২.২ কালীগঞ্জের বৌ

কালীগঞ্জের বৌ-এরও তখন চরম অবস্থা। নিঃসন্তান বিধবা মানুষ তিনি। এককালে স্বামীর জীবিতাবস্থায় তিনি অনেক সুখ অনেক ঐশ্বর্য দেখেছেন। দুটি ছেলে হয়েছিল তার। তারাও তখন আর নেই। কালীগঞ্জে যেবার কলেরা মহামারী হয়ে দেখা দিয়েছিল সেবার দুই ছেলেই তার চোখের সামনেই মারা গিয়েছিল! স্বামীর মৃত্যু, দুই ছেলের মৃত্যু, সবই তিনি সহ্য করেছেন বুকে পাথর বেঁধে। তখন ওই নরনারায়ণ চৌধুরীই ছিল কালীগঞ্জের জমিদারের নায়েব। তার হাতেই সব কিছুর ভার দিয়ে কালীগঞ্জের বউ বড় নিশ্চিন্ত ছিলেন। পনেরো টাকা মাইনে পেতেন তখন নরনারায়ণ চৌধুরী। সামান্য নায়েব মাত্র। অতি কষ্টেসৃষ্টে সংসার চলতো তার। কিন্তু সন্তান-হারা বিধবার হাতে জমিদারির ভার পড়ার পর থেকেই নরনারায়ণ চৌধুরীর অবস্থা ফিরতে লাগলো। তিনি নায়েবগিরি করেন কালীগঞ্জে কিন্তু একখানা ছোট কোঠাবাড়ি করলেন নবাবগঞ্জে, নিজের গ্রামে। মাসে পনেরো টাকা মাইনে পাওয়া নায়েবের কোঠাবাড়ি করবার সামর্থ্য হয় কী করে সে প্রশ্ন জমিদারির বিধবা মালিক কালীগঞ্জের বৌ-এর মাথায় আসেনি। এলে আর নরনারায়ণ চৌধুরী আজ এত বড়লোক হতে পারতেন না। আর তখন সে-প্রশ্ন উঠলে আজকের এই আসামী সদানন্দ চৌধুরীকে নিয়ে উপন্যাস লেখবার প্রয়োজনও এমন করে অনিবার্য হয়ে উঠতো না।

তা সেদিন সেই সদানন্দ চৌধুরীর বিয়ের আগের দিন সন্ধ্যেবেলা হঠাৎ কালীগঞ্জের বৌ সদানন্দকে তার বাড়িতে দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিল। বুড়ি মানুষ, ভালো করে তখন চোখেও দেখতে পায় না। বিরাট বাড়ি। কিন্তু ওই বিরাট বাড়িটাই শুধু আছে তখন। আর কিছু নেই। সব ঘরগুলোতে ভালো করে ঝাঁটও পড়ে না। আগেকার সেই সব লোক-লস্করও নেই আর তখন। একটা ঝি শুধু হাতের কাজগুলো করে দেয়। আগে গোয়াল-ভরা গরু ছিল, বলদ ছিল চাষবাসের। আর ছিল কিছু লোকজন, যারা এককালে কর্তাদের নিমক খেয়েছে। তারা কৃতজ্ঞতার তাগিদে বাড়ির আনাচে-কানাচে কোনও রকমে তখনও বাসা বেঁধে আছে। দরকার হলে ভাঙা পালকিটায় করে গিন্নীমাকে এখানে–ওখানে নিয়ে যায়। তাও পালকিটার তখন রং চটে গেছে, একটা পায়া ভেঙে গেছে। কোনও রকমে মেরামত করে করে সেটা একটু চালু আছে।

–তুমি কে বাবা?

সদানন্দ একেবারে নিচু হয়ে বুড়ির পায়ে হাত দিয়ে মাথায় ঠেকালে।

–আমি সদানন্দ। আমি নবাবগঞ্জের নরনারায়ণ চৌধুরীর নাতি, আর হরনারায়ণ চৌধুরী আমার বাবা।

কালীগঞ্জের বৌ তখন বিস্ময়ে হতবাক। যেন কথাটা বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হচ্ছিল না বুড়ির।

বললে–তা আমার কাছে যে তুমি হঠাৎ? নায়েবমশাই কি তোমার হাত দিয়ে আমাকে টাকা পাঠিয়েছে?

সদানন্দ বললে–না

–তাহলে তুমি কী করতে এয়েছ?

–আমি তোমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি কালীগঞ্জের বৌ! আমি বাড়ি থেকে চলে এসেছি। আমার কালকে বিয়ে, এবার থেকে আমি তোমার কাছেই থাকবো।

কালীগঞ্জের বৌ কথাগুলো শুনে কেমন যেন আকাশ থেকে পড়লো। কী করবে বুঝতে পারলে না। তখনও আহ্নিক সারা হয়নি তার। এতক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল, এবার বসে পড়লো বুড়ি। বললে–তোমার বিয়ে? কাল?

–হ্যাঁ–

–তা কাল তোমার বিয়ে যদি হয় তো তুমি বাবা আজকে আমার বাড়িতে এলে কেন? কাল সকালেই তো তোমার গায়ে-হলুদ হবে, তখন তো তোমার খোঁজ পড়বে। তখন তো আমার নামেই দোষ পড়বে যে, আমি তোমাকে আমার কাছে আটকে রেখেছি। তা নায়েব মশাই জানে যে, তুমি আমার কাছে এসেছ?

সদানন্দ বললে–না। আমি কাউকেই জানাইনি এখানে আসার কথা। কাউকে আর জানাবোও না। আমি আর ও বাড়িতে যাবোও না।

কালীগঞ্জের বৌ বললে–তোমার হলো কী বাবা? তুমি কি বাড়ির সঙ্গে রাগারাগি করেছ?

–না কালীগঞ্জের বৌ, আমি তোমার এখানে থাকবো বলেই এসেছি। এবার থেকে আমি বরাবর তোমার এখানেই থাকবো। নবাবগঞ্জে আর যাবো না।

কালীগঞ্জের বৌ বললে–তুমি দেখছি ছেলেমানুষ আছ এখনও। আমার এখানে যে তুমি থাকবে তা খাবে কী? তুমি বড়লোকের বাড়ির ছেলে, আমি গরীব মানুষ, আমি কি তোমাকে খাওয়াতে পারবো বাবা? তুমি ছেলেমানুষি কোর না, বাড়ি চলে যাও। একে তো তোমার দাদু আমাকে দেখতে পারে না, এর পরে যদি তোমাকে আমার এখানে দেখতে পায় তো আমাকে আর আস্ত রাখবে না, আমাকে আর তোমাদের বাড়িতেও ঢুকতে দেবে না–

সদানন্দ জিজ্ঞেস করলে–তা তুমি দাদুর কাছে যাও কেন? কেন তুমি দাদুর কাছে ভিক্ষে করতে যাও? ভিক্ষে করতে তোমার লজ্জা করে না?

কালীগঞ্জের বৌ বললে–কিন্তু আমার পাওনা টাকা চাইতে যাওয়াও ভিক্ষে? তোমার দাদু তো আমার সর্বস্ব নিয়েছে। আমার জমি-জমা কিচ্ছু আর বাকি রাখে নি। কেবল এই ভিটেটুকু ছাড়া আর আমার নিজের বলতে কিছু নেই। আমার লাখ-লাখ টাকার সম্পত্তি সব তোমার দাদু নিয়ে নিয়েছে, তাই শেষকালে আমি অনেক কান্নাকাটি করাতে তোমার দাদু বলেছিল আমাকে হাজার দশেক টাকা দেবে। তাই শুনে আমি মামলা তুলে নিয়েছিলুম। তা এখন সেই টাকাটা চাওয়াও নাকি আমার অন্যায়! আমি তো আর দুদিন পরে মরে যাবো, তখন টাকা দিলে আমার কী লাভ হবে বলো বাবা? সে টাকা কি আমার ছেরাদ্দে খরচ হবে?

সদানন্দ বললে–তোমাকে কিছু বলতে হবে না, আমি সব জানি–

–তুমি সব জানো বাবা? সব জানো তুমি? বুড়ির যেন আনন্দে গলা বন্ধ হয়ে এলো।

সদানন্দ বললে–সব জানি বলেই তো আমি এসেছি–

–কী করে জানলে তুমি? কে বললে–তোমাকে? কে আমার এমন শুভাকাঙ্ক্ষী আছে বাবা? আমি জানতুম, আমার কেউ নেই। কর্তা গেছেন, নিজের পেটের দুটো ছেলে থাকলেও আজ আমার এই দুর্দশা হতো না। তাই ভাবি, মানুষ এমনি করেই মানুষের সর্বোনাশ করে? কই, তোমার দাদুর তো কোনও ক্ষতি হয়নি? তার তো ছেলে বেঁচে রয়েছে! তুমি তার নাতি, তোমারও তো কাল বিয়ে হবে, তারপর একদিন তোমারও ছেলে পুলে হবে, ঘর-সংসার ভরে উঠবে তোমাদের। তখন তো একবার কেউই ভাববে না কার টাকায় এসব হলো, কার সর্বোনাশ করে তোমাদের এত বাড়বাড়ন্ত হলো। কিন্তু আমার কী হলো? আমি তোমার দাদুর কাছে কী অপরাধ করেছি যে তিনি আমার এত বড় সর্বোনাশটা করলেন। দেখ বাবা, আমি তাই তাঁকে রাগের মাথায় শাপ দিয়ে এসেছি–

–শাপ দিয়ে এসেছো? কাকে?

–তোমার দাদুকে। ওই নায়েব মশাইকে রাগের মাথায় শাপ দিয়েছিলুম। শাপ দিয়ে বলেছিলুম যে আপনি নির্বংশ হবেনই, বামুনের শাপ নিষ্ফল হবে না। তা রাগ হলে কি মানুষের জ্ঞান থাকে বাবা? আমিও তাই রাগের মাথায় ওই কথা বলে ফেলেছিলুম। তাই আমার ওপর তোমার দাদুর অত রাগ। এখন বলছে আর টাকা দেবে না–

সদানন্দ বললে–আমি তোমার টাকা সব মিটিয়ে দেবো–আমি তোমাকে তো সেই কথা বলতেই এসেছি–

–তুমি আমার টাকা মিটিয়ে দেবে? তা আমি মরে গেলে আমার টাকা মিটিয়ে দিলে আমার কী লাভ? বেঁচে থেকেই যদি খেতে না পেলুম তো আমি মারা গেলে সে টাকা কে খাবে? ভূতে খাবে?

হঠাৎ একটা শব্দে সদানন্দর যেন চম ভাঙলো। হঠাৎ বাইরে কে যেন বলে উঠলো– ওরে বাজনা বাজা–বাজনা বাজা–

সঙ্গে সঙ্গে ঢোল বেজে উঠলো বাইরে। তখন সম্প্রদান হচ্ছে। পুরুতমশাই মন্ত্র পড়তে শুরু করেছেন–

যদিদং হৃদয়ং তব তদিদং হৃদয়ং মম

নয়নতারার হাতের পাতাটা ধরে আছে সদানন্দ আর পুরুতমশাই নিজের মনেই গড় গড় করে মন্ত্র পড়ে চলেছেন। কিন্তু একটা কথাও যেন আর তখন কানে যাচ্ছে না তার। তার তখন কেবল মনে পড়ছে সেই রাধার গাওয়া গানটা। রাণাঘাটের বাজারের রাধা।

আগে যদি প্রাণসখি জানিতাম
শ্যামের পীরিত গরল মিশ্রিত
কারো মুখে যদি শুনিতাম।
কুলবতী বালা হইয়া সরলা
তবে কি ও বিষ ভখিতাম ॥

সদানন্দর মনে হলো প্রকাশ মামার রাধা সেদিন গানটা ঠিক গায়নি। ‘শ্যামের পীরিত’ নয়, ওটা হবে ‘টাকার পীরিত’। টাকার পীরিত গরল মিশ্রিত বললেই যেন ঠিক হতো। টাকার জন্যেই তো আজ তার দাদু বড়লোক, টাকার জন্যেই তো তারা জমিদার, টাকার জন্যেই তো আজ এই সুন্দরী মেয়ের সঙ্গে তার বিয়ে হচ্ছে। অথচ এ টাকা তারও নয়, তার বাবারও নয়, তার দাদুরও নয়। এই সমস্ত যা কিছু তাদের সম্পত্তি সব তো কালীগঞ্জের বৌ-এর।

পুরুতমশাই তখনও মন্ত্র পড়িয়ে চলেছে–যদিদং হৃদয়ং তব, তদিদং হৃদয়ং মম, যদিদং হৃদয়ং তব তদিদং হৃদয়ং……

কোথা দিয়ে যে সেদিন কী ঘটে গেল তা সদানন্দ জানতেও পারলো না। কিম্বা হয়ত জানতে চাইলোও না। সব সময় প্রকাশ মামা পাশে দাঁড়িয়ে। কানের কাছে মুখ এনে বলতে লাগলো, কী রে, অমন গোমড়া মুখ করে আছিস কেন? কী হয়েছে তোর? দেখছিস কত মেয়েছেলে রয়েছে চারদিকে, একটু চেয়ে দেখ!

.

চৌধুরী মশাই ভোরের ট্রেনেই চলে এলেন। আসবার সময় প্রকাশকে কাছে ডাকলেন। প্রকাশ সারারাত জেগেছে। বিয়ের সম্প্রদান থেকে শুরু করে একেবারে বাসর-ঘর পর্যন্ত। নিরঞ্জন পরামাণিকও ছিল সঙ্গে। নিরঞ্জনের ঘুমোলে চলবে না। একেবারে বাসর-ঘরের দরজার সামনেই কাছাকাছি কোথাও থাকতে হবে। যেন সে নজর রাখে একটু। যেন সদানন্দ পাগলামি না করে।

প্রকাশ বলেছিল–অমিও তো আছি জামাইবাবু, আমি রাত্তিরে ঘুমোব না।

তা নিরঞ্জন আর প্রকাশ মামা দু’জনের ভরসাতেই চৌধুরী মশাই-এর জন্যে ব্যবস্থা-বন্দোবস্তের কোনও ত্রুটি রাখেননি। পাকা বন্দোবস্ত একেবারে। নিজে আলাদা বসিয়ে তাঁকে খাইয়েছেন। চৌধুরী মশাই যে নিজে আসবেন এটা কালীকান্ত ভট্টাচার্যের কাছে কল্পনার বাইরে ছিল। অত বড় রাশভারি মানুষটাকে নেহাৎ বেকায়দায় পড়েই ছেলের বরকর্তা হয়ে এত দূরে আসতে হয়েছে।

রাত্রে শুতে যাবার আগেও জিজ্ঞেস করলেন–তাহলে আমি শুতে যাই প্রকাশ?

প্রকাশ বললে–হ্যাঁ হ্যাঁ, আপনি শুতে যান জামাইবাবু। আপনি কী করতে জেগে থাকবেন? আমি তো আছি, আমি আছি, নিরঞ্জন আছে–

তবু যেন স্বস্তি পাচ্ছিলেন না চৌধুরী মশাই। বললেন–দেখো প্রকাশ, যেন আবার কেলেঙ্কারি না হয়!

প্রকাশ বলেলে–কেলেঙ্কারি? আমি থাকতে কী কেলেঙ্কারি হবে?

চৌধুরী মশাই বললেন–মানে আবার যদি খোকা পালিয়ে যায় সেই কথাই বলছি–

–আর পালাবে না।

চৌধুরী মশাই বললেন কীসে বুঝলে? প্রকাশ একটু ইঙ্গিতপূর্ণ হাসি হাসলো।

বললে–বুঝি জামাইবাবু, আমি বুঝি–

–খুলে বলো না কীসে বুঝলে?

প্রকাশ বললে–সদার বউ পছন্দ হয়েছে–

–তাই নাকি? খোকা তোমায় বললে?

প্রকাশ বিশেষজ্ঞের মত ভঙ্গি করে বলে উঠলো–ও কি আর মুখে বলবার জিনিস জামাইবাবু? ও বুঝে নিতে হয়।

চৌধুরী মশাই বললেন–তাহলে ত আর কোনও ভাবনাই নেই–

প্রকাশ বললে–না, কোনও ভাবনা নেই, আপনি নিশ্চিন্তে নাক ডাকিয়ে ঘুমোতে যান।

এর পরে চৌধুরী মশাই-এর কোনও দুশ্চিন্তা ছিল না। তিনি তার নির্দিষ্ট বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়েছিলেন। তারপর সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে যাবার আয়োজন করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। যাবার আগে আবার ডেকে পাঠালেন প্রকাশকে। শুধু প্রকাশ নয়, তার সঙ্গে নিরঞ্জন পরামাণিকও এলো।

তাদের জন্যেই চৌধুরী মশাই উগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করছিলেন।

বললেন–কী খবর প্রকাশ?

প্রকাশ বললে–যা বলেছিলুম তাই–

–তার মানে?

প্রকাশ বললে–তার মানে আমাকে জিজ্ঞেস করবেন না, জিজ্ঞেস করুন এই নিরঞ্জনকে-একে বাসর-ঘরের কাছেই একটা বারান্দায় শুতে বলেছিলুম। ও শুয়ে শুয়ে সব শুনেছে–

চৌধুরী মশাই নিরঞ্জনের দিকে চাইলেন।

নিরঞ্জন বললে–হ্যাঁ বড়বাবু, শালাবাবু যা বলেছেন ঠিক বলেছেন। খোকাবাবু কাল বাসর-ঘরে কথা বলেছেন।

–কী কথা?

–আজ্ঞে বাসর-ঘরে কাল রাত্তিরে মেয়েরা গান গাইছিলেন তো, আমি বারান্দা থেকে সব শুনতে পাচ্ছিলাম। গানের পর মেয়েরা বরকে জিজ্ঞেল করলেন–গান কেমন লাগলো!

–তা খোকা কী উত্তর দিলে?

–খোকাবাবু মনে হলো খুব খুশী। খোকাবাবুর গলা শুনতে পেলুম। খোকাবাবু বললেন–খুব ভালো।

যাক, সুখবরটা শুনে চৌধুরী মশাই খুশী হলেন। তাহলে আর ভয় নেই।

প্রকাশ বললে–আমি তো আপনাকে আগেই বলেছিলুম জামাইবাবু, ও কনের মুখ দেখলে সদার সব পাগলামি বাপ বাপ বলে পালিয়ে যাবে। অমন ডানাকাটাপরী দেখলে মুনি-ঋষিদের ধ্যান পর্যন্ত ভেঙে যায় তো আমাদের সদা তো কোন্ ছার–

ততক্ষণে ট্রেন ছাড়বার সময় হয়ে গিয়েছিল। চৌধুরী মশাই আর থাকতে পারলেন না। ট্রেনে ওঠবার আগে প্রকাশ চৌধুরী মশাই-এর গা ঘেঁষে দাঁড়ালো। বললে–একটা কথা ছিল জামাইবাবু–

–কী?

–কিছু টাকার দরকার ছিল। আজ তো আবার বর-কনেকে নিয়ে যেতে হবে। অনেক খরচ হবে। মেয়েদের শয্যা-তুলুনি আছে, ওদের পরামাণিককে কিছু টাকা দিতে হবে। তারপর…..

চৌধুরী মশাই বললেন–কিন্তু তোমার হাতে যে কাল তিনশো টাকা দিলুম–

–আজ্ঞে তিনশো টাকায় কী হবে? সে টাকা তো আছে। তবু হাতে একটু বেশি টাকা থাকলে বুকে বল-ভরসা হয়–

চৌধুরী মশাই জামার ভেতরের পকেট থেকে কয়েকখানা নোট বার করলেন। করে এক এক করে গুনতে লাগলেন। বার বার গুনে বললেন–এই নাও—

প্রকাশ টাকাটা নিয়ে বললে–কত?

–আরো একশো দিলাম—

–একশো মোটে? একশোতে কী হবে?

চৌধুরী মশাই বললেন–তা এত টাকা তোমার কীসে লাগবে শুনি? রজব আলী তো ইস্টিসানে এসে হাজির থাকবে, তারপর পালকি-ভাড়া বর-কনে বাড়ি পৌঁছুলে সব মিটিয়ে দেব–

তা তাই-ই সই। নোট ক’খানা গুনে প্রকাশ সেগুলো পকেটে পুরে ফেললে। টাকা নিয়ে বেশি ছেঁড়াছিঁড়ি করতে নেই তা প্রকাশ জানে। তাতে কাজ হাঁসিল হয় না।

তারপর ট্রেন ছেড়ে দিলে।

এসব কবেকার ঘটনা। আজ এতদিন পর অতীতের সমস্ত পথগুলো পরিক্রমা করতে গিয়ে সেদিনকার সব কিছু খুঁটিনাটি ঘটনাগুলো মনে পড়তে লাগলো সদানন্দ চৌধুরীর। সেদিনকার সেই ছেলেটাকে যেন চেষ্টা করলে এখনও চেনা যায়। চেনা যায় তার ছোটখাটো কথা আর মানুষের সঙ্গে ব্যবহারের ঘটনাগুলো। অথচ কেউই তাকে চিনতে পারেনি। তার দাদু, তার বাবা, মা, প্রকাশ মামা, সবাই তাকে তাদের প্রচলিত নিয়মের বেড়াজাল দিয়ে ঘেরা পৃথিবী থেকে নির্বাসন দিয়েছিল। নির্বাসন দিয়ে তার মাথার ওপর শাস্তির বোঝা চাপিয়ে দিয়ে সমস্ত দায় থেকে নিজেদের বিবেককে মুক্ত করতে চেষ্টা করেছিল। তারা ভেবেছিল তাদের ছাঁচে সদানন্দকে ঢালাই করে শুধু বংশবৃদ্ধির প্রয়োজনে তাকে বাঁচিয়ে রাখবে। সদানন্দ তাদের প্রতিনিধি হয়ে দিনের পর দিন সেই একই নিয়মের পুনরাবৃত্তি করে যাবে, যে-নিয়মের প্রবর্তন করে এসেছে সমস্ত মানুষ জাতের পূর্বপুরুষ। সদানন্দ সেই দিন থেকেই ভেবেছিল এতদিনকার সেই নিয়ম সে ভাঙবে। সে ভেবেছিল সে বলবে আমি তোমাদের কেউ নই! তোমাদের পাপের ভাগীদার যেমন আমি নই, তেমনি তোমাদের পুণ্যের ভাগীদারও নই আমি। তোমাদের সমস্ত পাপ-পুণ্যের দুষ্কৃতি-সুকৃতি নিয়ে তোমরা সুখে থাকো, শুধু আমাকে মুক্তি দাও তোমরা। আমি যেমন তোমাদের সাহায্য চাই না তেমনি চাই না তোমাদের উত্তরাধিকারের অধিকারও।

অথচ সমস্ত অপরাধ থেকে দায়মুক্ত হয়েও আজ সে একজন আসামী। ভাগ্যের বোধ হয় এও এক বিচিত্র পরিহাস।

.

ভদ্রলোক পাশে পাশে আসছিল। ভদ্রলোক সারাজীবন আসামী আর ফরিয়াদী নিয়ে জীবন কাটিয়েছে। অনেক আসামী দেখেছে আবার অনেক ফরিয়াদীও দেখেছে। কিন্তু এমন আসামী আর দেখেনি।

বললে–একটু পা চালিয়ে চলুন–পা চালিয়ে চলুন–

সদানন্দবাবু হাসলেন। যেন পা চালিয়ে চললেই বেশি এগিয়ে যাওয়া যায়। তার দাদু, তার বাবা, তার মা, তার প্রকাশ মামা, তার দাদামশাই, সবাই তো সংসারে একটু পা চালিয়েই চলতে চেয়েছিল। তারা সবাই-ই ভেবেছিল পা চালিয়ে চললেই বুঝি তারা আরো একটু এগিয়ে যেতে পারবে। ভেবেছিল আরো টাকা, আরো ক্ষমতা, আরো আয়ু পাবে আর একটু পা চালিয়ে চললেই। তারা পা চালিয়েই চলতে চেয়েছিল, কিন্তু থেমে থেমে এগিয়ে যাওয়ার প্রজ্ঞা তাদের আসেনি। তারা জানতো না যে যারা থেমে থাকে তারাই চলা লোকদের হারিয়ে দিয়ে এগিয়ে যায়।

আশ্চর্য, শেষ পর্যন্ত তাই-ই হয়েছিল তাদের। তাদের সকলের।

সদানন্দর মনে আছে রসিক পালের বাড়িতে যেমন আজকে কাছারির পেয়াদা এসে হাজির হয়েছে সমন নিয়ে, ঠিক তেমনিই একদিন ওই প্রকাশ মামা তার কাছে এসে হঠাৎ হাজির হয়েছিল। সদানন্দ তখনও এখনকার মত নিঃস্ব নিঃসহায়। কলকাতার এক ধর্মশালায় তখন অন্নদাস হয়ে জীবন কাটছে তার।

প্রকাশ মামা তাকে দেখে অবাক। বললে–আমি তো তোকে খুঁজতেই বেরিয়েছি রে? তুই এখানে রয়েছিস?

সদানন্দ বললে–কেন? আমার সঙ্গে আবার তোমার কী দরকার?

প্রকাশ মামা বললে–তোর জন্যে কোথায় কোথায় গিয়েছি জানিস?

সদানন্দ বিরক্ত হয়ে উঠলো প্রকাশ মামার ওপর। বললে–ও-সব কথা থাক, তুমি আমার খোঁজ করছো কেন তাই বলো।

প্রকাশ মামা বললে–কেন, তোর এত তাড়া কিসের? আমি তো তোর ভালোর জন্যেই এসেছি, আমার নিজের তো কিছুই না–

সদানন্দ বললে–আমার তুমি অনেক ভালো করেছ মামা, আর আমার ভালোর দরকার নেই। তুমি আমার ভালোর জন্যেই আমার বিয়ে দিয়েছিলে, আমার ভালোর জন্যেই তোমরা আমাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলে, তোমরা আমার ভালোর জন্যেই কপিল পায়রাপোড়াকে ভিটে মাটি ছাড়া করেছিলে, আর আমার ভালোর জন্যেই তোমরা কালীগঞ্জের বৌ-এর সর্বনাশ করেছিলে, আবার আমার ভালোর জন্যেই তোমরা সেই বংশী ঢালীকে দিয়ে তাকে খুনও করিয়েছিলে। দয়া করে তোমরা আর ভালো করতে চেয়ো না মামা। আমার যথেষ্ট ভালো করেছ, আর ভালো করতে হবে না

কথাগুলো প্রকাশ মামার ভালো লাগলো না। বললে–তুই তো বেশ কথা বলতে শিখেছিস, অথচ জামাইবাবু বলতো–তোর মাথা খারাপ হয়ে গেছে। এখন তো বেশ সেয়ানা মানুষের মত কথা বলছিস তুই!

সদানন্দর বেশী কথা বলতে সেদিন ভালো লাগেনি।

বললে–তুমি কি করতে আমার কাছে এসেছ তাই আগে বলো—

প্রকাশমামা হঠাৎ বলে উঠলো–তোর বাবা মারা গেছে–

খবরটা শুনে সদানন্দর চমকে যাওয়া উচিত ছিল। অন্তত কিছুটা হতবাক হওয়া। কিন্তু সেদিন কিছুই হয়নি তার। সে শুধু প্রকাশমামার মুখের দিকে খানিকক্ষণ হাঁ করে চেয়ে রইল। আর যেন কিছু করবার ছিল না তখন তার।

প্রকাশমামা বললে–আমি এখন নবাবগঞ্জ থেকে আসছি। সেখানেও তোকে খুঁজতে গিয়েছিলাম। শেষকালে এলুম কলকাতায়। ভাবলুম এখানে তোকে কোথাও পাবো। তা এখেনেও অনেক জায়গায় খুঁজেছি। শেষে ভাগ্যি ভালো তাই হঠাৎ বউবাজারের সেই পুলিসের বড়বাবুর বাড়িতে গিয়েছিলুম মানদা মাসির খোঁজে। সেখানে তাদের বাড়ির চাকর মহেশের কাছে এই ধর্মশালার খবর পেলুম। তা এখন চল্ আমার সঙ্গে–

–কোথায়?

–ভাগলপুরে। তোর মামার বাড়িতে।

–সেখানে গিয়ে কী হবে? আমার কেউ নেই, আমি কোথাও যাবো না।

প্রকাশমামা বললে–কেউ নাই বা থাকলো, কিন্তু তোর বাবার সম্পত্তি তো আছে। অত লাখ টাকার সম্পত্তি তুই ছেড়ে দিবি! সে-সম্পত্তি তো সবই তোর রে, তুই তো বাবার একমাত্র ছেলে, একমাত্র ওয়ারিশন

–কিন্তু টাকা নিয়ে কী করবো? আমার টাকার দরকার নেই—

কিন্তু সদানন্দ ছাড়তে চাইলেও প্রকাশমামা ছাড়বার লোক নয়। বললে–তুই টাকা না নিলে কে নেবে সে টাকা? এত টাকার সম্পত্তি ছেড়ে দিয়ে তুই ধর্মশালায় বসে বসে ভ্যারেণ্ডা ভাজবি? আর টাকা যদি তুই না নিস তো আর কাউকে দানপত্র করে দে! আমি গরীব লোক, তোর টাকার দরকার না থাকতে পারে, কিন্তু আমার তো টাকার দরকার আছে রে, আমি তো আর তোর মত সন্নিসী হয়ে যাইনি! তোর না হয় মাগ ছেলে কেউ নেই, কিন্তু আমার তো আছে!

এতক্ষণে সদানন্দ বুঝলো কিসের তাগিদে প্রকাশমামা তার খোঁজে সেই ভাগলপুর থেকে বেরিয়ে সারা দেশ ঘুরে কলকাতায় এসেছে। আর কলকাতা কি ছোট জায়গা! কলকাতার মত জায়গায় কি কাউকে খুঁজে বার করা সহজ! যতদিন মা বেঁচে ছিল ততদিন প্রকাশমামার টাকার অভাব হয়নি। দিদির কাছে হাত পেতেছে আর টাকা নিয়ে পকেটে পুরেছে আর রাণাঘাটের বাড়িতে গিয়ে ফুর্তি করেছে। সারা জীবনটাই ফুর্তি করে বেড়িয়েছে প্রকাশমামা। এখন যখন তার জামাইবাবু মারা গেছে এখন এসেছে ভাগ্নের খোঁজে। এখন ভাগ্নের জন্যে দরদ উথলে উঠেছে তার।

সেই জন্যেই তো অনেকদিন ধরে সে ভেবেছিল যে সে তার জীবন কাহিনীটা লিখে যাবে। লিখে যাবে যে, সে পাগল নয়। পাগল তোমরা। যে পৃথিবীতে মানুষ মানুষকে পণ্য হিসেবে ব্যবহার করে, যে-মানুষ কেবল কপিল পায়রাপোড়াদের গলায় দড়ি দিতে সাহায্য করে, যে-মানুষ কেবল কালীগঞ্জের বউদের বঞ্চনা করে নিজের পুঁজিপাটা বাড়ায় সেই মানুষ পাগল না হয়ে পাগল হয় কিনা সদানন্দ!

সদানন্দ বলেছিল–তা হলে চলো—

প্রকাশমামা সেদিন আদর করে সদানন্দকে ভাগলপুরে নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তখন কি প্রকাশমামা জানতো যে তার জামাইবাবুর সমস্ত সম্পত্তি অন্য একজনের ভোগে লাগবে। জানলে বোধ হয় আর ভাগ্নের সন্ধানে আসতো না প্রকাশ রায়।

কিন্তু সে-সব কথা এখন যাক্। সে-সব অনেক পরের কথা। তখন নয়নতারারও অনেক বয়েস হয়েছে। তারও তখন নতুন করে সংসার হয়েছে। সে-সব কথা বলবার সময় পরে অনেক পাবো। এখন আজকের কথা বলি। এই নয়নতারার বিয়ের কথা।

এই নয়নতারার বিয়ের দিনে সে-সব বিপর্যয়ের কথা ভাবতে নেই। সে-সব অকল্যাণের কথা এই শুভদিনে বুঝি ভাবাও অন্যায়। আজ শুধু আনন্দ করো তোমরা সবাই। আজ শাঁখ বাজাও, আজ উলু দাও, আজ বলো–যদিদং হৃদয় তব তদিদং হৃদয় মম, যদিদং হৃদয়ং তব তদিদং হৃদয়ং মম—

আজ কালীকান্ত ভট্টাচার্যের একমাত্র সন্তানের বিয়ে। যে নয়নতারার রূপ দেখে সকলের চোখের পাতা পড়তে চাইতো না, যে-মেয়ের ভবিষ্যতের কথা ভেবে পণ্ডিতমশাই আর তার গৃহিণীর রাত্রে ঘুম ছিল না, সেই নয়নতারারই আজ বিয়ে। সেই বিয়েতে তোমরা আজ এসো, এসে নয়নতারাকে আশীর্বাদ করো। বলো–তুমি জন্ম-জন্ম স্বামী-সোহাগিনী হয়ে শ্বশুর-শাশুড়ীর সেবা করে অক্ষয় পুণ্য অর্জন করো মা। আশীর্বাদ করো–আমার নয়নতারা যেন সুখী হয়, আমার নয়নতারা যেন স্বামী-সোহাগিনী হয়। আশীর্বাদ করো–আমার। নয়নতারা যেন সিঁথির সিঁদুর নিয়ে জন্ম-জন্ম এয়োস্ত্রী হয়ে কাটায়–

তখন বেলা বেড়েছে।

প্রকাশমামা বেয়াই-মশাইকে খুঁজে খুঁজে হয়রান। বললে–কোথায়, বেয়াই মশাই কোথায়?

কালীকান্ত ভট্টাচার্য কদিন থেকেই ব্যতিব্যস্ত। তাঁর বিশ্রাম নেই, তাঁর দুশ্চিন্তারও শেষ নেই। কোন্ দিক দেখবেন ঠিক করতে পারছেন না। প্রকাশমামার কাছে আসতেই প্রকাশমামা একেবারে ঠেস দিয়ে বলে উঠলেন কী বেয়াই মশাই, এখন জামাই পেয়ে যে আমাকে একেবারে চিনতেই পারছে না দেখছি–আমি খেলুম কি খেলুম না, কিছুই দেখছেন না আর–

–না না, সে কী কথা বেয়াই মশাই, আপনিই তো সব! আপনি না থাকলে কি এ বিয়ে হতো?

প্রকাশমামা বললে–তা কেমন জামাই হলো বলুন? পছন্দ হয়েছে তো?

–আপনিই বলুন আপনার বৌমা কেমন হলো?

–আপনিই বেয়াই মশাই কেবল আপনার নিজের মেয়ের গর্বেই গেলেন। কেন, আমাদের ছেলে কি ফ্যাল্‌না?

কালীকান্ত ভট্টাচার্য বললেন–না, তা কেন বলবো। আমার নয়নতারার অনেক পুণ্যফল ছিল তাই অমন স্বামী পেয়েছে। আমাদের কেষ্টনগরের সবাই একেবাক্যে বরের প্রশংসা করে গেছেন।

প্রকাশমামা বললে–তা হলে যাত্রার সময়টা কখন?

কালীকান্ত ভট্টাচার্য বললেন–পুরুতমশাই তো পাঁজি দেখে সময় ধার্য করে দিয়েছেন।

–দেখবেন যেন বেশী দেরি না হয়, ওদিকে আবার রাণাঘাট থেকে ট্রেন বদল করতে হবে। সে ট্রেন মিস্ করলেই মুশকিল–

কালীকান্ত ভট্টাচার্য বললেন–না, সেদিকে কোনও গোলযোগ হবে না। আমি আমার লোক দিয়ে ট্রেন ধরিয়ে দেব

তারপর হঠাৎ যেন কী মনে পড়ে গেল। বললেন–আপনি সিগারেট-টিগারেট ঠিক পাচ্ছেন তো?

–কোথায় আর পাচ্ছি! আপনি জামাই পেয়ে গেছেন, এখন আর আমাকে কে দেখবে, আমি তো এখন পর হয়ে গেছি

কালীকান্ত ভট্টাচার্য মশাই ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠলেন।

–ওরে কে আছিস? ও নিতাই, ও কেষ্টধন, ও বিপিন, কে রে ওদিকে? বেয়াই মশাইকে সিগারেট দেয়নি কেউ? যেদিকে আমি দেখবো না সেই দিকেই গাফিলতি, ওরে কেষ্টধন……… 

বলতে বলতে ভেতর বাড়ির দিকে সিগারেটের সন্ধানে চলে গেলেন।

নিরঞ্জন এতক্ষণ পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। সে এতক্ষণে কাছে এল। বললে–শালাবাবু, এদিকে এক কাণ্ড হয়েছে–

–কাণ্ড? কীসের কী কাণ্ড?

নিরঞ্জন বললে–তেমন কিছু কাণ্ড নয়। ছোটবাবু এয়োদের সব বলে দিয়েছে–

–কী বলে দিয়েছে সদা?

–বলে দিয়েছে যে, পরশু ছোটবাবু কালীগঞ্জের বৌ-এর কাছে গিয়েছিল, সেইজন্যে গায়ে হলুদের সময় বাড়ি ছিল না।

প্রকাশমামা অবাক হয়ে গেল সদার বোকামি দেখে। বললে– সে কি রে? বলে দিয়েছে?

–হ্যাঁ।

–তুই জানলি কী করে?

–আমাকে ওদের নাপিত বিপিন জিজ্ঞেস করছিল। ছোটবাবুকে নাকি বাসরঘরে মেয়েরা জিজ্ঞেস করেছিল– গায়ে-হলুদের সময় তুমি কোথায় গিয়েছিলে? তা ছোটবাবু নাকি বলেছে–কালীগঞ্জের বৌ-এর কাছে। তাই মেয়ে-মহলে কানাঘুষো হয়েছে। তাই বিপিন জানতে চাইছিল আমার কাছে কালীগঞ্জের বউ কে? কালীগঞ্জের বৌ-এর বয়েস কত, এই সব…..

–তা তুই কী বললি?

নিরঞ্জন বললে–আমি আর কী বলবো। আমি শুধু বললুম সে এক বুড়ি থুত্থুড়ি মেয়েমানুষ।

তা জিজ্ঞেস করলে না বর কেন গিয়েছিল সেখানে?

–না, তা জিজ্ঞেস করেনি। আর জিজ্ঞেস করলেও তো আমি কিছু বলতে পারতুম না! আমি বলতুম বর কালীগঞ্জের বৌ-এর কাছে কেন গিয়েছিল তা আমি নাপিত মানুষ কী করে জানবো?

প্রকাশমামা কথাটা শুনে নিশ্চিন্ত হতে পারলো না। নিরঞ্জনকে সেখানে ছেড়ে ভেতর বাড়ির দিকে ছুটলো। ভেতরে তখন অনেক মেয়ে-পুরুষের ভিড়। প্রকাশমামা সেই দিকে যেতেই মেয়েরা মাথার ঘোমটা টেনে দিলে।

কে একজন দৌড়ে এসে প্রকাশমামার দিকে সিগারেট বাড়িয়ে দিলে। বললে–নিন সিগারেট নিন–

সিগারেট নিয়ে প্রকাশমামা বললে–সিগারেট নিচ্ছি, কিন্তু বর কোথায় গো তোমাদের? একবার ডেকে দাও তো আমার কাছে–কী করছে এখন বর?

সঙ্গে সঙ্গে ভিড়ের মধ্যে রাস্তা হয়ে গেল বেয়াই মশাইয়ের জন্যে। বরকর্তা বরের সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। একটু জায়গা ছাড়ো গো, রাস্তা দাও। ও রাঙাদিদি, একটু নড়ে বোস, একটু গতর ওঠাও। বরকর্তা বরের সঙ্গে কথা বলতে এসেছে–

চারিদিকে বাসি লুচি আর তরকারির গন্ধ। ছোট বাড়িতে লোক বেশি হলে যা হয় সেই অবস্থা। শেষকালে বরের ঘরে যেতেই দেখলে সদানন্দ একটা তাকিয়া হেলান দিয়ে গম্ভীর হয়ে বসে আছে। সারারাত ঘুম না হলে যেমন হয় সেই রকম চেহারা। উস্কোখুস্কো চুল। স্রিয়মাণ হয়ে বসে ছিল সে আর সামনে অনেকগুলো মহিলা।

–সদা!

প্রকাশমামার গলা শুনে যেন অকূলে কূল পেলে সদানন্দ। মুখ তুলে চাইলে। বললে–কী?

প্ৰকাশমামা বললে–একবার আমার সঙ্গে এদিকে আয় তো।

সদানন্দ সমস্ত রাত এতটুকুও ঘুমোয়নি। সমস্ত রাতই মেয়েরা বিরক্ত করেছে, কথা বলেছে। গান গাইবার জন্যে পীড়াপীড়ি করেছে। এক-একবার তার মনে হয়েছে এখান থেকে সে অন্য কোথাও চলে যায়। কিন্তু কেমন করে যাবে! এতগুলো অচেনা লোকের মধ্যে কাটিয়ে খুব আড়ষ্ট হয়ে ছিল। এবার প্রকাশমামাকে দেখে যেন একটু সহজ হলো।

প্রকাশমামা আগে আগে চলতে লাগলো। সদানন্দও তার পেছন-পেছন।

প্রকাশমামা চলতে চলতে পেছন না ফিরেই জিজ্ঞেস করলে–রাত্তিরে তোর ঘুম হয়েছিল রে?

সদানন্দ বললে–-না–

–ঘুম হয়নি ভালোই হয়েছে। আমার বিয়ের সময় আমারও বাসর-ঘরে ঘুম হয়নি। ওর জন্যে ভাবিসনি। কেমন বৌ দেখলি? পছন্দ হয়েছে তো?

বাসর-ঘরের মধ্যে একজন কে বলে উঠলো–ও লো, ও লোকটা বরের কে লো?

কনের এক মাসী বললে–ওই তো হলো আসল কর্তাগো, বরকর্তা, বরের মামা। ওই মামাই তো এই বিয়ের সম্বন্ধটা করেছে–

প্রকাশমামা সদানন্দকে নিয়ে তখন বার বাড়ির একটা ঘরের একান্তে এসে দাঁড়ালো। আশে-পাশে কেউ নেই দেখে প্রকাশমামা বললে–আয় বোস, এখানটা একটু নিরিবিলি মতন আছে—

.

কালীগঞ্জের জমিদার হর্ষনাথ চক্রবর্তী প্রায়ই গৃহিণীকে বলতেন–তোমার ভাবনা কী, দুই ছেলে রইলো, তারাই তোমাকে দেখবে–

চক্রবর্তী মশাই-এর একবার শরীর ভেঙে গিয়েছিল। প্রায় যায়-যায় অবস্থা। তখন গৃহিণী বড় মুষড়ে পড়েছিলেন। তখন থেকেই কেমন তিনি বুঝতে পেরেছিলেন জমিদারিই থাক আর টাকাকড়ি থাক মানুষের জীবন এই আছে এই নেই। বুঝতে পেরেছিলেন এই এত শক্ত-সমর্থ মানুষটা এ ক-দিনের অসুখেই যদি এমন কাতর হয়ে পড়েন তা হলে আসল হচ্ছে স্বাস্থ্য, আসল হচ্ছে পরমায়ু। আর সব চেয়ে আসল সত্য হচ্ছে ভগবান। তাই তখন থেকেই চক্রবর্তী-গৃহিণী পূজো-পাঠ নিয়ে মেতে উঠলেন।

অসুখ মানুষের হয় বটে, কিন্তু আবার সেরেও ওঠে একদিন। সেই মানুষ গৃহিণীর কাতরতা দেখে অভয় দিতেন। বলতেন–তোমার ভাবনা কী বৌ, আমি না-ই বা থাকলুম, তোমার দুই ছেলে তো রইল, ওরাই তোমাকে দেখবে–

গৃহিনী বলতেন–ওরা আর কত বড়, ওরা কী-ই বা বোঝে–

চক্রবর্তী মশাই বলতেন–যতদিন ওরা বড় না হয় ততদিন নারায়ণ আছে, আমার নায়েবমশাই আছে–

চক্রবর্তী মশাই নরনারায়ণকে নারায়ণ বলে ডাকতেন।

কিন্তু আশ্চর্য মানুষের জীবন, আর আশ্চর্য মানুষের বিশ্বাস! মানুষের জীবনেরও যেমন স্থিরতা নেই, মানুষের বিশ্বাসেরও তেমনি কি কোনও স্থিরতা থাকতে নেই? সত্যিই কত না বিশ্বাস করতেন তিনি নায়েব মশাইকে! আর নিজের নায়েবকেই যদি বিশ্বাস না করতে পারবো তো কাজকর্মই বা চলবে কেমন করে!

আর নরনারায়ণও ছিলেন তেমনি বিশ্বস্ত নায়েব। হিসেবের একটা পয়সা যেন তার এদিক ওদিক হতে নেই। নিজের ছেলেকেও বোধ হয় অমন করে বিশ্বাস করা যায় না যতখানি বিশ্বাস করা যেত নরনারায়ণ চৌধুরীকে। সেই পনেরো টাকা মাইনের কর্মচারী সেদিন যে শুধু বিশ্বাসী ছিলেন তাই-ই নয়, পিতার মতন ভক্তিশ্রদ্ধাও করতেন চক্রবর্তী মশাইকে।

যখন সেই চক্রবর্তী মশাই একদিন হঠাৎ মারা গেলেন তখন তাঁর গৃহিণীর মাথায় আকাশ থেকে একেবারে বাজ ভেঙে পড়লো। দুইটি মাত্র নাবালক ছেলে তখন তাঁর। কিন্তু তারা জমি-জমার কাজকর্ম কিছুই বোঝে না। ওই নরনারায়ণই তখন একমাত্র ভরসা। ওই নরনারায়ণই তখন গৃহিণীর কাছে এসে সান্ত্বনা দিয়েছিল। বলেছিল–আপনি কাঁদবেন না মা, আমি তো আছি, আপনার ভাবনা কী! আমি আপনার ছেলের মতন

তাই সেদিন রাত্রে যখন সেই নায়েব-মশাইয়ের নাতিই তার কাছে এসে হাজির হলো তখন তার মনে পড়তে লাগলো সেইদিনকার কথাগুলো। সেই কথাগুলো যেন তখনও তাঁর কানে বাজছে–আপনি কাঁদবেন না মা, আমি তো আছি, আপনার ভাবনা কী, আমি আপনার ছেলের মতন–

তা সেদিনকার সেই নারায়ণ এখন নরনারায়ণ হয়ে নবাবগঞ্জের জমিদার হয়েছে। নারায়ণ তখন সকাল বেলা রোজ এসে চক্রবর্তী মশাই-এর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতো। আপত্তি করলে নারায়ণ বলতো–আপনি আমাকে পায়ে হাত দিতে আপত্তি করবেন না, আমার বাবা-মা নেই, আপনারাই আমার বাবা-মা, সব কিছু–

তখন কত বিনয়ী ছিল নারায়ণ। মাঝে মাঝে নানান কাজে বাড়ির মধ্যেও আসতো। এসে বাড়ির ছেলের মত ব্যবহার করতো। চক্রবর্তী মশাই-এর গৃহিণীর কাছে এসে ছেলেমানুষের মত খেতে চাইতো।

বলতো-মা-জননী, কিছু খেতে দিন আমাকে, আমার বড় ক্ষিদে পেয়েছে–

তখন অনেক সময় দিনের পর দিন কালীগঞ্জেই থেকেছে নারায়ণ, জমি-জমা-হিসেব পত্র কিংবা মামলা-মকর্দমার কাজে অনেক সময় আহার-নিদ্রা ত্যাগ করে বুক দিয়ে খেটেছে। কখনও মাইনে বাড়াতে পর্যন্ত বলেনি। চক্রবর্তী মশাই তার মাইনে বাড়ানও নি। তা মাইনের দরকারই বা তার কী ছিল? খাওয়া-দাওয়া-থাকা-শোওয়া থেকে শুরু করে জামা কাপড় সবই তো তিনি দিতেন। পাল-পার্বণে নারায়ণের কাপড়-জামা-গামছা ছিল বাঁধা।

কিন্তু সেই নারায়ণই আবার অন্য রকম হয়ে গেল চক্রবর্তীমশাই-এর মৃত্যুর পর। মাঝে মাঝে মা-জননীর মনে হতো অমন করে নায়েব মশাইকে বিশ্বাস না করলেই ভালো হতো হয়তো। কিন্তু তখন সেই বিপদের দিনে তিনি মেয়েমানুষ হয়ে বিশ্বাস না করেই বা কী করতেন!

একদিন গিয়েছিলেন নবাবগঞ্জে। দেখে অবাক হয়ে গেলেন। এত বড় বাড়ি করেছে নারায়ণ! এত লোকজন! মনিবের বিধবা গৃহিণীকে দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিল নারায়ণ।

বললে–আপনি আবার এলেন কেন মা-জননী?

মা-জননী বললেন–না এসে কী করবো বাবা, কতবার তোমার কাছে লোক পাঠিয়েছি, তুমি একবার দেখাও করলে না। তাই নিজেই এলুম–আমার জমিজমার হিসেব-টিসেবগুলো একবার দেখতুম। আমার কী আছে না-আছে তাও বুঝতে পারছি না। আমার যদি টাকা কড়ি থাকতো ব্যাঙ্কে তাহলে তোমাকে আর এমন করে বিরক্ত করতাম না বাবা-নেহাত বিপাকে পড়ে তোমার কাছে এসেছি–

নারায়ণ বললে–আপনি আজকে যান, আমি আপনাকে যা বোঝাবার একদিন কালীগঞ্জে গিয়ে সব বুঝিয়ে দিয়ে আসবো। আপনাকে আর কষ্ট করে আসতে হবে না–

নায়েবমশাই-এর কথায় বিশ্বাস করে সেদিন চক্রবর্তী গৃহিণী ফিরে চলে গেলেন। কিন্তু নারায়ণ আর এলো না। তাঁর কথা রাখলো না। তার স্বামীর অত বড় সম্পত্তি যে কোথায় কর্পূরের মত উড়ে গেল কেমন করে সব অদৃশ্য হয়ে গেল তা তিনি জানতেও পারলেন না। লোকে বলতে লাগলো–কালীগঞ্জের নায়েব জমিদারকে ঠকিয়ে নবাবগঞ্জে নিজের জমিদারি করেছে।

যারা ভালোমানুষ লোক তারা জিজ্ঞেস করলে কালীগঞ্জের বৌকে নায়েব ঠকালে কী করে? বৌ জানতে পারলে না?

লোকে বললে–আরে, বউ তো ভালো মানুষ, তার ছেলে মেয়ে-জামাই কেউ নেই, কী করে জানতে পারবে?

তা সত্যি কথা। কালীগঞ্জের বউ কি কোর্ট-কাছারি করবে? নায়েবের নামে কাছারিতে নালিশ করবে?

কিন্তু নরনারায়ণ চৌধুরীকে যত খারাপ লোক ভাবা গিয়েছিল তত খারাপ সে নয়। কালীগঞ্জের বউ যখন টাকার তাগাদায় আসতো তখন তাকে নারায়ণ একেবারে খালি হাতে ফিরিয়ে দিত না। কখনও দশ টাকা, কখনও পাঁচ টাকা, আবার কখনও বা পঞ্চাশ টাকাও দিয়েছে। বলেছে–আর তোমার এখানে আসতে হবে না মা জননী, এবার আমি সব টাকাটা নিজে গিয়ে তোমাকে দিয়ে আসবো

কথাটা শুনে কালীগঞ্জের বউ-এর চোখে জল এসে গিয়েছিল।

বলেছিল–তুমি নিজে গিয়ে দিয়ে এলে তো খুবই ভালো হয় বাবা, আমার তাহলে আর এ হেনস্থা হয় না।

নরনারায়ণও ভেবেছিলেন বুড়ি আর কদিনই বা বাঁচবে! এই রকম স্তোক বাক্য দিয়ে দিয়ে যতদিন কাটানো যায়। তারপর একদিন বউ মারা যাবে। তখন আর কেউই তাগাদা করতে আসবে না। তখন একেবারে চিরকালের মত নিশ্চিন্ত।

কিন্তু কালীগঞ্জের বউ-এরও বোধ হয় অক্ষয় পরমায়ু। তারপর সেই নারায়ণের সন্তান হলো। সেই সন্তানের আবার বিয়েও হলো। তারও আবার ছেলে হলো। কিন্তু পাওনা টাকা কালীগঞ্জের বউ পেলে না। তখনও আসতো সেই কালীগঞ্জের বউ। তার আসার খবর পেয়েই নরনারায়ণ চৌধুরী রেগে যেতেন।

বলতেন–আবার এসেছে বুড়ি?

কৈলাস গোমস্তা বলতো–চলে যেতে বলবো?

কর্তাবাবু বলতেন–হ্যাঁ হ্যাঁ চলে যেতে বলো। বলো আমার শরীর খারাপ, এখন দেখা হবে না।

সেই সময়েই একদিন ছোট একটা ছেলে পালকির কাছে এসে দাঁড়িয়ে ছিল। বলেছিল– আমি পালকিতে চড়বো–

কালীগঞ্জের বউ বলেছিল–এ কে গো? কার ছেলে?

দীনু বলেছিল–এই তো কর্তাবাবুর নাতি–

কালীগঞ্জের বউ সদানন্দকে কোলে তুলে নিয়ে আদর করে বলেছিল–তুমি পালকি চড়বে?

সদানন্দ বলেছিল—হ্যাঁ–

সেদিন সদানন্দকে পালকিতে চড়িয়েছিল কালীগঞ্জের বউ। পালকি চড়ে সদানন্দ খুব সুখী। বলেছিল–আমাকে আরো দূরে নিয়ে চলো একেবারে নদীর ঘাটের দিকে।

নদীর ধারে গেলে যদি তোমার দাদু বকে?

সদানন্দ বলেছিল–বকুক গে। আমি দাদুকে ভয় করি না–

সেইদিনই কালীগঞ্জের বউ ছোট ছেলেটার সাহস দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিল। দীনু বলেছিল–খোকাবাবু কাউকে ভয় করে না, খুব দুষ্টু হয়েছে–

সেই-ই প্রথম পরিচয়। তারপর যতবার কালীগঞ্জের বউ নবাবগঞ্জে তাদের বাড়িতে এসেছে, ততবারই পালকি চড়বার বায়না ধরেছে। আর তাকে পালকিতে চড়িয়ে ঘুরিয়ে দিয়েছে কালীগঞ্জের বউ। পালকি চড়বার কেমন একটা নেশা হয়েছিল সদানন্দর। এলেই দৌড়ে যেত সদানন্দ। পালকিটা আসতে দেখলেই সদানন্দ চিনতে পারতো। ডাকত–ও কালীগঞ্জের বউ, কালীগঞ্জের বউ–

কালীগঞ্জের বউ পালকি থেকে নেমেই সদানন্দকে কোলে করতো।

বলতো–আমি যে কালীগঞ্জের বউ তা তোমাকে কে বললে–খোকাবাবু?

সদানন্দ বলতো–তোমার নাম তো কালীগঞ্জের বউ। আমাকে গৌরী পিসি সব বলেছে–তুমি কালীগঞ্জেই তো থাকো–

–তুমি কালীগঞ্জে যাবে? যাবে আমাদের কালীগঞ্জে?

–যাবো। তুমি আমাকে নিয়ে চলো।

–কিন্তু কালীগঞ্জে গেলে তোমার দাদু যে বকবে!

–দাদু বকুক! দাদু খুব দুষ্টু, দাদু তো আমাকে রোজ বকে! তবু আমি ভয় পাই না।

–তোমাকে কেন বকে দাদু?

সদানন্দ বলতো–আমি দুষ্টুমি করি বলে!

–কেন তুমি দুষ্টুমি করো?

সদানন্দ বলতো–বেশ করবো দুষ্টুমি করবো! দাদু তোমাকে টাকা দেয় না কেন?

কালীগঞ্জের বউ অবাক হয়ে যেত সদানন্দর কথা শুনে।

সদানন্দ বলতো–জানো, দাদু কাউকে টাকা দেয় না। দাদুর অনেক টাকা, তবু দাদু টাকা দেয় না কাউকে।

কালীগঞ্জের বউ কেমন অবাক হয়ে যেত বাচ্চা ছেলের মুখের কথা শুনে। বলতো কী করে বুঝলে দাদু আমাকে টাকা দেয় না?

সদানন্দ বলতো–গৌরী পিসী বলেছে–

গৌরী পিসী! কালীগঞ্জের বউ এ বাড়ির মেয়েদের বিশেষ কাউকেই চিনতো না। অন্দর মহলেও কোনও দিন ঢোকবার সুযোগ হয়নি। এ বাড়ির সমস্ত লোকজন বরাবর তাকে দেখলেই যেন কেমন গম্ভীর হয়ে যেত। জিজ্ঞেস করতো–গৌরী পিসী কে?

সদানন্দ বলতো–এ মা, গৌরী পিসীকে তুমি চেনো না? সে তো আমাকে খাইয়ে দেয়! ভাত খাইয়ে দেয়, দুধ খাইয়ে দেয়, মাছ খাইয়ে দেয়। আমি যদি না খাই তাহলে গৌরী পিসী আমাকে ভয় দেখায়–

–কী ভয় দেখায়?

–বলে জুজুবুড়িকে ডেকে ধরিয়ে দেবে।

এত দুঃখের মধ্যেও কালীগঞ্জের বউ-এর মুখে হাসি আসতো ছোট ছেলের মুখে পাকা পাকা কথা শুনে।

কালীগঞ্জের বউ-এর পালকিতে বসে সদানন্দর মুখে যেন কথার খই ফুটতো। অনেক কথা বলে যেত গড়গড় করে। বলতো–জানো, আমি যখন বড় হব তখন তোমাকে টাকা দেব।

–আমাকে তুমি টাকা দেবে?

হ্যাঁ তোমাকে টাকা দেব, মানিক ঘোষকে টাকা দেব, দুলে ষাটকে, কপিল পায়রা পোড়াকে সবাইকে টাকা দেব। তোমাদের জমি আমি খাস করে নেব না। জমি দেব তোমাকে, ধান দেব, গুড় দেব, তোমাকে সব দেব!

আশ্চর্য ছোট বয়েসের মন আর ছোট বয়সের সঙ্কল্প। কালীগঞ্জের বউ-এর মনে হতো ছোট বয়েসে বোধ হয় সবাই এই রকমই থাকে। ছোট বয়েসে সবাই-ই উদার হতে পারে, দাতা হতে পারে। তারপর বয়েস বাড়বার সঙ্গে সঙ্গেই বুঝি যত গোল বাধে আর যত স্বার্থচিন্তা আর জটিলতা এসে হাজির হয়। ছোট বয়েসে কালীগঞ্জের বউও তো সকলকে বিশ্বাস করতো। শুধু ছোট বয়েসে কেন, অনেক বেশি বয়েস পর্যন্ত যে-যা চেয়েছে সবাইকে সব কিছু দিয়েছে কালীগঞ্জের বউ। সকলকেই বিশ্বাস করেছে। নইলে এই নায়েব মশাই ই কি এমন করে তার সর্বস্ব কেড়ে নিতে পারতো! দশটা আমবাগান তিনটে বড় বড় বিল, আর জমি যে কত বিঘে তার কোনও হিসেবই রাখবার দরকার হতো না। আর তার হিসেব যে কোনও দিন রাখতে হবে তাও কখনও কালীগঞ্জের বউ স্বপ্নেও ভাবেনি। নায়েব মশাই ই সব দেখতো আর নায়ের মশাই-ই সব আদায় করতে। খাজনা যেমন আদায় করতো তেমনি খাজনা দিতও সরকারী কাছারিতে। জমিতে কত ধান হচ্ছে আর কত পাট, কত ছোলা, কত সরষে তার হিসেব নেবার দরকারও কখনও হয়নি কালীগঞ্জের বউয়ের।

কিন্তু শেষকালের দিকে কালীগঞ্জের বউ-এর শরীর একেবারে ভেঙে পড়েছিল। তবু সেই ভাঙা শরীর নিয়ে নবাবগঞ্জে আসতো!

একবার বড় রাগ হয়ে গিয়েছিল কালীগঞ্জের বউ-এর। আর থাকতে পারে নি। বলে ফেলেছিল–তবে কি আমার টাকাটা তুমি ঠকিয়েই নিলে নায়েব মশাই? এই-ই ছিল তোমার মতলব? তাহলে আগে বললে না কেন?

নরনারায়ণ চৌধুরী বললেন–কেন, আগে বললে–কী করতে?

–আগে বললে–এই হয়রানিটা আর হতো না আমার। এই পনেরো-কুড়ি বছর ধরে আমায় ঘোরাচ্ছো, ভাবছো মাথার ওপর ভগবান নেই?

নরনারায়ণ তখন শয্যাশায়ী হয়ে থাকেন সব সময়ে। কথাটা শুনে তার ভালো লাগলো না।

বললেন–কেন, ভগবান থাকলে আমার কী করতো?

কালীগঞ্জের বউ বললে–ভগবান তুমি মানো আর না মানো, আমি মানি। আমি সেই ভগবানের নাম করে বলে যাচ্ছি বামুনের মেয়েকে তুমি ঠকিয়েছ, এতে তোমার ভালো হবে না নারাণ, তোমার সর্বনাশ হবে–

–তার মানে?

–তার মানে তুমি আমার যেমন সর্বনাশ করেছ তেমনি তোমারও সর্বনাশ হবে।

নরনারায়ণ চৌধুরীর চোখ দুটো রাঙা হয়ে উঠলো। বললেন–তুমি আমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাও, বেরিয়ে যাও বলছি–

তারপর ডাকতে লাগলেন–দীনু, ও দীনু–

কালীগঞ্জের বউ বসে ছিল। এবার উঠে দাঁড়ালো। বললে–দীনুকে ডাকছো কেন? আমাকে সে গলা ধাক্কা দিয়ে তাড়াবে বলে?

কী জন্যে ডাকছি তা দীনু এলেই দেখতে পাবে, আমাকে আর মুখে বলতে হবে না। ও দীনু দীনু–ও দীনু–

কালীগঞ্জের বউ বললে–তার আর দরকার হবে না। আমার দশ হাজার টাকার জন্যে তোমাকে আর মহাপাতক হতে হবে না। তার আগেই আমি চলে যাচ্ছি। কিন্তু…..

বলতে বলতে যেন একটু দম নিয়ে নিলে কালীগঞ্জের বউ। বললে–কিন্তু আমি যদি বামুনের বংশে জন্মে থাকি, আর আমি যদি এক বাপের মেয়ে হই তো আমি এই তোমাকে শাপ দিয়ে গেলুম যে তুমি নির্বংশ হবে নারাণ, তুমি নির্বংশ হবে। তুমি যাদের জন্যে টাকা জমিয়ে রাখছো এ কারো ভোগে লাগবে না, কারো ভোগে লাগবে না–

বলে কালীগঞ্জের বউ এক নিমেষে ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল কিন্তু ঠিক সেই সময় দীনুর সঙ্গে সদানন্দ এসে ঢুকলো।

–কালীগঞ্জের বউ, ও কালীগঞ্জের বউ!

কর্তাবাবু দীনুকে দেখে ধমকে উঠলেন–এই দীনু, আমি তোকে ডাকলাম তা তুই আবার খোকাকে সঙ্গে করে নিয়ে এলি কেন এখেনে?

সদানন্দ বললে–বেশ করেছে আমাকে নিয়ে এসেছে, তুমি বলবার কে? আমি কালীগঞ্জের বউকে দেখতে এসেছি–

তারপর কালীগঞ্জের বউ-এর দিকে চেয়ে বললে–আমাকে পালকি চড়াবে না কালীগঞ্জের বউ? পালকি চড়াবে না আমাকে?

কালীগঞ্জের বউ সদানন্দকে দেখে একটু থমকে দাঁড়ালো। কিন্তু তারপরই আবার যেমন সিঁড়ি দিয়ে নামতে যাচ্ছিল তেমনি সোজা সিঁড়ি দিয়ে নিচেয় নেমে গেল। সদানন্দও তার পেছন-পেছন ডাকতে ডাকতে চলতে লাগলো–ও কালীগঞ্জের বউ……

নরনারায়ণ চৌধুরী রেগে উঠলেন–হাঁ করে দাঁড়িয়ে কী দেখছিস দীনু? খোকাকে ধর, খোকা যে চলে গেল রে, খোকা যে চলে গেল কালীগঞ্জের বউ-এর সঙ্গে, ধর ওকে– হাঁ করে দাঁড়িয়ে দেখছিস কী? ওকে ধরে আন–কিন্তু ততক্ষণে কালীগঞ্জের বউ বারবাড়ির উঠোনে গিয়ে তার পালকিতে উঠে পড়েছিল। চারজন বেহারা পালকিটা কাঁধে তুলতে যাচ্ছে।

এমন সময় সদানন্দও পেছনে গিয়ে ডাকলো–আমাকে আজ পালকি চড়ালে না কালীগঞ্জের বউ?

বেহারা চারজন পালকিটা তুলতে গিয়ে একটু বুঝি থেমে গিয়েছিল। কিন্তু ভেতর থেকে কালীগঞ্জের বউ ধমক দিয়ে উঠলো–কইরে দুলাল, পালকি তোল–

–আজ্ঞে মা ঠাকরুণ, খোকাবাবু যে পালকিতে উঠতে চাইছে।

কালীগঞ্জের বউ ধমকে উঠলো–যে সে পালকিতে উঠতে চাইলেই অমনি ওঠাবি তোরা? না, ওঠাতে হবে না–আমি যা বলছি তাই কর–

দুলালরা আর দেরি করলে না। পালকি কাঁধে তুলে নিয়ে চলতে আরম্ভ করলে।

সদানন্দ কাঁদতে কাঁদতে পেছনে-পেছনে ছুটতে লাগলো–ও কালীগঞ্জের বউ, কালীগঞ্জের বউ–

ছুটতে ছুটতে বোধ হয় সদানন্দ পালকির সঙ্গে বার বাড়ির উঠোন পেরিয়ে বাইরে চলে যাচ্ছিল। চৌধুরী মশাই চণ্ডীমণ্ডপে বসে ব্যাপারটা দেখতে পেয়েছেন। চিৎকার করে বলে উঠলেন–ওরে, খোকা যে বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছে, কেউ ধর ওকে, ওরে কে আছিস, দীনু

গৌরী ভেতর বাড়ি থেকে দৌড়ে এল–ও খোকা, খোকা, কোথায় যাচ্ছো?

ওদিকে যেতে নেই, আমি তোমাকে পালকি চড়াবো, তুমি এসো আমার কাছে–

বলে খপ করে সদানন্দকে ধরে ফেলেছে। সদানন্দও কেঁদে উঠেছে–কালীগঞ্জের বউ চলে গেল, আমাকে পালকি চড়ালে না–

গৌরীর কোলে উঠেও সে কাঁদতে লাগলো। আর ততক্ষণে দীনুও কর্তাবাবুর ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বার বাড়ির উঠোনে এসে হাজির হয়েছে।

চৌধুরী মশাই চণ্ডীমণ্ডপ থেকে দীনুকে দেখে বলে উঠলেন–কোথায় থাকিস রে তুই দীনু, আর একটু হলেই খোকা এখখুনি রাস্তায় বেরিয়ে যাচ্ছিল—

কিন্তু তাঁর কথা শেষ হবার আগেই কৈলাস গোমস্তা চণ্ডীমণ্ডপে এল দৌড়তে দৌড়তে। বললে–ছোটবাবু, কর্তাবাবু কেমন করছেন, আপনি একবার আসুন–

–বাবা? বাবার কী হয়েছে?

কৈলাস গোমস্তা তখনও হাঁপাচ্ছিল। বললে–এই কালীগঞ্জের বউ-এর সঙ্গে রাগারাগি করে কথা বলতে গিয়েই কর্তাবাবু কেমন হাঁপিয়ে উঠেছেন, আমার সুবিধে মনে হচ্ছে না—

চৌধুরী মশাই আর দাঁড়ালেন না। সোজা ভেতর বাড়িতে ঢুকে একেবারে কর্তাবাবুর ঘরে চলে গেলেন। দেখলেন কর্তাবাবু চিৎপাত হয়ে শুয়ে আছেন, চোখ দুটো বোঁজা। বুকটা জোরে জোরে উঁচু-নিচু হচ্ছে। যেন নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে তাঁর। কৈলাস গোমস্তাও পাশে এসে দাঁড়ালো। দীনু এল। গৌরী পিসি এল। বাড়িময় খবর রটে গেল কর্তাবাবুর অসুখ হয়েছে।

তারপর রাণাঘাট থেকে ডাক্তার এল, কবিরাজ মশাই এল। ওষুধের বন্যা বয়ে গেল। ডাক্তার কবিরাজ দুজনেই বলে গেল একেবারে পরিপূর্ণ বিশ্রাম নিতে হবে।

তারপর থেকে নিয়ম হলো কালীগঞ্জের বউ যদি এর পর আসে তো আর তাকে কর্তাবাবুর কাছে যেতে দেওয়া হবে না। কালীগঞ্জের বউ-এর জন্যেই এই বিপর্যয় ঘটলো।

কিন্তু সেই থেকেই সদানন্দের কৌতূহল হলো–ওই কালীগঞ্জের বউ কেন দাদুর কাছে আসে? কীসের টাকা চায়? কার টাকা? দাদু কালীগঞ্জের বউকে টাকা দেয়ই না বা কেন?

এমন প্রশ্নের কেউই ঠিকমত জবাব দিত না।

দীনু বলতো–কালীগঞ্জের বউ খুব দুষ্টু-

সদানন্দ জিজ্ঞেস করতো–কেন, কেন দুষ্টুমি করে কালীগঞ্জের বউ?

দীনু বলতো–যারা দুষ্টু লোক তারা তো কেবল দুষ্টুমিই করে, আর তো কিছু করে না।

–কিন্তু দাদু তার টাকা দেয় না কেন? টাকা না পেলে কালীগঞ্জের বউ চাল কিনবে কী করে? কাপড় কিনবে কী করে?

যত দিন যেতে লাগলো এই সব প্রশ্নই তার মাথায় ঢুকতে লাগলো। তারপর বয়েস হবার সঙ্গে সঙ্গে অনেক কিছুই সে জানতে পারলো। জানতে পারলো দাদু শুধু কালীগঞ্জের বউকেই ঠকায় নি, কপিল পায়রাপোড়াকেও ঠকিয়েছে, মানিক ঘোষকেও ঠকিয়েছে, ফটিক প্রামাণিককেও ঠকিয়েছে। জানতে পারলো রাণাঘাটের সদরে তাদের উকিল-বাড়ি আছে, সেখানে তাদের উকিলটা কেবল মামলা করে। মামলা করে করে নবাবগঞ্জের লোকদের জমি-জমা নিলেমে ডেকে নেয়, বাকি খাজনার দায়ে প্রজাদের জমি খাস করে নেয়। বংশী ঢালীকে দিয়ে লাঠিবাজি করায়। তারপর চণ্ডীমণ্ডপের পাশের ঘরে অনেককে তালাচাবি বন্ধ করে উপোস করিয়ে মারে। সে-সব কেউ টের পায় না। সদানন্দ অনেক দিন সেই দিকে যেতে চেয়েছে। কিন্তু জায়গাটা ঝোপ-ঝাড়-ঘেরা বলে সন্ধ্যেবেলা যেতে ভয় করতো তার খুব। আর যখন বংশী ঢালীকে ওদিক থেকে আসতে দেখতো তখন সদানন্দরও যেন কেমন গা ছমছম করে উঠতো।

সে বংশী ঢালীকে জিজ্ঞেস করতো–হ্যাঁ গো বংশী, এ-ঘরে থাকতে তোমার ভয় করে না?

বংশী ঢালী হাসতো সনানন্দর কথা শুনে।

বলতো–ভয় করবে কেন খোকাবাবু, ওখানে তো আমি রাত্তিরে ঘুমোই–ওই তো আমার ঘর–।

সদানন্দ আবদার ধরতো–আমি তোমার ঘরে যাবো বংশী–

–আমার ঘরে কী করতে যাবে? আমি গরীব লোক, আমার ঘরে থাকতে তোমার কষ্ট হবে–

বলে ও প্রসঙ্গ এড়িয়ে যেত। তারপর বলতো—চলো খোকাবাবু, তোমাকে আমি মাছ ধরা দেখতে নিয়ে যাই

বলে বিলের ধারে খ্যাপ্‌লা জাল দিয়ে মাছ ধরা দেখাতে নিয়ে যেত।

এতদিন পরে কালীগঞ্জের বউ-এর সঙ্গে সদানন্দর সেই সব কথা বলতে বলতেই অনেক রাত হয়ে গেল। কালীগঞ্জের বউ নিজের হাতে রান্না করে খাইয়ে দিলে সদানন্দকে। বললে–এবার বাবা তুমি নবাবগঞ্জে ফিরে যাও–তোমার দাদু এতক্ষণে তোমাকে খোঁজাখুঁজি শুরু করে দিয়েছে–

–না, আমি আর যাবো না।

কালীগঞ্জের বউ বললে–কিন্তু তুমি যদি না যাও বাবা তো শেষকালে আমার নামেই দোষ পড়বে। সবাই বলবে আমিই তোমাকে আটকে রেখেছি–আর তা ছাড়া কাল তোমার বিয়ে। সকাল-বেলাই গায়ে-হলুদ হবে, তোমার শ্বশুরবাড়ি থেকে অধিবাসের তত্ত্ব আসবে–

সদানন্দ বলল–সে আসুক, কিছুতেই যাবো না, আমি এখানেই শুয়ে রইলুম।

বলে কালীগঞ্জের বউ-এর বিছানাতেই গা এলিয়ে দিলে। একগুঁয়ে পাগল ছেলেকে নিয়ে মহা মুশকিলে পড়লো কালীগঞ্জের বউ। দুলালকে ডেকে তোশক বালিশ পেড়ে আবার তার জন্যে নতুন করে বিছানা করে দিতে হলো।

সে রাতটা একরকম করে কাটলো। কালীগঞ্জের বউ ভাবলে ভোরবেলাই না-হয় দুলালকে দিয়ে নবাবগঞ্জে খবর পাঠিয়ে দেবে যে খোকা এখানে এই কালীগঞ্জে এসে উঠেছে।

দুলালও সেই রকম তৈরি হয়ে ছিল।

কিন্তু সকাল বেলা থেকেই দুলালের নানা কাজ থাকে। সে কাজের মানুষ। ভোররাত্রে উঠে তাকে গরুকে শানি দিতে হয়। তারপর তিন ক্রোশ পথ হেঁটে গিয়ে বাঁশের ক’টা খুঁটি তৈরি করে আনবার কথা ছিল। তখন রাত অনেক। দুলাল ভেবেছিল সকাল হবার আগেই বাঁশ কেটে আবার ফিরে আসতে পারবে। কিন্তু বাঁশঝাড়ের মালিক বাড়ি ছিল না। তিনিও বুঝি কোন জরুরী কাজে রাত থাকতে বেরিয়ে গিয়েছেন। তাঁর জন্যে বসে বসে যখন শেষ পর্যন্ত মালিক এল তখন রোদ উঠে গেছে।

সেই বাঁশ বাছাই করে কেটে যখন দুলাল আবার বাড়িতে ফিরে এল তখন দেখলে বাড়িতে হইচই পড়ে গেছে।

দুলালকে দেখেই গিন্নীমা বলে উঠলো–হ্যাঁ রে দুলাল, তোকে আমি পইপই করে বলেছিলুম নবাবগঞ্জে গিয়ে নায়েব বাড়িতে খবরটা দিয়ে আসবি যে খোকাবাবু এখানে এসেছে। আর তুই কিনা বাঁশ আনতে গিয়েছিলি? আজই তোর বাঁশ আনবার জন্যে এত জরুরী দরকার পড়ে গেল? এখন আমি লোককে কী বলে কৈফিয়ত দেব? নবাবগঞ্জ থেকে যে লোক এসে হাজির হয়েছে সে আমাকেই দুষছে….

সত্যিই, দুলাল দেখলে এক ভদ্রলোক বসে আছে বাড়ির উঠোনে একটা চৌকিতে–

কালীগঞ্জের বউ বললে–এই দেখ বাবা, এই দুলালকে আমি ভোরবেলা নবাবগঞ্জে গিয়ে কর্তাবাবুকে খবর দিতে বলেছিলুম যে খোকাবাবু এখানে আছে তা আমার তো ওই এক দুলাল ভরসা, আর তো কোনও লোক নেই যে তাকে পাঠাবো–

ততক্ষণ সদানন্দ উঠে এসে দাঁড়ালো।

প্রকাশমামা রেগে আগুন।

–কী রে, তুই এখেনে এসে লুকিয়ে আছিস! আজ তোর বিয়ে! অধিবাস নিয়ে কেষ্টনগর থেকে লোক এসে হাজির হয়েছে, গায়ে-হলুদের সব রেডি আর তুই কিনা এই রকম পাগলামি করছিস! চল-চল –আর কথা বলবার সময় নেই আমার। চুড়ান্ত বেইজ্জতি হয়ে গেছে। কুটুমবাড়ির লোক সেখানে গিয়ে কী বলবে বল্ দিকিন, তারা কী ভাববে?

সদানন্দ বললে–ভাবুক গে, আমার কী? আমি যাব না, আমি এখানে থাকবো–

প্রকাশমামা বললে–ইয়ারকি করার আর জায়গা পাসনি–

বলে সদানন্দর হাত ধরে টান দিলে একটা। টেনে বাইরের রাস্তার দিকে নিয়ে যাবার চেষ্টা করতে লাগলো।

সদানন্দ হাত ছাড়িয়ে নিলে। বললে–তুমি কি আমাকে ছেলেমানুষ পেয়েছ প্রকাশমামা? অমি যাবো না তোমার সঙ্গে কী করবে তুমি?

কালীগঞ্জের বউ বললে–আমি কাল থেকে ওই কথা ওকে বোঝাচ্ছি বাবা যে বিয়ের ব্যাপারে এমন করতে নেই। এখন সব যোগাড় যন্তর হয়ে গেছে। এখন লোক-হাসাহাসির ব্যাপার করা উচিত নয়। তা….

প্রকাশমামা ধমক দিয়ে উঠলো। বললে–তুমি থামো, আমি তোমার সব মতলব ফাঁস করে দেব, দাঁড়াও, আগে বিয়েটা হয়ে যাক্, তখন যা করতে হয় আমি করবো–সে আমার মনেই আছে–

কালীগঞ্জের বউ বললে–তা আমি কী করলুম বাবা? আমার কী দোষ হলো?

–বলছি তুমি থামো, তবু আবার কথা বলছো? ভেবেছিলে আমার ভাগ্নেকে নিজের বাড়িতে ফুসলে এনে বিয়েটা ভেঙে দেবে? এত শয়তানি বুদ্ধি তোমার?

সদানন্দ কথার মাঝখানে বাধা দিয়ে বলে উঠলো-খবরদার বলছি প্রকাশমামা, কালীগঞ্জের বউকে তুমি অমন করে যা-তা বলতে পারবে না। তা হলে কিন্তু আমিও সব ফাঁস করে দেব।

প্রকাশমামা বললে–তার মানে?

–তার মানে তুমি জানো না? তুমি জানো না এই কালীগঞ্জের বউ-এর কত সম্পত্তি দাদু গ্রাস করেছে? জানো, এই কালীগঞ্জের বউ এককালে কত সম্পত্তির মালিক ছিল? কে তার সম্পত্তি ঠকিয়ে নিয়েছে, কে-তাকে পথের ভিখিরি করেছে, আমি সে-সব কথা জানি না বলতে চাও?

প্রকাশমামা কথাগুলো শুনে প্রথমে একটু হকচকিয়ে গেল। তারপর একটু দম নিয়ে বললে–এই সব কথা তোকে বুড়ি বলেছে বুঝি? এই সব ফুসমন্তর বুঝি ঢুকিয়ে দিয়েছে তোর মাথায়?

–আমাকে ফুসমন্তর দিতে হবে না প্রকাশমামা। বোঝবার মত যথেষ্ট বয়েসও হয়েছে আমার। বরং তুমি একটু বোঝ। যার পয়সায় তুমি এতদিন বাবুয়ানি করছে, জেনো সেটা তোমার ভগ্নিপতির পয়সা নয়, সে-সব এই কালীগঞ্জের বউ-এর–

প্রকাশমামা বললে–দ্যাখ, এসব কথার জবাব দেবার সময় নেই এখন, ওদিকে কুটুমবাড়ির লোক বসে আছে, তারপরে বিকেল বেলার ট্রেন ধরে আবার কেষ্টনগরে বিয়ে করতে যেতে হবে। পরে আমরা তোর এসব কথার জবাব দেব–

সদানন্দ বললে–না, জবাব দিলে এখনি জবাব দিতে হবে। আগে এর জবাব চাই তবে আমি তোমার সঙ্গে যাবো–

–তা কীসের জবাব চাস্ তুই বল? কবেকার পুরোনো কাসুন্দি ঘাঁটবার এই কি সময়? এ সব কাসুন্দি তো পরে ঘাঁটলেও চলতো।

–না চলতো না। আগে আমি এর জবাব চাই। আগে তুমি বলো, আগে তুমি কথা দাও, দাদু এই কালীগঞ্জের বউ-এর পাওনা দশ হাজার টাকা মিটিয়ে দেবে?

–দশ হাজার টাকা?

–হ্যাঁ, দাদু পনেরো বছর আগে কথা দিয়েছিল দশ হাজার টাকা দিয়ে সাহায্য করবে এই কালীগঞ্জের বউকে। এখনও কেবল ঘোরাচ্ছে। এখন দাদু এই কালীগঞ্জের বউ-এর সঙ্গে একবার দেখাও করে না। আগে তুমি কথা দাও সেই টাকা মিটিয়ে দেবে?

প্রকাশমামা বললে–তোর দাদু টাকা মেটাবে কি না তার কথা আমি দেব কি করে? আমি নিজে কি টাকা নিয়েছি যে কথা দেব?

সদানন্দ বললে–তা হলে আমিও বিয়ে করতে যাবো না–

প্রকাশমামা বললে–ঠিক আছে, তা হলে তুই বাড়ি চল, বাড়ি গিয়ে তোর দাদুকে সব বল্ গিয়ে। দাদু যদি তখন টাকা দিতে রাজী না হয় তখন না-হয় বিয়ে করতে যাস্ নি। আমাকে বাপু তুই এই দায় থেকে বাঁচা–

কালীগঞ্জের বউ এতক্ষণে কথা বললে। সদানন্দর দিকে চেয়ে বললে–সেই ভালো কথা বাবা। তোমার মামা তো ঠিক কথাই বলেছে। আর আমার টাকা? আমার তিন কাল গিয়ে এক কালে ঠেকেছে, এখন আমার টাকা দিলেও যা, না-দিলেও তাই। ও টাকার পিত্যেশ আর আমি করি না। কিন্তু তুমি বাবা আর দেরি করো না, যাও, তোমার গায়ে-হলুদের দেরি হয়ে যাবে–

সদানন্দ এতক্ষণে রাজী হলো। বললে—চলো—

তারপরে কালীগঞ্জের বউ-এর পায়ের কাছে মাথা নিচু করে প্রণাম করে বললে–তোমার টাকা আমি নিজের হাতে দিয়ে যাবো কালীগঞ্জের বউ, তুমি কিছু ভেবো না। টাকা না দিলে আমি বিয়ে করতেই যাবো না–

মনে আছে সদানন্দর মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করতে গিয়ে কালীগঞ্জের বউ-এর দু’চোখ জলে ভরে উঠেছিল। সদানন্দর চোখের সামনেই আঁচল দিয়ে চোখ-মুখ ঢেকে ফেলেছিল।

.

কেষ্টনগরে বিয়েবাড়ির একান্তে একটা ঘরের ভেতরে প্রকাশমামা সেই কথাটাই জিজ্ঞেস করলে। বললে–কীরে, তুই কালীগঞ্জের বউয়ের ব্যাপারটা বাসরঘরে সকলকে বলে দিস নি তো? নিরঞ্জন বলছিল–

সদানন্দ গম্ভীর মুখে বললে–না, বলি নি।

প্রকাশমামা সাবধান করে দিলে। বললে–না, বলিস, নি।

সদানন্দ বললে–কিন্তু কালীগঞ্জের বউ-এর সেই দশ হাজার টাকা? সেটা কিন্তু এখনও দাদু দিলে না, তুমি কথা দিয়েছিলে কিন্তু–

প্রকাশমামা বললে–তুই মিছিমিছি ও-সব নিয়ে ভাবছিস কেন? তোর দাদুর কাছে দশ হাজার তো হাতের ময়লা রে, দেবে যখন কথা দিয়েছে তখন নিশ্চয়ই দেবে। দশ হাজার টাকা মেরে দিয়ে কি তোর দাদু বড়লোক হবে? নিশ্চয়ই দেবে, আমি তো সাক্ষী আছি–

সদানন্দ বললে–কিন্তু কালীগঞ্জের বউ-এর টাকা যদি দাদু না দেয়, তখন কিন্তু সর্বনাশ হবে, এই আমি বলে রাখছি–

ওদিক থেকে কন্যাকর্তার গলা শোনা গেল–কই, বেয়াই মশাই কোথায়? সিগারেট পেয়েছেন তো?

বলতে বলতে কালীকান্ত ভট্টাচার্য এসে পড়লেন। বললেন–এই যে, এখানে বাবাজীবনও আছে দেখছি। তা সিগারেট-টিগারেট সব পাচ্ছেন তো বেয়াই মশাই?

প্রকাশমামার মুখে তখন সিগারেট জ্বলছিল। সুতরাং উত্তর আর তাকে দিতে হলো না। শুধু বললে–এবার যাত্রার বন্দোবস্ত করুন বেয়াই মশাই, আমি বর-কনেকে একবার নবাবগঞ্জে পৌঁছিয়ে দিতে পারলেই আমার ছুটি। তারপর আপনার ভাগ্য আর আপনার মেয়ের হাতযশ–

তা প্রকাশমামা করিতকর্মা লোকই বটে। করিতকর্মা লোক না হলে কি এ বিয়ে হত নাকি? বিয়ে তো প্রায় আটকেই গিয়েছিল কাল সকালবেলা। বাড়িময় সোরগোল উঠেছিল। নবাবগঞ্জে কথাটা প্রায় ছড়িয়েই গিয়েছিল। সবাই-ই জানতে পেরেছিল যে চৌধুরী মশাই এর ছেলে পালিয়ে গিয়েছে। তাকে আর কেউ খুঁজে পাচ্ছে না। একে গ্রাম-দেশ তার ওপর ছোট গ্রাম নবাবগঞ্জ। কার বাড়িতে জামাই এসেছে, কার বাড়ির মেয়ে কার সঙ্গে ফষ্টিনষ্টি করেছে, তা আর কারো জানতে বাকি থাকে! তা ছাড়া নেমন্তন্ন হয়েছে মোটামুটি সব বাড়িতেই। তারা কদিন ধরেই খাবে। শুধু খাবে না, একেবারে গণ্ডেপিণ্ডে খাবে। তার ওপর ছাঁদা বেঁধে নিয়ে যাবে। ক’দিন আগে থেকেই তারা বাড়িতে কম খেয়ে খেয়ে চালাচ্ছে, যাতে খাবার জন্যে পেটে কিছু জায়গা খালি থাকে। কিন্তু সদানন্দর পালিয়ে যাবার খবর পাওয়ার পর তাদের সব উৎসাহে যেন ভাঁটা পড়লো। তাহলে? তাহলে খাওয়াটা কি মাটি হলো?

বারোয়ারিতলায় নিতাই হালদারের দোকানের মাচার ওপর রীতিমত সভা বসলো।

পরমেশ মৌলিক তখন সবে খবরটা নিয়ে এসেছে। খবরটা শুনে সকলের মুখই ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। বললে–তাহলে খুড়ো মশাই, আজকে কি খাওয়া হবে না?

পরমেশ মৌলিক বললে–কী জানি হে কপালে কী আছে! মাছ-দই-মিষ্টি সব কিছুর বন্দোবস্ত হয়ে গেছে।

–কী কী কী মিষ্টি হয়েছিল? শুনলুম নাকি কেষ্টনগর থেকে সরভাজার অর্ডার দেওয়া হয়েছিল?

শুধু সরভাজা নয়। কদিন থেকেই খাওয়ার আইটেমগুলো নিয়ে আলোচনা করে করে সকলের সব মুখস্ত হয়ে গিয়েছিল। মাছ, মাংস, মাছের মুড়িঘণ্ট, ধোকার ডালনা, বেগুন ভাজা, নিরামিষ আর আমিষ দু’রকম চপ, দই, রসগোল্লা, পানতুয়া আরো অনেক কিছু।

এমন সময়ে দেখা গেল হন্তদন্ত হয়ে শালাবাবু আসছে। সবাই হাঁ করে চেয়ে রইল সেদিকে। কাছাকাছি আসতেই সবাই এগিয়ে গেল।

–শালাবাবু কী খবর? পেলেন সদাকে?

শালাবাবুর মুখটা গম্ভীর। বললে–না হে, পেলুম না, দেখি একবার কালীগঞ্জের দিকে গিয়ে–

কালীগঞ্জে? কালীগঞ্জে সদা কী করতে যাবে?

শালাবাবু বললে–রাণাঘাট-ফানাঘাট, রেলবাজার, নবাবপুর, সব তো দেখে এলুম, এবার কালীগঞ্জের দিকটাই বা বাকি থাকে কেন?

বলে আর দাঁড়াল না। হন্ হন্ করে সামনের দিকে চলতে লাগলো।

কেদারের হঠাৎ কথাটা মনে পড়ে গেল। এতক্ষণ খেয়াল ছিল না। আসল কথাটা জিজ্ঞেস করতে ভুল হয়ে গেল। বললে–ওই যাঃ, আসল কথাটাই তো জিজ্ঞেস করতে ভুল হয়ে গেল–

নিতাই জিজ্ঞেস করলে–কী কথা?

–খাওয়ার কথা?

বলে দৌড়তে লাগলো। শালাবাবু তখন অনেক দূর চলে গেছে। কেদার দৌড়তে দৌড়তে গিয়ে ডাকলে–ও শালাবাবু, শালাবাবু–

শালাবাবু পেছন ফিরে তাকালো। ভাবলে হয়ত সদাকে পাওয়া গেছে, সদার সন্ধান দিতে আসছে কেদার। বললে–কী রে, সদাকে পেইছিস?

কেদার কাছে গিয়ে হাঁপাচ্ছিল। হঠাৎ কথা বেরোল না মুখ দিয়ে। তারপর বললে– না, সদার কথা নয়, নেমন্তন্নর কথা বলছি। আমাদের নেমন্তন্নটার তাহলে কী হবে? সেটাও মারা যাবে নাকি?

কেদারের কথা শুনে শালাবাবুর পিত্তি জ্বলে গেল। বললে–দূর হ, ভোর রাত থেকে সদাকে খুঁজে খুঁজে আমার পায়ের রং-খিল গেল আর উনি এসেছেন নেমন্তন্নর খবর নিতে–দূর হ, দূর হ–

বলে রাগে গর গর করতে করতে শালাবাবু আরো জোর পায়ে এগোতে লাগলো। সভার সবাই খুব ম্রিয়মান হয়ে গেল কথা শুনে। বরকে না পাওয়া যাক, কিন্তু খাওয়াটা বন্ধ হবার কথা ভেবে সবাই যেন কেমন নিঝুম হয়ে গেল। এ ক’দিন অনেক ছিলিম তামা পুড়েছে, অনেক সময় তর্কাতর্কি করেছে। রেলবাজারের গৌরের দোকানের রসগোল্লা ভালো না রাণাঘাটের হরিহরের দোকানের রসগোল্লা ভালো তাই নিয়ে তর্ক করে কতদিন দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়েছে, কতদিন সেই তর্ক করতে করতে শেষকালে সেটা মারামারিতে পরিণত হয়েছে, তবু তর্কের মীমাংসা হয় নি। সকলেই ওই বিয়ের তারিখটার দিকে চোখ রেখে এতদিন জীবন-যাপন করে এসেছে, হঠাৎ সেই পরম লক্ষ্য ভ্রষ্ট হওয়াতে সবাই বিমর্য হয়ে রইল।

কিন্তু বিকেল পড়বার আগেই সবাই আবার চাঙ্গা হয়ে উঠলো। কেদারই খবর পেয়েছিল প্রথমে। সে দৌড়তে দৌড়তে এসে খবর দিলে গোপাল ষাটকে। গোপাল ষাট তখন গোয়াল ঘরে গরুকে জানা দিচ্ছে। কেদারের গলা শুনেই চেঁচিয়ে উঠলো–কী রে, কী খবর রে?

কেদার রাস্তা থেকেই চেঁচিয়ে উঠলো–ওরে, সদাকে পাওয়া গেছে–আর ভয় নেই—

গোপাল ষাট বললে–পাওয়া গেছে? তাহলে খাওয়া?

-–খাওয়া হবে।

বলে আর দাঁড়ালো না। অন্য দিকে চলে গেল। বললে–যাই নিতাইকে খবরটা দিয়ে আসি, সে খুব মনমরা হয়ে গেছে–

কথাটা শুনে পর্যন্ত গোপাল ষাটের বুক থেকে যেন একখানা ভারি পাথর নেমে গেল। গরুর জানা দেওয়া ফেলে রেখে তাড়াতাড়ি কোঁচার খুঁটটা গায়ে দিয়ে রাস্তায় বেরোল। এতক্ষণে সবাই-ই নিশ্চয় জেনে গেছে। সোজা বারোয়ারি তলার দিকে পা বাড়ালো। কিন্তু সেখানে তখন আগেই সভা বসে গেছে। নিতাই, কেদার সবাই হাজির। সবার মুখেই উত্তেজনা। নেমন্তন্ন খাওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হয়ে সবাই-ই যেন বেশ ধাতস্থ। সবাই-ই জেনে গেছে সদাকে পাওয়া গেছে। কালীগঞ্জ থেকেই শালাবাবু নাকি তার ভাগ্নেকে ধরে এনেছে।

–কিন্তু পালিয়েছিল কেন? কিছু বলছে না সদা?

কথাটা সবাইকে ভাবিয়ে তুললো। বিয়ের নামে কেউ পালায়? সদাকে ছোট্টবেলা থেকেই দেখে এসেছে। কিন্তু তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে পারেনি কেউ কখনও। ইস্কুল থেকে ফেরবার পথে এই বারোয়ারিতলা দিয়েই সে বাড়ি ফিরেছে। হাটের দিনেও অনেক সময় হাটে এসেছে সে। কিন্তু কেমন যেন ভুলো-ভুলো মন সব সময়ে। আর বেশির ভাগই শালাবাবু সঙ্গে থাকতো। চৌধুরী মশাই অনেকদিন ছেলেকে এনে চণ্ডীমণ্ডপে বসিয়েছেন। বলেছেন–একদিন তো তোমাকে কাজকর্ম বই দেখতে হবে, এখন একটু জেনে-শুনে নাও–

অতি সুবোধ বালকের মত সদানন্দ চুপচাপ শুনে গেছে বাবার কথা।

চৌধুরী মশাই বলতেন–এই দেখ, এইগুলোর নাম পরচা, এই হচ্ছে দাখলে, আর এই হলো নকশা। এই নকশার ওপর নম্বর দেওয়া রয়েছে। এইগুলো হচ্ছে দাগনম্বর–

এক এক করে চৌধুরী মশাই সেরেস্তার নথিপত্র সব বোঝাতেন। কীসের কী মানে, কীসের কী গুরুত্ব। এককালে যখন দাদু থাকবে না, বাবা-মা কেউই থাকবে না, তখন তাকে নিজেকেই তো এই সব দেখতে হবে। নায়েব-গোমস্তার ওপর ভরসা করে আর যা-ই করা যাক জমিদারি সেরেস্তার কাজ চলে না। তোমার নিজের জিনিস, তোমাকে নিজের হাতেই সব করতে হবে। উকিল তোমাকে ঠকাতে চাইলেও তুমি কেন ঠকবে? মামলা-মকর্দমার সময় তোমাকে নিজেকে কাছারিতে যেতে হবে। কাঠগড়ায় সাক্ষী হয়ে দাঁড়াতে হবে। এ রকম চুপ করে থাকলে চলবে না। উকিলের জেরায় ভয় পেলে চলবে না। নিজের স্বার্থ কড়ায় গণ্ডায় বুঝে নিতে শিখবে। আর প্রজা ঠ্যাঙাতে যদি না পারো তো জমিদারি কোর না। এ ভালোমানুষির কাজ নয়, বুঝলে?

এত যে উপদেশ, এত যে পাখি-পড়ানো, সব কিন্তু বৃথা হয়েছিল।

চৌধুরী মশাই বলতেন–কিছু বুঝলে? কথার জবাব দিচ্ছ না কেন? বুঝলে কিছু?

সদানন্দ বলতো–না–

চৌধুরী মশাই চটে যেতেন। বলতেন–কেন? এতে না-বোঝবার কী আছে? লেখাপড়া শিখেছ তুমি, তোমার কাছে এ-সব কথা তো শক্ত হবার কথা নয়। ওই কৈলাস গোমস্তাকে দেখ তো, ও তো লেখা পড়ার কিছুই জানে না, কিন্তু আমাদের কত নম্বর পরচায় কত বিঘে কত ছটাক জমি আছে সব ওর মুখস্থ, ও ম্যাট্রিক পাসও নয়, আই-এ পাসও নয়, তোমার মত বি-এ পাস ছেলে যদি এ-সব বুঝতে না পারে তো এতগুলো পয়সা নষ্ট করে কী লাভ হলো?

তারপর যেন চৌধুরী মশাই-এর খেয়াল হতে খোকা কিছুই শুনছে না, অন্য দিকে চেয়ে আছে। তারপর ছেলের দৃষ্টি অনুসরণ করে দেখলেন চণ্ডীমণ্ডপের উঠোনে রজব আলি তাঁদের গোরুটাকে জোরে জোরে মারছে।

চৌধরী মশাই ধমকে উঠতেন–ওদিকে কী দেখছো? আমি কাজের কথা বলে যাচ্ছি। আর তুমি রজব আলিকে দেখছো! রজব আলির দিকে দেখে তোমার কী লাভ?

কিন্তু না, তার লাভ ছিল। রজব আলিকে দেখেও তার লাভ ছিল। কথা নেই বার্তা নেই সেই অবস্থাতেই সদানন্দ সেখান থেকে উঠে গেল। উঠে রজব আলির হাত থেকে লাঠিটা এক মিনিটের মধ্যে কেড়ে নিলে। বললে–মারছিস কেন গরুটাকে? কী করেছে গোরুটা?

রজব আলি তো ভয়ে অস্থির। গাড়ির গোরুকে মেরেছে তাতে এমন কী কসুর করেছে সে যে খোকাবাবু তার পাঁচন-বাড়ি কেড়ে নিলে!

কিন্তু ব্যাপার বুঝে চৌধুরী মশাই সেখানে এসে হাজির হলেন।

বললেন–এ কী করছো? এ কী করছো?

সদানন্দ বলল–ও গোরুটাকে মারছে কেন? গোরুটা কী করেছে ওর?

চৌধুরী মশাই বললেন–তা দরকার হলে গোরুকে মারবে না? বদমায়েসি করেছে তাই মেরেছে। তুমি ও নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছো কেন?

সদানন্দ বললে–তাহলে আমিও রজবকে মারবো, ও-ও তো বদমায়েসি করেছে–

চৌধুরী মশাই ছেলের বেয়াড়া বুদ্ধি দেখে অবাক হয়ে গেলেন। তাঁর ছেলে হয়ে এ রকম বেয়াড়া বুদ্ধি কেন হলো? এমন বুদ্ধি হলে এত সম্পত্তি রাখবে কী করে? চিরকাল তো আর তিনি থাকছেন না। একদিন তো এই ছেলের হাতে এই সমস্ত সম্পত্তি তুলে দিয়ে তাঁকে চলে যেতে হবে। তখন?

সেইদিন থেকেই চৌধুরী মশাই-এর আর এক ভাবনা শুরু হলো। সেইদিন থেকেই তিনি ছেলেকে নিজের কাছে কাছে রাখবার চেষ্টা করতে লাগলেন। চণ্ডীমণ্ডপে নিজের কাছে বসিয়ে সব কিছু দেখাতে বোঝাতে লাগলেন। সদানন্দ কিছুক্ষণ কাছে বসে থাকতো বটে, কিন্তু তার মন কোথায় পড়ে থাকতো কে জানে।

খানিকক্ষণ পরেই বলতো–আমি যাই—

চৌধুরী মশাই বলতেন–কোথায় যাবে আবার?

সদানন্দ বলতো–আমার ভালো লাগছে না–

–ভালো লাগছে না তো যাবে কোথায়?

সদানন্দ বলতো-বাইরে–

–বাইরে কোথায় তা বলবে তো?

কিন্তু সদানন্দ বাইরে যে কোথায় যাবে তা সে নিজে জানলে তবে তো বলবে! রাত্রে চৌধুরী মশাই গৃহিণীকে বলতেন–খোকা কি এখনও প্রকাশের সঙ্গে মেশে নাকি? গৃহিণী অবাক হয়ে যেতেন। বলতেন–প্রকাশের সঙ্গে মিশলে কী হয়েছে?

চৌধুরী মশাই বলতেন–না, প্রকাশের সঙ্গে যেন বেশি মেলা-মেশা না করে খোকা। এই তোমাকে সাবধান করে দিলুম।

প্রীতিলতাও জমিদারের মেয়ে। বাপের বাড়ির লোকের নিন্দে সহ্য করবার মত মেয়ে সে নয়।

বলতো–তুমি তো প্রকাশকে দেখতে পারবেই না। তা সে তোমার কী ক্ষতি করেছে শুনি?

চৌধুরী মশাই একটু নরম হয়ে বলতেন–না, আমি তা বলছি না। চিরকাল ওই রকম আড্ডা দিয়ে বেড়ালেই চলবে? সেরেস্তার কাজকর্মও তো একটু-একটু করে রপ্ত করে নিতে হবে! আমি আর ক’দিন–

এর পরে এ-প্রসঙ্গ আর বেশিক্ষণ চলতো না। কিন্তু চৌধুরী মশাই মনে মনে অস্বস্তি বোধ করতেন সদানন্দকে নিয়ে। ঠিক যেমন ছেলে তিনি চেয়েছিলেন সদানন্দ তেমন ছেলে হলো না। বাবার কাছে আসতেই যেন তার অনিচ্ছে। বাবার চোখে পড়বার ভয়ে সে যেন কোথাও লুকিয়ে থাকে। তাঁর দৃষ্টির আড়ালে সে ঘুরে বেড়াতে পারলে যেন বাঁচে।

চৌধুরী মশাই প্রায়ই গৃহিনীকে প্রশ্ন করতেন–খোকা কোথায় গেল?

প্রীতিলতা বলতো–গেছে নিশ্চয়ই কোথাও—

চৌধুরী মশাই বলতেন–কিন্তু কোথায় গেছে সেটা বলবে তো?

প্রীতিলতা বলতো কিন্তু কোথায় গেছে তা আমি কী করে বলবো? তার বয়েস হয়েছে, সে নিজের খুশীমতো যেখানে ইচ্ছে ঘুরে বেড়াবে। আমাকে সে বলে যাবে নাকি?

এর জবাবে চৌধুরী মশাই কী আর বলবেন! নিজের অভিলাষের অপূর্ণতার দুঃখটা নিজের মনেই হজম করবার চেষ্টা করতেন। কিন্তু এমনি করে আর বেশিদিন চললো না। শেষকালে সমস্ত রোগের একমাত্র উপশম হিসেবে যখন খোকার বিয়ের প্রসঙ্গটা উঠলো, তিনি এক কথাতেই রাজি হয়ে গেলেন। ভাবলেন, হয়ত বিয়ের পরই সব কিছু সহজ স্বাভাবিক হয়ে যাবে। যেমন সবার হয়ে থাকে।

কিন্তু সেই বিয়ের দিনেই যে খোকা এমন কাণ্ড করে বসবে তা কে কল্পনা করতে পেরেছিল! প্রকাশই বিয়ের সম্বন্ধ করেছিল সুতরাং তারই যত দায়িত্ব। সে-ই ছুটলো চারিদিকে। চারিদিকে সকলকে নেমন্তন্ন করা হয়েছে, দই, মাছ, মিষ্টি সব কিছু তৈরি। অধিবাস নিয়ে কুটুমবাড়ি থেকে লোক এসে গেছে অথচ বর নেই। নিজের মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে হলো চৌধুরী মশাই-এর। কুটুমবাড়ির লোককে কী জবাব দেওয়া হবে!

কিন্তু না, প্রকাশ করিতকর্মা লোক বটে। বেলা তখন দ্বিতীয় প্রহর উৎরে গেছে। হঠাৎ খোকাকে নিয়ে এসে হাজির!

চৌধুরী মশাই খবর পেয়েই দৌড়ে নিচেয় গেছেন।

গিয়ে বললেন–কী হলো, কোথায় পেলে ওকে?

প্রকাশ বললে–সে সব কথা এখন থাক জামাইবাবু, সে অনেক কাণ্ড!

–অনেক কাণ্ড? অনেক কাণ্ড মানে কী, খুলে বলো! বেলা তিনটেয় বাড়ি থেকে বর নিয়ে বেরোতে হবে। হাতেও আর সময় নেই। এদিকে কুটুমবাড়ি থেকে লোক এল, অধিবাসের তত্ত্ব নিয়ে যারা এসেছিল তারা দেখে গেছে যে বরের গায়ে-হলুদ হয়নি

প্রকাশ বললে–তাদের বললেন কেন যে গায়ে-হলুদ হয়নি?

চৌধুরী মশাই বললেন বলতে হবে কেন? তাদের চোখ নেই? তারা তো সবই দেখতে পেলে–

প্রকাশ তাতেও ভয় পাবার লোক নয়। তার হাতে যখন সব কিছুর ভার দেওয়া হয়েছে তখন সেটা তারই দায়। বললে–ঠিক আছে, কুছ পরোয়া নেই, আমি বরকে কাঁটায় কাঁটায় ঠিক সময়ে হাজির করবোই, আমার ওপর ভর দিয়ে আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন–

দিদিও খবর শুনে কাছে এসে দাঁড়িয়েছিল। বললে–হ্যাঁ রে প্রকাশ, খোকাকে কোথায় পেলি তুই শেষ পর্যন্ত?

প্রকাশ বললে–তুমি এখন কথা বলতে বসো না দিদি, তুমি গায়ে-হলুদের যোগাড় করো গে, বিকেল তিনটেয় আমরা বর নিয়ে যাত্রা করবো। নইলে ট্রেন ধরতে পারবো না। আমার একটা জরুরী কথা আছে জামাইবাবুর সঙ্গে, তুমি এখান থেকে যাও–

তারপর চৌধুরী মশাইকে একপাশে ডেকে নিয়ে গেল প্রকাশ।

বললে–একটা কথা আছে জামাইবাবু, সদাকে পেয়েছি কোথায় জানেন, কাউকে যেন বলবেন না, পেয়েছি কালীগঞ্জে-

কালীগঞ্জে?

–হ্যাঁ, কালীগঞ্জের বউ-এর কাছে গিয়ে উঠেছিল সদা। জানি না কালীগঞ্জের বউ সদাকে কী ফুস মন্তর দিয়েছে, দশ হাজার টাকা না দিলে সদা বিয়ে করতে যাবে না–

–দশ হাজার টাকা? কালীগঞ্জের বউকে দিতে হবে?

–হ্যাঁ, তা না দিলে সদা বিয়ে করতেই যাবে না। ওর দাদু কালীগঞ্জের বউকে কথা দিয়েছিল। সেই কথা এখন রাখতে হবে!

চৌধুরী মশাই-এর বিস্ময়ের ঘোর যেন তখনও কাটেনি। বললেন–সে সব তো অনেক কাল আগেকার কথা। ওই কালীগঞ্জের বউ-ই তো আমাদের নামে মামলা করছিল। তখন বাবা কথা দিয়েছিল দশ হাজার টাকা দিয়ে সব মিটিয়ে নেবে–তা খোকা এ সব জানলে কী করে?

প্রকাশ বললে–কী জানি কী করে জানলে। সেখান থেকে তো সদা কিছুতেই আসতে চায় না, শেষে আমি বললুম যেনবাবগঞ্জে গিয়ে তোকে টাকা দেওয়া হবে, তবে এলো। এখন টাকাটার একটা বন্দোবস্ত করুন–

চৌধুরী মশাই বললেন–এখনই টাকা দিতে হবে?

 প্রকাশ বললে—হ্যাঁ–

–টাকা না দিলে?

–টাকা না দিলে ও বিয়ে করতে যাবে না।

–তা টাকা পরে দিলে চলবে না? বিয়ে-টিয়ে আগে মিটে যাক তারপর না হয় ভেবে চিন্তে টাকা দেওয়া যাবে।

প্রকাশ বললে–তা বোধ হয় শুনবে না সদা, ও যা বেয়াড়া ছেলে আপনার। একবার যখন গোঁ ধরেছে তখন টাকা না দিলে ছাড়বেই না।

মহা ভাবনায় পড়লেন চৌধুরী মশাই। ওদিকে বেশি ভাববারও সময় নেই। বেলা তিনটেয় ট্রেন, সেই ট্রেন ধরে রাণাঘাটে যেতে হবে। সেখান থেকে আবার কেষ্টনগর।

শেষকালে আর কিছু না ভেবে পেয়ে বললেন–দেখি, একবার বাবাকে গিয়ে বলে আসি–

বলে চৌধুরী মশাই ওপরে চলে গেলেন।

প্রকাশ মামা সদানন্দর কাছে এল। সদানন্দ জিজ্ঞেস করলে–কী হলো?

প্রকাশ মামা বললে–হচ্ছে, টাকার ব্যবস্থা হচ্ছে। জামাইবাবু তোর দাদুর কাছে টাকা আনতে গেছে। তুই কিচ্ছু ভাবিস নি, তোর টাকা পেলেই তো হলো। তোর দাদুর কি টাকার অভাব? দশ হাজার টাকা তোর দাদুর হাতের ময়লা–

সদানন্দ বললে–ঠিক আছে, দাদু যদি টাকা দেয় তো ভালো, কিন্তু টাকা না দিলে আমি কিন্তু বিয়ে করতে যাবো না, এ আমি তোমায় জানিয়ে রাখছি–ততক্ষণে ওপর থেকে ডাক এলো। ওপরে যেতে হবে দু’জনকে।

সদানন্দ আগে আগে পেছন-পেছন প্রকাশ মামা। দাদুর ঘরে তখন কৈলাস গোমস্তা আর চৌধুরী মশাই রয়েছে। বিছানার ওপর আধ-শোওয়া অবস্থায় দাদু।

সদানন্দকে দেখেই দাদু বললেন–কী সব পাগলামির কথা শুনছি তোমার? তোমার না বয়েস হয়েছে? এই বয়সে কি তোমার ছেলেমানুষী এখনও গেল না?

সদানন্দ কিছু উত্তর দিলে না। চুপ করে রইল।

–কথা বলছো না যে? যাও, বিয়ে করতে যাও। শেষকালে কি ট্রেন ফেল করবে নাকি?

সদানন্দ বললে–কিন্তু টাকা?

নরনারায়ণ চৌধুরীও তেমনি লোক। বললেন–টাকা কি হুট বললেই আসে?

তুমি বললে–টাকা দাও আর আমিও অমনি টাকা দিয়ে দিলুম, তাই কখনও হয়, না হয়েছে? টাকা দেওয়া হবেখন। তুমি এখন যা করতে যাচ্ছো তাই করতে যাও–শেষকালে কি লোক হাসাবে নাকি?

সদানন্দর মুখে সেই একই জবাব। বললে–টাকা না দিলে আমি যাবো না–

নরনারায়ণ চৌধুরীর জমিদারি মেজাজ তীক্ষ্ণ হয়ে উঠলো–বলছি তো টাকা আমি দেব। আমার কথার একটা দাম নেই? তোমার জিদটাই বজায় থাকবে?

–কিন্তু কখন টাকা দেবেন?

নরনারায়ণ চৌধুরী বললেন–তুমি কাল বিয়ে করে ফিরে এলেই দেব–

–যদি না দেন?

এতক্ষণে চৌধুরী মশাই কথার মধ্যে মুখ খুললেন। বললেন–আর তুমি কথা বাড়িও না খোকা, দাদু যখন বলছেন টাকা দেবেন তখন তার ওপরে আর কথা বলো না। আর এ নিয়ে কথা কাটাকাটি করলে ওদিকে গায়ে-হলুদের দেরি হয়ে যাবে, ট্রেনও ফেল করবো আমরা–

সদানন্দ বোধ হয় এতক্ষণে একটু নরম হলো। বললে–তোমরা সবাই কথা দিচ্ছ তাহলে? আমি এখন যাচ্ছি বটে, কিন্তু তোমরা সাক্ষী রইলে। টাকা না দিলে কিন্তু সর্বনাশ হয়ে যাবে,–এই বলে রাখলুম, চলো–

এতক্ষণে যেন চৌধুরী মশাই নিশ্চিন্তের হাঁফ ছাড়লেন। সব মিটে গেল। কর্তাবাবু ছেলেকে আলাদা করে ডেকে বলে দিলেন–তুমি সঙ্গে যাচ্ছো তো, একটু নজর রেখো, যেন আবার কোনও গণ্ডগোল না করে বসে সেখানে। তুমি কন্যে-কর্তার বাড়িতে রাত্তিরে থেকো

চৌধুরী মশাই বললেন–হ্যাঁ, আমি তো সঙ্গে যাচ্ছিই, রাত্রে সেখানেই থাকবো, সম্প্রদান পর্যন্ত দেখবো, তারপর নিরঞ্জন রইল, প্রকাশ রইল, তাদেরও একটু পাহারা দিতে বলবো–

নরনারায়ণ চৌধুরী বললেন–ছেলেমানুষের মন, কেউ হয়ত নানা রকম মতলব দিয়ে ওর মাথাটা গরম করে দিয়েছে, ও নিয়ে তুমি ভেবো না। ছেলেবয়সে বিয়ের আগে ওরকম সকলেরই মাথা গরম হয়। তারপর বিয়ে-থা হয়ে গেলে আবার যেমন-কে-তেমন, ও-সব আমার অনেক দেখা আছে—

তা এর পর আর কোন গণ্ডগোল হয় নি। তাড়াহুড়ো করে গায়ে-হলুদ হয়েছে সদার, জামা-কাপড় বদলে নিয়ে সবাই দুর্গা দুর্গা বলে যাত্রা করেছে। তারপর বিয়েও হয়েছে, বাসর ঘরও হয়েছে। সদানন্দ কোনও বেয়াড়াপনা করে নি।

একবার শুধু প্রকাশ মামাকে সদানন্দ জিজ্ঞেস করেছে–দাদু টাকা দেবে তো ঠিক প্রকাশ মামা?

প্রকাশ মামা বলেছে–আরে তুই অত ঘাবড়াচ্ছিস কেন? টাকা পেলেই তো তোর হলো?

নতুন বউকে নিয়ে ট্রেনে উঠেছে সবাই। সঙ্গে প্রকাশ মামা আছে। প্রকাশ মামা বরকর্তা। আর আছে নিরঞ্জন। আসবার সময় বেয়াই মশাই-এর চোখ দুটোও জলে ভরে এসেছিল। একমাত্র সন্তান, এই নয়নতারাই ছিল তাঁর সব। মেয়েও যত চোখের জল ফেলেছে, মেয়ের মা বাবাও তত। ট্রেনে ওঠবার সময় কালীকান্ত ভট্টাচার্য আর থাকতে পারেন নি। একেবারে প্রকাশ মামার হাত দুটো জাপটে ধরেছিলেন।

বলেছিলেন–আমার মেয়েকে একটু দেখবেন বেয়াই মশাই, ও-মেয়ে সংসারের কিছুই জানে না, দোষ-ত্রুটি যা-কিছু সব ক্ষমা করে নেবেন।

প্রকাশ মামা বলেছিল–আপনি কিছু ভাববেন না বেয়াই মশাই, আপনার মেয়ের অনেক পুণ্যফলে অমন শ্বশুর-শাশুড়ী পেলে। অমন শ্বশুর-শাশুড়ী কোনও মেয়ে পায় না।

তারপর ট্রেন ছেড়ে দিলে। নয়নতারা অনেকক্ষণ ধরে জানালা দিয়ে বাইরের দিকে চেয়ে রইল। তারপর যখন বাবাকে আর দেখা গেল না তখন ঘোমটার আড়ালে কান্নায় ভেঙে পড়লো।

তারপর বর-কনে যখন নবাবগঞ্জে এসে পৌঁছুলো তখন বেলা পড়ো-পড়ো। বাড়ির ভেতর থেকে উলুর শব্দ উঠলো, শাঁখ বেজে উঠলো। নতুন বউ এসেছে চৌধুরীবাড়িতে। চৌধুরীবাড়ির প্রথম লক্ষ্মী এসেছে। এ-গ্রাম ও গ্রাম থেকে লোকজন মেয়ে-পুরুষ একবারে ভেঙে পড়লো।

বারোয়ারীতলার নিতাই হালদারের দোকানের মাচায় তখন রীতিমত সভা বসে গেছে।

 কেদার বললে–বউ কী রকম দেখলি রে গোপাল?

গোপাল ষাট বললে–আমি আর কখন দেখলুম, আমার বউ গিয়েছিল, বললে–একেবারে জগদ্ধাত্রীর মত রূপ। বড়লোকের ছেলের বউ, আমাদের মতন শাঁকচুন্নী বউ হবে নাকি?

–কেন, তোর বউকে কি খারাপ দেখতে?

গোপাল ষাট বললে–খারাপ বলে খারাপ, একেবারে রক্ষেকালীর বাচ্চা ভাই, যখন আমার সঙ্গে ঝগড়া করে তোরা সে-চেহারা দেখিস নি–

সবাই হেসে উঠলো। নিতাই বলে উঠলো–ওরে তা নয়, আসলে পরের বউকে সকলেরই ভালো লাগে। যার সঙ্গে ঘর করতে হয় সে তো পুরোনো হয়ে যায়–

কেদার বললে–ওরে, এই আমার কথাই ধর না। আমি যখন বিয়ে করেছিলুম তখন সবাই বউ দেখে বললে–পরী। তারপর বছর বছর ছেলে বিইয়ে বিইয়ে চেহারাটা এমন করে ফেললে যে তার দিকে এখন চাইতে ঘেন্না করে আমার বউ তো নয় যেন কাঁঠাল গাছ–

নিতাই বললে–তা কাঁঠাল গাছের কী দোষ, কাঁঠাল গাছের গোড়ায় অত জল ঢাললে ফলন তো হবেই।

কথাটা-শুনে আর এক চোট হাসি উঠলো।

কিন্তু তখন চৌধুরি বাড়ির ভিড় একটু করে পাতলা হয়ে আসছে। প্রকাশ মামাই সকলকে তাড়া দিতে লাগলো। বললে–সরো সরো বাপু তোমরা, একটু ভিড় পাতলা করো, কাল সারা রাত বউ ঘুমোয় নি–সরো, একটু হাঁফ ছাড়তে দাও–

সদানন্দ একটা ফাঁকা জায়গায় খোলা আকাশের নিচেয় গিয়ে দাঁড়ালো। একটা অস্বস্তিকর অবস্থার আবহাওয়া তাকে যেন এতক্ষণ গ্রাস করেছিল। এবার সে মুক্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো।

হঠাৎ একটা আওয়াজ কানে এলো-আরে, তুই এখানে? আর আমি তোকে খুঁজে খুঁজে মরছি–

প্রকাশ মামা কাছে এসে দাঁড়ালো। বললে–তোকে যে সবাই খোঁজাখুঁজি করছে—আর—

সদানন্দ জিজ্ঞেস করলে–আমাকে কী দরকার, এখন তো বিয়ে হয়ে গেছে।

প্রকাশ মামা বললে–তোর মেজাজ এমন তিরিক্ষে কেন রে? বিয়ে করে এলি সুন্দরী বউ হলো তবু তোমার তিরিক্ষে মেজাজ গেল না, আয় আয়–

সদানন্দ বললে–কিন্তু আমার টাকা?

প্রকাশ মামা বললে–আরে, টাকা কি তোর পালিয়ে যাচ্ছে?

সদানন্দ বললে–না, দাদু বলেছিল আমি বিয়ে করে আসার পর টাকা দেবে। আমি সেই টাকা নিয়ে এখনই কালীগঞ্জের বউকে গিয়ে দিয়ে আসবো–

প্রকাশ মামা বললে–তাহলে তোর দাদুকে গিয়ে তুই বল–দাদু তো বলেই ছিল টাকা দেবে–

সদানন্দ বললে–আমি এখনই যাচ্ছি–

নরনারায়ণ চৌধুরীর মেজাজটা বেশ ঠাণ্ডা ছিল। এমনিতে সম্পত্তির ঝঞ্ঝাটে মেজাজ তাঁর সহজে ঠাণ্ডা থাকে না। নতুন বউ তাঁকে এসে প্রণাম করে গেছে। তিনি তাকে আশীর্বাদ করেছেন। আশীর্বাদ করেছেন যেন সে এবংশের সুখ-সমৃদ্ধি করে। যেন বংশ পরম্পরায় চৌধুরী বংশের অক্ষয়কীর্তি অমর করে রাখে। আর নতুন বউ-এর রূপ দেখেও তিনি খুশী হয়েছিলেন। রূপ বটে! যেমন রূপ তিনি আশা করেছিলেন ঠিক তেমনি। আর শুধু রূপ নয়, লক্ষণও ভালো। তিনি ভালো করে বউ-এর মুখখানা খুঁটিয়ে দেখছিলেন। সুলক্ষণা যাকে বলে ঠিক তাই, এ পারবে। এ তাঁর নাতির বেয়াড়াপনা দূর করবে।

হঠাৎ সামনে যেন ভূত দেখলেন। বললেন–কে?

সদানন্দ বললে–আমি সদানন্দ–

–ও, তা কী চাও?

সদানন্দ বললে–আমার টাকা–

–টাকা?

টাকার কথা শুনে নরনারায়ণ চৌধুরী চমকে উঠলেন। টাকা! যেন কিছুই জানেন না তিনি। যেন কিছুই তার জানবার কথা নয়। যেন কাউকে তিনি টাকা দেবার কথা বলেনও নি। কথাটা শুনে তিনি বাবার মত তাঁর নাতির মুখের দিকে চেয়ে রইলেন।

তারপর বললেন–কিসের টাকা?

সদানন্দ বললে–আপনার মনে নেই আপনি দশ হাজার টাকা দেবেন বলেছিলেন? আপনি বলেছিলেন আমি বিয়ে করে এলেই আপনি কালীগঞ্জের বউকে দশ হাজার টাকা দেবেন

কর্তাবাবুর যেন এতক্ষণে মনে পড়লো। বললেন–তা দেব যখন বলেছি তখন দেব। আমি কি বলেছি দেব না?

সদানন্দ বললে–তাহলে দিন টাকা আমি তাকে দিয়ে আসি–

কর্তাবাবু এতক্ষণে চটে গেলেন। বললেন তুমি কেন দিতে যাবে? তুমি এখন বাড়ি ছেড়ে যাবে কী করে? আর তুমি ছাড়া কি টাকা দিয়ে আসবার লোক নেই? আমি কি লোক দিয়ে টাকা পাঠাতে পারি না?

সদানন্দ বললে–কেন পাঠাতে পারবেন না, কিন্তু আমি জানি আপনি তা পাঠাবেন না। পাঠালে অনেক আগেই তা পাঠাতেন।

কর্তাবাবু নাতির কথা শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। এমন সুরে তো সদানন্দ কখনও কথা বলে না। কথার এত তেজ কোথায় পেলে সে? অবশ পা দুটো সামনের দিকে টানবার চেষ্টা করতে গিয়ে তিনি মনে মনে ছটফট করতে লাগলেন। বললেন–তুমি হঠাৎ এত কড়া কড়া কথা বলছো যে? কে তোমাকে এসব কথা শিখিয়েছে?

সদানন্দ বললে–কে আবার শেখাবে? আপনি বলেছিলেন টাকা দেবেন, তাই আপনার কথাই আপনাকে মনে করিয়ে দিতে এসেছি—

কর্তাবাবু বললেন–মনে করিয়ে তোমাকে দিতে হবে না। তুমি তোমার নিজের ধান্দা নিয়ে থাকো। এখন বাড়িতে আত্মীয়-স্বজন লোকজন এসেছে, তাদের দেখাশোনা করো তাহলেই যথেষ্ট করা হবে। এখন যাও–

সদানন্দ তবু নড়লো না, বললে–কিন্তু আপনি তো আপনার কথা রাখলেন না দাদু, আমি আপনার কথাতেই বিয়ে করতে গিয়েছি, এখন আপনি আপনার কথা রাখুন। টাকা দিন–

–আরে, এ তো মহা মুশকিলে পড়া গেল দেখছি। বাড়িতে নতুন বউ এসেছে, কোথায় সেই নিয়ে সবাই ভাবছে, আর এখন কি না বলে টাকা দাও! অমনি টাকা দিলেই হলো?

তারপর কী করবেন বুঝতে পারলেন না। বললেন–এখন আমি ব্যস্ত আছি, পরে তোমার সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলবো, তুমি এখন ভিতরে যাও

–না আমি যাবো না। আগে আমার টাকা চাই—

কর্তাবাবু বললেন–কী বললে–তুমি?

সদানন্দ বললে–আগে আপনি টাকা দেবেন তবে এখেন থেকে নড়বো—

কর্তাবাবু কৈলাসের দিকে চেয়ে বললেন–কৈলাস একবার ছোটবাবুকে ডাকো তো–

কৈলাস গোমস্তা উঠে নিচেয় চলে গেল। সদানন্দও সেই ঘরের মধ্যে কাঠের পুতুলের মত চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। সেই ঠিক করেই ফেলেছিল যে সে টাকা না নিয়ে ঘর থেকে আর বেরোবে না। সমস্ত বাড়ি তখন উৎসব অনুষ্ঠানের আয়োজনে মুখর। আজ চৌধুরীবাড়ীতে নতুন বউ এসেছে। মেয়েরা উলু দিয়েছে, শাঁখ বাজিয়েছে। বাড়ির সব লোকজন নতুন কাপড় পেয়েছে। কৈলাস গোমস্তা থেকে শুরু করে রজব আলী পর্যন্ত কেউ বাদ যায় নি। এমন ঘটনা তো রোজ রোজ ঘটে না। আবার কত বছর পরে এ বাড়িতে এমন ঘটনা ঘটবে কে বলতে পারে! বউ আসবার সঙ্গে সঙ্গে পাড়ার সব বউ-ঝিরা এসে– ভিড় করেছে। কেদার, গোপাল ষাট সবাই নিজের নিজের বউদের আগাম পাঠিয়ে দিয়েছে। বউভাতের দিন সবাই তো বউ দেখতে পাবেই। কিন্তু তার তো অনেক দেরি। চব্বিশ ঘণ্টা না গেলে তো আর বউভাত হচ্ছে না। শুধু বউভাতই নয়, ফুলশয্যাও হবে, বাড়ির উঠোন জুড়ে শামিয়ানা খাটানো হয়েছে। যেদিকে পুকুরঘাট সেই দিকটাতেই বসেছে ভিয়েন। সেখানে বড় বড় দশখানা উনুন তৈরি হয়েছে। দুদিন আগে থেকে সেখানে মিষ্টি তৈরি শুরু হয়ে গিয়েছে। রসগোল্লা তৈরি হবার পর গামলায় তুলে রাখতে হবে। সেই সব গামলাও এসে গিয়েছে। সেগুলো সার সার বসানো হয়েছে পুকুরের ধার ঘেঁষে। কিন্তু আসল বড় সামিয়ানাটা খাটানো হয়েছে বাড়ির সামনে। সেখানে বসবে বিশিষ্ট অতিথিরা।

প্রকাশ মামার এসে পর্যন্ত সময় নেই, পরশু থেকে নাইবার খাবার সময় ছিল না। দু’রাত নাগাড়ে জাগা। তার ওপর কেষ্টনগর থেকে বর কনে নিয়ে আসার পর দেখেছে যোগাড় যন্তর কিছুই হয় নি, অথচ রাত পোহালে সব লোকজন এসে হবে। তারপর আছে সদানন্দকে নিয়ে ভাবনা। সে কোথায় কখন কী করে বসে তার ঠিক নেই। রাস্তায় আসতে আসতে সদানন্দ অনেকবার জিজ্ঞেস করেছে–টাকা পাওয়া যাবে তো ঠিক, প্রকাশ মামা?

প্রকাশ মামা বলেছে–তুই অত ভাবছিস কেন? তোর দাদু তো নিজের মুখে তোকে বলেছে টাকা দেবে, তাহলে আর তোর এত ভাবনা কীসের?

সদানন্দ বলেছে–না, কথা না রাখলে কিন্তু আমি দেখে নেব, তা বলে রাখছি

প্রকাশ মামা বলেছে টাকা না দিলে তুই কী করবি?

 সদানন্দ বলেছে–কী করবো তা আমিই জানি–

–কী করবি তুই বল্ না। এখন তো বিয়ে তোর হয়েই গেছে। এখন তো আর তা বলে বউকে ফেলে দিতে পারবি না–

–সে আমি যা করবো, তুমি তা দেখতেই পাবে।

প্রকাশ মামা ভাগ্নের কথা শুনে হেসেছে। বলেছে–ওরে, প্রথমে সবাই ওরকম বলে রে! তারপর বউ-এর মুখ দেখে সবাই ভুলে যায়। আর এ তোর যে-সে বউ নয়। এ বউকে তুই ফেলতে পারবি? এই রকম সুন্দরী বউকে?

উত্তরে সদানন্দ কিছু কথা বলে নি। কিন্তু প্রকাশ মামা বুঝেছে বউ-এর মুখ দেখে তার ভাগ্নে গলে গেছে। এক রাত্রের মধ্যেই ভাগ্নের মুখের চেহারা বদলে গেছে। তার পরে ফুলশয্যার রাতটা একবার কাবার হোক তখন আবার সদানন্দ অন্য মানুষ হয়ে যাবে। তখন আর বাড়ি ছেড়ে কোথাও যেতেই চাইবে না। প্রকাশ মামা পাকা লোক। অনেক পুরুষ অনেক মেয়েমানুষকেই চরিয়েছে। সুতরাং সদানন্দ যা-কিছু টাকা-টাকা করেছে একটা রাত কাটলেই সব থিতিয়ে আসবে, এ সম্বন্ধে প্রকাশ মামার আর কিছু সন্দেহ ছিল না।

রাস্তায় ট্রেনের কামরায় প্রকাশ মামা ভাগ্নের কানের কাছে মুখ নিয়ে গেল।

বললে–কী রে, কী ভাবছিস?

সদানন্দ বললে–ভাবছি দাদু টাকাটা দেবে তো ঠিক?

প্রকাশ মামা বললে–তুই দেখছি আস্ত পাগল! কালীগঞ্জের বউ তোর কে শুনি যে তার টাকার জন্যে তুই মাথা ঘামচ্ছিস? আর বুড়িটা ক’দিনই বা বাঁচবে? ও টাকা পেলেই বা কী আর না পেলেই বা কী! তোর এমন বিয়ে হয়েছে, তুই এখন বিয়ের কথা ভাব। তুই এখন ভাব ফুলশয্যার রাত্তিরে বউ-এর সঙ্গে প্রথমে কী কথা বলবি–

সদানন্দ এ কথার কোনও উত্তর দিলে না।

প্রকাশ মামা বললে–দ্যাখ, তুই তো একটা আনাড়ির ডিম। তোকে আমি অনেক চেষ্টা করেও তো মানুষ করতে পারলুম না। রাধার ঘরে তোকে নিয়ে গিয়েই আমি তা বুঝেছি। মেয়েমানুষ দেখলে তুই অত ঘাবড়ে যাস কেন? কাল ফুলশয্যার রাত্তিরে যেন ঘাবড়ে যাস নি, বুঝলি?

সদানন্দ সে কথারও কিছু উত্তর দিলে না।

প্রকাশ মামা বললে–কী রে, কথা বলছিস না যে, ফুলশয্যার রাত্তিরে বউ-এর সঙ্গে প্রথমে কী কথা বলবি সব ভেবে রেখেছিস তো?

তবু সদানন্দর মুখে কোনও জবাব নেই।

প্রকাশ মামা তবু ছাড়লে না। বললে–কী রে, বুঝলি কিছু? কি বলছি তা বুঝতে পারলি?

সদানন্দ বললে—না–

–আরে, এই সোজা কথাটাও বুঝতে পারলি নে? জীবনে একটা অচেনা মেয়ের সঙ্গে প্রথম কথা বলবার আগে একটু ভেবে-চিন্তে নিতে হয়, বুঝলি? কিছু ভেবেছিস তুই?

সদানন্দ বললে–ভাববো আবার কী?

প্রকাশ মামা বললে–এই মরেছে! তুই দেখছি এখনও আনাড়ি আছিস! শোন, তোকে আমি বুঝিয়ে দিই, প্রথমে তো ঘরে ঢুকবি। ঢুকে দরজার খিল দিয়ে দিবি। তোর বউ যদি তখন চুপ করে খাটের বাজু ধরে দাঁড়িয়ে থাকে তো তুই আস্তে আস্তে তার কাছে গিয়ে…..

সদানন্দ হঠাৎ বলে উঠলো–কিন্তু একটা কথা প্রকাশ মামা, তোমার কথাতেই কিন্তু আমি বিয়ে করেছি, তা মনে থাকে যেন

অন্য প্রসঙ্গ আসতে প্রকাশ মামা বিরক্ত হয়ে উঠলো, বললে–তার মানে?

সদানন্দ বললে–তার মানে তুমি ভালো করেই জানো, দুবার করে তা আর শুনতে চেয়ো না। আমার কিন্তু দশ হাজার টাকা চাই।

প্রকাশ মামা বললে–দশ হাজার টাকা আমি কোথায় পাবো? তোর দাদু সে-টাকা দেবে।

–হ্যাঁ, আমি বাড়ি ফিরে গিয়েই টাকা চাইবো। তখন দাদু টাকা না দিলে কিন্তু তোমাকে সেটা পাইয়ে দিতে হবে। তোমার দায়িত্ব সেটা। শেষকালে যেন বোল না তোমার কোনও দায়িত্ব নেই–

–আরে, তুই দেখছি সেই যাকে বলে মালে ভুল তালে ঠিক।

সদানন্দ বললে–সে তুমি যাই বলো, আমি কিন্তু তখন তোমাকে ছাড়বো না। তখন যেন বলো না যে তুমি কিছু জানো না!

প্রকাশ মামা বলে উঠলো–দ্যাখ দিকিন, এখন কি ও সব কথা ভাববার সময়? কোথায় তুই বউ-র ঘোমটার ভেতর উঁকি মেরে দেখবার চেষ্টা করবি, কোথায় ফুলশয্যার রাত্তিরে কী কথা বলবি সেই কথা ভাববি, তা নয় যত সব…

ট্রেনের কামরার মধ্যে নতুন বর-কনে চলেছে তখন। অন্য প্যাসেঞ্জাররা নতুন কনের ঘোমটার ফাঁক দিয়ে তার মুখ দেখবার চেষ্টা করছে। হু-হু করে চলেছে ট্রেনটা। তারপর একসময় এসে থামলো রেলবাজারে। রজব আলি গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। তাদের সঙ্গে পালকীর বন্দোবস্তও ছিল। এর পরে আর কোনও গণ্ডগোল হয় নি। নবাবগঞ্জে বর কনেকে দিদির হেপাজতে রেখে ভিয়েন আর শামিয়ানা নিয়ে পড়েছিল। যেদিকে প্রকাশ মামা না দেখবে সেই দিকেই তো চিত্তির!

হঠাৎ কৈলাস গোমস্তা এসে ডাকলে–শালাবাবু, ছোটবাবু একবার ডাকছেন আপনাকে–

–ছোটবাবু? কেন? কোথায়?

–ওপরে।

–আচ্ছা, যাচ্ছি,–তুমি যাও—

বলে আর দাঁড়ালো না। কাজকর্ম ফেলে দোতলায় সিঁড়ির দিকে চলতে লাগলো। কিন্তু ওপরে তখন আর এক নাটকের অভিনয় চলছে। চৌধুরী মশাই গিয়ে হাজির হয়েছেন সেখানে। সদানন্দও রয়েছে। প্রকাশ যখন সেখানে গিয়ে পৌঁছুল তখন কর্তাবাবু বেশ রেগে উঠেছেন। –বলছেন তাহলে তোমার কথাই ঠিক থাকবে? আর আমি কেউ নই? আমার কথার কোনও দাম নেই? আমি তো বলছি ফুল-শয্যা-টয্যা হয়ে যাক তখন টাকার বন্দোবস্ত করবো। হুট করে বললেই কি টাকা বেরোয়? আর অত টাকা কি এক সঙ্গে কেউ ঘরে রাখে? ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তুলতেও তো সময় চাই?

সদানন্দ বললে–কিন্তু তখন কেন বললেন যে, আমি বিয়ে করে ফিরে এলেই টাকা দেবেন? আপনি তো এতক্ষণে আজকের মধ্যে কাউকে দিয়ে ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তুলে রাখতে পারতেন!

কর্তাবাবু বললেন–তার কৈফিয়ৎ কি তোমাকে দিতে হবে নাকি?

সদানন্দ বললে–কিন্তু আপনি তো জানতেন আমি বিয়ে করে ফিরে এসেই টাকাটা চাইবো।

কর্তাবাবু বললেন–গুরুজনদের সঙ্গে কেমন করে কথা বলতে হয় তাও দেখছি তুমি শেখো নি–

সদানন্দ বললে–আপনারা গুরুজন বলে কি আপনাদের সাতখুন মাফ? আমি তার প্রতিবাদ করতেও পারবো না?

চৌধুরী মশাই এবারে ছেলের দিকে চাইলেন। বললেন–তুমি চুপ করো। কার সঙ্গে কেমন করে কথা বলতে হয় তাও জানো না। যাও যাও, নিচেয় যাও, এখন আমাদের অনেক কাজকর্ম পড়ে আছে। কালকে আত্মীয়-স্বজন কুটুমরা আসবে, তাদের ব্যবস্থা করতে হবে, এই সময়ে কিনা তুমি দাদুকে এই রকম বিরক্ত করতে এলে, দুদিন সবুর করতে পারলে না? এখন যাও, পরে ওসব ব্যাপার হবে–

সদানন্দ বললে–তুমি এটা কী বলছো বাবা? যখন দাদু কথা দিয়েছিলেন, তখন তুমিও তো শুনেছ! এমন করবে জানলে তো তখন আমি বিয়ে করতেই যেতুম না।

–থামো!

কর্তাবাবু বিছানায় শুয়ে শুয়েই চিৎকার করে উঠলেন–থামো, থামো, বেয়াদপিরও একটা সীমা আছে।

বেয়াদপি আমি করছি না আপনি করছেন? আপনি কেন এমন করে একজন বিধবার সর্বনাশ করলেন? কেন তার সর্বস্ব কেড়ে নিলেন? কেন তাকে কথা দিয়ে কথা রাখলেন না?

হঠাৎ সমস্ত বাড়ির লোকজন বেশ সচকিত হয়ে উঠলো। কর্তাবাবুর ঘরের ভেতরে একটা গোলমালের আওয়াজ হতেই সবাই কান পেতে গোলমালের কারণটা জানতে চাইল। গৌরী পিসী সিঁড়ির তলা দিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ চমকে উঠলো। কীসের আওয়াজ? ভেতরে বাড়ির ঘরে তখন নতুন বউকে ঘিরে অনেক অভ্যাগতের ভিড়। কাছে গিয়ে ডাকলে–বউদি ও বউদি–

সদানন্দর মা ব্যস্ত ছিল। বললে–কী? কী বলছিস?

গৌরী বললে–কর্তাবাবুর ঘরে অত চেঁচামেছি হচ্ছে কীসের বলো তো?

–চেঁচামেচি হচ্ছে কীসের তা আমি কী করে জানবো?

গৌরী বললে–না, মনে হলো খোকার গলা শুনতে পেলাম। খোকাবাবুর সঙ্গে কর্তাবাবুর যেন কথা কাটাকাটি হচ্ছে–

–তাই নাকি?

এই এক ঘণ্টা আগে যে নতুন বউকে বিয়ে করে ঘরে নিয়ে এসেছে সে কী নিয়ে ঠাকুরদাদার সঙ্গে চেঁচামেচি করবে। সাধারণত সদানন্দ তো কারো সঙ্গে চেঁচিয়ে কথা বলে না। সে তো বরাবর চুপচাপই থাকে। সাধারণত কেউ তার মুখই দেখতে পায় না। সে যে কখন কোথায় থাকে কী করে কেউই তা জানতে পারে না। খেতে হয় তাই খায়। তারপর তাড়াতাড়ি খেয়ে নিয়েই আবার কোথায় বেরিয়ে যায় তাও কেউ জানতে পারে না। সে কেন গোলমাল করবে বাড়ির ভেতরে।

কিন্তু তখন ও-সব ভাবনা ভাববার সময় নেই বাড়ির গিন্নীর। প্রীতি বাড়ির গিন্নী। এই সমস্ত অন্দরমহলের মানুষগুলোর দায়িত্ব সমস্ত তার ওপর। কে খেতে পাচ্ছে, আর কে খেতে পাচ্ছে না তাও ভাবা তার দায়িত্ব। এতদিন পরে তার বাবা এসেছে ভাগলপুর থেকে। তিনি বুড়ো মানুষ। তাঁর একমাত্র নাতির আজ বিয়ে। এই প্রথম আর এই-ই বোধ হয় শেষ। কীর্তিপদবাবু সুলতানপুরে একলা পড়ে থাকেন। তারও অনেক সম্পত্তি। সেই সম্পত্তি দেখা-শোনার কাজেই তাঁর দিন কেটে যায়। অথচ তিনি চলে যাবার পর ওই সমস্ত সম্পত্তি তাঁরই মেয়ে-জামাই-নাতি পাবে। তখন এই নাতিকে যেমন নবাবগঞ্জের সম্পত্তি দেখতে হবে, তেমনি দেখতে হবে সুলতানপুরের সম্পত্তিও। তিনি যা কিছু করছেন সবই এদের জন্যে–এই মেয়ে জামাই আর নাতি! তাই নাতির বিয়ের সময় নবাবগঞ্জে না এসে পারেন নি।

এসেই মেয়ের সঙ্গে দেখা করেছেন। অনেকদিন পরে দেখা।

কীর্তিপদবাবু বললেন–কেমন আছিস রে প্রীতি? সব খবর ভালো তো?

প্রীতি বাবার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে উঠে দাঁড়ালো। বললে–তুমি কত রোগা হয়ে গেছ বাবা–

কীর্তিপদবাবু বললেন–রোগা তো হবোই, বুড়ো হচ্ছি না? এখন তোদের রেখে যেতে পারলেই তো হয় রে–

প্রীতি জিজ্ঞেস করলে–আসতে তোমার কোনও কষ্ট হয় নি তো বাবা?

কীর্তিপদবাবু বললেন–আমার কষ্টর কথা রাখ। কুটুম কেমন হলো তাই বল? মেয়ে দেখতে-শুনতে ভালো তো?

প্রীতি বললে–শুনেছি তো মেয়ে দেখতে-শুনতে ভালো। আমি তো টাকা চাই নি। একটা পয়সা নেওয়া হয় নি, শুধু দেখতে-শুনতে সুন্দরী আর স্বভাব-চরিত্রটা ভালো হবে এই-ই চেয়েছিলুম। এখন কালকে বউ আসবে তখন বুঝবো।

খোকা কোথায়? তাকে তো দেখছি নে?

প্রীতি বললে–তার কথা আর বোল না।

কীর্তিপদবাবু জিজ্ঞেস করলেন–কেন? তার আবার কি হলো?

প্রীতি বললে–তাকে তো আমি চোখেই দেখতে পাই না। কখন সে থাকে, কখন থাকে, কোথায় যায়, কী করে, কেউ জানতে পারে না।

–তা কলেজে তো বি-এ পড়ছিল, পাস-টাস করেছে?

–পাস করলে কী হবে, বুদ্ধিসুদ্ধি ভালো হয় নি। বাড়ির কাজকর্ম এখন থেকে বুঝে নেওয়া উচিত, তা সেদিকেও মন নেই। টাকা-পয়সার দিকেও কোনও টান নেই।

কীর্তিপদবাবু মেয়ের কথা শুনে নিশ্চিন্ত হলেন। বললেন–ও কিছু না, ও নিয়ে তুই ভাবিস নি। ওর মতন বয়েসে সবাই ওই রকমই থাকে। তারপর এই এখন বিয়ে হচ্ছে, দেখবি কাঁধে জোয়াল পড়লেই সব ঠিক হয়ে যাবে। ছোটবেলায় আমিও ওই তোর খোকার মতন ছিলুম–

বলে হাসতে লাগলেন। কিন্তু মেয়ের তখন বাবার সঙ্গে কথা বলবারও সময় ছিল না। ভাঁড়ারের চাবি যার শাড়ির আঁচলে তাকে সব দিকে নজর দিতে হয়। যাবার আগে বাবার থাকার ব্যবস্থা করে দিয়ে অন্য কাজে মন দিতে হলো। খোকা যখন বিয়ে করতে গেল সেদিনও গণ্ডগোলের সৃষ্টি হলো। প্রকাশকে কাছে ডাকলেন কীর্তিপদবাবু। জিজ্ঞেস করলেন–গোলমালটা কীসের প্রকাশ? খোকা কোথায় ছিল?

প্রকাশও তখন অনেক কাজে ব্যস্ত। কালীগঞ্জ থেকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে সদানন্দকে বাড়িতে নিয়ে এসেছে কোনও রকমে। তারপর বেলা করে গায়ে-হলুদ হয়েছে, যাত্রার জন্যে সবাই তৈরী হচ্ছে।

বললে–সে-সব আপনাকে পরে সব বলবো পিসেমশাই, সে অনেক কাণ্ড–এখন বলবার সময় নেই–

–অনেক কাণ্ড মানে?

প্রকাশ বললে–সদানন্দ এখন বায়না ধরেছে টাকা দিতে হবে, দশ হাজার টাকা দিলে তবে সে বিয়ে করতে যাবে–

দশ হাজার টাকা? দশ হাজার টাকা কাকে দেবে? নিজে নেবে?

–না।

–তবে কাকে দেবে?

–কালীগঞ্জের বউকে।

কীর্তিপদবাবু কিছুই বুঝতে পারলেন না। কালীগঞ্জের বউ আবার কে? খোকার বিয়ের সঙ্গে কালীগঞ্জের বউ-এর কীসের সম্পর্ক?

প্রকাশ বললে–পরে আপনাকে সব বুঝিয়ে বলবো, এখন আমার সময় নেই, দেরি হয়ে গেছে, আর দেরি হলে ট্রেন মিস করবো–

বলে প্রকাশ চলে গেল। তারপর শাঁখের শব্দ শোনা গেল। মেয়েদের উলু দেওয়ার শব্দ শোনা গেল। বর বিয়ে করতে চলে গেল। কীর্তিপদবাবু সবই দেখলেন, সবই শুনলেন।

এসব গতকালের ঘটনা। তারপর আজ নতুন বউ এসেছে। এসে নরনারায়ণ চৌধুরীর ঘরে গিয়ে তাঁকে প্রণাম করে এসেছে। কীর্তিপদবাবুকেও প্রণাম করেছে। বাড়িতে অনেক লোকজনের ভিড়। বাইরে শামিয়ানা খাটানো হচ্ছে। প্রীতির বিয়ের সময় ভাগলপুরে এমনি হয়েছিল। এমনি করেই হয়ত এক পুরুষ থেকে আর এক পুরুষে বংশের ধারা গড়িয়ে চলে।

হঠাৎ বেয়াই মশাই-এর ঘর থেকে চেঁচামেচি-চিৎকারের শব্দ হতেই তিনি যেন চমকে উঠলেন। বাইরে বেরিয়ে এলেন। কাউকে কোথাও দেখতে পেলেন না। কাকে জিজ্ঞেস করবেন বুঝতে পারলেন না। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হচ্ছে। সবাই নতুন বউকে দেখতেই ব্যস্ত। কিন্তু তখনও ওপরে চেঁচামেচি চলছে।

চৌধুরী মশাই বললেন–আমি কথা দিচ্ছি ফুলশয্যা মিটে গেলেই কালীগঞ্জের বউকে টাকা দিয়ে দেওয়া হবে। আমি নিজে তোমাকে কথা দিচ্ছি–

প্রকাশ মামা বললে–এবার হলো তো, এবার তাহলে তোর আর বলবার কিছু রইল না–তুই আর গোলমাল করিস নি—

নরনারায়ণ চৌধুরী অনেক কথা বলার পর ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন।

বললেন–তোমরা সবাই এখন যাও এখান থেকে আমার শরীর খারাপ লাগছে–

প্রকাশ মামা সদার দিকে চেয়ে বললে–চল্ চল্ এখান থেকে, দাদুকে আর বিরক্ত করিস নে। এখন তোর সব বায়না মিটলো তো।

সদানন্দ বললে–কিন্তু দাদু আগেও তো বলছিল টাকা দেবে, সে কথা কি রেখেছে?

–এবার ঠিক দেবে, আর একবার দ্যাখ। এবার না দিলে তোর যা ইচ্ছে তাই করিস।

সদানন্দর চোখ দিয়ে তখন কান্না বেরিয়ে আসছিল। ঘরের বাইরে যেতে যেতে বলতে লাগলো–জানো প্রাকাশ মামা, ও টাকা না দিতে পারলে আমি কালীগঞ্জের বউ এর কাছে মুখ দেখাতে পারবো না।

প্রকাশ মামা বললে–তা কালীগঞ্জের বউ-এর কাছে তোকে মুখ দেখাতে কে বলেছে? আর সে বুড়িই বা ক’দিন বাঁচবে? তারও তো আর বেশিদিন নেই।

সদানন্দ বললে–কিন্তু আমি? আমি নিজেকে কী বলে বোঝাব? আমার নিজের কাছেও তো আমার একটা দায়-দায়িত্ব আছে–

–তোর নিজের কাছে আবার কীসের দায়-দায়িত্ব? তুই বলছিস কী? এখন তুই বিয়ে করলি এখন যে কদিন বাঁচিস ফুর্তি করে যা! যতদিন তোর টাকা আছে কেবল পেট ভরে ফুর্তি করে যা। আমার যদি তোর মতন টাকা থাকতো দেখতিস আমি ফুর্তির ঘোড়দৌড় ছুটিয়ে দিতুম–

–না প্রকাশ মামা, তুমি জানো না, আমার দাদুর যত টাকা আছে, সব পাপের টাকা –

–পাপের টাকা? কী যা-তা বলছিস তুই?

সদানন্দ বললে–হাঁ, জানতে আমার কিছু বাকি নেই। কপিল পায়রাপোড়া গলায় দড়ি দিয়ে যে পাপ করছে, সে পাপ দাদুর। কালীগঞ্জের বউ-এর সর্বনাশ করেছে দাদু। মাখন ঘোষ, ফটিক প্রামাণিক, তাদেরও দাদু খুন করেছে। এই পাপের প্রায়শ্চিত্ত না করতে আমারও সুখ-ভোগ করবার কোনও অধিকার নেই

প্রকাশ মামা সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে বলল–তোর দেখছি লেখাপড়া শিখে মাথাটার একেবারে বারোটা বেজে গেছে। আমরা তোর জন্যে ভেবে ভেবে মরছি, কালকে লোকজনকে কেমনভাবে খাতির-যত্ন করবো সেই ভাবনায় আমরা সবাই অস্থির হয়ে যাচ্ছি, আর তুই কি না যত আবোল-তাবোল কথা নিয়ে মাথা খারাপ করছিস–

সদানন্দ বললেন,–না, তুমি জানো না প্রকাশ মামা, তোমরা কেউই বুঝতে পারবে না, আমি যা বলছি তা সকলের ভালোর জন্যেই বলছি–এতে তোমাদের সকলের ভালো হবে। কালীগঞ্জের বউকে টাকাটা না দিলে বরং আমাদের ক্ষতি–

-কী ক্ষতি হবে শুনি? ক্ষতিটা কী হবে?

সদানন্দ বললে–টাকাটা না দিলে আমাদের সব কিছু নষ্ট হয়ে যাবে।

–নষ্ট হয়ে যাবে মানে?

–আমাদের চৌধুরীবাড়িটা নষ্ট হয়ে যাবে। আমাদের এই নবাবগঞ্জ নষ্ট হয়ে যাবে। আমাদের এই দেশ আমাদের এই জাত নষ্ট হয়ে যাবে। আমরা সবাই মারা যাবো। তুমি আমি বাবা দাদু মা কাউকেই তাহলে আর বাঁচাতে পারবো না।

প্রকাশ মামা আর থাকতে পারলে না। বললে–তুই থাম দিকিনি। যত সব তোর বাজে কথা। সত্যিই লেখাপড়া শিখে তোর মাথার ব্যানো হয়েছে! তাই-ই যদি হতো তাহলে আর এতদিন পৃথিবী টিকে থাকতো না। জমিদারি চালাতে গেলে লাঠিবাজি খুনখারাবি না করলে চলে? চল, চল ও-সব কথা মাথায় ঢোকাস নি। ওসব যত ভাববি তত মাথাখারাপ হবে। তার চেয়ে চিরকাল সবাই যেমন করে এসেছে তেমনি করে যা, দেখবি তাতে অনেক আরাম। একটা জিনিস জেনে রাখিস ফুর্তির চেয়ে দুনিয়ায় বড় জিনিস আর কিছু নেই—

তখন আর প্রকাশ মামার নিজেরও দাঁড়াবার সময় নেই। সদানন্দ চলে যেতেই চৌধুরী মশাই কাছে এলেন।

বললেন কী হলো প্রকাশ, খোকাকে বোঝালে?

প্রকাশ বললে—হ্যাঁ–

–কী বললে খোকা? বুঝলো?

প্রকাশ মামা বললে–বুঝবে না? আমি সব বললুম বুঝিয়ে। বুঝিয়ে বললুম জমিদারি রাখতে গেলে লাঠিবাজি জালজোচ্চুরি না করলে জমিদারি থাকে? আর জমিদারির কথা না হয় ছেড়েই দিলুম, গভর্নমেন্ট চলে? গভর্নমেন্ট লাঠিবাজি করে না? গভর্নমেন্টও তো বন্দুকবাজি করে। কে না ওসব করে? ক্ষমতা রাখতে গেলে ওসব জালজোচ্চুরি করতেই হবে। আকবর বাদশা থেকে ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট পর্যন্ত সবাই ওই লাঠিবাজি বন্দুকবাজি করে এসেছে। তোর ঠাকুর্দা যা করেছে তোর দাদামশাইও তাই করেছে। না করলে এত সম্পত্তি আর এত জমির মালিক হওয়া যায়?

–তা শুনে কী বললে খোকা?

প্রকাশ বললে–কী আর বলবে? বলবার মুখ রইল না। বোবার মত চুপ করে শুধু শুনলো আমার কথাগুলো।

–তারপর?

প্রকাশ বললে–তারপর যখন বুঝলো তখন মাথা ঠাণ্ডা হলো। আসলে জামাইবাবু, অত লেখাপড়া শিখেই যত গণ্ডগোল হয়েছে। তার চেয়ে আমরা বেশ আছি। আমরা পেট পুরে খেলুম আর নাক ডাকিয়ে ঘুমোলুম। আমি দেখেছি মাথায় একটু বিদ্যে ঢুকলেই সব তালগোল পাকিয়ে যায়–

বলে আর সেখানে দাঁড়ালো না। শামিয়ানা খাটানো তখনও শেষ হয় নি। ওদিকে পুকুরের ধারে ভিয়েন চড়েছে। সেদিকেও তদারকি করতে যেতে হবে। আর একটু চোখের আড়াল হয়েই রসগোল্লা পানতুয়া টপাটপ দু’চারটে মুখে পুরে দেবে বেটারা।

আস্তে আস্তে সন্ধ্যে নেমে আসছিল। অগ্রহায়ণ মাসের বিকেল বেলা ছোট হয়ে আসতে শুরু করেছে। সন্ধ্যে হলেই হ্যাজাগ বাতি জ্বলে উঠবে উঠোনে। সমস্ত বাড়ির সামনে ভেতরে আলোয় আলো হয়ে উঠবে।

প্রকাশ মামারই যেন যত জ্বালা। বিয়ে করবে সদা আর জ্বলেপুড়ে মরবে প্রকাশ মামা। কেন রে বাপু? আমি কে? আমি গরীব মানুষ, আমার বিয়ের সময় এই এত জাঁকও হয় নি, এত জমকও হয় নি। তবু দিদি টাকা দিয়েছে, সেই টাকা দু’হাতে খরচ করার মধ্যেই যা সুখ। পকেটে হাত ঢুকিয়ে দিলেই হলো। করকরে নোট বেরিয়ে আসবে। সেই টাকার লোভেই সবাই খাতির করছে শালাবাবুকে। সবাই শালাবাবু বলতে অজ্ঞান। কদিন ধরে সবাই-ই একবার করে এসে প্রণাম করে যাচ্ছে। কাছে এসে পায়ে হাত দিয়ে বলছে-পেন্নাম হই শালাবাবু–

হঠাৎ প্রকাশ মামা সদরের দিকে চেয়ে চমকে উঠলো।

কে?

একটা পালকি এসে ঢুকলে সদরের বার বাড়িতে। পালকির চেহারা দেখেই প্রকাশ মামার চক্ষু চড়ক গাছ। কালীগঞ্জের বউ এলো নাকি?

আর কথাবার্তা নেই। প্রকাশ আর দাঁড়ালো না সেখানে। সোজা ভেতর বাড়িতে গিয়ে ঢুকলো। গিয়ে ডাকলে–দীনু, দীনু কোথায়, দীনু–

কাজের বাড়ি। সবাই-ই নাকে দড়ি দিয়ে খাটছে। অনেক ডাকাডাকির পর দীনু হাতের কাজ ফেলে এলো। প্রকাশ মামা বললে–দীনু, সিগগির কর্তাবাবুকে খবর দিয়ে এসো, কালীগঞ্জের বউ এসেছে–

–কালীগঞ্জের বউ?

নামটা শুনে দীনুরও যেন কেমন ভালো লাগলো না। আবার এসেছে মাগী!

–যাও, যাও খবরটা দিয়ে এসো শিগগির। তাড়াতাড়ি বিদেয় করে দেওয়া ভালো।

দীনু গিয়ে ওপরে খবরটা দিতেই কর্তাবাবু উঠে বসলেন। বললেন–কে? কে এসেছে বললি?

যেন বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হলো না দীনুর কথাটা।

দীনু আবার বললে–কালীগঞ্জের বউ।

নামটা শুনে নরনারায়ণ চৌধুরীর মুখ দিয়ে কিছুক্ষণ কোনও কথা বেরোল না। তিনি স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। আজ তাঁর নাতির বিয়ে আর আজকেই কিনা কালীগঞ্জের বউকে নবাবগঞ্জে আসতে হয়!

দীনু তখনও দাঁড়িয়ে আছে। কর্তাবাবু তার দিকে চেয়ে বললেন–তুই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিস কী?

দীনু বললে–তাঁকে কী বলবো তাই জিজ্ঞেস করছি–

সেকথার উত্তর না দিয়ে কর্তাবাবু কৈলাস গোমস্তার দিকে চাইলেন। বললেন–কৈলাস, কালীগঞ্জের বৌকে তুমি নেমন্তন্ন করেছিলে নাকি?

কৈলাস গোমস্তা বললে–আজ্ঞে না, আমি কেন নেমন্তন্ন করতে যাবো?

কর্তাবাবু সঙ্গে সঙ্গে দীনুর দিকে চাইলেন। বললেন–দীনু, যা তো একবার বংশী ঢালীকে ডেকে নিয়ে আয় তো, বংশী ঢালী আছে এখানে?

–আজ্ঞে হ্যাঁ, আমি ডেকে আনছি–

দীনু তাড়াতাড়ি চলে গেল। আর তার পরেই বংশী ঢালী এসে ঘরে ঢুকলো। মাথায় জড়ানো একটা লাল পাগড়ি। কালো কুচকুচে গায়ের রং। পরনের কাপড়টাকে বাসন্তী রং-এ ছুপিয়ে নিয়েছে।

বললে–কী হুকুম কর্তাবাবু?

কর্তাবাবু কৈলাস গোমস্তার দিকে চাইলেন। বললেন–কৈলাস, তুমি একবার বাইরে যাও তো। বংশীর সঙ্গে আমার একটা কাজের কথা আছে–দেখো, যেন এ সময়ে আমার ঘরে কেউ না ঢোকে—

কৈলাস গোমস্তা বাইরে চলে যেতেই কর্তাবাবু বংশীর দিকে চেয়ে বললেন–একটু কাছে সরে আয়, আমার মুখের কাছে–

বংশী কর্তাবাবুর মুখের কাছে মুখ নিয়ে গেল।

–একটা কাজ করতে পারবি বংশী? মোটা বখশিশ পাবি। কালীগঞ্জের বউ এসেছে, দেখেছিস তো? তাকে সরাতে হবে। পারবি? হবে তোর দ্বারা?

–পারবো হুজুর।

–কিন্তু দেখিস। খুব সাবধান, কেউ যেন জানতে না পারে! পারবি তো?

বংশী ঢালীকে এ-প্রশ্ন জিজ্ঞেস করা অবান্তর। তবু ঘটনার গুরত্বটা বোঝানোর জন্যেই বোধ হয় এই প্রশ্ন করলেন কর্তাবাবু।

বংশী ঢালী শুধু কর্তাবাবুরই নয়, এককালে কালীগঞ্জের জমিদারের লোক ছিল। কর্তাবাবু যখন এখানে এই নবাবগঞ্জে আসেন তখন বংশী ঢালীও তার সঙ্গে এসেছিল। এইটেই তার পেশা, এইটেই তার নেশা। তাই এ ধরনের কোনও কাজে না বলার অভ্যেস তার নেই। বরং কাজ না পেলেই যেন সে অখুশী হয়। তখন তার শরীর ভালো থাকে না, হজম হয় না, ঘুম হয় না, গা ম্যাজম্যাজ করে।

এবার এতদিন পরে কর্তাবাবুর মুখে কাজের কথা শুনে বংশী বেশ সতেজ হয়ে উঠলো। বললে–বলুন কর্তাবাবু কী কাজ, নিজের জান দিয়ে আপনার কাজ করে দেব–

কর্তাবাবু বললেন–খুব সাবধানে করতে হবে কিন্তু, কেউ যেন জানতে না পারে।

কথাটা শুনে বংশীর যেন অপমান বোধ হলো। বললে–আগে কি কখনও অসাবধান হয়েছি যে আপনি ওকথা বলছেন?

কর্তাবাবু নিজেকে শুধরে নিলেন। সত্যিই তো, বংশী ঢালীকেই যদি তিনি অবিশ্বাস করেন তাহলে তো তার নিজেকেই অবিশ্বাস করতে হয়। বললেন–ওরে, তা বলছি নে। বলছি আবার একটা ঝামেলা হয়েছে, সেই ঝামেলাটা তোকে কাটাতে হবে–

–বলুন না কাকে খতম করতে হবে?

কর্তাবাবু বললেন–এই এখখুনি খবর পেলাম কালীগঞ্জের বৌ নাকি এসেছে–

–তা যাচ্ছি আমি, এখুনি খতম করে দিচ্ছি–

–কী করে খতম করবি? সবাই যে জানতে পারবে। আজ যে কুটুমবাড়ির লোকজন এসেছে সব–

বংশী ঢালীর মুখটা একটা পৈশাচিক আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। মাথায় লাল কাপড়ে বাঁধা পাগড়িটা খুলে আর একবার জমপেশ করে বেঁধে নিলে। তারপর এক লাফে ঘরের বাইরে চলে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *