The man that runs away
Lives to die another day
সিঁড়ির শেষ ধাপে একটা পোস্টকার্ড উলটে পড়ে ছিল। পিয়ন কখন দরজার ফাঁক দিয়ে খুস করে ঠেলে দিয়ে গেছে, কেউ খেয়াল করেনি। আমাদের নীচেটা অন্ধকার-অন্ধকার, স্যাঁতস্যাঁতে। সদর থেকে পেছন পর্যন্ত টানা একটা রক। সার সার তালা বন্ধ ঘর। ডাচ আমলের কুঠিবাড়ি এইরকমই ছিল। ঘরগুলোয় সেই দূর অতীতে মুহুরিরা বসতেন। একটা ঘরের জানলার গরাদ থেকে লম্বা। একটা চেন ঝুলছে। অতীতের স্মৃতি। এই পরিবারের পূর্বপুরুষদের দুটি মজার শখ ছিল। এক, কুকুর পোষা, দুই, মানুষ পোষা। শেষ কুকুরটি ছিল বিশাল এক হাউন্ড। ধবধবে সাদা। নাম ছিল জিম। এই চেনটা দিয়ে জিমকে বাঁধা হত। চেনটাকে রোজ আমি পরিষ্কার করি আর একটি কুকুরের অস্তিত্ব অনুভব করি। আমার জ্যাঠামশাইয়ের মৃত্যুর পর কুকুরটি ইচ্ছামৃত্যু বরণ করে। মানুষ পারবে?
চেনটার পাশে বসে পড়লুম। পেছনে জানলা। সাবেক কালের চল্লিশ ইঞ্চি পুরু দেয়াল। ভেতরে কটা আনারকলি আছে কে জানে! পোস্টকার্ডে চোখ রাখলুম ভয়ে ভয়ে। কার চিঠি? পরিষ্কার হাতের লেখা। চিঠিটা পড়ে স্তব্ধ হয়ে বসে রইলুম কিছুক্ষণ। আবার এক খেলা! দোতলায় এসে কাকাবাবুর সামনে চিঠিটা ফেলে দিলুম, এই নিন, পড়ুন। আর এক বিপদ আসছে। যা বলেছিলেন, সব অক্ষরে অক্ষরে মিলছে।
কাকাবাবু পড়ে বললেন, এইবার কী করবে?
দোতলার বারান্দার মেঝেতে বসে পড়লুম। বেলা ঝুলে পড়েছে। আকাশের নীল শীতল হয়েছে। ছোটপিসিমার চিঠি। পিসেমশাই বেশ কিছুদিন গত হয়েছেন। তিনটি ছেলেমেয়ে। জেলা-শহরে জীবন প্রায় অচল হয়ে পড়েছে। পুঁজি নিঃশেষ। মাঝে মাঝে অনাহার চলছে। হয় মৃত্যু, না হয় এইখানে আশ্রয়। ছেলেমেয়েরা নাবালক। আত্মীয়স্বজনদের অত্যাচার ও ভীতিপ্রদর্শন। কেটে ফেলব, মেরে ফেলব। কারণ সামান্য কিছু ভূসম্পত্তি আছে, তার ভাগ শ্বশুরবাড়ির মহামানবরা দিতে প্রস্তুত নয়। আমার চিন্তা দেখে কাকাবাবু বললেন, হরিদা থাকলে হাসিমুখে বুক ফুলিয়ে বলতেন, চলে এসো। আমার এক মুঠো জুটলে তোমাদেরও জুটবে। হরিদা তো গৃহী সন্ন্যাসী, অবধূত। সাগরের মতো মন। সেই পিতার পুত্র তুমি। বিশাল এক পরিবার প্রতিপালনের। জন্যে নিজেকে উৎসর্গ করতে পারবে? ভেবে দেখো। তোমার যা রোজগার তা ভাগ করে নিতে হবে। দারিদ্র্য আসবে। অশান্তি আসবে। আয়েশ ঘুচে যাবে। রোজগার বাড়াতে হবে। তিনটি ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার খরচ জোগাতে হবে। প্রয়োজন হলে প্রাইভেট টিউশনি করে আয় বাড়াবার ফিকির করতে হবে। এই আদুরে সুখী জীবন আর থাকবে না তোমার। তোমাকে হরিদার মতো ফাঁইটার হতে হবে। পারবে তুমি? আমার সন্দেহ আছে যথেষ্ট। তোমার মেটাল আমি চিনি। তুমি কল্পলোকবিহারী। তোমার চরিত্রে আছে বিরোধ। ত্যাগের কথা ভাবো, কাজে তুমি ভোগী। দ্বিতীয় পথই তোমার পথ। পত্রপাঠ জানাও, আসবেন না। এ বাড়িতে কেউ থাকছে না। তালা ঝোলাও, সরে পড়ো। অথবা লেখো, যেখানে আছেন সেইখানেই থাকুন, আমি মাসে মাসে কিছু টাকা পাঠাব।
টাকা কী করে পাঠাব কাকাবাবু? আমি তো আশ্রমে যেতে চাই!
তা হলে তো হয়েই গেল। সেইটাই লিখে দাও। কে বাঁচল, কে মরল তোমার দেখার দরকার নেই। সংসার হল মায়া। তাই তো? সন্ন্যাস মানেই তো বেদান্ত। ন জায়তে ম্রিয়তে বা কদাচিৎ, নায়ং ভূত্বাইভবিতা বা ন ভূয়ঃ। আত্মা। জন্মও নেই, মৃত্যুও নেই। চুকে গেল লেঠা। লোকে বলবে, নিষ্ঠুরতা, স্বার্থপরতা, নীচতা, পলায়নী মনোবৃত্তি। ওসবে তুমি কান দিয়ো না। দিনকতক অ্যাডভেঞ্চার করে এসো। তারপর গেরুয়া ফেলে গৃহী। কী বলো? ভাবো। ভেবে দেখো।
এটা কোনও পরামর্শ হল? এ তো ব্যঙ্গ! প্রতিটি কথা যেন দু’মুখো ছুরি! এদিকেও কাটে, ওদিকেও কাটে। ভদ্রলোকটিকে বোঝা দায়। ক্ষণে ক্ষণে রূপ পালটান। এই বন্ধু, তো পরমুহূর্তেই শত্রু। কাগজপত্র গুছিয়ে কাকাবাবু উঠে দাঁড়ালেন। গম্ভীরমুখে বললেন, আমাকে এইবার যেতে হচ্ছে। আমার নিজস্ব কিছু কাজ আছে। সামান্য ক’টা টাকার পেনশনে তো দিন চলবে না। যত দিন বাঁচব তত দিন আমাকে খাটতে হবে। কে খাওয়াবে! কেউ তো নেই আমার!
কেন, আমি?
কাকাবাবু নাটকীয় ভঙ্গিতে তাকালেন আমার দিকে, দেখো পিন্টু, যে কথা বিশ্বাস করো না, সেকথা বোলো না। কোনটা কথা আর কোনটা কথার কথা বুঝতে শেখো। এ যুগে আপনই পর হয়ে যাচ্ছে, পর হবে আপন? ডোন্ট বি সিলি।
গোলার আঘাতে দুর্গ ভেঙে পড়ার মতো আমিও ভেঙে পড়লুম। কথার কথাই বলেছি। ফাঁকা কথা। ধরা পড়ে গেছি। ঠোঁট কাটা মানুষ। অভিনয় করতে জানেন না বলেই এমন তীব্র ধাক্কা মারতে পারলেন। অন্য কেউ হলে গলে গিয়ে বলতেন, ওরে আমার সোনা রে!
নিজেকে সামলে নিয়ে বললুম, আমাকে ফেলে চলে যাবেন?
সেইটাই পৃথিবীর নিয়ম। কেউ চিরকালের নয়। নিজের হাল নিজে ধরো। কারও ওপর নির্ভর কোরো না। আর তোমাকেও তো যেতে হবে। সন্ন্যাসী হবে বললে না?
আবার বাঁকা কথা। একটু খোঁচা। কথা না বাড়িয়ে আবার নতুন কোনও খোঁচার ভয়ে আমিও উঠে পড়লুম। এরই নাম বোধহয় সংসারের শকথেরাপি।
কাকাবাবু যাবার আগে ইট ছোঁড়ার মতো বলে গেলেন, বি এ ম্যান।
আমার বলতে ইচ্ছে করল, থ্যাঙ্ক ইউ ফর ইয়োর অ্যাডভাইস।
দরজা বন্ধ করে অন্ধকার সিঁড়ির মুখে অনেকক্ষণ থমকে দাঁড়িয়ে রইলুম। একেবারে চিন্তাশূন্য ফ্যালফ্যালে অবস্থা। মনে হচ্ছে, পৃথিবী শেষ হয়ে গেছে। সৃষ্টি লোপাট। একা আমি দাঁড়িয়ে আছি পৃথিবীর কিনারায়। শেষ জীবিত ব্যক্তি। মনে হচ্ছে, এই বাড়ির অসংখ্য ঘরের প্রতিটিতে একটা করে মমি শুয়ে বসে দাঁড়িয়ে আছে। নীচের কোণের ঘরে যেন তবলা বাজছে। প্রফুল্ল কাকাবাবু মৃত্যুর পর থেকে ফিরে এসে হাত সাধছেন। কাকিমা গা ধুয়ে কুয়োতলা থেকে আসছেন ভিজে শাড়ি পরে। মাতামহ দীর্ঘ শরীর নিয়ে তানপুরা হাতে দোতলা থেকে নেমে আসছেন। সম্রাটের মতো ভঙ্গিতে। বারান্দায় পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে আছে কনক। শূন্য বাড়িতে জীবিত-মৃত সবাই ফিরে আসছে একে একে। মহা কোলাহল কলরোল। যেন এক উৎসব হচ্ছে। নিমন্ত্রিতরা আসছেন একে একে। দমাস করে একটা আওয়াজ হল কোথায়। চমকে উঠলুম। বোধহয় ছিটকিনি দেওয়া ছিল না। জানলার পাল্লা পড়ল। ফাঁকা বাড়িতে শব্দটা বড় ভয়ংকর।
বিশাল বড় একটা সিন্দুক খুলে যদি দেখা যায় ভেতরটা একদম ফাঁকা তা হলে মনের যে অবস্থা হয়, আমার মনের অবস্থাও ঠিক সেইরকম। শূন্যতাও হাসে। শূন্যতারও দাঁত আছে। ভাষাহীন ভাষা আছে, অবয়ব আছে। ফাঁপা একটা চেহারা। বিশাল এক ইদারার মতো। অতল।
লেজ-ভোলা একটা বেড়ালের মতো এঘর ওঘর সেঘর ঘুরে ঘুরে বেড়ালুম খানিক। সব ছেড়ে যেতে হবে আমাকে! বেঁচে থাকার একটা পর্ব এইখানে এইভাবেই শেষ হয়ে যাবে! অসমাপ্ত উপন্যাসের মতো। মানুষের মৃত্যু না হলেও আয়োজনের মৃত্যু।
অন্ধকার হল, কিন্তু আলো জ্বালাতে ইচ্ছে করল না। পিতা হরিশঙ্করের খাটে বসে আছি। বালিশের পাশে পাটকরা একটা সাদা রুমাল। নিয়ে যাননি। পড়ে আছে। বসে বসে দেখছি, সব বাড়িতে আলো জ্বলে উঠেছে। হরিশঙ্কর ইমনে একটি সুন্দর গান গাইতেন, নিশি এল দেখে চোখেরি পলকে শূন্য কে সাজাল দীপমালায়/ঘরে ঘরে আলো দেখে লাগে ভাল, আমার হৃদিগেহ অন্ধকারে কালো। তখন ছিল গান, এই মুহূর্তে আমার উপলব্ধি। চারপাশে কেমন সব সুখের সংসার, আমি বসে আছি শ্মশানে। হঠাৎ মনে হল, দিদি গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলছেন। মনে হওয়ামাত্রই, শরীরে একটা কাঁপুনি খেলে গেল। অদ্ভুত একটা ভয়। এক মুহূর্ত আর এবাড়িতে থাকা যায় না। ভয়ংকর। কিন্তু, যাই কোথায়? কাকে গিয়ে বলি, আজকের রাতটা আমাকে থাকতে দেবেন আপনারা দয়া করে? প্রথমেই মনে পড়ল টিপের কথা। পরমুহূর্তেই এমন ঘোটলোক মন, ভাবতে বসল মেনিদার মেয়ে অচলার কথা। অচলাকে আমি দেখেছি। না দেখে কোনও উপায় নেই, এমনই তার আকর্ষণ!
অশরীরী আত্মার ভয়ে আলো জ্বাললুম। অন্ধকার ঘরে আলোটা লাফিয়ে পড়ার মুহূর্তে মনে হল খাটে কেউ বসে ছিলেন। আলো পড়ামাত্রই অদৃশ্য হয়ে গেলেন। ভয় যে কত শীতল সেই মুহূর্তে বুঝতে পারলুম। মাইনাস দশ-কুড়ি ডিগ্রিও হতে পারে। শরীরে একটা কাঁপুনি ধরে গেল। ওজন মনে হচ্ছে আড়াই মন।
নীল একটা আলো ঝলসে উঠল। কী ব্যাপার? পৃথিবীটা কি বিজ্ঞানের বাইরে চলে গেল! মেঘ ডাকার শব্দে বিজ্ঞান ফিরে এল। বিদ্যুৎ চমকেছে। খেয়াল করিনি, পশ্চিমের আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে গেছে। ঠান্ডা বাতাস বইছে। মনে হয় ঝড় আসছে। আবার একবার মেঘ ডাকল। দমকা হাওয়ায় টেবিলের ওপর থেকে ফড়ফড় করে কিছু কাগজ উড়ে গেল। আর কোনও উপায় নেই। রাতটা এই কফিনেই আটকে গেলুম।
যাই হোক, তবু একটা কিছু এসেছে। ঝড় এসেছে বৃষ্টি নিয়ে। তাড়াতাড়ি জানলা বন্ধ করলুম। সগর্জনে বৃষ্টি এসে গেল কেটল ড্রাম বাজিয়ে। হিটলারের প্যানজার বাহিনী মার্চ করছে। ঈশ্বরের কী খেলা! এমন এক ব্যবস্থা করেছেন, যদি কারও আসার ইচ্ছাও থাকত সে আর আসতে পারবে না, যেমন টিপ, বউদি, কি অন্য কেউ। খেলা জমে গেল। এরই নাম বেঁধে মারা। যেমন বৃষ্টি, তেমনি বাতাস। জানলা দরজা কেঁপে কেঁপে উঠছে। ঘনঘন বজ্রপাত। খড়খড়ির ফাঁক দিয়ে বাতাস আসছে। কেঁদে কেঁদে। যতটা চেষ্টা করছি মনটাকে ঘোরাতে, মন ততই চলে যাচ্ছে ঝুলন্ত একটা মৃতদেহের দিকে। দুলছে। ঘুরছে। বিদ্যুতের আলোয় নীল হয়ে উঠছে।
খাটের তলায় কিছু একটা পাশ ফিরছে। চোরটোর ঢুকে বসে আছে নাকি? শব্দ করে কী একটা গড়িয়ে গেল। আজ রাতে সব জড়বস্তুই কি প্রাণ পাবে? নৃত্য করতে থাকবে আমাকে ঘিরে? জড়জগতে একটা চক্রান্ত শুরু হয়েছে। ভয়ে ভয়ে নিচু হয়ে দেখলুম, কী থাকতে পারে খাটের তলায়! সাদা কাপড়ের একটা ব্যাগ। তলা দিয়ে বাতাস এসে ব্যাগটাকে কাত করে দিয়েছে। খালি একটা কৌটো গড়িয়ে গেছে।
দিদির ব্যাগ। মনে পড়ল সঙ্গে একটা ব্যাগও এনেছিলেন। ব্যাগটাকে টেনে বের করে আনলুম। বাইরে থেকে স্পর্শ করে মনে হচ্ছে দু’-একটা বই আছে। একটা চশমার খাপ। ছোট ছোট কয়েকটা পুঁটলি। একটাতে কিছু পয়সা আছে বলে মনে হচ্ছে। টিনের কৌটোটা অনেক চেষ্টা করেও খুলতে পারলুম না। ভেতরে একটা কিছু আছে। ঠকাস ঠকাস করে নড়ছে। ব্যাগটির সমস্ত জিনিস উলটে দেখতে ইচ্ছে করছে। সংকোচও হচ্ছে। জানলা দিয়ে জল ঢুকে মেঝের ওপর দিয়ে গড়িয়ে চলেছে। এই বাড়ির এইটাই দোষ। জল আটকানো যায় না। পিতা হরিশঙ্করের বিজ্ঞানও হার মেনেছে।
হঠাৎ মনে হল সদরের কড়াটা কেউ নাড়ছে। তুমুল বাদলেও শব্দটা কানে আসছে। নীচেটা এই মুহূর্তে আমার কাছে ভীতিপ্রদ কবরখানা। অশরীরীদের মিলনভূমি। মনের জোর করে নামতে হল। বীর হরিশঙ্করের ছেলে আমি। বাইরে কেউ দাঁড়িয়ে আছেন। ছাতার ওপর অঝোরে জলপড়ার শব্দ। দরজাটা খোলামাত্রই ছাতাটাতা সমেত মেনিদা ঢুকে পড়লেন। বাইরে নীল ইস্পাতের মতো রাস্তায় বৃষ্টি নাচছে। গাছের পাতা পড়ে আছে। পোস্টের আলোয় জলে খেলছে রুপোলি ফুলঝুরি। ছাতার জলে বৃষ্টির ঝাঁপটায় বেশ খানিকটা ভিজে গেলুম।
মেনিদা বললেন, ধরো ধরো। দুটো হাতই জোড়া। ছাতা বন্ধ করতে পারছি না।
বাঁ হাতে একটা টিফিন ক্যারিয়ার। আমার হাতে দিয়ে ছাতা বন্ধ করে ধেইধেই করে খানিক নেচে নিলেন।
কী করছেন?
সিঙ্গিং ইন দি রেন তো পারব না, তাই ড্যানসিং। সিনেমাটা দেখেছ? বাইরের রাস্তাটা নাচার মতোই।
এই বৃষ্টিতে বেরোলেন কেন?
বাঃ বেরোব না! দেখলুম ঘটোৎকচ কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে হনহন করে চলে গেলেন। জিজ্ঞেস করলুম, কী মশাই, চললেন? তা কোনও উত্তরই দিলেন না। গরম কচুরি হল। শুকনো আলুর দম। তোমার জন্যে নিয়ে এলুম। আর জানি তো, তুমি একলা আছ। পিন্টু, পিতা শব্দটা বড় বিশাল। সকলের ভেতরেই আছে। আমরা খাব, তুমি উপোস করে থাকবে? আমার মনে হয় এইতেই তোমার আজকের রাতটা চলে যাবে। চলো চলো, ওপরে চলো।
মেনিদা সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে বললেন, এই বাড়ি এত ফাঁকা ভাবাই যায় না। অতীতে কী সব দেখেছি আমরা! সংস্কৃতির পীঠস্থান। গানবাজনা, লেখাপড়া। একটা মানুষ যে একশোটা মানুষ হতে পারে, তোমার বাবাই ছিলেন তার প্রমাণ। কী হয়ে গেল। কী করে গেলেন! কত স্মৃতি ভেসে আসছে। মনে!
মেনিদা একটা চেয়ারে বিমর্ষ হয়ে বসলেন। কিছুক্ষণ নীরব থেকে আবার শুরু করলেন, সব বিষয়ে এমন দখল আমি আর কারও দেখিনি। অমন স্মৃতিশক্তি! অমন মেধা! একজন অতিমানব। আমরা চিনতে পারিনি। কথায় আছে, পেঁয়ো যোগী ভিখ পায় না। নিজেরও কোনও প্রচার ছিল না। তোমার সন্ধ্যাহ্নিক হয়ে গেছে তো!
ওসব তো আমি করি না।
সে কী! ব্রাহ্মণের ছেলে। ত্রিসন্ধ্যা তো কর্তব্য। তিনবার না পারো, দু’বার তো করতেই হবে। অবশ্যই করবে। দেখবে মনের জোর বাড়ছে। ভয় কেটে যাচ্ছে। এটা ধর্ম নয়, ডিসিপ্লিন। সবসময় একটা কিছু জপ করবে মনে মনে। যেন মুখে একটা সুপুরি রেখেছ। একেই বলে অজপা। দেখবে অদ্ভুত একটা শক্তি পাবে। আমাদের অনেক কিছু সম্পদ আছে পিন্টু। চর্চার অভাবে মরচে ধরে। যাচ্ছে। একালের ছেলেদের কেউ বলেও না। যাও, তুমি হাত ধুয়ে খানকয়েক গরম গরম খেয়ে নাও। ঠান্ডা হয়ে গেলে আর ভাল লাগবে না। আমার সামনে খেতে লজ্জা করবে তোমার। পাশের ঘরে চলে যাও।
মেনিদাকে যতই দেখছি, ততই অবাক হয়ে যাচ্ছি। ভুল করেছিলুম, না মানুষটি রাতারাতি বদলে গেলেন? মেনিদা আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলেন। যেন বুঝতে পেরেছেন আমার মনের কথা। মেনিদা বললেন, টেক ইট ইজি, টেক ইট ইজি। সবসময় দুঃখু দুঃখু ভাব করে থেকো না। কৃত্রিম মনে হতে পারে। আমাকে হারমোনিয়মটা বের করে দাও, ততক্ষণ হরিশঙ্করকে গান শোনাই।
হারমোনিয়মটা বের করে দিলুম। মেনিদার গলা কী সুন্দর! মিছরির মতো। তিনি গান ধরলেন, ওরা চাহিতে জানে না দয়াময়/চাহে ধন জন আয়ু আরোগ্য বিজয়/করুণার সিন্ধুকূলে/বসিয়া মনের ভুলে/এক বিন্দু বারি তুলে মুখে নাহি লয়। মাঝে মাঝে গান থামিয়ে প্রশ্ন করছেন, ঠিক হচ্ছে তো, হরিশঙ্কর!
পাশের ঘরে চোরের মতো একপাশে বসে কচুরি খাচ্ছি, আর মনে মনে হাসছি। ঠিক হয়েছে ব্যাটা! কেউ কোথাও নেই, একেবারে একা। Alone, alone, all all alone/Alone on a wide, wide sea/And never a Soul took pity on/My Soul in agony. 6tat 3631651 pretiot 07976157 বাঙালির মতো একপাশে বসে খাচ্ছি। তফাত এই, খাদ্যটা খিচুড়ি নয়, ঘিয়ে ভাজা হিংয়ের কচুরি। মেনিদা গাইছেন, তীরে করি ছুটাছুটি/ধূলি বাঁধে মুঠিমুঠি/পিয়াসে আকুল হিয়া আরো ক্লিষ্ট হয়/ওরা চাহিতে জানে না দয়াময়।
অঝোরে ঝরছে বৃষ্টি। লাল মেঝের ওপর বসে হনুমানের মতো একের পর এক কচুরি খেয়ে চলেছি। কচুরি আলুরদম দুটোই সাংঘাতিক সুস্বাদু হয়েছে। এও মনে হয় ঈশ্বরেরই ইঙ্গিত। হিমালয়ে আশ্রমে চটিতে এইভাবেই তো আমাকে পঙ্গতে বসে খেতে হবে। আর তো কয়েক ঘণ্টা, তার পরেই তো আমি ট্রেনে। হিমালয়মুখো।
হারমোনিয়ম বন্ধ করে মেনিদা বললেন, তুমি কী ভাবছ আমি জানি। তোমাকে জামাই করার জন্যে আমি কচুরির টোপ ফেলছি। না, তা নয়। আজই জানতে পারলুম, অচলার বিয়ে হয়ে গেছে। একালের মেয়েরা নিজের ব্যবস্থা নিজেরাই করে নেয়। তা হলে কচুরিটা টোপের কচুরি নয়। মুখে তুলতে গিয়ে তোমার মুখ ভেসে উঠল চোখের সামনে। করুণ অসহায় একটা মুখ। ছেলেটা কী খাবে! তারপরেই মনে হল, গলায় দড়ি। সারাটা রাত ভয়ে মরবে। বউকে বললুম, ভরো টিফিন কৌটো। ছেলেকে বললুম, ছাতাটা খুঁজে দে। চলে এলুম। রাতটা তোমার সঙ্গে কাটিয়ে ভোরে চলে যাব। কাল সারারাত তুমি জেগেছ। আজ তোমার ঘুম দরকার, সলিড ঘুম। বেশ বাদলার রাত আছে। আজ তুমি তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ো।
মেনিদার চোখেমুখে অদ্ভুত একটা স্নেহের ভাব। এমন স্নেহ বহুকাল আমি পাইনি। কীভাবে কৃতজ্ঞতা জানাব ভেবে পাচ্ছি না। প্রশ্নটা আর চেপে রাখতে পারলুম না, কোনটা আপনার আসল রূপ?
মেনিদা হাহা করে হেসে বললেন, শোনো, আমার থিয়োরির সঙ্গে তোমারটা মিলবে না। বাইরেটাকে এমন করে রাখবে, যেন তোমাকে কেউ চিনতে না পারে। মহাপুরুষের ভেক ধরলে। তাদের অপমান করা হয়। অভিনয় করা হয়। বাইরেটা ভাল ভেতরটা নোংরা, সে বড় সাংঘাতিক জীব। ভয়ংকর বিপজ্জনক। উলটে নাও। বাইরেটা ভয়ংকর, কিন্তু ভেতরটা সুন্দর। বিহারি নদী দেখেছ? বাইরে বালি, একটু খোঁড়ো, স্বচ্ছ টলটলে শীতল জল। তোমার বাবার কথাই ভাবো না! বাইরেটা রুক্ষ, কঠোর, তীব্র, ঝাঝালো, কর্কশ, ঘোরতর নাস্তিক। ভেতরে স্নেহের ফল্গুধারা। মেনি বাইরে খারাপ। সবাই ঘৃণা করে। কেউ কাছে ঘেঁষে না। আরে সেইটাই তো আমি চাই। তলে তলে এগিয়ে যাও। সাধু মরণে সাবধান! গল্পটা জানো?
বলুন না শুনি।
বারাণসীতে এক সাধু ছিলেন। ভক্তদের মাঝখানে বসে আছেন। এক পাগলি কোথা থেকে এসে। হাত পা নেড়ে রোজই এক কথা বলে যায়, ওরে সাধু মরণে হুশিয়ার! সাধুর অহংকারে লাগে। তেড়ে ওঠেন, বেরো বেরো। পাগলি হাসতে হাসতে পালায়। কিন্তু রোজই আসে, আর রোজই সেই এক কথা বলে যায়। অবশেষে সাধুর মরণকাল এসে গেল। নিজের আটচালায় চিত হয়ে শুয়ে আছেন। প্রাণ যায় যায়। এমন সময় সাধুর নজর হঠাৎ চলে গেল চালের বাতার দিকে। সেখানে গোঁজা রয়েছে। একজোড়া নতুন পাদুকা। কোনও ভক্ত দিয়ে গিয়েছিল। সেটি আর ব্যবহার করা হয়নি। সেই আফসোস নিয়েই সাধুর মৃত্যু হল। তারপর! আবার সেই বারাণসী, কিন্তু এর মাঝে বহু বছর পার হয়ে গেছে। দশাশ্বমেধ ঘাটের কাছে এক মুচি বসে বসে ঠুকঠুক করে জুতোয় পেরেক ঠুকছে। হঠাৎ এক সাধিকা সামনে এসে দাঁড়ালেন। মুচিকে বললেন, কী সাধু, মনে পড়ে, বলেছিলুম মরণে হুঁশিয়ার! মনে পড়ে সেই কথা? মুচি চোখ তুলে তাকালেন। চোখে জল। মুহূর্তে মনে পড়ে গেল পূর্বজন্মের কথা। জুতোর আফসোস নিয়ে মরেছিলেন। এই জন্মে তাই কত জুতো! জুতোর। দুনিয়াতেই জীবন কাটছে। সেই কারণেই খুব সাবধান পিন্টু। গল্প গল্পই। তবে নীতিটা হল বাইরের ভেক কিছুই নয়, আসল হল ভেতর, যেটাকে কেউ দেখতে পায় না। ভেতরটাকে বেশ ভাল করে সাজাও। আরে তুমি কোন বাপের সন্তান! লড়ে যাও। হও কর্মেতে বীর, হও ধর্মেতে ধীর, হও উন্নত শির। দেখো, আমি তোমাকে এইসব বলছি, বাইরে যেন প্রচার না হয়ে যায়। আমার ইমেজ ভেঙে যাবে। ঘৃণা মানুষকে একঘরে করে অচ্ছুত করে। নির্জনতা এনে দেয়। সংসার তাকে খারিজ করে। কী মজা! আচ্ছা, আমি একবার বাথরুমে যাই। হাত মুখ ধুয়ে, ইষ্ট নাম স্মরণ করে এবার ধুপুস করা। যাক।
দক্ষিণের একটা জানলা অল্প একটু ফাঁক করলুম। বৃষ্টির দাপট কমে গেছে। ফিনফিনে আদ্দির। পাঞ্জাবির মতো বাতাস বইছে। অনেকটা নীচে রাংতার মতো ভিজে রাস্তা। আকাশ ঘোলাটে সাদা। হঠাৎ রবীন্দ্রনাথ এসে গেলেন। ইলেকট্রিক তার থেকে জল পড়ছে ফোঁটা ফোঁটা। সেইদিকে তাকিয়ে মনে পড়ে গেল,নবাঙ্কুর ইক্ষুবনে এখনও ঝরিছে বৃষ্টিধারা/বিশ্রামবিহীন/মেঘের অন্তরপথে অন্ধকার হতে অন্ধকারে/চলে গেল দিন/শান্ত ঝড়ে, ঝিল্লিরবে, ধরণীর স্নিগ্ধ গন্ধোচ্ছাসে/মুক্ত বাতায়নে/বৎসরের শেষ গান সাঙ্গ করি দিনু অঞ্জলিয়া/নিশীথগগনে।
বৈষ্ণবরা যেভাবে বস্ত্র পরেন ধুতিটাকে সেইভাবে পরে মেনিদা ঘরে এলেন। গুনগুন করে কী একটা গাইছেন! আমি রাস্তার দিকেই তাকিয়ে আছি। হঠাৎ গাড়ির হেডলাইটের তীব্র একটা আলোয় রাস্তা ঝলসে উঠল। খুব মিহি বৃষ্টি এখনও পড়ছে। কালো একটা গাড়ি ঘাস করে থেমে পড়ল বাড়ির সামনে।
আর আমি! এই রে পিসিমারা এসে পড়েছেন, বলে নিচু হয়ে, প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে খাটের তলায়, ঢুকতে চাইছি। মেনিদা বলছেন, এ আবার কী? ছেলের এ কী ছিরি!