শাহরাজাদ বলে, এবার পুরুষ না নারী সেই কাহিনী শুনুন, জাঁহাপনা।
শোনা যায়, পারস্যের মহান সুলতান খুসরাও মাছ খেতে খুব ভালোবাসতেন। একদিন তিনি তার পরমা সুন্দরী বেগমকে নিয়ে ছাদের ওপরে বসেছিলেন। এমন সময় এক জেলে কিছু মাছ নিয়ে সেখানে হাজির হলো। তার ডালা থেকে একটা বিরাট বড় মাছ বের করে সে সুলতানের সামনে তুলে ধরলো। সুলতান তো দেখে মহা খুশি। জেলেকে চার হাজার দিরহাম ইনাম দেবার হুকুম দিলেন তিনি। কিন্তু সুলতানের এই বদন্যতা বেগম সাহেব সিরিনের মোটেই পছন্দ হলো না। লোকটা চলে গেলে সে সুলতানকে বললো, সামান্য একটা মাছের জন্য এত ইনাম দেবার কী প্রয়োজন? এটা নেহাতই খামখেয়ালী বাজে খরচ। তুমি ওকে অত টাকা দিও না। এর ফলে হবে কি, যখনই কোনও লোক কোনও কিছু নিয়ে আসবে সেও এই রকমই আশা করবে। কিন্তু সবাইকে যদি তুমি এইভাবে খয়রাতি কর, তাহলে লাটে উঠতে হবে যে!
সুলতান বললো, কিন্তু আমি একবার যা দান করেছি তা-ফেরত নেওয়া কী সম্ভব? এতে আমার ইজ্জত থাকবে? যা হবার হয়ে গেছে, ছেড়ে দাও।
সিরিন অবাক হয়, তুমি কী বলছে! ব্যাপারটা কী ছেলে খেলা? ছেড়ে দেব বললেই ছেড়ে দেওয়া চলে? তার চেয়ে সাপও মরে লাঠিও না ভাঙ্গে আমি সে ব্যবস্থাই করছি। তুমি ডাকো তাকে?
সুলতান কিছুতেই বুঝতে পারেন না বেগম সাহেবা কীভাবে দুকূল রক্ষা করতে পারবে? জেলের কাছ থেকে টাকাটাও ফেরৎ নেবে অথচ তার ইজ্জত বাঁচবে।–তা কী করে সম্ভব?
সিরিন বলে আমি একটা ফন্দী এঁটেছি। জেলেটাকে ডেকে তুমি জিজ্ঞেস কর, মাছটা পুরুষ না মেয়ে। লোকটা একটা কিছু জবাব দেবে। যদি সে বলে, পুরুষ, সঙ্গে সঙ্গে বলবে, না না, পুরুষ মাছ আমি খাই না, তুমি নিয়ে যাও আমি মেয়ে মাছ ছাড়া খাই না। আর যদি বলে মেয়ে, তুমি বলবে তোমার পুরুষ মাছের দরকার। ব্যাস অতি সহজ ভাবেই কেল্লা ফতে হয়ে যাবে।
সুলতানের বিবি অন্ত প্ৰাণ। তাকে তিনি কিছুতেই অখুশি রাখতে পারেন না। ব্যথিত মনেই তিনি জেলেকে ডেকে পাঠালেন।
-ওহে, মাছটা তো দিয়ে যাচ্ছে, তা-মাছটা কী? পুরুষ না মেয়ে?
সুলতানের কথায় জেলে প্রথমে ঘাবড়ে যায়। কী জবাব দেবে ভেবে পায় না। একটুক্ষণ চিন্তা করে সে বলে, জাঁহাপনা এ মাছ পুরুষও না মেয়েও না, একে বলে ক্লাব।
জেলের কথা শুনে সুলতান তো মহা খুশি। ছেলেও না মেয়েও না-ক্লাব। এমন আজব বস্তু তো বড় একটা দেখা যায় না। সে তৎক্ষণাৎ হুকুম দিলো জেলেকে চার হাজারের বদলে আট হাজার দিরহাম ইনাম দিয়ে দাও। জেলেটা তো আনন্দে গদগদ হয়ে গুণে গুণে আট হাজার দিরহাম থলেয় ভরে বাড়ির পথা হাঁটা দিলো।
তখনও সে প্রাসাদ প্রাঙ্গণ পার হতে পারেনি, হঠাৎ তার থলেটার মুখের বাঁধন খুলে গিয়ে সমস্ত দিরহামগুলো আঙ্গিনায় ছত্রাকারে ছড়িয়ে পড়লো। মাথার ডালাটা মাটিতে নামিয়ে সে তীক্ষ দৃষ্টি মেলে একটা একটা করে দিরহামগুলো কুড়িয়ে গুণে গুণে আবার থলোয় ভরতে থাকলো। যতক্ষণ না শেষ দিরহামটাও সে খুঁজে পেল ততক্ষণ চললো তার সেই একান্ত অনুসন্ধান।
ছাতের ওপর বসে বসে সুলতান খুসবাও এবং বেগম সিরিন এই দৃশ্য দেখে মজা পেল অনেক।
এই সময় রাত্রির অন্ধকার কাটতে থাকে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।
তিনশো বিরাশিতম রজনীতে আবার সে শুরু করে :
সিরিন বলে, দেখ লোকটা কী লোভী, একটা মাত্র দিরহাম সে খুঁজে পাওয়ার জন্য কী পরিশ্রম না করলো। অথচ এই টাকাগুলো তার আদৌ হকের ধন নয়। তুমি দয়া করে দিয়েছ। তাই সে পেয়েছে।
সুলতান বললো, ঠিক-ঠিক বলেছ বেগম সাহেবা, লোকটা একেবারে কঞ্জস। দাঁড়াও ওকে ডেকে পাঠাচ্ছি।
সুলতানের হুকুমে তখনি জেলেটাকে হাজির করা হলো। সুলতান বললো, তুমি তো লোকটা বড় কৃপণ হে। এমন চিড়িয়ার মতো দিল কেন তোমার? একটা মাত্র দিরহাম তুমি খুঁজে পাচ্ছিলে না। তাতে এমন ভাব দেখাচ্ছিলে যেন, তোমার বিশাল সলতানিয়ৎ, দরিয়ায় ডুবে যাচ্ছিল। আমার সন্দেহ হচ্ছে, কলিজোটা মানুষের না। যে দিরহামটা খোঁজার জন্য এত কসরৎ করলে, যদি সেটা খুঁজে নাই-ই পাওয়া যেত কী এমন যেত। আসতো তোমার? তোমার আশার অনেক বেশি তো তুমি আজ পেয়েছ। তার থেকে দু-চারটে যদি হারিয়েই যায়, ক্ষতি কতটুকু? তোমার থলে থেকে যেটা পড়ে গিয়েছিলো সেটা হয়তো কোনও গরীবগুর্বে মানুষ কুড়িয়ে পেত। তার অনেক কাজে আসতো। কিন্তু তুমি বড় অর্থ গৃধু। একটা দিরহামের মায়া তুমি কাটাতে পারো না?
আভূমি আনত হয়ে জেলেটা কুর্নিশ জানায়, খোদা সুলতানকে শতায়ু করুন, দিরহামটা খুঁজে না পেলে যে আমার একটা বিরাট লোকসান হয়ে যেত সে কথা ঠিক নয়, জাঁহাপনা। সামান্য একটা দিরহামের কী মূল্য আমিও জানি। তার জন্য অত সময় এবং অত ধৈর্য ব্যয় করা সঙ্গত না তাও মানি। আমি কিন্তু ঐ দিরহামিটাকে খুঁজে পাওয়ার জন্য ঐরকম আকুল হইনি। আমি উদভ্ৰান্ত হয়েছিলাম অন্য কারণে। আমার রোজগারের পয়সা হলে একটা কেন পাঁচটা দিরহাম আমি ভিখিরিকে দান করেও দিতে পারতাম। কিন্তু এ অর্থ আমার সুলতানের কাছ থেকে পাওয়া ইনাম। এর মূল্য কোনও টাকা পয়সা দিয়ে বিচার করা যাবে না হুজুর। এ আমার কাছে অমূল্য সম্পদ। এর প্রতিটি দিরহাম আমার কাছে লক্ষ মোহরের চাইতেও বেশি।
জেলের এই স্তুতি বাক্য শুনে সুলতান গলে জল হয়ে গেলো। গর্বে তার বুক দশ হাত ফুলে উঠলো। না লোকটা সত্যিই বোদ্ধা। দানের মর্যাদা সে বোঝে। সুলতান হুকুম করলো জেলেকে আরও চার হাজার দিরহাম ইনাম দিয়ে দাও। আর সারা সালতানিয়াতের প্রজাদের ট্যাড়া পিটে জানিয়ে দাও : মেয়েমানুষের পরমর্শে যেন পুরুষ কোনও কাজ না করে। তাদের কথায় চললে, সাধারণ ভাবে যা লোকসান হওয়ার কথা তার চতুগুণ লোকসান বাড়বে।
এই কাহিনী শুনে সুলতান শাহরিয়ার সুলতান খুসরাও-এর প্রসংশায় পঞ্চমুখ হয়ে ওঠে, সুলতান খুসরাও-এর ফরমান অক্ষরে অক্ষরে ঠিক। মেয়েরাই যত নষ্টের গোড়া। তারাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে সংসারের।
সুলতানের কথা শুনে শাহরাজাদ স্মিত হেসে আর একটা গল্প শুরু করে।