আমরা দেশ গড়বো কবে?
আমাদের দেশপ্রেম আমরা গানে গানে যতটা ছড়িয়ে দিয়েছি, দেশ গড়বার কাজে ততটা প্রসারিত করিনি।
আমরা নাকি এদেশের মানুষকে ভালোবাসি। সে ভালোবাসা এদেশের মানুষের মন থেকে অজ্ঞতা দূর করবার কাজে এগিয়ে যেতে আমাদের কতটুকু সাহায্য করেছে? এই সেদিনও (২৭ মার্চ, ১৯৬৮) ডাঃ ত্রিগুণা সেন লোকসভায় বললেন যে, প্রাথমিক শিক্ষা প্রসারের কাজে ভারতের অন্যান্য কয়েকটি প্রদেশ যতটা এগিয়ে গেছে, বাংলা দেশ ততটা এগোয়নি। ভারতের এই পূর্ব কোণে আধুনিক শিক্ষার প্রথম আবিভাব রামমোহনের দিনে। সেই বাংলা দেশ আজ অশিক্ষায় অগ্রণী হতে চলেছে। আমাদের সকলের। পক্ষেই, বিশেষত বিশ বৎসরের কংগ্রেসী শাসনের পক্ষে, এটা লজ্জার কথা। আমরা। শিক্ষার চেয়ে রাজনীতিকে, মানুষ তৈরীর কাজের চেয়ে ক্ষমতার কাড়াকাড়িটাকে বড় ভেবে নিয়ে দিনে দিনে ডুবছি। প্রাথমিক শিক্ষকেরাও অর্থব্যয় করে দিল্লীতে গিয়ে দাবি করেছেন, রাজ্যপাল ধর্মবীরকে বাংলা দেশ থেকে সরাও। তার চেয়ে বেশী প্রয়োজন শিক্ষকদের সংগঠন থেকে রাজনীতি সরানো এবং সেখানে খানিকটা শিক্ষাপ্রীতি ঢোকানো।
আমরা নাকি এদেশের মাটিকে ভালোবাসি। এদেশের কৃষি অথবা আর্থিক মানচিত্রের দিকে তাকালে বিশ্বাস করা কঠিন হয় যে, কথাটা সত্য। সরকারী ভূমি সংস্কার সত্ত্বেও কর্ষিত জমির একটা বড় অংশ এখনও স্বল্পাংশ লোকের হাতে থেকে গেছে। এই অপেক্ষাকৃত বিত্তবান ও শিক্ষিত ভূম্যধিকারীরা দেশের মাটিকে সুফলা করার জন্য কতটুকু উদ্যোগী হয়েছেন? যখন ধান কাটা হয়, তখন তাঁরা গ্রামে যান শস্যের একটি অংশ গ্রহণ করবার জন্য। কিন্তু শস্যোৎপাদন বৃদ্ধির জন্য তাঁরা কি করছেন? অথচ করবার কাজ অনেক আছে। একর প্রতি উৎপাদনে এশিয়ার অন্যান্য বহু দেশের চেয়ে আমরা পিছিয়ে আছি। ভারতের তুলনায় চীনে একর প্রতি ধানের উৎপাদন প্রায় দ্বিগুণ, তাইওয়ানে আরও বেশী। জাপানে তো প্রায় সাড়ে তিন গুণ। ১৯৪৮-৪৯ থেকে ১৯৫২-৫৩ সালের গড়পড়তা হিসাবে দক্ষিণ ভিয়েতনামে একর প্রতি ধানের উৎপাদন ছিল আমাদের চেয়ে মাত্র এক-পঞ্চমাংশ বেশী কিন্তু দশ বৎসর পর ওঁদের পরিমাণ দাঁড়ালো আমাদের প্রায় দেড় গুণ।
অর্থাৎ, আমাদের জমির উৎপাদন বাড়াবার সম্ভাবনা যতখানি, সেই তুলনায় কাজ হয়েছে সামান্য। আমাদের মাটিকে আমরা অবহেলা করেছি। দেশকে শসাশ্যামলা। কবরার জন্য কী প্রয়োজন তা জেনে নেওয়া আজ কঠিন নয়। ওপরে যে-কটি দেশের নাম করেছি তাদের নানা ব্যাপারে পার্থক্য, কিন্তু একটি জায়গায় মিল প্রত্যেকটিতেই আমাদের তুলনায় জমিতে সারের ব্যবহার বেশি। সারের সঙ্গে চাই জল, উপযুক্ত বীজ, কীটনাশকের ব্যবস্থা। শিক্ষিত ও বিত্তবান ভূম্যধিকারীদের কাছ থেকেই এই নতুন ধরনের চাষের প্রবর্তনে নেতৃত্ব প্রত্যাশিত। কিন্তু পশ্চিম বাংলায় এই প্রত্যাশা পূর্ণ হচ্ছে কোথায়? এ কথাটা আজ তীক্ষ্ণ ভাষায় জিজ্ঞাসা করবার সময় এসেছে যাঁরা সঙ্গতি থাকতেও কৃষির উৎপাদন বাড়াতে উদ্যোগী নন তাঁরা জমি থেকে আয় আশা করেন কোন্ যুক্তিতে? এ প্রশ্নের একটি পুরনো উত্তর অবশ্য আমরা জানি। টাকা ব্যাংকে রাখলে যদি সুদ পাওয়া যায় তো টাকা দিয়ে জমি কিনলে খাজনা নেওয়া যাবে না কেন! এই উত্তরে আজ আর সন্তুষ্ট হওয়া যায় না। মূল কথাটা হলো এই যে, এদেশের মাটিকে যদি আমরা ফলবান করতে চাই তো এই মাটিতে তাঁদেরই অধিকার সবাগ্রগণ্য, যাঁরা দেশকে শস্যশ্যামলা করতে সর্বতোভাবে সচেষ্ট। ব্যক্তিবিশেষের কোনো দাবি যদি এই মহৎ প্রচেষ্টার পথে বাধা হয় তো সমাজ সেই দাবিকে শ্রদ্ধা করতে বাধ্য নয়। যাঁরা জমিতে নিজ অধিকার বলবৎ রাখতে চান, কৃষির উন্নতির জন্য তাঁদের সক্রিয় হতে হবে।
অপেক্ষাকৃত বিত্তবান ভূম্যধিকারীর জমিও এখন ছড়িয়ে আছে ছোট ছোট খণ্ডে। যাঁরা জমির উন্নতিতে আগ্রহী তাঁরা এর ফলে বাধা পান। কথাটা আরও একটু স্পষ্ট করে বলা যাক। বৃহদাকার ক্ষেত ও ট্র্যাকটরের ব্যবহার ছাড়া একর প্রতি উৎপাদন বাড়ানো যায় না এ-ধারণাটা ভুল। তবু জমি বহু খণ্ডে থাকলে তাতে কিছু কিছু অসুবিধার সৃষ্টি হয়। একত্রসংবদ্ধ একটি ক্ষেতের জন্য নলকূপের ব্যবস্থা করা অপেক্ষাকৃত লাভজনক; চাষের উপর নজর রাখাও তাতে সহজ হয়। শিক্ষিত মধ্যবিত্ত মানুষকে কৃষিকাজে নামাবার জন্য যদি বহু খণ্ডে বিভক্ত জমিকে সংবদ্ধ করা প্রয়োজন হয় তো এবিষয়ে আর বিলম্ব না করাই উচিত। জমির উন্নতিতে অমনোযোগী জোতদার ও নিরক্ষর ভাগচাষীকে নিয়ে উন্নত কৃষি ও বলিষ্ঠ সমাজ গড়া যাবে না।
আমরা নাকি বাংলা দেশকে ভালোবাসি। কিন্তু কলকাতা থেকে দূরবর্তী জেলাগুলি মহানগরীর কাছ থেকে বিমাতার স্নেহও লাভ করেনি। কলকাতা দিল্লীর মন এমন কি সহায়তা থেকেও তত দূরে নয়, বাংলার অবহেলিত জেলাগুলি কলকাতাবাসীর চিন্তা থেকে যত দূরে। ফলে বাংলা দেশের রাজধানী থেকে এই জেলাগুলিতে যাতায়াত অপেক্ষাকৃত কঠিন। শিক্ষার ব্যবস্থাও তদ্রূপ। জেলায় জেলায় আজ নতুন বিদ্যালয় ও মহাবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি উঠেছে; এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু মুশকিল এই যে, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর ছাত্রেরা কলকাতার বাইরে কোথাও পড়বার প্রস্তাবকে নিবাসন দণ্ডের মতোই দুভাগ্যজ্ঞান করেন। বিদেশী মিশনারীরাই শুধু সেখানে হাসিমুখে পড়াতে রাজী। ফলে এই দূরের জেলাগুলিতে জ্ঞানের আলোও বৈদ্যুতিক আলোর মতোই নিষ্প্রভ ও কচিত প্রাপ্য।
এদেশের মেধা ও সম্পদ, রাজনীতি ও জনবল কেন্দ্রীভূত হয়েছে কলকাতা মহানগরীতে ও পার্শ্ববর্তী কয়েকটি জেলায়। কলকাতার জনসংখ্যা জলপাইগুড়ি ও পুরুলিয়া জেলার সমবেত জনসংখ্যার চেয়ে বেশী। হাওড়া ও হুগলী জেলাকে পশ্চিম দিনাজপুরে ঢুকিয়ে দিলে তারপরও আধ ডজন কলকাতা শহরকে পাশাপাশি বসাবার মতো। স্থান অবশিষ্ট থাকে। অথচ পশ্চিম দিনাজপুরের জনসংখ্যা হাওড়া ও হুগলি জেলার মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশও নয়। মারকিন যুক্তরাষ্ট্রে যখন উন্নতি শুরু হয়, তখন তার রাজধানী স্থাপিত হয় ওয়াশিংটনে, বাণিজ্যের কেন্দ্র নিউ ইয়রকে, শিক্ষার কেন্দ্র। হারভারড়ে। কলকাতা আমাদের বাণিজ্যের কেন্দ্র, আবার শিক্ষা ও রাজনীতিরও কেন্দ্র। এই অতিকেন্দ্রিকতা মহানগরীর পক্ষেও ভালো নয়, বাংলা দেশের পক্ষেও নয়। অবশিষ্ট বাংলার পশ্চাৎপদতা ও রাজধানীতে অসংখ্য স্বার্থান্বেষীর তিক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা এদেশের সমাজকে অসুস্থ করে তুলেছে। এর প্রতিকার প্রয়োজন। বাংলা দেশের সামগ্রিক উন্নতি ছাড়া কোটি কোটি অর্থব্যয়েও কলকাতাকে আলাদাভাবে সুস্থ করে তোলা যাবে না।
কথাটা অবশ্য আমাদের অনেকের মনেই ইদানীং উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। মারচের ২৮-২৯ তারিখের আনন্দবাজার পত্রিকায় খবর বেরিয়েছিল যে, মাদরাজের উদাহরণে উৎসাহিত হয়ে “আগামী বছর পশ্চিমবঙ্গে আরও দশটি শিল্প এসটেট স্থাপনের বিষয় রাজ্য সরকার বিশেষভাবে বিবেচনা করছেন।” শিল্পের বিকেন্দ্রীকরণ এই পরিকল্পনার অন্যতম উদ্দেশ্য। মনে রাখা প্রয়োজন যে, যাতায়াতের ব্যবস্থা, বৈদ্যুতিক শক্তির সরবরাহ, শিক্ষার আয়োজন ইত্যাদির সঙ্গে যুক্ত করে তবেই শিল্পের বিকেন্দ্রীকরণের প্রস্তাব কার্যকরী হতে পারে; এই বৃহৎ পরিকল্পনার কোনো বিশেষ অংশের আলাদাভাবে সাফল্য আশা করা যায় না।
শিক্ষা, কৃষি ও শিল্পের ক্ষেত্রে একটি বিরাট অসমাপ্ত কাজ দীর্ঘকাল সমাপ্তির আকাঙ্ক্ষায় অপেক্ষা করছে। কিন্তু আমাদের অভ্যস্ত রাজনীতি গঠনমূলক পরিকল্পনার অনুকূল নয়। যে-দেশপ্রেম গড়তে জানে না তা বিদ্বেষ হয়ে সব ভাঙতে চায়। আমাদেরও তাই হয়েছে। এর পরিবর্তন সাধন সহজ নয়; অথচ একান্ত প্রয়োজন। কেন্দ্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে অথবা পশ্চিমবঙ্গকে অরাজকতার দিকে ঠেলে দিয়ে আমরা এদেশের কোনো মহৎ ভবিষ্যৎ উদঘাটন করতে পারব, এ-চিন্তা বৈষ্ণুবিক বাতুলতা। ছাড়া কিছুই নয়। এই মূঢ় বিল্পবমত্তার পাশে পাশে আছে এক সংকীর্ণচিত স্বজন ও অনুচর। পোষণ নীতি, সমাজের স্বাভাবিক ঐক্য ও ন্যায়বোধ যাতে দণ্ডে দণ্ডে খণ্ড খণ্ড হচ্ছে। এরও পরিবর্তন প্রয়োজন। আজ যখন নতুন করে নির্ধারিত হবার দিন এসেছে যে, আগামী বহু বৎসরের জন্য ভারতে কারা এগিয়ে যাবে আর কারা পিছিয়ে পড়বে, তখন আমরা যেন এমন একটা রাজনীতিকে আঁকড়ে না থাকি যাতে আমাদের পিছিয়ে পড়াই অনিবার্য হয়।
রাজ্যপালের শাসন চিরস্থায়ী হবে না। আবারও একদিন নতুন মন্ত্রিসভা গঠন করতে হবে, বিধান সভা ডাকতে হবে। যাঁরা গড়বার কাজে আগ্রহী, তাঁদের কি সেই বিধান। সভায় আমরা পাব? একটি বড় গঠনমূলক কর্মসূচীকে কেন্দ্র করে তাঁরা কি দুলনির্বিশেষে দেশ গড়বার কাজে মিলিত হতে পারবেন? ঐতিহাসিক সূত্রে অর্জিত বহু তিক্ততা ও ছোট ছোট কলহের চেয়ে ভবিষ্যতের দাবি কি বড় বলে স্বীকৃত হবে? যদি হয়, তবেই মঙ্গল। আমাদের সমস্যা এতো জটিল, সম্পাদ্য কর্ম এতো বৃহৎ, এবং যথাসম্ভব শান্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রয়োজন এতো গভীর যে, গড়বার কাজে যাঁরা যোগ দিতে ইচ্ছুক, তাঁদের কাউকেই আজ দূরে সরিয়ে রাখার অর্থ হয় না।
প্রগতির পথ (১৯৬৮)