দ্বিতীয় অধ্যায় । ইসলাম ধর্ম । অলৌকিকত্ব
অনেক ইরানি গভীরভাবে বিশ্বাস করেন, যে কোনো ইমামজাদা(২৬) প্রতি মুহুর্তেই কোনো না কোনো রকমের অলৌকিক কাজকারবার করতে পারেন। নবি মুহাম্মদ ও হজরত আলি ইবনে আবু তালিবের কোনো বংশধর কিংবা ইরানের স্থানীয় কোনো সন্ন্যাসীকে ইমামজাদাবলে সম্বোধন করা হয়। অবশ্য তাদের যদি কোরান পড়ার সাধ্য থাকত তবে সেখানে আদৌ অলৌকিক কিছু নেই দেখে সত্যিই অবাক হয়ে যেত।
কোরানে বিশটিরও অধিক আয়াতে উল্লেখ রয়েছে, সংশয়বাদীরা যখনই নবিকে কোনো অলৌকিক কাজ করে দেখাতে বলেছে, ততবারই তিনি হয় নীরব থেকেছেন, নয়তো বলেছেন তিনি আর দশজনের মতই সাধারণ মানুষ, শুধুমাত্র আল্লাহর সাথে যোগাযোগ স্থাপন করে সুসংবাদ ও সতর্কবাণী নিয়ে আসা ছাড়া তাঁর পক্ষে অন্য কিছু করা সম্ভব নয়। এই আয়াতে এই বিষয়টি স্পষ্ট করে বলে দেয়া হয়েছে ; আর ওরা বলে, ‘আমরা তোমাকে বিশ্বাস করব না যতক্ষণ না তুমি মাটি ফাটিয়ে একটি ঝরনা ফোটাবে, বা তোমার খেজুরের বা আঙুরের বাগান হবে যার ফাঁকে ফাঁকে অজস্র নদীনালা বইবে, বা তুমি যেমন বল, আকাশকে টুকরো টুকরো করে ভেঙে ফেলবে আমাদের ওপর, বা আল্লাহ ও ফেরেশতাদেরকে নিয়ে আসবে আমাদের সামনে বা তোমার জন্য একটা সোনার বাড়ি হবে, বা তুমি আকাশে আরোহণ করবে, কিন্তু তোমার আকাশে আরোহণ আমরা কখনও বিশ্বাস করব না যতক্ষণ না আমাদের পড়ার জন্য তুমি আমাদের ওপর এক কিতাব অবতীর্ণ করবে। বলো, ‘আমার প্রতিপালকের পবিত্র মহিমা! আমি একজন মানুষ, একজন সুসংবাদদাতা রসুল ছাড়া আর কী?’ (সুরা বনি-ইসরাইল ; আয়াত ৯০-৯৩)।
পরের দুই আয়াতে সংশয়বাদীদের বিস্ময় প্রকাশিত হয়েছে এভাবে : আল্লাহ কি মানুষকে রসুল করে পাঠিয়েছেন? ওদের এই কথাই লোকদেরকে বিশ্বাস করতে বাধা দেয় যখন ওদের কাছে আসে পথের নির্দেশ। বলো, ‘ফেরেশতারা যদি নিশ্চিন্ত হয়ে পৃথিবীতে ঘোরাফেরা করতে পারত তবে আমি আকাশ থেকে এক ফেরেশতাকেই ওদের কাছে রসুল করে পাঠাতাম। (১৭:৯৪-৯৫)। এই দুটি আয়াত অত্যন্ত যুক্তিপূর্ণ ও সহজবোধ্য। নবি হলেন সাধারণ লোকজনের মধ্যেকার এমন একজন মানুষ, যিনি অন্যদের থেকে তুলনামূলক বেশি দূরদর্শী ও চিন্তাশীল, এবং তিনি প্রচলিত কুসংস্কারের অসারতা ও অযৌক্তিকতা সবাইকে দেখাতে পারেন। এমন কী, সমাজে প্রচলিত নিষ্ঠুর ও ক্ষতিকর প্রথা থেকে লোকজনকে দূরে রাখতে পারেন। মুহাম্মদের বক্তব্যের স্বচ্ছতা, সহজবোধ্যতা ও গভীরতা নিয়ে কখনো প্রশ্ন উঠেনি। তাই তাঁর বিরুদ্ধে প্রতিপক্ষের উঠেপড়ে লাগার কারণও পরিষ্কার। বেশিরভাগ মানুষ ঐ ধরনের হিংসামূলক আচার-আচরণে অভ্যস্ত ছিল। শৈশবকাল থেকে তারা এগুলো অনুসরণ করত। আজকের এই আধুনিক বিংশ শতাব্দীতেও একই দৃশ্য দেখা যায়। তাই সহজে বোঝা যায় আরবের তখনকার মানুষেরা এমন কোনো লোকের কথা সহজে মেনে নেবে না যিনি তাদের পূর্বসূরিদের ঐতিহ্যের বিরোধিতা করবেন। মুহাম্মদ যখন আল্লাহর পক্ষ থেকে কথা বলার দাবি করলেন, তখন খুব স্বাভাবিকভাবে অন্যরা তার প্রমাণ দেখতে চাইল। মুহাম্মদ নিজেও পূর্বের বিভিন্ন নবির অলৌকিক কর্মকাণ্ডের কথা নানা সময় স্বীকার করেছেন এবং বিভিন্ন ধর্মের নবি সম্পর্কে বিভিন্ন উদ্ধৃতি দিয়েছেন। পারস্যে একটি কথা প্রচলিত আছে এরকম : যে অন্যের বেশি প্রশংসা করে পরোক্ষভাবে সে নিজের অক্ষমতাই প্রকাশ করে।” এই কথার প্রভাব তখনও পড়েছিল। কুরাইশরা ভেবেছিল সময় এলে মুহাম্মদ নিজেও দৃশ্যমান কোনো অলৌকিক ঘটনা ঘটিয়ে দেখাবেন। তাই তারা অন্য কোনো বিকল্প মানতে রাজি ছিল না। এজন্য তারা জিজ্ঞাসা করেছিল এভাবে: ‘ওরা বলে, “এ কেমন রসুল যে খাবার খায় ও হাটে-বাজারে চলাফেরা করে! তার কাছে কেন ফেরেশতা পাঠানো হয় না যে তার সঙ্গে থাকবে ও ভয় দেখাবে, বা তাকে ধনভাণ্ডার দেওয়া হয় না কেন, বা তার একটা বাগানও নেই কেন যেখান থেকে সে তার খাবার যোগাড় করতে পারবে?’ জালেমরা আরও বলে, তোমরা তো এক জাদুগ্রস্ত লোকের অনুসরণ করছ! ( সুরা ফুরকান : আয়াত ৭-৮)।
কুরাইশদের এ-ধরনের দাবি কিংবা তীব্র অসন্তোষমূলক সমালোচনারও কোনো উত্তর দেননি নবি। অলৌকিক কিছু ঘটানোর গণদাবির মুখেও তিনি নীরব থেকেছেন। আল্লাহর তরফ থেকে প্রত্যাদেশ এলে তিনি পরে বলেন : তোমার পূর্বে আমি যেসব রসুল পাঠিয়েছি, তারা সকলেই তো খাওয়া-দাওয়া করত ও হাটে-বাজারে চলাফেরা করত। (২৫:২০)। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখা যায়: তারা বলে, ‘ওহে, যার ওপর এই উপদেশবাণী অবতীর্ণ হয়েছে, তুমি তো পাগল! তুমি সত্যবাদী হলে আমাদের সামনে ফেরেশতাদের নিয়ে আসছ না কেন? (সুরা হিজর ; আয়াত ৬-৭)। আবার সুরা আম্বিয়াতে রয়েছে একই কথা : ‘সীমালঙ্ঘনকারীরা গোপনে পরার্শ করে, এ তো তোমাদেরই মতো একজন মানুষ, তবুও কি তোমরা দেখেশুনে জাদুর খপ্পরে পড়বে?’. . . ‘ওরা বলল, “অলীক স্বপ্ন! না, সে এ বানিয়েছে। না, সে তো এক কবি। সুতরাং সে আমাদের কাছে এক নিদর্শন আনুক, যেমন নিদর্শন দিয়ে পূর্বসূরিদের পাঠানো হয়েছিল। (২১:৩, ৫)। একই সুরার পরবর্তী আয়াতে একটা উত্তর দেয়া হয়েছিল যেখানে আল্লাহ মুহাম্মদকে বলেন: “তোমার পূর্বে আমি প্রত্যাদেশ দিয়ে মানুষই পাঠিয়েছিলাম। পরবর্তী বাক্যে মুহাম্মদকে সংশয়বাদীদের উপদেশ দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে, তোমরা যদি না জান, তবে উপদেশপ্রাপ্ত সম্প্রদায়দেরকে জিজ্ঞাসা করো। (২১:৭)। আবারও পূর্বের নবিদের প্রসঙ্গ উঠলে বলা হয় : আর আমি তাদেরকে এমন দেহবিশিষ্ট করিনি যে তাদের খাবার খেতে হত না; তারা চিরস্থায়ীও ছিল না।’ (২১:৮)।
সব মিলিয়ে মক্কি সূরাগুলোর মধ্যে ২৫টিরও বেশি আয়াতে দেখা যায়মুহাম্মদকে অনুরোধ করা হচ্ছে তিনি যদি একজন নবি হয়ে থাকেন, তবে এমন কোনো অলৌকিক কাজ করে দেখাতে যা সাধারণ মানুষ পারে না। কিন্তু সর্বক্ষেত্রে মুহাম্মদ ছিলেন হয় নীরব নয়তো নিজেকে অন্য সাধারণ মানুষের মতোই বলে স্বীকার করেছেন। যদিও তিনি স্বয়ং আল্লাহর কাছ থেকে ওহি পেয়েছেন, তথাপি তিনি আর দশজনের মতোই মরণশীল ছিলেন। একটা কথা পরিষ্কার উল্লেখ রয়েছে সুরা ইউনুসে : ‘ওরা বলে, তার কাছে তার প্রতিপালকের কোনো নিদর্শন অবতীর্ণ হয় না কেন? বলো, অদৃশ্যের জ্ঞান তো কেবল আল্লাহরই। অতএব তোমরা প্রতীক্ষা করো, আমি তোমাদের সঙ্গে প্রতীক্ষা করছি। 🙁 ১০:২০)। অন্যসব মানুষের মতো মুহামদেরও আল্লাহর গায়েবি উদ্দেশ্য সম্পর্কে কোনো ধারণা ছিল না। সুরা রাদ-এ মুহাম্মদের নবুওতি ও অলৌকিক কিছু করার অক্ষমতা সম্পর্কে প্রশ্নগুলির উত্তর এভাবে দেয়া হয়েছে, তাঁর একমাত্র কাজ হল আল্লাহর বাণী মানুষের কাছে পৌছে দেয়া। যারা অবিশ্বাস করেছে তারা বলে, (মুহাম্মদের) প্রতিপালকের কাছ থেকে তার কাছে কোনো নিদর্শন অবতীর্ণ হয় না কেন? তুমি তো কেবল সতর্ককারী, আর প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্য তো পথপ্রদর্শক আছে।‘(২৭) (১৩:৭)। এ-বক্তব্য থেকে বোঝা যায় কোনো প্রকার অলৌকিক কিছু করা একজন নবির কাজের মধ্যে পড়ে না।
একই ধরনের বক্তব্য দেখা যায় আরও একটি আয়াতেযেখানেপৌত্তলিকদের করা প্রশ্নের জবাবে মুহাম্মদ বলেন, তিনি একজন সতর্ককারী মাত্র, অলৌকিকতা কেবল আল্লাহই দেখাতে পারেন আর কেউ না। যদিও বর্তমানকালে কোরান নাজিল হওয়াকে অনেকে অলৌকিক ঘটনা বলেই বিশ্বাস করেন। সুরা আনকাবুত-এ অবিশ্বাসীদের প্রশ্নের উত্তর মুহাম্মদকে এভাবে দিতে দেখা যায়: ‘ওরা বলে, “তার প্রতিপালকের কাছ থেকে তার কাছে নিদর্শন পাঠানো হয় না কেন?” বলো, নিদর্শন আল্লাহর নিয়ন্ত্রণে, আর আমি তো একজন স্পষ্ট সতর্ককারী মাত্র। ( ২৯:৫০)। আবার পরবর্তী আয়াতে আল্লাহ বলেন, “এ কি তাদের জন্য যথেষ্ট নয় যে, যে-কিতাব তাদের কাছে আবৃত্তি করা হয় আমিই তা পাঠিয়েছি তোমার কাছে? এতে অবশ্যই বিশ্বাসী সম্প্রদায়ের জন্য অনুগ্রহ ও উপদেশ রয়েছে। ( ২৯:৫১)। সুরা মুলক-এ পৌত্তলিকদের জিজ্ঞাসার জবাবে বলা হয়েছে: ‘ওরা বলে, “তোমরা যদি সত্যবাদী হও, তবে বলো এ-প্রতিশ্রুতি কবে পালন করা হবে? পরের আয়াতে মুহাম্মদ জবাব দেন : এর জ্ঞান কেবল আল্লাহরই আছে, আমি তো স্পষ্ট সতর্ককারী মাত্র।’ (৬৭:২৬-২৭)। সুরা নাজিআত-এ পুনরুত্থান দিবস ও নবুওতি জ্ঞানের অলৌকিকত্ব সম্পর্কে অস্বীকার করতে দেখা যায় মুহামদকে : ‘ওরা তোমাকে জিজ্ঞাসা করে, কেয়ামত কখন ঘটবে? তোমাকে কী বলা আছে এ-ব্যাপারে? এর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত তো কেবল তোমার প্রতিপালকের কাছে। তুমি তো একজন সতর্ককারী-তার জন্য যে একে ভয় করে। (৭৯:৪২-৪৫)।
পৌত্তলিকদের জেদের মুখে এবং তাদের দেয়া বক্তব্য অনুযায়ী অলৌকিক কাজ দেখালেই তারা বিশ্বাস করে ফেলবে মুহাম্মদ ও আল্লাহকে এমনটা ভেবে মুসলমান, এবং এমন কী মুহামদের ভেতরেও আশা জন্মাতে থাকে যে আল্লাহ হয়তো সত্যিই একদিন তাঁকে দিয়ে অলৌকিক কিছু করে দেখাবেন, যাতে সব অবিশ্বাসীই বিশ্বাসী হয়ে যায়। সুরা আনআম-এ এই বিষয়টির সুরাহা হয় এভাবে ; আর তারা আল্লাহর নামে কঠিন শপথ করে বলে, তাদের কাছে যদি কোনো নিদর্শন আসত তবে অবশ্যই তারা বিশ্বাস করত। বলো, নিদর্শন তো আল্লাহর এখতিয়ারভুক্ত। আর তাদের কাছে নিদর্শন এলেও তারা যে বিশ্বাস করবে না, এ কীভাবে তোমাদেরকে বোঝানো যাবে?’(৬:১০৯)। আল্লাহ এরপর নবিকে বলেন ; আর তারা যেমন প্রথমবারে ওতে বিশ্বাস করেনি তেমনি আমিও তাদের অন্তরে ও নয়নে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করব আর অবাধ্যতায় তাদেরকে উদভ্রান্তের ন্যায় ঘুরে বেড়াতে দেব। তাদের কাছে ফেরেশতা পাঠালেও এবং মৃত ব্যক্তিরা তাদের সাথে কথা বললেও এবং সব জিনিস তাদের সামনে হাজির করলেও তারা বিশ্বাস করবে না, যদি না আল্লাহ চান, কারণ তাদের অধিকাংশই অজ্ঞ। (৬:১১০-১১১)।
সুরা আনআম-এর এই ৩টি আয়াত নিয়ে মন্তব্য করা প্রয়োজন : (১) আরবের পৌত্তলিকরা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল মুহাম্মদ যদি কোনো ধরনের অলৌকিক ঘটনা দেখাতে পারেন তবে তারা ইসলাম গ্রহণ করবে। এর প্রেক্ষিতে আল্লাহ মুহাম্মদকে জবাব দিতে বলেন যে, অলৌকিক ঘটনা একমাত্র আল্লাহই করতে পারেন, তিনি বা অন্য কেউ নন। একজন মানুষের (হতে পারেন তিনি নবি)
এই ধরনের পরিষ্কার স্বীকারোক্তি থেকে বোঝা যায়, প্রকৃতির নিয়ম অলঙ্ঘনীয়। কারো পক্ষেই প্রাকৃতিক কোনো নিয়মের ব্যত্যয় ঘটানো সম্ভব নয়। যেমন আগুন কখনো তার পোড়ানোর ক্ষমতা হারাতে পারে না। (২) নবি মুহামদ নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করেছিলেন, ভবিষ্যতে যদি কখনো অলৌকিক ঘটনা হয় আর অন্যরা যদি এতে বিশ্বাস না করে, তবে তিনি তা কিভাবে জানতে পারবেন? এখানে একটি পাল্টা প্রশ্নের উদ্ভব হয়, এটা কী নিশ্চিতভাবে বলা যায়, একটা অলৌকিক ঘটনা ঘটলেই পৌত্তলিকরা তা বিশ্বাস করে ফেলবে? মানুষের একটা বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, অস্বাভাবিক কিছু দেখলে মানুষ বিস্মিত হয় এবং যে ব্যক্তি এই কাজ করে অনেকেই তার অনুগত হয়ে পড়ে। কোরানের তফসিরকারকদের বর্ণনায় বুঝা যায়, স্বয়ং আল্লাহ তাঁর ভবিষ্যৎ-দৃষ্টিক্ষমতার মাধ্যমে বুঝতে পেরেছিলেন, কোনো ধরনের অলৌকিক ঘটনা না-ঘটলে অবিশ্বাসীরা কখনোই মুহাম্মদ বা কোরানের বাণী স্বীকার করবে না। ৩) আল্লাহ সরাসরি জানিয়ে দেন, তাঁর পূর্বে পাঠানো নিদর্শন কে অবিশ্বাস করলে তিনি অবিশ্বাসীদের দৃষ্টি ও হৃদয়কে ভুলপথে নিয়ে যাবেন। এখানে প্রশ্ন দেখা দেয়, সর্বশক্তিমান আল্লাহ নিজেই কী সাধারণ মানুষের সত্য নির্ধারণের ক্ষমতা নষ্ট করে দিচ্ছেন? যদি তাই হয়, তবে মানবজাতির কাছে কী আশা করা যেতে পারে আর, কিংবা তাহলে তাদের কাছে বারেবারে নবি পাঠানোর প্রয়োজনটা কী? আর এটা পরিষ্কার নয়, পূর্বে পাঠানো নিদর্শন বলতে কি বোঝানো হয়েছে? পূর্বের নবিদের কিছু ঘটনা আছে, তেমনি মুহাম্মদেরও কিছু ঘটনা রয়েছে, হয়তো এগুলোর কোনো কিছুই হতে পারে। অবশ্য পূর্বের নবিদের সম্পর্কে নিশ্চিতভাবে খুব কমই জানা যায়। কিন্তু কোরান অনুসারে, যখনই পৌত্তলিকরা মুহাম্মদের কাছে অলৌকিক কিছু করে দেখানোর দাবি জানিয়েছে, তখনই তিনি নিজেকে শুধু আল্লাহর তরফ থেকে একজন সুসংবাদদাতা ও সর্তককারী বলে দাবি করেছেন। হতে পারে, পূর্বে পাঠানো নিদর্শনের প্রতি অবিশ্বাস বলতে কোরানের অন্য আয়াতগুলোর কথা বোঝানো হয়েছে। তাই যদি হয়ে থাকে তবে এটা কখনো উপযুক্ত জবাব নয়। কারণ পৌত্তলিকরা কোরানের অলৌকিক বাণীকে বিশ্বাস করতে চাইত না। মুহাম্মদের প্রতি তাদের দাবি ছিল – যিশু, মুসা, সালেহ বা অন্যান্য নবিদের যে রকম অলৌকিক ঘটনার কথা কোরানে বলা হয়েছে, সেরকম যেন মুহামদও কিছু করে দেখান। ৪) সুরা আনআম-এর ১১১নম্বর আয়াতে আল্লাহ স্বয়ং জানিয়ে দিলেন, ফেরেশতা পাঠালেও অবিশ্বাসীরা (পৌত্তলিকরা) বিশ্বাস করবে না। এমনকি মৃত মানুষ জীবিত হয়ে উঠে এসে তাদের সাথে কথা বললেও নাকি তারা বিশ্বাস করবে না। তারা মুহামদকে বারবার বলতো বেহেশত থেকে কোনো ফেরেশতা এনে দেখাতে বা যিশুর মতো কোনো মৃতকে জীবিত করে দেখাতে। মুহাম্মদ নিজেও সবসময় এমন কোনো অলৌকিক ঘটনা ঘটার আশায় ছিলেন। এরপর আল্লাহ নবিকে বলেন যে, তেমনটা ঘটলেও নাকি ওরা বিশ্বাস করবে না। ৫) এখন কিছু প্রশ্ন তৈরি হয়। এসব পৌত্তলিক লোকের ভবিষ্যৎ-অবিশ্বাস ও অনমনীয় চিন্তাধারা যদি পূর্ব থেকেই নির্ধারিত হয়ে থাকে তাহলে আল্লাহর তরফ থেকে তাদেরকে সঠিক পথে আনতে নবি প্রেরণের কি দরকার? আল্লাহর মতো একজন সর্বজ্ঞানী, সবজান্তা এবং অব্যর্থ কেন এই ধরনের অর্থহীন কাজ করবেন? সনাতনপন্থীরা, ধর্মীয় ব্যাপারে যারা যুক্তি প্রয়োগ করতে রাজি নন, তারা এই বক্তব্যের একটা ব্যাখ্যা দিতে চান এভাবে : যেসব মানুষ অসৎ পথে চলে তাদেরকে মৃত্যুর পরের শাস্তি সম্পর্কে একটা চূড়ান্ত সতর্কবাণী দেয়ার জন্য এমনটা করা। কিন্তু সনাতনপন্থীদের এই ব্যাখ্যা এক্ষেত্রে খাটে না। কারণ ১১১ নম্বর আয়াতের পরের বাক্যে রয়েছে, যদি না আল্লাহ চান। বোঝা যায় এই পৌত্তলিক মানুষেরা কখনোই বিশ্বাস করতে পারবে না কারণ আল্লাহই চান না তারা বিশ্বাস করুক কোরানের বাণীতে। এই বক্তব্যে সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায় একই সুরার ১১০ নম্বর আয়াত থেকে : “তারা যেমন প্রথমবারে ওতে বিশ্বাস করেনি তেমনি আমিও তাদের অন্তরে ও নয়নে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করব আর অবাধ্যতায় তাদেরকে উদভ্রান্তের ন্যায় ঘুরে বেড়াতে দেব। একই সুরার ১০৭নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে : “যদি আল্লাহ ইচ্ছা করতেন তবে তারা শরিক করত না।’(৬:১০৭)। অর্থাৎ আল্লাহই নিজে চান তারা পৌত্তলিক থেকে যাক। তাই স্বাভাবিকভাবে সর্বশক্তিমান আল্লাহর নগণ্য সৃষ্টি মানুষেরা তো আল্লাহর ইচ্ছাকে পরিবর্তন করতে পারে না। এমন কী মুহাম্মদও পৌত্তলিকদেরকে তাদের অবিশ্বাস থেকে ফিরিয়ে আনতে পারবেন না, যদি তাদের এই অবিশ্বাস আল্লাহর ইচ্ছায় হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে ‘কোরানের প্রতি অবিশ্বাসে পৌত্তলিকদের কোনো দোষ দেয়া যায় না। তাদেরকে কেন মৃত্যুর পরের শাস্তির ভয় দেখানো হবে? একজনের ধর্মীয় বিশ্বাস যদি কোনো ঐশ্বরিক নির্দেশেই হয়ে থাকে তবে যুক্তি আমাদের বলে যে, সেই ঐশ্বরিক নির্দেশ ওই ব্যক্তির নিয়তি, ভবিষ্যৎ সুখ-দুঃখ নিয়ন্ত্রণ করবে। আর সেক্ষেত্রে কোনো নবি প্রেরণেরও প্রয়োজন থাকবে না, কোনো অলৌকিকতা দেখানোর দাবিও থাকবে না এবং অলৌকিকতা না দেখানোর কোনো অজুহাত খোঁজারও প্রয়োজন হবে না।
উপরের সব বিষয় বিবেচনা করে বোঝা যায় পৌত্তলিকদের অলৌকিকত্ব দেখানোর দাবি সম্পর্কে নবি মুহাম্মদ সবসময় নীরব থেকেছেন কিংবা পাশ কাটিয়ে গেছেন। মক্কি সুরাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কাব্যিক সুরা তাকভির-এ আমরা নবুওতি সম্পর্কে উজ্জ্বল বাগিতার প্রকাশ দেখতে পাই। সেখানে নবি মুহাম্মদ অবিশ্বাসীদের প্রশ্নের সরাসরি জবাব দিতে অনীহা প্রকাশ করেন। আকারে ইঙ্গিতে আল্লাহর হয়ে কথা বলার দাবি জানিয়েছেন। সুরা তাকভির-এর প্রথম ১৮ আয়াত নাজিলকালে যেসব পৌত্তলিকঅবিশ্বাসীরা মুহাম্মদের নবুওতিকে মৃগীরোগীর বিভ্রম কিংবা জ্যোতিষীর কাজকারবার বলে উড়িয়ে দিয়েছে তাদের এভাবে জবাব দেয়া হয় : “সত্যই একথা এক সমানিত বার্তাবাহকের, যে শক্তিধর, আরশের অধিপতির নিকট মর্যাদাসম্পন্ন; যার আজ্ঞা সেখানে মান্য করা হয় এবং যে বিশ্বাসভাজন। আর (হে মক্কাবাসী!) তোমাদের সঙ্গী তো পাগল নয়। সে তো ওকে (ফেরেশতাকে) স্বচ্ছ দিগন্তে দেখেছে। সে অদৃশ্য প্রকাশ করতে কার্পণ্য করে না। আর এ তো অভিশপ্ত শয়তানের কথা নয়!( ৮১:১৯-২৫)।
মক্কার বেশিরভাগ অধিবাসীর চিন্তা ছিল মুহাম্মদ অলৌকিক কোনো কর্মকাণ্ড করে দেখালে তারা তখন ইসলাম গ্রহণ করার কথা ভাববে। সেখানে আল্লাহ জানিয়ে দেন, সাক্ষাৎ ফেরেশতা পাঠিয়ে দিলেও বা মরা-মানুষকে জীবিত করে তুললেও তারা বিশ্বাস করবে না। দশ-বারো বছর পর যখন নবির তরবারি ও অনুসারীরা অনেক শক্তিশালী হয়ে ওঠেন তখন তারা –দলে দলে আল্লাহর ধর্ম গ্রহণ করেন। (১১০:২)। নবির অন্যতম কট্টর প্রতিপক্ষ এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী আবু সুফিয়ান পর্যন্ত ৬৩১ খ্রিস্টাব্দে ইসলাম গ্রহণ করেন।
সুফিয়ানকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘এখন নিশ্চয় আপনি বুঝতে পারছেন এক সর্বশক্তিমান ছাড়া আর কোনো ঈশ্বর নাই? এবং তিনিই সর্বজ্ঞ। আবু সুফিয়ান জবাব দেন, হ্যাঁ, আমি সেই বিশ্বাসের দিকেই এগোচ্ছি, তবে এ নিয়ে আমাকে আরও ভাবতে হবে। আব্বাস তখন বলেন, আবু সুফিয়ান, তুমি এখনই মুসলমান হয়ে যাও, নয়তো নবিজি এই মুহুর্তে তোমার মাথা কেটে ফেলার নির্দেশ দিবেন। মুসলিম যোদ্ধা দ্বারা আবদ্ধ অবস্থায় আবু সুফিয়ান ইসলাম গ্রহণ করেন। আব্বাস বিন আব্দুল মোতালেবের পরামর্শে নবি আবু সুফিয়ানকে এই আশ্বাস দেন, তার গৃহ কাবার মতই নিরাপদ থাকবে, তার ঘরে যেই প্রবেশ করবে সেই নিরাপদ থাকবে। একই বছরের শেষের দিকে মুসলমানরা যখন হাওয়াজেন গোত্রকে পরাজিত করে বিপুল পরিমাণ সম্পদ লাভ করেন তখন আবু সুফিয়ানসহ অন্য কুরাইশ নেতাদের মুহাম্মদ এতো বেশি উপহার প্রদান করেন যে, আনসাররা (নবির মদিনাবাসী অনুসারীরা) অসন্তুষ্ট হয়ে ওঠে। আরেকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল (আবিসিনিয়া থেকে আগত ক্রীতদাস) ওয়াশির ইসলাম গ্রহণ। ওয়াশি ৬২৫ সালের মার্চে ওহুদের যুদ্ধে হামজা বিন আব্দুল মোতালেবকে হত্যা করে তাঁর লাশ ছিড়ে টুকরো করে ফেলেন। এ-ঘটনায় নবি এতোই ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন যে, তিনি এর প্রতিশোধ নিতে দৃঢ় শপথ নিয়েছিলেন। কিন্তু ওয়াশি বন্দী অবস্থায় ইসলাম গ্রহণ করলে মুহাম্মদ তা মেনে নেন।
বোঝা যায় এই ধর্মান্তরের পিছনের প্রধান কারণ ছিল ভয়। শত্রুভীত হলে নবি তাদেকে ক্ষমা করতেন। সুরা আনআমের আয়াত তিনটি (১০৯-১১১) নিছক কোনো অনুমান বা প্রকল্পিত ছিল না। এগুলো কোরানের অন্যান্য আয়াতের সারমর্ম। এখান থেকে দেখা যায়, যখন আল্লাহর কোনো সাহায্য নবির লক্ষ্যকে এগিয়ে নিতে আসছিল না তখন মুহাম্মদ ভীষণ অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে গিয়েছিলেন। এটা স্পষ্ট হয় সুরা ইউনুসের এই আয়াতদ্বয় থেকে ; আমি তোমার কাছে যা অবতীর্ণ করেছি তাতে যদি সন্দেহ হয় তবে তোমার আগের কিতাব যারা পড়ে তাদেরকে জিজ্ঞাসা করো। তোমার প্রতিপালকের নিকট থেকে তোমার কাছে সত্য এসেছে। তুমি কখনও সন্দিহানদের শামিল হয়ো না। আর যারা আল্লাহর নিদর্শন প্রত্যাখ্যান করেছে তুমি তাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না হলে, তুমি ক্ষতিগ্রস্তদের একজন হবে।’ ( ১০:৯৪-৯৫)।
আয়াতগুলো ব্যাখ্যা করতে নাজিলের দৃশ্য কল্পনা করার কোনো প্রয়োজন হয় না। সংশয়বাদী এবং দ্বিধাচিত্তের মানুষদের বিশ্বাস করাতে গিয়ে নবি নিজেও সন্দেহের মধ্যে পড়ে গিয়েছিলেন। পরে আল্লাহই তা দূর করে দেন। আরও ব্যাখ্যা দেয়া যায় যে, যখন কোনো অলৌকিক ঘটনা ঘটার আশা প্রায় শেষের পর্যায়ে চলে গিয়েছিল তখন মুহাম্মদ মনে মনে নিজের সাথে কিভাবে কথা বলতেন তা এই আয়াতগুলোতে পাওয়া যায়।
মক্কার সুরাগুলোর অন্যান্য আয়াতে দেখা যায় মুহাম্মদ নিজেও কিছুটা আধ্যাতিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলেন। সুরা হুদ-এ নবির প্রতি আল্লাহর বাণীকে এভাবে দেখা যায়: ‘ওরা যখন বলে, তার কাছে ধনভাণ্ডার পাঠানো হয় না কেন, বা তার সাথে ফেরেশতারা আসে না কেন? তখন তুমি যেন তোমার ওপর যা অবতীর্ণ হয়েছে তার কিছু বর্জন না কর এবং এর জন্য তোমার হৃদয় যেন দমে না যায়। তুমি তো কেবল সতর্ককারী, আর আল্লাহ সকল বিষয়ের কর্মবিধায়ক। ( ১১:১২)। অর্থাৎ লোকে যাই বলুক না কেন, নবির একমাত্র কাজ ছিল ধর্ম প্রচার করা। সুরা আন’আমে মুহাম্মদ আরেকটি দাবি খণ্ডনের দায় ঘাড়ে নেন : তাদের (কাফেরদের) মুখ ফিরিয়ে নেওয়াই যদি তোমার কাছে বড় মনে হয়, পারলে মাটির নিচে সুড়ঙ্গ খুঁড়ে বা আকাশে সিড়ি লাগিয়ে তাদের জন্য নিদর্শন নিয়ে এসো। আল্লাহ ইচ্ছা করলে নিশ্চয় সকলকে একসঙ্গে সৎপথে আনতেন। সুতরাং তুমি মূর্খদের মতো হয়ো না।’(৬:৩৫)। সুরা নিসায় একই ঘটনা আবার দেখা যায়। সম্ভবত ইহুদিরাও মুহাম্মদের কাছে মোজেজার দাবি জানিয়েছিল। তাদের সন্তুষ্ট করতেই এই আয়াত নাজেল করা হয়; কিতাবিরা তোমাকে তাদের জন্য আকাশ থেকে কিতাব অবতীর্ণ করতে বলে, কিন্তু মুসার কাছে তারা এর চেয়েও বড় দাবি করেছিল। তারা বলেছিল, আমাদেরকে আল্লাহকে সাক্ষাৎ দেখাও। তাদের সীমালঙ্ঘনের জন্য তারা বজ্ৰাহত হয়েছিল। তারপর স্পষ্ট প্রমাণ তাদের কাছে প্রকাশ হওয়ার পরও তারা গোবৎসকে উপাস্য হিসাবে গ্রহণ করেছিল। আমি এও ক্ষমা করেছিলাম। আর আমি মুসাকে স্পষ্ট প্রমাণ দান করেছিলাম।(৪:১৫৩)। সুরা বনি-ইসরাইলে অলৌকিকত্বের অনুপস্থিতিকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে এভাবে : পূর্ববর্তীরা নিদর্শন অস্বীকার করার ফলে আমি নিদর্শন প্রেরণ করা থেকে নিজেকে বিরত রাখি। আমি স্পষ্ট নিদর্শন হিসেবে সামুদের কাছে এক মাদি উট পাঠিয়েছিলাম। তারা ওর ওপর জুলুম করেছিল। আমি ভয় প্রদর্শনের জন্য নিদর্শন প্রেরণ করি। ( ১৭:৫৯)। এই আয়াত হয়েছিল। তাদের মধ্যে বিশ্বাস আনার জন্য আল্লাহ সালেহর মাধ্যমে একটি অলৌকিক ঘটনা দেখান। একটা পাথরখণ্ড থেকে একটা মাদি উট সৃষ্টি করা হয়। কিন্তু সামুদরা উটটিকে মেরে নিজেদের অবিশ্বাসকেই আঁকড়ে রাখে। এতে আল্লাহ রেগে গিয়ে বজ্রপাতের মাধ্যমে তাদের সবাইকে ধ্বংস করে দেন। এখন আল্লাহ যদি মুহাম্মদের হয়েও কোনো অলৌকিক-বিসায়কর ঘটনা দেখাতেন আর সবাই যদি নিজেদের অবিশ্বাসকেই ধরে রাখত তবে তাদেরও ধবংস হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু নবির লক্ষ্যের কথা বিবেচনা করে আল্লাহ তাদের ধ্বংসের আদেশ মুলতবি করে রাখেন।’
ঠিক পরের আয়াতটিও বেশ আকর্ষণীয় এবং চিন্তা-উদ্রেককর : ‘সারণ করো, আমি তোমাকে বলেছিলাম যে, তোমার প্রতিপালক মানুষকে ঘিরে রয়েছেন। আমি যে-দৃশ্য তোমাকে (মিরাজে) দেখিয়েছি তা এবং কোরানে উল্লিখিত অভিশপ্ত বৃক্ষ কেবল মানুষের জন্য। আমি তাদেরকে ভয় দেখাই, কিন্তু তা তাদের উগ্র অবাধ্যতাই বৃদ্ধি করে। (১৭৬০)। এর অর্থ হল যেহেতু আল্লাহ সকলকেই নিয়ন্ত্রণ করেন, নবির তাই ভয় পাওয়ার কিছু নেই, তিনি সতর্কবাণী প্রদান করে যাবেন। উদ্দেশ্য হচ্ছে জনগণের পরীক্ষা নেয়ার জন্য বলা হচ্ছে, কারণ তাঁরা মুহামদকে অবজ্ঞা করেছিল।
জাহান্নামের অভিশপ্ত জাক্কম বৃক্ষের কথা কোরানের তিন জায়গায় (৩৭:৬২, ৪৪:৪৩এবং ৫৬:৫৩) উল্লেখ করার মাধ্যমেও জনগণকে ভয় দেখানো হয়েছিল। কিন্তু এটা তাদের কাছে আরও বেশি হাস্যকর মনে হয়। উপহাসের সুরে আরবরা তখন জিজ্ঞাসা করতে থাকে, জাহান্নামের আগুনের মধ্যে একটা গাছ কিভাবে জন্মাতে বা বেঁচে থাকতে পারে। শেষ পর্যন্ত বিস্ময়কর ঘটনা প্রদর্শনের দায় থেকে সরে গিয়ে নবি সবাইকে কেয়ামত এবং জাহান্নামের ভীতি প্রদর্শন করে বলেন: ‘এমন কোনো জনপদ নেই যা আমি কেয়ামতের দিনের পূর্বে ধ্বংস করব না বা যাকে কঠোর শাস্তি দেব না। এ তো কিতাবে লেখা আছে।’(১৭:৫৮)। এটা সত্যিই বিস্ময়কর যে, আল্লাহ যিনি পরম দয়ালু, পরম করুণাময়তিনি সুরা সিজদা-তে দাবি করেছেন, “আমি ইচ্ছা করলে প্রত্যেক ব্যক্তিকে সৎপথে পরিচালিত করতে পারতাম (৩২:১৩), তিনি আবার সবাইকে মৃত্যুর পরের গুরুতর শাস্তির হুমকি দিয়ে চলেছেন। এ-ধরনের বক্তব্য প্রদানের বদলে সামান্য মোজেজা প্রদর্শন করে দিলেই কি বেশি ভালো হতো না? বিপুল সংখ্যক মানুষ তখন সহজেই ইসলাম গ্রহণ করত এবং সেই সাথে প্রচুর যুদ্ধ আর রক্তপাত এড়ানো সম্ভব হতো।
মোজেজার অনুপস্থিতির পৃথক একটি ব্যাখ্যা আমরা সুরা আনআম-এর ৩৭ নম্বর আয়াতে দেখতে পাই: “তারা বলে, তার প্রতিপালকের নিকট হতে তার কাছে কোনো নিদর্শন অবতীর্ণ হয় না কেন? বলো, নিদর্শন অবতারণ করতে নিশ্চয় আল্লাহ সক্ষম। কিন্তু তাদের অনেকেই (এ) জানে না। আয়াতটির শব্দগুলোর মধ্যে যুক্তির অভাব সহজেই দৃশ্যমান। অবিশ্বাসীরা অন্তত একটি অলৌকিক ঘটনা দেখার জন্য বারেবারে অনুরোধ করে যাচ্ছে অথচ তাদেরকে বারবার বলা হচ্ছে, আল্লাহ অলৌকিকবিস্ময়কর ব্যাপার দেখাতে পারেন কিন্তু দেখাচ্ছেন না। আল্লাহ সর্বশক্তিমান হলে অলৌকিকতা দেখানো খুব স্বাভাবিক একটা বিষয় কিন্তু তারপরও কোনো অলৌকিক কিছু ঘটেনি। আর ঘটলেও সুরা আনআমের এই আয়াত অনুসারে তাদের কেউই জানতে পারেনি। তাহলে সেটা কী ছিলযা তারা জানত না? তারা অবশ্যই বিশ্বাস করতযে আল্লাহ সর্বশক্তিমান, না-হলে তারা কখনোই অলৌকিক ঘটনা প্রদর্শনের দাবি তুলত না। হেজাজের জনতার এই দাবির জবাব নিয়ে ধোঁয়াশা রয়ে গেছে। এক্ষেত্রে তফসির আল-জালালাইনের বক্তব্য হচ্ছে, অলৌকিক ঘটনা দেখার বাসনাকারী বেশিরভাগই জানত না যে, বিস্ময়কর ঘটনা ঘটার পরও তারা অবিশ্বাস করলে ধ্বংস হয়ে যাবে। এখান থেকে দুটি প্রশ্ন উঠে প্রথমত, অলৌকিক ঘটনা ঘটার পরও কেন তারা অবিশ্বাস করবে? দ্বিতীয়ত, নির্বোধ এবং একরোখা মানুষ যারা আলৌকিক ঘটনা ঘটার পরও অবিশ্বাস করে যাবে তাদেরকে ধ্বংস করাটা কতটা যৌক্তিক?