটি অতি গোপন কথা। এ কথা কাউকে বলতে পারে না। ঘোষ মহাশয়রা জানতে পারলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। তবে ভাগ্যটা ভালই মনে হচ্ছে। মাইতো ঘোষ সাধারণত ইস্টিশানে যেতে তাকে ডাকেন না। মাল তো তার বেশি থাকে না। কি বলে, ‘বেগ’ না ‘সুটক্যাস’ আর তেরপলের মত মোটা কাপড়ের খোলে বাধা ‘বেনা’। এবার মাল নিয়েছেন বেশি। তাই ডাক পড়েছে ‘কোশকেঁধে বাড়ির বনওয়ারীর। ভালই হয়েছে, চন্ননপুরে যেকালে এসেছে, সেকালে বড়বাবুদের কাছারি হয়েই যাবে। বনওয়ারী উঠল। মাইতো ঘোষ যে সিগারেটটি দিয়েছিলেন, কানে যেটি গোঁজা ছিল, সেটি হাতে নিয়ে ইস্টিশানের বাইরে পান। বিড়ি-চায়ের দোকানের দড়ির আগুনে ধরিয়ে নিয়ে চন্ননপুর গ্রামের পথ ধরলে। প্রথমেই ইস্টিশান এলাকা। পথে পা বাড়িয়েও সে থমকে দাঁড়াল। মনে পড়ে গেল তার খুড়তুতো বোন সিধুকে। ঘুরল সে।

ইস্টিশানের এলাকাটি বেশ বড়।

ছোট ‘নাইন’ হলে কি হয়, চন্ননপুরের ইস্টিশানের সীমানা-সহর মস্ত। লাইন তো তৈরি হয়েছে সেদিন-বনওয়ারীর চোখের সামনে হল এসব। এই লাইনে খাটতে এসে কজন মেয়ে ঘর ছেড়েছে-পাচী খুকী বেলে চিত্ত নিম্মলা। খুকী আর বেলে গিয়েছে দেশ ছেড়ে-দুজন মুসলমান রাজমিস্ত্রির সঙ্গে। আর চিত্ত পাচী গিয়েছে একজন হিন্দুস্থানি লাইন-মিস্ত্রির সঙ্গে। নিৰ্ম্মলাও গিয়েছে আর একজন মিস্ত্রির সঙ্গে। ওই নিম্মলারই ছেলে করালী। পাঁচ বছরের ছোট করালীকে পর্যন্ত ফেলে হারামজাদী চলে গিয়েছে। ওঃ, রঙের নেশার কি ঘোর, সন্তান পর্যন্ত ভুলে যায়! সিধু আর ‘জগধাত্তি’ এরাও দুজনে ঘর ছেড়ে গিয়েছিল, কিন্তু তাদের ভালবাসার লোক তাদের সঙ্গে নিয়ে যায় নাই। তারা এখনও রয়েছে চন্ননপুরে, এই ইস্টিশান এলাকাতেই থাকে। মাস্টারদের বাড়িতে ঝিয়ের ‘পাটকাম’ করে, ইস্টিশানে পোড়া কয়লা কুড়োয়, কয়লা-চুনের ডিপোতে কামিনের কাজ করে। আবার রাত্রিকালে অন্য রূপ ধরে। বনওয়ারীই আর তাদের গায়ে ঢুকতে দেয় নাই। সিধু তার নিজের খুড়োর কন্যে; সিধুকে সে ভালবাসত। এই সিধুর জন্য আজও তার মন ‘বেথা পায়। আপন খুড়োর মেয়ে, কোলে-পিঠে করে মানুষ করেছে। হঠাৎ এসে আজ তার ইচ্ছে হল একবার সিধুকে দেখে যাবে। সিধুর ওখানে করালী-পাখীর খবরও পাবে।

ঘুরল বনওয়ারী। ইস্টিশানের এলাকার মধ্যে ঢুকল। লম্বা-এই এখান থেকে সেখান পর্যন্ত চলে গিয়েছে সারি সারি ঘর। পাকা ঘর, পাকা মেঝে, সামনে খানিকটা উঠান, এক এক ঘরে এক এক সংসার বেশ আছে। থাকবে না কেনে? সায়েবসুবোর কারখানা, তাদের ‘আশ্চয়ে আছে; কিন্তু বড় ঘুপচি। পাকা ছাদ, পাকা দেওয়াল, পাকা মেঝে হলেও এর মধ্যে থাকতে হলে বনওয়ারীর হাঁপ ধরে যেত। তাদের ঘর এর চেয়ে অনে; খারাপ, কিন্তু উঠানটি খোলা। তা ছাড়া এদের সংসারের ঘরদোরের গন্ধ যেন কেমন কেমন। এলেই নাকে লাগে। তাদের ঘরে গন্ধটির মধ্যে গোবর-মাটির গন্ধ, গরুর গায়ের গন্ধ, ধানের গন্ধ, কাঠ-ঘুটে পোড়ার গন্ধ, সারগাদার গন্ধ, পচাই মদের গন্ধ, বাড়ির আশপাশের বাবুরি তুলসীগাছের গন্ধ মিশে এক ভারি মিষ্টি প্ৰাণ-জুড়ানো গন্ধ। আর এখানকার গন্ধ আলাদা, ভারি কটু গন্ধ, ইঞ্জিনের ঝাড়া কয়লা আর জলে মিশে একটি ভাপানী তেজীয়ান গন্ধ এসে নাকে ঢোকে। ডাক্তারখানার তেজী ওষুধের গন্ধ ছাড়া আর কোথাকারও গন্ধ এমন তেজী নয়।

সিধু এই সকালবেলাতেই চুল আঁচড়াচ্ছে। যে অন্ন গেঁজে পচে যায়, সে অন্নের গন্ধ সকাল-বিকেল সব সময়ে এক। বনওয়ারী মনে মনে দুঃখের হাসি হাসলে। সকালবেলাতেই ‘ক্যাশ’ করতে বসেছে! বনওয়ারীকে দেখে সিধু ব্যস্ত হয়ে চুল আঁচড়ানো বন্ধ করে হেসে বললে—এস, দাদা এস, কি ভাগ্যি আমার!

—এলাম একবার। মাইতো ঘোষের মোটঘাট নিয়ে এসেছিলাম। তা বলি, একবার সিধুকে দেখে যাই।

সিধু উঠে তাড়াতাড়ি একখানা বস্তা পেতে দিলে—বস।

চন্দনপুরে থেকে সিধু তরিবৎ শিখেছে। আসন পেতে দিতে হয় সভ্যতার এ রীতি জেনেছে। তাদের পাড়ায় আগন্তুকেরা নিজেরাই ফু দিয়ে অথবা গামছা দিয়ে ধুলো-কুটো ঝেড়ে নিয়ে মাটিতেই বসে। গণ্যমান্য কেউ এলে বনওয়ারীর ঘরে দুটো মোড়া আছে, তাই এনে পেতে দেয়—যেমন দারোগাবাবু কি জাঙলের মনিব মহাশয়েরা কেউ। বনওয়ারী বসল বস্তাখানার উপর। বললে তারপরে, ভাল আছিল?

ভাল আর মন্দ! হেসে উঠল সিধু।–যেদিন খাটি সেদিন খাই, যেদিন খাটতে নারি সেদিন পেটে আঁচল বেঁধে পড়ে থাকি। জগধাত্তি কি কেউ যদি এক মুঠো দেয় তো খাই। আপনজন কে আছে যে তার উপর দাবি করব, বল?

বনওয়ারী চুপ করে রইল। সিধুর কথার মধ্যে প্রচ্ছন্ন অভিযোগ রয়েছে, তার সমস্তটাই এসে পড়ছে বনওয়ারীর উপর।

সিধু আবার বললে—তবু তোমার করালী ছোঁড়া লাইনে কাজ করা অবধি খোঁজখবর করে। পিসি বলে এসে বসে। তোমাদের খবর তার কাছেই পাই।

এতক্ষণে বনওয়ারী বললে—তা তুও তো মধ্যে-মাঝে যেতে পারিস উদিক পানে।

সিধু বললে—কে জানে বাপু, ভয় তো কাউকে নয়, ভয় তোমাকেই।

বনওয়ারী দুঃখের হাসি হেসে মাথা নামিয়ে রইল। সিধু হেসে বললে—তোমাকে বাপু বড় ভয় লাগে।

বনওয়ারী বললে—ছোটকালে বড় মারতাম ততাকে, লয়?

সিধু হেসে বললে—বাবা রে! তারপর গম্ভীর হয়ে বললে—তার লেগে লয়, তুমি বাপু ভারি কড়া নোক। কি বলে দেবে কে জানে? হয়ত বলবেসিধুকে কেউ বাড়িতে ঢুকতে দিয়ো না।

বনওয়ারীর চোখে হঠাৎ জল এসে গেল। মাথা হেঁট করে মাটির দিকে চেয়ে কোনোরকমে। আত্মসংবরণ করে সে উঠে পড়ল। ঘোষ যে চার আনা পয়সা তাকে দিয়েছিলেন, তারই একটি দুয়ানি সিধুকে দিয়ে সে বললে রাখ, মিষ্টি কিনে খাস।

সিধু বললে—সঁাড়াও। বলে ঘরে ঢুকে একটি পাকী মদের বোতল এনে বললে খানিক আছে, খাও।

বনওয়ারী একবার ভাবলে, তারপর বোতলটি নিয়ে গলায় ঢেলে দিলে।

সিধু বললে—সেদিন করালী সাপ মেরেছিল, মেরে এখানে অনেক খরচ করেছিল। দু বোতল এনে সবাই মিলে খেলাম। ওইটুকুন ছিল। তারপর হঠাৎ তার একটা সরস কথা মনে। পড়ে গেল, সে বেশ কৌতুক-পুলকিত স্বরে বলে উঠল—ওই দেখ, আসল কথাই শুধধতে ভুলে গিয়েছি—করালী-পাখীর রঙের কথা!

–হ্যাঁ, সে এক কাণ্ড হয়ে যেয়েছে। ছেড়াকে শায়েস্তা না করলে হবে না।

সিধু বললে—তারা এখানে পালিয়ে এসে দিব্যি রয়েছে। করালী তো লাইনে কাজ করে, একখানা ঘর পেয়েছে, সেইখানে রয়েছে। কি আর শায়েস্তা করবা তুমি? সে বলছিল—যাবেই। না আর তোমার এলাকাতে।

চমকে উঠল বনওয়ারী।

সিধু বললেওই সবশেষের ঘরখানায় রয়েছে তারা। এর পরে মুখে কাপড় দিয়ে হাসি ঢেকে বললে, ওদের রঙ দেখলাম খুব জমজমাট। করালী বলে–গায়েই যাব না, লাইনে খাটব, এইখানেই থাকব, কারুকে গেরাহ্যি করি না আমি। নতুন নোয়া এনে পরিয়ে দিয়েছে পাখীকে। ঘর পেতেছে, ধুম এখন চলছেইচলছেই।

চন্দনপুরে এসে সিধুর অনেক পরিবর্তন হয়েছে। রঙকে সে অঙ বলে না, নতুনকে নতুন বলে না। ঢলকো করে চুল বাধে।

বিড়ি লাও একটা, বিড়ি। সিধু বললে।

থাক্‌। বনওয়ারী হঠাৎ উঠে পড়ল।

বেরিয়ে এসে সে থমকে দাঁড়াল। হঠাৎ পাখী এবং করালীর ব্যাপারটা নিয়ে সে খুব চিন্তিত হয়ে উঠেছে। ভাল কথা নয়, গ্রামেই যাবে না এ মতলব ভাল নয়। বদমাশ হোক, দুষ্ট হোক, পাপী হোকছোঁড়া এখনও এমন অন্যায় কিছু করে নাই, যাতে তাকে গা থেকে দূর করে দিতে হবে। পাখীর সঙ্গে ব্যাপারটার মত ব্যাপার তো চিরকালই ঘটে আসছে। তা রঙ যখন পাকা, তখন নয়ানের সঙ্গে পাখীর ছাড়পত্র হয়ে যাক, সাঙা হোক করালীর সঙ্গে। গায়ে-ঘরেই থাকুক। এখানে সর্বনাশ হবে। পাখী-করালী জানে না, বুঝতে পারছে না, কিন্তু চোখ তো আছে—চেয়ে দেখুক ওই সিধুর দিকে, জগদ্ধাত্রীর দিকে।

 

খুব জমিয়ে বসেছিল ওরা। পাখী করালী নসুদিদি জগদ্ধাত্রী আর করালীর লাইনগ্যাঙ্গের দুজন সঙ্গী। মধ্যে একরাশ তেল-মাখানো মুড়ি-লঙ্কা-পেঁয়াজ, কতকগুলো বেগুনি ফুলুরি আর মদের বোতল। খুব গরম গরম কথা চলছে। পাখী কলরব করছে বেশি। দরজার মুখ থেকে তারই কথা শুনতে পেলে বনওয়ারী। পাখী বলছিল জগকে‘যার সঙ্গে মেলে মন, সেই আমার আপন জন’—ইয়ের আবার শাসনই বা কি মাতব্বরিই বা কিওই হেঁপে উগীর ঘরে আমি থাকব না, পালিয়ে এসেছি আজ ছ মাস। এখন একজনার সাথে আমার মনে অঙ ধরল, আমি তার ঘরে এলাম। এ কি লতুন নাকি কাহারদের ঘরে? না কি বল জগমাসি?

জগ বললেইয়ের আর বলব কি লো?

করালী বললে—মামলা যদি থাকে তো আমার সাথে ওই নয়না শলোর। তা আসুক নয়না, তার সাথেই বোঝাপড়া হোক। ঠেঙা আনুক, লাঠি আনুক, নিয়ে যাক পাখীকে কেড়ে।

পাখী ঝঙ্কার দিয়ে উঠল—ম মুখপোড়া, তোকে লাঠিসোটা মেরে আমাকে লিয়ে যেতে চাইলেই আমি যাব নাকি?

নসুদিদি বলে উঠল—তা বোলো না হে, তা বোলো না, সেই ‘কিল ধমধম পড়ে সই— কিল ধমধম পড়ে গো’, লাঠিসোটা মেরে নিয়ে যেতে ক্ষ্যামতা থাকলে চুলের মুঠোতে ধরে নিয়ে যাবে। তুমি হাত-পা ছুঁড়ে বড়জোর চেঁচিয়ে ‘রবশ্যাষে’ গলা ধরিয়ে কাপড়ের খুঁটে চোখ মুছে ভাত রাধতে বসবা, ‘হেনসেলে’ যাবা। মরদের কিলে বাবা ভুলে যায়, তা অঙের নোক!

পাখী বললে–না হে, না। অঙ যার পাকা হয়, অঙের নোকই পিথিবীর মধ্যে ‘ছেষ্ট’।

হি-হি করে হেসে উঠল নসুদি।

এই কি পাকা অঙ লাগল মনে মনে–ও সজনি!

এ সময়ে ঘরে ঢুকল বনওয়ারী। এক মুহূর্তে আসরটা স্তব্ধ হয়ে গেল। করালীর মুখ পর্যন্ত শুকিয়ে গেল। শুধু পাখী বার বার ঘাড় নেড়ে বলে উঠল–আমি যাব না, আমি যাব না। সঙ্গে সঙ্গে উঠে ছুটে ঘরের মধ্যে ঢুকে দরজাটা সশব্দে বন্ধ করে দিলে।

বনওয়ারী ডাকলে করালীকে শোন।

করালী এতক্ষণে একটা দীর্ঘনিশ্বাস টেনে বুকটা ফুলিয়ে নিয়ে উঠে এসে উদ্ধতভাবেই বললে—কি?

বনওয়ারী বললে—চুটি হলে বাড়ি যাস পাখীকে নিয়ে। এখানে থাকবার মতলব ভাল নয়। উ-সব ছাড়। বাড়ি যাস; সাঙার ব্যবস্থা করে দেব। বুঝলি?

করালী শান্ত ছেলেটির মতই ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালে।

বাড়ির বাইরে এসে আবার করালীকে ডাকলে বনওয়ারী, আর একটা কথা মনে পড়েছে থানায় গিয়েছিলি? বশকিশটা এনেছিস?

—না। —আয় আমার সাথে। দারোগাবাবুর কাছে তাকে শনাক্ত দিয়ে যাব।

শনাক্ত?

—হ্যাঁ রে। তুই যে করালী, দারোগা তা জানবে কি করে? সেই শনাক্ত দিয়ে যাব। তা’পরে আপনার বশকিশ তুই লিস যবে দেবে। আয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *