২.২৯ Still nursing the unconquerable hope

Still nursing the unconquerable hope
Still clutching the inviolable shade.

মেয়েদের এই এক সমস্যা। যৌবনটাকে সহজেই নয়ছয় করে ফেলে। জবার সেই পাগলামি, আবেগের বাঁধ ভাঙা নদী। সুখেনকে নিয়ে তো বেশ সুখেই ছিল। কী হল, কে জানে! কত রকমের বিভ্রাট যে নেমে আসে জীবনে। ভগবান করুন, আবার যেন সংসার ফিরে পায়! জবাকে বেশ দেখতে হয়েছে। আমার এইসব ভাবা উচিত নয়, শুধু ভয় করে, কোন জীবন যে কোথায় চলে যাবে! কী পরিণতি পাবে! একজন বলেছিলেন, জীবন একটা পিয়ানো। সেই পিয়ানোর রিডগুলো সব কাটা দিয়ে মোড়া। বাজাবে। সুর ঝরে পড়বে। কিন্তু আঙুলগুলো সব ক্ষতবিক্ষত হবে।

আমার পিতার একটা সুন্দর নোটবই আমি খুঁজে পেয়েছি। অপূর্ব হস্তাক্ষরে উপাদেয় সব দার্শনিক তত্ত্ব লেখা আছে। উপন্যাসের চেয়েও সুখপাঠ্য। জগৎ জীবন ভুল হয়ে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই তুলে নিয়ে যায় অন্য লোকে।

হরিশঙ্কর লিখছেন, একদিন স্বপ্ন দেখছি আমি একটা সুন্দর রঙিন প্রজাপতি হয়ে গেছি। ফুরফুর করে উড়ছি। ফুল থেকে ফুলে। কখনও ভেসে যাচ্ছি এক টুকরো কাগজের মতো। হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। ছিঁড়ে গেল স্বপ্ন। ভাবতে বসলুম, কোনটা ঠিক। আমি স্বপ্ন দেখছিলুম আমি একটা প্রজাপতি।

কি আমি একটা প্রজাপতি, স্বপ্ন দেখছিলুম আমি হরিশঙ্কর। বড় কঠিন ধাঁধা। আমার অঙ্কের জ্ঞান। হার মেনে যাবে। কোনটা ঠিক! প্রজাপতির স্বপ্নে হরিশঙ্কর, না হরিশঙ্করের স্বপ্নে প্রজাপতি?

এরপরেই লিখছেন, একদিন গঙ্গা পার হচ্ছি নৌকায়। যাব বেলুড়ে। আমাদের বিখ্যাত পতিতপাবন মাঝি নৌকা বাইছে। হাল ধরায় তার অসাধারণ দক্ষতা প্রবাদের মতো। বর্ষার অশান্ত নদী। বড় বড় ঢেউ। নৌকা হেলছে-দুলছে, সামনে-পেছনে দোল খাচ্ছে। পতিতপাবনের ভ্রূক্ষেপ নেই। আমি বসেছিলুম তার পায়ের কাছে। কী মনে হল, বললুম, নৌকা চালানো কি শেখা যায়? পতিত বললে, কেন যাবে না? খুব যায়। তবে কী জানেন, যারা ভাসতে জানে, ভাসাতে জানে, তারা ডোবাতেও জানে। এই যে আমার নৌকায় এত যাত্রী, আমার হাতে ডুবেও যেতে পারে। ইচ্ছে করে ডোবাব না। ভুল করে। জল আর ডাঙার তফাত তো আমি বুঝি না বাবু। জলে ভেসে ভেসে জলের ভয় আমার কেটে গেছে। আর সেইটাই হল সবচেয়ে ভয়ের। তার চেয়ে আমি কী বলি বাবু, নিজে ভাসতে শিখুন, নিজে সাঁতার কাটতে শিখুন, ডুবসাঁতার শিখুন, ডাঙা যে ডাঙা আর জল যে। জল সবসময়ে সেইটা মনে রাখুন। যাকে আমরা সাধারণ সামান্য মানুষ জ্ঞান করি, সেও কত জ্ঞানী। কেমন সহজে আমাকে বুঝিয়ে দিলে, অন্যের সাহায্য নিয়ে ভেসে থাকায় ভয় আছে। পাকা মাঝির নৌকার তলা ফেঁসে যেতে পারে। সংসার নদীতে ভেসে থাকো নিজের আয়ত্ত করা কৌশলে।

এরপর পিতা হরিশঙ্কর লিখছেন, একটি সুন্দর কাহিনি পড়লুম–এক দারুশিল্পী সুন্দর একটা কাঠের স্ট্যান্ড তৈরি করে উপহার দিলেন রাজাকে। রাজা সেই স্ট্যান্ডে বাদ্যযন্ত্র রাখবেন। সকলেরই উচ্ছ্বসিত প্রশংসা, এমন স্বর্গীয় শিল্পকর্ম সহসা দেখা যায় না। রাজা তখন শিল্পীকে জিজ্ঞেস করলেন, এমন সুন্দর কাজ আপনি করেন কী করে! কী আছে আপনার হাতে? রহস্যটা কী?

শিল্পী বললেন, কোনও রহস্যই নেই মহারাজ। তবে হ্যাঁ, কিছু একটা আছে। সেটা কী, তা হলে বলি শুনুন। এই ধরনের কাজ ধরার আগে প্রথমেই নিজেকে সুরক্ষিত করি, প্রাণশক্তি যেন কমে না যায়। তারপর মনটাকে স্থির করতে করতে একেবারে শান্ত করে ফেলি। তিন দিন নিজেকে এই অবস্থায় ফেলে রাখি। প্রাপ্তি পুরস্কারের সব চিন্তা চলে যায় মাথা থেকে। পাঁচ দিনের দিন ভুলে যাই যশ-খ্যাতির চিন্তা। সাত দিনের দিন আমার দুটো হাত, দুটো পা ও শরীর-বোধ চলে যায়। অবশেষে কার কাজ করছি, কোন রাজার, কোন মহারাজার, সে চিন্তাও আর মাথায় থাকে না। তখনই আমার দক্ষতা দানা বাঁধে। তখন আর আমি মানুষ থাকি না, পরিপূর্ণ একজন শিল্পী। বাইরের কোনও গোলমাল তখন আর আমাকে কাবু করতে পারে না। তারপর আমি এক পর্বত অরণ্যে প্রবেশ করে, উপযুক্ত একটা গাছের অনুসন্ধান করি। যে আকার দিতে চাই গাছটায় যেন মোটামুটি সেই আকার থাকে, পরে সেইটাকেই আমি ফুটিয়ে তুলব। এরপর আমি দেখতে পাই। আমি যা করতে চাই। সেইটা ভেসে ওঠে চোখের সামনে। আমি তখন সেই রূপকর্মকে অনুসরণ করি। প্রকৃতির গঠন ভঙ্গিমা আর আমার তন্ময়তা দুইয়ে মিলে তৈরি হয় শিল্প, যাকে আপনারা বলছেন অলৌকিক। এরপর হরিশঙ্কর লিখছেন, এই আমার জীবনের তত্ত্ব। অসীম তন্ময়তা।

মেঝেতে বসে দেয়ালে পিঠ রেখে খাতাটা পড়ছিলুম। অজস্র লেখা। হঠাৎ অদ্ভুত একটা জিনিসের দিকে চোখ চলে গেল। একটা পালক। পায়রার পালক। মুখের দিকে পাখার মতো অল্প একটু লেগে আছে। বাকিটা ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে। এইরকম কায়দার পালক দিয়ে হরিশঙ্কর কান চুলকোতেন। আর এই পালক থাকত চশমার খাপে। তার মানে? মানে খুব সহজ কাল রাতে চশমার খাপটা খোলার সময় পালকটা পড়ে গেছে। আমি নিঃসন্দেহ, ওই চশমা পিতা হরিশঙ্করের। মামা সত্য গোপন করছেন।

ভীষণ একটা শক্তি, ভয়ংকর এক উৎসাহ, ভীষণ এক উদ্দীপনা নড়েচড়ে উঠল ভেতরে। আমি পেয়ে গেছি। আমার বৃক্ষের সন্ধান আমি পেয়ে গেছি। তিনি রাঁচিতেই আছেন। আমি যাব। মামা মনে হয় কালই যাবেন। খাতা রেখে উঠে পড়লুম। উত্তেজনায় গোটা বাড়িটা একবার ঘুরে এলুম। তাকে নিয়ে আসব। আবার জমে উঠবে এই গৃহ সংসার। মাঝরাতে এসরাজের ছড়ে টান পড়বে। কেঁদে উঠবে রাগিণী। বাগেশ্রী, কেদারা কি জয়জয়ন্তীতে! ছাদ ভরে যাবে ফুলে। অন্ধকার ঘরে বোতলের পর বোতল ফিল্টার হবে কালি। পিতা হরিশঙ্কর শেকসপিয়ার আওড়াতে আওড়াতে কাজ করবেন। আমার বর্ণোজ্জ্বল অতীত ফিরে আসবে। মনে হচ্ছে লটারি পেয়ে গেছি। কয়েক লাখ। টাকার ফাস্ট প্রাইজ।

আনন্দে হঠাৎ ছায়া নামল। কত রকমের উৎপাত যে আছে! জবা আর জবার মা একসঙ্গে এসে হাজির। জবার মায়ের স্বাস্থ্য ইদানীং বেশ ফিরেছে। স্বামীর কারবার বেশ ফুলে ফেঁপে উঠেছে। জবার আকর্ষণও কিছুমাত্র কমেনি।

জবার মা বললেন, তোমার বাবা পালিয়ে গেছেন, খবর পেয়েছি। আসি আসি করে আর আসা হয়নি। পালিয়ে গেছেন, শব্দটা শুনে সর্বাঙ্গ জ্বলে উঠল। জবা আর জবার মা দুজনেই বাবার খাটের ধারে পা ঝুলিয়ে বসেছেন। শয্যায় নারীর স্পর্শ। চক্ষুলজ্জায় বলতে পারছি না কিছু। জবার আবার পা দোলানোর অভ্যাস। কাকাবাবু থাকলে বলতেন, শনি নীচস্থ। জবার চিরদিনই লজ্জা-শরম কম। আরও যেন একটু কমেছে। ইচ্ছে করছে উঠে গিয়ে শাড়ির আঁচলটা গোছগাছ। করে দিয়ে আসি।

জবার মা বললেন, খবর পেলে কিছু? বেঁচে আছেন তো? না গোবিন্দর বাবার মতো আত্মহত্যা করলেন? এইবার আমার ফেটে পড়তে ইচ্ছে করছে। জবার জন্যে পারছি না। মনের খুব গভীর গোপনে একটা ইচ্ছের নড়াচড়া টের পাচ্ছি। শয়তান এখনও মরেনি। ঘাপটি মেরে বসে আছে। জবা অসহায়। জবার বন্ধুর প্রয়োজন। শয়তান আবার ইংরেজিতে বার্তা প্রেরণ করে, জবা ইজ নাও অ্যাভেলেবল। জবা ভয়ংকরী। জবার কোনও সংস্কার নেই। কোনও নৈতিক বাঁধন নেই। বিদেশি মনের মেয়ে।

ধুর ঘোড়ার ডিম জবা! কম শক্তির অবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎতরঙ্গে শরীর যেন ঝিমঝিম করছে।

জবা বললে, কাকাবাবু আত্মহত্যা করার মানুষ নন। পিন্টুদাকে দেখে কিছুই বুঝতে পারবে মা। কাকাবাবুর কিছুই পায়নি। মেয়েছেলেরও অধম। কোনও সাহস নেই। সুখেনের যত প্রেমপত্র ওই লিখে দিত। তবু নিজের একটা লেখার সাহস হয়নি। বাবা বকবে! বাবার আঁচল-ধরা। সেই বাবাই এখন ছেলেকে ফেলে পালিয়েছে। কচি খোকা! এইবার কেঁদে মরো, কোথায় পিতা কোথায় পিতা, জ্বলছে বুকে স্মৃতির চিতা!

তুই থাম। জবার মা মেয়েকে ধমক দিলেন।

জবা খিলখিল করে হেসে পেছন দিকে উলটে পড়ল। দুটো পা টেনে তুলে নিল খাটে। এই সেই জবা। নিটোল পায়ের গোছে গোড়ালির ওপর দুটো পায়জোর। উলটো দিকে আমি বসে আছি। দুটো পা তুলে ওইভাবে শুয়ে থাকলে কী কী প্রকাশিত হতে পারে, সেই বোধটাই জবার নেই। জবার মায়েরও নেই। চিত হয়ে শুয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ জবা উপুড় হয়ে গেল। দুটো পা হাঁটুর কাছ থেকে ভঁজ হয়ে ওপরে উঠে আছে। এপাশে ওপাশে দুলছে। মলের সঙ্গে যুক্ত ঘোট ঘোট ঝুমকোয় চুনুর চুনুর শব্দ। হাতের ভরে চিবুক। ঘাড়ের কাছে আধ-ভাঙা বাসি খোঁপা। একটা কাটা একটু আলগা হয়ে আছে। জবা তাকিয়ে আছে জানলার বাইরে।

অসুস্থ অভুক্ত মানুষ দেখেছি। গাল ভাঙা। কোটরগত চোখ ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে। ঢেলাঢেলা। ঠোঁটদুটো সামান্য ফক। শ্বাসকষ্ট। সেইরকম এক মানুষের অস্তিত্ব অনুভব করলুম ভেতরে। ভীষণ খারাপ লাগছে। ভীষণ ভালও লাগছে। চোখ বলছে বাহবা। দৃশ্যটা স্থায়ী হোক। মন বলছে ছিছি। দেখো না। হতে পারে কবিতা, কিন্তু নিষিদ্ধ কবিতা। জবা মনে হয় পরিবেশ পরিস্থিতি সবই ভুলে গেছে। জবার মা যথারীতি বেহুঁশ। জবার আগুনে কত নির্বোধ যে বেপরোয়া পতঙ্গের মতো পুড়ে মরেছে। আমাকে আরও বিপদে ফেলেছেন জবার মা। মেয়ের একেবারে পাশটিতে তার কোমরের তলায় হাত ফেলে বসে আছেন। তাঁর দিকে তাকাতে গেলেই জবার শারীরিক বিপর্যয়ের দিকে চোখ চলে যাচ্ছে। বেড়ে যাচ্ছে আমার অস্বস্তি।

জবার মা হঠাৎ বললেন, তোমার জন্যেই আমার মেয়েটার এই সর্বনাশ হল।

জবা ঘুরে চিত হয়ে বলল, ওর জন্য কেন হবে মা? হয়েছে আমার বরাতে। সংসার যে আমার ভাল লাগে না!

তা কেন লাগবে! জবার মা গলা বিকৃত করলেন, ফুলে ফুলে মধু খেতে ভাল লাগে। যতদিন বুড়ি হচ্ছে, ততদিন আমাকে জ্বালাবে। শোয়ার ছিরি দেখো। ঠিক করে শো। সামনে একটা পুরুষমানুষ বসে আছে, সে হুঁশ নেই। উঠে বোস না। যেখানেই যাচ্ছে সেখানেই ঢ্যাস ঢ্যাস লটকে পড়ছে। তোর কিছু হয়েছে নাকি? মেয়ের দিকে সন্দেহের চোখে তাকালেন মা। পরিবেশটা হঠাৎ কেমন দূষিত হয়ে গেল। পিতার খাতা পড়ে ও তাকে পাবার সম্ভাবনায় মনে যে স্বর্গীয় ভাবের উদয় হয়েছিল তা ঘুচে গেল! ফুলের বাগান থেকে মাছের বাজারে।

জবার মা বললেন, তোমারও কিছুটা দায়িত্ব আছে। তুমি দু’জনকেই সাহায্য করেছিলে। তোমাদের বাড়িতেই দুজনের দেখা হত। চিঠি চালাচালি হত।

হঠাৎ মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল, আপনি তখন কী করতেন?

জবা কুঁককুঁক করে হাসতে হাসতে বললে, তখন রাজ কাপুরের সঙ্গে প্রেম করত। সিনেমার নেশা।

আমি আর এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে বললুম, নিজের মেয়েকে নিজে সামলাতে পারেননি?

জবার মা সুর পালটে বললেন, আমি এখন কী করব বাবা! মেয়ে কোলে মেয়ে তো শ্বশুরবাড়ির পাট চুকিয়ে চলে এল। এখন কী হবে!

কী আবার হবে? দুদিন পরেই সব ঠিক হয়ে যাবে। ও অমন ঝগড়াঝাটি হয়, আবার মিটে যায়। সুখেন খুব সাদাসিধে, ভাল ছেলে।

জবা বললে, সে ছেলে আর নেই। তার এখন অনেক গুণ। মদ খেতে শিখেছে। খারাপ জায়গায় যেতে শিখেছে। রোজ রাতে বউকে না পিটিয়ে বিছানা নেয় না। খারাপ অসুখও বাধিয়েছে।

সুখেনের এত গুণ হয়েছে! দুটো পয়সার মুখ দেখেছে বুঝি! আমি বললুম, তা হলে তো হয়েই গেল। এরপর তো আর কিছু করার নেই। জবা যে-অসুখের ইঙ্গিত করছে, সেই অসুখে মানুষের পরিবার জীবন নষ্ট হয়।

জবার মা তবু ছাড়লেন না। বললেন, ব্যাটাছেলেদের অমন বেচাল একটু-আধটু হতেই পারে। সব অসুখই চিকিৎসায় সারে। সুখেন তোমার বন্ধু, তুমি একটু খোঁজ নাও বাবা। বড় ছেলেটার তা হলে বিয়ে আটকে যাবে।

জবা উঠে পড়ল। সেই রাগী রাগী, বেপরোয়া ভাব, তোমার ছেলের বিয়ে ঠিকই হবে মা, জবার জন্যে আটকাবে না। জবার ব্যবস্থা জবা নিজেই করে নেবে। জবার জন্য তোমাকে জনে জনে গিয়ে নাকে কঁদতে হবে না।

জবার মা যেন ঘুরে ছোবল মারলেন, ওই স্বভাবের জন্যে তুমি মরেছ। এখন গতর আছে, অনেককে খেলাচ্ছ, এরপর দোরে দোরে ভিক্ষে।

জেনে রাখো, তোমার দোরে ভিক্ষে করতে আসব না। তোমার জামাইয়ের দশ হাজার টাকা শোধ করেছিলে?

সেটা সুখেনের সঙ্গে আমার ব্যাপার।

তার জন্যে আমাকে রোজ ধোলাই খেতে হয়েছে কেন?

টাকাটা আমি ফুর্তি করব বলে নিইনি। তোর বাপের ব্যবসায় ঢুকেছে। যখন দেবে তখন ঠিকই দিয়ে দেওয়া হবে।

সেই যখনটা কখন মা? কত দিন হল?

ইচ্ছে করলে এরা সারাদিন চালাতে পারবে। এদের সঙ্গ আর এক মুহূর্তও ভাল লাগছে না। বেশ একটু ভারী গলায় বললুম, মাসিমা, আমাকে বেরোতে হবে।

তা বেরোবে। ব্যাটাছেলের কি ঘরে বসে থাকা সাজে! তুমি বাবা সুখেনের সঙ্গে যেভাবেই হোক একটু যোগাযোগ কোরো। তা না হলে এই মেয়ের জন্যে আমাকে আত্মহত্যা করতে হবে। ওই তোমার জাড়তুতো দিদির মতো। তুমি দেখেছিলে, আমি এসেছিলুম?

লক্ষ করিনি।

ওমা, সেকী? আমি বললুম, পিন্টু, বিপদে বুদ্ধি হারিয়ো না। শুনতে পাওনি?

না, তখন আমি কুইনিন খেয়েছিলুম।

তোমার ম্যালেরিয়া হয়েছে বুঝি? সাবধানে থেকো। ইহসংসারে তো কেউই নেই তোমার। আমরা আর কতটুকুই বা করতে পারব! নিজেদের জ্বালায় জ্বলছি সব।

জবার মা দরজার দিকে এগোতে এগোতে বললেন, চল জবা চল। সৃষ্টি কাজ পড়ে আছে।

জবা বললে, তুমি যাও না! কতদিন পরে এলুম। আমি একটু পরে আসছি। পিন্টুদার সঙ্গে আমার প্রাইভেট কথা আছে।

ওকে আর বিরক্ত করিসনি। দেরি হয়ে যাচ্ছে। ও বেরোবে।

জবা বললে, তুমি যাও তো! আমাদের ব্যাপারে নাক গলিও না।

নাক না গলিয়ে গলিয়েই তো আজ তোমার এই অবস্থা হয়েছে।

জবার মা চলে গেলেন। জবা আমার খুব কাছে সরে এসে বললে, কেমন আছ? তোমাকে তো আগের চেয়ে বেশ ভালই দেখতে হয়েছে, প্রেমিক প্রেমিক। মনে হচ্ছে বেশ ভালই আছ?

জবা আমার এত কাছে যে অস্বস্তি হচ্ছে। জবার স্বভাব বরাবরই একটু আলগা ধরনের। ভীষণ সরল। বুঝতেই পারে না কী করছে, তার ফলে কী হচ্ছে। টেবিলের কোণে পেছন ঠেকিয়ে জবা আয়েশ করে দাঁড়িয়েছে। একটা পা তুলে দিয়েছে আমার চেয়ারের তলার কাঠে। হাঁটুটা ঠেকে আছে আমার উরুতে। ভীষণ একটা বিরক্তির ভাব আসছিল, সেটা কেটে গেল হঠাৎ। বেশ ভালভাবেই বললুম, জবা, তুমি আমাকে এই কথা বলার জন্যে আটকালে?

জবা মাথার পেছন দিকে হাত ঘুরিয়ে খোঁপাটা খুলে, বিনুনিটা বুকের সামনে টেনে এনে খুলতে শুরু করল। আমার দিকে তাকিয়ে আছে, কিন্তু আমাকে দেখছে না। হঠাৎ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললে, তুমি আমার একটা উপকার করবে? কেলে মানিককে বলবে, আইনত আমাকে যাতে ছেড়ে দেয়।

তার মানে তুমি বিবাহ-বিচ্ছেদ চাইছ?

হ্যাঁ। আমি একজনকে ভালবেসে ফেলেছি। ছেলেটা ভীষণ ভাল। ভীষণ দুঃখী। তার কেউ নেই। সে-ও আমাকে ভীষণ ভালবাসে। সুখেন যদি আমাকে ছেড়ে দেয় আমি তাকে বিয়ে করব।

সুখেনকেও তো তুমি ভালবেসেই বিয়ে করেছিলে!

আমি তো বাসিনি, সুখেনই আমার পেছনে লেগেছিল ফেউয়ের মতো। তখন মনে হল, যাক যা হয় হবে, বিয়েটা করেই ফেলি। তুমি তো আমাকে জানো, দুমদাম কিছু করে ফেলতে আমার ভীষণ ভাল লাগে।

বয়েস তো হচ্ছে। এইবার একটু নিজেকে বোঝাও না!

বুঝিয়েছি তো! সুখেনের সঙ্গে আমি পারব না। ও নিজে একটা শরীর, বোঝেও শরীর। আর  এই ছেলেটা হল শুধুই মন। একদিন সারারাত আমার পাশে শুয়ে ছিল, আমাকে ছোঁয়নি।

তার মানে মানুষ নয়!

ঠিক বলেছ, দেবতা।

আর পারলুম না। উঠে পড়লুম, ঠিক আছে, পরে তোমার সঙ্গে কথা বলব। তারপর সামান্য একটু কৌতূহল হল, জিজ্ঞেস করলুম, ছেলেটা কে? তোমাদের ওখানেই থাকে?

জবা একটু হাসল। হেসে বললে, না না, খুব কাছেই থাকে।

কোথায়? এইখানে?

হ্যাঁ, একেবারে সামনেই, এক হাত দূরে। সেই ছেলেটা হলে তুমি। জবা আমার দুকাঁধে বন্ধুর মতো হাত রাখল। মুখে হাসি, কিন্তু চোখে জল। প্রথম থেকে তোমাকেই আমি ভালবাসতুম।

স্বাস্থ্যবান জীবন্ত একটা মেয়ে ভালবাসার কথা বলছে সরাসরি। কেমন যেন অভিভূত হয়ে গেলুম। একটা মন জয় করা, বিশাল এক রাজ্য জয় করারও অধিক। জবার মতো দেহবাদী। পিচ্ছিল এক মেয়ে বলছে, আমি তোমাকেই ভালবাসতুম। আদর্শ, চরিত্র, ঈশ্বর, প্রখর নদীর স্রোতে এক টুকরো কুটোর মতো ভেসে গেল। জবার কপালে সোনালি টিপ। চিবুকে ছোট্ট একটা তিল। বুকের ওপর দুলছে বিনুনি।

জবা বললে, পারবে না আমার জন্যে সবকিছু ছাড়তে? নদীর ধারে ছোট্ট একটা বাড়িতে আমরা থাকব। একেবারে নতুন একটা জায়গায়, সেখানে কেউ আমাদের চিনবে না। ছোট্ট একটা ফুলের বাগান। একটু কিছু রোজগার। অনেক রাত পর্যন্ত আমরা জেগে থাকব। মেলায় গিয়ে নাগরদোলা চাপব। মাটির হাঁড়িতে কাঠের জ্বালে ভাত রাঁধব। তুমি নদী থেকে স্নান করে আসবে সাধুর মতো। কম্বলের আসনে পুজোয় বসবে। সামনে একথালা সাদা ফুল, তার ওপর সাদা একটা জবা, পাশেই একটা লাল পঞ্চমুখী, গোটাকতক টকটকে গেরুয়া কলকে ফুল। চওড়া লাল পাড় শাড়ি পরব আমি। হাট থেকে তোমার জন্যে কাঁচা শালপাতায় মুড়ে সাদা মাখম নিয়ে আসব, কোলে করে আনব লাল তরমুজ। গাছের ডালে ঝোলাব একটা দোলনা। লটলটে কান একজোড়া ছাগলছানা খেলে বেড়াবে। আমাদের জানলা দিয়ে পুবের আকাশে নীল একটা পাহাড় দেখা। যাবে। আমাদের বাড়ির ঢোকার মুখে দুটো বেতগাছের ঝোঁপ থাকবে। আমরা আমাদের নাম পালটে নোব। নতুন শাড়ির পাট খোলার মতো নতুন জীবনের ভাঁজ খুলব। জবার মাথা নেমে এল আমার বুকে। কাণায় ফুলছে। ধরাধরা গলায় বলল, হয় না এসব? হওয়ানো যায় না? এ কি একেবারেই অসীব!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *