১১.
কিছু কিছু ক্ষেত্রে, ওয়ি কঠোর নীতি পরায়ণ। (সব সেক্টরের বেলায়ই কথাটা সত্যি, তবে সেক্টর ভেদে মাত্রাটা কম বেশী হয়ে থাকে)। এখানে উত্তেজক পানীয়তে এ্যালকোহল থাকে না, তবে দেহ-মন চাঙ্গা করার জন্য অন্য ধরনের কৃত্রিম উপাদান মেশানো হয়। স্বাদ পছন্দ হলো না রাইখের, তবে সুবিধা এই যে গ্লাসে ছোট ছোট চুমুক দিয়ে সময় কাটাতে পারবে এবং চারপাশে লক্ষ্য রাখতে পারবে।
কয়েক টেবিল পরে এক তরুণীর চোখে চোখ আটকে গেল তার। দৃষ্টি ফিরিয়ে নিতে কষ্ট হলো। মেয়েটা যথেষ্ট সুন্দরী। পরিষ্কার বোঝা গেল সব ক্ষেত্রে ওয়ি নীতি পরায়ণ নয়।
কিছুক্ষণ পরে মেয়েটা মৃদু হেসে উঠে দাঁড়াল। এগিয়ে আসতে লাগল রাইখের টেবিলের দিকে আর রাইখ সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকে দেখতে লাগল। (বিরক্ত হয়ে ভাবল রাইখ) এই মুহূর্তে অন্য কোনো বিষয়ে জড়াতে পারবে না।
রাইখের টেবিলের কাছে এসে একটু থামল মেয়েটা। তারপর সংযুক্ত চেয়ারে বসল।
“হ্যালো,” মেয়েটা বলল। “তোমাকে আগে কখনো দেখিনি।” হাসল রাইখ। “না দেখারই কথা। এখানে যারা নিয়মিত আসে তাদের সবাইকে তুমি চেন?”
“মোটামুটি,” বিব্রত না হয়েই জবাব দিল মেয়েটা। “আমার নাম মানীলা। তোমার?”
রাইখ সম্ভবত নিজের উপর এতো করুণা বোধ করেনি কখনো। মেয়েটা যথেষ্ট লম্বা, রাইখ উঁচু হিলের জুতা পরেছে তারপরেও মেয়েটা লম্বায় তাকে ছাড়িয়ে যাবে লম্বা মেয়ে রাইখের সবসময়ই পছন্দ–ফর্সা গায়ের রং, ঢেউ খেলানো লম্বা মসৃণ চুল, তাতে লালচে ছোঁয়া। পোশাক আশাকে তেমন আভিজাত্য নেই তবে একটু চেষ্টা করলেই গায়ে খেটে খাওয়া শ্রেণীর নয় বরং মোটামুটি অভিজাত মহিলা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে।
“নাম জেনে কি হবে,” রাইখ বলল। “আমার কাছে কোনো ক্রেডিট নেই।”
“ওহ, খুব খারাপ।” হতাশ হলো মানীলা। “যোগাড় করতে পারবে না?”
“করতে তো চাই। কাজ দরকার। তোমার কাছে কোনো খোঁজ আছে?”
“কি ধরনের কাজ?”
কাঁধ নাড়ল রাইখ। “তেমন কোনো অভিজ্ঞতা নেই, তবে যে কোনো কিছু হলেই চলবে।”
মানীলা তার দিকে চিন্তিত দৃষ্টিতে তাকালো। “শোনো জনাব নামহীন। মাঝে মাঝে ক্রেডিট ছাড়াও কাজ হয়।”
জমে গেল রাইখ। মেয়েদের ব্যাপারে তার ভাগ্যটা বরাবরই ভালো, কিন্তু সেটা তার গোঁফের কারণে–গোঁফ। তার বালক সুলভ চেহারায় এই মেয়েটা কি পেয়েছে?
সে বলল, “আসলে আমার এক বন্ধু ওয়িতে থাকত। কয়েক সপ্তাহ আগেও ছিল, কিন্তু এসে আর তাকে খুঁজে পাচ্ছি না। যেহেতু এখানে যারা নিয়মিত আসে তাদের প্রায় সবাইকে তুমি চেন, হয়তো বলতে পারবে। আমার বন্ধুর নাম কাসপালভ।” গলা সামান্য চড়াল রাইখ, “কাসপাল কাসপালভ।”
মানীলা শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে মাথা নাড়ল। “এই নামের কাউকে চিনি না।”
“খুব খারাপ, সে জোরামাইট ছিল, আমিও।” আবারও শূন্য দৃষ্টি। “জোরামাইট কি তুমি জান?”
মাথা নাড়ল সে। “না, শব্দটা শুনেছি কিন্তু অর্থ জানি না। কোনো ধরনের কাজ?”
হতাশা ঘিরে ধরল রাইখকে। “ব্যাখ্যা করতে অনেক সময় লাগবে।”
আলোচনা শেষ করার সুরে বলল রাইখ। কিছুক্ষণ অনিশ্চয়তার পর মানীলা চলে গেল। যাওয়ার সময় তার মুখে হাসি ছিল না এবং রাইখ একটা ব্যাপার লক্ষ্য করে অবাক হলো যে সে যতক্ষণ চেয়েছে মানীলা ঠিক ততক্ষণই ছিল।
(বেশ, সেলডন তো বলেছেনই মানুষকে আকৃষ্ট করে রাখার ক্ষমতা আছে। রাইখের–কিন্তু সেটা নিশ্চয়ই এই ধরনের ব্যবসায়িক মেয়েদের বেলায় খাটে না। কারণ ওদের কাছে পাওনা বুঝে নেয়াটাই আসল কথা।)।
নিজের অজান্তেই তার দৃষ্টি মানীলাকে অনুসরণ করতে লাগল। আরেকটা টেবিলের সামনে থেমেছে সে। ওই টেবিলের লোকটা মাত্র মধ্য বয়সে পা দিয়েছে, চুলের রং মাখন হলুদ, খাড়া পিঠ। মসৃণ কামানো মুখ তবে রাইখের মতে লোকটার সম্ভবত দাড়ি ছিল কারণ থুতনির এলোমেলো কাঠামো প্রকট।
এই লোকটার সাথেও মানীলার ভাগ্য খুলল না। দুই একটা বাক্য বিনিময়ের পরেই সে চলে গেল। তবে হতাশ হওয়ার কিছু নেই, কারণ মেয়েটা নিঃসন্দেহে আকর্ষণীয়।
গভীর চিন্তায় ডুবে গেল রাইখ, হঠাৎ টের পেল সামনের চেয়ারে কেউ বসেছে। এবার একজন পুরুষমানুষ। সত্যি কথা বলতে কি এ সেই লোক যার সাথে মানীলা একটু আগে কথা বলেছে।
লোকটার দৃষ্টিতে কৌতূহল। “একটু আগে তুমি আমার এক বন্ধুর সাথে কথা বলছিলে।”
বিনা প্রচেষ্টাতেই হাসতে পারল রাইখ। “খুব ভালো মেয়ে।”
“হ্যাঁ এবং আমার খুব ভালো একজন বন্ধু। তোমাদের সব কথা শুনেছি।”
“আশা করি কোনো ভুল করি নি।”
“মোটেই না, কিন্তু নিজেকে তুমি একজন জোরামাইট বলে দাবী করছ।” ।
রাইখের হৃৎপিণ্ড লাফিয়ে উঠল। মানীলাকে বলা কথাগুলো শেষ পর্যন্ত জায়গামতো আঘাত করেছে। সে যে কথাগুলো বলেছে মানীলার কাছে তা অর্থহীন কিন্তু তার বন্ধুর কাছে মনে হয় যথেষ্ট অর্থ বহন করে।
তার মানে কি এই যে, সে একটা পথ খুঁজে পেয়েছে? নাকি সমস্যা মাত্র শুরু হলো?
.
১২.
সামনে বসা আগম্ভককে বোঝার চেষ্টা করছে রাইখ, তবে নিজের চেহারায় কোনো ভাব ফুটে উঠতে দিল না। লোকটার তীক্ষ্ণ সবুজ চোখ আর ডানহাতটা বিপজ্জনক ভঙ্গীতে মুষ্ঠিবদ্ধ করে টেবিলের উপর ফেলে রেখেছে।
গম্ভীরভাবে অপেক্ষা করছে রাইখ।
লোকটা আবার জিজ্ঞেস করল, “নিজেকে তুমি জোরানুমাইট বলছ।”
চেহারায় অস্বস্তি ফুটে উঠতে দিল রাইখ। পরিস্থিতির কারণে খুব একটা কষ্ট হলো না। “কেন জিজ্ঞেস করছ, মিস্টার?”
“কারণ, আমার মনে হয় না তোমার বয়স খুব বেশী।”
“আমার যথেষ্ট বয়স হয়েছে। জোরানিউমের ভাষণ আমি হলোভশনে সবসময়ই শুনতাম।”
“দুই একটা শোনাতে পারবে?”
কাঁধ ঝাঁকাল রাইখ। “না, কিন্তু মূল বক্তব্যটা বুঝতে পেরেছি।”
“তোমার সাহস খুব বেশী, নিজেকে খোলাখুলি জোরানুমাইট বলে পরিচয় দিচ্ছ। অনেকেই তাদেরকে পছন্দ করে না।”
“শুনেছি ওয়িতে অনেক জোরামাইট আছে।”
“হতে পারে। সেজন্যই এখানে এসেছ?”
“আমি কাজ খুঁজছি। আর হয়তো একজন জোরামাইটই আমাকে সাহায্য করতে পারবে।”
“ডাহুলেও অনেক জোরানুমাইট আছে। তুমি কোত্থেকে এসেছ?” নিঃসন্দেহে রাইখের বাচনভঙ্গী চিনতে পেরেছে সে। লুকিয়ে রাখা অসম্ভব।
“জন্মেছি মিলিমারুতে, তবে বাড়ন্ত বয়সের অধিকাংশ সময় কেটেছে ডাহলে।”
“কি করতে?”
“তেমন কিছুই না। কিছুদিন স্কুলে গিয়েছিলাম।”
“আর তুমি কেন জোরামাইট?”।
নিজেকে খানিকটা উত্তেজিত হতে দিল রাইখ। দারিদ্র পীড়িত, ভাগ্যবঞ্চিত ডাহলের অধিবাসী বলেই সে জোরামাইট এটা যে সত্যি নয় তা প্রমাণ করার জন্য বলল, “কারণ আমি মনে করি এম্পায়ারের শাসন ব্যবস্থা হওয়া উচিত আরো প্রতিনিধিত্বমূলক, জনগণের অধিকতর অংশগ্রহণ এবং প্রতিটি সেক্টর আর বিশ্বের সমান অধিকার নিশ্চিত করা। বিবেচক প্রতিটি মানুষই কি এভাবে চিন্তা করবে না?”
“এবং তুমি সম্রাটের শাসনের অবসান চাও?”
থমকাল রাইখ। নিজের খেয়াল খুশি মতো অনেক কথাই বলতে পারে যে কেউ কিন্তু সম্রাটের বিরুদ্ধে কিছু বলাটা নিঃসন্দেহে বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে। সে বলল, “এমন কিছু তো কই নাই। সম্রাটরে আমি বিশ্বাস করি, কিন্তু এতবড় একটা এম্পায়ার চালানো একজন মানুষের জইন্য কঠিন।”
“একজন মানুষ তো চালাচ্ছে না। পুরো একটা ইম্পেরিয়াল আমলাতন্ত্র রয়েছে। ফাস্ট মিনিস্টার হ্যারি সেলডনের বিষয়ে তোমার কি ধারণা?”
“কোনো ধারণা নেই। ওর ব্যাপারে কিছুই জানি না।”
“শুধু জান যে প্রশাসন চালানোর জন্য জনমতের উপর আরো বেশী গুরুত্ব দেয়া উচিত, ঠিক না?”
চেহারায় দ্বিধাগ্রস্ততা ফুটে উঠতে দিল রাইখ। “জো-জো-জোরানিউম এই কথাগুলোই বলত। তুমি এটাকে কি বলবে আমি জানি না। অনেকেই এটাকে বলে ‘গণতন্ত্র, কিন্তু আমি এর অর্থ জানি না।”
“অনেক বিশ্বই গণতন্ত্র চেষ্টা করে দেখেছে। অনেক বিশ্ব এখনো চেষ্টা করছে। আমি জানি না ওই বিশ্বগুলো অন্যান্য বিশ্ব থেকে ভালোভাবে চলতে পারছে কিনা। তো তুমি একজন গণতন্ত্রী?”
“তাহলে এটাকে তুমি বলছ গণতন্ত্র?” এবার নিজেকে গভীর চিন্তায় ডুবে যেতে দিল রাইখ। “তবে জোরানুমাইট হিসেবেই আমি অনেক বেশী স্বস্তি বোধ করি।”
“অবশ্যই একজন ডালাইট–”
“ওখানে আমি অল্প কিছুদিন ছিলাম।”
“–তুমি মানুষের সমান অধিকারে বিশ্বাস কর। ডাহ্লাইটরা বঞ্চিত জনগোষ্ঠী হওয়ার কারণে স্বাভাবিকভাবেই এইসব উঁচুদরের মতবাদে বিশ্বাস করে।”
“শুনেছি ওয়িতে জোরানুমাইট মতবাদ অত্যন্ত জনপ্রিয়। তারা তো বঞ্চিত নয়।”
“ভিন্ন কারণে। ওয়ির পুরনো মেয়ররা সবাই সম্রাট হতে চেয়েছিল। কথাটা তুমি জানো?”
মাথা নাড়ল রাইখ।
“আঠার বছর আগে, মেয়র রিশেলি একটা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে লক্ষ্যের প্রায় কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল। কাজেই ওয়িয়ানরা আসলে বিদ্রোহী, শুধুমাত্র ক্লীয়নের বিরোধীতা করার জন্যই জোরামাইট।”
“এইগুলান আমি কখনো শুনিনাই। আমি সম্রাটের বিপক্ষে না।”
“কিন্তু তুমি জনগণের প্রতিনিধিত্বে বিশ্বাস কর, তাই না? তোমার কি মনে হয় একটা নির্বাচিত সংসদ রাজনৈতিক কোন্দল আর দলীয় স্বার্থ ছাড়া গ্যালাকটিক এম্পায়ার চালাতে পারবে?”
“হাহ? কিছুই বুঝতে পারছি না।”
“তোমার কি মনে হয় প্রয়োজনের মুহূর্তে অনেকগুলো মানুষ দ্রুত সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারবে? নাকি তারা বসে বসে তর্ক বিতর্ক করবে?”
“আমি জানি না। কিন্তু মাত্র অল্প কয়েকজন মানুষের হাতে সবগুলো বিশ্বের ভাগ্য নির্ধারণের দায়িত্ব থাকবে সেটাও ঠিক মনে হয় না।”
“এই বিশ্বাস রক্ষা করার জন্য তুমি লড়াই করতে পারবে? নাকি তুমি শুধু এগুলো নিয়ে কথা বলতেই পছন্দ কর?”
“কেউ আমাকে কখনো কিছু করতে বলে নি।”
“ধরো তোমাকে বলা হলো। গণতন্ত্র অথবা জোরামাইট দর্শন–এই বিশ্বাসগুলো তোমার কাছে কতখানি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়?”
“আমি এর জন্য লড়াই করব–যদি বুঝতে পারি যে তাতে কোনো লাভ হবে।”
“তোমার সাহস আছে। তাহলে ওয়িতে এসেছ নিজের বিশ্বাসের পক্ষে লড়াই করার জন্য?”
“না,” অস্বস্তির সাথে বলল রাইখ। “এইভাবে বলাটা ঠিক হবে না। কাজের খোঁজে এসেছি। এই সময়ে কাজ খুইজা পাওয়াটা কঠিন–আর আমার কাছে ক্রেডিট নেই। মানুষরে বাঁচতে হয়।”
“আমি একমত। তোমার নাম কি?”
পূর্ব সতর্কতা ছাড়াই প্রশ্নটা করা হলো কিন্তু প্রস্তুত ছিল রাইখ। “আমার নাম প্ল্যানচেট।”
“প্রথম না শেষ নাম?”
“একটাই নাম আমার।”
“তোমার কাছে কোনো ক্রেডিট নেই এবং সম্ভবত খুব বেশী শিক্ষিতও নও।”
“হ্যাঁ।”
“বিশেষ ধরনের কাজ করার কোনো অভিজ্ঞতা নেই?”
“কাজের তেমন সুযোগ পাইনি, তবে আমি আগ্রহী।”
“ঠিক আছে, প্ল্যানচেট। ব্যবস্থা হয়তো করতে পারব।” লোকটা পকেট থেকে তিন কোণা একটা বস্তু বের করে এমনভাবে চাপল যেন ওটাতে কোনো লেখা ছাপাচ্ছে। তারপর ওটার উপর বুড়ো আঙ্গুল বুলিয়ে থামিয়ে দিল। “কোথায় যেতে হবে বলে দিচ্ছি। এটা সাথে রাখ, হয়তো কাজের একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে।”
কার্ডটা হাতে নিয়ে দেখল রাইখ। লেখাগুলো সম্ভবত ফ্লুরোসেন্ট, পড়া যাচ্ছে না। ক্লান্তভাবে লোকটার দিক তাকাল, “কেউ যদি মনে করে যে আমি এটা চুরি করেছি?”
“এই কার্ড চুরি করা যাবে না। আমার সিগনেচার দেয়া আছে আর তোমার নাম লিখে দিয়েছি।”
“যদি তোমার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করে?”
“করবে না।–তোমার কাজ দরকার। এটাই তোমার সুযোগ, যদিও একশভাগ নিশ্চয়তা দিতে পারব না” আরেকটা কার্ড বের করে দিল সে,”কোথায় যেতে হবে এখানে লেখা আছে।” এই লেখাগুলো রাইখ পড়তে পারল।
“ধন্যবাদ।”
হাতের ইশারায় বিষয়টা উড়িয়ে দেয়ার ভঙ্গী করল লোকটা।
চলে যাওয়ার জন্য উঠল রাইখ–বুঝতে পারছে না কোথায় ঝাঁপিয়ে পড়তে যাচ্ছে।
.
১৩.
উঠছে বসছে। উঠছে বসছে। উঠছে বসছে।
গ্লেব এডোরিন অনেকক্ষণ থেকেই গ্যাম্বল ডীন নামাত্রির ক্লান্তিকর পায়চারী দেখছে। নিঃসন্দেহে ভেতরের হিংস্র অস্থিরতা তাকে স্থির হয়ে বসতে দিচ্ছে না।
এডোরিন ভাবছে : নামাত্রি এম্পায়ারের সবচেয়ে ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ এই কথা কেউ কোনোদিন বলবে না, এমনকি তাদের আন্দোলনেও সে অনেকখানি ব্যক্তিত্বহীন, সে বদমেজাজী এবং যুক্তি দিয়ে চিন্তা করতে পারে না। খুব সহজেই তাকে থামানো যেতে পারে। কিন্তু সে আমাদের বাকী সবার চেয়ে অনেক বেশী নাছোড়বান্দা। অমরা হাল ছেড়ে দেব, কিন্তু সে ছাড়বে না। ধাক্কা মেরে টেনেহিঁচড়ে, লাথি মেরে সামনের বাধা ভেঙ্গে এগিয়ে যাবে। হয়তো আমাদের এমন মানুষই দরকার। হয়তো নয়, অবশ্যই দরকার আর নয়তো কিছুই অর্জিত হবে না।
নামাত্রি থামল, বুঝতে পারছে এন্ডোরিনের দৃষ্টি তার পিঠে আঠার মতো লেগে আছে। ঘুরে বলল, “কাসপালভের বিষয়ে যদি আবার লেকচার দেয়ার ইচ্ছে থাকে তাহলে ভুলে যাও। শুধু শুধু কষ্ট করো না।”
হালকা নিরাসক্ত ভঙ্গীতে কাঁধ ঝাঁকাল এন্ডোরিন। “লেকচার দিয়ে আর কি হবে? যা হবার তা হয়ে গেছে। ক্ষতি যা হতে পারে তাও হয়ে গেছে।”
“কিসের ক্ষতি, এডোরিন? কিসের ক্ষতি? এই পদক্ষেপ না নিলে সেই আমাদের ক্ষতি করত। লোকটা বিশ্বাসঘাতকতা করতে শুরু করেছিল। এক মাসের মধ্যেই সে—”
“জানি। আমিও ছিলাম ওখানে। কি বলেছে শুনেছি।”
“কাজেই তুমি বুঝতে পারছ যে কোনো উপায় ছিল না। কোনো উপায় ছিল না। তুমি নিশ্চয় বিশ্বাস কর যে পুরনো একজন কমরেডকে খুন করে আমার খুব ভালো লাগছে? আসলে আমার কোনো উপায় ছিল না।”
“বুঝলাম। তোমার কোনো উপায় ছিল না।”
আবার পায়চারী শুরু করল নামাত্রি। আবার থামল, ঘুরে জিজ্ঞেস করল, “এডোরিন, তুমি ঈশ্বরে বিশ্বাস কর?”
প্রশ্নটা বুঝতে না পেরে তাকিয়ে রইল এডোরিন। “কি বিশ্বাস করি?”
“ঈশ্বর।”
“কোনোদিন শুনিনি। কি জিনিস?”
“শব্দটা গ্যালাকটিক স্ট্যান্ডার্ড নয়। অতিপ্রাকৃতিক শক্তি। এই শব্দটা কেমন?”
“ও, অতি প্রাকৃতিক শক্তি। আগে বলনি কেন? না, এগুলো আমি বিশ্বাস করি না। সাধারণত: প্রকৃতির নিয়মের বাইরে কিছু থাকলে সেটাকেই অতিপ্রাকৃতিক শক্তি হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়, কিন্তু আসলে কোনোকিছুই প্রকৃতির নিয়মের বাইরে নয়। তুমি কি আধ্যাত্মিকতায় বিশ্বাস করতে শুরু করেছ?” প্রশ্নটা এমন ভাবে করল যেন ঠাট্টা করছে কিন্তু তার চোখের ভাষা ছিল অন্যরকম।
নামাত্রি তাকে চোখ নামিয়ে নিতে বাধ্য করল। ওই অসম্ভব ধারালো দৃষ্টির সামনে কেউই টিকতে পারে না। “বোকার মতো কথা বলো না। আমি বিষয়টা নিয়ে পড়াশোনা করছি। কোটি কোটি মানুষ অতিন্দ্রীয় ক্ষমতায় বিশ্বাস করে।”
“জানি। সবসময়ই করত।”
“মানুষ এগুলো বিশ্বাস করে আসছে ইতিহাস শুরু হওয়ারও অনেক আগে থেকে। ঈশ্বর’ শব্দটার উৎপত্তি অজানা। প্রাগৈতিহাসিক কোনো ভাষা থেকে এসেছে যার উৎস কোথায় আমরা জানি না, শুধু শব্দটা জানি। তুমি জানো বিভিন্নরকম কতগুলো ঈশ্বর বিশ্বাস প্রচলিত আছে?
“আমার অনুমান গ্যালাক্সিতে যতগুলো বোকা আছে ঠিক ততগুলো।”
মন্তব্যটা এড়িয়ে গেল নামাত্রি। “অনেকের মতে শব্দটার উৎপত্তি সেই সময়ে যখন সমগ্র মানবজাতি একটা মাত্র গ্রহে বাস করত।”
“এটা নিজেই একটা পৌরাণিক ধারণা। অতিন্দ্রীয় ক্ষমতায় বিশ্বাসের মতোই আরেকটা পাগলামী। মানুষের আদিগ্রহ কখনোই একটা হতে পারে না।”
“হতেই হবে, এন্ডোরিন, বিরক্ত সুরে বলল নামাত্রি। “ভিন্ন ভিন্ন গ্রহে বিবর্তিত হলে মানবজাতি একটা একক প্রজাতি হিসেবে গড়ে উঠতে পারত না।”
“তারপরেও, ওই ধরনের কোনো গ্রহ খুঁজে পাওয়া যাবে না, সংজ্ঞায়িত করা যাবে না, যুক্তিসহকারে ব্যাখ্যা করা যাবে না, কাজেই বলা যায় ওই ধরনের কোনো গ্রহ নেই।”
“এই ঈশ্বররা,” নামাত্রি তার ভাবনা না পাল্টিয়েই বলে যেতে লাগল, “মানবজাতিকে রক্ষা করত, নিরাপদে রাখত অথবা অন্তত সেই মানুষগুলো নিরাপদে থাকত যারা জানত ঈশ্বরদের কিভাবে ব্যবহার করতে হয়। সেই সময়ে যখন মানুষ মাত্র একটা গ্রহেই বাস করত, তখন তাদের দায়িত্ব ছিল মাত্র একটা গ্রহ এবং সেই গ্রহের অল্প কয়েকজন মানুষকে রক্ষা করা যেন ওরা ছিল বড় ভাই বা অংশীদার।”
“কি দয়ালু ছিল ওরা। পুরো এম্পায়ার কিভাবে সামলায় আমি তা দেখতে চাই।”
“যদি পারে? যদি ওদের সংখ্যা হয় অগণিত?”
“যদি নক্ষত্রগুলো জমে বরফ হয়ে যায়? এতগুলো যদি ব্যবহার করে কি লাভ?”
“আমি শুধু একটু হিসাব নিকাশ করছি। ভাবছি। তুমি কি কখনো চিন্তাভাবনা প্রসারিত কর না? সবসময়ই মনে লাগাম বেঁধে রাখ?”
“আমার মতে লাগাম ধরে রাখাটাই সবচেয়ে নিরাপদ। তোমার লাগামহীন মন তোমাকে কি বলল, চীফ?”
নামাত্রির চোখ জ্বলে উঠল, ধরে নিয়েছে তাকে নিয়ে ঠাট্টা করা
নামাত্রি বলল, “আমার মন যা বলছে তা হলো–যদি ঈশ্বর বলে কিছু থেকেই থাকে, তারা আমাদের পক্ষে আছে।”
“চমৎকার।–যদি সত্যি হয়। কি প্রমাণ আছে?”
“প্রমাণ? ঈশ্বর না থাকলে, আমার মতে পুরোটাই একটা কো-ইন্সিডেন্স, তবে অত্যন্ত চমৎকার।” আচমকা হাই তুলে বসে পড়ল নামাত্রি, তাকে ভীষণ পরিশ্রান্ত দেখাচ্ছে।
ভালো, এন্ডোরিন ভাবল। খ্যাপাটে লোকটা একটু শান্ত হয়েছে, এখন হয়তো যুক্তির সাথে কথা বলতে পারে।
“ট্র্যানটরের অবকাঠামোতে যে অভ্যন্তরীণ অচলাবস্থা চলছে-” অত্যন্ত নীচু গলায় বলল নামাত্রি।
এডোরিন তাকে বক্তব্য শেষ করতে না দিয়ে বলল, “চীফ, কাসপালভ আসলে পুরোপুরি ভুল বলে নি। যত বেশীদিন এই খেলা আমরা চালিয়ে যাব ইম্পেরিয়াল ফোর্সের মূল কারণটা বের করে ফেলার সম্ভাবনাও তত বেশী। একদিন না একদিন এই প্রজেক্ট আমাদের মুখের উপরই বিস্ফারিত হবে।”
“পরিস্থিতি এখনো সেই পর্যায়ে পৌঁছায়নি, এখনো এর দায় ইম্পেরিয়ালদের উপরই পড়ছে। ট্রানটরের পুঞ্জিভূত অসন্তোষ আমি টের পাচ্ছি।” হাত তুলে আঙ্গুলের ফাঁকে আঙ্গুল ঢুকিয়ে বসল। “আমি অনুভব করতে পারছি। এবং আমরা সঠিক পথেই এগোচ্ছি। পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়ার জন্য তৈরি।”
রসকষহীন ভঙ্গীতে হাসল এডোরিন। “আমি তোমার কাছ থেকে বিস্তারিত জানতে চাই না, চীফ। কাসপালভ বুঝতে পারে নি তার পরিণতি কি হবে। আমি কাসপালভ নই।”
“সত্যি কথা বলতে কি তুমি কাসপালভ নও বলেই তোমাকে আমি বলতে পারি। তাছাড়া এখন আমি যা জানি তখন সেটা জানতাম না।”
“আমার ধারণা, নিজের মুখে যা বলছে তার অর্ধেকও বিশ্বাস করে না এন্ডোরিন, “তুমি ইম্পেরিয়াল প্যালেস গ্রাউণ্ডে হামলা করার কথা ভাবছ।”
“অবশ্যই। আর কি করার আছে? অবশ্য গ্রাউণ্ডে অনুপ্রবেশ করাটা একটা সমস্যা। খবর পাঠানোর জন্য ওখানে আমার লোক আছে, কিন্তু ওরা সাধারণ গুপ্তচর। ওখানে একজন দক্ষ লোক দরকার।”
“গ্যালাক্সির সবচাইতে কঠিন নিরাপত্তাবেস্টিত অঞ্চলে নিজেদের একজন দক্ষ এজেন্টকে অনুপ্রবেশ করানো সহজ নয়।”
“অবশ্যই নয়। এখন পর্যন্ত এটাই ছিল আমার মাথাব্যথা–তখনই ঈশ্বররা নাক গলালেন।”
নরম সুরে এডোরিন বলল, (বিরক্তির ভাবটা লুকিয়ে রাখার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করতে হলো তাকে), “ঐশ্বরিক দর্শন নিয়ে আলোচনা করার কোনো প্রয়োজন আছে বলে আমার মনে হয় না। কি ঘটেছে সেটা বল–ঈশ্বরদের আলোচনা এখন থাক।”
“আমার প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী সকলের প্রিয় এবং মহানুভব সম্রাট প্রথম ক্লীয়ন একজন নতুন চীফ গার্ডেনার নিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সিকি শতাব্দীর মাঝে এই প্রথম।”
“তাতে কি হয়েছে?”
“কিছুই বুঝতে পারছ না?”
কিছুক্ষণ ভাবল এন্ডোরিন। “আমি বোধহয় ঈশ্বরদের প্রিয় পাত্র নই। কিছুই বুঝতে পারছি না।”
“যদি তুমি নতুন চীফ গার্ডেনার নিয়োগ কর, এন্ডোরিন, পরিস্থিতি অন্য যে কোনো উচ্চপদস্থ প্রশাসক নিয়োগের মতোই–নতুন ফার্স্ট মিনিস্টার বা নতুন সম্রাট ক্ষমতায় বসলে যে পরিস্থিতি হয় ঠিক সেরকম। নতুন চীফ গার্ডেনার অবশ্যই তার নিজের পছন্দের লোকদের নিয়োগ করবে। পুরনো যাদেরকে তার মনে হবে অকেজো তাদেরকে অবসর নিতে বাধ্য করবে এবং তরুণ আর উদ্যমী নতুনদের নিয়োগ দেবে।”
“হতে পারে।”
“হতে পারে না, এরকমই হয়। বর্তমান চীফ গার্ডেনার দায়িত্ব নেয়ার সময় হয়েছে, তার পূর্বসূরির বেলায়ও হয়েছে, এভাবেই হয়ে আসছে। আউটার ওয়ার্ল্ডগুলো থেকে শয়ে শয়ে কর্মী–”
“আউটার ওয়ার্ল্ড থেকে কেন?”
“বুদ্ধি খাটাও, এন্ডোরিন–যদি থাকে। বাগানের ব্যাপারে কি জানে ট্র্যানটরিয়ানরা? তারা সারাজীবন বাস করে গম্বুজের ভেতরে, কৃত্রিম উপায়ে তৈরি করা গাছপালা, চিড়িয়াখানা, শস্যখেত আর ফলের গাছ দেখে জীবন কাটিয়ে দেয়। বুনো প্রকৃতির ব্যাপারে কি জানে তারা?”
“আচ্ছা। এবার বুঝতে পারছি।”
“বাছাই প্রক্রিয়ার সুবাদে প্রচুর নতুন লোক গ্রাউণ্ডে ঢোকার সুযোগ পাবে। অবশ্যই সবার ব্যাপারে নিখুঁতভাবে খোঁজখবর করা হবে, তবে ট্র্যানটরিয়ানদের। বেলায় যতটা করা হতো অন্যদের বেলায় তা হবে না। তার মানে আমাদের কিছু কর্মী ছদ্ম পরিচয়ে অনুপ্রবেশ করতে সক্ষম হবে। কিছু হয়তো ধরা পড়বে, দুএকজন। ঠিকই ফাঁক গলে ঢুকে যেতে পারবে কোনো সন্দেহ নেই। ফার্স্ট মিনিস্টার সেলডন। (থুতু ফেলার মতো করে নামটা উচ্চারণ করল সে) দায়িত্বে আসার পর যে ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালানো হয়েছিল, তারপর যে কঠিন নিরাপত্তা ব্যবস্থা তৈরি হয়েছে তা সত্ত্বেও আমাদের কিছু এজেন্ট অনুপ্রবেশ করতে পারবে।”
এবার এডোরিন ক্লান্ত বোধ করল, তার মনে হচ্ছে সে একটা প্যাঁচের মধ্যে পড়ে গেছে যেখান থেকে আর বেরোতে পারছে না। হয়তো আমার মুখে কথাগুলো অদ্ভুত শোনাবে, চীফ, কিন্তু এই ‘ঈশ্বরদের’ বোধহয় আসলেই কিছুটা হাত আছে, কারণ তোমাকে যে কথাটা বলতে এসেছিলাম মনে হচ্ছে তা তোমার পরিকল্পনায় নিখুঁত ভাবে মিলে যাবে।”
নামাত্রির দৃষ্টিতে সন্দেহ ফুটে উঠল, তারপর কামরার চারপাশে তাকাল যেন হঠাৎ করেই নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছে। কিন্তু অমুলক ভয়। কামরাটা পুরনো এক আবাসিক কমপ্লেক্সের অনেক ভেতরে এবং নিখুঁতভাবে শীল্ড করা। বাইরের কেউ তাদের কথা শুনতে পারবে না, সম্পূর্ণ দিক নির্দেশনা থাকলেও কেউ সহজে খুঁজে পাবে না বা পেলেও সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবকদের নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তা বেষ্টনী ভেদ করে আসতে পারবে না।”
“খুলে বল।” নামাত্রি বলল।
“তোমার কাজে লাগবে এমন একজনকে খুঁজে পেয়েছি। বয়সে তরুণ অশিক্ষিত, সাধাসিধা। তোমার পছন্দ হবে, দেখলেই মনে হবে একে বিশ্বাস করা যায়। যা বলার তা সরাসরি বলে। ডালে বাস করত, সমান অধিকারের বিষয়টা নিয়ে ভীষণ উৎসাহী। তার মতে ডাহ্লাইট কোক-আইসারের পরে জোরানিউমই সবচেয়ে আকর্ষণীয় বস্তু; এবং আমার কোনো সন্দেহ নেই যে এই আদর্শের কথা বলে তাকে দিয়ে যা ইচ্ছে তাই করানো যাবে।”
“আদর্শ?” নামাত্রি বলল। তার সন্দেহ এক বিন্দুও কমে নি। “সে কি আমাদের একজন?”
“সত্যি কথা বলতে কি, সে আসলে কোনোকিছুর সাথেই জড়িত নয়। সে শুধু এইটুকুই জানে যে জোরানিউম সব সেক্টরের সমান অধিকারের কথা প্রচার করেছিল।”
“ওটা তার কল্পনা, কোনো সন্দেহ নেই।”
“কল্পনা আমাদেরও কিন্তু ছেলেটা এগুলো বিশ্বাস করে। সমান অধিকার এবং প্রশাসনে জনগণের অধিক অংশ গ্রহণ নিয়ে আমার সাথে কথা বলেছে। এমনকি গণতন্ত্রের কথাও সে জানে।”
ঘৃণায় নাক কুঁচকাল নামাত্রি। “বিশ হাজার বছরে গণতন্ত্র কখনোই সঠিকভাবে ব্যবহৃত হয়নি।”
“হ্যাঁ, কিন্তু সেটা আমাদের মাথাব্যথা না। এই জিনিসগুলোই ছেলেটির চালিকা শক্তি এবং আমি তোমাকে সত্যি কথা বলছি, চীফ, তাকে দেখেই বুঝতে পেরেছি যে দরকারী অস্ত্রটা আমরা পেয়েছি কিন্তু বুঝতে পারছিলাম না কিভাবে ব্যবহার করা যাবে। এখন জানি। তাকে আমরা গার্ডেনার হিসাবে ইম্পেরিয়াল প্যালেস গ্রাউণ্ডে ঢুকিয়ে দিতে পারব।
“কিভাবে? গার্ডেনিং এর কিছু জানে সে?”
“না, কিছুই জানে না। দক্ষ শ্রমের কোনো কাজ কখনোই সে করেনি। এই মুহূর্তে একটা হলার চালানোর দায়িত্ব দেয়া হয়েছে এবং আমার ধারণা কিভাবে চালাতে হয় তাও শিখিয়ে দিতে হয়েছে। তারপরেও ছেলেটাকে যদি কোনোভাবে গার্ডেনারের সহকারী হিসেবেও ঢোকানো যায়, তাহলেই আমাদের কাজ হয়ে যাবে।”
“কি কাজ হবে?”
“আমরা যে ব্যক্তিকে টার্গেট করব তার কাছাকাছি যেতে পারবে–কোনোরকম সন্দেহ না জাগিয়েই–আঘাত করার মতো কাছে যেতে পারবে। চীফ, নিজেকে সে মহান বিপ্লবী মনে করে, এই আদর্শগুলোই বোকা ছেলেটাকে আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছে।”
“আমরা যা করতে বলব তাই করবে সে?”
“নিঃসন্দেহে।”
“ওর সাথে তোমার দেখা হলো কিভাবে?”
“আসলে মানীলা ওকে খুঁজে বের করেছে।”
“কে?”
“মানীলা। মানীলা ডুবানকুয়া।”
“ও, তোমার সেই বান্ধবী।” বিরক্তিতে মুখ বাঁকা করল নামাত্রি।
“মানীলা অনেকেরই বন্ধু।” বোঝনোর সুরে বলল এডোরিন। “আর তাই তো সে অনেক কাজ করে দিতে পারে। যে কোনো মানুষকে বিচার করাতে তার জুড়ি নেই। ছেলেটাকে দেখে আকৃষ্ট হয়েছিল বলেই সে যেচে পড়ে আলাপ করে বিশ্বাস কর, মানীলা কখনো শুধু বাইরের চেহারা দেখে আকৃষ্ট হয় না। কাজেই বুঝতে পারছ এই ছেলেটার মাঝে নিশ্চয়ই কোনো গুণ আছে।
নামাত্রি হালকা সুরে বলল, “একবার ইম্পেরিয়াল প্যালেস গ্রাউণ্ডে ঢোকার পর তোমার এই চমৎকার হাতিয়ার কি করতে পারবে বলে তোমার মনে হয়, এডোরিন?”
এডোরিন লম্বা দম নিল। “আর কি করবে? আমাদের প্রিয় সম্রাট প্রথম ক্লীয়নকে পথ থেকে সরিয়ে দেবে।”
রাগে ফেটে পড়ল নামাত্রি। “কি? পাগল হয়েছ? ক্লীয়নকে খুন করব কেন? ওর মাধ্যমে প্রশাসনে ঢুকব আমরা। সে আমাদের আড়াল দেবে, আমরা তার পিছনে। থেকে শাসন করব। সে আমাদের ক্ষমতায় যাওয়ার পাসপোর্ট, তোমার বুদ্ধিশুদ্ধি কোথায় গেল? তাকে একজন ফিগারহেড হিসেবে আমাদের প্রয়োজন। সে আমাদের কাজে নাক গলাবে না আর তার কারণেই আমরা আরো শক্তিশালী হয়ে উঠব।”
লাল টকটকে হয়ে উঠল এন্ডোরিনের ফর্সা মুখ, ভদ্রতার মুখোস খসে পড়ল চেহারা থেকে, চীৎকার করে বলল, “তাহলে কি করতে চাও তুমি? কি পরিকল্পনা করেছ? বারবার অনুমান করে আমি ক্লান্ত।”
হাত তুলল নামাত্রি। “ঠিক আছে। ঠিক আছে। শান্ত হও। একটু ভেবে দেখ। জোরানিউমকে দমন করেছিল কে? দশ বছর আগে আমাদের স্বপ্ন ধুলিস্যাৎ করেছিল কে? সেই গণিতবিদ। এবং সেই এখন সাইকোহিস্টোরির প্রলাপ বকে এম্পায়ার শাসন করছে। ক্লীয়ন কিছুই না। হ্যারি সেলডনকে আমাদের পথ থেকে সরাতে হবে। আমি চেষ্টা করছি যে অচলাবস্থা চলছে তার দায় সেলডনের কাঁধে চাপানোর জন্য। জনগণের দুর্ভোগের জন্য তাকে দায়ী করা হবে। সবাই এটাকে ধরে নেবে। তার ব্যর্থতা এবং অযোগ্যতা হিসেবে।”
কথার তোড়ে নামাত্রির মুখের কোণা দিয়ে খানিকটা থুতু বেরিয়ে পড়ল। “সে খুন হলে আনন্দের বন্যা বয়ে যাবে এম্পায়ারে এমন কি কাজটা কে করেছে তা না। জানলেও চলবে। বারবার এই খবর প্রচার করা হবে প্রতিটা হলোভশন চ্যানেলে। সবাই আমাদের মেনে নেবে ত্রাণকর্তা হিসেবে।” হাত তুলে এমন ভাবে নামিয়ে আনল যেন কারো বুকে ছুরি বসাচ্ছে। “তোমার তরুণ সৈনিক কি হ্যারি সেলডনকে খুন করতে পারবে?”
অন্তত বাহ্যিকভাবে হলেও নিজেকে সামলে নিল এন্ডোরিন।
“অবশ্যই পারবে। সম্রাটের জন্য তার হয়তো একটু হলেও শ্রদ্ধাবোধ আছে; সম্রাট তার কাছে রহস্যময় পবিত্র ব্যক্তি। সেলডনের জন্য তার তেমন শ্রদ্ধাবোধ নেই।”
কিন্তু ভেতরে ভেতরে খেপে গেছে এন্ডোরিন। এটা সে চায়নি। তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়েছে।
.
১৪.
মানীলা চোখের উপর থেকে চুল সরিয়ে রাইখের দিকে তাকিয়ে হাসল। “বলেছিলাম না, তোমাকে কোনো ক্রেডিট খরচ করতে হবে না।”
চোখ পিটপিট করল রাইখ, নগ্ন কাঁধ চুলকাল। “কিন্তু এখন নিশ্চয়ই চাইবে?”
কাঁধ নেড়ে আকর্ষণীয় ভঙ্গীতে হাসল মানীলা। “কেন চাইব?”
“কেন নয়?”
“কারণ মাঝে মাঝে আমার নিজেরও আনন্দের প্রয়োজন হয়।”
“আমার সাথে?”
“আর কেউ তো নেই এখানে।”
দীর্ঘক্ষণের নীরবতার পর সান্ত্বনার সুরে মানীলা বলল, “তাছাড়া তোমার কাছে অত ক্রেডিট নেই। কাজ কেমন চলছে?”
“মজুরী বেশী না তয় কিছু না থাকার চাইতে ভালো। অনেক ভালো। তুমি ওই লোকটাকে আমার জন্য কাজের ব্যবস্থা করে দিতে বলেছিলে?”
ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল মানীলা। “গ্লেব এন্ডোরিনের কথা বলছ? আমি ওকে কিছুই বলিনি। শুধু বলেছিলাম যে তোমাকে হয়তো তার ভালো লাগবে।”
“সে কি রাগ করবে আমার আর তোমার এই-”
“কেন রাগ করবে? ওর কোনো ব্যাপার না এটা। তোমারও মাথা ঘামানোর দরকার নেই।”
“সে কি করে? মানে কি কাজ করে?”
“কোনো কাজ করে বলে মনে হয় না। ধনী লোক। পুরনো মেয়রদের আত্মীয়।”
“ওয়ির মেয়র?”।
“হ্যাঁ। ইম্পেরিয়াল গভর্নম্যান্ট সে পছন্দ করে না। অবশ্য আগের মেয়রদের কেউই করত না। সে বলে ক্লীয়ন—”
আচমকা মুখের লাগাম টানল সে, তারপর বলল, “বেশী কথা বলছি আমি। কাউকে বলো না।”
“আমি? আমি কিছুই শুনি নি। কাউকেই বলব না।”
“ঠিক আছে।”
“কিন্তু এন্ডোরিনের বিষয়টা কি? সে জোরানুমাইটদের উঁচুপদের নেতা? গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি?”
“আমি জানি না।”
“কখনো এই বিষয়ে কথা বলে নি?”
“আমার সাথে বলেনি।”
“ও, বিরক্তি গোপন করল রাইখ।
তার দিকে সরু চোখে তাকাল মানীলা। “তোমার এতো আগ্রহ কেন?”
“আমি ওদের সাথে কাজ করতে চাই। এভাবেই অনেক উপরে উঠতে পারব। ভালো চাকরী। অনেক ক্রেডিট।”
“হয়তো এডোরিন সাহায্য করতে পারবে। আমি জানি সে তোমাকে পছন্দ করে।”
“আমাকে যাতে আরো বেশী পছন্দ করে সেই ব্যবস্থা করতে পারবে তুমি?”
“চেষ্টা করে দেখতে পারি। তোমাকে পছন্দ না করার তো কোনো কারণ দেখি না। আমি তোমাকে পছন্দ করি। এন্ডোরিনকে যতটা করি তোমাকে তার চেয়ে বেশী করি।”
“ধন্যবাদ, মানীলা। আমিও তোমাকে পছন্দ করি। অনেক।” মানীলার দেহের নিচের অংশে হাত বোলাতে লাগল সে। আশা করল যেন বর্তমান এ্যাসাইনমেন্টের চেয়ে মেয়েটার দিকেই মনযোগ বেশী দিতে পারে।
.
১৫.
“গ্লেব এন্ডোরিন, ক্লান্ত সুরে বললেন সেলডন। দুহাতে চোখ ডলছেন।
“কে?” জিজ্ঞেস করল ডর্স ভেনাবিলি। তার আচরণ এখনো রাইখ চলে যাওয়ার দিন থেকে যেমন শীতল ছিল ঠিক তেমন।
“নামটা শুনেছি মাত্র কিছুদিন আগে, চারশ কোটি মানুষের একটা বিশ্ব চালানোর এই এক সমস্যা। তুমি কখনোই কারো কথা শুনবে না, যতক্ষণ না সেই ব্যক্তি নিজেকে প্রকাশ করবে। কম্পিউটারে বিশ্বের সব তথ্য থাকার পরও ট্রানটরের জনগণ নাম পরিচয়হীন মানুষ। রেফারেন্স নাম্বার এবং পরিসংখ্যানের সাহায্যে যে কাউকেই খুঁজে নেয়া যাবে, কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে কোন মানুষটাকে খুঁজতে হবে। তার সাথে যদি পঁচিশ মিলিয়ন গ্রহ যোগ দাও তাহলে সত্যি অবাক হবে যে গ্যালাকটিক এম্পায়ার হাজার হাজার বছর ধরে অব্যাহত গতিতে এগিয়ে চলেছে। সত্যি কথা বলতে কি আমার মনে হয় এম্পায়ার টিকে থাকার মূল কারণ আসলে এটা চলছে নিজে নিজেই। আর এখন শেষ পর্যন্ত তার পতন ঘটতে চলেছে।”
“দর্শন যথেষ্ট হয়েছে, হ্যারি। এন্ডোরিন কে?”
“এমন একজন যার ব্যাপারে আমার আরো আগেই জানা উচিত ছিল। নিরাপত্তা কর্মীদের রাজী করিয়েছি ওর ব্যাপারে তথ্য দেয়ার জন্য। আমাকে একটা ফাইল দিয়েছে। ওয়ির মেয়র পরিবারের সদস্য গুরুত্বপূর্ণ একজন সদস্য–আর তাই নিরাপত্তাকর্মীরা ওর ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহ করে রেখেছে। ওদের মতে লোকটার উচ্চাকাঙ্ক্ষা অনেক বেশী। প্লেবয় টাইপের বলে তেমন একটা গুরুত্ব দেয়নি।”
“সে কি জোরানুমাইটদের সাথে জড়িত?”
অনিশ্চিত ভঙ্গীতে হাত নাড়লেন সেলডন। “আমি যতদূর বুঝতে পেরেছি, নিরাপত্তাকর্মীরা জোরামাইটদের ব্যাপারে কিছুই জানে না। তার অর্থ হয়তো এই যে জোরামাইটদের কোনো অস্তিত্ব নেই অথবা এমনও হতে পারে যে অস্তিত্ব থাকলেও সেটা উল্লেখযোগ্য কিছু না। এটাও হতে পারে যে নিরাপত্তা কর্মীরা আসলে এই ব্যাপারে আগ্রহী নয়। তাদেরকে আগ্রহী করে তোলার কোনো কায়দাও আমার জানা নেই। অফিসাররা যদি কিছু তথ্য আমাকে দেয় তাহলেই কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। তবে আমি ফার্স্ট মিনিস্টার।”
“হয়তো বা তুমি ভালো ফার্স্ট মিনিস্টার নও?” কাঠখোট্টা গলায় বলল ডর্স। “সেটা সম্ভাবনার চেয়েও অনেক বেশী। সম্ভবত এই পদের জন্য আমার চাইতে অযোগ্য ব্যক্তি আর কেউ নেই। কিন্তু এর সাথে নিরাপত্তা বিভাগের কোনো সম্পর্ক নেই। এই বিভাগ প্রশাসনের সবচাইতে স্বাধীন অংশ। এমনকি ক্লীয়ন নিজেও তার এই বিভাগের ব্যাপারে তেমন কিছু জানেন কিনা আমার সন্দেহ আছে, যদিও কাগজে কলমে অফিসাররা তাদের পরিচালকের মাধ্যমে সম্রাটের কাছে রিপোর্ট করতে বাধ্য। বিশ্বাস কর নিরাপত্তা বিভাগের কাজের ধারা যদি আমরা জেনে ফেলি তাহলে ওদেরকে সাইকোহিস্টোরির সমীকরণ দিয়ে বেঁধে রাখার চেষ্টা করব, তার চেয়ে যেমন আছে তেমনই থাক।”
“নিরাপত্তাকর্মীরা আমাদের পক্ষে আছে তো?”
“মনে হয় আছে কিন্তু একশভাগ নিশ্চয়তা দিতে পারব না।”
“তুমি কি যেন নাম বললে–এই লোকটার ব্যপারে এতো আগ্রহী কেন?”
“গ্লেব এন্ডোরিন। কারণ রাইখের কাছ থেকে সংবাদ পেয়েছি।”
ডর্সের চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। “আগে বলনি কেন? কেমন আছে রাইখ?”
“ভালো, তবে আশা করি সংবাদ পাঠানোর চেষ্টা বন্ধ করে দেবে। ধরা পড়লে। আর ভালো থাকবে না। যাই হোক সে এন্ডোরিনের সাথে একটা যোগাযোগ তৈরি করেছে।”
“এবং জোরানুমাইটদের সাথেও?”
“আমার তা মনে হয় না। এই দুই শ্রেণীর এক হয়ে কাজ করাটা অস্বাভাবিক। জোরামাইট আন্দোলন সমাজের একেবারে নীচু শ্রেণীর জনগোষ্ঠীর মাঝে আবদ্ধ সর্বহারাদের আন্দোলন। আর এডোরিন অভিজাতদের চাইতেও অভিজাত। জোরামাইটদের সাথে সে কি করবে?”
“যেহেতু সে ওয়িয়ান মেয়র পরিবারের সদস্য, হয়তো সে ইম্পেরিয়াল ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করছে, তাই নয় কি?”
“ওরা বংশ পরম্পরায় চেষ্টা করে যাচ্ছে। আশা করি রিশেলির কথা তোমার মনে আছে। সে এন্ডোরিনের ফুপু।”
“তাহলে তোমার কি মনে হয় না সে জোরানুমাইটদের নিজের স্বার্থ হাসিলের সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করছে?”
“যদি তাদের অস্তিত্ব থাকে। এবং যদি এন্ডোরিন ওদেরকে সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করে– আমার মতে সে এক বিপজ্জনক খেলায় মেতেছে। জোরামাইটদের যদি এখনো তাদের অস্তিত্ব থাকে–নিজস্ব পরিকল্পনা থাকতে পারে এবং এন্ডোরিনের মতো লোক হয়তো শেষে দেখবে যে গ্রিটির পিঠে চড়ে বসেছে
“গ্রিটি কি?”
“বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া হিংস্র পশু। হ্যাঁলিকনের একটা প্রচলিত প্রবাদ। তুমি যদি গ্রিটির পিঠে চাপ তাহলে আর নামতে পারবে না। তখন পশুটা তোমাকে খেয়ে ফেলবে।”
বিরতি নিলেন সেলডন। “আরেকটা কথা। সম্ভবত একটা মেয়ের সাথে রাইখের ঘনিষ্ঠতা হয়েছে। এই মেয়েটা এন্ডোরিনের পরিচিত এবং রাইখ আশা করছে তার মাধ্যমে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বের করতে পারবে।”
ভুরু কুঁচকালো ডর্স। “মেয়ে।”
“হ্যাঁ, এমন একজন যে অনেক পুরুষমানুষকে চেনে যারা অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ মুহূর্তে অসতর্ক হয়ে অনেক বেফাঁস কথা বলে ফেলে।”
“ওই ধরনের মেয়ে।” কুঁচকানো ভুরু জোড়া আরো কুঁচকে গেল “আমি ভাবতেই পারছি না।”
“শান্ত হও। শান্ত হও। রাইখের বয়স ত্রিশ এবং নিঃসন্দেহে অভিজ্ঞ। এই মেয়েটাকে বা যে কোনো মেয়েকেই–তুমি নিশ্চিন্তে রাইখের হাতে ছেড়ে দিতে পার।” ডর্সের দিকে ঘুরলেন তিনি। দৃষ্টিতে অসহায়ত্ব আর ক্লান্তি ফুটে উঠল। . “তোমার কি মনে হয় এগুলো করতে আমার ভালো লাগছে?”
ডর্স কোনো জবাব দিতে পারল না।
.
১৬.
গ্যাম্বল ডীন নামাত্রি, কখনোই এমনকি যখন তার মন মেজাজ ভালো থাকে তখনো সৌজন্যমূলক ভদ্র এবং আন্তরিক আচরণ করেছে এমন নজির নেই–আর দশ বছরের পরিকল্পনা যতই সমাপ্তির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ততই তার আচরণ আরো বেশী উগ্র এবং অসহ্য হয়ে পড়ছে।
অস্থির হয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল সে। “অনেক দেরী করেছ, এডোরিন।”
“কিন্তু আমি এসেছি।” কাঁধ নেড়ে এডোরিন বলল। “তোমার সেই ছেলেটা কোথায় তোমার অত্যাশ্চর্য হাতিয়ার। কোথায় সে?”
“চিন্তা করো না, সেও আসবে।”
“এখন আসে নি কেন?”
এন্ডোরিন মাথা নিচু করল, চিন্তা করে একটা সিদ্ধান্ত নেয়ার চেষ্টা করছে। তারপর কাটা কাটা সুরে বলল, “নিজের অবস্থান ভালোমতো না বুঝে ওকে এখানে আনতে চাই নি।”
“তার মানে?”
“সোজা, সরল গ্যালাকটিক স্ট্যান্ডার্ড। হ্যারি সেলডনকে পথ থেকে সরানোর পকিল্পনা কতদিন থেকে করছ?”।
“একেবারে প্রথম থেকেই। এটা বোঝা কি খুব বেশী কঠিন? জো-জোর সাথে সে যা করেছে তার প্রতিশোধ আমাদের নিতে হবে। সে যদি কিছু নাও করত যেহেতু সে ফার্স্ট মিনিস্টার আমাদের পথ থেকে তাকে সরাতেই হবে।”
“কিন্তু আসলে ক্লীয়ন–ক্লীয়নকে পথ থেকে সরাতে হবে। প্রয়োজন হলে তার সাথে ফাস্ট মিনিস্টারকে।”
“একজন ফিগারহেড তোমাকে ভাবিয়ে তুলেছে কেন?”
“মাত্র গতকালকেই তোমার জন্ম হয় নি নিশ্চয়ই? এই পরিকল্পনায় আমার অংশটুকু কখনো ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন মনে করিনি কারণ ধরে নিয়েছিলাম না বোঝার মতো বোকা নও। যদি ইম্পেরিয়াল সিংহাসনের পরিবর্তন না ঘটে তাহলে তোমাকে কেন সাহায্য করব?”
শব্দ করে হাসল নামাত্রি। “অবশ্যই। আমি প্রথম থেকেই জানি যে তুমি আমাকে উপরে উঠার সিঁড়ি ভেবে নিয়েছ, ইম্পেরিয়াল সিংহাসনে বসার মই হিসেবে ব্যবহার করছ।”
“তুমি কি অন্য কিছু আশা করেছিলে?”
“মোটেই না। পরিকল্পনা করব আমি, ঝুঁকি নেব আমি, তারপর সবকিছু হয়ে গেলে পুরস্কার নেবে তুমি। কি চমৎকার তাই না?”
“হ্যাঁ, চমৎকার, কারণ পুরস্কারের অংশীদার হবে তুমিও। তুমি হবে ফাস্ট মিনিস্টার, তাই না? এমন এক নতুন সম্রাটের সহযোগীতা পাবে যে তোমার প্রতি কৃতজ্ঞ।”–বলার সময় ঠাট্টার ভঙ্গীতে মুখ বাঁকা করল সে–“আমি হব নতুন ফিগারহেড।”
“তুমি তাহলে ফিগারহেড হতে চাও?”
“আমি সম্রাট হতে চাই। তোমার ক্রেডিট ছিল না, আমি তার ব্যবস্থা করে দিয়েছি। সকল উপকরণের যোগান দিয়েছি। ওয়িতে বিশাল একটা সংগঠন গড়ে তোলার জন্য যা প্রয়োজন তার সব আমি সরবরাহ করেছি। যা দিয়েছি তার সবই ফিরিয়ে নিতে পারি।”
“আমার তা মনে হয় না।”
“তুমি ঝুঁকি নিতে চাও? কাসপালভের সাথে যা করেছ আমার সাথে সেরকম করার কথা স্বপ্নেও ভেবো না। আমার কিছু হলে তোমার এবং তোমাদের ওয়িতে বাস করা অসম্ভব হয়ে পড়বে এবং অন্য কোনো সেক্টর তোমার যা প্রয়োজন তা দিতে পারবে না।”
দীর্ঘশ্বাস ফেলল নামাত্রি। “তাহলে সম্রাটকে খুন করার পরামর্শ দিচ্ছ তুমি।”
“আমি খুন করার কথা বলি নি। বলেছি পথ থেকে সরিয়ে দেয়ার কথা। কিভাবে করবে সেটা তোমার দায়িত্ব।” আলোচনা শেষ করার ভঙ্গীতে হাত নেড়ে এমনভাবে বলল যেন সে ইম্পেরিয়াল সিংহাসনে বসে আছে।
“তারপর তুমি সম্রাট হবে?”
“হ্যাঁ।”
“না, তোমার স্বপ্ন অপূর্ণই থেকে যাবে। সম্রাট খুন হলে তুমিও মারা যাবে। তবে আমার হাতে না। এডোরিন, জীবনের কঠিন কিছু বাস্তব তোমাকে শিখিয়ে দেই। ক্লীয়ন খুন হলে প্রথমেই উত্তরাধিকারের বিষয়টা প্রাধান্য পাবে, গৃহযুদ্ধ এড়ানোর জন্য ইম্পেরিয়াল গার্ড বাহিনী ওয়িয়ান মেয়র পরিবারের সকল সদস্যকে খুঁজে বের করে হত্যা করবে–সবার আগে হত্যা করবে তোমাকে। অন্য দিকে শুধু যদি ফার্স্ট মিনিস্টারকে খুন করি তুমি নিরাপদ থাকবে।”
“কেন?”
“ফার্স্ট মিনিস্টার শুধুই ফার্স্ট মিনিস্টার। তারা আসে আর যায়। এমনও হতে পারে যে ক্লীয়ন নিজেই বিরক্ত হয়ে তাকে একদিন মেরে ফেলার ব্যবস্থা করল। অবশ্যই ব্যাপারটা আমরা সেভাবেই প্রচার করব। ইম্পেরিয়াল গার্ড প্রথমে দ্বিধা করলেও শেষ পর্যন্ত আমাদেরকেই নতুন সরকার গঠনের সুযোগ দেবে। সত্যি কথা বলতে কি সেলডনের হাত থেকে ছাড়া পেয়ে আমার মনে হয় ওরা বরং খুশিই হবে।”
“নতুন সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর আমি কি করব? অপেক্ষা করব? সারাজীবন?”
“না, আমি ফার্স্ট মিনিস্টার হতে পারলে ক্লীয়নকে সামলানোর অনেক উপায় বের করা যাবে। হয়তো ইম্পেরিয়াল গার্ড–এমন কি নিরাপত্তা বিভাগকে হাত করে আমার ইচ্ছামতো চালাতে পারব। তখন ক্লীয়নকে সরিয়ে তার জায়গায় তোমাকে বসানো অনেক সহজ হবে।”
রাগে ফেটে পড়ল এডোরিন। “কেন করবে?”
“কেন করবে মানে?”
“সেলডনের উপর তোমার ব্যক্তিগত আক্রোশ রয়েছে। সে চলে গেলে কেন তুমি অকারণে সর্বোচ্চ পর্যায়ের ঝুঁকি নেবে? ক্লীয়নের সাথে একটা সমঝোতা করে নেবে তুমি আর আমি সারাজীবনের স্বপ্ন অপূর্ণ রেখে অবসর নিয়ে ফিরে যাব। এবং সম্ভবত নিজেকে নিরাপদ করার জন্য আমাকে তুমি খুন করবে।”
“না! ক্লীয়ন সিংহাসনে বসার যোগ্যতা নিয়েই জন্মেছে। সে প্রাচীণ এ্যান্টান রাজবংশের সন্তান তার পূর্বপুরুষরা সবাই সম্রাট। তাকে সামলে রাখা অসম্ভব একটা কাজ। অন্যদিকে তুমি সিংহাসনে বসবে নতুন এক রাজবংশের সদস্য হিসেবে, যার সাথে ঐতিহ্যের কোনো সম্পর্ক নেই। নিশ্চয়ই স্বীকার করবে যে পূর্ববর্তী ওয়িয়ান সম্রাটরা কেউই তেমন পরিচিত নয়। দোদুল্যমান পরিস্থিতিতে সিংহাসনে বসবে তুমি, তোমার সমর্থনের প্রয়োজন হবে–আমি। আমারও এমন একজনকে দরকার যে আমার উপর নির্ভরশীল এবং যাকে আমি সামলাতে পারব। তুমি। শোনো, এডোরিন, আমরা পরস্পরকে ভালোবেসে বিয়ের সম্পর্ক গড়ে তুলি নি, যে সম্পর্ক সময়ের সাথে সাথে ফিকে হতে থাকবে। বরং আমরা পারস্পরিক সুবিধার জন্য বিয়ের সম্পর্ক গড়ে তুলেছি যে সম্পর্ক আমরা যতদিন বেঁচে থাকব। ততদিন টিকবে। পরস্পরের উপর বিশ্বাস রাখলে দুজনেই লাভবান হব।”
“প্রতিশ্রুতি দিচ্ছ যে আমি সম্রাট হব।”
“আমার মুখের কথা বিশ্বাস না করলে প্রতিশ্রুতি দিয়ে কি হবে? তারপরেও বলছি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমি তোমাকে ক্লীয়নের স্থলাভিষিক্ত করব। এবার তোমার লোকের সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দাও।
“ঠিক আছে। ছেলেটা অন্য সবার চেয়ে কেন আলাদা সেটা আগে শুনে রাখো। উঁচু দরের আদর্শবাদী সে নয়। যা করতে বলবে তাই করবে, বিপদ নিয়ে মাথা ঘামাবে না, দ্বিতীয়বার ভাববে না। আর দেখার সাথে সাথেই তার উপর বিশ্বাস জন্মাবে এমনকি হাতে একটা ব্লাস্টার থাকলেও।”
“বিশ্বাস হচ্ছে না।”
“অপেক্ষা কর। দেখলেই বুঝবে।”
.
১৭.
চোখ নামিয়ে রাখল রাইখ। দ্রুত একবার তাকিয়েই সব বুঝে ফেলেছে। দশ বছর আগে যখন জোরানিউমকে ফাঁদে ফেলার জন্য তাকে পাঠানো হয় তখন এই লোকটাকে সে দেখেছিল।
।দশ বছরে নামাত্রি বিশেষ একটা বদলায় নি। রাগ আর ঘৃণা তার চরিত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য এটা তাকে দেখে যে কেউই বলতে পারবে–অন্তত রাইখের বুঝতে কোনো অসুবিধে হলো না।
রাইখ দৃষ্টি সরিয়ে রাখল, কারণ সে জানে নামাত্রি এমন মানুষ যে সরাসরি তার চোখের দিকে তাকানোটা পছন্দ করে না।
তীক্ষ দৃষ্টিতে রাইখের দিকে তাকাল নামাত্রি। ঠোঁটের কোণায় বিদ্রুপের হাসি।
এন্ডোরিন এক কোণায় জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে উদ্দেশ্য করে নামাত্রি প্রশ্ন করল, “এর কথাই বলেছিলে তাহলে?” বলার ভঙ্গীতে মনে হলো যেন যাকে নিয়ে এতো আলোচনা সে এখানে উপস্থিত নেই।
মাথা নাড়ল এন্ডোরিন, নিঃশব্দে ঠোঁট নেড়ে বলল, “হ্যাঁ, চীফ।”
কাঠখোট্টা গলায় রাইখকে জিজ্ঞেস করল নামাত্রি, “তোমার নাম?”
“প্ল্যানচেট, স্যার।”
“তুমি আমাদের আদর্শে বিশ্বাস করো?”
“জ্বী, স্যার, এন্ডোরিনের পরামর্শ অনুযায়ী সাবধানে কথা বলছে সে। “আমি একজন গণতন্ত্রী এবং প্রশাসনে জনগণের অধিক অংশগ্রহণের নিশ্চয়তা চাই।”
এন্ডোরিনের দিকে দ্রুত দৃষ্টি ফেলে নামাত্রি বলল, “বক্তৃতাবাজ।” আবার রাইখের দিকে ঘুরল, “আদর্শ রক্ষার জন্য ঝুঁকি নিতে পারবে?”
“যে কোনো ঝুঁকি, স্যার।”
“যা বলব তাই করবে? কোনো প্রশ্ন করবে না? কখনো পিছ পা হবে না?”
“আমি আদেশ পালন করব।”
“গার্ডেনিং এর ব্যাপারে কিছু জানো?” ইতস্ততঃ করল রাইখ, “না, স্যার।”
“তুমি তাহলে ট্র্যানটরিয়ান? গম্বুজের নিচে জন্মেছ?”
“জন্মেছি মিলিমারুতে, স্যার। বড় হয়েছি ডাহুলে।”
“চমৎকার, তারপর এন্ডোরিনকে বলল, “নিয়ে যাও ওকে। বাইরে দাঁড়ানো লোকটার কাছে দিয়ে আবার এখানে আসবে। তোমার সাথে কথা আছে।”
ফিরে এসে নামাত্রির চেহারায় অবিশ্বাস্য পরিবর্তন লক্ষ্য করল এডোরিন। তার চোখগুলোতে অন্য রকম এক আলো, মুখে ভয়াল দর্শন মুচকি হাসি।
“বলেছিলাম না, লোকটা আমাদের কাজের উপযুক্ত।”
“তুমি যা ভেবেছ তার চেয়ে অনেক বেশী উপযুক্ত। তোমার মনে আছে আমাদের প্রাণপ্রিয় ফার্স্ট মিনিস্টার হ্যারি সেলডন জোরানিউমকে ফাঁদে ফেলার জন্য তার ছেলে–অথবা পালক ছেলেকে পাঠিয়েছিল।
“হ্যাঁ,” ক্লান্ত ভঙ্গীতে মাথা নাড়ল এডোরিন। “গল্পটা আমি জানি।”
“ছেলেটাকে আমি মাত্র একবার দেখেছিলাম, কিন্তু ওর চেহারা মনের মাঝে গেঁথে আছে। তোমার কি মনে হয় দশ বছরের পরিবর্তন, নকল হিল, আর গোঁফ ফেলে দিয়ে আমাকে বোকা বানাতে পারবে? তোমার এই প্ল্যানচেটই হ্যারি সেলডনের পালক ছেলে রাইখ।”
দম বন্ধ হয়ে গেল এন্ডোরিনের, মুখ থেকে রক্ত সরে গেছে। “তুমি নিশ্চিত, চীফ?”
“তুমি আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছ এই ব্যাপারে যেমন নিশ্চিত ঠিক সেরকম। তুমি শত্রুকে হাতে ধরে আমাদের ঘরের ভেতরে নিয়ে এসেছ।”
“আমার কোনো ধারণা-”
“ভয়ের কিছু নেই। আমার মনে হয় সারাজীবনে এই প্রথম একটা ভালো কাজ তুমি করতে পারলে। যথাযথভাবে পালন করেছ ঈশ্বরদের নির্ধারণ করে দেয়া ভূমিকা। যদি আমি চিনতে না পারতাম তাহলে সে তার উদ্দেশ্য পূরণ করে চলে যেতে পারত। কিন্তু এখন আর তা হবে না। সত্যিকথা বলতে কি তুরুপের তাস এখন আমাদের হাতে।” হাতে হাত ঘষল নামাত্রি, একটু থমকাল, যেন বুঝতে পারছে আচরণটা তার চরিত্রের সাথে খাপ খায় না, মুচকি হাসল–তারপর গলা ছেড়ে হেসে উঠল।
.
১৮.
“আমাদের বোধহয় আর দেখা হবে না, প্ল্যানচেট।” মানীলা বলল।
গোসল করে গা শুকাচ্ছে রাইখ। “কেন?”
“গ্লেব এন্ডোরিন চাইছে না আমি তোমার সাথে দেখা করি।”
“কেন চাইছে না?”
কাঁধ নাড়ল মানীলা। “ও বলেছে তোমাকে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে হবে, আমার সাথে মেলামেশা করে সময় নষ্ট করা যাবে না। হয়তো সে বোঝাতে চায় তুমি আরো ভালো কাজ পাবে।”
দেহ শক্ত হয়ে গেল রাইখের। “কি ধরনের কাজ নির্দিষ্ট করে কিছু বলেছে?”
“না, তবে বলেছে যে ইম্পেরিয়াল সেক্টরে যাবে।”
“তাই? তোমাকে সব জানায়?”
“তুমি তো জানই, প্ল্যানচেট, পুরুষ মানুষরা বিছানায় অনেক কথাই বলে।”
“আমি জানি,” জবাব দিল রাইখ, সে নিজে অবশ্য এই ব্যাপারে ভীষণ সতর্ক থাকে। “আর কি বলেছে?”
“এতো প্রশ্ন করছ কেন?” ভুরু সামান্য বাঁকা করল মানীলা। “সেও প্রায়ই তোমার কথা জিজ্ঞেস করে। পুরুষদের এই ব্যাপারটা আমি লক্ষ্য করেছি। কেন?”
“আমার ব্যাপারে কি বলেছ?”
“বেশী কিছু না। শুধু বলেছি যে তুমি চমৎকার ভদ্রলোক। এটা তো আর বলতে পারি না যে তোমাকে ওর চেয়ে বেশী পছন্দ করি। তাহলে মনে কষ্ট পাবে আমারও ক্ষতি হবে।”
পোশাক পড়ছে রাইখ। “তাহলে বিদায়।”
“আমার মতে সাময়িক বিদায়। গ্লেব মত পাল্টাতে পারে। আমিও ইম্পেরিয়াল সেক্টরে যেতে চাই–মানে যদি সাথে নেয় আর কি। কখনো ওখানে যাই নি।”
মুখ ফসকে প্রায় বলেই ফেলেছিল রাইখ, কাশি দিয়ে সামলে নিল। “আমিও যাই নি।”
“ওখানে আছে বড় বড় দালানেকোঠা, সুন্দর সুন্দর বেড়ানোর জায়গা, চমৎকার রেস্টুরেন্ট আর পয়সাওয়ালারা সব ওখানেই থাকে। বড়লোকদের সাথে পরিচিত হতে চাই আমি–গ্লেব ছাড়া।”
“আমার কাছ থেকে তো তুমি কিছুই পাও না।”
“তোমার কথা আলাদা। সবসময় ক্রেডিটের কথা ভাবলে চলে না, কিন্তু মাঝে মাঝে ভাবতেই হয়। বিশেষ করে যখন মনে হচ্ছে যে গ্লেব আমাকে নিয়ে ক্লান্ত।”
“তোমাকে নিয়ে কেউ ক্লান্ত হতে পারে না।” রাইখ বলল এবং বুঝতে পারল যে কথাটা সে মনে প্রাণে বিশ্বাস করে।
“পুরুষরা সবসময় এই কথাই বলে। যাই হোক, তোমার সাথে সময়টা ভালোই কেটেছে। নিজের দিকে খেয়াল রেখো, বলা যায় না আমাদের আবার দেখা হতেও পারে।”
মাথা নাড়ল রাইখ, বলার মতো কোনো শব্দ খুঁজে পেল না। মনের অনুভূতি প্রকাশ করার উপায় তার জানা নেই।
মনটাকে অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিল। নামাত্রি আর তার দলের পরিকল্পনা জানতে হবে। মানীলার কাছ থেকে তাকে পৃথক করার অর্থ হলো নাটকের যবনিকাপাত ঘটতে চলেছে। শুধু গার্ডেনিং এর ব্যাপারটা এখনো বুঝতে পারছে না।
সেলডনের কাছেও কোনো সংবাদ পাঠাতে পারেনি। নামাত্রির সাথে দেখা করার পর থেকেই তাকে কড়া নজরে রাখা হয়েছে, যোগাযোগের সকল উপায় বন্ধ নাটকের শেষ অঙ্কের আরেকটা প্রমাণ।
কিন্তু কি ঘটতে চলেছে তা যদি ঘটে যাওয়ার পরেই জানতে পারে আর সেলডনকে জানায় তখন কি লাভ হবে।
.
১৯.
হ্যারি সেলডনের সময় ভালো যাচ্ছে না। প্রথমবার যোগাযোগের পর রাইখের কাছ থেকে আর কোনো খবর পান নি; কি হচ্ছে সেই ব্যাপারে কোনো ধারণাই নেই।
রাইখের জন্য দুঃশ্চিন্তা ছাড়াও (ভয়ানক কিছু ঘটলে তিনি নিশ্চয়ই খবর পেতেন) শত্রুপক্ষের পরিকল্পনা নিয়েও অস্বস্তিতে ভুগছেন।
নিখুঁত হতে হবে। প্রাসাদে সরাসরি আক্রমণ অসম্ভব। ওখানে নিরাপত্তা ব্যবস্থা দুর্ভেদ্য। তারপরেও যদি তাদের সেরকমই পরিকল্পনা থাকে সেটা কি ধরনের হতে পারে?
এই চিন্তা তাকে রাতে ঘুমাতে দেয়নি, দিনের কাজে মন বসাতে দিচ্ছে না।
সিগন্যাল বাতি জ্বলে উঠল।
“ফাস্ট মিনিস্টার। দুটোর সময় আপনার একটা এ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে, স্যার-”
“কোন এ্যাপয়েন্টমেন্ট?”
“ম্যান্ডেল গ্রুবার, গার্ডেনার।”
মনে পড়ল সেলডনের। “হ্যাঁ, পাঠিয়ে দাও।”
এখন বারের সাথে কথা বলার সময় নয়। কিন্তু এক দুর্বল মুহূর্তে আজকে দেখা করবেন বলে কথা দিয়েছিলেন তাকে লোকটা পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছে। ফার্স্ট মিনিস্টারকে কখনো দুর্বল হলে চলবে না, কিন্তু সেলডন ফার্স্ট মিনিস্টার হওয়ার অনেক আগে থেকেই সেলডন।
“এসো, গ্রুবার।” আন্তরিক ভঙ্গীতে বললেন তিনি।
বিস্মিত হয়ে চারপাশে দেখতে লাগল গ্রুবার। সেলডনের কোনো সন্দেহ নেই যে এমন চমকদার অভিজাত অফিস গার্ডেনার কখনো দেখে নি। বলতে ইচ্ছে হলো : “তোমার পছন্দ হয়েছে? তাহলে নিয়ে যাও। আমি চাই না।”
কিন্তু শুধু বললেন, “কি হয়েছে, এবার? এমন দেখাচ্ছে কেন?”
সাথে সাথে কোনো জবাব পাওয়া গেল না। প্রাণহীন এক টুকরো হাসি ফুটল এবারের ঠোঁটে।
“বসো। ওই চেয়ারটাতে।”
“না, ফাস্ট মিনিস্টার। ভালো দেখাবে না। নোংরা হয়ে যাবে।”
“নোংরা হলে পরিষ্কার করা যাবে। যা বলছি তাই কর–ভালল! এখন একটু বসে তোমার চিন্তাগুলোকে গুছিয়ে নাও। তারপর বল কি ব্যাপার।”
নিঃশব্দে কিছুক্ষণ বসে থাকল গ্রুবার, তারপর বাধ ভাঙ্গা স্রোতের মতো তার মুখ দিয়ে কথাগুলো বেরিয়ে এল, “ফার্স্ট মিনিস্টার। আমাকে চীফ গার্ডেনার বানানো হয়েছে। মহানুভব সম্রাট নিজের মুখে বলেছেন।”
“হ্যাঁ, শুনেছি, কিন্তু এই ব্যাপারটা নিশ্চয়ই তোমাকে ভাবাচ্ছে না। তোমার নতুন পদ অভিনন্দন পাওয়ার যোগ্য এবং আমি তোমাকে অভিনন্দন জানাচ্ছি। এর পিছনে হয়তো আমারও কিছু অবদান আছে। আমার প্রাণ রক্ষার জন্য তুমি যা। করেছিলে সেটা আমি ভুলিনি এবং সম্রাটকে বিষয়টা বারবার জানিয়েছি। তুমি যা করেছ তার জন্য এর চেয়ে ভালো পুরস্কার আর কিছুই হতে পারে না। কাজেই এটা কোনো দুঃশ্চিন্তার বিষয় নয়, আসল কথা খুলে বল।”
“ফার্স্ট মিনিস্টার, নতুন পদ এবং পদোন্নতিই আমার দুঃশ্চিন্তার বিষয়। আমি সামলাতে পারব না, সেই যোগ্যতা নেই।”
“আমাদের বিশ্বাস তোমার সেই যোগ্যতা আছে।”
অস্থির হয়ে পড়ল গ্রুবার। “আমাকে অফিসে বসতে হবে। মুক্ত বায়ুতে কাজ করতে পারব না, গাছপালা আর পশুপাখিদের সাথে কাজ করতে পারব না। জেলখানায় বন্দী হয়ে থাকতে হবে, ফার্স্ট মিনিস্টার।”
বিস্মিত হলেন সেলডন। “সেরকম কিছু হবে না, গ্রুবার। তুমি সারাক্ষণ অফিসে বসে থাকবে কেন। ইচ্ছামতো ভোলা জায়গায় ঘুরে বেড়াবে। কাজ কর্ম দেখবে। তোমাকে আর কায়িক পরিশ্রম করতে হবে না, ব্যস।”
“আমি কায়িক পরিশ্রম করতে চাই, ফাস্ট মিনিস্টার। আর মনে হয় না ওরা আমাকে বেরোতে দেবে। বর্তমান চীফ গার্ডেনারকে দেখেছি। ইচ্ছা থাকলেও অফিস ছেড়ে বেরোতে পারতেন না। প্রশাসনিক কাজ আর হিসাব নিকাশ নিয়েই ব্যস্ত। থাকতেন। কিছু জানাতে হলে আমরাই তার অফিসে যেতাম। সবকিছু দেখতেন হলোভশনে”–প্রচণ্ড রাগ নিয়ে কথাগুলো বলল সে–“যেন ছবি দেখেই প্রকৃতি বুঝতে পারবেন। আমাকে দিয়ে এই কাজ হবে না, ফার্স্ট মিনিস্টার।”
“শান্ত হও, গ্রুবার। ব্যাপারটা এতো খারাপ না। তুমি অভ্যস্ত হয়ে যাবে। আস্তে আস্তে সব গুছিয়ে নেবে নিজের মতো করে।”
মাথা নাড়ল গ্রুবার। “প্রথম কথা–সবচেয়ে প্রথম কথা আমাকে নতুন গার্ডেনারদের নিয়ে কাজ করতে হবে। আমাকে জীবন্ত কবর দেয়া হচ্ছে।” তারপর হঠাৎ মরিয়া হয়ে বলল, “এই দায়িত্ব আমি চাই না এবং আমার পাওয়া উচিত নয়, ফার্স্ট মিনিস্টার।”
“গ্রুবার, এখন হয়তো চাও না, কিন্তু তুমি একা নও। এই মুহূর্তে আমার মনে হচ্ছে আমি ফার্স্ট মিনিস্টার না হলেই ভালো হতো। দায়িত্বটা আমার জন্য অনেক বেশী। মাঝে মাঝে মনে হয়েছে সম্রাট নিজেও ইম্পেরিয়াল দায়িত্ব ছেড়ে দিতে পারলে স্বস্তি বোধ করতেন। কিন্তু গ্যালাক্সির সকলকেই যার যার দায়িত্ব পালন করতে হবে এবং সেটা সবসময় আনন্দদায়ক হয় না।”
“বুঝতে পেরেছি, ফার্স্ট মিস্টিার, কিন্তু সম্রাটকে সিংহাসনে বসতেই হবে কারণ তিনি সম্রাট হয়েই জন্মেছেন। আপনাকে ফার্স্ট মিনিস্টারের দায়িত্ব পালন করতেই হবে কারণ এই পদের জন্য যোগ্যতর ব্যক্তি আর কেউ নেই। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে, আমরা কথা বলছি চীফ গার্ডেনারের পদ নিয়ে। পঞ্চাশজন গার্ডেনার এখানে কাজ করে। তাদের অনেকেই এই পদের জন্য আমার চেয়ে যোগ্য এবং তারা কেউই অফিসের চার দেয়ালে বন্দী হতে আপত্তি করবে না। আপনি বলেছেন যে সম্রাটকে আপনি আমার কথা জানিয়েছেন। আপনি কি দয়া করে তাকে আরেকবার বুঝিয়ে বলবেন যে যদি আমাকে পুরস্কৃত করতেই হয় তাহলে আমি যেমন আছি তেমন থাকতে দেয়াটাই হবে সবচেয়ে বড় পুরস্কার।”
চেয়ারে হেলান নিয়ে বসলেন সেলডন। গম্ভীর গলায় বললেন, “বার, যদি সম্ভব হতো তাহলে অবশ্যই করতাম। তবে একটা বিষয় ব্যাখ্যা করে বলছি তোমাকে, আশা করি তুমি বুঝবে। সম্রাট, আমরা সবাই জানি এম্পায়ারের একচ্ছত্র অধিপতি। বাস্ত বে কিন্তু খুব কম ক্ষেত্রেই তিনি তার কর্তৃত্ব প্রয়োগ করতে পারেন। মূলত এম্পায়ার চালাচ্ছি আমি, কিন্তু আমিও আমার কর্তৃত্ব প্রয়োগ করতে পারি না। সরকারের বিভিন্ন স্তরে লাখ-লাখ, কোটি-কোটি কর্মচারী দায়িত্ব পালন করে চলেছে, সবাই নিজের মতো করে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, সবাই ভুল করছে, কেউ কাজ করছে বীরের মতো, কেউ ভীরু কাপুরুষের মতো। তাদের উপর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। বুঝতে পারছ?”
“পারছি কিন্তু আমার সমস্যার সাথে এর কি সম্পর্ক।
“কারণ একটা জায়গাতে তিনি প্রকৃত অর্থেই সর্বেসর্বা। আর সেটা হলো ইম্পেরিয়াল প্যালেস গ্রাউণ্ড। এখানে তার কথাই আইন এবং অধীনস্ত কর্মচারী কর্মকর্তাদের সংখ্যা কম বলে সামলানো সহজ। ইম্পেরিয়াল প্যালেস গ্রাউণ্ডের ব্যাপারে তার নেয়া কোনো সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের কথা বললে সেটাকে তিনি ধরে নেবেন তার দুর্ভেদ্য দুর্গে অনুপ্রবেশের ঘটনা হিসেবে। আমি যদি তাকে বলি, দয়া করে গ্রুবারকে নতুন দায়িত্ব না দিয়ে আগের মতো থাকতে দেয়ার বিষয়টা একটু বিবেচনা করবেন, ইওর ইম্পেরিয়াল ম্যাজেস্টি, তাহলে তিনি তার সিদ্ধান্ত না পাল্টিয়ে বরং আমাকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেবেন। তাতে আমি খুশি হব কিন্তু তোমার কোনো লাভ হবে না।”
“কোনো উপায়ই নেই তাহলে?”
“ঠিক এই কথাটাই আমি তোমাকে বোঝানোর চেষ্টা করছি। তবে চিন্তা করো না, বার, আমি যতদূর পারি তোমাকে সাহায্য করব। দুঃখিত, আর সময় দিতে পারছি না তোমাকে।”
উঠে দাঁড়াল গ্রুবার, বাগানে কাজ করার টুপিটা দুহাতে মোচড়াচ্ছে, চোখে পানি। “ধন্যবাদ, ফার্স্ট মিনিস্টার। আমি জানি আপনি আমাকে সাহায্য করবেন। আপনি আপনি একজন ভালো মানুষ, ফার্স্ট মিনিস্টার।”
দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে চলে গেল সে।
হতাশ ভঙ্গীতে মাথা নাড়লেন সেলডন। বারের দুর্দশাকে এক কোয়াড্রিলিয়ন দিয়ে গুণ করলে পাওয়া যাবে এম্পায়ারের পঁচিশ মিলিয়ন গ্রহের প্রতিটা মানুষের
সম্মিলিত দুর্দশা আর তিনি সেলডন কিভাবে এই মানুষগুলোকে রক্ষা করবেন। যেখানে তিনি মাত্র একজন মানুষের দুর্দশা দূর করতে পারেন না?
সাইকোহিস্টোরি একজন মানুষকে রক্ষা করতে পারে না, কোয়াড্রিলিয়ন মানুষকে রক্ষা করতে পারবে?
আবারও মাথা নাড়লেন, পরবর্তী এ্যাপয়েন্টমেন্ট কখন এবং কি বিষয়ে দেখলেন, তারপর স্থির হয়ে গেলেন মূর্তির মতো। যোগাযোগ যন্ত্রের সামনে গিয়ে স্বভাববিরুদ্ধ হয়ে চীৎকার করে বললেন, “গার্ডেনারকে ফিরিয়ে আনো! এই মুহূর্তে তাকে এখানে আবার নিয়ে এসো!”
.
২০.
“নতুন গার্ডেনারদের বিষয়টা কি?” চীৎকার করে জিজ্ঞেস করলেন সেলডন। এবার আর গ্রুবারকে বসতে বললেন না।
অনবরত চোখ পিটপিট করছে বার। আবার ডেকে আনায় ভীষণ ভয় পেয়েছে। “-নতুন গৃ-গার্ডেনার?” তোতলাতে লাগল সে।
“তুমি বলেছিলে, সব নতুন গার্ডেনার। ঠিক এই কথাগুলোই বলেছিলে। কোন নতুন গার্ডেনার?”
অবাক হলো গ্রুবার। “নতুন চীফ গার্ডেনার দায়িত্ব নেয়ার সময় নতুন গার্ডেনার নিয়োগ দেয়া হয়। এটাই নিয়ম।”
“আমি কখনো শুনি নি।”
“শেষবার যখন চীফ গার্ডেনার পদে রদবদল বদল হয় তখন আপনি ফাস্ট মিনিস্টার ছিলেন না। সম্ভবত ট্রানটরেই ছিলেন না।”
“কিন্তু বিষয়টা কি নিয়ে?”
“গার্ডেনারদের কখনো অব্যাহতি দেয়া হয় না। কেউ মারা যায়, কেউ বয়সের কারণে অবসর নেয়। নতুন চীফ গার্ডেনার যখন দায়িত্ব গ্রহণ করে সেই সময়ে প্রায় অর্ধেক গার্ডেনার বুড়ো হয়ে যায়। তাদেরকে বিপুল অঙ্কের পেনশন দিয়ে অবসর দেয়া হয় আর সেই জায়গায় নতুন গার্ডেনারদের নিয়োগ দেয়া হয়।”
“তরুণ কর্মীর জন্য?”
“আংশিক, তাছাড়া বাগানটাকে নতুনভাবে সাজানোর জন্য নতুন মেধা আর নতুন ধারণার প্রয়োজন হয়। এখানে পাঁচশ বর্গ কিলোমিটারের মতো বাগান আর পার্ক আছে। পুরো এলাকাটা চিনতে যে কোনো মানুষের কমপক্ষে এক বছর লাগবে। আমার দায়িত্ব হবে সবকিছু তত্ত্বাবধান করা। প্লীজ, ফাস্ট মিনিস্টার, আপনি চেষ্টা করলে মহামান্য সম্রাটকে সিদ্ধান্ত বদলাতে রাজী করাতে পারবেন।”
গুরুত্ব দিলেন না সেলডন। গভীর চিন্তার কারণে তার কপালে অনেকগুলো ভাজ পড়েছে। “নতুন গার্ডেনাররা কোত্থেকে আসবে?”
“প্রতিটি গ্রহেই পরীক্ষা হবে–কর্মীর অভাব হয় না কখনো। প্রতিবারে এক ডজন ব্যাচ আসবে। প্রতি ব্যাচে থাকবে একশ জন। আমার অন্তত এক বছর লাগবে
“কোত্থেকে আসবে? কোত্থেকে?”
“পঁচিশ মিলিয়ন গ্রহের যে কোনোটা থেকেই আসতে পারে। আমাদের হরেক রকমের হর্টিকালচারাল জ্ঞান দরকার। এম্পায়ারের যে কোনো নাগরিক আবেদন করতে পারবে।”
‘ট্রানটর থেকেও?”
“না, ট্র্যানটর থেকে না। এই বাগানে ট্রানটরের কেউ নেই।” কণ্ঠে রাগ ফুটে উঠল। “ট্র্যানটরে কোনো গার্ডেনার নেই। গম্বুজের নিচে ওদের যে পার্ক আছে সেগুলোকে বাগান বলা যাবে না। টবে লাগানো গাছ আর খাঁচার ভেতরে পশুপাখি। ট্রানটরিয়ানরা মুক্ত বায়ু, স্রোতস্বীনি নদী, প্রকৃতির ভারসাম্য কিছুই জানে না।”
“ঠিক আছে গ্রুবার। তোমাকে একটা কাজ দিচ্ছি। আগামী কয়েক সপ্তাহে যত নতুন গার্ডেনার এখানে আসার জন্য নির্বাচিত হয়েছে তোমার দায়িত্ব তাদের সকলের নাম আমাকে জানানো। নাম, গ্রহ, রেফারেন্স নাম্বার, শিক্ষা, অভিজ্ঞতা, সবকিছু। সব তথ্য আমি আমার ডেস্কে চাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। তোমাকে সাহায্য করার জন্য লোক। পাঠাব। যন্ত্রপাতি সহ। তুমি কি ধরনের কম্পিউটার ব্যবহার কর?”
“সাধারণ মানের। উদ্ভিদ আর পশুপাখি চিহ্নিত করে রাখার জন্য।”
“ঠিক আছে। যে লোকগুলোকে পাঠাব তারা তুমি করতে পারবে না এমন যে কোনো কাজ করতে পারবে। বিষয়টা যে কত গুরুত্বপূর্ণ তোমাকে বুঝিয়ে বলতে পারব না।”
“আমি যদি কাজটা করে দেই-”
“বার, এখন দর কষাকষির সময় নয়। আমি ব্যর্থ হলে তোমাকে আর চীফ গার্ডেনার হতে হবে না। বরং পেনশন ছাড়াই তোমাকে বরখাস্ত করা হবে।”
আবার একা হলেন সেলডন। দিনের বাকী সব অ্যাপয়েন্টমেন্ট বতিল করার নির্দেশ দিলেন।
চেয়ারে হেলান দিয়ে প্রায় শুয়ে পড়লেন তিনি, পঞ্চাশ বছরের দেহের প্রতিটি স্পন্দন অনুভব করছেন, অনুভব করছেন মাথা ব্যথাটা ক্রমশ বাড়ছে। বছরের পর বছর ধরে, দশকের পর দশক ধরে ইম্পেরিয়াল প্যালেস গ্রাউণ্ডেত্র চারপাশে নিরাপত্তা বেষ্টনি তৈরি করা হয়েছে, ক্রমশই সেটা নিবিড় হয়েছে, নিখুঁত হয়েছে, এক স্তরের উপর আরোপ করা হয়েছে আরেক স্তর, নতুন নতুন আবিষ্কৃত যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হয়েছে।
–কিন্তু বহুদিন পরে হাজার হাজার আগন্তুককে বিনা বাধায় এখানে ঢুকতে দেয়া হবে। সম্ভবত “তুমি কি বাগানের কাজ জানো?” এটা ছাড়া আর কোনো প্রশ্নই করা হবে না।
বোকামির একটা সীমা থাকা দরকার।
আর ভাগ্যক্রমে তিনি সেটা সময়মতো ধরতে পারলেন। আসলেই পেরেছেন কি? নাকি এরই মধ্যে দেরী হয়ে গেছে?
.
২১.
গ্লেব এন্ডোরিন আধবোজা চোখে নামাত্রির দিকে তাকিয়ে আছে। লোকটাকে কখনোই পছন্দ করে নি তবে কয়েকবার এমন মুহূর্তও এসেছিল যখন সে লোকটাকে সাধারণত যা করে তারচেয়ে বেশী পছন্দ করেছিল, এবং এখন সেরকমই একটা মুহূর্ত। এন্ডোরিন, যার শরীরে রয়েছে ওয়ির সবচেয়ে অভিজাত পরিবারের রক্ত সে কেন উড়ে এসে জুরে বসা এই উন্মাদ লোকটাকে এতো পাত্তা দেবে।
কারণটা এন্ডোরিন জানে বলেই সহ্য করছে কষ্ট করে এমনকি যখন সে বুঝতে পারছে নামাত্রি দশ বছর ঘাম ঝরিয়ে তিল তিল করে কিভাবে সংগঠনটাকে নহে।
আজকের পর্যায়ে নিয়ে এসেছে সেই গল্প আবার শুরু করতে যাচ্ছে। গল্পটা কি সবাইকে বারবার শোনায়? নাকি শুধু তাকেই লক্ষ্য হিসেবে বেছে নিয়েছে?
ভয়ানক এক উল্লাস ফুটে উঠল নামাত্রির চেহারায়। অদ্ভুত একঘেয়ে সুরে বলা শুরু করল সে, “বছরের পর বছর, আমি লক্ষ্যে স্থির থেকে অমানুষিক পরিশ্রম করেছি, হঠাৎ হঠাৎ মনে হয়েছে কিছুই অর্জিত হবে না। তারপরেও সংগঠনটা গড়ে তুলেছি, প্রশাসনের বিরুদ্ধে জনগণকে খেপিয়ে তুলেছি। ব্যাংকিং ব্যবস্থার সমস্যার সময়-”
হঠাৎ থেমে গেল সে। “তোমাকে অনেকবার বলেছি আর তুমিও শুনে শুনে ক্লান্ত, তাই না?
প্রাণহীন শুষ্ক ছোট এক হাসিতে এডোরিনের ঠোঁট বাঁকা হলো। সে যে কি পরিমাণ বিরক্ত তা না বোঝার মতো বোকা নয় নামাত্রি। কিন্তু বিরক্ত না হয়ে কি করবে সে। “তুমি আমাকে অনেকবার বলেছ।” বলল সে। বাকী অংশটুকুর জবাব না দিয়ে ঝুলিয়ে রাখল। উত্তরটা তো জানাই আছে। সরাসরি বলার কোনো দরকার নেই।
নামাত্রির ফ্যাকাশে মুখ অপমানে খানিকটা লাল হলো। “যাই হোক, হয়তো এভাবেই চলত আজীবন–সংগঠন গড়ে তোলা, জনগণকে খেপিয়ে তোলা যদি সঠিক অস্ত্র খুঁজে না পেতাম–এবং কোনো রকম প্রচেষ্টা ছাড়াই সেটা আমার হাতে এসেছে।”
“ঈশ্বররা তোমার হাতে প্ল্যানচেটকে তুলে দিয়েছে।”
“ঠিক। আগামী কয়েকদিনের মধ্যেই একদল গার্ডেনার ইম্পেরিয়াল প্যালেস গ্রাউণ্ডে ঢুকতে যাচ্ছে।” একটু থেমে চিন্তাগুলো গুছিয়ে নিল নামাত্রি। “নারী এবং পুরুষ, আমাদের কর্মীদের আড়াল করে রাখার জন্য যথেষ্ট। তাদের মাঝে থাকবে তুমি–এবং প্ল্যানচেট। তবে পার্থক্য এই যে তোমাদের সাথে ব্লাস্টার থাকবে।”
“নিশ্চয়ই,” এন্ডোরিন তার বিদ্বেষ লুকানোর চেষ্টা করল না, “ঢোকার মুখে দরজাতেই আমাদের আটকানো হবে, প্রশ্ন করার জন্য বন্দী করবে। প্যালেস গ্রাউণ্ডে ব্লাস্টার নিয়ে ঢোকা-”
“তোমাদের কেউ আটকাবে না।” নামাত্রি বলল। এন্ডোরিনের কণ্ঠের বিদ্বেষ সে ধরতে পারে নি। “তোমাদের কেউ তল্লাশী করবে না। সেই ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রাসাদের কোনো কর্মকর্তা তোমাদের স্বাগত জানাবে। আমি জানি না দায়িত্বটা সাধারণত কার উপর ন্যস্ত করা হয়–খুব সম্ভবত ঘাস এবং পাতার দায়িত্বে নিয়োজিত থার্ড এ্যাসিসটেন্ট চেম্বারলেইন–তবে এই ক্ষেত্রে সেলডন নিজে আসবে। সেলডন তোমাদের গ্রাউন্ডে স্বাগত জানানোর জন্য অপেক্ষা করবে।”
“আশা করি এই ব্যাপারে তুমি নিশ্চিত।”
“অবশ্যই। সব ব্যবস্থা করা হয়েছে। একেবারে শেষ মুহূর্তে সে জানতে পারবে যে তার পালক ছেলে নতুন গার্ডেনারদের সাথে গ্রাউণ্ডে ঢুকছে। তখন কেউ তাকে আটকে রাখতে পারবে না। সে বেরিয়ে এলেই প্ল্যানচেট ব্লাস্টার তুলবে। আমাদের কর্মীরা একযোগে স্লোগান তুলবে, ‘বিশ্বসঘাতক। এই হৈ-হট্টগোলের মাঝে প্ল্যানচেট সেলডনকে খুন করবে’ আর তুমি খুন করবে প্ল্যানচেটকে। তারপর তুমি ব্লাস্টার ফেলে দিয়ে চলে আসবে। ওখানে আমাদের লোক আছে যারা তোমাকে পালিয়ে আসতে সাহায্য করবে।”
“প্ল্যানচেটকে খুন করা কি জরুরী?”
ভুরু কুঁচকালো নামাত্রি। “কেন? একজনকে খুন করবে আরেকজনকে খুন করতে তোমার আপত্তি কেন? তুমি কি চাও প্ল্যানচেট সুস্থ হয়ে আমাদের ব্যাপারে যা জানে সব কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দিক? তাছাড়া ঘটনাটাকে আমরা পারিবারিক কলহের জের হিসেবে প্রচার করার ব্যবস্থা করব। ভুলে যেয়ো না প্লনটেই আসলে রাইখ সেলডন। সবাই মনে করবে দুজন একসাথে গুলি করেছে–অথবা সেলডন নিজেই। নির্দেশ দিয়ে রেখেছে যে যদি তার ছেলে কোনো প্রকার সহিংস আচরণ করে তাকে যেন সাথে সাথে গুলি করা হয়। পারিবারিক কলহটা যেন অধিক গুরুত্ব পায় আমরা সেই বিষয়ে লক্ষ্য রাখব। অত্যাচারী সম্রাট ম্যানোয়েল এর ভয়াবহ দিনগুলোর পুনরাবৃত্তি ঘটবে। এই জঘন্য ঘটনার প্রতিবাদে ক্ষোভে ফেটে পড়বে ট্র্যানটরের জনগণ। জনজীবনে দীর্ঘদিন থেকে যে বিপর্যস্ত অচলাবস্থা চলছে সেই অসন্তোষের সাথে এই ঘটনার জের মিলে ভয়াবহ অবস্থা তৈরি হবে, নতুন সরকারের দাবী তুলবে জনগণ–এবং কেউ তাদেরকে দমিয়ে রাখতে পারবে না, সম্রাট তো নয়ই। ঠিক তখনই আমরা প্রকাশ্যে মাঠে নামব।”
“এতো সহজ?”
“না, এতো সহজ না। কল্পনার জগতে বাস করি না আমি। একটা অন্তবর্তী সরকার গঠন করা হবে, কিন্তু তারা ব্যর্থ হবে। তাদেরকে ব্যর্থ করে দেয়ার দায়িত্বও আমাদের। তখন আমরা প্রকাশ্যে মাঠে নামব, জোরানিউমের ধারণাকে ভিত্তি করে জনগণকে একত্রিত করব–যা ট্রানটরিয়ানরা কখনো ভুলে নি। এবং সময়মতো খুব বেশী দেরী হবে না–আমি হব ফার্স্ট মিনিস্টার।”
“আর আমি?”
“সম্রাট।”
“সফল হবার সম্ভাবনা খুবই কম। এই ব্যবস্থা হয়েছে, ওই ব্যবস্থা হয়েছে। সবগুলোই একত্রিত হতে হবে এবং নিখুঁতভাবে মিলাতে হবে, নয়তো সব ভেস্তে যাবে। কোথাও না কোথাও ভুল হবেই। অসম্ভব একটা ঝুঁকি।”
“অসম্ভব? কার জন্য? তোমার জন্য?”।
“অবশ্যই। তুমি চাইছ প্ল্যানচেট যেন তার বাবাকে খুন করে এবং তারপর আমার হাতে তার মৃত্যু হয় এই ব্যাপারটা নিশ্চিত করি, আমি কেন? আরো অনেকেই কাজটা করতে পারে। আমি ঝুঁকি না নিলেও চলে।”
“হ্যাঁ, কিন্তু অন্যদের দিয়ে কাজটা করানো মানে ব্যর্থতা নিশ্চিত করা। এই মিশনে তুমি ছাড়া আর কে আছে, যাকে আমি বিশ্বাস করতে পারি। অন্যরা শেষ মুহূর্তে পিছিয়ে যেতে পারে।”
“ঝুঁকির পরিমাণ সীমাহীন।”
“সেটা কি যুক্তিসঙ্গত নয়? তুমি ইম্পেরিয়াল সিংহাসনের আশায় কাজ করছ।”
“তুমি কি ঝুঁকি নিচ্ছ, চীফ? এখানে বসে থাকবে, নিরাপদে, সুখবরের আশায়।”
ঠোঁট বাঁকা করল নামাত্রি। “তুমি যে এতো বোকা আমি জানতাম না, এন্ডোরিন। কেমন সম্রাট হবে তুমি তোমার কি মনে হয় এখানে থাকব বলে আমি কোনো ঝুঁকি নিচ্ছি না? যদি জুয়ায় হেরে যাই, পরিকল্পনা ভেস্তে যায়, যদি দলের কর্মীদের কেউ ধরা পড়ে, তোমার কি মনে হয় ওরা মুখ বন্ধ রাখবে। যদি তুমি ধরা পড়, তাহলে কি ইম্পেরিয়াল গার্ডদের জামাই আদরের ঠেলায় মুখ না খুলে পারবে?
“আর একটা ব্যর্থ অভ্যুত্থানের পর, তোমার কি মনে হয় না যে আমাকে ধরার জন্য ওরা ট্র্যানটরে চিরুণীর মতো আচড়ানো শুরু করবে। তোমার কি মনে হয় ওরা আমাকে
ধরে থামবে? ধরা পড়লে ওরা কি আমাকে মাথায় তুলে নাচবে?–ঝুঁকি? এখানে চুপচাপ বসে থেকেই আমি তোমাদের সবার চেয়ে বেশী ঝুঁকি নিচ্ছি। আমি ফুটন্ত কড়াই এর উপর বসে আছি, এন্ডোরিন। তুমি সম্রাট হতে চাও নাকি চাও না।”
খাটো গলায় জবাব দিল এন্ডোরিন। “আমি সম্রাট হতে চাই।”
আর এভাবেই ঘটনার চাকা ঘুরতে শুরু করল।
.
২২.
তাকে যে একটু বিশেষ খাতির যত্ন করা হচ্ছে এটা বুঝতে রাইখের কোনো অসুবিধা হলো না। সম্ভাব্য গার্ডেনারদের পুরো দলটাই ইম্পেরিয়াল সেক্টরের এক হোটেলে উঠেছে। অবশ্যই সস্তাদরের হোটেল।
গার্ডেনারদের দলটা অদ্ভুত একটা দল, পঞ্চাশটা বিভিন্ন গ্রহ থেকে এসেছে, কিন্তু তাদের সাথে কথা বলার সুযোগ হয়নি রাইখের। এডোরিন সুকৌশলে তাকে অন্য সবার কাছ থেকে আলাদা করে রেখেছে।
রাইখ ভেবে পাচ্ছে না কেন। হতাশায় ভুগছে সে। সত্যি কথা বলতে কি ওয়ি ছেড়ে আসার পর থেকেই হতাশায় ভুগছে। ঠিকমতো ভাবতে পারছে না। এই অবস্থা কাটানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু সফল হতে পারছে না।
এন্ডোরিন সস্তা পোশাক পড়েছে, আচরণ করছে শ্রমিকদের মতো। এই ‘নাটকে’ গার্ডেনার হিসেবে সেও একটা ভূমিকায় অভিনয় করছে–সেটা যাই হোক।
রাইখের অস্বস্তির আরো একটা বড় কারণ এই নাটকের প্রকৃতি সে এখনো বুঝতে পারে নি। সবাই তাকে সর্বক্ষণ ঘিরে থাকছে এবং যোগাযোগের সুযোগ বন্ধ করে রেখেছে আর তাই বাবাকেও কিছু জানাতে পারে নি। হয়তো প্রত্যেক ট্র্যানটরিয়ানের জন্যই এই নিয়ম, অতিরিক্ত সতর্কতা। রাইখের হিসাবে তাদের সাথে আরো কমপক্ষে এক ডজন ট্র্যানটরিয়ান আছে, সবাই নামাত্রির কর্মী, নারী এবং পুরুষ।
যে বিষয়টা তাকে সবচেয়ে বেশী দ্বিধায় ফেলে দিয়েছে তা হলো এন্ডোরিনের মধুর ব্যবহার। প্রতিটি বিষয়ে তার প্রতি খেয়াল রাখছে, সাথে নিয়ে খেতে বসছে। অন্য সবার থেকে তার সাথে বেশী ভালো আচরণ করছে।
কারণটা কি এই যে তারা দুজনেই মানীলাকে শেয়ার করেছে? ওয়ির সামাজিক রীতিনীতির তেমন কিছুই জানে না রাইখ, কাজেই বলতে পারবে না তাদের সমাজে যখন দুজন পুরুষ একই মেয়ের সাথে সম্পর্ক তৈরি করে তখন কি তাদের মাঝে একটা ভ্রাতৃত্ব তৈরি হয়? একটা বন্ধন তৈরি হয়?
রাইখের জানা নেই। ট্র্যানটরের সামাজিক রীতিনীতিই সে জানে না গ্যালাকটিক সমাজের অগণিত রীতিনীতি তো দূরের কথা।
মানীলার কথা মনে পড়তেই আরো অস্থির হয়ে পড়ল। মেয়েটার অভাব অনুভব করছে সে। হয়তো এটাই তার হতাশার কারণ। কিন্তু সত্যি বলতে কি এন্ডোরিনের সাথে বর্তমান লাঞ্চ শেষ করার পর তার আরো জঘন্য মনে হতে লাগল–যদিও এর কোনো কারণ বুঝতে পারছে না।
মানীলা!
মেয়েটা বলেছিল ইম্পেরিয়াল সেক্টর দেখতে চায় এবং এন্ডোরিনকে হয়তো বা রাজী করাতে পারবে। বোকার মতো প্রশ্ন করা থেকে নিজেকে সে বিরত রাখতে পারল না। “মি, এন্ডোরিন, ভেবে পাচ্ছি না মিস ডুবানকুয়াকে ইম্পেরিয়াল সেক্টরে নিয়ে এলেন না কেন?”
নিখাদ বিস্ময় ফুটে উঠল এন্ডোরিনের চেহারায়। “মানীলা? ওকে কখনো গার্ডেনিং এর কাজ করতে দেখেছ? বা করতে পারে বলে মনে হয়েছে? না, না, মানীলা সেই ধরনের মেয়ে যাকে শুধু আমাদের আনন্দের জন্যই সৃষ্টি করা হয়েছে। তাছাড়া এখানে ওর কোনো কাজ নেই। হঠাৎ এই প্রশ্ন করলে কেন, প্ল্যানচেট?”
কাঁধ নাড়ল রাইখ। “জানি না। এখানে সবকিছু কেমন একঘেয়ে। হয়তো-” কণ্ঠস্বর ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে পড়ল।
সতর্ক দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করছে এন্ডোরিন। তারপর বলল, “নিশ্চয়ই এইকথা বলবে না যে কোন মেয়ের সাথে সম্পর্ক রাখছ সেটা তোমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ? বিশ্বাস কর মানীলা কতজন পুরুষের সাথে সম্পর্ক রাখছে সেটা নিয়ে মোটেই ভাবে না। হাতের কাজ শেষ হলে অন্য মেয়ে খুঁজে নিতে পারবে। অনেক মেয়ে।”
“কখন শেষ হবে?”
“শেষ হতে আর বেশী দেরি হবে না। এবং তুমি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা ভূমিকা পালন করবে।” সরু দৃষ্টিতে রাইখকে দেখছে এন্ডোরিন।
“কতখানি গুরুত্বপূর্ণ? আমি শুধুই গার্ডেনার হব–তাই না?” রাইখের গলাটা কেমন ফাঁকা শোনাল এবং চেষ্টা করল খানিকটা আগ্রহের সুর মেশাতে।
“আরো বড় কিছু হবে, প্ল্যানচেট। তোমার সাথে ব্লাস্টার থাকবে।”
“কি থাকবে?”
“ব্লাস্টার।”
“আমি কখনো ব্লাস্টার ধরিনি। জীবনেও না।”
“তেমন কঠিন কিছু না। তুলবে, নিশানা করবে, ট্রিগার চাপবে এবং কেউ একজন মারা যাবে।”
“আমি কাউকে খুন করতে পারব না।”
“ভেবেছিলাম তুমি আমাদেরই একজন, আদর্শের জন্য সবকিছু করতে পারবে।”
“আমি খুন করার কথা বলি নি।” রাইখ গুছিয়ে ভাবতে পারছে না। তাকে কেন খুন করার মতো জঘন্য কাজ করতে হবে? এই লোকগুলো তাকে নিয়ে কি পরিকল্পনা করে রেখেছে? এবং হত্যাকাণ্ড ঘটার আগেই কিভাবে ইম্পেরিয়াল গার্ডদের সতর্ক করা যায়?
হঠাৎ করেই এভোরিনের চেহারা কঠিন হয়ে গেল, বন্ধুত্বপূর্ণ কণ্ঠস্বর পাল্টে গেল তার, কর্তৃত্বপরায়ণ দৃঢ় সুরে সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিল, “তুমি অবশ্যই খুন করবে?”
সমস্ত শক্তি একত্রিত করে জবাব দিল রাইখ, “না, আমি কাউকেই খুন করমু। । এইডাই শেষ কথা।”
“প্ল্যানচেট, তোমাকে যা বলব তুমি তাই করবে।”
“খুন বাদে।”
“এমনকি খুনও করবে।”
“আপনি আমারে দিয়া ক্যামনে করাইবেন?”
“তোমাকে শুধু কাজটা করতে বলব।” ক্লান্ত বোধ করছে রাইখ। এন্ডোরিন এতো আত্মবিশ্বাসী কেন? মাথা নাড়ল সে। “না।”
“তোমাকে আমরা ভালো খাওয়াচ্ছি, প্ল্যানচেট, ওয়ি ছেড়ে আসার পর থেকেই। সবসময় খেয়াল রেখেছি তুমি যেন আমার সাথে খাও। আমি তোমার খাবারদাবারের তত্ত্বাবধান করেছি, বিশেষ করে এই মুহূর্তে যা খেলে।”
নিজের ভেতরে একটা প্রবল আতংক বেড়ে উঠছে, টের পেল রাইখ। হঠাৎ সব তার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল। “ডেসপারেন্স!”
“ঠিক। তুমি ভীষণ চালাক, প্ল্যানচেট।”
“কাজটা বে-আইনী।”
“অবশ্যই। খুনও তাই।”
ডেসপারেন্সের কথা জানে রাইখ। জিনিসটা একটা নির্দোষ ট্র্যাংকুইলাইজারের রাসায়নিক ভাবে পরিবর্তিত উপাদান। উপাদানটা মানুষকে সংজ্ঞাহীন না করে বরং হতাশাগ্রস্ত করে তোলে। মাইন্ড কন্ট্রোল করা যায় বলে এটার ব্যবহার আইন করে নিষিদ্ধ করা হয়েছে যদিও গুজব শোনা যায় যে ইম্পেরিয়াল গার্ডরা এই উপাদান ব্যবহার করে।
এন্ডোরিন এমন সুরে কথা বলল যেন সে রাইখের মনের কথা সব পড়তে পারছে। “এর নাম ডেসপারেন্স কারণ এটা একটা প্রাচীন শব্দ যার অর্থ নৈরাশ্য। আমার ধারণা তুমি ভীষণ নিরাশ বোধ করছ।”
ককোনো জবা, মনে জানে?
“কখনোই না।” ফিস ফিস করে বলল রাইখ।
“তুমি ভীষণ শক্ত, কিন্তু কেমিক্যালের বিরুদ্ধে কি করবে? তুমি যত হতাশ বোধ করবে ড্রাগসটা তত বেশী কার্যকরী হয়ে উঠবে।”
“কোনো সম্ভাবনা নেই।”
“ভেবে দেখো, প্ল্যানচেট। দেখার সাথে সাথেই নামাত্রি তোমাকে চিনতে পেরেছে, গোঁফ ছাড়াই। সে জানে তুমি রাইখ সেলডন এবং আমার নির্দেশে তুমি তোমার বাবাকে খুন করবে।”
“তার আগে তোকে খুন করব।” বিড় বিড় করে বলল রাইখ।
চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল সে। এই কাজটা করতে তার মোটেই কোনো সমস্যা হবে না। এন্ডোরিন হয়তো লম্বা, কিন্তু সে হালকা পাতলা, পেশীবহুল নয় মোটেই। রাইখ এক হাতেই তাকে দুটুকরো করে ফেলতে পারবে। কিন্তু উঠে দাঁড়াতেই তার দেহ টলে উঠল। মাথা ঝাঁকাল কিন্তু ঝাপসা ভাবটা দূর হলো না।
এন্ডোরিনও উঠে দাঁড়িয়েছে, পিছিয়ে গেল কয়েক কদম। পকেট থেকে হাত বের করে আনল। এখন সেখানে শোভা পাচ্ছে একটা অস্ত্র।
আমুদে গলায় বলল সে, “আমি তৈরি হয়েই এসেছি। শুনেছি তুমি দক্ষ হ্যাঁলিকনিয়ান টুইস্টার। কিন্তু হাতাহাতি লড়াইয়ের কোনো ইচ্ছা নেই।”
এবার হাতে ধরা অস্ত্রের দিকে তাকাল। “এটা ব্লাস্টার নয়।” সে বলল। “কাজ শেষ হওয়ার আগে তোমাকে মারব না। এটা নিউরোনিক হুইপ। আরো বেশী মারাত্মক। তোমার বাম কাঁধে মারব। বিশ্বাস কর, যে ভয়ংকর ব্যথা পাবে তা মহাবিশ্বের কোনোকিছু দিয়েই উপশম করা যাবে না।”
ধীরে ধীরে এগোচ্ছিল রাইখ। হোঁচট খেয়ে থেমে গেল। মাত্র বারো বছর বয়সেই নিউরোনিক হুইপের আঘাত সহ্য করতে হয়েছে তাকে। ছোট একটা আঘাত। কেউ যদি একবার এই অস্ত্রের আঘাত পায় তাহলে যতদিন বেঁচে থাকবে, জীবন যত ঘটনাবহুলই হোক না কেন–ব্যথাটা কখনো ভুলতে পারবে না।
এন্ডোরিন বলল, “তাছাড়া, আমি পূর্ণ শক্তিতে আঘাত করব। বাঁ হাতের স্নায়ুতে প্রথমে অসহ্য ব্যথা তৈরি হবে, তারপর অকেজো হয়ে যাবে। জীবনে আর কোনোদিন বাঁ হাত ব্যবহার করতে পারবে না। ডান হাতের কিছু করব না, কারণ ওই হাতে তোমাকে ব্লাস্টার চালাতে হবে। যদি শান্ত হয়ে বসে থাক, সবকিছু মেনে নাও, তাহলে দুই হাতই বাঁচাতে পারবে। এছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই। অবশ্য তোমাকে আবার খেতে হবে যেন ডেসপারেন্স লেভেল বৃদ্ধি পায়।”
রাইখ টের পাচ্ছে ড্রাগস এর প্রভাবে হতাশা তাকে দৃঢ়ভাবে আকড়ে ধরছে। চোখের সামনে প্রত্যেকটা বস্তুই দেখছে দুটো করে। মাথা ঠাণ্ডা করে ভাবতে পারছে না।
রাইখ শুধু জানে যে এন্ডোরিনের কথা তাকে মানতেই হবে। এই খেলায় সে হেরে গেছে। “না,” প্রায় মারমুখী হয়ে বললেন সেলডন। “তুমি ওখানে যেতে পারবে না, ডর্স।”
ডর্সের দৃষ্টিতেও ঠিক একই রকম দৃঢ়তা ফুটে উঠল। “তাহলে তোমাকেও যেতে দেব না, হ্যারি।”
“আমাকে যেতেই হবে।”
“কাজটা তোমার নয়। নতুনদের অভ্যর্থনা জানানোর দায়িত্ব প্রথম শ্রেণীর গার্ডেনারের।”
“হ্যাঁ। কিন্তু গ্রুবার পারবে না। সে ভীষণ মুষড়ে পড়েছে।”
“নিশ্চয়ই তার সহকারী আছে। অথবা বৃদ্ধ চীফ গার্ডেনারকেই কাজটা করতে বল। এই বছরের শেষ নাগাদ সে দায়িত্বে থাকবে।”
“চীফ গার্ডেনার অসুস্থ। তাছাড়া-” ইতস্ততঃ করছেন সেলডন।–“গার্ডেনারদের ভেতর গুঞ্জন শুরু হয়েছে। ট্রানটরিয়ানস। কোনো কারণে ওরাও আসছে। প্রত্যেকের নাম আমি জানি।
“সবাইকে কাস্টডিতে নিয়ে যাও। প্রত্যেককে। সহজ ব্যাপার। তুমি শুধু শুধু । ব্যাপারটাকে এতো জটিল করে তুলছ কেন?”
“কারণ আমরা জানি না ওরা কেন এসেছে। বার জন গার্ডেনার মিলে কি করতে পারবে আমি বুঝতে পারছি না, কিন্তু না, সংশোধন করে বলছি ওরা কি করতে পারে তার ডজন খানেক অনুমান আমার আছে, কিন্তু জানি না কোনটা করার পরিকল্পনা ওদের। অবশ্যই ওদেরকে কাস্টডিতে নেব কিন্তু তার আগে ভালোমতো জেনে নিতে হবে।
“ষড়যন্ত্রের সাথে জড়িত প্রত্যেককেই ধরতে হবে। দলনেতা সহ একেবারে নিচু সারির কর্মী পর্যন্ত। ওদের আসল পরিকল্পনা কি বুঝতে হবে যেন যথাযথ শাস্তির ব্যবস্থা করা যায়। হাস্যকর অভিযোগে বারো জন নারী পুরুষকে আমি গ্রেপ্তার করতে চাই না। ওরা বলবে যে বাধ্য হয়েই এসেছে কারণ কাজ দরকার। বরং পাল্টা অভিযোগ তুলবে যে ট্র্যানটরিয়ানদের বাদ দেয়াটা অনুচিত। প্রচুর সমর্থনও পাবে আর আমাদের বোকা বনতে হবে। কিছু একটা করার সুযোগ দিতে হবে যেন ওদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দাঁড় করাতে পারি। তাছাড়া-”
শীতল গলায় জিজ্ঞেস করল ডর্স, “তাছাড়া কি?”
নিচু গলায় বললেন সেলডন, “দলটার সাথে রাইখও আছে, প্ল্যানচেট ছদ্মনামে।”
“কি?”
“অবাক হচ্ছ কেন? তাকে ওয়িতে পাঠিয়েছিলাম জোরামাইট আন্দোলনের ভেতরে ঢুকে খবর বের করে আনার জন্য। কিছু একটা তো বের করতে পেরেছে। দলটার সাথে সে যখন আসছে জেনে শুনেই আসছে। নিশ্চয়ই ওর কোনো পরিকল্পনা আছে। কিন্তু আমিও ওখানে থাকতে চাই। সম্ভব হলে ওকে সাহায্য করতে চাই।”
“যদি সত্যিই সাহায্য করতে চাও তাহলে গার্ডেনারদের দুপাশে পঞ্চাশজন গার্ডকে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড় করিয়ে দাও।”
“না। তাতেও কোনো লাভ হবে না। ইম্পেরিয়াল গার্ড থাকবে। কিন্তু আড়ালে। গার্ডেনারদের মনে কোনো সন্দেহ জাগানো যাবে না। বুঝতে দিতে হবে যে তাদের পরিকল্পনা আমরা টের পাইনি। কিছু করার আগেই, কিন্তু ওরা যে কিছু একটা করতে চায় এবং কি করতে চায় তা বোঝার পর সবাইকে বন্দী করা হবে।”
“ঝুঁকিপূর্ণ। রাইখের জন্য অনেক বেশী ঝুঁকি”
“ঝুঁকি আমাদের নিতেই হবে। একজন মানুষের জীবনের চাইতে আমাদের লক্ষ্য অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ।”
“নির্দয়ের মতো কথা বললে।”
“তোমার ধারণা আমার কোনো দয়ামায়া নেই। না থাকলেও আমার একমাত্র চিন্তা সাইকো-”।
“আর বলল না,” মুখ ঘুরিয়ে নিল ডর্স।
“বুঝেছি,” সেলডন বললেন। “কিন্তু তুমি ওখানে থাকতে পারবে না। তোমার উপস্থিতি এতো বেশী চোখে পড়বে যে ষড়যন্ত্রকারীরা ধরে নেবে আমরা সব জানি। তখন তারা পরিকল্পনা বাদ দেবে। আমি সেটা চাই না।”
একটু থামলেন, তারপর নরম সুরে বললেন, “ডর্স, তুমিই বলেছ তোমার দায়িত্ব। আমাকে রক্ষা করা। রাইখকে নিরাপত্তা দেয়ার আগেই তোমাকে সেটা ভাবতে হবে। আমি কখনো বলি নি কিন্তু আমাকে রক্ষা করার মানে সাইকোহিস্টোরি এবং সমগ্র মানব জাতিকে রক্ষা করা। সর্বপ্রথম তোমাকে এই কথাই ভাবতে হবে। সাইকোহিস্টোরি আমাকে যা বলছে তা হলো আমি, আমাকেই যে কোনো মূল্যে কেন্দ্র রক্ষা করতে হবে এবং আমি তাই করার চেষ্টা করছি।–বুঝেছ?”
“বুঝেছি।”
আশা করি আমার কোনো ভুল হয়নি। সেলডন ভাবলেন।
যদি ভুল হয়, ডর্স তাকে কোনোদিন ক্ষমা করবে না। তারচেয়েও খারাপ তিনি নিজেই নিজেকে কোনোদিন ক্ষমা করতে পারবেন না–সাইকোহিস্টোরি হোক বা না হোক।
.
২৪.
চমৎকার সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছে সবাই, পা ছড়িয়ে, হাত পিছমোড়া। সবার পরনে ঘন সবুজ ইউনিফর্ম, ঢিলাঢালা, বড় পকেট। নারী পুরুষ আলাদাভাবে চেনার উপায় নেই তবে অনুমান করে নেয়া যায় যে খর্বাকৃতির দুই একজন হয়তো মেয়ে। হুড মাথার চুল ঢেকে রেখেছে, অবশ্য নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সব গার্ডেনারকেই মাথার চুল ছোট রাখতে হয় এবং দাড়ি গোঁফ রাখা যাবে না।
কেন করতে হবে, কেউ জানে না। প্রথা’ এই শব্দটাই সব ঢেকে দেবে, যেমনিভাবে আরো অনেক কিছুই ঢেকে রেখেছে। কোনটা কাজের কোনোটা অকাজের।
সবার মুখোমুখী দাঁড়িয়ে আছে গ্রুবার, দুপাশে দুজন সহকারী। সারা শরীর কাঁপছে বারের। ছলছল করছে বিস্ফারিত চোখগুলো।
হ্যারি সেলডনের ঠোঁট দৃঢ়ভাবে চেপে বসল। গ্রুবার যদি কষ্ট করে এটুকুই বলতে পারে, “সম্রাটের গার্ডেনারগণ, তোমাদের স্বাগতম।” সেটাই যথেষ্ট। তারপরের দায়িত্ব নেবেন তিনি।
নতুন দলটার উপর দৃষ্টি ঘুরে বেড়াতে লাগল তার। রাইখকে দেখতে পেলেন।
হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেল। গোঁফবিহীন রাইখ একেবারে সামনের সারিতে, অন্য সবার চেয়ে অনেক বেশী আড়ষ্ট ভঙ্গীতে দাঁড়ানো, সরাসরি সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। দৃষ্টি ঘুরিয়ে সেলডনের চোখের দিকে তাকাল না সে।
ভালো, সেলডন ভাবলেন। কোনোভাবেই তাদের দুজনের পরিচয় আছে বুঝতে দেয়া যাবে না।
গ্রুবার বিড় বিড় করে স্বাগত জানাল আর সেলডন কাজ শুরু করলেন।
সাবলীল পদক্ষেপে সামনে বাড়লেন তিনি, গ্রুবারের ঠিক সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, “ধন্যবাদ, গার্ডেনার ফার্স্ট ক্লাস। পুরুষ এবং নারীগণ, সম্রাটের গার্ডেনারগণ, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতে হবে তোমাদের। আমাদের এই মহান ট্র্যানটর, এম্পায়ারের রাজধানীর একমাত্র উন্মুক্ত প্রান্তরের সৌন্দর্য এবং রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব তোমাদের। তোমাদের প্রমাণ করতে হবে যে পুরো গ্রহটা গম্বুজ দ্বারা আবৃত থাকলেও আমাদের এমন এক মূল্যবান রত্ন আছে যা এম্পায়ারের সবকিছু থেকে বেশী দ্যুতিময়।
“তোমরা ম্যান্ডেল গ্রুবারের অধীনে কাজ করবে। অল্প কয়েকদিন পরেই সে চীফ গার্ডেনারের দায়িত্ব নেবে। প্রয়োজন হলে সে আমার কাছে রিপোর্ট করবে, আমি সম্রাটের কাছে। তার মানে, সবাই বুঝতে পারছ যে, স্বয়ং সম্রাটের কাছ থেকে মাত্র তিন স্তর দূরে থাকবে এবং সর্বক্ষণ তার কৃপাদৃষ্টি লাভ করবে। আমি জানি, এমনকি এই মুহূর্তেও তিনি এর ছোট প্রাসাদ তার বাসভবন থেকে আমদের দেখছেন, ডান দিকের বর্ণিল গম্বুজঅলা ভবনটা–এবং দেখে তিনি অত্যন্ত খুশি হয়েছেন।
“কাজ শুরু করার আগে তোমাদের সবাইকে প্রশিক্ষণ দেয়া হবে যেন তোমরা পুরো এলাকা এবং তার প্রয়োজনের সাথে পরিচিত হতে পার। তোমরা-”
এর মধ্যে তিনি সরাসরি রাইখের দৃষ্টি বরাবর এসে দাঁড়ালেন। কিন্তু রাইখ এখনো মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে, পলকহীন।
পুত্রস্নেহ যেন চেহারায় ফুটে না উঠে সেই চেষ্টা করলেন সেলডন, কিন্তু রাইখের পিছনে দাঁড়ানো চেহারাটা দেখে ভুরু সামান্য কুঁচকে গেল। লোকটাকে হয়তো সেলডন চিনতে পারতেন না, যদি তার হলোগ্রাম দেখা না থাকত। ওয়ির গ্নেব এন্ডোরিন? এবং ওয়িতে রাইখের আশ্রয়দাতা? সে কি করছে এখানে?
সেলডনের হঠাৎ ভাবান্তর নিশ্চয়ই এডোরিনের চোখে পড়েছে, কারণ ঠোঁট ফাঁক না করেই বিড় বিড় করে কি যেন বলল সে। পিছন থেকে ডান হাত সামনে নিয়ে এল রাইখ, হাতে একটা ব্লাস্টার। এডোরিনের হাতেও তাই।
সেলডনের উপর যেন বজ্রপাত হলো। গ্রাউণ্ডের ভেতর ব্লাস্টার নিয়ে ঢুকল কিভাবে? হতবুদ্ধিকর অবস্থার কারণে বিশ্বাসঘাতক!” শব্দটা তার কানে ঢুকল না। হঠাৎ প্রচণ্ড গোলমাল আর হুড়োহুড়োর কিছুই টের পেলেন না।
ওই মুহূর্তে তার মাথাতে শুধু একটা চিন্তাই ঘুরপাক খাচ্ছিল, রাইখের ব্লাস্টারের নিশানা সরাসরি তিনি এবং রাইখের দৃষ্টিতে পরিচয়ের কোনো চিহ্নই নেই। প্রচণ্ড আতংক নিয়ে বুঝতে পারলেন যে নিজের সন্তানের হাতে খুন হতে যাচ্ছেন তিনি। মৃত্যুর মুখ থেকে মাত্র কয়েক সেকেণ্ড দূরে দাঁড়ানো।
.
২৫.
ব্লাস্টার, নাম যাই হোক, কাজের ক্ষেত্রে এই অস্ত্র কোনো বস্তুকে ব্লাস্ট করে না। বরং দেহের অভ্যন্তরে কোনো অংশ বাষ্পে পরিণত করে এবং–অন্তঃবিস্ফোরণ ঘটায়। দীর্ঘশ্বাসের মতো একটা শব্দ হয়।
হ্যারি সেলডন শব্দটা শোনার আশা করেন নি। শুধু মৃত্যু আশা করেছিলেন। অথচ সীমাহীন বিস্ময়ের সাথে তিনি শব্দটা শুনতে পেলেন। দ্রুত চোখ পিটপিট করতে করতে হা করে তাকালেন নিজের দিকে।
তিনি বেঁচে আছেন? (মন্তব্য নয়, বরং প্রশ্নের মতো করে ভাবলেন।)
রাইখ এখনো দাঁড়িয়ে আছে, ব্লাস্টার সামনের দিকে নিশানা করা, কাঁচের মতো স্বচ্ছ চোখের দৃষ্টি, নিষ্প্রাণ মূর্তির মতো, যেন তার চলৎশক্তি কেড়ে নেয়া হয়েছে।
তার পিছনেই পড়ে আছে এন্ডোরিনের দোমড়ানো মোড়ানো দেহ, নিজের রক্তে ভাসছে আর তার পাশেই দাঁড়ানো, হাতে ব্লাস্টার, আরেকজন গার্ডেনার। মাথার হুড সরে গেছে; গার্ডেনার একজন মেয়ে, হয়তো বা মাত্র একদিন আগেই চুল কেটে ছোট করেছে।
মেয়েটা দ্রুত একবার সেলডনের দিকে তাকাল, বলল, “আপনার ছেলে আমাকে মানীলা ডুবানকুয়া নামে চেনে। আমি একজন সিকিউরিটি অফিসার। আমার রেফারেন্স নাম্বার জানতে চান, ফার্স্ট মিনিস্টার?”
“দরকার নেই,” দুর্বল গলায় বললেন সেলডন। ইম্পেরিয়াল গার্ডদের দ্রুত ঘটনাস্থলে হাজির হতে দেখা গেল। “আমার ছেলে! কি হয়েছে ওর?”
“ডেসপারেন্স, আমার ধারণা,” মানীলা বলল। “শরীর থেকে বের করে নেয়া যাবে, অসুবিধা হবে না।” সামনে এগিয়ে এসে রাইখের হাত থেকে ব্লাস্টারটা নিল সে। “দুঃখিত, আরো আগেই কিছু করতে পারি নি। ওদের পদক্ষেপের জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে। আসল উদ্দেশ্যটা যখন বুঝতে পারি, ভীষণ হতচকিত হয়ে যাই।”
“আমারও একই সমস্যা। রাইখকে প্যালেস হসপিটালে নিয়ে যেতে হবে।” হঠাৎ ছোট প্রাসাদ থেকে দ্বিধাগ্রস্ত হৈ-চৈ শোনা গেল। সেলডনের মনে হলো সম্রাট পুরো ঘটনাটাই দেখেছেন এবং অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়েছেন।
“আমার ছেলের দিকে খেয়াল রাখো, মিস, ডুবানকুয়া।” সেলডন বললেন। “সম্রাটকে আগে সামলাতে হবে।”
পদমর্যাদা ভুলে ভীড়ের মাঝ দিয়ে বিশাল লনের উপর দিয়ে দৌড় দিলেন। কোনোরকম আনুষ্ঠানিকতার ধার না ধেরেই ছোট প্রাসাদে ঢুকে পড়লেন। ক্লীয়নের নিশ্চয়ই এখন এটা নিয়ে মাথা ঘামানোর অবকাশ নেই।
এবং অনেকগুলো, হতভম্ব, আতংকিত দৃষ্টির সম্মুখে অর্ধবৃত্তাকার সিঁড়ির মাঝখানে হিজ ইম্পেরিয়াল ম্যাজেস্টি প্রথম ক্লীয়নের মৃতদেহ পড়ে আছে, দোমড়ানো, চেনার কোনো উপায় নেই। মূল্যবান ইম্পেরিয়াল আলখাল্লাই তার কাফনের কাজ করছে। দেয়ালের কোণায় জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে বোকার মতো দৃষ্টিতে চারপাশ থেকে ঘিরে থাকা আতংকিত মুখগুলো দেখছে, ম্যান্ডেল গ্রুবার।
সেলডনের মনে হলো তিনি আর সহ্য করতে পারবেন না। বারের পায়ের কাছে পড়ে থাকা ব্লাস্টারটা তুলে নিলেন। তিনি নিশ্চিত অস্ত্রটা এন্ডোরিনের। অবিশ্বাস্য রকম নরম সুরে বললেন, “বার, কি করেছ তুমি?”
গ্রুবার তার দিকে তাকিয়ে হড়বড় করে বলতে লাগল, “সবাই চীৎকার আর হৈ চৈ করছিল। ভাবলাম, কে বুঝতে পারবে? সবাই ধরে নেবে অন্য কেউ সম্রাটকে খুন করেছে। কিন্তু তারপর আমি আর দৌড়ে পালাতে পারি নি।”
“কিন্তু, গ্রুবার। কেন?”
“তাহলে আমাকে আর চীফ গার্ডেনারের অফিসে বসতে হতো না।” বলেই অচেতন হয়ে পড়ে গেল সে।
অচেতন বারের দিকে তাকিয়ে বিষণ্ণ মনে মাথা নাড়লেন সেলডন।
পরিকল্পনাটা করা হয়েছে অনেক হিসাব করে। কোনো বিকল্প ছিল না কিন্তু ঝুঁকি ছিল। তিনি নিজে বেঁচে আছেন, রাইখ বেঁচে আছে। এন্ডোরিন মৃত এবং জোরানুমাইট ষড়যন্ত্রকারীদের জড়শুদ্ধ উপড়ে ফেলা হবে। একজনও বাঁচবে না।
কেন্দ্র ধরে রাখা যাবে, সাইকোহিস্টোরি যেমন নির্দেশনা দিয়েছিল।
এবং সেই মুহূর্তেই, একজন মাত্র মানুষ, বিশ্লেষণের অযোগ্য হাস্যকর কারণে, সম্রাটকে হত্যা করল।
এখন, তিক্ত মনে ভাবলেন সেলডন, কি করব? কি হবে এরপর?